পাত্র নিতান্ত হতদরিদ্র জেনেও তার সিদ্ধান্ত ইতিবাচকই ছিল। ঘাড়ের উপর থেকে আপদ বিদেয় হচ্ছে, এতেই যারপরনাই খুশি ছিল সে; বাছ-বিচারের ধার ধারেনি। তার নিজেরও বিবাহযোগ্যা মেয়ে আছে, পরের মেয়ের জন্য রাজপুত্তুর খোঁজার সময় কোথায় তার?
কোনরকম পণ ছাড়া, বলতে গেলে এক কাপড়েই নতুন বউকে ঘরে তুলেছিল মাখনলাল। তবে পরদিনই গ্রামের হাট থেকে সাধ্যমত আলতা-চুড়ি কিনে দিয়েছিল সে বউকে, কোন কার্পণ্য করেনি। অল্প সময়েই মেয়েটাকে ভালবেসে ফেলেছে সে, আপন বলতে তারও তো কেউ নেই ত্রিভুবনে।
মাখনলাল বাড়ি আছে কিনা সে খবরটা জানতেই এদিকটায় এসেছে লতিফ মিয়া। মেয়েটাকে বেআব্রু দেখাটা তার বাড়তি পাওনা।
গাঁয়ের একেবারে শেষমাথায়, মরাখালের কোলঘেঁষে এক টুকরো খাস- জমিতে বসত গেড়েছে মাখনলাল। ত্রিসীমানায় অন্য কোন জনবসতি নেই’।
জমি কেনার মুরোদ নেই, তাই নিতান্ত বাধ্য হয়েই খাস জমিতে সংসার পাততে হয়েছে তাকে। যা আয় তার, তাতে দুটো প্রাণীতে খেয়ে-পরে বাঁচা যায় ঠিকই, তবে জমি কেনার কথা কল্পনাতেও আনা যায় না।
আরেক দফা দমকা হাওয়া গায়ে লাগতেই টনক নড়ল লতিফ মিয়ার। বহুকষ্টে ঘাটের উপর থেকে নজর সরিয়ে, ফিরতি পথ ধরল।
কখন যে এতটা সময় পেরিয়ে গেছে, টেরই পায়নি সে। দেরি করার জন্য নিশ্চিত আজ মতি চেয়ারম্যানের খিস্তি শুনতে হবে।
তবে দেরি করার কারণটা চেয়ারম্যান সাহেবকে বলা যাবে না কিছুতেই। নয়তো পিটিয়ে তার হাড়গোড় সব গুঁড়ো করে ফেলবে দজ্জাল চেয়ারম্যান।
মাখনলালের বউটার জন্য খানিকটা আফসোসই হলো লতিফ মিয়ার। মাগীর কী দরকার ছিল ভর সন্ধ্যায় চেয়ারম্যান বাড়িতে পানি আনতে যাওয়ার? এক বেলা পানি না খেলে মরে যায় নাকি মানুষ? ভেজা কাপড়ে চেয়ারম্যানের সামনে না গেলে পেটের ভাত হজম হচ্ছিল না?
ঘরের দাওয়ায় জলচৌকিতে বসে আয়েশ করে হুক্কা টানছিল তখন মতি সেই সঙ্গে চোখ দিয়ে চাটছিল মেয়েটার সারা শরীর। চেয়ারম্যানের এহেন দৃষ্টি লতিফ মিয়ার বহুকালের চেনা। তখনই সে বুঝে গিয়েছিল, সর্বনাশ হতে চলেছে মেয়েটার। একবার কারও উপর মতি চেয়ারম্যানের নজর পড়লে, তার আর নিস্তার নেই।
দ্রুত পা চালাল লতিফ মিয়া। বাড়ি নেই মাখনলাল, সদাই-পাতি নিয়ে গঞ্জে গেছে; খবরটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে পৌছানো দরকার!
দুই
মাঝরাতের পরপরই সন্তর্পণে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল মতি চেয়ারম্যান। বলা বাহুল্য, ছায়াসঙ্গী হয়ে তার সঙ্গে সেঁটে রইল লতিফ মিয়া। নিজে চলনদার হয়ে চেয়ারম্যানকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছে সে।
আকাশে ঝুলছে ক্লান্ত চাঁদ। তবে রাতজাগা পাখিরা ডেকে চলেছে বিরামহীন। খাবারের সন্ধানে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে দলছুট খেঁকশেয়ালেরা; আলোর পিদিম বয়ে নিয়ে ওদেরকে সঙ্গ দিচ্ছে জোনাকির ঝাঁক।
কাঁটাঝোপ এড়িয়ে মেঠোপথ ধরে দ্রুতলয়ে হেঁটে চলেছে দু’জন মানুষ। ইতোমধ্যে জলদি পা চালানোর জন্য বার দুয়েক লতিফ মিয়াকে তাগাদা দিয়ে ফেলেছে মতি। আজ বহুদিন পর শিকারে নেমেছে সে, কিছুতেই যেন তর সইছে না তার। প্রবল উত্তেজনায় কাঁপছে গোটা শরীর, রক্তে যেন বান ডেকেছে। আদিম নেশাটা ঝালিয়ে নেয়ার সুযোগ কদাচিৎই মেলে; পুরোটা সময় রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করতে চায় সে।
বাঁশের বেড়ার দেয়াল, উপরে ছনের ছাউনি; ঘর বানানোর জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু জোগাড় করার সামর্থ্য হয়নি মাখনলালের। একখানা চেলাকাঠ আড়াআড়ি করে গুঁজে দিয়ে ঘরের একমাত্র দরজাটা বন্ধ রাখা হয়।
চোর-ডাকাতের ভয় নেই, কেবল শেয়াল-কুকুরকে ঘরে ঢোকা থেকে বিরত রাখাটাকেই দরজাটার একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে ধরা হয়।
লতিফ মিয়ার কাঁধের জোরাল এক ধাক্কায় পাটকাঠির মত মট করে ভেঙে গেল চেলাকাঠটা; পরক্ষণেই হাঁ করে খুলে গেল দরজাটা।
বিদ্যুৎ খেলে গেল মতি চেয়ারম্যানের দেহে, অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ঘরের ভিতর সেঁধিয়ে গেল সে। উইয়ের ঢিবির মত প্রকাণ্ড ভুঁড়িটাকে অনুসরণ করল তার বাকি শরীর।
চেয়ারম্যানকে ঘরের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেখল লতিফ মিয়া, পরের কয়েকটা মুহূর্ত কান খাড়া করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল সে। পরক্ষণেই কানে এল কাঙ্ক্ষিত গোঙানির শব্দটা; মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল তার। হাত বাড়িয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল সে, আপাতত আর চাঁদের আলোর দরকার নেই চেয়ারম্যান সাহেবের।
না তাকিয়েও ভিতরে কী হচ্ছে দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছে লতিফ মিয়া বিশাল থালার মত হাতের তালু দিয়ে মেয়েটার মুখ চেপে ধরেছে মতি চেয়ারম্যান। নিজের জগদ্দল পাথরের মত শরীরটা চাপিয়ে দিয়েছে মেয়েটার শীর্ণ দেহের উপর। ছাড়া পাওয়ার জন্য আরও কিছুক্ষণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে মেয়েটা, তবে অচিরেই ক্ষান্ত দিতে হবে তাকে। বুঝে যাবে, এই দানবের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া রীতিমত অসম্ভব।
মাঝারী আকারের একটা কদম গাছের তলায় ঘন হয়ে জন্মে আছে কিছু দূর্বাঘাস। গাছের গুঁড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে ওখানটাতেই বসে পড়ল লতিফ মিয়া। লুঙ্গির কোঁচা থেকে প্যাকেট বের করে একখানা বিড়ি ধরিয়ে আয়েশ করে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল; প্রশান্তির রেশ ছড়িয়ে পড়েছে তার গোটা অবয়বে।