- বইয়ের নামঃ প্যারাডাইস লস্ট
- লেখকের নামঃ জন মিলটন
- প্রকাশনাঃ দি স্কাই পাবলিশার্স
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, কবিতা
প্যারাডাইস লস্ট
০১ম সর্গ
প্যারাডাইস লস্ট – জন মিলটন
অনুবাদ : সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ
প্রথম সর্গ
হে কাব্যকলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী, তুমি আমাকে প্রথমে বল আদি মানবের সেই ঐশ্বরিক আনুগত্যের অভাব বা ঈশ্বর-বিরোধিতার কথা, সেই নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফলের কথা যা মর্ত্যলোকে নিয়ে আসে মৃত্যু আর যত সব দুঃখ এবং পরিশেষে স্বর্গচ্যুতি। পরে এক মহামানবের সহায়তায় সেই হারানো স্বর্গ আবার পুনরুদ্ধার করে মানুষ। তুমি বল সেই ওরেব বা সিনাই পর্বতের শিখরদেশের কথা যার উপর থেকে ঈশ্বর আদি মানবজাতির মেষচারণরত মোজেসকে দেখে প্রথম সৃষ্টির বীজটিকে অঙ্কুরিত করে তোলার রহস্যটি শিখিয়ে দেন। যার ফলে সৃষ্টিহীন শূন্যতার মধ্য থেকে স্বর্গ-মর্ত্যের প্রথম উদ্ভব হয়। একথা যদি তোমার ভাল লাগে তো বল সিডন পাহাড় আর জেরুজালেমের পাশ দিয়ে প্রবাহিত মিলোয়া নদীর কথা।
তারপর আমি এক দুঃসাহসী সঙ্গীত রচনার জন্য তোমার সাহায্য প্রার্থনায় তোমাকে আবাহন করব যে সঙ্গীতের সুরলহরী আওনিয়ান পর্বতের শিখরদেশকে ছাড়িয়ে যেতে পারে স্বচ্ছন্দে। গদ্যে বা পদ্যে আজও পর্যন্ত যা রচিত হয়নি কখনো, সেই সঙ্গীতের মধ্যে আমি তা রচনা করব। হে দেবী, যেহেতু তুমি মন্দির বা ধর্মপ্রতিষ্ঠানের থেকে ভক্তজনের অন্তঃকরণের সততা ও শুচিতাকে বেশি মূল্যবান মনে করো, আমার প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে এ বিষয়ে চালনা করো আমাকে উপযুক্ত নির্দেশদানের দ্বারা। কারণ কোন কিছুই অপরিজ্ঞাত নয় তোমার। কারণ তুমি আদিকাল হতে বিরাজিত আছ, সৃষ্টিহীন বিশাল শূন্যতার গভীরে কপোতসুলভ এক গম্ভীর প্রশান্তির সঙ্গে শক্তিশালী দুটি বিরাট ডানা বিস্তার করে বসেছিলে এবং ধীরে ধীরে সকল সৃষ্টিকে সম্ভত করে তোল তুমি। আমার মধ্যে যা অন্ধকার এবং অপরিজ্ঞাত রয়ে গেছে, তার উপর প্রজ্ঞার আলোকপাত করে তাকে আলোকিত করে তোল। আমার মধ্যে যা কিছু অশক্ত ও অবনমিত আছে তাকে এক দৃঢ় ভিত্তিভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত করে তুলে ধরো যাতে আমি যত সব বিশৃঙ্খলাময় ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে ঈশ্বরের বিধানকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি এবং মানবজাতির কাছে পরিজ্ঞাত করে তুলতে পারি ঈশ্বরের রীতিনীতিগুলিকে।
স্বর্গলোকের কোন কিছুই লুক্কায়িত থাকতে পারে না তোমার দৃষ্টিপথ থেকে। এমন কি নরকের গভীর অন্ধকার গহ্বরের তলদেশ পর্যন্ত প্রতিভাত ও পরিদৃশ্য হয়ে ওঠে তোমার দৃষ্টির সম্মুখে। প্রথম বল, কোন্ কারণে আমাদের আদি পিতামহগণ ঈশ্বরের অনন্ত অনুগ্রহলাভে ধন্য হয়েও স্বর্গসুখ হতে বিচ্যুত হয়ে পড়ল? কেন তারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরম স্রষ্টা ও বিধাতার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল? কেন তারা তার আদেশ লঙঘন করে চরম অংযমের পরিচয় দিল? কে তাদের এই জঘন্য বিদ্রোহে প্রথম প্ররোচিত করল? শয়তানরূপী নারকীয় সর্পই কৌশলে মানবজাতির আদিমাতাকে প্রতারিত করে হিংসা আর প্রতিশোধ বাসনার উদ্রেক করে তার মনে। বল, কখন কোন সময়ে মানবজাতির আদিপিতা একদল বিদ্রোহী দেবদূতসহ তার মদমত্ততার জন্য বিচ্যুত হয় স্বর্গলোক থেকে।
এই সব বিদ্রোহী দেবদূতদের সহায়তায় আমাদের আদিপিতা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সমকক্ষতা অর্জন করার এক উদ্ধত উচ্চাভিলাষে মত্ত হয়ে ঈশ্বরের স্বর্গরাজ্য ও সিংহাসন অধিকার করতে চায়। এই উদ্দেশ্যে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে এক অন্যায় অধমোচিত যুদ্ধ ঘোষণা করে সে দর্পভরে। এর জন্য সর্বশক্তিমান ঈশ্বর স্বর্গলোক থেকে জ্বলন্ত অবস্থায় নরকের অতল গহ্বরের মধ্যে সরাসরি ফেলে দেন শয়তানদের। তারই জন্য এক ভয়ঙ্কর সর্বনাশের সম্মুখীন হতে হয় আমাদের আদিপিতাকে। ঈশ্বর বিরোধিতার এক চরম শাস্তিস্বরূপ জ্বলন্ত নরককুণ্ডের মধ্যে পরাভূত ও শৃঙ্খলিত অবস্থায় আবদ্ধ থাকতে হয় তাকে। পূর্ণ নয় দিন যাবৎ তাকে দলের সকলের সঙ্গে সেই জ্বলন্ত নরককুণ্ডে মৃত্যুহীন এক যন্ত্রণায় জীবনযাপন করতে হয়।
কিন্তু তার এই সর্বনাশা নরকভোগ আরও বাড়িয়ে দেয় তার ক্রোধের মাত্রাকে। কারণ হারানো স্বর্গসুখ আর দীর্ঘায়িত জীবনযন্ত্রণার ভাবনা পীড়িত করতে থাকে তাকে। চারদিকে তার স্লান দু’চোখের বিহ্বল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার দীর্ঘায়িত দুঃখকষ্টের বিপুলতাকে প্রত্যক্ষ করে ভীত হয়ে ওঠে সে। তথাপি সেই ভীতির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে ওঠে তার সহজাত অহষ্কার আর বদ্ধমূল ঘৃণার অনমনীয়তা। চারদিকে যতদূর দৃষ্টি যায়, সে দেখতে পায় শুধু এক বিরাট চুল্লীর মত জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের দ্বারা আকীর্ণ এক অন্ধকার কারাগার। সেই অগ্নিশিখার মধ্যে কোন আলো নেই। সেই অগ্নিশিখার এক অন্ধ আভায় শুধু বেশি করে প্রকটিত হয়ে ওঠে ঘনীভূত অন্ধকারের ভয়াবহতা। সে আভায় সে দেখতে পেল শুধু অন্তহীন দুঃখকষ্টের ছায়াচ্ছন্ন বিস্তার। সেখানে নেই কোন শান্তি বা বিদ্রোহের ন্যুনতম অবকাশ, নেই কোন ক্ষীণতম আশার আনাগোনা। সেখানে আছে শুধু অন্তহীন যন্ত্রণার নিদারুণ প্রদাহ আর জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের নারকীয় দীপ্তির দুঃসহ দীর্ঘতা।
ঈশ্বরের বিধানে এই চির-অন্ধকার নরকপ্রদেশটি বিদ্রোহীদের কারাগাররূপে নির্দিষ্ট হয়েছে। সেই নরকপ্রদেশটি ছিল আয়তনে বিশাল। তা ঈশ্বর ও তাঁর স্বর্গরাজ্য থেকে যত দূরে, তার কেন্দ্র হতে পরিধিও ছিল তত দূরে। হায়, যে স্থান থেকে তারা বিচ্যুত হয়েছে, যে স্থানে আগে তারা বাস করত, সে স্থান হতে এ স্থান কত পৃথক, কত নিকৃষ্ট! ওখানে তার সঙ্গে তার পতনের সঙ্গীরা বিক্ষুব্ধ অগ্নিপ্রবাহে অভিভূত হয়ে বসে আছে তারই মত।
কিছুক্ষণের মধ্যে সেই নরকের অন্ধকারে জ্বলন্ত অগ্নিশিক্ষার আভায় একজনকে চিনতে পারল আদিপিতা। ক্ষমতা ও অপরাধে তার পরেই যার স্থান, দীর্ঘকাল আগে প্যালেস্টাইনে যার সঙ্গে পরিচয় হয় তার সেই বীলজীবাব নামে এক শয়তানকে দেখে চিনতে পারল সে। স্বর্গে যাকে শয়তান বলা হত সেই বীলজীবাব এবার নরকপ্রদেশের ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে উদ্ধতভাবে বলল, তুমি যদি সে-ই হও তাহলে কেমন করে তোমার পতন ঘটল? একদিন যে তুমি কত সুখে ছিলে, এক স্বর্গীয় জ্যোতিতে কত উজ্জ্বল ছিল তোমার দেহাবয়ব, এখন তুমি আর সেই ব্যক্তি নেই। কত পরিবর্তন হয়েছে তোমার! একদিন আমরা দুজনে মিলেমিশে একই আশায় সঞ্জীবিত ও একই আঘাতে অভিভূত ও একই ভাবনায় ভাবিত হয়ে আমাদের গৌরবময় উদ্দেশ্যসাধনের পথে এগিয়ে চলি আমরা। আবার এখন একই দুঃখ আর সর্বনাশের কবলে পতিত হয়েছি আমরা। কত উঁচু থেকে কত নীচে পড়েছ তা একবার দেখ তো। বজ্রের যে এত শক্তি এর আগে তা জানতাম না আমরা।
কিন্তু এই সব দুঃখকষ্ট সত্ত্বেও বিন্দুমাত্র অনুশোচনা জাগেনি আমার মধ্যে। কোন পরিবর্তন হয়নি আমার মনের। এমন কি আমাদের শক্তিমান বিজয়ী প্রতিপক্ষ এর থেকে আরো যে বেশি শাস্তি দেবে আমাদের, তার জন্যও ভয় করি না আমি। যদিও আমার বহিরঙ্গের জ্যোতি আর জৌলুস আর নেই, তথাপি আমি দৃঢ়সংঙ্কল্প। আমার আহত অপমানবোধ ঘৃণা আর প্রতিশোধ বাসনার উদ্রেক করেছে আমার মনে। কারণ এর আগে আমি একবার বিদ্রোহী আত্মাদের সহায়তায় স্বর্গরাজ্যে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করি। সে যুদ্ধ কাঁপয়ে তোলে তার সিংহাসনকে তবু সে যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারিনি আমরা। কিন্তু আমরা পরাভূত হলেও অপরাজেয় রয়ে গেছে আমাদের মনোবল। দুর্মর ঘৃণা, প্রতিশোধ বাসনা আর দুর্দমনীয় সাহসের দ্বারা কি জয়লাভ করতে পারব না আমরা? আমাদের এই অদম্য অনিবারণীয় শক্তি আর সাহসই এক পরম গৌরবের বস্তু। আমাদের প্রতিপক্ষ যতই প্রবল ও শক্তিশালী হোক না কেন, এ গৌরব ছিনিয়ে নিতে পারবে না আমাদের কাছ থেকে। শত্রুর সামনে নতজানু হয়ে তার করুণা ভিক্ষা করতে কখনই পারব না আমরা। তার থেকে যে শত্রু তার শক্তির দম্ভের দ্বারা তার সমগ্র সামাজ্যকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছে, যে আমাদের শোচনীয় পতন ঘটিয়ে অমিত অপমান আর লজ্জার বস্তুতে পরিণত করেছে আমাদের, সে শত্রুর বিরোধিতা করব আমরা সমস্ত শক্তি দিয়ে। যদিও ভাগ্যের বলে বলীয়ান দেবতাদের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পতন ঘটেনি এখনো পর্যন্ত, তথাপি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা জেনেছি আমাদের শক্তিও কম নয়। আমাদের এই পরীক্ষিত শক্তির সত্যতা, দূরদর্শিতা, বলিষ্ঠ আশা আর অনমনীয় সংকল্পের দ্বারা অগ্রসর হয়ে সেই শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারি যে শত্রু বর্তমানে বিজয়গর্বে মত্ত হয়ে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে স্বর্গরাজ্যে। ছলে-বলে সে যুদ্ধে জয়লাভও করতে পারি আমরা।
এইভাবে সেই অধঃপতিত দেবদূত গর্বে উন্মত্ত, যন্ত্রণায় কাতর এবং আশাহত বেদনায় অভিভূত হয়ে এই কথাগুলি বললে আমাদের দুঃসাহসী শয়তান উত্তর করল, হে রাজন, বহু প্রতিষ্ঠিত রাজশক্তির প্রধান, তুমি এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে শক্তিশালী দেবদূতদের নির্ভীকভাবে নেতৃত্ব দান করে সনাতন রাজশক্তিকে বিপন্ন করে তোল এবং তার প্রভুত্বকে এক চরম পরীক্ষার সামনে উপস্থাপিত করো। জানি না তাদের শক্তির জোরে, অথবা দৈব বা নিয়তির প্রভাবে পরাজয় ঘটল না তোমার শত্রুপক্ষের। যাই হোক, আমি আমাদের এই শোচনীয় পরাজয়, পতন আর সর্বনাশের ঘটনাটি বিশেষ গুরুত্বসহকারে বিচার করে দেখেছি। আমাদের গৌরবসূর্য অস্তমিত হলেও এবং অন্তহীন দুঃখ আমাদের সকল সুখ ও অধিকারের মর্যাদাকে গ্রাস করে ফেললেও আমাদের অদম্য মনোবল এবং অপরাজেয় আত্মশক্তি ফিরে আসছে আবার। যে বিজয়ী আমাদের মত শক্তিকে পরাভূত ও ব্যর্থ করে দিয়ে এই বিড়ম্বনা ও যন্ত্রণার রাজ্যে নিক্ষেপ করেছে আমাদের, সে বিজয়ীকে সর্বশক্তিমান না বলে উপায় নেই।
এখন আমাদের ঠিক করতে হবে, আমরা কি সেই সর্বশক্তিমান বিজয়ীর প্রতিহিংসাকে চরিতার্থ করার জন্য এই অতল নরকাগ্নির মধ্য থেকে তার দাসরূপে তার যত আদেশ অপ্রতিবাদে পালন করে যাব? কিন্তু আমাদের শক্তি যখুন এখনো অটুট ও অক্ষত রয়ে গেছে তখন কেন আমরা অনন্তকাল ধরে অনন্ত শান্তির বোঝা বহন করে। যাব? কি লাভ হবে তাতে আমাদের?
একথা শুনে সেই অধঃপতিত দেবদূতরূপী শয়তান বীলজীবাব সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করল, দুঃখকষ্ট যত বেশিই হোক, তাতে দুর্বল হয়ে ভেঙে পড়া আরও দুঃখজনক। আমাদের বিরুদ্ধ শক্তির মঙ্গল সাধন করা কখনই উচিই হবে না আমাদের। তার ইচ্ছার বিরোধিতা করে তার অমঙ্গল করে যাওয়াই হবে আমাদের পক্ষে আনন্দের ব্যাপার। আমাদের পরমশ সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যদি আমাদের চরম দুরবস্থা হতে নিজের কোন স্বার্থ পূরণ করতে চায় তাহলে আমরা সর্বশক্তি দিয়ে সে উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দেব এবং তার ক্ষতি করার চেষ্টা করব। আমাদের চেষ্টা যদি ফলবতী হয় এবং আমরা যদি ব্যর্থ না হই, তাহলে সে দুঃখ পাবে এবং সে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়বে। একবার দেখ, কিভাবে সেই বিজয়ী শত্রু প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তার সহকারীদের নিয়ে অগ্নিঝড়, বস্ত্র ও বিদ্যুৎসহ স্বর্গের প্রান্তদেশ পর্যন্ত আমাদের তাড়া করে আসে এবং স্বর্গলোকের সেই খাড়াই উচ্চতা হতে নীচে ফেলে দেয় আমাদের। এখন অবশ্য আর সেই বজ্রের কোন গর্জন এই নরকগহ্বরে ধ্বনিত হয় না।
আমাদের শত্রুদের ক্রোধের প্রচণ্ডতা প্রশমিত হোক না হোক, এই ঘটনাকে উপেক্ষা করলে চলবে না। একবার চেয়ে দেখ, এক শূন্য ঊষর প্রান্তর বিস্তৃত হয়ে আছে। তোমার সামনে। আলোকহীন এই অন্ধকার প্রান্তরের এখানে-সেখানে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড হতে বিচ্ছুরিত শিখাগুলি এক ম্লান ও ভয়ঙ্কর আভা বিকীর্ণ করছে। যদি সম্ভব হয় তো ঐ অগ্নিপ্রবাহের মধ্যেই বিশ্রাম করতে হবে আমাদের। ঐখানেই আমাদের ছত্রভঙ্গ হতোদ্যম সেনানীদের পুনরায় সমবেত ও সংগঠিত করে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে দেখতে হবে কিভাবে শত্রুর উপর আমরা আঘাত হেনে আমাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারি, কিভাবে এই সর্বনাশা বিপর্যয় হতে পরিত্রাণ পেতে পারি এবং আশা থেকে এক প্রাণশক্তি আহরণ করতে পারি। যদি তা না পারি তাহলে ভেবে দেখতে হবে, এই নৈরাশ্যজনক অবস্থা থেকে কি কর্মপন্থা অবলম্বন করতে পারি।
এইভাবে শয়তান প্রবহমান বন্যাস্রোতের মধ্যে পা ডুবিয়ে মাথাটি কোনরকমে তুলে তার নিকটতম সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলতে লাগল। বিরাটাকার জলজ জন্তু অথবা টিটানীয় দৈত্য-দানবদের মত জলের উপর মাথা তুলে ভাসছিল শয়তান বীলজীবাব। ঈশ্বরের বিধানে সে শৃঙ্খলিত অবস্থায় সেই জ্বলন্ত জলরাশির উপর এমনভাবে ভাসছিল যাতে করে তার কু-অভিসন্ধি পূরণ করার প্রচুর অবকাশ ছিল। যাতে করে সে তার অপরাধের পুনরাবৃত্তি করে নতুন করে অভিশাপের বোঝা তুলে নিতে পারে তার মাথায়। সে তখন তার প্রচণ্ড ক্রোধ, প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধ বাসনায় অন্ধ উন্মত্ত হয়ে পরের ক্ষতি ও ধ্বংস সাধনের চেষ্টা করে চলেছিল, তখন সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি তার এই অশুভ চেষ্টার দ্বারা যে মানুষকে সে ছলনার দ্বারা অন্যায় পথে চালিত করে, সেই মানুষের সামনে অনন্ত মঙ্গল ও করুণার পথ প্রশস্ত হয়ে উঠেছে। সে বুঝতে পারেনি, সে চেষ্টার দ্বারা শুধু তার নিজের ক্ষতি করে চলেছে সে। তাই তার মাথায় পুঞ্জীভূত হয়ে উঠছে শুধু প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধ বাসনা। শুধু তারই জীবনে নেমে আসছে এক জটিল বিশৃঙ্খলা আর কুটিল অশান্তি।
সেই জলরাশির মধ্যে সাঁতার কেটে পায়ের তলায় এক শক্ত মাটি পেল সে। সে তখন তার পাখাদুটি বিস্তার করে শুকনো জমির উপর তার বিশাল দেহটি নিয়ে অবতরণ করল। ধূসর ছায়ান্ধকারে ভরা সেই জমির উপর জ্বলছিল শুকনো আগুন। সেই জলাশয়ে জ্বলতে থাকা আগুনের মত সে আগুন তরল ছিল না। শত শত ধাতব দাহ্য বস্তুর দ্বারা পুষ্ট এটনার মত জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি হতে যেমন ধূম ও অসংখ্য অগ্নিস্ফুলিঙ্গ উদগীরিত হয়ে বাইরের বাতাসকে উত্তপ্ত করে তোলে, তেমনি সেই ধরনের ধূমায়িত অগ্নিতপ্ত বাতাসের দ্বারা পরিপূর্ণ সেই পতিত জমির উপর পদার্পণ করল সে।
বীলজীবাবের পরেই তার সঙ্গীও পদার্পণ করল সেখানে। দুজনেই নিজেদের শক্তিতে মুক্তি পেল সেই জ্বলন্ত জলরাশি থেকে।
তারপর বীলজীবাবের সঙ্গী সেই হৃতগৌরব বিদ্রোহী দেবদূত বলল, চির-আলোকিত অনন্ত সুষমা স্বর্গলোকের পরিবর্তে চির-অন্ধকার ও বিষাদাচ্ছন্ন এই স্থানই কি আবাসভূমি হবে আমাদের? তাই হোক, কারণ সর্বশক্তিমান যা ভাল বুঝবে তাই হবে, তার ইচ্ছাই পরিপূরিত হবে এবং তারই আদেশ পালিত হবে। শুধু শক্তির জোরে যে
সকলের উপর প্রভুত্ব করছে সেই সর্বশক্তিমানের কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভাল। বিদায়, হে চিরসুখবিরাজিত চির-হাস্যোজ্জ্বল মনোরম ক্ষেত্ররাজি। স্বাগত হে বিভীষিকাময় গভীরতম নরকপ্রদেশ, তোমার এই নূতন অধিকারীকে বরণ করে নাও, স্থান ও কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যার মন পরিবর্তিত হয় না। স্বস্থানে সুপ্রতিষ্ঠিত সেই মনই নরককে স্বর্গে এবং স্বর্গকে নরকে পরিণত করে তোলে। আমি যেখানেই থাকি না কেন, কি আসে যায় তাতে? বজ্রধারী আমার শত্রুর থেকে শক্তিতে যদি আমি কিছু কম হই তাতেই বা ক্ষতি কি? এখানে অন্তত আমরা স্বাধীনভাবে থাকতে পারব। সর্বশক্তিমানের হিংসার জাল বিস্তৃত হবে না এতদূর পর্যন্ত। তার শাসন ও তাড়নের সীমা থেকে মুক্ত এ প্রদেশ। এখানে আমরা নিরাপদে রাজত্ব করতে পারি। আমার মতে রাজত্বই হবে সকল উচ্চাভিলাষের লক্ষ্যবস্তু এবং স্বর্গে দাসত্ব করার থেকে নরকে রাজত্ব করা অনেক ভাল। কিন্তু আমার সঙ্গীরা কি জন্য এখনো পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে এই শক্ত জমির উপর না উঠে সর্ববিস্মরণী ঐ জ্বলন্ত জলাশয়ের মধ্যে দুঃখে কাতর হয়ে শুয়ে আছে? কেন তারা আমাদের ছিন্নভিন্ন শক্তিগুলিকে সমবেত ও সংগঠিত করে হারানো স্বর্গরাজ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। না?
শয়তান এই সব বলার পর বীলজীবাব উত্তর করল, হে সুযোগ্য সেনানায়ক, একমাত্র সর্বশক্তিমান ছাড়া কেউ পরাভূত করতে পারত না তোমাকে। আজ যারা ঐ জ্বলন্ত জলরাশির মধ্যে দুর্দশার শেষপ্রান্তে উপনীত হয়ে ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে পড়ে আছে, তারা যদি তোমার এই তেজোদ্দীপক কণ্ঠস্বর একবার শুনতে পায় তাহলে নূতন সাহস ও উদ্যমে উদ্দীপিত হয়ে উঠবে তারা। আমরাও ওই জ্বলন্ত জলরাশির মধ্যে ছিলাম স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হবার পর।
তার কথা শেষ হতেই আর একজন তার থেকে বড় শয়তান জল ভেঙে কূলের দিকে এগিয়ে চলছিল। তার বিশাল গোলাকার ঢালটি তার কাঁধের উপর পূর্ণ চাঁদের মত উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল, যে চাঁদ তুষ্কার শিল্পীরা ফেলোলের গম্বুজ থেকে পর্যবেক্ষণ করে। তার বর্শাটিকে নরওয়ের পাহাড়ে জন্মানো সুউচ্চ পাইন গাছের মত দেখাচ্ছিল যে গাছ থেকে কোন বড় জাহাজের মাস্তুল হতে পারে। জল ভেঙে সমুদ্রপ্রমাণ সে জ্বলন্ত জলরাশির প্রান্তবর্তী কূলে উঠে দাঁড়াল সে, যে কুল ছিল ভলভার্নের পাহাড় নদী সমন্বিত উষর ও বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মত দেখতে।
জ্বলন্ত জলরাশির উপরে সেই কুলের উপর উঠে দাঁড়াতেই সে তার চিন্তামগ্ন সেই সব সঙ্গীদের ডাকল। তার সেই সব সঙ্গীদের অবস্থা হয়েছিল মিশরের রাজা ফ্যারাওর অত্যাচারে উৎপীড়িত ইহুদীদের মত। ফ্যারাওর সশস্ত্র সৈন্যরা যে মিশরীয় ইহুদীদের তাড়া করে লোহিত সাগরের উপকূলভাগ পর্যন্ত নিয়ে যায় এবং নিরাপদ উপকূলভূমি হতে সমুদ্রের জলে নিমজ্জিত ইহুদীদের ভাসমান মৃতদেহগুলিকে প্রত্যক্ষ করতে থাকে, সেই অসহায় ইহুদীদের মতই তার শয়তান সঙ্গীরাও সেই জলরাশির মধ্যে ডুবে ছিল শুধু তাদের মাথাটি বার করে।
সে তার সঙ্গীদের এত উচ্চকণ্ঠে ডাক দিল যে সেই শব্দে সেই নরকপ্রদেশের গভীরতম কন্দর পর্যন্ত ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। তাদের অবস্থার এই ভয়ঙ্কর পরিবর্তনে বিস্ময়াভিভূত তার সঙ্গীরা চমকে উঠল সেই ডাকে।
সে তাদের বলল, হে আমার সহকর্মী যোদ্ধগণ, স্বর্গের যে সুষমা এতদিন ভোগ করে এসেছ তোমরা, আজ সে সুষমা হারিয়েছ। হে অমর আত্মাগণ, তোমরা কি এমনি করে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বসে থাকবে বিকল প্রাণশক্তি নিয়ে? অথবা নিবিড় রণক্লান্তির পর স্বর্গলোকের মনোরম উপত্যকার মত এই স্থানটিকেই নিদ্রা যাবার জন্য বেছে নিয়েছ? অথবা তোমরা কি তোমাদের বিজয়ী শত্রুর বশ্যতা স্বীকার করে নিয়ে তাকে বরণ করে নেবার শপথ করেছ? সেই শত্রু তোমাদের মত অধঃপতিত ও জলমগ্ন বিদ্রোহী দেবদূতের দুরবস্থা আজও পর্যবেক্ষণ করে চলেছে সুদূর স্বর্গলোক হতে। আজও সব শত্রুতা মুছে যায়নি তার মন থেকে। যে কোন মুহূর্তে বজ্রাঘাতে সে তোমাদের গেঁথে দিতে পারে নরকগহ্বরের গভীরতম তলদেশের সঙ্গে। সুতরাং আর ঘুমিয়ে থেক না। জাগো, ওঠ। আর তা যদি না করো তাহলে চিরদিন অধঃপতিত হয়ে থাক এইভাবে।
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ডাকে যেমন তন্দ্রাচ্ছন্ন প্রহরীরা সহসা ব্যস্ত হয়ে জেগে ওঠে, তেমনি প্রধান শয়তানের ডাক শুনে তার দলভুক্ত সকলেই পাখা বিস্তার করে এক লাফে জল থেকে উঠে পড়ল কূলে। এতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের দুরবস্থার গুরুত্বটা বুঝতে পারেনি ঠিকমত, তাদের যন্ত্রণা অনুভব করতে পারেনি। তথাপি তারা তাদের প্রধানের ডাক শুনে প্রস্তুত হয়ে উঠল তার আদেশ পালনের জন্য।
মিশরে থাকাকালে এক ঘোর বিপদের দিনে আসরামপুত্ৰ মোজস সমুদ্রকূলে বেড়াতে বেড়াতে পুবের বাতাসে ভাসমান মেঘমালার মত পঙ্গপালের দলকে আহ্বান করে এবং সেই পঙ্গপালের দল যেমন অধার্মিক ফ্যারাওর রাজ্যের উপর পাখা বিস্তার করে অকালে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দেয় সেই রাজ্যের আকাশ, তেমনি এই সব অশুভ শক্তিসম্পন্ন ঈশ্বরদ্রোহী দেবদূতেরা পাখা বিস্তার করে অন্ধকার করে দিল সেই নরকপ্রদেশের আকাশকে।
তারপর তাদের নেতা বর্শা উত্তোলন করে তাদের পথনির্দেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তারা জল থেকে বাইরে উঠে দাঁড়াল শক্ত মাটির উপরে। মধ্যযুগের প্রাক্কালে ইউরোপের উত্তর দিক থেকে আক্রমণ করা বর্বর জাতিদের মতই তারা ছিল অগণ্য। সেই বর্বর জাতির আক্রমণকারীরা উত্তর দিক থেকে রাইন ও ড্যানিয়ুব নদী পার হয়ে বন্যাস্রোতের মত ছুটে এসে জিব্রাল্টার প্রণালী ও লিবিয়ার মরু অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তেমনি সেই বিদ্রোহী দেবদূতেরা তাদের সেনানায়কের নির্দেশে সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেইখানে এসে অবতরণ করল।
এই সব দেবদূতের দেহাকৃতি ছিল মানুষের থেকে সুন্দর, সুগঠিত ও রাজকীয় মর্যাদাসম্পন্ন। একদিন তাদের প্রত্যেকেই ঈশ্বরের স্বর্গরাজ্যে রাজকীয় সম্মান ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু বিদ্রোহ ও চক্রান্তের জন্য স্বর্গ থেকে মুছে যায় তাদের নাম। হারিয়ে ফেলে সব মর্যাদা ও মানসম্মান। আদি-মাতা ঈভের সন্তানদের মত তারা নূতন নামও পায়নি। স্বর্গচ্যুত হয়ে ঈশ্বরের শাস্তিস্বরূপ মানবজাতি যখন মর্ত্যলোকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তখন এই অধঃপতিত ও নামহীন বিদ্রোহী দেবদুতেরা মিথ্যা ছলনার দ্বারা দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে মানবজাতিকে। পরম স্রষ্টা ঈশ্বরকে ত্যাগ করতে বাধ্য করে তারা। ঈশ্বরের বিধানে দেবদূত থেকে বর্বরে পরিণত হয় তারা। অর্থ ও ঐশ্বর্যের মোহে দেবতার পরিবর্তে সেই সব শয়তানদেরই বরণ করে নেয় মানুষ। নাস্তিক মানবজাতির মধ্যে এই সব শয়তানরা বিভিন্ন নামে পূজিত হতে থাকে।
হে কাব্যকলার অদিষ্ঠাত্রী দেবী, বল, কোন কোন নামে অভিহিত হয়ে থাকে তারা। তাদের মধ্যে প্রথম কে এবং কে শেষে তাদের সম্রাটের ডাকে সাড়া দিয়ে সেই অগ্নিময় শূন্য বিশাল প্রান্তরে গিয়ে দাঁড়ায় তার কাছে।
তাদের মধ্যে যারা প্রধান তারা নরকগহুর হতে বেরিয়ে মানব শিকারের উদ্দেশ্যে মর্ত্যলোকে ঘুরে বেড়াতে থাকে। তারা ক্রমে ক্রমে মানবজাতির মধ্যে ঘুরে ঘুরে দেবতার আসনে তাদের অধিষ্ঠিত করে তাদের পূজা করতে বলে মানবজাতিকে। প্রতিটি মন্দিরে তাদের বিগ্রহমূর্তি বেদীতে প্রতিষ্ঠা করে তাদের পূজা করা হতে থাকে। এইভাবে তাদের জঘন্য অভিসন্ধির অন্ধকার দিয়ে ম্লান করে দিতে চায় ঈশ্বরের আলোকে।
মলোক হলো এই ধরনের এক দেবতা যার বিগ্রহ নরবলির রক্তে রঞ্জিত ও অসংখ্য পিতা-মাতার অশ্রুতে সিক্ত হয়ে থাকত সব সময়। কিন্তু অসংখ্য জয়ঢ়াক আর কসরের তুমুল শব্দে বলির শিশু ও তাদের পিতা-মাতাদের কান্না শুনতে পাওয়া যেত না। তারপর সেই নরবলির মাংস আগুনে ঝলসিয়ে ভোগ দেওয়া হত তার বিগ্রহকে।
আম্মোনাইট নামে আর এক দেবতাকে রাব্বা, আর্গর ও বেসালে পূজা করা হত। কিন্তু এই দেবতা এই পূজায় সন্তুষ্ট না হয়ে উদারহৃদয় সলোমনকে প্ররোচিত করে তাকে দিয়ে সেই ঘৃণ্য পাহাড়ের উপর ভগবানের মন্দিরের পাশে তার একটি মন্দির নির্মাণ করায়। এইভাবে জেরুজালেমের সন্নিকটস্থ সুন্দর হিল্লম উপত্যকাটি বলির রক্তে রঞ্জিত এক নরককুণ্ডে পরিণত হয়।
আর একজনের নাম হলো শেমস। অরোয়া থেকে নেবে ও হেনিবনের দক্ষিণের অরণ্যাঞ্চল পর্যন্ত মোয়াবের অত্যাচারী ভয়াবহ পুত্রেরা তার পূজা করত। এ ছাড়া সেদিন থেকে হয়রানাইম পর্যন্ত বিস্তৃত সিওমের রাজ্য ও তার ওপারে আঙুর গাছে আচ্ছাদিত সিবমার পুষ্পিত উপত্যকায় সে পূজিত হত।
আর একজনের নাম হলো পিওর। সে সিট্রিম্-এ ইহুদীরা যখন নীলনদের তীরে এক জায়গায় অভিযানে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল তখন তাদের তার জন্য অনেক পশুবলি দিতে প্ররোচিত করে। তার ফলে অনেক কষ্টভোগ করতে হয় তাদের। এরপর সে মাউন্ট অলিভ পর্যন্ত পশুবলি ও ধর্মবলির নিষ্ঠুর প্রথা প্রবর্তন করে। সেই সঙ্গে লোকের নরবলির প্রথাও চলতে থাকে। অবশেষে জোসিয়া একদিন মূর্তিপূজা ও নরবলি প্রথার উচ্ছেদ করে।
এরপর এল দু’জন নারী যারা মিশর ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী নদীবিধৌত অঞ্চলে র্যালিস ও এ্যাস্টারথ নামে দুই স্ত্রী-দেবতারূপে পূজিত হয়। দেবদূতদের বিদ্রোহী বিশুদ্ধ আত্মার মধ্যে অস্থিমজ্জা ও মাংসসমন্বিত কোন অবয়বসংস্থান না থাকায় তারা ইচ্ছামত স্ত্রী-পুরুষ যে কোন মূর্তি ধারণ করতে পারে। তারা যে কোন সময়ে সুন্দর বা কুৎসিত রূপ পরিগ্রহ করে মিত্ৰতা বা শত্রুতার দ্বারা তাদের যে কোন উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে। এই সব অপদেবতাদের প্রভাবেই ইহুদীরা তাদের প্রাচীন ধর্মসম্মত দেবতাদের ত্যাগ করে কতকগুলি পাশবিক অপদেবতার উপাসনা করতে থাকে। এই সব পাশবিক দেবদেবীর দ্বারা প্ররোচিত হয়ে তারা অন্যায় যুদ্ধে রত হয়ে ঘৃণ্য শত্রুদের সাময়িক শক্তির কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়।
ফিনীশীয়রা এই অপদেবী এ্যাস্টারথকে স্বর্গের রানী এ্যাস্তাতে নামে অভিহিত করত। এই দেবীর মাথায় দুটি শিং-এর মত দুটি অর্ধচন্দ্র বিরাজ করত। সিডোনিয়ার কুমারী মেয়েরা চন্দ্রালোকিত রাত্রিতে এই দেবীর বেদীর সামনে পূজা দিত এবং প্রার্থনার গান গাইত।
সিওনেও এই দেবী পূজিত হয় এবং একটি পাহাড়ের উপর তার এক মন্দির ছিল। কোন এক রাজা এই মন্দির নির্মাণ করে। এই রাজার অন্তঃকরণটি বেশ বড় এবং উদার হলেও এই সুন্দরী দেবীমূর্তির অশুভ প্রভাবে যত সব অপদেবতার পূজার্চনা করতে থাকে।
এর পর আসে থাম্মাজ। প্রতি বছর গ্রীষ্মকালের কোন এক তিথিতে সিডোনিয়ার কুমারীরা যার আঘাতের জন্য শোকাহত হয়ে বিলাপ করতে থাকে সকরুণ সুরে। প্রতি বছর ভেনাসের প্রেমিক এ্যাডনিসের আঘাতে একবার করে আহত হয় থাম্মাজ আর তার রক্তে রঞ্জিত হয়ে এ্যাডনিস ছুটে গিয়ে ঝাঁপ দেয় সমুদ্রের জলে। তার ব্যর্থ প্রেমের কাহিনীর দ্বারা সিয়নকন্যার হৃদয় সংক্রামিত হয়।
এরপর আর একজন এল। সে সত্যি সত্যিই বিলাপ করছিল তাঁর দুঃখে। একটি জাহাজের আঘাতে মন্দিরের মধ্যেই বিকৃত হয়ে যায় তার মৃর্তিটি। তার মাথা আর হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দেহ থেকে। বেদীর উপর মূর্তিটি পড়ে যায়। ভক্তেরা লজ্জিত হয়। ভেগন নামে সে এক সমুদ্রদানব। তার উপর দিকটা মানুষের আকৃতি আর নিচের দিকটা মাছের মত। তথাপি প্যালেস্টাইনের দক্ষিণভাগে উপকূলবর্তী এ্যাজোটাস নামে এক শহরে এই দানবদেবতার এক সুউচ্চ মন্দির নির্মিত হয়। প্যালেস্টাইনের সমস্ত উপকূলভাগ, গথ ও এ্যাসকাসনে এই দেবতা ভয়ের সঙ্গে পূজিত হয়। একারন ও গাঁজার সীমান্ত অঞ্চলেও এই দেবতা পূজিত হয়।
এরপর আসে সিরিয়ার অন্যতম দেবতা রিম্মন। দামাস্কাসের একটি সুন্দর মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হয় তার বিগ্রহমূর্তি। আব্বানা ও ফারফর নামে দুটি নদীর তীরবর্তী উর্বর ভূখণ্ডে সে পৃজিত হয়। জামন নামে সিরিয়ার সেনাপতি জন নদীতে স্নান করে কুষ্ঠরোগ থেকে মুক্ত হয়ে ইহুদীদের দেবতার ভক্ত হয়ে ওঠে। আহাজ নামে জুড়ার এক রাজা সিরিয়ার সেনাপতিকে পরাজিত করে তার পুত্রদের পুড়িয়ে মারে। প্রথমে সিরিয়ার দেবতাদের অবমাননা করার পর শেষে সেই দেবতাদের ভক্ত হয়ে সিরিয়ার ধর্ম গ্রহণ করে।
এরপর আসে ওরিসিস, আইসিস ও ওরাস। তারা ভয়ঙ্কর দৈত্যের আকার ধরে এসে মিশরের ধর্ম ও পুরোহিত সম্প্রদায়কে অবজ্ঞা ও অপমান করতে থাকে। মিশরীয় ইহুদীরা গরুদের মৃতি মন্দিরে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে দেবতারূপে পূজা করত। এ্যারন একটি সোনার বাছুর মন্দিরে দেববিগ্রহরূপে প্রতিষ্ঠা করে। রাজা জেরিবোয়ামও দুটি সোনার বাছুরমূর্তি বিগ্রহরূপে প্রতিষ্ঠা করে মন্দিরে। ওরিসিস, আইসিস ও ওরাস দৈত্যরূপে মিশরের গরুগুলোকে ভ্রাম্যমাণ ঘৃণ্য দেবতা ভেবে ধরতে যায়।
ইহুদীরা মিশরীয়দের গরু পূজা থেকেই গরুর মূর্তি মন্দিরে মন্দিরে পূজা করতে থাকে। চারণরত বলদকে তারা পরমস্রষ্টা বলে মনে করে। পরে ইহুদীদের ঈশ্বর জেহোভা মিশর থেকে চলে যাবার সময় বহু গরুকে বধ করে।
সবশেষে এল বিলায়েল। তার আত্মা সবচেয়ে বেশি হিংসাপরায়ণ। সে মন্দির ও বেদী পছন্দ করত না। তবু তার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয় মন্দিরবেদীতে। সে সবচেয়ে হিংসাকে ভালবাসত। মন্দিরের পুরোহিতরাও নাস্তিক হয়ে যায় তার প্রভাবে।
বিলায়ালের মত এলির পুত্ররাও কামনা আর হিংসার তীব্রতার দ্বারা কলুষিত করে তোলে ঈশ্বরের সৃষ্টিকে। বড় বড় শহরের পথে-ঘাটে তার প্রভুত্ব পরিলক্ষিত হয়। সেই সব শহরগুলিতে মারামারি হানাহানি হাঙ্গামার শব্দ যখন প্রাসাদশীর্ষগুলোতে ছড়িয়ে যায়, অন্ধকার নেমে আসে যখন রাজপথগুলোতে তখন বিলায়ালের পুত্ররা পানোন্মত্ত অবস্থায় দর্পভরে ঘুরে বেড়ায় সেই সব রাজপথে।
সোডম শহরের রাজপথেও এই ধরনের ঘটনা ঘটত। গিবীয়া শহরের রাজপথে কোন এক রাত্রিতে পাননান্মত্ত কয়েকজন ব্যক্তি এক নারীকে বলাৎকার করতে এলে পথের ধারে একটি বাড়ির দরজা খুলে তাকে আশ্রয় দেওয়া হয়। এই বিশৃঙ্খলাজনক ঘটনা প্রায়ই ঘটত তখন।
এরপর যারা এসেছিল তারা হলো গ্রীক দেবতাবৃন্দ যারা ছিল জোফেথপুত্র জানের সন্তান। গ্রীকপুরাণের মতে ইউরেনাস ও গী থেকেই সব দেবতা, দানব ও পৃথিবীর সৃষ্টি হয়। ইউরেনাস-এর ভাই হলো স্যাটার্ন বা শনি এবং তার জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম হলো টিটান। পরে তাদের থেকে শক্তিশালী রীয়ার পুত্র জোভ টিটান ও স্যাটার্নের কাছ থেকে স্বর্গরাজ্যের অধিকার ছিনিয়ে নেয়। পরে প্রথমে ক্রীট ও আইডা এবং পরিশেষে তুষারাচ্ছন্ন অলিম্পাসের সর্বোচ্চ শিখরে রাজত্ব করতে থাকে। এটাই ছিল স্বর্গের রাজধানী। ডেলফির পাহাড়ে এ্যাপোলোর ভবিষ্যদ্বাণী আর উত্তর গ্রীসে অবস্থিত দোদনায় জিয়াসের ভবিষ্যদ্বাণী শোনা যেত। সমগ্র দক্ষিণ গ্রীস, আদ্রিয়া হতে হেসপীরিয়া ও সুদূরবর্তী দ্বীপপুঞ্জগুলিতে এই সব দেবতার প্রভাব প্রসারিত হয়। স্যাটার্ন আদ্রিয়াতিক সাগর অতিক্রম করে ইতালি গিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে নিজেকে।
এরপর দেবদূতরূপী আরও অনেক আত্মা এল। তারা এল বিষণ্ণ মুখে ও অবনত মস্তকে। হতাশার ভারে তাদের অন্তর ভারী হয়ে থাকলেও তারা যখন দেখল তাদের প্রধানের মনে কোন হতাশা নেই, এক দুর্মর অবস্থায় উদ্দীপিত হয়ে আছে তার মনপ্রাণ, তখন আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাদের মুখগুলো। ‘ তারা দেখল তাদের প্রধান পরাজিত হলেও তার মুখে রয়েছে এক অপরাজেয় প্রাণশক্তির রহস্যময় উজ্জ্বলতা। দর্পভরে তার সমস্ত উদ্ধত শক্তিকে সংহত করে বাগাড়ম্বরপূর্ণ ভাষায় সে শক্তির দম্ভকে প্রকাশ করল সে। কিন্তু তাতে তার আসল শক্তির থেকে শক্তির দম্ভটাই প্রকাশিত হলো বেশি। তার এই দম্ভোক্তি তার অধীনস্থ অনুচরদের মন থেকে সব ভয় অপসারিত করে হারানো সাহস ফিরিয়ে আনল তাদের মনে।
এরপর প্রধান জোর গলায় ঘোষণা করল, যুদ্ধের জয়ঢাক আর ভেরী বাজার সঙ্গে সঙ্গে তার জয়পতাকা উত্তোলিত হবে ঊর্ধ্বে। আজাজেল নামে এক শয়তান হবে তার সেনাপতি এবং পতাকাবাহক।
এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পতাকা উত্তোলন করল আজাজেল। স্বর্ণ ও মণি-মুক্তাখচিত এবং বিভিন্ন অস্ত্র ও জয়চিহ্নমণ্ডিত সেই পতাকা ঊর্ধ্বলোকে বিস্তৃত হয়ে উল্কার মত জ্বলজ্বল করতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে নানারকমের ধাতব বাদ্যযন্ত্রে সামরিক বাজনা বাজতে লাগল। শয়তান সেনারা ভয়ঙ্করভাবে এমন জয়ধ্বনি দিতে লাগল যার শব্দে আদিম অন্ধকারে আচ্ছন্ন নরকপ্রদেশ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। মুহর্তমধ্যে বিচিত্র বর্ণের অজস্র পতাকা আন্দোলিত হতে লাগল আকাশে। অসংখ্য বর্শা, শিরস্ত্রাণ এবং ঢাল সঞ্চালিত হতে লাগল ইতস্তত।
এইভাবে রণসাজে সজ্জিত হয়ে উঠল শয়তানেরা। তাদের চোখমুখের উপর সেই সময় ছিল ক্রোধের পরিবর্তে এক বীরত্ববোধ এবং প্রাণপণ সংগ্রামের এক কঠিন সংকল্প। সমস্ত ভয়, সংশয় ও দুশ্চিন্তাকে মন থেকে নিঃশেষে অপসারিত করে ফেলার জন্য তারা যেন ছিল বদ্ধপরিকর।
একই সংকল্পে দৃঢ় ও একই উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেই বিশাল শয়তানবাহিনী বর্শা, ঢাল প্রভৃতি উজ্জ্বল অস্ত্রসম্ভারে প্রাচীনকালের যোদ্ধাদের বেশে সজ্জিত হয়ে সেই অগ্নিদগ্ধ ভূমির উপর দাঁড়িয়ে তাদের প্রধানের কাছ থেকে নির্দেশ পাবার প্রতীক্ষায় স্তব্ধ হয়ে রইল।
তাদের প্রধান তখন তার অভিজ্ঞ ও সন্ধানী দৃষ্টি ইতস্তত পরিচালিত করে সেই শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করতে লাগল। দেখল সেই বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি সেনার মুখ এবং চেহারা দেবতাদের মত, তাদের সংখ্যা অগণ্য। তা দেখে এক অপরিসীম গর্বে ভরে উঠল তার বুক। এক সুদৃঢ় শক্তির উচ্ছ্বসিত গৌরব উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে। পৃথিবীতে আসার পর থেকে কোন মানুষ সুসংগঠিত করে দেখেনি কখনো।
এইভাবে দক্ষিণ এশিয়ার লেগ্রায় দৈত্যরা দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। থীবস ও ইলিয়ামে যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় তাতে দেবতারা উভয় পক্ষে যোগদান করে সাহায্য করে দু পক্ষকে। উথার পুত্র রাজা আর্থারও ইংরেজ নাইটদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে ইতালির ক্যালাব্রিয়া ও এ্যাসপ্রামতে, দামাস্কা বা মরোক্কোতে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। খ্রিস্টানজীবি শার্লেমেনও সারাসীনদের সঙ্গে যুদ্ধে ফস্তারাব্বিয়াতে তার সেনাপতিগণসহ পরাজিত হয়।
এই সব মর্ত্যমানব বা যোদ্ধাদের সামরিক শক্তির থেকে সেই দেবদূতরূপী শয়তানদের শক্তি ছিল অনেক বেশি। অতুলনীয় সামরিক শক্তিসম্পন্ন সেই সব শয়তানরা রণসাজে সজ্জিত হয়ে তাদের প্রধানের কাছ থেকে চূড়ান্ত আদেশ পাবার জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগল। আকারে ও দর্পিত অঙ্গভঙ্গিমায় তাদের প্রধান ছিল তাদের সবার থেকে শ্রেষ্ঠ। উদ্ধত প্রাসাদশীষের মত দাঁড়িয়ে ছিল সে তাদের মাঝে। অধঃপতিত দেবদূত হলেও তার অঙ্গজ্যোতি তার স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা হারায়নি তখনো। তখনো ম্লান হয়নি তার গৌরব। কুয়াশাচ্ছন্ন দিগন্তে নবোদিত সূর্য অথবা গ্রহণকালে রাহুগ্রস্ত চন্দ্রের মত শুধু স্তিমিত দেখাচ্ছিল তার তেজ। স্তিমিত হলেও তার তেজ অন্য সব অধঃপতিত দেবদূতদের তুলনায় ভাস্বর হয়ে উঠেছিল সবার উপরে। যদিও তার মুখমণ্ডলে বজ্রাঘাতের এক ক্ষতচিহ্ন ছিল পরিস্ফুট এবং তার ম্লান মুখের উপরে বিরাজিত ছিল উদ্বেগের ছায়া, তথাপি এক দর্শনীয় সাহসিকতা প্রকট হয়ে উঠেছিল তার জ্বযুগলের মধ্যে। প্রতিশোধ বাসনায় উদ্ধত হয়ে উঠেছিল এক অনমনীয় দম্ভ। তার দু’চোখের মধ্যে এক দৃঢ় সংকল্পের নিষ্ঠুরতা ফুটে উঠলেও তার অধঃপতিত অনুচরবৃন্দের যন্ত্রণাভোগ দেখে অনুশোচনা ও সমবেদনা জাগছিল তাদের জন্য। একমাত্র শুধু তার অপরাধ ও বিদ্রোহের জন্য অসংখ্য আত্মা তাদের অনন্ত ঐশ্বর্যমণ্ডিত স্বর্গীয় আবাসভূমি থেকে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত হয়ে পতিত হয়েছে এই দুঃসহ নরকপ্রদেশে। আকাশ থেকে ঝরে পড়া জ্বলন্ত রৌদ্রতাপে পত্ৰচ্যুত হয়েও যেমন পর্বতোপরি পাইন গাছগুলি ও অরণ্যমধ্যস্থিত ওক গাছগুলি বিশুষ্ক শাখাপ্রশাখাসহ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে তেমনি হৃতগৌরব হয়েও তার অনুচরেরা তার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে দাঁড়িয়ে ছিল তার কাছে।
অবশেষে সে তাদের কিছু বলার চেষ্টা করল। তারা তা বুঝতে পেরে মাথা নত করে স্তব্ধ হয়ে রইল। তিনবার সে চেষ্টা করল। কিন্তু তিনবারই সে না চাইলেও অবধারিত অবাঞ্ছিত অশ্রুধারায় অবরুদ্ধ হয়ে উঠল তার কণ্ঠ। পরে এক গভীর দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে তার কথা পথ খুঁজে বেরিয়ে এল তার কণ্ঠ থেকে।
সে তার অনুচরদের সম্বোধন করে বলল, হে অমর আত্মাগণ, একমাত্র সর্বশক্তিমান ছাড়া আর কারো সঙ্গে তোমাদের শক্তির তুলনা হয় না। যে যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণামস্বরূপ তোমরা এই ঘৃণ্য ও অবর্ণনীয় দুরবস্থায় পতিত হয়েছ সে যুদ্ধ কিছুমাত্র অগৌরবের নয়। কে তার মনের সমস্ত শক্তি এবং বর্তমান ও অতীত সম্পর্কিত জ্ঞানের গভীরতা দিয়ে বুঝতে পেরেছিল স্বর্গের সম্মিলিত দেবগণ আমাদের প্রতি-আক্রমণের দ্বারা বিব্রত ও বিপন্ন হবে? এই সব অধঃপতিত ও স্বর্গ হতে নির্বাসিত দেবদূতেরা তাদের আদি আবাসভূমি স্বর্গলোক নিজেদের শক্তিতে পুনরুদ্ধার করতে পারবে না, একথা এখন কেউ বিশ্বাস করবে? কে বলবে আমি সব বিপদ অতিক্রম করতে না পেরে সব আশা হারিয়ে ফেলেছি? সে আজ তার রাজশক্তি নিয়ে স্বর্গের সিংহাসনে পূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে রাজত্ব করছে। তার শক্তির পরিমাণ সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতাই বিদ্রোহে প্রলুব্ধ করে আমাদের পতনকে ডেকে আনে।
এখন শুধু আমরা সেই শক্তির ও আমাদের নিজেদের শক্তির পরিমাণ কত তা জানি। এখন শুধু আমাদের প্রয়োজন উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে যাওয়া। এখন সামরিক শক্তি, ছলনা, প্রতারণা প্রভৃতি সব কিছু প্রয়োগ করে সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে পর্যদস্ত করতে হবে। তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে, যারা গায়ের জোরে শত্রুদের জয় করে তারা শুধু অর্ধশক্তিকে জয় করে। সম্পূর্ণরূপে জয় করতে পারে না। স্বর্গ, মর্ত্য ও নরক ছাড়া মহাশূন্যমণ্ডলে আরও অনেক নূতন জগতের সৃষ্টি হতে পারে এবং সেখানে ঈশ্বরের সন্তান মানবজাতির মত এক নূতন জাতির বংশধারার প্রবর্তন করার ইচ্ছা ছিল ঈশ্বরের। আমরা সেই ধরনের কোন জগতে বসতি স্থাপন করব। কারণ আমাদের মত স্বর্গীয় আত্মা বা দেবদূতেরা কখনো নরকগহ্বরের এই অন্ধকারে আবদ্ধ থাকতে পারে না চিরদিন। কিন্তু অনেক চিন্তাভাবনার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন ভেবে দেখতে হবে, অশান্তি আর হতাশায় মন আমাদের আচ্ছন্ন হয়ে থাকলেও পরাভব বা বশ্যতা স্বীকারের কথা ভাবতেই পারি না আমরা। সুতরাং একমাত্র যুদ্ধ, ঘোষিত বা অঘোষিত যুদ্ধই সমাধান করতে পারে সকল সমস্যার।
এই কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে বলিষ্ঠদেহী সেই সব শয়তানের কটিদেশে আবদ্ধ কোষগুলি থেকে মুক্ত হয়ে অসংখ্য শাণিত তরবারি ঊর্ধ্বে উত্তোলিত হলো। সেই সব তরবারির উজ্জ্বলতায় আলোকিত হয়ে উঠল অন্ধকার নরকপ্রদেশ। তাদের বজ্রমুষ্ঠিগুলি ঢালের সঙ্গে ঘর্ষিত হওয়ায় স্বর্গলোকের বিরুদ্ধে এক প্রকাশ্য বিদ্রোহ বা যুদ্ধের সশব্দ প্রস্তুতি প্রকটিত হয়ে উঠল।
অদুরে একটি পাহাড় ছিল যার শিখরদেশ হতে ক্রমাগত অগ্নি আর ধুম উদগীরিত হচ্ছিল। সেই পর্বতশিখরটি ছিল উজ্জ্বল প্রস্তরের দ্বারা মণ্ডিত। এর থেকে বোঝা যাচ্ছিল সেই পর্বতের গর্ভের মধ্যে ছিল অনেক জ্বলন্ত ধাতু।
অভিযানকারী রাজার সৈন্যদল হতে একটি অগ্রবর্তীবাহিনী যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে আগে গিয়ে শিবির স্থাপন বা পরিখা খনন করে তেমনি বিদ্রোহী দেবদূতরূপী শয়তানদের মধ্যে থেকে একটি দল পাখা মেলে উড়ে গেল সেই পর্বতশিখরে। ম্যামন তাদের নেতৃত্ব দান করল। ম্যামনের দেহটা ছিল কুজ প্রকৃতির এবং তার চোখের দৃষ্টি সব সময় অবনত ছিল। যতদিন সে স্বর্গে ছিল তার অবনত দৃষ্টি নিয়ে সে শুধু রাজপথের ঐশ্বর্যগুলিই দেখতে পেত। কিন্তু স্বর্গলোকের ঊর্ধ্বতন স্তরের কোন পবিত্র বা স্বর্গীয় সুষমা ও সৌন্দর্য দেখতে পেত না সে।
এই ম্যামনের দ্বারা প্ররোচিত হয়েই মানবজাতির অপবিত্র হাতে ধনরত্নের আশায় পৃথিবীর গর্ভদেশ খনন করে বহু স্বর্ণখণ্ড নিয়ে আসে। এই উদ্দেশ্যেই তারা ঐ পর্বতের ধূমায়িত শিখরদেশ বিদীর্ণ করে পৃথিবীর গর্ভে চলে যায় এবং ঐ মুখ নিয়েই বেরিয়ে আসে। তবে নরকের মধ্যে যে ঐশ্বর্য আছে, মাটির গর্ভে যে সম্পদ আছে তার জন্য কেউ যেন মর্ত্যলোকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ না হয়ে ওঠে। কারণ যারা মৰ্তমানবদের সম্পদ ও কৃতিত্বের জন্য বড়াই করে, যারা ব্যাবিলনের বিস্ময়কর স্বর্গোদ্যান ও মিশরের পিরামিডের জন্য গৌরববোধ করে তাদের জানা উচিত, মানুষ এক যুগে অসংখ্য হাতে অবিরাম শ্রমসহকারে যে সব গৌরবময় কীর্তি ও শিল্পকর্ম গড়ে তোলে, বিদেহী আত্মা বা দেবদূতেরা একদিনেই কত সহজেই তা নস্যাৎ করে দেয়। সামনের ঐ প্রান্তরের মধ্যেও অনেক ছিদ্রপথে পৃথিবীর গর্ভ থেকে অগ্নি উদগীরিত হচ্ছে।
অদুরে মাটির ভিতর থেকে যেখানে ঐকতানের মত এক সুরধারা বেরিয়ে আসে, সেইখানে অনেক মূর্তি ও কারুকার্যখচিত এক স্বর্ণমন্দির নির্মিত হয়েছে। সে মন্দিরের ছাদটিও স্বর্ণনির্মিত ছিল। মিশরের অন্তর্গত প্রাচীন কাইরো বা ব্যাবিলনের স্বর্ণযুগেও এই ধরনের অপূর্ব কোন দেবমন্দির নির্মিত হয়নি সেখানে। ও মন্দিরের সৌন্দর্যের কোন তুলনাই হয় না অতীতের কোন মন্দিরের সঙ্গে। এর সুউচ্চ স্তম্ভগুলি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার স্বর্ণনির্মিত ছাদের উপর নক্ষত্রের মত অসংখ্য বাতির আলো জ্বলে। মনে হয় আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে সে আলো। অসংখ্য মানুষ এ মন্দির দেখে এর স্থাপত্যকীর্তি ও স্থপতির প্রশংসা করে। এর স্থপতিই স্বর্গলোকের যত সব প্রাসাদ ও সৌধগুলিকে নির্মাণ করে তোলে নিজের হাতে। লোকে বলে তার নাম নাকি মুনসিবার। প্রাচীন গ্রীসেও তার নাম শোনা যেত এবং সর্বজনবন্দিত ছিল সে নাম।
তবু এই কীর্তিমান স্থপতিও স্বর্গচ্যুত হয়। ক্রুদ্ধ জোভ স্বর্গলোকের প্রান্তবর্তী এক দুর্গপ্রাসাদ হতে এই নরকে নিক্ষেপ করে তাকে। সেদিন গ্রীষ্মকালের কোন এক দিন। সকালে স্বর্গ থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে সূর্য অস্ত যাবার সময় ঈজিয়ান দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত লেমনস দ্বীপে পতিত হয় সে।
কিন্তু যারা একথা বলে তারা ভুল বলে। কারণ সেই স্থপতি এই সব বিদ্রোহী দেবদূতদের সঙ্গেই চিৎ হয়ে পতিত হয় এই নরকপ্রদেশে। যে স্থপতি একদিন স্বর্গে অবস্থানকালে কত প্রাসাদ ও অট্টালিকা নির্মাণ করত সেখানে, আজ সে সেই ধরনের প্রাসাদ ও সৌধমালা নরকে নির্মাণ করার জন্যই পতিত হয়েছে এখানে।
এদিকে দুতেরা রাজার আদেশে শয়তানদের রাজধানী প্যান্ডিমোনিয়ামে রাজপরিষদের ঘোষণা করে বেড়াতে লাগল। প্রতিটি সেনাবাহিনী হতে একজন করে সুযোগ্য প্রতিনিধিকে আহ্বান করল তারা। এইভাবে হাজার হাজার প্রতিনিধি যোগদান করল সে সভায়।
সে সভাস্থলের প্রকাণ্ড প্রবেশপথগুলি জনতার ভিড়ে ভরে গিয়েছিল। সুপ্রশস্ত হলঘরটিতে একেবারেই জায়গা ছিল না। সে ঘরের শুধু মেঝেতে নয়, মাথার উপর শূন্যেও অনেক দেবদূত পাখার উপর ভর করে ঝুলছিল।
বসন্তকালের মৌমাছিরা যেমন সকালবেলায় শিশিরসিক্ত ফুলের উপর ভিড় করে গুঞ্জন করতে থাকে, তেমনি সেই সভাগৃহে সমবেত প্রতিনিধিরা ভিড় করে কলগুঞ্জনে মুখরিত করে তুলেছিল সভাস্থলটিকে। তারা ছিল সংখ্যায় অগণ্য এবং এক স্বল্প পরিসরের মধ্যে অতিশয় ঘনসংবদ্ধ অবস্থায় ছিল।
সে এক আশ্চর্যজনক দৃশ্য। আকৃতিতে আসলে যারা ছিল মর্তমানবদের থেকে : অনেক বড়, তারা পিরামিডের মত নিজেদের দেহগুলিকে মায়াবলে যথাসম্ভব ক্ষুদ্রাকৃতি করে সেই ছোট সভাগৃহটিতে অগণিত সংখ্যায় ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই সব বিদেহী আত্মারা ইচ্ছামত ছোট-বড় করতে পারে নিজেদের দেহকে। তাদের মধ্যে ছিল প্রাচীন রোম ও গ্রীসের বহু অপদেবতা ও শয়তান। তারা স্বর্গআসনে ছিল সমাসীন। ক্ষণকাল নীরবতা পালনের পর সভার কার্যবিবরণী পাঠ করা হলে আলোচনা শুরু হলো।
০২য় সর্গ
দ্বিতীয় সর্গ
আলোচনার শুরুতেই তাদের প্রধান শয়তান স্বর্গের অধিকার পুনরুদ্ধার করার জন্য যুদ্ধের ঝুঁকি নেওয়া হবে কি না সে বিষয়ে এক বিতর্কের অবতারণা করল। উপস্থিত প্রতিনিধিদের কেউ কেউ যুদ্ধের সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করল। আবার কেউ কেউ যুদ্ধ হতে প্রতিনিবৃত্ত থাকার পরামর্শ দান করল। তখন তৃতীয় প্রস্তাব চাওয়া হতে তা উত্থাপিত হলো। শয়তান প্রধানই তার উল্লেখ করে বলল, স্বর্গে থাকাকালে । এর আগে তারা শুনেছিল ঈশ্বর আর এক জগৎ ও আর এক ধরনের মানবজাতি সৃষ্টি করবে। সে মানবজাতি হবে প্রায় দেবতাদেরই সমকক্ষ। এই ধরনের কোন জগৎ আছে কি না আমাদের তা খুঁজে বার করতে হবে। সম্ভব হলে সেখানে আমরা চলে যাব এবং সেই মানবজাতির সাহায্য নেব এই যুদ্ধে।
কিন্তু এই কঠিন অনুসন্ধানকার্যে যেতে কেউই উৎসাহ দেখাল না। তখন শয়তান নিজেই যেতে চাইলে সকলে হর্ষধ্বনি করে অভিনন্দন জানাল তাকে। শয়তান নরকদ্বারের। দিকে এগিয়ে গেলে তখনকার মত সভা ভঙ্গ হলো। এদিকে নরকদ্বারে গিয়ে শয়তান প্রধান দেখল দ্বার রুদ্ধ। কিভাবে সে দ্বার পার হয়ে নতুন জগতের সন্ধানে গেল তারই বর্ণনা আছে এই সর্গে।
রাজকীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে একটি সুউচ্চ সিংহাসনে সমুন্নত অবস্থায় বসেছিল শয়তানরাজ। স্বর্ণ ও মণি-মুক্তামণ্ডিত তার রাজসভার ঐশ্বর্য পারস্যের ওরহমাস, ভারতবর্ষ ও প্রাচ্যের রাজা-মহারাজের ঐশ্বর্যকেও হার মানিয়ে দিয়েছিল। সে তার বুদ্ধিবলে এই অশুভ খ্যাতিসম্পন্ন রাজসম্মানে অধিষ্ঠিত করে নিজেকে। হতাশার গভীর গহুর থেকে সমুচ্চ উচ্চাভিলাষের শিখরদেশে উন্নীত করে সে তার মনকে। স্বর্গের বিরুদ্ধে এক দুর্ধর্ষ সমরাভিযানের জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠে সে। অনাগত সাফল্যের এক গর্বোদ্ধত কল্পনায় উদ্দীপিত হয়ে সে বলতে থাকে,
হে শক্তিমান রাজন্যবর্গ ও স্বর্গের অপদেবতাগণ, আমরা উৎপীড়িত ও অধঃপতিত হলেও যেহেতু আমাদের সুসংহত ও অবিনশ্বর শক্তিকে নরকপ্রদেশের কোন গভীরতাই আবদ্ধ করে রাখতে পারবে না চিরতরে, সেইহেতু স্বর্গলোক অধিকারের আশা এখনো ত্যাগ করিনি আমি। এই পতনের শত অপমানকে অগ্রাহ্য করে আমাদের অমর গুণাবলী গৌরবময় ও ভয়াবহ হয়ে উঠবে আরও এবং ভাগ্যের অন্য কোন বিপর্যয়কে ভয় করবে না। যদিও স্বর্গের দেবতাদের বিধানে ন্যায়সঙ্গতভাবে আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি তথাপি আমার বুদ্ধি ও সামরিক শক্তির জন্য তোমরা তোমাদের স্বাধীন ইচ্ছা ও পরামর্শের দ্বারা সর্বসম্মতিক্রমে অবিসম্বাদিত ও নিরাপদ এক রাজকীয় মর্যাদায় এই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেছ আমাকে। কিন্তু আমি যখন স্বর্গলোকে আরও উন্নত ও সম্মানজনক অবস্থায় অধিষ্ঠিত হব তখন অনেকে আমায় হিংসা করতে পারে। কিন্তু যে সর্বশক্তিমান বস্ত্রধারী জুপিটারের সমকক্ষ এবং তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে তাকে হিংসা করার মত ক্ষমতা কার আছে?
আর এখানেই বা কে আমায় ঈর্ষা করবে? কেই বা যুদ্ধ করবে আমার বিরুদ্ধে? যেখানে পরিণামে ভাল বা লাভজনক কিছু পাবার আশা বা সম্ভাবনা না থাকে সেখানে কখনো যুদ্ধ হতে পারে না। যে নরকপ্রদেশে সকলেই যন্ত্রণায় জর্জরিত, সকলেই যেখানে একই যন্ত্রণায় অংশগ্রহণ করে চলেছে, সেখানে কেউ কখনই বেশি যন্ত্রণা ভোগ করতে চাইবে না। তার ফলে স্বর্গের থেকে এখানে আমরা আরও বেশি করে ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পে দৃঢ় হয়ে আমাদের পুরনো অধিকারের দাবি জানাব। নিশ্চয়ই আমরা আমাদের হারানো সুখসম্পদ পুনরায় লাভ করব। কিন্তু কিভাবে কোন উপায়ে তা সম্ভব হবে, আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করব প্রকাশ্যে অথবা কোন গোপন কৌশল অবলম্বন করে এগিয়ে যাব, সে বিষয়ে এখন আলোচনা করে দেখব। এ বিষয়ে এখন কোন পরামর্শ দেবার থাকলে সে তা বলতে পারে।
তার কথা শেষ হতেই মলোক নামে শয়তানদের আর এক দণ্ডধারী রাজা উঠে দাঁড়াল। শক্তি ও সমরকৌশলের দিক থেকে অন্যান্য শয়তানদের থেকে সে ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। অবস্থার প্রতিকূলতা এবং হতাশা তাকে করে তুলেছিল আরও ভয়ঙ্কর এবং দুর্বার। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সমকক্ষ হয়ে ওঠার উচ্চভিলাষে সে হয়ে উঠেছিল নিভীক। স্বর্গ বা নরকের কোন শাস্তির ভয়াবহতাকেই গ্রাহ্য করত না সে।
মলোক এবার বলতে লাগল, আমি চাই প্রকাশ্য যুদ্ধ। আমরা যখন বসে বসে আলোচনা করছি, কৌশলের কথা চিন্তা করছি তখন আমাদের লক্ষ লক্ষ স্বর্গচ্যুত অনুগামীরা যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে স্বর্গাভিযানের জন্য চূড়ান্ত নির্দেশ পাবার প্রতীক্ষায় স্তব্ধ হয়ে আছে। নরকের এই লজ্জাজনক ঘৃণ্য গহ্বরকেই তারা তাদের বর্তমান আবাসভূমি হিসাবে মেনে নিয়েছে। এটা তাদের আবাসভূমি নয়, কারাগার। অথচ যারা আমাদের উপর অত্যাচার ও অবিচার করেছে তারা আমাদের দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিয়ে রাজত্ব করছে স্বর্গে। না, কোন শক্তিই আমাদের আবদ্ধ করে রাখতে পারবে না এখানে। এখনি প্রস্তুত হও সকলে। এক নরকাগ্নি ও ক্রোধের প্রচণ্ডতায় মণ্ডিত হয়ে স্বর্গলোকের আকাশচুম্বী সৌধমালাগুলিতে জোর করে প্রবেশ করব আমরা। আমাদের উপর যত অত্যাচার করা হয়েছে সেই সব অত্যাচারকে অস্ত্রে পরিণত করে তুলব আমরা। সেই অস্ত্র দিয়ে আঘাত করব সেই সর্বশক্তিমান অত্যাচারীকে। যুদ্ধের ধ্বনি শুনে সেই অত্যাচারী বেরিয়ে এসেই শুনতে পাবে নারকীয় বর্জ্যের শব্দ, বিদ্যুতের পরিবর্তে শুনতে ও দেখতে পাবে নরকাগ্নি আর বিদ্রোহী দেবদূতদের ক্রোধকুটিল রক্তচক্ষু। বুঝতে পারবে তারই আবিস্কৃত সালফারমিশ্রিত যে অগ্নিদ্বারা আমাদের দগ্ধ করে সেই সালফার আর অগ্নি তার সিংহাসনের মধ্যে মিশে আছে।
কিন্তু স্বর্গারোহণের পথটি বড় দূরতিক্রম্য, বড় কঠিন। সে পথ এত উঁচু এবং খাড়াই যে পাখা মেলে সেখানে উঠে যাওয়া সম্ভব হবে না আমাদের পক্ষে।
এখন ভেবে দেখতে হবে স্বর্গ আর নরকের মধ্যবর্তী স্থানে যে বিস্মৃতির নদী আছে সেই নদী পার হয়ে স্বর্গে উঠে যেতে পারব কি না। ঊর্ধ্বগতিই আমাদের স্বভাবজাত ধর্ম। পতন বা নিম্নগতি আমাদের স্বভাবের বিপরীত। কিছুদিন আগে ভয়ঙ্কর শত্রুরা যখন আমাদের পিছন পিছন তাড়া করে নিয়ে আসছিল এই গভীর নরকগহ্বরে, যখন আমরা ছুটে পালিয়ে এসে রক্ষা পাই তখন আমাদের কি মনে হচ্ছিল? তাহলে আরোহণের কাজটা কি খুব সহজ হবে? এটা কি ভয়ের ব্যাপার নয়? যে আমাদের থেকে অধিকতর শক্তিশালী, আবার তাদের রোষ উৎপাদন করে নিজেদের ধ্বংস টেনে আনা কি উচিত হবে? আবার এই নরকে যদি নতুন করে আরও বেশি পরিমাণে শাস্তি ভোগ করতে হয় তাহলে অনেক বেশি পরিতাপের বিষয়।
তাছাড়া এই ঘৃণ্য নরকপ্রদেশে বাস করাটাই তো সবচেয়ে দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়। এই যে আমরা অনিবার্য অগ্নির জ্বালায় ক্রমাগত দগ্ধ হয়ে আমাদের শত্রুর ক্রোধাবেগকে পরিতৃপ্ত করে চলেছি, এর থেকে দুঃখ বা পরিতাপের কি থাকতে পারে? এর থেকে বেশি শাস্তি মানেই তো একবারে ধ্বংস বা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া। তা যদি হয় তাহলে আমাদের ভয় কিসের? তার রোষ উৎপাদনে আর ভয় পাই না আমরা। এই রোষ চরমে উঠলে হয় আমাদের ধ্বংস করে দেবে আর তা না হলে বিদ্রোহী আত্মা হিসাবে এই নরকেই রেখে দিতে পারে। কিন্তু এই আত্মা অমর ও অবিনশ্বর হলেও এখানে অন্তহীন যন্ত্রণা সহ্য করে যেতে হবে আমাদের। তথাপি এই যন্ত্রণার মাঝেও আমাদের সর্বশক্তিমান শত্রুর স্বর্গলোক আক্রমণ করার মত উপযুক্ত শক্তি আছে আমাদের। তার সিংহাসন যত দুর্গম স্থানেই থাক না কেন, তাদের ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলে সে সিংহাসন অধিকার করব আর তা না হলে চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করব তাদের উপর।
এক কুটিল জাকুটির মধ্যে দিয়ে তার কথা শেষ করল মলোক। সে বলল, প্রতিশোধাত্মক এই যুদ্ধ যত ভয়ঙ্করই হোক, দেবতারা তার থেকে বেশি ভয়ঙ্কর।
এবার অন্য দিক থেকে বিলায়েল নামে একজন উঠে দাঁড়াল। তার সমগ্র দেহাবয়বের মধ্যে ছিল এক মর্যাদা আর মহিমার ভাব। মনে হচ্ছিল সে যেন এক কৃতী মহান পুরুষ। কিন্তু তার ভিতরটা ছিল মিথ্যা আর ফাঁপা। এক কপট মাধুর্যে ভরা তার কণ্ঠনিঃসৃত প্রতিটি কথা সুন্দর এক একটি যুক্তি দিয়ে অন্যায়কে ন্যায় এবং মন্দকে শুভ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করত। তার যুক্তির অস্ত্র দিয়ে সে প্রতিপক্ষের যে কোন পরিণত যুক্তি ও পরামর্শকে খণ্ডন করার চেষ্টা করত।
তার সব চিন্তা ছিল নিম্নমানের। পাপকর্মে তার ছিল অসাধারণ উৎসাহ ও তৎপরতা, কিন্তু কোন পুণ্যকর্মে বা মহকর্মে সে ছিল একেবারে অলস এবং মন্দগতি। কিন্তু তার কণ্ঠে এমনই মাধুর্য ছিল যে তার কথা সকলেই মন দিয়ে শুনত।
এবার সে বলতে শুরু করল, হে নেতৃগণ, আমিও সরাসরি যুদ্ধের পক্ষে। এক প্রবল ঘৃণার আবেগে আমার চিত্তও পরিপূর্ণ আপনাদের মত। কিন্তু অবিলম্বে যুদ্ধ শুরু করার জন্য যে যুক্তি প্রদর্শিত হয়েছিল, সেই যুক্তি প্ররোচিত করার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে প্রতিনিবৃত্তও কম করেনি। যুদ্ধের সামগ্রিক সাফল্যের সম্ভাবনাকে ম্লান করে দিয়ে এক অশুভ সংশয়ের ছায়া বিস্তার করেছে আমার মনে। যারা শুধু এক ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ বাসনাকে লক্ষ্য করে সমস্ত সমরায়োজনকে সংহত করে এবং মন্ত্রণা ও জল্পনা-কল্পনার জাল বিস্তার করে, যারা শুধু এক হতাশার ভিত্তির উপর তাদের সমস্ত সাহসিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে বাধ্য।
কিন্তু কোন্ প্রতিশোধ তারা গ্রহণ করতে চায়? স্বর্গের দুর্গকারগুলি অগণিত সশস্ত্র সৈনিকদের দ্বারা পরিপূর্ণ। দুর্ভেদ্য সেই দুর্গদ্বারে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য। স্বর্গলোকের সীমান্তবর্তী নিম্নাঞ্চলগুলিতেও আছে অসংখ্য সৈন্যশিবির। এমন কি রাত্রির অন্ধকারেও অসংখ্য পক্ষবিশিষ্ট দেবসেনা দূর দূরান্ত পরিভ্রমণ করে প্রহরা দিয়ে চলেছে এবং তাদের প্রতি সদাসতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছে।
অথবা যদি আমরা বলপ্রয়োগের দ্বারা সেখানে প্রবেশ করি, যদি নরকপ্রদেশের সমস্ত অধিবাসী অভিযানে যোগদান করে এবং যদি আমরা আমাদের সম্মিলিত দেবদ্রোহিতার কৃষ্ণকুটিল ও নারকীয় অন্ধকারের দ্বারা স্বর্গলোকের পবিত্র জ্যোতিপুঞ্জকে ম্লান করে দিতে চাই, তাহলেও আমাদের প্রধানতম শত্রু ঈশ্বর অম্লান ও অক্ষত অবস্থায় অধিষ্ঠিত হয়ে থাকবে তার সিংহাসনে। আমাদের সকল অভিযান ও সমরোদ্যমকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে দিয়ে অপরাজেয় রয়ে যাবে সেই স্বর্গলোক।
এইভাবে যদি আমরা প্রতিহত হই সে যুদ্ধে, তাহলে ভূমিসাৎ হয়ে যাবে আমাদের সকল আশার উত্তঙ্গ সৌধ। আর তার ফলে সর্বশক্তিমান বিজেতা ঈশ্বরের ক্রোধাবেগ হবে বর্ধিত। সে তখন তার ক্রোধের সেই প্রচণ্ডতা আমাদের উপর প্রয়োগ করে সমূলে বিনাশ করবে আমাদের। আমাদের উপরে অকালে নেমে আসবে এক শোচনীয় পরিণতি।
তাহলে আসলে ক্ষতিটা কার হবে? মৃত্যুর অন্ধকার গর্ভে চিরতরে বিলীন হয়ে যাওয়ার থেকে এই নরকযন্ত্রণা ভোগ করে যাওয়া অনেক ভাল। আমাদের বুদ্ধি আর চিন্তাশক্তি আছে। আমাদের চিন্তাভাবনাকে অনন্ত প্রসারিত করে দিতে পারি।
কে জানে, এইখানে এইভাবে থাকাটাই হয়ত মঙ্গলজনক আমাদের পক্ষে। আমাদের ক্রুদ্ধ শত্রু ঈশ্বর আমাদের জন্য যে মঙ্গলের বিধান কোনদিনই করবে না, সে মঙ্গল আমাদের এখান থেকেই খুঁজে নিতে হবে। কিন্তু আমরা যদি আমাদের উদ্ধত কামনাকে পূরণ করার জন্য যুদ্ধ করি সে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে তাহলে অনন্তকাল ধরে শাস্তিভোগ করে যেতে হবে আমাদের।
যারা যুদ্ধ চায় আমাদের মধ্যে তারা বলতে পারে যুদ্ধ করে স্বর্গলোক অধিকার না করলে অনন্তকাল ধরে আমাদের এখানে দুঃখ ভোগ করে যেতে হবে। কিন্তু যেভাবে আমরা আছি এখন এখানে তাতে দুঃখ-কষ্ট কোথায় তা বুঝতে পারছি না। কিসের কষ্ট? এই যে আমরা বসে আছি, স্বাধীনভাবে আলোচনা করছি, সশস্ত্র অবস্থায় স্বাধীনভাবে বিচরণ করছি, এটাই যথেষ্ট নয় কি? কিন্তু আমরা যদি যুদ্ধ করতে গিয়ে দেবতাদের নিক্ষিপ্ত বজ্ৰদ্বারা তাড়িত হয়ে ক্রমাগত পালিয়ে বেড়াই এবং অবশেষে এই নরকের মত অন্ধকার গর্ভে আশ্রয় গ্রহণ করি আঘাত থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য, অথবা যদি শৃঙ্খলিত অবস্থায় জ্বলন্ত হ্রদে নিমজ্জিত হয়ে থাকতে হয় তাহলে সেটা কি আরো খারাপ হবে না?
আমাদের দগ্ধ করার জন্য যে অশুভ অগ্নি একদিন প্রজ্জ্বলিত হয় তার নিঃশ্বাসে, আজ আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করলে তার প্রচণ্ড ক্রোধাবেগে তপ্ত সেই নিঃশ্বাস থেকে আগের থেকে সাতগুণ বেশি জ্বলবে। আবার সে তার চরম প্রতিশোধ বাসনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে প্রসারিত করে দেবে তার রক্তলোহিত দক্ষিণ হস্তটি।
অথবা ধরো, আজ আমরা যারা এক গৌরবময় যুদ্ধের পরিকল্পনা করছি, এবং যে যুদ্ধে প্ররোচিত করছি সকলকে সেই আমাদের মাথার উপর যদি নরকের আকাশখানা সহসা প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠে ভেঙে পড়ে, যদি আমাদের আবার সেই জ্বলন্ত সমুদ্রের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে থাকতে হয়, যদি দেবতাদের দ্বারা নিক্ষিপ্ত প্রস্তরের সঙ্গে গ্রথিত থাকতে হয় আমাদের, যদি আমাদের যুগ যুগ ধরে আশাহীন, ভরসাহীন, বিশ্রামহীন। ও শৃঙ্খলিত অবস্থায় দিন যাপন করতে হয়, তাহলে আমাদের জয়ের গৌরব যাবে কোথায়? সে অবস্থা হবে আরও খারাপ আমাদের পক্ষে।
আমার কণ্ঠ তাই গোপন অথবা প্রকাশ্য যুদ্ধের বিরুদ্ধে ধ্বনিত হবে। যে শক্তি সর্বশক্তিমান, সর্বদপী, যে শক্তি এক স্থান থেকে সকল স্থানের সকল কিছু দেখতে পায়, সে শক্তিকে কেমন করে প্রতারিত করব আমরা? যে শক্তি স্বর্গ থেকে আমাদের বিতাড়িত করে স্বর্গ থেকে আমাদের সকল চক্রান্তজাল লক্ষ্য করছে এবং উপহাস করছে, সে শক্তি শুধু আমাদের বাহিনীর প্রতিরোধই করবে না, আমাদের সমস্ত চক্রান্তকে আগে থেকেই ব্যর্থ করে দেবে। আমাদের উচ্চাভিলাষকে পদদলিত করে দিয়ে আমাদের আবার বিতাড়িত করবে স্বর্গলোক থেকে। তাহলে আবার আমাদের সারাজীবন কষ্ট করে যেতে হবে। সারাজীবন আমাদের পীড়ন সহ্য করে যেতে হবে। সুতরাং বর্তমানে আমরা যে অবস্থায় আছি সেই অবস্থাই ভাল সুতরাং আমার পরামর্শ হচ্ছে এই যে, যে অমোঘ সর্বশক্তিমান শক্তির বিধানে আমাদের এই পতন ঘটেছে, বিজেতার অভিলাষ জয়যুক্ত হয়েছে সেই শক্তিকেই মেনে নিতে হবে অপ্রতিবাদে। সেই শক্তির বিরোধিতা করে কোন লাভ হবে না। যেহেতু শক্তিতে আমরা বিজেতার সমকক্ষতা অর্জন করতে পারিনি, সেইহেতু নির্বিবাদে আমাদের কষ্ট করে যেতেই হবে। তাছাড়া যে বিধানের বশে আমাদের পতন ঘটেছে সেই বিধানকে অন্যায়ই বা বলি কি করে?
আজ আমাদের এই সমস্যায় পড়তে হত না যদি আমরা এতবড় এক বিরাট শক্তির সঙ্গে বিরোধিতা করার ব্যাপারে আমাদের বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে পারতাম। একথা ভাবতে আমার হাসি পায় যে, আগে যারা এক সামরিক বীরত্ব প্রদর্শনে জন্য উদ্ধত ও অতিসাহসী হয়ে উঠেছে তারা যদি জানতে পারে তাদের সে বীরত্ব ব্যর্থ হলে বিজেতার নির্মম বিধানে আবার তাদের নির্বাসন, অপমান ও বন্দীত্বের বন্ধন-বেদনা ভোগ করে যেতে হবে, তাহলে তাদের সমস্ত ঔদ্ধত্য সঙ্কুচিত হয়ে উঠত মুহূর্তে।
এই হচ্ছে আমাদের বর্তমান অবস্থা। এই অবস্থা যদি আমরা এখন সহ্য করে যেতে পারি তাহলে আমাদের সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ক্রোধ হয়ত প্রশমিত হতে পারে, এমন কি সে ক্রোধ হয়ত দূরীভূত হয়ে যেতেও পারে। ক্রমে সে আমাদের কথা ভুলে যাবে একেবারে। আমরা যে শাস্তি এখন ভোগ করছি সেই শাস্তিতেই সন্তুষ্ট থাকবে সে। যদি তার ক্ৰোধতপ্ত নিঃশ্বাস ঐ জ্বলন্ত অগ্নির শিখাগুলিকে নতুন করে উদ্দীপিত না করে তাহলে ক্রমে নিস্তেজ ও স্তিমিত হয়ে আসবে সে অগ্নি, আমাদের সহিষ্ণুতার দ্বারা আবার সে অগ্নির ধূমরাশি ও ভয়ঙ্কর তাপকে জয় করব আমরা।
কালক্রমে আমরা হয়ত এই স্থানের ভূপ্রকৃতি ও আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারব নিজেদের। ক্রমে হয়ত যন্ত্রণাহীন ও সহনীয় হয়ে উঠবে এই দুঃসহ উত্তাপ। এই অন্ধকার হয়ে উঠবে আলো।
কিন্তু একবার ভেবে দেখ যদি আমরা আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়ে এই স্থানটুকুও হারাই, যদি চিরকাল আমাদের পালিয়ে বেড়াতে হয়, তাহলে কোন প্রত্যাশায় অনন্তকাল ধরে প্রতীক্ষা করে যাব আমরা? তার থেকে বর্তমানের এই অবস্থা যত খারাপই হোক, তার তুলনায় অনেক সুখের, যদি আমরা নতুন করে কোন দুঃখকে ডেকে না আনি।
এইভাবে এক অপমানজনক শাস্তি, আলস্য আর অকর্মণ্যতাকে যুক্তির আবরণে আবৃত করে ব্যক্ত করে গেল বিলায়েল। তারপর ম্যামন বলতে উঠল।
সে বলল, আমরা কিজন্য যুদ্ধ চাইছি? হয় স্বর্গের রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করতে অথবা আমাদের হারানো অধিকারকে পুনরায় লাভ করতে।
কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে আমরা স্বর্গের রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করার আশা করতে পারি না। সুতরাং এ আশা আমাদের বৃথা। স্বর্গের অধিপতিকে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত করতে না পারলে স্বর্গের মধ্যে কি করে স্থান পাব আমরা?
মনে করো, আমরা নরম হয়ে আত্মসমর্পণ করে আমাদের প্রতিপক্ষের করুণা ভিক্ষা করলাম। ধরে নাও, আমরা তার প্রভুত্ব মেনে নিয়ে আমাদের বশ্যতা স্বীকার করলাম নতুন করে। কিন্তু তার ফলে তার সামনে বিনয়াবনত হয়ে থাকতে হবে আমাদের। আমাদের উপর যে সব কঠোর বিধিনিষেধ আরোপিত হবে তা নির্বিবাদে মেনে চলবে হবে আমাদের। তার অবিসম্বাদিত আধিপত্য মেনে নিয়ে আবেগপূর্ণ ভাষায় স্তোত্ৰগান করে তুষ্ট করতে হবে তাকে। তিনি সর্বশক্তিমান সার্বভৌম প্রভু হিসাবে বসে থাকবেন তার সিংহাসনে আর তাঁকে ভগবান হিসাবে মেনে নিয়ে তার ঐশ্বরিক বেদীতে পুস্পাঞ্জলি দিতে হবে আমাদের অবনত মস্তকে। তাঁর সেবকরূপে।
স্বর্গলোকে এই হবে আমাদের একমাত্র আনন। অনন্তকাল ধরে এই হীন কর্ম করে যেতে হবে আমাদের। যাকে আমরা অন্তরের সঙ্গে ঘৃণা করি, আমাদের কাছে যে একেবারে অবাঞ্ছিত তাকেই পূজো করে যেতে হবে।
যে শক্তি, যে বল আমাদের পক্ষে লাভ করা সম্ভব নয় সে শক্তির মোহে আমরা যেন সবকিছু ভুলে মোহগ্রস্ত না হই, যে যুক্তি গ্রহণীয় নয় তা যেন আমরা গ্রহণ না করি। স্বর্গে গিয়ে পরের ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যবান হবার কামনা ত্যাগ করে আমরা নিজেরা নিজেদের মানের কথা চিন্তা করি, নিজেদের শক্তিতে বেঁচে থাকার জন্য সচেষ্ট হই।
এক বিশাল নরকপ্রদেশে আর যাই হোক, আমাদের অবস্থা যত খারাপ হোক না কেন, আমরা অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে চলেছি। এই স্বাধীনতা দুঃখকষ্টপূর্ণ দাসত্ব থেকে অনেক ভাল। আমাদের মহত্ত্ব সবচেয়ে প্রকটিত হয় তখনই যখন আমরা আমাদের শ্রমে ও সহিষ্ণুতার দ্বারা ছোট জিনিস থেকে বড় কিছু করতে পারি, অব্যবহার্য বস্তুকে ব্যবহার্য করে তুলতে পারি, দুরবস্থা হতে সমৃদ্ধি লাভ করতে পারি এবং যন্ত্রণাদায়ক অবস্থাকে আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যে পরিণত করতে পারি। আমরা কি এই অন্ধকার নরকের গভীর গহুরকে ভয় করি?
কিন্তু তোমরা দেখেছ স্বর্গলোকের সর্বাধিপতি কতবার সঘন ধূমরাশির অন্ধকারের দ্বারা তার সিংহাসনকে পরিবৃত করে তার সকল গৌরব ও ঐশ্বর্যকে আচ্ছন্ন করে রাখে। সেই ধূমরাশি হতে গভীর গর্জনে ফেটে পড়ে কত বজ্র। সমগ্র স্বর্গলোক হয়ে ওঠে নরকের মত। সে যদি এইভাবে আমাদের নারকীয় অন্ধকারের নকল করে তার দ্বারা নিজেকে পরিবৃত করে রাখতে পারে তাহলে আমরা কি তার স্বর্গীয় আলোর নকল করে সেই আলোকে এই নরকে নিয়ে আসতে পারি না? দেবতাদের দ্বারা পরিত্যক্ত এই নরকপ্রদেশের গর্ভেও কি মণি, মুক্তো, সোনা প্রভৃতি উজ্জ্বল ধনরত্ন : নিহিত নেই? আমাদেরও কি এমন কোন কলাকৌশল নেই যার দ্বারা আমরা সেই সব বস্তু ও ধনৈশ্বর্যকে উদ্ধার করতে পারি? স্বর্গে এর থেকে বেশি কি ঐশ্বর্য আছে?
জ্বলন্ত অগ্নির নির্মম দহনজনিত যে জ্বালাময় পীড়ন আমরা এখন অহেরহ ভোগ করে চলেছি, কালক্রমে তা সহনীয় হয়ে আমাদের পরিবেশগত ভৌতিক উপাদানে পরিণত হয়ে উঠতে পারে। কালক্রমে তাদের প্রকৃতি আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ফলে আমাদের যন্ত্রণা ও সকল বেদনা বিদূরিত হতে পারে।
এখন আমাদের সামনে যে সমস্যা সমুপস্থিত এর জন্য চাই শান্তিপূর্ণ সমাধান। চাই শান্তি ও শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠা। এখন আমাদের ভেবে দেখতে হবে কিভাবে আমরা আমাদের এই বর্তমানের বাস্তব অবস্থাকে মেনে নিয়ে এই অশুভ অসহনীয় অবস্থাকে উন্নতির সোপান হিসাবে ব্যবহার করতে পারি। তার জন্য প্রথমেই যুদ্ধের সকল চিন্তাকে অপসারিত করে ফেলতে হবে মন থেকে। এই হলো আমার পরামর্শ তোমাদের প্রতি।
ম্যামনের কথা শেষ হতে না হতেই এক প্রবল কলগুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠল সমগ্র সভাস্থল। যে সামুদ্রিক ঝড় সারারাত ধরে সমুদ্রকে বিক্ষুব্ধ করে সমুদ্রনাবিকদের ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলে তাদের কোন পর্বতসংকুল উপসাগরে নোঙর করতে বাধ্য করে, সে ঝড়ের গর্জনে শূন্য পর্বতপ্রদেশ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলে যে শব্দ উত্থিত হয়, সেই ধরনের শব্দে কম্পিত হয়ে উঠল শয়তানের নারকীয় সভাস্থল।
ম্যামনের কথা শেষ হতেই তার শান্তির পরামর্শ শুনে বিপুল হর্ষধ্বনি উঠল সভায়। শ্রোতারা সন্তুষ্ট হলো তার কথায়। কারণ যুদ্ধের বিভীষিকাকে, নরকযন্ত্রণাকে ভয় করছিল তারা। বজ্র আর মাইকেলের তরবারির ভয়ের দ্বারা তখনো পীড়িত হচ্ছিল তাদের মন। তার উপর এই নরকপ্রদেশে এমন এক সাম্রাজ্য স্থাপন করার আশায় উদ্দীপিত হয়ে উঠেছিল তাদের মন যে সাম্রাজ্য কালক্রমে তাদের দৃঢ় নীতি, শ্রম ও সাধনার দ্বারা স্বর্গরাজ্যের অনুরূপ মাহাত্ম্য ও মর্যাদা লাভ করবে।
এরপর সব কিছু দেখে শুনে বীলজীবাব উঠে দাঁড়াল। মর্যাদার দিক থেকে তাদের নেতা শয়তানের পরেই ছিল তার স্থান। তার চেহারাটা যেমন ছিল এক স্তম্ভের মতই বিশাল এবং গম্ভীর, তার মুখমণ্ডলের উপর তেমনি ছিল আলোচনার এক গভীর আগ্রহ এবং উদ্বেগ। এক শোচনীয় সর্বনাশের মধ্যেও তার মুখে ছিল এক রাজকীয় মর্যাদার ভাব। তার দৃঢ় ও উন্নত স্কন্ধদ্বয় বহু শক্তিশালী রাজ্যভার বহনের উপযুক্ত।
বীলজীবাবের রাত্রির মত গম্ভীর কণ্ঠস্বর উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সকলের মনোযোগ নিবদ্ধ হলো তার উপর। সে বলতে আরম্ভ করল,
সিংহাসন, সাম্রাজ্য, রাজকীয় শক্তি, স্বর্গের সন্তান, স্বর্গীয় গুণাবলী-আজ আমাদের এই সমস্ত উপাধি ত্যাগ করে নিজেদের কি নরকের রাজা হিসাবে অভিহিত করব আমরা? আমাদের এখানকার সকলে এখানে এক সাম্রাজ্য স্থাপনের পক্ষেই রায় দিয়েছে। কিন্তু যখন আমরা এই স্বপ্ন দেখছি তখন আমরা একথা ভেবে দেখছি না যে স্বর্গলোকের রাজা আমাদের এখানে কারারুদ্ধ করে রেখেছেন। এই নরকপ্রদেশ আমাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল নয়, আসলে এটি হলো আমাদের কারাগার। মনে রাখবে, এই নরকপ্রদেশও তার শাসন ও প্রভুত্বাধীন এলাকার বাইরে নয়। স্বর্গলোক হতে যত দূরেই হোক, এখানে আমাদের তারই কঠোর শাসনাধীনে বন্দী হয়ে থাকতে হবে।
একথা নিশ্চিত যে, স্বর্গে ও নরকে সে-ই একমাত্র সার্বভৌম রাজারূপে রাজত্ব করে থাকে অনন্তকাল ধরে এবং আমরা যতই বিপন্ন বা বিদ্রোহ করি না কেন, সে তার দুলোক ও ভূলোকব্যাপী বিশাল সাম্রাজ্যের কোন অংশ ছাড়তে চাইবে না। বরং সে তার সাম্রাজ্য এই নরকপ্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত করে কঠোরভাবে শাসন করবে আমাদের।
তাহলে আমরা বসে বসে শান্তি আর যুদ্ধের কথা আলোচনা করছি কেন? আমরা যদি যুদ্ধ করার সংকল্প করি তাহলে অপূরণীয় ক্ষয়-ক্ষতির ঝুঁকি নিতে হবে, আর যদি শান্তি বা সন্ধি স্থাপন করি তাহলে সে সন্ধির সুফল সম্বন্ধে কোন প্রতিশ্রুতি পাব না আমরা। আমাদের যদি দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকতেই হয় তাহলে কোন্ শান্তি পাব আমরা? শান্তির পরিবর্তে শুধু এক কঠোর স্বৈরাচারী শাসন আর শান্তি আরোপিত হবে আমাদের উপর বলপ্রয়োগের দ্বারা।
শুধু তাই নয়, আমরা আমাদের বিজেতা শক্তিকেও কোন শাস্তি দিতে পারব না। তার পরিবর্তে সে শক্তি আমাদের কাছ থেকে পাবে শুধু এক অপরিসীম বিদ্বেষ, ঘৃণা, দুর্দমনীয় বিতৃষ্ণা আর প্রতিহিংসার তীব্রতা। যতই আমরা যত সব অত্যাচার, অবিচার এবং নির্যাতন সহ্য করে যাব ততই আমরা ধীরে ধীরে বিজেতা শক্তির বিরুদ্ধে এক প্রতিশোধাত্মক ষড়যন্ত্রের জাল বুনে যাব। দেখব সে শক্তি আমাদের নির্যাতিত করে কত আনন্দ লাভ করে।
সে ক্ষেত্রে আমাদের সুযোগেরও হয়ত অভাব হবে না। হয়ত আমরা এক বিপজ্জনক অভিযানে তৎপর হয়ে স্বর্গলোক আক্রমণ করব। যে স্বর্গরাজ্যের সুউচ্চ প্রাসাদগুলি সুদুর নরকপ্রদেশ হতে কোন আক্রমণ, অবরোধ বা অভিযান আশঙ্কা করে না কখনো, সেই স্বর্গরাজ্য হয়ত আক্রান্ত হবে আমাদের দ্বারা।
এক্ষেত্রে দেখতে হবে আমরা এ বিষয়ে সহজতর উপায় খুঁজে পাই কিনা। স্বর্গ আর পাতালপ্রদেশের মাঝখানে আর এক তৃতীয় জগৎ আছে যেখানে মানবজাতি নামে এক নতুন জাতি বাস করে সুখে-শান্তিতে। এতদিনে হয়ত সে মানবজাতি সৃষ্ট হয়েছে। তারা দেখতে অনেকটা আমাদের মত। শুধু শক্তি-সামর্থ্য ও বীরত্বের দিক থেকে অনেক নিকৃষ্ট আমাদের থেকে। কিন্তু স্বর্গের অধিপতির বড় প্রিয় তারা এবং স্বর্গাধিপতি নিজে মানবজাতির প্রতি তার অনুগ্রহের কথা দেবতাদের কাছে ঘোষণা করে সদর্পে।
সেই মানবজাতির কথা আমাদের একবার ভাবা উচিত। তাদের দিকে একবার দৃষ্টি দেওয়া উচিত। আমাদের জানা উচিত সেই তৃতীয় জগতে কি ধরনের প্রাণী বাস করে, জানা দরকার কতখানি শক্তি ধারণ করে তারা। কি কি গুণাবলীর দ্বারা তারা ভূষিত এবং তাদের দুর্বলতাই বা কি। দেখতে হবে বলপ্রয়োেগ বা সূক্ষ্ম কৌশলের দ্বারা কিভাবে বশে আনতে পারা যাবে তাদের।
যদিও স্বর্গের দ্বার চিরতরে বন্ধ আমাদের কাছে এবং স্বর্গের সার্বভৌম অধিপতি। আপন শক্তিতে অধিষ্ঠিত আছেন নিরাপদে, তথাপি সেই বিরাট জগৎ হয়ত দুরধিগম্য নয় আমাদের কাছে। সে জগৎ স্বর্গরাজ্যের শেষ প্রান্তে অবস্থিত এবং তা হতে তার অধিবাসীরা বঞ্চিত। সে জগৎ যদি আমরা অকস্মাৎ আক্রমণ করি তাহলে হয়ত আমাদের কিছু সুবিধা হতে পারে।
হয় আমরা সে জগৎকে নারকীয় অগ্নিকাণ্ডের দ্বারা বিধ্বস্ত করব সম্পূর্ণরূপে, আমরা যেমন বিতাড়িত হয়েছি স্বর্গরাজ্য হতে তেমনি মানবজাতিকেও বিতাড়িত করব তাদের জগৎ থেকে, অথবা যদি বিতাড়িত না করি তাহলে তাদের বশীভূত করে দলভুক্ত করব আমাদের যাতে ঈশ্বর নিজেই শত্রু হয়ে দাঁড়ায় তার সৃষ্ট প্রিয় মানবজাতির উপর এবং নিজের সৃষ্টিকে নিজেই নস্যাৎ করতে বাধ্য হয়।
সাধারণ প্রতিশোধগ্রহণ থেকে এ পথ অনেক ভাল। এতে আমাদের আনন্দ বর্ধিত হবে আর ঈশ্বরের আনন্দ ব্যাহত হবে। তার মানবসন্তানরা তাদের বাস্তু থেকে বিচ্যুত হয়ে আমাদের দলে যোগদান করতে বাধ্য হবে এবং তখন তারা সব সুখ হারিয়ে তাদের স্রষ্টাকে অভিশাপ দেবে। এখন আলোচনা করে দেখ, এই পথ অনুসরণের যোগ্য কিনা, অথবা এখানে অন্ধকারে বসে বসে স্বরাজ্য স্থাপনের ব্যর্থ পরিকল্পনা খাড়া করে চল।
এইভাবে বীলজীবাব তার শয়তানী পরামর্শ দান করল।
এই পরিকল্পনা শয়তানরাজ স্বয়ং খাড়া করে এক গভীর ঘৃণার বশবর্তী হয়ে মানবজাতিকে উচ্ছেদ করে মর্ত্য ও নরককে এক করে মিশিয়ে দিতে চায় এবং পরম স্রষ্টাকে অপমানিত করে তার গৌরবকে খর্ব করতে চায়।
কিন্তু তাদের এই ঘৃণা আর বিদ্বেষ সত্ত্বেও ঈশ্বরের গৌরব বেড়ে যেতে থাকে।
এদিকে বীলজীবাবের দুঃসাহসিক পরিকল্পনার কথা শুনে নরকের সবাই আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠল। সে আনন্দের উজ্জ্বলতা এক একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গর মত উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তাদের চোখে। তারা পূর্ণ সমর্থন জানাল এ পরিকল্পনাকে।
বীলজীবাব তখন আবার বলতে লাগল, তোমরা ঠিকই রায় দিয়ে এক দীর্ঘ বিতর্কের অবসান ঘটালে, এক বিরাট সমস্যার সমাধান করলে। একমাত্র এই পরিকল্পনার সার্থক রূপায়ণই আমাদের দুর্ভাগ্য সত্ত্বেও এই গভীর নরকগহ্বর হতে আমাদের উত্তোলিত করে আমাদের পুরাতন বাসস্থানের নিকটে নিয়ে যাবে। সেখান থেকে হয়ত আমরা নতুন করে শক্তি সংগ্রহ করে উপযুক্ত সুযোগ বুঝে এক সামরিক অভিযানের দ্বারা স্বর্গলোকে পুনরায় প্রবেশ করব। আমরা স্বর্গের নিকটবর্তী এমন এক ভালো জায়গায় বসতি স্থাপন করব যে জায়গা স্বর্গের উজ্জ্বল আলোর দ্বারা আলোকিত, যে জায়গা নরকপ্রদেশের এই অন্ধকার হতে মুক্ত। সেখানকার শীতল বাতাস এই নরকাগ্নি দ্বারা দগ্ধ আমাদের দেহের ক্ষতগুলিকে শান্তির প্রলেপ দিয়ে সারিয়ে তুলবে।
কিন্তু সেই নতুন জগতের সন্ধানে কাকে আমরা পাঠাব? কাকে আমরা এ কাজের যোগ্য হিসাবে মনোনীত করব? কে আমাদের মধ্যে পায়ে হেঁটে পথ খুঁজে অথবা অক্লান্ত উদ্ধত পাখায় ভর করে আকাশপথে উড়ে যাবে সেই সুখের রাজ্যে? কার এমন শক্তি আছে যে শক্তির দ্বারা কৌশলে দেবদূতদের কঠোর প্রহরা এড়িয়ে গন্তব্যস্থলে উপনীত হতে পারবে? এজন্য তার চাই সার্বিক পর্যবেক্ষণশক্তি। আমাদের নির্বাচনও যেন ত্রুটিহীন হয়। কারণ যে ব্যক্তিকে আমরা পাঠাব তারই উপর নির্ভর করছে আমাদের পরিকল্পনার সকল গুরুত্ব এবং শেষ আশার সাফল্য।
এই কথা বলে বসে পড়ল বীলজীবাব। এরপর কে দাঁড়িয়ে তাকে সমর্থন করে অথবা প্রতিবাদ করে তা দেখার জন্য এক প্রত্যাশা ও উদ্বেগের আবেগ ফুটে উঠেছিল তার চোখে। তার প্রস্তাবিত তৃতীয় জগতের সন্ধানে, এক বিপজ্জনক যাত্রায় বার হতে কেউ এগিয়ে আসে কিনা তা দেখতে চাইছিল সে।
কিন্তু কেউ উঠে দাঁড়াল না। সকলেই নীরব নির্বাক হয়ে বসে রইল। এই পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিপদের কথা গভীরভাবে ভাবতে লাগল সবাই। প্রত্যেকেই বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যেকের চোখে তার আপন আপন আশঙ্কার প্রতিফলন দেখল।
যে সব বীরেরা কিছুক্ষণ আগে স্বর্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছিল তাদের কেউ এগিয়ে এসে সাহসের সঙ্গে এই ভয়ঙ্কর যাত্রা শুরু করতে চাইল না।
অবশেষে যার গৌরব ছিল সকলের ঊর্ধ্বে, এক রাজকীয় গর্বের বশবর্তী হয়ে যে নিজেকে সবচেয়ে যোগ্য বলে মনে করত সেই শয়তানরাজ অবিচলিতভাবে বলতে লাগল,
হে স্বর্গের সন্তানগণ, তোমরা যুক্তিসঙ্গতভাবেই যৌন হয়ে থাকলেও ভীত হয়ে পড়নি তোমরা। যে পথ এই নরকপ্রদেশ হতে আলোকের দিকে ঊর্ধ্বে উঠে গেছে সে পথ দীর্ঘ এবং শ্রমসাধ্য। সর্বগ্রাসী লেলিহান শিখাসমন্বিত বিশাল অগ্নিকুণ্ড আমাদের কারাগারটিকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। এখান থেকে বার হবার সব পথ রুদ্ধ। যদি কেউ জ্বলন্ত অগ্নিপূর্ণ এই কারাগার অতিক্রম করতে পারে তাহলেই সে জনপ্রাণীহীন ভীতিপ্রদ এক গভীর অন্ধকারের বিশাল ব্যাপ্তির মধ্যে নিমজ্জিত হবে। সেই অন্ধকারের রাজ্য থেকে সে যদি কোনরকমে একবার কোন এক অজানা জগতে প্রবেশ করতে পারে তাহলে সে এমন কি বিপদের সম্মুখীন হবে যা সে অতিক্রম করতে পারবে না? কিন্তু এই রাজসিংহাসন, সার্বভৌম শক্তি, ঐশ্বর্য ও অস্ত্রসম্ভারের অধিকারী হয়েও আমি যদি এই বিপদ ও শ্রমসংকুল যাত্রাপথে অগ্রসর না হই তাহলে বৃথাই আমাদের এই ক্ষমতা ও মর্যাদালাভ। যে দুঃসাহসিক কর্মের মধ্যে বিপদ এবং সম্মান দুইই আছে সে কর্মসম্পাদনে যদি আমি সচেষ্ট না হই তাহলে কেন আমি এই রাজক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আছি? কেন আমি তাহলে এই সিংহাসন ত্যাগ করছি না?
আমাদের ঊর্ধ্বে যে স্বর্গের অধিপতি হয়ে বসে আছে তাকে তো আরও কত বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। হে স্বর্গত্রাস শক্তিশালী বীরগণ, তোমরা অধঃপতিত হলেও শক্তিহীন নও। আমি যখন দূরে গিয়ে সর্বগ্রাসী এক বিশালব্যাপ্ত অন্ধকারের মধ্যে আমাদের সকলের জন্য মুক্তির সন্ধানে ব্যাপৃত থাকব তখন প্রতিকারের আশা তোমাদের এই দুঃসহ আবাসভূমিটিকে সহনীয় ও তোমাদের নরকযন্ত্রণাকে কিছুটা প্রশমিত করে তুললেও আমাদের সদাজাগ্রত শত্রুর প্রতি তোমাদের কড়া দৃষ্টির প্রহরাকে যেন কিছুমাত্র শিথিল করো না। আমার এই যাত্রায় আর কাউকে সঙ্গী হতে হবে না।
এই কথা বলে শয়তানরাজ কারো কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই উঠে দাঁড়াল। পাছে তার কথা শুনে উপস্থিত বীরদের মধ্যে কেউ তার যাত্রাপথের সঙ্গী হবার জন্য এগিয়ে আসে তার জন্য আগে হতেই সে সে-পথ বন্ধ করে দিল। এক বিপুল পরিমাণ বিপদের ঝুঁকি নিয়ে যে বিরাট খ্যাতি ও গৌরব সে অর্জন করতে চলেছে, সে খ্যাতি ও গৌরবের অংশীদার হবার জন্য কেউ যাতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে না পারে তার জন্য আগে হতে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করল সে।
কিন্তু উপস্থিত বীরদের কেউ কোন কথা বলতে সাহস পেল না। দুর্গম যাত্রাপথের ভয়াবহতার থেকে শয়তানরাজের এই নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত কণ্ঠস্বর আরও ভয়াবহ মনে হলো তাদের কাছে। বীরেরা সকলেই নীরবে উঠে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে দূরাগত বজ্রধ্বনির মত এক শব্দ উত্থিত হলো। তারা নত হয়ে ভয়ে ভয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করল তাদের রাজাকে। সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এক স্বর্গীয় দেবতার সম্মান তাকে দান করে তার গৌরবগান করল তারা। তাদের রাজা তাদের সকলের নিরাপত্তার জন্য নিজে কষ্ট স্বীকার করে যে বিপদসংকুল পথে যাত্রা করছে তার জন্য তার গুণগান করতেও ভুলল না। কারণ এই অভিশপ্ত অধঃপতিত আত্মারা সব গুণ হারায়নি। মর্ত্যের অনেক উচ্চাভিলাষী অহঙ্কারী ব্যক্তি অহঙ্কারে মত্ত হয়ে শুধু আপন কৃতিত্বের বড়াই করে চলে, অপরের গুণ বা যোগ্যতাকে স্বীকার করতে চায় না।
এইভাবে তাদের অতুলনীয় সর্বাধিনায়কের গুণগান ও আনন্দোল্লাসের মধ্য দিয়ে তাদের সকল সংশয়পূর্ণ আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটল। পর্বতের শিখরদেশ হতে সমুথিত ঘনকৃষ্ণ মেঘমালা যখন নীল আকাশকে আচ্ছন্ন করে তোলে ধীরে ধীরে, যখন দিন শেষের তুষার ও বৃষ্টিসিক্ত প্রান্তরের ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যে হিমশীতল বাতাস গর্জন করে বেড়ায় তখন যদি সহসা শেষ সূর্যরশ্মি ঝরে পড়ে সে প্রান্তরকে আলোকিত করে তোলে, তাহলে যেমন নীরব হয়ে যাওয়া পাখিরা আবার গান শুরু করে, গৃহাভিমুখী পশুর পাল আনন্দে চিৎকার করতে থাকে এবং পশুপাখির মিলিত কণ্ঠস্বর ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে পর্বত ও উপত্যকাদি মেনি এক উল্লসিত কলগুঞ্জনে ফেটে পড়ল সেই নরকনিবাসী শয়তানরা।
হায় মানুষ, তোমরা কত লজ্জার বস্তু! অভিশপ্ত শয়তানও শয়তানের সঙ্গে এক গভীর ঐক্যে আবদ্ধ হয়, কিন্তু মানুষ যুক্তিবাদী জীব হলেও ঐক্যবদ্ধ বা একমত হতে পারে না পরস্পরের সঙ্গে। যদিও তারা ঈশ্বরের অনুগ্রহ এবং শান্তিলাভের আশ্বাস পেয়েছে ঈশ্বরের কাছ থেকে তথাপি তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া, বিবাদ, হিংসা, শত্রুতা ও যুদ্ধবিগ্রহ করে দিন কাটায়। কিন্তু তারা জানে না তাদের নরকের শত্রুরা তাদের অলক্ষ্যে অগোচরে তাদের ধ্বংসের জন্য অপেক্ষা করছে দিনরাত। তা যদি তারা জানত তাহলে হয়ত তারা ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য হত।
এইভাবে স্টাইজিয়াস্থিত নরকের সভার অবসান হলো। সমস্ত বীরেরা তাদের মুকুটমণি নরকের সম্রাটকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এল সভাস্থল থেকে। এই স্বর্গদ্রোহী নরকসম্রাট ছিল রাজকীয় ঐশ্বর্যে ঈশ্বরেরই সমতুল। উজ্জ্বল অস্ত্রসম্ভার হাতে বীর সৈন্যরূপী অধঃপতিত দেবদূতেরা তাকে ঘিরে দাঁড়াল। তারপর জয়ঢাক বাজিয়ে সভার ফল রাজকীয় ঘোষণা হিসাবে ঘোষণা করল। বাদ্যসহযোগে সেই ঘোষণার কর্ণবিদারক শব্দ বিশাল নরকগহ্বরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
এইভাবে মনের দিক থেকে কিছুটা শান্ত হয়ে ও এক অর্থহীন উদ্ধত আশায় উদ্দীপিত হয়ে তারা সকলে আপন পথে চলে গেল। আপন আপন ইচ্ছানুসারে এক একটি জায়গায় বসে যত সব দুশ্চিন্তার কবল থেকে মুক্ত হয়ে তাদের প্রধান ফিরে না আসা পর্যন্ত এক স্তব্ধ প্রতীক্ষায় প্রহর গণনা করতে থাকবে তারা।
কিন্তু নিজেদের শোচনীয় দুরবস্থার কথা ভেবে এক জায়গায় বিশ্রাম করতে পারল না তারা। দলবদ্ধভাবে ভয়ে কম্পমান কলেবরে, ক্রোধে বিঘূর্ণিত চোখ নিয়ে ম্লান মুখে বহু তুষারাচ্ছন্ন হিমশীতল পর্বত ও উত্তপ্ত উপত্যকা পার হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে লাগল তারা।
তারা দেখল ঈশ্বরের দ্বারা শাপগ্রস্ত হয়ে যে নরকপ্রদেশে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, সে নরকপ্রদেশ স্বর্গের তুলনায় বড় হীন এবং বসবাসের অযোগ্য।
সে জগৎ মৃত্যুর রাজ্য। সেখানে জীবন্ত মৃত্যু এক অপরিহার্য ভয়াবহতায় সতত বিরাজ করে সর্বত্র। সেখানে প্রকৃতিদৃষ্ট অনেক অতিকায় দানবাকৃতি ভয়ঙ্কর জীবজন্তু মৃত্যুর দূতরূপে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায় এখানে সেখানে।
এদিকে তখন ঈশ্বরদ্রোহী শয়তানরাজ পাখা মেলে ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে নরকপ্রদেশের সীমানা অতিক্রম করার জন্য নরকদ্বারের দিকে কখনো বাঁ দিকে কখনো ডান দিকে উড়ে চলেছে।
ঊর্ধ্বে উৎক্রমণ করতে করতে এক দুর্ভেদ্য ছাদের কাছে এসে পড়ল শয়তানরাজ। দেখল আর সে উপরে উঠতে পারবে না। সে ছাদ ভেদ করে তার বাইরে যেতে পারবে না। তাকে নরকপ্রদেশের সীমানা পার হতে হলে নরকদ্বারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
অবশেষে নরকদ্বারের কাছে এসে উপনীত হলো সে। দেখল তিনটি রুদ্ধ দরজা দ্বারা সে দ্বারদেশ-সুরক্ষিত। একটি দরজা পিতলের এবং একটি কঠিন পাথরের দ্বারা নির্মিত। চক্রাকার অগ্নিকুণ্ডের দ্বারা পরিবৃত সে দ্বারদেশ সে অগ্নিকুণ্ড জ্বলন্ত হলেও কিছুই দন্ধ হচ্ছে না তার দ্বারা।
সে আরও দেখল সেই দ্বারদেশের দুইদিকে দুজন ভয়ঙ্কর আকৃতির প্রহরী রয়েছে। একজন প্রহরীর কটিদেশ থেকে উপর পর্যন্ত সুন্দরী নারীমূর্তির আকৃতি, কিন্তু নিচের দিকটি সম্পূর্ণ বিষধর সাপের মত। যার দংশনমাত্রই মৃত্যু অনিবার্য। তার কটিদেশে ছিল এক নারকীয় কুকুরের মুখ। সে মুখ থেকে সব সময় ভয়ঙ্কর ঘেউ ঘেউ আওয়াজ বার হচ্ছিল।
অদ্ভুতদর্শন বিকটাকৃতি এই প্রহরীর থেকে সমুদ্ররাক্ষসী স্কাইল্লা কম ভয়ঙ্করী। নিয়ত শিশুর রক্তগন্ধবিশিষ্ট ল্যাপল্যান্ডের যে সব ডাইনিরা উজ্জ্বল চাঁদকে গ্রাস করে তারাও এর থেকে কম ঘৃণ্য ও কম জঘন্য।
অন্য প্রহরীটির মুখ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিছুই চেনা যাচ্ছিল না। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল রাত্রির অন্ধকারের মত ঘনকৃষ্ণ এক করাল ছায়ামূর্তি। শয়তানকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সেই ছায়ামূর্তি তার দিকে দর্পভরে বেগে ধাবিত হলো। তার পদভরে কম্পিত হয়ে উঠল সমগ্র নরকপ্রদেশ।
অপরাজেয় শয়তানরাজ সেই ছায়ামূর্তিকে দেখে ভয় পেল না বিন্দুমাত্র। সে ঘৃণাভরে ছায়ামূর্তির দিকে তাকিয়ে নির্ভীকভাবে বলতে লাগল, হে ঘৃণ্য আকৃতিবিশিষ্ট জীব, কে তুমি? কোথা হতে এসেছ? কেন তুমি এমন ভয়ঙ্করভাবে এগিয়ে এসে আমার গতিপথ রুদ্ধ করছ? আমি এই নরকদ্বার অতিক্রম করতে চাই। এ বিষয়ে আমি তোমার অনুমতির অপেক্ষা করি না। তুমি নরকজাত হয়ে স্বর্গের সন্তানের সঙ্গে বিবাদ করতে এস না।
তখন সেই ছায়ামূর্তি সরোষে বলল, তুমিই কি সেই বিশ্বাসঘাতক দেবদূত যে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে দর্পিত বিদ্রোহের দ্বারা প্রথম স্বর্গের শান্তি ও বিশ্বাস ভঙ্গ করে তৃতীয় জগৎবাসী স্বর্গের মানবসন্তানদের ঈশ্বরের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করো? আর এই অপরাধের জন্য তুমি ও তোমার দলের শয়তানরা ঈশ্বরের দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে এই নরপ্রদেশে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় অশেষ দুঃখ ও যন্ত্রণাময় জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছ। এক অভিশপ্ত ঘৃণ্য জীব হয়ে তুমি নিজেকে স্বর্গজাত সন্তান হিসাবে বড়াই করছ? যে আমি নরকপ্রদেশের বৈধ রাজা ও রক্ষক তাকে অমান্য ও ঘৃণা করে তুমি আবার নতুন করে তোমার প্রভু ও রাজাকে রুষ্ট করে তুলছ? যাও, যেমন শাস্তি ভোগ করছিলে তেমনি নীরবে শাস্তি ভোগ করগে। তা না হলে আমি বৃশ্চিক দংশনের মত জ্বালাময় চাবুক হাতে তুমি যেখানে যাবে আমি তোমাকে অনুসরণ করে যাব। হে ব্যর্থ পলাতক, অবিলম্বে চলে যাও এখান থেকে। তা যদি না যাও তাহলে তোমাকে ধরে এমনভাবে আঘাত করব যাতে অননুভূতপূর্ব যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে তোমায়।
এই কথা বলতে বলতে সেই ভয়ঙ্কর ছায়ামূর্তি তার আকারটাকে দশগুণ বর্ধিত করল। আগের থেকে আরও অনেক বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠল সে।
অন্যদিকে এক ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠে এক জ্বলন্ত ধূমকেতুর মত নির্ভীকভাবে দাঁড়িয়ে রইল শয়তানরাজ।
মেরুপ্রদেশের আকাশে জ্বলতে থাকা যে ধূমকেতুর মাথার ভয়ঙ্কর কেশরাশি থেকে মহামারী, মড়ক আর যুদ্ধের বিভীষিকা ঝরে পড়ে সেই ধূমকেতু অথবা আকাশে যুদ্ধরত দুটি বজ্রগর্ভ মেঘের মত তাদের দুজনকে দেখাচ্ছিল তখন। কুটিকুটিল রোষকশায়িত লোচনে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তারা সামনাসামনি।– তাদের সেই ঐকুটিতে আরো বেড়ে গেল নরকের অন্ধকার। তাদের দুজনেরই মনে হলো তারা এমন ভয়ঙ্কর শত্রুর সম্মুখীন কখনো হয়নি জীবনে। তাদের দর্পিত পদভরে স্পর্ধিত আস্ফালনে মুহুর্মুহু কম্পিত হয়ে উঠেছিল নরকের সেই দ্বারদেশ।
এমন সময় সেই অর্ধনারী ও অর্ধনাগিনী অদ্ভুতদর্শনা মূর্তিটি ছুটে এসে দাঁড়াল তাদের মাঝখানে। সে শয়তানকে সম্বোধন করে বলল, হে পিতা, কেন তুমি তোমার একমাত্র পুত্রকে আঘাত করার জন্য হস্ত উত্তোলন করেছ? হে পুত্র, কোন্ সে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তুমি তোমার পিতার উপর এমন মারাত্মক আঘাত হানতে চলেছ? কিন্তু জান কি কার জন্য একাজ করছ তুমি? তুমি তারই জন্য এই সব করছ যে স্বর্গলোকে বসে থেকে তোমাকে উপহাস করে চলে, যার বিধানে তুমি নরকের দ্বারী হয়ে আছ এবং যে তোমাকে নিয়ে তার খুশিমত যত সব হীন কাজ করিয়ে নেয়। যার রোষ একদিন তোমাদের দুজনকেই ধ্বংস করবে।
নরকের আবর্জনার মত ঝরে পড়া তার কথাগুলো সব বলা শেষ হলে শয়তানরাজ তাকে বলতে লাগল, তোমার চিৎকার এবং কথা এমনই অদ্ভুত যে আমি প্রতিনিবৃত্ত না হয়ে পারলাম না। তোমাকে দেখিয়ে দিতে পারলাম না আমি কি চাই।
কিন্তু আগে তোমার পরিচয় জানতে হবে। বল, কে তুমি এবং কেনই বা তুমি আমাকে তোমার পিতা আর ঐ প্রহরীকে আমার সন্তান বললে? তোমাকে আমি চিনি না। তোমার মত এমন ঘৃণ্য জীব কখনো দেখিনি আমি।
তখন সেই নারীনাগিনী দ্বারপালিকা বলল, তুমি কি আমাকে ভুলে গেছ? তোমার চোখে কি আমি এতই ঘৃণ্য? অথচ একদিন স্বর্গের রাজসভায় এবং তোমার ও তোমাদের মত যে সব দেবদূত স্বর্গের রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাদের সকলের চোখে আমি ছিলাম সুন্দরী। তারপর অকস্মাৎ একদিন দুঃখ ও যন্ত্রণার মধ্যে পতিত হয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাও তুমি। তোমার মাথা ঘুরতে থাকে। যখন অন্ধকারে জ্বলন্ত আগুনের মাঝে পড়ে যাও তখন বাঁ দিকে তোমারই মাথা থেকে স্বর্গীয় দ্যুতিসম্পন্ন এক দেবীমূর্তি বেরিয়ে আসে। আমি হলাম সেই দেবী।
তা দেখে স্বর্গের সব দেবদূতেরা বিস্মিত ও ভীত হয়ে পিছিয়ে যায়। আমাকে তখন পাপ নামে অভিহিত করতে থাকে। আমার মধ্যে তোমারই অবিকল প্রতিরূপ দেখে তুমি আমার প্রেমে পড়ে যাও। গোপনে আমার সঙ্গে দেহসংসর্গ করতে থাক তুমি এবং তার ফলে গর্ভধারণ করি আমি।
তারপর বিদ্রোহীদের সঙ্গে ঈশ্বরের যুদ্ধ বাধে। আমাদের পরম শত্রু সর্বশক্তিমান ঈশ্বর চূড়ান্তভাবে জয়লাভ করেন। বিদ্রোহী দেবদূতেরা সকলে বিতাড়িত হয় স্বর্গরাজ্য থেকে। স্বর্গলোক হতে তাদের সঙ্গে আমিও এই নরককুণ্ডের মধ্যে সরাসরি পতিত হই। সেই সময় নগরদ্বার রক্ষার জন্য একটা চাবি দেওয়া হয় আমার হাতে।
তালাবন্ধ এই দ্বার আমি খুলে না দিলে কেউ নরকপ্রদেশ হতে মুক্ত হতে পারবে না। আমি বিষাদগ্রস্ত ও চিন্তান্বিত অবস্থায় একাকী বসে থাকতাম এখানে। কিন্তু। এখন আর দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে পারিনি কারণ তোমার ঔরসজাত সন্তান বড় হয়ে ওঠে আমার গর্ভে। আমার পেটের ভিতর নড়াচড়া করতে থাকে ভয়ঙ্করভাবে।
অবশেষে তোমার যে সন্তানকে তুমি তোমার সামনে দেখেছ সে সন্তান একদিন আমার পেটের নাড়িভুড়ি ছিঁড়ে আমাকে অশেষ যন্ত্রণা দিয়ে বেরিয়ে আসে আমার গর্ভ থেকে। এই জন্য আমার দেহটা বিকৃত হয়ে যায় সেই থেকে। জন্মমুহূর্ত হতেই সে আমার শত্রু হয়ে ওঠে। মাতৃদ্রোহী এই সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রসহকারে আমাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়।
আমি ‘মৃত্যু মৃত্যু’ বলে চিৎকার করতে করতে পালিয়ে যাই। আমার সেই চিৎকার ও আর্তনাদে সমগ্র নরকপ্রদেশ কম্পিত হয়ে ওঠে এবং আমার কথাটি প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। আমি যতই প্রাণভয়ে পালাতে থাকি সে ততই আমায় অনুসরণ করতে থাকে। কিন্তু আমি দেখলাম তার মধ্যে ক্রোধের আগুনের পরিবর্তে ছিল জারজ কামনার আগুন।
বিদ্যুৎবেগে ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে এসে ধরে ফেলল সে আমায়। আমি গর্ভধারিণী জননী হওয়া সত্ত্বেও সে আমাকে জোর করে ধরে বলাৎকার করল আমার উপর। সেই পাশবিক বলাৎকারের ফলে আমি আবার গর্ভধারণ করি এবং তার এক ঘণ্টার মধ্যে এই বিকটাকার জীবগুলি আমার সন্তান হিসাবে জন্মগ্রহণ করে। আমার চারপাশে চিরক্রন্দনরত যে জীবগুলি দেখছ তারাই হলো সেই সন্তান।
তারা বাইরে বিচরণ করতে করতে প্রায়ই আমার গর্ভের মধ্যে প্রবেশ করে আঁচড় কাটতে থাকে। এইভাবে আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে আবার তারা বেরিয়ে আসে গর্ভ থেকে এবং এক একটি জ্বলন্ত বিভীষিকার মত আমার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। ফলে আমি একমূহুর্তও কখনো বিশ্রাম বা শান্তি পাই না।
আমার বিপরীত দিকে আমার পুত্র করাল মৃত্যু বসে আছে। সে-ই অন্য সব সন্তানদের উত্তেজিত করে আমার বিরুদ্ধে। কোন খাদ্য না পেয়ে আমাকেই একদিন গ্রাস করবে। কিন্তু সে জানে নিয়তির বিধানে আমাকে গ্রাস করে সে আমার মৃত্যুর কারণ হলে তারও মৃত্যু ঘটবে সঙ্গে সঙ্গে। তারও জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে তখন।
কিন্তু হে আমার পিতা, আমি তোমাকে আগে হতে সাবধান করে দিচ্ছি, এর মারাত্মক শরটাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করো। তোমার অস্ত্র যত তীক্ষ্ণ ও ভারী হোক না কেন তা তোমাকে অজেয় করে তুলবে ওর কাছে, এই মিথ্যা আশা পরিত্যাগ করো। কারণ একমাত্র স্বর্গের রাজা ছাড়া ওর শর কেউ প্রতিহত করতে পারবে না।
তার কথা শেষ হলে তার পিতা শয়তানরাজ উত্তর করল, হে আমার প্রিয় কন্যা, তুমি আমাকে তোমার পিতা বলে দাবি করছ! আমাদের ঐ পুত্র আমাকে আজ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে স্বর্গে অবস্থানকালে আমি একদিন তোমার সঙ্গে নর্মক্রীড়া করে কী পরিমাণ আনন্দ লাভ করেছিলাম। সেকথা আজ মনে করতেও কষ্ট হয়।
তারপর এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে আমাদের জীবনে। আমাদের পতিত হতে হয় এক গভীর দুঃখের যুগে। তবে জেনে রেখো, আমি তোমাদের শত্রুরূপে আসিনি এখানে। আমি এসেছি তোমাদের ও এই নরকপ্রদেশের স্বর্গচ্যুত সমস্ত দেবদূতদের মুক্ত করতে। আমি এসেছি তোমাদের সকলকে এই ভয়াবহ যন্ত্রণার কবল হতে মুক্ত করতে।
তাদের সকলের পক্ষ থেকে আমি একা সমস্ত বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এক বিশাল শূন্যতা অতিক্রম করে স্বর্গ ও এই পাতালপ্রদেশের মাঝখানে সৃষ্ট এক জগতের সন্ধানে চলেছি যেখানে মানবজাতি নামে এক জীব বাস করে, যেখানে আমরা নূতন বাসস্থান লাভ করতে পারব। আমাদের এক গোপন পরিকল্পনা অনুসারে সেই জগতের কথা জানবার জন্য আমি যাচ্ছি সেখানে। একবার জানা হয়ে গেলেই ফিরে আসব আমি। সেখানে আমি তোমাদের নিয়ে যাব। সেখানে তোমরা স্বচ্ছন্দে বাস করতে পারবে এবং অদৃশ্য পাখা মেলে ইতস্তত উড়ে বেড়াতে পারবে সুগন্ধি বাতাসে। সেখানে অনেক শিকার করতে পারবে তোমরা।
শয়তানরাজ তার কথা বলা শেষ করলেই নরকদ্বারের এই প্রহরীরা সন্তুষ্ট হলো তার কথায়। মৃত্যু নামে তাদের সেই ভয়ঙ্কর সন্তানটা এক নূতন জগতে তার ক্ষুধা পরিতৃপ্ত হবে ভেবে এক ভয়াবহ হাসি হেসে সমর্থন জানাল খুশি হয়ে। তার মাও। খুশি হয়ে বলল :
স্বর্গের সর্বশক্তিমান রাজার আদেশে এই নরকের চাবি আমি রেখেছি, এই দ্বার আমি পাহারা দিচ্ছি। এই দ্বার খোলা নিষিদ্ধ। আমার পুত্র সাক্ষাৎ মৃত্যু তার অতুলনীয় শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখানে নির্ভীকভাবে যাতে এই দ্বারপথ দিয়ে কেউ ঢুকতে বা বেরোতে না পারে। যে যতবড় শক্তিধরই হোক না কেন ওর সঙ্গে পেরে উঠবে না। আমি স্বর্গে জাত ও স্বর্গের অধিবাসী হলেও সে আমাকে ঘৃণাভরে জোর করে এই নরকান্ধকারে এক চিরসখী যন্ত্রণার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে, যেখানে আমারই সন্তানরা আমার নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে অহোরহ তার আদেশ কেন মানব আমি? তুমিই আমার পিতা, তুমিই আমাকে এ জীবন দান করেছ, আমি তোমারই আদেশ পালন করব। তুমি আমাকে এক আলোকিত সুখের জগতে নিয়ে যাবে যেখানে আমি তোমার কন্যা ও প্রিয়তমারূপে তোমারই পাশে থেকে সুখে বাস করতে পারব চিরকাল ধরে। সে জগতে তোমার সঙ্গে আমিও আধিপত্য বিস্তার করব।
এই বলে সে তার হাতের চাবি দিয়ে তালা খুলে নরকের দরজার বিশাল লৌহকপাটগুলো খুলে দিল। সেই কপাটগুলো খোলার সময় বজ্রগর্জনের শব্দ হলো এবং তাতে সমস্ত নরকপ্রদেশ কেঁপে উঠল।
সেই দরজা খুলে দিল সে। কিন্তু তা বন্ধ করবার শক্তি ছিল না তার। উন্মুক্ত রয়ে গেল সেই বিশাল দরজা যাতে রথ ও অশ্বসহ এক বিশাল বাহিনী যাতায়াত করতে পারে। ধূম আর অগ্নিশিখা নির্গত হচ্ছিল সেই দ্বারপথ দিয়ে।
তারা সেই উন্মুক্ত দ্বারপথ দিয়ে দেখল তাদের সামনে এক অন্ধকার মহাসমুদ্র অন্তহীন বিশালতায় প্রসারিত। সে মহাসমুদ্রের কোন দৈর্ঘ্য নেই, প্রস্থ নেই, কোন সীমা-পরিসীমা নেই। কোন স্থান-কাল নেই। সেখানে বিরাজ করে শুধু অনন্ত রাত্রির গভীর অন্ধকার আর বিশৃঙ্খলা, বিক্ষোভ আর সীমাহীন অরাজকতা। সেখানে উত্তাপ, শীতলতা, আদ্রতা আর শুষ্কতা–এই চারটি দুর্ধর্ষ শক্তি প্রভুত্বলাভের জন্য এক অপরিসীম দ্বন্দ্বে চিরপ্রমত্ত। তাদের সঙ্গে আছে তাদের আপন বংশজাত অসংখ্য অণু পরিমাণ জ্বণ।
কখনো বাতাস, কখনো বিক্ষোভ, কখনো খেয়ালী নিয়তি বা দৈব আধিপত্য করে অন্যদের উপর। সে সমুদ্রের কোন কূল নেই। শেষ নেই, সীমা নেই, আলো নেই, অগ্নি নেই। সেই চির অন্ধকার সমুদ্রই প্রকৃতির গর্ভদেশ এবং সমাধিগহ্বর। সেই অন্ধকার সমুদ্রের মধ্যে পরস্পরবিরুদ্ধ প্রাকৃতিক শক্তিগুলি চিরকাল ধরে সংগ্রাম করে চলেছে পরস্পরের সঙ্গে।
নরকদ্বার হতে নির্গত হয়ে নরকপ্রান্তের সেই অন্ধকারাবৃত সমুদ্রকূলের উপর হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে সেই সমুদ্র অতিক্রম করার কথা বিহ্বল হয়ে ভাবতে লাগল শয়তানরাজ। প্রবল ঝড় আয় সমুদ্রতরহের প্রমত্ত গর্জনের সঙ্গে আপীড়িত হচ্ছিল তার কর্ণকুহর।
অবশেষে নৌকার পালের মতো চওড়া পাখাগুলো মেলে মাটি থেকে ধূমরাশি ভেদ করে শয়তানরাজ লাফ দিল শূন্যে। সেই অন্ধকার শূন্যতার মধ্য দিয়ে আকাশপথে সমুদ্র, জলাশয়, পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে লাগল সে। কিন্তু চারদিক থেকে আসা প্রকৃতিজগতের নানা বিক্ষোভ ও প্রচণ্ড শব্দে অভিভূত হয়ে পড়ল সে।
অবশেষে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সে প্রকৃতিকে সম্বোধন করে বলতে লাগল, হে প্রাকৃতিক শক্তিবৃন্দ, হে আদিম রাত্রি এবং বিশৃঙ্খলার অপদেবতাগণ, গুপ্তচর হয়ে তোমাদের গোপন কর্ম জানতে বা কোনরূপে বিব্রত করতে আসিনি আমি। আমি এই শূন্য। অন্তহীন অন্ধকারে আবৃত তোমাদের রাজ্যের মধ্যে এমন এক পথের সন্ধান করছি যে পথ আমাকে নিয়ে যাবে আলোকিত এক নতুন জগতে। তোমরা আমায় পথ দেখিয়ে দাও। আমায় সঠিক পথ বলে দাও।
তখন এক অদৃশ্য কণ্ঠস্বর শয়তানকে বলল, হে বিদেশী আগন্তুক, আমি তোমাকে চিনি, আমি জানি তুমি কে। তুমি হচ্ছ অধঃপতিত দেবদূতদের শক্তিশালী নেতা। স্বর্গের রাজা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য নরকে নিক্ষিপ্ত হয়েছ তুমি। আমাদের এই রাজ্যের নিম্নে তোমাদের বর্তমান বাসস্থান অন্ধকার নরকপ্রদেশ বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। আমাদের রাজ্যের উর্বদেশে স্বর্গ ও পাতালের মাঝখানে সম্প্রতি এক নূতন জগতের সৃষ্টি হয়েছে। সে জগৎ একটি সোনার শিকল দিয়ে স্বর্গের সেই দিকের সঙ্গে বাঁধা আছে যে দিক থেকে তোমরা নিক্ষিপ্ত হয়েছ। সে জগৎ যদি তোমার গন্তব্যস্থল হয় তাহলে তা বেশিদূর নয় এখান থেকে। যাও, বেগে ধাবিত হও সেইদিকে।
এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আর সেখানে না থেমে আবার যাত্রা শুরু করল শয়তানরাজ। তার যাত্রাপথের আর বেশি বাকি নেই। অতি কষ্টে অকূল সমুদ্র পার হয়ে তার কুলের কাছে এসে পড়েছে একথা ভেবে খুশি হয়ে নূতন উদ্যমে পাখা মেলে ঊর্ধ্বে উঠে যেতে লাগল সে। আরও বাড়িয়ে দিল তার উড়ে চলার গতিবেগ এক জ্বলন্ত আগুনের পিরামিড যেমন ঝড়-ঝঞ্জার মধ্য দিয়ে অনন্তবিস্তৃত আকাশে উড়ে চলে, জেসনের গ্রীকজাহাজ যেমন একদিন দ্রুতবেগে ছুটে চলে অথবা গ্রীকবীর ইউলিসিসের জাহাজ যেমন একদিন চ্যামিবডিসের ঘূর্ণনবর্ত এড়িয়ে দ্রুতবেগে এগিয়ে যায় তেমনি দ্রুতবেগে পাখা মেলে উড়ে চলতে লাগল শয়তানরাজ।
ঈশ্বরের বিধানে অন্ধকার শূন্যতার মধ্য দিয়ে পাপ ও মৃত্যু শয়তানের অনুসরণ করে চলতে থাকায় পথ অতিক্রম করতে দারুণ কষ্ট হচ্ছিল তার।
এমন সময় সহসা সোনায় শিকলবাঁধা সেই নূতন জগৎটা পরিদৃশ্য হয়ে উঠল শয়তানের চোখের সামনে। আকাশে সেটা নক্ষত্রের থেকে ছোট চন্দ্রের পাশে একটা গ্রহের মত দেখাচ্ছিল।
সেই জগতের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল শয়তানরাজ।
ঈশ্বর স্বর্গের সিংহাসনে সমাসীন অবস্থায় দেখলেন, শয়তান তাঁর নবনির্মিত পৃথিবীর দিকে উড়ে যাচ্ছে। তিনি তাঁর ডান পাশে বসে থাকা তাঁর মানসপুত্রকে তা দেখিয়ে বললেন, শয়তান মানবজাতির মনকে কলুষিত করে তাদের বশীভূত করে তুলবে। তিনি তাঁর ন্যায়পরায়ণতার কথা উল্লেখ করে বললেন, তিনি মানুষ সৃষ্টি করে তাকে স্বাধীন বিচারবুদ্ধি দান করেছেন যাতে সে যে কোন বাইরের প্রলোভনকে জয় করতে পারে। তবে যদি কোন কারণে মানবজাতির পন ঘটে তাহলেও তারা তার অনুগ্রহলাভে বঞ্চিত হবে না। কারণ এক্ষেত্রে যদি মানবজাতির পতন ঘটে তাহলে বুঝতে হবে তারা ঈশ্বরের প্রতি কোন হিংসা পোষণ করে না এবং এই হিংসা থেকে তাদের পতন ঘটেনি, তাদের পতন ঘটেছে শয়তানের প্ররোচনাতে।
মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের অশেষ করুণা ও অনুগ্রহের জন্য তার মানবসন্তান তার পরমপিতা ঈশ্বরের গুণগান করতে লাগলেন। কিন্তু ঈশ্বর তাকে এই বলে সতর্ক করে দিলেন যে, মানুষ ঈশ্বরের বিধান যদি যথাযথভাবে মেনে না চলে, তার ন্যায়পরায়ণতা ও বিচারবুদ্ধির পরিচয় দিতে না পারে তাহলে সে তাঁর কোন অনুগ্রহ লাভ করতে পারবে না। মানবজাতির সবচেয়ে বড় দোষ তারা ঈশ্বরের সমকক্ষতা অর্জনের উদ্ধত উচ্চাভিলাষের দ্বারা তারা রুষ্ট করে তুলেছে ঈশ্বরকে। এই অপরাধের জন্যই অপরিহার্য মৃত্যুর দ্বারা খণ্ডিত তাদের জীবন। যদি তাদের মধ্যে কোন যোগ্য ব্যক্তি সমগ্র মানবজাতির এই পাপের সমুচিত শাস্তি মাথা পেতে নেবার জন্য এগিয়ে না আসে তাহলে এই মরণশীল জীবন থেকে মহাজীবন লাভ করতে কোনদিন পারবে তারা। ঈশ্বরের সেই পুত্র বলল, মানবজাতির মুক্তির জন্য সে শাস্তিভোগ করতে রাজী আছে। ঈশ্বর মেনে নিলেন তার প্রস্তাব। তাকে ঈশ্বরপুত্র হিসাবে অবতার দান করলেন এবং স্বর্গ ও মর্ত্যের সকলের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মহান করে তুললেন। তিনি দেবদূতদের তার মহত্ত্বকে স্বীকার করে তাকে বরণ করে নিতে আদেশ দিলেন। দেবদূতেরা তখন তাদের বীণা বাজিয়ে ঈশ্বর ও তাঁর পুত্রের জয়গান করতে লাগল।
ইতিমধ্যে শয়তান পৃথিবীর শেষ প্রান্তে এক ফাঁকা জায়গায় এসে অবতরণ করল। ঘুরতে ঘুরতে সে এক উপত্যকায় এসে পড়ল। তারপর সে স্বর্গের দ্বারদেশে এসে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। ক্রমে সে আকাশের উপরে সৌরমণ্ডলের কক্ষপথে এসে পড়ল। সেখানে সে ইউরিয়েল নামে এক দেবদূত প্রহরীর দেখা পেল। তখন সে এক নিম্নস্তরের দেবদূতের বেশ ধারণ করল। তখন সে ঈশ্বরসৃষ্ট নূতন মানবজগতের সবকিছু দেখার জন্য এক প্রবল কৌতূহল অনুভব করল।
হে পবিত্র জ্যোতি, স্বর্গের প্রথমজাত সন্তান, আমি কি তোমার মহিমা অবিকৃতভাবে প্রকাশ করতে পারি? যে ঈশ্বর এক পরম জ্যোতিস্বরূপ, সেই জ্যোতির্ময় পরম পুরুষের সঙ্গে একই সঙ্গে আপনা থেকে সৃষ্ট হয়ে অনন্তলোকে বিরাজ করছ। অনন্তকাল ধরে আদিঅন্তহীন যে পবিত্র ধারায় তুমি প্রবাহিত হয়ে চলেছ তার উৎস কোথায় তা কে জানে?
যখন সৌরমণ্ডল ও আকাশের সৃষ্টি হয়নি তখনও তুমি ছিলে। যখন ঈশ্বরের ইচ্ছায় ও আদেশে ধীরে ধীরে পৃথিবী জেগে ওঠে এবং জল সৃষ্ট হয় তারও আগে তুমি অনন্ত মহাশূন্যে নিরাকার অবস্থায় বিরাজ করতে। উদ্ধত পাখা মেলে আমি আবার তোমাকে দর্শন করতে এসেছি।
আমি স্টাইজিয়ার নারকীয় নদী পার হয়ে অনেক অন্ধকার আকাশপথ অতিক্রম করে অনন্ত রাত্রির প্রশস্তি গাইতে গাইতে কখনো নিচের দিকে নেমে, কখনো উপরের দিকে উঠে বহু ক্লেশ সহ্য করে এখানে এসেছি। তোমার সর্বব্যাপী পরম জ্যোতি পুনরায় দর্শন করতে চাই আমি। কিন্তু সে জ্যোতি হতে নিঃসৃত কোন আলোকরশ্মি পরিদৃশ্য হয়ে উঠছে না আমার সম্মুখে। এই নৈশনিবিড় অন্ধকারের যেন শেষ নেই। কোন প্রভাতের আলো দেখছি না কোন দিকে। তবে কি ঘন কুজ্বটিকাজাল ও মেঘমালার দ্বারা সমাচ্ছন্ন হয়ে আছে তোমার জ্যোতির্মালা?
তবু আমি অদম্য ও অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলেছি। কোন ছায়াচ্ছন্ন কুঞ্জবনে অথবা আলোকোজ্জ্বল কোন পর্বতশিখরে অথবা নির্মল জলের ঝর্ণাধারা তোমার পদধৌত করে কলস্বরে প্রবাহিত হয়ে চলে আমি সেখানে চলে যাই নিশীথ অন্ধকারে।
কিন্তু মাঝে মাঝে আমি আমারই মত দুজন কবির কথা ভুলে যাই। তারা হলেন প্রাচীন থ্রেসের কবি থেমিরিস আর এশিয়া মাইনরের অন্তর্গত মেওনিয়ার কবি হোমার। এঁরা দুজনেই অন্ধ ছিলেন। তাঁরা ছিলেন চারণ কবি এবং গায়ক। অন্ধকার বনভূমিতে নাইটিঙ্গেল পাখি যেমন গান করে, তেমনি তারা সুমধুর স্বরে গান গেয়ে ঘুরে বেড়াতেন বিভিন্ন স্থানে।
মাসের পর মাস, ঋতুর পর ঋতু আসে, তবু আলোকোজ্জ্বল কোন দিনের মুখ দেখতে পাই না আমি। বসন্তের পুষ্পদ্যান ও গ্রীষ্মের গোলাপ কখনো চোখে পড়ে না আমার। চারণরত কোন পশুর পাল অথবা কোন মানুষের স্বর্গীয় সুষমাসমৃদ্ধ মুখ দেখতে পাই না আমি।
তার পরিবর্তে নিয়তনিবিড় মেঘমালা আর অন্তবিহীন অন্ধকার পরিবৃত করে রেখেছে আমায় সব সময়ের জন্য। আনন্দময় মানবজগৎ হতে বিচ্ছিন্ন আমি সম্পূর্ণরূপে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডব্যাপী এক সীমাহীন শূন্যতা আর অন্ধকার ছাড়া আর কোন জগৎ ও জীবনের কথা জানা নেই আমার। প্রকৃতি জগতের কোন সুন্দর বস্তু চোখে পড়ে না আমার। আমার অন্তরলোককে উদ্ভাসিত করো যাতে আমি অপরিদৃশ্যমান সকল বস্তু অবলোকন করতে পারি। আমার মন হতে সকল অন্ধকার বিদূরিত করে আমার অন্তরের চক্ষুকে উন্মীলিত করো।
ঠিক সেই সময় সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যদি তার স্বর্গের সিংহাসন হতে নিম্নে তার দৃষ্টিনিক্ষেপ করতেন তাহলে তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে একনিমেষে নিরীক্ষণ করতে পারতেন। তাঁর চারপাশে তখন স্বর্গলোকের জ্যোতিষ্মন পবিত্র বস্তুগুলি ঘনবদ্ধ নক্ষত্ররাজির মত বিরাজ করছিল। তার দিকে তার ডান পাশে তার একমাত্র পুত্র প্রদীপ্ত গৌরবে বসেছিল।
মর্ত্যলোকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে তিনি দেখলেন মানবজাতির আদি পিতামাতা তখন একটি সুন্দর কাননে অনাবিল অখণ্ড আনন্দ আর অতুলনীয় প্রেমের ফল পেড়ে খাচ্ছিল পরম সুখে।
এরপর তিনি নরক আর মর্ত্য আর নরকপ্রদেশের মধ্যবর্তী অন্ধকার শূন্যতার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখলেন শয়তান ক্লান্ত পাখা মেলে পৃথিবীর প্রান্তভূমিতে দেওয়াল বেয়ে উঠে পদস্থাপনের চেষ্টা করছে। স্বর্গের সিংহাসনে বসে থেকে শয়তানকে দেখার পর তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালের সব কিছু দেখতে পেলেন।
এই দেখে তিনি তাঁর পুত্রকে বললেন, হে আমার একমাত্র পুত্র, দেখতে পাচ্ছ আমাদের ক্রোধের বশবর্তী হয়ে কি করছে শয়তান? নরকের কারাগার তাকে আবদ্ধ করে রাখতে পারেনি, কোন সীমার শাসন সে মানেনি, তূপাকৃত শৃঙ্খল তাকে দমন করতে পারেনি, সীমাহীন অন্ধকার ও শূন্যতা, মহাসমুদ্রের অনন্ত জলরাশি তার গতিরোধ করতে পারেনি। আমাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য এক আত্মঘাতী সংকল্পে মত্ত হয়ে উঠেছে সে। কিন্তু সে জানে না এর দ্বারা কিছুই করতে পারবে না সে। তার বিদ্রোহী উদ্ধত মস্তকের উপর দ্বিগুণ পরিমাণে চাপবে শুধু শাস্তির বেদনাভার। সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে সমস্ত বিধিনিষেধের বেড়াজাল অতিক্রম করে এখন সে পাখা মেলে স্বর্গলোকের কাছাকাছি আলোর মধ্যে চলে এসেছে।
সে সরাসরি যেতে চায় মানবজাতির দ্বারা অধ্যুষিত নবনির্মিত পৃথিবীতে। বলপ্রয়োগ অথবা ছলনার দ্বারা সে জাতিকে ধ্বংস করতে চাইবে সে। মানু শয়তানের আপাতমধুর ও চাককিপূর্ণ যত সব মিথ্যাকথা শুনে ভুলে যাবে। ফলে তারা ঈশ্বরের প্রতি তাদের আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি ও ঈশ্বরের আদেশ লঙঘন করবে। এইভাবে তারা এবং তাদের বংশধরেরা অধঃপতিত হবে।
কিন্তু সে অধঃপতন ঘটবে কার দোষে? তার নিজের দোষ ছাড়া এ দোষ কার? বড় অকৃতজ্ঞ এই মানবজাতি। তাদের যা যা প্রয়োজন তা তারা সব পেয়েছে আমার কাছ থেকে। আমি তাদের ন্যায়-অন্যায় বোধ দান করেছি। এই বোধের দ্বারা তারা দাঁড়াতেও পারে আবার তাদের পতনও ঘটতে পারে। কারণ ন্যায়-অন্যায় বোধের সঙ্গে তাদের ইচ্ছামত চলার স্বাধীনতাও দান করেছি। স্বর্গের দেবদুতদেরও আমি এমনি করে স্বাধীনভাবেই সৃষ্টি করেছিলাম। তাদের মধ্যে অনেকে এই স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করে দাঁড়িয়েছিল, আবার অনেকে সে স্বাধীনতার অপব্যবহার করে অধঃপতিত
তারা স্বাধীন হলেও একনিষ্ঠ আনুগত্য, স্থায়ী বিশ্বাস ও অচলা প্রেমভক্তির কি প্রমাণ কি পরিচয় তারা দান করেছে? কি প্রশংসা তারা করেছে? তাদের আনুগত্য থেকে কতখানি আনন্দ আমি লাভ করেছি? তারা শুধু নিজেদের প্রয়োজনসিদ্ধির জন্য খুশিমত কাজ করে গেছে। তাদের ইচ্ছার স্বাধীনতা এবং যুক্তিবোধের যথেচ্ছ অপব্যবহার করে সে দুটিকে ব্যর্থতায় পরিণত করে তুলেছে তারা। এ দুটিকে নিষ্ক্রিয় করে তুলে শুধু নিজেদের প্রয়োজনের সেবা করে গেছে। আমার সেবা করেনি তারা।
এইভাবে ইচ্ছামত চলার অধিকার আমিই দান করেছিলাম এবং এইভাবে তাদের সৃষ্টি করেছিলাম যারফলে তারা তাদের পতনের জন্য তাঁদের স্রষ্টার উপরে ন্যায়সঙ্গতভাবে কোন দোষারোপ করতে পারবে না। তাদের নিয়তিকেও কোন দোষ দিতে পারবে না। পূর্বনিদিষ্ট বিধির বিধান ও তাদের ভবিষ্যৎকাল অদের ইচ্ছাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে বলেই তারা বিদ্রোহ করে আমার বিরুদ্ধে। আমি যদি একথা আগে হতে জানতে পারতাম তাহলে তাদের এই ভবিষ্যৎকাল কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারত না এই বিদ্রোহের উপর। তাদের স্বাধীন বিচারবুদ্ধি ও ইচ্ছানুসারেই আমার অমোঘ– বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে তারা। নিজেদের কর্মদোষে ও অপরাধের জন্য নিজেদের দাসত্ব ডেকে না আনা পর্যন্ত তারা স্বাধীনই থাকবে। আমার অমোঘ অপরিবর্তনীয় বিধান অনুসারেই তারা স্বাধীনতা পায়। কিন্তু তারা নিজেদের দোষে নিজেদের পতন ডেকে আনে। তারা শয়তানের দ্বারা প্রলুব্ধ ও প্ররোচিত হয়ে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠে। তবু তারা আমার অনুগ্রহ এবং করুণা লাভ করবে। স্বর্গ আর মর্ত্যলোকের অধিবাসীরা আমার করুণা আর ন্যায়বিচার লাভ করে ধন্য হবে। আমার গৌরব উজ্জ্বলভাবে কিরণ দান করবে স্বর্গ ও মর্ত্যলোক ব্যাও করে।
এইভাবে ঈশ্বর তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। আনন্দরূপ অমৃতের এক অক্ষয় দিব্য সৌরভে আমোদিত হয়ে উঠল যেন সমগ্র স্বর্গলোক। এক নূতন আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠল দেবদূতেরা। তার পরমপিতার এক গৌরবোজ্জ্বল দীপ্তিতে দীপ্তিমান হয়ে বসেছিল তার পুত্র। অনন্ত প্রেম আর করুণার এক স্বর্গীয় দ্যুতি উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছিল তার মুখমণ্ডলে।
ঈশ্বরের পুত্র এবার বলতে লাগলেন, হে পরমপিতা, তোমার শেষ বাক্যটির জন্য স্বর্গে-মর্ত্যে ঘোষিত হবে তোমার গৌরব। বিভিন্ন স্তোত্র ও পবিত্র প্রার্থনার সঙ্গীতে ধ্বনিত হবে তোমার জয়গান। কিন্তু তোমার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তোমার প্রিয় সৃষ্ট মানবজাতি কি তাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য শয়তানের ছলনা ও প্রতারণার শিকার হয়ে অধঃপতিত হবে?
হে পরমপিতা, যে তুমি সমস্ত ন্যায়বিচারের অধিকর্তা এক মূর্ত প্রতীক সেই তোমার পুত্রের এমন অবস্থা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। এত সহজে কি তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে এবং তোমার উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে তুলবে? সে কি তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে তোমার মহত্ত্বকে খর্ব করে তুলবে? সে কি সমগ্র মানবজাতিকে প্রলোভিত করে তাদের সকলকে তার সঙ্গে নরকে নিয়ে যাবে? অথবা তুমি কি তোমার নিজের গৌরবজনক সৃষ্টির নিজেই এইভাবে উচ্ছেসাধন করবে?
তাঁর পুত্রের এই কথার উত্তরে পরমপিতা ও স্রষ্টা বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র, আমার আত্মার আনন্দ, আমার অন্তরের অন্তর, তোমার মধ্যেই আমার জ্ঞান ও শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে। তুমি আমার মনের কথাই ব্যক্ত করেছ। আমার অমোঘ বিধান এবং উদ্দেশ্য হলো এই যে, মানবজাতি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হবে না। তাদের ইচ্ছাশক্তির দ্বারা নয়, আমার অনুগ্রহের দ্বারাই সমস্ত বিপদ হতে উদ্ধার লাভ করবে তারা। তাদের উচ্ছল কামনা-বাসনার তাড়নায় পাপের বশবর্তী হয়ে যে শক্তি হারাবে তারা সে শক্তি আমি পুনরায় দান করবে তাদের। আমার সাহায্য লাভ করে তাদের শত্রুর সব কাণ্ড ও শয়তানিকে ব্যর্থ করে আবার যথাস্থানে দাঁড়াতে পারবে তারা। আমার কাছ থেকে অনুই ও সাহায্য লাভ করে তারা বুতে পারবে তাদের অধঃপতিত অব। কত সোশী এবং জানতে পারবে একমাত্র আমার দ্বারাই উদ্ধার লাভ করেছে তারা।
মানবজাতির মধ্যে কিছু লোককে আমার বিশেষ অনুগ্রহলাভের যোগ্য হিসাবে নির্বাচিত করেছি। তাদের স্থান হবে অ্ন্য সকলের ঊর্ধ্বে। আমার নির্বাচিত এই সব অনুগৃহীত ব্যক্তিরা ছাড়া বাকি সকলে আমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সতর্ক হয়ে তাদের পাপ সম্বন্ধে সচেতন হবে। তাদেরও আমি আমার অনুগ্রহ দান করব এবং তাদের মনের সব অন্ধকার ও অজ্ঞানতা দূর করব। ফলে তাদের প্রস্তরকঠিন অন্তর মেদুরতা প্রাপ্ত হয়ে আবার আমার অনুগত হয়ে উঠবে তারা। তারা তখন অনুতপ্ত হৃদয়ে আমার প্রার্থনা করে সমস্ত পাপ স্খালন করবে।
সদিচ্ছার সঙ্গে তারা পুনরুত্থানের জন্য নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা করলেও তাদের সব কথা শোনার জন্য আমার কর্ণকুহর সজাগ থাকবে সতত এবং তাদের সবকিছু দেখার জন্য আমার চোখও খোলা থাকবে। আর পরিচালক হিসাবে আমি বিবেককে স্থাপন করব তাদের অন্তরে। যদি তারা সেই বিবেকের বিবেকের নির্দেশ মেনে চলে তাহলে অন্ধকারের মধ্যে আলোর সন্ধান পাবে তারা এবং অবশেষে নিরাপদ হয়ে উঠবে তাদের জীবন। কিন্তু বিবেকবুদ্ধিকে অবহেলা ও ঘৃণার চোখে দেখলে তারা বঞ্চিত হবে আমার অনুগ্রহলাভে। তারা মুক্তির আস্বাদ লাভ করতে পারবে না। তাদের কঠিন অন্তর কঠিনতর হবে এবং তাদের অন্ধ দৃষ্টি আরও অন্ধ হবে। ফলে পতনের গভীরতর স্তরে নেমে যাবে তারা এবং আমার করুণা হতে বঞ্চিত হবে।
কিন্তু সেটাই সব নয়। মানুষ যদি বিধির বিধানকে অমান্য করে স্বর্গের পরমেশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে পাশে নিমজ্জিত হয় তাহলে তাকে সব হারাতে হবে। তাতে সমগ্র মানবজাতির ধ্বংস অনিবার্য। তাদের সকলকেই মরতে হবে যদি তাদের মধ্যে কোন যোগ্য ব্যক্তি স্বেচ্ছায় তাদের সকলের সম্মান ও মুক্তির জন্য মৃত্যুবরণ করে ঈশ্বরকে তুষ্ট না করে। হে দেবদূতগণ বল, এমন আত্যাগ ও ঈরশ্রেয় আমি কোথায় পাব? বল, কে তোমাদের মানবজাতিকে পাপ হতে উদ্ধার করার জন্য স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসবে এ কাজে? মরণশীল মানুষের জন্য এভাবে আত্মোৎসর্গ করে স্বর্গবাসীদের মধ্যে কে এমন বিরল মহানবতার পরিচয় দেবে?
ঈশ্বরের এই প্রশ্নে সমস্ত দেবদূতগণ এক নির্বাক নীরবতায় স্তব্ধ হয়ে রইল। মানবজাতির প্রতি অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কেউ এগিয়ে এসে মৃত্যুবরণ করতে চাইল না। কেউ তাদের মুক্তির জন্য এই ভয়ঙ্কর আত্মোৎসর্গে সম্মত হলো না। ফলে। মুক্তিহীন মানবজাতির ধ্বংস, মৃত্যু ও নরকভোগ অনিবার্য হয়ে উঠল।
এমন সময় পরিপূর্ণ স্বর্গীয় প্রেমের মূর্ত প্রতীক ঈশ্বরপুত্র স্বয়ং বলতে লাগলেন : হে পরমপিতা, তোমার যা কিছু বলার তা শেষ হয়েছে। মানুষ তোমার অনুগ্রহ ও করুণালাভে ধন্য হবে ঠিক, কিন্তু কি উপায়ে এই করুণা তারা লাভ করবে তা জানে না। তোমার দ্রুতগতিসম্পন্ন পক্ষবিশিষ্ট যে সব দেবদূত সকল প্রাণীর কাছে অবাধে গিয়ে সাহায্য করে বেড়ায় তারা এখন নীরব। কিন্তু মানবজাতি যদি একবার ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে তারা দেবদূতদের কাছ থেকে কিভাবে সাহায্য চাইবে? এই মানবজাতির পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য জীবনদান করার কেউ নেই।
কিন্তু কেউ না এলেও আমি আছি। আমি সমগ্র মানবজাতির উদ্ধারের জন্য জীবনদান করতে প্রস্তুত আছি। আমাকে মানুষ মনে করে তোমার সমস্ত ক্রোধের আবেগ উজার করে ঢেলে দাও আমার উপর। আমি সেই মানবজাতির মুক্তির জন্য তোমার বক্ষস্থল ও আমার গৌরবের আসন ত্যাগ করে মৃত্যুবরণ করব। মৃত্যুর সমস্ত রোষ হাসিমুখে সহ্য করব আমি।
কিন্তু মৃত্যুবরণ করলেও মৃত্যর অন্ধকার কারাগারে তার কঠিন শক্তির অধীনে শর্ঘকাল আবদ্ধ থাকতে হবে না আমায়। কারণ তুমি আমায় অনন্ত জীবন দান করেছ। তোমার দ্বারাই বেঁচে আছি।
মানবজাতির ঋণ পরিশোধের জন্য আমি যদিও মৃত্যুবরণ করি তথাপি তুমি নিশ্চয় ঘৃণ্য কবরের মধ্যে মৃত্যুর শিকাররূপে বেশিদিন ফেলে রাখবে না আমাকে। আমার নিষ্কলুষ নিষ্কলঙ্ক আত্মাকে পাপে নিমজ্জিত হয়ে সেই অন্ধকার সমাধিগহ্বরের মধ্যে বেশি দিন বাস করতে হবে না নিশ্চয়।
আমি সে গহ্বর হতে অবশ্য বিজয়ী শত্রু মৃত্যুকে পরাভূত করে বেরিয়ে আসব শীঘ্র। তার সংশয়জনিত ক্ষতের দ্বারা নিজেই আহত হয়ে বীর্যহীন ও অগৌরবের গ্লানির দ্বারা জর্জরিত হয়ে পড়বে মৃত্যু। আমি মৃত্যুকে জয় করে বিজয়ী বীরের মত সমাধিগহ্বরের অন্ধকার হতে বেরিয়ে আসব প্রভূত আলো-বাতাসের রাজ্যে। আসার। সময়ে নরক বা মৃত্যুপুরীকেই বন্দী করে নিয়ে আসব।
হে পিতা, আমার সে কৃতিত্ব দেখে সন্তুষ্ট হবে তুমি। স্বর্গের সিংহাসন থেকে সে দৃশ্য অবলোকন করে আনন্দে হাসবে। তোমার সাহায্য ও অনুগ্রহে আমি সমাধিগহ্বর থেকে উত্থিত হয়ে আমার সমস্ত শত্রুদের ধ্বংস করব। মৃত্যুকে ধ্বংস করব সব শেষে। তার মৃতদেহ দিয়ে আমি চিরতরে বন্ধ করে দেব কবরের মুখ। তারপর মুক্ত মানবজাতিকে নিয়ে আমি আবার ফিরে আসব স্বর্গলোকে। হে পিতা, তখন তোমার মুখে কোন ক্ৰোধাবেগের মেঘ থাকবে না, সে মুখমণ্ডলে তখন বিরাজ করতে থাকবে শান্তি আর পুনর্মিলনের পরিপূর্ণ আনন্দ। তখন থেকে মানবজাতির উপর আর কোন ক্রোধের ধ্রুকুটি থাকবে না তোমার চোখে-মুখে।
ঈশ্বরপুত্রের কথা এইখানেই শেষ হলো। কিন্তু তাঁর নীরব মুখ হতে মরণশীল মানবজাতির প্রতি অমর নিরুচ্চার প্রেমের কত বাণী অশ্রুতভাবে ধ্বনিত হচ্ছিল যেন। সেই প্রেমের সঙ্গে তার মুখে দ্যোতিত হয়ে উঠছিল তাঁর পরমপিতার প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্যের ভাব। আনুগত্যের আনন্দের দীপ্তিতে ভাস্বর হয়ে উঠছিল তাঁর সমগ্র দেহাবয়ব। তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল স্বর্গলোকের অধিবাসীবৃন্দ। ঈশ্বরপুত্রের এই মহানুভবতায় আশ্চর্য হয়ে গেল তারা সকলে।
সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর তখন বললেন, হে আমার পুত্র, আমার কোপানলে পতিত অধঃপতিত মানবজাতির মুক্তির জন্য তুমি আত্মোৎসর্গ করতে চেয়ে স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যে সকল বিবাদ-বিসম্বাদ দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করলে। হে আমার আনন্দ আর আত্মপ্রসাদের মূর্ত প্রতীক, তুমি জান, আমার সকল সৃষ্টি কত প্রিয় আমার কাছে। মানুষ আমার শেষ সৃষ্টি হলেও সেও কম প্রিয় নয় আমার। সেই অধঃপতিত মানবজাতির উদ্ধারকল্পে আমি আমার বক্ষস্থল ও দক্ষিণ পার্শ্ব থেকে কিছুকালের জন্য দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমায়। একমাত্র তুমিই পার তাদের চূড়ান্ত পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে। এই মুক্তির মধ্য দিয়ে তাদের অন্ত:প্রকৃতি যেন তোমার অন্তঃকরণের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে উঠতে পারে। তোমার মধ্য দিয়ে তারা যেন লাভ করতে পারে এক আশ্চর্য নবজন্ম।
মানবজাতির আদিপিতা আদমের বংশধর তারা। কিন্তু আদমের পাপের জন্যই পতন ঘটে তাদের। কিন্তু তোমার দ্বারা উদ্ধার লাভ করে আবার তারা নবজন্ম গ্রহণ করে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠবে তারা গৌরবের আসনে। তুমি ছাড়া তাদের এ মুক্তি এ নবজন্ম সম্ভব নয়। আদমের দোষে দোষী হয়ে ওঠে তার সকল সন্তান। তোমার মহত্ত্বের গুণে তারা পাপমুক্ত হয়ে সমস্ত অন্যায় ঝেড়ে ফেলে এক নবজীবনের সন্ধান পাবে তোমার মধ্যে। তুমি মানুষ হয়ে জন্মে মানুষের জন্যই মৃত্যুবরণ করবে এবং মৃত্যুর পর পুনরভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাদের সকলকে তুলে ধরবে। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তুমি আনবে সমগ্র মানবজাতির মুক্তি। স্বর্গীয় প্রেমের সুষমা নারকীয় ঘৃণাকে ধ্বংস করে জয়ী হবে।
যদিও তুমি স্বর্গ থেকে অবতরণ করে মর্তে গিয়ে মানবসন্তানরূপে জন্মগ্রহণ করবে, মানবপ্রকৃতি প্রাপ্ত হবে তথাপি তোমার দেবভাব ক্ষুণ্ণ হবে না কিছুমাত্র। কারণ তুমি ঈশ্বরপুত্র হিসাবে স্বর্গে মান-মর্যাদায় ঈশ্বরের সমতুল হয়ে ঐশ্বরিক সুযোগ-সুবিধা সবই ভোগ করেছ। কিন্তু সেই পরম স্বর্গীয় সুখ ত্যাগ করে একটা জগৎকে আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ঈশ্বরের পুত্র হিসাবে জন্মগত অধিকারের থেকে তোমার নিজের গুণের জোরে আরো অনেক বেশি অধিকার লাভ করেছ। তোমার সততা, উদারতা ও মহত্ত্বের জন্য তুমি বেশি যোগ্যতা অর্জন করেছ। তোমার মধ্যে গৌরবের থেকে প্রেমের পরিমাণ বেশি।
মর্তে গিয়ে মানবসন্তানরূপে যে অপমান যে লাঞ্ছনা তুমি পাবে সেই অপমান যেন তোমার প্রকৃতিকে খর্ব বা কলুষিত করতে না পারে। কারণ তুমি মনে রাখবে তুমি আজ ঈশ্বরের সমান মর্যাদায় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছ। ঈশ্বরের মতই পরম সুখ ও ঐশ্বর্য ভোগ করবে। তুমি সব কিছু ত্যাগ করে একটি জগৎকে চরম ধ্বংস হতে উদ্ধার করতে চলেছ। ঈশ্বরের পুত্র হিসাবে তোমার সহজাত গুণের বাইরেও তোমার অনেক গুণ আছে। যেহেতু তোমার অন্তঃকরণ গৌরববোধ থেকে প্রেমবোধের দ্বারা বেশি পরিপূর্ণ, তোমার চরিত্রে মহত্ত্বের থেকে সততা ও উদারতার প্রাধান্যই বেশি। সুতরাং যদি তুমি যে কোন অপমান পাও তাহলে সে অপমান এই সিংহাসনের উপর অধিষ্ঠিত তোমার মানবত্বকে সমুন্নত ও মহিমান্বিত করে তুলবে।
এখানে তুমি ঈশ্বরের মানবতারূপে অধিষ্ঠিত থেকে দেবতা ও মানবদের উপর রাজত্ব করবে। তুমি হবে একাধারে ঈশ্বরপুত্র ও মানবপুত্র। সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বররূপে অভিষিক্ত হবে তুমি। আমি তোমাকে সমস্ত ক্ষমতা দান করলাম। তুমি সেই ক্ষমতাবলে চিরকাল রাজত্ব করবে। স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালের যেখানে যত রাজা-রাজড়া আছে তাদের সমস্ত রাজক্ষমতা তোমার সার্বভৌম ক্ষমতার অধীনস্থ হয়ে থাকবে। তোমার ক্ষমতার কাছে খর্ব হয়ে থাকবে। এটাই আমার বিধান। তুমি যখন মহিমায় গৌরবোজ্জ্বল মূর্তিতে আকাশে আবির্ভূত হবে তখন স্বর্গ, মর্ত ও পাতালের সকলেই নতজানু হয়ে তোমার অকুণ্ঠ বশ্যতা স্বীকার করবে। তোমার অধীনস্থ দেবদুতেরা তোমার কঠোর আইনকানুনগুলি সর্বত্র ঘোষণা করে বেড়াবে। সেই সব আইনকানুন যুগপৎ সমানভাবে বলবৎ হবে জীবিত ও মৃতদের জগতে।
মৃতদের শেষ বিচারের ক্ষণটি বজ্রগর্জনে নির্ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অতীত সকল যুগের মৃতদের আত্মারা তাদের চিরনিদ্রা হতে উখিত হয়ে ছুটে আসবে তোমার কাছে। তুমি সাধু-সম্ভদের আত্মার সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে সকলের পাপপুণ্যের চূড়ান্ত বিচার সকলকে কর্মানুরূপ ফল দান করবে। কর্মের দ্বারা তাদের মধ্যে কে সাধু কে শয়তান তা নির্ণয় করবে। সৎ ও সাধুদের স্বর্গে এবং পাপীদের নরকে প্রেরণ করবে। পাপীদের দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে নরকদেশ। পাপীরা বিচারকালে ভয়ে সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে তোমার সামনে।
ইতিমধ্যে পাপপূর্ণ পৃথিবী অগ্নিদগ্ধ হয়ে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। তখন তার সেই ভস্মতূপ থেকে এক নূতন বিশুদ্ধ স্বর্গ ও বিশুদ্ধ মতের উদ্ভব হবে যেখানে নিয়ত বিরাজ করবে শুধু সত্য আর ন্যায়পরায়ণতা। সকল সৎ সাধু ব্যক্তিরা তাদের সুদীর্ঘকালীন দুঃখকষ্টের অবসানে দেখতে পাবে এক নূতন স্বর্ণযুগের আগমন। পুণ্যাত্মক কর্মের সুবর্ণ ফলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে পৃথিবী। অনাবিল আনন্দ, মহতী প্রেম আর সুন্দর সত্যের জয় প্রতিষ্ঠিত হবে সর্বত্র।
তখন আর তোমার রাজদণ্ডের প্রয়োজন হবে না। ঈশ্বরই হবে সর্বময় কর্তা। ঈশ্বরের ন্যায়রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে স্বর্গ ও মর্ত্যলোকে। কিন্তু হে দেবতাবৃন্দ, তোমরা আমার পুত্রকে বরণ করে নাও। আমার এই পুত্র ন্যায় ও সত্যের জয় প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমেই মৃত্যুবরণ করবে। তোমরা আমার মতই তাকে সম্মান দান করো।
সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কণ্ঠ নীরব হতেই অসংখ্য দেবদূতেরা সমস্বরে চিৎকার করে উঠল। এক বিপুল আনন্দোল্লাসে নিনাদিত সেই দিব্যমধুর কণ্ঠস্বরে আকাশমণ্ডলের প্রতিটি প্রত্যন্তভাগ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। তারা গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তিভরে মাথা নত করল ঈশ্বর ও ঈশ্বরপুত্রের কাছে।
স্বর্গলোকের কাননে অমর জীবনবৃক্ষে প্রস্ফুটিত দিব্য কুসুমমাল্যে সংজড়িত বীণাগুলি হাতে তুলে সেই নিয়ে বীণাবাদন সহযোগে মধুর সঙ্গীতের দ্বারা পরমপিতার জয়গান গাইতে লাগল তারা। তারা মধুর কণ্ঠে স্তব করতে লাগল, হে সর্বশক্তিমান, অনন্ত, অমর, সমগ্র ত্রিভুবনের অধিপতি, তুমিই সকল জীবের স্রষ্টা, সকল আলোর উৎস। চারিদিকের গৌরবময় উজ্জ্বলতার মাঝে তুমি নিজে অদৃশ্য অবস্থায় তোমার সিংহাসনে উপবিষ্ট থাক। সে সিংহাসন এমনই দুরধিগম্য যে কেউ তার নিকটস্থ হতে পারে না। যে দিব্য জ্যোতির দ্বারা তুমি সতত পরিবৃত সে জ্যোতি এমনই যে তার মাঝে পরিদৃশ্য হয় না তোমার মূর্তি। তোমার জ্যোতির তীব্রতা এমনই যে কারো চোখের দৃষ্টি তা সহ্য করতে পারে না। এমন কি সবচেয়ে উজ্জ্বল দেবদূত সেরাফিমও তোমার কাছে যেতে পারে না। তার ডানাদুটি দিয়ে চোখ চেপে রাখে। তুমি তোমার জ্যোতির তীব্রতাকে প্রশমিত না করলে কারো চোখে পরিদৃশ্য হবে না তোমার মূর্তিটি।
এরপর তারা ঈশ্বরপুত্রের স্তব করে বলতে লাগল, হে ঈশ্বরপুত্র, সমস্ত সৃষ্টির মাঝে ঈশ্বরের অবিকল সাদৃশ্যে উৎপন্ন ঈশ্বরের একমাত্র সন্তান তুমি। তোমার নির্দোষ, নির্মল মুখমণ্ডলে যে সর্বশক্তিমান পরমপিতাকে কেউ দেখতে পায় না চোখে সেই পরমপিতা এক মধুর উজ্জ্বলতায় অতিমূর্ত ও পরিদৃশ্য হয়ে আছেন। তার গৌরবের উজ্জ্বলতায় উজ্জ্বল তুমি। তাঁর অমিত শক্তি ও তেজ সঞ্চারিত তোমার মধ্যে। তিনি হচ্ছেন স্বর্গের স্বর্গ। তিনি হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ উচ্চাভিলাষী, সর্বোচ্চ প্রভুত্বস্পৃহার মূর্ত প্রতীক।
একদিন তুমি তোমার পিতার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে তোমার দেবদূত সেনাদের নিয়ে পিতার শত্রুদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে নির্গত হও। তোমার জ্বলন্ত রথচক্রনির্ঘোষে বিকম্পিত হয় সমগ্র স্বর্গলোক। কিন্তু স্বর্গচ্যুত মানবজাতির উপর তোমার কোন ক্রোধ বর্ষিত হয়নি। তাদের উপর কোন প্রতিশোধ গ্রহণ না করে বা তাদের ধ্বংস না করে তাদের প্রতি করুণা ও মমতায় বিচলিত হয়ে যাও তুমি। তোমারই এই মমতা ও করুণা থেকেই তোমার পরমপিতা সর্বশক্তিমান ঈশ্বর মানবজাতির সঙ্গে স্বর্গলোকের সব বিবাদ-বিসম্বাদের অবসান ঘটিয়ে ফেলেন।
হে ঈশ্বর, পরমপিতা! তোমার পরেই যাঁর স্থান, তোমার পরেই যিনি ঐশ্বরিক সম্মানের অধিকারী তোমার সেই পুত্র পরম স্বর্গীয় সুখে জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু মানবজাতির অপরাধ স্খলনের জন্য নিজে মৃত্যুবরণ করেছেন।
হে ঈশ্বরপুত্র, মানবজাতির পরিত্রাতা, তোমার দৃষ্টান্তবিহীন অতুলনীয় ঐশ্বরিক প্রেম শুধু তোমার মাঝেই মূর্ত, এ প্রেম অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। তোমার, নামই হবে আমার সঙ্গীতের একমাত্র বিষয়বস্তু। আজ হতে পরম ঈশ্বরের জয়গানের সঙ্গে সঙ্গে তোমার জয়গান গাইতে কখনই ভুলে যাবে না আমার বীণা।
এইভাবে নক্ষত্রখচিত আকাশমণ্ডলের উর্ধ্বে স্বর্গলোকে দেবতারাঈশ্বর ও ঈশ্বরপুত্রের স্তোত্ৰগান গেয়ে সুখে কালাতিপাত করছিলেন।
এমন সময় চির-আলোকিত স্বর্গলোকের তলদেশে অনন্ত রাত্রির সীমাহীন অন্ধকারে আচ্ছন্ন এক বিশাল জগতে অবতরণ করল শয়তান।নক্ষত্রহীন রাত্রির অন্তহীন অন্ধকারে আবৃত চির-উষ্ণ সে জগৎ সীমাহীন মহাদেশ বলে মনে হচ্ছিল। অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবায়ুর দ্বারা সতত জর্জরিত সে মহাদেশ। সেই বিস্তৃত মহাদেশের একটিমাত্র অংশ স্বর্গের এক প্রাচীর বলে বিচ্ছুরিত স্বল্প আলোকরেখার দ্বারা আলোকিত। সে অংশে ঝড়ের প্রকোপ ছিল কিছু কম। সে অংশে শয়তান একাকী হাঁটতে লাগল।
হিমালয় পর্বতের পৃষ্ঠে অথবা গঙ্গা বা ঝিলামের নদীতটে চারণরত মেষ বা ছাগশিশুদের মাংস ভক্ষণ করার মত কোন মাংসলোভী কুনি যেমন সেই সব জায়গায় ইতস্তত পদচারণা করে তেমনি নিঃসঙ্গ শয়তান কোন জীবিত বা মৃত জীবনের আশায় সেখানে পদচারণা করতে লাগল। অন্য জাতীয় কোন না কোন জীবের দেখা পাবার আশা করছিল সে।
কিন্তু কোন জীবকেই দেখতে পেল না শয়তান। সেই উষর অন্ধকার প্রস্তরভূমি জুড়ে বিচরণ করে বেড়াচ্ছিল শুধু বিদেশী কতকগুলি মানুষের ছায়ামূর্তি। মর্ত্যজীবন যাপনকালে যে সব মানুষ শুধু ইহলোকে বা পরলোকে সুখের আশায় ও অক্ষয় যশের লোভে সব কাজ করে, আত্মস্বার্থসর্বশ্ব সেই সব মানুষের আত্মা মৃত্যুর পর স্বর্গ ও মর্ত্যলোকের মধ্যবর্তী এই স্থানে এসে অনুশোচনার তীব্র জ্বালায় দগ্ধ হতে থাকে প্রকৃতির যে সব কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে যায় পৃথিবীতে অথবা ব্যর্থ হয় কোন কারণে, সেই ব্যর্থ অসমাপ্ত কাজের জন্য এই অঞ্চলে এসে ঘোরাফেরা করতে থাকে।
যে সব সাধুপুরুষদের আত্মা মৃত্যুর পরও স্বর্গগমন করতে পারেননি সেই সব সাধুদের দেবদূত ও মানুষের মাঝামাঝি এক একটি পোশাক পরে ছায়ামূর্তি ধারণ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে।
প্রাচীনকালের ভাগ্যহত মানবসন্তানদের ও কুখ্যাত দানবদের আত্মারাও এখানে ঘুরে বেড়ায়। কত শত ব্যর্থ যুদ্ধবিগ্রহের পর মৃত্যুবরণ করে দানবদের আত্মারাও ছায়ামূর্তি ধরে আসে এখানে। বেবিলনের শূন্য উদ্যানের গর্বিত নির্মাতারাও মৃত্যুর পর এখানে আসে। আর আসে আত্মহত্যার দ্বারা যারা মৃত্যুবরণ করে সেই সব পাপী আত্মারা। গ্রীক দার্শনিক দেবোপম এম্পিডোকলস্ বৃহত্তর জীবনের অভিলাষে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি এটনাতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন এবং ক্লিওমব্রোস প্লেটোর ফিড্রো পড়ে পরম স্বর্গীয় সুখ উপভোগ করার মানসে সমুদ্রে ঝাঁপ দেন। এইভাবে আত্মহত্যারূপ মহাপাপে নিমগ্ন হয়ে তাদের বিদেহী আত্মারা ছায়ামূর্তি ধরে স্বর্গলাভ হতে বঞ্চিত হয়ে এই ঊষর অন্ধকার দেশে ঘুরে বেড়াতে থাকে। এই দুটি আত্মার ছায়ামৃতি একা একা এল।
ভ্রূণ অবস্থায় যারা যারা গেছে তারে ও যত সব নির্বোধের আত্মারাও আসতে লাগল। তাদের পরনে ছিল সাদা, কালো ও ধূসর রঙের পোশাক। সে সব তীর্থযাত্রীরা গলগাথায় ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মৃতদেহটিকে খুঁজতে থাকে, অথচ যীশু স্বর্গে বাস করার জন্য যাদের দেখতে পায়নি সেই সব তীর্থযাত্রীরা এখানে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ে।
নিশ্চিত স্বর্গলাভের আশায় এ্যাঞ্জেলো পলিজিয়ানো মৃত্যুশয্যায় ডোমিনিকান সম্প্রদায়ের পোশাক পরেন এবং গিদো বৃদ্ধ বয়সে স্বৰ্গকামনায় ফ্রান্সিসকান সম্প্রদায়ভুক্ত হন। মৃত্যুর পর তাদের আত্মা পর পর সাতটি গ্রহ পার হয়ে স্বর্গদ্বারের নিকটস্থ হয়।
স্বর্গের দ্বারপাল পিটার রুদ্ধদ্বারের চাবি হাতে অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। কিন্তু এ্যাঞ্জেলো ও গিদোর আত্মার ছায়ামূর্তি স্বর্গে ওঠার শেষ সিঁড়িতে পৌঁছানোর জন্য পা তুলতেই এক প্রতিকূল ঝঞ্জাবায়ু প্রবলভাবে বইতে বইতে তাঁদের প্রায় বিশ মাইল দূরে ফেলে দেয়।
সেই প্রবল ঘূর্ণিবায়ু তাদের লিম্বো নামক এক নিম্নতর হীনতর নরকে ফেলে দেয়। সে নরকপ্রদেশকে মূর্খদের স্বর্গ বলা হয়।
এই অন্ধকার জগতের মধ্যে এই সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল শয়তান। অন্ধকারে এদিকে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে বেড়াল। চারিদিকে সূচীভেদ্য অন্ধকার আর অদৃশ্য ছায়ামূর্তির আনাগোনা।
অনেকক্ষণ এইভাবে কেটে যাবার পর স্বর্গ থেকে বিচ্ছুরিত এক আলোকরেখা শয়তানের প্রতিটি পদক্ষেপকে আলোকিত করে তুলল। সেই আলোর সাহায্যে ধীরে ধীরে সে স্বর্গপ্রাচীরের দিকে উঠে যেতে লাগল।
এইভাবে অনেকটা ওঠার পর শয়তানরাজ সেই প্রাচীরের উপর রাজপ্রাসাদের মত লোহার গেটওয়ালা এক প্রকাণ্ড বাড়ি দেখতে পেল। স্বর্ণ, হীরক ও নানা মণি-মুক্তাখচিত সেই প্রাসাদের মর্ত্যলোকের কোন তুলনাই হয় না। একমাত্র শুধু চিত্রে অঙ্কিত হতে পারে। সে প্রাসাদে ওঠার সিঁড়িগুলি সুন্দরভাবে সাজানো ছিল।
ইসেউ থেকে পাদান আরামে পালিয়ে যাবার সময় লজের প্রান্তরে মুক্ত আকাশের তলে রাত্রিতে নিদ্রাভিভূত অবস্থায় জ্যাকব স্বপ্নে যে সিঁড়ি দিয়ে দেবদূতদের ওঠানামা করতে দেখেছিল সেই প্রাসাদের সিঁড়িগুলি ছিল এমনি।
জ্যাকব সেদিন ঘুম থেকে জেগে উঠেই বলেছিল, এই হলো স্বর্গারোহণের সিঁড়ি।
কিন্তু সে সিঁড়ি বড় রহস্যময়, ঐন্দ্রজালিকভাবে নির্মিত। সেই সিঁড়িগুলি সব সময় প্রাসাদের সঙ্গে সংজড়িত থাকে না। মাঝে মাঝে স্বর্গের উপর সেগুলিকে তুলে নেওয়া হয়। তার অর্থ হলো এই যে, বাইরের কোন অবাঞ্ছিত বা স্বর্গসুখে অনধিকারী কোন ব্যক্তির আত্মা যেন সে সিঁড়ি দিয়ে স্বর্গে আরোহণ করতে না পারে।
সেই সিঁড়ির তলদেশে গলিত ধাতুর এক বিশাল সমুদ্র প্রবহমান। মৃত্যুর পর মর্ত্য থেকে যে পুণ্যাত্মা দেবদূতদের দ্বারা বাহিত নৌকাযোগে সেই সমুদ্র পার হয়ে আসে অথবা আগ্নেয় অস্ত্রের দ্বারা বাহিত মায়াময় রথে করে এসে স্বর্গদ্বারে এসে উপস্থিত হয়, একমাত্র তারাই এই সিঁড়ি বেয়ে স্বর্গারোহণের অধিকারী। তারা স্বর্গদ্বারে উপনীত হবার সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে তুলে নেওয়া সিঁড়িগুলি আবার সাজিয়ে রাখা হয়।
শয়তান যাতে সহজে স্বর্গে আরোহণ করতে না পারে, স্বর্গদ্বার হতে যাতে সে সহজে বহিষ্কৃত হয় তার জন্য মর্ত্যভূমি হতে সুদূর স্বর্গ পর্যন্ত এক বিশাল অন্ধকার গহুর সৃষ্ট হলো শয়তানরাজের সামনে।
সে তখন স্বর্গের নিম্নতম সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে এক অন্তহীন বিহ্বলতার সঙ্গে অকস্মাৎ সৃষ্ট সেই বিশাল অনতিক্রম্য গহ্বরের দিকে তাকিয়ে রইল। সে দেখল সেই গহ্বরের অন্ধকার শূন্যতার উপর দেবদূতেরা পাখা মেলে ইতস্তত উড়ে চলেছে।
কোন এক অন্ধকার বিশাল মরুভূমিতে বিচিত্র ও বিপজ্জনক রাত্রিযাপনের পর কোন নিঃসঙ্গ সৈনিক যেমন আলোকোজ্জ্বল প্রভাতকালে একটি পাহাড়ের উচ্চ চূড়া হতে অসংখ্য প্রাসাদ ও অট্টালিকামণ্ডিত কোন সুরম্য ও সুসজ্জিত বিদেশী নগরী দেখে এক বিস্ময়বিমিশ্রিত আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়ে, শয়তানও তেমনি সেই অন্ধকার শূন্য গহ্বরের পরপারে দৃষ্টি প্রসারিত করে আশাসঞ্চারিণী কোন সুরম্য নগরী দেখার চেষ্টা করতে লাগল।
সে যখন দেখল অন্ধকার শূন্য আকাশমণ্ডলের পরপারে নক্ষত্ররাজির মাঝে মাঝে আরো কত জগৎ রয়েছে। কিন্তু সে সব জগতে কারা বাস করে তা জানার কোন ইচ্ছা হলো না তার। ছোট ছোট দ্বীপের মত সেই সব জগৎগুলিতে রয়েছে বিস্তৃত প্রান্তর ও পুষ্পিত কত উপত্যকা। হেসপীরিয়ার উদ্যানের মত কত উদ্যানও আছে সেই সব জগতে।
অন্ধকার শূন্যমণ্ডলে ভাসমান সেই সব জগতের উর্ধ্বে বিরাজিত সূর্যকিরণের মত উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত স্বর্গলোক বিমুগ্ধ করল তার দৃষ্টিকে। এই স্বর্গলোক তার উর্ধ্বায়িত দৃষ্টিপথে পতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একই সঙ্গে বিস্ময় ও ঈর্ষায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠল তার উচ্চাভিলাষী মন।
সুদূর ঊর্ধ্বলোকে অবস্থিত সেই উজ্জ্বল আলোকমণ্ডলকে লক্ষ্য করে অন্ধকার শূন্যতার মাঝে ঝাঁপ দিল শয়তানরাজ। ঊর্ধ্ব আকাশপথে যতই উৎক্রমণ করতে লাগল ততই সে বুঝতে পারল ঐ আলোকমণ্ডলই হলো সৌরমণ্ডল। যে স্বর্গ সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে আলোকিত করে, যা দিনরাত্রি, মাস ও বৎসররূপ কালকে নির্ণীত করে, যে সূর্য সারা বিশ্বভুবনের সকল জীবের প্রাণের উৎস, সেই সূর্যমণ্ডলকে লক্ষ্য করে শূন্যে উঠে যেতে লাগল সে।
ক্রমে সে দেখল অনন্ত মহাশূন্যে অসংখ্য গ্রহনক্ষত্র এক একটি আলোকিত জগতের মধ্যে ভাসছে। তাদের মৃদুকম্পিত দেহগুলি দেখে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে তারা যেন ঝুলন্ত অবস্থায় নৃত্য করছে। কিন্তু সর্বত্র এমন এক সুন্দর শৃঙ্খলা বিরাজ করছে যাতে কারো সঙ্গে সংঘাত সংঘটিত হচ্ছে না।
শয়তানরাজ আরও দেখল, সূর্যের জ্বলন্ত কিরণগুলির মাঝে অনেক ভূখণ্ড রয়েছে।
সূর্যমণ্ডলমধ্যবর্তী সেই সব ভূখণ্ডের একটিতে অবতরণ করল শয়তান। সে ভূখণ্ডের সন্ধান আজও কোন জ্যোতির্বিজ্ঞানী পায়নি। সে দেখল সেই ভূখণ্ডে সোনা, রুপো ও হীরকের মত অনেক ধাতুর স্তূপ উজ্জ্বল কিরণমালায় চকচক করছে। তেমন উজ্জ্বল ধাতু মর্ত্যলোকে বা পাতালপ্রদেশের কোথাও দেখা যায় না।
শয়তান আরও দেখল সেই বিশাল ভূখণ্ডের নিম্নদেশ শুধু উজ্জ্বল ধাতুতে পরিপূর্ণ হলেও কোথাও কোন উঁচু বস্তু বা পাহাড়-পর্বত, ঘর-বাড়ি, নদীর জলপথ, কিছুই নেই। চারিদিক উজ্জ্বল, কোথাও কোন ছায়া বা অন্ধকার নেই। যেদিকেই সে দৃষ্টি প্রসারিত করল, কোন বাধা পড়ল না তার দৃষ্টিপথে, চারিদিকেই মনে হতে লাগল উজ্জ্বল ধাতুর নদী বয়ে যাচ্ছে। এখানকার সব ধাতুই নির্বাচিত এবং খাঁটি।
কোনরূপ বিচলিত বা কিছুমাত্র অভিভূত না হয়ে অসমসাহসী শয়তান চারিদিক দেখতে দেখতে বহুদূরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে তাকিয়ে রইল। এইভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর দূরে এক দেবদূতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। কি জন্য একদিন স্বগের মধ্যে এক দেবদূতকে দেখতে পেয়েছিল। সে পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু পিছন ফিরে থাকলেও তার জ্যোতি কিছুমাত্র কমেনি। তার মাথায় ছিল সোনার টায়রা। তার মাথার চুলগুলো ঘাড়ের উপর ছড়িয়ে পড়েছিল। তার দু’পাশের পাখাদুটি ঝুলছিল।
মনে হচ্ছিল কোন এক বড়রকমের কার্যভারে বিব্রত ছিল সেই দেবদূতটি। অথবা সে ছিল গভীর কোন চিন্তায় মগ্ন।
সেই দেবদূতকে দেখে নতুন আশায় উদ্দীপিত হয়ে উঠল শয়তানরাজের অন্তর। সে ভাবল, কোন পথে উড্ডীন হয়ে সে মানবজাতির পরম সুখের আকাঙ্ক্ষিত স্থান তার গন্তব্যস্থল স্বর্গে উপনীত হতে পারবে তা ঐ দেবদূতই বলে দিতে পারবে।
কিন্তু ঐ দেবদূতকে কিছু বলার আগে সে তার রূপ পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। কারণ এই শয়তানের বেশে তার কাছে গেলে তার বিপদ হতে পারে অথবা তার গন্তব্যস্থলে যেতে বিলম্ব হতে পারে।
এই ভেবে শয়তান এক দেবদূতের রূপ পরিগ্রহ করল। সে দেবদূত বয়সে যুবক না হলেও এক অনন্ত যৌবনের উজ্জ্বল দীপ্তি শোভা পাচ্ছিল তার মুখে। তার এই ছদ্মবেশ এমনই সার্থক হয়ে উঠেছিল যে তার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে এক স্বর্গীয় সুষমা ঝরে পড়েছিল। তার কুঞ্চিত কেশপাশ দু গালের উপর ছড়িয়ে পড়েছিল। বিচিত্র যাদুকাঠি।
দেবদূতের এই ছদ্মবেশ ধারণ করে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে লাগল শয়তানরাজ। কিন্তু সে দেবদূতের কাছে যাবার আগেই তার উপস্থিতির কথা জানতে পারল সেই দেবদূত। তার উজ্জ্বল মূর্তিটি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে।
তখন সেই দেবদূতের মুখ দেখেই তাকে চিনতে পারল শয়তান। সে ছিল আর্কেঞ্জাল ইউরিয়েল। স্বর্গলোকে ঈশ্বরের সিংহাসনের কাছে যে সাতজন দেবদূত তাঁর আদেশ পালনের জন্য সর্বদা প্রস্তুত হয়ে থাকে ইউরিয়েল ছিল তাদেরই একজন। তারা সব সময় জলে স্থলে অন্তরীক্ষে ত্রিভুবনের সর্বত্র ঈশ্বরের বার্তা বহন করে বেড়ায়।
ইউরিয়েলকে সম্বোধন করে শয়তান বলল, হে ইউরিয়েল, যে সাতজন দেবদূত এক গৌরবময় উজ্জ্বলতায় মণ্ডিত হয়ে ঈশ্বরের সিংহাসনের সম্মুখে বিরাজিত থাকে তুমি তাদের মধ্যে প্রথম। তোমারই দৌত্যের দ্বারা ঈশ্বরের পুত্ররা তাদের পরমপিতার সকল অভিলাষ অবগত হন। স্বর্গলোকে ঊর্ধ্বতন প্রদেশ হতে ঈশ্বরের সকল বার্তা, সকল আদেশ তোমারই মাধ্যমে প্রচারিত হয়। তুমি আজ এখানেও হয়ত ঈশ্বরেরই কোন পরম বিধান বহন করে এনেছ।
ঈশ্বরের যে সব বিস্ময়কর সৃষ্টি চারিদিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে সেই সব সৃষ্টি এবং বিশেষ করে তার সবচেয়ে অনুগৃহীত ও তার আনন্দের বস্তু মানবজাতি সম্পর্কে কিছু জানার কৌতূহলের তাড়নায় আমি একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছি। হে উজ্জ্বলতম দেবদূত, চারিদিকে যে সব উজ্জ্বল গ্রহ মহাশূন্যে ঘূর্ণমান তাদের কোটিতে মানবজাতি বাস করে অথবা তাদের কি কোন নির্দিষ্ট বাসভূমি নেই? সব গ্রহতেই বাস করে সাময়িকভাবে। বল, কোথায় কিভাবে তাদের দেখা পাব? তাদের কি গোপনে দূর থেকে দেখতে হবে, না কাছে গিয়ে প্রকাশ্যে দেখব? এক অবর্ণনীয় কামনায় অভিভূত হয়ে পড়েছি আমি তাদের দেখার জন্য।
যে ঈশ্বর মানবজাতিকে কত বড় জগৎ দান করেছেন অনুগ্রহবশত, যাদের উপর কত মহিমা ঢেলে দিয়েছেন, সেই মানবজাতিকে দর্শন করে পরমস্রষ্টার জয়গান করতে চাই। এই পরমস্রষ্টা ঈশ্বর ন্যায়সঙ্গতভাবেই তার বিদ্রোহী শত্রুদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে নরকের গভীরতম প্রদেশে নিক্ষেপ করেছেন এবং তাদের স্থান পূরণ করার জন্য এক নতুন সুখী জাতি সৃষ্টি করেছেন। এই জাতিই হলো মানবজাতি। যাতে তারা ঈশ্বরের আরও ভালভাবে সেবা করতে পারে তার জন্যই এই মানবজাতিকে সৃষ্টি করেন ঈশ্বর। তিনি পরমপিতা।
এইভাবে দেবদূতের ছদ্মবেশে শয়তান তার কু-অভিসন্ধি সিদ্ধির জন্য এক বিরাট মিথ্যার অবতারণা করল। কিন্তু তার সেই ছলনা ও মিথ্যা ধরতে পারল না ইউরিয়েল।
বস্তুত একমাত্র সর্বদশী ঈশ্বর ছাড়া স্বর্গ বা মর্ত্যের কেউ কারো কোন ভণ্ডামি বা ছলনা ধরতে পারে না। যখন কেউ ছলনার আশ্রয় নিয়ে মিথ্যার অবতারণা করে তখন সকলে স্বাভাবিক ক্ষমতার বশে সেই মিথ্যাকে সত্য বলে মেনে নেয়। তখন আমাদের জ্ঞানের দ্বার থাকে রুদ্ধ, সকল সংশয় সেই জ্ঞানের রুদ্ধ দ্বারপথে ঘুমিয়ে থাকে, সরলতা কোন কাজ করে না। সূর্যের প্রতিনিধি এবং স্বর্গের সবচেয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন দেবদূত হয়েও ইউরিয়েল ভণ্ড প্রতারক শয়তানের এই ছলনা বুঝতে পারল না।
ইউরিয়েল শয়তানরাজকে বলল, হে সুন্দর সদাশয়, ঈশ্বরের সৃষ্টিকার্য নিজের চোখে দেখা ও তা দেখে সেই পরমস্রষ্টার গৌরবগান করার বাসনায় তুমি যে তোমার সুরম্য স্বর্গীয় প্রাসাদ ছেড়ে একাকী এই ভূখণ্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছ এটা এমন কিছু দোষাবহ ব্যাপার নয়। বরং অতীব প্রশংসার যোগ্য। কারণ অন্য যে কোন দেবদূত স্বর্গ থেকে এই সৃষ্টিকার্যের বিবরণ শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে পারত।
ঈশ্বরের সৃষ্টিকার্য সত্যিই বিস্ময়কর এবং তা জানা সত্যিই আনন্দদায়ক যে অভিজ্ঞতার কথা আনন্দের সঙ্গে স্মৃতির স্বর্ণকোঠায় সংরক্ষিত রাখার যোগ্য। কিন্তু ঈশ্বর ছাড়া আর কার মন সে সৃষ্টির সংখ্যা গণনায় সক্ষম এবং কার এমন অনন্ত জ্ঞান আছে যার দ্বারা সে সৃষ্টির গভীর কারণ হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হবে?
আমি জানি, আমি নিজে দেখেছি সৃষ্টির আগে সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে এক অন্ধকার মহাশূন্যতা বিরাজ করত, চারিদিকে ছিল বিরাট বিশৃঙ্খলা। সে সময় মাটি, জল, বাতাস, অগ্নি, আকাশ প্রভৃতি বিশ্বসৃষ্টির এই উপাদান বা ভূতগুলি নিরাকারভাবে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়িয়ে ছিল। এমন সময় ঈশ্বরের একটিমাত্র কথায় সেই নিরাকার উপাদানগুলি এক একটি আকার লাভ করে অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্রের রূপ পরিগ্রহ করে। ঈশ্বরের দ্বিতীয় আদেশে সমস্ত অন্ধকার বিচ্ছুরিত হয়ে যায় এবং উজ্জ্বল আলোকমালায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দশদিক। শৃঙ্খলা নেমে আসে সমস্ত বিশৃঙ্খলার মাঝে। তুমি এখন দেখছ, সেই সব গ্রহ-নক্ষত্রগুলি আপন আপন স্থানে আপন আপন কক্ষপথে কি সুন্দরভাবে ঘুরছে। নিম্নে যে জগৎ দেখছ, সে জগৎ স্বর্গলোক হতে প্রতিফলিত আলোকেই আলোকিত। ঐ পৃথিবীই হলো মানবজাতির বাসভূমি।
দুটি গোলার্ধে বিভক্ত এই জগতে সূর্যের আলো যখন একটি গোর্ধকে আলোকিত করে তখন অন্য গোলার্ধে রাত্রির অন্ধকার বিরাজ করে। তবে সূর্যের আলোয় আলোকিত চন্দ্রের আলো পৃথিবীর নৈশ অন্ধকারকে প্রতিমাসে একপক্ষকাল কিছুটা আলোকিত করে।
এরপর ঊর্ধ্বে হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে ইউরিয়েল বলল, ঐ হলো স্বর্গলোক, আমাদের বাসভূমি। যে পথ দেখিয়ে দিলাম সে পথে যেতে ভুল করো না। আমি এবার চললাম।
শ্রদ্ধা জানাল। ইউরিয়েল চলে গেলে শয়তান শূন্যে ঝাঁপ দিয়ে পৃথিবীর উপকূল অভিমুখে পাড়ি দিল তারপর আর্মেনিয়ার নাইকেত পর্বতে অবতরণ করল।
০৩য় সর্গ
তৃতীয় সর্গ
এ্যাপোকনিগম একদিন স্বর্গলোকে উচ্চকণ্ঠে সতর্ককরে মর্তমানবদের, শয়তানরূপী ড্রাগন তাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করতে আসবে। কিন্তু হায়, ব্যর্থ হলো সে কণ্ঠস্বর।
ধিক মর্ত্যলোকের অধিবাসীদের। একবার মানবজাতির আদি পিতা-মাতাকে সতর্ক করে দেওয়া হয় এক গোপন শত্রুর আগমন সম্পর্কে। তখন সেই শত্রুর মারাত্মক ফাঁদ এড়িয়ে পালিয়ে যান তারা।
এখন সেই শয়তান ঈশ্বরের অনুগৃহীত মানবজাতির উপর ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত চিত্ত হয়ে মানবকুলের আদি পিতা-মাতাকে প্রলোভিত ও স্বর্গচ্যুত করার জন্য এল নরক, থেকে স্বর্গলোকে। এইভাবে ঈশ্বর ও দেবতাদের সঙ্গে প্রথম যুদ্ধে যে হীন পরাজয় স্বীকার করে স্বর্গচ্যুত হয়ে দুর নরকপ্রদেশে গিয়ে তাদের আশ্রয় নিতে হয়, দুর্বলচিত্ত মানুষের উপর সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চায় শয়তানরাজ।
কিন্তু কৌশলে সে স্বর্গারোহণের ও মানবকুলের আদি পিতা-মাতার সন্ধানলাভে সমর্থ হলেও তার এই কঠিন প্রচেষ্টায় কোন আনন্দের উল্লাস ছিল না, ছিল না কোন গর্বোদ্ধত ভাব। তার বিক্ষুব্ধ বুকের মধ্যে যেন এক জ্বলন্ত এঞ্জিন তার অগ্রপ্রসারী চিত্তকে পিছন থেকে টানছিল। সে স্বভাবত নির্ভীক হলেও এক অজানা শঙ্কা আর সংশয় তার বিপন্ন বিব্রত চিন্তাকে নিপীড়িত করছিল। নরক থেকে স্বর্গে আরোহণ করলেও কোন উত্তরণ ঘটেনি তার চিত্তে। তার অন্তরের অন্তঃস্থলে সে যেন নরকপ্রদেশের কুটিল অন্ধকাররাশিকেই বহন করে এনেছিল। তাই স্বর্গের শান্ত সুন্দর পরিবেশেও এক অশান্ত কু-অভিসন্ধিরূপ নরকাগ্নি জ্বলছিল তার অন্তরে।
সহসা বিবেক তার লুপ্ত সংশয় ও হতাশাকে জাগ্রত করে তুলল। সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতির পীড়ন শুধু হলো তার মনে। সে অতীতে কি ছিল, এখন কি হয়েছে এবং তার এই চেষ্টিত কার্যের যে কুফল হতে পারে, এই সব বিষয় চিন্তিত করে তুলল তাকে। কখনো আনন্দোজ্জ্বল মনোরম স্বর্গোদ্যানের পানে, কখনো ঊর্ধ্বে বিরাজিত স্বর্গলোকের পানে, কখনো মধ্য আকাশে দেদীপ্যমান ও পর্যাপ্ত কিরণমালায় অতিভাস্বর সূর্যের পানে সে তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।
তারপর সে এক গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আপন মনে বলতে লাগল, যে সূর্য, যে তুমি সর্বোচ্চ গৌরবের মুকুটে ভূষিত হয়ে এই নূতন জগতের দেবতারূপে স্বরাজ্যে অধিষ্ঠিত হয়ে আছ এবং যে তোমার চক্ষু হতে বিচ্ছুরিত প্রোজ্জ্বল দৃষ্টিদ্যুতির সামনে নক্ষত্রেরাও লজ্জায় মাথা নত করে, সেই তোমাকে বন্ধুভাবে সম্বোধন করতে পারলাম না।
হে সূর্য, তোমার সে আলোকমালা আমার অতীতকে স্মৃতিপথে জাগ্রত করে তুলছে। সেই আলোকমালাকে আমি কত ঘৃণা করি। অতীতে একদিন আমি কি গৌরবময় আসনেই না অধিষ্ঠিত ছিলাম এবং অহঙ্কার ও ভ্রান্ত উচ্চাভিলাষের বশবর্তী হয়ে আমি স্বর্গরাজ্যের অতুলনীয় অধীশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়ে সেই গৌরবের আসন হতে বিচ্যুত হয়ে সুদুর নরকপ্রদেশে কিভাবে নিক্ষিপ্ত হই–আজ এই সব কথা মনে পড়ছে আমার। সেই স্মৃতির জ্বালাময়ী পীড়নে অনুক্ষণ আপীড়িত হচ্ছি আমি।
আমার পক্ষ থেকে এই ধরনের প্রতিদানে কোনরূপে যোগ্য ছিলেন না তিনি। তিনিই আমাকে সৃষ্টি করে খ্যাতির সুউচ্চ সু-উজ্জ্বল শিখরদেশে প্রতিষ্ঠিত করেন আমাকে। তিনি আসলে কোন ভর্ৎসনা বা কোনরূপ দুর্ব্যবহার করেননি আমার সঙ্গে। তার শাসন এমন কিছু কঠোর বা দুঃসহ ছিল না কারো পক্ষে, বরং তা প্রশংসা ও ধন্যবাদেরই যোগ্য ছিল সর্বাংশে।
কিন্তু হায়, তার সকল মঙ্গলময় কার্য মন্দ মনে হয় আমার এবং আমার মধ্যে জাগায় শুধু হিংসা আর বিদ্বেষ। বস্তুত তিনি আমাকে এত উচ্চে স্থান দেন যে . আমি তার প্রতি কোন বশ্যতা বা আনুগত্যকে ঘৃণার চোখে দেখতে থাকি। ভাবি আর এক ধাপ উপরে উঠলেই আমি সম্মান ও গৌরবের উচ্চতম স্তরে উন্নীত হব। এইভাবে তার প্রতি আমার অন্তহীন কৃতজ্ঞতার প্রভূত ঋণের কথা ভুলে যাই আমি। সে কৃতজ্ঞতার ঋণ দুঃসহ বোঝাভার বলে মনে হয়। কিন্তু ভুলে যাই কৃতজ্ঞতার ঋণ এমনই এক ঋণ যে সে ঋণের স্বীকৃতি উপকারীর সব উপকারের ঋণ পরিশোধ করে দেয়। কিন্তু আমি তখন সে ঋণ স্বীকার না করে সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়েছিলাম, তার কাছে আমি কত কি পেয়েছি। তার কাছে কত দিক দিয়ে উপকৃত আমি।
হায়! তখন তার অমোঘ বিধানে যদি আমি কোন হীনতর দেবদূত হয়ে জন্মাতাম, তাহলে আমি হয়ত সুখে স্বর্গসুখ ভোগ করতাম আজও। তাহলে অসংযত উদ্দাম আমার ছলনা এমন ভ্রান্ত উচ্চাভিলাষের সৃষ্টি করত না।
আবার এমনও হতে পারে, ঈশ্বর ছাড়া কোন বৃহৎ শক্তি আমি ক্ষুদ্র হলেও আমাকে আকর্ষণ করে উচ্চাকাঙ্ক্ষার ছলনাজাল বিস্তার করে টেনে নিয়ে যায় আমাকে অনিবার্য বেগে। কিন্তু আমার মধ্যেও যদি স্বাধীন ইচ্ছা ও অনুরূপ শক্তি থাকত আমার অন্তরে ও বাইরে তাহলে আমি তার সকল প্রলোভনকে প্রতিহত করতে পারতাম, ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারতাম তার সকল ছলনাজালকে।
তাহলে কাকে আমি দোষ দেব? কাকে অভিযুক্ত করব আমার এই অবস্থার জন্য? ঈশ্বরের সংস্কারযুক্ত ভালবাসা সকলের উপরেই সমানভাবে পতিত হয়েছিল। কিন্তু আমার কাছে অভিশপ্ত ও ঘৃণার বস্তু হয়ে উঠেছিল সে ভালবাসা।
কিন্তু আমি ঠিক অভিশপ্ত নই। কারণ তখন আমার মধ্যে ছিল স্বাধীন ইচ্ছা। সেই স্বাধীন ইচ্ছার বলেই আমি স্বাধীনভাবে এমন পথ বেছে নিই যার জন্য আজ আক্ষেপ ও অনুশোচনা করতে হচ্ছে আমায়। আমি এখন কোন পথে যাব? অন্তহীন ক্রোধ ও প্রতিহিংসার পথে, না অন্তহীন হতাশার পথে? সত্যিই আমি বড়ই হতভাগ্য। আমি এখন যে পথে চলেছি তা অন্তহীন নরকের পথ। আমিই এক জীবন্ত নরক।
বর্তমানে নরকের যে গভীরতম প্রদেশে যন্ত্রণাদায়ক জীবন যাপন করি তার থেকেও গভীর এক গহুর তার ভয়ঙ্কর মুখব্যাদান করে গ্রাস করতে আসে আমায়। তার তুলনায় বর্তমানে নরক স্বর্গ বলতে হবে।
হে আমার অন্তরাত্মা, অবশেষে এতদিনে তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ। কিন্তু এখন অনুতাপের মাধ্যমে কি কোন উপায় নেই আমার পাপস্খলনের? কোন ক্ষমা বা মার্জনা নেই আমার জন্য? উন্মুক্ত আছে শুধু আত্মসমর্পণের পথ? আত্মসমর্পণ ছাড়া কি অন্য কোন পথ নেই?
অথচ এই আত্মসমর্পণেই আমার যত কিছু আপত্তি। এই শব্দটাই আমার কাছে এক চরমতম ঘৃণার বস্তু। এই আত্মসমর্পণের কথাটা নরকে আমার অধীনস্থ প্রজাদের কাছে আমাকে এক অনপনেয় লজ্জা আর অপমানের পাত্র করে তুলবে।
আমি শুধু তাদের যত সব আপাত উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি দিয়ে বশীভূত করে রেখেছি, কিন্তু তাদের আত্মসমর্পণ করতে শেখাইনি। আমি যেন মিথ্যা আত্ম-অহঙ্কারের দ্বারা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকেও আমার বশীভূত করতে পারব এমনি একটা ভাব দেখিয়েছি তাদের।
হায়, তারা জানে না কত ব্যর্থ আমার সেই অহংকার। জানে না, সে অহঙ্কারের জন্য কতখানি মূল্য আমায় দিতে হয়েছে। কি ভীষণ আত্মদহনে দগ্ধ হচ্ছে আমার অন্তর। যতই তারা আমাকে নরকের রত্নখচিত সিংহাসনে বসিয়ে হাতে শাসনদণ্ড তুলে দিয়ে সম্মানের সুউচ্চ স্তরে তুলে দেয় ততই আমি নীচে তলিয়ে যাই। আমি শুধু দুঃখেই মহান, অতৃপ্ত অপূর্ণ উচ্চাভিলাষেই আমার যা কিছু আনন্দ।
যদি আমি আমার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করি তাহলে কি পূর্বের সেই গৌরবময় অবস্থা ফিরে পাব? তার সেই উন্নত অবস্থায় পুনরধিষ্ঠিত হওয়ার পর আমি যদি আমার আত্মসমর্পণ প্রত্যাহার করে নিই? অবস্থার দ্বারা প্রপীড়িত হয়ে বাধ্য হয়ে কপট আত্মসমর্পণকালে যে শপথ করব পরে তা যদি তুলে নিই? ঘৃণার ক্ষত যেখানে অন্তরের গভীরে অনুপ্রবিষ্ট হয় সেখানে কোন প্রকৃত পুনর্মিলন সম্ভব হতে পারে না।
এই পুনর্মিলন সম্ভব নয় বলেই আমার পরিণাম আরও খারাপ হতে বাধ্য। আমার পতন হয়ে উঠবে আরও শোচনীয়। শুধু তার আগে আমি একটু বেশি মূল্য দিয়ে একটুখানি বিরাম নিতে চাই, যদিও এই বিরাম বা শান্তি নিতান্ত সাময়িক।
আমার শাস্তিদাতা সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তা জানেন। আমি পূর্ণ শান্তি বা পুনর্মিলন প্রার্থনা করিনি তার কাছে আর তিনিও তা দান করতে চাননি আমাকে।
এখন আর কোন আশা নেই। কারণ তিনি আমাদের বিতাড়িত করে আমাদের পরিবর্তে তাঁর নূতন আনন্দের মানবজাতিকে সৃষ্টি করে একটি জগৎ তাদের দান করেছেন।
সুতরাং হে আশা বিদায়, আশার সঙ্গে সঙ্গে সব শঙ্কা ও অনুশোচনাকেও বিদায়। আমার জীবনে মঙ্গলের আর কোন সম্ভাবনা নেই। হে অশুভ, তুমি আমার পক্ষে শুভ হও। তোমার সেই অশুভ শক্তির বলেই আমি স্বর্গের সুবিশাল সাম্রাজ্যের অর্ধাংশ জয় করে তাতে রাজত্ব করতে পারি।
শয়তানরাজ যখন আপন মনে কথাগুলি বলে যাচ্ছিল তখন প্রতি মুহূর্তে ক্রোধ, প্রতিহিংসা, হতাশা প্রভৃতি আবেগানুভূতির প্রভাবে বিবর্ণ ও ম্লান হয়ে উঠছিল।
তার মুখমণ্ডল স্নান করে দিচ্ছিল তার দেবদূতের ছদ্মরূপ। এই অবস্থায় তাকে যদি কোন স্বর্গীয় দেবদূত নিরীক্ষণ করত তাহলে তার মুখ দেখে তার শয়তানসুলভ কু-অভিসন্ধির কথা বুঝতে পারত।
এটা সে নিজেও বুঝতে পারল। তাই সে তার বহিরঙ্গের এক কৃত্রিম শান্তির আবরণে তার অন্তরের তুমুল আলোড়ন আর গভীর প্রতিহিংসাকে ঢেকে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যেতে লাগল। কারণ প্রতিশোধ বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্য সে ছিল দৃঢ়সংকল্প। শয়তান হয়ে সাধুর ছদ্মবেশে ছলনার এই মিথ্যাচারণ তার জীবনে এই প্রথম।
কিন্তু শত চেষ্টা করেও ইউরিয়েলের চোখকে সে ফাঁকি দিতে পারল না। যে পথে সে এসেছিল ইউরিয়েলের সন্ধানী দৃষ্টি সে পথে তাকে সর্বক্ষণ অনুসরণ করে। তারপর এমিরিয়ার পর্বতে ইউরিয়েল তার বিকৃত মূর্তিটি দেখতে পেয়ে যায়। সে মূর্তিটি এক সুখী দেবদূতের মূর্তি নয়। তার উন্মাদের মত ভয়ঙ্কর হাবভাব লক্ষ্য করেছিল ইউরিয়েল।
কিন্তু শয়তান ভাবছিল, সে সম্পূর্ণ একা একা সকলের অলক্ষ্যে চলেছে তার গন্তব্যস্থল অভিমুখে। অবশেষে সে স্বর্গোদ্যান ইডেনের প্রান্তে এসে উপনীত হলো। এখান থেকে স্বর্গলোক অতি নিকটে। খাড়াই পাহাড়ের মত মাথা উঁচু করে উঠে যাওয়া স্বর্গলোক ছিল ঘন সবুজ বনে সমাচ্ছন্ন। তাতে প্রবেশ করার কোন পথ নেই। পাইন, দেবদারু, ফার প্রভৃতি বড় বড় গাছের ছায়ায় আচ্ছন্ন সেই বিশাল বনপ্রদেশের উপর থেকে স্বর্গের সুউচ্চ প্রাচীর উঠে গেছে। সে প্রাচীরের রং এনামেলের মত ধূসর। তার উপর সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে পড়ায় অপূর্ব হয়ে উঠেছিল সে বনপ্রকৃতির দৃশ্য।
শয়তানরাজ যতই এগিয়ে চলেছিল সেদিকে ততই নির্মল বাতাস যেন তাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য ছুটে আসছিল তার দিকে। তার মন থেকে একমাত্র হতাশা ছাড়া সব বিপদ দূর করে বসন্তের আনন্দ জাগাচ্ছিল সে মনে। সন্ধ্যার মেঘমালায় মণ্ডিত আকাশে রামধনু দেখা গেলে পৃথিবীতে যে শোভা হয় সে শোভার থেকে সুন্দরতর হয়ে উঠেছিল সেই সবুজ বনপ্রকৃতির দৃশ্য। ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসা বাতাসের পাখনায় ছিল অসংখ্য বনফুলের গন্ধ। সে গন্ধে মাতোয়ারা বাতাসেরা যেন ফিসফিস করে কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে।
উত্তমাশা অন্তরীপ ও মোজাম্বিকের ওপারে দক্ষিণ-পশ্চিম আরবের উপকূল থেকে ছুটে আসা গন্ধবহ উত্তর-পূর্ব সমুদ্রবায়ু যেমন সমুদ্রনাবিকদের অভ্যর্থনা জানায়, তেমনি শয়তানরাজকেও যেন অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল স্বর্গোদ্যান থেকে প্রবাহিত সুবাসিত বাতাস। এ্যাসমোদিয়াস নামে এক অশুভ প্রেতাত্মা তোবিতের পুত্রের স্ত্রীর প্রতি মোহাসক্ত হয়ে পড়লে মাছপোড়ার যে গন্ধ দিয়ে তাকে মিডিয়া থেকে মিশরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, স্বর্গোদ্যানের বাতাস সে গন্ধের মত উৎকট নয়, অনেক মনোরম ও আনন্দদায়ক।
শয়তানরাজ এবার সেই অরণ্যসমাচ্ছন্ন খাড়াই পাহাড়ে উঠে যেতে লাগল। মন তার বিষাদগ্রস্ত থাকায় গতি ছিল তার মন্থর। কিছুদূর উপরে ওঠার পর কঠিন অরণ্যে পথ হয়ে উঠল অদৃশ্য ও দুর্গম। কোন মানুষ বা পশুর পক্ষে সেখানে প্রবেশ করা সম্ভব নয়।
একদিকে একটামাত্র প্রবেশদ্বার আছে। পূর্বদিকে সেই প্রবেশদ্বারটি দেখতে পেয়ে তা দিয়ে প্রবেশ করতে ঘৃণাবোধ করল শয়তানরাজ। সে তখন আপন শয়তানসুলভ শক্তিবলে সেই অরণ্যসমাচ্ছন্ন পাহাড় ও স্বর্গপ্রাচীর এক উল্লম্ফনে অতিক্রম করে ওপারে স্বর্গলোকের মধ্যে গিয়ে পড়ল। কোন ক্ষুধিত নেকড়ে যেমন সন্ধ্যায় বেড়াবেষ্টিত ভূমির মধ্যে সমবেত মেষপালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে লাফ দিয়ে বেড়া ডিঙিয়ে যায়, অথবা যেমন কোন দুঃসাহসী চোর কোন ধনীর বাড়িতে টাকা চুরির জন্য জানালা দিয়ে উঠে রুদ্ধদ্বার ঘরের ভিতর জোর করে ঢোকে তেমনি শয়তানরূপী এই বিরাট চোর বাতাস শূন্যপথে উড়ে গিয়ে প্রাচীরবেষ্টিত দেবলোকে প্রবেশ করল। সে লোভী তস্করের মত স্বর্গমধ্যস্থিত জীবনবৃক্ষের শাখায় উঠে বসে রইল।
কিন্তু সেই বৃক্ষের উপর বসেও সে তার জীবনপ্রদায়িনী শক্তির কথা কিছুমাত্র চিন্তা করল না, শুধু জীবিতদের কিভাবে মৃত্যু ঘটানো যায় সেই কথাই চিন্তা করতে লাগল। অমৃতের উৎস কোথায় আছে এই স্বর্গলোকে এবং সে উৎস কিভাবে নিবারিত ও নিষ্ক্রিয় করা যায় শয়তান শুধু সেই কথাই ভাবতে লাগল।
সে উৎসের সন্ধান শুধু পরমেশ্বর একাই জানেন, সে উৎসের সকল রহস্য শুধু আছে তারই অধিকারে। শয়তান শুধু যা কিছু শুভ ও ভাল তাকে অশুভ ও মন্দে পরিণত করতে পারে।
শয়তানরাজ দেখল তার নীচে স্বর্গোদ্যান আর সবুজ ঐশ্বর্যে পূর্বদিক প্রসারিত। পুর্বে ইভেন নগরীকে বলা হত তেনাসার। এ শহরে আছে গ্রীসের রাজাদের দ্বারা নির্মিত বিরাট এক রাজপ্রাসাদ। পরে ঈশ্বর এইখানে এক উর্বর বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড বেছে নিয়ে তার উপর গড়ে তোলেন এক মনোরম উদ্যান। সে উদ্যানে রোপণ করেন বিভিন্ন জাতীয় বড় বড় গাছ। সেই সব গাছের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু হচ্ছে জীবনবৃক্ষ। সে বৃক্ষে সোনার অমৃত ফল ফলত।
এই জীবনবৃক্ষের পাশেই ছিল. জ্ঞানবৃক্ষ। মানুষের এই জ্ঞানবৃক্ষই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় একদিন। এই উদ্যানের দক্ষিণ দিকে একটি বড় নদী বয়ে গেছে। সে নদীর সামনে কতকগুলি পাহাড় তার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে থাকলেও নদী তার গতি পরিবর্তন করেনি। সে সেই পাহাড়গুলির তলদেশ ভেদ করে প্রবাহিত হয়েছে।
অনুন্নত যে পাহাড়টিকে ভিত্তি করে স্বর্গের উদ্যানটি রচিত হয়েছে সেই পাহাড়ের উপর আছে একটি স্বচ্ছসলিলা ঝর্ণা যার জলধারা উদ্যানটিকে বিধৌত করে খাড়াই পাহাড়ের গা বেয়ে নীচে পড়েছে। তারপর চারটি শ্রোতোধারায় বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন দিকে বিধৌত করে বিভিন্ন দিকে চলে গেছে।
স্বর্গোদ্যানের বিশাল সীমানার মধ্যে তৃণাচ্ছন্ন উপত্যকার উপর মেষপাল চড়ছিল। মুক্তোর মত স্বচ্ছ জলের ঝর্ণার ধারে ছিল কত ফুল ও ফলের গাছ। সেই উদ্যানের মনোরম দৃশ্যাবলী দেখতে লাগল শয়তানরাজ। তার নিজের মনে কোন আনন্দ না থাকলেও আনন্দময় পরিবেশ দেখতে দেখতে অভিভূত হয়ে গেল সে।
এমন সময় সেই উদ্যানের এক জায়গায় দুটি দেবোপম নগ্ন দানবমূর্তি দেখতে পেল শয়তানরাজ। ঈশ্বরের অনুগৃহীত সৃষ্টি হিসাবে তাদের দেহাবয়বদুটি স্রষ্টার গৌরবকে যেন ঘোষণা করছিল নীরব ভাষায়। তাদের আয়ত চোখের প্রশস্ত উজ্জ্বল দৃষ্টির মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছিল ঐশ্বরিক দ্যুতি। সত্য, প্রজ্ঞা, কঠোর শুচিতা ও পবিত্রতার মূর্ত প্রতীক ছিল যেন তারা। কিন্তু শুচিতার কঠোরতা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে ছিল সন্তানসুলভ স্বাধীনতা। তারা যেন ছিল নিজেরাই নিজেদের প্রভু।
জাতি হিসাবে মৃর্তিদুটি মানব হলেও আকৃতি ও প্রকৃতির দিক থেকে তারা সমান ছিল না। প্রকৃতির দিক থেকে একটি মূর্তির মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিল সাহসিকতা এবং তেজস্বিতা। আর একজনের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিল মেদুরতা, নম্রতা, কমনীয়তা এবং মোহপ্রসারী সৌন্দর্যের সুষমা।
একটি মূর্তি ছিল আকারে কিছু বড় এবং তার সম্মুখভাগ ও প্রশান্ত উজ্জ্বল চক্ষুদুটিতে ছিল পূর্ণ প্রভুত্বের ছাপ। তার ঘনকৃষ্ণ কেশপাশ তার স্কন্ধদেশ পর্যন্ত ছিল লম্বিত। কিন্তু আর একজনের কুঞ্চিত কেশপাশ ছিল তার ক্ষীণ কটিদেশ পর্যন্ত লম্বিত ও আলুলায়িত। তার মধ্যে ছিল এক সলজ্জ অধীনতা, বিনম্র অহংবোধ। তাকে মনে হচ্ছিল সে যেন কারো অধীন, কিন্তু সে কোন কঠোর শাসন বা রূঢ় প্রভুত্বের বস্তু নয়। তাকে মৃদু অনুশাসনের দ্বারা পরিচালিত করতে হবে।
তার মধ্যে কতকগুলি রহস্যময় দিক ছিল যেগুলি অসংবৃত অবস্থাতেই দেখা যাচ্ছিল। সে ছিল প্রকৃতির সৃষ্টি, যেন প্রকৃতির জীবন্ত কারুকর্ম। তার মধ্যে ছিল যেন এক পাপজনিত লজ্জাবোধ আর অসম্মানজনক সম্মানবোধ।
এই মূর্তিটিই হলো নারীমূর্তি, মানবজাতির আদিমাতা।
হে নারী, তোমার আপাত পবিত্র কপট ভাবের দ্বারা কিভাবে তুমি বিব্রত করে তোল পুরুষদের, কিভাবে তুমি মানুষের জীবন থেকে সব দুঃখ, নীরবতা ও নিষ্কলঙ্ক নির্দোষিতাকে নির্বাসিত করে দিয়েছ চিরতরে?
সেই আদি মানব ও মানবীর মূর্তিদুটি নগ্ন অবস্থায় হাত ধরাধরি করে ধীরে ধীরে গাছে ঘেরা একটি ঝর্ণার ধারে ঈশ্বর ও দেবদূতদের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। তাদের মনে কোন কুচিন্তা বা পাপবোধ ছিল না। সেই থেকে পৃথিবীতে যত আলিঙ্গনাবদ্ধ প্রেমিকযুগল দেখা গেছে তারা ছিল তাদের সবার থেকে সুন্দর।
আদিপিতা আদম ছিল পরবর্তী কালের সমস্ত মানব সন্তানদের থেকে সুন্দর পুরুষ আর আদিমাতা ঈভ ছিল তার সব কন্যাদের চেয়ে সুন্দরী। ঝর্ণার ধারে এক খণ্ড সবুজ তৃণভূমির উপর তারা দুজনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলতে লাগল। শুধু উদ্যানের কিছু কাজ ছাড়া অন্য কোন শ্রমের কাজ তাদের করতে হত না।
বনের ফল আর ঝর্ণার জল খেয়ে ক্ষুধাতৃষ্ণা নিবারণ করত তারা। ক্ষুধা পেলে রসাল ফলের ভারে আনত গাছের শাখাগুলি থেকে ফল পেড়ে খেত তারা। তৃষ্ণা পেলে কানায় কানায় ভরা নদী-ঝর্ণার উপর পাশ থেকে ঝুঁকে জলপান করত। এক এক সময় তারা রসাল কচিকচি ভঁটা চিবোত। বিবাহিত যুবক-যুবতীর মত তারা নির্জনে যৌবনসুলভ নেশায় মত্ত হয়ে উঠত মাঝে মাঝে। তাদের মুখের উপর ফুটে উঠত প্রেমমদির হাসি। তাদের চারপাশে বনের পশুরা এমন কি বাঘ, সিংহ, চিতা, ভল্লুক প্রভৃতি হিংস্র জন্তুরাও তাদের সকল হিংস্রতা ভুলে গিয়ে শান্তভাবে সেবা করত তাদের। হাতিরা তাদের শুড় ঘুরিয়ে আনন্দদান করত। সাপেরাও তৃণশয্যার উপর শান্তভাবে শুয়ে ছিল, তাদের অনেক ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
ক্রমে অস্তগমননান্মুখ সূর্য আকাশ থেকে ধীরে ধীরে নেমে এসে পশ্চিমের সমুদ্রের দ্বীপাবলীর উপর ঢলে পড়ল। নক্ষত্রেরা ধীরে ধীরে উদিত হতে লাগল সান্ধ্য আকাশে।
শয়তানরাজ প্রথম থেকে সমানে সঁড়িয়ে এই সব কিছু দেখে যেতে লাগল। বিষাদগ্রস্ত মনে তার স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চারদিকের এই সব দৃশ্যাবলী দেখতে। দেখতে অবশেষে কিছু কথা না বলে থাকতে পারল না।
সে বলল, হে নরক, আমি বিষাদঘন চিত্তে কি সব দেখছি? একদা যা ছিল আমাদের সুখের আবাস সেখানে যারা দেবদূত নয় এমন সব শত শত প্রাণীরা কত সুখে বসবাস করছে। তারা উজ্জ্বলতা বা দিব্য দ্যুতির দিক থেকে কিছুটা নিকৃষ্ট হলেও যে স্রষ্টা তাদের সৃষ্টি করেন সে স্রষ্টার কিছুটা দ্যুতি ও সুষমা ঝরে পড়েছিল তাদের দেহ থেকে। দৈব সাদৃশ্যের একটা অংশ মূর্ত তাদের মধ্যে।
হে প্রেমিকযুগল, তোমরা জান না, তোমাদের এই অবস্থার পরিবর্তন কত নিকটে। অত্যাসন্ন সেই ভাগ্যপরিবর্তনে তোমাদের জীবনের সকল সুখ সকল আনন্দ নিঃশেষে অন্তহিত হয়ে যাবে কোথায় চিরতরে। দুঃখের সীমাহীন গভীরে নিক্ষিপ্ত হবে তোমরা। বর্তমানে যে সুখের যে আনন্দের আস্বাদ লাভ করছ তোমরা, সে দুঃখ হবে এই সুখের থেকে অনেক গুণ বেশি।
তোমরা এখন যে সুখে সুখী সে সুখ তো চিরস্থায়ী নয়। যে স্বর্গলোকের সীমানার মধ্যে বাস করছ তোমরা সে সীমানা তো সুরক্ষিত নয়। যে প্রাচীর দ্বারা এই স্বর্গসীমা বেষ্টিত তা দুর্বল এবং তার প্রতিরক্ষাগত শক্তি এমনই অপ্রচুর ও অসার্থক যে তা আমার মত এক বহিঃশত্রুকে নিবারিত করতে পারল না। অবাধে এ লোকে প্রবেশ করলাম আমি।
কিন্তু স্বর্গের শত্রু হলেও তোমাদের উপর কোন জাতক্রোধ নেই আমার। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমি শত্রু নই তোমাদের। আমি কারো কাছে কোন করুণা বা মমতা না পেলেও আমি এখানে আসি অদৃশ্য অবস্থায়। তোমাদের অলক্ষ্যে অগোচরে তোমাদের করুণামিশ্রিত দৃষ্টিতে না দেখে পারছি না। তোমাদের সঙ্গে মিত্রতাই আমার কাম্য। আমি চাই তোমাদের সঙ্গে এমন এক মিত্ৰতাসূত্রে আবদ্ধ হতে যাতে তোমাদের সঙ্গে মিলেমিশে আমি বাস করতে পারি অথবা তোমরা আমার সঙ্গে বাস করতে পার এখন থেকে।
আমার বাসস্থান হয়ত তোমাদের মনঃপুত না হতে পারে, কারণ তা এই স্বর্গলোকের মত সুন্দর নয়। তবু সেই বাসভূমি সেই পরম স্রষ্টারই এক সৃষ্টি এবং সেই হিসাবে তোমাদের তা মেনে নেওয়া উচিত। তিনিই আমাকে তা দান করেছেন এবং আমি তোমাদের দান করছি।
তোমরা সেখানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নরকপ্রদেশ উন্মুক্ত করে দেবে তার বিস্তৃত দ্বারপথ। সেখানকার রাজারা এগিয়ে আসবে তোমাদের অভ্যর্থনা করতে। সেই নরকপ্রদেশই আমার বাসভূমি। কিন্তু সে স্থান এখানকার মত সংকীর্ণ নয়। তোমার অসংখ্য সন্তানদের স্থানসংকুলানের কোন অভাব হবে না। তারা অনায়াসে বাস করতে পারবে সেখানে।
সে স্থান যদি তোমাদের ভাল না লাগে তাহলে কোন উপায় নেই। তাহলে তোমরা আমার প্রতি কোন অন্যায় না করলেও যিনি আমার উপর অন্যায় করেছেন, যিনি আমাকে তোমাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের পথে টেনে নিয়েছেন তাকে ধন্যবাদ দিও। যদিও তোমাদের নিস্পৃহতা ও নির্দোষিতায় আমি বিগলিত হয়ে পড়ছি, তথাপি সাধারণের স্বার্থ ও সম্মানের খাতিরে রাজ্যলাভের আকাঙ্ক্ষায় আমি এই নতুন জগৎ অধিকার করে আমার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চাই আর তার জন্যই আমি বাধ্য হয়ে এমন এক জঘন্য কাজ করতে এসেছি যা আমি নিজেই ঘৃণা করি।
এই সব কথাগুলি আপন মনে বলল শয়তান। সকল অত্যাচারীই তাদের অন্যায় কর্মের স্বপক্ষে যে যে যুক্তি দেখায়, যে প্রয়োজনীয়তার কথার উল্লেখ করে শয়তানও তা করল। তারপর সে যে গাছের উপর একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিল সেই গাছ হতে নীচে অবতরণ করে এক চতুষ্পদ জন্তুর রূপ ধারণ করে সেই সব জন্তুদের মাঝে মিশে গেল। কারণ এখান থেকে এইভাবেই তার শিকারের বস্তুর উপর লক্ষ্য রাখা সম্ভব হবে। এখান থেকে তাদের কথাবার্তা বা কাজকর্ম দেখতে পাবে। কখনো বাঘ বা কখনো সিংহ হয়ে সে অগ্নিদৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে সামনে।
মাঝে মাঝে তার দৃষ্টিটাকে এদিকে সেদিকে স্থানান্তরিত করতে লাগল শয়তান। তার মনে হতে লাগল যে কোন মুহূর্তে এই দুটি শিকারকে দুটি থাবার মধ্যে ধরে ফেলতে পারবে।
এরপর দেখা গেল আদি মানব আদম আদি মানবী ঈভকে কি বলতে লাগল আর শয়তান তা শুনতে লাগল কান খাড়া করে।
আদম ঈভকে বলতে লাগল, হে আমার সকল আনন্দের অংশীদার, যে শক্তি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং যে বিস্তৃত জগতে আমরা বাস করছি সেই শক্তি ও জগৎ যেন চিরমঙ্গলময় হয় আমাদের পক্ষে। পরম মঙ্গলময় ঈশ্বর আমাদের প্রতি। অপার করুণাবশত আমাদের পথের ধূলি থেকে তুলে এনে এই সর্বসুখকর স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি আপন ইচ্ছা বা প্রয়োজনমত সব কিছুই সৃষ্টি করতে পারেন।
সেই ঈশ্বর আমাদের জন্য এত কিছু করলেও তিনি আমাদের কোন সেবাই চান না। তিনি আমাদের কাছে চান শুধু একটিমাত্র আনুগত্য। এই বিশাল বিস্তীর্ণ উদ্যানে যত সব উপাদেয় সুস্বাদু ফলের গাছ আছে তার মধ্যে শুধু জ্ঞানবৃক্ষের ফল যেন কখনো আমরা ভক্ষণ না করি। জীবনবৃক্ষের পাশে রোপিত জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেলে তা মৃত্যুসম হয়ে উঠবে আমাদের পক্ষে।
বুদ্ধিমান ঈশ্বর নিজে ঘোষণা করেছেন এই জ্ঞানবৃক্ষের ফলভক্ষণ আমাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠবে। এই জগৎ ও জগতের জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে যত জীব বাস করে সেই সব জীবের উপর প্রভুত্ব ও শাসনক্ষমতা আমাদের দান করে তার বিনিময়ে শুধু এই আনুগত্যই চান। সুতরাং এই নিষেধাজ্ঞাটি যেন খুব আমরা কঠিন না ভাবি।
আমরা যখন অন্য সব কিছু বস্তুই স্বাধীনভাবে উপভোগ করতে পারি, অসংখ্য আনন্দের উপকরণ ইচ্ছামত বেছে নিতে পারি তখন এই একটিমাত্র নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা এমন কিছু দুঃসাধ্য কর্ম নয় আমাদের কাছে। আমাদের শুধু একটিমাত্র কর্তব্যকর্ম সাধন করতে হয়। সে কর্ম হলো এই যে, এই সব চারাগাছগুলি অতিরিক্ত বেড়ে গেলে তা হেঁটে দিতে হয় এবং এই ফুলগাছগুলির সেবাযত্ন করতে হয়। এই কাজগুলি করার পর আমরা দুজনে একসঙ্গে ঈশ্বরের গৌরবগান করব। তাছাড়া এ কাজ শ্রমসাধ্য হলেও তোমার সঙ্গে করি বলে মোটেই কষ্ট হয় না।
আদমের কথা শেষ হলে ঈভ তার উত্তরে বলল, যার জন্য আমার এই জীবন সৃষ্ট হয়েছে, যার অঙ্গ থেকে অর্ধাঙ্গিনীরূপে সৃষ্ট হয়েছে আমার দেহ, সেই তুমিই আমার মস্তিষ্ক, তুমিই আমার পথপ্রদর্শক ও পরিচালক! তুমি যা বলেছ তা ঠিক এবং ন্যায়সঙ্গত। ঈশ্বরের কাছে কত বিষয়ে কত ঋণী আমরা। প্রতিদিনই তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়া এবং তার প্রশংসা বা গৌরবগান গাওয়া উচিত।
এদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমার দায়িত্ব আরও বেশি, কারণ আমি তোমার থেকে আরো বেশি সুখ ও সৌভাগ্য ভোগ করি। তোমাকে পেয়ে সব দিক দিয়ে নির্বিঘ্ন ও নিষ্কন্টক হয়ে উঠেছি আমি। অবশ্য তুমি আমার মত সাথী আর কোথাও খুঁজে পাবে না।
সেই দিনটির কথা প্রায়ই মনে পড়ে আমার আজও। সেদিন ঘুম থেকে জেগে উঠেই দেখি একটি গাছের তলায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ফুলের উপর শুয়ে আছি আমি। তখন আমি বিপুল বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবতে লাগলাম, আমি কে এবং কোথায় আছি। সেখান থেকে উঠে আমি কিছুটা এগিয়ে গেলাম। সহসা আমার অদূরে একটি গুহার মুখে জলের কলকল শব্দ শুনে সেদিকে তাকিয়ে দেখি একটি পার্বত্য গুহা থেকে : একটি জলের ধারা সশব্দে বেরিয়ে এসে সমতলের উপর ছড়িয়ে পড়ছে। তারপর সেই জলধারা একটি হ্রদের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকছে। সেই হ্রদের জল স্বচ্ছ নীল– আকাশের মতই এমন স্বচ্ছ ছিল যে তাতে সবকিছু প্রতিবিম্ব দেখা যায়।
কৌতূহলবশত আমি সেই হ্রদের সবুজ তটভূমিতে নিজেকে শায়িত করে হ্রদের নির্মল জলের দিকে তাকালাম। আমার মনে হল হ্রদ নয়, যেন আর এক আকাশ। সহসা সেই স্বচ্ছ জলের ওপরে একটি মূর্তি ঘাড় বেঁকিয়ে আমাকে দেখছে। আমি তাকে দেখে পিছিয়ে গেলে সেও পিছিয়ে গেল। কিন্তু থাকতে না পেরে আমি ফিরে গিয়ে তার দিকে সপ্রেম ও সহানুভূতির দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলাম তার উপর। তাকে একান্তভাবে পাবার জন্য সাধনা করতে লাগলাম। এমন সময় একটি অদৃশ্য কণ্ঠস্বর সতর্ক করে দিল আমায়, হে সুন্দরী, ওখানে যা দেখছ তা তোমারই ছায়া। তোমার সঙ্গেই তা যাওয়া-আসা বা ওঠা-বসা করে। আমাকে অনুসরণ করো। আমি তোমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাব যেখানে তুমি শুধু তোমার ছায়া বা দেহের প্রতিরূপটিকেই দেখবে না, সেখানে তুমি যার প্রতিমূর্তি তাকে তুমি সশরীরে দেখতে পাবে, তাকে তুমি আলিঙ্গন করতে পারবে। চিরদিন তার সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত থেকে উপভোগ করে যেতে পারবে তুমি। তুমি তার বহু সন্তান গর্ভে ধারণ করবে এবং মানবজাতির আদি মাতা হিসাবে অভিহিত হবে।
সেই কণ্ঠস্বর আরও বলল, তুমি আমাকে দেখতে পাবে না। অদৃশ্য অবস্থায় আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব তোমাকে। তুমি শুধু নীরবে নির্বিচারে অনুসরণ করে যাবে আমায়।
আমি সেই কণ্ঠস্বরের কথামত তাকে অনুসরণ করে যেতে লাগলাম। তোমাকে দেখতে পেলাম। সুন্দর, দীর্ঘ দেহ। কিন্তু আমার মনে হলো জনবিস্মিত সেই মূর্তির থেকে কম নমনীয়, কম নম্র। আমি তাই পিছন ফিরে চলে যেতে শুরু করলাম। তুমি তখন চিৎকার করে আমায় বললে, ফিরে এস সুন্দরী ঈভ, কার ভয়ে তুমি পালাচ্ছ এমন করে? তুমি জান না, যার কাছ থেকে পালিয়ে যাচ্ছ তুমি তারই অংশ। তোমার দেহাবয়ব গড়ে তোলার জন্য আমি আমার নিজের দেহের অংশ থেকে অস্থি, মজ্জা, ও মাংস দান করি। তুমি আমার অন্তরের নিকটতমা, আমার জীবনের জীবন। তুমি আমার পাশে পাশে সব সময় থাকবে, তুমিই হবে আমার প্রিয়তমা, অন্তরতমা, আমার সকল শান্তি ও সান্ত্বনার উৎসস্থল। তুমি আমার আত্মার অর্ধাংশ, আমার অর্ধাঙ্গিনী। তুমি তোমার শান্ত হাত দিয়ে আমাকে ধরেছিলে। আমি আত্মসমর্পণ করেছিলাম তোমার কাছে। তখন থেকে দেখতে পাচ্ছি, সৌন্দর্য কিভাবে পুরুষোচিত জ্ঞান ও মহিমার দ্বারা পূর্ণতা লাভ করে এবং সেই সৌন্দর্যই প্রকৃত সৌন্দর্য।
এই কথা বললেন আমাদের আদি মাতা। তাঁর চোখে-মুখে ছিল নির্মম দাম্পত্য প্রেমের মদির আকর্ষণ, নীরব আত্মসমর্পণের ভাব। তিনি তখন অর্ধ-আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে আমাদের আদি পিতার উপর হেলে পড়লেন। আলুলায়িত সোনালী কেশপাশে। আচ্ছন্ন তাঁর স্ফীত বক্ষ আদি পিতার বক্ষের উপর স্থাপন করলেন তিনি।
আদি পিতা তখন আদি মাতার দেহসৌন্দর্য ও ননত মাধুর্য দর্শনে বিশেষ প্রীত হয়ে প্রসন্নতার হাসি হাসলেন, ঠিক দেবরাজ জুপিটার যেমন একদিন জুনোর পানে তাকিয়ে হেসেছিলেন এবং পবিত্র চুম্বনের দ্বারা তাঁর ওষ্ঠাধরকে আপীড়িত করেন। জুপিটারের সে হাসিতে মেঘ হতে বসন্ত ফুল ঝরে পড়ে।
তা দেখে শয়তান ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে সরে দাঁড়াল। কঠিন ঈর্ষান্বিত দৃষ্টি দিয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগল তাদের। তারপর আপন মনে বলতে লাগল, এ দৃশ্য ঘৃণ্য এবং পীড়াদায়ক। মনোরম স্বর্গোদ্যানে এই দুটি মানব-মানবী পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় এক পরম স্বর্গীয় সুখ উপভোগ করছে, অথচ আমি নরকে নিক্ষিপ্ত। যে নরকে কোন প্রেম নেই, আনন্দ নেই, আছে শুধু অতৃপ্ত কামনার ভয়ঙ্কর পীড়ন, সেই নরকের অন্ধকারে প্রজ্জ্বলিত নরকাগ্নির জ্বালাময়ী উত্তাপের সঙ্গে অতৃপ্ত কামনার বেদনা আর ব্যাকুলতা ভোগ করে যেতে হয় আমাদের।
এখন আমি ওদের মুখ থেকে যা শুনেছি তা ভুললে চলবে না। এই স্বর্গলোকে বা স্বর্গোদ্যানে যা কিছু আছে তা তারা সব উপভোগ করতে পারে না। এই উদ্যানে জ্ঞানবৃক্ষ নামে একটি মারাত্মক গাছ আছে যার ফল নিষিদ্ধ তাদের কাছে। এ গাছের ফলের আস্বাদন থেকে বঞ্চিত তারা। তার মানে তাদের প্রভু ঈশ্বর এক অযৌক্তিক সংশয়ের দ্বারা আচ্ছন্ন। কিন্তু তাদের প্রভু ঈর্ষান্বিত কেন তাদের প্রতি? জ্ঞানলাভ করা কি পাপ? সে জ্ঞানলাভের পরিণাম কি মৃত্যু? তবে কি তারা অজ্ঞ রয়ে গেছে আজও? জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকাটা কি সুখী অবস্থা? সেটা কি তাদের আনুগত্য আর বিশ্বাসের অভ্রান্ত প্রমাণ বা পরিচায়ক?
হ্যাঁ, এটাই হবে তাদের ধ্বংসের সৌধ নির্মাণের ভিত্তি। এই অজ্ঞতাই হবে তাদের ধ্বংসের কারণ। আমি তাদের মনে জ্ঞানের বাসনা সঞ্চারিত করে তাদের উত্তেজিত করে তুলব। আমি তাদের এমনভাবে উত্তেজিত করে তুলব যাতে তারা ঈশ্বরের ঈর্ষাজনিত আদেশ প্রত্যাখ্যান করে। তাদের আমি বুঝিয়ে দেব, ঈশ্বরের এ আদেশ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তারা যাতে চিরকাল ঈশ্বরের অধীন হয়ে থাকে, ঈশ্বরের সমান মর্যাদার আসনে কখনো উন্নীত হতে না পারে, তারই জন্য ঈশ্বর জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষণ করতে নিষেধ করেছেন তাদের।
তারপর নিষিদ্ধ জ্ঞান লাভ করে ঈশ্বরের সমকক্ষ হবার অভিলাষে যেমন জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাবে অমনি অনিবার্য হয়ে উঠবে তাদের মৃত্যু। এর থেকে ভাল তাদের ধ্বংসের উপায় আর কি থাকতে পারে?
কিন্তু তার আগে এই উদ্যানের চারিদিক আমাকে একবার ঘুরে দেখতে হবে। এর প্রতিটা কোণ ভাল করে দেখতে হবে আমায়। ঘটনাক্রমে এই উদ্যানে কোথাও কোন গাছের তলায় অথবা কোনও ঝর্ণার ধারে কোন ভ্রাম্যমাণ দেবদূতের দেখা পেয়ে যেতে পারি। তাহলে তার কাছ থেকে জ্ঞাতব্য বিষয় জানা যাবে।
হে প্রেমিকযুগল, যতক্ষণ পর বেঁচে থাক। ক্ষণস্থায়ী আনন্দ প্রাণভরে উপভোগ করে যাও আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত। কারণ এক সুদীর্ঘকালীন দুঃখ অপেক্ষা করে আছে তোমাদের জন্য।
এই বলে ঘৃণাভরে দর্পিত পদক্ষেপে এগিয়ে চলল সে। যেতে যেতে সুচতুরভাবে নিরীক্ষণ করতে লাগল চারিদিক। ধীরে ধীরে বন, প্রান্তর, পাহাড়, উপত্যকার উপর দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল সে। যেতে যেতে দেখল একসময় চুড়ান্ত দ্রাঘিমারেখায় যেখানে আকাশ মর্ত্যের মহাসমুদ্রে মিলিত সেইখানে সূর্য অস্তাচলে গেল। স্বর্গের পূর্বদ্বারে শেষ সূর্যরশ্মিগুলি ঝরে পড়তে লাগল। সেই পূর্বদ্বারে ছিল তূপাকৃত মমরপ্রস্তরের এক অভ্রভেদী পাহাড়। মেঘলোক পর্যন্ত বিস্তৃত সেই পাহাড়ের মর্ত্যভূমি থেকে ওঠার একটিমাত্র পথ ও প্রবেশদ্বার আছে। বাকি সবটাই হচ্ছে এবড়ো-খেবড়ো পাথরে ভরা খাড়াই পাহাড় উপরে উঠে গেছে। তাতে ওঠা অসম্ভব কারো পক্ষে।
সেই পাহাড়ের উপর এক জায়গায় প্রহরাকার্যে নিযুক্ত দেবদূতদের মধ্যে প্রধান গ্যাব্রিয়েল আসন্ন রাত্রির প্রতীক্ষায় বসেছিল। স্বর্গের যুবকরা বিনা অস্ত্রে খেলা দেখাচ্ছিল তাকে। কিন্তু নিকটে ঢাল, বর্ম, শিরস্ত্রাণ, বর্শা প্রভৃতি স্বর্ণ ও হীরকখচিত অস্ত্রাদি ঝুলিয়ে রাখা ছিল।
এমন সময় গ্যাব্রিয়েলের সামনে আকাশমণ্ডলে ব্যাপ্ত ঘনায়মান সান্ধ্যছায়ার মধ্য দিয়ে সূর্যের একটি আলোকরেখার মত কক্ষচ্যুত উল্কার বেগে ইউরিয়েল এসে দাঁড়াল সহসা। শরৎকালের রাত্রিতে নক্ষত্রবিচ্ছুরিত বাম্পাগ্নি যেমন সমুদ্রনাবিকদের আসন্ন ঝড় সম্বন্ধে সতর্ক করে দেয়, ইউরিয়েল মেনি গ্যাব্রিয়েলকে সতর্ক করে দিয়ে বলল, শোন গ্যাব্রিয়েল, তোমার উপর এক নূতন কাজের ভার দেওয়া হয়েছে। সদাজাগ্রত ও সদাসতর্ক অবস্থায় কড়া নজর রাখতে হবে, কোন দুষ্ট আত্মা যেন এই চির আনন্দময় লোকে প্রবেশ করতে না পারে। আজই বেলা দ্বিপ্রহরে আমাদের এলাকায় একটি আত্মা এসেছিল। তাকে খুবই কৌতূহলী ও তৎপর দেখাচ্ছিল।
দেবদূতের মত দেখতে সেই আত্মা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সৃষ্টিকার্য সম্বন্ধে আরও অনেক কিছু জানতে চাইছিল, বিশেষ করে ঈশ্বরের সর্বশেষ প্রতিরূপ মানবজাতি সম্বন্ধে। আমি তখন মানবজাতির আদি পিতা-মাতার বাসভূমিতে যাবার পথ বলে দিই। সে সঙ্গে সঙ্গে আকাশপথে সেই দিকে উড়ে যায়। আমি তার উড়ে চলার কক্ষপথে তাকিয়ে লক্ষ্য করতে থাকি। তাকে প্রথমে দেবদুতের মত দেখালেও ইডেনের উত্তরদিকে যে পর্বত আছে তার উপর সে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার আকৃতি-প্রকৃতি ও চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়ে একেবারে স্বর্গীয় দেবদূতদের বিপরীত হয়ে যায়। তার উদ্দেশ্য কু-অভিসন্ধিমূলক আর আচরণ ও হাবভাব রহস্যময় মনে হয়।
আমি আমার দৃষ্টি দিয়ে তখনো তার অনুসরণ করতে থাকি। কিন্তু গাছের আড়ালে আমার দৃষ্টিপথের বাইরে চলে যায় সে। আমার মনে হয় সে হচ্ছে স্বর্গ হতে নির্বাসিত শয়তানদের একজন। নরকপ্রদেশ থেকে উঠে এসে স্বর্গলোকের মধ্যে প্রতিহিংসাবশত নতুন কোন বিপদ বাধাতে চায়। তোমার কাজ হবে তাকে খুঁজে বের করা এবং তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা।
একথা শুনে দেবসেনা গ্যাব্রিয়েল উত্তর করল, ইউরিয়েল, অত্যুজ্জ্বল সৌরমণ্ডলের মধ্যে বসে থেকে দৃষ্টি প্রসারিত করে তুমি যে দূরের বস্তুকে দেখতে পাবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। এই দ্বারপথে যে প্রহরা রয়েছে সে প্রহরা এড়িয়ে কেউ আসতে পারবে না। একমাত্র স্বর্গের পরিচিত কেউ ছাড়া এখানে আসে না। কিন্তু স্বর্গের দেবদূত ছাড়া বাইরের জগতের কেউ যদি পার্থিব বাধা ডিঙিয়ে স্বর্গোদ্যানের ভিতরে প্রবেশ করে, যদি সে স্বর্গের কোন দৈবশক্তি না হয় তাহলে তুমি যার কথা বললে সে এই স্বর্গলোকের মধ্যে যে রূপেই প্রবেশ করুক বা ঘুরে বেড়াক, আগামীকাল প্রত্যুষেই আমি তার বিষয়ে জানতে পারব।
গ্যাব্রিয়েলের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে ইউরিয়েল তার সৌরমণ্ডলের মাঝে চলে গেল। সূর্য তখন আকাশের পূর্বপ্রান্তে ঢলে পড়েছে সারাদিনের কাজ শেষ করে। পশ্চিম প্রান্তে মেঘগুলিকে নীলচে ও সোনালী রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে কে যেন।
এবার ধীরে ধীরে নেমে এল নিস্তব্ধ নিঝুম সন্ধ্যা। গোধূলির ধূসর-গম্ভীর আবরণে সব কিছু আচ্ছন্ন হয়ে গেল একেবারে। এক অখণ্ড নীরবতা বিরাজ করতে লাগল চারিদিকে। পশুরা তাদের তৃণশয্যায় শয়ন করল, পাখিরা চলে গেল তাদের আপন আপন বাসায়। একমাত্র নাইটিঙ্গেল সারারাত জেগে জেগে এক প্রেমমধুর গান গেয়ে চলল একটানা। সে গানের সুরে পুলকের জোয়ার জাগল সেই নৈশ নীরবতার বুকে।
সহসা জীবন্ত মুক্তাসন্নিভ এক আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল সমগ্র আকাশমণ্ডল। সন্ধ্যাতারার পিতা যে হেসপারায়াস নক্ষত্রগুলিকে পরিচালিত করে নিয়ে আসছিল, আকাশে সে হেসপারায়াস উজ্জ্বল হয়ে উঠলে অবগুণ্ঠিত চন্দ্ররাণী উদিত হয়ে তার রজতশুভ্র আলোর আবরণগুলি ছড়িয়ে দিলেন অন্ধকারের উপর।
আদি মানবপিতা আদম তখন ঈভকে বললেন, হে আমার জীবনসঙ্গী, এখন রাত্রিকাল সমাগত। এই কাল সকল জীবেরই বিশ্রামলাভের সময়। চল আমরাও বিশ্রামলাভ করিগে। কারণ শ্রম এবং বিশ্রাম, দিন এবং রাত্রি এক অবিচ্ছিন্ন পারম্পর্যে ঈশ্বরই সৃষ্টি করেছেন। নিদ্রায় শিশিরবিন্দুগুলি নিদ্রার বোঝাভার নিয়ে ঝরে পড়ছে আমাদের চোখের পাতার উপর। অন্যান্য প্রাণীরা কর্মহীন অবস্থায় ঘুরে বেড়ায় বলে তাদের বিশ্রামের প্রয়োজন কম কিন্তু মানুষকে প্রতিদিন দৈহিক বা মানসিক কর্মে ব্যাপৃত থাকতে হয় এবং তাতেই তার গৌরব। তার সকল পথে সকল কাজেই ঈশ্বরকে ভক্তি করে চলে মানুষ। কারণ তার কর্মাকর্মের ভাল-মন্দ দিকগুলি ঈশ্বর বিচার করে দেখেন এবং সেইমত ফলদান করেন। কিন্তু অন্যান্য জীবদের কর্মকর্ম সম্বন্ধে উদাসীন থাকেন তিনি।
আগামীকাল প্রভাতে পূর্বদিকে আলো ফুটে ওঠার আগে ঘুম থেকে উঠতে হবে আমাদের। তারপর কাজে মন দিতে হবে। ঐ ফুলগাছগুলির গোড়া থেকে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। তারপর দুপুরে বিভিন্ন গাছের যে সব শাখাপ্রশাখাগুলি অতিরিক্ত বেড়ে গাছের গোড়ায় দেওয়া সারগুলি খেয়ে ফেলে সেই শাখাপ্রশাখাগুলিকে হেঁটে ফেলতে হবে। কিন্তু এ কাজে আরও লোকের দরকার। শুধু আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। যে সব ফুলের কুঁড়িগুলি গাছ থেকে ঝরে তলায় ছড়িয়ে পড়ে আছে সেগুলোকে পরিষ্কার করতে হবে। যাই হোক, এখন আমরা কিছুই করতে পারব না, কারণ এখন রাত্রিকাল, শুধু বিশ্রামের সময়।
রূপলাবণ্যবতী ঈভ তখন বলল, হে আমার প্রভু ও পরিপালক, তুমি আমাকে যা করার নির্দেশ দেবে, আমি বিনা প্রতিবাদে তাই করব। ঈশ্বরের বিধানই হলো এই। তোমার কাছে ঈশ্বরই আইন, আর আমার আইন তুমি। অধিক না জানতে চাওয়াটাই নারীদের পক্ষে সুখের, এবং প্রশংসার যোগ্য।
তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি সময়ের কথা, ঋতু ও ঋতু পরিবর্তনের কথা সব ভুলে যাই। কী সুন্দর ও শান্ত এই প্রভাতকাল। পাখিদের সুমধুর সঙ্গীতে মধুময় হয়ে উঠেছে এই সকাল। সকালের মনোহর সূর্য এই মনোরম উদ্যানভূমিতে ওষধি, বৃক্ষপত্রে, ফুলে-ফলে পতিত শিশিরবিন্দুর উপর তার পূর্বাচলের আলোক বিকীরণ শিশিরসিক্ত বস্তুগুলিতে সূর্যকিরণ পড়ায় তা চকচক করছে মুক্তার মত। বৃষ্টির পর এই উর্বর ভূমি সুগন্ধি হয়ে ওঠে।
তারপর যখন শান্ত স্তব্ধ সন্ধ্যা নেমে আসে এবং তারপর আসে রাত্রি তখন পাখিগুলি ঘুমিয়ে পড়ে এবং চাঁদ ওঠে। তখন নক্ষত্ররাজি মুক্তার মত আকাশে কিরণ দিতে থাকে। কিন্তু শান্ত সকাল, পাখিদের গান, সূর্যকিরণোজ্জ্বল বৃক্ষরাজি ও ফুল-ফল, মুক্তাসন্নিত শিশিরবিন্দু, বর্ষণোত্তর মাটির সৌরভ, অথবা শান্ত সন্ধ্যা, নিস্তব্ধ রাত্রি, চন্দ্রের আকাশ পরিক্রমা, উজ্জ্বল নক্ষত্র তুমি বিনা আনন্দ দান করতে পারে না। কিন্তু স্বর্গ ও মর্ত্যের সকল জীবই যখন তাদের চক্ষু মুদিত করে ঘুমিয়ে আছে তখন সারারাত ধরে এই চন্দ্র ও এই সব নক্ষত্ররাজি কি কারণে কিরণ দান করে চলেছে?
তখন আমাদের আদিপিতা বললেন, হে ঈশ্বরদুহিতা মানবী, অনন্তগুণসম্পন্না ঈভ, এই সব নৈশ জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর কাজই হল পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে উদয়-অস্তের মাধ্যমে আপন আপন কর্তব্য পালন করা। রাত্রিকালে যদি এরা কিরণ না দেয়, যদি পরিপূর্ণ অন্ধকারের উপর রাত্রির সনাতন অধিকার ফিরে না পায় তাহলে প্রকৃতি ও জীবজগতের সকল প্রাণের আগুন নির্বাপিত হয়ে যাবে। চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজি তাদের উজ্জ্বলকিরণের দ্বারা রাত্রিকালে প্রকৃতি ও জীবজগতের সবকিছুকে শুধু আলোকিত করে তোলে না, সেই উত্তপ্ত ও নানাবিধ প্রভাবের দ্বারা তাদের উত্তপ্ত ও অনুপ্রাণিত করে।
রাত্রিকালে মর্ত্যজাত যে সব বস্তুরাজি চন্দ্র ও নক্ষত্রমণ্ডল হতে জ্যোতির যে একটি অংশ পায় তারা সূর্যের পর্যাপ্ত ও পূর্ণায়ত কিরণলাভের জন্য ব্যগ্র হয়ে ওঠে।
যদিও রাত্রি গম্ভীর হলে চন্দ্র ও নক্ষত্রলোক দেখার জন্য কোন মানব জাগ্রত থাকে না, তথাপি সে আলোক বৃথা যায় না। স্বর্গলোকে কখনো নৈশ দর্শক বা চন্দ্রালোক বা নক্ষত্রালোক উপভোগের অভাব হয় না। ঈশ্বর চান তাঁর গৌরবগান বা প্রশংসা। রাত্রিকালে সারা পৃথিবী জুড়ে লক্ষ লক্ষ অদৃশ্য দেবদূত চন্দ্র ও নক্ষত্রমণ্ডলের আলোকমালা উপভোগ করে বেড়ায়। আমরা জাগ্রত বা নিদ্রিত কোন অবস্থাতেই দেখতে পাই না তাদের।
এইসব অদৃশ্য দেবদূতেরা সারা দিন-রাত ঈশ্বরের সৃষ্টিকার্য দেখে তার প্রশংসা করে এবং ঈশ্বরের গুণগান করে। কতবার আমরা গভীর নিশীথে খাড়াই পাহাড়ের উপর অথবা গভীর অরণ্যমাঝে কত দৈব কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হতে শুনেছি। এই কণ্ঠস্বর এক জায়গায় কোথাও ধ্বনিত হলে অন্য এক জায়গায় অন্য এক কণ্ঠস্বর যেন তার প্রত্যুত্তর দেয় এই সব কণ্ঠস্বরগুলি তাদের মহান স্রষ্টা পরমেশ্বরের গৌরবগান করে বেড়ায়। যখন তারা দলে দলে পাহারা দেয়, যখন তারা নৈশপ্রহরায় নিযুক্ত হয়ে রাত্রিকালে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় তখন তারা বাদ্যযন্ত্র সহযোগে ঈশ্বরের নামকীর্তন করে। তাদের সেই ভিন্ন ভিন্ন দলগত সঙ্গীতের সুরধারাগুলি এক ঐকতানে মিলিত হয়ে রাত্রির অখণ্ড বিশুদ্ধতাকে খণ্ড খণ্ড করে আমাদের সকল চিন্তাকে ঊর্ধ্বাভিমুখী ও ঈশ্বরাভিমুখী করে তোলে।
এইভাবে কথা বলতে বলতে হাত ধরাধরি করে তাদের পরম আনন্দঘন কুঞ্জমাঝে চলে গেল তারা। পরমস্রষ্টা মানুষের আনন্দ বিধানের জন্য লড়েল ও মাটেল গাছের লতাপাতার ছাদবিশিষ্ট এই কুঞ্জবন নির্মাণ করে দেন। সে কুঞ্জবনের চারিদিকে ছিল সুগন্ধি সুন্দর ফুলে ভরা গাছের বেড়া। সে কুঞ্জের মেঝের উপর ছিল দামী পাথরের পরিবর্তে আইরিস, গোলাপ, যুঁই, ভায়োলেট প্রভৃতি বিভিন্ন রঙের সুগন্ধি ফুলের মেদুর আস্তরণ। কোন পশু-পাখি বা কীটপতঙ্গ মানুষের ভয়ে প্রবেশ করতে পারে না সে কুঞ্জবনে। এর থেকে বেশি নিভৃত নির্জন বা বেশি ছায়াচ্ছন্ন কুঞ্জবনে বনদেবতা প্যান, সিলভানাস বা কোন পরী কখনো ঘুমোয়নি বা বাস করেনি।
ফুল, মালা ও সুগন্ধি ওষধিতে পরিপূর্ণ এই বিস্তৃত কুঞ্জবনের মাঝেই একদিন আদম ও ঈরে প্রথম বাসরশয্যা স্থাপিত হয়। স্বর্গের দেবদূতেরা সেদিন বিবাহের দেবতা হাইমেনের গান গেয়ে নগ্ন সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ ঈভকে বিবাহের নববধূ হিসাবে আদি মানব আদমের হাতে তুলে দেয়। ঈভ ছিল প্যান্ডোরার থেকে বেশি সুন্দরী এবং দেবতারা তাকে বিবিধ অপার্থিব উপহারে ভূষিত করেন। এমনি করে একদিন প্যান্ডোরাকে তার উপহারের বাক্সটাই অগ্নিদেবতা প্রমিথিউসের ভাই এপিমেথিউসকে ছলনার দ্বারা মুগ্ধ করার জন্য এনে দেয়। প্যান্ডোরার সেই উপহারের বাক্স খোলার সঙ্গে সঙ্গে অভিশাপ নেমে আসে মানবজগতের উপর।
আদি মানবপিতা আদম ও আদিমাতা ঈভ সেই বিস্তৃত কুঞ্জমাঝে প্রবেশ করে দুজনেই পঁড়িয়ে রইল। তারপর তারা যে ঈশ্বর যে পরমশ্রষ্টা স্বর্গ-মর্ত্য, জ্যোতির্ময় চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজি সৃষ্টি করেছেন সেই ঈশ্বরের বন্দনাগান করতে লাগল। তারা স্তবের মাধ্যমে বলতে লাগল, হে পরমেশ্বর, হে সর্বশক্তিমান, তুমিই এই রাত্রি ও দিন
সৃষ্টি করেছ। সারাদিন আমরা আমাদের নির্দিষ্ট কর্মগুলি যথাযথভাবে পরস্পরের সাহায্যে সম্পন্ন করে আমাদের এই দাম্পত্যশয্যায় বিশ্রামলাভের জন্য এসেছি।
আমাদের এই দাম্পত্য সুখ তোমারই অনুগ্রহে লব্ধ। কিন্তু এই মনোরম স্থান এতই বড় যে অনেক লোক এখানে স্বচ্ছন্দে বাস করতে পারে। আমাদের দুজন থাকার পরও অনেক জায়গা খালি পড়ে থাকে এখানে।
আমাদের দুজনের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি লাভ করেছিলে যে আমাদের এই দুজনের মিলন থেকে এমন এক জাতির উদ্ভব হবে যারা সমগ্র মত্যভূমি পরিপূরিত করে থাকবে এবং যারা আমাদের মত জাগ্রত অথবা নিদ্রাকালে ঈশ্বরের অনন্ত মহানুভবতার জন্য গৌরবগান করবে।
এইভাবে তার নৈশ প্রার্থনা শেষ করলেন আদিপিতা আদম এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মগুলি করলেন। তারপর চারদিকে অকিয়ে দেখলেন কেউ কোথাও নেই। তখন সেই কুঞ্জের ভিতরকার দিকের একটি ঘরে পাশাপাশি দুজনে শুয়ে পড়লেন মুখোমুখি। আদম বা ঈভ কেউ কারও দিকে পিছন ফিরে পাশ ফিরলেন না।
প্রেমের যে রহস্য ভণ্ড প্রেমিকরা ধরতে পারে না, দাম্পত্য প্রেমের যে পবিত্রতা ও শুচিতা তারা রক্ষা করতে পারে না, আমাদের আদি পিতা-মাতা ঈশ্বর নির্দেশিত পথে চলে সেই পবিত্র দাম্পত্য প্রেমের প্রতি ছিলেন একান্তভাবে বিশ্বস্ত ও মনেপ্রাণে শুচিশুদ্ধ।
ঈশ্বর চান এই দাম্পত্য প্রেম হবে সন্তানবৃদ্ধির উৎস। তিনি চান সুসন্তানদের সংখ্যাবৃদ্ধি। শুধু যারা ঈশ্বর ও মানবজাতির শত্ৰু, যারা ঈশ্বরদ্রোহী, দেবদ্রোহী ও মানবদ্রোহী, সেই দেববৈরী ও মানববৈরী ধ্বংসকারীরাই ঈশ্বরের কাছে সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত।
হে রহস্যময় ঐশ্বরিক বিধান দ্বারা বিধৃত দাম্পত্য প্রেম, তুমিই মানব-সন্তান বৃদ্ধির একমাত্র উৎস, স্বর্গ ও মর্ত্যের সকল জীবের তুমিই একমাত্র প্রকৃত উৎপাদনকারী। তোমারই দ্বারা ব্যভিচারী ও অবৈধ কামনা-বাসনাগুলি মানবজাতির মন থেকে বিতাড়িত ও বিদূরিত হয়ে পশুদের জগতে চলে যায়। তুমিই সকল প্রেমের মধ্যে যুক্তিবোধ, সততা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা, পবিত্রতা প্রভৃতি সদ্গুণগুলি প্রবর্তন করো। তোমারই
সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। তোমার উপর কোন পাপদোষ আরোপ করে বা কোন অন্যায়ে অভিযুক্ত করে তোমাকে এই পবিত্রতম স্থানের অনুপযুক্ত হিসাবে পরিগণিত করতে পারি না আমি। তুমি সকল পারিবারিক সম্পর্কের মাধুর্যের স্থায়ী উৎস।
হে দাম্পত্য প্রেম, তোমার শয্যা চিরনিষ্কলুষ ও চিরপবিত্র। সাধু ব্যক্তিরা ও ধার্মিক পিতারা এই শয্যায় শয়ন করেই সৎপুত্রদের জন্মদান করে থাকেন।
এই পবিত্র দাম্পত্য প্রেম কখনো সুবর্ণ বাণ নিক্ষেপ করে, কোথাও তার স্থিরোজ্জ্বল প্রদীপটি জ্বালিয়ে দেয়। কখনো বা নীল পাখা মেলে কল্পনার আকাশে উড়ে চলে। এই দাম্পত্য প্রেমের শুচিতা ও বিশ্বস্ততা কখনো অর্থলোলুপ ব্যভিচারিণী রমণীদের কৃত্রিম হাসিতে অথবা চটুল নৃত্যগীত ও তরল আমোদ-প্রমোদে প্রমত্তচিত্ত অভিজাত সমাজের নর-নারীদের মধ্যে পাওয়া যায় না। অথবা কোন ক্ষুধার্ত প্রেমিকা তার গর্বিত প্রেমিকের কাছে যে গান গায় সেই গানের প্রাণহীন সুরের মধ্যেও প্রেমের কোন শুচিতা আশা করা যায় না।
এই পবিত্র দাম্পত্য প্রেমে চিরবিশ্বস্ত আমাদের আদি পিতামাতা আদম ও ঈভ পরস্পর নগ্ন ও আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় সেই নিভৃত কুঞ্জবনের মধ্যে তৃণশয্যায় শয়ন করে নাইটিঙ্গেল পাখির গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লেন। কুঞ্জগৃহের কুসুমাস্তীর্ণ চন্দ্রাতপ হতে গোলাপ ঝরে পড়তে লাগল।
হে দম্পতিযুগল, তোমরা সুখে নিদ্রা যাও। তোমরা যে পরম সুখে সুখী তার থেকে বেশি সুখ আর চেও না। তোমরা যা জান তার থেকে আর বেশি কিছু জানতে চেও না।
রাত্রির প্রহর তখন অতীতপ্রায়। চন্দ্র সবেমাত্র আকাশস্থ তার যাত্রাপথ অর্ধাংশ। পরিক্রমা করেছে। এমন সময় নৈশ প্রহরায় নিযুক্ত চেরাবিম জাতীয় দেবদুতেরা যুদ্ধের বেশে এসে নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়াল।
গ্যাব্রিয়েল তার পাশের আর এক দেবদূতকে বলল, শোন উজ্জীয়েল, তোমাদের দলের অর্ধেক সংখ্যক দেবদূত দক্ষিণ প্রান্তে প্রহরা দিক। আর একদল উত্তর দিকে প্রহরা দিতে থাক। আমাদের দল থাকবে পশ্চিম দিকে।
সঙ্গে সঙ্গে দেবদূতরা বাণ, বর্শা প্রভৃতি অস্ত্র হাতে এক একটি অগ্নিশিখার মত চলে গেল। এরপর ইথুরিয়েল ও জেফন নামে দুজন বলিষ্ঠ দেবদূতকে ডাকল গ্যাব্রিয়েল।
তাদের উপর এক কার্যভার দিয়ে বলল, ইথুরিয়েল ও জেফন, তোমরা তোমাদের পাখায় ভর দিয়ে উড়ে সারা উদ্যানটা খুঁজে দেখ। কোন জায়গা বাদ রাখবে না। বিশেষ করে যেখানে দুজন মানব-মানবী নিশ্চিন্ত নিদ্রায় অভিভূত হয়ে আছে। আজ বিকালে সূর্যের অস্তগমনকালে নরকের কোনও এক শয়তান নরকের কারাগার থেকে অসদুদ্দেশ্যে পালিয়ে এখানে উঠে এসেছে। সে কোথায় লুকিয়ে আছে খুঁজে বার করো। তাকে ধরে নিয়ে এস এখানে।
এই বলে গ্যাব্রিয়েল তার জ্যোতির্ময় মূর্তিতে চন্দ্রের উজ্জ্বলতাকে ম্লান করে তার নিজের কাজে চলে গেল। অন্য দুজন দেবদূত শয়তানের সন্ধানে কুঞ্জবনের দিকে চলে গেল। কুঞ্জবনে তারা গিয়ে দেখল সেই পলাতক শয়তান এক সাপের রূপ ধরে ঈভের কানে কানে কি বলছে। এইভাবে শয়তান এক হীন অপকৌশলের দ্বারা ঈভের কল্পনাকে নাড়া দিয়ে তার মধ্যে যত সব ভ্রান্ত আশা ও স্বপ্ন সঞ্চারিত করার চেষ্টা করছে। এক অবৈধ ও নীতিবিগর্হিত অভিলাষের বিষ তার কানের মধ্যে ঢেলে তার জৈব সত্তার মধ্যে প্রবাহিত বিশুদ্ধ রক্তের ধারাকে কলুষিত করে দিচ্ছে। এইভাবে ঈভের মধ্যে ঘুমের ঘোরে জাগল কতকগুলি বিক্ষুব্ধ চিন্তা। জাগল ব্যর্থ আশা, ব্যর্থ লক্ষ্য, অসঙ্গত কামনা-বাসনা আর এক মিথ্যা আহঙ্কার আর আত্মম্ভরিতার ঊর্ধ্বচাপ।
ইথুরিয়েল তখন তার বর্শা দিয়ে শয়তানকে মৃদুভাবে স্পর্শ করল। কোন মিথ্যা বা মিথ্যাবাদী স্বর্গের রোষকশায়িত স্পর্শ সহ্য করতে পারে না।
শয়তান বিস্ময়ে চমকিত হয়ে উঠে দাঁড়াল ব্যস্ত হয়ে। নাইগ্রীস পাউডারের স্থূপে কোন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পড়লে বারুদের স্পর্শে যেমন আগুন জ্বলে ওঠে, তেমনি শয়তান ক্রোধে জ্বলে উঠে তার আসল মূর্তি পরিগ্রহ করে দেবদূত দুজনের সামনে এগিয়ে গেল। দেবদূতদ্বয়ও অকস্মাৎ নরকের শয়তানরাজকে স্বর্গলোকের উদ্যানে দেখে বেশকিছুটা বিস্মিত না হয়ে পারল না।
তবু তারা কোনরূপ ভয় না পেয়ে অবিচলিতচিত্তে শয়তানরাজকে বলতে লাগল, নরকে নির্বাসিত কোন বিদ্রোহী আত্মা, তুমি নরকের কারাগার ভেঙে এখানে পালিয়ে এসে ছদ্মরূপ ধারণ করে প্রাচীর লঙ্ঘনকারী তস্করের মত এখানে সুখনিদ্রায় অভিভূত দুজনের মাথার কাছে বসে কি করছিলে?
শয়তানরাজ তখন ঘৃণাভরে বলল, আমাকে তোমরা জান না? চিনতে পারছ না আমায়? একদিন তোমরা যেখানে উঠতে পারতে না সেই সুউচ্চ গৌরবের আসনে আমি যখন সমাসীন থাকতাম তখন তোমরা আমার সঙ্গে কথা বলতে বা আমার কাছে যেতে সাহস পেতে না। আর আজ কিনা বলছ আমাকে তোমরা চেনই না। আর চিনতে যদি পেরেই থাক তবে বৃথা জিজ্ঞাসা করে কি লাভ?
দেবদূত জেফন তখন ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যুত্তর দিল, হে বিদ্রোহী আত্মা! তুমি যেন ভেবো না, একদিন স্বর্গবাসকালে যে উজ্জ্বল মূর্তিতে অক্ষুণ্ণ গৌরবে প্রতিষ্ঠিত ছিলে, আজও তোমার সেই মূর্তি আছে। তখন তোমার মধ্যে যে ন্যায়পরায়ণতা, সততা ও পবিত্রতা ছিল এখন তা নেই। আজ তুমি সে স্বর্গলোক হতে নির্বাসিত। আজ তোমার পাপ, নারকীয় অন্ধকারের কুটিলতা মূর্ত তোমার মধ্যে। যাই হোক, এখন চল, যিনি আমাকে এই স্থানের প্রতিরক্ষা ও পবিত্রতা রক্ষার কাজে নিযুক্ত করেছেন, যিনি আমাদের এখানে তোমার সন্ধানে পাঠিয়েছেন, তুমি তার কাছে গিয়ে তোমার আসার কারণ ও যাবতীয় বিবরণ দান করবে।
চেরাব জাতীয় সেই দেবদূত এই কথা বলল। তার এই তীব্র ভর্ৎসনা তার যৌবনসমৃদ্ধ চোখমুখকে এক বিশেষ দ্যুতির দ্বারা উজ্জ্বল করে তুলল আরও। অপ্রতিরোধ্য করে তুলল তার ভর্ৎসনার আবেদনটিকে। লজ্জারুণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল শয়তানরাজ। সে বুঝতে পারল সততা ও সাধুতার তেজ কত ভয়ানক। দেখল স্বর্গীয় গুণাবলী তার দেহে কত সুন্দরভাবে প্রকটিত। হারানো গৌরবের কথা ভেবে দুঃখে জর্জরিত হয়ে উঠল সে। এক তীব্র অনুশোচনা জাগল তার মধ্যে। তার এই গৌরবহীন হতশ্লান অবস্থায় তার অলক্ষ্যে অজান্তে দেবদূতরা তাকে দেখে ফেলায় লজ্জাভিভূত না হয়ে পারল না সে। তবু সে দমল না কিছুমাত্র। তবু হার মানল না দেবদূতদের কাছে।
সে বলল, লড়াই যদি করতে হয় তাহলে সামনে সামনে করাই ভাল। যে তোমাদের পাঠিয়েছে আমার যা কিছু বাদ-প্রতিবাদ হবে তার সঙ্গে, প্রেরিত তোমাদের সঙ্গে নয়। তাতে হয় অধিকতর গৌরব অর্জন করব অথবা অধিকতর ক্ষতিকে বরণ করে নেব।
জেফন তখন বলল, যদি তুমি আমাদের সঙ্গে যাও তাহলে আমাদের এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য বিচারের সম্মুখীন হতে হবে না। আর যদি না যাও তাহলে তুমি যত বড়ই দুবৃত্ত হও তোমার সঙ্গে আমাদের অবশ্যই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে হবে।
আর কোন কথা বলল না শয়তানরাজ। রাগের আবেগে এমনই অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে কোন বাক্যস্ফুর্তি হলো না তার মুখে। বল্লাবিদমিত দর্পিত অশ্বের মত সে উদ্ধতভাবে এগিয়ে চলতে লাগল দেবদূতদ্বয়ের সঙ্গে।
শয়তান বুঝতে পারল, এ অবস্থায় বলপ্রয়োগের চেষ্টা অথবা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা বৃথা। ঊর্ধ্বলোকের ঐশ্বরিক শান্তির ভয় অবদমিত করল তার অন্তরের ক্ষোভকে। এ ছাড়া অন্য কোন ভয় তার ছিল না।
ক্রমে তারা পশ্চিম প্রান্তে এসে উপনীত হলো। প্রহরারত দেবদূত বাহিনী তাদের দেখতে পেয়ে ঘিরে দাঁড়াল। তাদের কর্তব্যকর্ম সম্বন্ধে নির্দেশের অপেক্ষা করতে লাগল।
তখন তাদের প্রধান গ্যাব্রিয়েল তাদের বলল, বন্ধুগণ, আমি এই পথে কাদের। পদশব্দ শুনে চকিত হয়ে দেখি ইথুরিয়ের ও জেফনের সঙ্গে তৃতীয় এক ব্যক্তি আসছে। সে ব্যক্তির মধ্যে কোন স্বর্গীয় দ্যুতি নেই, তার ভয়ঙ্কর আচরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে। সে নরকপ্রদেশের উদ্ধত রাজা! তার চোখের দৃষ্টির মধ্যে প্রকটিত ঔদ্ধত্যের ভাব থেকে বেশ বোঝা যাচ্ছে বিনা যুদ্ধে যাবে না সে এখান থেকে। সুতরাং প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াও।
গ্যাব্রিয়েলের কথা শেষ হতে না হতেই ইথুরিয়েল ও জেফন শয়তানকে ধরে এনে বলল কাকে তারা এবং কিজন্য ধরে এনেছে এখানে, কিভাবে তারা দেখতে পায় তাকে এবং কিভাবে সে এক সাপের রূপ ধারণ করে ঘুমন্ত ঈভের কানে কানে কি বলছিল।
গ্যাব্রিয়েল তখন কঠোর ভাষায় শয়তানরাজকে বলতে লাগল, হে শয়তানরাজ, কেন তুমি নরকপ্রদেশের নির্ধারিত সীমানা লঙঘন করে এখানে প্রহরারত দেবদূতদের বিব্রত করতে এসেছ? স্বর্গলোকের সীমানার মধ্যে তোমার এই অবৈধ ও উদ্ধত প্রবেশ সম্পর্কে তোমার কাছ থেকে জবাবদিহি চাইবার অধিকার এবং ক্ষমতা আমাদের আছে। ঈশ্বরের বিধানে এখানে যারা সুখনিদ্রায় অভিভূত আছে তাদের নিদ্রাভঙ্গের কাজে ব্যাপৃত দেখেছে তোমাকে প্রহরীরা। তোমার এই ন্যায়নীতি লঙ্ঘনের কাজকে যে কেউ সমর্থন করবে না এখানে তা কি জান না তুমি?
একথা শুনে ঘৃণায় তার ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে শয়তান বলল, গ্যাব্রিয়েল, স্বর্গে তোমাকে জ্ঞানী বলে সবাই শ্রদ্ধা করে। আমিও এতদিন তাই করতাম। কিন্তু তোমার এই প্রশ্ন সংশয়ান্বিত করে তুলেছে আজ আমার সেই ধারণাকে। এমন কেউ কি কোথাও আছে যে অন্তহীন সীমা-পরিসীমাহীন যন্ত্রণা ও বেদনাকে ভালবাসে? আর যদি তুমি আমার এই অবস্থার মধ্যে পড়তে তাহলে তুমিও আমার মত সব ন্যায়-নীতি লঙঘন করে সেই যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তিলাভের আশায় এমন এক দূরবর্তী স্থানের সন্ধান করতে যেখানে সমস্ত পীড়ন ও যন্ত্রণা পরিণত হবে আরাম আর স্বাচ্ছন্দ্যে। যেখানে সমস্ত দুঃসহ দুঃখক্লেশ পরিণত হয়ে উঠবে এক নিবিড়তম সুখানুভূতিতে। জানবে আমিও সেই সুখের সন্ধানেই এসেছি এখানে। তোমার মধ্যে আছে শুধু ভাল-মন্দের এক অন্ধবোধ, নেই কোন যুক্তিবোধ। কোন মন্দ বা অশুভ অবস্থার মধ্যে, কোন দুঃখকষ্টের মধ্যে জীবনে পড়নি তুমি।
বল, তুমি কি আমাদের এই অসহনীয় কারাবাস সম্বন্ধে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে? পারবে না। বরং সেই নরকের লৌহদ্বারগুলিকে আরও দৃঢ়ভাবে রুদ্ধ করতে বলবে, যদি তিনি সেখানে আমাদের অবস্থানকে দীর্ঘায়িত করতে চান। এরা আমাকে যেখানে এবং যা করতে দেখেছে তা সত্য। তোমার প্রশ্নের উত্তরে আমি শুধু এই কথাই বলতে চাই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমি কোন ক্ষতি করেছি বা করতে চেয়েছি।
শয়তানের কথা শেষ হলে যোদ্ধাবেশে গ্যাব্রিয়েল মুখে কিছুটা হাসি ফুটিয়ে ঘৃণার সঙ্গে বলল, যে স্বর্গচ্যুত সে কিনা জ্ঞানীর মত বিচার করছে। যে নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নরকে নিক্ষিপ্ত ও নির্বাসিত হয় সে সেই নরকের কারাগার থেকে কোন্ সাহসে পালিয়ে এসেছে এখানে তাকে তা জিজ্ঞাসা করায় আমাদের জ্ঞানের বিচার করছে। তার নির্বাসনদণ্ড অমান্য করে বিনা ছাড়পত্রে নরক থেকে ও নাকি যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে আসাটাকে ও জ্ঞানের পরিচায়ক হিসাবে প্রচার করছে। এইভাবে ও বিধিনির্ধারিত শাস্তিকে পরিহার করে এসেছে জোর করে।
হে দুঃসাহসী বীর, ঠিক আছে, বিচার করে যাও আমাদের। তারপর দেখবে তোমার এই পালিয়ে আসার জন্য দণ্ডদাতার রোষ সাতগুণ হয়ে উঠছে। তোমার নরকবাসের যন্ত্রণা যত তীব্ৰই হোক তাঁর রোষের সমান হতে পারবে না তা কখনো। তাঁর রোষকশায়িত দণ্ড আবার তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে নরকে।
কিন্তু তুমি একা কেন? তোমার নরকবাসী সঙ্গীরা কি নরকের কারাগার ভেঙে পালিয়ে আসেনি? তাদের কাছে কি নরকযন্ত্রণা কম অনুভূত হয়? তাই কি তারা পালিয়ে আসেনি? অথবা তাদের থেকে তোমার সহ্যশক্তি কম? হে সাহসী শয়তানরাজ, যদি তুমি তোমার এই পালিয়ে আসার কারণ তোমার সেই নির্বাসিত অনুচরদের বলতে তাহলে তারা তোমাকে একা আসতে দিত না এখানে। তারাও সকলে নরকযন্ত্রণা হতে মুক্তিলাভের আশায় পালিয়ে আসত এখানে।
তখন শয়তানরাজ আরও কঠোরভাবে কুটি করে বলল, হে অপমানকারী দেবদূত, আমার সহ্যশক্তি কারো থেকে কম নয়, যন্ত্রণার ভয়ে ভীত বা কাতরও নই আমি। তুমি জান আমার শক্তি কতখানি। তুমি দেখেছ একদিন যুদ্ধের মাঝে কেমন ভয়ঙ্কর ও অবিচলভাবে দাঁড়িয়ে সাহায্য করেছিলাম তোমাকে। যে বজ্রগর্জন শুনে ও বজ্রাগ্নি দেখে ভয় পেয়ে সবাই পালিয়ে যায় আমি তাতে ভয় পাইনি। কোন বর্শাফলক ভীত করতে পারেনি আমাকে। আমি ছিলাম নির্ভীক এবং দুর্জয়। তুমি সেকথা জেনেও জানার ভান করছ।
আমি কিন্তু আজও তেমনি নির্ভীক আছি। তাই আমি নতুন কোন আশ্রয়ের সন্ধানে কোন অনুচরকে না পাঠিয়ে নিজে অজানার পথে শূন্যে ঝাঁপ দিই। নিজে কোন বিপদের ঝুঁকি না নিয়ে বসে থেকে আমার অধীনস্থ কারো উপর বিপদের বোঝা চাপিয়ে দিইনি। তাহলে দেখছ, নেতা হিসাবে আমি কতখানি বিশ্বস্ত।
ঈশ্বরের সৃষ্ট এই নতুন জগতে আমাদের নতুন বাসভূমি গড়ে তুলতে চাই আমি। আমার বিপর্যস্ত শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চাই এই পৃথিবীতে। তারই সন্ধানে এসেছি আমি। এই মর্ত্যভূমি অথবা স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝখানে কোন শূন্যলোকে কোন বাসভূমি গড়ে তোলা যায় কিনা তাও দেখব আমি। কিন্তু এ জগতের দখলাধিকার বিনা যুদ্ধে পাব না আমি। তবে তোমাদের কাজ তো শুধু ঈশ্বরের সিংহাসনের চারপাশে দাঁড়িয়ে ঈশ্বরের স্তোত্ৰগান করা। ঈশ্বরের জয়গান গাওয়াই হলো তোমাদের কাজ। যুদ্ধ করা তো তোমাদের কাজ নয়।
তা শুনে দেবদূতসেনা গ্যাব্রিয়েল বলল, কি করে একটা কথা বলে পরমুহূর্তেই তা অস্বীকার করো তুমি? প্রথমে তুমি বললে দুঃসহ নরকযন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরেই পালিয়ে এসেছ তুমি, আবার পরমুহূর্তেই বললে সব বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এক বিশ্বস্ত নেতা হিসাবে নতুন বাসভূমির সন্ধানে এখানে এসেছ এবং কোন যন্ত্রণার ভয়ে ভীত বা নত নও তুমি। কোন নেতার মুখে কখনো এ কথা শোভা পায় না। কোন নেতা এমন কথা বলে না। মিথ্যাবাদীরাই এমন কথা বলে।
শয়তান, তুমি আর যাই বল, ‘বিশ্বস্ততার কথা তুলে বিশ্বস্ততা’ নামক শব্দকে কলুষিত করো না। তুমি বিশ্বস্ত কার কাছে? মোর বিদ্রোহী অনুচরবৃন্দের কাছে। একদল শয়তান যাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত শুধু শয়তানিতে ভরা, তাদের কাছে তোমার সমস্ত শৃংখলাবোধ ও বিশ্বস্ততা সীমাবদ্ধ। যিনি পরম ঈশ্বর, সর্বস্বীকৃত সর্ববন্দিত পরম শক্তি তাঁর প্রতি তোমার সমস্ত সামরিক আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা নস্যাৎ করে তুমি সেই ধর্মভ্রষ্ট, নীতিভ্রষ্ট শয়তাদের কাছে শুধু বিশ্বস্ত? এক সুচতুর ভণ্ডরূপে তুমি আজ মুক্তির দূত হতে চাইছ, অথচ তুমিই একদিন স্বর্গের রাজার কাছে ক্রীতদাসের মত তাঁর প্রতি অনুরক্ত ছিলে এবং তাঁর পদলেহন করতে। তবে কি সেই স্বর্গাধিপতিকে সিংহাসনচ্যুত করে নিজে স্বর্গে রাজত্ব করার জন্যই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলে?
সে যাই হোক, এখন আমার কথা শোন, দূর হয়ে যাও এখান থেকে। যেখান থেকে পালিয়ে এসেছ সেখানেই উড়ে চলে যাও। এই মুহূর্তে যদি তুমি এখান থেকে চলে না যাও, যদি তোমাকে স্বর্গের এই পবিত্র সীমানার মধ্যে দেখতে পাই তাহলে তোমাকে শৃংখলে আবদ্ধ করে টানতে টানতে আমি নরকের কারাগারে দিয়ে আসব। সে কারাগারের দ্বার এমন কঠোরভাবে রুদ্ধ করে আসব যে আর তুমি কোনদিন সে দ্বার ভেঙে কোথাও পালাতে পারবে না।
এইভাবে শয়তানরাজকে ভীতি প্রদর্শন করল গ্যাব্রিয়েল। কিন্তু শয়তান তাতে কর্ণপাত করল না। সে আরও ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, হে চেরাব নামে সীমান্তরক্ষী যদিও দেবদূত, যদিও তুমি আমাকে তোমার বন্দী ভেবে শৃংখলাবদ্ধ করার ভয় দেখাচ্ছ। কিন্তু তাহলে জেনে রেখো, তার থেকেও ভারী আমার লৌহকঠিন বাহুর চাপ সহ্য করতে হবে তোমায়, যদিও স্বর্গের রাজা তোমার পাখার উপর চড়ে গমনাগমন করেন এবং যদিও অন্যান্য দেবদূতদের সঙ্গে তোমাকে স্বর্গের নক্ষত্রখচিত পথের উপর দিয়ে স্বর্গরাজ্যের রথচক্র টেনে নিয়ে যেতে হয়।
শয়তান যখন এইসব বলছিল তখন দেবদূত সেনারা তাদের অস্ত্র শানিয়ে ও বর্শা উঁচিয়ে শয়তানের দিকে এগিয়ে এল। তাদের সামনে নির্ভীক অবস্থায় মনের সমস্ত শক্তি সংহত করে আটনাস পর্বতের মত দাঁড়িয়ে রইল শয়তানরাজ। তার হাতেও ছিল বর্শা এবং বাণ।
সে সময় উভয়পক্ষে যদি যুদ্ধ হত তাহলে হয়ত ধ্বংসের তাণ্ডব নেমে আসত সমগ্র স্বর্গলোকে। সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যেত।
এমন সময় ঈশ্বর একটি দাঁড়িপাল্লা নিয়ে শয়তানের ভাগ্য নির্ধারণ করার জন্য দুদিকে নিক্তি ঝুলিয়ে দাঁড়িপাল্লা ধরে বসলেন। দুটি নিক্তির একটিতে ছিল শয়তানের ভাগ্য আর ভবিষ্যৎ আর একটিতে ছিল স্বর্গের ভাগ্য।
এখন দেখা গেল শয়তানের ভাগ্যের নিক্তিটি হাল্কা হয়ে উঠে গেল অনেকটা।
গ্যাব্রিয়েল ঊর্ধ্বে তাকিয়ে তা দেখে শয়তানকে বলল, শয়তান, আমি জানি তোমার শক্তি কতখানি এবং তুমিও জান আমার শক্তি কতদূর। সুতরাং আর অস্ত্র নিয়ে আস্ফালন করে লাভ কি? কারণ আমাদের সকল শক্তিই ঈশ্বরের অধীন। তিনি ইচ্ছা করলে আমাদের সকল শক্তির উচ্ছ্বাসকে স্তব্ধ করে দিতে পারেন মুহূর্তে। যদি একবার প্রমাণ চাও তাহলে ঊর্ধ্বে তাকিয়ে দেখ। দেখ ঈশ্বরের দ্বারা বিধৃত দাঁড়িপাল্লায় তোমার ভাগ্যের দিকটি কত হাল্কা, কতখানি তা উপরে উঠে গেছে। তুমি বাধা দিতে চেষ্টা করলেও আসলে তোমার প্রভুত্বশক্তি কত কম।
শয়তানরাজ তা দেখেই নিজের অবস্থার কথা বুঝতে পেরে সেই মুহূর্তেই ক্ষোভের সঙ্গে বিড়বিড় করে কি বলতে বলতে পালিয়ে গেল স্বর্গলোক থেকে। তার সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্হিত হলো রাত্রির অন্ধকার।
০৪র্থ সর্গ
চতুর্থ সর্গ
রাত্রিশেষে গোলাপী আলোর আভা পূর্বাকাশে ফুটে উঠতেই ঘুম থেকে জেগে উঠল আদম। প্রতিদিন এই সময়েই ওঠে সে। প্রতিদিন সকালে মৃদু বাতাসে গাছের পাতাগুলো যখন পতপত্ শব্দ করতে থাকে, যখন সকালের আলো আকাশ থেকে মুক্তোর মত ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, যখন নদী ও ঝর্ণার জলধারাগুলি বয়ে যেতে থাকে কলকল শব্দে, যখন গাছের শাখায় শাখায় পাখিরা গান গাইতে থাকে তখনি ঘুম থেকে জেগে ওঠে আদম। তার সঙ্গে সঙ্গে ঈভও জেগে ওঠে।
কিন্তু সেদিন উঠে এক বিরল ব্যতিক্রম দেখল ঈভের জীবনে। দেখল, ঈভ তখনো ওঠেনি ঘুম থেকে। তার বিস্ত কেশপাশ মাথার চারদিকে ছড়িয়ে আছে। তার নিটোল মসৃণ গালদুটো কচক করছিল। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল রাত্রিতে তার ভাল ঘুম হয়নি বলেই সে এখনো ঘুমোচ্ছে।
আদম তখন ঘুমন্ত ঈভের উপর ঝুঁকে পড়ে দাম্পত্য প্রেমের মাধুর্যমণ্ডিত দৃষ্টিতে তার পানে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল তার সরল স্বাভাবিক সৌন্দর্যে। ঘুমন্ত বা জাগ্রত অবস্থায় সকল সময়ে একই সুষমার দ্যুতি বিকীরণ করে।
আদম এবার জেফাইরাস যেমন একদিন ফ্লোরাকে ডেকেছিল মৃদুস্বরে ঈভের কোমল হাতটি স্পর্শ করে সেও ডাকলো, হে আমার সুন্দরী প্রিয়তমা, আমার প্রিয়তমা পত্নী ওঠ, জাগো। তুমি ঈশ্বরের সর্বোত্তম দান, আমার আনন্দপ্রতিমা। তুমি জাগো, ওঠ, প্রভাতসূর্য নবীন কিরণ জাল বিস্তার করছেন। সজীব শস্যক্ষেত্র আমাদের ডাকছে। এখন না গেলে কিভাবে আমাদের রোপিত চারাগাছগুলি বেড়ে উঠছে, কিভাবে বাতাসে কুঞ্জবনগুলি কঁপছে, কিভাবে প্রকৃতির বিচিত্র বর্ণে পাহাড় কাঁপছে, পর্বত, বন, প্রান্তর, সব কিছুকে রঞ্জিত করে দিয়েছে, কেমন করে মধুমক্ষিকাগুলি প্রস্ফুটিত ফুলের উপর বসে তার থেকে নির্যাস বার করে তা পান করছে–তা আমরা দেখতে পাব না।
এইভাবে ঈভের কানে কানে মৃদুস্বরে কথা বলে তাকে জাগিয়ে তুলল। জেগে উঠেই ঈভ আদমের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে তাকে আলিঙ্গন করে বলল, হে আমার সকল গৌরবের একমাত্র বস্তু, আমার সকল পূর্ণতার মূর্ত প্রতীক, তোমার মধ্যেই আমার সকল চিন্তা-ভাবনা কেন্দ্রীভূত। প্রভাতের আলোয় তোমাকে প্রথম দেখে আনন্দিত হলাম। গতরাত্রির মত ভয়ঙ্কর রাত্রি জীবনে কখনো যাপন করিনি আমি।
গতরাত্রে আমি এমন এক আশ্চর্য স্বপ্ন দেখেছি যে স্বপ্ন আমি আর কখনো দেখিনি। সাধারণত তোমারই স্বপ্ন দেখি, সারাদিনের কাজের স্বপ্ন, অথবা পরবর্তী দিনের কাজের পরিকল্পনার স্বপ্ন। গতরাতে আমি দেখেছি যত সব বিপজ্জনক অপরাধজনক কামনা-বাসনার স্বপ্ন, যার কথা এর আগে আর কোনদিন মনে আসেনি আমার।
আমি স্বপ্নে দেখলাম কে যেন আমার কানে কানে মৃদুস্বরে তার সঙ্গে হাঁটতে বলছে। আমি ভাবলাম তুমি। সে বলল, কেন ঘুমোচ্ছ ঈভ, শান্ত স্তব্ধ রাত্রির মনোরম
অবকাশে যখন পূর্ণচন্দ্রের আলো বনচ্ছায়ার জালগুলিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে প্রতিভাত করে তুলছে বিভিন্ন বস্তুর মুখগুলিকে, যখন রাতের পাখিরা ঢেলে দিচ্ছে সুমধুর প্রেমসঙ্গীতের ধারা, তখন কেউ যদি এসব না দেখে তাহলে ঈশ্বরের জাগ্রত দৃষ্টি তোমাকে ছাড়া আর কাকে দেখতে পাবে? হে প্রকৃতির কামনার বস্তু, তুমি ছাড়া আর কাকে সকল জীব দেখবে, আর কাকে দেখে এত আনন্দ পাবে?
তুমি ডাকছ ভেবে আমি উঠে পড়ি, কিন্তু তোমাকে দেখতে না পেয়ে তোমাকে দেখার জন্য হাঁটতে শুরু করি। আমার তখন মনে হচ্ছিল আমি একাই হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে এমন একটি পথ ধরলাম যে পথ আমাকে সেই জ্ঞানবৃক্ষের কাছে। নিয়ে গেল।
দিনেতে যেমন দেখি তার থেকেও তখন সুন্দর লাগছিল গাছটিকে। আমি যখন দেখছিলাম ঠিক সেই সময় স্বর্গের দেবদূতের মত পাখাওয়ালা এক মূর্তি যাকে আমরা প্রায়ই দেখতে পাই এবং যার শিশিরসিক্ত কেশপাশ থেকে অমৃতের মধু ঝরে পড়ছিল, সেই জ্ঞানবৃক্ষের তলায় দাঁড়িয়ে সেও গাছটির দিকে তাকিয়ে ছিল। সে বলতে লাগল, হে সুন্দরী ফলবতী বৃক্ষ, তুমি কাউকে কখনো তোমার ফল আস্বাদন করতে দাও না। কাউকে দান করো না তোমার ফল। দেবতা বা মানুষ কাউকে না। জ্ঞান কি এতই তুচ্ছ যে তা লাভ করার উপযুক্ত নয় অথবা তা কি এতই মূল্যবান যে তা সকলের জন্য নয়? অথবা এ বৃক্ষের স্রষ্টা কি ঈর্ষাবশত অন্যের জন্য এর ফলকে নিষিদ্ধ করে রেখেছেন? কিন্তু যেই তা নিষিদ্ধ করে রাখুক, আমাকে আর কেউ তোমার এই প্রসারিত বাহুবিধৃত ফল থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না।
এই বলে সে তার দুঃসাহসী হাতদুটি বাড়িয়ে সেই জ্ঞানবৃক্ষ হতে ফল তুলে খেতে লাগল।
তার এই অসমসাহসিক কথা ও কাজ দেখে ভয়ে হিমশীতল হয়ে উঠল আমার দেহ।
কিন্তু সে তখন আনন্দে উল্লসিত হয়ে বলতে লাগল আবার, হে স্বর্গীয় ফল, তুমি এমনিতেই মধুর, কিন্তু তুমি নিষিদ্ধ বলে তোমাকে এইভাবে গোপনে তুলে খেতে আরও মধুর মনে হচ্ছে। মনে হয় তুমি যেন শুধু দেবতারই ভক্ষণযোগ্য, তবু তোমার এ ফল ভক্ষণ করলে মানুষও দেবতা হয়ে উঠতে পারে। আর মানুষরাই বা ভক্ষণ করবে না কেন? জ্ঞানের মত ভাল জিনিস যতই প্রচারিত হয় ততই ভাল, সে ফল যত বেশি উৎপন্ন হয় ততই ভাল, তাতে তার স্রষ্টা ঈশ্বরের গৌরবহানি হয় না কিছুমাত্র। বরং তাতে বেড়ে যায় তার গৌরব ও সম্মান।
হে দেবদূতোপম সুন্দরী ঈভ, সুখী প্রাণী, তুমিও আমার মত ফল ভক্ষণ করো, যদিও তুমি সুখী, এই ফল ভক্ষণে আরও সুখী হবে। আরও যোগ্য হয়ে উঠবে সবদিক দিয়ে। এই ফল ভক্ষণ করার সঙ্গে সঙ্গে তুমিও দেবতাদের মাঝে এক দেবী হয়ে উঠবে। শুধু মর্ত্যভূমির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে না। তুমি তখন আমাদের মত কখনো শূন্যপথে উড়ে বেড়াতে পারবে, কখনো স্বর্গলোকে উঠতে পারবে। সেখানে উঠে দেখতে পাবে দেবতারা স্বর্গে কি ধরনের জীবন যাপন করে। তুমিও তাদের মতোই স্বর্গীয় সুষমায় পূর্ণ এক দৈব জীবন যাপন করতে পারবে।
এই বলে সে আমাকে ধরে টেনে নিয়ে আমার মুখের উপর সেই ফলের এক অংশ তুলে ধরল। জ্ঞানবৃক্ষ হতে সে ফলটি তুলে সে খাচ্ছিল তখন। সেই ফলের সুমধুর গন্ধে আমার মধ্যে এমনই ক্ষুধার উদ্রেক হলো যে আমি তা না খেয়ে পারলাম না। সে ফলের রস আস্বাদন করার মুহূর্তমধ্যে সেই মূর্তির সঙ্গে আমি মেঘের উপর উঠে পড়লাম। তার তলদেশে দেখলাম অন্তহীন বৈচিত্র্যে প্রসারিত হয়ে আছে এই মহাপৃথিবী। আমার এই আকস্মিক পরিবন ও সমুন্নতি দেখে আমার সেই পথপ্রদর্শক সহসা অন্তর্হিত হয়ে গেল কোথায়। আমার তখন মনে হলো আমি যেন পড়ে যাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
তারপর জেগে উঠে যখন বুঝলাম সবই স্বপ্ন তখন আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে কত আনন্দ পেলাম।
এইভাবে ঈভ তার গতরাত্রির অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করলে আদম বলতে লাগল, হে আমার অন্তরের থেকে প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী, আমার প্রতিমূর্তি, গতরাত্রিতে নিদ্রাকালে তোমার দেখা দুঃস্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নজনিত ক্লেশ আমাকেও তোমার মত সমানভাবে বিব্রত করে তুলছে। কোন অশুভ শক্তির দ্বারা উৎপন্ন এই কুৎসিত স্বপ্নকে আমিও মেনে নিতে পারছি না। আমার ভয় হচ্ছে। কিন্তু পবিত্রতার মূর্ত প্রতীকরূপে সৃষ্ট তুমি। তোমার মধ্যে তো কোন অশুভ শক্তি স্থান পেতে পারে না। কিন্তু জেনে রেখো, মানুষের আত্মার মধ্যে এমন কতকগুলি হীন অন্তরবৃত্তি আছে যারা যুক্তিকেই তাদের একমাত্র প্রভুরূপে সেবা করে। এই অন্তরবৃত্তিগুলির মধ্যে কল্পনা হচ্ছে প্রধান, যুক্তির পরেই যার স্থান। আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় বহির্জগতের সকল বস্তুর প্রতিনিধিত্ব করে মনের সঙ্গে তাদের সংযোগসাধন করে, তাদের সাহায্যেই অলীক কল্পনার সৃষ্টি হয় আমাদের মনে। এই কল্পনার সঙ্গে যুক্তিযুক্ত বা নিযুক্ত হয়ে জ্ঞান বা মতামতের সৃষ্টি করে যার দ্বারা আমরা কোন বস্তু বা ঘটনাকে স্বীকার বা অস্বীকার করি।
রাত্রিতে স্তব্ধ অবকাশে মানুষের নিদ্রাকালে তার যুক্তি আর জ্ঞানও বিশ্রামলাভ করে তার গোপন কক্ষে। কিন্তু মাঝে মাঝে সহসা কল্পনা জাগ্রত হয়ে যুক্তি ও জ্ঞানকে জাগ্রত করে স্বপ্নের মধ্যে কতকগুলি অসংগঠিত মূর্তির উদ্ভব ঘটায় এবং উদ্ধত ক্রিয়ার সৃষ্টি করে। স্বপ্নে দেখা অসংলগ্ন অসঙ্গত কথা ও ক্রিয়াসমূহের মধ্যে আমার সুদূর বা অদূরবর্তী অতীতের কথা ও কাজের কিছু সাদৃশ্য খুঁজে পাই ঠিক। কিন্তু তার বাইরেও কিছু অদ্ভুত কথা ও কাজের ব্যাপার থাকে। তথাপি এতে বিষণ্ণ হবার কোন কারণ নেই। কারণ দেবতা বা মানুষের মনের মধ্যে অশুভ শক্তি আসে এবং যায় কিন্তু তা কোন সমর্থন পায় না সে মনে। কোন দোষ বা কলঙ্কের চিহ্ন রেখে যেতে পারে না সে শক্তি। এটাই হচ্ছে আশার কথা আমার পক্ষে।
নিদ্রাকালে স্বপ্নের মধ্যেও যে কাজ করতে তুমি ঘৃণাবোধ করেছিলে, নিশ্চয় সে কাজ করতে চাইবে না তুমি। সুতরাং হতাশ হয়ো না। প্রথম প্রভাতের হাস্যোজ্জ্বল কিরণমালা যখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে তখন তোমার যে দৃষ্টি সবচেয়ে আনন্দময় ও প্রশান্ত থাকে সে দৃষ্টিকে বিষাদের কুটিল মেঘের দ্বারা আচ্ছন্ন করে তুলল না। তার থেকে বরং যখন প্রস্ফুটিত কুসুমরাজি তাদের সারারাত্রি সঞ্চিত সুগন্ধিরাশি বনে, প্রান্তরে ও ঝর্ণাধারায় ঢেলে দিচ্ছে তখন আমরা নূতন উদ্যমে চলে গিয়ে কাজ শুরু করি।
এইভাবে তার সুন্দরী স্ত্রীকে উৎফুল্ল করে তোলার চেষ্টা করল আদম। ঈভও তাতে কিছুটা উৎফুল্ল হলো। কিন্তু নিঃশব্দে একটি করে শান্ত অশ্রুবিন্দু ঝরে পড়ল তার দুচোখ থেকে এবং সে তার আলম্বিত কেশপাশ দিয়ে তা মুছে ফেলল সঙ্গে সঙ্গে।
আরো দুটি স্ফটিকস্বচ্ছ অশ্রুবিন্দু ঝরে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল ঈভের চোখে। কিন্তু তারা ঝরে পড়ার আগেই এক মধুর সমবেদনার প্রতীকচিহ্ন হিসাবে এক নিবিড় চুম্বনের দ্বারা আদম মুছে দিল সে অশ্রুবিন্দুটিকে।
এইভাবে সকল দুঃস্বপ্নজনিত সকল দুশ্চিন্তার অবসান ঘটল। তারা তাড়াতাড়ি মাঠে কাজ করতে চলে গেল। কিন্তু কাজ শুরু করার আগে তারা ছায়াচ্ছন্ন কুঞ্জবন হতে নবোদিত সূর্যের শিশিরসিক্ত আলোয় এসে দাঁড়িয়েই প্রথমে তারা নত হয়ে স্বতস্ফূর্ত উচ্চারণে গদ্যে ও পদ্যে মিলিয়ে প্রভাতের স্তোত্ৰগান শুরু করল। এক আধ্যাত্মিক আবেগের আতিশয্যে তাদের কণ্ঠ হতে স্বতস্ফূর্তভাবে নিঃসৃত সেই প্রার্থনাসঙ্গীত বীণা বা কোন বাদ্যযন্ত্রসহযোগে গীত না হলেও কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়নি তার মাধুর্য।
পরমস্রষ্টার উদ্দেশ্যে উচ্চারিত সেই স্তোত্ৰগানে তারা বলল, হে পরম মঙ্গলময়, সর্বশক্তিমান, এইসব সুন্দর বস্তুরাজিই তোমার গৌরবময় সৃষ্টি, এই হলো তোমার বিশ্বব্যাপী রূপ। তোমার সৃষ্টি এইসব বস্তু যদি এত সুন্দর ও বিস্ময়কর হয় তাহলে তুমি নিজে কত না সুন্দর ও বিস্ময়কর।
তোমার রূপ ও গুণ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তুমি অবর্ণনীয়রূপে স্বর্গের ঊর্ধ্বলোকে সতত অধিষ্ঠিত থাকায় অপরিদৃশ্য অথবা অস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান আমাদের কাছে। এইসব সুন্দর বস্তু তোমার নিম্নমানের সৃষ্টি হলেও এই সব সৃষ্টি তোমার অচিন্ত্যনীয় সততা, তোমার শুভপ্রদায়িনী ও ঐশ্বরিক শক্তির কথাই ঘোষণা করে। আলোর সন্তান হে দেবদূতবৃন্দ, ঈশ্বরের অবর্ণনীয় মহিমার কথা তোমরাই সবচেয়ে ভাল করে ব্যক্ত করতে পার। কারণ তোমরাই তাঁর দর্শনলাভে ধন্য এবং স্বর্গে তাঁর সিংহাসনের চারপাশে রাত্রিবিহীন অবিচ্ছিন্ন দিবালোকে সতত সমবেত হয়ে সমস্বরে এক সুমধুর ঐকতানে তাঁর জয়গান গেয়ে থাক।
হে মর্ত্যবাসী সকল জীব, তোমরাও ঈশ্বরের অনন্ত গৌরবগানে যোগদান করো সকলে। সে গানের যেন আদি, অন্ত, মধ্য বলে কিছু না থাকে। সে সঙ্গীতের সুরলহরী যেন অনাদ্যন্ত ধারায় চিরপ্রবাহিত হতে থাকে সারা জগতে।
রাত্রিশেষে উদিত সমস্ত নক্ষত্ৰকুলের মধ্যে সুন্দরতম ধ্রুবতারা, তুমিই তোমার স্থির উজ্জ্বল জ্যোতির দ্বারা ঊষাকালকে দ্যোতিত করো। তুমি প্রত্যুষে ঈশ্বরের জয়গান করো তোমার কক্ষপথে।
হে জগচ্চক্ষু ও জগতাত্মা দিবাকর, সেই সর্বশক্তিমান পরমেশ্বরকে তোমার প্রভু বলে স্বীকার করে। তার প্রার্থনা গান করো। যখন তুমি উদিত হও, যখন তুমি মধ্যাহ্ন গগনে ভাস্বর হয়ে ওঠ ভাস্বর মহিমায় অথবা তুমি যখন অস্তাচলে অধোগমন করো–সব সময় সব অবস্থাতেই তুমি তোমার শাশ্বত কক্ষপথে ঈশ্বরের গৌরবগান করো।
হে নক্ষত্রমণ্ডলমধ্যবর্তী চন্দ্র, যিনি অন্ধকার হতে আলোর সৃষ্টি করেন সেই পরমস্রষ্টার গুণগান করো।
বায়ুসহ হে পঞ্চমহাভূত, তোমরাই প্রকৃতির গর্ভজাত আদি সৃষ্টি, তোমরা বিচিত্ররূপে বিরাজিত হয়ে বিশ্বের সকল বস্তুকে লালন করো। অন্তহীন বিরামহীন রূপ পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আমাদের মহান স্রষ্টার জয়গান করো।
পাহাড় ও উত্তপ্ত জলরাশি হতে উখিত হে কুয়াশা ও বাষ্পরাশি, বিশ্বস্রষ্টার সম্মানে উদিত হয়ে সূর্য যতক্ষণ পর্যন্ত না ধূসরবর্ণের তোমাদের দেহগুলিকে সোনালী বর্ণে অণুরঞ্জিত করে দেয় ততক্ষণ বিরাজিত থাকবে তুমি। বর্ণহীন আকাশ মেঘের বা প্রান্তরভাগগুলি পরিশোভিত করার জন্যই হোক, বা তৃষ্ণার্ত পৃথিবীতে কয়েক পশলা বৃষ্টির দ্বারা বারিসিক্ত করার জন্যই হোক বা যে কোন কারণেই তোমাদের উৎপত্তি হোক না কেন, তোমরা উখানে-পতনে সমানভাবে ঈশ্বরের সেবা করে যাও, তাঁর গুণগান করো।
হে বাতাস, তুমি তাঁরই গৌরবগান চারদিকে প্রবাহিত হয়ে ছড়িয়ে দাও। হে পাইনগাছ, অন্যান্য গাছপালার সঙ্গে তোমরা তোমাদের মাথা নেড়ে তারই গৌরবগান ধ্বনিত করো সশব্দে। হে ঝর্ণাধারা, তোমরা কলশব্দে তারই গুণগান করো। হে পাখিরা, তোমরাও সকল জীবের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ঈশ্বরের প্রার্থনাস্তোত্র গাও। তোমাদের সেই স্তোত্রের সম্মিলিত সুরধারা স্বর্গাভিমুখে উৎক্রমণ করুক। তোমরা পাখা মেলে চারদিকে উড়ে বেড়িয়ে মধুর কলকাকলির মাধ্যমে তাঁর গুণগান করো। আকাশ-বাতাস পূর্ণ হোক সে গানে।
হে জলচর, স্থলচর, উভচর ও সরীসৃপ জাতীয় জীবকুল, তোমরা দেখ, আমি সকাল-সন্ধ্যায় পাহাড়ে-পর্বতে, উপত্যকায় বা নদীতটে যেখানেই যখন থাকি না কেন, জঙ্গম সকল বস্তুকেই তাঁর গুণগান করতে শেখাই।
হে বিশ্বস্রষ্টা, জগৎপতি, তুমি আমাদের মঙ্গলদান করো। অশুভ শক্তির কুটিল অন্ধকার কালরাত্রির মতো আমাদের চারদিকে যতই ঘন হয়ে উঠুক না কেন, আলো যেমন অন্ধকারকে অপসৃত করে তেমনি তুমিও আমাদের চারদিকে ঘনীভূত সে অন্ধকারকে বিদূরিত করো।
এইভাবে সেই আদি পিতামাতা নির্মল নিষ্কলুষ অন্তঃকরণে ঈশ্বরের প্রার্থনা গান করল। আবার এক অনাবিল প্রশান্তি প্রতিষ্ঠিত হলো তাদের অন্তরে। তখন তারা মাঠে তাদের কাজে চলে গেল। যে সব ফলবতী গাছের শাখাগুলি অত্যধিক বেড়ে গিয়ে অন্যান্য গাছগুলিকে উদ্ধতভাবে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছিল তাদের সেই সব শাখাগুলিকে কিছুটা করে ছেটে দিল তারা। আঙ্গুরের লতাগুলিকে এলম গাছের সঙ্গে জড়িয়ে দিল। বিবারে যৌতুকস্বরূপ গুচ্ছ গুচ্ছ ফলের উপহার দিয়ে আঙ্গুর লতাগুলি দুহাত বাড়িয়ে এলম গাছগুলিকে বিবাহের বর হিসাবে বরণ করে নিতে চাইছিল যেন। আদম ও ঈভ তাদের সাহায্য করছিল।
স্বর্গাধিপতি ঈশ্বর আদম ও ঈভকে এইভাবে কর্মে নিযুক্ত দেখে রাফায়েল নামে একজন দেবদূতকে ডাকলেন। রাফায়েল তোরিয়াস নামে এক মেয়ে দেবদূতকে বিয়ে করে তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াত।
ঈশ্বর রাফায়েলকে ডেকে বললেন, তুমি হয়ত শুনেছ শয়তানদের রাজা অন্ধকার নরকপ্রদেশ থেকে পালিয়ে শূন্যপথে স্বর্গে এসে উঠেছে, মর্ত্যে সে বিচরণ করছে। গত রাতে সে সমগ্র মানবজাতির সর্বনাশ সাধনের জন্য আদি মানবপিতা ও মানবতার সুখনিদ্রাকে ব্যাহত করার চেষ্টা করেছিল। তুমি আজ তাদের কাছে গিয়ে আজকের মত কাজ থেকে বিরত হয়ে তাদের বিশ্রাম নিতে বল। তুমি আদমের সঙ্গে বন্ধুভাবে কথা বলবে। কোন এক ছায়াচ্ছন্ন কুঞ্জবনে তাদের কাছে বসবে।
এমনভাবে তার সঙ্গে কথা বলবে যাতে সে বুঝতে পারে তার এই সুখী জীবন সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে তার স্বাধীন ইচ্ছার উপরে। সে যেন বুঝতে পারে তার নিজের ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন হলেও তা পরিবর্তনযোগ্য। তাকে সাবধান করে দেবে কথাপ্রসঙ্গে সে যেন তার এই স্বাধীন ইচ্ছাকে সতত অবিচলিত ও অপরিবর্তনীয় রাখতে পারে।
সেই সঙ্গে তার বিপদের কথাটাও বলে দেবে। তার সে বিপদটা কোন্ দিক থেকে আসতে পারে সেটাও বুঝিয়ে দেবে। বলবে তার শত্রু কে। তার সেই শত্রু স্বর্গ থেকে বিতাড়িত ও নরকে নির্বাসিত হবার পর সে পালিয়ে এসে মানবজাতির বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। সে চাইছে তার মত মানবজাতিরও পতন ঘটুক। সে কিন্তু কোনরকম বলপ্রয়োগ করবে না। কারণ সে জানে তাতে সে বাধা পাবে। এ ব্যাপারে সে শুধু মিথ্যা ও ছলনার আশ্রয় নেবে।
আদমকে সাবধান করবে এ বিষয়ে, সে যেন স্বেচ্ছায় ন্যায়নীতি লঙ্ঘন করে পরে সে কিছু জানত না বলে অজুহাত না দেখায়।
এই বলে পরম পিতা রাফায়েলকে যাবার নির্দেশ দিলেন। রাফায়েলও আর দেরি না করে রওনা হয়ে পড়ল। অসংখ্য দেবদূতের মাঝখানে সে দাঁড়িয়ে ছিল। ঈশ্বরের আদেশ পেয়ে সে তার বিরাট পাখা মেলে আকাশপথে উড়ে গেল। স্বর্গদ্বারের কাছে গিয়ে একবার থামল সে। রুদ্ধদ্বার সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল। পরম স্থপতিরূপে ঈশ্বর এমনইভাবে স্বর্গদ্বারের সোনার স্প্রিং দেওয়া দরজাটি নির্মাণ করেন।
স্বর্গের দ্বারপথ পার হয়ে আবার উড়ে চলল রাফায়েল। কোন মেঘ বা নক্ষত্র কোন বাধা সৃষ্টি করল না তার গতিপথে। রাফায়েল অন্যান্য উজ্জ্বল গ্রহগুলির মত পৃথিবী ও স্বর্গের উদ্যানটিকে দেখতে পেল। রাত্রিতে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে যেমন চাঁদের মধ্যবর্তী ভূমিখণ্ডকে দেখা যায়, নাবিকরা যেমন সমুদ্র থেকে দক্ষিণ ঈজিয়ান দ্বীপগুলির মধ্যে ভেলস ও সামসকে অস্পষ্টভাবে দেখতে পায় তেমনি অস্পষ্টভাবে রাফায়েল দূরের আকাশ হতে অরণ্যাচ্ছাদিত পাহাড় ঘেরা ইডেনের উদ্যানটিকে দেখতে পেল।
গতিটার বেগ কমিয়ে দিয়ে স্বর্গলোকের পূর্বদিকে অবতরণ করল রাফায়েল। একটা পাহাড়ের উপর নেমেই তার নিজের আসল মূর্তি ধারণ করল। তার স্বর্গীয় পোশাকটা ঢাকার জন্য দুটো পাখা ধারণ করল সে দেহের বিভিন্ন জায়গায়। একজোড়া কাঁধে, একজোড়া বুকে আর একজোড়া জানুতে বেঁধে নিল। তাতে পায়ের আর গোড়ালিদুটো ঢাকা পড়ে গেল।
এইভাবে ছয়টি পাখাদ্বারা তার দেহটিকে যুক্ত করে মাইয়ার পুত্র হামিসের মত দাঁড়িয়ে রইল রাফায়েল। তার পাখার পালক থেকে এক সুগন্ধ নির্গত হয়ে চারদিক আমোদিত করে তুলল।
যে সব দেবদূত সেখানে পাহারা দিচ্ছিল আগে হতে তাদের দলের সবাইকে একনজরে চিনতে পারল রাফায়েল। তারাও তাকে দেখে বুঝতে পারল স্বর্গীয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোন নির্দেশ বা কোন বাণী নিয়ে এসেছে সে।
প্রহরারত দেবদূতদের শিবিরের চকচকে তাঁবুগুলির মধ্যে দিয়ে স্বর্গোদ্যানের সেই মনোরম ছায়াচ্ছন্ন কুঞ্জবনে চলে গেল রাফায়েল। বিচিত্র ফুলের গন্ধভরা সেই কুঞ্জবনে চিরবসন্তের বর্ণগন্ধময় বিচিত্র শোভায় শোভিত প্রকৃতি বিরাজ করছিল উজ্জ্বল মহিমায়। সেখানে অনন্ত সুখ ছিল সতত লীলায়িত।
আকাশে প্রদীপ্তভাস্বর সূর্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে তাপ বিকীরণ করছিল তা মর্ত্যভূমির মাটির গর্ভে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে মাটিকে উত্তপ্ত করে তোলায় কুঞ্জবনের দ্বারপথে শীতল ছায়াতলে বসেছিল আদম। রাফায়েলকে দেখতে পেয়েই এগিয়ে এল সে। ঈভ তখন কুঞ্জবনের ভিতরে থেকে তাদের মধ্যাহ্নভোজনের ব্যবস্থা করছিল। তাদের ক্ষুধাতৃপ্তির জন্য নানারকমের সুস্বাদু রসাল ফল সে সাজিয়ে রাখছিল। এই সব ফল খেয়ে তারা নিকটবর্তী কোন ঝর্ণা থেকে দুধের মত জলপান করে তৃষ্ণা মেটায়।
দূরে এক দেবদূতকে আসতে দেখে ঈভকে ব্যস্ত হয়ে ডাকল আদম। বলল, এখানে এস ঈভ, পূর্বদিকে একবার চেয়ে দেখ। কি এক উজ্জ্বল মূর্তি আমাদের এই দিকে আসছে। মনে হচ্ছে বেলা দ্বিপ্রহরে অসময়ে এক চাঁদ উঠেছে আকাশে। আর সেই চাঁদ নেমে আসছে আকাশ থেকে। নিশ্চয় কোন দেবদূত স্বর্গ থেকে কোন বাণী নিয়ে আসছে আমাদের জন্য। ঐ স্বর্গীয় অতিথিকে যথাযথভাবে আপ্যায়িত ও প্রীত করার জন্য তাড়াতাড়ি করে তোমার ভাঁড়ারে কি সব ফলমূল আছে দেখ। না থাকে সংগ্রহ করে রাখ। প্রকৃতিজাত ফলমূল কখনো ফুরোয় না। প্রকৃতি যতই ফল দান করে ততই তা জন্মায়।
তা শুনে ঈভ আদমকে বলল, প্রকৃতি জগতে সকল ঋতুতেই প্রচুর পাকা ফল পাওয়া যায়। আমি প্রতিটি বৃক্ষশাখায় ঝুলতে থাকা ভাল ভাল রসাল ফল তুলে এনে তা আমাদের সম্মানীয় দেবদূত-অতিথিকে প্রদান করব। সেইসব ফল ভক্ষণ করে তিনি যেন স্বীকার করতে বাধ্য হন স্বর্গের মত এই মর্ত্যলোকেও ঈশ্বরের দানের সীমা নেই।
এই কথা বলে একমাত্র অতিথিসেবার কথা ভাবতে ভাবতে ব্যস্ত হয়ে ফলবতী বৃক্ষগুলির দিকে চলে গেল ঈভ। অনেক ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বৃক্ষশাখা থেকে অনেক পাকা রসাল ফল তুলল ঈভ। সেগুলি একটি পাত্রে করে নিয়ে কিছু সুগন্ধি গোলাপ ফুল তুলে পথে ছড়াতে ছড়াতে কুঞ্জমাঝে ফিরে এল সে।
ইতিমধ্যে আমাদের মহান আদিপিতা সেই দেবোপম অতিথিকে সাদর অভ্যর্থনা জানাবার জন্য এগিয়ে গেল। তার নিজস্ব কতকগুলি গুণ ছাড়া কোন অনুচর ছিল না তার সঙ্গে। সে ছিল একা। কিন্তু সে একা হলেও এবং তার অভ্যর্থনায় কোন জাঁকজমক না থাকলেও তা ছিল রাজা-মহারাজের জানানো জাঁকজমক ও প্রভূত ঐশ্বর্যসম্পন্ন অভ্যর্থনার থেকে অনেক ভাল। তা ছিল সরল, স্বাভাবিক এবং গুরুগম্ভীর। কোন কৃত্রিমতা বা অহেতুক কোন উচ্ছ্বাস ছিল না তার মধ্যে।
রাফায়েল কাছে এসে গেলে ভীত না হলেও শ্রদ্ধাবনত চিত্তে ননত ভঙ্গিতে তার সামনে এসে দাঁড়াল আদম। তারপর বলতে লাগল, হে স্বর্গাধিবাসী, স্বর্গ ছাড়া আর কোন লোক এমন উজ্জ্বল মূর্তি ধারণ করতে পারে? স্বর্গলোক ছেড়ে কিছুক্ষণের জন্য তুমি যে আমাদের মত এক মানবদম্পতিকে মনে করে তাদের সাহচর্য দান করতে এসেছ, এজন্য কি বলে ধন্যবাদ দেব তোমায়? এই মাঠটুকু ঈশ্বর আমাদের দান করেছেন। এই মাঠেই আমরা কাজ করি। তবে দুপুরের এই দুঃসহ তাপটা না কমা পর্যন্ত আমরা এই কুঞ্জেই বিশ্রাম করি।
আগন্তুক দেবদূত রাফায়েল তখন বলল, হ্যাঁ আদম, আমি তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ যাপন করার জন্যই এসেছি এখানে। তোমরা এই মনোরম উদ্যানে ও ভূখণ্ডে বাস করলেও স্বর্গের দেবদূতরা মাঝে মাঝে প্রায়ই আসবে তোমাদের কাছে। এখন তোমার ঐ ছায়াশীতল কুঞ্জে চল। আমি এই দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকব তোমার কাছে।
আদম তখন তার কুসুমদামসজ্জিত ও সুবাসিত কুঞ্জমাঝে নিয়ে গেল রাফায়েলকে। ঈভের কিন্তু কোন সাজসজ্জাই ছিল না। তার নগ্ন দেহটি ছিল প্রকৃতিদত্ত স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও লাবণ্যে সমৃদ্ধ। তবু তাকে বনপরী ও যে তিনজন পরমাসুন্দরী দেবী একদিন আইডা পর্বতে রাখালবেশি প্যারিসের কাছে তাদের সৌন্দর্য বিচারের জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁদের সকলের থেকে সুন্দরী দেখাচ্ছিল। পরম রূপবতী ও গুণবতী ঈভের মাথায় কোন বস্ত্রের অবগুণ্ঠন ছিল না, মনে কোন দুর্বলতা ছিল না, গণ্ডদ্বয়ের উপর লজ্জার অরুণ আভা ছিল।
তাকে দেখে দেবদূত রাফায়েল সম্মানের সঙ্গে অভিবাদন করে বলল, হে মানবজাতির মাতা, তোমার ফলবতী গর্ভ হতে জাত সন্তানদের দ্বারা সমগ্র জগৎ হবে একদিন পরিপূর্ণ। তারা সংখ্যায় এইসব গাছের ফলের থেকেও বেশি।
তৃণাচ্ছন্ন একটি মাটির উচ্চ টিপি তাদের খাবার টেবিলের কাজ করল। সেই কুঞ্জে বসন্ত ও শরৎ যেন হাত ধরাধরি করে নাচছিল। কথাবার্তা বা আলাপ-আলোচনার আগে তাদের ভোজনপর্ব সেরে ফেলার জন্য আদিপিতা আদম বলল, হে স্বর্গীয় অতিথি, এই সব ফল ভক্ষণ করুন। পরম পিতা ঈশ্বরের ইচ্ছায় এইসব সুস্বাদু ফল প্রচুর পরিমাণে মর্ত্যভূমিতে জন্মায়। এ সবই আমাদের পরম পিতার দান।
তখন দেবদূত রাফায়েল বলল, পরম গৌরবময় ঈশ্বর-সৃষ্ট মানবজীবনের দুটি দিক আছে–দেহ ও আত্মা। দেহ ও আত্মার দুইয়েরই খাদ্য চাই। একটি স্কুল, একটি সূক্ষ্ম। মানুষের আত্মিক দিকে আছে বুদ্ধিবৃত্তি আর যুক্তিবোধ আর আছে পঞ্চ ইন্দ্রিয় যার দ্বারা তারা চোখে দেখে, কানে শোনে, নাক দিয়ে ঘ্রাণ নেয়, হাত দিয়ে স্পর্শ করে আর জিভ আস্বাদন করে। এইভাবে তারা কর্মেন্দ্রিয়কে জ্ঞানেন্দ্রিয়তে পরিণত করে। এই ইন্দ্রিয়জ্ঞানই মানুষের বুদ্ধি ও যুক্তিকে খাদ্যের উপাদান করে পুষ্ট করে তোলে। আবার যুক্তি ও বুদ্ধি দ্বারা পুষ্ট ও বলিষ্ঠ আত্মা উন্নত হয়। ঈশ্বর সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তার খাদ্য চাই। খাদ্যবস্তুদ্বারা পুষ্টি বা লালিত না হলে কোন বস্তু বা জীব কখনো বাঁচতে পারে না।
আবার দেখবে স্কুল বা সূক্ষ্ম যে সব উপাদানের দ্বারা বিশ্বজগৎ গঠিত তাদের মধ্যে স্থূল উপাদানগুলি সূক্ষ্ম উপাদানগুলিকে খাদ্য সরবরাহ করে বাঁচিয়ে রাখে। পঞ্চ মহাভূতের মধ্যে দেখ মাটি সমুদ্র বা জলকে খাদ্য দান করে, জল বাতাসকে খাদ্য দান করে, বাতাস অগ্নিকে খাদ্য দান করে, অগ্নি আবার আকাশ ও চন্দ্রকে খাদ্য যোগায়। যে সূর্য বিশ্বের সকল বস্তু ও জীবকে আলো ও জীবন দান করে সেই সূর্যও পৃথিবীর জলরাশিকে বাষ্পকারে শোষণ করে বেঁচে থাকে। সৃষ্ট হয়। ঈশ্বর এই মানুষের দেহ ও মনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন বস্তুর সৃষ্টি করেছেন।
এই বলে খেতে বসল রাফায়েল। সে দেবদূত হলেও মানুষের মত তারও পেটে ছিল দারুণ ক্ষুধা এবং সেই ক্ষুধার তাড়নায় সে প্রচুর খেল। তার হজমশক্তি যেন মানুষের মতোই বেশি। যে কোন স্কুল খাদ্যবস্তুকে সে জীর্ণ করে সহজেই তার থেকে আসল নির্যাস আকর্ষণ করে তা দিয়ে তার প্রাণশক্তিকে পুষ্ট করতে পারে। স্বর্ণকারেরা যেমন খাদমিশ্রিত সোনার টুকরোগুলিকে কয়লার আগুনে গলিয়ে খাঁটি সোনায় পরিণত করে।
এদিকে ঈভ তাদের খাবার পরিবেশন করতে লাগল সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায়। খাবার দেওয়ার পর তাদের কাপগুলি উত্তম মদ্যদ্বারা পূর্ণ করে দিল কানায় কানায়। কিন্তু স্বর্গসুলভ এক নিষ্কলুষ নির্দোষিতায় ভরা তখন ঈশ্বরের সৃষ্ট সন্তানদের মনপ্রাণ ছিল কত পবিত্র। কত নির্বিকার। খাদ্যবস্তু পরিবেশনকারিণী ঈভের নগ্ন সৌন্দর্য দেখেও কোন কামপ্রবৃত্তি জাগল না তাদের মনে। যে দুর্বার কামপ্রবৃত্তি প্রেমকে আদর্শচ্যুত করে তার অধোগতি ঘটায়, যে ঈর্ষা প্রেমিক-প্রেমিকাকে নরকে নিয়ে যায়, সে কামপ্রবৃত্তি ও ঈর্ষা থেকে মুক্ত ছিল তাদের মন।
এইভাবে পানভোজনে তৃপ্ত হলো তারা। আদম তখন ভাবল, এই সুযোগ তার হাতছাড়া করা চলবে না। দেবদূত রাফায়েলের কাছ থেকে ঊর্ধ্বলোকে বিরাজিত স্বর্গধামে দেবতাদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনে নেবে। কারণ সে জানত দেবতাদের গুণ, গরিমা ও শক্তি মানুষের থেকে অনেক বেশি। তাদের রূপও মানবদেহের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু দেবতাও মানব–দুই জাতির একই পিতা ঈশ্বরের সৃষ্ট হলেও তাদের মধ্যে এই পার্থক্য প্রভেদের মধ্যে কোথায় কোন্ রহস্য আছে তা জানতে চায় সে।
আদম তাই বলল, হে ঈশ্বরের নিকটতম প্রতিবেশী, জানি তুমি শুধু আমাদের প্রতি দয়াবশত স্বর্গের আসন ছেড়ে এখানে এসে যে ফল যে খাদ্য ও পানীয় দেবদূতদের পক্ষে উপযুক্ত নয় তা তৃপ্তির সঙ্গে ভোজন করেছ। আমাদের হীন ঘরে মাথা নত করে প্রবেশ করেছ।
দেবদূত রাফায়েল তখন বলল, আদম, সর্বশক্তিমান এক অদ্বিতীয় ঈশ্বর থেকেই সকল বস্তু ও জীবের জন্ম হয় এবং মৃত্যুর পর তার কাছেই ফিরে যায়। কোন জীব যদি সততা থেকে বিচ্যুত না হয় তবে তা পূর্ণতা লাভ করবেই। প্রথমে ঈশ্বর বিচিত্র রূপ ও গুণবিশিষ্ট বস্তুজগৎ সৃষ্টি করেন। তারপর সৃষ্টি করেন প্রাণীজগৎ ও পরে আরও সূক্ষ্ম আরও পবিত্র জ্যোতিষ্কমণ্ডলী যা স্বর্গের নিকটবর্তী আকাশমণ্ডলে বিরাজ করে। একটি বৃক্ষকে দেখ। প্রথমে শিকড়, তারপর কাণ্ড, তারপর পাতা, সবশেষে ফুল ও ফল।
মানুষের জীবনও দেখবে ধীরে ধীরে এক মহান সমুন্নতির দিকে উঠে গেছে। প্রথমে অস্থিমজ্জা মাংসরক্তসমন্বিত দেহ, তারপর প্রাণ, তার মন ও ইন্দ্রিয়সমূহ, বৃদ্ধি, কল্পনা, যুক্তি। সবশেষে আছে আত্মা। এই আত্মার দ্বারাই পূর্ণতা লাভ করে মানুষ। আত্মার চুড়ান্ত উন্নতির দিকেই পরিচালিত হবে মানুষের সকল অন্তরবৃত্তি।
এই আত্মিক উন্নতির মধ্য দিয়ে মানুষ পূর্ণতা লাভ করতে করতে ভবিষ্যতে এমন একদিন আসবে যেদিন মানুষ তার স্থূল দেহ ত্যাগ করে সূক্ষ্ম উজ্জ্বল দেবদূতের দেহ ধারণ করবে। আমাদের মত পাখা নিয়ে আকাশে বাতাসে উড়ে যেতে পারবে আর স্বর্গলোকে বাস করবে। অবশ্য যদি তোমরা একান্তভাবে মনে-প্রাণে ঈশ্বরের প্রতি অনুগত থাকতে পার, তাঁর প্রতি প্রেমে ও বিশ্বস্ততায় অবিচল থাকতে পার তাহলে একদিন তোমরা এই মর্ত্যজীবন থেকে উত্তীর্ণ হয়ে পরম স্বর্গীয় সুখের আস্বাদন লাভ করে ধন্য হতে পারবে। আপাতত যে অবস্থায় আছ তাতেই সন্তুষ্ট থাক। এখন এর বেশি কিছু পাওয়া সম্ভব নয়।
তা শুনে আদি মানবপিতা বলল, হে দৈব অতিথি, বন্ধু দেবদূত, কিভাবে আমরা আমাদের জ্ঞানকে ঠিকপথে পরিচালিত করে সৃষ্ট জীব হিসাবে ধাপে ধাপে ক্ষেত্র থেকে পরিধির পথে যেতে পারি, কিভাবে এই স্কুল দেহ ত্যাগ করে পবিত্র ও অতিসূক্ষ্ম উজ্জ্বল দেবমূর্তি ধারণ করে স্বর্গলোকে গিয়ে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে পারি সে বিষয়ে যথার্থ শিক্ষা ও উপদেশ দান করেছ।
কিন্তু একটা জিনিস বল, তুমি কথা প্রসঙ্গে বললে, যদি তোমরা অনুগত থাক–একথার অর্থ কি? তবে কি আমরা ঈশ্বরের প্রতি অনুগত নই? তিনি আমাদের সৃষ্টি করলেও তাঁর প্রেম কি আমাদের এখন পরিত্যাগ করেছে? তিনিই তো আমাদের এখানে প্রতিষ্ঠিত করে মানুষ যে সুখ কামনা করে সেই সুখ চূড়ান্তভাবে ঈশ্বর আমাদের দান করেছেন।
রাফায়েল তখন বলল, হে স্বর্গ ও মর্ত্যের সম্ভান, শোন, তুমি এখন সুখী এবং এই সুখের জন্য ঈশ্বরের কাছে ঋণী, আবার তোমার এই সুখ যদি স্থায়ী হয় তাহলেও তুমি থাকবে তাঁর কাছে। তোমার এই সুখ-শান্তি নির্ভর করবে তাঁর প্রতি আনুগত্যের উপর। আমি তখন ‘অনুগত’ কথাটির মধ্য দিয়ে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম।
সুতরাং আমার উপদেশ শোন। ঈশ্বর তোমাকে পূর্ণতা দান করেছেন ঠিক, কিন্তু তোমার এই পূর্ণতা অপরিবর্তনীয় নয়। তোমার গুণাবলীর অভাব ঘটলে, তোমার মধ্যে সততা ও নীতিবোধের অভাব ঘটলে এই পূর্ণতা তোমার নাও থাকতে পারে।
ঈশ্বর তোমাকে সৎ করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন কিন্তু চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের দ্বারা তোমার জীবনের নির্দিষ্ট কর্ম সম্পাদন করে এই সততা বজায় রাখা তোমার ইচ্ছাশক্তির উপর নির্ভর করে। মনে রেখো, তোমার ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন, তা ভাগ্য বা কঠোর অভাব বা প্রয়োজনীয়তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়।
ঈশ্বর চান আমাদের ঐচ্ছিক সেবা ও আনুগত্য। কোন প্রয়োজনের দ্বারা বাধ্য হয়ে আমরা তাঁর সেবা করি–এটা চান না তিনি। এ ধরনের সেবা গ্রহণ করেন না তিনি। মানুষের অন্তর যদি স্বাধীন হয়, তবে কেন মৃত্যুর পর তার বিচার হয়, সে স্বেচ্ছায় ঈশ্বরের সেবা করেছে কোন প্রয়োজনের বা কোন কামনার তাড়নায় সে সেবা করেছে তা বিচার করে দেখা হয়? যদি মানুষের ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন না হত, যদি তারা ভাগ্যের দ্বারা তাড়িত হয়ে সবকিছু করত তাহলে সে কাজের জন্য বিচার করার কি অর্থ হত?
আরও দেখ, আজ আমি ও আমার মত যত সব দেবদূতেরা স্বর্গ-সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ঈশ্বরের চারদিকে অবস্থান করে পরম স্বর্গীয় সুখ উপভোগ করছি, তা শুধু তার প্রতি আমাদের আনুগত্যের জন্য। এই আনুগত্য যতদিন আমাদের থাকবে ততদিনই আমরা উপভোগ করে যাব এ সুখ। অন্য কোন কারণ নেই। আমরা আমাদের স্বাধীন ইচ্ছার বশবর্তী হয়েই ঈশ্বরকে ভালবাসি এবং তাঁর সেবা করি। এই দেশ, ভালবাসা ও আনুগত্যের দ্বারাই আমরা এই অবস্থার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থাকব। আবার এই গুণগুলির অভাব ঘটলেই আমাদেরও পতন ঘটবে। আজ যারা অধঃপতিত, স্বর্গচ্যুত হয়ে নরকে নির্বাসিত, আনুগত্যের অভাব আর ঈশ্বরদ্রোহিতাই তার একমাত্র কারণ। আর সেই পতনের ফল কি দেখ। কি পরিমাণ স্বর্গীয় সুখ থেকে আজ কি ভীষণ নরকযন্ত্রণা তারা সহ্য করছে!
তখন আমাদের আদিপিতা বলল, তোমার কথাগুলি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। হে ঐশ্বরিক। পরামর্শদাতা, তোমার উপদেশামৃত আমি সানন্দে আমার কণ্ঠদ্বারা পান করেছি। চেরাবজাতীয় দেবদূতদের নৈশ সঙ্গীতের থেকেও শ্রুতিমধুর তোমার নীতি উপদেশ। আমি জানতাম না মানুষের ইচ্ছা ও কর্ম স্বাধীন। যাই হোক, আমি কখনো আমাদের পরম পিতার প্রতি ভালবাসার কথাকে ভুলব না। তার ন্যায়সঙ্গত আদেশ আমি কখনো অমান্য করব না। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত, আমার চিন্তা ও সংকল্প স্থির। যদিও তুমি ঈশ্বরের নামে অনেক কিছুই বলেছ তথাপি কিছু সংশয় রয়ে গেছে আমার মনে। আমি আরো কিছু জানতে চাই। অবশ্য যদি তোমার অমত না থাকে তবে বলতে পার। ঈশ্বর ও আমাদের মধ্যে যে রহস্যময় সম্পর্ক বিদ্যমান তার পূর্ণ বিবরণ আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই। এখনো সময় আছে। সূর্য সবেমাত্র তার আহ্নিক গতিপথের অর্ধাংশ অতিক্রম করেছে।
আদমের এই অনুরোধে রাফায়েল সম্মত হয়ে কিছুক্ষণ থামার পর বলতে আরম্ভ করল, হে আদি মানবপিতা, তুমি আমার উপর যে কাজের ভার দিলে তা যেমন কঠিন তেমনি বিষাদজনক আমার পক্ষে। কেমন করে আমি অদৃশ্য দেবতাদের কার্যাবলী মানুষের জ্ঞানের বিষয়ীভূত করে তুলব? একদিন যারা পূর্ণতার গৌরবে মণ্ডিত হয়ে স্বর্গলোকে প্রতিষ্ঠিত ছিল তাদের ধ্বংস ও পতনের কথা প্রকাশ করে অন্য এক জগতের রহস্য কি করে উদঘাটিত করব? তবু আমি শুধু তোমার মঙ্গলের জন্য মানুষের জ্ঞানের অতীত বিষয় প্রকাশ করব তোমার কাছে। যদিও এই মর্ত্যলোক স্বর্গেরই ছায়ামাত্র এবং যদিও দেহধারী মানুষের সঙ্গে বিদেহী দেবতাদের সম্পর্ক খুবই জটিল তথাপি সে সম্পর্কের কথা বলব তোমায়।
কেন্দ্র ও পরিধিবিশিষ্ট যে জগৎ আজ এখানে দেখছ, যে সব গ্রহ ও জ্যোতিষ্কমণ্ডলীকে আজ মহাশূন্যে শৃংখলাবদ্ধভাবে ঘুরতে দেখছ, সৃষ্টির আদিকালে এসব কিছুই ছিল না। ছিল শুধু এক মহাশূন্য আর যত সব বিশৃংখলা।
এই সময় একদিন যখন স্বর্গের বৎসর গণনা শুরু হয় সেদিন ঈশ্বরের ডাকে স্বর্গের বিভিন্ন প্রান্ত হতে দশ হাজার দেবদূত ঈশ্বরের সিংহাসনের চারপাশে সমবেত হয়। পরম পিতার কোলে ছিল তখন তার সন্তান।
তিনি তখন দেবদূতদের সম্বোধন করে বললেন, শোন হে দেবদূতবৃন্দ, আলোর জনক, কত রাজা, রাজ্য, গুণ ও শক্তির জন্মদাতা। আজ আমি আমার একমাত্র পুত্রের জন্ম ঘোষণা করছি। আজ আমি এই পবিত্র পাহাড়ে তার অভিষেক করছি। যাকে তোমরা আমার কোলের ডানদিকে দেখছ তাকে আমি তোমাদের নেতা নিযুক্ত করেছি। তোমরা তার কাছে মাথা নত করে তাকে তোমরা তোমাদের প্রভু বলে মেনে নেবে। তোমরা তার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুখে শান্তিতে বাস করবে। যে আমার পুত্রকে অমান্য করবে সে আমাকেই অমান্য করবে। সে ঐক্যকে বিচ্ছিন্ন করবে সে ঈশ্বরের আশীর্বাদ হতে বঞ্চিত হবে, ঈশ্বরের দর্শন হতে বঞ্চিত হবে, নরকের গভীর অন্ধকারে পতিত হবে। প্রতিকারের অতীত পাপে মগ্ন হবে সে। অনন্তকাল ধরে নরকজ্বালা সহ্য করবে সে।
সর্বশক্তিমান পরম পিতা এই কথা বলতে উপস্থিত সকলে সন্তুষ্ট হলো বলে মনে হলো, কিন্তু একেবারে সকলে সন্তুষ্ট হলো না। সেদিন দিনের শেষে আসন্ন সন্ধ্যায় অন্যান্য দিনের মত সমবেত দেবদূতেরা নাচগানে মত্ত হয়ে উঠল। তখন মনে হলো তাদের সেই নৃত্যগীতের তালে তালে মহাশূন্যে ঘূর্ণমান গ্রহনক্ষত্রগুলিও যেন নৃত্য করছে।
দেবদূতদের সমবেত কণ্ঠে ও নৃত্যরত গ্রহনক্ষত্রদের তানের মধ্যে এমনই একটি সুমধুর ঐকতান ছিল যে তা শুনে পরম প্রীত হলেন ঈশ্বর। সেদিন কিন্তু ঘূর্ণমান গ্রহনক্ষত্রগুলির মধ্যে আমাদের তেমন শৃংখলা বা নিয়মনিষ্ঠা ছিল না।
ক্রমে সন্ধ্যা সমাগত হলো। তখন কিন্তু সকাল-সন্ধ্যার মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে নাচগান ছেড়ে নৈশভোজনে মন দিল দেবদূতেরা। তারা চক্রাকারে দাঁড়িয়ে পড়ল। তখন তাদের সামনে খাবার টেবিল সাজানো হলো আর দেবদূতদের উপযুক্ত রাশিকৃত খাবার সাজিয়ে দেওয়া হলো। স্বৰ্গজাত পুষ্পমণ্ডিত নানা ফল পরিবেশন করা হলো তাদের। তার সঙ্গে দেওয়া হলো লাল মুক্তোর মত মদ। পরম পিতা ঈশ্বর নিজে প্রচুর পানভোজনের ব্যবস্থা করেছিলেন।
দেবদূতেরা সকলে মিলেমিশে তৃপ্তির সঙ্গে পানাহার করল। পরম আনন্দের এক অমৃতধারা বয়ে যাচ্ছিল যেন তাদের সেই ভোজনসভায়। পরমেশ্বরও তাদের সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করছিলেন। আলোছায়ার নাচন চলছিল যেন ঈশ্বরবিরাজিত সেই পবিত্র পাহাড়ে। চলছিল আলোছায়ার চঞ্চল লীলামাধুরী।
রাত্রি আসার সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গের উজ্জ্বল মুখমণ্ডল সহসা ধূসরবণ হয়ে উঠল। কারণ স্বর্গলোকে কখনো ঘনীভূত হয়ে ওঠে না রাত্রির অন্ধকার। রাত্রিকালে ঈশ্বরের চক্ষু কখনো নিদ্রিত হয় না। তিনি শুধু দিনের শেষে শায়িত হয়ে বিশ্রাম লাভ করেন।
দেবদূতেরা তখন দলে দলে তাদের শিবিরে প্রস্থান করল। জীবন-বৃক্ষের চারপাশে অসংখ্য চত্বর ছিল। সেখানে তারা শীতল বাতাসে শরীর তোষণ করে সুখনিদ্রায় অভিভূত হয়ে উঠল। যারা শুধু সারারাত ঈশ্বরের সিংহাসনের চারপাশে পালাক্রমে মধুর স্তোত্ৰগান করত তারাই জেগে রইল।
আজ যে শয়তানরাজ নামে অভিহিত, সেদিন রাত্রিতে সেই শয়তান তখন স্বর্গেই থাকল। সেদিন ঘুমোল না, আবার স্তোত্ৰগানরত দেবদূতদের মত কোন কাজ করতে লাগল না। অথচ সে জেগে রইল।
সেদিন আজকের এই শয়তানরাজ ছিল প্রধানতম দেবদূত। সে তখন ঈশ্বরের অনুগৃহীত এবং প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু ঈশ্বরের প্রকাশ্য পুত্রের প্রতি তার মনে ছিল দারুণ ঈর্ষা। সেদিন ঈশ্বর যখন সেই পবিত্র পাহাড়ে তাঁর পুত্রকে যুবরাজরূপে অভিষিক্ত করেন তখন সে দৃশ্য সইতে পারেনি শয়তান। সে দৃশ্য সে ঈর্ষার জ্বালায় দেখতে পারেনি। তার অহঙ্কারে আঘাত লেগেছিল।
এক গভীর হিংসা ও তীব্র ঘৃণার বশবর্তী হয়ে সেদিন মধ্যরাত্রিতে সংকল্প করল সে, সে ঈশ্বরের প্রতি আর কোন আনুগত্য প্রদর্শন করবে না। তাঁর আদেশ পালন বা মান্য করবে না, শুধু তাই নয়, তাকে সিংহাসনচ্যুত করার চেষ্টা করবে। সে আর ঈশ্বরের কোন উপাসনা করবে না।
প্রধান দেবদূতরূপী শয়তান এই সংকল্প মনে মনে করার পর, তার প্রধান সহকর্মীকে জাগাল ঘুম থেকে। সে বলল, হে আমার প্রিয় সঙ্গী, তুমি ঘুমোচ্ছ? কি করে ঘুম নেমে এল তোমার চোখের পাতায়? গতকাল সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মুখ থেকে যে কথা নিঃসৃত হয়েছে তা তুমি শুনেছ? আমরা যখন দুজনেই জাগ্রত অবস্থায় ছিলাম তখন আমাদের মনপ্রাণ সব এক ছিল। আমি আমার মনের কথা তোমায় বলতাম, তুমি আমায় বলতে তোমার মনের কথা। এক নতুন আইন প্রবর্তিত হয়েছে। রাজা যখন নতুন আইন বলবৎ করেছে তখন আমরা তাঁর প্রজা হিসাবে সে আইনে সন্দেহ হওয়ায় সে আইন পর্যালোচনা করে অবশ্যই দেখব। সে সন্দেহ আমাদের নিরসন করতে হবে। তবে এখানে এ বিষয়ে বেশি কথা বলা নিরাপদ নয়। তাই আমাদের অধীনে যারা কাজ করে তাদের সবাইকে সমবেত করে উত্তরদিকে আমাদের যে সব বাসা আছে সেখানে তাড়াতাড়ি যেতে আদেশ করো। সেখানে রাত্রি শেষ হবার আগেই আমি চলে যাব। সেখানে আমরা আমাদের রাজার নূতন বিধান ও তার যুবরাজপুত্র সম্বন্ধে বিশেষভাবে আলোচনা করে দেখব। তারা যথাশীঘ্র সম্ভব। তাদের এই নূতন বিধান সর্বত্র বলবৎ করতে চায়।
এইভাবে সেই আর্কেঞ্জাল বা দেবদূতপ্রধান তার সহকর্মীদের মনকে প্রভাবিত করে তার কথা বুঝিয়ে বলল। তার সহকর্মী ও তাদের অধীনস্থ দেবসেনাদের সমবেতভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে ডেকে তার প্রধানের কথাগুলি বুঝিয়ে বলল। দ্বৰ্থবোধক কথায় ও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে সে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের কু-অভিসন্ধির কথাগুলি বুঝিয়ে দিল। তাদের ক্ষমতাশালী নেতার কথা তারা মেনে চলতে সম্মত হলো।
রাত্রিশেষে ধ্রুবতারা আকাশে উঠতেই স্বর্গের সেনাদলের এই একটি অংশ সমবেত হলো তাদের প্রধানের আদেশমতো। লুসিফারই হলো এই ধ্রুবতারা। তাকে দেখে উৎসাহিত হলো তারা।
এদিকে সর্বশক্তিমান সর্বদশী ঈশ্বরের যে চক্ষু সকল অন্তঃগূঢ় গোপন চিন্তাগুলিকেও দেখতে পায় এবং বুঝতে পারে, সেই চক্ষু সেই পবিত্র পর্বতে সারারাত্রি ধরে প্রজ্জ্বলিত স্বর্ণদীপের শিখায় দেখতে পেল এক বিদ্রোহের অভ্যুত্থান হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারলেন কারা তাঁর সৃষ্ট দেবসন্তানদের একটি অংশের মধ্যে সেই বিদ্রোহের বিষাক্ত হাওয়া ছড়িয়ে দিচ্ছে। বুঝতে পারলেন তারা তাঁর বিধানের বিরোধিতা করছে।
তিনি যখন তাঁর পুত্রকে হাসিমুখে বললেন, হে আমার পুত্র, আমার শক্তির একমাত্র অধিকারী, আমার গৌরবের মূর্ত প্রতীক, এখন আমাদের অবিসম্বাদিত শক্তিপরীক্ষার সময় এসেছে। আমাদের শক্তি কতখানি সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে আমাদের। আমাদের প্রাচীন সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য অস্ত্র প্রয়োগ করতে হবে। এমন এক প্রবল শত্রুর উদ্ভব হয়েছে যে স্বর্গলোকের উত্তরে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আমাদের মতোই রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে সিংহাসনে বসতে চায়। আবার এতেই সন্তুষ্ট নয় সে। সে আমাদের অধিকার ও প্রভুত্বকে অস্বীকার করে যুদ্ধে আমাদের শক্তি পরীক্ষা করতে চায়। এখন এ বিষয়ে কি করা উচিত বল। এখন দেখ, আমাদের কি পরিমাণ শক্তি অর্থাৎ সৈন্য ও অস্ত্রবল আছে এবং সেই সমস্ত সামরিক শক্তি আমাদের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত করে বিপদটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করো। তা না হলে শত্রুদের অতর্কিত আক্রমণে আমাদের এই পবিত্র পার্বত্য রাজ্যটিকে হারাতে হতে পারে।
এ কথার উত্তরে ঈশ্বরপুত্র প্রশান্ত চিত্তে মৃদু অথচ স্পষ্ট কণ্ঠস্বরে বলল, হে পরম শক্তিমান পিতা, শত্রুরা যতই চক্রান্ত করুক, যতই হৈচৈ করুক, তাদের ষড়যন্ত্র ও প্রয়াস ব্যর্থ হতে বাধ্য। এটা আমার পক্ষে সত্যিই এক গৌরবের বিষয়। আমিই হলাম তাদের এই বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের কারণ। তারা যখন দেখল তুমি তাদের উদ্ধত গর্বকে খর্ব করার জন্য আমাকে তোমার সমস্ত রাজশক্তি দান করেছ তখন তারা এ বিষয়ে আমার যোগ্যতা কতখানি তা যাচাই করে দেখতে চাইল।
ঈশ্বরপুত্র যখন এইসব কথাগুলি বলছিল ঠিক সেই সময় শয়তান তার সেনাদল নিয়ে বহু দূরবর্তী উত্তরাঞ্চল থেকে পাখায় ভর দিয়ে অনেক পথ পার হয়ে একটি পাহাড়ের দিকে উড়ে আসতে লাগল।
যে পাহাড়ে ঈশ্বরপুত্রের অভিষেকক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল, এ পাহাড়টি ছিল তারই অনুরূপ। সেই পাহাড়ের উপরেই ছিল দেবদুতপ্রধান লুসিফারের প্রাসাদ। সেখানে ঈশ্বরপুত্রের অনুরূপ এক রাজকীয় সিংহাসন স্থাপন করেছিল সে। এইখানেইলুসিফাররূপী শয়তান তার অধীনস্থ সেনাদের সমবেত করে তার পরিকল্পনার কথা জানায়। ছলনা ও এক হীন অপকৌশলের দ্বারা নানাভাবে যত অসত্য কথা বলে তাদের বশীভূত করে তোলে।
সে তাদের বলতে লাগল, ভাই সব, রাজত্ব ও রাজক্ষমতার কোনরকম বিকেন্দ্রীকরণ না করে একজনমাত্র সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। তারপর তার পুত্রকে যুবরাজরূপে অভিষিক্ত করে আইনের বিধানদ্বারা আমাদের সব অধিকার গ্রাস করে আমাদের সকলকে তার অধীনস্থ দাস করে রেখেছে।
এই কারণেই আজ এই মধ্যরাত্রিতে তাড়াতাড়ি এই সভার আয়োজন করেছি। আজ যে ঈশ্বরপুত্র হিসাবে পিতার নিজের দ্বিগুণীকৃত শক্তি ও সম্মানে ভূষিত সেই ঈশ্বরপুত্রকে আমরা ক্রীতদাসের মত নতজানু বা প্রণিপাত হয়ে সসম্মানে বরণ করে নেব কিনা সে বিষয়ে আলোচনা করব এই সভায়। অথবা ভেবে দেখতে হবে এই হীনতা ও পরাধীনতার জোয়াল হতে মুক্ত করার জন্য কোন ভাল পরিকল্পনা খাড়া করতে পারি কি না। তোমরা কি তোমাদের কাঁধের উপর জোয়াল ধারণ করবে? তোমরা কি তার সামনে নতজানু হবে?
আমি যতদূর জানি তোমরা তা পারবে না। তোমরা যদি নিজেদের সম্বন্ধে ভালভাবে জান এবং নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হও তাহলে বুঝতে পারবে পদের দিক থেকে তোমরা সকলে সমান না হলেও তোমরা সকলেই সমানভাবে স্বাধীন। পদের তারতম্য ও শৃংখলা কখনো স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়। শক্তি ও ঐশ্বর্যে সমান না হলেও অধিকারের দিক থেকে আমরা যদি সমান ও সকলেই স্বাধীন হই তাহলে একজন কেন শুধু তার রাজশক্তির জোরে আমাদের সকলের উপর প্রভুত্ব করবে? কেন সে আইনের বিধান আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে শাসন করবে আমাদের? কেন আমাদের প্রভু হয়ে শুধু সম্মান আর শ্রদ্ধা উপচার চাইবে আমাদের কাছ থেকে? কিন্তু যে নীতি অনুসারে আমরাই আমাদের প্রভু, আমরা কারো দাসত্ব করতে বাধ্য নই, আমাদের স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় যে নীতি সে নীতিকে লঙঘন করতে চায় ঈশ্বর।
এইরকম উদ্ধতভাবে অনেকক্ষণ ধরে উত্তেজনামূলক কথাগুলি বলে চলল সেই দেবদূতপ্রধান শয়তান। এমন সময় এ্যাবদিয়েল নামে সেরাফিম জাতীয় এক দেবদূত যে ঈশ্বরকে খুব ভক্তি করত এবং সব ঐশ্বরিক আদেশ নির্বিবাদে পালন করত, শয়তানের কথা শুনে প্রচণ্ড ক্রোধানলে উত্তপ্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। এক জ্বলন্ত প্রতিবাদে ফেটে পড়ে সে বলতে লাগল, হে নাস্তিক, ঈশ্বরদ্রোহী, এই মিথ্যা গর্বোদ্ধত কথাগুলি স্বর্গলোকের মধ্যে অন্তত তোমার মুখে শোভা পায় না। যে তুমি আর সকলের থেকে উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত সেই তোমার মুখ থেকে এসব কথা শোনার কেউ আশাই করতে পারে না। ঈশ্বর তাঁর একমাত্র পুত্রকে ন্যায়সঙ্গতভাবে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত ও রাজশক্তিতে ভূষিত করে যে শপথবাক্য উচ্চারণ করেছেন ও যে বিধান ঘোষণা করেছেন সেই বিধানের বিরুদ্ধে ন্যায়, নীতি ও ধর্মবিহর্গিতভাবে তীব্র ভাষায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছ।
অথচ স্বর্গলোকের প্রত্যেকে নতজানু হয়ে ঈশ্বরের পুত্রকে তার সকল শক্তি ও সম্মানের একমাত্র বৈধ উত্তরাধিকারী হিসাবে বরণ করে নেবে। আইনের বিধানের সঙ্গে স্বাধীনতাকে যুক্ত করে এক করে দেখে তুমি যা কিছু বলেছ তা সর্বতোভাবে অন্যায়। সমানাধিকারের ভিত্তিতে সকলে সমান হলেও সকল শক্তির অধিকারী একজনই শাসন করে যাচ্ছে। এটাই হলো ঈশ্বরের বিধান। আইন ও স্বাধীনতার মধ্যে কোন বিরোধ নেই। যে ঈশ্বর তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাকে এই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছেন সেই ঈশ্বরের বিধানকে খণ্ডন করে তার বিরোধিতা করে এক পাল্টা বিধান তুমি সৃষ্টি করতে চাও।
ঈশ্বর গলোকের মধ্যে সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গতভাবে সকলের মধ্যে যোগ্যতানুযায়ী ক্ষমতা বণ্টন করে সে ক্ষমতা নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন, যাতে কারো সঙ্গে কোন বিরোধ না বাধে। তাছাড়া আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার দ্বারা এটা বেশ বুঝেছি ঈশ্বর পরম মঙ্গলময়, তিনি আমাদের সকল মঙ্গল, সম্মান ও উন্নতির বিধানকর্তা। তিনিই। আমাদের এই সুখী অবস্থায় উন্নীত করেছেন। তিনিই আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছেন।
তোমার মধ্যে দেবদূতের সব গুণগুলি মূর্ত হয়ে ওঠায় তোমাকে ঈশ্বর সৃষ্টি করে এক মহান ও গৌরবময় আসনে অধিষ্ঠিত করে শক্তিতে তাঁর প্রায় সমকক্ষ করে তুলেছেন। ঈশ্বর তোমাকে ও সকল দেবদূতকে সৃষ্টি করেছেন এবং সকলকে তাদের আপন আপন গুণ ও যোগ্যতানুসারে গৌরবে মণ্ডিত করেছেন। তিনি এই স্বর্গরাজ্য শাসন করলেও সে শাসনের দ্বারা কিছুমাত্র খর্ব হয়নি আমাদের গৌরব, বরং তা উজ্জ্বল হয়েছে আরও। তাঁর প্রণীত আইন আমরা বিবেকের আইন ভেবেই মেনে চলি। তাঁর প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করি তা আমাদেরই কাছে ফিরে আসে। সুতরাং এই অধর্মোচিত ক্রোধ পরিহার করা। মিথ্যা কারণে এদের প্ররোচিত করো না। তোমার আচরণে রুষ্ট আমাদের পরম পিতা ও তাঁর পুত্রের কাছে তাড়াতাড়ি গিয়ে তাঁদের সন্তুষ্ট করো। যথাসময়ে চাইলে ক্ষমা মিলতে পারে। কিন্তু দেরি হলে আর মার্জনা পাবে না।
দেবদূত এ্যাবদিয়েল এইসব কথাগুলি আবেগের সঙ্গে বলল। কিন্তু তার কথা উপস্থিত কেউ সমর্থন করল না। সবাই ভাবল এই কথা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। কোন এক হঠকারীর ব্যক্তিগত মতামতমাত্র। ফলে সেই দেবদূতপ্রধানরূপী শয়তান খুশি হলো। সে তখন আরও উদ্ধতভাবে বলতে লাগল, তুমি বলছ, ঈশ্বরই আমাদের সৃষ্টি করেন, তাই তার সঙ্গে আমাদের পিতাপুত্রের সম্পর্ক। এ এক অভিনব এবং অদ্ভুত যুক্তি। কোথা থেকে একথা শিখেছ তা জানতে পারি কি?
এই সৃষ্টির উৎপত্তি কে দেখেছে? তোমার জন্মকথা কি তোমার মনে আছে? স্রষ্টা ঠিক কখন তোমার এই অস্তিত্ব দান করেন তা কি মনে আছে তোমার? কেউ তা জানে না। জেনে রেখো, তুমি আমি আমরা সবাই স্বয়ম্ভু, আপনা হতেই সৃষ্টি হয়েছে আমাদের। আপন আপন শক্তিতেই আমাদের জন্ম ও বৃদ্ধি ঘটে। একটি ঘূর্ণমান গ্রহের কক্ষপথ সম্পূর্ণ হওয়ার সময় আমাদের জন্মস্থান এই স্বর্গলোকের যখন উৎপত্তি হয় তখনই আমাদের জন্ম হয়। হে স্বয়ম্ভু সন্তানগণ, তোমরা স্বজাত, স্বয়ংসিদ্ধ। আমাদের এই দক্ষিণ হস্তই আমাদের প্রধান কর্তব্যকগুলি কি তা শিখিয়ে দেবে। কে আমাদের সমকক্ষ, তা আপন শক্তির দ্বারাই প্রমাণিত হবে। এবার তোমরা বিচার-বিবেচনা করে দেখবে, স্বর্গাধিপতির সিংহাসনের চারপাশে স্তাবকের মত সমবেত হয়ে প্রার্থনা ও অনুনয়-বিনয়ের দ্বারা তাঁকে তুষ্ট করবে, না সেই সিংহাসন অবরোধ করবে। অথবা চূড়ান্ত শক্তিপরীক্ষার মাধ্যমেই এ বিষয়ের নিষ্পত্তি করবে।
এই সংবাদ অভিষিক্ত যুবরাজের কাছে যথাশীঘ্র বহন করে নিয়ে যাও। তা না হলে কোন অশুভ শক্তি তোমাদের গতিরোধ করতে পারে।
শয়তান এই কথা বললে গভীর সমুদ্রগর্জনের মত এক প্রবল সমর্থনধ্বনি বিপুল হর্ষধ্বনির সঙ্গে যুক্ত হয়ে অসংখ্য বিদ্রোহী নেতৃবৃন্দের কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। কিন্তু এ্যাবদিয়েল একাকী শত্রু দ্বারা পরিবৃত হয়েও কোন ভয় পেল না। আগের মত সে নিতীকভাবে উত্তর করল, হে ঈশ্বরদ্রোহী, হে অভিশপ্ত দেবদূত, আজ তুমি সমস্ত শুভ অমঙ্গলকে পরিত্যাগ করলে। আমি দেখতে পাচ্ছি তোমাদের পতন অনিবার্য। তোমরা এই বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণাময় কুকর্মের সঙ্গে তোমার অধীনস্থ এই দেবসেনা দলও সংজড়িত হয়ে পড়ল। তোমার অপরাধ ও শাস্তি সংক্রামক রোগজীবাণুর মত ছড়িয়ে পড়বে তাদের জীবনে।
ঈশ্বরের পুত্রের প্রভুত্বকে পরিহার করার জন্য আজ থেকে আর বিব্রত হতে হবে না তোমায়। ঈশ্বরঘোষিত আইনের বিধান আর মেনে যেতে হবে না তোমাকে। অমোঘ অপরিবীয় শক্তির বিধান জর্জরিত করে তুলবে তোমায়। সুবর্ণময় যে ঐশ্বরিক রাজদণ্ডকে অমান্য করেছ তুমি, সেই রাজদণ্ড আজ লৌহদণ্ড হয়ে তোমার বিদ্রোহের মূলে আঘাত হানবে, তাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে।
তুমি ভালই উপদেশ দিয়েছ। কিন্তু তোমার উপদেশ যত খারাপই হোক, আমি তার ভয়ে অথবা তোমার ভয়ে তোমাদের এই অধ্যুষিত বাসস্থান ছেড়ে চলে যাচ্ছি না। আমি যাচ্ছি কারণ ঈশ্বরের ধূমায়িত রোষ সহসা প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠলে তখন কে ভাল কে মন্দ তা বিচার বা বাছাই করার কোন অবকাশ থাকবে না।
আমি বলে দিচ্ছি, শীঘ্রই তুমি অগ্নি উদগীরণকারী বস্ত্রের আঘাত তোমাদের মাথার উপর অনুভব করবে। তবে বুঝতে পারবে কে তোমায় সৃষ্টি করেছে। তখন বুঝতে পারবে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন তিনি তোমাকে ধ্বংস করছেন।
অসংখ্য অবিশ্বস্তের মাঝে একমাত্র বিশ্বস্ত দেবদুত এ্যাবদিয়েল অটুট অবিচলভাবে এই কথাগুলি বলল। কোন ভয়ে কম্পিত না হয়ে, সে তার অদম্য শক্তিকে অটুট রাখল যে শক্তি সমস্ত প্রলোভনকে জয় করে অব্যাহত রয়ে গেল তার ঈশ্বরপ্রেম। কোন কিছুই সত্য থেকে বিচ্যুত করতে পারল না তাকে। অসংখ্যের মাঝে সে একা হলেও তার মন পরিবর্তিত হলো না কিছুতেই।
তাদের মধ্য থেকে সভা ছেড়ে চলে গেল এ্যাবদিয়েল। উপস্থিত সকলের ঘৃণার উত্তরে সে সকলের সামনে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে উড়ে চলে গেল।
০৫ম সর্গ
পঞ্চম সর্গ
সারারাত্রি ধরে সেই নির্ভীক দেবদূত নির্ভয়ে উড়ে যেতে লাগল। অবশেষে রাত্রি প্রভাত হলেই কে যেন তার গোলাপী হাত দিয়ে আলোর দ্বার উন্মুক্ত করে দিল পূর্বাচলে।
ঈশ্বরের সিংহাসনের পাশে একটি গুহা ছিল। সেই গুহাতে আলো-অন্ধকার অনন্তকাল ধরে যাওয়া-আসা করে পালাক্রমে। সে গুহার এক দ্বারপথ দিয়ে আলো দেখা দিলে অন্যপথ দিয়ে অন্ধকার প্রবেশ করে।
একদিন প্রভাতকালে সেই গুহা থেকে আলো বেরিয়ে এসে আকাশে তা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বর তার সিংহাসন থেকে দূরে সমতলভূমির উপর অসংখ্য উজ্জ্বল রথ, সশস্ত্র সৈন্য ও অশ্বসমূহ দেখতে পেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর সুযোগ্য সেনাদল যুদ্ধশেষে সৈন্যসহ ফিরে আসছে। তিনি বুঝতে পারলেন, এ বিষয়ে যে সংবাদ তিনি আগেই পেয়েছিলেন তা সত্য।
তাই তিনি বেরিয়ে এলেন সেই পবিত্র পর্বতশিখরে। তাঁকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে বিপুল হর্ষধ্বনি করে উঠল বিজয়ী সেনাদল। তারা যুদ্ধে শত্রুদের পরাজিত করে সকলেই অক্ষতদেহে ফিরে এসেছে।
সেই শিখরদেশে ইতস্তত সঞ্চরমান সোনানী মেঘমালার মধ্যে ঈশ্বরের কণ্ঠ ধ্বনিত হলো। তিনি বললেন, হে ঈশ্বরের সেবকবৃন্দ, তোমরা ভালভাবেই যুদ্ধ করেছ। তোমরা অসংখ্য বিদ্রোহী সেনাদের যুদ্ধক্ষেত্র হতে বিতাড়িত করে বীরের উপযুক্ত কার্যই করেছ। তারা এখন সকলের দ্বারা ধিকৃত। কৌশল ও পারদর্শিতার থেকে তাদের বাগাড়ম্বর বেশি। এবার সম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত জয়ের পথ আরও সুগম হবে। মিত্রশক্তির সাহায্যে তোমরা আমাদের শত্রুদের আক্রমণ করে তাদের সম্পূর্ণরূপে দমন করে অধিকতর বিজয় গৌরবে ফিরে আসবে। তারা আমার বিধান মানে না, আমার পুত্রের রাজশক্তিকে স্বীকার করেন না।
যাও মাইকেল ও গ্যাব্রিয়েল, তোমরা দুজন হলে স্বর্গের সামরিক শক্তির দুই নেতা। তোমরা আমার হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ দেবসেনা নিয়ে সেই সব দণ্ডিত ঈশ্বরদ্রোহী বিদ্রোহীদের সম্পূর্ণরূপে নিৰ্জিত করার জন্য সঙ্গে যাও। বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা তাদের আক্রমণ করে স্বর্গলোক হতে বিতাড়িত ও অখণ্ড স্বর্গসুখ হতে চিরতরে বঞ্চিত করে নরকগহ্বরে নিক্ষেপ করো। এটাই হবে তাদের চরম শাস্তি। পতনশীল সেই সব বিদ্রোহীদের গ্রাস করার জন্য নরকগহর মুখ বিস্তার করে আছে।
এই বলে ঈশ্বরের কণ্ঠ নীরব হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণকুটিল মেঘমালা ঘনীভূত হতে লাগল পাহাড়ের উপরে। ঈশ্বরের প্রচণ্ড রোষের প্রতীক হিসাবে অগ্নিগর্ভ ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে লাগল আকাশে। সমস্ত দেবসেনারা অভিযানের জন্য প্রস্তুত হয়ে সঙঘবদ্ধভাবে দাঁড়ালে রণবাদ্য বাজতে লাগল। সেই সব বাদ্যে ও রণভেরীতে বীরত্বব্যঞ্জক সুর ধ্বনিত হতে লাগল।
এরপর অসংখ্য দেবসেনা সমরনেতাদের পরিচালনায় সারিবদ্ধভাবে ঈশ্বর ও ঈশ্বরপুত্রের গৌরব ও সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য অটল সংকল্পে দৃঢ় হয়ে আকাশপথে এগিয়ে চলতে লাগল। সে পথে পাহাড়, পর্বত, নদী বা সমুদ্রের কোন বাধা ছিল না। অনুকূল বাতাসে অব্যাহত ছিল তাদের অগ্রগতি।
অবশেষে অবিলম্বে স্বর্গলোকের উত্তর প্রান্তে এসে উপনীত হলো দেবসেনাদল।
এদিকে শয়তানও চুপ করে বসে ছিল না। প্রথম যুদ্ধে সে রণক্ষেত্র হতে পালিয়ে গিয়ে রাত্রির অন্ধকারে আশ্রয় নিলেও আবার সে নূতন রণোদ্যমে তার সেনাদল নিয়ে ভয়ঙ্কর অভিযানে এগিয়ে আসতে লাগল। অহঙ্কারী উচ্চাভিলাষী শয়তান ঈশ্বরের স্বর্গসিংহাসনে অধিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল নিজেকে।
ক্রমে উভয়পক্ষ পরস্পরের নিকটবর্তী হলে উভয়পক্ষ হতে যুদ্ধের ধ্বনি উঠতে লাগল। শয়তানদের রাজা ঈশ্বরের সব কৃত্রিম মহিমায় নিজেকে সমুন্নত করে তার রথের উপর সিংহাসনে বসে ছিল। সে ছিল চেরাবিম জাতীয় বিদ্রোহী দেবসেনাদের দ্বারা পরিবৃত। তার পাশে ছিল সোনার বাঘ আর অস্ত্র। তার গায়ে ছিল সোনার কর্ম।
দুপাশের মাঝখানে যে উন্মুক্ত প্রান্তর বিস্তৃত হয়েছিল, রথ থেকে নেমে শয়তান ধীর পায়ে উদ্ধতভাবে এক রাজকীয় গাম্ভীর্যের সঙ্গে সেই দিকে এগিয়ে যেতে লাগল শত্রুপক্ষের সম্মুখীন হবার জন্য।
শয়তানের এই গর্বোদ্ধত ভাব দেখে সহ্য করতে পারল না এ্যাবিদিয়েল। সে তখন ঈশ্বরের মহান কর্মে ব্ৰতী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার কাছে এটা ধর্মযুদ্ধ, এ যুদ্ধ করার অর্থ হলো ঈশ্বরেরই সেবা করা।
সে তখন নির্ভীক অদম্য অন্তরে আবেগের সঙ্গে বলল, হে ঈশ্বর! তোমার অনুরূপ। এক সর্বোচ্চ শক্তিতে ভূষিত হয়ে একটা শয়তান স্বর্গলোকের সীমানার মধ্যে বিচরণ করবে, এটা কখনই শোভা পায় না। যার মধ্যে কোন ঈশ্বরবিশ্বাস বা ঈশ্বরভক্তি নেই, যে ধর্মচ্যুত, যার গুণহীন অন্তরের অসারতা সাহসিকতার ছদ্মরূপে সকলের দৃষ্টিতে অজেয় হিসাবে প্রতীয়মান করে তুলেছে তাকে, সে কেন এমন এক ছলনাময় ঔদ্ধত্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে? সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সহায়তার উপর বিশ্বাস রেখে আমি তার শক্তি পরীক্ষা করব। আমি তার অসার অসত্য যুক্তিগুলিকে এর আগেই মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছি। সত্যের বিতর্কে যে পাশবিক শক্তির বলে সকল যুক্তিকে নস্যাৎ করে তর্কযুদ্ধেও জয়ী হতে চায় তাকে তুমি এখনো কি করে সহ্য করছ?
আপন মনে এ্যাবদিয়েল এই সব বলার পর তার সহযোদ্ধাদের মধ্যে হতে এগিয়ে এসে শয়তানের সম্মুখীন হলো। তার পরম শত্রুর সামনে গিয়ে তার প্রতিরোধ করে বলল, শোন বলগর্বিত অহঙ্কারী, তোমার অভিলাষ কি পূর্ণ হয়েছে? তুমি ভেবেছিলে তোমার অন্যায় অসঙ্গত উচ্চাভিলাষ অবাধে সিদ্ধির সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত হবে। তুমি ভেবেছিলে, ঈশ্বরের অরক্ষিত স্বর্গসিংহাসনের গিয়ে বিনা বাধায় অনায়াসে উপবেশন করবে আর তোমার বাহুবল ও বাক্যবলের জন্য ঈশ্বরের পক্ষভুক্ত সকলে তাঁকে ত্যাগ করে পালিয়ে যাবে। নির্বোধ, এখন বোঝ, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার পরিণাম কি ভয়াবহ! এখন দেখ, সেই সর্বশক্তিমানের শক্তি কতখানি। কিভাবে তিনি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শক্তি হয়ে এক বিরাট দুর্বার বাহিনীর উদ্ভব করে তোমার নিবুদ্ধিতার অসারতাকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন। তিনি ইচ্ছা করলে একা কারো সাহায্য না নিয়েই শুধু নিজের হাতে তোমাকে ধ্বংস করে তোমার সমস্ত সেনাবাহিনীকে নরকের অন্ধকারে নিক্ষেপ করতে পারতেন।
এখন দেখতে পাচ্ছি, সকলেই তোমার দলভুক্ত নয়। সে দলের মধ্যে এমন একজনও অন্তত আছে যে ধর্ম ও ঈশ্বরবিশ্বাসকে সবচেয়ে বড় বলে মনে করে। তোমরা সকলেই যখন উদভ্রান্ত হয়ে ভুল পথে যাচ্ছিলে তখন আমি একা তোমাদের দল থেকে বেরিয়ে এসে সত্যের পথ অবলম্বন করি। এবার তাহলে বুঝতে পারছ হাজারজন ভুল করলেও
এ্যাবিদিয়েলের একথা শুনে তার পরম শত্রু শয়তান তখন বলল, হে দুবৃত্ত দেবদূত! আমার দল থেকে পালিয়ে ঠিক সময়েই আমার সামনে এসে পড়েছিস। তোর উপর আমি আমার প্রা প্রথম চরিতার্থ করতে চাই। এবার তোর এ কাজের উপযুক্ত পুরস্কার গ্রহণ কর। আমার উত্তেজিত দক্ষিণ হস্তের প্রথম আক্রমণ তোরই উপরে পতিত হোক। তুই-ই আমাদের সেই ধর্মসভায় তোর শানিত জিহ্বার দ্বারা আমাদের যুক্তিকে খণ্ডন করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলি। আমরা যখন আমাদের দৈবশক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পাই, আমরা যখন আমাদের মধ্যে এক দৈবশক্তিকে অনুভব করি তখন কেন অন্য একজনকে সর্বশক্তিমান বলে মান্য করব? কিছুতেই তা করব
যাই হোক, এখন তুমি তোমার দলের সকলের থেকে আগে এগিয়ে এসেছ। তুমি আমার পাখা থেকে একটি পালক তুলে আমার গৌরবকে খর্ব করতে চাও, তোমার দলের ধ্বংসকে ডেকে আনতে চাও। তুমি উচ্চাভিলাষী। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম স্বর্গে ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং ঐশ্বরিক শক্তি এক ও অভিন্ন। কিন্তু এখন দেখছি তোমার মত যারা অপদার্থ তাদেরই কাছে ব্যক্তিস্বাধীনতার কোন মূল্য নেই। তোমাদের কাছে দাসত্ব আর স্বাধীনতার কোন ভেদ নেই। তোমরা শুধু পান-ভোজন বন্দনাগান গেয়েই খুশি।
এ্যাবিদিয়েল তখন তার উত্তরে বলল, হে দেবদূতপ্রধান, এখনো তুমি ভুল করছ এবং তোমার এ ভুলের আর শেষ হবে না কখনো। তোমার এই ভ্রান্ত পথ অন্যের– পথ হতে অনেক দূরে। ঈশ্বরসেবা করার কাজকে তুমি দাসত্বের নামে অন্যায়ভাবে কলুষিত করছ। এই সেবার কাজ প্রকৃতি ও বিধিনির্দিষ্ট। যিনি যোগ্যতম হিসাবে শাসন করেন, যিনি শাসিতদের থেকে সব দিক দিয়ে বড়, যিনি সর্বগুণান্বিত তার সেবা করাকে দাসত্ব করা বলে? বরং যে অবিজ্ঞ অজ্ঞানী, যে ঈর্ষাবশত তার থেকে যোগ্যতর জনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তার সেবা করাই হলো দাসত্ব। যেমন তোমার অধীনস্থ যারা তোমার সেবা করে তারাই তোমার দাসত্ব করে। আসলে তোমারই কোন স্বাধীনতা নেই। তুমি প্রকৃত স্বাধীনতার মর্ম বোঝ না। তুমি তোমারই সকাম সত্তার দাস, নিজের কাছেই নিজে পরাধীন। তুমি নরকে গিয়ে সেখানকার রাজা হয়ে রাজত্ব করো। আমাকে স্বর্গে থাকতে দাও। আমি চিরকাল সুখে শান্তিতে স্বর্গবাস করে যিনি আমাদের মধ্যে যোগ্যতম, যিনি পরমেশ্বর তার সেবা করে ঐশ্বরিক আদেশ পালন করে ধন্য হতে চাই। শৃঙ্খলিত অবস্থায় আমি নরকবাস করতে চাই না। তুমি বলেছিলে আমি পালিয়ে এসেছি। এবার তোমার অধার্মিক মস্তকে আমার অভ্যর্থনা গ্রহণ করো।
এই বলে ঝড়ের বেগে এত তাড়াতাড়ি শয়তানের মাথায় আঘাত করল এ্যাবিদিয়েল যে শয়তান তা কল্পনাও করতে পারেনি। তার হাত সে আঘাতের প্রতিরোধ করতে পারল না। শয়তান সে আঘাত সহ্য করতে না পেরে দশ পা পিছিয়ে গিয়ে নতজানু হয়ে বসে পড়ল। মনে হলো, ঝড়-জলের প্রচণ্ড আঘাতে অসংখ্য পাইনগাছসহ একটি পাহাড়ের অর্ধেকটা ধসে গেল মাটির তলায়।
তাদের নেতার এই অবস্থা দেখে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল বিদ্রোহী সেনাদল।
এদিকে মাইকেল ও গ্যাব্রিয়েলের অধীনস্থ দেবসেনাগণ জয়ঢাক বাজিয়ে ঈশ্বরের জয়গান গাইতে লাগল। বিপক্ষ সেনাদল তখন প্রচণ্ড বিক্রমে যুদ্ধ শুরু করল। অজস্র অস্ত্রের ঝংকার নিনাদিত হতে লাগল সমগ্র রণক্ষেত্র জুড়ে। শাঁ শাঁ শব্দে তীর উড়ে যেতে লাগল লক্ষ্যাভিমুখে। রথের চাকাগুলি উন্মত্ত হয়ে ঘুরতে লাগল ক্রমাগত।
উভয় পক্ষের যুদ্ধ ঘোরতর হয়ে উঠল। তুমূল হয়ে উঠল সৈন্যদের চিৎকার ও রণধ্বনি। তখন যদি পৃথিবী থাকত তাহলে সে পৃথিবীর ভিত্তিমূল পর্যন্ত কাঁপতে থাকত। সে এক আশ্চর্যজনক ঘটনা। উভয় পক্ষের লক্ষ লক্ষ দেবদূত যুদ্ধ করতে লাগল। তারা পরস্পরকে একেবারে ধ্বংস করতে না পারলেও বিক্ষত করে তুলছিল বিশেষভাবে। এক একজন সৈন্যকে অনেক সৈন্য বলে মনে হচ্ছিল।
এইভাবে উভয় পক্ষের ক্ষিপ্ত যুদ্ধোন্মত্ত সেনাদল স্বর্গলোক ধ্বংস করে ফেলত। কিন্তু এমন সময় সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ ঈশ্বর তার প্রাসাদদুর্গের মধ্যে থেকেই যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থার কথা জানতে পেরে সৈন্যদের ক্ষমতা সীমায়িত করে দিলেন।
তবু কিন্তু পলায়ন বা পশ্চাদপসরণের কথা ভাবল না তারা। তারা কেউ ভয় পেল না। সকলে আবার অদম্য উদ্যমের সঙ্গে যুদ্ধ করে যেতে লাগল।
শয়তান সেদিন এমন প্রবল বিক্রমের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগল যে মনে হতে লাগল সে যুদ্ধে তার কোন সমকক্ষ নেই। তবু সে দেখতে পেল অপরাজেয় মাইকেলের অস্ত্রাঘাতে তার সব সৈন্য ভূপতিত হচ্ছে। তা দেখে সে মাইকেলকে নিজে বাধা দেবার জন্য এগিয়ে এল। মাইকেলও তার ঘৃণ্য শত্রুকে বন্দী করে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটাতে চাইল। কিন্তু সে তখনই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলো না।
মাইকেল তখন তাকে বলল, হে অশুভ শক্তির জনক, তোমার দৃষ্ট স্বরূপ এই বিদ্রোহের আগে পর্যন্ত অবিদিত ছিল স্বর্গলোকে। এখন তোমার সেই অশুভ স্বরূপ ও পাপপ্রবৃত্তি এই জঘন্য দ্বন্দ্বের মধ্যে প্রকটিত। এখন তোমার মত তোমার অনুগামীরা সকলের ঘৃণার বোঝাভার বহন করছে তোমার এই হীন কাজের জন্য।
একবার ভেবে দেখ, স্বর্গের যে শাস্তি তোমার এই বিদ্রোহের আগে পর্যন্ত অক্ষুণভাবে বিরাজিত ছিল, সে শান্তিকে কিভাবে তুমি বিপন্ন করে তুলেছ, প্রকৃতি জগতের মধ্যে এনেছ কত বিশৃংখলা। একদিন যারা ছিল বিশ্বস্ত ও ন্যায়পরায়ণ সেই হাজার হাজার দেবদূতের মধ্যে হিংসা সঞ্চারিত করেছ। আজ তাদের অবিশ্বস্ততা প্রমাণিত সত্য। কিন্তু ভেবো না তুমি ঈশ্বরের শান্তি ও স্বর্গের পবিত্রতা বিনষ্ট করে তুলবে। ঐশ্বরিক বিধানে এই স্বর্গ হতে তুমি বিতাড়িত, স্বর্গের কোন অংশে আর তোমার স্থান হবে না। পরমসুখে ও অনন্ত শান্তিতে পরিপূর্ণ এই পবিত্র স্বর্গলোক কখনো কোনরূপ হিংসা, বলপ্রয়োগ বা যুদ্ধবিগ্রহ সহ্ করে না। সুতরাং এখন তুমি তোমার দুষ্ট অনুচরদের নিয়ে যত সব অশুভ শক্তির লীলাভূমি নরকে চলে যাও। সেখানে গিয়ে যত খুশি অশান্তি সৃষ্টি করো। যদি না যাও তাহলে প্রতিশোধবাসনায় উদ্ধত আমার এই তরবারি তোমার ধ্বংসসাধন করবে অথবা ঈশ্বরের কোন প্রতিহিংসামূলক উড়ন্ত অস্ত্রের আঘাত তোমার যন্ত্রণাকে দীর্ঘায়িত করবে।
মাইকেল এই কথা বললে তার প্রতিপক্ষ শয়তান বলল, যাকে তুমি এখনো পর্যন্ত কার্যত ভীত করে তুলতে পারনি কে ভেবেছ হাস্তা দিয়ে অর্থাৎ ফাঁকা কথা বলে ভয় দেখাবে? তুমি কি আমার সেনাদলের একজনকেও রণক্ষেত্র হতে পালাতে বাধ্য করেছ অথবা তার পতন ঘটাতে পেরেছ? বরং তারা এক অপরাজেয় বিক্রমের সঙ্গে আমার জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। তাহলে কোন যুক্তিতে রাজকীয় মেজাজের সঙ্গে বলছ আমাকে তাড়িয়ে দেবে স্বর্গ থেকে? ভুলে যেও না এ যুদ্ধের গৌরব আমাদের পক্ষই লাভ করবে। আমরা জয়ী ঘ অথবা এই সমগ্র স্বর্গলোককে নরকে পরিণত করব। আমরা এখানে রাজত্ব করতে না পারলেও স্বাধীনভাবে বাস করতে চাই। আমাদের স্বাধীনতা যেন অবাধ য় এবং কেউ তাতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে। যাই হোক, এখন তোমার সাহায্যের জন্য তোমাদের সর্বশক্তিমানকে ডাক। তাকে বল, তোমার পরম শত্রু আমি কিছুতেই পালাচ্ছি না। পালাব না। যুদ্ধে তোমাকে আহ্বান জানাচ্ছি।
এখানেই তাদের কথাবার্তা শেষ হলো। সম্মুখ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠল দুজনেই। তাদের সে যুদ্ধ অবর্ণনীয়। কোন মানুষ তা বর্ণনা করা তো দূরের কথা তা কল্পনাও করতে পারে না। তাদের গতিভঙ্গি, আকৃতি ও অস্ত্রশস্ত্রের দিক থেকে জনকেই দুই দেবতার মত মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল স্বর্গসাম্রাজ্য কোন পক্ষের অধিকারে থাকবে তা একমাত্র তারাই যেন স্থির করবে। বায়ুস্তর বিদীর্ণ করে তাদের তরবারি দুটি অর্ধবৃত্তাকারে সঞ্চালিত হতে লাগল। তাদের প্রকাণ্ড ঢালদুটি জ্বলন্ত সূর্যের মত দুদিকে দীপ্যমান হয়ে আছে। তাদের সেই যুদ্ধের কাছ থেকে অন্য সেনারা সরে যেতে লাগল ভয়ে।
যুদ্ধে তাদের সেই ক্ষোভ দেখে মনে হচ্ছিল প্রকৃতির নিয়ম ভেঙে জ্যোতিষ্কমণ্ডলী হতে দুটি বিশাল নক্ষত্র মধ্য আকাশে পরস্পরের দিকে পড়তেই তা দু খণ্ড হয়ে গেল। সেই সঙ্গে শয়তানের দক্ষিণ দেহের দিকে সে আঘাতে অনেকটা গভীর ক্ষত হয়ে গেল। জীবনে প্রথম আঘাতের যন্ত্রণা অনুভব করল শয়তান। সে যন্ত্রণায় সে ইতস্তত টলতে লাগল। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না।
তবে স্বর্গজাত কোন ব্যক্তির কোন আঘাতে মৃত্যু হয় না বা কোন ক্ষত দীর্ঘস্থায়ী হয় না তার দেহের মধ্যে। তাই শয়তানের সেই ক্ষতস্থান থেকে লাল রক্ত বার হয়ে তার বর্ষটিকে ভিজিয়ে দিলেও তার ক্ষতস্থানটি অল্পক্ষণের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে শয়তানের সাহায্যে একদল বিদ্রোহী সেনা ছুটে এল। আর একদল তাকে ধরাধরি করে তার রথে নিয়ে গিয়ে চাপিয়ে দিল। যুদ্ধক্ষেত্র হতে কিছুটা দূরে ছিল সে রথ। সেখানে কিছুক্ষণ শুয়ে বিশ্রাম করল শয়তান। সেই আঘাতের যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে এক অন্তর্বেদনা আচ্ছন্ন করে তুলেছিল শয়তানের মনটাকে। এইভাবে আহত হওয়ায় লজ্জা পাচ্ছিল সে মনে মনে। শক্তিতে সে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সমকক্ষ তার এই আত্মবিশ্বাস খর্ব হলো অনেকখানি।
তবে কিছুক্ষণের মধ্যে আবার সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে উঠল শয়তান। স্বর্গের দেবদূতদের দেহে কখনো কোন আঘাত মরণশীল মানুষের দেরে মত মারাত্মক হয়ে ওঠে না। তারা ইচ্ছামত যে কোন দেহ ধারণ করতে পারে।
সেই রণক্ষেত্রের অন্য দিকে মাইকেলের মত গ্যাব্রিয়েলও তার অনুরূপ সামরিক শক্তির পরিচয় দিচ্ছিল। গ্যাব্রিয়েল তখন মলোক নামে এক বিদ্রোহী সেনাপতির দ্বারা সাজানো ব্যুহ ভেদকরেরথের দিকে অপ্রতিরোধ্য বেগে ধাবিত হলো। গ্যাব্রিয়েলের কোন কথাতেই সংযত হলো না মলোক। উপরন্তু সে এই বলে আস্ফালন করতে লাগল যে সে গ্যাব্রিয়েলকে তার রথের চাকায় বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যাবে। অথচ কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্যাব্রিয়েলের অব্যর্থ আঘাতে তার পৃষ্ঠদেশে আঘাত পেয়ে যন্ত্রণায় হাঁপাতে হাঁপাতে পালিয়ে গেল নাস্তিক মলোক।
এদিকে ইউরিয়েল ও রাফায়েল, আামেকে ও আসমাদাই নামে দুই শত্রুকে পরাজিত করে তাদের পাখায় তাদের বেঁধে নিয়ে উড়ে যেতে লাগল। এ্যাবদিয়েলও বলছিল সেও এরিয়েল, এরিওক, ব্যামিয়েল প্রভৃতি নাস্তিক ঈশ্বরদ্রোহী শত্রুদের পরাভূত করেছে শোচনীয়ভাবে। তাদের সকল গর্ব খর্ব করল। সেই বিস্ময়কর যুদ্ধে বিদ্রোহী দেবতসেনারাও কম শক্তি ও সাহসের পরিচয় দেয়নি। শক্তি, বীরত্ব ও রণকৌশলে তারাও কম চমকপ্রদ ছিল না। কিন্তু তাদের শক্তি ধর্ম এবং ন্যায় ও নীতি হতে ভ্রষ্ট ছিল বলে তাদের সকল বীরত্ব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং তার ফলে কোন খ্যাতি বা গৌরব লাভ করতে না পেরে নরকে নির্বাসিত হয় তারা। তলিয়ে যায় বিস্মৃতির চির অন্ধকারে।
বিদ্রোহী সেনাদলের শক্তিমান ও পরাক্রমশালী সেনাপতিরা একে একে পরাজিত ও আহত হওয়ায় যুদ্ধের গতি ফিরে গেল। ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল তাদের সেনারা। ভগ্ন রথ ও অস্ত্রশস্ত্র ছড়িয়ে রইল সারা রণক্ষেত্র জুড়ে।
প্রতিরক্ষার আর কোন শক্তি রইল না শয়তানের সেনাদলের। ভয়ে, বিস্ময়ে, লজ্জায় ও বেদনায় বিমূঢ় হয়ে এক হীন পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে পালাতে লাগল তারা। এই পরাজয় ও বেদনাবোধের অভিজ্ঞতা জীবনে আজ প্রথম তাদের।
পাপ আর অবাধ্যতা তাদের জীবনে যে দুঃখ যে অভিশাপ নিয়ে এল সে দুঃখ বা অভিশাপ আগে ছিল না তাদের জীবনে। তারা সকলেই ছিল সাধু প্রকৃতির দেবদূত, সব দিক দিয়ে উন্নত, সকল শত্রুর কাছে অপরাজেয় অপ্রবৃষ্য। এই ঈশ্বরদ্রোহিতার আগে তারা কোন পাপ করেনি, কোন অবাধ্যতা ছিল না তাদের মধ্যে। ফলে যুদ্ধে তারা ছিল অক্লান্ত, কোন আঘাতের বেদনা সহ্য করতে হত না তাদের।
তারপর রাত্রি নেমে এল। অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল স্বর্গলোক ও সমগ্র আকাশমণ্ডল। স্তব্ধ হয়ে গেল যুদ্ধের সকল ধ্বনি। রাত্রির নিবিড় অন্ধকারে আশ্রয় গ্রহণ করল বিজেতা আর বিজিতের দল।
যুদ্ধশেষের সেই রণপ্রান্তরে মাইকেল তার দেবদূত-সেনাদের নিয়ে বিজয়ানন্দে শিবিরমধ্যে বিশ্রাম করতে লাগল। জ্বলন্ত মশাল হাতে প্রহরীরা পাহারা দিতে লাগল।
অন্যদিকে শয়তান তার বিদ্রোহী সেনাদের নিয়ে দূরে নিরাশ্রয় অবস্থায় অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে। তারপর তার দলের প্রধানদের নিয়ে মন্ত্রণাসভায় বসল।
সে নির্ভীকভাবে বলতে লাগল, হে আমার প্রিয় সহচরগণ, তোমরা আজ যুদ্ধে তোমাদের যে বিক্রম ও সামরিক শক্তির পরিচয় দিয়েছ তা নির্জিত হয়নি এখনো শত্রুদের দ্বারা। তোমাদের এই শক্তি আজ এই কথাই প্রমাণ করে যে তোমরা শুধু স্বাধীনতার যোগ্য নও, সেই সঙ্গে সম্মান, রাজত্ব, গৌরব ও খ্যাতিরও অধিকারী। একদিনের যুদ্ধে যে শক্তির পরিচয় দান করেছ তোমরা, অনন্তকাল ধরে সে শক্তিতে সমৃদ্ধ কেন থাকবে না তোমরা? স্বর্গাধিপরি কি এমন সার্বভৌম ক্ষমতা আছে। যে তিনি তাঁর ইচ্ছার কাছে আমাদের মাথা নত করানোর জন্য আমাদের বিরুদ্ধে সেনাদল পাঠিয়ে তাঁর রাজক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন? সে শক্তির প্রমাণ কি, পরিচয় কি দিয়েছেন তিনি? সে শক্তি তো এখনো প্রমাণিত হয়নি নিঃসংশয়িরূপে।
এখনো পর্যন্ত তিনি সর্বশক্তিমান হিসাবে পরিগণিত হলেও ভবিষ্যতে তাঁর পতন ঘটবেই। একথা সত্য যে, আমাদের অস্ত্রশস্ত্র অপ্রচুর আর অপ্রতুল থাকার জন্য যুদ্ধে কিছু অসুবিধায় পড়তে হয়েছে আমাদের এবং তার জন্য কিছু আঘাতজনিত ক্ষত ও ব্যথা-বেদনা সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু আগে যে সত্যটি আমরা জানতাম না তা আজ জানলাম। আজ আমরা একথা বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জেনেছি যে আমাদের দৈব দেহাবয়ব মরণশীল জীবের মত কোন মারাত্মক আঘাতের অধীন নয়, কারণ আমরা অক্ষয় অমর। আমাদের দেহে কোন আঘাতজনিত ক্ষত হলেও সে ক্ষত আপন অন্তর্নিহিত শক্তিবলে আরোগ্য হয়ে ওঠে অল্পকালের মধ্যে।
সুতরাং যুদ্ধে আমাদের বিপদের ঝুঁকি যখন কম তখন সহজেই প্রতিকারের উপায় নির্ধারণ করতে পারি। আমরা যদি আরও উন্নত ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পরে শত্রুদের সম্মুখীন হই তাহলে আমাদের হয়ত ভাল হবে এবং শত্রুদের খারাপ হবে, অথবা উভয় পক্ষের শক্তির সমতা প্রমাণিত হবে। আর যদি আমাদের উপর তাদের শ্রেষ্ঠত্বের পিছনে কোন অজ্ঞাত কারণ থাকে তাহলেও আমরা আমাদের অক্ষুণ্ণ মনোবল ও অবিচল বুদ্ধির দ্বারা এ বিষয়ে উপযুক্ত অনুসন্ধান ও আলোচনা করে সে কারণকে প্রকাশ করব।
এই বলে সেই মন্ত্রণাসভায় বসে পড়ল শয়তানরাজ। তখন নিসরুক নামে এক প্রধান নেতা উঠে দাঁড়াল। তাকে খুবই রণক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তার আহত ও ক্ষতবিক্ষত বাহুদুটির জন্য প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পালিয়ে আসে সে। তার চেহারাটাকে স্নান দেখাচ্ছিল মেঘাচ্ছন্ন সূর্যের মত।
নিসরক বলতে লাগল, হে আমাদের পরিত্রাতা, আমাদের স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের প্রবক্তা, এমন কি দেবতারা যে স্বাধীনতা, যে অধিকার ভোগ করতে পারে না আমরা যাতে সেই স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করতে পারি তারই জন্য সংগ্রাম করছ তুমি। কিন্তু এই সংগ্রামে আমরা কি বুঝেছি? আমরা বুঝেছি ঈশ্বরের অনুগত দেবসেনাদের সমকক্ষ নই আমরা। অস্ত্রশস্ত্রের দিক থেকে অসম দুই পক্ষে কি যুদ্ধ সম্ভব? আমরা যারা আঘাত ও ব্যথা-বেদনার অধীন তারা কি যারা ব্যথা-বেদনার অতীত তাদের সঙ্গে মর্যাদাসহকারে যুদ্ধ করতে পারে? এর ফল অশুভ হতে বাধ্য আমাদের। এতে শুধু আমাদের আসন্ন সর্বনাশেরই সম্ভাবনা বিদ্যমান। যে ব্যথা যে বেদনা সকলকে প্রতিপক্ষের বশীভূত করে তোলে, শুধু পরাজয় আর পলায়নী মনোবৃত্তির জন্ম দেয় সেই ব্যথা-বেদনার অধীন হয়ে শুধু সাহস আর অতুলনীয় শক্তি নিয়ে কি করব আমরা? তার কি মূল্য আছে আমাদের কাছে? এতে শুধু সর্বশক্তিমানের হাতই শক্ত হবে। অবশ্য আমরা জীবনের সব আনন্দ হারিয়ে অনুতাপ বা অনুশোচনাহীন এক কৃত্রিম সন্তোষের মধ্যে মনপ্রাণকে কেন্দ্রীভূত করে শান্ত থাকতে পারি। কিন্তু যন্ত্রণার মত জীবনে দুঃখ আর নেই, এই যন্ত্রণা বেদনাই জীবনে সবচেয়ে অশুভ ও অবাঞ্ছিত ঘটনা। এই যন্ত্রণা যখন আতিশয্যে অসহনীয় হয়ে ওঠে তখন তা সকল ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার বিচ্যুতি ঘটায়।
সুতরাং এখন কেউ যদি আমরা কিভাবে অধিকতর শক্তি সঞ্চয় করে ও উপযুক্ত অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের দ্বারা শত্রুদের সমতুল প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারি এবং তার ফলে অপযুদস্ত শত্রুদের পযুদস্ত করতে পারি তার উপায় নির্ধারণ করতে পারেন তাহলে তিনিই হবেন আমাদের আকাঙিক্ষত মুক্তির মৃত প্রতীক।
একথা শুনে শয়তানরাজ তার স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। সে উপায় তো অনির্ধারিত বা অনাবিষ্কৃত নেই। বৃক্ষলতা, ফুল, ফল, মণিমুক্তা, স্বর্ণ প্রভৃতির দ্বারা পরিশোভিত আমাদের এই বাসভূমি স্বর্গলোকের উজ্জ্বল উপরিপৃষ্ঠটি আমাদের মধ্যে যারা দেখেছে তারা কিন্তু ভাবতে পারেনি, এই উপরিপৃষ্ঠের অন্তরালে এই ভূখণ্ডের গভীর অন্ধকার গর্ভে কত অজানিত অপরিজ্ঞাত সম্পদ লুকিয়ে আছে।
উপযুক্ত আলোকপাতের দ্বারা সেই সব সম্পদ আহরণ করে অগ্নির দ্বারা পরিশোধিত করে আমাদের কার্যসিদ্ধি করব। সেই সব সম্পদ থেকে অগ্নিগর্ভ বজ্রের মত এমন এক ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক অস্ত্র নির্মাণ করে তা শত্রুদের প্রতি নিক্ষেপ করব যা আমাদের সকল প্রতিপক্ষের অগ্রপ্রসারী ও আক্রমণোদ্যত শক্তিকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে। তখন তারা বুঝতে পারবে তাদের বস্ত্রধারীর বজ্রকেও হার মানিয়েছি আমরা। এর জন্য দীর্ঘায়িত শ্রমের প্রয়োজন হবে না। রাত্রি প্রভাত হবার আগেই ফলবতী হয়ে উঠবে আমাদের অভিলাষ। সুতরাং ভয় ত্যাগ করে নূতন প্রাণশক্তিতে সঞ্জীবিত হয়ে ওঠ। এ কাজ মোটেই কঠিন বলে মনে করো না। হতাশার কিছু নেই।
শয়তানের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে তার সেনাদলের নিরানন্দ মন আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আবার। উদ্দীপিত হয়ে উঠল তাদের সকল আশা। সাফল্যের মূলমন্ত্রস্বরূপ সেই উপায় উদ্ভাবনের প্রশংসা করতে লাগল সকলে। তাদের দলের অনেকে ভাবল এ উপায় যখন পাওয়া গেছে তখন তা খুব সহজ এবং তাদের যে কেউ তা আবিষ্কার করতে পারে। আবার অনেকে ভাবল তা যখন এখনো কার্যকরী হয়নি তখন তা অসম্ভব।
হে মানবজাতি, ভবিষ্যতে হয়ত হিংসার বশবর্তী হয়ে আবার কোন শয়তানী বুদ্ধি ও কৌশলের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মানবসন্তানদের ধ্বংস করার জন্য অনুরূপ এক অস্ত্র আবিষ্কার করবে। পাপযুদ্ধে পরস্পর পরস্পরকে বধ করবে।
শয়তানের কথামত সেই বিদ্রোহী সেনাদল মন্ত্রণাসভা ত্যাগ করে কর্মে প্রবৃত্ত হলো। কেউ কোন কথা বলল না, কেউ দাঁড়িয়ে রইল না আলস্যভরে। অসংখ্য হস্ত এগিয়ে এল কর্মে যোগদান করার জন্য। মুহূর্তমধ্যে তারা স্বর্গলোকের উপরিপৃষ্ঠের মাটি সরিয়ে তার গর্ভে দেখল প্রকৃতির মূল উপাদানের সঙ্গে সালফার ও নাইট্রোজেন দুটি ধাতু রয়েছে। তারা কৌশলে সেই দুটি ধাতু মিলিয়ে কাজে লাগাবার মত একরকম বস্তু তৈরি করে সেগুলি সঞ্চয় করে রাখল। তারপর আরও মাটি খুঁড়ে পৃথিবীর ভূগর্ভনিহিত ধাতব পদার্থের মত দাহিকাশক্তিসম্পন্ন এক পদার্থ দেখতে পেল। সামান্য অগ্নিসংযোগেই তা ভয়ঙ্কর ক্ষেপণাস্ত্রের রূপ ধারণ করবে। এইভাবে রাত্রি শেষ হবার আগেই গোপনে সকলের অলক্ষ্যে অগোচরে সর্ব কার্য সাধন করল।
তারপর পূর্বদিকের আকাশে প্রভাতের আলো দেখা দিলে বিজেতা দেবদূতেরা উঠে পড়ে অস্ত্র ধারণ করল। রণসজ্জায় সাজতে লাগল। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে দলবদ্ধভাবে দাঁড়াল তারা। তাদের মধ্যে একটি দল প্রভাতকিরণমণ্ডিত পর্বতশীর্ষ হতে চারদিকে তাকিয়ে শত্রুদের খোঁজ করতে লাগল। শত্রুরা পালিয়ে গেছে না দূরে কোথায় আছে, তারা সচল না অচল অবস্থায় আছে তা লক্ষ্য করতে লাগল।
এমন সময় তারা দ্রুতগতিসম্পন্ন পাখা বিস্তার করে চেরাবিম জাতীয় দেবদূত জেফিয়েলকে উড়ে আসতে দেখল তাদের দিকে। মাঝপথে এসে শূন্য থেকে সে তাদের বলল, যোদ্ধারা অস্ত্র ধারণ করো। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। যে শত্রুরা পালিয়ে গেছে ভেবেছিলাম সে সব শত্রুরা ঠিকই আছে, তাদের আর সন্ধান করতে হবে না কষ্ট করে। আমি তাদের মুখে দেখেছি এক বিষাদগম্ভীর সংকল্প আর দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ। সুতরাং তোমরা প্রত্যেকে বর্ম পরিধান করো, শিরস্ত্রাণ নাও মাথায় আর বাণগুলি শক্ত করে ধর। সে বাণগুলিকে উর্ধ্বে তুলে ধর। কারণ আমি বুঝতে পেরেছি আজ কোন গুঁড়িগুড়ি তীরবৃষ্টি নয়, আজ জ্বলন্ত তীরের ঝড় বয়ে যাবে।
এই বলে তার দলের সেনাবাহিনীকে সতর্ক করে দিল জেফিয়েল। সচেতন করে দিল তাদের কর্তব্যকর্ম সম্বন্ধে। দেবসেনাবাহিনীও সর্বতোভাবে প্রস্তুত হয়ে অগ্রসর হতে লাগল। অবিলম্বে তারা দেখল এক বিশাল শত্রুবাহিনী দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে। সেই বিশাল বাহিনী তাদের মধ্যে নবোদ্ভাবিত আগ্নেয়াস্ত্রগুলিকে এমনভাবে ঢেকে আনছিল যাতে অপরপক্ষ দেখতে না পায়।
অগ্রসরমান শত্রুবাহিনী হঠাৎ থেমে গেল কিছুক্ষণের জন্য। তখন শয়তানরাজ তাদের সামনে এসে তাদের সম্বোধন করে বলতে লাগল, তোমরা ডাইনে-বাঁয়ে সরে গিয়ে মাঝখানটা ফাঁক করে দাও। যারা আমাদের ঘৃণা করে তারা দেখুক কি ধরনের শান্তি চাই আমরা। তাদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্য প্রস্তুত হও। এবার এমনভাবে আমাদের আবিষ্কৃত আগ্নেয়াস্ত্রগুলি ছাড় যাতে ঈশ্বর নিজে তা দেখতে পান, যাতে সকলে তার আওয়াজ শুনতে পায়।
শয়তানের এইসব দ্ব্যর্থবোধক কথাগুলি শেষ হতে না হতেই তার সেনাদল দুভাবে বিভক্ত হয়ে ডাইনে-বাঁয়ে দুটি বিশেষ স্তম্ভের মত দাঁড়াল। মাঝখানটা ফঁক রইল। সৈন্যদের প্রত্যেকের হাতে ছিল একটি করে আগ্নেয়াস্ত্র অর্থাৎ অগ্নিময় বাণ। আমরা তা দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলাম। এরপর তারা সেই সব বাণ নিক্ষেপ করতে লাগল আমাদের লক্ষ্য করে। সহসা ধূমপরিবৃত জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় আকাশ আচ্ছন্ন হয়ে গেল। তার থেকে নিঃসৃত গম্ভীর গর্জনে বিদীর্ণ হয়ে যেতে লাগল বিশুদ্ধ বায়ুস্তর। আমাদের নাড়িভূঁড়ি যেন ছিঁড়ে যেতে লাগল। বজ্র হতে নির্গত অগ্নিময় লৌহগোলকের মত অস্ত্রগুলি বিজেতা সৈন্যদলের উপর নিক্ষিপ্ত হতে লাগল। সেগুলি এমন ভয়ঙ্কর জোরের সঙ্গে আঘাত হানতে লাগল যে সে আঘাত পাবার সঙ্গে সঙ্গে কেউ দাঁড়াতে পারছিল না পায়ের উপর ভর দিয়ে। হাজার হাজার আমাদের দেবদূতসেনা পড়ে যেতে লাগল।
আমাদের অস্ত্রগুলি সব যেন বিকল হয়ে গেল। অস্ত্র থেকেও আমরা নিরস্ত্র হয়ে উঠলাম। আমরা যেন কি করব তা ভেবে পেলাম না। আমাদের সেনাদল যদি এইসব সত্ত্বেও এগিয়ে যায় তাহলে তাদের আবার ফিরে আসতে হবে। কারণ তাদের সেইসব ভয়ঙ্কর আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারবে না তারা। তারা তাহলে হাস্যাস্পদ হয়ে উঠবে শত্রুদের সামনে। দ্বিগুণ বেড়ে যাবে তাদের লজ্জা। কারণ দ্বিতীয় পর্যায়ে আর একঝাক সেই আগ্নেয়াস্ত্র যোগানোর জন্য প্রস্তুত হয়েছিল আর একটি দল।
শয়তান যখন আমাদের অবস্থা দেখে উপহাস করে তার দলের সেনাদের বলতে লাগল, বন্ধুগণ, ঐ সব দর্পিত বিজেতা সেনাদলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছ না কেন? আমরা তো ওদের উন্মুক্ত বক্ষে খোলা মন নিয়ে আহ্বান জানাচ্ছি। তবু ওরা কেন পিছিয়ে যাচ্ছে এবং পালাচ্ছে? ওরা দাঁড়াতে পারছে না, টলছে। যেন মনে হচ্ছে আমাদের শক্তির নমুনা দেখে আনন্দে উন্মত্ত হয়ে নৃত্য করছে। আমার মনে হচ্ছে আমাদের এই শান্তির প্রস্তাব যদি দ্বিতীয়বার ওরা শুনতে পায় তাহলে তার ফল খুব শীঘ্রই পাওয়া যাবে।
তখন বিলায়েল নামে ওদের এক সেনা তেমনি বিদ্রুপাত্মক স্বরে বলল, হে আমাদের প্রিয় নেতা, আমরা আমাদের শান্তিচুক্তির যে শর্তাবলী পাঠিয়েছিলাম তা যেমনি ভয়ঙ্কর তেমনি জ্বালাময়। তা সহ্য করতে না পেরে অনেকে পড়ে যায়। সেগুলি যাদের উপর পড়ে তাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারবে।
এইভাবে শত্রুরা আনন্দ করতে লাগল। তাদের জয় সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ রইল না তাদের মনে। অনেক উর্ধ্বে উঠে গেল তাদের চিন্তা। তারা বুঝতে পারল যে অস্ত্র তারা আবিষ্কার করেছে তা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের শক্তির সমতুল। শুধু সমতুল নয়, আরও বড়। তারা ঈশ্বরের অমোঘ বজ্ৰাস্ত্রকেও হার মানিয়ে দিয়ে তাকে হাস্যাস্পদ করে তুলবে।
এইভাবে আমাদের সেনাদল শত্রুদের উপহাসের পাত্র হয়ে কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল না। প্রচণ্ড ক্রোধ ও অপমানের জ্বালায় তারা অবশেষে শত্রুদের প্রতিরোধ করার মত এক অস্ত্র খুঁজে পেল। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তার দেবসেনাদের মধ্যে সহসা এক বিস্ময়কর শক্তি সঞ্চারিত করলেন।
আমাদের সেনারা তখন তাদের নিজেদের অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যে পাহাড়ের উপর তারা দাঁড়িয়ে ছিল সেই পাহাড়ের পাথরগুলোকে হাতে তুলে এনে ছুঁড়তে লাগল শত্রুদের লক্ষ্য করে।
বিদ্রোহী সেনারা ভয় পেয়ে গেল। তারা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এসে দেখল শত্রুরা পাথর তুলতে তুলতে গোটা পাহাড়টাকে যেন তার তলদেশ সমেত উপড়ে ফেলছে। ক্রমাগত পাথর বর্ষণের ফলে তাদের আগ্নেয়াস্ত্রগুলো সব বিকল হয়ে যাচ্ছে পাথরের চাপে। তাদের সমস্ত আত্মবিশ্বাস সেই সব পাথরের চাপে নিষ্পেষিত হয়ে যেতে লাগলো, প্রপীড়িত হতে লাগলো সশস্ত্র বিদ্রোহী সেনার দল।
তাদের দেহে বর্ষ থাকার জন্য তাদের কষ্ট আরও বেড়ে যেতে লাগল। কারণ পাথরের জোর আঘাতে লোহার বর্মগুলো ভেঙে খানখান হয়ে যাওয়ায় তাদের গাগুলো ছিঁড়ে-খুঁড়ে গেল এবং ক্ষতবিক্ষত হতে লাগল তাদের গাগুলো। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে লাগল তারা।
যে পাহাড়ের উপর বিদ্রোহী সেনারা দাঁড়িয়ে ছিল সেই পাহাড়টার উপর দিকটা দেবসেনাদের দ্বারা পাথর নিক্ষেপের ফলে ভেঙে যেতে লাগল। বিদ্রোহী সেনারা তখন সে পাহাড় থেকে নেমে এসে শেষ চেষ্টা হিসাবে মরীয়া হয়ে যুদ্ধ করতে লাগল। উভয় পক্ষের চিৎকার-চেঁচামেচিতে তুমুল গোলমাল ধ্বনিত হতে লাগল। সে যুদ্ধে সমগ্র স্বর্গলোক বিকম্পিত হয়ে এক প্রবল ধ্বংসের সম্মুখীন হলো।
এমন সময় সর্বশক্তিমান পরম পিতা তার পবিত্র সিংহাসনে বসে তার অলৌকিক ঐশ্বরিক শক্তিবলে যুদ্ধের অবস্থার কথা সব জানতে পেরে তাঁর অনুগত অনুচরদের সঙ্গে পরামর্শ করতে লাগলেন। তিনি বললেন তার মহান উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য তার পুত্র গিয়ে শত্রুদের উপর চরম প্রতিশোধ নিয়ে তার ঐশ্বরিক শক্তি ও যোগ্যতার পরিচয় দিক। তার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসাবে তার যোগ্যতাকে প্রমাণিত করুক।
পরম পিতা এবার তাঁর পুত্রকে বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র, আমার গৌরবের উজ্জ্বল প্রতীক মূর্তি আমার অদৃশ্য মুখমণ্ডল তোমার মুখের মধ্যেই হয়ে ওঠে পরিদৃশ্যমান। আমার পরেই তুমি দ্বিতীয় সর্বশক্তিমান। দুই দিন গত হয়ে গেল আমাদের হিসাবে। মাইকেল তার সেনাদলসহ অবাধ্য বিদ্রোহীদের দমন করতে গেছে। তারা ঘোরতর যুদ্ধে প্রবৃত্ত। তুমি জান ব্যাপারটা আমি তাদের উপরেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। সৃষ্টির দিক থেকে সমস্ত দেবদূতই সমান, তারা সকলেই সমান শক্তিমান। শুধু পাপপ্রবৃত্তির ফলে শক্তিতে কিছুটা হীন হয়ে পড়ে বিদ্রোহী দেবদূতেরা। তবু তাদের জৈব দেহাবয়ব ধ্বংস হবে না কিছুতেই। যত যুদ্ধই হোক, শেষ পর্যন্ত জীবিত থাকবে তারা। সুতরাং কোন সমাধানই হবে না, নিষ্পত্তি হবে না এ যুদ্ধ ও বিরোধের।
একদিকে পাহাড়ের পাথর আর একদিকে আগ্নেয়াস্ত্র–এইভাবে দুপক্ষে যুদ্ধ চলছে। কিন্তু স্বর্গলোকে এই ধরনের বিধ্বংসী যুদ্ধ চলতে দেওয়া উচিত নয়। দু দিন তখন হয়ে গেছে। এখন তৃতীয় দিনে তুমি গিয়ে যুদ্ধের অবসান ঘটাবে। এটাই আমার বিধান। এ কাজ একমাত্র তোমার দ্বারাই সম্ভব। তোমার মধ্যে আমি এমন সব আলোকসামান্য গুণের গরিমা ও অতুলনীয় শক্তির মহিমা প্রভূত পরিমাণে সঞ্চারিত করেছি যাতে স্বর্গ ও নরকের সকলে সে গুণ ও শক্তির পরিচয় পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। এই অন্যায় বিদ্রোহ দমন করে স্বর্গরাজ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসাবে তোমার যোগ্যতাকে একান্তভাবে সপ্রমাণিত করবে তুমি।
সুতরাং পিতার শক্তিতে সর্বশক্তিমান হয়ে রথে চড়ে এখনি চলে যাও। আমার সৈন্যসামন্ত এবং ধনুর্বাণ ও বজ্র এই অমোঘ অস্ত্রটি নিয়ে যাও। তোমার কটিদেশে থাকবে তরবারি। দ্রুতগতিতে রথ চালনা করবে। সেই সব অপরিণামদশী বিদ্রোহীদের স্বর্গলোকের ত্রিসীমানা থেকে বিতাড়িত করে নরকের গভীর অন্ধকারে নিক্ষেপ করবে। সেখানে গিয়ে তারা বুঝতে পারবে ঈশ্বর ও তার পুত্রকে অবজ্ঞা করার পরিণাম কী ভীষণ।
ঈশ্বর এই কথাগুলি বললে তাঁর পুত্রের মুখমণ্ডলে এক স্থির জ্যোতি ফুটে উঠল। তিনি পরমপিতার কথাগুলি হৃদয়ঙ্গম করলেন যথাযথভাবে। তারপর পিতার প্রতি ভক্তিনম্র চিত্তে বললেন, হে স্বর্গাধিপতি, পরমপিতা, তুমি সর্বোচ্চ, সর্বোত্তম ও পবিত্রতম। তুমি সকল সময় তোমার পুত্রকে গৌরবান্বিত করতে চাও। আমিও স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গতভাবে তোমাকে গৌরবান্বিত করতে চাই। তোমার গৌরবেই আমার গৌরব, তোমার আনন্দেই আমার আনন্দ। তোমার ইচ্ছাপূরণ করাতেই আমার পরম সুখ। তুমি যে রাজদণ্ড, রাজক্ষমতা ও দায়িত্বভার অর্পণ করেছ আমাকে আমি তা সানন্দে বহন করে যাব। তুমি কিন্তু শেষ পর্যন্ত সর্বেসর্বা রয়ে যাবে। তুমি সর্বশক্তিমানই থাকবে এবং তোমার শক্তিতেই আমি হব শক্তিমান। তুমি যাদের ভালবাস তারা হবে আমার আশ্রিত। তুমি যাদের ঘৃণা করো আমিও তাদের ঘৃণা করব। তোমার করুণাময় মূর্তির মত তোমার ভীতিপ্রদ মূর্তিটিও মূর্ত আমার মধ্যে। সকল বিষয়েই আমি তোমার প্রতিরূপ। আমি তোমার শক্তিতে শক্তিমান হয়ে স্বর্গলোককে মুক্ত করব বিদ্রোহীদের কবল থেকে। তাদের কু-উদ্দেশ্যে নির্মিত দুর্গ হতে বিতাড়িত করে কীটকণ্টকিত নরকের অন্ধকারে নিক্ষেপ করব। এইভাবে অন্যায়কারী ঈশ্বরদ্রোহীদের শাস্তি দেব। বুঝিয়ে দেব তোমার প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্যেই আছে পরম সুখ। তারপর তোমার ভক্তবৃন্দের সঙ্গে সুর মিলিত করে স্তোত্রগান করব।
এই বলে তার আসন হতে রাজদণ্ড হাতে উঠে পড়ল ঈশ্বরপুত্র। তখন স্বর্গলোকে ছড়িয়ে পড়ল তৃতীয় দিনের পবিত্র প্রভাতের আলো। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো অভিযান। পরম পিতার রথটি উজ্জ্বল আলোক বিকীর্ণ করতে করতে আপন বেগে এগিয়ে চলতে লাগল। সে রথে কোন অশ্ব যযাজিত ছিল না। স্বয়ংচালিত সেই রথে ঈশ্বরপুত্র ছাড়া ছিল চারজন চেরাবজাতীয় দেবদূত। তাদের মাথার উপর নীল শূন্যে নীলকান্তমণিখচিত সিংহাসনের উপর ঈশ্বরপুত্র আরূঢ় ছিলেন। তাঁর একপাশে ছিল ঈশ্বরের মত পাখাবিশিষ্ট বিজয়মূর্তি। তার একপাশে ছিল একটি বড় ধনুক আর একটি তুণের মধ্যে দ্বিমুখী বজ্র। তার চারপাশে ধূমায়িত অগ্নিশিখা হতে অসংখ্য ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছিল। তিনি হাজার হাজার সাধুপ্রকৃতির দেবদূতদের দ্বারা পরিবৃত ছিলেন। তার পশ্চাতে ছিল অসংখ্য রথ।
দূর হতে অসংখ্য রথ সেনাসমভিব্যাহারে স্বচ্ছ আকাশপথে উজ্জ্বলভাবে আসতে দেখে মাইকেল যুদ্ধ বন্ধ করে পাহাড়ের পাথরগুলিকে সাজিয়ে রাখতে লাগল যথাস্থানে। ঈশ্বরপুত্রের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়টি আবার পুষ্পিত গাছপালায় শোভিত হয়ে উঠল।
হতভাগ্য শত্রুরা তাঁকে দেখেও স্থির অনমনীয় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারা কিছু না জেনেই হতাশা থেকে কোনরকমে আশা আহরণ করে তাদের সমস্ত শক্তিকে যুদ্ধের জন্য সংহত করল। কোন স্বর্গীয় আত্মার মধ্যে কখনো এই ধরনের বিকৃত প্রবৃত্তি থাকতে পারে না। কিন্তু যারা অহঙ্কারী, উদ্ধত ও ঈশ্বরদ্রোহী তারা স্বর্গবাসী হলেও কখনো কোন লক্ষণ থেকে কিছু শিক্ষা পায় না। কোন অলৌকিক আশ্চর্যজনক ঘটনা দেখেও তাদের অনমনীয় আত্মা নত হয় না।
ঈশ্বরপুত্রের অলৌকিক শক্তি ও ঐশ্বর্য দেখেও তারা পরিশুদ্ধ ও নত হওয়ার পরিবর্তে কঠোর হয়ে উঠল আরও। তাঁর সমুন্নত অবস্থা ও ঐশ্বর্য দেখে তাদের মধ্যে ঈর্ষা জাগল, প্রবল হয়ে উঠল তাদের অসঙ্গত উচ্চাভিলাষ। তারা আরও ভয়ঙ্করভাবে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠল। তারা স্থির করল মনে মনে হয় তারা তাদের শক্তি বা প্রতারণার দ্বারা ঈশ্বর ও তার পুত্রের উপর নিজেদের প্রভুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করবে, হয় তারা জয়লাভ করবে আমরা শোচনীয় পতন বা সর্বনাশকে বরণ করে নেব। এইভেবে তারা শেষ যুদ্ধের জন্য সমবেত হলো।
ঈশ্বরপুত্র তখন তার দুদিকে সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান সেনাদলকে সম্বোধন করে বললেন, হে সশস্ত্র দেবদূতগণ ও সাধু আত্মাগণ, এখন সারিবদ্ধ ও সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়াও। আজ যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত থাক। তোমরা আজ ঈশ্বরের ন্যায়সঙ্গত উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য যুদ্ধ করতে এসেছ। তোমাদের এই কাজ ঈশ্বরের দ্বারা সমর্থিত। তোমরা তাই অজেয় এ যুদ্ধে। কিন্তু অন্যদিকে এ সব অভিশপ্ত বিদ্রোহী সেনাদের চরম শাস্তি পেতেই হবে। তোমাদের সংখ্যা বা শক্তির পরিমাণ যাই হোক, তোমরা শুধু দেখ ঈশ্বরের রোষাগ্নি ঈশ্বরদ্রোহী নাস্তিকদের উপর আমার মধ্য দিয়ে কিভাবে ঝরে পড়ে। ওরা তোমাদের অবজ্ঞা বা তুচ্ছজ্ঞান করেনি, করেছে আমাকে। তারা আমার প্রতি ঈর্ষান্বিত ও ক্রুদ্ধ। কারণ ঈশ্বরের যা কিছু রাজক্ষমতা ও গৌরব আছে তা তিনি আমাকেই দান করেছেন। তার ইচ্ছামত প্রভূত সম্মানে ভূষিত করেছেন আমাকে।
তাই তাদের ধ্বংসসাধনের ভার আমারই উপর ন্যস্ত করেছেন পরম পিতা। তারা তাদের ইচ্ছাপূরণের জন্য আমার সঙ্গে যুদ্ধ করবে। আমার ও তাদের মধ্যে এ যুদ্ধে কে বেশি শক্তিশালী–এটাই দেখতে চায় কারণ শুধু শক্তির মাধ্যমেই সকলের সব মহত্ত্বকে যাচাই করতে চায়। অন্যান্য গুণের বিচার করতে চায় না তারা। সুতরাং আমি আমার শক্তিরই পরীক্ষা দিতে চাই তাদের সমক্ষে।
এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরপুত্রের মুখমণ্ডল এমন ভীতিপ্রদ হয়ে উঠল যে সেদিকে তাকানোই যায় না। এবার তার রোষকশায়িত কুটি শত্রুদের করলেন তিনি।
সঙ্গে সঙ্গে তার রথের উপর যে চারজন দেবদূত ছিল তারা তাদের নক্ষত্রখচিত পাখাগুলি মেলে ধরল। তার ফলে এক বিরাট ছায়া বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। রথের চাকাগুলি বন্যা বা প্রবল জলোচ্ছাসের গর্জনের মত প্রচণ্ড শব্দ তুলে বিষাদের অন্ধকারে নিমজ্জিত শত্রুদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। একমাত্র ঈশ্বরপুত্রের সিংহাসন ছাড়া রথের সব কিছুই কাঁপতে লাগল।
ক্রমে শত্রুসেনাদের মাঝখানে গিয়ে উপস্থিত হলো সেই রথ। ঈশ্বরপুত্রের ডান হাতে ছিল দশ হাজার বর্জ। সেগুলি নিক্ষেপ করার জন্য তুলে ধরলেন তিনি। তা দেখে বিস্ময়াভিভূত শত্রুসেনাদের সব প্রতিরোধক্ষমতা লুপ্ত হয়ে গেল। তারা সব সাহস হারিয়ে ফেলল। তাদের মনে হলো তাদের অস্ত্রগুলি সব বিকল হয়ে গেছে। মনে হলো, সে অস্ত্রপ্রয়োগে কোন কাজ হবে না। তারা ভেবেছিল তাদের উপর আগের মত আবার পাহাড় থেকে পাথর নিক্ষেপ করা হবে। কিন্তু পাথরের পরিবর্তে ঝড়ের বেগে অজস্র বজ্রবাণ বর্ষিত হতে লাগল তাদের উপর।
তখন রথের উপর সেই চারজন দেবদূতের চোখ হতে বিদ্যুতাগ্নি বিচ্ছুরিত হতে লাগল অভিশপ্ত সেনাদের উপর। মনে হলো চারজন দেবদূতের চারজোড়া চোখ অজস্র হয়ে উঠেছে সংখ্যায়। ফলে সব শক্তি হারিয়ে একেবারে হতোদ্যম হয়ে পড়ল বিদ্রোহীরা।
তথাপি ঈশ্বরপুত্র মাত্র অর্ধেক শক্তি প্রয়োগ করেছিলেন। এই যুদ্ধে তাঁর সব। শক্তি প্রয়োগ করলে একেবারে ধবংস হয়ে যেত বিদ্রোহী সেনারা। তাই তিনি বজ্রগুলি নিক্ষেপ করলেও মাঝপথে সেগুলিকে থামিয়ে দিলেন। শত্রুদের ধ্বংস করার কোন উদ্দেশ্য ছিল না তার। তাদের স্বর্গ থেকে উৎখাত ও বিতাড়িত করাই ছিল তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য।
বিদ্রোহী সেনারা আর যুদ্ধ করতে না পারলে ঈশ্বরপুত্র বজ্রাহত ম্রিয়মাণ মেষপালের মত তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন স্বর্গলোকের সীমান্তবর্তী প্রাচীরের দিকে।
বিদ্রোহীরা সেই প্রাচীরের নিকটে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রাচীর আপনা থেকে ভিতরে সরে এসে তার একটা বিস্তৃত অংশ উন্মুক্ত করে পথ করে দিল। কিন্তু সে প্রাচীরের ওপারে কোন পথ ছিল না। স্বর্গের প্রাচীর যেখানে শেষ হয়েছে তার পরেই এক শূন্য গহ্বর শুরু হয়ে অতল নরকপ্রদেশ পর্যন্ত নেমে গেছে।
সেই অতলান্তিক অন্ধকার শূন্য গহ্বরের পানে একবার তাকিয়েই ভয়ে কিছুটা পিছিয়ে এল বিদ্রোহীরা। কিন্তু পিছিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আবার অজস্র বজ্রসহ তাড়া করলেন ঈশ্বরপুত্র। তারা তখন দেখল পতনের থেকে সেই বজ্রাগ্নির জ্বালা আরও ভয়াবহ। তাই আর তিলমাত্র অপেক্ষা না করে শেষ সীমানা থেকে অন্ধকার শূন্য গহুরে ঝাঁপ দিল বিদ্রোহীরা।
তখন ঈশ্বরপুত্র তাদের অনুসরণ না করলেও ঈশ্বরের রোষাগ্নির জ্বালা অনুভব করতে লাগল নরকপ্রদেশ পর্যন্ত। অধঃপতিত বিদ্রোহী নাস্তিকদের কাতর আর্তনাদে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সমগ্র নরকপ্রদেশ। তারা বুঝতে পারল স্বর্গবাসীদের একটি দলই স্বর্গলোক ধ্বংস করে দেবার উপক্রম করেছিল। পরে যুদ্ধে পরাভূত হয়ে ঈশ্বরের বিধানে এই নরকের গভীরে শাস্তিভোগ করতে এসেছে। পুরো নয়দিন ধরে বিদ্রোহীদের পতন চলতে লাগল। প্রচুর গোলমাল ও চেঁচামেচি চলতে লাগল। নরকগহুর মুখ বিস্তার করে পাপাত্মা বিদ্রোহীদের গ্রাস করল সকলকে। তারপর সমস্ত বিদ্রোহী নরকপ্রদেশে প্রবেশ করলে নরকের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। নরকদ্বার রুদ্ধ হলো। অনির্বাণ অগ্নিদ্বারা প্রজ্জ্বলিত, অন্তহীন দুঃখ ও যন্ত্রণার আধার নরকপ্রদেশই তাদের উপযুক্ত বাসস্থান।
এদিকে স্বর্গলোক বিদ্রোহীদের কবল হতে মুক্ত হয়ে আনন্দোৎসব করতে লাগল। যুদ্ধের জন্য স্বর্গলোকের যে সব জায়গা ভেঙেচুরে গিয়েছিল, সে সব জায়গা শীঘ্রই মেরামত হয়ে গেল। তার শত্রুদের স্বর্গের সীমানা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত করে একমাত্র বিজয়ী হয়ে তার বিজয়রথ যুদ্ধক্ষেত্র হতে ঘুরিয়ে রাজধানীর অভিমুখে চালিত করতে লাগলেন ঈশ্বরপুত্র।
সর্বদশী সর্বশক্তিমান ঈশ্বর কিন্তু এতক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে দুর থেকে সব কিছুই প্রত্যক্ষ করছিলেন। অনুগত দেবদূতসেনারা যখন তালপাতা মাথায় দিয়ে ঈশ্বরের যোগ্যতম বিজয়ী বীরপুত্রের জয়গান গাইতে গাইতে আসছিল তখন তা দেখতে পেয়ে ঈশ্বর এগিয়ে গেলেন কিছুটা তাদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্য।
স্বর্গলোকে স্থাপিত যে সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলেন ঈশ্বরপুত্র মেসিয়া সেদিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। ঈশ্বরও সাদরে বরণ করেছিলেন তাদের।
আমি তোমার অনুরোধে স্বর্গলোকে যা যা ঘটে গেছে তার বিষয় বলেছি যাতে তুমি অতীতের ঘটনাবলীর সম্বন্ধে সচেতন হয়ে শিক্ষা পেতে পার। কোন মানুষের পক্ষে যা জানা সম্ভব নয় তোমার কাছে তা ব্যক্ত করছি। স্বর্গে ঈশ্বরের সঙ্গে যে বিরোধ বাধে এবং যে যুদ্ধ হয় আর সেই যুদ্ধের ফলে উচ্চাভিলাষী দেবদূতদের পতন ঘটে তার কথা সব বলেছি তোমায়। যে শয়তান বিদ্রোহী দেবদূতদের নেতৃত্বদান করে ঈশ্বর ও ঈশ্বরপুত্রের বিরুদ্ধে সেই শয়তান তোমার সুখী অবস্থার প্রতি ঈর্ষান্বিত। সে এখন তুমি যাতে ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য ও ভক্তি হতে বিচ্যুত হয়ে স্বর্গসুখ হতে বঞ্চিত হও এবং তার মত নরকে গিয়ে শাস্তিভোগ করতে থাক অনন্তকাল ধরে তার জন্য সে চক্রান্ত করছে। প্ররোচিত করবে সে তোমাকে ঈশ্বরের বিরোধিতা করতে। সেটা করাই হবে তার সান্ত্বনা ও ঈশ্বরের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ। সে তোমাদের তাদের দুঃখ ও যন্ত্রণার অংশভাগী করে খুশি হতে চায় কিন্তু তার প্রলোভনে যেন তুমি সাড়া দিও না কখনো। তোমার দুর্বলতর সাথীকে এ বিষয়ে সাবধান করে দিও। শয়তান তার অবাধ্যতা ও ঈশ্বরদ্রোহিতার প্রতিফলস্বরূপ যে শাস্তি পায় তার ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত দেখে তুমি সাবধান হতে পার। মনে রাখবে যে যত শক্তিমানই হোক পতনকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি সে। সুতরাং ঐশ্বরিক বিধান লঙ্ঘনের প্রতিফলের প্রতি সচেতন থাকবে।
০৬ষ্ঠ সর্গ
ষষ্ঠ সর্গ
হে ইউরানিয়া, আমি অলিম্পাস পর্বতের ঊর্ধ্বলোকে বিরাজিত যে স্বর্গলোকে কাব্য ও সঙ্গীতের অধিষ্ঠাত্রী দেবীদের অনুগৃহীত অশ্ব পেগাসের পাখায় ভর করে উড়ে যেতে চাই সেই স্বর্গলোক হতে তোমার অলৌকিক কণ্ঠনিঃসৃত সুরধারা সহ নেমে এস। তুমি স্বর্গজাত, শিল্পকলার অধিষ্ঠাত্রী নয়জন দেবীর সঙ্গে সুপ্রাচীন অলিম্পাস পর্বতের উপর বাস করো।
তুমি সেই পর্বতে ঝর্ণার ধারে তোমর কোন জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর সঙ্গে কথা বল। তুমি একবার তোমার বোনের সঙ্গে পরম পিতাকে অলৌকিক সঙ্গীত শুনিয়ে তাঁকে প্রীত করেছিলে।
আমি ভেবেছিলাম আমার মত একজন মর্ত্যলোকের অতিথিকে আকাশমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে পথ দেখিয়ে স্বর্গলোকে নিয়ে যাবে এবং আবার নিরাপদে আমাকে আমার এই মর্ত্যলোকের আবাসভূমিতে পৌঁছিয়ে দিয়ে যাবে। তা না হলে শিমেরাকে হত্যা করে বেলারোফোন যেমন পক্ষীরাজ ঘোড়ায় করে স্বর্গে যেতে গিয়ে দেবরাজ জিয়াসের কোপে লাইসিয়ায় এ্যানিয়ার সমতলভূমিতে পতিত হয়েছিল, আমারও হয়ত তেমনি অবস্থা হবে। সুতরাং স্বর্গলোকে একাকী যাওয়া বা সেখানে ঘুরে বেড়ানো আমার পক্ষে বিপজ্জনক।
আমার সব গান গাওয়া এখনো হয়নি। অর্ধেক বাকি আছে।
আমি একজন মরণশীল মানুষ, এই মর্ত্যভূমির সীমার ঊর্ধ্বে উঠতে পারি না। আমি এই মর্ত্যভূমির উপর নিরাপদে দাঁড়িয়ে আপন মনে আপন কণ্ঠে গান করি কিন্তু সে গানের সুর ঠিক হয় না। দুঃখকষ্ট দুঃসময়ের অন্ধকারে নিষ্ফল হয়ে বিপদের আশঙ্কার দ্বারা পরিবৃত হয়ে আমি একাকী গান করি। কিন্তু তুমি যখন রাত্রিতে আমার ঘুমের মধ্যে আবির্ভূত হও, তখন আর আমি একা থাকি না।
হে ইউরানিয়া, তুমি আমার গানকে শ্রুতিমধুর করে তোল। কিন্তু সুরার দেবতা আনন্দোন্মত্ত বেকারসের বেসুরো বর্বর সঙ্গীতের মত সে সঙ্গতি যেন না হয়। বেকাস একবার রোডোপে একজন থ্রেসীয় চারণকবিকে রেগে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলেন। সেখানে প্রতিটি অরণ্য ও পাহাড় উল্লসিত হয়ে সেই কবির গান শুনত। কিন্তু মত্ত বেকাসের অত্যাচারে সেই কবির কণ্ঠ ও বীণার সুর পৈশাচিক তর্জন-গর্জনের মধ্যে ডুবে যায়। তখন মিউজ বা সঙ্গীত ও কাব্যকলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী তাঁর পুত্রকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। হে ইউরানিয়া, আমি তোমাকে অনুনয়-বিনয় করছি, আমার কথা শোন। কারণ তুমি স্বর্গের দেবী।
হে দেবী বল, অন্যতম প্রধান দেবদূত রাফায়েল শয়তানদের সেই ভয়ঙ্কর পতনের দৃষ্টান্ত দ্বারা আদমকে সতর্ক করে দিলে কি হলো। যাতে আদম ও মানবজাতির স্বর্গীয় বিধান লঙ্ঘনের জন্য শয়তানদের মত পতন না হয় তাকে বারবার সাবধান করে দিল, তারা যেন সেই জ্ঞানবৃক্ষকে স্পর্শ না করে। তারা ক্ষুধাতৃপ্তির জন্য যে কোন বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করতে পারে, কিন্তু তারা যেন জ্ঞানবৃক্ষের ফল আস্বাদন করতে না যায়। তারা যদি ঈশ্বরের অমোঘ নিষেধাজ্ঞা ঘুণাক্ষরেও অমান্য করে তাহলে তাদেরও পতন অনিবার্য। এই বলে তাদের সাবধান করে দিল রাফায়েল।
রাফায়েলের কথাগুলি এবং অতীতের কাহিনী শ্রদ্ধা ও মনোযোগসহকারে শুনল আদম ও তার স্ত্রী ঈভ। শুনতে শুনতে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগল তারা। কথাগুলি অদ্ভুত মনে হলো তাদের। যে স্বর্গলোকে স্বয়ং ঈশ্বর বাস করেন এবং সতত পরম শান্তি ও স্বর্গীয় সুখ বিরাজ করে সেই স্বর্গে ঘৃণা, যুদ্ধবিগ্রহ বা কোন শৃংখলার স্থান থাকতে পারে–একথা অকল্পনীয় তাদের কাছে। তবে যাই হোক, অশুভ শক্তিগুলি শীঘ্রই নিঃশেষে বিতাড়িত হয়েছে স্বর্গ থেকে। অশুভ শক্তি কখনো পরম শুভ ঐশ্বরিক শক্তির সঙ্গে থাকতে পারে না মিলেমিশে।
অবশেষে আমাদের মনে যে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল সে তা ব্যক্ত করল। তবু তার মন ছিল নিষ্পাপ। তাদের জানতে ইচ্ছা হলো কিভাবে এই জগৎ এবং স্বর্গলোকের উৎপত্তি হয়। কখন, কার দ্বারা এবং কি কারণে সৃষ্ট হয় এই স্বর্গ-মর্ত্য? এই ইডেনের ভিতরে বা বাইরে কিভাবে সব জিনিস সৃষ্ট হয়? ইডেনের ভিতরে যে সব ঝর্ণা আছে তার কলতান শোনার সঙ্গে সঙ্গে কেন পিপাসা বেড়ে যায়?
স্বর্গীয় অতিথি রাফায়েলের কাছ থেকে আরও কিছু জানার জন্য আদম বলে যেতে লাগল, এই জগতের বাইরের অনেক বিষয়ের রহস্য উদঘাটন করে তুমি ঈশ্বরের নির্দেশে আমাদের অনেক বিষয়ে যথাসময়ে পূর্ব হতে সতর্ক করে দিয়েছ যা মানুষ কখনো তার সীমিত জ্ঞানের দ্বারা জানতে পারে না এবং তা জেনে আমরা ভুল করে বসলে সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হতাম আমরা। এজন্য পরম মঙ্গলময়ের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ এবং তাকে অশেষ ধন্যবাদ। আমরা পরম নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর উপদেশাবলী মেনে চলব এবং তার ইচ্ছা পূরণ করে চলব।
যেহেতু তুমি পার্থিব জ্ঞানের অতীত পরম জ্ঞানের বিষয় আমাদের শিক্ষার জন্য অনেক বলেছ সেইহেতু আমি আরও কিছু জানতে চাই এবং তা আমাদের জানা উচিত বলে মনে করি। তুমি না বললে এসব আরও কোনদিন জানা সম্ভব হবে না আমাদের পক্ষে।
এখন দয়া করে বল, আমাদের ঊর্ধ্বে দূরে যে স্বর্গলোক দেখতে পাচ্ছি, যার চারপাশে অসংখ্য জ্যোতিষ্কমণ্ডলী মহাশূন্যে শৃংখলাবদ্ধভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং যার ভতরে ও বাইরে সর্বত্র বায়ু প্রবাহিত হয়ে চলেছে, পরমস্রষ্টা কি কারণে তাঁর পবিত্র বিশ্রাম ব্যাহত করে তা সৃষ্টি করেন? অনন্ত বিশৃংখলা আর শূন্যতার মাঝে কিভাবে শুরু হয় তার সৃষ্টিকার্য এবং কত শীঘ্রই বা তা শেষ হয়? ঈশ্বরের এইসব অনন্ত সৃষ্টিকার্যের রহস্যময় বিষয়গুলি আমাদের জানালে আমরা তার মহিমা কীর্তন করতে পারি। তাতে তাঁর গৌরব আরো বাড়বে ছাড়া কমবে না। এখনো দিনের আলো শেষ হয়নি, শেষ হয়নি সূর্যের আকাশ পরিক্রমা। সূর্য যেন তোমার মুখ থেকে তার বংশধারার উৎপত্তির কথা শুনতে চায়, শুনতে চায় কি করে এই বিশ্বপ্রকৃতি শূন্যতার অনন্ত গর্ভ হতে সৃষ্ট হয়। এরপর সন্ধ্যাতারা আর চন্দ্রও হয়ত তোমার কথা শুনতে আসবে। তারপর বিশুদ্ধতা ও নিদ্রাসহ রাত্রি এসেও তোমার কথা শুনতে চাইবে। অবশেষে রাত্রি প্রভাত হলে তুমি চলে যাবে।
আদমের কথা শেষ হলে দেবদূতপ্রধান রাফায়েল শান্তকণ্ঠে বলতে লাগল, তুমি সাবধানে অনুরোধ করলেও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অনন্ত সৃষ্টিকার্যের সব কথা ভাষায় ব্যক্ত করা কোন দেবদূতের পক্ষে সম্ভব নয়, কোন মানুষের পক্ষে তা বোঝাও সম্ভব নয়। তথাপি স্রষ্টার গৌরববৃদ্ধি করার মানসে এবং তোমাকে সুখী করার জন্য তোমাকে আমি তা শোনাব। কারণ একটি বিশেষ সীমার মধ্যে থেকে তোমার জ্ঞানপিপাসাকে নিবৃত্ত করার জন্য ঈশ্বর আমাকে পাঠিয়েছেন। তাঁর বাইরে আর কিছু জানতে চেও না এবং নিজের কোন চেষ্টার দ্বারাও তা জানতে যেও না। অদৃশ্য সর্বজ্ঞ ঈশ্বর তার আপন আত্মার গুহান্ধকারেই তা নিহিত রেখেছেন। স্বর্গ বা মর্ত্যের কারোরই সে বিষয় জ্ঞাতব্য নয়। সেই পরম গুহ্য বিষয় ছাড়া আর সব কিছুই জানতে পার। জ্ঞান হচ্ছে একরকম খাদ্যের মত। খাদ্যের মত জ্ঞানও হবে পরিমিত। অপরিমিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে খাদ্য গ্রহণ করলে যেমন দেহের ক্ষতি হয় তেমনি অনিয়মিত জ্ঞানও নির্বুদ্ধিতায় পরিণত হয়।
জেনে রাখ, স্বর্গের ভূতপূর্ব দেবদূতদের প্রধান লুসিফারের পতন ঘটলে এবং সে তার অনুগত বিদ্রোহী সেনাদের নিয়ে জ্বলন্ত নরককুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হলে ঈশ্বরপুত্র সদলবলে ঈশ্বরের সিংহাসনের কাছে বিজয়গৌরবে ফিরে এলেন।
ঈশ্বর তখন তাঁর পুত্রকে বললেন, অবশেষে আমার প্রতিহিংসাপরায়ণ শক্তির পতন ঘটল। ব্যর্থ হলো তাদের সশস্ত্র বিদ্রোহ। সে ভেবেছিল স্বর্গের সব দেবদূতই তার মত বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। ভেবেছিল স্বর্গের সব দেবদূতদের ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুলে তাদের সাহায্যে আমাদের সিংহাসনচ্যুত করে সমগ্র স্বর্গসাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে উঠবে। তাই সে প্রতারণা ও ছলনামূলক কথায় অনেক দেবদূতকে বশীভূত করে বিদ্রোহী করে তোলে। তাদেরও তাই পন ঘটে। তাদের আর কোন দিন স্থান হবে না এই স্বর্গলোকে। তবে বেশির ভাগ দেবদূতই আজও আমার অনুগত আছে। স্বর্গের জনসংখ্যা খুব একটা কম না হলেও এই স্বর্গলোকের মধ্যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল আছে যেখানে কোন লোকবসতি নেই। তাছাড়া এখানে মন্দিরে আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম ও পূজা-অর্চনার জন্য অনেক লোক দরকার। কিন্তু ইতিমধ্যেই আমার এই স্বর্গলোকের অনেক অধিবাসীদের তার দলভুক্ত করে নিয়ে গিয়ে যে ক্ষতি সে আমার করেছে সে ক্ষতি পূরণ করতে হবে আমাকে।
আমার যতই ক্ষতি হোক, আমি একমুহূর্তে আর এক জগৎ সৃষ্টি করব। একজন মানুষ থেকে অসংখ্য মানুষ জন্মলাভ করে সে জগতে বাস করবে। সে জগৎ হবে এই স্বর্গলোক থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এই মানবজাতিকে তাদের গুণাবলীর উন্নতিসাধনের দ্বারা ধীরে ধীরে উন্নীত করার জন্য কিছুকাল তাদের সেই জগতে অর্থাৎ মর্ত্যলোকে রাখব। সেখানে তাদের আনুগত্য ও ঈশ্বরভক্তির পরীক্ষা করব। পরে তারা সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে এবং দেবোপম গুণগরিমায় সমুন্নত হলে আমি তাদের সেই মর্ত্যকে একদিন স্বর্গলোকে পরিণত করব এবং এই স্বর্গ ও মতের সব ব্যবধান লুপ্ত করে দিয়ে দুটি জগৎকে এক করে তুলব। দুটিকে যুক্ত করে এক রাজ্যে পরিণত করব এবং সেই সম্মিলিত স্বর্গরাজ্যে দেবতা ও মানুষ সব এক হয়ে সকলে মিলেমিশে এক অনন্ত মিলনানন্দ উপভোগ করবে।
এখন আমি তোমার মাধ্যমে এ কাজ করতে চাই। তুমিই এ কাজ সম্পন্ন করবে। সুতরাং হে আমার পুত্র, তুমি যাও। এই স্বর্গলোকের নিম্নদেশে যে শূন্যতার গহ্বর অতলান্তিক গভীরে নেমে গেছে, তুমি সে শূন্যতাকে শুধু মর্ত্যলোকে পরিণত হবার জন্য আদেশ করবে। সঙ্গে সঙ্গে তা মর্ত্যজগৎ হয়ে উঠবে। মনে রাখবে, সেই শূন্যতার মাঝেও আমি আছি। আমার সীমাহীন অন্তহীন সত্তা কোন এক বিশেষ স্থানে আবদ্ধ থাকে না। আমি জলে স্থলে অন্তরীক্ষের শূন্যতায় এক সর্বব্যাপী মহাসত্তায় বিরাজিত থাকি।
সর্বশক্তিমান ঈশ্বর এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সে আদেশ কার্যকরী করার জন্য সময়ের থেকে দ্রুতগতিতে চলে গেলেন ঈশ্বরপুত্র। ঈশ্বরের এই ইচ্ছা ঘোষিত হতেই এক বিপুল আনন্দের সাড়া পড়ে গেল স্বর্গলোকে। ঈশ্বরের জয়গান গাইতে লাগল দেবদূতেরা। ভবিষ্যৎ মানবজাতির শান্তিপূর্ণ আবাসভূমির প্রতি অকুণ্ঠ শুভেচ্ছা জানাতে লাগল তারা। তারা বলল, ঈশ্বরের প্রতিশোধাত্মক রোষ পবিত্র স্বর্গভূমি হতে ঈশ্বরদ্রোহীদের ও সকল অশুভ শক্তিকে ন্যায়সঙ্গতভাবে বিতাড়িত করে তাদের জায়গায় এক নূতন প্রজাতিকে সৃষ্টি করতে চলেছেন।
এইভাবে পরম মঙ্গলময় ও পরম স্রষ্টা ঈশ্বরের গৌরবগান করতে লাগল সাধু দেবদূতেরা। তারা বুঝতে পারল এইভাবে তাদের পরম-পিতার মঙ্গলময় শুভপ্রসারী হস্ত লোকে লোকান্তরে যুগ যুগান্তরে চিরকাল ধরে প্রসারিত হবে।
এদিকে ঈশ্বরপুত্রের সেই বিরাট সৃষ্টি-অভিযান শুরু হয়ে গেল। সর্বশক্তিমানের শক্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে তার জ্যোতিতে মস্তক ও মুখমণ্ডলকে দ্যোতিত করে তিনি যাত্রা শুরু করার জন্য প্রস্তুত হলে অসংখ্য রথ এসে উপনীত হলো তাঁর সামনে। অসংখ্য দেবদুত তাঁর সহকারী হিসাবে তার সঙ্গে যাবার জন্য এগিয়ে এল।
স্বর্গের অনন্ত ঐশ্বর্যসম্ভার ও অজস্র দেবদূতে পরিপূর্ণ রথগুলি যেতে লাগল । স্বর্গসীমান্তের দিকে। সবার আগে ছিল ঈশ্বরপুত্রের রথ। ঘর্ঘর শব্দে রথগুলি নিকটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গদ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেল আপনা থেকে।
এক নূতন জগৎসৃষ্টির মানসে অগ্রসরমান ঈশ্বরপুত্র ও দেবদূতেরা স্বর্গলোকের সেই শেষ প্রান্তে উপনীত হয়ে থামলেন।
ঈশ্বরপুত্র সেখান থেকে দৃষ্টি প্রসারিত করে অবলোকন করলেন। তিনি দেখলেন, স্বর্গলোকের প্রান্তসীমা যেখানে শেষ হয়েছে সেই উপকূলভাগের পর থেকেই শুরু হয়েছে এক অপরিমেয় শূন্যতার অন্ধকার গহুর। সে শূন্যতার যেন শেষ নাই, সমুদ্রের মতোই অন্তহীন, অতলান্তিক ও সর্বগ্রাসী সেই শূন্য গহ্বরের অতল থেকে সমুদ্র তরঙ্গের মতই বেগবান বাতাসের বিশাল ঢেউগুলি সমুন্নত স্বর্গলোককে আঘাত হানার জন্য ছুটে আসতে লাগল প্রবলতম উচ্ছ্বাসে।
ঈশ্বরপুত্র সেইদিকে তাকিয়ে জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, স্তব্ধ হও হেবিক্ষুব্ধ বায়ুপ্রবাহ ও তরঙ্গমালা, হে গভীর গহুর, শান্ত হও। তোমাদের সর্বগ্রাসী ক্ষোভের অবসান ঘটুক।
এই বলে কিন্তু ক্ষান্ত হয়ে রইলেন না ঈশ্বরপুত্র। তিনি দেবদূতদের পাখায় ভর করে তার পরম পিতার গৌরবে গৌরবমণ্ডিত হয়ে সেই শূন্যগহ্বরের মধ্যে ঝাঁপ দিলেন। এক সীমাহীন শূন্যতার মধ্য থেকে কোন্ অলৌকিক শক্তিবলে এক নূতন জগতের সৃষ্টি করেন ঈশ্বরপুত্র তা দেখার জন্য দেবদূতেরাও তাঁর সঙ্গে তাদের পাখা মেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই গহ্বরে।
সেই নতুন জগতের পরিধি ও সীমা নির্ধারণের জন্য হাতে একটি সোনার দিকনির্ণয়যন্ত্র নিলেন ঈশ্বরপুত্র। একটি পাকে শূন্যে এক জায়গায় স্থাপন করে সেটিকে কেন্দ্র করে আর একটি পাকে প্রসারিত করে ও চক্রাকারে ঘুরিয়ে তিনি বলতে লাগলেন, হে নবজাত জগৎ, তুমি এই পর্যন্ত প্রসারিত হবে, এই হবে তোমার পরিধি বা প্রান্তসীমা।
এইভাবে শূন্য থেকে সৃষ্টি হয় এই পৃথিবীর। সৃষ্টির আগে সেই সর্বব্যাপী শূন্যতা গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল। তারপর প্রথমে শান্ত জলরাশির সৃষ্টি হলো। ঈশ্বরের আত্মা তখন সেই শান্ত জলরাশির উপর পাখা বিস্তার করে তাঁর প্রাণশক্তির সঞ্চার করলেন। সেই তরল পদার্থকে উত্তপ্ত করলেন। তারপর তার উপর বাতাস ও মাটি সৃষ্টি করে তাদের এক ভারসাম্যের মধ্যে স্থাপন করলেন। এইভাবে পৃথিবীর উৎপত্তি হলো।
তারপর ঈশ্বর বললেন, আলো হোক। সঙ্গে সঙ্গে সেই অন্ধকার গহ্বরের গম্ভীর হতে আলোক উৎপন্ন হয়ে পূর্বদিক হতে সেই শূন্যপথে আকাশ পরিক্রমা করতে লাগল। কিন্তু পৃথিবীতে তখন সূর্য ছিল না। ঈশ্বর তখন পৃথিবীকে উত্তর ও দক্ষিণ–এইদুটি গোলার্ধে বিভক্ত করে আলো ও অন্ধকারকেও ভাগ করে দিলেন। আলোকে দিন আর অন্ধকারকে রাত্রি নাম দিলেন।
স্বর্গের দেবদূতরা যখন প্রথম অন্ধকারের ভিতর হতে স্বচ্ছ আলোকরশ্মিকে বেরিয়ে আসতে দেখল, তখন তারা আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়ল। তারা তখন আনন্দোৎসবের সঙ্গে পৃথিবীর জন্মোৎসব পালন করতে লাগল। তাদের উল্লসিত আনন্দধ্বনিতে পরিপূরিত হয়ে উঠল পৃথিবীর আকাশ-বাতাস। সোনার বীণা বাজিয়ে পরম স্রষ্টা ও তার সৃষ্টিকার্যের গৌরবগান করতে লাগল তারা।
এরপর ঈশ্বর বললেন, আকাশ হোক জলের উপরে। এইভাবে ঈশ্বর স্বচ্ছ বায়ুমণ্ডলে পূর্ণ আকাশ উৎপন্ন করে গোলাকার পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে দিলেন। এই আকাশ উপরের জল থেকে নিচেকার জলরাশিকে বিভক্ত করে দিল। পৃথিবীর নিম্নভাগের অনন্ত জলরাশি মহাসমুদ্ররূপে বিস্তৃত হয়ে রইল। ঈশ্বর আকাশকে স্বর্গ নামে অভিহিত করলেন। পৃথিবী সৃষ্টির দ্বিতীয় দিনে সকাল সন্ধ্যায় দেবদূতেরা সমবেত কণ্ঠে ঈশ্বরের স্তোত্ৰগান করতে লাগল।
পৃথিবী সৃষ্টি হলো বটে, কিন্তু তার জলময় গর্ভে তখন জ্বণের মত যে মাটি ছিল তা বাইরে প্রকাশ পেল না। পৃথিবীর সমগ্র উপরিপৃষ্ঠ জুড়ে অনন্ত মহাসমুদ্র প্রবাহিত হতে লাগল। কিন্তু জল একেবারে নিষ্ক্রিয় ছিল না। তার থেকে তপ্ত বাষ্প উখিত হচ্ছিল। এক আদ্রতা আচ্ছন্ন করেছিল পৃথিবীকে।
ঈশ্বর তখন বললেন, হে আকাশ ও নিকটস্থ জলরাশি, তোমরা একত্রিত হও এক জায়গায়, শুষ্ক ভূমিকে উত্থিত হতে দাও।
সঙ্গে সঙ্গে বহু বিরাট পর্বত বেরিয়ে এল সেই জলরাশির মধ্য হতে। তাদের মাথায় ও পৃষ্ঠদেশে ছিল মেঘের আস্তরণ। সেইসব পর্বতের চূড়াগুলি আকাশ পর্যন্ত উঠে গেছে। তাদের মাথাগুলি যেমন আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, তাদের নিম্নদেশও সমুদ্রের তলদেশ পর্যন্ত ছিল বিস্তৃত। সেই খাড়াই পর্বতগুলির গাত্রদেশগুলিকে বিধৌত করে তরঙ্গায়িত জলরাশি প্রবাহিত হয়ে যেতে লাগল।
তারপর ঈশ্বর শুষ্ক তটভূমিসমম্বিত অনেক নদী সৃষ্টি করলেন পৃথিবীতে। তিনি বললেন, পৃথিবীর শুষ্ক ভূমিগুলি সবুজ তৃণগুল্মদ্বারা আচ্ছাদিত হোক। অনেক ফলবান বৃক্ষরাজি উৎপন্ন হোক এবং এক একটি বৃক্ষ তাদের শ্রেণী ও গুণানুসারে এক এক রকমের বিশেষ ফল দান করুক।
ঈশ্বর আদেশদানের সঙ্গে সঙ্গে শুষ্ক মরুভূমির মত পৃথিবীর ভূখণ্ডগুলি তৃণগুল্ম ও অরণ্যরাজির দ্বারা সমাচ্ছাদিত হয়ে মনোরম সবুজের শোভায় শোভিত হয়ে উঠল। বৃক্ষলতাগুলি বিভিন্ন বর্ণগন্ধময় পুষ্পে মণ্ডিত হয়ে উঠল।
প্রথমে ঝোপেঝাড়ে বিভিন্ন লতাগুল্ম ও পরে একে একে অসংখ্য বৃক্ষ তাদের সবুজ পত্ৰশোভিত শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে ফলবতী হয়ে উঠল। কত নদী ও ঝর্ণার জলধারাবিধৌত উপত্যকাগুলি তৃণগুল্ম ও পুষ্পিত ফুলের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে মনোরম আকার ধারণ করল। শুষ্ক প্রস্তরময় পর্বতশীর্ষগুলিও অরণ্যের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে উঠল। ক্রমে সমগ্র মর্ত্যভূমি অসংখ্য পাহাড়, পর্বত, উপত্যকা, প্রান্তর, নদী, পুষ্প ও অরণ্য সমন্বিত হয়ে এমন মনোহর শোভায় শোমান হয়ে উঠল যে তা দেবভোগ্য হয়ে উঠল। দেবতারাও সেখানে প্রমোদভ্রমণে বিশেষ প্রীত হতে পারেন। ক্রমে শিশির, কুয়াশা, মেঘ ও বৃষ্টির দ্বারা জলসিঞ্চিত ও সিক্ত করে পৃথিবীর তৃণলতাগুল্ম ও গাছগুলিকে সবুজ ও সজীব করে তুললেন ঈশ্বর। তিনি দেখলেন এই সব কিছুই মঙ্গলময়। এই হলো বিশ্বসৃষ্টির তৃতীয় দিন।
তারপর সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বললেন, ঊর্ধ্বলোকে অনন্তবিস্তৃত আকাশের উপর আলোক সৃষ্ট হয়ে পৃথিবীর দিবারাত্রিকে সুস্পষ্টরূপে বিভক্ত করুক এবং তার ফলে একে একে ঋতুর আবক্স ও মাস বৎসরের পরিক্রমা শুরু হোক।
পৃথিবীকে ঠিকমত আলোকিত করার জন্য ও আলোকমালার গতিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আকাশের ঊর্ধ্বে অবস্থিত স্বর্গলোকে এক কার্যালয় স্থাপিত হলো। দিনে ও রাত্রিতে পৃথিবীকে পর্যায়ক্রমে আলোকিত করার জন্য সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্রমণ্ডলের সৃষ্টি করেন ঈশ্বর। সূর্য পৃথিবীর দিনকে আলোকিত করতে লাগল এবং চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজি রাত্রিকে আলোকিত করে অন্ধকার হতে আলোকে পৃথক করে তুলল।
এই ব্যাপারে ঈশ্বর প্রথমে আকাশের জ্যোতিষ্কমণ্ডলের মধ্যে প্রথমে সূর্য ও এক ক্ষীণালোকসম্পন্ন নক্ষত্রমণ্ডলের সৃষ্টি করলেন। সূর্য যেমন দূরের আকাশ থেকে দিনের বেলায় পৃথিবীর একটি গোলার্ধকে আলোকদান করতে লাগল আর সূর্য থেকে আলোকসম্ভার বার করে চন্দ্র দূর থেকে পৃথিবীর অন্য একটি গোলার্ধকে অপেক্ষাকৃত কম উজ্জ্বল আলোকদান করতে লাগল। এই চন্দ্র হাজার হাজার নক্ষত্ৰদ্বারা পরিবৃত। রাত্রিশেষে আকাশে সূর্য উদিত হবার আগেই ঊষাকালে সূর্যের অগ্রবর্তী আলোকরশ্মির দ্বারা আকাশের পূর্ব দিগন্ত আলোকিত হয়। তারপর সূর্য ধীরে ধীরে উদিত হয় এবং দিবাভাগ শুরু হয়। এই হলো চতুর্থ দিন।
অতঃপর ঈশ্বর বললেন, পৃথিবীর জলরাশিতে সরীসৃপ জাতীয় প্রচুরসংখ্যক জীব সৃষ্টি হোক। এই বলে তিনি জলের মধ্যে তিমি মাছ ও নানা প্রকার জলজ জীবজন্তুর সৃষ্টি করলেন।
তারপর সৃষ্টি করলেন নানা রকমের পাখি যারা পাখা মেলে উড়ে বেড়াতে লাগল নীল আকাশে। নানা রকম মাছ তাদের পাখনা আর উজ্জ্বল চকচকে আঁশ নিয়ে জলের তলায় ঘুরে বেড়াতে লাগল। তারা কখনো একা একা আবার কখনো বা তাদের সাথীসহ জলজ আগাছা-সমূহ ভক্ষণ করতে লাগল। খেলা করে বেড়াতে বেড়াতে মাঝে মাঝে তারা জলের উপরিপৃষ্ঠে তাদের মুক্তোর মত চকচকে গাগুলোকে তুলে ধরতে লাগল সূর্যের আলোয়।
তারপর সমুদ্রের মধ্যে সবচেয়ে বৃহদাকার লেভিয়াথান বা বিরাটাকায় এক জলজন্তুর উৎপত্তি হলো। তারা কখনো ঘুমোতো, কখনো বা সাঁতার কাটতো জলে। সাঁতার কাটার সময় তাদের এক একটি সচল দ্বীপের মত দেখাত। আকারে তারা এমনই বড় ছিল।
তারপর ঈগল পাখিরা পাহাড়ের চূড়ায় ও দেবদারু গাছের উপর বসে থাকতে লাগল আবার কখনো উড়ে বেড়াতে লাগল। সারস পাখিরা বছরে একবার এক একটি জায়গায় অনুকূল বাতাসে ভর করে উড়ে আসত। এ ছাড়া আরও কত সব ছোট ছোট পাখি তাদের গানের মিষ্টি স্বরে বনভূমিগুলিকে মুখরিত করে তুলত। মধুকষ্ঠি নাইটিঙ্গেলরা গান গাইত রাত্রিতে।
শুভ্রপক্ষ শুভ্রবক্ষ জলচর হাঁসেরা নদী ও হ্রদে সাঁতার কেটে বেড়াতে লাগল সারিবদ্ধভাবে।
এইভাবে জল, মাছ ও জলজন্তুর দ্বারা এবং পৃথিবীর আকাশ বাতাস ও পাখিদের দ্বারা পূর্ণ হওয়ায় সৃষ্টির পঞ্চম দিন গত হলো।
ষষ্ঠ দিনে ঈশ্বর বললেন, এবার পৃথিবীতে বিভিন্ন শ্রেণীর পশু সৃষ্টি হোক। সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী সে আদেশ পালন করল। পৃথিবীর স্থলভাগে অসংখ্য ও বিভিন্ন জাতীয় জন্তু-জানোয়ার জন্মগ্রহণ করল। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তারা পূর্ণ আকৃতি লাভ করল। ব্যাঘ্র, সিংহ প্রভৃতি বন্য হিংস্র জন্তুর সঙ্গে সঙ্গে মেষ, মৃগ, গরু প্রভৃতি শান্ত পশুর সৃষ্টি হলো। স্থলচর সর্প ও মৌমাছির সৃষ্টি হলো।
কিন্তু বন্যজন্তুদের প্রকৃতি যাই হোক, তোমাদের পক্ষে কিন্তু তারা কেউ ক্ষতিকর হবে না। বরং তোমার ডাকে সবাই শান্তভাবে আসবে তোমার কাছে।
এইভাবে স্বর্গ ও মর্ত্য আপন আপন গৌরব ও গরিমায় মণ্ডিত হয়ে আপন আপন কক্ষপথ পরিক্রমা করতে লাগল। পৃথিবীর মাটি, জল ও আকাশ বিভিন্ন জাতীয় প্রাণীর দ্বারা পূর্ণ হয়ে গৌরববোধ করতে লাগল।
সৃষ্টির ষষ্ঠ দিন তখনো অতিবাহিত হয়নি। ঈশ্বর তখন সহসা উপলব্ধি করলেন, তিনি এতকিছু সৃষ্টি করা সত্ত্বেও সৃষ্টিকার্য সম্পূর্ণ হয়নি তাঁর। তাঁকে এখনো এমন এক প্রাণী সৃষ্টি করতে হবে যারা অন্যান্য বন্যজন্তুদের মত বন্য বা বর্বর নয়, যাদের যুক্তিবোধ আছে এবং যারা বিভিন্ন সদ্গুণাবলীতে ভূষিত। এই প্রাণী অন্যান্য প্রাণীদের শাসন করবে এবং যার মহত্ত্ব স্বর্গবাসীদের সমতুল।
তাই পরম পিতা তাঁর পুত্রকে বললেন, এবার আমরা আমাদেরই প্রতিরূপ মানুষ সৃষ্টি করি। তারা হবে দেহের দিক থেকে আমাদেরই প্রতিমূর্তি। তারা পৃথিবীতে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে সকল জীবের উপর প্রভুত্ব করবে।
এই বলে তিনি হে আদম, তোমাকে সৃষ্টি করলেন। তুমিই হচ্ছ আদি মানব। তোমার নাসারন্ধ্র দিয়ে প্রাণবায়ু প্রবাহিত হচ্ছে। তোমাকে তিনি তাঁরই প্রতিরূপ হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। তুমি এক জীবন্ত আত্মা। তোমাকে পুরুষজাতি এবং তোমার সাথীকে নারীজাতিরূপে সৃষ্টি করেছেন। তোমাদের থেকে সৃষ্টি হবে মানবজাতির।
সৃষ্টির পরেই তোমাদের তিনি বলেছেন, হে মানব, সংখ্যাবৃদ্ধি করো। সমগ্র পৃথিবীকে মানবজাতির দ্বারা পরিপূর্ণ করে পৃথিবীর জলে স্থলে বিচরণকারী সকল জীবের উপর প্রভুত্ব করো। ঈশ্বর তাঁরই বৃক্ষশোভিত এই মনোরম উদ্যান মধ্যস্থিত কুঞ্জবনে নিয়ে এসেছেন তোমাকে। এখানকার সুন্দর সুন্দর ফলগুলি তোমারই ভক্ষণের জন্য দান করেছেন তিনি। কিন্তু একমাত্র জ্ঞানবৃক্ষের ফল তুমি ভক্ষণ করতে পাবে না। যেদিন তুমি তা ভক্ষণ করবে সেইদিনই তোমার মৃত্যু ঘটবে। মৃত্যুই তার শাস্তি। সুতরাং তোমার ক্ষুধা আর কৌতূহলকে নিয়ন্ত্রিত করবে। তা না হলে নিয়মভঙ্গের জন্য পাপ আর সেই পাপের ফলে মৃত্যু অনিবার্য।
এইখানেই সমাপ্ত হলো ঈশ্বরের সৃষ্টিকার্য। তিনি যা যা সৃষ্টি করেছেন তা সব নিরীক্ষণ করলেন। এইভাবে ষষ্ঠ দিন সমাপ্ত হলো।
এইসব সৃষ্টিকার্যে ঈশ্বর কোন ক্লান্তিবোধ না করলেও কাজ শেষ করে স্বর্গলোকের ঊর্ধ্বতন লোকে তার আবাসভূমিতে উঠে গেলেন তিনি। সেখান থেকে তিনি তার সৃষ্ট নূতন জগৎকে প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন। এই নূতন জগতের দ্বারা আরও প্রসারিত হলো তাঁর সাম্রাজ্য। তাঁর সিংহাসন থেকে সে জগৎ দেখতে কত সুন্দর, কত ভাল। তিনি ঠিক যেমনটি চেয়েছিলেন ঠিক তেমনটি।
এরপর ঈশ্বর তার সিংহাসনে উপবেশন করলে দশ হাজার বীণা তাঁর বন্দনাগানে ধ্বনিত হতে লাগল আর সেই মধুর ধ্বনি পৃথিবীর শান্ত আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। মহাশূন্যে ঘূর্ণমান গ্রহনক্ষত্রগুলি সহসা স্তব্ধ হয়ে সেই বন্দনাগীতির সুর শুনতে লাগল। হে স্বর্গলোক, তোমার শাশ্বত দ্বারপথগুলি উন্মুক্ত করে দাও। সেই দ্বারপথে যেন ছয় দিন ধরে যে সব সৃষ্টি করেছেন এবং যে নূতন জগৎ সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর তা সব প্রবেশাধিকার পায়। সেই নূতন জগতে যে সুখী মানবজাতি বাস করবে সেখানে পরম স্রষ্টা ঈশ্বর মাঝে মাঝে ভ্রমণ করতে যাবেন। সেই জগতের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের জন্য প্রায়ই দেবদূতদের পাঠাবেন।
এইভাবে দেবদূতেরা স্বর্গলোকের ঈশ্বরের বন্দনাগান গাইল। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার আকাশে দৃষ্ট ছায়াপথের মত নক্ষত্রখচিত একটি প্রশস্ত পথ ঈশ্বরের পবিত্র আবাসভূমি পর্যন্ত উন্মুক্ত হলো। সে পথের প্রতিটি ধূলিকণা পর্যন্ত সুবর্ণময়। এদিকে মর্ত্যলোকে সূর্য অস্ত যাওয়ায় পূর্বদিক হতে সন্ধ্যা সমাগত হলো। আভাসিত হয়ে উঠল আসন্ন রাত্রি।
এদিকে স্বর্গের উধ্বলোকে সেই পবিত্র পর্বতশীর্ষে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত ঈশ্বরের রাজসিংহাসনের পাশে এসে ঈশ্বরপুত্ৰ উপবেশন করলেন।
ক্রমাগত ছয়দিন ধরে সৃষ্টিকার্যে ব্যাপৃত থাকার পর বিশ্রাম গ্রহণ করতে লাগলেন ঈশ্বর। সকল কর্ম হতে বিরত হলেন। কিন্তু একেবারে নিঃশব্দে অতিবাহিত হলো না সে বিশ্রামকাল। অজস্র বীণাবাদন সহযোগে বন্দনাগান গীত হতে লাগল দেবদূতদের দ্বারা। এক সোনালী, তরল ও গন্ধবহ মেঘমালা বিস্তৃত হয়ে আচ্ছন্ন করে ফেলল সেই পবিত্র পর্বতশীর্ষস্থ ঈশ্বরের আবাসভূমিটিকে।
দেবদূতেরা তাদের সেই স্তুতিগানে বলতে লাগল, হে জেহোভা, পরম ঈশ্বর, কি মহান তোমার সৃষ্টি, অনন্ত তোমার শক্তি। কোন চিন্তা সে শক্তির পরিমাপ করতে পারে না। কোন ভাষা তা প্রকাশ বা বর্ণনা করতে পারে না। দেবদূতেরা তাদের পূজার্চনার মাধ্যমে তাদের অন্তরের যে ভক্তি-শ্রদ্ধা দান করে তোমায়, তার থেকে অনেক বেশি তারা প্রতিগ্রহণ করে তোমার কাছ থেকে। সেদিন তোমার অজস্র বজ্রের শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু তুমি যে পরিমাণ ধ্বংসকার্য সাধন করেছ তার থেকে অনেক বেশি তোমার সৃষ্টিকার্যের পরিমাণ।
হে স্বর্গাধিপতি, কে তোমার শক্তিকে খর্ব করতে পারে? কে তোমার সীমাহীন সাম্রাজ্যকে অধিকার করতে পারে? কত অনায়াসে তুমি বিদ্রোহী দেবদূতদের সকল চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দাও। যারা তোমার মহান শক্তিকে খর্ব করতে চায় তারা তাদের অজানিতে তোমার শক্তির মহিমাকে বাইরে প্রকাশিত ও প্রকটিত করে তোলে। যে বিদ্রোহীরা ভেবেছিল তোমার সঙ্গে শক্তিপরীক্ষায় জয়ী হয়ে তোমার বহুসংখ্যক ভক্তকে তোমার প্রতি বিমুখ করে তুলে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে, তারা ব্যর্থ ও বিতাড়িত হয়ে তোমার শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করল অবিসম্বাদিতভাবে। গূঢ় গোপন সকল অশুভ শক্তিকেই দেখতে পাও তুমি। শুভ ও মঙ্গলজনক সৃষ্টির দ্বারা সেই সব অশুভ শক্তিকে ব্যর্থ ও বিদূরিত করো তুমি।
তুমি তোমার এই গৌরবোজ্জ্বল সিংহাসন হতে পৃথিবী নামে তোমার সৃষ্ট যে নূতন জগৎকে প্রত্যক্ষ করছ তা হচ্ছে মানবজাতির মনোরম স্থায়ী বাসস্থান। সেখানে মানবজাতি সুখে বসবাস করে তোমার উপাসনা করবে এবং তার পুরস্কারস্বরূপ সমুদ্র ও আকাশসমন্বিত পৃথিবীর উপর প্রভুত্ব করবে তারা। একজন আদিপিতা ও আদিমাতা থেকে অসংখ্য মানব সৃষ্ট হয়ে তোমার উপাসনা করবে, তোমাকে ভক্তি করবে।
এইভাবে স্তুতিগান করল তারা এবং সে গানের সুরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো স্বর্গের সাম্রাজ্য। এইভাবে সম্পন্ন হলো তাদের ধর্মোৎসব।
হে আদম, তোমার অনুরোধ আমি রক্ষা করলাম। তুমি জানতে চেয়েছিলে কিভাবে এই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়, তোমার স্মৃতিশক্তি জাগ্রত হবার আগে কি কি ঘটেছিল, যাতে তুমি তোমার উত্তরসুরীদের সে সব কথা জানাতে পার। কিন্তু যা মানুষের জ্ঞাতব্য নয়, যা তাদের জ্ঞানের সীমার অতীত তা যেন জানতে চেও না।
০৭ম সর্গ
সপ্তম সর্গ
দেবদূত রাফায়েলের কথা শেষ হলে তার কণ্ঠস্বর আদমের কানে এমনভাবে অনুরণিত হতে লাগল যে তার মনে হলো তার কথা যেন শেষ হয়নি তখনো। মনে হলো এখনো সে সব কথা শুনতে পাচ্ছে।
তখন সে সদ্যনিদ্রোখিত ব্যক্তির মত বলতে লাগল, হে ঐশ্বরিক দৈব ঐতিহাসিক, কি বলে ধন্যবাদ দেব তোমায়? তোমার এ কর্মের জন্য কি প্রতিদান দেব তোমায়? তুমি আমার জ্ঞানপিপাসা নিবৃত্ত করার জন্য অনেক কিছু বলেছ। যে জ্ঞান শত অনুসন্ধান ও চেষ্টার দ্বারা অধিগত করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে, তুমি তোমার দৈব মর্যাদার আসন হতে পরম বন্ধুর মত নেমে এসে সে জ্ঞান আমায় দান করেছ। সে জ্ঞানের কথা আমি বিস্ময় ও আনন্দের সঙ্গে সব শুনেছি এবং উপযুক্ত গৌরবদানের দ্বারা আমাদের পরম স্রষ্টাকেই অনিন্দিত করছি।
তথাপি কিছু সংশয় এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে এবং একমাত্র তুমিই তার সমাধান করতে পার।
যখন আমি স্বর্গ ও মতসমন্বিত এই জগৎকে প্রত্যক্ষ করি এবং তার বিশালতাকে অনুধাবন করার চেষ্টা করি তখন এই পৃথিবীকে অনন্ত প্রসারিত আকাশের তুলনায় একটি শস্যকণা বা অণু বলে মনে হয়। আকাশের অসংখ্য নক্ষত্ররাজি যে দূরত্বের ব্যবধানে আপন আপন কক্ষপথে ঘুরতে থাকে তা সত্যিই রহস্যময় এবং দুর্বোধ্য।
আমি শুধু একটা জিনিস যুক্তি দিয়ে বোঝবার চেষ্টা করেও বুঝতে পারি না। সেটা হলো এই যে, প্রকৃতি বিজ্ঞ এবং উদার হলেও তার সৃষ্টির মধ্যে এমন সমানুপাতবিহীন তারতম্য কেন? যে প্রকৃতি উদার হাতে এত সব বিরাটাকায় গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টি করেছে সেই প্রকৃতি তাদের তুলনায় এই পৃথিবীকে এত ছোট করে কেন সৃষ্টি করল?
আমাদের আদিপিতা এইসব কথা দেবদূত রাফায়েলকে বলল। তার মুখমণ্ডলের উপর এক অতৃপ্ত জ্ঞানানুসন্ধিৎসা ফুটে উঠল। ঈভ তা দেখে তার আসন থেকে উঠে এসে তাদের সামনে বসল। সে একবার ফল-ফুল কোথায় কি আছে তা দেখার ও গাছপালার সেবা করার জন্য তার কব্যকর্ম পালনের উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু তার স্বামী ও দেবদূত অতিথির মধ্যে যে সব আলোচনা হচ্ছিল তা শোনার জন্য সে উঠে দাঁড়িয়েও গেল না।
সুন্দরী ঈভকে তাদের কাছে বসতে দেখে তারা প্রীত হলো। উচ্চ বিষয়ে এইসব আলোচনা সে যে বুঝতে পারছিল না তা নয়। এসব শোনার সে অযোগ্য ছিল কোনক্রমে। বরং এসব শুনে সে আনন্দই পাচ্ছিল।
তার স্বামীর সঙ্গেও নানা বিষয়ে কথাবার্তা হয় তারা যখন একা থাকে। আদম কথা বলে, সে শুনে যায়। শুনতে ভালবাসে। কত জটিল বিষয়ের সমাধান করে দেয় সে। এখন তাদের অতিথি দেবদূতের সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তার স্বামীর যে সব কথাবার্তা হচ্ছিল তার মধ্যে তার স্বামীর কথাই দেবদূত্রে কথার থেকে বেশি ভাল লাগছিল তার। তার স্বামীর শুধু কথা নয়, তার জ্ঞান, তার জানার আকাঙ্ক্ষা ও বৃদ্ধির প্রশংসা না করে পারে না সে। স্বামীর প্রতি তার ভালবাসার মধ্যে মিশ্রিত ছিল শ্রদ্ধা। এমন দাম্পত্য প্রেম সত্যিই বিরল। স্বামীর প্রতি তার প্রেম যেমন ছিল অতুলনীয় তেমনি তার দেহসৌন্দর্য ও রূপলাবণ্য ছিল অনুপম। তাকে এবার দেখলেই আরও দেখার বাসনা শর হয়ে বিদ্ধ করতে থাকে।
আদমের সংশয় নিরশনের জন্য রাফায়েল এবার বলতে লাগল, এ বিষয়ে কোন কিছু প্রশ্ন করা বা গবেষণা করা আমি দোষাবহ বলি না। কারণ স্বর্গলোক হচ্ছে ঈশ্বরের এমন একটি গ্রন্থ যাতে তাঁর আশ্চর্যজনক সৃষ্টিসমূহের কথা জানতে পারা যায়। ঋতু পরিবর্তন, প্রহর, দিন, মাস, বৎসর, প্রকৃতির আবর্তনের কথা জানা যায়। জানা যায় পৃথিবী ঘোরে না গ্রহনক্ষত্রাদি সৌরজগৎ ঘোরে। বাকি বিষয় পরম স্রষ্টা মানুষ বা দেবদূতদের কাছে অপরিজ্ঞাত রেখেছেন। সে রহস্য তারা উদঘাটন করতে পারবে না বা তার কোন চেষ্টাও করবে না, তারা শুধু ঐশ্বরিক সৃষ্টিকার্যের প্রশংসা করে যাবে।
তবু যদি তারা এ বিষয়ে অনুমানের দ্বারা কিছু জানতে চায় এবং তর্কবিতর্ক করে তাতে শুধু বিবাদই বেড়ে যাবে এবং অজ্ঞতাজনিত তাদের নির্বোধসুলভ মন্তব্য ঈশ্বরের মধ্যে হাসির উদ্রেক করবে অর্থাৎ তারা তাঁর কাছে হাস্যাস্পদ হয়ে উঠবে। তারা যদি জানতে যায় স্বর্গলোকের গঠনপ্রণালী কি, কিভাবে এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড গঠিত হয়েছে বা চালিত হচ্ছে, তারা যদি আকাশের অগণিত নক্ষত্ররাজিকে গণনা করতে যায় তাহলে ভুল করবে।
আমি ইতিমধ্যেই তোমার কথা ও প্রশ্ন থেকে জানতে পেরেছি তুমি ভাবছ সৌরজগতের জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর মধ্যস্থিত যে সব গ্রহনক্ষত্রগুলি আকার অনেক বড় এবং সতত আলোকোজ্জ্বল তারা অপেক্ষাকৃত ছোট ও অনুজ্জ্বল গ্রহগুলিকে আলোকদান করে কেন? তারা বড় হয়েও সব সময় সচল ও সক্রিয় এবং তারা স্বতন্ত্র ও অতন্ত্রভাবে তাদের আপন আপন কক্ষপথে আকাশ পরিক্রমা করে অথচ পৃথিবী অন্য জায়গায় স্থির হয়ে থাকে কেন? অথচ পৃথিবীই তাদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি উপকার পায়।
কিন্তু আর একটা জিনিস ভেবে দেখ, কোন বস্তু আকারে বড় এবং উজ্জ্বল হলেই যে তা গুণগতভাবে উত্তম হবে এমন কোন কথা নেই। যদিও পৃথিবী সূর্য বা অন্য সব গ্রহনক্ষত্রের তুলনায় আকারে ছোট এবং তার কোন নিজস্ব উজ্জ্বলতা নেই, তথাপি তার মধ্যে এমন অনেক মূল্যবান ও ব্যবহারযোগ্য বস্তু আছে যা জ্যোতিষ্কগুলির মধ্যে নেই। সূর্য ও গ্রহনক্ষত্রগুলি আকারে ও আয়তনে বিরাটাকায় হলেও তারা একেবারে বন্ধ্যা। কোন প্রাণীর পক্ষেই তা বসবাসযোগ্য বা ব্যবহারযোগ্য নয়। তাদের যে সব নিজস্ব গুণ আছে তার ফল তারা নিজেরাই পায় না, অথচ সেই গুণের দ্বারা পৃথিবী হয় ফলবতী। তাদের আলো পৃথিবীতেই পড়ে এবং পৃথিবী তাতে আলোকিত হয়। অথচ পৃথিবী ও তার অধিবাসীদের কাছ থেকে ঐ সব জ্যোতিষ্কগুলি কত দূরে।
স্বর্গলোকের সুবিশাল পরিমণ্ডল, তার আয়তন ও পরিধি পরম স্রষ্টার মহত্ত্বকেই সূচিত করে। তিনিই তাকে এত বড় ও বিস্তৃত করে গঠন তার সীমারেখা। বিশালায়তন স্বর্গলোকের সুবিস্তৃত পরিসরের একট মাত্র অংশে ঈশ্বর বাস করেন, বাকি স্থানে কারা বাস করে তা তিনিই জানেন। চোখে কিছুই দেখা যায় না পৃথিবী থেকে। অথচ স্বর্গে ও সৌরলোকে যারা থাকে তারা প্রচণ্ড গতিশক্তিসম্পন্ন। একটি জড়দেহের মধ্যে এমন গতিশক্তির সঞ্চার ঈশ্বরেরই সর্বশক্তিমত্তার পরিচয় দান করে। কিন্তু পৃথিবী থেকে সে গতি বোঝা যায় না।
এই আমাকেই ধরো না কেন। আমাকে তুমি ধীরগতি ভেবো না। আমি সুদূর স্বর্গলোক থেকে প্রভাতকালে রওনা হয়েছিলাম এবং বেলা দ্বিপ্রহরের আগেই এখানে এসে উপনীত হয়েছি। অথচ স্বর্গ ও মর্তের মধ্যে দূরত্ব অবর্ণনীয়, অপরিমেয়। এ বিষয়ে তোমার সংশয় দূর করার জন্যই একথা বললাম।
ঈশ্বর স্বর্গলোক থেকে যে সব কার্য পরিচালনা করে থাকেন তা মানবজগতের জ্ঞানের গোচরীভূত না করার জন্য স্বর্গকে পৃথিবী থেকে এত দূরে রেখেছেন। মানুষ যদি পৃথিবী থেকে স্বর্গের সব কিছু দেখতে পেত তাহলে ঐশ্বরিক কার্যাবলী সম্বন্ধে তারা অনেক কিছু ভুল অনুমান করত, অথচ তার থেকে কোন লাভই হত না তাদের।
সূর্যকে কেন্দ্র করে সৌরজগতের গ্রহনক্ষত্রেরা যেন মহাশূন্যে ঘুরছে অবিরাম। মনে হয় যেন তারা ঈশ্বরের চারদিকে কখনো উপরে উঠে, কখনো নীচে নেমে, কখনো একটু এগিয়ে, কখনো কিছুটা পিছিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে নাচতে থাকে। তাদের গতি সব সময় একভাবে থাকে না।
পৃথিবীরূপ এই গ্রহটিকে তোমার স্থিতিশীল মনে হয় বটে, কিন্তু তারও মধ্যে তিনটি গতি আছে। আরও কয়েকটি গ্রহের এই গতি আছে। কিরণদানের ব্যাপারে সূর্যের শ্রমকে বাঁচাবার জন্য পৃথিবী পূর্বদিকে প্রতিদিন এগিয়ে যায় ঘুরতে ঘুরতে। পৃথিবীর যে দিকটি সূর্যের দিক থেকে সূর্যালোক গ্রহণ করে সেই দিকেই দিন হয় এবং তার অনালোকিত অপর দিকটিতে রাত্রি হয়। পৃথিবী আবার সূর্যের কাছ থেকে আলো নিয়ে চাঁদে স্বচ্ছ বাতাসের মধ্য দিয়ে সেই আলো পাঠিয়ে চন্দ্রলোকের দিনকে আলোকিত করে। চন্দ্র আবার তার প্রতিদানস্বরূপ রাত্রিবেলায় সূর্যের কাছ থেকে আলো নিয়ে পৃথিবীর রাত্রিকে পর্যায়ক্রমে আলোকিত করে। চন্দ্রলোকেও নিশ্চয় ফুল, ফল, মাঠ, ঘাট ও মানুষ আছে। চাঁদের মধ্যে যে সব কালো কালো দাগ দেখা যায় সেগুলি হয়ত মেঘ। সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়ে চাঁদের ভূখণ্ডকে উর্বর করে তুলে গাছে গাছে ফল ফলায়। সেই ফল নিশ্চয় তার অধিবাসী জীবরা খায়। প্রতিটি গ্রহ-উপগ্রহেই নিশ্চয় জীবন্ত প্রাণী ও নরনারী আছে। আলোর মধ্যেও নারী-পুরুষ আছে। সূর্যের আলোকে আমরা বলি পুরুষ-আলো, চাঁদের আলোকে আমরা বলি মেয়ে-আলো। প্রকৃতি পুরুষ সব জগৎ শাসন করে। প্রকৃতির রাজ্যে কোন স্থানই শূন্য বা পরিত্যক্ত থাকতে পারে না।
কিন্তু কেন এ জিনিস হলো, কেন হলো না, তা জানতে চেও না। আকাশের জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর মধ্যে সূর্য কেন এত প্রভাবশালী, সেই সূর্য পৃথিবীতে উদিত হয় কি না, সূর্য পূর্বদিক হতে তার উজ্জ্বল পথে পৃথিবীকে আলোকদান করার জন্য এগিয়ে আসে না কি, পৃথিবী পশ্চিম দিক হতে সূর্যের আলো গ্রহণ করার জন্য এগিয়ে যায়–এই সব গোপন বিষয় জানার জন্য কোন অনুরোধ করো না। এসব ব্যাপার ঈশ্বরের উপরেই ছেড়ে দাও। তাঁকে ভয় করো, তাঁর সেবা করে যাও। অন্যান্য প্রাণীরা এসব বিষয় কিছুই জানতে চায় না। তাই তারা নীরব আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে তাঁকে প্রীত করে সবচেয়ে বেশি। ঈশ্বর নিজে থেকে তোমাকে যা কিছু দিয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাক। তাতেই আনন্দলাভ করে। এই মনোরম স্বর্গোদ্যান, তোমার জীবনসঙ্গিনী ঈত–এ সবই ঈশ্বরের দান। স্বর্গে কি হচ্ছে, ঈশ্বর কি করছেন না করছেন–এসব ঊর্ধ্বলোকের ব্যাপার তোমার জ্ঞানগম্য নয়। তোমার জ্ঞানকে সীমিত করে রাখ। যে সব বিষয় তোমার জীবন ও অস্তিত্বের সঙ্গে সংজড়িত তুমি শুধু সেই সব কথাই ভাব। অন্যান্য জগতের কথা স্বপ্নেও ভাবতে যেও না। অন্যান্য গ্রহগুলিতে কারা কিভাবে এবং কি অবস্থায় বাস করে তা মর্ত্যমানবের জানার বিষয় নয়, তা একান্তভাবে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ব্যাপার।
আদম তখন সংশয়মুক্ত হয়ে উত্তর করল, হে প্রশান্ত দেবদূত, বিশুদ্ধ স্বর্গীয় জ্ঞানের প্রতীক, তুমি আমার জ্ঞানগত কৌতূহলটিকে সম্পূর্ণরূপে পরিতৃপ্ত করেছ। আমার চিন্তাকে সমস্ত জটিলতা থেকে মুক্ত করেছ তুমি। যে সব জটিল চিন্তা ও জ্ঞানান্বেষণ বাঁচার আনন্দকে বিঘ্নিত করে সেই সব অহেতুক চিন্তা হতে মুক্ত হয়ে কিভাবে সহজ সরল জীবনযাপন করা যায় তুমি তা শিখিয়েছ আমাকে। এই সব উদ্বেগাকীর্ণ চিন্তাভাবনা থেকে ঈশ্বর দুরে থাকতে বলেছেন আমাদের। আমরা যেন অস্থির উদ্ধত চিন্তাকল্পনা ও ব্যর্থ অনুমানের দ্বারা নিজেদের অকারণে বিব্রত করে
তুলি। কিন্তু মনের ধর্মই হচ্ছে অবাধ উদ্ধত কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করা এবং তার এই। বিচরণ বা অশান্ত গতিচঞ্চলতার বিরাম নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে মন কারো দ্বারা সতর্কিত হচ্ছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার অভিজ্ঞতার দ্বারা জানতে পারছে দূরাম্বিত, দূরধিগম্য রহস্যজটিল ও সূক্ষ্ম বিষয়গুলিকে জানতে চাওয়া এক অর্থহীন নির্বুদ্ধিতা, তার বাস্তব ব্যবহারিক দৈনন্দিন জীবনের সীমার মধ্যে যা কিছু আছে শুধু সেই সব কিছুই তার একমাত্র জ্ঞাতব্য বিষয় এবং তার বাইরে সব কিছুই ধোঁয়া, এক শূন্যতামাত্র ততক্ষণ মন আমাদের শান্ত হয় না।
সূতরাং জ্ঞানের দিক থেকে বেশি উপরে উড়তে না গিয়ে নীচের দিকে নামাই ভাল। আমাদের ব্যবহারিক জীবনে যে সব বিষয়গুলি অপরিহার্য যা আমাদের হাতের কাছে থেকে ঘটনাক্রমে প্রশ্ন জাগায় আমাদের মনে, সেই সব বিষয় নিয়ে চিন্তা করা বা কথা বলাই উচিত আমাদের পক্ষে।
কিছুক্ষণ আগে আমার স্মৃতি ক্রিয়াশীল হবার আগে যা যা ঘটেছে তা বর্ণনা করেছ তুমি এবং আমি তা শুনেছি। এবার আমার কাহিনী শোন। এখনো দিন শেষ হয়নি। সে কাহিনী তুমি শোননি। দিন গত হলে দেখবে কেমন কৌশলে আমি তোমায় আটকে রেখে আমার কাহিনী শোনাচ্ছি। এই উদ্যানের সুমিষ্ট ফলের থেকে তোমার মুখের উত্তর-প্রত্যুত্তরগুলি অনেক বেশি মধুর বলেই তোমার কথা শুনতে চাই। শ্রমজনিত ক্লান্তির পর এখানকার তালগাছের সুস্বাদু ফলগুলি ভক্ষণ করলে শীঘ্রই আমাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা একই সঙ্গে পরিতৃপ্তি হয়। কিন্তু তোমার মুখের মিষ্টি কথা শত শুনেও আশ মেটে না। যত শুনি ততই শুনতে মন হয়।
রাফায়েল তখন তার উত্তরে বলল, হে মানবজাতির আদিপিতা, তোমার ওষ্ঠাধরনিঃসৃত বচনগুলিও কম সুধাময় নয়। তোমার জিহ্বাও জড়তামুক্ত। কারণ তুমি ঈশ্বরেরই এক সুন্দর প্রতিমূর্তি বলে ঈশ্বর তোমার অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গটিকে তার দ্বারা প্রদত্ত অনেক গুণেই ভূষিত করেছেন। সবাক বা নির্বাক যে অবস্থাতেই তুমি থাক না কেন তোমাকে সব অবস্থাতেই সুন্দর দেখায়। তোমার প্রতিটি বচন ও গতিভঙ্গি সুন্দর।
স্বর্গে আমরা আমাদের অনুগত সেবকদের কথা যেমন বলি, তেমনি তোমার কথাও কম আলোচনা করি না, মানবজাতির সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক সম্বন্ধে অনেক কিছু প্রশ্নও করি। কারণ ঈশ্বর তোমাদের কম সম্মানে ভূষিত করেননি। আমাদের মতো তোমাদেরও সমানভাবে ভালবাসেন। সুতরাং কি বলবে বল।
সেদিন আমি উপস্থিত ছিলাম না। ঈশ্বরের আদেশে আমি একদল দেবসেনা নিয়ে নরকদ্বারে এক অভিযানে গিয়েছিলাম। ঈশ্বর যেদিন এই পৃথিবী সৃষ্টি করেন সেদিন। তিনি হয়ত আভাস পেয়েছিলেন নরক থেকে শয়তানপ্রেরিত কোন শত্রু বা গুপ্তচর এসে ভঁর নবনির্মিত সৃষ্টিকার্যের মধ্যে কোন ধ্বংসের বীজ বপন করতে পারে। তাই তিনি আমাকে পাঠান।
তারা অবশ্য সে চেষ্টা করেনি। আমরা গিয়ে দেখলাম নরকের ভয়ঙ্কর দ্বারগুলি দৃঢ়ভাবে রুদ্ধ আছে। আমরা নরকদ্বারের এপার হতে শুনতে পেলাম নরকের অভ্যন্তরে যন্ত্রণায় কাতর আর্তনাদ করছে অসংখ্য ব্যক্তি। কোন নৃত্যগীতের শব্দ নয়, শুধু সেই আর্তনাদের ধ্বনিইশুনতে পেলাম আমরা। আমরা সানন্দে ফিরে এলাম স্বর্গলোকে।
যাই হোক, এবার তোমার কাহিনী বর্ণনা করো। আমার কথা শুনে তুমি যেমন আনন্দ পাও, তেমনি তোমার কথা শুনেও আনন্দ পাই আমি।
রাফায়েলের এই কথা শুনে আমাদের আদিপিতা বলল, মানবজীবনের উৎপত্তির কথা বলা মানুষের পক্ষে সত্যিই এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। কেউ কখনো তার নিজের জীবনের উৎপত্তির কথা জানতে পারে না। তোমার সাহচর্যকে দীর্ঘায়িত করার জন্যই আমি এ কাহিনী বলতে যাচ্ছি।
একদিন গভীর ঘুম থেকে সূর্যালোকের তপ্ত স্পর্শ পেয়ে জেগে উঠে দেখলাম পত্রপুষ্পের এক পেলব শয্যায় শুয়ে আছি, রৌদ্রতাপে ঘর্মাক্ত হয়ে উঠেছে আমার কলেবর। সহসা আমার চোখের দৃষ্টি আকাশের পানে নিবদ্ধ হতে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি।
তারপর আকাশ থেকে আমার দৃষ্টি নামিয়ে আমার চারদিকে তাকিয়ে পাহাড়, উপত্যকা, ছায়াচ্ছন্ন বনভূমি সূর্যালোকিত প্রান্তর ও কলমন্দ্রমুখরা ঝর্ণার তরলিত প্রবাহ দেখতে পেলাম। তার সঙ্গে অনেক জীবজন্তুকেও ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। দেখলাম অনেক পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে অথবা গাছের শাখায় বসে গান করছে। দেখলাম সমগ্র প্রকৃতি হাস্যোজ্জ্বলা, শব্দগন্ধবর্ণময় এক আনন্দের উচ্ছ্বাসে মত্তপ্রাণা।
তা দেখে এক সুবাসিত আনন্দের প্লাবনে প্লাবিত হয়ে উঠল আমার অন্তর। তখন এক অদম্য উজ্জ্বল প্রাণশক্তিতে সজীব আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম আমি। কিন্তু আমি কে, কোথা হতে কি কারণে এসেছি এখানে তার কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি কিছুক্ষণ হেঁটে ও ছুটে বেড়ালাম। তারপর কথা বলার চেষ্টা করলাম এবং কথা বলতে পারলাম।
আমি তখন বলতে লাগলাম, হে সূর্য, হে আলোকোজ্জ্বল ও আনন্দময় পৃথিবী, হে পর্বত ও উপত্যকারাজি, নদী বন ও প্রান্তরসমূহ, হে সকল প্রাণিগণ, তোমরা বল, এখানে আমি কেমন করে এলাম তা তোমরা দেখেছ কি? কিভাবে আমার উৎপত্তি হলো বল। আমি নিজের দ্বারা নিজে সৃষ্ট হইনি। নিশ্চয় সততা, উদারতা ও সৃষ্টিশক্তিতে মহান কোন স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন আমাকে। যাঁর অনুগ্রহে আমি আমার এই জীবন ও গতিশক্তি লাভ করেছি, যাঁর কৃপায় আমি এত সুখী, তাঁকে কেমন করে জানব? কেমন করে ভক্তিশ্রদ্ধা করব?
এই কথা বলতে বলতে আমি ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। কিন্তু কোথায় যাচ্ছি তা আমি বুঝতে পারলাম না। পথে যেতে যেতে আমি প্রাণভরে বাতাস থেকে নিঃশ্বাস নিলাম। তখন আমি এই আলোর সুষমা দেখলাম। কিন্তু কেউ আমার কথার উত্তর দিল না।
ছায়াচ্ছন্ন এক কুসুমিত নদীতটে আমি বসলাম। ক্রমে শান্ত মধুর এক নিদ্রা এক মেদুর চাপ সৃষ্টি করে আচ্ছন্ন করে ফেলল আমার তন্দ্রাভিভূত চেতনাকে। তখন আমার মনে হলো আমি যেন আমার জন্মের পূর্বাবস্থায় ফিরে গিয়েছি। অবলুপ্ত হয়ে গেছে আমার সচেতন সত্তাটি।
সহসা স্বপ্নের মধ্যে আমার নিজেরই এক ছায়ামূর্তি দেখে মনে হলো আমি তখনো বেঁচে আছি, চেতনা আছে আমার দেহের মধ্যে।
এমন সময় এক দৈবাকৃতি পুরুষ এসে আমায় বলল, হে আদি মানবপিতা আদম, ওঠ, তুমি হবে অসংখ্য মানবসন্তানের পিতা। তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে এই স্বর্গোদ্যানের মধ্যে তোমার পথপ্রদর্শকরূপে আমি তোমার বাসস্থান নির্দিষ্ট করে দিতে এসেছি।
এই বলে সেই পুরুষ তার হাত দিয়ে আগাভাবে ধরে তুলে নিয়ে মাটিতে পা না দিয়ে শুধু বাতাসে ভর করে কত পাহাড়, উপত্যকা, নদীপ্রান্তরের উপর দিয়ে আমাকে পর্বতশিখরস্থ এক সমতল ভূমির উপর নিয়ে গেল। সেই মালভূমিটি ছিল সুন্দর সুন্দর গাছে ঘেরা। সেই উদ্যানের মধ্যে মাঝে মাঝে পথ আর কুঞ্জবন ছিল। আগে যে জায়গায় প্রথম পৃথিবীকে দেখি তখন তাকে এত সুন্দর ও মনোরম মনে হয়নি।
সেই মনোরম উদ্যানের মধ্যে আমার ঘুম ভাঙতেই দেখি আমার চারদিকে প্রতিটি গাছে ফল ঝুলছে। তা দেখে সেই সব ফল খাবার লোভ হলো আমার। আমার ক্ষুধা জাগল। দেখলাম স্বপ্নে যা দেখেছিলাম তা সব সত্য।
সেখানে আবার ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। এমন সময় আমার পথপ্রদর্শক দৈবমূর্তিতে আমার সামনে উপস্থিত হলো। তাকে দেখে আমি আনন্দিত হলেও ভয়ে ভয়ে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তার চরণতলে পতিত হলাম।
সেই মূর্তিটি বলল, তুমি যাঁকে খুঁজছ আমি হচ্ছি সেই। এই উদ্যানের যিনি স্রষ্টা তিনি ঊর্ধ্বে, নিমে বা তোমার চারপাশে সর্বত্রই বিরাজমান। এই স্বর্গোদ্যান ঈশ্বরনির্মিত। এই উদ্যান আমি তোমাকে দান করলাম। এখানে তুমি ভূমি কর্ষণ করে গাছপালা উৎপন্ন করে ও সব রক্ষণাবেক্ষণ করে ফল ভক্ষণ করবে। এই উদ্যানে যত গাছ আছে, সেই সব গাছের ফল তুমি ইচ্ছামত ভক্ষণ করবে। ফলের কোন অভাব তোমার কোনদিন হবে না।
কিন্তু এই উদ্যানের মধ্যে জীবনবৃক্ষের পাশে যে জ্ঞানবৃক্ষ আছে তার ফলের। মধ্যে আছে ভাল-মন্দ ও ন্যায় জ্ঞান। সেই ফল তুমি ভক্ষণ করবে না। এই ফল তোমার ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বাসের প্রতীক। আমার এই সতর্কবাণী স্মরণ রাখবে। এ ফল কোনদিন আস্বাদন করবে না, খাবে না, কারণ তার আস্বাদ যাই হোক, সেই ফলভক্ষণের পরিণাম বড় ভীষণ হবে। সুতরাং এই পরিণামের কথা স্মরণ করে সে ফলভক্ষণের কৌতূহল ত্যাগ করবে।
জেনে রাখবে, যেদিন এই জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষণ করবে সেই দিনই আমার ও ঈশ্বরের আদেশ লঙ্ঘিত হবে। সেই দিন তোমার অনিবার্যভাবে মৃত্যু ঘটবে। তুমি হয়ে উঠবে মরণশীল। সেইদিন তুমি এই স্বর্গোদ্যান হতে বিতাড়িত হয়ে এক চিরমূখের জগতে নির্বাসিত হবে।
তার এই কঠিন নিষেধাজ্ঞাটি এখনো আমার কানে অনুরণিত হচ্ছে, যদিও এর কারণ আমি বুঝতে পারছি না।
এরপর সেই মূর্তি আবার বলতে লাগল, শুধু এই উদ্যান নয়, এই উদ্যানসীমানার বাইরে যে জগৎ আছে সে জগৎ তোমাকে ও তোমার থেকে যে মানবজাতির উদ্ভব হবে তাদের দান করে গেলাম আমি। সে জগতের নদ-নদী, সমুদ্র, আকাশ, পাহাড়, পর্বত, পশুপাখি–সব কিছুর উপর প্রভুত্ব করবে তোমরা। সব কিছু ভোগ করে যাবে। সেই জগতের যেখানে খুশি তোমরা বাস করবে। সেখানকার পশুপাখিরা তোমাদের প্রভুত্ব মেনে নেবে। তোমরা তাদের নামকরণ করবে। জলাশয়ের মাছদের ক্ষেত্রেও এই বিধান প্রযোজ্য হবে। জলের মাছ মাটিতে আসতে পারবে না। তারা জলেই বিচরণ করবে।
তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই অনেক জোড়া জোড়া পশুপাখি আমি দেখতে পেলাম। আমি তাদের নাম দিলাম। তাদের প্রকৃতি আমি বুঝে নিলাম।
আমি তখন সেই দৈবমূর্তিকে বললাম, তোমরা যারা মানবজাতির ঊর্ধ্বে, এই পৃথিবীর ঊর্ধ্বলোকে যাদের বাস, যারা মানবজাতির উন্নতি ও কল্যাণের জন্য এই জগৎ সৃষ্টি করে আমাদের সুখের জন্য দান করেছ তাদের কি নামে অভিহিত করব? কিন্তু আমার তো কোন অংশীদার দেখছি না। নিঃসঙ্গ জনের সুখ কোথায়? একা কেউ কি সুখভোগ করে যেতে পারে? সঙ্গী ছাড়া সুখভোগে তৃপ্তি কোথায়?
তখন আমার কথায় সেই মূর্তি বলল, নির্জনতা তুমি কাকে বলছ? কত প্রাণী ও জীবজন্তুদ্বারা এই পৃথিবী পরিপূর্ণ। জগতের সর্বত্র বায়ু প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এখানকার সব প্রাণীই তোমার বশীভূত। তোমার ডাকে তারা যে কোন সময়ে এসে খেলা করবে তোমার সামনে। তাদের ভাষা তুমি বুঝতে পার না। তোমার এই বিশাল রাজ্যে তুমি তাদের নিয়েই আনন্দ করবে। তাদের নিয়েই থাকবে।
কথাগুলি আদেশের সুরে বলল সে। আমি তখন তার অনুমতি নিয়ে বলতে লাগলাম, হে ঐশ্বরিক শক্তি, আমার কথায় রাগ করো না। তোমরা আমাকে তোমাদের প্রতিরূপ করে সৃষ্টি করেছ, কিন্তু এই পশুরা অন্য আকৃতির এবং আমার থেকে নিম্নমানের। সমজাতীয় প্রাণীতে প্রাণীতেই বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু আমি ও এই পশুরা সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতীয় প্রাণী। তাদের সঙ্গ বা সাহচর্য আমাকে কি কোন আনন্দ দিতে পারে? বন্ধুত্ব মানেই পারস্পরিক দান-প্রতিদান। এই দান-প্রতিদান সমানুপাতিক হওয়া চাই। কিন্তু সেখানে ছোট-বড় ভিন্ন দুই জাতীয় প্রাণীর মধ্যে বন্ধুত্ব হলেও দুজনের দান-প্রতিদানের ব্যাপারটা সমান হয় না। একজনের ভালবাসার পরিমাণ বেশি হলে অন্যজন তার প্রতিদান দিতে পারে না। সে ভালবাসার গুরুত্ব বুঝতে পারে না। ফলে সে বন্ধুত্ব অসহনীয় হয়ে ওঠে উভয়ের পক্ষে।
আমি চাই এমন বন্ধু যে বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে আমার আনন্দের অংশগ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু যারা অসভ্য পশু তারা কখনো মানুষের সহচর বা বন্ধু হতে পারে না, যেমন সিংহ সিংহীর সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। এই জন্য তাদের জোড়া জোড়া করে সৃষ্টি করেছ। একই জাতীয় প্রাণীর মধ্যে স্ত্রী-পুরুষ হলে বন্ধুত্ব ভাল হয়। তাই সেখানে পাখি পশুর সঙ্গে, মাছ পাখির সঙ্গে, বনজ বানরের সঙ্গে মিশতে বা বন্ধুত্ব করতে পারে না। মানুষও পশুর সঙ্গে কোনক্রমেই মিশতে পারে না।
তখন সেই ঐশ্বরিক মূর্তি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট না হয়েই উত্তর করলেন, আদম? আমি দেখছি তুমি তোমার সঙ্গী নির্বাচন করে এক সুন্দর ও সূক্ষ্ম আনন্দ লাভ করতে চাও। অর্থাৎ নির্জনে একা থেকে কোন আনন্দই আস্বাদন করতে পারবে না, এটাই হলো তোমার অভিমত।
কিন্তু আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেখ তো। আমার অবস্থা দেখে আমাকে সুখী বলে মনে হয় কি না। আমাকে কি প্রভূত সুখে সুখী বলে মনে হয় না তোমার? অনন্তকাল ধরে আমি নিঃসঙ্গ অবস্থায় একা একা বাস করে আসছি। কারণ আমার সমান বা উপযুক্ত যোগ্য সাথী কেউ নেই। সুতরাং আমার সমান বা অনুরূপ কোন সাথী যদি না পাই তাহলে আমারই সৃষ্ট হীনতর প্রাণীদের সঙ্গে ছাড়া আর কার সঙ্গে কথাবার্তা বলব? যারা আমার থেকে ছোট, আমার আসন থেকে নেমে তাদের কাছে গিয়েই আলাপ-আলোচনা করতে হয় আমাকে। অন্যান্য প্রাণী ও পশুরা যেমন তোমার থেকে হীন তেমনি তারাও আমার থেকে হীন।
এই বলে তিনি থামলেন। আমি তখন বিনয়াবনত হয়ে তাঁকে বললাম, তোমার ঐশ্বরিক বিধান ও কর্মপদ্ধতির গুরুত্ব, মহিমা বা গভীরতা অনুধাবন করা কোন মানবমনের চিন্তার পক্ষে সম্ভব নয়।
হে পরম স্রষ্টা, তুমি স্বয়ংসিদ্ধ, আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ। তোমার মধ্যে কোন অপূর্ণতা নেই। কিন্তু এ পূর্ণতা মানুষের নেই। মানবজীবনের মধ্যে আছে অনেক অপূর্ণতা আর তাই তারা পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার দ্বারা আপন আপন অপূর্ণতার দুঃখে সান্ত্বনা পেতে চায়। কিন্তু যেহেতু তুমি এক অদ্বিতীয়, সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, স্বয়ংসম্পূর্ণ, কারো সঙ্গে আলোচনা করার কোন প্রয়োজন নেই তোমার। তুমি অনন্ত, পূর্ণ, পরম স্রষ্টা।
কিন্তু মানুষ সংখ্যায় যত বেশিই হোক, সকলের মধ্যেই আছে কিছু না কিছু অপূর্ণতা। অপূর্ণ মানুষ তারই অনুরূপ অপূর্ণ মানুষের জন্ম দেবে। তাই তাদের পারস্পরিক ভালবাসা, বন্ধুত্ব ও ঐক্যের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যেহেতু তুমি আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ সেইহেতু তুমি নির্জনে নিঃসঙ্গ অবস্থায় থাকলেও আপন আত্মিক পূর্ণতায় সমৃদ্ধ হয়ে পরমানন্দে বিভোর হয়ে থাক। সামাজিক মেলামেশার কোন প্রয়োজন হয় না। কারো কোন সাহচর্য বা সঙ্গ ছাড়াই তুমি আনন্দ পেতে পার।
তুমি যেমন তোমার সৃষ্ট হীন প্রাণীদের তোমার স্তরে উন্নীত করে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পার না তেমনি আমিও এই সব পশুদের সঙ্গে কথা বলে তাদের হীন স্তর ০ আনতে পারি না। তাদের জীবনযাত্রার মধ্যেও কোন আনন্দ পেতে পারি না।
তার অনুমতি নিয়ে আমি সাহস করে এই কথা বললে তিনি বললেন, আমি তোমাকে পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হয়েছি আদম। আমি দেখছি তুমি শুধু পশুদের প্রকৃতিই বোঝ না। নিজের প্রকৃতির বা স্বরূপের কথাও অনেক জান। তুমি ঠিকই বলেছ, তোমার মধ্যে যে আত্মা আছে তা আমার মতই স্বাধীন। পশুদের মধ্যে সে আত্মা নেই। তাই তাদের সাহচর্য তুমি যুক্তিসঙ্গতভাবেই প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছ। সে সাহচর্য কখনো তোমার মনোমত বা পছন্দমত হতে পারে না।
আমি তা জানতাম। আমি জানতাম মানুষ একা থাকতে চাইবে না। সেটা শুভ হবে না মানুষের পক্ষে। তা জেনেও আমি পরীক্ষা করে দেখলাম তুমি কি ধরনের সাথী চাও। দেখলাম তোমার বিচারবুদ্ধি কেমন।
এরপর দেখবে আমি যাকে এখানে আনব সে হবে তোমারই অনুরূপ, তোমার পছন্দমত। সে হবে তোমারই আর এক আত্মা, তোমার অন্তরের কামনার যথাযথ প্রতিমূর্তি।
এই কথা বলেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর! আমি আর তাঁর কথা শুনতে পেলাম না। তাঁর দিব্য দ্যুতির দ্বারা আমার সকল ইন্দ্রিয়চেতনাকে অভিভূত করে দিয়ে তিনি তার স্বর্গলোকের আপন ভূমিতে প্রস্থান করলেন।
আমার সেই অভিভূত অবসন্ন ইন্দ্রিয়চেতনার উপর নিদ্রার আবেশ নেমে এল। মুদ্রিত হয়ে গেল আমার চক্ষুদুটি। প্রকৃতি যেন আমার সাহায্যে সে নিদ্রাকে পাঠিয়ে দিল। কিন্তু আমার চর্মচক্ষু দুটি মুদ্রিত হলেও আমার অন্তঃক্ষুটি খোলা রয়ে গেল। আমি সেখানেই শুয়ে পড়লাম।
আমি সেই নিদ্রিত অবস্থাতেই স্বপ্নের মধ্যে আগের ঐশ্বরিক মূর্তিটির থেকে আরও উজ্জ্বল এক মূর্তি দেখতে পেলাম। সে মৃর্তি আমার পাশে বসে আমার দেহের বাম দিকটিকে একেবারে খুলে ফেলল। আমার বাঁ দিক থেকে একটি পাঁজর তুলে নিল। তার মধ্যে তখনো ছিল ক্রিয়াশীল হৃৎপিণ্ডের তাপ। উষ্ণ রক্তস্রোত বেরিয়ে আসছিল সেই ক্ষতস্থান থেকে। কিন্তু নূতন মাংসপিণ্ড দ্বারা তখনি পূর্ণ হয়ে গেল সেই ক্ষতস্থান।
সেই মূর্তিটি এবার আমার পাঁজরটি খুলে নিয়ে তা দিয়ে কি গড়তে লাগল দুহাত দিয়ে। এইভাবে তার হাতে মানুষের মতই এক প্রাণী গড়ে উঠল। কিন্তু পুরুষ নয় আমার মত, নারী। সে নারীমূর্তি দেখতে এত সুন্দর যে পৃথিবীতে প্রকৃতি জগতের মধ্যে যত সুন্দর বস্তু দেখেছি সেই সৌন্দর্যের থেকেও সুন্দর। অথবা সেই সব সৌন্দর্যের সমন্বিত রূপই মূর্ত হয়ে উঠেছে তার মধ্যে। তার দৃষ্টি ও ভাবভঙ্গি আমার মধ্যে প্রেম ও আনন্দ সঞ্চারিত করল। এ আনন্দ আগে আমি অনুভব করিনি কখনো।
সহসা আমার কাছ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। আমি তাকে আর দেখতে পেলাম না। আমি তাকে দেখতে পেয়ে চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম সব কিছু।
আমার ঘুম ভেঙে গেল। তাকে দেখার জন্য জেগে উঠলাম আমি। শুনলাম, বাইরের জগতে তার দেখা পাই তো ভাল, তা নাহলে সারাজীবন ধরে তার অভাব আমাকে দুঃখ দেবে। তার অভাব আর কিছুতে পূরণ হবে না আমার জীবনে। উল্টে আমার জীবনের সকল আনন্দই ব্যর্থ হয়ে যাবে।
সহসা তাকে কিছুদুরে দেখতে পেলাম আমি। স্বপ্নে তাকে যেমন দেখেছিলাম তার অদৃশ্য স্রষ্টার সঙ্গে আমার দিকে আসতে লাগল সে। তার সেই স্রষ্টাকে চোখে দেখা যাচ্ছিল না। শুধু তার কণ্ঠস্বর শুনে পথ চলছিল সে। তার প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল এক গম্ভীর আত্মমর্যাদার ভাব, দৃষ্টিতে ছিল এক স্বর্গীয় প্রেমের দ্যুতি। বিবাহের আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম সবই মেনে চলল সে।
আমি তা দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললাম, হে আমার পরম স্রষ্টা, উদার করুণাময়। তুমি তোমার কথা রেখেছ। আমার সব অভাব পূরণ করে দিয়েছ। তুমি আমাকে অনেক কিছুই দিয়েছ। কিন্তু তোমার এই দান অন্য সব দানের থেকে সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ। এখন আমি আমারই অস্থিমজ্জামাংস ও আত্মারই একটি অংশকে দেখেছি আমারই সামনে। তার নাম হলো নারী, পুরুষেরই অর্ধাঙ্গিনীরূপে সৃষ্ট। একই রক্তমাংস থাকবে তাদের দেহে–একই প্রাণ, একই আত্মা।
সেই নারী আমার কথা শুনল। ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্টি সেই নারী ছিল নির্দোষিতা, সরলতা ও লজ্জার মূর্ত প্রতীক। তার বিচিত্র গুণাবলী, বিবেক ও যোগ্যতা সকলেরই ভালবাসার যোগ্য। কিন্তু তার এই সব গুণ ও অন্তরবৃত্তি বাইরে তেমন প্রকাশ হচ্ছিল না। তার এই সব অন্তর্নিহিত ও আভাসে অস্পষ্টভাবে প্রকাশিত গুণগুলির জন্যই সে আরও বেশি কাম্য হয়ে উঠেছিল আমার কাছে। প্রকৃতি যেন তাকে এইভাবে সরল নিষ্পাপ করে গড়ে তুলেছিল।
সে আমাকে দেখে ও আমার কথা শুনে পিছন ফিরে চলে যেতে লাগল। কিন্তু তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম আমি। তাকে থামিয়ে আমি তাকে বোঝাতে লাগলাম। এক সুগম্ভীর আত্মমর্যাদাবোধের সঙ্গে সে আমার যুক্তি মেনে নিল। পরে লজ্জারুণ ঊষার মত দেখাচ্ছিল তাকে। আমি তার হাত ধরে তাকে বিবাহের জন্য বাসরকুঞ্জে নিয়ে গেলাম। সেই মুহূর্তে আকাশ ও সমস্ত গ্রহনক্ষত্রগুলি উজ্জ্বল অনুকূল প্রভাব বিস্তার করতে লাগল। সমগ্র পৃথিবী যেন নানা সুলক্ষণ প্রকাশের দ্বারা আমাদের এই বিবাহ সমর্থন করল। প্রতিটি আনন্দোচ্ছল পাহাড়-পর্বত, প্রতিটি পাখি, চঞ্চল বাতাস যেন আমাদের বিবাহ সম্পর্কে সবুজ বনভূমির কানে কানে ফিস ফিস করে কি সব বলতে লাগল। পবর্তশীর্ষে উদিত সন্ধ্যাতারার আলো বাসরপ্রদীপের কাজ করতে লাগল আমাদের কুঞ্জে।
এইভাবে আমি আমার অতীত অবস্থার কথা আমার যতদূর মনে আছে তা তোমাকে বললাম। আমি বর্তমানে যে পার্থিব সুখ ভোগ করি সে কথা তো আমার অন্তর থেকে প্রকাশের আলোয় টেনে আনলাম। আমি স্বীকার করছি, সকল বস্তুতেই আমি আনন্দ পাই। কিন্তু সে আনন্দ পাই বা না পাই আমার মনের ক্রিয়ার কোন পরিবর্তন হয় না। অথবা কোন বস্তু দেখে আমার কামনার বেগ বেড়ে যায় না। কারণ ফুল ও ফলের রূপ, রস ও গন্ধ, পাখিদের গান, বর্ণ গন্ধ ও গানের সমন্বিত সৌন্দর্যসম্ভারে ভূষিত বনপ্রকৃতির মধ্যে আমাদের ইতস্তত বিচরণ–এই সব কিছুই অন্যরূপে দেখি আমি।
প্রকৃতি জগতের সকল সৌন্দর্যের আবেদনের মাঝে আমার মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতির আলোড়ন জাগে। সে অনুভূতির মধ্যে এমনই এক অটল অবিচলিত মহত্ত্বের ভাব আছে যার কাছে প্রকৃতির রূপ, রস, শব্দ, গন্ধজনিত সকল সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়। তখন আমার মনে হয় প্রকৃতির যা কিছু সৌন্দর্য তা শুধু তার বহিরঙ্গেই সীমাবদ্ধ। তার অন্তরঙ্গে নেই কোন সে সৌন্দর্যের মহিমা।
পরিশেষে আমি বুঝতে পারি আমাদের মধ্যে যে সব অন্তরবৃত্তিগুলি আছে তা প্রকৃতির থেকে অনেক বড়; তাদের তুলনায় প্রকৃতি ছোট। আবার তার বহিরঙ্গে যে সৌন্দর্য প্রকটিত সে সৌন্দর্য তাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই পরম স্রষ্টার সৌন্দর্যের অনুরূপ নয় অথবা তার সৃষ্ট যে মানবের উপর এই প্রকৃতি জগতের ও অন্যান্য প্রাণীর উপর প্রভুত্ব করার ভার ন্যস্ত হয়েছে তার চরিত্রের মতও সমুন্নত মহিমায় সমৃদ্ধ নয়।
তবু যখন আমি এই প্রকৃতির সুন্দর রূপকে প্রত্যক্ষ করি, তাকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অখণ্ড সত্তা বলে মনে হয়। মনে হয় তার নিয়ম, তার ইচ্ছা সবচেয়ে বিজ্ঞ, সবচেয়ে গুণবান ও উত্তম। প্রকৃতির সামনে মানুষের সকল প্রজ্ঞা ব্যর্থ হয়, অপ্রতিভ বা হীনপ্রভ হয় মানুষের সকল জ্ঞানগর্ভ আলোচনা। প্রকৃতির কাছে মানুষের সকল প্রভুত্ব ও যুক্তিবোধ হয়ে যায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত। মনে হয় যে প্রকৃতি পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের আগেই সৃষ্ট হয়, সে প্রকৃতি মানবমনের সকল মহত্ত্ব ও সমুন্নতিকে আত্মসাৎ করে নিয়েছে তার রূপের মধ্যে। দেবদূত প্রহরীর মত কেমন যেন এক ভীতির ভাব জাগাল আমাদের মনে।
দেবদূত রাফায়েল তখন ভ্রুকুটি করে বলল, প্রকৃতিকে দোষী করো না। সে তার আপন কাজ করে চলেছে, তুমি তোমার কাজ করে যাবে। অজ্ঞতার পরিচয় দিও । তুমি যদি প্রকৃতিকে ভুল না বোঝ তাহলে সে তোমাকে কখনই ত্যাগ করবে । তাকে তোমার প্রয়োজন আছে। তার কাছে তোমাকে যেতেই হবে। কোন বস্তুর অপূর্ণতাকে প্রত্যক্ষ করলে তার উপর খুব একটা বেশি গুরুত্ব আরোপ করো না। প্রকৃতির যে বহিরঙ্গ তোমাকে আনন্দ দেয়, যার তুমি প্রশংসা করো, নিঃসন্দেহে তা সুন্দর, তা নিশ্চয়ই তোমার কামনা, সম্মান ও ভালবাসার যোগ্য। তা কখনই তোমার প্রভুত্বের অধীন নয়। তার সঙ্গে নিজেকে ঠিকমত ওজন করে বিচার করে তবে তা মূল্যায়ন করো। তা না হলে তোমার বিচারের কোন অর্থ হয় না। সে বিচারে শুধু এক ভ্রান্ত আত্মপ্রসাদ ছাড়া আর কিছু লাভ হয় না। তোমার জ্ঞানবুদ্ধি ও কলাকৌশলদ্বারা প্রকৃতিকে যতই জানবে সে ততই মাথা নত করবে তোমার কাছে। তোমার বাস্তব জীবনে সে তোমাকে অনেক ভোগ্যবস্তু দান করবে। তখন মনে হবে তোমারই আনন্দের জন্য সজ্জিত হয়ে আছে বিচিত্র সম্ভারে।
প্রকৃতিকে যতই ভীতিপ্রদ মনে হবে ততই তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে ভালবাসবে। যে নারী তোমার জীবনের সাথী, তাকেও তুমি দান করবে শ্রদ্ধাবিমিশ্রিত ভালবাসা। মনে রাখবে শুধু স্পর্শেন্দ্রিয়ের পরিতৃপ্তি বা আনন্দ ভালবাসা নয়। সে ইন্দ্রিয়তৃপ্তি পশুদের জন্য, মানুষের জন্য নয়। তার মধ্যে যে সব গুণ আকর্ষণীয়, মানবিক ও যুক্তপূর্ণ তাই ভালবাসবে। কোন কামনার আবেদনকে প্রশ্রয় না দিয়ে শুধু ভালবেসে যাবে। কামনার আবেগের মধ্যে কখনো প্রকৃত ভালবাসা থাকে না। প্রকৃত প্রেমচিন্তাকে পরিমার্জিত করে হৃদয়কে করে প্রসারিত, যুক্তি ও নীতির মধ্যে তার উচ্চ আসনটি পাতা। ন্যায়পরায়ণ প্রেমের সোপান থেকেই মানুষ ঐশ্বরিক প্রেমের ঊর্ধ্বতন স্তরে উন্নীত হতে পারে। শুধু দেহগত আনন্দের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে থেকো না, এইজন্যই পশুদের মধ্যে তোমার সাথী পাওয়া যায়নি।
এই কথায় আদম কিছুটা লজ্জিত হয়ে বলল, তার বহিরঙ্গটি সুন্দর এবং সে সৃষ্টির দিক থেকে অন্যান্য প্রাণীর থেকে পৃথক, শুধু এই জন্যই তার মধ্যে আমি আনন্দ পাই না। তার দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কর্মের মধ্যে যে সুষমা ছন্দায়িত হয়ে ওঠে, তার প্রতিটি কথার মধ্যে যে প্রেম যে সৌন্দর্য তরঙ্গায়িত হয়ে ওঠে তাতেই আমি আনন্দ পাই। তার সুমধুর নমনীয়তা, শান্ত নিরুচ্চার এক আত্মসমর্পণের ভাব আমাদের দুটি মনকে মিলিত করে দেয়, এক ও অভিন্ন করে তোলে দুটি আত্মাকে। ঐক্য বা মিলন কথাটি শুনতে যত না ভাল, কোন বিবাহিত দম্পতির মধ্যে তা দেখতে আরও অনেক ভাল।
তুমি অন্য কিছু মনে করো না। অন্তরে আমি যা ভাবি বা অনুভব করি তাই অকপটে বললাম আমি। তুমি বলছ ভালবাসায় কোন দোষ নেই। ভালবাসাই মানুষকে স্বর্গের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। প্রেম একই সঙ্গে মানুষের পরম পথ এবং পথ প্রদর্শক। এখন যদি অন্যায় না হয় তাহলে আমার একটি কথার উত্তর দাও।
স্বর্গে যারা বাস করে অর্থাৎ ঈশ্বর ওদেবদূতেরা কি ভালবাসে? তাদের ভালবাসা কি শুধু দৃষ্টির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, না কি স্পর্শের মধ্য দিয়েও প্রকাশিত হয়?
দেবদূত রাফায়েল তখন গোলাপের মত লাল স্বর্গীয় সুষমামণ্ডিত এক হাসি হেসে বলল, শুধু এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে জেনে রাখবে আমরা সুখী। কিন্তু ভালবাসা ছাড়া কারো সুখ হতে পারে না। তোমরা তোমাদের দেহের মধ্যে যে সুখ ও আনন্দ উপভোগ করো, আমরা বিদেহী হয়েও সেই সুখ ও আনন্দ উপভোগ করি। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা অবয়বসংস্থান কোনভাবে কোন বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। বাতাসের থেকে হালকা বিদেহী দেবদূতেরা যখন পরস্পরকে আলিঙ্গন করে তখন দুজনে একেবারে মিশে যায়। সেই আলিঙ্গনের মধ্য দিয়ে একটি পবিত্র আত্মা আর একটি পবিত্র আত্মার মধ্যে লীন হয়ে যায় তারা। মানুষের মত দেহের সঙ্গে দেহ ও মনের সঙ্গে মনের মিশবার কোন প্রয়োজন হয় না। রক্তমাংসের দেহগত কোন বাধা বিঘ্ন ঘটাতে পারে না তাদের সে মিলনে।
কিন্তু আর আমি থাকতে পারছি না এখানে। সূর্য এখন সবুজ পৃথিবীর সীমা ত্যাগ করে অস্তাচলে গমন করছে। এটা আমার প্রস্থানের সংকেত। আমি যাচ্ছি, তুমি তোমার মনকে শক্ত করো। সুখে বসবাস করো। ভালবেসে যাও। তবে তোমার পরম স্রষ্টা ঈশ্বরকে ভুলে যেও না। তাঁর প্রতি তোমার প্রেম এবং আনুগত্য যেন অব্যাহত থাকে চিরকাল। তাঁর মহান আদেশ মেনে চলবে সব সময়। স্বাধিকারপ্রমত্তের মত স্বাধীন ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে যেন কামনার স্রোতে তোমার বিচারবুদ্ধিকে ভেসে যেতে দিও না। মনে রাখবে তোমার ভবিষ্যৎ সন্তানসন্ততিদের সমস্ত সুখদুঃখ তোমার উপরেই নির্ভর করছে। তুমি ঠিক থাকলে আমি তাতে আনন্দিত হব। ন্যায়নীতিকে ভিত্তি করে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে, না তোমার পতন ঘটবে সেটা তোমার বিচারবৃদ্ধির উপর নির্ভর করে। আপনাতে আপনি পূর্ণ হও। কোন বাইরের সাহায্যের প্রয়োজন হবে না। সমস্ত প্রলোভনকে জয় করবে সংযত চিত্তে। কোন কিছুই যেন বিধির বিধান লঙ্ঘনে বাধ্য করতে না পারে।
এই বলে উঠে পড়ল রাফায়েল। আমও তার সঙ্গে কিছুটা এগিয়ে গেল। তার আশীর্বাদ লাভ করল। বলল, আমার পরম শ্রদ্ধেয় পরম মঙ্গলময় ঈশ্বরের দ্বারা প্রেরিত হে বিদেশী দেবদূত, হে স্বর্গীয় অতিথি, তুমি স্বস্থানে প্রস্থান করো। তোমার এই সদয় আচরণের কথা আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ রাখব। মানবজাতির প্রতি সদয় হয়ে যেন মাঝে মাঝে স্বর্গ থেকে নেমে এস এমনি করে।
এইভাবে তাদের ছাড়াছাড়ি হলো। রাফায়েল চলে গেল স্বর্গলোকে আর আদম ফিরে এল কুঞ্জবনে।
০৮ম সর্গ
অষ্টম সর্গ
যেখানে ঈশ্বর বা দেবদূত স্বর্গ থেকে নেমে এসে বন্ধুর মত মানুষের পাশে এসে কত কথাবার্তা বলেন, তার সরল সামান্য খাদ্য ভোজন করেন, সেখানে আমাদের মত মানুষের কোন কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। আমি শুধু এই ঘটনার মর্মান্তিক পরিণাম দেখাব। মানুষ কিভাবে বিধির বিধান লঙ্ঘন করে অবিশ্বাসী, আনুগত্যহীন ও ঈশ্বরদ্রোহী হয়ে ওঠে, আমি বলব তারই কথা।
মানুষের এই অবিশ্বস্ততা ও নিষিদ্ধ আচরণের জন্য তাকে ত্যাগ করে তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান ঈশ্বর চিরতরে। ফলে স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যে ব্যবধান বা দূরত্ব বেড়ে যায়। উভয়পক্ষে ক্রমাগত চলতে থাকে ক্রোধ আর ভর্ৎসনার বাণবর্ষণ। অবশেষে ঈশ্বর বিচারের রায়দানের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে দুঃখ নেমে আসে চিরকালের জন্য। নেমে আসে পাপ আর মৃত্যুর করাল ছায়া। সত্যিই দুঃখের বিষয়। কিন্তু এ নিয়ে প্রচুর তর্কবিতর্ক হয়। ট্রয় যুদ্ধে শত্রুদের পশ্চাতে ধাবিত কঠোর একিলিসের মধ্যে যে রোষ দেখা গিয়েছিল, ঈনিসের প্রতি জুনো এবং ওডিসিয়াসের প্রতি সমুদ্রদেবতা পসেডন যে রোষ দেখান, ইতালির অধিপতি টার্নাস তার স্ত্রী ল্যাভিনিয়াকে হারিয়ে যে রোষে ফেটে পড়ে, সেই রোষ এইসব তর্কবিতর্কে প্রকাশিত হয়।
আমি এইসব কাব্যে প্রকাশ করার জন্য আমার স্বর্গীয় সাহায্যকারিণীর সাহায্য নিতে পারি। তিনি অযাচিতভাবে মাঝে মাঝে আমার নিদ্রার মধ্যেই আবির্ভূত হন। আমার স্বতোৎসারিত সকল কাব্যই তিনি আমাকে নিদ্রিত অবস্থাতে বলে দেন।
বহুদিন আগে হতেই এক বীরত্বপূর্ণ আখ্যানকাব্য রচনা করার প্রয়াস পেয়েছিলাম। কিন্তু শুধু বীরত্বের কথা মনঃপূত হয়নি আমার।
তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল মর্ত্যলোকে। ঘনীভূত হয়ে উঠছিল গোধূলির ছায়া, রাত্রির গোলার্ধে দিগন্তকে আচ্ছন্ন করে তুলেছিল।
এমন সময় যে শয়তানরাজ গ্যাব্রিয়েলের দ্বারা তাড়িত হয়ে ইডেন উদ্যানের সীমানা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সে আবার ফিরে এল। সে আবার তার পূর্বপরিকল্পিত প্রতারণা আর প্রতিহিংসাকে সজীব করে তুলল তার মনে। মানবজাতির ধ্বংসসাধনের উদ্দেশ্যে ও সংকল্পে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠল সে। সে তারপর মধ্যরাত্রির অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে নির্ভীকভাবে ফিরে এল।
ইতিমধ্যে সে গোটা পৃথিবীটাকে পরিক্রমা করে এসেছে। ইউরিয়েল তাকে চিনতে পারার পর থেকে চেরাবজাতীয় দেবদূত প্রহরীদের সতর্ক করে দেয় সে। সে তাই সারাদিন ধরে দেবদূতদের প্রহরা এড়িয়ে অতি সন্তর্পণে ঘুরে বেড়িয়ে রাত্রির অন্ধকারে ফিরে আসে ইডেন উদ্যানে।
এর আগে পৃথিবী পরিক্রমাকালে সে শুধু পৃথিবীর নদী-সমুদ্র-পাহাড়-পর্বত সমম্বিত বিচিত্র ভূপ্রকৃতি দর্শন করেনি, সে তার বিচিত্র জীবজন্তুগুলিকেও বিভিন্ন জায়গায় ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে। সে দেখে কোন্ জীব তার উদ্দেশ্যসাধনের বেশি কাজে লাগবে। সব দেখার পর অবশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় সে যে, সাপই হলো সব জীবজন্তুর মধ্যে সবচেয়ে কুটিল। সে সর্পদেহ ধারণ করে তার কু-অভিসন্ধি সিদ্ধ করলে কেউ তাকে সন্দেহ করবে না। অন্য জীবদেহ ধারণ করে এ কাজ সিদ্ধ করতে গেলে সন্দেহ জাগতে পারে অন্যের মনে। সে তাই মনে মনে ঠিক করল সর্পদেহের মধ্যে প্রবেশ করে তার কুটিল প্রতারণার গোপন বাসনাকে লোকচক্ষু হতে ঢেকে রেখে স্বচ্ছন্দে তা চরিতার্থ করতে পারবে সে।
সে তখন পৃথিবীকে সম্বোধন করে আবেগের সঙ্গে বলতে লাগল, হে পৃথিবী, তুমি স্বর্গলোকের শুভ অনুরূপ যদিও স্বৰ্গকেই সকলে পছন্দ করে বেশি। তথাপি তুমি দেবতাদের বসবাসযোগ্য, যদিও তোমাকে স্বর্গের পর দ্বিতীয় স্থানাধিকারী হিসাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে। ঈশ্বর স্বর্গের সব স্থান সৃষ্টি করার পর কখনো তার থেকে খারাপ কিছু সৃষ্টি করতে পারেন না।
অনন্ত মহাশূন্যে যে সব ঘূর্ণমান গ্রহনক্ষত্র, সূর্য ও জ্যোতিষ্কমণ্ডলী নিয়ত নৃত্যশীল তাদের আলোক শুধু তোমার উপরেই পতিত হয়। তারা শুধু তোমাকেই আলোকিত করে। ঈশ্বর যেমন ত্রিভূবনের কেন্দ্রস্থলে বিরাজিত থেকে সর্বত্র তাঁর প্রভাব ও প্রভুত্ব বিস্তার করেন তেমনি তুমিও সমস্ত গ্রহের কেন্দ্রস্থলে থেকে সমস্ত সৌরজগতের শুভ প্রভাবগুলি আকর্ষণ করো। তাদের গুণগুলি তোমার গাছপালা ও ওষধিতে সঞ্চারিত হয় সফলভাবে। সেইসব গুণের প্রভাবেই তোমার মধ্যস্থিত প্রাণীগুলি জন্মলাভ করে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ধীরে ধীরে। তাদের মধ্যে মানুষই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ প্রাণী, একমাত্র তারই মধ্যে জ্ঞানবুদ্ধি আছে।
হায়, আমি যদি হে পৃথিবী, তোমার অধিবাসী হতাম তাহলে তোমার মত সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়ে পাহাড়-উপত্যকা, নদী-সমুদ্র, সমতল ভূমি, অরণ্যরাজি দেখে কত আনন্দই না লাভ করতাম। কিন্তু তোমার মধ্যে এত সব কিছু থাকা সত্ত্বেও কোথাও আমার আশ্রয় নেই। কোথাও আমার বাসের স্থান নেই। আমার চারদিকে আমি এইসব আনন্দময় বস্তুগুলি যতই দেখি তই আমার অন্তজ্বালা বেড়ে যায়। আমার মধ্যে এমন কতকগুলি ঘৃণ্য বিপরীতমুখী ভাবধারা আছে যার জন্য সকল সুন্দর বস্তু অসুন্দর হয়ে যায় আমার কাছে। এমন কি স্বর্গলোকেও আরও শোচনীয় হয়ে উঠবে আমার অবস্থা। কিন্তু এই মর্ত্যলোকে অথবা স্বর্গলোকে আমি বাস করতে চাই না। আমি চাই শুধু স্বর্গের অধিপতিকে জয় করতে। তাঁর সব গৌরবকে খর্ব করে দিতে। কিন্তু আমার এই দুঃখময় অবস্থা তা শুধু একা ভোগ করতে চাই না, আমি অন্য সব সুখীদেরও আমার এই দুঃখের অংশভাগী করে তুলতে চাই। তাতে যদি আমার দুঃখ আরও বেড়ে যায় তো যাক।
ধ্বংসের মধ্যে সবচেয়ে শান্তিলাভ করে আমার বিক্ষুব্ধ চিন্তাগুলি। যাদের জন্য এই সুন্দর পৃথিবী সৃষ্ট হয়েছে তাদের ধ্বংস করা অথবা তাদের ক্ষতিসাধন করাই হলো আমার কাজ। তাহলে এর স্রষ্টাও দুঃখ পাবে। তাতেই আমি সমস্ত নরকবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে গৌরববোধ করব।
সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যে পৃথিবী ছয়দিন ছয়রাত ধরে সৃষ্টি করেছেন এবং তার আগেও কতদিন ধরে তার পরিকল্পনার চেষ্টা করেছেন তা আমি একদিন ধ্বংস করে দিতে চাই।
আমরা স্বর্গলোক থেকে বিতাড়িত হবার পর আমাদের সংখ্যা পূরণের জন্য অথবা আমাদের প্রতি ঘৃণাবশত আমাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য এই পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করে তাদের উন্নতি সাধনের জন্য বিভিন্ন স্বর্গীয় গুণাবলীতে ভূষিত করেছেন। তাঁর ইচ্ছা ও পরিকল্পনা মতোই কাজ করেছেন তিনি।
তিনি মানুষ সৃষ্টি করে সেই মানুষের জন্য এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষকে এই জগতের অধীশ্বররূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হায়, এইভাবে কী উপকারই না তিনি আমাদের করেছেন। স্বর্গের দেবদূতেরা সর্বদা পাখা মেলে এই মানুষের অধীনস্থ দাসের মত সেবা করে বেড়ায়। দেবদূত প্রহরীরা সারা পৃথিবী প্রহরা দিয়ে বেড়ায়। তাদের। প্রহরাকেই আমি সবচেয়ে ভয় করি। তাদের সেই প্রহরা এড়ানোর জন্যই আমি মধ্যরাত্রির কুয়াশা ও অন্ধকারের আবরণে গা ঢাকা দিয়ে গোপনে নিঃশব্দে এখানে প্রবেশ করেছি। কোথায় এক ঘুমন্ত সর্পকে দেখতে পাব এবং তার দেহে প্রবেশ করে আমার কুটিল কামনাকে চরিতার্থ করতে পারব তার জন্য প্রতিটি ঝোঁপঝাড় আমি অনুসন্ধান করে চলেছি।
যে আমি একদিন সর্বোচ্চ পদে অভিষিক্ত হয়ে দেবতাদের সঙ্গে ওঠাবসা করতাম, সেই আমি আজ বাধ্য হয়ে পশু হতে চলেছি। পশুর গুণাবলী ধারণ করতে চলেছি। কিন্তু উচ্চাভিলাষ পূরণ ও প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য কে নীচে নামবেনা? যে উচ্চাভিলাষের আকাশে পাখা মেলে উড়তে চায় তাকে নীচে নামতেই হবে। যে প্রতিশোধ চায় তাকে আপাতমধুর সেই প্রতিশোধের তিক্ত ফল ভোগ করতেই হবে!
তাই হোক। যেহেতু সুউচ্চ স্বর্গলোকে গিয়ে আমি ঈশ্বরকে ধরতে পারলাম না, সেইহেতু সেই ঈশ্বরের পরেই যে আমার মনে ঈর্ষা জাগায়, যে ঈশ্বরের নূতন প্রিয় বস্তুরূপে আমাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। আমাদের প্রতি ঘৃণাবশত যাকে ঈশ্বর সামান্য মাটি থেকে সৃষ্টি করে এমন উন্নত অবস্থায় উন্নীত করেছেন, সেই মাটির মানুষকে ঈশ্বরের নবজাত সন্তানকে ঘৃণা করতে চাই আমি। ঘৃণার শোধ ঘৃণার দ্বারাই নিতে হয়।
এই কথা বলার পর একরাশ কালো কুয়াশার মত গুঁড়ি মেরে প্রতিটি সিক্ত অথবা শুষ্ক ঝোঁপের মধ্যে সে একটি ঘুমন্ত সর্পের সন্ধান করে যেতে লাগল। অবশেষে সে এক জায়গায় দেখতে পেল ঘাসের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে মাথা রেখে একটি সাপ নির্ভয়ে ঘুমোচ্ছে। শয়তান তার মুখের মধ্যে প্রবেশ করে তার পাশবিক কুটিল স্বভাবটি লাভ করল। তারপর তার বুদ্ধিকে সক্রিয় করে তুলল। কিন্তু তাতে সর্পটির ঘুমের কোন ব্যাঘাত হলো না। এইভাবে রাত্রি প্রভাত হবার অপেক্ষায় রইল।
তারপর যখন প্রভাতের শুচিস্নিগ্ধ আলো ইডেন উদ্যানের প্রস্ফুটিত ফুলগুলির উপর ঝরে পড়তে লাগল, তখন সেই সব ফুলগুলি হতে বিচিত্র সৌরভে আমোদিত হয়ে উঠল উদ্যান। পৃথিবীর সমস্ত সুগন্ধি বস্তুগুলি পরম স্রষ্টার উদ্দেশ্যে নীরবে গৌরবগান করতে লাগল। তখন সর্পরূপী শয়তান দেখল সেই মানবদম্পতি ঈশ্বরের স্তোত্ৰগানে মুখর হয়ে উঠল। সমস্ত প্রকৃতি ও প্রাণীজগতের মধ্যে একমাত্র তারাই এই কণ্ঠস্বরের অধিকারী। ঈশ্বরের স্তবগানে সমর্থ। গান শেষে তারা প্রথমে প্রকৃতির রূপ, বর্ণ ও গন্ধ কিছুক্ষণ উপভোগ করল। পরে তারা তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করতে লাগল।
ঈভ তখন বলল, আদম, যতই আমরা এই উদ্যানের গাছপালা ও ফুলগুলির পরিচর্যা করছি ততই আমাদের কাজ বেড়ে যাচ্ছে। এতদিন আমরা দুজনে একসঙ্গে কাজ করে আসছি। একাজে আরও লোকের দরকার। যে সব গাছপালার অতিরিক্ত অংশ হেঁটে দিচ্ছি, একরাত্রির মধ্যেই তারা আবার বেড়ে উঠছে। তাই উপায়স্বরূপ একটি চিন্তা আমার মনে হয়েছে। এ বিষয়ে তোমার পরামর্শ চাই। আমি আমাদের শ্রমকে ভাগ করে নিতে চাই। আমরা দুজনে দু জায়গায় কাজ করব। তুমি পছন্দমত এক জায়গায় যেতে পার অথবা যেখান বেশি প্রয়োজন বুঝবে সেখানে যাবে। অথবা যেখানে আইভিলতাগুলি কোন গাছকে জড়িয়ে উঠতে পারছে না সেখানে গিয়ে তাদের উঠিয়ে দেবে। আর আমি ঐ গোলাপবনে গিয়ে তাদের পরিচর্যা করব বেলা দুপুর পর্যন্ত।
কিন্তু আমরা দুজনে যদি একই জায়গায় কাছাকাছি কাজ করি তাহলে পরস্পরের দৃষ্টি বিনিময়, হাসাহাসি ও কথাবার্তায় সময় কেটে যায়, কাজের কাজ কিছুই হয় না। সারাদিন বৃথাই কেটে যায়।
আদম তখন শান্তকণ্ঠে উত্তর করল, হে আমার একমাত্র সহচরী, সমস্ত প্রাণীর মধ্যে তুমিই আমার প্রিয়তমা, ঈশ্বরনির্দিষ্ট আমাদের দৈনন্দিন কাজগুলি কিভাবে সুচারুরূপে সম্পন্ন হতে পারে সে বিষয়ে তুমি ঠিকই বলেছ। কাজ ঠিকমত না হওয়ার জন্য যাতে আমার কোন নিন্দা বা বিরূপ সমালোচনা না হয় সেদিকে তোমার লক্ষ্য আছে। পারিবারিক মঙ্গলসাধনই নারীর সৌন্দর্যকে পূর্ণতা দান করে। পারিবারিক উন্নতির জন্য যথাসাধ্য কাজ করে যাওয়াই নারীর ধর্ম।
কিন্তু ঈশ্বর আমাদের উপর এমন কিছু কঠোর শ্রমের ভার চাপিয়ে দেননি যে আমরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে দুজনে একসঙ্গে বসে বিশ্রাম করে অথবা মধুর আলাপ-আলোচনার দ্বারা চিত্তবিনোদন করতে পারব না। যে হাসি মানুষের যুক্তিবোধ থেকে উৎসারিত হয়, সে হাসি পশুদের মুখে পাওয়া যায় না। নরনারীর মুখের সেই মিষ্টি হাসি ও মধুর বিশ্রম্ভালাপ মানবমনের খাদ্য। প্রেম হচ্ছে মানবজীবনের এক মহান লক্ষ্য, কোন হীনতম লক্ষ্য নয়।
কোন কষ্টকর বিরক্তিকর শ্রমের জন্য আমাদের সৃষ্টি হয়নি, আমাদের সৃষ্টি হয়েছে আনন্দের জন্য এবং এই আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তি। এইসব বনপথ ও কুঞ্জগুলি আমরা দুজনেই হাত দিয়ে পরিষ্কার রাখতে পারব। আমাদের বেড়াবার প্রশস্ত পথ থাকবে। পরে আমাদের সন্তানরা তাদের ছোট ছোট হাত দিয়ে সাহায্য করবে আমাদের কাজে।
তবে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার দ্বারা তোমার মন যখন তৃপ্ত হবে তখন তুমি অল্প : কিছুক্ষণের জন্য অনুপস্থিত থাকতে পার। আমি তা সহ্য করতে পারব। কারণ নির্জনতা অনেক সময় উত্তম সাহচর্য বা সঙ্গদানের কাজ করে। স্বল্পকালীন বিরাম বা বিশ্রাম ভাল ফল দান করে।
তবে এ বিষয়ে আর একটি সংশয় আচ্ছন্ন করছে আমার মনকে। পাছে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্যত্র কোথাও গেলে তোমার কোন বিপদ ঘটে বা তোমার কোন ক্ষতি হয় তা ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠেছে আমার মন। আমাদের কিভাবে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে তা তুমি জান। আমাদের কোন প্রতিহিংসাপরায়ণ শত্রু আমাদের সুখে ঈর্ষান্বিত ও তার হতাশায় বিক্ষুব্ধ হয়ে এক হীন চক্রান্ত ও অপকৌশলের দ্বারা আমাদের পতন ঘটিয়ে অন্তহীন দুঃখ, লজ্জা ও অপমানের গহুরে নিক্ষেপ করতে চাইছে। সে শত্ৰু নিশ্চয় আমাদের নিকটবর্তী কোন জায়গায় থেকে লক্ষ্য করছে, তার কু-অভিসন্ধি পূরণের সুযোগ খুঁজছে। দেখছে আমরা এক জায়গায় পাশাপাশি থাকলে সুবিধা হবে না। কারণ তাহলে একজনের প্রয়োজনে অন্যজন সাহায্য করতে পারব সঙ্গে সঙ্গে। সেই জন্য আমরা দুজনে ছাড়াছাড়ি হয়ে দূরে দূরে থাকলে তার সুবিধা হবে।
তার আসল উদ্দেশ্য হলো তার ঈর্ষার প্রধান বস্তু আমাদের এই সুখী জীবনের অবসান ঘটানো। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সে ঈশ্বরের প্রতি আমাদের আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা অথবা আমাদের দাম্পত্যপ্রেমে ব্যাঘাত ঘটাতে চায় সে। তবে সে যাই করুক, যে ঈশ্বর তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাকে আজীবন রক্ষা করে চলেছেন তার পক্ষ যেন ত্যাগ করো না। যেখানে স্ত্রীর বিপদ বা অপমানের আশঙ্কা থাকে, সেখানে সে স্বামীর কাছে নিরাপদে থাকে, সেখানে স্বামীই তাকে রক্ষা করে।
ঈভ তখন গম্ভীরভাবে বলল, হে ঈশ্বরের সন্তান এবং পৃথিবীর অধীশ্বর, আমাদের এমন একজন শত্রু আছে যে আমাদের সর্বনাশ ঘটাতে চায় তা তোমার কাছ থেকেই জানতে পেরেছি আমি। আমাদের সেই দেবদূত অতিথি বিদায় নেবার সময় এ বিষয়ে যা বলে যান তাও আমি আমাদের বনকুঞ্জের পিছনে দাঁড়িয়ে সব শুনেছি।
কিন্তু আমাদের একজন শত্রু আমাদের প্রলোভিত করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে বলে তুমি যে ঈশ্বরের প্রতি ও তোমার প্রতি আমার বিশ্বস্ততা ও দৃঢ়তায় সংশয় প্রকাশ করবে এটা আমি আশা করতে পারিনি। তার শক্তিকে তুমি ভয় করো না। কারণ আমরা মৃত্যুযন্ত্রণার বশীভূত নই। মৃত্যু আমাদের আক্রমণ করতে পারবে না, তার সে আক্রমণকে আমরা প্রতিরোধ করতেও পারব না। তার প্রতারণাকে একমাত্র তুমিই ভয় করো। আর সেই ভয় থেকেই তুমি বিশ্বাস করো ঈশ্বরের প্রতি আমার বিশ্বস্ততা তোমার প্রতি আমার ভালবাসা তার প্রতারণার দ্বারা বিকম্পিত ও ব্যাহত হবে। যে তোমার জীবনে সবচেয়ে প্রিয় তার প্রতি এই চিন্তা কেমন করে পোষণ করো তুমি তোমার অন্তরে? কি করে সে চিন্তা প্রবেশ করল তোমার মনে?
আদম তখন উত্তর করল, হে ঈশ্বরসৃষ্ট মানবকন্যা, অমর ঈভ, জানি তুমি মৃত্যু, পিপ বা কোন দোষ থেকে মুক্ত। তুমি নিষ্পাপ, নির্দোষ ও কলুষমুক্ত তা জানি। তোমার কোন অপূর্ণতা বা ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য আমি তোমাকে আমার কাছ থেকে সরে যেতে দিচ্ছি না, আমাদের শত্রুর সম্ভাব্য প্রলোভনটাকে এড়াবার জন্যই তোমাকে নিষেধ করছি আমি। তার প্রলোভন বৃথা হলেও তোমার ধর্মবিশ্বাস প্রলোভনের অতীত নয় জেনে সে তোমার সম্মানকে কলুষিত করার চেষ্টা করবেই। তার সেই অন্যায় প্রচেষ্টা যত নিষ্ফলই মনে হোক না কেন, তুমি তা ঘৃণা ও ক্রোধের দ্বারা প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। তাই আমি বলি তুমি একা এই প্রলোভনের সম্মুখীন হও এটা যদি আমি না চাই তাহলে কিছু মনে করো না। আমরা একসঙ্গে এক জায়গায় দুজনে থাকলে শত্রু তা করতে সাহস করত না। আর সাহস করলেও আমাদের উপরেই প্রথমে নেমে আসত তার সে আক্রমণ। যে শয়তান তার ছলনার দ্বারা দেবদূতদেরও প্রতারিত করে সে এমন সূক্ষ্মভাবে তার ছলনাজাল বিস্তার করবে যে তুমি তার সে ছলনা ও প্রতারণা ধরতে পারবে না। সুতরাং এ বিষয়ে অপরের সাহায্য অপ্রয়োজনীয় ভাবা ঠিক নয়।
আমি কিন্তু তোমার দৃষ্টির প্রভাবে অনেক গুণ ও জ্ঞান লাভ করি। তোমাকে দেখে মনে অনেক জোর পাই। কারণ বুঝি দরকার হলে তোমার সাহায্য পাব। অথচ তুমি লজ্জা পাচ্ছ কেন এতে? সব লজ্জা জয় করে তুমি তোমার জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে এটা বুঝতে পারছ না কেন যে আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকলে আমাদের শক্তি আরো বেড়ে যাবে। আমার উপস্থিতিতে তোমার গুণ ও মানসিক শক্তির পরীক্ষা হলে ভাল হবে।
তার স্ত্রীর প্রতি ভালবাসাবশত আদম এই কথা বললে ঈভ কিন্তু তার বিশ্বস্ততার নিষ্ঠা সম্বন্ধে কোন সংশয় না থাকায় সে আর কোন গুরুত্ব দিতে চাইল না সে কথায়।
ঈভ বলল, এই যদি আমাদের অবস্থা হয়, ছোট-বড় কোন শত্রুর ভয়ে এক সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে যদি আমাদের বাস করতে হয় এবং একা সে শত্রুর সম্মুখীন হওয়া যদি সম্ভব না হয় তাহলে কিসের আমরা সুখী? যদি বিপদের আশঙ্কায় আজও শঙ্কিত হতে হয় আমাদের তাহলে আমাদের সুখ কোথায়? কিন্তু কোন পাপ না করলে তো কোন ক্ষতি হতে পারে না? সে আমাদের দাম্পত্য প্রেমের নিবিড়তা বা অখণ্ডতাকে হীনজ্ঞান করতে পারে। কিন্তু তাকে হীনজ্ঞান মনে করলেই তো তা হীন বা অসম্মানিত হয়ে পড়বে না। সুতরাং আমরা পরস্পরের কাছ থেকে ছাড়াছাড়ি হলেও তাতে ভয়ের কি আছে?, বরং তার অনুমান মিথ্যা প্রমাণিত হলে এই ঘটনা থেকে দ্বিগুণ সম্মান লাভ করবে আমাদের প্রেম। কারণ আমরা ঈশ্বরের দ্বারা অনুগৃহীত। তাছাড়া বিশ্বাস, প্রেম প্রভৃতি গুণগুলি যদি কখনো প্রতিকূল ঘটনার আঘাতে সুরক্ষিত না হয়, যদি তারা একাকী আপন আপন প্রাণশক্তির দ্বারা আত্মরক্ষা করতে না পারে তাহলে সে সব ক্ষণভঙ্গুর গুণগুলির প্রয়োজন কি? সুতরাং আমাদের এই সুখী অবস্থার প্রতি কোন সংশয় পোষণ করা উচিত নয়। যদি তোমার ধারণা ঠিক হয় তবে বুঝতে হবে স্রষ্টা আমার সুখকে ক্ষণভঙ্গুর করেছেন যাতে আমরা একাকী সে সুখকে রক্ষা করতে পারি। তাহলে ঈশ্বরনির্মিত এই ইডেনই নয়, সামান্য সাধারণ এক উদ্যানমাত্র।
আদম তখন আবেগের সঙ্গে বলল, হে নারী, ঐশ্বরিক ইচ্ছায় সৃষ্ট সকল বস্তুই উত্তম। ঈশ্বর নিপুণহস্তে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তার কোন কিছুই অপূর্ণ নয়। মানুষকেও তিনি অপূর্ণ করে সৃষ্টি করেননি। বাইরের যেকোন প্রতিকূল শক্তিকে প্রতিহত করে সে তার নিজের সুখের অবস্থাকে নিরাপদ বা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে। তার যা কিছু বিপদ বা শত্রু তা আছে তার ভিতরে এবং সে বিপদ অতিক্রম করার ক্ষমতা তার নিজের মধ্যেই আছে। তার নিজের ইচ্ছা না থাকলে কোন ক্ষতিই হতে পারে না।
কিন্তু ঈশ্বর মানুষের ইচ্ছাকে স্বাধীন করে রেখেছেন। কারণ যা কিছু যুক্তিকে মেনে চলে তাই স্বাধীন। এই যুক্তি সব সময় সঠিক এবং ন্যায়ের পথ দেখায়। কিন্তু এই যুক্তি অন্তরে গোপন অবস্থায় থাকে। তবু ইচ্ছা কোন ভুল করলেই তাকে ঠিক পথে চালিত করার জন্য সব সময় খাড়া হয়ে থাকে। পাছে কোন আপাতসুন্দর বস্তু বা ব্যক্তি ভালর বেশ ধরে এসে তাকে ভুল পথে চালিত করে এবং ইচ্ছাকে ভুল তথ্য পরিবেশন করে তাকে ভুল বুঝিয়ে ঈশ্বরের দ্বারা নিষিদ্ধ কোন কাজ করতে বাধ্য করে তার জন্য সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রেখে চলে সে।
সুতরাং আমি ভালবেসে যে তোমাকে প্রায়ই মনে করিয়ে দিই তা যেন অবিশ্বাস করো না। আমরা আমাদের আদর্শে যত দৃঢ় বা অবিচল থাকি না কেন, সে আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে পারি আমরা। কারণ যুক্তি অনেক সময় শত্রুর বিস্তৃত ছলনাজালে পড়ে তার প্রহরা শিথিল করে তার অজানিতেই প্রতারণার শিকার হয়ে পড়ে।
সুতরাং প্রলোভনকে ডেকে এনো না। তাই তাকে পরিহার করে চলা ও আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়াই ভাল। কখন কিভাবে বিপদ আসবে অপ্রত্যাশিতভাবে বলা যায় না। তুমি যদি মনেপ্রাণে বিশ্বস্ত হও তাহলে প্রথমে তোমার আনুগত্যের পরিচয় দিতে হবে।
যদি তুমি মনে করো আমরা একসঙ্গে থাকলেও বিপদ অতর্কিতভাবে আমাদের উপরেও এসে পড়তে পারে, যদি মনে করো তুমি তোমার শক্তিতে খুব বেশি আস্থাশীল হয়ে উঠেছ তাহলে যেতে পার। কারণ তুমি যদি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার কাছে থাক তাহলে তোমার সে উপস্থিতি অনুপস্থিতির থেকেও দুর্বিসহ হয়ে উঠবে। তাহলে তোমার সহজাত নির্দোষিতা এবং নিজস্ব গুণাবলীর উপর ভিত্তি করে চলে যাও। ঈশ্বর যেমন করে তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, যে সব গুণাবলী দান করেছেন, তুমি সেই সব গুণানুসারেই চলবে।
আমাদের আদিপিতা এই কথা বললেও ঈভ জেদ করতে লাগল। সে বিরক্তির সঙ্গে বলল, তোমার অনুমতি নিয়ে এবং পূর্ব হতে সতর্কিত হয়ে আমি যাচ্ছি। তোমার দ্বারা উপস্থাপিত শেষ যুক্তিটি স্পর্শ করে আমার মনকে। আমরা একসঙ্গে থাকলেও আমাদের অপ্রস্তুত অবস্থাতেই অতর্কিতভাবে বিপদ এসে পড়তে পারে। সুতরাং আমি স্বেচ্ছায় যাচ্ছি। আমাদের দর্পিত শত্ৰু অতর্কিতে এসে আমাদের মধ্যে যে বেশি দুর্বল শুধু তারই খোঁজ করবে এটা আমি আশা করতে পারি না। ঈভকে এইভাবে অনমনীয় দেখে আদম ভাবল এরপর তাকে নিষেধ করতে হলে সেটা লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
ঈভ তার কথা বলা শেষ করেই আদমের হাত হতে তার নরম হাতটি ছাড়িয়ে নিল। হালকা বনপরীর মত সে বাতাসের বেগে তখনি চলে গেল।
বাগানের কাজ করার উপযুক্ত যন্ত্রপাতি নিয়ে ঈভ যখন আদমের কাছ থেকে অন্যত্র কাজ করতে যাচ্ছিল তখন তাকে দেখে রোমকদেবতা ভাতুমনাসকে ছেড়ে চলে যেতে থাকা তার প্রেমিকা পমোনার মত দেখাচ্ছিল।
তার পথপানে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে যতদূর দেখা যায় ততদূর দেখতে লাগল আদম। তার শুধু মনে হচ্ছিল ঈভ তার কাছে আরো কিছুক্ষণ থাকলে ভাল হত। যাবার সময় সে ঈভকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বলে দেয় বারবার। ঈভও তাকে জানিয়ে দেয় সে দুপুর হলেই ফিরে আসবে তাদের কুঞ্জে। তারা একসঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজন করবে এবং একসঙ্গে বিশ্রাম গ্রহণ করবে।
হে অতিপ্রতারিত, অতিব্যর্থ, ভাগ্যহীনা ঈভ, প্রতিকূল ঘটনার দ্বারা তোমার প্রস্তাবিত প্রত্যাবর্তন হবে কত কলুষিত। সেই প্রত্যাবর্তনের পরমুহূর্ত হতেই তুমি আহার ও বিশ্রামে আর কোন মাধুর্য বা আনন্দ পাবে না। কারণ শয়তান সকাল থেকেই তোমার পথে অতর্কিত আক্রমণে তোমার সকল নির্দোষিতা, ঈশ্বরবিশ্বাস ও স্বর্গীয় সুখ হতে চিরতরে তোমাকে বঞ্চিত করার জন্য সাপের রূপ ধরে ছায়াচ্ছন্ন ফুলবনে ওৎ পেতে লুকিয়ে আছে। যে দুটিমাত্র আদি মানব-মানবীর মধ্যে ভাবী কালের সমগ্র মানবজাতি নিহিত আছে সেই দুটি মানব মানবীই তার উদ্দিষ্ট শিকারের বস্তু।
মাঠে, বাগানে, কুঞ্জবনে কত খুঁজেছে তাদের। সে তাদের দুজনকেই কোন ঝর্ণা বা ছায়াচ্ছন্ন নদীতটে নির্জনে দেখতে চেয়েছে। তবে ঈভকে একা পেলেই ভাল হয়। কিন্তু ঈভকে সে তার স্বামীর থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একা পেতে ইচ্ছা করলেও সে ইচ্ছা পূরণ তার আশাতীত। কারণ তারা সব সময় দুজনে একসঙ্গে থাকে। একসঙ্গে কাজ করে অথবা বেড়ায়।
কিন্তু শয়তান তার গুপ্তস্থান থেকে ঈভকে সেদিন একাই দেখল। দেখল একটি ফুটন্ত গোলাপের ঝোঁপের পাশে একা একা দাঁড়িয়ে কাজ করছে ঈভ আপন মনে। গোলাপগাছের যে সব সরু সরু শাখাগুলি ফোঁটা ফুলের ভারে নুইয়ে পড়ছিল তাদের তুলে ধরে এক একটি অবলম্বন দান করছিল সে। গাছের আড়ালে থাকায় ঈভকে সম্পূর্ণ দেখা যাচ্ছিল না।
শয়তান এবার তার গুপ্তস্থান থেকে বেরিয়ে এসে গাছপালার মধ্যে দিয়ে ঈভের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল সন্তর্পণে। গোলাপের গন্ধে আমোদিত ও তার রূপ সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ দেখে তার গাটাকে সত্যিই খুব মনোরম দেখাচ্ছিল। মুক্তবায়ুহীন শহরে দীর্ঘকাল আবদ্ধ থাকার পর কোন লোক যদি গ্রীষ্মের কোন এক সকালে গ্রামের মুক্ত বাতাসে ভরা খোলা মাঠে এসে পড়ে তাহলে সে গ্রামের প্রতিটি বস্তু ও শব্দদৃশ্য দেখেই আনন্দ পায়। নরকবাসী শয়তানরাজও তেমনি সেই গোলাপকুঞ্জের কাছাকাছি এসে অনুরূপ আনন্দ লাভ করল। দেখল ঈভও প্রস্ফুটিত ফুলের মতই সুন্দর। সকল আনন্দ যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে ঈভের চোখে।
সর্পরূপী শয়তান দেখল ঈভের চেহারাটা অনেকটা দেবদূতের মত, কিন্তু এক অপরূপ সৌন্দর্যসুষমায় মণ্ডিত নারীমূর্তি। তার চেহারার মধ্যে এমনই একটি স্বর্গীয় ছবি ছিল যা দেখে শয়তানের ভয়ঙ্কর অভিলাষ ও প্রতিহিংসার সকল ভীষণতাও যেন ভয় পেয়ে গেল।
ঈভকে দেখতে দেখতে ক্ষণকালের জন্য সেখানে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল শয়তান। ক্ষণকালের জন্য সে সমস্ত শত্রুতা, হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণা ও প্রতিশোধ-বাসনার কথা সব ভুলে গিয়ে খুব ভাল হয়ে উঠল মনে মনে। হয়ে উঠল পবিত্রচিত্ত। ঈভকে দেখে এক সত্যিই বিশুদ্ধ আনন্দ লাভ করল।
কিন্তু সে শুধু ক্ষণকালের জন্য। তার বুকের মধ্যে যে ভয়ঙ্কর নরকাগ্নি অনির্বাণভাবে জ্বলে চলছিল, সে অগ্নি প্রবল হয়ে উঠল আবার। সে আগুন মুহূর্তে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল তার আগুনের সকল শুচিতা ও আনন্দকে। এই ইডেন উদ্যানে যে সব মনোরম বস্তু তাদের ভোগের জন্য সৃষ্ট হয়নি, হয়েছে মানবজাতির জন্য, সেই সব জিনিস দেখার সঙ্গে সঙ্গে মনের উপর দুঃখের পীড়ন বেড়ে যায়। প্রবলতর হয়ে ওঠে ঘৃণা, প্রতিহিংসা আর বিদ্বেষ। কলুষিত ও বিষাক্ত হয়ে ওঠে তার সকল চিন্তা।
নিজের চিন্তাভাবনাকে সম্বোধন করে উন্মাদের মত বলতে লাগল শয়তান, হে আমার চিন্তারাজি, তোমরা আমায় কোথায় নিয়ে এসেছ? কোন্ মায়াবলে আমাকে এমন এক মধুর বিস্মরণের মধ্যে ডুবিয়ে দিলে যাতে আমি আমার আসল উদ্দেশ্যটাকে ভুলে গেলাম! কোন ভালবাসা, স্বর্গলাভের আশা বা এখানকার উদ্যানসুলভ আনন্দ আস্বাদনের জন্য এখানে আসিনি আমি, আমি এসেছি এখানকার সব আনন্দ ধ্বংস করে দিতে।
আমি এখন কেবল ধ্বংস করেই আনন্দ পেতে চাই। অন্য যে কোন আনন্দ মিথ্যা আমার কাছে। যে সুযোগ সৌভাগ্যের রূপ ধরে সুপ্রসন্ন হয়ে উঠেছে আমার, প্রতি তাকে যেন ব্যর্থ হয়ে চলে যেতে দিও না। ঐ দেখ, সেই আদি মানবী এখন সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় কাজ করছে। আমার প্রচেষ্টাকে সার্থক করে তোলার এই হলো সুবর্ণ সুযোগ। আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি ওর স্বামী এখন অনেক দূরে আছে, তার কাছে নেই। তার উচ্চমনের বুদ্ধি, বীরত্বপূর্ণ চেহারা, তার শক্তি, সাহস সবই ভয়ের বস্তু আমার কাছে। ও এখন ঈশ্বরের অনুগ্রহে ধন্য বলে ওর দেহে কোন ক্ষত হবে না, কোন আঘাত মারাত্মক হয়ে উঠবে না তার পক্ষে। অথচ আমি আমার সেই দৈবী শক্তি হারিয়েছি। বর্তমানে আমি দীর্ঘদিন নরকযন্ত্রণা ভোগ করে করে ক্ষীণ হয়ে উঠেছি।
ঐ আদি মানবী সত্যিই সুন্দরী, এক স্বর্গীয় সুষমায় মণ্ডিত তার সৌন্দর্য। সে সৌন্দর্য দেবতাদের ভালবাসার যোগ্য। কপট ভালবাসার এক ছলনাময় ক্ষীণ আবরণের মধ্যে প্রবলতম এক ঘৃণাকে ঢেকে রেখে আমি যাচ্ছি তার কাছে।
নিজের মনে এই কথা বলার পর মানবজাতির শত্রু শয়তানরূপী সর্প ঈভের দিকে এগিয়ে এল। মাটির উপর শুয়ে হেঁটে চলতে লাগল সে। তারপর নীচের দিকটা কুণ্ডলী পাকিয়ে মাথাটা উঁচু করে তুলে রাখল ঘাসের উপর তরঙ্গায়িত ভঙ্গিতে এঁকেবেঁকে এল সে। তার আকারটা সত্যিই খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। ইতিলরিয়াতে থীবস-এর রাজা ক্যাডমাস ও তার রানী হার্মিওন যে সর্পদেহ ধারণ করে অথবা এপিডরাসে ওষুধের দেবতা এপিকনিপাম যে সর্পরূপ ধারণ করে রোমে প্লেগরূপ মহামারীর অবসান ঘটাতে যান, সেই সব সর্পরূপের থেকে সর্পরূপী শয়তানকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল।
নিয়ত পরিবর্তনশীল কোন বায়ুপ্রবাহের মত সর্পরূপী শয়তান তার দেহটাকে আঁকিয়ে-বাঁকিয়ে ঈভের মন ভোলাবার চেষ্টা করছিল। তার মুগ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছিল।
ঈভ কিন্তু তার উপস্থিতির কথা কিছুই বুঝতে পারেনি। সে শুধু গাছপালার পাতার পতপত শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ শুনতে পায়নি। বনের মধ্যে জীবজন্তু চলাফেরার সময় তাদের পায়ের এরকম শব্দ প্রায়ই হয়। তাই সে কিছু মনে করেনি।
এদিকে সর্পরূপী শয়তান সেখানেই থেমে রইল। সে তার সোনালী ঘাড়টা প্রায়ই উঁচু করছিল।
অবশেষে তার এই নীরব ক্রীড়াভঙ্গির প্রকাশ ঈভের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ঈভের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরে শয়তান খুশি হয়ে তার কুটিল প্রলোভনজাল বিস্তার করার জন্য মানুষের মত বলতে লাগল, হে মর্ত্যলোকের অধীশ্বরী, আশ্চর্যান্বিত হয়ো না। ঘৃণামিশ্রিত ও কঠোর করে তুলো না তোমার দৃষ্টিকে। তুমি হচ্ছ বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টি। সৌন্দর্য ও স্নিগ্ধতার রানী। আমি এখানে এসে মুগ্ধ ও অতৃপ্ত নয়নে তোমাকে অবলোকন করছি। এই দেখ, আমি একা হলেও তোমার কুটিকে ভয় পাচ্ছি না।– তোমার স্রষ্টার অনুরূপ সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ তোমার দেহ। এ জগতের সব বস্তুই তুমি পেয়েছ উপহার হিসাবে। এখানকার সব জীবন্ত প্রাণীই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তোমাকে দেখে। কিন্তু শুধু মুগ্ধ দৃষ্টির সার্থকতা কোথায় যদি না সে দৃষ্টির মুগ্ধতা প্রশংসা বা বন্দনার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত না হয়?
এখানকার বন্য পশুরা তোমার স্বর্গীয় সৌন্দর্য শুধু মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে কিন্তু শুধুমাত্র একজন মানুষ ছাড়া আর কোন পশু বা প্রাণী তোমার এই স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মহিমার মর্ম বুঝতে পারে না। যিনি দেবতাদের মধ্যে মানবীর মত, যিনি অসংখ্য দেবদূতদের সেবালাভের যোগ্য তাঁকে সামান্য এক মানুষ প্রশংসা করে কি করবে?
এইভাবে প্রলোভনের জালবিস্তারকারী শয়তানের ছলনাময় কথাগুলি ধীরে ধীরে প্রবেশ করল ঈভের অন্তরে। সর্পের মুখে মানুষের কণ্ঠস্বর শুনে আশ্চর্য হয়ে উঠল সে। পরে বিস্ময়ের ঘরটা কাটিয়ে উঠে সে বলল, এর মানে কি? পশুর কণ্ঠে মানুষের কথা ব্যক্ত হচ্ছে আর মানুষের জ্ঞানের কথা প্রকাশিত হচ্ছে?
আমি তো জানতাম পশুরা মানুষের মতো কথা বলতে পারে না। কারণ ঈশ্বর সৃষ্টিকালে পশুদের মূক হিসাবেই সৃষ্টি করেছিলেন। যদিও অদের সৃষ্টি ও কর্মের মধ্যে মানবিক যুক্তিবোধ ও জ্ঞানের অনেক পরিচয় পাওয়া যায়। হে সর্প, আমি জানতাম তুমি খুব চতুর একটি জীব, কিন্তু তুমি যে মানবসুলভ কণ্ঠস্বরের অধিকারী তা তো জানতাম না।
এখন বল, কিভাবে তুমি তোমার মূক অবস্থা থেকে এমন কণ্ঠস্বর লাভ করলে এবং কেমন করেই বা এখানকার অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে আমার প্রতি সবচেয়ে বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে উঠলে? একথা বলে আমার বিস্ময়কে দ্বিগুণীকৃত করে দাও।
একথা শুনে সুচতুর প্রলোভনকারী বলল, সৌন্দর্যের সম্রাজ্ঞী, হে জ্যোতির্ময়ী ঈভ, তুমি যা বলতে আমাকে আদেশ করেছ সে কথা বলা খুবই সহজ আমার পক্ষে। তাছাড়া তোমার আদেশ মান্য করা আমার উচিত।
আমিও প্রথমে অন্যান্য প্রাণীর মত বনের ঘাসপাতা প্রভৃতি সামান্য খাদ্য খেয়ে বিচরণ করে বেড়াতাম। কোন্ খাদ্য ভাল বা মন্দ, কে নারী কে পুরুষ, কোন বিষয়েরই কোন বিশেষ জ্ঞান ছিল না আমার।
একদিন মাঠে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে দূরে একটি সুন্দর গাছ দেখতে পেলাম। সোনালী ও লালে মেশানো অসংখ্য সুন্দর সুন্দর ফলে ভরা গাছটি। গাছটিকে ভাল করে দেখার জন্য তার কাছে গেলাম আমি। সহসা গাছটির শাখাগুলি থেকে একঝলক গন্ধ বাতাসে ভেসে আসায় জাগ্রত হয়ে উঠল আমার ক্ষুধা। সেই মধুর গন্ধে মন আমার মাতোয়ারা হয়ে উঠল। আমি সেই ফল ভক্ষণ করে একই সঙ্গে আমার ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিরসনের সংকল্প করলাম। এরপর আমি শ্যাওলাধরা গাছের গুঁড়িটিকে জড়িয়ে ধরলাম। সেই গাছের ডালগুলো এত উঁচু ছিল যে আদমের মত লম্বা কোন মানুষ ছাড়া তা নাগাল পাবে না।
সেই গাছের তলায় আরো যে সব পশু ফল খাবার আশায় দাঁড়িয়ে ছিল তারাও তার নাগাল পেল না।
কিন্তু আমি সেই গাছটির উপর সর্পিল গতিতে উঠে গেলাম। দেখলাম আমার হাতের কাছে প্রচুর ফল ঝুলছে। তা আমি তখন পেড়ে মনের সাধ মিটিয়ে পেট ভরে খেতে লাগলাম। সেই রসাল ফল খেয়ে যে মধুর আস্বাদ আমি পেয়েছিলাম তার আগে কোন খাদ্য বা কোন ঝর্ণার জল খেয়ে সে আস্বাদ আমি পাইনি।
সেই ফল খাবার সঙ্গে সঙ্গে এক আমূল পরিবর্তন এল আমার অন্তরে। আমার মনের জোর বেড়ে গেল। আমার জ্ঞানবুদ্ধি ও যুক্তিবোধ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। আমার বাকশক্তি ফুরিত হলো। স্বর্গ, মর্ত্য দুইয়ের মধ্যবর্তী এই জগৎ সম্বন্ধে সব জ্ঞান স্পষ্টভাবে ধরা দিল আমার কাছে। আমি যেন ত্রিভুবনের সব কিছু দেখতে পেলাম। তবে আমার দেহটি তেমনই রয়ে গেল। বহিরঙ্গের কোন পরিবর্তন হলো না। কিন্তু এই ত্রিভুবনের মধ্যে তোমার মত সুন্দরী কোথাও দেখিনি। স্বর্গের সমস্ত অপ্রাকৃত জ্যোতি যেন মিলিত হয়েছে তোমার রূপের মধ্যে। সৌন্দর্য ও সততায় ত্রিজগতে তোমার তুলনীয় দ্বিতীয় একজন কেউ নেই।
এরজন্যই আমি এখানে এসে থেকে তাকিয়ে আছি তোমার দিকে। তোমাকে পূজা করতে ইচ্ছা করছে। হে আদি মানবমাতা, মানবী হয়েও তুমি দেবী।
চতুর সর্পরূপী শয়তান এই কথা বললে তার চাতুর্য ও ছলনা কিছু ধরতে না পেরে ঈভ বলল, সেই আশ্চর্য ফলের গুণ সম্বন্ধে তোমার অতি প্রশংসার কথা শুনে মনে সন্দেহ জাগছে আমার। বল, সে ফলের গাছ কোথায় আছে? এখান থেকে কত দূরে? কারণ এই স্বর্গদ্যানে ঈশ্বরের অনেক রকমের গাছ আছে এবং তাদের সংখ্যা এত বেশি যে অনেক গাছের ফল আমরা স্পর্শ করিনি এখনো পর্যন্ত। কারণ আমাদের পছন্দমত ফল হাতের কাছেই প্রচুর পেয়ে যাই। আরো অনেক মানুষ না আসা পর্যন্ত অনেক গাছের ফল ঝুলতে থাকবে, কেউ তাদের পাড়বে না।
তা শুনে সর্পরূপী শয়তান খুশি হয়ে বলল, হে রানী, পথ তো প্রস্তুত হয়েই রয়েছে এবং সে পথ দীর্ঘ নয়। কয়েকটা গাছের সারির পাশ দিয়ে গিয়ে একটা ঝর্ণার ধারে একটা সমতল জায়গা পাওয়া যাবে। সেখানে একটা ঝোঁপের ধারেই। আছে সেই গাছটা। তুমি চাইলে আমিই সেখানে তোমাকে নিয়ে যাব।
ঈভ বলল, তাহলে আমাকে সেখানে নিয়ে চল।
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে এক অদম্য আনন্দে বুকটা স্ফীত হয়ে উঠল শয়তানের। রাত্রির পুঞ্জীভূত একধরনের বাষ্প থেকে হঠাৎ জ্বলে ওঠা আলেয়ার আলো যেমন নৈশপথিককে ভুল পথে চালিত করে তেমনি সেই আপাত-উজ্জ্বল চকচকে সর্পরূপ শয়তান আমাদের সরলতম আদিমাতাকে প্রতারিত করে সেই নিষিদ্ধ গাছটির কাছে নিয়ে গেল। সেই গাছই হলো মানবজাতির সকল দুঃখের মূল।
সে গাছ দেখে ঈভ বলল, হে সর্পরাজ, এখানে না এলেই ভাল হত। এ গাছে অনেক ফল থাকলেও আমার কাছে তা নিষ্ফল। এ গাছের ফলের গুণ তোমার কাছেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাক। তাতে আমার কোন প্রয়োজন নেই কারণ এ গাছের ফল আমরা স্পর্শ বা ভক্ষণ করতে পারব না। ঈশ্বরের আদেশ। আর সব বিষয়েই আমরা স্বাধীন হলেও এই একটা বিষয়ে তাঁর এই নিষেধাজ্ঞাকে মেনে চলতে হয় আমাদের। অন্য সব বিষয়ে আমাদের আইনের বিধান আমরাই রচনা করি। আমাদের যুক্তিই আমাদের আইন।
তখন সর্প বলল, তাই নাকি? এই বাগানের সব গাছের ফল খেতে ঈশ্বর তোমাদের তাহলে নিষেধ করেছেন?
নিষ্পাপ ঈভ তখন বলল, এই বাগানের মধ্যে এই একটিমাত্র গাছের ফল ছাড়া আর সব গাছের ফল আমরা খেতে পারি। ঈশ্বর শুধু বলেছেন এ গাছের ফল তোমরা খাবে না বা স্পর্শ করবে না। তাহলে তোমাদের মৃত্যু ঘটবে।
এই কথা শেষ হতে না হতে সর্পরূপী শয়তান একই সঙ্গে মানবজাতির প্রতি ভালবাসা এবং ঈশ্বরের অন্যায়ের প্রতি এক ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধের ভাব দেখাল। তারপর প্রাচীন এথেন্স বা রোমের কোন কুশলী বাগ্মীর মতো কোন ভূমিকা না করেই আবেগের সঙ্গে বলতে লাগল, হে পবিত্র প্রজ্ঞাসম্পন্না, জ্ঞানদাত্রী বৃক্ষলতা, সকল জ্ঞানবিজ্ঞানের জননী, এখন আমি তোমার শক্তি আমার সমস্ত অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারছি। তোমার প্রসাদে শুধু জাগতিক সমস্ত বস্তু ও ঘটনার কারণ জানতে পারা যায় না, তোমার দ্বারা যাদের আমরা পরম জ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ বলে মনে করি সেই স্বর্গবাসী দেবতাদের জীবনযাত্রাপ্রণালী ও কর্মপদ্ধতির বা রীতিনীতিরও অনেক কিছু জানতে পারি আমরা।
হে বিশ্বজগতের রানী! বিধাতার কঠোর বিধানজনিত মৃত্যুর ভয় তুমি করো না। ও বিধানে বিশ্বাস করো না। মৃত্যু তোমার হতে পারে না। কেন মরবে তুমি? ঐ ফল খেয়ে? বরং তুমি ঐ ফল ভক্ষণ করে প্রভাপূর্ণ এক নবজীবন লাভ করবে। আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেখ, আমি ঐ ফল স্পর্শ করে ও ভক্ষণ করে এখনো বেঁচে আছি। শুধু তাই নয়, বিধির বিধানে যে জীবন আমি লাভ করেছিলাম তার থেকে পূর্ণতর এক জীবন লাভ করেছি। আমি আমার বিধিনির্দিষ্ট সীমাকে লঙঘন করে ঊর্ধ্বে হাত বাড়িয়ে চেষ্টা করে এ জীবন লাভ করেছি। যে জ্ঞান পশুর কাছে উন্মুক্ত তা কি মানুষের কাছে রুদ্ধ থাকতে পারে? মৃত্যুযন্ত্রণার ভয়ের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ ছিল যে জ্ঞান, অদম্য নির্ভীক প্রচেষ্টার দ্বারা সে জ্ঞান তুমি লাভ করবে, ঈশ্বর তোমার উপর ক্রুদ্ধ হবেন না, বরং তোমার গুণের প্রশংসা করবেন, বরং তিনি স্বীকার করবেন, মৃত্যু যে পদার্থই হোক, তার যন্ত্রণা যত দুঃসহই হোক, তার দ্বারা নিবারিত না হয়ে তুমি সেই পরম বস্তু লাভ করেছ যা তোমাকে দেবে বৃহত্তর সুখের সন্ধান, যা দেবে ভালমন্দের পরম জ্ঞান। শুধু ভালর জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, যা কিছু মন্দ বা অশুভ, যা জীবনে একটি অতি বাস্তব ও অপরিহার্য ঘটনা, তার জ্ঞান যদি আমরা লাভ করতে না পারি তাহলে কেমন করে তাকে পরিহার করি বলতো?
সুতরাং ঈশ্বর তোমার কোন ক্ষতি করতে পারেন না, বরং তিনি ন্যায়সম্মত আচরণ করবেন। ঈশ্বর যদি ন্যায়পরায়ণ না হন তাহলে তিনি ঈশ্বরই নন। তাহলে কেন কে ভয় করবে? কেন তাঁকে মান্য করে চলবে? তোমার এই অর্থহীন মৃত্যুভয়ই অন্য সকল ভয় দূরীভূত করে দিচ্ছে।
একবার ভেবে দেখতো, এই ফল কেন নিষিদ্ধ হয়? কেন ভীতি প্রদর্শন করা য়? তুমি তার ভক্ত ও উপাসিকা হলেও নে তোমাকে নীচু ও অজ্ঞ করে রাখা হবে? তিনি জানেন যেদিন তুমি ঐ ফল ভক্ষণ করবে সেদিন তোমার ঐ ম্লান চক্ষুদুটি পরিষ্কার ও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং তুমি তখন দেবতাদের মতোই ভাল-মন্দ সব কিছুই জানতে পারবে। আমি যেমন পশু হলেও অন্তরের দিক থেকে মানুষের গুণ লাভ করেছি, মানুষের মতো কথা বলতে পারছি তেমনি মানুষ হয়েও তুমি দেবতাদের গুণ লাভ করবে। তাদের সব জ্ঞানের অধিকারিণী হবে। আর তাতে যদি তোমার মৃত্যুও ঘু অহলে সে মৃত্যুর অর্থ হবে তোমার এই মানবজীবন ও মানবদেহ ত্যাগ করে দৈবজীবন লাভ করা। সে মৃত্যু মোটেই খারাপ হবে না। দেবতাদের এমন কি গুণ আছে যা মানুষ লাভ করতে পারবে না? মানুষ তো দেবতাদেরই দেহের অনুরূপ। দেবতাদের খাদ্য তারাও কেন গ্রহণ করতে পারবে না?
তাছাড়া আমরাই দেবতাদের বড় করে দেখি। আমাদের বিশ্বাস তারা আমাদের থেকে শ্রেষ্ঠ। তারাই সব কিছু সৃষ্টি করে, দান করে। এই শ্রেষ্ঠত্বের সুযোগ নেয় তারা।
কিন্তু আমি এসব বিশ্বাস করি না। এই সুন্দর পৃথিবীতে সূর্যালোক পতিত হয়ে সব বস্তু সৃষ্টি করে, স্বর্গলোকে তা করে না। ঈশ্বর বা দেবতারাই যদি সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, তাহলে ভালমন্দের জ্ঞানসমন্বিত এই জ্ঞানবৃক্ষ কে সৃষ্টি করল? যে বৃক্ষের ফল খেয়ে দেবতাদের অনুমতি ছাড়াই সব জ্ঞান লাভ হবে সে বৃক্ষ সৃষ্ট হলো কেন এবং কার দ্বারা? মানুষ যদি জ্ঞান লাভ করে, ভালমন্দের কারণ জানতে পারে, তবে তাতে অপরাধ কোথায়? তাতে ঈশ্বর বা দেবতাদেরই বা কি ক্ষতি হবে? আর সকল বস্তুই যদি ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট হয়, তাঁর বিধান মেনে চলতে বাধ্য হয় তাহলে এই বৃক্ষ কি শুধু অর সে বিধানের বাইরে? এ বৃক্ষ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেনই বা নিষিদ্ধ ফল দান করে? এখানে কোন বাধা নেই। আমি তো ইচ্ছামতো সে ফল তুলে খেয়েছি। এই বৃক্ষ তো আমায় বাধা দেয়নি। কোন অসম্মতি প্রকাশ করেনি। তবে কি শুধু মানবজাতির প্রতি ঈর্ষাবশতই ঈশ্বর এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন? কিন্তু ঈর্ষা ঈশ্বরের মনে থাকবে কেন? যিনি সমস্ত গুণের আকর তিনি ঈর্ষার মত একটি কুটিল দোষকে লে পোষণ করে রাখবেন আঁর বুকে?
সুতরাং গেমার এই সুন্দর ফলভক্ষণের যে প্রয়োজন আছে সে প্রয়োজন সিদ্ধ করার পিছনে অনেক কারণ অনেক যুক্তি আছে। অতএব হে মানবরূপিণী দেবী, তুমি অবিলম্বে ঐ ফল অবাধে ভক্ষণ করে।
এই বলে থামল সেই সরূপী শয়তান। তার ছলনার কথাগুলি সহজেই প্রবেশ করুল ঈরে অন্তরে।
জ্ঞানবৃক্ষের ফলগুলির পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ঈভ। সেই সুন্দর ও সুগন্ধি ফলগুলি দেখামাত্রই লোভ আসছিল তার মনে, তার উপর শয়তানের প্ররোচনামূলক ও যুক্তিপূর্ণ কথাগুলি তখনো কানে বাজছিল তার। সে কথাগুলিকে সত্য বলে মনে হচ্ছিল তার।
এদিকে তখন বেলা দুপুর হয়ে ওঠায় ক্ষুধা জেগে উঠল তার মধ্যে। ফলগুলির মিষ্ট গন্ধ তার সে ক্ষুধাকে আরও বাড়িয়ে দিল। সে ফল খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে ইচ্ছা হলো তার। কামনাতুর হয়ে উঠল তার দৃষ্টি। তবু সেই বৃক্ষতলে দাঁড়িয়ে একবার ভাবতে লাগল ঈভ।
ঈভ তখন মনে মনে বলল, হে সর্বোত্তম ফরাজি, নিঃসন্দেহে তোমাদের গুণ কত মহান। তুমি মানুষের কাছে নিষিদ্ধ, তবু প্রশংসার যোগ্য। তোমার ঐন্দ্রজালিক আস্বাদ মূককে দিয়েছে বাকশক্তি, বাকশক্তিহীন পশুর জড় জিহ্বা মুখর হয়ে উঠেছে তোমার গুণগানে।
যে ঈশ্বর তোমাকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন আমাদের কাছে, তিনিও তোমার গুণের কথা গোপন রাখেননি আমাদের কাছে। তাই তিনি তোমার নামকরণ করেছেন জ্ঞানবৃক্ষ। তোমার মধ্যে ভালমন্দের দুই জ্ঞানই আছে। তিনি তোমার সম্বন্ধে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন সেই নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও তোমার আলোকসামান্য গুণের কথাই প্রমাণিত হয়। তোমার আস্বাদনকারী জীবকে যে মঙ্গল দান করো সে মঙ্গলে আমাদের প্রয়োজন। আছে। কারণ শুধু মঙ্গলই যথেষ্ট নয়, মঙ্গলের জ্ঞানই হলো সবচেয়ে বড় কথা। যে ভাল বা যে মঙ্গল সম্বন্ধে আমাদের কোন জ্ঞান নেই সে জ্ঞান বা মঙ্গল লাভ করা বা না করা দুই-ই সমান আমাদের কাছে।
মঙ্গল-অমঙ্গলের এই জ্ঞানকে ঈশ্বর নিষিদ্ধ করেছেন আমাদের জন্য। আমরা জ্ঞানী হতে পারব না। এই নিষেধাজ্ঞা লঙঘন করা এখন এমন কিছু কঠিন নয়। এই নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করলে যদি মৃত্যু আমাদের গ্রাস করে তাহলে আমরা জ্ঞান বা অন্তরে স্বাধীনতা নিয়ে কি করব?
ঈশ্বর বলেছেন, যেদিন আমরা এই ফল ভক্ষণ করব সেইদিনই আমাদের মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু এই সর্পের মৃত্যু হলো না তো। সে এই ফল ভক্ষণ করেও এখনো বেঁচে আছে। যুক্তির সঙ্গে কথা বলছে, তার জ্ঞানের পরিচয় দিচ্ছে। তাহলে এ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে যুক্তি কোথায়?
তাহলে এ বিষয়ে মৃত্যু কি শুধু আমাদের জন্য উদ্ভাবিত হয়েছিল? তবে কি এই সব জ্ঞানগর্ভ ফলগুলি থেকে মানবজাতিকে বঞ্চিত করে পশুদের জন্য সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে?
আমরা একে পশু বলছি বটে, কিন্তু এর আচরণ তো পশুর মতো নয়। পশু হলেও এর মনে কোন ঈর্ষা নেই। ফলভক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে যে শুভ ফল লাভ করেছে জীবনে, মানুষকে বন্ধুভাবে সেই ফলের গুণের কথা আনন্দের সঙ্গে বলতে এসেছে। তাহলে আমার ভয়ের কি আছে? ভাল-মন্দের জ্ঞানবিবর্জিত হয়ে অজ্ঞতার অন্ধকারে থাকাটাই তো সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। কিসের ভয়? ঈশ্বরের বিধানের ভয়? না কি অন্য কোন শক্তির ভয়?
এই স্বর্গীয় ফলের মধ্যেই আছে সকল ভয়, সকল উদ্বেগ হতে মুক্তি এবং শান্তি। এ ফল দেখতে যেমন সুন্দর, আস্বাদে যেমন মধুর, তেমনি গুণের দিক থেকে জ্ঞানদানের শক্তিসম্পন্ন।
সুতরাং এ ফল স্পর্শ করতে বাধা কোথায়? এ ফল ভক্ষণ করে কেন আমি দেহ ও মনকে পরিতৃপ্ত করব না?
এই কথা বলা শেষ হতেই সে সেই অভিশপ্ত মুহূর্তে হস্ত সঞ্চালন করে সেই জ্ঞানবৃক্ষ হতে ফল তুলে খেতে শুরু করল।
সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা বাজল পৃথিবীর বুকে। যেন এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি হলো। বাতাস ও গাছপালার মধ্য দিয়ে দুঃখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পৃথিবী। পৃথিবী বুঝতে পারল আজ শেষ হয়ে গেল মানবজাতির ভবিষ্যৎ।
কুটিল সর্পরূপী শয়তান তার কু-অভিসন্ধি সিদ্ধ করে ঝোঁপের মধ্যে নিঃশব্দে প্রবেশ করল। এদিকে ঈভ সব কিছু ভুলে গিয়ে ফলের আস্বাদে মত্ত হয়ে শুধু ফল খেয়ে যেতে লাগল। এমন ফল জীবনে কোনদিন আস্বাদন করেনি সে।
আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠল সে। সে আনন্দের সঙ্গে ছিল জ্ঞানলাভের এক নিশ্চিত প্রত্যাশা। কোন ঈশ্বরচিন্তা ছিল না তার মনে। কোন মৃত্যুভয় ছিল না অন্তরে। সে শুধু অবাধে একান্ত অসংযতভাবে জ্ঞানবৃক্ষের নিষিদ্ধ ফলগুলি খেয়ে যেতে লাগল।
অবশেষে অতিমাত্রায় তৃপ্ত হয়ে আপন মনে সে বলতে লাগল, হে বৃক্ষদের রানী, এতদিন তোমার গুণ ও মূল্যের কথা জানা ছিল না। আজ বুঝলাম, গুণ ও মূল্যের দিক থেকে তুমি সকল বৃক্ষের শ্রেষ্ঠ। এতদিন তোমার শাখায় যে ফলগুলি ঝুলত তা আস্বাদন করতে পেতাম না আমরা। তাই কোন মূল্যই ছিল না তাদের আমাদের কাছে।
এবার থেকে প্রতিদিন তোমার ফল খেয়ে জ্ঞান বৃদ্ধি করব আমাদের। তোমার প্রশংসা ও গুণগান করব প্রতিদিন সকালে। তোমার শাখা-প্রশাখাগুলি সব সময় প্রচুর পরিমাণ ফলে পরিপূর্ণ হয়ে থাক। সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে তুমি।
যে বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করে জ্ঞানের দিক থেকে পরিণতি লাভ করব আমরা সে বৃক্ষ দেবতারা আমাদের দান করেননি। এ বৃক্ষ তারা দান করতে পারেননি বলে ঈর্ষাবশত তার ফলকে নিষিদ্ধ করে রেখেছেন আমাদের কাছে।
হে বৃক্ষ, তোমার দ্বারাই আমি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। আমার সকল জ্ঞানের জন্য তোমার কাছে ঋণী আমি। তুমিই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শক। তোমাকে এতদিন অনুসরণ করিনি বলেই আমি এতদিন অজ্ঞ ছিলাম। আজ জ্ঞানের পথকে উন্মুক্ত ও প্রসারিত করো আমার জীবনে। এই জ্ঞান গোপনতার গুহার মধ্যে নিহিত থাকলেও সেখানে আমাকে প্রবেশাধিকার দাও।
ঈশ্বর এই পৃথিবীর থেকে অনেক দূরে মনের ঊর্ধ্বে বিরাজ করেন। অসংখ্য চরদ্বারা পরিবৃত আমাদের মহান বিধাতাপুরুষ সদাজাগ্রত প্রহরীর মত এই মর্ত্যলোকের সব কিছু লক্ষ্য করলেও এখানকার অনেক ঘটনা হয়ত অজানিত রয়ে যায় তার কাছে।
কিন্তু আদমের কাছে আমি কিভাবে যাব? আমি কি তাকে আমার এই পরিবর্তনের কথা জানিয়ে আমার এই নবলব্ধ জ্ঞানসমৃদ্ধ সুখের সমান অংশ দান করব অথবা তাকে কিছুই না জানিয়ে এই জ্ঞানকে আমার শক্তির মধ্যে, আমার মধ্যে, আমার অধিকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখব? তাকে আমার সহ অংশীদার করব না এ বিষয়ে? আমি তার সমান হয়েও নারী হিসাবে কি তার প্রেমাকর্ষণের জন্য আমার জ্ঞানগত স্বাধীনতা ও শ্রেষ্ঠত্বকে বজায় রেখে চলব? এটাই হয়ত ভাল হতে পারে।
কিন্তু যদি এই ঘটনা ঈশ্বর প্রত্যক্ষ করে থাকেন এবং যদি এর ফলে আমাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়? তাহলে আমি আর এ পৃথিবীতে থাকব না এবং আদম তখন আর একজন ঈভকে বিবাহ করে তাকে তার জীবন-সঙ্গিনী করে তুলবে। তখন আমার অবর্তমানে তাকে নিয়ে সুখে বাস করতে থাকবে সে। সুতরাং আমি নিশ্চিতরূপে দৃঢ়তার সঙ্গে স্থির করলাম আদমকেও আমি আমার এই পরম স্বর্গীয় সুখের সমান অংশ দান করব। আমি তাকে এত গভীরভাবে ভালবাসি যে আমি তার সঙ্গে হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করতে পারব। কিন্তু তাকে ছেড়ে জীবনে বেঁচে থেকেও বাঁচার কোন আনন্দ পাব না।
এই বলে সেই বৃক্ষতল হতে তার স্বামীর সন্নিধানে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল ঈভ। কিন্তু যাবার আগে যে অলৌকিক বৃক্ষ দেবতাদের পানীয় অমৃত থেকে তার প্রাণরস আহরণ করে, তার অন্তর্নিহিত শক্তির প্রতি নত হয়ে শ্রদ্ধা জানাল।
এদিকে আদম সর্বক্ষণ ঈভের প্রত্যাগমন কামনায় উন্মুখ হয়ে অধীর আগ্রহের সঙ্গে প্রতীক্ষা করছিল তার। তার একক শ্রমকে সম্মানিত করার জন্য উপহারস্বরূপ তার গলদেশকে শোভিত করবে বলে বাছাই করা বিচিত্র ফুল দিয়ে একখানি মালা গেঁথে রেখে দিয়েছিল সযত্নে। চাষীরা প্রায়ই ফসলের রানী বা দেবীর উদ্দেশ্যে এমনি করে মালা গেথে রাখে।
ঈভের দীর্ঘ বিলম্বিত প্রত্যাবর্তনে কতখানি আনন্দ ও সান্ত্বনা লাভ করবে আদম শুধু একা একা সেই কথাই ভাবছিল। তবে সেই সঙ্গে এক অজানিত আশঙ্কা মনটাকে পীড়িত করছিল তার।
এইসব ভাবতে ভাবতে আজ সকালে তার কাছে বিদায় নিয়ে যে পথে গিয়েছিল ঈভ সেই পথ ধরে এগিয়ে যেতে লাগল আদম। যেতে যেতে জ্ঞানবৃক্ষের কাছে আসতেই ঈভের দেখা পেয়ে গেল। তখন সবেমাত্র সেই জ্ঞানবৃক্ষের তলা থেকে ফিরছিল ঈভ। তার হাতে ছিল কতকগুলি উজ্জ্বল ফলে ভরা একটি সদ্যভগ্ন শাখা। অমৃতের সুবাস ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে।
ঈভ বলল, আমার দেরি হওয়াতে তুমি হয়ত আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলে। তোমার সাহচর্য হতে বঞ্চিত হওয়ায় তোমার অভাবটাকে দীর্ঘ মনে হচ্ছিল আমার। বিরহের বেদনা আজকের মত আর কখনো অনুভব করিনি। তবে এই শেষ। এ ভুল আর কখনো করব না আমি। বিচ্ছেদের বেদনা আর কখনো অনুভব করতে হবে না কাউকে। আর আমি হটকারিতার সঙ্গে আমার শক্তি পরীক্ষার জন্য আর কোথাও যাব না তোমাকে ছেড়ে।
তবে আমার বিলম্বের কারণটা বড় অদ্ভুত। আশ্চর্য হয়ে যাবে তা শুনে। আমাদের যা বলা হয়েছিল তা কিন্তু সত্য নয়। এই বৃক্ষের ফল আস্বাদন মোটেই বিপজ্জনক নয়। এ ফল ভক্ষণ করলে অজানিত কোন অশুভ শক্তি মুখব্যাদান করে গ্রাস করতে আসে না। বরং যারা এ ফল আস্বাদন করে তাদের দেবতাদের মত জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়ে যায়। একটি সর্প এই ফল ভক্ষণ করে মরেনি বরং সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মত জ্ঞান ও কণ্ঠস্বর লাভ করেছে। অথচ আমাদের মৃত্যুভয় দ্বারা শাসানো হয়েছিল।
সর্পটি মানুষের মত যুক্তি খাড়া করে এমনভাবে ফলের গুণ সম্বন্ধে বোঝাতে লাগল যে আমিও এই ফল ভক্ষণ করে দেখলাম তার কথাই ঠিক। আমার জ্ঞানচক্ষু সত্যিই খুলে গেল। মনের তেজ বেড়ে গেল। আমার অন্তর প্রসারিত হলো। আমি দেবতাদের মত হয়ে উঠলাম। তখন তোমার কথা মনে পড়েছিল, কারণ যে সুখে তোমার অংশ নেই, সে সুখ তুচ্ছ আমার কাছে।
সুতরাং তুমিও এ ফল আস্বাদন করো। দুজনের ভাগ্য, আনন্দ, প্রেম এক হোক। আমাদের দুজনের মধ্যে যেন কোন পার্থক্য বা তারতম্য না থাকে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে দুজনেই আমরা সমান দুঃখ ভোগ করব।
ঈভ তার গণ্ডদ্বয়কে আনন্দে উজ্জ্বল করে এই কথা বলল। কিন্তু অচিরেই সে গণ্ডদ্বয় ম্লান হয়ে গেল।
এদিকে আদম ঈভের এই মারাত্মক নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের কথা শুনে বিস্ময়ে ও বেদনায় অভিভূত হয়ে পড়ল। প্রাণহীন প্রস্তরস্তম্ভের মত শূন্যদৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রইল সে। এক হিমশীতল ভয়ের স্রোত শিরায় শিরায় বয়ে যেতে লাগল তার। ঈভকে পরাবার জন্য যে মালাটি হাতে ছিল তার, সে মালাখানি মাটিতে পড়ে গেল তার হাত থেকে।
অবশেষে সে সেই অস্বস্তিকর নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, হে সকল সৌন্দর্যের রানী, সব বিশ্বের সকল বস্তুর সারভৃতা সত্তা! আজ মুহূর্তের মধ্যে কিভাবে সকল মহিমা হারিয়ে ফেললে তুমি! আজ তুমি সকল সৌন্দর্য ও সকল সম্মান হতে বিচ্যুত হয়ে নিজের মৃত্যুকে নিজেই ডেকে আনলে। আজ তোমার সত্তার সকল মহিমা অপগত! কেমন করে লোভের বশবর্তী হয়ে ভুলে তুমি নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করলে? কেমন করে কোন্ সাহসে ঈশ্বরের নিষেধাজ্ঞা লঙঘন করলে? নিশ্চয় কোন অজাতশত্রু অলক্ষ্যে থেকে প্রভাবিত করেছে তোমাকে। নিজের সঙ্গে সঙ্গে তুমি আমার সর্বনাশ নিয়ে এলে। কারণ তোমার সঙ্গে আমিও মৃত্যুবরণ করার জন্য দৃঢ়সংকল্প।
তোমাকে ছাড়া কি করে আমি বাঁচব? তোমার মধুর কথাবার্তা, তোমার গভীর ভালবাসা, তোমার অবিরাম সাহচর্য সব হারিয়ে কেমন করে একা থাকব আমি এই বিশাল অরণ্যপ্রদেশে?
ঈশ্বর কি আর এক ঈভ সৃষ্টি করবেন আমার আর একটি পাঁজর থেকে? লু আমার অন্তর থেকে তোমার অন্তরের ক্ষত মুছে যাবেনা কখনো। হে আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার অস্থিমজ্জার আর এক প্রতিমূর্তি, একই প্রকৃতির দ্বারা অবিচ্ছেদ্যভাবে আবদ্ধ আমরা। সুখ-দুঃখ যাই হোক, আর কখনই আমরা বিচ্ছিন্ন দ্য না পরস্পরের কাছ থেকে।
এই কথা বলে কিছুটা সান্ত্বনা পেল আদম। এরপর ঈভের দিকে ঘুরে আবার শান্ত কণ্ঠে বলতে লাগল, হে দুঃসাহসী ঈত, তুমি ঐ নয়নমনোস্ত্র পবিত্র ফল আস্বাদন করে এক বিপজ্জনক কাজ করেছ। যে ফল স্পর্শ করা নিষিদ্ধ তা তুমি ভক্ষণ করেছ। কিন্তু যা হয়ে গেছে তা আর ফিরবে না। হয়ত ঈশ্বর বা নিয়তি সর্বশক্তিমান নয়। হয়ত তুমি মরবে না। কাজটা হয়ত যতটা ভয়ঙ্কর ভেবেছিলে ততটা ভয়ঙ্কর নয়। সর্প তোমার আগেই সে ফল ভক্ষণ করায় সে ফল তার অলৌকিকত্ব হারিয়ে সাধারণের ভক্ষ্য হয়ে উঠেছে। তুমি বলছ সে এখনো জীবিত আছে এবং পশু হয়ে বাকশক্তি লাভ করেছে মানুষের মত। তাহলে এ ফল ভক্ষণ করে আমরাও সেই অনুপাতে উন্নততর জীবন লাভ করতে পারি। দেবতা অথবা দেবতার সমান দৈবীশক্তি লাভ করতে পারি। পরম স্রষ্টা ঈশ্বরের মত সর্বজ্ঞ আমাদের যতই ভীতি প্রদর্শন করুন ধ্বংস করবেন বলে, তিনি নিশ্চয়ই তাঁরই সৃষ্ট জীব আমাদের ধ্বংস করবেন না। শেষ পর্যন্ত। আমরা হচ্ছি তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, উদার মর্যাদাসম্পন্ন। আমাদের যদি পতন হয় তাহলে যে কাজের জন্য ঈশ্বর আমাদের নিযুক্ত করেছেন, সে কাজ পণ্ড হয়ে যাবে। তাহলে ঈশ্বরকে নিজের হাতে তাঁর সৃষ্টিকে ধ্বংস করে তার সমস্ত শ্রমকে ব্যর্থ করে দিতে হবে নিজের হাতে। ঈশ্বর সম্বন্ধে এমন ধারণা আমরা পোষণ করতে পারি না। আবার নূন করে কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা ঈশ্বরের আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে আমাদের উচ্ছেদসাধন করতে নিশ্চয়ইরমন চাইবেনা। তাহলে তার প্রতিপক্ষের জয় হবে এবং সে বলবে ঈশ্বরের অনুগ্রহ কত চঞ্চল, কত অস্থায়ী। তিনি প্রথমে আমাকে ধ্বংস করে পরে মানবজাতিকে ধ্বংস করবেন। এরপর কাকে ধ্বংস করবেন? এইভাবে তাঁকে ঘৃণা করার সুযোগ তিনি ভঁর শত্রুকে দেবেন না নিশ্চয়। আমি তোমার সঙ্গে আমার ভাগ্যকে নির্ধারিত করে ফেলেছি। মৃত্যু বা ধ্বংসের অভিশাপ যদি নেমে আসে তাহলে দুজনে একসঙ্গে তা ভোগ করব। তোমার যদি মৃত্যু হয় তাহলে সে মৃত্যু জীবনে খুবই বরণীয় হয়ে উঠবে আমার কাছে। প্রকৃতির এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে এমনভাবে আবদ্ধ আছি আমরা যে আমাদের মধ্যে কেউ সে বন্ধন ছিন্ন করতে পারবে না। আমরা হৃদয়ে এক, একই রক্তমাংসে গঠিত। তোমাকে হারানো মানেই আমার নিজেকে হারানো।
আদম এই কথা বললে ঈভ তাকে বলল, তোমার প্রেমাতিশয্যের কী অপূর্ব পরীক্ষা, কী উজ্জ্বল ও উচ্চমানের দৃষ্টান্ত! কিন্তু তোমার পূর্ণতার অংশ কেমন করে আমি লাভ করব আদম যাতে আমি তোমার পার্শ্বদেশ থেকে উদ্ভূত হয়েছি একথা আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি? তুমিই এমনি আমাদের অচ্ছে মিলনের কথা বললে। তোমার সংকল্পের কথা ঘোষণা করে আমাদের মিলন কত নিবিড় তার প্রমাণ দিলে। মৃত্যু বা মৃত্যুর থেকে ভয়ঙ্কর কোন শক্তিই আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। তুমি আমার প্রতি এক গভীর ভালবাসার বন্ধনে এমনভাবে বিজড়িত হয়ে আছ যে, এই ফল ভক্ষণের জন্য যদি কোন অপরাধ বা পাপ হয়ে থাকে আমার তাহলে সে অপরাধ ও সে পাপের শাস্তি মাথা পেতে নিতে রাজি আছ তুমি। আজ এই ফলের আস্বাদ এক মহা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমাদের প্রেমের গুণ ও শক্তিকে অভ্রান্তভাবে প্রমাণ করে দিল যার কথা এর আগে কখনো জানতে বা বুঝতে পারিনি আমরা।
যদি তুমি তোমার প্রেমের এই সততা ও বিশ্বস্ততার কথা আজ এমন ভাবে ঘোষণা না করতে তাহলে আমার এই ফলভক্ষণের ফলে মৃত্যু এসে ভয়াবহরূপে উপস্থিত হলে আমি পরিত্যক্ত অবস্থায় একাকী সে মৃত্যুকে বরণ করে নিতাম। তোমার জীবনের শান্তিকে বিঘ্নিত করে তোমাকে আমার সঙ্গে মৃত্যুবরণ করতে কোনভাবে প্ররোচিত করতাম না।
কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে আসল ঘটনা তা নয়। আমি ভাবছি অন্য কথা। কোন মৃত্যু নয়, এক পূর্ণ ও পরিণত জীবনের রূপ লাভ করতে চলেছি আমরা। এই ফলের স্বর্গীয় আস্বাদ আমার জ্ঞানচক্ষুকে উন্মীলিত করে দিয়েছে, এক নূতন আশা ও আনন্দের দিগন্তকে উন্মোচিত করে দিয়েছে আমাদের সামনে। সুতরাং আমার অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে হে আদম, তুমিও এ ফল অবাধে ‘আস্বাদন করো। সমস্ত মৃত্যুভয় বাতাসে উড়িয়ে দাও।
এই কথা বলে আদমকে আলিঙ্গন করল ঈভ। আনন্দাশ্রু ঝরে পড়তে লাগল তার চোখ থেকে। আজ আদম তার প্রেমকে এক মহত্তর সুমন্নতি দান করেছে, সে তার সেই প্রেমের খাতিরে সমস্ত ঐশ্বরিক রোষ ও মৃত্যুকে বরণ করে নিতে চেয়েছে, এ কথা ভেবে আনন্দের সঙ্গে এক বিরল গর্ব অনুভব করল সে।
ঈভ জ্ঞানবৃক্ষের শাখাসহ যে ফল এনেছিল সে ফল সে উদার হাতে আদমকে দান করল। ঈভের থেকে সে অধিকতর জ্ঞানের অধিকারী হলেও কোন কুণ্ঠা না করেই সে ফল খেয়ে নিল, ঈভের নারীসুলভ সৌন্দর্য ও সুষমায় সহজেই মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ল সে।
পৃথিবীর নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত প্রবলভাবে কম্পিত হয়ে উঠল। সমগ্র প্রকৃতি যন্ত্রণায় দ্বিতীয়বার আর্তনাদ করে উঠল। মানবজাতির পাপ পূর্ণ হওয়ায় আকাশ বজ্রবৃষ্টিসহ অশ্রুবিসর্জন করতে লাগল।
আদম কিন্তু এ সব কিছুই জানল না। সে শুধু পেট ভরে তৃপ্তির সঙ্গে ফল খেয়ে যেতে লাগল। ঈভও আর তার নিষেধাজ্ঞা-লঙ্ঘনের কোন ভয় করল না। সে শুধু তার প্রেমময় সাহচর্যের দ্বারা সান্ত্বনা দিয়ে যেতে লাগল তার স্বামীকে। এক নৃতন মদ্যপানের ফলে মত্ত হয়ে এক উচ্ছল আনন্দের স্রোতে সাঁতার কাটতে লাগল যেন তারা। তাদের মনে হলো, যেন তারা এক দৈবশক্তির অধিকারী হয়ে উঠেছে সেই নিষিদ্ধ ফল খেয়ে। এই পৃথিবীকে উপেক্ষা করে পাখা মেলে তারা যেন উড়ে যেতে পারবে আকাশে।
কিন্তু সেই নিষিদ্ধ ছলনাময় ফল ভক্ষণের প্রতিক্রিয়া শুরু হলো এবার। প্রথমে তাদের মোহগত জ্বলন্ত কামনাকে বাড়িয়ে দিল। আদম ঈভের পানে সকাম দৃষ্টিতে তাকাল। ঈভও সে দৃষ্টির প্রতিদান দিল। কামনার আগুনে জ্বলতে লাগল তারা।
আদম এবার ঈভকে বলল, ঈভ, তুমি যা বলেছ তা সব ঠিক। আজ তুমি যে আমাকে আস্বাদ দিলে তার জন্য তোমার প্রশংসা না করে পারছি না। এতদিন এই উপাদেয় ফল আস্বাদন না করে জীবনের কত আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছি আমরা। আজ প্রথম আস্বাদন করে এর গুণ জানতে পারলাম। এই নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে যদি এত আনন্দ পাওয়া যায় তাহলে সব ফলই নিষিদ্ধ হোক।
এখন তৃপ্তির সঙ্গে আহার করার পর দুজনে নর্মক্রীড়া করিগে চল। তোমাকে প্রথম দেখা ও বিবাহ করার পর থেকে তোমার রূপ-লাবণ্য এতখানি নিখুঁত ও পরিপূর্ণ বলে মনে হয়নি আমার। এই ফলের গুণেই যেন অনেক গুণ বেড়ে গেছে তোমার দেহসৌন্দর্য। সে সৌন্দর্যকে উপভোগ করার জন্য আজ এক অদম্য কামনার জ্বালা অনুভব করছি আমার মনে।
এই কথা বলে আর কোন ভণিতা না করে ঈভের হাত ধরে এক ছায়াচ্ছন্ন নিঝরিণীর তটভূমিতে নিয়ে গেল আদম। সে বেশ বুঝতে পারল যে কামনার আগুনে তার মনপ্রাণ জ্বলছে সে আগুন ঈভের মধ্যেও জ্বলছে, সে আগুনের আত্মা ঠিকরে বেরিয়ে আসছে তার চোখে-মুখে।
সেই তৃণাচ্ছাদিত তটভূমির উপর, ভায়োলেট, এ্যাসফোডেল, হায়াসিনত্ প্রভৃতি ফুলের আস্তরণ পাতা ছিল কোমল শয্যার মত, তাদের মাথার উপরে ছিল ঘনসন্নিবদ্ধ বৃক্ষপত্রের সবুজ চন্দ্রাতপ। সেইখানে দুজনে শুয়ে প্রাণভরে সুরতক্রিয়ায় মত্ত হয়ে উঠল তারা। তাদের সকাম প্রণয়লীলার উচ্ছ্বসিত প্রবলতার দ্বারা তাদের পাপবোধকে মুছে দিতে চাইল, যেন ক্রমে এক নিবিড় রতিক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল তারা।
সেই ভ্রান্ত ফল তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ এক নির্দয় বাষ্প উদগীরণের দ্বারা তাদের মত্ত করে তুলে তাদের অন্তর্নিহিত শক্তিকে বার করে আনে। তাই তারা দারুণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
ঘুম থেকে উঠে পরস্পরের পানে তাকাল তারা। তাদের জ্ঞানচক্ষু যে উন্মীলিত হয়েছে তা তারা এবার বুঝতে পারল। এক কুটিল কালিমায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠল তাদের মন। যে নিষ্পাপ সরলতা তাদের মনকে আবৃত করে রাখায় কোন কিছুতে অশুভ বা মন্দ কিছু দেখতে পেত না তারা, সে সরলতা অপগত হলো। ফলে এক সহজাত আত্মবিশ্বাস, ন্যায়নীতি ও মর্যাদাবোধ জেগে উঠল তাদের মধ্যে। তাদের দেহের নগ্নতায় লজ্জাবোধ করল তারা।
সঙ্গে সঙ্গে গাছের পাতা নিয়ে তার গোপনাকে আবৃত করল আদম। কিন্তু তাতে আরো প্রকট হয়ে উঠল তার নগ্নতা। এমন সময় চৈতন্য হলো আদমের। একদিন স্যামসন যেমন তার সব শক্তি হারিয়ে ব্যভিচারিণী নাস্তিক ডেলাইলার অঙ্কদেশ হতে উঠে দাঁড়িয়েছিল, তেমনি গুণবর্জিত হয়ে উঠল আদম।
হতবুদ্ধি হয়ে ম্লান মুখে বসল তারা। বজ্রাহতের মত স্তম্ভিত বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে রইল। অবশেষে আদম ঈভের মত লজ্জায় অপ্রতিভ হয়ে বলল, হে ঈত, এক অভিশপ্ত মুহূর্তে তুমি সেই কপট কুটিল প্রাণীর ছলনায় মুগ্ধ হয়ে তার কথায় কান দিয়েছিলে। মানুষের নকল কণ্ঠস্বরে ভুল শিক্ষা দিয়েছিল সে তোমাকে। সত্য হয়ে উঠল আমাদের পতন, মিথ্যা হয়ে উঠল আমাদের উন্নতির আশ্বাস। আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ন্যায়-অন্যায় বোধ জাগল আমাদের মধ্যে কিন্তু ন্যায়কে বর্জন করে শুধু অন্যায় ও অশুভকে গ্রহণ করলাম আমরা। এই যদি জ্ঞানের অর্থ হয় তাহলে এই জ্ঞানের ফল কত বিষময়। সরলতা, সততা, নির্দোষিতা, ধর্মবিশ্বাস, শুচিতা প্রভৃতি যে সব গুণগুলি আমাদের মনের অলঙ্কারস্বরূপ ছিল সেইসব গুণগুলিকে এই জ্ঞান কলুষিত, এ মন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় আমরা একেবারে নগ্ন হয়ে পড়েছি গুণের দিক থেকে। এক অশুভ লজ্জার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আমাদের। চোখে-মুখে। এই মুখ নিয়ে আমি কি করে ঈশ্বর অথবা দেবদূতের মুখ দেখব? যে বিশুদ্ধ অনাবিল আনন্দের আবেগ ছিল আমার মনে তা আজ কোথায়? সেইসব দেবদুতেরা এবার থেকে তাদের অত্যুজ্জ্বল জ্যোতির দ্বারা আমার এই পার্থিব চোখের সব দৃষ্টিকে অভিভূত করে দেবে। আমি তাদের সেই জ্যোতিকে সহ্য করতে পারব না।
হায়, আমি যদি এই নির্জন বনের গভীরতর কোন দুর্গম প্রদেশ যেখানে সূর্য বা কোন নক্ষত্রের আলো প্রবেশ করতে পারে না সেখানে বন্য পশুর মত জীবন যাপন করতে পারতাম তাহলে হয়ত ভাল হত। হে বনস্পতিবৃন্দ, হে দেবদারু ও পাইন বৃক্ষ, তোমরা তোমাদের পত্রবহুল শাখা-প্রশাখাদ্বারা আমাকে এমনভাবে ঢেকে রাখ যাতে আমি আর কখনো দেবদূতদের মুখ দেখতে না পাই।
এরপর আদম ঈভকে বলল, এখন আমাদের এই দুরবস্থার মধ্যে একটা উপায় খুঁজে বার করো যাতে আমাদের দেহের যে সব অংশগুলি পরস্পরের চোখে সবচেয়ে লজ্জাজনক বলে মনে হচ্ছে সেগুলি ঢেকে রাখতে পারি। কোন গাছের চওড়া পাতাগুলিকে সেলাই করে কৌপীণের মত পরে আমরা কটিদেশদুটিকে ঢাকতে পারি যাতে নবাগত লজ্জা আর সেখানে গিয়ে বসতে না পারে।
এই পরামর্শ দিল আদম। তারপর তারা দুজনে বনের গভীরে চলে গেল। সেখানে গিয়ে তারা একটি বিরাট বটবৃক্ষ বেছে নিল। সুপ্রাচীন বিশাল সেই বটবৃক্ষের দীর্ঘপ্রসারিত শাখাপ্রশাখাগুলি মাটিতে নুইয়ে পড়ে শিকড় গেড়ে বসে গিয়েছিল এবং তাদের থেকে আবার নূতন করে বটবৃক্ষ উগত হয়েছিল। এইসব বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় মালাবার ও ভারতের গোচারণরত রাখালরা খরতপ্ত দ্বিপ্রহরে আশ্রয় নেয়।
সেই বটবৃক্ষের কতকগুলি চওড়া পাতা পেড়ে সেগুলিকে তারা সেলাই করে তাদের কটিদেশ আবৃত করল। এইভাবে তারা তাদের নগ্নতা ও লজ্জা নিবারণের এক ব্যর্থ প্রয়াস পেল। তাদের যে নগ্নতা আগে ছিল গৌরবময়, এখন সে নগ্নতা লজ্জাজনক হয়ে উঠল তাদের কাছে।
কলম্বাস দক্ষিণ আমেরিকা আবিষ্কারকালে উপকূলগুলির বানঞ্চলে যে সব বন্য আদিবাসীদের যেভাবে পালক ও পাতা দিয়ে তাদের কটিদেশকে আচ্ছাদিত করতে দেখেছিলেন, আদম ও ঈভ সেইভাবে তাদের কটিদেশ আচ্ছাদিত করল। কিন্তু এতে তাদের লজ্জা আংশিক নিবারিত হলেও মনে শান্তি পেল না তারা।
তারা দুজনে বসে কাঁদতে লাগল। কিন্তু শুধু কান্না নয়, শুধু দরবিগলিত অবিচল অশ্রুধারা তাদের চোখ থেকে বয়ে যেতে লাগল না, আবেগের ঝড় বয়ে যেতে লাগল তাদের অন্তরে। একদিন তাদের যে শান্ত মনের ভূমিতে অখণ্ড প্রশান্তি বিরাজ করত সতত, আজ ক্রোধ, ঘৃণা, অবিশ্বাস, সংশয় ও অনৈক্য প্রভৃতি বিচিত্র কুটিল আবেগ ঝড়ের বেগে তাদের সে মনোভূমিকে আঘাতে আঘাতে বিপর্যস্ত করে সকল শক্তিকে ছিন্নভিন্ন করে দিল।
তাদের দুজনের মধ্যে যে পারস্পরিক বোঝাঁপড়ার ভাব ছিল তা বিনষ্ট হয়ে গেল। ন্যায়নীতি ও ধর্মের অনুশাসন মানতে চাইল না। দুজনেই ইন্দ্রিয়গত ক্ষুধার অধীন হয়ে পড়ল এবং সে ক্ষুধা যুক্তির অবিসংবাদিত প্রভুত্বকে অস্বীকার করে নিজের প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠিত করল।
আদমের অন্তরের বিক্ষোভ তার চোখের দৃষ্টি ও ভাবভঙ্গিতে প্রকাশ পেতে লাগল। সে তখন ঈভকে বলল, সেদিনকার সেই অশুভ সকালে তুমি যদি আমার কথা শুনতে এবং আমি যা চেয়েছিলাম সেইমত আমার কাছে থাকতে তাহলে আমাদের এ অবস্থায় পড়তে হত না। কিন্তু জানি না কিসের মায়া ও মোহে আচ্ছন্ন হয়ে তুমি আমার কথা না শুনেই চলে গেলে। সেদিন আমরা কত সুখে ছিলাম। আর আজ সমস্ত সদগুণ হতে বিবর্জিত হয়ে এক লজ্জাজনক নগ্নতার শিকার হয়ে উঠেছি।
এখন থেকে কেউ যেন অকারণে তার ধর্মবিশ্বাসকে ভঙ্গ করে নিজের পতন নিজেই ডেকে না আনে।
দোষের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ঈভ বলল, তোমার মুখ থেকে কি কঠোর কথাই না নির্গত হলো আদম। তুমি বললে, আমি তোমাকে ছেড়ে দূরে চলে যাওয়ার জন্যই এইরকম হলো। আজ আমার দ্বারা যে বিপর্যয়ের উদ্ভব হলো তা তো তোমার দ্বারাও হতে পারত। আমার মতো তুমি যদি সেখানে একা থাকতে অথবা তুমি যেখানে ছিলে সেখানে যদি সর্প এসে তোমাকে একইভাবে প্ররোচিত বা প্রলোভিত করত তাহলে তুমি তার প্রতারণা বা ছলনাকে ধরতে পারতে না। সেই সর্পের সঙ্গে আমার কোন শত্রুতা ছিল না। অকারণে সে আমার অমঙ্গলসাধন বা বঞ্চিত করবে তা কেমন করে বুঝব? তোমার কাছ ছেড়ে একা কোথাও যাবার কি কোন স্বাধীনতাই ছিল না আমার? তোমার পার্শ্বদেশের একটি পঞ্জর থেকে আমার জন্ম হওয়ার জন্য আমাকে কি চিরকাল একটি প্রাণহীন স্বাধীনতাহীন পঞ্জর হিসাবেই থাকতে হবে? তাই যদি হয়, আমার জন্য এখন বিপদের সম্মুখীন হতে হয় তরে কেন তখন আমার যাওয়াকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে কঠোর আদেশ প্রদান করলে না? তোমার সে নিষেধের মধ্যে কঠোরতার অভাব এবং কুণ্ঠা ছিল কেন? তুমি তখন আমার কথায় নরম হয়ে আমাকে যেতে অনুমতি দিয়েছিলে। আমাকে সমর্থন করেছিলে। কিন্তু তখন যদি তুমি কঠোর এবং তোমার অসম্মতিতে দৃঢ় ও অবিচল থাকতে তাহলে ঐশ্বরিক নিষেধাজ্ঞা আমি লঙ্ঘন করতাম না এবং আমার মনে হয় তুমিও তা করতে না।
আদম তখন রুষ্ট হয়ে বলল, হে অকৃতজ্ঞ ঈভ, এই কি আমার প্রেমের প্রতিদান? এই কি তোমার ভালবাসা? তোমার যখন পতন হয় তখন আমি আমার প্রেমকে অপরিবর্তনীয়রূপে ঘোষণা করেছিলাম। আমি তো তোমাকে ছেড়ে পরম সুখে আমার জীবন যাপন করতে পারতাম। কিন্তু তা না করে স্বেচ্ছায় তোমার সঙ্গে মৃত্যুকেই বরণ করে নিই। অথচ এখন আমাকেই তুমি তোমার ঐশ্বরিক বিধান লঙ্ঘনের কারণ বলে ভর্ৎসনা করছ?
অবশ্য তখন তোমাকে খুব কঠোরভাবে সংযত করিনি। কিন্তু আর কি আমি করতে পারতাম? আমি তোমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম। মৃদু তিরস্কার করেছিলাম। বিশ্বাসের কথা বলেছিলাম। যে শত্রু সুযোগের অপেক্ষায় ওৎ পেতে বসে আছে তার কথাও বলেছিলাম। তোমার স্বাধীন ইচ্ছার অপব্যবহার করতে বারবার নিষেধ করে দিয়েছিলাম।
কিন্তু অতিমাত্রিক আত্মবিশ্বাসে প্রবৃত্ত হয়ে কোন কথা না শুনে তুমি চলে গেলে। হয়ত ভেবেছিলে নিষিদ্ধ ফল খেলে কোন বিপদই হবে না অথবা তাতে কি হয় তা পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলে।
অবশ্য আমিও তখন তোমার ভ্রান্ত পূর্ণতার লক্ষণ দেখে অতিমাত্রায় তোমার প্রশংসা করে ভুল করেছিলাম। ভেবেছিলাম এতে কোন বিপদ হবে না। এখন আমি আমার এই কাজের জন্য অনুশোচনা করছি। এটাই হলো আমার অপরাধ আর এই অপরাধে এখন তুমি অভিযুক্ত করছ আমাকে।
নারীদের উপর অতিরিক্ত আস্থা স্থাপন করে তাদের ইচ্ছাপূরণ করতে গিয়ে পুরুষেরা ভবিষ্যতে এই অপরাধই বারবার করবে। কোন সংযম বা অনুশাসন নারী মানবে না। পরে নিজের ইচ্ছায় ক্ষয় হয়ে বিপদে পড়বে। পুরুষের দুর্বলতা বা প্রশ্রয়কে দায়ী করে অভিযুক্ত করবে তাকে।
এইভাবে পরম্পরকে অভিযুক্ত করে দুঃখের সঙ্গে কালযাপন করতে লাগল তারা। কেউ নিজের দোষ দেখল না, নিজেকে ধিক্কার দিল না। আত্মপ্রতিষ্ঠার চেষ্টাজনিত এই দ্বন্দ্বের কোন শেষ ছিল না।
অষ্টম সর্গ
যেখানে ঈশ্বর বা দেবদূত স্বর্গ থেকে নেমে এসে বন্ধুর মত মানুষের পাশে এসে কত কথাবার্তা বলেন, তার সরল সামান্য খাদ্য ভোজন করেন, সেখানে আমাদের মত মানুষের কোন কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। আমি শুধু এই ঘটনার মর্মান্তিক পরিণাম দেখাব। মানুষ কিভাবে বিধির বিধান লঙ্ঘন করে অবিশ্বাসী, আনুগত্যহীন ও ঈশ্বরদ্রোহী হয়ে ওঠে, আমি বলব তারই কথা।
মানুষের এই অবিশ্বস্ততা ও নিষিদ্ধ আচরণের জন্য তাকে ত্যাগ করে তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান ঈশ্বর চিরতরে। ফলে স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যে ব্যবধান বা দূরত্ব বেড়ে যায়। উভয়পক্ষে ক্রমাগত চলতে থাকে ক্রোধ আর ভর্ৎসনার বাণবর্ষণ। অবশেষে ঈশ্বর বিচারের রায়দানের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে দুঃখ নেমে আসে চিরকালের জন্য। নেমে আসে পাপ আর মৃত্যুর করাল ছায়া। সত্যিই দুঃখের বিষয়। কিন্তু এ নিয়ে প্রচুর তর্কবিতর্ক হয়। ট্রয় যুদ্ধে শত্রুদের পশ্চাতে ধাবিত কঠোর একিলিসের মধ্যে যে রোষ দেখা গিয়েছিল, ঈনিসের প্রতি জুনো এবং ওডিসিয়াসের প্রতি সমুদ্রদেবতা পসেডন যে রোষ দেখান, ইতালির অধিপতি টার্নাস তার স্ত্রী ল্যাভিনিয়াকে হারিয়ে যে রোষে ফেটে পড়ে, সেই রোষ এইসব তর্কবিতর্কে প্রকাশিত হয়।
আমি এইসব কাব্যে প্রকাশ করার জন্য আমার স্বর্গীয় সাহায্যকারিণীর সাহায্য নিতে পারি। তিনি অযাচিতভাবে মাঝে মাঝে আমার নিদ্রার মধ্যেই আবির্ভূত হন। আমার স্বতোৎসারিত সকল কাব্যই তিনি আমাকে নিদ্রিত অবস্থাতে বলে দেন।
বহুদিন আগে হতেই এক বীরত্বপূর্ণ আখ্যানকাব্য রচনা করার প্রয়াস পেয়েছিলাম। কিন্তু শুধু বীরত্বের কথা মনঃপূত হয়নি আমার।
তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল মর্ত্যলোকে। ঘনীভূত হয়ে উঠছিল গোধূলির ছায়া, রাত্রির গোলার্ধে দিগন্তকে আচ্ছন্ন করে তুলেছিল।
এমন সময় যে শয়তানরাজ গ্যাব্রিয়েলের দ্বারা তাড়িত হয়ে ইডেন উদ্যানের সীমানা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সে আবার ফিরে এল। সে আবার তার পূর্বপরিকল্পিত প্রতারণা আর প্রতিহিংসাকে সজীব করে তুলল তার মনে। মানবজাতির ধ্বংসসাধনের উদ্দেশ্যে ও সংকল্পে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠল সে। সে তারপর মধ্যরাত্রির অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে নির্ভীকভাবে ফিরে এল।
ইতিমধ্যে সে গোটা পৃথিবীটাকে পরিক্রমা করে এসেছে। ইউরিয়েল তাকে চিনতে পারার পর থেকে চেরাবজাতীয় দেবদূত প্রহরীদের সতর্ক করে দেয় সে। সে তাই সারাদিন ধরে দেবদূতদের প্রহরা এড়িয়ে অতি সন্তর্পণে ঘুরে বেড়িয়ে রাত্রির অন্ধকারে ফিরে আসে ইডেন উদ্যানে।
এর আগে পৃথিবী পরিক্রমাকালে সে শুধু পৃথিবীর নদী-সমুদ্র-পাহাড়-পর্বত সমম্বিত বিচিত্র ভূপ্রকৃতি দর্শন করেনি, সে তার বিচিত্র জীবজন্তুগুলিকেও বিভিন্ন জায়গায় ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে। সে দেখে কোন্ জীব তার উদ্দেশ্যসাধনের বেশি কাজে লাগবে। সব দেখার পর অবশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় সে যে, সাপই হলো সব জীবজন্তুর মধ্যে সবচেয়ে কুটিল। সে সর্পদেহ ধারণ করে তার কু-অভিসন্ধি সিদ্ধ করলে কেউ তাকে সন্দেহ করবে না। অন্য জীবদেহ ধারণ করে এ কাজ সিদ্ধ করতে গেলে সন্দেহ জাগতে পারে অন্যের মনে। সে তাই মনে মনে ঠিক করল সর্পদেহের মধ্যে প্রবেশ করে তার কুটিল প্রতারণার গোপন বাসনাকে লোকচক্ষু হতে ঢেকে রেখে স্বচ্ছন্দে তা চরিতার্থ করতে পারবে সে।
সে তখন পৃথিবীকে সম্বোধন করে আবেগের সঙ্গে বলতে লাগল, হে পৃথিবী, তুমি স্বর্গলোকের শুভ অনুরূপ যদিও স্বৰ্গকেই সকলে পছন্দ করে বেশি। তথাপি তুমি দেবতাদের বসবাসযোগ্য, যদিও তোমাকে স্বর্গের পর দ্বিতীয় স্থানাধিকারী হিসাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে। ঈশ্বর স্বর্গের সব স্থান সৃষ্টি করার পর কখনো তার থেকে খারাপ কিছু সৃষ্টি করতে পারেন না।
অনন্ত মহাশূন্যে যে সব ঘূর্ণমান গ্রহনক্ষত্র, সূর্য ও জ্যোতিষ্কমণ্ডলী নিয়ত নৃত্যশীল তাদের আলোক শুধু তোমার উপরেই পতিত হয়। তারা শুধু তোমাকেই আলোকিত করে। ঈশ্বর যেমন ত্রিভূবনের কেন্দ্রস্থলে বিরাজিত থেকে সর্বত্র তাঁর প্রভাব ও প্রভুত্ব বিস্তার করেন তেমনি তুমিও সমস্ত গ্রহের কেন্দ্রস্থলে থেকে সমস্ত সৌরজগতের শুভ প্রভাবগুলি আকর্ষণ করো। তাদের গুণগুলি তোমার গাছপালা ও ওষধিতে সঞ্চারিত হয় সফলভাবে। সেইসব গুণের প্রভাবেই তোমার মধ্যস্থিত প্রাণীগুলি জন্মলাভ করে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ধীরে ধীরে। তাদের মধ্যে মানুষই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ প্রাণী, একমাত্র তারই মধ্যে জ্ঞানবুদ্ধি আছে।
হায়, আমি যদি হে পৃথিবী, তোমার অধিবাসী হতাম তাহলে তোমার মত সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়ে পাহাড়-উপত্যকা, নদী-সমুদ্র, সমতল ভূমি, অরণ্যরাজি দেখে কত আনন্দই না লাভ করতাম। কিন্তু তোমার মধ্যে এত সব কিছু থাকা সত্ত্বেও কোথাও আমার আশ্রয় নেই। কোথাও আমার বাসের স্থান নেই। আমার চারদিকে আমি এইসব আনন্দময় বস্তুগুলি যতই দেখি তই আমার অন্তজ্বালা বেড়ে যায়। আমার মধ্যে এমন কতকগুলি ঘৃণ্য বিপরীতমুখী ভাবধারা আছে যার জন্য সকল সুন্দর বস্তু অসুন্দর হয়ে যায় আমার কাছে। এমন কি স্বর্গলোকেও আরও শোচনীয় হয়ে উঠবে আমার অবস্থা। কিন্তু এই মর্ত্যলোকে অথবা স্বর্গলোকে আমি বাস করতে চাই না। আমি চাই শুধু স্বর্গের অধিপতিকে জয় করতে। তাঁর সব গৌরবকে খর্ব করে দিতে। কিন্তু আমার এই দুঃখময় অবস্থা তা শুধু একা ভোগ করতে চাই না, আমি অন্য সব সুখীদেরও আমার এই দুঃখের অংশভাগী করে তুলতে চাই। তাতে যদি আমার দুঃখ আরও বেড়ে যায় তো যাক।
ধ্বংসের মধ্যে সবচেয়ে শান্তিলাভ করে আমার বিক্ষুব্ধ চিন্তাগুলি। যাদের জন্য এই সুন্দর পৃথিবী সৃষ্ট হয়েছে তাদের ধ্বংস করা অথবা তাদের ক্ষতিসাধন করাই হলো আমার কাজ। তাহলে এর স্রষ্টাও দুঃখ পাবে। তাতেই আমি সমস্ত নরকবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে গৌরববোধ করব।
সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যে পৃথিবী ছয়দিন ছয়রাত ধরে সৃষ্টি করেছেন এবং তার আগেও কতদিন ধরে তার পরিকল্পনার চেষ্টা করেছেন তা আমি একদিন ধ্বংস করে দিতে চাই।
আমরা স্বর্গলোক থেকে বিতাড়িত হবার পর আমাদের সংখ্যা পূরণের জন্য অথবা আমাদের প্রতি ঘৃণাবশত আমাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য এই পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করে তাদের উন্নতি সাধনের জন্য বিভিন্ন স্বর্গীয় গুণাবলীতে ভূষিত করেছেন। তাঁর ইচ্ছা ও পরিকল্পনা মতোই কাজ করেছেন তিনি।
তিনি মানুষ সৃষ্টি করে সেই মানুষের জন্য এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষকে এই জগতের অধীশ্বররূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হায়, এইভাবে কী উপকারই না তিনি আমাদের করেছেন। স্বর্গের দেবদূতেরা সর্বদা পাখা মেলে এই মানুষের অধীনস্থ দাসের মত সেবা করে বেড়ায়। দেবদূত প্রহরীরা সারা পৃথিবী প্রহরা দিয়ে বেড়ায়। তাদের। প্রহরাকেই আমি সবচেয়ে ভয় করি। তাদের সেই প্রহরা এড়ানোর জন্যই আমি মধ্যরাত্রির কুয়াশা ও অন্ধকারের আবরণে গা ঢাকা দিয়ে গোপনে নিঃশব্দে এখানে প্রবেশ করেছি। কোথায় এক ঘুমন্ত সর্পকে দেখতে পাব এবং তার দেহে প্রবেশ করে আমার কুটিল কামনাকে চরিতার্থ করতে পারব তার জন্য প্রতিটি ঝোঁপঝাড় আমি অনুসন্ধান করে চলেছি।
যে আমি একদিন সর্বোচ্চ পদে অভিষিক্ত হয়ে দেবতাদের সঙ্গে ওঠাবসা করতাম, সেই আমি আজ বাধ্য হয়ে পশু হতে চলেছি। পশুর গুণাবলী ধারণ করতে চলেছি। কিন্তু উচ্চাভিলাষ পূরণ ও প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য কে নীচে নামবেনা? যে উচ্চাভিলাষের আকাশে পাখা মেলে উড়তে চায় তাকে নীচে নামতেই হবে। যে প্রতিশোধ চায় তাকে আপাতমধুর সেই প্রতিশোধের তিক্ত ফল ভোগ করতেই হবে!
তাই হোক। যেহেতু সুউচ্চ স্বর্গলোকে গিয়ে আমি ঈশ্বরকে ধরতে পারলাম না, সেইহেতু সেই ঈশ্বরের পরেই যে আমার মনে ঈর্ষা জাগায়, যে ঈশ্বরের নূতন প্রিয় বস্তুরূপে আমাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। আমাদের প্রতি ঘৃণাবশত যাকে ঈশ্বর সামান্য মাটি থেকে সৃষ্টি করে এমন উন্নত অবস্থায় উন্নীত করেছেন, সেই মাটির মানুষকে ঈশ্বরের নবজাত সন্তানকে ঘৃণা করতে চাই আমি। ঘৃণার শোধ ঘৃণার দ্বারাই নিতে হয়।
এই কথা বলার পর একরাশ কালো কুয়াশার মত গুঁড়ি মেরে প্রতিটি সিক্ত অথবা শুষ্ক ঝোঁপের মধ্যে সে একটি ঘুমন্ত সর্পের সন্ধান করে যেতে লাগল। অবশেষে সে এক জায়গায় দেখতে পেল ঘাসের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে মাথা রেখে একটি সাপ নির্ভয়ে ঘুমোচ্ছে। শয়তান তার মুখের মধ্যে প্রবেশ করে তার পাশবিক কুটিল স্বভাবটি লাভ করল। তারপর তার বুদ্ধিকে সক্রিয় করে তুলল। কিন্তু তাতে সর্পটির ঘুমের কোন ব্যাঘাত হলো না। এইভাবে রাত্রি প্রভাত হবার অপেক্ষায় রইল।
তারপর যখন প্রভাতের শুচিস্নিগ্ধ আলো ইডেন উদ্যানের প্রস্ফুটিত ফুলগুলির উপর ঝরে পড়তে লাগল, তখন সেই সব ফুলগুলি হতে বিচিত্র সৌরভে আমোদিত হয়ে উঠল উদ্যান। পৃথিবীর সমস্ত সুগন্ধি বস্তুগুলি পরম স্রষ্টার উদ্দেশ্যে নীরবে গৌরবগান করতে লাগল। তখন সর্পরূপী শয়তান দেখল সেই মানবদম্পতি ঈশ্বরের স্তোত্ৰগানে মুখর হয়ে উঠল। সমস্ত প্রকৃতি ও প্রাণীজগতের মধ্যে একমাত্র তারাই এই কণ্ঠস্বরের অধিকারী। ঈশ্বরের স্তবগানে সমর্থ। গান শেষে তারা প্রথমে প্রকৃতির রূপ, বর্ণ ও গন্ধ কিছুক্ষণ উপভোগ করল। পরে তারা তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করতে লাগল।
ঈভ তখন বলল, আদম, যতই আমরা এই উদ্যানের গাছপালা ও ফুলগুলির পরিচর্যা করছি ততই আমাদের কাজ বেড়ে যাচ্ছে। এতদিন আমরা দুজনে একসঙ্গে কাজ করে আসছি। একাজে আরও লোকের দরকার। যে সব গাছপালার অতিরিক্ত অংশ হেঁটে দিচ্ছি, একরাত্রির মধ্যেই তারা আবার বেড়ে উঠছে। তাই উপায়স্বরূপ একটি চিন্তা আমার মনে হয়েছে। এ বিষয়ে তোমার পরামর্শ চাই। আমি আমাদের শ্রমকে ভাগ করে নিতে চাই। আমরা দুজনে দু জায়গায় কাজ করব। তুমি পছন্দমত এক জায়গায় যেতে পার অথবা যেখান বেশি প্রয়োজন বুঝবে সেখানে যাবে। অথবা যেখানে আইভিলতাগুলি কোন গাছকে জড়িয়ে উঠতে পারছে না সেখানে গিয়ে তাদের উঠিয়ে দেবে। আর আমি ঐ গোলাপবনে গিয়ে তাদের পরিচর্যা করব বেলা দুপুর পর্যন্ত।
কিন্তু আমরা দুজনে যদি একই জায়গায় কাছাকাছি কাজ করি তাহলে পরস্পরের দৃষ্টি বিনিময়, হাসাহাসি ও কথাবার্তায় সময় কেটে যায়, কাজের কাজ কিছুই হয় না। সারাদিন বৃথাই কেটে যায়।
আদম তখন শান্তকণ্ঠে উত্তর করল, হে আমার একমাত্র সহচরী, সমস্ত প্রাণীর মধ্যে তুমিই আমার প্রিয়তমা, ঈশ্বরনির্দিষ্ট আমাদের দৈনন্দিন কাজগুলি কিভাবে সুচারুরূপে সম্পন্ন হতে পারে সে বিষয়ে তুমি ঠিকই বলেছ। কাজ ঠিকমত না হওয়ার জন্য যাতে আমার কোন নিন্দা বা বিরূপ সমালোচনা না হয় সেদিকে তোমার লক্ষ্য আছে। পারিবারিক মঙ্গলসাধনই নারীর সৌন্দর্যকে পূর্ণতা দান করে। পারিবারিক উন্নতির জন্য যথাসাধ্য কাজ করে যাওয়াই নারীর ধর্ম।
কিন্তু ঈশ্বর আমাদের উপর এমন কিছু কঠোর শ্রমের ভার চাপিয়ে দেননি যে আমরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে দুজনে একসঙ্গে বসে বিশ্রাম করে অথবা মধুর আলাপ-আলোচনার দ্বারা চিত্তবিনোদন করতে পারব না। যে হাসি মানুষের যুক্তিবোধ থেকে উৎসারিত হয়, সে হাসি পশুদের মুখে পাওয়া যায় না। নরনারীর মুখের সেই মিষ্টি হাসি ও মধুর বিশ্রম্ভালাপ মানবমনের খাদ্য। প্রেম হচ্ছে মানবজীবনের এক মহান লক্ষ্য, কোন হীনতম লক্ষ্য নয়।
কোন কষ্টকর বিরক্তিকর শ্রমের জন্য আমাদের সৃষ্টি হয়নি, আমাদের সৃষ্টি হয়েছে আনন্দের জন্য এবং এই আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তি। এইসব বনপথ ও কুঞ্জগুলি আমরা দুজনেই হাত দিয়ে পরিষ্কার রাখতে পারব। আমাদের বেড়াবার প্রশস্ত পথ থাকবে। পরে আমাদের সন্তানরা তাদের ছোট ছোট হাত দিয়ে সাহায্য করবে আমাদের কাজে।
তবে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার দ্বারা তোমার মন যখন তৃপ্ত হবে তখন তুমি অল্প : কিছুক্ষণের জন্য অনুপস্থিত থাকতে পার। আমি তা সহ্য করতে পারব। কারণ নির্জনতা অনেক সময় উত্তম সাহচর্য বা সঙ্গদানের কাজ করে। স্বল্পকালীন বিরাম বা বিশ্রাম ভাল ফল দান করে।
তবে এ বিষয়ে আর একটি সংশয় আচ্ছন্ন করছে আমার মনকে। পাছে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্যত্র কোথাও গেলে তোমার কোন বিপদ ঘটে বা তোমার কোন ক্ষতি হয় তা ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠেছে আমার মন। আমাদের কিভাবে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে তা তুমি জান। আমাদের কোন প্রতিহিংসাপরায়ণ শত্রু আমাদের সুখে ঈর্ষান্বিত ও তার হতাশায় বিক্ষুব্ধ হয়ে এক হীন চক্রান্ত ও অপকৌশলের দ্বারা আমাদের পতন ঘটিয়ে অন্তহীন দুঃখ, লজ্জা ও অপমানের গহুরে নিক্ষেপ করতে চাইছে। সে শত্ৰু নিশ্চয় আমাদের নিকটবর্তী কোন জায়গায় থেকে লক্ষ্য করছে, তার কু-অভিসন্ধি পূরণের সুযোগ খুঁজছে। দেখছে আমরা এক জায়গায় পাশাপাশি থাকলে সুবিধা হবে না। কারণ তাহলে একজনের প্রয়োজনে অন্যজন সাহায্য করতে পারব