- বইয়ের নামঃ ট্যাবু
- লেখকের নামঃ তৌফির হাসান উর রাকিব
- সিরিজঃ সেবা হরর সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী বই
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প
ট্যাবু
হনন
এক
মাঘ মাসের মাঝামাঝি সময়ে হাড় কাঁপানো শীত পড়ার কথা। অথচ শীতের পরিবর্তে ঝোড়ো হাওয়ার তাণ্ডবে জগৎ অস্থির। সেই দমকা বাতাসেও কনকনে মিহি হিমের আমেজটুকু নেই, আছে অদ্ভুত এক ধরনের খেপাটে ভাব।
দিগ্ভ্রান্ত বাতাসেরা হাতে হাত রেখে চলতে-চলতে আচমকাই গোত্তা মেরে নেমে আসে চকের উপর। নরম-নরম ধানগাছগুলোকে ঠেসে ধরে মাটির সঙ্গে। কীসের চাপা আক্রোশে, কে জানে! তারপর আচমকাই হয়তো ওদেরকে মুক্তি দিয়ে ঘুরে যায় অন্য কোন দিকে।
ক্ষণে-ক্ষণেই এখানে-ওখানে জেগে ওঠে ধুলোর ঘূর্ণি।
পাগলা হাওয়ার তোড়ে পত-পত করে উড়তে থাকে কাকতাড়ুয়ার শরীরে পরানো বাহারী রঙের পুরনো জামা-কাপড়। মাঝে-মধ্যে হেঁচকা টানে সেগুলো খুলে আসে খড়ের পুতুলগুলোর শরীর ছেড়ে। তারপর কোথায় যে উড়ে গিয়ে পড়ে, তার হদিস কেউ পায় না।
কাঁচা রাস্তার ধারে একটা শতবর্ষী বটগাছ। তার হোঁৎকা মোটা গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়ানো লতিফ মিয়া অনেকটা আপনমনেই বার কয়েক বিড় বিড় করে, ‘আউলা বাতাস! লক্ষণ ভালা না। লক্ষণ ভালা না।’
আশৈশব সে শুনে এসেছে, শীতকালের আউলা বাতাস ভীষণ রকম অলক্ষুণে। গ্রামে দুঃখ-দুর্দশা ডেকে আনে। খোলা শরীরে আউলা বাতাস লাগলে সহজে রোগ-বালাই পিছু ছাড়ে না। মসজিদের ইমামকে দিয়ে শরীর বন্ধ না করা থাকলে, আউলা বাতাসে ঘোরাঘুরি করা কোন কাজের কথা না। অশুভ শক্তির নজর পড়ে যায়।
একবার তাদের নজর পড়লে, কৰ্ম্ম কাবার। কপালের জোর ছাড়া প্রাণ বাঁচানো দায় হয়ে পড়ে। অন্তত একটিবারের জন্য হলেও, যমে-মানুষে টানাটানি হবেই হবে।
ট্যাবু
এহেন ক্ষমতাধর আউলা বাতাসের সামনে পড়ে লতিফ মিয়া বিচলিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এই মুহূর্তে আউলা বাতাস নিয়ে খুব একটা ভাবছে না সে, তার সমস্ত মনোযোগ এখন মরাখালের ঘাটের দিকে।
সুদূর অতীতে মরাখালের নাম ছিল নারণী নদী। বর্ষায় পূর্ণযৌবনা সেই নদীর তর্জন-গর্জনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠত দশগাঁয়ের মানুষজন।
ভাঙনের হাত থেকে বাঁচার জন্য মন্দিরে পুজো দিত, মানত করত আর সাঁঝ ঘনালেই মসজিদের বারান্দায় জ্বেলে দিত সুগন্ধি আগরবাতি। একবার নারণী খেপে উঠলে কেবল ফসল নিয়েই ক্ষান্ত হত না, গোটা কয়েক প্রাণও কেড়ে নিত অবলীলায়।
কালের আবর্তে সবার চোখের সামনেই নারণী নদী ধীরে-ধীরে মরে গেল। দু’ধার চেপে এসে খরস্রোতা নদীটাকে গিলে নিল পুরোপুরি। সিটি কর্পোরেশনের ড্রেনের আকৃতি নিয়ে টিকে রইল কেবল শীর্ণ একখানা জলের ধারা। অবশ্য টিকে রইল না বলে, টিকিয়ে রাখা হলো বলাটাই বেশি যুক্তিসঙ্গত।
কারণ বহুরকমের কায়দা-কানুন করে আশপাশের মানুষজনই খালটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে আজতক। খেত-খামারে সেচের কাজে ব্যবহার করা হয় এর জল; সেজন্যই বাঁচিয়ে রাখা। নদী মরে গিয়ে এই খালের জন্ম, তাই লোকমুখে নারণী নদী রূপান্তরিত হয়েছে মরাখালে। গ্রামের প্রায় সব বাড়ির গা ঘেঁষে বয়ে যেতে হচ্ছে তাকে।
লোকেরা নিজেদের সুবিধামত এখানে-ওখানে ছোট-বড় ঘাট বানিয়েছে। ফসলের মৌসুমে ধান-পাট ধোয়ার কাজটা সেরে নেয়া যায়, আর বাড়ির বউ- ঝি’রা সারা বছর সেখানে থালা-বাসন মাজে, কাপড় কাচে। বাঁশের কঞ্চি আর কলাপাতা দিয়ে ঘিরে নিলে গোসলটাও দিব্যি সেরে নেয়া যায় মরাখালে।
এই মুহূর্তে তেমনই একটা ঘাটের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে লতিফ মিয়া।
শাড়ি-পেটিকোট হাতে মাখনলালের নতুন বউটা খানিকক্ষণ আগে বলতে গেলে একেবারে লতিফ মিয়ার চোখের সামনে দিয়েই ওখানটায় গিয়ে ঢুকেছে। গাছের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকায় লতিফ মিয়াকে দেখতে পায়নি সে।
আপনমনে কী যেন ভাবছিল মেয়েটা, চারপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেদিকে খুব একটা নজর ছিল না।
যে আউলা বাতাসের ভয়ে থরহরিকম্প দশা ছিল লতিফ মিয়ার, সেটাই শেষতক তার কপাল খুলে দিল। ঘাটের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বেখেয়ালে হেঁচকা টানে তুলে নিয়ে গেল খানিকটা পাতার আচ্ছাদন। আর তাতেই ঘাটের ভিতরের দৃশ্যটা এক লহমায় একেবারে লতিফ মিয়ার চোখের সামনে চলে এল। যা দেখতে চেয়েছিল তার প্রায় সবই দেখতে পাচ্ছে সে এখন, ফকফকা পরিষ্কার।
মাখনলালের বউটা আদতে এখনও কিশোরী, অন্তত ভরাযৌবনা বলা যাবে না তাকে কিছুতেই। তবুও তার স্নানের দৃশ্যটা উত্তেজিত করে তুলল লতিফ মিয়াকে।
মাখনলালের ভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে, গোটা কয়েক অশ্রাব্য গালি দিল তাকে লতিফ মিয়া। ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাচ্চা একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে হারামজাদা। কেন রে, ধাড়ি মেয়েছেলের বুঝি অভাব পড়েছে দেশে?
মেয়েটা এই গ্রামের কেউ না, উজান অঞ্চল থেকে তাকে বিয়ে করে এনেছে মাখনলাল। এর-ওর মালামাল গঞ্জে পৌঁছে দিতে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই উজানে যেতে হয় তাকে। এটাই ওর পেশা, একখানা ছোট ডিঙি নৌকাই তার একমাত্র সম্বল।
কিছুদিন আগে এমনই একটা সফর শেষে মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে ফিরেছে সে। বাপ-মা মরা মেয়ে, তিনকুলে আপন বলতে তেমন কেউ নেই। তাই স্বল্প পরিচিত মাখনলালের কাছে মেয়েটাকে বিয়ে দিতে কোন আপত্তি করেনি তার দূর সম্পর্কের কাকা।