১. জন্মদাতা পিতা
এক.
০১.
আমার জন্মদাতা পিতা এবং গর্ভধারিণী জননীকে আমি দেখিনি। কোথায়, কোন শহরে অথবা গ্রামে আমার জন্ম হয়েছিল আমি জানি না। হয়তো ভোরের আলোয় এই পৃথিবীর বাতাসে আমার প্রথম নিশ্বাসটি নিয়েছি। দুপুরে, সন্ধ্যায় কিংবা রাতেও হতে পারে; আমি জানি না। কে জানে, তখন গ্রীষ্ম না বর্ষা, শরৎ বা শীত, কি বসন্ত!
০২.
ছেলেবেলায়, একটু বয়স হবার পর, আমি আমার বাবা এবং মার চেহারা মনে মনে গড়ে নিয়েছিলাম। আমার একটুও সন্দেহ ছিল না আমার বাবা এবং মার চেহারাটি অবিকল ওইরকমেরই। লম্বা আধফরসা, মোটা মোটা হাড়ওলা, রুক্ষ বদমেজাজি শ্যামলালবাবুকে আমি মনে মনে বাবা বলতাম। বাবার কথা ভাবতে বসলে শ্যামলালবাবুকে দেখতাম। …টকটকে ফরসা, গোলগাল, কীসের-যেন-আটা-মাখানো হাসিহাসি মুখ, পুরু ঠোঁট এবং চোখে কাজল কি সুর্মাটানা চাঁপারানির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আমি মনে মনে কতবার মা মা বলেছি। চাঁপারানিকে আমার মা বলে ডাকতে ইচ্ছে হত স্পষ্ট পুরো গলায়। ডাকিনি কখনও।
০৩.
শ্যামলালবাবু আমায় ইজের জামা কিনে দিত। একবার ক্যাম্বিসের জুতো কিনে দিয়েছিল। চাঁপারানি আমায় দুবেলা খেতে দিত। একবেলা ডাল-ভাত-তরকারি; অন্যবেলা শ্যামলালবাবু এবং চাঁপারানির পাতকুড়নো। পাতকুড়নো খাবার সময় আমি প্রায়ই মাংসর হাড়, চর্বির ডেলা, গলা আলু, মাছের কাঁটা, ছাল-টাল পেতাম। রাত্রে এই খাওয়া পেতে অনেক রাত হত–কোনও কোনও দিন আমি সদর-দরজার সামনে কলঘরের কাছটায় বসে বসে ঘুমিয়ে পড়তাম–তবু এই রাতের পাতকুড়নো আমার ভাল লাগত। ওই খাবারের গন্ধ এবং স্বাদের জন্য আমি সারারাত বসে থাকতে পারতাম।
০৪.
চাঁপারানি আমায় অ-আ ক-খ চিনিয়েছিল। শ্যামলালবাবু আমায় কথামালা কিনে দিয়েছিল। বাজারের চাবাবু আমায় ফোর ক্লাসের বই পর্যন্ত পড়িয়েছিল। এবং পিয়ারীচরণ সরকারের ফার্স্টবুকের সাতান্ন পাতা। সাতান্ন পাতায় এক গরিব অন্ধ বেচারির কথা আছে। চা-বাবু আমায় পড়িয়েছিল: বেচারি অন্ধ, আকাশ মাটি গাছ এমনকী মানুষ পর্যন্ত দেখতে পায় না, তার খুব কাছাকাছি থাকলেও নয়। …পড়াটুকু পড়িয়ে চা বাবু বলেছিল, তুই বেটাও অন্ধ।
০৫.
হ্যাঁ, চোখে না হলেও এক হিসেবে আমি অন্ধই ছিলাম। শ্যামলালবাবু বদমাশ, মাতাল, চোর–আমি জানতাম না। চাঁপারানি বেশ্যা আমি কী করে জানব।
০৬.
তার পর অনেকদিন খাওয়ার কষ্ট পেয়েছি। দিনের বেলায় চাবাবুর দোকানে ফাইফরমাশ খাটলে দু-চারটে পয়সা, দু-এক কাপ চা, এক আধ টুকরো শুকনো পাঁউরুটি পেতাম। রাত্রে কালাচাঁদের হোটেলের কাছে ঘুরঘুর করতাম কুকুরের মতন। চাঁপারানির কথা মনে পড়ত; মাংসের হাড় চর্বি, মাছের কাঁটা, গলা আলুর গন্ধ ও স্বাদের কথা ভাবতাম।
০৭.
আমার ইজের জামা ছিঁড়ে গেল, পা অনেককাল খালি। তখন বেশ শীত পড়ছে। রেল স্টেশনের মিঠাইঅলা পানঅলাদের দোকানের কাছে আমি রাত কাটাতাম। টিনের চাঁদোয়ার তলায় সেখানে অনেক লোক জমত। স্টেশনের কুলিকাবারি, ভিখিরি, পোঁটলা-পুঁটলি বোঁচকা কুঁচকি নিয়ে থার্ড ক্লাসের যাত্রী, দু-তিনটি কুকুর। শেডের তলায় কুলিরা এক জায়গায় গোল করে আগুন জ্বালাত। সবাই চেষ্টা করত আগুনের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকতে। আগুনটা কুলিরা জ্বালত বলে ওটা তাদেরই সম্পত্তি ছিল। ওদের পিছু ফেলে কেউ ধুনির কাছে এগিয়ে যেতে চাইলে কুলিরা গালাগাল করত। রাত প্রায় ফুরিয়ে এলে, যখন সবাই মুড়ি দিয়ে তালগোল পাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত, আমি আগুনটার কাছ ঘেঁষে শুয়ে পড়তাম।
০৮.
একদিন ভীষণ এক আগুনের স্বপ্ন দেখলাম। কোথায় কোন মহল্লায় যেন আগুন লেগেছে। আকাশ লাল, পাখির দল চিৎকার করে উড়ছে, গলগল করে ধোঁয়া উঠছে এক পাশে, শব্দ হচ্ছে কীসের এক, বহু মানুষের কলরব দূর থেকে ভেসে ভেসে আসছিল। …আগুন দেখে আমারও ছুটে যাবার ইচ্ছে করছিল। যেতে পারছিলাম না। আমি নিজেকেই দেখছিলাম, নিজের অসহায়তাকে। কী ভীষণ ছোট্ট আমি, কতটুকু মাত্র এক হাত কি তার চেয়েও বুঝি ছোট। সদ্যোজাত। কথা বলতে জানি না, চোখে দেখতে পাই না, গলা দিয়ে শুধু কান্না আর কান্না।
০৯.
স্বপ্নটা দেখার পর আমার কেন যেন দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেল, যেদিন আমি জন্মেছিলাম–সেদিন আশেপাশে কোথাও ভীষণ এক আগুন লেগেছিল। আমার বাবা সেই আগুন নেবাতে ছুটে গিয়েছিল, আর ফেরেনি; আমার মা আমায় নিয়ে শুয়ে ছিল। মা আর আমি একা ছিলাম।
১০.
রাস্তা থেকে একটা লোক আমায় একদিন হাতের ইশারা দিয়ে ডাকল। লোকটা দেখতে সুন্দর, খুব সুন্দর। তার মাথায় কোঁকড়ানো চুল, চোখে সোনার চশমা। কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোকটাকে আমি দেখলাম। বড়লোক, ভদ্রলোক: আমি ভাবলাম। তাকে খুব ভাল লেগে গেল আমার। …ভদ্রলোক আমায় দিয়ে একটা কাজ করিয়ে নিতে চাইল। আমার হাতে চকচকে আধুলি ফেলে দিয়ে বলল, কাজটা করে দিতে পারলে পুরো দুটো টাকা আমায় দেবে।
১১.
কাজটা সোজাই ছিল। আসলে ওটা কোনও কাজই নয়, কেউ তার জন্যে এক আধলাও খরচ করে না। তবে বড়লোকদের কথা আলাদা, টাকা-পয়সার মায়া তাদের নেই। ভদ্রলোক কাগজে মুড়ে আমায় যে ওষুধের শিশিটি দিয়েছিল, আমি ঠিক জায়গায় সেটি পৌঁছে দিলাম। চাঁপারানির চেয়ে অনেক কম বয়সের ভারী সুন্দর একটি মেয়ে সেই শিশি নিল। মেয়েটি, জানি না কেন, কাঁদছিল। তার চোখ মুখ ফ্যাকাশে। বুকের কাছে হাত দিয়ে শাড়ির আঁচলটা সে হাতের উপর দিয়ে হাঁটু পর্যন্ত ছড়িয়ে রেখেছিল। ওর কপালে আমি সিঁদুর দেখতে পাইনি। ওষুধটি নিয়ে আঁচলের তলায় রেখে ও বলল বিড়বিড় করে, ছাই হবে। কেন বলল, আমি জানি না। …রাস্তায় এসে সেই সুন্দরমতন ভদ্রলোকটিকে আমি আর দেখতে পেলাম না। এপাশ ওপাশ কত খুঁজলাম, কোথাও নেই। গোটা একটা দিনই প্রায় আমি লোকটাকে খুঁজেছি। তার কাছে আমার দু টাকা পাওনা। কিন্তু কোথাও আর তার টিকি দেখা গেল না। লোকটা ঠগ।
১২.
স্টেশনে চায়ের দোকানে আমি যখন কাজ করছি ছ টাকা মাস মাইনেয়, একটি ছেলের সঙ্গে আমার খুব ভাব হল। তার নাম পার্বতী। সে মিঠাইয়ের দোকানে কাজ করে। তার চোখ ট্যারা, মুখে বসন্তের গর্ত-গর্ত দাগ। পার্বতী আমার চেয়ে বয়সে একটু বড়। আমায় সে চুরি করতে শেখাল, চা বেচার পয়সা মারতে। পার্বতী বুঝিয়ে দিয়েছিল, চুরি যে করে না সে গাধার বাচ্চা। পয়সা না মারলে দোকানের মালিক তলব বাড়াবে না। চুরি করে করে পার্বতী এখন পনেরো টাকা পর্যন্ত মাইনে বাড়িয়েছে। …পার্বতী আমায় আরও কত কী শিখিয়েছিল। একদিন একটা দেহাতি মেয়ে রাত্রে আমাদের দোকানের কাছে আর-পাঁচটা যাত্রীর মতন ঘুমোচ্ছিল, পার্বতী মেয়েটার ঘুমন্ত বেসামাল শরীরটার দিকে আঙুল দেখিয়ে দেখিয়ে আমায় অনেক কিছু শেখাল।
১৩.
পার্বতীর কথামতন একদিন আমি পকেটে এক দেড় টাকা নিলাম, পানঅলা কাশীর কাছ থেকে বেনারসী খয়েরের পাঁচ ছ খিলি পানও। তার পর দুজনে এক জায়গায় গেলাম। এরকম জায়গা আগে আর আমি দেখিনি। একটা মেয়েছেলে পার্বতীর গলা জড়িয়ে ধরে গান গেয়ে উঠল। আর-একটা মেয়েছেলে হাত পেতে আমার পানের দোনা এবং পকেটের সব পয়সা নিয়ে নিল। হেসে হেসে আমার গাল টিপে বলল, আহা চাঁদ রে–গায়ে এখনও দুধের গন্ধ মরেনি, রাঁড় করতে এসেছে। …যা ছোঁড়া বাড়ি যা…
১৪.
সেই সুন্দর চেহারার লোকটাকে একদিন স্টেশনে পেয়ে গেলাম। বললাম, কই আমার টাকা দিন। ..লোকটা প্রথমে আমায় চিনতেই পারল না। পরে বলল, টাকা কীসের টাকা। যাকে ওষুধ নিয়ে গিয়ে দিয়েছিলি সে কবে মরে ভূত হয়ে গেছে। বেশি ঝটফট করবি না, পুলিশে ধরিয়ে দেব। বেটা, বিষ দিয়ে এসে আবার টাকা! হেট…শালা, মারব এক থাপ্পড় মেয়েটি মরে গেছে! ভয় বিস্ময় এবং বেদনায় আমি কাঠ হয়ে গেলাম।
১৫.
আমার তারপর থেকে খুবই ভয় করত। পুলিশ দেখলে বুক কাঁপত, গা হাত অসাড় হয়ে যেত। কোনও পুলিশের লোক চা খেতে এলে আমি বেশি বেশি চা দিতাম, অনেকটা করে দুধ চিনি।
১৬.
পার্বতী একদিন পালিয়ে গেল। তার কাছে আমার চুরির সব টাকা গচ্ছিত করা ছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম, এক শো সোয়া শো করে টাকা জমলে এই লাইনের অন্য একটা স্টেশনে গিয়ে চা-মিঠাইয়ের দোকান করব। …কিন্তু পার্বতী পালাল। মাসখানেক পরে–চায়ের দোকানের হাতবাক্স ভেঙে গোটা কুড়ি টাকা নিয়ে আমিও পালালাম। একটা পুলিশ তার আগের দিন সারারাত আমাদের দোকানের সামনে বেঞ্চিতে বসে ছিল।
১৭.
আমি আগে কখনও নদী দেখিনি। গাড়িটা মস্ত রেল পুল পেরিয়ে এক জায়গায় থামল। আমি নেমে পড়লাম। কতক মেয়েছেলে কয়লা কুড়োচ্ছ, দরজা-খোলা মালগাড়ির মধ্যে পা ঝুলিয়ে বসে এক ছোকরা বাঁশি বাজাচ্ছে, ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে নদীর। আম গাছে বোল ধরার মতন একটি গাছে অজস্র পাখি।
১৮.
ব্যবসাটা চলল না। আমারই ভাল লাগল না। সের আড়াই আটার বিস্কুট, ঘড়ির কাঁটার মতন মস্ত এক কাঁটা, গোল ঘর আঁকা ছক–এক থেকে পঁচিশ পর্যন্ত নম্বর, আর ঘণ্টি নেড়ে নেড়ে ঘুরে বেড়ানো–আমার পোষাল না। আমার কাঁটাটায় কোনও রকমের দোষ ছিল। যে ঘঘারাত তার ভাগ্যেই দশ পনেরো বিশ উঠত। এক পয়সায় দশটা বিশটা বিস্কুট দেওয়া যায় না।
১৯.
এক মারোয়াড়ির গুদোমে আলু আর গুড় তোলার কাজ করলাম। কী দুর্গন্ধ গুদামের মধ্যে। পচা আলু পচে পচে পঞ্চান্ন হচ্ছে; গুড়ের সঙ্গে কাদাজল, তামাক-পাতার জল, মেটে কাদা, আখের আঁশ মেশানো হত। টোপকা টোপকা মাছি, পিঁপড়ে, কতকগুলো ভিমরুল সারাদিন ঘেঁকে থাকত। একদিন একটা ভিমরুল আমার গালে কামড়াল। কী জ্বালা তার!
২০.
কাচের কারখানায় একটা কাজ জুটে গেল। কারখানাটা প্রায় নদীর কাছে। ওখানে লণ্ঠনের চিমনি, মোটা মোটা কাচের গ্লাস বাটি তৈরি হত। আর কী আশ্চর্য আমাদের যে সাহেব ছিল তার মাথার চুল কাচের মতনই সাদা। আমি ভাবতাম,কাচের কারখানায় কাজ করে করে সাহেবের মাথার চুল অমন হয়েছে। একদিন আমারও হবে।
২১.
আমাদের ছোট মিস্ত্রির বাড়িতে আমি থাকতাম। ছোট মিস্ত্রি গাঁজা খেত। তার বউ ছিল বোবা। পেল্লায় এক কলসির মতন ফুলো মোটা বউটাকে ছোট মিস্ত্রি মাঝে মাঝে আদর করত, নয়তো বেশির ভাগ দিনই মারত। বোবা বউটা গলায় কাপড়-পুরে-দেওয়া কুকুরের মতন বিশ্রী করুণ শব্দ করে কাঁদত।
২২.
ছোট মিস্ত্রির মেয়ে কৌশল্যা একদিন আমার চটের বিছানার পাশে এসে শুয়েছিল রাত্রে। আমি ঘুমোচ্ছিলাম। বাইরে খুব বৃষ্টি পড়ছিল। জল পড়ছিল আমাদের খোলার ঘরে। আমার গা নেড়ে কৌশল্যা ডাকল, একটু জায়গা চাইল পাশে। আমি কৌশল্যাকে চুমু খেলাম, কৌশল্যা আমায় গোগ্রাসে খেল। …ভোরবেলায় ছোট মিস্ত্রি আমায় মেরে আধমরা করে ফেলল। আমার হাতের কবজি মচকে গেল, কপাল ফেটে রক্ত পড়ছিল, পিঠের শিরদাঁড়া বেঁকে গেল।
২৩.
নদীর তীরে একটা লোককে পোড়াতে এনেছিল। তখন শীতকাল। মিঠে গরম ঝকঝকে রোদ। আলুথালু বাতাস বইছে। বালিসার চরে গোরু মোষ চরছিল কটা। লোকটাকে খুব করে ঘি মাখিয়ে চিতায় চড়িয়ে দিল। আমি আগে মানুষ পোড়ানো দেখিনি। অবাক হয়ে দেখছিলাম। ঘিয়ের সুন্দর গন্ধ ছুটছিল। আমি দু-চার বার মাত্র ঘি খেয়েছি। চাঁপারানিরা রাত্রে তাদের যে উচ্ছিষ্ট আমায় খেতে দিত তার মধ্যে ঘিয়ের গন্ধ থাকত। আমি ভাবছিলাম, আমি মরে গেলে কেউ ঘি মাখাবে না, কেউ নতুন কাপড় পরিয়ে দেবে না। একটা কোকিল আশেপাশে কী সুন্দর করেই ডাকছিল তখন। অথচ চিতা জ্বলে উঠল।
২৪.
ভয়ংকর শীত। আমার গায়ে ছেঁড়া একটা জামা। হেঁটে হেঁটে মেলায় যাচ্ছি। সামনে লাল ধুলো উড়িয়ে ককিয়ে ককিয়ে গোরুর গাড়ি যাচ্ছে, ফটফট ডাক মেরে ঝরঝরে মোটরগাড়িও চলে গিয়েছে দু একটা। দু-দশ জন মানুষ পায়ে হেঁটেও চলেছে। দেহাতি এবং ভদ্র বাবু-বিবিরা। খুশিতে হাসছে, ঢলছে, কমলালেবু খাচ্ছে। মন্দিরটা মাইল তিন দূরে। মেলা সেখানে।
২৫.
পাহাড়ের পাথরের খাঁজে মন্দির, পাথরের ছোট ছোট ঘর, ধর্মশাল, হাড়িকাঠ। অনেক লোক এসেছে। ভদ্রলোক এক রাশ, বউ, মেয়ে, ছেলের দল। তারা দাপাদাপি করছে। ছুটোছুটি, হাসাহাসি। দেহাতিরা মেলা বসিয়েছে। একটা নাগরদোলা উঠছিল, নামছিল; নামছিল, উঠছিল।
২৬.
আহা, মন্দিরের কাছে ভিড়ে একটি মেয়ে দেখলাম। টুকটুকে রং, হাঁটু ছড়ানো চুল, ডাগর চোখ, পাখির পালকের মতন ভুরু। এই মেয়ে পরী। এত সুন্দর কাউকে আর দেখিনি।
২৭.
মেয়েটি এই থাকে–এই হারিয়ে যায়। আমায় ডাকলেন, এই ছোঁড়া এদিকে আয়। মেয়েটির আরও কাছে যেতে পারছি ভেবে আমি দৌড়ে পাথর টপকে কাছে গেলাম, একেবারে কাছটিতে। …বাবু তাঁর পায়ের জুতোটা খুলে আমার দু গালে দু ঘা মারলেন, জোরে…বেশ জোরে। বললেন, হারামজাদা সোয়াইন… ভদ্দরলোকের জিনিসের পেছনে ফেউ লাগা! হারামজাদা কোথাকার। আমি চলে আসছিলাম। মেয়েটি হাসছিল আর কী বলছিল। বাবু বলছিলেন, ইতর ভদ্র সবাই তোমার রূপে মজে যায় আশা, কী আর করবে। .মেয়েটির নাম আশা। আশা আশা।
২৮.
বিকেল হল। মেলা ভাঙল। সবাই ফিরছে। সবাই। দোকানপত্র উঠছে। গোরুর গাড়ি জোতা হল। মোটর গাড়ি স্টার্ট দিল। দেহাতিরা গান গাইছে। বাবু ছোরারাও গান গাইছে। বউমারা জুতো পায়ে দিয়ে টুক টুক করে হাঁটছে। পাতা উড়ছে, সারাদিনের খাওয়া-দাওয়ার পর। পাথর সাজিয়ে তৈরি উনুনগুলো পোড়া কাঠ আর ছাই নিয়ে পড়ে আছে।
২৯.
সন্ধ্যা হয়ে এল। ধর্মশালায় দু-পাঁচটি মাত্র যাত্রী। শীতের খর বাতাস বইছে।
৩০.
নদীর ধারে অভুক্ত এঁটোকাঁটা ছড়ানো খাবার খুঁজতে গিয়েছিলাম। ভীষণ খিদে আমার। বাঁশের ঝোঁপের কাছে হঠাৎ দেখলাম সেই মেয়েটি। আশা..আশা। তাকে দেখে আমি পালাচ্ছিলাম। পায়ের শব্দ পেয়ে একটুক্ষণ দেখলাম তাকে। আশা একা। ধীরে ধীরে কাছে গেলাম। আশা বলল, অন্ধকার হয়ে গেলে আমি আর কিছু দেখতে পাই না, কানা হয়ে যাই। তুমি আমায় মন্দির পর্যন্ত পৌঁছে দাও। …আশা হাত বাড়িয়ে দিল তাকে ধরে ধরে পথ ঠাওর করে নিয়ে যাবার জন্যে। …আশার হাতে চুড়ি বালা। আমি দেখলাম। আশার গলায় সুন্দর হার। কানে দুল। …আমি তার হাত ধরলাম। সন্ধ্যা ঘন হয়ে এসেছে।
৩১.
উঁচু শক্ত ধারালো শ শ বছরের পুরনো মিশকালো পাথরের খাঁজের মধ্যে, বাঁশঝোঁপের আড়ালে, অল্প অল্প জলে, অন্ধকারে আশার শরীর নিস্পন্দ হয়ে গেল। অন্ধকারেই আশারা মরে।
৩২.
সমস্ত গহনা আমার কাছে, পুঁটুলি করে বাঁধা। ছেঁড়া জামাটা দিয়ে আগুনের চেয়েও গরম, তপ্ত এক পুঁটলি বেঁধেছি। শীতের হোবলও আর গায়ে লাগছে না আমার।
৩৩.
মন্দিরের পাশ দিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে যাবার সময় এক বৃদ্ধা মহিলাকে হঠাৎ বলতে শুনলুম, কোথায় যেন আগুন লেগেছে গো! ..মেলার দিকে না ধর্মশালার দিকে কোথায় যেন আগুন লেগেছিল। লাল আঁচ উঠছিল একটা।
৩৪.
মন্দির থেকে অনেকটা দুরে এক কুমোর বাড়ির খোলার চালের তলায় কুঁকড়ে জড়সড় হয়ে শুয়েছিলাম। এক হিন্দুস্থানি সাধু আমার বয়সি একটা ফরসা ছেলেকে দিয়ে পা টেপাচ্ছিল। গাঁজার গন্ধ খুব। …কখন আমি ঘুমিয়ে পড়লুম। রাত্রে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম–আগুনের স্বপ্ন। এই আগুন সেই আগুন, আমার জন্মের সময় যেটা লেগেছিল। আমার বাবা আগুন নেবাতে ছুটে গিয়েছিল, মা আর আমি অসহায় হয়ে পড়ে ছিলাম।
৩৫.
আগুনটা আমার গায়ে এবং মনে লেগেছে। এতকাল পরে। মা পুড়েছে; বাবা মরেছে। …আশাকেও আমি মেরেছি।
.
দুই
০১.
আমি কে, কী আমার নাম, কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাব–আমার মনে পড়ছিল না কিছুই। তিন দিন তিন রাত কেউ যেন আমায় কোনও গুহায় নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখল, বেহুঁশ জ্বর আর যন্ত্রণার কালো খুঁটি বেড় দিয়ে ফুলি-আঁটাবলদের মতন ঘুরলাম। দিন গেল রাত এল, রাত ফুরাল দিন এল, আমি ঘুরছি ঘুরছি। কখনও বুনন কুকুরের,কখনও পুলিশের, কখনও বা রাশ রাশ বিছের স্বপ্ন দেখলাম। কুকুর তাড়া করেছে, পুলিশ বেত মারছে, বিছেতে কামড়ে দিয়েছে। …তারপর একদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখলাম, খোলা দরজা দিয়ে আলো এসেছে, কুঁই কুঁই করে বেড়াল বাচ্চা ডাকছে, ঘরের মধ্যে মালসার ছাই উড়ছে তুলোর আঁশের মতন, খোলার চাল থেকে কুটো পড়ছে উড়ে উড়ে। আমার ঘাড় পিঠ বুক হাত পা সব যেন বিরাট একটা ফোঁড়ার মতন টাটিয়ে টা টা করছিল। কী যন্ত্রণা, কী কষ্ট। নিজেকে মনে পড়ল। আশাকে মনে পড়ল। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। গা থেকে কুটকুটে ছেঁড়া কালো কম্বলটা টান মেরে ফেলে দিলাম। কে দিয়েছে এই কম্বল আমার গায়ে চাপা দিয়ে? কে? কে আমার অত কষ্টের ধন সোনা বাঁধা পুঁটলিটা চুরি করে পালিয়েছে?
০২.
কুমোর বউ শটির পথ্য দিল। ওর নাম ময়না। বলল, মরতে হয় অন্য কোথাও গিয়ে মরো, এখানে মরলে পোড়াবার লোক নেই। .. ময়না আমার সোনা চুরি করেছে। জিজ্ঞেস করতে গিয়েও মুখে আটকে গেল। ভয়। আমার মতন ভিখিরি ছেলের কাছে অত সোনা কী করে এল? চালাক চতুর ময়না আমায় পুলিশে ধরিয়ে দেবে ঠিক। আশার কথাও জানাজানি হয়ে যাবে।
০৩.
ময়নার গোটা নাম ময়নাবতী। তার বর নেই। কোথায় আছে কে জানে। ময়না সিথিতে সরু করে মেটে-সিঁদুর দেয়। তার ভাশুরের নাম গোলক। গোলকের একটা পা খোঁড়া, পা টেনে টেনে হাঁটে। গোলক সারাদিন গোরুর গাড়ির চাকার মতন একটা চাকা ঘুরোয়। ময়না কাদা ছানে, তাল করে, আগুন তৈরি করে দেয়, গোলক হাঁড়ি কলসি গেলাস বানায়, আগুনে পোড়ায়। সারা সকাল সারা দুপুর সন্ধেতক ওর শুধু কাজ, কাজের মধ্যে ফাঁকে ফাঁকে গান: যদি আশা দিলে নিশি জাগালে তবে কেন যে কাঁদালে হে…।
০৪.
গুড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছিল সকালে। শীত গায়ে বিঁধছিল। নতুন পেরেকের রঙের মতন মেঘলা হয়েছিল বাইরেটা। শন শন হাওয়া বইছিল। টিঙটিঙে দুই গোরু জুতে, মাথায় পুরনো ছাতাটা মেলে গোলক হাঁড়ি কলসি সাজিয়ে রোববারের হাটে গেল। …দুপুরের পর মেঘ কেটে সূর্য মুখ দেখাল। হাওয়াও যেন গায়ের খাপ ফেলে তার আরও ধারালো ফলা শন শন করে ঘোরাতে লাগল। কী শীত। …সন্ধে হল, গোলক ফিরল। ঘেঁড়া কানিতে পুঁটলি বাঁধা চাল ডাল, গামছায় কিছু আনাজ বেঁধে এনেছে নীল রঙের বোতলে আধসেরটাক সরষের তেল, একটা বাঁধাকপিও নামাল। আর শালপাতার ঠোঙায় ঝুরি ভাজা, দু-চারটে মিঠাই ময়নার জন্যে। রাত হল; মালসায় আগুন জ্বালিয়ে দাওয়ায় বসে থাকল গোলক, গায়ে কাঁথা। তামাক খায় আর গান গায়: কী যাতনা যদি না বোঝো তবে আর কেন এ প্রাণ রাখা–। পাকশালে মিটমিট টিমি জ্বলে ময়নার। ভাতের ফেন পোড়ার গন্ধ ছোটে। –আমি ভাবি, গোলক ময়না বর বউ হলে খাশা হত।
০৫.
মাঝরাতে ময়না ডাকাত পড়ার মতন করে দরজা পিটিয়ে ডাকল। ধড়মড় করে উঠে বসলাম খড় বিছানো চটের বিছানায়। ঘরটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। ময়না ডাকছিল। নিশির ডাক নয় তো? আমার বড় ভয় নিশি পাওয়ায়। খুলে দিলাম দরজা ভয়ে ভয়ে। ময়না ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিল। অন্ধকারে না দেখি মুখ না পাই ঠাওর। তবু মনে হল ময়না হাঁপাচ্ছে। খানিকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিল ও। তার পর বিছানায় গিয়ে বসল। আমি দাঁড়িয়ে। ডাকল ময়না। বার বার তিনবার। ডাকে ডাকে দু পা দেড় পা করে এগিয়ে কাছে গেলাম। হাত ধরে টেনে পাশে বসাল ময়না। বলল, শো। …ভয় করছিল শুতে! মুখ তো দেখিনি মেয়েটার! যদি ময়নার গলা করে নিশি এসে থাকে!
০৬.
ভোর হবার আগে আগে ময়না উঠে আমায় ডাকল। বলল, চল আমার সঙ্গে। –কোথায় যাব। গায়ের শাড়িটা পেঁচিয়ে নিল ময়না, ঘাড়ের খোঁপাটা আরও উঠিয়ে দিল! দরজা খুলে চলে গেল। আবার এল একটু পরেই। মুখে জল দিয়েছে। হাতে একটা বড় পুঁটলি। বলল, এখনও বসে আছিস হাঁদার মতো। ওঠ…কাঁথাটা গায়ে জড়া, চল শিগগির, এরপর ফরসা হয়ে যাবে।
০৭.
কত দিন পরে আবার পথ হাঁটছি। পায়ে ধুলো লাগছে। ভোরের ধুলো, সারারাতের হিমে ভেজা ভিজে ভিজে ধুলো। কুয়াশা চারপাশে। গাছের মাথায় পাখি ডেকেছে, কাকা করছে কাক, এখনও আকাশে শুকতারা জেগে আছে। কী শীত। কনকন করছে মুখ মাথা হাত পা। ময়না জোরে জোরে হাঁটছে, ছুটে ছুটে; আমি তাল রাখতে পারছি না। ওর ঘোমটা খসে গেছে, ঢিলে খোঁপাটা ঘাড়ে নেমে কখনও ডানে কখনও বাঁয়ে সরে যাচ্ছে। পিছু থেকে ময়নাকে ভোরবেলার ঘুম-ভাঙা টাটকা বউয়ের মতন দেখাচ্ছে। মুখ ওলটানো ঘড়ার মতন পিঠ, কোমর দুলছে, সরু কোমর, কোমরের তলায় দুটো গোলগোল বাচ্চা যেন হামাগুড়ি দিয়ে হেসে হেসে ছুটছে, গোড়ালির অনেকখানি উঁচুতে শাড়ির পাড়টা ঘষে ঘষে যাচ্ছে ময়নার গোড়ালি আঁট শক্ত পুটু, ওর পায়েও ধুলো।
০৮.
সূর্য উঠে গেল। আমরা নদীতে। ময়না ডান হাতে জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে নদীতে নামল। বার কয় কুলকুচি করল। আমার বাসি মুখ, এতক্ষণে আমি জল দিলাম। কী ঠাণ্ডা জল। পুঁটলিটা আমার হাতে দিয়ে ময়না আড়ালে গেল।
০৯.
পুঁটলিটা আমার খুলতে ইচ্ছে করছিল। কী আছে? আমার সেই সোনাগুলো আছে না কি এর ভেতর? গা শিরশির করে উঠল। এপাশ ওপাশ তাকালাম। ময়না ভাঙা-পাড়ের খাঁজের আড়ালে গেছে। ওকে দেখা যাচ্ছে না। পুঁটলিটা খুলব? পালাব নিয়ে? কেমন করে পালাব, কোথায় বা যাব!
১০.
ওপরের শক্ত গিঁটটা খুলেছি কি চোখে পড়ল ময়না খানিকটা তফাতে জলে নেমেছে। সঙ্গে সঙ্গে বুকের রক্ত ছলাত করে উঠল। গিটটা আবার বাঁধতে লাগলাম তাড়াতাড়ি।
১১.
নদী পেরোতে পেরোতে ময়না বলল, তুই বলিস কী, ফটকে। …আমার বুক অবধি জল উঠেছে, ময়নার কোমর ছাড়িয়েছে। দাঁড়িয়ে পড়ল ময়না। আমরা দুজনেই হেলে হেলে পড়ছিলাম; আমি বেশি, ময়না কম। তরতর করে জল বয়ে যাচ্ছে। ময়নার ভেজা শাড়ি জলের তলায় তোড় খেয়ে ফেঁপে ওপরে ভেসে ভেসে উঠছিল, ময়না বশ করছিল থাবড়ে থাবড়ে। …আমার দিকে অবাক চোখে সন্দেহ সন্দেহ ভাব নিয়ে খানিক তাকিয়ে থাকল ময়না। তার পর বলল, মাথার ওপর আকাশে সূয্যি উঠেছে, নদীর মাঝ-মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছি–এক গলা জলে ডুবে–এ-জলও গঙ্গা বুঝলি–এই ভোরে এখানে তোকে ছুঁয়ে দিব্যি কাটছি, তোর এক দানা সোনা আমি চক্ষেও দেখিনি। ময়না কী ভীষণ দিব্যি কাটল। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে আকাশটা দেখলাম, সূর্য লাল হয়ে উঠছে; দূরে তাকালামনদী বয়ে যাচ্ছে। কী শান্ত নির্জন। চারপাশে তীরের গাছপালা সবুজ হয়ে উঠছে। আমার কেন যেন বুক কুরে কুরে কান্না আসছিল। চোখ আমার জলে ভরে এল। …ময়না বলল, সেই সাধুটা সাত সকালেই পালিয়েছিল; নিশ্চয় তার কাজ। …সাধুরা চোর হয় আমি ভাবিনি। মনে পড়ল সেদিন যে সাধুটা আমার বয়সি একটা ফরসা গোলগাল ছোঁড়াকে দিয়ে গা পা টেপাচ্ছিল, সে-সাধুটা ইশারায় আমাকেও ডেকেছিল। ঘুমের মধ্যে একবার যেন মনে হয়েছিল ও আমার গায়ে পায়ে হাত দিয়েছে। কিন্তু তখন আমার জ্বর এসে গেছে, যন্ত্রণায় পুড়ছিলাম। আমি হুশ হারিয়েছি ততক্ষণে। অথচ ওই শুয়ারের বাচ্চা সাধুটাই আমায় আদর করে ডেকে সে-রাতের মতন ময়নাদের ঘরে নিয়ে গিয়ে তুলেছিল।
১২.
নদী পেরিয়েছি বেলায়। তার পর রোদ আরও ছড়াল, গরম হল, বেলা চড়ল, আমরা হাঁটছি হাঁটছি। হাঁটার শেষ নেই। একটা বসতি মতন এল। ময়না বলল, না ওখানে নয়। একটা ছোট গ্রাম দেখলাম, ময়না হাত বাড়িয়ে আমার হাত ধরল। আরও একটু চ..আরও একটু। রোদে রোদে ময়নার শাড়ি আমার ধুতি কখন শুকিয়ে গেছে। নদীর কনকনে জল ঠেলে ঠেলে কোমর পর্যন্ত অসাড়, হেঁটে হেঁটে দু পা আমার ব্যথায় টনটন করছে। আর টানতে পারছি না নিজেকে। মনে হচ্ছিল আবার আমার জ্বর আসবে। মাথা টাল খেয়ে যাচ্ছিল।
১৩.
আমরা এক পুকুরপাড়ে বসলাম। চারপাশে ফাঁকা ক্ষেত আঁকা বাঁকা আল। সরু সরু পায়ে চলা পথের জাল চারপাশে ছড়িয়ে আছে। …কোন পথ আমরা ধরব কে জানে। আমি জানি না; ময়না জানে। ময়না জানে আমরা আর কত হাঁটব, কোথায় যাব, কোনখানে গিয়ে জিরেন পাব।
১৪.
পুকুরের জলে হাত মুখ ধুয়ে এসেছি আমরা। ময়না পুঁটলি থেকে চিড়ে বের করছে, একটা করে গুড়ের লাড্ড। পেটের খিদে জিবে এসে উঠেছিল। নাড়ি পড়ে গেছে, জিবে আর জল কাটছে না। মরা খিদেয় চিড়েগুলো আরও শুকনো লাগছে। গলায় আটকে যাচ্ছিল। দম নিতে পারছি না ভাল করে। ময়না গোগ্রাসে খাচ্ছিল। তার চোখ আঁচলের ওপর, চিড়ের মুঠো সমেত হাতটা উঠছে নামছে। ওর গাল ফাঁক হয়ে ছড়িয়ে পড়লে মাঝে মাঝে দাঁতের পুরো পাটি দেখা যাচ্ছিল। কী সাদা আর শক্ত দাঁত! এই দাঁত দিয়ে কাল রাত্তিরে গোলককে ও ক্ষ্যাপা কুকুরের মতন ছিঁড়েছে। মানুষের দাঁত যে এমন সাংঘাতিক হতে পারে আমি জানতাম না।
১৫.
গাছের ছায়ায় শুয়ে শুয়ে আমরা জিরেন নিচ্ছি। শীতের রোদ নরম হয়ে আসছে। দুটো ফিঙে মাথার ওপর বসেছিল, উড়ে গেছে; একটা কাক কা কা করছিল। ইনতি-লতার ডাল বেয়ে হলুদ গিরগিটিটা উঠছে আর নামছে। ময়নার খোঁপা মাথার চুল ধুলোয় ধুলোয় রুক্ষ। দু চোখ জড়িয়ে এসেছে ওর। আমার মনে হচ্ছিল, আমি ময়নার বর হলে বেশ হত। ময়নার বর নেই।
১৬.
বিকেল পড়ে এল। আমরা হাঁটছি। শিমুল গাছের তলায় খোঁড়া একটা কুকুর শুয়েছিল। মুখ তুলে দেখল। বার কয় ডাক দিয়ে আমাদের পিছু পিছু আসতে লাগল। ময়না বলল, স্বগের কুকুর চলেছে। সঙ্গে। ..ময়নার হাসি আমি বুঝলাম না। কোথায় যাচ্ছি আমরা? স্বগগে, স্বৰ্গগে, স্বগগে.ময়না হেসে হেসে বলল।
১৭.
মাঝরাতে আমরা স্বগগে এসে পৌঁছলাম। কী ভীষণ শীত। হাত পা জমে যাচ্ছিল। পা গুটিয়ে বুকের সঙ্গে ঠেসে ধরে মুখ মাথা গুঁজে একটা পুঁটলির মতন পেচ্ছাবখানার কোণে আমি বসে ছিলাম। শীতের চোটে ঘুম ভেঙে ভেঙে যাচ্ছিল। দু-চোখ ঘুমে জড়ানো, তাকাতে পারছি না, ঘুমোতেও না। ময়না হাত ধরে টানল, এই ওঠ ওঠ–এখানে নামব আমরা। রেল কামরার আলো দুটো পিট পিট করে চাইছে। বিশ পঁচিশ জন লোক, সবাই কুণ্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে শুয়ে, দু-একজন বসে বসে ঘুমোচ্ছ। আমরা। নেমে গেলুম।
১৮.
এটা খুব বড় ইস্টিশান। পুল পেরিয়ে মুসাফিরখানা। শীতের খুব চোট। হিমে সব ভিজে গেছে, আশপাশের বাতিগুলো নিবু নিবু লণ্ঠনের মতন টিম টিম করছে। অল্প কটি লোক আমাদের মতনই কাঁপতে কাঁপতে দু হাতে কান মাথা ঢেকে পুল পেরিয়ে চলল। ঠক ঠক করে কাঁপছে সবাই, হি হি করছে। আমার দাঁত বাজছিল। পা আর নড়ছিল না।
১৯.
মুসাফিরখানায় বসে আমরা গরম গরম চা খেলাম। তিনপাশ ঢাকা এই বড় মুসাফিরখানায় অনেক লোক। তাল তাল হয়ে পড়ে আছে। চিনেবাদামের খোসা, ছোলা ভাজা, তরকারির আলু, এঁটো পাতা, কলার খোসা ছত্রাকার করে ছড়ানো। আমার পুরনো কথা মনে পড়ছিল…সেই চায়ের দোকানের কথা। পার্বতাঁকে যদি এখানে পেতাম! আমার টাকা চুরি করে পালিয়ে ও যে কোথায় দোকান দিয়েছে কে জানে!
২০.
ময়না আমার হাত ধরে টেনে একটা অন্ধকার কোণে গিয়ে বসল। পুঁটলিটা কোলে রেখে গা ঘেঁষে বসে বলল, তোর বয়স কত? ..আমার কত বয়েস আমি কী করে জানব! কে আমার বয়সের হিসেব রেখেছে! বললাম, জানি না। ময়না আমার মুখের দিকে অল্প একটু চেয়ে থেকে বলল, তোর বাপ মা কোনও চুলোয় কেউ নেই–ঠিক তো, না মিথ্যে বলছিস? ..চাঁপারানি আর শ্যামলবাবুকে আমার মনে পড়ল। কতদিন তাদের কথা ভাবিনি।
২১.
আমার জাঙে হাত রেখে একটু টিপে দিল ময়না। আমরা বিহান হলেই এক জায়গায় যাব। তুই যা ল্যাঙপেঙে নয়তো তোকে আমার বর করতুম। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি তুই আমার দেওর। বুঝলি?
২২.
গোকুল ময়নার ভাসুর সেজে ছিল, আমি দেওর সেজে থাকব। আমার বয়স বেশি হলে আমি ওর বর হতে পারতাম। ময়নার বর হতে আমার খুব ইচ্ছে ছিল। আমার বয়স কেন যে একটু বেশি হল না! ময়নার শাড়ির জামার গায়ের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে আমার শরীরের ভেতর কেমন করে উঠল। কাল রাত্তিরে ময়না আমায় পাশে টেনে নিয়ে শোবার পর আমি ভয়ে ভয়ে চোখ বুজে ছিলাম, আজ চোখ খোলা। বোজা চোখে কত কী হওয়া যায়, খোলা চোখে কিছুই না।
২৩.
টকটকে রোদে খুঁজে খুঁজে আমরা যেখানে এলাম সেটা ঝি-পাড়া। মাটির কুঁড়ে, খড়ের চাল, পুরনো টিন কিংবা খোলার ছাদ। নালি নর্দমা থিক থিক করছে ময়লায়। একটা পোডড়া বাড়ির গায়ে খুঁটে শুকোচ্ছে, নামে মাত্র; অথচ কয়েক শো দাগ। ছেঁড়া ময়লা শাড়ি শুকোচ্ছে এদিক ওদিক। ন্যাংটা ছেলেমেয়ে, লেড়িকুত্তা। …ময়না আমায় ইশারায় সামনে এগিয়ে যেতে বলল। বলে ঘাড়ের কাপড়টা মাথায় উঠিয়ে মুচকি হাসল একটু। ক পা এগিয়ে ময়নাই শুধোল একটা কাঠিসার কবসা মেয়েকে, হরিমতীদের বাসা কোনটা গো?
২৪.
তালপুকুরের শেষ বাড়িটা হরিমতীদের। বাসার পাশে মরা কদম গাছ। হরিমতীর বেশ বয়েস। গলার একপাশে গলগণ্ড। চোখা নাক, চোখ দুটো গর্তে ঢোকা, সাঁড়াশির আগার মতন টিপে ধরবে যেন এমন করে তাকায়। ছেঁড়া গামছা পরে হরিমতী গুল পাকাচ্ছিল। ময়নাকে দেখে বুড়ি অচেনা মানুষ দেখার মতন চেয়ে থাকল।
২৫.
হরিমতী ময়নার খুড়ি। বুড়ি ভীষণ ধূর্ত, কঠিন মেয়েছেলে। কাঁদুনিতে গলল না। তার উচ্ছের মতন কোঁচকানো কপাল, চিমসে বুকের হাড়ে কখনও ডান কখনও বাঁ হাত চাপড়াল; থেকে থেকে মঙ্গলচণ্ডীর নাম আওড়াল। আমরা বাইরের ডোবা থেকে মুখ হাত ধুয়ে এলাম। বুড়ি আমাদের এক পালি করে মুড়ি দিল, এক খামচা করে একো গুড়। মাটির উঠোনে ভাঙা মাচার তলায় বসে আমি গোগ্রাসে সেই মুড়ি খেলাম। ময়না বসেছিল বুড়ির ঘরের ঠকঠকে দরজার কাছটায়। ময়নার তেমন মন ছিল না খাওয়ায়। কী ভাবছিল কে জানে। চৌকাঠের সামনে ঘর আড়াল করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল বুড়ি। নড়ল না। ..ঘটিটা এক চুমুকে শেষ করে আরামের নিশ্বাস ফেলেছি কি বুড়ি বলল, এ-ছোঁড়া করে কী, এমুন ফিঙের মতন দেখতে? ..আমায় কথা বলতে না দিয়ে ময়না বলল, হাটে হাঁড়ি কলসি বেচতে যেত। পালা জ্বরে ভুগছে চার মাস, শরীরটা কাহিল। .বুড়ি তার ঠিকরোনো চোখে চেয়ে দেখল খানিক, তার পর বিড়বিড়িয়ে কী যে বলল, শুনতে পেলাম না।
২৬.
মাঝদুপুরে শীতের রোদ যেন উবু হয়ে বসেছিল। আকাশটা নীল। দুটো না তিনটে চিল আরামে পাখা ছড়িয়ে ভাসছে। ময়না আর আমি হাঁটছিলাম।
২৭.
রাস্তার লোকজন আমাদের দেখছিল। ময়নাকে বেশি আমাকে কম। আমার পায়ের শিরায় টান ধরছিল। থেমে থেমে যাচ্ছিলাম দু দশ পা অন্তর। এই শহরটা খাসা। ঘোড়ার গাড়ি আছে, মোটর গাড়ি আছে, বাস চলে। আমার কেবল মনে পড়ছিল পুরনো দিনের কথা। তেমনি শহর এটা। তার চেয়েও বড়। চাঁপারানির মতন একটা মেয়ে রিকশা চেপে চলে গেল। আমি হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলুম। রিকশাটা কোথায় আড়াল পড়ে গেল। রোদও আড়াল পড়ে যাচ্ছে। ডান পাশের মস্ত মস্ত ছায়া রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে। আমরা বাজারের বড় সড়ক ধরে হাঁটছি।
২৮.
বিকেল ফুরিয়ে এল। অন্ধকার এখানে থিতিয়ে ঠায় ঠায় জমতে পারে না। খামচা খামচা আলো, রাস্তার–দোকান পশারের। অন্ধকার কেটে যায়। আলোগুলোর রোশনাই ঠিকরে ওঠার আগেই বটতলা দিয়ে আমরা এক গলির মুখে ঢুকে পড়লাম। ময়না পথে দু পাঁচজনকে কী যেন সব শুধিয়েছে। আমি ঠাওর করে দেখছিলাম, ময়না দোকানি মেয়েছেলে দেখতে পেলে যা শুধোবার শুধোচ্ছিল, নয়তো চুপ মুখে পথ হাঁটছিল।
২৯.
বাড়িটা কাদা না ইট না টিনের কিছুই বুঝতে পারিনি প্রথমটায়। পরে দেখলাম মাঠকোঠার মতন। ওপর তলা টিন দিয়ে ঘেরা। কামিনী হোটেল। ভাতের ফেনের গন্ধ ছুটছিল। নীচের চাতালে ছড়ছড় করে কলের জল পড়ছে; কোথা থেকে ভ্যাপসা আঁশটে হাওয়া আসছিল। মিটমিট করছে লণ্ঠন। বেঁটে মোটা ধুমসো কাঁঠালের মতন একটা মেয়ে ভাঙা খসখসে গলায় সব কিছু তদারকি করছিল। ওরই নাম কামিনী। হোটেলের মালিক। ওর পরনের শাড়িটা বেশ বাহারি। হাতে কৌটো ভর্তি পান। কামিনীর গলায় মোটা হার, হাতে বালা। মাথায় কেমন এক ধরনের চুল। …ময়না গোটা একটা টাকা দিল কামিনীকে। চার চার আনা করে রাতের খাওয়া। মাছ খেলে পাঁচ আনা। তিন আনা কুঠরি ভাড়া, এক আনা টিমির জন্যে। আমার খুব ইচ্ছে করছিল একটু মাছ খাই। ময়নাকে বলতে পারছিলাম না।
৩০.
টিমি জ্বালিয়ে দুহাত টিনের খুপরির মধ্যে আমি আর ময়না বসেছিলাম। পাশাপাশি আট দশটা খুপরি থেকে অনেক লোক কথা বলছিল। মেয়েছেলেদের গলাই বেশি। হট্টগোলটা হাটের মতন। ওই গোলমালের মধ্যেও একটি মেয়ে সমানে কেঁদে চলেছে। তার ছেলে সকালে মারা গেছে আজ। শহরের হাসপাতালে। টুলিটায় মাথা ঠেস দিয়ে কুঁকড়ে পাশ দিয়ে আমি শুয়ে থাকলাম। শীত করছিল খুব ঘুমও পাচ্ছিল। টিমিটা টিম টিম করছে।
৩১.
নীচের একটা ঘরে আমরা খেতে বসেছি। মেঝেটা জলো ন্যাতা মুছে মুছে প্যাঁচপ্যাঁচে হয়ে আছে। মাটি খুঁড়ে দেওয়াল ঝরে এঁটো কাটার কেমন এক ঠাস গন্ধ জমেছে এখানে। একটা লণ্ঠন ট্যারা হয়ে জ্বলছে। শালপাতায় ফেন-আগালা ভাত, মুসুরের জলো ডাল। ঘেঁটে কাদা হয়ে গেছে কপির তরকারি। আমি, ময়না, আরও চার পাঁচ জনে হুসহাস করে খাচ্ছিলাম। কামিনী দরজার কাছে এসে দাঁড়াল।
৩২.
লণ্ঠনটা একটু জোর করতে গেল কামিনী। হঠাৎ তার মাথার সমস্ত চুল পড়ে গেল। একেবারে সাদা। কামিনীর মাথায় একটিও চুল নেই।
৩৩.
সবাই হাসছিল। ময়নাই কেবল হাসল না। আমি সাদা মাথা মেয়েছেলে কখনও দেখিনি। কামিনীকে দেখে আমার কেমন ভয় হচ্ছিল।
৩৪.
শীতের কাঁপুনিতে ঘুম ভেঙে গেল। টিমি নিবেছে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার ঘর। পুঁটলি বাঁধা কাপড়টা মাটিতে বিছিয়ে আমরা শুয়েছিলুম। ঠাণ্ডা যেন হাড় মাংস পেরিয়ে শরীরে মধ্যে জমে বসেছে। বুক পেট পা হাত অসাড় অসাড় লাগছিল। কুঁকড়ে পাকিয়ে গিয়েছিলুম, দেহটাকে আরও কুণ্ডলী পাকানোর চেষ্টা করলাম, কাঁথাটাকে আরও জড়ালামহঠাৎ মনে হল, আমার শরীরটাই খুলে পড়ে গেছে। কামিনীর চুলের কথা মনে পড়ল। আমার শরীর থেকে হাড় মাংস খুলে গিয়ে তা হলে কী আছে?
৩৫.
ময়না ধড়মড় করে উঠে বসল। কী হয়েছে রেফটকে-অ্যাঁ? কী হল তোর? …আমি ভয়ে গোঁ গোঁ করছিলাম। ময়নার সাড়া পেতে ভয়টা খসে গেল। আমার গা পা মাথা ছুঁয়ে দেখলাম। সব ঠিক আছে। খুলে পড়ে যায়নি।
৩৬.
ময়নার পাশে গা ঘেঁষে এবার শুলাম। ওর গায়ের গন্ধ ঠাণ্ডায় মরে গেছে। তার নাকের বড় বড় হাওয়া আমার গলায় লাগছিল। ঘুমিয়ে পড়েছে আবার ময়না। …আমার খুবই ভাল লাগছিল। ময়নার পরচুলা নেই। ও যেমন দেখতে ঠিক তেমনটি।
৩৭.
কামিনী হোটেলে সক্কালবেলায় এক হুদো মদ্দ চোখের ইশারা করে ময়নাকে ডাকছিল। কলতলায় মুখ চোখে জল দিতে গিয়ে আমি সব দেখলাম। ময়না ঘরের বাইরে সরু পথটুকুর ওপর দাঁড়িয়েছিল। কাঠের ফাঁক ফাঁক বেড়া তার সামনে, হাঁটুতক। মাথার ওপর ঢালু টিনের ছাদ। মদ্দটা উত্তরদিকের ঘর থেকে ইশারা করছিল। করেই চলছিল…।
৩৮.
তিন দিন আমরা কামিনী-হোটেলেই থাকলুম। ময়না রোজই একটা করে টাকা দিত কামিনীকে। আমি পেট পুরে ভাত খেতাম। কামিনীর হোটেলে খরিদ্দার ভাত চাইলে না বলার উপায় ছিল না। অনেক খেতাম বলে ঘুম পেত খুব। দুপুর ভোর ঘুমোতাম, রাতে ভাল ঘুম হত না শীতে। ময়না মাঝে মাঝে কোথায় বেরিয়ে যেত। ফিরত দেরি করে। আমার ওপর হুকুম ছিল কোঠা ছেড়ে না যেতে। হয় ঘর না হয় বারান্দায় আমি বসে থাকতুম। ময়নার পুঁটলির ওপর নজর রাখতে হত। ওই পুঁটলিটায় কী আছে আমি জানতুম না। ময়না ওর মধ্যে থেকে তার শাড়ি জামা চিরুনি বের করত। টাকাও।
৩৯.
চারদিনের দিন ময়না অনেক বেলায় ফিরল, খুব সকাল সকাল সেদিন বেরিয়ে গিয়েছিল। অনেক ঘুরেছে, অনেক হেঁটেছে। মুখ শুকনো দেখাচ্ছিল। ফিরে এসেই বসে পড়ল। হাঁপাচ্ছিল। জল চাইল। ঢকঢকিয়ে জল খেল, মুখ গলা মুছল; তারপর ঘাড় ফিরিয়ে পিছু দিকে একবার চাইল। আমায় বলল, চান খাওয়া করে তুই ঘুরে বেড়াগে যা।
৪০.
দু-আনা পয়সা চেয়ে নিয়ে আমি সেই যে দুপুরে বেরুলাম ফিরলাম সাঁঝ করে। ময়না নেই। কামিনী বলল, ময়না চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে কোন বাবুর বাসায়। সেখানে চলে গেছে। বলে গেছে, আমি যেন কোথাও কিছু একটা জোগাড় করে নি।
৪১.
কামিনী আমায় সে রাতের মতন তার হোটেলে থাকতে দিল, খেতে দিল। অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে আমি সারাক্ষণ ময়নার কথা ভেবেছি।
৪২.
সমস্ত শহরটাই একদিন আমার চেনা হয়ে গেল। পথে পথে কত খুঁজেছি ময়নাকে, দেখতে পাইনি। অনেক সময় ভুল হত। কাছে গিয়ে বুঝতাম, ও ময়না নয়।
৪৩.
বাড়ি বাড়ি ঘুরে বাবুদের মেসে চাকরি পেয়েছিলাম। এক বাবুর নাম ছিল মোহনবাবু। মোহনবাবুকে কেউ ডাকলে মাঝে মাঝে আমি চমকে উঠতাম। মোহনবাবুও একদিন চমকে উঠেছিলেন। আমি বাজার থেকে তাঁর মেরামত করা জুতোটা এনে জড়ানো খবরের কাগজটা পড়ছিলাম। একটা লোক তার বউকে দা দিয়ে কুপিয়ে কেটেছে। বিপিনঠাকুর রান্নাঘরে বসে বসে আমার পড়া শুনছিল। বানান করে করে পড়তে খুব একটা আটকাচ্ছিল না। মোহনবাবু কী কাজে রান্নাঘরে আসছিলেন। আমায় কাগজ পড়তে দেখে অবাক হলেন।
৪৪.
এক ফাঁকে মোহনবাবু আমায় সব কথা শুধোলেন। কোথায় বাড়ি, কী জাত, বাপ-মার কথা, লেখাপড়া-টড়া কতটা এগিয়েছিল-সব। সব কথা বলা যায় না। আমি সব কথা বলিনি। আমার যে বাড়ি নেই, জাত নেই, বাপ-মার নামটুকু পর্যন্ত জানা নয় খোলাখুলিই বলে দিয়েছিলাম। বলতে বলতে মনে হয়েছিল, শুনে মন গলে যায় এমন কথাই মানুষকে বলতে হয়; খারাপ কাজের কথা বলতে নেই। আমি চায়ের দোকানের টাকা চুরি, আশা বা ময়না এদের কথা বলিনি।
৪৫.
আমার ওপর মোহনবাবুর দয়া হয়েছিল। একদিন তিনি বললেন, ভদ্দরলোকের ছেলের মতন হবার চেষ্টা কর। লোকের এঁটো বাসন মেজে জুতো বুরুশ করে তোর জীবন কাটবে নাকি! সারাদিন বসে বসে করিস কী তুই? বই এনে দিলাম, খাতা পেনসিল কিনে দিলাম–লিখতে পড়তে পারিস না!
৪৬.
লিখতাম পড়তাম। ঠেকলে মোহনবাবুকে শুধিয়ে নিতাম। অন্য অন্য বাবুরাও আমায় বলেকয়ে দিত। অনাদিবাবু বা কেষ্টবাবুর মতন দু এক জন যা টিটকিরি কাটত। আর পেছনে লাগল মদনা। মদনা আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। গায়ে তার ভীষণ জোর। এই মেসে তিন বচ্ছর চাকরি হল। মদনা আমায় বসে থাকতে, জিরোতে, বই হাতে দেখলেই ফরমাস করত। যা দোকানে, ওখানটায় ঝাঁট দে, খাবার পৌঁছে দিয়ে আয় সামন্তবাবুর। একদিন সে আমায় দিয়ে দু সের লঙ্কা বাটিয়েছিল। হাতের সেই অসহ্য জ্বালা তিন দিন আমি ভুলতে পারিনি।
৪৭.
নিশিবাবুর ঘড়ি চুরি গেল। আমি চুরি করিনি। মদনা আমায় ফাঁসিয়ে দিল। নিশিবাবুরা আমায় বেদম মারলেন। পুলিশে দিতে যাচ্ছিলেন আর একটু হলে। মোহনবাবু বাঁচিয়ে দিলেন। আমায় তাড়িয়ে দিলেন বাবুরা। বললেন, এ ধরনের চাকরবাকর রাখা আর হবে না। চাল-চুলো ঠিক-ঠিকানা নেই যার তাকে বিশ্বাস কী।
৪৮.
বছর ঘুরে আবার একটা শীত এসে পড়ছিল। শহর চষে ফেললাম। চাকর-বাকরের কাজ আর করব না। অন্য কিছু কাজ কেউ দেয় না। হেট হেট করে তাড়িয়ে দেয়। মোটর কারখানা, সাইকেল সারানোর দোকান–কেউ আমায় নিল না। মাড়োয়ারি পাঠশালার রাস্তার দিকে বারান্দায় রাত কাটাই, স্টেশনের বাইরে থেকে বাজারে মোট বয়ে আনি বাবুদের–দু-চার আনা যা রোজগার হয়।
৪৯.
বিকেল পড়ে গেলে আর আমি কাজ করতে পারি না। যত সাঁঝ বাড়ে, আঁধার ঘন হয়ে আসে ততই যেন কীসের এক দুঃখ আমায় পেয়ে বসে। আমার আর কিছু ভাল লাগে না। কিছু না। সব কেমন ফাঁকা মনে হয়। মন কেমন করে, কান্না পায়। একটা ভয়ংকর কষ্ট–সে যে কীসের কষ্ট কে জানে–আমায় বেহুঁশ করে ফেলে। সন্ধে হলেই জ্বর আসার মতন এই অসুখটা আসে–যত রাত বাড়ে তত তার জ্বালা বাড়ে, ভোরের আলোয় চলে যায়। …এ-অসুখের কী নাম, কেমন করে এল আমি বুঝে পাই না।
৫০.
মাড়োয়ারি স্কুলের বারান্দা থেকে আমায় তাড়িয়ে দিয়েছিল কবে। কাঠগোলার সামনে কতকালের পুরনো ধসা আগাছা ভর্তি একটা বাড়ি, আমরা–আমি আর কতক কানা কুষ্ঠ ভিখারি, একটা ঘেয়ো কুকুর, আট দশটা পায়রা সেখানে রাত কাটাতাম। একদিন এক থুথুড়ে বুড়ো তার ধুমসো পেট লিকলিকে মেয়ে নিয়ে রাত কাটাতে এল। মেয়েটা অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে পায়রা ধরছিল। আমি দেখতে পেয়ে তার হাত ধরে ফেললাম। মেয়েটা সাথে সাথে কেঁদে ফেলল। বুড়ো বলল, ওর মেয়ের রক্তকাশের ব্যারাম, পায়রা পুড়িয়ে খেলে সেরে যাবে, বদ্যিতে বলেছে।
৫১.
বুড়ো আর বুড়োর মেয়ে থেকে গেল; শেষ চারটে পায়রাই একদিন সকালে উড়ে গেল, আর এল
৫২.
আবার শীত পড়ল। মাঘ মাস। ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে রামেশ্বর ড্রাইভার আমায় দিয়ে গাড়ি ধোয়ায় মোছায়, তেল ঢালায়। মোবিল তেলের টিনে বাজারের কল থেকে জল ভরে এনে আগুনের মতন গরম ধোঁয়াওঠা ইঞ্জিনের মুখে জল ঢালি। মাঝে ভাবি ওটার পেটে যেন রাবণের চিতে জ্বলছে। বুকটা রাক্ষসের মতন হা-হা করা জ্বালায় পুড়ছে সর্বক্ষণ। …ওর মুখের ভাপে আমার বুকটাও জ্বলে যায়। আমারও তেষ্টা পায় খুব। জল খেয়ে খেয়ে সে-তেষ্টা যায় না, ভাপের সেই জ্বালা চোখ মুখ থেকে মোছে না।
৫৩.
গোটা রাত অসুখের ঘোরে থাকি। আকাশ দেখতে পাই না, বাতাসের জন্যে দমবন্ধ হয়ে আসে। খাঁচায় পোরা ময়নাটা মাথার কাছে থেকে থেকে পাখা নাড়ে, ডেকে ওঠে। গলির আলোটা তার গায়ে না খাঁচার শিকে–আমি স্পষ্ট করে দেখি না। গভীর রাতে সেও ঘুমিয়ে পড়ে। আমার সঙ্গী পাখিটা বোবা হয়ে গেলে সমস্ত ঘর আমায় ডুবিয়ে নেয়। মনে হয়, আমি ভয়ের কুয়োয় ডুবে আছি, ফাঁকা অসাড় অন্ধকার এক জগতে।
৫৪.
পাড়ায় পাড়ায় বসন্ত এল। মা শীতলার দশটা মূর্তিতেও কুলোন পাওয়া গেল না। একদিন আমাদের বস্তির উত্তর দিকটা আগুনে আগুনে লাল হয়ে গেল। মিউনিসিপ্যালিটির বিশ পঁচিশটা ধাঙর, পুলিশ আর সাহেব ডাক্তার নাগবাবুদের বস্তির আধখানা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিল।
৫৫.
রামেশ্বর ড্রাইভারের আমি ক্লিনার। বিকেল তিনটের সওয়ারি তুলতে স্টেশনে গাড়ি ভিড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মুখে বিড়ি, পরনে কালো ঝুল পাজামা, গায়ে হাতকাটা শার্ট। রামেশ্বর তার ইয়ার বন্ধুদের সঙ্গে দূরে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। রেলগাড়ি এসে গেল। স্টেশনের পুল দিয়ে সওয়ারিরা আসছে–সিঁড়ি ভেঙে। বিড়ি টানতে টানতে ছুটলাম। অন্য গাড়ির ফড়েরাও ছুটেছে। ঘোড়ার গাড়ি আর রিকশাগুলোও। যে আগে ভাগে ভুলিয়ে ভালিয়ে ছোঁ মারতে পারে কপাল তার। আমাদের বা ট্যাক্সিবালাদের–আবার চিলের ছোঁ।
৫৬.
ফিনফিনে জমকালো শাড়ি পরে এক বউ নেমে আসছে, তার পাশে কাঁচাপাকা চুলের এক বাবু। ট্যাক্সির খদ্দের। বউটার শাড়ির বাহার রামধনুর মতন। হরেক রং। গায়ের এখানে সেখানে ফেঁপে ফুলে রয়েছে শাড়িটা। বাবুর হাতে ছড়ি। …ভিড় ভারিক্কি হঠিয়ে বউটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পায়ের কাছে। সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমে এসেছে ওরা। …কোথায় যাবেন শুধিয়েছি কি হেঁট-মুখ বউটি মুখ তুলে তাকাল। আমার মুখে আর কথা সরল না।
৫৭.
ময়না আমায় চিনল না। একবারই যা তাকিয়ে দেখেছিল, আর দেখল না। আমিই ওকে দেখলাম। তার গা গতর আরও মজেছে, হাতে গলায় গয়না, চোখে সুরমা, টকটকে ঠোঁট, সারা মুখটাই ভীষণ ফরসা ফরসা।
৫৮.
বাবুর ছড়ির খোঁচা খেয়ে আমি পথ ছেড়ে সরে গেলাম। ময়না আর বাবু চলে গেল। ময়নার পায়ে লাল মখমলের কাজ করা চটি। চটিতে আওয়াজ উঠছিল।
৫৯.
সন্ধ্যেবেলায় ডেরায় ফিরে পোষা ময়নাটাকে খোঁচা দিলাম। যেমন করে বাবু আমায় ছড়ির খোঁচা দিয়েছিল।
৬০.
রাত্রে সেই বেহুশ ঘোর। নিত্যকার বুকভাঙা কষ্ট। পাশের কুঠরিতে অমূল্য ছুতোরের বউ গোঙাচ্ছে। গায়ের ওপর ফরফর করে আরশোলা এসে বসেছে আমার। এক সময় মাথায় গিয়ে বসবে, হয়তো চোখ কিংবা চুল কুরে কুরে খাবে। রামেশ্বর ড্রাইভার বলে, দুনিয়া বুঝলি বে উললু–বিলকুল বি এন আর-এর আপ রোড, গিয়ার চড়িয়ে যাবি, ইঞ্জিন থামাবি কি শালা চম্পট লাট হয়ে যাবে। …সবাই বুঝি গিয়ার চড়িয়েই দুনিয়া উতরে যেতে চাইছে। ময়নাও।
৬১.
ঘোরের মধ্যেই দেখলাম, ময়নার মাথার চুল খসে গেছে। ঠিক যেন কামিনী। কামিনীর শুধু পরচুলা খুলেছিল, ময়নার আস্তে আস্তে সব খসে গেল; চুল চোখ গলা বুক হাত পা গায়ের চামড়াটা পর্যন্ত। কী তবে থাকল ময়নার! কিছু না, কোথাও কিছু নয়; সব ফাঁকা। বাতাসের মতন ফাঁকা হয়ে গেল বলেই আজ পুরোপুরি স্পষ্ট করে দেখতে পেলুম, আমার সোনার গয়নার পুঁটলিটা সত্যি সত্যিই ময়নার পোশাক কি শরীরের মধ্যেও লুকোনো নেই। ও আগেই বলেছিল, নেই। আমিও জানতাম নেই; তবু যেন কেন বিশ্বাস হত না। বরং ভেবেছি, ওর কাছেই থাক, গচ্ছিত থাক। সব সোনাই চোরাই সোনা নয়। এ অন্য সোনা।
৬২.
ভোররাতে আমার জন্মের সময়কার আগুনের আঁচটা গায়ে লাগছিল। মাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমায় কোলে নিয়ে মা বসে আছে। অপেক্ষায় অপেক্ষায়। বাবা আর এল না। মার চোখ থেকে বিশ্বাসের আলোটুকু মরে গেল। জলের ফোঁটা হয়ে আমার চোখেই ঝরে পড়ল টপ টপ। সেই জল আমার দু-চোখে মাখামাখি হয়ে গেল।
৬৩.
ভোরে ঘুম ভেঙে উঠে ময়নাটাকে ছেড়ে দিলাম। খাঁচা খুলতেই ও উড়ে গেল। আজ বুঝতে পারলাম, ওটা আমার পোষ-মানা ময়না নয়।
.
তিন
০১.
নদীর জল দাঁড়ায় না। সময়ও নদীর জল, তার বাঁধা ঘাট নেই। একদিন আমি বুঝতে পারলাম, রোদ জল শীত গায়ে মেখে মেখে আমার বয়স বেড়ে গেছে। দিনের বেলায় এত কথা মনে আসত না, রাতে শুয়ে শুয়ে অনুভব করতাম কত কী! মনে হত, আমি যেন চারাগাছ থেকে ধীরে ধীরে দিনে দিনে একটা বড় গাছ হয়ে উঠছি। তবে কিনা আমার মাটি একই জায়গার জমানো পুরনো মাটি নয়, নিত্য নতুন মাটি। বলতে গেলে, আমিও নদীর জল, আমারও কোনও বাঁধাধরা ঘাট নেই।
০২.
রামেশ্বর ড্রাইভারের ট্যাক্সি নিয়ে একদিন শেষ বিকেলে দুরের এক সওয়ারি পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় সন্ধে হয়ে গেল; রেলফটকের কাছে একটা লোককে চাপা দিয়ে সেই যে পালালাম–আর পুরনো শহরে ফিরিনি। রামেশ্বর আমায় গাড়ি চালাতে শিখিয়েছিল কিন্তু লাইসেন্স করাতে দেয়নি। পরে অনেক দিন, সন্ধে হলেই আমি যেন গাড়িটার এক-চোখ কানা হেডলাইটটাকে চোখের সামনে জ্বলতে দেখতাম। আলোটা ঘোলাটে, প্রাণহীন, দাগ ধরা ধরা–মনে হত, একটা ভোঁতা জবুথবু বিশ্রী জন্তু যেন আমাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।
০৩.
গা ঢাকা দিয়ে পালিয়ে পালিয়ে কিছুকাল কাটল। কবে যেন এক মেলায় গিয়ে ভেলকি দেখানো লোকটার সাথে ভিড়ে গেলাম। ওর নাম বানোয়ারি বানোয়ারিলাল। বানোয়ারি একটা মেয়েকে নিয়ে জিব কেটে ফেলা, চোখ উপড়ে নেওয়ার খেলা দেখাত। মেয়েটার বয়স বেশি নয়, তায় আবার বেঁটে, ছোট-ছোটই মনে হত। কিন্তু ওই টুকুন মেয়ের গা বুক চলন বলন অমন হয় না। ময়লা ঘাঘরা আর খাটো জামা পরে থাকত বলে লোকে ওকেই বেশি দেখত। কুচকুচে কালো রং গায়ের, মাথা ভর্তি ঘন রুক্ষ চুল-রাশ রাশ উকুন। একদিন খেলা দেখাবার সময়, উকুনের জ্বালায় জ্বলে সে মাথা নড়িয়ে ফেলেছিল, বানোয়ারি ভুল করে নকল জিবের বদলে তার আসল জিবেই ছোরা চালিয়ে দিল। …বানোয়ারিকে সেদিন আর লোকে আস্ত রাখেনি। পুলিশ এসে পড়বার আগেই আমি পালালাম। আসল নকলের খেলা বড় সাংঘাতিক। বানোয়ারি বোধহয় নকলের খেলা আর খেলতে চায়নি।
০৪.
গাঁ গ্রামেও আমার অনেকদিন কেটেছে। কাজকর্মের ঠিক ছিল না, যখন যা জুটেছে করেছি। জল ঘেঁচেছি, ধান গোলায় তুলেছি, জনমজুরি খেটেছি। আমার ভাল লাগত না কিছুই। মনে হত, এখানকার মানুষগুলো একেবারে গাছপালার মতনই বর্ষার জলে বাড়ে, তাদের অন্য কোনও বাড় নেই। আমার সারাদিনের এই দুঃখ সন্ধেবেলায় আর মানতে চাইত না। ইচ্ছে করত, পালিয়ে যাই। কোথায় যে পালাব! বিশু ঠাকুরের দাওয়ায় গিয়ে বসতাম। শিস ওঠা ছোট্ট লণ্ঠন জ্বালিয়ে ছেঁড়া মাদুরে বসে বিশু ঠাকুর মহাভারত পড়ত। নিত্যই দু-চারজন এসে বসত কাছে, আমিও একপাশে দাওয়ার কোল ঘেঁষে বসে থাকতাম। বঁধুল ঝোঁপের অন্ধকারে থোকা থোকা জোনাকি জ্বল, পাশের ডোবা আর বাঁশঝোপে অনবরত ঝিঁঝি ডেকে যেত। বিশু ঠাকুর মধুমাখানো গলায় সুর করে পড়তেন–অর্জুনের বিদ্যা যদি হইল শেষ, রঙ্গভূমি মধ্যে কর্ণ করিল প্রবেশ। ধুধুল ঝোঁপের অন্ধকার কাঁপত না, নড়ত না কিন্তু সেই কালো মেঘের মতন আঁধারে চেয়ে চেয়ে চোখ আমার কর্ণ দুর্যোধন দ্রোণ সবাইকেই দেখতে পেত। ওই তো কর্ণ হেঁট মাথা হাতে ধনুক, অপমানে জ্বালায় পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে: না দিল উত্তর কিছু কর্ণ মহাবল, বৃষ্টি হইতে ছিন্ন যেন কমলের দল। ..কুন্তীর ওপর মনটা বিষিয়ে যেত। কাঁঠাল গাছের মাথায় পাখির বাসা থেকে চোট খাওয়া কোনও পাখি কাতরে কাতরে ডেকে উঠত। আমার গলা বুজিয়ে কান্না উপচে আসত বার বার; বিশু ঠাকুর একটানা পড়েই যেতেন।
০৫.
একদিন ইন্দ্রধরদের সবজি ক্ষেতে দুটো সাপ জড়াজড়ি করে পড়েছিল। ইন্দ্র পড়িমড়ি করে ছুটে এল, মুখে তার ফেনা উঠছে। আশপাশের মাঠ ক্ষেতখামার কুঁড়ে ভেঙে পড়ল জোড়া সাপ দেখতে। ইন্দ্রর বিধবা বোন কলমি আমার হাতে চিনে সিদুরের পাতা দিয়ে বললে, মনসা মায়ের মাথায় দিয়ে এসো। ..সাপের মাথায় সিঁদুর দিতে গিয়ে দেখলাম সাপ দুটো মরা। …সাঁঝের ঘোরে কলা বাগানে কলমি আমার জন্যে দাঁড়িয়েছিল। বলল, জোড়া সাপ দেখলে কপাল ফেরে। রাজা হয়। তোমারও ফিরবে। আমি হাসছিলাম কলমির কথা শুনে।
০৬.
আমার কপাল সত্যি সত্যিই ফিরল। ইন্দ্রর পায়ে এক বিষফোঁড়া হল। দেখতে দেখতে পা-টা ফুলে কলাগাছ। নড়তে চড়তে পারে না ইন্দ্র, সারা দিন শুধু চেঁচায় যন্ত্রণায়। কত লতাপাতা বাঁধা, শেকড় বেটে খাওয়া, কিছুতেই কিছু নয়, পা বিষিয়ে গেল। গোরুর গাড়ি করে ইন্দ্রকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলাম কলমি আর আমি। আগুনের চেয়েও গরম ইন্দ্রর গা-ভুল বকে বকে কখন সে চুপ করে গেছে। শরৎকালের রোদ ধানের মতো পেকে উঠেছে, সবুজে সবুজে ছড়াছড়ি ধানক্ষেত, কাশফুলের অন্ত নেই, পুকুর ভরা শালুক হঠাৎ কেমন একটা নাগপাশ হাওয়া এসে গোরুর গাড়িটাকে যেন ঘিরে ধরল। গোরু দুটো থমকে গেল, চাকা দুটো বার কয়েক আগুপিছু করল, কলমি কেঁদে উঠল আচমকা, ডাক ছেড়ে। আমার হাত পা অবশ। মুখ ফিরিয়ে দেখি কলমি ইন্দ্রর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাচ্ছে।
০৭.
গোরুর গাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আমরা যখন গ্রামে ঢুকলাম সাহানা মশাইদের ঠাকুরদালানে তখন দুর্গা প্রতিমার গায়ে মাটি লেপছিল হরিহর। কলমির কান্নার সুর মোটা ভাঙা, যেন আড় বাঁশের ফাটা বাঁশির ফুটো দিয়ে একটা শব্দ হচ্ছে থেমে থেমে। আমার কেন যেন হঠাৎ মনে হল, হরিহর খড়ের গায়ে মাটি লেপতে পারে, ইন্দ্রর গায়ে পারে না?
০৮.
আমি রাজা হলাম। ইন্দ্রর ক্ষেত খামারের সব কাজ আমার হাতে। বেচা-কেনার পয়সা আমার ট্যাঁকে। ইন্দ্রর বউয়ের মাথাটা কেমন গোলমাল হয়ে গেছে। কাঁদে হাসে পুকুরের ঘাটে বসে কথা বলে আপন মনে। একদিন ইন্দ্রর ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে গিয়েছিল; আর-একদিন ডুবে মরতে চলেছিল গলায় কলসি বেঁধে। কলমি ভাজকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিল।
০৯.
অঘ্রাণ মাসের এক সকালে ঘুম ভেঙে উঠে মনে হল, আমার গলা পর্যন্ত যেন কোথায় ডুবে গেছে। চোটুকাদার মতন চারপাশ থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে গিয়েছে। নড়াচড়ার উপায় নেই। এমন কঠিন বাঁধনে আর কখনও বাঁধা পড়িনি জীবনে। ডান বাঁ কোনও পাশে এক বিন্দু নড়ার মতন শক্তি নেই। …মনটা খাঁ খাঁ করছিল, উদাস লাগছিল। কোথাও সুখ পাচ্ছিলাম না; ঘর না বাইরে না–দু দণ্ড স্বস্তি ছিল না কোথাও। আকাশটা রোদে ফেটে পড়ছে, শীত শীত হাওয়া, ধুনুরি এসে বসেছে তেঁতুলতলায়, ধুনছে। সাতকড়ি কুঁজো হয়ে বসে আছে বড় পাথরটার ওপর। তার কতকালের পুরনো লেপের তুলো ধুনা হচ্ছে। সেই কালো ঝুল তেঁতুলের দলার মতন পুরনো জমা তুলো ধুনুরির হাতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছত্রাকার হয়ে পেঁজা আঁশের মতন ছড়িয়ে পড়ছে, বাতাসে উড়ছে। আমার মনে হচ্ছিল, আমাকে কেউ ধুনে দিক, আমি পুরনো লেপের তুলোর মতনই দলা পাকানো, শক্ত, তাল হয়ে গেছি।
১০.
কলমি বলে, অত মন আনচান কীসের? বলেছিলুম না রাজা হবে। তা কম কী হলে গো! কপাল না ফিরে গেল! নজরে দোষ না ধরলে আরও ফিরবে। কলমি গায়ের ঢিলে কাপড় আর সামলায় না, মুখের চিবুনো পান সামনের দাঁতে এনে যাদু করা হাসি হাসে, ওপর ঠোঁটে টোল হয়ে থাকে হাসিটা, খুশির আঁচে চোখ জ্বলে। আমি ওর হাসি দেখি, ঠোঁট দেখি, মুখ, চুল, আলগা গা। নতুন করে দেখা নয়। দেখছি তো কবে থেকেই। কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কলমি আমায় রাজা করেছে, কিংবা সেই জোড়া সাপ। ইন্দ্রও জোড়া সাপ দেখেছিল। সে বিজোড় হল। আমি কলমি জোড় হলুম।
১১.
আর একদিন কলমি বলল, আমাদের এরা একঘরে করবে;বউয়ের বড় ভাই নাকি বলে পাঠিয়েছে, জমিজমা ভালয় ভালয় ছেড়ে না দিলে মামলা করবে..সবাই এখন ধম্ম অধম্ম দেখাচ্ছে, বলে, চোখের সামনে বসে বসে এত পাপ দেখা যায় না। কলমির মুখে আজ হাসি নেই। তার গোমড়া তেজালো চটন্ত মুখের দিকে আমি চেয়ে থাকলাম। দুর্ভাবনায় ওর চোখের তলায় কালি ফুটেছে। আমার দুঃখ হয় না, ভয়ও নয়। কলমি ঠাট্টা করে শুধোয়, পাত নোংরা করে অধম্মকে ডরাচ্ছ? মুখের আগায় কথা এসেছিল, বললাম না। নোংরা পাতেই আমি দুমুঠো খেয়েছি।
১২.
কলমিকে বলেছিলাম, দুজনাতেই যাব। যাবার সময় আমি একাই পালালাম। কলমি ঘাটে গিয়েছিল তখন। নগদ টাকা কুড়িয়ে বাড়িয়ে কলমি গিট বেঁধেছিল সালুর কাপড়ে। সত্যনারায়ণের পটের পাশে হরিনামের ঝোলায় নগদ চারশো টাকা। আগের রাতে রেখেছে, আমি বলেছিলাম। টাকাটা পুরোই নিলাম আমি। কলমি যেন স্পষ্ট করে বোঝে অধম্মর ভয় আমার ঠিক ঠিক কতখানি।
১৩.
রেলগাড়ি চেপেছিলাম। কখন যেন দেখি সেই পুরনো স্টেশনে এসে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। একদিন মাঝরাতে ময়না আমাকে এখানেই নিয়ে এসেছিল। রামেশ্বর ড্রাইভার আজও আছে এখানে। রেলের পুলটুকু পার হলেই ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে তাকে দেখতে পাব। পুলিশ আমায় আজও খুঁজছে হয়তো। ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে গেল না, গলা কাঠ হল না। বেঞ্চি টপকে এপাশের প্ল্যাটফর্মের দিকে এলাম। মাথা তুলে দেখলাম উঁচুর বেঞ্চটা খালি। লাফ মেরে উঠে মুখ ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। …কে জানত ঘুরে ফিরে একদিন আবার এই পথেই আসতে হবে। …গাড়ি ছেড়ে দিল; কামরাটা দুলছে, চাকাগুলো চলতে চলতে যেন চলকে উঠছে, শব্দটা বুকে এসে লাগছে। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না, রামেশ্বর ড্রাইভারদের শহর ছেড়ে আমি যে অনেক দূর পালিয়েছিলাম কলমিদের গাঁয়ে, তবু এত তাড়াতাড়ি আবার সেইখানেই ফিরে এলাম কী করে! …
১৪.
রাত বেহুশ; বাইরে পাকা জামের মতন অন্ধকার, কামরায় সবাই ঘুমে ঢুলছে, গাড়িটাও যেন হাই তুলে তুলে এগুচ্ছে, কানা বাতিটা ঠায় আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ততক্ষণে আমি বুঝে ফেলেছি, রামেশ্বর ড্রাইভারদের শহর ছেড়ে আমি বেশি দুর পালাতে পারিনি; আমার পথ জানা ছিল না, ধোপার গাধার মতন সাত মাঠ ঘুরেছি শুধু। …গাড়িটা আমায় আবার কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে!
১৫.
গাড়ি থামল। স্টেশনে কে যেন ঘুমের গলায় টেনে টেনে নাম হাঁকছিল। ছোট স্টেশন, প্ল্যাটফর্মে দু-চারটি লোক, আঁধার মাখামাখি হয়ে আছে। আমি নেমে পড়লাম। পুরনো, ফেলে-আসা কোনও জায়গাতেই আর আমি ফিরে যেতে চাই না। রেলগাড়িটা আমায় বোকা বানিয়ে পিছু পথে নিয়ে যাচ্ছিল।
১৬.
একদিন নিজের দিকে চেয়ে চেয়ে বুঝলাম, চেহারাটা বড় পুরনো হয়ে গেছে। এই কবছরের নানা দাগ ধরে কতকালের বাসাবাড়ির মতন দেখায়। ইচ্ছে হল, নিজেকে নতুন করি। ভাল বাহারি করে চুল ছাঁটলাম,নতুন কাপড় পরলাম; গেঞ্জি, জামা, জুতো–সব নতুন হল। ভদ্রলোকদের সঙ্গে আমার তফাত দুর থেকে বোঝা যেত না। কিন্তু, আমার মুখে কী যে ছিল কে জানে–দোকানে বাজারে রাস্তায় কেউ আমায় আপনি করে কথা বলত না, খাতির দেখাত না। শেষ পর্যন্ত খাতির পাবার লোভটা চাপা পড়ে গেল, আমি আর গ্রাহ্য করলাম না কে কী বলে।
১৭.
আরামের সব সময় নগদ কারবার। আমার গাঁটের টাকায় তলানি পড়ল। কতকাল শুধু খেয়েছি ঘুমিয়েছি আর আজ এখান কাল ওখান করে ঘুরেছি। ঘুরে ঘুরে এক নতুন শহরে এসে পৌঁছলাম। মস্ত শহর, বহু লোক, গাড়িঘোড়ায় পথ ভরতি, কারখানার চিমনি ধোঁয়া ছাড়ছে সর্বক্ষণ, উত্তরের আকাশটা কালো হয়ে থাকে।
১৮.
এখানে একদিন এক সাধু দেখলাম। অন্ধ। অথচ তার হাতে জট পাকানো এক তাল সুতো। সারাদিন বসে বসে সে শুধু সুতোর জট ছাড়ায়। সন্ধেবেলায় জট-ছাড়ানো সুতো থলির মধ্যে ভরে রাখে। প্রথমে মনে হয়েছিল, সাধুটা ভণ্ড; ঠাওর করে, বাজিয়ে নিয়ে দেখলাম–লোকটা বাস্তবিকই অন্ধ। শুধোলাম, সাধু মহারাজ, এটা তুমি কী কর? সাধু একটু হাসল, বলল, কিছু না বাবা, কিছু না সুতোটায় বড্ড জট; খানিক খুলি, খানিক থেকে যায়, যাও বা খুলি তাও আবার একদিন জট পাকিয়ে যায়। পাগলের মন কথা সাধুবাবার, ঠাট্টা করে শুধোই, তো মহারাজা, তুমি তো চোখে দেখতে পাও না, কী করে সুতোর জট খোল? খোলা সুতোতেও তো আবার জট পড়ে যায়–কী লাভ তোমার বেগার খেটে? সাধুবাবা আরও নরম করে হাসে, বলে, বাবা, এই তো আমার সংসার, বড় জট; অভ্যেস বশে খুলি নয়তো অন্ধ মানুষ কেমন করে খুলব। সাধুবাবা একটু চুপ করে থেকে আবার বলে, কোথায় খোল কোথায় লাগে কেউ জানে না।
১৯.
পিঠে গাঁঠরি, কাপড় ফিরি করে ফিরছি, কাঠফাটা রোদ, মাথার চাঁদি আগুন; বটগাছের তলায় সাধুবাবা শুয়ে আছে। পাশে মাটির জালা, জল দেওয়া হাতা। সাধুবাবা সারাটা গরম এই গাছতলায় ছায়ায় বসে সুতোর জট খুলেছে আর পথের মানুষকে জল দিয়েছে। কাছে গিয়ে ছায়ায় বসলাম। তেষ্টায় গলা কাঠ। মুখ গলার দরদর ঘাম মুছতে মুছতে দু-চারটে কথা বললাম, সাধুবাবা জবাব দিল না। গাছের ছায়া ঘন, কিন্তু বাতাসটা গরম, সাধুবাবা কি ঘুমিয়ে পড়ল? ডেকে তোলার মতন গলা করে জল চাইলাম। জবাব নেই। হল কী সাধুবাবার? এত গাঢ় ঘুম–এই খাঁ খাঁ দুপুরে। গায়ে ঠেলা দিতেও নড়ল না মানুষটা। উলটে দিতেই বুঝলাম সাধুবাবা মারা গেছে। সাধুবাবার হাতের মুঠোয় দলা পাকানো সুতো-সুতোর জট। কারখানার সিটিটা আকাশ চিরে বাজছিল। বোশেখের দুপুর ছটফটিয়ে পড়ে আছে রাস্তার মাঠে। ঘোড়ার গলায় ঘন্টি বাজিয়ে একটা একা আসছিল। সাধুবাবার মুখের একপাশে ধুলো বুঝি একটু, আর-একপাশে বটতলার ছায়ার মতন তৃপ্তির হাসি। …আমার বুকের হাড় গুঁড়িয়ে কেমন যেন-এক কান্না গলায় এসে পৌঁছে গেল।
২০.
কাপড় ফিরিতে বড্ড কষ্ট। সকাল দুপুর নেই–একটু বেলা হল কি গাঁঠরি পিঠে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ো-সারাটা দিন দুপুর সন্ধেতক টো টো। কোথায় যাব তার কি ঠিক আছে? আজ যদি বাবুপাড়া কাল হাসপাতাল পাড়া-পরশু মতিবাজারে। দুর দুর এলাকাতেও যেতে হয়। প্রত্যহ এক জায়গায় বেচাকেনা চলে না। বড় ঝামেলা কাপড় বিক্রির, গাঁঠরি খোলো, দশখানা দেখাও, দরদাম নিয়ে মুখের থুতু শুকিয়ে যায়–তবু শেষ পর্যন্ত এক পয়সা বিক্রি নেই, গাঁঠরি সাজাও আবার পিঠে তেলো–হাঁটো হাঁটো–পায়ে খিল ধরে যায় হাঁটতে হাঁটতে।
২১.
ভাদ্র মাসের চড়া রোদ, পচা গরমবর্ষার জল সেই কোন শ্রাবণে আকাশ ধুয়ে নিয়ে চলে গেছে আর এক বিন্দুও জলনা। হাঁটতে হাঁটতে গোরুহাটা পেরিয়ে গাঁয়ে এসে ঢুকেছিলাম। ভরা পুকুর,কচু পাতার জঙ্গল, কয়েকটা কুঁড়েঘরের মাথায় পচাখড়ের ছাউনি। একটা মস্ত তেঁতুলগাছ চোখ আড়াল করে রেখেছিল, কাছে আসতে চোখে পড়ল। কহাত দুরে বেড়ালতার বেড়া দেওয়া ছোট একটি মাটির ঘর, মাটির খোলার ছাউনি, উঁচু দাওয়া, কলাগাছের চামর দোলানো মাথাটাও চোখে পড়েছিল। রোদ মাথা থেকে পশ্চিমে হেলেছে খানিক। সারাদিন হেঁটেছি। এক পাই পয়সা বিক্রি নেই। পেটে ভয়ংকর খিদে, তেষ্টায় মুখ কনো।
২২.
কাপড় ফিরির হাঁক দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কেউ এল না। বুঝি বার চার হাঁকের পর কপাট ফাঁক করে এক বউ মুখ বাড়াল। সওদা বেচতে চাই না, গাঁঠরিটা দুদণ্ড দাওয়ায় রেখে একটু জিরোন নেব, পুকুরে মুখ হাত খোব, জল খাব এক ঘটি। বউটি মাথা নেড়ে সায় দিল।
২৩.
হাত মুখ ধোওয়া হল। কার যে মুখ দেখে উঠেছি আজ, ভেতর থেকে মুড়ি আর মোয়া পেলাম, একটা আম–এক ঘটি জল। খাওয়া-দাওয়ার পালা চুকলে বিড়ি খাচ্ছি বসে বসে কপাটের আধখানা আড়াল থেকে বউটি শুধোয়, গামছা আছে?
২৪.
আছে। মোটা তাঁতের শাড়ি, দরজির সেলাই সেমিজ, দু-চারখানা জামা, গামছা। বাচ্চাদের ইজের জামাও আছে দু-পাঁচটা। খুশি হয়ে দেখাই। শাড়ি, সেমিজ, জামা… বউটি দেখে, তবু মাথা নাড়ে না। উই, অনেক দাম। গামছা–দেড়হাতি গামছাটাই নিল। পয়সা দিল দরদাম না করে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, সারাদিন বেচাকেনা নেই বলে ওইটুকু বউনি করে দিল।
২৫.
যশোদা একা মানুষ। তার স্বামী জেলে। এগারো বছরের জেল। মাত্র বুঝি দেড় বছর কেটেছে। লোকমুখে যশোদা শুনেছে কথাটা, আসলে তার স্বামী কেন কোন অপরাধে জেলে গেছে যশোদা জানে না। জেলা আদালত থেকে গাঁয়ের লোক এসে বলেছিল মুকুন্দর এগারো বছরের সাজা হয়েছে, খুনের আসামীর নাকি এমনটাই হয়। অবশ্য মুকুন্দ যাবার আগে শুধু বিয়েটাই করেনি, কিছু রেখে গেছে। বিঘে দেড়েক ধানি জমি, গোয়ালে গোরু, সবজি বাগানে আনাজের ফলন আর কলাগাছের ঝোঁপ। পিছুটান আর কিছু রেখে যায়নি মুকুন্দ। না কোনও পরিজন, না বা একফোঁটা বাচ্চা। যশোদা বলে, যাবার আগে কিছু বলল না মানুষটা, সদরে গিয়েছিল দলিল করতে, কে জানে কীসের দলিল, হয়তো আমার কপালের।
২৬.
বর্ষার শেষে যশোদার ম্যালেরিয়া জ্বর হল। বললুম, কপা বাড়ালেই কারখানা শহরচলল না আমার সঙ্গে ওষুধ নিয়ে ফিরবে। যশোদা মাথা নাড়ে। না, ঘর ছেড়ে পা বাড়াবে না। …দুঃখ হয়, রাগ হয়; বলি, খানায় পড়ে পা তোমার ভাঙবে না। চলো। …যশোদা চোখ নিচু করে মাথা নাড়ে, বলে, পা খানাতেও পড়ে না, মানাতেও নড়ে না।
২৭.
জ্বর ছাড়ল যশোদার; জ্বালায় ধরল। বলল, তুমি এত ঘন ঘন কেন আস? আমি হাসি; বলি, ফিরি করতে। যোদা আড়ালে সরে যায়, গুন গুন করে বলে, এখানে ফিরির মাল কিনবে কে? আমার কানে কথাটা ভোমরার মতন কাছে দূরে নেচে বেড়ায়। যশোদা জানে, আমি কী জিনিস ফিরি করতে আসি। কেনার লোক বুঝি, একটি-ই।
২৮.
ফিকে আলতার রং, আঁচলায় রুপোলি রেশমের কাজ একটা শাড়ি এনে দিলাম যশোদাকে। দুধের ভরা ঘটি হাতে যশোদা দাওয়ায় দাঁড়িয়েছিল। শাড়ি দেখে তার মুখ কার্তিকের রোদে নেয়ে গেল। শ্যামা পাখিটা ডাকছিল। সবুজে সোনায় মাচাটা ভরে গেছে। শিউলি ফুলের গন্ধ আসছে ভেসে ভেসে। আস্তে আস্তে যশোদার মুখে যেন কাজলের ছোপ লাগল। শাড়ি ফেরত দিয়ে বলল, বেশ সুন্দর; এটা চড়া দামে বেচে দিও। আমি কি বেচতে এসেছি, দিতে এসেছি, কাল বাদে পরশু দুর্গাপুজো। ..যশোদা মাথা নাড়ল, না।
২৯.
হিম লেগে অসুখে পড়লাম। দু হপ্তা ঘরে কাটল। যশোদার কাছে গিয়ে দেখি মুখে তার কালি ধরেছে। বলল, আমি ভাবি ফিরিঅলা বুঝি এ-দেশ ছেড়ে চলে গেছে। বললাম, কেন, দেশ ছাড়ব কেন? যশোদা গালে-ঠোঁটে হাসে, বলে, আর কোথাও ফিরি করতে! যশোদার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে আমি যেন কী ভাবি, কী বলতে যাই, বলা হয় না।
৩০.
একদিন সারারাত জেগে থাকলাম। বাইরে শীত ঝাঁপিয়ে পড়েছে, হিম আর কুয়াশা বুঝি আকাশটাকেও জমিয়ে দিয়েছিল। শুয়ে শুয়ে আমার ঘরের লণ্ঠনের আলোটা দেখছিলাম। আলোটা থেমে থেমে কথা বলছিল। সেকথা কানে শোনা যায় না, মনে শোনা যায়। আলোর কথা শুনতে শুনতে বেহুঁশ হয়ে গেলাম। মনে হল, আমার গায়ের পাশে যশোদা গা দিয়ে শুয়ে পড়েছে। …হুঁশ হল কারখানার সিটি শুনে। কারখানার সিটিটা প্রাণপণ চিৎকার করে লোক জড়োকরা ডাক ডাকছে। আশপাশ থেকে বহু লোক ঘুম ভেঙে উঠে বসল, রাস্তার দিকে ছুটল। আমি শুয়ে থাকলাম।
৩১.
পরের দিন শুনলাম কারখানায় সাতটা লোক রাত্রে মারা গেছে। তাদের একটাকে আমি চিনতাম। প্রীতম নাম। তার বউয়ের জন্যে আমার কাছ থেকে ফুলছাপা শাড়ি কিনেছিল, ছেলের জন্যে আলপাকার জামা। দাম দেয়নি, বলেছিল পরের মাসে দেবে। …কেন কে জানে আমার ভাল লাগছিল খুব, দামটা সে দেয়নি।
৩২.
ভরা পৌষ। শীত ভীষণ খর। যশোদা বলল, সংক্রান্তির মেলায় যাবে। মানত আছে অনেক দিনের, মেটাতে পারছে না; ঘন ঘন স্বপ্ন দেখছে, খারাপ স্বপ্ন। বললাম, বেশ তো চলো, আমার মেলা দেখা কলা বেচা দুই-ই হবে।
৩৩.
আমাদের কপাল ছিল মন্দ। মেলার আগের দিন সকাল থেকেই পশলা পশলা বৃষ্টি হচ্ছিল। মেঘ দেখে মনে হয়, ও-বেলা নাগাদ কেটে যাবে, ও-বেলা ভাবি, সকালে। সকালে যাত্রা শুরু করার সময় ঝির ঝির জল। যশোদা বলল, পথ তো কম নয়, এই বাদলা মাথায় নিয়ে যাব। আমি সাহস দিয়ে বলি, এবাদলা কেটে যাবে, দুপুর থেকে রোদ উঠবে। তা ছাড়া বারো তেরো মাইল দূরে মেলা– সেখানেও কি বাদল আছে নাকি!
৩৪.
প্রথমে হাঁটা পথ, তারপর রেলগাড়ি, রেলগাড়ি থেকে নেমে একা। মেলায় চলেছি যখন তখন এই রোদ এই মেঘলা। রোদ চড়তে পারছে না, রং ধরাতে পারছে না। এক্কা ছুটছে। ঘোড়ার গলায় ঘন্টা বাজছে ঠুন ঠুন। মোটর গাড়িতে পুঁটলি বাঁধা করে লোক চাপানো৷ ধুলো উড়িয়ে টাল খেতে খেতে ছুটছে। চলেছে গোরুর গাড়ি-ইনিয়ে বিনিয়ে ককিয়ে। পায়ে হেঁটে হেঁটে কত লোক। কত না ব্যাপারিও। …আমাদের এক্কায় আমরা দুজন। যশোদা দুলে দুলে পড়ছিল, শক্ত করে আঁকড়ে ছিল খুঁটি। তার মাথা থেকে ঘোমটা খসে খসে যাচ্ছে। থেকে থেকে হেসে ফেলছে যশোদা। কাপড়ের বোঝাটা পিঠের পাশে হেলান দিয়ে বসে বসে আমি যশোদাকে দেখছিলাম।
৩৫.
মেলা তছনছ হয়ে গেল। কোথা থেকে এক ঝড় এল ঝাঁপিয়ে, আর বৃষ্টি। দুপুর কালো হয়ে গেল। মনে হল বুঝি সন্ধে ঘনিয়ে গেছে। সবাই ছুটল। আমরাও।
৩৬.
শহরে পৌঁছে দেখি যেন ভরা ভাদ্দর নেমেছে। কী জল! সারারাত আটকে থাকতে হবে, সকালে গাড়ি। ভিজে কাক হয়ে গেছি আমরা, শীতের হাওয়ায় কাঁপছি ঠকঠকিয়ে। শহরে আলোগুলো ভিজে ভিজে। পথে আর লোক চলে না।
৩৭.
খুঁজে পেতে হোটেলে উঠলুম। একটা ঘর। লোকে আমাকে যশোদার স্বামী ভাবল। ভিজে কাপড় জামা ছাড়ল যশোদা, আমার ভিজে গাঁঠরির মাঝ থেকে বেছে বুছে বস্ত্র নিল। আমিও শুকনো একটা কিছু পরলাম। ঘরে বসে বসেই খেলাম দুজনে। তারপর বাতি জ্বেলে শীত সয়ে শুয়ে থাকলাম। রাত বাড়ল, গম্ভীর হল, মাঝরাত থেকে গড়িয়ে নেমে গেল। বাতি জ্বলছে। যশোদা আমার কাছ থেকে কহাত দূরে, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে। সে ঘুমের ভান করে পড়ে আছে, আমিও ভান করে পড়ে আছি। …বাতিটার তেল ফুরোল, নিভে গেল।
৩৮.
যশোদা আমার পাশে, আমি যশোদার পিঠে মাথা রেখে। আমার হাত ধরেছে যশোদা। কাঁদছে। সে বউ মানুষ। তার স্বামী আছে। স্বামীর জন্যে সে অপেক্ষা করবে।
৩৯.
কোনওদিন ফিরবে না যে তার জন্যেও মানুষ কি অপেক্ষা করে? …যশোদা কিছুক্ষণের মতন বুঝি ভাবল, না সব মানুষ ফেরে না, সবদিন ফেরে না, ফিরিঅলাও ফিরে ফিরে আসে না।
৪০.
যশোদা আর আমায় ফেরাল না। বাইরে ঝড় জল, ঘরে আমরা দুজন। এই মেলা, মেলা না ভাগ্যের খেলা, কে জানে!
৪১.
মেলা ফিরতি ভিজে শরীরে আবার জ্বর এল। ভীষণ জ্বর। জ্বরের ঘোরে খালি দেখতাম, মেলায় ঝড় উঠেছে, বৃষ্টি পড়ছে মাটি আছড়ে, গাছপালা ভেঙেভুঙে ছত্রাখার হচ্ছে। এক্কার ঘোড়াগুলো কানের কাছে তারস্বরে চেঁচাত। হঠাৎ কখন সব থেমে যেত, চাঁপারানির মুখটা ভেসে উঠত। আরও যেন গাল দুটো ফুলেছে চাঁপারানির। চোখ ডুবেছে। দাঁত কালো, ঠোঁটে পানের পুরু শক্ত বিশ্রী দাগ। চাঁপারানিকে আর মা বলে ডাকতে ইচ্ছে করত না। মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে গিয়ে মানুষ যেমন হঠাৎ কী মনে পড়লে আবার ফিরে তাকায়, আমি তেমন করে ফিরে তাকাতাম। দেখতাম, চাঁপারানির মুখের পাশ দিয়ে ভেসে উঠেছে যশোদার মুখ। আমার ভাল লাগত না।
৪২.
প্রায় দিন বাইশ পরে যশোদার বাড়ি এলাম। আসার আগে রোগা দুর্বল শরীরটা ছটফট করছিল, তেঁতুলতলায় আসতেই বুক দপ দপ করতে লাগল। শিউরে শিউরে উঠছিলাম। শীতের গাঢ় রোদে একটা পায়রা-ছানা দানা খুঁটে খুঁটে নাচছিল বাড়ির কাছটায়। কী যে এক সুখ আমার শরীর মন মিঠে রোদের মতন তাত দিয়ে জুড়িয়ে দিচ্ছিল কী করে বলব।
৪৩.
বার বার ডেকেও যশোদার সাড়া পাওয়া গেল না। কলাগাছের পাতার ওপর চড়ুইটা ফর ফর করে উড়ে গেল। যশোদাকে ডাকতে যেন। ভাবছি কোথায় গেল ও! হঠাৎ দরজা খুলে একটা রোগা মতন লোক বেরিয়ে এল। সে কাশছিল, হাঁপাচ্ছিল। মরা পানকৌড়ির মতন চোখ লোকটার। শুধোল, কী চাই? …যশোদা আমার কাছ থেকে কাপড় কিনত শুনে লোকটা আমায় ঘরে এসে বসতে বলল। বসলাম, ঘরে গিয়ে। দড়ির খাঁটিয়ার বসিয়ে ও চলে গেল। আর ফেরে না, ফেরে না। ভাবলাম, এ বুঝি কেউ দূর জ্ঞাতি-টাতি হবে যশোদার, নতুন এসেছে। যশোদা বাড়ি নেই বোধহয়, লোকটা ডেকে আনতে গেছে। ঘরটা আজ অন্ধকার অন্ধকার ঠেকছিল, জানলা খোলা নেই, দরজার পাটও পুরো খোলা নয়। কোথাও কোনও শব্দ নেই। …যশোদার পথ চেয়ে বসে বসে কতক্ষণ কেটে গেল। তারপর ও এল। যশোদা নয়–সেই লোকটা, মরা পানকৌড়ির মতন চোখ যেন আরও বাসি দেখাচ্ছে। ওর হাতে হুঁকো। পাশে বসল। বলল, সে যশোদার স্বামী।
৪৪.
ঝিমঝিমে মাথা, মাতালের মতন টাল-বেটাল পা, জ্বররা রুগির মতন হুঁশহারা হয়ে তেঁতুলতলা পেরিয়ে আসতেই মনে হল কারা যেন আমায় দেখছে। চেয়ে দেখলাম, ডোবার পাশে বসে বাসন ধুচ্ছে দুটি বউ। তারা আমার দিকে চেয়ে আছে। নকড়ির মা আসছিল। মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। শুধোলাম, যশোদা কোথায়? বুড়ি আঙুল দিয়ে আমার পিছু দিকে কী যেন দেখাল, ওই হোথায়। পিছু ফিরতেই চোখ পড়ল, তেঁতুলগাছের একটা নিচু মোটা ঘা ঘা পাকানো বিশ্রী কালো ডাল। অজগর সাপের মতন বিরাট ডালটা যেন আমার দিকে মুখ করে চেয়ে আছে। বুকের মধ্যে আতঙ্ক বাজ মেরে গেল। ঘাড়ের কোথায় বুঝি একটা মোটা শিরা রক্তের তোড়ে ফুলে উঠে অসম্ভব টনটনিয়ে উঠল,কপালের রগে খুরের মতন কী বসে গেল যেন। যশোদার স্বামী তার খুনে হাতে আমার গলা টিপে ধরেছে মনে হল। আমার দম বন্ধ, শরীর কাঠ। কখন যেন ছুটতে শুরু করলাম। ছুটে ছুটে ছুটে কোথায় যে শেষে টলতে টলতে মুখ থুবড়ে পড়লাম জানি না।
৪৫.
ফিরিঅলার গাঁঠরিতে আগুন ধরিয়ে দিলাম শেষ রাতে। দাউ দাউ করে নেচে নেচে আগুন জ্বলল। শীতের রাতে আগুন দেখতে কেউ এল না। একটা নেড়ি কুত্তা শীতে মরছিল–সে এসে আগুনের পাশে মড়ার মতন শুয়ে পড়ল।
৪৬.
ভোরবেলায় কে যেন আমার কানের পাশে কথা বলছিল। কে? সাধুবাবা না যশোদা? কী বলল তাও বুঝলাম না। সাধুবাবার কথা মনে পড়ছিল: বাবা এই তো সংসার, বড্ড জট; কোথায় খোলে কোথায় লাগে কেউ জানে না! যশোদার কথাও মনে আসছিল; হোটেলে অন্ধকারে আমার পিঠে মুখ রেখে কেঁদে কেঁদে যশোদা বলেছিল: ফিরিঅলা আমায় নষ্ট কোরো না।
৪৭.
ঘুম ভাঙলে বুঝলাম আমার পাশে কেউ নেই, না সাধুবাবা না যশোদা। আমি একলা। আমার ঘরের সামনে অনেক পোড়া কালো ছাই, বাতাসে উড়ছে; আমার ঘরের বাইরে ময়লা-টানা মোষের গাড়িটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। যেন অনন্তকাল ওই গাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকবে, মোযটা মুখের ফেনা কাটবে জড়াবে, আর ডাঁশ মাছিটা তার বোজা বোজা লালচে চোখের পাশে বসবে উড়বে। কোনও দিন কোনও কিছুই বদল হবে না, না গাড়ি না মোষ না মাছি।
.
চার
০১.
মাসে বছরে রোদে জলে দেখতে দেখতে কবে যেন একদিন আমি ফটিকবাবু হয়ে গেলাম। কমলা বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার নন্দনবাবু বলত: ছোকরা দু বছর কাশীতে থেকে চেহারাখানা কী রকম করেছে দেখছ, খাস গুণ্ডা। মাল খেয়ে খেয়ে ঢোল হয়ে গেছে। …আমি আয়নায় নিজের চেহারা দেখে খুশি হতাম। জোয়ান বয়সের পুরুষ এই রকমই হবে,শক্ত সমর্থ জীবন্ত। আমার চেহারার জলুস থেকে আজ কারও বোঝবার উপায় নেই চাঁপারানির পাত কুড়োনো খেয়ে আমার জীবন কেটেছে একদিন। আজ আমায় ভদ্রলোক মনে হয়। মুখের দাগ কি ধুয়ে গেছে তবে! কমলা বোর্ডিংয়ের গাইডগিরি করতে করতে কতবার এ-ঘরে সে-ঘরে আয়নায় মুখ দেখেছি, বুঝতে পারতাম না, কোন দাগ ছিল কোন দাগ গেছে।
০২.
আমাদের তিন গাইডের মধ্যে প্রফুল্লদার আয় ছিল সব চেয়ে বেশি। সে সব চেয়ে পুরনো গাইড সব চেয়ে তুখোড়। এক যুগ তার কাশীতে কেটেছে। বউ মেয়ে নিয়ে বাঙালিটোলার দিকে ঘর ভাড়া করে থাকে। আমি আর নীলু নীলরতন-কমলা বোর্ডিংয়েরই একটা ছোট ঘর ভাগাভাগি করে থাকতাম। নীলুর আয় ছিল সব চেয়ে কম, অথচ সব চেয়ে সে দেখতে সুন্দর। তার কথাবার্তা ছিল চমৎকার, লাজুক লাজুক। আমাদের মতন মাছি আঁটা হয়ে বাক্স বিছানা টেনে সে যাত্রী তুলে নিতে পারত না। আমাদের মতন সে অন্য হোটেলের গাইডদের সঙ্গে গলা ফাটিয়ে চেঁচামেচি ঝগড়া করতেও পারত না। প্রফুল্লদা বলত, নীলুর দ্বারা গাইডগিরি করা হবে না, ওকে জামাই করে ছাদনাতলায় দাঁড় করালে মানায়।
০৩.
একদিন নীলু আমায় নিয়ে সিনেমায় গেল, সিনেমা থেকে বেরিয়ে খুব খাওয়া-দাওয়া করল, মদ খেল, ডালকামুণ্ডির বেশ্যাবাড়ি গেল, ভোররাতে সাইকেল রিকশা করে ফিরলাম দুজনে। কমলা ববার্ডিংয়ের কাছে এসে,নীলু বললে–গঙ্গার ঘাটে যাব। আমি ওকে টেনেটুনে নামাতে চাইলাম নীলু নামল না। আমার পা এত টলছিল যে নীলুকে ধরতে গিয়ে কিছুই ধরতে পারলাম না, খানিকটা বাতাস আঁকড়ে মাটিতে বসে পড়লাম। নীলু চলে গেল।
০৪.
নীলু আর ফেরেনি। সে আর বেঁচে থাকতে চায়নি। নীলু সেদিন আমায় তার দেশ থেকে পাওয়া চিঠি দেখিয়েছিল। তার দিদি শ্বশুরবাড়ি থেকে দেওরের সঙ্গে পালিয়েছে, মা রক্তবমি করছে, ছোট ভাই কী যেন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে জুতো পেটা খেয়েছে। নীলু বলেছিল, আমরা হোল ফ্যামিলি একেবারে থার্ডক্লাস, বুঝলে ফটিকদা, থার্ডক্লাস-শালা পচা ঘা কার্বাংকোলের মতন…
০৫.
আমার ঘরে নীলুর সব কিছু পড়ে থাকল কত দিন, শেষে হোটেলের চাকর এক এক করে সব নিয়ে নিল। আমার কাছে নীলু আর একটি রোগা রোগা মেয়ের একসঙ্গে তোলানো ফটোটা থেকে গেল। মেয়েটি যে কে আমি বুঝতে পারলাম না,নীলুর বোন নানীলুর আর কেউ! ..পড়ে থেকে থেকে একদিন নীলুর ছবি থেকে সবটুকু কালো উঠেফটোটায় শ্বেতির মতন চিহ্ন ধরে গেল। কবে একদিন ছবিটা আমি ফেলে দিলাম।
০৬.
সেবার পুজোর মুখে মালদার এক কলকাতার বাবু পাকড়েছিলাম। মথুরচন্দ্র সাহা। ডান হাতে তিন আর বাঁ হাতে দুই–পাঁচ পাঁচটা পাথর সেট করা আংটি। গোল বেঁটে তাকিয়ার মতন চেহারা। ধবধবে ফরসা রং, ফলাও গোঁফ। বাবুর সাথের মেয়েছেলেটি যে বাবুর পরিবার নয়, দেখেই বুঝেছিলাম। কাশীর হোটেলে গাইডগিরি করতে করতে আমাদের চোখ পেকে গিয়েছিল। বাবু অবশ্য হোটেলের খাতায় রেওয়াজ মতন মেয়েছেলেটিকে পরিবার বলেই লেখালেন। তা পরিবারটির মোটাসোটা গোলগাল শরীর ছিল, ফেটে পড়া রং। বাঁকা সিঁথিতে অল্প একটু সিঁদুর, এক রাশ ভারী ভারী গয়না, জরির ফুল-তোলা ফিনফিনে শাড়ি, আর পানের পিচে জরদায় কালো কষ ধরে যাওয়া দাঁত দেখেই বুঝেছিলাম সব। জরির চুমকি তোলা ভেলভেটের চটি পায়ে দিয়ে পরিবার যখন নামলেন টাঙা থেকে–ববার্ডিংয়ের তিনটে চাকর থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
০৭.
ফার্টক্লাস বর্ডার আমার বাবু। বড় ঘর পেয়েছেন। ঘরে চার পাঁচ প্রস্থ আসবাব-পালঙ্ক খাট, আয়না-লাগানো সাজ-টেবিল, বেতবুনন চেয়ার খান দুই, খান দুই এমনি কাঠের চেয়ার, গোল খাটো টেবিল–আলনা। বাবুর দুপুর আর রাতের জন্যে যে খাওয়া আসে তাতে হোটেলের ঠাকুরকে তিন রকম ভাজা আলাদা করে ভেজে দিতে হয়, ডালে নারকেল না হয় কিসমিস, মাছ দুরকম, রাত্রে মাংস, তার ওপর দই মিষ্টি। দু বোতল করে সোডা।
০৮.
দু বোতল সোড়া বাবুর কিছুই নয়। আমায় সারাদিনে ডজন খানেক বোতল বয়ে এনে দিতে হয়। সকালবেলা বাবুর ঘরের পরদার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি, কখন কী হুকুম হয়। স্টেশনে গাড়ি ধরতে যেতে হলে, বাবুর কাছে দাঁড়িয়ে হাত কচলাই, উনি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললে তবে হোটেল ছাড়তে পারি। সারাটা দিন বাবুদের সঙ্গে এঁটে আছি। এখন চক বাজার, তখন গঙ্গার ঘাট, চলো সারনাথ। সারাদিনে পনেরো বিশ টাকা টাঙা ভাড়াই গুনছেন বাবু, এ-মুল্লুক ও-মুলুক ঘুরছেন, গাদা গাদা জিনিস কিনছেন; বাবুর পরিবারের মুখভরা হাসি, রঙ্গ করে কথা বলছেন। সন্ধের পর সরাসরি ঘরে ফিরে দুজনে দরজা বন্ধ করে দেন। তার আগে অবশ্য আমায় ছ বোতল সোডা আর দামি মদ কিনে এনে দিতে হয়।
০৯.
ছদিনের মাথায় বাবু বললেন, ফটিক আমি এবার লক্ষ্ণৌ যাব। যাবে নাকি আমার সঙ্গে? চললা– দিন কয় বেড়িয়ে আসবে। .আমতা, আমতা করে হাত কচলে বললাম, হোটেলের চাকরি বাবু, এরা ছাড়বে না। বাবুর পরিবার বিছানায় বসে থেকে থেকে হাই তুলছিলেন, তিনি বললেন, ফটিককে আমাদের কলকাতায় নিয়ে গেলেই হয়। .বাবু পরিবারের দিকে তাকিয়ে থাকলেন একটু। সিগারেট ধরালেন, ধোঁয়া ছাড়লেন। যাবে নাকি কলকাতায় ফটিক? ..কলকাতা! কোন সেই চাঁপারানির কাছে থাকবার সময় থেকে নাম শুনেছি কলকাতার, সে নাকি শহরের রাজা। লোভ তো কতকাল থেকে! বাবুর কথায় যেন মনে হল, আমার সামনে লটারির টাকা ধরেছে কেউ। হাত বাড়ালেই পেয়ে যাব। বুকের মধ্যে ধক ধক করতে লাগল। বাবুর পরিবার সামনে বসে না থাকলে আমি বাবুর পা ধরতে পারতাম তখন। পা ধরা আর হল না, মাথা নেড়ে বললাম, যাব বাবু। বাবু ঘাড় হেলালেন, বেশ, তোমায় নিয়ে যাব।
১০.
ঘরের বাইরে এসে আমার মনে হল, বাবুর পা নয় বাবুর পরিবারের পা জড়িয়ে ধরাই উচিত আমার। তিনিই তো কলকাতায় নিয়ে যাবার কথা বললেন। বাবুর পরিবারকে আর একটুও খারাপ ধরনের মেয়েছেলে বলে মনে হচ্ছিল না। তাঁর চেহারা সাজপোশাক সবই কেমন করে যেন আমার চোখে চমৎকার হয়ে উঠল।
১১.
বিকেলে নৌকো ভাড়া করে মাঝগঙ্গায় বাবুদের নিয়ে খুব ঘোরা হল। মণিকর্ণিকার আগুন দেখে বাবুর পরিবার শিউরে উঠলেন। তখন বিকেল ঘোর হচ্ছিল, সার সার চিতার আগুন যেন প্রাণপণ করে আলোটুকু কোথাও আঁকড়ে রাখবার চেষ্টা করছিল। গঙ্গার জল বইছিল উজানে। বাবুর পরিবার মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তাঁর সহ্য হচ্ছিল না। নৌকোর মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া হল। দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে নৌকো চলল আবার। সন্ধে নামল। গঙ্গার জল কালো হয়ে হয়ে মিলিয়ে গেল, কেদার ঘাটে গিয়ে বাবু বললেন, ফটিক ফিরতে বলল। ..ফিরতি মুখে বাবুরয়ে রয়ে মদ খাচ্ছিলেন। পরিবারকে বললেন, ফুল্লরা, একটা গান গাও। ওরনাম যে ফুল্লরা, এই আমি প্রথম জানলাম। নামটা বেশ লাগল। গান ধরলেন উনি। কে জানত, অত হাসি আর রঙ্গকরা গলা, অত পান-জরদা খাওয়া পুরু আড়ষ্ট জিব,হয়তো মদের নেশায় শুষে যাওয়া স্বরেও বেহালার মতন মিষ্টি সরু অদ্ভুত সুর লুকিয়ে থাকতে পারে। চড়ায় সেসুর হেঁড়ে না, খাদে ডোবে না, কাঁপনে ভাঙে না। উনি গাইছিলেন: মরা জনম মরণকা সাথী…। এমন গান আমি শুনিনি জীবনে। মাথার ওপরকার কালো আকাশ যেন নিচু হয়ে আমাদের নৌকোর সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে এগুচ্ছিল গান শুনতে শুনতে। গঙ্গার জলও চলেছে। ওপাশে মিলিয়ে যাওয়া হারিয়ে যাওয়া কিনারা, এপাশের ঘাটে ফোঁটা ফোঁটা আলো।
১২.
দশাশ্বমেধ ঘাটে নৌকো ভিড়ল। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে উঠতে বাবু বললেন, ফটিক, একটা ভাল ফটোর দোকানে-টোকানে নিয়ে যেতে পারো? বাবুর হঠাৎ এই রাতে ফটো তোলার শখ কেন হল জানি না। মনটা ঘোর ঘোর ছিল, বললুম, চলুন–
১৩.
মল্লিক স্টুডিয়োতে বাবুরা ফটো তোলালেন। বাইরে এসে বাবু বললেন, ফটিক, ফটোটা তুমি পরশু নিয়ে নেবে। কাল আমরা লক্ষৌ যাচ্ছি, ফেরার সময় চিঠি দেব, ফটো আর তোমার জিনিসপত্র নিয়ে স্টেশনে হাজির থেকো।
১৪.
জিনিসপত্র আমার কী ছিল, তবু কলকাতা যাব বলে কাপড়-জামা ঘোয়ালাম; শীত আসছে সামনে-ছেঁড়া লেপটা বোর্ডিংয়ের মেথরটাকে দিয়ে দিলাম, বদলে ভাল কম্বল কিনলাম একটা। বাবুদের ছবি এনে কবেই রেখে দিলাম কাছে। খাসা ছবি উঠেছিল। সিংহাসনের মন একটা চেয়ারে বসে আছেন বাবুর পরিবার, পাশে চেয়ার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন বাবু, পায়ের তলায় মল্লিক স্টুডিয়োর সেই নকল বাঘ, বাবুর পরিবার বাঘের মাথায় বুটি ভোলা ভেলভেটের নাগরা সমেত পা রেখে আছেন। বাবুর একটা হাত সিংহাসনের মাথা টপকে তাঁর পরিবারের কাঁধে পড়ে আছে। ঠিক যেন স্বামী-স্ত্রী। ওঁরা দুজনেই না গম্ভীর, না হাসিখুশি, কেমন যেন আনমনা।
১৫.
সপ্তাহ কাটল বাবুর চিঠিপত্র এল না। আশায় আশায় আরও কিছুদিন গেল, বাবুর খোঁজ খবর নেই। তবে কি লক্ষ্ণৌয়ে গিয়ে বাবুর অসুখ-বিসুখ হল, কোনও আপদ বিপদ! মাস কাটল; শীত এল, শীত ফুরোল; বাবুর কলকাতার ঠিকানায় পোস্টকার্ড লিখলুম ভয়ে ভয়ে, জবাব এল না।
১৬.
বাবুদের সেই ছবি আমার কাছে পড়ে থাকল, ঠিক যেমন নীলু আর নীলুর পাশে রোগা রোগা একটি মেয়ের মুখের ছবি মাসের পর মাস আমার কাছে পড়েছিল। নীলুর মুখ আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। বাবুদের ছবিটা দেখলেইনীলুর সেই ভোলা মুখ আবার নতুন করে মনে পড়ত। …তখন বুঝিনি,নীলুর পাশে ওই মেয়েটি কে, এখন বুঝলাম। ভালবাসলে সব মুখ সব পুরুষ সব মেয়ের মুখ একই রকম হয়ে যায়।
১৭.
আবার এক পুজোর মুখে একটা চিঠি এসে হাজির: বাবা ফটিক, তোমার বাবু আর এ-জগতে নেই। তাঁর ছবিটা আমায় পাঠিয়ে দিয়ে। তুমি যদি কলকাতায় আস কখনও আমার সঙ্গে দেখা কোরো। ইতি তোমার মা।
১৮.
মা! আমার মা! কে জানে কোন্ মেয়ে আমার মা! তবে গঙ্গার বুকে অন্ধকারে যে গান গেয়ে গেয়ে বলেছিল, মহরা জীবন মরণকা সাথী, সে-মেয়ে আমার মা নয়, যাকে বলেছিল জীবন মরণের সাথী, সেই সাথীটিও আমার বাবা নয়। …তবু বাবুর জন্যে আমার কান্না পাচ্ছিল, মার জন্যে কষ্ট হচ্ছিল।
১৯.
ছবিটা পাঠিয়ে দিলাম। চিঠিও লিখলাম: মা, কলিকাতায় আসিলে আপনার সহিত দেখা করিব। আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম লইবেন। ইতিফটিক।
২০.
কাশী শহর আর ভাল লাগত না। সব যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগত। বোর্ডিং, স্টেশন, বাজার, চক, নদীর ঘাট–সব বুঝি মরে গেছে। চাপা দমবন্ধ সরু সরু ঠাণ্ডা গলিগুলো ঘুমের মধ্যে আমায় জড়িয়ে ধরত। অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতাম। চাঁপারানিকে হরিশ্চন্দ্র ঘাটে পোড়াতে নিয়ে এসেছে কারা, কলমি এসেছে বউ সেজে পোয়াতি হয়ে বিশ্বেশ্বরকে প্রণাম করতে, যশোদা কলকাতার গাড়ি চেপে আমায় হাত নেড়ে ডাকছে, ফিরিঅলা এসো, এসো। …
২১.
একদিন নীলু এল। স্বপ্নে। বলল, ফটিকদা কমলা বোর্ডিংয়ে কতকাল পড়ে থাকবে আর। স্টেশন আর হোটেল ছাড়া আর কিছু চিনলে না, ঠুলি-আঁটা বলদ হয়ে থাকলে পালিয়ে যাও, ভেগে পড়ো…
২২.
খর গ্রীষ্ম তখন। কাঠ ফাটা বৈশাখের রোদ মাথায় নিয়ে ঘুরে ঘুরে মার দরজায় এসে দাঁড়ালাম। কলকাতার গলিতে তখন বিকেলের ছায়া নেমেছে। মার বাড়ির সামনে একটা লোক মোটর গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
২৩.
বাড়ির নম্বর আমি ভুল করিনি। কত হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি করলাম, কেউ এল না। বিকেল পড়ে আসছিল। গলির মোড়ে এক ফালি আকাশ তখন কাঁসার মতন হয়ে আছে। বাড়ির সদর খুলে এক ঝি বেরিয়ে এসে কোথায় যেন যাচ্ছিল। শুধোলাম, এবাড়িতে ফুল্লরা বলে কেউ থাকেন? … ঝি খানিক যেন থমকে গিয়ে আমায় দেখল। বলল, থাকত আগে, এখন উঠে গেছে। উঠে গেছে, কোথায়?
২৪.
ভরা সন্ধেতে বস্তি খুঁজে খুঁজে ওঁর দেখা পেলাম। সারা মুখে ঘা, গলার কাছটা পোড়া ঝলসানো চামড়ায় বীভৎস, বাঁ-হাতটা কাঁপে সর্বক্ষণ। কুপির আলোয় দড়ির ঝোলা-খাঁটিয়ায় শুয়েছিলেন। আমায় দেখে ঠাওর করতে পারেন না। পরে চিনতে পেরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। অনেক পরে বললেন, লক্ষ্ণৌতে গিয়ে ওঁর মাথার অসুখ হল, তাড়াতাড়ি কলকাতা ফিরলাম। মাস ছয় ভুগে উনি চলে গেলেন। সাধ্যেরও বেশি করেছি, ফটিক; আটকে রাখতে পারলাম না।
২৫.
শেষের দিকে বাবু ঝোঁক ধরেছিলেন, ওঁকে বাবুর সঙ্গে পুড়ে মরতে হবে। এই ঝোঁক আর কিছুতেই কাটে না। শেষ পর্যন্ত একদিন সত্যি সত্যি কাপড়ে আগুন ধরিয়ে দিলেন মা। মরলেন না, তার আগেই লোকজন এসে পড়েছিল।
২৬.
কুপি নিভে গেল। তেল ফুরিয়েছে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে মা আর আমি বসে। মা বলল, ফটিক, চার পয়সার কেরোসিন কিনে আনতে পারো? এখানে বড় ইঁদুর, ইঁদুরগুলো অন্ধকারে বড় গা ঠোকরায়।
২৭.
তেল কিনে ফিরে গিয়ে দেখি, মার মুখের ঘা ঠুকরে রক্তে রক্তে ভাসিয়ে দিয়েছে ইঁদুরে।
২. নিমতলা শ্মশান
০১.
নিমতলা শ্মশানে ভোর ফুটল, রাস্তায় রাত কাটানো ভিখিরির মতন রাতের কালো কালো ছায়াগুলো সরে গেল, সূর্য উঠল, দিনের আলোয় কলকাতা শহরকে শ্মশানেই প্রথম দেখলুম। মা পুড়ল। গঙ্গার ঘোলা-জলে রোদ তখন প্রাণখুলে হাসছে।
০২.
কলকাতা শহর নাকি ইন্দ্রপুরী। আমার কাছে শহরটা কিছুদিন কাঠ হয়ে থাকল। চারপাশে কেবল যেন ফাঁকা ফাঁকা। আমি এই শহরের কথা বুঝতে পারতাম না। এখানের সব কিছুই আমাকে অবাক করত। মনে হত, সমস্ত শহরটা বিরাট এক তাঁবুর তলায় সার্কাসের খেলা দেখাচ্ছে।
০৩.
হাঁদুবাবুর বস্তিতে ওরা আমার কাছ থেকে এক মাসের ভাড়া আগাম নিয়ে নিয়েছিল। কাশীর গলির চেয়েও বস্তিটা ঠাণ্ডা, অন্ধকার, দুর্গন্ধভরা। ঠিক কত যে লোক থাকত এই বস্তিতে আমি কিছুতেই ঠাওর করে উঠতে পারিনি। ভোর হবার আগে থেকে মানুষের গলার স্বর শুনতে পেতুম, রাত বারোটার পরও বস্তিটা চুপ হত না। যারা কথা বলত, তারা কি মেয়ে কি মন্দবাই যেন গলার সহজ স্বর হারিয়ে ফেলেছে। কেমন কর্কশ, ভাঙা, ফাঁপা সুর গলায়। আমার মনে হত, এদের বুকে অনেক বুঝি শ্লেষ্ম জমা হয়েছে।
০৪.
মাঝে মাঝে মনে হত, কাশী ফিরে যাই। কিন্তু ফিরে যেতে পারতাম না। মানুষ একবার যা ফেলে আসে সহজে সেখানে আর ফিরে যেতে পারে না। কলকাতা আসার সময় আমার মনে একটা জীয়ন্ত ফুলের চারা যেন মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে নাচছিল, হু হু করে বাড়ছিল; কলকাতায় আসতে না আসতেই সেই চারা কে যেন উপড়ে ছিঁড়ে টান মেরে ফেলে দিল।
০৫.
গ্যাসবাতির আলোয় একদিন নিজের ছায়া দেখলুম। ছায়াটা রাস্তার ধার বয়ে দেওয়ালে পেচ্ছাপখানার ওপর তালপাতার ভূতের মতন পড়েছিল। যেন আমার পা গা মেরুদণ্ড মুখ মাথা বলে আর কিছু নেই। ছায়াটা বেশিক্ষণ দেখতে পারলাম না, কেমন একটা ভয় হল হঠাৎ। হন হন করে হেঁটে গলি ধরে ভেতরে চলে এলাম অনেকটা। দাঁড়ালাম হঠাৎ। গলি আরও সরু হয়ে পথ বন্ধ হয়ে গেছে। লম্বা মতন এক বাড়ির তলায় দাঁড়িয়ে দুটো মেয়ে সিগারেট খাচ্ছিল ভাগাভাগি করে। অনেক খড়িগুড়ো আর আলতা ওদের মুখে, কপালের টিপ জোনাকির মতন পিটপিট করছে। আচমকা আমার মনে হল, সত্যি কি আমার শরীরটা ছায়া হয়ে গেছে? আস্তে আস্তে একটি মেয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, রেল স্টেশনের টিকিটঘরে যেমন করে মানুষ টিকিটের টাকা গুণে দেয়, আমি ঠিক সেইভাবে ওর হাতে টাকা গুণে দিলাম। আর টাকা গুণে দিয়ে আমি এমন এক টিকিট কিনলাম যে-টিকিট আমায় ছায়া থেকে মাংস ও রক্তের ঠিকানায় নিয়ে যাবে।
০৬.
একটা বাচ্চা ককিয়ে ককিয়ে কাঁদছিল। ঘুম ভাঙল আমার। ফরসা হয়েছে। ভাঙা খড়খড়ির জানালার ওপারে বাচ্চাটা কাঁদছে। এপারে আমরা। আমি আর গোলাপ। গোলাপ মুখ থুবড়ে হাত ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে, ঠিক যেন মরা জন্তু। দিশি মদের বোতলটা গড়িয়ে গড়িয়ে গোলাপের বাসনের কাছ-পর্যন্ত চলে গেছে। বাচ্চাটা কাঁদছিল। …গোলাপকাল বলছিল, তার একটা ছেলে হয়েছিল একবার। মা মা বলতে শেখার পর মাত্র দুটো দাঁত নিয়ে মরে গেছে।
০৭.
গোলাপকে জাগিয়ে দিয়ে আমি চলে আসছিলাম। গোলাপ শুধোল, আবার কবে আসা হবে? কথার কোনও জবাব দিলাম না। একটু হাসি হাসি মুখ করলাম শুধু। ..আর আসা হবে না। আমি কেন এসেছিলাম গোলাপ জানে না। গোলাপের জন্যে খরচ করার মতন পয়সাও আর আমার নেই।
০৮.
বইয়ের দোকানের চাকরিটা আমায় সহদেবদাই দিয়েছিল। কেন দিয়েছিল জানি না। ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াই তখন চিৎপুরের রাস্তায়, কাশী থেকে আনা পুঁজি ফুরিয়েছে; পকেট মেপে একবেলা চিড়ে মুড়ি খাই অন্যবেলা উপোস। একদিন সন্ধে তখন উতরে গেছে, শ্রাবণের ধরা বৃষ্টি আবার এল হুড়মুড় করে। রাস্তা থেকে উঠে দোকানের সরু বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। চিৎপুরের রাস্তা জলের ঝাঁপটা খাচ্ছে সকাল থেকেই, মাগুর মাছের মতন কালো পিছল তার চেহারা, বাতিগুলিতে তেমন রোশনাই নেই। অনেক পরে পরে ঠং ঠং করে ঘন্টা বাজিয়ে জানলা-আঁটা ট্রাম এক-আধটা যাচ্ছিল। বৃষ্টি আর ধরে না। কানে গেল, দোকানের মধ্যে বসে কে যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পালা পড়ছে। এ আমার চেনা পালা, শোনা পালা। ছেলেবেলায় শুনেছি, ইন্দ্রদের কাছে থাকবার সময় গাঁ-গ্রামে এ-পালা কতবার গেয়ে গেছে যাত্রার দল। বারান্দা ছেড়ে দোকানের চৌকাঠে এসে দাঁড়ালাম। সহদেবদা পালা পড়ছে–দোকান ফাঁকা। …কখন যেন আমি ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছিলাম সহদেবদাও পালা পড়তে পড়তে হঠাৎ আমায় দেখতে পেয়ে থেমে গেল। কী চাই? সহদেবদা শুধোল। চটক ভাঙল আমার, আধভেজা চেহারা, মুখ ভর্তি দাড়ি, চিট ময়লা জামাকাপড়। ভয় হল, আমায় না চোর ভাবে। তাড়াতাড়ি ঢোঁক গিলে বললাম, পালা কিনব। .কোন পালা? আপনি যেটা পড়ছিলেন। সহদেবদা একটুক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকল, আমি কোন পালা পড়ছিলাম? কর্ণার্জুন। .সহদেবদা সামান্যক্ষণ আর কথা বলল না, হাঁ করে চেয়ে চেয়ে আমায় দেখল। তারপর একটা বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে বলল, কর্ণের বাপের নাম কী? …আমি থতমত খেয়ে গেলাম। সহদেবদা সরাসরি চেয়ে আছে, আমার দিকে। শেষে ঘাবড়ে গিয়ে বলে ফেললাম, সূর্যদেব। সহদেবদা শুনল, বিড়িতে টান দিল জোরে জোরে। তারপর বলল, কর্ণর বাবার নাম নারায়ণচন্দ্র শীল। আমি কর্ণ বলে খ্যাপার মন হা হা করে হাসতে লাগল সহদেবদা। এমন হাসি আমি আর শুনিনি। হাসিটা যেন দপ দপ করে হলকা তুলে জ্বলছিল। আমার মনে পড়ল, কাশীতে একজন ম্যাজিক দেখাত, একগলা স্পিরিট খেয়ে দেশলাই জ্বালিয়ে হাসত, মুখ খুললে আগুন জ্বলত, বন্ধ করলে নিবত।
চন্দ্র শীল। আমি কণা
০৯.
সেই থেকে আমার তারিণী লাইব্রেরিতে চাকরি। দিনের বেলা সহদেবদার বাসায় খেতে পেতাম, মাস-মাইনে পঁচিশ টাকা। আমি নতুন, পুরনো কর্মচারী আরও ছিল দেড়জন। দাশমশাই আর দুলাল। দুলালটা বাচ্চা, বছর চোদ্দ-পনেরো বয়স। ছেলেটা বোবা-হাবা, কথা বলতে পারত না, কিন্তু কাজকর্ম করত চমৎকার। সহদেবদা দুলালকে সব সময় নন্দদুলাল বলে ডাকত। কেন, কে জানে?
১০.
শহর কলকাতা দেখতে দেখতে কবে যেন সয়ে গেল আমার। সহদেবদা বলত: কলকাতায় এলে ফিলটার করা জল খাওয়া যায় বুঝলে ফটিকচাঁদ, আয়নার মতন রং জলের। এ-জল পেটে ধরে গেলে অন্য জল মুখে সরে না আর। ঠাট্টা করেই বলত সহদেবদা। আর দোকানের তক্তায় তবলার বোল বাজিয়ে কলকাতার গান গাইত:
তুমি যে পরের সোনা আগে তা ছিল না জানা…
সহদেবদার বুড়ো আঙুল থেকে আরও একটা ছোট কচি আঙুল বেরিয়েছিল। ডান হাতটা উপুড় করলে বুড়ো আঙুলটা চেপ্টা মাথা-ভাঙা মাগুর মাছের মতন দেখাত। একদিন সহদেবদা আমায় বলেছিল, আমাকে তুই একলব্য করে দিতে পারিস ফটিকচাঁদ, এই আঙুলটা দেখলে বউ শালী বড় ঘিন ঘিন করে।
১১.
সহদেবদার বউ দেখতে ভাল ছিল। বেশ কটকটে ফরসা রং, মাটির সরার মতন গোল মুখ, চোখ দুটি ছিল ভয়ংকর টানা টানা–যেন কাজললতা। …দুপুরের আগে আগে আমি খেতে যেতাম, সহদেবদা দোকানে থাকত, আমি ফিরে এলে সহদেবদা চলে যেত। সহদেবদার বউ আমায় পাত পেড়ে খেতে দিত। প্রথম প্রথম কথাবার্তা বলত না, পরে বলত। গলার স্বরটা কিন্তু মোটা মোটা ছিল তার।
১২.
একদিন ভাতের মধ্যে একটা মাথার কাঁটা পেয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সহদেবদার বউকে আমার ভয় করত। কপালের চারপাশ থেকে টেনে কষকষে করে চুল বাঁধত সহদেবদার বউ, বিড়ের মতন মস্ত খোঁপা করত, সরার মতন গোল মুখটা তাতে যেন রুক্ষ রুক্ষ দেখাত। গলার স্বরটাও ছিল মোটা, খ্যাসখ্যাসে।
১৩.
রুপোর ঝুমকো কাঁটাও পেয়েছিলাম একদিন। সহদেবদার বউ গা করেনি। বরং ঠোঁট উলটে চোখ চলকে এমন ভাব করেছিল যেন ঠাট্টা করেই বলল, কাঁটাটা তোমার গলায় বিঁধেছে নাকি?
১৪.
সহদেবদার দোকানে হরেক রকমের বই-যাত্রার পালা, ব্রতকথা, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, নাটক, নবেল, যাদুমন্ত্র, শিক্ষা, রতিশাস্ত্র। দোকানের কাজকর্ম হালকা থাকলে আমি বসে বসে বই পড়তাম। একদিন দুপুরে এক ছোকরা বাবু বশীকরণ কিনতে এসেছিল। খদ্দের বিদেয় করার পর সহদেবদার হঠাৎ সে কী হাসি। হাসতে হাসতে দমবন্ধ হবার জোগাড়। একটু সুস্থির হবার পর সহদেবদা বলল, কী কারবারই ফেঁদে বসেছি ফটিকচাঁদ, আমার দোকানে বাজারের সেরা বশীকরণ পাওয়া যায়; মেয়েছেলে বশীকরণটা আমার বাবা লিখেছিল, বেটাছেলে বশীকরণটা আমি লিখেছি। সহদেবদা হা হা করে হেসে উঠল আবার।
১৫.
সহদেবদার বউয়ের সঙ্গে আমার বেশ জমে আসছিল। চুলের কাঁটা ভাতের পাতে পড়ত না আর। তার বদলে সাজানো গোছানো ভাতের থালায় কোনওদিন একটু ঘি পড়ত, কোনওদিন বা মাছের বড় টুকরো। খেয়ে-দেয়ে আঁচিয়ে উঠলে সহদেবদার বউ আমার হাতে দুখিলি পান টুপ করে ফেলে দিত। …একদিন পানের সঙ্গে কড়া জরদা মিশিয়ে দিয়েছিল। দোকানে আসার পথে গা গুলিয়ে বমি এল। সেদিন সারাটা বিকেল গা বিড়োনো ভাব নিয়ে কাটল।
১৬.
পরের দিন সহদেবদার বউ ঠোঁটা-টেপা চাপা হাসি হেসে শুধোল, কী গো কাশীর বাবু, কেমন আছ? হাসিটা যেন রঙ্গ রসে জ্বাল দেওয়া, মোটা সর পড়েছে গালে চোখে। আমি নজর করে সে হাসি দেখলাম। …সেদিন সহদেবদার বউ পান দেবার সময় হাতের খিলি খুলে দেখাল। বলল, চুন সুপুরি ছাড়া কিছু নেই বাপু, দেখে নাও; পরে যে বলবে শেকড়-টেকড় খাইয়ে দিয়েছিবলতে বলতে দুলে দুলে হেসে উঠল সহদেবদার বউ। আমার মনে হচ্ছিল, মানুষের শরীরে যত শেকড় থাকে এত আর কোথাও নয়।
১৭.
শীত ফুরিয়ে গেছে। আমাদের চিৎপুরের গলিতে ভোঁ কাটা ঘুড়ির মতন টাল খেতে খেতে ফাল্গুনের বাতাস দু-এক দমকা এসে পড়ে। হোলির হররা ছুটছে রাতে। সহদেবদার বউ ততদিনে আমার কাছে আমি তুমি হয়ে গেছে। ওর চোখ দেখে আমার কী মনে হয় তা বলেছিঃ কী টানা টানা–ঠিক যেন কাজললতা। সহদেবদার বউ চোখের মনি আড় করে হেসেছে, বলেছে, তা হলে বলল এই কাজললতার কাজল পরতে কাশীর বাবুর বড্ড সাধ।
১৮.
সাধ মেটার আগে আগেই একদিন সহদেবদা সাত সকালে দোকানে এসে হাজির। সবে দোকান খুলে আমি ঝাড়া-মমাছা করছি, মাটির গণেশের তাকে ধূপদানিতে ধূপকাঠিটা অর্ধেকও পোড়েনি, খুশির চোটে লুটোপুটি খেতে খেতে যেন দোকানে ঢুকল সহদেবদা। আত্মহারা। দোকানের সিন্দুক খুলল, কাগজপত্র কী বের করল, পকেটে পুরল। আমায় দশটাকার একটা নোট দিয়ে বলল, আমি একটু শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি বুঝলি, দাশমশাই এলে পাঁচটা টাকা দিয়ে কালীঘাটে পাঠিয়ে দিবি পুজো দিতে, বাকি টাকাটায় তোরা পেট ভরে মিষ্টি খাস৷কীসের পুজো, মিষ্টিই বা কেন হঠাৎ? সহদেবদা চৌকাঠের ওপারে পা রেখে একটু দাঁড়াল, প্রাণভরে হাসল। বলল, তুই না একেবারে গবেট, গবেটের বাচ্চা…কীসের আবার মিষ্টি বুঝলি নান্যাকা চৈতন…তোর বউদির এবার মাইরি জোর আটকেছে…সহদেবদা হাসির টাল সামলাতে সামলাতে নেমে গেল। …চমক ভেঙে চেয়ে দেখলাম, ফুল দিয়ে ময়ূরপঙ্খী সাজানো একটা মোটর গাড়ি হুস করে চলে গেল, বর বউয়ের মুখ দেখতে পেলাম না।
১৯.
সেদিন দোকানের বউনি শুরু করেছিলাম ভোজবাজি শিক্ষা দিয়ে।
২০.
চৈত্র মাসটা খাঁ খাঁ করে উঠল। আমাদের বস্তিতে নটু পালের বউ বেশ্যা হল, কার্তিক ছুতোর বসন্ত হয়ে মরল, শৈলবালা বঁটি দিয়ে সোমত্ত মেয়ের পা কুপিয়ে দিল। কেন, কী করে, কেমন ভাবে ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে কে জানে! ঘটছে দেখছি, চোখের সামনে হুট হাট ঘটে যাচ্ছে। সমস্তই ভোজবাজি। সহদেবদার বউয়ের পেটে বাচ্চা আসাটাও বোধ হয়।
২১.
সহদেবদার বাড়ি যাওয়া বন্ধ করেছিলাম। দুপুরে দোকানের কাছাকাছি এক হোটেলে ভাত খেতাম। পাঁচ টাকা মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছিল সহদেবদা। মানুষটার মেজাজ আরও দরিয়া হয়ে গিয়েছিল। মুখ ফুটে চাইলে আরও পাঁচটা টাকা বেশি দিতে না করত না। সহদেবদার এই ডগমগে ফুর্তির ভাবটা আমি হামেশাই লক্ষ করতাম। মাঝে মাঝে অসম্ভব রাগ হত। লোকটা এত বোকা গাড়োল অঙ্ক কী করে হল।
২২.
ও বাড়িতে একদিন ঘটা করে সত্যনারায়ণ পুজো হল। বউ যাতে ভালয় ভালয় বিয়োয় সহদেবদা সেই আশায় পুজো-আচ্চা তুকতাক কিছু আর বাকি রাখছিল না। সত্যনারায়ণের নেমন্তন্ন রাখতে আমরা তিন জনেই গিয়েছিলাম–আমি, দাশমশাই আর দুলাল। বাড়িতে অন্য লোকজনও এসেছিল। সহদেবদার বউকে অল্পের জন্যে একবার দেখেছিলাম। পেট-ঝোলা হাঁসের মতন হাঁটছিল। উত্তর দিকের ঘর থেকে এল, বারান্দায় সত্যনারায়ণের পুজোর কাছটায় এসে গড় হয়ে প্রণাম করল, শান্তির জল মাথায় নিয়ে চলে গেল। ওর গায়ের কোরা ফাঁপানো শাড়িটা যেন চালচিত্তিরের মতন চটক দিচ্ছিল।
২৩.
ফেরবার পথে দাশমশাই সহদেবদার বাড়ির কথা আমার কাছে খাটো গলায় গল্প করলেন। সহদেবদার বউ বাপের একমাত্র সন্তান, বাপের কিছু সম্পত্তি আছে, নেবুতলায় বাড়ি আর চালু তেলকল। বুড়ো বছর খানেক হল চোখ বুজেছে। মরার আগে মেয়ে-জামাইকে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে। বেঁচে থাকতেই জামাইয়ের ওপর হাড়ে হাড়ে চটা ছিল বুড়ো; ভাবত, বেজাত বেজন্ম এই ছোঁড়াটাই তার মেয়েকে পটিয়ে পাটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে গেছে। আসলে ওই মেয়েতেই এই ছেলেকে গিথেছিল। …বড্ড রাগ বুড়োর, মেয়ে জামাইয়ের ওপর। সম্পত্তির কানাকড়িও দেয়নি; উইল করে গেছে। মেয়ের যদি ছেলেমেয়ে হয় পুরো সম্পত্তি তাদের বর্তাবে নয়তো ও-সম্পত্তি বুড়োর ভাইপোদের। দাশমশাই বিড়িতে টান দিয়ে বললেন, বুড়োর ভাইপোরা এই সম্পত্তি লুটতে শুরু করেছিল। আমাদের বাবু আর তাঁর পরিবার হাত কামড়ে মরছিল এতদিন। নিজের পাতের ঘি–অন্যে চেটেপুটে খাচ্ছে মানুষ কাঁহাতক আর সহ্য করে!
২৪.
সহ.দেবদার বউকে এরপর আমি যথার্থ করে চিনলাম। বাজির দৌড় জেতবার জন্যে সে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। মাথার কাঁটা তার কিছু কমতি ছিল না। আঁকশির মতন এই কাঁটা সে আরও কত ছড়িয়েছিল কে জানে। তবে ছড়িয়েছিল। নয়তো ছ বছর ধরে যে সহদেবদা কাজে আসেনি–সেই সহদেবদা হঠাৎ কাজে আসত না। সহদেবদার নিজের গুপ্তকথাও আমি কিছু কিছু জানতাম। কবিরাজি হাকেমি নানান ওষুধ খেত ও! বলত, আমার লাইব্রেরির বশীকরণও যেমন ভুসি মাল বুঝলি ফটিকচাঁদ, এশালাও সব তেমনি…কিছু হয় না।
২৫.
সহদেবদার বউকে চিনতে পেরেছিলাম, চিনতে পারিনি সহদেবদাকে। বড্ড সাদামাটা ভাল মানুষ লোক, তার ঘরে অন্যে সিঁধ কেটেছে এবুঝি স্বপ্নেও ভাবত না। শেষ পর্যন্ত নিজের পৌরুষেই সে জিতেছে–মানুষটা এই আনন্দে গর্বে ভরপুর হয়েছিল।
২৬.
বেশ কয়েক মাস পরে সহদেবদাকে আমি চিনতে পারলাম। বাড়িতে সহদেবদার বউয়ের আজকাল অবস্থা। পাক্কা তিন দিন কামাইয়ের পরে দোকানে এল সহদেবদা। তখন সন্ধে হয়ে গেছে, আমরা দোকান বন্ধ করছি। সহদেবদার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, আমাদের যেন শ্মশানে যাবার জন্যে ডাকতে এসেছে। দাশমশাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, আমি চমকে উঠেছিলাম, বোবা দুলাল দোকানের দরজার সামনে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দাশমশাইয়ের গলা থেকে স্বর বেরুচ্ছিল না, তবু তিনিই আধ-খাপচা বেয়াড়া স্বরে শুধোলেন, বউমা? .সহদেবদা মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে বলল, ঠিক আছে, বেঁচে আছে। আমরা তিনজনে নিশ্চিন্ত হলাম খানিকটা। ..দাশমশাই আর দুলালকে বিদায় করে দিয়ে সহদেবদা বলল, আমায় একটু জল খাওয়া। জল খাওয়ালাম, চা সিগারেট এনে দিলাম। সহদেবদা দু হাতে মাথা ঢেকে চুপ করে বসে থাকল। মাঝে মাঝে মুখ উঠিয়ে রাস্তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিল। আমার সঙ্গে কথা বলছিল না, যেন সে একা একটি মানুষ এই ঘরে বসে আছে। ধীরে ধীরে রাত হয়ে উঠল। দোকানের বইয়ের আলমারির ফাঁক-ফোকর থেকে দু একটা ইঁদুর বেরিয়ে এল, কড়িকাঠের ওপর থেকে টিকটিকি ডাকল, ট্রামের টিকিতে আগুন ঝলসে দোকানের সামনেটা পলকের জন্যে আলো হয়ে উঠল। …চমক ভাঙল সহদেবদার। বলল, দোকান বন্ধ কর। …কাঠের পাল্লা লাগাতে লাগাতে দেখলাম, দোকানের ক্যাশ খুলে মুঠো ভর্তি করে যা পারল পকেটে পুরে নিল সহদেবদা। দরজায় তালা লাগাচ্ছি সহদেবদা একটা রিকশা থামাল। রিকশায় বসে আমায় ডাকল, উঠে আয় ফটিক।
২৭.
আমরা বেশ্যাপাড়ায় এলাম। গলিটা যেখানে শেষ হব হব, সহদেবদা রিকশা থামাল, নামল। গোটা একটা টাকাই দিয়ে দিল রিকশাঅলাকে। আমায় বলল, ভাল দেখে একটা মেয়েছেলে বাছ–বলতে বলতে সহদেবদা কপা এগিয়ে পাশের দোকানটায় চলে গেল।
২৮.
মানুষটার মতিভ্রম হয়েছে। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। উলটো দিকের রাস্তা থেকে একজন গলা ছেড়ে সোডাজলের গান গাইল। দেড়তলার খোলা জানালা দিয়ে বুক গলিয়ে পানের পিচ ফেলল আর-একজন। নাচের সাথে ডুগি তবলার বোল বাজছিল আশেপাশে কোথাও। আমার মুখোমুখি বাড়িটার সরু ছোট খোলা সদরের দিকে চোখ পড়তে দেখলাম, তিন ধাপ সিঁড়ি, তিন সিঁড়িতে তিনটে মেয়ে বসে। প্রথম ধাপের মেয়েটা পা ফাঁক করে বসে পায়ের গোড়ালির কাছে সায়া টানছে আর হাসছে। …সহদেবদা এল, কাঁধে হাত রাখল। কাঁধের কাছটা এমন জোরে থাবা দিয়ে ধরেছিল, মনে হল যেন ওর সমস্ত শরীরের ভারটা আমার ওপর ফেলে দিয়েছে। আস্তে আস্তে গলা জড়িয়ে ধরল সহদেবদা। শোষা শোষা গলায় বলল, ওই মেয়েটার কাছে চল, জানলার মেয়েটা…একলা আছে।
২৯.
সহদেবদাকে এগিয়ে দিয়ে পিছু ফিরতে যাচ্ছি খপ করে আমায় ধরে ফেলল। এত জোরে এমন করে কখনও আমার হাত আর কেউ ধরেনি। মনে হচ্ছিল, আমায় ছাড়া আর এক পা এগোবার সাধ্য সহদেবদার নেই। ইচ্ছে করলে হাতটা হয়তো আমি ছাড়িয়ে নিতে পারতাম। ছাড়ালাম না। বললাম, তুমি যাও, আমি একটু পান খেয়ে আসি। দুজনেই এক জায়গায়…। আমায় কথা শেষ করতে দিল না সহদেবদা, ওর হাতের আঙুলগুলো আরও শক্ত হল, আমার কবজির কাছটায় হাড় কনকন করে উঠল, সহদেবদা বলল, দুজনেই এক সঙ্গে যাব। তুই সাক্ষী থাকবি, ফটিক। আমি শালা পুরুষ মানুষ কি না স্বচক্ষে তুই দেখবি। সহদেবদার গলা কর্কশ রুক্ষ, চোখে ফুলকি। আমার হাত ধরে টানছিল সহদেবদা, টকটকে লাল শাড়ি পরা বেশ্যাটা দেওয়ালে পিঠ হেলিয়ে দাঁড়িয়ে হাসছিল।
৩০.
কতটা রাত হয়েছিল জানি না। রিকশা করে সহদেবদাকে নিয়ে ফিরছিলাম। সোনাগাছির গলিটা যেন থকে গিয়ে মড়ার মতন পড়ে ছিল। গ্যাসবাতিগুলো বাড়ির বউয়ের মতন পথ চেয়ে চেয়ে জড়ানো চোখে ঢুলছে। নোংরা ঘিঞ্জি ঠাণ্ডা বাড়িগুলোর গা বেয়ে দিশি মদ কাঁকড়া ভাজা আর পেঁয়াজের গন্ধ ব্যাড় ব্যাড় করছে। রিকশাটা আস্তে আস্তে চলেছে। সহদেবদা মাল খেয়ে আমার ঘাড়ে মাথা গুঁজে পড়ে আছে। …গলির জট ছাড়াতে ছাড়াতে আমরা যে কোথায় এসে পড়লাম কে জানে। আমি কিছু ঠাওর করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, কোথায় এসেছি কোথায় যাচ্ছি আমরা কেউ জানি না–আমি না, সহদেবদা নয়, রিকশাঅলাও না। আমাদের যাওয়া কোনও জানা ঠিকানায় নিয়ে যায় না শেষ পর্যন্ত। সহদেবদা যেখানে এসেছে সেটা না বাড়ি না বেশ্যাপাড়া। বোধহয় এটা দোকানপাড়া। সহদেবদা দোকান খুলে বসে বুড়ো বয়স পর্যন্ত বশীকরণ শিক্ষা বিক্রি করবে। বাড়িতে তার কলমকরা ছেলে বড় হবে, বেশ্যাপাড়ার আজকের মেয়েটা বুড়ি হবে; সহদেবদা কোনওটাকেই বশ করতে পারবে না। ছেলের নাম দিয়ে আরও একটা বশীকরণ লিখবে। বেচবে। গাঁট গাঁট বেচবে আর দোকান বন্ধ হয়ে গেলে ট্রাম রাস্তায় নেমে দেখবে–জগতে কোনও কিছু তার বশে নেই। কাঁদবে সহদেবদা, রোজ–প্রত্যহ, আজকের মতন। কিংবা হাসবে, যেমন করে আমায় দেখে প্রথম দিন হেসেছিল।
৩১.
রিকশা থামিয়ে আমি নেমে পড়লাম। তারপর ভীষণ ভয়ংকর একটা বোঝার মতন যেন সহদেবদাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে দিয়ে হন হন করে ছুটে পালালাম।
.
ছয়
০১.
ময়রার দোকানের সামনের এঁটো পাতার যেমন ঠিক-ঠিকানা নেই, কখনও ভিখিরি কখনও কুকুরের মুখে মুখে একখান থেকে আর-একখানে গিয়ে পড়ে, শেষে দমকা হাওয়ায় উড়ে উড়ে কোথাও চলে যায়–আমার জীবনটাও সেইভাবে কাটছিল। শশী কোম্পানির ছবি বাঁধাইয়ের দোকান থেকে মাধবমোহন অপেরায় এসেছিলাম। সেবার অপেরা নতুন পালা খুলেছিল নহুষের প্রেতাত্মা। আমায় সারাটা শীত কলকাতার বাইরে মফঃস্বলে নহুষের প্রেতাত্মা সেজে কাটাতে হয়েছে। ছাতার কাপড়ের কালোবোরখা পরে রাতের পর রাত জেগে থাকা আর যাত্রার আসরের বাইরে এলেই খেকি কুকুরগুলোর তাড়া খাওয়া আমার ভাল লাগত না। আমি জানতাম, ধুতি জামা পরা এই মানুষটাই আসল প্রেতাত্মা কালো বোরখাটা নেহাতই কাপড়, তার আত্মা নেই। মাধবমোহন অপেরার মালিক আমায় বাপ মা তুলে গাল দিয়ে বলেছিল, ওরে আমার বিদ্যেসাগর, খুব যে কুলোয় করে বিদ্যে ঝাড়ছিস, আত্মা দেখার জন্যে কেউ বায়নার টাকা দিয়ে যায় না-বুঝলি। ..আমি জানতাম কালো কাপড়টার জন্যেই মানুষ দাম দেয়।
০২.
অপেরা ছেড়ে দিয়ে মাস দুই নীলাম হাঁকার কাজ করলাম ডাববাবুর দোকানে। নীলাম হাঁকার গলা আমার ভালই ছিল। ডাববাবুর ধারণা হল, আমার গলার স্বর তেমন ভাবে চড়তেই পারে না, খদ্দের যে ভাববে এই বুঝি হাতছাড়া হল হল তেমনটি হয় না। ডাববাবু বললেন, নীলামের কারবারে খদ্দেরকে গরম করে দিতে হয়, তুমি ঠিক গরম করতে পারো না। ..চল্লিশ টাকা মাস মাইনের আর কত গরম করার মতো আগুন থাকে শরীরে আমি বুঝতে পারিনি।
০৩.
ছেঁড়া-খোড়া শুকনো পাতার মতন আমি যখন যে-পাশে হাওয়ার দমকা সেই পাশে উড়ে যাচ্ছিলাম। দেখতে দেখতে আর একটা বছর কেটে গেল। দরজিপাড়ার দিকে এক গেঞ্জিকলে চাকরি পেয়েছিলাম। চাকরিটা কিছু নয়, কিন্তু কারখানার বাড়িটা আমার অদ্ভুত লাগত। ভাঙা গেটঅলা কতকালের পুরনো এক বাড়ি, গায়ে একরত্তি চুন সুরকি নেই, ইটগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে ঝরছে, নাট-মন্দিরের মতন বাড়িটার পেল্লায় মাথাটা লম্বা লম্বা তালগাছের মতো থামের ওপর ভর করা। কত যে ঘর ছিল ওবাড়িতে কে জানে, বিশ-পঁচিশ পঞ্চাশও হতে পারে। কাঠের সিঁড়ি, ঘুটঘুঁটে অন্ধকার কুঠরি, হাঁটুড়োবা ধুলো, কেমন এক পাতাল পাতাল গন্ধ। একরাশ পায়রা আর এক গাদা চড়ুই সারাদিন বারান্দায় ঝটপট করছে। দালানের সামনে একটুকরো জমি। একটা ন্যাংটো মেয়েছেলের মূর্তি হেঁট মুখে পিঠ নুইয়ে পায়ের তলা থেকে কাপড় তুলে নিচ্ছে, যেন দালানে কারুর পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে লজ্জায় মরি মরি। জমিটার একপাশে কামিনী ফুলের গাছ একটা, আর কিছু জবা গাছ। …উত্তর দিকের দালানের কুঠরিতে আমাদের গেঞ্জিকল, ওপাশে সাইনবোর্ড লেখার কারখানা–মাঝের কুঠরিগুলোয় ছাপাখানা। দোতলায় এক জ্যোতিষী বসে, গয়নার বাক্স তৈরি করে দু-তিন জন কারিগর, থিয়েটারের সিন আঁকে শশিবাবু আর তার সাকরেদ দুজন। বাড়িটার আর কোথায় কী আছে জানতাম না। অথচ দোতলার উত্তর দিকের জানলার আধখানা বন্ধ পাপড়ির ওপর দিয়ে প্রত্যহ ভিজে শাড়ি ঝুলত, প্রত্যহ। সকালে যখন কারখানায় আসতাম, দেখতাম শাড়িটা ভিজে; দুপুরে দেখতাম শাড়ির বদলে ধুতি ঝুলছে। আমাদের মধ্যে কেউ জানত না, ওই ঘরটায় কে থাকে। কেউ কোনওদিন জানলায় কারুর মুখ দেখেনি। সবাই ভাবত, এ বাড়ির বুড়ো ম্যানেজারের ওটা অন্দরমহল। বুড়ো ম্যানেজারকে দুপুরবেলা একবার দেখা যেত। খড়ম পায়ে সিঁড়ির রেলিং ধরে আস্তে নেমে আসত দালানে। ন্যাংটা মেয়ের মূর্তিটার কাছে এসে বেতের বাটি থেকে ভাতের দানা ছিটিয়ে পায়রা আর চড়ুইগুলোকে খাওয়াত। তারপর খট খট করে আবার চলে যেত, মনে হত মানুষটা এই মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে, আবার এখুনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। কারও দিকে তাকাত না, কথা বলত না; মাঝে মাঝে শুধু সিঁড়ি ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাত।
০৪.
গেঞ্জিকলের কাঠিমগুলো সুতো ছাড়ত আর কলগুলো গেঞ্জি বুনত। মাঝে মাঝে আমার মনে হত, আমরা সবাই কাঠিম হয়ে গেছি।
০৫.
একদিন ছাপাখানার কেষ্টপদ দোতলার জ্যোতিষীর কাছে হাত দেখিয়ে এসে বলল, দুমাসের মধ্যে তার বিয়ে হবে। আমি ঘুরন্ত কাঠিমগুলোর দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছিলাম, কেষ্টপদ বিয়ে করতে যাবার সময় একটা জালি গেঞ্জি পরবে। হয়তো এই কারখানার গেঞ্জি।
০৬.
কারখানার ছুটি হয়ে গেলে একদিন আমি আস্তে আস্তে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। জ্যোতিষীর ঘরের সামনে শশিবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন। সারাটা বারান্দা জুড়ে একটা থিয়েটারের আঁকা সিন মাটিতে মেলা ছিল। আকাশের চাঁদ, কটা পাখি, গাছের ডাল-পালা শশিবাবুর পায়ের তলায়। ফুরোন বিকেলের আলো দিয়ে যেন আকাশ চাঁদ গাছ পাখির গায় পালিশ তুলে নিচ্ছিলেন শশিবাবু। …তাঁর উলটো দিকে দুই বাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমি অতটা খেয়াল করিনি। পাঁচ টাকায় শশিবাবু অতটা আকাশ অমন গোল চাঁদ গাছ পাখি সব বাবুদের ভাড়া দিয়েছিলেন এক রাত্রের জন্যে। …আমার কেন যেন ইচ্ছে হচ্ছিল, একদিন পাঁচ টাকা দিয়ে আমিও অতটা আকাশ অমন বাতাস ভাড়া করব।
০৭.
ছাপাখানার কেষ্টপদ সোনালি প্রজাপতি আঁকা কবিতা ছাপিয়ে বিয়ে করল। তার বউয়ের নাম চাঁপা। আমার বার বার চাঁপারানির কথা মনে পড়ছিল। চাঁপারানি এতদিনে বুড়ি হয়ে গেছে। মানুষ শুধু বুড়ো হয়। একদিন আমিও হয়ে যাব। এখনই নিজেকে কত পুরনো লাগে। রাত্রে শুয়ে শুয়ে আমি আমার শরীরের চারপাশে গন্ধ পাই। কারখানার পুরনো বাড়িটার গায়ে যেমন গন্ধ, অনেকটা যেন ওই রকম, নোনা, ভ্যাপসা, ধুলো ধুলো। গন্ধটা আমার মন মেজাজ খারাপ করে দেয়। আনমনা হয়ে থাকি। কখনও কখনও অসহ্য লাগে; মনে হয় চৌবাচ্চার কতকালের বাসি জলের মতো আমার শরীরের রক্তেও বাসি গন্ধ ধরেছে, পোকা হয়েছে, মশা উড়ছে। আর হাড়গুলো মরা গাছের ডালের মতন শুকনো।
০৮.
একদিন স্বপ্ন দেখলুম: শশিবাবু চুনের বালতি আর পাটের পোচড়া নিয়ে আমার কাছে এসেছেন। থিয়েটারের পুরনো রং উঠে যাওয়া পট যেমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন, আমায় তেমন করে দেখছেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমাকে নিয়ে শশিবাবু কী করতে চান।
০৯.
সকালে ঘুম ভাঙতে তারাপদ ড্রাইভারের বউটাকে খুব হাসতে দেখলাম। কলের গোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছিল আর ননীর বোনকে কী যেন ইশারা করছিল। আমায় কল ছেড়ে দিয়ে তারাপদর বউ সরে গেল। বস্তির বাইরে নোংরা কলতলায় ননীর বোন সুহাসিনী হাঁটুতে মুখ ঢেকে ধনুকের মতন পিঠ করে বসেছিল। আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। …মুখে চোখে জল দিয়ে চলে আসছিলাম, কানে গেল তারাপদর বউ হেসে হেসে বলছে, তাড়াতাড়ি মুক্ত হয়ে নে…আজ বাদে কাল বিয়ের পিড়িতে বসবি না! ..যত অনাছিষ্টি বাপু তোদের।
১০.
গেঞ্জিকলে ঢোকার সময় দেখলাম, ন্যাংটা মেয়ের মূর্তিটার মাথায় চড়ে সাদা পায়রাটা ময়লা ফেলছে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পায়রাটাকে উড়িয়ে দিলাম শব্দ করে। মেয়েটার সারা গা বুক পেট পাছা পায়ে এত ময়লা জমে আছে আমি জানতাম না। ইচ্ছে করছিল, মেয়েটাকে পরিষ্কার করে চান করিয়ে দি।
১১.
দুপুরে এক ফাঁকে দু-গ্রাস মুড়ি চিবিয়ে জল খেয়ে বাইরে রোদে পঁড়িয়েছিলাম। কেষ্টপদ এসে এক খিলি পান দিল। বিড়ি ধরিয়ে পান চিবুতে চিবুতে মূর্তিটাকে দেখছিলাম। কেষ্টপদ হাসতে হাসতে বলল, নকল জিনিস দেখে দেখে মন খারাপ করে লাভ কী, একটা আসল জিনিস নেবে তো বলল, ব্যবস্থা করি। .কথাটা আমার বুকে যেন কোথায় একটা আলগা গিটের মতন এসে পড়ল। কেষ্টপদ যদি টানত, গিটটা লাগত, শক্ত হত। ও টানল না গিটটা, আমি বোকার মতন হাসলাম। বললাম, বিয়ের পিড়েতে বসার আগে নাকি মুক্ত হতে হয়? কী–? কেষ্টপদ অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকল। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল এমন কথা জীবনে শোনেনি। আমি সকালবেলার কথা তুলে বললাম, আমাদের বস্তিতে একটা মেয়ের পরশু দিন বিয়ে, একটা বউ তাকে মুক্ত হতে বলছিল…। কেষ্টপদ এবার হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে আমার গায়ে নুয়ে পড়ছিল। যতবার মুখ খুলতে গেল ডুবন্ত মানুষের জল গেলার মতন হাসির খাবি খেল। আমি হাঁ করে কেষ্টপদর হাসি দেখছিলাম। ম্যানেজার বুড়ো ঠিক তখন সামনে, ন্যাংটা মূর্তিটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কেষ্টপদ তখনও হাসছে। কা কা করে কাক ডেকে উঠল, পায়রাগুলো ঝটপট করতে করতে নেমে এল, চড়ুইগুলো মাঠে, বুড়ো ম্যানেজার ভাতের দানা ছিটোচ্ছে। কেষ্টপদর হাসির দমক কমে এসেছে ততক্ষণে, আমার কানের কাছে মুখ হেলিয়ে বলল, হায়রে আমার কপাল মহারাজ, তুমি বললে কী! …আরে, মেয়েদের হতে হয়…মুক্ত-টুক্ত হতে হয়… কেষ্টপদর সারা মুখ কেমন যেন দেখাচ্ছিল, বিশ্রী রকম হাসির পিচ ছড়িয়ে মুখটা ছেতরে গেছে। হাসতে হাসতে দুলতে দুলতে চলে গেল কেষ্টপদ। আমি বোকার মতন দাঁড়িয়ে থাকলাম। চোখে পড়ল, একটা কাক আদুল গা পাথুরে মেয়েটার একপাশের উঁচু বুকের ওপর পায়ের নোখ রাখার চেষ্টা করছিল; পা পিছলে গেল, কাকটা সঙ্গে সঙ্গে পাক খেয়ে উড়ে গেল, তারপরই ছিটনো ভাতের দানার ওপর এসে বসল নাচতে নাচতে।
১২.
আমার কলের কাঠিমটা সেদিন বার বার সুতো ছিঁড়তে লাগল। ঝাপসা ঠাণ্ডা ঘর, তিনটে হলুদ মিটমিটে বাতি, কলের কেমন একটা একঘেয়ে শব্দ, ত্রৈলোক বিশ্বাসের কাশি আর থুতু ছিটানো, আমার মনে হচ্ছিল চারপাশে মাথা বোঝাই আস্তাকুঁড় নিয়ে আমি বসে আছি। ভাল লাগছিল না কিছু। বুকের মধ্যে একটা ফোঁড়া যেন এবার পেকে টাটিয়ে টনটন শুরু করছে। কেষ্টপদ আমার মন মেজাজ বিগড়ে দিয়ে গেছে। দু-দিন বিয়ে করেই সবজান্তা! আমি সহদেবদার দোকানে অঢেল রতিশিক্ষার বই পড়েছি, মেয়েছেলেদের সাথে শোওয়া বসাও কি কম করেছি! কেষ্টপদ আমায় কী শেখাবে! সুহাসিনীর মুক্ত হওয়া মেয়েদের মামুলি ব্যাপার এ-আমার ভাবতেই ভাল লাগছিল না।
১৩.
সুহাসিনীর বিয়ের দিন আমি ওকে অনেক বার তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি। মেয়েটা তার সব নোংরা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করেছিল। ওকে লাজুক খুশি সুন্দর দেখাচ্ছিল। সিঁথিতে সিঁদুর ওঠার পর সুহাসিনীর মুখ একরাত্রে ফুটে উঠল। সকালে উঠে আমি অবাক হয়ে সেই ফোঁটা ফুল দেখলাম।
১৪.
শশিবাবু কিছুদিন ধরে একটা ভাঙা মন্দির আঁকছেন। মন্দিরের পাশে গা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে গাছ-গাছালি। অন্ধকার থম থম করছে।
১৫.
ম্যানেজার বুড়ো একদিন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পা পিছলে পড়ে গেল। শেষ সিঁড়িতে তার মাথা, ডান পায়ের খড়মটা অনেকগুলো ধাপ উঁচুতে একপাশে পড়ে আছে। হাতের বাটি থেকে ভাতের দানা দালানে ছড়িয়ে পড়েছে। হই-হট্টগোলের মধ্যেও একটা কাক, কয়েকটা চড়ুই, এক জোড়া পায়রা দালানে উড়ে এসে ভাতের দানা খুঁটে খাচ্ছিল। ন্যাংটো মূর্তিটার পেটের তলায় এক খাবলা ছায়া, পিঠ মাথা হাত রোদে পড়ছে।
১৬.
এমন মেয়ে আমি জীবনেও দেখিনি। নকশা করা পালংকে শুয়ে ছিল। পালঙ্কটা শশিবাবুর আঁকা পুরনো ভাঙা মন্দিরের মতন দেখাচ্ছিল। মেয়েটির বাড়ন নেই, পায়ের দিকটা বেঁটে বেঁটে, বুকের দিক ভীষণ পুরুষ্ট, মাথাটা মোটা মোটা। মুখ গোল। তবু কেমন কচি কচি দেখায়। ডান চোখের তলায় মস্ত এক তিল। গায়ের রং ফরসা, খুব ফরসা। ম্যানেজার বুড়োর কাঠ শরীরটা দেখে ও শুধু কাঁদল, অন্ধের মতন দুটি হাত দিয়ে বাতাস হাতড়াল, উঠতে পারল না বসতে পারল না, কান্নাটা যেন শোওয়া শরীরে তেমন করে উথলে উঠতে না পেরে মরে গেল।
১৭.
ম্যানেজার বুড়োর নাতনি উঠতে বসতে দাঁড়াতে হাঁটতে পারে না। হাত দুটো নৌকোর দাঁড়ের মতন নড়াতে চড়াতে পারে, আলগা করে মুঠো করতে পারে আঙুল। আর পারে কথা বলতে। ওর নাম রাজলক্ষ্মী।
১৮.
শশিবাবুই ফ্যাসাদে পড়েছিলেন। ম্যানেজার বুড়ো মরার পর রাজলক্ষ্মীকে দেখাশোনা করার ভার যেন আপনা থেকেই তাঁর ঘাড়ে পড়ল। শশিবাবু বলতেন, আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়লুম তো, এখন এই পুতুলটাকে নিয়ে আমি করি কী! শশিবাবু একটা ঝি রেখে দিয়েছিলেন। সপ্তাহখানেক পরে ঝি পালাল। শশিবাবু আর-একটাকে ঠিক করে নিয়ে এলেন। পরের দিন সেও পালাল। শশিবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। বললেন, পুরুষ মানুষ হলে আমিই না হয় সামলে দিতাম, কিন্তু মেয়েছেলেকে। চান করানো কাপড় ছাড়ানো…এটা ওটা, আমিই বা করি কী করে!
১৯.
আমাদের বস্তি থেকে আমি এক বিধবা বুড়িকে এনে দিয়েছিলাম। বুড়ি আমায় বলল, দিনের বেলা তবু কাটে, রাতে থাকতে পারি না গো। ভয় লাগে। থ্যাঁতলানো টিকটিকির মতন মেয়েটা যখন বুক পেট ঘষড়ে বিছানায় উঠে বসতে যায়, পারে না…মাগো, সে কী দেখায় তখন। চোখে দেখা যায় না। এ কাজ পারবনি করতে।
২০.
কেষ্টপদ একদিন হেসে হেসে আমায় বলল, আরে তুমিই তো আছ, বিয়ে করে ফেলো না মেয়েটাকে। পাথরের ন্যাংটো চেহারা দেখার চেয়ে এতে অনেক আরাম পাবে। …হাজার হোক মানুষের ধড়টা তো আছে রে, বাবা!
২১.
কেষ্টপদর হাসি আমার ভাল লাগেনি, তার কথা শুনে লোকটাকে চামার বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু রাত্রে শুয়ে শুয়ে আমি রাজলক্ষ্মীকে বিয়ের কথা ভাবছিলাম। কালো আলপাকার মতন অন্ধকারে চোখ খুলেও সব কিছু ভাবা যায়। ভাবতে ভাবতে আমার মনে হল, পাথরের মূর্তি আর রাজলক্ষ্মীর ধড়ের মধ্যে কোনও তফাত নেই। সুহাসিনীর মত বউ হতে ওরা পারে না।
২২.
একদিন রাজলক্ষ্মীকে কে যে হঠাৎ নিয়ে চলে গেল! কেষ্টপদ বলল, হাসপাতালে নিয়ে গেছে, সেখানেই রেখে দেবে। খাওয়াবে দু-বেলা আর কাটা-ছেঁড়া করবে। …জ্যোতিষী বলল, বয়ে গেছে হাসপাতালে নিয়ে যেতে…এ সব কার কীর্তি আমি জানি। বেওয়ারিশ মাল, ভাঙা ফুটো যাই হোক হাতের মুঠোয় পেলে কে ছাড়ে রে, বাবা!
২৩.
শশিবাবু এ বাড়িতে আর আসতেন না। শুনলাম, থিয়েটারের সিন আঁকার জন্যে নতুন বাড়ি নিয়েছেন। …আমি মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখতাম, শশিবাবুর আঁকা ভাঙা মন্দিরের মধ্যে একটা মূর্তি হাসি মুখে শুয়ে আছে। মুখটা দেখতে পেতাম না। তবু মনে হত, মুখ আছে, মূর্তি আছে…কারখানা বাড়ির সামনে ন্যাংটো মেয়ের মূর্তিটা আমরা সবাই দেখতে পাই, শশিবাবুর মন্দিরের মধ্যে মূর্তিটাকে দেখতে পাই না।
২৪.
গেঞ্জিল আর আমার ভাল লাগত না। মনে হত, আমার সমস্ত জীবন কাঠিমের সুতোর মতন একঘেয়ে হয়ে এসেছে। আমি ফুরিয়ে এসেছি। সেই কোন সকাল থেকে হেঁটে হেঁটে এখন আমার পা ধরে এসেছে, শরীর ক্লান্ত, আর হাঁটতে ইচ্ছে করে না। থিতিয়ে বসার জন্যে সর্বাঙ্গ ভেঙে যাচ্ছে। বস্তিঘরের ভাঙা খাঁটিয়া চিটচিটে বালিশ একটা লণ্ঠন আর নিজের শরীরের বিশ্রী গন্ধ ছাড়া আমার আর কিছু নেই। …একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসে নিজের বুকের ব্যথাটার কথা বলতে চাইছিলাম, কিন্তু আমার পাশে কথা শোনার মতন কেউ ছিল না; আর-একদিন বাগবাজারের গঙ্গার ঘাট থেকে উঠে আসার সময় আকাশ উতলা করে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছিল, আমি বিহ্বল হয়ে চাঁদ দেখবার জন্যে আঙুল তুলে বুঝতে পারলাম, আমার পাশে এমন কেউ নেই যে আমার আঙুলে ভোলা চাঁদ দেখবে।
২৫.
আমাদের ভোলা মুদির দোকানে একটা খাঁচা ঝুলত। খাঁচার মধ্যে মস্ত এক টিয়াপাখি। ভোলার বউ ছেলে বিয়োতে গিয়ে মরে যাবার পর ভোলা একদিন সকাল থেকে পাখিটাকে খোঁচাতে লাগল। সারাটা দিন খোঁচাল। সন্ধের আগে পাখিটা মরে গেল।
২৬.
গেঞ্জিকলের মালিক খাঁ বাবুর শালার সঙ্গে আমার কোনও শত্রুতা ছিল না। একদিন লোকটা কারখানায় এসে কী কথায় যেন হাসতে শুরু করল। আমার দিকে চেয়েই হাসছিল। আমার ভাল লাগছিল না। রাগ হচ্ছিল, ঘেন্না হচ্ছিল। খাঁ বাবুর শালার বাঁধানো দাঁতের পাটি হাসির তোড়ে খুলে গেল। সমস্ত মুখটা হঠাৎ যেন চুপসে গেল লোকটার, গাল ভেঙে গেল। শেয়ালের মতন দেখাচ্ছিল ওকে। দাঁতের পাটি কুড়িয়ে নেবার সময় খাঁ বাবুর শালার ভুড়ি থেকে কাপড়টা আলগা হয়ে খসে গেল। লোকটা নকল দাঁত, খোলা পাছা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কী জানি কেন, লোকটাকে আমার মারতে ইচ্ছে করছিল। কাপড় সামলে উঠেও যদি আবার কষে হাসতে শুরু করত, আমি ঠিক ওকে মারতাম। মাথায় তখন রক্ত চড়ে গিয়েছিল আমার। খাঁ বাবুর শালা আর হাসল না। দাঁতের নকল পাটি মুখে ফেলে চলে গেল। পরে শুনলাম, লোকটা ওইরকমই। কাঁদার সময় ও হাসে,কাঁদতে পারেনা; কান্নাটাই ওর হাসি। …কে জানে কেন, খাঁ বাবুর শালা আমার দিকে চেয়ে চেয়ে কাঁদছিল। হয়তো আমাকে দেখে, হয়তো আমায় কিছু মনে করিয়ে দিতে।
২৭.
সেদিন রাত্রে শুয়ে শুয়ে আমিও কেঁদেছিলাম। নিজের চোখের নোনতা জল জিব দিয়ে চেটেছি। বালিশ থেকে মরা মরা গন্ধ উঠছিল। ঘরের মধ্যে অন্ধকারে ইঁদুর ছুটছিল, মুড়ির ঠোঁঙাটা ফুটো হয়ে গেছে বোধহয়। সেই অন্ধকারে কে যেন আমার দিকে চেয়েছিল। হয়তো যশোদা, হয়তো…। ভোররাতে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আকাশ দেখতে পাচ্ছিলাম না; মনে হল সারারাতের অন্ধকার বস্তির খোলার চালে নিংড়ে দিয়ে আকাশ এবার শুকোতে যাবে। কোথাও কোনও শব্দ ছিল না। বস্তির নখানা ঘরের দরজা আঁট হয়েছিল। …কয়েক পা এগিয়ে এসেছি কি উত্তর দিকের ঘর খুলে গেল। শব্দ শুনলাম। কাঠের খিল খুলে কে যেন বাইরে এসেছে। চিনতে পারছিলাম না।
২৮.
সদর থেকে পা টিপে টিপে ফিরলাম। খোলা দালানে সে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। ওর শাড়ির আঁচল কাঁধের ওপর আলগা হয়ে ঝুলে ছিল, মস্ত গোল খোঁপাটা ঘাড়ের ওপর ভেঙে পড়েছে, পিঠের দিকটা যেন কলাগাছের পাতার মতন বাঁকা। আকাশের দিকে মুখ উঁচিয়ে ও হয়তো সকাল বুঝতে চাইছিল। কাক তখন ডেকে উঠেছে। ভোরের ফরসা পা বাড়িয়েছে দালানে। …আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ও আমায় ডাকল। হাত নেড়ে নয়, ডাক দিয়ে নয়, আমার দিকে ফিরে চেয়ে। ওর দুটি চোখ ঠিক যেন ভোরবেলার ঘুমভাঙা এক জোড়া পাখির মতন আমার গায়ে উড়ে এসে বসল। পা-পা করে আমি এগিয়ে গেলাম। কাছে এসে মনে হল, ওর মুখ প্রতিমার চেয়েও সুন্দর, ওর শরীর পেঁজা তুলোর মতো নরম, শিশির ভেজা মাঠের মতন ওর গা থেকে মাটির গন্ধ আসছে। আমি ওকে ছুঁতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই সকালের আলো এসে বস্তির দাওয়া ভরে গেল। আমার মনে হচ্ছিল, আকাশ থেকে আরও কিছু আসবে। মাথার ওপর চোখ তুলে একটুক্ষণ অপেক্ষা করলাম, মুখ নামিয়ে দেখি, ও চলে গেছে, দাওয়া ফাঁকা।
২৯.
গেঞ্জিকলে সেদিন অযথা ঝগড়া করলাম। কোনও কারণ ছিল না; অযথাই। গেঞ্জিকলের ঘর, কল, কাঠিম, মানুষ জন সবই আমার অসহ্য লাগছিল। আমার মনে হচ্ছিল, এই কারখানার মানুষগুলোকে খেলো রদ্দি সাইজ-মাপা গেঞ্জি করে তোলা হয়। এরা সবাই হাত পা মাথা কাটা ধড়।
৩০.
সেদিন রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম: চারপাশে শুধু গেঞ্জি উড়ছে। মেঘের তলায় এক ফোঁটা জায়গা নেই। ছোট বড় মাঝারি ঢাউস গেঞ্জিতে আকাশ ভরে গেছে।
৩১.
স্বর্ণকে আমি বলেছিলাম, শশিবাবুর কাছে সাকরেদিকরলে আমি থিয়েটারের সিন আঁকতে পারব। স্বর্ণ মাথা নেড়ে বলেছিল, না; তুমি অন্য কিছু করো। .শশিবাবুর ঠিকানা আমি জানতাম না, তবু বলেছিলাম।
৩২.
খুব গরম তখন। স্বর্ণকে বললাম, আমি ঠেলাগাড়ি করে আইসক্রিম বিক্রি করার কাজ পেতে পারি। স্বর্ণ মাথা নাড়ল, বলল, ছিঃ! আইসক্রিম বিক্রি করার ঠেলাগাড়ি কোথায় পাওয়া যায় আমি জানতাম না, তবু স্বর্ণকে বলেছিলাম।
৩৩.
বর্ষা এল। স্বর্ণ বলল, এত লোক এত কাজ পাচ্ছে, তুমি পাচ্ছ না! …আমি যে লুকিয়ে লুকিয়ে নুটবিহারী সাধুখাঁর ভেজাল তেল আর হুঁকোর তামাকের আড়তে কাজ করছিলাম স্বর্ণ জানত না।
৩৪.
পুজোর আগে আগে স্বর্ণকে বললাম, অঘ্রান মাসের পর আর দেরি সইব না। স্বর্ণ মুখ নিচু করে হাসল। বলল, বিয়ের কথা কেউ কি জোর করে বলতে পারে। কপালে থাকলে অঘ্রানেই হবে।
৩৫.
পুজোর পর সত্যিই আমি কিছু আখের গুছিয়ে নিয়েছিলাম। নুটবিহারী সাধুখাঁর ভেজাল আমার উপকার করেছিল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আড়তের মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকতাম। আমার সমস্ত শরীরে তেল ধরে গিয়েছিল, তামাক ঘেঁটে ঘেঁটে হাত কালো হয়ে গিয়েছিল। মালিক আমায় ভীষণ বিশ্বস্ত কর্মচারী মনে করত। আমি পেছোনো কালো হাত দিয়ে আমার মজুরি তুলে নিলাম।
৩৬.
গিলটি সোনার বাহারি দোকান দিয়ে বসলাম খাসা জায়গায়, একবারে মোড়ে। আমার দোকানের চারদিকে চারটে রাস্তা চলে গিয়েছিল। উত্তরে গরিব গেরস্থ পাড়া, পুবে বেশ্যাপটি, দক্ষিণে হিন্দুস্থানি আর উড়ে ঝি-চাকরদের মহল্লা। পশ্চিমের রাস্তাটা বাবুপাড়ার অন্দর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। …গিলটি গহনার দোকানে বসে আমি ভদ্রলোক হয়ে গিয়েছিলাম। কাশীর হোটেলের গাইডগিরি করার সময়ও এতটা ভদ্রলোক ছিলাম না। স্বর্ণ খুব খুশি হয়েছিল। স্বর্ণ ভদ্রলোক হওয়া ভালবাসত, তার বড় সাধ ছিল ভদ্রলোককে বিয়ে করবে।
৩৭.
একদিন আমার গিলটি সোনার দোকানের আয়নায় মাঝদুপুরে যশোদার ছায়া পড়ল। আমি চমকে উঠেছিলাম। মরা মানুষ জ্যান্ত হয় না। কোনও নকল যশোদা এসেছিল–হাত ভরে মিছরি-তোলা চুড়ি পরে চলে গেল। আমি বাজিয়ে বাজিয়ে টাকাগুলো গুণে নেবার সময় বুঝতে পেরেছিলাম আসল-নকল বোঝার ক্ষমতা আমার হয়ে গেছে।
৩৮.
শীত পড়তে স্বর্ণদের বস্তি ছেড়ে আমি উঠে এলাম। দরজিপাড়ার দিকে একখানা ঘর ভাড়া করে বাসা বাঁধলাম। জাম কাঠের তক্তপোশ, নতুন বিছানা, একটা চেয়ার, দেওয়াল-গাঁথা আলনা। স্বর্ণর জন্যে শাড়ি কিনে রাখলাম, চুল বাঁধার আয়না, নিমফলের নকশা করা ভরি দেড়েকের হার। চিনে সিঁদুরও কিনেছিলাম এক পাতা।
৩৯.
পৌষ মাসে স্বর্ণ তার বাবার সঙ্গে দেশে গেল, বারাসতে। বিয়ের আগে দেশ বাড়ি ঘুরে আসতে গেল একবার। মাঘের প্রথমে বিয়ে। স্বর্ণর জন্যে নতুন তুলোর সুন্দর এক লেপ করিয়ে রাখলাম। ওপরের কাপড়টায় মস্ত এক পদ্ম; যেন লাল শালুর পুকুরে পদ্মটা পুরোপুরি ফুটে উঠেছে। আমার মনে হত, পদ্মটা স্বর্ণর মুখ।
৪০.
মাঘ মাস পড়ল। স্বর্ণদের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই স্বর্ণর বাবা বলল, এই যে ফটিক, তুমি এসেছ। এসো, ঘরে এসে বসো। ঘরে কোথাও স্বর্ণ ছিল না। স্বর্ণর একটা শাড়ি সায়া মাথার চুলের ফিতে কিচ্ছু । ঘরটা খাঁ খাঁ করছিল। স্বর্ণর বাবা নীলকণ্ঠের দোকান থেকে ছোট ছোট গ্লাসে দু গ্লাস চা নিয়ে এল। আমার দিকে একটা গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল, কড়া শীত হে, নাও গরম গরম খেয়ে নাও। ..স্বর্ণর বাবা বুঝতে পারছিল না, আমার শরীর তার মতন বুড়ো হয়ে যায়নি, আমার রক্ত এই মাঘের শীত পাবে বলে কতদিন ধরে ভেতরে ভেতরে নিজেকে গরম করে নিয়েছে। স্বর্ণর বাবা বুঝতে পারছিল না, আমার তেষ্টা নীলকণ্ঠর দুর্গন্ধ চায়ে মিটবে না। সব তেষ্টা এক রকম নয়।
৪১.
স্বর্ণকে তার বাবা খাঁটি সোনার দোকানের মালিকের হাতেই তুলে গিয়েছে। স্বর্ণ জানে, খাঁটি সোনার মালিক গিলটি সোনার মালিকের চেয়ে অনেক বেশি ভদ্রলোক।
৪২.
সেদিন ভীষণ শীতে পদ্ম আঁকা সেই নরম নতুন তুলোর মধ্যে শুয়ে শুয়ে আমি কারখানা ঘরের ন্যাংটা মেয়েটার কথাই ভাবছিলাম। এই জগৎটাই আজব, পাথর আর মানুষের ধড়ের মধ্যে তফাতটা গায়ে গায়ে, তলায় তলায় নয়। লেপের শালুর পুকুরে ডুবে যেতে যেতে আমার মনে হল, স্বর্ণর চেয়েও সুন্দর মেয়েছেলে বেশ্যাপাড়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে। হয়তো স্বর্ণকেই পাওয়া যেতে পারে। …আমি লেপ ছুঁড়ে ফেলে উঠে বসতে গেলাম। পারলাম না। আমার জ্বর এসেছে। সেই অদ্ভুত পুরনো জ্বর।
.
সাত
০১.
সেবারে শীত ভাঙতে তর সইল না। ফাল্গুন মাসেই রোদ ভীষণ চড়ে উঠল, গরম পড়ল হাঁসফাঁসিয়ে। আমার বাড়ির সামনে হাড়গিলে নোংরা রাস্তাটা চওড়া করা হচ্ছিল। নুড়ি পাথরের ঢিবি জমল চারপাশে, বাতাসে আলকাতরার পোড়া পোড়া গন্ধ, রোলার গাড়ির দশ বিশ মণি পাথরটা সব কিছু পিষে ফেলছে। মরা শুকনো নুলো গাছটাকে ওরা কুপিয়ে কাটল, রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলল।
করপোরেশনের মালটানা লরির ওপর চাপিয়ে যখন পাচার করছে আমি অবাক হয়ে দেখলাম, মরা কোপানো গাছটার সব চেয়ে পলকা ছোট ভোঁতা ডালে দুটি সবুজ কচি পাতা। খোলা লরিটা চলে যাচ্ছিল, ধড়কাটা মরা গাছটার একটা ডাল মাটিতে লুটিয়ে ঘষটে ঘষটে যাচ্ছে, ধুলো উড়ছে; মনে হচ্ছিল, বুড়ো কঙ্কালসার একটা হাত বাড়িয়ে গাছটা যেন তার পুরনো মাটি আঁকড়ে থাকতে চাইছে প্রাণপণে। কচি সবুজ দুটি পাতার দিকে চেয়ে চেয়ে আমি ভাবছিলাম, গাছটা মরতে চায়নি, অনেক কষ্ট করে অনেক দিন ধরে ওর মরা গায়ে দুটি নতুন পাতা জাগিয়েছিল। কেউ দেখল না।
০২.
গিলটি সোনার দোকানটা বেচতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত বেচা হল না। আরও ছটা মাস নকল সোনার কারবার চলল। আস্তে আস্তে আবার মন কখন মুষড়ে পড়ল। কিছু আর ভাল লাগত না, না দোকান না বাসা। কলকাতা শহর আমার ভেতরটা ফাঁপা ভোঁতা করে দিয়েছিল। আমি অন্য কোথাও পালিয়ে যাবার কথা ভাবতাম, কোনও ছোটখাটো মফস্বল শহর কিংবা গাঁ-গ্রামে।
০৩.
একদিন আমি মাঠ, গাছ আর নদীর স্বপ্ন দেখলাম। সে মাঠের শেষ ছিল না, মাঠের পর মাঠ, ধু ধু করছে। কখন যেন সেই মাঠও ফুরিয়ে গেল, তখন শুধু গাছ। কী গাছ কে জানে! গাছগুলো ঠায় দাঁড়িয়েছিল, একটা পাতাও কোথাও কাঁপছিল না। সব কেমন চুপচাপ। তারপর গাছও সরে গেল, তখন নদী। নদী ভরা জল। কল কল করে শুধু জল বইছে।
০৪.
আমার বাসাবাড়ির উলটো দিকে এক অন্ধ ছোকরা থাকত। একদিন মাঝরাতে লোকটা পাগল হয়ে গেল। পাগল হয়ে যাবার আগে সে বারান্দায় এসেভীষণ চেঁচামেচি শুরু করেছিল। আমি তার চেঁচানি শুনেছি। লোকটা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পাড়ার লোকের ঘুম ছুটিয়ে দিচ্ছিল আর বলছিল, তার চোখ খুলে গেছে, সে দেখতে পাচ্ছে।
০৫.
দোকানটা বেচার জন্যে আমি মরীয়া হয়ে উঠেছিলাম। খদ্দের জুটছিল না। একদিন চালু দোকানটার দিকে অনেকেই চোখ দিত, এখন আর কেউ ফিরে তাকায় না। গিলটি সোনার দোকান পুরনো হয়ে বুঝি আসল চেহারা নিয়েছিল: ভাঙা আয়না, কাঁচ-ফাটা শো-কেস, পা-মচকানো চেয়ার, ধুলো-সমস্ত দোকানটাই ম্যাড়ম্যাড় করত। খদ্দের আর বড় একটা আসত না।
০৬.
সেদিন সন্ধের ঝোঁকে এক খদ্দের এসে হাজির। আমার দোকানে ঝকঝকে গয়না একটাও ছিল না। সময়ে পেলে ম্যাড়ম্যাড়ে কালচে গয়নাগুলোতে পালিশ তুলে দিতে পারতাম। লোকটা বসতেও চায় না। বিশ পঁচিশ টাকার বেচা-কেনা বরবাদ হয়ে যায় দেখে আমি বললাম, বাড়ির ঠিকানা দিলে কাল ভোরে পৌঁছে দেব। কী ভেবে লোকটা হঠাৎ বলল, কাল সে আসবে, দুপুরে। …পুরো এক সেট মেয়েদের গয়না বেছে দিয়ে লোকটা চলে গেল। বারোগাছা চুড়ি, হার, আঁটি আর পালিশের মাল মশলা নিয়ে আমি বসে পড়লাম।
০৭.
পরের দিন দুপুরে লোকটা এল না। বিকেল হয়ে গেল, আশা ছেড়ে দিলাম। অযথা কাল রাত পর্যন্ত বসে বসে বোকার মতন অচল গয়নাগুলোর পেছনে খেটেছি। অন্য কোথাও থেকে গয়নাগুলো সে কিনে নিয়েছে। লোকটার ওপর নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল। পালিশ করা গয়নাগুলোর দিকে তাকাচ্ছিলাম আর পায়ের শব্দ গুণছিলাম নোকটার, যদি আসে–এসে পড়ে…..
০৮.
লোকটা আর এল না। অথচ ওই রকম বিকেল-ভাঙো-ভাঙো মুখে পরের দিন এক জোড়া মেয়ে দোকানে এসে উঠল। আমার দোকানে তখনও বাতি জ্বলেনি। বাতিটা জ্বালিয়ে দিলাম। একটি মেয়ের মাথায় ঘোমটা ছিল, সিঁথিতে সিঁদুর ছিল, হাতে শাঁখা, ব্রোঞ্জের পাতলা কলঙ্ক-ওঠা দুগাছা করে চুড়ি, গলায় গিলটির হার। অন্য মেয়েটির গলা খালি, হাতে কাচের লাল চুড়ি কগাছা করে, মাথার বাঁ পাশ ঘেঁষে সাদা সিঁথি। মেয়েটা লাজুক, নিরীহ, তার ফরসা মুখে বসন্তের দাগ। …বউ মেয়েটি গয়না দেখতে চাইল। আইবুড়ো মেয়েটি মাঝে মাঝে আয়নার দিকে তাকাচ্ছিল আর আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাস্তার দিকে ঘাড় ঘোরাচ্ছিল। ..সদ্য সদ্য পালিশ-তোলা গয়নাগুলো ওদের সামনে ধরে দিলাম। বউ মেয়েটির চোখে লেগে গেল। সঙ্গের মেয়েটির গলায় হারটা পরিয়ে দিয়ে পরখ করে দেখতে লাগল। আমার দিকে ফিরে আচমকা শুধোল, মানিয়েছেনা? আমি দোকানদার, আমার সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলা উচিত ছিল, চমৎকার মানিয়েছে; কিন্তু বলতে গিয়েও কথাটা মুখে এল না। মেয়েটির গলা সরু, লম্বা ধরনের অথচ হাড়গিলে নয়, নিটোল; বুকটা রোগাটে হলেও কলাপাতার মতন ছড়ানো। হারটা ওর গলায় ঠিক মানাচ্ছিল না। আমি মাথা নাড়লাম, নিজের লোকসানের কথাটা খচখচ করে উঠছিল, তবু মাথা নেড়ে বললাম, হারটা মানায়নি৷…বউ মেয়েটি যেন আমার সঙ্গে তামাশা করে বলল, যা মানাবে তবে তাই একটা দেখি। .দেখানোর মতন হার আমার দোকানে ছিল না, দোকানের আর সব গয়নাই ম্যাড়ম্যাড় করছে। যে-হারের জলুস নেই সে-হার দেখিয়ে কী করব। …হার বেচার আশা ছেড়ে দিয়ে আমি পালিশ তোলা চুড়িগুলো ওদের দিকে ঠেলে দিলাম। বউ মেয়েটি চুড়ির গোছ মুঠোয় তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল; দেখতে দেখতেই বলল, এ ওর হাতে বড় হবে…দেখ তো, কুমু… মেয়েটির দিকে চুড়ি ঠেলে দিয়ে ও আমার দিকে তাকাল, কই হার কই? ..খোলাখুলি বলতে হল অগত্যা:হার আছে, তবেনষ্ট হয়ে আছে, ভাল লাগবে না দেখতে। …বউ মেয়েটি ঠেটি কেটে হাসল, বলল, হিরে জহরত গিনি সোনার দোকানে এসেছি নাকি, গিলটির আবার ভাল মন্দ, দেখি কী আছে। কুমু চুড়ি দেখছিল, অল্প একটু চোখ তুলে আমায় দেখল।
০৯.
চুড়ির গোছ নিয়ে গেল ওরা। দর দাম করে ছটাকার এক পয়সা বেশি দিল না। পরের দিন হার নিতে আসবে বলে চলে গেল। আমি কথা দিয়েছিলাম পরের দিন কুমুর গলার মানানসই হার এনে রেখে দেব।
১০.
সেই লোকটার মতন কুমুও আসবে না জানতাম। তবু ওর জন্যে হার বেছে পালিশ তুলে রেখেছিলাম। কুমু এল। একা। হারটা ওকে মানিয়েছিল খুব। আয়নায় নিজের গলা দেখে কুমুর চোখে খুশির ফুল ফুটল। ওর সরল সহজ খুশি দেখে আমার মন খুঁত খুঁত করছিল। হারের জলুসটা কদিন পরেই চলে যাবে, তখন তো কুমু হাসবে না। বলি কি নাবলি করে শেষ পর্যন্ত বললাম, পালিশটা বেশি দিন থাকবে না…। কুমু চোখ ফিরিয়ে তাকাল। তার চোখের পাতা ক্ষণে ক্ষণে পড়ে। ছোট ছোট নরম চোখ, যেন ভাল করে তাকাতে কষ্ট পায়। কুমু গলার কাছে হাত তুলে হার ছুঁল, একটু মাথা হেলিয়ে বলল, জানি; আমি বেশি পরব না।
১১.
কুমুর পুরো নাম কুমুদিনী। বউ মেয়েটি ওর বউদি, নাম বিন্দু। সরখেল লেনের গলিতে ওরা থাকে। বাইশ নম্বর বাড়ি। বাড়িটা বোধহয় এক সময় আস্তাবল ছিল। এখন দু পরিবারের। দালানে পুরু শ্যাওলা আর আস্তাকুঁড়। ঘরের ভেতর বাইরে শুধু খামচা খামচা ইট, কালচে রং ধরে গেছে। কুমুদের কুঠরিটা দক্ষিণ কোণে। ঘরের সামনে আধভাঙা একটা কড়িকাঠ মাথার ওপর ঝুলে রয়েছে। কুমুর দাদা অনাদিবাবু পোস্টাফিসে পিয়নের চাকরি করে। বিন্দু ঘরে বসে ডজন দরে বাচ্চাদের ইজের কেটে দেয় দরজিদের। বিন্দুর নিজের দুটো বাচ্চা।
১২.
ওবাড়ির সঙ্গে আমার ভাব হয়ে গিয়েছিল। বিন্দু বউদি ঠোঁটকাটা কিন্তু বেশ রগুড়ে মানুষ। আমায় বলত, দোকানি ঠাকুরপো৷ বিন্দু বউদিরা ভদ্র ভাল-ঘরের মেয়ে ছিল, অবস্থা পড়ে পড়ে যখন ভিখিরি তখন অনাদিদার সঙ্গে বিয়ে হয়। বিন্দু বউদি বলত, আমার মাথার ওপর চার বোন, বাবা বড় দুজনকে তবু সোনা ছুঁইয়ে বিয়ে দিতে পেরেছিল, আমাদের দুজনের বেলায় শুধু শাঁখা, নয়তো পোস্টাফিসের পিয়নকে বিয়ে করতে বয়ে গেছল আমার! .অনাদিদা কথাগুলো শুনত, মনে হত মনে মনে হাসছে। কিন্তু মুখে একদিনও এক চিলতে হাসি ফুটতে দেখিনি। অনাদিদা বড় ভালমানুষ, বড় ভাল।
১৩.
বিন্দু বউদির মুখেই শুনেছিলুম, কুমুর এক জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে যায়, অনাদিদার চেনাশোনা ছেলে, পোস্টাফিসের লাল গাড়ি চালাত। বিয়ে করব বলে মত দিয়ে শেষ পর্যন্ত বেঁকে বসল, মেয়ের মুখে অত খাবলা খাবলা গর্ত, বাড়িতে মত হচ্ছে না। বিন্দু বউদি বলেছিল, বিয়ে লাগবে বলেই না তোমার দোকানে গিয়েছিলাম গো, দোকানি ঠাকুরপো, ওই একটু গলা হাত সাজিয়ে ননদ পার করব, তা সে ভাগ্যে হল না। ..কথাটা শুনে আমি মনমরা হয়ে গিয়েছিলাম।
১৪.
কুমু গিলটির চুড়ি হার পরত না। তার ভাঙা বাক্সে তুলে রেখে দিয়েছিল বোধহয়। তার হাতে কাচের লাল চুড়ি থাকত দুগাছা করে।
১৫.
দোকানটা সেবারে শীতের সময় বেচে দিলাম। বিন্দু বউদি শুনে বলল, আহা-হা করলে কী ঠাকুরপো, তোমার মাথায় কি ভূত চেপেছিল…দোকানটা বেচে দিলে? অনাদিদা ছেলেকে ভাঙা শ্লেটে অঙ্ক শেখাচ্ছিল, বলল, তোমরা ছেলে-ছোকরারা সব রকম ভেবেচিন্তে কাজ করো না। …বেশ তো, গয়নার দোকান চলছিল না–ওখানে একটা চুল কাটার সেলুন করলে পারতে। …কলকাতার অলিতে-গলিতে আজকাল নানান রকমের চুল কাটার সেলুন হচ্ছে, খুব চালু ব্যবসা…চুল না কেটে দাড়ি গোঁফ না কামিয়ে পুরুষ মানুষের চলে না। বিন্দু বউদি স্বামীকে ধমক দিয়ে বলল, অত বুদ্ধি তো নিজেই কেন চিঠির থলির সঙ্গে নাপিতদের মতন একটা বাক্স আর এক শিশি জল নিয়ে বেরোও না, তবু কিছু আয় হয়।
১৬.
কুমু কিছু বলল না। কলাইয়ের বাটিতে করে যখন চা দিচ্ছিল কুমু, তার চোখের দিকে ঠাওর করে চেয়ে থাকলাম। মনে হল, দোকানে হার পরার পর আমার কথা শুনে যে ভাবে চোখ তুলে তাকিয়ে বলেছিল, জানি–ঠিক সেই ভাবে যেন চোখ দিয়ে বলেছে, দোকান তুমি বেচে দেবে আমি জানি।
১৭.
বিন্দু বউদি দিন কয় পরে পরে একদিন শুধোল, কী করবে এবার তুমি, ঠাকুরপো? কী করব জানতাম না, আমি ভেবেও ঠিক করতে পারি না কিছু। বললাম, কলকাতায় আর থাকব না। বিন্দু বউদি আকাশ থেকে পড়ল যেন, অবাক হয়ে শুধোল, তোমার কি বাড়ি আছে? একটু বুঝি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, তারপর সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলাম, আছে। বিন্দু বউদি শুধোল, কোথায়? …কোথায়? কোথায় আমার দেশ বাড়ি? কোন নামটা বলব? আমার ছোটবেলার শহরের নাম বলতে পারি, ময়না আমায় ঠাঁই দিয়েছিল যেখানে সেখানকার কথাও বলতে পারি, সেই শহরটার কথা, কলমিদের গাঁয়ের নাম, যশোদার বাড়ি ছিল যেখানে সেই জায়গাটার নাম আমি আরও অগুনতি নামের যে কোনও একটার কথা বলতে পারি। বিড়ি ধরাবার অছিলায় খানিকটা সময় নিয়ে বললাম, কাশী, কাশীতে মাথা গোঁজার মতন একটা জায়গা আছে। কথাটা বলে আমি এমন হাসি হাসি মুখ করলাম, যেন কত বিনয় করে বলেছি কথাটা। বিন্দু বউদির চোখের পলক পড়ছিল না। কাশী নামটা কানেই শুনেছে বউদি, দেখেনি কোনওদিন। আমি কাশীর লোক জেনে চোখ ভরে আমায় দেখল; শেষে মনভরা গলায় বলল, তোমার মা বাবা বুঝি কাশীতেই থাকেন? বিড়িতে জোর এক টান দিয়ে কাশতে কাশতে বললাম, হ্যাঁ, সবাই কাশীতে।
১৮.
আমারই দোকানের সেই পুরনো গিলটি গয়না কুমুর গলায় হাতে পরিয়ে দিয়ে বিন্দু বউদিরা আমার সঙ্গে কুমুর বিয়ে দিল। সেটা মাঘ মাস। বিয়ের দিন খুব শীত পড়েছিল। স্বর্ণর জন্যে তৈরি করানো লেপটা দিয়ে পরের দিন কুমুকে ঢেকে দিয়েছিলাম। লেপটা ময়লা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু লাল শালুর ওপর পদ্মফুলের নকশাটা নষ্ট হয়ে যায়নি। স্বর্ণর শাড়ি কুমুকে দিয়েছিলাম। কুমু জানল ও শাড়ি তার জন্যেই আমি কিনে রেখেছি আগেভাগে। স্বর্ণর হারটা বেচে না দিলে কুমুকেই দিতাম। হারটা অনেক আগেই বেচা হয়ে গিয়েছিল।
১৯.
বিন্দু বউদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেদিন রেলগাড়িতে চাপলাম সেদিন বিন্দু বউদি বলেছিল, মেয়েটা বড় চাপা, ওর মন আর পাথরে চাপা জল দুইই সমান, একটু বুঝেসুঝে তোমার মনের মতন করে নিয়ো; তুমি যে স্বামী।
২০.
কাশীর ট্রেনে চেপে বসলেও আমি কাশী যাচ্ছিলাম না। কোথায় যাচ্ছিলাম, তাও জানি না। কুমু আমার পাশে চুপ করে বসেছিল। আমাদের পায়ের তলায় একটা বাক্স, মাথার ওপর পুঁটলি। বিছানাটা আধ খোলা করে বলেছিলাম দুজনে। রাত্রে গাড়ি ছেড়েছিল, মেল গাড়ি। বাইরে ফ্যাকাশে জ্যোৎস্না। গাড়িটা সিটি মারতে মারতে হাওয়ার বেগে আমাদের কাশীতে নিয়ে যাচ্ছিল।
২১.
কুমু জানলায় মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। ঘুমোচ্ছিল বোধহয়। আমার চোখে ঘুম ছিল না। কী করব, কোথায় গিয়ে নামব, কোনখানে গিয়ে উঠব কিছুই ঠিক করতে পারছিলাম না। কুমু জানে সে তার স্বামীর বাড়ি যাচ্ছে, কাশীতে। কী করে কমুকে সত্যি কথাটা বলব তাও ভেবে পাচ্ছিলাম না। কুমু আমায় ঠক ভাববে, কিন্তু কুমু তো বুঝবে না, ওদের না ঠকালে আমি কিছুতেই কুমুকে বিয়ে করতে পারতাম না।
২২.
কী একটা বড় স্টেশনে গাড়ি থামতে কুমুকে ঠেলা দিলাম। কুমু জেগে উঠল। শুধোলাম, চা খাবে? কুমু মাথা নাড়ল। খুরি করে চা নিয়ে কুমুকে দিলাম। ভয়ংকর শীত! চা খেতে খেতে সেই হলুদ আলোয় কুমুকে দেখছিলাম। গাড়িটা ঘুমিয়ে পড়েছে, অসাড় অসাড় ভাব। ছুটন্ত চাকার শব্দ মাঝে মাঝে বাতাসের চাবুকের মতন শোনাচ্ছিল। কে যেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হেঁপো রুগির মতন কাশছিল। একটা হিন্দুস্থানি বউ তার স্বামীর পায়ের কাছে পুঁটলির মতন পড়েছিল। থেকে থেকে তার স্বামীর পায়ের ঠেলা তার মাথায় মুখে নাকে লাগছিল, বউটা তবু ঘুমোচ্ছিল। …বিড়ি ধরিয়ে টানছিলাম আমি, বন্ধ জানলার কাঁচে জলের দাগের মতন কুমুর ছায়া দেখা যাচ্ছিল, ছায়াটা গাড়ির তালে তালে দুলছিল। মনে হচ্ছিল, কুমুর ছায়াটা কলকাতায় যাচ্ছে, কুমু কাশীতে।
২৩.
শেষরাতে হঠাৎ ঠেলে ঠুলে জাগিয়ে দিলাম কুমুকে। জিনিসপত্র টানাটানি করছি দেখে কুমু শুধোল, কাশী এসে গেছে? কোনও জবাব দিলাম না। কুমুকে নিয়ে নেমে পড়লাম। শীতের শেষরাতের স্টেশন, লোক প্রায় নেই। কনকনে ঠাণ্ডা। হাত পা মুখ জমে যাচ্ছিল শীতে। কুমুঠক ঠক করে কাঁপছিল।
২৪.
মুশাফিরখানায় সবাই তাল পাকিয়ে বাক্স পোঁটলা আগলে ঘুমোচ্ছ। জায়গাটা ঢাকা। বাইরের কনকনানি অতটা নেই। চায়ের দোকানে উনুনটা জ্বলছিল। মাথা কান বেঁধে কম্বলে গা ঢেকে একটা লোক দোকানের টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। …আমরা একটা কোণ বেছে নিয়ে বসলাম। কুমু তখনও কাঁপছিল। আমার গায়ের গরম চাদরটা তার গায়ে জড়িয়ে দিলাম।
২৫.
আগুন গরম চা। কুমুর জিব পুড়ে গেল। আমার খুব আরাম হচ্ছিল। ভোর হয়ে আসছে। বাইরে ফরসা যত বাড়ছিল ততই যেন মাঘের শীত কামড়ে ধরছিল। শীতে না ভয়ে–আমি কেন কাঁপছিলাম কে জানে। ঘুমন্ত লোকগুলো একে একে জেগে উঠছিল।
২৬.
রোদ উঠল। কুমুকে বললাম, আমরা ভুল করে অন্য গাড়িতে উঠেছিলাম। কাশীর গাড়িতে নয়। মাঝপথে টিকিটবাবুরা নামিয়ে দিয়েছে। …কুমু কিছু বলল না।
২৭.
মুশাফিরখানার বাইরে আসতে আমি চমকে উঠলাম। কাল শেষ রাতে শীতে আমি বুঝতে পারিনি, কোথায় এসে নেমেছি। এখন বুঝলাম। এই শহর আমার ছেলেবেলার শহর–এই শহরে চাঁপারানি ছিল, শ্যামলালবাবু ছিল, মুশাফিরখানায় চায়ের দোকানে পার্বতী ছিল। স্টেশনের ভেতরে বাইরে এত বদলে গেছে যে চেনার কোনও উপায় ছিল না। …কুমুকে বললাম এখানে একটা দিন থেকে যাই, কাল আবার কাশীর গাড়ি ধরব। …কুমু কিছু বলল না।
২৮.
শহরটা বদলে গেছে। চাঁপারানিদের বাড়ির সেই গলিটা আছে, বাড়ি নেই। কালাচাঁদের হোটেল কবে উঠে গেছে। চাবাবুর দোকানটা খুঁজে পেলাম না। মাড়োয়ারিদের ধর্মশালাটা ছিল। সেখানেই উঠলাম।
২৯.
ধর্মশালার ঘরটায় জানলা ছিল না। দরজাটা নড়বড়ে। রাত্রে মোমবাতি জ্বালিয়ে কুমুর মুখোমুখি বসেছিলাম। আজ আর কুমু কাঁপছিল না। বিছানার ওপর পায়ে লেপ চাপা দিয়ে বসেছিল। শালপাতার এঁটো ঠোঙা পড়ে আছে এক দিকে, জলের কুঁজোটার মুণ্ড ভেঙে গেছে। একটা পোকা ফর ফর করে উড়ছিল। কুমুর মুখের বসন্তের দাগগুলো চন্দনের শুকনো ফোঁটার মতন দেখাচ্ছিল। ওর হাতে সেই চুড়ি সেই হার। মাথায় খোঁপা ছিল না। …আমার মন খুশিতে আনন্দে ভরে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল, কুমুর সঙ্গে আমার কত কাল আগে যেন বিয়ে হয়েছে।
৩০.
আমার কথা কুমুকে বললাম। কুমু শুনল। একটিবারের জন্যেও মুখ খুলল না। সব কথা বলা হয়ে গেলে আমার হঠাৎ মনে হল, কাশীর গাড়ি কাশীতে পৌঁছে গেছে। …কুমু আমার দিকে শেষ পর্যন্ত একটুক্ষণ চেয়ে ছিল। তার চোখ বলছিল, জানি, আমি সব জানি।
৩১.
লেপের তলায় কুমুকে আমি দু হাতে এমন করে জড়িয়ে শুয়েছিলাম যে এক সময় আমারই মনে হল, ওকে আমি আগলে রেখেছি প্রাণপণে। হয়তো কুমুর ব্যথা লাগছিল, তবু একটিবারও কুমু নড়ল না, আমার হাত সরিয়ে দিল না। মুখ ফুটে একটুও শব্দ বেরুল না ওর। ও যেন বোবা।
৩২.
কুমুকে আমার বোবাই মনে হত। আমার কোনও কাজে সে হাঁনা করত না। …বাজারের মধ্যে সেই চাঁপারানিদের গলির কাছাকাছি একটা এক-খুপরির বাসা ভাড়া করেছিলাম, সবজিবাজারে আলুর দোকান দিয়ে বসেছিলাম। কুমু কিছু বলত না। কুমু সারাদিন কাজ করত, ঘর ঝাঁট দিত, কয়লা ভাঙত, উনুন ধরাত, রান্না করত, বাসন মাজত আর রাত্রে বিছানা পাতত শোবার।
৩৩.
গরম পড়তে আলু পচতে শুরু করল। আমার বাসা-ঘরের মেঝেতে কুমু বস্তা থেকে আলু ঢেলে ছড়িয়ে রাখত, পচা আলু আলাদা করত। সমস্ত ঘরটা পচা আলুর গন্ধে ভেপসে থাকত। রাতে শুয়ে শুয়ে মনে হত আমি কুমু আমরাও একদিন পচে যাব।
৩৪.
একদিন কুমু ভীষণ বমি করতে শুরু করল। তারপর থেকে প্রায় রোজই খাওয়ার পর কুমু নর্দমার কাছে ছুটে যেতবমি করত।
৩৫.
কুমুর চেহারাটা বর্ষার জলে হঠাৎ কেমন সুন্দর হতে শুরু করল। মুখ ভরে গেল, গা ভরে গেল, পা হাত ফরসা হয়ে উঠল। কুমুর চোখের নীচে একটু কালি কালি দাগ ধরল, বুক পুরন্ত হয়ে উঠল।
৩৬.
পুজোর সময় কুমুকে সুন্দর শাড়ি জামা কিনে দিয়েছিলাম, ওকে নিয়ে ঠাকুর দেখিয়ে বেড়াতাম। বেশি হাঁটতে পারত না কুমু। ওর কষ্ট হত। মুখ ফুটে তবু বলত না।
৩৭.
একদিন বাজার থেকে দুপুরে বাড়ি ফিরে দেখি কুমু কার্তিকের রোদে দাওয়ায় বসে আছে। তার পায়ের কাছে পেটমোটা একটা বেড়াল। কুমুর পা আঁচড়াচ্ছিল বেড়ালটা। আমায় দেখে কুমু বেড়ালটাকে হাতে করে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। কুমুর হাতে শাঁখা আর কাচের চুড়ি।
৩৮.
সবজিবাজারে আমার আলুর ব্যবসা ফেঁপে উঠছিল। আমি ভাবছিলাম বাজারে দোকান পেতে না বসে আলু চালান আর আড়ত নিয়ে বসবা…কুমুর পয়ে আমার ভাগ্য পালটে যাচ্ছে। কুমুর পেটে যে আসছে তার পয়ে। কুমুকে আমার আরও ভালবাসতে ইচ্ছে করত।
৩৯.
কুমু ভালবাসা বোঝে কি বোঝে না আমি ভেবে পেতাম না। ওর খুশি বলে কিছু দেখিনি, আহ্লাদ বলে মুখে কিছু ফুটত না। সমস্ত মুখটা কাঁচড়ার পুতুলের মতন। হাসি না, কান্না না, কথা না। বিন্দু বউদির কথা মনে হত: ও বড় চাপা মেয়ে, সহজে মন বোঝা যায় না; পাথর চাপা জলের মতন। …কুমুর মন আমি সত্যিই বুঝতে পারতাম না। মনে হত, ওর মন নেই; কিংবা মনটাও মুখের মতন বোবা।
৪০.
তখন পৌষ মাস। একদিন সকালে কুমু কাঁদছিল। ঘুম ভাঙলে উঠে বসে দেখলাম কুমু মুখে কাপড় পুরে কাঁদছে। তার মুখ যন্ত্রণায় নীলচে হয়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছিল ওর সমস্ত মুখটায় বুঝি এখুনি কালশিরে পড়ে যাবে। ..পাশের বাসার বউ বলল, প্রসব ব্যথা। আমি দাই ডাকতে লালাবাবুর কুঠির দিকে ছুটলাম। মন্দা দাই ছিল না। কে যেন বললে, কাঠগোলার দিকে দাই মাসি আছে, খুব ভাল, তাকে নিয়ে যাও।
৪১.
কাঠগোলার কাছে একটা কুয়ো। মুখোমুখি দাই মাসির বাড়ি। ডাগর মতন ফরসা একটা মেয়ে কুয়ো থেকে জল তুলছিল। চাকার শব্দ হচ্ছিল। দাই মাসির দরজা হাট করে খোলা। ডাকাডাকি করতে মেয়েটাই এগিয়ে এল। বলল, তার মা এখনও ঘুমোচ্ছ।
৪২.
ঘুম ভাঙা চোখ কচলাতে কচলাতে যে এল তাকে দেখে আমি চিনতে পারলাম। চমকে উঠলাম। মুখ থেকে কথা খসছিল না। চাঁপারানি–সেই চাঁপারানি, আমি যাকে ছেলেবেলায় মনে মনে মা বলতাম। চাঁপারানি আমায় চিনতে পারল না।
৪৩.
কুমু সারাটা বেলা কাটা কই মাছের মতো ছটফট করল, কাতরাল, কাঁদল। বিকেল নাগাদ তার ছেলে হল। চাঁপারানির পায়ে আমার গড় হয়ে প্রণাম করতে ইচ্ছে করছিল।
৪৪.
ছেলেটার চোখ হল না। সবাই বলল, ফুটবে–পাতা জুড়ে আছে তাই অমন জোড়া জোড়া দেখায়।
৪৫.
ছেলেটার গায়ের নীলচে ভাবটা গেল না। সবাই বলত মায়ের নাড়ি ময়লা ছিল তাই অমন হয়েছে, আর একটু বড় হলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
৪৬.
ছেলেটার গা ভর্তি লোম, মাথাটা বড়, ঠ্যাংগুলো বাঁকা বাঁকা।
৪৭.
কুমু জীবনে এক দিনই কেঁদেছিল–সেই প্রসবের দিন; আর কাঁদত না। কাঁদত না, হাসত না, কিছু বলত না। ছেলেকে কোলে করে বসে থাকার সময় তার চোখ ছেলেটাকে এক নজরে দেখত, আর দৃষ্টিটা যেন বলত, এমন হবে আমি জানতাম।
৪৮.
আমার অসহ্য লাগত। অন্ধ, ময়লা, লোমওলা, কদাকার ওই ছেলেটাকে দেখলে সমস্ত শরীর ঘিন ঘিন করতে উঠত। মানুষ না বাঁদর কীসের বাচ্চা ওটা বুঝতে পারতাম না। রাগে যন্ত্রণায় ছটফট করতাম, কুমুকে গালাগাল দিতাম। ওর নাড়িতে এত ময়লা কেন ছিল! কেন! একদিন কুমুকে মেরেছিলাম। কুমু আমার ভাত খাওয়ার সময় বাচ্চাটাকে কোলে করে কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল; বাচ্চাটা কাকের ছানার মন চেঁচাচ্ছিল।
৪৯.
আস্তে আস্তে বাসায় আসা আমার বন্ধ হয়ে গেল প্রায়। দুপুরে ভাত খেতে আসতাম একবার। রাত্রে আসতাম না প্রায় দিনই, কোনও কোনওদিন আসতাম, গলা পর্যন্ত মদ গিলে। কুমুকে কুমুর বাচ্চাকে নেশার চোখে দেখতে পেতাম না, বাচ্চার কান্নাটা আমার সেই মরা ঘুম ভাঙাতে পারত না।
৫০.
জগতে হাজার হাজার মানুষের ছেলে জন্মায় মানুষের মতো চেহারা নিয়ে, আমার ছেলে কেন অমন হল? আমি হাজার ভেবেও বুঝতে পারতাম না, কুমুর পেটে একটা জানোয়ার কী করে এল, কুমুর নাড়িকে কে ময়লা করল!
৫১.একদিন জানোয়ারটার মুখে কথা ফুটল। কুমুকে জড়ানো স্বরে মা মা বলছিল। তখন বাইরে ভয়ংকর বৃষ্টি। আমি ঘরে আটকা পড়ে বসেছিলাম। ঘরের চৌকাঠের কাছে কাত হয়ে পড়েছিল ছেলেটা। ওটা ঠিক মতন বসতে পারে না, অপলকা পায়ে দাঁড়াতেও পারে না। জন্তুর মতন মেঝেতে পড়ে পড়ে ছেলেটা মা মা করছিল। …আমার হঠাৎ ইচ্ছে হল, ছেলেটার গলা টিপে মেরে ফেলি। কুমু বাসন মাজতে বসেছে, বাইরে তুমুল বৃষ্টি, কেউ কিছু জানতে পারবে না।
৫২.
কুমুর ছেলের জ্বর হল ধ্ব। আমি বাসায় থাকতাম না। বাজারের মানিকলাল আমায় একটা আস্তানা জোগাড় করে দিয়েছিল। কালী মন্দিরের গলিতে সেই আস্তানায় আমি ভূতের মতন বেঁচেছিলাম। সকালে উঠে বাজারে আলুর আড়তে যেতাম, দুপুরে জগুবাবুর হোটেলে ভাত খেতাম, বিকেলে আড়তের দরজায় তালা ঝুলিয়ে খাঁ খাঁমনে এদিকে সেদিকে ঘুরতাম, চা বিড়ি পান খেতাম, সন্ধের ঝোঁকে মনে হত আমার মেরুদণ্ডের তলা থেকে একটা ব্যথা বিষফোঁড়ার মন তর তর করে পেকে ফুলে চড়িয়ে যাচ্ছে। মাথাটা জ্বরো রুগির মক্স গরম ভার হয়ে আসত, ঘাড়ের কাছটায় অসহ্য ব্যথা, চোখ কান জ্বলে যেত। বুকের মধ্যে একটা হাত যেন ক্রমাগত কী একটা খুঁজে পাবার জন্যে হাতড়ে বেড়াত। …আমি কালী মন্দিরের গলিতে ফিরে আসতাম। কৌশল্যা আমার খাঁটিয়া পেতে দিত, ধেনো মদের বোতল পেড়ে দিত কুলুঙ্গি থেকে। সারাটা রাত মদ আর কৌশল্যার গায়ের টক টক কেমন এক গন্ধের মধ্যে আমি ডুবন্ত মানুষের মন হাঁসফাঁস করে মরতাম।
৫৩.
বাজারে আলুর আড়তে খবর পাঠাল কুমু। ছেলেটা মরে যাচ্ছে।
৫৪.
আমাদের বাজারে এক পাগলি জুটেছিল। তার সারা গায়ে ঘা। পাগলি একটা ভাঙা হাঁড়ির মধ্যে এক গণ্ডা কুকুর ছানা নিয়ে বসে থাকত, আর থেকে থেকে সব কটা বাচ্চাকে এক সঙ্গে হাঁড়ি চাপা দিয়ে বলত, চারটে পয়সা দিলে কুকুরগুলোকে সে পায়রা করে আকাশে উড়িয়ে দেবার খেলা দেখাবে। আমি জানতাম, এ হয় না; এ রকম ভেলকি হবার নয়, তবু তাকে চারটে পয়সা দিয়েছিলাম।
৫৫.
কুমু আমায় আর ডেকে পাঠায়নি, তবু একদিন সাঁঝে বাসায় গেলাম। কুমু দাওয়ায় বসে তার ছেলেকে দুধ দিচ্ছিল। আমার সারা গা ঘিন ঘিন করে উঠল। কুমুর শরীরের ভেতরটাও নোংরা হয়ে যাচ্ছে। কুমু আমার দিকে চোখ তুলে চাইল। তার দু-চোখ গর্তে ঢুকেছে, কালো হয়ে গেছে চোখের চারপাশ, মাথার চুল রুক্ষ, গায়ের শাড়িটা চিটচিটে ময়লা। …কুমুকে বললাম, ছেলে ফেলে রেখে ভাল করে চান করে আসতে। কুমু গ্রাহ্য করল না।
৫৬.
এই ভাবে নোংরা হয়ে তুমি কত দিন বসে আছ? কুমুকে চোয়াড়ের মতন শুধোলাম। কুমু জবাব দিল না।
৫৭.
তোমার ঘেন্না করে না, সারাদিন এই নোংরা কোলে নিয়ে বসে থাকতে, ঘেন্না করে না? আমি বেপরোয়া গলায় চিৎকার করে উঠলাম। কুমু চমকাল না, ভয় পেল না, জবাব দিল না।
৫৮.
ওই জন্তুটাকে মেরে ফেলল। ওটাকে কোলে পিঠে বুকে করে বয়ে বেড়িয়ে লাভ কী তোমার! সারা জীবন ওকে নিয়ে বাঁচতে পারবে না। কুমুকে ভাল কথাটা বোঝাতে গেলাম। কুমু বুঝল কি না কে জানে। ছেলেটাকে মাদুরে শুইয়ে লণ্ঠন ধরাতে গেল। ঘর অন্ধকার। ছেলেটা চৌকাঠের পাশেই শুয়ে ছিল। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। মনে হল চৌকাঠের পাশে অন্ধকারে আমার পা কেউ টেনে নিচ্ছে..ঠিক তখন লণ্ঠন হাতে কুমু এল। কুমুর হাতে লণ্ঠন, আমার ছায়াটা কেমন যেন দুলে নেচে ভেঙে ছোট্ট হয়ে ছেলেটার গায়ে পড়ল। লণ্ঠন নামিয়ে রেখে কুমু আমার পাশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, আমি তার হাত ধরে ফেললাম। ঝটকা মেরে কাছে টানতেই লণ্ঠনের আলোটা আড়াল পড়ে গেল। আর অন্ধকার আচমকা এমন ভাবে কুমুর গায়ে মুখে ছড়িয়ে পড়ল যে আমার মনে হল, কুমুই আমার ছায়া হয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। মাঘের শীত হঠাৎ আমার গায়ে কনকনিয়ে উঠল, চোখ ঝাপসা হয়ে গেল।
৫৯.
কুমু বলল, জানি সব জানি। .এই গলার স্বর ঠিক সেদিনের মন, অবিকল সেই সুর। দোকানে আমার গিলটির হার গলায় পরার পর আমি বলেছিলাম ওর পালিশ থাকবে না। কুমু বলেছিল, জানি সব জানি। …হঠাৎ আমার মনে হল, কুমু আমার সব জানত, আমার সমস্ত কুমু আমার সব জানে, সব জানবে।
৬০.
হাত ছেড়ে মাটির দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল, আমার ছায়া কুমুর গায়ে আড়াল হয়ে আছে কুমুর ছায়াটাই মাটিতে ছড়ানো। মনে হচ্ছিল, আমার আর ছায়া নেই কুমুই আমার ছায়া। আর সেই ছায়ার ওপর ছেলেটা শুয়ে আছে।
৬১.
ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পালাতে গিয়ে লণ্ঠনটা পায়ে লেগে ছিটকে পড়ল। কাঁচ ভাঙল, কেরাসিনের গন্ধ উঠল ধক করে, ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। বাইরে এসে দেখি আকাশটা কেমন লালচে। হয়তো ঝড় উঠবে, হয়তো কোথাও আগুন লেগেছে।
৬২.
ঘুরে ঘুরে ছুটে ছুটে কখন যেন আর পা চলল না, ঠাণ্ডায় হিমে শীতে সমস্ত শরীর অসাড়, একটু আগুনের আশায় গরমের লোভে স্টেশনে এলাম। চায়ের দোকানের উনুনটা নিবে গেছে। লোকগুলো পুঁটলির মতন হাত পা গুটিয়ে মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছ। …কলকাতার গাড়ি এসে চলে গেল, মাঝরাতে কাশীর গাড়ি এসে উলটো দিকে চলে গেল। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল, যে কোনও গাড়িতে গিয়ে উঠে বসি। উঠতে পারছিলাম না। ভীষণ জ্বর এসে গিয়েছিল।
৬৩.
শেষরাতে বুঝি গাড়িতে উঠে বসেছি। গাড়ি ছাড়ল। কোথাকার গাড়ি কোথায় যাচ্ছে কিছু জানি না। হুঁশ নেই। চাকার শব্দের সঙ্গে কুমুকাঁদছিল। ছেলেটা চেঁচাচ্ছিল। …কে জানত, আমার সমস্ত ময়লা আমি কুমুকে মাখিয়েছি, কে ভেবেছিল কুমুর নাড়িতেও সেই ময়লা পুরু হয়ে জমে থাকবে। আমায় কেউ মুক্ত করেনি।
৬৪.
ঘুম ভাঙলে দেখলাম, আমি স্টেশনের মুশাফিরখানায় শুয়ে আছি। ঝাড়ুদারের ঝেটা জঞ্জাল সাফ করছে। এটো পাতা বিড়ির টুকরো আমার মুখে এসে পড়ছে। …উঠে বসলাম। গায়ে জ্বর। পা টলছিল। …বাইরে এসে দেখি শীতের রোদ উথলে পড়ছে।
৬৫.
বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলাম। জ্বর, না জ্বালা,না কি আর কিছুতে কে জানে আমার পিঠে যেন একটা কুঁজের মতন কী উঁচু হয়ে আছে।
৬৬.
হয়তো আমার কুঁজ হচ্ছিল।
৬৭.
কুমু ছেলে কোলে দাওয়ায় বসেছিল। পায়ের কাছে কাঠের গুঁড়ো ভরা কাপড়ের ছোট্ট পাখি। সদরের দরজাটা আমি বন্ধ করে দিলাম। খিল তুলে দিলাম।