অমল মনের বিষণ্ণ ভাবটি আর যেন সহ্য করতে পারল না, সামান্য নড়েচড়ে হঠাৎ গুন-গুন করে গান গাইল, তারপর উঠে বসল। কোটের বুক-পকেটে একটা সিগারেট রেখেছিল অমল। সিগারেটটা চেপটে গেছে। আঙুলের ডগা দিয়ে সিগারেট গোল করতে-করতে অমল উঠল।
“ভ্রমর—!” অমল উবু হয়ে বসে সিগারেট ধরাচ্ছিল মালসার আগুনে।
“উঁ—”
“আজ সকালে তোমাদের গান শুনে ঘুম ভেঙেছে।” সিগারেট ধরানো হয়ে গিয়েছিল বলে অমল একমখ ধোঁয়া টেনে নিল। কিছুটা গলায় গেল, কিছুটা ঘরের বাতাসে মিশল। ফাঁকা হলে অমল ভ্রমরের দিকে তাকিয়ে এবার বলল, “আমি বলি এবার তুমি একটা ক্লোজিং সঙ্ গাও।” কথাটা হালকা এবং লঘু করেই বলল অমল।
ভ্রমর জবাব দিল না। অমল অপেক্ষা করল। মালসার আগুন যেন আজ তেমন করে জ্বলছে না। ছাই হয়ে আসছে।
সহসা ভ্রমর খুব মৃদু, মিহি এবং নিবিড় গলায় গান গাইতে শুরু করল। অমল উঠল না। মেঝের ওপর বসে গান শুনতে লাগল। ‘হাত ধরে মোরে নিয়ে চলল সখা, আমি যে পথ চিনি না…’
গানের মধ্যে অমল ভাবল, ভ্রমর তাকে সত্যি-সত্যি শেষ-গান শোনাচ্ছে।
গান শেষ হলে অমল বলল, “বাঃ; ওআল্ডারফুল! আমি এ-গান আগে শুনেছি।” বলে অমল কি ভেবে হঠাৎ হেসে বলল, “আচ্ছা ভ্রমর, এই ‘সখা’-টা কে?”
ভ্রমর যেন আশা করে নি এ-রকম প্রশ্ন। ইতস্তত করল। বলল, “কেন, ভগবান।”
“ভগবান!”…অমল কেমন থতমত খেয়ে গেল, তারপর কেমন অদ্ভুত গলায় বলল, “আমি ভেবেছিলাম, আমি।”
১০. দূরে বৃষ্টি নামলে
১০
দূরে বৃষ্টি নামলে যেমন সব সাদা ঝাপসা দেখায়, সকালের কুয়াশা সেই রকম ধোঁয়াটে ঘন ভিজে আবরণ ছড়িয়ে অনেকক্ষণ শূন্যের সমস্ত স্বচ্ছতা ঢেকে রেখেছিল। রোদ উঠতে বেলা হল। আলোর রঙ প্রথমটায় মেঘলা দিনের মতন খুব ফিকে এবং নিষ্প্রভ দেখাচ্ছিল। তারপর এক সময় শূন্যের সমস্ত আবিলতা মুছে গেল, কুয়াশার আর্দ্র কণা রৌদ্রে শুষ্ক হল, এবং অতিশয় উজ্জ্বল রোদ উঠল।
কৃষ্ণা সাইকেল নিয়ে কলাঝোপের দিকে মাঠে স্লো-সাইকেল প্র্যাক্টিস করছিল; ঠিক পারছিল না, পড়ে যাচ্ছিল, পা দিয়ে মাটি ধরছিল। এ-সব আর কিছু নয়, নিতান্ত যেন ভূমিকা, সামান্য পরে বাড়ি ছেড়ে লীলার কাছে পালাবে।
আনন্দমোহন ফুলবাগানে কাজ করছিলেন। হাতে মস্ত এক কাঁচি আর মাটি কোপানো ছোট্ট খুরপি। মরসুমীফুলের নরম মাটি আলগা করে হিমে-ভেজা রোদে-মরা পাতা সরিয়ে এবার তিনি গোলাপগাছগুলোতে হাত দিয়ে-ছিলেন। ডালপালা কেটে দিচ্ছিলেন, গোড়ায় চা-পাতার সার দিচ্ছিলেন অল্প-স্বল্প। ঠোঁটের ডগায় সিগারেট পুড়ছিল।
অমল কাছাকাছি ছিল। কখনও কৃষ্ণার স্লো-সাইকেল দেখে হাসছিল, কখনও মেসোমশাইয়ের ফরমাস খাটছিল।
আজকের রোদটি সময় পেরিয়ে এসেছে বলেই যেন তার কুন্ঠা ছিল, খুব দ্রুত তপ্ত ও ঘন হয়ে আসছিল। দেখতে-দেখতে মাঠ ঘাস ফুলপাতার ওপর রোদের পাতলা পালিশ ঘন হয়ে এসে যেন রোদ্দুরের একটি সর পড়ে যাওয়ার মতন হয়েছে। নরম তাতের আমেজ লাগছিল গায়ে। বাতাস তেমন চঞ্চল ছিল না। সোনাঝুরি গাছের মতন সেই গাছগুলি থেকে আলতারঙের ফল ফেটে সুতোর মতন আঁশ বাতাসে উড়ে-উড়ে আসছিল, শীতের মরাপাতা ঝরছিল কখনো বা। পাখিগুলি বাগানে নিত্যকার মতন আসা-যাওয়া করছে। সাদা পুচ্ছ, কালো পাখা, লাল ঠোঁটঅলা একটি পাখি এসেছিল একবার, উড়ে চলে গেছে আবার।
আনন্দমোহন গোলাপবাগান থেকে ছাঁটা ডালগুলি তুলে জড় করে অমলকে ফেলে দিতে বললেন। অমল যখন ডালপালা জড় করছিল, ফটকের সামনে মজুমদার-ডাক্তারের মোটরবাইক এসে দাঁড়াল।
কৃষ্ণা ফটক খুলতে গিয়েছিল। ফটক খুলে দিয়ে সে আর ফিরল না, মজুমদারডাক্তার ভেতরে এলে আবার গেট বন্ধ করে দিয়ে বাইরে থেকেই পালাল।
আনন্দমোহন হাতের কাঁচি খুরপি রেখে দিলেন মাটিতে, ধুলোময়লা রুমালে মুছতে মুছতে এগিয়ে গেলেন। অমল গোলাপডালগুলো জড় করে একপাশে ফেলে দিতে গেল।
মজুমদারডাক্তারের বয়েস অনেক আগেই চল্লিশ পেরিয়েছে, গায়ে দোহারা, মুখ চৌকো মতন। চোখে চশমা। মোটামুটি ফরসা রঙ। মানুষটিকে দেখলেই মনে হয়, রোদ-জল খাওয়া অভিজ্ঞ মানুষ। চোখের মণি একটু, কটা রঙের, ঠোঁট মোটা।
মোটরবাইক ঠেলে আসতে-আসতে মজুমদারডাক্তার বড়দিনের সুখ-শুভেচ্ছা জানালেন সহাস্য গলায়।
এগিয়ে গিয়ে আনন্দমোহন অভ্যর্থনা করলেন, “এস এস, তোমার দেখা পাওয়া ভাগ্য।” বলে আনন্দমোহন মজুমদারের কাঁধে হাত দিয়ে বাড়ির বারান্দার দিকে যেতে লাগলেন।
অমল কলাবাগানের দিকে গোলাপগাছের ছাঁটা ডালপালাগুলো ফেলে দিয়ে বারান্দার দিকে আসছিল; বুড়ো আঙুলে একটা কাঁটা ফুটে গেছে জোরে, মুখে আঙুল পরে যন্ত্রণা সইয়ে নিচ্ছিল।
“এদিকে এসেছিলাম! মিসেস যোশী কাল সন্ধেবেলায় পড়ে গিয়ে পা মচকেছেন। একে ভারী চেহারার মানুষ, তাতে আবার সামান্যতেই অধীর হয়ে পড়েন।” মজুমদারডাক্তার মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে রাখলেন।
“হাড়টাড় ভেঙেছে নাকি?” আনন্দমোহন শুধোলেন।
“না। সেরকম কিছু না।”
কথা বলতে-বলতে বারান্দার সিঁড়িতে উঠলেন দুজনে। অমল সামান্য পিছনে। বারান্দায় উঠে আনন্দমোহন নিজের হাতে বেতের চেয়ার টেনে আনছিলেন রোদে, অমল একটু, তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে গিয়ে তাঁকে সাহায্য করল। মজুমদার অমলকে দেখে হাসলেন একটু, পরিচিতজনের মতন দু-একটা কথা বললেন: কি খবর, কেমন লাগছে গোছের, তারপর চেয়ার টেনে বসার উপক্রম করে বললেন আনন্দমোহনকে, “এদিকে এসেছিলাম, ভাবলাম আপনাকে খবরটা দিয়ে যাই।”