০১. অন্ধকার আকাশের তলায়
১
অন্ধকার আকাশের তলায় দেখতে-দেখতে একটি আলোর ময়ূর ফুটে উঠল। অবিকল সেই রকম কণ্ঠ, সেই পুচ্ছ। আলোয় ফুলকিগুলো যেন ভাসছিল। তারপর ওই আকৃতি তরল হয়ে ভাসমান অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতন কাঠিন্য হারাতে শুরু করল। ময়ূরটির আকার যত বাড়ছিল, তার প্রত্যঙ্গগুলি ততই গলে যাচ্ছিল। কিছু, সোনালী তারা, কিছু রূপালী স্ফুলিঙ্গ আরও ওপরে উঠে আকাশের তারাদল প্রায় যেন স্পর্শ করল; কণ্ঠ এবং পুচ্ছ থেকে খচিত কণাগুলি নক্ষত্রচূর্ণের মতন বিক্ষিপ্ত হয়ে মাটিতে নেমে আসতে-আসতে নিবে যাচ্ছিল। শেষে, যখন আলোর ময়ূরটি অন্ধকারেই হারিয়ে গেল তখন কয়েকটি মাত্র রূপালী ফুল বৃষ্টির ফোঁটার মতন গড়িয়ে-গড়িয়ে পড়ল, মাঠের ঘাস স্পর্শ করার আগেই ছাই হয়ে গেল।
চারপাশে অফুরন্ত খুশীর গুঞ্জন ছিল; ক্রমশ মাঠে রোল উঠল। গলা ছেড়ে, হাততালি দিয়ে এই ময়ূরের বাজিকরকে সকলে বাহবা দিচ্ছিল। ততক্ষণে আকাশতলায় আবার অন্ধকারের যবনিকা ছড়িয়ে গেছে।
অমল প্রবল উচ্ছ্বাসে হাততালি দিয়েছে অনেকক্ষণ, অবশেষে সবাই থেমে গেলে সেও থেমে গেছে। তার মুগ্ধ উত্তেজিত চোখমুখ অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু গলার স্বরে তার রোমাঞ্চ বোঝা যাচ্ছিল। পাশে ভ্রমর। ভ্রমরকে বার বার সে বলছিল, “বিউটিফুল। আমি কখনও দেখি নি এ রকম। যে তৈরী করেছে, সে একজন আর্টিস্ট। কী রকম সুন্দর গলাটা করেছিল দেখেছ!”
ভ্রমর যেন তখনও আলোর ময়ূরটিকে চোখের মধ্যে কোথাও দেখতে পাচ্ছে। ঝিকমিক ঝিকমিক করে জ্বলছে ছবিটা। বিরিজমোহন প্রত্যেক বছর দেওয়ালিতে রাজ-ময়দানে এই রকম সুন্দর সুন্দর বাজি পোড়ানো দেখায়।
“গত বছরে একজোড়া রাজহাঁস দেখিয়েছিল। খুব সুন্দর।” ভ্রমর বলল।
লাউডস্পীকারের গলা ততক্ষণে পরের দ্রষ্টব্য বিষয়টি ঘোষণা করেছে। হিন্দীতেই বলা হচ্ছিল। বাজি পোড়ানোর আগামী খেলাটাই শেষ। ঠিক বোঝা গেল না কি নাম বললে, শুধু আটামল কোম্পানী আর বোম্বাই শব্দ দুটো কানে গেল।
রাজ-ময়দানের চতুর্দিকে লোক। মাঠ ঘিরে সব বসে আছে। উত্তরের দিকে রাজবাড়ির মহল। আলোর মালা পরানো প্রাচীন প্রাসাদ। গম্বুজের চুড়োয় তিনটি নীল তারা জ্বলজ্বল করছে। পূর্ব-পশ্চিমে গাছের সার, মস্ত মস্ত ঝাউ আর শিরীষ গাছ; অন্ধকারে নিস্তব্ধ, দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণের দিকে স্ট্যান্ড; কাঠের তক্তা গ্যালারীর মতন করে পাতা। ব্যবস্থাটা স্থায়ী। খেলাধুলো হয় এই মাঠেই, ফলে স্ট্যাণ্ডটা রেখে দেওয়া হয়েছে।
অমলরা স্ট্যাণ্ডেই বসেছিল। ওদের পাশে মোহনচাঁদরা বাড়িসুদ্ধ লোক বসে আছে।
তার ওপাশে আছে যোশীরা। যোশীদের দিক থেকে একটি মেয়ে চেঁচিয়ে কি যেন বলল, ভ্রমরকে, হিন্দীতেই। ভ্রমর নীচু গলায় জবাব দিল।
অমল বলল, “কে?”
“পুষ্পা।”
“কি বলল?”
“এবারে মাঠে জোনাকি জ্বলবে।”
অমল বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে শুধোল, “কেন? হঠাৎ জোনাকি জ্বলবে কেন?”
“বাজি; জোনাকির বাজি দেখাবে এবার।”
অমল কল্পনা করতে পারল না, সেটা কি করে সম্ভব হবে। সারা মাঠ ভরে জোনাকি উড়বে নাকি? অথবা অন্যান্য বাজি পোড়ানো যেরকম দেখল, একটা মস্ত ফানুস কি হাউই আকাশে উড়ে গিয়ে তারপর ফেটে পড়বে, সারা আকাশ পিটপিট জোনাকি-আলোয় ছেয়ে যাবে! হর্ষ, রোমাঞ্চ ও অগাধ বিস্ময় নিয়ে অমল মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকল।
এই যে অদ্ভুত অদ্ভুত বাজি পোড়ানোর খেলা, এর একটা মাত্র অসুবিধে এই, একটা শেষ হলে অন্যটা শুরু হতে অনেকক্ষণ সময় লাগে। যারা ব্যক্তি পোড়াবে, তারা তাদের জিনিসপত্র গোছগাছ করে, এটা আনে সেটা আনে, ব্যবস্থা পাকা করে নেয় সব—ফলে সময় যায় অনেকটা; কিন্তু যারা দেখে, তারা অধীর হয়ে পড়ে। অমল বুঝতে পারল না, মাঠে বাজি পোড়ানো হবে, অথচ কতক ছায়া-সদৃশ লোক আলো হাতে চারপাশে ছোটাছুটি করছে কেন?”
“আচ্ছা, মেসোমশাই সেই যে গেলেন, আর এলেন না?” অমল বলল। বাজি পোড়ানো দেখতে সে এত তন্ময় যে, আনন্দমোহনের কথা ভুলে গিয়েছিল।
ভ্রমর বলল, “বাবা বোধ হয় রাজবাড়ির দিকে বসে গল্প করছেন।”
“কৃষ্ণাও ত এল না।”
‘এসেছে ঠিক; ওর বন্ধুদের সঙ্গে এসেছে; বন্ধুদের সঙ্গেই বসে আছে।”
ভ্রমরের কথা শেষ হতে-না-হতেই মাঠের অন্ধকারে একটি আলো দপ করে উঠল, ঠিক মাঝ-মধ্যিখানটায়। তারপর চোখের পলকে মাটির অন্ধকার থেকে ফোয়ারার মতন আলোর ধারা উঠল; উঠল ত উঠলই, গাছের মাথা-সমান উঁচু হয়ে রঙমশালের তারার মতন, তুবড়ির ফুলের মতন ফরফর করে পুড়তে লাগল, জ্বলতে থাকল, নিবতে থাকল। আর সেই আলোর ফোয়ারা নিস্তেজ হয়ে আসতে না আসতেই, কী আশ্চর্য, মাঠের কোণে-কোণে, দূর ও কাছের গাছগুলির অন্ধকারে থোকা-থোকা জোনাকি জ্বলতে থাকল। এই এখানে জ্বলে, ওই ওখানে জ্বলে, কখনও ঘাসের মাথায় এক মুঠো জোনাকি দপ করে ফুটে ওঠে, কখনও দূরে শিরীষ অথবা ঝাউগাছের গোড়ায় জোনাকিদল নাচতে থাকে।
দেখতে-দেখতে চারপাশে যেন জোনাকির মেলা বসে গেল। টিপটিপ করে নীলাভ আলোর বিন্দুগুলি জ্বলছে নিবছে, পাক খাচ্ছে, নাচছে, বাতাসে ছিটকে আসছে, উঁচুতে উঠছে, মাটিতে পড়ছে। মনে হচ্ছিল, একদল লোক যেন মাঠ ও গাছগাছালির কাছে গিয়ে অন্ধকারে জোনাকির পিচকিরি ছুঁড়ে মারছে, আর পলকে অন্ধকারের বসনে জোনাকি ধরে যাচ্ছে।