একটি ফোটো চুরির রহস্য
প্রথম সংস্করণ : জানুয়ারি ২০০৩
.
ছুটকুকে দাদাই
.
হঠাৎ একটা রব উঠল। আঁতকে ওঠার।
পথচলতি লোজন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে দেখছিল দৃশ্যটা। গেল গেল রব।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য ভয়ঙ্কর কিছু ঘটল না। লোকটা হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে কোনওরকমে সামলে নিল। তবু ফুটপাথেই ছিটকে পড়েছিল।
ট্রাম দাঁড়ায়নি। চলে গেল সোজা। ফুটবোর্ডে দাঁড়ানো লোকগুলো দেখল মানুষটাকে।
কাটাও পড়েনি। চাকার তলাতেও যায়নি। তবে আর ট্রাম বাস থামবে কেন! কলকাতা শহরে হামেশাই ট্রাম বাস মিনিবাস থেকে লোকজন ছিটকে পড়ছে রাস্তায়, তার জন্যে গাড়িটাড়ি দাঁড়াবেই বা কোন দুঃখে?
রাস্তায় ছিটকে-পড়া লোকটা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে।
কাছাকাছি পথচলতি মানুষের নানান মন্তব্য : “আর একটু হলেই তো হয়ে গিয়েছিলেন, দাদা; বরাত জোর…।” অন্য কে যেন বলল, “রাখে হরি মারে কে! বেঁচে গিয়েছেন, মশাই।” এক ছোকরা মশকরা করে বলল, “দাদু, এল বি হয়ে যাচ্ছিলেন যে! লেগ চাকার তলায় চলে যাচ্ছিল। আম্পায়ার বাঁচিয়ে দিয়েছে। এ্যাত্রায়।”
ভিড় সরে গেল। কাজের মানুষ সবাই, কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকবে।
কিকিরার নজরে পড়েছিল দৃশ্যটা। এগিয়ে এলেন সামান্য তফাত থেকে।
“আরে, পাতকী না?”
লোকটা ততক্ষণে নিজের হাত-পা দেখছে। হাত ছড়েছে দু’ জায়গায়, কনুইয়ে লেগেছে, হাঁটু সোজা করতে কষ্ট হচ্ছিল।
কিকিরার দিকে তাকাল লোকটা। তার নাম পাতকী নয়। পিতৃদত্ত নাম পতাকী। কিকিরা তাকে পাতকী বলে ডাকেন।
কিকিরাকে দেখে পাতকীর চোখে জল এসে গেল। যন্ত্রণাও হচ্ছিল।
“দেখলেন বাবু, আমি নামতে যাব, আমায় ল্যাং মেরে ফেলে দিল।” বলেই পতাকী চারপাশে দেখতে লাগল। আমার ব্যাগ?”
“ব্যাগ!”।
পতাকী খোঁড়াতে খোঁড়াতে ট্রাম লাইন পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে দেখল। নজর করল এপাশ-ওপাশ। তারপর প্রায় কেঁদেই ফেলল। “আমার সর্বনাশ হয়ে গেল রায়বাবু। এখন আমি কী করব?”
“কেমন ব্যাগ?”
“ছোট ব্যাগ! আধ হাত চওড়া হবে। বুকের কাছে ধরে রাখি…।”
“চামড়ার? প্লাস্টিকের মতন দেখতে?”
“কালো রং।”
কিকিরা বললেন, “সে তো একটা ছোকরা উঠিয়ে নিয়ে গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল। তোমার সঙ্গেই নেমেছিল ট্রাম থেকে।”
“পকেটমার। চোর। প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা! রঙিন গেঞ্জি? লাল-সাদা চাকা চাকা গেঞ্জি।”
“তাই তো দেখলাম।”
“দেখেছেন বাবু! আমি ঠিক ধরেছি। বেটা আমায় তখন থেকে নজর করছিল। পিছু নিয়েছিল। ওকে আমার সন্দেহ হচ্ছিল আগাগোড়া। ওরই জন্যে আগে আগে নেমে পড়তে গেলাম ট্রাম থেকে। …আমার এখন কী হবে বাবু?”
কিকিরা বললেন, “টাকা-পয়সা ছিল?”
“টাকা বেশি ছিল না। সোয়া শ’ মতন। আদায়ের টাকা। কয়েকটা কাগজপত্র, রসিদ, টুকটাক…”
“অল্পের ওপর দিয়ে গিয়েছে হে! এত ছটফট করো না।”
“টাকার জন্যে নয় বাবু। ওর মধ্যে একটা অন্য জিনিস ছিল। কী জিনিস আমি জানি না। জহরবাবু বলে দিয়েছিলেন, খুব সাবধানে আনতে।”
কিকিরা অবাক হলেন। দেখলেন পতাকীকে।
“ঠিক আছে। পরে কথা হবে। এখন চলো চাঁদনিচকের উলটো দিকে আমার চেনা একটা ওষুধের দোকান আছে, তোমার কাটা-ছেঁড়া জায়গাগুলোর ব্যবস্থা করা যাক।”
পতাকী বোধ হয় কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিকিরা কান করলেন না। বাধ্য হয়েই পতাকীকে এগিয়ে যেতে হল।
সামান্য এগিয়েই ওষুধের দোকান।
পতাকী দোকানের বাইরের দিকের একটা বেঞ্চিতে বসে থাকল, একটি রোগামতন ছেলে, ওষুধের দোকানের, অভ্যস্ত হাতে পতাকীর কাটা-ছেঁড়া জায়গাগুলো পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিল, দু-এক জায়গায় ব্যান্ড-এইড। তারপর এক ইনজেকশন।
পতাকী নানা করছিল। তার কাছে পয়সাকড়ি না-থাকার মতন। কিকিরা শুনলেন না। রাস্তার ধুলোবালি লেগে মরবে নাকি! পয়সার ভাবনা করতে হবে না তোমায়।
ইনজেকশনের পর কয়েকটা ট্যাবলেটও পতাকীর হাতে গুঁজে দেওয়া হল। তার আগে ব্যথা-মরার একটা বড়িও সে খেয়েছে।
পতাকীকে নিয়ে উঠে পড়লেন কিকিরা।
“চলল হে পাতকী, কোথাও বসে একটু জিরিয়ে নেবে চলো। চা খাওয়া যাবে।”
পতাকীকে ভাল করেই চেনেন কিকিরা। বড়াল লেনের শরিকি বাড়ির একটা ঘরে থাকে। মাথার ওপর ওইটুকুই তার আশ্রয়। সংসার রয়েছে। স্ত্রী ছেলে মেয়ে। পতাকী আগে হালদারদের স্টুডিয়োয় কাজ করত। সারাদিনই পাওয়া যেত দোকানে। স্টুডিয়োর কর্মচারী। হালদার স্টুডিয়ো’র বুড়ো মালিক রামজীবনবাবু তখন বেঁচে। তিনি বেঁচে থাকলেও এককালের নামকরা পুরনো হালদার স্টুডিয়ো তখন ডুবতে, মানে উঠে যেতে বসেছে। নতুন নতুন স্টুডিয়ো, তাদের জেল্লা, রকমারি কায়দা কানুনের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না, আদ্যিকালের ব্যবস্থা কি একালে চলে!
রামজীবনবাবু মারা গেলেন, ষাটের ঘরে এসেই। পায়ের সামান্য একটা কারবাঙ্কল বিষিয়ে কী যে হয়ে গেল–! বাঁচানো গেল না। দোকানটা অবশ্য থাকল। রামজীবনের ছেলে জহর নিজেই বসতে লাগল দোকানে। তাদের সংসারের অবস্থা মাঝারি। নিজেদের বাড়িও আছে মলঙ্গা লেনে। দিন আনি দিন খাই–না করলেও চলে। তা ছাড়া জহরের একটা চাপা আত্মমর্যাদা রয়েছে। তার বাবার হাতে গড়া হালদার স্টুডিয়োর জন্ম সেই উনিশশো বিশ বাইশে। সোজা কথা! বাবার তখন ছোকরা বয়েস, টগবগে রক্ত, স্বদেশি করার জন্যে মাসকয়েক জেলও খেটেছেন। বাবার মাথায় কেন স্টুডিয়োর চিন্তা এসেছিল কেউ জানে না। তবে তাঁর হাত আর চোখ ছিল ভাল, ফোটো তোলায় ভীষণ ঝোঁক। কলকাতা শহরে তখন কটাই বা স্টুডিয়ো!
হালদার স্টুডিয়ো বেশ নাম করেছিল তখন।
সময় বসে থাকে না। জল গড়িয়ে যাওয়ার মতন সময়ও চলে গেল। রামজীবন নেই। কিন্তু তাঁর স্মৃতির সঙ্গে কিছু পুরনো কাজও আছে-যার মূল্য কম কী!
পতাকীকে বাবা যখন রাখেন দোকানে, তখন তিনি প্রৌঢ়। পতাকী ছোকরা। আজ পতাকীর বয়েস অন্তত চল্লিশ।
বড়বাবু বেঁচে থাকলে কী হত পতাকী জানে না। তবে জহর অনেক ভেবেচিন্তেই পতাকীকে সারাদিনের জন্যে দোকানে রাখতে চায়নি। আজকের দিনে একটা মানুষকে সারাদিনের জন্যে রাখতে হলে যত টাকা দেওয়া দরকার জহর তা পারে না। কাজেই সে অন্য ব্যবস্থা করে নিয়েছে। পতাকী বাইরে আর দুটো কাজ করুক, তাতে তার রোজগার বাড়বে খানিকটা, সেইসঙ্গে হালদার স্টুডিয়োর কাজ।
পতাকী তাতেই রাজি। সে অন্য অন্য কাজের সঙ্গে হালদার স্টুডিয়োর কাজ করে। তার কোনও অভিযোগ নেই। জহরকে সে নাম ধরেই ডাকে দোকানে, জহরদা; বাইরে বলে জহরবাবু। জহরও তাকে পতাকীদা বলে ডাকে।
পতাকী মানুষ হিসেবে সাদামাঠা সরল। কিন্তু অনেক সময় এমন সব গোলমাল পাকায়, ভুল করে বসে যে মনে হয়, তার বুদ্ধির পরিমাণটা অত্যন্ত কম। জহর বিরক্ত হয়, রাগ করে, তবু পতাকীর সরলতা আর বোকা স্বভাবের জন্যে তাকে কড়া কথাও বলতে পারে না। কী হবে বলে! অবশ্য বিরক্তি আর অসন্তোষ তো চাপা থাকে না, লুকনো যায় না সবসময়। তাতেই পতাকী যেন নিজের অক্ষমতার জন্যে কুঁকড়ে যায়।
.
চা খেতে খেতে কিকিরা পতাকীকে বললেন, “তুমি অত ঘাবড়াচ্ছ কেন? জহর কিছু বলবে না।”
“বলবে না! না রায়বাবু, জহরদা আমায় বারবার করে বলে দিয়েছিল, জরুরি জিনিস, কাজের জিনিস, সাবধানে নিয়ে যেতে!”
কিকিরা হাসলেন। হালকা গলায় বললেন, “তোমার মাথায় সত্যি কিছু নেই। জরুরি কাজের জিনিস হলে ওভাবে কাউকে নিয়ে আসতে বলে! তোমার আধ হাতের পুরনো প্লাস্টিকের ব্যাগে কোন মহামূল্যবান জিনিস আনতে বলবে জহর? নিশ্চয় হিরে-জহরত নয়, পঞ্চাশ একশো ভরি সোনাদানাও নয়।”
“আজ্ঞে না, তেমন কিছু তো নয়।”
“তবে?”
“আমি জানি না বাবু। শুধু জানি, একটা শক্তপোক্ত খাম ছিল। খামের ওপরের কাগজটা পুরু। মোটা নয় খামটা। তবে শক্ত। খামের মুখ বন্ধ। সিল করা। রেজিস্টারি চিঠির মতন অনেকটা।”
কিকিরা অবাক হলেন। দেখছিলেন পতাকীকে। কী বলছে ও? একটা সিল করা খাম অত জরুরি হয় নাকি? খামের মধ্যে কী থাকবে? টাকা! টাকা থাকলেও কত আর হতে পারে!
“মোটা, পুরু, ভারী খাম নাকি?” কিকিরা বললেন।
“এমনিতে খামটা মোটা নয়, ভারীও নয়। তবে ভেতরটা শক্ত বলেই মনে হয়েছিল।”
“লম্বা খাম?”
“আজ্ঞে না; মাঝারি মাপের। ধরুন লম্বায় ইঞ্চি ছয়েক, চওড়ায় চার পাঁচ ইঞ্চি হবে।”
“কিছু লেখা ছিল না ওপরে?”
“না।”
“কার কাছ থেকে আনছিলে?”
“ঠনঠনিয়ার পাঁজাবাবুর কাছ থেকে।” কিকিরা পাঁজাবাবুকে জানেন না, চেনেন না! পাতকীও চেনে না বলল। অনেক আগে হয়তো দু-একবার দেখেছে।
“তিনি তোমায় কিছু বলে দেননি?”
“না। শুধু বলেছিলেন, জহরকে দিয়ে দেবে। দরকারি জিনিস।”
“কিকিরার মাথায় কিছুই এল না। সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “একটা কাগজ নিয়ে এসো তো!”
পতাকী দোকানের মালিকের কাছ থেকে একচিলতে কাগজ এনে দিল।
কিকিরার কাছে ডট পেন ছিল। তিনি নিজের নাম ঠিকানা ফোন নম্বর লিখে কাগজটা পতাকীর হাতে দিলেন।
“এটা জহরকে দিয়ে দিয়ে,” কিকিরা বললেন, “তুমি যে ট্রাম থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়েছ, তোমার হাতের ব্যাগ খোয়া গিয়েছে, চোরছ্যাঁচড় নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে, আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমাকে সাক্ষী মানতে পারো। জহর তোমায় অবিশ্বাস করবে না। …আর ওকে বলো, আমায় ফোন করতে। দরকার হলে ফোন করবে। আজ সন্ধেতেও করতে পারে। আমি বাড়িতেই থাকব। কাল সকালেও পারে। এনি টাইম।…এখন তুমি যেতে পার। সাবধানে যাবে। ওষুধগুলো মনে করে খেয়ো। নয়তো ভুগবে।”
পতাকী কেমন করুণ গলায় সঙ্কোচের সঙ্গে বলল, “বাবু, আপনার টাকাগুলো দিতে পারছি না এখন।”
“ঠিক আছে। ও নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। এখন এসো। পকেটে খুচরো আছে, না তাও গিয়েছে?”
পাতকী মাথা নাড়ল। পকেটে খুচরো আছে কিছু। চলে যেতে পারবে।
“তবে এসো।”
চলে গেল পাতকী।
কিকিরার চুরুট ছিল না পকেটে। ফুরিয়ে গিয়েছে। চায়ের দোকানের ছোকরাটাকে ডেকে টাকা দিলেন বাইরের পানের দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট এনে দিতে।
দোকানে এতক্ষণ তেমন একটা ভিড় ছিল না। সবে শুরু হল। দু’চারজন এইমাত্র কথা বলতে বলতে ঢুকল। অফিসের বাবু।
এখনও পুরোপুরি গরম পড়েনি, ফায়ূনের মাঝামাঝি। দোকানের পাখাগুলো ধীরে ধীরে চলছে। বাইরে রোদ পড়ে এসেছে। দুপুরের ঝলসানি নেই, আলো যথেষ্ট। বিকেল হয়ে গেল।
সিগারেটের প্যাকেট হাতে পেয়ে কিকিরা অন্যমনস্ক ভাবে প্যাকেট খুললেন, সিগারেট ধরালেন একটা।
পাতকীর কথাই ভাবছিলেন। ও যে ঠিক কী বোঝাতে চাইল, কিকিরা ধরতে পারেননি। কলকাতা শহরে পকেটমারের অভাব নেই। বিশেষ করে এই সময়টায়, অফিস ছুটির মুখে ওদের ব্যস্ততা খানিকটা বাড়বে যে, তাতে আর সন্দেহ কোথায়! কিন্তু পাতকীর কথামতন ওই ছোকরা অনেকক্ষণ থেকে তাকে নজরে রেখেছিল কেন? পাতকী ট্রাম থেকে নামার সময় গায়ে গায়ে লেগে ছিল। কেন? কিকিরার হাতের মামুলি ছোট ব্যাগটায় কত টাকা বা কী এমন সোনাদানা থাকতে পারে যে, তার গন্ধে গন্ধে ছোকরা পাতকীর পিছনে লেগে থাকবে! জানবেই বা কেমন করে। তবে কলকাতা শহরের পকেটমারগুলোর চোখ, অনুমানশক্তি দারুণ। বেটাদের অভিজ্ঞতাও প্রচুর। স্যাকরা বাড়ি থেকে দোকানের বিশ্বস্ত কর্মচারী রেশন ব্যাগের মধ্যে সোনার হার বালা চুড়ি নিয়ে কোনও জানাশোনা খরিদ্দারের বাড়িতে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে, অদ্ভুতভাবে সেই ব্যাগ হাওয়া হয়ে গেল! তা থাক, সে অন্য কথা। পাতকীর ব্যাপারটি আসলে কী! কিকিরা অবাকই হচ্ছিলেন।
.
২.
সন্ধেবেলায় ফোন। তারাপদদের সঙ্গে গল্পগুজব হাসি-তামাশা করছিলেন কিকিরা। এমন সময়ে ফোন।
কিকিরা মনে মনে আন্দাজ করে নিলেন কার ফোন হতে পারে। “হ্যালো?”
“রায়কাকা? আমি জহর।”
“হ্যাঁ, রায় বলছি। তোমার কথাই ভাবছিলাম। পাতকীর সঙ্গে দেখা হয়েছে?”
“আমি একটু বেরিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি পতাকীদা দোকানে বসে আছে। শুকনো মুখ, হাতে পায়ে তাপ্পি লাগানো। কাঁপছে। জ্বর এসে গিয়েছে যেন।”
“শুনলে সব?”
“শুনলাম। আপনার লেখা কাগজের টুকরোটাও পেলাম।”
“পাতকী আছে, না, চলে গিয়েছে?”
“চলে গেল খানিকটা আগে। আমিই বললাম, তুমি এভাবে তখন থেকে বসে আছ! যাও, বাড়ি যাও।”
“ভালই করেছ! ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল। বেচারি পড়েছেও বিশ্রীভাবে। আর একটু বেকায়দায় পড়লে ট্রামের চাকার তলায় চলে যেতে পারত। ভাগ্য ভাল; অল্পের ওপর দিয়ে গিয়েছে।”
“আপনি সব দেখেছেন?”
“দেখেছি। …মানে চোখে পড়ে গিয়েছে হঠাৎ। এই সময় আমি ওখান দিয়ে যাচ্ছিলাম।”
জহর একটু চুপ করে থেকে বলল, “কী হল বলুন তো? পকেটমারের কেস? ছিনতাই? পতাকীদার কথা শুনে মনে হচ্ছে–” জহর কথাটা শেষ করল না।
“কী হল আমি কেমন করে বলব! তুমিই বলতে পারো। পাঁজাবাবুর বাড়ি থেকে পাতকী কী এমন আনতে গিয়েছিল যে–”
কিকিরাকে কথা শেষ করতে দিল না জহর। বলল, “ফোনে অত কথা বলা যাবে না রায়কাকা। আমি নিজেই বোকা হয়ে গিয়েছি। আপনি কাল সকালে বাড়ি আছেন?”
“কোথায় আর যাব। বাড়িতেই আছি।”
“তা হলে কাল আমি যাচ্ছি। দেখা হলে সব বলব।”
“চলে এসো।”
“তা হলে ফোন রাখছি। কাল দেখা হবে।”
কিকিরাও ফোন নামিয়ে রাখলেন। তারাপদরা কিকিরার কথা শুনছিল। অনুমান করছিল, কিছু একটা ঘটেছে। কী, তা তারা জানে না। কিকিরা বলেননি।
“কী কেস, সার? আপনি তো কিছু বলেননি আমাদের?” চন্দন বলল। বলে তারাপদকৈ আড়চোখে কীসের যেন ইশারা করল।
তারাপদ বলল, “আপনি আজকাল হাইডিং করছেন, কিকিরা। ভেরি ব্যাড।”
কিকিরা বললেন, “হাইডিং নয় হে, ওয়েটিং। দেখছিলাম,
ব্যাপারটা তুচ্ছ, না, পুচ্ছ।”
“কার সঙ্গে টক করছিলেন?”
“জহর। হালদার স্টুডিয়ো, মানে ফোটোগ্রাফির দোকানের একটি ছেলে। মালিক। আমাকে কাকা বলে। ওর বাবাকে আমরা দাদা বলতাম।”
“মোদ্দা ব্যাপারটা কী?”
“আজকের ঘটনাটা বলতে পারি শুধু। বাকিটা আমি জানি না। কাল জহর আসার পর জানতে পারব মোটামুটি।”
“আজকেরটা শুনি।”
কিকিরা দুপুরের ঘটনা বর্ণনা করলেন সবিস্তারে।
তারাপদরা মন দিয়ে শুনছিল।
কিকিরার বলা শেষ হলে তারাপদ উপেক্ষার গলায় বলল, “এটা আবার কোনও কেস নাকি সার! আপনি আমি চাঁদু সবাই জানি চাঁদনিচক একটা বাজে জায়গা। জ্যোতি সিনেমার চারদিকে পিকপকেট-অলাদের রাজত্ব। ওটা ওদের এলাকা। একবার পকেট কাটতে পারলে এ-গলি ও-গলি, মায় চাঁদনির ওই বাজারে ঢুকে পড়তে পারলে কার বাবার সাধ্য ওরকম গোলকধাঁধার মধ্যে তাকে খুঁজে বার করে। অসম্ভব।… আপনি যাই বলুন, এটা সিম্পল পিকপকেট কেস! তিলকে তাল করার কোনও দরকার নেই।”
কিকিরা মাথা দোলাবার ভঙ্গি করে বললেন, “আমারও প্রথমে সেরকম মনে হচ্ছিল। কিন্তু জহরের ফোন পাওয়ার পর খটকা লাগছে।”
“কেন?”
“মামুলি পকেটমারের ব্যাপার হলে ও বলেই দিত, চোর ছ্যাঁচড়ের ব্যাপার, পাতকী নিজের বোকামির জন্যে ব্যাগ খুইয়েছে। তা তো বলল না, বরং কাল দেখা করতে আসবে বলল।”
চন্দন কী যেন ভাবছিল। বলল, “আপনি পতাকীনা পাতকীকে কতদিন চেনেন?”
“তা অনেকদিন। কেন?”
“নোকটা চালাক, না বোকা?”
“চালাক-চতুর বলে জানি না। তবে নিরীহ। খানিকটা কাছাখোলা ধরনের। তুমি এসব কথা বলছ কেন?”
“ওই জহর না কী নাম বললেন, তাকেও চেনেন অনেকদিন, তাই?”
“চিনি। ওর বাবাকেই বেশি চিনতাম।”
“আপনার কাছে নানারকমের লোক আসে। পুরনো আলাপী লোককেও আসতে দেখেছি। কই জহর বলে কাউকে তো দেখিনি কোনওদিন।”
কিকিরা মাথার চুল ঘাঁটতে ঘাঁটতে বললেন, “তোমরা দেখোনি তাতে কী হয়েছে গো। আমার বয়েসটা কত হল খেয়াল করেছ! বুড়ো গাছের অনেক ডালপালা। তা সে যাকগে।… তুমি তারাবাবু যা বলতে চাইছ, আমি নিজেও ভাবছিলাম সেরকম। পাতকীর ব্যাগ হাতিয়ে পালানোর ব্যাপারটা নেহাতই চোর-পকেটমারের কাণ্ড। বোকা হাবাগোবা মানুষকে হাতের কাছে পেয়েছে, সুযোগ ছাড়েনি।”
“তা ছাড়া আবার কী!” তারাপদ বলল, “এ সেরেফ পাতি পকেটমারের কাণ্ড। একটা কথা, সার। লোকটা জেনেশুনে আপনার পাতকীর ব্যাগ ছিনতাই করেছে-হতেই পারে না। সে জানবে কেমন করে কী আছে ব্যাগে? টাকা-পয়সা থাকা স্বাভাবিক, তা পঞ্চাশ একশোই হোক বা কম-বেশি!”
“তোমার যুক্তি ঠিক। আমি আগেও বলেছি। কিন্তু জহরের ফোন পেয়ে মনে হচ্ছে, একটা গণ্ডগোল রয়েছে কোথাও!”
“কেন?”
“নয়তো জহর ফোনে ওভাবে কথা বলত না। বলত, পতাকীদার পকেটমার হয়েছে তো হয়েছে। অমন হয়, পতাকীদা অকারণ ভাবছে, এটা তার গাফিলতি। বারবার আপনাকে ফোন করে সাক্ষী মানতে বলছে। বোঝাতে চাইছে তার কোনও দোষ নেই।” কিকিরা পকেট হাতড়াতে লাগলেন, বোধ হয় নেশা খুঁজছিলেন। বললেন, “কিন্তু এখন দেখছি, ব্যাপারটা অত তরলং নয়।”
“তরলং মানে?”
“মানে জলবৎ তরলং নয় বোধ হয়। গোলমাল একটা আছে নিশ্চয়।”
“তরলং নয়। জটিলং..” চন্দন হাসল।
“ধরে নিচ্ছি। নয়তো জহর নিজে কেন কাল এসে দেখা করতে চাইছে! একটু খোঁচা থাকবে না হে!”
তারাপদ চুপ করে গেল। কিকিরার কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার মতন নয়। সামান্য ও স্বাভাবিক ব্যাপার হলে সত্যি সত্যিই জহরের এত তড়িঘড়ি করে কিকিরার কাছে আসার দরকার ছিল না। সে নিশ্চয় কিছু বলতে আসবে।
কৌতূহল বোধ করলেও তারাপদদের পক্ষে, কাল-পরশু বিকেলের আগে কিছুই জানতে পারবে না। তারাপদদের অফিসে এখন কাজের চাপ বেশি। টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে ছ’টা বেজে যায়। এই মাসটা এইরকমই চলবে। আর কাল চন্দনের দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত হাসপাতালে থাকতে হবে।
আরও খানিকটা বসে তারাপদ উঠে পড়ল। “চলি, সার। পরশু দেখা হবে। তখন শুনব আপনার জহর কী বলে গেল। চল রে চাঁদু।”
ওরা চলে গেল।
কিকিরা বসেই থাকলেন। ভাবছিলেন। জহরের সঙ্গে তাঁর মাঝেমধ্যে দেখা হয়ে যায় রাস্তাঘাটে। ওর দোকানে শেষ গিয়েছেন কিকিরা মাসকয়েক আগে। কোনও কাজে নয়, এমনি। যাচ্ছিলেন এক কাজে, হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে যাওয়ায় মাথা বাঁচাতে গিয়ে হালদার স্টুডিয়োর দোকানটা চোখে পড়ে গেল। ঢুকে পড়লেন।
দোকানে লোক ছিল না। জহর ডার্করুমে কাজ করছিল, বেরিয়ে এল।
আধঘণ্টাখানেক ছিলেন কিকিরা। গল্পগুজব হল। জহরের বাড়ির খবর ভাল নয়। মায়ের অসুখ। হার্টের গোলমাল। ওর স্ত্রী ভুগছে চোখ নিয়ে। লাফ মেরে মেরে পাওয়ার বাড়ছে। ডাক্তার বলছে, এভাবে চললে শেষমেশ কী দাঁড়াবে কে জানে। আর ওর ছেলেটা একেবারে দস্যু হয়ে উঠছে। সামলানো যায় না।
দোকানের কথা তুলেছিলেন কিকিরা। “পুরনো দোকান, আজকাল ব্যবসার বাজারে খানিকটা চাকচিক্য প্রয়োজন, জহর। তুমি তো নিজেই বুঝতে পারো, পুরনো ব্যাপারগুলো সব পালটে যাচ্ছে, কতরকম ক্যামেরাই তো এসে গিয়েছে বাজারে। কালার ফোটোগ্রাফির এখন রমরমা।”
জহর জানে। রঙিন ফোটো সেও তোলে। তবে তার বাবার আমলে রং সেভাবে আমদানি হয়নি। বাবার তোলা সমস্ত ছবি সাদা কালো।
আসলে জহর যদি মোটাসোটা টাকা ঢালতে পারত দোকানে, হালদার স্টুডিয়োর চেহারা-চমক পালটে দিত। তার অত টাকা নেই। টাকা না থাকা যদি প্রধান কারণ হয়, দ্বিতীয় কারণ জহরের মতে, একজন ভাল ফোটোগ্রাফার যদি আর্টিস্টের ধারেকাছে পৌঁছতে চায়, তাকে সাদা কালোয় কাজ দেখাতে হবে।
কিকিরা বুঝুন বা না-বুঝুন জহরের কথাগুলো তাঁর ভালই লাগে। ছেলেটার গুণ আছে, জেদও রয়েছে।
নিজের বসার জায়গা ছেড়ে উঠে পড়েন কিকিরা। ঘরের মধ্যে পায়চারি করারও জায়গা নেই। একেবারে ঠাসা। জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। বাতাস আসছে ছোট পার্কটার দিক থেকে।
হঠাৎ তাঁর মনে হল, একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। জহরের ফোন নম্বরটা নেওয়া হয়নি। খেয়াল ছিল না। অবশ্য টেলিফোনের গোবদা বইটায় হালদার স্টুডিয়োর ফোন নম্বর পাওয়া কঠিন কাজ নয়। পেতেই পারেন কিকিরা। তবে অত ব্যস্ততার কী আছে। তা ছাড়া জহর দোকান বন্ধ করে চলে গিয়েছে এতক্ষণে! তার বাড়িতে ফোন হয়তো আছে। কার নামে কে জানে! খুঁজেপেতে নম্বরটা পাওয়া গেলেও লাভ কী ফোন করে!
কিকিরার কী খেয়াল হল, কেন হল, তাও জানেন না, নিজের জায়গায় ফিরে এসে ফোন তুললেন।
রিং করতেই সাড়া এল।
“পানুদা, আমি কিঙ্কর কথা বলছি।”
ক্রিমিনাল কেসের ওকালতি করতে করতে পানু মল্লিক বা পান্নালাল মল্লিকের গলার স্বর খেসখেসে কর্কশ হয়ে গিয়েছে।
“রায়। কী ব্যাপার! তুই–?”
পানু মল্লিক কিকিরাকে তুমি’ ‘তুই’–যখন যা মনে আসে, বলেন।
“আপনি কি মক্কেল নিয়ে বসে আছেন?”
“না। আমি ওপরে রয়েছি। নীচে নামিনি। প্রেশার সামলাচ্ছি। আজ কোর্টে বড় দমবাজি করতে হয়েছে। টায়ার্ড।… তা তুমি ব্রাদার ফোন করছ! কোথা থেকে?”।
“বাড়ি থেকে। আমার একটা ফোঁ হয়েছে।”
“ফোঁ?”
“ফোন!”
“সু-খবর। তোমার টিকি ধরা যাবে। নাম্বারটা বলে রেখো।… ইয়ে, হঠাৎ আমায় মনে পড়ল কেন ভায়া। বেকায়দা কিছু করেছ?”
কিকিরা হাসলেন। কে কাকে বেকায়দায় ফেলে। পানুদাই তার গলায় হরিচন্দনবাবুর ঝামেলা জুটিয়েছিলেন।
“পানুদা, আপনি যেদিকে থাকেন সেখানে পাঁজাবাবু বলে কাউকে চেনেন?”
“পাঁ-জা! আমাদের ওখানে?”
“ঠনঠনিয়া পাড়ায়।”
“কই মনে পড়ছে না। কী করে? গলি, বাড়ির নম্বর?”
“এখনও জানি না। কাল জানতে পারব।”
“জানিও খোঁজ করব। কী দরকার বলো তো।” বলেই চুপ করে গেলেন পানুবাবু। তারপর হঠাৎ কী মনে পড়ে যাওয়ায় বললেন, “তুমি কি বিনয় পাঁজার কথা বলছ?”
“বিনয় পাঁজা! চেনেন?”
“আলাপ নেই। নাম শুনেছি। আমি তো ঠিক ঠনঠনিয়া পাড়ার লোক নই।… তা কী দরকার তোমার?”
“পরে বলব। আমি ঠিক এই মুহূর্তে জানি না কিছু। কী করেন উনি? মানে পাঁজাবাবু?”
“বলতে পারব না। তবে শুনেছি ভেরি ওল্ড ফ্যামিলি। কত ওল্ড কে জানে! বাড়িটা দেখেছি। তেতলা ইটের পাঁজা। তুমি কোথাও প্লাস্টার দেখতে পাবে না। খড়খড়িঅলা সেকেলে দরজা জানলা। তেতলায় বিস্তর পায়রা উড়ে বেড়ায়। আগে একটা ফিটন গাড়ি দেখতাম, এখন দেখি না। বোধ হয় ঘোড়া মরে গেছে।… সে যাকগে, তুমি পাঁজামশাইয়ের খবর নিচ্ছ কেন?”
“পরে বলব। কালও বলতে পারি। এখন আমি কিছু জানি না, পানুদা। নাথিং ।”
“ঠিক আছে। রাত্রে ফোন করো।… তোমার ফোঁ-নম্বরটা বলল একবার, টুকে রাখি।”
কিকিরা নম্বর বললেন।
.
৩.
পরের দিন জহর এল। সকাল সকালই এসেছে।
কিকিরা বললেন, “এসো। আমি ভাবছিলাম তোমার না দেরি হয়!”
কিকিরাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল জহর। বড় পরিবারের ছেলে; সহজ শিষ্টাচার, সহবত ভুলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
জহরকে দেখতে সাধারণ। মাঝারি লম্বা। স্বাস্থ্য ভালই। পলকা নয় আবার মেদবহুল নয়। মাথার চুল কোঁকড়ানো। চোখ-নাক পরিষ্কার। সামনের একটা দাঁত আধ-ভাঙা। তবে ওর চোখ দুটিতে কেমন একটা আবেগ মাখানো। মনে হয়, ভাবুক বা কল্পনাপ্রবণ।
“বোসো, চা-টা খাও। তাড়া নেই তো?” জহর বসবার আগেই কিকিরার জন্যে অপেক্ষা করল। “আপনি বসুন।”
কিকিরা বসলেন।
“আমি প্রথমে পতাকীদার বাড়ি গিয়েছিলাম। কেমন আছে খবর নিয়ে এলাম।”
“কেমন আছে?”
“পায়ে হাতে প্রচণ্ড ব্যথা। রাত্রে জ্বরও এসেছিল। সকালে কম। এখন দু-তিনদিন বসে থাকতে হবে বাড়িতে।”
“জোরেই পড়েছিল। …তা ও আসবে না। তোমার দোকান?”
“ও ব্যবস্থা করে নেব। আজ একজনকে বলে এসেছি দোকানটা খুলে দেবে। দশটায় খুলি। এখান থেকে ফিরতে ফিরতে যদি দশটা বেজে যায়–তাই বলে এসেছি। দুপুরে একবার বাড়ি যাব, খাওয়া দাওয়া সেরে আসতে। বিকেল থেকে দোকানেই থাকব।”
জহরের বাড়ির খবরাখবর নিলেন কিকিরা অভ্যাসমতো।
“তারপর,” কিকিরা বললেন। “কাজের কথা শুনি। ব্যাপারটা কী, জহর?”
জহর বলল, “কাকা, আমি নিজেই জানি না ভেতরের ব্যাপারটা কী! গত পরশুদিন আমায় এক ভদ্রলোক, পাঁজাবাবু, দোকানে ফোন করে বললেন যে, আমাদের ভোলা ভোলা ফোটো, তাঁর মায়ের, ওঁদের বাড়িতে রয়েছে। সেই ফোটো থেকে ফুল সাইজ, মানে পুরো বড় সাইজের একটা এনলার্জড কপি করে দিতে হবে। কোথাও কোথাও রিটাচ’ দরকার।”
“তোমাদের দোকানের, মানে স্টুডিয়োতে ভোলা ফোটো?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদের ভোলা, তবে স্টুডিয়োতে নয়। ওঁদের বাড়িতে গিয়ে ভোলা।”
“তা ও বাড়ি থেকে ফোটো পাঠাবে কেন? তোমাদের স্টুডিয়োয় ছবিটার নেগেটিভ নেই?”
জহর মাথা নাড়ল। আলগা ধরনের হাসি। বলল, “না। সব ফোটোর কি নেগেটিভ রাখা যায়! স্পেশ্যাল হলে রাখা যায়। আছেও আমাদের। এমনি অর্ডিনারি ফোটোর নেগেটিভ রাখব কেন! সম্ভব নয়। কাস্টমারকেই দিয়ে দিই। আমাদের স্টুডিয়োয় ইস্পট্যান্ট ঘটনা, বিশিষ্ট বিখ্যাত মানুষজনের কারও কারও ফোটোর নেগেটিভ এখনও আছে। প্রিন্টও আছে কিছু। কিন্তু রাম-শ্যাম যদু মধুর নেগেটিভ নেই। রাখি না? কেউ রাখে না। তা ছাড়া, কাকা, আগেকার দিনের ফিল্মের কোয়ালিটি আজকের মতন ছিল না। রাখলেও নষ্ট হয়ে যেত।”
“ফোটোটা কে তুলেছিল?”
“আমি।”
“কতদিন আগে?”
“আমার সঠিক মনে নেই। উনি যা বললেন তাতে মনে হল, ছ’সাত বছর আগে।”
“তোমার স্টুডিয়োতে নয়!”
“না, পাঁজাবাবুর বাড়িতে গিয়ে। তাঁর বিধবা মায়ের ছবি। বৃদ্ধা মহিলা। সত্তরের কাছাকাছি বয়েস হবে। মাথায় কাপড়–মানে থান। গায়ে নামাবলি চাদর। হাতে মালা। আসনে বসে ছিলেন।”
কিকিরা বুঝতে পারলেন। এরকম ফোটো অনেক বাড়িতেই দেখা যায়, জীবনের শেষবেলায় তুলে রাখা ঠাকুমা-মা-দিদিমার ছবি। ঠাকুরদা বা বাবারও হতে পারে। সব ফোটোরই ধরন প্রায় এক। হেরফের বিশেষ থাকে না।
বগলা চা জলখাবার নিয়ে এল। রেখে দিল সামনে। জহর বলল, “এত?”
“আরে খাও।”
“এত আমি পারব না, কাকাবাবু?”
“খুব পারবে। ইয়াং ম্যান। সেই কোন দুপুরে বাড়ি গিয়ে ভাত খাবে। ওমলেট, রুটি আর দুটো মিষ্টি খেতে না পারলে হজমযন্ত্রটা শরীরে রেখেছ কেন! নাও, হাত লাগাও।”
কিকিরা নিজের চায়ের মগ তুলে নিলেন। সকালের দিকে তাঁর তিন মগ চা বাঁধা। খাদ্য যৎসামান্যই খান।
জহর যেন বাধ্য হয়েই খাবারের প্লেটটা তুলে নিল। তার আগে জল খেল গ্লাস তুলে নিয়ে।
“জহর, তোমার ওই পাঁজাবাবুর নাম কী? …বিনয় পাঁজা?”
জহর অবাক! তাকিয়ে থাকল। “আপনি জানলেন কেমন করে! পতাকীদা বলেছে?”
“না। পতাকী কি নাম জানত?”
“কই! আমি তো নাম বলিনি। ঠিকানা বলেছিলাম আর একটা স্লিপ, টুকরো স্লিপ দিয়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল, আমার লোক পাঠালাম, যা দেওয়ার দিয়ে দেবেন। খামের ওপর পেনসিলে শুধু মিস্টার বি. পাঁজা লেখা ছিল। ওঁর পুরো নাম বিনয়ভূষণ না, বিনয়রঞ্জন– আমি মনে করতে পারিনি।”
“মিস্টার?”
“হ্যাঁ। শ্ৰী লিখিনি। …আপনি কেমন করে নাম জানলেন। চেনেন নাকি?”
“আমি কেমন করে চিনব! তোমার ফোন পেয়ে কী মনে হল, পরে একজনকে ফোন করলাম। কাছাকাছি পাড়ায় থাকে। পুরনো লোক। ক্রিমিন্যাল কেসের প্র্যাকটিস করেন। পাকা উকিল।”
“ও! …চেনেন তিনি বিনয়বাবুকে?”
“নামে চেনেন। আলাপ নেই,” বললেন কিকিরা। জহরের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থাকলেন। জহর খাওয়া শুরু করেছে। চোখ সরিয়ে জানলার দিকে তাকালেন একবার। বোদ এখনও জানলার ওপারে। অনেকটা বেলায় ঘরে ঢুকবে। আবার চোখ ফেরালেন কিকিরা। বললেন, “অনেককালের পুরনো বাড়ি শুনলাম পাঁজাবাবুদের। এখন শুধু ইট ছাড়া চোখে পড়ে না কিছু।”
“ঠিকই শুনেছেন। বহু পুরনো জরাজীর্ণ বাড়ি। বাইরে থেকে ইটই চোখে পড়ে। ভেতরে নীচের তলায় খুপরি খুপরি ঘর। হরেকরকম লোক। তারা কেউ দরজিগিরি করে, কেউ স্টিলের বাসন মাথায় নিয়ে ফেরি করে পাড়ায় পাড়ায়, কারও বা হাওয়াই চপ্পলের ব্যবসা-ফুটপাথে বসে কেনাবেচা…”
“পাঁজামশাই থাকেন কোথায়?”
“দোতলায়। আমি দোতলায় দেখেছি তাঁকে। সেকালের দোতলা, মানে যত ঘর তত প্যাসেজ! ফোটোও তুলেছিলাম দোতলার পিছন দিকের একটা ঘরের সামনে। বোধ হয় পাশেই ঠাকুরঘর।”
“তেতলায় কে থাকে?”
“বলতে পারব না। আমি তো তেতলায় উঠিনি। ওপরে কোনও শব্দও শুনিনি!”
“ফাঁকা পড়ে থাকত?”
“কী জানি!…আমি তো ফোটো তুলতে একবারই মাত্র গিয়েছি।”
“ছবি দিতে যাওনি?”
“না। উনি এসে দোকান থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন।”
চা প্রায় শেষ। কিকিরা চুমুক দিলেন চায়ে। আলগাভাবে। বললেন, “ওঁকে একবারই দেখেছ?”
“না, না, আরও দু-তিনবার দেখেছি। পথেঘাটে।” জহর জল খেল আবার। চায়ের কাপ টেনে নিল। “ভদ্রলোক খুব ইন্টারেস্টিং। গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, না হলে ফিনফিনে আদ্দির। পরনে মিহি ধুতি- দুইই বেশ দামি। গলায় একটা সোনায় গাঁথা পাথরের মালা। কী পাথর জানি না। হালকা নীল দেখতে। দানাগুলো ছোট ছোট। কাঁধে রঙিন চাদর। মাথার চুল ঝাঁকড়া, ফোলানো। হাতের আঙুলে অদ্ভুত সব আংটি…. লোহা, সিসে, তামা, সোনা, রুপো। বাঁ হাতে পাথর বসানো একটা বড় আংটি। কী পাথর জানি না। কালো কুচকুচে দেখতে।”
কিকিরা কৌতূহল বোধ করছিলেন। “আচ্ছা! জ্যোতিষী ভক্ত। ভাগ্য বিশ্বাসী। কী করেন উনি? ভাল কথা, বয়েসটা বললে না?”
“বয়েস হয়েছে৷ ফোটো তুলতে যখন গিয়েছিলাম তখন ওনার বয়েস পঞ্চাশ-টঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। এখন ষাটের মতন হবে।”
“মানে ঠিক বুড়ো নয়, প্রৌঢ়! কলসির জল গড়িয়ে খান? না, কিছু করেন? ব্যবসাপত্র?”
জহর বলল, “তা আমি জানি না, কাকা! তবে চাকরিবাকরি করার লোক নয়। ওসব পুরনো বনেদি বাড়িতে চাকরি করার রেওয়াজ থাকে না। গোলামির ধাতই নয় ওঁদের। ব্যবসাপত্র কী করেন বা করতেন, বলতে পারব না। শুধু জানি বা শুনেছি, বীরভূমের কোথায় যেন বিস্তর জমিজমা, বাগান, পুকুর, চালকল, এটাসেটা ছিল। জমিদার বংশ।”
“আর কলকাতায়?”
“এখানেও ছিল। তবে এটা পৈতৃক। আর বীরভূমে ওঁর মাতুল বংশের বাড়ি। সেই বংশ একেবারে ফাঁকা। বিনয়বাবুই একমাত্র জীবিত স্বজন। তিনিই মাতুলবংশের যাবতীয় সম্পত্তি ভোগদখলের উত্তরাধিকার পেয়েছেন।”
কিকিরা কেমন ধাঁধায় পড়ে গেলেন। বীরভূমে মাতুলবংশের জমিদারি আর কলকাতায় পৈতৃক সম্পত্তির একমাত্র মালিক।
কী ভেবে কিকিরা বললেন, “ভদ্রলোককে তুমি চিনলে কেমন করে?”
মাথা নাড়ল জহর। “সেভাবে আমি চিনি না, কাকা। বাবার সঙ্গে আলাপ ছিল। বাবার কাছে মাঝেসাঝে আসতেন। তখন দেখেছি। যেটুকু শুনছি তাও বাবার মুখে। আপনি তো জানেন, বাবা আজ প্রায় আট বছর আগে চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে।”
অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন কিকিরা! চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে একটা চুরুট ধরালেন।
শেষে কিকিরা বললেন, “পতাকীর ব্যাগ তো খোয়া গিয়েছে। বিনয়বাবুর পাঠানো ফোটো তো তুমি হাতে পেলে না। এরপর–?”
জহর মাথা চুলকে হতাশ গলায় বলল, “আমি বুঝতে পারছি না কী করব?”
“ফোটোটা যে খোয়া গিয়েছে, জানিয়েছ পাঁজামশাইকে?”
“না।”
“কেন?” ‘সাহস হচ্ছে না।”
“সাহস!”
জহর ইতস্তত করে বলল, “বিনয়বাবু বারবার বলে দিয়েছিলেন, ওটা খুব জরুরি। সাবধানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে। কাজটাও পনেরো দিনের মধ্যে করে দিতে হবে।” বলে একটু থেমে জহর কেমন সন্দেহের গলায়, বা খুঁতখুঁতে গলায় বলল, “আশ্চর্য কী জানেন। ফোটোটার–মানে ওটা এনলার্জ করার পর কোথায় কী রিটাচ করতে হবে তাও বলে দিয়েছিলেন।”
“মানে?”
“মানে রিটাচের সময় বাঁ চোখটা ডান চোখের তুলনায় সামান্য ছোট করতে হবে, চোখের দৃষ্টি একটু টেরা, মাথার কাপড় কপাল পর্যন্ত নামিয়ে দিতে হবে, নাক অতটা খাড়া রাখা চলবে না, গাল বসা, ভাঙা গোছের… আরও ছোটখাট দু-চারটে ব্যাপার!”
কিকিরা অবাক হয়ে বললেন, “কেন?”
“সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না। কতকাল আগে এক বৃদ্ধা মহিলার ফোটো তুলেছিলাম– মুখের ফোটো একেবারে নিখুঁত হয় না সাধারণত। তবু একটা মুখ নিয়ে কাজে বসলে আমরা–আমি অন্তত যেমন প্রয়োজন রিটাচ করে থাকি। বাবা অনেক ভাল পারতেন কাজটা। আমি অতটা পারি না। তবু খারাপ করি না। তা বলে, মুখের চেহারাটাই আমি দেখলাম না, মনেও নেই, উনি আমায় ফোনে কী কী করতে হবে বলে দিচ্ছেন, এটা কী ধরনের কথা!”
“তুমি কিছু বলেনি?”
“না। মুখে আসছিল, বলতে পারলাম না। বুড়োমানুষ; বাবার সঙ্গে আলাপ ছিল একসময়। ভাবলাম, আগে তো ফোটোটা দেখি, কী অবস্থা হয়েছে সেটার, তারপর বলা যাবে। ফোটো কম-বেশি নষ্টও হয়ে যেতে পারে।”
‘যত্ন করে না রাখলে হতেও পারে,” কিকিরা বললেন। চুপ করে গেলেন হঠাৎ। পায়ের দিকে একটুকরো কাগজ উড়ে এসেছিল হাওয়ায়। সরিয়ে দিলেন। বাইরে রোদ বাড়ছে। উজ্জ্বল রোদ আলোর সঙ্গে তাত। বাতাস সামান্য গরম।
কিকিরা বললেন, “তুমি একটা ফোন করো পাঁজামশাইকে, বা নিজে তাঁর বাড়ি যাও। ব্যাপারটা বলো। ওঁর কথামতন কাজ যখন নিয়েছ তখন তো তোমার জানানো উচিত, ফোটোটা তুমি পাওনি, সেটা খোয়া গিয়েছে।”
“তা তো বলতেই হবে। ভাবছি, আজ ফোন করব। নম্বরটা উনি বলেছিলেন।”
“দেখো কী বলেন! …আচ্ছা জহর, তোমার কি মনে হয়, কেউ জেনেশুনে পতাকীর কাছ থেকে ব্যাগটা হাতিয়েছে? তা যদি হয় তবে মামুলি পকেটমারের কাজ এটা নয়। টাকা-পয়সার জন্যেও ব্যাগ হাতায়নি। তার উদ্দেশ্য ছিল ওই ফোটোটা হাতিয়ে নেওয়া!”
জহর গলা ঘাড় মুছে নিল রুমালে। কিকিরাকে দেখছিল। বলল, “আমি বুঝতে পারছি না কাকা। আপনি যা বলছেন, সেরকম সন্দেহ আমারও হয়েছে। কিন্তু ভাবছি, সামান্য একটা ফোটো হাতাবার জন্যে এত কাণ্ড কে করবে? কেনই বা করতে পারে? …আমি পতাকীদাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছি, কেউ তাকে কিছু বলেছে কি না! কিংবা তার পিছু নিয়েছিল বলে মনে হয়েছে কি না! পতাকীদা বলছে, একটা লোক তার পিছু নিয়েছিল। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, আবার কথাটা উড়িয়ে দিতেও পারছি না। হয়তো একটা গোলমাল, আছে। হয়তো…?”
“পরে সেটা ভাবা যাবে। আগে তুমি একটা ফোন করো পাঁজামশাইকে। তাঁর রি-অ্যাকশানটা দেখো। তারপর যা করার করতে হবে।”
“আপনি যদি দেখেন তার চেয়ে ভাল আর কী হবে!” জহর অনুরোধের গলায় বলল।
কিকিরা হাসলেন। সমেহ হাসি। “দেখা যাক..!”
.
৪.
তারাপদদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর জহরকে বললেন কিকিরা, “এরা অ্যামেচার। আমারই মতন। যেমন গুরু, তেমনই চেলা। তবে কাজের বেলায় অপদার্থ নয় একেবারে।” বলে হাসলেন।
জহরকে আগে কোনওদিন দেখেনি তারাপদরা। দেখার কথাও নয়। দুজনেই দেখছিল জহরকে। একেবারে সমবয়েসি না হলেও প্রায় কাছাকাছি বয়েস। চোখমুখের চেহারাতেই বোঝা যায়, ভদ্র সাদাসিধে মানুষ। ঘোরপ্যাঁচে থাকার লোক নয়। বরং. খানিকটা বেশি সরল।
পতাকী আজও দোকানে আসেনি। তবে অনেকটাই ভাল। পাশের দোকানের একটি আধবুড়ো লোককে মাঝে মাঝে ডেকে নিয়ে জহর তার দোকান সামলে যাচ্ছে। আগামীকাল হয়তো পতাকী আসতে পারে।
কিকিরাদের দোকানে বসিয়ে জহর বলল, “কাকা, আপনারা একটু বসুন, আমি আসছি। পাঁচ-সাত মিনিট…”
সন্ধে হয়ে গিয়েছে। এখন সাত, সোয়া সাত। দোকান বন্ধ হবে আরও ঘণ্টাখানেক পরে। আটটায়। বাইরের বড় রাস্তায় গাড়িঘোড়ার ভিড় এখনও কম নয়। তবে কমে আসছে ক্রমশ। একটা বাসের হর্ন কানের পরদা কাঁপিয়ে চলে গেল এই মুহূর্তে।
তারাপদরা দোকানের ভেতরটা দেখতে দেখতে বলল, “এ একেবারে ভেরি ওল্ড দোকান, সার। চেয়ার টেবিলগুলো পর্যন্ত সে আমলের। কাঠের বাজারে দাম আছে।”
কিকিরা নিস্পৃহ গলায় বললেন, “ওল্ড ইজ গোল্ড।”
তারাপদ মজা করে বলল, “পিওর, না খাদ মেশানো?”
চন্দন দোকানের দেওয়ালে টাঙানো কয়েকটা ফোটো দেখছিল। ফ্রেমে বাঁধানো বড় আর মাঝারি ছবি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধি, একটি বৃদ্ধ সন্ন্যাসী, মড়ক বা দুর্ভিক্ষের অসাধারণ এক ফোটোগ্রাফ। আরও আছে। পুরনো হাওড়া ব্রিজ, ময়দানে দাঁড়ানো একটা ফিটন…. মায় একটা ভাঙা কলসি আর কাক, কলকাতার গঙ্গার ঘাট– বাবুঘাট বোধ হয়।
চন্দনের কৌতূহল হচ্ছিল। কিছু ফোটোগ্রাফ এত পুরনো যে, ওসব দৃশ্য যখন তোলা হয়েছে জহর তখন জন্মায়নি, বা শিশু।
কিকিরা চন্দনকে দেখছিলেন। অনুমান করতে পারলেন সে কী ভাবছে। বললেন, “ভেরি সিল ব্যাপার, চাঁদুবাবু! জহরের বাবার হাতে ভোলা ফোটো অনেক, দু-একটা আবার বাবার গুরুর, মানে যিনি হাত ধরে জহরের বাবাকে বিদ্যেটা রপ্ত করাতেন। বাকি যা দেখছ…”
কথাটা শেষ করতে না দিয়ে চন্দন বলল, “আপনি দেখছি নাড়ি নক্ষত্র জানেন?”
“জানি মানে, শুনেছি। আড্ডা মারা স্বভাব, দোকানে এলে গল্প-গুজব হত–তখন শুনতাম। বিখ্যাত বিপ্লবী হেম কানুনগো একজন মাস্টার ফোটোগ্রাফার ছিলেন, জানো?”
চন্দন মাথা নাড়ল, জানে না।
স্টডিয়োর এটা অফিসঘর। হাতকয়েক জায়গা। টেবিল চেয়ার। একটা পুরনো আলমারি। কাঁচের পাল্লা। ভেতরে বিক্রিবাটার জন্যে শস্তা দু-তিনটে বক্স ক্যামেরা, ফিল্ম রোল, বাঁধানো অ্যালবাম। ডানপাশে বোধ হয় স্টুডিয়ো ঘর। কাঠের খুপরি ঘরের দরজা
তারাপদ হঠাৎ হেসে বলল, “কিকিরা, আপনি কি কোনও সময়ে ক্যামেরা কাঁধে ঘুরতেন নাকি?”
“আমি! …না তারাবাবু, নেভার। আমার দুটো জিনিস নেই, ধৈর্য আর তৃতীয় নয়ন।”
“সে কী, সার! আপনার তো দুটোই প্রবল।”
“ঠাট্টা করছ! …তা হলে তো তোমাদের ভজুদার বাণী শোনাতে হয়!”
“কে ভজুদা?”
“ফিশ ক্যাচার। ছেলেবেলার, আমার ছেলেবেলার কথা বলছি, ভজুদা আমাদের পাড়ার পয়লা নম্বর ওস্তাদ ছিল মাছ ধরার। এগারোটা নানা টাইপের ছিপ, এক কৌটো বঁড়শি, সাত কিসিমের চার বানাতে পারত। ভজুদার কাছে তালিম নিতে গিয়েছিলাম। একটা পুঁটিমাছও ধরতে পারিনি। ভজুদা তখন মাথায় চাঁটি মেরে বলেছিল, তোর দ্বারা হবে না! ওরে গাধা, তোর না আছে ধৈর্য, না চোখ। না ধৈর্য, না দৃষ্টি…. ওরে ভূত, অর্জুন কি সাধে অর্জুন! চোখের দৃষ্টি একেবারে নিবাত নিষ্কম্প…. তুই গর্দভ– গো ব্যাক। ভাতের পাতে যে মাছভাজা পাবি, তুলে নিয়ে মুখে পুরগে যা। পুকুরের মাছে তোর নো চান্স।”
তারাপদ হাসতে হাসতে বলল, “সংস্কৃত বাণীটাও ভজুদার?”
“ও ইয়েস। ভজুদার ইংলিশও ছিল আমার মতন। হোম মেইড ইংলিশ।”
ওরা হেসে উঠল।
এমন সময় ফোন বাজল দোকানের। টেবিলের ওপর ফোন। কিকিরারা ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। জহর ফেরেনি এখনও। তিনি ইতস্তত করে উঠে গিয়ে ফোন ধরলেন।
সাড়া দিলেন না কিকিরা। সরাসরি নয়। তবে শব্দ করলেন। কাশলেন যেন।
ওপাশ থেকে গম্ভীর গলা, “জহর…!”
কিকিরা টেলিফোনের মুখের কাছটায় হাত চাপা দিলেন। তারাপদদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন। চুপ করতে বললেন।
“উনি একটু বাইরে গেলেন; আসবেন এখনই,” কিকিরা ফোনের মুখ থেকে হাত সরিয়ে সাধারণ ভাবে বললেন।
“তুমি কে?” ওপার থেকে প্রশ্ন।
“আমি ওঁর চেনা কাস্টমার। …আমাকে বসিয়ে একটু বাইরে গেছেন দরকারি কাজে এসে পড়বেন।”
“ঠিক আছে। আমি পরে ফোন করছি।”
“কী নাম বলব?
“বিনয়বাবু?” ওপাশে ফোন নামিয়ে রাখলেন ভদ্রলোক।
কিকিরা তারাপদদের দিকে তাকালেন। “পাঁজাবাবুর ফোন।” গলায় ঈষৎ উত্তেজনা। সরে এলেন টেবিলের সামনে থেকে।
তারাপদ বোধ হয় আগেই আন্দাজ করেছিল। চন্দনের দিকে তাকাল।
“কড়া গলা নাকি, সার?” তারাপদ বলল।
“গম্ভীর।”
“হিজ মাস্টার্স ভয়েস?” চন্দন ঠাট্টা করে বলল।
“মেজাজ আছে।”
“তা থাক। কড়া হলে অন্যরকম মনে হত।”
ততক্ষণে জহর ফিরে এল। এসেই বলল, “আমার একটু দেরি হয়ে গেল কাকা। আসলে আমি বুলুবাবুর দোকানে গিয়েছিলাম। ওঁর বাবাকে বিকেলে নার্সিং হোমে ভরতি করা হয়েছে। হার্ট অ্যাটাক। খবর নিয়ে এলাম। পাশাপাশি সব দোকান, একসঙ্গে আছি..”
“তোমার বিনয়বাবু ফোন করেছিলেন।”
জহর যেন ঘাবড়ে গেল। “কিছু বললেন?”
“আবার ফোন করবেন।”
মাথা নাড়তে নাড়তে জহর টেবিলের সামনে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল। “কাল থেকে এই নিয়ে বারচারেক হয়ে গেল। এক
একবার ফোন আসে আর আমার বুক ধড়ফড় করে।”
“তুমি কাল পাঁজামশাইকে ফোন করে খবরটা জানিয়েছ তা হলে!”
“জানিয়েছি। তবে একটু ঘুরিয়ে।”
“মানে?”
“বললাম, যে-লোকটিকে পাঠিয়েছিলাম, আমার দোকানের পাতকীদা, সে ফেরার পথে অ্যাকসিডেন্ট করেছে। তার ব্যাগটা পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় হারাল…”
“অশ্বত্থামা হত ইতি গজ…”
“হ্যাঁ, এইরকম আর কী! শুনে তো উনি একেবারে আগুন। রাগে ফেটে পড়লেন। যা মুখে এল বললেন আমাকে। ….আমি তখনকার মতন ওঁকে ঠাণ্ডা করার জন্যে বললাম, আমি খোঁজখবর করছি। ব্যাগটার। পতাকীদা বাড়িতে পড়ে আছে বিছানায়, নয়তো…”
“ওতে কি আর ভবি ভোলে?”
“ভুলছে না। কাল দু’বার ফোন এসেছে। আজ ও-বেলা একবার। আবার এখন একবার। আরও তো আসবে বলছেন।”
চন্দন বলল, “একটা পুরনো ফোটোর জন্যে এমন পাগলামি! ভদ্রলোকের এত হইচই করার মানেটা কী?”
দোকানের ভেতরের দরজাটা হালকা কাঠের ঠেলা-দরজা। বাইরের দিকেও একটা দরজা আছে, কাঠের। দরজা ঠেলে যে ঢুকল তার হাতে চায়ের কেটলি আর কাপ৷ জহরকে বলতে হল না, আগেই বলে এসেছে। কিকিরাদের চা দিল লোকটি। জহরও চা নিল।
লোকটি চলে যাওয়ার পর জহর বলল, “পতাকীদা আমায় ডুবিয়ে দিল। এখন আমি কী করব! বিনয়বাবুকে সামলাই কেমন করে!”
তারাপদ তামাশা করে বলল, “এক কাজ করুন। বাড়ির কেউ হারিয়ে গেলে লোকে কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়, অমুক চন্দ্র অমুক নিরুদ্দেশ। বয়েস এত, চেহারার একটা বর্ণনা…। আপনি ভদ্রলোককে বলুন-ফোটো নিরুদ্দেশের একটা বিজ্ঞাপন দিতে কাগজে।” বলে হাসল।
চন্দন বলল, “কেন! শুধু মানুষ কেন, দরকারি কাগজপত্র, চাবি, লাইসেন্স হারানোর বিজ্ঞাপনও তো কাগজে থাকে।”
জহর কোনও জবাব দেবে না ভেবেছিল। যার জ্বালা সে বোঝে, অন্যে কী বুঝবে! ওরা রসিকতা করছে করুক।
কিছু বলব না ভেবেও জহর হঠাৎ বলল, “যাঁর ফোটোর কথা হচ্ছে–তিনি অবশ্য সত্যিই নিরুদ্দেশ।”
কিকিরা একবার তারাপদদের দেখলেন, তারপর জহরের দিকে তাকালেন। “নিরুদ্দেশ। মানে মিসিং।”
“হ্যাঁ। নিখোঁজ।”
“কবে? কই, তুমি তো আগে আমায় বলোনি।”
“আমি কেমন করে বলব! জানতাম আগে?”
“জানতে না!… কবে জানলে?”
“গতকাল,” জহর বলল। চুপ করে থাকল কয়েক মুহূর্ত, তারপর কেমন হতাশ গলায় বলল, “কাল যখন উনি আবার ফোন করলেন, দ্বিতীয়বার, তখন আমি কিছু না ভেবেই বলেছিলাম, “আপনি রাগ করছেন কেন? একটা ফোটো তো! আপনি বলুন, যেদিন বলবেন, আমি আপনার বাড়ি গিয়ে তুলে আনব।… উনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, কার ফোটো তুলবে! যে-মানুষ নেই তার ফোটো তুলবে। ননসেন্স। কাজটা অত সহজ হলে আমি তোমায় পুরনো ফোটোটা পাঠাতাম না, বলতাম না–তুমি ওই পুরনো থেকে আমায় একটা এনলার্জ কপি করে দাও।”
“নেই মানে?” কিকিরা বললেন।
“মানে আমি জানি না। তবু বোকার মতন বলেছিলাম, সে কী! মারা গিয়েছেন। আমার কথা শুনে কী ভাবলেন কী জানি, শুধু বললেন, মিসিং, খোঁজ পাওয়া যায়নি।”
“মিসিং! তারপর।”
“আর কিছু বলেননি। আমিও সাহস করে অন্য কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি।”
কিকিরা বেশ অবাক। চন্দনদের দিকে তাকালেন। তারাও বোকার মতন বসে আছে। বুঝতে পারছে না ঠিক কী হয়েছে, হতে পারে।
এমন সময় ফোন বাজল।
ফোন তুলল জহর।
“হ্যাঁ, জহর বলছি।” ওপাশ থেকে বিনয়বাবুই কথা বলছেন। কী বলছেন কিকিরা শুনতে পাচ্ছিলেন না; শোনার কথাও নয়। জহর শুধু সাড়া দিয়ে যাচ্ছিল।
সামান্য পরেই ফোন রেখে দিল জহর। “পাঁজামশাই?”
“হ্যাঁ।”
“কী বললেন?”
“বললেন,কাল বিকেলে উনি নিজেই আসবেন দোকানে। অনেক খুঁজে একটা নেগেটিভ তিনি পেয়েছেন। অন্য নেগেটিভ। পড়ে থেকে থেকে ফেড হয়ে গিয়েছে। নষ্ট হয়ে যাওয়াই সম্ভব। তবু সেটা নিয়ে তিনি আসবেন, যদি কাজে লাগে।”
তারাপদ হঠাৎ বলল, “তা আগে এলেই তো পারতেন।”
জহর বলল, “উনি অসুস্থ মানুষ। বয়েস হয়েছে। কী করে বুঝবেন যে-ফোটোটা পাঠাচ্ছিলেন সেটা হারিয়ে যাবে ওভাবে।”
“উনি অসুস্থ। কী অসুখ?” কিকিরা জানতে চাইলেন।
“আমি তো শুনলাম, সবসময় মাথা ঘোরে। বললেন, ভারটিগো।”
“ভারটিগো!” চন্দন বলল, “ভারটিগো সাধারণত ঘোরানো সিঁড়ি-টিড়ি উঠতে গেলে হয়, খুব উঁচু জায়গায় গিয়ে নীচে তাকালেও হয়। আরও নানা কারণে হতে পারে। উনি কি হাইপার টেনশান–মানে হাই ব্লাড প্রেশারে ভোগেন?”
অসহায় মুখ করে জহর বলল, “আমি জানি না। হতে পারে…”
কিকিরা কী যেন ভাবছিলেন। চোখ বুজে ডান হাতটা কপালে রেখে বসে থাকলেন। খানিকটা পরে চোখ খুললেন। বললেন, “শোনো উনি কাল আসছেন আসুন। ভালই হল। আমিও আসব। তবে দোকানে নয়। উনি যতক্ষণ থাকবেন ততক্ষণ নয়। তার বদলে একটা জিনিস আমি রেখে যাব।” বলে কিকিরা হাত বাড়িয়ে টেবিলের একটা নির্দিষ্ট জায়গা দেখালেন। “শোনো জহর, কাল একসময় এই বেলার দিকে এসে আমি তোমার টেবিলেই ওই জায়গায় একটা ডেস্ক পে-হোল্ডার রেখে যাব। ছ’ সাত ইঞ্চি লম্বা। হোল্ডারের মাঝখানে একটা ছোট ঘড়ি। টেল ঘড়ি৷ দেখতে কালো, ছোট, হালকা, স্মল পিস। ঘড়িটার দু পাশে দুটো খোপ আছে। একটাতে পেন-হোল্ডার-মানে কলম রাখার ব্যবস্থা, অন্যটায় পেপারকাটার, ক্লিপ এ-সব। আসলে টেক্ল ঘড়ি হলেও এটা কিন্তু টেপ রেকর্ডার। পেন হোল্ডারের মুখটা আসলে মাইক। তলায় টেপ আর ব্যাটারি রাখার ব্যবস্থা। বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না। জাপানি মাল তো, পাক্কা অ্যারেঞ্জমেন্ট। ফ্যান্সি মার্কেট থেকে কিনেছিলুম। … আমার কাছে এরকম দু-একটা জিনিস আরও আছে, অন্য কায়দার। তবে সেগুলোয় এখানে সুবিধে হবে না। ঘড়িটাই একদম মানিয়ে যাবে।”
তারাপদরা কিকিরার বাড়িতে হরেকরকম পুরনো নতুন, নানান ধরনের জিনিসপত্র দেখেছে। এসব তাঁর জমিয়ে রাখার শখ। ওরা অবাক হল না।
জহর বলল, অবাক হয়েই, “ঘড়ি নিয়ে আমি কী করব, কাকা?”
“তুমি কী করবে আর! সময়মতন চালু করে দেবে। কেমন করে দেবে আমি দেখিয়ে দেব। ভেরি ইজি ব্যাপার।”
“তারপর?”
“পাঁজাবাবুকে যা বলার বলতে দেবে। তুমি চেষ্টা করবে তাঁকে দিয়ে বেশি কথা বলাবার।”
“মানে?”
“মানে যতটা পারো নিরুদ্দেশ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবে। কোথায় কবে কেমন করে নিরুদ্দেশ হলেন মহিলা? এতকাল পরে ফোটোটা এনলার্জ করার দরকার পড়ল কেন? কী হবে এনলার্জ করিয়ে? অত রিটাচ করারই বা দরকার কেন?”
“ফোটোই হল না, তো রিটা।”
“যদি ওঁর নেগেটিভ থেকে হয়?”
“কিন্তু কাকা, এসব ওঁর ফ্যামিলির ব্যক্তিগত ব্যাপার। বলবেন কেন?”
“না বলতেও পারেন! আই অ্যাডমিট।”
“তবে?”
“জহর! আমি পাঁজামশাইকে দেখিনি। তাঁর সম্পর্কে জানি না কিছু। তবু তোমায় বলছি, ভেতরে কোনও বড় রহস্য আছে। সাম্ মিস্ট্রি। নয়তো এতকাল পরে ভদ্রলোক ফোটো নিয়ে এত ব্যস্ত, উতলা হতেন না।”
জহর চুপ করে থাকল।
কিকিরা তারাপদদের দিকে তাকালেন। তারাপদরাও যেন গন্ধ পাচ্ছিল রহস্যের।
“আমরা এখন উঠি,” কিকিরা বললেন জহরকে। “ঘাবড়ে যেয়ো, না। কাল আমি যথাসময়ে তোমার স্টুডিয়োর কাছাকাছি হাজির থাকব। দেখাও হবে। নার্ভাস হবে না একেবারে। চলি।” কিকিরা উঠে পড়লেন।
.
৫.
হালদার স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খানিকটা এগিয়ে কিকিরা দাঁড়িয়ে পড়লেন।
কলকাতা শহরে কদাচিৎ বসন্তকালের মোলায়েম ফুরফুরে স্নিগ্ধ হাওয়া অনুভব করা যায়। এখন যে হাওয়া দিচ্ছিল তা মনোরম, খানিক এলোমেলো। ফুটপাথের পাশেই পুরনো এক গির্জা, সামান্য ফাঁকা মাঠ, কয়েকটা সাবু গাছ।
“কটা বাজল, চাঁদু?”
চন্দন ঘড়ি দেখল হাতের। “সাড়ে সাত বেজে গিয়েছে।”
কিকিরা একবার আকাশের দিকে তাকালেন। পূর্ণিমার কাছাকাছি কোনও তিথি। দ্বাদশী ত্রয়োদশী হবে।
“ভাবছি একবার পানু মল্লিকের কাছে যাবা”
“ক্রিমিন্যাল ল’ইয়ার?” তারাপদ বলল।
“ক্রিমিন্যাল ল’ইয়ার আবার কী হে! ক্রিমিন্যাল কেসের প্র্যাকটিস করেন।”
“ওই হল!… তা তাঁর কাছে কেন?”
“পানুদাকে বলেছিলাম, আপনার পাড়ার কাছাকাছি পাঁজামশাই থাকেন, একটু খবরাখবর নেবেন।”
“ও! কোথায় থাকেন আপনার পানু মল্লিক?”
“কেশব সেন স্ট্রিট।” বলেই হাত বাড়ালেন কিকিরা, “দেখি একটা ফুঁ দাও তো!” ফুঁ মানে সিগারেট। কিকিরা নিজের মনেই বললেন, “পানুদার ঠিকানা কেশব সেন স্ট্রিট হলেও ওঁর বন্ধুবান্ধব আজ্ঞা থিয়েটার ক্লাব বরাবরই বউবাজারের দিকে ছিল।”
সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে তারাপদ বলল, “এখন যাবেন। বেটাইম হয়ে যাবে না। গিয়ে হয়তো দেখবেন, ভদ্রলোক মক্কেল নিয়ে বসে আছেন। উকিল আর ডাক্তার– সন্ধেবেলায় কামাই দেয় না শুনেছি। টাকা কামাবার টাইম ওটা।” বলে চোখ টেরা করে চন্দনকে দেখল।
চন্দন পাত্তাই দিল না তারাপদকে, কথাটা যেন তার কানেই যায়নি। “আপনি একা যাবেন তো চলে যান, আমরা কেটে পড়ি।”
“তা হয় না। তোমরাও চলো। …আরে আমি বুড়োমানুষ, অর্ধেক কথা মাথায় আসে না, যা শুনি ভুলেও যাই। চলো।”
“আমাদেরও টেনে নিয়ে যাবেন!”
“বা, তোমরাই তো আমার কমান্ডো।”
তারাপদরা হেসে উঠল। কিকিরা নজর করে ফাঁকা ট্যাক্সি দেখছিলেন। পেয়েও গেলেন একটা।
ট্যাক্সিতে বসে কিকিরা হঠাৎ বললেন, “চাঁদু, তোমাদের ডাক্তারিতে কী বলে! এমন তো অনেক সময় দেখো, আপাতত, গোড়ায় গোড়ায় যে রোগটাকে সিম্পল বলে মনে করছ, পরে দেখলে সেটা ভীষণ জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ঠিক কি না?”
চন্দন মাথা হেলিয়ে বলল, হয়।
“আমার সন্দেহ হচ্ছে, পাঁজাবাবুর কেসটা জলবৎ নয়।”
তারাপদ বলল, “সার, জলবৎ না জটিলবৎ সেকথা বাদ দিন। এই কেসটা তো আপনাকে কেউ নিতে বলেনি। ক্লায়েন্ট নেই। তবু নিজেই আপনি নাক গলাচ্ছেন।”
কিকিরা বললেন, “আমার যে স্বভাব ওইরকম। নেই কাজ তো। খই ভাজ।” বলে হেসে উঠলেন।
.
পানু মল্লিক নীচেই ছিলেন। তাঁর বাড়ির চেম্বারে। এক মক্কেলকে সবেই ঘর থেকে সরিয়েছেন, কিকিরা মুখ বাড়ালেন।
“আরে কিঙ্কর!”
“আসব?”
“ন্যাকামি কোরো না! এসো।”
“আপনার আরেক মক্কেল বাইরে বসে আছে।”
“কালী!” পানু মল্লিক ডাকলেন।
ঘরের একপাশে আধবুড়ো একটি লোক টাইপ মেশিন আর কাগজপত্র নিয়ে বসে ছিল। কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
পানু মল্লিক বললেন, “বাইরে বলরাম শীল বসে আছে। তাকে বলে দাও, কাল কোর্টে গিয়ে যেন দেখা করে। জজসাহেবকে কাল পাব না। এ হপ্তায় কাজের কাজ কিছুই হবে না। সবুর করতে হবে ক’টা দিন।”
কালী চলে গেল।
পানু মল্লিক কিকিরাদের বসতে বললেন। “ও দুটি তোমার নন্দীভৃঙ্গী নয়!”
কিকিরা হাসলেন। তারাপদদের চেনেন পানু। চোখের চেনা।
দু-চারটে সাধারণ কথা। তারপর কিকিরা বললেন, “আমার সেই পাঁজামশাই, বিনয় পাঁজার খোঁজ নিয়েছেন?”
“নিয়েছি কিছু কিছু। …আরে ওই ভদ্রলোক তো এখন লাটে উঠে বসে আছেন। টোটালি ডুবে গিয়েছেন।”
“মানে?”
“আমি শুনলাম, ভদ্রলোক দেনায় দেনায় মাথা ডুবিয়ে বসে আছেন। সবচেয়ে বড় দেনা হল, তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগে বারো কাঠা জমি ওইরকম হবে, একটা লোককে মর্টগেজ দেন। জমির মালিকানা ছিল বিধবা মায়ের নামে। সত্তর আশি হাজার টাকায় মর্টগেজ ছিল। সুদ ধরা ছিল টাকার ওপর। এখন সুদ সমেত তার পাওনা ছ’সাত লাখ টাকা।
তারাপদ আঁতকে উঠে বলল, “ছ’-সাত লাখ?”
“কম্পাউন্ড ইন্টারেস্ট হলে হতেই পারে। তার ওপর ওই জমিতে একটা ছোট সিনেমা হল তৈরি করেছিলেন ওই ভদ্রলোক– যিনি টাকা ধার দেন। বছর কয়েক হল– সিনেমা বন্ধ। চলছে না।”
“কেন?”
“জানি না। …ওসব থার্ডক্লাস হল আর চলে না বলেই বোধ হয়।”
“এ ছাড়া!”
“বরানগরের দিকে একটা বাজার ছিল। লিজ দিয়েছিলেন। সেটাও হাতছাড়া হয়েছে।
“আর?”
“আরও ছিল। চিৎপুরের দিকে একটা বাড়ি ছিল। বারো ভাড়াটের বাস। তারা ভাড়া তো দেয়ই না, বাড়ির মালিকানাও মানতে চায় না। কোর্ট দেখিয়ে দেয়।”
“আশ্চর্য!”
“ধুস, এতে আবার আশ্চর্য হওয়ার কী আছে! কলকাতা শহরের কত পুরনো বাড়ির এই হাল- তোমরা তার খোঁজ পাবে কেমন করে!”
কিকিরা চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। পরে বললেন, “শুনেছি, বীরভূমের দিকে পাঁজামশাইয়ের মাতুল বংশ। ওদিকেও ফাঁকা। সেখানে জমি জায়গা বাগান পুকুর..”
“জানি না কিঙ্কর। আমার কাছে তেমন খবর নেই। বীরভূমের দিকে মায়ের বাপের বাড়ি ছিল শুনেছি। তবে জমিজমা বাগান সত্যি কতটা ছিল– আর থাকলেও শেষ পর্যন্ত মায়ের বাপের বাড়ির সম্পত্তি ওঁর হাতে এসেছিল কি না, বলতে পারব না। খোঁজ করার উপায় আমার নেই।” বলতে বলতে পানু মল্লিক আয়াস করে বসে একটা সিগারেট ধরালেন। “কালী, এদের চা কী হল? বাড়ির মধ্যে বলেছ?”
কালী বলল, বলে এসেছে।
“কিঙ্কর?”
“বলুন পানুদা?”
“ব্যাপারটা কী হে? তুমি হঠাৎ পাঁজা নিয়ে পড়লে কেন?.. ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় নেই, তবে দেখেছি। লোকটিকে। প্রায় বুড়ো, ষাট-বাষট্টি তো হবেই। বনেদি চেহারা। ধুতি-পাঞ্জাবি পরেন। মাথার চুল বারো আনাই সাদা। পথেঘাটে বড় একটা চোখেই পড়ে না। শুনেছি নিজের ওই বাড়ি ছেড়ে বেরোন না একরকম। ওঁর আপাতত কোনও সংসারও নেই। মেয়ে-জামাই বিদেশে।”
কিকিরা মন দিয়ে পানুবাবুর কথা শুনছিলেন। যত শুনছিলেন ততই যেন ধাঁধায় পড়ে যাচ্ছিলেন।
কাঠের ট্রে করে চা নিয়ে এল একটি ছোকরা।
“নাও চা খাও,” পানুবাবু বললেন। “ব্যাপারটা কী আমায় একটু বলবে?”
কিকিরা মাথা হেলালেন। চায়ের কাপ তুলে নিলেন টেবিল থেকে, তারপর সংক্ষেপে বললেন ঘটনাটা।
পানু শুনলেন। ভাল উকিলের চোখ কান যেন অনেক বেশি সতর্ক ও তীক্ষ্ণ হয়। বিশেষ করে ক্রিমিন্যাল প্র্যাকটিস নিয়ে যাদের দিন কাটে মাসের পর মাস।
কিকিরা চুপ করলেন। চন্দন আর তারাপদ কোনও কথাই বলেনি। তারা নেহাতই যেন সঙ্গী। মাঝে-মাঝে মনে হচ্ছিল, ওদের উদাসীন ভাব দেখে, বিষয়টা নিয়ে কিকিরার যত উৎসাহই থাক তাদের বিশেষ কোনও আগ্রহ নেই।
পানু মল্লিক একটা অদ্ভুত শব্দ করলেন। তারপর বললেন, “কিঙ্কর, যত চোর গুণ্ডা বাটপাড় খুনে নিয়ে আমার দিন কাটে। এক্সপিরিয়ান্স কী কম হল! দেখলাম অনেক। হাই লেভেল লো লেভেন— কোথায় ক্রিমিন্যাল নেই! এভরি হোয়ার। পেশাদারি ভাবে কথার প্যাঁচে, অনেককে বাঁচিয়েছি, অনেকের জন্যে সরকারি খানাদানার ব্যবস্থা করেছি দু’-চার বছরের জন্যে। …তা সে কথা থাক। আসল কথাটা কী জানো ভায়া, ক্রিমিন্যালরা দু’-ক্লাসের হয়। মেইনলি। একটার কাজকর্ম হয় অনেকটা সরল গতির। এরা মুখ, টেম্পারামেন্টাল, গবেট। আর-এক ক্লাসের ক্রিমিন্যাল দেখেছি, তারা যত চতুর ততই জটিল। এদের হল বক্ৰগতি। ধরাই যায় না, বেটারা সত্যিই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, না, এক-একটা ভয়ঙ্কর শয়তান।…আমি পাঁজামশাই সম্পর্কে আগে থেকে কোনও কমেন্ট করব না। কিন্তু তুমি যদি ওঁকে নজরে রাখো হয়তো সত্যি-মিথ্যে অনেক কিছু জানতে পারবে।…আর শোনো, আমি ভদ্রলোক সম্পর্কে আরও খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করব। জানাব তোমায়।”
কিকিরা উঠে পড়লেন। “চলি পানুদা। আপনি যা বলেছেন আমি তার সঙ্গে একমত।”
চন্দনরাও উঠে পড়ল।
রাস্তায় এসে চন্দন হঠাৎ বলল, “কিকিরা আমাদের হাসপাতালে বীরভূমের একটি ছেলে আছে। আমার কলিগ। বীরভূমের খোঁজ আমি নেব।”
.
৬.
দুটো দিন কেটে গেল। কিকিরা আশা করেছিলেন, জহরের টেবিলে যে যন্ত্রটি রেখে এসেছিলেন–সেই গোপনে রাখা টেপ রেকর্ডার থেকে বিনয় পাঁজার মুখে তাঁর নিজের তরফের কথা অনেকটাই জানা যেতে পারে।
পাঁজামশাই কম কথার মানুষ। জহরও ততটা চতুর নয়, তার সেই বুদ্ধি আর তৎপরতাও নেই যে খুঁচিয়ে ভদ্রলোকের মুখ থেকে, বলা ভাল পেট থেকে, দশটা কাজের কথা বার করে নেবে। জহর পারেনি।
ওরই মধ্যে কাজের কথা যা জানা গিয়েছে, তা হল–বিনয়বাবু তাঁর মা আর বাড়ির কাজকর্মের দু-তিনজনকে নিয়ে সে বছর হরিদ্বার হৃষীকেশ যান। ওই পথে যতটা পারেন যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। তখনও ঠিক বর্ষা পড়েনি। গরম শেষ হয়ে আসছে। বিনয়বাবু আগে থেকেই কোথায় কোথায় উঠবেন সে ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। সবই প্রায় কোনওনা-কোনও আশ্রম। বিনয়বাবুদের পরিবারের সঙ্গে পরিচিত, দু’পুরুষ তো হবেই। তীর্থযাত্রীদের জন্যে ধর্মশালা বা ওইরকম কিছু তো আছেই। তা তীর্থযাত্রার মধ্যে একদিন হঠাৎ দুর্যোগ দেখা দিল। আচমকা। দুপুর থেকে বৃষ্টি। বিকেল-শেষে সেই বৃষ্টি প্রবল হল; তার সঙ্গে ঝড়। অন্ধকারে ডুবে গেল পাহাড়পর্বত গাছপালা। কিছুই আর ঠাওর করা যায় না।
তখন ঘন রাতও নয়, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, হঠাৎ সব কেমন দুলে উঠল। ভীষণ এক শব্দ। মুহূর্তের মধ্যে রটে গেল ভূমিকম্প। তখন মাথা ঠাণ্ডা রাখার মতন মানুষই বা ক’জন। প্রাণের ভয়ে কে যে কীভাবে মাথার আশ্রয় সাধারণ ধর্মশালা ফেলে বাইরে বেরিয়ে পাগলের মতন ছোটাছুটি শুরু করল বোঝানো মুশকিল।
পাঁজাবাবুর পরিবারের একজন সেই দুর্যোগে চিরকালের মতন হারিয়ে গেলেন। পাঁজাবাবুর বৃদ্ধা মা। বৃদ্ধা হলেও একেবারে অক্ষম বা পঙ্গু নন।
কোথায় হারালেন?
সম্ভবত দিকদিশা পথ ঠিক করতে না পেরে ওই বৃষ্টি আর অন্ধকারের মধ্যে পাহাড়ি সরু পথের কিনারা থেকে গড়িয়ে পড়েছিলেন নীচে। গভীর কোনও খাদে। সেখান থেকে কাউকে উদ্ধার করা অসম্ভব। ঘন গাছপালায় পাথরে মাটিতে অন্ধকার একেবারে। কোন অতলে নেমে গিয়েছে সেই খাদ কে জানে। তার ওপর ধস নেমেছিল কোথাও কোথাও। বৃষ্টি তো ছিলই।
যাই হোক, পরের দিন বিকেলে আবহাওয়া খানিকটা ভাল হলেও ওঁর খোঁজ করা সম্ভব হয়নি। তার পরের দিন উন্নতি হল আবহাওয়ার। বৃদ্ধার খোঁজ করা হল। পাওয়া যায়নি। সকলেরই ধারণা হল, উনি মারা গিয়েছেন, দেহটা কোথায় চাপা পড়ে আছে জানা সম্ভব নয়।
ঘটনাটা ঠিক পাঁচ বছর আগেকার।
আশ্চর্যের ব্যাপার, এই সময়ের প্রায় বছরখানেক আগে বিনয় পাঁজা জহরকে বাড়িতে ডেকে পাঠিয়ে বৃদ্ধার ফোটোটি তুলিয়েছিলেন। উনি কী করে জানবেন, জানা সম্ভব যে, বছরখানেকের মধ্যে এই পরিণতি হবে মায়ের।
.
কিকিরা যেন একটা বিদঘুঁটে অঙ্ক নিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন; কোন পথে যাবেন বুঝতে পারছেন না, নিজের ওপরেই অপ্রসন্ন হয়ে উঠছিলেন, এমন সময় ছকু এসে হাজির। গুরুজির তলব, না এসে সে থাকতে পারে!
ছকু এসে যথারীতি গড় হয়ে কিকিরার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল, তারপর হাতকয়েক তফাতে মাটিতে বসল। গুরুজির সামনে কোনওদিনই সে উঁচু জায়গায় বসে না।
“তোমায় আরও আগে খবর দিলে হত।” কিকিরা বললেন, “মাথায় এসেছিল একবার, কিন্তু ভাবলাম আগে থেকে খবর না দিয়ে এদিকের ব্যাপারটা বুঝে নিই আগে।”
“খবর ভেজলেই চলে আসতাম,”ছকু বলল। “কোই কাম আছে, গুরুজি?”
“আছে। আগে বলল তোমার বাড়ির সব ভাল?”
“বালবাচ্চা ভাল। বহুকে ঘোড়া ম্যালারু ধরেছিল। এখন ঠিক হয়ে গেছে।”
কিকিরা হাসলেন। পরে বললেন, “ছকু, তুমি তো বড় ওস্তাদ ছিলে৷ এদিকেই আগে তোমার কারবার ছিল। এখন পাড়া পালটেছ, পেশাও পালটে ফেলেছ অনেকদিন।”
ছকু যেন লজ্জার মুখ করে হাসল।
“আচ্ছা, একটা কথা বলতে পারো? ধর্মতলার লাইনে তোমার পুরনো চেলা কে কে আছে এখনও?”
ছকু একসময়ে পকেটমারদের মাস্টার ছিল। ভাল ট্রেনার। হাতে কলমে কাজ শিখিয়েছে। তখন সে মাস্টার ওস্তাদ। এখন সে অন্য পাড়ায় লন্ড্রির দোকান দিয়েছে। মাঝে মাঝে অল্পস্বল্প টেলারিং। এখনও তার চেলা আছে। তারা মাস্টার বলে ডাকে ছকুকে। ছকু নিজে পকেটমারের মতন ইতর কর্ম নিজে করে না। তবে চেলাদের ছোটখাটো টিপস দিতে আপত্তি কীসের!
ছকু বলল, “আছে। কেন গুরুজি?”
“আমার একটা কাজ করতে হবে।”
“হুকুম করুন।”
“একটা লোকের খোঁজ দিতে পারবে?”
“ক্যায়সা লোক?”
কিকিরা সেদিনের ঘটনার কথা বললেন। যে-লোকটা পতাকীর ব্যাগ উঠিয়ে নিয়ে গলির মধ্যে পালিয়ে গিয়েছিল তার একটা বর্ণনাও দিলেন যতটা পারেন। আচমকা ঘটনা; মন দিয়ে নিখুঁতভাবে সব দেখার মতন অবস্থা তখন নয়, তবু, যতটা পেরেছেন দেখেছেন কিকিরা। ছোকরার গায়ে ছিল চাকার মতন গোল গোল লাল-সাদা, ছাপ তোলা গেঞ্জি, ঘোড়ার মাঠের জকিদের মতন অনেকটা। মাথার চুলের সামনেটা সাপের মতন ফণা তোলা। লম্বা জুলফি।
ছকু সব শুনল। ভাবল কিছুক্ষণ। পরে বলল, “লাইনে নয়া নয়া ছোকরা চলে আসছে গুরুজি। আপনি যার কথা বললেন, আমি ওকে চিনি না। নয়া ছোকরা হবে। তো আমার পুরানা দোস্তরা আছে এখানে, পাত্তা নিয়ে নেব।”
কিকিরা বললেন, “ছকু, আমি জানতে চাই, যে-লোকটা রাস্তা থেকে ব্যাগ কুড়িয়ে নিয়ে পালাল, সে সত্যিই ওই এলাকার পকেটমার, না, অন্য মতলব ছিল তার।”
ছকু বুঝতে পারল। আসলে লোকটা মামুলি পকেটমার, না, তাকে কেউ ওই কাজের জন্যে ভাড়া খাটাচ্ছিল–জেনে নিতে চান গুরুজি।
কাজটা সহজ। ছকু জেনে নেবে। কলকাতা শহরের প্রত্যেকটি এলাকায় সেখানকার পকেটমারদের ঘাঁটি থাকে। ঘাঁটির বাদশাও থাকে–মানে লিডার, কর্তা। তার হুকুম না মানার মতন বুকের পাটা কারও হয় না।
“তুমি তাড়াতাড়ি খবর নিয়ে আমায় জানাবে।”
ছকু মাথা নাড়ল। হয়ে যাবে কাজ।
আরও খানিকটা বসে চা খেয়ে ছকু চলে গেল।
.
বিকেলে চন্দন এল।
“তারা আসেনি?”
“এখনও নয়। আসবে।” চন্দন রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বলল, “কী গরম পড়ে গেল, সার! চৈত্র মাস কি শুরু হয়ে গিয়েছে। দেখতে দেখতে টেম্পারেচার…”
“জল খাও।” বলেই হাঁক দিলেন কিকিরা, বগলাকেই।
চন্দন একবার পাখাটার দিকে তাকাল। জোরেই চলছে। নিজের জায়গাটিতে বসতে বসতে চন্দন বলল, “আপনাকে বলেছিলাম না, হাসপাতালে আমার এক কলিগ রয়েছে বীরভূমে বাড়ি। সজল নাগ।”
“নাগ…! হ্যাঁ, বলেছিলে।”
“আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিনয় পাঁজাকে চেনো কি?”
“নাগ কি পাঁজামশাইয়ের দেশের লোক! বীরভূম তো একটা জেলা। পাজামশাইদের জমিদারির চৌহদ্দি ছিল কোন দিকটায়?”
“দিকটিক জানি না, সার। বীরভুম আমার ডিস্ট্রিক্ট নয়,” চন্দন বলল। “সজল বীরভূম জেলার ছেলে। নলহাটির দিকে তার বাড়ি। সে বলল, পাঁজাদের সে চেনে না। তবে নাম শুনেছে। ডুমুরগ্রাম বলে একটা জায়গা আছে ওদিকে। পাঁজারা সেখানকার লোক। মানে পাঁজার মামার বাড়ি ওখানে। চৌধুরীবাড়ি।”
বগলা জল নিয়ে এল।
জল খেয়ে চন্দন বলল, “ইন ফ্যাক্ট, ডুমুরগ্রাম-পাঁজাবাবুর মামার বাড়ি বেশ বিখ্যাত। মামাদের একসময় জমিদারি-টমিদারি ছিল। তবে জমিদারদের এখন আর দাপট কোথায়! ওই লুকিয়েচুরিয়ে বেনামা করে যা রাখতে পেরেছে তাতেই পেট চলে। অবশ্য পাঁজাবাবুর মামার বাড়ির অতটা দীনদশা হয়নি। দু মহলা ভাঙা বাড়িটা আছে। দু’ মহলা হলেও বাড়ি বিশাল। কাছারি, দেউড়ি, ঠাকুর দালান সবই আছে। আছে মদনমোহনের মন্দির। দেবোত্তরের আয় থেকে বছরের দুর্গাপুজোটাও হয় এখনও…”
“কে থাকে ওখানে?”
“কেউ নয়। জনাদুই কর্মচারী আর একজোড়া বাস্তু সাপ। চন্দন হাসল। “বারোয়ারি লোকজনও ঢুকে পড়ে।”
কিকিরা যেন চোখ বুজে অনুমান করার চেষ্টা করলেন ডুমুরগ্রামের জমিদার বাড়িটা।
“চাঁদু, আমাদের বুঝতে একটু গোলমাল হচ্ছিল। একেবারে সঠিক করে বলতে গেলে বলতে হয়, বিনয়বাবুর পৈতৃক বাড়ি কলকাতায়, ঠনঠনিয়ার দিকে যেখানে এখন তিনি আছেন। এটা তাঁর নিজস্ব। আর ওই বীরভূমের বাড়ি এটা-ওটা যা রয়েছে সব তার মামার বাড়ির। ভদ্রলোকের কপালে ছিল তাই মামার বাড়ির প্রপাটি–যাই হোক না কেন–ইনহেরিট করেছেন। ঠিক তো!”
“পুরোপুরি ঠিক।”
“প্রশ্ন হচ্ছে, বিনয়বাবুর মামার বংশে এমন কেউ কি ছিল না যে-লোক সম্পত্তির ভাগীদার হতে পারে? অন্তত পার্টলি? ..কী বলে তোমার কলিগ?”
চন্দন বলল, “সার, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কথাটা। সজল বলল, আর-একজন ছিল। তবে তার থাকা না-থাকা সমান।”
কিকিরা কৌতূহল বোধ করলেন। বললেন, “কে?”
“ও-বাড়ির একটি ছেলে। বিনয়বাবুর মাসতুতো ভাই! ঘটনা হল, বিনয়বাবুর মায়েরা দু’বোন। ভাই নেই। বিনয়বাবুর মা-বোনদের মধ্যে বড়। ছোট বোন বয়েসে খানিকটা ছোট তো বটেই, কপালটাও খারাপ। কম বয়েসে বিধবা হন। মায়ের কাছেই অবশ্য থাকতেন। একটি ছেলে ছিল। তা একদিন ছেলেটির দিদিমা আর মা দুই-ইচলে গেলেন। ছেলেটা খেপাটে গোছের। ঘরবাড়ির সঙ্গে আলগা। সম্পর্ক। সাধুসন্ন্যাসী শ্মশান-মশান করে বেড়াত। শেষে বিশ-বাইশ বছর বয়েসেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেল। পরে শোনা গেল সে কোনও তান্ত্রিকের দলে গিয়ে ভিড়েছে।”
অবাক হয়ে কিকিরা বললেন, “সে কী! জমিদার বাড়ির ছেলে তান্ত্রিক।”
“চমকে যাচ্ছেন সার! চমকাবার কিছু নেই। সজল বলে, বীরভূমের রক্তে নাকি দুটো জিনিসেরই টান আছে। একদিকে বৈষ্ণব, অন্যদিকে তন্ত্র। একদল বাজায় একতারা,অন্যদল শ্মশানের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়।”
কিকিরার কৌতূহল ততক্ষণে তীব্র হয়েছে। বললেন, “একদিকে জয়দেব, অন্যদিকে বামাক্ষ্যাপা! তা পাঁজাবাবুর মাতুলবংশ কি…”
“ঘোরতর বৈষ্ণব।”
“বৈষ্ণববংশের ছেলে হয়ে গেল তান্ত্রিক।”
“সজল তো তাই বলে।”
“চাঁদু, এ তো দেখছি সেই ভক্তকুলে দৈত্য।”
তারাপদর গলা পাওয়া গেল। বগলার সঙ্গে কথা বলছে। কিকিরা বললেন, “চাঁদু, সেই তান্ত্রিকের আর খবর পাওয়া যায়নি। পরে কখনও বাড়িঘর ভিটেতে দেখা যায়নি তাকে?”
“না,” চন্দন বলল। বলে কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল। বলল, “সার, একটা কথা মনে রাখবেন। সজল ওই পাঁজাবাবুর মামার বাড়ির গ্রামের মানুষ নয়, তাদের বাড়ি নলহাটির দিকে। সে যা শুনেছে এ-মুখ সে-মুখে– তাই বলেছে। কোনটা কতদূর সত্যি, কোনটা লোকমুখে বানানো– তা সে জানে না।”
কিকিরা মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “চাঁদু, আমার বুদ্ধিতে বলে, সামান্য ধোঁয়া দেখলেও অনুমান করতে হবে আগুন অল্পস্বল্প আছে কাছাকাছি; এখানে একটু ধোঁয়া দেখছি, কিন্তু আগুন…?”
তারাপদ ঘরে এল। শেষ কথাটা তাঁর কানে গিয়েছে। বলল, “কীসের ধোঁয়া সার?”
“ধুনির,” কিকিরা হালকা স্বরে বললেন।
“ধুনি! কার ধুনি? কোথায়?” বলে তারাপদ চন্দনের দিকে তাকাল। তাকিয়ে নিজের মাথা দেখাল। “অফিস থেকে বেরিয়ে ও-পাড়ার মডার্ন হেয়ার কাটিংয়ে একটা হেয়ার কাট দিলুম। শ্যাম্পুও করিয়ে নিলুম। কেমন হয়েছে রে?”
চন্দন গম্ভীর মুখে বলল, “কুমারটুলির কার্তিক!”
“যাঃ!” তারাপদ যেন খুশি হল না, মুখের ভাবে হতাশ হওয়ার ভান করে বলল, “তোর চোখ বলে কিছু নেই। দারুণ হেঁটেছে।”
“তো হেঁটেছে। বোস।”
বসল তারাপদ। মাথার চুলে শ্যাম্পুর গন্ধ। সাবধানে একবার মাথায় হাত বুলিয়ে গন্ধটা শুকল। কীসের ধুনি, সার? কার কথা বলছিলেন?” কিকিরার দিকে তাকাল তারাপদ।
কিকিরা বললেন, “চাঁদুকে জিজ্ঞেস করো।…তুমি শোনো, আমি একটা ফোন সেরে নিচ্ছি।”
চন্দন ডুমুরগ্রামের বৃত্তান্ত শোনাতে লাগল তারাপদকে।
কিকিরা হালদার স্টুডিয়োতে ফোন করলেন। বার দুই বৃথা চেষ্টা। কথা চলছিল ওপাশে। তিনবারের বার পেলেন।
“জহর! রায়কাকা বলছি। পতাকী আসছে?”
ওপার থেকে সাড়া এল। “এসেছে। ভালই আছে।”
“গুড। …ইয়ে তোমার সেই নেগেটিভের কী হল? পাঁজামশাই পরে যেটা দিয়েছিলেন?”
“ও কিছু হবে না। নষ্ট হয়ে গিয়েছে।”
“চেষ্টা করেছিলে?”
“চেষ্টা করেও হল না। একটা কালচে দাগ আর বাদবাকি একেবারে ধোঁয়া। দেখলে মনে হবে ভুতুড়ে…”
“ও! বিনয়বাবুকে জানিয়েছ?”
“হ্যাঁ।”
“কী বললেন?”
“কী আর বলবেন! বললেন, জানতাম।”
“অল্পক্ষণ চুপচাপ। তারপর কিকিরা বললেন, “কাল তোমার সঙ্গে দেখা হবে। আমি যাব।”
ফোন রেখে দিয়ে কিকিরা তারাপদদের দিকে তাকালেন। চন্দন আর তারাপদদের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল না আর। যা বলার বলা হয়ে গিয়েছে চন্দনের।
বগলা এসে চা দিয়ে গেল। কিকিরা নিয়ম করেছেন, এখন থেকে যেহেতু গরম পড়ে যাচ্ছে, গরমের বদলে ঠাণ্ডা চা খাওয়া হবে। মানে হালকা চা, দুধ থাকবে না, চিনি সামান্য, আর চায়ের মধ্যে এক টুকরো বরফ। অবশ্য বাজারের বরফ নয়, ফ্রিজের বরফ।
চা খেতে খেতে কিকিরা বললেন, “জহর বলল, কাজ হয়নি,” বলে না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করলেন।
তারাপদ বলল, “আপনি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছেন।”
“মানে?”
“পরের চরকায় তেল দিচ্ছেন। পাঁজামশাইয়ের ঠিকুজি কোষ্ঠী জানতে আপনাকে কেউ লাগায়নি। জহরও বলেনি। আপনি নিজে উঠেপড়ে লেগে গিয়েছেন। তাও যদি দু পয়সা আসত! কী লাভ, সার?”
কিকিরা বিরক্ত হলেন বোধ হয়। রাগ না করেই বললেন, “ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।…আসলে কী জানো, এ হল অভ্যেস। এক রকম খেলাও বলতে পারো–চুপচাপ বসে থাকতে পারি না। …তা সে যাই হোক, ওই পতাকীকে আমি অনেকদিন থেকে চিনি। বেচারি মানুষ। ভাল মানুষ। নিজের চোখে আমি দেখলাম লোকটা ট্রাম লাইনে কাটা পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। পরে শুনলাম, ওটা নিছক অ্যাকসিডেন্ট নয়। তাই একটু খোঁজখবর করে দেখছি। টাকা কামানো আমার উদ্দেশ্য নয়, তারা।”
.
৭.
জহর কিকিরাকে দেখছিল।
কিকিরা শেষপর্যন্ত মাথা নাড়লেন। হতাশ গলায় বললেন, “না, এই প্রিন্ট থেকে কিছুই বোঝা যায় না। সত্যিই ভুতুড়ে।” বলে প্রিন্টটা তারাপদর হাতে দিলেন।
জহর তার সাধ্যমতো যতটা করা যায় করেছে। বিনয়বাবুর দেওয়া পুরনো নেগেটিভ থেকে, নয় নয় করেও তিনটে প্রিন্ট। সবই সমান। একপাশে কালো একটা ছোপ, যেন ঘন ছায়ার পরদা, বাকিটা সাদাটে বা ঈষৎ বাদামি ধোঁয়া ধোঁয়ার আকারটাও কেমন যেন কুণ্ডলী পাকানো।
তারাপদ আর চন্দনও দেখেছে প্রিন্টগুলো। কিছুই ধরতে পারেনি।
চন্দন বলল, “আনাড়ি কেউ শাটার টিপেছিল ক্যামেরার। না হয় কোনও সোর্স থেকে আলো ঢুকে ফিল্ম নষ্ট করে দিয়েছে।” চন্দন ফোটো তুলতে পারে। শখের ফোটোগ্রাফার।
তারাপদ বলল, কিকিরাকেই, ঠাট্টার গলায়, “যাই বলুন সার, ওই প্রিন্টটাকে, মৃতজনের আত্মা বলে চালানো যায়। স্পিরিট আর কী!”
কিকিরা কথাটা শুনলেন। কিছু বললেন না ওকে। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে কিকিরা বললেন, “জহর, আমাদের একবার পাঁজাবাবুর বাড়িতে যাওয়া দরকার। মানে, যেতে পারলে ভাল হত৷ ওঁর দর্শন পাওয়ার একটা ব্যবস্থা…”
কথার মাঝখানে জহর বলল, “ব্যবস্থা মানে আপনি আমার সঙ্গে যাওয়ার কথা বলছেন?”
“হ্যাঁ। আমরা সবাই যেতে চাই।”
কী যেন ভাবল জহর, বলল, “কীভাবে যাব? হঠাৎ একটা দল করে এত অচেনা লোক ওঁর কাছে গেলে…”
“অসন্তুষ্ট হবেন? কিছু মনে করবেন?” কিকিরা বললেন, “সেটা স্বাভাবিক। তবে তুমি ভেবো না। আমার ওপর ছেড়ে দাও, আমি কাঁচা কাজ করব না।”
জহর সামান্য চুপ করে থেকে বলল, “কবে যাবেন?”
“ক-বে! …কাল হবে না। কাল যদি ছকু আসে, ওর দ্বারা কতটা কী হল জেনে নিই। পরশু বা তার পরের দিন হতে পারে।”
জহর আপত্তি করল না।
কিকিরা হঠাৎ পতাকীকে ডাকলেন। পতাকী দোকানেই ছিল।
“পতাকী, তোমার হাতে সে ব্যাগটা ছিল–ঠিক ওইরকম, অন্তত ওর মতন একটা ব্যাগ কাল কিনে রাখবে। চাঁদনিতেই পাবে। নিউ সিনেমার উলটো দিকে ফুটপাথে। মনে রেখো ব্যাগটা যেন তোমার ব্যাগের মতন হয়। রং একই রকম।” বলে কিকিরা পকেট থেকে টাকা বার করে পতাকীর হাতে দিলেন।
জহর প্রথমটায় বোঝেনি, পরে অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “আপনি টাকা দিচ্ছেন কেন, কাকা! আমি দিচ্ছি।”
“আরে রাখো! কটাই বা টাকা!”
“আমার বড় খারাপ লাগছে কাকা। আমার জন্যে—”
“তোমার খারাপ লাগার কোনও কারণ নেই জহর। আমি নিজেই যখন নাক গলাচ্ছি, তখন তোমার খারাপ লাগবে কেন! …ও কথা থাক, তুমি ওই ভুতুড়ে প্রিন্টগুলোর একটা আমাকে দেবে। পাঁজাবাবুকে অন্য দুটো। কিন্তু তাঁকে বলবে না যে, আমায় দিয়েছ! বুঝলে!”
জহর মাথা নাড়ল। কিকিরার কথামতনই কাজ হবে।
চেয়ার সরিয়ে কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “আমরা চলি আজ। চলো তারাপদ। কলকাতা ঠনঠনিয়া বীরভূম হরিদ্বার মায়ের অন্তর্ধান ভূমিকম্প ধস নামা–ব্যাপারটা বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। দেখি কত জট পাকিয়েছে, কেনই বা।”
বাইরে এসে তারাপদ বলল, “সার, আপনার পাগলামির মাথামুণ্ডু আমি বুঝতে পারি না। হুট করে আপনি পাঁজাবাবুর বাড়ি যাবেন কেন? উনি আপনাকে ডাকেননি। কী করবেন আপনি ভুতুড়ে ওই প্রিন্ট নিয়ে! লাইফ আফটার ডেথ বইটইয়ে এরকম ছবি দেখা যায়। মৃতজনের আত্মা টাইপ। এদিকে আবার একটা ব্যাগ কিনতে বললেন পতাকীকে! সবই আপনার অদ্ভুত!”
কিকিরা হাসলেন, “শোনো তারাবাবু, ভাগ্য প্রসন্ন করার জন্যে জ্যোতিষীরা নানান রত্ন ধারণ করতে বলে। তাতে কী হয় জানি না। আমি বলি, বেস্ট রত্ন হল ধৈর্য। ওটাই ধারণ করা। মহাভারত পড়েছ? পাণ্ডবরা কতদিন ধৈর্য ধারণ করে বসে ছিল বলো তো?”
তারাপদ তামাশার গলা করে বলল, “সার কি আজকাল নতুন করে মহাভারত পড়ছেন?”
“তা মাঝে-মাঝে পড়ি৷ কেন, পড়লে আপত্তি কীসের!”
তারাপদ আর কিছু বলল না।
.
বাড়ি ফিরে কিকিরা দেখলেন, ছকু আর চন্দন দিব্যি গল্প করছে। বসার ঘরে বসে। হাসাহাসি হচ্ছিল। চন্দনের গলার জোরই বেশি। বোঝা যায়, ছকুই বক্তা, চন্দন শ্রোতা।
তারাপদ সঙ্গেই ছিল কিকিরার। এখনও রাত হয়নি। আটটাও নয়।
কিকিরাকে দেখে ছকু লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল।
“বোসো, বোসো৷” ছকুকে বসতে বলে কিকিরা চন্দনের দিকে তাকালেন। “তুমি কতক্ষণ?”
“ঘণ্টাখানেক হবে। খানিক পরে ছকু এল। ওর কাছে গল্প শুনছিলাম। গল্পগুলো যদি সত্যি হয়, সার–তবে ওকে একটা অ্যাওয়ার্ড দেওয়া উচিত। ছকু জিনিয়াস।”
ছকু যথারীতি কিকিরার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বসে পড়ল। তার আগেই কিকিরারা বসেছেন।
“খবর বলো?” কিকিরা বললেন, “আমি ভাবছিলাম তুমি কাল সকালে আসবে।”
ছকু বলল, “না গুরুজি, আজই চলে এলাম। খবর ভাল নয়।”
“ভাল নয়!”
“দশ নম্বর ঘাঁটিয়া দেখে কানহাইয়া। সে বলল, ওই মাফিক ছোকরা–আপনি যেমন বললেন–কেউ তাদের খাতায় নেই। মালও কিছু জমা পড়েনি ওদের কাছে। এলিট সিনেমার পিছে ফিরিঙ্গি ওস্তাদ থাকে। সেও বলল, ওই ছোকরাকে কেউ দেখেনি।”
কিকিরা বুঝতে পারলেন। যে লোকটা, ছোকরাই বলা যাঃ সেদিন ট্রাম লাইনের পাশ থেকে ব্যাগ নিয়ে পালিয়েছিল সে ওই চাঁদনি এলাকার পকেটমার ছিনতাইবাজদের দলে নেই, তাদের ‘পকেটে থাকে না। তাকে ওরা চেনে না।
ছকু বাজে কথা বলার মানুষ নয়। তার খোঁজখবরে ত্রুটি থাকার কথা নয়। তবে ওই ছোকরা যদি বেপাড়ার হয়, অন্য কথা। তবে বে-পাড়ার লোক এ-পাড়ায় নাক গলায় না। ওটা ওদের মধ্যে একটা বোঝাপড়ার ব্যাপার। হয়তো কখনও-কখনও এই নিয়ম ভাঙা হয়। তরে সেটা ব্যতিক্রম।
তারাপদ নিচু গলায় চন্দনকে দোকানের ঘটনা শোনাচ্ছিল।
একসময় চন্দন বলল, “বীরভূমের মামার বাড়ির কথা বলেছিস তো?”
“বলা হয়েছে।”
“কী বলল জহর?”
“কী বলবে আর! শুনে বোবা হয়ে বসে থাকল। ও এত কথার কিছুই জানে না।”
কিকিরা কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক ভাবে বসে থাকলেন। ছকুকে দেখলেন আবারখুব যে হতাশ হয়েছেন, মনে হল না। হয়তো তিনি পুরোপুরি আশাও করেননি, পতাকীর ব্যাগ আর উদ্ধার করা যাবে। তবে পকেটমার ছোকরা সম্পর্কে একটা খোঁজ পাওয়া যেতে পারে–এমন আশা ছিল। পাওয়া গেল না। অবশ্য না-পাওয়া একপক্ষে ভাল। ছোকরা তবে বাইরের আমদানি। হাজির হল কোথা থেকে? কীসের লোভে?
কিকিরা যা ভেবে রেখেছেন, সেভাবেই একটা চেষ্টা করা ছাড়া আপাতত অন্য উপায় নেই।
“ছকু?”
“গুরুজি?”
“কাল হবে না, পরশু আমরা ও-বাড়ি যাব। পাঁজামশাইয়ের ঠনঠনিয়ার বাড়িতে। যাব সন্ধেবেলায়। আমরা সকলেই যাব। তারা, চাঁদু, তুমি আর আমি। জহরও যাবে।”
চন্দন ঠাট্টা করে বলল, “একটা পুলিশভ্যান ভাড়া করবেন নাকি?”
কথাটা কানেই তুললেন না কিকিরা, ছকুকেই বললেন, “তুমি কাল ওই বাড়ির আশপাশ যতটা পারো, নজর করে নেওয়ার চেষ্টা, করবে। পারলে দু-একজনের সঙ্গে আলাপ, গল্পগাছা। আমি যা শুনেছি–তাতে ও বাড়ির নীচের তলা শিয়ালদার কোলে বাজারের মতন। যার যেমন খুশি থাকে, বারো ভাড়াটের হাট। তোমায় বাড়ির ভেতর যাওয়ার দরকার নেই। বাইরে থেকে যা নজরে আসে দেখে নেবে। হাওয়ার ঝাঁপটাতেও গাছের আম মাটিতে পড়ে হে! ভাল করে নজর করবে। আর পরশু দিন আমাদের আসল কাজ।”
চন্দন হেসে বলল, “ইটের দুর্গে প্রবেশ!”
“হ্যাঁ। সম্মুখ সমর। তুমি থাকবে ছকুর সঙ্গে, নীচে একতলায়। তারাপদ থাকবে, দোতলার সিঁড়ির মুখে, আর জহর আর আমি দোতলায় পাঁজাবাবুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ব। দেখা যাক..”
তারাপদ মাথা নেড়ে বলল, “অসম্ভব, সার। আপনি বরং চাঁদুকে দোতলায় রাখুন। ওর সাহস বেশি। আমি আপনার চেলা হয়ে সঙ্গে থাকব। প্লিজ।”
কিকিরা বললেন, “পরে সেসব দেখা যাবে। এখন আর কথা নয়।”
.
৮.
পাঁজাবাবুর বাড়ির একতলা সম্পর্কে যা শোনা গিয়েছিল তার কোনওটাই বাড়িয়ে বলা নয়। কোন আমলের পুরনো বাড়ি, অনুমান করা যায় না। বাড়ির মাঝখানে বিশাল চাতাল। চাতালের একপাশে এক বারোয়ারি চৌবাচ্চা। বোধ হয় সারাদিনই সুতোর মতন জল পড়ে। গোটাতিনেক কলও আছে বারান্দার গায়ে। চাতালের চারদিক ঘিরে সরু বারান্দা। গাঁ ঘেঁষে ছোট ছোট ঘর। খুপরিই বলা যায়।
নীচের তলার বাসিন্দাদের বিশেষ কোনও পরিচয় নেই। কোথাও মিস্ত্রি ক্লাসের কোনও লোক রয়েছে পরিবার নিয়ে, কোথাও পাঁচ ছ’জন বিহারি মজুর থাকে একসঙ্গে, রান্না খাওয়া মিলেমিশে। ওপাশে দুই ছোকরা হাওয়াই চটির কারবারি, ফুটপাথে বসে হকারি করে চটির। ট্রাম কোম্পানির এক কন্ডাক্টর থাকে পাশেই, স্ত্রী-পুত্র নিয়ে। মামুলি দরজি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, মায় এক স্টিলের বাসনওয়ালা! আরও কত কী!
টিমটিমে আলো, পাঁচ সংসারের কলরব কালচে শ্যাওলার রং ধরা উঠোন। অদ্ভুত এক গন্ধ এই নীচের তলায়।
কোনও সন্দেহ নেই, এরা যে যার খুশিমতন ভাড়া দেয় ঘরের, বা দেয় না। কারও কিছু বলার নেই। ওই বিচিত্র কলরব আর দুর্গন্ধের মধ্যে কোথাও রেডিয়ো বাজে, কোথাও বা টিভি চলে একটা।
কিকিরা জহরকে নিয়ে দোতলার সিঁড়ি ধরলেন। পিছনে তারাপদ।
যাওয়ার আগে ছকুর ইশারা থেকে বুঝে নিয়েছেন। তাঁর অনুমান অন্তত এক জায়গায় সঠিক।
ছকু আর চন্দন নীচের তলার সদরের বাইরে দাঁড়িয়ে! ভেতরে ঢুকে দাঁড়াবার মতন মেজাজ নেই।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে কিকিরা বললেন, “জহর, যা শুনেছিলাম এ যে তার চেয়েও ভয়ঙ্কর। সত্যিই কোলে বাজার।..ধরো বাড়ির যা অবস্থা। হঠাৎ যদি ভেঙে পড়ে–”
“জনাপঞ্চাশ খতম,” তারাপদ পিছন থেকে বলল।
দোতলার মাঝামাঝি সিঁড়ির বাঁকে দাঁড়িয়ে কিকিরার মনে হল, এ বাড়িতে আলো জ্বালানো যেন নিষিদ্ধ। হলুদমতন যৎসামান্য আলো যা আছে-তা না থাকলেও ক্ষতি ছিল না। সিঁড়িতে বোধ হয় মানুষের পা পড়ে না, শুধু ধেড়ে টাইপের কয়েকটা ইঁদুর ছোটাছুটি করে। পাঁজামশাইয়ের কি এমনই অর্থাভাব যে, প্রয়োজন বুঝে আলো জ্বালাতেও দেন না, ওই যা টিমটিম করে জ্বলে তাই যথেষ্ট।
দোতলায় পা দিয়ে দেখা গেল, সামনে টানা বারান্দা। ঢাকা বারান্দা অবশ্য। বারান্দার মাঝামাঝি জায়গায় একটা বাতি জ্বলছে। তার আলো এত কম যে, অত বড় বারান্দা প্রায় অন্ধকার। বাড়ির কাউকেই দেখা গেল না।
কিকিরা জহরকে বললেন, “ডাকো কাউকে।”
জহর ডাকল। “কে আছে?”
বারতিনেক গলা চড়িয়ে ডাকার পর বারান্দা-ঘেঁষা ঘর থেকে একটি লোক বেরিয়ে এল। মাঝবয়েসি। পরনে খাটো ধুতি, গায়ে ফতুয়া। দাড়ি গোঁফ কামানো নয়।
লোকটি সামনে এসে দাঁড়াল। দেখছিল কিকিরাদের। কিকিরা জহরকে ইশারা করলেন। জহর বলল, “বাবুকে গিয়ে বলো জহরবাবু এসেছেন। জহর।”
লোকটি জহরদের অপেক্ষা করতে বলে চলে গেল।
কিকিরা চারপাশ দেখছিলেন। কলকাতা শহরে পুরনো বাড়ি অনেক দেখেছেন কিকিরা। এ বাড়ি যেন হার মানায় অন্যগুলোকে। এত জীর্ণ, হতশ্রী, অদ্ভুত এক গন্ধ-খসে পড়া বালি, সুরকির চুন আছে কি না বোঝা যায় না। অথচ ইমারতের গড়ন দেখলে মনে হয়, যে আমলেই হোক বাড়ি তৈরির সময় অন্তত রীতিমতন বাড়ির মালমশলা খরচ করা হয়েছিল।
নীচের ফাঁকা চাতাল থেকে সেই একই কলরব ভেসে আসছে। তবে অত জোরালো নয়।
কিকিরা আর জহর নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। তারাপদ সামান্য পেছনে। তাকে বলা হয়েছে, সিঁড়ির দিকে চোখ রাখতে।
লোকটি ফিরে এল। “আসুন আপনারা। বাবু আসছেন।”
বারান্দা বরাবর দু’তিনটে বন্ধ ঘর পেরিয়ে একটা ঘরে এনে কিকিরাদের বসতে বলল লোকটি।
ঘর খুলে আলো সে জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল আগেই। এবার সে পাখা খুলে দিল। আলো জ্বেলে দিল অন্য একটা দেওয়ালেরও।
বিশাল ঘর, মানে সাধারণ বড় ঘরের চেয়েও আকারে বড়। ঘর জুড়ে পুরনো আমলের সোফা, চেয়ার, আর্মচেয়ার, ডিভান। কোনওটাই আজ আর উজ্জ্বল নয়। ময়লা। ধুলো জমেছে। কাপড় ছিঁড়ে গিয়েছে এখানে ওখানে। ঘরের একপাশে একটা নকল বাজপাখি, বাঘের মাথা, দেওয়ালে হরিণের শিং। আর কিছু ছবি দেওয়ালে। তার মধ্যে একটা ছবি পাজামশাইয়ের কোনও পূর্ব পুরুষের অয়েল পেন্টিং, মাথায় পাগড়ি, গায়ে রাজকীয় পোশাক।
কিকিরা আবাক হচ্ছিলেন, আবার কেমন যেন শঙ্কিত হচ্ছিলেন, যে চালাকির খেলাটা তিনি খেলতে এসেছেন, সে-খেলায় কি জিততে পারবেন।
হঠাৎ কিকিরার চোখ পড়ে গেল বাজপাখির ওপর। আশ্চর্য, বনেদি বাড়ির কেউ কেউ বসার ঘরে কুকুর, পাখি, এমনকী হায়েনার নকল মাথা সাজিয়ে রাখে। বাজপাখি কিকিরা আগে কোথাও দেখেননি। পাখিটা দেখলে মনে হয় জীবন্ত।
পায়ের শব্দ হল।
পাঁজামশাই ঘরে এলেন। বিনয়ভূষণ পাঁজা।
জহররা উঠে দাঁড়িয়েছিল।
বিনয়ভূষণ কিকিরাদের দেখছিলেন। তাঁর কৌতূহল হচ্ছিল।
জহর বলল, “আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। আপনি বসুন।”
বিনয়ভূষণ বসলেন। হাতের ইশারায় কিকিরাদের বসতে বললেন, “বসুন। আপনারা…”
নমস্কারের সৌজন্যপর্ব চুকিয়ে কিকিরাও বসে পড়েছেন ততক্ষণে।
“ইনি আমার বাবার বন্ধুর মতন ছিলেন,” কিকিরাকে দেখিয়ে জহর বলল, “আমি কাকা বলে ডাকি। নাম কিঙ্করকিশোর রায়। আর উনি কাকার সঙ্গে এসেছেন…!” বলে তারাপদকে দেখাল।
কিকিরা বিনয়ভূষণকে দেখছিলেন। বৃদ্ধই ধরা যেতে পারে, তবে অক্ষম নন শারীরিক ভাবে। এখনও পিঠ সোজা, গাল-মুখ শুকিয়ে কুঁচকে যায়নি। ওঁর পরনে ধুতি, গায়ে হাফ হাতা গেঞ্জি। গলার কাছে বোম দেওয়া। পায়ে তালতলার চটি। বাঁ হাতে চশমার খাপ। চোখে চশমা নেই। বোঝা যায় দূরের জিনিস দেখতে অসুবিধে হয় না, চশমাটা কাছের বস্তু দেখা বা পড়ার জন্যে। ধবধবে ফরসা রং গায়ের। মাথার চুল সাদা এবং স্বল্প। গলায় একটি ছোট মাপের সোনার হার।
জহর বলল, “সেদিন যা ঘটেছিল রায়কাকা স্বচক্ষে দেখেছেন। ওইজন্যে ওঁকে নিয়ে এলাম। পতাকীদার কোনও দোষ নেই।… তা ছাড়া কাকারও কিছু বলার আছে।”
বিনয়ভূষণ বললেন, “আপনি নিজের চোখে দেখেছেন?”
“হ্যাঁ,” কিকিরা বললেন, “একটা কাজে আমি ওদিকে গিয়েছিলাম। ঘটনাটা চোখে পড়ে যায়। পতাকীকে আমি চিনি। অনেকদিন। স্টুডিয়োয় কাজ করে জানি।”
“বুঝতে পারছি। তা আপনি কি এই কথাটাই বলতে এসেছেন?”
মাথা নাড়লেন কিকিরা। বললেন, “না, আমি একটা ব্যাগ আপনাকে দেখাতে এসেছি।”
“ব্যাগ! কীসের ব্যাগ!”
কিকিরার কাঁধে একটা কাপড়ের ঝোলা ছিল। তার মধ্যে হাত ডুবিয়ে প্লাস্টিকের ব্যাগ বার করলেন। দেখতে প্রায় কালো। লম্বায় ফুটখানেক। পতাকীকে দিয়ে ব্যাগ কিনিয়ে সেটার চেহারা পুরনোর মতন করা হয়েছে। যদিও তা হয়নি।
“এই ব্যাগ,” কিকিরা বললেন “আগে আপনি দেখেছেন?”
বিনয়ভূষণ ব্যাগ দেখতে দেখতে অবাক হয়ে বললেন, “তা আমি কেমন করে বলব! তবে হ্যাঁ, জহরের সেই লোকের হাতে এইরকম ব্যাগ ছিল! …আপনি কি ব্যাগটা উদ্ধার করেছেন?”
জহর তাড়াতাড়ি বলল, “হ্যাঁ। উনি…”
“উনি কুড়িয়ে পেয়েছেন? কেউ দিয়েছে?”
জহর বলল, “আজ্ঞে, মানে ঠিক কুড়িয়ে পাওয়া নয়। দেয়নি কেউ?”
“তবে?”
কিকিরা এবার নিজেই কথা বললেন। “আমি অনেকদিন ধরেই ওদিকে ঘোরাফেরা করি। চেনা লোকজন আছে। চুরিচামারি, পকেটমার, ছিনতাই হলে খোঁজখবর পাই।”
“আপনি পুলিশের লোক?”
“আজ্ঞে না। পুলিশের লোক নয়। তবে ওই যে গুমঘর লেনের কাছে বাচ্চাদের একটা ক্লিনিক আছে। পোলিও পেশেন্টদের দেখাটেখা হয়, তার পাশে একটা ছোট বাড়ি আছে। সেখানে কাঁচা চোরছ্যাঁচড় পকেটমারদের শুধরানোর চেষ্টা করা হয়। থানা পুলিশ থেকেই পাঠায় অনেককে। আমি ওখানে যাই। ধরাপড়া ছোকরাগুলোকে বাবা বাছা করে ধর্মকথা শোনাই, বারণ করি কুকর্ম করতে।” কিকিরা আগেই মনে মনে এসব কথা বানিয়ে রেখেছিলেন।
বিনয়ভূষণ অবাক হয়ে বললেন, “কই, এরকম তো আগে শুনিনি। জুভেনাইল কোর্ট বলে একটা কী আছে শুনেছি। তা সে তো অন্য ব্যাপার।”
“কত কী আছে পাঁজামশাই, আমরা কি সব জানি? না, খোঁজ রাখি!”
মাথা নাড়লেন বিনয়ভূষণ। “আপনি বলতে চাইছেন ব্যাগটা সেখান থেকে পেয়েছেন?”
“আজ্ঞে, যথার্থ।”
“আমার জিনিসটা কই? সেই খাম–?”
“ফোটোর কথা বলছেন!” কিকিরা বললেন, “কী বলি আপনাকে বলুন তো! যে-বেটা ব্যাগ মেরে পালিয়েছিল সেই রাস্কেলটা ব্যাগের মধ্যে টাকা-পয়সা যা ছিল-পকেটে পুরে বাকি যা কাগজপত্র ছিল ছিঁড়ে দলা করে পাকিয়ে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়েছে।” কিকিরার বলার ধরনে ইতস্তত ভাব, একটু যেন কুণ্ঠা, সেভাবে গোছানো নয় কথাগুলো। এ-সবই তাঁর ইচ্ছাকৃত।
বিনয়ভূষণ কেমন বিহ্বল, হতবাক। মুখে কথা নেই। শেষে বললেন, “ফেলে দিয়েছে, আঁস্তাকুড়ে?”
“আজ্ঞে, চোরের আর কাগজপত্র কী কাজে লাগবে! টাকা যা পেয়েছে–নিয়েছে। কাগজ তো সোনাদানা ঘড়ি আংটি নয় যে, বাজারে বেচা যাবে! ফেলে দিয়েছে।”
সেই লোকটি আবার ঘরে এল। হাতে শ্বেতপাথরের বড় থালা। তিনটি গ্লাস, গ্লাসে শরবত। কাঁচের গ্লাস নয়, জার্মান সিলভারের গ্লাস। অল্প কারুকার্য গ্লাসের গায়ে।
শরবত এগিয়ে দিয়ে চলে গেল লোকটি।
বিনয়ভূষণকে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ মনে হচ্ছিল। তবু সৌজন্য দেখিয়ে কিকিরাদের শরবত খেতে বললেন।
তারাপদ অস্বস্তি বোধ করছিল। কিকিরা হয়তো ভুল করেছেন। এভাবে জড়িয়ে পড়া উচিত হয়নি তাঁর।
জহরও চুপ।
বিনয়ভূষণ হঠাৎ বললেন, কিকিরাকেই, “আপনি কি আমাকে একটা ঘেঁড়া পুরনো ব্যাগ দেখাতে এসেছেন! এর কোনও দরকার ছিল না।” বলে জহরের দিকে তাকালেন। মনে হল জহরের ওপর অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছেন।
কিকিরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শেষে বিনীতভাবে বললেন, “আপনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। হওয়ারই কথা। কিন্তু আমি ঠিক ব্যাগ দেখাতে আসিনি। …একটা কথা আপনাকে বলে নিই। কিছু মনে করবেন না। অন্যের ব্যাপারে আমার অকারণ মাথা গলাবার অভ্যেস নেই। এখানে ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে গেল। পতাকীকে আমি অনেককাল ধরে চিনি। সে ভাল মানুষ, নিরীহ, গরিব। জহর সবই জানে।” শরবত খেলেন সামান্য কিকিরা। ঘরের চারপাশ তাকালেন একবার, তারপর বিনয়ভূষণকে বললেন, “সেদিন আমি নিজের চোখে যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, মামুলি পকেটমারের কাজ ওটা নয়। পতাকীকে ট্রাম থেকে ফেলে দেওয়া, আর ওই ব্যাগ নিয়ে পালানোর একটা মতলব আগেই করা হয়েছিল। আমি যা করছি পতাকীর জন্যে করছি। অবশ্য জহরের জন্যেও খানিকটা।”
বিনয়ভূষণ আরও বিরক্ত হলেন। “কী বলছেন আপনি! ওই পতাকীকে কে ট্রাম থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে চাইবে! কেন? কাউকে চলন্ত গাড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া বিরাট অফেন্স। ও তো মারা যেতেও পারত।”
“আপনি ঠিকই বলেছেন। একাজ কে করল?”
“কে করল? মানে?”
“আপনি অনুমান করতে পারেন না?”
বিনয়ভূষণ থতমত খেয়ে গেলেন। “আমি! কী বলছেন মশাই, আমি কেমন করে অনুমান করব।”
কিকিরা বললেন, “কাউকে সন্দেহ হয় না!”
“কাজের কথা বলুন। না হয় আমায় ছেড়ে দিন। আমি বুড়ো লোক– এখন আমার বিশ্রামের সময়!”
কিকিরা সামান্য হাসলেন। “আপনার মায়ের ফোটো আমার কাছে আছে। যদিও সেটা ছেঁড়াফাটা, চটকানো৷ চিনে নিতে অসুবিধে হয়।”
“আপনার কাছে আমার মায়ের ফোটো আছে!” বিনয়ভূষণ যেন উঠে বসার মতন পিঠ সোজা করলেন। উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন।
“আপনার ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই, যা পাওয়ার আপনি পাবেন। তার আগে আপনি বলুন, আপনার মায়ের, বৃদ্ধা বিধবা মায়ের যে ফোটো আপনি প্রায় বছরদুয়েক আগে তুলিয়েছিলেন জহরকে দিয়ে, এতদিন পরে হঠাৎ সেটার জন্যে এত উতলা হয়ে উঠলেন কেন? কেন ওই ফোটো থেকে আরও বড় সাইজের একটা ছবি তৈরি করে দিতে বললেন?”
বিনয়ভূষণ কিকিরাকে দেখছিলেন একদৃষ্টে। প্রথমে তাঁর চোখমুখ দেখে মনে হল, অজানা অচেনা বাইরের একটা লোকের এই ধৃষ্টতায় তিনি অত্যন্ত বিরক্ত ও বিস্মিত। কী যেন বলতেও যাচ্ছিলেন, কিন্তু নিজেকে সংযত করলেন।
কিকিরা শান্তভাবে বললেন, “আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না।”
বিনয়ভূষণ কিছুক্ষণ কোনও কথা বললেন না। শেষে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, “এসব আমার ব্যক্তিগত কথা। আমার মা…”
কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে কিকিরা বললেন, “আপনার মায়ের কথা আমরা কিছু কিছু জানি।”
“জানেন? কেমন করে?” বিনয়ভূষণ যেন বিশ্বাস করছিলেন না।
“খোঁজ নিয়েছি। উনি বীরভূমের ডুমুরগ্রামের জমিদার পরিবারের মেয়ে। কলকাতায় তাঁর বিবাহ হয়। এই বাড়ি তাঁর শ্বশুর বংশের, মানে এখন আপনার পৈতৃক বাড়ি।”
বিনয়ভূষণ মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ। ..সঠিক খবরই জোগাড় করেছেন।”
“আরও দু-একটা খবর বলতে পারি। এই বাড়ি ছাড়া কলকাতায় ও আশেপাশে যেসব সম্পত্তি আপনাদের এককালে ছিল এখন তা দেনার দায়ে হাতছাড়া। অবস্থা আপনাদের…”
“কী হবে শুনে! আমি নিজেই বলছি, এখন আমি ভিখিরি। অপচয় আর অহংকার আমার বাবার মাথায় ভুতের মতন চেপে বসেছিল। সেইসঙ্গে দুর্ভাগ্য। যাতে হাত দিয়েছেন ব্যর্থ হয়েছেন, টাকা-পয়সা জলে পড়েছে। …তা এসবই আমি আমার মন্দভাগ্য বলে মেনে নিয়েছি। …শুধু শেষ বয়েসে একটা জিনিস পারিনি।…শুনবেন সেকথা?”
কিকিরা মাথা হেলালেন। শুনবেন।
.
৯.
বিনয়ভূষণ প্রথমটায় চোখ বন্ধ করে বসে থাকলেন।
অনেকক্ষণ পরে চোখ খুললেন, দেখলেন না কিকিরাদের, যেন নিজের মনে-মনেই বললেন, “পাপ আর পাঁক- এর মধ্যে পা ডুবলে মানুষ তলিয়ে যায় ধীরে ধীরে। জন্তুও যায়। তবে পাপে নয়, কেন না তারা মানুষ নয়, পাপপুণ্য জানে না। আমরা দাদামশাই তাঁর আমলে করেছিলেন বিস্তর, তবে নষ্টও করেছেন। তিনি গত হলে, আমার দিদিমা জমিদারির রাশ টেনে নেন। না, নেন বলব না, ‘নেয়’ বলব। দিদিমাকে আমি দেখেছি ছেলেবেলায়। আপনি-টাপনি করে কথা বলতাম না। আপনি খোঁজ করলে জানতে পারবেন, আমার দিদিমাকে ওদিককার লোক বলত আর-এক দেবী চৌধুরাণী। দেখতে সুন্দর, তবে স্বভাবে হিংস্র। লাঠিয়াল, ডাকাত, বল্লমবাজ সবই পুষত দিদিমা। মামলা আর খুনোখুনি দাঙ্গা লেগেই থাকত।”
তারাপদ বলল হঠাৎ, “উনি নিজে খুনোখুনি করতেন?”
“দিদিমার পোষা লোকরা করত। হুকুম থাকত দিদিমার। …তা ওই দিদিমা যখন নানা ঝাটে জড়িয়ে পড়েছে তখন আমার মা, আমি, বাবা-কলকাতায়। খবর এল দিদিমাকে কেউ চালাকি করে বিষ খাইয়েছে। আমরা ডুমুরগ্রাম পৌঁছোবার আগেই দিদিমা মারা গেল।”
“কী বিষ?”
“জানি না। গাঁ গ্রামে কতরকম বিষের চল আছে কে জানে! সেঁকো বিষ হতে পারে।…কেউ আবার বলল, দিদিমা নিজেই বিষ খেয়েছে।”
“কেন?”
“আমার এক ছোট মাসি ছিল। মাসি বেশিরভাগ সময়েই বাপের বাড়িতে থাকত। মাসি হঠাৎ বিধবা হয়ে গেল। শোকের ধাক্কাটা নাকি সহ্য করতে পারেনি দিদিমা। আমার মা আর মাসি ছাড়া দিদিমার অন্য কোনও সন্তানাদি নেই।”
“মাসির একটি ছেলে ছিল না?”
“জানেন? হ্যাঁ ছিল। খেপাটে, নির্বোধ, জেদি। সে কার পাল্লায় পড়েছিল কে জানে! বাউণ্ডুলে হয়ে ঘুরে বেড়াত। শেষে শ্মশানে গিয়ে কী করত জানি না। কোনও তান্ত্রিকের সঙ্গ নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।”
“কম বয়েসেই?”
“হ্যাঁ পনেরো ষোলো বছর বয়েস থেকেই খেপামি শুরু হয়েছিল। কুড়ি একুশে ঘরছাড়া। আমার চেয়ে বয়েসে ছোট ছিল। আমরা তার খবর পেতাম না। মাসিও একদিন মারা গেল।”
বিনয়ভূষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।
ঘরের আলোও কেমন অনুজ্জ্বল হয়ে আসছিল। তারাপদ চোখ সরিয়ে ভেতর দরজার দিকে তাকাতেই সেই নকল বাজপাখির ওপর দৃষ্টি পড়ল। দেখলে বাস্তবিক ভয় হয়।
কিকিরা বললেন বিনয়ভূষণকে, “আপনার মায়ের কথা একটু বলুন। উনি যে হরিদ্বারে তীর্থ করতে গিয়ে…”
“আপনি শুনেছেন? কে বলল?”
“জহর।” কিকিরা টেপ রেকর্ডার লুকিয়ে রাখার কথা আর বললেন না।
বিনয়ভূষণ বিষঃ গলায় বললেন, “মানুষ বোধ হয় তার দিন ফুরিয়ে আসার আগে ভেতরে ভেতরে কিছু বুঝতে পারে। কেউ কেউ নিশ্চয় পারে। আমার মা বোধ হয় পেরেছিল। একদিন নিজেই বলল, আমার একটা ছবি র্ভুলিয়ে রাখ। পুজোর আসনে বসে জপ করছি। যখন থাকব না ওটাই দেখবি।’ …আমি কোনওদিন মায়ের কথা অমান্য করিনি। জহরকে বাড়িতে ডেকে এনে ফোটো তোলালাম। এরকম ফোটো আপনি হয়তো ঘরে ঘরে দেখবেন। ভেরি কমন। মায়ের মনে কী ছিল জানি না, শেষ ছবিটা আমার হাতে তুলে দিয়ে মা বায়না ধরল, শেষ বয়েসে তীর্থে যাবে। তীর্থ তো আগেই সারা হয়েছিল, বাকি ছিল হরিদ্বার হৃষীকেশ কেদার– ওই দিকটা। মায়ের বয়েস হয়েছে তবে পঙ্গু হয়ে পড়েনি।…সবরকম ব্যবস্থা করে মাকে নিয়ে গেলাম হরিদ্বার। তারপর, ঘোরাফেরার পথে কী ঘটে গেল জানেন বোধ হয়। জহর বলেনি?”
“বলেছে। জানি। শুনেছি।”
“তা হলে আর তো আমার বলার কিছু নেই।”
“একটু আছে। এতকাল পরে ওই বিশেষ ফোটোটা নিয়ে…
বাধা দিয়ে বিনয়ভূষণ বললেন, “আপনি মশাই একটা কথা জানেন না। আপনি কি জানেন আমার মায়ের শ্রাদ্ধকৰ্ম হয়নি। হয়নি, কারণ, আমাদের যিনি কুলপুরোহিত, তিনি অবশ্য নেই, তাঁর ছেলে আছেন, তিনিই এখন আমাদের পুরোহিত। আমি ইদানীং প্রায়ই মাকে স্বপ্ন দেখতাম। খারাপ লাগত। পুরোহিতমশাইকে বললাম। তিনি বললেন, অপঘাতে মৃতজনের প্রেতকর্ম হয় না। আর শাস্ত্রমতে নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তির শ্রাদ্ধকৰ্ম করার কতক নিয়ম মানেন প্রাচীনরা। যেমন নিরুদ্দিষ্ট হলে বারো বছরের আগে স্ত্রী তার স্বামীর শ্রাদ্ধকৰ্ম করতে পারে না। নিয়ম নেই। সেইরকম পুত্রসন্তানকেও কিছু নিয়ম মানতে হয়। এক্ষেত্রে আমি সন্তান হিসেবে মায়ের নিরুদ্দেশ হওয়ার পাঁচ বছর আগে কোনও শ্রাদ্ধকর্ম করতে পারি না। তবে এসব প্রাচীন লোকমত। যে মানে সে মানে, নয়তো মানে না।”
“বুঝেছি। আপনার মা নিরুদ্দেশ হওঁন্নার পর পাঁচ বছর পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।”
“হ্যাঁ।”
“আপনি মায়ের শ্রাদ্ধকর্মে তাঁর ওই শেষ ফোটোটি বড় করে তুলিয়ে…।”
“ঠিকই বলেছেন।”
“ওটা যদি নাই পেতেন, মায়ের অন্য ফোটো?”
“না। আপনি কোথাকার মানুষ আমি জানি না। এখন তো সবই হয়। কিন্তু আপনার জানা নেই, তখনকার দিনে বনেদি সম্ভ্রান্ত বাড়িতে বিধবা বয়স্কা মহিলাদের ফোটো যখন-তখন ভোলা যেত না। পরিবারের আচার বিচারে বাধত। …আরে তেমন হলে তো আমি আমার বাবা-মায়ের একসঙ্গে তোলা পুরনো ছবিও নিতে পারতাম। তা তো হয় না। তা ছাড়া ওটি আমার মায়ের শেষ ফোটো। তাঁর কথাতেই ভোলা।”
কিকিরা তারাপদকে বললেন, “দেখো চাঁদুরা কী করছে। ডাকো ওদের। ছকুকে বলবে ছোকরাকেও ধরে আনতে।” কিকির জানতেন, ছকু আজও ছোকরাকে এই গলির মধ্যে দেখেছে। চায়ের দোকানের বাইরে বেঞ্চিতে বসে ছিল। ছকু বলেছে তাঁকে।
তারাপদ চলে গেল। বিনয়ভূষণ অবাক হয়ে বললেন, “ওরা আবার কে? কাকে ডাকতে পাঠালেন?”
“আমার লোক।”
“আপনার লোক! তারা এখানে কেন?”
কিকিরা বললেন, “ওরা আসুক, দেখতেই পাবেন।”
“আপনার কথাবার্তা বড় ধোঁয়াটে। যাকগে, আমার মায়ের ফোটোটা দিন। আপনি বলেছেন, ফোটো দেবেন। কই, দিন।”
কিকিরা মাথা নাড়লেন। “দেব। একটু অপেক্ষা করুন। আচ্ছা পাঁজামশাই, একটা কথা জানতে ইচ্ছে করে। আপনার মায়ের শ্রাদ্ধশান্তির কাজ কবে করবেন ঠিক করেছিলেন?”
“এই পূর্ণিমার পর। তৃতীয়া তিথিতে।”
“এ বাড়িতে? না, মামার ভিটে ডুমুরগ্রামে?”
“আপনি কি পাগল! এই বাড়ি মায়ের স্বামীর ভিটে। মায়ের শ্রাদ্ধকৰ্ম তার বাপের বাড়িতে হবে কেন? এ বাড়িতেই হবে।”
“আমার ভুল হয়েছিল। যাক, বাদ দিন। এই বাড়ি আগলে আপনি কতদিন বসে থাকবেন। বাড়ির যা হল..”
কিকিরার কথা শেষ হওয়ার আগেই ছকু আর চন্দন একটা ছোকরাকে ধরে আনল। সঙ্গে তারাপদ। ছকু ছোকরার গলা জড়িয়ে তার কোমরের কাছে ছকুর বিখ্যাত অস্ত্রটি ধরে আছে। সাইকেলের চাকার স্পোকের মতন সরু দেখতে। অথচ বড় ভয়ঙ্কর এই অস্ত্র। অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ও শক্ত। ছকু এর নাম দিয়েছে, সূচা’! মানে, দ্য নিডল।
কিকিরা চিনতে পারলেন। সেই ছোকরা। ট্রাম লাইনের গায়ে ফুটপাথ থেকে ব্যাগ তুলে নিয়ে পালিয়েছিল। এখন অবশ্য গায়ে লাল-সাদা গেঞ্জি নেই। অন্য জামা।
বিনয়ভূষণ হতবাক। এসব কী করছে এরা বাড়ির মধ্যে!
কিকিরা বললেন, “চেনেন একে?”
“দেখেছি। কাছেই থাকে। কী নাম যেন, কী নাম! চু-চুনি।”
চুনির অবস্থা দেখে মনে হল ভীত, আতঙ্কিত, হতবুদ্ধি। সে যেন এমন এক জালে জড়িয়ে পড়েছে, যেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার কোনও উপায় নেই। ছকুর হাতের অস্ত্রটা তার কোমরে ফুটছিল। একটু জোর দিলেই পেটে ঢুকে যাবে।
কিকিরা বললেন, “এই ছোকরাই সেদিন পতাকীকে ট্রাম থেকে ফেলে দিয়েছিল কায়দা করে। আর ওকেই আমি দেখেছি, ব্যাগ তুলে নিয়ে পালাচ্ছে। ওর কাছেই আপনি ফোটোর হদিস পাবেন।”
বিনয়ভূষণ বিহ্বল, বিমূঢ়। কথা আসছিল না। শেষে বললেন, “কোথায় ফোটো?”
চুনি বলতে চাইছিল না। কিন্তু ছকুর অস্ত্রটার খোঁচা লাগল। কী যেন গালমন্দ করল ছকু।
“কোথায় ফোটো?”
চুনির গলা জড়িয়ে গেল। ভয় পেয়েছে। সাধুবাবার কাছে।”
“কী?” বিনয়ভূষণ যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না। “সাধু–এ বাড়ির সাধু।”
“আমি ঠিক বলেছি বড়বাবু। মা কালীর পা ছুঁয়ে বলতে পারি। বিশ্বাস করুন। আমাকে টাকা দিয়েছিল সাধু।”
বিনয়ভূষণ আর সংযত থাকতে পারলেন না। চেঁচিয়ে ডাকলেন কাউকে।
সেই লোকটি এসে দাঁড়াল।
“ওপর থেকে সাধুবাবুকে ডেকে দাও। আর শিবুকে।”
লোকটি চলে গেল।
কিকিরা বললেন, “ওপরে–মানে তেতলায়। সেখানে লোকজন থাকে?”
“না। লোক নয়, শয়তান। আজ আমি তাকে দেখে নেব।” উত্তেজিত হয়ে বিনয়ভূষণ উঠে দাঁড়ালেন। চিৎকার করে ডাকলেন শিবুকে। বসে পড়লেন আবার।
শিবু এল।
বিনয়ভূষণের বোধবুদ্ধি যেন লোপ পেয়েছে। বললেন, “ছোট দেরাজের মাথায় চাবি আছে। বড় আলমারি খুলে বন্দুক আনবে আমার। টোটাও পাবে আলমারির তলায়। যাও।”
.
১০.
যে-লোকটি এসে দাঁড়ালেন তাঁকে দেখলে মন বিরূপ হয়ে ওঠে। ভদ্র সাংসারিক পরিবেশের সঙ্গে একেবারে বেমানান, গাঢ় গেরুয়া রঙের বসন পরনে। গায়ে জামা নেই, গেরুয়া চাদর মাত্র। গলায় দু’-তিন ধরনের মালা, রুদ্রাক্ষ আর রঙিন পাথরের। মাথার চুল ঝাঁকড়া, রুক্ষ, জট পড়ে আছে। মুখে দাড়ি গোঁফ। পেকে গিয়েছে অর্ধেক। বাঁ চোখটি ছোট, পাতা যেন বুজে রয়েছে। পিঠে সম্ভবত কুঁজ আছে; বেঁকে হেলে দাঁড়িয়ে থাকলেন ভদ্রলোক।
কিকিরা কিছু বলার আগেই বিনয়ভূষণ বললেন, রাগে ঘৃণায় গলা কাঁপছিল, “গত বছরখানেকের বেশি এই বাড়ির তেতলায় ও রয়েছে। ওই সাধুবাবু।”
এই বাড়ির তেতলা! কিকিরারা তো শুনেছেন তেতলার দরজা জানলা খোলা থাকে না বাড়ির। খড়খড়িকরা দরজা বন্ধই থাকে বরাবর। রাজ্যের পায়রা, তাদের ময়লা, খসে পড়া পালক পড়ে থাকে জঞ্জাল হয়ে। আর থাকে ইঁদুর, বাদুড়, চামচিকে। সাধুবাবুকে দেখে মনে হল, অন্ধকার আর দুর্গন্ধময় ওই নরক থেকে সত্যিই ওই মানুষটি বেরিয়ে এসেছেন।
বিনয়ভূষণ বললেন সাধুবাবুকে, উত্তেজনায় গলা কাঁপছে, “মুখে রক্ত-তুলে মরতে বসেছিলে রাস্তায়। আঁস্তাকুড়ে তোমায় মরতে হত। এখানে এসে আশ্রয় চাইলে, দয়া করে থাকতে দিয়েছিলাম। আর তুমি আমার সঙ্গে বেইমানি করে ওই গুণ্ডা ক্লাসের ছেলেটিকে পেছনে লাগিয়েছিলে আমার। শয়তান, অকৃতজ্ঞ।”
সাধুবাবুর যেন রাগ উত্তেজনা নেই। নির্বিকার গলায় জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন, “না; আমার কৃতজ্ঞতা নেই। তুমি তোমার মায়ের ছবি সাজিয়ে ঘটা করে শ্রাদ্ধ করবে আর আমি দেখব!”
“কেন দেখবে না? তুমি কে?”
“আমি. কে তুমি জানো, আমিও জানি। তোমার মায়ের বলা ছিল, তার মৃত্যুর পাঁচ বছর আগে তুমি ডুমুরগ্রামের বাড়ি সম্পত্তি, কোনও কিছুতেই হাত দিতে পারবে না। তোমার সে-অধিকার নেই। কী তুমি অস্বীকার করবে? করলে আমি প্রমাণ দেখাতে পারি…”
“না। আমি ঠগ জোচ্চর নই। মায়ের আদেশ, ইচ্ছে কাগজপত্রে লেখা আছে।”
“কিন্তু এটা লেখা নেই যে, তোমার মায়ের যে শেষ ফোটো তুমি তুলিয়েছিলে, সেই ফোটোর চারপাশে বাহারি ডিজাইন করা লাইন টেনে ওটা বাঁধাবার পর ফোটোর চার কোণে চারটি অক্ষর তোমার মা পরে বসিয়ে দিয়েছিল।” সাধুবাবুর দাঁতগুলো দেখা গেল এক পলক। হয়তো ঘৃণাভরে হাসলেন। “চারটি অক্ষর কী, তুমি জানো। শুনবে?”
“ভয় দেখাচ্ছ আমাকে। আমি তোমার মতন একটা নোংরা জন্তুকে গুলি করে মারতে পারি। তুমি আমাদের মাতুল বংশের মান ইজ্জত সম্ভ্রম-সব নষ্ট করেছ। মাসিকে তিলে তিলে মেরেছ।”
“যা করেছি তা করা হয়ে গিয়েছে। সেটা পুরনো কথা। আমি যা ভেবেছিলাম, চেয়েছিলাম–তা পাইনি। সবই মিথ্যে হয়ে গেল। রাবণের স্বর্ণলঙ্কা ছাই হয়ে গিয়েছিল কে না জানে! …ও কথা থাক, আসল কথা বলি। ওই চারটে অক্ষর হল ‘ম’ ‘তি’ হা’ ‘সি’… তুমি জানতে না ওই অক্ষরগুলোর মানে কী? পরে জেনেছ।”
কিকিরা অবাক হয়ে বললেন, “ম-তি-হা-সি। মানে কী?”
সাধুবাবু বললেন, “ওকে জিজ্ঞেস করুন।” বলে বিনয়ভূষণের দিকে তাকালেন, “তুমি যুধিষ্ঠির নাকি! তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আর আমি চোর! শোনো, আমাদের ডুমুরগ্রামের মদনমোহন মন্দিরে যে বিগ্রহ আছে মদনমোহনের, তার তিন হাত তলায় এক সিংহাসন লুকনো আছে সোনার হীরে। চুনি বসানো। দিদিমার কীর্তি। তুমি ওই সিংহাসন তুলে নেওয়ার পর তার বিক্রির অর্ধেক টাকা আমায় দেবে। বাদবাকি যা সম্পত্তি, যত কমই হোক-তারও আধা ভাগ। মদনমোহন আর তোমার মা–মানে মাসির নামে প্রতিজ্ঞা করো, ফোটো আমি তোমায় দেব।”
কেউ কিছু বোঝার আগেই, বিনয়ভূষণ বন্দুকটা তুলে নিলেন। শিবু যে কখন এসে মনিবের হাতে বন্দুক দিয়েছে, কেউ খেয়াল করেনি। পুরনো আমলের একনলা বন্দুক। টোটা পোরা ছিল কি না কে জানে!
বিনয়ভূষণ উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর মাথা ঘুরছিল। টলে যাচ্ছিলেন।
সাধুবাবুর ভ্রূক্ষেপ নেই। জড়ানো গলায় বললেন, “তোমার মা–আমার মাসি ধাঁধা করে পদ্য লিখত। ফোটোর পিছনে কী লিখেছিল তুমি আগে ধরতে পারতে না। শুনবে ধাঁধাটা? মনে হয় মোহন অতি/ তাঁহারে করিবে নতি/ তিন সূতা নীচে যাবে/ চাও যাহা তাহা পাবে ॥” …মানেটা তোমার মাথায় ঢুকত না। নির্বোধ তুমি। ‘মোহন’ হল ‘মদনমোহন’; তিন সূতা হল ‘তিন হাত’, ওটা হল গেঁয়ো মাপের হিসেব। আর মদনমোহনের মূর্তির হাততিনেক নীচে গেলে তুমি যা চাও তাই পাবে…।”
বিনয়ভূষণ উন্মাদের মতন চেঁচিয়ে উঠলেন, “রাস্কেল! নেমকহারাম।”
“আমাকে তোমার যা খুশি বলল। আমি এখানে বসে বসে তোমার সমস্ত কিছু নজর করেছি। তোমার টেলিফোন লাইনের সঙ্গে তার টেনে আড়িও পেতেছি। হাঁ করেছি। অন্যায় করিনি।”
বিনয়ভূষণ নিশানা ঠিক করতে পারছেন না মাথা ঘুরছে। চোখের দৃষ্টিও ঝাপসা।
“শয়তান, আজ আমি তোমায়…”
তারাপদ আর চন্দন আতঙ্কে কেমন এক শব্দ করে উঠল। কিকিরা এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তার আগেই ছকু লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিনয়ভূষণের ওপর।
একটা শব্দ হল। গুলির শব্দ। ঘর কেঁপে উঠল যেন। নকল বাজপাখিটা ছিটকে উঠে মাটিতে পড়ে গেল।
সাধুবাবু নির্বিকারভাবে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
বিনয়ভূষণ টলতে টলতে চেয়ারে বসে পড়েছেন। চোখের পাতা খুলছেন না। ঘামছেন। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল বুঝি!
চন্দন এগিয়ে গেল বিনয়ভূষণের দিকে।
আশ্চর্য, চুনি কিন্তু পালিয়ে গেল না, দাঁড়িয়ে থাকল স্থির হয়ে।
১.১ কাপালিকরা এখনও আছে
এক
কত বিচিত্র ঘটনাই না জগতে ঘটে যায়। তারাপদর জীবনে যেমন ঘটল আজ।
সকালে খুব বিরস মুখে তারাপদ ঘুম থেকে উঠেছিল। ঘুম ভাঙার মুখে মুখে যদি মনে পড়ে যায়, মেসের বটুকবাবুকে গোটা তিরিশেক টাকা অন্তত দিতেই হবে আজ, নিচের জগন্নাথ চা-অলাকেও পাঁচ-সাত টাকা, তা হলে কারই বা ভাল লাগে! লোকের কাছে ধার-দেনার কথা, নিজের অভাবের কথা মনে হলে ভাবনা-চিন্তা বেড়েই যায়, আরও কত রকম ধারটারের কথা মনে পড়ে, কত রকম অভাব এসে দেখা দেয়। তারাপদরও সেই রকম হল মনে পড়ল–আজ লন্ড্রি থেকে জামাটামা আনতে হবে, তা তাতেও দেড় দু টাকা; নীলুর মনিহারী দোকান থেকে একটা সাবান, নিদেন পক্ষে একটা কি দুটো ব্লেড আনতে গেলে সেও বাকি সতেরো টাকার জন্যে হাত পেতে বসবে। এই রকম আরও কত টুকটাক। না, এ আর ভাল লাগে না! এইভাবে কি বাঁচা যায়, দিনের পর দিন! মাঝে মাঝে তারাপদর মনে হয়, এ জীবন রেখে লাভ নেই; তার চেয়ে একদিন ‘জয় মা বলে ডবল ডেকারের তলায় ঝাঁপ দেওয়াই ভাল।
বিরক্ত বিরস মুখ করে তারাপদ উঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে। তার ঘরের জানলা বন্ধ, দরজা খোলা। শীতের দিন বলেই যে জানলা বন্ধ তা নয়, এখন অনেকটা বেলা হয়ে গেছে, রোদ উঠেছে, জানলা খুলে দেওয়া যেত। কিন্তু তার রুমমেট বঙ্কিমদা কখনো সকালে জানলা খুলবেন না। কেননা, জানলাটা খোলা এবং বন্ধ করার মধ্যে কলা-কৌশল আছে। জানলার দুটো পাটই আলগা, প্রায় কৰ্জাবিহীন, হিসেব করে না খুললেই একটা পাট সোজা নিচে বটুকবাবুর মাথায় গিয়ে পড়তে পারে, আর-একটা হয়ত মাঝপথে কোথাও ঝুলতে থাকবে। নারকোল দড়ি, লোহার ছোট শিক–এইসব মালমশলা দিয়ে তারাপদ কোনো রকমে ঘরের জানলা দুটোকে ধরে রেখেছে, যদি না রাখত–এই ঘরে জানলা বলে কিছু থাকত না। তারাপদ খুব বিবেচক। বাড়ির দোষ সে দেয় না। একশো সোওয়াশো বছরের পুরনো বাড়ির হাল এর চেয়ে আর কি ভাল হতে পারে! গলির গলি তার মধ্যে বাড়িটা নড়বড়ে চেহারা নিয়ে, কপোরেশনের ময়লাফেলা গাড়ির মতন ইটকাঠের আবর্জনা হয়ে যে এখনো দাঁড়িয়ে আছে তাই যথেষ্ট। যদি গঙ্গাচরণ মিত্তির লেনের ওই বাড়ি না থাকত-কোথায় যেত তারাপদ? আজকের দিনে মাথা গোঁজার জন্যে তার মাত্র ন’ টাকা খরচ হয় মাসে মাসে। বটুকবাবু এবাড়ির জন্যে সিট রেন্ট বাবদ মাথা পিছু ন টাকা নেন। তাতেও তাঁর লাভ থাকে। আটান্ন টাকা মাসিক ভাড়ার বাড়ি। অবশ্য পুরনো ভাড়াই চলছে। জনা দশেক মেম্বারের মেসের।
তারাপদ ঘরের এক কোণ থেকে তার টুথব্রাশ তুলে নিয়ে আবার বিরক্ত হল। পেস্ট নেই। পরশুই ফুরিয়ে গিয়েছিল। গতকাল কোনো রকমে পেস্টের মুণ্ডু টিপে একটু পাওয়া গিয়েছিল, দাঁত মাজার কাজটা তাতেই সেরেছে। কাল। সারাদিন আর টুথপেস্টের কথা মনে হয়নি।
এক চিলতে সাবানের ওপর ব্রাশ ঘষে নিয়ে মুখ ধুতে যাবার সময় তারাপদর মনে পড়ল, আজ শনিবার। একুশ তারিখ। শনিবার দিনটা এমনিতেই ভাল যায় না তারাপদর, তার ওপর একুশ তারিখ। একুশ তারিখটা তার পক্ষে ভাল নয়। তিন সংখ্যাটাই তার ভাগ্যে সয় না। একুশ, মানে দুই আর এক–সংখ্যা দুটো পাশাপশি রাখলে তাই হয়। দুই আর এক যোগ করো, তিন। খারাপ। ওদিকে আবার একুশকে শুধু তিন আর সাত দিয়ে ভাগ করা যায়, করলে মিলে যায়। তিন দিয়ে মেলানো অশুভ। আবার সাত দিয়ে ভাগ করলে সেই তিন। মানে, যোগ আর ভাগ দু দিকেই একুশ সংখ্যাটা এত খারাপ তারাপদর পক্ষে যে তাকে ডবল খারাপ বলা যায়।
দিনটা যে আজ খুবই খারাপ যাবে সকাল থেকে তারাপদ তার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছে । ঘুম থেকে উঠেই টাকার চিন্তা, কোথায় বটুকবাবু, কোথায় নীলু, কোথায় লন্ড্রি। মুখ ধোবার গেস্ট পর্যন্ত জুটল না।
.
মাত্র ক’ঘণ্টা পরেই কিন্তু সব কেমন ওলোট-পালোট হয়ে গেল ।
বেলা সাড়ে বারোটা বাজেনি। তারাপদ হন্তদন্ত হয়ে চন্দনের মেডিক্যাল হোস্টেলে গিয়ে হাজির। চন্দন ঘরেই ছিল। দাবা খেলছিল বন্ধুর সঙ্গে। সবে এম-বি পাশ করেছে চন্দন, পাশ করে পি আর সি-তে আছে।
তারাপদকে এমন অসময়ে আসতে দেখে চন্দন, “কী রে? হঠাৎ?” বলতে বলতে সে তারাপদর খানিকটা উত্তেজিত, খানিকটা বা বিমূ মুখ দেখতে লাগল ।
তারাপদ হাঁপাচ্ছিল। শীতের দিন হলেও তার মুখে যেন সামান্য ঘাম ফুটেছে। চুলটুল রুক্ষ শুকনো শুকনো চেহারা।
তারাপদ দম টেনে বলল, “চাঁদু, তোর সঙ্গে সিরিয়াস কথা আছে।”
“বল”, বলে চন্দন তার দাবার বন্ধুর মুখের দিকে তাকাল।
তারাপদ বলব কি বলব না মুখ করে বসে থাকল। তৃতীয়জনের সামনে তার কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।
চন্দন তার দাবা খেলার বন্ধুকে চোখের ইশারায় আপাতত উঠে যেতে বলল। বন্ধুটি স্নান করতে যাচ্ছিল, তার কাঁধে তোয়ালে ঝোলানো, সে চলে গেল।
বিছানার মাথার দিক থেকে সিগারেটের প্যাকেট দেশলাই উঠিয়ে নিয়ে সিগারেট ধরাল চন্দন; বলল, “কী তোর সিরিআস কথা, বল?”
তারাপদ নিজের উত্তেজনা সামান্য সামলে নিয়ে বলল, “চাঁদু, সাঙ্ঘাতিক একটা কাণ্ড হয়ে গিয়েছে। আমি একটা চিঠি পেয়েছি, আজ, খানিকটা আগে; রেজিস্ট্রি করে এসেছে।“
“কিসের চিঠি? চাকরির?”
“আরে না না–চাকরির নয়,” বলতে বলতে তারাপদ পকেট থেকে খামে মোড়া একটা চিঠি বের করল। “চিঠিটা পড়ে আমার মাথা ঘুরে গেছে। কিছু বুঝতে পারছি না…।” বলে তারাপদ খামসমেত চিঠিটা চন্দনের হাতে দিল।
চিঠি নিল চন্দন। রেজিস্ট্রি করা চিঠি, উইথ এ ডি। খামের মুখ ছেঁড়া। চন্দন চিঠিটা বের করে নিল। ছাপানো প্যাডে ইংরেজিতে লেখা চিঠি। যেন খানিকটা পোশকি ব্যাপার।
প্রথমটায় চন্দন তেমন মন দিতে পারেনি। চিঠির মাঝামাঝি এসে তার কেমন চমক লাগল। তারাপদর দিকে তাকাল একবার। তারপর আবার মন। দিয়ে প্রথম থেকে চিঠিটা পড়তে লাগল।
চিঠি পড়া শেষ করে চন্দন অবাক হয়ে বলল, “এ তো কোনো সলিসিটারের চিঠি বলে মনে হচ্ছে রে।”
তারাপদ মাথা নেড়ে বলল, “মনে হবার কী আছে, লেটার প্যাডের মাথায় তো লেখাই আছে, ভদ্রলোক সলিসিটার।”
“কিন্তু সলিসিটাররা অফিস থেকে চিঠি দেয় বলে শুনেছি। এটাতে বাড়ির ঠিকানা দেওয়া আছে। “
“চিঠিটা খানিকটা পাসসান্যাল বলে বোধ হয়।”
চন্দন আরও একবার চিঠিটা পড়তে পড়তে সিগারেট খেতে লাগল।
তারাপদ বলল, “কিচ্ছু বুঝলি?”
চন্দন বলল, “খানিকটা বুঝলাম। ভদ্রলোক তোকে পত্রপাঠ দেখা করতে বলেছেন। বিষয়সম্পত্তির একটা বড় ব্যাপার জড়িয়ে আছে। কিন্তু এই সলিসিটার ভদ্রলোক যাঁর কথা লিখেছেন, ওই ভুজঙ্গভূষণ হাজরা; উনি কে?”
তারাপদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমি ভাই এরকম নাম কখনো শুনিনি। অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারছি না। তবে মা বেঁচে থাকতে শুনেছিলুম–সাঁওতাল পরগনার দিকে আমার এক পিসিমা থাকতেন, তাঁরা হাজরা ছিলেন। পিসিমার নাম বোধ হয় ছিল সুবর্ণলতা। পিসেমশাই নাকি অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। আমার মনে হচ্ছে, ভুজঙ্গভূষণ আমার সেই পিসেমশাই। চিঠিতে তো আর কিছু লেখা নেই তেমন।”
চন্দন চিঠিটা মুড়ে খামের মধ্যে ঢোকাল। অন্যমনস্ক। পরে বলল, “বোধ হয় ভুজঙ্গভূষণ তোকে বিরাট কোনো সম্পত্তিটম্পত্তি দিয়ে গেছেন…” বলে হাসল চন্দন, “দেখ, রাজত্বটাজত্ব পেয়ে যেতে পারিস।”
তারাপদ বলল, “আমার তিন কুলে কেউ নেই। টিউশানি করে আর বটুকবাবুর মেসে ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে আছি। একটা চাকরি পর্যন্ত জোটাতে পারলাম না। যাও বা একটা জুটেছিল হাতাহাতি করে ছেড়ে এলাম। আমার কপালে ভাই রাজত্ব বর্তাবে ।”
চন্দন হেসে বলল, “বর্তে যাবে রে, তার হিন্টস্ রয়েছে চিঠিতে। তুই বড়লোক হয়ে যাবি। নে লেগে পড়।”
তারাপদ মাথা নাড়ল। তারপর বলল, “কতকগুলো অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার রয়েছে এর মধ্যে, তুই লক্ষ করেছিস?”
“কী?”
“প্রথমত ধর, আমার ঠিকানা এরা পেল কেমন করে? যদি ধরেই নি ভুজঙ্গভূষণের বিষয়সম্পত্তি আমার জন্যে বসে বসে কাঁদছে, তবু ব্যাপারটা হেঁয়ালির মতন নয় কি? আমার ঠিকানা সলিসিটার মশাই জানলেন কী করে? কেমন করে বুঝলেন আমি ভুজঙ্গভূষণের আত্মীয়? যদি আমার ঠিকানা জানাই থাকবে তবে সেই ভুজঙ্গভূষণ কেন আমায় নিজে চিঠি লিখলেন না?
চন্দন আচমকা বলল, “ভুজঙ্গভূষণ হয়ত মারা গিয়েছেন।”
“মারা গিয়েছেন?”
“মারা গেলেই এ-সব বিষয়সম্পত্তির ওয়ারিশানের কথা ওঠে।“
“তা আমায় কেন?”
“তুই-ই বোধ হয় একমাত্র মানুষ যে কিনা ভুজঙ্গভূষণের জীবিত আত্মীয়।”
তারাপদ চুপ করে থাকল, অন্যমনস্কভাবে লক্ষ করতে লাগল, ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারটা দমকা বাতাসে নড়ে নড়ে যাচ্ছে ।
চন্দন বলল, “তুই এত ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেন?”
“ব্যাপারটা আমার কাছে খুব গোলমেলে লাগছে।”
“গোলমালের কী আছে, তুই আজ সোজা ওই সলিসিটার ভদ্রলোক কী যেন নাম–মৃণালকান্তি দত্ত, তাই না–, তাঁর কাছে চলে যা। গিয়ে দেখা কর।”
“তারপর?”
“দেখা করে দেখ, কী বলেন ভদ্রলোক। কেন তোকে যেতে বলেছেন।”
“কিন্তু আমি যে ভুজঙ্গভূষণের আত্মীয়, তার প্রমাণ কী? নামে মিললেই মানুষ এক হয় না। আমি তো জাল হতে পারি।”
মাথা নেড়ে চন্দন বলল, “জাল ভেজাল প্রমাণ হয়ে যাবে । ভদ্রলোকের। কাছে নিশ্চয়ই কোনো প্রমাণ আছে। তা ছাড়া যদি তোর সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর ও-পক্ষ না রাখত তবে তোর ঠিকানায় চিঠি আসত না।”
তারাপদ চুপ করে থাকল। চন্দন যা বলছে এসব চিন্তা যে তার মাথায়। আসেনি এমন নয়। চিঠি পাবার পর থেকে সে অনবরত ভেবেই যাচ্ছে, ভেবে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছে না। সমস্ত ব্যাপারটাই অবিশ্বাস্য। তারাপদ ভাবতেই পারছে না, যে ভুজঙ্গভূষণকে সে জীবনে চোখে দেখেনি, যার নাম শোনেনি, সেই লোক সত্যি সত্যি তারাপদর জন্যে বড়সড় কোনো বিষয়সম্পত্তি রেখে যেতে পারে! বরং এ-সব ব্যাপারে এমন একটা রহস্য রয়েছে যে, না জেনে না বুঝে এগুতে পেলে বিপদে পড়ে যাবে । গোলমেলে ব্যাপারের মধ্যে গেলেই বিপদ।
খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে তারাপদ বলল, “তুই যেতে বলছিস?”
“আলবত্ যাবি।”
“আমার কেমন নার্ভাস লাগছে।”
“কিসের নার্ভাস! তোকে কি সলিসিটার খেয়ে ফেলবে? তুই কি নিজে যাচ্ছিস? তোকে দয়া করে যেতে বলেছে বলে তুই যাচ্ছিস।”
“তুই আমার সঙ্গে যাবি?”
“আমি?”
“উকিল অ্যাটর্নি শুনলেই আমার ভয় করে। তা ছাড়া ওই যে কী ঠিকানা–কত নম্বর ওল্ড আলিপুর–ও সব ভাই আমি চিনি না। চল তুই…।”
‘বিকেলে আমার যে অন্য দরকার ছিল রে!”
“ক্যানসেল করে দে।…তোর এমন কোনো কাজ নেই। হাসপাতালের চাকরিরও যা বাহার।”
একটু কি ভাবল চন্দন, তারপর বলল, “বেশ, তা হলে বিকেল বিকেল চল । শীতের দিন। পাঁচটা বাজতেই সন্ধে হয়ে যাবে।”
তারাপদ যেন আশ্বস্ত হল খানিকটা। হঠাৎ আবার চোখে পড়ে গেল ক্যালেন্ডারটা। তারাপদ বলল, “চাঁদু, আজ কিন্তু আমার দিনটা ভাল নয়।”
“মানে?”
“একে শনিবার তায় একুশ তারিখ। তিন হল আমার আনলাকি নাম্বার। চন্দন হেসে উঠল। গালাগাল দিয়ে বলল, “তোর যত কুসংস্কার। এসব মাথায় কে ঢোকায় রে? আমি তো দেখছি আজ তোর সাঙ্ঘাতিকু দিন, এ ডে। অফ ফরচুন।”
তারাপদ তখনো খুঁতখুঁত করতে লাগল।
শেষে চন্দন বলল, “আমার এখনো নাওয়া-খাওয়া হয়নি। তুই মেসে যা। ঠিক চারটের সময় ওয়েলিংটনের মোড়ে থাকবে। আমি আসব ।”
তারাপদ উঠল । অনেক বেলা হয়ে যাচ্ছে।
.
আলিপুরে পৌঁছতে পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে গেল। ডিসেম্বর মাসের এই সময়টা এই রকমই, বিকেল ফুরোবার আগেই সব ঝাপসা, ঝপ করে যেন অন্ধকার নেমে আসে আকাশ থেকে। জায়গাটাও কেমন নিরিবিলি। পুরনো আলিপুরের সেই প্রাচীন, বনেদি বাড়ি-ঘর এদিকে রাজারাজড়ার এলাকা যেন, উঁচু উঁচু দেওয়াল ঘেরা বাড়ি, মস্ত মস্ত গাছ, ফটকে দরোয়ান, ভেতরে অ্যালসেশিয়ান কুকুরের গর্জন, ঝকঝকে গাড়ি বেরুচ্ছে, ঢুকছে, রাস্তাটাস্তা বেশ ফাঁকা-ফাঁকা। তারাপদর কেমন গা ছমছম করছিল। সে বেচারি বউবাজারের দিকে থাকে, গঙ্গাচরণ মিত্তির লেনে, যেখানে আলো-বাতাসও ঢুকতে ভয় পায়, গাছটাছ তো দূরের কথা, কোথাও একটা সবুজ পাতা পর্যন্ত দেখা যায় না–সেই তারাপদ এরকম একটা জায়গায় এসে ঘাবড়ে যাবে না তো কী হবে!
তারাপদ বলল, “চাঁদু, এ-দিকে এলে মনেই হয় না এটা কলকাতা, কী বল?”
চন্দন দু পাশের বাড়ি, বাগান, গাছপালা দেখতে দেখতে হাঁটছিল ধীরে ধীরে সলিসিটার দত্ত-র বাড়ির নম্বর খুঁজছিল। ততক্ষণে রাস্তার বাতি জ্বলে উঠেছে, মাথার ওপর আকাশে তারা দেখা যাচ্ছিল।
বাড়িটা পাওয়া গেল। আশেপাশের বাড়ির তুলনায় ছোট। পুরনো আমলের বাড়ি। সামনে বাগান ছোটমতন।
ফটকের সামনে কেউ ছিল না। তারাপদ ঢুকতে চাইছিল না, যদি অ্যালসেশিয়ান তেড়ে আসে।
চন্দন বলল, “কুকুর নেই, থাকলে বাঁধা আছে; চলে আয়–।”
ফটক খুলে দুজনে ভেতরে ঢুকল। তারাপদর ভয় করছিল। তার ওপর শীতটাও যেন বেচারিকে জাপটে ধরেছে, কাঁপতে লাগল তারাপদ।
অল্প এগিয়ে গাড়ি বারান্দা।
গাড়ি বারান্দার সিঁড়িতে উঠে একজনকে দেখতে পাওয়া গেল। বুড়ো মতন একটি লোক। পরনে খাটো ধুতি, গায়ে মোটা চাদর।
তারাপদদের দেখতে পেয়ে লোকটি কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। তারপর কাছে এল। তার চোখে দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে জিজ্ঞেস করছে, কাকে চাই আপনাদের?
চন্দন বলল, “আমরা বউবাজার থেকে আসছি। মিস্টার দত্ত আমাদের দেখা করতে বলেছেন।” বলে চন্দন তারাপদকে দেখিয়ে দিল। “বাবু এঁকে চিঠি লিখেছেন দেখা করার জন্যে। এঁর নামটা বলে গিয়ে বাবুকে।” চন্দন তারাপদর নাম ঠিকানা বলল।
তারাপদদের অপেক্ষা করতে বলে লোকটি চলে গেল। দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে থাকল চুপ করে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখতে লাগল। এক সময় নিশ্চয় বিস্তর পয়সা ছিল বাড়ির মালিকের, সাজিয়ে গুছিয়ে বাড়ি করেছিল, এখনো তার প্রমাণ চোখে পড়ে। মাথার ওপর শেকল দিয়ে ঝোলানো সাদা শেড় পরানো বড় বাতি জ্বলছে, আলোর রঙ বাদামী; এই ঢাকা জায়গা–অনেকটা যেন লবির মতন, দু পাশেই বড় বড় সেটি পাতা রয়েছে বসার জন্যে, এক কোণে হ্যাট স্ট্যান্ড, আয়না, দেওয়ালে গোটা দুয়েক বিশাল বিশাল ছবি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের, একটা চমৎকার হরিণের মাথা।
সমস্ত বাড়ি কিন্তু কী চুপচাপ। দোতলা থেকে পাতলা স্বর ভেসে আসছিল সামান্য।
লোকটি ফিরে এল। এসে বলল, “আসুন আপনারা।”
খুবই আশ্চর্য, ডান বা বাঁ দিকের মুখোমুখি দুটো বাইরের ঘরের কোনোটাতেই ওদের নিয়ে গিয়ে বসাল না লোকটি। একটু ভেতর দিকের একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। তারাপদদের আর-একবার ভাল করে দেখে চলে গেল। .
সেকেলে কাঠের গদি-আঁটা চেয়ারে বসল তারাপদরা। এই ঘরটা সামান্য ছোট। ঘরের বারোআনা শুধু বইয়ে ভরতি। মোটা মোটা বই। বোধ হয় আইনের বই। একদিকে দেওয়ালে-গাঁথা সিন্দুক। লোহার একটা আলমারি অন্যদিকে। জানলা বরাবর বোধহয় দত্ত-মশাইয়ের বসার জায়গা, সিংহাসনের মতন চেয়ার, সামনে সেক্রেটারিয়েট টেবিল।
এই ঘরের গন্ধই যেন কেমন আলাদা। বইপত্রের জন্যেই বোধ হয় ধুলোধুলো গন্ধ লাগে নাকে। পায়ের তলায় জুট কার্পেট। দেওয়ালের দু-এক জায়গায় ছোপ লেগেছে। ঘরে মস্ত বড় একটা পোর্ট্রেট ঝোলানো, কোনো বৃদ্ধের, দত্ত-মশাইয়ের বাবা কিংবা ঠাকুরদার। এক দিকে নিচু টেবিলের ওপর একটা বেড়াল। জ্যান্ত নয়, মরা। কেমন করে তৈরি করেছে কে জানে! একেবারে জ্যান্ত বলে মনে হয়। গায়ের লোেম, চোখের মণি, কান, পায়ের থাবা সব যেন জীবন্ত। বেড়ালের গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। চোখে খুব যে ভাল লাগে তা কিন্তু নয়।
তারাপদ আর চন্দন নিচু গলায় কথা বলছিল, পায়ের শব্দ শুনে চুপ করে গেল।
ছিপছিপে চেহারার এক ভদ্রলোক ঘরে এলেন। টকটকে গায়ের রঙ, মাথায় বেশ লম্বা, পরিষ্কার করে কামানো মুখ, মাথার চুল একেবারে সাদা ধবধবে, পরনে ধুতি, গায়ে পুরো হাতা পশমী গেঞ্জির ওপর দামি শাল। চোখে চশমা।
তারাপদরা উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে জড়সড়ভাবে নমস্কার করত হাত তুলে।
ভদ্রলোক প্রতিনমস্কার করলেন। চশমার আড়াল থেকে দুজনকে লক্ষ করতে করতে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলেন শেষে ।
চন্দন ইশারায় তারাপদকে চিঠিটা বের করতে বলল।
তারাপদ চিঠি বের করল।
চিঠি বের করে তারাপদ দু পা এগিয়ে সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। “আজ সকালে আমি এই চিঠিটা পেয়েছি । আপনিই কি আমায় দেখা করতে বলেছিলেন?”
ভদ্রলোক চিঠির জন্যে হাত বাড়ালেন। দেখলেন। বললেন, “হ্যাঁ, আমারই নাম মৃণালকান্তি দত্ত। বসুন আপনি।”
তারাপদ আবার দু পা পিছিয়ে এসে চন্দনের পাশে বসল।
মৃণাল দত্ত কিছুক্ষণ সরাসরি তারাপদদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, “আপনার নামই তারাপদ?”
তারাপদ একটু কেমন ধাঁধায় পড়ে গেল। এ আবার কেমন প্রশ্ন? সামান্য যেন রাগই হল। ভাবল, বলে–আজ্ঞে আমি তো তাই জানি।…
কিন্তু মৃণাল দত্তের সামনে দাঁড়িয়ে সে-কথা বলতে তার সাহস হল না। ভদ্রলোকের চেহারায় শুধু ব্যক্তিত্বই নেই, দেখলেই বোঝা যায়, অসম্ভব সাবধানী, চালাক এবং বুদ্ধিমান উনি।
তারাপদ নিজের নাম বলল, আবার, পদবী সমেত। বটুকবাবুর মেসের ঠিকানাও।
“আপনার পিতার নাম?”
তারাপদ তার বাবার নাম বলল। তাতেও রেহাই নেই, মার নামও বলতে হল। বাবার নাম, মার নামের পর তাদের পৈতৃক দেশবাড়ি ভিটেমাটির কথাও।
তারাপদ বলল, “আমি এ-সব চোখে দেখিনি। ছেলেবেলায় একবার দেশের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখন আমার চার-পাঁচ বছর বয়েস, আমার কিচ্ছু মনে নেই। শুধু একটা তেঁতুল গাছের কথা মনে আছে, খুব বড় তেঁতুল গাছ, গাছটায় নাকি ভূত থাকত…..” তারাপদ একটু হাসল।
এমন সময় বাহারি ট্রের ওপর সুন্দর কাপে করে চা আনল সেই বুড়ো লোকটি। তারাপদদের দিল।
মৃণাল দত্ত বললেন, “চা খাও–”, বলেই তাঁর কী খেয়াল হল, সামান্য হালকা গলায় বললেন, “তোমাদের তুমি বলছি, কিছু মনে করো না, বয়েস তোমাদের অনেক কম।”
চা পেয়ে তারাপদরা বেঁচে গেল । একে এই বিশ্রী অবস্থা, তার ওপর শীত, হাত-পা রীতিমত ঠাণ্ডা হয়ে আসার জোগাড়।
“ওই ছেলেটি তোমার বন্ধু?” মৃণাল দত্ত চন্দনকে দেখিয়ে তারাপদকে জিজ্ঞেস করলেন।
“আমার পুরনো বন্ধু । ওর নাম চন্দন। ডাক্তারি পাশ করেছে সবে।”
মৃণাল দত্ত চন্দনকে দু চারটে কথা জিজ্ঞেস করলেন, পুরো নাম কী চন্দনের, কোথায় থাকে, বাড়ি কোথায়, বাবা কী করেন, কোথায় থাকেন–এই সব ।
শেষে মৃণাল দত্ত তারাপদর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমায় এবার কটা কথা জিজ্ঞেস করব। ঠিকঠিক জবাব দিও। তোমার বন্ধু এখন এখানে থাকতে পারে–পরে তাকে একটু উঠে যেতে হবে।”
তারাপদ একবার চন্দনের মুখের দিকে তাকাল। তারপর মৃণালবাবুর দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, “চাঁদু আমার পুরনো বন্ধু। ওর কাছে আমার কিছু গোপন করার নেই। ও আমার সবই জানে।”
“আচ্ছা, সে আমি পরে ভেবে দেখব। এখন তোমার বন্ধু থাকুক।” বলে মৃণাল দত্ত যেন সামান্য কি ভেবে নিলেন।
খুবই আচমকা মৃণাল দত্ত বললেন, “তুমি ভুজঙ্গবাবুকে কখনো দেখেছ?”
“আজ্ঞে, না।”
“তাঁর নাম শুনেছ?”
“আমার মনে পড়ছে না।“ মার কাছে আমার এক পিসিমার কথা শুনেছি। পিসিমার শ্বশুরবাড়ির পদবী ছিল হাজরা। সাঁওতাল পরগনার কোথায় যেন থাকতেন জায়গাটার নাম আমি জানি না । মা যদি বলেও থাকে–আমি ভুলে গিয়েছি।”
মৃণাল দত্ত খুব শান্তভাবে বসে, তারাপদর দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন, “তোমার বাবা কবে মারা যান?”
“বাবা–! বাবা মারা গেছেন অনেক দিন। আমি তখন স্কুলে পড়ি। ক্লাস এইট-এ।”
“অসুখ করেছিল? কী অসুখ?”
“কী অসুখ আমি বলতে পারব না।…বাবা কলকাতার বাইরে কোথায় যেন গিয়েছিলেন। অসুস্থ হয়ে ফিরে আসেন। কয়েক দিনের মধ্যে মারা যান।”
“কোথায় গিয়েছিলেন জানো না?”
“না।”
“মা-র কাছে কিছু শুনেছ?”
“না।…বাবা যখন ফিরে আসেন তিনি কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলেন, অনেকটা পাগলের মতন। অথচ একটা কথাও বলতেন না। বলতে পারতেন না। একেবারে বোবা। মাথায়ও কিছু হয়েছিল, মনে হত আমাদের চিনতেও পারছেন না।” বলতে বলতে তারাপদ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। এতকাল পূরে বাবার কথা মনে হওয়ায় হঠাৎ যেন সেই পুরনো স্মৃতি তাকে কেমন বিষণ্ণ করে তুলল।
মৃণাল দত্ত নীরব। চন্দন আড় চোখে একবার কালো বেড়ালটার দিকে তাকাল। তার চোখের মণিতে আলো পড়েছে যেন।
“তোমার মা কবে মারা যান?” মৃণাল শুধোলেন।
“আমি কলেজ থেকে বেরুবার পর মা মারা যায়। বাবা মারা যাবার পর মা অনেক কষ্টে স্কুলে একটা চাকরি জুটিয়ে নেয়। আমরা বরাবরই খুব গরিবভাবে থেকেছি। কোনো রকমে চলত দুজনের। মার বুকের অসুখ করেছিল। তাতেই মারা যায়।”
মৃণাল দত্ত সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর রাখা চুরুটের বাক্স থেকে একটা চুরুট বেছে নিলেন। “তোমরা আগে কোথায় থাকতে, ঠিকানা কী?”
তারাপদ মদন দত্ত লেনের ঠিকানা বলল।
“তারপর?”
তারাপদ বটুকবাবুর মেসে এসে ওঠার আগে যেখানে যেখানে ছিল তার কথা বলল ।
চুরুট ধরিয়ে নিয়ে মৃণাল দত্ত এবার বললেন, “তোমার পিসেমশাই ভুজঙ্গভূষণ তোমায় তাঁর সমস্ত বিষয়সম্পত্তি স্থাবর অস্থাবর-সবই দিয়ে যেতে চান। ভূজঙ্গবাবুর প্রপার্টি যা যা আছে তার সঠিক ভ্যালুয়েশান আমি এখনই দিতে পারব না। ধরো মোটামুটি দেড় থেকে পৌনে দুই লাখ টাকার। এ-সমস্তই তোমার হবে। কিন্তু…”
তারাপদর মাথা প্রায় ঘুরে উঠল। দেড় লাখ টাকার সম্পত্তি! আজ সকালে দাঁত মাজার স্টে পর্যন্ত যার ছিল না, বটুকবাবুর তিরিশটা টাকার জন্যে যারা আত্মহত্যা করার ইচ্ছে করছিল, সেই লোক সন্ধেবেলায় দেড় লাখ টাকার সম্পত্তি পাচ্ছে। তারাপদর ইচ্ছে করছিল থিয়েটারের লোকদের মতন হাহা করে হেসে ওঠে।
মৃণাল দত্ত বললেন, “কিন্তু এই সম্পত্তি পাবার আগে তোমায় দুটো শর্ত পালন করতে হবে।”
তারাপদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল।
মৃণাল দত্ত বললেন, “তুমিই যে ভুজঙ্গবাবুর আত্মীয় তারাপদ তা প্রমাণ করতে হবে।”
“কী করে করব?”।
“তোমার যা করার করেছ, বাকিটা আমি করব। আমার কাছে প্রমাণ আছে। আমি মিলিয়ে দেখব। তার আগে তোমার বন্ধুকে এ-ঘর থেকে কিছুক্ষণের জন্যে উঠে যেতে হবে।”
তারাপদ কিছু বলার আগেই চন্দন উঠে দাঁড়াল। সেও রীতিমত উত্তেজনা বোধ করছিল।
তারাপদ বলল, “আর-একটা শর্ত কী?”
মৃণাল দত্ত শান্ত গলায়, “প্রথমটা যদি মেলে তবে না দ্বিতীয়টা!”
চন্দন আর-একবার বেড়ালটার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
.
দুই
চন্দন চলে যাবার পর তারাপদর বড় ভয় করতে লাগল। ঘরে সে এখন একলা; মৃণাল দত্ত মুখোমুখি বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে দেখছেন তো দেখেই যাচ্ছেন, চুরুটটা তাঁর দাঁতের সঙ্গে ছোঁয়ানো, কেমন একটা কড়া তামাকের গন্ধ নাকে লাগছে। তারাপদ বুঝতে পারছিল না, অন্ধকারের আলো ফেলার মতন চোখ করে মৃণাল দত্ত এত কী দেখছেন তাকে! তার মাথায় ঢুকছিল না, ওই ভদ্রলোকের কাছে এমন কী প্রমাণ রয়েছে যাতে তিনি আসল আর জাল তারাপদ ধরে ফেলবেন? খানিকটা যেন রাগও হচ্ছিল তারাপদর, তার, পরিচয় এই নিয়ে সন্দেহ করার কী আছে? সে কি মুদির দোকানের বনস্পতি ঘি যে খাঁটি আর ভেজাল পরীক্ষা করে দেখতে হবে? বাস্তবিক পক্ষে এটা কিন্তু অপমান;. তারাপদ যেচে এখানে আসেনি, সে ভুজঙ্গভূষণের দেড় দু লাখ টাকার সম্পত্তি পাবার আশায় কাঙাল নয়, তবু তাকে নিয়ে এটা কি বিশ্রী ব্যাপার হচ্ছে? এভাবে তাকে বসিয়ে রাখার কোনো অধিকার মৃণাল দত্তর নেই।
তারাপদ মনে মনে যাই ভাবুক সে কিছু বলতে পারল না; বোবার মতন বসে থাকল।
শেষে মৃণাল দত্ত উঠলেন। ওঠার আগে টেবিলের ড্রয়ার খুললেন চাবি দিয়ে, ড্রয়ারের মধ্যে থেকে আরও একটা বড় মতন চাবির গোছা বার করলেন, দুটো কি তিনটে চাবি একসঙ্গে বাঁধা।
তারাপদর সামনে দিয়ে মৃণাল দত্ত আস্তে আস্তে দেওয়াল-সিন্দুকের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, “তোমার চেহারার সঙ্গে কার মিল বেশি বলে মনে হয়, তোমার বাবার না মা-র?”
তারাপদ খানিকটা অবাক হল। বাবা এতকাল হল মারা গিয়েছেন যে, তাঁর মুখ আর ভাল করে মনেই পড়ে না। তা ছাড়া বাবা মারা যাবার সময় সে ছেলেমানুষ ছিল, এখন কত বড় হয়ে গিয়েছে, চব্বিশ পঁচিশ বয়েস হতে চলল–কেমন করে সে বলবে তার চেহারা বাবার মতন’ হয়ে আসছে কি না! মা অবশ্য বলত, তারাপদর চেহারার আড় তার বাবার মতন হয়েছে, মুখের খানিকটা বাবার ছাঁদে, বাকিটা মার।
শুকনো শুকনো গলায় তারাপদ বলল, “আমি বলতে পারব না। মা বলত, মেশানো মুখ ।”
মৃণাল দত্ত বড়সড় দেওয়াল-সিন্দুকটা খুলে ফেলে কী যেন বের করতে লাগলেন। তারপর বাঁধানো অ্যালবামের মতন একটা মোটা খাতা বের করলেন যত্ন করে রাখা কিছু কাগজপত্রও নিলেন; নিয়ে সিন্দুকের ডালা বন্ধ করলেন।
নিজের চেয়ারে ফিরে এসে বসলেন মৃণাল দত্ত। বললেন, “তুমি আমার সামনে এগিয়ে এসে বসো।” বলে আঙুল দিয়ে টেবিলের অন্য প্রান্তটা দেখালেন।
তারাপদ চেয়ারটা টেনে এনে টেবিল ঘেঁষে বসল, মুখোমুখি ।
মৃণাল দত্ত বাঁধানো খাতার মতন জিনিসটা এগিয়ে দিলেন। হ্যাঁ, ওটা অ্যালবামই, তবে বাজারে যেমন কিনতে পাওয়া যায় সেই রকম নয়। মোটা মোটা কাগজ, বেশিরভাগ পাতায় একটা করে মাত্র ছবি, কখনো কখনো দুটো; প্রতিটি পাতা নিখুঁত করে রাখা, গোটা খাতাটাই চামড়ায় বাঁধানো, ছবির পাশে লাল পেনসিলে পুরু করে শুধু নম্বর লেখা আছে বাংলায় ।
তারাপদ অ্যালবাম হাতে করে বসে থাকল।
মৃণাল দত্ত কাগজপত্রের মধ্যে থেকে একটা পাতলা চামড়ার খাপ–চুরুট রাখার খাপ যেমন হয় অনেকটা সেই রকম খাপ-খুঁজে নিয়ে তার ভেতর থেকে একটা মোটা কাগজ বের করে নিলেন।
মৃণাল দত্ত বললেন, “তুমি ওই ছবিগুলো দেখে যাও একটা একটা করে; যে ছবিটা তোমার চেনাচেনা লাগবে সেই ছবিটা কার আমায় বলবে। বুঝলে?”
তারাপদ মাথা হেলিয়ে বলল, সে বুঝেছে।
“নাও বলো”, বলে মৃণাল দত্ত চেয়ারে পিঠ হেলিয়ে বসে মুখের সামনে মোটা কাগজটা মেলে রাখলেন। তারাপদ বুঝতে পারল, উনি খুব সাবধানী, কাগজের কোনো আঁচড়ও যাতে তারাপদর চোখে না পড়ে সেজন্য দূরত্ব সৃষ্টি করলেন। এর কোনো প্রকার ছিল না, কেন না তারাপদ কাগজের সাদা পিঠ ছাড়া অন্য কিছু এমনিতেই দেখতে পাচ্ছিল না।
তারাপদ অ্যালবামের দিকে চোখ দিল। প্রথম ছবিটা যে কার কে জানে! অনেক পুরনো ছবি, কেমন হলদেটে হয়ে গেছে, ছোপ ছোপ ধরেছে, কোথাও কোথাও একেবারেই ধূসর। বিশাল দাড়িঅলা এই বৃদ্ধ মানুষটিকে সেকেলে কোনো গুরুদেব-টুরুদেবের মতন দেখতে লাগে, পরনের খুট গায়ে জড়ানো, পদ্মাসন না কী বলে যেন সেই ভাবে বসা, হাত দুটি হাঁটুর ওপর।
তারাপদ মাথা নাড়ল বলল, “এই এক নম্বরের ফটো যে কার আমি জানি না। জীবনেও দেখিনি।”
মৃণাল দত্ত বললেন, “তোমার দেখার কথাও নয়। তারপর বলে যাও…।”
তারাপদ দুই তিন চার পাঁচ নম্বর ছবি পর্যন্ত কাউকে চিনতে পারল না। বুঝতে পারল, ছবিগুলো সবই পারিবারিক, বৃদ্ধবৃদ্ধাদের, প্রবীণের । এই পরিবারের সঙ্গে তারাপদর সম্পর্ক কী? সে তো কাউকে চেনে না দেখেনি। তবে? তবে কি তারাপদ এই পরিবারেরই কেউ, এদেরই বংশধর, এদেরই রক্ত গায়ে নিয়ে বেঁচে আছে? এইসব স্বর্গত পুরুষরা কি আজ অদৃশ্য হয়ে তাকে দেখছে? তারাপদর ঘাড় এবং মাথার কাছে যেন কারা দাঁড়িয়ে রয়েছে এরকম একটা অস্বস্তি বোধ করল সে।’
সাত নম্বর ছবির দিকে চোখ রেখে তারাপদ কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল । কী যেন মনে করার চেষ্টা করতে লাগল। ওই ছবির সঙ্গে একটা কিছুর যোগ রয়েছে কোথাও। অথচ ছবিটা কোনো মানুষের নয়। সেকেলে একটা বাড়ির ছবি। পাকা বাড়ি, তার চেহারাই কেমন আলাদা–একালের শহুরে বাড়ির সঙ্গে মেলে না। বাড়ির ঢঙে, আশপাশের চেহারায়, গ্রাম-গাম লাগে। দোতলা বাড়ি, একটানা ঘর, বাঁ দিকে একটা চালার মতন, ডান দিকে ক’টা গাছপালা, তার পাশে মস্ত একটা গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে, গাছটার মাথা দেখা যাচ্ছে না।
তারাপদ গভীর মনোযোগে গাছটার অস্পষ্ট ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ বলল, “এই বাড়িটা বোধ হয় আমাদের দেশের বাড়ি। আমার ঠিক মনে নেই, তবে সেই তেঁতুলগাছটা, যার মাথায় ভূত থাকত, সেই গাছটা যেন এইটে–” বলে তারাপদ আঙুল দিয়ে গাছটা দেখাল।
মৃণাল দত্ত বললেন, “হ্যাঁ, তোমাদের দেশের বাড়ি। তোমার কি মনে আছে ওই বাড়ির পেছনে কী ছিল?”
তারাপদ মনে করার বৃথা চেষ্টা করল, তারপর হঠাৎ কেমন একটু হেসে বলল, “আমার মনে নেই। তবে মার মুখে শুনেছি পুকুর ছিল।”
মৃণাল দত্ত শান্ত গলায় বললেন, “তেঁতুলগাছটার কথাও মা-বাবার মুখে শুনতে পার।…যাক, অন্য ছবি দেখো।”
তারাপদ বেশ ক্ষুব্ধ হল। তার বাল্যস্মৃতির মধ্যে তেঁতুলগাছটা কেমন করে যেন থেকে গেছে অথচ মৃণাল দত্ত তা বিশ্বাস করতে পারছেন না। আশ্চর্য! এত সন্দেহ কেন?
পর পর তিনটে ছবি উলটে গিয়ে তারাপদ হঠাৎ থেমে গেল। তার চোখ উজ্জ্বল দেখাল । সামান্য গলায় বলল, “আমার বাবার ছবি ।” বলে তারাপদ ঝুঁকে পড়ে তার বাবার ছবি দেখতে লাগল । কতকাল পরে বাবাকে দেখছে। যেন। এই মুখ চোখ মাথার চুল সব বুঝি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ ফিরে পেল।
মৃণাল দত্ত বললেন, “তোমার কাছে তোমার বাবার ছবি নেই?”
“না”, মাথা নাড়ল তারাপদ।
“তোমার মার কাছে নিশ্চয়ই ছিল।”
তারাপদ এবার রেগে গিয়ে বলল, “আপনি আগাগোড়া আমায় অবিশ্বাস করছেন কেন? আপনি ভাবছেন, মা বাবা বেঁচে থাকার সময় আমি যা শুনেছি দেখেছি সেগুলো চালাবার চেষ্টা করছি।”
মৃণাল দত্ত বললেন, “আমি আমার কাজ করছি। তোমার কথার জবাব পরে দেব। এখন তুমি ছবিগুলো দেখে যাও।”
বিরক্ত অসন্তুষ্ট মনে তারাপদ অন্য ছবিগুলো দেখতে লাগল। মার ছবি দেখল, বলল। একটা মন্দিরের পাশে মা বাবা এবং আরও যেন দুজনকে দেখল। বলল, “মা বাবাকে চিনতে পারছি, আর কাউকে পারছি না।”
“তোমাকে পারছ না?”
“আমাকে? আমিও আছি নাকি? কোথায়?” তারাপদ বেশ কৌতূহল বোধ করে নিজেকে খুঁজতে লাগল। দুটো বাচ্চার একটা নিশ্চয় সে। কিন্তু কোটা? ছেলেবেলার তারাপদ কি তালপাতার সেপাই ছিল? কাঠির মতন হাত পা, ঢলঢলে হাফ প্যান্ট, একটা শার্ট গায়ে, খোঁচা খোঁচা চুল মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই ছেলেটাই কি তারাপদ নিজে? অন্যটা কে তা হলে?
তারাপদ ছবির ওপর আঙুল দিয়ে বলল, “আমি বোধ হয় এইটে…।”
মৃণাল দত্ত একটু যেন হাসলেন। বললেন, “ঠিক আছে, পরের ছবিগুলো দেখো।”
তারাপদ পরের ছবিগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা ছবি দেখে কেমন থমকে গিয়ে বলল, “এ আমার বোন পরী…।”
“ওটা কত নম্বরের ছবি?”
“উনিশ।”
“তোমার বোনের কথা মনে পড়ে?”
“হ্যাঁ । দেখতে খুব সুন্দর ছিল। ঝাঁকড়া চুল, ফরসা রঙ, একটু একটু কথা বলতে শিখেছিল, দা—দ–দা, মা—ম–মা বলতে পারত জলকে বলত দল…। বছর দুই বয়সও হয়নি, পরী মারা যায়।”
“কেমন করে?”
“সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে মাথায় লেগেছিল। তাতেই মারা গেল।”
মৃণাল দত্ত কিছু বললেন না। নিবন্ত চুরুটটা ছাইদান থেকে আবার উঠিয়ে নিলেন।
তারাপদ অন্যমনস্ক বিষণ্ণ মুখে বসে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর আবার পাতা ওলটাতে লাগল। ওলটাতে ওলটাতে দেখল কী আশ্চর্য, তার স্কুলে পড়ার সময়কার ছবি, মা-র সঙ্গে আরও একটা ছবি, তার কৈশোর ও যৌবনকালের ছবিও এই অ্যালবামে রয়েছে। কেমন করে থাকল? বি এ পাশ করার পর সে কনভোকেশনে গিয়েছিল–একটা ছবিও তুলিয়েছিল অন্যদের মতন জোব্বা পরে, সেই ছবিও রয়েছে। অদ্ভুত তো!…একেবারে শেষের দিকে তারাপদ সাধুমামার ছবি দেখতে পেল। দেখে অবাক হয়ে গেল। সাধুমামা তাদের একেবারে নিজের কেউ নয়, মার কোন দুর সম্পর্কের আত্মীয়, আবার বাবারও যেন কেমন একটা ভাইটাই হত । তবু মার সম্পর্কেই তাঁকে মামা বলা হত। একটু খেপাগোছের লোক। হঠাৎ কলকাতায় তাদের বাড়িতে আসত, আবার চলে যেত, কোথায় যে থাকত সাধুমামা, কেউ জোর করে বলতে পারবে না। কখনো বর্ধমানে কখনো রানীগঞ্জে, কখনো দেওঘরে। সাধুসন্ন্যাসী আশ্রম-টাশ্রম করে বেড়াত খুব। মা মারা যাবর পরও সাধুমামা দু-এক বছর তারাপদর খোঁজখবর করেছে, থেকেছে এক-আধ রাত। বটুকবাবুর মেসে তারাপদ আস্তানা গাড়ার পরও সাধুমামা দেখা দিয়ে গিয়েছে। আজ বছর দেড় দুই অবশ্য আর আসেনি। তারাপদ ভাবত, সাধুমামা মারা গেছে।
সাধুমামার কথা ভাবতে গিয়েই তারাপদর আচমকা খেয়াল হল, আরেসাধুমামাই তো তার কনভোকেশনের একটা ছবি জোর করে নিয়ে গিয়েছিল। ওই ছবি কি সেইটে? নিশ্চয়ই তাই।
তারাপদ চোখ তুলে বলল, “আমি এখন বুঝতে পারছি।”
“কী বুঝছ?”
“সাধুমামা আমাদের অনেক ছবি জোগাড় করে এই অ্যালবামে রেখেছে।”
“না”, মৃণাল দত্ত মাথা নাড়লেন। “সাধুমামার অ্যালবাম এটা নয়। এটা ভুজঙ্গবাবুর। তোমাদের সাধুমামা অনেক ছবি ভুজঙ্গবাবুকে দিয়েছে, তঅমাদের ছবি–বিশেষ করে তোমার বাবা মারা যাবার পর তোমাদের সমস্ত ছবিই সাধুমামা ভুজঙ্গবাবুকে জোগাড় করে দিয়েছে।”
“শুধু ছবি কেন, আমাদের সমস্ত খবরই বোধ হয় সাধুমামা দিত?”
“হ্যাঁ ।”
“আমার ঠিকানাও সাধুমামা দিয়েছিল!”
“না দিলে ভুজঙ্গবাবু কোথায় পাবেন?”
“আমি যদি বটুকবাবুর মেসে না থাকতাম–তা হলে কী হত?”
“তোমার খোঁজ করার চেষ্টা করতাম, কাগজে নোটিশ দিতাম। তাতেও যদি তোমার খোঁজ না পাওয়া যেত–আমায় এই বোঝা মাথায় নিয়ে বসে থাকতে। হত তোমার অপেক্ষায়।”
তারাপদ অ্যালবামটা বন্ধ করে দিল। এতক্ষণে তার যেন স্বস্তি লাগছে। বড় করে নিশ্বাস ফেলল।
মৃণাল দত্ত বললেন, “এবার আমায় দু-একটা ছোটখাট কথা বলো! তোমার শরীরে কোনো আইডেন্টিফিকেশান মার্ক আছে? কোনো কাটাকুটি, জড়ল, তিল–?”
তারাপদ নিজের হাত দেখতে দেখতে বলল, “তিল তো অনেক আছে, বাঁ পায়ে হাঁটুর তলায় কাটা আছে।”
“আর কিছু?”
“জানি না, লক্ষ করিনি।”
মৃণাল দত্ত হাতের কাগজ টেবিলের ওপর রাখলেন। বললেন, “তোমার বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলের কাছটা জোড়া নয়? আরও আঙুলের মতন আছে। পাঁচের জায়গায় ছয় বলতে পারো। ঠিক কি না? দেখি?”
তারাপদ স্বীকার করল, হ্যাঁ, তার বাঁ পায়ের আঙুল ওই রকমই। মৃণাল দত্তকে দেখাল।
মৃণাল দত্ত এবার যেন নিশ্চিন্ত। চুরুট নিবে গিয়েছিল। আবার ধরালেন। বললেন, “আর একটু চা খাবে?”
তারাপদ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। মাথা নেড়ে বলল, “খাব।”
মৃণাল দত্ত টেবিলের পাশে লাগানো কলিং বেলের বোতামে হাত দিলেন। একটু পরেই সেই বুড়োমতন লোকটি ঘরে এল।
মৃণাল দত্ত বললেন, “দু কাপ চাপ নিয়ে এসো, আর বাবুর বন্ধুকে এ ঘরে পাঠিয়ে দাও।”
লোকটি চলে গেল।
মৃণাল দত্ত এবার মোলায়েম গলায় বললেন, “প্রথম শর্তটা মিটল। তুমি যে আসল তারাপদ সবার আগে আমার সেটা দেখা দরকার ছিল। তোমার শরীরের চিহ্ন ছাড়াও–ওই ছবিগুলো যা তুমি চিনতে পেরেছ–তাতেও প্রমাণ হয় তুমি তারাপদই। আমার আর কোনো সন্দেহ নেই।”
“তোমার এই বন্ধুটি কি সত্যিই পুরনো বন্ধু?” মৃণাল দত্ত জিজ্ঞেস করলেন।
“আজ্ঞে হ্যাঁ।“
“বিশ্বাস করার মতন?”
“আজ্ঞে, ও আমার সবচেয়ে ইনটিমেট ।”
“ভাল। খুবই ভাল।” মৃণাল দত্ত আস্তে আস্তে চুরুটে টান দিলেন। খানিকটা যেন চিন্তিত।
চন্দন ঘরে এল। তারাপদর পাশে বসতে পারল না, নিজের পুরনো জায়গায় বসল। এখানে বসলে চোখ যেন নিজের থেকেই বেড়ালটার দিকে চলে যায়। চন্দন তাকাল। তাকিয়েই তার কেমন যেন ধাঁধা লেগে গেল। সামান্য যেন চমকেও উঠল। চন্দন যখন এ-ঘর ছেড়ে চলে যায় তখন ওই বেড়ালটার মুখ যে অবস্থায় ছিল-এখন যেন তার চেয়ে খানিকটা ঘুরে গিয়েছে। তখন, মানে তারাপদ আর সে যখন এই ঘরে এসে প্রথমে বসে, তখন বেড়ালটার মুখ তাদের দিকে ফেরানো ছিল, এখন ঘড়ির কাঁটার মতন ডানদিকে সরে গিয়েছে, বেড়ালটার মুখ বা চোখের সঙ্গে চন্দনের চোখাচুখি হচ্ছে না। আশ্চর্য ব্যাপার তো! চন্দন কি চোখে ভুল দেখছে? নাকি তারাপদ বেড়ালটা হাতে করে তুলে দেখেছিল, আবার নামিয়ে রাখার সময় ওই ভাবে বসিয়েছে? চন্দন কিছু বুঝতে পারল না। সে বেড়ালটার দিকে নজর রেখে বসে থাকল।
ততক্ষণে তারাপদ একবার ঘাড় ঘুরিয়ে বন্ধুকে দেখে নিয়েছে।
মৃণাল দত্ত তারাপদকে বললেন, “আমি তোমায় গোড়ার কয়েকটা কথা বলে নিতে চাই। তোমার শুনে রাখা ভাল। তোমার পিসেমশাই ভুজঙ্গভূষণের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। আমি একবার পুজোর ছুটিতে ফ্যামিলি নিয়ে মধুপুরে চেঞ্জে গিয়েছিলাম। ভুজঙ্গবাবুও গিয়েছিলেন কয়েক দিনের জন্যে। পাশাপাশি বাড়ি। আলাপ হয়েছিল সে-সময়। তারপর আমি কলকাতায় ফিরে আসি। ভুজঙ্গবাবু মাঝে মাঝে আমায় চিঠি লিখতেন। আমিও জবাব দিতাম। তারপর তিনি আমায় তাঁর সলিসিটার হবার অনুরোধ জানান। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম হব না। পরে তাঁর চিঠির তাগাদায় রাজি হয়ে যাই। এবার পুজোর সময়, লক্ষ্মী পূর্ণিমার পর ভুজঙ্গবাবু একদিনের জন্যে কলকাতায় আসেন, আর এই সমস্ত কাগজপত্র ছবি দিয়ে যান। কিছু সই-সাবুদের ব্যাপার ছিল–ছুটির আগেই আমি তা সেরে রেখেছিলাম, তিনি সেগুলো সইটই করে দেন। তখন আমায় বলেছিলেন, তাঁর চিঠি পাবার পর আমি যেন তোমার খোঁজখবরের চেষ্টা করি। আজ দিন সাতেক হল আমি তাঁর দুটো চিঠি পেয়েছি। দুটো চিঠিতেই তিনি তোমার কথা লিখেছেন; লিখেছেন তোমায় তাড়াতাড়ি একবার তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিতে।”
তারাপদ মন দিয়ে কথা শুনছিল। বলল, “তিনি কোথায় থাকেন আমি তো । জানি না!”
“তোমার জানবার কথাও নয়, মৃণালবাবু বললেন। “তুমি কোনোদিন মধুপুর দেওঘরের দিকে গিয়েছ?”
“আজ্ঞে না ।”
“মধুপুর আর যশিডির মধ্যে একটা স্টেশন আছে, স্টেশনটার নাম শংকরপুর। সেখানে নেমে মাইল তিন-চার ভেতরে গেলে ভুজঙ্গবাবুর বাড়ি পাবে। জায়গাটাকে মাঠমোকাম বলে।”
বুড়োমতন লোকটি আবার চা নিয়ে এল ট্রে-তে করে। তারাপদ আর । চন্দনকে দিল। চন্দন যত না মৃণাল দত্তর কথা শুনছে তার চেয়ে বেশি। মনোযোগ দিয়ে কালো বেড়ালটার দিকে তাকিয়ে আছে। আপাতত কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
এত রকম ঝঞ্ঝাটের পর গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে তারাপদর আরাম লাগছিল।
মৃণাল দত্ত সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “তুমি তো ভুজঙ্গবাবুকে কখনো দেখোনি, তাঁর বিষয়ে কিছু জানো না।”
“না,” তারাপদ মাথা নাড়ল।
মৃণাল দত্ত কী যেন ভাবছিলেন, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলেন, “আমি দেখেছি—ওঁকে স্বাভাবিক অবস্থায় দেখলেও তোমার ভয় করত। আর এখন, কী অবস্থায় তুমি তাঁকে দেখবে আমি বলতে পারছি না।”
তারাপদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। “ভয় করবে? কেন?”
“এক একজন মানুষের চেহারা দেখলে কেমন একটা লাগে না? তেমার কখনো লাগেনি?”
তারাপদ মনে করবার চেষ্টা করল। প্রথমেই তার মনে পড়ল, মদন দত্ত লেনের সেই মুদিঅলাকে; বীভৎস চেহারা, পাড়ার ছেলেরা তাকে ফ্র্যাংকেস্টাইন বলত; মনে পড়ল ছেলেবেলায় একবার সে সেকেন্ড ক্লাস ট্রামে একটা বাবরি চুলঅলা, কালো কুচকুচে চেহারার ষণ্ডা লোক দেখেছিল, তার চোখ দুটো লাল টকটকে। কে যেন বলেছিল, লোকটা জল্লাদ, জেলে জেলে ফাঁসি দিয়ে বেড়ায়। সেই লোকটাকে দেখে তারাপদর ভীষণ ভয় হয়েছিল। তারপর আরও কাউকে কাউকে দেখেছে যাদের চেহারার কোনো না কোনো অস্বাভাবিকতা, কোনো অঙ্গহানির জন্যে সত্যিই বড় বিশ্রী দেখতে লাগে ।
তারাপদ বলল, “হ্যাঁ, তা লাগে।”
“ভুজঙ্গবাবুকেও দেখতে তোমার ভাল লাগবে না–” মৃণাল দত্ত বললেন, “অনেকটা যেন কাপালিকের মতন দেখতে। আমি নিজে অবশ্য কোনো কাপালিক কখনো দেখিনি–বঙ্কিমবাবুর কপালকুণ্ডলা’ সিনেমায় একবার কাপালিক দেখেছি, সে তো সিনেমার কাপালিক। ভুজঙ্গবাবুকে আরও ভয়ঙ্কর দেখতে। তাঁর একটা ছবি আমার কাছে আছে তিনিই দিয়েছেন, তোমায় দেখাচ্ছি।” বলে মৃণালবাবু টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে কাগজপত্র থেকে একটা খাম বের করলেন। ফটো রাখার হলুদ খাম। ভুজঙ্গবাবুর ছবি বের করে তারাপদর দিকে এগিয়ে দিলেন।
চন্দনের কান তখন মৃণাল দত্তর কথায়। সে কালো বেড়ালটার দিকে তাকাতে ভুলে গেল। তারাপদ ছবিটা হাতে নিল। মাঝারি ছবি। ভুজঙ্গবাবুর বুক পর্যন্ত দেখা যায়। ছবি দেখে তারাপদ স্তম্ভিত। বিশাল মুখ, খড়ের মতন লম্বা নাক, বড় বড় চোখ, চওড়া কান। চোখ দুটো এত তীব্র, এমন অস্বাভাবিক রুক্ষ যে তাকালেই মনে হয়, মানুষটা তোমার সব কিছু দেখে নিচ্ছে। চোখের মধ্যে কেমন এক নিষ্ঠুরতা। মানুষের ভুরু যে কত চওড়া হতে পারে ভুজঙ্গভূষণের মুখ না দেখলে বোঝা মুশকিল। পুরু ঠোঁট, সামান্য দাঁত দেখা যাচ্ছে, ধারালো শক্ত ঝকঝকে দাঁত। ভুজঙ্গবাবুর উঁচু চওড়া কপাল, নাক, চোখ আর ঠোঁটের সামান্য অংশ ছাড়া বাস্তবিক মুখের আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। মুখে ঘন দাড়ি, সন্ন্যাসীদের মতন, মাথার চুল পিঠ পর্যন্ত বাবরি করা। দাড়ি আর চুল কোনোটাই পরিপাটি নয়, উস্কোখুস্কো, ঝড়ে-ওড়া চুলের মতন এলোমেলো।
তারাপদ ভাবতে পারছিল না, এই লোকটা কী করে তার পিসেমশাই হয়? এ তো কোনো ভয়ংকর তান্ত্রিক হতে পারে। কাপালিক হওয়াও সম্ভব। ১
মৃণাল দত্ত বললেন, “ভুজঙ্গবাবুর কাছে তোমায় যেতে হবে। তিনি তোমায় নিজের চোখে দেখতে চান।”
“কেন?”
“তিনি লিখেছেন, আর বেশি দিন তিনি বাঁচবেন না। কীভাবে আগুন লেগে তাঁর মুখ পুড়ে গেছে। ওষুধপত্র লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে কোনোরকমে বেঁচে আছেন। মারা যাবার আগে একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান। এ হয়ত তাঁর দুর্বলতা। তা ছাড়া, তুমি ছাড়া তাঁর আর কোনো জীবিত আত্মীয় নেই, হয়ত সেই জন্যেই নিজের ওয়ারিসানকে একবার স্বচক্ষে দেখতে চান।”
তারাপদ চুপ করে থাকল। ভুজঙ্গভূষণের কাছে যেতে তার ইচ্ছে করছিল না, আবার যখনই দেড় দু’লাখ টাকার সম্পত্তির মনে আসছিল–তখন সেটা হারাবার কথাও ভাবতে পারছিল না।
মৃণাল দত্ত যেন তারাপদর মনের কথা বুঝতে পেরে বললেন, “ভুজঙ্গবাবুর সঙ্গে যদি তোমার দেখা না হয় তা হলে দ্বিতীয় শর্ত মতন তুমি তাঁর সম্পত্তির কানাকড়িও পাবে না।”
তারাপদর মনে হল, সে যেন মনে মনে কিসের স্বপ্ন দেখছিল, হঠাৎ তা ভেঙে গেল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মৃণালবাবু আবার বললেন, “তোমায় আমার আপাতত আর কিছু বলার নেই। যদি ভুজঙ্গবাবুর কাছে যেতে চাও, আমি তোমায় দু-একটা জিনিস দেব। সেটা তাঁর হাতে পৌঁছে দিতে হবে। তিনি জিনিসগুলো পেয়ে আমায় জানাবেন–তোমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে।”
“কিন্তু আমি গিয়ে যদি দেখি তিনি মারা গেছেন?”
“মারা যাবেন বলে মনে হয় না। দু-চার দিনের মধ্যে বোধ হয় নয়। নিজের মৃত্যুর দিন নাকি তাঁর জানা। সামনের অমাবস্যা পর্যন্ত তিনি বেঁচে থাকবেন লিখেছেন। মানে আরও দিন আষ্টেক । আজ সপ্তমী-টপ্তমী হবে।”
তারাপদ বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকল।
“যদি যেতে চাও কাল সকালে একবার তোমায় এখানে আসতে হবে। আমি সব তৈরি করে রাখব।”
তারাপদর মুখে কথা ফুটল না।
ঘর ছেড়ে চলে আসার মুখে চন্দন আবার কালো বেড়ালটার দিকে তাকাল। তাকিয়ে তার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। বেড়ালের মুখ মৃণাল দত্তর দিকে ঘুরে গিয়েছে প্রায়। চন্দন তারাপদর হাতের কাছটা জোরে চেপে ধরল।
.
তিন
টাইম টেল-এ গাড়ি ছাড়ার সময় রাত প্রায় দশটা; ন’টার আগেই তারাপদরা হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেল। হাতে খানিকটা সময় থাকা ভাল, টিকিট কাটা, আগেভাগে বসবার জায়গা দখল করা । সারা রাত এই শীতে তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া যাবে না, ঘুমোতে না পারুক–অন্তত ভাল করে বসার জায়গা দরকার।
তারাপদ নিজে টিকিট কাটতে গেল না। চন্দনকে পাঠিয়ে দিল। সারাটা দিন আজ তারাপদর বড় ছুটোছুটি গিয়েছে। কাল সারা রাত তেমন একটা ঘুমোতেই পারল না, মাথার মধ্যে মৃণাল দত্ত আর ভুজঙ্গভূষণ। ওরই মধ্যে সাধুমামার মুখ মাঝে মাঝে উঁকি দিয়েছে, মা বাবার কথা মনে পড়েছে, পরীর কথাও মনে পড়ল। পরীর মুখ তো মনেই ছিল না তারাপদর, ছবি দেখে মনে পড়ল। ওই একটিমাত্র বোন, আর তো কেউ ছিল না তার, আহা সে বেচারিও থাকল না। হাজার চিন্তায় ঘুম হল না। তার ওপর ওই ব্যাপারটাও তাকে বেশ অবাক করে তুলেছিল। মৃণালবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়েই চন্দন সেই কালো বেড়ালটার কথা বলল। বেড়ালটা নাকি ঘড়ির কাঁটার মতন ঘুরে যায়। চন্দন স্বচক্ষে দেখেছে, তারাপদরা যখন মৃণালবাবুর ঘরে গিয়ে বসে তখন তার মুখ ছিল তাদের দিকে, আর যখন চলে আসে তখন বেড়ালটার মুখ মৃণাল দত্তর দিকে। এ কি করে সম্ভব? একটা ভুয়ো, নির্জীব, পুতুল ধরনের বেড়াল কেমন করে মুখ ঘোরাবে? চন্দন নিশ্চয় ভুল দেখেছে।
চন্দন জোর দিয়ে বলল, না, সে ভুল দেখেনি। ঠিকই দেখেছে।
কেমন করে এটা হয় তারাপদ বুঝতে পারল না। ভূতের ব্যাপার নাকি? ম্যাজিক?
ভুজঙ্গভূষণের পুরো ব্যাপাটাই ভূতুড়ে মনে হচ্ছে, ভাবতে গেলে সেরকমই মনে হয় নাকি? কোথায় তারাপদ আর কোথায় ভুজঙ্গভূষণ–চেনা না জানা না–কস্মিনকালেও যারা পরস্পরের মুখ পর্যন্ত দেখল না, তারা কেমন করে। আজ একজন অন্যজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে! ভুজঙ্গভূষণ খুঁজছে তারাপদকে, আর তারাপদ খুঁজে বেড়াচ্ছে ভুজঙ্গভূষণের দেড় দুলাখ টাকার সম্পত্তি! সত্যিই ব্যাপারটা ভুতুড়ে।
ব্যাপার ভুতুড়ে হোক আর যাই হোক, সকালে ঘুম ভেকে উঠে তারাপদকে মৃণালবাবুর কাছে ছুটতেই হল। দেড় দু’লাখ টাকার লোভে কি? হতে পারে। আবার টাকার লোভ ছাড়াও কেমন একটা রহস্যের টানও রয়েছে। সত্যি সত্যি ওই ভুজঙ্গভূষণ কে? কেনই বা তাঁর ওই রকম কাপালিক-মাকা চেহারা? কী করতেন তিনি এতকাল? কেন কোনদিন তারাপদদের খোঁজখবর নেনি, অথচ সাধুমামাকে দিয়ে তাদের পরিবারের–মানে তারাপদর মা, বাবা, পরী সকলের ছবি জোগাড় করে নিয়েছেন! কী তাঁর উদ্দেশ্য ছিল?
হাজার রকম ‘কেন’র কোনো জবাব যেমন পাওয়া যাচ্ছে না–সেইরকম। বোঝা যাচ্ছে না ভুজঙ্গভূষণ কী করে জানতে পারলেন যে সামনের অমাবস্যা পর্যন্ত তিনি বেঁচে থাকবেন? ভদ্রলোকের কি ইচ্ছামৃত্যু? কে জানে বাবা! এত রকম অবাক হবার ব্যাপার যখন রয়েছে তখন বেড়ালটার মুখ ঘোরানোও আর এমন কি আশ্চর্যের! তবে, ওই কালো বেড়ালটা তো ছিল, মৃণাল দত্তর ঘরে। তা হলে? মৃণাল দত্তও কি ভুজঙ্গভূষণের ছোঁয়া পেয়েছেন?
সকালে মৃণাল দত্তকে একবার কালো বেড়ালটার কথা জিজ্ঞেস করলে হত। এসব কথা জিজ্ঞেস করতে লজ্জাও তত করে। কিন্তু সে সুযোগই হল না। পুরনো ঘরে মৃণাল দত্ত তারাপদকে আর বসাননি। বাইরের বৈঠকখানায় বসিয়ে রেখে তাঁর দরকারি কাগজপত্র এনে দিলেন। যেন তিনি জানতেন তারাপদ ঠিকই আসবে, রাত পোহালেই এসে হাজির হবে। সমস্ত তৈরি করে রেখেছিলেন। সিলমোহর করা একটা চিঠি, সামান্য ভারী মতন একটা প্যাকেট, রেজিস্ট্রি করা পার্শেলের মতন চেহারা সেটার চারপাশে গালা দিয়ে করা, মোহরের ছাপ।
সেইসব জিনিস নিয়ে তারাপদ এল চন্দনের মেডিক্যাল হোস্টেলে। চন্দনকে বলল, “চাঁদু তোকে সঙ্গে যেতে হবে ।”
চন্দন প্রথমটায় রাজি হচ্ছিল না; তার হাসপাতাল। আবার পুরো ব্যাপারটাই এমন গোলমেলে যে একলা তারাপদকে ছেড়ে দিতে তার ভাল লাগছিল না। তারাপদ কোনো কালেই সাহসী নয়, বরং ভিতু ধরনের; তার শরীর স্বাস্থ্য ততটা মজবুত নয়; নিরীহ ভালোমানুষ গোছের ছেলে ও, ভিড়ের ভয়ে কোনোদিন মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের লিগ বা শিন্ডের খেলা পর্যন্ত দেখতে গেল না। চন্দন কতবার বলেছে, চল্ না-আমি তো রয়েছি। তারাপদ মাথা নেড়েছে আর বলেছে, থাক ভাই, আমার মাঠে গিয়ে দরকার নেই, রিলে শুনলেই আমার খেলা দেখা হয়ে যাবে।
সেই তারাপদকে একলা একলা কী করে ছেড়ে দেয় চন্দন! তারাপদর মা যখন মারা যায় চন্দন শ্মশানে গিয়েছিল, তার মনে আছে সেদিন বারবার তারাপদ শুধু চন্দনকেই আঁকড়ে ধরেছিল আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল ।
অনেক রকম গবেষণার পর ঠিক হল, চন্দন হাসপাতাল থেকে কয়েক দিনের ছুটি নেবে, বললবাবার অসুখ। কথাটা মিথ্যে হলেও করার কিছু নেই, ছুটির যখন দরকার তখন বড় কিছু একটা না বললে ছুটি দেবে কেন?
চন্দন রাজি হয়ে যাবার পর তারাপদ বটুকবাবুর মেসে ফিরল। স্নান খাওয়া সেরে বেরুলো কিছু টাকা পয়সা জোগাড়ের ধান্ধায়। বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে যা পায় জুটিয়ে অন্তত একশো সোয়া শো টাকা তো হাতে রাখতেই হবে।
দুপুরের পর তারাপদ মেসে ফিরল। বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তারপর গোছগাছ শুরু করল।
সন্ধের গোড়ায় গেল চন্দনের হোস্টেলে। চন্দন প্রায় তৈরি। তারপর দুই বন্ধু মিলে জয় মা বলে বেরিয়ে পড়েছে। দেখা যাক কপালে কী আছে!
চন্দন টিকিট কেটে ফিরে এসে বলল, “নে, চল…। ননম্বরে গাড়ি দেবে।
জিনিসপত্র তেমন কিছু নেই তাদের, দুজনের দুটো কিট ব্যাগ, চন্দন একটা কম্বল নিয়েছে হাতে ঝুলিয়ে, রাত্রে শীতের হাত থেকে বাঁচতে হবে। তারাপদর কম্বল নেই, সে একটা তুষের পুরনো চাদর আর বঙ্কিমদার হনুমান টুপিটা নিয়ে নিয়েছে সঙ্গে করে। মেসে কেউ জানে না–তারাপদ কোথায় যাচ্ছে।
তারাপদ শুধু বলেছে, একটু বাইরে যাচ্ছি এক বন্ধুর সঙ্গে, দরকার আছে।
প্লাটফর্মে ঢুকে তারাপদরা দেখল, ভিড় ভীষণ একটা কিছু নয়, মোটামুটি। প্যাসেঞ্জার ট্রেন; তায় আবার শীতকাল, হয়ত তাই ভিড়টা কমই।
একটু পরেই প্লাটফর্মে গাড়ি দিয়ে দিল। চন্দন বাহাদুর ছেলে। গাড়ি প্লাটফর্মে ঢুকতে না ঢুকতেই কী-এক বিচিত্র কায়দায় সে চলন্ত ট্রেনের হ্যাঁন্ডেল ধরে ঝুলে পড়ল ।
গাড়ি দাঁড়াবার পর তারাপদ খুঁজে খুঁজে চন্দনকে বের করে নিল। চমৎকার জায়গা জুটিয়ে কম্বল বিছিয়ে ফেলেছে।
গাড়িতে উঠে তারাপদ বলল, “তোর দৌড়বার কী ছিল? ভিড় তেমন নেই।”
চন্দন বলল, “দেখতেই পাবি। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে আসুক। নে বসে পড়। এদিকে আয়-জায়গা নিয়ে বস্–চাদরটা বিছিয়ে দে; শোবার জায়গা ছাড়বি না।”
কি ব্যাগ মাথার কাছে রেখে একেবারে কোণের দিকে মুখোমুখি দুই বন্ধু কম্বল আর চাদর পেতে ফেলল। কামরায় লোক উঠছে, কুলি উঠছে, আবার নেমেও যাচ্ছে, মালপত্র রাখার হইচই।
চন্দন নিজের জায়গায় বসে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। “তোর এই মালগাড়ি কাল নটা দশটার সময় শংকরপুর পৌঁছবে।”
গাড়িটা অবশ্য প্যাসেঞ্জার ট্রেন, মালগাড়িরই যমজ-ভাই। ঢিকির ঢিকির করে যাবে, হাজারবার দাঁড়াবে। অন্য কোনো গাড়িতে যাওয়া চলত, কিন্তু সারাদিন এত ছুটোছুটি করতে হয়েছে তারাপদকে যে সে-সুযোগ তার হয়নি। একটা এক্সপ্রেস গাড়ি ছিল, সেটা শংকরপুরে দাঁড়াত না।
ততক্ষণে দু বন্ধু মিলে সিগারেট ধরিয়ে নিয়েছে। কামরায় তোক বাড়ছে, দেখতে দেখতে বেশ ভিড় হয়ে গেল। প্লাটফর্মে আরও যাত্রী এসে পৌঁছচ্ছে। তারাপদদের কামরায় এক দঙ্গল বেহারি উঠেছে, দু পাঁচজন বাঙালিও।
এমন সময় এক অদ্ভুত ধরনের ভদ্রলোক এসে কামরায় উঠলেন। টিয়াপখির মতন নাক, তোবড়ানো গাল, গর্তে বসা চোখ। চেহারাটি রোগাসোগা, গায়ে সেই আদ্যিকালের অলেস্টার, মাথায় কাশ্মীরি টুপি ডান হাতে একটা সুটকেস ঝুলছে, বাঁ হাতে খয়েরি বালাপোশ । ভদ্রলোক এতই রোগা যে গায়ে অলেস্টার চাপিয়েও তাঁকে মোটা দেখাচ্ছে না। গলায় মোটা মাফলার জড়ানো।
চন্দন ভদ্রলোককে দেখে নিচু গলায় বলল, “ডিসপেপসিয়ার কেস রে তারা, টিপিক্যাল ডিসপেপটিক পেশেন্ট।”
ভদ্রলোক তারাপদদের দিকেই এগিয়ে এলেন। কাছে এসে এমন মুখ করে হাসলেন যেন কতই না চেনা তারাপদর, গঙ্গাচরণ মিত্তির লেনে রোজই দেখা হয়।
“কত দূর?” ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন হাসিমুখে। হাসবার সময় তাঁর। দাঁত দেখা গেল। এবড়োখেবড়ো কালচে দাঁত, পান-খাওয়া দাঁত যেন।
তারাপদ ভদ্রলোককে কোনোদিন দেখেনি। জবাবও দিল না কথার।
ভদ্রলোক কিন্তু নির্বিকার, সুটকেসটা বেঞ্চির তলায় রেখে বালাপোশটা বিছিয়ে নিলেন, তারাপদর চাদর সামান্য গুটিয়ে গেল। তাঁর চেনাচেনা হসি আর কথা : “এই ট্রেনটায় যত ছিঁচকে চোরের উপদ্রব, বুঝলেন মশাই, চোখে পাতা দু দণ্ড বুজেছেন কি পুঁটলি-পাটলা সুটকেস ব্যাগ হাওয়া। ওই দরজার দিকটায় তাই গেলাম না।…ওদিকটায় একটু পরেই দেখবেন কী হয়-ছিলিম চলবে। সে কী দৃর্গন্ধ।! গোয়ালাগুলো ব্যোম ভেলার জাত। গাঁজাই ওদের সর্বনাশ করল। দেখি স্যার, আপনার পা-টা একটু সরান–সুটকেসটাকে প্লেস করে দি আরও একটু সেফ সাইডে।“
চন্দন হেসে ফেলেছিল। সামলে নিল। ভদ্রলোক এবার গোছগাছ সেরে তারাপদর পাশে বসলেন।
গাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে আসছিল। প্লাটফরমের কলরব কমে আসছে যেন। তারাপদদের কামরা থেকে কিছু বেহারি লোকজন নেমে গেল।
ভদ্রলোক ততক্ষণে পান-জরদা মুখে পুরেছেন। “আপনারা কদুর যাবেন স্যার?” ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞেস করলেন। তারাপদ কিছু বলার আগেই চন্দন বলল, “মধুপুর-টধুপুরের দিকে।”
“মধুপুর? কোথায়? কোন দিকটায়?”
“আপনি মধুপুরে থাকেন?”
“না স্যার, আমি অরিজিন্যালি ভাগলপুরের, তারপর থেকেছি জামসেদপুরে, শেষে ইছাপুরেও কিছুদিন ছিলাম, এখন আর কোনো পুরে থাকি না, টুরে টুরে দিন কেটে যায়।”
তারাপদ হেসে ফেলল। চন্দনও।
“আমার স্যার কতকগুলো বদ দোষ আছে,” পান চিবোতে চিবোতে ভদ্রলোক বললেন, “আমি হাসিঠাট্টা করতে ভালবাসি। আমার আপন-পর নেই। ভেরি ফ্র্যাংক…। একটা কথা স্যার আগেই বলে নি, আমার মুখ থেকে হরদম ইংলিশ বেরোয়, নো গ্রামার, কিছু মনে করবেন না। আমার বাবাকে একজন অ্যাংলো ঘুষি মেরে নাক ভেঙে দিয়েছিল, তখন থেকেই আমার ওই ভাষাটার ওপর রাগ। অ্যাংলোরা হাফ ইংলিশ বলে, তাতেই আমার বাবার নাক চলে গেল, ফুল ইংলিশ যারা বলে তাদের ঘুষি খেলে তো আমার বাবার ফেসই পালটে যেত। বলুন ঠিক কি না! আমি তখন থেকে রিভেজ নিতে শুরু করেছি ভাষাটার ওপর, যা মুখে আসে বলব–তুই আমার কাঁচকলা করবি। তোর ভাষা কি আমার মার না বাবার ভাষা!”
তারাপদরা এবার জোরে হেসে উঠল।
গাড়ি ছাড়ল। গাড়ি ছাড়ার সময় যেমন হয়, দু-একজন নেমে পড়ল, ছুটতে ছুটতে কে এজন পা-দানিতে উঠে পড়ল, প্লাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে কেউ কেউ হাত নাড়ছে, একদল দেহাতী গোছের মানুষ ‘গঙ্গা মাই কি জয়’ বলে চেঁচিয়ে উঠল।
ধীরে ধীরে গাড়িটা প্লাটফর্মের বাইরে আসতেই শীতের হাওয়া এসে ঢুকল জানলা দিয়ে।
চন্দন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল, এবার ভেতরে মুখ ফেরাল।
চন্দন বলল, “আপনার নামটা কী স্যার?”
“কিঙ্করকিশোর রায়, দেড়গজী নাম স্যার, ছোট করে লোকে বলে কিকিরা দি গ্রেট।“
জোরে হেসে উঠে চন্দন বলল, “আলেকজান্ডার দি গ্রেট-এর পর আর কোনো গ্রেট দেখিনি স্যার, আপনাকে দেখলাম।”
কিকিরা খকখক শব্দ করে হেসে উঠলেন। অদ্ভুত সে শব্দ। তারাপদও হেসে উঠল। ঠাট্টা করে চন্দনকে বলল, “তুই তা হলে আলেকজান্ডার দি গ্রেটকে দেখেছিস।”
“ছবি দেখেছি”, চন্দন রসিকতা করে বলল।
কিকিরা হাসতে হাসতে বললেন, “এবার জ্যাস্ত দেখুন, লিভিং গ্রেট।”
তারাপদ জিজ্ঞেস করলে, “আপনি কী করেন?”
কিকিরা অলেস্টারের গলার দিকে বোতাম খুলতে খুলতে বললেন, “আমার করার কিছু ঠিক নেই, স্যার। কখনো ছুরি-কাঁচির এজেন্ট, কখনো খোস পাঁচড়ার মলমের, কখনো অম্লশূলের ওষুধ বেচে আসি, কখনো আবার অন্য কিছু–যা হাতের কাছে জুটে যায়। আমার নেচারটা অস্থির গোছের। মেজাজে না বলে আমি কাউকে ছেড়ে কথা বলি না। লাস্ট মাস্থে আমি একটা নতুন কোম্পানির স্নো ক্রিম পাউডারের রিপ্রেজেনন্টেটিভ ছিলাম । মালিক বেটা ছ্যাঁচড়া, আমার সঙ্গে বনলো না, ছেড়ে দিলাম। দিয়ে এখন একটা কোম্পানির কাঁচি, খুর, ক্লিপের এজেন্ট হয়ে গিয়েছি। হাওড়ায় কারখানা খুলেছেন ভদ্রলোক বেশ ভাল খুর তৈরি করছে স্যার । আমার সুটকেসে স্যাম্পল আছে। কাল সকালে দেখাব।”
চন্দন হাত নেড়ে বলল, “থাক্ স্যার, খুব আর দেখাবেন না, খুর দেখলেই আমার ভয় করে।”
“ভয়ের কিছু নেই, স্যার। ঠিক মতন টানতে পারলে মাখনের মতন গাল নরম থাকবে। বেকায়দায় টানলে অবশ্য গলা যাবে…” বলে কিকিরা তারাপদর দিকে তাকিয়ে খখক্ শব্দ করে হাসলেন। তারপর নিজেই বললেন, “সত্যি কথা বলতে কি স্যার, আমি আসলে ম্যাজিশিয়ান ছিলাম। গণপতিবাবু আমার গুরুর গুরু। আমার সাক্ষাৎ গুরু বড় একটা কলকাতায় আসতেন না। তাঁর ফিল্ড ছিল পাটনা, মজঃফরপুর, জামালপুর; ওদিকে বেনারস, লক্ষ্ণৌ, আগ্রা–এইসব। আমার গুরু অদ্ভুত অদ্ভুত খেলা জানতেন। ইন্ডিয়ান ট্রিক বলে তাঁর একটা খেলা ছিল–তাতে তিনি স্টেজের ওপর একটা মেয়ের হাত-পা, মুখ সব আস্তে আস্তে অদৃশ্য করে দিতেন। তারপর আবার একে একে সব জোড়া লাগিয়ে দিতেন।”
চন্দন কৌতূহল বোধ করছিল, “বলেন কী!”
“মিথ্যে বলব না স্যার, গুরুর নামে কেউ মিথ্যে বলে না।” বলে কিকিরা হাত জোড় করে গুরুর উদ্দেশে প্রণাম জানালেন। উঁচুদূরের লোক ছিলেন তিনি। একবার নাইট্রিক অ্যাসিড খাবার খেলা দেখাতে গিয়ে কী একটা গণ্ডগোল হয়ে গেল। তিনি মারা গেলেন। আমি পনেরো বছর বয়েস থেকে তাঁর চেলাগিরি করেছি। সাত আট বছর লেগে ছিলাম। আরও পাঁচ সাতটা বছর সঙ্গে থাকতে পারলে দেখতেন–কিকিরা কী না করত! জাপান, আমেরিকা, লন্ডন করে বেড়াতাম । কপাল স্যার, কপাল, ব্যাড লাক…।”
তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “আপনি নিজেও কি ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াতেন?”
“আমরা ম্যাজিকের বংশ স্যার। আমার ফাদারের অলটারনেট ফাদার বিরাট ম্যাজিশিয়ান ছিলেন।”
চন্দন অবাক হয়ে বলল, “ফাদারের অলটারনেট ফাদার কী জিনিস মশাই?”
কিকিরা মজার মুখ করে হেসে বললেন, “বাবার বাবাকে ছেড়ে তাঁর বাবা–-মানে প্রপিতামহ।”
তারাপদ আর চন্দন হেসে গড়িয়ে গেল।
কিকিরা বললেন, “ওটাই তো আমার অরিজিন্যাল ব্যবসা ছিল স্যার, বছর আট দশ কিকিরা ম্যাজিক মাস্টার হয়েছিল; তারপর আমার বাঁ হাতটায় কী যে হল–প্রথমে ব্যথা-ব্যথা করত, দেখতে দেখতে হাত শুকোতে লাগল, জোর একেবারে কমে গেল, সব সময় কাঁপত। হাত না থাকলে ম্যাজিশিয়ান হওয়া। যায় না। ম্যাজিশিয়ানের হাত, চোখ আর মুখ এই তিনটেই হল আসল। “
চন্দন কী যেন বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই কিকিরা তার বাঁ হাতটা দেখালেন। সত্যিই শুকনো মতন দেখতে। আঙুলগুলো বেঁকা বেঁকা, চামড়া কেমন পোড়া পোড়া রঙের। হাতটা কাঁপছিল। কোট থাকার জন্যে কব্জির ওপর দেখা গেল না ।
চন্দন বলল, “আপনি ডাক্তার-টাক্তার দেখাননি?”
“দেখিয়েছি, কত ডাক্তার দেখিয়েছি, ওষুধ খেয়েছি, ইনজেকশান নিয়েছি, কিছু হয়নি। ডাক্তাররা ধরতে পারছে না। কেউ বলছে, নার্ভের রোগ;কেউ বলছে কোনো বিষাক্ত জিনিস থেকে হয়েছে, কেউ আবার অন্য কিছু বলছে–।”
তারাপদ চন্দনকে দেখিয়ে কিকিরাকে বলল, “ও হল ডাক্তার।“
চন্দন যেন সামান্য লজ্জা পেল। বলল, “না না, এখনো পুরো ডাক্তার হইনি, সবে পাশ করেছি।”
তারাপদ রগড় করে বলল, “চন্দন এখনও দশ বিশটা কেন, একটাও মানুষ মারেনি। কাঁচা হাত। দু-চার বছর আরও যাক তারপর ডাক্তার হবে।”
তিনজনেই হেসে উঠল।
হাসি-ঠাট্টার কথা বলতে বলতে রাত বাড়তে লাগল। গাড়ি মাঝে মাঝে থামছে, আবার চলছে। শীতের জন্যে জানলা সব বন্ধ। কামরার লোকজন কথাবার্তা বলতে বলতে ক্রমশই নিস্তেজ হয়ে আসছে। দু-একজন ঘুমিয়েও পড়েছে। কিকিরা ততক্ষণে তারাপদদের নামধাম জেনে গিয়েছেন। শুধু জানতে পারেননি তারাপদরা ঠিক কোথায় যাচ্ছে। ওরা সেই যে বলেছিল মধুপুর-ধুপুর, তার বেশি আর কিছু বলেনি।
বর্ধমানের পর গোটা কামরাটাই যেন ঘুমিয়ে পড়ল।
তারাপদর ঘুম পাচ্ছিল। হাই উঠছিল তার।
হাই তুলতে তুলতে চন্দন হঠাৎ কিকিরাকে বলল, “আপনি তো একজন এক্স-ম্যাজিশিয়ান আচ্ছা এই যে লোকে মন্ত্রটন্ত্রর কথা বলে, আপনি ওসব বিশ্বাস করেন?
মাথা নাড়লেন কিকিরা, “না, ম্যাজিক হল খেলা, তার সঙ্গে মন্ত্রটন্ত্রর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে আমি হিপ্নোটিজম, মেসম্যারিজম্ এ-সব বিশ্বাস করি । নিজে করেছি একসময়। আমাদের দেশে অনেকে যোগ অভ্যাস করে অনেকে কিছু করতে পারেন। আমার গুরু মাটির তলায় চাপা দেওয়া অবস্থায় দু-তিন ঘণ্টা থাকতে পারতেন।”
তারাপদ আর বসে থাকতে পারছিল না, বড় ঘুম পাচ্ছে। শুয়ে পড়ার জন্যে তৈরি হতে হতে বলল, “আপনার দু-চারটে ম্যাজিক কাল সকালে উঠে দেখব।”
কিকিরা তারাপদকে দেখতে দেখতে হেসে বললেন, “কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন, না এখনই দেখবেন?”
“এখন?”
কিকিরা যেন মজা করছেন এমন চোখমুখ করে বললেন, “একটা স্যাম্পল দেখিয়ে দিই, কী বলেন?” বলে কয়েক পলকের জন্যে চোখ বুজলেন, তারপর বললেন, “আপনি আপনারা মধুপুর যাচ্ছেন না। কোথায় যাচ্ছেন জানি না–তবে মধুপুর নয়, এমন কোনো জায়গায় যাচ্ছেন যার নামের প্রথমে ‘এস্’ অক্ষর আছে। রাইট? যার কাছে যাচ্ছেন তার নামের প্রথমে ‘বি’ অক্ষর থাকবে। রাইট?”
তারাপদ যেন চমকে উঠল। চন্দনও। দুজনেই হতভম্ব; অপলকে কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল, নিশ্বাস নিতেই যেন ভুলে গেছে ।
শেষে তারাপদ বলল, “আপনি–আপনি কে?”
কিকিরা খক খক্ করে বিচিত্র হাসি হেসে বললেন, “আমি কিকিরা দি গ্রেট, কিকিরা দি ম্যাজিশিয়ান।”
তারাপদ মাথায় পাশে তার কিট ব্যাগের দিকে তাকাল। ওই ব্যাগের মধ্যে ভুজঙ্গভূষণকে দেবার জন্যে সিলমোহর করা চিঠি আর প্যাকেট আছে একটা। খুব দরকারি জিনিস। মৃণাল দত্ত বার বার সাবধান করে দিয়েছেন। ও দুটো যদি খোয়া যায় সর্বনাশ হবে। তারাপদ যেজন্য শংকরপুর যাচ্ছে তা ব্যর্থ হবে। এই কিকিরা লোকটা কি সেটা জানে? সে কি সমস্ত জেনেশুনে তারাপদদের পিছু ধরেছে? লোকটার উদ্দেশ্য কী? কোন মতলব নিয়ে সে তাদের সঙ্গী হয়েছে?
তারাপদ ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। চন্দনও বিচলিত, বিমূঢ়।
.
চার
অনেকক্ষণ আর কেউ কোনো কথা বলল না। তারাপদ ভাল করে আর কিকিরার দিকে তাকাচ্ছিল না, তার সাহস নেই তাকাবার। ভীষণ সন্দেহ হচ্ছে। লোকটাকে। মুখে যতই হাসি থাক, মজার মজার কথা বলুক–তবু কিকিরা যে বড় রকমের ঘুঘু তাতে সন্দেহ কী।
আড়চোখে তাকিয়ে তারাপদ চন্দনকে ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝাবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল। তার মুখের ভাব, চোখের সাবধানী দৃষ্টি বলছিল : চাঁদু, বি কেয়ারফুল; লোকটা ঘুঘু ।
চন্দন নিজেও সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছিল। কিকিরা যত বড় ম্যাজিশিয়ানই হোক, ওরা কোথায় যাচ্ছে, কার কাছে যাচ্ছে–এটা মুখ দেখে ঠাহর করতে কিছুতেই পারে না। অসম্ভব। থট রিডিং না কী যেন বলে একটা–কিকিরা কি সেই মনের কথা জানতে পারার খেলা দেখাল? বোগা। চন্দন ওসব বিশ্বাস করে না। তবে এটা বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছে, কিকিরা প্রচণ্ড ধূর্ত। সে কেমন কায়দা করে পুরো শংকরপুর, কিংবা সোজাসুজি ভুজঙ্গভূষণ না বলে রহস্যময় ভাবে বলল, প্রথমটা অক্ষর ‘এস’ আর ‘বি’। ও যে সবই জানে তাতে চন্দনের সন্দেহ হচ্ছিল না। অন্তত, কিকিরা নিশ্চয় জানে চন্দনরা শংকরপুরে যাচ্ছে, ভুজঙ্গভূষণের কাছে।
চন্দন চোখে চোখে তারাপদকে বোঝাবার চেষ্টা করল : সবই বুঝতে পারছি। সাবধান হতে হবে।
কিকিরা কিন্তু একই রকম হাসিমুখে তারাপদদের দেখছিলেন। বরং তাঁর চোখ দেখে মনে হচ্ছিল, কিকিরা এরকম একটা খেলা দেখাবার পর যেন তারাপদদের হাততালি আশা করেছিলেন, না পেয়ে একটু দুঃখবোধ করছেন।
চন্দন মনে মনে ভেবে দেখল, আর বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকা উচিত নয়। ওরা ভয় পেয়েছে কিকিরা সেটা বুঝে ফেলবে। বার দুই শুকনো কাশি কেশে তারাপদকে বলল, “অনেক রাত হয়ে গেল: তুই শুয়ে পড়। আমি জেগে আছি। ট্রেনে আমার ঘুম হয় না। “
তারাপদ ঘুমোবে কি, ঘুম তার মাথায় উঠে গেছে।
কিকিরাই যেন কী মনে করে বললেন, “বাস্তবিক স্যার, রাত হয়ে গেছে অনেক, বারোটায় বর্ধমান পেরিয়ে পেরিয়ে এসেছি। তা ধরুন এখন সাড়ে বাররা। শীতটাও জব্বর। এবার শোবার ব্যবস্থা করতে হয়। তবে একজনের জেগে থাকা উচিত, নয়ত এ-গাড়িতে যা চোরের উৎপাত, গা থেকে জামাকাপড়ও খুলে নিয়ে যায়।”
চন্দন একটু ঠাট্টার ছলেই বলল, “আপনার নিশ্চয় অম্বলের রোগ আছে, বয়েসও হয়েছে, আপনি শুয়ে পড়ন–আমি জেগে আছি।”
কিকিরা বললেন, “ঠিক ধরেছেন স্যার, আমার জুস বেশি হয়, রাত জাগলে বোতলের সোডার মতন হয়ে যায় পেট বুক। সে কী কষ্ট! যাকগে, আমি একবার বাথরুম ঘুরে এসে শুয়ে পড়ি, কী বলেন?”
বালাপোশটা হাত দিয়ে আবার একটু ঝেড়েঝুড়ে কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন, বাথরুমে যাবেন।
তারাপদ যেন এই সুযোগের অপেক্ষা করছিল।
কিকিরা ওপাশে বাথরুমের দিকে যেতেই নিচু গলায় তারাপদ বলল, “চাঁদু, লোকটা ঘোড়েল। ওর কোনো মতলব আছে।”
চন্দন বলল, “আমিও তাই ভাবছি। ম্যাজিক-ফ্যাজিক বাজে কথা।”
“কিকিরা কি আমাদের ফলো করছে?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।”
“তাই তো মনে হয়। কিন্তু কেন?”
তারাপদ দূরে বাথরুমের দিকে তাকাল। কিকিরা দরজা খুলে ঢুকে গেলেন।
তারাপদ বলল, “আমার ভুজঙ্গভূষণের নামে একটা সিল করা প্যাকেট, চিঠিঠি আছে, মৃণাল দত্ত দিয়েছেন। ওগুলো যতক্ষণ না ভুজঙ্গভূষণের হাতে দিতে পারছি ততক্ষণ আমার কোনো ক্লেম হচ্ছে না সম্পত্তির ওপর। “
“তা জানি,” চন্দন মাথা নাড়ল।” কিকিরা কি ওটা হাতাবার জন্যে এসেছে? তাতে ওর লাভ কী হবে? কিকিরা তো তারাপদ নয় যে, ওগুলো হাতিয়ে ভুজঙ্গভূষণের কাছে হাজির হলেই দেড় দুই লাখ টাকার সম্পত্তি পেয়ে যাবে। তা ছাড়া ওর মধ্যে কী আছে তাও তো আমরা জানি না।”
তারাপদ চিন্তায় পড়ে কেমন বিমর্ষ হয়ে আসছিল। বলল, “আমিও তো তাই ভাবছি।..আচ্ছা, তোর কি মনে হয়, কিকিরা মৃণাল দত্তর লোকর?”
“মানে?”
“মৃণাল দত্ত ওকে পাঠাননি তো? উনি ছাড়া আর তো কেউ জানে না আমরা শংকরপুরে ভুজঙ্গভূষণের কাছে যাচ্ছি।”
চন্দন বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকল। ভাবল। বলল, “তা ঠিক। তুই যখন সকালে মৃণাল দত্তর বাড়ি গিয়েছিলি তখন কাউকে দেখেছিস?”
“না”, মাথা নাড়ল তারাপদ।
“ঘরে কেউ ছিল না?”
“কালকের সেই বুড়োমতন লোকটি দু একবার এসেছিল।”
“তার চোখের সামনেই মৃণাল দত্ত তোকে এই এই সব দিয়েছেন?”
“হ্যাঁ।”
“গাড়ির কথা কিছু বলেছেন?”
“বলেছেন, রাত্রে দুটো গাড়ি আছে, একত্সপ্রেস শংকরপুরে থামে না।”
চন্দন কিছুই বুঝতে পারল না। মৃণাল দত্ত নিজেই তাঁর মক্কেলের জন্যে তারাপদর খোঁজ করছিলেন, তিনি যেচে তারাপদকে ভুজঙ্গভূষণের কাছে। পাঠাচ্ছেন, এটা তাঁর কর্তব্য। তবে কেন তিনি পেছনে লোক লাগাবেন? তা হলে কি ওই বুড়ো লোকটা, মৃণাল দত্তর বাড়ির কাজের লোকটা, আসলে অন্য কারও হাতের পুতুল। তাই যদি হয়, তবে ধরে নিতে হবে, ভুজঙ্গভূষণের সম্পত্তি যাতে তারাপদর হাতে না যায় সেজন্যে ফন্দি আঁটার লোক আছে। তারাই কিকিরাকে লাগিয়েছে। কিন্তু এ-সব ভাবনা কি বাড়াবাড়ি নয়। কার গরজ তারাপদকে বঞ্চিত করার। তেমন কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না ।
চন্দন বলল, “আমি ভাই কিছু বুঝতে পারছি না। এভরিথিং ইজ মিস্টিরিয়াস। ভুজঙ্গভূষণ, মৃণাল দত্ত, কালো বেড়াল, কিকিরা–সবই কেমন গোলমেলে।”
তারাপদ ম্লান মুখ করে বলল, “আমারও মাথায় কিছু ঢুকছে না। লাভের মধ্যে ভাবতে ভাবতে মাথা ধরে গেল। টাকা-পয়সা, সম্পত্তি ব্যাপারটাই ঝাটের। বেশ ছিলুম, এখন কী প্যাঁচেই পড়লাম।”
কিকিরাকে আবার দেখা গেল।
চন্দন নিচু গলায় বলল, “যাই হোক–তুই ঘাবড়াবি না, তারা। ওই লোকটার কাছে একেবারেই নার্ভাসনেস দেখাবি না। ওর সামনে তুইও শুয়ে পড়।”
“আমার ঘুম হবে না।”
“না হোক, তবু তুই শুয়ে পড়বি। ঘুমোবার ভান করবি। আমি জেগে থাকব। হাসপাতালের ডিউটিতে আমার রাত জাগা অভ্যেস আছে।”
“তুই একলা কতক্ষণ জাগবি?”.
“সারা রাত। কিকিরাকে আমি নজর রাখব।”
তারাপদর হঠাৎ মনে পড়ল, কিকিরা বলেছে, তার সুটকেসে নাকি খুরটুর আছে। স্যাম্পল দেখাবে বলেছিল। লোকটা কত বড় শয়তান। সুটকেসে করে খুর এনেছে। গলা কাটবে নাকি? খুন?
তারাপদ ভয়ে ভয়ে বেঞ্চির তলার দিকে তাকাল, কিকিরার সুটকেস দেখবার চেষ্টা করল। তারপর অস্ফুটভাবে চন্দনকে বলল, “কিকিরার কাছে খুর আছে–।”
কিকিরা ততক্ষণে একেবারে কাছে এসে পড়েছেন।
চন্দন আবার একটা সিগারেট ধরাল। যেন কিছুই হয়নি।
তারাপদ তখনও বসে।
কিকিরা বললেন, “জমজম করে শীত পড়ছে। পানাগড় দুর্গাপুর কাছেই বোধ হয়। আরও জব্বর ঠাণ্ডা পড়বে স্যার, একেবারে আর্লি মর্নিংয়ে আসানসোল, তারপর শীতের বহরটা দেখবেন, লাইক্ ক্যাটস অ্যান্ড ডগস্।”
চন্দন ব্যঙ্গ করে বলল, “ওটা বৃষ্টির বেলায় স্যার, শীতের বেলায় নয়।”
কিকিরা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ খখকে হাসি হেসে বললেন, “একই হল স্যার, বৃষ্টির বেলায় যদি বেড়াল কুকুর পড়তে পারে শীতের বেলায় কেন পড়বে না। ইংরিজি ভাষার কোনো নিয়ম নেই, যা পড়াবেন তাই পড়বে।”
কথা বলতে বলতে কিকিরা তাঁর সেই বেখাপ্পা অলেস্টার খুলে পাট করে বালিশের মতন করে নিলেন। টুপি আগেই খুলেছিলেন, মাফলারটা পাগড়ির মতন করে কানে বাঁধলেন, জুতো খুললেন।
চন্দন ইশারায় তারাপদকেও শুয়ে পড়তে বলল।
কিকিরা পাট করা অলেস্টারের ওপর মাথা রেখে বালাপোশ গায়ে টেনে শুয়ে পড়তে পড়তে বললেন, “স্যার, একটু সাবধানে থাকবেন। চোখের পাতাটি বুজেছেন কি সর্বনাশ হয়ে যাবে।…আচ্ছা, শুয়ে পড়ি। আসানসোলে আমায় ডেকে দেবেন। চা খাব।”
কিকিরা লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে চোখ বুজলেন। তারাপদও যেন বাধ্য হয়ে শুয়ে পড়ল।
কামরার মধ্যেটা একেবারেই চুপচাপ। কেউ কেউ বেঞ্চের ওপর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে, কেউ কেউ বাংকের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে, পুঁটলি পাকানো চেহারা করে বসে বসেই ঘুমোচ্ছে দু-চার জন। মাঝে মাঝে কাশির শব্দ, এক-আধটা ঘুম-জড়ানো কথা, ট্রেনের একঘেয়ে শব্দ–সব মিলিয়ে কেমন একটা নিঝুম আবহাওয়া।
একটা ছোট স্টেশনে গাড়ি থেমে আবার চলতে শুরু করল চন্দন বড় বড় হাই তুলছিল।
কিকিরা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তারাপদ অনেকক্ষণ মটকা মেরে পড়েছিল। সারাদিনের ক্লান্তি যেন কখন তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল।
চন্দন নানারকম কথা ভাবছিল। কিকিরা লোকটা কি সত্যিই চালাক? তার ভাঁড়ামির খানিকটা হয়ত অভিনয়, কিন্তু চালাকির ব্যাপারটা অভিনয় করে দেখানো যায় না। কিকিরা যদি চালাকই হবে তাহলে সে কেন অযথা প্রথমেই চন্দনদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করতে গেল? যে-লোক জানে চন্দনরা শংকরপুরে ভুজঙ্গভূষণের কাছে যাচ্ছে সেই লোক কেন আগেভাগে তা প্রকাশ করে দেবে? বরং সে চুপচাপ থাকবে, ঘুণাক্ষরেও জানতে দেবে না তারাপদদের ব্যাপারটা সে ছিটেফোঁটাও জানে। তারপর সবাই যখন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়বে, কিকিরা তারাপদর কিট ব্যাগ নিয়ে নেমে পড়বে যে কোনো স্টেশনে। এই গাড়িটা এমনই যে, যখন তখন নেমে পড়া যায়, অনরবত থামছে, চলছে, আবার থামছে।
কিকিরা বোকামি করেছে। হয় বোকামি করেছে, না হয় জেনেশুনে ইচ্ছে করেই সতর্ক করে দিয়েছে। জানিয়ে দিয়েছে, তারাপদদের ব্যাপার সে জানে । কিন্তু কেন কিকিরা সতর্ক করে দেবে? চোর কি বাড়ির লোককে সাবধান করে দিয়ে চুরি করে? তবে?
চন্দন যতই ভাবছিল ততই তার মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে যাচ্ছিল । শুরু থেকেই যার মধ্যে এত রহস্য আর ঝামেলা–শেষে গিয়ে তার মধ্যে যে আরও কত গভীর রহস্য দেখা যাবে কে জানে।
.
গায়ে হাত পড়তেই চন্দন ধড়মড় করে উঠে বসল ।
মুখের সামনে কিকিরা। চন্দন তারাপদকে দেখে নিল। ঘুমোচ্ছে। তারাপদ।
“আপনি স্যার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন”, কিকিরা বললেন, এমনভাবে বললেন। যেন কতই না সহানুভূতি দেখাচ্ছেন।”
চন্দন বলল, “হ্যাঁ, কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।” ঘুমিয়ে পড়ার জন্যে তার লজ্জা এবং রাগ হচ্ছিল।
“অনেকক্ষণ থেকেই ঘুমোচ্ছেন,” কিকিরা হাসি হাসি মুখ করলেন। চন্দন তাড়াতাড়ি হাতের ঘড়ি দেখল। সর্বনাশ, সাড়ে তিনটে বাজে। সে যখন শেষবার ঘড়ি দেখে তখন দুটো বাজছিল। টানা দেড় ঘণ্টা সে ঘুমিয়ে থাকল। আশ্চর্য। হাসপাতালে কখনও এ-রকম হয় না। রাত্রের গাড়িটাড়ির এই দোষ, যাত্রীদের ঘুম, ঢুলুনি, গাড়ির দোলানি, একঘেয়ে শব্দ, ট্রেন থামা আর যাওয়া, হলুদ হলুদ আলো, সব মিলেমিশে কেমন ঘুম এনে দেয়। ছোঁয়াচে রোগের মতন ব্যাপারটা।
চন্দন কিকিরাকে সন্দেহের চোখে দেখল। “আপনি কি জেগেছিলেন?”
“আমার ঘুম স্যার খুব পাতলা, একটু খুসখস শব্দ হলেই জেগে উঠি। রাতের গাড়িতে চলাফেরা করতে করতে এই অভ্যেস হয়ে গেছে ।”
চন্দন হাই তুলল। চোখ যেন এখনও জুড়ে রয়েছে।
“আপনি অনেকক্ষণ থেকে জেগে বসে আছেন?” চন্দন জিজ্ঞেস করল।
“অনেকক্ষণ। বসে নয়, শুয়ে ছিলাম।”
হঠাৎ চন্দনের কেমন যেন মনে হল, মনে হতেই চমকে উঠল। আরে–কিকিরা এর মধ্যে কোনো হাত সাফাই করেনি তো? তারাপদর কিটু ব্যাগে মৃণাল দত্তর দেওয়া সেই কাগজপত্তর ঠিকঠাক আছে? না কিকিরা চুরি করে নিয়েছে?
কথাটা মনে হতেই চন্দনের বুক ধকধক করে উঠল, ভয় যেন লাফ মেরে। গলার কাছে এসে বসল। তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে সে তারাপদকে ঠেলা দিল।“তারা, এই তারা–”
বলিহারি ঘুম তারাপদর। মরার মতন ঘুমোচ্ছে ।
“ওঁকে আবার কেন অযথা জাগাচ্ছেন, স্যার?” কিকিরা বলল।
“দরকার আছে,” চন্দন রুক্ষভাবে জবাব দিল।
বার কয়েক ঠেলা খেয়ে তারাপদ উঠে বসল। উঠে বসে চোখ রগড়াতে লাগল। যেন তার খেয়ালই নেই সে বাড়িতে বিছানায়, না রেলগাড়িতে। কয়েক মুহূর্ত পরে তারাপদ হুঁশ ফিরে পেল।
চন্দন রেগে গিয়ে বলল, “আশ্চর্য ঘুম তোর!”
তারাপদ লজ্জিত হয়ে বলল, “কাল সারাদিন যা ধকল গেছে–পারছিলাম না।”
“এদিকে যে—” বলতে গিয়ে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল চন্দন, আড়চোখে কিকিরাকে দেখে নিল। তারপর ইঙ্গিতে বলল, ‘আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বলে কিকিরাকে দেখাল, “উনি জেগে ছিলেন।”
তারাপদ হয় ইঙ্গিতটা বুঝল না, না হয় তার মাথা মোটা। সে তখনো হাই তুলছে।
বিরক্ত হয়ে চন্দন আবার বলল, “এই ট্রেনে ছিঁচকে চোরের যা উপদ্রব । দেখে নে আমাদের জিনিসপত্র ঠিক আছে কিনা?”
তারাপদ এবার বুঝতে পারল। তার মুখের অদ্ভুত এক চেহারা হল ।
কিকিরা বললেন, “না না, এদিকে কেউ আসেনি। আমার ঘুম ভেরি ভেরি ভেরি থিন, গায়ের পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেই ঘুম ভেঙে যায়।”
চন্দন তারাপদকে হুকুমের ভঙ্গিতে বলল, “তা হলেও একবার দেখে নে।“
তারাপদ কিব্যাগ-টিটব্যাগ দেখল।
“তোর ব্যাগের মধ্যে আমার একটা সিগারেটের প্যাকেট রেখেছিলাম–দেখ তো আছে কি না?” একবারে ডাহা মিথ্যে কথা চন্দনের! সে চাইছিল, ব্যাগ খুলে তারাপদ একবার আসল জিনিসটা আছে কিনা দেখে নিক।
তারাপদ কোলের ওপর ব্যাগ তুলে চেন খুলল। দেখল। হাত ডুবিয়ে ডুবিয়ে ঘাঁটল। তারপর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মৃণাল দত্তর দেওয়া জিনিসগুলো ঠিকই রয়েছে।
তারাপদ কায়দা করে বলল, “আছে।…তুই এখন আমার সিগারেট নে। নতুন প্যাকেট পড়ে ভাঙবি।”
চন্দন নিশ্চিন্ত হল। বাব্বা, যা ভয় ধরে গিয়েছিল তার।
কিকিরা সমস্ত ব্যাপারটাই স্বাভাবিকভাবে দেখছিলেন। এবার বললেন, “আমায় একটা সিগারেট খাওয়ান, স্যার; যা শীত…।”
চন্দন তারাপদর প্যাকেট থেকে কিকিরাকে সিগারেট দিল। নিজেও ধরাল।
বালাপোশ গায়ে জড়িয়ে বসে সিগারেট খেতে খেতে কিকিরা খখক্ করে কাশছিলেন। বললেন, “সিগারেটের নেশা আমার নেই, একটা দুটো খাই কখনো।”
গাড়িটা যেন কোনো ইয়ার্ডে ঢুকল । লাইন বদলের শব্দ হচ্ছে। এক একবার বাঁয়ে টাল খাচ্ছে, আবার যেন ডাইনে টাল খেল।
কিকিরা বললেন, “অন্ডাল এসে গেল । আর খানিকটা পরে আসানসোল। সোয়া চারটে নাগাদ আসানসোল পৌঁছোয়।”
“আপনি এদিকে খুব যাতায়াত করেন?” চন্দন জিজ্ঞেস করল ।
“প্রায়ই।”
“সবই আপনার চেনা।”
“তা বলতে পারেন।”
তারাপদ হঠাৎ বলল, “যশিডিতে থাকবেন এখন?”
“যশিডিতে নয়, দেওঘরে যাচ্ছি…। ওখানে আমার ফিল্ড আছে।”
“কী?”
“ফিল্ড স্যার, মানে চেনাজানা আছে, কাস্টমার রয়েছে।”
চন্দন মনে মনে একটা প্যাঁচ ভাবছিল। দাবা খেলার চালের মতন একটা মোক্ষম চাল দিলে কেমন হয়? কিকিরা কি সামলাতে পারবে? হয়ত কিকিরা আরও পাকা খেলোয়াড়, চন্দনকে বসিয়ে দেবে। তবু একটা ঝুঁকি নিতে আপত্তি কী? এখনও যাত্রা শেষ হয়নি চন্দনদের, আরও পাঁচ ছ ঘণ্টার বেশি ট্রেনে থাকতে হবে। কিকিরার যদি কোনো মতলব থাকে, এর মধ্যে হাসিল করবে কি না কেউ বলতে পারে না। তবে এখন পর্যন্ত করেনি। সুযোগ পেয়েও ছেড়ে দিয়েছে। যদি তারাপদর ব্যাগ নিয়ে কিকিরা কোথাও নেমে যেত মাঝপথে, চন্দনরা জানতেও পারত না। লোকটাকে পুরোপুরি অবিশ্বাস করার চেয়ে একটু বিশ্বাস করা যাক না, ক্ষতি কী!
চন্দন আরও খানিকক্ষণ ভেবে শেষে বলল, “স্যার, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
“নিশ্চয় নিশ্চয়, একশোটা কথা জিজ্ঞেস করুন।”
“আপনি যে বললেন, আমরা মধুপুরে যাচ্ছি না–এটা কী করে বললেন?”
কিকিরা অদ্ভুত মুখ করে হাসলেন, “ম্যাজিক।”
“ম্যাজিক দেখতে আমাদের ভাল লাগে, কিন্তু তা বিশ্বাস করি না।”
“ভাল ম্যাজিক আপনারা দেখেননি স্যার, তাই বলছেন–” কিকিরা বললেন। একটু চুপ করে থেকে আবর বললেন, “আপনারা ছেলেমানুষ, অনেক কিছুই জানেন না, দেখেননি। যখন দেখবেন, জানবেন,–তখন বিশ্বাস করবেন।”
“তা বলে এই থট রিডিং না কী যেন বলে, তাও বিশ্বাস করতে হবে? আপনি নিজেই তখন বলছিলেন, ম্যাজিক হল খেলা, মন্ত্রট বাজে–।”
“বলেছি,” কিকিরা ঘাড় হেলালেন, “এখনও বলছি, মন্ত্রটন্ত্র বাজে। তবে যোগীদের আমি বিশ্বাস করি। তাঁরা আশ্চর্য আশ্চর্য ঘটনা ঘটাতে পারেন। মাটি চাপা হয়ে তিন ঘণ্টা কী করে মানুষ থাকতে পারে স্যার, আপনি তো ডাক্তার, বলুন না?”
চন্দন কোনো জবাব দিল না। কিকিরাকে এখন আর ভাঁড় মনে হচ্ছে না। তার গলার স্বরও যেন পালটে গিয়েছে।
তারাপদ লল, “আপনি কি যোগী?”
“না, না”, কিকিরা মাথা নেড়ে জিব কাটল, “যোগের য পর্যন্ত আমি জানি না। ওসব মহাপুরুষরা পারেন, আমরা কত তুচ্ছ।”
“তা হলে আপনি কী করে জানলেন আমরা কোথায় যাচ্ছি, কার কাছে যাচ্ছি?”
কিকিরা খুব বিনয় করেই যেন বললেন, “একথাটা ঠিক হল না স্যার, আমি শুধু বলেছি, আপনারা যেখানে যাচ্ছেন সেই জায়গাটার নামের প্রথমে ‘এস’ অক্ষর আছে। যার কাছে যাচ্ছেন তাঁর নামের প্রথমে ‘বি’ অক্ষর আছে তা আপনারা তো ‘এন’ অক্ষর দিয়ে নামের কত জায়গাতেই যেতে পারেন, সীতারামপুর, সালানপুর, শিমুলতলা আর যার কাছে যাচ্ছেন তাঁর নাম বিহারীপ্রসাদ, বিজনকুমার, বটুকচন্দ্রও হতে পারে…”
চন্দন বুঝতে পারল, কিকিরা পাকা লোক, সহজে মচকাবে না। বলল, “হতে সবই পারে, কিন্তু আপনি জানেন আমরা কোথায় যাচ্ছি। জানেন না?”
কিকিরা হাসি-হাসি মুখ করে চেয়ে থাকলেন।
চন্দন আর তারাপদ তাকিয়ে থাকল, অপেক্ষা করতে লাগল।
কিকিরা কোনো কথাই বলছিলেন না।
“কিছু বলছেন না?”
“কী বলব স্যার!”
“আপনি সত্যি সত্যিই কিছু জানেন না?”
কিকিরা এবার একবার তারাপদর দিকে তাকালেন। চোখ বন্ধ করলেন। আবার খুললেন। তাঁর হাসি-হাসি মুখ মুখ ধীরে ধীরে গম্ভীর, করুণ হয়ে উঠল, গলার স্বর ভারী শোনাল। বললেন, “একটা কথা আপনাদের আমি বলে দিই। আপনারা ছেলেমানুষ। যেখানে যাচ্ছেন সেই জায়গা কিন্তু ভয়ংকর। আপনারা ভয় পেয়ে যাবেন, বিপদেও পড়তে পারেন। চোখ কান খোলা রাখবেন। কোনো ভেলকি বিশ্বাস করবেন না। ওই লোকটা যোগী নয়–শয়তান, পিশাচ। তার চেহারা দেখলে আপনাদের বুক কাঁপবে। অনেক মানুষের জীবন সে নষ্ট করেছে। ও একটা কাপালিক। কী নিষ্ঠুর জানেন না। এত বড় শয়তান কেমন করে বেঁচে আছে–আমি জানি না। ভগবান এত লোককে নেন, ওই পিশাচকে কেন নেন না?” বলতে বলতে কিকিরার মুখ কেমন রক্তজমার মতন নীলচে হয়ে এল। তিনি দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেললেন।
তারাপদ আর চন্দন যেন স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকল। কোনো কথা বলতে পারল না।
কোনোরকমে কাঁপা কাঁপা গলায়, জড়ানো স্বরে তারাপদ বলল, “সামনের অমাবস্যায় নাকি তিনি মারা যাবেন?”
কিকিরা বললেন, “তাই যেন যায়।…এত পাপ করেও মানুষ যদি বেঁচে থাকে তবে ভগবান বলে কিছু নেই।”
চন্দনরা অবাক হয়ে দেখল, কিকিরার গলা ফুলে উঠেছে, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে।
.
পাঁচ
শংকরপুর গাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে সামান্য বেলা হয়ে গেল। মধুপুরে মিনিট কুড়ি দাঁড়িয়ে থাকল ট্রেন, কিসের একটা গণ্ডগোল হয়েছিল ইঞ্জিনে। শংকরপুরে পৌঁছতে হরেদরে আধ ঘণ্টা লেট।
কিটব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে তারাপদরা প্লাটফর্মে নেমে পড়ল। ছোটখাট স্টেশন, তেমন একটা লোকজন ওঠানামা করল না। যারা নামল বা গাড়িতে উঠল, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই দেহাতী মানুষজন।
প্লাটফর্মে নেমে তারাপদরা কিকিরার জানলার দিকে সরে এল । চন্দন বলল, “আপনিও নেমে গেলে পারতেন।”
কিকিরা মাথা নেড়ে বললেন, “না স্যার, এখন আমার নামা চলবে না। এখানে আমাকে দু-চারজন চেনে। আপনাদের সঙ্গে নামলে চোখে পড়ে যেতে পারি।”
তারাপদ বলল, “চোখে পড়লে কী হবে?”
“কী হবে তা কেমন করে বলব। সাবধানের মার নেই। আপনারা ভাববেন না; আমি যশিডির কাজকর্ম সেরে বিকেলের প্যাসেঞ্জার ট্রেনে এখানে ফিরে আসব। যা বলে দিয়েছি মনে রাখবেন, স্টেশনের পুব দিকে বালিয়াড়ির মতন জায়গাটার কাছে হরিরামের আস্তানা। ওখানে আমায় পাবেন। কাল দেখা করার চেষ্টা করবেন। যান স্যার, আর দাঁড়াবেন না। খুব সাবধানে থাকবেন, চোখ কান খোলা রেখে। ভয় পাবেন না। “
তারাপদরা দাঁড়িয়ে থাকার কোনো কারণ দেখল না আর। গাড়িও ছাড়ল ছাড়ব করছে। হুইল বেজে গেছে। ইঞ্জিনের দিকেও স্টিম ছাড়ার শব্দ উঠছে।
চন্দন হঠাৎ কিকিরাকে বলল, “আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন আমরা ভুল বুঝেছিলাম। বুঝতেই তো পারছেন–”
কিকিরা চন্দনের কথায় বাধা দিয়ে বললেন, “কিছু না, কিচ্ছু না স্যার, ক্ষমা-টমার দরকার নেই। আমি আপনাদের পেছনে আছি। আমার যতটা সাধ্য করব।”
ট্রেন ছেড়ে দিল। কিকিরা কেমন হাসি-হাসি অথচ মায়া-মাখানো মুখ করে তারাপদর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
তারাপদ একটু হাত ওঠাল, যেন বিদায় জানাল কিকিরাকে ।
প্লাটফর্ম ততক্ষণে ফাঁকাই হয়ে এসেছে । দুই বন্ধু মিলে হাঁটতে লাগল।
টিকিট কালেক্টারকে টিকিট দিয়ে স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়াল ওরা। পাঁচ-সাতটা ছোট ছোট দোকান, এক ফালি রেল কোয়াটার, মস্ত মস্ত ক’টা শিমুলগাছ ছাড়া আশেপাশে আর কিছু চোখে পড়ে না। পানের দোকান, দেহাতী মিঠাইয়ের দোকান। একপাশে কয়েকটা বুড়বুড়ি গোছের লোক ছোট-ছোট ঝুড়ি করে বেগুন, কাঁচা টমাটো, অল্প ক’টা ফুলকপি বিক্রি করছে। খদ্দের বলতে রেলের বাবু আর খালাসি গোছের লোক। একদিকে ছোট এক হনুমান-মন্দির, বাঁশের আগায় পতাকা উড়ছে।
তারাপদ বলল, “চাঁদু, নো রিকশা? নাথিং?”
চন্দন বলল, “কিকিরা তো বলেই দিয়েছিলেন হাঁটতে হবে।“
“তা হলে নে, হাঁট।”
চারদিক তাকিয়ে চন্দন বলল, “ওদিকে একটা মারোয়াড়ি দোকান দেখছি। চল, আগে সিগারেট-ফিগারেট কিনে নিই। ভুজঙ্গভূষণের মাঠ-মোকামের কথাও জেনে নেব।”
জায়গাটা এই রকম যে, তারাপদ আর চন্দনের মতন দুটি বাঙালি ছেলে কাঁধে কিট ব্যাগ ঝুলিয়ে নেমেছে, হাতে কম্বল ঝোলানো–এই দৃশ্যটাই যেন অনেকের কাছে কৌতূহলের বিষয় হয়ে উঠেছিল। সকলেই তাদের নজর করছিল। কালো জোয়ান গোছের একটা লোক সাইকেল কোমরের কাছে হেলিয়ে দেহাতী মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ময়লা কাঁচের গ্লাসে চা খাচ্ছিল। লোকটার চেহারা ষণ্ডার মতন, মাথা নেড়া, পরনে নীল একটা প্যান্ট, গায়ে কালো রঙের সোয়েটার।
চন্দন এবং তারাপদ দুজনেই তাকে দেখল।
তারাপদ ইশারা করে চন্দনকে বলল, “ভুজঙ্গভূষণের লোক নাকি রে?”
চন্দন বলল, “ড্রেস থেকে রেলের লোক মনে হচ্ছে। মালগাড়ির ড্রাইভার হতে পারে।”
“বেটা আমাদের অমন করে দেখছে কেন?”
“দেখুক। তাকাস না। ইগনোর করে যা।”
সামান্য এগিয়ে চন্দনরা মারোয়াড়ির দোকানটার মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল।
দোকানটা দেখতে বড় নয়, কিন্তু হরেক রকম জিনিস রয়েছে। মুদির দোকান খানিকটা, খানিকটা মনিহারী। কবিরাজী তেল আর ভাস্কর লবণ ধরনের করলে আরও নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।
সস্তা সিগারেট পাওয়া গেল। কয়েক প্যাকেট কিনে নিল চন্দন।
তারাপদ মাঠ-মোকামের কথাটা দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল । কিকিরা যদিও বলে দিয়েছিলেন রাস্তাটা, তবু তারাপদ জিজ্ঞেস করল । নতুন জায়গায় কিছু খুঁজে বের করতে হলে একজনের জায়গায় দুজন কি তিনজনকে জিজ্ঞেস করলে আরও নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।
দোকানের ছোকরামতন লোকটি মাঠ-মোকামের যাবার রাস্তাটা বলে দিলেও দোকানের বাইরে যে বুড়োমতন লোকটি টিনের চেয়ারে বসে ছিল, সে কেমন কৌতূহলের সঙ্গে ভাঙা ভাঙা বাঙলায় হিন্দিতেই জিজ্ঞেস করল, “কাঁহা যাবেন?
তারাপদ বলল, “ভুজঙ্গবাবুর বাড়ি।“
লোকটা অবাক হলেও নিজেকে যেন সামলে নিতে নিতে বলল, “ভুজঅংগ মহারাজজি? আচ্ছা আচ্ছা । যাইয়ে…।”
দোকানের বাইরে এসে তারাপদরা একটা নিমগাছের পাশ দিয়ে পাথরফেলা রাস্তাটা ধরল। সামান্য এগিয়ে চড়াই। চড়াইয়ের কাছে পৌঁছতেই ডান দিকে গ্রাম চোখে পড়ল। ছোট গ্রাম। কয়েকটা মাত্র ঘর। হরিরামের আস্তানা দেখা গেল না, টিলাটা চোখে পড়ল গ্রামের কাছাকাছি। ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে আস্তানাটা বোধ হয় আড়াল পড়েছে। বাঁ দিকেও দু-একটা পাকা বাড়ি, বাঁধানো কুয়ো ।
চড়াই ফুরিয়ে গেলেই বাঁ দিকের কাঁচা রাস্তা ধরতে হল।
জায়গাটা যে সুন্দর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। খটখটে শুকনো শক্ত মাটি, বিশাল বিশাল মাঠ, ঢেউ-খেলানো; মাঝে-মাঝে বড় বড় পাথর পড়ে আছে, জংলা গাছ নানা রকমের, মাথার ওপর দিয়ে দু-চারটে বক উড়ে যাচ্ছে, রোদ টকটক করছে, শীতের বাতাস দিচ্ছে শনশন করে।
হাঁটতে হাঁটতে চন্দন বলল, “জায়গাটা কিন্তু চমৎকার, কী বলিস?”
তারাপদ বলল, “খুব ভাল। কিন্তু জায়গার কথা এখন ভাবতে পারছি না চাঁদু।”
“কেন? জেনেশুনেও চন্দন বলল।
“ভুজঙ্গ যেরকম ফণা ধরে দাঁড়িয়ে আছে–,” তারাপদ হাজার দুভাবনার মধ্যেও তামাশা করবার চেষ্টা করল।
চন্দন হেসে বলল, “যা বলেছিস। ভুজঙ্গ যে কোন্ ফণা ধরে দাঁড়িয়ে আছে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। কিকিরা যা বললেন তাতে লোকটাকে একটা আস্ত শয়তান বলেই মনে হচ্ছে।”
তারাপদ বলল, “কিকিরা কিন্তু সত্যিই বড় ভাল লোক।”
“আমরা ভাই ওঁকেই অবিশ্বাস করছিলাম। সত্যি, মানুষ চেনা বড় কঠিন।”
“সবই কঠিন। এই সংসার চেনাই কি সহজ। ধর না ভুজঙ্গভূষণের কথা লোকটা এত শয়তান কিন্তু সেই লোক মরার আগে আমায় সম্পত্তি দেবার জন্যে ডেকে পাঠায়?”
চন্দন একটা কুলঝোঁপের পাশে বিশাল এক গিরগিটির মতন জীবন দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। “তারা, দেখ।“ চন্দন আঙুল দিয়ে জীবটাকে দেখাল।
তারাপদ বলল, “কী রে ওটা? তক্ষক নাকি?”
চন্দন পায়ের শব্দ করতেই জন্তুটা ঝোঁপের আড়ালে পালাল।
তারাপদ বলল, “ডেনজারাস্ জিনিস। বিষটিষ আছে বোধ হয়।
চন্দন বলল, “তুই এক আচ্ছা জায়গায় এলি, কী বল? চারপাশেই ডেনজার।”
“সত্যি! এখন ভাবছি, টাকার লোভে মানুষ কী না করে!”
“আমার কিন্তু ভালই লাগছে।”
“ভালই লাগছে?”
“অ্যাভেঞ্চার-অ্যাডভেঞ্চার মনে হচ্ছে। সেই যকের ধনের মতন ব্যাপার। তোর পিসেমশাই ভুজঙ্গভূষণের গুপ্তধন উদ্ধারের থ্রিলটা মন্দ কী রে?”
তারাপদ দুঃখের শব্দ করে বলল, “গুপ্তধন উদ্ধার! বলেছিস বেশ। ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার।”
“কেন কেন? নিধিরাম কেন?”
“কিকিরার মুখে শুনলি না ভুজঙ্গ কেমন ভয়ংকর। তার সঙ্গে লড়ব আমরা? আমাদের কী আছে রে? নাথিং। একটা লাঠি পর্যন্ত হাতে নেই।”
চন্দন এবার মুচকি হেসে বলল, “আছে, আছে।”
“কী আছে?”
“বলব?”
“বল।”
“প্রথমে আছে কিকিরার হেল্প। কিকিরা আমাদের সব রকম সাহায্য করবেন বলেছেন।”
“তুই বড় বাজে কথা বলিস, চাঁদু। কিকিরা একটা রুগ্ন লোক, তাঁর একটা হাত একরকম অসাড়। ওই মানুষ তোকে মুখের কথায় ছাড়া আর কিসে সাহায্য করতে পারেন?”
চন্দন একটা ছোট পাথর লাফ মেরে টপকে গেল। যেন তার হাত-পায়ের সাবলীল ভাবটা দেখাল। বলল, “শোন তারা, কিকিরা আমাদের কাছে চোদ্দ আনা কথাই ভাঙেননি। আমি তোকে বলছি, কিকিরা ভুজঙ্গভূষণের হাঁড়ির খবর রাখেন। কিকিরা ভুজঙ্গভূষণের শত্রু। কাজেই শত্রু যদি ভুজঙ্গভূষণের হাঁড়ির খবর দেন তা হলে আমরা সেটা জানতে পেরে যাচ্ছি। ওটা কম কাজে লাগবে না। দু নম্বর হল, কিকিরার অ্যাডভাইস। সেটা খুব কাজের হবে। আর তিন নম্বর হল, আমার দুটো অস্ত্র।”
“অস্ত্র?” তারাপদ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
চন্দন মিটমিট করে হেসে বলল, “ভাই, যখন থেকে আমি ভুজঙ্গভূষণের কথা শুনেছি তখন থেকেই আমি তাঁকে সাসপেক্ট করেছি। ভুজঙ্গভূষণের দুর্গে ঢুকব অথচ একেবারে খালি হাতে, তা কি হয়! আমি দুটো জিনিস সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। ইনজেকসানের সিরিঞ্জ, আর একটা পাতলা ছিপছিপে ছুরি।”
তারাপদ বন্ধুর এই ব্যাপারটাকে তামাশা মনে করে তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, “এই তোর অস্ত্র? আমি ভেবেছিলাম রিভলবার-টিভলবার নিয়ে এসেছিস।
“ওটা আমি চালাতে জানি না। এ দুটো জানি।”
“তুই ভুজঙ্গকে ওই দিয়ে ভয় দেখাবি? সত্যি চাঁদু তোর যা বুদ্ধি!”
“ভয় দেখাব কেন? ভদ্রলোকের মতন সব যদি মিটমাট হয়ে যায়–তোর ভুজঙ্গভূষণকে ভগবানের হাতে দিয়ে আমরা কলকাতায় ফিরে যাব।”
তারাপদ যেন কি ভেবে বলল, “কিন্তু চাঁদু, যদি ভুজঙ্গ আগেই তোর চালাকি ধরতে পারে?”
চন্দন বলল, “ধরা পড়লেই বা কী হবে! আমরা কলকাতাতেই শুনেছি, ভুজঙ্গভূষণের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আমি তোর ডাক্তারবন্ধু; ইমার্জেন্সিতে কাজে লাগতে পারে ভেবে জিনিস দুটো এনেছি।”
যুক্তিটা তারাপদর পছন্দ হল। তবু বলল, “তুই স্টেথোকোপটা এনেছিস?”
“না।”
“বাঃ, তা হলে? স্টেথোস্কোপ ছাড়া ডাক্তার হয়?
“ভুলে গিয়েছি। তাড়াহুড়োর মধ্যে জরুরি জিনিস নিতে লোকে ভুল করে না? সেই রকম ভুল।”
তারাপদ কী যেন ভাবল, বলল, “শুধু ইজেকসানের সিরিঞ্জ নিয়ে কী হবে? ওষুধপত্র?”
চন্দন বলল, “মাথা ধরা, পেট ব্যথার দু-চারটে খুচরো ওষুধ ছাড়া ইনজেকসানের জন্যে মরফিয়ার দুটো অ্যাম্পুল এনেছি, আর-একটা অ্যাম্পুল আছে হার্টের গোলমালের ওষুধ। সবই ইমার্জেন্সির জন্যে।”
তারাপদ এক ফোঁটাও ডাক্তারি বোঝে না। কিন্তু চন্দনের এই উপস্থিত বুদ্ধির জন্যে ওকে বাহবা দিতে ইচ্ছে করছিল । সত্যিই তো, একজন ডাক্তার বন্ধু নিয়ে সে মুখ ঝলসানো ভুজঙ্গভূষণের কাছে আসছে, এরকম অবস্থায় একেবারে খালি হাতে কি আসা যায়?
চুপচাপ কয়েক পা এগিয়ে এসে তারাপদ বলল, “দেখ চাঁদু, ভুজঙ্গকে আমরা যতটা ভয় পাচ্ছি–এতটা ভয়ের কারণ আমাদের বেলায় নাও থাকতে পারে । কাল রাত্রেও ঠিক এতটা ভয় আমাদের ছিল না। আজ সকালে কিকিরাই আমাদের ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। আমরা যতটা ভাবছি তা হয়ত কিছুই হবে না। তা ছাড়া আমি কি যেচে এসেছি? ভুজঙ্গভূষণই আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন।”
তারাপদ তার কথা শেষ করেনি, চন্দন অনেকটা দূরে গাছপালার আড়ালে একটা বাড়ি দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে বলল, “তারা, ওই তোর মাঠ-মোকাম, ভুজঙ্গভূষণের বাড়ি।”
চন্দন তাকাল। জায়গাটা দেখার মতন। মাঠের ঢল নেমে গেছে অনেকটা, চারদিকে জঙ্গলের ঝোঁপঝাড় গাছপালা, মনে হয় জঙ্গল বুঝি এখান থেকেই শুরু হয়েছে। ওরই এক পাশে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আড়ালের জন্যে বোঝা যাচ্ছে না বাড়িটা কেমন।
আরও আধ মাইলটাক হেঁটে তারাপদরা ভুজঙ্গভূষণকে বাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এটা বাড়ি না দুর্গ বোঝা যায় না। জেলখানার মতন উঁচু পাঁচিল দিয়ে চারদিক ঘেরা। গাছপালার অভাব নেই, আম জাম নিম কাঁঠাল থেকে শুরু। করে শিমুল পর্যন্ত। জল বৃষ্টি রোদ সয়ে সয়ে পাঁচিলের গায়ে শ্যাওলার রঙ ধরেছে। কোথাও কোথাও কালো হয়ে গেছে। পাঁচিলের এ-পাশ থেকে বাড়ির সামান্যই চোখে পড়ে। অনেকটা ভেতর দিকে বাড়িটা। দোতলাই হবে। দোতলরা রেলিং-দেওয়া বারান্দা চোখে পড়ছিল। কেমন একটা ফটফট শব্দ হচ্ছে, যেন একটা মেশিন গোছের কিছু চলছে।
তারাপদ বলল, “কিসের শব্দ রে?”
চন্দন বলল, “ডায়নামো বলে মনে হচ্ছে।”
“কী করে ডায়নামো দিয়ে?”
“বোধ হয় বাতিটাতি জ্বালায়।”
“অবাক হয়ে তারাপদ বলল, “বাব্বা! বিশাল কারবার তা হলে?”
একটা জিনিস চন্দন লক্ষ করল। তারা বাড়ির হয় পেছনে না হয় পাশে কোথাও এসে দাঁড়িয়েছে। সামনের দিকটা নজরে আসছে না।
পাঁচিলের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চন্দন বলল, “আয়, সামনের দিকে যাই।”
শুকনো পাতা, গাছের সরু সরু ভাঙা ডালপালা, ছড়ানো পাথরের ভূপ টপকে তারাপদরা বাড়ির সামনের দিকে এসে পড়ল। প্রথমেই চোখে পড়ল, লোহার ফটক। বিশাল ফটক। কারখানার গেটে যেমন দেখা যায়, অনেকটা সেই রকম। ফটকের একপাশে পাঁচিল জুড়ে ছোট একটা ঘর মতন। বোঝাই যায় পাহারা দেবার ব্যবস্থা রয়েছে। খুবই আশ্চর্য, ফটকের সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা মাঠের দিকে চলে গেছে–সেটা কাঁচা হলেও গাড়ি চলার দাগ আছে। মরা ঘাস, কাঁকর-মেশানো মাটির ওপর চাকার দাগ। গরুর গাড়ি চললে যেমন দাগ ধরে যায় মাটিতে। কিন্তু দাগের গর্ত গভীর নয়।
তারাপদ ফটকের সামনে এসে বলল, “এবার?”
চন্দন আশেপাশে কাউকে দেখতে পেল না। ফটক বন্ধ। পাহারা ঘরের গায়ে একটা ছোট ফটক রয়েছে, কিন্তু তালা দেওয়া। ফটকটা টপকানো যেত, যদি না মাথায় বশার ফলার মতন শিক থাকত।
গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকা ছাড়া চন্দন অন্য কোনো উপায় খুঁজে পেল না।
হঠাৎ তারাপদ বলল, “চাঁদু, এদিকে একবার দেখ।”
চন্দন তারাপদর কাছে গেল। বাঁ ফটকের পাশে থামের গায়ে একটা কী যেন লেখা আছে। লোকে সাদা পাথরের ওপরেই বরাবর কালো দিয়ে বাড়ির নামটাম লিখে এসেছে। এ একেবারে উলটো। কালো পাথরের ওপর সোনালি দিয়ে কিছু লেখা ছিল। সোনালি রঙ এখন প্রায় কালচে হয়ে এসেছে, অক্ষরগুলো বোঝা কষ্টকর, অর্ধেক নষ্ট হয়ে গিয়েছে, গিয়ে পাথরের খোদাইটুকু কোনো রকমে টিকে আছে। দেবনাগরী অক্ষরে কিছু লেখা। চন্দন দেবনাগরী বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছে, তারাপদ হয়ত বুঝতে পারত, কিন্তু ভাঙা অস্পষ্ট অক্ষর সে পড়তে পারছিল না।
খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তারাপদ বলল, “সংস্কৃত মনে হচ্ছে। ঠিক ধরতে পারছি না, তবে আত্মাটাত্মা কিছু লেখা আছে।”
“আত্মা?”
“তাই তো দেখছি।”
চন্দন কী যেন ভাবল, “আত্মা পরে হবে। জোর খিদে পেয়ে গিয়েছে। নিজেদের আত্মা আগে বাঁচাই। আয় আগে তোর পিসেমশাইয়ের সঙ্গে মোলাকাত করি।“
তারাপদকে টেনে নিয়ে চন্দন পাহারা-ঘরটার কাছে এল। “টপকাতে পারবি?”।
“পাগল, বর্শায় গিঁথে যাব।”
“তা হলে?…আচ্ছা, দাঁড়া, আমার কম্বলটা পাট করা রয়েছে। এটা বশার মাথায় দিচ্ছি। তুই ওই সেট্রি পোস্টের গা ধরে ওঠ, উঠে টপকে যা।”
চন্দন যাকে সেট্রি পোস্টের গা বলল সেটা পাহারা-ঘরের দেওয়ালই বলা যায়।
তারাপদ ইতস্তত করল। এই ফটকটা ছোট, ফুট চারেকেরও কম উঁচু মাটি থেকে। হাই জাম্প করেও পেরিয়ে যাওয়া যেত যদি জায়গা থাকত দু পাশে । অবশ্য তারাপদ স্পোর্টসম্যান নয়, চন্দন খানিকটা লাফঝাঁপ করতে পারে।
চন্দনের তাড়া খেয়ে তারাপদ মনে-মনে ভগবানকে ডেকে গেটের ওপর চেপে পড়ল।
কপাল ভাল, কোনো অঘটন ঘটল না। দুজনেই গেট টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ল।
ভেতরে ঢুকে তারাপদরা দেখল, বাড়িটা ফটক থেকে গজ পঞ্চাশেক দূরে হবে। গড়নটা সেকেলে জমিদারবাড়ির মতন, অবশ্য সামনের দিকে গোলাকার ভাব আছে। মজবুত বাড়ি মস্ত মস্ত থাম, পাকাঁপোক্ত বারান্দা বাইরে। দূর থেকে মনে হয়, যেন বড় বড় পাথরে গাঁথা বাড়ি। বাইরে রঙরঙ কিছু নেই, কালচে হয়ে আছে, মানে ভুজঙ্গভূষণ বাইরের দিকে আর নজর দেন না। দেখতে বাড়িটা ছোট নয়। ভুজঙ্গভূষণ একলা মানুষ, এই বাড়ি নিয়ে কী করেন কে জানে!
ফটক থেকে যে রাস্তাটা সোজা বাড়ির সদর সিঁড়িতে গিয়ে পড়েছে, তার দু পাশে বাগান। এক সময় নিশ্চয় ফুলের বাগান ছিল, এখন ফুলটুল তেমন কিছু নেই, নানা ধরনের পাতাবাহার, জবা, গাঁদা আর এলোমেলো কিছু ফুলগাছ। চোখে পড়ে। বাগানে বেদী আছে বসার । ঘাসগুলো মরে যাচ্ছে শীতে। কিছু লতাপাতা নিজের মতন বেড়ে যাচ্ছে। পাঁচিলের গা ধরে অবশ্য বড় বড় গাছ–নিম, কাঁঠাল, আম, হরীতকী ।
তারাপদ আর চন্দন ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সেই ডায়নামোর শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই। মানুষের গলা পাওয়া যাচ্ছে না, কারও কোনো রকম টিকি দেখা যাচ্ছে না। ক’টা প্রজাপতি উড়ছে বাগানে। রোদ আরও গাঢ়, রীতিমত তাপ লাগছে গায়ে। শীত যেন এই রোদের কাছে। হার মেনে গেছে।
চন্দন বলল, “তারা, একটাও লোক নেই, কোনো সাড়াশব্দ নেই, তোর ভুজঙ্গভূষণ বেঁচে আছে তো?”
কথাটা শোনামাত্র তারাপদ যেন চমকে উঠল। সত্যিই তো, ভুজঙ্গভূষণ যদি মারা গিয়ে থাকে? ভুজঙ্গ নিজে অমাবস্যা পর্যন্ত বাঁচব বলেছে–কিন্তু মরা বাঁচা কি মানুষের নিজের হাতে? ওটা ভগবানের হাত । যদি ভুজঙ্গভূষণ মারা গিয়ে থাকে তবে তো হয়েই গেল! তারাপদর এই ছুটে আশা বৃথা হল । বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার যে আশা দেখা গিয়েছিল তাও গেল।
তারাপদ বেশ বুঝতে পারল, সে ভুজঙ্গভূষণকে জীবিত দেখতে চায় টাকার লোভে, সম্পত্তির লোভে? অথচ এই ভুজঙ্গকে নিয়ে তাদের ভয় দুশ্চিন্তা কি কম!
পাথরকুচি-ছড়ানো রাস্তা দিয়ে বাড়ির একেবারে সামনের সিঁড়িতে এসে দাঁড়াল তারাপদরা। তবু কোনো শব্দ নেই, কারও সাড়া নেই। একেবারে চুপচাপ সব।
চন্দন বন্ধুর দিকে তাকাল। “কী ব্যাপার রে?”
“কী জানি, বুঝতে পারছি না।”
“চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকব?”
“কাকে?”
“কেন, ভুজঙ্গভূষণকে?”
তারাপদ বুঝতে পারল না, কী বলবে।
পাঁচ-সাত ধাপ সিঁড়ি উঠে গেল ওরা। বারান্দায় উঠে এসে দাঁড়াল। সামনেই একটা বড়-মতন ঘর। দরজা খোলা। বারান্দার একদিকে গোটা দুই চেয়ার পাতা রয়েছে।
চন্দন ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে উঁকি মারতে যাচ্ছিল, এমন সময় পাশের ঘর থেকে কে বাইরে এসে দাঁড়াল। চন্দন তাকাল।
তারাপদ একদৃষ্টে লোকটিকে দেখছিল। তারপর অবাক হয়ে বলল, “সাধুমামা!”
সাধুমামা যেন তারপদকে চিনতে পারছিলেন না। তাকিয়ে থাকলেন।
তারাপদ আবার বলল, “সাধুমামা, আমি তারাপদ । তোমার এ কী চেহারা হয়েছে? তুমি ওভাবে আমায় দেখছ কেন? আমায় চিনতে পারছ না?”
সাধুমামার শরীর কঙ্কালের মতন, মাথার চুল একেবরে সাদা, ঘাড় পর্যন্ত ছড়ানো, মুখের মাংস কুঁচকে বিশ্রী হয়ে গেছে। বীভৎস দেখাচ্ছে। কিছু যেন হয়েছিল মুখে। কাটাকুটি, ঘা, নাকি সাধুমামারও মুখ পুড়ে গিয়েছিল ঝোঝা যাচ্ছে না। সাধুমামা এমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকলেন যেন সত্যিই তারাপদকে চিনতে পারছেন না।
তারাপদ বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, সাধুমামা তাকে চিনতেও পারছেন না। বছর দেড় দুই আগেও সাধুমামা তার কাছে গিয়েছিলেন,
এমন সময় একেবারে আচমকা ভয়ংকর গম্ভীর গলায় কে যেন বলল, “ওদের হলঘরে বসাও। বসিয়ে তুমি ওপরে আমার কাছে এসো।”
তারাপদরা চমকে উঠল।
কে যে কথাটা বলল দেখবার জন্যে তারাপদরা তাকাল। কাউকে দেখতে পেল না কোথাও। গলার স্বরটা কী গম্ভীর, কী কঠিন। গমগম করে উঠল যেন বারান্দাটা। কিন্তু কে কথা বলল? কে?
সাধুমামা ওই গলা শোনামাত্র বাড়ির চাকরবাকরের মতন হাত দেখিয়ে তারাপদদেরর মাঝের ঘরটার দিকে যেতে ইশারা করলেন। কথা বললেন না।
.
ছয়
হলঘরে বসে থাকার সময়েই তারাপদরা বুঝতে পারল, তারা এক অদ্ভুত জায়গায় এসে পড়েছে। এই বিশাল বাড়ি এত ফাঁকায়–এমনিতেই নিঝুম থাকার কথা তার ওপর যদি এই বিরাট পুরীতে মানুষের সাড়াশব্দ, হাঁকডাক, চলাফেরা না থাকে–তবে কেমন লাগে? তারা কলকাতার মানুষ, মানে হইহই রইরইয়ের মধ্যে মানুষ। কোন্ ভোর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত সেখানে শুধু শব্দ আর শব্দ, মানুষজন থেকে গাড়ি-ঘোড়া, রাস্তার খেকি কুকুরগুলোও কানের পরদা ফাটিয়ে দেয় অনবরত। আর এখানে এই অদ্ভুত চুপচাপ। শুধু ডায়নামো চলার সেই ফটফট শব্দ; মাঝে মাঝে বাইরে দু-চারটে পাখির ডাক।
হলঘরটাও কেমন জাদুঘরের মতন দেখাচ্ছে। রীতিমত বড় ঘর, কবেকার কোন্ মান্ধাতা আমলের আসবাবপত্র, কারিকুরি করা লোহার ফ্রেমের সোফা সেট, বড় বড় আর্ম চেয়ার, মোগলাই নকশার একটা বড় সেন্টার টেবিল, মোটা মোটা বেটপ আলমারি গোটা দুই, দেওয়াল জুড়ে নানা ধরনের সামগ্রী ঝুলছে, বাঘের মাথা, বুনো মোষের সিং, বড় বড় তীর-ধনুক, এক জোড়া খঙ্গ, মা কালীর বিরাট পট, আর ওই সবের মধ্যে একটিমাত্র মানুষের ছবি। ফটো নয়, তেলরঙে আঁকা ছবি । ও ছবি যে ভুজঙ্গভূষণের তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওই মুখের দিকে তাকালে সমস্ত শরীর যেন থরথর করে কাঁপে, গায়ের লোমকূপে কাঁটা দিয়ে ওঠে। বেশ লম্বা, খাঁড়ার মতন নাক, ভীষণ চওড়া কপাল; চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, কী তীব্র, তীক্ষ্ণ। খুবই আশ্চর্য, ঘরের মাঝখানে যেখানেই তুমি বসো, মনে হবে ভুজঙ্গভূষণ তোমায় দেখছে। ঘাড় পর্যন্ত ঝাঁকড়া এলোমেলো চুল, মুখভরতি দাড়ি। দাঁত যেটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হয় মানুষটি বড় ভয়ংকর।
তারাপদরা বসে থাকল তো বসেই থাকল। চুপচাপ। ঘরের মধ্যে একটা বড় দেওয়াল-ঘড়ি টিকটিক করে বেজে যাচ্ছিল। আর তারাপদর বুকের মধ্যে ধকধক করছিল, গলা শুকিয়ে আসছিল।
এমন সময় একজন ঘরে এল। ছিপছিপে চেহারা, গায়ের রঙ কালো, অন্তত বছর চল্লিশ বয়েস, লালচে রঙের গেরুয়া পরনে, মাথায় রুক্ষ একরাশ কোঁকড়ানো চুল, দাড়ি নেই। লোকটার মুখের দিকে তাকালেই প্রচণ্ড ধূর্ত মনে হয়।
লোকটা দু মুহূর্ত তারাপদদের দেখল। তারপর বলল, “তোমাদের জন্যে ঘর ঠিক করা হয়েছে, এসো।”
তারাপদ বলল, “আমরা ভুজঙ্গবাবুর সঙ্গে দেখা করব।”
“এখন নয়। গুরুজির অসুখ। তিনি বিকেলের পর দেখা করবেন।”
তারাপদ কী ভেবে বলল, “একবার একটুর জন্যে দেখা করা যায় না?”
“না; এখন নয়। দেখা করার সময় তিনি নিজেই দেখা করবেন।”
তারাপদ ঢোক গিলল। চন্দন একটাও কথা বলছিল না। লোকটাকে দেখছিল। তার মনে হল, লোকটা মোটামুটি টেরা, গলার কাছে একটা জায়গা ফোলা, থায়রয়েড় গ্ল্যান্ডের গোলমাল আছে বোধ হয়, চোখ দুটোও যেন সামান্য ঠেলে বেরিয়ে আসার মতন লাগছে।
তারাপদরা ঝোলাঝুলি নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
আবার বারান্দায়। লোকটার পিছু পিছু হেঁটে বাড়ির একেবারে শেষ দিকে একটা ঘরে তারা এসে দাঁড়াল।
তারাপদ কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই লোকটা বলল, “আমার নাম মৃত্যুঞ্জয়। এখানে আমায় সকলে ছোট মহারাজ বলে।” বলেই তারাপদর দিকে তাকাল, “গুরুজি আদেশ দিয়েছেন, তোমার কাছে কাগজপত্র যা আছে, আমার হাতে দিতে। গুরুজি দেখবেন।”
তারাপদ ভাবল আপত্তি করে। কাগজপত্রগুলো নিজের হাতে ভুজঙ্গভূষণকে দেবার কথা। অবশ্য মৃণাল দত্ত বলে দেননি যে, হাতে-হাতেই দিতে হবে। পৌঁছে দেবার কথাই তিনি বলেছিলেন। এই মৃত্যুঞ্জয়কে কাগজপত্র দিলে কি কোনো ক্ষতি হবে? তারাপদ বুঝতে পারল না। লোকটা যখন এই বাড়িরই লোক, বোধ হয় ভুজঙ্গভূষণের ডান হাত–তখন একে দিতে আপত্তি কি? তা ছাড়া ভুজঙ্গভূষণ তো বিকেলের আগে দেখাই করবেন না। কাগজপত্রের কথা ভুজঙ্গভূষণ বলে না দিলে এই লোকটা জানবেই বা কোথা থেকে?
তারাপদ একবার চন্দনের দিকে তাকাল। চন্দন চোখের ইশারায় দিয়ে দিতে বলল।
কিট ব্যাগ খুলে যা কিছু দেবার বের করে তারাপদ মৃত্যুঞ্জয়কে দিয়ে দিল।
চন্দন এতক্ষণ পরে কথা বলল। বলল, “কিছু মনে করবেন না, আমরা সারারাত ট্রেন জার্নি করেছি। খিদে-তেষ্টা পেয়েছে। একটু চা পেলে অন্তত ভাল হয়।”
মৃত্যুঞ্জয় বলল, “ও হ্যাঁ, আমি দেখছি। ব্যবস্থা হয়ে গেছে।” বলে চলে যেতে গিয়ে আবার বলল, “এখানে কোনো অসুবিধে হবে না। কিছু দরকার হলে আমাদের জানিও। নাও, বিশ্রাম করো। কলঘরটা ডানদিকে।” বলে হাত দিয়ে বাথরুমের দিকটা দেখাল।
মৃত্যুঞ্জয় চলে যাবার পর তারাপদ নিচু গলায় বলল, “চাঁদু, এ কোথায় এলাম । আমার ভাল লাগছে না। সাধুমামা আমায় চিনতে পারল না। কেমন শরীর হয়ে গেছে! একটাও কথা বলল না। ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি না।”
চন্দন বলল, “তোর লোক চিনতে ভুল হয়নি তো?”
“কী বলিস! সাধুমামাকে চিনব না?”
চন্দন কোনো জবাব দিল না। ঘরটা দেখতে লাগল। বড়ঘর। দু পাশে দুই বিছানা। একটা দেরাজ একপাশে। গোটা দুয়েক চেয়ার। মাথার ওপর পাখা। ইলেকট্রিক বাতি ঝুলছে। শীতকাল বলে পাখা চালানোর প্রয়োজন নেই। আর দিনের বেলায় বাতি জ্বালানোর প্রশ্নই ওঠে না। পুবের মস্ত জানলা দিয়ে আলো আসছে, রোদ অবশ্য নেই, সরে গেছে।
চন্দন বলল, “দাঁড়া, আগে মুখ ধুই, চা খাই, তারপর ভাবব। এখন আর মাথা খুলছে না।”
চন্দন কিট ব্যাগ খুলে টুথব্রাশ, পেস্ট, তোয়ালে বার করল। এক টুকরো সাবানও।
তারাপদ তার কিট ব্যাগ খুলতে লাগল। তার মুখ দেখলেই মনে হয় সে বেশ উদ্বেগ এবং হতাশা বোধ করছে।
ঘরের ভেতর দিকের দরজা খুলে চন্দন একটা প্যাসেজ দেখল, তার গায়েই বাথরুম।
তারাপদ জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঘরটা একেবারে শেষের দিকের। জানলার গা ঘেঁষে বাগান, পেছনের দিকে আস্তাবল। একটা বাদামী রঙের ঘোড়া চরে বেড়াচ্ছে ফাঁকা জমিতে। তারাপদ বুঝতে পারল, ভুজঙ্গভূষণের বাড়িতে ঘোড়ার গাড়ি আছে।
সেই ফটফট শব্দটা হঠাৎ কখন থেমে গেছে তারাপদ বুঝতে পারেনি। আচমকা খেয়াল হল। কান পেতে থাকল সামান্য, না, কোনো শব্দ নেই। সাধুমামার মুখ আবার তার মনে পড়ল। মানুষ না কঙ্কাল? কী হয়েছিল সাধুমামার? সাধুমামা কেন তাকে চিনতে পারল না? কেন কথা বলল না? সাধুমামা কি অসুখবিসুখে বোবা হয়ে গেছে? আশ্চর্য!
চন্দন ফিরে এসে বলল, “যা তারা, মুখটুখ ধুয়ে আয়। ফাইন জল এখানকার রিফ্রেশিং…।”
তারাপদ নিশ্বাস ফেলে মুখ ধুতে চলে গেল।
চা জলখাবার এসেছিল। বাড়িতে তৈরি জলখাবার । মিষ্টিও। চা-টাও মন্দ নয়।
দুই বন্ধু চা খেতে খেতে নিচু গলায় কথা বলছিল।
চন্দন বলল, “শোন তারা, আমি সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু এতদূর এসে আর ফিরে যাওয়া যায় না।”
“এমন জানলে আমি আসতাম না, চাঁদু।”
“না এলে সম্পত্তি ফসকে যেত।” চন্দন যেন ঠাট্টাই করল।
তারাপদ মুখ কালো করে বলল, “যেত তো যেত। আমি গরিব ছিলাম, গরিবই থাকতাম; বটুকবাবুর মেসে আমার জীবন কেটে যেত। কিন্তু এ-কোথায় এলাম? মৃণাল দত্ত আমায় এত কথা বলে দেননি।’
চন্দন বলল, “এসে যখন পড়েছিস, দুটো দিন দেখে যা না কী হয়? আমাদের কী করবে ভুজঙ্গভূষণ? খুনও করবে না, জেলেও পাঠাবে না। যদি অবস্থা খারাপ দেখি, পালাব।”
“কেমন করে পালাবি এই দুর্গ থেকে?”
“পালাব। সে-ভার আমার।…এই বাড়িতে অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে, তারা; অ-নেক। এই রহস্যগুলো কী?”
তারাপদ বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই শার্লক হোমস্ নাকি?”
চন্দন বলল, “শোন, তুই এ-বাড়িতে একটা মেয়েকে দেখেছিস?”
“মেয়ে? না।” তারাপদ অবাক।
“আমি দেখেছি,” চন্দন বলল, “দোতলার দিকে ভেতর বারান্দায় একটা মেয়েকে দেখলাম। একটুর জন্যে। মনে হল, খুব রোগা, ফরসা, বয়স কম।”
তারাপদ বলল, “ভুজঙ্গভূষণ বা তার চেলার কেউ হবে।“
“হতে পারে,” চন্দন একটা সিগারেট ধরাল, “কাপালিকের বাড়িতে অতটুকু মেয়ে কেন?”
তারাপদর বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে তার কপালকুণ্ডলার কথা মনে পড়ে গেল। বন্ধুর মুখের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকল তারাপদ।
ভুজঙ্গভূষণ যে অতিথিদের ব্যাপারে খুবই যত্নশীল সেটা বোঝা গেল। শীতের বেলা গড়িয়ে যাচ্ছিল, স্নান খাওয়া শেষ করল তারাপদরা। দোতলায় গিয়ে তাদের খেতে হল আসনে বসে। খেতে বসে মনে হল, এতরকম সুখাদ্য তারাপদ জীবনে খায়নি। মৃত্যুঞ্জয় তাদের তদারক করছিল। ঠাকুরগোছের একটা লোক খেতে দিচ্ছিল ওদের। সমস্ত কিছু পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন।
নিজেদের ঘরে ফিরে এসে চন্দন বলল, “তারা, তোর পিসেমশাই যে দারুণ খাতির করছে রে? এই রেটে যদি সাত দিন খাই আর ঘুমোই–এই শীতে একটা ফার্স্ট ক্লাস চেঞ্জ হয়ে যাবে।”
তারাপদ ঢেকুর তুলে বলল, “খাতিরের শেষটায় কি হয়, দেখ।”
“কেন, তুই সম্পত্তি পাবি, আর আমরা বগল বাজাতে বাজাতে কলকাতা ফিরব। “
“সাধুমামাকে আর একবারও দেখছি না কেন বল তো?”
“কী জানি! হয়ত তাঁর অন্য কাজ।”
“মৃত্যুঞ্জয়কে তোর কেমন লাগছে?”
“একটা ক্যারেকটার।”
“লোকটা শয়তান বলে মনে হচ্ছে আমার।”
“পাকা শয়তান। …নে এবার একচোট ঘুমিয়ে নে। ট্রেনে ভাই ভাল ঘুম হয়নি।” বলতে বলতে চন্দন বিছানায় শুয়ে পড়ল। হাতের সিগারেটটা টিল করে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দিল।
তারাপদও প্রচুর খাবার পর একটা সিগারেট খাচ্ছিল। বলল, “চাঁদু, আজ একবার কিকিরার সঙ্গে দেখা করা যায় না? উনি তো বলেছেন বিকেলেই যশিডি থেকে ফিরবেন।”
চন্দন বলল, “আজ আর কী করে হবে? সন্ধের দিকে ভুজঙ্গভূষণের সঙ্গে দেখা হবে তোর। তারপর আর সময় কোথায়? স্টেশন কম দূর নয়।”
তারাপদ চুপ করে থাকল। চন্দন বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল।
তারাপদরও আলস্য লাগছিল। শীতের দুপুরে চন্দন ঘুমোচ্ছে। বিছানায় গা গড়িয়ে নানারকম ভাবতে ভাবতে তারাপদও ঘুমিয়ে পড়ল।
.
তারাপদর ঘুম ভাঙল শেষ বেলায়। শীতের দিন। হুহু করে রোদ পালিয়ে আলো মরে আসছে। ঘরের মধ্যে ছায়াছায়া ভাব। কেমন যেন বিষণ্ণ রঙ ধরে গিয়েছে বাগানে।
চন্দন ঘুমোচ্ছিল। তারাপদ হাই তুলতে তুলতে উঠল। জানলার কাছে দাঁড়াল। হাওয়া দিয়েছে শীতের, গাছপালায় সেই হাওয়া লেগেছে। দূরে যেন কোথায় একটা কাক ডাকছে। শব্দটা কানে খারাপ লাগছে না। গাছের পাতা উড়ে গেল বাতাসে, বোধ হয় ওই ইউক্যালিপটাস গাছটার শুকনো পাতা।
তারাপদ চোখেমুখে জল দিয়ে আসতে কলঘরের দিকে চলে গেল।
ফিরে এসে ঘরে ঢুকতেই দেখল জানলার কাছে সাধুমামার মুখ ।
তারাপদ প্রথমটায় কেমন বিশ্বাস করতে পারেনি। যখন তার বিশ্বাস হল, তখন আর সাধুমামা নেই। কী যেন একটা বিছানার দিকে ছুঁড়ে দিয়েই সাধুমামা চলে গেছেন।
তারাপদ তাড়াতাড়ি এসে জানলার কাছে দাঁড়াল। জানলায় গরাদ, মুখ বাড়ানো যায় না। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল তারাপদ–সাধুমামাকে দেখতে পেল না। ডেলাটা তুলে নিল তারাপদ। ধীরে ধীরে খুলল। এক টুকরো কাগজে কী যেন লেখা সিস-পেনসিলে; পড়তে কষ্ট হয় ।
তারাপদ পড়ল : “তুমি শেষ পর্যন্ত যমপুরীতে পা দিয়েছ। এসে ভাল করেছ। খুব সাবধানে থাকবে। আমি আছি । তোমায় পরে সব বলব। আমি বোবা সেজে আছি। এই যন্ত্রণা থেকে তুমি আমাদের উদ্ধার করবে বাবা? একাগজ রেখো না। নষ্ট করে ফেলো।”
অরাপদর সর্বাঙ্গ পাথর হয়ে গেল। সাধুমামা বোবা সেজে রয়েছে। কেন? তারাপদ তাদের উদ্ধার করতে পারে, মানে? কাদের? কারা এখানে বন্দী? কেন?
তারাপদ ভয়ে কেমন যেন হয়ে গিয়ে চন্দনকে ঠেলা মেরে জাগিয়ে তুলতে লাগল ।
“চাঁদু, এই চাঁদু; ওঠ..।”
চন্দন ধড়মড় করে উঠে বসল। ভেবেছিল, না জানি কী ঘটেছে; উঠে বসে দেখল ঘরটা ছায়ায় ভরা, তারাপদ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
তারাপদ বলল, “আচ্ছা ঘুম ঘুমোচ্ছিস? সন্ধে হয়ে গেল। ওঠ। …এইটে পড়ে দেখ।”
ঘুম জড়ানো ছলছলে চোখে চন্দন বলল, “কী ওটা?”
“সাধুমামার চিঠি।“
চন্দন চিঠিটা নিল। চোখ ঝাপসা, কোনো রকমে পড়ল। বার দুই তিন। তারপর বলল, “এখানকার সবই মিস্টিরিয়াস ।”
.
এবাড়ির আরও বড় রহস্য তারাপদরা সন্ধের দিকে জানতে পারল।
শীতের দিন; বিকেল ফুরোতেই সন্ধে। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল । কলকাতার মানুষ তারাপদরা, অন্ধকার দেখার সুযোগ কমই জোটে; জুটলেও এমন চারপাশ জুড়ে থমথমে অন্ধকার দেখার অভিজ্ঞতা তাদের নেই। তার ওপর শীত। কুয়াশা জমছে মাঠঘাটে। কোনো দিকেই তাকানো যায় না।
মৃত্যুঞ্জয় এসে জানিয়ে গিয়েছে, সামান্য পরে এসে তারাপদদের ভুজঙ্গভূষণের কাছে নিয়ে যাবে। তারাপদরা জামা-প্যান্ট পরে তৈরি হয়ে বসে আছে। সেই ফটফট শব্দটা আবার বিকেলের পর থেকে শোনা যাচ্ছিল । ডায়নামো চলছে আর কি। ঘরে বাতি জ্বলছি।
তারপর বুকের মধ্যেও ধকধক করছিল। ভুজঙ্গভূষণের কাছে যেতে হবে। জীবনে যাকে কোনোদিন দেখেনি, যার নামও তিন দিন আগে পর্যন্ত তার জানা ছিল না, সেই লোকটার কাছে। অথচ এই লোকই তারাপদকে দেড় দুই লাখ টাকার সম্পত্তি দিয়ে যেতে ডেকে পাঠিয়েছে। এমন মানুষকে দেখার আগে এমনিতেই বুক কাঁপার কথা। তার ওপর সেই মানুষ যদি এত রহস্যময় ও ভয়ঙ্কর হয় তবে কেমন লাগে? তারাপদর মুখ গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল, বলে যেন অনবরত কেউ হাতুড়ি পিটছে।
চন্দন তারাপদর চেয়ে সাহসী । তবু তারও ভয় হচ্ছিল।
তারাপদর কাঠের মতন শুকনো গলা করে বলল, “চাঁদু, কী হবে?”
চন্দন বলল, “কিছু ভাই বুঝতে পারছি না। যাই হোক, আমাদের নিশ্চয় মেরে ফেলবে না। কাপালিকই হোক আর শয়তানই হোক–আজকের দিনে মানুষকে বাড়িতে ডেকে এনে মেরে ফেলা মুশকিল। পুলিসে ধরবে। আমরা দুজন যে এবাড়িতে এসেছি তার প্রমাণ কলকাতার মৃণাল দত্ত থেকে শুরু করে এখানে সাধুমামা পর্যন্ত সবাই দিতে পারবেন।”
তারাপদ ভয় সামলাবার জন্যে ঘন ঘন সিগারেট খেতে লাগল।
শেষে মৃত্যুঞ্জয় এল। বলল, “এসো।”
তারাপদরা উঠল।
ফাঁকা ফাঁকা ঘর, বারান্দা, সিঁড়ি দিয়ে তারাপদরা দোতলায় এল। দোতলার ভেতর বারান্দা দিয়ে হেঁটে একটা ছোট ঘরের কাছে এসে মৃত্যুঞ্জয় বলল, “ওই ঘরে যাও। ঘরে থোয়ানো ধুতি, ফতুয়া, গরম চাদর আছে। তোমাদের এই জামা-প্যান্ট পালটে নেবে, জুতো-মোজা খুলে রাখবে । জানলার দিকে জল আছে। হাত ধুয়ে নেবে। নোংরা, বাইরের জামা কাপড়ে গুরুজির কাছে যাওয়া যায় না।”
চন্দন প্রতিবাদ করে বলল, “আমরা লড্রির প্যান্ট জামা পরেছি।”
“তা হোক; এখানের এই নিয়ম। বাইরের কোনো পোশাকেই কাউকেই গুরুজির কাজে যেতে দেওয়া হয় না।”
“আমি ধুতি পরতে পারি না,” চন্দন বলল।
“তা হলে তুমি থাকো।”
তারাপদ চন্দনের হাত ধরে টানল। “ঠিক আছে–আমি তোকে ধুতি পরিয়ে দেব।”
ওরা দুজনে পোশাক পালটাতে পাশের ঘরে চলে গেল।
ঘরে ঢুকে চন্দন রাগের গলায় বলল, “যত্ত বাজে নিয়ম। কোনো মানে। হয়? কোন মহারাজ তোর পিসেমশাই যে তাকে দেখতে হলে ধুতি পরতে হবে। কেমন শীত দেখছিস। ধুতির ভেতর দিয়ে ঢুকে হাড় কাঁপাবে।”
তারাপদ বলল, “কপাল ভাই। কিছু করার উপায় নেই।”
চন্দন একেবারেই ধুতি পরতে পারে না তা নয়, বছরে এক-আধ দিন পরে, রীতিমত যুদ্ধ করে।
ওরা জামা-প্যান্ট ছেড়ে ধুতি ফতুয়া পরতে লাগল।
পোশাক পালটে তারাপদরা বাইরে এল। মৃত্যুঞ্জয় দাঁড়িয়ে আছে। বলল, “এসো ।”
বারান্দার গা-লাগানো একটা প্যাসেজ ঘুরে সামনের ঘরটার সামনে এসে দাঁড়াল মৃত্যুঞ্জয়। বলল, “ভেতরে যাও, বসবার জায়গা আছে, গিয়ে বসে থাকো। কথাবার্তা বলো না।”
দরজা ভেজানো ছিল, মৃত্যুঞ্জয় খুলে দিল।
তারাপদরা ঘরে পা বাড়াল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
সামনেই মোটা ভারী পরদা। পরদা সরিয়ে ঘরের মধ্যে তাকাতেই চোখ যেন অন্ধ হয়ে গেল। কিছু দেখা যায় না। মনে হল, সিনেমা আরম্ভ হয়ে যাবার পর হলে ঢুকলে চোখে কিছু দেখা যায় না, অনেকটা সেই রকম। কিন্তু সিনেমার হলে তবু এদিকে ওদিকে চোরা আলোর ব্যবস্থা থাকে, ছবি দেখানোর আলোও এক এক সময় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এখানে ওসব কিছু না। মিটমিট করে দুপাশে দুই চোরা দেওয়াল-আলো জ্বলছে যদিও, তবু সেই আলোয় কিছু দেখা যায় না।
দুই বন্ধু পাশাপাশি থমকে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে চোখ সয়ে এলে খুব অস্পষ্টভাবে ঘরটা চোখে পড়ল। ঘরের মাঝখানে দুটো চেয়ার। দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে বসে থাকা ভাল ভেবে দুজনে হাতড়াতে হাতড়াতে এগিয়ে চলল। পায়ের তলায় যে কী আছে বোঝা যাচ্ছে না। মনেই হয় না মাটিতে পা; যেন কোনো তুলোর মধ্যে পা ডুবে যাচ্ছে, এত নরম! কোনো সন্দেহ নেই, খুব দামি কার্পেট পাতা রয়েছে ঘর জুড়ে, কার্পেটের রঙটাও। হয় কালো, না হয় ঘন লাল–কালচে দেখাচ্ছে, অবশ্য এই অন্ধকারে সবই কালচে দেখাচ্ছে।
তারাপদরা কোনো রকমে চেয়ারে এসে বসল। বসামাত্র মনে হল, যেন নরম গদির মধ্যে সমস্ত শরীরটা ডুবে গেছে।
ভয় দু’জনেরই বুকের ওপর চেপে বসেছে। তবু চোখ আরও খানিকটা সয়ে আসায় তারা ঘরের চারপাশ দেখছিল। ঘর নিশ্চয় ছোট নয়। দেওয়ালগুলো দেখা যায় না। সারা ঘরে কেমন এক সুন্দর গন্ধ। দামি ধূপের, নাকি কোনো আতর ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে বোঝা যায় না। গন্ধটা বাতাসে ক্রমেই ভারী হয়ে উঠছিল। তাদের চেয়ারের সামনে–খানিকটা তফাতে আরও একটা চেয়ার চোখে পড়ল। তারাপদদের দিকে মুখ করা। সিংহাসনের মতনই যেন। উঁচু, বড়। মনে হল–বেশ যেন বাহারি। চেয়ারের দু’পাশে পরদা। ভেলভেটের পরদা বুঝি। কোঁচানো হয়ে ঝুলছে। ঠিক একেবারে ছোট স্টেজের দুটো উইং। মাথার ওপর দিকটা এত অন্ধকার যে, কোথায় ছাদ বোঝা যাচ্ছে না।
হঠাৎ চন্দন তারাপদর হাত আঁকড়ে ধরল। ধরে ফিসফিস করে বলল, “তারা, সেই বেড়াল।
তারাপদ তাকায়। ভেলভেটের পরদার একপাশে, ছোট্ট একটা গোল টেবিলের ওপর সেই কালো বেড়াল, মৃণাল দত্তের বাড়িতে যেমন দেখেছিল তারা। অন্ধকারে তার গা দেখা যাচ্ছে না, চোখের মণিদুটো শুধু জ্বল। করছে। নিশ্চয় কালো বেড়াল। মৃণাল দত্তের বাড়ির বেড়ালের মতনই মরা, সাজানো বেড়াল। নয়ত একই জায়গায় বসে থাকবে কেন?
চন্দনের হাত ঘামছিল। সে বেড়ালের দিকে তাকিয়ে থাকল। নিশ্চয় ঘুরবে, মুখ ফেরাবে।
এমন সময় ভেলভেটের পরদার পরদার দিকে আর-একটা চোরা আলো জ্বলে উঠল। লাল আলো। মৃদু তার আভা।
আর তারাপদরা দেখল এক ভৌতিক আকৃতি ডানদিকের পরদা সরিয়ে এসে দু মুহূর্ত দাঁড়াল। তারপর সেই সিংহাসনের মতন চেয়ারে বসল ধীরে ধীরে।
ভয় দুজনেরই গলায় এসে জমা হয়েছে। জিব শুকনো। বুক যেন আর সইতে পারছে না এত জোরে ধকধক করছে হৃদপিণ্ড । শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল। অসাড় লাগছে। কাঁপছে হাত-পা ।
মানুষটি যে কী পরেছে বোঝা যাচ্ছিল না। হয়ত আলখাল্লা। রক্ত-গৈরিক রঙের। তার মাথা থেকে গলা পর্যন্ত একটা ঢাকা পরানো, শুধু নাক মুখ আর চোখের জায়গাটা ভোলা। তারাপদরা প্রচুর ইংরেজি ছবি দেখেছে। তাদের মনে হল, এককালে এই রকম মুখোশ পরে রাজারাজড়ারা গোপন জায়গায়। যেত, এইরকম মুখোশ পরেই কেউ কেউ অনাচার অত্যাচার করতে বেরিয়ে পড়ত; দুশমন দমন করতেও যেত।
এই কি ভুজঙ্গভূষণ?
হঠাৎ সেই মানুষটি গম্ভীর চাপা গলায় বলল, “তারাপদ, আমি তোমার পিসেমশাই ভুজঙ্গভূষণ।”
উঠে গিয়ে প্রণাম করার কথা তারাপদ ভুলে গেল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “আমার মুখ পুড়ে গিয়েছে। ব্যান্ডেজ বাঁধা। তোমাদের দেখতে ভাল লাগবে না। তাই এটা পরেছি। তুমি আমার মুখ দেখতে পাচ্ছ না বলে আমারই কষ্ট হচ্ছে। আমার শরীর ভাল নয়। তোমায় শুধু দেখতে এসেছি। তুমি এসেছ, আমি খুশি হয়েছি।”
তারাপদ সাহস করে বলল, “মৃণালবাবু আমার হাত দিয়ে কিছু কাগজপত্র আর চিঠি দিয়েছিলেন আপনাকে দেবার জন্যে। আপনি পেয়েছেন?”
“পেয়েছি। ..ওই ছেলেটি তোমার বন্ধু, ডাক্তার?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। মৃণালবাবুর মুখে শুনলাম, আপনার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে–তাই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এলাম। কী হয়েছিল আপনার?”
“কী হয়েছিল তুমি ঠিক বুঝবে না। অগ্নিচক্রের মধ্যে মুখ ছিল, মনটা হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যায়। একাগ্রতা নষ্ট হয়ে গেলে পাপ হয় সেই পাপের ফল।”
“অগ্নিচক্র কী?”
“তোমরা বুঝবে না। না দেখলে বুঝতে পারবে না। এই যে ঘরে তোমরা বসে আছ, এই ঘরে পরলোক থেকে আত্মারা আসেন। আমি তাঁদের ডেকে আনি। তাঁরা আসেন, দেখা দিয়ে যান, কত লোক তাদের হারানো প্রিয়জনকে এখানে একটু দেখতে আসে। আত্মা অদৃশ্য। তাকে দেখা যায় না। তবে সদয় হলে তাঁরা আমাদের নানা প্রশ্নের জবাব দিয়ে যান। অনেক সময় স্পর্শও করে যান। চিহ্নও রেখে যান কোনো কোনো সময়ে।…ওই দেখো, একজন এসেছেন…এই মুহূর্তে এসে গেছেন।” বলতে বলতে যেন ভুজঙ্গভূষণ কেমন হয়ে গেলেন, মাটি থেকে একটা বড় পুজোর ঘণ্টা উঠিয়ে নিয়ে বাজালেন সামান্য। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ঘর ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।
সেই নিকষ কালো অন্ধকারে মাথার ওপর ক্ষীণ একটু আলো জ্বলে উঠল । আর কোথা থেকে একটা লাল বল, সোনালি ডোরা দেওয়া, ঘরের মাঝখানে এসে হাজির হল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “আপনি কে আমি জানি না। যদি আমার পরিচিত হন আপনার আসার প্রমাণ দিন।”
বলার পর বলটা কাঁপতে লাগল, নড়তে লাগল, তারপর ধীরে ধীরে শূন্যে উঠতে লাগল, ভাসতে ভাসতে ওপরে ছাদের দিকে উঠে গেল, ওপরের আলোয় সেই লাল আর সোনালি রঙের বলটা ঝকঝক করে উঠল। বলটা আবার সামান্য নেমে এল। নেমে এসে লাফাতে লাফাতে ঘরের ডান দিক থেকে বাঁ দিক পর্যন্ত চলে গেল। আবার বাঁ দিক থেকে ডান দিকে আসতে লাগল।
তারাপদ ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবার মতন।
চন্দন দু চোখ বন্ধ করে ফেলল।
.
সাত
পরের দিন সকালেও তারাপদ নিজেকে সামলে নিতে পারল না। চোখমুখ বসে গিয়েছে, শুকনো চেহারা। পর পর দু’ রাত্রিই ঘুম হল না বেচারির; আগের দিন কেটেছে ট্রেনে; আর কাল সারা রাত বিছানায় শুয়ে ভয়ে আতঙ্কে মরেছে । চন্দন ডাক্তার-মানুষ, তার অনেক সাহস, মড়া কাটা থেকে শুরু করে সে কত কী করেছে, সহজে ঘাবড়ে যাবার ছেলে চন্দন নয়; তবু চন্দনও কেমন বোকা হয়ে গেছে। ভয়ও পেয়েছে খানিকটা। দুজনে আলোচনা করেও বুঝতে পারছে না–এরকম ঘটনা কেমন করে ঘটে? ছোট ফুটবল সাইজের, একটা বল কেমন করে হাওয়ার মধ্যে নেচে বেড়ায়? ভৌতিক ব্যাপার? না ম্যাজিক?
যদি বিশ্বাস করে নেওয়া যায় ম্যাজিক, তবে ভয়-ভাবনার কিছু থাকে না। কিন্তু ম্যাজিক বলে ঠিক বিশ্বাস করতেও মন চাইছে না।
সকাল বেলায় মুখটুক ধুয়ে কোনো রকমে চা খেয়ে দুজনে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াল। বাগানে।
তারাপদ বলল, “চাঁদু, কিকিরার কাছে যেতেই হবে।”
চন্দন বলল, “আমিও তাই ভাবছি। কখন যাবি।”
‘বিকেলে যাওয়া যাবে না। ভুজঙ্গ আবার আজ বিকেলের পর আমাদের সঙ্গে দেখা করবে বলেছে। যেতে হলে এখনই যাওয়া দরকার।”
চন্দন বলল, “চল, আমরা ঘুরে আসি।”
“কাউকে কিছু বলতে হবে না?”
“কী দরকার । নতুন জায়গা, কেমন সুন্দর দেখতে, আমরা একটু বেড়িয়ে বেড়াচ্ছি–এইভাবে যেতে হবে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলব, বেড়াচ্ছি। তারপরও যদি খোঁচায়, বলব–স্টেশনে যাচ্ছি ব্লেড কিনতে কিংবা সিগারেট কিনতে। “
তারাপদ বলল, “ঠিক আছে, চল।”
বাগানের মধ্যে সামান্য সময় দুজনে বেড়ানোর ভাব করে ঘুরে বেড়াল। বাড়ির চার পাশ না হলেও অন্তত তিনটে পাশ দেখে নিল । ভুজঙ্গভূষণের এই পুরী যতই দুর্গ হোক, কেউ যদি পালাতে চায় নিশ্চয় পালাতে পারে । সব দিক সর্বক্ষণ আটকে রাখা সম্ভব নয়। মানুষ জেলখানা থেকেও পালায়–এখান থেকে পালানো নিশ্চয়ই তার চেয়ে কঠিন নয়।
বাগানে বেড়াতে বেড়াতেই মৃত্যুঞ্জয়কে দেখা গেল।
চন্দন বলল, “তারা, তোকে এবার একটু খেলতে হবে।”
তারাপদ অবাক চোখে বন্ধুর দিকে তাকাল।
চন্দন বলল,”তুই ওই মৃত্যুঞ্জয়টাকে ডাক। ডেকে বল, ছোট ফটকের তালা খুলে দিতে। বলবি, আমরা বেড়াতে যাব। শোন, মিনমিন করে কথা বলবি না ওর সঙ্গে, হুকুমের গলায় বলবি।”
“এখানকার ছোট মহারাজাকে হুকুম? তুই বলছিস কী?” তারাপদ ঘাবড়ে গিয়ে বলল।
চন্দন বলল, “আমি ঠিকই বলছি। তুই ভুজঙ্গভূষণের সম্পত্তির মালিক হতে যাচ্ছিস। ও বেটার কোনো রাইট নেই এখানে; তোর আছে। তুই এখন থেকেই এটা দেখিয়ে যা।”
“তারপর যদি–”
“যদি-টদি বাদ দে; নো রিস্ক নো গেই।…তুই চালা না–তারপর আমি আছি।” বলে চন্দন মাতব্বরের মতন মৃত্যুঞ্জয়কে ডাকল।
মৃত্যুঞ্জয় কাছে এলে তারাপদ ছোট ফটকের তালা খুলে দিতে বলল। ঠিক হুকুমের গলায় অবশ্য বলতে পারল না।
“খুবই আশ্চর্য যে, মৃত্যুঞ্জয় সাধারণভাবে জিজ্ঞেস করল, তারাপদরা কোথায় যাবে? তারপর চাকরকে ডেকে তালা খুলে দিতে বলল।
ফটকের বাইরে এসে তারাপদরা হাঁটতে লাগল। মাঠ ময়দান, গাছপালা, দূরের জঙ্গল–যেদিকে চোখ যায়–সব যেন রোদে ভেসে যাচ্ছে। শীতের রোদ, তবু কী গাঢ়, কত উষ্ণ। আকাশ নীল, রোদ যেন উপচে পড়ছে আকাশ থেকে; মাঠঘাটের ভেজা ভাব শুকিয়ে এসেছ, শিশির আর চোখে পড়ছে না। এখনো শীতের সেই শনশন হাওয়া দেয়নি, অল্পস্বল্প যা আছে তাতে ভালই লাগে।
কাল রাত্রের সেই অন্ধকার রহস্যময় ঘর, সেই আত্মার ব্যাপার-স্যাপার, বলের নাচ যেন অন্য একটা জগৎ। আর এখানকার এই রোদ, মাঠ, কুলঝোঁপ, আতাগাছের ডালে বসে পাখির ডাক–এ আর-এক জগৎ। এই জগৎ তারাপদরা বুঝতে পারে, অনুভব করতে পারে, কিন্তু কালকের ওই রহস্যময় ঘটনার কিছুই বুঝতে পারে না। মনে হয় যেন দুঃস্বপ্ন।
হেঁটে আসতে আসতে দুজনেই গল্প করছিল।
তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “চাঁদু, তুই তো ডাক্তার । আত্মা-টাত্মা কখনো দেখেছিস?”
“না ভাই, আমি মর্গও দেখেছি, বাট নো আত্মা।”
“আমি প্ল্যানচেট দেখেছি,” তারাপদ বলল, “পরলোক-টরলোক নিয়ে একবার একটা বইও পড়েছিলাম। কিছু বুঝিনি।”
“এ-সব গাঁজাখুরি…।”
“কিন্তু কাল আমরা নিজের চোখে যা দেখলাম–?”
“তাই তো ভাবছি। পি সি সরকারের ম্যাজিক যেন!”
এমন সময় একটা দেহাতী গোছের লোককে সাইকেলে করে আসতে দেখা গেল দূরে। ভুজঙ্গভবনের দিক থেকে আসছে। চন্দনের চোখে পড়েছিল।
চন্দন বলল, “তারা, ওই লোকটা এদিকে কেন আসছে?”
তারাপদ দেখল। বলল, “আমরা কোথায় যাচ্ছি দেখতে আসছে বোধ হয়।”
“তার মানে ভুজঙ্গ আমাদের ওপর চোখ রাখতে চায়? না, মৃত্যুঞ্জয়?”
“বুঝতে পারছি না।”
দুজনেই হাঁটতে লাগল, দাঁড়াল না। চন্দন হঠাৎ বেয়াড়া গলায় গান গাইতে শুরু করল, যেন খুব খুশ মেজাজে রয়েছে।
লোকটা কাছাকাছি এল। পুরোনো সাইকেল, মাঝ বয়েসী লোক; বাঙালি বলে মনে হয় না। তারাপদদের কাছাকাছি এসেও দাঁড়াল না। একবার শুধু দেখল, খাতিরের ভঙ্গিতে মাথা নোয়ালো, তারপর চলে গেল।
সাইকেল খানিকটা এগিয়ে যেতে চন্দন বলল, “তারা, আমার মনে হচ্ছে লোকটা নজর রাখার জন্যে এসেছে। কিন্তু কেন? ভুজঙ্গ না মৃত্যুঞ্জয়, কার হুকুমে ও নজর রাখছে? আমরা পালিয়ে যাব ভাবছে নাকি?”
তারাপদ বলল, “চাঁদু, সম্পত্তির নিকুচি করেছে, চল, আমরা এই ভূতের বাড়ি থেকে পালাই।”
মাথা নেড়ে চন্দন বলল, “এত সহজে পালাব কেন রে? আরও দু-একটা দিন দেখি । অন্তত তোর পিসেমশাইয়ের অরিজিন্যাল মুখটা একটু দেখি। পালাবার জন্যে তুই ভাবিস না। ওটা আমার হাতে ছেড়ে দে। সে ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি। পালাবার জায়গা দেখে রেখেছি ভাই।
আরও একটু এগিয়ে আসতেই আচমকা পাখির ডাকের মতন শোনা গেল । ডাকটার একটা আলাদা সুর ছিল, কানে লাগে। চন্দন দাঁড়িয়ে পড়ল, তার দেখাদেখি তারাপদও দু-চার পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। চন্দন আশেপাশে তাকাল । ডানদিকে খানিকটা উঁচু জমি, মস্ত মস্ত দুই পাথর, আশেপাশে ছোট ছোট পাথর-টুকরো পড়ে আছে। রুক্ষ জায়গা, কাঁকরভরা মাটি। কোনো গাছপালা চোখে পড়ছে না। কাঁটা গাছের ছোট্ট একটু ঝোঁপ পাথরের পাশে। কোথাও কোনো পাখির চিহ্ন নেই।
চন্দন কিছু বোঝবার আগেই একটা ছোট ঢিল এসে পায়ের কাছে পড়ল । তারপরেই পাথরের আড়াল থেকে কিকিরার মুখ উঁকি মারল।
“আরে, আপনি?” চন্দন অবাক । তারাপদকে বলল, “কিকিরা।”
হাতছানি দিয়ে কিকিরা ডাকলেন।
তারাপদরা এগিয়ে গেল ।
কিকিরা বললেন, “এখানে আসুন স্যার, গুঁড়ি মেরে চলে আসুন।”
তারাপদরা পাথরের আড়ালে গেল। কিকিরা বললেন, “একটু আগেই এক চেলা গেল, দেখেছি। দেখেই শেলটার নিয়েছি।”
“আমরা আপনার কাছেই যাচ্ছিলুম।”
“আমিও আপনাদের খোঁজে আসছিলাম। মনে হচ্ছিল, দেখা হয়ে যেতেও পারে।”
“ওই লোকটাকে আপনি চেনেন?”
“না। তবে আন্দাজ করতে পারি।”
“ও কি আমাদের ওপর নজর রাখছে?”
“মনে তো হয়, স্যার। তবে ও বেটা অনেকটা চলে গেছে। দেখতে পাবে আর। যদি দেখি ফিরে আসছে, আপনাদের বলব। আপনারা সোজা ভুজঙ্গ ভয়ালের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করবেন।”
চন্দনরাও একবার দেখে নিল। লোকটা বেশ দূরে চলে গেছে। সেখান থেকে পাথরের আড়ালে তাদের দেখতে পাবে না। না গেলে কী ভাববে বলা মুশকিল। মাঠের মধ্যে দুটো লোক নিশ্চয় ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারে না। কিন্তু অন্য সন্দেহই বা কী করবে? ভাববে, এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কিকিরা বলল, “খবর বলুন, স্যার।”
তারাপদ বলল, “খবর অনেক। কিন্তু এখানে বলব?”
“এখানেই স্যার নিরাপদ। যদি লোকটা এখনি না ফিরে আসে,তা হলে এই হল বেস্ট জায়গা।”
“যদি আসে?”
“সামনে গিয়ে মনের সুখে নিজেরা গল্প করবেন, লাফাবেন, নাচানাচি করবেন, যেন ওর মনে হয় আপনারা কলকাতার লোক, ছেলেমানুষ, বাইরে বেড়াতে এসে বেজায় খুশি হয়েছেন। “
“আপনাকে যদি দেখতে পায়?”
“পাবে না স্যার, পাবে না। আমি মিলিটারির পজিসন নিয়েছি।”
চন্দন একটা সিগারেট ধরাল।
কিকিরা বললেন, “দিন স্যার, একটা ধোঁয়া দিন। টানি।”
কিকিরা সিগারেট নিয়ে ধরালেন।
তারাপদ খুব সংক্ষেপে গতকালের ঘটনা বলল। বলে ভুজঙ্গভূষণের সঙ্গে সাক্ষাতের বিবরণটা দিল। তার গলার স্বর থেকে বোঝা যাচ্ছিল, তারাপদ উত্তেজনা, ভয়, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বিধার মধ্যে রয়েছে।
কিকিরা মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন। আজ তাঁর বেশবাস খানিকটা অন্যরকম। পরনে পাজামা, গায়ে কেমন এক আলখাল্লা ধরনের জামা। মাথায় গরম হনুমান-টুপি। টুপির তলার দিকটা গুটোনো। পায়ে খাকি কেডস্ জুতো।
চন্দন বলল, “মশাই, ভুজঙ্গ আত্মা নামায়; আপনি জানেন?”
কিকিরা ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন। “জানি।”
“ব্যাপারটা কী?”
“ব্যাপারটা আপনারা এমনিতে বুঝবেন না। একে বিদেশিরা পেঁয়াস। বলে।”
“সেঁয়াস? সেটা আবার কী?”
“সেটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার, আত্মাটাত্মা নামানো হয়, আত্মাদের দিয়ে নানারকম ভেলকি দেখানো হয়।”
“আপনি আত্মা মানেন?”
“আমার মানামানির কথা জিজ্ঞেস করবেন না। আত্মা মানি কিনা আমি জানি না। তবে ভুজঙ্গর আত্মাটাত্মা মানি না।”
তারাপদ বলল, “তা হলে ও কেমন করে ওই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটাল?
কিকিরা চুপ করে থেকে কিছু ভাবলেন, তারপর বললেন, “কেমন করে ঘটল তা আমি বলতে পারব না। নিজের চোখে দেখলে বলার চেষ্টা করতাম। কিন্তু স্যার, আমি বলছি, এ হল ভেলকি। বড় রকমের ম্যাজিক। বিশ্বাস করবেন না। ভুজঙ্গ এই ভেলকি দেখিয়েই তার প্রতিপত্তি করেছে, বহু লোকের সর্বনাশও করেছে সেই সঙ্গে। কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত পাগলের মতন হয়ে গেছে, কারও কারও যথাসর্বস্ব গিয়েছে। আপনারা ওই পিশাচের ধোঁকায় ভুলবেন না।”
চন্দন বলল, “আপনি আমাদের কী করতে বলছেন তা হলে?”
“আমি বলছি, আপনারা রয়ে সয়ে থাকুন। ভয় পাবেন না। চোখ খুলে ভুজঙ্গর বাড়ির সবকিছু লক্ষ করার চেষ্টা করুন। আপনাদের ও প্রাণে মারার সাহস করবে না।…শুনুন স্যার, এই মানুষটা–কিকিরা দি গ্রেট–একেবারে অপদার্থ নয়, যশিডিতে আমার অনেক মক্কেল আছে,তার মধ্যে একজন রয়েছে পুলিসের লোক–তেওয়ারিসাহেব। আমি তাঁকে বলে এসেছি। ভুজঙ্গ যদি বেশি চালাকি করার চেষ্টা করে, এবার আমি ওকে ছাড়ব না।”
তারাপদ কিকিরার মুখ দেখতে লাগল। মানুষটির চোখ দেখলে বোঝা যায়–কিসের যেন এক জ্বালা তার চোখে ঝকঝক করে উঠেছে।
মাথার টুপিটা খুলে নিলেন কিকিরা, রোদে মাথা তেতে উঠেছে। বললেন, “ভুজঙ্গ এখনো তার আসল চাল চালেনি, স্যার। কাল সে আপনাদের ভেলকি দেখিয়ে ঘাবড়ে দেবার চেষ্টা করেছে। ধরুন আজ কিংবা আগামী কাল সে আসল চাল চালবে।”
“কী চাল?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল ।
কিকিরা বললেন, “আমার মনে হচ্ছে–চালটা আপনাকে নিয়ে। ভুজঙ্গ হয়ত আপনাকেই সব দিয়ে যেতে চায়, কিন্তু দিয়ে যাবার আগে সে আপনার সঙ্গে শর্ত করতে চাইবে। কিসের শর্ত আমি বুঝতে পারছি না! ভুজঙ্গ এত শঠ আর শয়তান যে তার চাল আগে থেকে বোঝা যায় না। তাই বলছি–আপনারা ধৈর্য ধরে থাকুন। দেখুন। ভয় পাবেন না। আমি এখানেই থাকব। আপনাদের খোঁজখবর করব। যদি কোনো বিপদে পড়েন ভুজঙ্গর আস্তাবলে রামবিলাস বলে যে কোচোয়ান আছে তাকে বলবেন। রামবিলাস আমার লোক। বুঝলেন? আমি কোথায় থাকব সে জানে?”
তারাপদরা অবাক হয়ে কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল। চন্দন বলল, “ভুজঙ্গের বাড়িতে আপনার লোক কে কে আছে?”
কিকিরা যেন কতই লজ্জা পেয়েছেন, এমনভাবে হাসলেন। বললেন, “স্যার, আমার ধাতটাই হল ম্যাজিশিয়ানের, সব খেলাই ধীরেসুস্থে দেখাতে হয়, ঝট করে দেখাতে নেই। যথাসময়ে সবইদেখতে পাবেন।”
তারাপদ বলল, “কিকিরাবাবু, আপনি সাধুমামাকে চেনেন?
কিকিরা কেমন একটু হেসে বললেন, “চিনি।”
“কেমন চেনেন?”
“ভাল করেই চিনি। দয়া করে আমায় এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আপনারাও আর দেরি করবেন না। এবার ফিরতে শুরু করুন। ওই লোকটার ফেরার সময় হয়ে গেছে।…শুনুন, আর-একটা কথা বলে দিই। বাড়িতে এমনভাবে থাকবেন যেন ভুজঙ্গর ভেলকি দেখে আপনারা একেবারে ঘাবড়ে গিয়েছেন। কাউকে বুঝতে দেবেন না, আপনারা ব্যাপারটা সন্দেহ করেছেন।…আর হ্যাঁ, কাল আমি আপনাদের জন্যে একটা জিনিস নিয়ে আসব। আজকের রাত্রের খেলাটা আগে দেখে নিন, দেখুন ভুজঙ্গ কী করে।”
তারাপদরা উঠতে লাগল। “কাল কোথায় দেখা হবে?”
“কাল আপনারা ওই জঙ্গলের দিকে বেড়াতে যাবেন। আমি থাকব । একটা ভাঙা সাঁকো আছে, নালার মতো নদী, শুকনো; ওখানে থাকব।”
উঠে দাঁড়িয়ে চন্দন হেসে বলল, “স্যার, আজ আপনার একটা ইংলিশ শুনলাম না।”
কিকিরা হেসে বললেন, “শুনবেন, ঠিক সময়ে শুনবেন। এখন ভুজঙ্গ আমার ইংলিশ স্টিম করে দিচ্ছে। পেটে কিছু থাকছে না, স্যার। পেটে না থাকলে কি করে ইংলিশ হবে? ইংলিশ হল পেট্যারন্যাল ব্যাপার, পেট প্লাস ইন্টারন্যাল সন্ধি করুন…”
চন্দন হো হো করে হেসে উঠল।
পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে দুজনেই রাস্তায় নেমে এল। হাত নাড়ল। কিকিরাও হাত তুললেন।
ফিরতে লাগল দুজনেই।
তারাপদ বলল, “চাঁদু, আমার মনে হচ্ছে–ভুজঙ্গর বেশ কিছু শত্রু আছে। তারা একটা দল করেছে। সেই দলে সাধুমামা, কিকিরা, রামবিলাস না কি নাম বললেন কিকিরা–ওরা আছে। আর ভুজঙ্গর দলে আছে তার চেলারা।”
চন্দন বলল, “তাই মনে হয়।”
আরও খানিকটা এগিয়ে চন্দন ঘাড় ঘোরাল পিছনে। সাইকেলে-চড়া লোকটিকে দেখতে পেল না; কিকিরাকেও চোখে পড়ল না।
দুপুরটা ভালই কাটল। ভুজঙ্গভূষণের লোকজন আতিথ্যের ব্যাপারে কোনো কৃপণতা করল না। খাওয়া, শোওয়া, বাগানে ঘুরে বেড়ানো–কোনো দিকেই কারও কোনো বাধা নেই। কিন্তু তারাপদদের কেমন মনে হচ্ছিল, তারা যেন কাদের নজরে নজরে রয়েছে। সাধুমামার সঙ্গে বার দুই চোখাচুখি হয়েছে, হওয়া মাত্র সাধুমামা সরে গেছেন।
বিকেল পড়তে না পড়তে ফুরিয়ে গেল। তারপর সন্ধে। ৪ ।
তারাপদর তৈরি । আজ আবার সেই রহস্যময় ঘরেগিয়ে বসতে হবে। ভুজঙ্গ গতকালই জানিয়ে দিয়েছিলেন। আজ আবার কী দেখতে হবে কে জানে?
তারাপদ বরাবরই ভিতু ধরনের। বড় বেশি নিরীহ। কিকিরা যতই সাহস দিন, ভূত, প্রেত, আত্মা বিশ্বাস করুক আর না করুক তারাপদ, তবু বিকেল থেকেই বেশ বিচলিত বোধ করতে লাগল। সন্ধের মুখে তার মুখ কেমন শুকিয়ে এল। তারাপদ চন্দনকে বলল, “চাঁদু, আমার এ-সব ভাল লাগে না। মিস্ট্রিই বল আর অলৌকিক ব্যাপারই বল–কোনোটাই আমি সহ্য করতে পারি না। “ চন্দন বলল, “উপায় নেই ভাই, ভুজঙ্গর সব রকম খেলা দেখতেই হবে। লোকটার মনে কী আছে এখনো বোঝা যায়নি।”
তারাপদ বলল, “আজ আমি স্পষ্টই বলব, ভুজঙ্গকে বলে দেব–আত্মাটাত্মা। আমি দেখতে চাই না। আপনার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে চাই। আপনার মুখ দেখতে চাই। হয় সাফসুফ কথা বলুন মশাই, না হয় ছেড়ে দিন, বাড়ি চলে যাই–আপনার সম্পত্তি আমি চাই না।”
দুই বন্ধুর কথাবার্তার মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় এসে তাদের ডাকল। “এসো।”
.
সেই একই ঘর । কালকের মতনই অন্ধকার । বাতি যেটুকু জ্বলছে তাতে পাশের মানুষকেও আবছা দেখায়। ধূপধুনো গুগগুলের সেই রকম গন্ধ । তফাতের মধ্যে আজ একটা ছোট টেবিল রয়েছে গোল ধরনের, তার তিন দিকে চেয়ার।
তারাপদরা বসল।
ওরা বসার পর আচমকা কোথা থেকে ভারী গলায় স্তোত্র পাঠের মতন গানের সুর ভেসে এল । তারপর সেটা স্পষ্ট হল, যাকে বলে। জলদগম্ভীর–সেই স্বরে কে যেন স্তোত্র পাঠ করতে লাগল। সংস্কৃত স্তোত্র । কে কোথায় গান করছে বোঝবার আগেই সেই গম্ভীর স্বর যেন কেমন অন্যমনস্ক করে ফেলল তারাপদকে ।
স্তোত্রের মধ্যেই ভুজঙ্গভূষণ এলেন। কখন এলেন বোঝা গেল না। তাঁর বসার আসনেই বসলেন। মাথার ওপর সেই লাল আলো জ্বলে উঠল। ভুজঙ্গভূষণের পরনে রক্ত-গৈরিক বসন। একটা বড় রুদ্রাক্ষ ঝুলছে গলায় । মুখের ওপর সেই আবরণ।
স্তোত্র পাঠ বন্ধ হয়ে গেল।
ভুজঙ্গভূষণই কথা বললেন প্রথমে। বললেন, “তারাপদ, কাল তুমি ভয়, পেয়ে গিয়েছিলে। তোমার বন্ধুও ভয় পেয়েছিল। আজ ভয় পেয়ো না যাঁরা তোমার আত্মীয়–মা, বাবা, বোন–”
“মা, বাবা, বোন-” তারাপদ চমকে উঠে বলল, গলার স্বর যেন বুজে আসছে।
“হ্যাঁ, তোমারই নিজের লোক। এঁদের আত্মা যখন আসেন তখন তোমার ভয় কী? এঁরা কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করবেন না। অনেক দূর থেকে তারা আসেন, আসতে তাঁদের কষ্টও হয়। এই মর্ত্যলোকে তাঁরা আসতে চান না, তবুও আমরা যখন ডাকি, না এসে পারেন না। আজ আমি তোমার মাকে প্রথমে তাকব।”
“মা?”
“তোমার মা আমার আত্মীয়া। আমরা তাকে ছেলেবেলায় বেণু বলে ডাকতাম। বলতে গেলে আমার বোনেরই মতো। আমি বেণুকে ডাকব।”
তারাপদর গায়ে কাঁটা দিল। মা! মা আসবে? কোন্ ছেলেবেলায় বাবাকে সে হারিয়েছে, স্কুলে পড়ার সময়, তারপর মা-ই ছিল তার সব । কত কষ্ট করে তাকে মানুষ করেছে, সেই মা আজ আসবে? তার কাছে? মা তা হলে আজও আছে, এ-জগতে নয়, অন্য জগতে, হয়ত স্বর্গে। মা কি তাকে দেখতে পায়?
তারাপদর বুকের মধ্যে কত দুঃখ যেন টনটন করে উঠল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমার মা আসবে। এই ঘরেই আসবে। কিন্তু তুমি তাকে দেখতে পাবে না। আত্মা অদৃশ্য। ছায়ারূপে তাঁরা আসেন, চলে যান। মানুষের চোখ তাঁদের দেখতে পায় না। কোনো কোনো চিহ্ন তাঁরা রেখে যান, স্পর্শও দিয়ে যান–কিন্তু সব সময় নয়, কখনো কখনো, এসব কাজ করতে তাঁদের কষ্ট হয়।”
কথা শেষ করে ভুজঙ্গভূষণ পায়ের কাছে পড়ে থাকা ঘণ্টা তুলে নিয়ে বাজালেন।
ঘণ্টা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ভুজঙ্গভূষণের পিঠের দিক থেকে ভেলভেটের পরদা সরিয়ে একটি মেয়ে এল। ভাল করে দেখা যায় না মেয়েটিকে। তবু যেটুকু দেখা গেল তাতে মনে হল, কিশোরী মেয়ে, বছর পনেরো হয়ত হবে বয়স, রোগা দেখতে, ধবধবে ফরসা রঙ, লম্বাটে মুখ, মাথার চুল এলো করা, পুনে ঘন কালো শাড়ি জামা। মেয়েটি এল। কিন্তু কিছুই দেখল না । কোনো দিকেই তাকাচ্ছিল না। ভুজঙ্গভূষণের পায়ের দিকে রাখা ঘণ্টাটা তুলে লি। নিয়ে তারাপদদের কাছে এসে বসল। ঘণ্টাটা নিচে টেবিলের তলায় নামিয়ে রাখল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তারাপদ, এই মেয়েটির মধ্যে দিয়ে তোমার মা হনবেন। ও হল আধার, ওর মধ্যে দিয়ে তোমার মাকে আসতে হবে। তোমরা দুজনে ওর হাতে হাত ছুঁয়ে বসো। পায়ে পা ছুঁইয়ে রাখবে। ও তোমাদের দেখিয়ে দেবে।”
তারাপদ কিছু ভাবতে পারছিল না। বিহ্বল বোধ করছিল।
চন্দনের মনে হল, এই হয়ত সেই মেয়ে–গতকাল যাকে সে এক লহমার জন্যে দোতলায় দেখেছিল।
ছোট গোল টেবিলের তিন দিকে চেয়ার। মেয়েটি একটি চেয়ারে বসল। ইশারায় তারাপদদের চেয়ার সামান্য সরিয়ে নিতে বলল। চেয়ার সাজিয়ে নেবার পর দেখা গেল, টেবিলের ওপর হাত ছড়ালে তারাপদর একটা হাত মেয়েটির হাত ছোঁয়, অন্য হাত চন্দনের হাত ছোঁয়। চন্দনেরও সেই একই অবস্থা, তার বাঁ হাত তারাপদর হাত ছুঁয়ে রয়েছে, ডান হাত মেয়েটির হাত ছুঁয়েছে। এ যেন বাচ্চা বয়েসে সেই গোল হয়ে হাতে হাত ধরে খেলার মতন।
মেয়েটি তার পা দু পাশে বাড়িয়ে দিল। ইশারায় তারাপদদের বলল, ওদের এক একটা পা দিয়ে তার পা ছুঁয়ে থাকতে।
সামান্য বিব্রত বোধ করলেও তারাপদরা পা বাড়াল ।
মেয়েটির পা বড় শক্ত শক্ত লাগল তারাপদর। অবশ্য বুড়ো আঙুলের কাছটায় আলগা করে ছুঁয়ে থাকল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তুমি এবার মনে মনে তোমার মাকে ডাকো, তারাপদ। চোখ বন্ধ করে। একমনে। আমিও তাকে ডাকছি।” বলে ভুজঙ্গভূষণ তাঁর গম্ভীর গলায় কিসের যেন একটা মন্ত্র পাঠ করতে লাগলেন।
ঘরের সমস্ত আলো নিবে গেল। ঘুটঘুট করছে অন্ধকার।
তারাপদ চোখ বন্ধ করে মার কথা ভাবতে লাগল। তার ভয় হচ্ছিল; তবু সে মা-র কথা না ভেবে থাকতে পারল না। চন্দন প্রথমটায় চোখের পাতা খুলে রেখেছিল। কিন্তু চোখ খুলে রাখা না রাখা সমান; দু চোখই যেন অন্ধ । কিছু দেখা যায় না; শুধু কালো আর কালো। চন্দনও চোখের পাতা বুজে ফেলল। তারাপদর মাকে সে দেখেছে, ভালো করেই জানত তাঁকে। চন্দনও তারাপদর মার কথা ভাবতে লাগল। আর মাঝে মাঝে অনুভব করছিল, তার একটা হাতের আঙুল মেয়েটির হাতের ওপর রাখা, অন্য হাতটি তারাপদর হাতের ওপর রয়েছে।
কতক্ষণ সময় যেন চলে গেল। কোনো শব্দ নেই। শেষে ভুজঙ্গভূষণ চাপা গলায় বললেন, “বেণু, তুমি এসেছ? তুমি কি এসেছ?”
কোনো সাড়াশব্দ নেই। আবার চুপচাপ। আরও কিছু সময় গেল।
ভুজঙ্গভূষণ এবার আবার বললেন, “বেণু, তুমি এসেছ? আমরা তোমায় ডাকছি, তুমি এসেছ?”
হঠাৎ টেবিলের তলার দিকে মৃদু করে ঘণ্টা বেজে উঠল ।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “বেণু, তুমি যদি সত্যি সত্যি নিজে এসে থাকো—ঘণ্টাটা একবার বাজাও, বাজিয়ে থামিয়ে দাও, আবার বাজাও।”
ঘণ্টা সেইভাবেই বাজল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমার ছেলেকে দেখতে পাচ্ছ? যদি পাও অন্যভাবে ঘণ্টা বাজাও। একটানা।”
এবারও সেই রকম বাজল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমার ছেলেকে আমি এখানে এনেছি। তুমি তাকে বলল আমার ইচ্ছা মতন সে যেন চলে। আমি তার ভাল চাই।”
ঘন্টাটা আস্তে আস্তে বাজল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমার সঙ্গে আর কেউ এসেছে বেণু? কে এসেছে?”
ঘণ্টা বাজল না।
ভুজঙ্গভূষণ কেমন আকুল স্বরে বললেন, “কে এসেছে বেণু? তোমার স্বামী?”
ঘণ্টা এবার জোরে বেজে উঠল। তারাপদ সমস্ত কিছু ভুলে চিৎকার করে উঠল, বাবা!”
বলার সঙ্গে সঙ্গে সে হাত টেনে নিয়েছিল। মেয়েটি কেমন শব্দ করে উঠল । যেন ঘুমের ঘোর থেকে চমকে উঠে শব্দ করেছে।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “কী হল? কী হল?”
বাতি জ্বলে উঠল। সেই মৃদু আলো। মেয়েটি টেবিলের ওপর মুখ রেখে। পড়ে আছে। হাত ছড়ানো। থরথর করে কাঁপছে।
ভুজঙ্গভূষণ তারাপদকে বললেন, “কী করেছিলে তোমরা? বেণু চলে গেছে।”
তারাপদ ভয়ে ভয়ে বলল, “কিছু করিনি । হাত ছেড়ে দিয়েছিলাম।”
কঠিন গলায় ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “মূর্খ!…সমস্ত বৃথা গেল।..যাও, তোমরা চলে যাও। ওকে ছুঁয়ো না। ধীরে ধীরে ও সুস্থ হয়ে উঠবে।”
তারাপদরা অপরাধীর মতন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
.
আট
সকালে তারাপদর চেহারা দেখে চন্দন বেশ ঘাবড়ে গেল। মুখ কেমন থমথম করছে তারাপদর, উদাস চোখ, বার বার নিশ্বাস ফেলছে শব্দ করে, কিসের এক দুঃখ যেন তার সমস্ত মুখ ম্লান করে রেখেছে। কথাবার্তা বলতেও তার তেমন ইচ্ছে করছি না। আপন মনে কত কী যে ভাবছে তারাপদ, কে জানে!
চন্দন বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলল, “তুই এত মুষড়ে পড়লে চলবে কেন? কী হয়েছে তোর?”
তারাপদ চুপচাপ, কথার জবাবই দেয় না, শেষে বলল, “কাল আমার মা এসেছিল। একবার যদি দেখতে পেতাম…।”
চন্দন বলল, “তুই সত্যিই বিশ্বাস করিস মাসিমা এসেছিলেন?”
“তুই করিস না?”
চন্দন বুঝতে পারছিল না, বিশ্বাস করা উচিত কি উচিত নয়। সে বিশ্বাস করতেও চাইছে না, আবার অবিশ্বাস করারও জোর পাচ্ছে না।
তারাপদ ধরা-ধরা গলায় বলল, “মার সঙ্গে বাবাও এসেছিল, চাঁদু। আমার বাবা। স্কুলে যখন ক্লাস এইটে পড়ি, সেই সময় বাবা মারা গেছে; এত বছর পরে বাবা এসেছিল…; ইস্ আমি যে কী করলাম!”
তারাপদর চোখ ছলছল করে উঠল; ঠোঁট কাঁপতে লাগল । চন্দন বুঝতে পারল না কী বলবে। তার খারাপ লাগছিল। মাবাবার জন্যে বন্ধুর এই দুঃখ সে বুঝতে পারে, কিন্তু কেমন করে সান্ত্বনা দেবে জানে না। মাথা চুলকে চন্দন বলল, “তারা, এমন তো হতে পারে এ সবই মিথ্যে।”
তারাপদর ভাল লাগল না কথাটা। বন্ধুর দিকে ক্ষোভের চোখে তাকাল। বলল, “মিথ্যে?”
“কিকিরা তো তাই বলেছেন।”
“কিকিরা যা বলবেন তাই সত্যি হবে? বেশ, তুই বল–এটা কেমন করে সম্ভব হল? আমি ওই মেয়েটার একটা হাত আর একটা পা ছুঁয়ে রেখেছিলাম। একবারও ছাড়িনি। তুইও ছুঁয়ে ছিলি। ঠিক কি না?”
“হ্যাঁ।”
“তা হলে ঘন্টাটা কেমন করে বাজল? কে বাজাল?”
চন্দন জবাব দিতে পারল না। সে এই ব্যাপারটা নিয়ে কাল রাত থেকেই। ভেবেছে, ভেবে কোনো কূল-কিনারা পায়নি। এক যদি এমন হয় যে, ওই ঘুটঘুঁটে অন্ধকার ঘরে কেউ লুকিয়ে এসে ঘণ্টাটা বাজিয়ে দিয়ে যায়! কিন্তু তা কেমন করে সম্ভব? লোকটা আসবে, বাজাবে, চলে যাবে–আর তারা দুজনে কিছুই বুঝতে পারবে না?
চন্দন বলল, “আমিও বুঝতে পারছি না। আচ্ছা তারা, ঘণ্টা যেটা বেজেছিল সেটা আমাদের টেবিলের তলায় ছিল সেটা ঠিক তো?”
“নিশ্চয়। কেন, তোর সন্দেহ হচ্ছে?”
“না, আমারও হচ্ছে না। তবু তোকে কাল যা বলছিলাম রাত্রে, কেউ যদি লুকিয়ে এসে বাজিয়ে দিয়ে যায়?”
“বাজে কথা বলিস না। অত অন্ধকারে এসে ঘণ্টা খুঁজে বাজিয়ে দিয়ে যাবে–আর আমাদের গায়ে পায়ে কোথাও তার ছোঁয়া লাগবে না–তা কি হয়? তুই একটা জিনিস ঠিক জানবি, যতই অন্ধকার থাকুক, তোর গায়ের পাশে কেউ যদি এসে দাঁড়ায় তুই নিশ্চয় বুঝতে পারবি। বাই ইনটিংক্ট।”
চন্দন অস্বীকার করতে পারল না।
তারাপদ বলল, “তারপর আমরা হাত ছেড়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় বাতি জ্বলে উঠেছিল। যদি কেউ এসে থাকে–অত তাড়াতাড়ি পালাবে কোথায়?”
স্বীকার করে নিল চন্দন। এমন সব রহস্যময় কাণ্ড পর পর দু’ দিন তারা দেখল যে, কোনো রকমেই তা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। তা হলে কি সত্যিই আত্মা আছে? মানুষ মারা যাবার পর এই জীবলোকে না-থাকলেও অন্য কোনো জায়গায় থাকে? মানে তাদের আত্মা থেকে যায়? হাজার হাজার বছর ধরে কত। মানুষ এই জগতে এসেছে, চলে গেছে। সবাই কি তা হলে অন্য কোনো জগতে–অন্য কোনো লোকে আছে? কোটি কোটি আত্মা সেখানে কেমন করে আছে?
বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল না চন্দনের। সে ডাক্তার । মানুষ একটা বিচিত্র যন্ত্রের মতন, কে জানে ভগবান কেমন করে এই যন্ত্র তৈরি করেছিলেন, কিন্তু এই যে যন্ত্র, এর কোনো তুলনা নেই, চাঁদে যাওয়ার চেয়েও এ অনেক রহস্যময়। সেই যন্ত্র যখন অচল হয়ে যায় কোনো কারণে, তখনই মৃত্যু। তারপর আর কিছু থাকতে পারে না।
থাকতে পারে না; কিন্তু এ-সব কেমন করে হচ্ছে? চন্দন অতশত আর ভাবতে পারল না। বলল, “নে ওঠ, কিকিরার সঙ্গে দেখা করার সময় হয়ে গেছে।”
তারাপদ এতই মুষড়ে পড়েছিল যে, কিকিরার কাছে যাবার জন্যে গা করল না। বলল, “আমার আর ভাল লাগছে না। তুই যা।”
চন্দন অবাক বন্ধুকে দেখতে লাগল। “তুই যাবি না মানে?”
“আমার ইচ্ছে করছে না।”
“কিন্তু কিকিরা এই ব্যাপারটা আমাদের বুঝিয়ে দিতে পারেন।”
“মুখে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেওয়া যায়, চাঁদু-” তারাপদ বলল, “মন তা মানতে চায় না।”
চন্দন বন্ধুর এই ভেঙে পড়া ভাব পছন্দ করল না। বলল, “তুই এখানে বসে থেকে কী করবি একলা একলা। তার চেয়ে কিকিরার কাছে চল । কিকিরাকে সব বলি। আমার তো মনে হয় কিকিরার পরামর্শ খুব দরকার এখন।”
তারাপদ বলল, “তুই যা। আমি একবার সাধুমামাকে ধরবার চেষ্টা করি । সাধুমামা আমার মা-বাবার কথা সবই জানে। দেখি, সাধুমামাকে দিয়ে যদি কোনো কথা বলাতে পারি ।”
চন্দন কী ভেবে তারাপদর কথায় রাজি হয়ে গেল। তারাপদ যদি সাধুমামাকে দিয়ে দু-চারটে কথা বলাতে পারে, ভালই হবে। চন্দন বলল, “ঠিক আছে তুই এই বাড়ির দিকটায় নজর রাখ, সাধুমামাকে যদি ধরতে পারিস ধর; আমি কিকিরার সঙ্গে দেখা করে আসি। এবাড়িতে সাইকেল আছে। একটা সাইকেল বাগিয়ে এক চক্কর ঘুরে আসতে আসতে পারলে ভাল হয়। চল, দেখি কী করা যায়।”
দুই বন্ধু বাগানের রোদে পায়চারি করতে করতে মৃত্যুঞ্জয়কে খুঁজতে লাগল।
চন্দন একটা সাইকেল জুটিয়ে চলে গেছে অনেকক্ষণ। তারাপদ সে বাগানেই ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে শেষ পর্যন্ত পেয়ারা গাছের ছায়ায় এসে বসে। ছিল। মৃত্যুঞ্জয় আজ তারাপদর সঙ্গ ছাড়তে চাইছিল না। গায়ে যেন লেপটে ছিল অনেকক্ষণ। বোধ হয় চন্দনকে একটা সাইকেল তাড়াতাড়ি জুটিয়ে দিয়ে সে তারাপদকে একলাই পেতে চাইছিল ।
তারাপদ নিরীহ, সরল মানুষ। হয়ত অনেক সময় বোকামি করে ফেলে। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় লোকটাকে দেখা পর্যন্ত তার মন যেরকম বিগড়ে আছে, তাতে লোকটার সঙ্গে মেলামেশা করতে চাইছিল না। তা ছাড়া মানুষ যাকে সন্দেহ করে, তার কাছে মনখোলা হয় না, হতে পারে না। তারাপদ একেবারে বোক নয়, সে মৃত্যুঞ্জয়ের উদ্দেশ্য জানে না যদিও, তবু খুব সাবধানে কথাবার্তা বলতে লাগল। কথাবার্তা বলতে বলতে বুঝল, লোকটা যতই ধূর্ত শয়তান হোক, তার মনের ইচ্ছেটা একেবারে গোপন রাখতে শেখেনি। মৃত্যুঞ্জয় চায় না, তারাপদ এবাড়িতে বেশিদিন থাকে। হ্যাঁ, কথাবার্তা থেকে সেই রকমই আঁচ করল তারাপদ।
বেলা আরও বেড়ে উঠল। শীতের রোদ মাথা-গা তাতিয়ে যখন কপালে ঘাম ফোঁটাতে লাগল, তারাপদ তখন পেয়ারাতলায় একা-একা বসে একটা সিগারেট শেষ করল। এদিক ওদিক তাকিয়েও সে সাধুমামাকে কোথাও দেখতে পেল না। বাগান ফাঁকা। একটা দেহাতী মালী কিছু কাজকর্ম করছিল বাগানের একপাশে সবজি বাগানে; সেও চলে গেছে। ডায়নামোটা আর চলছে না। শব্দ নেই। আকাশ একেবারে নীল। চিলটিল উড়ছে অনেক উঁচুতে।
তারাপদ বারবার তার মা বাবার কথা ভাবছে। বেচারি বাবা, দুঃখী মা। মা যে কত কষ্ট করে তাকে মানুষ করেছিল, তারাপদই জানে। মা বাবা বেঁচে থাকলে আজ কি তারাপদর এমন অবস্থা হত?
পেয়ারাতলা ছেড়ে তারাপদ উঠে পড়ল। ভাল লাগছে না। কেন সে এখানে এল? না এলে এমন করে তাকে দুঃখ পেতে হত না। মা বাবাকে তো। সে ভুলেই গিয়েছিল, ভুজঙ্গ নতুন করে সেই দুঃখ জাগিয়ে তুলল। শুধু জাগিয়ে তুলল না, তারাপদর এখন থেকে বারবার মনে পড়বে–তার বাবা, মা বোন–সকলেই যেন আকাশে বাতাসে কোথাও আছে, কোনো ছায়ালোকে, অদৃশ্য আত্মা হয়ে।
অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে তারাপদ আস্তাবলের কাছে আসতেই হঠাৎ তার নজরে পড়ল, খানিকটা তফাতে টালির একটা ভাঙাচোরা ঘরের একপাশে আতা-ঝোঁপের দিকে সাধুমামা দাঁড়িয়ে। কী যেন করছিল সাধুমামা।
তারাপদ একবার চারপাশে তাকাল। কাউকে দেখতে পেল না। আস্তাবলে ঘোড়া নেই। সহিস বোধ হয় ঘোড়া নিয়ে মাঠে গিয়েছে।
প্রায় চোরের মতন তারাপদ সাধুমামার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। ততক্ষণে সাধুমামা তারাপদকে দেখতে পেয়ে গেছেন।
সাধুমামা তারাপদকে দেখে ভয়ের চোখে চারপাশে তাকালেন, যেন কেউ তাঁকে দেখে ফেলবে।
তারাপদ বলল, “সাধুমামা!”
আতা-ঝোঁপের আড়ালে মাটিতে বসে পড়লেন সাধুমামা, চোখে ভয়, সারা মুখে উদ্বেগ । ইশারায় তারাপদকে বসে পড়তে বললেন।
তারাপদ বসল। বসে একদৃষ্টে সাধুমামার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, “সাধুমামা, তুমি বোবা সেজে বসে রয়েছ কেন?”
সাধুমামা জবাব দিতে পারলেন না। তাঁর গলার শিরা ফুলে উঠল, মুখ কেমন কালচে হয়ে এল, জল এসে পড়ল চোখে । তারপর চাপা গলায়, ভাঙা ভাঙা স্বরে, জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন, “প্রাণের ভয়ে।” বলতে বলতে সাধুমামা তাঁর রোগা হাত কপালে তুললেন। তাঁর হাত কাঁপছিল থরথর করে । শিরাগুলোই চোখে পড়ে, বিন্দুমাত্র মেদ-মাংস যেন হাতে নেই, হাড় ফুটে আছে। সাধুমামার গলার স্বর থেকেই বোঝা যায়, তাঁর গলা কি বিশ্রী খসখসে হয়ে গেছে, জিবের কোনো দোষ হয়েছে তাঁর, কথা জড়িয়ে যায়।
তারাপদর কান্না পাচ্ছিল। বেচারি সাধুমামা। যেভাবে সাধুমামা বেঁচে আছেন, তা প্রায় মরে যাবারই সামিল। তারাপদ বলল, “ভুজঙ্গ তোমায় মেরে ফেলবে?”
“মারতে চেয়েছিল। পারেনি।” টেনে-টেনে জড়িয়ে-জড়িয়ে সাধুমামা বললেন।
“কেন?”
“আমি ওর বাধা হয়ে পড়েছিলাম।”
“কিন্তু তুমি আমাদের সব খবরাখবর ওকে দিয়েছ। আমাদের ছবি দিয়েছ।”
“দিয়েছি, বাবা। তখন ওকে বুঝিনি। ও আমায় বশ করে রেখেছিল। আমি তোমাদের ভালই চেয়েছিলাম। পরে বুঝলাম, ও একটা পাপী, নরকেও ওর জায়গা নেই। পশু…পশু..একেবারে পশু।” সাধুমামা অনেক কষ্ট করে কথাগুলো বললেন। বলতে তাঁর কী পরিশ্রম যে হচ্ছিল, তারাপদ বুঝতে পারল।
“কথা বলতে তোমার বড় কষ্ট হয়, না?”
“হ্যাঁ। বড় কষ্ট।“
তুমি আমায় একটা কথা বলো সাধুমামা। ভুজঙ্গ কি আত্মা নামাতে পারে?”
সাধুমামা কিছু বলার আগেই মৃত্যুঞ্জয়কে তারাপদ দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে তার বুক ধক করে লাফিয়ে উঠল যেন। সর্বনাশ! মৃত্যুঞ্জয় যদি তাদের দেখতে পায়, সাধুমামার ভীষণ অবস্থা হবে। তারাপদ ভয়ে কাঠ হয়ে বলল, “সাধুমামা, মৃত্যুঞ্জয়।”
মৃত্যুঞ্জয়ের নাম শোনামাত্র সাধুমামা আতা-ঝোঁপের আড়ালে শুয়ে পড়লেন। শুয়ে পড়ে হাত-পা গুটিয়ে কুণ্ডলী হয়ে গড়াতে গড়াতে আরও হাত কয়েক দূরে সরে গেলেন। জায়গাটা আরও ঝোপেঝাড়ে ভরা, বুনো তুলসীর ঝোঁপ, কাঁটা-ঝোঁপ, তারই মধ্যে এক ধরনের বুনো লতা গাছপালার গা জড়িয়ে জড়িয়ে বেড়ে উঠেছে। সাধুমামা ইশারায় তারাপদকে চলে যেতে বললেন।
তারাপদ আড়াল থেকে মৃত্যুঞ্জয়কে লক্ষ করতে লাগল। সামান্য সময় লক্ষ করার পর দেখল, মৃত্যুঞ্জয় অন্যদিকে চলে যাচ্ছে । বাড়ির ভেতরেই যাচ্ছে।
তারাপদ বসে বসেই বলল, “সাধুমামা, কাল ভুজঙ্গ আমার মা-র আত্মাকে এনেছিল। বাবাও এসেছিল। আমি গোলমাল করে ফেলায় সব নষ্ট হয়ে গেল ভুজঙ্গ কেন আমার মা-বাবাকে এনেছিল? সত্যিই কি তারা এসেছিল?”
সাধুমামা হাত বেড়ে তারাপদকে চলে যেতে ইশারা করছিলেন। বললেন, “ভুজঙ্গ তোমায় এইখানে এবাড়িতে আটকে রাখতে চায়। সারা জীবনের মতন। তোমাকেও সে ভুজঙ্গ করতে চাইছে। খবরদার, তুমি থেকো না। এই সম্পত্তির জন্যে নিজের সর্বনাশ তুমি করো না, বাবা। তুমি পাপী হয়ো না। এ বড় পাপের জিনিস।..যাও, আর এখানে থেকো না। উঠে যাও। পরে কথা বলব।”
তারাপদ কয়েক মুহূর্ত বসে থেকে সাধুমামাকে দেখল। অবশ্য সাধুমামাকে দেখা যাচ্ছে না আর, আড়ালে মাটিতে শুয়ে আছেন, এমনভাবে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছেন যে, মুমূর্ষ জন্তুর মতন দেখাচ্ছে।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তারাপদ উঠে দাঁড়াল। তারপর ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে চলল।
.
আরও খানিকটা বেলায় চন্দন ফিরল।
তারাপদ তার বিছানায় শুয়ে ছিল ছাদের দিকে তাকিয়ে। খোলা জানলা দিয়ে রোদ আসছে না, কিন্তু আলো আসছিল। উজ্জ্বল আলো। এক জোড়া ভোমরা ঘরের মধ্যে উড়ছে, জানলা দিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে, আবার কখন এসে ঘরে ঢুকে পড়ছে। শেষ পর্যন্ত তারা উড়ে গেল বাইরে। তারাপদও নিশ্চিন্ত বোধ করল ।
চন্দন এসে বলল, “তারা, তুই না-যাওয়ায় কিকিরা খুব ঘাবড়ে গিয়েছেন।”
“কেন?”
“কিকিরা ভয় পাচ্ছেন, তুই না শেষ পর্যন্ত ভুজঙ্গর খপ্পরে পড়ে যাস।”
তারাপদ তেমন খুশি হল না; বলল, “খপ্পরে পড়ে যাবার কী দেখলেন উনি?”
চন্দন বলল, “তুই আত্মা-নামানোর ব্যাপারে বিশ্বাস করে ফেলেছিস। ভুজঙ্গ এই চাল দিয়ে তোকে বাগিয়ে ফেলবে।”
“মানে?”
“মানে এর পর ভুজঙ্গ যা বলবে–তুই তাই করবি।”
তারাপদ হঠাৎ যেন কেমন রেগে উঠল। বলল, “কিকিরা যা বলবেন তাই মেনে নিতে হবে? উনি মুখেই বলছেন, কাজে কিছু দেখাতে পারছেন? বোঝাতে পারছেন? কালকের ব্যাপারটা কেমন করে হল–কিকিরা আমায় বোঝান, তারপর অন্য কথা।”
চন্দন বলল, “কিকিরা বললেন, ঘরে কোনো আত্মাটাত্মা নামেনি। এটা ওই মেয়েটিরই কাজ।”
তারাপদ এত অবাক হয়ে গেল যে, কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না। তারপর বলল, “কী বাজে কথা বলছিস তুই? মেয়েটা কেমন করে ঘণ্টা বাজাবে! আমরা তার হাতে হাত রেখে বসে ছিলাম, আমাদের পা তার পা ছুঁয়ে ছিল। তুই কি বলতে চাস মেয়েটার আরও একটা লুকোনো হাত ছিল? বাজে বকিস না চাঁদু।”
চন্দন বলল, “কিকিরাকে আমি সে-কথা বলেছিলাম। উনি বললেন, হাতে হাত রাখা, পায়ে পা ছোঁয়ানো সবই ঠিক কিন্তু ওরই মধ্যে একটা ভেলকি আছে।”
“ভেলকি আছে বললেই তো চলবে না, তার প্রমাণ কী?”
“কোনো প্রমাণ নেই, মানে আমরা কাল ধরতে পারিনি। ওইভাবে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে বসিয়ে আত্মা নামালে লোকে সমস্ত ব্যাপারটায় এত অবাক হয়ে যায় যে, ভেতরে ভেতরে কী হচ্ছে খেয়াল করে না। মেয়েটা যদি কোনো চালাকি করে থাকে আমরা ধরতে পারিনি।”
“কোনো চালাকি করেনি,” তারাপদ বলল।
চন্দন একটু চুপ করে থেকে বলল, “ঠিক আছে। আজ যদি আবার ওই মেয়েটা আসে আমিও তক্কে তক্কে থাকব।”
“থাকিস।”
চন্দন বেশ বুঝতে পারল, তারাপদ তার মা-বাবার আত্মা আসার ব্যাপারটা বিশ্বাস করে নিয়েছে প্রায়। না, বন্ধুর সে দোষ ধরছে না। মানুষের এই দুর্বলতায় দোষ ধরা যায় না। কিকিরাও বলেছেন, ভুজঙ্গ তারাপদর দুর্বল জায়গায় ঘা মারছে, এই ঘা দিয়েই সে তারাপদকে বশ করবে, তাকে নিজের মুঠোয় এনে ফেলবে। চন্দন যে কেমন করে বন্ধুকে ভুজঙ্গর হাত থেকে বাঁচাবে বুঝতে পারছে না। কিকিরা বলেছেন, আপনি স্যার এখন থেকে আরও সজাগ থাকবেন, আরও নজর রাখবেন সব ব্যাপারে।
.
চন্দন আজ খুব সতর্ক থাকবে। আজ সে দেখবার চেষ্টা করবে কেমন করে আত্মা আসে, কেমন করে ঘন্টা বাজে। কিকিরা তাকে একটা জিনিস দিয়েছেন। ছোট্ট জিনিস, লুকিয়ে রাখা যায়। চন্দন আজ যখন ওপরের ওই ভুতুড়ে ঘরে যাবে–তখন জিনিসটা লুকিয়ে নিয়ে যাবে কাপড়ের মধ্যে। চন্দনের ইচ্ছে ছিল, ইনজেকশনের উঁচটা লুকিয়ে নিয়ে যাবার। যদি সে দেখত, বা তার সন্দেহ হত, আত্মার নাম করে আশেপাশে কেউ ঘোরাঘুরি করছে, তবে একবার উঁচটা ফুটিয়ে দিত গায়ে। আত্মা হলে নিশ্চয় ছুঁচ ফুটত না, বাতাসে কি আর ছুঁচ ফোটে? কিন্তু কোনো মানুষ হলে, সে যেমনই মানুষ হোক, আচমকা উঁচ ফুটলে উঃ করে উঠত। আর তখনই ব্যাপারটা জানা যেত। বোঝা যেত, ভুজঙ্গ আত্মা নামায় না মানুষ নামায়।
চন্দন বিছানায় শুয়ে এইসব ভাবতে লাগল, আর তারাপদ বসল দাড়ি কামাতে।
দাড়ি কামাতে কামাতে তারাপদ বলল, “চাঁদু, সাধুমামার সঙ্গে আজ আমার কথা হয়েছে।”
চন্দন তাকাল।
তারাপদ বলল, “সাধুমামাকে আমি দু-চারটে কথা জিজ্ঞেস করেছি–এমন সময় মৃত্যুঞ্জয়কে দেখতে পেলাম। বেশি কথা হল না। সাধুমামা কথা বলতে পারে–কিন্তু কেমন জড়িয়ে-জড়িয়ে। খুব কষ্ট হয়। সাধুমামা আমায় বলল, ভুজঙ্গ আমায় এইখানে আটকে রাখতে চায়। কেন বল তো?”
চন্দন বলল, “কিকিরাও তাই বললেন।”
“কিন্তু কেন?”
“ভুজঙ্গ মারা যাবার পর তুই আর-এক ভুজঙ্গ হয়ে থাকবি বলে।”
“আমি কেন ভুজঙ্গ হয়ে থাকব?”
“ভুজঙ্গই তোকে সে কথা বলবে। আমি কেমন করে জানব!”
.
সন্ধেবেলায় আবার সেই আত্মা-নামানোর ঘরে তারাপদরা এসে বসল। তেমনই অন্ধকার ঘর, মিটমিটে আলো জ্বলছে গুটি দুই, সেই একই ভাবে টেবিল-চেয়ার সাজানো, বাড়তির মধ্যে একটা নিচু ধরনের টেবিল ভুজঙ্গর কাছাকাছি রাখা, তার ওপর দু-একটা জিনিস; গোল বয়ামের মতন দেখতে।
তারাপদরা বসে থাকল তো বসেই থাকল। ঘরের সেই অন্ধকারে চোখ যেন নরম হয়ে আসছিল। গন্ধও আজ চমৎকার লাগছিল, কেমন একটা আবেশ আসছিল। হঠাৎ চন্দন উঠে পড়ে তারাপদকে তার চেয়ারে আসতে বলল । তারাপদ কিছু বুঝল না। কিন্তু চেয়ার বদল করল।
চন্দন ঘরের চারপাশ খুঁটিয়ে দেখবার চেষ্টা করতে লগল । পর পর তিন দিন এই ঘরে এল তারা। এখন খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। প্রথম দিনের মতন অতটা গা ছমছম করে না। চন্দন দেখল, এই ঘরের বাইরে মন একরকম থাকে কিন্তু ঘরটায় ঢুকলেই ধীরে ধীরে কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যায় । সেই বেড়ালটাকেও চন্দন দেখল। চোখের মণি দুটো জ্বলছে।
আরও খানিকটা পরে ভুজঙ্গভূষণ এলেন। তাঁর মাথার ওপরকার চোরা লাল আলো জ্বলে উঠল। ঘরের অন্য বাতি দুটো নিবে গেল সঙ্গে-সঙ্গে। ভুজঙ্গভূষণের একই বেশ : রক্তগৈরিক বসন, মুখের ওপর সেই মুখোশ, গলায় বিশাল রুদ্রাক্ষমালা। তিনি এসে বসার পর সেই কালকের মতন স্তোত্র পাঠ হল। গ্রামোফোন রেকর্ডে যে-ভাবে গান হয়, সেইভাবেই । এই ঘরের কোথাও এই গান-বাজাবার ব্যবস্থা আছে। ভেতর থেকে কেউ বাজায়, বন্ধ করে। যে বাজায় সে-ই বোধ হয় ঘরের আলো জ্বালায় । চন্দন আজ সমস্ত কিছু লক্ষ করতে লাগল।
স্তোত্রপাঠ শেষ হবার পর একেবারে স্তব্ধ সব। সেই স্তব্ধতা ভেঙে ভুজঙ্গভূষণ গম্ভীর স্বরে সংস্কৃতে কী-যে মন্ত্রপাঠ করলেন। তারপর তারাপদকে বললেন, “তারাপদ, তুমি কি তোমার মা বাবাকে আজ আবার ডাকতে চাও?”
তারাপদ সঙ্গে-সঙ্গে জবাব দিল, “হ্যাঁ।”
একটু থেমে ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “কাল তুমি–” তোমরা যা করেছ তাতে বড় ক্ষতি হয়েছে। ওই মেয়েটি–যার মধ্যে তোমার মা-বাবার আত্মা এসেছিলেন–আচমকা তোমরা তার হাত থেকে হাত উঠিয়ে নেবার পর সে এক রকম অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ পরে তার জ্ঞান আসে। খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল। মিডিয়ামদের স্নায়ু হল সূক্ষ্ম তারের মতন–একটুতেই গোলমাল হয়ে যায়।”
তারাপদ লজ্জা পেল। বলল, “আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি।”
“তোমার মা বাবার আত্মাও কষ্ট পেয়েছেন। তোমরা এখনকার মানুষ, তোমাদের বোঝার সাধ্য নেই এইভাবে আত্মাদের আসতে-যেতে কত কষ্ট হয়। ডাকলেই কি তাঁরা আসেন? না–না। অনেক সময় হাজার বার ডাকলেও আসেন না। আবার যখন আসেন, তখন তাঁরা নিজেরা না চলে যাওয়া পর্যন্ত বিদায় দিতে নেই, এতে তাঁদের আরও কষ্ট হয়। কাল তোমরা তাঁদের কষ্ট দিয়েছ। আজ তাঁরা আবার আসবেন কিনা আমি বলতে পারছি না।”
“আসবেন না?” তারাপদ ব্যাকুল হয়ে বলল।
“কেমন করে বলব?”
“আপনি ডেকে দিতে পারেন না?”
“চেষ্টা করি। দেখি।”
ভুজঙ্গভূষণ ঘণ্টা বাজালেন।
কয়েক মুহূর্ত পরেই সেই মেয়েটিকে দেখা গেল। ঘন কালো শাড়ি, কালকের মতনই, সিল্কের শাড়িই হবে; পায়ের দিকটা দেখা যাচ্ছে না, শাড়ি লুটোচ্ছে কার্পেটে। মাথায় এলো চুল, পিঠ পর্যন্ত ছড়ানো। মুখ বড় সাদা, অবশ্য লাল আলোয় কেমন লালচে দেখাল।
মেয়েটি ঘণ্টা উঠিয়ে নিয়ে টেবিলের কাছে চলে এল। একবার শুধু তারাপদ আর চন্দনকে দেখল। ওর দুই চোখ কেমন টানা টানা ছোট দেখাল, যেন ঘুম জড়িয়ে আছে।
কালকের মতন করেই বসল তিনজনে গোল টেবিল ঘিরে। মেয়েটির একটা ছড়ানো হাতের ওপর তারাপদর হাত, আঙুলে আঙুলে ছোঁয়ানো, অন্য হাতটি চন্দনের দিকে বাড়ানো। চন্দন তার হাত এমন করে মেয়েটির আঙুলে ছুঁইয়ে রাখল যেন একটু হাত কাঁপলেই সে বুঝতে পারে। পায়ে পা ছোঁয়ানো থাকল। চন্দন বুঝতে পারল না, মেয়েটির পায়ের আঙুল এত শক্ত কেন? হাড়-হাড় বলেই হয়ত।
ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।
ভুজঙ্গ বললেন, “তারাপদ, একমনে নিবিষ্টচিত্তে ওঁদের ডাকো।”
তারাপদ চোখ বুজে মা-বাবাকে ডাকতে লাগল। চন্দন চোখের পাতা বন্ধ করল না । তাকিয়ে থাকল। এই অন্ধকার যেন পাহাড়ের কোনো গুহার মধ্যের অন্ধকার, কিছুই দেখা যায় না, চোখের সাধ্য নেই এক বিঘত দূরের জিনিসও অনুমান করতে পারে।
ঘর একেবারে নিস্তব্ধ। নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই।
সময় কেটে যেতে লাগল। চন্দনও যেন আর না-পেরে চোখের পাতা বন্ধ করে ফেলল ।
তারাপদ অধীর হয়ে উঠছিল। মা-বাবা আজ কি আর আসবে না? কাতর হয়ে তারাপদ তার মা বাবাকে ডাকতে লাগল।
সময় কেটে গেল আরও কতক্ষণ যেন। মনে হল, আজ আর কেউ আসবে না।
তারাপদ প্রায় যখন হতাশ হয়ে পড়েছে, তখন ঠিক তখন ঘণ্টার মৃদু শব্দ হল।
ভুজঙ্গ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “কে, বেণু?”
ঘণ্টা বাজল না।
“বেণু, তুমি কি আসোনি?”
কোনো শব্দ হল না।
ভুজঙ্গ এবার বললেন, “কে তুমি? বিষ্ণু নাকি?”
বিষ্ণু তারাপদর বাবার নাম, বিষ্ণুপদ নাম থেকে বিষ্ণু।
এবারও কোনো শব্দ হল না। ঘণ্টা বাজল না।
ভুজঙ্গ নিজেই যেন বিচলিত হয়ে পড়েছেন, বললেন, “তুমি কে? তারাপদ যদি কেউ না হও, সাড়া দাও।”
ঘণ্টা বাজল না।
ভুজঙ্গ কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বললেন, “তুমি কি তাহলে বেণুর মেয়ে?”
এবার খুব আস্তে করে ঘণ্টা বাজল।
তারাপদ কল্পনাই করেনি, তার সেই ছোট্ট বোন পরী আসবে। সেই পরী! কত ছোট্ট ছিল! কী সুন্দর ছিল! তার মাথার ঝাঁকড়া চুল আর ফুটফুটে গায়ের রঙ ছাড়া কিছুই আর মনে নেই তারাপদর। সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে মাথায় চোট লেগেছিল পরীর। মারা গেল। আহা রে!
তারাপদর সেই ছোট্ট বোন পরী আজ এসেছে। কিছুতেই নিজেকে সংযত রাখতে পারল না তারাপদ, ছেলেমানুষের মতন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
.
নয়
তারাপদ কান্নার আবেগে হাত ছেড়ে দিচ্ছিল প্রায়, আচমকা তার খেয়াল হল, হাত ছেড়ে দিলেই পরী চলে যাবে। কালকের মতন অবস্থা হবে তা হলে, পরীর আত্মা আর এই ঘরে থাকবে না। ওই মেয়েটি–যার মধ্যে দিয়ে পরীর আত্মা এসেছে-টেবিলের ওপর মুখ থুবড়ে পড়বে, অজ্ঞান হয়ে যাবে। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাতি জ্বলে উঠবে। ভুজঙ্গভূষণ আজ আর ক্ষমা করবে না। ভীষণ রেগে যাবে।
কথাটা খেয়াল হবার সঙ্গে সঙ্গে তারাপদ মেয়েটির হাত আরও জোরে চেপে ধরল। চন্দনের হাতও ছাড়ল না।
ভুজঙ্গভূষণ সামান্য অপেক্ষা করলেন। তারাপদর কান্না শুনতে-শুনতে তাকে যেন সময় দিলেন সামলে নেবার।
তারাপদ নিজেকে খানিকটা সামলে নিল।
ভুজঙ্গভূষণ পরীকে উদ্দেশ করেই বললেন, “তোমার নামটা আমার মনে পড়ছে না। বেণুর মেয়ে বলেই তোমায় আমি জানি।”
তারাপদ জড়ানো গলায় বলল, যেন ভুজঙ্গভূষণের ওপর রাগ করেই, “ওর নাম পরী । পরী আমার বোন। একটি মাত্র বোন।”
ভূজঙ্গভূষণ কান দিলেন না তারাপদর কথায়। পরীকেই বললেন, “তুমি একলা এসেছ? যদি একা এসে থাকো, চুপ করে থেকো যদি সঙ্গে কেউ এসে থাকে–ঘণ্টা বাজিয়ে। একবার ।…তুমি একলা এসেছ?”
ক’ মুহূর্ত কোনো শব্দ হল না। তারপর ঘণ্টা বাজল। একবার ।
ভূজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমার সঙ্গে কে এসেছে? বেণু, না বিষ্ণু? শোনো, মন দিয়ে শোনো, আমার কথার জবাবে যদি হ্যাঁ হয়–তবেই একবার ঘণ্টা বাজাবে; যদি না হয় তবে চুপ করে থাকবে–ঘণ্টা বাজাবে না। বুঝলে? এখন বলল, তোমার সঙ্গে কে এসেছে? বেণু?”
একবার ঘণ্টা বাজল।
তারাপদ বুঝতে পারল, মা এসেছে।
চন্দন অন্ধকারে চোখের পাতা খুলল। তাকাল। কিছুই দেখতে পেল না। এত অন্ধকার চন্দন আর কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারল না, অন্ধ হয়ে গেলে কি মানুষ চোখে এই রকম অন্ধকার দেখে সর্বক্ষণ? চন্দনের মনে হচ্ছিল খুব ঘন কালো কোনো কালিতে ব্লটিং পেপার চুবিয়ে কেউ যেন তার চোখে চাপা দিয়ে কাপড়ে চোখ বেঁধে দিয়েছে। না, তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করা বৃথা তাতে চোখের মণি টনটন করে ওঠে। চোখ বন্ধ করল চন্দন। মেয়েটির হাত ঠিক আছে, নড়েনি। পায়ের আঙুলও ঠিক রয়েছে, আঙুলে-আঙুলে ছোঁয়ানো আছে। চন্দন ঠিক বুঝতে পারল না, মেয়েটির আঙুল এরকম শক্ত শক্ত লাগছে কেন? হাড় ছাড়া আঙুলে কিছু নেই নাকি?
ভুজঙ্গভূষণের গম্ভীর গলা শোনা গেল। স্পষ্ট করে টেনে টেনে কথা বললেন, “বেণু, তুমি আজ আবার এসেছ, আমরা খুশি হয়েছি। কাল তোমার ছেলে একটু ভুল করে ফেলেছিল। ও ছেলেমানুষ, অত বোঝেনি। তা ছাড়া তারাপদ ভয় পেয়েছিল। ওর কোনো দোষ নেই। ও কেমন করে জানলে তোমরা আত্মা হয়ে সূক্ষ্ম শরীরে অন্য লোকে বাস করছ? ওকে তুমি ক্ষমা করো।”
তারাপদও মনে মনে মা-র কাছে ক্ষমা চাইল । মা, আমায় ক্ষমা করো। “বেণু, তুমি জানো কেন আমি তোমার ছেলেকে ডেকে পাঠিয়েছি?” ভুজঙ্গভূষণ বললেন।
সঙ্গে-সঙ্গে না হলেও ঘণ্টা বাজল।
“তুমি তা হলে জানো!…আমারই ভুল। তোমায় কেন বোকার মতন কথাটা জিজ্ঞেস করলাম। তোমাদের কিছুই অজানা থাকে না । ভূত-ভবিষ্যৎ সবই তোমরা জানো। তবু, দু-একটা কথা বলি। তোমার ছেলেও শুনুক।” বলে ভুজঙ্গভূষণ একটু চুপ করে থাকলেন তারপর বললেন, “বেণু, তুমি জানো আমার তিনকুলে কেউ নেই। আমার এই ঘরবাড়ি ছাড়াও অনেক সম্পদ আছে। আমার যা কিছু আছে–স্থাবর অস্থাবর সব আমি তোমার ছেলেকে দিয়ে যাব স্থির করেই তাকে ডেকে আনিয়েছি। কিন্তু আমার দুটি শর্ত আছে। এই শর্ত তাকে পালন করতে হবে। যদি শর্ত মানে, এ-সবই তার যদি না মানে, সে একটা পাই পয়সাও পাবে না। যেমন এসেছে সেই ভাবে তাকে ফিরে যেতে হবে।”
আচমকা ঘণ্টাটা বেয়াড়া ভাবে বেজে উঠল, না থেমে, কোনো রকম ছন্দ না মেনে। শব্দটা এমনই যে কানে লাগে। মনে হয়, কেউ বুঝি প্রবল কোনো আপত্তি জানাচ্ছে।
ভুজঙ্গভূষণ ঘণ্টার শব্দটা শুনে কী বুঝলেন কে জানে, বললেন, “বেণু, তুমি অমন করছ কেন? কী হয়েছে?”
আবার সেই একইভাবে একটানা ঘণ্টা বেজে গেল। তারপর থামল।
ভুজঙ্গভূষণ সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “বেণু, তোমার সঙ্গে কি অন্য কেউ এসেছে? কে এসেছে? বিষ্ণু?”
এবার আর ঘণ্টা বেয়াড়াভাবে বাজল না। একবার মাত্র বাজল।
তারাপদ বুঝতে পারল, তার বাবাও এসেছে। বাবা, মা, পরী–সবাই এসে হাজির হয়েছে। চোখ বুজেই ছিল তারাপদ। তার মনে হল, যদি এমন হত–চোখ খুললেই তিনজনকে দেখতে পেত,তা হলে তার কী আনন্দই না হত, কিন্তু তা তো দেখতে পাবে না। তা ছাড়া সে-সাহসই বা তার কোথায়? তবু সকলে এসেছে জেনে তারাপদর মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল।
“বিষ্ণু, তুমি এসে ভাল করেছ,” ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমরা যে সবাই আসবে আজ–আমি ভাবতেও পারিনি। এসে ভাল করেছ। তোমাদের ছেলেকে আমি আমার যথাসর্বস্ব দিয়ে যেতে চাই। আমার যাবার দিন হয়ে এসেছে। আগামী অমাবস্যার পর ইহজগতে আমি আর থাকব না। তোমাদের কাছে চলে যাব ।..যাক, কাজের কথাটা আগে বলে নিই। তারাপদকে আমি সব দিয়ে যাব–কিন্তু দুটো শর্ত রয়েছে। আমার প্রথম শর্ত হল তারাপদকে তার আগের জীবনের কথা ভুলতে হবে। আমি জানি, মানুষ তার অতীত ভুলতে পারে না। সে-ভাবে আমি তাকে কিছুই ভুলতে বলছি না। আমি বলছি–সে আর কলকাতায় ফিরে যেতে পারবে না। পুরনো কোনো কিছুর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবে না। এই বাড়িতে এখানে তাকে থাকতে হবে, বরাবরের মতন।”
তারাপদ চমকে উঠল তাই কি সম্ভব নাকি? কী বলছে ভুজঙ্গভূষণ? তারাপদ কলকাতায় ফিরে যাবে না? কলকাতার কথা, বন্ধুবান্ধবের কথা, চন্দনের কথা–সব ভুলে যাবে? অসম্ভব। তারাপদ বাঁচবে কী করে?
“আমার দ্বিতীয় শর্ত, ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “আমার মৃত্যুর পর তারাপদকে আমার জায়গায় বসতে হবে। আমি জানি তার কোনো সাধনা নেই, শিক্ষা নেই, আমাদের তন্ত্র-মন্ত্র সে জানে না। তবে সবই ধীরে ধীরে সে জেনে নেবে। তার মন যদি বশ করতে পারে, এই সাধনার কিছু কিছু সে জেনে নিতে পারবে। তারপর ধ্যান আর সাধনার মধ্যে দিয়ে একদিন সবই তার আয়ত্ত হবে।…এই আমার শর্ত।”
তারাপদ স্তব্ধ। তার বুকের অস্বস্তি হচ্ছিল। উত্তেজনা, ভয়, প্রতিবাদ, অসম্মতি সব যেন একসঙ্গে তার বুকের মধ্যে জমে যাচ্ছিল, গলায় এসে উঠছিল। তারাপদ বলতে যাচ্ছিল–না না,–সে এ-সব শর্ত মানতে রাজি নয়। তারাপদ ভুজঙ্গভূষণের মতন কাপালিক হতে চায় না। বটুকবাবুর মেস তার পক্ষে অনেক ভাল। সেখানে সে স্বাধীন। এই পরাধীনতা সে চায় না।
তারাপদ কিছু বলতে যাচ্ছি, তার আগেই ভুজঙ্গভূষণ কথা বললেন। “বিষ্ণু, তুমি কি চাও না, তোমার ছেলে আমার শর্তে রাজি হয়? যদি তোমার আপত্তি থাকে তুমি ঘণ্টাটা একবার বাজাও, যদি তুমি রাজি থাকো দু’বার বাজাবে। মনে রেখো, তুমি রাজি থাকলে দু’বার বাজাবে।”
তারাপদ উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। বুক এত জোরে ধকধক করছে যে, নিজের কানেই সে শব্দটা শুনতে পাচ্ছিল।
সেই অন্ধকার স্তব্ধ ঘরে দু’বার ঘণ্টা বেজে উঠল। তার মানে তারাপদর বাবা বিষ্ণুপদ রাজি।
তারাপদ কিছুই বুঝল না, চেঁচিয়ে উঠে বলল, “না, না।”
ভুজঙ্গভূষণ গম্ভীর গলায় বললেন, “চুপ করো, তুমি এখন কথা বলো না। তোমার মা বাবা কী বলছেন আগে সেটা শোনো। তারপর তোমার যা বলার বলো।” বলে ভুজঙ্গভূষণ গলার স্বর পালটে তারাপদর মাকে যেন জিজ্ঞেস করছেন, বললেন, “বেণু, তোমার কী ইচ্ছে বলো? তুমি কী চাও–তোমার ছেলে এই ঘরবাড়ি, সম্পত্তি, সুখ সমস্ত ফেলে দিয়ে কলকাতায় ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াক? কোনো মানুষ যা স্বপ্নেও ভাবে না-তোমার ছেলেকে আমি নিজের হাতে তা দিয়ে যেতে চাই। বলো, তুমি কী চাও? কী তোমার ইচ্ছে?”
ঘর একেবারে স্তব্ধ। তারাপদ ঘেমে উঠছিল। মা-ও কি সম্মতি জানাবে?
খুবই আশ্চর্য, সামান্য পরে ধীরে ধীরে ঘন্টাটা বেজে উঠল। একবার নয়, দু’বার ।
তারাপদ নির্বাক। তার সমস্ত কথা হারিয়ে গেছে। চন্দনের হাতটা জোরে চেপে রাখল তারাপদ। তার হাত ভিজে গিয়েছে।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “বিষ্ণু, বেণু–তোমরা বাবা-মা হিসেব তোমাদের ছেলেকে যা ভাল, যাতে তার ভাল হবে–তাই করতে বলেছ। তোমাদের ওপর আমি খুশি হয়েছি। তবু তোমরা আর-একটু কি থাকতে পারো না? আমি তোমাদের সামনে তোমাদের ছেলের সঙ্গে দুটো কথা বলে নিতে চাই।”
ঘণ্টা বাজল না। তারাপদ বুঝতে পারল না, বাবা-মা আছে না চলে গেল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তারাপদ তোমার মা বাবার ইচ্ছে তুমি শুনলে। এখন বলো, কী তুমি বলতে চাও।”
তারাপদ ভাবছিল কী জবাব দেবে। সে এখানে থাকবে না। কিছুতেই নয়। কিন্তু মা বাবা যদি চান তারাপদ এখানে থাকুক, তা হলে সে কী করবে? ঠিক এই মুহূর্তে তার মাথায় যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ ঘণ্টাটা আস্তে আস্তে বেজে উঠল, বেজে বেজে যেন দুরে কোথাও মিলিয়ে গেল।
ভুজঙ্গভূষণ কথা বললেন, “তোমার মা বাবা-বোন চলে গেল তারাপদ। ওরা চলে গেল।” বলার পর গম্ভীর মৃদুস্বরে তিনি একটা সংস্কৃত শ্লোক আওড়ালেন, মনে হল, আত্মাদের বিদায় জানালেন।
ঘরের বাতি জ্বলল। মাথার ওপরকার ফিকে আলো ।
তারাপদ চোখ খুলল । চন্দনও তাকাল। চোখে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঝাপসা। ধীরে ধীরে দৃষ্টি পরিষ্কার হল সামান্য।
মেয়েটি হাত টেনে নিল, পা সরিয়ে নিল। কোনো দিকে তাকাল না। মুখ মাথা নিচু করে থাকল। তবু তার ফরসা মুখ আরও সাদা ভিজে ভিজে দেখাচ্ছিল। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। তারাপদ একবার মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল। কেমন যেন ঘুম-জড়ানো চোখ, আচ্ছন্নের মতন লাগছে।
ঘুমের মধ্যে যেন হেঁটে যাচ্ছে এইভাবে চলে গেল মেয়েটি।
মেয়েটি চলে যাবার পর ভুজঙ্গভূষণ আবার কথা বললেন। তাঁর দিকের সেই লাল আলো এখন আর জ্বলছে না। ঝাপসা অন্ধকারে ভৌতিক চেহারা নিয়ে তিনি বসে আছেন। ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তারাপদ, তোমার যা বলার আছে বলো।”
তারাপদ চন্দনের দিকে তাকাল। চন্দনকে খানিকটা অন্যমনস্ক দেখাল। চোখাচোখি হওয়া সত্ত্বেও সে কোনো রকম ইশারা করল না।
তারাপদ অস্পষ্ট গলায় বলল, “আমি এখানে কেমন করে থাকব?”
“কেন?”
“কলকাতা ছেড়ে আমি কখনো থাকিনি। আমার বন্ধুবান্ধব, চেনা-জানা যারা, তারা সবাই কলকাতায় থাকে। তাদের ছেড়ে আমি এখানে একা একা কেমন করে থাকব?”
“একা একা কেন থাকবে, এই বাড়িতে লোকজন কম নেই, এরা থাকবে।” তারাপদ শুকনো গলায় ঢোক গিলল। “আমার মন টিকবে না।”
“প্রথম প্রথম টিকবে না, তারপর টিকে যাবে। আমার কেমন করে টেকে?”
“আপনি কতকাল ধরে এখানে আছেন। তা ছাড়া আরও একটা কথা রয়েছে–আপনি সাধনা করেন, কত বছর ধরে তন্ত্র-টন্ত্রর সাধনা করে আসছেন। আমি কিছু জানি না। আমার ওসব জিনিস পছন্দও হয় না। আমি কেমন করে আপনার মতন সাধক হব?”
ভুজঙ্গভূষণ শান্ত গলায় বললেন, “সে-চিন্তা আমার। তোমায় যে অনেক কিছু শেখাতে হবে–তা আমি জানি। তার ব্যবস্থাও আমি করেছি।”
তারাপদ আবার চন্দনের দিকে তাকাল। চন্দনও তার দিকে তাকিয়ে আছে।
কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলল না তারাপদ; পরে বলল, ধরুন যদি এমন হয়, আজ আমি আপনার শর্তে রাজি হলাম, তারপর আপনি যখন থাকবেন না–তখন শর্ত ভাঙলাম–তখন কী হবে?”
ভুজঙ্গভূষণ স্বাভাবিক গম্ভীর গলায় বললেন, “তুমি তোমার মা বাবার মনের ইচ্ছে জেনেছ। কাল আবার আমি ওদের ডাকব। ওই আত্মাদের কাছে তোমায় শপথ করতে হবে।…তারাপদ, মৃত পিতা-মাতার আত্মার সামনে শপথ করে সেই শপথ যদি তুমি ভাঙো, তার পরিণতি যে কী হবে–তুমি কল্পনাও করতে পারছ না। তোমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।..তা ছাড়া, আমার নির্দেশ আছে, অন্তত তিন বছর তুমি পুরনো সমস্ত সংসর্গ থেকে দূরে থাকবে। এই বাড়িতে তোমায় থাকতে হবে। কোথাও যাবে না। এখানে সাধনা করবে। যদি তিন বছর তুমি আমার নির্দেশ-মতন থাকতে পারো, তবেই তুমি আমার সমস্ত কিছুর একমাত্র উত্তরাধিকারী হবে। নয়ত নয়। আর এই তিন বছর তোমার থাকা, খাওয়া-পরার কোনো কষ্ট হবে না, দরকার পড়লে কিছু কিছু টাকা তুমি খরচ করতে পারবে। তিন বছর পরে তুমি বিষয়সম্পত্তি পেয়ে যা খুশি করতে পারো। কিন্তু মনে রেখো, তোমার মাথার ওপর আত্মারা থাকবে–তোমার মা-র, বাবার, আমার ।…তিন বছর পরে আমার বিশ্বাস, তুমি আজ যা ভাবছ তা আর ভাবতে পারবে না।”
তারাপদ কোনো কালেই অঙ্ক জিনিসটা বোঝে না; তার মাথায় ফন্দি ফিকিরও খেলে না। তবু ভুজঙ্গভূষণের কথা থেকে বুঝতে পারল, লোকটি ভীষণ চতুর, সবদিক দিয়েই পথ আগলে রেখেছে।
তারাপদ চুপ। কী বলবে? সরাসরি না করে দেবে? কী দরকার তার এত সম্পত্তিতে? কোন দুঃখে সে তান্ত্রিক-টান্ত্রিক হতে যাবে? কেনই বা সে ভুজঙ্গভূষণের মতন আত্মা-টাত্মা নামাতে যাবে? সে যা আছে–এই কি যথেষ্ট নয়? সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ল সাধুমামার কথা, কিকিরার কথা। সবাই তাকে বলেছেন, ভুজঙ্গ শয়তান, ভুজঙ্গ পাপী। সাধুমামা মিনতি করে বলেছেন, বাবা
তুমি আমাদের এই নরক থেকে উদ্ধার করো। কেমন করে উদ্ধার করবে। তারাপদ? তিন বছর এই পুরীতে নিজে বন্দী থেকে সমস্ত কিছু নিজের আওতায় আনার পর? কিন্তু আত্মা? মা-বাবার মৃত আত্মার সামনে শপথ নেবার পর সে কি অমন কাজ করতে পারবে? . তারাপদ কথা বলছে না দেখে ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তুমি মন স্থির করতে পারছ না?”
বিড়বিড় করে তারাপদ বলল, “আমায় ভাববার একটু সময় দিন।”
“বেশি সময় তোমায় কেমন করে দেব। আমার সামনেও যে সময় নেই। তুমি কি কোনো সন্দেহ করছ তারাপদ? তোমার মা-বাবার আত্মার ইচ্ছে কি পূরণ করতে মন চাইছে না?”
তারাপদ কিছু খেয়াল না করেই বলল, “আত্মা কি কথা বলে না?”
“না। কখনো-সখনো এক-আধটা কথা কেউ বলেছেন। আমি কাউকে কথা বলতে দিতে চাই না।”
“আমার মা-বাবা যদি একটা কথা বলতেন।”
‘তারাপদ, আত্মারা তোমারা আমার মতন স্কুল দেহ নিয়ে থাকেন না। সূক্ষ্ম আত্মা, সে প্রায় বাতাসের মতন। তাঁদের দিয়ে কথা বলাবার চেষ্টা না করাই উচিত। যিনি বাতাসের আকার নিয়ে থাকেন, তাঁকে সবাক করা উচিত নয়। তাতে তাঁদের বড় কষ্ট হয়।…তবে আমি একটা কাজ করতে পারি। আত্মারা
যে কখনো কখনো নিজেদের আসা-যাওয়ার চিহ্ন রেখে যান, সে-প্রমাণ আমি তোমায় দেখাতে পারি? দেখবে?”
তারাপদ চন্দনের দিকে তাকাল। চন্দনের চোখে কৌতূহল।
তারাপদ বলল, “দেখব। “
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “বেশ। তুমি দেখতে চেয়েছ যখন আমি দেখাব। ওই ঘন্টাটা আমার কাছে দিয়ে যাও।”
তারাপদ উঠল। ঘন্টাটা চন্দনের পায়ের দিকে, যেদিকে চন্দন আর মেয়েটি পায়ে পা ছুঁইয়ে বসেছিল। চন্দন মাটিতে হাত নামিয়ে ঘণ্টাটা তুলে দিল। তারাপদ ঘন্টা হাতে করে ভুজঙ্গর সামনে গিয়ে হাত বাড়াল ।
ভুজঙ্গভূষণ ইশারা করে ঘন্টাটা নিচে নামিয়ে রাখতে বললেন।
তারাপদ ঘণ্টা নামিয়ে রাখল। রেখে নিজের জায়গায় ফিরে আসার সময় শুনল ভুজঙ্গ ঘণ্টা বাজালেন। তাঁর মাথার দিকে টকটকে লাল আলো জ্বলে উঠল আবার। তারাপদদের ওপরকার আলো নিবে গেল। আর কী আশ্চর্য, ভুজঙ্গভূষণের পেছন দিক থেকেই পরদার আড়াল সরিয়ে সাধুমামা এলেন। তারাপদদের দিকে তাকালেন না সাধুমামা, বাধ্য অনুগত চাকরের মতন ভুজঙ্গর সামনে মাথা নিচু করে আদেশের অপেক্ষা করতে লাগলেন।
ভুজঙ্গভূষণ হাতের ইশারায় তাঁর সামনের নিচু টেবিলটার দিকে দেখালেন। নিচু গলায় কী যেন বললেন, শুধু ‘মোম’ শব্দটা কানে গেল তারাপদর। সাধুমামা টেবিলের ওপর থেকে সামান্য লম্বা গোল মতন অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রটা নিয়ে চলে গেলেন। কাঁচের গোল বয়ামটা পড়ে থাকল। তার মধ্যে যেন জল, অর্ধেকের বেশি বয়ামটা ভরতি।
ভুজঙ্গভূষণ তারাপদর দিকে তাকালেন। “তুমি কতটা সাহসী?” কথার মধ্যে যেন একটু ঠাট্টার ভাব ছিল।
তারাপদ কথার জবাব দিল না। সে সাহসী নয়। ঘরের মধ্যে যা ঘটছে, তা সহ্য করার মতন মনের জোরও তার থাকার কথা নয়। তবু, দু দিনের পর–আজ তৃতীয় দিনে কেমন করে সে সাহস দেখাতে পারছে–সে নিজেই জানে না।
“তোমার বন্ধুর সাহস বোধ হয় বেশি।”–ভুজঙ্গ চন্দনকে লক্ষ করে বললেন। “ডাক্তার লোক..আমার এখানে ভয় পাবার মতন কিছু নেই, তবু লোকে ভয় পায়। ভয় পায় কেন জানো? যারা ইহলোকের মানুষ, তারা পরলোকের কথা বোঝে না। পরলোক থেকে যাঁরা আসেন, তাঁদেরও বুঝতে পারে না। যা অজ্ঞেয়, তাকে মানুষ ভয় করে। তবে আত্মারা সচরাচর কারও ক্ষতি করেন না, যদি না আমরা তাঁদের বিরক্ত করি, অশ্রদ্ধা করি। কখনো কখনো কোনো দুষ্ট আত্মা হঠাৎ এসে যান। তাঁরাই বড় ভয়ংকর। তাঁরা কাউকে ভর করলে বিপদে পড়তে হয়। যাক, আবার একবার আমি চেষ্টা। করে দেখি তারাপদ–যদি কাউকে আনতে পারি। একটা কথা মনে রেখো, আত্মারা আমাদের ইচ্ছাধীন নন, আমরাই তাঁদের ইচ্ছাধীন। তোমার মা বাবাকে আজ অনেকক্ষণ আমরা ডেকে এনে কাছে রেখেছিলাম। এভাবে থাকতে ওদের বড় কষ্ট হয় । জানি না ওরা আর আসবে কিনা! তুমি কাকে আনাতে চাও আমি জানি না। “
তারাপদর মনে হল, মা-বাবার হয়ত কষ্ট হবে আসবে। হতেও তো পারে।
তারাপদ আচমকা বলল, “পরী আসবে না?”
“পরী?”
“পরীকে দেখতে আমার বড় ইচ্ছে করে। সে যদি একবার আসত.” বলতে বলতে আবেগে গলা ধরে গেল তারাপদর।
ভুজঙ্গভূষণ অল্প নীরব থেকে বললেন, “তুমি যে-পরীকে দেখেছ সেই পরী–তোমার সেই ছোট্ট পরী কি এখনও অতটুকু আছে! আত্মা অমর, তার কোনো পরিবর্তন থাকে না–তবু নিজেদের মতন করে তারা কিছুটা বদলে যায়।…ঠিক আছে, আমরা পরীকেই ডাকব। যদি সে আসে–এই ঘরে তার আসার চিহ্ন রেখে যাবে। তোমাদের আমি সাবধান করে দি, এবার যে আসবে–সে সরাসরি আসবে, মিডিয়ামের মধ্যে দিয়ে নয়, তোমরা কোনো রকম নড়াচড়া করবে না, কথা বলবে না, কিছু ধরবার চেষ্টা করবে না–আত্মাকে ধরার চেষ্টা করা মুখ । শান্ত, ধীর-স্থির হয়ে বসে থাকবে–। দেখো কী। হয়! পরী আসে কি আসে না।”
সাধুমামা আবার ফিরে এলেন। সেই পাত্রটা ভুজঙ্গভূষণের টেবিলের সামনে নামিয়ে রাখলেন। ভুজঙ্গ ঘরে আরও কিছুটা ধুনো-গুগগুল দিয়ে দিতে বললেন। ঘরের কোণে কোণে ধূপের বাটি ছিল ঢাকা, ধূপ দিতে বললেন।
সবাই যেন তৈরি ছিল। সাধুমামা চলে যেতেই মৃত্যুঞ্জয় এল। তার দু হাতে ধোঁয়া-ওঠা ধুনোর পাত্র। গলগল করে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ঘরে ধোঁয়া দিয়ে সে পাত্র দুটো আড়ালে রেখে দিল। একটুও আগুন বা আভা দেখা গেল না। বাটিতে ধূপ এনে সাধুমামা ঘরের কোণে আড়াল করা জায়গায় রেখে গেলেন। ধূপের আগুনও চোখে পড়ল না।
ঘরের সমস্ত বাতি নিভে গেল। ঘোর অন্ধকার । কোথাও এক বিন্দু আলো নেই। ভুজঙ্গভূষণ তাঁর জলদগম্ভীর গলায় আশ্চর্য সুরে দীর্ঘ এক সংস্কৃত মন্ত্র আবৃত্তি করতে লাগলেন। গানের সুরের মতন লাগছিল। ধোঁয়ায় ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে, ধুনোর গন্ধ, গুগগুলের গন্ধ, ধূপের তীব্র এক গন্ধেও ঘর ভরে উঠল।
ভুজঙ্গভূষণ মন্ত্রের মতন করে সেই শ্লোক আবৃত্তি করতে করতে শেষ পর্যন্ত থেমে গেলেন কিছুক্ষণ পরে বললেন, “যাকে আনতে চাইছ, তাকে চোখ বন্ধ করে একমনে ডাকো, তারাপদ। কোনো কথা বলো না। তোমরা কেউ কাউকে স্পর্শ করো না।”
তারাপদ পরীকে মনে মনে ভাবতে লাগল। ডাকতে লাগল। পরী-পরী সেই ছোট্ট পরী।
চন্দন চোখ খোলার চেষ্টা করল বার কয়েক। পারল না। যেন পাতালের তলায় তারা কোথাও নেমে গেছে, ঘটুঘুট করছে অন্ধকার।
কোনো শব্দ নেই, আলোর একটি ফোঁটাও কোথাও নেই। সময় বয়ে যাচ্ছে। এর যেন শেষ নেই। তারাপদ কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পরীকে ভাবতে লাগল।
কতক্ষণ যে কেটে গেল খেয়াল নেই। হঠাৎ ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “আমি ফুলের গন্ধ পাচ্ছি। কে একজন এসেছে! কে?”
তারাপদ সচেতন হল। চন্দনও।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “পরী, তুমি যদি এসে থাকো, তোমার দাদার কাছে যাও। তাকে ওই গন্ধ, তোমার বয়ে আনা গন্ধ তাকে জানতে দাও মা।”
তারাপদ একেবারে ধীরস্থির হয়ে বসে থাকল। বুক কাঁপছে। তবু সে অধৈর্য।
পরী আসছে না। কেন আসছে না? তার দাদা তাকে ডাকছে–তবু কেন আসছে না?
একেবারে আচমকা তারাপদর নাকে এক গন্ধ ভেসে এল। কোন ফুলের গন্ধ সে বুঝতে পারল না। চাঁপা ফুলের মতনই অনেকটা।
পরী এসেছে। তারাপদ থরথর করে কাঁপতে লাগল। পরী এসেছে। পরী, পরী, সোনা বোন আমার।
আবেগে তারাপদ যখন কেঁদে ফেলেছে, হঠাৎ তার গালের পাশে পরীর চুলের ছোঁয়া পেল। তারপর আর নয়। ছোঁয়া নয়। গন্ধটাও ফিকে হয়ে যেতে যেতে মিলিয়ে যাচ্ছিল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “পরী, তুমি যে এই ঘরে এসেছিলে তার কিছু চিহ্ন রেখে যাও। তোমার দাদা সামান্য কিছু চিহ্ন চায়। আমার সামনে মোমের পাত্র আছে। তোমার হাতের কিছু চিহ্ন রেখে যাও মা। অন্তত একটা-দুটো আঙুলের।”
আবার সব নিস্তব্ধ।
অনেকক্ষণ পরে জঙ্গভূষণ বললেন, “পরী চলে গেছে। আমি আর কোনো গন্ধ পাচ্ছি না।”
আরও সামান্য সময় গেল । ভুজঙ্গভূষণ ঘণ্টা নাড়লেন। তারাপদদের মাথার ওপরকার বাতি জ্বলে উঠল।
তারাপদ আর চন্দন অন্ধের মতন বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে তাদের চোখ ফুটল।
ভুজঙ্গভূষণ সামনের টেবিলের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, “তারাপদ, তোমার বোন পরী এসেছিল। ওই দেখো সে তোমার জন্যে তার আঙুলের ওই চিহ্ন রেখে গেছে।”
তারাপদ প্রায় পাগলের মতন সামনে ছুটে গেল। ভুজঙ্গভূষণের সামনের টেবিলে মোমের একটা আঙুল পড়ে আছে।
আঙুলটা নেবার জন্যে তারাপদ হাত বাড়াল।
.
দশ
সকালে তারাপদর আর বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। ঘুম ভেঙে যাবার পরেও সে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকল। শরীর যেন ভেঙে যাচ্ছে, হাত-পা ভার, চোখ জ্বালা করছিল। সারা রাত জ্বরের ঘোরে পড়ে থাকার পর সকালে ঘুম ভাঙলে যেমন লাগে, সেই রকম লাগছিল। শরীরের দোষ নেই, আজ ক’দিনই একটা-না-একটা এমন কিছু ঘটে যাচ্ছে যাতে মাথার ঠিক থাকে না, একের পর এক ভাবনা সারাক্ষণ জট পাকিয়ে থাকে মাথায় । রাত্রে ঘুম হয় না ভাল করে। তার ওপর কালকের ঘটনার পর তারাপদ একেবারেই ঘুমোত পারেনি। বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছে, মাঝে মাঝেই কেঁদে উঠেছে বাবা-মা-পরীর কথা ভেবে। তবু বাবা কিংবা মা তাকে এমন করে বিহ্বল করে যায়নি। পরীই যেন সব উলটে-পালটে দিয়ে গেল। তার আত্মা তারাপদর গায়ের কাছে, সামনেই এসে দাঁড়াল, গন্ধ শুকিয়ে দিল, চুলের ছোঁয়া দিল মুহূর্তের জন্যে, একটা মোমের আঙুলও রেখে গেল চিহ্ন হিসেবে। এরপর তারাপদ কেমন করে স্থির থাকবে! সে কাকে বোঝাবে, এই ছোট্ট বোনটিকে সে কতদিন কোলে করে একটু বসে থাকার জন্যে মায়ের কাছে আবদার করত!পরী তখন চার ছ’মাসের বাচ্চা! ওইটুকু বাচ্চা কিছুই তো বোঝে না, তবু তারাপদ বিকেলে খেলাধুলো ছেড়ে বোনের পাশে শুয়ে-শুয়ে কাগজের ফুল দেখিয়েছে, ঝুমঝুমি নেড়েছে, প্রাণপণে ছড়া কেটেছে। পরী আরও যখন বড় হল একটু, তারাপদ বোনকে বসতে, পা-পা করে হাঁটতে, একটা দুটো আধো-আধো কথা বলতে শিখিয়েছিল। সেই বোন যখন থাকল না–তখন তারাপদর বুক ভেঙে গিয়েছিল। সমস্ত বাড়ি অসাড় থাকত তখন; মা আড়ালে বসে কাঁদত, বাবা কেমন পাথরের মতন হয়ে গিয়েছিল, আর তারাপদ বেড়াল-ছানার মতন সারা বাড়ি কেঁদে কেঁদে ঘুরে বেড়াত।
সেই পরী কাল এসেছিল। তারাপদ তাকে চোখে দেখতে পেল না বটে, তবে আসার প্রমাণ তো পেল। পরী আজও কোথাও-না-কোথাও রয়েছে এটা জানার পর বুকের মধ্যে কেমন হয় এ-কথা শুধু তারাপদই বুঝতে পারে। আর কেউ বুঝবে না।
মাঝরাত পর্যন্ত চন্দনকে জ্বালিয়ে শেষরাতে তারাপদ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর এখন উঠল বেশ খানিকটা বেলায়, ঘরে রোদ ঢুকে পড়ার পর ।
চন্দন বিছানায় নেই । অনেক আগেই বোধ হয় উঠে পড়েছে ।
শেষ পর্যন্ত বিছানা ছেড়ে উঠল তারাপদ, অনেকটা জ্বোরো রোগীর মতন বেখেয়ালে মুখটা ধুয়ে এল। একজনকে দেখতে পেয়ে চা দিতে বলল রুক্ষ গলায়। কেন যে রুক্ষ হল নিজেও বুঝল না।
ঘরে বসে যখন চা খাচ্ছে তারাপদ, চন্দন এল।
“ঘুম ভাঙল তোর?” চন্দন বলল।
“হ্যাঁ। তুই কোথায় গিয়েছিলি?”
চন্দন হাত বাড়িয়ে নিজের জন্যে এক পেয়ালা চা ঢেলে নিল; কথা বলল প্রথমটায়, তারপর বলল, “রোগী দেখতে!”
অবাক হয়ে তারাপদ বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।
চন্দন বলল, “সাধুমামার বুকে ব্যথা উঠেছিল।”
“সাধুমামার?”
“ভোর রাতে আমায় মৃত্যুঞ্জয় ডাকতে এসেছিল। তোকে আর আমি জাগাইনি। একটু আগে আর একবার দেখতে গিয়েছিলাম সাধুমামাকে।”
তারাপদ উদ্বিগ্ন মুখে বলল, “কী হয়েছে সাধুমামার? কেমন আছে?”
“ভালই আছেন এখন!”
“বুকে ব্যথা কেন? হার্টের গোলমাল?” চন্দন পর পর দু’ চুমুক চা খেল। সিগারেটও ধরাল। শেষে হেঁয়ালি করেই যেন বলল, “হতে পারে।”
“হতে পারে মানে?”
“বলতে পারছি না। হার্টের গোলমাল ধরা কঠিন। আমার কাছে স্টেথোও নেই। তবে ব্যথাটা হার্টের দিকটাতেই।”
“তোর কাছে তো ওষুধও নেই কিছু?”
“না। দু-চারটে যা এনেছি, তাতেই আপাতত কাজ চালিয়ে দিচ্ছি।”
তারাপদ কিছুই বুঝতে পারছিল না। সাধুমামার বুকের ব্যথা যদি এতই বেশি তাহলে চন্দন তেমন গা করছে না কেন? আশ্চর্য! যে ডাক্তারের না আছে স্টেথোসকোপ না কোনো ওষুধপত্র, সে-ডাক্তার কেন রোগীর ভার নেবে! তারাপদ বলল, “তুই সবে পাশ করেছিস, তোর কাছে ওষুধপত্র নেই–কেন তুই এই দায়িত্ব মাথায় নিচ্ছিস? সাধুমামা বুড়োমানুষ, একটা-কিছু হয়ে গেলে তখন সামলাতে পারবি না। তার চেয়ে ভুজঙ্গদের বল–কোনো ডাক্তার-টাক্তার ডেকে আনবে।”
চন্দন কথাগুলো কানে শুনেও গা করল না, বলল, “বোকার মতন কথা বলিস না। আমি যেমন ডাক্তারই হই বিপদে পড়ে কেউ যদি আমায় ডাকতে আসে আমি না বলতে পারি না। তা ছাড়া এখানে ধারেকাছে কোনো ডাক্তার নেই । হয় মধুপুর না হয় দেওঘর থেকে ডাক্তার আনতে হবে। তার মানে গোটা একটা দিনের ব্যাপার । তোকে বলেছি না–কাজে লাগতে পারে ভেবে আমি দু-একটা ইনজেকশানের ওষুধ নিয়ে এসেছিলাম। তার মধ্যে একটা হার্টের ওষুধ ছিল। ভেবেছিলাম ভুজঙ্গ অক্কা পাবার আগে কাজে লাগবে। সাধুমামার দরকারে লেগে গেল ।…যাক গে, সাধুমামা এখন ঘুমোচ্ছে; ইনজেকশান দিয়ে দিয়েছি ভোর রাতেই। মনে হচ্ছে, কোনো গণ্ডগোল হবে না। এর পর ভুজঙ্গ কী করবে না-করবে সেটা তার ব্যাপার। আমার যা করার করেছি, যা বলার মৃত্যুঞ্জয়কে বলেছি।”
তারাপদ চা শেষ করে ফেলল। হাই তুলল আবার। চা খাওয়ার পর সামান্য আরাম লাগছিল।
চন্দন বলল, “একবার কিকিরার কাছে যেতে হবে।”
“কেন?”
“চল না; গেলেই বুঝতে পারবি।”
মাথা নাড়ল তারাপদ। “আমার ভাল লাগছে না।”
“এই বাড়িতে বসে বসেই বা তোর কী ভাল লাগবে?”
কথার জবাব দিল না তারাপদ।
অপেক্ষা করে চন্দন হঠাৎ বলল, “তুই যদি আমার সঙ্গে না যাস, তারা–আমি কিন্তু আর এ-বাড়িতে ফিরব না; কিকিরার কাছে দুপুরটা কাটিয়ে বিকেলের ট্রেনে কলকাতা ফিরে যাব।”
তারাপদ বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল, যেন চন্দনের হঠাৎ এই মত পালটে ফেলার ব্যাপারটা বুঝতে না-পেরে তাকে লক্ষ করতে লাগল।
চন্দনও চা শেষ করে ফেলল। তারাপদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চল্।” ।
তারাপদ বলল, “কী হবে কিকিরার কাছে গিয়ে?”
“কী হবে না-হবে, তোর কাছে আমি এখন বলব না। যদি তুই না যাস, আমি বুঝব তুই ভুজঙ্গর ফাঁদে ধরা পড়ে গিয়েছিস। আমি আর এখানে থাকব না।“
চন্দনের মুখ দেখেই তারাপদ বুঝতে পারল, ও বাজে কথা বলছে না। সত্যিই-সত্যিই তারাপদকে রেখে চন্দন চলে যাবে। ও বরাবরই জেদী, একবার যা ঠিক করে নেয় তার নড়ানো যায় না। তবু তারাপদ বলল, “কী হল ব্যাপারটা? হঠাৎ তুই এরকম করছিস?”।
চন্দন চাপা গলায় বলল, “এখানে বসে সব কথা বলা যাবে না। তুই হয় আমার সঙ্গে চলনা হয় তুই এই লাখটাকার সম্পত্তির জন্যে ভুজঙ্গর কাছে বসে থাক–আমি থাকব না।”
তারাপদর কানে কথাটা বড় লাগল। আহত হয়ে বলল, “তুই আমায় এত লোভী ভাবলি?”
চন্দন বলল, “এই বাড়িতে বসে আমি আর একটা কথাও বলব না। যদি তোর ইচ্ছে না থাকে, তুই যাস না। আমি যাচ্ছি।”
তারাপদর সাধ্য হল, না চন্দনকে ছেড়ে দেয়। সে স্পষ্টই বুঝল, চন্দন তাকে। মিছিমিছি ভয় দেখাচ্ছে না–সত্যিই ও চলে যাবে, যা একগুঁয়ে ছেলে। তা। ছাড়া তারাপদর সন্দেহ হল, চন্দনের যেন কিছু বলার আছে, গোপনে বলবে। অগত্যা তারাপদ বলল, “বেশ। আমি যাব। “
তারাপদ আর চন্দন বেরিয়ে পড়ল । মৃত্যুঞ্জয় তাদের দেখেছিল, কিছু বলল না। কেউ যে নজর রাখছে, তাও মনে হল না।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঠ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চন্দন বলল, “তোকে একটা কথা বলি তারা, কিছু মনে করিস না। ভুজঙ্গ তোকে জব্বর প্যাঁচ মেরে কবজা করে ফেলেছে।”
তারাপদ রেগে গেল। বলল, “কেন? কী করে বুঝলি?”
“বুঝেছি। তোকে আমি বুঝব না? তুই বরাবর নরম ধাতের । একটুতেই কেঁদে ফেলিস, বুক চাপড়াস, ছটফট করিস। তোর মতন সেন্টিমেন্টাল ছেলে আমি খুব কম দেখেছি। তোর মনে কোনো জোর নেই।”
চন্দন আরও কী বলতে যাচ্ছিল, তারাপদ বাধা দিয়ে রাগের গলায় বলল, “লেকচার মারিস না, চাঁদু । আমি অনেক লেকচার শুনেছি।”
“তুই চটে যাচ্ছিস কেন?”
“আলবাত চটব। তুই আমায় লোভী বলবি, সেন্টিমেন্টাল বলবি–আর আমি চটব না!”
চন্দন বন্ধুর রাগ দেখে হেসে ফেলল। তারাপদর রাগ ভাঙাবার জন্যে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “তুই মিছিমিছি চটছিস। সকলের মন কি একরকম হয়? কারুর মন শক্ত হয়, কারুর নরম; কেউ নিষ্ঠুর হয় তোর ভুজঙ্গ-পিসেমশায়ের মতন, কেউ বা সাধুমামার মতন দুর্বল হয়। তোর মন নরম বললে তুই চটবি কেন?”
“তুই আমায় লোভী বলেছিস।”
“লোভ সব মানুষেরই অল্পস্বল্প থাকে, তারা। পড়ে-পাওয়া সম্পত্তির লোভ ভাই আমারও থাকত। যাকগে, তুই লোভী নোস, যা বলেছি–ভুল করে বলেছি। এবার হল তো?”
তারাপদ কোনো কথা বলল না। চন্দন বন্ধুর গলা জড়িয়েই হাঁটতে লাগল। খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, “ভুজঙ্গ তোকে বশ করে ফেলছে, তারা। ধীরে ধীরে তোকে মুঠোয় পুরে ফেলছে। এরপর তুই আর পালাতে পারবি না, সে-ক্ষমতা তোর থাকবে না। আমিও তোকে সাবধান করে দিচ্ছি।”
তারাপদ বলল, “যা মনে করিস বল, আমি কিছু বলব না।”
“তুই সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করিস তোর মা-বাবার আত্মা আসে? তুই কি বাস্তবিকই মনে করেছিস–কাল তোর কাছে পরী এসেছিল?”
“হ্যাঁ, পরী এসেছিল।”
“আমি বিশ্বাস করি না। এ অসম্ভব।”
“তুই বিশ্বাস না করতে পারিস, কিন্তু আমি করি। যদি পরী না আসবে তবে কে আমার নাকের কাছে গন্ধ শুকিয়ে যাবে, কার মাথার চুল আমার মুখে লাগবে? কার আঙুলের ছাঁচ পড়ে থাকবে?”
চন্দন বন্ধুর গলা থেকে হাত সরাল। মুখোমুখি তাকাল। বলল, “তুই পাগলের মতন কথা বলছিস। পরী মারা গিয়েছিল ছোট্ট বয়সে, তুই বলিস বছর দুই-তিন বয়েসে । শোন তারা, যা বলছি ভেবে দেখ । পরী যখন মারা যায় তখন তুই নিজেই ছেলেমানুষ; পরীর ঠিক-ঠিক বয়েস কত হতে পারে তুই জানিস না। দু-তিন বছর হতে পারে, আবার চারও হতে পারে। সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু ছোট্ট পরী কি মরে গিয়েও পরলোকে বাড়ছে?”।
তারাপদ কথাটা বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে বলল, “মানে?”
চন্দন বলল, “এটা তো সোজা ব্যাপার। আমরা চেয়ারে বসেছিলাম–ঠিক কিনা বল? একটা তিন-চার বছরের মেয়ে মাথায় কত লম্বা হবে রে যে তোকে গন্ধ শুকিয়ে যাবে, মুখে চুলে ছোঁয়া দিয়ে যাবে? যদি মেয়েটা কম করেও ফুট চারেকের মতন লম্বা না হয়, কখনোই আমরা চেয়ারে বসে থাকার সময় মুখে মাথার চুল ছোঁয়াতে পারে না। এটা সোজা অঙ্কের ব্যাপার। চেয়ারে বসে থাকার সময় আমাদের মুখ মাটি থেকে অন্তত সোয়া তিন সাড়ে তিনি ফুট উঁচুতে থাকে, ওই হাইটের কোনে মেয়ে পাশে না দাঁড়ালে তার চুলের ছোঁয়া তোর মুখে লাগতে পারে না। অবশ্য যে-মেয়ে মাথায় আরও লম্বা সে কিন্তু ঘাড় নামিয়ে হেঁট হয়ে তোর মুখে চুলের ছোঁয়া লাগাতে পারে। এবার তুই বল, মারা যাবার পর স্বর্গে গিয়ে পরী কি তোর-আমার মতন বছরে বছরে বাড়ছে? তা যদি বাড়ে–তবে তার বয়েস আজ ষোলো সতেরো হতে পারে।”
তারাপদ বোকার মতন বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। কথা বলতে পারল না। পরীর মুখ কিংবা স্মৃতি যেটুকু মনে আছে তারাপদর, তাতে সেই ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে কখনোই মাথায় অত লম্বা হতে পারে না। বড় জোর বছর তিনেকের ছিল পরী। সে কতই বা লম্বা হবে? তা ছাড়া তার মাথার চুল ছিল ঝাঁকড়া, কিন্তু বল্ করে ছাঁটা। সেই চুলই বা কেমন করে মুহূর্তের জন্যে পালকের ছোঁয়ার মতন তারাপদর গালে লেগে সরে যাবে? মোমের আঙুলের যে ছাঁচ তারাপদ দেখেছে–সেটাও তো কচি মেয়ের নয়। তা হলে? আত্মারা কি মানুষের মতন পরলোকে গিয়ে বয়েসেও বাড়ে? যদি তা বাড়ত–তবে হাজার-হাজার আত্মার বয়েস শ, দুশ, পাঁচশ বছর হয়ে গেছে।
তারাপদ এরকম একটা হেঁয়ালির কোনো কূলকিনারা খুঁজে পেল না। বলল, “কী জানি, আমি কিছু জানি না। তবে ভুজঙ্গ তো আগেই বলেছে–পরী আর অত ছোট্টটি নেই। আত্মাদের অন্য কোনো ব্যাপার আছে।”
“কোনো ব্যাপার নেই”, চন্দন ঘাড় নেড়ে বলল, “আমি তোকে বলছি–যে-মেয়েটি আমাদের সঙ্গে টেবিলে বসে, আত্মা নামাবার মিডিয়াম হয়–সেই মেয়েটাই কাল পরী সেজে তোর কাছে এসেছিল।”
তারাপদ প্রবলভাবে বাধা দিতে গেল, চন্দন শুনল না। বলল, “মেয়েটার মাথায় অনেক চুল, সব সময় চুল এলো করে থাকে, মাথায় লম্বা, গায়ে রোগা–তারা, এই মেয়েই কাল পরী সেজে এসেছিল।”
চন্দন আরও কী বলতে গিয়ে থেমে গেল। পরে বলল, “কিকিরার কাছে চল । কিকিরা তোকে বুঝিয়ে দিতে পারবেন ভুজঙ্গ কেমন করে আত্মা নামায়।”
.
মাঠেঘাটে নয়, কিকিরা বাড়িতে চন্দনদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। বাড়ি মানে সেই হরিরামের আস্তানা। বালিয়াড়ির আড়ালে মাঠকোঠা ধরনের বাড়ি, দোতলা, কাঠের সিঁড়ি, মাথায় খাপরার চাল। চারদিকেই কিছু-না-কিছু গাছপালা। বাড়ির একপাশে বাঁধানো কুয়ো।
হরিরাম খেতখামার নিয়ে পড়ে থাকত একসময়, ছেলে গোরখপুরে বড়সড় ব্যবসা ফাঁদার পর বাবার কাছে বড় একটা আসতে পারে না। হরিরামের স্ত্রী মারা গিয়েছে বছর কয়েক আগে। সংসারে একলা মানুষই এখন হরিরাম। খেতখামারের ওপর তার আর টান নেই, ধর্মকর্ম নিয়েই দিন কাটায়। বাড়িতে জোয়ান বয়েসের কাজের লোক আছে একটা, আর আছে পাঁড়েজি, বুড়ো বামুন।
কিকিরা দোতলার ঘরে ডেকে নিলেন চন্দনদের। ঘরটা কাঠের, শীতের রোদ খেয়ে মোটামুটি গরমই লাগছিল, সরাসরি রোদ পড়েছে পেছন দিকটায়, সামনে সরু বারান্দা।
কিকিরার ঘরে একটা তক্তপোশ, টিনের চেয়ার আর কাঁঠালকাঠের টেবিল ছাড়া বিশেষ কিছু নেই। দড়ির আলনায় জামাটামা ঝুলছে কিকিরার।
চন্দনরা বসার পর কিকিরা তারাপদর মুখ খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, “রাত্তিরে ঘুম হয়নি, স্যার?” বলে একটু হাসলেন।
চন্দন বলল, “ওর ঘুম তো গেছেই, সঙ্গে-সঙ্গে আমারও। কাল সারারাত তারা যা করেছে–ভাবছিলাম ওকেই একটা ইঞ্জেকশান ঠুকে দিই।”
“কেন কেন?” কিকিরা কৌতূহল বোধ করে বললেন।
চন্দন বলল, “বলছি। তার আগে আর-একটা খবর আছে। সাধুমামার আজ শেষরাত থেকে শরীর খারাপ। বুকে ব্যথা। মৃত্যুঞ্জয় আমায় ডাকতে এসেছিল শেষরাতে।”
কিকিরা কেমন ব্যস্ত হয়ে বললেন, “বুকে ব্যথা? কী হয়েছে?”
“আমার মনে হল, অনেকদিন ধরেই উনি কোনো দুঃখ-দুভাবনার মধ্যে রয়েছেন, শরীরটাও দুর্বল। হার্টের কিছু গোলমাল হয়ে থাকতে পারে। আমার কাছে স্টেথেসকোপও নেই। নাড়ি ধরে কতটুকু আর বুঝব! প্রেশার, হার্টসই দেখানো দরকার। তবে এই ব্যথাটা বোধ হয় মনের ভীষণ দুভাবনা থেকে হয়েছে।” বলে চন্দন অল্প সময় করে থেকে তারাপদকে দেখল দু পলক, শেষে কিকিরার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি যখন সাধুমামাকে দেখছিলাম, মৃত্যুঞ্জয় আমার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। যখন নিচে এসে ইনঞ্জেকশান নিয়ে আবার ওপরে গেলাম তখন আমি মৃত্যুঞ্জয়কে ঘর থেকে সরিয়ে দিলাম কায়দা করে।”
“কেমন করে?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।
“ব্যাপারটা সহজ। বললাম, আমার কাছে ইথার-টিথার নেই, ইনজেকশানের সিরিঞ্জ আর ছুঁচ স্টেরিলাইজ করতে হবে। গরম জলে এগুলো ফুটিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন তাড়াতাড়ি।”
কিকিরার মুখ দেখে মনে হল তিনি চন্দনের উপস্থিত বুদ্ধিতে খুশি হয়েছেন।
চন্দন বলল, “সাধুমামার মুখ চোখ দেখে আমি আগেই বুঝেছিলাম তিনি আমায় কিছু বলতে চান। তাই কায়দা করে মৃত্যুঞ্জয়কে সরালাম। ঘরে যখন আমি আর সাধুমামা ছাড়া অন্য কেউ নেই, তখন সাধুমামা বালিশের ওয়াড়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখা একটা চিরকুট বের করে আমার হাতে গুঁজে দিলেন। বললেন, আপনার কাছে চিরকুটটা দিতে।” বলে চন্দন প্যান্টের পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করল।
তারাপদ বোকার মতন বসে থাকল । অবাক চোখ করে, সে একবার চন্দনকে দেখছে, একবার কিকিরাকে। কী যে হয়ে যাচ্ছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছিল না। বেশ বোঝা যাচ্ছে সাধুমামা কিকিরাকে জানেন। এটাও জানেন যে কিকিরা এখন এখানে। তারাপদদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। সাধুমামাও যেন এক রহস্য।
কিকিরা চিরকুটটা নিয়ে পড়লেন। বার দুই মনে হল, চঞ্চল হয়ে পড়েছেন; প্রকাশ করতে চাইলেন না। কী মনে করে একটা সিগারেট চাইলেন চন্দনের কাছে, তারপর সিগারেটটা ধরিয়ে হঠাৎ উঠে গেলেন।
ঘরে তারাপদ আর চন্দন।
তারাপদ বলল, “কিসের চিরকুট?”
চন্দন বলল, “কিকিরা বলবেন।”
“তুই দেখিসনি?”
“দেখেছি। বুঝতে পারিনি।” চন্দন এ কথা এড়িয়ে গেল ।
তারাপদ একটু চুপ করে থেকে বলল, “সাধুমামা তোকে চিরকুট দিল কেন?”
চন্দন বলল, “তোকে দিয়ে লাভ হত না বলে। কিংবা তোকে দেবার কোনো সুযোগ ছিল না বলে।”
তারাপদর সন্দেহ হল। কিছু যেন ভাবল তারাপদ; বলল, “তুই কী বলতে চাসবুকের ব্যথার নাম করে সাধুমামা তোকে ডেকে ওই চিরকুটটা দিয়েছে?”
“আমার তাই মনে হয়,” চন্দন ছোট করে জবাব দিল।
“সাধুমামাও তাহলে কিকিরাকে চেনে?” তারাপদ বলল।
চন্দন চুপ করে থাকল।
কিকিরা ফিরে এলেন। ফিরে এসে বসলেন না, ঘরের মধ্যে বার দুই পায়চারি করলেন, তারাপদকে দেখলেন বারবার। তারপর বললেন, “একটু দেহাতী চা খেয়ে নিন স্যার, তারপর কথা বলা যাবে।”
তারাপদর ধৈর্য থাকছিল না। সাধুমামা কেন চিরকুট পাঠিয়েছে কিকিরাকে? কী লিখেছে চিরকুটে? অসহিষ্ণু হয়ে তারাপদ বলল, “সাধুমামা আপনাকে কী লিখেছে?”
কিকিরা প্রথমটায় জবাব দিলেন না। পরে বললেন, “সবই বলব স্যার, রয়েসয়ে শুনতে হবে। তার আগে বলুন, ভুজঙ্গ কাল আপনাকে কোন্ খেলা দেখিয়েছে?”
তারাপদর রাগ হল। খেলা? কিকিরা সব জিনিসকেই খেলা মনে করেন? রাগ করে তারাপদ বলল, “ভুজঙ্গ যা যা দেখায়, সবই আপনি খেলা মনে করেন?
কিকিরা তারাপদর রাগ বুঝে যেন মনে-মনে হাসলেন। চন্দনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনিই বলুন স্যার।”
সাধুমামার চিরকুটে কালকের কথার একটু-আধটু উল্লেখ ছিল । কিকিরা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন কাল ভুজঙ্গ কোন্ খেলা দেখিয়েছে। তবু, সবটাই শুনতে চান তিনি। কাল যা যা ঘটেছে চন্দন বলতে লাগল ।
ওরই মধ্যে কাঁচের বড় বড় গ্লাসে চা এল। দেহাতী চা না দুধ-চা বলা মুশকিল, দুধে সাদা হয়ে রয়েছে, সর ভাসছে ওপরে।
চন্দন কথা শেষ করে থামল।
কিকিরা সব শুনে তারাপদর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “আপনি ঠিক জানেন আপনার বোনের আত্মা এসেছিল?”
তারাপদ জেদীর মতন বলল, “আসেনি তার প্রমাণ কোথায়?”
চন্দন চা খেতে খেতে বলল, “তারা, তোর মতন মুখ্য আমি আর দেখিনি। তোকে আমি অত করে বোঝালাম সাধারণ নিয়মে এটা হতে পারে না, অসম্ভব ব্যাপার।”
তারাপদ বলল, “জগতে অনেক অসম্ভবই সম্ভব হয়। ভুজঙ্গ আমার পিসেমশাই হয়ে ডেকে পাঠাবে এটাই কি সম্ভব?” চন্দন ভীষণ বিরক্ত বোধ করে চুপ করে গেল ।
সামান্য চুপচাপ। কিকিরা বললেন, “তারাপদবাবু, আপনি তা হলে বিশ্বাস করেন, আত্মা আছে, আর পরলোক থেকে সেই আত্মারা ভুজঙ্গর ডাকে মাটিতে। নেমে আসে?”
তারাপদ একগুঁয়ের মতন বলল, “হ্যাঁ করি। আমি যা দেখেছি তা অবিশ্বাস করব কেমন করে?”
কিকিরা কয়েক মুহূর্ত তারাপদর দিকে তাকিয়ে থেকে মজার গলায় বললেন, “আপনি যা যা দেখেছেন আমি যদি আপনাকে সেগুলো দেখাতে পারি তাহলে কি আপনি স্বীকার করবেন ভুজঙ্গ আপনাদের ধোঁকা দিয়েছে?”
তারাপদ প্রথমে অবাক হল, তারপর অবিশ্বাসের চোখে কিকিরার দিকে তাকাল।
কিকিরা তাঁর আলখাল্লার মতন জামাটা খুলে ফেললেন। মাথার সেই টুপিটাও খুললেন। বড় রোগা দেখাচ্ছিল তাঁকে; রোগা আর রুগ্ন। মাথার চুলও কিছু কিছু সাদা, লম্বা লম্বা চুল, ঘাড় পর্যন্ত নামানো ।
কিকিরা বললেন, “চলুন আমরা নিচে যাই। নিচের তলায় হরিরামের একটা গুদোমঘর আছে। পুরনো, পোড়ো, ঘর। ঘরটা বেশ অন্ধকার। সেখানে আমরা এই সাত-সকালেই আত্মা নামাব ।” বলে কিকিরা যেন হাসলেন; বললেন, “ভুজঙ্গর আত্মা-নামানোর ঘরে অনেক ব্যবস্থা আছে। সেটা স্যার মডার্ন । আমাদের পোড়ো গুদোমঘরে কিছু নেই। তবু দেখা যাক সেখানে আত্মা নামে কি না?”
তারাপদ এবার কেমন বিব্রত বোধ করল । ভুজঙ্গর আত্মা-নামানোর ব্যপারটা পুরো ধোঁকা এ-কথা এখন প্রমাণ হয়ে গেলেও তার যেন ভাল লাগবে না। অথচ এটা যে মিথ্যে তাও জানা দরকার।
কিকিরা বললেন, “চলুন স্যার, দিনের বেলায় আত্মারা বড় একটা আসতে চায় না, তবু একবার চেষ্টা করা যাক। কিকিরা দি ম্যাজিশিয়ান অনেকদিন পরে তার খেলা দেখাবে।” বলে ঠাট্টার গলায় হাসলেন কিকিরা। তারপর জাদুকরের ভঙ্গিতে পিঠ নুইয়ে মাথা নিচু করে অভ্যর্থনার ভঙ্গি করে ডাকলেন তারাপদদের, “আসুন।”
চন্দন প্রথমে উঠে দাঁড়াল, তারপর তারাপদ। তারাপদ কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছিল।
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নামবার সময় কিকিরা বললেন, “তারাপদবাবু, একটা কথা আপনাকে বলে দি। ভুজঙ্গ যতবড় শয়তান তার চেয়েও বেশি বুদ্ধিমান। কিন্তু বুদ্ধিমানও ভুল করে। ভুজঙ্গ মস্ত বড় ভুল করেছে। বারবার একই ফন্দি কাজে লাগে না। পরীর আত্মা নামিয়ে সে আপনার বাবাকে পাগল করেছিল। তাঁকে মেরেছিল বলা যায়। ওই একই কায়দা করে সে আপনাকে হাতের মুঠোয় ধরে ফেলেছে। কিন্তু ও জানে না–একই ফাঁদে দু’বার শিকার ধরা যায় না।”
বাবার কথায় তারাপদ সিঁড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
কিকিরা কিন্তু দাঁড়ালেন না। রোগা, রুগ্ন, হাড় জিরজিরে মানুষটির মুখে ঘৃণা এবং প্রতিহিংসা যেন জ্বলে উঠেছিল।
তারাপদ কিকিরার এমন মুখ কখনো দেখেনি। তার কেমন যেন ভয় হল।
কিকিরা নিচে নেমে গেলেন।
.
এগারো
হরিরামে গুদোমঘরটা বেশ অন্ধকার। তবু ভুজঙ্গর আত্মা-নামানোর ঘরটার মতন ঘুটঘুঁটে নয়। এখন আবার দিনের বেলা, বাইরের আলো ছোটখাট ফাঁকফোকর দিয়ে একটু না একটু ঢুকে পড়ছে। ম্যাটিনি শোয়ে সিনেমা দেখতে গেলে হলের মধ্যে যেমন লাগে–অনেকটা সেই রকম অন্ধকার লাগছিল এখানে।
কিকিরা বড় বড় ফাঁক-ফোকরগুলো ছেঁড়া চট, কাগজ, আরও যা যা পেয়েছেন হাতের কাছে, তাই দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন আগেই; ছোটগুলো ঢাকতে পারেননি। তার জন্যে তিনি ব্যস্তও হলেন না।
ঘরের মাঝমধ্যিখানে একটা ছোট টেবিল ছিল চৌকো ধরনের; আর দুটো চেয়ার, মুখোমুখি।
গুদোমঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন কিকিরা। বললেন, “তারাপদবাবু, আপনি আর আমি চেয়ারে গিয়ে বসব। মুখোমুখি। টেবিলের ওপরে আমাদের হাত থাকবে, আমরা দুজনে দুজনের হাত ধরে থাকব। আর টেবিলের নিচে আমাদের পা থাকবে, আমরা পায়ে পা ছুঁইয়ে রাখব। চন্দনবাবু যেখানে খুশি দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন।..আসুন।”
তারাপদ কিকিরার মতিগতি বুঝতে পারছিল না। ওই খেপা মানুষটি কী পাগলামি শুরু করলেন? তা ছাড়া তারাপদর মাথায় বাবার কথা বারবার এসে পড়ছিল। কিকিরা কেন বললেন, ভুজঙ্গই একরকম তার বাবাকে মেরেছে? কেন বললেন, পরীর আত্মা নামিয়ে ভুজঙ্গ বাবাকে পাগল করেছিল? কিকিরা কি তার বাবার কথা জানেন? আশ্চর্য! যদি জানেন তবে আগে কেন বলেননি?
তারাপদর মন বড় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল, ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিল।
কিকিরা ততণে চেয়ারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তারাপদকে আবার ডাকলেন তিনি, “আসুন।”
ঝাপসা অন্ধকারে তারাপদ ধীরে ধীরে এগিয়ে টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
“বসুন,” কিকিরা বসতে বললেন।
কেমন যেন অন্যমনস্কভাবে তারাপদ বলল, “জুতো রয়েছে পায়ে।”
কিকিরা বললেন, “আগেই দেখেছি। শু। চামড়ার। বেশ শক্ত জুতো। ওতে কোনো ক্ষতি হবে না। আমার পায়েও রয়েছে।” বলে চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর ঠাট্টার গলায় বললেন, “ধূপ ধোঁয়া স্তোত্রপাঠ গানটান কিছুই তো এ-ঘরে দেখছেন না । ভুজঙ্গর তাক-লাগানো ব্যাপার কোনোটাই নেই স্যার। তবু দেখবেন আপনার পছন্দসই আত্মারা সবাই একে-একে চলে আসবে।…নিন, বসে পড়ন।”
তারাপদ চেয়ার টেনে বসল। কিকিরাও বসে পড়েছেন। চৌকো ধরনের ছোটখাট অথচ সামান্য উঁচু টেবিলের দু ধারে মুখোমুখি দুজনে বসে। কিকিরা তাঁর দু’হাত সামনে বাড়িয়ে দিলেন। টেবিলের ওপরই ফেলে রাখলেন হাত দুটো। বললেন, “নিন, আপনার হাত দুটো এগিয়ে দিন; আমার হাত ধরুন।”
তারাপদ হাত ধরল । কিকিরা টেবিলের তলায় জুতোসমেত পা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তারাপদও তার পা বাড়াল। কিকিরা বললেন, “না না, আপনি অত লজ্জা পাবেন না স্যার, জুতোর মুখে মুখে ছুঁইয়ে রাখছেন কেন–ডগাটার ওপর একটু চাপ দিয়ে থাকুন।”
সঙ্কোচ হচ্ছিল তারাপদর। কিকিরার পায়ের ওপর নিজের জুতোসমেত পা কেমন করে চাপানো যায়? তার ভদ্রতায় বাধছিল। ভুজঙ্গর ওখানে তারা শুধু মেয়েটির পায়ের আঙুলের সঙ্গে আঙুল ছুঁইয়ে রাখে। আর এখানে কিকিরা জুতোর মুখের ওপর পা চাপিয়ে দিতে বলছেন। এ
তারাপদ তার জুতোর ডগা দিয়ে কিকিরার জুতোর ডগা চেপে থাকল।
কিকিরা বললেন, “বাঃ বাঃ, চমৎকার হয়েছে। এবার আমরা চোখ বন্ধ করব । বন্ধ করে আত্মার কথা ভাবব । চন্দনবাবু, আপনি চোখ খুলে সবই দেখতে পারেন, যদি অবশ্য এই অন্ধকারে দেখা যায়। রেডি,…তা হলে এবার আমরা আত্মা ডাকতে বসতে পারি। নিন তারাপদবাবু, চোখ বুজে ধ্যান করুন। কাকে ডাকতে চান?”
“বাবাকে।”
“বেশ, বেশ।”
তারাপদ চোখের পাতা বুজে ফেলল। কিকিরাও চোখ বন্ধ করার ভান করলেন–কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ করলেন না। চন্দন সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে কিকিরাদের দিকে তাকিয়ে থাকল। এই অন্ধকারে দুজনকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল মাত্র।
তারাপদ তার বাবাকে ডাকবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু একমনে ডাকতে পারছিল না। নানা ধরনের চিন্তা এসে যাচ্ছিল। কখনো ভুজঙ্গ এসে পড়ছিল, কখনো। সেই মেয়েটি। বাবার কথা ভাবতে গিয়েও কিকিরার কথাটা মনে আসছিল। কিকিরা কেন বললেন ভুজঙ্গই তার বাবাকে মেরেছে?
সমস্ত মন এলোমেলো হয়ে থাকায় তারাপদ কিছুতেই তার বাবাকে তেমন করে ভাবতে পারছিল না।
এইভাবে সময় কেটে যাচ্ছিল, আস্তে আস্তে । কতক্ষণ যে কেটে গেল তাও বোঝা গেল না। সবই চুপচাপ। এক-আধবার বাইরে থেকে কোনো কাকের ডাক কিংবা দূরে কাঠ কাটার শব্দ খুব ফিকেভাবে ভেসে আসছিল।
হঠাৎ যেন কিকিরা সামান্য কেঁপে উঠলেন। তারপর বললেন, “তারাপদবাবু, উনি এসেছেন।”
তারাপদ বোধ হয় সামান্য অপ্রস্তুত ছিল। বলল, “কে?”
“আপনার বাবা।”
“বাবা?” তারাপদ বিশ্বাস করতে পারল না। কিকিরা কি তার সঙ্গে তামাশা করছেন! কোথায় বাবা?
কিকিরা বললেন, “আপনার বাবার আত্মা আমায় ভর করে নেই, কিন্তু তিনি আমার কাছেই রয়েছেন। প্রমাণ চান?”
তারাপদ মুখ ফুটে বলতে পারল না–হ্যাঁ চাই। তার মন বলছিল–চাই, নিশ্চয়ই চাই।
কিকিরা যেন তারাপদর মন বুঝেই বললেন, “আপনার বাবার আত্মা এসেছেন কিনা সেটা আপনিই যাচাই করে নিন। ওঁকে কিছু জিজ্ঞেস করুন। জবাব হ্যাঁ হলে ঘন্টার শব্দ শুনবেন; না হলে ঘণ্টা বাজবে না।”
তারাপদ এবার খানিকটা অবাক হল। কিকিরা ঘণ্টার ব্যবস্থাও রেখেছেন? আগে তো বলেননি! কেমন একটা থতমত ভাব হল তারাপদর সত্যি সত্যিই কি কিকিরা আত্মা নামিয়েছেন না মজা করছেন তার সঙ্গে?
কিকিরা বললেন, “কই, জিজ্ঞেস করুন?”
তারাপদ ঢোক গিলে প্রশ্ন করল,”বাবা! বাবা আপনি এসেছেন?”
প্রথমটায় চুপচাপ। তারপর সত্যি সত্যিই ঘণ্টা বেজে উঠল ।
তারাপদ চমকে গেল। সে স্বপ্নেও ভাবেনি কিকিরা এইভাবে তাকে অবাক করে দেবেন। হতবুদ্ধি হয়ে গেল তারাপদ। আর ওই অবস্থায় আবার জিজ্ঞেস করল, “বাবা, সত্যিই আপনি এসেছেন?”
আবার ঘণ্টা বাজল। তারাপদ কান পেতে শব্দটা শুনল। ভুজঙ্গর ঘরে ঘণ্টার শব্দ আরও সুন্দর শোনায়, এখানে শব্দটা একটু অন্যরকম। ঠাকুরঘরে ঘণ্টা বাজার মতনই অনেকটা। হঠাৎ তারাপদর ঝোঁক চাপল, কিকিরা কোনো চালাকি করছেন কিনা জানতে হবে। চোখ সামান্য খুলে তারাপদ কিকিরার দিকে তাকাল । কিকিরাও তাকিয়ে আছেন।
তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “বাবা, আপনার সঙ্গে আর কেউ এসেছে?”
ঘণ্টা এবার বাজল না।
“কাল ভুজঙ্গর ঘরে পরী এসেছিল?”
ঘণ্টা বাজল।
“পরী কি কিছু রেখে গিয়েছে?”
এবারও ঘণ্টা বাজল।
তারাপদ বিচলিত হয়ে পড়ছিল। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন হেরে যাচ্ছে । কিকিরা তাকে জব্দ করছেন। খানিকটা রাগও হচ্ছিল তার, কেন রাগ হচ্ছিল বুঝতে পারছিল না। কিকিরা তার বিশ্বাস ভেঙে দিচ্ছেন বলে কি?
আচমকা তারাপদ কতকগুলো উলটো-পালটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বসল। “আপনার নাম বিষ্ণুপদ না বিষ্ণুব্রত?…আপনি অ্যাকসিডেন্টে মারা যান না অসুখে ভুগে?…পরী বাড়িতে মারা গিয়েছিল না হাসপাতালে?”
হেরেই গেল তারাপদ। কিকিরার নামানো আত্মা ঠিক-ঠিক জবাবে ঘণ্টা বাজাল।
শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল তারাপদ।
এবার কিকিরা বললেন, “তারাপদবাবু, এ এক এমন আত্মা যে আপনার সমস্ত প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারে, যদি অবশ্য তার জানা থাকে। যাকগে, এবার আর লুকোচুরির দরকার নেই, আসল ব্যাপারটা আপনাকে দেখাই।” বলে কিকিরা তাঁর হাত টেনে নিলেন। চন্দনকে বললেন, “চন্দনবাবু, আপনাকে একটু হাত লাগাতে হবে। এখানে তো আলো নেই, না দেখলে ব্যাপারটা আপনারা বুঝতে পারবেন না। দয়া করে ওই ভেতর দিকের জানলাটা খুলে দেবেন? দরজাও খুলে দিন। ওপাশের উঁচু ঘুলঘুলি থেকে চটটা নামিয়ে নিন স্যার।
চন্দন ঝাপসা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে জানলা-টানলা খুলল। এবার খানিকটা আলো আসছিল। মোটামুটি সবই চোখে পড়ে।
কিকিরা চন্দনকে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতে বললেন। তারপর তারাপদর দিকে তাকিয়ে হাসি-হাসি গলায় বললেন, “স্যার, এই আত্মা নামানোর ব্যাপারটা স্রেফ জোচ্চুরি। লোক ঠকানোর খেলা।…আপনারা স্যার লেখাপড়া-শেখা ছেলে–নিজেরাই জানেন মানুষ মনে-মনে কত দুর্বল। আমরা কেউই তো চাই না আমাদের মা বাবা ভাই বোন আমাদের ছেড়ে চলে যায়। অনেক বয়েস হল, মানুষ বুড়ো হল, অসুখবিসুখে ভুগে মারা গেল, সেটা অন্য কথা; কিন্তু সময় হল না, অথচ মা বাবা ছেলে মেয়ে ভাই বোন যদি চলে যায় তবে কে তা সহ্য করতে পারে বলুন। মানুষের এই দুর্বলতাকে কিছু লোক মাথা খাঁটিয়ে কাজে লাগায়। এরই নাম সেয়াঁস, বা আত্মা-নামানোর চক্র। আমাদের দেশ বলে নয়, সব দেশেই এটা বেশ ভাল ব্যবসা হিসেবে চলে। য়ুরোপ আমেরিকাতেও চলে, আবার হংকং-টংকংয়েও চলে। লাখ লাখ টাকার ব্যবসা চলছে স্যার এইভাবে। যাকগে, সে পরের কথা, এখন কাজের কথায় আসি।” বলে কিকিরা একটু থামলেন। তারপর হেসে বললেন, “এইবার দেখুন, স্যার ঘন্টাটা কেমন করে বাজে।”
তারাপদ আর চন্দন কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল। কিকিরা হাসি-হাসি মুখ করে ঘণ্টাটা বাজাতে লাগলেন। তারাপদরা মাটির দিকে তাকাল, কিছু দেখতে পেল না। অথচ বেশ বুঝতে পারল টেবিলের তলায় ঘন্টা বাজছে।
কিকিরা বললেন, “আপনারা মাটিতে বসে পড়ন, উবু হয়ে বসুন, তা হলেই দেখতে পাবেন।”
চন্দন ঝপ করে বসে পড়ল। বসে পড়ে টেবিলের তলার দিকে তাকাল। দেখল, টেবিলের মাঝ-মধ্যিখানে একটা আঙটার ফাঁকে ছোট মতন এক পুজোর ঘণ্টা ঝোলানো। দেখে চন্দন বোবা হয়ে গেল।
তারাপদও চেয়ারে বসে মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ে টেবিলের তলাটা দেখতে লাগল ।
কিকিরা হেসে হেসে বললেন, “ভেরি ইজি স্যার, শুধু একটু প্র্যাকটিস দরকার। এই দেখুন, আমি আমার ডান পায়ের বুড়ো আর মাঝখানের আঙুল দিয়ে কেমন করে ঘন্টা বাজাচ্ছি।” কিকিরা ঘণ্টা বাজাতে লাগলেন।
কিকিরার জুতো জোড়ার একটাতে তাঁর পা নেই। জুতো পড়ে আছে।
তারাপদ সন্দেহের গলায় বলল, “আপনার ডান পায়ের জুতো পড়ে আছে, পা নেই।”
চন্দন আবার উঠে দাঁড়িয়েছে।
কিকিরা বললেন, “পা যদি জুতোর মধ্যেই থাকবে স্যার, তবে ঘণ্টাটা বাজাব কেমন করে!”
তারাপদ বলল, “আপনি বলতে চান জুতোর মধ্যে থেকে পা বার করে নিয়ে ঘণ্টা বাজানো হয়?”
“এক্কেবারে ঠিক কথা। যদি ঘন্টাটা এ-দেশি হয় তবে ওইভাবে বাজাতে হবে।”
“কিন্তু আপনি জুতোর মধ্যে থেকে পা বার করলেন কেমন করে? আমি তো বুঝতে পারলাম না। আপনার জুতোর ডগার ওপর আমার পা চাপানো ছিল।“
“আমি বোকা বানিয়েছি। অবশ্য স্যার, এইভাবেই আমরা আপনাদের বোকা বানাই। ব্যাপারটা কী জানেন, আমার যে জুতো জোড়া দেখছেন এটা ঠিক আমার নয়, চেয়েচিন্তে বেছে জোগাড় করেছি। এটা হল খাদে পরে যাবার মালকাট্টাদের জুতো। হরিরামের কাছে পড়ে ছিল। এই জুতোর মুখটা খুব শক্ত, লোহার মতন। এরকম জুতো পাওয়া যায় বাজারে। এই ধরনের শক্ত মুখের আরও পাঁচ রকম জুতো আছে। কলকারখানায় যারা কাজ করে তারা
অনেকেই এই ধরনের জুতো পরে। আঙুলগুলো বাঁচে আর কি-ঠোক্কর, খান, হোঁচট খান, কিসসু হবে না।…সত্যি বলতে কী স্যার, আপনাকে আমি ইচ্ছে করেই বলেছিলাম, জুতোর ডগার ওপর আপনার জুতোসুদ্ধ পা চাপিয়ে রাখতে। আপনি পা ঠিকই চাপিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু বুঝতে পারেননি আমি আলগা জুতো থেকে পা বের করে নিয়েছি। কেমন করে বুঝবেন? খুব শক্ত মুখের জুতোর ওপর যদি আপনার জুতোর মুখটা চেপে থাকেন–আপনার মনে হবে, আপনি অন্যের জুতো ঠিকই চেপে ধরে আছেন।”
চন্দন বলল, “আপনার জুতোর ফিতে বাঁধা রয়েছে।”
কিকিরা হেসে উঠে বললেন, “সেটা ওপরে-ওপরে। প্রথমত ফিতে আমি আলগা করে বেঁধেছি, তা ছাড়া–ফিতের তলার দিকে কাটা আছে স্যার। জুতোটা একবার দেখলেই বুঝতে পারবেন।”
তারাপদ বলল, “এ-সব আপনি কখন করলেন?”
“কেন, সেই যে একবার আপনাদের ঘরে বসিয়ে রেখে বাইরে গেলাম, তখন এই স্পেশ্যাল জুতো পরে এলাম। “
চন্দন কেমন কৌতূহলের সঙ্গে বলল, “আত্মারা তা হলে এইভাবে ঘণ্টা বাজায়?
কিকিরা মুচকি হাসলেন।
তারাপদ সন্দেহের গলায় বলল, “কিন্তু ওই মেয়েটি কেমন করে ঘণ্টা বাজাবে? সে আপনার মতন জুতো পায়ে এসে বসত না। খালি পায়ে বসত। আমরাও খালি পায়ে থাকতাম।”
কিকিরা সহজভাবেই বললেন, “স্যার, যে নিয়মে নৌকো জলে ভাসে, সেই একই নিয়মে জাহাজও জলে ভাসে। একই মাটি, একই খড়গড়ার বেলায় কখনো আমরা গড়ি মা দুর্গা, কখনও মা কালী ।” বলে জিবে একটা শব্দ করলেন কিকিরা। তারপর বললেন, “আপনি যদি ম্যাজিকের লাইনে থাকতেন স্যার, বুঝতে পারতেন, খেলাটা একই, তবে এক একজন এক একভাবে দেখায়, সামান্য অদলবদল করে। ভুজঙ্গ খেলাটাকে একটু অন্যভাবে দেখাত।”
চন্দন বলল, “কেমন করে?”
কিকিরা বললেন, “ব্যাপারটা খুব কঠিন নয়। আপনারা হাতে পরার দস্তানা দেখেছেন তো? নরম শক্ত অনেক রকম দস্তানা থাকে। যদি বলি মেয়েটি পায়ের দস্তানা পরত–তা হলে?”
অবিশ্বাসের সুরে তারাপদ বলল, “কী বলছেন?”
“ঠিকই বলছি স্যার, তবে বলায় একটু ভুল হয়েছে। দস্তানা না বলে বলা উচিত পায়ের ঢাকনা, অবিকল পায়ের পাতার সামনের দিকটার মতন।” বলতে বলতে কিক্রি নিজের ডান পা তুলে ধরে দেখালেন। বললেন, “এই যে আঙুল দেখছেন–ঠিক এইরকম আঙুল-অলা একটা কাঠের কিংবা খুব শব্দ রবারের, বা মেটালের ফলস্ পায়ের পাতা দরকার । পুরো পাতা না হলেও চলে, আধখানা হলেই যথেষ্ট। মেয়েটা এই রকম ফলস্ আঙুল-অলা পায়ের পাতা পরে থাকত। দরকারের সময় সে এই খোপের মধ্যে থেকে পা বার করে নিত, আপনারা বুঝতে পারতেন না।”
তারাপদ বোকার মতন তাকিয়ে থাকল। বিশ্বাস হচ্ছিল না যেন। বলল, “আমাদের পায়ের আঙুল তার পায়ের আঙুলের সঙ্গে ছোঁয়ানো থাকত।”
“না, কখনোই নয়, কিকিরা বললেন, “আপনারা ভাবতেন মেয়েটির পায়ের আঙুলের সঙ্গে আপনাদের পায়ের আঙুল ছোঁয়ানো আছে। কিন্তু তা থাকত না। আপনারা তার নকল পায়ের পাতার নকল আঙুলে নিজেদের আঙুল ছুঁইয়ে রাখতেন। আর সেই মেয়েটি দরকারের সময় ঢিলেঢালা ওই নকল পায়ের পাতা থেকে নিজের পা বার করে নিয়ে ঘণ্টা বাজাত।”
চন্দন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলল, “মাই গড়। ওই জন্যেই মেয়েটির পায়ের আঙুল আমার একদিন শক্ত-শক্ত লেগেছিল।”
তারাপদরও খেয়াল হল, তারও প্রথম দিন শক্ত-শক্ত লেগেছিল। চন্দন বলল, “তারা, তোর মনে আছে–আমি তোর সঙ্গে একদিন জায়গা বদল করে নিয়েছিলাম। যেদিকে মেয়েটা ঘণ্টা এনে রাখত সেদিকের চেয়ারে বসেছিলাম। আমার সেদিন কেমন মনে হয়েছিল মেয়েটির পায়ের আঙুল বেশ শক্ত।”
তারাপদ অস্বীকার করতে পারল না। চুপ করে থাকল। চন্দন খানিকটা উত্তেজনার গলায় বলল, “কিকিরা স্যার, মেয়েটা তা হলে একটা মাত্র পায়ে ফলস ফুট পরত?”
“খুব সম্ভব তাই পরত। যেদিকে ঘণ্টা থাকত–সেই দিকের পায়ে পরত।“
“ওই পায়ে ঘন্টা বাজাত?”
“কোনো সন্দেহ নেই।”
“অত বড় ঘণ্টা পায়ের আঙুলে ধরে কেমন করে বাজাত?”
“ওটা অভ্যাসের ব্যাপার। অভ্যাসে মানুষ সবই শেখে। সাকাসের খেলা দেখেছেন তো! আপনি আমি পারব না। কিন্তু যে শিখেছে সে পারবে। অত কথায় দরকার কী স্যার, সামান্য একটা শাঁখ যদি আপনাকে বাজাতে বলি আপনি পারবেন না–অথচ কত ছোট-ছোট মেয়েরা কেমন চমৎকার শাঁখ বাজায়!”
তারাপদ আর. যেন কথা বলতে পারছিল না। এখন তার বিশ্বাস হচ্ছিল ভুজঙ্গ আগাগোড়া তাদের সঙ্গে ধাপ্পা মারছে! কিন্তু তাই কি?, সবই ধাপ্পা? মোমের আঙুলটাও ধাপ্পা?”
কিকিরা বললেন, “একটা কথা কিন্তু বলে রাখি। যে-ঘণ্টাটা পায়ের সামনে এনে রাখা হত–সেটা হয়ত আপনাদের ধোঁকা দেবার জন্যে। দেখানো হত–আত্মা কেমনভাবে এসে ঘণ্টা তুলে নিয়ে বাজায়। আসলে টেবিলের তলার দিকে লুকোনো একটা ঘণ্টা ঝুলানো থাকত। কিংবা এমনও হতে পারে–মেয়েটি পায়ের আঙুলে ঘণ্টার মুণ্ডুটা আঁকড়ে ধরে বাজাত। এতে অবশ্য কিছুই আসে যায় না। মোদ্দা কথা পা দিয়েই ঘণ্টা বাজানো হত?”
কেউ কোনো কথা বলল না কিছুক্ষণ। তারাপদর দীর্ঘ নিশ্বাস শোনা গেল।
সামান্য পরে ভারী গলায় তারাপদ বলল, “আপনি বাবার কথা তখন কী বলছিলেন? ভুজঙ্গই বাবাকে মেরেছে?”
কিকিরা বললেন, “সেকথাও বলব। তবে এখানে আর নয়–বাইরে চলুন।”
নিজের ঘরে এনে কিকিরা তারাপদদের বসালেন। আবার একবার দেহাতী চা খাওয়া হল। চন্দনের কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে নিয়ে ধরালেন কিকিরা । জোরে-জোরে টান মারলেন। তারপর তারাপদর দিকে তাকালেন।
কিকিরা বললেন, “তারাপদবাবু, এবার আপনার বাবার কথা শুনুন। আপনার বাবাকে আমি কখনো চোখে দেখিনি। তবে তাঁর কথা শুনেছি। মানুষটি বড় ভাল ছিলেন, সরল সাদাসিধে। তাঁর মন খুব নরম ছিল, সামান্যতেই ছটফট করতেন, কেঁদেকেটে মরতেন। আপনার ছোট বোন পরী যখন ওইভাবে আচমকা একটা দুর্ঘটনায় মারা গেল, তিনি একেবারে পাগলের মতন হয়ে গেলেন।”
তারাপদ তখনকার কথা মনে করবার চেষ্টা করল। ওই বয়েসের কথা স্পষ্ট করে কিছুই মনে পড়ে না, অস্পষ্ট করেও বা কতটুকু মনে পড়তে পারে । পরী মারা যাবার পর সমস্ত বাড়িটাই কেমন ফাঁকা, ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। বাবা, মা, সে নিজে–সকলেই যে যার মতন কেঁদে মরত।
কিকিরা বললেন, “মন একেবারেই ভেঙে গিয়েছিল আপনার বাবার। এই সময়ে মানুষ বড় দুর্বল হয়ে পড়ে। তার মতি নষ্ট হয়। আপনার বাবা সেই সময় পরলোক, আত্মা–এইসব ব্যাপার নিয়ে লেখা বইটই পড়তেন, নানা লোকের কাছে গল্প শুনতেন, লুকিয়ে লুকিয়ে প্ল্যানচেট করতে বসতেন। আপনার মা এ-সব একেবারেই পছন্দ করতেন না।…যাই হোক, এই সময় একবার আপনাদের সাধুমামা কলকাতার বাড়িতে এলেন। আপনার বাবা তাঁকে ধরলেন। সাধুমামাও আপনার বাবার অবস্থা দেখে তাঁকে ভুজঙ্গভূষণের কাছে নিয়ে যেতে চাইলেন। লুকিয়ে। সেই যাওয়াই কাল হল।”
তারাপদর বুকটা কেমন যেন করে উঠল। দুঃখে না রাগে বোঝা গেল না। উত্তেজনাতেও হতে পারে। কিকিরার দিকে সে তাকিয়ে থাকল।
“সাধুমামা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার দু-দিন দিন পরে আপনার বাবা চুরি করে লুকিয়ে ভুজঙ্গভূষণের কাছে হাজির। ভুজঙ্গকে হাতে পায়ে ধরলেন–আমার মেয়েকে একবার দেখান। ভুজঙ্গ তো মেয়ে দেখাল না, কিন্তু মেয়ের আত্মাকে দেখাল, যেমন করে আপনাদের দেখিয়েছে। মেয়ের পুরো হাতের একটা মোমের ছাঁচও দেখাল। সেই ছাঁচ বুকে করে আগলে আপনার বাবা কলকাতায় ফিরে এলেন। কিন্তু আসবার পথেই তাঁর মাথায় কী যে হল, একেবারে অন্য মানুষ। কথাবার্তা বলতেন না, কাজকর্মে যেতেন না, বোবা হয়ে থাকতেন, পাগলের মতন তাকাতেন। আপনার মা কিছুই জানলেন না। আপনার বাবার অসুখ করল–মাথার গোলমালের দরুনই হবে। অল্প ক’দিনের মধ্যে তিনি মারা গেলেন। সেই মোমের ছাঁচটার কী হল আমি জানি না। হয় আপনার বাবা নিজেই নষ্ট করে ফেলেছিলেন, না হয় আপনার মা কিছু না-জেনেই ফেলে দিয়েছিলেন।”
তারাপদর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বুক ধকধক করছিল। চন্দনও যেন। বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
কিকিরাও অনেকক্ষণ কথা বললেন না ।
চন্দন হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “মোমের ছাঁচ–মানে হাতের ওই ছাঁচ তৈরি করা যায়?”
কিকিরা বললেন, “যায়। পৃথিবীতে যেখানেই সেয়াঁসের আড্ডা বসে–সেখানেই এটা চালু আছে। আত্মা যে এসেছে তার প্রমাণ দেবার জন্যে ছাঁচ দেখানো হয়।”
“কেমন করে হয়?”
“সেটা আপনি এখানে আপনাদের দেখাতে পারব না। কারণ খানিকটা মোম আমি এ-জায়গায় জোগাড় করতে পারলেও রবারের একটা দুস্তানা জোগাড় করতে পারব না। তবে নিয়মটা বলে দিই । রবারের একটা দস্তানার মধ্যে জল ভরে দস্তানাটা ইচ্ছেমতন ফুলিয়ে নিতে হয়। তারপর সেটা ভাল প্যারাফিন বা মোমের মধ্যে ডুবিয়ে দিতে হয়। দস্তানার গায়ে মোম জমে গেলেই সেটা উঠিয়ে নিয়ে জলের পাত্রে ডুবিয়ে দিতে হয়। তারপদ দস্তানার ভেতরের জল ফেলে দিলেই রবারের দস্তানা কুঁচকে যাবে। সেটা বেরিয়ে আসবে । ছাঁচটা ঠিক থাকবে। এইভাবে আঙুল করা যায়, হাতের মুঠো করা যায়..। অনেক সময় এগুলো আগে থেকেই করা থাকে। সেয়াঁসের সময় লুকোনো জায়গা থেকে বার করে দেওয়া হয়।”
তারাপদ আর সহ্য করতে পারল না। রাগে, ক্ষোভে সে কাঁপতে লাগল। চিৎকার করে বলল, “এ সমস্তই তা হলে ধোঁকাবাজি? ব্লাফ?”
“সমস্তই।”
“আমার বাবাকে ভুজঙ্গ ভাঁওতা দিয়েছিল? আর বেচারি বাবা সেই ধোঁকাবাজিতে বিশ্বাস করে পাগল হয়ে গেল?”
“আমি তাই মনে করি। শুধু আমি কেন, আপনাদের সাধুমামা–মানে সাধনদাও তা জানে। সে এর সাক্ষী ।”
তারাপদ কেমন এক শব্দ করে উঠল। তারপর মুখ নিচু করে যেন মাথার চুল ছিঁড়তে লাগল নিজেরই। সে কেঁদে ফেলেছিল।
চন্দন চুপ। কিকিরাও চুপ। তারাপদকে সান্ত্বনা দিতেও পারছিলেন না।
কিছু পরে চন্দন চাপা গলায় বলল, “আপনি যা বললেন তা কি সবই সত্যি?”
কিকিরা বললেন, “সমস্তই সত্যিই। ঘণ্টা বাজানোই বলুন আর মোমের ছাঁচের কথাই বলুন, এর কোনোটাই আত্মা এসে করে দিয়ে যায় না। সবটাই ধোঁকা, চালাকি, হাত সাফাই । জাদুর রাজা হুডিনির নাম শুনেছেন? তিনি নিজে এইসব লোক-ঠকানো খেলা ধরে দিয়ে গেছেন। তাঁর বইয়ে যেমন-যেমন আছে, আমি ঠিক সেই-সেইভাবে ঘণ্টা বাজিয়েছি, রবারের দস্তানা থাকলে হাতের ছাঁচও গড়ে দেখিয়ে দিতাম।”
তারাপদ মুখ তুলল। তার মুখ কেমন যেন খেপার মতন দেখাচ্ছে, চোখের জলে গাল ভেজা। তারাপদ বলল, “ঠিক আছে, ভুজঙ্গকে আমি দেখছি। “
কিকিরা হাত তুলে বললেন, “না না, ওভাবে দেখা নয়। আমি বলে দেব কী ভাবে আপনারা তাকে দেখবেন। ভুজঙ্গ বড় চালাক, ভীষণ শয়তান। তা ছাড়া এটা কলকাতা নয়। এখানে ভুজঙ্গর অনেক শক্তি। তার সঙ্গে সোজাসুজি লড়া চলবে না। অন্য পথ আছে। চলুন–আপনাদের একটু এগিয়ে দিই। এগিয়ে দিতে দিতে বলব।“ কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন।
.
বারো
সন্ধের পর পর তারাপদ ভুজঙ্গভূষণের আত্মা-নামানোর সেই রহস্যময় ঘরে এসে বসল। আজ সে একা, চন্দন নেই। চন্দন আসবে না।
দুপুরটা যে কেমন করে কেটেছে, তারাপদ নিজেই শুধু জানে, আর জানে চন্দন। উত্তেজনায় যেন ফেটে পড়েছিল মাঝে মাঝে; দুঃখে ঘৃণায় এক এক সময় সে খেপার মতন কাণ্ড করছিল। চন্দন তাকে অনেক কষ্টে সামলেছে। বলেছে, “ওরকম করিস না তারা, ভুজঙ্গর কোনো চেলা যদি একবার বুঝতে পারে আমরা ভুজঙ্গর সিক্রেট জানতে পেরেছি তা হলে তুইও গেলি, আমিও গেলাম। নিজেকে কন্ট্রোল কর। তোকে এখন অ্যাক্টিং করতে হবে, কিকিরা যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছেন।”
চন্দন অনেক বুদ্ধিমান। তারাপদর ওই ছটফটে ভাবটাকে সে বুদ্ধি করে কাজে লাগাল। কম্বল মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে বলল বন্ধুকে। তারপর মৃত্যুঞ্জয়কে ডেকে পাঠাল। তারাপদকে বলল, “ভুজঙ্গর সঙ্গে আর একবার দেখা করতে চাস তুই; একলা। শেষবারের মতন তোর মা-বাবার কাছে দুটো কথা জানতে চাস। বুঝলি?”
তারাপদ সবই বুঝল। ভুজঙ্গর ওই ঘরে বসে আজ তাকে সত্যিই অনেক কিছু করতে হবে। কিকিরা বলে দিয়েছেন, বুঝিয়ে দিয়েছেন।
মৃত্যুঞ্জয় এল, চন্দনই কথা বলল বেশি, তারাপদ কেমন ভেঙে পড়েছে, কী ভীষণ কান্নাকাটি করছে–এই সব বুঝিয়ে বলল, আজ আর-একবার সে ভুজঙ্গভূষণের সঙ্গে দেখা করতে চায়।
তারাপদ প্রায় কিছুই বলল না, বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে লাগল। তার চোখমুখ দেখে মৃত্যুঞ্জয় কী ভাবল কে জানে, ভুজঙ্গভূষণকে তারাপদর কথা বলতে গেল। খানিকটা পরেই আবার ফিরে এল, বলল, “হ্যাঁদেখা হবে।”
সেই দেখা করতেই তারাপদ এখন সন্ধেবেলায় ভুজঙ্গভূষণের রহস্যময় ঘরে এসে বসেছে। একলা।
তারাপদ চুপচাপ বসেই থাকল। আজ ক’দিন আসা-যাওয়া করতে করতে এই ঘর তারাপদর চেনা হয়ে গেছে। অভ্যেসও হয়ে এসেছে অনেকটা। আগের মতন অতটা গা-ছমছম করে না। তবু এই ঘরের একটা ভৌতিক পরিবেশ রয়েছে, মন যেন অন্যরকম হয়ে যায়, বুকের মধ্যে শিরশিরে ভাব হয়।
তারাপদ এপাশ ওপাশ তাকাতে লাগল। এত অস্পষ্ট, প্রায়-ঘুটঘুঁটে ঘরে কোনো কিছুই ভাল করে দেখা যায় না। এই ঘর যেমন ছিল সেই রকমই রয়েছে। সেই একই মিটমিটে আলো, সেই ধূপধুনোর গন্ধ, সেই ভুজঙ্গভূষণের সিংহাসন, সেই বেড়াল ।
ছোট টেবিলের ওপর বসানো কালো বেড়ালটাকে দেখল তারাপদ। এই বেড়াল তাদের খুব অবাক করেছিল, ভয়ও পাইয়ে দিয়েছিল। আজ তারাপদ কালো বেড়ালটাকে দেখল। তার ভয় হল না। কেনই বা হবে? এটাও তো চালাকি, কিংবা মানুষকে বোকা বানিয়ে দেবার ফন্দি। চন্দন কিকিরাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন করে বেড়ালটা ঘুরে যায়?
কিকিরা হেসে হেসে বলেছিলেন, ঘড়ির কাঁটা যেভাবে ঘোরে। ঘড়িতে দুটো কাঁটা থাকে, ছোট কাঁটা আর বড় কাঁটা, যদি একটা থাকত কী হত? একটাই ঘুরত। খুব পুরনো আমলের বড় বড় দেওয়াল-ঘড়ি কিংবা দেরাজের ওপর রাখা ঘড়ি দেখেছেন স্যার? এক একটা ঘড়ি থাকত যার মধ্যে ঘণ্টার কাঁটার ওপর ছোট্ট রঙিন পাখি বসানো থাকত মেটালের। ঘণ্টার সঙ্গে সঙ্গে সেটাও ঘুরত। এটাও সেই রকম, তফাতের মধ্যে কী জানেন, ঘড়ির যন্ত্রপাতিগুলো নিচে আছে, আর ওপরে–কাঁটার বদলে একটা ফুঁকো বেড়াল, পেপার পাল্পের কিংবা হালকা কিছুর। ঠিক যেভাবে গ্রামোফোনের রেকর্ড ঘোরে–সেইভাবে বেড়ালটা ঘুরছে, তবে খুব ধীরে ধীরে–বোঝা যায় না। যদি একটা ওয়াল-ক্লক মাটিতে শুইয়ে রাখেন চিত করে তার কাঁটাও এইভাবে ঘুরবে।
তারাপদ কালো বেড়ালটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেবার আগেই স্তোত্রপাঠ শুরু হল। যেমন রোজই হয়–সেইরকম। দামি লাউডস্পিকারটা যে কোথায়, বোঝা যায় না, কিন্তু বড় নিখুঁত। এই নিঃশব্দ ঘরে চমৎকার শোনায়, মন ধীরে ধীরে কেমন যেন হয়ে যায়।
স্তোত্রপাঠ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সেই ক্ষীণ আলো নিবে গেল। নিবে গিয়ে ভুজঙ্গভূষণের বসবার দিকটায় লাল আলো জ্বলে উঠল । ভেলভেটের পরদা সরিয়ে ভুজঙ্গভূষণ এলেন, সেই একই রক্ত-গৈরিক বসন, গলায় রুদ্রাক্ষ মালা, মুখ মুখোশে ঢাকা।
নিজের আসনে বসলেন ভুজঙ্গভূষণ। তাঁর পায়ের দিকে একপাশে ঘণ্টা।
তারাপদ এইবার ভয় পেতে শুরু করল। উত্তেজনা আর ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছে। আজ যে কী হবে শেষ পর্যন্ত সে জানে না। হয়ত ভীষণ কোনো বিপদে পড়বে, তেমন কিছু ঘটলে বাঁচবে না মরবে–কে বলতে পারে । মনের এই ভয়ের ভাবটাও কাটাবার জন্যে প্রাণপণে তারাপদ বাবার কথা ভাবতে লাগল। এই লোকটা–ওই ভুজঙ্গভূষণ তার সরল, ভালোমানুষ, সাদাসিধে স্বভাবের বাবাকে কী ভীষণ প্রবঞ্চনা করেছে। শুধু প্রবঞ্চনা নয়, সেই প্রবঞ্চনার দরুন তার বাবা-বেচারি মিথ্যেকে সত্য বলে জেনেছে। বাবা-বেচারির হয় মানসিক আঘাত লেগেছিল, না হয় বাবা মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতে পাগলের মতন হয়ে পড়েছিল। তাতেই বাবার অসুখ, আর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই মৃত্যু।
এই সমস্তর জন্যে ওই ভুজঙ্গই দায়ী। বাবাকে ওই লোকটাই মেরেছে। তারাপদদের সংসার, তাদের জীবন, এত দুঃখকষ্ট, মার অত কষ্ট সওয়াসবই ওই শয়তানটার জন্যে। তারাপদ কেমন করে লোকটাকে ক্ষমা করবে?
তারাপদকে চমকে দিয়ে ভুজঙ্গভূষণই কথা বললেন, “তারাপদ, তুমি আজ আবার আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছ কেন? আমার শরীর ভাল নেই, ভাবছিলাম বিশ্রাম করব।”
প্রথমে কথা বলতে পারল না তারাপদ, গলা কাঠ হয়ে থাকল। বার দুই গলা পরিষ্কার করে শেষে কাঁপা কাঁপা গলায় তারাপদ বলল, “আপনার সঙ্গে আমার ক’টা কথা ছিল।”
“বলো।”
একটু থেমে নিজেকে সামলে নিতে নিতে তারাপদ বলল, “কাল সারারাত আমি ঘুমোত পারিনি, শুধু ভেবেছি। আজও সারাদিন ভেবেছি। আমার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছি।” বলে আবার একটু থামল তারাপদ, তারপর গলায় যতটা সম্ভব আবেগ দিয়ে বলল, “পিসেমশাই, আপনি রাগ করবেন না, আপনার। কথামতন আমি চলতে রাজি। কিন্তু আর একবার, একটিবার মাত্র আমি মা-বাবার কাছে তাঁদের আদেশ জানতে চাই। মনে কোনো খুঁত রাখতে চাই না। আপনি দয়া করে আজ একবার ওঁদের ডাকুন।”
“আবার?” ভুজঙ্গভূষণ বললেন।
“শুধু আজকের মতন-” তারাপদ মিনতি জানাল।
“তোমার মনে কি এখনো সন্দেহ আছে, তারাপদ? তোমার মা বাবার যা ইচ্ছে সে তো আগেই জেনেছ।”
“আমার কোনো সন্দেহ নেই। তবু সব ছেড়েছুঁড়ে যখন আপনার এখানে চলে আসব ভাবছি–তখন আসবার আগে আর একবার মা বাবার আদেশ নিতে চাই।”
দু মুহূর্ত অপেক্ষা করে ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “বেশ। আজই তোমায় মনঃস্থির করতে হবে, আর সময় পাবে না।”
ভুজঙ্গভূষণ ঘণ্টা বাজালেন। মৃত্যুঞ্জয় এল ।
কিছু যেন বললেন ভুজঙ্গভূষণ, তারাপদ কিছুই শুনতে পেল না, বুঝতেও পারল না। মৃত্যুঞ্জয় চলে গেল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমার বন্ধু কবে ফিরবে?”
“ফিরবে। শীঘ্রি।”
তারাপদ বেশি কথা বলল না। কিছু না বলে চুপ করে থাকাই ভাল। কথা ঘুরোবার জন্যেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণেই হোক, তারাপদ আচমকা বলল, “পিসেমশাই, একটা কথা বলব?”
“বলো।”
“আপনার এই ঘরবাড়ি সম্পত্তি আপনি কেন আমায় দিয়ে যেতে চাইছেন?”
“কেন চাইছি তোমায় বলেছি। আমার নিজের বলতে কেউ নেই, তুমি ছাড়া। আমি যা করেছি ও রেখেছি, তা তোমার হাতে থাকলেই খুশি হব। “
মৃত্যুঞ্জয় ততক্ষণে আবার ফিরে এল। ভুজঙ্গভূষণকে কিছু বলল মুখটা নামিয়ে । ভুজঙ্গ ইশারায় ঘরের দিকে আঙুল দিয়ে কী দেখালেন। চলে গেল মৃত্যুঞ্জয়। একটু পরেই আর-একজন এল, ঘরের মধ্যে আবার ধুনো দিয়ে গেল, লুকোনো জায়গায় ধূপ বসিয়ে গেল।
ঘরটা আবার ধোঁয়ায় আরও অস্পষ্ট হল। ধুনো-গুগগুলের গন্ধে চাপা বাতাস ভারী হয়ে উঠল।
আর-একটু পরেই সেই মেয়েটি এল। কালো শাড়ি জামা পরা, মাথায় এলো চুল। এল, ভুজঙ্গর সামনে দাঁড়াল, তারপর ঘণ্টাটা তুলে নিয়ে গোল টেবিলের অন্যদিকে বসল। আজ চন্দন নেই, সে থাকলে যেমনভাবে তিনজনে গোল হয়ে বসা যায়, কানামাছি খেলার মতন হাত ছড়িয়ে-তেমনভাবে বসা গেল না। মুখোমুখি বসতে হল; সকালে কিকিরার সামনে যেমনভাবে বসেছিল তারাপদ।
নতুন করে শেখাবার কিছু নেই। তারাপদ টেবিলের ওপর হাত ছড়িয়ে দিল, পা বাড়িয়ে দিল টেবিলের তলা দিয়ে। মেয়েটিকে একবার ভাল করে দেখল। অন্য দিনের চেয়ে আজ যেন মেয়েটিকে শুকনো দেখাচ্ছে। রোগা মুখ আরও শুকনো।
এরপর রোজই যেমন হয়–সেই রকম। ঘরের বাতি নিবে গেল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। টেবিলের ওপর তারাপদ হাত বাড়িয়ে মেয়েটির হাত ধরে রেখেছে। তার পায়ের আঙুলের সঙ্গে মেয়েটির পায়ের আঙুল ছোঁয়াননা। ভুজঙ্গভূষণ তাঁর গম্ভীর গলায় বললেন, “তারাপদ, তুমি তোমার মার কথা ভাব। তাকে ডাকো। মন যেন চঞ্চল না হয়!”
তারাপদ মা বাবার কথা ভাবল না। কোনো প্রয়োজন নেই।
খুব সতর্ক ছিল তারাপদ। সমস্ত কিছু অনুভব করার চেষ্টা করছিল। চোখ খুলছিল মাঝে মাঝেই। যদিও চোখ খোলার কোনো অর্থ হয় না। এই জমাট অন্ধকারে এক বিঘত দূরের জিনিসও বিন্দুমাত্র চোখে পড়ে না।
প্রথমেই একটা জিনিস অনুভব করতে পারল তারাপদ। মেয়েটির ডান পায়ের আঙুল শক্ত শক্ত লাগলেও বাঁ পায়ের আঙুল অত শক্ত লাগছে না। তার মানে, আগের কদিন মেয়েটির দুটি পায়ের একটি চন্দন ছুঁয়ে থাকত, অন্য পা ছুঁয়ে থাকত তারাপদ। একই লোকের পক্ষে এই তফাত বোঝার উপায় ছিল না, মেয়েটির এক পায়ের আঙুল কেন কাঠের মতন শক্ত, অন্য পায়ের আঙুল স্বাভাবিক? এই তফাতটুকু কেন?
তারাপদ খুব সহজেই এই ধাঁধা ধরে ফেলতে পারল। মেয়েটি তার ডান পায়ে নকল পাতা পরে। সেই পা কাঠ কিংবা শক্ত রবারের পায়ের ফাঁপা পাতা থেকে বের করে নিয়ে ঘণ্টা বাজায়। কিকিরা ঠিকই বলেছেন।
আজও মেয়েটি ঘণ্টা বাজাতে পারবে। সে সুযোগ তারাপদ তাকে দেবে।
নিস্তব্ধ ঘরের মধ্যে সত্যিই এক সময় ঘণ্টা বেজে উঠল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “কে, বেণু? তুমি এসেছ?”
ঘণ্টা বাজল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “বেণু, তোমার ছেলে তোমায় ডেকেছে। সে তোমার আদেশ চায়। তোমাদের মনের ইচ্ছে তাকে জানাও…”
তারাপদ আত্মা আবিভাব, ঘণ্টা বাজানোর দিকে মন দিল না, ভুজঙ্গর কথাতেও নয়। খুব সাবধানে নিজের বাঁ পা দিয়ে মেয়েটির ডান পায়ের ফেলে রাখা নকল ফাঁপা পাতা আস্তে আস্তে টেনে নিতে লাগল। যে কোনো সময়ে এই চালাকি মেয়েটি বুঝে ফেলতে পারে। ভয় করছিল তারাপদর, শুধু সাবধানে সে তার কাজ করে যাচ্ছিল। এর আগে চন্দনও একদিন ঘণ্টা বাজানোর রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা করেছিল, কিকিরার কথা মতন। মাফলার থেকে ছিঁড়ে আনা সাদা উলের টুকরো ঘণ্টার পাশে ফেলে রেখেছিল। ধরবার চেষ্টা করছিল ঘন্টাটা কেউ তুলে নিয়ে বাজায় কিনা? মানুষেই হোক অথবা ভূতেই হোক, ঘণ্টা তুলে নিয়ে বাজানোর পর আবার যখন রাখবে–তখন একটুও নড়চড় হবে না, উলের টুকরোর ঠিক পাশেই থাকবে–এটা হতে পারে না। চন্দন দেখেছিল, ঘন্টা আর উলের টুকরো ঠিক জায়গাতেই আছে। তখন থেকেই চন্দনের সন্দেহ আরও বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই তুচ্ছ একটা প্রমাণ প্রমাণই নয়, আরও বড় প্রমাণ চাই।
ভুজঙ্গ আত্মা নামিয়ে যাচ্ছেন। বেণু গেল, বিষ্ণু এল। কথা বলছেন ভুজঙ্গ। তারাপদ ততক্ষণে তার কাজ সেরে ফেলেছে। বাজাক-টেবিলের তলায় গোপনে ঝুলিয়ে রাখা ঘণ্টা যত খুশি বাজাক মেয়েটি কিছু আসে যায় না তারাপদর।
আত্মারা শেষ পর্যন্ত বিদায় নিল। তারাপদ নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল, এবার মেয়েটি পা নামাবে, নামিয়ে তার নকল পায়ের পাতা খুঁজবে।
তারাপদ বুঝতে পারছিল মেয়েটি পা নামিয়েছে, পায়ের পাতা খুঁজছে। তার পা নড়ছে, শাড়িও নড়ছে। ঠিক জায়গায় নকল জিনিসটি না পেয়ে পা দিয়েই যেন চারদিক খুঁজছে, অন্ধকারে আমরা যেভাবে পায়ের চটি খুঁজি।
মেয়েটির হাতের আঙুলের ওপর সামান্য চাপ দেবার চেষ্টা করল তারাপদ, বোঝাতে চাইল-তুমি ধরা পড়ে গেছ। চলে যাও।
এইবার সেই ক্ষীণ বাতি জ্বলল। আত্মারা চলে যাবার সামান্য পরে যেমন রোজই বাতি জ্বলে ওঠে। মেয়েটি তারাপদর মুখের দিকে তাকাল। তার ফরসা মুখে ভয় ও বিস্ময়। চোখের পাতা পড়ল না মেয়েটির। কয়েক মুহূর্ত একই ভাবে তাকিয়ে থেকে মেয়েটি উঠে পড়ল। তারাপদর মনে হল, ভুজঙ্গকে বলে দেবে।
মেয়েটি কিছু বলল না। মুখ নিচু করে অন্য দিনের মতন ভুজঙ্গর পাশ দিয়ে চলে গেল।
তারাপদর এবার সত্যি সত্যিই বুক কাঁপছিল।
ভুজঙ্গ বললেন, “তোমার আর কিছু বলার আছে, তারাপদ?”
কথার জবাব দেবার আগে তারাপদ প্রাণপণে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছিল। শেষে বলল, “না। আর কিছু নেই।” একটু থেমে আবার বলল, “পিসেমশাই, পরীকে আজ আর-একবার দেখতে পাব না?”
ভুজঙ্গ যেন বিরক্তই হলেন; বললেন, “তোমায় আমি বারবার বলেছি–আত্মাদের যখন-তখন খেয়াল-খুশি মতন ডাকতে নেই। তাতে তাঁদের কষ্ট হয়।”
তারাপদ মনে মনে বুঝতে পারল, ভুজঙ্গ কেন বারবার পরীকে আনতে চান না। ধরা পড়ে যাবার ভয় রয়েছে। যতই চালাকি করে শিখিয়ে পড়িয়ে, কায়দা কানুন করে পরীর নাম দেখিয়ে ওই মেয়েটিকে আনা হোক না কেন–তবু ঘণ্টা বাজানোর চেয়ে এই ব্যাপারটা কঠিন। সামান্য ভুলচুক হলেই ধরা পড়ে যাবার ভয় রয়েছে। এই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে যে-কোনো মানুষের পক্ষে আসা, আর ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো মুশকিল। তার চেয়েও মুশকিল হল, একেবারে গায়ের সামনে এসে দাঁড়ানো রুমালে মাখানো সেন্টের গন্ধ নাকের কাছে ধরা, খুব আলগা করে মাথার ছড়ানো চুলের ছোঁয়া দিয়ে যাওয়া। কাল। তারাপদকে এইভাবে ঠকানো হয়েছে। যদি ওই মেয়েটি সামান্য ভুলচুক করত–তারাপদর গায়ে এসে পড়ত । হয়ত তারাপদ তখন উত্তেজনার মাথায় হাত বাড়িয়ে পরীকে ধরতে গিয়ে মেয়েটিকে ধরে ফেলত।
ভুজঙ্গ চতুর লোক। ঝুঁকি নিতে বারবার রাজি হবে না। কিন্তু তেমন একটা বড় ঝুঁকি কি ভুজঙ্গ নেয়? কিকিরা বলেছেন, এই সশরীরে আত্মা আসার ব্যাপারটা ব্ল্যাক ম্যাজিকের মতন। এখানে একটু অন্যরকম চালাকি করতে হয়। অন্ধকারে দেখা যাবার একরকম দূরবীন আছে। যুদ্ধের সময় রাত্রে ঝোঁপঝাড়ের আড়াল থেকে শত্রুরা গুলি ছুঁড়তে পারে ভেবে অন্ধকার দেখার জন্যে সৈনিকেরা এই দূরবীন ব্যবহার করে। একে বলে স্নাইপারস্কোপ। পরীর বেশে যখন মেয়েটি এসেছিল–তখন তার হাতে ওই দূরবীন ছিল, ছোট ধরনের। কাজেই এই অন্ধকারে সে সবই দেখতে পাচ্ছিল। কোনো অসুবিধে তার হয়নি।
তবু কখনো কখনো এ-সব কাজে ভুল হয়ে যায়। ভুজঙ্গ খুব সাবধানী।
তারাপদ বলল, “আমি তা হলে উঠি?”
ভুজঙ্গ বললেন, “তুমি মনঃস্থির করেছ?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি রাজি?”
“রাজি।”
“আমার সমস্ত শর্ত মানছ?”
“মানছি।”
“খুশি হলাম, তারাপদ। তোমায় আমি আমার আশীর্বাদ জানাচ্ছি।” বলে ভুজঙ্গ একটু চুপ করে থাকলেন, তারপর বললেন, “ঘন্টাটা আমার কাছে দিয়ে যাও।”
তারাপদ ঘণ্টা তুলে নিল। তার চেয়ারের পেছন দিকে পায়ের নকল পাতা পড়ে আছে। ভুজঙ্গর দেখার কোনো সম্ভাবনা নেই।
ভুজঙ্গভূষণের পায়ের কাছে ঘণ্টাটা নামিয়ে তারাপদ দাঁড়িয়ে থাকল।
ভূজঙ্গভূষণ হাত নেড়ে ইশারায় তারাপদকে তার নিজের জায়গায় ফিরে যেতে বললেন। ফিরে এল তারাপদ ।
ঘণ্টাটা বাজালেন ভুজঙ্গ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “তারাপদ, আমাদের পালনীয় কিছু আচার আছে, নিয়ম পদ্ধতি রয়েছে। আজ তোমায় তার জন্যে ব্যস্ত হবে না। কাল সকালে মৃত্যুঞ্জয় তোমাকে যেমন-যেমন বলবে তুমি সেইভাবে কাজ করবে। আজ আর তোমায় আমি বসিয়ে রাখব না। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, আমার সমস্ত শর্ত মেনে কাজ করলে এই আসনের তুমি হবে একমাত্র উত্তরাধিকারী। যদি প্রবঞ্চনা করো, ছলনা করো–তবে তার। শাস্তি কত ভয়ংকর হবে তুমি জানো না।”
তারাপদকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়েই ভুজঙ্গ ঘণ্টা বাজাতে লাগলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল । নিকষ কালো অন্ধকার।
সেই অন্ধকার যেন এবার পাতালের অন্ধকার বলে মনে হচ্ছিল। থমথম করছে সব, স্তব্ধ। আচমকা ভুজঙ্গভূষণের গলা শোনা গেল, বজ্রগম্ভীর। “আমার সঙ্গে প্রবঞ্চনা করলৈ তোমার কী হবে তুমি জানো না। সামনে তাকাও। দেখো।”
ভুজঙ্গর কথা শেষ হবার আগেই ঘরের মাথার দিকে ক্ষীণ একটা আলো জ্বলে উঠল । তারাপদ মাথা তুলে আলোটা দেখবার চেষ্টা করে মুখ নামাতেই ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল।
ঘরের মাঝখানে একটা রক্তাক্ত মুণ্ডু ঝুলছে। শরীর হিম হয়ে গেল তারাপদর। মাথা ঘুরতে লাগল। দু হাতে চোখ ঢাকল।
সমস্ত ঘর কাঁপিয়ে অট্টহাস্য হেসে উঠলেন ভুজঙ্গ। সেই হাসি যেন ঘরের বাতাসে ঘূর্ণির মতন পাক খেতে লাগল। অসহ্য। একেবারেই অসহ্য। চোখ ছেড়ে দিয়ে দু হাতে কান চেপে ধরল তারাপদ। আবার তাকাল। দেখল মুণ্ড নয়, একটা মাথার খুলি, টকটকে লাল রক্তে যেন চোবানো। তার চোখের গর্ত, মুখের হাঁ–বীভৎস। মাথার খুলিটা ঘরের একপাশ থেকে অন্য পাশ পর্যন্ত শূন্যে লাফাতে লাফাতে আসা-যাওয়া করছিল।
ভুজঙ্গভূষণ তখনো হাসছেন। তারাপদ টেবিলের ওপর মাথা থেকে বেহুঁশের মতন পড়ে থাকল।
.
রাত অনেক হয়েছে। বারোটা বাজতে চলল।
তারাপদদের ঘর অন্ধকার। সমস্ত বাড়ি নিস্তব্ধ। বাইরে প্রচণ্ড শীত।
চন্দন আর-একটা সিগারেট শেষ করে নিচু গলায় বলল, “আর দেরি করে লাভ নেই।”
চন্দনের বিছানার একপাশে কিকিরা সেই অলেস্টার পরে, মাথায় টুপি এঁটে বসে আছেন। গলায় মাফলার। অন্ধকারে তিনজনে বসে আছে। কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না।
তারাপদ তার বিছানায়। শীতের সবরকম সাজ তার পরনে। কিকিরা চাপা গলায় বললেন, “আরও পনেরো বিশ মিনিট অপেক্ষা করা যাক।”
তারাপদ বলল, “সাধুমামার দায়িত্ব আপনার।”
কিকিরা বললেন, “সাধনদার দায়িত্ব আমি ঠিক লোককে দিয়েছি। আপনি স্যার নিশ্চিন্ত থাকুন।”
চন্দন বলল, “আপনি আর আমাদের সম্মান করে আজ্ঞে-আপনি করবেন না কিকিরাবাবু, বড় লজ্জা লাগে।”
কিকিরা একটু হাসলেন, “তা হলে বলব না।”
তারাপদ বলল, “ওই মেয়েটির জন্যে আমার বড় ভয় হচ্ছে।”
“ভয়ের কিছু নেই,” কিকিরা ফিসফিস করে বললেন, “সাধনদা যদি বেঁচে থাকে–ওই মেয়েটিও বেঁচে থাকবে । ও হল সাধনদার ভাইঝি। ইন্দু। ছেলেবেলায় মা বাপ হারিয়ে অনাথ হয়ে পড়েছিল ও সাধনদা ওকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন অনাথ মেয়েকে মানুষ করবেন বলে। কিন্তু ও ভুজঙ্গর চোখে পড়ল । ভুজঙ্গ ওকে হাতে পেয়ে নিজের আত্মা নামানোর কাজে লাগাচ্ছিল।“
তারাপদ বুঝতে পারছিল, মেয়েটি আজ তাকে বাঁচিয়েছে। মেয়েটি তার নকল পায়ের পাতা খোয়া যাবার কথা ভুজঙ্গকে বলে দিতে পারত। বলেনি। বলেনি, কারণ মেয়েটি সাধুমামার কাছে সব শুনেছে।
তারাপদ বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ কেঁপে উঠল। কেমন শব্দ করল, বিড়বিড় করে কিছু বলল।
চন্দন বলল, “কী হল তোর?” তারাপদ বলল, “মাঝে মাঝেই সেই মড়ার মাথা-খুলিটা আমার চোখে ভেসে উঠছে। হরি। এখনো বমি আসছে।”
কিকিরা বললেন, “আপনার–তোমার নার্ভ বড় দুর্বল তারাপদ। তুমি কখনো ম্যাজিকে মেয়েদের পেট কাটা, স্টেজের ওপর কংকাল নেচে বেড়ানো দেখোনি? আশ্চর্য! আমি তো তোমায় বললাম, ওটা কিছু নয়। প্রথম দিন যেভাবে তোমরা রঙিন বল নাচতে দেখেছিলে, এটাও সেইভাবে নাচানো হয়েছে। সবই চালাকি। ওই খেলাটা হবার সময় মাথার ওপরে যে বাতিটা জ্বলে ওঠে–সেটা ব্ল্যাক ল্যাম্প। আর যে বস্তুটা নাচে তার গায়ে লাগানো থাকে লুমিনাস পেন্ট। পাশের ঘর থেকে কেউ একজন ওটা নাচায়। কেমন করে নাচায় তাও বলছি। তোমরা ভাল করে কিছু লক্ষ করোনি। করার মনও তোমাদের ছিল না। ওই ঘরের মাথায় কালো রঙ করা লম্বা তার ঝোলানো আছে। এক পাশ থেকে আরেক পাশ পর্যন্ত। সেই তারের সঙ্গে আবার কালো রঙ করা অন্য তারে রঙিন বলই বলো আর মাথার খুলিই বলো ঝোলানো আছে। পুলি জানো? কিংবা গোল গোল চাকা! চাকার গায়ে তার জড়িয়ে এই খেলা দেখানো হয়। একটা স্ট্রেট লাইনে একদিক থেকে অন্যদিকে টেনে নেওয়া কিংবা ঢিলে করা কিছুই নয়। ঢিলে করলে ঝুলবে, টানলে উঠবে। নাথিং বাট পুলি সিস্টেম। পুতুল নাচের মতন ব্যাপার, তবে পুলিটাই হচ্ছে এখানে আসল। আর ওই ব্ল্যাক ল্যাম্প। দুটো পুলি দিয়ে এ কাজ করতে হয়। পাশের ঘরে বসে ভুজঙ্গর কোনো চেলা এই ভূতের নাচ দেখায়।”
তারাপদ অত বুঝল না। তবে বুঝতে পারল, ঘণ্টা বাজানোর মতন এও একটা ধাপ্পা, ধোঁকা ।
চন্দন দেশলাই জ্বেলে ঘড়ি দেখল। বারোটা বাজতে দু মিনিট। ঘড়িটা দেখাল কিকিরাকে ।
কিকিরা মাথা নাড়লেন। “ডায়নামো দশটার পর বন্ধ হয়ে গেছে। আর চলবে না?”
“না”, চন্দন বলল, “সে ব্যবস্থা আমি করেছি। খারাপ হয়ে গেছে।”
“বেশ। তা হলে তারাপদ থাকবে আস্তাবলে, গাড়িতে ঘোড়া জোতা থাকবে। রামবিলাস থাকবে। সাধনদা, ইন্দু, আর তারাপদ গাড়ি করে পালাবে।” বলতে বলতে কিকিরা তাঁর লুকোনো ছোট টর্চটা বার করে নিয়ে জ্বালালেন একবার । নিবিয়ে দিলেন আবার।
“ফটক?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।
“খোলা আছে,” কিকিরা মুচকি হাসলেন। “এই বাড়িতে যারা থাকে তারা সকলেই ভুজঙ্গ নয়। দায়ে পড়ে থাকে। ভয়ে। দু-চারজন ভাল লোকও আছে যারা এই পাপের রাজ্য থেকে বেরিয়ে যেতে চায়, তারাপদ সাধনদার মতনই তারা একদিন এসে পড়েছিল, হয় কিছু পাবার আশায়, না হয় পেটের দায়ে। তারপর আর ফিরে যেতে পারেনি। মৃত্যু ছাড়া তাদের মুক্তি ছিল না। ওরাই আজ আমাদের সহায় সম্বল বন্ধু। নয়ত আমি কেমন করে এখানে এলাম বলো?”
তারাপদ কিছু বলল না। কিকিরা বিচিত্র মানুষ। এই লোকটির আসল পরিচয় আজও জানা গেল না।
বারোটা বাজতেই চন্দন উঠে দাঁড়াল।
কিকিরাও ধীরে-সুস্থে উঠলেন। টর্চ জ্বালালেন। বললেন, “আমার পকেটে দু বোতল পেট্রল আছে। ভুজঙ্গ শয়তানের আত্মার ঘর তাতেই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।…তুমি একটা কিছু নাও চন্দন। কিছু নেই?”
চন্দন পকেট থেকে পাতলা সরু ছুরিটা বার করল। বলল, “আপনি চলুন।”
তিনজনেই দাঁড়াল। পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল।
তারাপদ চন্দনকে বলল, “তোরা আগুন লাগিয়েই পালিয়ে আসবি। আমরা বাইরে থাকব।”
কিকিরা বললেন, “ভয় পেয়ো না, আমরা আসব। তোমরা সাবধানে থেকো।”
.
ফটকের বাইরে সামান্য তফাত থেকে তারাপদ দেখল, ভুজঙ্গভূষণের দোতলায় আগুন জ্বলে উঠেছে। শীতের বাতাসে দেখতে দেখতে দাউ দাউ করে আগুনটা যেন ছড়িয়ে যাচ্ছিল। দমকা হাওয়ায় আগুনের শিখা যেন ঝাঁপটা মারছে, আকাশের দিকে লকলক করে উঠে যাচ্ছে, তারপর ধোঁয়া হয়ে শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। চারদিকের জমাট অন্ধকার আলো হয়ে উঠল। ভীত, ত্রস্ত মানুষের কলরব। ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে ভুজঙ্গভূষণের বাড়ির চারদিক।
তারাপদ হঠাৎ কেমন আনন্দ অনুভব করল। প্রতিহিংসার আনন্দ। একজন শয়তানের সর্বনাশ হবার আনন্দ। তারপরই সে ব্যাকুল হয়ে উঠল । চন্দনের জন্যে, কিকিরার জন্যে। ওরা কোথায়?
একটু পরেই চন্দনকে দেখতে পেল। বাগান দিয়ে প্রাণপণে ছুটে আসছে।
কিকিরা! কিকিরা কোথায়?
চন্দন ফটক পর্যন্ত পৌঁছে যাবার পর তারাপদ এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। পরনে লাল গেরুয়ার বস্ত্র, গায়ে চাদর, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মুখে ব্যান্ডেজ এক উন্মাদ ছুটে আসছে। হাতে তার খঙ্গ। চোখে বুঝি দেখতে পাচ্ছে না। তবু ছুটে আসছে । গায়ের চাদরে আগুন জ্বলছে। চাদরটা ফেলে দিল ও নগ্ন গা।
তারাপদ চিৎকার করে ডাকতে লাগল, “চাঁদু–চাঁদু–চাঁদু, আমরা এখানে।”
চন্দন মুহূর্তের জন্যে দাঁড়াল। দেখল। তারপর ছুটতে ছুটতে গাড়ির কাছে এসে পড়ল।
চন্দন হাঁপাচ্ছিল।
“কিকিরা কোথায়?” তারাপদ ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল।
চন্দন আগুনের দিকে তাকাল। সমস্ত বাড়িতেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। কী ভীষণ কোলাহল হচ্ছে ওদিকে।
“কিকিরা কোথায়?” তারাপদ আবার বলল।
“আমরা একসঙ্গে ঘরে আগুন দিই। তারপর আর তাঁকে দেখিনি। কোথায় যে ছুটে চলে গেলেন!”
তারাপদ বিহ্বল হয়ে পড়ল। এখন কী করা যাবে? সেই উন্মাদ ততক্ষণে ফটকের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতের খড়গ উঁচু হয়ে আছে। আগুনের আলোয় ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। চারিদিকে পাগলের মতন তাকাচ্ছে। ও যে ভুজঙ্গ বুঝতে কষ্ট হয় না। তারাপদ বলল, “ভুজঙ্গ আমাদের খুঁজছে। কী করব?”
কম্বল মুড়ি দিয়ে সাধুমামা ঘোড়ার গাড়ির মধ্যে বসে ছিলেন। তাঁর পাশে ইন্দু। কালো চাদরে সর্বাঙ্গ ঢাকা। সে থরথর করে কাঁপছিল।
সাধুমামা বললেন, “গাড়িটাকে আরও একটু আড়ালে নিয়ে যেতে বলি।”
গাড়ির কোচোয়ানকে সাধুমামা কী যেন বললেন। কোচোয়ান হাতের লাগাম টেনে ঘোড়ার গাড়িটাকে আরও আড়ালে সরিয়ে নিয়ে গেল।
ভুজঙ্গর লোকেরা দু একজন প্রাণ বাঁচাতে বাগানে ছুটে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু কিকিরা কোথায়?
সময় বয়ে যাচ্ছে। প্রতি মুহূর্ত যেন কত দীর্ঘ! তারাপদ অস্থির হয়ে পড়ছিল, চন্দন বুঝতে পারছিল না তার কী করার আছে।
তারাপদ ব্যাকুল হয়ে বলল, “সাধুমামা, আমরা কী করব?” সাধুমামা বললেন, “ভুজঙ্গর বাড়িতে বন্দুক আছে। মৃত্যুঞ্জয় বন্দুক চালাতে পারে। সেও যদি এসে পড়ে আমরা বিপদে পড়ব।”
“কিন্তু কিকিরা?”
সাধুমামাও কিছু বলতে পারলেন না।
ভুজঙ্গ যেন কিছু অনুমান করে আরও কয়েক পা এগিয়ে এলেন। হঠাৎ চন্দন বলল, “কিকিরা!”
কিকিরাকে বাগানের কাছে দেখা গেল। প্রাণপণে ছুটে আসার চেষ্টা করছেন, পারছেন না। বাগানের লোকগুলো চিৎকার করে উঠল। কিকিরার ওভারকোটটা গায়ে নেই। হাতে। আগুন জ্বলছে কোটটায় দাউ দাউ করে। কিকিরা সেই কোটটাকেই আত্মরক্ষার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে লাঠি ঘোরানোর মতন চারপাশে ঘোরাচ্ছেন ।
ভুজঙ্গ কিন্তু দেখতে পেয়ে গিয়েছেন কিকিরাকে। ছুটে গেলেন । মাথার ওপর খাঁড়া তুলে।
তারাপদ ভয়ে চোখ বুজে ফেলল । চন্দন কেমন আর্তনাদ করে উঠল।
আবার যখন চোখ খুলল তারাপদ, দেখল, ভুজঙ্গর খাঁড়া কিকিরার মাথার ওপর। কিকিরা কোটটা ঘোরাচ্ছেন। আগুনের হলকায় খাঁড়া ঝকঝক করে উঠল। ভুজঙ্গর খাঁড়া পড়ল। কিকিরার মাথাতেই পড়ার কথা কিন্তু কেমন করে যেন সরে গেলেন কিকিরা, খাঁড়ার কোপ থেকে নিজেকে বাঁচালেন। ভুজঙ্গ ক্ষিপ্ত হয়ে আবার কিকিরার শরীর লক্ষ করে খাঁড়া তুললেন। তারাপদ বুঝতে পারছিল, কিকিরার হাত দুর্বল। এতক্ষণ তিনি নিজেকে ভাগ্যের জোরে, সামলেছেন–আর পারবেন না। চোখের সামনে মানুষটা মরবে।
পারলেন না কিকিরা, জ্বলন্ত কোটটা খাঁড়ায় জড়িয়ে গেল। ভুজঙ্গ প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন কোটটা ফেলে দেবার । কিকিরাও সেই ফাঁকে ছুটতে শুরু করেছেন।
কোচোয়ান রামবিলাস বলল, “সামালকে বসুন বাবুরা। জান বাঁচান।” বলতে বলতে রামবিলাস তার ঘোড়াকে হঠাৎ ঘুরিয়ে নিল ফটকের দিকে। তারপর চাবুক কষাল।
আচমকা চাবুক খেয়ে ঘোড়া লাফ মেরে উঠল। তারপরই সামনের দিকে ছুটল।
কিকিরার কোটের আগুন ভুজঙ্গর কাপড়ে লেগে গিয়েছিল। তিনি এই অবস্থাতেই ছুটে আসছিলেন, হাতের খাঁড়া থেকে কোটটা মাটিতে পড়ে গেছে।
রামবিলাস কোনো দিকে তাকাল না, সোজা ভুজঙ্গর দিকে গাড়ি ছুটিয়ে দিল।
তারাপদ পলকের জন্যে দেখল ভুজঙ্গ খাঁড়া তুললেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াটা তাঁর সামনে লাফ মেরে, ভুজঙ্গকে মাটিতে ফেলে দিয়ে ফটক পর্যন্ত ছুটে গেল ।
রামবিলাস ফটকের কাছ থেকে আবার গাড়িটা ঘুরিয়ে নিল। ফেরার সময় দেখল ভুজঙ্গ মাটিতে পড়ে আছেন। উপুড় হয়ে। তার খাঁড়া একদিকে, তিনি অন্যদিকে। কাপড়ে আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে।
কিকিরাকে গাড়িতে তুলে নিল রামবিলাস।
তারাপদ বলল, “আপনি এত দেরি করলেন কেন?”
কিকিরার কথা বলার শক্তি ছিল না। হাঁপাচ্ছিলেন। অনেকক্ষণ পরে বললেন, “মৃত্যুঞ্জয়কে খুঁজছিলাম। ভুজঙ্গর ঘরে সিন্দুক খুলে সে পাগলের মত টাকা-পয়সা সোনাদানা হাতড়াচ্ছিল। তাকে ঘরের মধ্যেই বন্ধ করে রেখে এলাম। জানলা দিয়ে লাফানো ছাড়া তার আর উপায় নেই।”
ভুজঙ্গর বাড়ি ছেড়ে গাড়িটা অনেক দূর চলে এল। এখনো দূরে তাকালে আকাশের একটা দিক লাল দেখায়। অথচ আশপাশে মাঠ আর ঝোঁপঝাড়ে অন্ধকার ঘন হয়ে আছে। শীতের বাতাস বইছে শনশন করে, ঘোড়ার গাড়ির চাকার শব্দ আর খুরের আওয়াজ উঠছে খটখট।
সাধুমামা বসে থাকতে থাকতে কেঁদে উঠলেন।
কিকিরা প্রথমে কিছু বললেন না, পরে বললেন, “সাধনদা, তুমি কাঁদছ কেন? আজ এতকাল পরে তোমার মুক্তি হল।”
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সাধুমামা কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, “আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হল। তারাপদর বাবাকে আমিই এনেছিলাম।”
কিকিরা বললেন, “তারাপদকেও তুমি এনেছ। ভুজঙ্গকে শেষ করবে বলে তুমি ধীরে ধীরে ধৈর্য কতকাল ধরে জাল ছড়িয়েছে সাধনদা। সেই জালে একে একে সবাই জড়িয়ে পড়েছে।”
সাধুমামা কাঁদতে কাঁদতে বললেন “না না, আমার কিসের সাধ্য। তুমিই তো করলে সব। তোমার ও কত ক্ষতি করেছিল আমি জানি।”
চন্দন জিজ্ঞেস করল, “কিকিরাবাবু, আপনি কে? আপনার সত্যিকারের পরিচয়টা জানতে পারি?”
কিকিরা তাঁর আগুনে ঝলসানো হাত সামলাচ্ছিলেন মনের জোরে। যন্ত্রণার শব্দও করছিলেন মাঝে মাঝে। বললেন, “আমি সাধনদার বন্ধু। কিঙ্করও বলতে পার । সাধনদা আমায় কলকাতায় খবর দিয়েছিল তোমরা শংকরপুরে আসছ।” বলে একটু থেমে কিকিরা আবার বললেন, “সলিসিটার মৃণাল দত্তর বাড়িতে যে বুড়ো মতন লোকটিকে তোমরা দেখেছ, সে আমাদের লোক। আমরা তাকে মধুপুর থেকেই সলিসিটার দত্তর বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম কাজে লাগাব বলে।”
তারাপদ চুপ করে ছিল। খানিক পরে বলল, “আপনি সত্যি সত্যি কে–আমরা জানি না। কিন্তু আপনার দয়াতেই আমরা বাঁচলাম।”
কিকিরা বললেন, “অতশত জানি না বাবা, তবে এটুকু জানি–তুমি যদি একবার ভুজঙ্গর ফাঁদে পা দিতে তুমিও ভুজঙ্গ হয়ে যেতে। পাপের পথ, লোভের পথ–মানুষ যদি একবার ধরে, সে আর সহজে ছেড়ে আসতে পারে না। দেড় দু লক্ষ টাকার সম্পত্তির লোভ থেকে তুমি বেঁচেছ।”
তারাপদ মনে মনে বলল, “হ্যাঁ, সে বেঁচেছে।” বেঁচে গিয়েছে।
১.২ রাজবাড়ির ছোরা
০১.
কলকাতায় তখনো শীত ফুরোয়নি। মাঘের শেষটেষ। পাড়ায়-পাড়ায় সরস্বতী পুজোর তোড়জোড় চলছে। আর মাত্র দিন দুই বাকি। এমন সময় আকাশ ঘুটঘুটে হয়ে আচমকা এক ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল! এমন বৃষ্টি যেন শ্রাবণ-ভাদ্রতেই দেখা যায়। এক রাত্রের ঝড়বৃষ্টিতেই কলকাতার চেহারা হল ভেজা কাকের মতন। সরস্বতী পুজোর তোড়জোড় জলে ভেসে যায় আর কি! ছেলের দল আকাশের এই কাণ্ড দেখে মহাখাপ্পা। কাণ্ড দেখেছ, বৃষ্টি আসার আর সময় হল না! বুড়োরা অবশ্য খনার বচন আউড়ে বলতে লাগল যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্যি রাজার পুণ্যি দেশ।
পুজোর ঠিক আগের দিন দুপুর থেকে আকাশ খানিকটা নরম হল। মেঘ আর তত ঘন থাকল না, হালকা হল, ফেটে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে বাতাসে উড়ে যেতে লাগল। ঝিরঝির এক-আধ পশলা বৃষ্টি আর হাওয়া থাকল। মনে হল, কাল সকালে হয়ত রোদ উঠবে।
বিকেলের দিকে টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে চন্দনরা এল কিকিরার বাড়ি। কিকিরার সঙ্গে চন্দনদের এখন বেশ ভাব। বয়েসে কিকিরা অনেকটাই বড়, নয়ত তিনি হয়ত গলায় গলায় বন্ধু হয়ে যেতেন তারাপদ আর চন্দনের। ঠিক সেরকম বন্ধু তো কিকিরা হতে পারেন না, তবু সৰ্কটা বন্ধুর মতনই হয়ে গিয়েছিল। কিকিরা তারাপদদের স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। আর তারাপদরাও কিকিরাকে যথেষ্ট মান্য করত, পছন্দ করত; রবিবার দিনটা তারা কিকিরার জন্যে তুলে রেখেছিল। বিকেল হলেই দুই বন্ধু কিকিরার বাড়ি এসে হাজির হত, গল্পগুজব, হাসি-তামাশা করে, খেয়েদেয়ে রাত্রে যে যার মতন ফিরে যেত।
দিনটা ছিল রবিবার। চন্দন আর তারাপদ কিকিরার বাড়ি এসে দেখে এক ভদ্রলোক বেশ দামি ছাতা আর কালচে রঙের নাইলনের বর্ষাতি গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের চোখমুখ দেখলেই মনে হয়, মানুষটি বেশ বনেদি। পুরোপুরি বাঙালি চেহারাও যেন নয়, চোখের মণি কটা, ভুরুর রঙও লালচে, লম্বা নাক, থুতনির তলায় ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি।
ভদ্রলোক যাবার সময় চন্দনদের একবার ভাল করে দেখে নিলেন।
উনি চলে গেলে দরজা বন্ধ করে কিকিরা তারাপদদের দিকে তাকালেন। হেসে বললেন, “এসো, এসো–আমি ভাবছিলাম আজ বুঝি তোমরা আর আসবে না।”
চন্দন বলল, “আসব না কেন, আজ আপনি আমাদের আফগান খিচুড়ি খাওয়াবেন বলেছিলেন।”
কিকিরা বললেন, “আফগানি খিচুড়ি, মুলতানি আলুর দম।..বৃষ্টি দেখে আমার মনে হচ্ছিল–তোমরা বোধ হয় আফগানি ভুলে গেছ।”
চন্দন বলল, “খাওয়ার কথা আমি ভুলি না।”
কিকিরা বললেন, “ভেরি গুড। যাও ঘরে গিয়ে বসো, আমি বগলাকে চায়ের জল চাপাতে বলি।”
পায়ের জুতো জলে-কাদায় কদাকার হয়ে গেছে। ছাতা রেখে, জুতো খুলে তারাপদ বাথরুম থেকে পা-হাত ধুয়ে এল। চন্দনও। এই বাড়িতে কোথাও তাদের কোনো সঙ্কোচ নেই। যেন সবই নিজের।
ঘরে এসে বসল দুজনে। বাতি জ্বলছে। যে-রকম মেঘলা দিন, বাতি বিকেল থেকেই জ্বালিয়ে রাখতে হয়। চন্দন কোণের দিকে চেয়ারে বসল। এই চেয়ারটা তার খুব পছন্দ। সেকেলে আর্মচেয়ার। বেতের বুনুনির ওপর কিকিরা পাতলা গদি বিছিয়ে রেখেছেন। হাত পা ছড়িয়ে, গা ডুবিয়ে দিব্যি শোয়া যায়। চন্দন বেশ আরাম করে বসে তারাপদকে ডেকে সিগারেট দিল, নিজেও ধরাল। কিকিরাকে যখন চিনত না চন্দনরা, এন্তার সিগারেট খেয়েছে। চেনাজানা হয়ে যাবার পর ওঁর সামনে সিগারেট খেতে লজ্জাই করত কিন্তু কিকিরা ঢালাও হুকুম দিয়ে দিয়েছেন, বলেছেন–”নো লজ্জা-শরম, খাও। তোমরা তো সাবালক ছেলে।”
চন্দন আরাম করে সিগারেট টানতে টানতে ঘরের চারপাশে তাকাতে লাগল। কিকিরার মতন এই ঘরটাও বড় বিচিত্র। পাড়াটাও কিছু কম বিচিত্র নাকি। ওয়েলিংটন থেকে খানিকটা এগিয়ে এক গলির মধ্যে বাড়ি। পার্ক সাকাসের ট্রামে উঠলেই সুবিধে। কিংবা পঁচিশ নম্বর বালিগঞ্জের ট্রামে উঠতে হয়। নানা জাতের মানুষ থাকে এপাশে। লোকে যাকে বলে অ্যাংলো পাড়া, সেই ধরনের। তবে শুধু অ্যাংলোই থাকে না, চীনে বেহারী বোম্বাইঅলাও থাকে। কিকিরার বাড়ির নিচের তলায় মুসলমান করিগররা দরজিগিরি করে, কেউ কেউ টুপি বানায়। পুরনো আমলের বাড়ি। বোধ হয় সাহেব-সুবোতেই তৈরি করেছিল। কাঠের সিঁড়ি মস্ত উঁচু ছাদ, কড়িবরগার দিকে তাকালে ভয়। হয়। কিকিরার এই দোতলার ঘরটি বেশ বড়। ঘরের গা লাগিয়ে প্যাসেজ। তারই একদিকে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা। কাজ চলার মতন বাথরুম। এক চিলতে পার্টিশানকরা ঘরে থাকে বগলা, কিকিরার সব্যসাচী কাজের লোক।
চন্দনরা যতবার কিকিরার ঘরে এসেছে, প্রায় বারেতে দেখেছে একটা-না-একটা নতুন জিনিস আমদানি করেছেন কিকিরা। এমনিতেই ঘরটা মিউজিয়ামের মতন, হরেক রকম পুরনো জিনিসে বোঝাই, খাট আলমারি দেরাজ বলে নয়, বড় বড় কাঠের বাক্স, যাত্রাদলের রাজার তরোয়াল, ফিতে-জড়ানো ধনুক, পুরনো মোমদান, পাদরি টুপি, কালো আলখাল্লা, চোঙঅলা সেকেলে গ্রামোফোন, কাঠের পুতুল, রবারের এটা সেটা, অ্যালুমিনিয়ামের এক যন্ত্র, ধুলোয় ভরা বই–আরও কত কী। কাচের মস্ত বড় একটা বল-ও রয়েছে, ওটা নাকি জাদুকরের চোখ।
চন্দন বলল, “তারা, কিকিরা নতুন কী আমদানি করেছেন বল তো?”
তারাপদ একটা বাঁধানো বইয়ের মতন কিছু নাড়াচাড়া করছিল, বলল “কী জানি! চাঁদু, এই জিনিসটা কী রে?”
চন্দন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। বই বলেই মনে হল তার। চামড়ায় বাঁধানো। তারাপদ মামুলি বই চিনতে পারছে না। মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি। চন্দন বলল, “কেন, বই।”
মাথা নেড়ে তারাপদ বলল, “বই নয়।”
“মানে?”
“বইয়ের মতনই অবিকল দেখতে। বই নয়। বাক্স।”
“বাক্স? কই দেখি।”
তারাপদ এগিয়ে এসে জিনিসটা দিল। হাতে নিয়ে দেখতে লাগল চন্দন। সামান্য ভারী। একেবারে বাঁধানো বইয়ের মতন দেখতে। আগেকার দিনে মরক্কো-চামড়ায় যেরকম বই বাঁধানো হত, বিশেষ করে বিদেশি দামি বইটই, সেই রকম। বই হলে পাতা থাকত। এর চারদিকই বন্ধ। ঘন কালো রঙের চামড়া দিয়ে মোড়া। আঙুল দিয়ে টোকা মেরে বোঝার উপায় নেই, কার্ডবোর্ড না পাতলা টিনের ওপর বোর্ড দিয়ে আগাগোড়া বাক্সটা তৈরি করা হয়েছে। কোথাও কোনো চাবির গর্তও চোখে পড়ল না।
চন্দন বাক্সটা নাড়াচাড়া করছে, এমন সময় কিকিরা ঘরে এলেন।
বাক্সটা হাতে তুলে নিয়ে দেখাল চন্দন।”এটা কি আপনার লেটেস্ট আমদানি?”
কিকিরার নিজের একটি বসার জায়গা আছে। নিচু সোফার মতন দেখতে অনেকটা, তার চারধারে চৌকো, গোল, লম্বা নানা ধরনের কুশন। রঙগুলোও বিচিত্র; লাল, কালো, সোনালি ধরনের। মাথার দিকে একটা বাতি। গোল শেড, শেডের গায়ে নকশা।
কিকিরা বসলেন। হেসে বললেন, “ঘণ্টাখানেক আগে হাতে পেয়েছি।”
“মনে হয়, চোরাবাজার, না হয় চিতপুর, কিংবা কোথাও পুরনো জিনিসের নীলাম থেকে কিনে এনেছেন।”
কিকিরা মাথা নাড়তে লাগলেন। তাঁর পোশাক বলতে একটা ঢলঢলে পাজামা, পায়ে চটি, গায়ে আলখাল্লা। আলখাল্লার বাহার দেখার মতন, যেন কম করেও দশ বারো রকমের কাপড়ের ছাঁট সেলাই করে কিকিরার এই বিচিত্র আলখাল্লা তৈরি হয়েছে।
তারাপদ নিজের চেয়ারে ফিরে গিয়ে বসেছে ততক্ষণে।
কিকিরা যেন খানিকটা মজা করার জন্যে প্রথমে কিছু বললেন না–শুধুই মাথা নাড়তে লাগলেন। শেষে মজার গলায় বললেন, “নো থিফমার্কেট, নো চিতপুর। সিটিং সিটিং রিসিভিং।”
চন্দন হেসে ফেলল। বলল, “ইংলিশ রাখুন। এটা কী জিনিস? বাক্স?”
কিকিরা চন্দনের দিকে হাত বাড়ালেন। বললেন, “স্যান্ডাল উড, ওই পদার্থটি নিয়ে আমার কাছে এসো। ম্যাজিক দেখাব।” চন্দনকে মাঝে মাঝে কিকিরা ঠাট্টা করে স্যান্ডাল উড বলে ডাকেন।
উঠে গেল চন্দন। কিকিরা তারাপদকে ডাকলেন, “ওই টিপয়টা নিয়ে এসো তো।”
কিকিরার সামনে টিপয় এনে রাখল তারাপদ। মাথার দিকের বাতি জ্বালিয়ে দিলেন কিকিরা। বাক্সটা হাতে নিয়ে একবার ভাল করে দেখে নিলেন। তারপর বললেন, “তোমরা চৌকোনা টিফিন বাক্স কিংবা পানের কৌটা দেখোনি? এটাও সেই রকম। তবে এর কায়দাকানুন খানিকটা আলাদা, একে জুয়েলবক্স বলতে পারো।” কিকিরা কথা বলতে বলতে বাক্সর সরু দিকের একটা উঁচুমতন জায়গা বুড়ো আঙুল টিপতে লাগলেন।
তারাপদরা দেখতে লাগল। যদি এটা কোনো বাঁধানো বই হত তা হলে বলা যেত-বইয়ের যেটা পুটের দিক–যেখানে পাতাগুলো সেলাই করা হয়–সেই দিকে শিরতোলা বা দাঁড়া-ওঠানো একটা জায়গায় কিকিরা চাপ দিচ্ছিলেন। বার কয়েক চাপ দেবার পর তলার দিকে পুটবরাবর পাতলা কিছু বেরিয়ে এল সামান্য। কিকিরা তার আলখাল্লার পকেট থেকে হাতঘড়ির চাবির মতন একটা চাবি বার করলেন। বললেন, “এই দেখো চাবি।”
হাতে একটা ম্যাগনিফায়িং গ্লাস থাকলে হয়ত আলপিনের মাথার সাইজের ফুটোটা দেখা যেত। আশ্চর্য, বাক্সর ডালা খুলে গেল। যেন স্প্রিং দেওয়া ছিল কোথাও ওপরের ডালা লাফিয়ে উঠল একটু।
চন্দন আর তারাপদ অবাক।
কিকিরা যেন আড়চোখে চন্দনদের মুখের ভাবটা দেখে নিলেন। হাসলেন মিটমিটে চোখে। তারপর ওপরের ডালাটা পুরোপুরি তুলে ধরলেন।
ঘাড় মুখ সরিয়ে নিয়েছিলেন কিকিরা। চন্দন আর তারাপদ প্রথমটায় যেন কিছুই বুঝতে পারল না। কী ওটা? মেয়েদের গয়নার মতন মনে হচ্ছে। চকচক করছে। কত রকমের পাথর! দুজনেই ঝুঁকে পড়ল। বাক্স থেকে বিঘতখানেক তফাতে মাথা রেখে হাঁ করে দেখতে লাগল। ভেলকি না ভোজবাজি? চোখের পলক আর পড়ে না।
ধীরে ধীরে জিনিসটা পরিষ্কার হয়ে আসছিল চোখে, মাথায় ভাসা-ভাসা একটা ধারণা জাগছিল। না, মেয়েদের গয়নাগাটি নয়। অন্য কিছু। কিন্তু কী?
তারাপদ বলল, “কী এটা?” কিকিরা বললেন, “একে বলে কিডনি ড্যাগার।”
“ড্যাগার? মানে ছোরা?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু ছোরা কোথায়? ওটা তো গয়নার মতন দেখতে।”
কিকিরা হাত বাড়িয়ে বাক্সটা তুলে নিলেন। বললেন, “যেটা গয়নার মত দেখছ, সেটা হল ছোরার বাঁট। দেখেছ একবার ভাল করে বাঁটটা? কত রকমের পাথর আছে জানো? দামি সবরকম পাথর রয়েছে। বাজারে এর দাম কত হবে আন্দাজ করতে পারো?”
চন্দন মুখ তুলেছিল। তারাপদও হাঁ করে কিকিরাকে দেখছে।
কিকিরাও মুগ্ধ চোখে সেই পাথর বসানো, কারুকর্ম করা বাঁটটা দেখছিলেন। নীলচে ভেলভেটের ওপর রাখা হয়েছে বাঁটটা। গয়নার মতনই কী উজ্জল, সুন্দর দেখাচ্ছে।
কিকিরা বললেন, “বাঁটটা দেখছ, ছুরিটা দেখতে পাচ্ছ না তো! ওটাই তোত সমস্যা।”
“সমস্যা?” চন্দন বলল।
“ব্যাপারটা তাই। বাঁটটা আছে, ছুরির দিকটা নেই!…ওটা জোগাড় করতে হবে।”
কিকিরার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই তারাপদরা বুঝতে পারল না। কিসের ছুরি, বাঁটটাই বা কোথা থেকে এল? কিকিরা কত টাকা খরচ করে এটা কিনলেন? অত টাকাই বা পেলেন কেমন করে? বড়লোক মানুষ তো কিকিরা নন।
একেবারে পাগলামি কাণ্ড কিকিরার। পুরনো জিনিস কেনার কী যে খেয়াল ওঁর-তারাপদরা বুঝতে পারে না।
চন্দন বলল, “আপনি এটা কিনলেন?”
“কিনব? এর দাম কত জানো? এখনকার বাজারে হাজার ত্রিশ-চল্লিশ তো হবেই–বেশিও হতে পারে।”
“তবে পেলেন কোথায়?”
কিকিরা এবার রহস্যময় মুখ করে বললেন, “পেয়েছি, তোমরা আসার সময় যে ভদ্রলোককে বেরিয়ে যেতে দেখলে, উনি আমায় এটা দিয়ে গেছেন।”
তারাপদ আর চন্দন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। ভদ্রলোককে মনে পড়ল। তেমন করে খুঁটিয়ে তো লক্ষ করেনি, তবু চেহারার একটা ছাপ যেন থেকে গেছে মনে।
তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “কে ওই ভদ্রলোক?”
কিকিরা তখনোও খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছিলেন ছোরার বাঁটটা, যেন তারিফ করছিলেন। কোনো জবাব দিলেন না।
চন্দন বলল, “কিকিরা স্যার, আপনি দিন দিন বড় মিস্টিরিয়াস হয়ে যাচ্ছেন।”
কিকিরা চোখ না-তুলেই রহস্যময় গলায় বললেন, “আমার চেয়েও এই ছোরার ইতিহাস আরও মিস্টিরিয়াস।”
চন্দন হেসে-হেসেই বলল, “আপনার চারদিকেই মিস্ত্রি, স্যার; একেবারে মিস্টিরিয়াস ইউনিভার্স হয়ে বসে আছেন।”
তারাপদ হেসে ফেলল। কিকিরাও মুখ তুলে হাসলেন।
এমন সময় চা এল। চা আর গরম গরম ডালপুরী।
কিকিরা শুধুই চা নিলেন। তারাপদ আর চন্দন যে যার নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে খাবার আর চা নিয়ে বসল। চন্দনদের জন্যে প্রতি রবিবারেই কিকিরাকে কিছু না-কিছু মুখরোচক খাদ্যের ব্যবস্থা রাখতে হয়। রান্নাবান্নাতেও হাত আছে কিকিরার।
ডালপুরী খেতে খেতে চন্দন বলল, “তা ইতিহাসটা বলুন?”
তারাপদরও ধৈর্য থাকছিল না। বলল, “ভদ্রলোক আপনার চেনা?”
কিকিরা বাক্সটা বন্ধ করে রেখেছিলেন আলগা করে। চা খেতে-খেতে বললেন, “ভদ্রলোক আমার চেনা নন, মানে তেমন একটা পরিচিত নন। গত পরশু দিন আগে এক জায়গায় আলাপ হয়েছিল।”
“কী নাম?” তারাপর আবার জিজ্ঞেস করল।
“দীপনারায়ণ। দীপনারায়ণ সিং।”
“কোথায় থাকেন?”
“এখন কয়েক দিনের জন্যে রয়েছেন পার্কসার্কাসে।”
চন্দন বলল, “ভদ্রলোকের চেহারায় একটা আভিজাত্য আছে।”
কিকিরা বললেন, “রাজ-রাজড়ার বংশধর, চেহারায় খানিকটা রাজ-ছাপ থাকবেই তো।”
তারাপদ বলল, “আপনার এই ক্রমশ আর ভাল লাগছে না কিকিরা, স্পষ্ট করে বলুন ব্যাপারটা।”
কিকিরা আরাম করে কয়েক চুমুক চা খেলেন। তারপর বললেন, “আগে কোনটা শুনবে, বংশের ইতিহাস, না ছোরার ইতিহাস? দুটোই দরকারি, একটাকে বাদ দিলে আরেকটা বোঝা যাবে না। আগে বংশের ইতিহাসটা বলি, ছোট করে।” কিকিরা একটু থামলেন, তাঁর জোব্বা থেকে সরুমতন একটা চুরুট বের করে ধরালেন। ধোঁয়া উড়িয়ে বললেন, “দীপনারায়ণের চার পুরুষের ইতিহাস শুনে তোমাদের লাভ হবে না। আমার আবার ওই বাবার বাবা তার বাবা–ওসব মনে থাকে না। সোজা কথাটা হল, আগেকার দিনে যারা ধন-সম্পত্তি গড়ে তুলতে পারত তারা এক-একজন রাজাগজা হয়ে উঠত সমাজে। দীপনারায়ণের কোনো পূর্বপুরুষ মুসলমান রাজার আমলে এক সেনাপতির সৈন্যসামন্তর সঙ্গে বিহার বাংলা-ওড়িশার দিকে হাজির হন। সৈন্যসামন্তরা যুদ্ধটুদ্ধ সেরে যখন ফিরে যায় তখন আর তাঁকে নিয়ে যায়নি। কেন নিয়ে যায়নি–তা জানা যায় না। হয় কোনো দোষ করেছিলেন তিনি, না হয় কোনো রোগটোগ হয়েছিল বড় রকমের। সেই পূর্বপুরুষই ওদিকে একদিন দীপনারায়ণদের বংশ স্থাপন করেন। তারপর দু পুরুষ ধরে মস্ত জমিদারি গড়ে তুলে, জঙ্গলের মালিকানা কিনে নিয়ে অনেক ঐশ্বর্য সঞ্চয় করেছিলেন। ব্রিটিশ রাজত্বে ছোট বড় রাজার তো অভাব ছিল না বাপু, দীপনারায়ণের বাপ-ঠাকুরদাও সেই রকম ছোটখাট রাজা হয়ে বসেছিলেন। দীপনারায়ণের বাবার আমলে সাহেব কোম্পানিরা কতকগুলো জায়গা ইজারা নেয়। মাটির তলায় ছিল সম্পদ-মিনারেলস। দীপনারায়ণের বাবা আদিত্যনারায়ণ ইজারার টাকাতেই ফুলেফেঁপে ঢোল হয়ে যান। ভদ্রলোক মারা যান শিকার করতে গিয়ে বন্দুকের গুলিতে।…এই ছোরাটা হল তাঁর–আদিত্যনারায়ণের। এ-দেশি ছোরা এরকম হয় না, এ-ছোরা বিদেশি। হয় তিনি বিদেশ থেকে তৈরি করে আনিয়েছিলেন–না হয় এদেশের কোনো বিদেশি কারিগর তাঁকে ছোরাটা তৈরি করে দিয়েছিল। আগেকার দিনে য়ুরোপ-টুরোপ-এ যখন তরোয়াল নিয়ে যুদ্ধ হত, তখন এই রকম সব ছোরাছুরি কোমরে গোঁজার রেওয়াজ ছিল। আদিত্যনারায়ণ অবশ্য কোমরে গুঁজতেন না। রাজবাড়িতে নিজের ঘরে রেখে দিয়েছিলেন। রাজবংশের ওটা পবিত্র সম্পদ।”
তারাপদ আর চন্দন মন দিয়ে কথা শুনছিল কিকিরার। চন্দন তার ডালপুরী শেষ করে ফেলল। তারাপদ ধীরে-সুস্থে খাচ্ছে।
কিকিরা বললেন, “এই ছোরাটাকে দীপনারায়ণেরা বিগ্রহের মতন মনে করেন, মান্য করেন। তাঁদের বিশ্বাস এই ছোরার দৈবশক্তি রয়েছে। কিংবা দৈবগুণ বলতে পারো। আমরা সোজা কথায় যাকে বলি মন্ত্রঃপূত, এই ছোরাও তাই। দীপনারায়ণ বলেছেন, কখনো কোনো কারণে যদি কেউ প্রতিহিংসার বশে, কিংবা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাউকে এই ছোরা দিয়ে আহত করেন, খুন করেন–তা হলে এই ছোরার মুখ থেকে রক্তের দাগ কোনোদিনই, হাজার চেষ্টাতেও উঠবে না। আর প্রতিদিন, একটু একটু করে, ছোরাটা ভোঁতা হয়ে যাবে, ছোট হয়ে যাবে।”
তারাপদ বলল, “সে কী!”
চন্দন অবিশ্বাসের গলায় বলল, “গাঁজাখুরির আর জায়গা হল না। দীপনারায়ণ আপনাকে ব্লাফ ঝেড়েছে।”
কিকিরা চন্দনকে দেখতে-দেখতে বললেন, “সেটা পরে ভেবে দেখা যাবে। আগে দীপনারায়ণ যা বলছেন সেটা শোনা যাক।”
“কী বলছেন তিনি?” চন্দন তুচ্ছতাচ্ছিল্যের গলায় বলল।
কিকিরা বললেন, “দীপনারায়ণ বলছেন, গত এক মাসের মধ্যে তাঁদের পরিবারে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে। দীপনারায়ণের ছোট ভাই জয়নারায়ণ খুন হয়েছেন।”
তারাপদ আঁতকে উঠে বলল, “খুন?”
কিকিরা বললেন, “এই ঘটনা ঘটে যাবার পর–খুবই আশ্চর্যের কথা–এই ছোরার বাক্স থেকে কেউ ছোরার ফলাটা খুলে নিয়েছে, শুধু বাঁটটা পড়ে আছে।”
চন্দন বলল, “তার মানে আপনি বলতে চান, দীপনারায়ণের ছোট ভাই জয়নারায়ণকে কেউ খুন করেছে এই ছোরা দিয়ে? খুন করে ফলাটা খুলে নিয়েছে?”
মাথা নেড়ে কিকিরা বললেন, “দীপনারায়ণ তাই মনে করেন। তাঁর ধারণা, যে জয়নারায়ণকে খুন করেছে সে এই ছোরা রহস্যটা জানে। জানে যে, ছোরার ফলা থেকে রক্তের দাগ মুছবে না–হাজারবার জলে ধুলেও নয়। তা ছাড়া ছোরার ফলাটা ক্রমশই ক্ষয়ে আসবে। কাজে-কাজেই পুরো ফলাটাই সরিয়ে ফেলেছে।”
“কিন্তু আপনি কি বলতে চান–এই ছোরার বাঁট থেকে ফলাটা খুলে ফেলা যায়?”
“যায়,” মাথা নেড়ে কিকিরা বললেন, “তোমরা ভাল করে ছোরাটা দেখলে বুঝতে পারতে বাঁটের নিচের দিকে সরু ফাঁক আছে। ওই ফাঁকের মধ্যে দিয়ে ফলা গলিয়ে–দু দিকের স্প্রিং টিপলে ফলাটা আটকে যায়।”
চন্দন এবার একটু চুপ করে থাকল। চা খেতে লাগল।
তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “কিডনি নাম হল কেন?”
কিকিরা বললেন, “ছোরার ওপর দিকের গড়নটা মানুষের কিডনির মতন। দু দিকে দুটো বরবটির দানা বা বিচির মত জিনিস রয়েছে, অবশ্য বড় বড় দানা, প্রায় ইঞ্চিটাক। এটা দু রকম কাজ করে। স্পিংয়ের কাজ করে, আবার ছোরা ধরার সময় ধরতে সুবিধেও হয়।
চন্দন রসিকতা করে বলল, “বোধ হয় মানুষের কিডনি ফাঁসাবারও সুবিধে হয়–কী বলেন কিকিরা? নামটাও তাই কিডনি ড্যাগার।”
কিকিরা কোনোরকম উচ্চবাচ্য করলেন না।
সামান্য চুপচাপ থেকে তারাপদ বলল, “ব্যাপারটা কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আর একটু পরিষ্কার হয়ে নিই। রাজবাড়ির পুরনো ইতিহাস এখন থাক। আসল ব্যাপারটা কবে ঘটেছে, কিকিরা?”
“মাসখানেক আগে।”
“রাজবাড়িতে?”
“হ্যাঁ। রাজবাড়ির লাইব্রেরি-ঘরে।”
তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
“তা কেমন করে বলব! কেন খুন হয়েছে আর কে খুন করেছে সেটাই তো জানার জন্যে এত–!”
চন্দন পাকা গোয়েন্দার মতন ভুরু কুঁচকে বলল, “রাজবাড়িতে কে কে থাকে?”
“রাজপরিবারের লোকরা। দীপনারায়ণের এক অন্ধ কাকাও আছেন-ললিতনারায়ণ। আদিত্যনারায়ণের বৈমাত্র ভাই।”
“জন্মান্ধ?”
“না, মান্সঙ্কয়েক হল অন্ধ হয়েছেন। খালি চোখে সূর্যগ্রহণ দেখতে গিয়ে।”
“বোগাস। ওরকম শোনা যায়, আসলে অন্য কোনো রোগ ছিল চোখের।”
“কাকার কেমন বয়েস?”
“ললিতনারায়ণের বয়স ষাটের কাছাকাছি। জয়নারায়ণের বছর বত্রিশ।”
“দীপনারায়ণ নিশ্চয় বছর-পঁয়তাল্লিশ হবেন?”
“আর একটু কম। বছর চল্লিশ। দীপনারায়ণের পর ছিলেন তাঁর বোন। তিনি এখন শ্বশুরবাড়ি মধ্যপ্রদেশে থাকেন।”
তারাপদ চা খাওয়া শেষ করে মুখ মুছল। বলল, “ছোরাটা থাকত কোথায়?”
“রাজবাড়িতে, দীপনারায়ণের ঘরে, সিন্দুকের মধ্যে।”
“কবে দীপনারায়ণ জানতে পারলেন ছোরার ফলা চুরি হয়েছে?”
কিকিরার চুরুট নিবে গিয়েছিল। চুরুটটা আঙুলে রেখেই কিকিরা বললেন, তা জয়নারায়ণ খুন হবার আট-দশ দিন পরে।”
“কেন? অত দিন পরে জানলেন কেন?”
কিকিরা বললেন, “জয়নারায়ণ যে ভাবে খুন হয়েছিলেন, তাঁকে যে ভাবে লাইব্রেরি ঘরে পাওয়া গিয়েছিল তাতে মনে হয়েছিল, ওটা দুর্ঘটনা। পরে একদিন আচমকা ছোরার বাক্সটা খুলতেই তাঁর চোখে পড়ে, ছোরার বাঁট আছে, ফলাটা নেই। তখন থেকেই তাঁর সন্দেহ।”
চন্দন বলল, “পুলিশকে জানিয়েছেন দীপনারায়ণ?”
“না। পুলিশ দুর্ঘটনার কথা জানে। অন্য কিছু জানে না। দুর্ঘটনায় জয়নারায়ণ মারা গেছেন এই কথাটাই ছড়িয়ে গেছে। তা ছাড়া ওই জঙ্গল-অঞ্চলে কোথায় পাচ্ছ তুমি থানা পুলিশ কলকাতার মতন। ওসব জায়গায় ডেথ সার্টিফিকেটও নেই, পোস্টমর্টেমও নেই। তার ওপর রাজবাড়ির ব্যাপার।”
তারাপদ বলল, “দীপনারায়ণের কথা আপনি বিশ্বাস করেছেন?”
কিকিরা বললেন, “বিশ্বাস-অবিশ্বাস আমি কোনোটাই করিনি। আমার কথা হল, কোনো দলেই ঝুঁকবে না। একেবারে মাঝামাঝি থাকবে। যখন দেখবে বিশ্বাসের দিক টানছে তখন বিশ্বাসের দিকে টলবে, যদি অবিশ্বাসের দিক টানে তবে অবিশ্বাসের দিকে ঝুঁকবে। আমার হল চুম্বকের কাঁটা–যেদিকে টানবে সেদিকে ঝুঁকব।”
চন্দন বলল, “আপনি যাই বলুন আমি বিশ্বাস করি না, কোনো ছোরার ফলার ওসব গুণ থাকতে পারে! এ একেবারে গাঁজাখুরি। ব্লাফ।”
কিকিরা চুরুটটা আবার ধরিয়ে নিলেন। আস্তে-আস্তে টানলেন। তারপর বললেন, “স্যান্ডাল উড়, আমাদের এই জগতে কত কী অদ্ভুত-অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে তার সব কি আমরা জানি। জানলে তো ভগবান হয়ে যেতুম।”
“আপনি তা হলে বিশ্বাস করছেন যে এমন ছোরাও আছে যার গায়ে রক্তের দাগ পড়লে মোছে না? আপনি বিশ্বাস করছেন, ইস্পাতেও ক্ষয় ধরে?”
মাথা নেড়ে নেড়ে কিকিরা বললেন, “আমি বিশ্বাস করছি না। কিন্তু যারা বিশ্বাস করে তারা কেন করে, সত্যিই তার কোনো কারণ আছে কিনা সেটা আমি খুঁজে দেখতে চাই।”
চন্দন চুপ করে থেকে বলল, “বেশ, দেখুন।…আপনি তা হলে গোয়েন্দাগিরিতে নামলেন?”
“মাথা খারাপ নাকি তোমার। আমি হলাম ম্যাজিশিয়ান। কিকিরা দি ম্যাজিশিয়ান। গোয়েন্দারা কত কী করে, রিভলবার ছেড়ে, নদীতে ঝাঁপ দেয়, মোটর চালায়; আমি তো রোগা-পটকা মানুষ, পিস্তল রিভলবার জীবনে হাতে ধরিনি।..তা ওসব কথা থাক। কথা হচ্ছে আগামী পরশু কি তরশু আমি তারাপদকে নিয়ে একবার দীপনারায়ণের রাজবাড়িতে যাচ্ছি! তুমি কবে যাচ্ছ?”
চন্দন অবাক হয়ে বলল, “আপনি যাচ্ছেন তারাপদকে নিয়ে?” কিকিরা বললেন, “দিন দশ-পনেরো রাজবাড়ির ভাত খেয়ে আসব। মন্দ কী।”
.
০২.
তারাপদর আর ঘুম আসছিল না। বটুকবাবুর মেসের কোথাও আর ছিটেফোঁটা বাতি জ্বলছে না বৃষ্টির দরুন ঠাণ্ডাও পড়েছে, খুব, এ-সময় লেপ মুড়ি দিয়ে তোফা ঘুম মারবে কোথায়, তা নয়, মাথার মধ্যে যত রকম এলোমেলো ভাবনা। আগের বার, যখন তারাপদর কপালে ভুজঙ্গ কাপালিক জুটেছিল, তখন দশ-পনেরোটা দিন মাথা খারাপ হয়ে যাবার অবস্থা হয়েছিল তার। তারাপদ নিজেই সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল, তার ভাগ্য নিয়ে অদ্ভুত এক খেলা চলছিল, মাথা খারাপ না হয়ে উপায় ছিল না তার। কিন্তু এবারে তারাপদ নিজে কোথাও জড়িয়ে নেই। তবু এত ভাবনা কিসের?
কিকিরা মানুষটি সত্যিই অদ্ভুত। এই ক’মাসের মেলামেশায় তারাপদরা বুঝতে পেরেছে, কিকিরা মুখে যত হাসি-ঠাট্টা তামাশা করুন না কেন, তাঁর একটা বিচিত্র জীবন আছে। স্পষ্ট করে, খুলে কিকিরা এখন পর্যন্ত কোনোদিন সে জীবনের কথা বলেননি। বলেছেন, সে-সব গল্প পরে একদিন শুনো, বললে মহাভারত হবে, তবে বাপু এটা ঠিক–আমি ম্যাজিকের লাইনের লোক। তোমরা ভাবো, ম্যাজিক জানলেই লোকে ম্যাজিশিয়ান হয়ে খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। তা কিন্তু নয়, কপালে না-থাকলে শেষ পর্যন্ত কেউ দাঁড়াতে পারে না। আমার কপালটা মন্দ। এখন আমি একটা বই লেখার চেষ্টা করছি ম্যাজিকের ওপর, সেই পুরনো আমল থেকে এ পর্যন্ত কেমন করে ম্যাজিকের ইতিহাস চলে আসছে বুঝলে?
তারাপদরা অতশত বোঝে না। কিকিরাকে বোঝে। মানুষটি চমৎকার, খুব রসিক, তারাপদদের স্নেহ করেন আপনজনের মতন। সত্যি বলতে কী, এতকাল চন্দন ছাড়া তারাপদর নিজের বলতে কেউ ছিল না, এখন কিকিরাকেও তারাপদর নিজের বলে মনে হয়।
কিকিরা যখন বলেছেন, তখন তারাপদকে সিংভূমের কোন এক জঙ্গলে যেতেই হবে তাঁর সঙ্গে। তবে দীপনারায়ণের ব্যাপারটা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার সময় তারাপদরা আবার কথাটা তুলেছিল। চন্দন কিকিরাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি যাঁকে চেনেন না জানেন না, তাঁর কথা বিশ্বাসই বা করছেন কেন, আর এইসব খুনখারাপির মধ্যে নাকই বা গলাচ্ছেন কেন?”
কিকিরা তখন যা বললেন, সেটা আরও অদ্ভুত।
এই কলকাতাতেই কিকিরার এক বন্ধু আছেন, যিনি নাকি আশ্চর্য এবং অলৌকিক এক গুণের অধিকারী। কিকিরার চেয়ে বয়েসে সামান্য বড়, নাম রামপ্রসাদ। সন্ন্যাসীধরনের মানুষ, কোনো মঠের সন্ন্যাসী নন, সাত্ত্বিক ধরনের লোক, চিতপুরের দিকে গানবাজনার যন্ত্র সারাবার একটা দোকান আছে তাঁর। একা থাকেন। এই মানুষটির এক অলৌকিকশক্তি আছে। অদেখা কোনো কোনো ঘটনা তিনি দেখতে পান। তাঁকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বা জানতে চাইলে তিনি চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকেন কিছুক্ষণ, তারপর ওই অবস্থায় যদি কিছু দেখতে পান সেটা বলে যান। যখন আর পান না, থেমে যান। সব সময় সব প্রশ্নের জবাবও দেন না। বলেন, তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। তাঁর এই অলৌকিক শক্তির কথা সকলে জানে না, কেউ-কেউ জানে। মুখে-মুখে তাঁর কথা খানিকটা ছড়িয়ে গেলেও মানুষটি অন্য ধাতের বলে তাঁকে নিয়ে হইচই করার সুযোগ হয়নি। নিজেও তিনি কারও সঙ্গে গলাগলি করছে চান না। একলা থাকতে ভালবাসেন। তবু গণ্যমান্য জনাকয়েক আছেন, যাঁরা রামপ্রসাদবাবুর অনুরাগী। কিকিরা রামপ্রসাদবাবুকে যথেষ্ট মান্য করেন।
রামপ্রসাদবাবুর বাড়িতেই কিকিরা দীপনারায়ণকে দেখেছিলেন। আলাপ সেখানেই। রামপ্রসাদবাবুই কিকিরাকে বলেছিলেন, “কিঙ্কর, তুমি এর ব্যাপারটা একটু দেখো তো, আমি ভাল কিছু দেখতে পাচ্ছি না।”
“চন্দন জিজ্ঞেস করেছিল, “রামপ্রসাদবাবু চোখ বন্ধ করে কী দেখতে পান?”
“ভূত আর ভবিষ্যৎ–দুইই কিছু কিছু দেখতে পান।” বলেছিলেন কিকিরা।
চন্দন ঠাট্টা করে বলেছিল, “দৈবজ্ঞ!”
কিকিরা বলেছিলেন, “যদি দৈবজ্ঞ বলতে চাও বলো, তবে ব্যাপারটা ঠাট্টার নয় চন্দন। তোমায় আগে বলেছি, আবার বলছি, এই জগৎটা অনেক বড়, বড়ই অদ্ভুত, আমরা তার কণার কণাও জানি না। তুমি রামপ্রসাদবাবুকে দৈবজ্ঞ বলে ঠাট্টা করছ, কিন্তু তুমি জানো না, বিদেশে–যেমন হল্যাণ্ডে সবচেয়ে পুরনো যে বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে সাইকলজির ডিপার্টমেন্টে বিশ বাইশজন এই ধরনের মানুষকে রেখে নিত্যিদিন গবেষণা চালানো হচ্ছে। এই বিশ বাইশজনকে আনা হয়েছে সারা য়ুরোপ খুঁজে–যাঁদের মধ্যে কমবেশি এমন কোনো অলৌকিক ক্ষমতা দেখা গিয়েছে যা সাধারণ মানুষের দেখা যায় না। ডাক্তার আর সাইকলজিস্টরা মিলে কত এক্সপেরিমেন্ট না করছে এদের ওপর। জানার চেষ্টা করছে–কোন্ ক্ষমতা এদের আছে, যাতে এরা যা চোখে দেখেনি তার কথাও কিছু না-কিছু বলতে পারে।”
কিকিরা যত যাই বলুন, চন্দন বিশ্বাস করেনি কোনো মানুষ অলৌকিক কোনো ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়।
তারাপদ চন্দনের মতন সবকিছু অবিশ্বাস করতে পারে না। বিশেষ করে কিকিরা যখন বলছেন। ব্যাপারটা যদি গাঁজাখুরি হত–কিকিরা নিজেই মানতেন না। ভুজঙ্গের আত্মা নামানো তিনি মানেননি। তারাপদ ঠিক বুঝতে পারছে না, কিন্তু তারও মনে হচ্ছে, কিছু থাকলেও থাকতে পারে। সাধারণ মানুষ সাধারণই, তারা কী পারে না-পারে, তা নিয়ে অসাধারণের বিচার হতে পারে না। রাজার ছেলে রাজাই হয়, এটা সাধারণ কথা, কিন্তু রাজার ছেলে সমস্ত কিছু ত্যাগ করে গৌতম বুদ্ধও তো হয়।
এই সব দশরকম ভাবতে-ভাবতে শেষ পর্যন্ত তারাপদ কখন ঘুমিয়ে পড়ল।
পরের দিন বিকেলে সে একাই কিকিরার বাড়ি গিয়ে হাজির। আজ সারাদিন আর বৃষ্টি নেই। তবে মাঝে মাঝে রোদ উঠলেও আকাশটা মেঘলা-মেঘলা। কলকাতা শহরে সব পুজোতেই হইচই আছে সরস্বতী পুজোর বেলায় কম হবে কেন! তারাপদর আজ টিউশানি নেই, কালও নয়। ছুটি। দু-চার দিন ছুটি নিতে হবে আরও। তারাপদর একটা চাকরির জন্যে কিকিরাও উঠে পড়ে লেগেছেন। বলেছেন, “দাঁড়াও, তোমায় আমি চাকরিতে না বসিয়ে মরব না।”
কিকিরা বাড়িতেই ছিলেন। বললেন, “এসো এসো। তোমার কথাই ভাবছিলাম।”
তারাপদ বলল, “কেন?”
কিকিরা বললেন, কালকেই আমাদের যেতে হবে, বুঝলে! টিকিট-ফিকিট দিয়ে গেছে।”
“কালকেই? কখন ট্রেন?”
“রাত্তিরে।”
তারাপদ বসল। কিকিরাকে দেখতে লাগল।
কিকিরা সুটকেসের মতন একটা বাক্সে নানা রকম জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। পাশে একটা ঝোলা।
তারাপদ বলল, “আপনার সেই দীপনারায়ণ আজ আবার এসেছিলেন?”
না। সকালে আমি গিয়েছিলাম।” কিকিরা বললেন।”একটা জায়গায় যাব, তার আগে কিছু ব্যবস্থা করা দরকার তো! তার ওপর তুমি সঙ্গে যাচ্ছ, চন্দনও যাবে দু-চার দিন পরে–দীপনারায়ণকে বলে আসা দরকার।”
সামান্য চুপ করে থেকে তারাপদ বলল, “উনি নিজে যাবেন না?”
“আজই ফিরে যাবেন!”
কী মনে করে তারাপদ হেসে বলল, “আমরা তা হলে কাল থেকে রাজ-অতিথি?”
কিকিরা মাথা দুলিয়ে-দুলিয়ে বললেন, “কাল এ-বাড়ি ছাড়ার পর থেকে।”
“থাকব কোথায়?”
“রাজবাড়ির গেস্ট হাউসে।”
তারাপদ মনে মনে রাজবাড়ির একটা ছবি কল্পনা করবার চেষ্টা করল। দেখল, হিন্দি সিনেমার রাজবাড়ি ছাড়া তার মাথায় আর কিছু আসছে না। গঙ্গাধরবাবু লেনে বটুকবাবুর মেসের বাসিন্দে বেচারি, রাজবাড়ির কল্পনা তার মাথায় আসবে কেন? নিজের মনেই হেসে ফেলল তারাপদ।
কিকিরা নিজেই বললেন, “আমরা রাজবাড়িতে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকব না, বুঝলে!”
তারাপদ বুঝতে পারল না। নিজেদের পরিচয় ছাড়া আর কী পরিচয় আছে তাদের। অবাক হয়ে কিকিরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।
সুটকেস গুছোতে-গুছোতে কিকিরা বললেন, “দীপনারায়ণ চান না যে, রাজবাড়ির লোক বুঝতে পারে আমরা তাঁর হয়ে গোয়েন্দাগিরি করতে যাচ্ছি। আমরা যাব পুরনো বই কেনাবেচার ব্যবসাদার হিসেবে। পুরনো বই, পুরনো ছবি।”
বুঝতে না-পেরে তারাপদ বলল, “সেটা কী?”
“সেটা ভয়ংকর কিছু নয়। এই কলকাতা শহরে আগে এক ধরনের ভাল ব্যবসা ছিল। প্রেস্টিজঅলা ব্যবসা। একশো সওয়াশো দেড়শো বছর আগেকার সব ছবি-সাহেবদের আঁকা–বিলেতে ছাপা হত নানা জায়গায় বিক্রি হত, এ-দেশেও। ছবিগুলো সব এদেশের মানুষকে নিয়ে, এখানকার নদী পাহাড় বন জঙ্গল নিয়ে। ছবিগুলো মোটা দামে বিকোত, রাজারাজড়ারা, ধনী লোকেরা কিনত, বাড়িতে লাইব্রেরি বৈঠকখানা সাজাত। ছবি ছিল, বইও ছিল। সে সব বই আর পাওয়া যায় না, ছাপা হয় না। কোনো ধনী লোক মারা গেল, কিংবা রাজা স্বর্গে গেল, দেখাশোনার লোক নেই, তখন সে সব বই বিক্রি হয়ে যেত। কখনো কখনো নীলামে আজকাল সেব্যবসা নেই। দু-একজন অবশ্য খোঁজে থাকে। তারা কোনোরকমে কেনা-বেচা করে পেট চালায়–এই আর কী।”
তারাপদ বলল, “আমি তো ওসব কিছু জানি না।”
কিকিরা বললেন, “জানবার দরকার নেই। আমিই কি ছাই জানি। যাদের বাড়িতে যাব, তারাও জানে না। বাপ-ঠাকুরদা ঘর সাজিয়েছিল, তারাও সাজিয়ে রেখেছে। নয়ত হাজার টাকা দামের ছবি একশো টাকায় ছাড়ে, না পাঁচশো টাকার বই পঞ্চাশ টাকায় ছেড়ে দেয়? তুমি শুধু আমার সঙ্গে থাকবে; যা করতে বলব, করে যাবে। বুঝলে?”
তারাপদ মাথা নাড়ল। বলল, “নামটামও পালটাতে হবে নাকি?”
“না, মোটেই নয়। ফাদার-মাদারের ডোনেট করা নাম পালটাবে কেন?”
কিকিরা এতক্ষণ পরে একটা রসিকতা করলেন। তারাপদ হেসে ফেলল। বলল, “কিকিরা, আমরা তা হলে সত্যি সত্যি গোয়েন্দাগিরি করতে যাচ্ছি? শার্লক হোমস আর ওয়াটসন?”
কিকিরা বললেন, “বলতে পারো। কিন্তু ওয়াটসনসাহেব, সেখানকার জঙ্গলে তোমার এই ফতুয়া চলবে না। একটা লম্বা গরম কোটটোট–পুরনো হলেই ভাল–জোগাড় করতে পারো না? নয়ত শীতে মরবে।”
তারাপদ বলল, “বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে চেয়ে নেব।”
কিকিরা সুটকেস বন্ধ করলেন। বাইরে গেলেন। সামান্য পরে ফিরে এলেন।
তারাপদ যেন কিছু ভাবছিল বলল, “কাল আমি রাত্তিরে শুয়ে-শুয়ে ভাবছিলাম। আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো? রামপ্রসাদবাবুর জন্যেই কি আপনি দীপনারায়ণের এই ব্যাপারটা হাতে নিলেন?”
নিজের চেয়ারে বসে কিকিরা একটা সরু চুরুট ধরাচ্ছিলেন। চুরুট ধরানো হয়ে গেলে বললেন, “খানিকটা তাই।”
“খানিকটা তাই মানে?”
ফুঁ দেবার মতন করে ধোঁয়া ছেড়ে কিকিরা বললেন, “রামপ্রসাদবাবুর কোনো ভৌতিক ক্ষমতা আছে, মস্তর-ফন্তর জানা আছে তা আমি বিশ্বাস করি না, তারাপদ। তবে আমি পড়েছি এবং দেখেছি এক-একজন মানুষ থাকে যারা সচরাচর না-দেখা জিনিস দেখতে পায়, কিংবা ধরো বুঝতে পারে। রামপ্রসাদবাবু যেটা পারেন সেটা হল, দেখা। যেমন ধরো, একটা ছেলে স্কুলে গেল-বিকেলেও বাড়ি ফিরে এল না, সন্ধেতেও নয়। বাড়ির লোক দুশ্চিন্তায় ভাবনায় ছটফট করছে, ভাবছে কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটল কি না! থানা-পুলিশ হাসপাতাল করে বেড়াচ্ছে। এখন তুমি রামপ্রসাদবাবুকে গিয়ে ধরলে। তিনি যদি রাজি হন, তবে চোখ বন্ধ করে বসে থাকবেন কিছুক্ষণ। তারপর হয়ত চোখ বন্ধ করেই বলবেন–আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তার মানে–সেই ছেলেটি সম্পর্কে তিনি কিছুই বলতে পারছেন না। আবার এমনও হতে পারে, তিনি বললেন : ছেলেটিকে তিনি আর-একটি কালো প্যান্ট-পরা ছেলের সঙ্গে সাইকেল চেপে রাস্তায় ঘুরতে দেখছেন, কোনো পার্কের কাছে গিয়ে দুজনে বসল, তারপর দুই বন্ধু মিলে আবার সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। হঠাৎ কোনো বাস এসে পড়ল রাস্তায়। সাইকেলটাকে ধাক্কা মারল…তারপর–তারপর আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না।”
তারাপদ শিউরে উঠে বলল, “মানে ছেলেটি বাস চাপা পড়েছে?”
“চাপাই পড়ুক আর ধাক্কা খেয়ে ছিটকেই পড়ক–সেটা অন্য কথা। মরল, না হাসপাতালে গেল, সেটাও আলাদা কথা। ওই যেটুকু তিনি দেখলেন, মাত্র সেইটুকুই বলতে পারলেন।”
অবাক হয়ে তারাপদ কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, “উনি যা বলেন তা কি সত্যি হয়?”
“হতে দেখেছি। শুনেছি।”
“এটা কেমন করে হয়?”
“তা বলতে পারব না। জানি না। কেমন করে হয় তা জানার জন্যেই তো কত লোক, পণ্ডিত-টণ্ডিত, দিনের পর দিন মাথা ঘামাচ্ছে। ওই যে তোমাদের প্যারা-সাইকোলজি বলে কথাটা আছে, এ-সব বোধ হয় তার মধ্যে পড়ে।”
তারাপদর অবাক ভাবটা তখনো ছিল, তবু খুঁতখুঁত গলায় বলল, “কেমন করে এটা হয় তার একটা যুক্তি দেবার চেষ্টাও তো থাকবে।”
সরু চুরুটটা ঠোঁটে চুঁইয়ে আবার নামিয়ে নিলেন কিকিরা। বললেন, “বুঝতে পারলে, ধরতে পারলে তবে না যুক্তি। এখন মোটামুটি একটা ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয় সিক্সথ সেন্স।”
“সিক্সথ সেন্স?”
“মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কথা আমরা জানি। এটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, কিংবা বোধ। কেউ কেউ বলছেন, মানুষ যখন পশুর পর্যায়ে ছিল, আদিম ছিল, তখন তার মধ্যে একটা বোধ ছিল যার ফলে সে অজানা আপদ-বিপদ-ক্ষতি বুঝতে পারত। এখনো বহু পশুর মধ্যে সেটা দেখা যায়। মানুষ বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যত সভ্য হয়েছে ততই তার আদিমকালের অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। কিন্তু কখনো কখনো দেখা যায় যে, সেই হাজার-হাজার বছর আগেকার মানুষের কোনো দোষ বা গুণ কোটিতে এক আধজনের মধ্যে অস্পষ্টভাবে থেকে গেছে। একে তুমি প্রকৃতির রহস্য বলতে পারো। এ ছাড়া আর কী বলা যায় বলো।”
তারাপদ বরাবরই খানিকটা নরম মনের ছেলে। সহজে কিছু উড়িয়ে দিতে পারে না। বিশ্বাস করুক না করুক অলৌকিক ব্যাপারে বেশ আগ্রহ বোধ করে। কিকিরার কথা তার ভাল লাগল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর তারাপদ বলল, “রামপ্রসাদবাবু কি আপনাকে বলেছেন, দীপনারায়ণের সন্দেহ সত্যি?”
“তিনি সত্যি মিথ্যে কিছু বলেননি। চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষণ বসে থেকেও তিনি কিছু দেখতে পাননি রাজবাড়ির। কাজেই এমনও হতে পারে দীপনারায়ণের সন্দেহ মিথ্যে। বা এমনও হতে পারে সত্যি। রামপ্রসাদবাবুর কাছ থেকে আমরা কোনো রকম সাহায্য এখানে পাচ্ছি না, তারাপদ। কিন্তু আমি ওঁকে শ্রদ্ধাভক্তি করি। উনি যখন দীপনারায়ণের ব্যাপারটা দেখতে বেললেন, আমি না বলতে পারিনি।”
তারাপদ যেন কিছু মনে করে হেসে বলল, “তা হলে ধাঁধার পেছনে ছুটছি?”
“তা বলতে পারো।”
“ওহো, একটা কথা কাল আপনাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছি। রাত্রে আমার মনে পড়ল। দীপনারায়ণদের যে ছোরার বাঁটটা আপনি রেখেছেন, সেটার হাজার-হাজার টাকা দাম বললেন। অত দামি জিনিস আপনি নিজের কাছে রাখলেন কেন? দীপনারায়ণই বা কোন বিশ্বাসে আপনার কাছে রেখে। গেল?”
কিকিরা এবার মজার মুখ করে তারাপদকে দেখতে-দেখতে হেসে বললেন, “ওয়াটসনসাহেব, এবার তোমার বুদ্ধি খুলেছে। সত্যি ব্যাপারটা কী, জানো? ছোরার যে বাঁটটা তোমরা দেখেছ, ওটা নফল, ইমিটেশান। আসলটা রাজবাড়িতে রয়েছে। সিন্দুকের মধ্যেই।”
তারাপদ হাঁ করে তাকিয়ে থাকল।
খানিক পরে আবার বললেন, “না, তোমার সঙ্গে মজা করলাম। ওটা আসলই। ও জিনিসের কি নকল হয়। উনি আমায় বিশ্বাস না করলে রাজবাড়িতে নিয়ে যাবেন কেন! যাকগে, যাঁর জিনিস তাঁকে ফেরত দিয়ে এসেছি।”
.
০৩.
তারাপদ চিরটাকাল কলকাতায় কাটিয়েছে। একেবারে ছেলেবেলায় অবোধ বয়সে মা বাবার সঙ্গে কবে এক-আধবার দেশের বাড়িতে গেছে, কবে কলেজ-টলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের সঙ্গে দলে ভিড়ে ব্যান্ডেল চার্চ কিংবা বিষ্ণুপুর বেড়াতে গেছে, সেসব কথা বাদ দিলে তার ঘোরা-ফেরার কোনো বালাই কোনকালে ছিল না। ভুজঙ্গভূষণকে দেখতে গিয়েছিল শংকরপুর, আর এবার এল কিকিরার সঙ্গে দীপনারায়ণের রাজত্বে। অবশ্য এখন রাজত্ব বলতে কিছুই নেই, রাজার দল প্রজা হয়ে গিয়েছে। রাজত্ব না থাক, পুরনো সম্পদ-সমৃদ্ধি তো খানিকটা থাকবেই। আর লোকের মুখে রাজা নামটা অত সহজে কি যায়।
রাত্রে হাওড়া ছেড়েছিল যে গাড়িটা, পরের দিন বেলা দশটা নাগাদ তারাপদদের এক স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। তারাপদর কাছে সবই বিস্ময়! কলকাতায় বাস, ট্রাম, কপোরেশানের ময়লা ফেলা গাড়ি, ঠেলা, রিকশা ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। কলকাতা থেকে দশ পা বাইরে গেলেই হয় কলকারখানা, না হয় এঁদো পুকুর, বাঁশঝোঁপ, কচুরিপানা। এদিকে যে-মুহূর্তে এসে পড়ল তারাপদ, ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে জানলা দিয়ে দেখল–সব পালটে গেছে। মাঠের পর মাঠ, কোথাও নিচু, কোথাও বা উঁচু, হিমে কুয়াশায় সাদা চারপাশ, ঝোঁপঝাড়, বন, পাহাড়ি বা পাথুরে ঢল নেমেছে, বালিয়াড়ি। এ একেবারে আলাদা দৃশ্য। এমনি করেই সূর্য উঠে গেল, বেলা বাড়তে লাগল। বেশ বোঝা যাচ্ছিল, মাটির রঙ পালটে গিয়েছে। বনজঙ্গলের দৃশ্যগুলোও ঘনঘন চোখে পড়ছিল। পাহাড়ের মাথা এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত চলেছে তো চলেইছে, ঢেউয়ের মতন উঁচুনিচু হয়ে।
তারাপদা যেখানে নামল, তাকে বড় ছোট কোনো স্টেশনই বলা যায় না। তবু রেলগাড়ি যেখানে থামে, কাঁকর-বিছানো স্টেশন পাওয়া যায় দেখতে, তাকে স্টেশন না বলে উপায় কী?
স্টেশনের গায়ের ওপরই যেন জঙ্গল হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। তারাপদ গাছটাছ চেনে না, তবু তার মনে হল, নিশ্চয় শাল-সেগুন হবে।
স্টেশনের বাইরে জিপ ছিল। দীপনারায়ণ পাঠিয়েছেন।
কিকিরাকে কিছু বলতে হল না, তাঁদের দেখামাত্র জিপগাড়ির লোক এগিয়ে এল। কলকাতার লোক বুঝতে এদের বোধ হয় অসুবিধে হয় না। অন্য যারা পাঁচ-দশজন নেমেছিল–সবই স্থানীয়।
মালপত্র জিপে তুলে নিল যে, তার নাম বলল, দশরথ। বাঙালি। তার বাংলা উচ্চারণে মানভূম-সিংভূমের টান, তারাপদ যা জানে না, কিকিরাই বলে দিলেন।
জিপগাড়ির ড্রাইভারের নাম জোসেফ। মাথায় খাটো, বেঢপ প্যান্ট পরনে, গায়ে কালো সোয়েটার, গলায় মাফলার। মাথায় একটা নেপালি টুপি।
কিকিরা আর তারাপদ গাড়ির পেছনে, সামনে জোসেফ আর দশরথ। গাড়ি চলতে শুরু করল।
কিকিরা আলাপী লোক, দশরথ আর জোসেফের সঙ্গে গল্প শুরু করলেন। কে কতদিন আছে রাজবাড়িতে, কার কোথায় বাড়ি, জায়গাটা কেমন, এখানকার জঙ্গলে কোন্ কোন্ পশু দেখা যায়–এইরকম সব গল্প। দশরথরা দু পুরুষ রাজবাড়িতে কাজ করে কাটাচ্ছে, তার বাড়ি ঝাড়গ্রামে, দশরথের কাজ হল বাইরের লোকের তদারকি করা; যখন বাইরের লোকজন থাকে না, তখন তার প্রায় কোনো কাজই থাকে না সারাদিন; রাজবাড়ির বাগানের তদারকি করে দিন কাটে।
জোসেফ লোকটা ক্রিশ্চান। আগে কাজ করত চাঁইবাসায়। বছর দুয়েক হল রাজবাড়িতে এসে ঢুকেছে। আগে ট্রাক চালাত, পিঠের শিরদাঁড়ায় এক বেয়াড়া রোগ হল, ট্রাক চালানো ছেড়ে দিল জোসেফ। তার কোনো দেশ বাড়ি নেই, আত্মীয়স্বজন নেই।
তারাপদ কিকিরাদের কথাও শুনছিল, আবার চারপাশের বনজঙ্গল গাছপালা দেখছিল। মাইল চল্লিশ যেতে হবে জিপে। রাস্তা সরু, পিচ করা। এক-একটা জায়গায় যেন ঘন জঙ্গলের গা ছুঁয়ে চলে গেছে রাস্তাটা, কখনো কখনো পাহাড়তলি দিয়ে, মাঝে মাঝে ছোট-ছোট লোকালয় ভেসে উঠছে, পাঁচ সাতটা কুঁড়ে, আদিবাসী লোকজন চোখে পড়ছে, সামান্য কিছু খেত-খামার।
দেখতে-দেখতে জিপগাড়িটা কখন একেবারে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। বিশাল বিশাল গাছ, বড় বড় ফাটল, পাথর, ঝোঁপ, সূর্যের আলোও ভাল করে ঢুকতে পারছে না যেন।
তারাপদ কিকিরাকে বলল, “ভীষণ জঙ্গল। ডিপ ফরেস্ট।”
কিকিরা বললেন, “সরকারি জঙ্গল সব, বুঝল। এখন যত জঙ্গল সব রিজার্ভ ফরেস্ট হয়ে গিয়েছে।” বলে তিনি দশরথকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই জঙ্গলের নাম কী দশরথ!”
“আজ্ঞে, আমরা বেরার জঙ্গল ডাকি,” দশরথ বলল, “বিশাল জঙ্গল উত্তরে।”
বেরার জঙ্গলের মধ্যে অবশ্য জিপ ঢুকল না। জঙ্গলের পাশ দিয়ে আরও পূবের দিকে এগিয়ে চলল।।
যেতে যেতে এক জায়গায় গাড়ি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। জোসেফ ইশারা করে তার ডান দিকটা দেখাল। জোসেল বলল, “সাপ।”
গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে কিকিরা আর তারাপদ দেখলেন একটা বিশাল সাপ রাস্তার মধ্যে পড়ে আছে। একেবারে স্থির। যেন মরে পড়ে রয়েছে।
এত বড় সাপ তারাপদ জীবনে দেখেনি। সাপটা দেখতে-দেখতে হঠাৎ তার গা কেমন গুলিয়ে উঠল।
শীতকালে সাপ বড় একটা বেরোয় না বলে শুনেছিলেন কিকিরা, কিন্তু এ যে মস্ত সাপ।
জোসেফ জিপ নিয়ে দাঁড়িয়েই থাকল। সাপটা রাস্তা ছেড়ে সরে না গেলে সে গাড়ি নিয়ে এগুতে পারবে না।
দশরথ গাড়ি থেকে নেমে পাথর কুড়িয়ে সাপের দিকে ছুঁড়তে লাগল, যাতে সাপটা রাস্তা ছেড়ে চলে যায়। তারাপদর এতই গা ঘিনঘিন করছিল যে, বমি চেপে সে বসে থাকল কোনোরকমে।
কিকিরা আস্তে গলায় বললেন, “সর্পযাত্ৰা ভাল না মন্দ, তারাপদ?”
তারাপদ কিছু বলল না।
.
রাজবাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুরই হয়ে গেল প্রায়।
তারাপদ কল্পনাই করেনি এই পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে এমন একটা রাজবাড়ি থাকতে পারে। চোখের সামনে যেন ভোজবাজির মতন এক বিশাল ইমারত ভেসে উঠল। বিরাট পাঁচিল দিয়ে ঘেরা রাজবাড়ির কম্পাউন্ড। বিশাল ফটক। মূল রাজবাড়িটা সামনে, দোতলা বিশাল বাড়ি, সেকেলে দোতলা, মানে আজকালকার বাড়ির প্রায় চারতলার কাছাকাছি উঁচু। কলকাতার অনেক পুরনো বনেদি বাড়ির এই রকম ধাঁচ দেখেছে তারাপদ, একটানা বারান্দা, আর ঘর। মাথার দিকে আর্চ করা। মোটা মোটা গোল থাম। মূল রাজবাড়ির মুখেও লোহার ফটক।
রাজবাড়ির মুখোমুখি, খানিকটা তফাতে গেস্ট হাউস। একতলা বাড়ি। উঁচু পাঁচিল দিয়ে কম করেও বিঘে দশ পনেরো জমি ঘেরা। ফুলের বাগান, পাখিঘর, একদিকে ছোট মতন এক বাঁধানো পুকুর। মন্দিরের মতনও কিছু একটা দেখা যাচ্ছে পশ্চিমে।
দশরথ জিনিসপত্র নামাতে লাগল। জোসেফ গেল জল খেতে। এ
তারাপদ চারদিকে তাকাতে-তাকাতে বলল, “এই জঙ্গলের মধ্যে এমন বাড়ি, ভাবাই যায় না।”
কিকিরা বললেন, “একসময়ে করেছিল, এখন আর ধরে রাখতে পারছে না। দেখছ না, চারিদিকে কেমন পড়তি চেহারা। রাজবাড়ির গায়ে ছোপ ধরে গেছে, শ্যাওলা জমেছে, বাগানে ফুলের চেয়ে আগাছাই বেশি। ওদিকে তাকিয়ে দেখো, রাজবাড়ির মাঠে কিছু চাষবাস হচ্ছে। দীপনারায়ণ বলেছিলেন, লাখ পাঁচেক টাকা ধার ঝুলছে মাথার ওপর। দেখছি, সত্যিই তাই।”
কিকিরা খেয়াল করেননি, তারাপদও নয়, হঠাৎ পেছন থেকে কার যেন গলা শোনা গেল। মুখ ফিরিয়ে তাকালেন কিকিরা। তাকিয়ে অবাক হলেন। যাত্রাদলের শকুনির মতন চেহারা, রোগা লিকলিকে শরীর, মাথার চুল সাদা, পাটের মতন রঙ, তাও আবার বাবরি করা, গর্তে ঢোকা চোখ, ধূর্ত দৃষ্টি, পরনে ধুতি, গায়ে ফতুয়া আর চাদর। খুব বিনয়ের সঙ্গে নমস্কার করে সেই শকুনির মতন লোকটা বলল, “আমার নাম শশধর সিংহ। রাজবাড়ির কর্মচারী। আসুন আপনারা, বিশ্রাম স্নান সেরে খাওয়া-দাওয়া করুন। আপনাদেরই অপেক্ষা করছিলাম। আসুন।”
রাজবাড়ির অতিথিশালা; ব্যবস্থা সবই রয়েছে–খাট, বিছানা, আয়না, ড্রয়ার, যা যা প্রয়োজন। এক সময় ঘরের শোভা ছিল, ঝকমকে ভাব ছিল বোঝ যায়–এখন সেই শোভার অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। তবু যা আছে–তেমন পেলেই তারাপদর মতন মানুষরা বর্তে যায়।
পাশাপাশি দুটো ঘর ব্যবস্থা করা ছিল কিকিরাদের। স্নান-টানের ঘর সামনেই, শোবার ঘরের গায়ে-গায়ে। খাবার ব্যবস্থা খাবার ঘরে।
শশধর ছিল না। কিকিরা এক সময়ে তারাপদকে বললেন, “কেমন লাগছে শশককে?”
“শশক? কে শশক?”
“ওই শশধরকে?”
তারাপদ বলল, “সুবিধের লাগছে না।”
“ওর বাঁ হাতে ছ’টা আঙুল লক্ষ করেছ?”
“না।” তারাপদ অবাক হয়ে বলল।
“লক্ষ করো। যতটা পারবে লক্ষ করবে।…বাঁ হাতের আঙুল ছ’টা; কানের লতিতে ফুটো, বোধ হয় এক সময় মাকড়ি পরত।”
“পুরুষমানুষ মাকড়ি পরবে কেন?”
“অনেক জায়গায় পুরুষমানুষও মাকড়ি পরে। এদের বোধ হয় রাজবংশের ব্যাপার–পারিবারিকভাবে পরতে হত আগে, এখন ছেড়ে দিয়েছে “
“শশধর কি রাজবংশের লোক?”
“পদবী সিংহ বলল, সিং সিংহ হতে পারে। রাজবংশের সরাসরি কেউ নয় হয়ত-তবে সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক। যাক গে, নাও; আর দেরি করো না। স্নানটান করে নাও। খিদে পেয়ে গেছে বড়।”
স্নান খাওয়া-দাওয়া সেরে কিকিরা আর তারাপদ যে-যার ঘরে শুয়ে পড়লেন। তখন শীতের দুপুর ফুরিয়ে আসছে।
অবেলায় খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় গড়ানো মানেই ঘুম। তার ওপর কাল ট্রেনে রাত কেটেছে। কিকিরা যখন তারাপদকে ডাকলেন তখন শীতের বিকেল বলে কিছু নেই, ঝাপসা অন্ধকার নেমে এসেছে।
মুখে চোখে জল দিয়ে চা খেল তারাপদ কিকিরার সঙ্গে। তারপর অতিথিশালার বাইরে এসে পায়চারি করতে লাগল। সন্ধের আগেই শীতের বহরটা বোঝা যাচ্ছিল, রাত্রে যে কতটা ঠাণ্ডা পড়বে তারাপদ কল্পনা করতে পারল না।
এমন সময় শশধর আবার হাজির। পোশাক-আশাক খানিকটা অন্যরকম। লম্বা কোতার ওপর জ্যাকেট, তার ওপর চাদর। পায়ে ক্যানভাস জুতো।
শশধর সদালাপী মানুষের মতন হাসল, বিনয় করে জিজ্ঞেস করল, কোথাও কোনো অসুবিধে হচ্ছে কি না! তারপরে বলল, “দু বার এসে ফিরে গিয়েছি, আপনারা ঘুমোচ্ছিলেন। রাজাসাহেব বলেছেন, আপনারা জেগে উঠলে তাঁকে খবর দিতে।”
কিকিরা চুরুট টানতে-টানতে বললেন, “খবর দিন।”
“উনি নিচেই আছেন, দেখা করতে চাইলে চলুন।”
“অপেক্ষা করছেন?”
“না, অপেক্ষা করছেন না; শরীর ঠিক রাখার জন্য এ-সময় তিনি ভেতরের লনে একটু টেনিস খেলেন।”
“বাঃ বাঃ! কার সঙ্গে খেলেন?”
“ছেলের সঙ্গে।”
“আচ্ছা–আচ্ছা। তা চলুন দেখা করে আসি। এখন রাজাসাহেব নিশ্চয় বিশ্রাম করছেন?”
“আসুন।”
শশধরের সঙ্গে কয়েক পা মাত্র এগিয়েই কিকিরা বললেন, “ওহে, একটু দাঁড়ান শশধর, আমি আসছি।” বলেই কিকিরা অতিথিশালার দিকে চলে গেলেন।
শশধর কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত। তারপর তারাপদর দিকে তাকিয়ে বলল, “ওঁর নামটা যেন কী বলেছিলেন তখন–?”
“কিঙ্করকিশোর রায়।”
“আপনার?”
নাম বলল তারাপদ।
শশধর বললেন, “বইপত্রের ব্যবসা করেন আপনারা?”
“ওল্ড বুকস্ অ্যান্ড পিকচার্স।” তারাপদ মেজাজের সঙ্গে বলল।
“দোকানটা কোথায় মশাই?”
তারাপদ ঘাবড়ে গেল। এরকম একটা আচমকা প্রশ্ন সে আশাই করেনি। কিন্তু যার দোকান রয়েছে সে দোকানের ঠিকানা বলতে পারবে না–এ কেমন কথা? তারাপদ ধরা পড়ে যেতে যেতে কোনোরকমে সামলে নিয়ে কিকিরার বাড়ির ঠিকানা বলল। নিজের ঠিকানাটাই বলত–শেষ সময়ে বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়–গঙ্গাচরণ মিত্তির লেন বললেই কেলেঙ্কারি হত; দোকানের ঠিকানায় লেন-টেন’ মানে গলিখুঁজি থাকলেই ইজ্জত চলে যেত।
“জায়গাটা কোথায়?” শশধর জিজ্ঞেস করল ছোট ছোট চোখ করে।”
“পার্কসার্কাস।”
“আপনার দোকান? না ওই ভদ্রলোকের?”
“ওঁর। আমি কাজ করি।”
শশধর পকেট থেকে রুমাল বের করে নাক ঝাড়ল। চতুর চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে বলল, “আপনার মনিব লোকটি ভালই, কর্মচারীকে আদর-যত্ন করে দেখছি।”
তারাপদ বুঝতে পারল গোলমেলে ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। শশধর ধূর্ত, তাকে ধাপ্পা দিয়ে পার পাওয়া সহজ নয়। কথা ঘোরাবার জন্যে সে বলল, “জায়গাটা বেশ ভাল। এদিকে কতদিন শীত থাকে?”
“থাকবে। আরও মাসখানেক।”
কিকিরা আসছিলেন। তারাপদ কিকিরাকে দেখতে পেয়ে যেন বেঁচে গেল।
কাছে এসে কিকিরা বললেন, “সিংহীমশাই, অপনাদের গেস্টরুমের দরজাগুলো কোন্ কাঠের?”।
শশধর ঠিক বুঝতে পারল না। “আজ্ঞে?”
“শাল না সেগুন কোন্ কাঠের বলুন তো?”
“শাল কাঠের। আপনি দরজা দেখতে গিয়েছিলেন?”
“দরজা দেখতে কি কেউ যায়, মশাই? গিয়েছিলুম চশমা আনতে। আমি আবার রাতকানা–নাইট ব্লাইন্ড। সন্ধে হলে কি আমি অন্ধ হয়ে গেলুম একরকম।” বলে কিকিরা হাতে রাখা চশমার খাপ দেখালেন।
শশধর বলল, “এখন অন্ধকার হয়ে গেছে। দেখছেন কেমন করে?”
“কই আর দেখছি! ঝাপসা ঝাপসা দেখছি। আপনাকে ভাসা ভাসা দেখতে পাচ্ছি। এইবার চশমাটা পরব।”
কিকিরা খাপ খুলে একটা নিকেল ফ্রেমের চশমা বের করে পরতে লাগলেন। তারাপদ কোনোদিন কিকিব্রাকে চশমা পরতে দেখেনি। বুঝতে পারল না কোন মতলবে কিকিরা ঘরে গিয়েছিলেন, কেনই বা চশমা নিয়ে ফিরলেন।
তিনজনেই হাঁটতে লাগল আবার। হঠাৎ কোথা থেকে যেন কুকুরের ডাক শোনা গেল। সাধারণ ডাক নয়, গর্জনের মতন। রাজবাড়ির দিক থেকে প্রথমে একটা পরে যেন একদল কুকুরের ভয়ংকর ডাক শোনা যেতে লাগল। তারাপদ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
শশধর বিনীতভাবেই বলল, “ইন্দরবাবুর কুকুর। ভয় নেই।”
.
০৪.
কিকিরাদের দীপনারায়ণের কাছে পৌঁছে দিয়ে শশধর চলে গেল।
রাজবাড়ির নিচের তলায় একসারি ঘরের মধ্যে তারাপদরা যে-ঘরটায় এসে বসল সেটা ঠিক বসার ঘর নয়, বসা এবং অফিস করা–দুই যেন চলতে পারে। বেশ বড় মাপের ঘর, মস্ত মস্ত দরজা জানলা মেঝেতে কার্পেট পাতা, আসবাবপত্র সাবেকি এবং ভারী ধরনের। রাজবাড়িতে ইলেকট্রিক নেই, ডিজ ল্যাম্প, পেট্রমাক্স, হ্যাঁজাক-এইসব জ্বলে।
দীপনারায়ণ বসতে বললেন কিকিরাদের।
কিকিরা ঘরের চারদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, তারপর বসলেন। তারাপদ বোকার মতন দাঁড়িয়েছিল, কিকিরাকে বসতে দেখে বসে পড়ল।
দীপনারায়ণ বললেন, “গাড়িতে আপনাদের কোনো কষ্ট হয়নি তো?”
মাথা নাড়লেন কিকিরা। “না, আরামেই এসেছি। জিপ গাড়িতে খানিকটা সময় লাগল।”
“অনেকটা দূর। জঙ্গলের রাস্তা।”
তারাপদ নজর করে দীপনারায়ণকে দেখছিল। কলকাতায় সেদিন কয়েক মুহূর্তের জন্যে যাকে দেখেছিল–সেই মানুষই সামনে বসে আছেন–তবু আজ অন্যরকম লাগছে। দীপনারায়ণ সুপুরুষ, গায়ের রঙ উজ্জ্বল, চোখমুখ পরিষ্কার, সুশ্রী, মাথার চুল পাতলা, শরীর স্বাস্থ্য দেখলে মনে হয় চল্লিশের বেশি বয়েস। অথচ কিকিরা বলেছেন, দীপনারায়ণের বয়েস পঞ্চাশ। দেখতে ভাল লাগে মানুষটিকে। ভদ্র, নিরহঙ্কার ব্যবহার।
দীপনারায়ণ কিকিরার সঙ্গে আরও দু-একটা কী যেন সাধারণ কথা বললেন, তারাপদ খেয়াল করে শুনল না।
কলকাতায় ঠাকুর বিসর্জন কিংবা মারোয়াড়ি বিয়ে-টিয়েতে তাসা পার্টি সঙ্গে যেমন গ্যাস বাতি নিয়ে আলোর মিছিলদাররা চলে তাদের হাতে থাকে বাহারি বাতি–সেই রকম একটা বাতি ঘরের একপাশে জ্বলছিল। আজকাল এরকম বাতি কলকাতাতেও কম দেখা যায়, আগে যেত। কার্বাইডের আলো, কিন্তু অন্য ধাঁচের; চারদিক থেকে চারটে সরু সরু নল বেরিয়ে চারদিক ঘিরে রেখেছে, মুখ খোলা কাচের শেড, আলোর শিখা যেন কাচে না লাগে। মাত্র দুটি নলের মুখে শিখা জ্বলছিল, অন্য দুটো নেবানো। শিখাও কমানো রয়েছে। ঘরে কার্বাইডের সামান্য গন্ধ।
দীপনারায়ণ বললেন, “এবার কাজের কথা হোক, কিংকরবাবু?”
“বলুন।”
“আমি আপনাদের কথা বলে রেখেছি। তিনজনের কথাই। দুজনে এসেছেন।”
“আর একজন পরশু নাগাদ আসবে।”
“আমারও তাই বলা আছে।…আমি বলেছি, আপনারা এই রাজবাড়ির লাইব্রেরির ছবি আর বইয়ের ভ্যালুয়েশান করতে আসছেন। যদি দর-দস্তুরে পোষায় আপনারা কিছু কিনতে পারেন। নয়ত কলকাতায় ফিরে গিয়ে আপনারা পার্টি জোগাড় করবেন, বিক্রি বাটা হয়ে গেলে কমিশন পাবেন। ভ্যালুয়েশান করার জন্যে ভ্যালুয়ার হিসেবে আপনারা রাজবাড়িতে অতিথি হিসেবে থাকবেন, আর কাজ শেষ হয়ে গেলে দু হাজার টাকা পারিশ্রমিক পাবেন।…বোধ হয় ঠিক বলেছি, কী বলেন?”
কিকিরা বললেন, “ঠিকই বলেছেন।”
তারাপদ হঠাৎ বলল, “শশধরবাবু আমায় কতগুলো কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।”
দীপনারায়ণ তারাপদর দিকে তাকালেন, কিকিরাও।
একটু আগে যে-সব কথা হয়েছে শশধরের সঙ্গে, তারাপদ তা বলল।
কিকিরা বললেন, “যা বলেছ ঠিকই বলেছ। আবার কিছু জিজ্ঞেস করলে বলো, হিসেব তৈরি করা চিঠি লেখা এইসব কাজগুলো তুমিই করো, আমি ও-সব করতে পারি না।”
ঘাড় নাড়ল তারাপদ।
কিকিরা দীপনারায়ণকে বললেন, “আমায় ক’টা কথা বলতে হবে দীপনারায়ণবাবু।”
“বলুন।”
“তার আগে আরও একটা কথা আছে। কেউ যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করে রাজবাড়ির ছবি বই–এ-সব কেন আপনি বেচে দিতে চাইছেন তার জবাব কী হবে?”
দীপনারায়ণ তাঁর সিগারেটের কেস থেকে একটা সিগারেট তুলে নিয়ে কেসটা কিকিরার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
কিকিরা সিগারেট নিলেন না।
দীপনারায়ণ সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বললেন, “কেউ জিজ্ঞেস করবে না। বিক্রি করার অধিকার আমার আছে। তবু যদি জিজ্ঞেস করে, তার জবাব আমার তৈরি আছে।”
“সেটা জানতে পারি?”
“পারেন। পুরনো ছবি কিংবা বই আমি বুঝি না। আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। জয়নারায়ণ কিছু কিছু বুঝত। তার ভালও লাগত। জয়নারায়ণ ছাড়া লাইব্রেরি ঘরে এবাড়ির কেউ পা দিত না। সে যখন নেই, লাইব্রেরি সাজিয়ে রাখা অকারণ।” দীপনারায়ণ একটু থেমে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন–দরজার দিকে পরদা নড়ে উঠল। তিনি চুপ করে গেলেন।
মাঝবয়সী একটা লোক এসে কফি দিয়ে গেল।
লোকটা চলে যেতে দীপনারায়ণ বললেন, “জয় নেই এটা একটা কারণ। আর অন্য কারণ হল, আমাদের অবস্থা। আপনাকে আমি আগেই কলকাতায় বলেছি–আমাদের অবস্থা পড়ে গেছে, জমি-জায়গা হাতছাড়া হয়েছে আগেই, জঙ্গল-টঙ্গল এখন সরকারি সম্পত্তি, আমাদের একটা ক্লে মাইন ছিল–সেটা নানা ঝামেলায় বেচে দিতে হয়েছে লাখ পাঁচেক টাকা ধার। মামলা মোকদ্দমায় বছরে হাজার দশ পনেরো টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে এখনো।“
তারাপদ বেশ অবাক হচ্ছিল। রাজরজাড়া মানুষ–তারও টাকা-টাকা চিন্তা। তা হলে আর তারাপদ কোন দোষ করল। দীপনারায়ণ মানুষটিকে ভালই লাগছিল তারাপদর, কেমন খোলামেলাভাবে সব কথা বলে যাচ্ছেন।
কফি নিতে বললেন দীপনারায়ণ।
কিকিরা কাপে চিনি মেটাতে মেশাতে বললেন, “এবার আমায় অন্য কয়েকটা কথা বলুন।”
দীপনারায়ণ জবাব দেবার জন্যে তাকিয়ে থাকলেন।
“রাজবাড়িতে কে কে থাকেন? মানে আপনাদের পরিবারের?”
“আমাদের এই বাড়ির তিনটে মহল। কাকার, আমার আর জয়নারায়ণের।”
“মহলগুলো কেমন একটু বলবেন?”
“কাকা থাকেন পুবের মহলে, জয় থাকত মাঝ-মহলে, আর আমি পশ্চিম মহলে…।”
“নিচের মহলে কারা থাকে?”
দীপনারায়ণ কালো কফিতে চিনি মিশিয়ে কাপটা তুলে দিলেন।”নিচের মহলের এই সামনের দিকটা আমাদের অফিস কাছারি, বাইরের লোকজন এলে বসাটসা, লাইব্রেরির জন্যে রাখা আছে। বাবার আমল থেকেই। ভেতর দিকে আমরা সকলেই ওপর আর নিচের মহল যে যার অংশ মতন ব্যবহার করি। শুধু নিচের একটা দিক রাজবাড়িতে যারা কাজ করে তাদের থাকার জন্যে।”
কফি খেতে খেতে কিকিরা বললেন, “আপনার কাকা কি একা থাকেন?”
“না। কাকিমা জীবিত রয়েছেন। কাকার প্রথমা স্ত্রীর ছেলে আমার খুড়তুতো ভাই এখানে থাকে না। সে আসামে থাকে। ডাক্তার। দ্বিতীয় স্ত্রীর একটি মেয়ে। সে বোবাহাবা। সে এখানেই থাকে। তার বিয়ে হয়নি। কাকিমার এক ছোট ভাই, সেও থাকে কাকার কাছে।”
“ছোট ভাইয়ের নাম?”
“ইন্দর।”
“কী করে?”
“কিছু করে না। ভাল শিকারি। খায় দায় ঘুমোয় আর কুকুর পোষে।”
“কুকুর পোষে?”
“কুকুরের শখ ওর। পাঁচ-সাতটা কুকুর এনে রেখেছে। একেবারে জংলি। চেহারা দেখলে ভয় করে। বুনো কুকুর, অ্যালসেশিয়ান কিংবা টেরিয়ারের চেয়ে কম নয়।”
তারাপদ ভয়ে ভয়ে বলল, “খানিকটা আগে আমরা কুকুরের ডাক শুনেছি।”
“ইন্দরের একটা কুকুর-ঘর আছে। কুকুরদের মাঝে মাঝে হান্টার কষায়। বলে ট্রেনিং দিচ্ছে।”
কিকিরা কুকুরের কথা কানেই তুললেন না যেন, বললেন, “আপনার পরিবারের কে কে আছেন দীপনারায়ণবাবু?”
দীপনারায়ণ সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “আমার মা শয্যাশায়ী, পঙ্গু। স্ত্রী মারা গেছেন। বড় ছেলে দেরাদুন মিলিটারি কলেজে। ছোট ছেলে সিবাস্টিন কলেজে পড়ে, মাদ্রাজের কাছে। এখন সে ছুটিতে। এখানেই রয়েছে।”
“জয়নারায়ণবাবুর কে কে আছেন?” কিকিরা জিজ্ঞেস করল।
“জয়ের স্ত্রী রয়েছেন। একটি ছোট মেয়ে, বছর চার বয়েস। এখন এঁরা নেই, ভুবনেশ্বর গিয়েছেন।”
কফির পেয়ালা নামিয়ে রেখে কিকিরা যেন কিছুক্ষণ কিছু ভাবলেন। তারপর বললেন, “শশধর কি আপনাদের দূর সম্পর্কের কোন আত্মীয়?”
“না”, মাথা নাড়লেন দীপনারায়ণ, “এ বাড়িতে পঁচিশ ত্রিশ বছর রয়েছে। বাবার আমলের কর্মচারী। অনুগত।”
“এই লোকটাকে আপনার সন্দেহ হয় না?”
দীপনারায়ণ তাকালেন কিকিরার দিকে। সামান্য পরে বললেন, “এত দুঃসাহস ওর হবে? শুনেছি, বাবা ওকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন।”
“কেন?”
“আমি জানি না।”
“ইন্দর লোকটাকে আপনি সন্দেহ করেন?”
“করি। ও একটা জন্তু। অথচ জয় ওকে পছন্দ করত। বন্ধুই ছিল জয়ের।”
কিকিরা আবার চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “দীপনারায়ণবাবু, আপনি কি সত্যি-সত্যিই বিশ্বাস করেন, আপনাদের রাজবাড়িতে যে ছোরাটা ছিল তার কোনো জাদু আছে?”
দীপনারায়ণ বললেন, “করি। হয়ত এটা আমাদের সংস্কার। বিশ্বাস। কোনো প্রমাণ তো দেখাতে পারব না কিংকরবাবু!”
কিকিরা আর কিছু বললেন না।
.
০৫.
তিন চারটে দিন দেখতে দেখতে কেটে গেল। চন্দনও এসে পড়েছে। তারাপদরা যেভাবে এসেছিল সেই ভাবেই। জিপ গিয়েছিল চন্দনকে আনতে, সঙ্গে ছিল তারাপদ। দশরথ আর জোসেফের সামনে দুই বন্ধু কেউই মুখ খোলেনি, অন্য পাঁচ রকম গল্প করেছিল, কখনো কখনো সাঁটে কথা বলছিল।
চন্দন বুঝতে পারল, কিকিরা কোনো দিকেই এগুতে পারেননি.; লাইব্রেরি ঘরে বসে বসে দিন কাটাচ্ছেন আর চুরুট যুঁকছেন, কাগজ-পেনসিল নিয়ে অকারণে লিস্টি করছেন। চন্দন মনে মনে একটু যেন খুশিই হল, কিকিরা এবার জব্দ হয়েছেন। বললে শোনেন না, কোথাকার কোন্ দীপনারায়ণ গিয়ে এক গাঁজা ছাড়ল, আর এক অন্তর্যামী রামপ্রসাদ কী বলল-কিকিরা অমনি নাচতে নাচতে ছুটে এলেন এবয়সে এ-সব পাগলামি করলে কি চলে!
এ-সব দিকে চন্দনও আগে আসেনি। বেড়াতে আসার পক্ষে জায়গাটা নিঃসন্দেহে ভাল। তবে কখনো কখনো ঘন জঙ্গল দেখে তার মনে হচ্ছিল, সিনেমার ছবিতে আফ্রিকার জঙ্গল বলেও এটা চালিয়ে দেওয়া যায়।
.
গেস্ট হাউসে পৌঁছে কিকিরার সঙ্গে দেখা হল। বললেন, “এসো এসো স্যান্ডাল উড, তোমার জন্যেই হাঁ করে বসে আছি।”
চন্দনহেসে বললে, “শুনলাম তাই তারার কাছে, বসে আছেন, উঠে দাঁড়াতে পারছেন না।”
“এখনো পারিনি।”
“পারবেন বলে মনে হয়?”
“দেখা যাক। তুমি আমার জিনিস এনেছ?”
“এনেছি।” বলে চন্দন চোখের ইশারায় তারাপদকে দেখাল, বলল, “তারা জানে?”
“না।”
চন্দন বলল, “সে কী? তারা জানে না?” তারাপদর দিকে তাকাল চন্দন। “কিকিরা আমায় খানিকটা কুকুর-বিষ আনতে বলেছিলেন–জানিস। সিক্রেট মেসেজ। খামের ওপর ছোট্ট করে লিখেছেন–ব্রিং ডগ পয়জন তার ওপর স্ট্যাম্প মেরে দিয়েছেন। কার বাবার সাধ্যি ধরে। স্ট্যাম্প না তুললে দেখা যাবে না।”
তারাপদর মনে পড়ল, হাওড়া স্টেশন ছাড়ার আগে কিকিরা চন্দনকে এই ম্যাজিকটা বলে দিচ্ছিলেন। বলেছিলেন, চিঠি মতন কাজ করা, কোনো স্পেশ্যাল মেসেজ থাকলে ওই কায়দায় জানাব।
তারাপদ কিকিরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল, বুঝতে পারল না কুকুর-বিষ কী কাজে লাগবে। কুকুর মারবেন নাকি কিকিরা? কিকিরাও কিছু বললেন না।
স্নান খাওয়া-দাওয়া সেরে চন্দন এসে তারাপদর ঘরে শুয়ে পড়ল। চন্দনের জন্যে একটা বাড়তি খাট তারাপদর ঘরে ঢোকানো হয়েছে। আলাদা ঘর অবশ্য ছিল কিন্তু চাকরবাকরকে বলে কয়ে একই ঘরে দু জনের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।
সিগারেট ধরিয়ে বিছানায় শুয়ে চন্দন বলল, “বল, এবার তোদের গোয়েন্দাগিরি শুনি।”
তারাপদ রাজবাড়ির একটা বর্ণনা ও বিবরণ দিল। কারা থাকে, কে কী করে, কার কার ওপর আলাদা করে নজর রাখার চেষ্টা করছেন কিকিরা, সে-সব বৃত্তান্তও বলল। শেষে তারাপদ হতাশ গলায় বলল,”আমাদের কী কাজ হয়েছে জানিস এখন?”
“কী?”
“সকাল বেলায় চা-টা খেয়ে এক দিস্তে কাগজ, এক বান্ডিল পুরনো ক্যাটালগ, গোটা তিনেক ছোট বড় ম্যাগনিফায়িং গ্লাস, কার্বন পেপার, পেনসিল নিয়ে লাইব্রেরিতে ঢোকা। বেলা বারোটা পর্যন্ত ওই ঘরে বসে থাকতে হয়। স্নান খাওয়া-দাওয়ার জন্যে ঘণ্টা দেড়েক ছুটি। আবার যাই, সারাটা দুপুর কাটিয়ে ফিরি।”
“করিস কী?”
“ঘোড়ার ডিম। বইয়ের নাম লিখি সাদা কাগজে। মাঝে মাঝে পাতা ওলটাই। বই ঘাঁটি।”
“কিকিরা কী করেন?”
“বায়নাকুলার চোখে দিয়ে এ-জানালা সে-জানালা করে বেড়ান মাঝে মাঝে। আর মন্ত-মস্ত ছবিগুলো দেখেন কখনো-সখনো চুরুট ফোঁকেন। খেয়াল হলে বই দেখেন।”
“তার মানে–তোরা বসে বসে ভেরাণ্ডা ভাজছিস?”
“পুরোপুরি!..তবে একটা কথা সত্যি চাঁদু, টাকা থাকলে বড়লোকদের শখ যে কেমন হয়–তুই রাজবাড়ির লাইব্রেরি দেখলে বুঝতে পারবি। এক-একটা ছবি আছে–দেখলে মনে হবে দেওয়ালসাইজের, এত বড়। বইয়ের কথাই বা কী বলব! গাদা গাদা বই নানা ধরনের, অর্ধেক বইয়ের পাতাও কেউ ছোঁয়নি। শুধু শখ করে মানুষ এত টাকা খরচ করে তুই না দেখলে বিশ্বাস করবি না।”
চন্দনের ঘুম আসছিল। জড়ানো চোখে আলস্যের গলায় বলল, “দুর–তোরা ফালতু এসেছিস। একটা অ্যাডভেঞ্চার গোছের কিছু হলেও বুঝতাম।”
তারাপদ একটু চুপ করে থেকে বলল, “আমাদের ওপর এরা চোখ রেখেছে।”
“কাবা?”
“শশধররা। প্রথম দিন আমরা যখন দীপনারায়ণের সঙ্গে দেখা করতে যাই–আমাদের ঘরে কেউ ঢুকেছিল। কিকিরার মনে সন্দেহ হয়, আমরা যখন থাকব না–কেউ ঘরে ঢুকতে পারে। তিনি দরজা বন্ধ করার পর কতকগুলো দেশলাইকাঠি চৌকাঠে সাজিয়ে রেখেছিলেন। দরজা খুলে ঢুকতে গেলেই পা লাগার কথা। দীপনারায়ণের কাছ থেকে ফিরে এসে আমরা দেখলাম, কাঠিগুলো ছড়িয়ে রয়েছে।” তারাপদর মনে পড়ল, কিকিরা চশমা আনার ছুতো করে সেদিন কেমন ভাবে কাঠি সাজিয়ে এসেছিলেন।
চন্দন ঘুম-ঘুম চোখে বলল, “আর কিছু নয়?”
তারাপদ বলল, “সন্ধের পর এখানে থাকা যায় না। ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। শীতও সেই রকম। যত রাত বাড়ে, হাত পা একেবারে জমে যায়। তার ওপর এখানে কত কী যে হয়, চাঁদ! এ একটা ভুতুড়ে জায়গা। পাঁচ সাতটা কুকুর রাত্তিরে মাঠের মধ্যে ছুটে বেড়ায়, একবার ডাকতে শুরু করল তো সে কী ডাক ভাই, বুক কেঁপে যায়। ইন্দর বলে একটা লোক আছে রাজবাড়িতে, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গাল-ভরা দাড়ি, ছুরির মতন চোখ; সে আবার মাঝে মাঝে ঘোড়া ছুটিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সঙ্গে কুকুর। মোটরবাইক চালায় ঝড়ের মতন। একদিন তো আমার ঘাড়ে এসে পড়েছিল প্রায়।”
চন্দন কিছুই শুনছিল না। ঘুমিয়ে পড়েছিল।
.
দুপুরে কিকিরা লাইব্রেরিতে যাননি, তারাপদও নয়। বিকেলে চন্দনকে নিয়ে বেড়াতে বেরোলেন কিকিরা, সঙ্গে তারাপদ। রাজবাড়ির চৌহদ্দিটাই ঘুরে দেখাচ্ছিলেন কিকিরা। সেটা কম নয়। উঁচু পাঁচিল দিয়ে চারপাশ ঘেরা। একটা মাত্র বড় ফটক। চারদিকে মস্ত মাঠ, বড় বড় গাছ সারি করে সাজানো, একপাশে ফুলবাগান, চৌকোনা বাঁধানো পুকুরটা পশ্চিমদিকে, তারই কাছাকাছি মন্দির। এ-সব হল মূল রাজবাড়ির বাইরে, মুখোমুখি। রাজবাড়িতে ঢোকার মুখে আবার এক মস্ত লোহার ফটক। অবশ্য রাজবাড়ির বাইরের দিকের ঘর, বারান্দা সবই দেখা যায়। বাইরের দিকটায় বাইরের মহল, রাজবাড়ির কাউকে বড় একটা দেখাও যায় না।
বেড়াতে বেড়াতে চন্দন নানারকম প্রশ্ন করছিল। কিকিরা জবাব দিচ্ছিলেন। তারাপদও কথা বলছিল। চন্দন বুঝতে পারছিল, এক সময়ে রাজবাড়ির শখ-শৌখিনতা কম ছিল না, অর্থব্যয়ও হত অজস্র। এখন পড়তি অবস্থা। যা আছে পড়ে রয়েছে; কারও কোনোদিকে চোখ নেই, অর্থও নেই। যদি অর্থ এবং শখ-শৌখিনতা থাকত, তবে জাল দিয়ে ঘেরা, গোল, অত বড় পাখি-ঘরটায় মাত্র একটা ময়ুর পঁচিশ-ত্রিশটা পাখি থাকত না, আরও অজস্র পাখি থাকতে পারত। অমন সুন্দর পুকুরের কী অবস্থা! পাথর দিয়ে বাঁধানো পুকুরের চারপাশের পথের কী বিশ্রী হাল হয়েছে। বাঁধানো পুকুর, কিন্তু তার জলের ওপর শ্যাওলা আর শালুক-পাতা, জল চোখেই পড়ে না প্রায়। মন্দিরটা অবশ্য কোনোরকমে চকচকে করে রাখা হয়েছে। সকালে পুরোহিত এসে পুজোটুজো করেন, সন্ধেবেলায় আরতি হয়, অন্য সময় মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে।
চন্দনরা যখন পুকুরের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আচমকা শশধরকে দেখা গেল। গোলমতন একটা লতাপাতা-ঘেরা জায়গার পাশ দিয়ে বেরিয়ে এল।
নজরে পড়েছিল কিকিরার। দাঁড়িয়ে পড়লেন।
শশধর এগিয়ে এল।
শশধর কাছে এলে কিকিরা বললেন, “এদিকে কোথায় সিংহীমশাই?”
শশধর বলল, “ওদিকে গিয়েছিলাম। যন্ত্রপাতি খারাপ হয়ে গেলে মেরামতের যা হাল হয়–” বলে শশধর অনেকটা দূরে রাখা একটা ছোট ট্রাকটর দেখাল।
চন্দনের সঙ্গে শশধরের আলাপ করিয়ে দিলেন কিকিরা।”তারাপদর বন্ধু। ওর সঙ্গে আপনার আলাপ হয়নি।”
শশধর বলল, “দুপুরে আমি ছিলাম না। উনি আসছেন শুনেছিলাম।”
“ছেলেটি বড় কাজের সিংহীমশাই। বয়স কম, কিন্তু চোখ বড় পাকা। পুরনো জিনিস ঠাওর করা মুশকিল, আসল নকল বোঝা যায় না। চন্দন এসব ব্যাপারে পাকা লোক। ঠিক জিনিসটি ধরতে পারে। কলকাতার মিউজিয়ামে চাকরি করে করে চোখ পাকিয়ে ফেলেছে।”
শশধর ধূর্তের মতন বলল, “আপনার দলের লোক?”
কিকিরা ঘাড় নেড়ে হাসি মুখে বললেন, “ধরেছেন ঠিক।…আমার যখনই কোনো ব্যাপারে সন্দেহ হয়, ওকে ডেকে পাঠাই, সে ছবিই বলুন বা দু-একশো বছরের পুরনো কিছু জিনিস হলেই। আপনাদের রাজবাড়িতে কত যে জিনিস আছে সিংহীমশাই যার মূল্য আপনারাও বোঝেন না। চন্দনের আবার এসব ব্যাপারে বড় শখ। চোখে দেখলেও ওর শান্তি। বড় গুণী ছেলে ভাল কথা, আপনি কি কোনো দৈবচক্ষুর কথা শুনেছেন?”
“দৈবচক্ষু?”
“আছে। এই রাজবাড়িতেই আছে।” কিকিরা বললেন।
শশধর আর দাঁড়াল না। বলল, “উনি আছেন; পরে আলাপ করব। আমি যাই।”
শশধর চলে গেল। কিকিরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর চন্দনদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “এই শশধরটাকে আমি প্রায়ই এই পুকুরের দিকটায় ঘোরাফেরা করতে দেখি! কী ব্যাপার বলো তো?”
চন্দন বলল, “সে তো আপনিই বলবেন!”
মাথা নেড়ে কিকিরা বললেন, “না, লোকটা মিছেমিছি এদিকে ঘুরে বেড়াবার পাত্র নয়। কিছু রহস্য আছে।” বলে কিকিরা চুপ করে গিয়ে কিছু যেন ভাবতে লাগলেন, চারদিক দেখতে লাগলেন তাকিয়ে-তাকিয়ে।
চন্দন বলল, “কিকিরা স্যার, আমার মনে হচ্ছে আপনিই বেশি রহস্যময়।”
“কেন?”
“আপনি এখানে বসে বসে যে কী করছেন আমি বুঝতে পারছি না। তারা বলছিল, আপনি রোজ সকালে এক দফা, আর দুপুরে এক দফা তারাকে সঙ্গে করে লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে থাকেন। মাত্র দু বার দীপনারায়ণের সঙ্গে। আপমার দেখা হয়েছে এ পর্যন্ত।”
কিকিরা একবার তারাপদকে দেখে নিয়ে চন্দনকে বললেন, “লাইব্রেরিতে আমি বসে থাকি না চন্দন, বসে বসে দেখি-সব দেখি, অবজার্ভ করি। আমার একটা বায়নাকুলার আছে, তারাপদ তোমায় বলেনি?”
“বলেছে?”
“লাইব্রেরির পজিশনটা খুব ভাল। বড় বড় জানলা, স্কাই লাইট। দূরবীন চোখে লাগিয়ে বসে থাকলে ভেতর আর বাইরের অনেক কিছু দেখা যায়। শশধরটাকে আমি এদিকে ঘোরাফেরা করতে যে দেখেছি, সে তত ওই দূরবীন চোখে দিয়েই।”
“বেশ করেছেন দেখেছেন। কিন্তু শশধরকে দেখেই দিন কাটাচ্ছেন?”
“না”, মাথা নাড়লেন কিকিরা, “ব্রেন শেক্ করছি?”
চন্দন হাঁ হয়ে গেল। “সেটা কী?”
“মগজ নাড়াচ্ছি”, গম্ভীর মুখে কিকিরা বললেন।
চন্দন প্রথমটায় থমকে গেল, তার পর হো হো করে হেসে উঠল। তারাপদও।
হাসি থামিয়ে চন্দন বলল, “কিছু তলানি পেলেন, স্যার?”
“গট অ্যান্ড নো গাই।”
“তার মানে?”
“পাচ্ছি আবার পাচ্ছিও না। চলো, ঘরে ফিরি, তারপর বলব।”
তিনজন গেস্ট হাউসের দিকে ফিরতে লাগলেন। শীতের বিকেল বলে আর কিছু নেই, অন্ধকার হয়ে আসছিল। আকাশে দু একটা তারা ফুটতে শুরু করেছে। বাতাসও দিচ্ছিল ঠাণ্ডা।
গেস্ট হাউসের কাছাকাছি পৌঁছতে শব্দটা কানে গেল। রাজবাড়ির দিক থেকে একটা গাড়ি বেরিয়ে আসছে। মোটর বাইক। আলো পড়ল। ভটভট শব্দটা কানে গর্জনের মতন শোনাল। যেন ঝড়ের বেগে গাড়িটা রাস্তা ধরে সোজা বড় ফটকের দিকে চলে গেল।
হাত বিশেক দূর থেকে কিকিরা মানুষটিকে দেখতে পেলেন।
ইন্দরের পরনে প্যান্ট, গায়ে সেই চামড়ার কোট, গলা পর্যন্ত বন্ধ। মাথায় একটা টুপিকালো রঙেরই।
যাবার সময় ইন্দর একবার তাকাল। দেখল কিকিরাদের।
বড় ফটকের কাছে একটু দাঁড়াতে হল ইন্দরকে, বোধ হয় ফটক খোলার জন্য। তারপর বেরিয়ে গেল। তার মোটর বাইকের শব্দ বাতাসে ভেসে থাকল কিছুক্ষণ; শেষে মিলিয়ে গেল।
কিকিরা বললেন, “আজ হল কী? এক সময়ে দুই অবতার?”
চন্দন কিছু বুঝল না তারাপদও কথা বলল না।
হাঁটতে হাঁটতে কিকিরা বললেন, “ওই যে মানুষটিকে দেখলে চন্দন, ওর নাম ইন্দর। ও শুধু ভটভটি চালাতে পারে যে তা নয়, ওর অনেক গুণ। ঘোড়ায় চড়তে পারে, শিকার করতে পারে, কুকুর পোষে–আবার সার্কাসের রিং মাস্টারদের মতন খেলাও দেখাতে পারে। তবে বাঘ-সিংহর নয়, কুকুরের। ও হল দীপনারায়ণের কাকা ললিতনারায়ণের শ্বশুরবাড়ির লোক। এখানেই থাকে। বছর দশেক ধরে আছে। জয়নারায়ণের চেয়ে বয়েসে ছোট হলেও জয়নারায়ণের খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। লোকটাকে দিনের বেলায় দেখলে তুমি বুঝতে পারবে।”
.
০৬.
কিকিরার ঘরে বাতি জ্বালা হয়ে গিয়েছিল। কেরোসিনের টেবিলবাতি, দেখতে কিন্তু সুন্দর, সাদা ঘষা কাচের শেড় পরানো, সরু মতন, চিমনিটা শেডের মাথা ছাড়িয়ে গেছে। গেস্ট হাউসে ঠাকুর চাকর থাকে সব সময়। সন্ধেবেলায় চা দিয়ে গিয়েছে চাকরে।
ঘরের দরজাটা খোলাই রেখেছিলেন কিকিরা, তারাপদকে দরজার কাছাকাছি বসিয়ে রেখেছিলেন পাছে কেউ এসে আড়ি পাতে। মাঝে-মাঝে তারাপদকে দরজার বাইরে গিয়ে দেখে আসতে হচ্ছিল আশেপাশে কেউ ঘোরাঘুরি করছে কিনা!
কিকিরা তাঁর সরু চুরুট ধরিয়ে নিয়ে বললেন, “সমস্ত ব্যাপারটা এবার একবার ভাল করে ভেবে দেখা যাক, কী বলো?”
চা খেতে খেতে মাথা হেলাল চন্দন।
কিকিরা বললেন, আস্তে গলায়, “সোজা কথাটা হচ্ছে এই মাসখানেক আগে জয়নারায়ণ রাজবাড়িতেই মারা গেছেন। প্রথমে মনে করা হয়েছিল, সেটা দুর্ঘটনা; দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন জয়নারায়ণ। বাইরের লোক এই কথাটাই জানে। কিন্তু জয়নারায়ণের দাদা দীপনারায়ণের পরে সন্দেহ হয়েছে, তাঁর ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর কারণ দুর্ঘটনা নয়, কেউ তাকে খুন করেছে। তাই না?”
চন্দন আরাম করে চায়ে চুমুক দিল। দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বার করল।
কিকিরা বললেন, “প্রশ্নটা হল, জয়নারায়ণকে কেউ খুন করেছে, নাকি তিনি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন? যে মারা গিয়েছে তাকে আমরা চোখে দেখিনি। মানুষ দুর্ঘটনায় মারা গেলে তার পোস্ট মর্টেম হয়, ডাক্তারেরা অনেক কিছু বলতে পারে। এখানে কোনোটাই হয়নি। কাজেই কিছু জানার বা সন্দেহ করার প্রমাণ আমাদের নেই। তবু মানুষের মন মানতে চায় না; তার সন্দেহ বলল, ধোঁকা বলল, থেকে যায়। দীপনারায়ণের মনে একটা ঘোরতর সন্দেহ জন্মেছে, জয়নারায়ণকে কেউ খুন করেছিল।”
তারাপদ চন্দনের দেওয়া সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে একবার উঠল; দরজা দিয়ে মুখ বাড়াল। কাউকে দেখতে পেল না। ফিরে এসে বসল।
কিকিরা চা খাচ্ছিলেন ধীরে ধীরে। বললেন, “দীপনারায়ণের সঙ্গে কথা বলে আমি দেখেছি, এরকম সন্দেহ হবার প্রথম কারণ রাজবাড়ির ওই ছোরা, যার নাকি একটা আশ্চর্য গুণ আছে। কী গুণ তা তোমরা শুনেছ। ওই ছোরা কাউকে অন্যায় কারণে খুন করলে ছোরা থেকে রক্তের দাগ কিছুতেই যায় না, তা ছাড়া দিন দিন ছোরাটা ভোঁতা আর ছোট হয়ে আসে।”
চন্দন সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে বলল, “গাঁজা।”
“গাঁজা না গুলি–সেটা পরে ভাবলেও চলবে”, কিকিরা বললেন, “আপাতত ধরে নাও দীপনারায়ণ যা বলছেন সেটাই সত্যি। যদি তাই হয় তবে জয়নারায়ণকে খুন করল কে? কেনই বা করল?”
তারাপদ মাথা নাড়ল। তাকাল দরজার দিকে। চন্দন চুপ করে থাকল।
কিকিরা বললেন, “আমি একটা জিনিস ভেবে দেখেছি। রাজবাড়ির ওই ছোরার জাদু যাই থাক না কেন–তার বাঁটটার বাজার-দর আছে। দামি পাথর দিয়ে কারুকার্য করে বাঁটটা যেভাবে বাঁধানো–তাতে ওটা যেন কোনো মানুষকে রাতারাতি বেশ কিছু পাইয়ে দিতে পারে। যদি কেউ অর্থের লোভে খুন করে, থাকত–তবে বাঁটটা রেখে যেত না। তাই না?”
চন্দন কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল। যেন বলল, ঠিক কথা।
চুরুটটা আবার ধরিয়ে নিলেন কিকিরা।”অর্থের লোভে কেউ জয়নারায়ণকে খুন করেনি। কিংবা যদি করেও থাকে–শেষ পর্যন্ত বাঁটটা নিয়ে পালাবার পথ পায়নি। যে অর্থের লোভে ছোরা চুরি করবে, খুন করবে–সে বাঁটটা ফেলে রাখবে এ বিশ্বাস করা যায় না।”
চন্দন বলল, “ছোরাটা না দীপনারায়ণের ঘরে সিন্দুকে থাকত?”
“হ্যাঁ।”
“দীপনারায়ণের শোবার ঘরে ঢুকে কেউ একজন সিন্দুক খুলে ছোরাটা চুরি করবে, সেই ছোরা দিয়ে খুন করবে, আবার সিন্দুকে রেখে আসবে বাঁটটা–এটা বেশ বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কিকিরা?”
মাথা হেলিয়ে কিকিরা বললেন, “হচ্ছে বইকি! খুবই বাড়াবাড়ি হচ্ছে।”
“এরকম বোকা লোক কে থাকতে পারে! রাজবাড়ির ছোরা-রহস্যের কথা জেনেও, ধরা পড়ার জন্যে সেই ছোরা বার করে আনবে, আবার খুন করে রেখে আসবে?”
“আমিও তো তাই ভাবছি। জয়নারায়ণ কেমন করে মারা গিয়েছিলেন। জানো?”
“অ্যাকসিডেন্টে। মাথার ওপর ভারী জিনিস পড়ে।”
“হ্যাঁ। লাইব্রেরি-ঘরে জয়নারায়ণ মারা যান। তাঁর মাথার ওপর একটা বড় সেলফ বইপত্রসমেত ভেঙে পড়ে, সেই সঙ্গে বড় একটা ছবি, কাঁচে গলা হাত কেটে গিয়েছিল। মাথায় চোট লেগেছিল, তা ছাড়া রক্তপাত হয়েছিল প্রচুর। গলার নলি কেটে গিয়েছিল, হাত কেটেছিল, মুখের নানা জায়গায় কাঁচ ঢুকে গিয়েছিল।”
তারাপদ উঠল। বাইরে চলে গেল।
চন্দন বলল, “ঘটনাটা ঘটেছিল কখন?”
“রাত্রের দিকে। আটটা নাগাদ।”
“কোনো ডাক্তার আসেনি?”
“এখানে কোনো ডাক্তার নেই। মাইল কুড়ি দূরে ডাক্তার আছে। রাজবাড়ি থেকে গাড়ি গিয়ে যখন ডাক্তার নিয়ে এল–ততক্ষণে জয়নারায়ণ মারা গেছেন।”
“কাছেপিঠে কোনো হাসপাতাল নেই?”
“না। এ-জঙ্গলে তুমি হাসপাতালে কোথায় পাবে!”
তারাপদ ফিরে এসে আবার বসল।
কিকিরা বললেন, “কাল তোমাকে লাইব্রেরিতে নিয়ে যাব। দেখবে লাইব্রেরির চেহারাটা কেমন। মেঝে থেকে পনেরো আঠারো ফুট উঁচুতে ছাদ। চারদিকে বিরাট বিরাট র্যাক। বই পড়তে হলে সিঁড়ি লাগে। সিঁড়ি রয়েছে কাঠের। র্যাকে ঠাসা বই। বিশাল বিশাল চেহারা। ওজনও কম নয়। জয়নারায়ণ সিঁড়ি দিয়ে উঠে সেলফ থেকে বই টানছিলেন এমন সময় হুড়মুড় করে এক তাক বই তাঁর ঘাড়ে মুখে পড়ে, সিঁড়িসমেত উলটে মাটিতে পড়ে যান। ব্ল্যাকটাও ভেঙে যায়।”
“জয়নারায়ণ কি পণ্ডিত লোক ছিলেন?” জিজ্ঞেস করল চন্দন।
কিকিরা বললেন, “দীপনারায়ণ বলেন, লাইব্রেরি-ঘরে প্রায়ই গিয়ে বসে থাকতেন।”
“পড়াশোনা করতেন?”
“হয়ত করতেন, আমি জানি না।” কিকিরা একটু থেমে হঠাৎ বললেন, “তুমি একটা জিনিস মোটেই লক্ষ করছ না। বই পড়তে গিয়ে একসঙ্গে অনেকগুলো বই হঠাৎ পড়ে যাওয়া সম্ভব। র্যাক ভেঙে যাওয়াও অসম্ভব নয়। কিন্তু অত বড় একটা বাঁধানো ছবি, যার ওজন অন্তত পনেরো কুড়ি সের হবে, কেমন করে দেওয়াল থেকে ভেঙে পড়ল তা বলতে পারো? দীপনারায়ণকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন, তাঁদের ধারণা হয়েছিল, জয়নারায়ণ যখন সিঁড়ি সমেত উলটে পড়ছিলেন–তখন হয়ত হাত বাড়িয়ে ছবিটা ধরবার চেষ্টা করেছিলেন।”
“ছবিটা কি নাগালের মধ্যে ছিল?”
“দুটো পাশাপাশি র্যাকের ফাঁকে ছবিটা টাঙানো ছিল। ফ্রেম দিয়ে বাঁধানো ছবি।”
“অত বড় ছবি কেমন করে টাঙানো ছিল?”
“তার দিয়ে।”
“তার ছিঁড়ে গেল?”
“পুরনো তার ছিঁড়তে পারে। মরচে ধরে ক্ষয় হতে পারে। কিংবা কোনো জায়গায় পলকা ছিল।”
“আমি বিশ্বাস করি না। তবু দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। ঘরের টাঙানো পাখাও তো মাথায় পড়ে। ছাদ খসে মানুষ মারা যায়।”
চন্দন কিছু বলল না।
কিকিরা বললেন, “বিপদের সময় মানুষের মাথার ঠিক থাকে না। ছবিটা কেমন করে পড়ল, কেমন করে তার কাঁচে জয়নারায়ণের গলা মুখ হাত কেটে রক্তে সব ভেসে গেল তা কেউই খেয়ালও করল না। জয়নারায়ণ মারা যাবার পর দীপনারায়ণ যখন একদিন নিতান্তই আচমকা নিজের সিন্দুকের মধ্যে ছোরাটাকে দেখলেন তখন তাঁর টনক নড়ল। তখনই তাঁর সন্দেহ হল, ভাইয়ের মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়। ছবির ব্যাপারটাও তাঁর খেয়াল হল।”
তারাপদ বলল, “আপনি বলতে চাইছেন, জয়নারায়ণকে আগে খুন করা হয়েছে; তারপর বাকি যা কিছু সাজানো হয়েছে।”
“আমি এখনই কিছু বলতে চাইছি না। যা বলার পরশু রাত্রে বলব, শুধু রাজবাড়ির ছোরা নয়, ওই ছবিও নয়, জয়নারায়ণ যখন দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন তখন ইরচাঁদের ওই ডালকুত্তার মতন কুকুরগুলো কেন তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে চারপাশে ছোটাছুটি করছিল এবং ডাকছিল–সেটাও রহস্য। কুকুরের ডাকের জন্যে আশপাশের কেউ অনেকক্ষণ কিছু শুনতে পায়নি।”
চন্দন কিছু বলার আগেই কিকিরা আবার বললেন, “কাল আমার অনেক কাজ তোমাদের নিয়ে। চন্দন, কতটুকু ড পয়জেন এনেছ?”
চন্দন হাত দিয়ে মাপ দেখাল।
পরের দিন সকাল থেকেই দেখা গেল কিকিরা খুব ব্যস্ত। সকালে চা খেয়ে তারাপদদের নিয়ে লাইব্রেরিতে চলে গেলেন, ফিরলেন দুপুরে। তারাপদ আর চন্দনকে দেখলেই বোঝা যায় যত রাজ্যের ধুলো ঘেঁটেছে, মুখে চোখে মাথায় ধুলোর ছোপ।
দুপুরে স্নান-খাওয়ার পর চন্দন আর তারাপদ দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল; কিকিরা সামান্য বিশ্রাম সেরে তাঁর ঝোলাঝুলি নিয়ে বসলেন। দরজা বন্ধ থাকল। কী যে করলেন তিনি সারা দুপুর, কেউ জানল না।
বিকেলে চন্দনদের নিয়ে প্রথমে গেলেন দীপনারায়ণের সঙ্গে দেখা করতে। তারপর দীপনারায়ণের সঙ্গে রাজবাড়ির ভেতর মহল ঘুরে বেড়ালেন, দেখলেন সব। মায় দীপনারায়ণের ঘরের সিন্দুক পর্যন্ত।
ফিরে এসে আবার দীপনারায়ণের নিচের অফিস-ঘরে বসলেন সকলে।
কিকিরা বললেন, “দীপনারায়ণবাবু, এবার খোলাখুলি ক’টা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।”
“বলুন।”
“এই রাজবাড়িতে আপনার অনুগত বিশ্বাসী লোক ক’জন আছে?”
দীপনারায়ণ কেমন যেন অবাক হলেন। বললেন, “কেন?”
“দরকার আছে। আপনি যাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতে পারেন, এমন লোকদের বাদ দিয়ে বলছি।“
সামান্য ভেবে দীপনারায়ণ বললেন, “চার-পাঁচজন আছে।”
“আপনার বাড়িতে বন্দুক রাইফেল, রিভলবার নিশ্চয় আছে?”
মাথা নেড়ে সায় দিলেন দীপনারায়ণ।
“কার কার আছে?”
“আমার আর জয়নারায়ণের। কাকারও বন্দুক ছিল।”
“কে কে বন্দুক-টন্দুক চালাতে পারে আপনারা তিনজন বাদে?”
আমার ছেলেরা পারে। ইন্দরও পারে।”
“অন্য কোনো মারাত্মক অস্ত্র আছে?”
“পুরনো কিছু অস্ত্র ছিল, কৃপাণবল্লম গোছের, সেসব কোথায় পড়ে আছে, কেউ ব্যবহার করে না।”
কিকিরা একটু চুপ করে থেকে বললেন, “রাজবাড়িতে কাঠের মিস্ত্রি আছে কেউ?”
“কাঠের মিস্ত্রি? কেন?”
“কেউ নেই?”
“আছে।”
“তাদের মধ্যে একজনকে কাল আমার একটু দরকার। সকালের দিকে। আর আপনার বসার ঘরে উঁচু গোল হালকা একটা টেবিল দেখেছি। ওটাও দরকার।”
দীপনারায়ণ অবাক হয়ে বললেন, “কাঠের মিস্ত্রি, টেবিল–এ-সব নিয়ে কী .. করবেন আপনি?”
কিকিরা মজার মুখ করে বললেন, “ম্যাজিক দেখাব।”
“ম্যাজিক?”
“আপনি তো জানেন, আমি ম্যাজিশিয়ান, কিকিরা দি ওয়ান্ডার…!” কিকিরা হাসতে লাগলেন।
দীপনারায়ণ বিরক্ত বোধ করলেও মুখে কিছু বললেন না। সংযতভাবে বললেন, “কিংকরবাবু, এখন আমার মনের অবস্থা ম্যাজিক দেখার মতন নয়।”
কিকিরা বললেন, “জানি দীপনারায়ণবাবু, কিন্তু কাল সন্ধের পর ওই লাইব্রেরি-ঘরে আমি একটা ম্যাজিক দেখাব। আপনাকে সেখানে থাকতে হবে; শুধু আপনি হাজির থাকলেই চলবে না, ইন্দর, শশধর, আপনার কাকা ললিতনারায়ণকেও থাকতে হবে।”
দীপনারায়ণ কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। বললেন, “কাকা অন্ধ। তিনি কেমন করে ম্যাজিক দেখবেন?”
“তাঁকে দেখতে হবে না। তিনি হাজির থাকলেই চলবে।” বলে কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন, চোখের ইশারায় চন্দনদের উঠতে বললেন।
দীপনারায়ণ বোবা বোকা হয়ে বসে থাকলেন।
কিকিরা হেসে হেসেই বললেন, “দীপনারায়ণবাবু, আপনি আপনাদের রাজবাড়ির ছোরার অদ্ভুত-অদ্ভুত গুণের কথা বিশ্বাস করেন। আমার একটা ম্যাজিক আছে যার নাম দিয়েছিলাম–’মিস্ট্রিরিয়াস আইজ’–এই খেলাটার মধ্যে একটা অলৌকিক গুণ আছে। কাল সেটা দেখাব। ওই খেলা ছাড়া জয়নারায়ণের খুনিকে ধরবার আর কোনো উপায় আমার জানা নেই। আপনার দায়িত্ব হল, যাদের কথা বলেছি তাদের প্রত্যেককে ঠিক সময়ে ঠিক মতন লাইব্রেরিতে হাজির করা। আপনার হুকুম সবাই মানতে বাধ্য। আর আমরা যখন লাইব্রেরিতে বসব কাল রাত্রে, তখন আপনার বিশ্বাসী লোক দিয়ে। লাইব্রেরি-ঘরের চারপাশে পাহারা বসাবেন। খেলার কথা কাউকে বলবেন না।”
দীপনারায়ণ কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বলার কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। শেষে বললেন, “আপনি এসেছেন পুরনো বইয়ের ভ্যালুয়ার হিসেবে। লোকে সেটাই জানে। আপনি তাদের ম্যাজিক দেখাবেন?”
কিকিরা বললেন, “আপনি ম্যাজিক দেখানোর কথা বলবেন না কাউকে। অন্য কিছু বলবেন। হুকুম করবেন। ও দায়িত্বটা আপনার।…আর একটা কথা, কাল আপনি যখন লাইব্রেরিতে আসবেন, ছোরার বাক্সটা সঙ্গে রাখবেন। লুকিয়ে।…পারলে একটা পিস্তল গোছের কিছু রেখে দেবেন।”
.
০৭.
লাইব্রেরি-ঘরে সবাই হাজির ছিল : দীপনারায়ণবাবু, ললিতনারায়ণ, ইন্দর, শশধর–সকলেই। তারাপদও ছিল। চন্দন ছিল না, সবে ঘরে এসে ঢুকল। কিকিরার সঙ্গে চোখে চোখে ইশারা হল চন্দনের।
সন্ধে উতরে গিয়েছে। রাত বেশি নয়, তবু লাইব্রেরি-ঘরের উঁচু ছাদ, রাশি রাশি বই, ছবি, নানা ধরনের পুরনো জিনিস, বন্ধ জানলা এবং অনুজ্জ্বল বাতির জন্যে মনে হচ্ছিল রাত যেন অনেকটা হয়ে গিয়েছে।
কালো রঙের পায়া-অলা গোল টেবিল ঘিরে সকলে বসে ছিলেন। টেবিলটা প্রায় বুকের কাছাকাছি ঠেকছিল। টেবিলের ওপর পাতলা কালো ভেলভেটের কাপড় বিছানো। শশধর তার মনিবদের সামনে বসতে চাইছিল না, দীপনারায়ণ হুকুম করে তাকে বসিয়েছেন।
চন্দন ফিরে আসার পর কিকিরা ঘরের চারপাশে একবার ভাল করে তাকিয়ে নিলেন। আজ তাঁর একটু অন্যরকম সাজ। গায়ের আলখাল্লার রঙটা কালো, পরনের প্যান্টও বোধহয় কালচে, দেখা যাচ্ছিল না। চোখে চশমা। কাঁচটা রঙিন। তাঁর চোখ দেখা যাচ্ছিল না।
কিকিরা তারাপদকে বললেন, দরজাটা বন্ধ আছে কিনা দেখে আসতে।
তারাপদ দরজা দেখে ফিরে আসার পর কিকিরা তাকে বাতিটা আরও কম। করে দিতে বললেন।
টেবিল থেকে সামান্য তফাতে উঁচু টুলের ওপর একটা বাতি ছিল। তারাপদ মিটিমিটে সেই আলো আরও কমিয়ে দিল। অত বড় লাইব্রেরি-ঘর এমনিতেই প্রায় অন্ধকার হয়েছিল, বাতি কমাবার পর আরও অন্ধকার হয়ে গেল।
টেবিলের চারধারে গোল হয়ে বসে আছেন : কিকিরা, কিকিরার ডান পাশে দীপনারায়ণ, বাঁ পাশে ললিতনারায়ণ, দীপনারায়ণের একপাশে ইন্দর, ইন্দরের পর বসেছে শশধর। তারাপদ আর চন্দন কিকিরার মাথার দিকে দাঁড়িয়ে।
সকলকে একবার দেখে নিয়ে কিকিরা প্রায় কোনো ভূমিকা না করেই বললেন, “দীপনারায়ণবাবু, আপনি আমাদের একটা কাজের ভার দিয়ে এই রাজবাড়িতে এনেছিলেন। আমরা এই ক’দিন সাধ্যমত খেটে আপনার কাজ শেষ করে এনেছি। সামান্য একটু কাজ বাকি আছে। কাজটা সামান্য, কিন্তু সবচেয়ে জরুরি। আপনাদের সকলকে আজ শুধু সেই জন্যেই এখানে ডেকেছি। হয়ত কেউ-না-কেউ আপনারা আমায় সাহায্য করতে পারেন।”
দীপনারায়ণ তাকিয়ে থাকলেন, ললিতনারায়ণ অন্ধ হয়ে যাবার পর চোখে গগলস্ পরেন, তাঁর চোখের পাতা খোলা থাকে, দেখতে পান না। ললি