১. দরজা খুলতে দেরি হল
০১.
দরজা খুলতে দেরি হল।
দরজা খুললেন বিনুর মা। বোধনকে দেখলেন। ও, তুমি! বিনুর শরীর ভাল নেই।
বোধন বিনুর মাকে দেখছিল। কী হয়েছে?
জ্বর।
বিনুর মা দরজা পুরোপুরি খোলেননি। এক পাট খুলে পাললায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে। ভেতরের দিকে বাতি জ্বলছিল। বিনুর মার মুখের ওপর অন্ধকার পড়ছে।
বোধন বিনুর মার মুখ দেখতে দেখতে বলল, সকালে আসতে পারিনি তাই এখন এসেছিলাম। আমি তা হলে যাই।
আচ্ছা, এসো।
বিনুর মা অপেক্ষা করছিলেন; বোধন পিঠ ফেরালেই দরজা বন্ধ করবেন। ভেতর থেকে বিনুর গলা শোনা গেল। কে এসেছে, মা?
বোধন।
বোধনদা! ওকে একটু বসতে বলল না।
ঘাড় ঘুরিয়ে বিনুর মা ঘরের দিকে তাকালেন। বসতে বলব?
হ্যাঁ বলো। আমার খুব দরকার। একটু বসুক।
বিনুর মা বলতে যাচ্ছিলেন, তোমার না জ্বর–না বলে বোধনের দিকে মুখ ফেরালেন আধাআধি। হয়তো বিরক্ত। তুমি তা হলে বসো।
বোধনকে ভেতরে আসতে জায়গা দিলেন বিনুর মা। বোধন ভেতরে আসতেই আবার দরজার ছিটকিনি তুলে দিলেন।
কয়েক পা এগিয়ে ডান দিকে বসার ঘর বিনুদের। বিনুর মা ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালালেন। পাখা চালাবার আগে ইতস্তত করলেন। তুমি তবে বসো।
ঘরটা অগোছালো হয়ে আছে। চায়ের কাপ, জলের গ্লাস, কাচের প্লেট পড়েছিল সেন্টার টেবিলের ওপর, সোফার পিঠে পাট করা সুজনি। হয়তো কেউ রেখে গিয়েছে।
বিনুর মা এটা ওটা তুলে নিচ্ছিলেন। সারাদিনের একটা লোক পাই না এখানে! ঠিকে ঝি দিয়ে কত আর হবে! কী জায়গায় যে এসেছি!
বোধন বিনুর মাকে অন্যমনস্কভাবে দেখছিল। দেখতে ভাল লাগে। অনেক ছিমছাম। আঁটোসাঁটো চেহারা, বাঁধা গড়ন। মোটা-সোটা বেয়াড়া নয়। মাথায় বেশ লম্বা। গায়ের রং ধবধবে ফরসা নয়, তবে ফরসাই, গালের এক পাশে সামান্য নীলচে দাগ। বিনুর মার নাক উঁচু; চোখ বড় বড়। চোখে চশমা। রূপোলি ফ্রেমের চশমায় বিনুর মার মুখ ঝকঝক করছিল। বোধহয় সামান্য আগে গা ধুয়েছে। চোখমুখ পরিষ্কার, ঝরঝরে। মুখে গলায় পাউডার বুলোনো। গলার ভাঁজে গুড়ো জমে আছে। পরনে কালো পাড়ের শাড়ি। ধবধব করছে জমি। গায়ে মিহি সাদা কাপড়ের জামা। মাথার চুল খোঁপা করে বাঁধা।
বাইরে অনেকক্ষণ থেকে মেঘ ডাকছিল, বিনুর মা বললেন, তুমি কি বৃষ্টির মধ্যেই এলে?
না মাথা নাড়ল বোধন, গুঁড়ি গুঁড়ি পড়ছিল। ও কিছু না।
বিনুর মার হাতে সব আঁটছিল না। কিছু নিলেন, কিছু পড়ে থাকল। আবার আসবেন। উনি চলে গেলেন।
বোধন এতক্ষণে বসল।
বিনুর মাকে দেখলে বোধন আড়ষ্ট বোধ করে। নিজেদের কাছাকাছি মনে হয় না। সম্ভ্রম হয়। অমন সুশ্রী চেহারা, বয়সও কম নয়। বিনুর মা এলোমেলো, আলগা কথা বলেন না। গলায় জোর নেই, ঠাণ্ডা স্বরে কথা বলেন। হাসাহাসি করা মুখ নয়, খানিকটা গম্ভীরই বরং। বোধন বিনুর মার সঙ্গে মাঝে মাঝে নিজের মার তুলনা করে। আকাশ পাতাল তফাত। বোধনের মা অন্যরকম। রাগী, বদমেজাজি, রুক্ষ। মুখে কিছু আটকায় না, গালিগালাজ খারাপ কথা–কিছুই নয়। মায়ের চেহারার সঙ্গেও বিনুর মার চেহারার মিল নেই। বোধনের মা মাথায় মাঝারি। থলথলে, জলেভরা চেহারা। বেমানান মোটা দেখায়, ফোলা ফোলা মুখ-চোখ। রক্ত কম থাকলে নাকি ওই রকম হয়। অ্যানিমিয়া। বোধন জানে না। তবে মার মুখ-চোখ খড়ির মতন সাদাটে, বিবর্ণ। গায়ের চামড়া খসখসে। মাথার চুল পেকে যাচ্ছে মার, গালে দাগ পড়ছে কালো কালো। মা যখন অফিসে যায়–বোধন দেখেছে, হাঁফাতে হাঁফাতে, চোখ-মুখ লাল করে ঘামতে ঘামতে।
পায়ের চটি চট চট করতে করতে বিনু এল। গায়ে সেই আলখাল্লা জামা, কাঁধ থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত মাটিতে লুটোনো। বিনুর হাতে রুমাল, গলায় পাতলা মাফলার জড়ানো, রুক্ষ চুল, শুকনো মুখ। ছল ছল করছে।
সকালে কী হল ঘরে পা দিয়েই বিনু বলল। বলে উলটো দিকের সোফায় ধপ করে বসে পড়ল। নাক টানল। গলার টাগরায় শব্দ করল। সেন্টার টেবিলের দিকে তাকিয়ে নাক কোঁচকাল। এতক্ষণ কী জ্বালাই জ্বালিয়ে গেল!
কে?
মার দুই বন্ধু। কেদার যেতে গিয়ে ভাব হয়েছিল মার সঙ্গে। বেড়াতে এসেছিল। কোথা থেকে এসেছিল জান? রিজেন্ট পার্ক। ওখান থেকে ঠেঙিয়ে কেউ এত দূর আসে! মাথা খারাপ! এসেছে সেই বিকেলের গোড়ায়, আর এই উঠল।
বিনু আর বিনুর মা আলাদা। বিনু রোগা, টিংটিং করছে, রং ময়লা। পাতলা, ছোট্ট মুখ বিনুর। কাটা কাটা নাক-চোখ। বিনুর চুল ঘাড় পর্যন্ত। কোঁকড়ানো। কথা বলার শেষ নেই বিনুর। সরু গলায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলে। এখন অবশ্য ভাঙা, বসে-যাওয়া গলায় কথা বলছিল। নাক বোজা।
তোমার তো জ্বর! বোধন বলল।
শুধু জ্বর! বাব্বা, এ একেবারে হাড্ডি জ্বর বিনু নাক টেনে গলা পরিষ্কার করল।
কেমন করে হল, শোনো! বিনু বলল, পরশু দিন নুন শোয়ে লোটাস সিনেমায় গিয়েছিলাম, চার বন্ধু। বেরিয়ে দেখি, বন্যা। কী বৃষ্টি কী বৃষ্টি! চার বন্ধু হাবুডুবু খেতে খেতে, ভিজে ন্যাতা হয়ে সন্ধেবেলায় বাড়ি। আর যাবে কোথায়! রাত্তির থেকেই হুহু…।
বিনুর মা আবার এলেন। বাকি জিনিসগুলো তুলে নিতে নিতে মাথার ওপরে তাকালেন। পাখা কম করে নাও।
নিবিয়ে দাও না! আমার শীত করছে।
গায়ে জড়ালেই আবার গরম লাগছে।