প্রগতিমূলক বিকাশের দিকে জীবদের একটি সহজাত প্রবণতার কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ যদিও আমাদের হাতে নেই, তথাপি এটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের অবিরাম ক্রিয়াবিক্রিয়ার মাধ্যমে অবশ্যই ঘটে, যেটি আমি চতুর্থ অধ্যায়ে দেখাতে চেষ্টা করেছি। জীব সংগঠনের একটি মান সম্বন্ধে এখন পর্যন্ত প্রদত্ত সর্বোত্তম সংজ্ঞাটি হচ্ছে–কোন্ মাত্রায় অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি বিশিষ্ট অথবা ভিন্ন হয়েছে; এবং এই লক্ষ্যের দিকে প্রাকৃতিক নির্বাচন চেষ্টা করে, যাতে করে প্রত্যঙ্গগুলি দক্ষতার সঙ্গে নিজেদের কাজ করতে সমর্থ হয়।
বিশিষ্ট প্রাণীতত্ত্ববিদ মিঃ সেন্ট জর্জ মিভার্ট, মিঃ ওয়ালেস এবং আমার নিজের প্রস্তাবিত প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের বিরুদ্ধে আমার নিজের এবং অন্যদের দ্বারা উপস্থাপিত সমস্ত আপত্তিগুলি সম্প্রতি সংগ্রহ করেছেন এবং প্রশংসনীয় দক্ষতা ও মনোবলের সাহায্যে সেগুলির ব্যাখ্যা করেছেন। এভাবে যথাবিহিত বিন্যাস দ্বারা এগুলি একটি দূরূহ ব্যুহ সাজায়; এবং নিজের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্য ও বিচার বিশ্লেষণ উপস্থাপিত করা মিঃ মিভার্টের পরিকল্পনায় নেই বলে যুক্তি ও স্মরণশক্তির আশ্রয় নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না পাঠকের, যিনি উভয় দিকের সাক্ষ্যপ্রমাণাদি বিচার করতে ইচ্ছুক হতে পারেন। বিশেষ বিষয়গুলি আলোচনার সময় মিঃ মিভার্ট প্রত্যঙ্গদের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ব্যবহার ও অব্যবহারের প্রভাবগুলিকে উপেক্ষা করেছেন, যেটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি উল্লেখ করেছি এবং অন্য যে কোন লেখকের তুলনায় আমার ‘গৃহপালনাধীনে পরিবর্তন’ প্রবন্ধে বিস্তৃতভাবে তা আলোচনা করেছি। তিনি এভাবে প্রায়শই ধরে নেন যে প্রাকৃতিক নির্বাচন ব্যতিরেকে পরিবর্তনে আমি কিছুই আরোপ করিনি, অন্যথায় আমার জানা অন্য কোন গবেষণামূলক কাজের তুলনায় এইমাত্র উল্লিখিত প্রবন্ধে আমি অসংখ্য সুপ্রতিষ্ঠিত ঘটনাসমূহ সংগ্রহ করেছি। আমার বিচার-বিশ্লেষণ বিশ্বাসযোগ্য না হতে পারে, কিন্তু মিভার্টের বইটি যত্ন সহকারে পাঠ করে এবং একই বিষয়ে আমি যা বলেছি প্রতিটি অনুচ্ছেদে তার তুলনা করে, এখানে উপনীত সিদ্ধান্তসমূহের সাধারণ সত্যতা সম্পর্কে আমি পূর্বে কখনও এত বেশি দৃঢ় প্রত্যয় অনুভব করি নি, কিন্তু বিষয়টি এত জটিল যে কিছু ভুল হতে পারে।
মিঃ মিভার্টের সমস্ত আপত্তিগুলি বর্তমান গ্রন্থে আলোচিত হবে অথবা হয়েছে। অনেক পাঠকের মনে দাগ কেটেছে বলে মনে হওয়া নূতন বিষয় হচ্ছে, “প্রাকৃতিক নির্বাচন উপকারী দেহগঠনের জায়মান ধাপগুলির উদ্দেশ্য নির্ধারণ করতে অসমর্থ।” নির্দিষ্ট ক্রিয়ার কোন পরিবর্তনের সঙ্গে প্রায়শই সংশ্লিষ্ট থাকা বৈশিষ্ট্যগুলির ক্রমবিন্যাসের সঙ্গে বিষয়টি নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত–উদাহরণস্বরূপ, একটি পটকার ফুসফুসে রূপান্তর বিষয়টি দুটি শিরোনামে গত অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও মিঃ মিভার্ট কর্তৃক উত্থাপিত কয়েকটি বিষয় সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করব আমি এবং সেইগুলি বেছে নেব যেগুলি সবচেয়ে ব্যাখ্যামূলক। স্থানাভাবে অন্যগুলি আলোচনা করা যাবে না।’
অত্যুচ্চ দৈহিক উচ্চতা, অতিশয় লম্বা গলা, সামনের পা, মাথা এবং জিভ সমেত জিরাফের দৈহিক কাঠামো উঁচু গাছের শাখাপল্লব খাওয়ার জন্য সুন্দরভাবে অভিযোজিত হয়েছে। একই দেশে বসবাসকারী পায়ে ক্ষুর সমেত অথবা অন্য আনগুলাটা (ক্ষুরযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী) প্রাণীদের তুলনায় সহজেই এরা এভাবে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে, এবং অভাবের সময় এটি এদের পক্ষে খুবই সুবিধাজনক। দক্ষিণ আমেরিকার নিয়াটা গবাদি পশু আমাদের দেখায় দেহগঠনের একটি অল্প পার্থক্য কেমন করে এই সময়ের মধ্যে একটি প্রাণীর জীবনরক্ষার জন্য একটি বিরাট পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে। এই গবাদি পশুরা ঘাস ও বৃক্ষশাখাপল্লবাদি ছিঁড়ে খেতে পারে, কিন্তু নিচের চোয়াল বেরিয়ে থাকার জন্য প্রায়শই সংঘটিত খাবার সময় এরা গাছের শাখাপল্লব, জলীয় ঘাস ইত্যাদি টেনে ছিঁড়ে খেতে পারে না, এইসব খাদ্যে সাধারণ গবাদি পশু ও ঘোড়ারাই প্রাধান্য বিস্তার করে; এবং এদের মালিকরা এদের খাবার না-যোগালে নিয়াটা গবাদি পশুরা ধ্বংস হয়। মিঃ মিভার্টের আপত্তিগুলি আলোচনার পূর্বে, কেমন করে প্রাকৃতিক নির্বাচন সমস্ত সাধারণ ক্ষেত্রে কাজ করে তা পুনরায় ব্যাখ্যা করা সুবিধাজনক হতে পারে। দেহগঠনের বিশেষ বিষয়ে মনোনিবেশ না করে মানুষ সবচেয়ে দ্রুতগামী এককদের সরলভাবে সংরক্ষণ ও প্রজনন করে তার কয়েকটি রূপান্তর ঘটিয়েছে-যেমন ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া। এবং গ্ৰেহাউণ্ড কুকুর, অথবা বিজয়ী পাখিদের প্রজননের মাধ্যমে সৃষ্ট লড়াইয়ের মোরগ। এভাবে প্রকৃতিতেও হয়, যেমন সদ্যজাত জিরাফের এককরা, যারা সবচেয়ে উঁচু গাছের শাখাপল্লব খেত এবং অভাবের সময় অন্যদের তুলনায় এক অথবা দুই ইঞ্চি বেশি উপরে উঠতে সমর্থ হত, তারা প্রায়শই সংরক্ষিত হয়ে থাকবে; কারণ এরা সারা দেশ জুড়ে খাদ্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে থাকবে। একই প্রজাতির এককরা তাদের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আপেক্ষিক দৈর্ঘ্যে প্রায়শই ভিন্ন হয়, এটি প্রাকৃতিক ইতিহাসের অনেক গ্রন্থে দেখা যাবে, যেখানে যত্নসহকারে পরিমাপ দেওয়া আছে। বৃদ্ধি ও পরিবর্তনের নিয়মগুলির জন্য এইসব অল্প আনুপাতিক পার্থক্যসমূহ সমস্ত প্রজাতির ক্ষেত্রে অল্পতম, অনুপকারী এবং অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু সম্ভবপর জীবনস্বভাবের কথা বিবেচনা করলে মনে হয় সদ্যজাত জিরাফের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম হবে, কারণ যাদের শরীরের এক বা কয়েকটি অঙ্গ সাধারণের তুলনায় কিছুটা লম্বাটে হয়, সেইসব এককরাই সাধারণতঃ বেঁচে থাকবে। এরা আন্তঃসঙ্করিত হতে থাকবে এবং বংশধর উৎপাদন করতে থাকবে। এরা একই শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলি বংশগতভাবে পেতে থাকবে অথবা একইভাবে পুনরায় পরিবর্তিত হতে চেষ্টা করে চলবে; অন্যথায় একই বিষয়ে কম আনুকূল্যপ্রাপ্ত এককদের ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হবে।