- বইয়ের নামঃ এ টেল ট্যু সিটীজ
- লেখকের নামঃ চার্লস ডিকেন্স
- প্রকাশনাঃ বিজ্ঞান একাডেমী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
এ টেল ট্যু সিটীজ
এ টেল ট্যু সিটীজ – চার্লস ডিকেন্স
প্রকাশ করেছেন : শ্রী রাজর্ষি মজুমদার দেব সাহিত্য কুটীর প্রাইভেট লিমিটেড ২১, ঝামাপুকুর লেন। কলকাতা-৭০০ ০০৯
.
লেখক পরিচিতি
এই বইয়ের লেখক ইংরেজি সাহিত্যের দিকপাল লেখকদের ভিতর চার্লস ডিকেন্স একজন। প্রায় দু’শো বছর আগে তাঁর জন্ম হয়।
ছেলেবেলায় বড় কষ্টে মানুষ হয়েছিলেন তিনি। পেটের জ্বালায় পথে পথে ঘুরতে হত। পরিচিতের কাছে পেতেন শুধু অবহেলা, অপরিচিতের কাছে অপমান। সেদিনকার সে দৈন্যের জ্বালা সারাজীবন তিনি ভুলতে পারেননি। তার নানা বিখ্যাত বইয়ের শিশু ও কিশোর চরিত্রের ভিতর দিয়ে সেই জ্বালাই ফুটে বেরিয়েছে নানা ভাবে।
লেখক হিসাবে তার প্রথম খ্যাতিলাভ হয় ‘ক্রিসমাস কেরল’ প্রকাশিত হবার পরে। বইখানি এখনও লোকের এত ভাল লাগে যে কিছুদিন আগে এক মার্কিন ধনকুবের দু’লক্ষ টাকারও বেশি দাম দিয়ে ওর পাণ্ডুলিপিখানি কিনে নিয়েছেন।
গত শতাব্দীর ইংরেজ লেখকদের ভিতর ডিকেন্স-এর আসন অতি উচ্চে। এ টেল অব টু সিটীজ, পিকউইক পেপার্স, অলিভার টুইস্ট, ডেভিড কপারফিল্ড–তার এ সব বই সারা পৃথিবীতে সমাদর লাভ করেছে। প্রশ্ন হতে পারে–কোন বিশেষ গুণে ডিকেন্স-এর লেখা লোকের এত ভাল লাগে? সে-প্রশ্নের উত্তর হবে এই দলিত নিপীড়িতের উপর গভীর সমবেদনার জন্যই তার লেখা হৃদয় স্পর্শ করে পাঠকের। যখন যে-বই তিনি লিখেছেন, তারই ভিতর ঐ একটা জিনিস সর্বদাই জোরালো হয়ে দেখা দিয়েছে–দুর্বলের উপর প্রবলের অত্যাচার–শিশুর উপর বয়স্কের বা গরিবের উপর ধনীর বা প্রজার উপর রাজার। এমনভাবে তিনি প্রাণের দরদ ঢেলে দিয়েছেন দলিত দুর্বলের উপরে যে তারই গুণে তাঁর রচনা হয়েছে কালজয়ী।
আর একটা কথা। ডিকেন্স-এর সাহিত্যিক প্রতিভা ছাড়াও আর একটি জিনিসকে আমাদের শ্রদ্ধা করা উচিত। সে তার পুরুষকার। পথের ভিখারী শিশু একদিন জগতের পুজো লাভে সক্ষম হল। কী করে হল? প্রতিভার সাথে পুরুষকারের মিলন না ঘটলে এমনটা হয় না। যে শ্রমশীলতা আর অধ্যবসায় ডিকেন্সকে সাফল্যের পথে নিয়ে গিয়েছিল, তা সকল দেশের সর্বকালের কিশোরগণের অনুকরণীয়।
.
এ টেল ট্যু সিটীজ – চার্লস ডিকেন্স
১. গোড়ার কথা
খৃস্ট জন্মের ১৭৭৫ বৎসর পরে।
নভেম্বর মাসের এক সন্ধ্যা। গড় গড় করে একখানা ঘোড়ার গাড়ি ছুটছিল ডোভারের রাস্তা ধরে। মস্ত লম্বা গাড়ি, অনেক লোক তাতে যেতে পারত, কেউ ভিতরে, কেউ ছাদে। তখন রেলগাড়ি ছিল না, ডাক চলাচল করত এই রকম সব ঘোড়ার গাড়িতে। এ গাড়িটাও সেই ডাকগাড়ি।
মাত্র সাতাশ মাইল চওড়া সমুদ্রের খড়ি। নাম তার ইংলিশ চ্যানেল। তার এপারে ইংলন্ড, ওপারে ফ্রান্স। দুই দেশের ভিতর অনবরত লোকের আনাগোনা। এই ডাকগাড়ি ছাড়া সে সব লোকের চলাচলের আর কোন উপায় ছিল না সেকালে। এপারে ওপারে সারা পথটাই চলতে হত ডাকগাড়িতে; মাঝখানে শুধু খাড়িটুকু পার হওয়ার জন্য ছিল জাহাজ।
সেই সন্ধ্যাবেলা।
.
গাড়িখানা একটা ছোট পাহাড়ের নিচে দিয়ে চলেছে। হঠাৎ একজন লোককে ঘোড়া ছুটিয়ে আসতে দেখা গেল সেই গাড়ির দিকে। সে গাড়ির কাছাকাছি এসেই চিৎকার করে উঠলল–”গাড়ি থামাও!”
ডাকগাড়ির চালক গাড়ি থামিয়ে দিলো। অশ্বারোহী তখন গাড়ির কাছে এসে পড়েছে। সে তাড়াতাড়ি দরজার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো–টেলসন ব্যাঙ্কের মিঃ লরী এই গাড়িতে আছেন কি?
গাড়ির ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে একটি ভদ্রলোক বললেন–আমিই মিঃ লরী। কি দরকার আপনার বলুন।
লোকটা তখন তার পকেট থেকে একখানা খাম বের করলো। খামের মুখ আঁটা। সেটা মিঃ লরীর দিকে এগিয়ে ধরে বললো–আপনার চিঠি।
–আমার চিঠি!
–হ্যাঁ, ব্যাঙ্ক থেকে দেওয়া হয়েছে, খুব জরুরি চিঠি।
মিঃ লরী লোকটার হাত থেকে চিঠিখানা নিয়ে তাড়াতাড়ি খুলে পড়লেন। চিঠিখানা খুবই ছোট। তাতে লেখা ছিল–
“মিঃ লরী,
ডোভারের রয়্যাল জর্জ হোটেলে দেরি করবেন একটু। সেখানে আসবেন সেই ভদ্রমহিলা। আপনার সঙ্গে তার দেখা হওয়া দরকার!”
এ টেস্ অব টু সিটীজ চিঠিখানা পড়া হয়ে গেলে মিঃ লরী সেখানাকে আবার খামে বন্ধ করলেন; পকেটে রাখতে রাখতে বললেন–আচ্ছা, তুমি এখন যেতে পারো।
অশ্বারোহী নমস্কার করে চলে গেল। তার ঘোড়ার খুরের আওয়াজ একটু একটু করে ঢিমিয়ে এল। দূর থেকে দূরে সরে যেতে যেতে একসময়ে তা একেবারে মিলিয়ে গেল।
ডাকগাড়িখানা আবার ছুটতে লাগলো হাওয়ার বেগে।
পরদিন সকালে ডাকগাড়িখানা এসে দাঁড়ালো রয়্যাল জর্জ হোটেলের দরজার সামনে।
গাড়ি থামতেই হোটেলের সর্দার খানসামা এগিয়ে এসে মিঃ লরীকে খাতির করে উপরে নিয়ে গেল।
টেলসন ব্যাঙ্ক খুব বড় ব্যাঙ্ক। লন্ডন আর প্যারী–এই দুই রাজধানীতেই তার বিশাল কারবার। বিখ্যাত ব্যাঙ্কের সমস্ত কাজ দেখাশোনার ভার মিঃ লরীর উপরে। কাজেই লোক তিনি সামান্য নন। তাঁকে খাতির করবার জন্য যে হোটেলের লোকেরা ছুটে আসবে, একথা না বললেও চলে।
মিঃ লরী হোটেলের ম্যানেজারকে তার জন্য দু’খানা ভাল ঘর ব্যবস্থা করে। দিতে বললেন। তিনি আরও বললেন যে, ঘর দু’খানির একখানিতে থাকবেন একজন তরুণী। তিনিও আজই আসবেন।
তখনই ঘর ঠিক হয়ে গেল।
.
ঘরে গিয়ে পোশাক বদল করবার সঙ্গে সঙ্গেই সকাল বেলার খাবার নিয়ে এলো একজন খানসামা।
মিঃ লরী তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে পড়লেন, তার ইচ্ছে সমুদ্রের ধারে কিছুক্ষণ বেড়িয়ে আসা।
ডোভার শহরটা ঠিক সমুদ্রের উপরে নয়; একটু দূরে, পাহাড়ের গায়ে। সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে যদি কেউ শহরের দিকে তাকায়, তার হঠাৎ মনে হবে শহরটা সমুদ্রের ভয়ে ছুটে পালাবার চেষ্টা করছিল। বেশি দূরে যেতে পারেনি; মাঝপথে পাহাড়কে পেয়ে তারই বুকে মুখ লুকিয়ে রয়েছে। সমুদ্র কিন্তু অত সহজে তাকে ছেড়ে দিতে রাজী নয়। সে পেয়াদার পর পেয়াদা পাঠাচ্ছে শহরটাকে ধরে আনবার জন্য। সে
পেয়াদা হল পাহাড় সমান বড় বড় ঢেউ। সে সব ঢেউ কিন্তু শহরের নাগাল পাচ্ছে না; শহর পাহাড়ের গায়ে অনেক উঁচুতে বসে ঢেউ-পেয়াদাকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। ঢেউয়েরা রেগে যাচ্ছে তাতে, লাফিয়ে উঠছে কূলের উপর। তাতে শহরের কিছু ক্ষতি হচ্ছে না; মাঝখান থেকে ভেঙে পড়ছে কূলের মাটি। বেড়াবার পক্ষে খুব যে মনোরম জায়গা এটা, তা নয়। একটা সোঁদা আঁশটে গন্ধ ডাঙায়; আর একটা গোলমেলে আওয়াজ জলের দিক্টাতে, সে-আওয়াজ শুনতে শুনতে বিরক্তি ধরে যায় মানুষের।
ডোভারে তখন ব্যবসা-বাণিজ্য খুব কমই হত। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য না করেও হঠাৎ বড়লোক হতে দেখা যেতো দু’চার জনকে। কী করে হত? জাহাজ তো মাঝে মাঝে ডোবে সমুদ্রে! সে সব জাহাজের অনেক মালপত্রই ভাসতে ভাসতে কূলে গিয়ে লাগে। তার ভিতর সোনা-দানা হীরে-জহরতের বাক্সও পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। ডোভারের উপকূলটা এরকম ভাবে বাঁকানো যে ওখানে এসে লাগলে সে জিনিস আর ভেসে বাহির সমুদ্রে যেতে পারে না। এখন যেমন সরকারী লোক নিযুক্ত হয়েছে ঐ সব ভেসে-আসা মাল টেনে তুলবার জন্য, তখন তা ছিল না। কাজেই যার সম্মুখে পড়ত, সেই নিয়ে যেত। কেউ কেউ বড়লোক হয়ে যেত এই ভাবেই। তাই লোভে লোভে ডোভারবাসী সবাই সমুদ্রের ধারে ধারে ঘুরে বেড়াত অবসর পেলেই।
সেদিনও ঐ রকম কয়েকজন লোক ঘুরে বেড়াচ্ছিল সমুদ্রের তীরে। মিঃ লরীর ভাল লাগল না তাদের ঐ রকম ঘোরাফেরা। অনেকক্ষণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি হোটেলে ফিরে গেলেন।
বিকেলের দিকে কুয়াশায় আবছা হয়ে এলো চারিদিক। ওপারের ফরাসী-উপকূল ভাল দেখা যায় না আর। সেইদিকে চেয়ে মিঃ লরীর মনে নানা চিন্তার উদয় হতে লাগল। দুঃখেরই চিন্তা। পনেরো বছর আগে একটি দু’বছরের শিশুকে কোলে নিয়ে ফরাসী-দেশ থেকে পালিয়ে এসেছিলেন তিনি। সেই দু’বছরের শিশু আজ সতেরো বছরের তরুণী। তাকেই আজ আবার ফরাসীদেশে নিয়ে যাবার দরকার হয়েছে। রয়্যাল জর্জ হোটেলে এসে তারই পথ চেয়ে বসে রয়েছেন মিঃ লরী। অবশ্য আজকের দিনটা এমনিতেই তাকে অপেক্ষা করে থাকতে হত, কারণ কালকের আগে আর জাহাজ নেই ওপারে যাবার।
তখন সন্ধ্যা উতরে গেছে। খাওয়ার ঘরে লোকের ভিড় দেখে মিঃ লরী তার খাবার আলাদা জায়গায় দিতে বললেন। নির্জনে বসে চিন্তা করতে চান তিনি। এই যে তরুণীটি আসছেন, কী ভাবে এঁর সঙ্গে আলাপ করবেন তিনি, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না এখনও। কিন্তু বুঝে পড়ে ঠিক হয়ে থাকা দরকার; তা নইলে বিপদ হবে দু’জনেরই; তাঁরও, তরুণীরও! নিজের মনকে তিনি আরও সময় দিতে চান তৈরি হওয়ার জন্য।
খাওয়া শেষ হবার আগেই সদরে একখানা ঘোড়ার গাড়ির শব্দ শোনা গেল। দু’মিনিট পরেই একজন খানসামা এসে মিঃ লরীকে জানালো যে, একজন তরুণী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান।
খানসামা আরও বললো যে, যে ঘরখানা মহিলাটির জন্য আগে থেকে বন্দোবস্ত করে রাখা হয়েছিল, সেইখানেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তিনি সেই ঘরেই অপেক্ষা করছেন। মিঃ লরী তখন তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে সেইদিকে চললেন। ঘরের ভিতর আলো অতি কম, সহসা তিনি কিছুই দেখতে পেলেন না, কিন্তু একটি মিষ্টি কণ্ঠস্বর তিনি শুনতে পেলেন; কে যেন তাকে আসন গ্রহণ করবার জন্য অনুরোধ করে উঠলো। মিঃ লরী এইবার ঠাহর করে দেখলেন–সামনেই একটি তরুণী আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, টুপি হাতে করে। মেয়েটির বয়স বছর সতের। ছিপছিপে লম্বা চেহারা, বেশ সুন্দরী। মাথায় একরাশ সোনালী চুল।
মিঃ লরী নমস্কার করলেন। অপরিচিত বৃদ্ধ ভদ্রলোকের যেরকম নমস্কার করা উচিত এক তরুণীকে, সেই ভাবেরই এ নমস্কার। কারণ, পরিচয় যেটুকু হয়েছিল একদিন, তা এ-মেয়েটির মনে থাকবার কথা নয়। পনেরো বছর আগে এই লুসী ম্যানেটকে তিনিই ফরাসীদেশ থেকে কোলে করে নিয়ে এসেছিলেন অবশ্য, কিন্তু এই দীর্ঘ পনেরো বছর একে আর দেখবার সুযোগ হয়নি তার। তিনি যখন টেলসন ব্যাঙ্কের লন্ডন-অফিসের খাতাপত্রের তদারকে ব্যস্ত, তখন লুসী ম্যানেটের তদারক করছিলেন পল্লী-অঞ্চলের এক বিদ্যালয়ের পরিচালক। অবশ্য, ব্যাঙ্ক থেকেই যোগানো হয়েছে লুসীর সমস্ত খরচা।
মেয়েটিই কথা বালো প্রথমে। ব্যাঙ্ক থেকে কাল একখানা চিঠি পেয়েছি, আমার বাবার টাকাকড়ি বিষয়-আশয়ের সম্বন্ধে। শুধু টাকাকড়িই নয়, বাবার নিজের কথাও কিছু আছে চিঠিতে। এতদিন পরে এ-রকম চিঠি এল–এতে আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি। বাবাকে আমি চোখেও দেখিনি । শুনেছি যে আমার জন্মের কয়েকমাস আগেই–
মিঃ লরী নীরবে শুনে যান মেয়েটির কথা।
মেয়েটি বলে চলে–ব্যাঙ্কের চিঠিতে আমাকে বলা হয়েছে–এই হোটেলে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আপনি আমায় নিয়ে যাবেন প্যারী-নগরে…আমার। পিতার সেই বিষয়-আশয়ের সম্বন্ধে যেমন দরকার হবে, তেমনি ব্যবস্থা করবার জন্য।
মিঃ লরী বললেন–হ্যাঁ, সেই রকমই কথা আছে বটে!
মেয়েটির কথা তখনও শেষ হয়নি! সে বললো–চিঠিতে এ-কথাও লেখা ছিল–এ ব্যাপার সম্বন্ধে সব-কিছু আপনার কাছেই জানতে পাবো আমি।
মিঃ লরী কিভাবে তার কথাটা শুরু করবেন, তা ভেবে ঠিক করবার আগেই মেয়েটি আবার প্রশ্ন করলো–আচ্ছা, আপনি কি একেবারেই অপরিচিত আমার?
এ প্রশ্নের সোজা উত্তর না দিয়ে মিঃ লরী পাল্টা প্রশ্ন করলেন–অপরিচিত নই কি?
দারুণ দোনা-মনায় পড়লে মানুষের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। মেয়েটির কপালেও দেখা দিল সেই রেখা। খুবই চিন্তিত ভাবে সে ধীরে-ধীরে বসে পড়লো চেয়ারে। এতক্ষণ সে দাঁড়িয়েই ছিল।
আগের কথা একেবারেই চাপা দিলেন মিঃ লরী। এই যেন নূতন পরিচয় হচ্ছে তাদের, সেই ভাবে বলতে শুরু করলেন, কুমারী ম্যানেট! আমি ব্যবসায়ী লোক।’ ব্যবসার কথাই আপনার সঙ্গে বলতে এসেছি। ব্যবসার ব্যাপারেই আমাদের এক মক্কেলের জীবনের কোন কোন ঘটনার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছি আমরা, সে সব কথাই বলতে চাই আপনাকে।
–মক্কেলের কথা!
–হ্যাঁ, মক্কেলের কথা। যারা আমাদের ব্যাঙ্কের সঙ্গে লেনদেন করেন, তাদেরই আমরা বলি মক্কেল। ভদ্রলোক ছিলেন ফরাসী বৈজ্ঞানিক, উঁচুদরের পণ্ডিত চিকিৎসক।
–তাঁর বাড়ি কি বোভেয়াতে?
-হ্যাঁ, আপনার পিতা মঁসিয়ে ম্যানেটের মত, এ ভদ্রলোকও ছিলেন বোভেয়াবাসী। মঁসিয়ে ম্যানেটের মত, এঁর খ্যাতি ছিল দেশে। প্যারীতে তার সঙ্গে আলাপ হয় আমার। বৈষয়িক লেনদেন নিয়েই আলাপ অবশ্য, তবে একটু গোপনীয় ব্যাপার ছিল এর ভিতর। আমি তখন আমাদের প্যারীর অফিসে। সে আজ কুড়ি বছর আগের কথা।
-কি বললেন? কুড়ি বছর আগের কথা?
–হ্যাঁ, কুড়ি বছর আগের কথা। তিনি বিবাহ করেন একটি ইংরেজ-মহিলাকে। তার সম্পত্তির ভার ছিল আমার উপর। ও-রকম অনেক ফরাসী-ভদ্রলোকেরই সম্পত্তির ভার আমায় নিতে হয়েছিল তখন ব্যাঙ্কের তরফ থেকে।–নিছক ব্যবসায়ের দিক দিয়েই সম্পর্ক, ওতে বন্ধুত্ব নেই, দরদ তো নেই-ই। সারাদিন ব্যাঙ্কে বসে মক্কেলের পর মক্কেলের হিসাব যেমন পরীক্ষা করি, ঠিকই তেমনই, মক্কেলের পর মক্কেলের বৈষয়িক সুবিধা কিসে হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখি আমি। ও আমার কর্তব্য। কর্তব্য করে যাওয়ার একটা কল আমি, আর কিছু নই। হ্যাঁ, যা বলছিলাম! সেই বোভেয়াবাসী ভদ্রলোক মারা গেলেন। যদি না যেতেন–ওকি! চমকে উঠছেন কেন?
লুসী সত্যিই চমকে উঠে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মিঃ লরীর হাত, নিজের দু’হাত দিয়ে। মিঃ লরী বুঝতে পারলেন, লুসীর মনে ভয় হয়েছে, যদিও কিসের ভয় তা সে জানে না। তাই তাকে সাহস দেবার জন্যে বাপ যেমন মেয়ের হাত ধরে তেমনি ভাবে তার হাত চেপে ধরে শান্তভাবেই বলতে থাকেন–
–হ্যাঁ, যা বলছিলাম! ঐ ভদ্রলোক যদি মারা না যেতেন! মিস্ ম্যানেট, আপনি মনে মনে একটা ধারণা গড়ে তুলবার চেষ্টা করুন। ধারণা করুন যে ভদ্রলোকটি মারা যাননি, মারা যাওয়ার বদলে তিনি হঠাৎ হারিয়ে গেছেন, অসাধারণ শক্তিমান কোন শত্রু তাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে অতি গোপন জায়গায় এমন ভাবে লুকিয়ে রেখেছে যে তার কোন খোঁজ তার আত্মীয়-বন্ধুরা শত চেষ্টাতেও পাচ্ছে না! ধারণা করতে পারছেন? তাহলে এখন বুঝে দেখুন যে সেই অভাগা ভদ্রলোকটির কী অবস্থা!
এই পর্যন্ত বলে একটু থামলেন লরী, বোধ হয় মিস্ ম্যানেটকে তৈরি হবার সময় দেওয়ার জন্য। তারপর আগের চেয়ে নিচু গলায় বললেন–ঐ বোভেয়াবাসী ডাক্তারটির যে অবস্থা আপনি ধারণা করতে পেরেছেন, ঠিক সেই অবস্থাই ঘটেছিল ডাক্তার ম্যানেটের, আপনার শিত।
লুসী ম্যানেট তাকিয়ে আছে। তার চোখের চাউনিতে ভয় আর সংশয় মাখামাখি। সে-অসহায় দৃষ্টি দেখে দুঃখ হল মিঃ লরীর। কিন্তু দুঃখ পেয়ে কথা চেপে গেলে তো চলবে না। তিনি আবার বলতে লাগলেন–হ্যাঁ, এ-রকম ব্যাপার ঘটে ফরাসীদেশে…প্রচুরই ঘটে! ফ্রান্সের যাঁরা ধনী মানী প্রবল জমিদার–তারা ইচ্ছে। করলেই, যে-কোন ব্যক্তিকে ব্যাস্টিল কারাগারে আবদ্ধ করতে পারতেন, যা এখনও পারেন–সারা জীবনের মত। এক-রকম সরকারী ফর্ম, ছাপানো কাগজ আছে। সেই ফর্ম পূরণ করে দিলেই হল। যার নাম লিখে দেওয়া হবে, সে অন্তর্ধান করবে সঙ্গে সঙ্গে। তার স্ত্রী-কন্যা গিয়ে রাজা-রানীর পায়ে নিজের কলিজা ছিঁড়ে উপড়ে দিলেও কিছু হবে না। আর আত্মীয়-স্বজনেরা সংবাদটি পর্যন্ত পাবে না যে, সে অভাগা বেঁচে আছে না মরে গেছে। এ-রকম ঘটনা ঘটে থাকে ফরাসীদেশে। যে ভাগ্যহীন বোভেয়াবাসী ডাক্তারের কথা আমি বলছিলাম আপনাকে, তার স্ত্রীর ভাগ্যে এমনি ঘটনাই ঘটেছিল। যদিও তার সাহস ছিল অসীম, ধৈর্যের তুলনা ছিল না। তা হলেও স্বামীর এ রকম অদ্ভুত ভাবে হারিয়ে যাওয়ার ব্যথা তিনি বেশিদিন সহ্য করতে পারলেন না। একটি সন্তানের জননী তিনি। সন্তানটি যখন জন্মগ্রহণ করল, তখন তার স্বামী অন্তর্ধান করেছেন…
বাধা দিয়ে নিচু গলায় লুসী বললো–সন্তানটি, বোধ হয় মেয়ে?
মিঃ লরী উত্তর করলেন–হ্যাঁ, মেয়েই বটে। মেয়েটি দু’বছরের হতে-না-হতেই তার মাকেও সে হারালো। বুদ্ধিমতী জননী একটি কৌশল করে গিয়েছিলেন মরবার আগে। মেয়েকে জানিয়েছিলেন যে তার বাবা মৃত।
লুসীর সারা দেহ থেকে-থেকে কেঁপে উঠতে লাগলো। মিঃ লরী বললেন–স্বামী বেঁচে আছেন, অথচ তার কাছে যাবার উপায় নেই, তার সংবাদ নেবার উপায় নেই, এমনকি, কোথায় কতদূরে কীভাবে যে তাকে আটক করে রেখেছে দুশমনেরা, তা জানবারও কোন উপায় নেই!–এ-রকম অসহায় অবস্থায় পড়লে মানুষের মনে কি যে নিদারুণ যাতনা হয়, তা তিনি সেই দু’বছরে ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন। মেয়েও যাতে বাপের জন্য ঐ-রকম যাতনা ভোগ করতে বাধ্য না হয়, তাই এ কৌশল তিনি করেছিলেন। কন্যা যাতে কোনদিন জানতে না পারে যে, তার পিতা জীবিত-ওকি! আপনি হাঁটু গেড়ে বসছেন কেন?
–আমায় দয়া করুন! সত্যি কথা বলুন আমায়! নতজানু হয়ে প্রার্থনা করছি আপনার কাছে–আপনি আমায় সত্য কথা বলুন–সকাতরে বলে উঠলো লুসী।
এ অবস্থায় কি যে করা যায়–বুঝতে না পেরে মিঃ লরী বললেন–বিপদে ফেললেন আপনি! আপনার অবস্থা দেখে আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। মাথা গুলিয়ে গেলে কথা কইবো কি করে?…নয় পেন্সকে নয় গুণ করলে কত হয় বলুন তো চট করে? কুড়ি গিনিতে কত শিলিং হয়, হিসাব করে বলুন তো? এঃ!–আপনি গুলিয়ে দিলেন সব!
বলতে-বলতে মিঃ লরী লুসীকে তুলে সযত্নে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। লুসীর অস্থিরভাবটা ধীরে-ধীরে কমে আসতে লাগলো। মিঃ লরীও মাথা ঠিক করে নিজের গল্প শুরু করলেন আবার।
–শুনুন তাহলে, কুমারী ম্যানেট। আপনার মা ঠিক এই ব্যবস্থাই করেছিলেন আপনার সম্বন্ধে। তারপর তিনি স্বর্গে গেলেন। ভগ্নহৃদয়ে মারা গেলেন বলেই আমার বিশ্বাস। আপনার পিতার জন্য সন্ধানের তার বিরাম ছিল না–জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। যাই হোক, তিনি মারা গেলেন। আপনি বড় হয়ে উঠলেন দিনে-দিনে…সুন্দরী, লাবণ্যময়ী, সুখী। আপনার পিতা বেঁচে আছেন, বেঁচেও মরার সামিল হয়েই আছেন, এ-কথা আপনি জানতে পারেননি কোনদিন। তা যদি পারতেন, তা হলে আপনার মায়ের মত আপনারও জীবন কাটত সংশয় আর যাতনার মাঝে। সে-যাতনার হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন আপনি এতদিন–মায়ের আশীর্বাদে।
লুসীর সোনালী চুলের দিকে নতনেত্রে তাকিয়ে ছিলেন মিঃ লরী। তার চোখের চাহনির ভিতর দিয়ে গভীর স্নেহ ঝরে পড়ছিল যেন। হঠাৎ তার মনে হল–পিতার দুর্ভাগ্যের কথা গোড়া থেকে জানতে পারলে এই সতেরো বছরের মেয়েরই চুল হয়তো আজ সাদা হয়ে যেতো, যাতনার আগুনে পুড়ে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মিঃ লরী বললেন–না, সম্পত্তির কোন কথা নয়, ও-সম্বন্ধে নতুন কোন খবর নেই। কিন্তু…
তাঁর একখানা হাত লুসীর হাতের ভিতরে বন্দী রয়েছে বহুক্ষণ, তার উপর যেন বড় বেশি চাপ পড়তে লাগলো এইবার। ওদিকে লুসীর দুই ভ্রর মাঝখানের যে চিন্তারেখা তিনি লক্ষ্য করেছিলেন তা যেন স্থায়ী আসন গেড়ে বসেই রইলো সেখানে। শুধু সেই রেখাঁটির দিকে তাকিয়েই মিঃ লরী বুঝতে পারলেন–কী ভয়ানক বেদনা আর বিভীষিকায় ভরে গেছে কোমলা কুমারীর অন্তর। লুসীর চেতনাই যেন আধা আধি লোপ পেয়েছে; মিঃ লরীর কথাগুলো সে শুনছে বটে, কিন্তু তার কোন অর্থ সে বুঝতে পারছে না।
মিঃ লরী বললেন–হাঁ, পাওয়া গেছে…তাকে পাওয়া গেছে…বেঁচে আছেন তিনি। খুবই বদলেছেন–অবশ্য। শরীর-মন একেবারেই ভেঙে গেছে বলে মনে হয়। অবশ্য, আশা করছি তিনি হয়তো ভালোই আছেন। অন্তত বেঁচে যে আছেন, এটাও তো কম কথা নয়! ব্যাস্টিল থেকে বেরুবার পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়, তারই এক পুরাতন কর্মচারীর বাড়িতে। আমরা সেখানেই যাবো এখন। আমি যাচ্ছি–দেখি তাকে চিনতে পারি কি না, অর্থাৎ ইনিই সত্যি সত্যি আপনার পিতা কি না, সেটা সনাক্ত করবার ভার আমার। আর, আপনার ভার–আপনার স্নেহে ও সেবায় ওঁকে আবার বাঁচিয়ে ভোলা, জীবনের আনন্দ আর আশা ওঁকে আবার ফিরিয়ে দেওয়া…
সারা দেহে একটা শিহরন খেলে গেল লুসীর। সে যেন স্বপ্নের ঘোরেই বলে উঠলো–বাবা! আমার বাবা বেঁচে আছেন। তাকে আমি দেখতে পাবো?
সে-কথার উত্তর না দিয়ে মিঃ লরী বললেন–আর একটা জিনিস মনে রাখা দরকার কুমারী ম্যানেট! প্যারীতে রাজার যে কারাগার আছে ব্যাস্টিল,–নামে এ টেস্ অব টু সিটী কারাগার মাত্র হলেও সবদিক দিয়ে একটা দুর্গের মতই যা মজবুত–সেইখানেই আপনার পিতাকে আটক রেখেছিল শত্রুরা। কে সে শত্ৰু, কেন সে আটক রেখেছিল তাকে–এ-সব বিষয়ে সন্ধান নিতে যাওয়া বিপজ্জনক হবে এখন। আমাদের কাজ হবে—ওঁকে যত শীঘ্র সম্ভব ফ্রান্স থেকে সরিয়ে আনা। দেখুন, আমি ইংরেজ। ইংলক্সে রাজার প্রজা আমি, তার উপর টেলসন ব্যাঙ্কের পদস্থ কর্মচারী হিসেবে ফরাসীদেশে আমার কিছুটা সম্মানও আছে, কিন্তু ব্যাস্টিলের কথা মুখে উচ্চারণ করতে ভয় পাই আমি।–কিন্তু! একি! মিস ম্যানেট।…লুসী।
লুসী স্থির হয়েই বসেছিল–কিন্তু মিঃ লরীর কথা শুনতে-শুনতে কখন চেতনা লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল ভাগ্যহীনা বালিকার। চক্ষু দুটি বিস্ফারিত হয়ে শরীর মুখের দিকে তাকিয়েই আছে, দুই জ্বর মাঝখানটা তখনো আগের মতই কুঁচকে রয়েছে। সবই আগের মত আছে, নেই কেবল জ্ঞান। এমন শক্ত করে লুসী মিঃ লরীর হাত দু’খানা ধরেছিল যে, তার নড়বার উপায় ছিল না। নড়লেই লুসী মাটিতে পড়ে যাবে। সুতরাং সেইভাবে বসে বসেই মিঃ লরী হোটেলের দাসীদের ডাকতে লাগলেন-সাহায্যের জন্য।
২. ডিফার্জের দোকানে
প্যারী মহানগরীর এক গরিব পাড়া–সেন্ট আন্টইন। তারই এক রাস্তার ধারে ডিফার্জের মদের দোকান। দোকানের সামনে প্রকাণ্ড একটা মদের পিপে ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে। মদের স্রোত বইছে রাস্তায়। লাল মদে রাস্তাটা যেন রক্তনদী হয়ে গিয়েছে। অবশ্য, এমন দিনও এসেছিল দু’দিন পরেই, যখন সেন্ট আন্টইনের ঐ রাস্তা দিয়ে বাস্তবিকই বয়ে গিয়েছিল সত্যিকার রক্তের স্রোত। কিন্তু সে-কথা পরে।
আজ কিন্তু বিনা পয়সায় মদ খাওয়ার এই সুযোগ পেয়ে পল্লীর নারী-পুরুষ শিশু-বৃদ্ধ সবাই, তা আকণ্ঠ পান করে নিচ্ছে। উঁচু-নিচু পাথরের রাস্তার ছোট-বড় গর্তগুলি মদের চৌবাচ্চায় পরিণত হয়েছে। তা থেকে আঁজলা ভরে-ভরে পান করেছে ওরা সাধ মিটিয়ে। কেউবা পেয়ালা ভর্তি করে ঢালছে বালতির ভিতর, কেউ আবার রুমাল ভিজিয়ে তাই নিংড়ে দিচ্ছে শিশুর মুখে। একটা উৎসব চলেছে যেন পাড়ার ভিতর। ছুটোছুটি, হাসাহাসি,নাচতেও শুরু করেছে কেউ-কেউ হাত ধরাধরি করে।
দোকানের দোরে দাঁড়িয়ে ডিফার্জ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে পাড়ার লোকদের এই মাতামাতি। পিপে ভেঙেছে, সেটা আড়তদারের লোকসান, ডিফার্জের নয়। তাই এত বড় লোকসান দেখেও সে বিচলিত হয়নি। সে বরং খুশিই হয়েছে এতে। পাড়ার গরিবেরা একটু আনন্দ পায় যদি তো পাক না। পয়সা দিয়ে খাবার মত অবস্থা তো ওদের নয়।
অবশেষে রাস্তার গর্তে মদ আর যখন রইলো না, সেই সময় আধা-মাতাল একটা নোংরা চেহারার লোক আঙুলের ডগায় একটুখানি মদ লাগিয়ে পাশের বাড়ির দেয়ালের গায়ে লিখলো
“রক্ত! রক্ত!”
লেখাটা চোখে পড়া মাত্র ধীর শান্ত ডিফার্জ হঠাৎ ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেল সেখানে। হাতে করে কাদা তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘষে দিলো ঐ লেখার উপরে। তারপর লেখকের জামার উপরে নিজের কাদা-মাখা হাতখানা মুছতে-মুছতে তিরস্কার করে উঠলো–এ-সব রসিকতা করবার জায়গা কি রাস্তার উপরে, গ্যাসপার্ড? তোমায় দেখছি পাগলা গারদে পাঠানোর দরকার।
গ্যাসপার্ড হেসে ডিগবাজি খেতে-খেতে চলে গেল। ডিফার্জও ঢুকলো নিজের দোকানে। সেখানে বসে দোকানের তদ্বির করছে তার স্ত্রী মাদাম ডিফার্জ।
মাদাম ডিফার্জ সর্বদাই তার সেলাই নিয়ে ব্যস্ত। চোখ তুলে চাইবার অবসর নেই কোনদিকে। সেই সেলাইয়ের দিকে মনোযোগ দিয়ে কেউ লক্ষ্য করতে যদি, চক্ষুস্থির হয়ে যেতো তার। নানা রঙের সুতোয় কাপড়ের ভাঁজে-ভাঁজে শুধু নাম লেখা! হাজারো নাম! কাদের এ সব নাম, কে জানে তা!
স্বামীকে দেখে একটিবার মাত্র একটুখানি কাশতে শোনা গেল মাদাম ডিফার্জকে। স্বামীর মনে হলো–কেউ অপরিচিত ব্যক্তি এসেছে হয়তো, তা নইলে এমনভাবে অসময়ে কাশতো না তার স্ত্রী। সে খরিদ্দারদের ভিড়ের ভিতর মিশে গেল।
.
কেউ বসে আছে মদের গেলাস নিয়ে। কোথাও-বা দুই বন্ধু মিলে ডোমিনো খেলতে বসেছে। মাথা নেড়ে সবাইকে সম্ভাষণ জানালো ডিফার্জ, মাথা নেড়েই গ্রহণ করলো সবাইয়ের সম্ভাষণ। এক জায়গায় তিনজন লোক দাঁড়িয়ে নিম্নস্বরে কথা বলছিলো, গেলাস হাতে নিয়ে।
একজন বলছিলো–রাস্তার মদটা বোধ হয় সবই উদরস্থ করেছে পাড়ার লোকে, কি বলো জ্যাক্স্?
ডিফার্জ উত্তর করলো–হ্যাঁ, আর এক ফোঁটাও নেই জ্যাক্স্!
তিনমূর্তির ভিতর দ্বিতীয় বললো কালো রুটি খেয়ে-খেয়েই জীবন কাটে এদের! মদ তো বড় একটা পায় না খেতে…কি বলো জ্যাক্স্?
ডিফার্জ উত্তর করলো–ঠিকই বলেছো জ্যাক্স্!
তৃতীয় ব্যক্তি এবারে বললো–যা হোক তবু মুখ বদলাবার একটা সুযোগ পেলো আজ এই অভাগার দল। ঠিক কথা কি না..জ্যাক্স্?
ডিফার্জ উত্তর করলো–তা ঠিক বইকি, জ্যাক্স্।
তিন-তিনবার এই একই নামের আদান-প্রদান মাদাম ডিফার্জের মনোযোগ এড়ায়নি। প্রতিবারই ঈষৎ কুঁচকে উঠেছে তার ভ্র, আর, প্রতিবারই একটুখানি কেশেছে সে। ডিফার্জ তখন তোক তিনটিকে পরিচিত করে দিলো তার স্ত্রীর সঙ্গে। মাদাম ডিফার্জ একটুখানি মাথা নামিয়ে গ্রহণ করলো তাদের নমস্কার, আর সঙ্গে সঙ্গে চকিত দৃষ্টি দিয়ে দেখে নিলো একবার লোক তিনটিকে। তার সেলাই কিন্তু একটুও থামলো না, সমান ভাবেই চলতে লাগলো।
ডিফার্জ লোক তিনটিকে বললো–হ্যাঁ! যে ঘরখানা তোমরা দেখতে চাইছিলে, তা ছ’তলার উপর। সোজা উপরে উঠে গেলেই দেখতে পাবে।
মদের দাম চুকিয়ে দিয়ে ওরা উপরে উঠে গেল। ওরা চলে যেতেই একটি বৃদ্ধ ভদ্রলোক পিছনের বেঞ্চ থেকে উঠে এসে ডিফার্জকে বললেন–আমি কি একটা কথা বলতে পারি?
ডিফার্জ বললো–নিশ্চয়!
এক মিনিটের বেশি কথা হল না। প্রথম শব্দটি শুনেই চমকে উঠেছিল ডিফার্জ, তারপর বিশেষ মনোযোগ দিয়ে সে শুনলো ভদ্রলোকের কথাটি, শুনেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
দোকানের একদিকে বেঞ্চের উপর বছর-সতেরো বয়সের একটি তরুণী বসে ছিলেন। তাকে ডেকে নিয়ে বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিও বেরিয়ে গেলেন ডিফার্জের পিছনে পিছনে। মাদাম ডিফার্জ তখন আপন মনে সেলাই করে চলেছে…সে কিছুই দেখতে পেলো না বোধ হয়।
অনেক সিঁড়ি ভাঙতে হবে। ধীরে-ধীরে ওঠাই ভালো!–ডিফার্জ বেশ বিরক্ত সুরেই বললো কথাগুলো। তার পিছনে-পিছনে মিঃ লরী উঠছেন কুমারী ম্যানেটকে নিয়ে।
মিঃ লরী ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন–উনি কি একা?
ডিফার্জ বললো-একা ছাড়া তার কাছে কে থাকবে?
–সর্বদাই একা থাকেন তিনি?
–একা তো থাকেনই–তা ছাড়া সব সময় দরজা বন্ধ করে থাকেন…দীর্ঘ দিন কারাগারের খুপরিতে বন্দী থাকতে-থাকতে তার এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে যে, খোলা দরজা তিনি সহ্য করতে পারেন না!
–কিছু পরিবর্তন হয়নি?
–যেদিন প্রথম ব্যাস্টিলের লোক এসে আমার হাতে তুলে দিয়ে গেল ওঁকে, সেদিন যে-রকম দেখেছি ওঁর অবস্থা, আজও অবিকল তেমনি।
–খুবই বদলে গেছেন কি তিনি?
–বদলে? ভয়ানক একটা অস্বাভাবিক স্বরে ডিফার্জ বলে উঠলো কথাটা; আর সঙ্গে-সঙ্গে একটা ভীষণ শপথ উচ্চারণ করে দেয়ালে মারলো একটা ঘুষি। মিঃ লরীর আর বুঝতে বাকি রইলো না–মঁসিয়ে ম্যানেটের পরিবর্তনের রকমটা কী সাংঘাতিক।
সিঁড়ির মাঝপথে দু’বার বিশ্রামের জন্য থেমে, অবশেষে ওঁরা এসে সিঁড়ির মাথায় পৌঁছুলেন। সেখান থেকেও আবার একটা সরু কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হলো একটা চিলে কুঠুরিতে। তার দোর তালাবন্ধ। আর, দোরের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সেই তিনটি জ্যাস, একটু আগে যাদের কথা কইতে দেখা গিয়েছিল ডিফার্জের সঙ্গে। ডিফার্জের পিছনে দু’জন অপরিচিত লোক দেখে ওরা তাড়াতাড়ি পাশ কাটিয়ে নেমে চলে গেল। মিঃ লরী রুষ্টভাবে ডিফার্জকে জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি কি লোক ডেকে-ডেকে আনো নাকি মঁসিয়ে ম্যানেটকে দেখবার জন্য?
ডিফার্জ উত্তর করলো–বিশেষ-বিশেষ লোককে আনি বৈকি ওঁর অবস্থা দেখবার জন্য।
–বিশেষ্য-বিশেষ? কী রকম?–প্রশ্ন করলেন মিঃ লরী।
— বিশেষ লোক, অর্থাৎ তাদের নাম হবে জ্যাক্স্, আমারই মত। আপনি ইংরেজ, ওসব বুঝবেন না। ফরাসীদেশের পক্ষে কী যে এখন প্রয়োজন, তা আমার চেয়ে আপনার ভালো জানবার কথা নয়!–এই কথা বলেই আর উত্তরের অপেক্ষা না । করে দরজার উপর জোরে জোরে বার কয়েক আঘাত করলো ডিফার্জ। যেন, ঘরের ভিতরকার লোকটির মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায় সে এইভাবে। তারপর সে তালা খুলে ফেললো। ঘরের ভিতরে এগিয়ে গিয়ে কী-যেন একটা কথা বললো সে। অতি ক্ষীণ স্বরে একটা উত্তরও শোনা গেল সে-কথার। মিঃ লরী প্রবেশ করলেন, লুসী ম্যানেটকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন, নইলে লুসীর পক্ষে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হতো না হয়তো।
লুসী বললো–আমার ভয় করছে!
মিঃ লরী বললেন–ভয় কি? কিসের ভয়?
লুসী কানে-কানে বলে–কি জানি, কি দেখবো।
ঘরখানা একেবারে ছোট এবং অন্ধকার। এক দিকের একটা জানলা দিয়ে সামান্য আলো এসে পড়েছে ভিতরে। ভালো করে জানলা খুলে দিলে আরও আলো আসতে পারতো অবশ্য, কিন্তু তা খোলা হয়নি। হয়তো এ-ঘরের অধিবাসীর চোখে বেশি আলো সহ্য হয় না বলেই।
সেই সামান্য আলোতে একখানা নিচু বেঞ্চিতে বসে এক পকেশ বৃদ্ধ আপন মনে জুতো সেলাই করছে।
ডিফার্জ বললো–সুপ্রভাত!
বৃদ্ধের মাথাটা এক সেকেন্ডের জন্য একটুখানি উঁচু হল, তারপর তার অতি ক্ষীণস্বর ভেসে এলো যেন অতি দূর থেকে–সুপ্রভাত!
–খুবই পরিশ্রম করছেন তো?–বললো ডিফার্জ।
অনেকক্ষণ কোন উত্তর নাই। অবশেষে আর-একবার সেই নতমস্তক উঁচু হল– এক সেকেন্ডের জন্য, এবং সেই স্বর আবার শোনা গেল-হা, আমি কাজ করছি! এবারে দুটি ঘোলাটে কোটরগত চক্ষু এক মুহূর্তের জন্য চেয়ে দেখলো-ডিফার্জের দিকে। তারপরে আবার নুয়ে পড়লো জুতো সেলাইয়ের উপর।
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর ডিফার্জ বললো–আর একটু বেশি করে খুলে দিতে চাই এই জানলাটা, বেশি আলোতে আপনার অসুবিধে হবে কি?
–কী বলছো?
–আর একটু আলো সহ্য করতে পারবেন কি?
–আলো আনো যদি, আমায় সহ্য করতেই হবে!–শেষ দু’টি কথার উপরে। আপনা থেকেই যে জোর পড়লো একটু, তা বোধ হয় বৃদ্ধ বুঝতেই পারলেন না। জানলাটা আর-একটু বেশি করে খুলে দিলো ডিফার্জ। অমনি জোরালো আলোর ঝলকে ঘর ভরে উঠলো। সেই আলোয় এইবার গৃহের বাসিন্দাটিকে বেশ ভালো ভাবে লক্ষ্য করা সম্ভব হল। অর্ধেকটা-সেলাই-করা একটা জুতো কোলে নিয়ে তিনি বসে আছেন। বেশি আলো তিনি অনেকদিন চোখে দেখেননি। হঠাৎ সেই বেশি আলোর ভিতর পড়ে তার চোখ জ্বালা করছিল বোধ হয়, তাই একখানা হাত আড়াল করে ধরেছেন চোখের উপর। জুতা-সেলাইয়ের কিছু যন্ত্রপাতি এবং কয়েক টুকরো চামড়া পড়ে আছে তার পায়ের কাছে। সাদা দাড়ি যেমন-তেমন করে ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। শীর্ণ কপালের নিচে অতিরিক্ত রকম বড় দুটো চোখ। একে তো সে চোখ স্বভাবতই বড়, তার উপর মুখের শীর্ণতা আর মাথার এলোমেলো চুলের রাশ এ-দুয়ের দরুন আরো বেশি বড়ো দেখাচ্ছে। জামা-কাপড় শত জায়গায় ছেঁড়া। শার্টের গলা খোলা; তার নিচে থেকে বুকের হাড়-পাঁজর গুনে নেওয়া যায়। তার গায়ের চামড়া, পরিধানের কাপড়, পায়ের মোজা–এ-সবেতে রৌদ্র-বাতাস লাগেনি বহুদিন; সবই বিশ্রী রকমের নোংরা আর হলদে হয়ে গেছে–কোষ্টা চামড়া আর কোন্টা কাপড়–তা চিনে বার করা শক্ত।
যে-হাতখানি দিয়ে আলো আড়াল করেছিলেন বৃদ্ধ, তার হাড় পর্যন্ত যেন স্বচ্ছ দেখাচ্ছিল সেই আলোর ভিতর। কাজ বন্ধ করে একদম চুপচাপ তিনি সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন, লক্ষ্যহীন দৃষ্টি তার চোখে। কথা শুনলে কোন্দিকে তাকাতে হবে, তা যেন হঠাৎ ঠাহর পান না তিনি! একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে চোখ ফিরিয়ে খুঁজতে থাকেন–শব্দটা এলো কোথা থেকে!
ডিফার্জ বললো–আপনি কি ঐ জুতো জোড়া আজই শেষ করতে চান? প্রশ্ন করেই সে মিঃ লরীকে ইশারা করলো কাছে আসবার জন্য।
–কী বললে তুমি?
–জুতোটা কি আজই শেষ করতে চান?
–না, শেষ করতেই চাই–এমন কিছু নয়। তবে হয়ে যেতে পারে। এই বলে তিনি আবার কাজে হাত দিলেন।
মিঃ লরী ধীরে-ধীরে এগিয়ে এলেন। কুমারী ম্যানেট দরজার পাশেই অপেক্ষা করতে লাগলো। মিঃ লরী ডিফার্জের পাশে এসে দাঁড়াবার মিনিট-দুই পরে বৃদ্ধ আবার মুখ তুলে চাইলেন। একজন লোকের জায়গায় দু’জন দেখেও কিছুমাত্র বিস্ময় প্রকাশ করলেন না তিনি, একবার কেবল তার হাতের আঙুল উঠলো গিয়ে ঠোঁটের কাছে। আঙুল এবং ঠোঁট দুই-ই বর্ণহীন ফ্যাকাসে।
ডিফার্জ বললো–আপনার সঙ্গে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন।
–কী বললে?
–একটি ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন।
জুতোর উপর থেকে চোখ একবার উপরে উঠলো বটে, একপলকের জন্য, হাত কিন্তু কাজ করতেই থাকলো।
ডিফার্জ বললো-জুতোটা ভদ্রলোককে দেখান না! ঠিক হচ্ছে কি না, বলতে পারবেন ইনি! এই বলেই সে জুতোটা তুলে নিয়ে লরীর হাতে দিয়ে আবার বললো–এ জুতোটা কী জুতো, বলুন না ভদ্রলোককে!
এবারে একেবারে অনেকক্ষণ পর্যন্ত বৃদ্ধ নীরব, তারপর উত্তর হলো–কী তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে, ভুলে যাচ্ছি আমি।…কী বলছিলে?
–আমি বলছিলাম–এ জুতোটা কী জুতো, বলুন না এঁকে!
–এটা মেয়েদের জুতো। তরুণীদের বেড়াবার জুতো, আজকালকার ফ্যাশান এইরকমই। ও ফ্যাশান আমি কখনো চোখে দেখিনি, তবে একটা নমুনা দেখেছিলাম।
ডিফার্জ বললো–যিনি তৈরি করছিলেন, তার নামও জানতে চান এই ভদ্রলোক।
হাতে জুতো নেই, একবার ডান হাতের কব্জি বাঁ হাতে, এবং বাঁ হাতের কব্জি ডান হাতে নিয়ে যেন নাড়ী টিপতে লাগলেন বৃদ্ধ। তারপর গালের দাড়িতে বুলোতে লাগলেন হাত…এক মুহূর্ত বিরাম নেই তার। মনটা ভরে আছে আঁধারে, দীর্ঘ দিনের জমাট আঁধার। ডিফার্জের কথা বিজলীর ঝিলিকের মত সে-আঁধার এক একবার চিরে দিয়ে যাচ্ছে বটে, কিন্তু পরের মুহূর্তেই সারা অন্তর আগের মতই জমাট অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে আবার। তাকে সেখান থেকে তুলে আনা সহজ নয়। দুর্বল রোগী যখন মূর্ছা যায়, তখন তার চেতনা ফিরিয়ে আনা শক্ত। যে লোক মরতে বসেছে, সংসারের খুঁটিনাটির ব্যাপারে তার আগ্রহ ক্ষণিকের জন্য জাগিয়ে তোলা আরও শক্ত। কিন্তু ও সবের চাইতেও বুঝি শক্ত এই সব-ভুলে-যাওয়া বৃদ্ধের মনে স্মৃতি জাগিয়ে তোলা। অন্তত মিঃ লরীর তো তাই মনে হল।
কিন্তু যতই শক্ত হক, সেই চেষ্টাই তবু করতে হবে এখন ডিফার্জ, মিঃ লরী আর লুসী ম্যানেটকে।
ডিফার্জ এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে–ভদ্রলোকেরা আপনার নামটা জানতে চাইছেন।
বৃদ্ধ নীরব। ডিফার্জ তখন আবার জিজ্ঞাসা করে।
–আমার নাম…আমার নাম হলো ১০৫, নর্থ টাওয়ার।
–সে কি!
–হ্যা…১০৫, নর্থ টাওয়ার।
একটা ক্লান্তির শব্দ। দীর্ঘশ্বাস নয়, কাতর কোন উক্তি নয়! দেহ-মন যে একটা দারুণ ক্লান্তির ভারে ভেঙে পড়েছে, বাইরে তারই একটুকুন একটা প্রকাশ ছোট্ট একটা অস্পষ্ট শব্দের ভিতর দিয়ে! শব্দটা বেরুলো মুখ থেকে। তারপরই আবার কাজ শুরু। কিন্তু তার মনোযোগ আবার ভঙ্গ হল, এবারে ডিফার্জের কথা নয়, প্রশ্ন এলো মিঃ লরীর কাছ থেকে।
–আপনি কি চিরদিনই জুতো তৈরি করছেন?
ঘোলাটে দুটো চোখ একবার তাকালো ডিফার্জের দিকে, যেন ডিফার্জকে বলতে চায়–এ প্রশ্নের উত্তর তুমি দাও। কিন্তু ডিফার্জ নীরব। তখন বৃদ্ধের দৃষ্টি মিঃ লরীর দিকে ফিরলো।
–আমি চিরদিন জুতো তৈরি করছি কি না? না, তা করিনি। এ আমি এখানেই শিখেছি। নিজে নিজেই শিখেছি। শিখবার অনুমতি অবশ্য নিয়েছিলাম আমি–
বলতে-বলতেই আবার ডান হাতে বাঁ হাতের কব্জি, বাঁ হাতের ভিতর ডান হাতের কব্জি–আর দাড়িতে হাত বুলোনো। তারপর দৃষ্টি আবার পড়লো এসে মিঃ লরীর মুখের উপর। এক-পলক সে মুখখানি দেখে নিয়ে হঠাৎই যেন চমকে উঠলেন বৃদ্ধ, মনে পড়ে গেল মিঃ লরীর প্রশ্ন, আর সে-প্রশ্নের উত্তর দিতে-দিতে তার থেমে যাওয়া। কী-যেন গল্প তিনি রাত্রিবেলা বলতে শুরু করেছিলেন; বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। তারপর জেগে উঠলেন ভোরবেলায়, আর জেগে উঠেই সেই অর্ধেক-বলা গল্পের খেই ধরে নতুন করে বলতে শুরু করলেন–
–হ্যাঁ, আমি অনুমতি নিয়ে নিজে নিজেই শিখেছি এটা। অনেক দিনের চেষ্টায় একটু-একটু করে শিখতে হয়েছে। তারপর থেকে বরাবরই করছি এই কাজ। এই বলে বৃদ্ধ মিঃ লরীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। একখানা জুতো তখনও মিঃ লরীর হাতেই রয়েছে। সেখানা ফিরে পাওয়ার জন্যই হাত বাড়ানো। জুতো ফেরত দিয়ে মিঃ লরী বললেন :
মঁসিয়ে ম্যানেট! আমায় কি একটুও মনে পড়ে না আপনার?
হাতের জুতো হাত থেকে পড়ে গেল বৃদ্ধের। প্রশ্নকর্তার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে বসে রইলেন তিনি।
ডিফার্জ তার হাতের উপর হাত রেখে বললো–মঁসিয়ে ম্যানেট, এই লোকটির কথা কি কিছুই মনে পড়ে না আপনার? ওঁকে দেখুন ভাল করে! কোন ব্যাঙ্কারকে নিতেন কি আপনি পুরোনো দিনে? কোন ব্যবসাকর্মের কথা মনে পড়ে–আগেকার পুরোনো দিনের? আপনার কোন আত্মীয়-স্বজনের কথা?
বহু, বহু বৎসরের নির্জন কারাকক্ষের বন্দী নীরবে স্থির নয়নে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখেন–একবার ডিফার্জকে, আর একবার মিঃ লরীকে–তাঁর স্মৃতিকে আড়াল করে, যে কালো কুয়াশার পর্দা ঝুলছে আজ বহু বৎসর ধরে, তা যেন হঠাৎ কোথায় একটুখানি ফাঁক হয়ে যায় এক লহমার জন্য। বহুদিনের মুছে-যাওয়া, নিবে-যাওয়া চেতনার ঝিলিক যেন কপালের মাঝখান থেকে একবার এক-মুহূর্তের জন্য ফুটে উঠলো চকিত দীপ্তি নিয়ে। তারপরই সে আলোর উপর ঘনিয়ে এলো আবার বিস্মৃতির কালো মেঘ! ম্লান হয়ে গেল স্মৃতির সে ক্ষণিক আলো,–নিবে গেল, মুছে গেল তা একেবারে। গেল বটে, কিন্তু সে যে এসেছিল–তাতে সন্দেহ নেই। মিঃ লরীর আর কোন সন্দেহ নেই যে, ইনিই ডাক্তার ম্যানেট।
ডিফার্জ ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলো–আপনি কি চিনতে পেরেছেন ওঁকে?
–হ্যাঁ। এক মুহূর্তের জন্য। আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম, কিন্তু অবশে পেয়েছি দেখতে। এক মুহূর্তের জন্য হলেও, পেয়েছি দেখতে সেই অতিপরিচিত মুখখানি। ইনিই ডাক্তার ম্যানেট!
সহসা কিন্তু তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ডিফার্জকে টেনে নিয়ে দেয়াল-ঘেঁষে দাঁড়ালেন সরে গিয়ে। লুসী ম্যানেট এসে চুপি-চুপি দাঁড়ালো তার হতভাগ্য কবর থেকে ফিরে পাওয়া পিতার পাশে। হাত বাড়ালে লুসীর হাত স্পর্শ করতে পারতো ম্যানেটের মাথা। তবু ম্যানেট একেবারেই জানতে পারেননি লুসীর উপস্থিতির কথা। নীরবে তিনি ঝুঁকে পড়েছেন সেলাইয়ের উপরে।
হঠাৎ বৃদ্ধের দরকার হল ছুরি। ছুরি খুঁজবার জন্য একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে তাকাতে লাগলেন তিনি। ও কি দেখা যায় এত কাছে? চমকে উঠলেন বৃদ্ধ। তিনি লুসীর বসনের একাংশ দেখতে পেয়েছেন!
হাতে ছুরি, চোখে পাগলের মত দৃষ্টি নিয়ে যে-ভাবে লুসীর পানে চাইতে লাগলেন বৃদ্ধ ম্যানেট, তাতে ডিফার্জ আর লরী ভয় পেয়ে ছুটে আসবার জন্য প্রস্তুত হলেন। এই বুঝি হতভাগ্য উন্মাদ দেয় ওর বুকে ছুরি বসিয়ে! ভয়ে বুঝি লুসী অজ্ঞান হয়ে যায়। কিন্তু না, লুসীর আজ আর ভয় নেই। সে মিঃ লরী আর ডিফার্জের মতলব বুঝতে পেরেছে। সে হাত নেড়ে নিবারণ করলে ওঁদের। বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে নিজের হস্ত চুম্বন করতে লাগলো সে, বারবার দুই হাত এনে বুকের উপর জড়িয়ে ধরতে লাগলো, যেন বৃদ্ধ পিতার শুষ্ক শিরই সে জড়িয়ে ধরেছে। নিজের স্নেহকোমল বুকের উপরে। তার সে করুণ দৃষ্টির অর্থ পাগলের পক্ষেও ভুল বোঝা বা না-বোঝা অসম্ভব। কোন স্নেহের সম্ভাষণ তার মুখ থেকে উচ্চারিত না হলেও তার দু’টি ওষ্ঠ যেভাবে ফুলে ফুলে উঠছিল, তাতে পাগলকেও বুঝি বিচলিত হতে হল। অনেকক্ষণ ধরে লুসীর দিকে চেয়ে থাকতে-থাকতে বৃদ্ধ বলে উঠলেন–
০-তুমি-তুমি তো কারাধ্যক্ষের মেয়ে নও!
লুসী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো–না।
–কে তুমি তবে?
লুসীর সারা দেহ আবেগে কাঁপছিল…কথা বলবার শক্তি যেন তার ছিল না। কোন উত্তর না দিয়ে ধীরে ধীরে সে বৃদ্ধের পাশে বসলো। বেঞ্চের উপরে। ভয়ে সংকোচে সরে যেতে চান বৃদ্ধ, কিন্তু লুসী বৃদ্ধের হাতের উপরে রাখলো নিজের হাত। সে-স্পর্শে হঠাৎ আশ্চর্যভাবে শিউরে উঠলো বৃদ্ধের সারা অঙ্গ, ধীরে হাতের ছুরি তিনি নামিয়ে রাখলেন পায়ের কাছে, তারপর বিস্মিত তৃষিত দৃষ্টি নিয়ে তিনি চেয়ে রইলেন এই মমতাময়ী তরুণীর দিকে।
সোনালী রঙের এলো-চুল ছড়িয়ে পড়েছিল লুসীর কাঁধের উপর। একটু-একটু করে বৃদ্ধের হাত এগিয়ে যেতে লাগলো সেই দিকে। এক-গোছা চুল হাতে তুলে নিলেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করতে লাগলেন যেন!
আর থাকতে না পেরে লুসী নিজের কোমল উষ্ণ হাত দুখানি তুলে দিলো বৃদ্ধের কণ্ঠে। বৃদ্ধ সেদিকে বারবার তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখেন। তারপর নিজের গলা থেকে খুলে নিলেন–নোংরা সূতায় ঝোলানো একটা ততোধিক নোংরা ছোট্ট পুঁটুলি। খুলতে লাগলেন সেই পুঁটুলি ধীরে-ধীরে কম্পিত হস্তে।
তার ভিতর থেকে বেরুলো একগাছা লম্বা চুল, লুসীর চুলের মতই উজ্জ্বল সোনালী, লুসীর চুলের মতই মসৃণ চিকণ! হারিয়ে গেছে তার যে অতীত জীবন, তারই এক কণা অবশেষ এই একগাছি চুল। সংসার গেছে, সম্পদ গেছে, ঘর গেছে, ঘরণী গেছে, শুধু হারিয়ে-যাওয়া সেই ঘরণীর একগাছি সোনালী চুল যায়নি শুধু তাই।
একবার সেই একগাছি সোনালী চুল, আর একবার লুসীর মাথার সোনালী চুলের গোছার দিকে বৃদ্ধ বারবার আকুল দৃষ্টিতে চান। তার মনের ভেতর অকস্মাৎ জেগে ওঠে স্মৃতির ক্ষীণ আলো। চিৎকার করে ওঠেন–এ তো সেই একই চুল! কী করে হল? কেমন করে? কেমন করে? কখন? কী এসব?
বৃদ্ধ সোজা উঠে দাঁড়িয়ে লুসীর মুখটা তুলে ধরে বলেন–কে তুমি? তুমি…তুমি কি সেই?
হাঁটু গেড়ে বৃদ্ধের সমুখে বসে পড়লো লুসী। আর্তকণ্ঠে বলে উঠলো–আমি তোমার মেয়ে, তোমার মেয়ে। বাবা! বাবা! আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
বৃদ্ধের দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অবিরল চোখের জল।
০৩. রাজদ্রোহের মামলা
পাঁচ বৎসর পরে।
লন্ডনের ফৌজদারী আদালত-ওল্ড বেইলী।
লোকে লোকারণ্য, আজ একটা রাজদ্রোহের মামলা চলেছে। খুব সম্ভব, জুরীরা দোষীই সাব্যস্ত করবেন আসামীটাকে। জুরীরা সাধারণত তাই করে থাকেন, রাজদ্রোহের মামলা পেলে। রাজার প্রতি একটা কর্তব্য আছে তো ভদ্রলোকদের! তাছাড়া, মাঝে মাঝে ফাঁসিটা-আষ্টা নাগরিকদের দেখবার সুযোগ দেওয়াও দরকার বই কি! নইলে, তারা টেস্লো দেয় কিসের জন্য?
তার উপর, রাজদ্রোহের আসামীর যা দণ্ড, তা শুধু ফাঁসির মত নিরামিষ নয়। প্রথম অবশ্য ফাঁসিতেই ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু প্রাণটা বেরিয়ে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে নামিয়ে ফেলতে হবে তাকে। তারপর গলার দড়ি খুলে নিয়ে তা দিয়ে বাঁধতে হবে হাত-পা। সেই অবস্থায় তাকে শুইয়ে রেখে, পেট ফেড়ে নাড়িভুড়ি বার করে ফেলা হবে তার। সে নাড়িভুড়ি তার সমুখেই পোড়ানো হবে আগুন জ্বেলে। এদিকে জ্ঞান থাকতে-থাকতেই অনেক কিছু করতে হবে তাকে নিয়ে। দেরি করা চলে না। এক-একখানি হাত, এক-একখানা পা ধীরে-সুস্থে পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে কাটা হবে তরোয়াল দিয়ে। কখনও কখনও তরোয়াল ব্যবহার না করে, ঘোড়ার পেছন-পায়ের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয় হাত-পা। পরস্পরের বিপরীত-দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে দু’টো তেজী ঘোড়া। একটার পেছন-পায়ে বাঁধা হল আসামীর হাত, আর-একটার পেছন-পায়ে তার পা দুখানা। তারপর দু’টো ঘোড়াকেই মারা হলো জোরসে চাবুক। তারা ছুটলো বায়ুবেগে। অপরাধীর হাত ছিঁড়ে ছুটে চললো উত্তর দিকে, পা ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল দক্ষিণে। কী স্বর্গীয় উল্লাস দর্শকদের! এরকম মজা কি পয়সা দিয়েও সাকাসে দেখা যায়? সুসভ্য ইংরেজ গভর্নমেন্ট দেড়শো বছর আগেও নাগরিকদের আনন্দের জন্য এ-রকম সব মনোরম ব্যবস্থা রেখেছিলেন আইনে। এই অল্প কয়েক দিনেই অনেক অধঃপতন হয়েছে দেশটার, উঠে গেছে সে-সব কানুন….
যাই হোক, হাত-পা কেটে বা ছিঁড়ে বেরিয়ে যাবার পরেও প্রাণ বলতে যদি কিছু অবশেষ থাকে আসামীর দেহে, তবে তার অবসান করবার জন্য এইবার গলায় এক ঘা তলোয়ার বা কুড়াল বসানোর জন্য জল্লাদকে ডাকা হয় চটপট। আজকের আসামীটাকে দেখলে তো বেশ ভালো বলেই মনে হয়। দিব্য ভদ্রলোকের মত চেহারা, বছর পঁচিশ বয়স হবে, বেশ পুষ্ট নধর দেহ, পোশাক সাধারণ হলেও পরিচ্ছন্ন। বর্তমান বিপদের জন্য মুখটা বিবর্ণ, কিন্তু কোনরকম চাঞ্চল্যের পরিচয় নেই তার ভাবভঙ্গির ভিতর। বেশ গম্ভীর সংযত ভাবেই সে নমস্কার করলো জজ ও জুরী মহোদয়গণকে।
আসামীর উকিল একগোছা কাগজ নিয়ে ক্রমাগত নাড়া-চাড়া করছেন। আর, তার কাছেই আর-একটি পরচুলা-পরা (তখন সব উকিলই পরচুল পরতেন) উকিল বসে-বসে ছাদের কড়িকাঠ গুনছেন। সরকারী উকিল সওয়াল শুরু করলেন।
“কয়েক বৎসর থেকেই আসামী চার্লস ডার্নে ক্রমাগত ইংলিশ চ্যানেল পারাপার করছে। কী এত প্রয়োজন তার ফ্রান্সে? কেন যায় সে ঘন-ঘন ও-দেশে? খুব সন্দেহজনক নয় কি তার গতিবিধি?
জন বরসাদ হল ঐ ডার্নেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। “হল” না বলে, “ছিল” বলাই উচিত বোধহয়। কারণ, আসামীর জঘন্য আচরণের যা পরিচয় পাওয়া গিয়েছে, তাতে সাক্ষী মিঃ বরসাদের মত মহানুভব দেশপ্রেমিকের পক্ষে তাকে আর বন্ধু বলে মনে করা সম্ভব নয়। আসামীর জঘন্য আচরণের পরিচয় প্রথমে এই মিঃ বরসাদই পান, এবং নিছক দেশপ্রেমের তাগিদেই তাঁকে প্রকাশ করে দিতে হয়েছে উক্ত জঘন্য আচরণের কথা। জঘন্য আচরণটা কি?না, ডানে গুপ্তচর। মহা-মহিমান্বিত সদাশয় সর্বগুণান্বিত ইংলভাধিপ শ্রীল তৃতীয় জর্জের সৈন্যবাহিনীতে কত সৈন্য আছে, সে সব সৈন্য কোথায় কোথায় আছে, কী কী অস্ত্রে তারা শিক্ষালাভ করছে–এইসব গুরুতর বিষয়ের সমস্ত খুঁটিনাটি সংবাদ যে কোন উপায়ে সংগ্রহ করে তাই ফরাসীরাজ লুইয়ের দরবারে পেশ করাই হল তার পেশা। ঐসব সংবাদ সরবরাহ করতে তাকে নিজের চোখে দেখেছেন দেশপ্রেমিক বরসাদ। আসামী ঐসব বিবরণ যে কাগজপত্রে লিখে রেখেছিল, তা তার পকেটে ও টেবিলের দেরাজে পাওয়া গিয়েছে, পেয়েছে তারই ভৃত্য। উক্ত ভৃত্যও–তার গুপ্তচর-প্রভুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে এসেছে; এসেছে দেশপ্রেমেরই তাগিদে।”
সওয়াল শেষ করে সরকারী উকিল বরসাদ এবং রোজার ক্লাইয়ের সাক্ষ্য গ্রহণ করলেন। বাদ ছিল ডানের বন্ধু, ক্লাই ছিল তার ভৃত্য। উকিল পূর্বেই যা বলে রেখেছেন, সাক্ষীরা পরে এসে বললো সেই কথাই। তবে জেরাতে ও-ছাড়াও দু’চারটে নতুন কথা প্রকাশ হয়ে পড়লো। বরসাদের মুখ থেকে যা শোনা গেল তা কতকটা এই রকম :
–তুমি নিজে কোনদিন গুপ্তচর ছিলে?
–না। ও-রকম বদনাম যে দেয়, তাকে ঘৃণা করি আমি।
–কিসে চলে তোমার?
–সম্পত্তি আছে, মশাই!
–সম্পত্তিটা কোথায়?
–সেটা–সেটা ঠিক মনে পড়ছে না চট করে।
–সম্পত্তিটা কী?
–তাতে অন্যের কি প্রয়োজন, মশাই?
–সম্পত্তিটা কারও কাছ থেকে পাওয়া বোধ হয়?–হ্যাঁ, তা বই কি।
কার কাছ থেকে?
–দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিল একজন
–খুবই দূর–বোধ হয়?
–তা, দূরই বটে!
–জেলে গিয়েছিলে কখনো?
–নিশ্চয়ই না।
–দেওয়ানি জেলে? দেনার দরুন?
–এ-মামলার সঙ্গে সে-কথার সম্বন্ধ কী, তা তো বুঝতে পারছি না।
–আবারও বলছি, দেওয়ানি জেলে গিয়েছিলে? উত্তর দাও।
–তা, হ্যাঁ—
–কতবার?
–দু’তিনবার হবে।
–না–পাঁচ-ছ’বার।
–তাও হতে পারে হয়তো!
–পেশা কি?
–ভদ্রলোক! ভদ্রলোকের আবার পেশা কি?
–লাথি খেয়েছো কখনো? কারো কাছে?
–তা—হয়তো–
–বহুবার?
–না, না!
–লাথি মেরে সিঁড়ির ওপর থেকে নিচে ফেলে দিয়েছিল কেউ?
–না, না। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ-ই লাথিটা পড়লো এসে! টাল সামলাতে না পেরে নিজেই পড়ে যাই!
–লাথি খেয়েছিলে, জোচ্চুরির দরুন তো?
–বলেছিল বটে সেই মিথক লোকটা। কিন্তু ওটা মিছে কথা! লোকটা মাতাল ছিল তখন!
–যদি বলি, জোচ্চুরিই তোমার পেশা? তাই করেই দিন চলে তোমার?
–কখনো না।
–আসামীর কাছে টাকা ধার করেছিলে?
–হ্যাঁ।
–সে টাকা শোধ দিয়েছিলে?
–না।
–আসামীর সঙ্গে যে বন্ধুত্বের কথা তুলেছে, সেটা কী রকম বন্ধুত্ব? তুমিই গায়ে পড়ে পড়ে খানিকটা আলাপ-পরিচয় জমিয়েছিলে, কী বলে? গাড়িতে, স্টীমারে, হোটেলে এবং রাস্তায়ই যা-কিছু আলাপ–কী বলো?
–না, তা হবে কেন?
–তুমি গভর্নমেন্টের মাইনে-করা গোয়েন্দা কি?
–বলেন কি মশাই?
–এই মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার দরুন বকশিশ পাবে কিছু?
–আরে বলেন কি মশাই?
–ভগবানের নামে দিব্যি করে বলতে পারো এ-কথা?
–লক্ষ বার!
আসামীর কোন এক সময়ের ভৃত্য রোজার ক্লাইকে সরকারী উকিল খুব জোর সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। সে নাকি কর্তব্যের জন্য সবই করতে পারে। সে নাকি উঁচুদরের দেশপ্রেমিক। জবানবন্দীতে সে বলেছিল–আসামীর পকেটে সে লম্বা লম্বা তালিকা দেখতে পেতো প্রায়ই। ক্যালে বন্দরে একদিন আসামী এই ধরনের কয়েকখানা তালিকা দিয়েছিল এক ফরাসী ভদ্রলোককে। এসব তালিকায় প্রায়ই যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্রের কথা থাকত, যুদ্ধের সময় কোন্খানে ঘাঁটি করলে ভালো হবে, কোন্ জায়গা সকলের আগে দখল করবার দরকার হবে, এসব কথারই উল্লেখ দেখা যেত। সাক্ষী যখন বুঝতে পারলো যে তার প্রভু গুপ্তচর, তখন আর তার পক্ষে চুপ করে বসে থাকা সম্ভব হল না। দেশপ্রেমের প্রেরণায় সে গভর্নমেন্টের কাছে এসে প্রকাশ করতে বাধ্য হল তার প্রভুর জঘন্য বৃত্তির কথা। সে এক নম্বর সাক্ষীকে চেনে। জন বাদ নাম তার। প্রায় সাত-আট বৎসর থেকে চেনে।
জেরার মুখে ক্লাই প্রকাশ করে ফেললো–সে যেচে এসে আসামীর কাছে চাকরিতে ভর্তি হয়েছিল, এক স্টীমারের উপরে! কষ্টে পড়েছে, খেতে পাচ্ছে না ইত্যাদি বলেই সে আসামীর দয়া লাভ করেছিল। তারপর সে একটা রুপোর টি পট চুরি করে।
তৃতীয় সাক্ষী হলেন মিস্টার জার্ভিস্ লরী। সরকারী উকিলের সঙ্গে তার এইরকম প্রশ্নোত্তর হল :
–মিস্টার লরী, আপনি টেলসন ব্যাঙ্কের কর্মচারী?
–হ্যাঁ।
–১৭৭৫ সালের নভেম্বরে এক শুক্রবার রাত্রে ডোভার-মেলে যাত্রী ছিলেন আপনি?
-হ্যাঁ।
–ডাকগাড়িতে আর যাত্রী ছিল?
–দু’জন ছিল।
–তারা রাত্রির ভিতরেই রাস্তায় নেমে গিয়েছিল?
–গিয়েছিল।
–এই আসামী কি সেই দু’জনের ভিতর একজন? দেখে বলুন।
–বলা সম্ভব নয়। তারা দুজনেই এভাবে কাপড়-চোপড়ে ঢাকা ছিল, আর রাত্রি ছিল এমন অন্ধকার যে কারো মুখ বা আকৃতি কিছুমাত্র দেখতে পাইনি আমি।
–এ আসামীর সঙ্গে তাদের কারও কোন সাদৃশ্য ছিল না, এমন কথাও তো জোর করে বলতে পারেন না আপনি?
–তা পারি না।
–তাহলে এমনও হতে পারে যে, এ লোকটি ছিল সেদিন সে-গাড়িতে?
–তা হতেও পারে।
–এ আসামীকে আপনি দেখেছেন আগে?
–দেখেছি!
–কবে?
–ক্যালে থেকে আসবার সময়ে স্টীমারে। উনিও আসছিলেন।
–ক’টার সময়ে স্টীমারে উঠেছিল আসামী?
–রাত্রি বারোটার একটু পরে।
–অর্থাৎ, নিশুতি রাতে। ওসময়ে আর কেউ এসেছিল?
–না। উনি একাই এসেছিলেন।
–আপনি কি একা ভ্রমণ করছিলেন?
–আমার সঙ্গে দু’জন ছিলেন আরও। এক তরুণী মহিলা, এবং এক বৃদ্ধ। ভদ্রলোক। তারা এখানে উপস্থিত আছেন।
–ঐ সময় আসামীর সঙ্গে কোন কথা হয়েছিল আপনার?
–বিশেষ কিছু নয়।
সরকারী উকিল ডাকলেন–মিস্ ম্যানেট!
তরুণী মহিলাটি নিকটেই উপবিষ্ট ছিলেন, তার পিতার পাশে। সেইখানেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি, সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর পিতাও দাঁড়ালেন।
–কুমারী ম্যানেট! এই আসামীকে পূর্বে দেখেছেন কখনো?
–দেখেছি। যে স্টীমারের কথা আগের সাক্ষী এইমাত্র বললেন–সেই স্টীমারেই দেখেছি। মিস্টার লরীর সঙ্গিনী সেই মহিলা–আমিই।
–চ্যানেল পার হওয়ার সময়ে আসামীর সঙ্গে আপনার কোন আলাপ হয়েছিল–মিস্ ম্যানেট?
০০হয়েছিল।
–মনে করে বলুন তোকী কথা হয়েছিল!
–ভদ্রলোকটি যখন স্টীমারে উঠলেন—
–বলুন–আসামী।
–আচ্ছা। আসামী যখন স্টীমারে উঠলেন তখন খুব হাওয়া ছিল–ঝড়ের বেগে বইছিল হাওয়া। আমার পিতার স্বাস্থ্য তখন খুবই খারাপ ছিল। কীভাবে কোথায় তাঁকে রাখলে হাওয়া কম লাগবে তার গায়ে, সেই বিষয়ে দয়া করে উনি পরামর্শ দিয়েছিলেন আমায়। এইভাবেই আলাপের শুরু হয় তার সঙ্গে।
–উনি কি একা এসেছিলেন স্টীমারে?
–না, দু’জন ফরাসী ভদ্রলোক ছিলেন ওঁর সঙ্গে।
–কোন কাগজপত্রের আদান-প্রদান হয়েছিল কি–আসামী আর তাদের ভিতর?
–হ্যাঁ, তবে কী কাগজ, তা জানি না আমি।
–কী কথা হয়েছিল আপনার সঙ্গে আসামীর?
–উনি বলেছিলেন–খুব গোপনীয় কাজে উনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সে কাজ যে কী, তা প্রকাশ হয়ে পড়লে অনেক লোক বিপদে পড়ে যেতে পারে হয়তো। সেইজন্য উনি ভ্রমণ করছিলেন বেনামীতে। অনেকবার ফ্রান্স আর ইংলন্ডের মাঝে ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে, এবং পরে আরও অনেকবার হয়তো ঘুরতে হবে, এ রকম কথাও বলেছিলেন তিনি।
–আমেরিকা সম্বন্ধে কিছু বলেছিল আসামী?
–আমেরিকার সঙ্গে ইংলন্ডের কলহ কী করে শুরু হল, তাই বলেছিলেন তিনি। তার মতে ইংলন্ডেরই অন্যায় ছিল এ কলহে। রহস্য করে তিনি একথাও বলেছিলেন যে, হয়তো ইতিহাসে জর্জ ওয়াশিংটনের নাম, রাজা তৃতীয় জর্জের সমানই গৌরব লাভ করবে একদিন। তবে কথাটা নিছক রহস্যই, আমাদের মহান্ রাজাকে খেলো করবার উদ্দেশ্য ওর ভিতর ছিল না মোটেই।
এইভাবে সাক্ষ্য দিতে, কুমারী ম্যানেট যে খুবই দুঃখ অনুভব করছেন, তা আদালত কক্ষে উপস্থিত অগণিত লোক কারুরই বুঝতে বাকি ছিল না। সত্যিই দুঃখের কারণ ছিল কুমারীর। ডার্নে যেরকম ভদ্র ব্যবহার করেছিলেন জাহাজের উপর, তাতে তার কাছে কুমারী কৃতজ্ঞ হয়েই আছেন। অথচ সত্যের খাতিরে যে-কথা তাকে এখন বলতে হচ্ছে আদালতে, তা হয়ত জুরীর বিচারে ডানের বিরুদ্ধেই যাবে। ডার্নের যদি মৃত্যুদণ্ডই হয়, তবে তার জন্য কুমারী ম্যানেটকেও খানিকটা নিমিত্তের ভাগী হতে হবে বই কি!
অতঃপর সরকারী উকিল এই মহিলার পিতাকে সাক্ষ্য দিতে আহ্বান করলেন। ডাক পড়লো’ডাক্তার ম্যানেট!
–ডাক্তার ম্যানেট, এই আসামীকে দেখুন। পূর্বে একে দেখেছেন কখনো?
–একবার আমার লন্ডনের বাসায় এসেছিলেন উনি। তিন বা সাড়ে তিন বৎসর আগে।
–সীমারে একে দেখেছিলেন আপনি? আপনার কন্যার সঙ্গে আসামীর যে আলাপ হয়েছিল সেই স্টীমারে–তা শুনেছিলেন আপনি?
–আমি এ-সম্বন্ধে কিছুই বলতে পারি না মহাশয়।
–না পিরবার কোন বিশেষ কারণ আছে কি?
–আছে।–অত্যন্ত নিম্নস্বরে এই কথা বললেন ম্যানেট।
–বিনা বিচারে দীর্ঘদিন আপনাকে কি কারারুদ্ধ থাকতে হয়েছিল স্বদেশে?
–দীর্ঘ দিন, দীর্ঘ দিন!–এমন করুণ সুরে ম্যানেট এই কথা বললেন যে, উপস্থিত সমস্ত লোকের হৃদয় ব্যথায় ভরে উঠলো তা শুনে।
–আপনি কি ঐ স্টীমারে উঠবার অল্পদিন আগে মুক্ত হয়েছিলেন–সেই কারাবাস থেকে?
–তাই শুনেছি বটে।
–আপনার কি সে-কথা কিছুই মনে নেই?
–কিছু না। কারাগারে কবরস্থ হবার কিছুদিন পরেই আমার স্মৃতি, বুদ্ধি, চৈত্য সবই লোপ পায়। আমার মাথা এবং মন তখন ছিল একেবারে শূন্য। সে সময় আমি জুতো সেলাই করতাম কেবল। নিজের এবং পৃথিবীর সম্বন্ধে আমি আবার সচেতন হয়ে উঠলাম, লন্ডনে আসবার পর, আমার এই কন্যার সেবায় ও সাহচর্যে। আমার মানসিক শক্তি ফিরে পাবার কত দিন আগে থেকে যে কন্যার সেই সেবা ও সাহচর্য আমি পাচ্ছিলাম–সে-সব কিছুই মনে নেই আমার।
সরকারী উকিল এইবার আর-একজন সাক্ষী ডাকলেন। সে লোকটির বক্তব্য এইরকম :
পাঁচ বৎসর আগে নভেম্বর মাসের এক শুক্রবার রাত্রে ডোভার-মেলের অনেক যাত্রীর ভিতর আসামী ছিল একজন। পথের কোন এক স্থানে সে নামে। তারপর মাইল-বারা পথ সে ফিরে আসে পায়ে হেঁটে, পুলিশের চোখে ধূলো দেবার জন্য। ফিরে আসে এক শহরে যার অতি নিকটে রয়েছে রাজার এক বৃহৎ সেনানিবাস। সেখানে এসে সেনানিবাসের খুঁটিনাটি বিবরণ সংগ্রহ করে সে। এই সময়ে এক হোটেলে সাক্ষী তাকে দেখতে পায়। জীবনে সেই একবারই দেখেছে আসামীকে; এই আসামী যে সেই ব্যক্তি, তাতে সাক্ষীর কিছুমাত্র সন্দেহ নেই।
এ সাক্ষী সত্যই বিপদ ঘটাবে। আসামীর উকিল জেরা করেও ওর কোন গলদ এ টেল অব টু সিটীজ। বার করতে পারছেন না। এমন সময়ে একটা ঘটনা ঘটলো।
আসামীর উকিলের নিকটেই আর-একজন উকিল ছাদের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন গোড়া থেকে, এ-কথা আগেই বলা হয়েছে। এই ভদ্রলোক হঠাৎ এক টুকরো কাগজে কি লিখে আসামীর উকিলকে ছুঁড়ে মারলেন। তিনি সে কাগজ পড়ে এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন, তারপর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন একবার আসামীর মুখের দিকে, আর একবার সেই পত্ৰলেখক উকিল বন্ধুর দিকে! এইবার তিনি প্রশ্ন করলেন সাক্ষীকে
–তুমি সেই হোটেলে যাকে দেখেছিলে, সে যে এই আসামী, এ-কথা তুমি শপথ করে বলছো?
–অবশ্য।
–আসামীর সঙ্গে চেহারায় হুবহু মিল আছে, এমন কোন লোককে তুমি দেখেছো
কখনো?
–এমন মিল কারো দেখিনি–যাতে লোক ভুল হবে, মশাই!
–ঐ যে উকিল ভদ্রলোক বসে আছেন ছাদের দিকে তাকিয়ে, ওঁকে দেখ তো একবার! তারপর আসামীকে দেখ আবার! কী বলল এখন? একজনকে দেখে আর-একজন বলে ভুল হতে পারে কি?
উকিলের এই অদ্ভুত অনুরোধে শুধু সাক্ষী কেন, আদালতসুদ্ধ লোক বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল। একজনকে দেখে আর-একজন বলে ভুল! ওরা কি যমজ ভাই। নাকি?–জজ, জুরী, উকিল, পুলিশ, শত-শত দর্শক–সবাই দম বন্ধ করে তাকাতে লাগলো–একবার এর দিকে, একবার ওর দিকে। জজের আদেশে উকিল ভদ্রলোক মাথায় পরচুলা খুলে ফেলে দিলেন। এইবার আর কারোই সন্দেহ রইল না যে, একটা অদ্ভুত মিল রয়েছে, দু’জনের মুখের চেহারায়। আসামী হয়তো একটু বেশি সংযত ও গম্ভীর, উকিল-লোকটির মুখে-চোখে হয়তো অসংযত জীবন যাপনের দরুন দু’চারটে বাড়তি রেখাপাত হয়েছে এখানে-ওখানে, কিন্তু মোটামুটি সাদৃশ্য অতিশয় প্রবল। যে-লোক এঁদের দুজনকেই খুব ভালরকম চেনে না, তার চোখে দু’জনের চেহারার ঐ অতি সামান্য পার্থক্যটুকু দিনের আলোতেও ধরা পড়া সম্ভব নয়।
“তাহলে কি মিস্টার কার্টনকেই এখন রাজদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত করতে বলছেন নাকি?” জজ সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন আসামীর উকিলকে।
কার্টন হল ঐ উকিল-ভদ্রলোকের নাম, আসামীর সঙ্গে যাঁর চেহারার মিল মামলাটিকেই বানচাল করে দিতে বসেছে।
কার্টনকে অভিযুক্ত করার অভিসন্ধি কারোই ছিল না, কিন্তু ডার্নের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ যা-কিছু ছিল, তার অর্ধেকই ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেল। জুরীরা অনেক বিবেচনা এ টে অব টু সিটীজ ও বিতর্কের পরে রায় দিতে বাধ্য হলেন যে, আসামীকে অপরাধী বলে সাব্যস্ত করবার মত জোরালো প্রমাণ কিছুই পাওয়া যায়নি। অগত্যা জজ ডার্নেকে মুক্ত করে দিতে আদেশ দিলেন, ঘোর অনিচ্ছায়। অনিচ্ছা এইজন্য যে, জর্জ ওয়াশিংটন সম্বন্ধে ডানের উচ্চ ধারণা ভয়ানক চটিয়ে দিয়েছে রাজভক্ত জজ বাহাদুরকে। কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ তার বিরুদ্ধে থাক বা না-থাক, ডার্নেকে দণ্ড দিতে পারলেই তিনি খুশি হতেন।
ডার্নে মুক্ত হলেন, এবং সেই থেকে ম্যানেট-পরিবারের সঙ্গে তার আত্মীয়তা গাঢ়তর হয়ে উঠলো। মামলার কালে লুসী ম্যানেট ও তাঁর পিতা ডানের উপর যে সহানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন, তার দরুন ডার্নে চিরদিনের জন্য কৃতজ্ঞ হয়ে রইলেন তাদের কাছে।
ওদিকে একান্ত অপরিচিত মাতাল যুবক সিডনী কার্টনও এই সূত্রে পরিচিত হয়ে উঠলো ম্যানেট-পরিবারের সঙ্গে। ডার্নের সঙ্গে তার চেহারার মিল সকলেরই একটা বিস্ময়ের বস্তু হয়ে রইলো!
এই মিল যে ওদের সকলেরই জীবনের উপরে কতখানি ছায়াপাত করবে ভবিষ্যৎ-জীবনে, সে-কথা কিন্তু তখন কেউ বুঝতে পারেনি।
০৪. দণ্ডমুণ্ডের মালিক
প্যারী নগরে বিরাট এক রাজপ্রাসাদ।
রাজপ্রাসাদ বটে কিন্তু এই প্রাসাদের মালিক ঠিক রাজা নন। রাজার ঠিক নিচেই। যাঁদের স্থান, রাজার অসীম প্রতাপ আর ক্ষমতা পরিচালিত হয় যাঁদের হাত দিয়ে ইনি তাদেরই একজন।
এঁর দরবারে সেদিন সকাল বেলায় অতি লোকের আমদানি হয়েছে। সবাই প্রভুর দর্শনের অভিলাষে এসেছে। প্রভু যেন ভুলে না যান, এইজন্যই হাজিরা দেওয়া। আর হাজিরা দিতে যারা এসেছে তারাই কি বড় নগণ্য? দু’চারটে মাকুইস মার্শালও আছে ঐ দলে–যারা নিজের নিজের এলাকায় প্রত্যেকেই হাজার হাজার লোকের দণ্ডমুণ্ডের মালিক।
সারি-সারি ঘর। এক ঘরের ভিতর দিয়ে অন্য ঘরের দরজা। বহুমূল্য আসবাবে, রাজকীয় আড়ম্বরে সাজানো সব ঘর। সব ঘরেই অভ্যাগতের ভিড়। প্রভু আছেন এই সারিবদ্ধ ঘরের শেষ ঘরখানিতে। দরজা বন্ধ করে চকোলেট পান করছেন তিনি। চারজন সুদক্ষ চাকরের সাহায্য দরকার হয় প্রভুর চকোলেট খাবার সময়।
চারজনের জায়গায় তিনজন হলে চলে না। অচল তো হয়ই, প্রভু নিজেকে অবহেলিত, অপমানিত মনে করেন। এ-রকম অঘটন ঘটেনি কোনদিন, ঘটতে যদি–ফরাসী দেশকে রসাতলে দিতেন প্রভু! চারজন ভৃত্যের কমে চকোলেট খাওয়া? কী করে হতে পারে? একজন নিয়ে আসবে চকোলেটের স্বর্ণপাত্র, একজন নাড়বে সেই চকোলেট সোনার কাঠি দিয়ে, আর একজন সোনার তারে গাঁথা চীনদেশের রেশমী কাপড় দিয়ে ঢাকা দেবে প্রভুর অঙ্গ, যাতে চকোলেটের ছিটেফোঁটা
পড়ে যায় সে দেবদেহে, আর, চতুর্থ ব্যক্তি–এ হলো স্বয়ং সর্দার-খানসামা এর জামার দুই পকেটে দুটো সোনার ঘড়ি বাজে টিটি করে–যেন তারা বলছে–টিক্ টিক্, ঠিক ঠিক, এইভাবেই চলছে চিরদিন, এইভাবেই চলবে ঠিক! ঠিক্ ঠি! টিক্ টিক্!
হ্যাঁ, কী বলছিলাম, এই ডবল সোনার-ঘড়িওয়ালা সর্দার-খানসামা চকোলেট ঢেলে দেবে সোনার পেয়ালায়, তবে তা প্রভুর পানযোগ্য হবে! কারণ ইনি প্রভু, প্রভুদেরও প্রভু! এঁর উপরেও আর-এক প্রভু আছেন বটে, তিনি স্বয়ং রাজা। কিন্তু রাজার সঙ্গে সরাসরি ধরা-ছোঁয়ার ভিতর কম লোকই আসে। রাজশক্তির উত্তাপ নিজেদের অঙ্গে ধারণ করে এই প্রভুর দলই জনসাধারণকে পুড়িয়ে মারেন। সূর্যের তেজে গরম হয়ে ওঠে মরুভূমির বালুকা। রৌদ্রের চেয়ে সেই তপ্ত বালুকাই বেশি অসহ্য লাগে মরুপথের পথিকের কাছে।
চকোলেট পানপর্ব অবশেষে সাঙ্গ হল। রুদ্ধদ্বার খুলে গেল। প্রভুর উদয় হল তাদের সমুখে, যারা দলে দলে বাইরে বসে আছে একটিবার তাঁর দর্শন পাবার জন্য। ডাইনে-বাঁয়ে মাথা সব নুয়ে পড়তে লাগলো কর্তিত শস্যের মত। কাউকে একটি কথা, কারুর উপর একটুখানি হাসি, কারুর পানে চোখের কোণের এতটুকুন দৃষ্টি বর্ষণ করতে-করতে প্রভু চলেছেন কক্ষের পর কক্ষ অতিক্রম করে। শেষপ্রান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন এক ব্যক্তি, ইনিও প্রভুজাতীয়। গৃহস্বামী-প্রভুর মত অতবড় প্রভু না হলেও ইনিও বড় কম যান না। দেয়ালে কোন ইতালীয়ান ওস্তাদ শিল্পীর আঁকা ম্যাডোনা চিত্র। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে হয়তো তিনি সেই মাতৃমূর্তির সৌন্দর্যই দেখছিলেন, যদিও নিজের জীবনে মায়েদের সম্মান কমই রক্ষা করা অভ্যাস তার। মাতৃজাতি তত তার খেলার বস্তু! অর্থাৎ ওঁর একার নয়, সেই সময়কার প্রভু জাতিরই খেলার বস্তু।
গৃহস্বামীকে সামনে দেখে অন্য সবাইয়ের মত তটস্থভাব মোটেই দেখালেন না ইনি। অনেকটা সমকক্ষের মতই অভিবাদন করলেন তাঁকে। ভাবটা এই আজ তুমি রাজার কৃপালাভ করে খানিকটা উঁচুতে উঠে গেছ বটে, কিন্তু কাল পাশা উলটে যেতে পারে। তখন তোমার পদে আমি বসবো হয়তো, আর আমার বাড়িতে তুমি হাজিরা দেবে স্বার্থের খাতিরে।
আগন্তুক-প্রভুর মনের ভাব গৃহস্বামী-প্রভুর অজানা থাকবার কথা নয়, কারণ, এসব ব্যাপারে প্রভুরা পরস্পরের মনের ভাব ঠিকই বুঝতে পারেন। তিনি গম্ভীর ভাবে ঠিক সেইটুকুন সৌজন্যই দেখালেন–যা না দেখালে শিষ্টাচার বজায় থাকে না। যে চমৎকার কায়দায় আগন্তুকের নমস্কার তিনি ফিরিয়ে দিলেন, তাতে স্পষ্টই ফুটে উঠলো তার মনের কথা–অত আশা করো না বন্ধু! রাজার কৃপা তোমার বরাতে নেই, আর আমি গিয়ে তোমার বাড়িতে হাজিরা দেবো কোনদিন–এ আশা মগজে স্থান না দেওয়াই তোমার ভালো।
গৃহস্বামী পিছন ফিরলেন, দুশো লোককে খুশি করে বিদায় করার ঝামেলা মিটিয়ে দিলেন পাঁচ মিনিটের ভিতর। তিনিও নিজের খাসকামরায় গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন, অভ্যাগত প্রভুটিও রুক্ষ মেজাজে মুখটি কালো করে ত্যাগ করলেন সে গৃহ। আসবার তার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু না এলেও সেটা অপরাধ বলে গণ্য হবার সম্ভাবনা। যতক্ষণ যার হাতে ক্ষমতা রাছে, তাকে তোয়াজ করতে হবে বইকি, তা সে যতই দাম্ভিক হোক!
অভ্যাগত প্রভুর চার ঘোড়ার গাড়ি সিঁড়ির নিচেই অপেক্ষা করে আছে। প্রভু উঠে পড়লেন, ইশারা পেয়ে বায়ুবেগে গাড়ি চালিয়ে দিলো কোচোয়ান। জনাকীর্ণ নগরীর রাজপথ; তাও যে আবার সব জায়গায় তা সমান প্রশস্ত, তা নয়। তার উপর দিয়ে এ-রকম বেগে গাড়ি চালানো নিরাপদ নয় জেনেও কোচোয়ান চাবুকের পর চাবুক মারতে লাগলো ঘোড়ার গায়ে। তেজী ঘোড়া ছুটলো ঝড়ের মত ।
এ ১ অব টু সিটীজ পথচরেরা চাপা পড়তে-পড়তে ছুটে পালাতে লাগলো। তাণে প্রাণ বাঁচানো তাদেরই। কাজ। ঘোড়ার পায়ের তলায় পড়ে মরে যদি তারা, ঘোড়ার কোন দোষ হবে না, কোচোয়ানের তো নয়ই। আরোহী? আরোহী যদি নেমে এসে মৃতের আত্মীয়দের ধরে চাবুক না মারেন, তবে তার নাম রটে যাবে দয়ালু বলে।
ঘড়-ঘড় ঝন্ঝন্ ঘটাং-ঘটাং শব্দ করে ছুটে চলেছে গাড়ি। ঝড়ের বেগে ছুটেছে, মোড়ের পর মোড় ঘুরে যাচ্ছে সেই ঝড়ের বেগে। নারীরা চিৎকার করে পালাচ্ছে পথ ছেড়ে, পুরুষেরা টানাটানি করছে শিশুদের। হৈ-হৈ ব্যাপার! রৈরৈ কাণ্ড! মাকুইসের গাড়ি! সামা!
পথের ধারে একটা ফোয়ারা। অনেক নারী ও শিশু সেখানে। নারীরা জল ভরছে, শিশুরা কাদা মাখছে। ঝড়ের বেগে এসে পড়লো মার্কুইসের গাড়ি। একটা রব উঠলোপালাও! পালাও!
একখানা চাকা ধাক্কা খেয়েছে কিসের সঙ্গে যেন। একটা আর্ত কোলাহল চারিদিকে। ঘোড়ারা পা তুলে লাফিয়ে উঠলো।
ঘোড়ারা লাফিয়ে উঠলো বলেই গাড়ি থামলো। তা নইলে থামবে কেন? গাড়ির। তলায় মানুষ চাপা পড়ে থাকে অমন, তা বলে প্রভুদের গাড়ি থেমে পড়বে রাস্তার। মাঝখানে, অমন আশা করে না গরীবেরা। কিন্তু এ-যাত্ৰা ঘোড়ারা লাফিয়ে উঠেছে, গাড়ি থামাতেই হল। মাকুইস মুখ বাড়িয়ে প্রশ্ন করলেন–হল কি?
লম্বা একটা লোক, ঘোড়ার পায়ের তলা থেকে টেনে বার করেছে একটা মাংসপিণ্ড, আর কাদার উপর সেইটেকে রেখে, তার উপরে পড়ে চিৎকার করছে হাউহাউ করে।
ছেঁড়া কাপড় পরা একটা লোক বিনীত স্বরে বললে–মহান্ মার্কুইস! ক্ষমা করুন প্রভু!–একটা বাচ্চা চাপা পড়েছে!
–ও লোকটা অমন জানোয়ারের মত চেঁচায় কেন? ওরই বাচ্চা বুঝি?
–তাই বটে হুজুর। ওরই ছেলে বটে!
লম্বা লোকটা হঠাৎ রক্তমাখা মাংসপিণ্ডের উপর থেকে লাফিয়ে উঠলো, ছুটে এলো গাড়ির দিকে। দুই হাত মাথার উপর তুলে চিৎকার করে বললো–মেরে ফেলেছে! মরে গেছে আমার ছেলেটা? সে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো মার্কুইসের দিকে চোখে তার যেন বিজলীর ঝলক!
বহু লোক গাড়ির চারিপাশে। সবাই তাকিয়ে মাকুইসের দিকে কী তিনি। বলেন–শুনবার জন্য কান খাড়া করে আছে তারা; কী তিনি করেন–দেখবার। জন্য চোখে তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। কিন্তু সে দৃষ্টিতে ক্রোধ নেই, মুখেও তাদের ভাষা নেই। মহান্ মাকুইস একবার সবাইয়ের দিকে একনজর দেখে নিলেন, নিছক তাচ্ছিল্য তার সে নজরে। অপরিসীম তাচ্ছিল্য–যেন গর্ত থেকে একপাল ইঁদুর বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে তার সমুখে! টাকার থলে বার করলেন মার্কুইস! তারপর তার মুখ থেকে ধীরে ধীরে বেরুলো :
–আমি দেখে অবাক হয়ে যাই যে, তোদের নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার, বা ছেলেগুলোকে সাবধানে রাখার পর্যন্ত ক্ষমতা নেই। একটা-না-একটা সর্বদাই এসে। পড়ছে গাড়ির সমুখে! কী জানি আমার ঘোড়ার পা খোঁড়া হয়ে গেল কি না! নে, এইটে দে ওকে!
একটা মোহর থলে থেকে নিয়ে তিনি ভিড়ের ভিতর ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। সমস্তগুলো ঘাড় সেইদিকে ফিরলো, সমস্তগুলো চোখ দেখতে লাগলো–মোহরটা কী-রকম ঘুরপাক খেয়ে উপরে উঠে আবার ঘুরপাক খেয়ে নিচে নামতে লাগলো। শুধু লম্বা লোকটা আবার দু’হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলো–মেরে ফেলেছে! মরে গেছে। ছেলেটা!
অনেকবার সে এইভাবে চিৎকার করেছে, আরও কতবার যে এইভাবে চিৎকার করতো–কে জানে! কিন্তু এই সময়ে আর একটি লোক জোর-পায়ে এসে হাজির। হল সেখানে। তাকে দেখে অন্য সবাই পথ ছেড়ে সরে গেল। লম্বা লোকটা এই আগন্তুকের কাঁধের উপর মাথা রেখে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করলো এইবার। একটা আঙুল তুলে কেবল সে ফোয়ারার দিকে দেখাতে লাগলো–যেখানে এক রক্তমাখা মাংসপিণ্ড ঘিরে পাড়ার মেয়েরা ঘুরছে আর ফিরছে–নীরবে, মাথা নিচু করে।
আগন্তুক বললো–সব শুনেছি, সব জানি ভাই গ্যাসপার্ড। ভালোই হলো, বাচ্চাটার পক্ষে এ ভালোই হলো। যে-ভাবে মানুষ বাঁচে এ-দেশে, সে-ভাবে বেঁচে থাকার চাইতে মরে যাওয়াই ভালো গ্যাসপার্ড! বুক বাঁধো ভাই! বুক বাঁধো!
মাকুইসের বাঁকা-অধরে খেলে গেল মৃদু হাসি। সে হাসি নিছক অবজ্ঞার। বাঃ! তুমি তো জ্ঞানী লোক দেখছি! নাম কি তোমার?
–ডিফার্জ।
–কী করো?
–মহান্ মার্কুইস! আমি মদের দোকানী।
–জ্ঞানী ও মদের দোকানী! এই তোমার বকশিশ!–বলে মার্কুইস আর-একটা মোহর ছুঁড়ে মারলেন ডিফার্জের দিকে। তারপর হুকুম দিলেন–চালাও গাড়ি!
জনতার দিকে আর দ্বিতীয়বার দৃষ্টি না দিয়ে মহান্ মাকুইস গদীতে ঠেসান দিয়ে বসলেন। চলতে চলতে পায়ের গুঁতোয় একখানা মেটে বাসন ভেঙে ফেলেছেন যেন! দাম চুকিয়ে দিয়েছেন–আবার কী?–চালাও!
গাড়ি সবে চলতে শুরু করেছে, এমন সময়ে ঠং করে তারই ছুঁড়ে দেওয়া মোহর উড়ে এসে পড়লো গাড়ির পাটাতনের উপরে। চমকে উঠলেন প্রভু।
–রোখো! রোখো!–কে ছুঁড়লো মোহর?
মার্কুইস তাকিয়ে দেখলেন। মদের দোকানী জ্ঞানী ডিফার্জ আর সেখানে নেই। আছে আর একটি কালো শক্ত নারী, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বুনে চলেছে ছবির পর ছবি, সাদা কাপড়ে।
গলার স্বর এক পর্দাও না চড়িয়ে মার্কুইস বললেন–কুত্তা সব। কে ঐ ঢিল ছুঁড়েছে গাড়ির ভিতর, জানতে যদি পারতাম! তাকে গাড়ির চাকার নিচে ফেলে গুঁড়ো করে ফেলতাম আমি!
গাড়ি গড়গড় করে চলে গেল, ফোয়ারার জল তরতর করে বয়ে চললো। থরথর করে কাঁপতে-কাঁপতে ইঁদুরের দল ঢুকলো-যে যার গর্তে। একটা ছেলে মরে গেছে, সেটা বড় কথা নয়; বড় কথা এই যে মার্কুইস রেগেছেন! কাজেই কাঁপছে ইঁদুরেরা।
সেই রাত্রে।
নিজের প্রাসাদে নৈশ-ভোজনে বসেছেন মহান্ মার্কুইস। টেবিলে দু’জনের খাবার! খাচ্ছেন কিন্তু মার্কুইস একাই। ইংলন্ড থেকে তার ভ্রাতুস্পুত্রের আজ আসবার কথা। এখনও পৌঁছোননি তিনি! একাই খেতে বসেছেন মার্কুইস! রাজভোেগ! পরম পরিতোষের সঙ্গে ভোজন চলেছে প্রভুর!
পথে একটা ব্যাপার ঘটেছে যা মার্কুইস ঠিক বুঝতে পারেননি! গাড়ির তলা: লোহার কাঠামো ধরে ঝুলতে ঝুলতে একটা লম্বা লোক না-কি এসেছিল বহুদূর! সইস-কোচোয়ানেরা দেখতে পায়নি তাকে, কিন্তু পথচরেরা দেখেছিল। তাদেরই কানাকানি থেকে কথাটা প্রচার হয়ে পড়ে। মাকুইসের কানে যখন এলো এ-খবর, তখন আর গাড়ির তলার লম্বা লোকটাকে কোথাও পাওয়া গেল না; সে কোন্ ফাঁকে পালিয়ে গেছে!
অবশ্য, কোন ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার পাত্র মার্কুইস নন–তা সে ব্যাপার যত দুর্বোধ্যই হোক না কেন! তবে হ্যাঁ, খেতে-খেতে দু’তিনবার তিনি ভৃত্যদের বললেন জানলা খুলে দেখতে–বাইরে কোন অচেনা লোককে দেখা যায় কি না। নাঃ, সন্দেহজনক কিছু কোথাও নেই।
গাড়ির শব্দ!–ঐ বোধ হয় এলো তার ভ্রাতুস্পুত্র! আসবামাত্রই ভৃত্যেরা তাকে। জানালো যে মাকুইসের ঘরে তার খাবার দেওয়া হয়েছে। তিনি এলেন। কে তিনি? তাকে আমরা দেখেছি লন্ডনে। ওল্ড বেইলীর বিচারকক্ষে। তার নাম ছিল তখন, চার্লস্ ডার্নে।
খুবই ভদ্রভাবে ভাইপোকে ডেকে পাশে বসালেন মার্কুইস। কিন্তু সভ্যসমাজের যা রীতি, আপনজনের সঙ্গে দেখা হলে করমর্দন করা, কিন্তু তার জন্য হাত বাড়ালেন না কেউ।
ডার্নে বললেন–আপনি এই এলেন প্যারী থেকে?
–হ্যাঁ। আর তুমি?
–সোজা লন্ডন থেকে!
–অনেক দিন থেকেই আসবার কথা শুনছিলাম তোমার।
–একটু দেরি হয়ে গেল! কাজ ছিল–
–তা তো বটেই!
ভৃত্যেরা যতক্ষণ কক্ষে রইলো, এইরকমই মামুলী আলাপ চললো দু’জনের ভিতর। তারপর ভোজন শেষ হয়ে গেল, কফি পরিবেশন করে ভৃত্যেরা চলে গেল ঘর থেকে। তখন ডার্নে বললেন :
যে-কাজের জন্য ঘুরছি কিছুদিন থেকে আপনি তা জানেন। তারই দরুন আসতে হল আবার! এ-রকম যাতায়াত খুবই বিপজ্জনক। এর জন্য বৃটিশ সরকারের সন্দেহভাজন হয়ে পড়েছি আমি। মাঝখানে রাজদ্রোহের মামলায় পড়েছিলাম। অতি কষ্টে প্রাণে বেঁচেছি! অবশ্য, প্রাণ গেলেও দুঃখ ছিল না। যে পবিত্র কাজ মাথায় তুলে নিয়েছি, তার জন্য হাসিমুখে মরতেও পারি আমি।
পিতৃব্য একটুও ব্যস্ত না হয়ে বললেন–আরে না, না, মরতে হবে কেন?
ভ্রাতুস্পুত্র উত্তর করলেন–অবশ্য, আমি মরতে বসলেও যে আপনি আমার রক্ষার জন্য কোন চেষ্টা করতেন না, তা আমি বিলক্ষণ জানি।
পিতৃব্য হাত নেড়ে একটা প্রতিবাদেরই ভঙ্গি করলেন অবশ্য, কিন্তু সে-প্রতিবাদ যে আন্তরিক নয়, তা বুঝতে কষ্ট হল না ডার্নের। তিনি যেন স্পষ্ট কথা শোনাবার জন্যই এসেছেন আজ; পিতৃব্যকে সোজা শুনিয়ে দিলেন–আপনার ক্ষমতা থাকলে আপনি বরং আমার বিপক্ষেই দুচারটা জোরালো প্রমাণ যুগিয়ে দিতেন, তা আমি বুঝি।
আশ্চর্য মানুষ এই মাকুইস! একটুও বিরক্ত বা ক্রুদ্ধ না হয়ে মিষ্টস্বরে বললেন– আরে, না–না! বলো কি?
ডার্নে সে-কথায় কান না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–আমার কাজে বাধা দেবার শক্তি থাকলে আপনি কি তা দিতেন না?
মাকুইসের অধরে চকিতের জন্য ক্ষীণ হাসি দেখা দিয়ে তা মিলিয়ে গেল। তিনি উত্তর করলেন–তা যে দিতাম, সে কথা তো আগেই বলেছি!
–সম্ভব হলে আপনি আমাকে ব্যাস্টিলে আবদ্ধ করতেন। বলুন, এ কথা সত্য কিনা!
–খুবই সত্য! ব্যাস্টিলে কিছুদিন রাখতে পারলে তোমার উপকার হতো। নির্জন কারাবাসে চিন্তার সময় পাওয়া যায়। আর চিন্তাতেই মানুষের স্বভাব শোধরায়।
ডানে হেসে বললেন–তাহলে বলতে হয় যে, এ-দেশের বর্তমান শাসক যাঁরা, তাদের সঙ্গে আপনার সদ্ভাব নেই বলেই আমি এখনো স্বাধীন আছি?
তিক্তকণ্ঠে মাকুইস বললেন–কী যে হল দেশটার! অল্পদিন আগেও আমরা যা খুশি তাই করেছি। যাকে দরকার ব্যাস্টিলে পাঠিয়েছি, যাকে ইচ্ছে ফাঁসিতে লটকেছি! কিন্তু সেভাবে চলতে গেলে এখন যেন সুবিধে হবে না বলে মনে হয় মাঝে-মাঝে! এ টেস্ অব সিটীজ একটা নতুন কথা শুনতে পাই এখন। জনগণের স্বাধীনতা! হাঃ হাঃ- কী গেরো বল দেখি! হতাশভাবে মার্কুইস এক টিপ নস্য নাকে খুঁজে দিলেন।
ডানে উত্তর করলেন–সেইভাবে চলে-চলে যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে–ছিঃ ছিঃ! আমাদের এই বংশকে যতটা অভিশাপ দেয় এ-দেশের লোক, এমন আর বোধ হয় কাউকে নয়!
মার্কুইস যেন খুশি হয়ে বললেন–তাই তো চাই! যে অভিশাপ দেয়, বুঝতে হবে যে প্রতিহিংসা নেবার শক্তি তার নেই!
এ-কথার উত্তরে ডার্নে নতমুখে তাকিয়ে রইলেন টেবিলের দিকে। উদ্বেগ আর নৈরাশ্য তার বসার ভঙ্গি থেকেই ফুটে বেরুচ্ছিলো যেন। আর মাকুইস? তিনি যখন কথা কইলেন আবার, তা থেকে ফুটে বেরুলো শুধু অসহ্য দম্ভ। বলে চললেন– যত দিন এই প্রাসাদের উপর ছাদ বজায় থাকবে, ততদিন চাবুকের চোটে কুকুরের দলকে ঠাণ্ডা রাখবো বৎস! নিজেকে বড় করে রাখার সহজ পথ দুনিয়ায় চিরদিনই একটি মাত্র–সে হচ্ছে, অত্যাচার!
ডার্নে বললেন–অন্যায় করলেই সাজা পেতে হয় তার জন্য। আমরা অন্যায় করেছি, তারই সাজা আসছে কিস্তিতে কিস্তিতে। প্রথম কিস্তি এই অভিশাপ।
–আমরা অন্যায় করেছি?–মার্কুইস জিজ্ঞাসা করলেন–আমরা কারা?
–আমরা অভিজাতেরা! সে অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্তের জন্যই আমার ইংলন্ডে থাকা। মা আমায় আদেশ করে গিয়েছেন মৃত্যুকালে–এ জমিদারীর সঙ্গে সংস্রব না-রাখতে! অত্যাচারিত প্রজাদের মাথায় নতুন অত্যাচারের বোঝ আমি যেন কোনদিন না চাপাই, মা আমায় মিনতি করে গিয়েছেন বারবার।
মার্কুইস ব্যঙ্গের সুরে বললেন–জমিদারী আগে পাও তো, তারপর সে-কথা। আমি তো আজই মরছি না!
ডার্নে বললেন–না, সে কামনা আমি করি না। আপনি আরও দীর্ঘ দিন বাঁচুন!–তবে আপনার দেহান্ত ঘটলে এ-সম্পত্তি যদি আমার হয়, হবেই অবশ্য, আমি এর পরিচালনার নতুন ব্যবস্থা করবো। গরীব প্রজার দুর্গতি যাতে দূর হয়, তারা যাতে পেট ভরে খেতে পায়, পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতে পায় সত্যিকার মানুষের মত, তা আমি করবো সেদিন।
–এবং তুমি নিজে উপবাস করবে–প্রজাদের ভরপেট খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে–এই তো?–বিদ্রূপ করে উঠলেন মার্কুইস।
উত্তেজিত হয়ে ডানে বললেন,”উপবাস? উপবাস কেন করবো? এখন কি আমি উপবাস করে আছি? যে খেটে খেতে পারে, তাকে কখনো উপবাস করতে হয় না। শুধু আমি কেন, বহু ফরাসী-ভদ্রলোকই এই অভিশপ্ত দেশ ত্যাগ করে ইংলন্ডে গিয়েছেন–নিজের চেষ্টায় নিজের জীবিকা অর্জন করবার জন্য।
আবার বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠলো মার্কুইসের মুখে। বহু ফরাসী-ভদ্রলোক? তার ভিতর বোভেয়াবাসী এক ডাক্তার আছেন বোধ হয়? চেনো সে ডাক্তারকে? ডাক্তার ম্যানেট?
মাকুইসের হাসির কারণ বুঝতে না পেরে বিস্মিত ডার্নে সংক্ষেপে বললেন– চিনি।
-বেশ, বেশ। ম্যানেটের এক মেয়ে আছে না? তোমার এ নতুন মতবাদের মূলে কি সেই ম্যানেটের মেয়ে? যাকগে, ঘুম পাচ্ছে আমার! কাল আবার কথা হবে বৎস। শুভরাত্রি!
এই বলে মার্কুইস ঘণ্টা বাজালেন। ভৃত্যেরা আলো নিয়ে এলো ডার্নেকে তার শয়নকক্ষে নিয়ে যাবার জন্য। মার্কুইসও নিজের ঘরে প্রবেশ করলেন গিয়ে। কিন্তু আজ কেন চোখে ঘুম আসে না?
সুকোমল সুগন্ধি রাজশয্যায় শুয়ে মাকুইসের নয়নে তবু নিদ্রা নেই। চোখের সামনে ছবির পর ছবি ভেসে ওঠে। ঘরের ভিতর অন্ধকার; কিন্তু সে অন্ধকারের বুক থেকে ফুটে ওঠে রক্তরাঙা সব ছবি। প্যারীর রাজপথ, রাজপথের কোণে ফোয়ারা, গাড়ির চাকার নিচে দলিত মাংসপিণ্ড…মুমূর্ষ চিৎকার করছে…অন্ধকারে রক্তবিন্দু ঝরে পড়ছে শিশিরের মতন।
এমন সময় অকস্মাৎ একটা ঘ-ঘস্ শব্দ ঘরের ভিতর! মাকুইস চকিত হয়ে ওঠেন, কিন্তু ভৃত্যদের ডাকবার আগেই একখানা ছোরা আমূল বিঁধে যায় তার হৃদয়ে। প্রায়শ্চিত্তের পালা শুরু হয়েছে এবার।
***
সেই গ্যাসপার্ড! যে একদিন লাল মদ দিয়ে দেওয়ালের গায়ে লিখেছিল–”রক্ত? রক্ত!” যে একদিন কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিল পুত্রকে মাকুইসের গাড়ির তলায় চাপা পড়তে দেখে! সেই গাড়ির নিচেকার লৌহদণ্ড ধরে ঝুলতে-ঝুলতে মাকুইসের অনুসরণ করেছিল।
গ্যাসপার্ড কিন্তু ধরা পড়লো! পালাতে পারলো না। মাকুইসের প্রাসাদের পায়ের তলায় মাথা গুঁজে পড়ে আছে যে গরীবদের গ্রাম, সেইখানে হলো তাঁর ফাঁসি। চল্লিশ ফুট উঁচুতে তুলে ফাঁসি দেওয়া হল তাকে। সেই চল্লিশ ফুট উঁচুতে ঝুলতে থাকলে তার দেহ, যতদিন না পচে গলে খসে পড়লো তার হাত-পাগুলো–চল্লিশ ফুট নিচের গ্রামের ভিতর। জমিদার খুন? এ-পাপের এমনি চরম দণ্ড না দিলে দেশে শান্তি রক্ষা হবে কি করে?
দিন যায়। অত বড় দাপট যে মাকুইসের, তিনি আর নেই! যিনি চাবুকের চোটে শায়েস্তা রাখতে চেয়েছিলেন দেশের লোককে, তিনি হঠাৎ-ই, দেশকে অভিভাবকশূন্য করে চলে গেলেন পরলোকে। তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র–যিনি বিশ বৎসরের ভিতর জমিদারী হাতে পাবার প্রত্যাশা করেননি, তিনি হঠাৎ প্রভাতে শয্যাত্যাগ করেই দেখতে পেলেন–জমিদারী পেয়ে গেছেন তিনি। গ্যাবেলকে ডেকে পাঠালেন।
এ টেস্ অব দ্যু সিটীজ গ্যাবেল হল মাকুইসের তহশীলদার। খাজনাপত্র সেই আদায় করে। এখন থেকে আর কোন খাজনা আদায় হবে না প্রজাদের কাছে, বরং উলটে সকল রকমে তাদের সাহায্য করা হবে জমিদারীর সঞ্চিত অর্থ থেকে, এই সোজা আদেশ দিয়ে ডার্নে প্রস্থান করলেন লন্ডনে। এই অভিশপ্ত জমিদারীতে বাস করবেন না তিনি, পাছে সংক্রামক ব্যাধির মত তার মনেও ক্ষমতার মোহ সঞ্চারিত হয়।
ডার্নে চলে গেলেন, গ্যাবেল নতুন নিয়মে জমিদারী চালাবার জন্য প্রস্তুত হল। কিন্তু সে প্রস্তুত হবার আগেই একদিন মাকুইসের প্রাসাদে আগুন লাগলো! গ্রামের লোকে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো সেই আগুন। এ ওকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো–আগুনটা চল্লিশ ফুট উঁচুতে উঠেছে কি না!
সেই একই রাত্রে ও-অঞ্চলের প্রত্যেক জমিদারবাড়িই আগুনে ছাই হয়ে গেল! প্রায়শ্চিত্তের দ্বিতীয় কিস্তি!
০৫. ভালো ও মন্দ
শত্রুরা ম্যানেটকে ব্যাস্টিল কারাগারে আটক করবার আগে চিকিৎসক হিসাবে তার খুব নাম ছিল। আঠারো বছর নির্জন কারায় বাস করে তিনি যখন স্বাধীনতা ফিরে পেলেন আবার, তখন তিনি পাগল বললেই হয়। ওঁর অবস্থা দেখে মেয়ে লুসী, বা বন্ধু লরী, কেউই আশা করতে পারেননি যে, এই পাগলের মাথা আবার ঠিক হয়ে আসবে, তিনি আবার আগের মতই ভালো চিকিৎসক হয়ে বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে চমৎকার চিকিৎসা করতে পারবেন।
কিন্তু যা আশা করা যায়নি, সেই ব্যাপারও সত্যই ঘটলো। সেই জড়তার আবরণ–ম্যানেটের দেহ-মন যার নিচে একেবারেই চাপা পড়ে গিয়েছিল, ভালোবাসার পরশ পেয়ে ধীরে ধীরে তা সরে যেতে লাগলো, যেন রৌদ্রের তাপে বরফ গলে যাচ্ছে। ম্যানেটের মনুষ্যত্ব লোপ পেয়েছিল একেবারে, তার প্রতিভা পড়েছিল ঘুমিয়ে। লুসী আর লরী–দু’জন দু’ভাবে তাদের জাগিয়ে তুললেন আবার। পাঁচ বৎসরের ভিতর লন্ডন-নগরের বড়লোক-মহলে ডাক্তার ম্যানেট সুবিজ্ঞ চিকিৎসক বলে বিখ্যাত হয়ে উঠলেন। তাঁর জ্ঞানও অসাধারণ, আবার রোগীর জন্য তিনি খাটেনও খুব বেশি; কাজেই তার উপার্জনও হয় প্রচুর।
একদিন তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন, চার্লস ডার্নে। লন্ডনে ইনি ফরাসী ভাষা শিক্ষা দেন, ইংরেজ তরুণ-তরুণীদের। এঁরও আয় ভালো। মাঝে মাঝে কেমব্রিজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে নিজেও পড়াশুনা করেন।
ম্যানেট-পরিবারের সঙ্গে তিনি এখন খুবই মেলামেশা করেন। সেই মামলার পর থেকেই ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। আর একজনও ম্যানেট-পরিবারের বাড়িতে আনাগোনা করে থাকেন–ঐ একই সময় থেকে। ইনি অবশ্য ঘনিষ্ঠ হতে পারেননি, কিন্তু এঁকে দেখলেও বাড়ির লোকেরা খুশি হন, আদর করেই এঁকে গ্রহণ করেন। ইনি সেই মক্কেলশূন্য উকিল সিডনী কার্টন–কোর্টে গিয়ে যিনি তাকিয়ে থাকেন ছাদের দিকে, ডার্নের সঙ্গে যাঁর চেহারার মিল একদা ডানের প্রাণটাই বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
সে-কথা যা। আমরা বলছিলাম–ডার্নে যে দিন ম্যানেটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন সেই দিনের কথা। ডাঃ ম্যানেট তখন অধ্যয়ন করছিলেন। ডার্নেকে দেখে বই রেখে দিয়ে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন–এসো ডার্নে! তিন চারদিন থেকেই ভাবছি তুমি এইবার আসবে, কারণ, কেমব্রিজে একটানা বেশিদিন থাকা তো তোমার অভ্যেস নয়! তুমি বসো! লুসী কী-সব কেনা-কাটা করতে গেছে। আসবে এখনই!
ডাক্তার ম্যানেট! আপনার কন্যা যে এখন বাড়িতে নেই, তা জেনেই আমি এসেছি। তিনি ফিরে আসবার আগেই দু-একটা কথা বলতে চাই আমি আপনাকে।
–কি বলবে, বলো! কীভাবে কথা শুরু করবেন, তা ঠিক করতেই যেন ডানের কিছু সময় কেটে গেল। তারপর তিনি বললেন কিছুদিন থেকে আপনার এখানে যে-রকম ঘনিষ্ঠভাবে মিশবার সুযোগ পেয়েছি আমি, তাতে আমার আশা হয়–যে-বিষয়ে আমি কথা কইবো আজ
ডাক্তার যেন হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিতে চাইলেন ডার্নেকে। তারপর হাত গুটিয়ে এনে ধীরে ধীরে নিচুগলায় বললেন :
–কথাটা কি, লুসী-সম্পর্কে?
–আজ্ঞে, হ্যাঁ।
–বলো!
–কী আমি বলবো, তা বোধ হয় বুঝতে পারছেন আপনি। আপনার কন্যাকে আমি ভালোবাসি! সারা হৃদয় দিয়ে! নিঃস্বার্থভাবে! ভক্ত যে-ভাবে পূজা করে উপাস্য দেবীকে, সেইরকম পূজা করি আমি তাকে! এই কথাই বলতে এসেছি আমি আপনাকে।
ডাক্তার বসে রইলেন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে, মাথা নিচু করে। লুসীকে বিয়ে দিয়ে পর করে দেবেন, এ কথা ভাবতেই তার কষ্ট হয়। লুসী ছাড়া জগতে তার কে আছে আর? লুসীই তাকে কবর থেকে তুলে এনেছে। লুসীরই সেবা আর যত্নে তিনি নিজের মনুষ্যত্ব আর প্রতিভা ফিরে পেয়েছেন; সমাজে আবার দশজনের একজন হতে পেরেছেন। লুসীকে হারালে এ-সবই আবার হারিয়ে ফেলা অসম্ভব নয় তার!
বহুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকবার পর ডাক্তার বললেন–তুমি কি লুসীকে বলেছো এ কথা?
–না।
–চিঠিতেও লেখোনি?
–কখনো না।
–বলোনি, বা লেখোনি যে, তা আমি বুঝি! আমি ধন্যবাদ দিই তোমায়। ডার্নে বলতে লাগলেন–ডাক্তার ম্যানেট। আমি জানি, আপনার পক্ষে লুসী এবং লুসীর পক্ষে আপনি কত বেশি প্রয়োজনীয়। শৈশবে লুসী পিতামাতার স্নেহ পাননি, আপনাকে তিনি পেয়েছেন রীতিমত বড় হয়ে। যেন পরলোক থেকে ফিরে পেয়েছেন তিনি আপনাকে। তার অন্তরের স্নেহভক্তি–যা জীবনের প্রথম সতেরোটি বৎসরের ভিতর ফুটে উঠবার কোন পথই পায়নি, তা অকস্মাৎ আপনাকে পেয়ে একান্ত নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলো–এক নিশ্বাসে আপনার উপর উজাড় করে দিল ভক্তি, ভালোবাসা, স্নেহ, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, নারীর অন্তরে যত কিছু পবিত্র ভাব থাকে সবই। আবার আপনিও আঠারো বৎসর এমন জায়গায় আটক ছিলেন, যার তুলনা করা যায় শুধু কবরের সঙ্গে। সেখান থেকে ভগবানের দয়ায় বেরুবার পরে ঐ মেয়েকে অবলম্বন করেই ফিরে পেলেন জীবন, স্বাস্থ্য, প্রতিভা, কর্মশক্তি, আশা ও আনন্দ। দেশের বে-আইনী অত্যাচারে, আঠারো বৎসর পূর্বে যে মহীয়সী পত্নীর কাছ থেকে চিরদিনের জন্য আপনাকে দূরে সরে যেতে হয়েছিল, তারই ছায়া যেন আপনি দেখতে পেলেন লুসীর মাঝে! ঐ মেয়েই আপনার জীবনের সম্বল, ওঁকে কেন্দ্র করেই আপনার সংসার, উনিই আপনার চোখের আলো– তা সবই বুঝি আমি। এ অবস্থায় বিয়ে দিয়ে ঐ মেয়েকে পর করে দেওয়া আপনার পক্ষে কতখানি শক্ত, তাও আমি বুঝি! আর বুঝি বলেই, এ বিয়ের প্রস্তাবই আমি উত্থাপন করতাম না, যদি-না এমন একটা উপায় আমি আবিষ্কার করতে সক্ষম হতাম, যাতে আপনাকে দুঃখ পেতে না হয়। আমার প্রস্তাব এই যে, লুসীকে আমি আপনার কাছ থেকে নিয়ে যাবো না, আমিই এসে আপনার কাছে আশ্রয় নেবো লুসীর পাশে! একটি সন্তানের জায়গায় দু’টি হবে আপনার!
এতক্ষণ নীরব নিস্পন্দ থাকবার পর, ডাক্তার এইবার ডার্নের হাতের উপর একটুখানি মৃদু চাপ দিলেন। তারপর, এতক্ষণ পরে তিনি মুখ তুলে চাইলেন একবার। তার মুখ দেখেই ডানে বুঝলেন যে অন্তরে তার লড়াই চলেছে একটা; মেয়ের ভালো কিসে হবে সেই চিন্তা একদিকে, আর নিজের সুখ-সুবিধা কিসে বজায় থাকবে–সেই চিন্তা অন্য দিকে। লড়াইয়ে যে নিজের সুখের চিন্তা পরাজিত হতে বাধ্য, তা আগে থাকতেই বুঝতে পেরেছেন তিনি। বুঝতে পেরে ভয়ও পেয়েছেন; সে-ভয়ের ছায়া তার মুখেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এইবার তিনি ধীরে ধীরে বললেন–ডার্নে, এমন আন্তরিকতার সুর, এতখানি উদারতার পরিচয় তোমার কথার ভিতর দিয়ে ফুটে বেরুচ্ছে বৎস, যে, তোমায় ধন্যবাদ না দিয়ে আমি পারি না। লুসী তোমায় ভালোবাসে বলে কি তোমার মনে হয়?
–এখন পর্যন্ত, কই, সে-রকম কিছু মনে করবার কোন কারণ দেখতে পাইনি আমি।
–আমার অনুমতি পেলে, তুমি কি এখনই লুসীর কাছে কথা তুলতে চাও?
–না, তাও না। কবে যে সাহস করে তাকে এ-কথা বলতে পারবো, তা। আমি জানি না! হয়তো কয়েক সপ্তাহের ভিতরও সে সাহস আমি সঞ্চয় করে উঠতে পারবো না।
–তুমি কি আমার কাছে পরামর্শ চাও?
–যদি দয়া করে দেন—
–কোন প্রতিশ্রুতি চাও আমার কাছে?
–চাই। আর বেশি কিছু নয়, লুসী নিজে যদি কখনো আপনার কাছে পরামর্শের জন্য আসেন এই ব্যাপারটি নিয়ে, তাহলে আপনি আমার বিপক্ষে কিছু বলবেন না, এইটুকু ভিক্ষা আমি চাই আপনার কাছে।
–সে অনুরোধ আমি রক্ষা করবো তোমার! তোমার বিরুদ্ধে আমি কখনো কিছু বলবো না–যদি বুঝি যে লুসীর সুখের জন্য তোমার সঙ্গে তার বিবাহ দেওয়া একান্ত আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি জানি না তোমার প্রকৃত মা, তোমার পারিবারিক ইতিহাস–না, না, এখন সে-সব বলবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ কথা আমি তোমায় বলছি–তোমার নাম বা পারিবারিক ইতিহাস শুনে তোমার উপর যদি আমার দারুণ বিরাগও জন্মে কোনদিন, তাহলে সে বিরাগও আমি দমন করবো লুসীর মুখ চেয়ে। আমার নিজের আপত্তির জন্য লুসীর সুখের পথে বাধা হবো না আমি।
*
পরের দিন।
একা ঘরে বসে সেলাই করছিলেন লুসী ম্যানেট।
ঘরে এসে ঢুকলো সিডনী কার্টন। মক্কেলশূন্য উকিল সিডনী, যার কাজ হলো অন্য উকিলদের কাগজ ঠিক করে দেওয়া, আর কোর্টে গিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকা।
উপার্জন কিছু আছে। অন্য উকিলদের সাহায্য করে বেশকিছু পায় সে। তার বারো-আনা খরচ হয় মদে। সংসারে সে একা। আপনার জন্য কোথাও কেউ নেই। প্রতিভা ছিল, নষ্ট হয়েছে মদে। কর্মশক্তি ছিল, লোপ পেয়েছে মদে। মনুষ্যত্ব ছিল, প্রায় ধ্বংস হয়েছে মদে। প্রায়’ বলছি এইজন্য–মাঝে-মাঝে তার আচরণে নিবন্ত মনুষ্যত্বের ছাই-চাপা পাঁশুটে আলো এখনো এক-আধবার দেখা দেয় বইকি!
সিডনী কার্টন এসে ঘরে ঢুকলো। লুসী অভ্যর্থনা করে বসতে বললেন তাকে। একটু বিব্রত বোধ করলেন বইকি লুসী! সিডনীকে ঠিক সুস্থ মনে হচ্ছিল না। লুসীর মনে হল, হয়তো অতিরিক্ত পান করে এসেছে সে। কিন্তু এ কী?–সিডনীর। মুখে তো এ-রকম বিষণ্ণ ভাব কখনো দেখা যায় না! যা দেখা যায় সর্বদা, সে । হল ছোট-বড় কতকগুলো রেখা–যাদের দিকে তাকালেই লোকের বুঝতে বাকি থাকে না যে সিডনী কার্টন কত বড় উচ্ছঙ্খল, অসংযমী আর চরিত্রহীন পুরুষ। আজকের এ মলিন মনমরা ভাব তো সিডনীর মুখে বড় কেউ দেখেনি কোনদিন।
লুসী প্রশ্ন করলেন–আপনার কি অসুখ করেছে মিস্টার কার্টন?
–না। তবে আমি যে-জীবনযাপন করি, তাতে স্বাস্থ্য তো ভালো থাকবার কথা নয়! দুশ্চরিত্র লোকের মুখে লাবণ্যের আলো দেখবার আশা করবেন না।
–এর চাইতে ভালো জীবনযাপন করায় তো বাধা নেই, মিস্টার কার্টন।
–বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আর উঠবার আশা নেই, এখন ক্রমেই নামছি, নামতে থাকবো!
টেবিলের উপর দুই কনুই রেখে, দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে রইলো সিডনী। অন্তরের আবেগে সারা শরীর কাঁপছিল তার, টেবিলখানাও কাঁপতে লাগলো তার কনুইয়ের ভারে।
সিডনীর এ-রকম কাতরতা কখনো দেখেননি লুসী। তিনিও বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন। সিডনী মুখ না তুলেই বলতে লাগলো–আমায় ক্ষমা করতে হবে কুমারী ম্যানেট! একটা কথা বলতে এসেছি। কিন্তু বলতে এসে এখন ভয়ে কাঁপছি, এমন গুরুতর কথা সেটা। আপনি শুনবেন আমার কথাগুলি?
–শুনলে যদি আপনার কোন উপকার হয়, তবে সানন্দে শুনবো।
–এত দয়া আপনার? ভগবান ভালো করুন আপনার!
মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ধীরভাবে বলতে লাগলো সিডনী–ভয় পাবেন না, শুনুন। যা বলবো, তাতে শিউরে উঠবেন না। লোকে বলে না–আহা! ছেলেটা মরে গেল, নইলে খুব বড় হতে পারতো? আমিও সেইরকম। মরে গেছি। তা নইলে বড় হতে পারতাম!
লুসী বললেন–কেন একথা বলছেন? আমার তো মনে হয় এখনো সময় আছে আপনার, ইচ্ছে করলে আপনি এখনো একটা যোগ্য নোক হয়ে উঠতে পারেন।
–আপনার যোগ্য? একবার কথাটা বলুন মুখ দিয়ে, মিস্ ম্যানেট! বিশ্বাস করবার মত কথা না হলেও সে কথাটা আমি সারাজীবন মনে রাখবো…সারা জীবন!
লুসীর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল, তিনি কাঁপতে লাগলেন।
সিডনী বলে চললো–এই দেখুন আমাকে। নিজেকে নিজে নষ্ট করেছি, শরীরটাকে করেছি ধ্বংস!…মাতাল। প্রতিভার অপচয় করে-করে অন্তর আজ শূন্য! এই অপদার্থ জীবের ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়া যদি আপনার পক্ষে সম্ভবও হত, তাহলেও আমি খুশি হতাম না তাতে। আমি জানি আমার দ্বারা একটা জিনিসই ঘটতে পারত সে ক্ষেত্রে, আপনাকে কলঙ্কে ডুবিয়ে, অনুতাপে মনস্তাপে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিজের সাথে-সাথে নরকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া আপনাকে! তাছাড়া অন্য কিছু করবার শক্তি ছিল না আমার! কিন্তু সে সব কথা অবান্তর! আমি জানি আমার জন্য কোন করুণা আপনার অন্তরে থাকতে পারে না। পারে না যে–এতে আমি খুশি, মিস্ ম্যানেট!
–সে করুণা না-ই যদি থাকে, তবুও কি আপনার কোন উপকারে আসতে পারি না আমি? মহত্ত্বের পথে কি আবার তুলে দাঁড় করিয়ে দিতে পারি না আমি আপনাকে? আপনি যে বিশ্বাস করে আপনার হৃদয়ের গোপন ব্যথার কথা আমায় জানিয়েছেন, তার প্রতিদানে আপনার কি কোন উপকারই করতে পারি না আমি?
লুসীর চোখ জলে ভরে এল। তিনি সকাতরে বললেন–আপনার কোন উপকারে কি আসতে পারি না আমি?
সিডনী মাথা নেড়ে বললো–না। কিছু না! তবে আর দু’একটা কথা বলবার আছে। তা যদি শোনেন ধৈর্য ধরে, তাহলেই যথেষ্ট উপকার করা হবে। আমি আপনাকে জানাতে চাই যে, আমার জীবনে এই অল্প কিছুদিন আগে থেকে একটিমাত্র সুখস্বপ্নের উদয় হয়েছিল, সে-স্বপ্ন-আপনি। এই গৃহের সুখ-নীড়ের মাঝখানে আপনাকে দেখবার পর থেকেই প্রত্যহ অন্তত একবার আমার মনে হয়েছে আমার শৈশবের গৃহের কথা–যার কথা তার আগে এতদিন আমার একবারও কখনো মনে হত না। সেখানে এমনি নির্মল আবহাওয়া চিরদিন বিরাজ করত, আমার দেবীর মত মায়ের আশেপাশে। আপনার সঙ্গে পরিচিত হবার পর থেকেই মাঝে মাঝে মনস্তাপ দেখা দিয়েছে আমার নিঃসাড় প্রাণে-হায়, এ আমি কোথায় নামিয়ে এনেছি আমাকে! আপনার কাছে আসবার পর থেকেই মাঝে-মাঝে শুনতে পেয়েছি কাদের যেন বিস্মৃত কিন্তু পরিচিত কণ্ঠস্বর–ওঠো, এই পাঁকের ভিতর পড়ে থেকো
আর, উঠে চলো আলোর রাজ্যে!–মনে জেগেছে আধ-গড়া সংকল্প-হা, আমি উঠবো, আবার উঠবো, এই আলস্য আর লালসার দাসত্ব ঝেড়ে ফেলে আবার। নতুন করে শুরু করব সেই জীবন-সংগ্রাম–যা থেকে ভীরুর মত পালিয়ে এসে সকলের পেছনে মুখ লুকিয়েছি আমি! কিন্তু সে সংকল্প আধ-গড়াই রয়ে গেছে চিরদিন, পুরোপুরি গড়ে উঠতে আর পারেনি, কুমারী ম্যানেট! শেষ পর্যন্ত সে একটা স্বপ্ন মাত্রই রয়ে গেল…সুখস্বপ্ন! স্বপ্নই বটে, কুমারী ম্যানেট…কিন্তু আমার জীবনে স্বপ্নও আজকাল কদাচিৎ আসে। তাই এর মূল্য আছে আমার কাছে, আর তাই আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ–আমার জীবনে এ স্বপ্নের উদয় আপনার জন্যই সম্ভব হয়েছিল বলে।
লুসী ব্যথিত-কণ্ঠে বলে উঠলেন–স্বপ্ন কি নিছক স্বপ্নই রয়ে যাবে, মিস্টার কার্টন? ওর এক তিলও কি সত্য হয়ে বজায় থাকবে না আপনার জীবনে?
–না, সে আশা নেই। এ হৃদয় ছাইয়ের গাদা, এক কণা আগুনও যদি থাকতো। এতে, তারই আলোতে পথ দেখতে পেতাম হয়তো উপরে উঠবার। কিন্তু এ ছাইয়ের গাদা অন্তত এক লহমার জন্যেও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠেছিল আপনাকে দেখে, এ আমি ভুলতে পারবো না। ভুলতে পারবো না, কিন্তু উঠতেও পারবো না আমি। আগুন জ্বলে উঠে আবার তখনই নিবে গেছে, সে স্বর্গীয় আগুনকে জ্বালিয়ে রাখবে, এমন কাঠখড় তো আমার এ ছাইয়ের গাদায় ছিল না! প্রেরণা আপনি দিয়েছিলেন, কিন্তু আমার অন্তরে সৎ বৃত্তি কোথায় যে সে-প্রেরণাতে কাজ হবে?
–আপনার দুঃখকে আরও বাড়িয়ে দিলাম তাহলে আমি! দুর্ভাগ্য আমার! সকাতরে বললেন লুসী।
–না, না, এমন কথা বলবেন না। কেউ যদি আমায় উদ্ধার করতে পারতো তাহলে সে আপনি। কিন্তু উদ্ধার হবার মত শক্তিই নেই আমার, সে আমি হারিয়ে ফেলেছি! দীর্ঘদিনের অনাচারের নিচে সে কোথায় চাপা পড়ে হারিয়ে গেছে। তাকে আজ আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়!
–আপনার কোন উপকারেই কি তাহলে আসতে পারি না আমি?
–আপনি ধৈর্য ধারণ করে, সমবেদনার সঙ্গে এই অপদার্থ জীবের দুঃখের কথা শুনেছেন, এইতেই অপরিসীম উপকার করা হল আমার। বিশ্বাস করুন মিস্ ম্যানেট, এই যে একান্ত নিরিবিলি আপনার কাছে আমার মনের গোপন ব্যথা জানাতে পেরেছি, এ সৌভাগ্যের কথা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি মনে রাখব, চিরদিন এর স্মৃতি আমায় গভীর আনন্দ দেবে।…হ্যাঁ, এ আলাপন আপনি গোপনই রাখবেন তো? আপনার কাছে ঐ আমার একটিমাত্র ভিক্ষা!
-~-অবশ্য।
–আপনার অতি প্রিয় ব্যক্তির…প্রিয়তমের কাছেও কোনদিন প্রকাশ করবেন না তো এ-কথা?
লুসী একটু ইতস্তত করে তারপর বললেন–আপনার গোপন কথা প্রকাশ করবার অধিকার আমার কি আছে? আপনি চিন্তা করবেন না। এ-কথা কেউ জানবে না।
–ধন্যবাদ! ভগবানের আশিস বর্ষিত হোক আপনার উপর।
বিদায় নিয়ে দ্বার পর্যন্ত গিয়ে আবারও ফিরে দাঁড়ালো সিডনী।–আপনার ভয় নেই মিস্ ম্যানেট, এ-প্রসঙ্গের আলোচনা আর কখনো শুনতে পাবেন না আমার মুখে। আজও যে একথা শুনতে পেলেন, সে শুধু আমি একটা প্রলোভন দমন করতে পারিনি বলে। কী প্রলোভন, বলব? আমি সারা জীবন মনে মনে অনুভব করতে চাই যে, আমার গোপন-কথা আমারই অন্তরে শুধু নিবদ্ধ নেই, আমার গোপন-ব্যথা গোপনে বহন করবার জন্য আর-এক অংশীদার আছে আমার। আমার নাম, আমার অকীর্তি, আমার বিফল ভালোবাসার কাহিনী যে আপনার কোমল হৃদয়ের এক কোণে চিরদিনের জন্য একটুখানিও স্থান লাভ করল, এ আমার পরম সৌভাগ্য কুমারী ম্যানেট, এ আমার আশাতীত আনন্দ!
কার্টনের যে মূর্তি এতদিন চোখে পড়েছে লুসীর, তার চেয়ে এতটাই আলাদা, এতখানি উঁচু তার আজকের এই মূর্তি, যে, তাকে বিদায় দেবার কালে একটা সান্ত্বনার কথাও বলবার পথ না পেয়ে লুসী ব্যথিত-হৃদয়ে অশ্রুবর্ষণ করতে লাগলেন। সিডনী দেখলো সে অশ্রু, দেখে বললো-কাঁদবেন না কুমারী ম্যানেট! কার জন্য কাঁদছেন? একটা অপদার্থ! একটা পশু! এখান থেকে বেরিয়ে গিয়েই যে আবার তার অভ্যস্ত পাঁকের রাজ্যে নেমে যাবে! কার জন্য দুঃখ করছেন আপনি?–তবে হ্যাঁ, যতই নেমে যাই-না কেন, যে-নরকেই বাস করি না আমি, আপনার সেবার সুযোগ যদি কখনো পাই, প্রাণ দিয়েও আমি তা করব–এ-কথা বিশ্বাস করুন কুমারী ম্যানেট! প্রাণ দিয়েও তা করব আমি! আপনি সুখী হোন। আর, সর্বসুখের মাঝে যেন আপনার স্মরণ থাকে যে, আপনার সুখের পথের কাটা দূর করবার জন্য প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করতে প্রস্তুত একটা জীব ধরায় আছে, নাম তার–সিডনী কার্টন।
০৬. ঝড় বুঝি উঠছে
পাঁচ বৎসর পরে।
লন্ডনে সোহো-পল্লীর এক গৃহে এক সুখী পরিবার। ডার্নে লুসীকে বিয়ে করেছেন। লুসী ম্যানেট আজ লুসী ডার্নে। তাদের একটি ছোট্ট মেয়েও হয়েছে, মায়ের নামে তাকে ডাকা হয় ছোট্ট লুসী বলে।–এই কয়টি মাত্র প্রাণী নিয়ে সেই ছোট্ট পরিবার। তবে হ্যাঁ, পরিবারভুক্ত না হয়েও এঁদের একটি অতি আপনজন বিশিষ্ট বন্ধু আছেন তিনি হলেন মিস্টার লরী, টেলসন ব্যাঙ্কের কর্মাধ্যক্ষ।
আর এই পরিবারে মাঝে মাঝে দুই-এক ঘণ্টার জন্য একজন সুপরিচিত অতিথির দেখা মেলে, সে হচ্ছে সিডনী কার্টন, যার সঙ্গে ছিল ডার্নের আশ্চর্য চেহারার মিল। বৎসরে তিন-চারবারের বেশি সে আসে না। এসেও ছোট্ট লুসী ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে বেশি কথা সে বলে না। দু’এক ঘণ্টা! তারপরেই সে চলে যায় আবার। দিন দিন ধাপের পর ধাপ নেমে যাচ্ছে সে, তা তার চেহারা দেখেই বোঝা যায়। মুখে ভদ্রতার অভাব না দেখিয়েও অন্তরে সবাই তাকে তাচ্ছিল্য করে, শুধু এক লুসী ছাড়া। লুসীর হৃদয় বেদনায় করুণ হয়ে ওঠে, সিডনীর বিবর্ণ মলিন মুখের দিকে চাইলেই।
ওদিকে প্যারী নগরে ডিফার্জের মদের দোকান আগের চাইতেও সরগরম। মাদাম ডিফার্জের সেলাইয়ের বিরাম নেই। একা মাদাম ডিফার্জ নয় আবার! আজকাল ঐ দোকানের এক অংশে বহু নারী এসে সেলাই নিয়ে বসে। সংকেতে কথা হয়। গুপ্তচরের ভয়ে সবাই সচকিত হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। ডিফার্জ সদা সতর্ক!
একদিন গভীর রাত্রে।
দোকান বন্ধ করে ডিফার্জ-দম্পতি চুপি চুপি কথা কইছে। স্বামী বলছে–আর কতদিন বলো দেখি? কতদিন আর অপেক্ষা করতে হবে এমনি ধারা?
স্ত্রী উত্তর দিচ্ছে–হয়তো বহুদিন! জমি তৈরি করার সময়টা দীর্ঘই হয়ে থাকে! ভূমিকম্পের কথা ভাবো! এক মিনিটে গোটা দেশটা ধ্বংস করে দেয় সে। কিন্তু ভূমিকম্পের উপযোগী অবস্থা তৈরি হয় মানুষের চোখের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে। বজ্রপাতের কথা ভাবো! বাজ মাথায় পড়লে এক সেকেন্ডে মানুষ মরে। কিন্তু বজ্রপাতের উপযোগী অবস্থার আবহাওয়া তৈরি হয় দীর্ঘদিন ধরে। আমরাও প্রস্তুত হচ্ছি। একদিন বাজের মত পড়বো গিয়ে অত্যাচারীর মাথায়, ভূমিকম্পের মত এসে গুঁড়িয়ে দেবো অত্যাচারী বড়লোকদের সমস্ত শক্তি!
স্বামী বললে–একদিন? আমরা বেঁচে থাকতে-থাকতে আসবে কি সে-একদিন?
–নাই-বা এলো? প্রস্তুতি চলছে তো! দেশের প্রতি নগরে, প্রতি গ্রামে জ্যাকস্ ভাইদের সংঘ গড়ে উঠেছে। পুলিশে জ্যাক্স্, সেনাদলে জ্যাক্স্, দোকানে জ্যাক্স্, হোটেলে জ্যাকস্। একদিন এক শুভ মুহূর্তে এরা মাথা নাড়া দিয়ে জেগে উঠবে সবাই, অত্যাচারী রাজার সিংহাসন টলমল করে কেঁপে মাটিতে পড়ে চুরমার হয়ে যাবে অমনি। প্রতীক্ষা করো।
প্রতীক্ষা আর বেশি দিন করতে হলো না। বাসুকির সহস্র ফণা দুলে উঠলো একদিন প্রভাতে! ধরণী কেঁপে উঠলো থর-থর…থর…থর…।
রোগা, শুকনো দাঁড়কাক যেন হাজারে-হাজারে উড়ছে ডিফার্জের দোকানের চারিপাশে। কিন্তু এরা দাঁড়কাক নয়, মানুষ। এদের মাথার উপর ইস্পাতের ঝিলিক খেলে যাচ্ছে মাঝে-মাঝে। যে-কোন অস্ত্র হাতের কাছে পেয়েছে, তাই নিয়ে ছুটে এসেছে এরা। সারা সেন্ট আন্টইন-পাড়া এক সুরে গর্জন করছে, হাতিয়ার তুলে হাজারে-হাজারে অনাবৃত বাহু বাতাসে দুলছে শীতের দিনে পাতাঝরা অরণ্যে মলিন কালো বৃক্ষশাখার মত!
হাতে হাতে অস্ত্র, হাজারে হাজারে! কোথা থেকে এলো এত অস্ত্র? কেউ বলতে পারে না–কোথা থেকে এলো। কিন্তু এসেছে তারা…অজানা লোকেরা বিতরণ করেছে সেই অস্ত্র ভিড়ের ভিতর। বন্দুক, কার্তুজ, বারুদ, লোহার ডাণ্ডা, বাঁশের লাঠি, কাঠের মুগুর, ছুরি, কাটারি, কোদাল, কুড়াল–আঘাত করবার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, এমন কোন জিনিসই বাদ পড়েনি। যাদের ভাগে কোন হাতিয়ার পড়লো না, তারা রাস্তা খুঁড়ে পাথর আর ইট তুলতে লাগলো। সেন্ট আন্টইনের প্রত্যেকটা লোকের মাথায় বিকার চেপেছে, বিকারের রোগীর মতই দপ্ করছে তাদের নাড়ী, জ্বলজ্বল করছে তাদের টকটকে লাল চোখ। জীবনটাকে সবাই মনে করছে খেলার বস্তু, আর সে খেলার বস্তুটাকে গুড়ো করে ভেঙে ফেলবার জন্যই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে এই হাজার হাজার লোক–যারা দাঁড়কাকের মত এসে ভিড় করেছে ডিফার্জের দোকানের সমুখে, এই সাংঘাতিক সকালবেলায়।
দাঁড়কাকেরা ঘুরছে ডিফার্জকে কেন্দ্র করে। ধ্বংসের এই মহাযজ্ঞের প্রধান পুরোহিত সে। অস্ত্রবিতরণে ডিফার্জ, আদেশদানে ডিফার্জ, সকল ব্যাপারে ডিফার্জ! কাউকে পিছনে হটিয়ে দিচ্ছে, কাউকে সমুখে টেনে আনছে, কাউকে অস্ত্র দিচ্ছে, কারুর অস্ত্র কেড়ে নিচ্ছে, হুকুম দিচ্ছে, শাসন করছে, উপদেশ দিচ্ছে, মিনতি করছে–সারা গায়ে বারুদ আর ঘাম, চরকির মত ঘুরছে অনবরত।
–তিন নম্বর জ্যা, তুমি আমার কাছে থাক!–এই বলে সে চিৎকার করে উঠলো–এক নম্বর আর দু’নম্বর জ্যাস্ত তামরা এক-একটা দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করো, এগিয়ে গিয়ে! আমার স্ত্রী কোথায়? আমার স্ত্রী?…মাদাম ডিফার্জের উত্তর শুনতে পাওয়া গেল কাছেই! মাদাম ডিফার্জ কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আজ আর তার হাতে সেলাই নেই, তার বদলে আছে একখানা কুঠার। কোমরবন্ধে একখানা বাঁকা ছোরা, আর একটা গুলিভরা পিস্তল। ডিফার্জ জিজ্ঞাসা করলো–তুমি কোন্ দিকে যেতে চাও?
উপস্থিত তোমাদের সঙ্গেই যাচ্ছি। কিন্তু আমি নেবো মেয়েদের দলের নেতৃত্ব। শয়তানদের হত্যা করার কাজে মেয়েরা কি অক্ষম?
বজ্রনাদ ____ করে উঠলো ডিফার্জ–দেশপ্রেমিক বান্ধবেরা! আমরা প্রস্তুত। চলো– ___ চলল!
এক গর্জন উঠলো বহু সহস্র কণ্ঠ থেকে। সেই বিরাট জনতা ছুটলো এবার, যেন কূল ছাপিয়ে সমুদ্র ছুটলো তরঙ্গে-তরঙ্গে। সমগ্র নগরী প্লাবিত, মগ্ন হয়ে গেল সেই তরঙ্গের নিচে। গির্জায়-গির্জায় বাজছে আতঙ্কের ঘণ্টা, জয়ঢাক বাজছে তোরণে-তোরণে, উদ্বেল সমুদ্র ধেয়ে গিয়ে ভেঙে পড়লো ব্যাস্টিল-কারাদুর্গের পাঁচিলের ওপর।
গভীর পরিখা ব্যাস্টিলের চারিপাশে। একটার পর একটা টানা-সেতু-নীরেট পাথরের প্রশস্ত দেওয়াল, তার মাথায় আটটা গুম্বজ,-গুম্বজে-গুঁজে কামান, বন্দুক, আগুন, বিস্ফোরক! মৃত্যুকে তুচ্ছ করে আগুন আর ধোঁয়ার ভিতর এগিয়ে চললে পাগল জনতা, আগুন আর ধোঁয়া অতিক্রম করে এগিয়ে গিয়ে গুম্বজে-গুম্বজে কামান নিলো দখল করে।
মদের দোকানী ডিফার্জ চোখের পলকে গোলন্দাজ হয়ে দাঁড়ালো। ঘণ্টার পর। ঘণ্টা কামান দাগতে লাগলো ব্যাস্টিলের দুর্গপ্রাচীরে। গভীর পরিখা পার হয়ে, টানা-সেতু উত্তীর্ণ হয়ে, নীরেট পাথরের দেয়াল টপকে, গুম্বজে-গুম্বজে কামানের পাশে দাঁড়ালে গিয়ে বিরাট জনসমুদ্র। ডিফার্জ গর্জন করে ওঠে থেকে থেকে– কমরেডরা! বিশ্রাম নেই…শত্রু মাররা! এগিয়ে চলো ব্যাস্টিলের মাঝখানে! জ্যাক। নম্বর এক! জ্যাক্স্ নম্বর দুই! জ্যাক্স্ নম্বর এক হাজার! জ্যাক্স্ নম্বর দু’ হাজার! জ্যাক্স্ নম্বর পঁচিশ হাজার! ভগবানের ভক্ত, ভগবানকে ডেকে নাও! শয়তানের যে সঙ্গী, শয়তানকে সে স্মরণ কর! এগিয়ে চলো বন্ধু! এগিয়ে চলল! শত্রু মারো!
কামান, বন্দুক, আগুন আর ধোঁয়া। সেতুর পর সেতু পেরিয়ে, পরিখার পর পরিখা উত্তীর্ণ হয়ে, গুম্বজের পর গুম্বজে চড়ে নীরেট দেয়ালের মাথায় গিয়ে ওঠে বিরাট জনসমুদ্র। অস্ত্রের মুখে রৌদ্র জ্বলে ঝক্ঝক্! মশালের মুখে আগুন জ্বলে জু-জুল! খড়ের গাদায় সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে আগুন আর ধোঁয়া! আর্তনাদ, অভিশাপ, গোলাবৃষ্টি–বিরাট জনসমুদ্র এগিয়ে চলে ব্যাস্টিলের কেন্দ্রস্থলে। উথলে ওঠে জনসমুদ্রের তরঙ্গ, চিরতরে ডুবে যায় ফরাসীদেশের অত্যাচারী রাজতন্ত্র! নিরুপায় দেখে দুর্গরক্ষীরা সাদা নিশান উড়িয়ে সন্ধির প্রার্থনা জানালো।
ঝড়ের বেগে ধেয়ে যায় জনতা, তার মাথার উপর চকিতে উড়লো একবার সেই শ্বেতপতাকা, অমনি উল্লাসে গর্জন করে প্রাচীরের মাথার দিকে ছুটলো জনতা, যেন আকাশপানে লাফিয়ে উঠলো সমুদ্রের তরঙ্গ। সেই তরঙ্গদোলার মাথায় চড়ে ডিফার্জ আর তার সঙ্গীরা গিয়ে পড়লো ব্যাস্টিলের মাঝখানে। একজন প্রহরীকে সমুখে দেখে তার গলার কলার চেপে ধরলো ডিফার্জ :
–১০৫, নর্থ টাওয়ার, জিনিসটা কি?
ভীত ত্রস্ত প্রহরী বুঝতে পারলো না—১০৫?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওটা কি কোন বন্দীর নাম? ১০৫, নর্থ টাওয়ার?
–ও একটা কারা-গহ্বরের নাম!
–দেখাও সেটা!
ঘুরতে-ঘুরতে কক্ষের পর কক্ষ, সিঁড়ির পর সিঁড়ি, দ্বারের পর দ্বার, সুড়ঙ্গের পর সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে চললো প্রহরীর পিছনে-পিছনে ডিফার্জ আর তিন নম্বর জ্যাক্স্! অবশেষে ছোট একটা গর্ত! কক্ষ বলা ভুল তাকে। যেন পাথরের ভিতর খোদাই করে বার করা হয়েছে একটা গর্ত! একটা মাত্র জানালা, তাতে মোটা-মোটা লোহার গরাদে!
সেই ঘরের দেয়ালে ডিফার্জ দেখে, তখনও রয়েছে একটা নাম লেখা, আঁচড় কেটে-কেটে। ডিফার্জ পড়লো–আলেকজান্ডার ম্যানেট!
সেই গর্তের মেঝে খুঁড়ে, চিমনী ভেঙে, লোহার খাট আর টুল উল্টেপাল্টে তালাসী করলো ডিফার্জ। হ্যাঁ, পেলো বইকি! চিমনীর কোন্ ফাঁকে সে আবিষ্কার করলো একতাড়া কাগজ!
তারপর তারা বেরিয়ে পড়লো, ১০৫ নম্বর নর্থ টাওয়ার থেকে। প্রাঙ্গণে তখন ডিফার্জের সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সবাই। ডিফার্জ এসে আবার নেতৃত্ব গ্রহণ করলো সেই বিরাট জনসমুদ্রের। ১০৫-এর মতই ছোট-ছোট গর্ত থেকে সাতজন বন্দীকে করা হল মুক্ত! আর ব্যাস্টিলের সবচেয়ে মজবুত, সবচেয়ে উঁচু গুম্বজ থেকে ধরে আনা হলো সাতজন উঁচুদরের রাজকর্মচারীকে!
তারপর সেই সাতজন বন্দীকে কাঁধে করে নিয়ে বেরুলো সেই বিরাট জনতা– ব্যাস্টিলের কারাদুর্গ থেকে। কাঁধে তাদের সাতজন মুক্ত রাজবন্দী, আর সেই জনসমুদ্রের মাথার উপর উঁচু-বাঁশে-বসানো সাতটি রক্তঝরা নরমুণ্ড! সেই অত্যাচারী সাতজন রাজকর্মচারীর সদ্য-কেটে-আনা মুণ্ড! যুগের পর যুগ অত্যাচারিত, অপমানিত জনতার সেই পাগল প্রতিহিংসা রক্তের অক্ষরে লেখা হয়ে গেল মানুষের ইতিহাসে। যুগ পালটে গেল।
***
এই যুগ-পালটানো ঘটনার অল্প পরেই একদিন টেলসন ব্যাঙ্কের লন্ডন অফিসে কথা হচ্ছিলো মিস্টার লরীর সঙ্গে চার্লস্ ডার্নের। ব্যাঙ্কের প্যারী-শাখার কাজকর্ম গুটিয়ে ফেলার দরকার হয়েছে। সেখানে আর কারবার চলছে না। কাগজপত্র যথাসম্ভব নিয়ে আসতে হবে লন্ডন অফিসে। সব হয়তো নিয়ে আসা সম্ভব হবে না–কারণ ফরাসী সীমান্তে কড়া পাহারা বসিয়েছে বিদ্রোহীরা। যা নিয়ে আসার উপায় নেই, তা লুকিয়ে রেখে, বা নষ্ট করে দিয়ে আসতে হবে। এ গুরুভার কাজের জন্য মিস্টার লরীকে দু’চার দিনের জন্য যেতেই হবে প্যারীতে একবার। ডার্নেকে ডেকে পাঠিয়েছেন লরী এই সংবাদই দেবার জন্য। ডার্নে ও ম্যানেটকে না জানিয়ে লরী যেতে পারেন না, কারণ, ওঁরাই এখন লরীর একমাত্র আপনার জন পৃথিবীতে।
লরী এ-সময়ে প্যারী যাবেন শুনেই ডার্নের চক্ষুস্থির! প্যারী যাবেন? যে-প্যারীতে এখন মৃত্যুর প্রলয়নাচ চলেছে চব্বিশ ঘণ্টা? যে প্যারী ছেড়ে পালাবার জন্য ব্যগ্র সবাই? ফ্রান্সের রাজা-রানী বন্দী! জমিদার ও ভূতপূর্ব শাসকেরা–যে পেরেছে, সেই পালিয়েছে। যে পারেনি সে গিলোটিনে প্রাণ দিয়েছে। গিলোটিন-বড়লোকদের মাথা কাটবার জন্য বিদ্রোহীরা নতুন কল তৈরি করেছে ঐ গিলোটিন! খ্যাঁচ্, খ্যাঁচ –অস্ত্র পড়ছে অপরাধীর শিরে, একের পর এক! মাথার পর মাথা লুটিয়ে গড়িয়ে পড়ছে নিচেকার ঝুড়ির ভিতর! এই গিলোটিনে দৈনিক দুশো-একশো লোক প্রাণ দিচ্ছে। বিদ্রোহীদের অবিশ্বাস বা সন্দেহভাজন যে, তার আর নিস্তার নেই গিলোটিন থেকে। যে কেউ একটা যেমন তেমন অভিযোগ করলেই হল। সঙ্গে-সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তি বন্দী হবে। সঙ্গে-সঙ্গে তার বিচার হবে এবং সঙ্গে-সঙ্গে গিলোটিন।
কিন্তু ডার্নের সমস্ত প্রতিবাদ, সমস্ত অনুনয় ব্যর্থ হয়ে গেল। লরী এতকাল টেলসন ব্যাঙ্কের নিমক খেয়েছেন, এখন তিনি গিলোটিনের ভয়ে ব্যাঙ্কের কাজে অবহেলা করবেন? বিশেষ করে লরী হলেন ইংরেজ, হঠাৎ কোন ইংরেজকে গিলোটিনে পাঠাতে ফরাসী-বিদ্রোহীরাও সাহস পাবে না।
লরী সেইদিনই রাত্রে রওনা হবেন। মনস্থির করে ফেলেছেন একেবারে।
লরীকে নিরস্ত করতে না পেরে ডার্নের বড়ই চিন্তা আর ভয় হল তার জন্য। কিন্তু উপায় তো নেই। তিনি চলে আসবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, এমন সময়ে ব্যাঙ্কের মালিকদের ভিতরই একজন এসে লরীর হাতে দিলেন একটা চিঠি। চিঠির খামখানা নোংরা হয়ে গেছে, যেন বহু হাত ঘুরে এসেছে সে। লরী চিঠিখানা হাতে নিয়ে বললেন–না, মহাশয়! বহু খোঁজই তো করা হল। এ-নামের কাউকে দেখতে পাই না।
ফরাসীদেশ থেকে কিছুদিন ধরে নিত্যই নতুন-নতুন লোক পালিয়ে আসছে ইংলন্ডে। জমিদার, সামরিক-কর্মচারী, মন্ত্রী, ম্যাজিস্ট্রেট–সবাই পালিয়ে আসছেন প্রাণ হাতে করে। এঁরা সবাই প্রায় একবার করে টেলসন ব্যাঙ্কের লন্ডন অফিসে দেখা দিয়ে যান। অনেকের হিসাব আছে এ-ব্যাঙ্কে। অনেকের ছিল, এখন নেই, কিন্তু পূর্বের খাতিরে ধার পাওয়ার প্রত্যাশা করেন। কেউ আবার আসেন–পরিচিত বন্ধুবান্ধবের সাক্ষাৎ এখানে পাওয়া যাবে এই আশায়। ফরাসীদেশের লোকমাত্রেই জানে–পলাতক-ফরাসীদের আড্ডা লন্ডনে ঐ একটিই আছে—টেলসন ব্যাঙ্কের অফিস। তাই কোন পলাতক-ফরাসীকে পত্র লিখতে হলে ফ্রান্সবাসী ফরাসীরা টেলসনের ঠিকানাতেই পত্র দেয়। লরীর হাতের চিঠিখানাও ঐ জাতীয় একখানা চিঠি! লরী মাথা নাড়লেন–না, রোজই তো খোঁজ করা যাচ্ছে। এ-নামের কাউকে দেখতে পাই না।
চিঠিখানা টেবিলের উপর পড়ে আছে। ডার্নে শিরোনামাটা পড়লেন। তাঁর বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ড ধক্ করে লাফিয়ে উঠলো। মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল। নাম লেখা আছে–মার্কুইস এভরিমন্ডি।
মাকুইস এভরিমন্ডি? সে তো ডার্নে! ফরাসীদেশে তো ডার্নের ঐ নাম! গুপ্তহন্তার হাতে তাঁর পিতৃব্য খুন হওয়ার পরে ডানেই তো এখন মার্কুইস বা জমিদার! সে অভিশপ্ত নামের সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক রাখবেন না বলেই ডার্নে ইংলন্ডে নিজেকে ডানে নামে পরিচিত করেছেন। কিন্তু এখন-কে তাকে চিঠি লিখলো পিছনে-ফেলে-আসা ফরাসীদেশ থেকে?
ডার্নে লরীকে বললেন–এভরিমন্ডি? ভদ্রলোকটি আমার পরিচিত। চিঠিখানি যদি আমায় দেন, আমি দিয়ে দিতে পারবো।
লরী খুশি হয়েই পত্র দিয়ে দিলেন ডার্নেকে।
ডার্নের প্রকৃত নাম ডাক্তার ম্যানেট ভিন্ন কেউ জানে না। ম্যানেটও জেনেছিলেন সবে লুসীর বিবাহের দিন। জেনেই তার প্রবল ইচ্ছা হয়েছিল বিবাহ ভেঙে দেওয়ার। কিন্তু তা তিনি পারেননি, লুসীর মুখ চেয়ে। লুসী যে ভালোবাসে ডার্নেকে! তাই পরম শত্রুর পুত্রকে তিনি জামাতা বলে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে ডার্নেকে সাবধান করে দিয়েছিলেন তিনি যেন নিজের আসল নাম লুসীকে বা লরীকে না বলেন।
ডার্নে পত্র পড়ে দেখলেন–তার ফরাসীদেশের কর্মচারী গ্যাবেল লিখেছে চিঠি। এভরিমন্ডি-জমিদারীর গোমস্তা বলে, সে বন্দী হয়েছে, শীঘ্রই তার মৃত্যুদণ্ড হবে। তাকে বাঁচাতে হলে, এভরিমন্ডি-মার্কুইসের অবিলম্বে ফ্রান্সে যাওয়া প্রয়োজন। তা নইলে প্রভুর অপরাধে ভৃত্য প্রাণ হারাবে!
০৭. প্রলয়-দোলা
মিস্টার লরী ইংরেজ, সুতরাং ফরাসীদেশের প্রলয়-দোলার মাঝখানেও তিনি খানিকটা নিরাপদ। গৃহবিবাদের সময় বিদেশী লোকের উপর অত্যাচার পারতপক্ষে কেউ করে না। আইনে ওটা নিষেধ আছে। লরী প্যারীর অফিসে বসে নিজের কাজ করে যেতে লাগলেন, কেউ তার উপর উৎপাত করতে এলো না। টাকা পয়সা আগে থাকতেই লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল–যতটা সম্ভব! কাগজপত্র কতক মাটির তলায় পুঁতে ফেললেন লরী, কতক বা ফেললেন পুড়িয়ে। সীমান্তে পাহারার যা কড়াকড়ি, তাতে এক টুকরো হিসাবের কাগজও যে ফ্রান্স থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া যাবে, সে-ভরসা তিনি করতে পারলেন না।
ব্যাঙ্কেরই একাংশে বাস করছেন মিস্টার লরী। বাড়ির ভিতরটা নির্জন। বাসিন্দা যারা ছিল, তারা পালিয়েছে। প্যারীর অনেক মহল্লাই এখন এমনি নির্জন। একটা প্রকাণ্ড শান-যন্ত্র বসানো রয়েছে বাড়ির উঠানে। সেখানে অবিরত অন্ত্রে শান দেওয়া চলেছে। শত-শত লোক আসছে আর যাচ্ছে। সকলেরই হাতে কোন-না-কোন অস্ত্র। মানুষ কেটে-কেটে ভোতা হয়ে যাচ্ছে অস্ত্র, আর অমনি ছুটে আসছে তারা শান। দেওয়ার জন্য। তরোয়াল, কোদাল, কুড়াল, ছুরি, ছোরা! যারা আসছে, তাদের হাতে রক্ত, কাপড়ে রক্ত, হাতিয়ারে রক্ত…
রাত্রে লরী ঘরের ভিতর বসে ভগবানের নাম স্মরণ করছেন। উঃ! সবরক্ষা যে, এই মহা-নরকে আমার কোন প্রিয়জন আজ নেই! ভগবানকে ধন্যবাদ! হঠাৎ তার অফিস-ঘরের কড়া নড়ে উঠলো। সাবধানে দ্বার খুললেন লরী। হয়তো কোন দুর্ভাগ্য মক্কেল। রাত্রির অন্ধকারে টাকা নিতে এসেছে। পালাবার কোন উপায় করতে পেরেছে হয়তো। এখন টাকাটা পেলেই ত্যাগ করতে পারে এই অভিশপ্ত পুরী। লরী এমন অনেককেই দিয়েছেন টাকা গভীর রাত্রে। ব্যাঙ্কেরই টাকা অবশ্য। ব্যাঙ্কে টাকা কতদূর কী জমা আছে অভাগা মক্কেলের, তা না দেখেই টাকা দিতে হয়েছে তাকে।
কিন্তু এ কারা? মক্কেল তো নয়! লরীর চোখের সমুখে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। লুসী? ডাক্তার ম্যানেট? লুসীর মেয়ে?–এইমাত্র না তিনি ভগবানকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন যে, তাঁর কোনও প্রিয়জন–হ্যাঁ ঈশ্বর! এমন নিষ্ঠুর পরিহাস কি করতে আছে কারো সঙ্গে?
ওরা ছুটে ঘরে ঢুকলো এসে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো নিজেদের কাহিনী! লরী যেদিন চলে এলেন, তার পরদিন ডার্নেও কী একটা চিঠি পেয়েছিলেন নাকি ডার্নে; ফ্রান্স থেকে! কার নাকি জীবন রক্ষার জন্য একান্ত প্রয়োজন ছিল ডার্নের ফ্রান্সে আসবার। কাউকে কিছু বলেননি ডার্নে। লুসীর নামে একখানা পত্র লিখে রেখে, “বেড়াতে যাচ্চি একটু”–বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। চিঠি পেয়েই ডাক্তার ম্যানেট ছুটে এসেছেন। তিনি জানেন ডানের প্রকৃত পরিচয়। বিদ্রোহী ফরাসী, রক্ত-পাগল ফরাসী-জনসাধারণের হাতে পড়লে চিরদিনের অত্যাচারী এভরিমন্ডি জমিদারের যে নিশ্চয়ই প্রাণ যাবে, তা বুঝতে পেরে সঙ্গে-সঙ্গেই তাকে বাঁচাবার জন্য ছুটে এসেছেন ডাক্তার ম্যানেট! ডাক্তার ম্যানেট লুসীকে আনতে চাননি কোনমতেই, কিন্তু সে কি পড়ে থাকতে চায়? স্বামী যেখানে শত্রুর হাতে মরতে বসেছে, পতিব্রতা পত্নী কি সেখানে দূরে বসে থাকতে পারে, নিজের জীবনটাকে নিরাপদ রাখবার জন্য?
সব শুনে লরী কপালে করাঘাত করে হতাশভাবে বললেন–কিন্তু তুমি যে ছুটে এলে ম্যানেট, কী করতে পারবে তুমি? ডার্নেকে বাঁচাবার কতটুকু শক্তি আছে তোমার?
–তা আছে। একটু গর্বের সঙ্গেই ম্যানেট বললেন–তা কিছু আছে! কারণ, আমি আঠারো বৎসর বন্দী ছিলাম ব্যাস্টিলে। আমার নাম সবাই জানে–আজকের এই বিদ্রোহীরা। আমার খাতির এরা করবে। ইতিমধ্যেই খাতির পেয়েছি। ডার্নের খবর আমি সীমান্তের অফিসে বসেই সংগ্রহ করতে পেরেছি। অন্য কেউ সে খবরটাই যোগাড় করতে পারত না।
লরী বললেন–কী খবর? কী খবর পেয়েছে?
–ডার্নেকে বন্দী করে রাখা হয়েছে লা-ফোর্সের কারাগারে।
লরী শিউরে উঠলেন–লা-ফোর্সের কারাগারে? সেখান থেকে তো জীবন্ত বেরিয়ে আসতে কাউকে দেখলাম না এ-কয় দিনে। তোমার যদি কিছু করতে হয় তো–এক্ষুণি, ডাক্তার! হয়তো এখনও সময় থাকতেও পারে! যদি কিছু উপায় তুমি করতে পারো, তবে তা এক্ষুণি করো ডাক্তার! কাল হয়তো দেখবে যে, সব ফুরিয়ে গেছে। বিদ্রোহীরা বেশি সময় নেয় না। কেউ একজন অভিযোগ করলেই হল যে, এ-লোকের দ্বারা জনসাধারণের উপর অত্যাচার হয়েছে। জজ আর জুরী বসেই আছে মৃত্যুদণ্ড দেবার জন্য। গিলোটিন পাতাই আছে! যাও, যাও ডাক্তার! লুসী এখানেই থাকুক, তুমি দেখ কি করতে পারো!
বাইরের উঠানে কয়েক শত লোক অস্ত্রে শান দিচ্ছিলো তখনো, রক্তরাঙা অস্ত্র… রক্তরাঙা মানুষ! সেই কয়েক শত লোকের ভিড়ের ভিতর ঢুকে পড়লেন শুক্লকেশ ম্যানেট! অফিস-ঘরের দরজা একটুখানি খুলে লরী দেখতে লাগলেন– ম্যানেট কি-যেন-কি কথা কইছেন সেই ভিড়ে দাঁড়িয়ে! সহসা সেই ভিড় চিৎকার করে উঠলোব্যাস্টিলের বন্দী ম্যানেট, দীর্ঘজীবী হোন! ব্যাস্টিল-বন্দীর আত্মীয় এভরিমন্ডিকে চাই আমরা। মুক্ত করো ব্যাস্টিল-বন্দীর আত্মীয়কে। চলো সবাই লা ফোর্সে! চলো সবাই লা-ফোর্সে!
সেই কয়েক শত লোক ডাক্তার ম্যানেটকে কাঁধে করে নিয়ে ছুটে চললো লা ফোর্সে। লুসী আশায় উৎফুল্ল হয়ে ভূতলে জানু পেতে বসে ধন্যবাদ দিতে লাগলেন ভগবানকে। লরীরও আশা না হল তা নয়, কিন্তু তিনি জানেন–বন্দীকে খালাস করে আনা কত কঠিন আজকের দিনে! বেশি আশা করতে সাহস হল না তার।
চার দিন পরে ফিরে এলেন ম্যানেট। লরীর সঙ্গে গোপনে আলাপ হল তাঁর। জনতা তাকে কাঁধে করে নিয়ে গিয়েছিল লা-ফোর্সে। সারা দীর্ঘপথ রক্তে পিছল..মড়ার গাদা চারিদিকে। জনসাধারণ হত্যা করেছে জনসাধারণের শত্রুদের। কারার ভিতরেও চলেছে হত্যাকাণ্ড। বিচারসভা বসেছে কারার ভিতর। বিচারকেরা গায়ের জোরেই বিচারক হয়ে বসেছে। তাদের সম্মুখে বন্দীরা আনীত হচ্ছে একটি একটি করে। বেশির ভাগ বন্দীকে সঙ্গে-সঙ্গেই সঁপে দেওয়া হচ্ছে জনতার হাতে, তারা সঙ্গে-সঙ্গেই টুকরো করে কেটে ফেলছে তাদের। দু’চার জন মুক্তি পাচ্ছে। দু’একজনকে আবার ফেরত পাঠানো হচ্ছে কারাগারে। ম্যানেট এই বিচারসভার সমুখে গিয়ে পরিচয় দিলেন নিজের। তাঁকে জানে সবাই। জুরীর ভিতর বসেছিল তার সেকালের এক ভৃত্য, নাম তার ডিফার্জ।
তিনি শুনতে পেলেন–ডার্নে তখনও জীবিত। সেই স্বয়ং-নিযুক্ত আদালতের সমুখে তিনি জামাতার স্বপক্ষে অনেক কিছুই বললেন–প্রাণের সমস্ত দরদ ঢেলে! ম্যানেটের আঠারো-বৎসর ব্যাস্টিল-বাসের কাহিনী যে শুনেছে, সেই বলেছে– ডার্নের মুক্তি পাওয়া উচিত। ডাক্তার আশা করছেন প্রতি মুহূর্তে যে, এইবার সে মুক্তির আদেশ দেওয়া হবে, এমন সময়ে কেমন করে যেন হাওয়া বদলে গেল একেবারে। জুরীদের ভিতর কানাঘুষা চললো কিছুক্ষণ, তারপর আদেশ হলো– মুক্তি এখন হতে পারে না এভরিমন্ডির, তবে তাকে কারাগারে নিরাপদে রক্ষা করা হবে, জনতার হাতে তুলে দেওয়া হবে না তাকে। ডার্নেকে সঙ্গে সঙ্গে আবার কারাগারের ভিতরে চালান করে দেওয়া হলো। ডাক্তার তখন সকাতরে প্রার্থনা করলেন–তাকে সেইখানে থাকতে দেওয়া হোক, যতক্ষণ-না উন্মত্ত জনতা কারাগার ছেড়ে চলে যায়। তারা গেল চার দিন পরে। এই চার দিন ডাক্তারকে লা-ফোর্সে থেকে পাহারা দিতে হয়েছে–যাতে কারাগারের ভিতর থেকে ডার্নেকে টেনে বের করে হত্যা না করে রক্তপাগল জনতা।
এই চার দিনের ভিতর লরী একটা বাসা ঠিক করেছেন লুসীদের জন্য। লুসী ও ম্যানেট সেইখানেই বাস করতে লাগলেন। ডানে কবে মুক্তি পাবেন, স্থির নেই। মুক্তি পেলে ফ্রান্স ত্যাগ করে যাওয়া এখন কখনোই সম্ভব হবে না ডার্নের পক্ষে। কাজেই দীর্ঘদিন সকলের প্যারীতে থাকতে হবে হয়তো।
দেখতে দেখতে ডাক্তার ম্যানেটের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো চিকিৎসক হিসাবে। বিদ্রোহী নেতারা তাঁকে লা-ফোর্সে ও অন্য তিনটে কারাগারের পরিদর্শক নিযুক্ত করল। শুধু চিকিৎসক বলে নয়, আগের দিনের ব্যাস্টিল-বন্দী বলে তিনি এই কাজ পেলেন। তার ফলে ডার্নের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতে লাগলো তার মাঝে-মাঝে। লুসীকে পত্র দেবার সুযোগও পেলেন ডার্নে, ম্যানেটের হাত দিয়ে। দীর্ঘ এক বৎসর কেটে গেল এইভাবে। না হল ডার্নের মুক্তি, না হল তার বিচার। ম্যানেট এখন আর লুসী বা লরীর সাহায্যের উপর নির্ভরশীল নন, বরং তার উপর নির্ভর করেই এঁরা সবাই বাস করছেন প্যারীতে। আজ ম্যানেটের যেমন সম্মান, তেমনি তার কাজের শক্তি, আর তেমনি তার মনের জোর। এক বৎসর কেটে গেল। ডার্নের মুক্তির জন্য ম্যানেটের চেষ্টার বিরাম নেই। কিন্তু মুক্তির কথা তো পরে, বিচারের ব্যবস্থা পর্যন্ত হল না অভাগা বন্দীর। ও-রকম তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় কই নতুন শাসকদের? নতুন যুগের ঢেউ এসেছে দেশে। রাজার বিচার করা হয়েছে, রাজার উপর মৃত্যুদণ্ড প্রচার হয়েছে, রাজশির ছিন্ন হয়েছে ঘাতকের আঘাতে। সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফরাসীদেশে, সে-তন্ত্রের মূল নীতি হলো, “সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, আর তার অভাবে মৃত্যু।” সারা পৃথিবী ভয় পেয়ে কোমর বেঁধে দাঁড়িয়েছে এই নতুন সাধারণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। কিন্তু এই সাধারণতন্ত্র, কারও ভয়ে ভীত নয়, কারও কুটি দেখে নিরস্ত হবার পাত্র নয়। “হয় জয়, নয় মৃত্যু”–তার পণ! নোতরদামের গির্জার আকাশচুম্বী চুড়ায় দিবানিশি উঠছে কৃষ্ণপতাকা! পৃথিবীতে যে যেখানে অত্যাচারী আছে, তাদের সমূলে বিনাশ করবার জন্য তিন লক্ষ ক্ষুধার্ত, চিরদিন পদদলিত লোক লাফিয়ে উঠেছে ফরাসীদেশের প্রতি গ্রাম ও নগর থেকে। যেন দৈত্যের পাল গর্জন করে বেরিয়ে পড়েছে পাহাড় ও সমতল, পাথর ও বালুকা, লোকালয় ও অরণ্য থেকে। দক্ষিণের রৌদ্র-ঝলমল আকাশের নিচে, আর মেঘ-ঢাকা উত্তর-ফ্রান্সের আকাশের নিচে দ্রাক্ষা ও জলপাইয়ের আবাদে, আর শস্যহীন ক্ষেত্রের নাড়াবনে, নদীতীরে আর সাগর উপকূলে–সর্বত্র জেগেছে পালে-পালে দৈত্য-রক্ত-পিপাসায় লকলক জিহ্বা মেলে দিকে দিকে ছুটেছে তারা। সারা দেশে ছুটেছে ধ্বংসের বন্যা। তুচ্ছ ডার্নের কথা ভেসে গেল সে-প্লাবনের মুখে!
ও কী ও? রাজার ছিন্ন মুণ্ড! ও কী আবার? রানীর ছিন্ন শির! তরুণী রানীর শিরে সাদা চুল এলো কোথা থেকে? সেই সুন্দরী লাবণ্যময়ী যৌবনবতী নারীর শিরে? হাঃ হাঃ, কেশ শুরু হতে কি বেশি সময় লাগে? রাজার মৃত্যুর পরে নয় মাস বেঁচে ছিলেন রানী। সেই নয় মাসের প্রতি মুহূর্তে তাকে সইতে হয়েছে দারুণ অপমান, চরম অপমানের আশঙ্কা–যুবতীর কালো চুল সেই আশঙ্কাতেই অকালে সাদা হয়ে গিয়েছে।
এ টেস্ ট্যু সিটীজ সব ভেঙে চুরে যাচ্ছে! ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে সব! সব কিছু ধেয়ে চলেছে। ধ্বংসের মুখে। গোটা দেশটার উপর ঘন হয়ে নেমে এসেছে মরণের কালো ছায়া! সে ছায়া গিলোটিনের। আগে লোকে শপথ করবার জন্য ক্রশের চিহ্ন করতে, এখন করে, গিলোটিনের। গিলোটিনের ছবি সকল ঘরে, গিলোটিনের ক্ষুদে ছবি সকলের জামার বুকে! এক-একটা মুণ্ড কেটে ফ্যালে এক-এক মিনিটে…অত দ্রুত হাত চালাতে কোন জল্লাদ কোনদিন পারেনি।
নদীতে ডুবিয়ে মারা, লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারা–এ-সবও কি নেই? তাও আছে…সর্বত্র মৃত্যু! মৃত্যুর তাণ্ডব চলেছে এক বছরের উপর। ডার্নে পড়ে আছেন কারাগারে, লুসী পড়ে আছেন শিশুকন্যা নিয়ে লরীর তত্ত্বাবধানে, আর ম্যানেট ঘুরছেন বন্দীদের তদারক করে।
অবশেষে ডাক্তার একদিন সংবাদ নিয়ে এলেন–দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান, কাল হবে ডানের বিচার।
***
মুক্তি! মুক্তি! দীর্ঘ প্রত্যাশার পরে, দীর্ঘদিন সংশয়-দোলায় দোলবার পরে, ডার্নে পেয়েছেন মুক্তি! ডাক্তার ম্যানেটের করুণ ইতিহাস, অষ্টাদশবর্ষ ব্যাস্টিল-বাসের শোকাবহ কাহিনী, এ সব শুনে জনসাধারণের মনে জেগেছে গভীর সহানুভূতি। তাই জজ আর জুরীর মুখ থেকে প্রচারিত হয়েছে জনসাধারণের ইচ্ছা…ডার্নে মুক্ত।
সেদিন কী আনন্দ ডাক্তার ম্যানেটের গৃহে! মৃত্যুর গ্রাস থেকে ফিরে এসেছেন প্রিয়তম; লুসী চোখে জল, অধরে হাসি নিয়ে, নতজানু হয়ে বসেছেন ভগবানকে ধন্যবাদ জানাতে। বহুদিন অদর্শনের পর পিতার দর্শন পেয়ে শিশু লুসী মুখরা হয়ে উঠেছে কলকাকলি তুলে। ম্যানেটের মুখে স্নিগ্ধ হাসি, আত্মপ্রসাদে তার চিত্ত উঠেছে ভরে। লরীর আনন্দের সীমা নেই, লুসীর স্বামীকে নিরাপদ দেখে। নিঃসন্তান বৃদ্ধ লরীর জীবনে এখন যা কিছু আনন্দ, তা যে ঐ লুসীকে নিয়েই।
এদিকে এই আনন্দের বান ডেকেছে, অন্যত্র কিন্তু ডার্নের প্রসঙ্গ নিয়ে ক্রোধ আর উত্তেজনার সীমা নেই। ডিফার্জের ঘরে সেই উত্তেজনার প্রবল ঢেউ! ডিফার্জের চাইতেও মাদাম ডিফার্জের বেশি ক্রোধ এভরিমন্ডি-বংশের উপর। বিপ্লব আজ নারীর অন্তরের সমস্ত স্নেহ-মায়া-ক্ষমাকে নিঃশেষে মুছে ফেলে দিয়েছে। তাছাড়া, আরো গভীর কারণ আছে। মাদামের প্রতিজ্ঞা–এভরিমন্ডি-বংশকে ঝাড়েমূলে নির্মূল করতে হবে। এভরিমন্ডি-বংশের ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ-প্রত্যেকেরই নাম মাদাম ডিফার্জের সেলাইয়ের ভিতর বুনোট করা রয়েছে। সে দুর্বোধ্য ভাষায় রেজিস্ট্রী হয়ে গেছে যার নাম, তার আর নিস্তার নেই…কিছুতেই নেই!
ঐ এভরিমন্ডি-পরিবারের এক ভূতপূর্ব মার্কুইস–গ্যাসপার্ড যাঁর বুকে ছুরি বিঁধিয়ে দিয়ে নিজে চল্লিশ ফুট উঁচু ফাঁসিকাঠে ঝুলেছিল–সেই ভূতপূর্ব মাকুইসের প্রথম যৌবনের এক বীভৎস কুকীতির কথা বলতে হল এবার। দরিদ্র প্রজাদের ঘরে সুন্দরী রমণী দেখলে তার কামনা আগুনের মত লক লক করে উঠত। ছলে বলে-কৌশলে সে-নারীর সর্বনাশ করতেন তিনি। এক বালিকা এইভাবে চরম লাঞ্ছনায় লাঞ্ছিতা হলো তার হাতে। মনোবেদনায় দারুণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা পড়লো সে, ঐ মাকুইসেরই গৃহে। বালিকার পিতা ক্ষীণ প্রতিবাদ করেছিল একটু। সেই ধৃষ্টতার শাস্তিস্বরূপে তাকেও মরতে হল ছুরিকাঘাতে। বালিকার ভ্রাতা দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেছিল মার্কুইসকে। শিক্ষিত তলোয়ারবাজ মাকুইসের সঙ্গে সে এঁটে উঠতে পারবে কেন? অস্ত্রবিদ্যায় অশিক্ষিত কৃষক-বালক–সে-ও মরলো তরবারির আঘাতে।
দরিদ্র সেই কৃষক-পরিবারের একমাত্র অবশিষ্ট প্রাণী, একটি শিশুকন্যা, ধর্ষিতা যুবতীর কনিষ্ঠা ভগ্নী–তাকে আত্মীয়েরা পাঠিয়ে দিলো দূরে, সমুদ্রতীরে এক ধীবর পল্লীতে। সেইখানে সে মানুষ হল, আপন মনে প্রতিদিন এই মন্ত্র জপ করতে করতে মানুষ হল যে প্রতিহিংসা নিতে হবে–প্রতিহিংসা নিতে হবে–প্রতিহিংসা! সেই মেয়েই আজ এই মাদাম ডিফার্জ।
এমন যে মাদাম ডিফার্জ সে কখনো এভরিমন্ডি-বংশের বর্তমান মার্কুইস ডার্নেকে মুক্ত দেখে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে? যেভাবে হোক, মাদাম ডিফার্জ প্রতিহিংসার ব্রত উদ্যাপন করবেই, ধর্ষণকারী মাকুইসের বংশ নির্মূল করে। আর, ডার্নে কিন্তু সেই ধর্ষকের দূর আত্মীয়ও নয়, আপন ভ্রাতুস্পুত্র! ওর মৃত্যু চাই-ই!
মাদাম ডিফার্জ জ্যা-সঙেঘর নেতৃস্থানীয় কতিপয় ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলো গোপনে। স্বামীকেও সে এ-পরামর্শের ভিতর ডাকেনি, কারণ, ডিফার্জ একদা ডাক্তার ম্যানেটের অনুরক্ত ভৃত্য ছিল, সদাশয় প্রভুর কাছে সেদিনে যে স্নেহ সে লাভ করেছিল, তার কথা সে এখনো ভোলেনি। ডাক্তার ম্যানেটের জামাতাকে হত্যা করার পরামর্শে সে খুশি হয়ে সম্মতি দেবে না কখনো। তাই স্বামীকে গোপন করে, মাদাম ডিফার্জ চক্রান্ত করতে বসলো অন্য লোকের সঙ্গে! জ্যাকসঙ্ঘের ভিতর রক্তপিপাসু লোকের তো অভাব ছিল না! গোটা সঙঘটাই তো গড়ে উঠেছে, ফরাসীদেশের যাবতীয় নর-রাক্ষসদের (অবশ্য অত্যাচারেই রাক্ষস হয়ে দাঁড়িয়েছে এ-সব মানুষ) একত্র করে!
এই গোপন চক্রান্তের ফল ফলতে বিলম্ব হল না।
ডার্নের মুক্তির উপলক্ষে সেদিন সন্ধ্যায় পারিবারিক উৎসবে মেতেছেন ডাক্তার ম্যানেট–এমন সময়ে অস্ত্রধারী নাগরিকেরা গিয়ে সাধারণতন্ত্রের নামে দ্বিতীয়বার বন্দী করলো ডার্নেকে! অপরাধ, দেশদ্রোহ…জনসাধারণের উপর অত্যাচার! অপরাধ নিজের হোক বা পূর্বপুরুষের হোক, কথা একই।
এই আচমকা বিপদ সবাইয়ের মাথায় এসে পড়লো যেন নীল আকাশ থেকে বজ্রের মত।
ডার্নে আবার কারারুদ্ধ!
পরদিনই বিচার। প্রশ্ন উঠলো, আগের দিন যাকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, আজ আবার তাকে পুনরায় অভিযুক্ত করা হল কেন? তার উত্তরে একখানা কাগজ দাখিল হল আদালতে।
ব্যাস্টিল অধিকারের দিনে ডাক্তার ম্যানেটের ১০৫নং কারাগহুর থেকে যে কাগজখানা উদ্ধার করেছিল ডিফার্জ, এটা সেই কাগজ। ম্যানেট তার কারাবাসের দিনে নিজের হাতে লিখে রেখেছিলেন–অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ! কে সেই অত্যাচারী? অত্যাচারী–মার্কুইস এভরিমন্ডি! এভরিমন্ডি-মাকুইসের আবেদনেই ম্যানেট বিনা বিচারে আঠারো বছর বন্দী ছিলেন ব্যাস্টিলের নির্জন কারায়।
হায় দুর্ভাগা ম্যানেট!
এই কাগজের কথা তার একেবারেই স্মরণ ছিল না!
হ্যাঁ, এভরিমন্ডি-বংশ যে তার কারাবাসের কারণ, তা তিনি জানতেন। মাকুইসের আহ্বানে একদা তাকে যেতে হয়েছিল এক পীড়িতা নারীর চিকিৎসার জন্য। সেখানে গিয়ে বিকারগ্রস্ত রোগিণীর প্রলাপ থেকে এক ভয়াবহ কাহিনী শুনতে পান তিনি। রোগিণীর ভাইকেও দেখতে পান ঐ গৃহে, সে তখন মরতে বসেছে। তার বুকে তরোয়াল বিদ্ধ হয়েছে! রোগিণীর পিতাও নিহত হয়েছেন ঐ গৃহেই, এ-বৃত্তান্তও ম্যানেটের কানে আসে!
ম্যানেট ফিরে এলেন। কিন্তু মাকুইসের ভয় রইলো–তার এ অনাচারের ইতিহাস হয়তো ম্যানেট একদিন প্রকাশ করে দেবেন। দণ্ডের ভয় না থাক, কলঙ্কের ভয় মার্কুইসের ছিল। তাই তিনি ব্যবস্থা করলেন ম্যানেটকে সরিয়ে ফেলবার। আচমকা তাকে ধরে ব্যাস্টিলে বন্দী করা হল।
রাগে দুঃখে প্রতিহিংসার কামনায় ম্যানেট বুকের রক্তে লিখেছিলেন– এভরিমন্ডির বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগের বিবরণ। সেদিন প্রতিহিংসায় অন্ধ ম্যানেট স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে ঐ বিবরণ থেকেই আজ তার প্রাণাধিকা কন্যার প্রিয়তম স্বামীর জীবনান্ত ঘটবে। এর চেয়ে নিষ্ঠুর পরিহাস নিয়তির ভাণ্ডারে তো কিছু থাকতে পারে না!
এভরিমন্ডি! ম্যানেটের শত্রু ওরা। কিন্তু কন্যার মুখ চেয়ে এভরিমন্ডি-বংশধরকে তিনি হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলেন। তখন কি জানতেন যে, তিনি এভরিমন্ডিকে ক্ষমা করলেও, আর-একজন কেউ দুনিয়ায় আছে–যার কাছে এভরিমন্ডি-বংশের ক্ষমা লাভের কোন আশাই নেই?
হ্যাঁ, এমন একজন আছে দুনিয়ায়। সে হল মাদাম ডিফার্জ।
জামাতার স্বপক্ষে তবুও ম্যানেট কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আদালত আর সে-কথায় কর্ণপাত করলো না। এভরিমন্ডি-বংশের যে পৈশাচিক অত্যাচারের বিবরণ ম্যানেটের লিখিত অভিযোগে প্রকাশ পেয়েছে, তাতে স্বয়ং ম্যানেটের কোন কথাও। কেউ আর শুনতে চাইলো না, অপরাধীর স্বপক্ষে।
মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রচারিত হল।
ম্যানেট লুটিয়ে পড়লেন ডার্নের পায়ের কাছে। তিনিই ঠেলে দিয়েছেন প্রিয় জামাতাকে, মৃত্যুর মুখে। তিনিই নিজের হাতে প্রিয় কন্যাকে সাজিয়ে দিয়েছেন বিধবার বেশে! তিনিই নয়ন-মণি দৌহিত্রীকে করে দিয়েছেন পিতৃহীনা! হায় ভাগ্য!
ডার্নে স্থির, গভীর, অবিচলিত। লুসীও তাকে বিদায় দিলেন কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে। যাও প্রিয়তম! আমার জন্য বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না তোমায়। আমিও এলাম বলে!–এই হল লুসীর বিদায়-বাণী।
জানা গেল–অভিশপ্ত এভরিমন্ডি-বংশের শেষ সন্তানকে পরদিন বেলা তিনটেয় গিলোটিনে নিক্ষেপ করা হবে।
০৮. মৃত্যু ও অমৃত
পাগলের মত ডাক্তার ম্যানেট ঘুরতে লাগলেন শহরের পথে-পথে। যে-যেখানে বন্ধু আছে, যেখানে তিলমাত্র সহানুভূতি পাওয়ার আশা আছে, সকলের দরজায় পাগলের মত ঘুরতে লাগলেন তিনি। এই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ডাক্তার হিসেবে বহু লোকের বহু উপকার তিনি করেছেন। কিন্তু কেউ-ই আজ বেপরোয়া বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করতে রাজী হল না। আর ওধারে তার প্রতীক্ষায় ব্যাঙ্কের অফিসে বসে রইলেন লরী ও–
সিডনী কার্টন!
সিডনী কার্টন?–হ্যাঁ, সেই উছুঙ্খল, সুরাসক্ত, চরিত্রহীন, মক্কেলহীন উকিল সিডনী কার্টন! সে বহুদিন থেকে ফ্রান্সে রয়েছে। লুসীরা ডার্নের অনুসরণ করে প্যারীতে উপনীত হবার ঠিক পরেই সে এসেছে। কিন্তু ঘটনার গতি লক্ষ্য করা ছাড়া আর কিছুই সে করেনি। কী-ই বা করবার ছিল? যেখানে ডাক্তার ম্যানেটের মত সম্মানিত ব্যক্তিকেই অগ্রসর হতে হয়েছে অতি সাবধানে, সেখানে বিদেশী সিডনী কি করতে পারে? সে শুধু বাইরে বাইরে সন্ধান নিয়েছে, দুশ্চিন্তায় কাতর লুসীর কাছে গিয়ে সমবেদনা জানাবার প্রয়াস সে করেনি।
আজ, ডার্নের ভাগ্য যখন চূড়ান্তভাবে স্থির হয়ে গেছে, সে এসে বসলো লরীর অফিসে।
এখানে সিডনী কার্টনের আর একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। যেদিন আদালতে তার চেহারার সমত্ব দেখিয়ে সে ডানের মুক্তির উপায় করে দেয়, সেদিন স্বভাবতই ডাক্তার ম্যানেট আর লুসীর দৃষ্টি তার উপর পড়েছিল। ডার্নের সঙ্গে সঙ্গে সে-ও লুসীদের বাড়িতে আসে। লুসীর অপরূপ সৌন্দর্য দেখে, ডানের মতন সেও মুগ্ধ হয়। কিন্তু যখন জানতে পারলো, লুসী ডার্নেকে ভালবাসে, তখন কার্টন তার মনের সমস্ত ভালবাসার খবর তার নিজের মনেই রুদ্ধ করে রেখে দিলো। জগতে আর কেউই সে-খবর জানলো না। লুসীর ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে কাটনের অবলম্বনহীন জীবন ক্রমশ একেবারেই ব্যর্থ হয়ে গেল। আদালতে তার পসার একদম কমে গেল! শোনা গেল, লন্ডনের আঁধার পল্লীর অন্ধকার হোটেলে-হোটেলে, দুশ্চরিত্র লোকেদের সঙ্গে সে ঘুরে বেড়ায়। ক্রমশ সে নিজে ইচ্ছে করেই লুসীদের বাড়ি আসা বন্ধ করে দিলো, কিন্তু লুসীকে না দেখে তার মন যখন হাঁপিয়ে উঠতো, তখন এক একদিন হঠাৎ এসে উপস্থিত হতো। কিন্তু লুসীর সঙ্গে কোন কথা বড়-একটা বলতো না। লুসীর মেয়েকে আদর করে চলে যেত। যতক্ষণ সে লুসীদের বাড়িতে থাকতো, ততক্ষণ তার কথাবার্তায়, তার ভঙ্গিতে, কেউ বিন্দুমাত্র আপত্তি করবার কিছু পেতো না। সীদের বাড়িতে না এলেও, লুসীদের সব খবরই সে রাখত। তার গোপন ভালবাসার একমাত্র লক্ষ্য ছিল, কোন রকমে লুসীর সাহায্যে আসা। তাই যখন সে শুনলো, ডার্নে ফ্রান্সে গিয়ে বিপন্ন হয়েছে, তাকে উদ্ধার করবার জন্যে লুসীরাও ফ্রান্সে চলে গিয়েছে, সে আর লন্ডনে বসে থাকতে পারেনি।
হ্যাঁ, একটা কাজ করেছে সিডনী ইতিমধ্যে। সেই গুপ্তচর বরসাদ। সে এখন ফরাসী-সাধারণতন্ত্রে চাকরি করে। সেই বরসাদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করেছে সিডনী। লন্ডনের ওল্ড বেইলী কোর্টে যখন মামলা হয় ডার্নের, তখন এই বরসাদ ছিল সরকারপক্ষের সাক্ষী। সে যে গভর্নমেন্টের মাইনে-করা গোয়েন্দা, তার কাজই যে ছিল জনসাধারণের ভিতর ঘুরে-ঘুরে রাজদ্রোহীর সন্ধান করা, এটা একরকম প্রমাণই হয়ে গিয়েছিল সে-মামলায়। সিডনী সে-কথা জানতো। আজ বরসাদ ইংলন্ড থেকে তাড়িত হয়ে ফরাসী-সাধারণতন্ত্রের চাকরি নিয়েছে–প্রজাদরদী সেজে। তার পূর্ব-ইতিহাস যদি প্রকাশ হয়ে পড়ে, এই মুহূর্তে চাকরি তো যাবেই তার, এই মুহূর্হে বিদ্রোহীরা তাকে গিলোটিনের মুখে ফেলে দেবে।
হ্যাঁ, সিডনী জানে বরসাদের পূর্ব-ইতিহাস। সিডনী যদি বিরক্ত হয়, বত্সদের সর্বনাশ করতে পারে এক মিনিটে। ইংলন্ডের সরকারী-গোয়েন্দার একটিমাত্রই স্থান আছে ফরাসী-সাধারণতন্ত্রে। সে-স্থান হল, গিলোটিনের তলায়। কাজেই বাদ আজ সিডনীর আজ্ঞাবহ। এবং
এবং–বরসাদের চাকরি হল কনসিয়েরজারী কারাগারে। সেখানে সে প্রহরীদের একজন সর্দার। আর ঐ কনসিয়েরজারী কারাগারেই থাকে সেই সব বন্দীরা, যাদের উপর প্রাণদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। আজ ডার্নেও সেইখানেই।
ম্যানেটের প্রতীক্ষায় বসে থাকতে-থাকতে সিডনী চঞ্চল হয়ে উঠলো। ম্যানেট যা করবার, তা করুন! কিন্তু ধরে নেওয়া যাক, তিনি ফিরে এলেন ব্যর্থ হয়ে! তখন কী হবে? এই আসন্ন সর্বনাশ থেকে লুসীকে বাঁচাবার কোন উপায়ই কি সিডনীর হাতে নেই?
লরীকে সে বললো–আপনি বসুন, আমি ঘুরে আসছি!
সিডনী গেল বরসাদের সন্ধানে। তাকে খুঁজে বার করে অতি গোপনে, অতি সাবধানে সে তাকে বললো একটি কথা। একটি মিনতি, একটি অনুরোধ, একটি আদেশ! সে আদেশ যদি অবজ্ঞা করে বরসাদ,না! অবজ্ঞা করবার সাহস তার নেই, কেননা তাতে নিশ্চিত মৃত্যু বরসাদের!
কিন্তু সে-আদেশ পালন করলেও যে মৃত্যু থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে, তার ভরসা কী? এত-বড় বিপজ্জনক কাজের কল্পনা কি করে করলো সিডনী, তাই ভেবে পেলো না বেচারী গুপ্তচর!
কিন্তু সিডনী কঠোর, কোন কারণেই তার সংকল্প ত্যাগ করবে না। তার এ আদেশ মানতেই হবে বরসাদকে! নইলে চললো সিডনী বরসাদের পূর্ব-ইতিহাস প্রকাশ করে দিতে! বরসাদ ভেবে দেখলো–সিডনীর সাহায্য করলে, প্রাণ বাঁচলেও বাঁচতে পারে। কিন্তু সাহায্য না করলে প্রাণ যাবেই। অতএব–
বরসাদের সঙ্গে সমস্ত পরামর্শ স্থির করে, সিডনী গেল এক ওষুধের দোকানে। কয়েকটা ওষুধ সে কিনলো। বিক্রেতা সাবধান করে দিলো সিডনীকে—ওষুধগুলি একসাথে মিশিয়ে ফেলবেন না কিন্তু! তাতে কী আশঙ্কা আছে জানেন তো?
–জানি–বলে সিডনী বিদায় হল।
তারপর সিডনী গেল ডিফার্জের মদের দোকানে। এখানে সে যায় মাঝে-মাঝে। মার্কুইস এভরিমন্ডির সঙ্গে চেহারার আশ্চর্য মিল আছে এই ইংরেজের, তা সবাই জানে ডিফার্জের দোকানে। সবাইকে এ-কথাটা আগে থাকতে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন বিবেচনা করেছে সিডনী।
মদের দোকানে বসে রইলো বহুক্ষণ সিডনী। মদ খাবার ভানই করলো, কিন্তু খেলো খুব সামান্যই। আজ তার মাথা ঠিক রাখা প্রয়োজন। আজ মদ খেলে চলবে না। খবরের কাগজ আড়াল দিয়ে সুরাপানের ভানই করলো আজ সিডনী। অবশেষে মদটা মাটিতে ফেলে দিয়ে সে বেরিয়ে এল।
রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর।
লরীর ঘরে তখনও লরী একা। তবে বেশিক্ষণ আর অপেক্ষা করতে হল না। ম্যানেট ধীরে-ধীরে সিঁড়িতে উঠছেন শোনা গেল। ধীরে-ধীরে তিনি ঘরে এসে ঢুকলেন।
খবর আর জিজ্ঞাসা করে জানতে হল না। ম্যানেটের চোখের পাগলের মত দৃষ্টি, তার কম্পিত পদক্ষেপ, তার উস্কোখুস্কো চুল–সব সমস্বরে ঘোষণা করলো– না, কিছু হয়নি, কিছু করতে পারিনি, কোন আশা দেয়নি কেউ!
কিন্তু সে যাই হোক, ম্যানেটের হল কী? তিনি পাগলের মত চারিদিকে চাইছেন কেন? কী খুঁজছেন তিনি? তার ভাব দেখে লরীর শঙ্কা হল–তিনি হয়তো ঠিক প্রকৃতিস্থ নেই!
লরীর মনে এক মহা আশঙ্কা জেগে উঠলো। তবে কি এই শোকের ধাক্কায় ম্যানেট আবার পাগল হয়ে যাবেন? কিছুক্ষণ কাতর ভাবে এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে, অতি ক্ষীণ স্বরে ডাক্তার ম্যানেট জিজ্ঞাসা করলেন–কোথায় গেল সেগুলো? আমার জুতো-সেলাইয়ের সরঞ্জামগুলো?
আকাশ ভেঙে পড়ল লরীর মাথায!
ম্যানেট আবার পাগল হয়ে গেছেন!
আবার তার মন ফিরে গেছে ব্যাস্টিলের ১০৫ নং গহ্বরে, যেখানে সারা দিনমান তাঁর একমাত্র কাজ ছিল, জুতো সেলাই করা! দীর্ঘ দশ বৎসরের সংসার-ধর্মের ইতিহাস এক নিমেষে তিনি ভুলে গেছেন, ভুলে গেছেন লুসীকে পর্যন্ত–যে-লুসী হল তার চোখের আলো, বুকের রক্ত, ইহ-পরকালের একমাত্র অবলম্বন।
লরী আর কার্টন তাকে ধরে শুইয়ে দিলেন সোফার উপরে, আগুনের পাশে!–এখনই আনিয়ে দিচ্ছি আপনার সেলাইয়ের সরঞ্জাম–এই বলে আশ্বাস দিলেন অবুঝ পাগলকে। পাগল শ্রান্ত দেহে ঘুমিয়ে পড়লো সেই সোফায় শুয়ে!
তখন সিডনী আর লরী পরস্পরের দিকে তাকালেন। লরীর চোখে শুধুই গভীর নৈরাশ্য। সিডনীর চোখে গভীর নৈরাশ্যের ভিতরও ক্ষীণ একটু উত্তেজনার আভাস!
সে বললো–হ্যাঁ, সবই শেষ হল বলা চলে। তবে যতক্ষণ শাস, ততক্ষণ আশ! কাল বেলা তিনটেয় ডার্নের শেষ নিশ্বাস পড়বার কথা! ততক্ষণ–দেখা যাক কি হয়! আপনার পাসপোর্টগুলি তৈরি আছে তো?
লরীর বোধগম্য হল না–এ-সময়ে পাসপোর্টের কথা কেন? তবু তিনি পকেট থেকে বার করে দেখালেন–একতাড়া কাগজ। সেগুলি ফ্রান্স ছেড়ে যাওয়ার অনুমতিপত্র! লরী, ম্যানেট, লুসী, ডার্নে, লুসীর মেয়ে, লুসীর দাসী, লরীর ভৃত্য– সকলের জন্য এক-একখানা। সিডনী নিজের পকেট থেকে ঐরকমই আর-একখানা পাসপোর্ট বার করে লরীর হাতে দিল। সেখানিতে নাম লেখা–সিডনী কার্টন, এডভভাকেট, ইংরেজ!
জিজ্ঞাসু নেত্রে লরী চাইলেন সিডনীর পানে।
সিডনী বললো–কাল বেলা দু’টোর সময় ম্যানেটের বাড়িতে আমি আসবো। গাড়িতে আপনারা সব উঠে বসে থাকবেন। প্রতীক্ষা করবেন আমার জন্য। আমি যে অবস্থাই এসে পৌঁছেই, তখনই আমায় গাড়িতে তুলে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেবেন সীমান্তপানে। কারণ, বিলম্বে বিপদের আশঙ্কা আছে। ডানের প্রাণ যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই ডার্নের স্ত্রী-কন্যাকে বন্দী করবার জন্য প্রস্তুত হয়েছে–এভরিমন্ডিদের চিরশত্রু মাদাম ডিফার্জ।
এ পরামর্শ মনঃপূত হল লরীর। নিজের বা ম্যানেটের জন্য তিনি চিন্তিত নন, কিন্তু এভরিমল্ডি-বংশের শত্রুদের হাতে, লুসী ও তার কন্যার বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা যে খুবই আছে, তা বোঝা শক্ত নয়। গভীর বিষাদে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি স্বীকৃত হলেন–কাল বেলা দু’টোয় তিনি গাড়িতে সবাইকে তুলে নিয়ে প্রস্তুত থাকবেন প্যারী ছেড়ে যাবার জন্য, সিডনী এসে পৌঁছোলেই তাকে নিয়ে ছেড়ে দেবেন গাড়ি।
***
বেলা তিনটে! ডার্নে শুনেছেন–বেলা তিনটেয় গিলোটিনের ছুরি পড়বে তাঁর কণ্ঠে! তার একার নয়, আরো একান্ন জন বন্দীর কণ্ঠে! বাহান্ন জন শত্রু নিপাত হবে সাধারণতন্ত্রের, ঐ একই সময়ে।
বেলা তিনটে! সকাল থেকেই ডার্নের কানে ঘড়ির শব্দগুলো একটা বিশেষ বার্তা যেন শুনিয়ে শুনিয়ে যায়! সাতটা বাজলো। সাতটা বাজতে আর জীবনে শুনবে না ডানে! আটটা! আটটার বাজনা জন্মের শোধ এইবার শুনে নাও ডার্নে! নয়টা!–বারোটা! একটা….
ডার্নে দু’টোর সময়ই তৈরি থাকবেন স্থির করেছিলেন। যাতে কারারক্ষীরা এসে এক সেকেন্ডও দেরি করতে না বাধ্য হয়–মার্কুইস এভরিমন্ডির জন্য!
কিন্তু–এ-এ কী? সিডনী কার্টন? সিডনী কার্টন—লন্ডন থেকে প্যারীতে। এই সময়ে? যাই হোক, যা মনে করেই এসে থাকে কার্টন, একে দিয়ে লুসীকে একটা। শেষ খবর পাঠানো যেতে পারে হয়তো! একটা শেষ বিদায়বাণী!
দু’একটা আজে-বাজে কথা বললো কার্টন! যেমন চিরদিন বলে সে! তারপর সে ডার্নেকে বলল–একটা চিঠি লেখ তোমার স্ত্রীকে! আমি পৌঁছে দিতে পারব!
ডার্নে চিঠি লিখতে বসলেন। এ সময়ে মন স্থির করে চিঠি লেখা সহজ নয়। তবে, ডার্নের মন এ-অবস্থায়ও কতকটা স্থির। তা না হলে, এই বর্ষাধিক কালের অসহ্য অপমান আর যাতনায় কবে ভেঙে পড়তেন তিনি।
চিঠি লিখতে লিখতে হঠাৎ ডানের চোখে পড়লো সিডনী হাত দিয়েছে তার বুকের ভিতর। কী যেন টেনে বার করছে! কী অদ্ভুত! লোকটা কি অস্ত্র নিয়ে এসেছে এই হাজার পারাওলায় ঘেরা কারাদুর্গে? কী-জন্য? ডার্নে প্রশ্ন করলেন, চিঠি লেখা বন্ধ করে–ও কী তোমার হাতে, কার্টন?
কিন্তু উত্তর শোনবার সময় আর ল না ডার্নের। একখানা রুমাল এসে চাপা পড়লো ডানের নাকের উপর। ব্যাপার না বুঝতে পেরে, গিলোটিনমুখী ডার্নে সিডনীর হাত ছাড়াবার জন্য ধস্তাধস্তি করতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎই আক্রমণ করেছে সিডনী, তারপর ঔষধটার কাজও হয় খুব তাড়াতাড়ি। তিনি হাত ছাড়াতে পারলেন না। অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।
সিডনী জানতো, জ্ঞান থাকতে ডানে কখনও অন্যের জীবন নষ্ট করে নিজের জীবন বাঁচাতে স্বীকার করবেন না। তাই এই কৌশল সিডনীর।
ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজের বান, মায় টুপী জুতো রুমাল-ডার্নেকে পরিয়ে দিল সিডনী। ডার্নের চুলটি পর্যন্ত আঁচড়ে দিল নিজের ফ্যাশানে। তারপর ডার্নের কাপড়-জামা নিজে পরে দ্বারে টোকা দিল। বাইরেই পাহারায় আছে বরসাদ, সে খুললো দরজা।
সিডনী চোখ টিপে বললো—আমার বন্ধুটি মূৰ্ছা গেছেন প্রহরী! এঁকে বাইরে পাঠাবার ব্যবস্থা করো!
চোখ টিপেই বরদ সম্মতি জ্ঞাপন করলো। দু’জন প্রহরী এল তার আহ্বানে। তারা বরসাদের কথামত অচেতন ডার্নেকে বহন করে নিয়ে চললো দুর্গের বাইরে। দ্বার রুদ্ধ করে বরাদও চললো তাদের পিছনে। সিডনীর শেষ আদেশ-ডার্নেকে পৌঁছে দিতে হবে ম্যানেটের বাড়িতে বেনা দুটোর ভিতর। তা নইলে শেষ মুহূর্তেও সিডনী বক্সাদকে অভিযুক্ত করে যাবে সরকারি গোয়েন্দা বলে।
বরসাদ যেতে-যেতে উঁচু গলায় হেঁকে বলে গেল–তুমিও তৈরি হও এভরিমন্ডি! তিনটে বাজতে বাকি নেই বেশি!–ডার্নের বাহকেরা হেসে উঠলো সে রসিকতা শুনে।
***
সীমান্ত-পানে ছুটে চলেছে ঘোড়ার গf। সীমান্ত : এখানে যাত্রীদের কাগজপত্র পরীক্ষা হবে। গাড়ি থামলো। লরী নেমে এসে সমস্ত কাগজপত্র দিলেন অফিসারের হাতে। একে-একে নাম ডাকতে লাগলেন অফিসার!
–আলেকজান্ডার ম্যানেট!–ডাক্তার!
লরী দেখিয়ে দিলেন–গাড়ির এক কোণে বৃদ্ধ ডাক্তার নিচু গলায় কাতর স্বরে কেবলই গোঙাচ্ছেন, কেবলই গোঙাচ্ছেন…লরী বুঝিয়ে দিলেন–এভরিমন্ডির শ্বশুর কিনা উনি! এভরিমন্ডি এতক্ষণ গিলোটিনের তলায় নীত হয়েছে, সেই কল্পনাতেই কাতর হয়েছেন বৃদ্ধ। মনের দৃঢ়তা ওঁর নষ্ট হয়ে গেছে সেই আঠারো বছর ব্যাস্টিলবাসের ফলে!
অফিসার রেগে উঠেছিলেন–এভরিমন্ডির দরুন ম্যানেটের শোকের কথা শুনে। সাধারণতন্ত্রের শত্রুর জন্য যে কাঁদে, সেও তো শত্রু সাধারণতন্ত্রের!–কিন্তু পরমুহূর্তেই চতুর লরীর মুখ থেকে বেরিয়ে পড়লো ডাক্তারের ব্যাস্টিলবাসের কাহিনী! অফিসার সামলে গেলেন! তাইতো! আঠারো বছর যে লোক ব্যাস্টিলবাস করেছে, তাকে–আর যাই হোক–সাধারণতন্ত্রের শত্রু বলা চলে না।
–লুসী এভরিমন্ডি! এভরিমন্ডির স্ত্রী!
অশ্রুমুখী লুসীকে দেখিয়ে দিলেন লরী, সঙ্গে-সঙ্গে বলতে ভুললেন না যে, লুসী–ম্যানেটের কন্যা!
–লুসী এভরিমন্ডি। এভরিমন্ডির কন্যা! শিশু লুসীকে দেখিয়ে দিলেন লরী।
–সিডনী কার্টন, এডভোকেট, ইংরেজ! গাড়ির এক কোণে কাপড় চাপা দিয়ে পড়ে আছেন কার্টন। অফিসার বললেন ভদ্রলোক কি অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন?
–হ্যাঁ! এভরিমন্ডির বন্ধু কিনা! শেষ সাক্ষাতের পর থেকেই অচৈতন্য।
–জার্ভিস লরী! ব্যাঙ্কার! ইংরেজ!
–আমি।
–যেতে পারেন!
গাড়ি চলেছে। মাঝে-মাঝে ঘোড়া বদলানো হচ্ছে নির্দিষ্ট স্থানে। এক-একবার গাড়ি থামে, আর ভয়ে অস্থির হয়ে ওঠে ওরা! এ-গাড়ি কি আর ছাড়বে না? কখন আসবে নতুন ঘোড়া? যদি কেউ পেছন থেকে ধেয়ে আসে? যদি এই প্রকাণ্ড ছলনার কথা প্রকাশ হয়ে পড়ে থাকে? দেখুন, দেখুন, মিস্টার লরী! বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখুন-পেছনে ও শব্দ কিসের?
নাঃ, ও কিছু নয়!
হঠাৎ গাড়ির কোণ থেকে কাপড়ে-ঢাকা অচেতন কার্টন-বেশি ডার্নে বলে উঠলো–তোমার বুকে ওটা কি লুকিয়ে রেখেছো কার্টন? তাড়াতাড়ি তার মুখে হাত চাপা দিল রোরুদ্যমানা লুসী। কেউ শুনলো না তো? ধীরে ধীরে কেটে আসতে থাকে ডার্নের মূছার ঘোর।
গাড়ি চলছে। নাঃ, পিছনে আসেনি কেউ, পলাতক আসামী ধরবার জন্য। শুধু পিছনে ধাওয়া করে চলেছে পাগল হাওয়া, ধাওয়া করে চলেছে কালো-কালো মেঘ, নীল-আকাশে ভেসে ভেসে আসছে সঙ্গে সঙ্গে চতুর্থীর চাঁদ, ঘোর নিশীথিনী এলো চুল নাচিয়ে ছুটেছে পলাতক-আসামীর পিছনে-পিছনে। তাকিয়ে তাকিয়ে তাই দেখে লুসী, আর লুসীর অন্তর বলে ওঠে, ধন্যবাদ ভগবান–সাধারণতন্ত্রের সৈনিক কাউকে তো পিছনে দেখি না।
***
বেলা তিনটে বাজে! রাজপথে চলেছে ছ’খানা খোলা গাড়ি! বাহান্ন জন লোক সেই ছ’খানা গাড়িতে। যুবক, বৃদ্ধ, যুবতী, বৃদ্ধা–শিশুও দু-একজন। ধনী মানী জমিদার, মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী, দরিদ্র শ্রমিক–সব আছে সেই গাড়িতে।
অশ্বারোহী প্রহরী চলেছে ঐ ছ’খানা গাড়ি বেষ্টন করে। তরোয়াল উঁচিয়ে তারা দেখিয়ে দিচ্ছে একজন বিশেষ বন্দীকে! ঐ সেই এভরিমন্ডি! যে মুক্তি পেতে পেতে আবার ধরা পড়েছে। গিলোটিনকে ফাঁকি দেওয়া কি অত সোজা?
এভরিমন্ডি একটি ক্ষীণা বালিকার সঙ্গে কথা কইতে ব্যস্ত। অন্য কোনদিকে দৃষ্টি নেই তার! বালিকার বয়স আঠারো-উনিশের বেশি হবে না, একান্ত নিরীহ গোবেচারী সে! তাকেও ধরে এনেছে সাধারণতন্ত্রের শত্রু বলে! বিপ্লবের সেই পাগলামির দিনে, বিচার ছিল প্রহসন। যে-কেউ একজন এসে যা-হোক একটা অভিযোগ করলেই হল! তাহলেই গিলোটিন!
বালিকা কাতর হয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল এভরিমন্ডির পাশে! সে তাকে সান্ত্বনা দিয়েছে, আশা দিয়েছে, মৃত্যুর মুখোমুখি শান্তভাবে দাঁড়াবার সাহস দিয়েছে সে!
জনতার ভিতর কোলাহল উঠলো–নিপাত হোক এভরিমন্ডি! সাধারণতন্ত্রের শত্রু সবাই নিপাত হোক! অভিজাত বড়লোক নিপাত হোক সবাই!
একটা লোক বলে উঠল–থামো। থামো! এভরিমন্ডি তো নিজের সাজা মাথা পেতেই নিতে চলেছে! আর অভিশাপ কেন?
এ হল, মিঃ বরসাদ।
ঢং ঢং ঢং, তিনটে বাজলো!
ঘ্যাঁচ!–একটা মাথা গড়িয়ে পড়ল ঝুড়ির ভেতর।
ঘ্যাঁচ–আর একটা।
মাদাম ডিফার্জের সঙ্গিনীরা গিলোটিনের অদূরে বসে আছে চেয়ারে! হাতে তাদের উল আর কাঁটা! তারা গুনে যাচ্ছে–এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ…
ক্ষীণা বালিকাটি এভরিমন্ডিকে বলছে
–শেষ সময়ে তোমায় মিলিয়ে দিয়েছেন ভগবান! তোমায় পেয়ে তবে আমি ভগবানকে স্মরণ করতে পেরেছি।
–কিচ্ছু ভেবো না বোন! আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে শুধু! অন্য কোন দিকে তাকিয়ো না! এক সেকেন্ডে শেষ হয়ে যাবে। তারপর ভগবানের রাজ্য। আনন্দের দিন! কোন ভয় নেই!
এমন সময় এল মেয়েটির ডাক।
এভরিমন্ডি-রূপী সিডনীই ধীর-হস্তে ঠেলে দিল মেয়েটিকে। সিডনীর দিকে দুই আয়ত চক্ষুর দৃষ্টি রেখে সে অবনত করল নিজের মাথা! সে চক্ষুর দৃষ্টিতে ভয়ের লেশ নেই, আছে অশেষ বিশ্বাস।
সেই অন্তিম দৃষ্টির সামনে মেয়েটি স্পষ্ট দেখলো, সিডনীর পরিবর্তে তার সামনে দাঁড়িয়ে আলোক-মূর্তি যীশু, দুই হাত প্রসারিত করে। সিডনীর মুখ থেকে শান্ত কণ্ঠে উচ্চারিত হল যীশুর পরম আশ্বাস-বাণী,–আমিই পুনর্জীবন! আমিই অনন্ত জীবন! আমাতে যে বিশ্বাস করে, মরেও সে বাঁচবে! আমাতে যে বিশ্বাস করে, মৃত্যু নাই তার!
আনন্দে ভরে ওঠে মেয়েটির শেষ মুহূর্ত।
একটা ক্ষীণ শব্দ হয় শুধু। মেয়েটির ছিন্ন মাথা ঝুড়িতে গিয়ে পড়ে। উল বুনতে বুনতে মহিলারা গোনে–বাইশ!
এবার ডাক পড়লো, এভরিমন্ডি।
সিডনী বুক ফুলিয়ে গিলোটিনের তলায় গিয়ে দাঁড়ায়।
.
লক্ষ-কণ্ঠের স্তিমিত কলরব কানে আসে তার। চোখে পড়ে লক্ষ আবছা মুখ! উন্মত্ত জনতার উল্লাসধ্বনি তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ে…কিন্তু সিডনীর চোখের সামনে তখন জ্বলছে শুধু একটা আলো। কে যেন সিডনীর কানে কানে বলে, এস বন্ধু, এস ক্লান্ত পথিক!
উপর থেকে নেমে আসছে গিলোটিনের ধারালো ছুরি।
উল বুনতে বুনতে মহিলারা গোনে–তেইশ!
-সমাপ্ত-