- বইয়ের নামঃ গ্যেটে রচনাসমগ্র
- লেখকের নামঃ গ্যেটে
- প্রকাশনাঃ সালমা বুক ডিপো
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রচনাবলী, উপন্যাস
গ্যেটে রচনাসমগ্র
আত্মজীবনী
আত্মজীবনী
প্রথম পরিচ্ছেদ
১৭৪৯ সালের ২৮শে আগস্ট দুপুরের ঘড়িতে ঠিক বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই আমি এসেছিলাম এই পৃথিবীতে। এসেছিলাম ফ্রাঙ্কফোর্ট শহরের একটা ঘরে। আমার জন্মলগ্নে গ্রহনক্ষত্রের অবস্থিত এমন কিছু খারাপ ছিল না। সূর্য বা রবি ছিল কন্যা রাশিতে। বৃহস্পতি ও শুক্রের দৃষ্টি ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। বুধও বক্রী ছিল না। শনি ও মঙ্গল ছিল উদাসীন। আমার জন্মের উপর একমাত্র চন্দ্রের দৃষ্টি ছিল বক্রকুটিল, যে দৃষ্টির বক্রতা শোধরায়নি কখনও আমার সারা জীবনের মধ্যে।
আমরা থাকতাম আমার বাবার মার বাড়িতে। আমার ঠাকুরমাকে আজও মনে পড়ে আমার। উনি থাকতেন একতলায় পিছনের দিকে একটা বড় ঘরে। সুন্দর রোগা রোগা চেহারার এক মহিলা। সব সময় সাদা ফিটফাট পোশাক পরে থাকতেন। আমি আর আমার ছোট বোন প্রায়ই তাঁর চেয়ারের কাছে খেলা করতাম। অসুস্থ অবস্থায় তিনি বিছানায় শুয়ে থাকলেও আমরা তার বিছানায় উঠে খেলতাম। কিন্তু তিনি বিরক্ত হতেন না কখনও।
শৈশবের অনেক দুষ্টুমির মধ্যে একদিনের একটা দুষ্টুমির কথা মনে আছে। একবার একটা মাটির বাসনপত্রের এক মেলা বসে শহরের শেষপ্রান্তে। সেখান থেকে আমাদের রান্নাঘরের জন্য অনেক মাটির থালা ও নানারকমের পাত্র কেনা হয়। একদিন বিকালে বাড়িতে খেলার কিছু না পেয়ে একটা মাটির প্লেট রাস্তায় ছুঁড়ে দিই। মাটির পাত্রটা বাঁধানো রাস্তায় পড়ে খান খান হয়ে ভেঙে গেল। আমি আনন্দে হাততালি দিতে লাগলাম। আমার সে আনন্দে আমার এক প্রতিবেশীও আনন্দ পেলেন। আমি চিৎকার করে উঠলাম, আর একটা। সত্যি আর একটা মাটির পাত্র এনে এইভাবে ভাঙলাম। এইভাবে আমার প্রতিবেশী দর্শক ভন অকসেনস্টাইনকে খুশি করার জন্য একে একে সব মাটির পাত্রগুলো সেদিন ভেঙে ফেললাম আমি। সেদিন যেন শুধু ভাঙ্গার আনন্দে মত্ত ও আত্মহারা হয়ে উঠেছিলাম আমি।
আমাদের বাড়ির সামনের দিকে ছিল বড় রাস্তা আর পিছনের দিকে ছিল প্রতিবেশীদের বড় বাগান। বাড়ির তিনতলার ঘরটাকে বলা হতো বাগানবাড়ি। কারণ সে ঘরের প্রতিটি জানালার ধারে ধারে অনেক রকম লতা ও চারা গাছ টবের উপর সাজিয়ে রাখা হতো। আমি ছেলেবেলায় সেখানে বসে আমার পড়া তৈরি করতাম। আরও বড় হয়ে আমার কোনও খুশির ভাব এলেই আমাদের তিনতলার সেই বাগান ঘরটাতে চলে যেতাম। কিন্তু মনে কোনও বিষাদ জমলে সে ঘরে কখনও যেতাম না। জানালার ভিতর দিয়ে প্রসারিত আমার দৃষ্টিটা মাঝে মাঝে চলে যেত শহরের সীমানা ছাড়িয়ে এক সবুজ প্রান্তরে। আজ বেশ বুঝতে পারছি এই ঘরটাই আমার শিশুমনে প্রথম এনে দেয় নিভৃত চিন্তার প্রেরণা। আর কিছু অস্পষ্ট অব্যক্ত কামনার বাধাবন্ধহীন ব্যাকুলতা। আমি স্বভাবতই গভীরতাপ্রিয় এবং ভাবুক প্রকৃতির। এই ঘরে এলেই আমি যেন আমার সে প্রকৃতিকে খুঁজে পেতাম।
ছেলেবেলায় রাত্রিবেলাটা আমার ভারি খারাপ লাগত। ছায়া ছায়া বিষণ্ণতায় ভরা পুরনো আমলের বাড়িটা রাত্রির অন্ধকারে কেমন যেন ভয়ঙ্কর দেখাত। তার উপর তখনকার দিনে ছেলেদের ভয় জয় করতে শেখাবার জন্য রাত্রিবেলায় একা একা শোয়ার ব্যবস্থা ছিল। আমার বাবা-মাও সেই ব্যবস্থা করেছিলেন আমার জন্য। এক একদিন একা ঘরে ভয় লাগতেই উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতাম। বাবা বকতেন। তখন মা ফন্দি আঁটেন। তখন পীচফল পাকার সময়। আমার মা বলেন যে কোনও ভয় না করে একা ঘরে ঘুমোতে পারবে তাকে পীচফল বেশি করে দেওয়া হবে রোজ। এইভাবে ফলের লোভে পুরস্কারের লোভে ভয় জয় করতে শিখেছিলাম আমরা।
কেন জানি না আমার বাবা ছিলেন রোমক সংস্কৃতির উপাসক। ইতালীয় ভাষা, ইতালীয় গান, ইতালীয় শিল্পকলা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল অগাধ। আমাদের। বাড়ির একটা ঘর ভর্তি ছিল ইতালীয় ছবিতে। জিওতিনাৎসী নামে একজন প্রবীণ ইতালীয় সঙ্গীত শিক্ষক আসতেন আমাদের বাড়িতে। আমরা গান শিখতাম। আমার মা ক্লেভিকর্ড বাজাতে শিখতেন। বিয়ের পর মাকেও গান শিখাতে হয় বাবার জেদে পড়ে।
আমার ঠাকুরমা মারা যাবার পর বাড়িটা আমূল সংস্কার সাধন করলেন। পুরনো বাড়িটা ভেঙে তার জায়গায় গড়লেন নূতন ধাচের নূতন বাড়ি আর আমাদের পাঠালেন পাবলিক স্কুলে। আমি যেন নূতন এক জগতে এসে পড়লাম। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী থেকে আসা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে প্রথম মেলামেশা শুরু হলো আমার। আগের থেকে অনেক বেশি স্বাধীনতার সঙ্গে শহরের বিভিন্ন এলাকাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে বেড়াতে লাগলাম। কিন্তু আমার সবচেয়ে ভালো লাগত শ্যোন নদীর সেতুর উপর দাঁড়িয়ে নদীর স্রোত আর মালবোঝাই নৌকার আনাগোনা দেখতে। নীচেকার নদীর স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেতুর উপর দিয়ে অবিরাম চলে যেত জলস্রোত। কৌতূহলী হয়ে আমি দুদিকেই তাকাতাম। মাঝে মাঝে ঘিঞ্জি বাজারের নোংরা পথ পার হয়ে রঙিন জলছবি কিনে আনতাম। আবার মাঝে মাঝে চলে যেতাম রোমার হিলে। তবে আর একটা জিনিস ভালো লাগত আমার। তা হলো উঁচু উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা পুরনো কালের দুর্গ, বড় বড় বাড়ি আর বাগান দেখতে। অদেখা অচেনা কুহেলিঘেরা অতীতের প্রতি কেমন যেন এক সকরুণ মমতা গড়ে উঠেছিল আমার মনে। কিছু কিছু রূপকথা আর ইতিবৃত্ত শুনে সে মমতা বেড়ে উঠেছিল। আমরা শুনেছিলাম শার্লেমেদের রূপকথা, শুনেছিলাম যেমন করে হ্যাঁপস রুডলফ তার বীরত্ব আর সাহসিকতার দ্বারা শান্তি এনেছিল অশান্তির মাঝে। চতুর্থ চার্লস ও স্বর্ণবলদের কথাও শুনেছিলাম আমরা।