- বইয়ের নামঃ অরিজিন অফ স্পিসিস
- লেখকের নামঃ চার্লস ডারউইন
- প্রকাশনাঃ দীপায়ন
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
অরিজিন অফ স্পিসিস
০. ঐতিহাসিক রূপরেখা / ভূমিকা
অরিজিন অফ স্পিসিস – প্রথম ভাগ – চার্লস ডারউইন / ভাষান্তর – শান্তিরঞ্জন ঘোষ
প্রাকৃতিক নির্বাচন অথবা জীবনসংগ্রামে আনুকূল্যপ্রাপ্ত জাতসমূহের সংরক্ষণের সাহায্যে প্রজাতির উৎপত্তি।
.
মাতৃভাষায় সর্বস্তরে বিজ্ঞানশিক্ষার আপোষহীন সংগ্রামী প্রয়াত অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর স্মৃতির উদ্দেশে এই অনুবাদ পুস্তকটি নিবেদিত হলো
.
প্রকাশনা প্রসঙ্গে
ক্রমবিকাশের ধারা বেয়ে মানুষের উদ্ভব এবং তার ক্রমান্বয় বিকাশের ইতিবৃত্ত, মানবসমাজের ক্রমোন্নতির ইতিহাস, সম্পত্তি ও অর্থের বিভিন্ন রূপ ও তাদের ক্রমপরিবর্তনের অর্থাৎ আর্থ-সামাজিক কাঠামোর কালানুক্রমিক ইতিহাস, রাষ্ট্র, ধর্ম, ন্যায়নীতি ও দর্শনচিন্তার ক্রমবিকাশ, লিপি-বর্ণমালা ও শিল্পকলা-সাহিত্যের ইতিহাস এবং বিজ্ঞানের নানা ধারায় নিত্যনতুন আবিস্কার ও ক্রমসংযোজনের বৃত্তান্ত–এই বিষয়গুলিকেই মূলত আমরা বেছে নিয়েছিলাম মানুষের সামগ্রিক ইতিহাসকে উপলব্ধি করার জন্য। বিষয়গুলির ব্যাখ্যা হাতের কাছে পাওয়ার জন্য কয়েকটি বই বাছাই করা হয়েছিল। অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছে। এই পর্যায়ে এখন প্রকাশিত হল চার্লস ডারউইনের যুগান্তকারী বই ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’। প্রকাশনার সুবিধার্থে বইটিকে দু-খন্ডে প্রকাশ করেছি আমরা। এখন প্রথম খন্ডের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হল। এই পর্যায়ের বাকি বইগুলি সুধী পাঠকবৃন্দের হাতে যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে তুলে দেওয়ার অঙ্গীকার করছি।
বইটি প্রকাশের ক্ষেত্রে উভয় বাংলার বহু। শুভানুধ্যায়ী বন্ধু ও সহমর্মী সাথী নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন, প্রেরণা যুগিয়েছেন। এঁদের প্রতেকের কাছেই আমরা কৃতজ্ঞ। এ বিষয়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। অকৃত্রিম সুহৃদ বাসব ঘোষের নাম। তার আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া এ-বই প্রকাশ করা সম্ভব হত না।
.
কিছু প্রাসঙ্গিক কথা
প্রসঙ্গ ও বাংলা অনুবাদ
বেশি দিনের কথা নয়, একজনকে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে তুলে দিতে সকালবেলা হাওড়া স্টেশনে যেতে হয়েছিল। ট্রেনের সময়ের বেশ খানিকটা পূর্বেই উপস্থিত হওয়ায় আজকাল বসবার জন্য গোল করে চেয়ার পেতে তৈরি দ্বীপের দুটি চেয়ারে আমরা। দুজনে বসে কথা বলছিলাম। আমি যাকে তুলে দিতে গেছিলাম, তিনি তার সপ্তাহ। খানেক আগেই বেশ কিছুদিন মস্কো, আজকের রাশিয়ায় ঘুরে এসেছেন। তার কাছে প্রশ্ন করছিলাম দেশটাকে কেমন দেখলেন, সাধারণ মানুষের অবস্থা, তাদের মনোভাব কেমন বুঝলেন, পুরাতন সোবিয়েত ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের এখনকার মনোভাব কেমন, এই সব আর কি।
তার উত্তরের প্রধান কথাই ছিল, “আমি ত পুরাতন সোবিয়েত দেখিনি, তাই তুলনার কোন প্রশ্নই আমার কাছে ছিল না। সব থেকে বড় বাধা ছিল ভাষা। কোথাও কেউ রুশ ভাষা ছাড়া কথা বলে না, বা অন্য ভাষা, যেমন ইংরাজি, জার্মান, ফরাসি, বাংলা, হিন্দি কোন ভাষাই কেউ বোঝে না। তাই সর্বত্র প্রচণ্ড অসুবিধা।” তবু ওনার আত্মীয়রা বিগত ৩০ বছরেরও বেশি ও-দেশে থাকায় ও সকলেই রুশ ভাষায় যথেষ্ট পারঙ্গম হওয়ায় তারা কেউ সঙ্গে থাকলে তবেই কথা বলা বা তাদের কথা বোঝা সম্ভব হয়েছে। অন্যথায় একেবারেই জম্বৎ চলাফেরা। তবে বিদেশিদের, বিশেষ করে ভারতীয়দের প্রতি একটা হৃদ্যতা ও কথা বলার চেষ্টা, একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার ইচ্ছা বয়স্ক পুরুষ মহিলাদের মধ্যে বেশ লক্ষণীয়। আমরা এই সব কথা যখন আলোচনা করছিলাম, তখন আমাদের পাশেই বসে থাকা আর একটি পরিবারের প্রৌঢ় মহিলা বোধ হয় আমাদের কথা একটু মন দিয়েই শুনছিলেন। তিনি বলে উঠলেন, “কেন, ওরা ইংরাজি জানে না বা বোঝে না?” উত্তরে না শুনে চোখেমুখে যত না বিস্ময়, তার অপেক্ষা অবিশ্বাসের ছাপটাই যেন ধরা পড়ে বেশি। ইংরাজি ভাষা সম্পর্কিত প্রভাবে এঁরা এতই প্রভাবিত ও বিশ্ব সম্পর্কে এঁদের জ্ঞানের বহর এতদূর যে এঁরা মনে করেন যে পৃথিবীর সব দেশেই সবাই না হলেও লেখাপড়া জানারা ইংরাজি জানেন বা বোঝেন আর উচ্চশিক্ষার। অর্থই ইংরাজি। ফলস্বরূপ স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ শক্তিশালী বেশ কয়েকটি ভারতীয় ভাষা থাকা সত্ত্বেও ইংরাজি ছাড়া উচ্চশিক্ষার দরজা আমাদের কাছে বন্ধ। কারণ জিজ্ঞাসা করলে একটাই উত্তর–নানা বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বই কোথায়? কথাটি অসত্য নয়। কিন্তু কেন এই অবস্থা? আমাদের অধিকাংশ পণ্ডিত, বিজ্ঞ ব্যক্তিরা মাতৃভাষার পুস্তক রচনা করতে চান না। কারণ তারা মনে করেন ইংরাজিতে না লিখলে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ তাদের কম বিদ্বান বলে মনে করবে। অথচ এশিয়া, আফ্রিকার পূর্বের ঔপনিবেশিক দেশগুলির প্রভুরা নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার প্রয়োজনে যেমন নিজেদের উন্নত মানুষ হিসাবে জাহির করেছে, তেমনি নিজেদের ভাষাকে শ্রেষ্ঠতর ভাষা হিসাবে ব্যবহার করে এখানেও স্থানীয় শ্রেষ্ঠতর মানুষ সৃষ্টি করে তাদের দিয়েই নিচের তলার মানুষকে শাসন-শোষণের পাকা বন্দোবস্ত করেছিল। সেই ট্রাডিশন আজও সমানে চলেছে।
আমাদের মতো দাসসুলভ মানসিকতার দেশ ছাড়া যাদের সবল-সরস মাতৃভাষা বর্তমান, সেখানে তারা জ্ঞানবিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন সবকিছুই নিজেদের মাতৃভাষা রচনা করেন। অন্য দেশে প্রকাশিত প্রয়োজনীয় বইপত্র, সে বিজ্ঞানই হোক আর সাহিত্যই হোক, নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে আত্মস্থ করেন।
আমাদের দেশে সম্প্রতিকালে নানা বিষয়ে মৌলিক গ্রন্থ রচনা ও অনুবাদ কিছু কিছু হলেও তার সংখ্যা এত নগণ্য যে আগামী একশ বছরেও আমাদের প্রয়োজন মিটবার কোন সম্ভাবনা দেখতে পাই না। এই কাজের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান অবশ্যই অনেক হয়েছে। কিন্তু প্রচার যত কাজ যে তুলনায় অতি নগণ্য।
বাস্তব এই অবস্থার মধ্যে উচ্চশিক্ষা ও আমাদের মতো সাধারণ মানুষ বিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখার যুগান্তকারী জ্ঞানপাত্রের কানায় অন্ততঃ এই অনুদিত বইটির মাধ্যমে মুখ ছোঁয়াতে পারে। চার্লস ডারউইনের ‘Origin of Species’-এর অনুবাদ প্রকাশ করে অনুবাদক শ্রী শান্তিরঞ্জন ঘোষ ও প্রকাশক দীপায়ন উভয়েই আমাদের বিশেষভাবে অভিনন্দনযোগ্য হয়েছেন। প্রথমত এই ধরনের বিজ্ঞানগ্রন্থের যথার্থতা বজায় রেখে সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ অনুবাদ খুবই দুরূহ। এই কাজটিই আন্তরিকতার সঙ্গে সমাধা করার জন্য অসীম ধৈৰ্য্য সহকারে যে অমানুষিক পরিশ্রম শান্তিরঞ্জন ঘোষ করেছেন সে কথা আমার অজানা নয়। এই কাজটি করার জন্য, আমি নিঃসন্দেহ যে, কেবলমাত্র জীববিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানের সব বিভাগের ছাত্র, শিক্ষক ও বিজ্ঞানপ্রিয় সব মানুষেরই কৃতজ্ঞতা-ভাজন হবেন তিনি। প্রকাশককেও আমাদের সহস্র ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখলাম। আজকের দিনে মাতৃভাষাকে অপমানিত করার জন্য হঠাৎ কেঁপে ওঠা একদল পরশ্রমভোজী মধ্যবিত্ত যাঁরা কাঞ্চনকৌলিন্য ব্যতিরেকে আর সব কিছুকেই নস্যাকরণে উঠে-পড়ে লেগেছেন এবং সেই সঙ্গে জ্ঞানবিজ্ঞানের বইয়ের কেনা ও পড়ার দিকে ও প্রকাশে বেশ বড় রকমের ভাটা লক্ষণীয়। এমনি এক অবস্থায় আর্থিক লাভালাভের বিষয়টি গৌণ করে বইখানি প্রকাশে যে ঝুঁকি প্রকাশক নিলেন তার জন্য অবশ্যই তিনি আমাদের ধন্যবাদার্হ। সেই সঙ্গে আমরা আশা করব এই বই কিনে পড়বার যথেষ্ট পাঠক, লাইব্রেরি প্রকাশক পাবেন, যার ফলে এই ধরনের প্রকাশের কাজে তিনি আরও উৎসাহিত হবেন।
এ তো গেল প্রারম্ভিক কিছু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কথা। এই প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি কথা বলার চেষ্টা করছি। হয়ত অনেকের কাছে আমার এই বক্তব্য অনধিকার চর্চা মনে হতে পারে, কারণ বিজ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করার কোন ছাপ আমার গায়ে নেই। তথাপি আলোচনা করছি তার প্রধান কারণ–আমি আমার সীমিত ক্ষমতানুসারে সমাজবিজ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করে থাকি এবং এই সমাজ পরিবর্তনের যে বৈপ্লবিক চিন্তার প্রয়োজন, চালর্স ডারউইন সেই জগতে বেশ জবরদস্ত জায়গা করে নিয়েছেন। এই সূত্র ধরেই কিছু কথা বলা দরকার মনে হওয়ায় কিছু লিখবার স্পর্ধা দেখালাম।
.
প্রসঙ্গ : চার্লস ডারউইন
অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে ইরাসমাস ডারউইন একটি বিশেষ পরিচিত নাম। তিনি ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, উদ্ভাবক, লেখক, অনুবাদক। নিজের লেখা ‘জুনোমিয়া’ নামে একটি বইতে এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন যে সব প্রাণীর রক্ত গরম তারা সবাই একই সূত্র থেকে এসেছে–এই ধারণাটা যে খুবই সাহসী ও নূতন। চিন্তার খোরাক যোগাবে, তাতে কোন সন্দেহ থাকার কারণ নেই। এই ঠাকুরদার নাতিই হলেন চার্লস ডারউইন। পিতার নাম রবার্ট ডারউইন। মাতার নাম সুসানা ওয়েউড। পেশায় রবার্ট ডারউইন ছিলেন চিকিৎসক। কাজ করতেন সপশায়ারের শিউসবেরিতে। রবার্ট-সুসানার ছয় সন্তানের পঞ্চম সন্তান ছিলেন চার্লস ডারউইন। জন্ম ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি। পরিবারটি ছিল ধর্মভীরু গোঁড়া খ্রিস্টান। এই আবহাওয়াতেই গড়ে ওঠেন ডারউইন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত পিতৃভক্ত। চার্লস ডারউইনের জীবনী বলার কোন প্রয়োজনে এই কথার উল্লেখ করছি না। বলার উদ্দেশ্য একটিই, তা হল–যে খ্রিস্টীয় সৃষ্টিতত্তের বিশ্বাসের আওতায় তাকে মানুষ হতে হয়েছিল, তাঁর সারা জীবনের গবেষণা কর্মকাণ্ড সেই বিশ্বাসকেই সমূলে উৎপাটিত করেছে।
ডারউইনের বাবা চেয়েছিলেন পুত্র ডাক্তার হোক, সেই আশা ফলবতী না হওয়ায় চাইলেন অন্তত যাজক হোক। চার্লস ডারউইন তা-ও হননি, হলেন প্রকৃতিবিজ্ঞানী। ছোটবেলা থেকেই বাঁধাধরা লেখাপড়া ভাল লাগত না তার। ভাল লাগত প্রকৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়াতে। সাবেক কালের বাঁধাধরা পড়াশোনা তাঁকে আকর্ষণ করতে পারত না। তার ঝোঁক ছিল নানা ধরনের নুড়িপাথর, মুদ্রা, নামলেখা মোহর, গাছপালা, লতাপাতা, পোকামাকড়, পাখির ডিম সংগ্রহ করে চিহ্নিত করে রাখার কাজে। এছাড়া রসায়নশাস্ত্রের প্রতি ছিল তার এক সহজাত আকর্ষণ। সাহিত্যের প্রতিও তার আকর্ষণ লক্ষণীয়। কেব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইষ্ট কলেজের যাজক হওয়ার ক্লাস করতে গিয়ে যাজক হওয়া তার হয়নি। কিন্তু এই সময়েই চলত তার দল বেঁধে শিকার করা, সেই সঙ্গে পোকামাকড় সংগ্রহ করে চিহ্নিত করার কাজ। এখানেই তিনি পরিচিত হন উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক জন সিভেন্স হেনস্লো-র সঙ্গে। তিনি হয়ে ওঠেন চার্লস ডারউইনের প্রেরণাদাতা। ঠাকুরদার লেখা ‘জুনোমিয়া’ বইটি আবার ভাল করে পড়লেন। পড়লেন লামার্কের লেখা। পড়লেন হাম্বোল্ড-এর ‘পার্সোন্যাল ন্যারেটিভ’, হারসেল-এর ‘ইনট্রোডাকশন টু দ্য স্টাডি অফ ন্যাচারাল ফিলজফি’। ডারউইনের নিজের ভাষায়, ‘প্রকৃতিবিজ্ঞান’ পঠনে এই দুটি লেখার অবদান আমাকে তখন উৎসাহ-উদ্দীপনার তুঙ্গে তুলে দিয়েছিল। অধ্যাপক হেনস্লো তাকে ভূতত্ত্ব পড়তে উৎসাহ যোগান।
১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ। ভবিষ্যতের চার্লস ডারউইন তখন ২২ বছরের যুবক। হেশ্লোর। সুপারিশেই প্রকৃতিবিজ্ঞানী হিসাবে এইচ. এম. বিল্ল’ জাহাজের দীর্ঘ অভিযানের শরিক হন তিনি। ১৮৩১-এর ২৭শে ডিসেম্বর তারিখে প্লিমাউথ বন্দর থেকে বিলের যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার নানা দেশ, আন্দিজ পর্বতাঞ্চল, গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ-সহ নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া পরিভ্রমণ করে, কেপটাউন, সেন্ট হেলেনা হয়ে, ১৮৩৬-এর ২রা অক্টোবর ফলমাউথ বন্দরে ফিরে আসে বিল। বিল্ল জাহাজের অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলভাগের মানচিত্র তৈরির কাজে সাহায্য করা, সেই সঙ্গে সঠিকভাবে দ্রাঘিমারেখা নির্ধারণ করা।
কিন্তু প্রকৃতিবিজ্ঞানী ডারউইন পৃথিবীর গহনতম এই সব অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করলেন প্রচুর উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ, মথ, প্রজাপতি, শামুক, পাথর, জীবাশ্ম, সেই সঙ্গে বিপুল অভিজ্ঞতা। দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলের প্রচুর জীবাশ্ম এবং গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের বহু বিচিত্র প্রজাতিগুলিকেই ডারউইনের যাবতীয় চিন্তাভাবনার মূল উৎস হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।
গ্যালাপাগোসের মতো বিচ্ছিন্ন দ্বীপপুঞ্জে বিরল সমস্ত প্রজাতির বিস্তারণ (Distribution) লক্ষ্য করেই তিনি ভেবেছিলেন, ঐসব প্রজাতি একদা মূল ভূখণ্ডের পূর্বপুরুষদের মধ্য থেকেই এসেছিল এবং পরে কোন কারণে অন্যরকম হয়ে উঠেছে–কিন্তু কেমন করে এবং কেন? এমন কি হতে পারে যে জীবনযাত্রার পরিস্থিতির সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক রয়েছে–যা, সম্ভবত কতকগুলি বৈশিষ্ট্যেরই অনুকূল, অন্যগুলির নয়? তিনি তৎকালীন ইংল্যান্ডের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ধ্যানধারণার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। ভাবলেন, মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে প্রতিযোগিতার যে পরিস্থিতি বিদ্যমান তা হয়ত জীবজগতেও ক্রিয়াশীল, আর পুঁজিতান্ত্রিক শোষণকে ন্যায্য প্রমাণ করার জন্য যাজক ম্যালথাস-এর তত্ত্ব তো হাতের কাছেই ছিল। যাজক ম্যালথাসের মতে জীবন একটা যুদ্ধ, সে যুদ্ধে কেবল যোগ্যতমরাই জয়লাভ করে, সে যুদ্ধে নৈতিক উৎকর্ষের পুরস্কার হিসাবে জোটে সম্পদ ও সন্মান। জনসংখ্যার চাপ যাতে খাদ্যের যোগানকে ছাপিয়ে না ওঠে তারই জন্য যুদ্ধ, মহামারী, প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ডারউইন ভাবতে লাগলেন প্রাণীসমাজেও যদি তাই ঘটে? তা যদি হয় তাহলে পরিবেশের পক্ষে আরো উপযোগী হয়ে ওঠার পথে যারা নিজেদের এতটুকুও বদলে নিতে পারল তারা সেই সুবিধাটুকু তাদের উত্তরপুরুষের মধ্যে সঞ্চার করে দেবে, এই ভাবে ধীরে ধীরে প্রজাতির বর্তমান চেহারার উদ্ভব হবে। এই চিন্তা ডারউইনের আগেই করা চলছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক ছিল লামার্কের (১৭৪৪-১৮২৯) বক্তব্য। ফরাসী এই উদ্ভিদবিদ ১৮০৯ সালে সাহসের সঙ্গে এক তত্ত্ব উপস্থাপন করলেন যে পরিবেশের সঙ্গে আরও মানিয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নেয় যোগ্য হয়ে ওঠার এক প্রক্রিয়া, এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই পূর্ববর্তীকালের প্রজাতি থেকে ক্রমে আজকের প্রজাতির উদ্ভব। উঁচু গাছের পাতা খাবার আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নেয় যোগ্য হয়ে ওঠার এক প্রক্রিয়া, এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই পূর্ববর্তীকালের প্রজাতি থেকে ক্রমে আজকের প্রজাতির উদ্ভব। উঁচু গাছের পাতা খাবার আকাঙ্ক্ষায় জিরাফ তার গলা বাড়িয়েছিল, সেই গলা-বাড়ানোর উত্তরাধিকার বর্তায় তার পরবর্তী প্রজন্মের উপর। এই ভাবনাকে মনে হয়েছিল দূরকল্পিত, সমর্থনের অযোগ্য। কিন্তু ইতিমধ্যে জমতে শুরু করেছিল সাক্ষ্যপ্রমাণ–কেবল জীবিত প্রাণী সম্পর্কিত চর্চার ফলেই নয়, জীবাশ্ম সম্পর্কিত চর্চার ফলও এর সঙ্গে যুক্ত হল। আর এই কাজটি অতি সাফল্যের সঙ্গেই সমাধা করেন চার্লস ডারউইন। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের ক্ষেত্রে ১৮৪০-এর বিশ্বব্যাপী বুভুক্ষু দশক ছিল এরকম একটা পর্যবেক্ষণের পক্ষে একান্তই উপযোগী সময়।
‘Origin of Species & Natural Selection’ সংক্রান্ত যে চিন্তাভাবনা ও সিদ্ধান্তে। ডারউইন পৌঁছন, তার ২০ বছর পর পুস্তকাকারে তার আবিষ্কার ও সিদ্ধান্ত ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হল। এই সময়ের মধ্যে বহু ঘটনার সমাবেশ, যার উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করছি না।
পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারে সংযোজিত হল এক ঐতিহাসিক সম্পদ–অরিজিন অফ স্পিসিস। প্রজাতির বিবর্তন, তার ইতিহাস, রূপান্তর–সব কিছুর প্রধান উৎস হিসাবে চিহ্নিত হল প্রাকৃতিক নির্বাচন। কোপারনিকাস, গ্যালিলিওর সময় থেকে ঊনবিংশ শতকের ষাটের। দশকে পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে খানিকটা অগ্রসর হওয়া সত্ত্বেও তার ধ্যানধারণা এক তুমুল দীর্ঘস্থায়ী বিবাদের জন্ম দিল। এ বিবাদ ছিল মূলত ধর্মতাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক প্রশ্নকে ঘিরে, বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক প্রশ্নকে ঘিরে নয়। কেবলমাত্র জীববিদ্যা সংক্রান্ত বিজ্ঞানে নয়, এ তত্ত্ব কোপারনিকাস, গ্যালিলিওর তত্ত্বেরই সমগ্র সামাজিক চিন্তার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে পরিবর্তন করে দেওয়ার প্রতীকরূপে গৃহীত হতে পারে। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠলেন সারা দেশের ধর্মগুরুরা। এই তত্ত্ব বাইবেলোক্ত সৃষ্টিতত্ত্বের বিরোধী–এই বলে আক্রমণ করা হল ডারউইন-তত্ত্বকে। শুধু সভা-সমিতিতে নয়, কার্যক্ষেত্রে নানা ভাবে ডারউইনকে হেয় করার চেষ্টা হল। মানুষকে বানরের মতো করে কার্টুন আঁকা হল, Monkey law-র নামে আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে ডারউইন-তত্ত্ব পড়ানো নিষিদ্ধ হল। শুধু সেইসময়ে কেন, মাত্র কয়েকমাস আগেও আমেরিকার কানসাস প্রদেশে ডারউইন-তত্ত্ব পড়ানোর উপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এর কারণ কী?
ফরাসি বিপ্লবের বিরুদ্ধে তীব্র ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া যদি মাথাচাড়া না দিত, তাহলে এমন কি ডারউইন-তত্ত্বের প্রকাশের পূর্বে উনিশ শতকের গোড়াতেই সকল প্রজাতির উদ্ভব যে এক সাধারণ উৎস থেকে, এই ধারণাটা সহজেই স্বীকৃত হয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি। বরং সতেরো শতকের Counter-Reformation-এর দিনগুলির চেয়েও প্রবল উৎসাহে বাইবেল-বর্ণিত নির্দিষ্ট দিনে প্রজাতি, প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্মকাহিনীকে আক্ষরিক সত্য বলে প্রচার করাটা উনিশ শতকের গোড়ায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাছে অনেক বেশি জরুরী হয়ে পড়েছিল। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই রহস্যবাদী ধারা উনিশ শতকের গোড়ায় গুরুতরভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। উনিশ শতকের গোড়ায় জার্মানির নাটুরফিলসফি (Naturphilosophie) ধারণা ছিল এর প্রতিভূ। হের্ডর ও শেলিং-এর মতো দার্শনিক, গয়টের মতো কবির প্রেরণায় এঁরা মগ্ন ছিলেন ঐশ্বরিক পরিকল্পনার মাঝে প্রকৃতির পরম ভাবের সন্ধানে। এই সন্ধানের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত ছিল জার্মান জাতির পুনর্জাগরণ ও ‘ঘৃণিত’ ফরাসী গাণিতিক জড়বাদকে নির্মূল করার প্রয়াস। কাজেই পঞ্চাশ বছর ধরে অধিকাংশ প্রকৃতিবিদ অণুবীক্ষণে যে-চোখ লাগালেন, কার্যত তা ছিল অন্ধ। তারা প্রকৃতির অৎপর্য নিয়ে ভাবতে রাজী ছিলেন না।
এইখানেই ডারউইন-তত্ত্বের ঐতিহাসিক ও অপরিসীম গুরুত্ব। ১৮৫৯ সালে ‘অরিজিন। অফ স্পিসিস’ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই পুস্তক গভীরভাবে অধ্যয়ন করলেন। ফ্রিডরিশ এঙ্গেলস। পরের বছর কার্ল মার্কস এই বইটি অধ্যয়ন করে ১৮৬০ সালের ১৯ ডিসেম্বর এঙ্গেলসকে লিখলেন, “আমাদের ধারণার প্রাকৃতিক ঐতিহাসিক বনিয়াদ সৃষ্টি করে দিয়েছে এই বইটি। ডারউইনের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ঋণ স্বীকারের উদ্দেশ্যে ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থটি ডারউইনের নামেই উৎসর্গ করেছিলেন মার্কস। এঙ্গেলস তাঁর ডায়লেকটিস্ অফ নেচার’ পুস্তকে প্রকৃতিবিজ্ঞানের জগতে তিনটি ঘটনাকে চূড়ান্ত গুরুত্ব দিয়েছেন-জীবকোষের আবিষ্কার, শক্তির সংরক্ষণ ও তার রূপান্তরের নিয়ম আবিষ্কার আর ডারউইনের আবিষ্কার। মার্কস-এঙ্গেলসের চোখে চার্লস ডারউইনের আবিষ্কার ছিল এক প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর পাশাপাশি এঙ্গেলস তার ‘ডায়লেকটিস্ অফ নেচার’-এ ডারউইন-তত্ত্বের কিছু সমালোচনাও করেছেন। অবশ্য অরিজিন অফ স্পিসিস-এর সঙ্গে ‘ডিসেন্ট অফ ম্যান’ গ্রন্থেরও সাহায্য নিয়েছেন তিনি। যে সমস্ত প্রশ্নগুলি এঙ্গেলস তুলেছে, সংক্ষেপে তা উল্লেখ করছি। অস্তিত্বরক্ষার জন্য সংগ্রামের ওপর একপেশেভাবে অতিরিক্ত জোর দিয়েছেন ডারউইন, যা এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গিতে সঠিক বলে মনে হয়নি। প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্বন্ধেও এঙ্গেলসের মতামত কিছুটা ভিন্ন, যথা একই প্রাণীগোষ্ঠীতে সদস্যসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে যে প্রতিযোগিতা দেখা দেয়, তাতে সব থেকে শক্তিশালীরাই প্রধানত টিকে থাকলেও অন্য অনেক দিকের বিচারে দুর্বলতমরাও টিকে থাকতে পারে। তিনি আরও বলেছেন যে অজৈব প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তুগুলির মধ্যে শুধুমাত্র সংঘাতই থাকে না, সামঞ্জস্যও থাকে; জৈব প্রকৃতির বস্তুগুলির মধ্যে সচেতন ও অসচেতন সংগ্রামের পাশাপাশি সচেতন ও অসচেতন সহযোগিতাও অবস্থান করে। আর তাই এমন কি প্রকৃতির ক্ষেত্রেও শুধুমাত্র সংগ্রাম’ লিখে রাখাটা তার মতে নেহাতই একপেশে ধারণা। বিভিন্ন প্রজাতির পরিবর্তনশীলতার কারণ, পরিবেশের ভূমিকা, বিপাক ক্রিয়ার ভূমিকা–এ সব বিষয়েও কিছু প্রশ্ন তুলেছেন এঙ্গে লস। প্রশ্ন তুলেছেন ম্যালথাসের তত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও। এই সব সমালোচনার পাশাপাশি মানবদেহের শারীরস্থানবিদ্যা, তুলনামূলক শারীরস্থানবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা–সবকিছুর ভিত্তি হিসাবে এঙ্গেলস প্রজাতি তত্ত্বকেই চিহ্নিত করেছেন, অকৃত্রিম স্বাগত জানিয়েছেন ডারউইনের আবিষ্কারকে।
ডারউইন-তত্ত্বের অনেককিছুই আজ আধুনিক বিজ্ঞানের চর্চায় পরিত্যক্ত, সংশোধিত হচ্ছে। কিছু কিছু প্রশ্ন নিয়ে চলেছে গবেষণা, বিতর্ক। এটাই স্বাভাবিক, কারণ বিজ্ঞান এগিয়ে চলে নানা জনের নানা প্রয়াসের সমষ্ঠির রূপ নিয়ে, যদিও ডারউইনের মতো দিকপালদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পৃথিবীর ইতিহাসে ডারউইন ও তাঁর বিবর্তন তত্ত্বের মৃত্যু নেই।
পরিশেষে উল্লেখ করতে চাই, “সংস্কৃতির কোন ক্ষেত্রেই দিকপাল মানুষরা স্বয়ম্ভর নন, বিজ্ঞানে তো ননই। কেননা বিজ্ঞানের যে কোন আবিষ্কারের পশ্চাতে থাকে গৌণ ও কল্পনা-দীন শতশত বিজ্ঞানীর প্রস্তুতিমূলক কাজ। এই সব বিজ্ঞানীরা প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সঞ্চয় করে চলেন। বেশিরভাগ সময়েই না বুঝে সঞ্চিত সেই তথ্য-ভাণ্ডার নিয়েই দিকপাল বিজ্ঞানী তার কর্ম সমাধা করেন।”
“মানুষের মনের গঠন যে কত রকমের হয় তার ইয়ত্তা নেই। বিজ্ঞানে মৌলিক অবদান রাখার সম্ভাবনা অল্প কয়েকজনের মধ্যেই থাকে যদিও অতীতের তুলনায় আজ অনেক বেশি মানুষ সে সুযোগ পাচ্ছেন এবং ভবিষ্যতে আরো বেশি লোক তা পাবেন। যাঁরা বিজ্ঞানের কাজ করার জন্য নির্বাচিত হন বা নিজেদের নির্বাচিত করেন, তাঁদের মধ্যেও বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ছাড়া আর সব ব্যাপারে পার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। এর ফলে বিজ্ঞানে যেমন বিপুল বৈচিত্র্যের সঞ্চার ঘটে, তেমনি সমাজ আরোপিত নিয়ন্ত্রণের মারফৎ প্রয়োজনীয় একটি ঐক্যও সাধিত হয়। সে নিয়ন্ত্রণ সচেতনভাবে অথবা অচেতনভাবে আরোপিত হতে পারে। সমাজ-আরোপিত এই ঐক্যের সুবাদেই বিজ্ঞান মানুষের পরিবেশকে অনুধাবন করে তাকে বদলানোর এক সমবায়িকা যৌথ প্রয়াসকে উপলব্ধি করে যে সব দিকপাল বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আলোকে সমাজের অগ্রগমনের পথকে আলোকিত করছেন, চার্লস ডারউইন তাঁদেরই অন্যতম এক অগ্রণীপুরুষ বলেই আত্মজীবনীতে বলতে পেরেছেন, “আমি জানি, ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হবে–মানুষের উদ্ভব আর মানবজাতির ইতিহাসের উপর এসে পড়বে আরও উজ্জ্বল আলোকরশ্মি।”
পরিশেষে, আবার আমাদের ধন্যবাদ পুস্তকটির অনুবাদক ও প্রকাশককে।
হীরেন দাশগুপ্ত
কে. জি. দাস রোড
বারুইপুর
দঃ ২৪ পরগণা
.
পুস্তকটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে প্রজাতির উৎপত্তি সম্বন্ধীয় মতামতের অগ্রগতির একটি সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক রূপরেখা
.
আমি এখানে প্রথমেই প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতামতের অগ্রগতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেব। সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত অধিকাংশ প্রকৃতিবিজ্ঞানীর বিশ্বাস ছিল যে প্রজাতির এক অপরিবর্তনীয় উৎপাদন এবং এরা সৃষ্টি হয়েছিল পৃথক পৃথক ভাবে। অনেক প্রবক্তা এই মতকে দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন করেন। অন্যদিকে কোন কোন প্রকৃতিবিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন যে প্রজাতিরা রূপান্তরিত হয় এবং জীবের বর্তমান আকারগুলি পূর্বে অবস্থিত আকারগুলির বংশধরদের বিশুদ্ধ উৎপাদন। এ বিষয়ে ধ্রুপদী লেখকদের কথা বাদ দিলেও, বর্তমানে যিনি প্রথম এ বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বলার চেষ্টা করেছেন তিনি হলেন বুফন(১)। কিন্তু তাঁর মতামত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছিল এবং যেহেতু তিনি প্রজাতির রূপান্তরের কারণ ও উপায়গুলি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেননি, তাই আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না।
লামার্কই হলেন প্রথম প্রকৃতিবিদ যাঁর এই বিষয়ের সিদ্ধান্তগুলি গভীর মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। এই প্রখ্যাত প্রকৃতিবিজ্ঞানী ১৮০১ সালে সর্বপ্রথম তার মতামত প্রকাশ করেন এবং ১৮০৯ সালে তার ফিলসফি জুলোজিক এবং ১৮১৫ সালে হিস্ট্রি ন্যাচারালিস ডেস অ্যানিম্যাক্স স্যান্স ভার্টেব্রেস’-এর ভূমিকায় নিজের মতামত আরও স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন তিনি। মানুষ-সহ সমস্ত প্রজাতি অন্যান্য প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে এই মতবাদ তিনি তার এই সমস্ত লেখায় সমর্থন করেছিলেন। জৈব ও অজৈব জগতের সমস্ত পরিবর্তন কিছু নিয়মানুসারে হয়, কোন অলৌকিক হস্তক্ষেপ দ্বারা নয়–এই কথা বলে সকলের দৃষ্টিআকর্ষণের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন তিনি।
প্রজাতি ও প্রকারগুলির মধ্যে পার্থক্য করতে সমর্থ হয়ে, কয়েকটি গোষ্ঠীতে আকারদের প্রায় নিখুঁত ক্রমবিন্যাস এবং গৃহপালিত উৎপাদনের সঙ্গে সাদৃশ্য লক্ষ্য করেই সম্ভবত লামার্ক প্রজাতির ক্রমিক পরিবর্তন সম্পর্কে তার সিদ্ধান্তে উপনীত হন। রূপান্তরের উপায়গুলি সম্পর্কে, জীবনের ভৌত অবস্থায় প্রত্যক্ষ ক্রিয়াকলাপে ও বর্তমান আকারগুলির মধ্যে সঙ্করণে কিছু এবং বেশির ভাগই ব্যবহার এবং অব্যবহারে অর্থাৎ অভ্যাসের প্রভাবের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রকৃতিতে সুসম অভিযোজনের জন্য তিনি শেষের মাধ্যমটির উপর সম্ভবত বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন–যেমন জিরাফের লম্বা গলার কারণ হচ্ছে উঁচু গাছের ডালপালা খেতে পারা। কিন্তু একইভাবে তিনি প্রগতিমূলক বিকাশের নিয়মেও বিশ্বাস করতেন। এবং যেহেতু বর্তমান কালের সরল উৎপাদনগুলির অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে জীবনের সমস্ত ধরণগুলি ক্রমাগত উন্নত হয়েছে, সেহেতু তিনি বলেছিলেন যে আকারগুলি বর্তমানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভূত হয়(২)। তাঁর পুত্রের লেখা জীবনীতে উল্লিখিত হয়েছে যে ১৭৯৫ সালের প্রায় প্রারম্ভে জিওফ্রয় সেন্ট-হিলারে মনে করতেন যে আমরা যাকে প্রজাতি বলি তা আসলে একই টাইপের বিভিন্ন অধঃপতিত রূপ। ১৮২৮ সাল অবধি তিনি তার মতামত দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেননি যে সমস্ত বস্তুর উৎপত্তির সময় থেকেই একই আকারগুলি চিরস্থায়ী হয়নি। সম্ভবত জিওফ্রয় জীবনের পরিবেশ বা ‘মনডে অ্যাম্বিয়ান্ট’-কে পরিবর্তনের কারণ বলে। মূলতঃ বিশ্বাস করতেন। কোন সিদ্ধান্তে আসার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন তিনি এবং বিশ্বাস করতেন না যে বর্তমান প্রজাতিরা রূপান্তরিত হচ্ছে, এবং যেমন তাঁর পুত্র বলেছেন, “যে কোন প্রজাতিকে সম্পূর্ণভাবে সংরক্ষণ করাটাই একটা গভীর সমস্যা, কেননা সব প্রজাতিই ভবিষ্যতে অসম্ভবরূপে পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে চলেছে। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ডঃ ডব্লিউ. সি. ওয়েলস রয়াল সোসাইটির সম্মুখে “জনৈক শ্বেতকায় মহিলার চর্মের কিছু অংশ নিগ্রোসদৃশ” নামে একটি গবেষণাপত্র পাঠ করেন;
কিন্তু ১৮১৮ সালে তাঁর “ডিউ এ্যাণ্ড সিঙ্গল ভিশন সংক্রান্ত দুটি প্রবন্ধ” প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত পূর্বের প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়নি। এই গবেষণাপত্রে তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচনের নীতিকে স্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দেন, এবং এটিকে প্রথম স্বীকৃতি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, কিন্তু একে তিনি কেবলমাত্র মানবজাতির ক্ষেত্রে এবং কয়েকটি চরিত্রের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন। নিগ্রো ও মূলাটোরা কয়েকটি ক্রান্তীয় রোগের সংক্রমণ থেকে মুক্ত, এ-কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রথমতঃ, সমস্ত প্রাণীরাই কোন-না কোন মাত্রায় পরিবর্তনপ্রবণ হয়, এবং দ্বিতীয়তঃ, কৃষিবিদরা নির্বাচন দ্বারা তাদের গৃহপালিত প্রাণীদের উন্নত করেন, সেই কাজটি প্রকৃতিতে কিছুটা মন্থরগতিতে হলেও সমান দক্ষতায় সম্পন্ন হয়েছে–হয়েছে কোন নির্দিষ্ট দেশে বসবাসের পক্ষে উপযুক্ত মনুষ্যসৃষ্টির প্রক্রিয়ায়। মানুষের আকস্মিক ভ্যারাইটিদের মধ্যে, যা আফ্রিকার মধ্যভাগে বিচ্ছিন্ন অধিবাসীদের মধ্যে প্রথমে ঘটেছে, সেইসব দেশের বিভিন্ন অসুখ সহ্য করার ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় কোন একটি জাত অধিকতর উপযুক্ত হবে। পরিণামে সেই জাতটি সংখ্যায় বৃদ্ধি পাবে, যখন অন্যরা সংখ্যায় হাস পাবে। এই হ্রাস পাওয়ার কারণ কেবলমাত্র রোগাক্রমণ থেকে বাঁচার অক্ষমতাই নয়, সুস্থ-সবল প্রতিবেশীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সক্ষম না হতে পারাও তার কারণ হিসেবে কাজ করে। ইতিমধ্যে যা বলা হয়েছে তা থেকে আমি বিনা বিচারেই স্বীকার করে নিচ্ছি যে এই সবল জাতিটির বর্ণ হবে কালো। কিন্তু ভ্যারাইটি সৃষ্টির এই প্রবণতা বিদ্যমান থাকলে কালক্রমে কৃষ্ণ থেকে কৃতর জাতির উদ্ভব ঘটবে, এবং যেহেতু কৃষ্ণতমরা আবহাওয়াটিতে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত হবে, সেহেতু সেই বিশেষ দেশটিতে তারা একমাত্র জাত না হলেও কালক্রমে সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতে পরিণত হবে। তিনি তারপর শীতল আবহাওয়ার শ্বেতকায় অধিবাসীদের ক্ষেত্রে এই একই মতামত ব্যক্ত করেছেন। মিঃ ব্রেসের মাধ্যমে ডঃ ওয়েলসের গ্রন্থের উপরিউক্ত রচনাংশটি সম্বন্ধে আমার দৃষ্টিআকর্ষণ করার জন্য আমি ইউনাইটেড স্টেট~এর মিঃ রোলের নিকট কৃতজ্ঞ।
মাননীয় রেভারেণ্ড ডব্লিউ. হার্বাট, পরবর্তীকালে যিনি ম্যানচেস্টারের ডিন হন, ১৮২২ সালে প্রকাশিত তাঁর হর্টিকালচারাল ট্রানজাকশনস’ গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ডে এবং ‘অ্যামারিলিভেসি’র ওপর তার গবেষণামূলক রচনায় (১৮২৭, পৃঃ ১৯, ৩৩৯) ঘোষণা করেন, “উৎপাদন সংক্রান্ত পরীক্ষা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছে যে উদ্ভিদ প্রজাতিসমূহ কেবলমাত্র একটি উচ্চতর এবং স্থায়ী ভ্যারাইটি। প্রাণীদের ক্ষেত্রেও একই মত প্রকাশ করেন তিনি। ডিন মহাশয় বিশ্বাস করেন যে প্রত্যেক গণের একটি প্রজাতি প্রথমে অতি নমনীয় অবস্থায় সৃষ্টি হয়েছিল এবং এগুলি প্রধানতঃ আন্তঃসঙ্করণ দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে, বর্তমানে আমাদের সমস্ত প্রজাতিদের বিভিন্নতা এই ভাবেই সৃষ্টি হয়েছে।
স্পঞ্জিলার ওপর তার বিখ্যাত গবেষণাপত্রের (‘এডিনবার্গ ফিলোসফিক্যাল জার্নাল’, খণ্ড ১৪, পৃঃ ২৮৩) উপসংহার অনুচ্ছেদে তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন যে অন্য প্রজাতি থেকেই একটি প্রজাতির উদ্ভব হয়েছে এবং রূপান্তরের ফলে এরা উন্নত হয়েছে! ১৮৩৪ সালে প্রকাশিত ‘ল্যান্সেট’-এ তাঁর ৫৫তম বক্তৃতার এই একই মতামত প্রকাশ করেন তিনি।
১৮৩১ সালে মিঃ প্যাট্রিক ম্যাথিউ ‘নাভাল টির অ্যাণ্ড আর্বোরিকালচার’-এর ওপর তাঁর গবেষণামূলক রচনাটি প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে স্পষ্টভাবে একই মত পোষণ করেন, যেমনটা ( এখানে উল্লিখিত হবে) মিঃ ওয়ালেস এবং আমি লিনিয়ান জার্নাল’-এ প্রস্তাব করেছি এবং বর্তমান খণ্ডে পরিবর্ধিত হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশতঃ একটি ভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণামূলক কাজের পরিশিষ্টের কয়েকটি। বিক্ষিপ্ত অনুচ্ছেদে মিঃ ম্যাথিউ মতবাদটি প্রকাশ করেছিলেন, ফলে এটি অনেকদিন পর্যন্ত অলক্ষিত অবস্থায় থেকে গিয়েছিল। অবশেষে মিঃ ম্যাথিউ নিজেই ১৮৬০ সালের ৭ই এপ্রিল তারিখের ‘গার্ডেন ক্রনিকল’ পত্রিকায় এ বিষয়ে সকলের দৃষ্টিআকর্ষণ করেন। আমার সঙ্গে ম্যাথিউ-র মতের পার্থক্য খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয়। মনে হয় তিনি বিশ্বাস করতেন যে পৃথিবী পর্যায়ক্রমে প্রায় জনশূন্য হয়ে যেত এবং পরে আবার পূর্ণ হত; এবং তিনি বিপরীত ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে নূতন আকারসমূহ “পূর্বের পুঞ্জীভূত কোন মোল্ড বা জার্মের উপস্থিতি ছাড়া সৃষ্টি হতে পারে। কয়েকটি অনুচ্ছেদের সারমর্ম আমি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারিনি, তবে মনে হয় তিনি জীবনের পরিবেশের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ক্রিয়ার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তবে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের বিপুল ক্ষমতা স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করেছিলেন তিনি।
প্রখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ ও প্রকৃতিবিজ্ঞানী ভন বাখ “ক্যানারী: দ্বীপপুঞ্জের প্রাকৃতিক গঠনের বর্ণনা” (১৮৩৬, পৃঃ ১৪৭) শীর্ষক চমৎকার রচনাটিতে তার বিশ্বাস পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেন যে ভ্যারাইটিরা ধীরে ধীরে স্থায়ী প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়, যা আন্তঃসঙ্করণে আর সমর্থ হয় না।
১৮৩৬ সালে প্রকাশিত “নিউ ফ্লোরা অফ নর্থ আমেরিকা” গ্রন্থে রাফিনেস্ক লেখেন (পৃঃ ৬): “সমস্ত প্রজাতি এক সময় ভ্যারাইটি হলেও হতে পারত, এবং অনেক ভ্যারাইটি স্থায়ী ও নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করে ক্রমশ প্রজাতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। কিন্তু পরে তিনি উল্লেখ করেন (পৃঃ১৮) “গণের আদিম রূপ বা পূর্বপুরুষদের ক্ষেত্রে এ-ঘটনা ঘটেনি।”
অধ্যাপক হেল্ডমান ১৮৪৩-৪৪ সালে (“বোস্টন জার্নাল অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি, ইউনাইটেড স্টেটস, খণ্ড ৪, পৃঃ ৪৬৮) প্রজাতিদের ক্রমবিকাশ ও রূপান্তর সম্পর্কিত প্রকল্পসমূহের বিপক্ষে এবং স্বপক্ষে দক্ষতার সঙ্গে অনেক যুক্তি দেখিয়েছেন। সম্ভবত পরিবর্তনের দিকে তার ঝোঁক বেশি।
‘ভেস্টিজেস অফ ক্রিয়েশন’ গ্রন্থটি ১৮৪৪ সালে প্রকাশিত হয়; গ্রন্থটির দশম ও পরিমার্জিত সংস্করণে (১৮৫৩) অনামী লেখক বলেন (পৃঃ ১৫৫): “অনেক বিবেচনার পর এই সিদ্ধান্ত আসা গেছে যে জীবন্ত জীবের সরল ও আদিমতম অবস্থা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের সর্বোচ্চ রূপ পর্যন্ত দীর্ঘ ক্রমমালা হচ্ছে ঈশ্বরের ইচ্ছাপ্রসূত ফলে, প্রথমতঃ, জীবের আকারগুলিতে প্রদত্ত একটি উদ্দীপনা এদের বংশপরম্পরায় উন্নত করেছে যা জীব সংগঠনের বিভিন্ন ক্রমের মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদে ও মেরুদণ্ডী প্রাণীতে পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এই ক্রমবিন্যাস সংখ্যায় অল্প এবং জৈব বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য দ্বারা চিহ্নিত, এদের মধ্যেকার সম্পর্ক নিরূপণ করতে আমাদের বাস্তব অসুবিধা অনুভব করার সম্মুখীন হতে হয়; দ্বিতীয়তঃ, জীবনীশক্তির সঙ্গে সংযুক্ত অন্যান্য উদ্দীপক যা বংশানুক্রমে বহিরাবস্থানুসারে জৈবিক কাঠামোগুলিতে রূপান্তরিত করতে প্ররোচিত করে। যেমন, খাদ্য, আবাসস্থলের প্রকৃতি ও মহাকাশীয় উন্নপিণ্ডজাতীয় মাধ্যমগুলি, এগুলি হচ্ছে প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ববিদের ‘অভিযোজন’।” লেখক স্পষ্টতঃ বিশ্বাস করেন যে আকস্মিক উল্লম্ফন দ্বারা জীব সংগঠনের অগ্রগমন হয়, কিন্তু জীবের। পরিবেশ দ্বারা সৃষ্ট প্রভাব ক্রমান্বয়ী হয়। তিনি জোরের সঙ্গে মত প্রকাশ করেন যে প্রজাতিরা অপরিবর্তনীয় নয়। কিন্তু আমি বুঝতে পারি না কেমন করে অসংখ্য ও সুন্দর সহ-অভিযোজনের জন্য, যা আমরা প্রকৃতির সর্বত্র দেখি, দুটি কল্পিত ‘তাড়না’ বৈজ্ঞানিক অর্থে বিবেচিত হয়। আমি বুঝতে পারি না যে এইভাবে আমরা কোন্ জ্ঞান। লাভ করেছি, উদাহরণস্বরূপ–কেমন করে একটি কাঠঠোকরা পাখি অদ্ভুত স্বভাবে অভিযোজিত হয়েছে। শক্তিশালী ও অত্যুৎকৃষ্ট উপায়ে লেখা হলেও লেখাটি, যদিও এটির পূর্ববর্তী সংস্করণে যথাযথ জ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক সতর্কতার বিরাট অভাব ছিল, তৎক্ষণাৎ ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। আমার মতে এটি আমাদের দেশে এ বিষয়ে দৃষ্টিআকর্ষণ করতে, সংস্কারমুক্ত করতে এবং সঠিক মতামত গ্রহণের জন্য পটভূমি তৈরি করতে চমৎকার কাজ করেছে।
১৮৪৬ সালে অভিজ্ঞ ভূ-বিজ্ঞানী এম. জে. ডি’ ওমালিয়াস ডি’ হালয় তার চমৎকার অথচ সংক্ষিপ্ত গবেষণাপত্রে (বুলেটিনস ডে লাকাদ, রয়, ব্রাক্সেলেস্ টম. ১৩, পৃঃ ৫৪১) মতামত প্রকাশ করেন যে পৃথক ভাবে সৃষ্টির তুলনায় পরিবর্তনের পথ বেয়ে। নূতন প্রজাতিদের উদ্ভব ঘটাই অধিকতর সম্ভবপর। লেখক এই মতবাদ সর্বপ্রথম ১৮৩১ সালে প্রচার করেছিলেন।
১৮৪৯ সালে (নেচার অফ লিম্ব, পৃঃ ৮৬) অধ্যাপক ওয়েন নিচের অংশটি লেখেন: “এই গ্রন্থে সমস্ত প্রাণী প্রজাতিদের অবস্থানের বহু পূর্বে, বিচিত্র এইরূপ রূপান্তরের মধ্যে প্রাণীদের আদিরূপের ধারণা স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়েছিল। কোন্ প্রাকৃতিক নিয়ম এবং গৌণ কারণানুসারে এইরূপ জৈব ঘটনার সুশৃঙ্খল অনুগমন ও গ্রগতি ঘটে থাকতে পারে, সে সম্পর্কে আমরা এখনও অজ্ঞ।” ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে অভিভাষণে, তিনি “সৃজনশীল ক্ষমতার অবিচ্ছিন্ন ক্রিয়াকলাপের স্বতঃসিদ্ধ সত্যতার অথবা জীবন্ত দেহের নির্দেশমতো আবির্ভাবের কথা বলেন। ভৌগলিক বিস্তার উল্লেখ করে, তিনি আরও যোগ করেন, “এই সব ঘটনা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাসকে নাড়া দেয় যে নিউজিল্যাণ্ডের অ্যাপ্টেরিক্স এবং ইংল্যান্ডের লাল জংলি হাঁসেরা যথাক্রমে ঐ সব দ্বীপগুলির জন্যই পৃথকভাবে সৃষ্টি হয়েছিল। সর্বদা মনে রাখা দরকার যে সৃষ্টি’ শব্দটির দ্বারা এই প্রাণীবিজ্ঞানী বোঝাতে চেয়েছেন একটি প্রক্রিয়া যা তার অজানা। তিনি তার এই ধারণা ব্যাখ্যা করেন এটি যোগ করে যে লাল জংলি হাঁসের মত এই সব ঘটনা “এই দ্বীপগুলির মধ্যে পাখিটির স্বতন্ত্র সৃষ্টির সাক্ষ্য হিসাবে প্রাণীবিজ্ঞানীদের দ্বারা পরপর উল্লিখিত হয়েছে, তারা মূলতঃ বলতে চেয়েছেন যে কেমন করে লাল জংলি হাঁসেরা সেখানে এবং কেবলমাত্র সেখানেই এসেছিল তা তারা জানেন না; উল্লেখযোগ্য যে তাঁদের এরূপ অজ্ঞতার প্রকাশ তাঁদের এই বিশ্বাসই ব্যক্ত করে যে পাখিটি এবং দ্বীপগুলি উভয়েই একটি প্রথম সৃজনশীল কারণ অর্থাৎ ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল।” একই অভিভাষণে প্রদত্ত এই সমস্ত বাক্যগুলো যদি আমরা একের পর এক ব্যাখ্যা করি, তাহলে মনে হয় তার দৃঢ় বিশ্বাসে নাড়া লেগেছিল, তিনি ১৮৫৮ সালে অনুভব করেছিলেন যে অ্যাপ্টেরিক্স ও লাল জংলি হাঁসেরা সর্বপ্রথম তাদের নিজেদের দেশে আবির্ভূত হয়েছিল, “তিনি জানতেন না কেমন করে বা কোন্ পদ্ধতির দ্বারা “সেটাও অজানা”।
এখানে উল্লিখিত প্রজাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে মিঃ ওয়ালেস এবং আমার গবেষণাপত্র লিনিয়ান সোসাইটিতে পড়ার পর এই বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছিল। যখন এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল, তখন “সৃজনশীল ক্ষমতার নিরবচ্ছিন্ন কার্যপ্রণালী র মতো কথাগুলিতে অন্য অনেকের মতো আমিও এত প্রতারিত হয়েছিলাম যে আমি অধ্যাপক ওয়েনকে অন্যান্য জীবাশ্মবিদদের অন্তর্ভূক্ত করেছিলাম, যাঁরা প্রজাতির অপরিবর্তনশীলতায় বিশ্বাসী, কিন্তু এটি (অ্যানাট, অফ ভার্টেব্রটস’, খণ্ড ৩, পৃঃ ৭৯৬) আমার পক্ষে অস্বাভাবিক ভুল বলে প্রতীয়মান হয়। এই গ্রন্থের সর্বশেষ সংস্করণে “নিঃসন্দেহে টাইপ-আকারটি’ ইত্যাদি শব্দ দ্বারা শুরু একটি অনুচ্ছেদ (ঐ, খণ্ড ১, পৃঃ ৩৫) থেকে আমি সিদ্ধান্ত করেছিলাম এবং সিদ্ধান্তটি এখনও আমার সঠিক বলেই মনে হয়, যে অধ্যাপক ওয়েন স্বীকার করেছিলেন যে একটি নূতন প্রজাতির উৎপত্তিতে প্রাকৃতিক নির্বাচন কিছু ভূমিকা পালন করে থাকতে পারে; কিন্তু দেখা যায় (ঐ, খণ্ড ৩, পৃঃ ৭৯৮) এটি ভুল এবং প্রমাণহীন। আমি লন্ডন রিভিউ-এর সম্পাদক এবং অধ্যাপক ওয়েনের মধ্যে পত্রবিনিময় থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম, যা থেকে সম্পাদক ও আমরা নিকট এটি স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান হয় যে অধ্যাপক ওয়েন আমার. পূর্বে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব প্রচারের দাবীদার। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত পুস্তকের অনুচ্ছেদগুলো থেকে যেটুকু বোঝা যায় (ঐ, খণ্ড ৩, পৃঃ ৭৯৮), তাতে মনে হয় আমি অংশতঃ অথবা সামগ্রিকভাবে আবার ভুল করেছি। এটি আমার পক্ষে সান্ত্বনাদায়ক যে অন্যান্যরা অধ্যাপক ওয়েনের বিতর্কিত লেখাগুলো বুঝতে ও মীমাংসা করতে আমার মতোই। অসমর্থ। কেবল প্রাকৃতিক নির্বাচন পদ্ধতির ঘোষণা বিষয়ে যতদূর বলা যায়, এটি সম্পূর্ণ অনাবশ্যক যে অধ্যাপক ওয়েন আমার পূর্ববর্তী ছিলেন কি ছিলেন না, কারণ আমাদের উভয়ের বহু পূর্বে ডঃ ওয়েলস্ এবং মি. ম্যাথিউ যে কথা বলেছিলেন তা এই ঐতিহাসিক রূপরেখায় বর্ণিত হয়েছে।
এম. ইসিডোরে জিওফ্রয় সেন্ট-হিলারে তার ১৮৫০ সালের বক্তৃতায় (যার সারসংকলন ১৮৫১ সালের জানুয়ারি মাসের ‘রিভিউ এট ম্যাগ, ডে জুলজ’-এ প্রকাশিত হয়েছিল) বলেছেন যে “প্রতিটি প্রজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খুবই দৃঢ় থাকে সেই পরিবেশের মধ্যে, যে পরিবেশের মধ্যে সে তার জীবনকে গড়ে তুলতে পেরেছে। কিন্তু যদি তাদের জীবদ্দশায় তাদের পরিবেশের মধ্যে কোনরকম পরিবর্তন আসে, তবেই তারা নিজেদের পরিবর্তন করে থাকে। পর্যবেক্ষণ করে যা দেখা গেছে তা সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে কিছু প্রজাতির পশুরা যথারীতি নিজেদের মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এইসব পর্যবেক্ষকদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেখা গেছে যে বন্য পশুকে গৃহপালিত পশু বা পোষমানানো পশুতে রূপান্তরিত করা যায়, অন্যদিকে পোষ মানানো পশুকে পুনরায় বন্য পশু বা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া যায়। এই একই অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে প্রমাণিত হয় যে বিভিন্ন গণগত বৈশিষ্ট্য প্রজাতিদের মধ্যে কোন অপরিবর্তনীয় স্বতন্ত্রতা গড়ে তোলে না।” তিনি তার হিস্ট, ন্যাচ. জেনারেল (খণ্ড ২, পৃঃ ৪৩০, ১৮৫৯) গ্রন্থে সদৃশ সিদ্ধান্তসমূহ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন।
দেরীতে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তি থেকে প্রতীয়মান হয় যে ১৮৫১ সালে ডঃ ফ্ৰেক (ডাবলিন মেডিক্যাল প্রেস, পৃঃ ৩২২) একটি তত্ত্বের প্রস্তাব করেছিলেন যে একটি আদিম প্রকার থেকে সমস্ত জীবের উদ্ভব হয়েছে। তার বিশ্বাসের কারণ ও বিষয়টির বর্ণনা আমার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা; কিন্তু যেহেতু ডঃ ফ্রেক ‘ জৈবিক সাদৃশ্য দ্বারা প্রজাতির উৎপত্তি’ নামে একটি রচনা এখন (১৮৬১) প্রকাশ করেছেন, তাই তার মতবাদের উপর কোন ধারণা দেওয়ার কষ্টকর চেষ্টা আমার পক্ষে নিষ্প্রয়োজন।
মিঃ হার্বার্ট স্পেনসার একটি প্রবন্ধে ( প্রথমে ১৮৫২ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত “লিডার পত্রিকায় এবং ১৮৫৮ সালে তাঁর রচনাবলীতে পুনঃপ্রকাশিত) জীবের সৃষ্টি ও ক্রমবিকাশের তত্ত্বসমূহ সম্বন্ধে অত্যন্ত দক্ষতা ও ক্ষমতার সঙ্গে বিপরীত মত প্রকাশ করেছেন। গৃহপালিত উৎপাদনের উপমা, অসংখ্য প্রজাতির সূণের পরিবর্তন, প্রজাতি ও ভ্যারাইটিদের পার্থক্য করার অসুবিধা এবং সাধারণ ক্রমোন্নতির সূত্র থেকে তিনি যুক্তি দেখান যে প্রজাতিরা রূপান্তরিত হয়েছে; এবং তিনি বলেন রূপান্তরগুলি পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য হয়েছে। ক্রমবিন্যাসের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় মানবিক ক্ষমতা ও সামর্থ্য অর্জনের নীতির উপর ভিত্তি করে মনোবিজ্ঞান আলোচনা করেছেন তিনি।
বিশিষ্ট উদ্ভিদবিজ্ঞানী এম. নডিন ১৮৫২ সালে প্রজাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে একটি চমৎকার গবেষণাপত্রে (রিভিউ হর্টিকোলে, পৃঃ ১৩২; তারপর ‘নউভেলেস আর্কাইভস ডু মিউজিয়াম, খণ্ড ১, পৃঃ ১৭১-এ অংশতঃ পুনঃপ্রকাশিত) স্পষ্টভাবে তার বিশ্বাস ব্যক্ত করেন যে গৃহপালনাধীনে ভ্যারাইটিরা যেভাবে সৃষ্ট হয়, সেই একই উপায়ে প্রজাতিগুলি সৃষ্ট হয়। পরবর্তী পর্যায়ে মানুষের নির্বাচনী ক্ষমতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তিনি। প্রকৃতিতে কেমন করে নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল হয় তা তিনি উল্লেখ করেন নি। ডিন হার্বার্টের মতো তিনিও বিশ্বাস করেন যে বর্তমানের তুলনায় জায়মান অবস্থায় প্রজাতিরা আরও নমনীয় ছিল। তার কথিত পরিণামের নীতির উপর অতিশয় গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি, “ একটি রহস্যময় শক্তি, যা তাদের অলক্ষ্য ও নিয়তি, এই প্রকৃতি তাদের দিয়ে সেইসব কাজ নিরবচ্ছিন্নভাবে করিয়ে নিচ্ছে যা তাদের জন্য নির্ধারিত। কোন্ পরিবেশে তারা বেড়ে উঠবে, কোন্ পরিবেশ তাদের পক্ষে উপযুক্ত, সে সবই নির্ধারণ করে থাকে প্রকৃতি। প্রকৃতির এই লীলাখেলাকে অনুসরণ করেই তাদের বেড়ে উঠতে হয়। প্রকৃতির এই রহস্যময়তার মধ্যেই তাদের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সাদৃশ্যজনিত আকারে বেড়ে ওঠে। যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির দ্বারা তাদের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়। প্রকৃতির এই রহস্যময় ঘূর্ণাবর্তে সাধারণ জীবকূলের সমস্ত রকম ক্রিয়া সম্পাদিত হয়ে থাকে এবং সেই একই কার্য তাদের শাবকদের উপরেও প্রযুক্ত হয়।” (৩)
১৮৫৩ সালে কাউন্ট কেইসারলিং নামে একজন ভূবিজ্ঞানী (বুলেটিন ডে লা সোস, জিয়ে!লাজ’, ২য় ক্রম, খণ্ড ১০, পৃঃ ৩৫৭) প্রস্তাব করেন যে যেমন নূতন রোগসমূহ, যা পৃতিবাপ দ্বারা সংঘটিত হয় বলে মনে হয়, উদ্ভূত হয়েছে এবং সারা পৃথিবীতে বিস্তৃত হয়েছে, সেইভাবে কোন যুগে বর্তমান প্রজাতিদের জীবাণু একটি বিশেষ পরিবেষ্টক অণুদের দ্বারা রাসায়নিকভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারে এবং নূতন আকার ধারণ করতে পারে।
ঐ একই বৎসরে, ১৮৫৩ সালে, ডঃ শ্যাফহাউসেন একটি চমৎকার পুস্তিকা প্রকাশ করেন, (ভারহ্যান্ড, ডেস ন্যাচারিস্ট ভেরেইনস্ ডার প্রিউস. রাইনল্যান্ডস, ইত্যাদি) যাতে তিনি পৃথিবীতে জৈব আকারগুলোর ক্রমবিকাশ উল্লেখ করেন। তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে অনেক প্রজাতি দীর্ঘদিনব্যাপী বিশুদ্ধ থাকে, পক্ষান্তরে কিছু প্রজাতি রূপান্তরিত হয়। মধ্যবর্তী ক্রমিক আকারগুলির ধ্বংসসাধন দ্বারা প্রজাতির পার্থক্য ব্যাখ্যা করেন তিনি। “এইভাবে নূতন সৃষ্টির দ্বারা অধুনালুপ্তদের থেকে জীবন্ত উদ্ভিদ ও প্রাণীরা পৃথক হয় না, কিন্তু এদেরকে অনবরত জননের মধ্য দিয়ে তাদেরই বংশধর হিসেবে গণ্য করা দরকার।”
সুপরিচিত ফরাসী উদ্ভিদবিজ্ঞানী এম. লেকক ১৮৫৪ সালে লেখেন (এটুডেস সুর জিয়োগ্রাফ.বট’, খণ্ড ১, পৃঃ ২৫০), “কিছু প্রজাতির পশুদের পরস্পরের মধ্যে যে স্বতন্ত্রতা থাকে তা তাদের মন বা ধারণার স্বতন্ত্রতার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে– এই ধারণা আমরা দুই বিখ্যাত মণীষী জিওফ্রয় সেন্ট হিলারে ও গেটের গবেষণা থেকে যথারীতি লাভ করেছি।” এম. লেখকের বিশাল গ্রন্থের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা কয়েকটি অনুচ্ছেদে প্রজাতির রূপান্তর সম্বন্ধে তাঁর মতবাদ কিছু সন্দেহ জাগায়।
১৮৫৫ সালে প্রকাশিত “জগতের ঐক্যসংক্রান্ত প্রবন্ধসমূহ’-তে রেভারেণ্ড ব্যাডেন পাওয়েল সৃষ্টির দর্শন’ অতি সুনিপুণভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। নতুন প্রজাতির প্রবর্তন “একটি নিয়মিত অথচ আকস্মিক ঘটনা নয়” এটি তিনি যেভাবে দেখিয়েছেন তার তুলনায় আর কোন কিছুই অধিকতর চিত্তাকর্ষক হতে পারে না।
‘লিনিয়ান সোসাইটির জার্নাল’-এর তৃতীয় খণ্ডে মিঃ ওয়ালেস ও আমার রচিত এবং ১৮৫৮ সালের ১লা জুলাই তারিখে পঠিত গবেষণাপত্রে, যা এই খণ্ডের ভূমিকায় বলা হয়েছে, মি. ওয়ালেস প্রশংসনীয় দক্ষতায় এবং স্পষ্টভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব উপস্থাপিত করেছেন।
ভন বেয়ার, যার প্রতি সমস্ত প্রাণীবিজ্ঞানীরা অগাধ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন, ১৮৫৯ সালে (দ্রষ্টব্য, অধ্যাপক রুডলফ ওয়াগনার ‘জুলজিশ্চ-অ্যানথ্রপলজিশ্চ উণ্টারসুচাঙ্গেন’, ১৮৬১, পৃঃ ৫১) মূলতঃ ভৌগলিক শ্রেণীবিভাগের নিয়মাবলীর উপর ভিত্তি করে দৃঢ় বিশ্বাস প্রকাশ করেছিলেন যে নিখুঁতভাবে পৃথক বর্তমান আকারগুলি একটি পিতামাতা আকার থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
১৮৫৯ সালের জুন মাসে অধ্যাপক হালে ‘প্রাণীজীবনের স্থায়ী নমুনা’-র উপর রয়্যাল ইনস্টিউশনে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। এই সব ঘটনার উল্লেখ করে তিনি মন্তব্য করেন, “এ সবের মতো এইরূপ বিষয়গুলির অর্থ বোঝা কষ্টকর যদি আমরা মনে করি প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজাতি অথবা প্রতিটি জৈবসংগঠন দীর্ঘকালের ব্যবধানে পৃথিবীপৃষ্ঠে সৃজনশীল ক্ষমতার একটি স্বতন্ত্র প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট ও প্রবর্তিত হয়েছিল; এবং স্মরণ করা ভাল যে এরকম একটি ধারণা ঐতিহ্য বা প্রত্যাদেশ দ্বারা অসমর্থিত, যেহেতু এটি, প্রকৃতির সাধারণ উপমার বিরোধ। অন্যদিকে, যদি ঐ প্রকল্প সম্বন্ধীয় স্থায়ী নমুনাদের আমরা পর্যবেক্ষণ করি, যেটির মতে যে কোন সময়ে জীবিত প্রজাতিরা পূর্বে অবস্থিত প্রজাতিদের ক্রমিক রূপান্তরের পরিণাম, প্রকল্পটি যদিও অপ্রমাণিত ও এর কিছু সমর্থকের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত, তবুও কেবলমাত্র এটিই শারীরতত্ত্বের দ্বারা সমর্থিত হয়; এদের অবস্থান সম্ভবত দেখায় যে বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক যুগে সংঘটিত জীবন্ত জীবের রূপান্তরের পরিমাণ সমগ্র পরিবর্তনের তুলনায় অত্যন্ত কম।
১৮৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ডঃ হুঁকার ‘অস্ট্রেলিয়ার ফ্লোরার ভূমিকা’ প্রকাশ করেন। এই বিরাট গ্রন্থের প্রথমাংশে তিনি প্রজাতির উদ্ভব ও রূপান্তর স্বীকার করেছেন এবং অনেক মৌলিক পর্যবেক্ষণ দ্বারা এই তত্ত্ব সমর্থন করেছেন।
.
ভূমিকা
আমি যখন এইচ. এম. এস. ‘বিগ্ল’ জাহাজে চড়ে প্রকৃতিবিজ্ঞানী হিসাবে পরিভ্রমণ করেছিলাম, তখন দক্ষিণ আমেরিকায় বসবাসকারী জীবগুলির বিস্তার এবং ঐ মহাদেশে বর্তমান ও অতীতে বসবাসকারী জীবদের ভূতাত্ত্বিক সম্পর্ক লক্ষ্য করে কয়েকটি ঘটনায় রীতিমতো অভিভূত হয়েছিলাম। এই সব তথ্য, এই গ্রন্থের পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে দেখা। যাবে, মনে হয়েছিল প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কেও কিছু আলোকপাত করবে–যেমন আমাদের বিখ্যাত দার্শনিকদের মধ্যে একজন বলেছেন, রহস্যের মধ্যে রহস্য। ১৮৩৭ সালে গৃহে প্রত্যাবর্তনের পরে আমার মনে হয়েছিল, সমস্ত সংগৃহীত তথ্য গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এগুলি প্রশ্নটি সম্বন্ধে হয়তো কিছু আলোকপাত করতে পারে। পাঁচ বছর গবেষণার পর আমি বিষয়টির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্বন্ধে অনুমান করতে শুরু করেছিলাম এবং ছোট ছোট টীকার খসড়া তৈরি করেছিলাম, যা তখন। আমার নিকট সম্ভবপর বলে মনে হয়েছিল। সেইদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি একই বিষয় অবিচলভাবে অন্বেষণ করেছি। আশা করি এই সমস্ত ব্যক্তিগত বর্ণনার জন্য আমাকে ক্ষমা করা যেতে পারে, কারণ এই সিদ্ধান্ত আসার জন্য আমি হঠকারী হইনি।
আমার গবেষণা এখন (১৮৫৯) প্রায় শেষ। কিন্তু যেহেতু এটি শেষ করতে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে এবং আমার স্বাস্থ্য মোটেই ভাল নয়, তাই এই সারসংগ্রহ প্রকাশ করাতে আমাকে অনুরোধ করা হয়েছে। আমি বিশেষভবে এটি প্রস্তুত করতে প্রবৃত্ত হয়েছি, যেহেতু মিঃ ওয়ালেস, যিনি এখন মালয় দ্বীপপুঞ্জের প্রাকৃতিক ইতিহাস অনুশীলন করছেন, প্রজাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে আমার সিদ্ধান্তের মতো প্রায় একই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছেন। ১৮৫৮ সালে এই বিষয়ের উপর তিনি আমাকে একটি স্মারক বিবরণ পাঠিয়েছিলেন এবং অনুরোধ করেছিলেন যেন আমি সেটি চার্লস লিয়েলের নিকট পাঠাই। তিনি সেটি লিনিয়ান সোসাইটিতে পাঠান এবং বিবরণটি ঐ সোসাইটির জার্নালের তৃতীয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়। স্যার সি. লিয়েল ও ডঃ হুঁকার উভয়েই আমার গবেষণা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন-শেষের জন ১৮৪৪ সালে আমার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পড়েছিলেন–এবং তারা মি. ওয়ালেসের উৎকৃষ্ট স্মারক বিবরণের সঙ্গে আমার পাণ্ডুলিপির কয়েকটি সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি প্রকাশ করার কথা চিন্তা করে আমাকে সন্মানিত করেন।
বর্তমানে আমি যে সারসংগ্রহ প্রকাশ করছি তা অবশ্যই অসম্পূর্ণ। আমার কয়েকটি বক্তব্যের জন্য প্রামাণ্য গ্রন্থাদির বিশেষ অংশ ও বিশেষজ্ঞদের নাম উল্লেখ করতে আমি অক্ষম। আশা করি পাঠকরা আমার নিখুঁততায় আস্থা স্থাপন করবেন। ভুল অবশ্য হতেই। পারে, যদিও সর্বদাই আমি শুধুমাত্র বিচক্ষণ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যকেই গুরুত্ব দিয়েছি। ব্যাখ্যা সমেত কয়েকটি উদাহরণের সঙ্গে উপনীত আমার কিছু সাধারণ সিদ্ধান্তই শুধু উল্লেখ করতে পারি, তবে আমি আশা করি সেগুলোই যথেষ্ট। পূর্বসূত্রের উল্লেখ সমেত, সমস্ত তথ্যের পূর্ণ বর্ণনা, যেগুলো আমার সিদ্ধান্তের ভিত্তি, সেগুলো প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা আমার থেকে কেউই বেশি অনুভব করছেন না। আশা করি ভবিষ্যতে আমি এ কাজটি করব। কারণ আমি ভালভাবেই অবগত আছি যে এই গ্রন্থে এমন একটি বিষয়ও আলোচিত হয়নি যার কোন প্রমাণ উল্লেখ করা যেতে পারে না, যার থেকে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় যা আমার উপনীত সিদ্ধান্তের সরাসরি বিরোধী। প্রত্যেক প্রশ্নের উভয় দিকের তথ্য ও যুক্তিগুলির পূর্ণ বর্ণনা এবং সমতা রক্ষার দ্বারা ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু এখানে তা অসম্ভব।
আমি অতিশয় দুঃখিত যে, যে সমস্ত প্রকৃতিবিদের কাছ থেকে উদার সাহায্য লাভ করেছি স্থানাভাবে তাদের কাছে আমার ঋণস্বীকার সম্ভব হচ্ছে না, এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে আমার অপরিচিত। ডঃ হুঁকার, যিনি গত পঞ্চাশ বছর ধরে তার অগাধ জ্ঞানভাণ্ডার ও অপূর্ব বিচারশক্তির দ্বারা আমাকে সর্ববিধ সাহায্য করেছেন, তাঁর প্রতি আমার গভীর কৃতজ্ঞতা স্বীকারের এই সুযোগ আমি হারাতে পারি না।
প্রজাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে সবকিছু বিবেচনা করে, এটি সম্পূর্ণ বোধগম্য হয় যে একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী জীবদের পারস্পরিক সম্বন্ধ, ভূণ সম্বন্ধীয় সম্পর্ক, তাদের ভূ বিস্তারণ, ভূতাত্ত্বিক পর্যায় এবং অন্য সব তথ্য বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে আসতে পারতেন যে প্রজাতিরা স্বাধীনভাবে সৃষ্টি হয় নি, বরং ভ্যারাইটিদের মতো অন্য প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। তা সত্ত্বেও এরূপ একটি সিদ্ধান্ত সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও অসন্তোষজনক হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না দেখানো যায় যে এই পৃথিবীতে বসবাসকারী অসংখ্য প্রজাতি রূপান্তরিত হয়ে থাকবে, এটি অর্জন করার জন্য যে গঠনের উৎকর্ষতা এবং সহ অভিযোজন প্রয়োজন তা সঙ্গতভাবেই আমাদের বিস্ময় উদ্রেক করে। প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা অনবরত পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কথা উল্লেখ করেন, যথা আবহাওয়া, খাদ্য ইত্যাদি যেগুলি পরিবৃত্তির সম্ভাব্য একমাত্র কারণ। একটি সীমিত অর্থে যা আমরা এখন থেকে পর্যবেক্ষণ করব তা সত্য হতে পারে; কিন্তু, উদাহরণস্বরূপ, গাছের ছালে পোকামাকড় ধরার জন্য পায়ের পাতা, লেজ, ঠোঁট ও জিভ সমেত কাঠঠোকরার দেহগঠন এত সুন্দরভাবে অভিযোজিত যে তার কারণ কেবলমাত্র পারিপার্শ্বিক অবস্থায় আরোপ করা ভ্রমাত্মক হবে। মিলটো পরাশ্রয়ী গুল্মগাছের ক্ষেত্রে, যা অন্য গাছের থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে, তার একটি ফুল থেকে অন্য ফুলে পরাগ বহন করার জন্য কোন কোন পতঙ্গ কে মাধ্যম হিসাবে অবশ্যই প্রয়োজন হয়; পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাবের দ্বারা, বা স্বভাবের, বা উদ্ভিদের ইচ্ছাশক্তির দ্বারা কয়েকটি স্বতন্ত্র জীবের সম্পর্ক সমেত এই পরজীবীর দেহগঠনকে বিচার করা একইরকম ভ্রমাত্মক।
অতএব রূপান্তরের উপায়গুলি এবং সহ-অভিযোজনের মর্ম উপলব্ধি করা একান্তই প্রয়োজন। আমার পর্যবেক্ষণের প্রারম্ভে এটি সম্ভবপর বলে মনে হয়েছিল যে গৃহপালিত প্রাণী ও আবাদী উদ্ভিদদের যত্নপূর্বক পর্যবেক্ষণ এই দুর্বোধ্য সমস্যার সমাধানে ভাল ফল প্রদান করবে। তাতে আমি হতাশও হইনি; এক্ষেত্রে এবং অন্যান্য সমস্ত জটিল ক্ষেত্রে আমি নিয়তই দেখেছি যে আমাদের জ্ঞান অসম্পূর্ণ হলেও গৃহপালনাধীন অবস্থায় পরিবৃত্তি (variation) সম্পর্কে আমাদের সর্বোত্তম ও নিরাপদ সূত্র প্রদান করেছে। এ ধরনের পর্যবেক্ষণের প্রতি আমার দৃঢ় বিশ্বাস প্রকাশ করার সাহস আমি রাখি, যদিও প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের কাছে এগুলো সাধারণভাবে অবজ্ঞাতই রয়েছে।
এগুলো বিচার-বিবেচনা করেই, এই সংক্ষিপ্ত বিবরণের প্রথম অধ্যায়ে গৃহপালনাধীনে পরিবৃত্তির উপর মনোনিবেশ করব আমি। এইরূপে আমরা দেখব যে বহুপরিমাণে বংশগত রূপান্তর সম্ভবপর এবং সমভাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ হল আনুক্রমিক অল্প অল্প পরিবৃত্তিসমূহকে নির্বাচন দ্বারা সঞ্চয় করার ব্যাপারে মানুষের প্রচণ্ড ক্ষমতা। এরপর প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রজাতিদের পরিবৃত্তি সম্পর্কে মনোনিবেশ করব আমি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি এই বিষয়টি সংক্ষেপে বিবেচনা করতে বাধ্য হব, যদিও তথ্যসমূহের দীর্ঘ তালিকা প্রদান করেই এগুলোর সত্যতা অনুধাবন করা সম্ভব। তবে পরিবৃত্তির পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল অবস্থাটা কী, তা আমরা আলোচনা করতে সমর্থ হব।
পরবর্তী অধ্যায়ে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী সমস্ত জীবের মধ্যে জীবনসংগ্রাম প্রসঙ্গে আলোচনা করা হবে, যা এদের বৃদ্ধির উচ্চ জ্যামিতিক হার থেকে অনিবার্যভাবে অনুসৃত হয়। সমগ্র প্রাণী ও উদ্ভিদজগতে আরোপিত এটাই হচ্ছে ম্যালথাস তত্ত্ব। বেঁচে থাকার সম্ভাবনার তুলনায় প্রত্যেক প্রজাতির আরও অসংখ্য একক জন্মায়, এবং পরিণতিতে বাঁচার জন্য প্রায়শঃই পৌনঃপুনিক সংগ্রাম চলে। এর অর্থ হল–জীবনের জটিল ও কোন কোন সময় পরিবর্তিত জীবন-অবস্থায় যে কোন জীবের অল্প পরিবর্তন হলেও যদি তা লাভজনক হয়, তাহলে সেটির বেঁচে থাকার অধিকতর সম্ভাবনা থাকবে এবং এভাবে প্রকৃতিগতভাবে নির্বাচিত হবে। বংশানুসৃতির কঠোর নিয়মানুসারে, যে কোন নির্বচিত প্রকার তার নূতন ও রূপন্তরিত আকারে বংশবিস্তার করতে সমর্থ হবে।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের এই মৌলিক বিষয়টি চতুর্থ অধ্যায়ে সবিস্তারে আলোচিত হবে। তখন আমরা দেখব প্রাকৃতিক নির্বাচন কেমন করে জীবনের কম উন্নত আকারদের অথবা জাতদের প্রায় অনিবার্যভাবে বিলুপ্তি ঘটায় এবং সেইদিকে প্ররোচিত করে, যাকে আমি বৈশিষ্ট্যের কেন্দ্ৰাপসারণ বলি। পরবর্তী অধ্যায়ে পরিবৃত্তির জটিল ও অল্পজ্ঞাত নিয়মগুলো আলোচনা করব। পরবর্তী পাঁচটি অধ্যায়ে তত্ত্বটিকে স্বীকার করার পক্ষে সবথেকে স্পষ্ট ও জটিল সমস্যাগুলো আলোচিত হবে: যথা, প্রথমতঃ, অবস্থান্তরের অসুবিধাসমূহ, অথবা একটি সরল জীব এবং একটি সরল অঙ্গ কেমন করে একটি উচ্চ বিকশিত জীবে অথবা সুগঠিত অঙ্গে পরিবর্তিত অথবা নিখুঁত হতে পারে; দ্বিতীয়তঃ, সহজাত প্রবৃত্তির বিষয়টি অথবা প্রাণীদের মানসিক ক্ষমতা; তৃতীয়তঃ, সঙ্করণ অথবা আন্তঃসঙ্করণের পর প্রজাতিদের অনুর্বরতা ও প্রকারদের উর্বরতা; চতুর্থতঃ, ভূতাত্ত্বিক রেকর্ডের অসম্পূর্ণতা। পরবর্তী অধ্যায়ে সর্বকালের জীবের ভূতাত্ত্বিক অনুগমন বিবেচনা করা হবে। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ অধ্যায়ে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী এদের ভৌগলিক বিস্তার; চতুর্দশ অধ্যায়ে এদের শ্রেণীবিভাগ বা পরিণত ও ভূণাবস্থায় এদের পারস্পরিক সম্পর্কসমূহ; সর্বশেষ অধ্যায়ে সমগ্র গবেষণার সারসংক্ষেপ ও কয়েকটি উপসংহারমূলক মন্তব্য উপস্থিত করব আমি।
প্রজাতি ও ভ্যারাইটিদের উৎপত্তি সম্বন্ধে এমন অনেক কিছুই অব্যাখ্যাত রয়েছে যে তার জন্য কারুর আশ্চর্যান্বিত হওয়া উচিত হবে না, যদি তিনি আমাদের চতুষ্পার্শ্বের জীবদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে আমাদের গভীর অজ্ঞতা স্বীকার করেন। কেন। একটি প্রজাতি অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ও সংখ্যাধিক হয়, এবং কেন সম্বন্ধযুক্ত অন্য প্রজাতির বিস্তার সংকীর্ণ ও বিরল হয়, কে তা ব্যাখ্যা করতে পারে? তথাপি এই সম্পর্কগুলো অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমার বিশ্বাস এই পৃথিবীর প্রত্যেক অধিবাসীর বর্তমান কল্যাণ ও ভবিষ্যৎ সাফল্য এবং তার রূপান্তর এরাই নির্ধারণ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে বিগত বহু ভূতাত্ত্বিক যুগের সময় এই গ্রহে বসবাসকারী অসংখ্য অধিবাসীদের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে এখনও আমরা যথেষ্ট কম জানি। যদিও অনেক কিছুই অস্পষ্ট রয়েছে এবং দীর্ঘদিন অস্পষ্ট থাকবে, তবু সবিশেষ অনুশীলন এবং পক্ষপাতহীন বিচার-বিশ্লেষণের পর আমি এই মত পোষণ করতে পারি যে মতবাদটি, যা সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত অধিকাংশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী পোষণ করেন এবং যা আমি পূর্বে পোষণ করতাম–যথা, প্রত্যেক প্রজাতি স্বাধীনভাবে সৃষ্ট হয়েছে–তা ভ্রমাত্মক। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে প্রজাতিরা অপরিবর্তনশীল নয়; আরও বিশ্বাস করি যে একই গণের অন্তর্গত প্রজাতিরা অন্য কোন এবং সাধারণতঃ বিলুপ্ত প্রজাতির বংশধর, একইভাবে যে কোন একটি প্রজাতির স্বীকৃত ভ্যারাইটিরা ঐ প্রজাতিটির বংশধর। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি প্রাকৃতিক নির্বাচনই হচ্ছে রূপান্তরের পদ্ধতিসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু একমাত্র পদ্ধতি নয়।
————-
১। অ্যারিস্টটল তার ‘Physicae Auscultationes (lib2.cap.8.s.2) গ্রন্থে শস্য ফলবার জন্য বৃষ্টি হয় না, এই মন্তব্য করে জীবের ক্ষেত্রে একই যুক্তি প্রয়োগ করেন; এবং বলেন (যেমন মিঃ ব্লেয়ার গ্রেসে অনুবাদ করেছিলেন, এবং যিনি রচনাংশটি সম্পর্কে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন), “প্রকৃতিতে (শরীরের) বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ গুলির আকস্মিক সম্পর্ক থাকার বাধা কোথায়? যেমন দাঁতগুলি প্রয়োজনের জন্য বিকশিত হয়, সামনেরগুলি তীক্ষ্ণ ও ছেদনের জন্য অভিযোজিত এবং পেষকগুলি চেপ্টা ও খাবার চেবানোর উপযোগী; এই সব কাজের জন্য এদের সৃষ্টি হয়নি, বরং এটা দৈবক্রমে ঘটেছিল। অন্য প্রত্যঙ্গগুলি সম্পর্কেও এই নিয়ম প্রযোজ্য, এবং পরিশেষে অভিযোজনের অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয়। যে কোন স্থানেই হোক না কেন, সমস্ত জিনিসগুলি (একটি সমগ্রের বিভিন্ন অংশগুলি) একত্রে ঘটেছিল যেন এরা কোন কিছুর জন্য সৃষ্টি হয়েছিল, আভ্যন্তরীণ স্বতঃপ্রবৃত্ততার দ্বারা যথোচিতভাবে স্থাপিত হয়ে এগুলি সংরক্ষিত হয়েছিল; এবং যেকোন স্থানেই হোক না কেন, জিনিসগুলি এইরূপে স্থাপিত না হওয়ার জন্য ধ্বংস হয়ে গেছে এবং হচ্ছে।” এখানে প্রাকৃতিক নির্বাচন সূত্রটি অদৃশ্যভাবে অনুসৃত হয়েছিল দেখেছি। হাতের গঠনের ওপর তার মন্তব্য থেকে এই বিষয়ে অ্যারিস্টটলের ধারণা কত সীমিত ছিল তা বোঝা যায়।
২। ইসিডোর জিওফ্রয় সেন্ট-হিলারের (হিস্ট্রি ন্যাচ, জেনারালে’, খণ্ড ২, পৃঃ ৪০৫, ১৮৫৯) এই বিষয়ের ওপর মতবাদগুলির চমৎকার ইতিহাস থেকে আমি নামাৰ্কের রচনার প্রথম প্রকাশের তারিখটি গ্রহণ করেছি। এই বিষয়ের ওপর বুফনের সিদ্ধান্তসমূহের একটি পূর্ণ তালিকা এই গ্রন্থে দেওয়া হয়েছে। এটি কৌতূহলোদ্দীপক যে কেমন করে আমার পিতামহ ডঃ ইরাসমাস ডারউইন ১৭৯৪ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘জুনোমিয়া’ (খণ্ড ১, পৃঃ ৫০০-৫১০)-তে লামার্কের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমতসমূহের ভ্রমাতৃক যুক্তিগুলি পূর্বেই বহুলাংশে উপলব্ধি করেছিলেন। ইসিডোর জিওফ্রয়-এর মতানুসারে, গেটে নিঃসন্দেহে অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গির অতিশয় অনুগামী ছিলেন, যেমনটা ১৭৯৪ ও ১৭৯৫ সালে লিখিত কিন্তু দীর্ঘদিন পর্যন্ত অপ্রকাশিত, তার বই এর ভূমিকায় দেখা যায়। তিনি স্পষ্টভাবে মন্তব্য করেছেন (গেটে আলস্ নেচারফস্টার, ভন ডঃ কার্ল মেডিং, এস ৩৪) যে প্রকৃতিবিদদের কাছে ভবিষ্যতের প্রশ্নটি হবে, উদাহরণস্বরূপ, কেমন করে গো-মহিষাদিরা তাদের শিঙের অধিকারী হয়, কীভাবে তা ব্যহহৃত হয় সে প্রশ্ন নয়। এটি বরং একটি উপায়ের উৎকৃষ্ট উদাহরণ যাতে অনুরূপ মতবাদ প্রায় একই সময়ে উদ্ভব হয়, যে জার্মানিতে গেটে, ইংল্যান্ডে ডঃ ডারউইন এবং ফ্রান্সে জিওফ্রয় সেন্ট-হিলারে (যেমন আমরা এখন দেখব) প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে ১৭৯৪-১৭৯৫ সালে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হন।
৩। ব্রনের ‘আন্টারসূচন জেন ইউবার ডাই এণ্টউকেলাঙ্গস-গেজেটজে উল্লেখ থেকে প্রতীয়মান হয় যে প্রসিদ্ধ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও জীবাশ্মবিদ উনগার ১৮৫২ সালে বলেছিলেন যে প্রজাতিরা ক্ৰমবিকশিত ও রূপান্তরিত হয়। এইরূপে ডাল্টন, জীবাশ্ম শ্লথের উপর প্যাণ্ডার এবং ডাল্টনের ১৮২১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থে একটি বিশ্বাস উপস্থাপিত হয়েছিল। সকলেই জানেন, ওকেন তার রহস্যময় ‘নেচার ফিলসফি’ গ্রন্থে একই মত ব্যক্ত করেছিলেন, গড্রনের সুর এল’ এসপেসে’ গ্রন্থের উল্লেখ থেকে মনে হয় রবিসেণ্ট ভিনসেন্ট, বুড্যাক, পয়রেট এবং ফ্রাইস সকলেই স্বীকার করেছেন যে নূতন প্রজাতি অনবরত সৃষ্টি হচ্ছে। আমি যোগ করতে পারি যে এই ঐতিহাসিক রূপরেখায় উল্লিখিত ৩৪ জন লেখকের মধ্যে, যাঁরা প্রজাতির রূপান্তরে বিশ্বাস করেন বা অন্ততঃ সৃষ্টির পৃথক প্রক্রিয়া অবিশ্বাস করেন, ২৭ জন প্রাকৃতিক ইতিহাস অথবা ভূবিদ্যার বিশেষ শাখাগুলির উপর লিখেছেন।
০১. গৃহপালনাধীনে পরিবৃত্তি
প্রথম অধ্যায় – গৃহপালনাধীনে পরিবৃত্তি
পরিবৃত্তির কারণ–স্বভাবের প্রভাব এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবহার অথবা অব্যবহার–পরস্পর সম্পর্কযুক্ত পরিবৃত্তি বংশানুসৃতি–গৃহপালিত নানা প্রকার ভ্যারাইটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য–নানা প্রকার ভ্যারাইটি ও প্রজাতিদের মধ্যে বিভিন্নতা নির্দিষ্ট করার অসুবিধা–এক বা একাধিক প্রজাতি থেকে গৃহপালিত বিভিন্ন ভ্যারাইটির–উৎপত্তি গৃহপালিত পায়রা, এদের পার্থক্য ও উৎপত্তি– প্রাচীন যুগ থেকে অনুসৃত নির্বাচন পদ্ধতি, এদের ফলাফল–নিয়মানুযায়ী এবং অচেতন নির্বাচন–আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনগুলির অজানা উৎপত্তিরসূত্র—মানুষের নির্বাচন শক্তির অনুকূল পরিবেশ।
.
পরিবৃত্তির কারণসমূহ
আমাদের কর্ষিত (আবাদী) উদ্ভিদ ও গৃহপালিত প্রাণীদের একই ভ্যারাইটি অথবা। উপ-ভ্যারাইটিদের এককগুলোর তুলনা করার সময় প্রথম যে বিষয়টি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হচ্ছে প্রাকৃতিক অবস্থায় স্থিত যে কোন প্রজাতি অথবা ভ্যারাইটির এককগুলোর তুলনায় এরা পরস্পরের থেকে অধিকতর পৃথক। অতিশয় ভিন্ন আবহাওয়া ও পরিবেশে সমস্ত যুগ জুড়ে পরিবর্তিত হওয়া কৰ্ষিত ও গৃহপালিত উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের বৈচিত্র্যসমূহ বিবেচনা করলে আমরা সিদ্ধান্ত করতে বাধ্য হই যে এই অতি প্রকারণ বা বিভিন্নতা প্রাকৃতিক অবস্থায় অবস্থান রত পিতামাতা প্রজাতির তুলনায় পৃথক ও ভিন্ন অসমরূপ পরিবেশে উদ্ভূত আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনসমূহের জন্য হয়। অ্যাণ্ডু নাইটের মতে, এই প্রকারণ বা বিভিন্নতা অংশতঃ অধিক খাদ্য গ্রহণের জন্য হতে পারে। স্পষ্টতঃ মনে হয় যে পরিবৃত্তির যে কোন বিরাট পরিমাণ ঘটাতে গেলে কয়েক বংশপরম্পরায় নূতন পরিবেশে জীবদের অবশ্যই রাখতে হবে। এবং যখন জীবরা পরিবর্তিত হতে শুরু করে, তখন এই পরিবর্তন সাধারণতঃ বংশপরম্পরায় ঘটতে থাকে। পরিবর্তনশীল জীবের গৃহপালনাধীন অবস্থায় পরিবর্তন বন্ধ হয়েছে এমন কোন রেকর্ড নেই। আমাদের প্রাচীনতম আবাদী উদ্ভিদের মধ্যে গমের ক্ষেত্রে এখনও নূতন ভ্যারাইটি বা জাত সৃষ্টি হয়ে চলেছে। আমাদের গৃহপালিত প্রাণীরাও দ্রুত উৎকর্ষলাভ অথবা রূপান্তরে এখনও সমর্থ।
দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি সম্পর্কে অনুশীলনের পর আমার মনে হয়েছে এই জীবনাবস্থা দু-ভাবে কাজ করে–প্রত্যক্ষভাবে সমগ্র জীব সংগঠনের ওপর অথবা কেবল কোন প্রত্যঙ্গের ওপর এবং অপত্যক্ষভাবে জননেন্দ্রিয়কে প্রভাবিত করে। প্রত্যক্ষ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমরা নিশ্চয় মনে রাখব যে প্রত্যেক ক্ষেত্রে দুটি উপাদান রয়েছে, যেমন অধ্যাপক ভাইসম্যান ইদানিং দৃঢ়তা সহকারে বলেছেন এবং আমি যেমন ‘গৃহপালনাধীন পরিবৃত্তি’ নামক গবেষণামূলক কাজে প্রাথমিকভাবে দেখিয়েছি। উপাদান দুটি হচ্ছে জীবের প্রকৃতি ও পরিবেশের বৈশিষ্ট্য। পূর্বেরটি সম্ভবতঃ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যতদূর আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারি তাতে মনে হয় অসদৃশ পরিবেশে কোন কোন সময় সদৃশ পরিবৃত্তির উদ্ভব ঘটে এবং বিপরীতক্রমে প্রায়-সদৃশ বলে মনে হয় এমন পরিবেশে অসদৃশ পরিবৃত্তির উদ্ভব হয়, বংশধরদের ওপর এর প্রভাব কখনও নির্দিষ্ট, কখনওবা অনির্দিষ্ট। নির্দিষ্ট হিসেবে এটি বিবেচিত হতে পারে যখন কয়েক বংশপরম্পায় কোন নির্দিষ্ট পরিবেশের প্রভাবাধীন এককদের সব বা প্রায় সব বংশধররা একইভাবে রূপান্তরিত হয়। এরূপে নির্দিষ্টভাবে প্রবর্তিত পরিবর্তনের সীমা সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অত্যন্ত কষ্টকর। তবে, অনেক অল্প পরিবর্তন সম্বন্ধে খুব একটা সন্দেহ থাকত না, যেমন খাদ্যের পরিমাণ থেকে আকার, খাদ্যের বৈশিষ্ট্য থেকে বর্ণ, আবহাওয়া বা জলবায়ু থেকে চামড়া ও রোমের বেধ ইত্যাদি। মোরগ-মুরগীদের পালকগুলোকেও আমাদের দেখা সীমাহীন প্রকারণগুলোর প্রত্যেকটি কোন না কোন উপযুক্ত কারণের জন্য হয়ে থাকবে; এবং অনেক এককের ওপর দীর্ঘ বংশপরম্পায় একই কারণ ক্রিয়াশীল হলে সকলে সম্ভবতঃ সমরূপেই রূপান্তরিত হত। গল (gall) সৃষ্টিকারী একটি কীটের দ্বারা বিন্দুর আকারে বিষ প্রবেশ করানোর সাহায্যে উৎপন্ন জটিল ও অসাধারণ উপবৃদ্ধিগুলো সমেত এরূপ তথ্য আমাদের দেখায়-উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে প্রাণরসের বৈশিষ্ট্যে একটি রাসায়নিক পরিবর্তন থেকে কী অনন্য রূপান্তর ঘটে থাকে।
নির্দিষ্ট পরিবৃত্তির তুলনায় পরিবর্তিত পরিবেশে অনির্দিষ্ট পরিবৃত্তি আরও অনেক বেশি ফলদায়ক এবং সম্ভবতঃ আমাদের জাতগুলো সৃষ্টিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমরা সীমাহীন অল্প অল্প বৈশিষ্ট্যগুলোতে সুনির্দিষ্ট পরিবৃত্তি দেখি, যা একই প্রজাতির এককদের পৃথক করে এবং যাকে উভয় পিতামাতার যে কোন একটি অথবা আরও দূরবর্তী কোন পূর্বপুরুষের থেকে বংশানুসৃতির দ্বারা বিচার করা যাবে না। এমনকি সুচিহ্নিত পার্থক্যগুলো একই বংশধরের শাবকে এবং একই বীজাধার থেকে চারাগাছে হঠাৎ আবির্ভূত হয়। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে, একই দেশে লালিত-পালিত ও একই ধরনের খাদ্য খাওয়ানোর ফলে লক্ষ লক্ষ এককে দেহগঠনের বিচ্যুতি এত ব্যাপক ও সুস্পষ্ট যে এদের অঙ্গবিকৃতি হয়েছে বলে মনে করা হয়। স্বল্পতর পরিবৃত্তি থেকে অঙ্গবিকৃতিগুলোকে কোন স্বতন্ত্র রেখার দ্বারা পৃথক করা যায় না। অতি অল্প বা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত দেহগঠনের এইসব পরিবৃত্তি, যা একত্রে বসবাসকারী অনেক এককে আবির্ভূত হয়, প্রত্যেক একক জীবের ওপর জীবন-পরিবেশের অনির্দিষ্ট প্রভাব হিসেবে বিচার করা যেতে পারে। প্রায় একই পদ্ধতিতে দেহের গঠনবিন্যাস বা ধাত অনুসারে বিভিন্ন মানুষকে অনির্দিষ্টভাবে শৈত্য প্রভাবিত করে, যার ফলে ঠাণ্ডা লাগে সর্দি ও বাতরোগ হয় এবং বিভিন্ন অঙ্গের প্রদাহ ঘটে।
পরিবর্তিত পরিবেশের অপ্রত্যক্ষ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমি যা বলেছি অর্থাৎ জননতন্ত্র প্রভাবিত হওয়ার মধ্য দিয়ে, তা থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে অংশতঃ প্রকারণ এভাবে ঘটে, অংশতঃ পরিবেশের যে কোন পরিবর্তনে এই তন্ত্রের অতি সংবেদনশাল হওয়া থেকে এবং অংশতঃ, যেমন কোয়েলরয়টার ও অন্যরা বলেছেন, প্রকারণের মধ্যে সদৃশতা থেকে, যা স্বতন্ত্র প্রজাতির সঙ্করণের ফলে ঘটে এবং নতুন বা অস্বাভাবিক পরিবেশে লালিত-পালিত উদ্ভিদ ও প্রাণীদের ক্ষেত্রে যা দেখা যেতে পারে। অনেক তথ্য স্পষ্ট করে দেখায় পারিপার্শ্বিক পরিবেশের অতি অল্প পরিবর্তনে জননতন্ত্র কত বিপুলভাবে সংবেদনশীল হয়। একটি প্রাণীকে পোষ মানানোর থেকে সোজা আর কিছুই নয় এবং আটক অবস্থায় অবাবে সন্তান উৎপাদন করানোর থেকে কঠিন আর কিছুই নয়, এমনকি যখন স্ত্রী-পুরুষ মিলিত হয় তখনও। স্বদেশে মুক্তাবস্থায় রাখা সত্ত্বেও বহু সংখ্যক প্রাণী আছে যারা সন্তানসন্ততি উৎপাদন করতে পারে না! এটিকে সাধারণতঃ, কিন্তু ভুলবশতঃ, ত্রুটিপূর্ণ সহজাত প্রবৃত্তির ওপর আরোপ করা হয়। অনেক আবাদী উদ্ভিদ অত্যন্ত তেজিয়ান হয় এবং তথাপি বিরলভাবে অথবা কখনওই বীজ উৎপাদন করে বা করে না। কয়েকটি ক্ষেত্রে আবিষ্কৃত হয়েছে যে অতি তুচ্ছ পরিবর্তন, যেমন ধরুন বৃদ্ধির কোন বিশেষ সময়ে অল্প বা বেশি জল, একটি উদ্ভিদে বীজ হবে কি হবে না তা নির্ধারণ করে। এই অদ্ভুত বিষয়টি সম্পর্কে আমি যা তথ্য সংগ্রহ করেছি। এবং অন্যত্র প্রকাশ করেছি, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ এখানে দিতে পারছি না; কিন্তু যে নিয়মগুলো আটক অবস্থায় প্রাণীদের প্রজনন নির্ধারণ করে, সেগুলোর অনন্যতা দেখানোর জন্য আমি উল্লেখ করতে পারি যে এমন কি ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে আনীত মাংসাশী প্রাণীরাও এই দেশে আটক অবস্থায় মোটামুটি অবাধেই সন্তান উৎপাদন করে, কেবল প্ল্যান্টিগ্রেড অথবা ভল্লুক গোত্র ছাড়া যারা কদাচিৎ সন্তান উৎপাদন করে; পক্ষান্তরে, বিরলতম ব্যতিক্রম ছাড়া মাংসাশী পাখিরা কদাচিৎ উর্বর ডিম পাড়ে। এই অবস্থায় অতিশয় বন্ধ্যা সঙ্করগুলোর মত অনেক বিদেশি উদ্ভিদের পরাগরেণু নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর হয়। একদিকে আমরা দেখি গৃহপালিত প্রাণী ও উদ্ভিদরা দুর্বল ও অসুস্থ হলেও আটক অবস্থায় অবাধে সন্তান উৎপাদন করে, অন্যদিকে আমরা দেখি প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে সংগৃহীত শাবকের এককগুলোকে সঠিকভাবে পোষ মানানো গেলে তারা দীর্ঘায়ু ও স্বাস্থ্যবান হয় (যার অসংখ্য উদাহরণ আমি দিতে পারি), তথাপি এদের জননতন্ত্র কোন অজ্ঞাত কারণের দ্বারা এত গুরুতরভাবে প্রভাবিত হয় যে এটি কাজ করতে ব্যর্থ হয়। এই কার্যপদ্ধতিতে আমাদের বিস্মিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ এটি অনিয়মিতভাবে কাজ করে এবং এদের পিতামাতার কিছু ভিন্ন প্রকৃতির বংশধর উৎপাদন করে, আটক অবস্থায় কার্য সম্পাদন করে। আমি আরও বলতে পারি, যেহেতু কিছু জীবের অস্বাভাবিক অবস্থায় (যেমন খরগোশ ও খাঁচায় রাখা নকুল জাতীয় প্রাণী) অবাধে সন্তান উৎপাদন করার দ্বারা বোঝা যায় যে এদের জননাঙ্গ সহজে প্রভাবিত হয়, সেহেতু কিছু প্রাণী ও উদ্ভিদ গৃহপালন অথবা চাষকরণ প্রতিরোধ করবে এবং অতি অল্প পরিবর্তিত হবে–বোধ হয় প্রাকৃতিক অবস্থার তুলনায় কদাচিৎ বেশি।
কিছু প্রকৃতিবিজ্ঞানী বলেছেন যে সব প্রকারণই যৌন জনন-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এটা অবশ্যই ভুল, কারণ অন্য একটি গবেষণামূলক কাজে আমি বাগানের মালীদের দেওয়া নাম ‘কৌতুককর উদ্ভিদের’ একটি দীর্ঘ তালিকা দিয়েছি; অর্থাৎ সেইসব উদ্ভিদ যেখানে একই গাছে অন্য কুঁড়ির তুলনায় একটি নতুন ও ব্যাপকভাবে পৃথক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ভিন্ন কুঁড়ি সহসা জন্মায়। জোড় কলম, শাখা কলম ইত্যাদি এবং কোন কোন সময় বীজের দ্বারা এইসব পরিবৃত্তির বংশবিস্তার ঘটানো যেতে পারে এবং এদের ভিন্ন ভিন্ন নাম রাখা যেতে পারে–যা প্রাকৃতিক পরিবেশে কদাচিৎ ঘটে, কিন্তু চাষের ক্ষেত্রে এটি বিরল নয়। একই পরিবেশে একই গাছে বছরের পর বছর জন্মানো কয়েক হাজার কুঁড়ির মধ্যে একটি ভিন্ন কুঁড়ি হঠাৎ নতুন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং ভিন্ন পরিবেশে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত গাছের কুঁড়িগুলো কোন কোন সময় একই ভ্যারাইটি উৎপাদন করে–যেমন, পীচ গাছের মধু-উৎপাদনকারী কুঁড়ি এবং মস-গোলাপ উৎপাদনকারী সাধারণ গোলাপের কুঁড়িরা। এইসব ক্ষেত্রে আমরা স্পষ্টভাবে দেখি যে প্রত্যেক বিশেষ ধরনের পরিবৃত্তি নির্ধারণ করতে জীবটির বৈশিষ্ট্যের তুলনায় পরিবেশের বৈশিষ্ট্য গৌণ মূল্যের হয়; বোধ হয় যার দ্বারা দাহ্যবস্তু প্রজ্জ্বলিত হয় সেই স্ফুলিঙ্গের বৈশিষ্ট্যের তুলনায় শিখার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয় না।
স্বভাবের প্রভাব এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবহার অথবা অব্যবহারের
ফলাফল; পরস্পর সম্পর্কযুক্ত পরিবৃত্তি; বংশানুসৃতি
এক আবহাওয়া থেকে অন্য আবহাওয়ায় পরিবাহিত উদ্ভিদদের ফুল ফোঁটার ক্ষেত্রে যেমন হয়, পরিবর্তিত স্বভাব বংশানুক্রমিক ফলাফল সৃষ্টি করে। প্রাণীদের ক্ষেত্রে প্রত্যঙ্গগুলোর বেশি বেশি ব্যবহার বা অব্যবহারের আরও উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। বন্য পাতিহাঁসের একই হাড়গুলোর তুলনায় সমগ্র কঙ্কালের অনুপাতে ডানার হাড় কম ওজনের হয় এবং পায়ের হাড়গুলোর ওজন বেশি হয়, এটা আমি গৃহপালিত পাতিহাঁসের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করেছি। বন্য পিতামাতার তুলনায় গৃহপালিত হাঁসরা অতি অল্প ওড়ে এবং বেশি হেঁটে বেড়ায়, তার ফলেই এই পরিবর্তন। অন্য দেশে গরু ও ছাগলের বাঁট-স্তনের তুলনায় নিয়মিত দুগ্ধদোহন করা হয় এমন দেশের গরু ও ছাগলের বাঁট স্তনের বিরাট ও বংশানুক্রমিক বিকাশ অনেক বেশি, যা সম্ভবতঃ ব্যবহারের ফলাফলের আর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদের দেশের গৃহপালিত প্রাণীদের মধ্যে একটিরও নাম করা যেতে পারে না, অন্য কোন দেশে যাদের ঝুলন্ত কান নেই। কানের মাংসপেশী অব্যবহারের জন্যই কান ঝুলন্ত হয়, কারণ এই প্রাণীদের সতর্ক হওয়ার তেমন প্রয়োজন হয় না–এই মতটি যুক্তিসঙ্গত বলেই মনে হয়।
অনেক নিয়ম পরিবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে, যেগুলোর কয়েকটিকে অস্পষ্টভাবে দেখা যেতে পারে এবং এখানে এগুলো সংক্ষেপে আলোচিত হবে। আমি এখানে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত পরিবৃত্তি বিষয়ে উল্লেখ করব। ভুণে ও শূককীটে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সম্ভবতঃ বয়স্ক প্রাণীদের পরিবর্তন ঘটাবে। বিকৃতাঙ্গ জীবের সম্পূর্ণ পৃথক প্রত্যঙ্গদের মধ্যে পারস্পরিক সম্বন্ধ অত্যন্ত অদ্ভুত প্রকৃতির; ইসিডোরে জিওফ্রয় সেন্ট হিলারের বিরাট গ্রন্থে এ বিষয়ে অনেক উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। প্রজননকারীরা বিশ্বাস করেন যে লম্বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো প্রায় সর্বদাই লম্বাটে মস্তকের সঙ্গে সহবর্তমান। পারস্পরিক সম্বন্ধের কয়েকটি উদাহরণ খাপছাড়া ধরনের, যেমন সম্পূর্ণ সাদা ও নীলবর্ণের চোখওয়ালা বিড়ালেরা সাধারণত বধির হয়; কিন্তু মিঃ টেট সম্প্রতি বলেছেন যে এটি কেবল পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বর্ণ ও দেহগত বিন্যাসের বিশেষত্বগুলো একই সঙ্গে চলে, প্রাণী ও উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে এ সম্বন্ধে অনেক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারত। হিউসিনজারের সংগৃহীত তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে সাদা ভেড়া ও শূকররা কয়েকটি উদ্ভিদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু কৃষঃবর্ণের এককগুলো নিষ্কৃতি পায়। অধ্যাপক উইম্যান এ বিষয়ে একটি ভাল উদাহরণ সম্প্রতি আমাকে জানিয়েছেন। ভার্জিনিয়ার কয়েকজন কৃষককে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তাদের শূকররা কেন কৃষ্ণবর্ণের হয়। উত্তরে তারা তাকে জানিয়েছিল যে তাদের শূকররা রঙ্গিন শিকড় (ল্যাকনানথেস) খেয়ে থাকে, যা এদের হাড়কে পাটল বর্ণ করে দেয়, এবং কালো রঙের ভ্যারাইটিগুলো ছাড়া অন্য সকলের পায়ের ক্ষুর লোপ পায়; এবং দন্তী মানুষদের (অর্থাৎ ভার্জিনিয়া স্কোয়াটার্স) মধ্যে একজন বলেন, “শাবকদের মধ্যে কালোগুলোকে আমরা নির্বাচিত করি কেবলমাত্র এদের বাঁচার সম্ভাবনা বেশি বলে।” লোমহীন কুকুরদের দাঁত অসম্পূর্ণ হয়; মোটা লোমযুক্ত প্রাণীদের লম্বা অথবা অনেক শিং থাকে; পালকওয়ালা পায়ের পাতা সমেত পায়রাদের পায়ের পাতায় বাইরের আঙ্গুলগুলোর মধ্যে চামড়া থাকে; ছোট ঠোঁটযুক্ত পায়রার পা ছোট হয় এবং লম্বা ঠোঁটওয়ালাদের পা বড় হয়। অতএব মানুষ যদি কোন বৈশিষ্ট্যকে নির্বাচিত করতে থাকে এবং তার বৃদ্ধি ঘটাতে থাকে, তাহলে পারস্পরিক সম্পর্কের রহস্যময় নিয়মগুলির দরুন সে প্রায় নিশ্চিতভাবেই দেহের অন্য প্রত্যঙ্গগুলোকে অনিচ্ছাকৃতভাবে রূপান্তরিত করবে।
পরিবৃত্তির বিভিন্ন, অজ্ঞাত অথবা অস্পষ্টভাবে জানা নিয়মগুলোর ফলাফল অত্যন্ত জটিল ও বিচিত্র। প্রাচীন যুগ থেকে আবাদী কয়েকটি উদ্ভিদ, যেমন হায়াসিন্থ, আলু, এমনকি ডালিয়া প্রভৃতি সম্বন্ধে লেখা কয়েকটি প্রবন্ধ যত্নসহকারে অধ্যায়ন করা খুবই প্রয়োজনীয়; এবং দেহকাঠামো ও দেহগত বিন্যাসের অনন্ত বিষয়সমূহ লক্ষ্য করা অতিশয় বিস্ময়কর, কারণ ভ্যারাইটি ও উপভ্যারাইটিদের মধ্যে পার্থক্য অতি অল্প। সমগ্র জৈব সংগঠনটি সম্ভবতঃ নমনীয় হয়েছে এবং পিতামাতা বৈশিষ্ট্যগুলোর থেকে অল্প। মাত্রায় ব্যতিক্রম ঘটেছে।
বংশানুক্রমিক নয় এমন পরিবৃত্তি আমাদের কাছে গুরত্বহীন। কিন্তু দেহগঠনের বংশগত বিচ্যুতি সংখ্যা ও বিচিত্রতা, যারা অল্প এবং যাদের শরীরবৃত্তীয় বিশেষ গুরুত্ব থাকে, তা অনন্ত। বিষয়টির ওপর ডঃ প্রসপার লুকাসের লেখা দুটি বিরাট গ্রন্থ সর্বোত্তম এবং সম্পূর্ণ। কোন প্রজননকারীই সন্দেহ করে না বংশানুসৃতিতে প্রবণতা কত প্রবল। সদৃশ প্রাণী সদৃশ প্রাণীরাই জন্ম দেয়, এটাই হচ্ছে তাদের মৌলিক বিশ্বাস; তাত্ত্বিক লেখকরাই কেবল এই সূত্র সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেন। দেহগঠনের কোন বিচ্যুতি যখন প্রায়শই আবির্ভূত হয় এবং আমরা সেটি পিতা ও শিশুর মধ্যে দেখি, তখন আমরা বলতে পারি না একই কারণ উভয়ের ওপর কার্যকরী হয় কিনা। কিন্তু যখন পরিবেশের কয়েকটি অস্বাভাবিক জোটের জন্য আপাততভাবে একই পরিবেশের প্রভাবাধীন এককগুলোর মধ্যে যে কোন অতি বিরল বিচ্যুতি পিতামাতায় আবির্ভূত হয়–ধরুন কয়েক লক্ষ এককের মধ্যে একবার–এবং এটি শিশুটির মধ্যে পুনরাবির্ভূত হয়, তখন এটির পুনরাবির্ভাবের সম্ভাব্যতার একমাত্র কারণকে বংশানুসৃতির ওপর আরোপ করতে অনেকাংশে বাধ্য হই আমরা। একই গোত্রের সদস্যদের শরীরে ধবলতা, কাঁটাময় চামড়া, লোমাবৃত শরীর ইত্যাদি বিষয়ের কথা নিশ্চয় প্রত্যেকে শুনে থাকবেন। যদি দেহের অদ্ভুত ও বিরল বিচ্যুতিগুলো আনুবংশিক হয়, তাহলে কম অদ্ভুত ও সাধারণ বিচ্যুতিগুলোকে বংশগত বলে অনায়াসেই স্বীকার করা যেতে পারে। সমগ্র বিষয়টি লক্ষ্য। করার সঠিক উপায় হচ্ছে–নিয়ম যাই হোক না কেন, প্রত্যেক বৈশিষ্ট্যকে বংশগত হিসেবে দেখা এবং বংশগত নয় এমন বৈশিষ্ট্যকে ব্যতিক্রম হিসেবে দেখা।
বংশগতি নিয়ন্ত্রণের নিয়মগুলো অধিকাংশ সময় অজ্ঞাত। কেউ বলতে পারে না। কেন একই প্রজাতির অথবা ভিন্ন প্রজাতির বিভিন্ন এককগুলোতে একই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কোন কোন সময় আনুবংশিক হয় কোন কোন সময় হয় না; কেন শিশুর মধ্যে পিতামহ অথবা মাতামহীর অথবা আরও দূরবর্তী পূর্বপুরুষের কিছু কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রায়শই পুনরাবির্ভূত হয়; কেন একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এক লিঙ্গ থেকে উভয় লিঙ্গে, অথবা কেবল একটি লিঙ্গে, আরও বিশেষভাবে কোন সদৃশ লিঙ্গে নয়, প্রায়শই পরিবাহিত হয়। এটি আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ যে আমাদের গৃহপালিত জাতগুলোর পুরুষ লিঙ্গে আবির্ভূত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয় স্বতন্ত্রভাবে অথবা আরও বেশি মাত্রায় কেবলমাত্র পুরুষদের মধ্যে প্রায়শই বংশগতভাবে পরিবাহিত হয়। আরও অধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি, যা বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হয়, সেটি হচ্ছে জীবনের কোন বিশেষ বয়সে একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রথমে আবির্ভূত হয়, বংশধরের অনুরূপ বয়সে এটি পুনরাবির্ভূত হতে চেষ্টা করে, যদিও কোন কোন সময় আরও আগেও তা দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে এটি অন্যরূপে হয় না। এইরূপে গো-মহিযাদির শিংগুলোতে বংশগতভাবে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ কেবল পরিণত বয়সেই বংশধরে আবির্ভূত হতে পারে; রেশমকীটের বৈশিষ্ট্যগুলো শুয়োপোকা অথবা রেশমগুটির সমরূপ দশায় আবির্ভূত হয় বলে জানা গেছে। কিন্তু বংশগত রোগ এবং অন্য কয়েকটি বিষয় আমাকে বিশ্বাস করায় যে নিয়মটির ব্যাপক বিস্তৃতি আছে, এবং কেন একটি বৈশিষ্ট্য কোন বিশেষ বয়সে আবির্ভূত হবে তার আপাত কোন কারণ না থাকলেও পিতামাতার মধ্যে প্রথম যে বয়সে এই পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল, বংশধরের মধ্যেও সেই বয়সেই দেখা যায়। ভূণবিদ্যার নিয়মসমূহ ব্যাখ্যা করতে এই নিয়মটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ বলেই আমি বিশ্বাস করি। এই মন্তব্যগুলো নিশ্চয়ই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রথম আবির্ভাবের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ এবং প্রাথমিক কারণে নয় যা ডিম্বক অথবা পুরুষ-উপাদানের ওপর কার্যকরী হয়ে থাকতে পারে; প্রায় একইভাবে একটি লম্বা শিংওয়ালা ষাঁড়ের ছোট শিংওয়ালা গাভী থেকে উৎপন্ন বংশধরের শিঙের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত দৈর্ঘ্য স্পষ্টতই পুরুষ-উপাদানের জন্য হয়, যদিও তা বেশি বয়সে আবির্ভূত হয়।
পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তন বিষয়টি প্রসঙ্গে আমি এখানে প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের একটি উক্তি উল্লেখ করতে পারি–আমাদের গৃহপালিত ভ্যারাইটিরা যখন বন্যাবস্থায় প্রত্যাবর্তন করে, তখন তাদের মধ্যে আদিম বংশের বৈশিষ্ট্যগুলি ক্রমশঃ কিন্তু অনিবার্যভাবে ফিরে আসে। অতএব যুক্তি দেখানো হয় যে প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রজাতিদের সঙ্গে জাতসমূহের সম্পর্ক থেকে কোন সিদ্ধান্ত টানা যেতে পারে না। কোন্ চূড়ান্ত তথ্যের ভিত্তিতে উপরোক্ত বক্তব্যটি প্রায়শই এবং জোরের সঙ্গে বলা হয়, তা আবিষ্কার করার নিল চেষ্টা করেছি আমি। এটির সত্যতা নিরূপণ করা অত্যন্ত কষ্টকর। আমরা নিরাপদে সিদ্ধান্ত করতে পারি যে সুচিহ্নিত গৃহপালিত ভ্যারাইটিরা অধিকাংশই বন্যাবস্থায় সম্ভবতঃ বাস করতে পারত না। বহু ক্ষেত্রে আদিম বংশটি কী ছিল আমরা জানি না এবং সে জন্য নিখুঁত প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল কিনা আমরা বলতে পারি না। আন্তঃ সঙ্করণের প্রভাব প্রতিরোধ করতে এটি প্রয়োজন হবে যে কেবল একটি একক নূতন বাসস্থানে বন্ধনমুক্ত হয়ে থাকবে। তা সত্ত্বেও, যেহেতু আমাদের গৃহপালিত ভ্যারাইটিদের কয়েকটি বশিষ্ট্য পূর্বপুরুষীয় আকারে নিশ্চয় হঠাৎ প্রত্যাবর্তন করে, তাই এটি অসম্ভব নয় বলে মনে হয় যে আমরা যদি অনুর্বর মাটিতে (তবে এক্ষেত্রে অনুর্বর মাটির জন্য কিছু ফলাফল আরোপ করা যেতে পারে), ধরা যাক, বাঁধাকপির কয়েকটি জাতকে কয়েক বংশ জুড়ে ভিন্ন পরিবেশের উপযোগী করতে সমর্থ হতাম অথবা চাষ করতে পারতাম, তাহলে এরা অনেকাংশে বা এমনকি সামগ্রিকভাবে বন্য আদিম বংশে প্রত্যাবর্তন করত। পরীক্ষাটি সফল হবে কি হবে না তা আমাদের কাছে বিশেষ গুরুত্বের নয়, কারণ পরীক্ষা দ্বারাই জীবন-পরিবেশ পরিবর্তিত হয়। যদি দেখানো যেতে পারত যে আমাদের গৃহপালিত ভ্যারাইটিরা পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তনে অত্যন্ত প্রবণ হয়, অর্থাৎ একই পরিবেশে এবং বিশেষ সংখ্যায় রাখা হলে এরা এদের আহৃত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো হারাতে চায়, যাতে একত্রে মিলনের দ্বারা অবাধ আন্তঃসঙ্করণ এদের গঠনের যে কোন অল্প বিচ্যুতিকে রোধ করতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে প্রজাতি সম্পর্কে গৃহপালিত ভ্যারাইটিদের থেকে কোন সিদ্ধান্ত আমি করতে পারিনি। কিন্তু এই মতের অনুকূল সাক্ষ্যপ্রমাণের কোন চিহ্ন নেহ : অনন্ত বংশপরম্পরা ধরে আমাদের মালবাহী ও ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া, লম্বা ও ছোট শিংওয়ালা গো-মহিযাদি এবং বিভিন্ন জাতের কুকুটাদি গৃহপালিত পাখি ও খাদ্য-উপযোগী সবজি প্রজনন করতে পারতাম না, এটা দাবী করা সমস্ত অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে যাবে।
গৃহপালিত নানা প্রকার ভ্যারাইটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য; নানাপ্রকার ভ্যারাইটি ও প্রজাতিদের মধ্যে বিভিন্নতা নির্দিষ্ট করার অসুবিধা; এক বা একাধিক প্রজাতি থেকে বিভিন্ন ভ্যারাইটির উৎপত্তি।
আমরা যখন গৃহপালিত প্রাণী ও উদ্ভিদের বংশধর ভ্যারাইটি বা জাতগুলোর দিকে লক্ষ্য করি এবং নিকট সম্বন্ধীয় প্রজাতিদের সঙ্গে এদের তুলনা করি, তখন প্রত্যেক গৃহপালিত জাতে প্রকৃত প্রজাতির তুলনায় কম একরূপত্ব আমরা সাধারণতঃ দেখতে পাই, যা ইতিমধ্যে উল্লিখিত হয়েছে। গৃহপালিত জাতগুলো প্রায়শই কিছুটা অস্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে; যার দ্বারা আমি এই অর্থ করি যে যদিও কয়েকটি তুচ্ছ বৈশিষ্ট্যে এরা পরস্পরের থেকে এবং একই গণের অন্য প্রজাতির থেকে পৃথক হয়, পরস্পরের সঙ্গে এবং বিশেষত প্রাকৃতিক পরিবেশের নিকট সম্বন্ধীয় প্রজাতির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, এরা উভয়ে প্রায়শই যে কোন একটি অঙ্গে চূড়ান্ত মাত্রায় পৃথক। হয়। এগুলো ব্যতীত (সঙ্করিত হওয়ার পর ভ্যারাইটিদের সম্পূর্ণ উর্বরতা–বিষয়টি পরে আলোচিত হবে) একই প্রজাতির গৃহপালিত জাতগুলো পরস্পরের থেকে একই পদ্ধতিতে পৃথক হয়, যে পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক পরিবেশে একই গণের নিকট সম্বন্ধীয় প্রজাতিরা পৃথক হয়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে পার্থক্যগুলো কম মাত্রায় হয়। এটি অবশ্য সত্য বলে স্বীকার করা উচিত, কারণ কয়েকজন দক্ষ বিচারক প্রাণী ও উদ্ভিদের গৃহপালিত জাতগুলোকে আদিম স্বতন্ত্র প্রজাতির বংশধর হিসেবে গণ্য করেছেন এবং অন্য দক্ষ বিচারকরা এদের কেবলমাত্র ভ্যারাইটি হিসেবে গণ্য করেন। যদি একটি গৃহপালিত জাত এবং একটি প্রজাতির মধ্যে কোন সুচিহ্নিত পার্থক্য থাকে, সন্দেহের এই উৎসটি এভাবে চিরস্থায়ী রূপে আর পুনরায় ঘটবে না। প্রায়শই বলা হয় যে গণীয় মূল্যের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে গৃহপালিত জাতসমূহ পরস্পরের থেকে ভিন্ন হয় না। দেখানো যেতে পারে যে বক্তব্যটি সঠিক নয়; কিন্তু গণীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্ধারণ করতে প্রকৃতিবিদদের মধ্যে নানাবিধ মতভেদ হয়; এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের মূল্য নির্ধারণ বর্তমানে পরীক্ষাধীন। কেমন করে গণগুলি প্রাকৃতিক পরিবেশে উদ্ভূত হয় তা ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে যে আমাদের গৃহপালিত জাতগুলোতে পার্থক্যের গণীয় চারিত্রিক পরিমাণ আবিষ্কার করার আশা করার কোন অধিকার আমাদের নেই।
সম্বন্ধযুক্ত গৃহপালিত জাতগুলোর মধ্যে গঠনগত পার্থক্যের পরিমাণ নির্ধারণ করার চেষ্টায়, এরা এক বা একাধিক পিতামাতা প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে কিনা জেনে তৎক্ষণাৎ সন্দেহ করতে শুরু করি আমরা। বিষয়টি পরীক্ষিত হলে, কৌতূহলোদ্দীপক হবে। যেমন, যদি দেখানো যেতে পারত যে গ্ৰেহাউণ্ড, ব্লাডহাউণ্ড, টেরিয়ার, স্প্যানিয়েল এবং বুলডগ কুকুররা যে কোন একটি স্বতন্ত্র প্রজাতির বংশধর ছিল, আমরা জানি এরা এদের সদৃশ বংশধর জন্ম দেয়, তাহলে এইসব তথ্য অসংখ্য নিকট সম্বন্ধীয় প্রাকৃতিক প্রজাতির অপরিবর্তনশীলতা সম্পর্কে আমাদের সন্দেহ উদ্রেক করতে বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকবে-যা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী অসংখ্য শিয়াল সম্পর্কে খাটে। আমি বিশ্বাস করি না যে–যেটি আমরা এখানে দেখবো-কুকুরদের কয়েকটি জাতের মধ্যেকার সমস্ত পার্থক্য গৃহপালনাধীন অবস্থায় উদ্ভূত হয়েছে; স্বল্প পার্থক্য স্বতন্ত্র প্রজাতি থেকে উদ্ভবের জন্য দায়ী, এটা আমি বিশ্বাস করি। অন্য কয়েকটি গৃহপালিত প্রজাতির স্পষ্টচিহ্নিত, জাতগুলোর ক্ষেত্রে, অনুমিত অথবা এমনকি জোরাল সাক্ষ্যপ্রমানাদি রয়েছে যে সকলে একটি স্বতন্ত্র বন্য প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
অনেকে মনে করেন যে মানুষ গৃহপালনের জন্য এমন সব প্রাণী ও উদ্ভিদ নির্বাচন করে যাদের পরিবর্তনের জন্যে সহজাত প্রবণতা রয়েছে এবং যারা বিচিত্র জলবায়ু সহ্য করতে সমর্থ। আমি ভিন্নমত পোষণ করি না যে এই সামর্থগুলো আমাদের অধিকাংশ গৃহপালিত উৎপাদনে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে। কিন্তু যখন একজন বন্য মানুষ একটি প্রাণীকে প্রথম পোষ মানিয়েছিল, তখন কেমন করে সে জানত সেটি পরবর্তী বংশপরম্পরায় পরিবর্তিত হবে কিনা এবং অন্য জলবায়ু সহ্য করতে পারবে কিনা? গাধা ও রাজহাঁসের অল্প পরিবৃত্তি অথবা বন্না হরিণের গরম সহ্য করার বা সাধারণ উটের ঠাণ্ডা সহ্য করার অল্প ক্ষমতা এদের গৃহপালনে বাধা সৃষ্টি করেছে কি? আমি সন্দেহ পোষণ করি না যে যদি আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনগুলোর সমান সংখ্যায় এবং সমভাবে বিভিন্ন শ্রেণী ও দেশের অন্তর্গত অন্য প্রাণী ও উদ্ভিদদের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে গ্রহণ করা হত এবং গৃহপালনাধীন অবস্থায় এরা সমসংখ্যক বংশপরম্পরায় বংশবিস্তার করত, তাহলে এরা বর্তমানে গৃহপালিত জাতগুলোর পিতামাতা প্রজাতিদের মতো গড়ে একইরূপে পরিবর্তিত হত।
আমাদের সবচেয়ে প্রাচীন গৃহপালিত প্রাণী ও উদ্ভিদের অধিকাংশের প্রসঙ্গে বলা যায় যে এরা এক বা কয়েকটি বন্য প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে কিনা, সে ব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসা অসম্ভব। গৃহপালিত প্রাণীদের বহুবিধ উৎপত্তিতে বিশ্বাসী লোকেদের প্রধান যুক্তি হচ্ছে যে ইজিপ্টের স্মৃতিসৌধে এবং সুইজারল্যান্ডের অধিবাসীদের মধ্যে অতি প্রাচীনকালের জাতগুলোর ক্ষেত্রে বিপুল বিভিন্নতা লক্ষ্য করি আমরা, এবং প্রাচীন জাতগুলোর কয়েকটি বর্তমান জাতগুলোর সদৃশ বা এমনকি সমরূপ হয়। কিন্তু এটি সভ্যতার ইতিহাসকে অনেক পিছনে টেনে নিয়ে যায় এবং আজ পর্যন্ত যা মনে করা হয় তার চেয়ে বহু পূর্বেই প্রাণীদের গৃহপালিত করা হয়েছিল। সুইজারল্যান্ডের হ্রদ অধিবাসীরা কয়েক ধরনের গম এবং বার্লি, ছোলা, তেলের জন্য আফিম ও তিসির চাষ করত এবং কয়েকটি প্রাণীকেও পোষ মানিয়েছিল। অন্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যও করত তারা। হিয়ারের মন্তব্যানুসারে এ সব তথ্য স্পষ্ট করে দেখায় যে এরা সভ্যতার গোড়ার দিকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটিয়েছিল; এবং এটি আবার কম উন্নত সভ্যতার পূর্ববর্তী দীর্ঘস্থায়ী পর্যায়ের ইঙ্গিত দেয়, যখন বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর পোষ মানানো গৃহপালিত প্রাণীরা পরিবর্তিত হয়ে থাকবে এবং স্বতন্ত্র জাত উদ্ভূত হয়ে থাকবে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠে চকমকি পাথরের হাতিয়ার আবিষ্কার থেকে সব ভূবিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে বহু বহু বছর পূর্বে বর্বর মানুষরা বসবাস করত; এবং আমরা জানি যে অন্তত কুকুরকে পোষ মানাতে পারে না এ-রকম বর্বর গোষ্ঠী বর্তমানে একটিও নেই।
আমাদের অধিকাংশ গৃহপালিত প্রাণীদের উৎপত্তির বিষয়টি চিরকালের মত অস্পষ্ট থাকবে। সারা পৃথিবীর গৃহপালিত কুকুরদের লক্ষ্য করে আমি কিন্তু এখানে বলতে পারি যে সমস্ত জানা তথ্য কঠোর পরিশ্রম সহকারে সংগ্রহ করে আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে কুকুর গোত্রের বন্য প্রজাতিকে পোষ মানানো হয়েছে এবং এদের রক্ত কয়েকটি ক্ষেত্রে একত্রে মিশ্রিত হয়ে আমাদের গৃহপালিত জাতগুলোর শিরায় প্রবাহিত হয়ে আসছে। ভেড়া ও ছাগলের ক্ষেত্রে আমি কোন স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। কুঁজওয়ালা। ভারতীয় গবাদি পশুদের স্বভাব, কণ্ঠস্বর, দেহগঠন ও অবয়ব সম্বন্ধে মিঃ ব্লিথ প্রেরিত তথ্যসমূহ থেকে নিশ্চিতরূপে বলা যায় যে এরা আমাদের ইউরোপিয় গবাদি পশুদের থেকে ভিন্ন একটি আদিম কুল (বংশ) থেকে উদ্ভূত হয়েছে, এবং কয়েকজন দক্ষ বিচারক বিশ্বাস করেন যে ইউরোপিয় গবাদি পশুদের দুটি বা তিনটি বন্য পূর্বপুরুষ ছিল–এদের প্রজাতি হিসাবে গণ্য করা যুক্তিযুক্ত হবে কিনা তা পরের কথা। এই সিদ্ধান্তটি এবং কুঁজওয়ালা ও সাধারণ গবাদি পশুদের বিশেষ পার্থক্যের বিষয়টি অধ্যাপক রুটিমেয়ারের প্রশংনীয় গবেষণামূলক কাজের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। ঘোড়াদের ক্ষেত্রে, কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতামতের বিরুদ্ধে, আমি মনে করি সমস্ত জাত একই প্রজাতির অন্তর্গত, যার কারণগুলো আমি এখানে দিতে পারছি না। মুরগীদের প্রায় সমস্ত ইংলিশ জাতগুলোকে জীবিত রেখে, এদের প্রজনন করে সঙ্করণ ঘটিয়ে এবং এদের কঙ্কাল পরীক্ষা করে আমার কাছে স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান হয়েছে যে গ্যালাস ব্যাঙ্কিভা নামক ভারতীয় বন্য মুরগী থেকেই এরা উদ্ভূত হয়েছে; এবং মিঃ ব্লিথ ও অন্য যাঁরা এই পাখিটি সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছেন, এটা তাদেরই সিদ্ধান্ত। পাতিহাঁস ও খরগোশদের ক্ষেত্রে, যাদের কয়েকটি জাত পরস্পরের থেকে ভীষণভাবে ভিন্ন হয়, সাক্ষ্য প্রমাণাদি থেকে এটা পরিষ্কার যে এরা সকলে সাধারণ বন্য পাতিহাঁস এবং খরগোশ থেকেই উদ্ভূত হয়েছে।
কয়েকটি আদিম বংশ (কুল) থেকে কয়েকটি গৃহপালিত জাতের উৎপত্তি তত্ত্বকে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ অযৌক্তিক সীমায় নিয়ে গিয়েছেন। তারা বিশ্বাস করেন যে প্রত্যেক জাতের, যারা অকৃত্রিম বংশধর উৎপাদন করে এবং যাদের পার্থক্যমূলক বৈশিষ্ট্য যতই অল্প হোক না কেন, বন্য আদিরূপ ছিল। এই অনুপাতে কেবলমাত্র ইউরোপেই কম করেও এক কুড়ি বন্য গবাদি পশুর প্রজাতি, সমসংখ্যক ভেড়া, কিছু ছাগল নিশ্চয়ই থেকে থাকবে, এমনকি গ্রেট ব্রিটেনেও কয়েকটি। একজন বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে। কেবল গ্রেট ব্রিটেনেই পূর্বে ভেড়ার এগারটি বন্য প্রজাতি ছিল! আমরা যখন স্মরণে রাখি যে এখন গ্রেট ব্রিটেনের নিজস্ব কোন স্তন্যপায়ী প্রাণী নেই, এবং জার্মানির তুলনায় স্বতন্ত্র কয়েকটি ফ্রান্সে এবং এরূপে হাঙ্গেরি, স্পেন প্রভৃতি দেশেও নেই, তথাপি এসব দেশগুলোর প্রত্যেকটিতে গবাদি পশু, ভেড়া প্রভৃতির কয়েকটি নিজস্ব জাত রয়েছে, তখন আমাদের নিশ্চয় স্বীকার করা উচিত যে সারা ইউরোপে অনেক গৃহপালিত জাত উদ্ভূত হয়ে থাকবে, কারণ তা না হলে কোথা থেকে উদ্ভূত হয়েছে এরা? ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এমন কি সারা পৃথিবীর গৃহপালিত কুকুরদের জাতগুলোর ক্ষেত্রে–আমি স্বীকার করি যে এরা কয়েকটি বন্য প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে– নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এদের মধ্যে বিরাট পরিমাণে বংশগত পরিবর্তন ঘটেছে; কারণ কে বিশ্বাস করবে যে ইতালির গ্ৰেহাউণ্ড, ব্লাডহাউণ্ড, বুলডগ, পাগ-ডগ বা ব্লেনহিম স্প্যানিয়েল প্রভৃতি ঘনিষ্ঠভাবে সদৃশ প্রাণীরা, যারা সমস্ত বন্য কুকুর গোত্রীয়দের থেকে এত পৃথক, তারা কখনও প্রাকৃতিক পরিবেশে বর্তমান ছিল? প্রায়শই হালকাভাবে বলা হয় যে কয়েকটি আদিম প্রজাতির মধ্যে সঙ্করণের মাধ্যমে কুকুরদের সমস্ত জাতের উদ্ভব ঘটেছে। কিন্তু সঙ্করণ প্রক্রিয়া দ্বারা এদের পিতামাতাদের কেবলমাত্র কিছু মাত্রায় মধ্যবর্তী আকারই পেতে পারি আমরা; এবং এই পদ্ধতির দ্বারা আমরা যদি আমাদের গৃহপালিত জাতগুলো সম্বন্ধে বিচার-বিবেচনা করি, তাহলে ইতালির গ্ৰেহাউণ্ড, ব্লাডহাউণ্ড, বুলডগ ইত্যাদির অতিশয় চরম আকারদের বন্যাবস্থায় পূর্ব অবস্থান আমাদের। অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। অধিকন্তু সঙ্করণ প্রক্রিয়ার দ্বারা স্বতন্ত্র জাত সৃষ্টির সম্ভাবনার বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। অনেক লিপিবদ্ধ ঘটনা থেকে জানা যায় যে আকাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য সমেত এককদের যত্নসহকারে নির্বাচন করা হলে আকস্মিক সঙ্করণ পদ্ধতির দ্বারা একটি জাত রূপান্তরিত হতে পারে, কিন্তু দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। জাতের মধ্যবর্তী একটি জাতের উদ্ভব ঘটানো অত্যন্ত কষ্টকর। স্যার জে. সেবরাইট এই উদ্দেশ্যে বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন এবং ব্যর্থ হয়েছিলেন। দুটি বিশুদ্ধ জাতের মধ্যে প্রথম সঙ্করণ থেকে উৎপন্ন বংশধররা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে সহনীয় ও কোন কোন সময় (যেমন আমি পায়রাদের ক্ষেত্রে দেখেছি) সম্পূর্ণ একইরূপ হয়, এবং এর থেকে মনে হয় সবকিছুই যথেষ্ট সরল; কিন্তু যখন কয়েক বংশ ধরে এই বর্ণসঙ্কররা পরস্পরের সঙ্গে সঙ্করিত হয়, তখন কদাচিৎ এদের দুটি হুবহু একই রকম হয়, এবং তখন করণীয় কাজের অসুবিধাটি স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান হয়।
গৃহপালিত পায়রাদের জাত, এদের পার্থক্য ও উৎপত্তি
কয়েকটি বিশেষ গোষ্ঠী সম্বন্ধে অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ করা সর্বদাই উপকারী, এটা বিশ্বাস করে ও বিশেষভাবে বিবেচনা করে গৃহপালিত পায়রাদের বিষয়টি অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের জন্য গ্রহণ করেছি আমি। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, বিশেষ করে ভারতবর্ষ থেকে, মাননীয় ডব্লিউ, ইলিয়ট ও পারস্য থেকে মাননীয় সি. মুর প্রেরিত চামড়াগুলো সমেত আমার ক্রীত ও প্রাপ্ত প্রত্যেক জাত আমি সংগ্রহ করে রেখেছি। পায়রা সম্বন্ধে অনেক গ্রন্থ ও নিবন্ধ বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে এবং এদের মধ্যে কয়েকটি বহু প্রাচীন ও অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। আমি কয়েকজন পশুপাখিরসিক ব্যক্তির সান্নিধ্য লাভ করেছি এবং লন্ডনের দুটি পায়রা ক্লাবের সদস্য হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে আমাকে। জাতগুলোর বিচিত্রতা অতি বিস্ময়কর। ইংলিশ গিরাবাজ (কেরিয়ার) ও ছোট মুখওয়ালা লোটন পায়রাদের (টাম্বলার) তুলনা করুন এবং ফলস্বরূপ এদের করোটির অনুরূপ পার্থক্য সমেত ঠোঁটের বিস্ময়কর পার্থক্যগুলো লক্ষ্য করুন। গিরাবাজ পায়রাদের, বিশেষত পুরুষ-পাখিটির মাথায় আব সমেত চামড়ার অপূর্ব বৃদ্ধি লক্ষণীয়; এবং একই সময়ে বর্তমান থাকে বেশ লম্বাটে চোখের পাতা, নাসারন্ধ্রের বেশ বড় বাইরের রন্ধ্র মুখের বিরাট ফাঁক। ছোট মুখওয়ালা লোটন পায়রার ঠোঁটের বহিরাকৃতি প্রায় ফিন পাখির ঠোঁটের মত। দল বেঁধে আকাশে অধিক উচ্চতায় ওড়ার ব্যাপারে সাধারণ পায়রাদের অসাধারণ বংশগত স্বভাব রয়েছে। আকাশে এরা গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে ডিগবাজি খায়। রান্ট পায়রা বিরাটাকারের একটি পাখী, এদের লম্বা প্রকান্ড ঠোঁট ও বড় পায়ের পাতা থাকে; রান্ট পায়রার কিছু উপজাতের লম্বা গলা, কিছু উপজাতের অতিশয় লম্বা ডানা ও লেজ, আবার অন্য কিছু উপজাতের অস্বাভাবিক খর্ব। লেজ থাকে। গোলা পায়রারা (বাব) গিরাবাজ পায়রাদের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। কিন্তু লম্বা ঠোঁটের পরিবর্তে এদের ঠোঁট খুব ছোট ও প্রশস্ত। পাউটার পায়রাদের শরীর, ডানা ও পা লম্বাটে হয়; এরা এদের বিকশিত গলার থলি ফোলাতে গর্ব অনুভব করে। এদের এই কার্যকলাপ বিস্ময়, এমনকি হাসির উদ্রেক করতে পারে। টাবিট পায়রাদের খর্ব শঙ্কু আকৃতি ঠোঁট থাকে এবং বুকের নিচ বরাবর উল্টানো পালকের একটি সারি থাকে, অন্ননালীর ওপরের অংশ অনবরত ও অল্পভাবে ফোলানো এদের স্বভাব। জ্যাকবিন পায়রাদের পালকগুলো গলার পিছন দিক বরাবর এমনভাবে উল্টানো থাকে যে এরা একটি হুড তৈরি করে; এদের দেহের অনুপাতে লম্বাটে ডানা ও লেজের পালক থাকে। নামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ট্রামপেটার ও লফার পায়রারা অন্য জাত থেকে অতিশয় পৃথক বকবকম আওয়াজ করতে পারে। বিরাট পায়রা গোত্রের সকল সদস্যদের লেজে সাধারণত বারো অথবা চোদ্দটি পালক থাকে, কিন্তু লক্কা পায়রাদের লেজে ত্রিশ অথবা চল্লিশটি পালক থাকে। এই পালকগুলি এরা ফুলিয়ে রাখে ও খাড়াভাবে এমনভাবে বহন করে যে ভাল পায়রাদের মাথা ও লেজ পরস্পরকে স্পর্শ করে, তেলগ্রন্থি লুপ্ত হয়। কম ভিন্ন জাতগুলোর কয়েকটি সম্বন্ধে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার।
কয়েকটি জাতের কঙ্কালে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও বক্রতায় মুখমণ্ডলের হাড়গুলির বৃদ্ধি বহুলাংশে ভিন্ন হয়। নিচের চোয়ালের হাড়ে শাখার (র্যামাসের) আকার, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থও লক্ষণীয়ভাবে ভিন্ন হয়। পুচ্ছ ও নিতম্ব কশেরুকা সংখ্যায় ভিন্ন হয়, যেমন ভিন্ন হয় পঞ্জরাস্থির সংখ্যা, এর সঙ্গে এদের আপেক্ষিক প্রস্থের উদগত উপাঙ্গগুলির উপস্থিতি। বক্ষাস্থির রন্ধ্রগুলির আকার ও আয়তন ভয়ানক পরিবর্তনশীল; সেই রকম ফারকিউলার দুই বাহুর আপেক্ষিক আয়তন ও কেন্দ্ৰাপসারণের পরিমাণ; মুখগহ্বরের ফাঁকের আনুপাতিক বিস্তার; চোখের পাতা, নাকের রন্ধ্র ও জিহ্বার আনুপাতিক দৈর্ঘ্য (ঠোঁটের দৈর্ঘ্যের সঙ্গে সব সময় সঠিক সম্বন্ধযুক্ত হয় না), পাকস্থলী ও অন্ননালীর উপরাংশের আকার; তেলগ্রন্থির বৃদ্ধি ও বিলুপ্তি; মুখ্যডানা ও পুচ্ছের পালকদের সংখ্যা; পরস্পরের সঙ্গে ও শরীরের সঙ্গে ডানা ও লেজের আপেক্ষিক দৈর্ঘ্য; পা ও পায়ের পাতার আপেক্ষিক দৈর্ঘ্য; পদাঙ্গুলির স্কুটেলার সংখ্যা, পদাঙ্গুলির মধ্যেকার চামড়ার বৃদ্ধি, দেহগঠনের এইসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি পরিবর্তনশীল; নিখুঁত পালকসমূহের আবির্ভাবের সময়কাল ভিন্ন হয়, ডিম ফুটে বের হওয়া বাচ্চা পায়রাদের নরম পালকগুলো যেমন ভিন্ন হয়, ডিমের আকার ও আয়তন ভিন্ন হয়, উড্ডয়ন পদ্ধতি এবং কয়েকটি জাতের কণ্ঠস্বর ও স্বভাব লক্ষণীয়ভাবে পৃথক। সর্বশেষ কয়েকটি জাতের পুরুষ ও স্ত্রীরা পরস্পরের থেকে সামান্য ভিন্ন হয়।, সামগ্রিকভাবে অন্ততঃ এক কুড়ি পায়রাকে মনোনীত করে যদি একজন পক্ষীবিশারদকে দেখানো হয় এবং বলা হয় যে এরা সকলে বন্য পাখি, তাহলে তিনি নিশ্চয় এদের স্পষ্টচিহ্নিত প্রজাতি হিসাবে চিহ্নিত করবেন। অধিকন্তু আমি বিশ্বাস করি
যে এইসব ক্ষেত্রে কোন পক্ষীবিশারদ ইংলিশ গিরাবাজ, খবমুখওয়ালা লোটন, রান্ট, গোলা, পাউটার এবং লক্কা পায়রাদের একই গণের অন্তর্ভুক্ত করবেন; আরও বিশেষভাবে এইসব জাতগুলোর প্রত্যেকটির কয়েকটি প্রকৃত বংশধর উপ-জাত অথবা প্রজাতি তাকে দেখানো যেতে পারত যাদের তিনি প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করবেন।
পায়রাদের জাতগুলির মধ্যেকার পার্থক্যসমূহ যতই বিরাট হোক না কেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে প্রকৃতিবিদদের সাধারণ অভিমত নির্ভূল। যথা, পাহাড়ি পায়রাদের (কলম্বিয়া লিভিয়া) থেকেই কিছু ভৌগোলিক জাত অথবা উপপ্রজাতি সমেত সকলের উদ্ভব ঘটেছে, যারা পরস্পরের থেকে অতি তুচ্ছ কয়েকটি বিষয়ে ভিন্ন হয়। যুক্তিগুলোর কয়েকটি যা আমাকে বিশ্বাস করতে অনুপ্রাণিত করেছে ও যেগুলো অন্য ক্ষেত্রে কিছু মাত্রায় প্রযোজ্য হয়, তা আমি এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করব। যদি কয়েকটি জাত ভ্যারাইটি (প্রকার) না হয় এবং পাহাড়ি পায়রা থেকে উদ্ভূত না হয়ে থাকে, তাহলে এরা নিশ্চয় অন্ততঃ সাত বা আটটি আদিম বংশ (স্টক) থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকবে, কারণ যে কোন কম সংখ্যক সঙ্করণের মাধ্যমে বর্তমান গৃহপালিত জাতগুলির। সৃষ্টি অসম্ভব : উদাহরণস্বরূপ, কোন একটি পিতামাতার বংশে বিরাট পাকস্থলী না থাকলে, কেমন করে দুটি সঙ্করণের দ্বারা একটি পাউটার পায়রা সৃষ্টি করা যেতে পারে? তথাকথিত আদিম বংশগুলো সকলে নিশ্চয় পাহাড়ি পায়রা হয়ে থাকবে, অর্থাৎ এরা বংশবৃদ্ধি করেনি বা স্বেচ্ছায় গাছে এসে বসে না। কিন্তু কয়েকটি উপপ্রজাতি সমেত কলম্বিয়া লিভিয়া ছাড়া পাহাড়ি পায়রাদের কেবল দুটি বা তিনটি প্রজাতি আছে বলে জানা গেছে এবং এদের মধ্যে গৃহপালিত জাতসমূহের কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয় না। অতএব তথাকথিত আদিম বংশগুলি সেইসব দেশে এখনও নিশ্চয় আছে। যেখানে এদের প্রথমে গৃহপালিত করা হয়েছিল, তথাপি এটি পক্ষীবিশারদদের নিকট অজ্ঞাত রয়েছে; এবং এদের আকার, স্বভাব, লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলি বিবেচনা করলে মনে হয় এটি অসম্ভব; অথবা বন্যাবস্থায় এরা বিলুপ্ত হয়ে থাকবে। কিন্তু পাহাড়ের ঢালু জায়গায় ডিম পাড়তে ও ভালভাবে উড়ে পালাতে পারায় অভ্যস্ত পাখিদের নিশ্চিহ্ন হওয়া অসম্ভব, এবং ছোট ছোট কয়েকটি ব্রিটিশ দ্বীপে বা ভূমধ্যসাগরের উপকূলে গৃহপালিত জাতগুলোর স্বভাব সম্বলিত সাধারণ পাহাড়ি পায়রারা নিশ্চিহ্ন হয়নি। অতএব পাহাড়ি পায়রাদের সদৃশ স্বভাব সম্বলিত অসংখ্য প্রজাতির তথাকথিত নিশ্চিহ্ন হওয়ার বক্তব্যটি সম্ভবতঃ একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। এ ছাড়াও উপরোক্ত গৃহপালিত জাতগুলোর কয়েকটি পৃথিবীর সকল অংশে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং এদের মধ্যে কয়েকটি নিশ্চয় এদের নিজের দেশেও পুনরায় স্থানান্তরিত হয়েছে; কিন্তু একটিও বন্য। অথবা অপোষ্য হয়নি, যদিও অল্প পার্থক্যযুক্ত পাহাড়ি ডোভেকট পায়রাটি কয়েকটি জায়গায় অপোষ্য হয়েছে। যাবতীয় সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা দেখায় যে বন্যপ্রাণীদের গৃহপালনাধীনে অবাধে বংশবিস্তার করানো অতিশয় কষ্টকর; তথাপি আমাদের পায়রাদের বহুবিধ উৎপত্তির প্রকল্প অনুসারে নিশ্চয় অনুমান করা উচিত যে প্রাচীনকালে অর্ধসভ্য মানুষদের দ্বারা অন্ততঃ সাত বা আটটি প্রজাতি এত সম্পূর্ণরূপে গৃহপালিত হয়েছিল যে আটক অবস্থাতেও এরা বহু সন্তান উৎপাদনক্ষম হয়েছিল।
অন্য কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং অত্যন্ত জোরালো একটি যুক্তি হচ্ছে যে উপরোক্ত জাতগুলো, যদিও দেহগঠনে, স্বভাবে, কণ্ঠস্বরে, বর্ণে এবং এদের দেহের অধিকাংশ প্রত্যঙ্গে পাহাড়ি পায়রাদের সঙ্গে সাধারণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ বা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তথাপি অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে নিশ্চয় অতিমাত্রায় অস্বাভাবিক হয়; ইংলিশ গিরাবাজ অথবা। হ্রস্বমুখওয়ালা লোটন বা গোলা পায়রার ঠোঁটের মতো একটি ঠোঁট, জ্যাকোবিনদের মতো উল্টানো পালক, পাউটারের মত গলার থলি, লক্কা পায়রাদের মত লেজ পালক কলুকিম্বডির মত বিরাট গোত্রে খুঁজতে বৃথাই চেষ্টা করি আমরা। অতএব নিশ্চয় মনে করা উচিত যে অর্ধসভ্য মানুষরা কেবল কয়েকটি প্রজাতিকে গৃহপালিত করতে সমর্থ হয়নি, বরং তারা ইচ্ছাকৃত বা আকস্মিকভাবে অসাধারণ অস্বাভাবিক প্রজাতিদের বেছে নিয়েছিল; এবং আরও বলা যায় যে এইসব আসল প্রজাতিরা তখন থেকেই সকলে লুপ্ত হয়েছে অথবা অজ্ঞাত রয়েছে। এত সব অদ্ভুত অনিশ্চিত সম্ভাবনা অতিমাত্রায় অসম্ভাব্য।
পায়রাদের বর্ণ সংক্রান্ত কিছু তথ্য বিবেচনার যোগ্য। পাহাড়ি পায়রারা শ্লেট পাথরের মত নীলাভ, যার কটিদেশ শ্বেত বর্ণের; কিন্তু ভারতীয় উপপ্রজাতি স্ট্রিকল্যান্ডের কলম্বিয়া ইন্টারমিডিয়া পায়রার এই অংশটি ঈষৎ নীলাভ, লেজের শীর্ষভাগে কালো ডোরা দাগ থাকে, বাইরের পালকের নিচের দিকের ধার সাদা রঙের হয়। ডানাতে দুটি কালো ডোরা দাগ থাকে। কয়েকটি অর্ধগৃহপালিত এবং প্রকৃত বন্য জাতের দুটি কালো ডোরা দাগ ছাড়া ডানাগুলি কালো রঙের ছোপ দিয়ে নকশা কাটা। সমগ্র গোত্রের যে কোন প্রজাতিতে এইসব চিহ্ন একত্রে থাকে না। এমতাবস্থায় সম্পূর্ণরূপে বংশবৃদ্ধিপ্রাপ্তদের ধরে নিয়ে গৃহপালিত জাতসমূহের প্রত্যেকটিতে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি, এমনকি লেজের বাইরের পালকের সাদা ধারও কোন কোন সময় একত্রে নিখুঁতভাবে বিকশিত হয়ে ওঠে। এছাড়াও, যখন দুই বা ততোধিক ভিন্ন জাতের অন্তর্গত। পাখিরা সঙ্করিত হয়, তখন এদের কোনটাই নীল রঙের হয় না অথবা এরা উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যমূলক চিহ্নের অধিকারী হয় না, বর্ণসঙ্কর বংশধরে এইসব বৈশিষ্ট্য হঠাৎ-হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি উদাহরণের মাধ্যমে আমি যা লক্ষ্য করেছি তা হচ্ছে : কয়েকটি সাদা লক্কা পায়রার সঙ্গে, যারা অনুরূপ বংশধরের জন্ম দেয়, কয়েকটি কালো গোলা। পায়রার প্রজনন ঘটাই আমি; ফলস্বরূপ দেখা গেল যে গোলা পায়রার নীল জাতটি এত, বিরল হল যার একটিও উদাহরণ ইংল্যান্ডে আমি কখনও শুনি নি; এবং বর্ণসঙ্কররা কালো, বাদামী ও বহু বর্ণের হয়েছিল। একটি গোলা পায়রার সঙ্গে একটি ছোপ-ছোপ দাগওয়ালা পায়রার সঙ্করণ ঘটিয়েছিলাম, দাগওয়ালা সাদা পায়রাটির লেজ লাল ও কপালে লাল দাগ ছিল এবং সকলেই জানে যে এরা সদৃশ বংশধর উৎপাদন করে। বর্ণসঙ্কররা হয়েছিল ইষৎ লালচে রঙের এবং নানা বর্ণের ছোপযুক্ত। এরপর আমি গোলা-লক্কা পায়রার বর্ণসঙ্করদের একটির সঙ্গে গোলা ও ছোপ-ছোপ দাগওয়ালা পায়রার বর্ণসঙ্করদের একটির সঙ্করণ ঘটাই, এবং তার ফলে কোমর সাদা, ডানায় জোড়া কালো ডোরা দাগ ও মোটা ডোরা দাগ এবং লেজের পালকের ধারে ডোরা দাগ সম্বলিত যে কোন বন্য পাহাড়ী পায়রার মত একটি অতি সুন্দর নীল বর্ণের পাখি উৎপাদন করেছিল এরা! যদি সমস্ত গৃহপালিত জাতগুলি পাহাড়ি পায়রা থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকে, তাহলে পৈতৃক বৈশিষ্ট্যে প্রত্যাবর্তনের সুপরিচিত নীতির ওপর ভিত্তি করে আমরা এ সব বিষয় বুঝতে পারি। কিন্তু যদি আমরা এটি অস্বীকার করি, তাহলে নিচের দুটি অসম্ভব কল্পনা আমাদের অবশ্যই করতে হবে। প্রথমতঃ হয় সমস্ত কল্পিত আদিম বংশগুলো পাহাড়ি পায়রার মত বর্ণময় ও ছোপচিহ্নিত ছিল, যদিও বর্তমানের কোন প্রজাতি এইরূপ বর্ণময় ও চিহ্নিত নয়, যাতে করে প্রত্যেক পৃথক জাতে সেই একই বর্ণ ও চিহ্নের প্রত্যাবর্তনের প্রবণতা থাকতে পারত। দ্বিতীয়তঃ, নয়তো বিশুদ্ধতম জাতটি সমেত প্রত্যেক জাত বারো অথবা অন্ততঃ এক কুড়ি বংশের মধ্যে এমন একটিও বংশের উদাহরণ জানা নেই যেখানে সঙ্করিত বংশধররা বেশি সংখ্যক বংশ বাদ দিয়ে অনাত্মীয় রক্তের পূর্বপুরুষে প্রত্যাবর্তন করেছে। কেবলমাত্র একবার সঙ্করিত হওয়া জাতে এই সঙ্করণের ফলে উদ্ভূত যে কোন বৈশিষ্ট্যে প্রত্যাবর্তনের প্রবণতা স্বভাবতই অল্প থেকে অল্পতর হবে, কারণ প্রত্যেক পরবর্তী বংশে অনাত্মীয় (বিদেশি) রক্ত কমতে থাকবে; কিন্তু যখন কোন সঙ্করণ হয় না এবং একটি জাতে পূর্বের কোন কোন বংশে লুপ্ত হওয়া একটি বৈশিষ্ট্যে প্রত্যাবর্তনের প্রবণতা থাকে, তখন আমরা দেখি অনির্দিষ্ট সংখ্যক বংশ ধরে এই প্রবণতা অপরিবর্তিতভাবে পরিবাহিত হতে পারে। প্রত্যাবর্তনের এই দুটি ভিন্ন ঘটনা প্রায়শই তারা একত্রে মিশিয়ে ফেলেন, যাঁরা বংশগতি সম্বন্ধে লিখেছেন।
পরিশেষে, পায়রাদের সকল জাতের সঙ্কর ও বর্ণসঙ্কররা যে জননশক্তি সম্পন্ন হয়, সবচেয়ে স্বতন্ত্র জাতগুলির উপর আমি যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলাম তার উপর ভিত্তি করে তা আমি নিশ্চিতরূপে বলতে পারি। বর্তমানে প্রাণীদের দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির সঙ্কররা সম্পূর্ণরূপে উর্বর হয়, এমন কোন ঘটনার কথা কদাচিৎ নিশ্চিতরূপে জানা যায়। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে দীর্ঘদিন গৃহপালনাধীনে থাকার ফলে প্রজাতির বন্ধ্যা হওয়ার এই শক্তিশালী প্রবণতা অপসারিত হয়। কুকুর এবং অন্য কয়েকটি গৃহপালিত প্রাণীর ইতিহাস দেখলে বোঝা যায় যে এই সিদ্ধান্ত নিকট সম্বন্ধযুক্ত প্রজাতিদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হলে সম্ভবতঃ সম্পূর্ণ সঠিকই হবে। এখনকার গিরাবাজ, লোটন, পাউটার এবং লক্কা পায়রাদের থেকে উৎসগতভাবে স্বতন্ত্র প্রজাতিরা। সম্পূর্ণ উর্বর বংশধর উৎপাদন করে, এটা তর্কের খাতিরে স্বীকার করা চরম হঠকারিতা।
এইসব কারণগুলির কয়েকটি, যথা, পায়রাদের সাত বা আটটি কল্পিত প্রজাতির গৃহপালনাধীনে অবাধে প্রজনন করানোর ব্যাপারে মানুষের অক্ষমতা; এইসব কল্পিত প্রজাতিদের বন্যাবস্থায় অবস্থানের বিষয়টি সম্পূর্ণ অজানা এবং গৃহপালনাধীন বন্দীদশা। থেকে মুক্ত হয়ে কোথাও বন্য অবস্থায় ফিরে যাওয়া; কলাম্বিডি গোত্রের অন্য সব প্রজাতির তুলনায় এইসব প্রজাতিদের অতি অস্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করা, যদিও এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাহাড়ি পায়রাদের সদৃশ হয়; উভয়কেই যখন বিশুদ্ধ অবস্থায় রাখা হয় ও যখন সঙ্করিত হয় তখন সব জাতে নীল রঙ ও বিভিন্ন কালো দাগগুলির হঠাৎ পুনরাবির্ভাব হওয়া, এবং পরিশেষে বর্ণসঙ্কর বংশধরদের সম্পূর্ণ উর্বর হওয়া–এইসব কারণগুলোকে একত্র করে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে আমাদের সমস্ত গৃহপালিত জাতগুলি পাহাড়ি পায়রা অথবা তার ভৌগোলিক উপ-প্রজাতি সমেত কলাম্বিয়া লিভিয়া থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
এই মতবাদের সমর্থনে আমি আরও কিছু যোগ করতে পারি। প্রথমতঃ, বন্য। কলাম্বিয়া লিভিয়া পায়রাটি ইউরোপে ও ভারতবর্ষে পোষ মানতে সমর্থ বলে দেখা গেছে, এবং এরা স্বভাবে ও শরীরগঠনের অনেক বিষয়ে সমস্ত গৃহপালিত জাতের সঙ্গে। মিলে যায়। দ্বিতীয়তঃ, যদিও একটি ইংলিশ গিরাবাজ বা একটি ছোট মুখওয়ালা লোটন পায়রা পাহাড়ি পায়রাদের থেকে কোন কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ভীষণভাবে ভিন্ন হয়, তবুও এই দুটি জাতের কয়েকটি উপজাত, বিশেষ করে দূরবর্তী দেশগুলিতে আনীত উপ-জাতগুলির তুলনা করে পাহাড়ি পায়রা ও এদের মধ্যে প্রায় নিখুঁত একটি শ্রেণী আমরা তৈরি করতে পারি; এভাবে অন্য কয়েকটি ক্ষেত্রেও, অবশ্য সব জাতগুলির ক্ষেত্রে নয়, এরূপ শ্রেণী তৈরি করতে পারি আমরা। তৃতীয়তঃ, প্রত্যেক জাতে প্রধানত স্বাতন্ত্র-নির্দেশক বৈশিষ্ট্যগুলির প্রতিটিই বিশেষভাবে পরিবর্তনশীল, যেমন গিরাবাজ পায়রার মাথার ঝুঁটি ও ঠোঁটের দৈর্ঘ্য, লোটন পায়রার ঝুঁটি ও ঠোঁটের হ্রস্বতা এবং লক্কা পায়রার লেজের পালকের সংখ্যা; নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনার সময় এই বিষয়টি স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করা হবে। চতুর্থতঃ, অনেক মানুষ অতি যত্ন সহকারে ও মনোযোগ দিয়ে পায়রাদের পর্যবেক্ষণ ও পালন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েক হাজার বছর ধরে গৃহপালিত হয়েছে এরা; পায়রার সবচেয়ে পুরানো রেকর্ড হচ্ছে প্রায় ৩০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ইজিপ্টের পঞ্চম রাজবংশের রাজত্বকালে, যেটি অধ্যাপক লেপসিয়াস আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন; কিন্তু মিঃ বাৰ্চ, আমাকে অবহিত করেছেন যে পূর্ববর্তী রাজবংশের রাজত্বকালে পায়রাদের যাতায়াতের জন্য ভাড়া দেওয়া হত। যেমন আমরা প্লিনির লেখা থেকে জানতে পারি যে রোমানদের রাজত্বের সময় পায়রাদের জন্য অর্থ ব্যয় করা হত; “শুধু তাই নয়, এটি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে এরা এদের কুলজি ও জাত বিচার করতে পারে।” ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভারতবর্ষের আকবর খান। পায়রাদের অত্যন্ত মূল্য দিতেন, তাঁর রাজসভায় কখনও ২০০০-এর কম পায়রা রাখা হত না। “ইরান ও তুরানের সম্রাটরা তাঁকে কয়েকটি বিরল জাতের পায়রা পাঠিয়েছিলেন, এবং রাজসভার ঐতিহাসিকরা আরও বলেন, “জাতগুলির মধ্যে সঙ্করণের দ্বারা সম্রাট এদের বিস্ময়করভাবে উন্নত করেছিলেন। প্রায় একই সময়ে পায়রাদের সম্বন্ধে প্রাচীন রোমানদের মত ওলন্দাজরাও খুব আগ্রহী ছিল। পায়রাদের প্রচণ্ড পরিমাণ পরিবৃত্তি ব্যাখ্যা করতে এগুলো বিবেচনার গুরুত্ব স্পষ্টতর হবে যখন আমরা নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনা করব। তখন আমরা এ-ও দেখব যে কেমন করে কয়েকটি জাত প্রায়শই কিছু পরিমাণ বিকৃত বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। ভিন্ন জাত সৃষ্টির পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল অবস্থাটি হচ্ছে যাতে করে সহজেই বংশধর উৎপাদনের জন্য পুরুষ ও স্ত্রী পায়রারা মিলিত হতে পারে; এবং সেইজন্য বিভিন্ন জাতগুলোকে একত্রে একই পক্ষীশালায় রাখা যেতে পারে।
গৃহপালিত পায়রাদের সম্ভবপর উৎপত্তি সম্বন্ধে আমি কিছুটা অপর্যাপ্তভাবে আলোচনা করেছি; কারণ কেমন করে এরা সদৃশ বংশধর উৎপাদন করে তা ভালভাবে অবগত হয়ে আমি যখন প্রথম এদের পালন ও কয়েক প্রকার জাতকে পর্যবেক্ষণ করেছিলাম, তখন আমি বিশ্বাস করতে অতিশয় অসুবিধা বোধ করেছিলাম যে যেহেতু এরা গৃহপালিত হয়েছিল, সেজন্য এরা একটি সাধারণ পিতামাতা থেকে যাত্রা শুরু করেছিল, যেমন প্রাকৃতিক পরিবেশে ফিঞ্চ পাখির অনেক প্রজাতি বা অন্য গোষ্ঠীর পাখিদের সম্পর্কে যে কোন প্রকৃতিবিজ্ঞানী একই সিদ্ধান্তে পৌঁছাত। একটি ঘটনা আমাকে অতিশয় আশ্চর্যান্বিত করেছে, যথা, যাদের সঙ্গে আমি আলোচনা করেছি বা যাদের লেখা আমি পড়েছি এমন বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণীর প্রায় সব প্রজননকারী ও কৃষকরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে কয়েকটি জাত অনেক আদিম ভিন্ন প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে। যেমন, আমি যদি একজন বিখ্যাত হেরেফোর্ড গো-মহিষাদি প্রজননকারীকে জিজ্ঞাসা করি, যে তার গো-মহিষাদি লম্বা শিংওয়ালা গো-মহিষাদি থেকে বা উভয়েই সাধারণ পিতামাতা বংশ থেকে উদ্ভূত হয়েছে কিনা, তাহলে সে আপনার-আমার কথায় অবজ্ঞা সহকারে হেসে উঠবে। পায়রা বা গৃহপালিত পাখি ও হাঁস বা খরগোশ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আমি এমন একজনেরও সাক্ষাৎ পাইনি যিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন না যে প্রত্যেক প্রধান জাত একটি স্বতন্ত্র প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। ভ্যান মন্স ন্যাসপাতি ও আপেল সম্বন্ধে তার লেখা গ্রন্থরাজিতে দেখান কত চূড়ান্তভাবে তিনি অবিশ্বাস করেন যে রিবস্টোন-পিপ্পিন ও কডলিন-আপেলের মতো কয়েক জাতের আপেল একই গাছের বীজ থেকে উৎপন্ন হয়। অন্য অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারত। আমি মনে করি ব্যাখ্যাটি সরল : দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধানের পর কয়েকটি জাতের পার্থক্যগুলো সম্পর্কে তারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছে; এবং যদিও তারা ভালভাবে পরিচিত যে প্রত্যেক জাত খুব অল্প ভিন্ন হয়, সেজন্য তারা এই অল্প পার্থক্যযুক্ত জাতগুলোকে নির্বাচন করে, পুরস্কার লাভ করে, তথাপি তারা সমস্ত সাধারণ যুক্তিগুলোকে অগ্রাহ্য করে এবং বহু বংশপরম্পরা ধরে অল্প পার্থক্যগুলো সঞ্চিত হয়েছে। এই ধারণাকে মনে স্থান দিতে অস্বীকার করে। আবার যখন প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক পরিবেশে একটি প্রজাতিকে অন্য প্রজাতির বংশধর হিসেবে ভাবার ধারণাকে উপহাস– করেন, তখনই এইসব প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা প্রজননকারীর তুলনায় বংশগতির নিয়মাবলী অতি অল্প ও দীর্ঘ বংশধারার মধ্যবর্তী অবস্থা সম্বন্ধে একেবারে কিছু না জানলেও স্বীকার করেন যে আমাদের গৃহপালিত জাতগুলি একই পিতামাতা থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
প্রাচীন যুগ থেকে অনুসৃত নির্বাচন পদ্ধতি, তাদের ফলাফল
এক-এক করে ধাপগুলো আমাদের এখন সংক্ষেপে আলোচনা করা দরকার, যাদের দ্বারা আমাদের গৃহপালিত জাতগুলো হয় একটি অথবা কয়েকটি সম্বন্ধযুক্ত প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে। কিছু ফল জীবনের বহিঃপরিবেশের প্রত্যক্ষ ও নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া দ্বারা ঘটতে পারে, আবার কিছু ফল স্বভাবের জন্যও ঘটতে পারে। তা হলে তিনি একজন সাহসী লোক হবেন যিনি একটি ভারী ঠেলাগাড়ি-টানা ঘোড়া ও ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া, একটি গ্ৰেহাউণ্ড ও ব্লাডহাউণ্ড, একটি গিরাবাজ ও লোটন পায়রার মধ্যে পার্থক্যের জন্য এইসব মাধ্যমকে গুরুত্ব দেবেন। আমাদের গৃহপালিত জাতগুলোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদের অভিযোজন, যেটি ঘটে প্রকৃতপক্ষে প্রাণী বা উদ্ভিদের মঙ্গলের জন্য নয়, বরং মানুষের ব্যবহার ও পছন্দের জন্য। তার কাছে উপকারী কিছু পরিবৃত্তি সম্ভবতঃ হঠাৎ উদ্ভূত হয়, অথবা একটি ধাপের দ্বারা, যেমন, অনেক উদ্ভিদবিজ্ঞানী। বিশ্বাস করেন যে অঙ্কুশ সমেত ফুলারের টিশেল কেবল বন্য ডিস্যাকাসের একটি ভ্যারাইটি, যার কোন যান্ত্রিক কৌশলের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না, এই পরিমাণ পরিবৃত্তি হঠাৎ চারাগাছে উদ্ভূত হয়ে থাকতে পারে। এভাবে খর্ব পাওয়ালা কুকুরের ক্ষেত্রেও এটি ঘটে থাকতে পারে; এবং এটি অতি খর্ব পাওয়ালা ভেড়ার ক্ষেত্রে ঘটে বলে অনেকেই জানে। কিন্তু যখন আমরা ভারী-ঠেলাগাড়ি-টানা ঘোড়া ও ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া, এক কুঁজওয়ালা উট ও সাধারণ উট এবং ভেড়ার বিভিন্ন জাতের তুলনা করি, যে ভেড়া হয় কৃষি জমি বা পাহাড়ি চারণভূমির জন্য উপযুক্ত, এবং যাদের একটি জাতের পশম এক উদ্দেশ্যে ও অন্যটির অন্য উদ্দেশ্যের জন্য উপযুক্ত; মানুষের কাছে বিভিন্ন জাতের কুকুর বিভিন্নভাবে উপকারী এমন কুকুরের জাতগুলো তুলনা করি; একগুঁয়ে লড়াকু মোরগের সঙ্গে অল্প কলহপ্রিয় মোরগ, এক জায়গায় বসতে চায় না এমন অনবরত ডিম পাড়া মুরগী, এবং ছোট্ট অথচ সুশ্রী ব্যানট্যাম জাতীয় লড়িয়ে গৃহপালিত মোরগের যখন আমরা তুলনা করি, যারা বিভিন্ন ঋতুতে ও বিভিন্ন উদ্দেশ্যে মানুষের এত প্রয়োজনীয় ও মানুষের চোখে এত মনোমুগ্ধকর; আমি মনে করি কেবল পরিবৃত্তি ছাড়াও অন্য কিছুও আমাদের লক্ষ্য করা উচিত। এখনকার মতো নিখুঁত ও উপকারী সমস্ত জাত হঠাৎ উদ্ভূত হয়েছিল কিনা তা আমরা কল্পনা করতে পারি না; অনেক ক্ষেত্রে আমরা জানি যে যথার্থই এটি এদের ইতিহাস নয়। চাবিকাঠিটি হচ্ছে সঞ্চয়ী নির্বাচনে মানুষের ক্ষমতা। প্রকৃতি আনুক্রমিক পরিবৃত্তিগুলি উৎপাদন করে; নিজের উপকার হয়। এমনদিকে মানুষ এদের সংযোজিত করে। এ অর্থে বলা যেতে পারে মানুষ নিজের প্রয়োজনে উপকারী জাত সৃষ্টি করে।
নির্বাচনের এই পদ্ধতিটির বিরাট ক্ষমতা অনুমানভিত্তিক নয়। এটা নিশ্চিত যে আমাদের সময়ের কয়েকজন প্রজননকারী তাদের নিজস্ব জীবনকালের মধ্যে গো-মহিষাদি ও ভেড়ার জাতগুলোকে বহুল পরিমাণে রূপান্তরিত করেছিলেন। তাঁরা কী কী করেছেন তা পরিপূর্ণভাবে বোঝার জন্য বিষয়টি সম্বন্ধে লিখিত কয়েকটি বই পড়া ও প্রাণীদের সযত্নে নিরীক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন। প্রজননকারীরা অভ্যাসবশতঃ বলেন যে প্রাণীদের জৈবিককঠন বেশ নমনীয়, যেমন খুশি তেমনভাবে এদের পরিবর্তিত করতে পারেন। যদি এখানে জায়গা থাকত, আমি অতিশয় দক্ষ বিশেষজ্ঞদের লেখা থেকে অসংখ্য উদ্ধৃতি দিতে পারতাম। ইউয়াট, যিনি অন্য যে কোন ব্যক্তির তুলনায় কৃষিবিজ্ঞানীদের লেখা ও কাজ সম্বন্ধে সম্ভবতঃ বেশি অবহিত ছিলেন এবং নিজেও প্রাণী সম্বন্ধে অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, নির্বাচনের পদ্ধতিটি সম্পর্কে বলেন, “এটি শুধু গো-মহিষাদির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের রূপান্তর ঘটায় তাই নয়, সম্পূর্ণরূপে এদের রূপান্তর ঘটাতে কৃষিবিজ্ঞানীদের ক্ষমতাও প্রদান করে। এটি যদুকরের যাদুদণ্ডের মতো যার দ্বারা তিনি জীবনের যে কোন আকার দিতে পারেন ও পছন্দমতো রূপদান করতে পারেন।” ভেড়ার ক্ষেত্রে প্রজননকারীরা কী করেছেন তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লর্ড সমারভিল বলেন, “মনে হবে যেন আপনা থেকে নিখুঁত একটি আকৃতি এরা দেওয়ালে এঁকেছে ও পরে সেটিকে বাস্তব রূপ দিয়েছে।” স্যানিতে মেরিনো ভেড়া সম্পর্কে নির্বাচনের পদ্ধতিটির গুরুত্ব পুরোপুরি স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে এটিকে মানুষ একটি ব্যবসা বলে গণ্য করে। যেমন একজন রসজ্ঞ ব্যক্তি একটি ছবির কদর করে, তেমনিভাবে ভেড়াদের একটি টেবিলের উপর রাখা হয় ও পর্যবেক্ষণ করা হয়; একমাস অন্তর-অন্তর এটি তিন বার করা হয় এবং প্রত্যেকবার ভেড়াদের চিহ্নিত শ্রেণীভুক্ত করা হয়, যাতে করে সর্বোত্তমটিকে প্রজননের জন্য নির্বাচিত করা যায়।
ইংরেজ প্রজননকারীরা আসলে কী ফল পেয়েছে, ভাল বংশতালিকা সমেত প্রাণীদের উচ্চ মূল্যই তা প্রমাণ করে; এবং এরা পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশে রপ্তানি হয়েছে। বিভিন্ন জাতের সঙ্করণের দ্বারা কোন মতেই সাধারণতঃ উৎকর্ষসাধন হয়নি। কোন কোন সময় নিকট সম্বন্ধীয় উপ-জাত ছাড়া সেরা প্রজননকারীরা এই প্রথার দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করে। এবং যখন সঙ্করণ ঘটানো হয়, এমনকি সাধারণ ঘটনা ছাড়াও নিকটতম নির্বাচন আরও বেশি অপরিহার্য। যদি নির্বাচনের অর্থ কয়েকটি অতিশয় ভিন্ন। ভ্যারাইটির পৃথকীকরণ হয় এবং এর থেকে প্রজনন করা হয়, পদ্ধতিটি (নীতিটি) এতই স্পষ্ট হবে যা কদাচিৎ চোখে পড়ার যোগ্য; বরং পার্থক্যগুলির বংশপরম্পরায় একই দিকে পুঞ্জীভবনের দ্বারা উৎপন্ন বিরাট ফলাফলেই রয়েছে এটির গুরুত্ব, যেটি একজন। অশিক্ষিত লোকের চোখে ধরা পড়ে না–পার্থক্যগুলি ধরতে আমি একবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। একজন দক্ষ প্রজননকারী হওয়ার গুণ নিপুণ বিচার ক্ষমতা ও নিখুঁত চোখ যা এক হাজার জনের মধ্যে একজনেরও থাকে না। এইসব গুণ দ্বারা যদি ভূষিত হন। এবং যদি অনেক বছর ধরে পড়াশুনা করেন ও অদম্য ধৈর্য্যের সঙ্গে সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেন, তবে তিনি কৃতকার্য হবেন এবং বিরাট অগ্রগতি করতে পারবেন; এইসব গুণাবলী যে কোন একটি যদি তিনি চান, তাহলে নিশ্চিতভাবে অকৃতকার্য হবেন। এমনকি একজন দক্ষ পায়রা বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা ও স্বাভাবিক সামর্থ্যকে শুধু অল্প কয়েকজন সহজেই বিশ্বাস করবে।
উদ্যানবিদরাও একই নীতি বা পদ্ধতি অনুসরণ করেন; কিন্তু এখানে প্রকারণগুলি প্রায়শই আকস্মিক হয়। কেউই মনে করে না যে আমাদের উৎকৃষ্টতম উৎপাদনসমূহ আদিম বংশ (কুল) থেকে শুধুমাত্র একটি প্রকারণ দ্বারা উৎপাদিত হয়েছে। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে যে কয়েকটি ক্ষেত্রে এরূপ হয় না, যার লিখিত বিবরণ রয়েছে। এভাবে একটি তুচ্ছ উদাহরণ দিতে সাধারণ গুজবেরি অনবরত আকার বৃদ্ধির উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বিশ বা ত্রিশ বছর আগে আঁকা ছবির সঙ্গে বর্তমানের ফুলের যখন তুলনা করা হয়, তখন অনেক ফুলচাষীর দ্বারা বিস্ময়কর উন্নতিসাধন আমরা লক্ষ্য করি। উদ্ভিদের একটি জাত যখন সুপুষ্ট হয়, বীজ-সংগ্রহকারী উৎকৃষ্ট গাছটি তোলে না, বরং সে এদের বীজতলা পরিদর্শন করে ও নিকৃষ্টগুলিকে তুলে ফেলে, তারা বলে যে এরা সঠিক মান থেকে বিচ্যুত হয়েছে। প্রাণীদের ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতি একইভাবে অনুসরণ করা হয়, কারণ নিকৃষ্ট প্রাণীর প্রজনন ঘটাতে কোন লোক কদাচিৎ এত অসতর্ক হয়।
উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে নির্বাচন পদ্ধতির সঞ্চিত ফলাফল লক্ষ্য করার উপায় হচ্ছে–যথা, ফুলের বাগানে একই প্রজাতির বিভিন্ন ভ্যারাইটির ফুলের বৈচিত্র্য; একই ভ্যারাইটির ফুলের তুলনায় বাসগৃহ সংলগ্ন তরিতরকারীর বাগানের পাতা, শুটি বা কল অথবা প্রয়োজনীয় অংশগুলির বৈচিত্র্য; এবং ভ্যারাইটিদের একই গোষ্ঠীর পাতা ও ফুলের তুলনায় ফলের বাগানে একই প্রজাতির ফলের বৈচিত্র্য ইত্যাদির তুলনা করা। বাঁধাকপির পাতা কত বিভিন্ন ধরনের হয় ও ফুলগুলি একই ধরনের হয় তা লক্ষ্য করুন; হার্টসিজের ফুলগুলি কত অসদৃশ ও পাতাগুলি কত সদৃশ, গুজবেরি বিভিন্ন প্রকারের ফলের আকার, বর্ণ, আকৃতি ও রোম কত ভিন্ন ধরনের, তা সত্ত্বেও ফুলগুলি কত অল্প ভিন্ন। এটি এই নয় যে ভ্যারাইটিরা কোন একটি বৈশিষ্ট্যে বহুলাংশে ভিন্ন হয়, অন্য বৈশিষ্ট্যগুলিতে মোটেই ভিন্ন হয় না; এটি কদাচিৎ কখনও দেখা যায়–সতর্ক পর্যবেক্ষণের পর আমি বলছি, ঘটনাটি বোধহয় কখনও ঘটে না। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত পরিবৃত্তির নিয়ম, যার গুরুত্ব কখনও উপেক্ষা করা উচিত নয়, কিছু কিছু বিভিন্ন তার বিষয়ে আলোকপাত করবে। কিন্তু একটি সাধারণ নিয়মানুসারে, এটি সন্দেহ করা যায় না যে হয় পাতায়, ফুলে অথবা ফলে স্বল্পমাত্রায় পরিবৃত্তিগুলির ক্রমাগত নির্বাচন পরস্পরের থেকে এইসব বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন জাতগুলোকে সৃষ্টি করবে।
বলা যেতে পারে যে নির্বাচন পদ্ধতিটিকে বড়জোর এক শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশের কিছুটা বেশি কাল ধরে নিয়মনিষ্ঠ চর্চায় রূপান্তরিত করা হয়েছে শেষের বছরগুলিতে বিষয়টি সম্পর্কে বেশি বেশি করে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে এবং বিষয়টি সম্পর্কে অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, যার ফলাফল অনুরূপ মাত্রায় অতি দ্রুত ও গুরুত্বপূর্ণ। পদ্ধতিটি (নীতিটি) কিন্তু বর্তমান যুগের আবিষ্কার নয়। বিষয়টির উল্লেখ আছে এমন অতি প্রাচীন গ্রন্থ থেকে কয়েকটা উদ্ধৃতি দিতে পারতাম, যেখানে এই পদ্ধতিটির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হয়েছে। অসভ্য ও বর্বর যুগের ইংল্যান্ডের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে সেখানে পছন্দমতো প্রাণীদের আমদানী করা হত এবং এদের রপ্তানীর বিরুদ্ধে আইন পাশ করা হয়েছিল। কোন কোন জাতের ঘোড়াকে হত্যা করার হুকুম জারী হয়েছিল এবং ফুলের বাগানে “নিকৃষ্ট” গাছগুলিকে মেরে ফেলার সঙ্গে এটির তুলনা করা যেতে পারে। আমি দেখেছি একটি প্রাচীন চীনা বিশ্বকোষে নির্বাচন পদ্ধতিটি স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। কয়েকজন প্রাচীন রোমান লেখকের লেখায় বিষয়টি সম্পর্কে নিয়মাবলী স্পষ্টভাষায় লেখা আছে। জেনেসিস’-এর অনুচ্ছেদগুলি থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে আদিম যুগে গৃহপালিত প্রাণীদের শরীরের রঙের উপর মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল। এখন অসভ্য মানুষরা কোন কোন সময় তাদের কুকুরদের জাতের উন্নতি ঘটাতে কুকুরসদৃশ প্রাণীদের সঙ্গে এদের সঙ্করণ ঘটায় এবং পূর্বেও তারা এটি করত, এ বিষয়টি প্লিনির লেখা গ্রন্থের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লিখিত আছে। আফ্রিকার অসভ্য মানুষরা তাদের ভারবাহী পশুদের শরীরের রঙ দেখে খুঁজে বার করে, এক্সিমোরাও এভাবে কুকুরদের খুঁজে বার করে। লিভিংস্টোন উল্লেখ করেছেন যে ইউরোপীয়দের সঙ্গে অপরিচিত মধ্য আফ্রিকার নিগ্রোরা উৎকৃষ্ট গৃহপালিত জাতদের ভাল দাম দেয়। এইসব তথ্যের কয়েকটি প্রকৃত নির্বাচনের ব্যাপারটি দেখায় না, বরং এটি দেখায় যে প্রাচীন যুগে গৃহপালিত প্রাণীদের প্রজনন বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হত, যেমন নিম্নতম অসভ্য মানুষরা এখনও মনোযোগ দেয়। যদি প্রজনন বিষয়ে মনোযোগ না দেওয়া হত, তা হলে এটি একটি অদ্ভুত ব্যাপার হয়ে থাকত, কারণ ভাল ও মন্দ বৈশিষ্ট্য বংশানুসৃতির ফলে ঘটে বলেই এটি এত সুস্পষ্ট।
অচেতন নির্বাচন
বর্তমানে দক্ষ প্রজননকারীরা নিয়মানুগ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বিশেষ দিকে লক্ষ্য রেখে দেশের প্রাপ্ত যে কোন জাতের তুলনায় একটি নূতন স্ট্রেন বা উপজাত সৃষ্টির চেষ্টা করে। কিন্তু এখানে আমাদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য আর এক-প্রকার নির্বাচন অতি গুরত্বপূর্ণ, যেটিকে অচেতন নির্বাচন বলা যেতে পারে এবং যেটি সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রাণী সংগ্রহ করা এবং তার থেকে ভাল জাত সৃষ্টির ব্যাপার অনেক মানুষের চেষ্টার ফল। ‘পয়েন্টার কুকুর’ পোষার জন্য একজন মানুষ সাধারণতঃ সবচেয়ে ভাল কুকুর পাওয়ার চেষ্টা করে, এবং পরে স্থায়ীভাবে জাতটিকে রূপান্তরিত করার ইচ্ছা বা আশা না করেও নিজস্ব সর্বোত্তম কুকুরগুলি থেকে নূতন জাত সৃষ্টি করে। তা সত্ত্বেও আমরা এই ধারণায় উপনীত হতে পারি যে কয়েক শতাব্দী ধরে অনুসৃত এই প্রক্রিয়াটি যে কোন জাতকে উন্নত ও রূপান্তরিত করবে, যেমন একই উপায়ে বেকওয়েল কলিন্স প্রমুখরা একই পদ্ধতির দ্বারা কেবল আরও বেশি নিয়মানুগভাবে তাদের জীবকালের মধ্যে তাদের গো-মহিষাদির আকার ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে দারুণভাবে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন। বহু পূর্বে উল্লিখিত জাতগুলির তুলনা করার জন্য প্রকৃত পরিমাপ ও যত্নসহকারে ছবি আঁকা না হলে মন্থর ও অচেতন পরিবর্তনকে কখনও শনাক্ত করা যেতে পারে না, তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে একই জাতের অপরিবর্তিত বা অল্প পরিবর্তিত এককগুলি অনুন্নত জেলায় থাকে। বিশ্বাস করার যুক্তি আছে যে সম্রাট চার্লসের রাজত্বের সময় থেকে স্প্যানিয়েল কুকুররা অজ্ঞাতসারে বহুল পরিমাণে রূপান্তরিত হয়েছে। কয়েকজন অতিদক্ষ বিশেষজ্ঞ নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেন যে গোয়েন্দা কুকুররা স্প্যানিয়েল কুকুর থেকেই প্রত্যক্ষভাবে উদ্ভূত হয়েছে এবং সম্ভবতঃ পরিবর্তনটি ধীরে ধীরে ঘটেছে। আমরা জানি যে ইংলিশ নির্দেশক কুকুররা গত শতাব্দীতেই দারুণভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং এটি বিশ্বাস করা হয় যে পরিবর্তনটি ফল্স হাউণ্ড কুকুরের সঙ্গে সঙ্করণের ফলেই মূলতঃ ঘটেছে; কিন্তু যেটি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তা হচ্ছে পরিবর্তনটি অজ্ঞাতসারে ও পর্যায়ক্রমে ঘটেছে, তথাপি এত অভীষ্ট ফলদায়করূপে ঘটেছে যে প্রাচীন স্প্যানিশ নির্দেশক কুকুররা নিশ্চিতভাবে স্পেন দেশ থেকে এসে থাকলেও মিঃ বরোর কাছ থেকে জেনেছি যে তিনি আমাদের পয়েন্টার কুকুরের মতো কোন স্থানীয় কুকুর স্পেনে দেখেন নি।
নির্বাচনের এরূপ প্রক্রিয়া ও শিক্ষার মাধ্যমে ইংলিশ ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ারা তাদের আরবীয় পিতা-মাতাদের দ্রুতগামীতায় ও আকারে ছাড়িয়ে যায়। আরব ঘোড়াদের আইন মারফত মালবহনক্ষম গুডহুড দৌড়ের জন্য বাছাই করা হয়। লর্ড স্পেনসার ও অন্যান্যরা দেখিয়েছেন কেমন করে ইংল্যান্ডের গো-মহিষাদির ওজন বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঐ দেশের আগেকার কুলগুলির তুলনায় বেড়েছে। ব্রিটেন, ভারতবর্ষ ও পারস্যদেশের গিরাবাজ ও লোটন পায়রাদের অতীত ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থাদিতে প্রদত্ত বিবরণের তুলনা করে আমরা সেই ধাপগুলির খোঁজ করতে পারি, যার মধ্য দিয়ে এরা ধাপে ধাপে এগিয়েছে ও পাহাড়ি পায়রাদের থেকে এত ভিন্ন হয়েছে।
ইউয়াট নির্বাচন প্রক্রিয়ার ফলাফলের একটি সুন্দর উদাহরণ উপস্থিত করেছেন যেটিকে অচেতন নির্বাচন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, যতদূর পর্যন্ত বলা যায় যে প্রজননকারীরা পরিণামস্বরূপ ফল উৎপাদন করার আশা অথবা ইচ্ছা প্রকাশ না করে থাকতে পারে- যেমন দুটি স্বতন্ত্র স্ট্রেনের উৎপাদন। ইউয়াটের বক্তব্য থেকে জানা যায়, “মিঃ বাকলে ও মিঃ বার্জেস-এর পোষা লাইচেস্টার ভেড়ার দুটি পালকে” পঞ্চাশ বছরেরও অধিক কাল ধরে মিঃ বেকওয়েলের পোষা আদিম বংশ থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রজনন করা হয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত এমন কারও মনে এতটুকুও সন্দেহ নেই যে উভয়ের মধ্যে যে কোন মালিক মিঃ বেকওয়েলের পোষা পালটির বিশুদ্ধ রক্ত থেকে যে কোন বিষয়ে বিচ্যুত হয়েছে, এবং তা সত্ত্বেও এই দুজন ভদ্রলোকের পালিত ভেড়াদের পার্থক্য এত বিরাট যে এরা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভ্যারাইটির আকার ধারণ করেছে।”
যদি বর্বরদের মতো বন্য মানুষরা থাকত যারা কখনই তাদের গৃহপালিত প্রাণীদের বংশধরের বংশগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা চিন্তা করে না, তথাপি বিশেষ উদ্দেশ্যের জন্য তাদের কাছে বিশেষভাবে উপকারী যে কোন একটি প্রাণী প্রায়শই ঘটা দুর্ভিক্ষ ও, অন্যান্য দুর্ঘটনার সময় যত্ন সহকারে সংরক্ষিত হবে এবং এরূপ বাছাই করা প্রাণীরা নিকৃষ্টদের তুলনায় এভাবে সাধারণতঃ আরও বেশি বংশধর উৎপাদন করবে; যার। ফলে এ ক্ষেত্রে এক প্রকার অচেতন নির্বাচন হয়ে থাকবে। আমরা লক্ষ্য করি যে অভাবের সময় নিজেদের বৃদ্ধ স্ত্রীলোকদের হত্যা করা ও মাংস খাওয়ায় অভ্যস্ত এমনকি তিয়েরা দেল ফুয়েগোর বর্বররাও তাদের কুকুরদের তুলনায় প্রাণীদের কম মূল্য দেয়।
প্রথম আবির্ভাবে গুণগতভাবে ভিন্ন ভ্যারাইটি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করতে যথেষ্ট ভিন্ন হোক বা না হোক এবং দুই অথবা ততোধিক প্রজাতি বা জাত সঙ্করণের মাধ্যমে মিশ্রিত হোক বা না হোক, উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে সর্বোৎকৃষ্ট এককদের মাঝে মাঝে সংরক্ষণ করে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত আকার ও সৌন্দর্যের ক্রমোন্নতির একই প্রক্রিয়া স্পষ্টভাবে শনাক্ত করা যেতে পারে, যেগুলি আগেকার ভ্যারাইটি বা পিতামাতা বংশের তুলনায় আমরা হার্টসিজ, গোলাপ, পেলাগোনিয়াম, ডালিয়া ও অন্যান্য উদ্ভিদের ভ্যারাইটিগুলোতে আমরা লক্ষ্য করি। একটি বন্য উদ্ভিদের বীজ থেকে শ্রেষ্ঠ হার্টসিজ বা ডালিয়া পাওয়ার আশা কারও করা উচিত নয়। বন্য ন্যাসপাতির বীজ থেকে একটি সবচেয়ে নরম ন্যাসপাতির উদ্ভব ঘটানোর আশা কেউই করে না, যদিও বন্য অবস্থায় জন্মানো একটি দুর্বল গাছ থেকে এটি ঘটাতে তিনি সফল হবেন যদি এটি বাগানকুল থেকে নেওয়া হয়। প্লিনির বর্ণনা থেকে জানা যায় ন্যাসপাতি অতি নিকৃষ্ট ধরনের একটি ফল যা প্রাচীনকালেও চাষ হত। নিকৃষ্ট উপাদান থেকে উচ্চমানের ফলাফল সৃষ্টি করতে বাগানবিদদের অসাধারণ দক্ষতা সম্বন্ধে বাগানসম্বন্ধীয় রচনাবলীতে পরম আশ্চর্য প্রকাশ হতে আমি দেখেছি। কিন্তু ব্যবহারিক বিদ্যাটি সরল এবং সর্বশেষ পরিণামের কথা চিন্তা করলে মনে হয় বিদ্যাটি প্রায় অচেতনভাবে অনুসৃত হয়েছে। বিদ্যাটি হচ্ছে সুপরিচিত ভ্যারাইটি (প্রকার) চাষ করা, এর বীজ বপণ করা এবং সবচেয়ে ভাল ভ্যারাইটি যখন হঠাৎ আবির্ভূত হয় তখন এটিকে নির্বাচিত করা এবং এভাবে চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু প্রাচীন যুগের বাগানবিদরা কখনও ভাবেনি কি উৎকৃষ্ট ফল আমরা খাব, যারা তাদের সংগৃহীত সর্বোত্তম ন্যাসপাতি চাষ করত; যদিও উৎকৃষ্ট ফলটির জন্য তাদের কাছে আমরা কিছু মাত্রায় ঋণী, কারণ তারা যেখানেই পেত সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ভ্যারাইটিকে নির্বাচন ও সংরক্ষণ করত।
আমি বিশ্বাস করি এভাবে মন্থর ও অচেতনভাবে পুঞ্জীভূত বিরাট পরিবর্তন স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে যে অনেক ক্ষেত্রে উদ্ভিদের বন্য পিতামাতা বংশ আমরা চিনতে পারি না অর্থাৎ জানি না, যেগুলি আমাদের ফুলের ও গৃহসংলগ্ন বাগানে দীর্ঘদিন ধরে চাষ হয়ে আসছে। মানুষের কাছে উপকারিতার বর্তমান মানে পৌঁছাতে আমাদের অধিকাংশ উদ্ভিদদের উন্নত ও রূপান্তর ঘটাতে যদি শত সহস্র বছর লেগে যায়, তা হলে আমরা বুঝতে পারি কেন অস্ট্রেলিয়া, উত্তমাশা অন্তরীপ ও সম্পূর্ণ অসভ্য মানুষের বাস এমন যে কোন অঞ্চল চাষযোগ্য একটিও উদ্ভিদ আমাদের দেয়নি। এটি এই নয় যে উদ্ভিদ প্রজাতিতে পরিপূর্ণ এইসব দেশগুলিতে যে কোন উপকারী প্রজাতিদের আদিম বংশের উদ্ভিদ নেই, বরং প্রাচীন সুসভ্য দেশগুলিতে উদ্ভিদদের অর্জিত নিখুঁত মানে, পৌঁছানোর তুলনায় স্থানীয় উদ্ভিদের নিরবচ্ছিন্ন নির্বাচনের দ্বারা ঐ মানে উন্নত করা যায়নি।
অসভ্য মানুষের পোষা গৃহপালিত প্রাণীদের সম্পর্কে এটি উপেক্ষা করা উচিত নয় যে অন্ততঃ কোন কোন মরসুমে এদের খাদ্যের জন্য সংগ্রাম করতে হয়। এবং ভিন্ন পরিবেশের দুটি দেশে, জৈবিক গঠন ও কাঠামোয় অল্প পার্থক্যযুক্ত একই প্রজাতির এককগুলি অন্যটির তুলনায় একটি দেশে প্রায়শই সফলতা লাভ করবে এবং এইরূপে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ প্রক্রিয়াটি দ্বারা দুটি উপজাত সৃষ্টি হয়ে থাকবে, যে বিষয়ে পরে ভালভাবে আলোচনা করা হবে। বোধ হয় এটি অংশতঃ ব্যাখ্যা করে কেন অসভ্য মানুষদের পোষা ভ্যারাইটিগুলি সভ্য দেশে পোষা ভ্যারাইটিদের তুলনায় বিশুদ্ধ প্রজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বেশির ভাগের অধিকারী হয়, যেটি অনেক বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেছেন।
মানুষের দ্বারা নির্বাচন প্রক্রিয়াটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এখানে প্রদত্ত এই মতবাদটি অনুসারে এটি তৎক্ষণাৎ স্পষ্ট হয় যে কেন মানুষের প্রয়োজন ও শখের জন্য আমাদের গৃহপালিত জাতগুলো স্বভাবে ও দেহগঠনে অভিযোজিত হয়। আমি মনে করি গৃহপালিত জাতগুলির প্রায়শই উদ্ভূত অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ধারণ সম্পর্কে আমরা বুঝতে পারি এবং এভাবেও বাইরের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য এত বিরাট ও ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে এটি আপেক্ষিকভাবে কত অল্প তা-ও বুঝতে পারি। প্রত্যক্ষভাবে দৃষ্টিগোচর হয় এমন বিচ্যুতি ছাড়া জৈবিক গঠনের কোন বিচ্যুতি মানুষ কদাচিৎ নির্বাচন করে বা কেবল কষ্টসাধ্যভাবে নির্বাচন করে। বাস্তবিকপক্ষে ভিতরের গঠনের দিকে সে কদাচিৎ মন দেয়। অল্পমাত্রায় প্রাকৃতিক অবস্থায় উৎপন্ন পরিবৃত্তিগুলি ছাড়া সে কখনও নির্বাচনের কাজটি করতে পারে না। অস্বাভাবিকভাবে অল্পমাত্রায় বর্ধিত লেজ সমেত অথবা অস্বাভাবিক আকারের গলার থলি সমেত পায়রাদের না দেখে কোন মানুষ লক্কা বা পাউটার পায়রা সৃষ্টির কোন চেষ্টাই করবে না; এবং প্রথম আবির্ভাবে কোন বৈশিষ্ট্য যত বেশি অস্বাভাবিক বা অনিয়মিত হয়, তত বেশি এটি তার মনোযোগ আকর্ষণ করবে। কিন্তু একটি লক্কা পায়রা সৃষ্টিতে যে মত প্রকাশ করা হয়, কোন সন্দেহ নেই। সেটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে ত্রুটিপূর্ণ। একজন মানুষ যখন অল্প বড় লেজওয়ালা একটি পায়রা নির্বাচন করে, তখন ঐ পায়রাটির বংশধররা অংশতঃ অচেতন ও অংশতঃ নিয়মানুগ অবিরাম নির্বাচনের মাধ্যমে হয়েছিল কি না সে কখনও এই অলীক কল্পনা করেনি। বর্তমানের জাভা দেশীয় লক্কা পায়রা বা অন্য এবং ভিন্ন জাতের এককদের মতো, যাদের কম করেও সতেরোটি লেজের পালক গণনা করা হয়েছে, বোধ হয় সব লক্কা পায়রাদের পিতামাতা পাখিটির কেবল চোদ্দটি কিছু পরিমাণ প্রসারিত লেজ পালক ছিল। বর্তমানের টারবিট পায়রারা যেভাবে তাদের অন্ননালীর উপরের অংশ ফোলায় তার তুলনায় বোধ হয় প্রথম সৃষ্ট পাউটার পায়রাটি তার গলার থলি আরও বেশি ফোলাতো না–এই স্বভাবটিকে সব পাখিরসিকরা অবজ্ঞা করে, কারণ নূতন জাত সৃষ্টির পক্ষে এটি কোন প্রয়োজনীয় বিষয় নয়।
ধরে নেওয়া উচিত হবে না যে দেহগঠনের কোন বিরাট বিচ্যুতি পাখিপ্রেমিকদের চোখে লাগার জন্য প্রয়োজন হবে : সে অতি অল্প পার্থক্যকেও চিনতে পারে এবং মানুষের প্রবৃত্তি হল যত অল্পই হোক যে কোন নূতনত্বকে মূল্য দেওয়া। একই প্রজাতির এককদের অল্প পার্থক্যকে পূর্বে যে মূল্য দেওয়া হতো, কয়েকটি জাতের সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেই মূল্য দেওয়া নিশ্চয় বিচারযোগ্য নয়। অনেকেরই জানা আছে। যে পায়রাদের মধ্যে অনেক অল্প পরিবৃত্তি অনিয়মিতভাবে আবির্ভূত হয়, কিন্তু এগুলি প্রত্যেক জাতের নিখুঁততার মান থেকে বিচ্যুত বা অসম্পূর্ণ বলে বাতিল করা হয়। সাধারণ রাজহাঁস বা কোন স্পষ্ট চিহ্নিত ভ্যারাইটি উৎপাদন করে না; এই কারণে টাউলাউস ও সাধারণ জাতটি সাম্প্রতিক কালে গৃহপালিত পাখিদের প্রদর্শনীতে স্বতন্ত্র পাখি হিসেবে প্রদর্শিত হয়, যা কেবল সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী বৈশিষ্ট্য বর্ণের দ্বারা পৃথক করা হয়।
এইসব মতবাদ বোধ হয় স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে যে আমাদের যে কোন গৃহপালিত জাতগুলোর উৎপত্তি ও ইতিহাস সম্বন্ধে আমরা কদাচিৎ কিছু জানি। কিন্তু, আসলে কোন ভাষার একটি উপভাষার মতো একটি জাতের উৎপত্তিও স্বতন্ত্রভাবে হয়েছে, এটি কদাচিৎ বলা যেতে পারে। দেহগঠনের অল্প বিচ্যুতি সমেত একটি একককে মানুষ সংরক্ষণ করে ও তার বংশবৃদ্ধি ঘটায় বা তার সর্বোত্তম প্রাণীদের খুঁজে বের করতে প্রচলিত পন্থার চেয়ে বেশি যত্ন নেয়, এবং এভাবে তাদের উন্নত করে এবং উন্নত প্রাণীরা সন্নিহিত পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়। কিন্তু তখন পর্যন্ত এদের কোন স্বতন্ত্র নাম কদাচিৎ হয়ে থাকবে, এবং এদের অল্প উপযোগিতার মূল্য না দিয়ে এদের ইতিহাসকে অবজ্ঞা করা হয়ে থাকবে। একই মন্থর ও ক্রমিক প্রক্রিয়া দ্বারা আরও উন্নত। হলে এদের আরও ব্যাপকভাবে বিস্তার ঘটবে, এবং ভিন্ন ও মূল্যবান জাত হিসেবে চিহ্নিত হবে এবং সম্ভবতঃ সর্বপ্রথম একটি প্রাদেশিক নাম পেয়ে থাকবে। অল্প অবাধ যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে এমন অর্ধসভ্য দেশগুলিতে একটি নূতন উপ-জাতের বিস্তার মন্থর গতিতে ঘটবে। উপযোগিতার প্রশ্নটি যে মুহূর্তে স্বীকৃতি লাভ করে, যেটিকে আমি বলি অচেতন নির্বাচন, প্রক্রিয়াটি–যেহেতু জাতটির বৈশিষ্ট্যে উত্থান ও পতন হয়, বোধ হয় অন্য পর্যায়ের তুলনায় এক পর্যায়ে আর বেশিভাবে অধিবাসীদের সভ্যতা অনুসারে, সম্ভবতঃ অন্য জেলায় আরও বেশি ভাবে–যদি জাতটিতে নূতন বৈশিষ্ট্য ধীরে ধীরে যোগ করে, তাহলে প্রক্রিয়াটি সর্বদাই চালিত হবে। কিন্তু এরূপ মন্থর, ভিন্ন প্রকার, অচেতন পরিবর্তনগুলির সংরক্ষণের সম্ভাবনা নিতান্তই নগণ্য।
মানুষের নির্বাচন শক্তির অনুকূল পরিবেশ
মানুষের নির্বাচন শক্তির অনুকূল বা প্রতিকূল পরিবেশ সম্পর্কে আমি কয়েকটি কথা বলব। অধিক পরিবৃত্তি স্পষ্টতঃই অনুকূল হয়, কারণ এটি নির্বাচনের জন্য উপাদান অবাধে প্রদান করে। আকাঙ্খিত যে কোন দিকে বিপুল পরিমাণ রূপান্তরের পুঞ্জীভবনের জন্য এককীয় পার্থক্যসমূহ যথেষ্ট নয়। কিন্তু যেহেতু মানুষের কাছে উপকারী ও মানুষকে সন্তুষ্টকারী পরিবৃত্তিগুলি কেবল অনিয়মিতভাবে আবির্ভূত হয়, সেহেতু অসংখ্য একক রাখলে এদের আবির্ভাবের সম্ভাবনা অত্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। অতএব সংখ্যাই হচ্ছে সাফল্যের জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতিটির উপর ভিত্তি করে ইয়র্কশায়ারের কোন অঞ্চলের ভেড়াদের সম্পর্কে মার্শাল মন্তব্য করেছিলেন, “যেহেতু এরা দরিদ্র মানুষের অধিকারভুক্ত ও সংখ্যায় অল্প, তাই কখনও এদের উন্নত করা যেতে পারে না।” অন্যদিকে, একই উদ্ভিদের বিরাট সংখ্যক এককদের রক্ষণাবেক্ষণ করে মালীরা সাধারণতঃ অপেশাদারদের তুলনায় নূতন ও মূল্যবান ভ্যারাইটির উদ্ভব ঘটাতে আরও বেশি সাফল্য লাভ করে। একটি প্রাণী ও উদ্ভিদের বিরাট সংখ্যক এককদের লালনপালন করা যেতে পারে কেবলমাত্র সেখানেই, যেখানে বংশবৃদ্ধির পরিবেশ অনুকূল। যখন এককগুলি অপ্রচুর, তখন এদের বংশবৃদ্ধি ঘটতে দিলে, এদের বৈশিষ্ট্যমূলক গুণ যা-ই হোক, এরা সার্থকভাবে নির্বাচন প্রতিরোধ করবে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হচ্ছে উদ্ভিদ বা প্রাণীদের এত উচ্চ মূল্য দেবার জন্য মানুষ তাদের গুণ বা দেহের অল্পতম বিচ্যুতির প্রতি গভীর মনোযোগ দেয়। যদি এভাবে মনোযোগ না দেওয়া হয়, কোন কিছুই ঘটানো যেতে পারে না। গুরুগম্ভীরভাবে বলতে শুনেছি যে স্ট্রবেরী গাছ পরিবর্তিত হতে শুরু করে তখনই যখন বাগানবিদরা গাছটির দিকে নজর দেয়। সন্দেহ। নেই যে স্ট্রবেরী গাছের চাষ শুরুর সময় থেকেই সর্বদা পরিবর্তিত হতে শুরু করেছিল, কিন্তু অল্পতম ভ্যারাইটিগুলিকে অবহেলা করা হয়েছিল। তবে যখনই বাগানবিদরা অল্প বড় আকারে, ভাল ফল সমেত এই উদ্ভিদগুলিকে তোলেন, এদের থেকে চারাগাছ তৈরী করেন এবং পুনরায় উৎকৃষ্টতম চারাগাছ তোলেন, এদের বংশবৃদ্ধি (স্বতন্ত্র প্রজাতির সঙ্গে সঙ্করণের সাহায্যে) ঘটান, তখন থেকেই স্ট্রবেরী গাছের ঐ সব বিস্ময়কর ভ্যারাইটিদের উদ্ভব হয়েছিল যা গত অর্ধশতাব্দীতেই ঘটেছে।
প্রাণীদের ক্ষেত্রে, নূতন জাত সৃষ্টিতে সঙ্করণ প্রতিরোধ করাই হচ্ছে একটি প্রধান উপাদান–অন্ততঃ একটি দেশে যেখানে অন্যান্য জাত অধিক সংখ্যায় পরিপূর্ণ, এ ব্যাপারে কোন অঞ্চলের সীমাবেষ্টনী একটি ভূমিকা পালন করে। আদিম অসভ্য ও মুক্ত সমতলের অধিবাসীদের কাছে একটি প্রজাতির একটি জাতের বেশি জাত কদাচিৎ থাকে। পায়রাদের মিলন ঘটানো যেতে পারে, এবং এটি পাখিরসিকদের পক্ষে খুব সুবিধাজনক, কারণ একই পক্ষিশালায় মিশ্রিত থাকে এমন অনেক জাতকে উন্নত ও বিশুদ্ধ অবস্থায় রাখা যেতে পারে; এবং এই পরিবেশ নূতন জাত সৃষ্টিতে নিশ্চয়ই অনুকূল হয়ে থাকবে। আমি যোগ করতে পারি যে পায়রাদের অধিক সংখ্যায় এবং দ্রুত হারে বংশবৃদ্ধি করা যেতে পারে এবং নিকৃষ্টদের সহজেই বাতিল করা যেতে পারে ও হত্যার পর এদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্যদিকে, বিড়ালদের ক্ষেত্রে, যাদের মতো রাত্রিতে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাসবিশিষ্ট জুড়ি খুঁজে বার করা যায় না এবং যাদের মহিলা ও শিশুরা খুব পছন্দ করে, একটি স্বতন্ত্র জাত দীর্ঘদিন ধরে টিকে রয়েছে এমনটা আমরা কদাচিৎ লক্ষ্য করি। আমরা অনেক সময় দেখি যে এইসব জাত অন্য দেশ থেকে আমদানী করা হয়েছে। যদিও আমি সন্দেহ করি না যে কয়েকটি গৃহপালিত প্রাণী অন্যদের তুলনায় কম হারে পরিবর্তিত হয়, তথাপি বিড়াল, গাধা, ময়ূর, রাজহাঁস প্রভৃতির স্বতন্ত্র জাতদের বিরলতা বা অনুপস্থিতির জন্য বলা যেতে পারে যে নির্বাচন পদ্ধতিটি বহুলাংশে তার ভূমিকা পালন করে না; বিড়ালদের ক্ষেত্রে এদের মিলন ঘটানোর অসুবিধা; গাধাদের ক্ষেত্রে, দরিদ্র মানুষরা কয়েকটিকে পোষে ও তাদের বংশবৃদ্ধিতে কদাচিৎ মনোযোগ দেয়; সম্প্রতিকালে স্পেন ও ইউনাইটেড স্টেক্স-এর কোন কোন অঞ্চলে যত্নসহকারে নির্বাচন দ্বারা এই প্রাণীটি বিস্ময়করভাবে রূপান্তরিত ও উন্নত হয়েছে; ময়ূরদের ক্ষেত্রে, এদের সহজেই পালন করা যায় না ও অধিক সংখ্যায় বৃদ্ধি করা যায় না; রাজহাঁসরা কেবলমাত্র দুটি বিষয় অর্থাৎ খাদ্য ও পালকের জন্য মূল্যবান এবং বিশেষ করে স্বতন্ত্র জাতগুলি প্রদর্শন করিয়েও কোন আনন্দানুভূতি উদ্রেক করে না; কিন্তু গৃহপালনাধীন পরিবেশে রাজহংসীদের দেহগঠন অদ্ভুতভাবে অনমনীয়, তা সত্ত্বেও আমি অন্যত্র বর্ণনা করেছি যে এরা অল্পমাত্রায় পরিবর্তিত হয়।
কয়েকজন লেখক দৃঢ়ভাবে মত পোষণ করেন যে আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনসমূহে পরিবৃত্তির পরিমাণ শেষ সীমায় পৌঁছেছে এবং এগুলি কখনই এই সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে না। নিশ্চিত করে বললে বেশি হঠকারিতা হবে যে, যে কোন একটি ক্ষেত্রে শেষ সীমায় পৌঁছানো গিয়েছে; কারণ আমাদের সব প্রাণী ও উদ্ভিদের অধিকাংশই সম্প্রতিকালে অনেক বিষয়ে দারুণভাবে উন্নত হয়েছে এবং এটি পরিবৃত্তির ইঙ্গিত দেয়। আরও নিশ্চিতভাবে বললে একইরকম হঠকারিতা হবে যে প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছানো বর্তমানে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলি, অনেক শতাব্দী ধরে স্থির থাকার পর জীবনের নূতন পরিবেশে পুনরায় পরিবর্তিত হতে পারত না। মিঃ ওয়ালেসের মতানুসারে–যাঁর মতের যথেষ্ট সত্যতা আছে–কোন সন্দেহ নেই যে অন্ততঃ একটি সীমায় পৌঁছানো যাবে। উদাহরণস্বরূপ যে কোন স্থলচর প্রাণীর দ্রুতগামিতার বৈশিষ্ট্য নিশ্চয় থাকবে, কারণ ঘর্ষণকে কাটিয়ে ওঠা, শরীরের ভার বহনের ক্ষমতা ও মাংসপেশীর সংকোচনের দ্বারা এটি নির্ধারিত হবে, কিন্তু যে বিষয়টি আমাদের ভাবিত করে তা হচ্ছে–একই প্রজাতির গৃহপালিত ভ্যারাইটিগুলি একই গণের ভিন্ন প্রজাতিদের তুলনায় প্রায় সমস্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরস্পরের থেকে আরও বেশি ভিন্ন হয়, যে বৈশিষ্ট্যগুলোতে মানুষ বেশি মনোযোগ দেয় ও নির্বাচিত করে। ইসিডোরে জিওফ্রয় সেন্ট হিলারে আকার, বর্ণ, সম্ভবতঃ লোমের ক্ষেত্রেও এটি প্রমাণ করেছেন। দ্রুতগামিতার ক্ষেত্রে বলা যায় এটি অনেক শারীরিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভরশীল, কারণ। অতিশয় দ্রুতগামী এবং একই গণের অন্তর্গত যে কোন দুটি প্রাকৃতিক প্রজাতির তুলনায় ভারী ঠেলাগাড়ি-টানা ঘোড়া তুলনামূলকভাবে বেশি শক্তিশালী। উদ্ভিদের ক্ষেত্রে, বিন অথবা ভূট্টার বিভিন্ন ভ্যারাইটিদের বীজগুলি একই দুটি গোত্রের যে কোন একটি গণের ভিন্ন প্রজাতিদের বীজগুলির তুলনায় আকারে সম্ভবতঃ আরও বেশি ভিন্ন হয়। এটি কুলগাছের কয়েকটি ভ্যারাইটির ফল সম্পর্কেও খাটে, এবং তরমুজ জাতীয় গাছের ক্ষেত্রে আরও বেশিভাবে এবং সদৃশ অনেক ক্ষেত্রেও ঘটে।
প্রাণী ও উদ্ভিদের জাতগুলির উৎপত্তি সম্বন্ধে সংক্ষেপে মূল কথা হল–জীবনের পরিবর্তিত পরিবেশ জীবদেহে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে এবং অপ্রত্যক্ষভাবে জননতন্ত্রকে প্রভাবিত করে, উভয় উপায়েই পরিবৃত্তি ঘটাতে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। এটি বিশ্বাসযোগ্য নয় যে প্ৰকারণ সকল অবস্থায় একটি সহজাত ও প্রয়োজনীয় আকস্মিক উপাদান। বংশগতি ও পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তনের কম বা বেশি ক্ষমতা পরিবৃত্তিসমূহ স্থায়ী হবে কিনা নির্ধারণ করে। পরিবর্তনশীলতা (প্রকারণ) অনেক অজানা নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যার মধ্যে পারস্পরিক সম্বন্ধযুক্ত ক্রমিকবৃদ্ধি সম্ভবতঃ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের পরিবেশের নির্দিষ্ট প্রভাবের উপর কিছুটা আরোপ করা যেতে পারে, কিন্তু কতখানি তা আমরা জানি না। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ব্যবহার বা অব্যবহারেরও কিছু প্রভাব থাকে, সম্ভবতঃ বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবই থাকে, এটি বলা যেতে পারে। সর্বশেষ ফলাফল অত্যন্ত জটিল। কয়েকটি ক্ষেত্রে, আমাদের জাতগুলি সৃষ্টি করতে আদিম ভিন্ন প্রজাতিদের আন্তঃসঙ্করণ বোধ হয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যখন কয়েকটি জাত একবার কোন দেশে উদ্ভূত হয়, তখন নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের আকস্মিক আন্তঃসঙ্করণ নিঃসন্দেহেই নূতন উপজাত সৃষ্টিতে বহুলাংশে সাহায্য করেছে; কিন্তু প্রাণী ও বীজ দ্বারা বংশবৃদ্ধি করা উদ্ভিদের উভয় ক্ষেত্রে সঙ্করণের প্রয়োজনীয়তাকে অতিশয় অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। সাময়িকভাবে কর্তিত অংশ, কুঁড়ি ইত্যাদি দ্বারা বংশবৃদ্ধি করতে অত্যন্ত উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে সঙ্করণের প্রয়োজনীয়তা অসীম; কারণ চাষীরা সঙ্কর, বর্ণসঙ্কর উভয়েরই অত্যধিক পরিবর্তনশীলতা (প্রকারণ)-কে এবং সঙ্করদের বন্ধ্যাত্বকে এখানে অবজ্ঞা করে; বীজ দ্বারা বংশবৃদ্ধি করে না এমন উদ্ভিদগুলি আমাদের কাছে অল্প গুরুত্বের, কারণ এদের স্থায়িত্বকাল ক্ষণস্থায়ী। পরিবর্তনের এইসব কারণগুলির মধ্যে নিয়মানুগভাবে এবং দ্রুতহারে প্রয়োগ হোক বা না হোক, অথবা অচেতনভাবে ও মন্থরভাবে কিন্তু আরও দক্ষতার সঙ্গে নির্বাচনের সঞ্চয়কারক প্রক্রিয়াটি সম্ভবতঃ সর্বাধিক শক্তিমান।
০২. প্রাকৃতিক পরিবৃত্তি
দ্বিতীয় অধ্যায় – প্রাকৃতিক পরিবৃত্তি
বিভিন্নতা–এককের ভিন্নতা–সন্দেহজনক প্রজাতিরা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত, অতিশয় পরিব্যাপ্ত–সাধারণ প্রজাতিরা সর্বাধিক পরিবর্তনশীল–প্রত্যেক দেশের বৃহত্তর গণের প্রজাতিরা ক্ষুদ্রতর গণের প্রজাতিদের তুলনায় প্রায়শই বেশি পরিবর্তনশীল–বৃহত্তর গণের অনেক প্রজাতি সম্ভবতঃ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, কিন্তু সীমাবদ্ধ বিস্তারের ভ্যারাইটিরা পরস্পরের সঙ্গে অসমভাবে সম্পর্কযুক্ত।
আগের অধ্যায়ে উপনীত সিদ্ধান্তগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিনা তা আলোচনার পূর্বে প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবরা পরিবর্তনশীল কিনা এটা আমাদের আলোচনা করে নেওয়া উচিত। বিষয়টি উপযুক্তভাবে আলোচনা করতে নীরস তথ্যগুলির একটি দীর্ঘ তালিকা দেওয়া উচিত; তাহলে ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য এই তথ্যগুলি সংরক্ষিত করে রাখব। প্রজাতি পদটি সম্বন্ধে যে বিভিন্ন সংজ্ঞা দেওয়া হয় তা আমি এখানেও আলোচনা করব না। যে কোন একটি সংজ্ঞা সব প্রকৃতিবিজ্ঞানীকে সন্তুষ্ট করে না; তথাপি প্রজাতি বলতে কী অর্থ বোঝাতে চান তা প্রত্যেক প্রকৃতিবিজ্ঞানীর কাছেই অস্পষ্ট। সৃষ্টির একটি দূরবর্তী প্রক্রিয়ার অজানা উপাদান সাধারণতঃ পদটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভ্যারাইটি (প্রকার) পদটির সংজ্ঞা নিরূপণ করাও প্রায় সমভাবে কষ্টকর; কিন্তু এখানে এটির প্রায় সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত অর্থ হচ্ছে বংশ সম্প্রদায়, যদিও এটি কদাচিৎ প্রমাণ করা যেতে পারে। আমরা যাদের বিকৃতাঙ্গ উদ্ভিদ ও প্রাণী বলি তা-ও আছে, কিন্তু এরা ক্রমে ক্রমে ভ্যারাইটিতে (প্রকারে) পরিণত হয়। আমি ধরে নিই একটি বিকৃতাঙ্গের অর্থ দেহগঠনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিচ্যুতি, যা সাধারণতঃ প্রজাতির পক্ষে ক্ষতিকর, বা হিতকর নয়। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ পেশাগত অর্থে ‘পরিবৃত্তি’ পদটি ব্যবহার করে, যার অর্থ প্রত্যক্ষভাবে জীবনের ভৌতিক পরিবেশের জন্যই রূপান্তর ঘটে; এই অর্থে ‘পরিবৃত্তিগুলি’ মনে হয় আনুবংশিক হয় না; কিন্তু বাল্টিক সাগরের ঈষৎ লোনা জলের শম্বুক প্রাণীদের খর্বাবস্থা, অথবা আলপাইন পর্বতশৃঙ্গের উদ্ভিদদের খর্বাকৃতি, অথবা আরও উত্তরদিকের প্রাণীদের ঘনতর লোম, এদের কয়েকটি ক্ষেত্রে অন্ততঃ কয়েক বংশপরম্পরায় বংশগতভাবে প্রেরিত হবে না কে বলতে পারে? এবং এক্ষেত্রে আমি সত্য বলে মনে করি যে আকারটিকে একটি ভ্যারাইটি (প্রকার) বলা উচিত।
আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনগুলির ক্ষেত্রে, ও আরও বিশেষ করে উদ্ভিদের ক্ষেত্রে, দেহগঠনের আকস্মিক ও বিশেষ পরিমাণ বিচ্যুতি প্রাকৃতিক পরিবেশে কখনও স্থায়ীভাবে বংশবৃদ্ধি করেছে কিনা, তা সন্দেহজনক। প্রত্যেক জীবের প্রায় প্রত্যেকটি অঙ্গ তার জীবনের জটিল অবস্থার সঙ্গে এত সুন্দরভাবে সম্পর্কযুক্ত যে এটি অসম্ভব বলে হয় যে কোন একটি অঙ্গ নিখুঁতভাবে হঠাৎ উদ্ভূত হয়েছে, যেমন মানুষ কি কখনও একটি নিখুঁত জটিল যন্ত্র আবিষ্কার করেছে? গৃহপালনাধীন অবস্থায় বিকৃতাঙ্গদের উদ্ভব ঘটে যা ব্যাপকভাবে ভিন্ন প্রাণীদের স্বাভাবিক দেহগঠনের মতো হয়। এভাবে প্রায়শই শুড়ের মতো অঙ্গ সমেত শূকরছানা জন্মায়, এবং যদি একই গণের যে কোন বন্য প্রজাতির স্বাভাবিকভাবে একটি শুড় থাকত, তাহলে এখানে যুক্তি দেখানো যেতে পারত যে। বিকৃতাঙ্গ রূপে এটি আবির্ভূত হয়েছিল; কিন্তু পরিশ্রমসাধ্য অনুসন্ধানের পরেও প্রায় সম্বন্ধযুক্ত আকারদের স্বাভাবিক দেহের সদৃশ বিকৃতাঙ্গগুলি আবিষ্কার করতে আমি এখনও পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছি। যদি এই প্রকারের বিকৃতাঙ্গগুলি কখনও প্রাকৃতিক অবস্থায় আবির্ভূত হয় ও জননে সমর্থ হয় (যা সব সময় ঘটে না), যেহেতু এগুলি বিরল ও এককভাবে ঘটে, এদের সংরক্ষণ অসাধারণ অনুকূল অবস্থার ওপর নির্ভর করবে। এরা প্রথম ও পরবর্তী বংশসমূহে সাধারণ আকারের সঙ্গে সঙ্করিত হবে, এবং এরূপে এদের। অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রায় অনিবার্যভাবে লুপ্ত হবে। একক বা আকস্মিক পরিবৃত্তিসমূহের সংরক্ষণ ও স্থায়িত্বের বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী একটি অধ্যায়ে আলোচনা করব আমি।
এককের ভিন্নতা
একই পিতামাতার বংশধরে আবির্ভূত অথবা একই সীমাবদ্ধ অঞ্চলে বসবাসকারী একই প্রজাতির এককগুলিতে ধরে নেওয়া আবির্ভূত অনেক অল্প পার্থক্যকে এককীয় ভিন্নতা বা পার্থক্য বলা যেতে পারে। কেউ মনে করে না যে একই প্রজাতির সমস্ত একক প্রকৃতই একই ছাঁচে গড়া হয়েছে। এইসব এককীয় পার্থক্য আমাদের কাছে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রত্যেকেই জানে যে এরা প্রায়শই আনুবংশিক হয়; এবং এরা প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার ও সঞ্চয়নের জন্য উপাদান যোগায়, যেমন মানুষ তার গৃহপালিত উৎপাদনের এককীয় পার্থক্যগুলিকে যে কোন জানা দিকে সঞ্চয় করে। প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে এইসব এককীয় পার্থক্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিকে সাধারণত প্রভাবিত করে। কিন্তু তথ্য সম্বলিত একটি দীর্ঘ তালিকার মাধ্যমে আমি দেখাতে পারতাম যে একই। প্রজাতির এককদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি, যাদের নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়, শারীরবৃত্তীয় ও শ্রেণীবিভাগমূলক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও কোন কোন সময় পরিবর্তিত হয়, আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি যে এমনকি দেহগঠনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রকারণগুলির সংখ্যা দেখে সবচেয়ে অভিজ্ঞ প্রকৃতিবিজ্ঞানী অবাক হবেন যদি তিনি অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞের উপর নির্ভর করে তথ্যগুলি সংগ্রহ করেন, যেমন আমি কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় সংগ্রহ করেছি। স্মরণে রাখা উচিত যে সিস্টেম্যাটিস্টরা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলির বিভিন্নতা লক্ষ্য করে খুব একটা সন্তুষ্ট হয় না এবং খুব কম সংখ্যক লোকই অন্তঃস্থ ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ গুলিকে পরিশ্রম সহকারে পরীক্ষা করে এবং একই প্রজাতির অনেক নমুনা এককগুলির তুলনা করে। এটি কখনই আশা করা উচিত নয় যে একটি পতঙ্গের বিরাট কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের নিকটে প্রধান নার্ভদের শাখাবিন্যাস একই প্রজাতিতে পরিবর্তিত হবে। অনেকে মনে করেন যে এই প্রকৃতির পরিবর্তনগুলি কেবল অল্পমাত্রায় প্রভাবিত হয়ে থাকবে; তবুও স্যার জে. লুবক কক্কাসের এইসব প্রধান নার্ভের কিছু পরিমাণ পরিবর্তনশীলতা দেখিয়েছেন যা একটি বৃক্ষের একটি কাণ্ডের অনিয়মিত শাখাবিন্যাসের সঙ্গে প্রায় তুলনা করা যেতে পারে। আমি আরও যোগ করতে পারি যে দার্শনিক প্রকৃতিবিজ্ঞানীরাও দেখিয়েছেন কোন কোন পতঙ্গের লার্ভাদের মাংসপেশী মোটেই একইরূপ হয় না। বিশেষজ্ঞরা কোন কোন সময় পর্বতের মূষিক প্রসবের মতো যুক্তি দেখান যে প্রধান অঙ্গগুলি কখনও পরিবর্তিত হয় না; কারণ এইসব বিশেষজ্ঞরা আসলে ঐ সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেন যারা পরিবর্তিত হয় না (যেমন কয়েকজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী সততার সঙ্গে স্বীকার করেছেন), এই মতানুসারে একটি প্রধান অঙ্গের বিভিন্নতা উদাহরণ কখনও দেখা যাবে না; অন্যদিকে অন্য মতানুসারে অনেক উদাহরণ নিশ্চিতভাবে দেওয়া যেতে পারে।
এককীয় পার্থক্যসমূহের সঙ্গে জড়িত একটি বিষয় রয়েছে, যেটি অতিশয় জটিল: আমি এখানে সেই সব গণের প্রসঙ্গ উত্থাপন করব যাদের বলা হয় ক্রমাগত পরিবর্তনশীল’ বা ‘বহুরূপী’, যেখানে প্রজাতিরা অধিক পরিমাণে পরিবর্তনশীল। এইসব আকারদের প্রজাতি অথবা ভ্যারাইটি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা হবে কিনা সে ব্যাপারে। কদাচিৎ দু’জন প্রকৃতিবিজ্ঞানী একমত হন। উদ্ভিদের মধ্যে রুবাস, রোজা, হিয়ারেসিয়াম, প্রাণীদের মধ্যে পতঙ্গ ও ব্র্যাকিওপড় শম্বুকদের কয়েকটি গণের উদাহরণ দিতে পারি। অধিকাংশ বহুরূপী গণের কয়েকটি প্রজাতির স্থিতিশীল ও সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকে। প্রাচীন যুগের ব্র্যাকিওপড় শামুকদের পরীক্ষা করে জানা যায় যে গণগুলি যখন একটি দেশে বহুরূপী, কয়েকটি ক্ষেত্রে ছাড়া অন্য দেশেও বহুরূপী হয়। ব্যাপারটি অতিশয় জটিল, কারণ সম্ভবতঃ এরা দেখায় যে এ ধরনের পরিবর্তনশীলতা জীবনাবস্থা নিরপেক্ষ। মনে হয় এইসব বহুরূপী গণের অন্ততঃ কয়েকটিতে যে বিভিন্নতা আমরা লক্ষ্য করি তাতে প্রজাতির কোন উপকার ও অপকার হয় না এবং এখানে এরা প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার আওতায় আসে না। এটি পরে ব্যাখ্যা করা হবে।
প্রত্যেকেই জানে যে পরিবৃত্তি ছাড়াই একই প্রজাতির এককগুলির দেহগঠনে বিরাট পার্থক্য থাকে, যেমন বিভিন্ন প্রাণীদের দুটি লিঙ্গে, পতঙ্গদের মধ্যে বন্ধ্যা স্ত্রী অথবা শ্রমিকদের দুটি বা তিনটি জাতে এবং অনেক নিম্নবর্ণের প্রাণীদের অপরিণত ও লার্ভাবস্থায়। প্রাণী ও উদ্ভিদের উভয় ক্ষেত্রেই ত্রিরূপতা ও দ্বিরূপতার ঘটনাও লক্ষ্য করা যায়, এভাবে মিঃ ওয়ালেস, যিনি এ বিষয়ে সম্প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন, দেখিয়েছেন যে মালয় দ্বীপপুঞ্জের প্রজাপতিদের কোন কোন প্রজাতির স্ত্রীরা মধ্যবর্তী ভ্যারাইটি দ্বারা সংযুক্ত না হয়ে দুই, এমনকি তিনটি দৃষ্টি আকর্ষক ভিন্ন আকারে নিয়মিত আবির্ভূত হয়। ফ্রিজ মূলার ব্রাজিলদেশীয় কোন কোন জলজ খোলকী প্রাণীর পুরুষদের সম্পর্কে অনুরূপ কিন্তু আরও অসাধারণ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন; এভাবে টানাইস-এর পুরুষরা নিয়মিতভাবে দুটি ভিন্ন আকারের হয়, এদের একটিতে শক্ত ও ভিন্ন আকারের সাঁড়াশি থাকে, অন্যটিতে প্রচুর ঘ্রাণ-লোমযুক্ত শুঙ্গ থাকে। প্রাণী ও উদ্ভিদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে দুটি অথবা তিনটি আকার যদিও এখন মধ্যবর্তী ক্রমিক ধাপ দ্বারা যুক্ত নয়, তবুও এটি সম্ভবপর যে এক সময় এরা সংযুক্ত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, মিঃ ওয়ালেস এক ধরনের একটি প্রজাপতির বর্ণনা দিয়েছেন, যাদের একই দ্বীপে মধ্যবর্তী সংযোজক দ্বারা সংযুক্ত বিরাট সংখ্যক ভ্যারাইটি আছে এবং মালয় দ্বীপপুঞ্জের অন্য অংশে বসবাসকারী একটি ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধযুক্ত দ্বিরূপক প্রজাতির দুটি আকারের সঙ্গে এদের শৃঙ্খলের প্রান্তিক সংযোজকের সাদৃশ্য অত্যন্ত স্পষ্ট। এভাবে পিঁপড়েদের ক্ষেত্রেও, কতিপয় শ্রমিক জাত সাধারণতঃ সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়। এরপর আমরা দেখব যে কয়েকটি ক্ষেত্রে জাতগুলি সূক্ষ্ম ক্রমিক ধাপের ভ্যারাইটিদের দ্বারা একত্রে সংযুক্ত। কয়েকটি দ্বিরূপক উদ্ভিদের ক্ষেত্রে এরূপ হয় তা আমি নিজে লক্ষ্য করেছি। প্রথমে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে একই স্ত্রী প্রজাপতির একই সময়ে তিনটি স্ত্রী ও একটি পুরুষ আকার জন্ম দেওয়ার .. ক্ষমতা রয়ে থাকবে; এবং একটি উভলিঙ্গ উদ্ভিদ একই বীজ থেকে তিনটি ভিন্ন উভলিঙ্গ আকার উৎপাদন করবে যার মধ্যে তিনটি ভিন্ন প্রকার স্ত্রী ও তিনটি বা এমনকি ছয়টি ভিন্ন প্রকার পুরুষ থাকবে। তা সত্ত্বেও এই ঘটনাগুলি স্বাভাবিক বিষয়টির অতিরঞ্জন যে স্ত্রী দুই লিঙ্গের বংশধর উৎপাদন করে, যারা কোন কোন সময় পরস্পরের থেকে বিস্ময়করভাবে ভিন্ন হয়।
সন্দেহজনক প্রজাতি
আকারের কয়েকটি বিষয় আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আকারগুলিতে প্রজাতির কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে এবং এরা অন্য আকারের সঙ্গে এত সদৃশ বা মধ্যবর্তী ক্রমিক ধাপগুলির মাধ্যমে এত গভীরভাবে সংযুক্ত যে প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা এদের স্বতন্ত্র প্রজাতি হিসেবে গণ্য করতে পছন্দ করেন না। আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে যতদূর আমরা জানি ভাল ও বিশুদ্ধ প্রজাতির মতো এইসব সন্দেহজনক ও ঘনিষ্ঠভাবে সম্বন্ধযুক্ত আকারগুলির অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে তাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ বজায় রেখেছে; বাস্তবে যখন একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী যে কোন দুটি আকারকে মধ্যবর্তী সংযোজকদের দ্বারা যুক্ত করেন, সবচেয়ে সাধারণ কিন্তু কোন কোন সময়ে প্রথমে বর্ণিতটিকে প্রজাতি হিসেবে ও অন্যটিকে ভ্যারাইটি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করে, একটিকে অন্যটির ভ্যারাইটি হিসেবে গণ্য করে। এমনকি মধ্যবর্তী সংযোজকগুলি দ্বারা ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত একটি আকারকে অন্যটির ভ্যারাইটি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা বা na করার বিষয়টি স্থির করতে বিরাট অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়, যেটি আমি এখানে উল্লেখ করব না; অথবা মধ্যবর্তী আকারদের সঙ্কর হিসেবে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হলেও বিষয়টির অসুবিধা দূর হবে না। তবে অসংখ্য ক্ষেত্রে একটি আকারকে অন্য একটির ভ্যারাইটি হিসেবে গণ্য করা হয়, তা এই কারণে নয় যে মধ্যবর্তী সংযোজকগুলি সত্যিই আবিষ্কৃত হয়েছে, বরং উপমা (অনুরূপতা) পর্যবেক্ষককে অনুমান করতে প্ররোচিত করে যে হয় এরা এখন অন্যত্র অবস্থান করে অথবা পূর্বে কোথাও অবস্থান করত; এবং এখানে সন্দেহ ও কল্পনার অনুপ্রবেশের জন্য দরজা উন্মুক্ত।
অতএব একটি আকারকে প্রজাতি অথবা ভ্যারাইটি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা উচিত হবে কিনা তা নির্ধারণ করার জন্য বিচক্ষণ প্রকৃতিবিদদের মতামত ও ব্যাপক অভিজ্ঞতার অনুসরণ করাই হবে একমাত্র পথনির্দেশক। তবে অনেক ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চয় অধিকাংশ প্রকৃতিবিদদের মতামতকে অনুসরণ করব, কারণ অল্প কয়েকটি সুচিহ্নিত ও সুপরিচিত ভ্যারাইটিদের নাম করা যেতে পারে, অন্তত কয়েকজন দক্ষ বিচারক এদের প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেননি।
সন্দেহজনক স্বভাবের এইসব ভ্যারাইটিরা যে মোটেই বিরল নয় সে বিষয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে না। বিভিন্ন উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের দ্বারা লিখিত গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স বা ইউনাইটেড স্টেটস-এর কয়েকটি উদ্ভিদকুলের তুলনা করুন, এবং লক্ষ্য করুন আশ্চর্যজনক সংখ্যক আকারকে একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী ভাল প্রজাতি হিসেবে এবং অন্য একজন কেবল ভ্যারাইটি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেছেন। সমস্ত প্রকার সাহায্যের জন্য আমি যার কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ সেই মিঃ এইচ.সি.ওয়াটসন ১৮২টি উদ্ভিদকে চিহ্নিত করে আমার কাছে পাঠিয়েছেন, এদের সাধারণতঃ ভ্যারাইটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা কিন্তু এদের সকলকে প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেন, এই তালিকা তৈরির সময় তিনি অনেক তুচ্ছ ভ্যারাইটিদের বাদ দিয়েছেন, তা সত্ত্বেও কয়েকজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী কিন্তু এদের প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেন, এবং কয়েকটি বহরূপক গণকে তিনি সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়েছেন। সবচেয়ে বহরূপক আকারগুলি সমেত গণগুলির মধ্যে মিঃ ব্যাবিংটন ২৫১টি প্রজাতির উল্লেখ করেন, পক্ষান্তরে মিঃ বেন্থাম কেবল ১১২টির উল্লেখ করেন-তাহলে এদের বিয়োগফল ১৩৯টি সন্দেহজনক আকারের। প্রাণীদের ক্ষেত্রে, যারা জন্মদানের জন্য একবার মিলিত হয় এবং যারা অতিশয় ভ্রমণশীল, একই দেশে এদের সন্দেহজনক আকার কদাচিৎ দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলিতে এরা সুলভ, একজন প্রাণীবিজ্ঞানী এদের প্রজাতি হিসেবে এবং অন্য একজন ভ্যারাইটি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেন। উত্তর আমেরিকার ও ইউরোপের পরস্পরের থেকে অল্প ভিন্ন পাখি ও পতঙ্গদের কতকগুলিকে একজন বিখ্যাত প্রকৃতিবিজ্ঞানী সন্দেহজনক প্রজাতি এবং অন্য একজন ভ্যারাইটি হিসেবে গণ্য করেন, অথবা এদের প্রায়শই ভৌগোলিক জাত হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশাল মালয় দ্বীপপুঞ্জের দ্বীপগুলিতে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রাণীদের উপর, বিশেষভাবে লেপিডটেরার উপর কয়েকটি মূল্যবান গবেষণাপত্রে মিঃ ওয়ালেস দেখান যে এদের চারটি বিভাগে শ্রেণীভুক্ত করা যেতে পারে, যেমন পরিবর্তনশীল আকার, স্থানীয় আকার, ভৌগোলিক জাত বা উপপ্রজাতি এবং প্রকৃত প্রতিনিধিত্বমূলক প্রজাতি। প্রথমটি বা পরিবর্তনশীল আকারগুলি একই দ্বীপের সীমানার মধ্যে বেশি পরিবর্তিত হয়। স্থানীয় আকারগুলি প্রত্যেক পৃথক দ্বীপে পরিমিতভাবে অপরিবর্তনীয় ও স্বতন্ত্র; কিন্তু যখন কয়েকটি দ্বীপের আকারগুলির একসঙ্গে তুলনা করা হয়, তখন পার্থক্যগুলি এত অল্প ও ক্রমিক হয় যে এদের সংজ্ঞা নির্ধারণ এবং বর্ণনা করা অসম্ভব হয়, যদিও একই সময়ে প্রান্তিক আকারগুলি যথেষ্ট ভিন্ন হয়। ভৌগলিক জাত বা উপজাতিরা সম্পূর্ণরূপে অপরিবর্তনশীল এবং বিচ্ছিন্ন স্থানীয় আকার; কিন্তু যেহেতু এরা বলিষ্ঠভাবে চিহ্নিত ও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য দ্বারা পরস্পরের থেকে ভিন্ন হয় না, তাই “এদের মধ্যে কোনগুলিকে প্রজাতি হিসেবে ও কোনগুলিকে ভ্যারাইটি হিসেবে বিবেচনা করা হবে, তা নির্ধারণ করতে ব্যক্তিগত মতামত ছাড়া কোন সম্ভবপর পরীক্ষা নেই।” অবশেষে, প্রতিনিধিত্বমূলক প্রজাতিরা স্থানীয় আকার ও উপ-প্রজাতিদের মতো প্রত্যেক দ্বীপের প্রাকৃতিক অবস্থায় একই স্থান পূরণ করে; কিন্তু এরা স্থানীয় আকার ও উপ-প্রজাতিদের মধ্যে পার্থক্যের তুলনায় বেশি পরিমাণ পার্থক্য দ্বারা পরস্পরের থেকে ভিন্ন হয়, এরা প্রায়শই সার্বজনীনভাবে প্রকৃতিবিদদের দ্বারা বিশুদ্ধ প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত হয়, তা সত্ত্বেও পরিবর্তনশীল আকার, স্থানীয় আকার, উপ-প্রজাতি ও প্রতিনিধিমূলক প্রজাতিদের চিনতে পারার কোন নির্দিষ্ট নীতিগত মান সম্ভবতঃ দেওয়া যেতে পারে না।
অনেক বছর আগে, গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জের পার্শ্ববর্তী দ্বীপগুলির পাখিদের পরস্পরের সঙ্গে এবং আমেরিকার মূল ভূখণ্ডের পাখিদের সঙ্গে নিজে তুলনা করে এবং অন্যদের তুলনা করতে দেখে, আমি অতিশয় বিস্মিত হয়েছিলাম যে প্রজাতি ও ভ্যারাইটিদের মধ্যেকার পার্থক্য কত অস্পষ্ট ও নিয়মবহির্ভূত। ছোট ম্যাডেইরা দ্বীপপুঞ্জের ছোট ছোট দ্বীপগুলিতে অনেক ধরনের পতঙ্গ আছে যাদেরকে মিঃ ওলাস্টন তার প্রশংসনীয় গবেষণামূলক গ্রন্থে ভ্যারাইটি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, কিন্তু অনেক পতঙ্গবিজ্ঞানী এদের ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে নিশ্চয় শ্রেণীভুক্ত করবেন। এমনকি আয়ারল্যান্ডের অল্প কয়েকটি প্রাণী আছে যারা সাধারণতঃ ভ্যারাইটি হিসেবে স্বীকৃত, কিন্তু কিছু প্রকৃতিবিজ্ঞানী এদের প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেছেন। আমাদের ব্রিটিশ লাল বুনো হাঁসকে কয়েকজন অভিজ্ঞ পক্ষীবিজ্ঞানী নরওয়ের একটি প্রজাতির একটি সুচিহ্নিত জাত হিসেবে বিবেচনা করেন, পক্ষান্তরে বেশি সংখ্যক পক্ষীবিজ্ঞানী একে গ্রেট ব্রিটেনের নিজস্ব একটি প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেন। দুটি সন্দেহজনক আকারের বাসস্থানের মধ্যে বিরাট দূরত্ব অনেক প্রকৃতিবিদকে এদের ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করতে প্রভাবিত করে। কিন্তু সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠেছে যে এ ব্যাপারে কতটা দূরত্বকে যথেষ্ট বলে মনে করা হবে। আমেরিকা ও ইউরোপের মধ্যেকার দূরত্ব যদি পর্যাপ্ত হয়, তাহলে ইউরোপ এবং অ্যাজোর্স অথবা ম্যাডেইরা বা ক্যানারী দ্বীপপুঞ্জের মধ্যেকার বা এইসব ছোট দ্বীপপুঞ্জের ছোট ছোট দ্বীপগুলির মধ্যেকার দূরত্ব কি যথেষ্ট হবে?
ইউনাইটেড স্টেট-এর প্রখ্যাত পতঙ্গবিজ্ঞানী মিঃ বি. ডি. ওয়ালশ যাদের উদ্ভিদভূক ভ্যারাইটি ও উদ্ভিদভূক প্রজাতি বলেন, তাদের বর্ণনা দিয়েছেন। অধিকাংশ শাকসবজি ভক্ষণকারী পতঙ্গরা এক ধরনের বা এক শ্রেণীর উদ্ভিদ ভক্ষণ করে জীবনধারণ করে, কয়েক ধরনের পতঙ্গ নির্বিচারে অনেক ধরনের উদ্ভিদ ভক্ষণ করে, কিন্তু তার ফলে এরা পরিবর্তিত হয় না। তবে মিঃ ওয়াশ কয়েকটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্ভিদে বসবাসকারী পতঙ্গের পর্যবেক্ষণ করেছেন, যারা লার্ভা বা পরিণত অথবা উভয় অবস্থায় বর্ণে, আকারে অথবা শরীর থেকে নিঃসৃত রসের প্রকৃতিতে অল্প অথচ স্থায়ী পার্থক্য উপস্থিত করে। কয়েকটি ক্ষেত্রে কেবলমাত্র পুরুষদের এবং অন্য কয়েকটি ক্ষেত্রে পুরুষ ও স্ত্রী উভয়কেই অল্প মাত্রায় ভিন্ন হতে দেখা গেছে। যখন পার্থক্যগুলি আরও স্পষ্ট হয় এবং যখন উভয় লিঙ্গ ও সব বয়সে প্রভাবান্বিত হয়, তখন সমস্ত পতঙ্গবিজ্ঞানীরা আকারদের ভাল প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেন। কিন্তু এইসব উদ্ভিদভূক পতঙ্গ আকারদের কোনটিকে প্রজাতি এবং কোটিকে ভ্যারাইটি বলা উচিত তা কোন পর্যবেক্ষক নির্ধারণ করতে পারেন না। যে আকারগুলি মনে হতে পারে অবাধে যৌনসংযোগ করবে, সেগুলিকে মিঃ ওয়াশ ভ্যারাইটি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেন; এবং যেগুলি মনে হয় এই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে সেগুলিকে প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেন। যেহেতু পার্থক্যগুলি ভিন্ন ভিন্ন উদ্ভিদ ভক্ষণকারী পতঙ্গের উপর নির্ভর করে, তাই আশা করা যেতে পারে না যে কয়েকটি আকার সংযোগকারী সংযোজক আকারদের দেখতে পাওয়া যাবে। এভাবে সন্দেহজনক আকারদের ভ্যারাইটি অথবা প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা যাবে কিনা তা নির্ধারণ করতে প্রকৃতিবিজ্ঞানী তার বিচক্ষণতা হারিয়ে ফেলেছেন। পৃথক মহাদেশ ও দ্বীপগুলিতে বসবাসকারী নিকট সম্বন্ধীয় জীবদের ক্ষেত্রে এটি অবশ্যম্ভাবীরূপে ঘটে। পক্ষান্তরে, একটি প্রাণী বা উদ্ভিদ যখন একই মহাদেশে বিস্তৃত হয়, একই দ্বীপপুঞ্জের অনেক দ্বীপে বসবাস করে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন আকার ধারণ করে, তখন প্রান্তিক আকারদের একত্রে সংযুক্ত করার মধ্যবর্তী আকারগুলি আবিষ্কার করার সম্ভাবনা থাকবে এবং তখন এগুলিকে ভ্যারাইটির পর্যায়ে নামিয়ে আনা যাবে।
প্রাণীদের কখনও কোন ভ্যারাইটি থাকে না–অল্প কয়েকজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী এই মত পোষণ করেন; তা সত্ত্বেও এই একই প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা অল্পতম পার্থক্যকেও প্রজাতিক মূল্য দেন; এবং দুটি দূরবর্তী দেশে অথবা দুটি ভূতাত্ত্বিক যুগে যখন একই অভিন্ন আকারের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তখন দুটি ভিন্ন প্রজাতি একই পোষাকের মধ্যে লুকিয়ে থাকে বলে তারা বিশ্বাস করেন। প্রজাতি পদটি এভাবে একটি নিষ্ফল বিমূর্ত রূপ ধারণ করে, যার অর্থ সৃষ্টির একটি ভিন্ন কাজের ধারণা পোষণ ও অর্থ প্রকাশ করা। এটি নিশ্চিত যে অতি দক্ষ বিচারকের দ্বারা ভ্যারাইটি হিসেবে বিবেচিত অনেক আকার বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণরূপে প্রজাতির এত সদৃশ হয় যে এরা অন্য অতি দক্ষ বিচারকের দ্বারা প্রজতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত হয়েছে। কিন্তু এইসব পদগুলির কোন সংজ্ঞা সাধারণভাবে স্বীকৃত হওয়ার আগে, এদের প্রজাতি অথবা ভ্যারাইটি বলা উচিত কিনা তা আলোচনা করার চেষ্টা বৃথা।
সুচিহ্নিত ভ্যারাইটি অথবা সন্দেহজনক প্রজাতিদের অনেকেই সুবিবেচনার যোগ্য। তাদের শ্রেণী নির্ণয় করার প্রচেষ্টায় ভৌগোলিক বিস্তার, সমরূপ পরিবৃত্তি, সঙ্করণ প্রভৃতি বিষয়গুলিকে যুক্তি হিসেবে খাড়া করার চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু স্থানাভাবে এগুলির আলোচনা করা যাবে না। কেমন করে সন্দেহজনক আকারের শ্রেণীভুক্ত করা যাবে সে বিষয়ে গভীর অনুসন্ধানের পর প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা যে একমত হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবুও স্বীকার করা উচিত যে সবচেয়ে সুপরিচিত দেশে এদের আমরা অধিক সংখ্যায় অবস্থান করতে দেখি। এই বিষয়টি আমার মনোযোগ আকর্ষণ করে যে যদি প্রাকৃতিক অবস্থায় যে কোন প্রাণী বা উদ্ভিদ মানুষের কাছে উপকারী হয় অথবা যে কোন কারণে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তাহলে এদের ভ্যারাইটিগুলিকে প্রায় সার্বজনীনভাবে নথিভুক্ত হতে দেখা যাবে। অধিকন্তু কয়েকজন বিশেষজ্ঞ এই ভ্যারাইটিদের প্রায়শই প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করবেন। সাধারণ ওক গাছের কথা ধরুন, কত গভীরভাবে একে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে; তথাপি একজন জামান লেখক আকারদের থেকে এক ডজনের বেশি প্রজাতির নাম করেছেন; অন্যদিকে অন্য একদল বিজ্ঞানী প্রায় সার্বজনীনভাবে এইসব আকারকে ভ্যারাইটি হিসেবে বিবেচনা করেন; এবং এই দেশের সর্বোচ্চ উদ্ভিদ-বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ লোকের উদ্ধৃতি দিয়ে দেখানো যেতে পারে যে বৃন্তহীন ও বৃন্তল ওক গাছের হয় ভাল ও ভিন্ন প্রজাতি, নয়তো কেবল ভ্যারাইটি।
সারা পৃথিবীর ওক গাছ সম্বন্ধে দেরিতে প্রকাশিত এ.ডি. ক্যাণ্ডোলের সবিশেষ উল্লেখযোগ্য স্মৃতিকথাটির কথা এখানে উল্লেখ করতে পারি। প্রজাতির প্রভেদ সম্বন্ধে এত বেশি তথ্য তার আগে কেউ দিতে পারেনি, বা আরও বেশি আগ্রহ ও বিচক্ষণতা তার আগে কেউ দেখাতে পারেনি। প্রথমেই তিনি দেহকাঠামোর সমস্ত বিষয়গুলি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন, যেগুলি প্রজাতি থেকে প্রজাতিতে পরিবর্তিত হয় এবং তিনি। পরিবর্তন হারের সংখ্যাগত হিসাবও প্রদান করেছেন। তিনি এক ডজনের উপর বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন যা কখনও বয়স ও ক্রমবিকাশ অনুসারে, আবার কখনও নিরূপণযোগ্য কারণ ছাড়াই এমনকি একই শাখাতেও পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। এইসব বৈশিষ্ট্যগুলির নিশ্চয় কোন প্রজাতিক মূল্য নেই, যেমন মিঃ আসা গ্রে এই স্মৃতিকথাটি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন যে এরা সাধারণভাবে প্ৰজাতিক সংজ্ঞার দিকে অগ্রসর হয়। তিনি বলেছেন যে তিনি সেইসব আকারদের প্রজাতি হিসাবে শ্রেণীভুক্ত করেন যেগুলি বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন হয় ও কখনও একই গাছে পরিবর্তিত হয় না এবং কখনও মধ্যবর্তী আকারদের দ্বারা সংযুক্ত হতে দেখা যায় না। এত পরিশ্রম সহকারে আলোচনার পর তিনি জোরের সঙ্গে মন্তব্য করেন: তারা ভুল করেছে যারা পুনরায় বলে যে আমাদের প্রজাতিরা বহুলাংশে স্পষ্টতঃ সীমিত এবং সন্দেহজনক প্রজাতিরা সংখ্যায় অতি অল্প। যতদিন পর্যন্ত একটি গণকে অসম্পূর্ণভাবে জানা যায় এবং এর প্রজাতিরা কেবল কয়েকটি উদ্ভিদ নমুনার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয় অর্থাৎ বলতে গেলে অস্থায়ী হয়, ততদিন পর্যন্ত এটিকে সত্য বলেই মনে হয়। যখনই। এদের ভালভাবে জানতে লাগলাম, মধ্যবর্তী আকারগুলির সঙ্গে পরিচিত হলাম, তখনই প্রজাতির সীমা সম্পর্কে আমার সন্দেহ বাড়তে লাগল।” তিনি আরও বলেছেন যে সবচেয়ে সুপরিচিত প্রজাতিরা অধিক সংখ্যক ভ্যারাইটি ও উপ-ভ্যারাইটি সৃষ্টি করে। ফলতঃ কোয়ার্কাস রোবার প্রজাতির আঠাশটি ভ্যারাইটি থাকে, এর মধ্যে ছয়টি ছাড়া বাকিগুলি তিনটি উপ-প্রজাতিকে কেন্দ্র করে রয়েছে, এই তিনটি উপপ্রজাতি হচ্ছে। কোয়ার্কস পেডাঙ্কুলাটা, কোয়ার্কাস সেসিলিফ্লোরা ও কোয়ার্কাস পিউরেসেন্স। এই তিনটি উপ-প্রজাতি সংযোগকারী আকাররা তুলনামূলকভাবে বিরল; এখন বিরল এইসব সংযোগকারী আকাররা যদি সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে থাকে, তাহলে তিনটি উপ-প্রজাতি পরস্পরের সঙ্গে সেই একইভাবে সম্পর্কিত হবে যেমন আসল কোয়ার্কাস রোবারকে কেন্দ্র করে চার বা পাঁচটি সাময়িকভাবে স্বীকৃত প্রজাতি সম্পর্কিত হয়। অবশেষে, ডি ক্যাণ্ডোলে স্বীকার করেন যে ৩০০ প্রজাতির মধ্যে, যেগুলি তাঁর প্রোড্রোমাস গ্রন্থে তালিকাভুক্ত হয়েছে, অন্ততঃ দুই-তৃতীয়াংশই অস্থায়ী প্রজাতি, অর্থাৎ একটি প্রকৃত প্রজাতির প্রদত্ত সংজ্ঞা এরা যথাযথভাবে পূরণ করে না। আরও বলা সঠিক হবে যে ডি. ক্যাণ্ডোলে আর বিশ্বাস করেন না যে প্রজাতিরা অপরিবর্তনীয় সৃষ্টি, কিন্তু সিদ্ধান্ত করেন যে উদ্ভূত তত্ত্বটি সবচেয়ে প্রকৃতি সম্মত বা স্বাভাবিক, “এবং জীবাশ্মবিজ্ঞানে, উদ্ভিদ ও প্রাণীভূগোলে প্রদত্ত দেহের গঠন বিষয়ক ও শ্রেণীবিন্যাস সংক্রান্ত সুপরিচিত বিষয়গুলির সঙ্গে অতিশয় সামঞ্জস্যপূর্ণ।”
একজন তরুণ প্রকৃতিবিজ্ঞানী তার কাছে অপরিচিত একটি জীবগোষ্ঠী সম্বন্ধে যখন গবেষণা আরম্ভ করে, প্রথমেই সে কোন্ বৈশিষ্ট্যগুলি প্রজাতিক ও কোন্ বৈশিষ্ট্যগুলি ভ্যারাইটিগত তা নির্ধারণ করতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে; কারণ উক্ত গোষ্ঠীটির পরিবৃত্তির ধরন ও পরিমাণ সম্বন্ধে সে কিছুই জানে না; এবং এটি অন্ততঃ প্রায়শই দেখায় যে কিছু পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু যদি সে একটি দেশের একটি শ্রেণীর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে, তাহলে সন্দেহজনক আকারদের কিভাবে শ্রেণীভুক্ত করবে তা সে তৎক্ষণাৎ স্থির করে ফেলবে। এতে করে অনেক প্রজাতি সৃষ্টি করার স্বাভাবিক প্রবণতা থাকবে তার, কারণ অনবরত গবেষণাকৃত আকারদের পার্থক্যের পরিমাণ দেখে পূর্বে উল্লিখিত পায়রা ও কুক্কুটাদির রসিক ব্যক্তিদের মতই অভিভূত হবে সে; তার প্রথম অভিব্যক্তি সংশোধন করতে, অন্য দেশ এবং অন্য গোষ্ঠীদের পরিবৃত্তি সম্বন্ধে তার সাধারণ জ্ঞান অতি সীমিত। পর্যবেক্ষণ ক্ষেত্র প্রসারিত করার পরও সে অনেক
অসুবিধাজনক ঘটনার সম্মুখীন হবে। কিন্তু যদি সে তার পর্যবেক্ষণ ব্যাপকভাবে প্রসারিত করে, তখন সে স্বাভাবিকভাবে মনস্থির করতে সমর্থ হবে; কিন্তু অত্যধিক পরিবৃত্তি বা বিভিন্নতা স্বীকার করলেই সে সফলতা লাভ করবে এবং অন্য প্রকৃতিবিদরা এই স্বীকৃতির সত্যতা খণ্ডনের চেষ্টা করবে। এখন বিচ্ছিন্ন দেশগুলি থেকে নিয়ে আসা সম্বন্ধযুক্ত আকারদের সম্পর্কে সে যখন অনুসন্ধান শুরু করে, তখন মধ্যবর্তী সংযোজনক আকার পেতে আশা না করে সদৃশতার বিষয়ে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতে সে বাধ্য হবে এবং তার অসুবিধাগুলি চরম সীমায় পৌঁছাবে।
প্রজাতি ও উপপ্রজাতির মধ্যে সীমারেখা এখনও পর্যন্ত টানা সম্ভব হয়নি–অর্থাৎ প্রকৃতিবিদদের মতে আকারগুলি প্রজাতির নিকটবর্তী হয়, কিন্তু প্রজাতি শ্রেণীভুক্ত হতে সেই মানে পৌঁছায় না; অথবা যেমন উপপ্রজাতি ও সুচিহ্নিত ভ্যারাইটির মধ্যে বা গৌণতর ভ্যারাইটি ও এককীয় পার্থক্যগুলির মধ্যে ঘটে। এইসব পার্থক্য সংজ্ঞাহীন শ্রেণীতে মিশে যায় এবং এই শ্রেণী সঠিক পথের ধারণায় মনের ওপর রেখাপাত করে।
যদিও সিস্টেম্যাটিস্টটদের কাছে এটি কম গুরুত্বের, তবুও এককীয় পার্থক্যগুলি আমাদের কাছে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি আমি। কারণ গৌণ ভ্যারাইটিদের দিকে এগুলি প্রথম ধাপ, যেগুলি আবার প্রাকৃতিক ইতিহাসের গ্রন্থে নথিভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করা হয় না। এবং যে কোন মাত্রায় আরও ভিন্ন ও স্থায়ী ভ্যারাইটিদের আরও অতিশয় সুচিহ্নিত স্থায়ী ভ্যারাইটির দিকে ধাপ হিসাবে এবং এর পর উপপ্রজাতি, তারপর প্রজাতির দিকে পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করি আমি। এক ধাপ থেকে অন্য ধাপে পার্থক্যের অতিক্রমণ অনেক ক্ষেত্রেই জীবের প্রকৃতি ও দীর্ঘদিন ধরে ভিন্ন ভৌত পরিবেশে অবস্থানের জন্য ঘটতে পারে; কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণ ও অভিযোজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে এক ধাপ থেকে অন্য ধাপে পার্থক্যের অতিক্রমণ পুঞ্জীভূত প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গদের বর্ধিত ব্যবহার ও অব্যবহারের জন্য ঘটতে পারে বলে নিরাপদে বলা যেতে পারে। অতএব একটি সুচিহ্নিত ভ্যারাইটিকে জায়মান প্রজাতি বলা যেতে পারে; কিন্তু এই বইতে সামগ্রিকভাবে বর্ণিত। আলোচনা ও বিভিন্ন তথ্যসমূহের গুরুত্ব দ্বারা এই বিশ্বাস সমর্থনযোগ্য কিনা, তা নিশ্চয় বিচার করা উচিত।
সব ভ্যারাইটি ও জায়মান প্রজাতির প্রজাতিতে রূপান্তরিত হবে, এটা ভাবা ঠিক হবে না। এরা বিলুপ্ত হতে পারে বা ভ্যারাইটি হিসেবে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, যেমন ম্যাডেইরার কোন কোন জীবাশ্ম স্থলচর শামুকদের ভ্যারাইটি সম্পর্কে মিঃ ওলাস্টন এবং উদ্ভিদের ক্ষেত্রে গ্যাস্টন ডে স্যাপোর্টা দেখিয়েছেন। পিতামাতা প্রজাতির তুলনায় যদি একটি ভ্যারাইটি সংখ্যায় অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, তখন এটি প্রজাতি হিসেবে এবং প্রজাতিটি ভ্যারাইটি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত হবে; অথবা এটি পিতামাতা প্রজাতিকে স্থানচ্যুত ও নির্মূল করবে; অথবা উভয়েই সহ-অবস্থান করে থাকবে এবং উভয়েই স্বাধীন প্রজাতি হিসেবে গণ্য হবে। ভবিষ্যতে আমরা আবার এ বিষয়ে ফিরে আসব।
এইসব মন্তব্য থেকে দেখা যাবে যে পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সদৃশ একগুচ্ছ একককে সুবিধার জন্য ইচ্ছামতভাবে প্রজাতি পদটি প্রদান করা হয়েছে, এবং ভিন্ন ও আরও অস্থির আকারদের প্রদত্ত ভ্যারাইটি পদটি থেকে এটি আসলে ভিন্ন হয় না। আবার কেবল এককীয় পার্থক্য তুলনা করার সুবিধার জন্য ইচ্ছামতভাবে ভ্যারাইটি পদটি ব্যবহার করা হয়।
ব্যাপকভাবে বিস্তৃত, অতিশয় পরিব্যাপ্ত ও সাধারণ প্রজাতিরা সর্বাধিক পরিবর্তনশীল
তত্ত্বগতভাবে বিবেচনার মাধ্যমে আমি ভেবেছিলাম যে কয়েকটি সুলিখিত উদ্ভিদকুলায় উল্লিখিত সর্বাধিক পরিবর্তনশীল সমস্ত ভ্যারাইটিদের তালিকাভুক্ত করে প্রজাতির প্রকৃতি ও এদের সম্পর্কের বিষয় সম্বন্ধে ফল পাওয়া যেতে পারে। প্রথমে মনে হয়েছিল কাজটি খুব সোজা। কিন্তু মূল্যবান উপদেশ ও সাহায্যের জন্য আমি যাঁর নিকট অতিশয় ঋণী সেই মিঃ এইচ.সি.ওয়াটসন শীঘ্রই আমাকে বিশ্বাস করালেন যে এ ব্যাপারে অনেক অসুবিধা আছে, যেটি পরবর্তী সময়ে ডঃ হুঁকার আরও কঠোরভাবে বলেছিলেন। এইসব অসুবিধার আলোচনা এবং পরিবর্তনশীল প্রজাতিদের আনুপাতিক সংখ্যার সারণীগুলি ভবিষ্যৎ গবেষণার জুন্য সংরক্ষিত রাখব। ডঃ হুঁকার এখানে উল্লেখ করতে আমাকে অনুমতি দিয়েছেন যে আমার পাণ্ডুলিপি যত্নসহকারে অধ্যায়ন করে এবং সারণীগুলি পরীক্ষা করে তিনি মনে করেন যে নিচের বক্তব্যগুলি সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এখানে প্রয়োজন অনুসারে সংক্ষেপে উল্লিখিত সমগ্র বিষয়টি জটিল এবং ‘বাঁচার সংগ্রাম’, বৈশিষ্ট্যগুলির কেন্দ্ৰাপসারণ-এর প্রসঙ্গ এড়ানো যেতে পারে না, এবং অন্য প্রশ্নগুলি এর পর আলোচিত হবে।
আলফোসে ডি, ক্যাণ্ডোলে ও অন্যান্যরা প্রমাণ করেছেন যে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। উদ্ভিদরা সাধারণতঃ ভ্যারাইটিদের জন্ম দেয়; এবং এটি আশা করা যেতে পারত, কারণ। এরা বিভিন্ন ভৌত পরিবেশে অবস্থান করে এবং এরা জীবদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয় (আমরা এর পর দেখব, সমান বা আরও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থায়। যেটি সন্মুখীন হয়)। আমার সারণী আরও দেখায় যে কোন সীমাবদ্ধ দেশে সবচেয়ে সুলভ অর্থাৎ যার এককদের সংখ্যা প্রচুর, নিজের দেশে ব্যাপকভাবে পরিব্যাপ্ত (ব্যাপকভাবে বিস্তৃত থেকে ভিন্ন এবং সাধারণভাবে ভিন্ন) প্রজাতিরা প্রায়শই ভ্যারাইটিদের জন্ম দেয়; উদ্ভিদসংক্রান্ত লেখাগুলিতে যারা যথেষ্ট সুচিহ্নিত ভ্যারাইটি হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছে। অতএব যেগুলি প্রবলভাবে বেড়ে ওঠে বা যেগুলিকে প্রাধান্যবিস্তারকারী প্রজাতি বলা যেতে পারে, যারা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত, তারা নিজের দেশে সবচেয়ে বেশি পরিব্যাপ্ত হয় এবং এদের এককগুলির সংখ্যাও অত্যধিক হয়– তারা প্রায়শই স্পষ্টচিহ্নিত ভ্যারাইটিদের জন্ম দেয়, অথবা আমি যাদের জায়মান প্রজাতি হিসেবে বিবেচনা করি। বোধহয় পূর্বেই এটি প্রত্যাশা করা হয়ে থাকবে, কারণ যে কোন মাত্রায় স্থায়ী হতে গেলে, দেশটির অন্য অধিবাসীদের সঙ্গে এদের সংগ্রাম করতে হবে, ইতিমধ্যে প্রাধান্যবিস্তারকারী প্রজাতিদের সন্তানসন্ততি উৎপাদন করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে, এরা কিছু মাত্রায় রূপান্তরিত হয়েও তখনও ঐসব সুফলগুলি উত্তরাধিকারসূত্রে, পায়, যা স্বদেশবাসীদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে এদের পিতামাতাদের সক্ষম করে তোলে। প্রাধান্য সম্পর্কে এইসব বক্তব্য সম্বন্ধে এটি বোঝা উচিত যে কেবল ঐসব আকারের উল্লেখ করা হয়েছে, যারা পরস্পরের সঙ্গে এবং আরও বিশেষ করে প্রায় একইরকম স্বভাব সম্বলিত একই গণ বা শ্রেণীর সদস্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু করে। এককদের সংখ্যা অথবা প্রজাতির সুলভতা সম্পর্কে তুলনাটি অবশ্যই কেবল একই গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে সম্পর্কিত। উচ্চ শ্রেণীর উদ্ভিদদের একটিকে প্রভাবশালী বা প্রাধান্যবিস্তারকারী বলা যেতে পারে, যদি এটি একই দেশের প্রায় একই পরিবেশে বসবাসকারী অন্য উদ্ভিদের তুলনায় এককের সংখ্যায় অনেক বেশি হয় এবং আরও ব্যাপকভাবে পরিব্যাপ্ত হয়। এই ধরনের একটি উদ্ভিদ কম প্রভাবশালী নয়, কারণ জলে বসবাসকারী কিছু কনফার্ভা শৈবালের অথবা কিছু পরজীবী ছত্রাকের এককদের সংখ্যা অনেক বেশি ও এরা আরও ব্যাপকভাবে পরিব্যাপ্ত। কনফার্ভা শৈবাল অথবা পরজীবী ছত্রাক উপরোক্ত বিষয়ে এদের আত্মীয়দের তুলনায় যদি সংখ্যায় বেশি হয়, তখন এরা নিজেদের শ্রেণীর মধ্যে প্রভাবশালী বা প্রাধান্যবিস্তারকারী হবে।
প্রত্যেক দেশের বৃহত্তর গণের প্রজাতিরা ক্ষুদ্রতর গণের প্রজাতিদের তুলনায় প্রায়শই বেশি পরিবর্তনশীল
যে কোন উদ্ভিকুলে বর্ণিত একটি দেশের সমগ্র উদ্ভিদকুলকে যদি দুটি সমানভাগে ভাগ করা হয়, একদিকে বৃহত্তর গণের উদ্ভিদদের ( যেখানে অনেক উদ্ভিদ প্রজাতি থাকে) এবং অন্য দিকে ক্ষুদ্রতর গণের উদ্ভিদদের রাখা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে পূর্বের ভাগে অতিশয় সুলভ এবং অধিক পরিমাণে পরিব্যাপ্ত অথবা প্রভাবশালী প্রজাতিরা তাধিক সংখ্যায় থাকে। এটাই প্রত্যাশিত, কারণ যে কোন দেশে বসবাসকারী একই গণের অনেক প্রজাতি থাকার বিষয়টি কেবল দেখায় যে ঐ দেশটির জৈব ও অজৈব পরিবেশে গণটির পক্ষে অনুকূল কিছু রয়েছে, এবং বৃহত্তর গণগুলিতে অথবা অধিক প্রজাতি সম্বলিত গণগুলিতে প্রভাবশালী প্রজাতিদের বড় ধরণের আনুপাতিক সংখ্যা দেখার আশা করতে পারতাম আমরা। কিন্তু এটিকে অস্পষ্ট করে তুলতে অনেক কারণ দায়ী, আমি আশ্চর্যান্বিত হই যে আমার সারণী দেখায় যে বৃহত্তর গণের দিকে এমনকি প্রজাতিদের সংখ্যাধিক্য অল্প, দুর্বোধ্যতার দুটি কারণ এখানে আমি পরোক্ষভাবে। উল্লেখ করব। স্বাদুজল ও লবণপ্রিয় উদ্ভিদদের বিস্তার সাধারণতঃ বেশি এবং এরা। অতিশয় পরিব্যাপ্ত হয়, কিন্তু সম্ভবতঃ এদের বাসস্থানের প্রকৃতি বা ধরনের সঙ্গে এটি সম্পর্কিত, এবং প্রজাতিরা যে গণগুলির অন্তর্গত তার আকারের সঙ্গে এটির কোন সম্পর্ক নেই বা অল্প সম্পর্ক থাকে। দেহগঠনের মাত্রার দিক থেকে নিম্নশ্রেণীর উদ্ভিদরা সাধারণতঃ উচ্চশ্রেণীর উদ্ভিদদের তুলনায় খুব বেশি পরিমাণে পরিব্যাপ্ত হয় এবং এখানেও আবার গণেদের আকারের সঙ্গে এর কোন গভীর সম্পর্ক নেই। নিম্নশ্রেণীর উদ্ভিদদের ব্যাপক বিস্তারের কারণটি ভৌগোলিক বিস্তারের অধ্যায়ে আলোচিত হবে।
স্পষ্টচিহ্নিত প্রজাতি ও সুসংজ্ঞায়িত ভ্যারাইটিদের লক্ষ্য করে আমি প্রত্যাশা করেছিলাম যে প্রত্যেক দেশের বৃহত্তর গণগুলির প্রজাতিরা ক্ষুদ্রতর গণগুলির প্রজাতিদের তুলনায় প্রায়শই ভ্যারাইটি উৎপাদন করে; কারণ যেখানেই অনেক নিকট সম্পকীয় প্রজাতি (অর্থাৎ একই গণের প্রজাতিরা) সৃষ্ট হয়, সেখানে সাধারণ নিয়মানুসারে অনেক ভ্যারাইটি বা জায়মান প্রজাতি সৃষ্টি হতে থাকবে। যেখানে বড় বড় বৃক্ষ জন্মায় সেখানেই ছোট্ট ছোট্ট চারাগাছও জন্মায়, এটা দেখতে আমরা অভ্যস্ত। পরিবৃত্তির মাধ্যমে যেখানে একটি গণের অনেক প্রজাতির সৃষ্টি হয়, সেখানেই পরিবেশগত অবস্থা পরিবৃত্তির অনুকূল হয়; এবং অতএব আশা করতে পারতাম যে পরিবেশগত অবস্থা তখনও সাধারণতঃ পরিবৃত্তির অনুকূল হয়ে থাকবে। পক্ষান্তরে প্রজাতিকে যদি আমার সৃষ্টিকর্মের বিশেষ প্রক্রিয়া হিসেবে দেখি, সেখানে আপাতঃ কোন কারণ থাকে না কেন অল্প প্রজাতি সম্বলিত একটি গোষ্ঠীর তুলনায় অনেক প্রজাতি সম্বলিত একটি গোষ্ঠী আরও বেশি ভ্যারাইটি সৃষ্টি করবে।
এই প্রত্যাশার সত্যতা পরীক্ষা করার জন্য, বারটি দেশের উদ্ভিদ ও দুটি জেলার কলিওপ্টেরাস পতঙ্গদের বৃহত্তর গণগুলির প্রজাতিদের একদিকে এবং ক্ষুদ্রতর গণগুলির প্রজাতিদের অন্যদিকে দুটি প্রায় সমানভাবে বিভক্ত করে। বিন্যস্ত করেছি আমি এবং প্রমাণিত হয়েছে যে একদিকের ক্ষুদ্রতর গণগুলির তুলনায় অন্যদিকের বৃহত্তর গণগুলির প্রজাতিদের এক বিরাট অংশ ভ্যারাইটিদের উৎপাদন করেছে। অধিকন্তু ক্ষুদ্রতর গণগুলির প্রজাতিদের তুলনায় যে কোন সংখ্যক ভ্যারাইটি উৎপাদনক্ষম বৃহত্তর গণগুলির প্রজাতিরা গড়ে বেশি সংখ্যক ভ্যারাইটি উৎপাদন করে। যখন অন্য আর একটি ভাগ করা হয় এবং এক থেকে চারটি প্রজাতি সম্বলিত ক্ষুদ্র গণগুলিকে সারণী থেকে সম্পূর্ণরূপে বাদ দেওয়া হয়, তখন উভয় ক্ষেত্রেই ফল একই হয়। এইসব তথ্যের সরল তাৎপর্য হচ্ছে যে প্রজাতিরা হল স্পষ্টচিহ্নিত ও স্থায়ী ভ্যারাইটি; কারণ যেখানেই একই গণের অনেক প্রজাতি সৃষ্টি হয়েছে অথবা যেখানে, আমরা যদি অভিব্যক্তিটি ব্যবহার করতে পারি যে প্রজাতিদের উৎপাদন সক্রিয় রয়েছে, প্রজাতি সৃষ্টির প্রক্রিয়া এখনও চলছে এটি সাধারণতঃ আমরা দেখতে পাব, আরও বিশেষভাবে আমাদের বিশ্বাস করার কারণ আছে যে নূতন প্রজাতির উদ্ভব প্রক্রিয়া অতি মন্থর। এবং ভ্যারাইটিদের যদি জায়মান প্রজাতি হিসেবে দেখা হয়, তাহলে এটি নিশ্চয়ই সঠিক; কারণ সাধারণ নিয়মানুসারে আমার সারণী স্পষ্ট করে দেখায় যে যেখানেই একটি গণের অনেক প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছে, সেখানেই ঐ গণের প্রজাতিরা কিছু সংখ্যক ভ্যারাইটি অর্থাৎ জায়মান প্রজাতি সৃষ্টি করে। এর অর্থ এই নয় যে সমস্ত বড় গণগুলি এখন সবচেয়ে বেশি পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এভাবে এদের প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অথবা ক্ষুদ্রতর গণগুলি এখন পরিবর্তিত হচ্ছে না ও বৃদ্ধি পাচ্ছে না; কারণ তা ঘটলে সেটি আমার তত্ত্বের পক্ষে সাংঘাতিক হয়ে উঠত। ভূবিজ্ঞান আমাদের দেখায় যে ক্ষুদ্রতর গণগুলি দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পর প্রায়শই বিরাটাকারে বৃদ্ধি পায় এবং বৃহত্তর গণগুলি প্রায়শই শেষ সীমায় পৌঁছায়, ক্ষয়প্রাপ্ত হয় ও অন্তর্হিত হয়। আমরা যা দেখাতে চাই তা হল–একটি গণের যখন অনেক প্রজাতি সৃষ্টি হয়েছে, তখন গড়ে আরও অনেক সৃষ্টি হচ্ছে এবং এটা নিশ্চয়ই সঠিক।
বৃহত্তর গণের অনেক প্রজাতি মনে হয় পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, কিন্তু সীমাবদ্ধ বিস্তারের ভ্যারাইটিরা পরস্পরের সঙ্গে অসমভাবে সম্পর্কযুক্ত
বৃহত্তর গণগুলির প্রজাতি ও তাদের নথিভুক্ত ভ্যারাইটিদের মধ্যে অন্য সম্পর্ক রয়েছে যা পর্যবেক্ষণযোগ্য। আমরা দেখেছি যে এখানে কোন অভ্রান্ত বিচারের মান নেই যার দ্বারা প্রজাতি ও স্পষ্টচিহ্নিত ভ্যারাইটিদের পৃথক করা যায়; এবং সন্দেহজনক আকারগুলির মধ্যে সংযোজকদের পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃতিবিদরা এদের মধ্যে পার্থক্যের পরিমাণের দ্বারা এবং একটিকে অথবা উভয়কেই প্রজাতির শ্রেণীভুক্ত করতে পরিমাণটি যথেষ্ট কিনা তা উপমার দ্বারা বিচার করে একটি সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য। হয়েছেন। অতএব দুটি আকারকে প্রজাতি অথবা ভ্যারাইটি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা উচিত কিনা তা স্থির করতে পার্থক্যের পরিমাণই হচ্ছে বিচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মান। উদ্ভিদদের সম্পর্কে ফ্রাইস ও পতঙ্গদের সম্পর্কে ওয়েস্টউড বলেছেন যে বড় গণগুলির প্রজাতিদের মধ্যেকার পার্থক্যের পরিমাণ প্রায়শই অত্যন্ত কম। গড় হিসেব দ্বারা সংখ্যাগতভাবে এটি পরীক্ষা করতে চেষ্টা করেছি আমি এবং আমার প্রাপ্ত অসম্পূর্ণ ফলাফল যতদূর সম্ভব এই মতবাদটিকে সত্য বলে স্বীকার করে। কয়েকজন অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ পর্যবেক্ষকের সঙ্গে আমি আলোচনা করেছি এবং বিশেষভাবে বিবেচনার পর তারা এই মতের সঙ্গে একমত হয়েছেন। অতএব এক্ষেত্রে ক্ষুদ্রতর গণগুলির প্রজাতিদের তুলনায় বৃহত্তর গণগুলির প্রজাতিরা আরও বেশি ভ্যারাইটিদের সদৃশ হয়। অথবা বিষয়টিকে অন্যভাবে বলা যেতে পারে এবং বলা যেতে পারে যে ভ্যারাইটি বা জায়মান প্রজাতিরা সাধারণ গড়ের তুলনায় আরও বেশি সংখ্যায় সৃষ্ট হচ্ছে এমন বড় বড় গণগুলির ইতিমধ্যে সৃষ্ট প্রজাতিরা এখন কিছুটা পর্যন্ত ভ্যারাইটিদের সদৃশ হয়, কারণ এরা পার্থক্যের ক্ষেত্রে সাধারণ পরিমাণের তুলনায় কম পরিমাণে পরস্পরের থেকে ভিন্ন হয়। অধিকন্তু বৃহত্তর গণগুলির প্রজাতিরা একইভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত, যেমন। যে কোন একটি প্রজাতির ভ্যারাইটিরা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। কোন প্রকৃতিবিজ্ঞানী দাবী করেন না যে একটি গণের সব প্রজাতিরা পরস্পরের থেকে সমভাবে ভিন্ন। এদের সাধারণতঃ উপ-গণ বা শাখা বা ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত করা যেতে পারে, যেমন ফ্রাইস সঠিকভাবে মন্তব্য করেছেন যে প্রজাতিদের এইরূপ ছোট ছোট গোষ্ঠীগুলি উপগ্রহের মতো সাধারণতঃ অন্য প্রজাতির চতুর্দিকে দলবদ্ধভাবে অবস্থান করে। আকারদের গোষ্ঠী ছাড়া ভ্যারাইটিরা কি, যারা অসমানভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং কোন কোন আকারদের চতুর্দিকে দলবদ্ধভাবে অবস্থান করে–অর্থাৎ এদের পিতামাতা প্রজাতির চতুর্দিকে। সন্দেহাতীতভাবে ভ্যারাইটি ও প্রজাতিদের মধ্যে ভিন্নতার একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে; যথা, পরস্পরের সঙ্গে অথবা এদের পিতামাতা প্রজাতির সঙ্গে যখন তুলনা করা হয়, তখন ভ্যারাইটিদের মধ্যেকার পার্থক্যের পরিমাণ একই গণের প্রজাতিদের মধ্যেকারটির তুলনায় অতি অল্প হয়। কিন্তু যাকে আমি বৈশিষ্ট্যের অপসরণ বলি সেই পদ্ধতিটি যখন আলোচনা করব, তখন আমরা দেখব কেমন করে এটি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে এবং ভ্যারাইটিদের মধ্যেকার কম পার্থক্য প্রজাতিদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য বৃদ্ধিতে কেমন করে সাহায্য করে।
এখানে আর একটি বিষয়ও লক্ষণীয়। ভ্যারাইটিদের বিস্তার সাধারণতঃ খুবই সীমাবদ্ধ : বাস্তবিকপক্ষে এই বক্তব্য সত্যের তুলনায় মোটেই বেশি নয়, কারণ সম্ভাব্য পিতামাতা প্রজাতির তুলনায় এর একটি ভ্যারাইটির বিস্তার ব্যাপক হয়ে থাকে যদি এটি নেওয়া হয়, তবে এদের শ্ৰেণীগুলি উল্টিয়ে যাবে। কিন্তু বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ আছে যে প্রজাতিদের বিস্তার প্রায়শই অতিশয় সীমাবদ্ধ, এই প্রজাতিরা অন্য প্রজাতিদের অতি নিকট সম্বন্ধীয় এবং যতদূর সম্ভব ভ্যারাইটিদের সদৃশ হয়। উদাহরণস্বরূপ মিঃ এইচ.সি.ওয়াটসন লন্ডন ক্যাটালগ অফ প্ল্যান্টস’-এ (৪র্থ সংস্করণ) ৬৩টি উদ্ভিদকে বাছাই করে আমার জন্য চিহ্নিত করে রেখেছেন, যেগুলিকে এখানে প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু তিনি এদের নিকট সম্বন্ধীয় অন্য প্রজাতিদের সন্দেহজনক মূল্যের বলে বিবেচনা করেন; মিঃ ওয়াটসন গ্রেট ব্রিটেনকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করেছেন এবং এই প্রসিদ্ধ ৬৩টি প্রজাতি এইসব প্রদেশের ৬.৯ ভাগের বেশি অংশে বিস্তৃত। ঐ একই ক্যাটালগে ৫৩টি স্বীকৃত ভ্যারাইটি রয়েছে এবং এরা প্রদেশগুলির ৭.৭ ভাগের বেশি অংশে বিস্তৃত; পক্ষান্তরে, যাতে এইসব ভ্যারাইটিরা অন্তর্ভুক্ত এমন প্রজাতিরা ১৪.৩ ভাগের বেশি প্রদেশগুলিতে বিস্তৃত। অতএব স্বীকৃত ভ্যারাইটিদের প্রায় একই সীমাবদ্ধ গড় বিস্তার থাকে, যেমন থাকে নিকট সম্বন্ধীয় আকারদের ক্ষেত্রে, যেগুলিকে মিঃ ওয়াটসন সন্দেহজনক প্রজাতি হিসেবে আমার জন্য চিহ্নিত করে। রেখেছিলেন, কিন্তু যেগুলিকে আবার ব্রিটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা ভাল ও প্রকৃত প্রজাতি হিসাবে সার্বজনীনভাবে চিহ্নিত করেছেন।
সারাংশ
প্রথমতঃ মধ্যবর্তী সংযোজক আকারদের আবিষ্কার, দ্বিতীয়তঃ, এদের মধ্যে পার্থক্যের। কোন অনির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ণয় ছাড়া প্রজাতি ও ভ্যারাইটিদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা যেতে পারে না; কারণ, অল্প পার্থক্য থাকলেও দুটি আকারকে সাধারণতঃ ভ্যারাইটি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা হয়, যদিও এরা নিকটতর ভাবে সংযুক্ত হয় না; কিন্তু দুটি আকারকে প্রজাতি পদভুক্ত করার জন্য ভিন্নতার পরিমাণটির সংজ্ঞা নির্ণয় করা যেতে। পারে না। যে কোন একটি দেশে প্রজাতির গড় সংখ্যার তুলনায় বেশি প্রজাতি সম্বলিত এইসব গণের প্রজাতিদের গড় সংখ্যার বেশি ভ্যারাইটি থাকে। বড়-বড় গণগুলিতে, অন্য প্রজাতির চতুর্দিকে অল্প গুচ্ছভাবে অবস্থান করে, প্রজাতিরা যথাযথভাবে একত্রে ঘনিষ্ঠভাবে অথচ অসমানভাবে সম্বন্ধযুক্ত হয়। অন্য প্রজাতিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্বন্ধযুক্ত প্রজাতিদের আপাত সীমাবদ্ধ বিস্তার থাকে। এ সব ক্ষেত্রেই বড়-বড় গণগুলির প্রজাতিরা ভ্যারাইটিদের সঙ্গে গভীর সাদৃশ্য উপস্থিত করে। এবং প্রজাতিরা যদি একদা ভ্যারাইটি হিসেবে অবস্থান করত ও এভাবে উদ্ভূত হত, সেক্ষেত্রে এইসব সাদৃশ্যগুলি আমরা বুঝতে পারি; পক্ষান্তরে, প্রজাতিরা যদি স্বাধীনভাবে সৃষ্ট হয়, তাহলে এইসব উপমা সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যাতীত।
আমরা এ-ও দেখেছি যে প্রত্যেক শ্রেণীর বৃহত্তর গণগুলির সবচেয়ে প্রভাবশালী অথবা সংখ্যাবৃদ্ধিকারী প্রজাতিরা সবচেয়ে বেশি ভ্যারাইটিদের জন্ম দেয়; এবং যেমন আমরা এর পর দেখবো যে ভ্যারাইটিরা নূতন ও ভিন্ন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হওয়ার প্রবণতাযুক্ত হয়; এভাবে বৃহত্তর গণগুলি আরও বৃহত্তর হওয়ার প্রবণতাবিশিষ্ট হয়; এবং সমগ্র প্রকৃতিজগতে এখন প্রভাবশালী জীবনাকারগুলি অনেক রূপান্তরিত ও প্রভাবশালী বংশধর উৎপাদন করে আরও বেশি প্রভাবশালী হতে চেষ্টা করে। কিন্তু এর পর ব্যাখ্যা দেওয়া হবে এইসব ধাপগুলির দ্বারা বৃহত্তর গণগুলি ছোট-ছোট গণে ভাঙ্গ তে প্রবণতাযুক্ত হয় এবং এভাবে সমগ্র বিশ্বের জীবনাকারগুলি গোষ্ঠীর অধীনে গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়।
০৩. অস্তিত্বের সংগ্রাম
তৃতীয় অধ্যায় – অস্তিত্বের সংগ্রাম
প্রাকৃতিক নির্বাচনের ওপর এর প্রভাব ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত পদটি– বৃদ্ধির গুণোত্তরীয় অনুপাত–অভিযোজিত প্রাণী ও উদ্ভিদের দ্রুত বৃদ্ধি–বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণের ধরন–বিশ্বজনীন প্রতিযোগিতা–জলবায়ুর প্রভাব এককগুলির সংখ্যা থেকে সংরক্ষণ–প্রাকৃতিক জগতে প্রাণী ও উদ্ভিদের জটিল সম্পর্ক–একই প্রজাতির একক এবং ভ্যারাইটিদের মধ্যে জীবনসংগ্রামের তীব্রতা–একই গণের প্রজাতিদের মধ্যে এই জীবনসংগ্রাম কঠোর–জীবের সঙ্গে জীবের সম্পর্কটি সমস্ত সম্পর্কগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।
এই অধ্যায়ে বিষয়টির ওপর বিশদ আলোচনার আগে, কেমন করে অস্তিত্বের সংগ্রাম প্রাকৃতিক নির্বাচনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে সে বিষয়ে প্রাথমিকভাবে আমার কিছু বলা উচিত। আগের অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে যে প্রাকৃতিক অবস্থায় জীবগুলির মধ্যে কিছু এককীয় বিভিন্নতা দেখা যায়: বিষয়টির সত্যতা সম্পর্কে কখনও কোন প্রশ্ন তোলা হয়েছিল কিনা এ ব্যাপারে সত্যিই আমার কিছু জানা নেই। অসংখ্য সন্দেহজনক আকারদের প্রজাতি বা উপজাতি বা ভ্যারাইটি বলা যাবে কিনা তা আমাদের কাছে গুরুত্বহীন। যেমন, যদি কোন সুচিহ্নিত ভ্যারাইটিদের অবস্থান স্বীকার করা হয়, তবে ব্রিটিশ উদ্ভিদদের দুই বা তিনশত আকারদের কী পদ হবে? যদিও এই গবেষণার ভিত্তি হিসেবে এটি প্রয়োজনীয়, কিন্তু এককীয় বিভিন্নতার ও কিছু সুচিহ্নিত ভ্যারাইটিদের কেবল অবস্থান, কেমন করে প্রকৃতিতে প্রজাতিরা উদ্ভূত হয় এ বিষয়ে আমাদের বুঝতে অল্পই সাহায্য করে। জীবদেহের একটি অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের, এবং জীবনাবস্থার ও একটি জীবের সঙ্গে অন্য জীবের এইসব সূক্ষ্ম অভিযোজন কেমন করে নিখুঁত হয়েছে? সাধারণভাবে কাঠঠোকরা পাখি ও মিল্লটো উদ্ভিদে, চতুষ্পদ প্রাণীর লোমে বা পাখির পালকে আটকে থাকা নিচুস্তরের পরজীবীতে, জলে ডুব দেওয়া বিটল পতঙ্গের দেহগঠনে, মৃদুমন্দ বাতাসে তাড়িত হওয়া পালক সম্বলিত বীজে আমরা এইসব চমৎকার অভিযোজনগুলি দেখি। এককথায়, সর্বত্র ও জীবজগতের প্রতিটি অংশেই এইসব চমৎকার অভিযোজনগুলি দেখি আমরা।
এটি পুনরায় জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে যে যাদের আমরা জায়মান প্রজাতি বলেছি এমন ভ্যারাইটিরা কেমন করে অবশেষে ভাল ও ভিন্ন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে, যারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে একই প্রজাতির ভ্যারাইটিদের তুলনায় স্পষ্টতঃ আরও বেশি ভিন্ন হয়? যারা স্বতন্ত্র গণ সৃষ্টি করে এবং একই গণের প্রজাতিদের তুলনায় পরস্পরের থেকে ভিন্ন হয়, প্রজাতিদের সেইসব গোষ্ঠীর কেমন করে উদ্ভব হয়? অস্তিত্বের সংগ্রামের পরিণতিতেই এইসব ফলাফল, যা পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা পরিপূর্ণভাবে দেখব। অন্য জীব ও এদের ভৌতিক পরিবেশের অশেষ সম্পর্কগুলির ব্যাপারে যদি একটি প্রজাতির এককদের ক্ষেত্রে কোন মাত্রায় লাভজনক হয়, তাহলে এই সংগ্রামের জন্য যত অল্প এবং যে কারণেই হোক না কেন, পরিবৃত্তিগুলি ঐ সব এককদের সংরক্ষণ করার প্রবণতাযুক্ত হবে এবং সাধারণতঃ তা বংশধরে প্রেরিত হবে। এভাবে বংশধরটির বেঁচে থাকার ভাল সম্ভাবনা থাকবে, কারণ যে কোন প্রজাতির পর্যায়ক্রমিকভাবে জন্মানো অনেক এককের মধ্যে মাত্র অল্প কয়েকটিই বাঁচে। যদি উপকারী হয় তবে প্রত্যেক অল্প পরিবৃত্তি সংরক্ষিত হয়। এই পদ্ধতিটিকে আমি প্রাকৃতিক নির্বাচন নামে অভিহিত করেছি, এবং নির্বাচনের ব্যাপারে মানুষের শক্তির সঙ্গে এটির? সম্পর্ক চিহ্নিত করতে এই পদটি ব্যবহার করেছি। কিন্তু যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ মিঃ। হাবার্ট স্পেনসারের এই অভিব্যক্তিটি আরও সঠিক এবং কোন কোন সময় বেশি। সুবিধাজনক। আমরা দেখেছি নির্বাচনের দ্বারা মানুষ প্রভূত ফল লাভ করতে পারে এবং প্রকৃতি-প্রদত্ত অল্প অথচ উপকারী পরিবৃত্তিগুলির সঞ্চয়নের মাধ্যমে মানুষ তার নিজের ব্যবহারের জন্য জীবদের উপযোগী করে নিতে পারে। কিন্তু এর পর আমরা দেখব যে প্রাকৃতিক নির্বাচন হচ্ছে কর্মপ্রক্রিয়ার জন্য নিয়ত প্রস্তুত একটি শক্তি, এবং শিল্পকলার কাজের তুলনায় প্রকৃতির কাজকর্মের মত মানুষের ক্ষীণ প্রচেষ্টার তুলনায় এটি। তসবিমেয়ভাবে উৎকৃষ্টতর।
অস্তিত্বের সংগ্রাম বিষয়টি নিয়ে এখন আমরা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করব। ভবিষ্যতে আমার গবেষণার জন্য এটি বিস্তৃতভাবে আলোচিত হবে, কারণ এটি আলোচনার উপযুক্ত। অগ্রজ ডি ক্যান্ডেলে ও লিয়েল বিস্তৃতভাবে ও দর্শনগতভাবে দেখিয়েছেন যে সমস্ত জীবই কঠোর প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়। উদ্ভিদদের সম্পর্কে, উদ্যানসংক্রান্ত বিষয়ে বিপুল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, ম্যানচেস্টারের ডিন ডব্লিউ. হার্কটের তুলনায় কেউই অধিকতর দক্ষতা ও উৎসাহের সঙ্গে বিষয়টি পর্যালোচনা করেননি। সার্বজনীন অস্তিত্বের সংগ্রামের সত্যতা ভাষায় স্বীকার করা ছাড়া কোন কিছুই সহজতর নয়, অথবা, অন্ততঃ আমি যেমন দেখি, এই সিদ্ধান্ত অনবরত স্মরণে রাখার তুলনায় কোন কিছুই আরও কষ্টকর নয়। তথাপি, বিস্তার, বিরলতা, প্রাচুর্য, বিলুপ্তি ও পরিবৃত্তি সমেত প্রত্যেকটি বিষয়ে সমগ্র প্রাকৃতিক জগৎকে অস্পষ্টভাবে দেখা হবে অথবা ভুল বোঝা হবে, যতক্ষণ না এটি মনের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে প্রোথিত হচ্ছে। প্রকৃতির উজ্জ্বল মুখমণ্ডল আমরা আনন্দের সঙ্গে লক্ষ্য করি, যাদের অতিপ্রাচুর্য প্রায়শই আমরা লক্ষ্য। করি; আমরা লক্ষ্য করি বা ভুলে যাই যে আমাদের চারিদিকে অনাবশ্যকভাবে গান করে বেড়ানো পাখিদের অধিকাংশই কীটপতঙ্গ অথবা বীজ খেয়ে বেঁচে থাকে এবং এভাবে প্রতিনিয়ত জীবন ধ্বংস করছে তারা; অথবা আমরা ভুলে যাই কেমন করে এইসব গায়ক পাখি, এদের ডিম ও বাসাগুলি পাখি ও শিকারী পশুদের দ্বারা বহুলাংশে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। যদি খাদ্য এখন অতি সুলভ হয়, প্রতি বৎসর প্রতি ঋতুতে এরূপ হয় না এটি আমরা সর্বদা মনে রাখি না।
অস্তিত্বের সংগ্রাম পদটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত
আমার গোড়ায় উল্লেখ করা উচিত যে একটির ওপর অন্যটির নির্ভরশীলতা এবং শুধু এককটির জীবন নয় বরং বংশধর উৎপাদনে সক্ষম এই দুটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে ব্যাপক ও আলংকারিক অর্থে এই পদটি ব্যবহার করেছি আমি। সঠিকভাবে বলা যেতে পারে যে অভাবের সময় দুটি কুকুরসদৃশ প্রাণী খাদ্য ও বাঁচার জন্য পরস্পরের সঙ্গে সংগ্রাম করে। মরুভূমির প্রান্তে একটি উদ্ভিদ খরার বিরুদ্ধে বাঁচার জন্য পরস্পরের সঙ্গে সংগ্রাম করে বলা হয়, কিন্তু সঠিকভাবে বললে বলা উচিত যে এরা আর্দ্রতার উপর নির্ভরশীল। একটি উদ্ভিদ প্রতি বছর হাজার হাজার বীজ উৎপাদন করে, এদের মধ্যে গড়ে কেবলমাত্র একটিই পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। আরও সঠিকভাবে বললে বলা যেতে পারে যে এরা একই ধরনের ও অন্য ধরনের উদ্ভিদদের সঙ্গে সংগ্রাম করে, যারা ইতিমধ্যে জমিকে পূর্ণ করে রেখেছে। মিটো উদ্ভিদ আপেল ও অন্য অল্প কয়েকটি গাছের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু কষ্টকল্পিতভাবে বলা যেতে পারে যে এরা এইসব বৃক্ষের সঙ্গে সংগ্রাম। করে। আসল কারণ হচ্ছে এইসব পরজীবীরা যদি অসংখ্যভাবে একই বৃক্ষের সঙ্গে সংগ্রাম করে। আসল কারণ হচ্ছে এইসব পরজীবীরা যদি অসংখ্যভাবে একই বৃক্ষের ওপর জন্মায়, তবে এরা নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং মারা যায়। কিন্তু আরও সঠিকভাবে বললে বলা যেতে পারে যে একই শাখায় কাছাকাছি একত্রে জন্মানো কয়েকটি চারা মিটো উদ্ভিদ পরস্পরের সঙ্গে সংগ্রাম করে। যেহেতু পাখিরা মিটো উদ্ভিদের বীজ ইতস্ততঃ ছড়িয়ে দেয়, সেহেতু এর অস্তিত্ব পাখিদের ওপর নির্ভর করে। এবং নিয়মানুসারে বলা যেতে পারে যে এরা অন্য ফল-উৎপাদক উদ্ভিদের সঙ্গে সংগ্রাম করে, ফল গিলে খাওয়ার জন্য পাখিদের প্রলোভিত করে এবং এভাবে এরা ইতস্ততঃ ছড়িয়ে পড়ে। পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এই রকম কয়েকটি অর্থে সুবিধার জন্য অস্তিত্বের সংগ্রামের সাধারণ পদটি ব্যবহার করেছি আমি।
বৃদ্ধির গুণোত্তরীয় অনুপাত
সমস্ত জীবনের উচ্চ হারে বৃদ্ধির প্রবণতা থেকেই অস্তিত্বের সংগ্রাম গড়ে ওঠে। নিজেদের সাধারণ জীবৎকালে কয়েকটি ডিম বীজ উৎপাদন করে এমন প্রত্যেকটি জীব তার জীবনের কোন পর্যায়ে ও কোন ঋতুতে অথবা আকস্মিক কোন বছরে নিশ্চয় ধ্বংসের সম্মুখীন হয়, পক্ষান্তরে গুণোত্তরীয় বৃদ্ধির নিয়মানুসারে এদের সংখ্যা শীঘ্রই এত অত্যধিক বৃদ্ধি পাবে যে কোন দেশ উৎপাদনগুলিকে প্রতিপালন করতে পারবে না। অতএব যেহেতু বেঁচে থাকার তুলনায় আরও অনেক বেশি এককদের জন্ম হয়, সেহেতু হয় একই প্রজাতির একটি এককের সঙ্গে অন্যটির, না হয় ভিন্ন প্রজাতির এককদের সঙ্গে, অথবা জীবনের ভৌতিক পরিবেশের সঙ্গে প্রত্যেক ক্ষেত্রে নিশ্চয় বাঁচার সংগ্রাম চলবে। এটাই হচ্ছে ম্যালথাসের তত্ত্ব যা সমগ্র প্রাণী ও উদ্ভিদজগতে প্রচণ্ড জোরের সঙ্গে প্রয়োগ করা হয়, কারণ এক্ষেত্রে খাদ্যের কোন কৃত্রিম বৃদ্ধি হতে পারে না এবং কোন বিচক্ষণ ব্যক্তি বিবাহ করা থেকে নিবৃত্ত হতে পারে না। যদিও এখন কয়েকটি প্রজাতি কিছুটা দ্রুতহারে সংখ্যায় বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু সকলে এরূপ করতে পারে না, কারণ পৃথিবী এদের ধারণ করতে পারবে না।
নিয়মটির কোন ব্যতিক্রম নেই যে প্রত্যেক জীব স্বাভাবিকভাবে এত দ্রুতহারে বৃদ্ধি পায় যে যদি না তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তাহলে পৃথিবী এক জোড়া বংশধর দ্বারা শীঘ্রই পূর্ণ হবে। এমনকি মন্থরভাবে প্রজননক্ষম মানুষ পঁচিশ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে, এবং এক হাজার বছরের কম সময়ের মধ্যে আক্ষরিক অর্থে এই হারে এদের বংশধরদের দাঁড়াবার কোন জায়গা থাকবে না। লিনিয়াস গণনা করেছেন যে একটি একবর্ষজীবী উদ্ভিদ যদি কেবলমাত্র দুটি বীজ উৎপাদন করে–এভাবে এত অনুর্বর উদ্ভিদ যদি না থাকে–এবং যদি এদের চারাগাছগুলি পরের বছর দুটি উৎপাদন করে এবং যদি এইভাবে চলে, তবে কুড়ি বছরে দশ লক্ষ উদ্ভিদ জন্মাবে। সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে হাতি হচ্ছে সবচেয়ে কম প্রজননক্ষম, এবং এদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির সম্ভবপর সর্বনিম্ন হার আমি কষ্ট করে হিসেব করেছি। মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে হাতিরা ত্রিশ বছরের হলে সন্তান উৎপাদনক্ষম হয় এবং নব্বই বছর পন্ত বেঁচে থাকে। যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে : ৭৪০ থেকে ৭৫০ বছরপরে প্রায় এক শত নব্বই লক্ষ হাতি বেঁচে থাকবে, যারা প্রথম। জোড়ার বংশধর।
কিন্তু গেবল তত্ত্বগত গণনার তুলনায় এ বিষয়ে আমাদের কাছে ভাল সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে। যেমন, পরপর দুই বা তিনটি ঋতুপরিবর্তনের সময় যখন পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুকূল হয়, তখন প্রাকৃতিক পরিবেশে বিভিন্ন প্রাণীদের আশ্চর্যজনকভাবে দ্রুত বৃদ্ধির অসংখ্য নথিভুক্ত ঘটনা রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়া অনেক ধরনের গৃহপালিত প্রাণীদের মধ্যে অধিকতর চিত্তাকর্ষক সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকায় এবং পরবর্তী সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় মন্থর প্রজননক্ষম গোমহিষাদি ও ঘোড়াদের বৃদ্ধির হারের বক্তব্যগুলি সত্য বলে যদি প্রমাণিত না হয়, তবে এটি অবিশ্বাস্য হবে। উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও এমন হয়। প্রবর্তিত উদ্ভিদের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যারা সমগ্র দ্বীপের সর্বত্র দশ বছরের কম সময়ের মধ্যে সহজলভ্য হয়েছে। উদ্ভিদদের মধ্যে কয়েকটি, যেমন কার্টুন ও লম্বা থিসল, ইউরোপ থেকে লা-প্লাটায় প্রবর্তিত হয়েছিল, যারা পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ এখন সেখানে সহজলভ্য হয়েছে এবং অন্য প্রত্যেক উদ্ভিদকে বিতাড়িত করে কয়েক বর্গমাইল এলাকা দখল করেছে। ডঃ ফ্যালকনারের কাছ থেকে আমি শুনেছি আমেরিকা থেকে আমদানীকৃত কিছু উদ্ভিদ ভারতের কন্যাকুমারী থেকে হিমালয় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এ রকম আরও অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে কেউ মনে করে না যে প্রাণী বা উদ্ভিদের প্রজননক্ষমতা যুক্তিগ্রাহ্য পরিমাণে হঠাৎ এবং সাময়িকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা হচ্ছে-জীবন-পরিবেশ অতিশয় অনুকূল হয়েছে এবং ফলে নবীন ও প্রবীণদের কম বিনাশ হয়েছে এবং প্রায় সকল নবীনরা সন্তান উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে। নূতন বাসস্থানে অস্বাভাবিক দ্রুত বৃদ্ধি ও ব্যাপকভাবে ব্যাপ্তির বিষয়টি এদের গুণোত্তরীয় হার থেকে সরলভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, যার ফলাফল কখনও ব্যর্থ হয় না।
প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রায় প্রত্যেক পরিণত উদ্ভিদ বছরে একবার বীজ উৎপাদন করে, এবং প্রাণীদের মধ্যে অতি অল্প কয়েকটি বছরে একবার সন্তান উৎপাদন করে না। অতএব আমরা নিশ্চিতভাবে দাবী করতে পারি, যে সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রাণীরা গুণোত্তরীয় অনুপাতে বৃদ্ধির দিকে প্রবণতাযুক্ত হচ্ছে–যে যেখানেই অবস্থান করুক না কেন সেই অঞ্চলটিকে পূর্ণ করতে চেষ্টা করবে–যে জীবনের যে কোন সময়ে বিনাশের দ্বারা বৃদ্ধির এই গুণোত্তরীয় প্রবণতা নিশ্চয় নিয়ন্ত্রিত হবে। আমার মনে হয় গৃহপালিত প্রাণীদের সঙ্গে পরিচিতি আমাদের বিপথে পরিচালিত করতে উদ্যত হয়: এদের ব্যাপকভাবে বিনাশ আমরা লক্ষ্য করি না, অন্যদিকে এ-ও লক্ষ্য করি না যে খাদ্যের জন্য প্রতি বছর হাজারে-হাজারে এদের হত্যা করা হয় এবং প্রাকৃতিক পরিবেশেও সমসংখ্যক প্রাণী কোন না কোন প্রকারে শেষ হয়ে থাকে।
বছরে একবার হাজারে-হাজারে এবং অতি অল্প বীজ বা ডিম উৎপাদনকারী জীবদের মধ্যে একমাত্র পার্থক্যটি হচ্ছে অনুকূল পরিবেশে, যত বড়ই হোক না কেন, একটি জেলাকে পরিপূর্ণ করতে ধীরগতিতে বংশবৃদ্ধিকারীদের আরও কয়েক বছরের প্রয়োজন হবে। দক্ষিণ আমেরিকার বিশালাকায় শকুনরা কয়েক জোড়া ডিম পাড়ে ও উটপাখি এককুড়ি ডিম পাড়ে, তা সত্ত্বেও একই দেশে দুটির মধ্যে প্রথমোক্তটির সংখ্যা আরও বেশি হয়, ফুলমার পেট্রেল পাখিটি মাত্র একটি ডিম পাড়ে, তথাপি এটিকে পৃথিবীতে সবচেয়ে সংখ্যাবহুল পাখি বলে বলা হয়। একটি মক্ষিকা কয়েকশত ডিম পাড়ে, হিপ্নেবস্কার মত অন্য একটি কেবলমাত্র একটি ডিম পাড়ে; কিন্তু দুটি প্রজাতির কতগুলি একক এক জেলায় থাকতে পারবে, এই পার্থক্যটি তা নির্ধারণ করে না। অনিশ্চিত পরিমাণ খাদ্যের উপর নির্ভর করতে হয় বলে এইসব প্রজাতিদের অত্যধিক সংখ্যক ডিমের এত প্রয়োজন, কারণ এটি এদের দ্রুতহারে বৃদ্ধি ঘটায়। কিন্তু জীবনের কোন পর্যায়ে অত্যধিক বিনাশের ক্ষতিপূরণের জন্য অসংখ্য ডিম ও বীজের প্রকৃতই প্রয়োজন; এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি হয় জীবনের প্রাথমিক বয়সে। কোন প্রাণী যদি তার নিজের ডিম ও বাচ্চাদের রক্ষা করতে পারে, তাহলে অল্প সংখ্যায় এরা উৎপন্ন হতে পারে, এবং তা সত্ত্বেও গড় কুল সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ থাকবে। কিন্তু যদি বহু ডিম বা বাচ্চাগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তাহলে নিশ্চয় অসংখ্য উৎপন্ন হবে বা প্রজাতিটি বিলুপ্ত হবে। গড়ে এক হাজার বছর বাঁচে এমন একটি বৃক্ষের পূর্ণসংখ্যা বজায় রাখার পক্ষে এটি যথেষ্ট হবে যদি এক হাজার বছরে কেবল একটি বীজ উৎপন্ন হত এবং এটি কখনও নষ্ট না হত ও উপযুক্ত স্থানে অঙ্কুরিত হত। অতএব, এইসব ক্ষেত্রে ডিম ও বীজগুলির গড় সংখ্যার ওপর যে কোন প্রাণী ও উদ্ভিদের গড় সংখ্যা নির্ভর করে।
প্রকৃতির দিকে লক্ষ্য করার সময় আগেকার আলোচনাগুলি মনে রাখা প্রয়োজন কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে প্রত্যেক জীব তার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য প্রচণ্ড চেষ্টা করে বলে বলা হয়, প্রত্যেকে জীবনের কোন পর্যায়ে সংগ্রাম করেই বেঁচে থাকে, এবং হয় শৈশবে নয়তো পরিণত অবস্থায় প্রত্যেক বংশে বা মধ্যবর্তী যে কোন সময়ে ব্যাপক বিনাশ অনিবার্যরূপে ঘটে। প্রতিবন্ধকগুলিকে লঘুতর করলে, যত অল্পই হোক ধ্বংসের তীব্রতা হ্রাস করলে, প্রজাতির সংখ্যা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে যে কোন পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে।
বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণের ধরণ
প্রত্যেক প্রজাতির বৃদ্ধির সাধারণ প্রবণতা দমনের কারণগুলি খুবই অস্পষ্ট। সবচেয়ে সবল প্রজাতিদের দিকে লক্ষ্য করুন, এরা সংখ্যায় যতই বৃদ্ধি পায়, ততধিক বৃদ্ধি পেতে প্রবণ হয়ে ওঠে। এমন কি একটি মাত্র উদাহরণে নিয়ন্ত্রণগুলি কী কী তা সঠিকভাবে আমরা জানি না। অথবা এটি কাউকেই আশ্চর্যান্বিত করবে না যিনি স্মরণ করেন এ বষয়ে আমরা কত অজ্ঞ, এমন কি মানুষ জাতি সম্পর্কেও, যদিও তুলনামূলকভাবে অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় বেশি পরিচিত। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সম্পর্কে দক্ষতার সঙ্গে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন এবং আমি আশা করি ভবিষ্যতের গবেষণায় এটি সুদীর্ঘভাবে আলোচনা করবো, আরও বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকার বন্য প্রাণীদের সম্পর্কে। কয়েকটি প্রধান বিষয় পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এখানে আমি কয়েকটা কথা বলব। ডিম অথবা অতিশয় শিশু প্রাণীরাই সম্ভবতঃ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু এটি অপরিহার্য নয়। উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে বীজগুলি অতিমাত্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, কিন্তু আমার কয়েকটি পর্যবেক্ষণ থেকে মনে হয় অন্যান্য উদ্ভিদ দ্বারা পরিপূর্ণ ভূমিতে অঙ্কুরোদগমের সময় চারাগাছগুলি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন শত্রুদের আক্রমণে চারাগাছগুলি অধিক সংখ্যায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, তিন ফুট লম্বা ও দু ফুট চওড়া একটি জায়গার মাটি খনন ও পরিষ্কার করার পর এবং যেখানে অন্য উদ্ভিদদের জন্মাতে দেওয়া হয়নি সেখানে জন্মানোর পর আমাদের দেশের দেশীয় আগাছাদের চারাগাছগুলিকে চিহ্নিত করেছিলাম আমি, এবং লক্ষ্য করেছিলাম ৩৫৭টির মধ্যে কম করেও ২৯৫টি চারাগাছ প্রধানতঃ স্থলচর শামুক ও অন্যান্য পতঙ্গদের দ্বারা ধ্বংস হয়েছিল। ঘাসগুলি কেটে দেওয়া হলে বা কোন চতুষ্পদ প্রাণীর দ্বারা খাওয়ালেও এমন ঘাসের চাপড়া যদি বাড়তে দেওয়া হয়, তাহলে অধিক সকল উদ্ভিদরা পূর্ণবয়স্ক উদ্ভিদ হলেও কম সকল উদ্ভিদদের ক্রমশঃ হত্যা করে; এভাবে কাটা ঘাস চাপড়ার ছোট প্লটে (তিন ফুট x চার ফুট) জন্মানো কুড়িটি প্রজাতির মধ্যে নয়টি প্রজাতি ধ্বংস হয়েছিল এবং অন্য প্রজাতিদের স্বাধীনভাবে বাড়তে দেওয়া হয়েছিল।
খাদ্যের পরিমাণ নিশ্চয়ই প্রত্যেক প্রজাতির বৃদ্ধির চূড়ান্ত সীমা নির্ধারণ করে দেয় যার মধ্যে তারা বৃদ্ধি পেতে পারে; কিন্তু এটি প্রায়শই খাদ্য প্রাপ্তির জন্য হয় না, বরং অন্য প্রাণীদের শিকারের জন্য ব্যবহৃত হয়, যেটি আবার একটি প্রজাতির গড় সংখ্যা নির্ধারণ করে। সন্দেহ করার অবকাশ নেই যে, যে কোন বড় এস্টেটে তিতির ও গ্রাউস পাখি এবং শশকদের কুল মূলত কীটমূষিকাদির ধ্বংসের উপর নির্ভর করে। পরবর্তী কুড়ি বছরে ইংল্যান্ডে যদি একটিও প্রাণীকে হত্যা করা না হয় এবং এই সময়ে যদি কোন। পোকামাকড় ধ্বংস না হয়, তাহলে বর্তমানের তুলনায় খুব সম্ভবতঃ শিকারযোগ্য প্রাণী কম থাকবে, যদিও এখন শত সহস্র শিকারি পশুরা হাতিকে ধ্বংস করতে পারে না, কারণ এমনকি ভারতবর্ষেও বাঘেরা বাচ্চা হাতিদের আক্রমণ করার সাহস দেখায় এমন ঘটনা প্রায় বিরল।
কোন প্রজাতির গড় সংখ্যা নির্ধারণ করতে জলবায়ু একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এবং ভয়ানক ঠাণ্ডা ও খরার পর্যায়ক্রমিক ঋতুপরিবর্তন সম্ভবতঃ সমস্ত নিয়ন্ত্রকগুলির মধ্যে সবচেয়ে ফলপ্রদ। আমি হিসেব করেছিলাম (বসন্তকালে মূলতঃ পাখির বাসার ক্রমহ্রাসমান সংখ্যা থেকে) যে ১৮৫৪-৫৫ সালের শীতকাল আমার, নিজের জমির পাখিদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশকে ধ্বংস করেছে; এবং এই ধ্বংসকার্য ভয়ানক, যখন আমরা স্মরণ করি যে মানুষের ক্ষেত্রে মহামারী হলে দশ শতাংশ মৃত্যুই ভয়ানক। জলবায়ুর প্রক্রিয়াকে প্রথম দর্শনে অস্তিত্বের সংগ্রাম থেকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ বলে মনে হয়। কিন্তু জলবায়ুর প্রক্রিয়া যতখানি খাদ্য উৎপাদন হ্রাস করে, তখন একই সময়ে যারা একই ধরনের খাদ্যে জীবনধারণ করে, একই বা ভিন্ন প্রজাতির এককদের কঠোর সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করে এই প্রক্রিয়া। উদাহরণস্বরূপ, এমন কি যখন জলবায়ু অত্যধিক ঠাণ্ডা হয় তখন যদি এটি প্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়াশীল হয়, তাহলে কম সবল অথবা শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে যারা কম পরিমাণ খাদ্য খায় এমন এককরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা যখন দক্ষিণ থেকে উত্তরে বা আর্দ্র থেকে শুষ্ক অঞ্চলে ভ্রমণ করি, তখন কিছু প্রজাতি ক্রমশঃ বিরল থেকে বিরলতর এবং অবশেষে অদৃশ্য হয় এটা আমরা অনিবার্যরূপে লক্ষ্য করি; এবং আবহাওয়ার পরিবর্তন এত স্পষ্ট যে সমগ্র ফলাফলটিকে তারই প্রত্যক্ষ কাজ বলে চিহ্নিত করতে প্রলোভিত হই আমরা। কিন্তু এটি ঠিক নয়। আমরা ভুলে যাই যে প্রত্যেক প্রজাতি, এমনকি অতি সুলভ প্রজাতিও একই খাদ্য ও স্থানের জন্য শত্রু ও প্রতিযোগীদের দ্বারা জীবনের যে কোন পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে; আবহাওয়ার কোন অল্প পরিবর্তনের জন্য এই শত্রু ও। প্রতিযোগীরা যদি সামান্য মাত্রায় প্রভাবিত হয়, তাহলে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে; এবং যেহেতু প্রত্যেক অঞ্চল ইতিমধ্যে অধিবাসীদের দ্বারা পরিপূর্ণ, সেহেতু অন্য প্রজাতিরা নিশ্চয় হ্রাস পাবে। আমরা দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হলে লক্ষ্য করি একটি প্রজাতি সংখ্যায়। ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছে; আমরা নিশ্চয় অনুভব করতে পারি এর মূল কারণটি হচ্ছে সেই প্রজাতিরা আনুকূল্য পায়, যেমন এক্ষেত্রে অন্য একটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যাপারটা একইরূপ হয় যখন আমরা উত্তর দিকে অগ্রসর হই, কিন্তু কিছুটা কম মাত্রায়, কারণ সমস্ত ধরনের প্রজাতিদের সংখ্যা এবং প্রতিযোগীদের সংখ্যাও উত্তর দিকে হ্রাস পায়, অতএব উত্তরদিকে অগ্রসর হওয়া বা পর্বতে ওঠার সময় জলবায়ুর প্রত্যক্ষ ক্ষতিকর প্রক্রিয়ার জন্য আমরা প্রায়শই খর্বাকৃতি আকারের সাক্ষাৎ পাই, যেটা আমরা দক্ষিণদিকে যাওয়া বা পর্বত থেকে নামার সময় দেখি না। আমরা যখন মেরুঅঞ্চলে বা বরফাচ্ছাদিত পর্বতশীর্ষে কিংবা প্রকৃত মরুভূমিতে যাই, তখন দেখি কেবল উপাদানগুলির সঙ্গে প্রায়শই অস্তিত্বের সংগ্রাম ঘটছে।
অন্য প্রজাতিদের প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন করে জলবায়ু যে অপ্রত্যক্ষভাবে কাজ করে, তা আমরা বাগানের অসংখ্য উদ্ভিদের ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে দেখি। আমাদের বাগানের উদ্ভিদরা আমাদের জলবায়ুকে দক্ষতার সঙ্গে সহ্য করতে পারে, কিন্তু এরা কখনও পরিবেশানুগ (ন্যাচারালাইজ) হয় না, কারণ এরা আমাদের দেশজ উদ্ভিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে না বা আমাদের দেশীয় প্রাণীদের দ্বারা বিনাশপ্রাপ্ত হওয়াকে প্রতিরোধ করতে পারে না।
অতিশয় অনুকূল পরিবেশের জন্য যখন একটি প্রজাতি একটি ছোট এলাকায় অবাধে, সংখ্যাতীতভাবে বৃদ্ধি পায়, তখন মহামারী দেখা দেয়–অন্ততঃ শিকারি প্রাণীদের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটতে দেখা যায়; এবং এখানে অস্তিত্বের সংগ্রাম নিরপেক্ষ সীমিত নিয়ন্ত্রণ থাকে। কিন্তু তথাপি এই তথাকথিত মহামারী পরজীবী কৃমির জন্য হয় বলে মনে হয়, যেখানে সম্ভবতঃ অংশত দলবদ্ধ প্রাণীদের মধ্যে ব্যাপ্তির সুবিধা থেকে কিছু কারণের জন্য সামঞ্জস্যহীনভাবে আনুকূল্য প্রদর্শন করা হয়েছে: এবং পরজীবী ও তার শিকারির মধ্যে কিছু পরিমাণ সংগ্রাম এখানে পরিলক্ষিত হয়।
পক্ষান্তরে, অনেক ক্ষেত্রে সংরক্ষণের জন্য শত্রুদের সংখ্যার আপেক্ষিক অনুপাতে একই প্রজাতির এককদের বিরাট সংখ্যা প্রয়োজন হয়। এইরূপে আমরা আমাদের জমিতে অনায়াসে প্রচুর শস্য ও রেপসিড ইত্যাদি উৎপাদন করতে পারি, কারণ পাখিদের সংখ্যার তুলনায় পাখিদের খাদ্যবীজের পরিমাণ অনেক বেশি; অথবা এক ঋতুতে অত্যধিক পরিমাণ খাদ্যের যোগান থাকা সত্ত্বেও বীজ সরবরাহের অনুপাতে পাখিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে না, কারণ এদের সংখ্যা শীতকালে নিয়ন্ত্রিত হয়; কিন্তু যিনি এ ব্যাপারে চেষ্টা করেছেন তিনি জানেন যে একটি বাগানে কিছু গম ও এরূপ অন্য গাছ থেকে বীজ পাওয়া কতখানি কষ্টসাধ্য কাজ : এক্ষেত্রে আমি প্রত্যেক বীজ নষ্ট করেছি। সংরক্ষণের জন্য একই প্রজাতির এককদের বিরাট সংখ্যার প্রয়োজনীয়তার এই ধারণাটি প্রকৃতির কিছু অদ্ভুত বিষয়কে ব্যাখ্যা করে, যেমন কিছু জায়গায় অবস্থিত অতি বিরল উদ্ভিদ কোন কোন সময় সংখ্যায় প্রচুর হয় এবং কয়েকটি সামাজিক উদ্ভিদ এমন কি তাদের বিস্তারের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত সামাজিক থাকে অর্থাৎ এককগুলি সংখ্যায় প্রচুর হয়। কারণ এসব ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে একটি উদ্ভিদ কেবল সেখানেই অবস্থান করতে পারে যেখানে জীবনধারণের উপাদানসমূহ এত অনুকূল যে অনেক সংখ্যায় একত্রে অবস্থান করতে পারে এবং এভাবে প্রজাতিটিকে চরম বিনাশের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এখানে আমার আরও বলা উচিত যে আন্তঃসঙ্করণের ভাল ফল ও নিকট আন্তঃপ্রজননের খারাপ ফল নিঃসন্দেহে এ-সবের অনেক ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এখানে আমি বিষয়টি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করছি না।
অস্তিত্বের সংগ্রামে সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদের পরস্পরের মধ্যে জটিল সম্পর্ক
এমন অনেক ঘটনা নথিভুক্ত আছে যা থেকে দেখা যায় যে একই দেশের একত্রে সংগ্রামরত জীবদের মধ্যে সম্পর্ক ও নিয়ন্ত্রণগুলি কত জটিল ও অপ্রত্যাশিত। আমি একটিমাত্র সরল উদাহরণ দেব যা আমাকে উৎসাহিত করেছে। স্ট্যাফোর্ডশায়ারে আমার এক আত্মীয়ের একটা এস্টেটে একটি বিরাট ও অতিশয় উষর প্রান্তর ছিল, যেখানে কখনও মানুষের স্পর্শ লাগেনি এবং যেখানে আমার পর্যবেক্ষণের যথেষ্ট সুযোগ ছিল। কিন্তু পঁচিশ বছর আগে একই ধরনের কয়েকশ একর জমিকে বেড়া দেওয়া হয়েছিল এবং সেখানে স্কচ ফার গাছ লাগানো হয়েছিল। উষর প্রান্তরের গাছ লাগানো অংশের স্থানীয় গাছপালার পরিবর্তনটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল, সম্পূর্ণ ভিন্ন জমি থেকে অন্য জমি অতিক্রম করার সময় এটি সাধারণতঃ বেশি পরিলক্ষিত হত। উষর প্রান্তরের উদ্ভিদের আনুপাতিক সংখ্যা শুধুমাত্র সামগ্রিকভাবে পরিবর্তিত হয় নি, বরং উদ্ভিদের বারটি প্রজাতি (ঘাস ও ক্যারিসদের গণনা করা হয়নি) বাগিচায় প্রচুর পরিমাণে জন্মেছিল, যেগুলি আবার উষর প্রান্তরে দেখা যায়নি। কীটপতঙ্গের ওপর প্রভাব তখনও বেশি হয়ে থাকবে, কারণ বাগিচাগুলিতে ছয়টি কীটপতঙ্গভোজী পাখি সচরাচর দেখা যেত, যেগুলি উষর প্রান্তরে দেখা যায়নি; এবং উষর প্রান্তরে দুই বা তিনটি ভিন্ন কীটভোজী পাখি প্রায়শই আসত। অতএব আমরা লক্ষ্য করি একটিমাত্র বৃক্ষের প্রবর্তন কত শক্তিশালী; গবাদি পশুরা যাতে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য জমিটা ঘিরে দেওয়া ছাড়া অন্য কিছুই করা হয়নি। আমি সারের ফার্নহ্যামের নিকটে স্পষ্ট লক্ষ্য করেছিলাম বেড়া দেওয়া কত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে দূরবর্তী পাহাড়শীর্ষে স্কচ ফার গাছের কয়েকটি ঝাড় সমেত বিস্তৃত উষর প্রান্তর রয়েছে: গত দশ বছরের মধ্যে বিরাট অঞ্চল ঘিরে দেওয়া হয়েছে এবং এখন ফার গাছগুলি আপনা থেকেই এত নিকটে একত্রে অসংখ্যভাবে জন্মাচ্ছে যে এরা সকলে বাঁচতে পারে না। যখন আমি নিশ্চিত হই যে এই নূতন গাছগুলি লাগানো বা বসানো হয়নি, তখন এদের সংখ্যা দেখে আশ্চর্যান্বিত হই, কয়েকটি জায়গা ঘুরে দেখতে বাধ্য হই, এবং না-ঘেরা প্রান্তরের কয়েক শত একর জমি পরীক্ষা করি এবং সত্যি সত্যি পুরানো বসানো ঝাড় ছাড়া একটিও স্কচ ফার গাছ দেখিনি। কিন্তু ঐ প্রান্তরের গাছগুলির কাণ্ড ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর আমি অসংখ্য চারা এবং ছোট গাছ দেখি যেগুলিকে গবাদি পশুরা ঘন ঘন খেয়েছে। পুরানো ঝাড়গুলির একটির থেকে শত গজ দূরে অবস্থিত এক বর্গগজের মধ্যে বত্রিশটি ছোট গাছ গণনা করেছিলাম আমি। এদের মধ্যে ছাব্বিশটি বলয় সমেত একটি গাছ অনেক বছর ধরে উষর প্রান্তরের কাণ্ডদের চেয়ে মাথা তুলতে পেরেছিল, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিল। এটি মোটেই আশ্চর্যের ব্যাপার নয় যে, যে মুহূর্তে জমিটি ঘিরে দেওয়া হয়েছিল, তখন থেকেই এটি দ্রুত বৃদ্ধিশীল শিশু গাছগুলি দ্বারা পূর্ণ হয়েছিল। তথাপি প্রান্তরটি এতই অনুর্বর ও বিস্তৃত ছিল যে কেউ কখনও কল্পনাও করবে না যে এখানে গবাদি পশুরা নিবিড় ও সার্থকভাবে খাদ্যের সন্ধান করে থাকবে।
এখানে আমরা লক্ষ্য করি যে গবাদি পশুরা স্কচ ফার গাছের অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে নির্ধারণ করে; কিন্তু পৃথিবীর কয়েকটি অঞ্চলে কীটপতঙ্গরা গবাদি পশুর অস্তিত্ব নির্ধারণ করে। সম্ভবতঃ প্যারাগুয়েই এ বিষয়ে সবচেয়ে অদ্ভুত উদাহরণ, কারণ এখানে গবাদি পশু কিংবা ঘোড়া অথবা কুকুররা যথেচ্ছভাবে বেড়ে ওঠে না, যদিও এরা দলবদ্ধভাবে দক্ষিণ ও উত্তরদিকে চলাফেরা করে; এবং আজারা ও রেংগার দেখিয়েছেন যে প্যারাগুয়েতে বিপুল সংখ্যক কোন এক মাছিদের জন্যই এটি ঘটেছে, এই মাছিরা এইসব প্রাণীদের নাভিতে ডিম পাড়ে যখন এই প্রাণীরা প্রথম জন্মায়। এই মাছিদের অসংখ্য বৃদ্ধি কোন উপায় দ্বারা, সম্ভবতঃ অন্য কোন কীটপতঙ্গ দ্বারা, নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। অতএব প্যারাগুয়েতে কোন পতঙ্গভোজী পাখিদের সংখ্যা যদি কমে যায়, তখন পরজীবী কীটপতঙ্গদের সংখ্যা সম্ভবতঃ বৃদ্ধি পাবে; এবং এটি গবাদি পশুর নাভিতে ঘন ঘন আগমনকারী কীটপতঙ্গদের সংখ্যা কমাবে এবং তখন গবাদি পশু ও ঘোড়ারা অপোষ্য হবে এবং এটি নিশ্চয়ই বনানীর বিপুল পরিবর্তন ঘটাবে (প্রকৃতপক্ষে যেমনটা আমি দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি অঞ্চলে দেখেছি)। এটি পুনরায় ব্যাপকভাবে পতঙ্গদের ওপর প্রভাব ফেলবে; এবং স্ট্যাফোর্ডশায়ারের পতঙ্গভুক পাখিদের ক্ষেত্রে যেমন আমরা আগেই দেখেছি, এবং এভাবে জটিলতার ক্রমবর্ধমান চক্র চলতে থাকবে। এটি এই নয় যে প্রকৃতিতে এই সম্পর্কগুলি কখনও এইভাবে এত সরল হবে। ভিন্ন ভিন্ন সফলতার সঙ্গে সংগ্রামের পর সংগ্রাম অনবরত চলতেই থাকবে। এবং তথাপি পরিমাণে শক্তিগুলি এত সুন্দরভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় যে প্রকৃতির রূপটি দীর্ঘ সময় ধরে একই থাকে, যদিও নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে তুচ্ছ সংগ্রাম একটি জীবের ওপর অন্য জীবের বিজয় এনে দেবে। তা সত্ত্বেও আমাদের অজ্ঞতা এত গভীর ও আমাদের অনুমান এত প্রবল যে কোন জীবের অবলুপ্তির কথা শুনলে আমরা বিস্মিত হই এবং আমরা কারণটি লক্ষ্য করি না বলে পৃথিবীকে নির্জন করার জন্য বিধ্বংসী প্লাবনের প্রার্থনা করি অথবা জীবনাকারগুলির স্থায়িত্বের নিয়ম আবিষ্কার করি।
আর একটি উদাহরণ দেওয়ার জন্য আমি প্রলুব্ধ হচ্ছি, যা দেখায় প্রকৃতির মানদণ্ডে যথেষ্ট ব্যবধানবিশিষ্ট উদ্ভিদ ও প্রাণীরা জটিল সম্পর্কের জালে কেমন করে আবদ্ধ থাকে। এর পর আমি দেখানোর সুযোগ পাব যে কীটপতঙ্গরা কখনই আমার বাগানে আসে না যেখানে লোবিয়েলা ফুজেস গাছ আছে, এবং ফলস্বরূপ এর অদ্ভুত গঠন থাকা সত্ত্বেও কখনও এর বীজ হয় না। এদের পরাগপুঞ্জ অপসারণের জন্য আমাদের প্রায় সমস্ত অর্কিড জাতীয় উদ্ভিদগুলিতে কীটপতঙ্গের পরিদর্শন একান্ত দরকার এবং এর ফলে এরা নিষিক্ত হয়। পরীক্ষার মাধ্যমে আমি আবিষ্কার করেছি যে হার্টসিজ উদ্ভিদদের (ভায়োলা ট্রাইকালার) নিষিক্তকরণের জন্য ভ্রমর-মৌমাছিদের একান্ত প্রয়োজন, কারণ অন্য মৌমাছিরা এই ফুল পরিদর্শন করে না। আমি আরও লক্ষ করেছি যে কোন কোন ক্লোভার উদ্ভিদ নিষিক্তকরণের জন্য মৌমাছিদের আসা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, ডাচ ক্লোভারের (ট্রাইফোলিয়াম রিপেন্স) ২০টি পুষ্পমঞ্জরী ২২৯০টি বীজ উৎপাদন করেছিল, কিন্তু মৌমাছিদের থেকে সংরক্ষিত অন্য ২০টি পুষ্পমঞ্জরী একটিও বীজ উৎপাদন করেনি। তা ছাড়া লাল ক্লোভারের (ট্রাইফোলিয়াম প্যাটেন্স) ১০০টি পুষ্পমঞ্জরী ২৭০০টি বীজ উৎপাদন করেছিল, কিন্তু সমসংখ্যক সংরক্ষিত পুষ্পমঞ্জরী একটিও বীজ উৎপাদন করেনি। কেবল ভ্রমর-মৌমাছিরাই লাল ক্লোভার উদ্ভিদে আসে, কারণ অন্য মৌমাছিরা এর মধু সংগ্রহ করতে পারে না। মনে করা হয় যে মথ পতঙ্গরা ক্লোভার ফুলগুলিকে নিষিক্ত করতে পারে; কিন্তু লাল ক্লোভারের ক্ষেত্রে এরা এইরূপ করতে পারে কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে, কারণ এদের ভর যথেষ্ট নয় যা ফুলের পক্ষযুক্ত পাপড়িগুলিকে চাপ দিয়ে নত করতে পারে। অতএব যতদূর সম্ভব আমরা। সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে যদি ভ্রমর-মৌমাছির সমগ্র গণটি ইংল্যান্ডে অবলুপ্ত বা অতিশয় বিরল হয়, তাহলে হার্টসিজ ও লাল ক্লোভার উদ্ভিদরা অতিশয় বিরল ও সামগ্রিকভাবে অদৃশ্য হবে। যে কোন জেলায় ভ্রমর-মৌমাছির সংখ্যা মেঠো ইঁদুরের। সংখ্যার উপর দারুণভাবে নির্ভর করে, কারণ এরা এই মৌমাছিদের জাল ও বাসা নষ্ট করে ফেলে, এবং “সমগ্র ইংল্যান্ডে এদের দুই-তৃতীয়াংশেরও অধিক এভাবে ধ্বংস হয়েছে”-এই অভিমত ব্যক্ত করেন কর্ণেল নিউম্যান, যিনি ভ্রমর-মৌমাছিদের স্বভাব সম্বন্ধে দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান করেছেন। প্রায় সকলেই জানে যে বিড়ালদের সংখ্যার উপর ইঁদুরের সংখ্যা বহুলাংশে নর্ভর করে; এবং কর্ণেল নিউম্যান অভিমত ব্যক্ত করেন, “অন্য জায়গার তুলনায় গ্রাম ও ছোট শহরে ভ্রমর-মৌমাছিদের আরও বেশি সংখ্যক বাসা আমি দেখেছি, বিড়ালদের সংখ্যার জন্য এটি হয় বলেই মনে করি আমি; কারণ এরা ইঁদুর ধ্বংস করে।” অতএব এটি সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য যে একটি জেলায় একটি বিড়াল জাতীয় প্রাণীর বিরাট সংখ্যায় উপস্থিতি ঐ জেলায় প্রথমে ইঁদুর ও তারপর মৌমাছিদের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে কোন কোন উদ্ভিদের বারংবার ফুল ফোঁটা নির্ধারণ করে থাকবে।
প্রত্যেক প্রজাতির ক্ষেত্রে, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এবং বিভিন্ন ঋতুতে ও বছরে ক্রিয়াশীল হয়ে অনেক ভিন্ন ভিন্ন নিয়ন্ত্রণ সম্ভবতঃ কার্যকরী হয়; কেউ নিয়ন্ত্রণ করে অল্প, কেউ-বা সাধারণতঃ খুব শক্তিশালী হয়; কিন্তু প্রজাতিদের গড় সংখ্যা বা এমনকি তাদের অবস্থান নির্ধারণ করতে সকলেই একমত হবে। কতিপয় ক্ষেত্রে এটি দেখানো যেতে পারে যে ব্যাপকভাবে ভিন্ন ভিন্ন নিয়ন্ত্রণ বিভিন্ন জেলায় একই প্রজাতির ওপর কার্যকরী হয়। ঘেরা জায়গায় উদ্ভিদ ও ঝোঁপগুলি যখন আমরা লক্ষ্য করি, তখন এদের আনুপাতিক সংখ্যা ও ধরনগুলি হঠাৎ ঘটে বলে অভিহিত করতে প্রলোভিত হই। কিন্তু এই মতবাদটি একেবারেই ভুল: প্রত্যেকে শুনেছে যে আমেরিকার অরণ্য কেটে ফেলার পরবর্তী সময়ে ভিন্ন ধরনের বনানী আবির্ভূত হয়; কিন্তু লক্ষ্য করা গেছে যে দক্ষিণ ইউনাইটেড স্টেটস-এর প্রাচীন ইন্ডিয়ান ধ্বংসাবশেষের জায়গায় যেখানে বৃক্ষরাজি কেটে ফেলা হয়েছিল, সেখানে এখন পার্শ্ববর্তী স্বাভাবিক আদিম অরণ্যের মত একই রকম মনোরম বৈচিত্র্যে ভরা অরণ্যের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রতিবছর হাজারে হাজারে বীজ উৎপাদনকারী কয়েক ধরনের বৃক্ষের মধ্যে বহু শতাব্দী ধরে কি তীব্র সংগ্রামই হয়ে। থাকবে। কীটপতঙ্গের মধ্যে সংগ্রাম, কীটপতঙ্গ, শামুক ও অন্য প্রাণীদের সঙ্গে পাখি এবং শিকারি পশু-পাখিদের মধ্যে সংগ্রাম-সকলের একটাই চেষ্টা, সেটা হচ্ছে বৃদ্ধি। সকলে পরস্পরকে খাদ্য হিসেবে ভক্ষণ করে, অথবা বৃক্ষ, তাদের বীজ ও চারাগুলিকে খায় অথবা অন্য উদ্ভিদগুলিকে খায়, যারা প্রথম ভূমিকে পূর্ণ করেছিল এবং এইভাবে গাছের বৃদ্ধি রোধ করেছিল। কিছু পালক উড়িয়ে দিন, দেখবেন সকলে নির্দিষ্ট নিয়মে মাটিতে পড়ে। কিন্তু সমস্যাটি কত সরল, যেখানে অসংখ্য প্রাণী ও উদ্ভিদের ক্রিয়া ও প্রক্রিয়ায় ঐগুলির তুলনায় প্রত্যেকে পতিত হবে, যারা কয়েক শতাব্দী ধরে পুরনো ইন্ডিয়ান ধ্বংসাবশেষের ওপর এমন বাড়ন্ত বৃক্ষদের আনুপাতিক সংখ্যা ও ধরন নির্ধারণ করেছে।
পরজীবীরা যেমন তাদের শিকারের ওপর বেঁচে থাকে, তেমনি একটি জীবও অন্য জীবের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে এবং এই নির্ভরশীলতা সাধারণতঃ প্রকৃতির। মানদণ্ডে যথেষ্ট ব্যবধানবিশিষ্ট জীবদের মধ্যেই গড়ে ওঠে। কোন কোন সময় এটি সেই ঘটনার মত হয়, যাকে সঠিকভাবে বললে বলা যেতে পারে বাঁচার জন্য পরস্পরের মধ্যে সংগ্রাম, যেমন পঙ্গপাল ও তৃণভোজী চতুম্পদ প্রাণীদের ক্ষেত্রে ঘটে। কিন্তু একই প্রজাতির এককগুলির মধ্যে সংগ্রাম প্রায় অনিবার্যভাবে কঠোর হবে, কারণ এরা একই জেলায় নিয়মিত জন্মায়, এদের একই খাদ্যের প্রয়োজন হয়, এরা একই বিপদের সম্মুখীন হয়। একই প্রজাতির ভ্যারাইটিদের ক্ষেত্রে সংগ্রাম সাধারণতঃ প্রায় সমভাবে কঠোর হবে এবং কোন কোন সময় আমরা লক্ষ্য করি সংগ্রামটি মীমাংসিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গমের কয়েক ধরনের ভ্যারাইটিকে যদি একত্রে বোনা হয় এবং মিশ্রিত বীজ যদি আবার বোনা হয়, তাহলে মাটি ও আবহাওয়ার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত বা স্বভাবতই সবচেয়ে উর্বর এমন ভ্যারাইটিদের কয়েকটি অন্যদের পরাজিত করবে ও আরও বীজ উৎপাদন করবে এবং পরিণতিতে কয়েক বছরের মধ্যে অন্য ভ্যারাইটিদের স্থানচ্যুত করবে। বিভিন্ন রঙের মিষ্টি মটরের মত, এমন কি অতি নিকটতর ভ্যারাইটিদের মিশ্রিত কুল সংরক্ষিত করে রাখতে প্রত্যেক বছর এদের আলাদা করে চাষ করা উচিত এবং তারপর বীজদের সঠিক অনুপাতে মেশানো উচিত, অন্যথায় দুর্বলতর আকারগুলি নিয়মিতভাবে সংখ্যায় হ্রাস পাবে এবং অদৃশ্য হবে। ভেড়াদের ভ্যারাইটিদের ক্ষেত্রেও এইরূপ হয়। জোরের সঙ্গে বলা হয়েছে যে কোন কোন পর্বতবাসী ভ্যারাইটি অন্য পর্বতবাসী ভ্যারাইটিদের অনশনে রাখবে, সেইজন্য এদের একত্রে রাখা যেতে পারে না। ভেষজ জোঁকের বিভিন্ন ভ্যারাইটিদের একত্রে রাখলেও একই ফল পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক পরিবেশে একইভাবে যদি এদের সংগ্রাম করতে দেওয়া হত এবং বীজ বা শিশুদের যদি সঠিক অনুপাতে প্রতিবছর সংরক্ষণ না করা হত, তাহলে আমাদের গৃহপালিত উদ্ভিদ ও প্রাণীদের যে কোনটির ভ্যারাইটিদের একই ক্ষমতা, স্বভাব ও জৈবিক সংগঠন যথাযথভাবে বজায় থাকতো কিনা যাতে করে আধ ডজন বংশপর্যায় পর্যন্ত একটি মিশ্রিত কুলের (যাদের সংকরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে) আদি অনুপাত বজায় রাখা যেতে পারে, তাতে সন্দেহের অবকাশ আছে।
একই প্রজাতির একক ও ভ্যারাইটিদের মধ্যে জীবন-সংগ্রামের তীব্রতা
যেহেতু একই গণের প্রজাতিরা–যদিও আদৌ অপরিবর্তনীয় নয়–স্বভাবে ও গঠনবিন্যাসে এবং দেহকাঠামোয় সর্বদা সদৃশকার হয়, যদি এরা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু করে, তাহলে ভিন্ন গণগুলির প্রজাতিদের মধ্যেকার সংগ্রামের তুলনায় এদের মধ্যে সংগ্রাম মূলতঃ আরও তীব্র হবে। ইউনাইটেড স্টেটস-এর বিভিন্ন অংশে সাম্প্রতিককালে সোয়ালো পাখির একটি প্রজাতির বিস্তার আমরা লক্ষ্য করি, যা আবার অন্য একটি প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি এবং গায়ক গ্লাস পাখির সংখ্যা হ্রাস করেছে। আমরা প্রায়শই শুনি কেমন করে ইঁদুরের একটি প্রজাতি ভিন্ন আবহাওয়ায় অন্য প্রজাতির স্থান দখল করেছে। রাশিয়াতে এশীয় আরশোলারা তাদের সমগোত্রীয়দের সর্বত্র বিতাড়িত করেছে। অস্ট্রেলিয়ায় বহিরাগত মধুমৌমাছি ছোট কাটাহুলহীন স্থানীয় মৌমাছিদের দ্রুত ধ্বংস করেছে। জানা গেছে যে চার্লকের একটি প্রজাতি অন্য প্রজাতিদের স্থানচ্যুত করে; এবং অন্য সব ক্ষেত্রেও এরূপ হয়। কেন সমগোত্রীয় আকারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা অতিশয় তীব্র হলে আমরা তা অস্পষ্টভাবে দেখতে পারি, যারা আবার প্রাকৃতিক সংগঠনের একই স্থান পূর্ণ করে। কিন্তু সম্ভবতঃ কোন একটি ক্ষেত্রেও আমরা যথাযথভাবে বলতে পারি না বিরাট জীবনসংগ্রামে কেন একটি প্রজাতি অন্য একটি প্রজাতির ওপর বিজয়ী হয়।
উপরোক্ত মন্তব্যগুলি থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুসিদ্ধান্ত করা যেতে পারে, যথা–প্রত্যেক জীবের দেহকাঠামো অন্য সব জীবের দেহকাঠামোর সঙ্গে অপরিহার্যভাবে বা গুপ্তভাবে সম্পর্কযুক্ত, খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য সে যাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে, অথবা যাদের হাত থেকে পালাতে চায়, অথবা যাদেরকে সে শিকার করে। বাঘের দাঁত, পা ও নখগুলির বক্রাকার গঠনে এটি স্পষ্ট; বাঘের শরীরের লোমে আটকে থাকা পরজীবীদের ক্ষেত্রেও এটি স্পষ্ট। কিন্তু ড্যানডেলিওন উদ্ভিদের সুন্দর পালক সমেত বীজের এবং জল-বিটলের চেপ্টা ও লোমাবৃত পায়ের সম্পর্কটি প্রথমে মনে হয় বায়ু ও জলের সঙ্গে সম্পর্কিত। তথাপি পালক সমেত বীজের সুবিধাটি অন্য উদ্ভিদ দ্বারা পরিপূর্ণ জমির সঙ্গে নিঃসন্দেহেই গভীরভাবে সম্পর্কিত, যাতে করে বীজগুলি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করতে পারে ও ফাঁকা জমিতে পড়তে পারে। জল-বিটলের পায়ের গঠন সাঁতারের জন্য এত নিখুঁতভাবে অভিযোজিত যে নিজের শিকার খোঁজার জন্য ও অন্য প্রাণীর হাত থেকে পালানোর জন্য অন্য জলজ কীটপতঙ্গদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে পারে এরা।
অনেক উদ্ভিদের বীজের মধ্যে রক্ষিত পুষ্টিকর খাদ্যের ভাণ্ডারের সঙ্গে প্রথমে মনে। হয় অন্যান্য উদ্ভিদের কোন সম্পর্ক নেই। যখন মটর ও বিনের বীজ লম্বা ঘাসের মধ্যে বপন করা হয়, তখন বীজগুলি থেকে উৎপন্ন নতুন চারাগাছের বিপুল বৃদ্ধি থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে বীজের মধ্যে পুষ্টিকর খাদ্যের প্রধান ব্যবহার হচ্ছে। চারাগাছগুলিকে বাড়তে সাহায্য করা, তার পাশাপাশি যখন চতুর্দিকে বিপুলভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অন্যান্য উদ্ভিদের সঙ্গে এদের সংগ্রাম করতে হয়।
একটি উদ্ভিদের বিস্তার লক্ষ্য করুন, কেন এরা দ্বিগুণ বা চতুগুণ হয় না? আমরা জানি এরা আর একটু বেশি তাপ, শৈত, আদ্রর্তা অথবা শুষ্কতা ভালভাবে সহ্য করতে পারে, সেইজন্য অন্য কোথাও এরা অল্প বেশি তাপ অথবা ঠাণ্ডা, আদ্রর্তা অথবা শুষ্কতা সম্বলিত জেলাগুলিতে বিস্তৃত হয়। এক্ষেত্রে আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পারি যে যদি আমরা এদের সংখ্যাবৃদ্ধির ক্ষমতা প্রদান করার কল্পনা করতে ইচ্ছা করি, তবে প্রতিযোগীদের বা এদের ভক্ষণকারী প্রাণীদের থেকে এদের কিছু সুযোগসুবিধা দেওয়া উচিত। এদের ভৌগোলিক বিস্তারের মধ্যে, আবহাওয়ার জন্য গঠনবিন্যাসের একটি পরিবর্তন আমাদের উদ্ভিদটির পক্ষে স্পষ্টত লাভজনক হবে; কিন্তু বিশ্বাস করার সঙ্গ ত কারণ আছে যে কেবল কতিপয় উদ্ভিদ বা প্রাণী এতদূর বিস্তৃত হয় যে কেবল আবহাওয়ার তীব্রতার জন্যই ধ্বংস হয়। মেরু অঞ্চল এবং মরুভূমির প্রান্তদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত এমন জীবন আমরা দেখি না যেখানে প্রতিযোগিতা স্তব্ধ। দেশটি অতিশয় ঠাণ্ডা অথবা শুষ্ক হলেও উষ্ণতম বা অতিশয় আর্দ্রস্থানের জন্য কতিপয় প্রজাতি অথবা একই প্রজাতির এককদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা হয়।
অতএব আমরা লক্ষ্য করতে পারি যখন একটি উদ্ভিদ বা প্রাণী নূতন দেশ ও নূতন প্রতিযোগীদের মধ্যে এসে পড়ে, তখন আবহাওয়া প্রাক্তন বাসস্থানের মত একইরূপ থাকলেও এদের জীবন-পরিবেশ সাধারণতঃ প্রয়োজনানুগভাবে পরিবর্তিত হবে। নূতন বাসস্থানে যদি এদের গড় সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হয়, তাহলে নিজ দেশে যেমনভাবে এদের রূপান্তর ঘটেছে, নূতন বাসস্থানে এদের ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে রূপান্তরিত হওয়া উচিত; কারণ ভিন্ন প্রকার প্রতিযোগী ও শত্রুদের ওপর এদের কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া উচিত।
একটি প্রজাতিকে অন্য প্রজাতির তুলনায় বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টার কল্পনা করার ফল ভাল হয়। কী করা উচিত এ বিষয়ে সম্ভবতঃ একটিও উদাহরণ আমরা জানি না। সমস্ত জীবের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতার বিষয়ে আরও বেশি দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাতে সাহায্য করে। এই দৃঢ় প্রত্যয় যেমন প্রয়োজন, এটি অর্জন করাও তেমনি কষ্টকর। আমরা যা করতে পারি তা হচ্ছে দৃঢ়ভাবে মনের মধ্যে রাখা যে প্রত্যেক জীব গুণোত্তরীয় অনুপাতে বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। জীবনের যে কোন পর্যায়ে, বছরের যে কোন ঋতুতে, প্রত্যেক বংশে বা মধ্যবর্তী সময়ে, প্রত্যেক জীবকে অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম করতে হয় এবং ধ্বংসেরও সম্মুখীন হতে হয়। এই সংগ্রাম সম্বন্ধে যখন আমরা স্মরণ করি, তখন পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে আমরা নিজেদের সান্ত্বনা দিতে পারি যে প্রকৃতির সংগ্রাম অবিরাম নয়, কোন আশঙ্কা অনুভূত হয় না, মৃত্যু সাধারণত সক্রিয় এবং সবল, স্বাস্থ্যবান ও সুখীরা বেঁচে থাকে ও সংখ্যাবৃদ্ধি করে।
০৪. প্রাকৃতিক নির্বাচন অথবা যোগ্যতমের উদ্বর্তন
চতুর্থ অধ্যায় – প্রাকৃতিক নির্বাচন অথবা যোগ্যতমের উদ্বর্তন
প্রাকৃতিক নির্বাচনের তুলনায় এর ক্ষমতা–তুচ্ছ গুরুত্বের বৈশিষ্ট্যগুলির উপর এর প্রভাব–সমস্ত বয়সে উভয় লিঙ্গে এর ক্ষমতা–যৌন নির্বাচন–একই প্রজাতির এককদের মধ্যে আন্তঃ-সঙ্করণের সর্বজনীনতা–প্রাকৃতিক নির্বাচনের পরিণতিতে অনুকূল ও প্রতিকূল অবস্থাসমূহ, যথা আন্তঃ-সঙ্করণ, অন্তরণ, এককদের মন্থর প্রক্রিয়া–প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা সংঘটিত বিলুপ্তি–যে কোন ছোট অঞ্চলের অধিবাসীদের বিচিত্রতায় এবং অভিযোজন সম্পর্কিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অপসৃতি–একটি সাধারণ পিতামাতা থেকে বংশধরদের ওপর বৈশিষ্ট্য ও বিলুপ্তির অপসারণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া–সমস্ত জীবজগতের শ্রেণীবিন্যাসের ব্যাখ্যা–সংগঠনের অগ্রগতি–নিম্ন আকাররা সংরক্ষিত–চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অভিসৃতি–প্রজাতির অনির্দিষ্ট সংখ্যাবৃদ্ধি– সারাংশ।
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে সংক্ষেপে আলোচিত অস্তিত্বের সংগ্রাম পরিবৃত্তি সংক্রান্ত বিষয়ে কিরূপে কাজ করে? মানুষের হাতে এত শক্তিশালী নির্বাচন পদ্ধতিটি কি প্রকৃতিতে প্রয়োগ করা যেতে পারে? এর পর আমরা দেখব এটি অতিশয় ফলপ্রদভাবে কাজ করতে পারে। আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনে সংঘটিত অল্প পরিবৃত্তি ও এককীয় পার্থক্যের সীমাহীন সংখ্যা এবং এগুলি অল্পতর মাত্রায় প্রকৃতিতে ঘটে, এটা আমাদের স্মরণে রাখা উচিত; এবং সঙ্গে সঙ্গে বংশানুক্রমিক প্রবণতার ক্ষমতাটিও। এটি সত্য বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে গৃহপালনাধীন অবস্থায় সমগ্র জৈব সংগঠন কিছু মাত্রায় নমনীয়। কিন্তু যেমন হুঁকার ও আসা গ্রে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে বিভিন্নতাটি প্রত্যক্ষভাবে মানুষের দ্বারা উৎপাদিত হয় না, যা আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনগুলিতে আমরা প্রায় সার্বজনীনভাবে দেখি, সে ভ্যারাইটিদের উদ্ভব ঘটাতে পারে না অথবা এটির সংঘটনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না, যা ঘটে তা হচ্ছে যে এটি কেবল সংরক্ষণ ও পুঞ্জীভবন করতে পারে। সে অনিচ্ছাকৃতভাবে জীবগুলিকে নূতন ও পরিবর্তনশীল পরিবেশে প্রভাবাধীন করে এবং এর ফলে বিভিন্নতা বা পরিবৃত্তির উদ্ভব ঘটে; কিন্তু পরিবেশের একইরূপ পরিবর্তন প্রাকৃতিক অবস্থাতেও ঘটতে পারত এবং ঘটে। এটিও স্মরণে রাখা উচিত যে সমস্ত জীবের পরস্পরের ও এদের জীবনের ভৌতিক পরিবেশের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কগুলি কি-রকম জটিল ও অন্তরঙ্গ হয়; ফলস্বরূপ দেহগঠনের অসংখ্য বহুবিচিত্র বৈচিত্ৰসমূহ জীবনের পরিবর্তনশীল পরিবেশে প্রত্যেক জীবের কী প্রয়োজনে লাগতে পারত? মানুষের পক্ষে উপকারী পরিবৃত্তিগুলির সন্দেহাতীতভাবে উদ্ভব ঘটেছে এবং বিরাট ও জটিল জীবন-সংগ্রামে প্রত্যেক জীবের পক্ষে উপকারী পরিবৃত্তিগুলি অনেক বংশপরম্পরায় ঘটতে থাকবে, এসব দেখে এটি অসম্ভব বলে চিন্তা করা যেতে পারে কি? যদি এরূপ ঘটে, অন্যদের তুলনায় যত অল্পই হোক, কোন বিশেষ সুযোগ-সুবিধা লাভকারী এককদের বেঁচে থাকার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা থাকবে এবং নিজের মত সন্তান উৎপাদন করবে, এ ব্যাপারে আমরা কি সন্দেহ করতে পারি (বেঁচে থাকার তুলনায় আরও অনেক এককদের জন্ম হয় এটি স্মরণ করে? পক্ষান্তরে, আমরা স্থিরনিশ্চিত হতে পারি যে অল্পতম মাত্রায় ক্ষতিকর যে কোন পরিবৃত্তি ভয়ানকভাবে ধ্বংস হবে। অনুকূল এককীয় পার্থক্য এবং পরিবৃত্তিদের এই সংরক্ষণ এবং ক্ষতিকারকগুলির ধ্বংসসাধনকে আমি প্রাকৃতিক নির্বাচন বা যোগ্যতমের উদ্বর্তন বলেছি। অনুপকারী বা ক্ষতিকারক নয় এমন পরিবৃত্তিগুলি প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা প্রভাবিত হবে না, এবং হয় এটি অস্থিরতামূলক উপাদান হিসেবে পরিত্যক্ত হবে, যেমনটা আমরা কোন কোন বহুরূপক প্রজাতিদের ক্ষেত্রে দেখি, অথবা জৈবসংগঠন ও পরিবেশের প্রকৃতি অনুযায়ী অবশেষে স্থায়ী হবে।
কয়েকজন লেখক প্রাকৃতিক নির্বাচন পদটি সম্পর্কে অহেতুক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অথবা বিরোধিতা করেছেন। এমনকি কেউ কেউ কল্পনা করেছেন যে প্রাকৃতিক নির্বাচন পরিবৃত্তি ঘটাতে প্ররোচিত করে, পক্ষান্তরে জীবের জীবনাবস্থায় উপকারী ও উদ্ভূত পরিবৃত্তিদের কেবল সংরক্ষণই এটির অর্থ প্রকাশ করে। নির্বাচনে মানুষের বিশেষ ক্ষমতা আছে একথা যে সব কৃষিবিদরা বলেন, তারা কেউ এটির বিরোধিতা করেন না। এবং এক্ষেত্রে প্রকৃতিপ্রদত্ত এককীয় পার্থক্যগুলি অনিবার্যরূপে ঘটে, যাদের মানুষ কোন কোন কারণে নির্বাচন করে। অন্যরা বিরোধিতা করেছেন এভাবে যে রূপান্তরিত প্রাণীদের। সচেতন মনোনয়নই নির্বাচন পদটির অর্থ প্রকাশ করে, এবং এমনকি এ-ও বলার চেষ্টা হয় যে যেহেতু উদ্ভিদদের কোন ইচ্ছা নেই, সেহেতু প্রাকৃতিক নির্বাচন তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কোন সন্দেহ নেই আক্ষরিক অর্থে প্রাকৃতিক নির্বাচন একটি ভুল পদ, কিন্তু বিভিন্ন মৌল পদার্থদের ঐচ্ছিক সম্বন্ধতা সম্পর্কে বলেন, এমন রসায়নবিদদের কেউ কি। কখনও বিরোধিতা করেছেন? এবং তথাপি সঠিকভাবে বলতে গেলে অম্ল ক্ষারকে নির্বাচন করতে পারে না, যার সঙ্গে এর যুক্ত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। বলা হয়েছে যে একটি সক্রিয় শক্তি অথবা ঈশ্বররূপে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কথা বলেছি আমি; কিন্তু কে সেই লেখকের বিরোধিতা করে যিনি গ্রহদের গতির কারণ অভিকর্ষজ আকর্ষণ বলে প্রচার করেন? প্রত্যেকেই জানে এরূপ রূপক মিশ্রিত প্রকাশের অর্থ ও ইঙ্গিত কী; সংক্ষিপ্ততার জন্য এগুলির খুবই প্রয়োজন। অতএব প্রকৃতি শব্দটিতে ব্যক্তিত্ব আরোপ পরিহার করা অতিশয় কষ্টকর। কিন্তু কেবলমাত্র অনেক প্রাকৃতিক নিয়মের সামগ্রিক ক্রিয়া ও তজাত ফল, এবং আমাদের দ্বারা নির্ধারিত ঘটনার ক্রমবিন্যাসের নিয়ম দ্বারা প্রকৃতি সম্পর্কে আমি অর্থ প্রকাশ করি। অল্পজ্ঞানসম্পন্ন ভাসা-ভাসা বিরোধিতাগুলি ভুলে যেতে হবে।
কিন্তু অল্প ভৌত পরিবর্তন হচ্ছে এমন একটি দেশের কোন ঘটনা ধরলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের সম্ভাব্য গতি সম্পর্কে ভালভাবে জানতে পারব আমরা। উদাহরণস্বরূপ, জলবায়ুর কথা বলা যেতে পারে। দেশটির অধিবাসীদের আনুপাতিক সংখ্যা প্রায় তৎক্ষণাৎ পরিবর্তিত হবে এবং কতিপয় প্রজাতি সম্ভবতঃ বিলুপ্ত হবে। প্রত্যেক দেশের অধিবাসীরা যে অন্তরঙ্গ ও জটিলভাবে একত্রে আবদ্ধ থাকে, তা দেখে আমরা সিদ্ধান্ত। করতে পারি যে জলবায়ুর পরিবর্তন নিরপেক্ষভাবে অধিবাসীদের সংখ্যাসূচক অনুপাতের যে কোন পরিবর্তন অন্যদের গুরুতরভাবে প্রভাবিত করে। কোন দেশের সীমান্ত যদি খোলা থাকে, তাহলে নতুন আকারগুলি নিশ্চয় অনুপ্রবেশ করবে এবং এটি এভাবে পূর্বের কয়েকটির সম্পর্ককে গুরুতরভাবে প্রভাবিত করবে। স্মরণ রাখা উচিত, একটি প্রবর্তিত বৃক্ষ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর কত ক্ষমতা দেখানো হয়েছে। কিন্তু একটি দ্বীপ অথবা প্রতিবন্ধক দ্বারা বেষ্টিত একটি দেশের ক্ষেত্রে, যেখানে নতুন ও সু-অভিযোজিত আকারগুলি অবাধে প্রবেশ করতে পারে না, যদি আদিম অধিবাসীদের কয়েকটি কোনভাবে রূপান্তরিত হয়ে থাকত, তাহলে প্রকৃতিতে তখন অনেক অঞ্চল রয়ে থাকবে যা নিশ্চিতভাবে পরিপূর্ণ হবে। কারণ মুক্ত অঞ্চলটি অনুপ্রবেশের জন্য খুলে দিলে অনুপ্রবেশকারীরা এইসব অঞ্চল দখল নিত। এসব ক্ষেত্রে, পরিবর্তিত পরিবেশে ভালভাবে অভিযোজিত হওয়ার মাধ্যমে যে কোন ভাবে যে কোন প্রজাতির এককদের আনুকূল্য করে অল্প রূপান্তরগুলি সংরক্ষিত হওয়ার প্রবণতাসম্পন্ন হবে এবং আরও উন্নতিসাধনের জন্য প্রাকৃতিক নির্বাচনের অবাধ সুযোগ থাকবে।
আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে জীবন পরিবেশের পরিবর্তন পরিবৃত্তির বৃদ্ধি করতে জীবকে প্রবণ করে তোলে, যেমনটা প্রথম অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে; এবং পূর্ববর্তী ক্ষেত্রগুলিতে জীবন-পরিবেশে পরিবর্তিত হয়েছে এবং ফলদায়ক পরিবৃত্তি ঘটানোর একটি ভাল সম্ভাবনা প্রদান করে এটি স্পষ্টতঃ প্রাকৃতিক নির্বাচনের অনুকূল হবে। এগুলি না ঘটলে প্রাকৃতিক নির্বাচন কিছুই করতে পারে না। ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে ‘পরিবৃত্তি’ পদটির মধ্যে কেবল এককীয় পার্থক্যসমূহ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মানুষ যেমন এককীয় পার্থক্যগুলিকে বিশেষ দিকে বৃদ্ধি করিয়ে গৃহপালিত প্রাণী ও উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে ভাল ফল লাভ করতে পারে, প্রক্রিয়াটির জন্য তুলনামূলকভাবে বেশি সময় নিয়ে আরও সহজভাবে সেইরূপ প্রাকৃতিক নির্বাচনও করতে পারে। অথবা আমি বিশ্বাস করি না যে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করতে যে কোন বিরাট বিরাট ভৌত পরিবর্তন, যেমন জলবায়ু বা যে কোন অস্বাভাবিক পরিমাণের অন্তরণের প্রয়োজন এই জন্য হয় যে পরিবর্তনশীল অধিবাসীদের কয়েকটিকে উন্নত কোরে প্রাকৃতিক নির্বাচনের জন্য পূর্ণ করতে নূতন ও অদখলীকৃত স্থান পরিত্যক্ত হওয়া উচিত। কারণ যেহেতু প্রত্যেক দেশের অধিবাসীরা সুষম শক্তিগুলির সঙ্গে একত্রে সংগ্রাম করছে, সেহেতু একটি প্রজাতির দেহগঠন ও স্বভাবের অত্যল্প রূপান্তরসমূহ সুফলটিকে ততদিন পর্যন্ত প্রায়শই আরও বর্ধিত করবে, যতদিন পর্যন্ত প্রজাতিটি জীবনের একই পরিবেশে অবস্থান করবে এবং জীবনধারণ ও আত্মরক্ষার একইরূপ উপায়গুলির দ্বারা সুফল লাভ করবে। এমন একটিও দেশের নাম করা যেতে পারে না যেখানে সমস্ত স্থানীয় অধিবাসীরা এখন এত নিখুঁতভাবে পরস্পরের সঙ্গে এবং বেঁচে থাকার উপযুক্ত ভৌত অবস্থার সঙ্গে অভিযোজিত হয়েছে যে তাদের মধ্যে কেউই আরও নিখুঁতভাবে অভিযোজন ও উন্নতিসাধন করতে পারত না; কারণ সব দেশেই ভিন্ন পরিবেশে অভিযোজিতরা দেশজদের এতটা পরাজিত করেছে যে দেশজরা কতিপয় বিদেশিদের জমির অধিকার ছেড়ে দিয়েছে। এবং এভাবে প্রত্যেক দেশে বিদেশিরা দেশজদের পরাজিত করেছে বলে আমরা নিরাপদে সিদ্ধান্ত করতে পারি যে প্রাধান্যের জন্য দেশজদের রূপান্তর ঘটে থাকতে পারে, যাতে করে তারা অনুপ্রবেশকারীদের ভালভাবে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়।
মানুষ যেহেতু নিয়মানুগ ও অচেতন নির্বাচন পদ্ধতির দ্বারা বিরাট ফল উৎপাদন করতে পারে এবং নিশ্চয়ই করেছে, তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচন কি তা করতে পারে না? বহিঃস্থ ও দৃষ্টিগোচর বৈশিষ্ট্যদের ওপরই মানুষ কেবল কাজ করতে পারে; প্রাকৃতিক সংরক্ষণে অথবা যোগ্যতমের উদ্বর্তনকে নরত্ব আরোপ করতে আমাকে যদি অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে বলা যায় জীবের ক্ষেত্রে যতখানি উপযোগী হবে এমনগুলি ছাড়া প্রকৃতি বাহ্যরূপকে গ্রাহ্য করে না। অন্তঃস্থ অঙ্গের প্রত্যেকটির, জৈবসংগঠনীয় পার্থক্যের প্রত্যেক বৈচিত্র্যের, জীবনের সমগ্র তন্ত্রটির ওপর সে কাজ করতে পারে। মানুষ শুধুমাত্র নিজের ভালর জন্যই নির্বাচন করে, প্রকৃতি শুধুমাত্র জীবের সেইটির ওপর কাজ করে যাকে সে কোন লক্ষ্যে চালিত করে। প্রত্যেক নির্বাচিত বৈশিষ্ট্যকে সে পুরোপুরি কাজে লাগায়, যেটি এদের নির্বাচনের ঘটনার দ্বারা আভাসে-ইঙ্গিতে বোঝা যায়। মানুষ একই দেশে বহু ধরনের জলবায়ুতে অভ্যস্ত দেশজদের প্রতিপালন করে; প্রত্যেক নির্বাচিত বৈশিষ্ট্যকে কদাচিৎ সে কোন বিশেষ ও উপযুক্ত প্রথায় ব্যবহার করে; লম্বা ও ছোট চঞ্চুওয়ালা পায়রাকে সে একই খাবার খাওয়ায়; সে কোন বিশেষ পদ্ধতিতে লম্বা পৃষ্ঠদেশ বা লম্বা পাওয়ালা চতুষ্পদকে কাজে লাগায় না; লম্বা ও ছোট উল সমেত ভেড়াদের একই আবহাওয়ার মধ্যে রাখে। স্ত্রীদের জন্য সংগ্রাম করতে অতি শক্তিশালী পুরুষদের অনুমতি দেয় না সে। নিকৃষ্ট প্রাণীদের সে নির্বিচারে হত্যা করে না, বরং প্রত্যেক পরিবর্তনশীল ঋতুতে সে তার ক্ষমতানুসারে তার সমস্ত উৎপাদনকে রক্ষা করে। কোন অর্ধ অঙ্গবিকৃতিমূলক আকারের অথবা অন্ততঃ চোখে দেখা যায় এমন যথেষ্ট লক্ষণীয় কিছু রূপান্তরের অথবা সরলভাবে তার উপকারে লাগে এমন সব ক্ষেত্রে সে প্রায়শই তার নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করে। প্রাকৃতিক অবস্থায় দেহগঠন ও বিন্যাসের অল্পতম পার্থক্য জীবন-সংগ্রামে সুষম মানদণ্ডকে ঘুরিয়ে দিতে পারে এবং সেইজন্যই সংরক্ষিত হয়। মানুষের ইচ্ছা ও চেষ্টা কত ক্ষণস্থায়ী! কত অল্প তার সময়! এবং ফলস্বরূপ সমগ্র ভূতাত্ত্বিক যুগ ধরে প্রকৃতি দ্বারা সঞ্চিত ঐ সব ফলগুলির তুলনায় তার কার্যকাল কতই সামান্য! আমরা কি এই ভেবে বিস্ময় বোধ করতে পারি যে মানুষের উৎপাদনগুলির তুলনায় প্রকৃতির উৎপাদনগুলি বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে অনেক সঠিকতর’ হবে, বা তারা সবচেয়ে জটিল জীবন-পরিবেশে সীমাহীনভাবে অভিযোজিত হবে বা সরলভাবে উচ্চতর দক্ষতার ছাপ বহন করবে?
রূপক হিসেবে বলা যেতে পারে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন সমগ্র পৃথিবীব্যাপী অল্পতম পরিবৃত্তিগুলিকে প্রতিদিন ও প্রতিঘণ্টায় খুঁটিয়ে বা সযত্নে পরীক্ষা করছে, খারাপগুলিকে বাতিল করছে, ভালগুলিকে সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি করছে; এর জৈবিক ও অজৈবিক জীবনাবস্থাদের সম্পর্কে প্রত্যেক জীবের উন্নতিসাধনে যখন ও যেখানেই সুযোগ উপস্থিত হয়, নীরবে ও অচেতনভাবে কাজ করছে সে। দীর্ঘসময় অতিবাহিত না-হওয়া পর্যন্ত অগ্রগমনের এইসব মন্থর পরিবর্তন আমরা দেখতে পাই না, এবং তারপর দীর্ঘসময় পূর্বে অতিবাহিত ভূতাত্ত্বিক যুগগুলি সম্বন্ধে আমাদের পর্যবেক্ষণ এত ত্রুটিপূর্ণ যে পূর্বের অবস্থার তুলনায় জীবনাকারগুলি এখন অনেক ভিন্ন, এটিই আমরা দেখি।
একটি প্রজাতির যে কোন বিরাট পরিমাণ রূপান্তর হতে গেলে, একসময়ে সৃষ্ট একটি ভ্যারাইটি দীর্ঘসময় ব্যবধানে পুনরায় নিশ্চয় পরিবর্তিত হবে বা পূর্বের মত অনুকূল প্রকৃতির এককীয় পার্থক্যগুলো উপস্থিত করবে; এবং এগুলি নিশ্চয় পুনরায় সংরক্ষিত হবে এবং ধাপে ধাপে অগ্রসর হবে। একই প্রকার এককীয় পার্থক্য পুনঃ পুনঃ ঘটতে দেখে একটি অনধিকার ধৃষ্টতা হিসেবে এটিকে কদাচিৎ বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এটি সত্য কিনা, প্রকল্পটি কতখানি প্রকৃতির সাধারণ ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং কেমন ব্যাখ্যা উপস্থিত করে, তা দেখেই আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারি। বিপরীতক্রমে, সাধারণ বিশ্বাস হচ্ছে যে সম্ভবপর পরিবৃত্তির পরিমাণ কঠোরভাবে সীমায়িত। এটিও একটি সরল ধারণা।
প্রাকৃতিক নির্বাচন যদিও প্রত্যেক জীবের ভিতর দিয়ে ও মঙ্গলের জন্যই কেবল কাজ করতে পারে, তথাপি আমাদের বিবেচনায় অতি তুচ্ছ গুরুত্বের বৈশিষ্ট্য ও দেহগঠনের ওপরও ক্রিয়াশীল হতে পারে। আমরা যখন লক্ষ্য করি পাতা-ভক্ষণকারী পতঙ্গরা সবুজ, গাছের ছাল-ভক্ষণকারীরা বহুবর্ণে চিহ্নিত ধূসর, শীতে উচ্চ গিরিশৃঙ্গের টারমাইগানরা সাদা, লাল-গ্রাউসের রং হেদার গুল্মের মতো, তখন আমাদের নিশ্চয় বিশ্বাস করা উচিত যে এইসব রং ঐ সব পাখিদের ও পতঙ্গদের বিপদ থেকে আত্মরক্ষা করতে সাহায্য করে। জীবনের কোন পর্যায়ে এদের যদি ধ্বংস করা না হয়, তাহলে গ্রাউসরা (এক ধরনের বুনো হাঁস) সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি পাবে। এরা সাধারণত শিকারি পাখি দ্বারা বহুলাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এটা জানা গেছে; বাজপাখিরা দৃষ্টিশক্তির কারণে শিকারের সন্ধান পায়-মহাদেশের মানুষদের সাদা পায়রা না পোষার জন্য সতর্ক করে দেওয়া হয়, কারণ এরা সবচেয়ে বেশি ধ্বংসযোগ্য। অতএব প্রত্যেক প্রকার/ধরনের গ্রাউসকে সঠিক রং প্রদানের জন্য প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হবে এবং একবার অর্জন করার পর রংটিকে সঠিক ও স্থায়ী রাখতেও প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হবে। অথবা আমাদের এমন চিন্তা করা উচিত হবে না যে কোন বিশেষ রঙের একটি প্রাণীর আকস্মিক ধ্বংসসাধন অল্প ফল উৎপাদন করবে: আমাদের স্মরণে রাখা উচিত যে এক পাল ভেড়ার মধ্যে যদি একটি শিশু ভেড়ার রং কালো হয় তাহলে তাকে নষ্ট করা কত প্রয়োজনীয়। আমরা দেখেছি ভার্জিনিয়াতে ‘রং-করা শিকড় খাওয়ানো হয় এমন শূকরদের শরীরের রং তাদের বাঁচা-মরা নির্ধারণ করে। উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে, ফলের নরম রোম ও শাঁসের রংকে উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা অতি তুচ্ছ গুরুত্বের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করেন: তথাপি বিখ্যাত উদ্যানবিদ্ ডাউনিং-এর কাছ থেকে আমরা শুনি যে ইউনাইটেড স্টেট-এ নরম রোমযুক্ত ফলগুলির তুলনায় মসৃণ চামড়াযুক্ত ফলগুলি কারকিউলিও নামে গুবরে পোকার দ্বারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়; আরও শুনি যে হলদে প্লামের তুলনায় বেগুনি প্লামগুলি কোন বিশেষ রোগের দ্বারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়; কিন্তু পক্ষান্তরে, অন্য রঙের শাঁসসমেত পিচফলগুলির তুলনায় হলদে শাঁসের পিচফলগুলিকে অন্য ধরনের রোগ আক্রমণ করে। যাবতীয় দক্ষতার সঙ্গে কতিপয় ভ্যারাইটিকে চাষ করতে গিয়ে যদি এইসব অল্প পার্থক্য একটি বিরাট পার্থক্যে পরিণত হয়, তবে সেখানে বৃক্ষের ও অন্য অনেক শত্রুর সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়, প্রাকৃতিক অবস্থায় মসৃণ বা সূক্ষ্ম রোমযুক্ত, হলদে বা বেগুনি শাঁসযুক্ত ফলের যে কোন ভ্যারাইটি কৃতকার্য হবে কিনা তার ওপর এইরূপ পার্থক্যের ব্যাপারটির সফল সমাধান হবে।
প্রজাতিদের মধ্যে আপাতভাবে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় অনেক ছোট ছোট পার্থক্যের বিষয় লক্ষ্য করে আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে জলবায়ু, খাদ্য ইত্যাদি নিঃসন্দেহেই কিছু প্রত্যক্ষ ফল উৎপাদন করেছে। এটিও স্মরণে রাখা উচিত যে যখন একটি অঙ্গ পরিবর্তিত হয় এবং পরিবর্তনগুলি যখন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সঞ্চিত হয়, তখন পারস্পরিক সম্পর্কের নিয়মানুযায়ী অন্য রূপান্তরসমূহ প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবেই আবির্ভূত হবে।
আমরা লক্ষ্য করি যে পরিবৃত্তগুলি গৃহপালিত অবস্থায় জীবনের কোন বিশেষ বয়সে আবির্ভূত হয়। বংশধরের একই বয়সে ঐগুলির পুনরাবির্ভাবের সম্ভাবনা থাকে। যেমন, আমাদের রন্ধন ও চাষযোগ্য উদ্ভিদের অসংখ্য ভ্যারাইটিদের বীজগুলির আকার, আয়তন ও স্বাদগন্ধে; রেশম কীটের ভ্যারাইটিদের গুটি ও শুয়োপোকার বিভিন্ন ধাপে বা স্তরে; পক্ষিশালার ডিমগুলিতে ও তাদের ছানার পালকের রঙে; আমাদের প্রায় পূর্ণবয়স্ক ঘোড়া ও গোমহিষাদির শিঙে। অতএব প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাকৃতিক নির্বাচন ঐ একই বয়সে ফলদায়ক পরিবৃত্তিগুলিকে সঞ্চয়ের মাধ্যমে এবং সমরূপ বয়সে এদের বংশধরে প্রেরণের মাধ্যমে যে কোন বয়সে জীবকে পরিবর্তিত ও জীবের ওপর ক্রিয়া করতে সমর্থ হবে। যদি কোন গাছের বীজগুলি বায়ুর দ্বারা ব্যাপকভাবে বিস্তারে লাভবান হয়, তাহলে নির্বাচনের মাধ্যমে তার তুলগাছের গুঁটির রোমগুলির উন্নতি ও বৃদ্ধি করতে তুলাচাষীর অবদানের তুলনায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে এটি সম্পাদন করায় আমি কোন অসুবিধা দেখি না। একটি পতঙ্গের লার্ভাকে রূপান্তরিত ও অভিযোজিত করতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের বহু সম্ভাবনা থাকতে পারে, যা আবার পূর্ণবয়স্ক পতঙ্গের তুলনায় সামগ্রিকভাবে ভিন্ন এবং পারস্পরিক সম্পর্কের নিয়মের মাধ্যমে রূপান্তরগুলি লার্ভার গঠনকে প্রভাবিত করতে পারে। বিপরীতক্রমে এভাবে বয়স্কদের রূপান্তরগুলি লার্ভার গঠনকে প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে যে এরা ক্ষতিকর হবে না তা প্রাকৃতিক নির্বাচনই নিশ্চিত করবে, কারণ তা না হলে প্রজাতিটি বিলুপ্ত হবে।
পিতামাতা সম্পর্কে প্রাকৃতিক নির্বাচন তরুণদের গঠন রূপান্তরিত করবে এবং তরুণদের সম্পর্কে পিতামাতাদেরও। সামাজিক প্রাণীদের ক্ষেত্রে, যদি নির্বাচিত পরিবর্তনটির দ্বারা সম্প্রদায় লাভবান হয়, প্রাকৃতিক নির্বাচন সমগ্র সম্প্রদায়ের উপকারের জন্য প্রত্যেক এককের গঠনকে অভিযোজিত করবে। প্রাকৃতিক নির্বাচন যা করতে পারে না তা হচ্ছে অন্য প্রজাতির ভালর জন্য কোন সুবিধা প্রদান না করে একটি প্রজাতির গঠনকে রূপান্তরিত করা। প্রাকৃতিক ইতিহাসের গবেষণায় এই সংক্রান্ত বক্তব্য দেখা যেতে পারে, আমি একটিও উদাহরণ দেখতে পাইনি যা পরীক্ষার যোগ্য। একটি প্রাণীর জীবনে কেবল একবার ব্যবহৃত একটি গঠন যদি তার পক্ষে অতিশয় প্রয়োজনীয় হয়, তাহলে গঠনটি প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা যে কোন পর্যায় পর্যন্ত রূপান্তরিত হয়ে থাকবে; উদাহরণস্বরূপ, কোন কোন পতঙ্গের বিরাট চোয়াল গুটি খুলতে কেবল ব্যবহৃত হয় অথবা পাখিদের ঠোঁটের শক্ত অগ্রভাগ ডিম ভাঙ্গতে ব্যবহৃত হয়। জোরের সঙ্গে বলা হয় যে ডিম ফুটে বেরোনোর পূর্বেই সর্বোত্তম অসংখ্য হ্রসচক্ষুবিশিষ্ট লোটন পায়রা ডিমেই নষ্ট হয়; সেইজন্য পাখিরসিক বা প্রেমিকরা ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বের করতে সাহায্য করে। এখন যদি প্রকৃতি পাখির সুবিধার জন্য পূর্ণবয়স্ক পায়রার ঠোঁট অতিশয় ছোট করত, তাহলে রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি অতিশয় মন্থর হবে এবং ডিমের মধ্যে অতিশয় শক্তিশালী ও খুব শক্ত ঠোঁটওয়ালা সমস্ত তরুণ পাখিদের যুগপৎ কঠোর নির্বাচন হবে, ফলে দুর্বল ঠোঁটওয়ালারা সকলে অনিবার্যভাবে ধ্বংস হবে; অথবা আরও নরম ও সহজেই ভাঙ্গা যায় এমন খোলকরা নির্বাচিত হয়ে থাকবে–জানা গেছে যে খোলকের পুরুত্ব অন্য প্রত্যেক গঠনের মতোই পরিবর্তিত হয়।
এখানে বলে নেওয়া ভাল যে আকস্মিকভাবে সমস্ত জীবের ব্যাপক বিনাশ হতে পারে, যা প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অল্প প্রভাব ফেলে অথবা আদৌ কোন প্রভাব ফেলতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, অসংখ্য ডিম ও বীজ প্রতিবছর খেয়ে ফেলা হয়, যেগুলি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে রূপান্তরিত হতে পারত একমাত্র তখনই যখন এরা এমনভাবে পরিবর্তিত হত যাতে করে শত্রুদের হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে। তবুও যারা বেঁচে আছে তাদের যে কোনটির তুলনায়, ধ্বংস না হলে, এইসব ডিম ও বীজদের অনেকেই জীবন-পরিবেশে ভালভাবে অভিযোজিত, এককদের বোধহয় উৎপাদন করে থাকবে। এভাবে জীবন-পরিবেশে খুব ভালভাবে অভিযোজিত হোক আর না-ই হোক, বিরাট সংখ্যক প্রাণী ও উদ্ভিদ আকস্মিক কারণের জন্য প্রতিবছর নিশ্চয় ধ্বংস হবে, প্রজাতির পক্ষে উপকারী হবে এমন দেহকাঠামো ও জৈবসংগঠনে কোন পরিবর্তনের মাধ্যমে এদের তীব্রতা হ্রাস হবে না। কিন্তু ধরা যাক বয়স্কদের ধ্বংসসাধন কখনও খুব বেশি হয়, যে কোন জেলায় অবস্থানরত সংখ্যাটি যদি এরূপ কারণগুলির দ্বারা সামগ্রিকভাবে সংযত না রাখা হয়, অথবা ধরা যাক বীজ ও ডিমগুলির ধ্বংসসাধন এক বিরাট হয় যে কেবল শতাংশ বা সহস্রাংশ বেড়ে ওঠে–সেক্ষেত্রেও যারা বেঁচে থাকে, অনুকূল দিকে যে কোন বিভিন্নতা/পরিবর্তনশীলতা রয়েছে এটি মনে করে, এদের মধ্যে সবচেয়ে ভালভাবে অভিযোজিত এককরা সাধারণভাবে অভিযোজিতদের তুলনায় অধিক সংখ্যায় নিজেদের বংশধর উৎপাদন করতে প্রবণ হবে। এইমাত্র উল্লিখিত কারণের দ্বারা সংখ্যাটি সামগ্রিকভাবে সংযত রাখা হলে, যা প্রায়ই ঘটে থাকে, প্রাকৃতিক নির্বাচন কোন এক হিতকর দিকে কাজ করতে ক্ষমতাহীন হবে; কিন্তু অন্য সময়ে ও অন্য দিকে এরা দক্ষতা সম্পর্কে এটি কোন যুক্তিসংগত আপত্তি নয়, কারণ অনেক প্রজাতি একই সময়ে একই অঞ্চলে কখনও রূপান্তরিত হয় ও উন্নত হয় এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই।
যৌন নির্বাচন।
যে কারণে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলি গৃহপালনাবস্থায় একটি লিঙ্গে প্রায়শই আবির্ভূত হয় ও ঐ লিঙ্গেই বংশানুক্রমিক হয়, সেইরূপে নিঃসন্দেহে প্রকৃতিতেও এটি ঘটে। জীবনের বিভিন্ন স্বভাব সম্পর্কে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে দুটি লিঙ্গের রূপান্তর হওয়া এভাবে সম্ভবপর হয়, যেটি কখনও কখনও ঘটে; অথবা অন্য লিঙ্গের সম্পর্কে একটি লিঙ্গের রূপান্তর যেমন সাধারণভাবে ঘটে। এটিই আমাকে কয়েকটি কথা বলতে প্রভাবিত করেছে, যাকে আমি যৌন নির্বাচন বলেছি। অন্য জীবদের বা পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে অস্তিত্বের সংগ্রামের ওপর এটি নির্ভর করে না, কিন্তু অন্য লিঙ্গকে অধিকার করার জন্য একটি লিঙ্গের, সাধারণতঃ পুরুষদের, এককদের মধ্যে সংগ্রামের ওপর এটি নির্ভর করে। পরিণামে অকৃতকার্য প্রতিযোগীর মৃত্যু হয় না, বরং অল্প কয়েকটি বংশধর উৎপন্ন হয় অথবা একেবারেই হয় না। অতএব প্রাকৃতিক নির্বাচনের তুলনায় যৌন নির্বাচন কম কঠোর। প্রকৃতিতে ভালভাবে মানিয়ে নিয়েছে এমন সবল পুরুষরাই সাধারণতঃ বেশি বংশধর উৎপাদন করবে। অনেক ক্ষেত্রে জয়লাভ কিন্তু সাধারণ সবলতার ওপর নির্ভর করে না। সেটা সাধারণ অস্ত্র হিসেবে পুরুষদেরই থাকে। একটি শিংহীন হরিণ বা স্পারহীন মোরগের অসংখ্য বংশধর উৎপাদন করার কম সম্ভাবনা থাকে। সেরা মোরগদের যে পদ্ধতিতে নির্বাচন করে নিষ্ঠুর মোরগ-লড়িয়েরা, অনেকটা সেভাবেই সর্বদা বিজয়ীদের বংশবিস্তারের সুযোগ দিয়ে স্পার সমেত পায়ে আঘাত করতে যৌন নির্বাচন অদম্য সাহস, স্পারের (কাটা) দৈর্ঘ্য ও ডানার বল নিশ্চয় প্রদান করতে পারত। প্রকৃতির মানদণ্ড অনুযায়ী সংগ্রামের নিয়মটি কত নিম্নগামী হয় তা আমি জানি না। পুরুষ অ্যালিগেটরদের (চীন ও আমেরিকার কুমীর) সম্পর্কে বলা হয়েছে যে রেডইন্ডিয়ানদের যুদ্ধনৃত্যের মতই স্ত্রীদের অধিকার করার জন্য এরা লড়াই-গর্জন করতে করতে স্ত্রীদের চারদিকে ঘুরে বেড়ায়; দেখা গেছে পুরুষ স্যালমনরা সারাদিন লড়াই করে; পুরুষ স্ট্যাগ বিটলরা অন্য পুরুষদের বিরাট পার্শ্বীয় চোয়াল দ্বারা কোন কোন সময় আহত হয়; অননুকরণীয় পর্যবেক্ষক এম.ফেবার প্রায়শই লক্ষ্য করেছেন যে কোন কোন হাইমেনপ্টে রা পতঙ্গরা একটি বিশেষ স্ত্রীর জন্য সংগ্রাম করছে, ঐ স্ত্রীটি সংগ্রাম সম্পর্কে নির্বিকার থাকে এবং বিজয়ীর সঙ্গে প্রস্থান করে। বহুগামী প্রাণীদের ক্ষেত্রে সংগ্রামটি বোধ হয় কঠোর হয় এবং প্রায়শই এরা বিশেষ হাতিয়ার দ্বারা সজ্জিত হয়। মাংসাশী প্রাণীদের পুরুষরা সর্বদাই হাতিয়ার দ্বারা সজ্জিত। যৌন নির্বাচনের পদ্ধতিগুলির মাধ্যমে এদের ও অন্যদের আত্মরক্ষার বিশেষ উপায় প্রদান করা যেতে পারে; যেমন সিংহের কেশর, পুরুষ স্যালমনদের হুঁকাকার চোয়াল–কারণ যুদ্ধজয়ের জন্য তরবারি অথবা বর্শার মতো ঢালেরও প্রয়োজন হতে পারে।
পাখিদের মধ্যে লড়াই প্রায়শই আরও শান্তিপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের হয়। এ বিষয়ে যাঁরা মনোনিবেশ করেছেন তাঁরা সকলেই বিশ্বাস করেন যে সঙ্গীতের দ্বারা স্ত্রীদের আকর্ষণ করার জন্য অনেক প্রজাতির পুরুষদের মধ্যে ভয়ানক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। গিয়ানার পাহাড়ি গ্রাস, স্বর্গ উদ্যানের পাখিরা এবং অন্যরা একত্রে জড়ো হয় এবং অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ও সবচেয়ে ভালভাবে পর্যায়ক্রমে পুরুষরা তাদের চমৎকার পালকসমূহ প্রদর্শন করে; এভাবে তারা দর্শক হিসাবে উপস্থিত স্ত্রীদের সম্মুখে বিচিত্র সঙের অভিনয় প্রদর্শন করে এবং অবশেষে সবচেয়ে আকর্ষণীয় সঙ্গিনীকে পছন্দ করে। আটক অবস্থায় পাখিদের যাঁরা পুত্থানুপুঙ্খভাবে লক্ষ্য করেছেন তারা জানেন যে এদেরও নিজস্ব পছন্দ ও অপছন্দ থাকে। কেমন করে একটি চিত্রবিচিত্র ময়ূর তার সকল ময়ূরীদের নিকট আকর্ষণীয় হয়েছিল স্যার আর. হিরণ তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন। আমি এখানে বিশদ বিবরণ দিতে পারছি না, কিন্তু তার নিজস্ব সৌন্দর্য্যের মান অনুযায়ী মানুষ যদি তার গৃহপালিত। লড়িয়ে মোরগদের স্বল্প সময়ে সৌন্দর্য্য ও সুন্দরভাবে দাঁড়ানোর ভঙ্গি প্রদান করতে পারে, তাহলে আমি সন্দেহ করার উপযুক্ত যুক্তি খুঁজে পাই না যে স্ত্রী পাখিরা তাদের সৌন্দর্য্যের মান অনুযায়ী কয়েক সহস্র বংশ ধরে সবচেয়ে সুরেলা কণ্ঠস্বরবিশিষ্ট ও সুন্দর পুরুষদের নির্বাচন করে উল্লেখযোগ্য ফল উৎপাদন করে থাকবে। তরুণদের পালকদের তুলনায় পুরুষ ও স্ত্রী পাখিদের পালকের বিষয়ে সুপরিচিত কয়েকটি নিয়মকে বিভিন্ন বয়সে সংঘটিত পরিবৃত্তির ওপর যৌন নির্বাচনের কর্মশীলতার মাধ্যমে অংশত ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, এবং ঐ পরিবৃত্তিগুলি কেবল পুরুষদের অথবা উভয় লিঙ্গের সমরূপ বয়সে বংশগতভাবে প্রেরিত হয়; কিন্তু স্থানাভাবে এখানে আমি এ বিষয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যায় যাব না।
আমি বিশ্বাস করি বিষয়টি এমন হয় যে যখন কোন প্রাণীর পুরুষ ও স্ত্রীদের জীবনের সাধারণ স্বভাবসমূহ একই থাকে, কিন্তু দেহকাঠামো, রঙ ও অলংকরণ ভিন্ন হয়, তখন এ সব পার্থক্য প্রধানতঃ যৌন নির্বাচন দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। অর্থাৎ কোন পুরুষ বংশধরে বংশগতভাবে প্রেরিত এদের হাতিয়ারে, আত্মরক্ষায় উপায়ে বা আকর্ষণ করার ক্ষমতায় একক পুরুষদের পর্যায়ক্রমিক বংশে অন্য পুরুষদের ওপর অল্প সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার দরুণ এটি ঘটে। তথাপি সকল যৌন পার্থক্যই যে এর মাধ্যমে ঘটে, তা আমি বলতে চাই না, কারণ আমাদের গৃহপালিত প্রাণীদের লক্ষ্য করলে আমরা দেখি যে বৈশিষ্ট্যগুলি পুরুষ লিঙ্গে উদ্ধৃত হয় ও সংশ্লিষ্ট হয়, যা আবার আপাততঃ মানুষের নির্বাচনের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায় না। বন্য টার্কি মোরগের স্তনের লোমগুচ্ছ কোন কাজে লাগে না এবং এটি সন্দেহজনক যে স্ত্রী পাখির চোখে সৌন্দৰ্য্যবর্ধনের জন্য এটি সৃষ্টি হয়েছে কিনা। বাস্তবিকপক্ষে এই লোমগুচ্ছ গৃহপালনাধীন অবস্থায় আবির্ভূত হলে একে অঙ্গবিকৃতি বলা যেতে পারত।
প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া বা যোগ্যতমের উদ্বর্তনের উদাহরণসহ ব্যাখ্যা
আমার বিশ্বাস মত কেমন করে প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হয়, তা পরিষ্কার করে বলার জন্য একটি বা দুটি কল্পনামূলক উদাহরণ দেওয়ার অনুমতি চেয়ে নিচ্ছি আমি। নেকড়ে বাঘের কথাই ধরুন। এরা বিভিন্ন প্রাণীদের শিকার করে-কেউ চাতুর্যের দ্বারা, কেউ ক্ষমতা বা শক্তির দ্বারা, কেউ দ্রুতগামীতার দ্বারা; এবং ধরুন আমরা মনে করি যে দেশটির কোন পরিবর্তনের ফলেই দ্রুতগামী শিকার, উদাহরণস্বরূপ, হরিণের সংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেয়েছিল বা অন্য শিকারের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল। বছরটি ঐ ঋতুতে নেকড়েদের খাদ্যের যখন ভয়ানক প্রয়োজন, সেরূপ অবস্থায় সবচেয়ে দ্রুতগামী ও কৃশকায় নেকড়েরা বেঁচে থাকার ভাল সুযোগ পাবে এবং এইরূপে সংরক্ষিত বা নির্বাচিত হয়ে থাকবে–সর্বদা যদি বছরের একই সময়ে বা অন্য কোন সময়ে এরা শিকার করার শক্তি বজায় রাখত তাহলে এরা অন্য প্রাণীদের শিকার করতে বাধ্য হত। যত্ন সহকারে ও নিয়মানুগ নির্বাচনের দ্বারা অথবা জাতটির রূপান্তরের কোন চিন্তা ছাড়াই প্রত্যেক মানুষের সেরা কুকুর রাখার চেষ্টাপ্রসূত ঐ ধরনের অচেতন নির্বাচন দ্বারা মানুষ তার গ্রে হাউন্ড কুকুরের দ্রুতগামীতার উন্নতিসাধন করায়, তখন আমি সন্দেহ করার আর কোন যুক্তি দেখি না যে এটিই হবে তার ফল। আমি যোগ করতে পারি যে ইউনাইটেড স্টেটস-এর ক্যাটস্কিল পর্বতমালায় দুই ধরনের নেকড়ে বসবাস করে, একটির ধরন হচ্ছে গ্রে হাউন্ডের মত যারা শিকারের জন্য হরিণকে অনুসরণ করে এবং অন্যটি হচ্ছে আরও স্থূলকায়, যারা প্রায়শই মেষপালকের মেষের পালকে আক্রমণ করে।
লক্ষ্য করা উচিত এই উদাহরণে আমি সবচেয়ে কৃশকায় নেকড়ের কথা বলেছি, সংরক্ষিত হয়েছে এমন কোন স্পষ্টচিহ্নিত পরিবৃত্তির কথা বলিনি। এই বইটির পূর্বতন সংস্কারগুলিতে কোন কোন সময় আমি বলেছিলাম যে পরের বিকল্পটি বারংবার সংঘটিত হয়েছিল। এককীয় পার্থক্যদের বিরাট গুরুত্বের বিষয়টি আমি লক্ষ্য করেছিলাম। মানুষের দ্বারা অচেতন নির্বাচনের ফলাফলের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে এটি আমাকে প্ররোচিত করেছে, অচেতন নির্বাচন কমবেশি সব মূল্যবান এককদের সংরক্ষণের ও নিকৃষ্টদের ধ্বংসের ওপর নির্ভর করে। আমি এ-ও লক্ষ্য করেছিলাম যে প্রাকৃতিক অবস্থায় দেহকাঠামোর কোন আকস্মিক বিচ্যুতি, যথা একটি অঙ্গবিকৃতি, বিরল ঘটনা হবে; আরও লক্ষ্য করেছিলাম যে প্রথমেই যদি এটি সংরক্ষিত হয়, তাহলে সাধারণ এককদের সঙ্গে পরবর্তী আন্তঃসঙ্করণের মাধ্যমে এটি হারিয়ে যাবে। তা সত্ত্বেও নর্থ ব্রিটিশ রিভিউ’ পত্রিকায় (১৮৬৭) একটি মূল্যবান প্রবন্ধ না পড়া পর্যন্ত আমি উপলব্ধি করিনি যে যতই অল্প ও স্পষ্টচিহ্নিত হোক না কেন, কেমন করে একটিমাত্র পরিবৃত্তি ক্কচিৎ চিরস্থায়ী হয়ে থাকতে পারত। উক্ত লেখক এক জোড়া প্রাণীর বিষয় নিয়েছেন। এরা এদের সমগ্র জীবৎকালে দুই শত বংশধর উৎপাদন করেছে, যার মধ্যে, বিভিন্ন কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পর, গড়ে কেবলমাত্র দুটি নিজের মত সন্তান উৎপাদনের জন্য বেঁচে থাকে। বরং উচ্চতর প্রাণীদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে এটি একটি চূড়ান্ত হিসেব, কিন্তু নিম্নতর জীবদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে এটি কোন মতেই প্রযোজ্য নয়। এর পর তিনি দেখিয়েছেন যে যদি কেবলমাত্র একটি এককের জন্ম হত, যা কোনভাবে পরিবর্তিত হত, অন্য এককদের তুলনায় যদি এর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দুগুণ হত, তথাপি বেঁচে থাকার বিরুদ্ধ-সম্ভাবনাগুলি প্রবল হবে। মনে করা যাক যে এরা বেঁচে থাকে ও সন্তান উৎপাদন করে এবং এর অর্ধসংখ্যক তরুণরা অনুকূল পরিবৃত্তি। বংশগতভাবে প্রাপ্ত হয়েছে, তবুও পূর্বের আলোচনাকারী দেখিয়েছেন যে তরুণের বেঁচে থাকার ও সন্তান উৎপাদন করার কেবল অল্প সম্ভাবনা থাকবে এবং এই সম্ভাবনা পরবর্তী বংশপরম্পরায় ক্রমশঃ হ্রাস পেতে থাকবে। আমি মনে করি এইসব মন্তব্যের নায্যতা খণ্ডন করা যেতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, কোন এক ধরনের একটি পাখি যদি ঠোঁট বাঁকিয়ে সহজভাবে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারত এবং ভয়ানকভাবে বাঁকা ঠোঁট নিয়ে যদি কেউ জন্মাত এবং ফলস্বরূপ সতেজে বেড়ে উঠত, তা সত্ত্বেও সাধারণ আকারকে বর্জন করে এই একটি এককের নিজের রূপ চিরস্থায়ী করার সম্ভাবনা খুব অল্প হবে; গৃহপালন অবস্থায় যা ঘটে তা দেখে এটির বিচার-বিশ্লেষণ করে কিন্তু কোন সন্দেহ থাকতে পারে না যে খুব শক্ত ঠোঁটওয়ালা বিরাট সংখ্যক এককদের বহু বংশ ধরে সংরক্ষণ ও আরও বিরাট সংখ্যক সোজা ঠোঁটওয়ালাদের ধ্বংসসাধন থেকে এই ফলাফল ঘটবে।
তবে এটি উপেক্ষা করা ঠিক হবে না যে একই রকম জৈব সংগঠনের ওপর একইভাবে কাজ করার জন্য কোন কোন স্পষ্টচিহ্নিত পরিবৃত্তি, যাদের কেউ কেবলমাত্র এককীয় পার্থক্য হিসাবে গণ্য করবে না, প্রায়শই পুনঃ পুনঃ ঘটতে থাকবে–আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনগুলির ক্ষেত্রে যাদের অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তনশীল এককটি যদি তার বংশধরে নূতনভাবে অর্জিত বৈশিষ্ট্যটি প্রকৃতই বংশগতভাবে প্রেরণ না করত, যতদিন বিদ্যমান জীবন-পরিবেশ একইরূপ থাকে, সন্দেহাতীতভাবে এটি একইভাবে পরিবর্তিত হওয়ার আরও প্রবলতর প্রবণতা বংশগতভাবে প্রেরণ করবে। এখানেও অল্প সন্দেহ থাকতে পারে যে একই উপায়ে পরিবর্তিত হওয়ার প্রবণতা প্রায়শই এত প্রবল হয় যে একই প্রজাতির সকল একক কোন প্রকার নির্বাচনের সাহায্য ছাড়াই একইভাবে রূপান্তরিত হয়। অথবা এককদের কেবল তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম বা দশম অংশ এভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকবে, যার কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। গ্র্যাবা হিসেব করে দেখিয়েছেন যে ফারো দ্বীপপুঞ্জের গিলমট পাখিদের প্রায় এক পঞ্চমাংশই হচ্ছে একটি এত স্পষ্টচিহ্নিত ভ্যারাইটি যে পূর্বে এটিকে ইউরিয়া ল্যাক্রিম্যান্স নামে একটি ভিন্ন প্রজাতি হিসাবে গণ্য করা হত। এসব ক্ষেত্রে, পরিবৃত্তিটি যদি উপকারী প্রকৃতির হয়, প্রাথমিক আকারটি যোগ্যতমের উদ্বর্তনের মাধ্যমে শীঘ্রই রূপান্তরিত আকারটির দ্বারা স্থানচ্যুত হবে।
সমস্ত প্রকার পরিবৃত্তি অপসারণ করতে এই অর্থে আন্তঃসঙ্করণ সম্পর্কে আমার আরও কিছু বলা উচিত। কিন্তু এখানে বলা যেতে পারে যে অধিকাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদরা। তাদের উপযুক্ত বাসস্থানে বসবাস করে এবং তারা অপ্রয়োজনীয়ভাবে ঘুরে বেড়ায় না; এমনকি যাযাবর পাখিদের ক্ষেত্রেও আমরা লক্ষ্য করি যে এরা প্রায় সর্বদাই পূর্ব বাসস্থানে ফিরে আসে। ফলস্বরূপ নূতন সৃষ্ট প্রত্যেকটি ভ্যারাইটি সাধারণতঃ প্রথমে স্থানীয় হবে, যাকে প্রাকৃতিক অবস্থায় ভ্যারাইটিদের ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম বলে মনে হয়। অতএব একইরূপে রূপান্তরিত এককরা শীঘ্রই ছোট ছোট দলবদ্ধভাবে একত্রে অবস্থান করবে, প্রায়শই একত্রে সন্তান উৎপাদন করবে। নূতন প্রকারটি যদি জীবনসংগ্রামে কৃতকার্য হত, তাহলে একটি ক্রমাগত বৃদ্ধিশীল চক্রের কিনারায় অবস্থিত অপরিবর্তিত এককদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং জয় করে এটি একটি কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করত।
প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার অন্য আরও জটিল একটি উদাহরণ দেওয়া সময়োপযোগী হতে পারে। আপাত দৃষ্টিতে প্রাণরস থেকে ক্ষতিকর কোন কিছু অপসারণের জন্য কোন কোন উদ্ভিদ মিষ্টরস নিঃসরণ করে; কোন কোন শুটি জাতীয় উদ্ভিদের উপপত্রের গোড়ায় ও সাধারণ লরেল জাতীয় উদ্ভিদের পাতার পৃষ্ঠদেশে এই ধরনের নিঃসরণ গ্রন্থি বা গ্ল্যান্ড থাকে। পরিমাণে অতি অল্প হলেও এই রস পতঙ্গদের নিকট অতি লোভনীয়; কিন্তু এদের পরিদর্শন উদ্ভিদের কোন উপকারে আসে না। এখন মনে করা যাক যে রস বা মধু যে কোন প্রজাতির কিছু সংখ্যক উদ্ভিদের ফুলের অভ্যন্তর থেকে নিঃসৃত হয়েছিল। মধুর খোঁজে এসে কীটপতঙ্গরা পরাগরেণু দ্বারা আবিষ্ট হবে এবং প্রায়শই একটি ফুল থেকে অন্য ফুলে বহন করবে। একই প্রজতির দুটি ভিন্ন এককের ফুলগুলি এভাবে সঙ্করিত হবে; এবং সম্পূর্ণভাবে প্রমাণ করা যেতে পারে যে সঙ্করণ প্রক্রিয়া সবল চারাগাছের জন্ম দেয়, ফলস্বরূপ এদের প্রচুর পরিমাণে জন্মানোর ও বেঁচে থাকার উত্তম সম্ভাবনা থাকবে। বৃহত্তম নিঃসারক গ্রন্থি ও মধুগ্রন্থি সমেত ফুল উৎপাদনকারী উদ্ভিদগুলিতে প্রায়শই কীটপতঙ্গরা আসবে এবং প্রায়শই সঙ্করিত হবে; এবং এভাবে পরিণামে কর্তৃত্ব লাভ করবে ও একটি স্থানীয় ভ্যারাইটি সৃষ্টি করবে। পরাগরেণুর পরিবহনের জন্য কিছু সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিশেষ পতঙ্গটির আকার ও স্বভাব সম্পর্কে পুংকেশর ও গর্ভকেশরের বিশেষ অবস্থান সম্বলিত ফুলগুলি পতঙ্গদের বিষয়টি আমাদের গ্রহণ করা উচিত ছিল। কেবলমাত্র নিষেকের জন্য পরাগরেণু সৃষ্ট হয় বলে এর বিনাশ সম্ভবতঃ উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর; তথাপি যদি পরাগরেণু ভক্ষণকারী পতঙ্গদের দ্বারা প্রথমে আকস্মিকভাবে ও তারপর স্বভাবগতভাবে ফুল থেকে ফুলে অল্প বাহিত হত ও এভাবে সঙ্করিত হত, যদিও পরাগরেণুর দশভাগের নয়ভাগ নষ্ট হয়ে থাকে, উদ্ভিদটির পক্ষে এটি বিরাট লাভ হয়ে থাকবে; এবং বেশি বেশি করে পরাগরেণু উৎপাদনকারী ও বড় পরাগধানী সম্বলিত এককরা নির্বাচিত হবে।
উপরোক্ত প্রক্রিয়া চলার পর, যখন আমাদের উদ্ভিদটি পতঙ্গদের কাছে আকর্ষণীয় হয়, তখন এরা অনিচ্ছাকৃতভাবে এক ফুল থেকে অন্য ফুলে নিয়মিতভাবে. পরাগরেণু বহন করে এবং এরা এটি সার্থকভাবে করে। উল্লেখযোগ্য তথ্যের সাহায্যে বিষয়টি আমি। সহজেই দেখতে পারতাম। আমি কেবল একটি উদাহরণ দেব, যা এভাবে উদ্ভিদের লিঙ্গগুলির পৃথকীকরণের একটি ধাপকে ব্যাখ্যা করে। হোলি নামে এক প্রকার চিরসবুজ গুল্মে কেবল পুং-ফুল হয়, যাদের অল্প পরিমাণ পরাগরেণু উৎপাদনকারী চারটি পুংকেশর থাকে ও একটি অবর্ধিত গর্ভকেশরও থাকে; অন্য হোলি গুল্মে কেবল স্ত্রীফুল হয়; এদের পূর্ণ আকারের গর্ভকেশর ও কুঞ্চিত পরাগধানী সমেত চারটি পুংকেশর থাকে, যাতে পরাগরেণুর একটিও রেণু খুঁজে বার করা যায় না। একটি পুরুষ গাছের ঠিক ষাট গজ দূরে একটি স্ত্রী গাছ দেখে তার বিভিন্ন শাখা থেকে কুড়িটি ফুল সংগ্রহ করেছিলাম আমি ও এদের গর্ভমুণ্ডগুলি অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষা করে দেখেছিলাম যে ব্যতিক্রমহীনভাবে সবগুলিতেই অল্প কয়েকটি পরাগরেণু এবং অন্য কয়েকটিতে প্রচুর পরাগরেণু ছিল। কয়েকদিন ধরে স্ত্রী গাছের দিক থেকে পুরুষ গাছের দিকে বায়ুর প্রবাহ। থাকা সত্ত্বেও পরাগরেণু বাহিত হয়নি। আবহাওয়া খুব ঠাণ্ডা ও প্রচণ্ড ছিল, অতএব মৌমাছিদের পক্ষে এটি সুবিধাজনক ছিল না, তা সত্ত্বেও আমার পরীক্ষিত প্রত্যেক স্ত্রীফুল মৌমাছিদের দ্বারা কার্যকরভাবে নিষিক্ত হয়েছিল, যারা মধুর খোঁজে এক গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে বেড়াত। বরং আমাদের কল্পিত বিষয়ে ফিরে আসা যাক: নিয়মিতভাবে পরাগরেণু এক ফুল থেকে অন্য ফুলে বহনের জন্য যে মুহূর্তে উদ্ভিদটি পতঙ্গদের নিকট এত আকর্ষণীয় হয়েছিল যাতে করে অন্য একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে থাকবে। কোন প্রকৃতিবিজ্ঞানী সুবিধাটি সম্পর্কে সন্দেহ করে না যাকে “শ্রমের শারীরবৃত্তিয় বিভাজন” বলা হয়েছে; সুতরাং আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে একটি উদ্ভিদের পক্ষে এটি সুবিধাজনক হবে এবং অন্য ফুলে অথবা অন্য গাছে কেবলমাত্র গর্ভকেশরগুলির উদ্ভব ঘটাতে সুবিধাজনক হবে। চাষের জন্য ব্যবহৃত ও নূতন পরিবেশে স্থাপিত উদ্ভিদগুলিতে, কোন কোন সময় পুরুষ ও কোন কোন সময় স্ত্রী অঙ্গগুলি কম অথবা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়; এখন যদি আমরা মনে করি প্রাকৃতিক অবস্থায় এটি অল্পমাত্রায় হলেও ঘটে, এর পর যেহেতু আমাদের উদ্ভিদের লিঙ্গগুলির আরও সম্পূর্ণ পৃথকীকরণ শ্রমের বিভাজনের নীতি অনুসারে সুবিধাজনক হবে, আরও বেশি বেশি করে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এই প্রবণতা সমেত এককরা অনবরত মনোনীত ও নির্বাচিত হবে, যতক্ষণ না লিঙ্গদের সম্পূর্ণ পৃথকীকরণ কার্যকরী হয়ে থাকবে। দ্বিরূপতা ও অন্যান্য পদ্ধতির মাধ্যমের বিভিন্ন ধাপগুলি দেখাতে অনেক জায়গা লাগবে, যার দ্বারা বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদে লিঙ্গগুলির পৃথকীকরণ আপাতত এখন ঘটে চলেছে। কিন্তু এখানে আমি বলতে পারি যে আশা গ্রে-র মতে দক্ষিণ আমেরিকার হোলি উদ্ভিদের কয়েকটি প্রজাতি ঠিক মধ্যবর্তী অবস্থার হয়, যাকে তিনি ভিন্নবাসী-মিশ্রবাসী উদ্ভিদ আখ্যা দিয়েছেন।
এখন মধুভক্ষণকারী পতঙ্গদের বিষয়ে আসা যাক। আমরা ধরে নিতে পারি উদ্ভিদটি একটি সাধারণ বা সুলভ উদ্ভিদ, অনবরত নির্বাচনের মাধ্যমে যার মধু আমরা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করেছি এবং কোন কোন পতঙ্গ খাদ্যের জন্য এই মধুর ওপর নির্ভর করে। অসংখ্য উদাহরণ দিয়ে আমি দেখাতে পারতাম যে মৌমাছিরা সময় বাঁচাতে ব্যর্থ হয়: উদাহরণস্বরূপ, কোন ফুলের গোড়ায় গর্ত তৈরি ও মধুশোষণ করার স্বভাবের জন্য এরা মুখের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে পারে। এ সব ব্যাপার মনে রেখে বিশ্বাস করা যেতে পারে যে কোন কোন পরিস্থিতিতে শুড়ের দৈর্ঘ্য বা বক্রতা এবং অন্য অনেক ব্যাপারে ধর্তব্যের মধ্যে নয় এমন অতি অল্প এককীয় পার্থক্য মৌমাছি বা অন্য পতঙ্গদের উপকারে লাগতে পারে, যাতে করে অন্যদের তুলনায় কোন কোন একক তাড়াতাড়ি তাদের খাদ্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হবে; এবং এভাবে এদের অন্তর্ভুক্ত সম্প্রদায়গুলি প্রবলভাবে বেড়ে উঠবে এবং ঝক সৃষ্টি করবে যারা একই বৈশিষ্ট্য বংশগতভাবে লাভ করবে। সাধারণ লাল ও ইনকারনোট ক্লোভার উদ্ভিদদের (ট্রাইফোলিয়াম প্যাটেন্স ও ট্রাইফোলিয়াম কানেক্টাম) ফুলের দলমণ্ডলের নলগুলিকে একনজরে দেখলেও দৈর্ঘ্যে ভিন্ন হয় বলে মনে হয় না; তথাপি মধু-মৌমাছি ইনকারনেট ক্লোভারের মধু সহজেই শুষে নিতে পারে, কিন্তু লাল ক্লোভার ফুলগুলির মধু শুষে নিতে পারে না, সেখানে কেবল ভ্রমর-মৌমাছিরা (হাম্বল-বি) আসে; অতএব লাল ক্লোভারের। সমগ্র খেত মধুমৌমাছিদের মূল্যবান মধুর প্রচুর যোগান দেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে। এটা নিশ্চিত যে মধুমৌমাছিরা এই মধু খুবই পছন্দ করে; কারণ কেবল শরৎকালে আমি বারংবার দেখেছি যে নলের গোড়ায় ভ্রমর-মৌমাছিদের দ্বারা তৈরি গর্ত থেকে মধুমৌমাছিরা মধু শোষণ করছে। দু’ধরনের ক্লোভারের দলমণ্ডলের দৈর্ঘ্যের পার্থক্য অতিশয় তুচ্ছ হয়, যা আবার মধুমৌমাছির পরিদর্শন নির্ধারণ করে; কারণ আমাকে নিশ্চিতরূপে জানানো হয়েছে যে লাল ক্লোভারদের কেটে ফেলার পর দ্বিতীয়বারের ফুলগুলি কিছুটা ছোট হয় এবং তখন অনেক মধুমৌমাছি এদের পরিদর্শন করতে আসে। এই বক্তব্যটি সঠিক কিনা জানি না, অথবা অন্য একটি প্রকাশিত বক্তব্যে বিশ্বাস করা যেতে পারে কিনা তা-ও আমার জানা নেই। সেটি হচ্ছে–মধুমৌমাছির সাধারণভাবে বিবেচিত একটি ভ্যারাইটি এবং যার সঙ্গে অবাধে সঙ্করিত হয় এমন লিগুরিয়ান মৌমাছিরা লাল ক্লোভারে পৌঁছাতে ও মধু শোষণ করতে সমর্থ হয়। অতএব যে দেশে এই জাতীয় ক্লোভার প্রচুর জন্মায়, সেখানে অল্প দীর্ঘতর বা ভিন্নভাবে গঠিত একটি শুড় মধুমৌমাছির পক্ষে প্রভূত সুবিধাজনক হয়ে থাকবে। বিপরীতক্রমে, যেহেতু এই। ক্লোভারের উর্বরতা ফুলগুলিতে আসা মৌমাছিদের ওপর নির্ভর করে, সেহেতু কোন দেশে মধুমৌমাছিরা বিরল হলে একটি খবর ও গভীরভাবে বিভক্ত দলমণ্ডল থাকা উদ্ভিদটির পক্ষে বিরাট সুবিধা হয়ে থাকবে যাতে করে মধু মৌমাছিরা এর ফুলগুলিকে শোষণ করতে সমর্থ হবে। অতএব আমি বুঝতে পারি কেমন করে একটি ফুল ও একটি মৌমাছি পরস্পরের নিকট অনুকূল দেহকাঠামোর অল্প বিচ্যুতিগুলি সৃষ্টিকারী সমস্ত এককদের হয় যুগপৎ নয়তো একের পর এক ভাবে অনবরত সংরক্ষণের দ্বারা সবচেয়ে নিখুঁত উপায়ে পরস্পরের সঙ্গে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত এবং অভিযোজিত হয়ে থাকবে।
আমি সম্পূর্ণভাবে অবগত যে ওপরের কল্পিত উদাহরণের দ্বারা ব্যাখ্যাত প্রাকৃতিক নির্বাচনের এই তত্ত্বটি যে ধরনের আপত্তির সম্মুখীন হয়, সেইরকম ভূবিদ্যা দ্বারা ব্যাখ্যামূলক পৃথিবীর আধুনিক পরিবর্তনগুলির ওপর স্যার চার্লস লিয়েলের মহৎ মতবাদের বিরুদ্ধেও প্রথমে আপত্তি তোলা হয়েছিল; কিন্তু আমরা এখন মাধ্যমগুলি সম্পর্কে কদাচিৎ শুনি, যেগুলি এখনও কাজ করে চলেছে এবং যাদের অতি তুচ্ছ বা অকিঞ্চিৎকর বলা হয়। গভীরতম উপত্যকাদের খননকার্য বা আন্তর্দেশীয় পাহাড়দের গঠন ব্যাখ্যা করতে এই মাধ্যমগুলি ব্যবহৃত হয়। প্রত্যেক সংরক্ষিত জীবের পক্ষে উপকারী ছোট ছোট আনুবংশিক রূপান্তরগুলির সংরক্ষণ ও সঞ্চয়নের দ্বারা কেবল প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হয়; এবং যেমন আধুনিক ভূবিদ্যা একমাত্র একটি প্লাবন তরঙ্গের মাধ্যমে একটি বিরাট উপত্যকা সৃষ্টির মতবাদকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে নির্বাসিত করেছে, তেমনি প্রাকৃতিক নির্বাচন নূতন জীব ও এদের দেহকাঠামোর যে কোন বিরাট ও আকস্মিক রূপান্তরের অনবরত সৃষ্টির বিশ্বাসটিকে নির্বাসিত করবে।
এককদের আন্তঃসঙ্করণ
এখানে আমি একটি ছোট্ট অসাম্প্রদায়িক বিষয় উত্থাপন করব। ভিন্ন লিঙ্গসমূহ সম্বলিত প্রাণী ও উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে এটি সুস্পষ্ট যে প্রত্যেক জন্মের জন্য দুটি একক নিশ্চয় সর্বদা মিলিত হবে (অপুংজনির অদ্ভুত ও অজানা বিষয়গুলি ছাড়া); কিন্তু উভলিঙ্গীদের ক্ষেত্রে এটি মোটেই স্পষ্ট নয়। তা সত্ত্বেও বিশ্বাস করার কারণ আছে যে সমস্ত উভলিঙ্গীদের ক্ষেত্রে দুটি একক হয় আকস্মিকভাবে নয়তো স্বভাবগতভাবে নিজেদের মত সন্তান উৎপাদনের জন্য মিলিত হয়। অনেক আগে এই মতবাদের পক্ষে প্রেনজেল, নাইট ও কোয়েলরয়টার সন্দেহজনকভাবে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বর্তমানে এটির প্রয়োজনীয়তা আমরা দেখব। কিন্তু বিষয়টি অতিসংক্ষেপে আমি নিশ্চিয় আলোচনা করব, যদিও বিস্তৃত আলোচনার জন্য আমার কাছে যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। সমস্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীরা, সকল পতঙ্গরা এবং অন্য সব বড় গোষ্ঠীর প্রাণীরা প্রত্যেকে সন্তান উৎপাদনের জন্য মিলিত হয়। আধুনিক গবেষণা কল্পিত উভলিঙ্গীদের সংখ্যা ও প্রকৃত উভলিঙ্গীদের বিরাট সংখ্যক জোড়ার বিরাটভাবে হ্রাস করেছে; অর্থাৎ দুটি একক সন্তান উৎপাদনের জন্য নিয়মিত মিলিত হয়, এগুলি আমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলে। কিন্তু এখনও অনেক উভলিঙ্গী প্রাণী আছে যারা নিশ্চয়ই স্বাভাবিকভাবে মিলিত হয় না এবং বিরাট সংখ্যক উদ্ভিদরা উভলিঙ্গী। প্রশ্ন উঠতে পারে, এইসব ক্ষেত্রে মনে করার কি যুক্তি রয়েছে যে দুটি একক সন্তান উৎপাদনের জন্য কখনও মিলিত হয়? বিস্তৃত ব্যাখ্যায় যাওয়া অসম্ভব বলে আমি কেবল কয়েকটি সাধারণ বিবেচনার ওপরেই আস্থা রাখব।
প্রথমেই বলে রাখি, আমি এত বিপুল সংখ্যক তথ্য সংগ্রহ করেছি এবং এত সংখ্যক। পরীক্ষা করেছি যা প্রজননকারীদের প্রায় সার্বজনীন বিশ্বাস অনুসারে দেখায় যে প্রাণী ও উদ্ভিদের ক্ষেত্রে, ভিন্ন ভিন্ন ভ্যারাইটির অথবা একই ভ্যারাইটির কিন্তু অন্য জাতের। এককদের মধ্যে একটি সঙ্করণ তাদের বংশধরকে সবলতা ও উর্বরতা প্রদান করে; এবং বিপরীতক্রমে নিকট আন্তঃপ্রজনন সবলতা ও উর্বরতা হ্রাস করে; এসব তথ্য থেকে। মনে হয় এটি প্রকৃতির একটি সাধারণ নিয়ম যে কোন জীব বংশবিস্তারের জন্য নিজেই নিষিক্ত হয় না; কিন্তু অন্য এককের সঙ্গে একবার সঙ্করণ, সম্ভবতঃ বিরাট সময়ের ব্যবধানে, সাধারণভাবে অপরিহার্য।
এটিকে প্রকৃতির একটি নিয়ম বলে ধরে নিলে নিচে বর্ণিত কয়েকটির মত অসংখ্য তথ্যকে বুঝতে পারি আমরা, যা অন্য কোন মতের দ্বারা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। প্রত্যেক সংকরায়ণকারী জানে একটি ফুলের নিষেকের পক্ষে আর্দ্রতা কত প্রতিকূল হয়, তা সত্ত্বেও অসংখ্য ফুলের পরাগধানী ও গর্ভমুণ্ড আবহাওয়ায় সম্পূর্ণভাবে উন্মুক্ত থাকে। প্রয়োজনভিত্তিক সংকরণ অপরিহার্য হলেও উদ্ভিদের নিজস্ব পরাগধানী ও গর্ভকেশর স্ব নিষেক সুনিশ্চিত করার জন্য পরস্পরের এত কাছে অবস্থিত যে অন্য একক থেকে পরাগরেণু প্রবেশের পূর্ণ স্বাধীনতা অঙ্গদের উন্মুক্ততার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে। বিপরীতক্রমে, অনেক ফুলে নিষেকের অঙ্গগুলি গুপ্তভাবে পরিবেষ্টিত থাকে, যেমন দেখা যায় প্যাপিলিয়োনেসি বা মটর গোত্রে; কিন্তু পতঙ্গদের পরিদর্শনের জন্য এদের সুন্দর ও অদ্ভুত অভিযোজন প্রায় অপরিবর্তনীয়ভাবেই উপস্থিত থাকে। অনেক প্যাপিলিয়োন্যাসিয়াস ফুলে মৌমাছিদের ভ্রমণ এত প্রয়োজন যে এদের আগমন যদি বাধাপ্রাপ্ত হলে এই ফুলেদের উর্বরতা ভীষণভাবে হ্রাস পায়। এখন উদ্ভিদটির মঙ্গলের জন্য পতঙ্গদের ফুল থেকে ফুলে উড়ে আসা এবং একটি থেকে অন্যটিতে পরাগরেণু বহন না করা মোটেই সম্ভবপর নয়। পতঙ্গরা একটি ক্যামেল হেয়ার পেন্সিলের মত কাজ করে এবং নিষেক নিশ্চিত করার জন্য একটি ফুলের পরাগধানী ও তার পর অন্য ফুলের গর্ভমুণ্ড একই ব্রাস দ্বারা ঠিকভাবে স্পর্শ করাই যথেষ্ট; কিন্তু এটা মনে করা উচিত নয় যে মৌমাছিরা এভাবে ভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য সংকর সৃষ্টি করবে। গার্টনার দেখিয়েছেন যে যদি একটি উদ্ভিদের নিজস্ব পরাগরেণু এবং অন্য প্রজাতির পরাগরেণু একই গর্ভমুণ্ডে স্থাপন করা হয়, তাহলে পূর্বেরটি এত শক্তিশালী হবে যে এটি অনিবার্যভাবে ও সম্পূর্ণভাবে বহিরাগত পরাগরেণুর প্রভাবকে ধ্বংস করবে।
একটি ফুলের পুংকেশররা যখন গর্ভকেশরের দিকে হঠাৎ আবির্ভূত হয়, বা ধীরে ধীরে একের পর এক তার দিকে অগ্রসর হয়, তখনই মনে হয় যে কেবলমাত্র স্ব-নিষেক নিশ্চিত করার জন্যই কৌশলটি অভিযোজিত হয়েছে; এবং নিঃসন্দেহেই এটি এই উদ্দেশ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। যেমন বারবেরির ক্ষেত্রে কোয়েলরয়টার দেখিয়েছেন যে পুংকেশরদের সামনের দিকে আবির্ভাব ঘটাতে পতঙ্গদের সাহায্য প্রায়শই প্রয়োজন হয়, স্ব-নিষেকের জন্য বিশেষ কৌশলবিশিষ্ট এই গণটির ক্ষেত্রে এটি সুপরিচিত যে, নিকট সম্পর্কীয় আকার ও ভ্যারাইটিদের পরস্পরের নিকটে বসানো হলে বিশুদ্ধ চারাগাছ জন্মানো কদাচিৎ সম্ভবপর হয়, স্বাভাবিকভাবে সংকরায়নের ফলে যা বিরাটভাবে ঘটে। অন্যান্য অসংখ্য ক্ষেত্রে, স্পেনজেল ও অন্যদের গবেষণামূলক কাজ থেকে এবং আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ থেকে আমি দেখাতে পারতাম যে স্ব-নিষেককে উৎসাহ দেওয়ার পরিবর্তে এমন অসংখ্য কৌশল থাকে যা নিজের ফুলের পরাগরেণু পেতে গর্ভমুণ্ডকে কার্যকরভাবে বাধা দেয়। যেমন, লোবেলিয়া ফুলজেন্স-এ প্রকৃতই সুন্দর ও বিশদ কলাকৌশল থাকে যার দ্বারা এটি নিজস্ব ফুলের গর্ভমুণ্ড পাওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়ার পূর্বে অসংখ্য পরাগরেণু প্রত্যেক ফুলের সংযুক্ত পরাগধানী থেকে দ্রুতবেগে ধাবিত হয়; এবং যেহেতু এই ফুলে পতঙ্গরা কখনই আসে না, অন্ততঃ আমার বাগানে, তাই এরা কখনই বীজ উৎপাদন করে না, যদিও এক ফুলের পরাগ অন্য ফুলের গর্ভমুণ্ডে ছড়িয়ে অংসখ্য চারাগাছের জন্ম দিয়েছি আমি। লোবেলিয়ার অন্য একটি প্রজাতি আমার বাগানে অবাধে বীজ উৎপাদন করে, যাতে আবার মৌমাছিরাও আসে। আরও অনেক ক্ষেত্রে, যদিও একই ফুল থেকে পরাগ গ্রহণের জন্য গর্ভমুণ্ডকে বাধা দেওয়ার কোন বিশেষ কলাকৌশল নেই, তথাপি স্প্রেনজেল এবং আরও সম্প্রতি হিলডেব্র্যান্ড ও অন্যরা দেখিয়েছেন, যা আমি সত্য বলে স্বীকার করি, যে হয় নিষেকের জন্য গর্ভমুণ্ড প্রস্তুত হওয়ার আগেই পরাগধানী বিস্ফোরিত হয়, নয়তো ঐ ফুলের পরাগ প্রস্তুত হওয়ার আগেই গর্ভমুণ্ড প্রস্তুত হয়, সেই জন্যই অসম বা বিষম পরিণত উদ্ভিদ নামে খ্যাত এইসব উদ্ভিদে পৃথক লিঙ্গ থাকে এবং এরা স্বাভাবিকভাবে সংকরিত হয়। পূর্বে উল্লিখিত পারস্পরিক দ্বিরূপক ও ত্রিরূপক উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও এরূপ হয়। এইসব তথ্য কতই না বিচিত্র! কত অদ্ভুত যে স্ব-নিষেকের জন্য অতি নিকটে অবস্থিত একই ফুলের পরাগ, গর্ভমুণ্ডের পৃষ্ঠদেশ অনেক ক্ষেত্রে পরস্পরের কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়। একটি ভিন্ন এককের সঙ্গে আকস্মিক সংকরণ সুবিধাজনক ও অপরিহার্য, এই মত সম্বন্ধে এইসব তথ্য কত সরলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
বাঁধাকপি, মূলো, পিঁয়াজ ও অন্যান্য উদ্ভিদের কয়েকটি ভ্যারাইটিকে যদি পরস্পরের অতি নিকটে বীজ উৎপাদন করতে দেওয়া হয়, তাহলে আমার দেখা এভাবে উৎপন্ন চারাগাছগুলি সকলেই বর্ণসংকর হয়। পরস্পরের নিকটে জন্মানো বিভিন্ন ভ্যারাইটিদের কয়েকটি গাছের ২৩৩টি চারা বাঁধাকপি গাছ তুলেছিলাম আমি এবং লক্ষ্য করেছিলাম, এদের মধ্যে কেবলমাত্র ৭৮টি আসল বা প্রকৃতই ছিল, এবং এমনকি এদের কয়েকটি নিখুঁতভাবে আসল ছিল না। তথাপি প্রত্যেক বাঁধাকপির ফুলের গর্ভকেশরটি শুধু তার নিজস্ব ছয়টি পুংকেশর দ্বারাই পরিবেষ্টিত নয়, বরং একই গাছের অন্য অনেক ফুলের পুংকেশর দ্বারাও পরিবেষ্টিত; এবং কীটপতঙ্গদের সাহায্য ছাড়াই প্রত্যেক ফুলের পরাগ তার নিজস্ব গর্ভমুণ্ডে সহজেই যায়, কারণ যত্নসহকারে পতঙ্গদের হাত থেকে সুরক্ষিত উদ্ভিদরা যে অসংখ্য শুটি উৎপাদন করে তা আমি লক্ষ্য করেছি। তা হলে অসংখ্য চারাগাছ বর্ণসংকর সদৃশ হয় কী করে? এর অর্থ এই যে ফুলের নিজস্ব পরাগের ওপর একটি ভিন্ন ভ্যারাইটির পরাগের শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে, এবং একই প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন এককদের আন্তঃসঙ্করণের মাধ্যমে ভাল জীব উৎপন্ন হয়–এই সাধারণ নিয়মের একটি অংশ এটি। ভিন্ন প্রজাতিরা সংকরিত হলে ফলটি উল্টো হয়, কারণ একটি গাছের নিজস্ব পরাগ বহিরাগত পরাগের চেয়ে প্রায় সর্বদাই শক্তিশালী হয়। এ বিষয়ে পরবর্তী একটি অধ্যায়ে আলোচনা করব আমি।
অসংখ্য ফুল সম্বলিত একটি বিরাট বৃক্ষের ক্ষেত্রে আপত্তি করে বলা যেতে পারে যে বৃক্ষ থেকে কদাচিৎ পরাগ বাহিত হয়, এবং অন্ততপক্ষে একই বৃক্ষের ফুল থেকে ফুলে এটি ঘটতে পারে। এবং কেবল সীমাবদ্ধ অর্থে একই বৃক্ষের ফুলগুলি ভিন্ন ভিন্ন একক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই আপত্তিটি সঠিক বলেই বিশ্বাস করি আমি, কিন্তু এর বিরুদ্ধে প্রকৃতি পৃথক লিঙ্গ সমেত অসংখ্য ফুল উৎপাদন করতে বৃক্ষকে প্রবল প্রবণতা প্রদান করে। লিঙ্গগুলি যখন পৃথক হয়, যদিও পুং অথবা স্ত্রীফুল একই বৃক্ষে উৎপন্ন হতে পারে, পরাগ নিশ্চয়ই ফুল থেকে ফুলে নিয়মিতভাবে বাহিত হবে এবং গাছ থেকে গাছে মাঝেমাঝে পরাগ বহনের ভাল সম্ভাবনা প্রদান করবে। এই দেশে আমি দেখেছি যে সমস্ত বর্গের অন্তর্ভুক্ত বৃক্ষদের লিঙ্গগুলি অন্য উদ্ভিদের তুলনায় প্রায়শই ভিন্ন হয়। আমার অনুরোধে ডঃ হুঁকার নিউজিল্যান্ডের এবং ডঃ আসা গ্রে ইউনাইটেড স্টেট্রক্স এর বৃক্ষদের তালিকা তৈরি করেছিলেন, এবং আমি যেভাবে আশা করেছিলাম এটি তারই ফলশ্রুতি। বিপরীতক্রমে, ডঃ হুঁকার আমাকে জানান যে নিয়মটি অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে খাটে না, তবে অস্ট্রেলিয়ার সমস্ত বৃক্ষগুলি অসমপরিণত হলে একই ফল হবে, যেন এরা পৃথকীকৃত লিঙ্গ সুমেত ফুল উৎপাদন করে। এ বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য বৃক্ষদের সম্বন্ধে কেবল কয়েকটি কথা বলেছি আমি।
প্রাণীদের দিকে সংক্ষেপে দৃষ্টি দেওয়া যাক। বিভিন্ন স্থলচর প্রজাতির উভলিঙ্গের হয়, যেমন স্থলচর শম্বুক বা কম্বোজজাতীয় প্রাণী ও কেঁচো; কিন্তু এরা সকলে যুগলে মিলিত হয়। আমি এখনও পর্যন্ত একটিও স্থলচর প্রাণী দেখিনি যে নিজেই নিষিক্ত হয়। এই উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি স্থলচর উদ্ভিদদের তুলনায় প্রবল বৈসাদৃশ্য প্রদান করে। একটি আকস্মিক মিলন অপরিহার্য, এই মত স্বীকার করলে এটি বোধগম্য হয়। কারণ গর্ভনিষেক উপাদানের স্বভাবের জন্য প্রত্যঙ্গদের ক্রিয়া প্রক্রিয়া ও উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে বায়ুসদৃশ কোন উপায় নেই যার দ্বারা দুটি এককের মিলন ব্যতিরেকে ভূচর প্রাণীদের একটি আকস্মিক সংকরণ ঘটানো যেতে পারে। জলচর প্রাণীদের মধ্যে অসংখ্য স্ব নিষেককারী উভলিঙ্গী আছে, কিন্তু এখানে আকস্মিক মিলন ঘটাতে জলপ্রবাহ নিশ্চয় একটি বিশেষ উপায়। ফুলের বিষয়ের মত, সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞদের অন্যতম একজন প্রফেসর হাক্সলের সঙ্গে আলোচনার পর, আমি এখনও পর্যন্ত একটিও উভলিঙ্গী প্রাণী আবিস্কার করতে ব্যর্থ হয়েছি, তাদের জনন-অঙ্গগুলি এমন নিখুঁতভাবে পরিবেষ্টিত যে শূন্য থেকে প্রবেশ এবং একটি ভিন্ন এককের আকস্মিক প্রভাব বাস্তবিকপক্ষে দেখানো অসম্ভব। এই মতের পক্ষে সিরিপেডদের ঘটনা দেখানো অতিশয় কষ্টকর বলে আমার দীর্ঘদিন মনে হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে আমি প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছি যে দুটি একক কোন কোন সময় গর্ভধারণের জন্য মিলিত হয়, যদিও উভয়েই স্ব-নিষেককারী উভলিঙ্গী।
এই অদ্ভুত ব্যতিক্রম নিশ্চয় অধিকাংশ প্রকৃতিবিদদের বিমুগ্ধ করে যে উদ্ভিদ ও প্রাণীর উভয় ক্ষেত্রে সামগ্রিক জৈব সংগঠনে পরস্পরের সঙ্গে অধিকভাবে সদৃশ একই গোত্রের ও এমনকি একই গণের কিছু প্রজাতি উভলিঙ্গী ও কিছু একলিঙ্গী হলেও প্রকৃতপক্ষে সমস্ত উভলিঙ্গীরা মাঝেমধ্যে আন্তঃসঙ্করিত হয়। কার্যকলাপের ক্ষেত্রে যতদূর বিবেচনা করা যায়, এদের ও উভলিঙ্গী প্রজাতিদের মধ্যে পার্থক্য অতি অল্প।
এইসব বিচার-বিশ্লেষণ ও আমার সংগৃহীত অসংখ্য বিশেষ তথ্য (যা আমি এখানে। উপস্থিত করতে পারছি না) থেকে মনে হয় যে প্রাণী ও উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন এককদের মধ্যে একটি সময়োচিত আন্তঃসঙ্করণ প্রকৃতির একটি অতি সাধারণ নিয়ম, যদি সার্বজনীন না-ও হয়।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নূতন আকারের উদ্ভব ঘটানোর জন্য অনুকূল অবস্থাসমূহ
এটি একটি অত্যন্ত জটিল বিষয়। যে পদটির মধ্যে এককীয় পার্থক্য সর্বদা অন্তর্ভুক্ত হয় এমন প্রচুর পরিমাণ প্রকারণ বা বিভিন্নতা স্পষ্টতঃ অনুকূল হবে। যে কোন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লাভজনক বিভিন্নতা বা পরিবৃত্তির আগমন বা আবির্ভাবের জন্য ভাল। সম্ভাবনা প্রদান করে এককদের বিরাট সংখ্যা প্রত্যেক এককের অল্পতর পরিমাণ বিভিন্নতার ক্ষতিপূরণ করবে, এবং আমি বিশ্বাস করি কৃতকার্য হওয়ার পক্ষে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যদিও প্রাকৃতিক নির্বাচনের কাজের জন্য প্রকৃতি দীর্ঘ সময় দেয় না, সে অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষাও করে না। কারণ যেহেতু সমস্ত জীবকূল। প্রকৃতিমণ্ডলে নিজস্ব স্থান অধিকার করার চেষ্টা করছে, তাই কোন প্রজাতি তার প্রতিযোগীদের তুলনায় সমমাত্রায় উন্নত ও রূপান্তরিত না হলে প্রজাতিটি নিশ্চিহ্ন হবে। অনুকূল পরিবৃত্তির কয়েকটি অন্ততঃ বংশধরে যতক্ষণ না প্রেরিত হচ্ছে, ততক্ষণ প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হতে পারে না। পূর্বানুবৃত্তির প্রবণতা প্রায়শই নিয়ন্ত্রণ করে অথবা বাধা দেয়; কিন্তু এই প্রবণতা নির্বাচনের মাধ্যমে অসংখ্য গৃহপালিত জাত সৃষ্টি করতে মানুষকে নিবৃত্ত করেনি, কাজেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিরুদ্ধে কেন এটি প্রভাব বিস্তার করবে।
নিয়মানুগ নির্বাচনের ক্ষেত্রে, একজন প্রজননকারী কিছু বিশেষ উদ্দেশ্যে নির্বাচন করে, এবং এককদের অবাধে আন্তঃসঙ্করণের সুযোগ দেওয়া হলে তার কাজ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে। কিন্তু যখন জাতটিকে পরিবর্তনের উদ্দেশ্য ছাড়া অনেক মানুষের উৎকর্ষতার প্রায় একটি সাধারণ মান থাকে, সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণীদের সংগ্রহ ও প্রজনন করতে সকলে চেষ্টা করে, তখন নির্বাচিত এককদের বিচ্ছিন্নতা না থাকা সত্ত্বেও, নির্বাচনের এই অচেতন প্রক্রিয়া থেকে নিশ্চিতভাবে ধীরে ধীরে উন্নতি ঘটে। এভাবে এটি প্রকৃতির মধ্যেও ঘটে, কারণ প্রকৃতির রাজ্যে সম্পূর্ণভাবে অনধিকৃত কোন স্থান সমেত একটি সীমাবদ্ধ অঞ্চলে, সঠিক দিকে, যদিও বিভিন্ন মাত্রায়, পরিবর্তনশীল সমস্ত একক সংরক্ষিত হতে চেষ্টা করবে। কিন্তু অঞ্চলটি বিরাট হলে তার কয়েকটি জেলায় জীবন-পরিবেশ নিশ্চয় ভিন্ন হবে, এবং তখন একই প্রজাতি যদি ভিন্ন জেলায় রূপান্তরিত হয়, তাহলে নূতন সৃষ্ট ভ্যারাইটিরা নিজস্ব সীমার মধ্যে আন্তঃসংকরিত হবে। কিন্তু ষষ্ঠ অধ্যায়ে আমরা দেখব যে মধ্যবর্তী জেলাগুলিতে বসবাসকারী মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিরা পার্শ্ববর্তী ভ্যারাইটিদের একটি দ্বারা অবশেষে স্থানচ্যুত হবে। অন্তঃসঙ্করণ মূলতঃ সেই সব প্রাণীদের প্রভাবিত করবে যারা প্রত্যেকটি জন্মের জন্য মিলিত হয়, অতিশয় ঘুরে বেড়ায় এবং অত্যধিক দ্রুতহারে প্রজনন করে না। অতএব এই প্রকৃতির প্রাণীদের যথা পাখিদের ক্ষেত্রে, ভ্যারাইটিরা ভিন্ন ভিন্ন দেশে সীমাবদ্ধ থাকবে; এবং এটিই হয় বলে আমি লক্ষ্য করেছি। উভলিঙ্গী প্রাণীদের ক্ষেত্রে যারা মাঝেমধ্যে সংকরিত হয় এবং এভাবে প্রাণীদের ক্ষেত্রে যারা প্রত্যেকটি জন্মের জন্য মিলিত হয়, যারা অল্প ঘুরে বেড়ায় এবং দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেতে পারে, সেসব ক্ষেত্রে একটি নূতন ও উন্নত ভ্যারাইটি যে কোন স্থানে দ্রুত সৃষ্টি হয়ে থাকবে, সেখানে একত্রে লালিতপালিত হয়ে থাকবে এবং পরবর্তী সময়ে বিস্তৃত হয়ে থাকবে, ফলে নূতন ভ্যারাইটির এককরা মূলতঃ সংকরিত হবে। এই পদ্ধতি অনুসারে বাগানমালীরা বিরাট সংখ্যক উদ্ভিদ থেকে বীজ সংরক্ষণ পছন্দ করে, কেননা এতে আন্তঃসঙ্করণের সম্ভাবনা এভাবে হ্রাস পায়।
এমনকি প্রাণীদের ক্ষেত্রে যারা প্রত্যেকটি জন্মের জন্য মিলিত হয় ও দ্রুতহারে বংশবৃদ্ধি করে না, তাদের ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চয় মেনে নেব না যে অবাধ আন্তঃসঙ্করণ প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাবকে সর্বদা অপসারিত করবে; কারণ অসংখ্য তথ্য দ্বারা আমি দেখাতে পারি যে একই অঞ্চলে একই প্রাণীর দুটি ভ্যারাইটি বিভিন্ন স্থানে বারংবার। যাতায়াত করে, অল্প ভিন্ন মরশুমে বংশবৃদ্ধি করে, অথবা প্রত্যেক ভ্যারাইটির এককদের একত্রে মিলিত হওয়ার প্রবণতা থেকেও, দীর্ঘদিন গুণগতভাবে ভিন্ন থাকতে পারে।
প্রকৃতিতে একই প্রজাতি বা একই ভ্যারাইটির এককদের বৈশিষ্ট্যে বিশুদ্ধ ও একইরূপে রাখতে আন্তঃসঙ্করণ অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একবার জন্মদানের জন্য মিলিত হয় এমন সব প্রাণীদের ক্ষেত্রে এটি এভাবে স্পষ্টতঃ আরও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করবে। কিন্তু আমরা আগেই বলেছি, আমাদের বিশ্বাস করার যুক্তি আছে যে সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে আন্তঃসংকরণ ঘটে থাকে। এমন কি যদি এগুলি কেবল দীর্ঘ সময় অন্তর অন্তর ঘটে থাকে, তাহলে এভাবে উৎপন্ন তরুণটি দীর্ঘসময় ধরে চলতে থাকা স্ব-নিষেকের ফলে উৎপন্ন বংশধরের তুলনায় এত জীবনীশক্তি ও উর্বরতা লাভ করবে যে বাঁচার ও নিজের মত বংশবৃদ্ধির ভাল সম্ভাবনা তার থাকবে এবং এভাবে অবশেষে তার পরিণামে সংকরণগুলির প্রভাব বিরাট হবে, এমনকি বিরল বিরতির পরেও। যারা যৌন দিক থেকে বংশবৃদ্ধি করে না অথবা যাদের যুগ্ম প্রজনন হয় না এবং যারা সম্ভবতঃ আন্তঃসংকরিত হতে পারে না, এমন সব নিম্নস্তরের জীবদের ক্ষেত্রে, কেবল বংশগতির নিয়মের মাধ্যমে এবং প্রকৃত রূপ থেকে বিচ্যুত যে কোন এককদের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে একই জীবন-পরিবেশে বৈশিষ্ট্যের সমরূপতা বজায় রাখতে পারে। যদি জীবন-পরিবেশ পরিবর্তিত হয় এবং আকারটি রূপান্তরিত হয়, তাহলে সদৃশ অনুকূল পরিবৃত্তিগুলিকে সংরক্ষণ করে শুধুই প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা বৈশিষ্ট্যের সমরূপতা রূপান্তরিত বংশধরে প্রেরিত হতে পারে।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজাতির রূপান্তর প্রক্রিয়ায় অন্তরণও একটি প্রধান উপাদান। অতি বিরাট না হলে একটি সীমাবদ্ধ বা বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে জৈব ও অজৈব পরিবেশ সাধারণতঃ প্রায়ই একইরকম থাকবে, যাতে করে প্রাকৃতিক নির্বাচন একই প্রজাতির সমস্ত পরিবর্তনশীল এককদের একইভাবে রূপান্তরিত করতে সহায়তা করবে। পাশ্ববর্তী জেলাসমূহের অধিবাসীদের সঙ্গে আন্তঃসংকরণও এভাবে বাধাপ্রাপ্ত হবে। মরিজ ওয়াগনার এ বিষয়ের ওপর সম্প্রতি একটি কৌতূহলোদ্দীপক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন এবং দেখিয়েছেন যে নূতন সৃষ্ট ভ্যারাইটিদের মধ্যে সংকরণকে বাধা দিতে অন্তরণের কার্যকারিতা, এমনকি আমার অনুমানের তুলনায় সম্ভবতঃ আরও অধিকতর হয়। কিন্তু প্রাসঙ্গিকভাবে ইতিমধ্যে উল্লিখিত কারণসমূহ থেকে আমি এই প্রকৃতিবিদদের সঙ্গে কোন মতেই একমত হতে পারি না যে স্থানান্তরগমন ও অন্তরণ নূতন প্রজাতির উদ্ভবে প্রয়োজনীয় উপাদান। ভৌত অবস্থাসমূহের কোন ভৌতিক পরিবর্তনের পরে, যেমন আবহাওয়া, ভূমির উত্থান ইত্যাদি, ভালভাবে অভিযোজিত জীবদের অভিবাসন (immigration) প্রতিরোধ করতে অন্তরণের প্রয়োজনীয়তা এভাবে বিরাট হয়; এবং এভাবে জেলার প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের নূতন জায়গাগুলো বয়স্ক অধিবাসীদের রূপান্তরের দ্বারা পূর্ণ করতে খুলে দেওয়া হবে। শেষতঃ, অন্তরণ একটি নূতন ভ্যারাইটিকে ধীরে ধীরে উন্নত করতে যথেষ্ট সময় নেবে, এবং এটি কোন কোন সময় অতি প্রয়োজনীয়ও হতে পারে। তবে প্রতিবন্ধক দ্বারা পরিবেষ্টিত বা অদ্ভুত ভৌত পরিবেশ সম্বলিত একটি অঞ্চল যদি খুব ছোট হয়, তাহলে অধিবাসীদের সামগ্রিক সংখ্যা অল্প হবে; এটি অনুকূল পরিবর্তনগুলির উদ্ভবের সম্ভবনা হ্রাস করে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নূতন প্রজাতির সৃষ্টিকে এভাবে হ্রাস করবে।
কেবলমাত্র সময়ের ব্যবধান প্রাকৃতিক নির্বাচনের পক্ষে বা বিপক্ষে কোন কিছুই করে না। আমি এটা বলছি এই কারণে যে ভুলবশতঃ বলা হয় আমি যেন বলেছি সময় উপাদানটি প্রজাতির রূপান্তরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেন জীবনের সব আকার কোন সহজাত নিয়মের মাধ্যমে মূলতঃ রূপান্তরিত হচ্ছে। সময়ের অতিবাহন কেবল ততদূর পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও এ ব্যাপারে এর প্রয়োজনীয়তাও বিরাট হয় যে উপকারী পরিবৃত্তিগুলির উদ্ভব ঘটাবে ও এদের নির্বাচিত, সঞ্চিত ও স্থায়ী করতে এটি একটি ভাল সম্ভাবনা প্রদান করে। প্রত্যেক জীবের দেহগঠন সম্পর্কে জীবনের ভৌতিক পরিবেশসমূহের প্রত্যক্ষ বৃদ্ধি করতে এটি এভাবে সহায়তা করে।
এইসব বক্তব্যের সত্যতা পরীক্ষা করার জন্য আমরা যদি প্রকৃতির দিকে তাকাই এবং যে কোন একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল, যেমন একটি মহাসামুদ্রিক দ্বীপকে লক্ষ্য করি, যদিও এখানে বসবাসকারী প্রজাতির সংখ্যা অল্প হয়, তথাপি এসব প্রজাতিদের মধ্যে অধিকাংশই স্থানীয়–অর্থাৎ সেখানেই সৃষ্ট হয়েছে এবং পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না। বিষয়টি আমরা ভৌগলিক বিস্তারের ওপর আমার অধ্যায়ে দেখব। অতএব প্রথম দর্শনে এটি মনে হয় যে একটি মহাসামুদ্রিক দ্বীপ নূতন প্রজাতির সৃষ্টিতে অনুকূল। কিন্তু এভাবে আমরা নিজেদের প্রতারিত করতে পারি, কারণ একটি ছোট্ট বিচ্ছিন্ন অঞ্চল অথবা একটি মহাদেশের মত বিরাট মুক্ত অঞ্চল নূতন জৈবিক আকার সৃষ্টির জন্য। অনুকূল হয়েছে কিনা তা নির্ণয় করতে সমান সময়ের মধ্যে আমাদের তুলনা করা উচিত, এবং তা করতে আমরা অসমর্থ।
নূতন প্রজাতি সৃষ্টিতে অন্তরণ অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও সামগ্রিকভাবে আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য যে একটি অঞ্চলের বিরাটত্ব আরও গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে প্রজাতির সৃষ্টির জন্য, যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার ও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হওয়ায় সক্ষম এটি প্রমাণ করবে। বিরাট ও উন্মুক্ত অঞ্চলের সর্বত্র একই প্রজাতির অসংখ্য একক থেকে উদ্ভুত অনুকূল পরিবৃত্তিগুলির কেবল ভাল সম্ভাবনা থাকবে না, বরং ইতিমধ্যে অবস্থিত বিরাট সংখ্যক প্রজাতির জন্য জীবনের পরিবেশ আরও জটিলতর হবে; এবং অসংখ্য প্রজাতির কয়েকটি যদি রূপান্তরিত ও উন্নত হয়, তবে অন্যগুলিও অনুরূপ মাত্রায় উন্নত হবে অথবা বিলুপ্ত হবে। প্রত্যেক নূতন আকারটি যে মুহূর্তে আরও বেশি উন্নত হয়, উন্মুক্ত ও নিরবচ্ছিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে সেটি সমর্থ হবে এবং এভাবে অন্য আকারদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে। অধিকন্তু ভূমিতলের আগেকার স্পন্দনগুলির জন্য এখন বিচ্ছিন্ন, বিরাট অঞ্চল প্রায়শই ভঙ্গিলাবস্থায় অবস্থান করবে, সেইজন্য অন্তরণের ভাল ফল কিছু পরিমাণে সাধারণতঃ একত্রে সঙঘটিত হবে। অবশেষে আমি সিদ্ধান্ত করি যে যদিও ছোট বিচ্ছিন্ন অঞ্চলসমূহ কোন কোন বিষয়ে নূতন প্রজাতির উদ্ভাবনে অতিশয় অনুকূল হয়েছে, তথাপি বিরাট অঞ্চলগুলিতে রূপান্তরের গতি সাধারণতঃ আরও দ্রুততর হবে; এবং যা আরও গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে।—বিরাট অঞ্চলগুলিতে সৃষ্ট নূতন আকারগুলি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হবে, যারা ইতিমধ্যে অসংখ্য প্রতিযোগীদের সঙ্গে সংগ্রামে বিজয়ী হয়েছে, এবং বিরাট সংখ্যক নূতন আকার ও প্রজাতি সৃষ্টি করবে। এভাবে এরা জৈবজগতের ইতিহাস পরিবর্তনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এই মতানুসারে আমরা বোধ হয় কিছু বিষয় বুঝতে পারি, যেগুলি আমাদের ভৌগোলিক বিস্তারের অধ্যায়ে পুনরায় পরোক্ষভাবে উল্লিখিত হবে। উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রেলিয়ার মত ছোট মহাদেশের উৎপাদনগুলির নিকট ইউরোপ এশিয়ার বৃহত্তর অঞ্চলের উৎপাদনসমূহের এখন হার স্বীকারের বিষয়টি। মহাদেশীয় উৎপাদনগুলি দ্বীপসমূহের সর্বত্র এভাবে বহুলাংশে অভিযোজিত হয়েছে। একটি ছোট্ট দ্বীপে জীবনসংগ্রাম কম কঠোর হয়ে থাকবে এবং সেখানে কম রূপান্তর ও বিলুপ্তির ঘটনা ঘটে থাকবে। অতএব আমরা বুঝতে পারি কেমন করে ম্যাডেইরার উদ্ভিদকুলটি অসওয়াল হিয়ারের মতানুসারে ইউরোপের টার্শিয়ারী যুগের বিলুপ্ত উদ্ভিদকুলটির সঙ্গে কিছু পরিমাণে সদৃশ হয়। মিঠাজলের সমস্ত অববাহিকা একত্রে সমুদ্র ও স্থলভাগের অববাহিকার তুলনায় একটি ছোট অঞ্চল সৃষ্টি করে। ফলস্বরূপ, স্বাদুজলের উৎপাদনগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা অন্য জায়গার তুলনায় কম কঠোর হয়ে থাকবে, নূতন আকারগুলো আরও ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয়ে থাকবে এবং পুরানো আকারগুলো আরও ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হবে। এবং এই স্বাদুজলের অববাহিকাসমূহে আমরা গ্যানয়েড মাছেদের সাতটি গণ দেখতে পাই, যেগুলো একটি বহুবিস্তৃত বর্গের অবশিষ্টাংশ। এবং স্বাদুজলে আমরা কিছু কিছু ব্যতিক্রমী আকারদের দেখি যারা বর্তমানে সারা পৃথিবীতে অর্নিথোরিনকাস ও লেপিডোসাইরেন হিসেবে পরিচিত, এরা আবার জীবাশ্মদের মত প্রকৃতিমণ্ডলে বর্তমানে ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন বর্গগুলিকে কিছু পরিমাণে সংযুক্ত করে। এইসব ব্যক্ৰিমী আকারদের জীবন্ত জীবাশ্ম বলা যেতে পারে। এরা একটি সীমাবদ্ধ অঞ্চলে বসবাস করে ও কম বিচিত্র এবং অতএব কম কঠোর প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়ে বর্তমান কাল পর্যন্ত টিকে আছে।
বিষয়টি যতই জটিল হোক না কেন, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নূতন প্রজাতির সৃষ্টির জন্য অনুকূল ও প্রতিকূল পরিবেশের বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করে আমি সিদ্ধান্ত করেছি যে স্থলচর উৎপাদনগুলির জন্য আনুভূমিক তল অনেকবার আন্দোলিত হওয়া, একটি বৃহৎ মহাদেশীয় অঞ্চল দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হওয়া অনেক নূতন জীবনাকার সৃষ্টিতে অতিশয় অনুকূল হয়ে থাকবে। যখন অঞ্চলটি একটি মহাদেশ হিসেবে অবস্থিত ছিল, তখন একক ও ভ্যারাইটি সমেত অধিবাসীরা অসংখ্য হয়ে থাকবে এবং তারা কঠোর প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়ে থাকবে। অবনমনের ফলে যখন বিরাট ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপের সৃষ্টি হয়, তখনও প্রত্যেক দ্বীপে একই প্রজাতির অসংখ্য একক রয়ে থাকবে, যে কোন প্রকার ভৌত পরিবর্তনের পর অভিবাসন বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকবে, যাতে করে প্রত্যেক দ্বীপে সমগ্র অঞ্চলের নূতন জায়গাগুলি বয়স্ক অধিবাসীদের রূপান্তরের দ্বারা পূর্ণ হয়ে থাকবে; এবং প্রত্যেক দ্বীপে ভ্যারাইটিদের ভালভাবে রূপান্তরিত ও নিখুঁত হওয়ার জন্য সময় পেয়ে থাকবে। পুনরুত্থানের পর, যখন দ্বীপগুলি একটি মহাদেশীয় অঞ্চলের সঙ্গে পুনরায় যুক্ত হয়, সেখানে পুনরায় কঠোর প্রতিযোগিতা হয়ে থাকবে-সবচেয়ে আনুকূল্যপ্রাপ্ত বা উন্নত ভ্যারাইটিরা ছড়িয়ে পড়তে সমর্থ হয়ে থাকবে, কম উন্নত আকাররা ভয়ানকভাবে বিলুপ্ত হয়ে থাকবে এবং সংযুক্ত মহাদেশটির বিভিন্ন অধিবাসীরদের আপেক্ষিক আনুপাতিক সংখ্যা পুনরায় পরিবর্তিত হয়ে থাকবে; এবং আবার অধিবাসীদের আরও উন্নতি করতে ও এভাবে নূতন প্রজাতি সৃষ্টিতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের জন্য ভাল ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে থাকবে।
আমি সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করি যে প্রাকৃতিক নির্বাচন অতি মন্থরভাবে কাজ করে। এটি তখনই কাজ করতে পারে যখন একটি অঞ্চলের প্রকৃতিমণ্ডলের কিছু জায়গায় বিদ্যমান অধিবাসীদের কয়েকটির রূপান্তরিত আকারের মাধ্যমে ভালভাবে অধিকৃত হয়ে থাকে। এ সব জায়গার অবস্থান প্রায়শই ভৌতিক পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে, যা আবার অতি মন্থরভাবে ঘটে, এবং ভালভাবে অভিযোজিত আকারদের অভিবাসনকে প্রতিরোধ করার ওপর সেটি আবার নির্ভর করে। যেহেতু বয়স্ক অধিবাসীদের সামান্য কয়েকটিই রূপান্তরিত হয়, তাই অন্যদের পারস্পরিক সম্পর্কগুলিও প্রায়শই নষ্ট হবে এবং ভালভাবে অভিযোজিত আকারদের দ্বারা পূর্ণ করতে এটি নূতন নূতন জায়গা সৃষ্টি করবে। একই প্রজাতির সমস্ত একক পরস্পরের থেকে অতি অল্প মাত্রায় ভিন্ন হলেও, দেহের বিভিন্ন অঙ্গের সঠিক প্রকৃতির পার্থক্য ঘটতে দীর্ঘ সময় লাগবে। অবাধ আন্তঃকরণের দ্বারা পরিণামটি প্রায়শই বিরাটভাবে হ্রাস পাবে। অনেক বিস্ময়ের সঙ্গে বলবে যে এ সব কারণ প্রাকৃতিক নির্বাচনের ক্ষমতাকে খর্ব করতে যথেষ্ট। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে কেবল দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে ও একই অঞ্চলের অধিবাসীদের কেবল কয়েকটির ওপর এটি সাধারণতঃ মন্থরভাবে কাজ করবে। আমি আরও বিশ্বাস করি যে পৃথিবীর অধিবাসীদের পরিবর্তনের হার ও পদ্ধতি সম্পর্কে ভূবিদ্যা আমাদের যা বলে, এইসব মন্থর, সবিরাম পরিণামগুলি তার সঙ্গে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ।
নির্বাচনের পদ্ধতিটি হতে পারে মন্থর, দুর্বল মানুষ কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে যদি অনেক কিছু করতে পারে, পরস্পরের ও নিজেদের জীবনের ভৌতিক পরিবেশের সঙ্গে, সমস্ত জীবের মধ্যে সহ-অভিযোজনগুলির সৌন্দর্যে ও জটিলতায় আমি পরিবর্তনের পরিমাণের কোন সীমা দেখতে পাইনি, যা প্রকৃতির নির্বাচনের ক্ষমতার মাধ্যমে অর্থাৎ যোগ্যতমের উদ্বর্তনের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে কার্যকরী হয়ে থাকতে পারে।
প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা সংঘটিত বিলুপ্তি
আমাদের ভূতত্ত্ব সংক্রান্ত অধ্যায়ে এই বিষয়টি আরও বিশদভাবে আলোচিত হবে। তবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের সঙ্গে এটি গভীরভাবে সম্পর্কিত বলে এ বিষয়ে কিছু কথা এখানে বলা দরকার। কোন-না-কোনভাবে সুবিধাজনক পরিবৃত্তিগুলির সংরক্ষণের মাধ্যমেই প্রাকৃতিক নির্বাচন ক্রিয়া করে, যে সুবিধাগুলি শেষ পর্যন্ত স্থায়ী রূপ নেয়। সমস্ত জীবের বৃদ্ধির উচ্চ গুণোত্তরীয় হার থাকার জন্য প্রত্যেক অঞ্চল ইতিমধ্যে অধিবাসীদের দ্বারা পূর্ণ হয়েছে; এবং এর থেকে অনুধাবন করা যায় যে যেহেতু আনুকূল্যপ্রাপ্ত আকাররা সংখ্যায় বৃদ্ধি পায়, সেহেতু কম আনুকূল্যপ্রাপ্তরা সংখ্যায় হ্রাস। পায় ও বিরল হয়। ভূবিদ্যা আমাদের শেখায় বিরলতা হচ্ছে বিলুপ্তির পূর্বাভাস, কিন্তু। আমরা দেখতে পাই মরশুমের প্রকৃতির বিরাট পরিবর্তনের জন্য অথবা এদের শত্রুদের সাময়িক সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য অল্প কয়েকটি একক সম্বলিত আকারের সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আমরা আরও অগ্রসর হতে পারি; কারণ যেহেতু নূতন আকাররা সৃষ্ট হয়েছে, যতক্ষণ না আমরা স্বীকার করছি যে বিশেষ আকাররা অনির্দিষ্ট সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে পারে, অনেক বয়স্ক আকার নিশ্চয় বিলুপ্ত হবে। ভূতত্ত্ব আমাদের শেখায় যে বিশেষ আকাররা অনির্দিষ্টভাবে সংখ্যায় বৃদ্ধি পায় না। এখন আমরা দেখার চেষ্টা করব সমগ্র পৃথিবীতে প্রজাতির সংখ্যা কেন বিলুপ্ত হয় না।
আমরা দেখেছি যে কোন নির্দিষ্ট সময়পর্বে অধিক সংখ্যক একক সম্বলিত প্রজাতিদের অনুকূল/উপযুক্ত পরিবৃত্তি উদ্ভাবনের ভাল সম্ভাবনা থাকে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে উল্লিখিত তথ্যসমূহে এর সাক্ষ্যপ্রমাণাদি আমাদের কাছে আছে, সেখানে দেখানো হয়েছে যে সুলভ ও পরিব্যাপ্ত এবং প্রভাবশালী প্রজাতিরা অধিক সংখ্যক নথিভুক্ত ভ্যারাইটি সৃষ্টি করে। অতএব, যে কোন নির্দিষ্ট সময়পর্বে প্রজাতিরা কম মন্থরভাবে রূপান্তরিত ও উন্নত হবে, পরিণামে তারা জীবনসংগ্রামে সুলভ প্রজাতিদের রূপান্তরিত ও উন্নত বংশধরদের দ্বারা পরাজিত হবে।
এইসব বিচার-বিশ্লেষণ থেকে আমি মনে করি এটি অনিবার্যরূপে ঘটে যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে সময়ের ব্যবধানে নূতন প্রজাতিরা সৃষ্ট হয় বলে অন্যরা তখন বিরল থেকে বিরলতর হবে ও অবশেষে বিলুপ্ত হবে। রূপান্তরিত ও উন্নত হচ্ছে এমনগুলির সঙ্গে আকাররা কঠোর প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়, সাধারণতঃ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবং অস্তিত্বের সংগ্রাম সংক্রান্ত অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে সবচেয়ে নিকট সম্পর্কীয় আকারদের মধ্যেই এটি ঘটে–একই প্রজাতির ভ্যারাইটি ও একই গণের এবং সম্পর্কিত গণগুলির প্রজাতিরা, যাদের অবয়ব, দেহগঠন ও স্বভাব প্রায় একইরকম, তারাই সাধারণভাবে পরস্পরের সঙ্গে কঠোর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে, ফলস্বরূপ উদ্ভব প্রক্রিয়া চলতে থাকার সময় প্রত্যেক নূতন ভ্যারাইটি বা প্রজাতি সাধারণতঃ নিকটতম আত্মীয়কে প্রচণ্ড চাপ দেয় এবং তাদের বিনাশের দিকে চালিত করে। মানুষের দ্বারা উন্নত আকারদের নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনগুলির মধ্যে আমরা একইরকম ধ্বংসসাধন প্রক্রিয়া লক্ষ্য করি। অনেক বিচিত্র উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যা দেখায় কত শীঘ্র গো-মহিষাদি, ভেড়া ও অন্যান্য প্রাণীদের নূতন জাত ও ফুলের ভ্যারাইটিরা প্রবীণতর ও নিকৃষ্টতরদের স্থান গ্রহণ করে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে প্রাচীন কৃষ্ণকায় গো-মহিষাদিরা লম্বা শিংওয়ালাদের দ্বারা স্থানচ্যুত হয়েছিল এবং এরা “ছোট শিংওয়ালাদের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত হয়েছিল” (একজন কৃষিবিদের লেখা উল্লেখ করলাম), “যেন কোন ঘাতক মহামারী রোগের দ্বারা।”
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অপসৃতি
যে বিষয়টিকে আমি এই পদটির আখ্যা দিয়েছি, সেই পদ্ধতিটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ও আমার বিশ্বাস মতো কয়েকটি বিষয় ব্যাখ্যা করে। প্রথমে, ভ্যারাইটিরা, এমনকি স্পষ্টচিহ্নিতগুলিও, যদিও প্রজাতির কয়েকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়, তবুও বিশুদ্ধ ও ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিদের তুলনায় পরস্পরের থেকে নিশ্চয় আরও কম ভিন্ন হয়, যেমন অনেক ক্ষেত্রে সন্দেহের চোখে দেখানো হয়েছে যে কেমন করে এদের শ্রেণীভুক্ত করা হবে। তা সত্ত্বেও আমার মতানুসারে সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় ভ্যারাইটিরা হচ্ছে প্রজাতি, অথবা আমি যেমন বলি–জায়মান প্রজাতি। তা হলে ভ্যারাইটিদের মধ্যে কম পার্থক্য কেমন করে প্রজাতিদের মধ্যে বেশি পার্থক্যকে বর্ধিত করে? সমগ্র প্রকৃতিমণ্ডলে অংসখ্য প্রজাতির অধিকাংশই সুচিহ্নিত পার্থক্যসমূহ উপস্থিত করে। এ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে এটা স্বাভাবিকভাবেই ঘটে। পক্ষান্তরে, ভবিষ্যতের সুচিহ্নিত প্রজাতিদের অনুমতি আদিরূপ ও পিতামাতা এরূপ ভ্যারাইটিরা অল্প ও সংজ্ঞা নিরূপণের অসাধ্য পার্থক্যসমূহ উপস্থিত করে। আমরা বলতে পারি কেবল অপ্রত্যাশিতভাবে একটি ভ্যারাইটি তার পিতামাতার কিছু বৈশিষ্ট্য থেকে ভিন্ন হতে পারত, কিন্তু একই গণের। প্রজাতিদের মধ্যে স্বাভাবিক ও বিরাট পরিমাণ পার্থক্যের মতো এটি কখনই ঘটবে না।
নিজস্ব অভ্যাস মতো এ বিষয়ে আমি আমাদের গৃহপালিত উৎপাদিত উৎপাদনগুলির ওপর আলোকপাত করতে চেষ্টা করেছি। আমরা এখানে অনুরূপ কিছু দেখব। এটি স্বীকার করতে হবে যে ছোট শিংওয়ালা ও হেয়ারফোর্ড গো-মহিষাদিদের, ঘোড়দৌড়ের ও ভারবাহী ঘোড়াদের, পায়রাদের কয়েকটি জাতের মতো এত পার্থক্যজনিত জাতসমূহের উৎপাদন অসংখ্য ধারাবাহিক বংশ ধরে সমরূপ পরিবৃত্তিদের কেবল অপ্রত্যাশিত সঞ্চয়নের দ্বারা কখনই কার্যকরী হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, বাস্তবে একজন পাখিপ্রেমী বা পাখিরসিক খুব ছোট্ট ঠোঁটওয়ালা একটি পায়রাকে দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়; এবং স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসারে ‘প্রেমী বা রসিকরা মাধ্যমিক মানকে পছন্দ করে না ও করবে না, বরং চরমগুলিকে পছন্দ করে, এবং এরা উভয়েই (লোটন পায়রার উপ জাতগুলির ক্ষেত্রে যেমন সচরাচর ঘটে) ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর ঠোঁটওয়ালা পাখিদের পছন্দ ও প্রজনন করতে থাকবে। আবার আমরা মনে করতে পারি যে ইতিহাসের প্রথম পর্যায়ে একটি দেশ বা জেলার মানুষদের দ্রুতগামী ঘোড়ার প্রয়োজন হতো, বলবান ও স্থূলকায় ঘোড়ার। প্রাথমিক পর্যায়ে পার্থক্যগুলি অতি অল্প হবে; কিন্তু কালক্রমে, একটি ক্ষেত্রে দ্রুতগামী, অন্য ক্ষেত্রে বলবান ঘোড়াদের নিরবচ্ছিন্ন নির্বাচন দ্বারা পার্থক্যগুলি বিরাটতর হবে এবং লক্ষ্য করা যাবে যে দুটি উপজাত সৃষ্টি হয়েছে। অবশেষে, কয়েক শতাব্দী পরে এই উপজাতগুলি দুটি ভিন্ন ও সুপ্রতিষ্ঠিত জাতে রূপান্তরিত হবে। পার্থক্যগুলি বিরাট হয় বলে মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্য সমেত নিকৃষ্ট প্রাণীরা, যারা দ্রুতগামীও নয় বা বলবানও নয়, প্রজননে ব্যবহৃত হবে না। এবং এভাবে তারা বিলুপ্ত হতে থাকবে। এখানে আমরা মানুষের উৎপাদনগুলিতে এমন একটি ঘটনা দেখি যাকে আমরা অপসৃতির পদ্ধতি বলতে পারি এবং যা পার্থক্যগুলি ঘটায়, প্রথমে অতি অল্পভাবে, তার পর ক্রমাগত বৃদ্ধি পায় এবং অবশেষে পরস্পরের থেকে এবং নিজেদের সাধারণ পিতামাতার থেকে ভিন্নমুখী বৈশিষ্ট্যের জাতগুলির উদ্ভব ঘটায়।
কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে যে কোন অনুরূপ পদ্ধতি কেমন করে প্রকৃতিতে প্রয়োগ হতে পারে? আমি মনে করি এটি অতিশয় কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যায় ও যেতে পারে (কেমন করে এটি হয় তা অনুধাবন করতে অবশ্য অনেক সময় লেগেছিল)। সরল ঘটনা থেকে জানা যায় যে কোন একটি প্রজাতির বংশধররা অবয়বে, জৈবসংগঠনে ও স্বভাবে যত বেশি ভিন্নমুখী হয়; তত বেশি করে তারা প্রকৃতিমণ্ডলের অসংখ্য ও ব্যাপকভাবে বিচিত্র অঞ্চলসমূহ অধিকার করতে সমর্থ হয়, এবং এভাবে সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে সক্ষম হয়।
সরল স্বভাবের প্রাণীদের ক্ষেত্রে এটি আমরা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারি। মাংসাশী চতুষ্পদ প্রাণীদের বিষয়টি ধরা যাক, যে কোন দেশে যার সংখ্যা বহু পূর্বে গড়সংখ্যার পূর্ণতায় পৌঁছে গেছে। এদের বৃদ্ধির স্বাভাবিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দেওয়া হলে অন্য প্রাণীদের দ্বারা বর্তমানে অধিকৃত স্থানগুলি এদের পরিবর্তনশীল বংশধরদের দ্বারা অধিকার করার মাধ্যমে এরা কেবল বৃদ্ধি পেতে সমর্থ হতে পারে (দেশটির কোন ভৌতিক পরিবর্তন হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, এদের মধ্যে কয়েকটি মৃত অথবা জীবিত নূতন ধরনের শিকার ধরে খেতে সমর্থ হয়; কিছু প্রাণী নূতন জায়গায় বসবাস করতে শুরু করে, গাছে ওঠে, জলে ঘুরে বেড়ায় এবং কিছু বোধহয় কম মাংসাশী হয়। আমাদের মাংসাশী প্রাণীদের বংশধরদের দেহগঠন ও স্বভাব যত বেশি বিচিত্র হবে, এরা তত বেশি অঞ্চল অধিকার করতে সমর্থ হবে। যা একটি প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা সবসময় সমস্ত প্রাণীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে–অর্থাৎ যদি এরা পরিবর্তিত হয়, কারণ অন্যথায় প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হতে পারে না। এভাবে উদ্ভিদদের ক্ষেত্রেও এটি ঘটবে। পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে জমির একটি প্লটে যদি ঘাসের একটি প্রজাতির চাষ করা হয় এবং অনুরূপ প্লটে ঘাসের কয়েকটি ভিন্ন গণের প্রজাতির যদি চাষ করা হয় এবং অনুরূপ প্লটে ঘাসের কয়েকটি ভিন্ন গণের প্রজাতির যদি চাষ করা হয়, তাহলে পূর্বেরটির তুলনায় পরেরটির ক্ষেত্রে অধিক সংখ্যক ঘাস ও বেশি ওজনের শুকনো খড় উৎপাদন করা যেতে পারে। একই ঘটনা ঘটে গমের একটি ভ্যারাইটি ও কয়েকটি মিশ্র ভ্যারাইটিকে জমির সমান পরিমাণ প্লটে চাষ করা হলে। অতএব ঘাসের একটি প্রজাতিকে পরিবর্তিত হতে দেওয়া হলে এবং ভ্যারাইটিদের অনবরত নির্বাচন করা হলে, যারা পরস্পরের থেকে যদিও অতি অল্প মাত্রায় একইভাবে ভিন্ন হয়, যেমন প্রজাতি ও গণগুলির ক্ষেত্রে হয়, এদের রূপান্তরিত বংশধরগুলি-সমেত প্রজাতির বিরাট সংখ্যক এককরা জমির একই প্লটে বেঁচে থাকতে সমর্থ হবে। এবং আমরা জানি যে ঘাসের প্রত্যেক প্রজাতি ও প্রত্যেক ভ্যারাইটি প্রতি বছর অসংখ্য বীজ জমিতে ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং এভাবে এরা সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে তীব্র প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ফলস্বরূপ কালক্রমে, শত সহস্র বছর পরে, ঘাসের যে কোন একটি প্রজাতির সবচেয়ে ভিন্ন ভ্যারাইটিদের কৃতকার্য হওয়ার ও সংখ্যায় বৃদ্ধি পাওয়ার এবং এভাবে কম ভিন্ন ভ্যারাইটিদের স্থানচ্যুত করার সম্ভাবনা বেশি থাকবে; এবং যখন পরস্পরের থেকে আরও বেশি ভিন্ন হয়, তখন ভ্যারাইটিরা প্রজাতি পদে উন্নীত হয়।
দেহকাঠামোর বিপুল বৈচিত্র্যের ওপর জীবনের সংখ্যার পরিমাণ নির্ভর করে, এই নীতিটির সত্যতা অনেক প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। একটি ছোট এলাকা বিশেষভাবে যদি পরদেশীদের জন্য মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং সেখানে এককের সঙ্গে এককের সংগ্রাম কঠোর হয়, তাহলে আমরা সেখানের অধিবাসীদের মধ্যে বিপুল বৈচিত্র্য লক্ষ্য করি। উদাহরণস্বরূপ, একই অবস্থায় পড়ে থাকা তৃণাচ্ছাদিত তিন ফুট চওড়া ও চার ফুট লম্বা আয়তনের এক খণ্ড ঘাসের চাপড়া আমি দেখেছিলাম এবং সেখানে আটটি বর্গের আঠারোটি গণের অন্তর্গত কুড়িটি প্রজাতির উদ্ভিদ ছিল। এই সংখ্যা থেকে বোঝা যায় এইসব উদ্ভিদরা পরস্পরের থেকে কত পৃথক। ছোট্ট ছোট্ট দ্বীপে প্রাণী ও পতঙ্গদের ক্ষেত্রেও এরূপ ঘটে। স্বাদুজলের পুকুরগুলিতেও এরূপ ঘটে। কৃষকরা লক্ষ্য করে যে সবচেয়ে বেশি হতে পারে। প্রকৃতিও এটি অনুসরণ করে থাকে যাকে বলা যেতে পারে যুগপৎ চক্রগতি বা পর্যায়ক্রম। এক খণ্ড জমিতে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসবাসকারী অধিকাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদরা এখানে বাস করতে থাকবে (এদের প্রকৃতি কোনভাবেই স্বাতন্ত্র্যসূচক নয় মনে করে) এবং বলা যেতে পারে যে ‘বাঁচার জন্য তীব্র চেষ্টা করছে এরা। কিন্তু দেখা যায় এরা যখন তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়, এদের স্বভাব ও জৈবিকগঠনের পার্থক্য সমেত দেহের বৈচিত্র্যের সুবিধাগুলি নির্ধারণ করে যে পরস্পরের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতায় নামা অধিবাসীরা, একটি সাধারণ নিয়মানুযায়ী যাদের আমরা বিভিন্ন গণ ও বর্গ বলি, তার অন্তর্ভুক্ত হবে।
মানুষের হস্তক্ষেপ দ্বারা উদ্ভিদের বিদেশের মাটিতে স্বাভাবিকীকরণের ব্যাপারেও একই পদ্ধতি দেখা যায়। এটি আশা করা যেতে পারত যে যে-কোন দেশে পরিবেশানুগ হতে সমর্থ উদ্ভিদরা সাধারণতঃ দেশীয়দের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত হয়, কারণ সাধারণভাবে লক্ষ্য করা যায় যে এরা নিজের দেশে বিশেষভাবে সৃষ্ট ও অভিযোজিত হয়েছে। বোধ হয় আরও আশা করা যেতে পারত যে পরিবেশানুগ উদ্ভিদরা এদের নূতন বাসস্থানের কোন কোন জায়গায় আরও বিশেষভাবে অভিযোজিত কয়েকটি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকবে। কিন্তু বিষয়টি একেবারেই অন্যরকম। আলফোন্সে ডি ক্যান্ডেলে তার সুবৃহৎ ও প্রশংসনীয় গ্রন্থে সুন্দরভাবে মন্তব্য করেছেন যে উদ্ভিদকুলগুলি দেশীয় গণ ও প্রজাতিদের সংখ্যার অনুপাতে নূতন প্রজাতির তুলনায় নূতন গণের আরও বেশি দেশীয়করণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়। কেবল একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ডঃ আসা গ্রে-র ‘ম্যানুয়্যাল অফ দ্য ফ্লোরা অফ নর্দান ইউনাইটেড স্টেটস্’ গ্রন্থের সর্বশেষ সংস্করণ ২৬০টি পরিবেশানুগ উদ্ভিদের তালিকা দেওয়া হয়েছে এবং এরা ১৬২টি গণের অন্তর্গত। এভাবে আমরা লক্ষ্য করি যে এইসব পরিবেশানুগ উদ্ভিদরা অতিশয় বৈচিত্র্যপূর্ণ; অধিকন্তু দেশীয়দের তুলনায় এরা বহুল পরিমাণে ভিন্ন হয়, কারণ ১৬২টি পরিবেশানুগ গণের মধ্যে কম করেও ১০০টির মতো গণ দেশীয় নয়, এবং এভাবে ইউনাইটেড স্টেটস-এ বর্তমানে অবস্থিত গণগুলির সঙ্গে বিরাট সংখ্যক গণ যুক্ত হয়েছে।
দেশীয়দের সঙ্গে সফলভাবে সংগ্রাম করে সেই দেশের পরিবেশানুগ হয়েছে এমন উদ্ভিদ বা প্রাণীদের প্রকৃতি বিচার করে আমরা কিছু ধারণা লাভ করতে পারি যে সহযোদ্ধাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তারের জন্য কিভাবে রূপান্তরিত হতে হবে; এবং আমরা অন্ততঃ সিদ্ধান্ত করতে পারি যে অবয়বের নূতন গণীয় পার্থক্যের সমতুল বৈচিত্র্য। এদের পক্ষে লাভজনক হবে।
একই অঞ্চলের অধিবাসীদের অবয়বের বৈচিত্র্যের উপযোগিতা, বাস্তবিকপক্ষে এককদের শরীরের অঙ্গগুলির শ্রমের শারীরবৃত্তীয় কাজের মতো একই হয়–এই বিষয়টি মিলনে এডওয়ার্ডস বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কোন শারীরতত্ত্ববিদ সন্দেহ করেন না যে কেবল শাকসজী, অথবা কেবল হজমের পক্ষে উপযোগী একটি পাকস্থলী এইসব বস্তু থেকে সবচেয়ে পুষ্টিকর বস্তু গ্রহণ করে। অতএব যে কোন দেশের সাধারণ পরিমণ্ডলে প্রাণী ও উদ্ভিদরা ভিন্ন ভিন্ন স্বভাবের জন্য যত বেশি ব্যাপকভাবে ও নিখুঁতভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়, তত বেশি সংখ্যক এককরা বেঁচে থাকতে সমর্থ হবে। অল্প বৈচিত্র্যপূর্ণ জৈবসংগঠন সম্বলিত একদল প্রাণী জৈবসংগঠনে আরও নিখুঁতভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ আর একদল প্রাণীর সঙ্গে কদাচিৎ প্রতিযোগিতা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মিঃ ওয়াটারহাউস ও অন্যদের মন্তব্য অনুসারে, পরস্পরের থেকে ভিন্ন বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙারুরা আমাদের মাংসাশী, রোমন্থক, দন্তুর স্তন্যপায়ীদের সঙ্গে সফলতার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারত কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। অস্ট্রেলিয়ার স্তন্যপায়ীদের মধ্যে আমরা লক্ষ্য করি, বৈচিত্র্যপূর্ণ হওয়ার প্রক্রিয়াটি বিকাশের আদিম ও অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
একজন সাধারণ পূর্বপুরুষের বংশধরদের ওপর বৈশিষ্ট্যের অপসৃতি এবং বিলুপ্তির মাধ্যমে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার সম্ভাব্য প্রভাবসমূহ
অতি সংক্ষেপে উপরোক্ত আলোচনার পর আমরা ধরে নিতে পারি, যে কোন একটি প্রজাতির রূপান্তরিত বংশধররা অবয়বে যত বেশি ভিন্ন হবে তত বেশি ভালভাবে সাফল্য লাভ করবে এবং অন্যের অধিকৃত স্থানসমূহ অধিকার করতে সমর্থ হবে। এখন দেখা যাক প্রাকৃতিক নির্বাচন ও বিলুপ্তির পদ্ধতিগুলির সঙ্গে যুক্ত বৈশিষ্ট্যের অপসৃতি থেকে উদ্ভূত উপকারের এই পদ্ধতিটি কেমন করে কার্যকরী হয়।
এখানে প্রদত্ত রেখাচিত্রটি (৮৭-৮৮ পৃষ্টায় দ্রষ্টব্য) এই জটিল বিষয়টি বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে। নিজ দেশের একটি বিরাট গণের প্রজাতিদের A থেকে L অক্ষর দ্বারা চিহ্নিত করা যাক। মনে করা যাক এই প্রজাতিরা পরস্পরের সঙ্গে অসমান মাত্রায় সদৃশ, যেমন সাধারণতঃ প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘটে, এবং যেমন রেখাচিত্রে অসমান দূরত্বে অবস্থিত অক্ষরগুলি দ্বারা উপস্থাপিত করা হয়েছে। আমি একটি বিরাট গণের বিষয় উল্লেখ করেছি, কারণ দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখেছিলাম যে ছোট গণগুলির তুলনায় বড় গণগুলির গড়ে আরও বেশি প্রজাতি পরিবর্তিত হয় এবং বড় গণের পরিবর্তনশীল প্রজাতিরা আরও বেশি সংখ্যক ভ্যারাইটি উৎপাদন করে। আমরা আরও দেখেছি যে সবচেয়ে সুলভতম এবং ব্যাপকভাবে পরিব্যাপ্ত প্রজাতিরা বিরল ও সীমাবদ্ধ প্রজাতিদের তুলনায় বেশি পরিবর্তিত হয়। নিজ দেশের একটি বড় গণের অন্তর্গত, ধরা যাক (A) একটি সুলভ, ব্যাপকভাবে পরিবর্তনশীল প্রজাতি। (A) থেকে। উদ্ভূত অসমান দৈর্ঘ্যের শাখাবিভক্ত ও অপসারণশীল বিন্দুখচিত রেখাগুলি তার পরিবর্তনশীল বংশধরদের সূচিত করতে পারে। পরিবর্তনগুলিকে মনে করা হয় অত্যল্প, কিন্তু অতি বিচিত্র প্রকৃতির; মনে হয় এরা সকলে যুগপৎ আবির্ভূত হয়নি, বরং প্রায়শই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আবির্ভূত হয়েছে; অথবা মনে হয় না যে এরা সকলে সমান। সমান কালব্যাপী স্থায়ী হয়। কোন-না-কোনভাবে লাভজনক কেবল ঐ সব পরিবৃত্তিরাই সংরক্ষিত অথবা স্বাভাবিকভাবে নির্বাচিত হবে। এবং বৈশিষ্ট্যের অপসৃতি থেকে উদ্ভূত সুফলের মূল নীতির প্রয়োজনীয়তা এখানে উপস্থিত হয়, কারণ এটি সবচেয়ে ভিন্ন অথবা অপসারী পরিবৃত্তিদের (বাইরের বিন্দুখচিত রেখাগুলি দ্বারা সূচিত) প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা সংরক্ষিত ও পুঞ্জীভূত হতে সাধারণতঃ প্রণোদিত বা পথপ্রদর্শন করবে। যখন একটি বিন্দুখচিত রেখা সমান্তরাল রেখাগুলির একটিতে পৌঁছায় এবং সেখানে সংখ্যা সম্বলিত একটি ছোট অক্ষর দ্বারা চিহ্নিত হয়, তখন স্পষ্টভাবে সুচিহ্নিত একটি ভ্যারাইটি সৃষ্টি করতে যথেষ্ট পরিমাণ পরিবৃত্তি সঞ্চিত হয়েছে বলে মনে হয়। এটি একটি সিস্টেমেটিক গবেষণার কাজে লিপিবদ্ধ হওয়ার যোগ্য হিসেবে মনে করা উচিত হবে।
রেখাচিত্রের সমান্তরাল রেখাদের মধ্যের জায়গাগুলি প্রত্যেকে এক হাজার বা আরও বেশি বংশ সূচিত করতে পারে। এক হাজার বংশের পর প্রজাতি (A) ধরে নেওয়া যাক দুটি অতি স্পষ্টচিহ্নিত ভ্যারাইটি উৎপাদন করেছে, যথা a1 ও m1। যে। জীবন-পরিবেশ এদের পিতামাতাদের পরিবর্তনশীল করেছিল, এই দুটি ভ্যারাইটি সাধারণতঃ তখনও সেই একই জীবন-পরিবেশের প্রভাবাধীন হবে এবং পরিবর্তনশীলতার প্রবণতাও বংশগত হবে; ফলস্বরূপ যেভাবে এদের পিতামাতারা পরিবর্তিত হয়েছিল, প্রায়, সেভাবেই এরাও পরিবর্তনপ্রবণ হবে। অধিকন্তু, এই দুটি ভ্যারাইটি, যারা কেবলমাত্র অল্প রূপান্তরিত আকার, ঐ সব সুফলগুলিতে বংশগতভাবে প্রেরণ করতে চেষ্টা করবে, ঐ সুফলগুলি একই দেশের অধিবাসীদের অধিকাংশের তুলনায় এদের পিতামাতাদের (A) আরও সংখ্যাবহুল করেছিল; এরা ঐ সব আরও সাধারণ সুফলগুলিরও অধিকারী হবে। ঐ সুফলগুলি পিতামাতা প্রজাতিটির অন্তর্গত গণটিকে এর নিজের দেশে বিরাট গণে পরিণত করেছিল। এই সকল পরিবেশ নূতন ভ্যারাইটি সৃষ্টিতে অনুকূল হয়।
এখন এই দুটি ভ্যারাইটি যদি পরিবর্তনশীল হয়, তাহলে এদের মধ্যে সবচেয়ে অপসারী বা ভিন্নমুখী পরিবর্তনগুলি পরবর্তী হাজার পুরুষ ধরে সাধারণতঃ সংরক্ষিত হবে। এই সময়ান্তরের মধ্যে a1 ভ্যারাইটি রেখাচিত্রে a2 ভ্যারাইটি সৃষ্টি করেছে বলে মনে হয়, যা অপসৃতির নিয়ম অনুযায়ী a1 ভ্যারাইটির তুলনায় (A) থেকে বেশি ভিন্ন হবে। ধরা যাক m1 ভ্যারাইটিটি দুটি ভ্যারাইটি সৃষ্টি করেছে, যথা m2 ও s2, এরা পরস্পরের থেকে ও আরও বিশেষভাবে এদের সাধারণ পিতামাতার (A) থেকে ভিন্ন হয়। যে। কোন সময় ধরে আমরা একইরূপ ধাপগুলি দ্বারা প্রক্রিয়াটিকে চালিয়ে যেতে পারি; ভ্যারাইটিদের কয়েকটি প্রত্যেক হাজার বংশ পরে কেবলমাত্র একটি ভ্যারাইটি উৎপাদন করে, কিন্তু আরও বেশি রূপান্তরিত হওয়ার ফলে কয়েকটি ভ্যারাইটি দুটি বা তিনটি ভ্যারাইটি উৎপাদন করে এবং কয়েকটি একটিও সৃষ্টি করে না। এভাবে পিতামাতার (A) ভ্যারাইটিরা বা রূপান্তরিত বংশধররা সংখ্যায় বৃদ্ধি পাবে এবং সাধারণত বৈশিষ্ট্যে ভিন্নমুখী হতে থাকবে। রেখাচিত্রটিতে প্রক্রিয়াটি দশ হাজার বংশ এবং একটি সংক্ষিপ্ত ও সরলাকারে চোদ্দ হাজার বংশ পর্যন্ত দেখানো হয়েছে।
কিন্তু এখানে আমি নিশ্চয় বলবো যে প্রক্রিয়াটি সর্বদা এত নিয়মিতভাবে চলে বলে আমি মনে করি না, যেমন রেখাচিত্রটিতে দেখানো হয়েছে, যদিও এটি অনিয়মিতভাবে অঙ্কিত হয়েছিল, অথবা আমি এ-ও মনে করি না যে এটি অবিচ্ছিন্নভাবে চলে না। এটি আরও বেশি সম্ভবপর যে প্রত্যেক আকার দীর্ঘদিন অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকে এবং তারপর পুনরায় রূপান্তরিত হতে শুরু করে। অথবা আমি মনে করি না যে অতিশয় অপসারী/ভিন্নমুখী ভ্যারাইটিরা অনিবার্যভাবে রূপান্তরিত হয়; একটি মধ্যম আকার প্রায়শই দীর্ঘদিন স্থায়ী হতে পারে এবং একাধিক রূপান্তরিত বংশধর সৃষ্টি করতে পারে বা পারে না, কারণ জীব দ্বারা হয় অনধিকৃত বা সম্পূর্ণরূপে অধিকৃত নয় এমন স্থানসমূহের প্রকৃতি অনুযায়ী প্রাকৃতিক নির্বাচন সর্বদা ক্রিয়া করবে এবং তা অনির্দিষ্ট জটিল সম্পর্কগুলির ওপর নির্ভর করবে। কিন্তু একটি সাধারণ নিয়মানুসারে যে কোন একটি প্রজাতির বংশধরদের দেহ যত বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ হবে, তত বেশি অঞ্চল দখল করতে সমর্থ হবে এরা, এবং তত বেশি এদের বংশধরদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। অনুক্রমিক আকারদের চিহ্নিত করে ছোট সংখ্যার অক্ষরগুলি দ্বারা নিয়মিত ব্যবধানে আমাদের রেখাচিত্রটিতে পরম্পরার রেখাঁটি ভাঙ্গা দেখানো হয়েছে, ঐসব আকাররা ভ্যারাইটি হিসেবে লিপিবদ্ধ হতে যথেষ্ট ভিন্ন হয়েছে। কিন্তু এই বিযুক্তিগুলি কল্পিত এবং যথেষ্ট সময়ের ব্যবধানে বেশ কিছু পরিমাণ অপসারী/ভিন্নমুখী পরিবর্তনের পুঞ্জীভবনের সুযোগ দিয়ে বিযুক্তিগুলিকে যে কোন জায়গায় সন্নিবেশিত করা যেতে পারত।
একটি বিরাট গণের অন্তর্গত একটি সুলভ ও ব্যাপকভাবে পরিব্যাপ্ত প্রজাতির সমস্ত রূপান্তরিত বংশধররা সেই একই রকম সুযোগসুবিধাগুলি নিতে চেষ্টা করবে যেগুলি তাদের পিতামাতাদের কৃতকার্য হতে সাহায্য করেছিল, এবং এরা সাধারণত সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে ও বৈশিষ্ট্যে ভিন্নমুখী হতে থাকবে: এটি (A) থেকে উদ্ভূত কয়েকটি ভিন্নমুখী বা অপসারী শাখার দ্বারা রেখাচিত্রটিতে দেখানো হয়েছে। পূর্ববর্তীটির থেকে রূপান্তরিত বংশধর এবং বংশরেখাগুলির আরও উন্নত শাখারা, সম্ভবতঃ পূর্বের কম উন্নত শাখাদের স্থান প্রায়শই গ্রহণ করবে এবং এভাবে ধ্বংস করবে: উপরের সমান্তরাল রেখাগুলিতে না-পৌঁছানো নিচের কয়েকটি শাখার দ্বারা এটি রেখাচিত্রে দেখানো হয়েছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহেই রূপান্তরিত প্রক্রিয়াটি একটি একক বংশরেখায় সীমাবদ্ধ থাকবে এবং রূপান্তরিত বংশধরদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে না, যদিও ভিন্নমুখী/অপসারী রূপান্তরের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। রেখাচিত্রটিতে এই বিষয়টি দেখানো যেতে পারে a1 থেকে a10 পর্যন্ত রেখাগুলি ছাড়া (A) থেকে উদ্ভূত রেখাগুলি মুছে ফেলা হলে। এভাবে ইংলিশ ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া ও ইংলিশ পয়েন্টার কুকুর উভয়েই কোন নূতন শাখা বা জাত সৃষ্টি না করে, এদের আদিম কুল থেকে বৈশিষ্ট্যে ধীরে ধীরে ভিন্নমুখী হয়েছে।
দশহাজার বংশের পর, ধরা যাক প্রজাতি (A) তিনটি আকার a10, f10, m10 সৃষ্টি করেছে, যারা পর্যায়ক্রমিক বংশগুলিতে বৈশিষ্ট্যে ভিন্নমুখী/অপসারী হয়ে পরস্পরের থেকে ও নিজেদের সাধারণ পিতামাতার থেকে, সম্ভবতঃ অসমানভাবে প্রভূত পরিমাণে ভিন্ন হয়ে থাকবে। আমরা যদি মনে করি যে আমাদের রেখাচিত্রের প্রত্যেক সমান্তরাল রেখার মধ্যে পরিবর্তনের পরিমাণ অতি অল্প হয়, এই তিনটি আকার তখনও পর্যন্ত কেবলমাত্র সুচিহ্নিত ভ্যারাইটি হতে পারে; কিন্তু এই তিনটি আকার সন্দেহজনক বা অন্ততঃ সু-সংজ্ঞায়িত প্রজাতিতে রূপান্তরিত হতে রূপান্তর প্রক্রিয়ার ধাপগুলি আরও অসংখ্য ও বিরাট পরিমাণ হতে হবে, এটা আমাদের মনে করতে হবে। এভাবে রেখাচিত্রটি ধাপগুলির উদাহরণস্বরূপ ব্যাখ্যা উপস্থিত করে, যার দ্বারা ভ্যারাইটিদের প্রভেদকারী অল্প পার্থক্যসমূহ প্রজাতিদের প্রভেদকারী বড় ধরণের পার্থক্যে বৃদ্ধি পায়। বিরাট সংখ্যক বংশ ধরে প্রক্রিয়াটি চলার পর (সংক্ষিপ্ত ও সরলভাবে যেমন রেখাচিত্রটিতে দেখানো হয়েছে) আমরা আটটি প্রজাতি পাই, যারা a14 ও m14-এর মধ্যবর্তী অক্ষরগুলি দ্বারা চিহ্নিত হয়েছে এবং এরা সকলেই (A) থেকে উদ্ভূত হয়েছে। আমার বিশ্বাস মতো, এভাবে প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ও গণগুলি সৃষ্ট হয়।
একটি বড় গণে এটি সম্ভবপর যে একাধিক প্রজাতি পরিবর্তিত হবে। রেখাচিত্রটিতে আমি ধরে নিয়েছি যে দ্বিতীয় একটি প্রজাতি (I) দশ হাজার বংশের পর, সমান্তরাল রেখাদের মধ্যে কল্পিত পরিবর্তনের পরিমাণানুসারে অনুরূপ ধাপগুলির দ্বারা হয় দুটি সুচিহ্নিত ভ্যারাইটি (w10 এবং z10) বা দুটি প্রজাতি সৃষ্টি করেছে। চৌদ্দ হাজার বংশের পর, মনে হয় n14 থেকে z14 অক্ষরগুলি দ্বারা চিহ্নিত ছয়টি নূতন প্রজাতি সৃষ্টি হয়েছে। যে কোন গণের প্রজাতিরা, যারা বৈশিষ্ট্যে পরস্পরের থেকে ইতিমধ্যে অতিশয় ভিন্ন হয়েছে, সাধারণতঃ বিরাট সংখ্যক রূপান্তরিত বংশধর সৃষ্টি করতে চেষ্টা করবে; কারণ প্রকৃতিমণ্ডলে নূতন ও ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন স্থানগুলি অধিকার করার ভাল সুযোগ থাকবে! অতএব রেখাচিত্রটিতে আমি প্রান্তবর্তী প্রজাতি (A) এবং প্রায়-প্রান্তবর্তী প্রজাতি (I)-কে মনোনীত করেছি, যারা বিপুলভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং নূতন ভ্যারাইটি ও প্রজাতি সৃষ্টি করেছে। আমাদের আদি প্রথম গণের অন্য নয়টি প্রজাতি (বড় অক্ষর দ্বারা চিহ্নিত) দীর্ঘ এবং অসমান সময় ধরে অপরিবর্তিত বংশধরদের উৎপাদন করে থাকতে পারে। এটি রেখাচিত্রের ওপরদিকে অসমানভাবে প্রসারিত বিন্দুখচিত রেখাদের দ্বারা দেখানো হয়েছে।
রেখাচিত্রটির মাধ্যমে উপস্থাপিত রূপান্তর প্রক্রিয়া চলার সময়, আমাদের অন্য একটি মূলতত্ত্ব অর্থাৎ বিলুপ্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকবে। প্রত্যেক পরিপূর্ণ দেশে জীবনসংগ্রামে অন্য আকারের ওপর অল্প প্রাধান্য বিস্তারকারী নির্বাচিত আকারদের মাধ্যমে প্রাকৃতিক নির্বাচন যেহেতু স্বাভাবিকভাবে কাজ করে, তাই যে কোন একটি প্রজাতির উন্নত বংশধরদের উদ্ভবের প্রতিটি ধাপে এদের পূর্বপুরুষ ও জন্মদাতাদের অনবরত ধ্বংস ও স্বভাবচ্যুত করার প্রবণতা থাকবে। কারণ স্মরণ রাখা উচিত যে স্বভাবে, দেহগঠনে, অবয়বে পরস্পরের সঙ্গে প্রায় সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কিত এইসব আকারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সাধারণতঃ অতিশয় কঠোর হবে। অতএব পূর্বের ও পরবর্তী অবস্থার মধ্যে সমস্ত মধ্যবর্তী আকারদের, অর্থাৎ একই প্রজাতির কম ও বেশি উন্নত আকারদের এবং আদি পিতামাতা প্রজাতিরও বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সুতরাং এটি অনেক সমগ্র সমপার্শ্বিক বংশরেখার ক্ষেত্রেও হবে, যারা পরবর্তী সময়ে ও উন্নত রেখাদের দ্বারা বিজিত হবে। তবে একটি প্রজাতির রূপান্তরিত বংশধর যদি কোন ভিন্ন দেশে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়, অথবা সম্পূর্ণ নূতন জায়গায় তাড়াতাড়ি অভিযোজিত হয়, তাহলে সেখানে বংশধর ও জন্মদাতার মধ্যে কোন প্রতিযোগিতা থাকে না, উভয়েই একসঙ্গে অবস্থান করতে পারে।
যদি আমাদের রেখাচিত্রটি রূপান্তর প্রক্রিয়াকে কিছু পরিমাণে উপস্থাপিত করে বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে প্রজাতি (A) ও পূর্বের ভ্যারাইটিরা বিলুপ্ত হয়ে থাকবে, এরা আটটি নূতন প্রজাতি (a14 থেকে m14) দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে থাকবে; এবং প্রজাতি (I) ছয়টি (n14 থেকে z14) নূতন প্রজাতি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে।
কিন্তু আমরা এর চেয়ে আরও বেশি দূর এগোতে পারি। প্রকৃতির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী আমাদের গণের মূল/আদি প্রজাতিরা পরস্পরের মধ্যে অসমমাত্রায় সদৃশ বলে মনে করা হয়েছিল; অন্য প্রজাতিদের তুলনায় প্রজাতি (A) B, C ও D প্রজাতিদের সঙ্গে আরও বেশি সম্পর্কযুক্ত; এবং অন্যদের তুলনায় প্রজাতি (I) G, H, K, L প্রজাতিদের সঙ্গে আরও বেশি সম্পর্কযুক্ত। (A) এবং (I) এই দুই প্রজাতিকে অতিশয় সুলভ ও ব্যাপকভাবে পরিব্যাপ্ত বলে ধরা হয়েছিল, কেন না এরা গণটির অন্য অধিকাংশ প্রজাতিদের ওপর প্রথমের দিকে কিছু প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। এদের রূপান্তরিত বংশধরগণ, চৌদ্দ হাজারতম বংশে সংখ্যায় চোদ্দটি, একই সুফলগুলোর কয়েকটি সম্ভবতঃ বংশগতভাবে প্রাপ্ত হবে : উদ্ভবের প্রতিটি ধাপে এরা বিভিন্নরূপে উন্নত ও রূপান্তরিত হয়েছে, যাতে করে এরা এদের দেশের প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের অনেক সম্পর্কিত এলাকায় অভিযোজিত হয়ে থাকবে। অতএব এটি খুবই সম্ভবপর বলে মনে হয় যে এরা শুধুমাত্র এদের পিতামাতা (A) এবং (I) নয়, বরং এদের পিতামাতাদের সঙ্গে প্রায় সম্পর্কিত এরূপ মূল/আদি প্রজাতির কয়েকটির স্থান গ্রহণ করে থাকবে এবং এরূপে ধ্বংস করে থাকবে। অতএব মূল/ আদি প্রজাতি অল্প কয়েকটি চৌদ্দ হাজারতম বংশে বংশধর প্রেরণ করে থাকবে। আমরা অনুমান করতে পারি যে অন্য নয়টি প্রজাতির সঙ্গে কম ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত দুটি প্রজাতির (E এবং F) মধ্যে কেবল একটি (F) উদ্ভবের শেষ ধাপে বংশধরদের প্রেরণ করেছে।
আমাদের রেখাচিত্রটিতে মূল এগারটি প্রজাতি থেকে উদ্ভূত নূতন প্রজাতিদের সংখ্যা এখন পনেরটি হবে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের অপসারী/বহির্মুখী প্রবণতার জন্য প্রজাতি al4 এবং zl4-এর মধ্যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের চূড়ান্ত পরিমাণ মূল এগারটি প্রজাতির সবচেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যের তুলনায় আরও অনেক বেশি হবে। পরন্তু প্রজাতিরা ব্যাপকভাবে ও বিভিন্নভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হবে। (A) থেকে উদ্ভূত আটটি বংশধরের মধ্যে a14, p14, q14 চিহ্নিত তিনটি a10 থেকে সম্প্রতি শাখাবিস্তার করে সম্পর্কযুক্ত হবে; অনেক আগে a5 থেকে শাখাবিস্তার করে b14 ও f14 তিনটি প্রথম নাম দেওয়া প্রজাতি থেকে কিছু মাত্রায় ভিন্ন হবে এবং সবশেষে, o14, e14 এবং m14 পরস্পরের সঙ্গে প্রায় সম্পর্কযুক্ত হবে, কিন্তু রূপান্তর প্রক্রিয়ার প্রথম আরম্ভের জায়গা থেকে উদ্ভূত হয়ে অন্য পাঁচটি প্রজাতি থেকে ব্যাপকভাবে ভিন্ন হবে এবং একটি উপ গণ অথবা একটি পৃথক গণ সৃষ্টি করতে পারে।
(I) থেকে উদ্ভূত ছয়টি বংশধর দুটি উপ-গণ অথবা গণ সৃষ্টি করবে। কিন্তু যেহেতু মূল প্রজাতি (I) মূল গণটির প্রায় চূড়ান্ত প্রান্তে অবস্থিত (A) থেকে বহুলাংশে ভিন্ন, তাই (I) থেকে উদ্ভূত ছয়টি বংশধর, কেবল বংশানুসৃতির জন্য (A) থেকে উদ্ভূত আটটি বংশধরের তুলনায় আরও বিশেষভাবে ভিন্ন হবে; অধিকন্তু দুটি গোষ্ঠী সম্ভবতঃ বিভিন্ন দিকে বহিমুখী বা অপসারী হতে থাকবে। মধ্যবর্তী প্রজাতিরাও (এবং এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়), যারা মূল প্রজাতি (A) এবং (I)-কে সংযুক্ত করেছিল, (F) ছাড়া সকলে বিলুপ্ত হয়েছে এবং কোন বংশধর রেখে যায়নি। অতএব (I) থেকে উদ্ভূত ছয়টি নূতন প্রজাতিকে (A) থেকে উদ্ভূত আটটি নূতন প্রজাতিকে অতিশয় ভিন্ন ভিন্ন গণ হিসেবে অথবা এমনকি ভিন্ন ভিন্ন উপ-গোত্র হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করতে হবে।
আমার বিশ্বাস মতো এটি এভাবে হয় যে একই গণের দুই বা ততোধিক প্রজাতি থেকে রূপান্তরের সঙ্গে উদ্ভবের মাধ্যমে দুই বা ততোধিক গণ সৃষ্টি হয়েছে। এবং দুটি বা ততোধিক পিতামাতা প্রজাতি আগেকার একটি গণের যে কোন একটি প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে হয়। আমাদের রেখাচিত্র বড় অক্ষরগুলির নিচে ভঙ্গিল রেখাদের দ্বারা এর ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এবং ঐ রেখাগুলি নিচের দিকের উপ-শাখার একটি বিন্দুতে মিলিত হয়; এই বিন্দুটি প্রজাতির প্রতীক, যা আমাদের কয়েকটি উপ-গণ। ও গণসমূহের কল্পিত জন্মদাতা।
নূতন প্রজাতি F14-এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর কিছু আলোচনা সময়োপযোগী, মনে হয় যেটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে খুব একটা ভিন্নমুখী হয় না, বরং হয় অপরিবর্তিত অথবা অতি অল্পমাত্রায় পরিবর্তিত হয়ে (F)-এর আকার বজায় রেখেছে। এ ক্ষেত্রে অন্য চৌদ্দটি নূতন প্রজাতির সঙ্গে এর সম্বন্ধ অদ্ভুত ও ঘোরালো প্রকৃতির হবে। পিতামাতা প্রজাতি (A) এবং (I)-এর মধ্যবর্তী একটি আকার থেকে, যা অজানা ও বিলুপ্ত হয়েছে। বলে মনে হয়, উদ্ভূত হবার পর এটি এই দুই প্রজাতি থেকে উদ্ভূত দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে বৈশিষ্ট্যে কিছুমাত্রায় মধ্যবর্তী হবে। কিন্তু যেহেতু এই দুটি গোষ্ঠী এদের পিতামাতার টাইপ থেকে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ভিন্নমুখী হয়ে থাকে, তাই নূতন প্রজাতিটি (F14) প্রত্যক্ষভাবে এদের মধ্যবর্তী হবে না, বরং দুই গোষ্ঠীর টাইপের মধ্যবর্তী হবে; এবং এই ঘটনাগুলি সম্পর্কে প্রত্যেক প্রকৃতিবিদ মনে মনে প্রশ্ন তুলতে সমর্থ হবেন।
এখানে কল্পনা করা হয় যে রেখাচিত্রের প্রত্যেক সমান্তরাল রেখা এক হাজার বংশ সূচিত করে, কিন্তু প্রত্যেকে দশ লক্ষ বা আরও বেশি বংশ সূচিত করতে পারে; এটি দেহাবশেষ সমেত পৃথিবীপৃষ্ঠের পর্যায়ক্রমিক স্তরগুলির একটিকেও সূচিত করতে পারে; যখন আমরা ভূতত্ত্বের অধ্যায়ে আসব তখন পুনরায় এ বিষয়ে উল্লেখ করব, এবং তখন। আমরা দেখব যে রেখাচিত্রটি বিলুপ্ত জীবদের বংশগত মিলের ওপর আলোকপাত করে, যদিও এরা এখন জীবিতদের সঙ্গে একই বর্গ, গোত্র বা গণগুলির সাধারণতঃ অন্তর্ভুক্ত হয়, তবুও এরা প্রায়শই কিছুমাত্রায় বর্তমানের গোষ্ঠীদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যবর্তী হয়; এবং আমরা বিষয়টি বুঝতে পারি, কারণ বিলুপ্ত প্রজাতিরা সূদূর অতীতের বিভিন্ন যুগে বেঁচেছিল, যখন উদ্ভবের শাখারেখাগুলি কম ভিন্নমুখী হয়েছিল।
এখনকার ব্যাখ্যামতো কেবল গণগুলি সৃষ্টি করতে রূপান্তর প্রক্রিয়ার সীমারেখা নির্ধারণ করার কোন যুক্তি আমি খুঁজে পাই না। রেখাচিত্রটিতে, আমরা যদি কল্পনা করি যে অপসারণশীল বিন্দুখচিত রেখাদের প্রত্যেক পর্যায়ক্রমিক গোষ্ঠী দ্বারা সূচিত পরিবর্তনের পরিমাণ বিরাট হয়, তাহলে a14 থেকে p14, b14 ও f14 এবং o14 থেকে m14 চিহ্নিত আকাররা তিনটি অতিশয় ভিন্ন গণ সৃষ্টি করবে। আমরা (A)-এর বংশধরদের থেকে ব্যাপকভাবে ভিন্ন (I) থেকে উদ্ভূত দুটি ভিন্ন গণ দেখে থাকব। গণেদের এই দুটি গোষ্ঠী রেখাচিত্রে সূচিত অপসারী রূপান্তরের পরিমাণ অনুযায়ী এভাবে দুটি ভিন্ন গোত্র বা বর্ণ গঠন করবে। এবং দুটি নূতন গোত্র বা বর্গ মূল গণের দুটি প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে, এবং এরা আরও প্রাচীন ও অজ্ঞাত কোন আকার থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে হয়।
আমরা দেখেছি যে প্রত্যেক দেশে বৃহত্তর গণগুলির অন্তর্গত প্রজাতিরাই প্রায়শ ভ্যারাইটি অথবা জায়মান প্রজাতিদের সৃষ্টি করে। বাস্তবিকপক্ষে এটিই অবশ্য করা যায়, কারণ অস্তিত্বের সংগ্রামে অন্য আকারদের ওপর কিছু পরিমাণ প্রাধান্য বিস্তারকারী একটি আকারের ওপর প্রাকৃতিক নির্বাচন যেহেতু ক্রিয়াশীল হয়, সেহেতু এটি সেইগুলির ওপরেই মূলতঃ ক্রিয়া করে যেগুলি ইতিমধ্যেই কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে এবং যে কোন গোষ্ঠীর বিরাটত্ব থেকে বোঝা যায় যে তার অন্তর্গত প্রজাতিগুলি একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে কিছু সাধারণ উন্নতির সুফল বংশগতভাবে পেয়েছে। অতএব নূতন ও রূপান্তরিত বংশধরদের উদ্ভব বা সৃষ্টির সংগ্রাম মূলতঃ বৃহত্তর গোষ্ঠীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, যারা সকলে সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে চেষ্টা করছে। একটি বিরাট গোষ্ঠী ধীরে ধীরে অন্য বিরাট গোষ্ঠীকে জয় করবে, তার সংখ্যা হ্রাস করবে এবং এভাবে তাদের আরও পরিবর্তন ও উন্নতির সম্ভাবনা হ্রাস করবে। একটি বিরাট গোষ্ঠীর মধ্যে, পরের ও আরও নিখুঁত উপ-গোষ্ঠীরা শাখায় বিভক্ত হয়ে, প্রকৃতিমণ্ডলের অনেক নূতন স্থান দখল করে, অনবরত পূর্বেকার ও কম উন্নত উপ-গোষ্ঠাদের স্থানচ্যুত করতে ও ধ্বংস করতে চেষ্টা করবে। ছোট ও ভঙ্গিল গোষ্ঠী এবং উপ-গোষ্ঠীরা অবশেষে বিলুপ্ত হবে। ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি যে যারা এখন বিরাট ও বিজয়ী এবং যারা সামান্যতমও ভেঙ্গে যায়নি, অর্থাৎ যাদের বিলুপ্তির সম্ভাবনা কম জীবজগতের এমন গোষ্ঠীরা দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে থাকবে। কিন্তু কোন্ কোন্ গোষ্ঠী অবশেষে প্রাধান্য বিস্তার করবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়, কারণ আমরা জানি যে পূর্বের অতি-উন্নত অনেক গোষ্ঠী এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরও দূরের ভবিষ্যতের দিকে তাকালে, আমরা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি যে বৃহত্তর। গোষ্ঠীদের নিরবচ্ছিন্ন ও নিয়মিত বৃদ্ধির জন্য অসংখ্য ক্ষুদ্রতর গোষ্ঠী সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হবে এবং কোন রূপান্তরিত বংশধর রেখে যাবে না; ফলস্বরূপ, যে কোন যুগে জীবিত প্রজাতিদের মধ্যে অল্প কয়েকটি অদূর ভবিষ্যতে বংশধর রেখে যাবে। শ্রেণী বিভাগ অধ্যায়ে এ বিষয়ে আমাকে ফিরে আসতে হবে, কিন্তু এখানে আমি আরও বলতে পারি যে এই মতানুসারে যেহেতু আরও আদিম প্রজাতিদের অতি অল্প কয়েকটি বর্তমান। কাল পর্যন্ত বংশগতভাবে বংশধর প্রেরণ করেছে এবং যেহেতু একই প্রজাতির সমস্ত বংশধররা একটা শ্রেণী সৃষ্টি করে, তাই আমরা বুঝতে পারি কেমন করে এটি হয় যে প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের প্রত্যেক প্রধান বিভাগে এত অল্প কয়েকটি শ্রেণী রয়েছে। আদিম প্রজাতিদের কয়েকটি যদিও রূপান্তরিত বংশধর রেখে গেছে, তথাপি ভূতাত্ত্বিক যুগের বহু অতীতে সমগ্র পৃথিবী বর্তমান সময়ের মত অসংখ্য গণ, গোত্র, বর্গ ও শ্ৰেণীদের . প্রজাতি দ্বারা প্রায় পরিপূর্ণ হয়ে থাকতে পারে।
জৈবসংগঠনের উন্নতির প্রবণতার মাত্রা
প্রত্যেক জীব সারা জীবন ধরে জৈব ও অজৈব পরিবেশের প্রভাবাধীন থাকার ফলে উপকারী পরিবৃত্তিগুলির সংরক্ষণ ও সঞ্চয়নের মাধ্যমে প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করে। সর্বশেষ ফলটি এই হয় যে প্রত্যেক জীব তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আরও বেশি বেশি করে উন্নত হওয়ার চেষ্টা করে। সারা পৃথিবী জুড়ে বিরাট সংখ্যক জীবের দেহগঠনের ক্রমশঃ উন্নতি ঘটাতে অনিবার্যরূপে প্রভাবিত করে। কিন্তু আমরা এখানে একটি অতি জটিল বিষয়ে প্রবেশ করেছি, কারণ দেহগঠন বা জৈব সংগঠনের অগ্রগতির অর্থ কী, সে বিষয়ে প্রকৃতিবিদরা পরস্পরের সন্তুষ্টির জন্য কোন সংজ্ঞা নির্ধারণ করেননি। মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে বোধশক্তির মাত্রা ও দেহগঠন মানুষের নিকটবর্তী হওয়াটা স্পষ্টতঃ একটি ভূমিকা পালন করে। ভাবা যেতে পারত যে ভূণাবস্থা থেকে পূর্ণাবস্থায় এদের ক্রমবিকাশের জন্য বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের পরির্তনের পরিমাণই তুলনামূলক বিচারের একটি পর্যাপ্ত মান হবে। কিন্তু কোন কোন পরজীবী খোলকী প্রাণীদের সম্পর্কে কয়েকটি ঘটনা রয়েছে, এদের দেহের কয়েকটি প্রত্যঙ্গ এত অসম্পূর্ণ যে পূর্ণবয়স্ক প্রাণীটিকে তার লার্ভার তুলনায় উচ্চ পর্যায়ের বলা যেতে পারে না। ভন বেয়ারের মানদণ্ডটিই সম্ভবতঃ সবচেয়ে ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য ও সর্বোৎকৃষ্ট, সেটি হচ্ছে পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় একই জীবের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রভেদের পরিমাণ এবং ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ার জন্য তাদের বিশিষ্টতা; অথবা মিলনে এডওয়ার্ড যেমন বলেন সেটি হচ্ছে শারীরবৃত্তীয় শ্রমবিভাগের সম্পূর্ণতা। কিন্তু আমরা দেখব এই বিষয়টি কতটা অস্পষ্ট। যেমন হয় মাছগুলিকে লক্ষ্য করলে। এদের মধ্যে কিছুকে কয়েকজন প্রকৃতিবিদ উচ্চস্তরের বলে অভিমত ব্যক্ত করেন, এরা আবার হাঙ্গরের মতো উভচরদের কাছাকাছি; অন্যদিকে অন্য প্রকৃতিবিদরা সাধারণ অস্থিময় অথবা টেলিয়োস্টিয়ান মাছেদের উচ্চ শ্রেণীভুক্ত করেছেন, কারণ এরা অতি সঠিকভাবে মাছের মতো ও অন্য মেরুদণ্ডী শ্রেণীদের থেকে অতিশয় ভিন্ন। উদ্ভিদদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এই বিষয়টির অস্পষ্টতা আরও বেশি। এদের বুদ্ধির মান নিশ্চয় সম্পূর্ণরূপে বর্জিত হয়েছে এবং কয়েকজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী সেই সব উদ্ভিদদের উচ্চ পর্যায়ভুক্ত করেছেন, যাদের প্রত্যেক ফুলের প্রত্যেক অঙ্গ, যেমন বৃত্যাংশ, পাপড়ি, পুংকেশর, স্ত্রীকেশর সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে; অন্যদিকে অন্য উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা, সম্ভবতঃ যাঁরা আরও সঠিক, সেই সব উদ্ভিদদের উচ্চ শ্রেণীভুক্ত করেছেন যাদের অঙ্গ অতিশয় রূপান্তরিত হয়েছে ও সংখ্যায় হ্রাস পেয়েছে।
প্রত্যেক পূর্ণবয়স্ক জীবের কয়েকটি অঙ্গের বিশিষ্টতা এবং পৃথকীকরণের পরিমাণকে উচ্চ সংগঠনের মানদণ্ড হিসাবে যদি আমরা ধরি (এবং এটি বুদ্ধিমত্তার জন্য মস্তিষ্কের অগ্রগমনকে অন্তর্ভুক্ত করে), তাহলে দেখবো এই মানদণ্ডের দিকে প্রাকৃতিক নির্বাচন স্পষ্টতই চালনা করে; কারণ সমস্ত শারীরতত্ত্ববিদ স্বীকার করেন যে এদের প্রক্রিয়াটিকে ভালভাবে সম্পন্ন করার জন্য অঙ্গগুলির বিশিষ্টতা প্রত্যেক জীবের পক্ষে লাভজনক; এবং সেহেতু বিশিষ্টতার দিকে পরিচালিত পরিবৃত্তিদের সঞ্চয়ন প্রাকৃতিক নির্বাচনের কর্মের পরিধির মধ্যে আসে। অন্যদিকে, সমস্ত জীব উচ্চহারে বৃদ্ধি ও প্রকৃতিমণ্ডলের অনধিকৃত বা কম অধিকৃত অঞ্চল অধিকারের জন্য চেষ্টা করছে–এই বিষয়টি মনে রাখলে এটাও সম্ভবপর মনে হয় যে প্রাকৃতিক নির্বাচন একটি জীবকে যে কোন অবস্থা মানিয়ে নেওয়ার জন্য উপযুক্ত করে তোলে, যাতে করে কয়েকটি অঙ্গ অনাবশ্যক বা অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। এসব ক্ষেত্রে সংগঠনের মাত্রায় প্রত্যাগতি ঘটবে। ভূতাত্ত্বিক যুগের বহু পূর্ব থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে সংগঠনের প্রকৃতই কোন অগ্রগমন হয়েছে কিনা তা আমাদের ভূতাত্ত্বিক পর্যায়ক্রম সংক্রান্ত অধ্যায়ে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে যে যদি সমস্ত জীব উপযুক্ত মানে উন্নত হতে চেষ্টা করে, তবে কেমন করে এটি হয় যে সমগ্র পৃথিবীতে সর্বনিম্ন আকাররা বিশাল সংখ্যায় এখনও বর্তমান আছে? এবং কেমন করে এটি হয় যে প্রত্যেক বিরাট শ্রেণীতে অন্যদের তুলনায় কম উন্নত আকাররা রয়েছে? অতি উন্নত আকাররা কেন সর্বত্র নিম্নবতী আকারদের স্থানচ্যুত ও ধ্বংস করে না? লামার্ক বিশ্বাস করতেন যে সম্পূর্ণ নিখুঁত হওয়ার দিকে সমস্ত জীবের একটি সহজাত ও অনিবার্য প্রবণতা রয়েছে এবং তিনি এই অসুবিধাটি রীতিমতো গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন বলেই বোধ হয় মনে করতে বা হয়েছিলেন যে নূতন ও সরল আকারগুলি স্বতঃপ্রজননের মাধ্যমে অনবরত সৃষ্টি হচ্ছে। ভবিষ্যতে যা-ই আবিষ্কার হোক না কেন, বিজ্ঞান এখনও পর্যন্ত এই বিশ্বাসের সত্যতা প্রমাণ করতে পারেনি। আমাদের তত্ত্ব অনুযায়ী নিম্নবর্তী জীবদের ধারাবাহিকভাবে টিকে থাকাটা কোন অসুবিধা সৃষ্টি করে না; কারণ প্রাকৃতিক নির্বাচন অথবা যোগ্যতমের উদ্বর্তন প্রগতিমূলক বিকাশকে আবশ্যক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে না।–এটি কেকল এর জটিল জীবন সম্পর্কে প্রত্যেক জীবের ভাবে এবং উপকারী এইসব পরিবৃত্তিদের সুযোগ গ্রহণ করে। প্রশ্ন করা যেতে পারে-অগ্রগতির পক্ষে কোন্ সুবিধাটি, যতদূর আমরা দেখতে পাই, ইনফুসোরিয়ান অ্যানিম্যাল-অন্ত্রে বসবাসকারী একটি কৃমি, অথবা একটি কেঁচোর ক্ষেত্রে উচ্চহারে সংগঠিত হবে? যদি এর অগ্রগমনের কোন সুবিধা না থাকত, তাহলে যে সব আকার প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা অনুন্নত তা কম উন্নত অবস্থায় পরিত্যক্ত হবে এবং বর্তমানের নিম্ন অবস্থায় মতো অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত রয়ে থাকবে; এবং ভূতত্ত্ব আমাদের বলে যে ইনফুসোরিয়া ও রাইজোপড়ের মতো সর্বনিম্ন আকারদের মধ্যে কয়েকটি সুদীর্ঘ কাল ধরে প্রায় বর্তমান অবস্থার মতোই রয়েছে। কিন্তু এখন জীবিত অসংখ্য নিম্নবর্তী আকারদের অধিকাংশই জীবনের প্রথম প্রভাত থেকে অন্ততঃ অগ্রগতি করেনি বলে মনে করা অত্যন্ত হঠকারী সিদ্ধান্ত হবে; কারণ সাংগঠনিকভাবে নিম্নবর্তী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি জীবের শবব্যবচ্ছেদ করেছেন এমন প্রত্যেক প্রকৃতিবিদ নিশ্চয় এদের প্রকৃত সুন্দর ও আশ্চর্যজনক সংগঠন দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়েছেন।
একই বিরাট গোষ্ঠীর মধ্যে সংগঠনের বিভিন্ন ক্রমগুলি যদি আমরা লক্ষ্য করি, সেখানেও একই অভিমত প্রযোজ্য হয়। যেমন, মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে স্তন্যপায়ী প্রাণী ও মাছের সহবস্থান, স্তন্যপায়ীদের মধ্যে মানুষ ও অর্নিথোরিনচাঁদের সহাবস্থান, মাছেদের মধ্যে হাঙ্গর ও ল্যান্সলেট (অ্যাফিয়কসাস)-দের সহবস্থান, শেষের মাছটি তার দেহগঠনের অতিশয় সরলতার জন্য অমেরুদণ্ডী শ্ৰেণীদের নিকটবর্তী হয়। কিন্তু স্তন্যপায়ী প্রাণী ও মাছেদের পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা কদাচিৎ ঘটে; স্তন্যপায়ীদের সমগ্র শ্রেণীর বা এই শ্রেণীর কোন কোন সদস্যের উচ্চতম ধাপে উন্নতি মাছেদের স্থান গ্রহণ করতে প্রভাবিত করবে না। শারীরতত্ত্ববিদরা মনে করেন মস্তিষ্ককে অতিশয় সক্রিয় করতে উষ্ণ রক্তের প্রয়োজন এবং তার জন্য বায়বীয় শ্বসন দরকার; সেই জন্য অসুবিধাজনক অবস্থায় জলে বাস করতে অভ্যস্ত উষ্ণরক্তবিশিষ্ট স্তন্যপায়ীদের অনবরত জলের ওপর স্তরে উঠে আসতে হয়। মাছেদের ক্ষেত্রে, হাঙ্গর গোত্রের সদস্যরা ল্যান্সলেটদের স্থানচ্যুত করতে উৎসাহিত হবে না; কারণ আমি ফ্রিজ মূলারের কাছ থেকে শুনেছি ল্যান্সলেটের একমাত্র সঙ্গী ও প্রতিযোগী হচ্ছে দক্ষিণ ব্রাজিলের উষ্ণ বালুময় সমুদ্রসৈকতের একটি ব্যতিক্রমী অ্যানেলিড। স্তন্যপায়ীদের তিনটি নিম্নতম বর্গ, যথা মাসুপিয়াল, এডেন্টটা এবং রোডেন্টরা দক্ষিণ আমেরিকার একই অঞ্চলে অসংখ্য বানরদের সঙ্গে সহাবস্থান করে এবং পরস্পরের সঙ্গে সম্ভবতঃ অল্প সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। যদিও সামগ্রিকভাবে সমগ্র পৃথিবীতে জৈবসংগঠনের উন্নতি ঘটে থাকতে পারে এবং এখনও ঘটছে, তথাপি মানদণ্ডটি সর্বদা অতিশয় নিখুঁত পর্যায়ে যেতে চেষ্টা করবে; কারণ কোন কোন সমগ্র শ্রেণীর বা প্রত্যেক শ্রেণীর কোন কোন সদস্যদের অতিশয় উন্নতি ঐ সব গোষ্ঠীদের কোনমতেই বিলুপ্তি ঘটায় না, যাদের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতায়– অংশগ্রহণ করে এরা। আমরা এর পর দেখব কয়েকটি ক্ষেত্রে নিম্ন আকাররা বর্তমান কাল পর্যন্ত সংরক্ষিত রয়েছে বলে মনে হয়, যারা সীমাবদ্ধ বা বিশেষ অঞ্চলে বসবাস। করে, যেখানে তারা কম তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়ে থাকে এবং যেখানে তাদের কম সদস্যসংখ্যা অনুকূল পরিবৃত্তিদের উদ্ভবের সম্ভাবনাকে রদ করে।
অবশেষে, আমি বিশ্বাস করি যে অনেক নিম্নস্তরের আকার সারা পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন কারণে বেঁচে আছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে, অনুকূল প্রকৃতির পরিবৃত্তিগুলি বা এককীয় পার্থক্যসমূহ প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার এবং সঞ্চয়নের জন্য কখনও উদ্ভূত হতে পারে na, সম্ভবতঃ কোন ক্ষেত্রেই সম্ভবপর সম্পূর্ণ বিকাশের জন্য সময় যথেষ্ট নয়। যাকে আমাদের বলা উচিত জৈব সংগঠনের অধঃপতন, অল্প কয়েকটি ক্ষেত্রেই তা ঘটেছে। বরং প্রধান কারণটি এই ঘটনায় নিহিত আছে যে অতি সরল জীবন-পরিবেশে উচ্চ জৈব সংগঠন কোন উপকারে আসবে না, যেহেতু তাদের প্রকৃতি অতি নমনীয় এবং যেহেতু ধ্বংস হওয়া ও আহত হওয়ার সম্ভাবনা তাদের বেশি থাকে, সম্ভবতঃ সেই হেতু এটি কাজে লাগবে না।
জীবনের প্রথম উন্মেষের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সমস্ত জীবের দেহগঠন তখন সরলতম আকারের ছিল। তা হলে প্রশ্ন করা যেতে পারে–অঙ্গগুলির উন্নতি ও পৃথকীকরণের প্রথম ধাপগুলি কিভাবে উদ্ভূত হয়েছিল? মিঃ হার্বার্ট স্পেন্সার সম্ভবতঃ উত্তর দেবেন–যে মুহূর্তে এককোষী জীব বৃদ্ধি বা বিভাজনের দ্বারা কোষসমষ্টিতে পরিণত হয়েছিল অথবা কোন অবলম্বনে আসঞ্জিত হয়ছিল, সেই মুহূর্তেই তার নিয়ম অর্থাৎ “প্রাসঙ্গিক শক্তিগুলি যেমন পৃথক হয়, তার সম্পর্কে ও অনুপাতে যে কোন বর্গের অনুরূপ এককগুলিও তেমনি পৃথক হয়”–এই সূত্রটি কাজ করতে আরম্ভ করবে। কিন্তু যেহেতু পথপ্রদর্শক কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই, সেহেতু এ বিষয়ে দূরকল্পনা সবসময়ই অর্থহীন। তবে এটি মনে করা ভুল যে যতক্ষণ পর্যন্ত না অনেক আকার সৃষ্টি হয়, অস্তিত্বের সংগ্রাম ও ফলস্বরূপ প্রাকৃতিক নির্বাচন ঘটবে না : একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী একমাত্র একটি প্রজাতির পরিবৃত্তিসমূহ উপকারী হতে পারত এবং এভাবে সব এককরা রূপান্তরিত হয়ে থাকত অথবা দুটি ভিন্ন আকারের উদ্ভব হতে পারত। কিন্তু যেমন আমি ভূমিকার শেষে বলেছিলাম যে আরও অতীতে ও বর্তমানে সারা পৃথিবীতে বসবাসকারী সমস্ত এককদের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে যদি আমরা আমাদের গভীর অজ্ঞতা স্বীকার করি, তাহলে প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে অনেক কিছুর ব্যাখ্যা না পাওয়ার জন্য কারুর আশ্চর্যান্বিত হওয়া উচিত নয়।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অভিসৃতি
মিঃ এইচ. সি. ওয়াটসন মনে করেন যে আমি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অপসৃতির প্রয়োজনীয়তাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি (যাতে তিনি আপাতত বিশ্বাস করেন) এবং বলা। যেতে পারে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অভিসৃতি এভাবে একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। ভিন্ন অথচ সম্পর্কিত দুটি গণের অন্তর্গত প্রজাতি উভয়েই যদি নতুন ও অপসারী বা ভিন্নমুখী অসংখ্য আকার সৃষ্টি করত, তাহলে এরা পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে এত কাছাকাছি সম্পর্কযুক্ত হত যে এদের সকলকে একই গণের মধ্যে শ্রেণীভুক্ত করা যেতে পারত; এবং এভাবে দুটি ভিন্ন গণের বংশধররা একটিতে মিলিত হবে। কিন্তু ব্যাপকভাবে ভিন্ন আকারদের রূপান্তরিত বংশধরদের দেহগঠনের একটি ঘনিষ্ট ও সাধারণ সাদৃশ্যকে অভিসৃতি হিসেবে চিহ্নিত করা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতিশয় হঠকারী। কাজ হবে। একটি কেলাসের আকার কেবলমাত্র আণবিক শক্তি দ্বারা নির্ধারিত হয়, এবং এটি বিস্ময়কর নয় যে অসদৃশ পদার্থরা কোন কোন সময় একই আকার ধারণ করবে। কিন্তু জীবজগতের ক্ষেত্রে আমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে প্রত্যেকের আকার অনির্দিষ্ট জটিল সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে, যথা উদ্ভূত পরিবৃত্তিসমূহ, এগুলি এত জটিল কারণের জন্য হয় যে একে অনুধাবন করা দুঃসাধ্য-সংরক্ষিত ও নির্বাচিত পরিবৃত্তিদের প্রকৃতি, যা পারিপার্শ্বিক ভৌতিক অবস্থাসমূহের ওপর নির্ভর করে এবং আরও উচ্চ মাত্রায় পারিপার্শ্বিক জীবগুলির উপর, যাদের সঙ্গে এদের প্রতিযোগিতা করতে হয়, এবং অবশেষে অসংখ্য জন্মদাতা পূর্বপুরুষদের থেকে প্রাপ্ত বংশানুসৃতির (যা প্রকৃতিগতভাবে একটি অস্থির উপাদান) ওপর এদের সকলের আকার সমভাবে জটিল সম্পর্কের দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। এটি অবিশ্বাস্য যে প্রথমে স্পষ্টভাবে পৃথক দুটি জীবের বংশধররা। পরবর্তী সময়ে কখনও এমন ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হবে যে সমগ্র জৈবসংগঠন প্রায় একইরূপ হবে। এটি ঘটলে ব্যাপকভাবে ভিন্ন ভূতাত্ত্বিক গঠন-স্তরগুলিতে জৈবিক সম্পর্ক নিরপেক্ষভাবে একই আকারের সাক্ষাৎ পাওয়া যেত, কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণাদি যা পাওয়া যায় তা এই মতের বিরোধিতা করে।
মিঃ ওয়াটসন আরও আপত্তি করেছেন যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অপসৃতির সঙ্গে প্রাকৃতিক নির্বাচনের অনবরত বিক্রিয়া অনির্দিষ্ট সংখ্যক বিশেষ আকার সৃষ্টি করতে চেষ্টা করবে। যতদূর সম্ভব অজৈব পরিবেশগুলির কথা বিবেচনা করলে মনে হতে পারে যে যথেষ্ট সংখ্যক প্রজাতি তাপ, আদ্রর্তা ইত্যাদির নানাবিধ বৈচিত্র্যে শীঘ্র অতিযোজিত হবে; কিন্তু আমি সম্পূর্ণভবে স্বীকার করি যে সমস্ত জীবের পারস্পরিক সম্পর্ক আরও গুরুত্বপূর্ণ; এবং যে কোন দেশে প্রজাতিদের সংখ্যা জীবের পারস্পরিক সম্পর্ক আরও গুরুত্বপূর্ণ; এবং যে কোন দেশে প্রজাতিদের সংখ্যা অনবরত বৃদ্ধি পেতে থাকে বলে জীবনের জৈব পরিবেশ আরও বেশি বেশি করে জটিল হবে। ফলস্বরূপ প্রথম দর্শনে মনে হয় যে দেহগঠনের সুবিধাজনক বৈচিত্র্যগুলির কোন সীমা নেই, অতএব উদ্ভূত প্রজাতিদের সংখ্যারও কোন সীমা থাকবে না। এমনকি অতিশয় উর্বর অঞ্চল বিশেষ আকারদের দ্বারা পরিপূর্ণ কিনা তা-ও আমরা জানি না : বিস্ময়কর সংখ্যক প্রজাতিতে পরিপূর্ণ উত্তমাশা অন্তরীপ ও অস্ট্রেলিয়াতে অনেক ইউরোপীয় উদ্ভিদ ভিন্ন পরিবেশে মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ভূতত্ত্ব আমাদের দেখায় যে টার্শিয়ারী পর্বের গোড়ার দিকে খোলকী প্রাণীর প্রজাতিদের সংখ্যা এবং ঐ যুগের মধ্যবর্তী সময়ে স্তন্যপায়ীদের সংখ্যা বিরাটভাবে বাড়েনি বা আদৌ বৃদ্ধি পায়নি। প্রজাতিদের সংখ্যার অনির্দিষ্ট সংখ্যার নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারটা তাহলে কী? বিশেষভাবে বহুলাংশে ভৌত পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল একটি অঞ্চলের জীবনের মোট পরিমাণ বা সমষ্টির একটা সীমা নিশ্চয়। থাকবে; অতএব, একটি অঞ্চলে অধিক সংখ্যক প্রজাতি বাস করলে, প্রত্যেক বা প্রায়। প্রত্যেক প্রজাতির অল্প সংখ্যক একক থাকবে; এবং হঠাৎ মরশুমের প্রকৃতি পরিবর্তন ও শত্রুদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য এভাবে প্রজাতিদের ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। এ সব ক্ষেত্রে ধ্বংসের প্রক্রিয়াটি দ্রুতহারে ঘটবে, অথচ নূতন প্রজাতির উদ্ভব ঘটবে মন্থর গতিতে। একটি চরম অবস্থার কথা কল্পনা করুন। ইংল্যান্ডে যত প্রজাতি আছে তত। এককও রয়েছে, এবং প্রথম প্রচণ্ড শীত বা অতি শুষ্ক গ্রীষ্মকাল হাজার হাজার প্রজাতিকে ধ্বংস করবে; বিরল প্রজাতিরা এবং যে কোন দেশে প্রজাতিদের সংখ্যা অনির্দিষ্টভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার দরুন বিরল হওয়া প্রত্যেক প্রজাতি প্রায়শই ইতিমধ্যে ব্যাখ্যাত পদ্ধতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অল্প অনুকূল পরিবৃত্তির উদ্ভব ঘটাবে; ফলে নূতন বিশিষ্ট আকারের জন্মদান প্রক্রিয়ার গতি এভাবে হ্রাস পাবে। কোন প্রজাতি বিরল হয়ে এলে, নিকট আত্মীয়দের আন্তঃপ্রজনন তার ধ্বংসসাধনে সাহায্য করবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে লিথুয়ানিয়াতে আউরকদের, স্কটল্যান্ডে লাল হরিণদের, নরওয়েতে ভল্লুকদের সংখ্যা কমে যাওয়ার ব্যাপারে এটি একটি ভূমিকা পালন করেছে। অবশেষে আমি মনে করতে বাধ্য হচ্ছি যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হচ্ছে তার নিজের দেশে বহু প্রতিযোগীকে ইতিমধ্যেই পরাজিত করেছে এমন প্রাধান্য বিস্তারকারী প্রজাতি, সে বিস্তার লাভ করার জন্য এবং অনেককে স্থানচ্যুত করার জন্য সচেষ্ট হবে। আলফোনসে ডি ক্যান্ডেলে দেখিয়েছেন যে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত প্রজাতিরা সাধারণতঃ আরও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হতে সচেষ্ট হয়; ফলে এরা কয়েকটি অঞ্চলের কয়েকটি প্রজাতিকে স্থানচ্যুত ও ধ্বংস করতে চেষ্টা করবে, এবং এভাবে সারা পৃথিবীতে বিশেষ আকারদের অবাধ বৃদ্ধি প্রতিরোধ করবে। ডঃ হুঁকার সম্প্রতি দেখিয়েছেন যে অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে স্পষ্টতঃ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য অনুপ্রবেশকারী প্রবেশ করেছে, যার ফলে অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় প্রজাতিদের সংখ্যা দারুণভাবে হ্রাস পেয়েছে। এইসব বিচার বিবেচনাতে কতখানি গুরুত্ব দেওয়া উচিত, দুঃসাহসী হয়ে সে ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারি না; কিন্তু এগুলি একত্রে প্রত্যেক দেশে বিশেষ আকারদের অনির্দিষ্ট বৃদ্ধির প্রবণতাকে নিশ্চয় রোধ করবে।
সারাংশ
জীবনের পরিবর্তনশীল পরিবেশে জীবেরা তাদের প্রায় প্রতি অঙ্গে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য উপস্থিত করে, এ বিষয়টি খণ্ডন করা যেতে পারে না; বৃদ্ধির গুণোত্তরীয় হারের দরুন যদি কোন বয়সে, ঋতুতে বা বছরে কঠোর জীবন-সংগ্রাম হয়, তাহলে সে বিষয়েও কোন বিতর্ক করা যেতে পারে না; জীবদের দেহকাঠামো, জৈবসংগঠন ও স্বভাবসমূহের পক্ষে লাভজনক বা উপকারী অসংখ্য বৈচিত্র্য ঘটানোর জন্য দায়ী সমস্ত জীবের পরস্পরের সঙ্গে ও নিজেদের জীবন-পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কসমূহের সীমাহীন জটিলতা বিবেচনা করলে, মানুষের পক্ষে উপকারী পরিবর্তন ঘটার মতো প্রত্যেকের কল্যাণের জন্য উপকারী পরিবৃত্তিগুলি যদি না ঘটে, তবে সেটি একটি অস্বাভাবিক ঘটনা হবে। কিন্তু যে কোন জীবের পক্ষে উপকারী পরিবৃত্তিগুলি যদি কখনও ঘটে, তাহলে এভাবে অর্জিত বৈশিষ্ট্য সমেত এককদের জীবন-সংগ্রামে বেঁচে থাকার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে এবং বংশগতির কঠোর নিয়মের জন্য এরা এভাবে অর্জিত বৈশিষ্ট্য সমেত বংশধর উৎপাদন করতে সচেষ্ট হবে। সংরক্ষণের এই পদ্ধতিটিকে বা যোগ্যতমের উদ্বর্তনকে আমি প্রাকৃতিক নির্বাচন বলেছি। জৈব ও অজৈব জীবন-পরিবেশ সম্পর্কে এটি প্রত্যেক জীবের উন্নতি ঘটায় এবং ফলস্বরূপ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি সংগঠনের অগ্রগতি হিসাবে নিশ্চয় বিবেচিত হবে। তা সত্ত্বেও, সরলতম জীবন-পরিবেশ মানানসই হলে, নিম্ন ও সরল আকাররা দীর্ঘস্থায়ী হবে।
অনুরূপ বয়সে চারিত্রিক গুণগুলি আনুবংশিক হওয়ার নীতি বা পদ্ধতি অনুসারে, প্রাকৃতিক নির্বাচন বয়স্কদের মতো সহজেই ডিম, বীজ অথবা তরুণদের রূপান্তরিত করতে পারে। অসংখ্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে, সবচেয়ে প্রাণচঞ্চল ও অভিযোজিত পুরুষদের অধিক সংখ্যক বংশধর উৎপাদন সুনিশ্চিত করে যৌন নির্বাচন প্রাকৃতিক নির্বাচনকে সাহায্য করতে থাকবে। অন্য পুরুষদের সঙ্গে বিরোধ ও সংগ্রামে যৌন নির্বাচন কেবল পুরুষদেরই উপকারী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রদান করবে; এবং প্রচলিত বংশগতির প্রকৃতি অনুযায়ী এ সব বৈশিষ্ট্য একই লিঙ্গে বা উভয় লিঙ্গে বংশগতভাবে প্রেরিত হবে।
বিভিন্ন ধরনের জীবন-পরিবেশে ও অবস্থানস্থলে বিভিন্ন জীবনাকারদের অভিযোজিত করতে প্রাকৃতিক নির্বাচন সত্যসত্যই কাজ করছে কিনা, পরবর্তী অধ্যায়ে প্রদত্ত সাধারণ স্বাভাবিক অর্থে ও সাক্ষ্যপ্রমাণাদি দ্বারা তা বিচার-বিবেচনা করা হবে। কিন্তু আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করেছি কেমন করে এটি অবলুপ্তির কারণ হয়; এবং পৃথিবীর ইতিহাসে কেমন করে জীবকূলের অবলুপ্তি ঘটেছে ভূতত্ত্ব সাধারণভাবে তা আমাদের দেখিয়েছে; প্রাকৃতিক নির্বাচন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অপসারণ ঘটাতে প্রণোদিত করে, কারণ জীবকূল অবয়বে, স্বভাবে ও জৈব সংগঠনে যত বেশি অপসরণশীল হয়, তত বেশি সংখ্যক অঞ্চলে অবস্থান করতে পারে–যে কোন ছোট অঞ্চলের অধিবাসীদের ও বিদেশভূমিতে অভিযোজিত উৎপাদনসমূহ লক্ষ্য করার মাধ্যমে আমরা যার প্রমাণ দেখি। অতএব যে কোন একটি প্রজাতির বংশধরদের রূপান্তরের ও সমস্ত প্রজাতির সংখ্যায় বৃদ্ধির জন্য অবিরাম সংগ্রামের সময়কালে বংশধররা যত বেশি অপসরণশীল হবে, জীবনসংগ্রামে। তাদের সাফল্যের সম্ভাবনাও তত বেশি হবে। এভাবে একই প্রজাতির ভ্যারাইটিদের পৃথক করতে পার্থক্য বা প্রভেদসমূহ তত সময় পর্যন্ত নিয়ত বৃদ্ধি পেতে থাকে, যত সময় পর্যন্ত না এরা একই গণের বা এমনকি ভিন্ন গণগুলির প্রজাতিদের মধ্যেকার বড় বড় পার্থক্যগুলির সমান হয়।
প্রত্যেক শ্রেণীর বৃহত্তর গণগুলির ব্যাপকভাবে পরিব্যাপ্ত ও বিস্তৃত প্রজাতিরা যে সবচেয়ে পরিবর্তিত হয়, এই সাধারণ ঘটনাটি আমরা লক্ষ্য করেছি; এবং এই বিপুলতাকে এদের রূপান্তরিত বংশধরে বংশগতভাবে প্রেরণ করতে এরা সচেষ্ট হয় যা এখন নিজ নিজ দেশে প্রাধান্য বিস্তার করতে সাহায্য করে এদের। আগেই বলা হয়েছে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন বৈশিষ্ট্যের অপসৃতি ঘটায় এবং জীবের কম উন্নত ও মধ্যবর্তী আকারগুলির বিলুপ্তি ঘটায়। এই নীতি অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে প্রত্যেক শ্রেণীর অসংখ্য জীবের মধ্যে আত্মীয়তার প্রকৃতি ও সাধারণত সুনির্দিষ্ট পার্থক্যগুলি ব্যাখ্যা করা যেতে পরে। এটি প্রকৃতই একটি বিস্ময়কর বিষয়–যা সাধারণত আমাদের নজর এড়িয়ে যায়–সমস্ত দেশে ও সমস্ত কালে যাবতীয় প্রাণী ও উদ্ভিদরা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভিত্তিতে এবং এই গোষ্ঠীগুলির অধীনে পরস্পরের সঙ্গে তাদের কতটা পরিমাণে সম্পর্কিত হওয়া উচিত তা আমরা সর্বত্র লক্ষ্য করি–যেমন, একই প্রজাতির ভ্যারাইটিরা সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত, একই গণের প্রজাতিরা কম ঘনিষ্ঠভাবে ও অসমানভাবে সম্পর্কিত। যারা গোষ্ঠী ও উপগণ সৃষ্টি করে, ন্নি ভিন্ন গণের প্রজাতিরা কম ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত, এবং বিভিন্ন মাত্রায় সম্পর্কিত গণগুলি উপ-গোত্র, গোত্র, বর্গ উপশ্রেণী ও শ্ৰেণীদের সৃষ্টি করে। যে কোন শ্রেণীর কতিপয় অধীনস্থ গোষ্ঠীকে পরের পর কেবলমাত্র একটি সারিতে সাজানো যেতে পারে না, বরং মনে হয় এরা বিন্দুদের চারিদিকে গুচ্ছবদ্ধ, এগুলি আবার অন্য বিন্দুদের চারিদিকে গুচ্ছবদ্ধ হয় এবং এভাবে সীমাহীন চক্রে এটি চলতে থাকে। প্রজাতিরা যদি স্বাধীনভাবে সৃষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে এই প্রকার শ্রেণীবিভাগের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভবপর হবে না; কিন্তু বৈশিষ্ট্যের অপসৃতি ও বিলুপ্তির জন্য আবশ্যক বংশানুসৃতি ও প্রাকৃতিক নির্বাচনের জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এর ব্যাখ্যা করা যায়, যেমনটা রেখাচিত্রে দেখানো হয়েছে।
একই শ্রেণীর সমস্ত জীবের গঠনগত বা আকৃতিগত সৌসাদৃশ্যকে একটি বিরাট বৃক্ষের দ্বারা কোন কোন সময় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই উপমা অনেকাংশে প্রকৃত সত্যকে উদ্ঘাটন করে বলে আমি বিশ্বাস করি। সবুজ ও কুঁড়ি সমেত পল্লবরা এখানকার প্রজাতিদের সূচিত করতে পারে এবং পূর্ববর্তী বছরগুলিতে সৃষ্ট বা বিলুপ্ত প্রজাতিদের দীর্ঘ পরস্পরা সূচিত করতে পারে। বৃদ্ধির প্রত্যেক পর্যায়ে সমস্ত বর্ধনশীল পল্লবরা সমস্ত দিকে শাখাবিস্তার করতে এবং পাশের পল্লবদের ছাড়িয়ে যেতে ও বিনষ্ট করতে যে উপায়ে চেষ্টা করেছে, সেই একই উপায়ে প্রজাতি ও প্রজাতি গোষ্ঠীরা বিরাট জীবনসংগ্রামে সব সময় অন্য প্রজাতিদের উপর প্রাধান্যবিস্তার করেছে। বিরাট শাখায় বিভক্ত শাখাঙ্গরা এবং এদের আরও ছোট ছোট শাখাগুলি বৃক্ষটির তরুণাবস্থায় নিজেরাই তখন কুঁড়িসমেত পল্লব ছিল এবং শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হওয়ার মাধ্যমে পূর্বের ও বর্তমানের কুঁড়িদের এই সংযোগ বা সংযুক্তি সমস্ত বিলুপ্ত ও জীবন্ত প্রজাতির গোষ্ঠীদের অধীনে গোষ্ঠীগুলিতে শ্রেণীবিভাগ সূচিত করতে পারে। গুল্মবস্থায় বৃক্ষটির বহু শাখার মধ্যে এখন বিরাট শাখায় পরিণত কেবল দুটি বা তিনটি শাখা এখনও বাঁচে ও অন্য শাখা উৎপাদন করে। এভাবে প্রজাতিদের ক্ষেত্রে ভূতাত্ত্বিক যুগের অনেক কাল পর্যন্ত বেঁচে ছিল এমন অল্প কয়েকটি প্রজাতি জীবন্ত ও রূপান্তরিত বংশধর রেখে গেছে। বৃক্ষটির প্রথম বৃদ্ধির সময় থেকে অনেক শাখাঙ্গ ও শাখা বিনষ্ট হয়েছে ও খসে পড়েছে: এবং বিভিন্ন আকারের এইসব পতিত শাখারা সেই সব বর্ণ, গোত্র ও গণকে সূচিত করতে পারে যারা কোন জীবন্ত প্রতিনিধি রেখে যায়নি এবং যেগুলি কেবল জীবাশ্ম হিসেবে আমাদের নিকট পরিচিত। যেমন আমরা এখানে-সেখানে দেখি যে একটি বৃক্ষের একটি সন্ধিস্থল থেকে বের হয়ে একটি সরু ও ছড়িয়ে-পড়া শাখা ঝুলে থাকে এবং কোন না কোন ভাবে আনুকূল্যপ্রাপ্ত হয় ও তখনও এর শীর্ষে বেঁচে থাকে, সেভাবে অর্নিথোরিনচাস বা লেপিডোসাইরেনের মতো একটি প্রাণীকে মাঝেমাঝে লক্ষ্য করি, যারা আকৃতিগত বা গঠনগত সৌসাদৃশ্যের দ্বারা জীবনের দুটি বিরাট শাখাকে অল্পমাত্রায় সংযুক্ত করে এবং যারা একটি সংরক্ষিত অঞ্চলে বসবাস করে সর্বনাশা প্রতিযোগিতার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। যেমন কুঁড়ির বৃদ্ধির দ্বারা নূতন নূতন কুঁড়ির উদ্ভব হয় এবং সবল হলে সেগুলি চারিদিকে শাখা-বিস্তার করে ও দুর্বল শাখাকে সমস্ত দিক দিয়ে ঢেকে দেয়, আমি বিশ্বাস করি সেইভাবেই এরা বংশপরম্পরায় জীবনের একটি বিরাট বৃক্ষে পরিণত হয়, যা এর মৃত ও ভাঙা শাখাদের দ্বারা পৃথিবীর ভূত্বককে পূর্ণ করে এবং পৃথিবীর উপরিতলকে অনবরত শাখায় বিভক্ত হওয়া সুন্দর শাখাপ্রশাখা দ্বারা পরিপূর্ণ করে তোলে।
০৫. পরিবৃত্তির নিয়মসমূহ
পঞ্চম অধ্যায় – পরিবৃত্তির নিয়মসমূহ
পরিবর্তিত অবস্থাসমূহের পরিণাম-প্রাকৃতিক নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত ব্যবহার ও অব্যবহার-উড্ডয়ন ও দর্শনের অঙ্গসমূহ–পরিবেশানুগকরণ–সহসম্পর্কিত পরিবৃত্তি–ক্রমবৃদ্ধির ক্ষতিপূরণ ও সঞ্চয়ন–কৃত্রিম সহসম্পর্কসমূহ–বহুবিধ, অবর্ধিত বা লুপ্তপ্রায় ও নিম্নস্তরে সংগঠিত দেহগঠনসমূহের পরিবর্তনশীলতা—অসাধারণভাবে বিকশিত অঙ্গগুলি সবচেয়ে বেশি পরিবর্তনশীল–গণীয় বৈশিষ্ট্যের তুলনায় প্রজাতিক বৈশিষ্ট্য আরও বেশি পরিবর্তনশীল–গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যগুলি পরিবর্তনশীল–একই গণের প্রজাতিরা অনুরূপভাবে পরিবর্তিত হয়–বহু পূর্বে বিলুপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলির পূর্বানুবৃত্তি–সারাংশ।
.
আমি অনেক সময় বলেছি যে গৃহপালনাধীনে জীবদের ক্ষেত্রে একান্তই সাধারণ ও বহুবিধ এবং প্রকৃতিতে মুক্ত অবস্থায় একটু কম মাত্রায় পরিবৃত্তিসমূহ যেন আকস্মিকভাবে ঘটেছিল। এটি অবশ্যই একটি পুরোপুরি ভ্রান্ত অভিব্যক্তি, কিন্তু এটি প্রত্যেক বিশেষ পরিবৃত্তির কারণ সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতাকে স্বীকার করতে সাহায্য করে। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে পিতামাতার মতো শিশুকে তৈরি করতে এককীয় পার্থক্য বা দেহগঠনের অল্প বিচ্যুতি সৃষ্টি করতে এটি জননতন্ত্রের একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু প্রাকৃতিক অবস্থার তুলনায় গৃহপালনাধীন অবস্থায় আরও পুনঃ পুনঃ সংঘটিত পরিবৃত্তি ও অঙ্গবিকৃতির ঘটনাটি এবং সীমিত বিস্তৃত প্রজাতিগুলির তুলনায় ব্যাপকভাবে বিস্তৃত প্রজাতিরা বেশি পরিবর্তনশীল–এই তথ্য থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে পরিবর্তনশীলতা বা বিভিন্নতা সাধারণত জীবন-পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত, যাতে প্রত্যেক প্রজাতি কয়েক বংশপরম্পরাব্যাপী প্রভাবিত হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে আমি দেখাতে চেষ্টা করেছিলাম পরিবর্তিত অবস্থাসমূহ দু-ভাবে কাজ করে–প্রত্যক্ষভাবে সমগ্র সংগঠনে বা কেবলমাত্র কতিপয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপর এবং অপ্রত্যক্ষভাবে জননতন্ত্রের মাধ্যমে। সমস্ত ক্ষেত্রে দুটি উপাদান রয়েছে–জীবের প্রকৃতি, যেটি দুটির মধ্যে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এবং পরিবেশের প্রকৃতি। পরিবর্তিত পরিবেশসমূহের প্রত্যক্ষ ক্রিয়াটি নির্দিষ্ট ও অনির্দিষ্ট ফলাফল উৎপাদনের পথপ্রদর্শন করে। পরের ক্ষেত্রটিতে জৈবসংগঠন নমমীয় হয় বলে মনে হয় এবং এখানে অতিশয় হ্রাসবৃদ্ধিমূলক পরিবর্তনশীলতা বা বিভিন্নতা রয়েছে। পূর্বের ক্ষেত্রটিতে জীবের প্রকৃতি এমন হয় যে একে কোন বিশেষ পরিবেশে রাখা হলে এটি সহজেই প্রভাবিত হয় এবং সমস্ত বা প্রায় সমস্ত এককরা একইভাবে রূপান্তরিত হয়।
জলবায়ু, খাদ্য ইত্যাদির মতো পরিবর্তিত অবস্থাসমূহ একটি সুনির্দিষ্ট প্রণালীতে কতখানি কাজ করেছে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা খুবই কষ্টকর। বিশ্বাস করার যুক্তি আছে যে স্পষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা প্রমাণ করার তুলনায় কালক্রমে ফলাফল বা। পরিমাণসমূহ বিরাটতর হয়েছে। কিন্তু আমরা নিশ্চিন্তে সিদ্ধান্ত করতে পারি যে সমগ্র প্রকৃতি জীবদের মধ্যে আমাদের দেখা দেহগঠনের অসংখ্য জটিল সহ-অভিযোজনের জন্য এই প্রক্রিয়াটিকেই দায়ী মনে করা যেতে পারে না। নিম্নে বর্ণিত ঘটনাসমূহে পরিবেশ বা অবস্থা সম্ভবত অল্প কিছু সুনির্দিষ্ট ফলাফল সৃষ্টি করেছে : ই, ফরবেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন যে আরও উত্তরে বা আরও গভীর জলে বসবাসকারী একই প্রজাতির খোলকী প্রাণীদের তুলনায় উত্তর সীমান্তে এবং অগভীর জলে বসবাসকারী খোলকী প্রাণীদের দেহের রং উজ্জ্বলতর হয়; কিন্তু এটি নিশ্চয়ই সব সময় ঘটে না। মিঃ গোল্ড মনে করেন সমুদ্রতীরে অথবা দ্বীপসমূহে বসবাসকারী পাখিদের তুলনায় পরিষ্কার আবহাওয়ায়। বসবাসকারী একই প্রজাতির পাখিরা আরও বেশি উজ্জ্বল রঙের হয়, এবং ওলাস্টন স্থিরনিশ্চিত যে সমুদ্রের নিকটে বাসস্থান পতঙ্গদের রংকে প্রভাবিত করে। মকুইন-ট্যান্ডন উদ্ভিদের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছেন, যেখানে তিনি দেখিয়েছেন যে সমুদ্রতীরে জন্মানো উদ্ভিদের পাতাগুলি কিছু মাত্রায় শাঁসালো, কিন্তু অন্যত্র শাঁসালো নয়। এইসব অল্পভাবে পরিবর্তনশীল জীবরা ততদূর পর্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক, যতদূর অনুরূপ পরিবেশে আবদ্ধ প্রজাতির বৈশিষ্ট্যদের অন্যরূপ বৈশিষ্ট্য উপস্থিত করে।
একটি পরিবৃত্তি যখন কোন জীবের পক্ষে অল্পতমভাবে উপযোগী হয়, তখন এটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের সঞ্চয়ীকৃত প্রক্রিয়ার জন্য কতখানি এবং জীবন-পরিবেশের প্রত্যক্ষ প্রক্রিয়ার জন্য কতখানি দায়ী তা আমরা বলতে পারি না। পশম উৎপাদনকারীদের ভালভাবেই জানা আছে যে আরও উত্তরে বসবাসকারী একই প্রজাতির প্রাণীদের ঘন ও উৎকৃষ্ট পশম হয়। কিন্তু এই পার্থক্যের জন্য শুষ্কতম অঞ্চলের অধিবাসীদের বহু বংশপরম্পরা ধরে সংরক্ষিত ও আনুকূল্যপ্রাপ্ত হওয়া কতখানি দায়ী এবং খুব খারাপ আবহাওয়া কতখানি দায়ী, তা কে বলতে পারে? কারণ আমাদের গৃহপালিত চতুষ্পদ প্রাণীদের লোমের ওপর জলবায়ুর একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে বলেই মনে হয়।
জীবনের বহিঃস্থ পরিবেশে একই প্রজাতি থেকে উদ্ভূত একই রূপের ভ্যারাইটিদের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যেখানে ভিন্নতার বিষয়টি ভালভাবে অনুধাবন করা যায়। পক্ষান্তরে, আপাতঃ একই বহিঃস্থ পরিবেশে সৃষ্ট বিসদৃশ ভ্যারাইটিদের উদাহরণও দেওয়া যেতে পারে। আবার প্রত্যেক প্রকৃতিবিদের জানা অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যেখানে প্রজাতিরা সবচেয়ে বিপরীত ভিন্ন জলবায়ুতে বসবাস করলেও সঠিক থাকে বা মোটেই পরিবর্তিত হয় না। এইসব বিচার-বিশ্লেষণের পর পরিবর্তিত হওয়ার প্রবণতার তুলনায় পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রত্যক্ষ ক্রিয়ার ওপর কম গুরুত্ব আরোপ করতে প্রভাবিত হয়েছি আমি, কারণ এইসব কারণগুলি আমাদের অজানা।
পরোক্ষ অর্থে বলা যেতে পারে যে জীবন-পরিবেশগুলি হয় প্রত্যক্ষভাবে অথবা অপ্রত্যক্ষভাবে কেবলমাত্র বিভিন্নতাই ঘটায় না, বরং এভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনকেও অন্তর্ভুক্ত করে, কারণ জীবন-পরিবেশই এই বা ঐ প্রজাতিটি বাঁচবে কিনা তা নির্ধারণ করে। কিন্তু মানুষ নিজে যখন নির্বাচনী এজেন্ট, তখন আমরা স্পষ্টত দেখি যে পরিবর্তনের দুটি উপাদানই ভিন্ন; পরিবর্তনশীলতা বা বিভিন্নতা কোনো পরিস্থিতিতে সক্রিয় হয়, কিন্তু, এটাই মানুষের ইচ্ছা বা পরিবৃত্তিসমূহকে বিশেষ দিকে পুঞ্জীভূত করে, এবং এটাই হচ্ছে পরের মাধ্যম যা প্রকৃতিতে যোগ্যতমের উদ্বর্তনের প্রশ্নটির উত্তর প্রদান করে।
প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অঙ্গসমূহের বর্ধিত ব্যবহার ও অব্যবহারের পরিণামসমূহ
প্রথম অধ্যায়ে উল্লিখিত তথ্যসমূহ থেকে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না যে। আমাদের গৃহপালিত প্রাণীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার কোন কোন অঙ্গকে শক্তিশালী ও বৃদ্ধি করেছে এবং অব্যবহার এদের হ্রাস করেছে এবং এইসব রূপান্তরসমূহ আনুবংশিক বা বংশগত হয়েছে। মুক্ত প্রকৃতিতে তুলনা করার জন্য আমাদের কোন মানদণ্ড নেই, যার দ্বারা অবিরাম ব্যবহার ও অব্যবহারের ফলাফলসমূহ বিচার-বিশ্লেষণ করা যায়, কারণ পিতামাতা আকারদের সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না; কিন্তু অনেক প্রাণী এমন সব দেহগঠনের অধিকারী যেগুলিকে অব্যবহারের ফলাফল হিসেবে ভালভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। যেমন অধ্যাপক ওয়েন মন্তব্য করেছেন যে-কোন একটি পাখি উড়তে পারে না, এর থেকে বড় অংসগতি প্রকৃতিতে নেই; তথাপি কতিপয় পাখি এই অবস্থায় রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার মোটা মাথাওয়ালা পাতিহাঁসরা জলের উপরতলে কেবল ডানা ঝাঁপটাতে পারে, এবং গৃহপালিত আইলেসবুরি পাতিহাঁসের মতো এদের ডানাগুলি প্রায় একই অবস্থায় রয়েছে। এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা যে মিঃ কানিংহামের মতানুসারে তরুণ পাখিরা উড়তে পারে, কিন্তু বয়স্করা এই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। যেহেতু মাটিতে খাদ্যভক্ষণকারী বৃহৎ পাখিরা বিপদ থেকে আত্মরক্ষার সময় ছাড়া কদাচিৎ ওড়ে, সেহেতু এটি সম্ভবপর যে কতিপয় সামুদ্রিক দ্বীপে এখন বাস করে বা পূর্বে বাস করত এবং যেখানে শিকারী পাখিরা দখল নেয়নি এমন কতিপয় পাখির ডানাহীন অবস্থা অব্যবহারের ফলেই ঘটেছে। বাস্তবিকই উটপাখিরা মহাদেশসমূহে বসবাস করে এবং বিপদ থেকে আত্মরক্ষার জন্য উড়ে পালাতে পারে না, বরং অনেক চতুষ্পদ প্রাণীদের মতো দক্ষতার সঙ্গে শত্রুদের পদাঘাতের দ্বারা আত্মরক্ষা করতে পারে। আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে, উটপাখি গণের পূর্বপুরুষদের স্বভাব বাস্টার্ড গণের পূর্বপুরুষদের মতো ছিল এবং বংশপরম্পরায় এদের শরীরের আয়তন ও ভর বৃদ্ধি পেয়েছিল বলে এদের পাগুলি বেশি ও ডানাগুলি কম ব্যবহৃত হয়েছিল, এভাবে চলেছিল যতদিন পর্যন্ত না এরা উড়তে অসমর্থ হয়েছিল।
কির্বি উল্লেখ করেছেন যে (এবং আমিও একই বিষয় লক্ষ্য করেছি) গোবর ভক্ষণকারী অনেক পুরুষ-বিটলদের পিছনের গোড়ালি অথবা পায়ের পাতা প্রায়শই ভেঙে যায়; তিনি তার নিজস্ব সংগ্রহের সতেরোটি নমুনা পরীক্ষা করেছিলেন এবং দেখেছিলেন একটিতেও পুরনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। ওনাইটেস অ্যাপেলেস পতঙ্গের গোড়ালিটি এত স্বাভাবিকভাবে লুপ্ত হয়েছে যে পতঙ্গটির এই অঙ্গটি নেই বলে বর্ণনা করা হয়েছে। অন্য কতিপয় গণে এটি থাকে, কিন্তু অবর্ধিত অবস্থায়। এটিউকাস অথবা ইজিপ্ট বাসীদের নিকট পরিত্র বিটলদের মধ্যে এটি ত্রুটিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। দুর্ঘটনাজনিত অঙ্গহানি আনুবংশিক বা বংশগত হতে পারে, এই বক্তব্য বর্তমানে চূড়ান্ত নয়; গিনিপিগদের ক্ষেত্রে অস্ত্রপোচারের বা অপারেশনের আনুবংশিক প্রভাবের উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ব্রাউন-সেকোয়াউ লক্ষ্য করেছিলেন, এই প্রবণতাটিকে অস্বীকার করতে আমাদের সতর্ক করে দেয়। অতএব এটিউকাসের পিছনের গোড়ালির সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি এবং অন্য সবগুলিতে এদের লুপ্তপ্রায় অবস্থা অঙ্গহানির আনুবংশিক হওয়ার ঘটনা হিসেবে নয়, বরং দীর্ঘদিনের অব্যবহারের পরিণাম হিসেবে দেখাই বোধ হয় নিরাপদ হবে। কারণ দেখা যায় যে এমন অনেক গোবর-ভক্ষণকারী বিটলদের গোড়ালি লুপ্ত হয়ে গেছে, যা জীবনের প্রাথমিক অবস্থাতেই নিশ্চয় ঘটে থাকবে। অতএব গোড়ালির খুব একটা প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে না অথবা পতঙ্গরা এটি অধিক ব্যবহার করতে পারে না।
কয়েকটি ক্ষেত্রে আমরা দেহগঠনের রূপান্তরকে অব্যবহারের ফলে ঘটেছে বলে সহজেই গণ্য করতে পারতাম। এগুলি সামগ্রিকভাবে বা মূলতঃ প্রাকৃতিক নির্বাচনের জন্যেই ঘটেছে। মিঃ ওলাস্টন একটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয় আবিষ্কার করেছেন যে ম্যাডেইরাতে বসবাসকারী ৫৫০টি বিটল প্রজাতির মধ্যে ২২৩টি প্রজাতির (কিন্তু এখন আরও অনেক বেশি জানা গেছে) ডানাগুলি এত অসম্পূর্ণ যে এরা উড়তে পারে না। তিনি আরও আবিষ্কার করেছেন যে উনত্রিশটি স্থানীয় গণের মধ্যে কম করেও তেইশটি গণের সব প্রজাতিদেরও এরকম অবস্থা। আরও কয়েকটি বিষয় আছে, যথা–পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের বিটলরা সমুদ্রের দিকে ধাবিত হয় ও ধ্বংস হয়; ম্যাডেইরাতে মিঃ ওলাস্টন আরও লক্ষ্য করেছেন যে বাতাস শান্ত না হওয়া ও সূর্য অস্ত না-যাওয়া পর্যন্ত বিটলরা লুকিয়ে থাকে; তিনি লক্ষ্য করেছেন যে ম্যাডেইরার তুলনায় খোলা ডেসার্টাস ডানাহীন বিটলদের অনুপাত বেশি; মিঃ ওলাস্টন কর্তৃক দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত বিশেষভাবে অসাধারণ একটি ঘটনা হচ্ছে যে যারা অন্যত্র সংখ্যায় অত্যধিক ও যাদের ডানাগুলির ব্যবহার একান্ত প্রয়োজনীয়, এমন বিটলদের কোন কোন গোষ্ঠী এখানে প্রায় সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত; এই রকম কয়েকটি উদাহরণ আমাকে বিশ্বাস করায় যে এত সংখ্যক ম্যাডেইরা বিটলদের ডানাহীন অবস্থা সম্ভবতঃ অব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত প্রাকৃতিক নির্বাচন-প্রক্রিয়ার জন্যই মূলত ঘটেছে। কারণ হয় এদের ডানার সম্পূর্ণ বিকাশ না হওয়া, অথবা অলস স্বভাবের জন্য প্রত্যেক বিটল-এর কয়েক বংশ ধরে কম ওড়ার জন্যই এরকম হয়েছে, এবং সমুদ্রের দিকে তাড়িত না হলে বেঁচে থাকার ভাল সম্ভাবনা থাকত; এবং বিপরীতক্রমে সহজেই উড়তে পারা ঐ সব বিটলরা প্রায়শই সমুদ্রের দিকে ধাবিত হবে ও এভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হবে।
মাটি-ভক্ষণকারী নয় এবং কোলিওপটেরা ও লেপিড়পটেরার মতো ফুল-ভক্ষণকারী ম্যাডেইরা পতঙ্গরা, মিঃ ওলাস্টনের ধারণা, জীবনধারণের জন্য স্বভাবগতভাবে নিশ্চয় তাদের ডানা ব্যবহার করে, এমনকি ডানাগুলি হাস পায়নি বরং বর্ধিত হয়েছে। বিষয়টি প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ। কারণ যখন একটি নতুন পতঙ্গ দ্বীপটিতে আসে, তখন ডানার হ্রাস ও বৃদ্ধি ঘটাতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রবণতা বা ঝোঁকটি নির্ভর করবে বাতাসের সঙ্গে সাফল্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে অথবা ওড়ার চেষ্টা না করে এবং না-ওড়ার মাধ্যমে বিরাট সংখ্যক একক বেঁচেছিল কিনা তার ওপর। সমুদ্রতীরের নিকট ডুবন্ত জাহাজের নাবিকদের মধ্যে যারা ভাল সাঁতারু তাদের পক্ষে ভাল হবে যদি তারা আরও একটু সাঁতার কাটতে সমর্থ হয়, বিপরীতে খারাপ সাঁতারুদের পক্ষে সবথেকে ভাল হল মোটেই সাঁতার কাটতে সমর্থ না-হওয়া এবং ডুবন্ত জাহাজের সঙ্গে আটকে থাকা।
ছুঁচো ও গর্তে বসবাসকারী কয়েক প্রকার ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের চোখ লুপ্তপ্রায় অবস্থায় থাকে এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে চামড়া ও লোমে ঢাকা থাকে। ক্রমশঃ কম। ব্যবহারের জন্য চোখগুলির এই অবস্থা সম্ভবতঃ প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাহায্যেই হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকায় ছুঁচোদের তুলনায় টুকোটুকো বা টেনোমিসদের মতো গর্তে বাসকারী একটি তীক্ষ্ণদন্তী (রোডেন্ট) প্রাণী স্বভাবের দিক থেকে আরও বেশি ভূগর্ভবাসী; এবং আমি একজন স্পেনবাসীর নিকট শুনেছিলাম যে এরা প্রায়শই অন্ধ হয়, তিনি প্রায়শই এদের ধরতেন। এদের একটিকে আমি বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। তার শবব্যবচ্ছেদ করে দেখা গেল এদের অন্ধত্বের কারণ হচ্ছে চোখের ঝিল্লিতে প্রদাহ। চোখের বারংবার প্রদাহ যে কোন প্রাণীর পক্ষে ক্ষতিকর বলে এবং ভূগর্ভে বসবাসে অভ্যস্ত প্রাণীদের চোখের প্রয়োজন সীমিত বলে, চোখের পাতা এঁটে থাকা এবং পাতার ওপর লোমের বৃদ্ধি সমেত চোখের আয়তন হাস এরূপ ক্ষেত্রে সুবিধাজনক বা লাভজনক হয়ে থাকবে; এবং যদি তাই হয়, তবে প্রাকৃতিক নির্বাচন অব্যবহারের প্রভাবকে সাহায্য করবে।
এটি সুবিদিত যে কার্নিওলা ও কেন্টাকি গুহায় বসবাসকারী সবচেয়ে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর ক্ষতিকর প্রাণীরা অন্ধ হয়। কাকড়াদের কতিপয় চোখ নষ্ট হওয়া সত্ত্বেও চোখের বৃন্তটি বজায় থাকে, যেমন দূরবীনের গ্লাসগুলি নষ্ট হওয়া সত্ত্বেও স্ট্যান্ডটি অবশিষ্ট থাকে। অন্ধকারে বসবাসকারী প্রাণীদের পক্ষে চোখগুলি অপ্রয়োজনীয় হলেও কোন না কোন ভাবে ক্ষতিকর হতে পারত–এটা ভাবা কষ্টকর বলে ধরে নেওয়া যায় যে এদের নষ্ট হওয়াটা অব্যবহারের ফলেই হয়েছে। অধ্যাপক শিলিমান অন্ধ প্রাণীদের মধ্যে একজাতীয় গুহা-হঁদুরের (নিওটোমা) দুটিকে গুহার মুখ থেকে আধ-মাইলের মধ্যে ধরেছিলেন, এরা গুহার ভিতরে নিশ্চয়ই ছিল না, এদের চোখগুলি ছিল উজ্জ্বল ও বড় আকারের; অধ্যাপক শিলিমান আমাকে জানিয়েছিলেন যে এদের একমাস ধরে ক্রমাগত উজ্জ্বল আলোয় রাখার পর এরা কোন কিছুর উপস্থিতি সম্বন্ধে ক্ষীণ অনুভূতি অর্জন করেছিল।
প্রায় একইরূপ আবহাওয়ায় চুনাপাথরের গভীর গুহার তুলনায় আরও সদৃশ জীবন পরিবেশ কল্পনা করা কষ্টসাধ্য। অতএব আমেরিকা ও ইউরোপের গুহাসমূহে অন্ধ প্রাণীদের ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সৃষ্ট হওয়ার এই মতবাদ অনুসারে এদের জৈব সংগঠনে ও গঠনগত সৌসাদৃশ্যে অতি গভীর সদৃশতা আশা করা যেতে পারত। এটি নিশ্চয় এরূপ হয় না যদি আমরা দুটি দেশের দুটি সামগ্রিক প্রাণীকুলকে লক্ষ্য করি; শুধু পতঙ্গদের ক্ষেত্রেই সূচিওট মন্তব্য করেছেন, “ঘটনাটিকে সম্পূর্ণ স্থানীয় বিষয় হিসেবে দেখা ছাড়া অন্য কোন আলোকে বিচার করতে আমরা এভাবে বাধাপ্রাপ্ত হই এবং ইউরোপ ও আমেরিকার প্রাণীকুলগুলির মধ্যে উপমার তুলনায় ম্যামথ গুহা (কেন্টাকিতে) ও কার্নিওলা গুহার মধ্যে অল্প কয়েকটি আকারের সদৃশতাকেও বিবেচনা করতে আমরা এভাবে বাধাপ্রাপ্ত হই।” আমার মতে, আমেরিকার অধিকাংশ সাধারণ দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন। প্রাণীরা বহির্জগৎ থেকে বংশপরম্পরায় ধীরে ধীরে কেন্টাকি হার গভীরতর খাজের মধ্যে প্রচরণ করেছিল, যেমন ইউরোপের প্রাণীরা ইউরোপের গুহাগুলিতে করেছিল। স্বভাবসমূহের এরূপ ক্রমবিন্যাসের কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে; কারণ সূচিওট বলেছেন, “তদনুসারে আমরা ভূগর্ভস্থ প্রাণীকুলের ছোট ছোট শাখা হিসেবে দেখি, যারা ভৌগোলিকভাবে সীমিত পাশ্ববর্তী জায়গায় প্রাণীকুল থেকে ভূগর্ভের মধ্যে প্রবেশ করেছিল এবং যারা অন্ধকার জায়গায় বিস্তৃত হয়ে পার্শ্ববর্তী অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। সাধারণ আকারদের থেকে কম ভিন্ন প্রাণীরা আলো থেকে অন্ধকারে অবস্থান্তরের জন্য প্রস্তুত। এর পর আশা যাক তাদের সম্বন্ধে যারা গোধূলিলগ্নের সময়ে সৃষ্টি হয়েছে, এবং অবশেষে যারা অন্ধকারে বসবাসের জন্য সৃষ্টি হয়েছে এবং যাদের গঠন সম্পূর্ণ অদ্ভুত ধরনের।” চিওট-এর এইসব মন্তব্য থেকে এটাই বোঝা উচিত যে এটি একই প্রজাতির ক্ষেত্রে নয়, বরং ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অসংখ্য বংশের পর একটি প্রাণী ভূগর্ভের গভীরতম খাঁজগুলিতে পৌঁছেছিল, ফলে অব্যবহার তার চোখগুলিকে প্রায় পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল এবং অন্ধত্বের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রাকৃতিক নির্বাচন অন্যান্য পরিবর্তন ঘটিয়েছিল, যেমন শুঙ্গ অথবা পালপির দৈর্ঘ্যবৃদ্ধি। এইসব রূপান্তর হওয়া সত্ত্বেও, আমেরিকার গুহাবাসী প্রাণীদের সঙ্গে ঐ মহাদেশের অন্যান্য অধিবাসীদের, এবং ইউরোপের গুহাবাসী প্রাণীদের সঙ্গে ঐ মহাদেশের অন্যান্য অধিবাসীদের, ঘনিষ্ঠ মিল দেখার আশা করতে পারি আমরা। এবং অধ্যাপক ডানার কাছ থেকে আমি শুনেছি যে আমেরিকার গুহাবাসী প্রাণীদের ক্ষেত্রে এটিই হচ্ছে ঘটনা; ইউরোপের গুহাবাসী পতঙ্গদের কয়েকটি পার্শ্ববর্তী দেশের গুহাবাসী পতঙ্গদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এদের স্বতন্ত্র সৃষ্টির সাধারণ মতানুসারে দুটি মহাদেশের অন্ধ গুহাবাসী প্রাণীদের সঙ্গে অন্য অধিবাসীদের ঘনিষ্ঠ মিলগুলির সঙ্গত ব্যাখ্যা দেওয়া অতিশয় কষ্টকর হবে। এদের অন্য উৎপাদনগুলির অধিকাংশের সুবিদিত সম্পর্ক থেকে আমরা আশা করতে পারতাম যে উভয় গোলার্ধের গুহাগুলির অধিবাসীদের কয়েকটির ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হওয়া উচিত। গুহাগুলি থেকে বহু দূরে অন্ধকারাচ্ছন্ন পাহাড়ে ব্যাথিস্কয়ার একটি অন্ধ প্রজাতি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, এই একটি গণের গুহ-প্রজাতির দৃষ্টিশক্তি হারানোর সঙ্গে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গায় বসবাসের সম্ভবতঃ কোন সম্পর্ক নেই, কারণ এটি স্বাভাবিক যে ইতিমধ্যে দৃষ্টিশক্তি হারানো একটি পতঙ্গ অন্ধকারাচ্ছন্ন গিরিগুহায় সহজেই অভিযোজিত হয়ে থাকবে। অন্য একটি অন্ধ গণে (অ্যানফথ্যালমাস) এই অদ্ভুত ব্যাপারটি লক্ষ্য করা যায় যে প্রজাতিদের গুহা ছাড়া অন্য কোথাও এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায় নি; এটি মিঃ মারে লক্ষ্য করেছিলেন। তবুও যারা ইউরোপ ও আমেরিকায় কয়েকটি গুহায় বাস করে, তারা ভিন্ন। কিন্তু এটি সম্ভবপর যে এই কয়েকটি প্রজাতির চক্ষুবিশিষ্ট পূর্বপুরুষরা উভয় মহাদেশে পূর্বে বিস্তৃত হয়ে থাকতে পারে এবং এর পর এদের বর্তমান নির্জন বাসস্থান ছাড়া অন্যত্র এরা বিলুপ্ত হয়েছে। অন্ধ মাছ অ্যামব্লিঅপসিস সম্পর্কে আগাসিজের মন্তব্য শুনে আমি বিস্মিত হই না যে গুহাবাসী প্রাণীদের কয়েকটি অতিশয় ব্যতিক্রমী বা অস্বাভাবিক হবে, এবং ইউরোপের সরীসৃপদের মধ্যে অন্ধ প্রোটিয়াসদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমি কেবল আশ্চর্যান্বিত হই যে এইসব অন্ধকারাচ্ছন্ন নির্জন স্থানগুলির অতি অল্প অধিবাসীদের মধ্যে কম কঠোর প্রতিযোগিতার জন্য আদিম জীবনের ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষিত হয়নি।
পরিবেশানুগকরণ
ফুল ফোঁটার সময়, নিদ্রার সময়, বীজের অঙ্কুরোদগমের জন্য প্রয়োজনীয় বৃষ্টির পরিমাণ ইত্যাদির ব্যাপারে উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে স্বভাব বা প্রবৃত্তি বংশগত হয়, এবং পরিবেশানুগকরণ সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলতে এটি আমাকে অনুপ্রাণিত করে। যেহেতু এটি অতি সাধারণ ব্যাপার যে একই গণের ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিরা ঠাণ্ডা ও গরম দেশে বসবাস করে, এবং যদি এটি সত্য হয় যে একই গণের সমস্ত প্রজাতি একই পিতামাতা আকার থেকে উদ্ভূত হয়েছে, তাহলে একটি দীর্ঘ উদ্ভব প্রক্রিয়ার সময় পরিবেশানুগকরণ নিশ্চয় সহজেই কার্যকরী হয়ে থাকবে। এটি সর্বজনবিদিত যে প্রত্যেক প্রজাতি তার নিজস্ব বাসস্থানের জলবায়ুতে অভিযোজিত হয়; মেরু বা এমন কি নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের প্রজাতিরা উষ্ণ জলবায়ু সহ্য করতে পারে না, অথবা বিপরীতটিও ঘটে। আবার অনেক রসালো উদ্ভিদ আর্দ্র জলবায়ু সহ্য করতে পারে না। কিন্তু বিভিন্ন জলবায়ুতে বসবাসকারী প্রজাতিদের অভিযোজনের মাত্রাটিকে প্রায়শই অতিরঞ্জিত করা হয়। বিদেশ থেকে আনীত একটি উদ্ভিদ আমাদের জলবায়ু সহ্য করতে পারবে কি বা পারবে না তার ভবিষ্যদ্বাণী করতে আমাদের অক্ষমতা থেকে এবং বিভিন্ন দেশ থেকে আনীত অসংখ্য প্রাণী ও উদ্ভিদরা খুবই স্বাস্থ্যবান হয় দেখেই আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি। এটা বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ আছে যে বিশেষ জলবায়ুতে অভিযোজনের তুলনায় অন্য জীবদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার জন্য প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রজাতিদের বিস্তার ততখানি বা আরও বেশি সীমিত হয়। কিন্তু এই অভিযোজন অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘনসন্নিবিষ্ট হোক বা না হোক, আমাদের নিকট প্রমাণ আছে যে অল্প কিছু উদ্ভিদ বিভিন্ন তাপমাত্রায় স্বাভাবিকভাবে অভ্যস্ত হয়েছে, অর্থাৎ এরা পরিবেশানুগ হয়েছে। ডঃ হুঁকার কর্তৃক সংগৃহীত হিমালয়ের বিভিন্ন উচ্চতায় জন্মানো একই প্রজাতির বীজ থেকে উদ্ভূত পাইন ও রোডোডেনড্রনের চারাগাছ একই দেশে ঠাণ্ডা প্রতিরোধ করার জন্য বিভিন্ন জৈবিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিল বলে দেখা গেছে। মিঃ খোয়াইটস আমাকে জানিয়েছেন যে তিনি সিলোনে একই ঘটনা লক্ষ্য করেছিলেন; অ্যাজার্স থেকে ইংল্যান্ডে আনীত ইউরোপীয় উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে মিঃ এইচ. সি. ওয়াটসন একই ঘটনা লক্ষ্য করেছিলেন। অন্য অনেক ঘটনার কথাও উল্লেখ করা যায়। প্রাণীদের ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রামাণিক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারত যেখানে দেখা যায় ঐতিহাসিক কাল ধরে উষ্ণতর থেকে শীতলতর অক্ষাংশে এদের বিস্তার ঘটেছিল, এবং তার বিপরীতও ঘটেছিল। কিন্তু আমরা সঠিকভাবে জানি না যে এই প্রাণীরা এদের দেশজ জলবায়ুতে সঠিকভাবে অভিযোজিত হয়েছিল কিনা, যদিও যাবতীয় সাধারণ ক্ষেত্রে এটিই হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। অথবা আমরা জানি না প্রাথমিক অবস্থার তুলনায় সঠিকভাবে উপযুক্ত হওয়ার জন্যে এদের নূতন বাসস্থানে পরবর্তী সময়ে এরা বিশেষভাবে পরিবেশানুগ হয়েছে কিনা।
আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি আদিম যুগে অসভ্য মানুষরা আমাদের গৃহপালিত প্রাণীদের নির্বাচন করেছিল এই কারণে যে এরা উপকারী ছিল এবং আটক অবস্থায় এরা সহজেই সন্তান উৎপাদন করত, এবং এই কারণে নয় যে এরা পরবর্তী সময়ে দূরবর্তী পরিবহণের জন্য সমর্থ হয়েছিল, অতিশয় ভিন্ন জলবায়ু কেবল সহ্য করার জন্য নয়, বরং এসব জলবায়ুতে সম্পূর্ণ উর্বর হওয়ার ব্যাপারে আমাদের গৃহপালিত প্রাণীদের সাধারণ ও অসাধারণ ক্ষমতা একটি যুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে যে এখন একটি প্রাকৃতিক পরিবেশে অন্য প্রাণীদের একটা বিরাট সংখ্যাকে ব্যাপকভাবে ভিন্ন জলবায়ু সহ্য করানো যেতে পারত। আমাদের গৃহপালিত কয়েকটি প্রাণীর কতিপয় বন্য কুল থেকে সম্ভবপর উৎপত্তির জন্য আগের যুক্তিটিকে বেশিদূর নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না। উদাহরণস্বরূপ, গ্রীষ্মপ্রধান ও মেরু অঞ্চলের একটি নেকড়ের রক্ত আমাদের গৃহপালিত জাতগুলির মধ্যে সম্ভবতঃ মিশ্রিত হয়ে থাকতে পারে। নেংটি ও ধেড়ে ইঁদুরদের গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে না, কিন্তু এরা পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে মানুষের দ্বারা পরিবাহিত হয়েছে এবং এখন অন্য যে-কোন রোডেন্টদের চেয়ে এদের বিস্তার অনেক বেশি, কারণ এরা উত্তরের ফারো ও দক্ষিণের ফকল্যান্ডের ঠাণ্ডা জলবায়ুতে এবং উষ্ণ অঞ্চলের অনেক দ্বীপে বেঁচে থাকে। অতএব যে-কোন বিশেষ জলবায়ুতে অভিযোজনকে জৈবসংগঠনের একটি সহজাত নমনীয়তার ওপর সহজেই আরোপ করা যেতে পারে, যা অধিকাংশ প্রাণীদের ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হয়। এই মতানুসারে, মানুষের নিজের এবং তার গৃহপালিত প্রাণীদের অতিশয় ভিন্ন জলবায়ু সহ্য করার ক্ষমতা এবং বিলুপ্ত হাতি ও গণ্ডারদের একটি তুষারযুগের জলবায়ু সহ্য করার ঘটনাটি, অন্যদিকে এখন জীবন্ত প্রজাতিদের স্বভাবে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বা উপগ্রীষ্মমণ্ডলীয় হওয়াকে ব্যতিক্রম হিসেবে দেখা উচিত হবে না, বরং বিশেষ অবস্থায় জৈবসংগঠনের একটি অতি সাধারণ নমনীয়তা কার্যকরী হওয়ার উদাহরণ হিসেবেই দেখা উচিত।
প্রজাতিদের যে-কোন জলবায়ুতে পরিবেশানুগকরণ কেবল স্বভাবের জন্য কতখানি এবং ভিন্ন সহজাত জৈবসংগঠন সম্বলিত ভ্যারাইটিদের প্রাকৃতিক নির্বাচনের জন্য কতখানি, এবং উভয়ই যুক্তভাবে কতখানি, এইসব প্রশ্ন নিতান্তই দুর্বোধ্য। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় প্রাণীদের পরিবহণে অত্যন্ত সতর্ক হওয়ার জন্য কৃষিসংক্রান্ত গ্রন্থগুলিতে, এমন কি চীনের প্রাচীন বিশ্বকোষে অনবরত উপদেশ ও উপমা থেকেই আমি বিশ্বাস করি যে স্বভাব বা অভ্যাসের কিছু প্রভাব আছেই। এবং যেহেতু এটি বিশ্বাসযোগ্য যে এদের জেলাসমূহে বিশেষভাবে উপযুক্ত দেহগঠনসমূহ সমস্ত জাত ও উপজাতগুলিকে নির্বাচন করতে মানুষ সমর্থ হয়েছে, তাই আমি মনে করি পরিণামটি নিশ্চয় স্বভাবের জন্যই হয়েছে। বিপরীতক্রমে বা অপরদিকে, যে কোন দেশে অতি সুন্দরভাবে অভিযোজিত দেহগঠন সমেত জন্মানেনা ঐ সব এককদের প্রাকৃতিক নির্বাচন অনিবার্যভাবে সংরক্ষণ করতে সচেষ্ট হবে। চাষযোগ্য উদ্ভিদ সংক্রান্ত অনেক ধরনের গবেষণামূলক গ্রন্থে বলা হয়েছে যে অন্যদের তুলনায় কোন কোন বিশেষ ভ্যারাইটি বিশেষ বিশেষ জলবায়ু সহ্য করতে পারে। ইউনাইটেড স্টেটসে প্রকাশিত ফলের গাছ সংক্রান্ত বইগুলিতে সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবে সুপারিশ করা হয়েছে যে কোন কোন ভ্যারাইটি উত্তরের এবং কোন কোন ভ্যারাইটি দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে চাষ করা যাবে; এবং এইসব ভ্যারাইটিদের অধিকাংশই সাম্প্রতিককালে উদ্ভূত হয়েছে বলে এদের জৈবসংগঠনগত পার্থক্য স্বভাবের জন্য হতে পারে না। জেরুজালেম আর্টিচোক বা হাতিচোক প্রজাতিটি ইংল্যান্ডে কখনও বীজ উৎপাদন করেনি এবং ফলে এর কোন ভ্যারাইটির উদ্ভব ঘটেনি–এটি প্রমাণ করার জন্য বলা হয় প্রজাতিটির পরিবেশানুগকরণ করা যেতে পারে না, কারণ চিরকাল যেমন ছিল এটি এখনও সেরকমই কোমল বা নমনীয়! একই উদ্দেশ্যে কিডনি বা ফ্রেঞ্চ বা বাকা বিনের ঘটনাটি প্রায়শই আরও গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়; কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ বিংশতি বংশ ধরে তার কিডনি বিনগুলি এত অসময়ে বপন করবে যাতে করে বিরাট পরিমাণ বিন তুষারপাতের দ্বারা নষ্ট হয়, এবং তারপর আকস্মিক সংকরণ যত্ন সহকারে প্রতিরোধ করে কতিপয় জীবিতদের থেকে বীজ সংগ্রহ করবে, এবং তারপর পুনরায় একইরকম সতর্কতার সঙ্গে এইসব চারাগাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বলা যেতে পারে না যে পরীক্ষাটি বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছে। অথবা এমনও মনে করা উচিত নয় যে কিডনি বিনের চারাগাছের দেহগঠনের পার্থক্য কখনও উদ্ভূত হয় না, কারণ অন্যদের তুলনায় এর কয়েকটি চারাগাছ আরও কত বেশি অনমনীয় সে। সম্বন্ধে বিস্তৃত লেখা প্রকাশিত হয়েছে; এবং এ বিষয়ে আমি নিজেও বিস্ময়কর উদাহরণসমূহ লক্ষ্য করেছি।
সামগ্রিকভাবে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে স্বভাব অথবা ব্যবহার ও অব্যবহার কোন কোন ক্ষেত্রে দেহগঠন ও অবয়বের রূপান্তরে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে, কিন্তু পরিণামগুলি পরিবৃত্তিসমূহের প্রাকৃতিক নির্বাচনের সঙ্গে বহুলাংশে যুক্ত হয়েছে এবং কোন কোন সময় প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা পরাভূত হয়েছে।
সহসম্পর্কিত পরিবৃত্তি
এই অভিব্যক্তির মাধ্যমে আমি বোঝাতে চাই যে জীবের সমগ্র জৈবসংগঠনটি তার বৃদ্ধি ও বিকাশের পর্যায়কালে এমনভাবে সুসংবদ্ধ হয় যে যখন যে কোন অঙ্গে অল্প পরিবর্তন ঘটে তখন এটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে সঞ্চিত হয়, অন্য অঙ্গসমূহও রূপান্তরিত হয়। এটি একটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার সম্বন্ধে অসম্পূর্ণরূপে কিছু জানা গেছে, এবং সন্দেহ নেই যে বিভিন্ন শ্রেণীর তথ্য এখানে সহজেই আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারে। এখন আমরা দেখব যে সরল বংশানুসৃতি প্রায়শই সহসম্পর্কের ভ্রান্ত বাহ্যরূপ প্রদান করে। সবচেয়ে স্পষ্ট আসল ঘটনাসমূহের মধ্যে একটি হচ্ছে, তরুণ অথবা লার্ভা অবস্থায় দেহের পরিবৃত্তিসমূহ বয়স্ক প্রাণীদের দেহগঠনকে স্বাভাবিকভাবে প্রভাবান্বিত করার চেষ্টা করে। যেগুলি সমসংস্থ ও প্রাথমিক ভূণগতাবস্থায় দেহগঠনে অভিন্ন ও সদৃশ পরিবেশে স্বাভাবিকভাবে প্রভাবান্বিত হয়, শরীরের এমন কতিপয় অঙ্গ সম্ভবতঃ সমরূপে পরিবর্তিত হতে স্পষ্টতঃ বাধ্য হয়। একই ভাবে পরিবর্তনশীল শরীরের বাম ও দক্ষিণ দিকে আমরা এটি লক্ষ্য করি; সামনের ও পিছনের পাগুলি এবং এমনকি চোয়াল ও অঙ্গগুলিও একত্রে পরিবর্তিত হয়, কারণ কয়েকজন অঙ্গ ব্যবচ্ছেদকারী বিশ্বাস করেন যে নিচের চোয়ালটি অঙ্গগুলির সঙ্গে সমসংস্থ। আমার ধারণা, এই প্রবণতাসমূহকে প্রাকৃতিক নির্বাচন মোটামুটি সম্পূর্ণরূপে জয় করতে পারে। এভাবে উল্লেখ করা যায় যে হরিণদের এক সময় একটা গোত্র ছিল যাদের কেবল। একদিকে একটি শিং থাকত; এবং জাতটি যদি কোনভাবে উপকারী হত, তাহলে এটি সম্ভবতঃ প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা স্থায়ী হয়ে থাকতে পারত।
কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতানুসারে, সমসংস্থ অঙ্গরা সংসস্থ হয়ে থাকতে চেষ্টা করে; এগুলি প্রায়শই বিকৃতাঙ্গ উদ্ভিদে দেখা যায় : এবং একটি নলের সঙ্গে পাপড়ির সংযুক্তির মতো, সাধারণ দেহগঠনে সমসংস্থ অঙ্গদের সংযুক্তির তুলনায় কোন কিছুই আরও সাধারণ নয়, শক্ত অঙ্গরা সম্ভবতঃ সংলগ্ন কোমল অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে পাখিদের ক্ষেত্রে শ্রেণীর (পেলভিস) আকারের বৈচিত্র্য তাদের বৃক্কের (কিডনি) আকারের লক্ষণীয় বৈচিত্র্য ঘটায়। অন্যরা মনে করেন মানব-মাতার শ্রোণীর আকারের চাপ শিশুর মাথার আকার তৈরিকে প্রভাবিত করে। এসক্লেজেলের মতে, সাপেদের শরীরের আকার ও গিলে খাওয়ার পদ্ধতি সবচেয়ে প্রয়োজনীয় নাড়িভুঁড়ির (ভিসেরা) কয়েকটির আকার ও অবস্থান নির্ধারণ করে।
বন্ধনের প্রকৃতি প্রায়শই সম্পূর্ণ অস্পষ্ট থাকে। এম. ইসিডোর জিওফ্রয় সেন্ট হিলারে জোরের সঙ্গে বলেছেন যে কোন কোন গঠনবিকৃতি বারংবার ও অন্যরা বিরলভাবে সহ-অবস্থান করে, যার সম্বন্ধে আমরা কোন যুক্তি খাড়া করতে অসমর্থ। বিড়ালদের ক্ষেত্রে, শরীরের রং সম্পূর্ণ সাদা ও চোখের রং নীল হওয়ার সঙ্গে বধিরতার, অথবা কচ্ছপের খোলক ও স্ত্রীলিঙ্গের মধ্যে, অথবা পায়রাদের পালকওয়ালা পা এবং পায়ের বাইরের আঙ্গুলের মধ্যে চামড়ার, অথবা শিশু পায়রাদের কমবেশি নরম পালকের সঙ্গে ভবিষ্যতে তাদের পালকের রঙের, অথবা টার্কিশ কুকুরের লোম ও দাঁতের মধ্যেকার সম্পর্কের তুলনায় বিস্ময়কর ভূমিকা আর কী পালন করতে পারে। যদিও সন্দেহ নেই যে সমসংস্থতা বা অনুরূপতা এখানে একটি ভূমিকা পালন করে। সহসম্পর্কের পরবর্তী ঘটনাটি সম্পর্কে আমি মনে করি এটি কদাচিৎ আকস্মিক ঘটনা হতে পারে যে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সেটাসিয়া (তিমি) ও এডেন্টাটা (আর্মাডিলোস, স্কেলযুক্ত পিঁপড়ে ভক্ষণকারী) নামে দুটি বর্গের অন্তর্গত প্রাণীদের অন্তস্ত্বকের আবরণী অতিশয় অস্বাভাবিক, এদের দাঁতগুলিও এইরূপে সামগ্রিকভাবে অতিশয় অস্বাভাবিক হয়, কিন্তু মির্ভাটের মতে এই নিয়মের অসংখ্য ব্যতিক্রম আছে যাদের মূল্য অতি অল্প।
কম্পোজিটাস ও আমবেলিফেরাস উদ্ভিদদের বাইরের ও ভিতরের ফুলের মধ্যে পার্থক্যের সহসম্পর্কের তুলনায় উপযোগিতা অথবা প্রাকৃতিক নির্বাচন ছাড়াই সহসম্পর্ক ও পরিবৃত্তির নিয়মগুলির প্রয়োজনীয়তা দেখাতে উপযুক্তভাবে অভিযোজিত হয়েছে, এমন ঘটনা আমি জানি না। উদাহরণস্বরূপ, ডায়েসি ফুলের প্রান্ত ও মধ্য পুস্পিকাদের মধ্যে পার্থক্যটির সঙ্গে প্রত্যেকেই পরিচিত, এই পার্থক্যটি জনন-অঙ্গসমূহের আংশিক বা সম্পূর্ণ বিলুপ্তির সঙ্গে প্রায়শই সংসর্গী হয়। কিন্তু এইসব উদ্ভিদের কয়েকটিতে বীজগুলিও আকারে ও গঠনে ভিন্ন হয়। এইসব পার্থক্য পুষ্পিকাদের ওপর মঞ্জরীপত্রাবরণীর চাপ বা এদের পারস্পরিক চাপের ওপর কোন কোন সময় নির্ভর করে, এবং কয়েকটি কম্পোজিটি উদ্ভিদের প্রান্তপুস্পিকাদের বীজগুলির আকার এই ধারণাকে সমর্থন করে; ডঃ হুঁকার আমাকে জানিয়েছেন যে আমবেলিফেরি গোত্রের ঘনতম মাথা-সমেত প্রজাতিদের ক্ষেত্রে এটি কখনই ঘটে না, সেখানে প্রান্ত ও মধ্য পুষ্পিকারা প্রায়শই ভিন্ন হয়। মনে করা যেতে পারত যে জনন-অঙ্গগুলি থেকে পুষ্টি গ্রহণের মাধ্যমে প্রান্ত পাপড়িদের বিকাশবৃদ্ধি এদের অবলুপ্তির কারণ ঘটায়; কিন্তু এটি কদাচিৎ একমাত্র কারণ হতে পারে, কারণ কম্পোজিটি গোত্রের কয়েকটি উদ্ভিদে প্রান্ত ও মধ্য পুষ্পিকাদের বীজগুলি দলমণ্ডলের কোন পার্থক্য ছাড়াই ভিন্ন হয়। সম্ভবতঃ এইসব পার্থক্য প্রান্ত ও ভিতরের পুষ্টিকর খাদ্যের প্রবাহের পার্থক্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অন্ততঃ অনিয়মিত ফুলেদের ক্ষেত্রে আমরা জানি যে অক্ষের নিকটতম ফুলগুলি অতিশয় সমাঙ্গ হয়, অর্থাৎ অস্বাভাবিকভাবে প্রতিসাম্য অবস্থার হয়। এই ঘটনার একটি উদাহরণ হিসেবে এবং সহসম্পর্কের একটি চিন্তাকর্ষক ঘটনা হিসেবে আমি যোগ করতে পারি যে অসংখ্য পেলার্গোনিয়ামের পুষ্পগুচ্ছের মধ্য ফুলের ওপরের দুটি পাপড়ির কালো রং প্রায়শই নষ্ট হয়ে যায় এবং যখন এটি ঘটে তখন সংসক্ত মধুগ্রন্থিটিও প্রায় লুপ্ত হয়; এভাবে মধ্যফুল পেলোরিক বা সমাঙ্গ হয়। উপরের দুটি পাপড়ির কেবল একটির রং যখন অনুপস্থিত থাকে, তখন মধুস্থলী সম্পূর্ণ লুপ্ত হয় না, বরং খুব খর্ব হয়।
প্রান্তপুস্পিকারা পতঙ্গদের আকর্ষণ করে, ফলে এইসব উদ্ভিদের নিষেকের জন্য এটি অতিশয় লাভজনক ও প্রয়োজনীয় হয়, এর ওপর ভিত্তি করে দলমণ্ডলের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে স্পেনজেলের ধারণাটি অতিশয় সম্ভবপর; এবং যদি এরূপ হয়, তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচন নিশ্চয় ভূমিকা পালন করে থাকতে পারে। বীজদের ক্ষেত্রে এটি অসম্ভবপর বলে মনে হয় যে আকারের ক্ষেত্রে এদের ভিন্নতাসমূহ কোনভাবে উপকারী হতে পারে, কারণ সেটি দলমণ্ডলের কোন ভিন্নতার সঙ্গে সর্বদা সহসম্পর্কযুক্ত হয় নাঃ তবুও আমবেলিফেরি উদ্ভিদগুলিতে এইসব ভিন্নতার আপাত প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বাইরের ফুলের বীজগুলি কোন কোন সময় অর্থোপারমাস হয় এবং মধ্য ফুলের বীজরা কোয়েলোসপারমাস হয়–সেইজন্য অগ্রজ ডি ক্যান্ডেলে এইসব বৈশিষ্ট্য অনুসারে বর্গটির প্রধান প্রধান বিভাগগুলি সৃষ্টি করেছিলেন। অতএব সিস্টেম্যাটিস্টদের দ্বারা উচ্চমূল্য প্রাপ্ত দেহগঠনের রূপান্তরসমূহ পরিবৃত্তি ও সহসম্পর্কের নিয়মের দ্বারা হতে পারে, যেগুলি ছাড়া, যতদূর আমরা বিবেচনা করতে পারি, প্রজাতিদের পক্ষে অল্পতমও উপকার হয় না।
আমরা প্রায়শই ভুলবশতঃ দেহগঠনে সহসম্পর্কিত পরিবৃত্তির বিষয়টি আরোপ করতে পারি, যেটি আবার সমগ্র জাতিগোষ্ঠীতে অতি সাধারণ ব্যাপার এবং এটি প্রকৃতপক্ষে বংশানুসৃতির জন্য হয়; কারণ প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে এক আদিম পূর্বপুরুষ দেহগঠনের কোন একটি রূপান্তর অর্জন করে থাকতে পারে এবং কয়েক হাজার বংশের পর অন্য কতিপয় ও ভিন্ন রূপান্তর অর্জন করে থাকতে পারে; এবং বিচিত্র স্বভাব সমেত বংশধরদের একটি ভিন্ন গোষ্ঠীতে বংশগতভাবে প্রেরিত হয়ে এই দুটি রূপান্তর কোন প্রয়োজনের জন্য স্বাভাবিকভাবে সহসম্পর্কযুক্ত হয়ে থাকতে পারে। অন্য কোন সহসম্পর্ক আপাততঃ এমনভাবে হয়েছে যেখানে প্রাকৃতিক নির্বাচন কেবল কাজ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আলফোনসে ডি ক্যান্ডেলে দেখিয়েছেন যে অবিদারী ফলে সপক্ষ বীজ কখনই দেখা যায় না; ক্যাপসুল বিদারিত না হলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বীজগুলি ক্রমশ সপক্ষল হওয়ার অসম্ভাব্যতার দ্বারা এই নিয়মটিকে আমার ব্যাখ্যা করা উচিত। কারণ একমাত্র ক্যাপসুল বিদীর্ণ হলেই বাতাস দ্বারা তাড়িত হওয়ার জন্য একটু বেশি উপযোগী বীজগুলি ব্যাপকভাবে বিস্তারের জন্য কম উপযোগী অন্যদের ওপর তুলনামূলক সুবিধা লাভ করতে পারত।
ক্রমবৃদ্ধির ক্ষতিপূরণ ও সঞ্চয়ন
অগ্রজ জিওফ্রয় ও গেটে একই সময়ে বৃদ্ধির সুষমতা ও ক্ষতিপূরণের নিয়মটি উপস্থাপন করেছিলেন; অথবা গেটে যেমন বলেছেন, সেটি হচ্ছে “একদিকে অপব্যয়ের জন্য প্রকৃতি অন্যদিকে সঞ্চয় করে দিতে বাধ্য হয়।” আমি মনে করি আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনগুলির ক্ষেত্রে এটি কিছু পরিমাণে খাটে : পুষ্টিকর খাদ্য একটি অংশে বা অঙ্গে অতিরিক্তভাবে প্রভাবিত হলে সেটি কদাচিৎ অন্ততঃ অতিরিক্তভাবে অন্য অংশে প্রবাহিত হয়; এজন্যই বেশি দুধ দেয় ও সহজেই মোটা হয় এমন একটি গরু সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য। বাঁধাকপির একই ভ্যারাইটিরা প্রচুর ও পুষ্টিকর পাতা এবং প্রচুর তেলযুক্ত বীজ উৎপাদন করে না। আমাদের ফলগুলির বীজ কৃশ হলে ফলগুলি আকারে এবং গুণে বড় ও উৎকৃষ্ট হয়। আমাদের হাঁস-মুরগীর খামারে, মাথায় একটি বিরাট পালকগুচ্ছ সাধারণত হ্রাসপ্রাপ্ত ঝুঁটির সঙ্গে সংসর্গী হয় এবং হ্রাসপ্রাপ্ত ঝুঁটির সঙ্গে একটি বিরাট দাড়ি সংসর্গী হয়। প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রজাতিদের ক্ষেত্রে নিয়মটি সার্বজনীনভাবে প্রযোজ্য হতে পারে না, কিন্তু অসংখ্য দক্ষ পর্যবেক্ষণকারী, বিশেষতঃ উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা এর সত্যতায় বিশ্বাস করেন। তবে এখানে আমি কোন উদাহরণ দেব না, কারণ প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিরাটভাবে ক্রমবিকশিত একটি অংশের এবং একই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অব্যবহারের দ্বারা অন্য ও সংলগ্ন অঙ্গের হ্রাসপ্রাপ্তির, অন্যদিকে অন্য ও সংলগ্ন অঙ্গের অতিরিক্ত বৃদ্ধির জন্য একটি অংশের পুষ্টিকর খাদ্যের প্রকৃত প্রত্যাহারের ফলাফলগুলির মধ্যে তফাতের কোন পথ আমি কদাচিৎ লক্ষ্য করি।
ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে উপস্থাপিত কয়েকটি ঘটনা এবং এভাবে অন্য কতিপয় তথ্যকে আরও একটি সাধারণ সূত্রের সঙ্গে একত্রীভূত করা যেতে পারে। সূত্রটি হচ্ছে–প্রাকৃতিক নির্বাচন জীবের প্রত্যেক অংশকে সঞ্চয়ী করার চেষ্টা করছে; এ সম্পর্কেও আমার সন্দেহ আছে। জীবনের পরিবর্তিত পরিবেশে পূর্বে উপকারী একটি গঠন এখন কম উপকারী হলে তার জন্য এটির হ্রাসপ্রাপ্তি লাভজনক হবে, কারণ একটি অপকারী অঙ্গের গঠনে পুষ্টিকর খাদ্যের অপচয় না করে এটি এককটির ক্ষেত্রে লাভজনক হবে। সিরিপেড প্রাণীদের পরীক্ষার সময় আশ্চর্যান্বিত হয়ে আমি একটি ঘটনা লক্ষ্য করি এবং এর সদৃশ অন্য অনেক উদাহরণও উপস্থিত করা যেতে পারে। ঘটনাটি হল–একটি সিরিপেড প্রাণী যখন অন্য সিরিপেডের মধ্যে পরজীবী হিসাবে বাস করে এবং এভাবে সুরক্ষিত হয়, তখন সে তার নিজস্ব খোলক অথবা আবরণীটি সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলে। পুরুষ ইবলাদের ক্ষেত্রে ঘটনাটি এই রকম হয় এবং প্রোটিওলেপাসদের ক্ষেত্রে ঘটনাটি প্রকৃতই অসাধারণ : কারণ অন্য সকল সিরিপেডদের বাইরের খোলকটি (ক্যারাপাস) বিরাটভাবে বিকশিত মাথার তিনটি অতিশয় বিকশিত খণ্ড দিয়ে তৈরি এবং এটি বড় শিরা ও মাংসপেশী দ্বারা সজ্জিত; কিন্তু পরজীবী ও সংরক্ষিত প্রোটিওলেপাসের মাথায় সমগ্র অগ্রবর্তী অংশটি আঁকড়ে ধরার শুঙ্গের গোড়ায় সংযুক্ত কেবল অবর্ধক অঙ্গ হিসেবে হাসপ্রাপ্ত হয়। এখন একটি বিরাট ও জটিল দেহগঠন, যদিও অতিরিক্ত হয়, প্রজাতির প্রত্যেক পর্যায়ক্রমিক এককদের ক্ষেত্রে নিশ্চয় সুবিধাজনক হবে, কারণ জীবনসংগ্রামে–যাতে প্রত্যেক প্রাণীকেই অংশগ্রহণ করতে হয়-প্রত্যেকের পুষ্টিকর খাদ্য কম নষ্ট করে নিজেকে রক্ষা করার ভাল সম্ভাবনা থাকবে।
যে কোন উপায়ে অন্য কোন অংশের সমমাত্রায় বিরাটভাবে বিকশিত হওয়া ছাড়া যে মুহূর্তে এটি পরিবর্তিত স্বভাবসমূহের মাধ্যমে অতিরিক্ত হয়, তখন তার পরিণামে প্রাকৃতিক নির্বাচন জৈব সংগঠনের যে কোন অংশকে হ্রাস করতে চেষ্টা করবে। পক্ষান্তরে, কোন সংলগ্ন অঙ্গের হাসের প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রয়োজন ছাড়া প্রাকৃতিক নির্বাচন একটি অঙ্গের বিরাটভাবে বিকাশ ঘটাতে সঠিকভাবে কৃতকার্য হতে পারে।
বহুবিধ, অবর্ধক বা লুপ্তপ্রায় ও নিম্নস্তরে সংগঠিত দেহগঠনসমূহ পরিবর্তনশীল হয়
ইসিডোর জিওফ্রয় সেন্ট হিলারের বক্তব্য অনুসারে ভ্যারাইটি ও প্রজাতিদের উভয় ক্ষেত্রেই এটি একটি নিয়ম বলে মনে হয় যে একই এককে যে কোন অংশ বা অঙ্গ যখন অসংখ্যবার পুনরাবৃত্ত হয় (যেমন সাপেদের কশেরুকায় ও বহু পুংকেশরযুক্ত ফুলের পুংকেশরে), তখন সংখ্যাটি পরিবর্তনযোগ্য হয়; অন্যথায় কম সংখ্যার একই অংশ বা অঙ্গটি স্থায়ী বা অপরিবর্তনীয় হয়। পূর্বোক্ত বিশেষজ্ঞ ও কতিপয় উদ্ভিদবিজ্ঞানীর মত হচ্ছে, বহুবিধ অংশগুলি গঠনে পরিবর্তিত হতে ভীষণভাবে সম্ভাবনাযুক্ত হয়। অধ্যাপক ওয়েনের কথামতো বললে “উদ্ভিজ্জ পুনরাবৃত্তি” যেহেতু নিম্ন সংগঠনের একটি সূচকচিহ্ন, সেহেতু উপরোক্ত বক্তব্যগুলি প্রকৃতিবিদদের সাধারণ মতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ যে প্রাকৃতিক মানদণ্ডে নিম্নবর্গের জীবরা উচ্চবর্গের জীবদের তুলনায় অধিকতর পরিবর্তনশীল। আমি সাময়িকভাবে ধরে নিচ্ছি যে এখানে নিম্নতার অর্থ হচ্ছে জীবটির কতিপয় অংশ বিশেষ প্রক্রিয়ার জন্য বিশেষভাবে গঠিত, এবং যত সময় পর্যন্ত একই অঙ্গকে নানামুখী কাজ করতে হয়, তা থেকে আমরা বোধ হয় লক্ষ্য করতে পারি কেন এটি পরিবর্তনযোগ্য হবে, অর্থাৎ কেন প্রাকৃতিক নির্বাচন অতি যত্নসহকারে আকারটির প্রত্যেক অল্প বিচ্যুতির সংরক্ষণ বা বর্জন করবে না যখন প্রত্যঙ্গটিকে একটি বিশেষ কার্য। করতে হয়। একইভাবে যার দ্বারা অনেক কিছু কাটা যায় এমন একটি ছুরি যে কোন আকারের হতে পারে, অন্যদিকে বিশেষ কাজের জন্য একটি হাতিয়ার নিশ্চয় বিশেষ একটি আকারের হবে। ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রত্যেক জীবের সুবিধার জন্য ও তাদের মাধ্যমেই কাজ করে থাকে।
এটি সাধারণভাবে স্বীকৃত যে অবর্ধক বা লুপ্তপ্রায় প্রত্যঙ্গগুলি অত্যন্ত পরিবর্তনশীল। এ বিষয়টিতে আমরা পুনরায় ফিরে আসব; এবং আমি এখানে আরও বলব যে এদের অকার্যকারিতা থেকে মনে হয় পরিবর্তনীয়তা বা পরিবর্তনশীলতার উদ্ভব ঘটে এবং পরিণামে এদের দেহগঠনের বিচ্যুতিসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কোন ক্ষমতা থাকে না।
নিকট সম্বন্ধীয় প্রজাতির একই প্রত্যঙ্গের তুলনায় যে কোন প্রজাতির অস্বাভাবিক মাত্রায় বা উপায়ে ক্রমবিকশিত প্রত্যঙ্গটি অতি পরিবর্তনশীল হতে প্রবণ হয়
উপরোক্ত বিষয়ে কয়েক বছর পূর্বে মিঃ ওয়াটারহাউসের মন্তব্যে আমি অতিশয় বিস্মিত হয়েছিলাম। অধ্যাপক ওয়েন-ও সম্ভবতঃ একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। অসংখ্য। উদাহরণ না দিলে উপরের প্রস্তাবের সত্যতা প্রমাণ করার চেষ্টা ব্যর্থ হবে। ঐ সব উদাহরণ আমি নিজে সংগ্রহ করেছি এবং সেগুলি সম্ভবতঃ এখানে উপস্থিত করা যাবে না। আমি কেবল আমার প্রত্যয় ব্যক্ত করতে পারি যে এটি একটি সার্বজনীন নিয়ম। ভুলভ্রান্তির কয়েকটি কারণ সম্বন্ধে আমি অবগত। বরং আমি এদের অনুমোদন করার আশা করি। এটি বোঝা উচিত যে যত অস্বাভাবিকভাবেই বিকশিত হোক না কেন, নিয়মটি কোন প্রত্যঙ্গের ক্ষেত্রে কোনভাবেই প্রযোজ্য নয়। তা না হলে এটি অনেক নিকট সম্পর্কীয় প্রজাতির একই প্রত্যঙ্গের তুলনায় একটি বা কতিপয় প্রজাতিতে অস্বাভাবিকভাবে ক্রমবিকশিত হয়। এভাবে স্তন্যপায়ী শ্রেণীর মধ্যে একটি বাদুড়ের ডানা সবচেয়ে অস্বাভাবিক গঠনের হয়, কিন্তু নিয়মটি এখানে প্রযোজ্য হবে না, কারণ সমস্ত বাদুড়েরাই ডানার অধিকারী। এটি কেবল তখনই প্রযোজ্য হবে, যখন একই গণের অন্য প্রজাতিদের তুলনায় কোন একটি প্রজাতির ডানা উল্লেখযোগ্যভাবে বিকশিত হয়। কোন অস্বাভাবিক উপায়ে প্রদর্শিত গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যগুলির ক্ষেত্রে নিয়মটি কঠোরভাবে প্রযোজ্য। হান্টার কর্তৃক ব্যবহৃত গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্য অভিধাটি একটি লিঙ্গের সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু জননপ্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নয় এমন বৈশিষ্ট্যসমূহের সঙ্গে সম্পর্কিত। নিয়মটি পুরুষ ও স্ত্রী উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য; তবে স্ত্রীদের ক্ষেত্রে অনেক কম প্রযোজ্য, কারণ এরা কদাচিৎ গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্য উপস্থিত করে। এত সরলভাবে গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া নিয়মটি কোন অস্বাভাবিক উপায়ে প্রদর্শিত হোক বা না হোক, এ সব বৈশিষ্ট্যের বিরাট পরিবর্তনশীলতার বা বিভিন্নতার জন্য হতে পারে। এ ব্যাপারে বোধহয় কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু নিয়মটি যে গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যগুলির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, তা উভলিঙ্গী সিরিপেডদের ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে; এই বর্গটি পরীক্ষা করার সময় আমি ওয়াটারহাউসের বক্তব্যকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলাম, এবং আমি দৃঢ়নিশ্চিত যে নিয়মটি প্রায় সর্বদাই খাটে। ভবিষ্যতে আমি আরও উল্লেখযোগ্য ঘটনার তালিকা দেব; আমি এখানে উদাহরণ দেব যেখানে নিয়মটি সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য, শুধুমাত্র সেইগুলির। পদবিহীন সিরিপেডদের ওপারকিউলার ভালভৃগুলির গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং এমন কি ভিন্ন গণগুলিতে এদের পার্থক্য বা ভিন্নতা নিতান্তই নগণ্য; কিন্তু পিরগোমা নামে একটি গণের কতিপয় প্রজাতির এই ভালভৃগুলি অতি বিস্ময়করভাবে ভিন্ন হয়; ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিদের সমরূপ ভালভৃগুলি কোন কোন সময় আকারে অসদৃশ হয়; এবং একই প্রজাতির এককদের পরিবর্তনের পরিমাণ এত বিরাট হয় যে এটি বলা অত্যুক্তি হবে না যে অন্য ভিন্ন গণের অন্তর্ভুক্ত প্রজাতিদের তুলনায় একই প্রজাতির ভ্যারাইটিগুলির এইসব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ থেকে উদ্ভূত বৈশিষ্ট্যসমূহ পরস্পরের থেকে আরও বেশি ভিন্ন হয়।
পাখিদের ক্ষেত্রে, একই দেশে বসবাসকারী একই প্রজাতির এককরা অতি অল্পই পরিবর্তিত হয়–এটা আমি বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি; এবং নিয়মটি নিশ্চয় এই শ্রেণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। নিয়মটি উদ্ভিদদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য কিনা তা আমি বুঝে উঠতে পারিনি। উদ্ভিদের পরিবর্তনশীলতার বিভিন্ন আপেক্ষিক মাত্রার তুলনা করাটা উদ্ভিদদের বিপুল পরিবর্তনশীলতার দরুন অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ বলেই রক্ষা, অন্যথায় বিষয়টির সত্যতা সম্পর্কে আমার বিশ্বাস দারুণভাবে নাড়া খেত।
যখন আমরা দেখি যে একটি প্রজাতির কোন অংশ বা অঙ্গ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বা উপায়ে বিকশিত হয়, তখন সন্তোষজনক সম্ভাবনাটি হচ্ছে–এটি প্রজাতির পক্ষে অতি প্রয়োজনীয়, তা সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে এটি স্পষ্টতঃ পরিবৃত্তির জন্য দায়ী। কেন এরূপ হওয়া। উচিত? একটি মতবাদ অনুসারে, আমরা এদের এখন যেমন দেখি, সেভাবে সমস্ত প্রত্যঙ্গ সমেত প্রত্যেক প্রজাতি স্বাধীনভাবে সৃষ্টি হয়েছে। এর কোন ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পাইনি। কিন্তু অন্য একটি মতবাদ অনুসারে, প্রজাতির গোষ্ঠীগুলি অন্য কোন প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। আমার মনে হয় এর থেকে কিছু সত্যের আলো পেতে পারি আমরা। প্রথমে আমাকে কিছু প্রাথমিক বক্তব্য বলতে দেওয়া হোক। আমাদের গৃহপালিত প্রাণীদের ক্ষেত্রে, যে কোন অংশ বা সমগ্র প্রাণীটি যদি অবহেলিত হয় এবং যদি কোন নির্বাচন প্রয়োগ না করা হয়, তাহলে সেই অংশটি (উদাহরণস্বরূপ, কিং ফাউলের ঝুঁটি) অথবা সমগ্র জাতটি আর সমরূপ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন থাকবে না : এবং বলা যেতে পারে জাতটি বংশোচিত বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। অবর্ধক বা লুপ্তপ্রায় অঙ্গসমূহে এবং বিশেষ উদ্দেশ্যের জন্য অল্প বিশিষ্ট অঙ্গসমূহে এবং সম্ভবতঃ বহুরোপক গোষ্ঠীসমূহে, আমরা প্রায়শই এরূপ ঘটনা লক্ষ্য করি; কারণ এইসব ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচন হয় পূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি অথবা করতে পারেনি, এবং এভাবে জৈবসংগঠনটি অনিয়মিতভাবে বাড়া-কমা বা অস্থির অবস্থায় পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু এখানে যা আমাদের আরও বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন করে তা হল–আমাদের গৃহপালিত প্রাণীদের বর্তমানে অনবরত নির্বাচনের দ্বারা দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে এমন সব অঙ্গগুলিও স্পষ্টতঃ পরিবৃত্তির সম্ভাবনাযুক্ত হয়। পায়রাদের একই জাতের এককদের লক্ষ্য করুন, দেখবেন লোটনদের চঞ্চুতে, গিরাবাজদের চঞ্চু ও মাথা আর গলার ঝুঁটিতে, লক্কাদের হাঁটাচলা বা দাঁড়ানোর ভঙ্গি ও লেজ ইত্যাদিতে কী বিপুল পরিমান পার্থক্য রয়েছে। এইসব বৈশিষ্ট্যের প্রতি ব্রিটিশ পাখিরসিক বা পাখিপ্রেমিকরা এখন মনোনিবেশ করেছেন। এমন কি ছোট মুখওয়ালা লোটনের মতো একই উপজাতটির ক্ষেত্রেও প্রায় নিখুঁত পাখিদের প্রজনন করা অতিশয় কষ্টসাধ্য, অনেকেই মূলগত মান থেকে বিপথে গমন করে। সঠিকভাবে বলতে গেলে বলা যেতে পারে যে একদিকে কম নিখুঁত অবস্থায় পূর্বানুবৃত্তির প্রবণতা এবং নূতন পরিবর্তনগুলির দিকে সহজাত প্রবণতা, অন্যদিকে জাতটিকে নিখুঁত রাখতে স্থায়ী নির্বাচনের ক্ষমতার মধ্যে অনবরত একটি সংগ্রাম চলছে। পরিশেষে নির্বাচনই জয়ী হয়, এবং আমরা একটি ভাল। ছোট মুখওয়ালা স্ট্রেন থেকে একটি সাধারণ লোটন পায়রার মতো পাখি প্রজনন করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হওয়ার আশা করি না। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত নির্বাচন দ্রুত হারে চলতে থাকে, ততদিন পর্যন্ত রূপান্তরিত হচ্ছে এমন অঙ্গসমূহে অতি পরিবর্তনশীলতা সর্বদাই আশা করা যেতে পারে।
এখন আমাদের প্রকৃতির দিকে লক্ষ্য করা উচিত। একই গণের অন্য প্রজাতিদের তুলনায় যে কোন একটি প্রজাতির একটি প্রত্যঙ্গ যখন বিস্ময়করভাবে ক্রমবিকশিত হয়, তখন আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে ঐ প্রত্যঙ্গটি সেই সময় থেকে অস্বাভাবিক। পরিমাণে বা হারে রূপান্তরিত হয়েছে, যে সময় কতিপয় প্রতি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়। এই সময়টি অতিমাত্রায় দীর্ঘ হয় না, কারণ এজাতিরা কদাচিৎ একটি ভূতাত্ত্বিক যুগের বা পর্যায়ের বেশি স্থায়ী হয়। অস্বাভাবিক পরিমাণ রূপান্তরের অর্থ হচ্ছে পরিবর্তনশীলতার বা বিভিন্নতার একটি অস্বাভাবিকভাবে বিরাট ও দীর্ঘস্থায়ী পরিমাণ, যেটি প্রজাতির উপকারের জন্য প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা অবিচ্ছিন্নভাবে সঞ্চয়ীভূত। হয়েছে। কিন্তু যেহেতু অস্বাভাবিকভাবে ক্রমবিকশিত প্রত্যঙ্গ বা অঙ্গের পরিবর্তনশীলতা বা বিভিন্নতা এত বিরাটভাবে এবং অধিক দূরবর্তী নয় এমন সময় পর্যন্ত নিরবিচ্ছন্নভাবে ঘটেছে, সেহেতু আরও দীর্ঘসময় ধরে প্রায় স্থায়ী এমন জৈবসংগঠনের অন্য প্রত্যঙ্গদের তুলনায় এরূপ প্রত্যঙ্গসমূহে আরও বিভিন্নতা বা পরিবর্তনশীলতা একটি সাধারণ নিয়ম অনুসারে তখনও আশা করতে পারতাম। আমি স্থিরনিশ্চিত যে এটাই হচ্ছে আসল ঘটনা। একদিকে প্রাকৃতিক নির্বাচন, অন্যদিকে পূর্বানুবৃত্তি ও বিভিন্নতা বা পরিবর্তনশীলতার প্রবণতার মধ্যে সংগ্রাম কালক্রমে বন্ধ হবে এবং অস্বাভাবিকভাবে বর্ধিত অঙ্গগুলি স্থায়ী হতে পারবে, এ সব বিষয়ে সন্দেহ করার কোন কারণ আমি দেখি না। অতএব যখন একটি অঙ্গ, যতই অস্বাভাবিক হোক না কেন, অসংখ্য রূপান্তরিত বংশধরে প্রায় একই অবস্থাকে বংশগতভাবে প্রেরণ করে, যেমন বাদুড়ের ডানা, তখন আমাদের তত্ত্বানুসারে এটি বিরাট সময় ধরে প্রায় একই অবস্থায় অবস্থান করে থাকবে এবং এভাবে এটি অন্য কোন দেহগঠনের তুলনায় অধিকতর পরিবর্তনশীল হবে না। এটি কেবলমাত্র সেই সব ক্ষেত্রে হয় যেখানে রূপান্তরটি তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিককালের এবং এত অস্বাভাবিকভাবে বিরাট হয়েছে যে যাকে আমরা বলি উৎপাদনশীল পরিবর্তনশীলতা বা বিভিন্নতা, তা তখনও উচ্চমাত্রায় উপস্থিত বা বজায় থাকে। কারণ এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উপায় ও মাত্রায় পরিবর্তনশীল এককদের নিরবচ্ছিন্ন নির্বাচন দ্বারা এবং পূর্বে ও কম রূপান্তরিত অবস্থায় প্রত্যাবর্তনের প্রবণতাসম্পন্ন এককদের অনবরত বাতিলের দ্বারা পরিবর্তনশীলতা বা বিভিন্নতা তখনও পর্যন্ত কদাচিৎ স্থায়ী হবে।
গণীয় বৈশিষ্ট্যের তুলনায় প্রজাতিক বৈশিষ্ট্য আরও বেশি পরিবর্তনশীল
আগের রচনার শিরোনাম অংশটিতে আলোচিত পদ্ধতিটি বর্তমান বিষয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এটি সুবিদিত যে প্রজাতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ গণীয় বৈশিষ্ট্যগুলির তুলনায় অধিকতর পরিবর্তনশীল। এটির অর্থ একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক : উদ্ভিদের বড় একটি গণের কতিপয় প্রজাতির ফুলের রং যদি নীল হয় এবং কয়েকটির রং লাল হয়, তাহলে রংটি কেবল প্রজাতিক বৈশিষ্ট্যের হবে, এবং নীল প্রজাতির লাল প্রজাতিতে রূপান্তর বা বিপরীত ঘটনা দেখে কারও আশ্চর্য হওয়া উচিত হবে না; কিন্তু সব প্রজাতির ফুলের রং নীল হলে, রংটি গণীয় বৈশিষ্ট্যের হবে এবং তার পরিবর্তন আরও বেশি অস্বাভাবিক ধরনের হবে। আমি এই উদাহরণটি মনোনীত করেছি, কারণ অধিকাংশ প্রকৃতিবিদের দেওয়া এই ব্যাখ্যাটি এখানে প্রযোজ্য নয় যে প্রজাতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ গণীয় বৈশিষ্ট্যের তুলনায় অধিকতর পরিবর্তনশীল, কারণ গণেদের শ্রেণীবিভাগের জন্য সাধারণভাবে ব্যবহৃত বৈশিষ্ট্যগুলির তুলনায় কম শারীরবৃত্তীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গদের থেকে এদের গ্রহণ করা হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি এই ব্যাখ্যা আংশিক হলেও অপ্রত্যক্ষভাবে সত্য, তবে শ্রেণীবিভাগ অধ্যায়ে আমি এ বিষয়ে ফিরে আসব। এই বক্তব্যের সমর্থনে প্রমাণ উপস্থাপন করা প্রায় অনাবশ্যক যে সাধারণ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলি গণীয় বৈশিষ্ট্যের তুলনায় অধিকতর পরিবর্তনশীল হয়; কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলির ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক ইতিহাসের ওপর লেখাগুলিতে আমি বারংবার লক্ষ্য করেছি যখন একজন লেখক সবিস্ময়ে মন্তব্য করেন যে প্রজাতিদের একটি বিরাট গোষ্ঠীর সকলের ক্ষেত্রে সাধারণত অপরিবর্তনশীল গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গ নিকটসম্বন্ধীয় প্রজাতিগুলির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন হয়, তখন এটি একই প্রজাতির এককগুলিতে প্রায়শই পরিবর্তনশীল হয়। এবং এই ঘটনাটি দেখায় যে সাধারণতঃ গণীয় মূল্যের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যখন তার মূল্যে হাস পায় এবং কেবল প্রজাতিকে মূল্যের হয়, তখন এটি প্রায়শই পরিবর্তনশীল হয়, যদিও এর শারীরবৃত্তীয় গুরুত্ব একই থাকে। একই বক্তব্য কয়েকটি অঙ্গবিকৃতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অন্ততঃ ইসিডোর জিওফ্রয় সেন্ট হিলারে আপাত সন্দেহাতীতভাবে মনে করেন যে একই গোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির একটি অঙ্গ সাধারণভাবে যত বেশি ভিন্ন হয়, এককগুলিতে তত বেশি অনিয়মিত আকার দেখতে পাওয়া যায়।
প্রত্যেক প্রজাতি স্বাধীনভাবে সৃষ্ট হয়েছে–এই সাধারণ মতানুসারে, একই গণের স্বাধীনভাবে সৃষ্ট অন্য প্রজাতির একই প্রত্যঙ্গ থেকে ভিন্ন এমন দেহগঠনের ঐ প্রত্যঙ্গ টি সেইসব প্রত্যঙ্গদের তুলনায় অধিক পরিবর্তনশীল কেন হবে, যেগুলো কতিপয় প্রজাতিতে সদৃশ? আমি বুঝতে পারি না এর কোন্ ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু প্রজাতিরা কেবল স্পষ্টচিহ্নিত ও স্থায়ী ভ্যারাইটি–এই মতানুসারে আমরা প্রায়শই আশা করতে পারি যে এদের দেহগঠনের ঐ সব প্রত্যঙ্গ এখনও পরিবর্তিত হচ্ছে, যেগুলি আবার সাম্প্রতিককালের মধ্যে পরিবর্তিত হয়েছে এবং যা এভাবে ভিন্ন হয়েছে। অথবা ঘটনাটিকে অন্যভাবে ব্যক্ত করলে–যে লক্ষণগুলির দ্বারা একটি গণের সমস্ত প্রজাতি পরস্পরের সদৃশ হয় এবং নিকট সম্পর্কীয় গণগুলির থেকে এরা ভিন্ন হয়, এই লক্ষণগুলিকে গণীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বলে; এবং এই বৈশিষ্ট্যগুলি একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বংশগতভাবে প্রাপ্ত হয়েছে বলা যেতে পারে, কারণ এটি কদাচিৎ ঘটতে পারে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন ঠিক একইরকম কমবেশি ব্যাপকভাবে ভিন্ন স্বভাবের কতিপয় প্রজাতিকে রূপান্তরিত করে থাকবে : যেহেতু এইসব সুপরিচিত গণীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ঐ সময়কালের পূর্বে বংশগতভাবে প্রাপ্ত হয়েছে যে সময় কয়েকটি প্রজাতি তাগের সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে পরিবর্তিত হয়নি বা যে কোন মাত্রায় অথবা কেবল অল্প মাত্রায় পৃথক বা ভিন্ন হয়েছে, এটি সম্ভবপর নয় যে এরা বর্তমানে পরিবর্তিত হবে। বিপরীতক্রমে, যে লক্ষণগুলির দ্বারা একই গণের অন্য প্রজাতিদের থেকে প্রজাতিদের পৃথক করা হয়, সেই লক্ষণসমূহকে প্রজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বলে; এবং যেহেতু এইসব প্রজাতিক বৈশিষ্ট্য ঐ সময়কাল থেকে পরিবর্তিত হয়েছে এবং পৃথক হয়েছে যে সময়ে প্রজাতিরা একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছিল, সেহেতু এটি সম্ভবপর যে এরা তখনও পর্যন্ত কিছু মাত্রায় পরিবর্তনশীল হবে–যে প্রত্যঙ্গগুলি দীর্ঘসময় ধরে অপরিবর্তনীয় রয়েছে, জৈবসংগঠনের সেই প্রত্যঙ্গগুলি তুলনায় অন্ততঃ আরও বেশি পরিবর্তনশীল হবে।
গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যগুলি পরিবর্তনশীল।। আমি মনে করি যে কোন প্রকৃতিবিদই স্বীকার করবেন যে গৌণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি অতিশয় পরিবর্তনশীল। আরও স্বীকার করতে হবে যে একই গোষ্ঠীর প্রজাতিদের অন্যান্য প্রত্যঙ্গের তুলনায় এদের গৌণ যৌন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি পরস্পরের থেকে আরও ব্যাপকভাবে ভিন্ন হয়। উদাহরণস্বরূপ, গ্যালিনেসিয়াম পাখিদের গৌণ যৌন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান এমন পুরুষদের মধ্যে পার্থক্যের পরিমাণের সঙ্গে স্ত্রীদের মধ্যে পার্থক্যের পরিমাণের তুলনা করুন। এইসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মৌলিক পরিবর্তনশীলতার কারণটি স্পষ্ট নয়, কিন্তু আমরা দেখতে পারি কেন এরা অন্যদের তুলনায় স্থায়ী ও একইরূপের হয়ে থাকবে না, কারণ এরা যৌন নির্বাচন দ্বারা সঞ্চিত হয়েছে, যেটি এর কার্যকারিতায় সাধারণ নির্বাচনের তুলনায় কম কঠোর হয়, কারণ এটি মৃত্যু ঘটায় না বরং কম আনুকূল্য প্রাপ্ত পুরুষদের অল্প কয়েকটি বংশধর উৎপাদন করতে সাহায্য করে। এরা অতিশয় পরিবর্তনশীল বলে গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যসমূহের কারণ যাই হোক না কেন, যৌন নির্বাচন প্রক্রিয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়ে থাকবে এবং এভাবে একই গোষ্ঠীর প্রজাতিগুলিতে অন্য বিষয়গুলির তুলনায় পার্থক্যের বিরাটতর পরিমাণ প্রদান করতে সমর্থ হয়ে থাকবে।
এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা যে একই প্রজাতির দুটি লিঙ্গের মধ্যে গৌণ পার্থক্যগুলি দেহের সেই একই প্রত্যঙ্গসমুহেই সাধারণতঃ প্রদর্শিত হয়, যেগুলির দ্বারা একই গণের প্রজাতিরা পরস্পরের থেকে ভিন্ন হয়। এ বিষয়ে আমি দুটি উদাহরণ ব্যাখ্যা–সহ পেশ করব যা আমার কাছে আছে; এবং এইসব ক্ষেত্রে পার্থক্যগুলি অতি অস্বাভাবিক ধরনের হয় বলে সম্পর্কটি কদাচিৎ আকস্মিক ধরনের হতে পারে। গোড়ালির সন্ধিগুলির একই সংখ্যা বিরাট সাংখ্যক বিটলদের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য, কিন্তু ওয়েস্টউডের বক্তব্য অনুযায়ী এনগিডিদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি বিরাটভাবে ভিন্ন হয়; এবং এভাবে সংখ্যাটি একই প্রজাতির দুটি লিঙ্গে ভিন্ন হয়। পুনরায় ফোসোরিয়াল হাইমেনটেরাতে ডানার স্নায়ুবিন্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, কারণ এটি বিরাট গোষ্ঠীসমূহে সাধারণ ব্যাপার; কিন্তু কোন কোন গণে স্নায়ুবিন্যাস বিভিন্ন প্রজাতিতে এবং একইভাবে একই প্রজাতির দুটি লিঙ্গেও ভিন্ন হয়।
স্যার জে. লুবক সম্প্রতি উল্লেখ করেছেন যে কতিপয় ক্ষুদ্র খোলকী প্রাণীরা এই নিয়মের সুন্দর উদাহরণ উপস্থিত করে। “উদাহরণস্বরূপ, পন্টেলা প্রাণীদের সামনের শুঙ্গ (অ্যান্টেনা) ও পায়ের পঞ্চম জোড়ায় যৌন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ মূলতঃ প্রদর্শিত হয়: এই অঙ্গগুলির দ্বারা প্রজাতি