- বইয়ের নামঃ ট্যাবু
- লেখকের নামঃ তৌফির হাসান উর রাকিব
- সিরিজঃ সেবা হরর সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী বই
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প
ট্যাবু
হনন
এক
মাঘ মাসের মাঝামাঝি সময়ে হাড় কাঁপানো শীত পড়ার কথা। অথচ শীতের পরিবর্তে ঝোড়ো হাওয়ার তাণ্ডবে জগৎ অস্থির। সেই দমকা বাতাসেও কনকনে মিহি হিমের আমেজটুকু নেই, আছে অদ্ভুত এক ধরনের খেপাটে ভাব।
দিগ্ভ্রান্ত বাতাসেরা হাতে হাত রেখে চলতে-চলতে আচমকাই গোত্তা মেরে নেমে আসে চকের উপর। নরম-নরম ধানগাছগুলোকে ঠেসে ধরে মাটির সঙ্গে। কীসের চাপা আক্রোশে, কে জানে! তারপর আচমকাই হয়তো ওদেরকে মুক্তি দিয়ে ঘুরে যায় অন্য কোন দিকে।
ক্ষণে-ক্ষণেই এখানে-ওখানে জেগে ওঠে ধুলোর ঘূর্ণি।
পাগলা হাওয়ার তোড়ে পত-পত করে উড়তে থাকে কাকতাড়ুয়ার শরীরে পরানো বাহারী রঙের পুরনো জামা-কাপড়। মাঝে-মধ্যে হেঁচকা টানে সেগুলো খুলে আসে খড়ের পুতুলগুলোর শরীর ছেড়ে। তারপর কোথায় যে উড়ে গিয়ে পড়ে, তার হদিস কেউ পায় না।
কাঁচা রাস্তার ধারে একটা শতবর্ষী বটগাছ। তার হোঁৎকা মোটা গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়ানো লতিফ মিয়া অনেকটা আপনমনেই বার কয়েক বিড় বিড় করে, ‘আউলা বাতাস! লক্ষণ ভালা না। লক্ষণ ভালা না।’
আশৈশব সে শুনে এসেছে, শীতকালের আউলা বাতাস ভীষণ রকম অলক্ষুণে। গ্রামে দুঃখ-দুর্দশা ডেকে আনে। খোলা শরীরে আউলা বাতাস লাগলে সহজে রোগ-বালাই পিছু ছাড়ে না। মসজিদের ইমামকে দিয়ে শরীর বন্ধ না করা থাকলে, আউলা বাতাসে ঘোরাঘুরি করা কোন কাজের কথা না। অশুভ শক্তির নজর পড়ে যায়।
একবার তাদের নজর পড়লে, কৰ্ম্ম কাবার। কপালের জোর ছাড়া প্রাণ বাঁচানো দায় হয়ে পড়ে। অন্তত একটিবারের জন্য হলেও, যমে-মানুষে টানাটানি হবেই হবে।
ট্যাবু
এহেন ক্ষমতাধর আউলা বাতাসের সামনে পড়ে লতিফ মিয়া বিচলিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এই মুহূর্তে আউলা বাতাস নিয়ে খুব একটা ভাবছে না সে, তার সমস্ত মনোযোগ এখন মরাখালের ঘাটের দিকে।
সুদূর অতীতে মরাখালের নাম ছিল নারণী নদী। বর্ষায় পূর্ণযৌবনা সেই নদীর তর্জন-গর্জনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠত দশগাঁয়ের মানুষজন।
ভাঙনের হাত থেকে বাঁচার জন্য মন্দিরে পুজো দিত, মানত করত আর সাঁঝ ঘনালেই মসজিদের বারান্দায় জ্বেলে দিত সুগন্ধি আগরবাতি। একবার নারণী খেপে উঠলে কেবল ফসল নিয়েই ক্ষান্ত হত না, গোটা কয়েক প্রাণও কেড়ে নিত অবলীলায়।
কালের আবর্তে সবার চোখের সামনেই নারণী নদী ধীরে-ধীরে মরে গেল। দু’ধার চেপে এসে খরস্রোতা নদীটাকে গিলে নিল পুরোপুরি। সিটি কর্পোরেশনের ড্রেনের আকৃতি নিয়ে টিকে রইল কেবল শীর্ণ একখানা জলের ধারা। অবশ্য টিকে রইল না বলে, টিকিয়ে রাখা হলো বলাটাই বেশি যুক্তিসঙ্গত।
কারণ বহুরকমের কায়দা-কানুন করে আশপাশের মানুষজনই খালটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে আজতক। খেত-খামারে সেচের কাজে ব্যবহার করা হয় এর জল; সেজন্যই বাঁচিয়ে রাখা। নদী মরে গিয়ে এই খালের জন্ম, তাই লোকমুখে নারণী নদী রূপান্তরিত হয়েছে মরাখালে। গ্রামের প্রায় সব বাড়ির গা ঘেঁষে বয়ে যেতে হচ্ছে তাকে।
লোকেরা নিজেদের সুবিধামত এখানে-ওখানে ছোট-বড় ঘাট বানিয়েছে। ফসলের মৌসুমে ধান-পাট ধোয়ার কাজটা সেরে নেয়া যায়, আর বাড়ির বউ- ঝি’রা সারা বছর সেখানে থালা-বাসন মাজে, কাপড় কাচে। বাঁশের কঞ্চি আর কলাপাতা দিয়ে ঘিরে নিলে গোসলটাও দিব্যি সেরে নেয়া যায় মরাখালে।
এই মুহূর্তে তেমনই একটা ঘাটের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে লতিফ মিয়া।
শাড়ি-পেটিকোট হাতে মাখনলালের নতুন বউটা খানিকক্ষণ আগে বলতে গেলে একেবারে লতিফ মিয়ার চোখের সামনে দিয়েই ওখানটায় গিয়ে ঢুকেছে। গাছের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকায় লতিফ মিয়াকে দেখতে পায়নি সে।
আপনমনে কী যেন ভাবছিল মেয়েটা, চারপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেদিকে খুব একটা নজর ছিল না।
যে আউলা বাতাসের ভয়ে থরহরিকম্প দশা ছিল লতিফ মিয়ার, সেটাই শেষতক তার কপাল খুলে দিল। ঘাটের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বেখেয়ালে হেঁচকা টানে তুলে নিয়ে গেল খানিকটা পাতার আচ্ছাদন। আর তাতেই ঘাটের ভিতরের দৃশ্যটা এক লহমায় একেবারে লতিফ মিয়ার চোখের সামনে চলে এল। যা দেখতে চেয়েছিল তার প্রায় সবই দেখতে পাচ্ছে সে এখন, ফকফকা পরিষ্কার।
মাখনলালের বউটা আদতে এখনও কিশোরী, অন্তত ভরাযৌবনা বলা যাবে না তাকে কিছুতেই। তবুও তার স্নানের দৃশ্যটা উত্তেজিত করে তুলল লতিফ মিয়াকে।
মাখনলালের ভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে, গোটা কয়েক অশ্রাব্য গালি দিল তাকে লতিফ মিয়া। ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাচ্চা একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে হারামজাদা। কেন রে, ধাড়ি মেয়েছেলের বুঝি অভাব পড়েছে দেশে?
মেয়েটা এই গ্রামের কেউ না, উজান অঞ্চল থেকে তাকে বিয়ে করে এনেছে মাখনলাল। এর-ওর মালামাল গঞ্জে পৌঁছে দিতে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই উজানে যেতে হয় তাকে। এটাই ওর পেশা, একখানা ছোট ডিঙি নৌকাই তার একমাত্র সম্বল।
কিছুদিন আগে এমনই একটা সফর শেষে মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে ফিরেছে সে। বাপ-মা মরা মেয়ে, তিনকুলে আপন বলতে তেমন কেউ নেই। তাই স্বল্প পরিচিত মাখনলালের কাছে মেয়েটাকে বিয়ে দিতে কোন আপত্তি করেনি তার দূর সম্পর্কের কাকা।
পাত্র নিতান্ত হতদরিদ্র জেনেও তার সিদ্ধান্ত ইতিবাচকই ছিল। ঘাড়ের উপর থেকে আপদ বিদেয় হচ্ছে, এতেই যারপরনাই খুশি ছিল সে; বাছ-বিচারের ধার ধারেনি। তার নিজেরও বিবাহযোগ্যা মেয়ে আছে, পরের মেয়ের জন্য রাজপুত্তুর খোঁজার সময় কোথায় তার?
কোনরকম পণ ছাড়া, বলতে গেলে এক কাপড়েই নতুন বউকে ঘরে তুলেছিল মাখনলাল। তবে পরদিনই গ্রামের হাট থেকে সাধ্যমত আলতা-চুড়ি কিনে দিয়েছিল সে বউকে, কোন কার্পণ্য করেনি। অল্প সময়েই মেয়েটাকে ভালবেসে ফেলেছে সে, আপন বলতে তারও তো কেউ নেই ত্রিভুবনে।
মাখনলাল বাড়ি আছে কিনা সে খবরটা জানতেই এদিকটায় এসেছে লতিফ মিয়া। মেয়েটাকে বেআব্রু দেখাটা তার বাড়তি পাওনা।
গাঁয়ের একেবারে শেষমাথায়, মরাখালের কোলঘেঁষে এক টুকরো খাস- জমিতে বসত গেড়েছে মাখনলাল। ত্রিসীমানায় অন্য কোন জনবসতি নেই’।
জমি কেনার মুরোদ নেই, তাই নিতান্ত বাধ্য হয়েই খাস জমিতে সংসার পাততে হয়েছে তাকে। যা আয় তার, তাতে দুটো প্রাণীতে খেয়ে-পরে বাঁচা যায় ঠিকই, তবে জমি কেনার কথা কল্পনাতেও আনা যায় না।
আরেক দফা দমকা হাওয়া গায়ে লাগতেই টনক নড়ল লতিফ মিয়ার। বহুকষ্টে ঘাটের উপর থেকে নজর সরিয়ে, ফিরতি পথ ধরল।
কখন যে এতটা সময় পেরিয়ে গেছে, টেরই পায়নি সে। দেরি করার জন্য নিশ্চিত আজ মতি চেয়ারম্যানের খিস্তি শুনতে হবে।
তবে দেরি করার কারণটা চেয়ারম্যান সাহেবকে বলা যাবে না কিছুতেই। নয়তো পিটিয়ে তার হাড়গোড় সব গুঁড়ো করে ফেলবে দজ্জাল চেয়ারম্যান।
মাখনলালের বউটার জন্য খানিকটা আফসোসই হলো লতিফ মিয়ার। মাগীর কী দরকার ছিল ভর সন্ধ্যায় চেয়ারম্যান বাড়িতে পানি আনতে যাওয়ার? এক বেলা পানি না খেলে মরে যায় নাকি মানুষ? ভেজা কাপড়ে চেয়ারম্যানের সামনে না গেলে পেটের ভাত হজম হচ্ছিল না?
ঘরের দাওয়ায় জলচৌকিতে বসে আয়েশ করে হুক্কা টানছিল তখন মতি সেই সঙ্গে চোখ দিয়ে চাটছিল মেয়েটার সারা শরীর। চেয়ারম্যানের এহেন দৃষ্টি লতিফ মিয়ার বহুকালের চেনা। তখনই সে বুঝে গিয়েছিল, সর্বনাশ হতে চলেছে মেয়েটার। একবার কারও উপর মতি চেয়ারম্যানের নজর পড়লে, তার আর নিস্তার নেই।
দ্রুত পা চালাল লতিফ মিয়া। বাড়ি নেই মাখনলাল, সদাই-পাতি নিয়ে গঞ্জে গেছে; খবরটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে পৌছানো দরকার!
দুই
মাঝরাতের পরপরই সন্তর্পণে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল মতি চেয়ারম্যান। বলা বাহুল্য, ছায়াসঙ্গী হয়ে তার সঙ্গে সেঁটে রইল লতিফ মিয়া। নিজে চলনদার হয়ে চেয়ারম্যানকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছে সে।
আকাশে ঝুলছে ক্লান্ত চাঁদ। তবে রাতজাগা পাখিরা ডেকে চলেছে বিরামহীন। খাবারের সন্ধানে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে দলছুট খেঁকশেয়ালেরা; আলোর পিদিম বয়ে নিয়ে ওদেরকে সঙ্গ দিচ্ছে জোনাকির ঝাঁক।
কাঁটাঝোপ এড়িয়ে মেঠোপথ ধরে দ্রুতলয়ে হেঁটে চলেছে দু’জন মানুষ। ইতোমধ্যে জলদি পা চালানোর জন্য বার দুয়েক লতিফ মিয়াকে তাগাদা দিয়ে ফেলেছে মতি। আজ বহুদিন পর শিকারে নেমেছে সে, কিছুতেই যেন তর সইছে না তার। প্রবল উত্তেজনায় কাঁপছে গোটা শরীর, রক্তে যেন বান ডেকেছে। আদিম নেশাটা ঝালিয়ে নেয়ার সুযোগ কদাচিৎই মেলে; পুরোটা সময় রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করতে চায় সে।
বাঁশের বেড়ার দেয়াল, উপরে ছনের ছাউনি; ঘর বানানোর জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু জোগাড় করার সামর্থ্য হয়নি মাখনলালের। একখানা চেলাকাঠ আড়াআড়ি করে গুঁজে দিয়ে ঘরের একমাত্র দরজাটা বন্ধ রাখা হয়।
চোর-ডাকাতের ভয় নেই, কেবল শেয়াল-কুকুরকে ঘরে ঢোকা থেকে বিরত রাখাটাকেই দরজাটার একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে ধরা হয়।
লতিফ মিয়ার কাঁধের জোরাল এক ধাক্কায় পাটকাঠির মত মট করে ভেঙে গেল চেলাকাঠটা; পরক্ষণেই হাঁ করে খুলে গেল দরজাটা।
বিদ্যুৎ খেলে গেল মতি চেয়ারম্যানের দেহে, অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ঘরের ভিতর সেঁধিয়ে গেল সে। উইয়ের ঢিবির মত প্রকাণ্ড ভুঁড়িটাকে অনুসরণ করল তার বাকি শরীর।
চেয়ারম্যানকে ঘরের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেখল লতিফ মিয়া, পরের কয়েকটা মুহূর্ত কান খাড়া করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল সে। পরক্ষণেই কানে এল কাঙ্ক্ষিত গোঙানির শব্দটা; মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল তার। হাত বাড়িয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল সে, আপাতত আর চাঁদের আলোর দরকার নেই চেয়ারম্যান সাহেবের।
না তাকিয়েও ভিতরে কী হচ্ছে দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছে লতিফ মিয়া বিশাল থালার মত হাতের তালু দিয়ে মেয়েটার মুখ চেপে ধরেছে মতি চেয়ারম্যান। নিজের জগদ্দল পাথরের মত শরীরটা চাপিয়ে দিয়েছে মেয়েটার শীর্ণ দেহের উপর। ছাড়া পাওয়ার জন্য আরও কিছুক্ষণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে মেয়েটা, তবে অচিরেই ক্ষান্ত দিতে হবে তাকে। বুঝে যাবে, এই দানবের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া রীতিমত অসম্ভব।
মাঝারী আকারের একটা কদম গাছের তলায় ঘন হয়ে জন্মে আছে কিছু দূর্বাঘাস। গাছের গুঁড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে ওখানটাতেই বসে পড়ল লতিফ মিয়া। লুঙ্গির কোঁচা থেকে প্যাকেট বের করে একখানা বিড়ি ধরিয়ে আয়েশ করে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল; প্রশান্তির রেশ ছড়িয়ে পড়েছে তার গোটা অবয়বে।
শেষ কবে আস্ত এক প্যাকেট বিড়ির মালিক ছিল, অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে ব্যর্থ হলো সে। অবশ্য এ নিয়ে তাকে খুব একটা দোষারোপেরও সুযোগ নেই; কারণ আদতে কখনওই তার পুরো এক প্যাকেট বিড়ি কেনার সৌভাগ্য হয়নি অতীতে।
আজও হত না, যদি না খুশির আতিশয্যে প্যাকেটটা তাকে উপহার দিত মতি চেয়ারম্যান! নির্দিষ্ট কোন বেতন পায় না সে, কাজ করে পেটে-ভাতে। চেয়ারম্যান বাড়ির একটা ঘুপচি ঘরে রাত কাটায়, নিজের বলতে গোটা কয়েক পুরনো কাপড় ছাড়া তেমন কিছুই নেই তার।
জ্ঞান হবার পর থেকে মতিকেই ভগবান মেনে এসেছে সে, যে কোন আদেশ পালন করেছে নির্দ্বিধায়।
শৈশবে গঞ্জের রাস্তায় ওকে কুড়িয়ে পেয়েছিল চেয়ারম্যান। কান্নারত নিষ্পাপ একটি বালককে অসহায়ের মত এখানে-ওখানে ঘুরতে দেখে তুলে এনেছিল নিজের বাড়িতে। তখনও চেয়ারম্যান হয়নি মতি, তবে মাস্তান হিসেবে ততদিনে বেশ নাম কামিয়ে ফেলেছিল সে।
টুকটাক ফুট-ফরমায়েশ খাটা, বিনিময়ে অন্ন-বস্ত্রের নিশ্চয়তা, কারও জন্যই হিসেবটা খুব একটা কঠিন ছিল না।
ধীরে-ধীরে লতিফ মিয়ার কাজের পরিধি বাড়তে থাকল, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকল পাপ! সেদিনের সেই ছোট্ট লতিফ মিয়া কালক্রমে হয়ে উঠল, মতি চেয়ারম্যানের ডানহাত, ভাল-মন্দ সমস্ত কাজের দোসর।
লতিফ মিয়া মনে করতে পারে না কে তার বাবা-মা, কী তার বংশ পরিচয়। তবে এ নিয়ে কোন যাতনা অনুভব করে না সে। মতি চেয়ারম্যানকে অভিভাবক হিসেবে পাওয়াটা রীতিমত ভাগ্যের ব্যাপার। গ্রামের অনেকেই এটা নিয়ে ঈর্ষা করে তাকে। যদি কোনদিন লতিফ মিয়ার কিছু হয়ে যায়, জায়গাটা নেয়ার জন্য আগ্রহী প্রার্থীর অভাব হবে না চেয়ারম্যানের।
পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকাল লতিফ মিয়া। চট করে দূরে ছুঁড়ে ফেলল আধপোড়া চতুর্থ বিড়িটা। বেরিয়ে এসেছে মতি। ঘর্মাক্ত, পরিশ্রান্ত; তবে চেহারায় ফুটে আছে প্রচ্ছন্ন পরিতৃপ্তির ছাপ।
‘হারামজাদী মইরা গেছে রে, লতিপ্পা।’
কয়েক মুহূর্ত মূক পশুর মত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল লতিফ মিয়া। মাথা কাজ করছে না তার। এইমাত্র যা শুনেছে, ঠিক শুনেছে তো? সত্যিই কি মরে গেছে মেয়েটা?
‘গরিবের মাইয়া এমুন কমজোরি হইব, কেডা জানত! পুরা মজাড়াই মাডি কইরা দিল খানকি।’
‘অহন…? অহন কী করুম, চেরম্যান সাব?’ কোনমতে বলল লতিফ মিয়া। এখনও বিহ্বলতা কাটেনি তার।
‘হেইডাই ভাবতাসি। খাড়া। একটু ভাববার দে,’ পুরোপুরি নিষ্কম্প শোনাল মতির কণ্ঠ। কারণে-অকারণে এযাবৎকালে বহু মানুষ মেরেছে সে; মৃত্যু তার কাছে বিশেষ কোন গুরুত্ব বহন করে না। কেবলমাত্র নিজের জীবনই মূল্যবান তার কাছে, অন্যদের ব্যাপারে থোড়াই কেয়ার করে সে। পরম নির্ভরতায় তার দিকে তাকিয়ে রইল লতিফ মিয়া। তার জানা আছে, একটা না একটা বুদ্ধি ঠিকই বের করে ফেলবে মতি চেয়ারম্যান। বুদ্ধিতে তার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারে, গোটা চৌহদ্দিতে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সাধে তো আর পর-পর চারবার চেয়ারম্যান হয়নি লোকটা!
আচমকা তার দিকে ফিরে তাকাল মতি, জ্বলজ্বল করছে দু’চোখের তারা। ‘লাশটা মরাখালে ফালাইয়া দিলে কেমুন হয়? ভাইস্যা চইল্যা যাইব অন্য গেরামে। কেডায় চিনব? বেবাকতে তো আর দেহে নাই মাখইন্যার নয়া বউরে। কী কস?’
প্রভুভক্ত কুকুরের মত মাথা দোলায় লতিফ মিয়া। ‘ভালা বুদ্ধি, চেরম্যান সাব। জব্বর বুদ্ধি।’ কথা না বাড়িয়ে তড়িঘড়ি কাজে নেমে পড়ে সে। চেয়ারম্যানের সাহায্য ছাড়াই রোগা-পাতলা মেয়েটাকে পাঁজাকোলা করে বের করে আনে ঘরের বাইরে। তারপর দ্রুত এগিয়ে যায় মরাখালের দিকে।
.
রাত পোহাবার খুব বেশি বাকি নেই আর। তাই ভিতর-বাড়িতে না গিয়ে কাছারি ঘরেই কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে মতি।
বহুদিন বাদে সে রাতে খুব ভাল ঘুম হয় তার। কাছারি ঘরের শক্ত বিছানা আর পাতলা কাঁথার ওমটাকেই তার কাছে স্বর্গীয় মনে হয়, ছাড়া ছাড়া স্বপ্নও দেখে সে।
তবে নিজের ঘরে রাতের বাকি সময়টা নির্ঘুমই কাটে লতিফ মিয়ার। বিছানায় ক্রমাগত এপাশ-ওপাশ করে, দু’চোখের পাতা এক করতে ব্যর্থ হয় সে। তার কেবলই মনে হয়, কোথাও একটা ঘাপলা হয়ে গেছে!
খোলা জানালার গরাদের ফাঁকে চোখ রেখে ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায় থাকে সে।
তিন
সচরাচর সাতসকালেই লোকেদের আনাগোনা শুরু হয় চেয়ারম্যান বাড়িতে। নানা রকম তদবির, ছোট-বড় সালিশ; হাঙ্গামার কোন শেষ নেই।
আশপাশের দশ গাঁয়ের মাথা মতি চেয়ারম্যান, তার হুকুম ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ার সাহস পায় না এই তল্লাটে। লোক মন্দ হলেও, নিতান্ত বাধ্য হয়েই তার কাছে আসতে হয় সবাইকে।
তবে আজকের ভিড়টা অন্যান্যদিনের চেয়ে আলাদা, কয়েকগুণ বড়। দেখে মনে হচ্ছে একজনও আর নিজেদের ঘরে বসে নেই, পুরো গ্রামের সব ক’জন ছেলে-বুড়ো এসে জমায়েত হয়েছে চেয়ারম্যান বাড়ির আঙিনায়!
ভিতর বারান্দায় শীতল পাটিতে বসে আয়েশ করে গরুর গোশত আর যবের রুটি চিবুচ্ছিল মতি চেয়ারম্যান, হন্তদন্ত হয়ে সেখানে গিয়ে হাজির হলো লতিফ মিয়া।
তার পাতিলের তলার মত কালো মুখটা দেখতেই মেজাজ খিঁচড়ে গেল মতির; দিনের শুরুতে কী দুঃসংবাদ নিয়ে হাজির হয়েছে হারামজাদা!
‘হইসেডা কিতা? সকাল-সকাল চেহারাডা কাউয়ার পুটকির মত কইরা রাখসস কিল্লাইগ্যা?’ খেঁকিয়ে উঠল চেয়ারম্যান।
ধমক খেয়ে লতিফ মিয়ার মুখের অন্ধকার বাড়ল বৈ কমল না। ইতস্তত করে বলল, ‘একটা লাশ পাওয়া গেছে, চেরম্যান সাব। মাখন মাঝির বউয়ের লাশ।’
‘কস কী!’ নিজের অজান্তেই চেঁচিয়ে উঠল মতি। হতভম্ব হয়ে লতিফ মিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে সে।
‘মাইনষে আফনের লগে কথা কইতে চায়। সবতে আইছে কাছারি ঘরের সামনে।’
নিজেকে ফিরে পেতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল মতির। সদ্য মুখে দেয়া অচর্বিত গো’মাংস-রুটি কোঁৎ করে গিলে নিল সে। তারপর গ্লাসের পুরো পানিটুকু গলায় চালান করে দিয়ে সটান উঠে দাঁড়াল।
কাছেপিঠেই ছিল চেয়ারম্যানের বড় বউ রাহেলা। লতিফ মিয়ার কথাগুলো স্পষ্টই শুনতে পেয়েছে সে। পর্দার আড়াল থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘ঘটনা কী, লতিফ মিয়া? ক্যামনে মরসে মাইয়াডা?’
চট করে একবার চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়েই চকিতে চোখ নামিয়ে নিল লতিফ মিয়া। নিচু গলায় বলল, ‘কইতে পারি না, আম্মা। লাশ পাওয়া গেসে মরাখালে। মীর্জা বাড়ির ঘাড়ে।’
দ্রুত পা চালিয়ে কাছারি ঘরের দিকে রওনা হলো মতি চেয়ারম্যান। বিনাবাক্যব্যয়ে তাকে অনুসরণ করল লতিফ মিয়া। আপাতত রাহেলার আর কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে না বলে যারপরনাই খুশি সে।
রাহেলাকে অজ্ঞাত কারণে ভীষণ ভয় পায় সে। অথচ আজ অবধি তার সঙ্গে কখনও উচ্চস্বরে কথা বলেনি রাহেলা, ধমক দেয়া তো পরের ব্যাপার।
লোকে বলে, চেয়ারম্যানের বড় বউ সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। কেবল তার দিকে তাকিয়েই খোদা এখনও গজব ফেলেনি চেয়ারম্যানের উপর!
লতিফ মিয়া খেয়াল করে দেখেছে, রাহেলার সামনে চেয়ারম্যান সাহেবও কেমন যেন গুটিয়ে থাকে, হয়তো খানিকটা ভয়ও পায়। আর সেই ভয়টাই হয়তো স্থানান্তরিত হয়েছে লতিফ মিয়ার মনে। স্বয়ং গুরু যেখানে ভীত, শিষ্যর সেক্ষেত্রে কী-ই বা আর করার আছে!
.
কাছারি ঘরের সামনে বিশাল একটা জামগাছ আছে। দু’জন মানুষ মিলেও বেড় পাওয়া যায় না, এমনই গুঁড়ির গড়ন। অনেকদূর অবধি ছড়ানো-ছিটানো ডালপালার কারণে প্রখর রোদেও জায়গাটায় ছায়া পাওয়া যায়। সভা-সালিশের কাজগুলো সাধারণত এখানেই করে মতি চেয়ারম্যান।
তাকে হন্তদন্ত হয়ে মজলিশে ঢুকতে দেখে জমায়েতের মধ্যে স্থূল একটা পরিবর্তন হলো। নিমিষেই থেমে গেল সমস্ত কানাকানি-ফিসফাস, সবাই একযোগে তাকিয়ে রইল চেয়ারম্যানের দিকে।
বারান্দায় গদিআঁটা একখানা বেতের চেয়ার শোভা পাচ্ছে। ধীরেসুস্থে ওটায় আয়েশ করে বসল মতি। তারপর অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল অপেক্ষমাণ মুখগুলোর দিকে।
পুরো আঙিনা জুড়ে হোগলা বিছানো, তাতেই আসন পেতে বসেছে সবাই। অপেক্ষাকৃত বয়স্করা বসেছে সামনের সারিতে, চেয়ারম্যানের মুখোমুখি; এটাই নিয়ম।
‘ঘটনা কিতা? খুইল্যা কও দেহি,’ গম্ভীর’ কণ্ঠে বলল মতি। পুরোপুরি শান্ত দেখাচ্ছে তাকে। সামনের সারিতে বসা একজন বুড়োমতন লোক নড়েচড়ে বসল। মাথার চুলের বেশিরভাগই গত হয়েছে তার, যে কয় গাছি এখনও লড়াই করে টিকে আছে সেগুলোও ধবধবে সাদা। মুখের বলিরেখা গুণতে বসলে বেলা পড়ে যাবে, তবুও কাজটা শেষ হবে কিনা সন্দেহ আছে।
চরম উৎসাহে নিজের বয়ান দিতে শুরু করল লোকটা।
‘জগইন্য একখান ঘটনা হইসে, চেরম্যান সাব। মাখনলালের নয়া বউডার লাশ ভাইস্যা ওঠসে মরাখালে। মীর্জা বাড়ির ঘাড়ে ডোল কলমির দঙ্গলের লগে আটকাইয়া আছিল হেতির লাশটা। গতরে কোন কাফর নাই। এক্কেরে ল্যাংটা। শইলের জায়গায়-জায়গায় গর্ত হইয়া গেসে। কীয়ে খুবলাইয়া খাইয়া ফালাইসে কেডা জানে! মাখইন্যা তো নাও লইয়া চইলা গেছে গঞ্জে, হেতিরে কেডা মারসে খোদা মালুম! কেউই কিছু কইতে পারে না, চেরম্যান সাব।’
চেয়ারে নড়েচড়ে বসল মতি। বেশ অবাক হয়েছে সে। পরনে ব্লাউজ- পেটিকোট ছিল না সত্যি, কিন্তু শাড়িটা ভালমত শরীরে পেঁচিয়েই মেয়েটাকে মরাখালে ফেলা হয়েছে, উলঙ্গ ফেলা হয়নি। কাপড়টা খুলল কীভাবে?
তাছাড়া হিসেব মত লাশটা ভেসে যাওয়ার কথা খালিশপুরের দিকে; স্রোত ওদিকেই বইছিল। অথচ ওটাকে কিনা পাওয়া গেল সম্পূর্ণ উল্টোদিকে, মীর্জা বাড়ির ঘাটে!
এত তাড়াতাড়ি মেয়েটার মাংসই বা খেল কীসে? শিয়াল? ওরা কি পানিতে নেমেও লাশ খায় নাকি?
‘কী আজিব কারবার! পুরা আচানক হইয়া গেলাম। লাশটা অহন কই?’ চেহারায় গাম্ভীর্য ধরে রেখেছে মতি, গলার স্বরও কঠিন
‘মীর্জা বাড়ির উড়ানে রাইখ্যা আইছি। পুরান একটা কাফর দিয়া ঢাইক্যা দিসি। দুইন্নার বেড়িরা হেতিরে দেহনের লাইগ্যা মীর্জা বাড়িত জড় হইসে। হের লাইগ্যা জয়নাইল্যারে রাইখ্যা আইছি, ভিড় সামলাইব হেতে।’
‘কেডা পাইসে লাশটা? প্রথমে দেখসে কেডা?’
‘আই দেখসি, চেরম্যান সাব,’ কিন্নর কণ্ঠের জবাব এল জমায়েতের পিছন দিক থেকে। ধীরে-ধীরে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এল এক কিশোর। খালি গা, পরনে আধছেঁড়া ময়লা একটা লুঙ্গি। নাক দিয়ে সিকনি ঝরছে, দেখলেই গা গুলিয়ে আসে। গলায় কালো সুতো দিয়ে বাঁধা মস্ত একখানা পিতলের তাবিজ।
‘খালের ধারে হাগতে গেসিলাম, চেরম্যান সাব। পরথমে বুইজতে পারি নাই জিনিসটা কিতা। ভাল কইরা দেহনের লাইগা কাছে আগাইয়া গেসিলাম। দেইখ্যা কিন্তুক বহুত ডরাইসি। গলা ফাডাইয়া এমুন এক চিক্কুর দিসি, হেই চিক্কুর হুইন্যা হগলে দৌড়াইয়া ঘাডে আইয়া পড়সে,’ দাঁত কেলিয়ে হাসতে-হাসতে কৃতকর্মের বর্ণনা দিল ছেলেটা।
নিজের বীরত্বে ভীষণ গর্বিত সে। হাড় জিরজিরে বুকের ছাতি আদতেই এখন আধ-ইঞ্চি ফুলে আছে তার।
বহুকষ্টে নিজের ক্রোধ দমন করল মতি। তার ইচ্ছে করছে, ছুটে গিয়ে ছেলেটার পাছায় কষে একখানা লাথি দিতে। এই হারামিটাই যত নষ্টের গোড়া। এক লাথিতে হারামজাদার হাগা-মুতা চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিতে পারলে খানিকটা শান্তি পাওয়া যেত।
‘বুঝলাম,’ অবদমিত ক্রোধটাকে চট করে গিলে নিল চেয়ারম্যান। ‘অহন কী করবার চান আফনেরা?
‘আমরা আর কী কমু, চেরম্যান সাব। আফনে যা ভালা মনে করেন, হেইডাই করেন। আফনের উফরে কি আর কুনু কতা আছেনি? আফনেই তো গেরামের মা- বাপ,’ জটলার একপাশ থেকে বলে উঠল মজু বেপারী। চেয়ারম্যানের খয়ের খাঁ হিসেবে এলাকায় বেশ কুখ্যাতি আছে তার। নিন্দুকেরা বলে, চেয়ারম্যানের পৃষ্ঠপোষকতায় নানা রকম অবৈধ মালের ব্যবসা করে মজু বেপারী। একারণেই রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে তার।
এক দশক আগেও অন্যের বাড়িতে কামলা খাটত মজুর বাবা, সপরিবারে বসবাস করত গ্রামের সবচেয়ে জীর্ণ বাড়িটায়।
আজ সেখানে টিনের ঘর উঠেছে, বারান্দায় বসে সকাল-সন্ধ্যা নিয়ম করে হুক্কা টানে মজুর বাবা।
‘হুম,’ শিরদাঁড়া সোজা করে বসল চেয়ারম্যান। ‘মাখইন্যা যেহেতু গেরামে নাই, আমাগোরেই বিষয়ডার একটা বিহিত করন লাগব। আমরাই তো হেতের গার্জিয়ান। আমরা ছাড়া তিনকুলে আর কেডা আছে হেতের? আমাগোর উফরে হেতের একটা দাবিও তো আছে। কি কন?’
‘হ, হ। ঠিক, ঠিক,’ অনেকেই সায় জানাল চেয়ারম্যানের কথায়।
‘হিন্দু মাইয়া। দাফন তো আর করন যাইত না। পোড়াইতে হইব। তাইলে ‘হেইডাই করি। একটা পুরুত ডাইকা সবকিছুর আয়োজন করি। টেকাটুকা যা লাগে, আমিই দিমু। হেইডা লইয়া আফনেরা মাথা ঘামাইয়েন না।’
মৃদু গুঞ্জন করে উঠল জনতা, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কেউ-কেউ। চাঁদা দিতে হচ্ছে না, এতেই খুশি সবাই। তাছাড়া ঝামেলাটাও জলদি মিটানো দরকার, ঝুলিয়ে রাখার সুযোগ নেই। এখানে উপস্থিত প্রায় সবাইকেই দিন-রাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিবারের অন্ন-বস্ত্রের জোগান দিতে হয়। সারাদিন এখানে বসে থাকলে, দিনশেষে অভুক্ত থাকতে হবে ওদের।
‘মাইয়াডা মরল ক্যামনে, হেইডা সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত লাশ পোড়ানডা ঠিক হইব না, চেয়ারম্যান সাব,’ আচমকা জমায়েতের পিছন থেকে বলে উঠল করিম মাস্টার।
ইউনিয়নের একমাত্র প্রাইমারী স্কুলটা খালিশপুরে, ওখানেই ক্লাস ফাইভে বাংলা পড়ায় সে। বয়সে তরুণ; কথাবার্তা-চালচলনে যৌবনের তেজ ঠিকরে পড়ে।
করিম মাস্টারকে দু’চোখে দেখতে পারে না মতি। তার কাছে করিম মাস্টার মূর্তিমান উপদ্রব ছাড়া আর কিছু নয়। ব্যাটা অহেতুক সব জায়গায় বাগড়া দেয়; এটাই হারামিটার স্বভাব।
কিছুদিন আগে গ্রামে একটা হাইস্কুল খোলার জন্য জনমত তৈরির চেষ্টা করেছিল করিম। বাড়ি-বাড়ি গিয়ে জনে-জনে বুঝাচ্ছিল হাই স্কুলের উপকারিতা। শেষতক অবশ্য তার সমস্ত পরিশ্রমই জলে গেছে, ভেস্তে গেছে পুরো পরিকল্পনা। নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নেড়ে সবকিছু বানচাল করে দিয়েছে মতি চেয়ারম্যান।
তবে মাস্টারকে একটা উচিত শিক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্তটা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে অনেক বেশি বেগ পেতে হয়েছে মতিকে। নিজেকে বুঝিয়েছে, মাথা গরম না করে উপযুক্ত সময়ের প্রতীক্ষায় থাকাই শ্রেয়। ঝোপ বুঝে কোপ মারলেই চলবে; মাস্টারকে সরিয়ে ফেলা তেমন কোন কঠিন কাজ না তার জন্য।
চোখ সরু করে করিমের দিকে খানিকক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইল মতি। ‘ক্যামনে সুরাহা হইব? কেউ তো ঘটনা ঘটতে দেহে নাই, মাস্টর।’
‘পুলিসে জানান লাগব। হেরাই তদন্ত কইরা বাইর করব সব,’ দৃঢ় গলায় জবাব দিল করিম।
‘পুলিস! এর মইধ্যে আবার থানা-পুলিস করনের কাম কী? বেহুদা গেরামে পুলিস আইলে, গেরামের ইজ্জত থাহেনি, মিয়া?’ বিরক্ত কণ্ঠে বলল মতি। মনে- মনে আফসোস করছে, সময় থাকতে হারামজাদার কল্লা ফালাই দেওনের কাম আছিল। বেশি বাড় বাড়ছে খানকির পোলার।
‘বেহুদা ক্যামনে হয়, চেয়ারম্যান সাব? একটা মাইয়ারে জানে মাইরা ফালাইসে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটে নাই, হেইডাই বা কই ক্যামনে! এর একটা ফয়সালা না কইরা লাশটা পোড়াইয়া ফালাইবেন?’
‘ধর্ষণ! খুন! এইগুলান কী কও তুমি! হেতি তো আত্মহত্যাও করবার পারে, নাকি?’
‘আত্মহত্যা করব কিল্লাই? আমরা তো জানি হেতি মাখইন্যার লগে সুখেই আছিল।’
‘তুমি হেইডা ক্যামনে কও, মাস্টর! বাইরে থাইকা দেইখা কি মাইনষের সংসারের ভিতরের খবর কওয়া যায়? সবাই তো কইবা আমার সংসারে সুখের শেষ নাই, সুখ বাইয়া-বাইয়া পড়তাসে ঘরের বেড়ার ফুটা দিয়া। আমি নিজেই না কেবল কইতে পারি কোন্ আগুনে পুড়তাসি।
‘মাখইন্যা সারা বছর থাহে বাইরে-বাইরে। কোন্হানে কুন আকাম-কুকাম কইরা বেড়ায়, কেডা হের খবর রাহে! এইগুলান লইয়াও তো হেতাগো মইধ্যে ঝামিলা হইবার পারে, নাকি?’
‘পারে। হেইডা বাইর করন পুলিসের কাম, আমাগো না।’
‘আফনে এত ফুলিস-ফুলিস করতাসেন ক্যান, মাস্টার সাব? হগলে মিল্যা তো একটা ফয়সালা কইরা ফালাইসে। অহন বেহুদা এইডা লইয়া গ্যাঞ্জামের কাম কী?’ চেঁচিয়ে বলে উঠল মবিন; ওরফে মবু চোরা।
আশপাশের সমস্ত গ্রামে সিঁধেল চোর হিসেবে বিশেষ খ্যাতি আছে তার। ছোটখাট চুরির দায়ে বেশ কয়েকবার জেলও খেটেছে। হাজতে ছিঁচকে চোরদের কী পরিমাণ দুরমুশ করা হয়, সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা আছে তার।
স্বভাবতই পুলিসের উপর বছরের তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই মহাখাপ্পা হয়ে থাকে সে। সবসময় ওদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চায়। গ্রামে পুলিসের আগমন ওর জন্য সত্যিই সুখকর কিছু নয়।
‘তুই চুপ থাক, মবু,’ খেঁকিয়ে উঠল করিম মাস্টার। ‘চোরের মন পুলিস- পুলিস। তোরে তো আর ধরতে আইতাসে না অহন, তোর এত ডর কীয়ের? যার ডরানোর হেতেই ডরাইব, তুই জুত কইরা বইয়া থাক।’
জনতার সম্মিলিত দৃষ্টি নিজের উপর অনুধাবন করে আচমকা ভীষণ লজ্জা পেল মবু। আড়াল পাওয়ার আশায় জটলার ভিতর আরও খানিকটা সেঁধিয়ে গেল সে। মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করল, সব ধরনের সালিশে এখন থেকে নিজের মুখটা বন্ধ করে রাখবে, একটা শব্দও উচ্চারণ করবে না। চোর হলেও তার তো একটা ইজ্জত আছে, নাকি?
‘তাইলে পুলিস না আনলে আর চলতাসে না। তাই না, মাস্টর?’ হালকা গলায় জিজ্ঞেস করল মতি চেয়ারম্যান। কেউ জানে না কী খেলা চলছে ধূর্ত লোকটার মাথায়।
‘হ, পুলিস আনতেই হইব,’ জবাব দিতে এক মুহূর্তও দেরি করল না করিম মাস্টার।
‘আইচ্ছা। তুমি যহন এমনে জিদ করতাস, আনুম পুলিস। কোন সমস্যা নাই,’ হাসিমুখে বলল মতি। ‘তোমরা তো হগলেই জান, থানার দারোগা সাবের লগে আমার কীরাম দহরম-মহরম। আমি দাওয়াত দিলে হেয় কোনদিন মানা করত না। অন্য সব কামকাজ ফালাই থুইয়া এক দৌড়ে এইহানে আইয়া পড়ব। তারে আনাডা কোন ব্যাফার না। আমার খালি একটাই চিন্তা, তুমি না আবার মামলাডায় ফাইস্যা যাও, মাস্টর!’
নিজের অজান্তে পায়ের ভার বদল করে দাঁড়াল করিম। অনিশ্চিত কণ্ঠে বলল, ‘আমি ফাঁসমু ক্যান! কী কন এগুলা, চেয়ারম্যান সাব?’
‘মানে, লাশটা কিন্তুক পাওয়া গেসে মীর্জা বাড়ির ঘাড়ে। আর মীর্জা বাড়িত তো অহন তুমি একলাই থাহ। নাকি মিছা কইলাম?
‘তুমি জোয়ান-মর্দ পোলা, কিন্তু অহনতরি বিয়া-শাদী কর নাই। এইদিকে আবার মাখইন্যার বউ মাসের বেশিরভাগ সময় হেতির জামাইরে কাছে পায় না। তোমাগো মইধ্যে একটু ইটিশ-পিটিশ তো হইতেই পারে, হাছা না?
‘ধইরা নিলাম এইগুলান কিছুই হয় নাই, হেরপরেও কিন্তুক কথা থাইক্যা যায়। ধর্ষণ-খুন, এইসব কথা যেহেতু তোমার মাথায় আইয়া পড়সে, দারোগা সাবের মাথাতেও নিচ্চই আইবে। উনি যদি ভাইবা নেন যে, মাইয়াডা রাইতের বেলা খাওয়ার পানি আনতে মীর্জা বাড়ির চাপকলে গেসিল, আর কায়দামত পাইয়া তুমি হেতির উফরে ঝাঁপাইয়া পইড়া…’ ইচ্ছে করেই কথাটা অসমাপ্ত রাখল ধুরন্ধর চেয়ারম্যান। চেহারা পুরোপুরি নির্লিপ্ত তার।
এদিকে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গেছে করিম মাস্টারের মুখ, একেবারে চুপসে গেছে সে। ঘটনার মোড় এভাবে ঘুরে যাবে, এটা সে কস্মিনকালেও কল্পনা করেনি।
মীর্জারা শহরে চলে গেছে অনেক দিন আগে; বলতে গেলে মীর্জা বাড়ি সারা বছর খালিই পড়ে থাকে। তাই ছোট মীর্জার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ঘাটের পাশের অতিথিশালায় বাচ্চাদের জন্য একটা অবৈতনিক স্কুল খুলেছে করিম মাস্টার। পড়ানোর সুবিধার্থে নিজের বাড়িতে না থেকে বেশিরভাগ সময় ওখানেই থাকে সে।
কোন সন্দেহ নেই, গ্রামের অন্তত অর্ধেক মানুষ ইতোমধ্যেই মতি চেয়ারম্যানের কথা বিশ্বাস করে বসে আছে। বাকি অর্ধেকও দ্বিতীয়বার নেড়েচেড়ে দেখছে যুক্তিগুলো। শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায়, এই মুহূর্তে জনমত পুরোপুরি করিম মাস্টারের বিপক্ষে
তাছাড়া থানার দারোগার সঙ্গে চেয়ারম্যানের সখ্যের কথা সর্বজনবিদিত। সত্যিই দারোগাকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে লোকটা। একবার যদি অপকৌশলে দারোগার মনে সন্দেহের বীজটা বপন করে দিতে পারে সে, তাহলেই কম্ম কাবার। আর কিছু করতে হবে না খচ্চর চেয়ারম্যানকে, বাকিটা দারোগা সাহেব নিজেই করবেন। আর ভাবতে চাইল না করিম মাস্টার, দু’চোখে সর্ষেফুল দেখছে সে।
বহুবছর ধরে তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে মতি, এবার বুঝি সুযোগটা পেয়েই গেল হারামিটা। অনেক ভেবেও ফাঁদটা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন পথ খুঁজে পেল না করিম। হাল ছেড়ে দিয়ে নিজের জায়গায় অনড় দাঁড়িয়ে রইল সে।
‘তাইলে কী কও, মাস্টর? ডাকমু পুলিস?’ ভ্রূ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল চেয়ারম্যান। পুরো ব্যাপারটায় ভীষণ আমোদ পাচ্ছে সে। করিমের নাজেহাল অবস্থাটা তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করছে। দেখা যাক, বড়শিতে গাঁথা মাছটা আর কতটুকু আনন্দের জোগান দিতে পারে!
তবে জবাবটা মাস্টারের কাছ থেকে নয়, এল তার বাবা, রহিম হাজীর কাছ থেকে। পরিস্থিতি বুঝে নিতে বিন্দুমাত্র সময় লাগেনি ঘাগু বুড়োর। একজন ইউপি মেম্বার হিসেবে বহুবছর ধরে মতির সঙ্গে ওঠাবসা রহিম হাজীর। বদের হাড্ডি মতি কী-কী করতে পারে, এ ব্যাপারে অনেকের চেয়ে স্পষ্ট ধারণা আছে তার। তাই আচমকা পাথরের মূর্তি বনে যাওয়া ঘাড়তেড়া ছেলেকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে, তাকেই শেষতক মাঠে নামতে হলো।
‘কী যে কন, চেয়ারম্যান সাব! পুলিস ডাকনের দরকার কী! আফনে যা কইসেন, হেইডাই হইব। পুলাপান কত কথাই কইব, হেগো লগে তাল মিলাইয়া নাচলে চলব নাকি আমাগো? কী কও, মিয়ারা?
‘হ, হ। ঠিক, ঠিক। বেহুদা ঝামেলা বাড়ানের কাম নাই। আজাইরা জিনিস লইয়া পইড়া থাকলে পেট চলত না। হগলেরই কাজ-কর্ম করন লাগে,’ সমর্থন জোগাল সামনের সারিতে উপবিষ্ট একজন বয়স্ক মানুষ। অন্যরাও মাথা নেড়ে সায় জানাল।
‘তাইলে হেই কথাই রইল। লাশটা সৎকারের ব্যবস্থা নিতাসি আমি। আফনেরা যে যার কামে যান, এইডা লইয়া আর চিন্তার কিছু নাই।’
উঠে দাঁড়াল মতি। পা বাড়াল ভিতর-বাড়ির দিকে। মুখে ফুটে উঠেছে কুটিল হাসি। ঝামেলাটা এত সহজে মিটে যাবে, ভাবেনি সে। উপরি পাওনা হিসেবে পাকনা মাস্টারকেও কিছুটা শায়েস্তা করা গেছে। আশা করা যায়, কিছুদিন অন্তত চুপচাপ থাকবে হারামজাদা।
.
ভিড় কমতে-কমতে একসময় পুরোপুরি খালি হয়ে গেল জামতলাটা। তবে একজন বয়স্কমতন অচেনা মানুষ আরও বহুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ওখানটায়।
লোকটার পরনে সফেদ আলখাল্লা, কাঁধ থেকে ঝুলছে একখানা বাহারী রঙের ঝোলা। ক্ষণে-ক্ষণেই খিক্-খিক্ করে হাসছে সে, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে। মুখের হাসি তার চোখ দুটোকে ছুঁতে ব্যর্থ হয়েছে, ছাইচাপা আগুনের মতই ধিকিধিকি জ্বলছে ওগুলো!
চার
একখানা লণ্ঠন মৃদু আলো বিলাচ্ছে চেয়ারম্যান বাড়ির কাছারি ঘরে। দরজাটা খোলা থাকায় সে আলোর কিয়দংশ চৌকাঠ ডিঙিয়ে অবলীলায় চলে আসছে লাগোয়া বারান্দায়।
আলোর সীমারেখার খানিকটা বাইরে কাঠের একটা নড়বড়ে বেঞ্চিতে বসে আছে লতিফ মিয়া। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ঝিম মেরে বসে আছে সে, গায়ে একখানা পাতলা চাদর জড়ানো; ক্লান্ত। আজ সারাদিন ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে তাকে, দম ফেলারও ফুরসত মেলেনি। তাই এই ভর সন্ধ্যায়, সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়া আরামদায়ক আলস্যটুকু চুটিয়ে উপভোগ করছে সে। সকালটা কেটে গেছে মাখনলালের স্ত্রীর সৎকারে। পুরোহিত ডাকা, শ্মশানঘাট পরিষ্কার করা, আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র জোগাড়যন্ত্র করা; ঝক্কি তো নেহায়েত কম নয়। তাছাড়া উপরি হিসেবে অতি উৎসাহী জনতার ভিড় সামলানোর ধকলটা তো আছেই।
কাজটা শেষ করেই ছুটতে হয়েছে বাবুর্চি খুঁজতে, তারপর তাকে সঙ্গে নিয়ে মাড়াতে হয়েছে হাটের পথ; শিরনি রাঁধার প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনার জন্য।
আচমকা মতি চেয়ারম্যানের মনে হয়েছে, বিশাল একখানা ফাঁড়া কেটেছে আজ। শোকরানা স্বরূপ পীরের দরগায় এক হাঁড়ি শিরনি না পাঠালেই নয়।
নীলগঞ্জের বড়পীরের মস্ত বড় ভক্ত সে, মুরিদ। যে কোন বিপদ-আপদে পীরের দরগায় ছুটে যায়, গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে আসে। লোকজন যদিও আড়ালে- আবডালে মানুষটাকে ভণ্ড বলে, তবে মতির কাছে সে-ই এ জগতের সবচেয়ে কামেল পীর।
আগামী নির্বাচনের পর হুজুরের দরগায় গোটা তিনেক ষাঁড় দেয়ার কথা মানত করে রেখেছে সে মনে-মনে। বিষয়টা অবশ্য পুরোপুরি নিজের ভিতরেই গোপন রেখেছে, কাউকে বলেনি; এমনকী ছায়াসঙ্গী লতিফ মিয়াকেও না। প্রকাশ হয়ে গেলে সেই মানতের আর জোর থাকে না, আশৈশব এটাই শুনে এসেছে সে।
নীলগঞ্জ থেকে ফিরতে-ফিরতে বিকেল গড়িয়ে গেছে। অবেলায় গোসল করে কোনরকমে মুখে ক’টা ভাত গুঁজে, বারান্দায় এসে বসেছে লতিফ মিয়া। জ্বলন্ত বিড়ি হাতে চকের দিকে তাকিয়ে অলস সময় পার করতে ভীষণ আমোদ পায় সে। অধিক পরিশ্রমের কারণেই কি না কে জানে, বসে থাকতে-থাকতে খানিকটা ঝিমুনি এসে গেল তার। নিজের ছন্নছাড়া জীবনের কথা ভাবছে, আদৌ কি ভবিষ্যৎ বলে কিছু আছে?
বয়স চল্লিশের কোঠায়, কিন্তু এখনও বিয়ে-শাদী করা হয়নি। অন্তরে সংসার পাতার একটা গভীর টান অনুভব করে সে, কিন্তু মুখ ফুটে চেয়ারম্যান সাহেবকে কিছু বলার সাহস হয় না। তার জানা নেই, রাহেলা ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকবার মতির কানে তার বিয়ের কথাটা তুলেছে। শুনেও কোন রা করেনি মতি।
বিয়ে করালে এখনকার মত সকাল-সন্ধ্যা খাটতে পারবে না লতিফ মিয়া, এটা তার ভালই জানা আছে। এমন আরেকজন যোগ্য লোক না পাওয়া পর্যন্ত লতিফ মিয়াকে বিয়ে করানো কি ঠিক হবে?
অদ্ভুত একটা বোটকা গন্ধে তন্দ্রা টুটে গেল লতিফ মিয়ার। চোখ খুলেই ভয়ানক চমকে উঠল সে।
বুড়োমতন একজন লোক একেবারে তার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁত কেলিয়ে হাসছে, মুখের কশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানের পিক। লালচে দাঁতগুলো ভীষণ এলোমেলো, ফাঁক দিয়ে ভিতরের কালো গহ্বর নজরে আসে; রীতিমত গা গুলিয়ে ওঠে।
‘কেডা? কেডা আফনে?’ নিজের অজান্তেই গলার স্বর খানিকটা চড়ে গেল লতিফ মিয়ার। জবাব না দিয়ে, স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় এগিয়ে এসে তার পাশে বেঞ্চিতে বসে পড়ল লোকটা। মুখে এখনও বিশ্রী হাসিটা ধরে রেখেছে।
বাধ্য হয়েই খানিকটা সরে বসল লতিফ মিয়া। ভয়ানক দুর্গন্ধে দম আটকে আসার জোগাড় হলো তার।
গন্ধটা আসছে কোত্থেকে! লোকটার গা থেকে? নাকি সঙ্গের ঝোলাটা থেকে? কয়দিন ধরে গোসল করে না, খোদা মালুম! পরনের আলখাল্লাটা কয়দিন ধরে গায়ে আছে তা-ই বা কে জানে!
‘কেমুন আছ, লতিপ মিয়া?’ মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল লোকটা।
‘ভালাই। কিন্তু আফনে কেডা? চিনলাম না তো।’ হড়বড়িয়ে বলল লতিফ মিয়া। এখনও ধাতস্থ হতে পারেনি সে।
‘আমি কেডা, হেইডা গুরুত্বপুন্ন না। আমি কিতা কইতে আইসি হেইডা গুরুত্বপুন্ন।’
‘কী কইতে আইসেন? চেরম্যান সাবরে ডাকুম?’
‘নাহ, হেরে ডাইক্কা কাম নাই। বজ্জাতটারে দেখলেই শইলডা জ্বলে। ‘মুখ সামলাইয়া কথা কন, মুরুব্বী।’
‘ক্যান? হেয় কি ভালা মানুষ নাকি, লতিপ?’
চুপ করে রইল লতিফ মিয়া, জবাব দিল না প্রশ্নটার। মতি চেয়ারম্যান কেমন মানুষ, এটা তার চেয়ে ভাল আর কে-ই বা জানে?
‘কামডা ক্যান করলা, লতিপ?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল লোকটা।
‘কোন্ কাম?’
‘মাইয়াডারে মারলা ক্যান?’
উত্তেজনার বশে এক লাফে উঠে দাঁড়াল লতিফ মিয়া। ‘কোন্ মাইয়া? আমি মারুম ক্যান! এইগুলান আফনে কী কইতাসেন! কেডা আফনে? কেডা?’
‘শান্ত হইয়া বও, লতিপ। এমনে চিল্লাইলে তো মাইনষে হোন্ব। বিপদ তো আরও বাইড়া যাইব তাইলে।’
চট করে বসে পড়ল লতিফ মিয়া। ঘন-ঘন শ্বাস নিচ্ছে সে, বুক ধড়ফড় করছে। কে এই লোক? কতটুকু জানে সে?
‘কার কথা কইতাসি, হেইডা তুমি ভালই জান, লতিপ। সাধু সাইজ্জা ফয়দা কী? মাখনলালের বউডারে মারলা ক্যান?’
‘আমি মারুম ক্যান? আমি কাউরে মারি নাই।’
‘মারসো, লতিপ, মারসো। তুমি আর মইত্যা হারামজাদা মিল্লা মারসো। মাইয়াডা বহুত ভালা আছিল, লতিপ।’
‘মিছা কথা। আমি মারি নাই। কেউ দেহে নাই কেডা মারসে হেতিরে। কোন সাক্ষী নাই।’
‘সাক্ষী আছে, লতিপ মিয়া, সাক্ষী ঠিকই আছে। তোমরা দেহ নাই, কিন্তুক তোমাগোরে হেতারা ঠিকই দেখসে।’
‘কোন্ বেডারা দেখসে? কেডা? নাম কিতা হেতারার?’
এখনও এক নাগাড়ে হাসছে লোকটা। হাসিটা এখন আগের চেয়েও বেশি বিরক্তিকর লাগছে লতিফ মিয়ার কাছে।
‘বেডা দেখসে, কহন কইলাম? সাক্ষীরা কেউ মানুষ না, লতিপ।’
আরও ঘাবড়ে গেল লতিফ মিয়া। কী বলছে এসব লোকটা! কোত্থেকে এসেছে এই পাগলা? কোন্ গ্রামের লোক?
‘মাইয়াডা হাছাই খুব লক্ষ্মী আছিল, লতিপ,’ আবারও বলল লোকটা। ‘টানাটানির সংসার, নিজেরই ভাত জোটে না দুই বেলা। হের মইধ্যেই আমারে একবেলা ভাত খাওয়াইসিল। নিজের ভাগেরটাই দিয়া দিসিল মনে হয়। ওই অল্প একটু খানাতেই আমাগো সবার পেট ভইরা গেসিল, লতিপ। সবই খোদার ইচ্ছা।’
‘সবাই কেডা? আর কেডা-কেডা আছিল আফনের লগে?’
‘তাগো লগে খুব জলদিই তোমাগো মোলাকাত হইব, মিয়া। চিন্তা লইয়ো না।’ খিক্-খিক্ করে হেসে উঠল লোকটা।
কী বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইল লতিফ মিয়া। লোকটার কাছ থেকে আরও খানিকটা সরে বসল সে। ইতোমধ্যেই লোকটা তাকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।
‘মানুষ বেঈমান হয়, নিমকহারাম হয়, কিন্তুক অন্য জন্তু-জানোয়ার কুনু সময় বেঈমানী করে না, লতিপ,’ কথা চালিয়ে গেল লোকটা। ‘মাইয়াডা জিন্দা থাকতেও বহুত জানোয়ারের খিদা মিটাইসে, মইরা লাশ হইয়াও কিছু জানোয়ারের খাওনের জোগান দিসে। অরা কিন্তুক ঠিকই হের প্রতিদান দিব, লতিপ। শোধ কইরা দিব বেবাক দেনা-ফাওনা।’
বলতে-বলতে নিজের ঝোলায় হাত বুলাল লোকটা, দৃষ্টিতে স্নেহ ঝরে পড়ছে। এই প্রথম লতিফ মিয়া খেয়াল করল, লোকটার ঝোলায় যা-ই থাকুক না কেন, ওগুলো জীবন্ত! তার চোখের সামনেই বার কয়েক নড়ে উঠল ঝোলাটা!
কী আছে ব্যাগটার ভিতরে? বিড়াল? কুকুর? নাকি মানুষের বাচ্চা?
তড়িৎ বেগে লাফিয়ে উঠল লতিফ মিয়া। ভীষণ ভয় পেয়েছে সে। কোথায় যেন শুনেছিল, প্রেত-সাধকেরা সাধনার জন্য মানুষের বাচ্চা বলি দেয়। সিদ্ধি লাভের জন্য কাজটা করতে হয় ওদের। এই লোকটা নিশ্চয়ই তাদেরই একজন, বাচ্চাটাকে বলি দিতে চলেছে শয়তানের উদ্দেশে। তবে লোকটার যে কিছুটা হলেও আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে, এটা নিশ্চিত। না হয় মাখনলালের বউয়ের কথাটা জানতে পারত না সে।
তাই অযথা লোকটাকে ঘাঁটানোর ঝুঁকি নিতে চাইল না লতিফ মিয়া। কোনমতে বলল, ‘শিগির বিদায় হন এহান থাইকা। আফনে পোলাচুর। বেশি ঝামেলা করলে চেরম্যান সাবরে ডাইকা আইনা থানায় চালান কইরা দেমু কইলাম।’
তাকে অবাক করে দিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়াল লোকটা। ঝোলাটা কাঁধে ঝুলিয়ে নেমে পড়ল বারান্দা ছেড়ে। এতটা সহজে এহেন উটকো ঝামেলা থেকে রেহাই পাবে, কল্পনাও করেনি লতিফ মিয়া। হতভম্ব হয়ে লোকটার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল সে।
বিড়বিড় করতে-করতে কয়েক কদম এগিয়ে গেল লোকটা, তারপর ঘাড়ের উপর দিয়ে ফিরে তাকাল। হাসি মুছে গেছে তার, দু’চোখ থেকে ছিটকে পড়ছে ক্রোধ।
‘সাবধানে থাইকো, লতিপ মিয়া। আজকের রাইতটা তেমন সুবিধার ঠেকতাসে না।’
পাঁচ
অন্যান্যদিনের তুলনায় সে রাতে খানিকটা আগেভাগেই শুয়ে পড়ল লতিফ মিয়া বুকটা ভারী হয়ে আছে তার, কিছুতেই অদ্ভুত লোকটাকে মাথা থেকে তাড়ানো যাচ্ছে না। লোকটার মধ্যে অশুভ কী যেন একটা আছে, মনের উপর চাপ ফেলে।
জীবনে এই প্রথম সত্যিকারের আতঙ্ক কাকে বলে টের পাচ্ছে লতিফ মিয়া। এতটাই ভয় পেয়েছে যে, নিজের ঘুপচি ঘরে শোয়ার সাহসটুকুও আজ হয়নি তার, বিছানা পেতেছে কাছারি ঘরে।
আগুন কেন জ্বেলে রেখেছে, নিভানোর সাহস নেই। তবে ভয়টা যে ঠিক কীসের, এটা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না সে। একারণে শঙ্কাটা আরও বেশি জাঁকিয়ে বসেছে তার মনে। কাছারি ঘরের বিছানায় জাজিম নেই, কাঠের পাটাতনের উপর পাতলা চাদর পাতা। বালিশটাও ইটের মত শক্ত, ঘাড়ের কাছটায় ব্যথা লাগে।
তাতেই কোনরকমে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ মুদল লতিফ মিয়া। ভারী কাঁথা টেনে দিয়েছে গলা পর্যন্ত। পরিশ্রান্ত মানুষ, গতরাতেও ঘুমোতে পারেনি; অচিরেই চোখের পাতা ভারী হয়ে এল তার।
খানিকক্ষণের মধ্যেই রীতিমত নাক ডাকতে শুরু করল সে। শীতের নিস্তব্ধ রাতে সে শব্দ ছড়িয়ে পড়ল অনেক দূর অবধি।
আচমকা চোখ খুলে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল লতিফ মিয়া। ঠিক কী কারণে কাঁচা ঘুমটা এভাবে চট করে ভেঙে গেল, প্রথমটায় কিছুতেই ঠাহর করতে পারল না সে। পরক্ষণেই দেখতে পেল, ভারী কাঁথাটা এখন আর গায়ে নেই তার, মেঝের ওপর পড়ে আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে! চোখ কচলে ওটার দিকে ভাল করে তাকাতেই, দেহের সমস্ত রক্ত জমে বরফ হওয়ার জোগাড় হলো তার। কাঁথাটা আর আস্ত নেই মোটেও; চিরে ফালাফালা করে ফেলা হয়েছে! যেন প্রচণ্ড আক্রোশে ওটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কোন বিশালদেহী দানব!
কীসে এমন হাল করেছে ওটার? বন্ধ দরজা ডিঙিয়ে ঘরেই বা ঢুকল কেমন করে?
ঠিক তখনই ঘরের কোনায় হুটোপুটির আওয়াজ শুনতে পেল লতিফ মিয়া। নিমিষেই শরীরের সবক’টা লোম দাঁড়িয়ে গেল তার।
বিস্ফারিত নেত্রে কোণের জমাটবাঁধা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল সে। আর অপেক্ষায় রইল ভয়ানক কোন দানবকে চাক্ষুষ করার।
পরমুহূর্তেই তাকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়ে মাঝারী আকারের একটা ধেড়ে ইঁদুর বেরিয়ে এল ওখান থেকে! কয়েক কদম এগিয়ে মেঝের আলোকিত অংশে এসে থমকে দাঁড়াল ওটা।
চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা সশব্দে ছাড়ার অবকাশ পেল লতিফ মিয়া। সামান্য একটা ইঁদুরের কারণেই কি না আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়েছিল তার! এতটা ভীতুও বুঝি হয় কেউ?
তবে পরের দৃশ্যটা চোখে পড়া মাত্রই আবারও দম আটকে এল তার!
প্রথম ইঁদুরটার পিছু নিয়ে একে-একে অন্ধকার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করল ইঁদুরের পাল! সবক’টা বিশালাকার, দেখতে অবিকল একই রকম। শত- শত, হাজার-হাজার ইঁদুর! দেখতে-দেখতে পুরো মেঝেটাই ঢেকে গেল ইঁদুরের পালে!
বিদ্যুৎ চমকের মত সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল লতিফ মিয়ার কাছে। বুঝে গেল, কাঁথাটার এমন হাল কারা করেছে। সন্ধ্যায় কাদের কথা বলেছিল রহস্যময় লোকটা; কারা ছিল গতরাতের হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী!
পিছাতে-পিছাতে দেয়ালঘেঁষা খাটের একেবারে শেষ কোনায় চলে গেল লতিফ মিয়া। নিদারুণ আতঙ্কে সমস্ত অন্তরাত্মা কাঁপছে তার; নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঘরভর্তি অগুনতি ইঁদুরের দিকে।
মেঝেতে এখন সমুদ্রের ঢেউয়ের মত ঢেউ উঠছে, একে অন্যের শরীরে ভর দিয়ে ধীরে-ধীরে উঁচু হচ্ছে খুনে ইঁদুরের দল। খাটের পায়া বেয়ে উঠতে শুরু করেছে বাকিরা, লতিফ মিয়ার নাগাল পেতে খুব বেশি বাকি নেই আর।
ঘোরলাগা চোখে পুরোটা সময় ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলেও, তার মন পড়ে আছে অতীতে। দৈববলে শৈশবের সবকিছু মনে পড়ে গেছে তার! মা-বাবা, ভাই-বোনদের সঙ্গে কাটানো সুখের খণ্ডচিত্রগুলো একে-একে ভাসছে তার চোখের সামনে। নিয়তির নিষ্ঠুর ছোবলে, চোখের পলকে বদলে গেল সবকিছু!
প্রথম ইঁদুরটা শরীরে কামড় বসাতেই ঘোর কেটে গেল লতিফ মিয়ার। সাহায্যের আশায় গলা ফাটিয়ে চেঁচানোর জন্য মুখ খুলল সে।
তবে চিৎকারটা আর কখনওই ওর গলা ছেড়ে বেরোনোর সুযোগ পায়নি। মুখ খোলা মাত্রই অন্তত গোটা পাঁচেক ইঁদুর একযোগে ঢুকে পড়ল তার মুখগহ্বরে!
লতিফ মিয়ার আলজিভের দখল পেতে একে অন্যের সঙ্গে লড়াই শুরু করল ওরা!
ছয়
মতি চেয়ারম্যানের সাকল্যে তিনজন বউ। তবে বেশিরভাগ সময় রাতটা সে ছোট বউ ময়নার ঘরেই কাটায়।
বাচ্চা-কাচ্চা জন্ম দিয়ে বড় দু’জনের দেহের বাঁধন ঢিলে হয়ে গেছে; ওতে আর আজকাল মন ভরে না মতির।
ময়নার বয়স সবে উনিশ, আগুনরঙা রূপ। পা থেকে মাথা পর্যন্ত উপচে পড়া যৌবন, এক দফায় খাঁই মেটানো কঠিন। অমন বউ ছেড়ে কী কারণে অন্য বউদের ঘরে রাত কাটাতে যাবে মতি? চেয়ারম্যানকে ঢুকতে দেখেই লণ্ঠনের আঁচটা খানিকটা কমিয়ে দিল ময়না। অর্ধেক সেলাই করা নকশী কাঁথাটা তুলে রাখল পাশের টেবিলে। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল সলজ্জ হাসি।
ঘরে ঢুকেই চটজলদি দরজাটা বন্ধ করে দিল মতি। পরনের পাঞ্জাবীটা আলনায় তুলে রেখে, ভুঁড়িতে হাত বুলাতে-বুলাতে বিছানায় এসে বসল। খুশিতে সবক’টা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে তার, কিছুতেই ওদেরকে ঠোঁটের আড়ালে লুকোতে পারছে না সে।
ময়নার কাছে এলেই কী যেন হয় তার! নিজেকে বাচ্চা-বাচ্চা মনে হয়, আহ্লাদ করতে ইচ্ছে করে, ন্যাকামো করতে মন চায়।
‘কাইল রাইতে কই আছিলেন? বড় বুবুর ঘরে?’ অভিমানী গলায় জিজ্ঞেস করল ময়না। আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ এই প্রশ্নটাতেই ভয়ানক চমকে উঠল মতি। এক নিমিষে মুছে গেল মুখের দ্যুতি।
‘হ,’ কোনমতে বলল সে। তার জানা আছে, রাতে থাকা নিয়ে সতীনেরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করে না কখনওই। তাই ধরা পড়ার আশঙ্কা এক্ষেত্রে নেই বললেই চলে।
‘আইজও থাকতেন। আইলেন ক্যান?’ কণ্ঠে আরও খানিকটা আহ্লাদ ঢেলে বলল ময়না। নীচের দিকে মুখ নামিয়ে রেখেছে বলে আধো অন্ধকারে তার মুখের ভাব স্পষ্ট ঠাহর করতে পারল না মতি।
‘আমার ময়না পাখিডারে দেখতে মন চাইল। তাই চইলা আইলাম,’ যথাসম্ভব নরম গলায় বলল সে। তারপর এগিয়ে গেল ময়নার দিকে।
দ্রুত কাজে নেমে পড়ল চেয়ারম্যান। হাত বাড়িয়ে লণ্ঠনের আঁচটা আরও খানিকটা কমিয়ে দিল; তারপর অভ্যস্ত হাতে খুলতে শুরু করল ময়নার বসন।
‘ও, মা গো,’ আচমকা চেঁচিয়ে উঠল ময়না। ঝটকা মেরে মতিকে নিজের গায়ের উপর থেকে সরিয়ে দিল সে। উঠে বসে নিজের পায়ে হাত বুলাতে লাগল।
‘কী হইল আবার! চিল্লান দিলা ক্যান? অহনও তো শুরুই করি নাই কিছু, অবাক কণ্ঠে জানতে চাইল মতি।
‘কীয়ে জানি কামুড় দিল পায়ে…’
‘কও কী!’ লণ্ঠনটা, ময়নার পায়ের কাছে নিয়ে এল মতি। ‘দাঁতের দাগ দেহি। রক্তও তো বাইর হইতাসে!’
‘সাপে কামুড় দিলনি কোন? আমার অহন কী হইব? ও, আল্লা গো…’ আবারও চিৎকার শুরু করল ময়না।
তবে চেয়ারম্যানের কড়া ধমক খেয়ে আপাতত ক্ষান্ত দিল কাজটায়। ‘খাড়াও। বেহুদা চিল্লাইও না। দেইখা লই আগে।’
খাটের তলাটা ভাল করে দেখার জন্য আলোটা বাড়িয়ে দিল মতি। দামী লণ্ঠন, নিমিষেই দিনের আলোর মত ফকফকা হয়ে গেল জায়গাটা।
‘খাইসে! কত্ত বড় ইন্দুর! সাপখোপ না গো, ইন্দুরে কামড়াইসে তোমারে।’ ভুঁড়ি দুলিয়ে হাসতে শুরু করল মতি।
একটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ইঁদুরটাকে তাড়িয়ে দিল সে। ঘরের পিছন দিকটায় বড়-বড় কয়েকটা গোলায় আতপ চাল রাখা আছে, ওখানেই গিয়ে লুকিয়ে পড়ল ওটা।
ইঁদুরটার চোদ্দগোষ্ঠীর উদ্দেশে খানিকক্ষণ খিস্তি করে উঠে দাঁড়াল মতি, দরজা খুলতে শুরু করল।
‘অহন আবার কনে যাইতাসেন?’
‘খাড়াও। আইতাসি। লতিপ্পারে ইঁদুরের ওষুধের কথা কইয়া আই। পরে ভুইল্যা যামু। ওষুধ না দিলে হারামিগুলান আমার গোলা সাফ কইরা ফালাইব।’
‘তাড়াতাড়ি আইয়েন কিন্তুক। আমার ডর করে।’
‘ডর কীয়ের আবার! আমি এই গেলাম আর আইলাম।’
দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে উঠনে পা রাখল মতি। জোর কদমে হাঁটতে শুরু করল কাছারি ঘরের দিকে।
বিশালকায় উঠনের একেবারে শেষ মাথায় কাছারি ঘর, তার পাশেই একটা ছোট্ট ঘরে রাত কাটায় লতিফ মিয়া।
অবচেতন মনে মাখনলালের বউটার কথা ভাবতে শুরু করল মতি চেয়ারম্যান। মেয়েটাকে প্রাণে মারার কোন ইচ্ছেই ছিল না তার। কী থেকে যে কী হয়ে গেল, খোদা মালুম!
বেঁচে থাকলে আরও অন্তত বার কয়েক মেয়েটাকে ভোগ করা যেত। বহুবছর পর ভীষণ রকম তৃপ্তি দিয়েছিল তাকে মেয়েটা।
আচমকা পিছনে অস্পষ্ট একটা শব্দ শুনতে পেয়ে ফিরে তাকাল মতি। শিশিরমাখা চাঁদের আলোয় যে দৃশ্যটা দেখতে পেল সে, কিছুতেই সেটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না তার। সত্যিই কি এটা বাস্তব? নাকি নিদারুণ কোন ভ্রম?
জগতের সমস্ত ইঁদুর এসে জড় হয়েছে উঠনে! দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে এখন ওরই দিকে তেড়ে আসছে ওগুলো। কে কার আগে ওকে ধরতে পারবে, এই নিয়েই যেন প্রতিযোগিতায় মত্ত ওরা! নাগাল পেলে নিজের পরিণতি কী হবে, এটা না বোঝার মত বোকা নয় মতি। জীবন বাঁচাতে প্রাণপণে দৌড়তে শুরু করল সে।
ঘোলাটে জোছনায় কুয়াশা ভেজা খেতের আইলের উপর দিয়ে পালাচ্ছে মতি চেয়ারম্যান, তাকে তাড়া করে ছুটে চলেছে অপার্থিব ইঁদুরের পাল!
এসব থেকে অনেক দূরে এক ছোট্ট নৌকায় ঘুমিয়ে আছে পরিশ্রান্ত মাখনলাল। তার মাথার কাছে গামছায় জড়ানো কয়েক গাছি কাচের চুড়ি। বউয়ের জন্য হাট থেকে আজ বিকেলেই ওগুলো কিনেছে বেচারা।
সী-কুইন
ঢেউয়ের তালে-তালে মৃদু দুলছে জাহাজ-সী-কুইন। এই মাঝ দরিয়ায় জাহাজটার নিঃসঙ্গতা ঘোচাতেই যেন ওটাকে সঙ্গ দিয়ে চলেছে কয়েকটা দলছুট গাঙচিল।
জাহাজটা মাঝারি আকারের; মালবাহী। তবে যে কোন বিলাসবহুল যাত্রীবাহী জাহাজের মতই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে-তকতকে।
ক্যাপ্টেন রবার্ট বায়রনের পরিচ্ছন্নতা বাতিক আর নাবিকদের নিখাদ আন্তরিকতার যুগপৎ মিশেলের কারণেই কেবল আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব এই ব্যাপারটাকে সম্ভব করা গেছে। বায়রনের যে কোন আদেশ বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নেয় তাঁর অধীন ক্রুরা; নিজেদের ক্যাপ্টেনের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ওদের।
এই মুহূর্তে ক্যাপ্টেনের কেবিনে বসে তাঁর সাথে তাস পেটাচ্ছে ফার্স্ট মেট, নেলসন।
ভর সন্ধ্যার বিষণ্ণতা ভাসছে ঘরের বাতাসে। তাতে কীসের যেন একটা অশুভ গন্ধ মেশানো, যা নোনা জলের গন্ধ ছাপিয়ে আলাদা করে ধরা পড়ছে অবচেতন মনে।
সজোরে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লেন ক্যাপ্টেন রবার্ট, নিজের উপর বিরক্ত। ‘আজ একটাবারও ভাল কার্ড আসছে না আমার হাতে। ঘটনা কী, নেলসন? জাদুটোনা করোনি তো আবার? আমার সহায়-সম্পত্তি সমস্ত কিছু হাতিয়ে নিতে চাও বুঝি?’
হাসার চেষ্টা করল ফার্স্ট মেট, কিন্তু হাসিটা ঠিকঠাক ফুটল না চেহারায়। ব্যাপারটা ক্যাপ্টেনের নজর এড়াল না।
‘কী হয়েছে তোমার? পর-পর তিনবার জিতেও খুশি হতে পারছ না নাকি? আরও বেশি চাও? লোভটা একটু কমাও, নেলসন। একা মানুষ তুমি; এত পয়সা দিয়ে করবেটা কী, শুনি?’
‘না…মানে…ইয়ে…আপনাকে একটা কথা বলার ছিল, ক্যাপ্টেন।’
‘তো সেটা বলে ফেললেই হয়। এত ভণিতা করছ কেন?’
‘ছেলেরা…ছেলেরা ভীষণ ভয় পাচ্ছে, স্যর।’
‘মানে? কারা?’ অবাক কণ্ঠে জানতে চাইলেন ক্যাপ্টেন রবার্ট। আর যা-ই হোক অন্তত এধরনের কোন কথা আশা করেননি তিনি I
‘নাবিকেরা, খালাসীরা, ইঞ্জিন মাস্টার…মোদ্দা কথা আপনি ছাড়া জাহাজের আর বাদবাকি সবাই,’ ঢোক গিলতে-গিলতে কোনরকমে বলল নেলসন। ‘এমনকী ‘আমি নিজেও।’
‘কীসের ভয়?’ হতভম্ব মনে হলো ক্যাপ্টেন বায়রনকে। নিজের অজান্তেই গলার স্বর খানিকটা চড়ে গেছে তাঁর।
আমতা-আমতা শুরু করল ফার্স্ট মেট নেলসন। ‘আমাদের কার্গো হোল্ডে রাখা কষ্টি পাথরের মূর্তিটার জন্য, স্যর। ওটা…ওটা…রাসং উপজাতির অভিশাপের দেবতা তাখাপোং-এর মূর্তি!’
‘তো হয়েছেটা কী তাতে? সামান্য একটা মূর্তিই তো, তাই না? স্বয়ং দেবতা তো আর নয়। কী সমস্যা করছে ওটা তোমাদের? কেন ভয় পাচ্ছ ওটাকে?’ স্পষ্ট উষ্মা প্রকাশ পেল ক্যাপ্টেনের গলায়। ‘তোমাকে তো নাস্তিক বলেই জানতাম, নেলসন। কবে থেকে আবার এসব দেব-দেবতায় বিশ্বাস করা শুরু করলে?’
চুপ করে রইল ফার্স্ট মেট। কী জবাব দেবে এই প্রশ্নের?
কিন্তু ক্যাপ্টেন বায়রনের রাগ তখনও পড়েনি, বলে চললেন তিনি, ‘সাধারণ একটা মূর্তি তোমাদের সবাইকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে; বিষয়টা ভাবতেই বিরক্তি লাগছে আমার। তোমরা ভাল করেই জান যে, রানীর জন্য উপহার হিসেবে পাঠানো হয়েছে ওটা। পাঠিয়েছেন স্বয়ং আমাদের জাহাজের মালিক, মিস্টার হারলান। চাইলেই ওটা আমি রেখে আসতে পারতাম না; ফেলে আসার কোন যৌক্তিক কারণও নেই। তাছাড়া ওটা পড়ে আছে কার্গো হোল্ডের এক অন্ধকার কোনায়। ওটাকে নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মত কী আছে, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’
খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর ধীরে-সুস্থে বোমাটা ফাটাল নেলসন। ‘কারণ, স্যর, রোজ রাতেই ওটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছি আমরা! স্বপ্নটা ভীষণ বিদঘুটে, স্যর। আর আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, সবার স্বপ্নই অবিকল এক!’
পরবর্তী কয়েকটা মুহূর্ত বিস্ফারিত নেত্রে নেলসনের দিকে চেয়ে রইলেন ক্যাপ্টেন বায়রন। বলছে কী এই লোক? অবিকল একই স্বপ্ন! তা কী করে হয়? ‘গোটা ব্যাপারটা খুলে বলো তো, নেলসন। স্বপ্নে ঠিক কী দেখতে পাচ্ছ তোমরা?’
বলার জন্য তৈরিই ছিল ফার্স্ট মেট। কালক্ষেপণ না করে তোতাপাখির মত ঠোঁট নাড়াতে শুরু করল সে।
.
স্বপ্নটা শুরু হয় খুব সাদামাঠাভাবে। লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে, বিশাল এক ন্যাড়া পর্বতের অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা গুহায়, দেবতা তাখাপোং-এর উপাসনালয়।
মিশমিশে কালো কষ্টি পাথর কুঁদে বানানো দেবমূর্তির সামনে ছোট একখানা পোড়ামাটির বেদি। তাতে তাজা রক্তের পাশাপাশি, শুকিয়ে আসা ছোপ-ছোপ রক্তও অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। নিজের শরীরের রক্ত ঢেলেই এই দেবতার আরাধনা করা হয়। বেদিটাকে ঘিরে থাকে এক দঙ্গল পুরোহিত। পরনে এক গাছি সুতোও নেই ওদের। পুরোপুরি দিগম্বর।
সাধারণত অন্য উপজাতি সম্প্রদায়গুলোতে মহিলাদেরকে পুরোহিতদের কাজ করতে দেখা যায় না; তবে রাসংরা এক্ষেত্রে একেবারেই আলাদা। পুরুষদের পাশাপাশি বেশ ক’জন মহিলা পুরোহিতকেও নগ্ন হয়ে নাচতে দেখা যায় মূর্তিটার সামনে।
পুরোহিতদের তৈরি করা মানব ব্যূহটা পুরোপুরি অভেদ্য নয়, মাঝখানটায় একটা ফোকরমতন রয়েছে। সাধারণ পূজারীরা এই পথেই একসারিতে পায়ে- পায়ে এগিয়ে চলে বেদি অভিমুখে। বেদির সামনে গিয়ে খানিকক্ষণ চোখ মুদে দাঁড়াতে হয়। এ সময়টায় দেবতার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়া হয়।
তারপর চোখ খোলামাত্রই সামনে রাখা ধারাল ছোরাটা নিজের হাতের যে কোন একটা আঙুলে অবলীলায় চালিয়ে দেয় ওরা। ক্ষতটা থেকে কয়েক ফোঁটা তাজা রক্ত বেদিতে গড়িয়ে পড়ার পর নির্বিবাদে জায়গাটা থেকে সরে দাঁড়ায়, আরাধনার সুযোগ করে দেয় পাশের জনকে। শত-শত রাসং ওখানটায় উপস্থিত থাকলেও কোথাও একরত্তি বিশৃঙ্খলা চোখে পড়ে না। সম্পূর্ণ নিঃশব্দে এগিয়ে চলে রক্ত সমর্পণের এই আয়োজন।
স্বপ্নের এ পর্যায়ে স্বপ্নদ্রষ্টা নিজেকে একেবারে সবার সামনে আবিষ্কার করে, যেন এবার তারই পুজো দেয়ার পালা! স্বভাবতই নিজের হাতে ছুরি চালাতে খানিকটা ইতস্তত করে সে। নিজেরা রাসং না হওয়ায় কাজটায় কেউই অভ্যস্ত নয়, কিছুটা জড়তা ভর করাটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
ঠিক এই সময় উপস্থিত সবার পিলে চমকে দিয়ে আচমকা খুলে যায় দেবতা তাখাপোং-এর রক্তলাল দুটো চোখ! বেশ কিছুক্ষণ নির্নিমেষে স্বপ্নদ্রষ্টার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। ধীরে-ধীরে নিজের বাম বাহুটা উঁচু করে তাখাপোং, সরাসরি তাক করে আসামীর বুকের দিকে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে ওঠে, ‘এই লোকটা চুরি করে এখান থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। পরিণামে ভয়ঙ্কর শাস্তি ভোগ করতে হবে তাকে। এই মহাপাপের কোন ক্ষমা নেই। ধ্বংস অনিবার্য।’
কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই চোখের পলকে আবারও নিষ্প্রাণ মূর্তি বনে যায় ওটা। যেন চিরকাল অমন নিষ্প্রাণই ছিল, প্রাণের কোন চিহ্নই আর খুঁজে পাওয়া যায় না মূর্তিটার মধ্যে! তবে স্বপ্নদ্রষ্টার জন্য তখন আরও ভয়াবহ এক পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে অগণিত ক্রোধান্বিত রাসং; যারা দেবতা-চোরকে নিজের হাতে শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর!
ধীরে-ধীরে মানব-বৃত্তটা ছোট হয়ে আসে, বুনো জানোয়ারের হিংস্রতা ভর করে সবার চোখে-মুখে।
একেবারে অন্তিম মুহূর্তে যে-ই না ওরা আসামীর উপরে সদলবলে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হয়, ঠিক তখনই ঘুমটা ভেঙে যায়!
তারপর আর চোখের পাতা এক করার সাহস হয় না কারও, জেগেই কাটাতে হয় পুরোটা রাত।
.
হাঁপাতে-হাঁপাতে নিজের বয়ান শেষ করল ফার্স্ট মেট নেলসন। ক্যাপ্টেনের কাছে স্বপ্নটা সবিস্তারে বলতে গিয়ে গায়ের সবক’টা লোম দাঁড়িয়ে গেছে তার।
রাতের স্বপ্নের মতই সবকিছু যেন জীবন্ত হয়ে ভাসছিল তার মনের পর্দায়।
কিন্তু ক্যাপ্টেন বায়রনকে দেখে মোটেও বিচলিত মনে হলো না। শিরদাঁড়া সোজা করে এমন একটা ভঙ্গিতে বসে আছেন, যেন এতক্ষণ ধরে মনোযোগ দিয়ে ঠাকুরমার ঝুলির কোন একটা সরেস গল্প শুনছিলেন তিনি!
তাঁর কথাতেও সেটা পরিষ্কার ফুটে উঠল। আমুদে গলায় বললেন, ‘গল্পটা দারুণ। বেশ রোমাঞ্চকর। রোজ রাতে এহেন অ্যাডভেঞ্চার করার সৌভাগ্য কিন্তু সবার হয় না, নেলসন। তোমাদের উচিত খুশি হয়ে স্রষ্টাকে কৃতজ্ঞতা জানানো। আর তোমরা কিনা ভয় পাচ্ছ! স্বপ্ন তো স্বপ্নই, তাই না?’
ক্যাপ্টেনের কথায় বেশ মর্মাহত হলো ফার্স্ট মেট। তিনি গোটা বিষয়টা এতটা হালকাভাবে নেবেন, এটা সে কস্মিনকালেও কল্পনা করেনি।
‘আমরা কিন্তু ভয়ই পাচ্ছি, স্যর। কারণ আমাদের কাছে ব্যাপারটাকে এখন আর নিছক স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে না। সত্যি-সত্যিই কোন একটা দুর্যোগ নেমে আসার আগেই মূর্তিটাকে ফিরিয়ে দেয়া উচিত, স্যর।’
‘কিন্তু সেটা তো আর চাইলেই এখন করা যাচ্ছে না, তাই না? আমরা বন্দর ছেড়েছি অন্তত সপ্তাহখানেক আগে। এই হতচ্ছাড়া মূর্তিটার জন্য পুরোটা পথ আবার ফিরে যেতে বলছ নাকি? উপরওয়ালার কাছে এই ঘটনার কী ব্যাখ্যা দেব আমি, শুনি?’
‘না, স্যর। ফিরে যেতে হবে না আমাদের।’ আচমকা চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল নেলসনের। ‘মূর্তিটাকে এখানে…এই মাঝ-সাগরেই ফেলে দিতে পারি আমরা। ওটা নিজেই নিজের আস্তানায় ফিরে যেতে পারবে, স্যর। আমরাও ওটার অভিশাপ থেকে বেঁচে যাব।’
পরবর্তী কয়েকটা মুহূর্ত চোখভরা অবিশ্বাস নিয়ে নেলসনের দিকে তাকিয়ে রইলেন ক্যাপ্টেন রবার্ট বায়রন। তাঁর সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে এতদিন একজন বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবেই জেনে এসেছেন তিনি। অতীতে কখনওই সে এতটা নির্বোধের মত আচরণ করেনি
গলা অনেকখানি চড়ে গেল ক্যাপ্টেন বায়রনের। ‘তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি কি সব লোপ পেয়েছে, নেলসন? এত দামী একটা জিনিস এভাবে স্বেচ্ছায় জলে ফেলে দেব, এমনটা ভাবলে কী করে তুমি?’
মূক পশুর মত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল নেলসন, কী বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। বলে চললেন ক্যাপ্টেন বায়রন, ‘তাছাড়া এভাবে মূর্তিটাকে জলে ফেলে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এটাই বা তোমাকে কে বলল? হিতে বিপরীতও তো হতে পারে। হয়তো দেখা গেল পানিতে চুবানোর জন্য আরও বেশি রেগে উঠেছেন তাখাপোং, তখন?’
এবার যেন হালে কিছুটা পানি পেল ফার্স্ট মেট। চটজলদি বলে উঠল, ‘না, না, স্যর। মোটেও রাগবেন না তিনি, উল্টো মুক্তি দিয়েছি বলে আমাদের উপর বেশ প্রসন্ন হবেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই এখন একমাত্র পথ, স্যর।’
‘কী করে জানলে সেটা? এটাও কি স্বপ্নে দেখেছ নাকি?
ক্যাপ্টেনের কণ্ঠের প্রচ্ছন্ন উপহাসের সুরটা ধরতে পারল না নেলসন। তড়িঘড়ি বলল, ‘তৈমুরের কাছ থেকে জেনেছি, স্যর। ও-ই আমাদেরকে সবকিছু খুলে বলেছে।’
নিমিষেই পাল্টে গেল ক্যাপ্টেন বায়রনের চেহারা; প্রচণ্ড রেগে গেছেন তিনি। ‘এই তাহলে ব্যাপার? তৈমুরের অবাস্তব গল্পগুলোই তাহলে তোমাদের উদ্ভট স্বপ্নের রসদ জোগাচ্ছে!’ হতাশায় বার কয়েক মাথা দোলালেন ক্যাপ্টেন। ‘ছিঃ, নেলসন। লজ্জা পাওয়া উচিত তোমাদের। একটা মাতালের গল্প শুনে জাহাজসুদ্ধ এতগুলো বুদ্ধিমান লোক কেমন করে ভড়কে গেলে?’ মাথা নিচু করে রইল ফার্স্ট মেট। ভুল কিছু বলেননি ক্যাপ্টেন; তৈমুর সত্যিই নির্ভরযোগ্য কোন মানুষ নয়।
.
নতুন একজন খালাসীর নাম তৈমুর। লোকটা শ্রীলঙ্কার বাসিন্দা; এবারই প্রথম সী- কুইনে কাজ নিয়েছে সে। হাবভাবে বেশ শিক্ষিতই মনে হয় তাকে, যদিও মুখে কখনও সেটা স্বীকার করেনি লোকটা।
গায়ের রঙ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ; অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকলে চট করে চোখে পড়ে না, সহজেই নজর এড়িয়ে যায়।
এমনিতে লোকটা মন্দ নয়, নিজের কাজে বেশ পারদর্শী। বিনাবাক্যব্যয়ে যে কোন আদেশ মেনে নেয়, কোন রা করে না।
তবে সমস্যা একটাই; তার ভয়াবহ মদ-প্রীতি!
সন্ধ্যার পর আর তাকে দিয়ে কোন কাজ করানোর জো নেই, একেবারে বেহেড মাতাল হয়ে থাকে তখন লোকটা। কয়েক ঢোক পেটে পড়া মাত্রই হুঁশ- জ্ঞান লোপ পায়, চোখের পলকে সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষে পরিণত হয় সে। ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদে, প্রলাপ বকে। যেন গোটা জীবনের দুঃখগুলো ভাসিয়ে দিতে চায় দু’চোখের নোনা জলে।
কান্নার পর্বটা শেষ হলে খানিকটা শান্ত হয় সে; গল্প বলতে শুরু করে। তার গল্পের ধরনটা বেশ অদ্ভুত, কাহিনিগুলো তারচেয়েও বেশি চমকপ্রদ।
চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বিশ্রামরত নাবিকেরা বেশ আগ্রহ নিয়েই শোনে তার বয়ান। সমুদ্রযাত্রার একঘেয়ে সন্ধ্যাগুলোয় এহেন বিচিত্র কেচ্ছা-কাহিনি, সবার কাছেই বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়। গল্পকথকের বিশ্বাসটা শ্রোতাদের ভিতরে সঞ্চারিত হতে সময় লাগে না।
এতটাই দৃঢ়তার সাথে কথাগুলো ব্যক্ত করে তৈমুর, যেন সে নিজেই সেগুলো চাক্ষুষ করেছে। শুনতে যত উদ্ভটই লাগুক না কেন, অনেকটা বাধ্য হয়েই শ্রোতারা ভাবতে বসে, গল্পগুলো তো সত্যি হতেও পারে, তাই না? এই বিপুলা পৃথিবীর কতটুকুই বা আর জানতে পেরেছে মানুষ?
জরুরি পয়গাম পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ক্যাপ্টেনের কেবিনে ছুটে এল তৈমুর। চোখের তারায় বিরক্তি খেলা করছে। মাত্রই মদের বোতলটা খুলতে শুরু করেছিল সে; সুখযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটলে কারই বা আর ভাল লাগে?
তবে ক্যাপ্টেন রবার্টের দিকে চোখ পড়া মাত্রই চুপসে গেল সে, নিমিষেই বেমালুম গায়েব হয়ে গেল চেহারার সমস্ত বিরক্তি। স্পষ্ট বুঝতে পারছে, খোশগল্প করতে ডাকা হয়নি তাকে। অজ্ঞাত কারণে রেগে বোম হয়ে আছেন ক্যাপ্টেন বায়রন!
রাগটা কি তার উপর? কী করেছে সে? কী শাস্তি অপেক্ষা করছে তার জন্য?
এক লহমায় মনের কোণে অনেকগুলো প্রশ্ন এসে উঁকি দিতে শুরু করল, যার একটারও জবাব জানা নেই তার। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে রইল সে; অপেক্ষা করছে। কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর মুখ খুললেন ক্যাপ্টেন বায়রন। ঝাঁঝাল গলায় বললেন, ‘সবাইকে দেবতা তাখাপোং-এর গাঁজাখুরি গল্পটা তাহলে তুমিই শুনিয়েছ, তাই না?’
প্রশ্নটা শুনে তৈমুরের মনে হলো, এর চেয়ে বুঝি নীরবতাই ভাল ছিল। কালো মুখটা আরও অনেকখানি কালো হয়ে গেল তার। ভাল করেই জানে সে, বাস্তবতা বিবর্জিত গল্পগুজব একদমই পছন্দ করেন না ক্যাপ্টেন রবার্ট। একারণে আগেও বেশ কয়েকবার সতর্ক করা হয়েছে তাকে। সচেতনই ছিল সে, কিন্তু আর বুঝি শেষ রক্ষা হলো না।
মদ…এই মদই শেষতক সর্বনাশ করল তাহলে। কয়েক ঢোক গিললেই কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায় তার, তখনই হয়তো কোন এক ফাঁকে তাখাপোং-এর কাহিনিটা বলে ফেলেছিল সে নাবিকদের। আর এ-কান ও-কান করতে-করতে শেষটায় কথাটা পৌছে গেছে ক্যাপ্টেনের কান অবধি। এখন আর কিছুই করার নেই তার; বন্দুক থেকে বেরনো গুলি আর মুখ ফসকে বলে ফেলা কথা, কোনটাই আর ফেরানো যায় না।
নিজের দোষ স্বীকার করল তৈমুর, নীরবে মাথা দোলাল উপর-নীচে
‘তোমাকে বার-বার মানা করার পরও কী কারণে আজগুবি গল্পটা ফাঁদলে, শুনি?’ ক্যাপ্টেনের কণ্ঠে ক্রোধাগ্নির উত্তাপ।
‘আমি…আমি মাতাল ছিলাম, স্যর,’ আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করল তৈমুর। মাথা নিচু করে রেখেছে; অপরাধবোধে ভুগছে।
অগ্নিদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন ক্যাপ্টেন বায়রন, কিছু বলার মত ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি।
আচমকা নিজের উপর জোর খাটিয়ে মুখটা তুলল তৈমুর। নিজের ভিতরকার সবটুকু সাহস জড় করে বলল, ‘কথাটা কিন্তু সত্যি, স্যর, নির্জলা সত্যি। নিছক কোন গল্প নয়, একবিন্দু মিথ্যে নেই ওতে।’
‘মানে?’ হতভম্ব গলায় জানতে চাইলেন ক্যাপ্টেন রবার্ট; তৈমুরের কণ্ঠের দৃঢ়তা বিস্মিত করেছে তাঁকে।
‘সত্যিই রাসংদের অভিশাপের দেবতা তাখাপোং-এর মূর্তি বয়ে চলেছি আমরা। প্রতি মুহূর্তে নিজের পূজারীদের সাথে দূরত্ব বাড়ছে তাঁর। যে কোন সময় ভয়ানক খেপে উঠতে পারেন তিনি, প্রাণঘাতী কোন অভিশাপ দিয়ে বসতে পারেন আমাদেরকে। এর ফল কোনমতেই শুভ হবে না, স্যর। আমাদের উচিত যত দ্রুত সম্ভব মূর্তিটাকে সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ করা। তাহলেই কেবল তাখাপোং-এর করাল গ্রাস থেকে মুক্তির আশা করতে পারি আমরা।’
‘এতটা জোর গলায় বলছ কী করে? তুমি নিজেই কি একজন রাসং? নাহলে কী করে জানলে এতকিছু? তাছাড়া কেন একজন আদিবাসী দেবতা নিয়ে মাথা ঘামাতে যাব আমরা, শুনি? অতীতে কখনও তাখাপোং-এর উপাসনা করিনি আমরা, ভবিষ্যতেও করার কোন সম্ভাবনা দেখছি না। তাহলে?’
‘না, স্যর। আমি রাসং নই,’ নরম গলায় জবাব দিল তৈমুর। ‘তবে রাসং সম্প্রদায়ে অনেক বন্ধু আছে আমার। ওদের কাছ থেকেই সবকিছু জেনেছি আমি। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটিকে কিন্তু আপনিও দেখেছেন, স্যর। জাহাজ ছাড়ার সময় আমাকে বিদায় জানাতে বন্দরে এসেছিল সে। আমার প্রাণের বন্ধু, মিরাপ্পা। সৈকতে বসে সমস্ত দেবতার নামে হলফ করে নিজেদের নাম অদলবদল করেছি আমরা। কথা দিয়েছি, যতদিন বেঁচে থাকি, একে অন্যকে ভালবেসে যাব। যত দূরেই থাকি, হৃদয়ের বন্ধন অটুট থাকবে চিরকাল।
‘ওর কাছেই তাখাপোং-এর ব্যাপারে বিস্তারিত শুনেছি আমি। জেনেছি, কতটা নিষ্ঠুর এই দেবতা। মূর্তিটাকে আমাদের জাহাজে তুলতে দেখে ভয়ে কেঁপে উঠেছিল ও, বার-বার সাবধান করছিল আমাকে।
‘কিন্তু কথাটা আপনাকে বলার সাহস হয়নি আমার, স্যর। মাতাল হয়ে মুখ ফসকে বলে না ফেললে হয়তো গোপনই থাকত ব্যাপারটা। আর আপনারাও ধীরে-ধীরে এগিয়ে যেতেন ভয়াবহ এক পরিণতির দিকে, কোনকিছু না জেনেই।’
দম নেয়ার জন্য কয়েক মুহূর্ত বিরতি নিল তৈমুর। তারপর আবারও বলতে শুরু করল, ‘তাখাপোং একজন অপদেবতা, স্যর। অপদেবতারা এমনিতেই মানুষের কাছ থেকে খুব কম অর্চনা পায়। তাই যারা তাদের আরাধনা করে, তাদেরকে অনুগ্রহের সাগরে ভাসিয়ে দেয় ওরা; আর কেউ তাতে বাধা দিলে, তাদের জন্য বরাদ্দ থাকে সীমাহীন নিগ্রহ।
‘গোটা পৃথিবীতে একমাত্র রাসংরাই বোধহয় তাখাপোং-এর আরাধনা করে। তাই স্বভাবতই ওদের কাছ থেকে তাকে সরিয়ে নেয়াটা ভালভাবে নেবে না সে।’
‘রাসংরা কি শুধু তাখাপোং-এর পূজাই করে? নাকি আরও কোন দেবতা আছে ওদের?’ জানতে চাইল ফার্স্ট মেট নেলসন। এতক্ষণ চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে তৈমুরের কথা শুনছিল সে। লোকটা যে আদতেই একজন শিক্ষিত মানুষ, এ নিয়ে আর কোন সন্দেহ নেই তার মনে।
‘না, না, তা হবে কেন? আরও অনেক দেবতা আছে রাসংদের,’ গম্ভীর গলায় জবাব দিল তৈমুর। ‘সালজং ওদের উর্বরতার দেবতা। সূর্য হলো সালজং-এর প্রতিনিধি। ফসলের ভাল-মন্দ এই দেবতার মর্জির উপরই নির্ভর করে বলে রাসংরা বিশ্বাস করে। প্রতিটি রাসং-মাসের শুরুর দিনে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সালজং-এর পূজা করে ওরা। ফসলের মাঠে পানি ছিটায়, চিৎকার করে কাঁদে। তাদের প্রতি প্রীত হয়ে ন্যাড়া জমিনগুলো ফসলে ভরিয়ে দেন দেবতা সালজং।
‘রাসংদের ধন-দৌলতের দেবীর নাম, সুসাইম। এই দেবীর প্রতিনিধি হলো চন্দ্র। ভরা পূর্ণিমার রাতে দেবী সুসাইমের আরাধনা করে রাসংরা। উলঙ্গ হয়ে শুয়ে থাকে খোলা মাঠে, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আকাশের পূর্ণ চাঁদের দিকে। চাঁদটা অস্ত যাওয়ার আগ পর্যন্ত একটা শব্দও উচ্চারণ করে না ওরা। এই নির্বাক পূজার বিনিময়ে দেবী সুসাইম তাঁর ভক্তদের মাঝে সম্পদ বণ্টন করে দেন। রাসংদের ভিতরে শ্রেণিবিভাগ নেই, তাই প্রত্যেকেই তারা সমপরিমাণ সম্পদের মালিক হয়।
‘শক্তির দেবতার নাম, গোয়েরা। বজ্রকে ধরা হয় এই দেবতার প্রতিনিধি হিসেবে। প্রচণ্ড ঝড়-বাদলের সময় গোয়েরার উপাসনা করে রাসংরা। সবাই এক জায়গায় জড় হয়ে কোন একটা বিশাল বৃক্ষের নীচে বসে থাকে। খানিকক্ষণ পর- পর গোয়েরার নাম ধরে একযোগে চিৎকার করে। আশপাশের সমস্ত এলাকায় সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন গোয়েরা। কিন্তু পূজারীদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকায় রাসংদের কোনরকম ক্ষতিই করেন না তিনি। বজ্রের অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে সবক’টা রাসং গ্রাম!
‘ওদের জীবন-মৃত্যুর দেবতার নাম, কালকেম। বাতাসকে বলা হয় এই দেবতার প্রতিনিধি। তিনিই নাকের সরু দুটো ফুটো দিয়ে বাতাস চলাচলের অনুমতি দেন, আর একারণেই বেঁচে থাকে মানুষ; এমনটাই বিশ্বাস করে রাসংরা কালকেমের উপাসনার ধরনটাও অন্যদের তুলনায় অনেকখানি আলাদা। একাকী করতে হয়, দলবদ্ধভাবে নয়। দিনের নির্দিষ্ট একটা সময় নির্ধারণ করে প্রত্যেক রাসংই আলাদাভাবে কালকেমের আরাধনা করে। চোখ মুদে, দম বন্ধ করে কালকেমের কাছে দীর্ঘায়ু কামনা করে পূজারীরা।
‘আর তাখাপোং-এর কথা তো আপনারা জানেনই। রাসংদের অভিশাপের দেবতা এই তাখাপোং। অন্ধকারকে বিবেচনা করা হয় এই দেবতার প্রতিনিধি হিসেবে। তাখাপোং-এর উপাসনার জন্য আলাদা মন্দির আছে। নিজের শরীরের কয়েক ফোঁটা রক্ত সঁপে দিতে হয় দেবতার চরণে। নাহয় তাখাপোং রুষ্ট হয়ে ভয়াবহ অভিশাপ দেবেন, আর তাতে যে কোন মানুষের ধ্বংস অনিবার্য। অন্য দেবতাদের চেয়ে তাখাপোংকেই বেশি ভয় পায় ওরা। তাখাপোং-এর অভিশাপ থেকে বেঁচে গেছে কেউ, এমন কোন নজির নেই রাসং-সমাজে।’
‘কথা শেষ হয়েছে তোমার?’ গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন ক্যাপ্টেন রবার্ট। চেহারা নির্বিকার। হ্যাঁ-সূচক মাথা দোলাল তৈমুর; ক্যাপ্টেনের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে।
‘গল্পটা চমৎকার। বুঝতে পারছি, কেন সবাই তোমার কথায় প্রভাবিত হয়েছে,’ শান্ত গলায় বললেন ক্যাপ্টেন। ‘তবে আমাকে টলানোর জন্য কেবল এটুকুই যথেষ্ট নয়। একটা উপকথার উপর ভিত্তি করে অত দামী একটা মূর্তিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া কিংবা জলে ফেলে দেয়া, কোনটাই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। দুঃখিত।
এক পলকের জন্য নেলসনের মুখের উপর দৃষ্টি বোলালেন তিনি, তারপর আবারও স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন তৈমুরের দিকে।
‘প্রথমত, আমি নিজে রাসং সম্প্রদায়ের কেউ নই। তাই তাদের দেব-দেবী, উপদেবতা-অপদেবতা, কোনকিছু নিয়েই মাথাব্যথা নেই আমার। গল্প হিসেবে শোনা যায়, তবে এগুলো মনে-প্রাণে বিশ্বাস করার ব্যাপারে ঢের আপত্তি আছে আমার।
‘জগতের সমস্ত দেব-দেবীর তুষ্টির দিকে খেয়াল রাখতে গেলে মানুষের পক্ষে কাজকর্ম করাটাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। সম্ভবত একারণেই নিজেদের সুবিধামত দেব-দেবী বেছে নিয়েছে নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষজন।
‘একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, দেবতারা তাদের পূজারী বেছে নেন না, বরঞ্চ পূজারীরাই তাদের দেবতা বেছে নেয়।
‘এই কারণেই ওই কষ্টি পাথরের মূর্তিটা আমার কাছে অন্য দশটা মূর্তির মতই সাধারণ একটা মূর্তি, এর বেশি কিছু নয়।
‘দ্বিতীয়ত, আমি একজন কর্তব্যপরায়ণ মানুষ। আমি নিজের উপর অর্পিত দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালনের চেষ্টা করি; তোমাদের নিজেদেরও ঠিক সেটাই করা উচিত। তোমাদেরকে মনে করিয়ে দিতে চাই, ওই মূর্তিটা এই জাহাজের মালিক স্বয়ং রানীকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন। প্রাপকের হাতে পৌঁছে দেয়ার আগপর্যন্ত ওটার দেখভাল করাটাই আমাদের কর্তব্য; ওটার কোনরকম ক্ষতিসাধন কিংবা গোটা মূর্তিটাকেই খুইয়ে ফেলা নয়।
‘এ সমস্ত অবাস্তব চিন্তা-ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজেদের কাজে মনোযোগী হও তোমরা, এতেই সবার মঙ্গল হবে। ফালতু দুশ্চিন্তায় মাথা খাটিয়ে মগজ ক্ষয় করার কোন মানে হয় না।
‘এ নিয়ে আর কোন কথা যেন না শুনি। দু’জনেই আপাতত বিদেয় হও, খানিকক্ষণ একা থাকতে চাই আমি।’
ক্ষণিকের জন্য মিলিত হলো দু’জোড়া বিমর্ষ চোখের দৃষ্টি, পরক্ষণেই বিনাবাক্যব্যয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ওরা।
কী-ই বা আর বলার আছে ওদের? অযৌক্তিক কিছু তো বলেননি ক্যাপ্টেন বায়রন।
নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল নেলসন। মনটা ভার হয়ে আছে, দেখতে-দেখতে চোখের পাতাও ভারী হয়ে এল তার।
তৈমুর ফিরে গেল তার মদের বোতলের কাছে; আকণ্ঠ সুরাপানের মধ্য দিয়েই তাখাপোংকে ভুলে থাকতে চায় সে।
ব্যাপারটা শুরু হলো অতর্কিতে, সাবধান হওয়ার কোনরকম সুযোগই পাওয়া গেল না।
এক সন্ধ্যায় আচমকা পাগলামি শুরু করল তৈমুর, চিৎকার করে ক্যাপ্টেন রবার্টকে গালাগাল করতে শুরু করল সে!
তার অশ্রাব্য খিস্তির তোড়ে ভীষণ লজ্জিত বোধ করলেন ক্যাপ্টেন। নিজেকে কেবিনেই বন্দি করে রাখলেন তিনি, বাইরে আর বেরোলেন না। অধস্তন কেউ যদি অকারণে এভাবে গাল বকতে শুরু করে, অন্যদের কাছে কি আর মুখ দেখানোর জো থাকে?
প্রথমটায় সবাই ভাবল, আজ বুঝি খানিকটা আগেভাগেই মদ গেলা শুরু করেছে তৈমুর। একারণেই এমন অপ্রকৃতিস্থের মত আচরণ করছে ব্যাটা।
কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই আবিষ্কার হলো যে, সকাল থেকে মদের বোতলের ধারেকাছেও ঘেঁষেনি সে, মাতাল হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না!
বেশ অবাক হলো সবাই। শরাব না গিলে থাকলে আচমকা এমন উন্মাদ হয়ে ওঠার কারণটা কী? প্রশ্নটার জবাব পাওয়ার আগেই পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠল!
দেখতে-দেখতে পাগলামিটা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল, একেবারে মহামারীর মত! প্রথমে আক্রান্ত হলো তৈমুরের আশপাশে অবস্থান করা নাবিকেরা, পরের ধাপে জাহাজসুদ্ধ সব ক’জন মানুষ!
প্রত্যেকেই স্পষ্ট টের পেল যে, তার পাশের জন উন্মাদের মত আচরণ করছে; কিন্তু নিজের করা পূর্ণমাত্রার উদ্ভট কর্মকাণ্ডগুলো সম্পর্কে বেখবরই রইল সবাই!
প্রথমে হালকা গালিগালাজ দিয়ে শুরু হলেও, ক্রমেই ব্যাপারটা হাতাহাতিতে গড়াল। যে যাকে পারছে, মারছে। সেই সাথে অনবরত বর্ষিত হচ্ছে ছাপার অযোগ্য সব খিস্তি-খেউড়!
এক দঙ্গল পাগলের ধুন্ধুমার কাণ্ডে অল্পক্ষণের মধ্যেই গোটা জাহাজ নরক গুলজার হয়ে উঠল। চেঁচামেচিতে অতিষ্ঠ হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন ক্যাপ্টেন বায়রন। খোলা ডেকে পা রাখা মাত্রই রীতিমত হতভম্ব হয়ে পড়লেন তিনি। নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর! কী দেখছেন এসব?
ইতোমধ্যেই শরীরের সমস্ত পোশাক-পরিচ্ছদ বর্জন করেছে নাবিকেরা, পুরোপুরি নগ্ন এখন সব ক’জন!
হাতের কাছে যে যা পাচ্ছে, তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারছে অন্যদের দিকে; কোনরকম বাছবিচার করছে না।
এদিক-ওদিক হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে বেশ কয়েকজন উলঙ্গ নাবিক। বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে, খোদা মালুম!
ক্যাপ্টেনের দিকে চোখ পড়া মাত্রই তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল একজন খালাসী। হাতের মাঝারি আকারের পিপেটা সজোরে ছুঁড়ে মারল সে ক্যাপ্টেনের দিকে।
সরে যাওয়ার কোন সুযোগই পেলেন না তিনি। তাঁর ডান হাঁটুতে এসে আছড়ে পড়ল জলভরা ভারী পিপেটা।
ককিয়ে উঠলেন তিনি, হুমড়ি খেয়ে পড়লেন মেঝেতে।
তাঁর এই সশব্দ পতনটা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করল। দাঁত কেলিয়ে হাসতে-হাসতে নিজেদের হাতের জিনিসপত্র তাঁর দিকে ছুঁড়ে মারতে শুরু করল ওরা।
রকমারি উডুক্কু সামগ্রীর আঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে রীতিমত যুঝতে হলো ক্যাপ্টেন বায়রনকে।
তবুও শেষরক্ষা হলো না; ভারী এবং ধারাল জিনিসপত্রের আঘাতে শরীরের নানান জায়গায় মারাত্মক আহত হলেন তিনি। অচিরেই বুঝতে পারলেন, এভাবে খোলা জায়গায় পড়ে থাকলে প্রাণ বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।
তাই পিঠের উপর মালামালের ভারী বর্ষণ সহ্য করেই হামাগুড়ি দিয়ে নিজের কেবিনের উদ্দেশে এগোতে শুরু করলেন তিনি। মাঝখানের স্বল্পদৈর্ঘ্যের জায়গাটা তাঁর কাছে এখন সাত সমুদ্র তেরো নদীর শামিল।
অবশেষে বহুকষ্টে যখন নিজের কেবিনে পৌঁছলেন ক্যাপ্টেন বায়রন, একবিন্দু শক্তিও তখন অবশিষ্ট নেই তাঁর দেহে।
শরীরের এখানে-ওখানে থেঁতলে গেছে মাংসপেশী; চামড়া ফেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে কয়েক জায়গায়।
কোনমতে দরজার খিলটা এঁটে দিয়েই মেঝেতে গড়িয়ে পড়লেন তিনি। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই জ্ঞান হারালেন।
.
চেতনা ফিরে পেয়ে ধীরে-ধীরে চোখ মেললেন ক্যাপ্টেন রবার্ট। ঘরের অন্ধকারের সাথে মানিয়ে নিতে বার কয়েক চোখ পিট-পিট করলেন।
ইতোমধ্যে কেটে গেছে অনেকটা সময়, মধ্যরাত পেরিয়ে ভোরের দিকে যাত্রা শুরু করেছে ঘড়ির কাঁটা।
জাহাজটাকে এতটা শান্ত মনে হচ্ছে কেন? কোথাও কোন কোলাহল নেই! উন্মাদের দল গেল কোথায়? সবক’টা একযোগে সমুদ্রে ঝাঁপ দিল নাকি?
হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন, চোখ রাখলেন দরজার উপরের লুক- হোলে। কী কাণ্ড! কাউকে চোখে পড়ছে না কেন? হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নাকি সবাই? এই মুহূর্তে পুরো জাহাজে উনি কি একাই রয়ে গেলেন নাকি?
একটা অদ্ভুত আতঙ্ক ঘিরে ধরল তাঁকে। যদি সত্যিই জাহাজের বাকি সবাই কোন কারণে মরে গিয়ে থাকে, তাহলে এক অর্থে তিনি নিজেও মৃত!
এই আহত শরীরে এতবড় একটা জাহাজকে ঠিকঠাক তীরে নিয়ে যাওয়ার কথা কল্পনাও করা যায় না।
একমুঠো খাবারও নিশ্চয়ই অবশিষ্ট নেই জাহাজে। নিজের চোখে পাগলগুলোকে খাবারের বাক্সগুলো ছুঁড়ে ফেলতে দেখেছেন তিনি।
নাহ্, কোন আশা নেই। আর যদি গোটা ডেকে ছেয়ে থাকে মৃত নাবিকদের লাশ…
আর ভাবতে পারলেন না ক্যাপ্টেন রবার্ট, গা গুলিয়ে এল তাঁর। বমি ঠেকাতে রীতিমত কসরত করতে হলো তাঁকে।
ওখানে যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, এই অন্ধকারে সেটা নিরীখ করতে যাওয়ার কোন মানে হয় না। এগিয়ে গিয়ে বিছানায় পা তুলে বসলেন তিনি, হেলান দিলেন পিছনের দেয়ালে।
মাথা ভার হয়ে আছে এলোমেলো সব ভাবনায়; অল্পক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েই পড়লেন।
.
ঘড়ির কাঁটায় খুব বেশি সময় পেরোয়নি, একটা চাপা হট্টগোলের শব্দে কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেল তাঁর।
কোত্থেকে আসছে আওয়াজটা? কীসে করছে?
প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে লুক-হোলে চোখ রাখতেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল তাঁর। যা দেখছেন, ঠিক দেখছেন তো?
মরেনি উন্মাদগুলো; মনে হচ্ছে সব ক’জনই বেঁচেবর্তে আছে।
কার্গো হোল্ড থেকে ডেকে তুলে আনা হয়েছে তাখাপোং-এর মূর্তিটাকে। দু’পাশে আগুনের কুণ্ডলী জ্বেলে আলোকিত করা হয়েছে জায়গাটা। কয়েকটা কাঠের পাটাতন জড় করে সামনে একটা বেদিমতন তৈরি করা হয়েছে। ওটাকে ঘিরেই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দিগম্বরের দল, কী যেন এক দুরভিসন্ধি পাকাচ্ছে।
ঘোলাটে কাচের ভিতর দিয়ে তাকিয়ে গোটা ব্যাপারটা আঁচ করতে কয়েক মুহূর্ত বেশি সময় লাগল ক্যাপ্টেন বায়রনের, তবে শেষতক ঠিকই তিনি আয়োজনটার উদ্দেশ্যটা ধরতে পারলেন। পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে গেলেন তিনি, এ-ও কি সম্ভব?
তাখাপোং-এর সামনে একটা নরবলি ঘটাতে চলেছে উন্মাদের দল, সেটাই চাক্ষুষ করছেন তিনি!
এক কোনায় ধারাল একখানা ভোজালি হাতে দাঁড়িয়ে আছে এক ন্যাংটো নাবিক, তার সামনে উবু হয়ে আছে একজন অসহায় মানুষ।
হাঁটু গেড়ে বসে আছে সে, হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধা।
মানুষটা আর কেউ নয়, স্বয়ং তৈমুর!
উন্মাদের দল মানসিক ভারসাম্য হারানোর পরও বর্ণ বৈষম্যের দোষটা কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়েছে।
নিজেকে কিছুতেই আর নিবৃত্ত করতে পারলেন না ক্যাপ্টেন বায়রন; সাতপাঁচ না ভেবেই ছুটে গেলেন বাইরে। তাঁর সামনে একজন অসহায় মানুষকে খুন করা হবে, আর তিনি সেটা চেয়ে-চেয়ে দেখবেন, এটা একেবারেই অসম্ভব একটা ব্যাপার।
গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, দুর্বৃত্তদেরকে থামতে বললেন।
যে যার জায়গায় অনড় দাঁড়িয়ে রইল নগ্ন নাবিকের দল, শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকাল ক্যাপ্টেন রবার্টের দিকে। চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টি, মুখে পিত্তি জ্বালানো হাসি। বৃত্তের পরিধি ভেদ করে একেবারে কেন্দ্রে পৌছে গেলেন ক্যাপ্টেন বায়রন, যত দ্রুত সম্ভব তৈমুরের বাঁধন খুলে দিতে চান।
তিনি কাছাকাছি পৌঁছনো মাত্রই তাঁকে হতবাক করে দিয়ে ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়াল তৈমুর। কীসের বাঁধন, সারাক্ষণ মুক্তই ছিল সে!
বজ্রাহত মানুষের মত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন ক্যাপ্টেন রবার্ট; কী হচ্ছে এসব?
তাঁর প্রশ্নের জবাব দিতে স্বপ্রণোদিত হয়েই এগিয়ে এল ফার্স্ট মেট নেলসন। ‘তৈমুর আমাদেরই লোক, স্যর। আপনাকে বের করে আনার জন্য এটা একটা ফাঁদ ছিল। আপনাকে তো আর আমরা জোর করতে পারি না, তাই না? সেটা কি আমাদের পক্ষে শোভা পায়?
‘আমরা ঠিকই জানতাম যে, চোখের সামনে নরহত্যা ঘটতে দেখলে আপনি কিছুতেই আর আত্মগোপন করে থাকতে পারবেন না; নির্দ্বিধায় মানুষটাকে বাঁচাতে ছুটে আসবেন। এজন্যই এই ছোট্ট নাটকটা মঞ্চস্থ করতে হয়েছে আমাদেরকে।’
‘কেন? কী দরকার আমাকে?’ চিবিয়ে-চিবিয়ে বললেন ক্যাপ্টেন বায়রন, ঘৃণায় গা রি-রি করছে তাঁর।
‘এটা কি আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, স্যর?’ অবাক হওয়ার কাঁচা অভিনয় করল নেলসন। ‘দেবতা তাখাপোং-এর উদ্দেশে বলি দেয়া হবে আপনাকে। কারণ আপনিই সেই বেঈমান, যে সবকিছু জানার পরও দেবতাকে ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
‘আমাকে হত্যা করলেই তোমাদের অপদেবতা তুষ্ট হবেন তোমাদের উপর?’ নিস্পৃহ স্বরে জানতে চাইলেন ক্যাপ্টেন। নিজের সম্ভাব্য পরিণতিটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন তিনি।
‘হয়তো হবেন, হয়তো হবেন না। এটাকে একটা জুয়া বলতে পারেন। কিন্তু এছাড়া অন্য কোন পথও তো খোলা নেই আমাদের সামনে।’
তৈমুরের দিকে ফিরে তাকালেন ক্যাপ্টেন। শীতল গলায় বললেন, ‘এই আইডিয়াটাও নিশ্চয়ই তোমার মাথা থেকেই এসেছে?’
দু’পাটি দাঁত বের করে হাসল তৈমুর, নিজেকে নিয়ে অহংকারের শেষ নেই তার। ‘একদম ঠিক ধরেছেন, স্যর। দেবতা তাখাপোং-এর ব্যাপারে আমার চেয়ে বেশি আর কে-ই বা জানে এখানে?’
ঘৃণাভরে তার দিকে একদলা থুতু ছুঁড়লেন ক্যাপ্টেন বায়রন। তবে তৈরি ছিল তৈমুর, চট করে নিচু হয়ে ধাবমান আঠাল তরলটার পথ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল সে।
দ্রুত বেঁধে ফেলা হলো ক্যাপ্টেনকে, তাখাপোং-এর মূর্তিটার সামনে মাথা নিচু করে বসতে বাধ্য করা হলো।
ভোজালি হাতে এগিয়ে এল তৈমুর; দেবতার সামনে জল্লাদ হিসেবে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিতে চায়।
শেষবারের মত মূর্তিটার দিকে ফিরে তাকালেন ক্যাপ্টেন বায়রন।
ভোজালির ধারাল প্রান্তটা তাঁর ঘাড় স্পর্শ করার আগপর্যন্ত একবারের জন্যও মূর্তিটার উপর থেকে চোখ সরালেন না তিনি!
খানিকক্ষণ পর একযোগেই ক্যাপ্টেন রবার্ট বায়রন এবং তাখাপোং-এর মূর্তিটাকে জলে ফেলা হলো। মূর্তিটা অক্ষত থাকলেও, ক্যাপ্টেনের শবটা ছিল মুণ্ডুহীন।
আর কখনও বন্দরে ফেরেনি সী-কুইন। তবে ওই তল্লাটের জেলেরা দাবি করে, এখনও নাকি রাত-বিরেতে মাঝেমধ্যে সী-কুইনের দেখা মেলে!
একদল গলাকাটা নগ্ন নাবিক পরিচালনা করে জাহাজটাকে। মাস্তুলের সাথে শিকল দিয়ে বাঁধা থাকে কালোমতন একজন মানুষ।
আর একের পর এক আদেশ দিয়ে সবাইকে সর্বক্ষণ ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন, স্বয়ং ক্যাপ্টেন রবার্ট বায়রন!
চিলেকোঠা
এক
অপেক্ষা ব্যাপারটা ঠিক উপভোগের বিষয় নয়, আর রবির কাছে সেটা রীতিমত অসহ্য। চিরকালই চঞ্চল স্বভাবের ছেলে সে, ধীরস্থির হয়ে কোন কাজ করাটা তার ধাতে নেই। এজন্য প্রায়ই তাকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তবে এতে করে তার স্বভাব পরিবর্তন হয়নি এতটুকুও।
এই যেমন এখন, নির্দিষ্ট সময়ের আধঘণ্টা আগে হাজির হওয়ার মাশুল গুনতে হচ্ছে তাকে। অপেক্ষা করতে হচ্ছে, কখন ডাক আসে ডা. নোরার চেম্বার থেকে।
ডা. নোরা একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। মনোবিজ্ঞানের উপর বেশ কয়েকটা বিলেতি ডিগ্রী আছে তাঁর। ওগুলোর নামগুলোও বেশ কঠিন, উচ্চারণ করতে রীতিমত দাঁত ভেঙে যাবার উপক্রম হয়। প্রতিদিন দশজনের বেশি রোগী দেখেন না নোরা। আর ভাগ্যের ফেরে সর্বশেষ নাম্বারটিই জুটেছে রবির কপালে।
ডা. নোরার অ্যাসিস্টেন্ট তাকে একাধিকবার বলে দিয়েছিল, সন্ধ্যা ছয়টার আগে তার সিরিয়াল আসার কোন চান্সই নেই। বরং আরও দেরি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মানসিক সমস্যা নিয়ে আসা মানুষজনের কার কতক্ষণ সময় লাগবে, তা কি আর আগে থেকে ঠাওর করা যায়?
তবুও স্বভাবসুলভ চপলতায় কাঁটায়-কাঁটায় ঠিক সাড়ে পাঁচটায় এসে হাজির হয়ে গেছে রবি। যদিও এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, কাজটা মোটেও ঠিক করেনি সে। ছয়টার পরে এলেই ভাল করত।
ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে একটা লম্বামতন বারান্দা আছে। তাতে দর্শনার্থীদের বসবার জন্য একসারি প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা। দেয়ালের ধারে, একেবারে শেষমাথার চেয়ারটায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে রবি। চোখে-মুখে রাজ্যের হতাশা খেলা করছে তার।
কিছুক্ষণ আগেও সে ভাবছিল, ভিতরের রোগীটাই হয়তো শেষ রোগী। সে বের হওয়া মাত্রই টুক করে ঢুকে পড়বে ও।
কিন্তু বিধি বাম। মাত্র মিনিট পাঁচেক আগেই তিনজনার একটা পরিবার আচমকা এসে হাজির হয়েছে।
অ্যাসিস্টেন্টের সঙ্গে তাদের আলাপচারিতা থেকে এটুকু ঠিকই বুঝতে পেরেছে রবি, তাদের সিরিয়াল তার আগে-নয় নাম্বার। আরও কতক্ষণের ধাক্কা কে জানে!
কাছেপিঠে আর কেউ না থাকায় রবির পাশেই এসে বসল সম্প্রতি আসা মানুষগুলো। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের কিছু বেশিই হবে, ভদ্রমহিলারও চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই। আর তাঁদের সঙ্গে আসা মেয়েটির বয়স বিশ থেকে পঁচিশের মধ্যে।
পানপাতার মত গোলগাল মুখ, খাড়া নাক, চ্যাপ্টা চিবুক, রীতিমত সুন্দরীই বলা চলে তাকে। প্রায় কোমর ছুঁই-ছুঁই দীঘল কালো চুল আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে তাকে।
সাতাশ বছরের অবিবাহিত কুমার রবি, মেয়েটির দিকে আড়চোখে বার-বার তাকাবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই না?
কিছুক্ষণ নীরবেই কেটে গেল। চোখের কোণ দিয়ে তাকানোর বাইরে আর বিশেষ কিছু করেনি রবি। তার কাছে মনে হচ্ছে মেয়েটিও তার প্রতি যথেষ্টই আগ্রহী। নইলে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসবে কেন?
সাহস করে একবার সরাসরি তাকাল সে। মেয়েটিও তখন তার দিকেই তাকিয়ে আছে! চোখেমুখে কৌতূহল, যেন বিশেষ কিছু জানতে চায় সে রবির ব্যাপারে। অদম্য আগ্রহে নিজের অজান্তেই গলাটা বকের মত লম্বা করে দিল রবি। আর ঠিক তখনই কথা বলে উঠল মেয়েটি।
‘তোর প্যান্টের চেইন খোলা ক্যান?’
হতভম্ব হয়ে গেল রবি। এসব কী বলছে মেয়েটা?
চট করে প্যান্টের দিকে চোখ চলে গেল তার। লাগানোই তো আছে চেইন!
‘মাইয়া দেখলেই বুঝি চউখ দিয়া চাটতে মন চায়? বেজন্মা কোনহানকার। কে রে তুই? মানুষ নাকি ভাদ্রমাসের পাগলা কুত্তা?’
চোখেমুখে অন্ধকার দেখল রবি। কী করবে, বলবে, কিছুই মাথায় আসছে না তার। গা কাঁপছে, শ্বাসও ঠিকমত নিতে পারছে না সে। কী হচ্ছে এসব? বাস্তবেই ঘটছে তো? নাকি এটাও আরেকটা দুঃস্বপ্ন?
ঠাস করে একটা চড়ের শব্দে ঘোর কাটল তার। মেয়েটির গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ বসিয়ে দিয়েছে তার বাবা। কিছুক্ষণ আগের শান্ত-সৌম্য রূপ আর নেই ভদ্রলোকের, তিনি এখন পুরোপুরি অগ্নিশর্মা।
রবির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আই অ্যাম সরি, ইয়াং ম্যান। আমার মেয়ে মানসিকভাবে সুস্থ নয়। এজন্যই এখানে আসা। তুমি কিছু মনে কোরো না, প্লিজ।’
‘না, না। ইট’স ওকে। আমি বুঝতে পেরেছি,’ কোনমতে বলল রবি।
হাত-পা গুটিয়ে নিজের চেয়ারে জড়সড় হয়ে বসল সে। মাথা নিচু করে রেখেছে, মেয়েটির দিকে তাকানোর সাহস আর নেই। তাকালে দেখতে পেত, তার দিকেই অপলক তাকিয়ে আছে মেয়েটি। ফিসফিস করে বলছে, ‘পলাইয়া যা। পলাইয়া যা…’
দুই
‘আমি ভয় পাই,’ মৃদুস্বরে বলল রবি। ডা. নোরার মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে সে। তাকিয়ে আছে ডাক্তারের ভাবলেশহীন চেহারার দিকে |
‘কম আর বেশি, ভয় আমরা সবাই পাই। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়,’ নোরা বললেন। ‘তা আপনার ভয় পাওয়ার কারণটা কী?’
কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করল রবি। ‘আমি জানি আমার ব্যাপারটা কোন মানসিক সমস্যা নয়। আমি পাগল নই। তবুও কেন যে আপনার এখানে এলাম, সেটা আমি নিজেও জানি না।’
‘মানসিক সমস্যা থাকা মানেই কিন্তু পাগল হয়ে যাওয়া নয়,’ শান্তস্বরে বললেন নোরা। ‘তাছাড়া কখনও-কখনও মন খুলে কারও সাথে কথা বলতে পারলে অস্থিরতা অনেকটুকু কমে যায়। কিংবা বিশেষ কারও সামান্য একটু কাউন্সিলিংই হয়তো মনের ভার লাঘব করে সঠিক পথনির্দেশনা দিতে পারে মানুষকে। তাই আমায় সবকিছু খুলে বলুন। শ্রোতা হিসেবে আমি কী ভাবছি না ভাবছি, কিংবা আমার পেশা কী, সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই আপনার।’
তাঁর কথায় খানিকটা আশ্বস্ত হলো রবি। তার চেহারার বিব্রতভাব অনেকটাই কেটে গেল। ‘ঘটনার সূত্রপাত সপ্তাহ দুয়েক আগে। হঠাৎ করেই দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করি আমি। অথচ এর আগে ঘুমের কোন সমস্যাই ছিল না আমার। বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়তাম, তারপর একঘুমে রাত কাবার। স্বপ্ন-টপ্ন বিশেষ একটা দেখতাম না। কিন্তু আচমকাই সবকিছু বদলে গেল। দুঃস্বপ্নগুলো মাঝরাতেই ঘুম ভেঙে দিতে শুরু করল। একবার ঘুম ভাঙার পর সারারাত আর একটুও চোখের পাতা এক করতে পারি না আমি, কিছুতেই আর ঘুম আসে না। বিছানায় গড়াগড়িই কেবল সার হয়। সেই সাথে প্রচণ্ড ভয় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আমাকে। ভোরের আলো ফোটার আগপর্যন্ত আর ভয়টা থেকে মুক্তি মেলে না আমার। এখন আপনি নিশ্চয়ই জানতে চাচ্ছেন, কী নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখি আমি?’
মুখে কিছু না বলে কেবল হ্যাঁ-সূচক মাথা দোলালেন নোরা।
‘আমি দেখি আমার ঘরের প্রতিটি আসবাবপত্রের প্রাণ আছে, ওরা নিথর কোন জড়বস্তু নয়! আঁধার ঘনালেই ওদের ভিতর প্রাণসঞ্চার ঘটে, আর একেকটা জিনিস পরিণত হয় একেকটা জীবন্ত বিভীষিকায়। তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাচল করতে পারে, কথা বলতে পারে, এমনকী চিৎকারও করতে পারে। তাদের প্রত্যেকের গলার স্বর আলাদা। তাদের চিন্তাচেতনা, কথা বলার ধরন, এমনকী আবেগের প্রকাশও স্বতন্ত্র। কেবল একটা ব্যাপারেই তারা একাট্টা, তাদের অভিপ্রায়। তারা কেউই চায় না, আমি তাদের সাথে একঘরে থাকি! তারা চায়, আমি যেন দূরে কোথাও চলে যাই, তবে ঘরের একটা জিনিসেও যেন হাত না দিই। ওরা যেমন আছে তেমনই থাকবে, শুধু আমিই যেন না থাকি! প্রথম- প্রথম ওরা এলোপাতাড়ি হুমকি দিত। তবে শেষমেশ আমাকে একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে ঘরটা ছাড়ার জন্য। আর আজই তার শেষ দিন। ওরা প্রত্যেকেই আমাকে পই-পই করে বলে দিয়েছে, আজকের পরও যদি আমি ঘর না ছাড়ি, আমাকে এর জন্য চরম মূল্য চুকাতে হবে। এখন আপনিই বলুন, দু’সপ্তাহ ধরে প্রতি রাতে এমন স্বপ্ন দেখলে কীভাবে একজন মানুষ ভাল থাকে? ভয় পাওয়াটা কি খুবই অস্বাভাবিক?’
মাথা নাড়লেন নোরা। ‘মোটেও অস্বাভাবিক নয়, খুবই স্বাভাবিক। যে কেউ এমন পরিস্থিতিতে ভয় পাবে।’
রবিকে স্বাভাবিক হতে খানিকটা সময় দিলেন তিনি। খেয়াল করেছেন, কথা শেষ হলেও এখনও অল্প-অল্প কাঁপছে সে।
‘আচ্ছা, দুঃস্বপ্নগুলো কি কেবল রাতেই দেখেন? নাকি দিনে ঘুমালেও হানা দেয় ওরা?’ হালকা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন নোরা।
জবাব দেয়ার আগে কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিল রবি। ‘দিনে দেখিনি কখনও। আসলে দিনে ঘুমানোর সুযোগই হয় না আমার। সপ্তাহে ছয়দিন চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। সাতসকালে বেরিয়ে, ফিরি সন্ধ্যার পর। আর ছুটির দিনটা বন্ধুদের সাথে কাটাই অথবা সপ্তাহের জমানো নিজস্ব টুকিটাকি কাজগুলো সেরে নিই। এই যেমন আজ আপনার এখানে এলাম।’
‘বেশ। বুঝলাম,’ মাথা দোলালেন নোরা। ‘অফিসে অথবা অফিসের বাইরে, কোন কিছু নিয়ে মানসিক চাপের মধ্যে নেই তো আপনি?’
আবারও কিছুক্ষণের বিরতি নিল রবি। ‘উঁহু। এই মুহূর্তে আমার জীবন কোন ক্রিটিকাল ফেইজ অতিক্রম করছে না। চাকরিটা পরিশ্রমের হলেও, ওটা নিয়ে সন্তুষ্ট আমি। আমার যা যোগ্যতা, তাতে এরচেয়ে ভাল কিছু আশা করাটাও বোকামি। অফিসের সবার সাথে সম্পর্ক ভাল আমার। বসও আমাকে বেশ পছন্দ করেন বলেই জানি। অফিসের বাইরেও কোন কিছু নিয়ে ঝামেলা নেই আপাতত।’
‘বাসায় কে-কে থাকেন আপনার সাথে?’
‘আসলে একাই থাকি আমি এখানে। একটা দোতলা বাড়ির চিলেকোঠায় বাবা-মা গ্রামে থাকেন, শহরে আসতে চান না। তাই নিজের জন্য কোনমতে চলনসই একটা আশ্রয় খুঁজে নিয়েছি আরকী। তাছাড়া যে আয় করি, তা দিয়ে বিলাসবহুল জীবন কাটানোর কথা কল্পনাও করা যায় না। তবে তা নিয়ে কোন আফসোস নেই আমার, আমি মোটেও অসুখী নই।’
‘সুখ ব্যাপারটা আসলে নিজের কাছে। আপনার চাহিদাকে আপনি যত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, আপনার প্রাপ্তিকে যত বেশি উপভোগ করতে পারবেন, আপনি তত বেশি সুখী হবেন। আপনি বলছিলেন, আপনি একটা বাড়ির চিলেকোঠায় থাকেন। তো ওখানে, আলো-বাতাস ঠিকঠাক পান তো? মানে বলতে চাচ্ছি, পরিবেশটা স্বাস্থ্যকর তো? এমন অনেক ঘিঞ্জি এলাকা আমার চেনা, যেখানে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই বাতি জ্বেলে রাখতে হয় আলোর জন্য। আর খোলা হাওয়ার কথা তো ভাবাই বৃথা।’
‘না, না। আমার ঘরটা মোটেও তেমন নয়। আসলে নামে চিলেকোঠা হলেও, ঘরটার আকার বেশ বড়। অ্যাটাচ্ড় বাথরুম আছে। আশপাশে বড় কোন ইমারত না থাকায়, আলো-বাতাস বেশ ভালই পাওয়া যায়।’
‘সম্প্রতি বাসার কাছাকাছি এমন কোন কলকারখানা কি গড়ে উঠেছে, যেটা বাজে গ্যাস কিংবা দুর্গন্ধ ছড়ায়? আজকাল তো হরহামেশাই আবাসিক এলাকায় ফ্যাক্টরি দেখতে পাচ্ছি। নিয়ম না মানাটাই এখন এদেশের মানুষের জন্য নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘উঁহুঁ। তেমন কোন কারখানা চোখে পড়েনি ইদানীং ওই এলাকায়। বাজে কোন গন্ধ কিংবা গ্যাসও নাকে এসেছে বলে মনে পড়ছে না। আসলে বাসাটা শহর থেকে খানিকটা দূরে কি না, তাই পুরোপুরি দূষিত হওয়ার সুযোগ পায়নি এখনও। শহরের চৌহদ্দিতে কে একজন ব্যাচেলরকে ঘর ভাড়া দেবে, বলুন? এই শহরে ব্যাচেলর হিসেবে ঘর ভাড়া পাওয়া আর চাঁদে যাবার টিকিট পাওয়া একই ব্যাপার। দুটোর কোনটাই আমার ভাগ্যে নেই। মেস করে একগাদা লোকের সাথে থাকতে ইচ্ছে করে না। প্রাইভেসির জলাঞ্জলি দিতে ঘোর আপত্তি আমার। সবকিছু মিলিয়েই শহর থেকে খানিকটা দূরে বাসা ভাড়া নিয়েছি।’
‘ভাল। নিজের স্বকীয়তা বজায় রাখতে, ঝাঁকের কই না হওয়ার কোন বিকল্প নেই। আচ্ছা, আপনার ঘরে এখন যেসব আসবাবপত্র আছে, সেগুলোর সাথে কি আপনার কোন বিশেষ স্মৃতি জড়িয়ে আছে? কোন দুঃখের স্মৃতি? অথবা এমন কিছু, যা আপনাকে বিশেষ কোন মুহূর্তের কথা মনে করিয়ে দেয়?’
খানিকক্ষণ ইতস্তত করল রবি। কথাটা কীভাবে বলবে, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। ‘সত্যি বলতে, ওগুলোর একটাও আমার নয়। তাই ওগুলোর সাথে জড়ানো কোনরকম স্মৃতি থাকার সুযোগই নেই আসলে। আমি যাবার আগে থেকেই ওগুলো ঘরটায় ছিল।’ –
‘ঠিক বুঝতে পারলাম না আপনার কথা। একটু ক্লিয়ার করুন, প্লিজ।’
‘আমার আগে যিনি ও ঘরটায় থাকতেন, জিনিসগুলো আসলে তাঁরই। চলে যাবার সময় ওগুলো সঙ্গে করে নিয়ে যাননি তিনি। আসলে নিজেও তিনি গায়েব হয়ে গেছেন কাউকে কিছু না বলেই।
‘একদিন সকালে নিয়মমাফিকই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন, কিন্তু রাতে আর ঘরে ফেরেননি। সেই যে উধাও হলেন, তারপর থেকে তাঁর আর কোন খোঁজই পাননি বাড়ির মালিক।
‘চেষ্টার কোন ত্রুটি করেননি তিনি, কিন্তু শেষতক ভাড়াটে ভদ্রলোকের কোন হদিস বের করা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। ভদ্রলোক যেন পুরোপুরি বাতাসে মিলিয়ে গেছেন!
‘একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন, কারও সাথেই খুব একটা কথা বলতেন না। কাউকে কখনও তাঁর কাছে আসতেও দেখা যায়নি। দেশের বাড়ির যে ঠিকানা উনি দিয়েছিলেন, ওটাও ছিল ভুয়া। ওই নামের কাউকেই চিনতে পারেনি এলাকার লোকজন।
‘নিজে গায়েব হয়ে বাড়ির মালিককে অথৈ সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। বাড়িভাড়া দিয়েই সংসারের জন্য অন্নের সংস্থান করতে হয় বেচারাকে। অনির্দিষ্টকাল ঘরটা ফাঁকা রাখার কোন উপায় নেই তাঁর। তবুও মাস তিনেক অপেক্ষা করেছেন তিনি। তারপরই কেবল টু-লেট নোটিশ ঝুলিয়েছিলেন সদর দরজায়। তবে ঘরের মালামালগুলো ফেলে দেননি কিংবা বিক্রি করে দেননি তিনি। যেন ওই হারিয়ে যাওয়া ভদ্রলোক কখনও ফিরে এলে তাঁর মালসামান কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিতে পারেন।
‘আমাকে ঘরটা ভাড়া দেবার সময় এটাই ছিল একমাত্র শর্ত। নিজের মালামাল আনা চলবে না আমার, আপাতত ওগুলোই ব্যবহার করতে হবে।
‘জানেনই তো, এই শহরে ঘরভর্তি মালামাল সহ বাসা বদলানোটা কতটা ঝক্কির কাজ। তাই আমিও নির্বিবাদে শর্তটা মেনে নিয়েছিলাম। নিজের যা কিছু ভাঙাচোরা মালপত্র ছিল, পানির দরে বেচে দিয়ে একেবারে ঝাড়া হাত-পা নিয়ে উঠে পড়েছিলাম ওই চিলেকোঠায়। তাছাড়া আমার নিজের জিনিসপত্রের চেয়ে ওই ভদ্রলোকেরগুলো অনেক বেশি উন্নতমানের। শর্তটা মেনে নেয়ার এটাও একটা কারণ বটে,’ হাসতে হাসতে কথা শেষ করল রবি।
রক্তা এবং শ্রোতা, হাসছে দু’জনেই। আলাপচারিতার এ পর্বটা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
‘এতক্ষণে আপনার সমস্যাটার একটা সম্ভাব্য কারণ পাওয়া গেল, হেসে বললেন নোরা।
‘বলেন কী! জলদি খোলসা করুন, প্লিজ,’ কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে এল রবি।
‘মানুষের অন্যতম দুর্বল একটি বৈশিষ্ট্যের নাম, মায়া। অদৃশ্য, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফোর্স এটি। যা পিছুটান তৈরি করে, সামনে এগোতে বাধা দেয় মানুষকে। মায়ার বন্ধন ছিন্ন করতে নিজের উপর অনেকখানি জোর খাটাতে হয়, যা প্রায়শই বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। মানুষ এই মায়া কেবল অন্য মানুষদের প্রতিই অনুভব করে, ব্যাপারটা এমন নয়। যে কোন স্থান, যে কোন জড়বস্তুর উপরেও জন্মাতে পারে মায়া।
‘কোথাও বেশিদিন থাকলে, জায়গাটার প্রতি আমাদের মায়া পড়ে যায়। কোন জিনিস অনেকদিন ধরে ব্যবহার করলে, সেটার প্রতিও আমরা এক ধরনের মায়া অনুভব করি। তাই পুরনো জিনিসপত্র আমরা চট করে ফেলে দিতে পারি না, আমাদের কষ্ট হয়। নতুনকে আমরা স্বাগত জানাই ঠিকই, তবে পুরনোর প্রতি হৃদয়ের টানটাও আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তাদের হারানোর ভয়টা আমাদের মর্মযাতনার কারণ হয়।
‘আপনার ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই ঘটছে এখন। বর্তমান ঘরের আসবাবপত্রগুলো আপনার অনেক বেশি পছন্দ হয়ে গেছে। আপনার অবচেতন মন নিজের অজান্তেই সেগুলোকে আপন করে নিয়েছে। তাই তাদের প্রতি মায়ার টানটাও বেশ জোরাল। কিন্তু সচেতন আপনি জানেন, ওগুলো আপনার নয়। ওগুলোর মালিক অন্য কেউ, যে কোন সময় হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে জিনিসগুলো। তাই আপনার নিজের ভিতরে একধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে।
‘ওদেরকে হারানোর ভয়টা আপনার অবচেতন মনে আগে থেকেই ছিল কিন্তু কোন কারণে আচমকা সেই ভয়টা বেড়ে গেছে বহুগুণে। আপাত দৃষ্টিতে কোন সাধারণ ঘটনা, কিংবা দৈনন্দিন আলাপচারিতার কোন নির্দোষ সংলাপই এক্ষেত্রে ট্রিগার হিসেবে কাজ করেছে বলে আমার ধারণা। আর এরপর থেকেই আপনার মধ্যে তৈরি হয়েছে এক ধরনের ঘোর। আর সেটাই দুঃস্বপ্ন হয়ে প্রতিনিয়ত আপনাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে এখন।
‘আমার মনে হয়, শুধু রাতে নয়, দিনে ঘুমালেও স্বপ্নটা আপনি দেখতে পাবেন। কারণ কেবলমাত্র ঘুমের সময়ই আপনার অবচেতন মন সচেতন আপনার উপর আধিপত্য করার সুযোগ পায়। রাত কিংবা অন্ধকারের সাথে আদৌ এর কোন সম্পর্ক নেই।’
নোরার কথা শেষ হলেও বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল রবি। বুঝতে পারছে, অযৌক্তিক কিছু বলেননি ভদ্রমহিলা। সমস্যাটা আসলেই তার মনে।
তাকে আরও কিছু টুকটাক প্রশ্ন করলেন নোরা। শান্তভাবেই প্রশ্নগুলোর জবাব দিল রবি। তাকে যত দ্রুত সম্ভব বাসা পাল্টানোর পরামর্শ দিলেন ডাক্তার। সেই সঙ্গে বেশ কিছু ওষুধও লিখে দিলেন। গভীর ঘুম এবং দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে এগুলো কাজে দেবে।
ওষুধ নিয়ে যখন বাসায় ফিরল সে, ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত নয়টা বেজে দশ মিনিট। অন্যান্যদিনের তুলনায় সে রাতে বেশ খানিকটা জলদিই বিছানায় গেল ও। বহুদিন পর দুঃস্বপ্নমুক্ত একটা ফ্রেশ ঘুমের প্রত্যাশা করছে।
তিন
ঠিক কী কারণে অমন গভীর ঘুমটা চট করে ভেঙে গেল, সেটা রবি নিজেও জানে না। তবে আজ সত্যিই কোন দুঃস্বপ্ন দেখেনি সে। নিস্তব্ধ রাতে ঘড়ির কাঁটার একঘেয়ে শব্দটাও অনেক বেশি জোরাল শোনাচ্ছে।
বালিশের পাশে রাখা মোবাইলে সময় দেখল রবি। রাত দুটো বাজে। সকাল হতে এখনও ঢের দেরি।
এতটা সময় অযথা জেগে থাকার কোন মানে হয় না। তাই একগ্লাস পানি খেয়ে আবারও শুয়ে পড়বে বলেই মনস্থ করল সে।
রাতে ঘুম ভাঙলে বড্ড পানি পিপাসা পায় তার। তাই পানির জগ আর গ্লাসটা সবসময় হাতের নাগালেই রাখে। খাটের পাশে ছোট্ট একটা টী-টেবিল। তার উপরেই রাখা থাকে ওগুলো।
পাশ ফিরে গ্লাসে পানি ঢালতে গিয়েই রীতিমত আঁতকে উঠল রবি। ঘরের মাঝখানে খানিকটা উবু হয়ে ওটা কে বসে আছে? হাত-পাগুলো অমন অদ্ভুত ভঙ্গিমায় দোলাচ্ছে কেন লোকটা? ঘরেই বা ঢুকল কেমন করে?
‘তোকে এখান থেকে চলে যেতে বলেছিলাম,’ ফিসফিস করে বলে উঠল লোকটা। যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে তার কণ্ঠস্বর।
আতঙ্কে আত্মা খাঁচাছাড়া হবার উপক্রম হলো রবির। গায়ের সবকটা লোম দাঁড়িয়ে গেল মুহূর্তেই। প্রাণপণে চিৎকার করার জন্য মুখ খুলল সে। আর ঠিক তখনই আবিষ্কার করল, নড়ছে না আর লোকটা এখন, পুরোপুরি স্থির হয়ে আছে!
মনে খানিকটা সাহস সঞ্চার করতে অনেকটা সময় লেগে গেল রবির। তবে শেষতক নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল সে।
প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা তার বয়সী একজন তরুণ যদি রাত-দুপুরে ভূতের ভয়ে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে, সবার সামনে মুখ দেখাতে পারবে আর? লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাবে না?
খানিকটা মনোবল ফিরে পেতেই এক দৌড়ে দেয়ালের সুইচবোর্ডের কাছে চলে গেল সে। উজ্জ্বল আলো নিমিষেই ঘরের সমস্ত অন্ধকার ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিল।
কোথায় লোক, কোথায় কী! ঘরের মাঝখানে ওটা তো একটা কাঠের চেয়ার!
কিন্তু লাখ টাকা বাজি রেখে বলতে পারে রবি, কিছুক্ষণ আগেও ওটা দেখতে ঠিক এরকম ছিল না। আর ফিসফিস করে দেয়া হুমকিটাও সে ভুল শোনেনি।
চট করে ব্যাপারটা মাথায় এল তার। চেয়ারটা ঘরের মাঝখানে এল কী করে? ওটা তো সবসময় ঘরের কোনায় রিডিং টেবিলটার পাশে থাকে। আজ ঘুমানোর সময়ও ওখানেই ছিল ওটা। তাহলে?
কাছে গিয়ে ভাল করে ওটাকে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল রবি। উঁহুঁ, কোন পরিবর্তন নেই, যেমন ছিল তেমনই আছে ওটা। তবুও ভয়টা পুরোপুরি কাটল না তার।
শেষমেশ দরজা খুলে ওটাকে ছাদের এক কোনায় রেখে এসে তবেই সে শান্ত হলো। সকালে ভেবে দেখবে কী করা যায় ওটাকে নিয়ে।
আবার বিছানায় সে ফিরল ঠিকই, কিন্তু ঘরের বাতিটা জ্বালানোই রইল। অন্ধকারে ঘুমানোর সাহস নেই আর।
বেশ কিছুক্ষণ কিছুই ঘটল না। তার চোখের পাতা দুটোও ভারী হয়ে এল। পাশ ফিরে আরও খানিকটা আরাম করে শুতে গেল সে। আর ঠিক তখনই দপ করে নিভে গেল বাতিটা!
চমকে উঠল রবি। লোডশেডিং? কিন্তু ফ্যানটা তো দিব্যি ঘুরছে! বাইরের ল্যাম্পপোস্টের বাতি থেকে হালকা আলো আসছে জানালার ফাঁকফোকর গলে। লাইটটা কি তাহলে ফিউজ হয়ে গেল?
‘কেউ আজ তোকে বাঁচাতে পারবে না আমাদের হাত থেকে। খোদার দরবারে তোর মরণ লেখা হয়ে গেছে। আজ আর তোর কোন নিস্তার নেই, আচমকা শোনা গেল ভয়াল এক কণ্ঠস্বর। ঘরের বদ্ধ বাতাসে বার কয়েক প্রতিধ্বনি তুলল বাক্যটা।
নিখাদ আতঙ্কে কেঁপে উঠল রবির সারা শরীর। ঘরের আবছা অন্ধকারে যা দেখছে সে, তার নিজের কাছেই সেটা অবিশ্বাস্য ঠেকছে এখন। স্বপ্ন কেমন করে সত্যি হয়?
আলনাটা আর সাধারণ কোন আলনা নেই এখন! অসংখ্য ডানাবিশিষ্ট অতিকায় এক পাখি হয়ে গেছে ওটা। পরিপাটি করে সাজানো কাপড়গুলো যেন একেকটা দুর্বিনীত পাখা, পতপত শব্দে উড়ছে ওগুলো। মাটি থেকে ফুটখানেক উপরে ভাসছে এখন আলনাটা। নিঃসন্দেহে একটু আগে শোনা কথাটা ওটাই বলেছে।
কম্পিত হাতেই মোবাইলের টর্চটা জ্বালল রবি, আলো ফেলল ওটার গায়ে। প্রত্যাশা ছিল, ভয়ানক কিছু একটা দেখতে পাবে। কিন্তু ভীষণ অবাক হতে হলো তাকে। আলনাটা যেমন ছিল ঠিক তেমনই আছে, এতটুকুও রদবদল হয়নি ওটার!
আশ্চর্য! সবই কি হ্যালুসিনেশন?
তবে কাছে গিয়ে ভালমত পরীক্ষা করতেই খুঁতটা ধরা পড়ল তার চোখে। আলনাটা নিজের জায়গা থেকে বেশ কিছুটা সামনে এগিয়ে এসেছে। মেঝেতে স্পষ্ট ফুটে আছে বালির দাগ।
তবে এটা নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবনা-চিন্তা করার অবকাশই পেল না রবি। খটখট শব্দে পিলে চমকে উঠল তার।
প্রচণ্ড বেগে নড়ছে খাটটা! যেন ভয়াবহ কোন ভূমিকম্প সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওটার উপর। পরক্ষণেই শোনা গেল তীক্ষ্ণ একটা কণ্ঠস্বর, ‘মরবি তুই আজ। মরবি…’
ঝট করে ওটার উপর টর্চের আলো ফেলল রবি। কাঁপুনির চোটে মোবাইলটা হাতে ধরে রাখতেই বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।
আলো পড়তেই নড়াচড়া থেমে গেল খাটটার। যেন চিরকাল এভাবেই স্থির পড়ে ছিল ওটা!
ভয়ানক বিপদে পড়েছে, এটা বুঝতে বাকি রইল না রবির। সিদ্ধান্ত নিল, কাল সকালেই বাসাটা ছেড়ে দেবে। আজ রাতটা কোনরকমে পার করতে পারলেই হয় কেবল।
অ্যাডভান্সের টাকা যদি ফেরত না-ও পাওয়া যায়, তাতেও কিছু যায় আসে না তার। জীবনের চেয়ে টাকা বড় নয়। কিন্তু রাতটা কাটাবে কীভাবে? সকাল অবধি এহেন অত্যাচার সহ্য করা রীতিমত অসম্ভব।
পরক্ষণেই মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল তার। চেয়ারটার মত সবকিছু ঘরের বাইরে রেখে এলে কেমন হয়? ছাদে রেখে আসার পর থেকে ওটা আর কোনরকম ঝামেলা করেনি।
সবগুলো মালপত্র সরাতে অনেক পরিশ্রম হবে, হয়তো মিনিট বিশেক সময়ও লেগে যাবে। তবে বাকি রাতটা আরামসে কাটিয়ে দেয়া যাবে। ভোর হতে এখনও অনেকটা সময় বাকি।
কাজে নেমে পড়ল রবি। প্রথমেই ঘরের জানালাগুলো খুলে দিল। বাইরের সোডিয়াম বাতির হলদে আলোয় ঘরের অন্ধকার অনেকটাই কেটে গেল। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে রাখার ঝামেলাটা আর পোহাতে হলো না তাকে। একে- একে ঘরের সবকিছু বাইরে রেখে আসতে শুরু করল সে। একাকী করার জন্য বেশ কষ্টসাধ্য কাজ, কিন্তু রবি নিরুপায়। পুরো ঘরটা ফাঁকা করতে তার হিসেবের চেয়ে মিনিট পাঁচেক সময় বেশিই লাগল। তবে তাতে কিছু যায়-আসে না তার। কাজটা শেষ করা গেছে, এটাই স্বস্তি।
এখন অন্তত শান্তিতে কিছুক্ষণ ঘুমানো যাবে।
মেঝেতে একখানা চাদর বিছিয়ে তাতেই শুয়ে পড়ল সে। ক্লান্ত শরীর, চোখের পাতা বুজে আসতে সময় লাগল না। সবে চোখদুটো বন্ধ করেছে কি করেনি, আবারও শোনা গেল কলজে কাঁপানো এক কণ্ঠস্বর, ‘সময় শেষ।’
চমকে জেগে উঠল রবি। কে কথা বলছে? ঘরে তো একটা কিছুও অবশিষ্ট নেই আর!
খিকখিক হাসির শব্দে উপরে তাকাতে বাধ্য হলো রবি। সঙ্গে-সঙ্গেই আতঙ্কে জমে বরফ হয়ে গেল তার পুরো শরীর। চোখদুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে পড়বার প্রাণপণ চেষ্টা করছে।
মাথার উপর সবেগে ঘুরছে সিলিঙ ফ্যানটা। আর ঠিক তার মাঝখানের জায়গাটায় ফুটে উঠেছে ভয়াল একখানা চেহারা! তার দিকে তাকিয়ে হাসছে সেটা।
ফ্যানটার কথা মনেই ছিল না রবির। আগের ভাড়াটের এই একটা জিনিসই এখনও রয়ে গেছে ঘরে!
ঝট করে উঠে দাঁড়াল রবি। দৌড়ে পালাতে চাইল ঘরের বাইরে। তবে তাকে সে সুযোগ দেয়া হলো না!
আচমকা খুলে গেল ফ্যানের সবকটা পাখা। প্রচণ্ড বেগে সেগুলো ধেয়ে গেল রবির দিকে। ধারাল ব্লেডের উপর্যুপরি আঘাতে নিমিষেই চিরে ফালাফালা হয়ে গেল তার গোটা দেহ।
কেবলমাত্র একবারই গলা ফাটিয়ে চেঁচানোর সুযোগ পেল রবি। নীরব রাতে সেই চিৎকারটা অনেক দূর থেকেও স্পষ্ট শোনা গেল। বহু মানুষের ঘুম ভাঙিয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ল রবি!
ওরাকল
এক
দিগন্ত বিস্তৃত বনভূমি, মাঝে এক চিলতে খোলা জায়গা। বাওয়াদের সবচেয়ে বড় গ্রামটা এখানেই। গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়ানো কয়েক সারি কুঁড়েঘর। বাঁশের বেড়ার দেয়াল, মাথার উপর মাকানো পাতার ছাউনি। সবক’টা দেখতে অবিকল একই রকম।
প্রথম দর্শনে নিতান্ত নড়বড়ে মনে হলেও, ঘরগুলো আদতে বেশ পোক্ত। পাকা বাঁশের কঞ্চির ফাঁকে-ফাঁকে বেতের ডাল গুঁজে মজবুত করা হয়েছে দেয়াল।
আর রোদ-বৃষ্টি ঠেকাতে মাকানো পাতার ছাদের কোন জুড়ি যে নেই, সে তো সবারই জানা। একেকটা পাতা প্রায় এক মানুষ সমান লম্বা, প্রস্থেও নেহায়েত কম নয়। পরিণত পাতার প্রান্তের দিকে এক ধরনের আঠা তৈরি হয়। তাই সহজেই একটার সঙ্গে আরেকটা জোড়া লাগিয়ে আকার বাড়ানো যায়। আঠার কারণেই কি না কে জানে, পাতাগুলো বেশ পিচ্ছিল হয়। বৃষ্টির জল সহজেই গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে, লেগে থাকে না।
দার্শনিক অংরা, মাকানো পাতাকে বেশ পছন্দ করতেন। তাঁর ধারণা ছিল, মানব সভ্যতার বিকাশে এর বেশ বড় রকমের অবদান রয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী, তাই মাকানো পাতাতেই আদিম মানুষ প্রথম চিত্র আঁকতে শুরু করে বলে মত প্রকাশ করে গেছেন তিনি।
বাওয়াদের ধারণাও নেই, এই বনের বাইরেও একটা জগৎ আছে, সেখানেও বাস করে মানুষ। দৃষ্টিসীমার ভিতরের পর্বত, নদী, অরণ্য, এসব নিয়েই বাওয়াদের পৃথিবী।
গ্রামটার নাম, সাসাকো। বাওয়া ভাষায় যার অর্থ দাঁড়ায়, নদীর কন্যা। গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা লানু নদীর কারণেই এহেন নামকরণ। তবে কন্যার প্রতি মাঝে-মাঝেই বিমাতাসুলভ আচরণ করতে দেখা যায় লানুকে। ভরা বর্ষায় যখন দু’কূল ছাপিয়ে প্লাবিত হয় লানু, তখন সাসাকোকেও সে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় না। গোটা গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় তখন।
তবে লানুর মেজাজ-মর্জির খবর বাওয়ারা আগে থেকেই টের পেয়ে যায়। তাই তল্পিতল্পা গুটিয়ে অদূরের পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারে। খুব একটা ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না কখনওই।
বাওয়াদের জীবনযাত্রা খুব সহজ। দক্ষতার নিরিখে শ্রমবিভাগ গড়ে উঠেছে বাওয়া সমাজে। সবচেয়ে শক্তিশালী গড়নের পুরুষেরা যোদ্ধা হয়। গাঁয়ের সবার নিরাপত্তার ভার ওদের উপর। শিকারের মাধ্যমে সবক’টা মুখে আহার জোগানোর কাজটাও ওরাই করে।
অপেক্ষাকৃত দুর্বল পুরুষেরা সাধারণত শ্রমিক হয়। ঘরবাড়ি, অস্ত্রশস্ত্রসহ নিত্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিসপত্র নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়ভার তাদের।
মহিলারা মূলত ঘরের কাজেই ব্যস্ত থাকে। রন্ধনশৈলীর প্রদর্শন ছাড়া, সন্তান উৎপাদন এবং প্রতিপালনকেই তাদের প্রধান কাজ বলে গণ্য করা হয়। তবে যৎসামান্য কৃষিকাজের যে প্রচলন বাওয়া সমাজে আছে, সেটা মহিলারাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কৃষিকে চিরকাল অসম্মানের চোখেই দেখতে অভ্যস্ত বাওয়ারা।
গোটা সাসাকো জুড়েই আজ উৎসবের আমেজ। বাওয়াদের সবার মধ্যেই অন্যান্যদিনের তুলনায় খানিকটা বাড়তি কর্মচাঞ্চল্য লক্ষ করা যাচ্ছে আজ। কালো-কালো মুখগুলো নিষ্পাপ হাসিতে উদ্ভাসিত, ভিতরের খুশি গোপন করার কোন চেষ্টাই করছে না সহজ-সরল মানুষগুলো। উৎসবের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সবাই, সূর্য ডুবলেই শুরু হবে মূল অনুষ্ঠান। আজ সন্ধ্যারাতেই সিংহাসনে আরোহণ করতে চলেছে সাসাকোর নতুন সর্দার। পূর্ববর্তী সর্দার শাংকুর ছেলে, কিকা। বাওয়ারা সবাই তাকে পছন্দ করে, এজন্য তাদের খুশিটাও পুরোপুরি নিখাদ প্রয়াত সর্দার শাংকুকেও ভালবাসত বাওয়ারা। নিজের মৃত্যুশয্যায় অধীনস্তদের চোখে শতভাগ অকৃত্রিম বিষাদ দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য সব শাসকের কপালে জোটে না। একশো সতেরো বছর বয়সে থুথুড়ে বুড়ো হয়ে মরার আগে সর্দার শাংকু সেটাই দেখে যেতে পেরেছে। দিন সাতেক আগে, ভর সন্ধ্যাবেলায় গোটা সাসাকোবাসীকে কাঁদিয়ে পরলোকগমন করেছে সে।
সেদিন থেকে গতকাল রাত অবধি তার জন্য শোক পালন করেছে বাওয়ারা। ভাগাড়ে থাকা পুরানো শুকনো খাবার খেয়ে থেকেছে, শিকারে যায়নি কেউই। মদ গেলেনি, সঙ্গম করেনি। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া অহেতুক ঢাকও বাজায়নি I কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল গোটা সাসাকো জুড়ে। শিশুরাও বুঝতে পেরেছিল, অবস্থা বিশেষ সুবিধের নয়। তাই তারাও সারাক্ষণ বড়দের মত মুখ ভার করে রেখেছিল। যেন সব ক’জন সুবোধ বালক-বালিকা, চেঁচামেচি কাকে বলে জানেই না কেউ!
তবে আজ সকালে উৎসবের সপ্তাহ শুরু হওয়া মাত্রই ওরা চোখের পলকে আমূল বদলে গেছে, ফিরে গেছে ওদের চিরচেনা রূপে। এতদিন গোলমাল না করার শোধটা তুলে নিচ্ছে কড়ায়-গণ্ডায়। তাদের সম্মিলিত রণনিনাদের তোড়ে বড়দের কানের পর্দা ফাটার উপক্রম হলেও, আজ তাদের শাসন করতে এগিয়ে যাচ্ছে না কেউ। বরঞ্চ হাসিমুখে সহ্য করছে সমস্ত অত্যাচার। আজ উৎসবের দিন, আজ আনন্দের দিন। শাসন-বারণের নিয়মগুলো আজকের জন্য মুলতবী রাখা হয়েছে।
লানু নদীর কোল ঘেঁষে ছোট একখানা মঞ্চ বানানো হয়েছে। মাঝখানে সর্দারের বসার জন্য তাকিয়ামতন একখানা আসন।
মঞ্চের সামনের দিকটায় ভাকরা গাছের ডাল দিয়ে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে বিশাল চত্বর। বাওয়ারা সবাই এখানেই বসবে, যাবতীয় অনুষ্ঠান এবং সামাজিক প্রথাগুলো এখানেই পালন করা হবে।
মঞ্চের পিছনেই বাওয়াদের ঘাট। তাতে হরেক রকমের সারি-সারি নৌকা বাঁধা। গত এক সপ্তাহ ধরে ওগুলো ওখানেই ঠায় পড়ে আছে, ব্যবহার করেনি কেউ। তবে বাওয়াদের জানা নেই, শীঘ্রিই ওগুলো ব্যবহারের দরকার পড়বে ওদের!
দুই
সাঁঝ ঘনাতেই ঢাক বেজে উঠল। বাওয়া যুবকেরা প্রায় সবাই একখানা করে ভাগে পেয়েছে আজ। প্রত্যেকেই চেষ্টা করছে, অন্যদের চেয়ে জোরে বাজাতে। কেউ কারও চেয়ে পিছিয়ে থাকতে রাজি নয়। মশালের আলোয় ঘর্মাক্ত রঙচঙে মুখগুলো রীতিমত ভয়ঙ্কর লাগছে। যদিও মানুষ হিসেবে বাওয়ারা মোটেও হিংস্র নয়।
চত্বরের একপাশে চলছে ভূরিভোজের আয়োজন। আগুনের উপর ঝুলছে আস্ত এক দাঁতাল শুয়োর। ছোট বাচ্চাদের বেশ ভিড় ওখানটায়। বাদুড় আর চামচিকা দিয়ে তৈরি হরেক রকম পদ শোভা পাচ্ছে তার পাশেই। বেশ কয়েকটা ছোট বানরকে কাঠিতে পুড়িয়ে মচমচে করা হয়েছে। মূল খাবারের পর বাওয়াদের হাতে-হাতে ঘুরবে ওগুলো। যার-যার পছন্দমত অংশ ভেঙে ভেঙে খাবে। এতে একে অপরের সঙ্গে সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায় বলেই বাওয়াদের বিশ্বাস। প্রিয় মানুষকে আস্ত বানরপোড়া উপহার দেয়ার রীতিও প্রচলিত আছে বাওয়া সমাজে। ফালি- ফালি করে কাটা হয়েছে হরিণের মাংস। বাহারি মশলায় মাখানো টুকরোগুলো দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, খেতেও তেমনি চমৎকার।
সাপ, ব্যাঙ, গিরগিটি, গুইসাপ থেকে শুরু করে অজগর অবধি সবই আছে। কিছুই বাদ পড়েনি ভোজের তালিকা থেকে।
সর্দারের জন্য বিশেষ খাবার হিসেবে তৈরি করা হয়েছে পুপার রোস্ট। পুপা একজাতের ছোট হরিণ, খুবই বিরল। আকারে বিড়ালের চেয়ে সামান্য বড়, তবে গতিতে চিতাকেও হার মানাতে পারে এরা। গভীর বনে লুকিয়ে থাকে, ক্ষণে-ক্ষণে চামড়ার রঙ বদলায়। তাই ওদের দেখতে পাওয়া যতটা কঠিন, ধরা তার চেয়েও দুষ্কর।
তবে সর্দারের জন্য মূল্যবান উপহার না আনলে চলবে কেন? তাই নিজেদের তাগিদেই কষ্টসাধ্য কাজটা করেছে বাওয়ারা। জোগাড় করেছে একজোড়া মধ্যবয়স্ক পুপা।
ভাবি সর্দার কিকা দাঁড়িয়ে আছে ওঝার পাশে। পুরোদস্তুর নগ্ন হয়ে। গায়ে বিচিত্র রঙের আঁকিবুকি। মুখেও আঁকা হয়েছে বাহারী নকশা। এই নকশার মাধ্যমেই সমগ্র বাওয়া ইতিহাস শরীরে ধারণ করেছে সে। ওঝার সাজপোশাকও কম বিচিত্র নয়। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত হলেও, কোমরে একখানা নেকড়ের ছাল জড়িয়েছে সে। গলায় হাড়ের মালা, লকেট হিসেবে শোভা পাচ্ছে ছোট একখানা খুলি। মানুষের নয়, হনুমানের। মাথায় কাঁটার মুকুট। কপালের এখান-ওখান থেকে হালকা রক্ত ঝরছে তার। তবে চেহারায় যন্ত্রণার কোন ছাপ নেই। বাওয়ারা ভাবে, চাইলেই ব্যথা বেদনার ঊর্ধ্বে চলে যেতে পারে ওঝারা! তা নইলে আর তারা ওঝা কেন? কালবিলম্ব না করে অনুষ্ঠান শুরু করল ওঝা। প্রথমেই করা হবে পূর্বপুরুষদের আরাধনা। তাঁদের আত্মারা অসীম শক্তির উৎস। বংশের সাফল্য- ব্যর্থতা মূলত ওঁরাই নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁরাই তৈরি করেন বীর যোদ্ধা, আবার যোদ্ধাদের মরণও ডেকে আনেন তাঁরাই! তাই এসব কায়াহীনদের সন্তুষ্ট রাখাটা বাওয়াদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। বাওয়ারা চিরকাল সেটাই করে এসেছে।
টামবারানের সামনে বিশাল একখানা অগ্নিকুণ্ড তৈরি করা হয়েছে। জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পালান কাঠের লাকড়ি। এই বিশেষ কাঠ পোড়ার সময় তীব্র সুগন্ধ উৎপন্ন করে। পূর্বপুরুষ-পূজার এটাও একটা বিশেষ অনুষঙ্গ।
ওরা দু’জন আগুনের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্রই থেমে গেল সবক’টা ঢাকের আওয়াজ। বাওয়ারা সবাই যে যার জায়গায় অনড় দাঁড়িয়ে পড়ল। নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করেও কথা বলছে না কেউ। বাচ্চারাও কুলুপ এঁটে দিয়েছে নিজেদের মুখে।
মাথা ঘুরিয়ে চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে সন্তুষ্ট হলো ওঝা। পরক্ষণেই বিড়বিড় করে মন্ত্র জপতে শুরু করল সে। প্রথমটায় নিচু স্বরে শুরু করলেও, ধীরে-ধীরে স্বরটা উঁচু হতে থাকল তার। একেবারে শেষ মাথায় দাঁড়ানো বাওয়া মানুষটাও এখন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে তার কথা।
একরত্তি অর্থ বুঝতে না পারলেও, ওঝার কণ্ঠের আকুতি অনুধাবন করতে কষ্ট হচ্ছে না কারও। জানে, পূর্বপুরুষদের আত্মাকে ডাকছে ওঝা। অতীতেও এহেন দৃশ্য চাক্ষুষ করেছে বাওয়ারা।
ধীরে-ধীরে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল। সবাই স্পষ্ট বুঝতে পারল, এসে গেছে অতিথিরা। চোখে যদিও কোন কিছুই দেখতে পেল না কেউ।
কণ্ঠের সবটুকু জোর কাজে লাগিয়ে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে ওঝা। একটু পর-পরই হাতের মুঠো থেকে আগুনে বালি ছিটিয়ে চলেছে সে। সাধারণ কোন বালি নয়, পবিত্র গুহার বালি। বহু বছর আগে এক বাওয়া সর্দার এনেছিল ওগুলো।
আচমকাই টামবারানের ভিতর থেকে ভেসে এল খুলিতে-খুলিতে ঠোকাঠুকির শব্দ! সেই সঙ্গে পিলে চমকানো সম্মিলিত হাসি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমানো বীর পুরুষদের খুলিতে আবারও ফিরে এসেছে প্রেতাত্মারা। বংশধরদের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেনি।
মন্ত্র জপা বন্ধ করল ওঝা। আপাতত তার কাজ শেষ। ঘেমে নেয়ে একাকার তার গোটা শরীর, যেন সদ্যই লানু নদীতে ডুব দিয়ে এসেছে সে।
ধীর পায়ে টামবারানের বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল কিকা। মাথা নিচু করে রেখেছে। ভয়ে রীতিমত কাঁপছে তার গোটা শরীর। তার মনে হচ্ছে, যে কোন মুহূর্তে হুড়মুড় করে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে সে। পাজোড়া দেহের ভার বইতে অক্ষমতা জানাচ্ছে বারংবার।
শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা নিয়ে কিকার দিকে তাকিয়ে আছে বাওয়ারা। জানে, কিকার ভাগ্য এখন একটা সুতোর উপর ঝুলছে। যে কোন মুহূর্তে সে তার প্রাণ পর্যন্ত হারাতে পারে। সর্দারকে প্রেতাত্মাদের পছন্দ হলে, খুশি মনে বিদায় নেবে ওরা। কিন্তু পছন্দ না হলে, কী করে বসবে তার কোন্ ঠিক-ঠিকানা নেই। সবই নির্ভর করছে অশরীরীদের মেজাজ-মর্জির উপর।
ঠিক তখনই প্রচণ্ড শব্দে খুলে গেল টামবারানের দরজাটা। একঝলক দমকা হাওয়া বেরিয়ে এল ভিতর থেকে। শোঁ-শোঁ শব্দে বাতাসটা গিয়ে হামলে পড়ল আরাধনার অগ্নিকুণ্ডটার উপর। মুহূর্তেই নরক গুলজার হয়ে উঠল জায়গাটায়। আগুন-বাতাস, দুই চিরশত্রুর লড়াই বেধে গেল নিমেষেই, কে জিতবে বলা মুশকিল।
নিজের অজান্তেই যার-যার জায়গা ছেড়ে এক কদম পিছিয়ে গেল বাওয়ারা। বিস্ফারিত নেত্রে দুই দানবের লড়াই দেখছে সবাই। এহেন অভূতপূর্ব ঘটনা এর আগে কেউই দেখেনি ওরা, শোনেওনি।
যেমনভাবে শুরু হয়েছিল, চোখের পলকে ঠিক তেমনিভাবে শেষ হয়ে গেল ব্যাপারটা। রসগোল্লার মত বড়-বড় চোখ নিয়ে সাসাকোবাসী আবিষ্কার করল, আগুনটা নিভে গেছে! পবন দানবও উধাও হয়ে গেছে; তার টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না কোথাও।
সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে চারদিকে, খানিক আগে যেন কিছুই ঘটেনি এখানে!
পরক্ষণেই একযোগে হুল্লোড় করে উঠল সমবেত জনতা। সন্তুষ্ট চিত্তে প্রস্থান করেছে প্রেতাত্মারা, নতুন সর্দারকে পছন্দ হয়েছে ওদের।
উৎসাহের আতিশয্যে কেউ-কেউ দৌড়ে গেল কিকার দিকে। উত্তেজনার রেশ কাটতেই ভীষণ দুর্বল হয়ে মাটির উপর বসে পড়েছে নতুন সর্দার।
নিজেকে ফিরে পেতে খুব একটা সময় লাগল না কিকার। উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত একখানা হরিণের ছাল কোমরে জড়িয়ে নিল সে। প্রেতাত্মাদের সামনে দিগম্বর হয়ে দাঁড়ানোর রেওয়াজটা পালন করেছে সে। তাই বলে সবার সামনে নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়ানোর কোন মানে হয় না।
কিকাকে মঞ্চের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল ওঝা। আর মাত্র একটা কাজই বাকি এখন। কুফলু পাখির পালকে তৈরি মুকুটটা মাথায় পরা। তাহলেই আনুষ্ঠানিকভাবে সাসাকোর সর্দার হয়ে যাবে কিকা।
কুফলু পাখিরা কেবল আভিজাত্যের নয়, ভয়ঙ্কর ক্ষমতারও প্রতীক। তাই কুফলুর পালকে তৈরি মুকুট কেবল সর্দারই পরতে পারে, অন্য কেউ নয়।
কুফলুরা মাংসাশী, থাকে পর্বতের চূড়ায়। আকারে বিশাল, ডানা ছড়ালে সূর্যকেও ঢেকে দিতে পারে অনায়াসে। যে কোন বড় জানোয়ারই খায় ওরা, খুব একটা বাছ-বিচার করে না। তবে মানুষকে বাগে পেলে অন্য খাবারে আগ্রহ হারায়
একা কেউ কুফলুদের কবলে পড়লে, বেঁচে ফিরে আসতে পারে না কখনওই। ফি-বছর অন্তত জনা দশেক বাওয়া প্রাণ হারায় ওদের হাতে। বাওয়া শিশুদের প্রথম যে ভয়ের সবকটা দেয়া হয়, তার নাম-কুফলু। তবে স্বভাবে ওরা যতই হিংস্র হোক না কেন, দেখতে ভারি সুন্দর। পালকে সাদার উপর গোলাপি রঙের প্রলেপ দেয়া, এখানে-ওখানে ছোপ-ছোপ নীল রঙ।
বাওয়ারা বিশ্বাস করে, ঘরে কুফলুর পালক রাখলে, দৈবশক্তির অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাই সর্দারের মুকুট তৈরির জন্য কুফলুর পালককেই সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করে ওরা।
তিন
কম্পনটা শুরু হলো খুব মৃদুভাবে। যেন অদূরের পাহাড়শ্রেণীর কোথাও বড় কোন পাথরের স্থানচ্যুতি ঘটেছে। আর তাতেই কেঁপে উঠছে পায়ের তলার জমিন আর সেই সঙ্গে ভেসে আসছে দূরাগত মেঘের আবছা গর্জন। প্রথমটায় বাওয়াদের কেউই আসল ঘটনা আঁচ করতে পারল না। সবাই কেমন যেন হকচকিয়ে গেল। কম্পনের প্রকোপ বৃদ্ধির সঙ্গে-সঙ্গে তাদের বিহ্বলতার পরিমাণ বাড়ল বৈ কমল না। ভূমিকম্পে অভ্যস্ত নয় বাওয়ারা। আচমকা লানু নদীর মধ্যখানটায় প্রচণ্ড রকমের আলোড়ন উঠল। টনকে টন জল ফোয়ারার মত দিগ্বিদিক্ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। যেন প্রকাণ্ড কোন দানব সীমাহীন আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নদীর জলের উপর। বহুদিনের পুষে রাখা ক্ষোভ, আজ সুদে-আসলে উসুল করা চাই তার।
তবে অল্পক্ষণ পরে জল ফুঁড়ে যে আকৃতিটা বেরিয়ে এল, সেটা মানুষেরই, কোন দানবের নয়। যদিও সাধারণ মানুষের গড়নের চেয়ে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ দুটোই ঢের বেশি তার। গায়ের রঙ বাওয়াদের মত ঘোর কৃষ্ণবর্ণের নয়, অনেকটাই ফর্সা। আর সেই ত্বকের নীচে কিলবিল করতে থাকা মাংসপেশীগুলো যে অমিত শক্তির আধার, এটা বুঝতে দিব্যদৃষ্টির প্রয়োজন পড়ে না।
কোমরে একখানা কালো জাগুয়ারের চামড়া জড়ানো, দু’পায়ে দু’খানা সোনার বেড়ি। কালের আবর্তে উজ্জ্বল সোনালি রঙ বিলুপ্ত হয়ে খানিকটা কালচে হয়ে গেছে।
মাথাভর্তি ধূসর চুল, প্রায় নিতম্ব ছুঁই-ছুঁই করছে। দু’কাঁধে দুটো কুফলু পাখি বসে আছে, বাচ্চা, পূর্ণবয়স্ক হতে এখনও ঢের দেরি। তবে কুফলুদের স্বভাবসুলভ চপলতা অনুপস্থিত ওদের মধ্যে।
বাওয়ারা কিছুতেই ভেবে পেল না, কেমন করে কুফলুদের পোষ মানাল লোকটা! পানির তলাতেই বা ছিল কেমন করে? শ্বাস আটকে আসেনি?
জলের উপর দিয়ে অবলীলায় তাকে হেঁটে আসতে দেখে সভয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল বাওয়ারা। আঁতকে উঠে অস্পষ্ট অস্ফুট শব্দ করে উঠল কেউ-কেউ। শুধু ভাবি সর্দার কিকা আর ওঝা নিজেদের জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। দু’জনেই তাকিয়ে আছে আগন্তুকের আগমনী পথের দিকে। মনে একই প্রশ্ন খেলা করছে, কে এই অদ্ভুত লোকটা?
কাছে এসে ওদের মুখোমুখি দাঁড়াল অদ্ভুতদর্শন আগন্তুক। দু’চোখ ভয়ানক রাগে জ্বলজ্বল করছে তার। যেন চোখের আগুনে ভস্ম করে দেবে সামনে দাঁড়ানো সবক’টা মানুষকে! ভিতরকার দুর্বিনীত ক্ষোভ চাপা দেয়ার কোন চেষ্টাই নেই লোকটার। তার ভীতিকর চাহনির সামনে একেবারে কুঁকড়ে গেল ওঝা ও কিকা।
আচমকা লোকটা যখন মুখ খুলল, চারপাশটা রীতিমত গম-গম করে উঠল। যেন একসঙ্গে বেজে উঠেছে গোটা দশেক ঢাক! ‘দেবরাজ জারাল পাঠিয়েছেন আমাকে, যাঁর আদেশ তোমরা অমান্য করে চলেছ প্রতিনিয়ত। তোমাদের জন্য বয়ে এনেছি দুঃসংবাদ, শাস্তি, যা কৃতকর্মের ফলস্বরূপ তোমরা নিজেরাই অর্জন করে নিয়েছ। বয়ে এনেছি সুসংবাদ, এই প্রায়শ্চিত্তের পর তোমরা প্রত্যেকেই হবে একেকজন নবজাতকের মত পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত। দেবরাজ জারাল ক্ষমা করে দেবেন সবাইকে।’
বাওয়ারা প্রত্যেকেই যে যার জায়গায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। অতিথিকে সম্মান জানানোর বহু প্রাচীন রীতি এটা। দেবদূতকে সম্মান জানানো মানেই পরোক্ষভাবে দেবতাকে সম্মান জানানো। জ্ঞাতসারে ছোট দেবতাদেরও যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে কার্পণ্য করে না বাওয়ারা। সেখানে দেবতাদের রাজা, দেবরাজ জারালকে অসম্মান করার তো প্রশ্নই আসে না।
তবে যে কারণেই হোক, তাদের উপর ঠিকই অসন্তুষ্ট হয়েছেন দেবরাজ। অন্যথায় কখনওই তিনি দেবদূত পাঠাতেন না মর্ত্যে। কী শাস্তি ভোগ করতে হবে, কে জানে! আতঙ্কে রীতিমত কাঁপতে শুরু করল বাওয়ারা। মাথা নিচু করে থাকা ভয়ার্ত মুখগুলোর দিকে কিছুক্ষণ পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন দেবদূত। তারপর ফিরলেন ওঝা এবং কিকার দিকে। অন্যদের মত ওরাও মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেছে দেবদূতের সামনে, নড়ছে না একচুলও।
‘দেবরাজের পূজার জন্য কৃষ্ণপাথরের কোন বেদী নেই তোমাদের গ্রামে নেই দেবরাজের মন্দির। নেই মন্দিরের দোরগোড়ায় পঞ্চতোরণের প্রবেশপথ প্রতি পূর্ণিমার রাতে গাঁয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী মোষটাকে বলি দেয়ার কথা ছিল তোমাদের। মোষের উষ্ণ রক্তের ঢল, পূর্ববর্তী ত্রিশদিনের পাপগুলোকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেয়।
‘কথা ছিল প্রতি ছয় চাঁদ পর-পর কুমারী কন্যার রক্তে ভেজানো হবে দেবরাজের বেদী। আর তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে পরবর্তী ছয় চাঁদের জন্য খাবারের বরাদ্দ দেন দেবরাজ জারাল।
‘কিন্তু তোমরা এর কিছুই করনি। দেবরাজকে ভুলে গিয়ে অন্য দেবতাদের তুষ্টিতে নিজেদেরকে নিয়োজিত রেখেছ সবসময়। কী কারণে এত বড় স্পর্ধা দেখালে তোমরা? জবাব দাও,’ একদমে কথাগুলো বলে থামলেন দেবদূত। ক্রুদ্ধ সাপের মতই ফোঁসফোঁস করে শ্বাস নিচ্ছেন তিনি, দৃষ্টিতে এখনও আগুন ঝরছে। ভীষণ ঘাবড়ে গেল কিকা। দেবরাজের আরাধনার ব্যাপারে যা-যা বললেন দেবদূত, এর কিছুই তার জানা ছিল না। অতীতের কোন ওঝা দূরে থাক, তার বাবা সর্দার শাংকুও এ ব্যাপারে কখনওই কিছু বলেনি। অথচ দেবতাদের ব্যাপারে সমস্ত রকম বিদ্যাশিক্ষা শৈশবেই দেয়া হয়েছে তাকে, সর্দার নিজেই দিয়েছে।
এতবড় বিষয়টা কী করে ভুলে গিয়েছিল বাবা? কিছুতেই ভেবে পেল না কিকা।
সে চিরকাল জেনে এসেছে, মর্ত্যের মানুষের আরাধনার প্রয়োজন নেই দেবরাজ জারালের। কারণ অন্য দেবতারাই দিনরাত তাঁর প্রার্থনায় মত্ত থাকেন। তাঁদের স্তুতিবাক্যেই সর্বদা বিগলিত থাকেন দেবরাজ। খুশি হয়ে যাঁর-যাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী ক্ষমতা বণ্টন করে দেন। যেন পৃথিবীর মানুষজনের দেখভাল করতে পারেন দেবতারা। তাহলে হঠাৎ কেন মানুষের পুজো পেতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন দেবরাজ? নাকি বরাবর ভুল জেনে এসেছে বাওয়ারা? হাজার বছরের পাপের প্রায়শ্চিত্ত কতটা কঠিন হবে?
ভয়ে-ভয়ে মুখ তুলে দেবদূতের দিকে তাকাল কিকা। দেবদূতের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল তার। স্পষ্ট বুঝতে পারছে, জবাবটা সবার হয়ে তাকেই দিতে হবে। এটাই আশা করছেন দেবদূত, এটাই নিয়ম। কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কার করল, গলা দিয়ে স্বর বেরোতে চাচ্ছে না, নিজের উপর রীতিমত জোর খাটাতে হচ্ছে তাকে।
‘দেবরাজের পায়ে মাথা ঠেকাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই, হুজুর। কিন্তু এ ব্যাপারে কিছুই আমাদের জানা ছিল না। কীভাবে দেবরাজ জারালের উপাসনা করতে হয়, কখন করতে হয়, এর সবটুকুই আমাদের অজানা। আমরা অথর্ব, অধম। আমাদের ক্ষমা করুন, হুজুর।’
গর্জে উঠলেন দেবদূত, ‘ক্ষমা? কখনওই না। শাস্তি তোমাদের পেতেই হবে।. এটাই দেবরাজের ইচ্ছা।’
জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওঝার দিকে তাকালেন দেবদূত। ‘ওদেরকে জানানোর দায়িত্বটা তোমারই ছিল। তাই না? কীসের ওঝা তুমি?’
লজ্জায়, ভয়ে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো ওঝার। মৃদুস্বরে বলল, ‘আমার নিজেরও এ ব্যাপারে কিছু জানা ছিল না, হুজুর।
ভীষণ অবাক হলেন দেবদূত। একজন ওঝা কেমন করে দেবরাজের আরাধনার নিয়ম না জানতে পারে? এসব নিয়েই তো ওঝাদের কারবার। ‘তোমার আগে সাসাকোর ওঝা কে ছিল?’
‘আমার বাবা, হুজুর।’
‘তার আগে?’
‘আমার দাদা।’’
‘তারও আগে?’
‘আমার পরদাদা, হুজুর।’
‘এরা কেউই তোমাদের দেবরাজের উপাসনার ব্যাপারে কিছু বলেনি?’
‘জী না, হুজুর।’
‘কলিকাল, ঘোর কলিকাল,’ গর্জাতে-গর্জাতে বললেন দেবদূত। ছোট পরিসরে পায়চারি করছেন তিনি। কিছু একটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছেন। আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে ওঝার দিকে তাকালেন দেবদূত। চোখ-মুখ উজ্জ্বল, যেন কঠিন কোন সমস্যার সমাধান পেয়ে গেছেন।
‘পুরো ব্যাপারটাতে তোমার বংশের দোষই সবচেয়ে বেশি দেখতে পাচ্ছি আমি। দেবরাজের কথা সবাইকে জানানোর দায়িত্বটা তোমাদেরই ছিল। তোমরা অপরাধী, ভয়াবহ অপরাধ করেছ। স্বীকার করো এটা?’
‘স্বীকার করি, হুজুর। আমরা অপরাধী।’
‘অপরাধের শাস্তি পেতে হবে তোমাকে। তোমার নিজের অপরাধের জন্য তো বটেই, পূর্বসুরিদের কৃতকর্মের শাস্তিও তোমাকেই ভোগ করতে হবে।’
‘আমি প্রস্তুত, হুজুর। যে কোন শাস্তি মাথা পেতে নেব। আমায় সাজা দিন।’
‘উঠে দাঁড়াও,’ ওঝার দিকে তাকিয়ে বললেন দেবদূত। তারপর ফিরলেন কিকার দিকে। ‘তুমিও।
চট করে উঠে দাঁড়াল দু’জনেই। এখনও অধোবদন হয়ে আছে। নীরব, চিন্তিত। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান। জানা নেই, কতটা ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হতে চলেছে।
নিজের পিছন দিকটায় হাত বাড়িয়ে, ছোট একটা মাটির পাত্র আর একখানা রঙচঙে খুলি বের করে আনলেন দেবদূত। তাঁর পিঠের ঝোলাটা দীঘল চুলের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে, ইতিপূর্বে কেউই সেটা লক্ষ করেনি। দেবদূতের নির্দেশে লানু নদী থেকে পাত্রটায় পানি ভরে নিয়ে এল ওঝা। রঙিন খুলিটা রাখা হয়েছে মঞ্চের তাকিয়ার উপর। বড্ড জীবন্ত মনে হচ্ছে ওটাকে। একনজরে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, গায়ে কাঁটা দেয়। মাটির পাত্রটা ওটার পাশে রাখলেন দেবদূত। তারপর এক কদম পিছনে সরে এলেন। তাঁর দেখাদেখি ওঝা এবং কিকাও খানিকটা পিছিয়ে গেল। বাওয়ারা যে যার জায়গায় ঠায় বসে আছে এখনও, একচুলও নড়েনি কেউ। যতদূর সম্ভব দু’হাত প্রসারিত করে আকাশের দিকে মুখ তুলে দাঁড়ালেন দেবদূত। তারপর নিচু গলায় প্রার্থনা শুরু করলেন। দেবরাজ জারালকে ডাকছেন তিনি।
ধীরে-ধীরে মৃদু ধোঁয়া উঠতে শুরু করল পাত্রের পানি থেকে! যেন অদৃশ্য কোন আগুন জ্বলছে ওটার নীচে, আর তাতেই উত্তাপ পাচ্ছে পাত্রের তরল।
দেবদূত মোটেও গলা চড়ালেন না। কিন্তু ধোঁয়ার পরিমাণ ক্রমেই বাড়তে লাগল। একসময় রীতিমত ফুটতে শুরু করল পাত্রের জল। ছলকে পড়তে লাগল পাশে রাখা খুলিটার উপর।
প্রার্থনায় ক্ষান্ত দিলেন দেবদূত। ওঝা এবং কিকাকে ইশারা করে এগিয়ে গেলেন পাত্রটার দিকে। দু’হাত নাড়িয়ে সরিয়ে দিলেন উপরে জমে থাকা ধোঁয়ার ভারী আস্তরণ।
ভিতরে তাকিয়ে অস্ফুট শব্দ করে উঠল ওঝা এবং কিকা। ভীষণ চমকে গেছে দু’জনেই।
পাত্রের পানির উপর অস্পষ্ট কিছু খণ্ডচিত্র দেখতে পাচ্ছে ওরা। প্রাচীন কিছু বাওয়া মানুষের ছবি, যারা বহুকাল আগে এই সাসাকোতেই বসবাস করত। অন্তরের অন্তস্তল থেকে উপলব্ধি করল ওরা, মানুষগুলো অপরিচিত নয়, তাদেরই পূর্বপুরুষ।
প্রত্যেককেই দেখা গেল বিচিত্র ধরনের আরাধনায় মগ্ন। দেবদূত যেমনটা বলেছিলেন, অনেকটা সেরকমই তাঁদের কার্যকলাপ। মনে হচ্ছে, দেবরাজ জারালের পূজা অর্চনাতেই ব্যস্ত সবাই। একসময় সত্যিই তাহলে দেবরাজের উপাসনা হত সাসাকোয়! কালের আবর্তে বাওয়ারা সেটা ভুলে গেছে। অকারণে রাগেননি দেবরাজ জারাল। আচমকা আবারও ফুটতে শুরু করল পাত্রের পানি, নিমিষেই মিলিয়ে গেল ছবিগুলো। সে জায়গা আবারও দখল করে নিল সফেদ ধোঁয়ার দঙ্গল।
সবাইকে চমকে দিয়ে নড়ে উঠল খুলিটা। তারপর সবার চোখের সামনেই শূন্যে ভাসতে শুরু করল! ফুটখানেক উপরে উঠে থামল ওটা, স্থির হয়ে রইল ওখানেই।
প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাতজোড় করলেন দেবদূত, চোখ মুদলেন। ‘ওঝার শাস্তি কী হবে, প্রভু?’
বহুক্ষণ ধরে প্রশ্নের জবাব দিল না কেউ। একমাত্র দেবদূতই চোখ বন্ধ করে আছেন, বাকি সবাই ছানাবড়া চোখ নিয়ে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শূন্যে ভাসমান খুলিটার দিকে।
তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার ঠিক আগমুহূর্তে শীতল একটা কণ্ঠ ভেসে এল খুলিটার ভিতর থেকে। ‘মৃত্যুদণ্ড।’
চার
ওঝার মৃত্যুদণ্ড রদ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করল কিকা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। তার সমস্ত কাকুতি-মিনতি বৃথা গেল, খুলির মুখ দিয়ে আর একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না দেবরাজ জারাল। রায় ঘোষণার পর-পরই আগের অবস্থানে নেমে এসেছে ওটা। অনড় পড়ে রয়েছে মাটির পাত্রটার পাশে।
প্রচণ্ড এক ধমকে কিকাকে নিবৃত্ত করলেন দেবদূত। না হয় সারা রাতই দেবরাজের কাছে ওঝার প্রাণভিক্ষা চাইত সে। তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, বিরক্ত হতে পারেন দেবরাজ। এটাই বাওয়াদেরকে বুঝিয়ে বললেন দেবদূত।
দেবরাজের সামনে অন্য দেবতারাই যেখানে কথা বলার সাহস পায় না, সেখানে তুচ্ছ এক বাওয়া সর্দারের বাড়াবাড়ি না করাটাই মঙ্গলজনক।
বুঝল কিকা। অদৃষ্টের লিখন, না যায় খণ্ডন।
ওঝার মৃত্যুদণ্ড কীভাবে কার্যকর করা হবে সে সিদ্ধান্তের ভার বাওয়াদের উপরই ছেড়ে দিলেন দেবদূত। নিজ থেকে কোন উপায় বাতলে দেয়া থেকে বিরত থাকলেন। এতেই বাওয়ারা তাঁর প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ল। তারা জানে, চাইলেই নৃশংস কোন পন্থায় ওঝার প্রাণদণ্ড কার্যকর করতে পারতেন দেবদূত, সে ক্ষমতা তাঁর আছে।
প্রবীণ বাওয়ারা একত্রিত হয়ে আলোচনায় বসল। বয়স নিতান্ত কম হলেও ভাবি সর্দার হিসেবে, কিকাও যোগ দিল তাতে। দীর্ঘক্ষণ আলাপচারিতা শেষে সিদ্ধান্ত হলো, পরদিন ভোরবেলায় কার্যকর করা হবে ওঝার দণ্ড। রাতে কাজটা করা যাবে না কিছুতেই। রাতের বেলা প্রাণী হত্যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ সাসাকোয়, যুগ- যুগ ধরে এই নিয়মই চলে আসছে এখানে।
বাওয়াদের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করলেন না দেবদূত। শাশ্বতকালের নিয়ম ভাঙার কোন প্রয়োজন নেই। একটা রাতের আয়ু না হয় বেশিই পেল ওঝা, কী আসে-যায় তাতে?
সবাই জানে, পালাবে না ওঝা, তবুও কড়া পাহারায় রাখা হলো তাকে। চারজন যোদ্ধার সশস্ত্র প্রহরায় বেঁধে রাখা হলো টামবারানের সামনে। এই টামবারানের ভিতরেই দেবদূতের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, তিনি নিজেই বেছে নিয়েছেন জায়গাটা। সাধারণ মানুষের পক্ষে কিছুতেই টামবারানের ভিতরে রাত কাটানো সম্ভব নয়, কিন্তু দেবরাজ জারালের দূতের তো আর প্রেতাত্মাদের ভয় নেই। বরঞ্চ প্রেতাত্মারাই আজ কেউ টামবারানের ছায়া মাড়ানোর সাহস করবে বলে মনে হয় না।
ভোরেই জেগে উঠল গোটা সাসাকো। আজ তাদের জন্য একটা বিশেষ দিন। কারণ আজ থেকেই শুরু হতে চলেছে শুদ্ধি অভিযান, অতীতের পাপকর্মের কালিমা মোচনের পালা। ওঝার মৃত্যুদণ্ডের মধ্য দিয়ে সূচনা হতে চলেছে সে প্রক্রিয়ার।
প্রথমটায় ঠিক হলো, লানু নদীতে ডুবিয়ে মারা হবে ওঝাকে। দু’জন শক্তিশালী বাওয়া যোদ্ধা সজোরে পানির তলায় চেপে ধরে রাখবে তাকে। ধরাধাম ত্যাগ করতে খুব একটা সময় লাগবে না ওঝার। পুরো ঘটনা ঘটবে জলের তলায়, তাই ওঝার মৃত্যুযন্ত্রণাও কারও চোখে পড়বে না।
প্রস্তাবটা প্রায় সবারই পছন্দ হলো। যন্ত্রণাক্লিষ্ট একটা মুখ, কারই বা দেখতে ইচ্ছে হয়?
ওঝা নিজেই গিয়ে নদীর জলে নামল। বুক পানিতে নেমে স্থির হয়ে দাঁড়াল। নিয়তি মেনে নিয়েছে সে, কোনরকম অস্থিরতা নেই তার মধ্যে। শান্ত, সৌম্য, মৃত্যুকে বরণ করে নেয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কিন্তু বিপত্তি বাধল অন্যখানে। কোন যোদ্ধাই এগিয়ে গেল না ওঝাকে চেপে ধরার জন্য!
একে-একে শক্তিশালী যোদ্ধাদের প্রায় সবাইকেই ডাকল ওঝা, কিন্তু কেউই তার ডাকে সাড়া দিল না। কিকাও কাউকে আদেশ দিতে পারল না, কারণ আইনত এখনও সর্দার হয়নি সে। তাকে কুফলু পাখির পালকে গড়া মুকুটটা পরানোর সুযোগ পায়নি ওঝা। আর সর্দার ছাড়া অন্য কারও আদেশই মানতে বাধ্য নয় বাওয়ারা! নিজেকে নিজে ডুবিয়ে মারা যায় না। তাই খানিকক্ষণ বৃথা চেষ্টা করে গোমড়া মুখে নদী থেকে উঠে এল ওঝা। এবার নিজেই একটা প্রস্তাব রাখল সে। কোমর সমান গর্ত খুঁড়ে, মাটি চাপা দেয়া হোক তাকে। তারপর সবাই একযোগে পাথর ছুঁড়ে মারুক তার দিকে। এতে করে বিশেষ কেউ আর অপরাধবোধে ভুগবে না। কারণ সবারই সমান অংশগ্রহণ থাকবে পুরো প্রক্রিয়ায়।
যৌক্তিক প্রস্তাব, তাই ব্যাপারটা অনুমোদন করলেন দেবদূত। গর্ত খুঁড়তে সময় লাগল না, নিমিষেই কাজটা করে ফেলল শ্রমিক বাওয়ারা। ওঝা গিয়ে ওখানটায় দাঁড়ালে, কোমর পর্যন্ত মাটি চাপা দেয়া হলো তাকে। সবাই মাঝারি আকারের পাথর তুলে নিল হাতে, তারপর গিয়ে গোল হয়ে দাঁড়াল ওঝার চারদিকে। দেবদূতের সংকেত পেলেই একযোগে পাথর ছুঁড়বে সবাই। এহেন প্রস্তরবৃষ্টি থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই ওঝার। যথাসময়ে সংকেত দিলেন দেবদূত।
একবার নয়, পরপর তিনবার!
কিন্তু দেখা গেল, একজন বাওয়াও পাথর ছোঁড়েনি! প্রত্যেকেই নিজ-নিজ জায়গায় অনড় দাঁড়িয়ে আছে। কারও-কারও চোখে টলমল করছে অশ্রুজল।
বলা বাহুল্য, এ পদ্ধতিতেও হত্যা করা সম্ভব হলো না ওঝাকে।
.
ভীষণ রেগে গেলেও খুব একটা চোটপাট করলেন না দেবদূত। বাওয়াদের আবেগের ব্যাপারটা বুঝতে মোটেও কষ্ট হচ্ছে না তাঁর। শেষটায় নিজেই একটা উপায় বাতলে দিলেন।
বাওয়ারা প্রত্যেকেই মনে-মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলো, এবার আর কিছুতেই প্রাণদণ্ড ঠেকানো যাবে না ওঝার। তবে এ পদ্ধতিতেই সম্ভবত তার মরণযন্ত্রণা সবচেয়ে কম হবে।
ঠিক হলো, বিষপ্রয়োগে মারা হবে ওঝাকে। তিতাম গাছের রস দিয়ে বানানো বিষ।
বাওয়ারা বড় কোন জানোয়ার শিকারে গেলে, এ বিষ সঙ্গে করে নিয়ে যায়। কোনমতে শিকারকে কোণঠাসা করা সম্ভব না হলে, এই বিষ প্রয়োগ করা হয়। মোষ, গণ্ডার থেকে শুরু করে বিশালাকার ভ্যারল পর্যন্ত সহজেই কাবু হয়ে যায় তিতামের বিষে।
তিতাম গাছের তলায় প্রায়শই মৌমাছি, পোকামাকড় আর ছোট পাখি মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তিতামের বর্ণিল ফুল থেকে মধু খেতে আসাটাই কাল হয় ওদের জন্য। মধুর সঙ্গে-সঙ্গে খানিকটা বিষও ওদেরকে উপহার দেয় তিতাম আর প্রাণ কেড়ে নিতে কেবলমাত্র একফোঁটা তিতামের বিষই যথেষ্ট।
অস্ত্রাগার থেকে আনা হলো তিতামের রস। পাকা বাঁশের মোটা নলের ভিতর রাখা হয় এই বিষ। সংগ্রহের পরপরই মুখে ছিপি এঁটে দেয়া হয়। রাখা হয় সাধারণের নাগালের বাইরে, অস্ত্রাগারের গোপন কুঠুরিতে। যেখানে কেবল যোদ্ধাদেরই প্রবেশাধিকার আছে।
ওঝাকে একটা লম্বা পাটাতনে শোয়ানো হলো। পাতা দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো দু’চোখ।
বিষের পাত্র আর একখানা ধারাল ছুরি নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল কিকা হাঁটু গেড়ে বসল তার পাশে। তারপর ওঝার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে আলতো করে ছুরি ছোঁয়াল তাতে।
ধারাল ফলার স্পর্শ পেতেই দ্বিখণ্ডিত হলো ত্বক, বেরিয়ে এল রক্তের ক্ষীণ ধারা। খুব সাবধানে তাতে ফোঁটায় ফোঁটায় বিষ ঢালল কিকা। তারপর হাতটা খানিকক্ষণ উপরেই ধরে রাখল, যেন রক্তের ফোঁটা মাটিতে না পড়ে। নিমিষেই শিরাপথে ওঝার দেহের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ল গরলের দল। আর ধরে রাখার প্রয়োজন নেই বুঝতে পেরে হাতটা ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে এল কিকা। বুকের ভিতরটা ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে যাচ্ছে তার। জানে, আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না ওঝা। তিতামের বিষ ঠেকানোর সাধ্য নেই কোন মানুষের।
এই মানুষটাই তাকে শৈশবে হাত ধরে-ধরে শিখিয়েছে অনেক কিছু। সর্দারের ছেলের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ওঝা, এটাই বাওয়া সমাজের প্ৰথা। –
মুখ দিয়ে কোন আর্তনাদ বেরোল না ওঝার। শুধু বারকয়েক খিঁচুনি উঠল গোটা শরীরে। হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল তার, কুঁচকে গেল মুখের চামড়া। তারপর আচমকা পুরোপুরি নিথর হয়ে গেল তার দেহ, সব শেষ। কান্নায় ভেঙে পড়ল কিকা। তবে তাকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে গেল, না কেউ, যে যার জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সবাই। নিজের দুঃখ নিজেকেই বহন করতে হয় বাওয়াদের।
পাঁচ
শোকের প্রকোপটা খানিকটা লাঘব হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন দেবদূত। তারপর মঞ্চে উঠে সবার দিকে তাকালেন তিনি। আবারও দৃঢ়চেতা ভাবভঙ্গি ফিরে এসেছে তাঁর, খানিক আগের সহনশীলতার লেশমাত্রও নেই এখন চেহারায়।
‘এবার তোমার পালা, কিকা। তুমি প্রস্তুত?’
‘আমি প্রস্তুত, হুজুর। বলুন কী শাস্তি অপেক্ষা করছে আমার জন্য,’ শান্তস্বরে . বলল কিকা।
‘শাস্তি নয়, প্রায়শ্চিত্ত। সর্দার হিসেবে অনেক ভুলই শোধরাতে হবে, যার জন্য চড়া মূল্যও দিতে হতে পারে তোমাকে। কাজগুলো তুমি নিজেও করতে পারো, চাইলে অন্য কাউকে প্রতিনিধি হিসেবেও পাঠাতে পারো। সর্দার হিসেবে এই অধিকার তোমার আছে।’
‘আমি নিজেই কাজগুলো করতে চাই, হুজুর। সাসাকোর মানুষের জন্য প্রাণ বিলিয়ে দিতেও কখনও দ্বিধা করব না আমি। যদিও এখনও সর্দার হইনি আমি, তবুও সর্দার হিসেবে আমার জীবন সবার মঙ্গলের জন্যই উৎসর্গ করা।’
সময়টা অন্যরকম হলে, সমগ্র সাসাকোবাসী চিৎকার করে তাদের সর্দারের প্রতি আনুগত্য জানাত। এটাও জানাত যে, আইনত সর্দার না হলেও, কিকাকে ওরা অনেক আগেই সর্দার হিসেবে নিজেদের অন্তরে স্থান দিয়েছে। তাই তার আদেশে যে কোন কাজই করতে প্রস্তুত ওরা।
কিন্তু এখন এই দুর্যোগঘন সময়ে, দেবদূতের সামনে, চিৎকার করার সাহস নেই কারও। তাই নীরবে মাথা দুলিয়েই কিকার প্রতি শ্রদ্ধা জানাল বাওয়ারা।
সবই দেখলেন দেবদূত। কিছুই নজর এড়াল না তাঁর।
‘একজন যোগ্য সর্দারের মতই কথা বললে তুমি, কিকা। তবে তোমাকে কাজের মাধ্যমেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। সবাইকে দেখাতে হবে, জিভের মতই তোমার মাথা এবং পেশীগুলোও দ্রুত চলে।’
‘প্রাণ থাকতে আমি কোন কাজে পিছপা হব না, হুজুর।’
‘বেশ। আমিও সেটাই চাই। এখন সবাই এসো আমার সাথে।’
নদীর ঘাটের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন দেবদূত। পিছন পিছন চলল বাওয়ারা। প্রত্যেকেই খেয়াল রাখছে, তাদের পদশব্দ যেন বিরক্ত না করে দেবদূতকে। তাই এত বড় দলটা বলতে গেলে প্রায় নিঃশব্দেই নদীর ঘাটে পৌছে গেল।
পানির কিনারায় পৌছে থমকে দাঁড়ালেন দেবদূত। ঘুরে সমবেত জনতার মুখোমুখি হলেন। ‘তোমাদের কারও জানা আছে, লানু নদীর নীচ দিয়ে বয়ে চলা পাতাল নদীটার কথা?’
অস্ফুট শব্দ করে উঠল বাওয়ারা। চোখ বড়-বড় হয়ে গেছে সবার। মাটির তলায় আবার কেমন করে নদী থাকে? হাসলেন দেবদূত। তাঁর ঠিকই জানা ছিল, পাতাল নদী সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই বাওয়াদের। ‘চলো, তোমাদেরকে এমন কিছু দেখিয়ে আনি, যা এর আগে কখনও দেখনি তোমরা। আবার কখনও দেখতে পাবে, সে সম্ভাবনাও নেই।’
কথা শেষ করেই নদীর দিকে পা বাড়ালেন দেবদূত। হাঁটতে শুরু করলেন পানির উপর দিয়ে! আগের রাতেও তাঁকে ঠিক এভাবেই পানির উপর দিয়ে হাঁটতে দেখেছিল সবাই।
তবে অল্পক্ষণের মধ্যেই বাওয়ারা যা আবিষ্কার করল, তাতে তাদের বিস্ময় বাড়ল বৈ কমল না! দেবদূত পানির উপর দিয়ে হাঁটছেন না, তিনি হাঁটছেন এক দঙ্গল কুমিরের পিঠের উপর দিয়ে! শত-শত কুমির গায়ে গা ঠেকিয়ে আড়াআড়িভাবে নদী পারাপারের একটা অস্থায়ী সাঁকো তৈরি করেছে তাঁর জন্য! কুমিরগুলোর দেহের প্রায় সবটুকুই জলের আড়ালে থাকায়, চট করে চোখে পড়ে না। দিনের আলোতেই ঠাহর করতে কষ্ট হয়, রাতের আঁধারে ওদেরকে দেখতে পাওয়া রীতিমত অসম্ভব।
শ্রদ্ধায়, ভয়ে মাথা নত হয়ে এল বাওয়াদের। কেমন করে কুমিরদের বশ করলেন দেবদূত? তাঁর ক্ষমতার পরিসীমা আঁচ করতে পেরে নিজের অজান্তেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল সবার।
বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই হুড়োহুড়ি করে যে যার নৌকায় চড়ে বসল বাওয়ারা। দেবদূত ততক্ষণে পৌঁছে গেছেন নদীর ওপারে। নিশ্চয়ই তিনি বাওয়াদের জন্য অপেক্ষা করে থাকাটা উপভোগ করবেন না।
সমস্ত বাওয়া ওপারে পৌঁছনোর পর তাদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে নির্দেশ দিলেন দেবদূত। তারপর ভীষণ মোটা একখানা গাছের গুঁড়িতে আলতো করে হাত রাখলেন। দেখতে-দেখতে একপাশে হেলে পড়ল অতবড় গাছটা, তবে পুরোপুরি লুটিয়ে পড়ল না মাটিতে। গাছটার গোড়ার দিককার শিকড়বাকড়গুলো উঠে এসেছে জমিনের উপরে। আর সেখানেই একটা ফোকরমতন তৈরি হয়েছে।
ইশারায় সবাইকে পিছু নিতে বলে সেই ফোকরটার মধ্যে গিয়ে ঢুকলেন দেবদূত। তাঁর ঠিক পিছনেই আঠার মত সেঁটে রয়েছে কিকা। অন্যরাও একে- একে তাদের সর্দারকে অনুসরণ করল।
পাতালে নামতেই বাওয়াদের চোখগুলো বিস্ময়ে পুরোপুরি ছানাবড়া হয়ে গেল। এ কোথায় এসেছে ওরা? পৃথিবীতে এমন জায়গাও বুঝি থাকতে পারে!
তাদের চোখের সামনেই বিশাল একখানা পাথুরে দেয়াল। তবে পাথরের গড়নটা অদ্ভুত, স্বচ্ছ। কাচের মতই দেয়ালের ওপাশটা স্পষ্ট চোখে পড়ছে সবার। সেখানে নীরবে বয়ে চলেছে একটা শান্ত নদী!
মাথার বেশ খানিকটা উপরে মাটির ছাদ। সেখান থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় জল চুইয়ে পড়ছে। অস্পষ্ট হলেও, লানু নদীর বয়ে চলার শব্দটা ঠিকই কানে আসছে। নদীটার ঠিক নীচেই এখন আছে সবাই।
গমগমে গলায় কথা বলে উঠলেন দেবদূত। ‘নদী দেখাতে তোমাদেরকে এখানে আনিনি আমি। এনেছি বিশেষ একটা জিনিস দেখাতে। সবাই নদীটার তলার দিকে ভাল করে তাকাও।’
তাঁর আদেশ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করল বাওয়ারা। পাথুরে দেয়ালটার কাছাকাছি গিয়ে ভাল করে লক্ষ করল পাতাল নদীর তলদেশের দিকে। পরক্ষণেই ভীষণ চমকে উঠল।
শত-শত মানব কঙ্কালে বোঝাই হয়ে আছে জায়গাটা। রীতিমত হাড়ের স্তূপ। যতজন মানুষের হাড়গোড় পড়ে আছে এখানে, এর বিশ ভাগের একভাগ মানুষও এখন সাসাকোয় নেই।
সবার আঁতকে ওঠাটা আয়েশ করে উপভোগ করলেন দেবদূত। তাদের চোখের তারায় ফুটে ওঠা প্রশ্নবোধক চিহ্নটাও নজর এড়াল না তাঁর।
‘এরা তোমাদেরই পূর্বপুরুষ। বহুকাল আগে এরাই দাপিয়ে বেড়াত গোটা অঞ্চল, ঠিক তোমাদেরই মত। যতদিন না মালানিরা এদিকটায় সরে আসতে শুরু করে। যুগের পর যুগ মালানিদের সাথে লড়াইয়ের ফলাফল দেখতে পাচ্ছ তোমরা চোখের সামনে। এরা সবাই প্রাণ দিয়েছে সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে, যেন তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিরাপদে বসবাস করতে পারে। যেন মালানিদের হাত থেকে নিস্তার পায়।’
মালানিদের সঙ্গে দুই শতাব্দী ধরে চলা ভয়ঙ্কর যুদ্ধের কথা জানা আছে বাওয়াদের। এই যুদ্ধ নিয়ে প্রচুর কাহিনি শুনেছে ওরা বয়স্কদের মুখে।
মালানি, একরকমের বনমানুষ। বহুকাল আগে ওরা পৃথিবীর অন্য কোন কোণে বসবাস করত। সম্ভবত সপ্ত পাহাড়ের অন্য পাশে। কিন্তু খাবারে টান পড়ায় ধীরে-ধীরে ওরা সরে আসতে শুরু করল বাওয়া এলাকায়। স্বভাবতই শিকার নিয়ে ওদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বাওয়ারা। মালানিরাও ছেড়ে কথা বলার পাত্র ছিল না। তাই খণ্ড-খণ্ড সংঘর্ষ ধারাবাহিক যুদ্ধে রূপ নেয়। দেখতে-দেখতে জাতশত্রুতে পরিণত হয় বাওয়া এবং মালানিরা। সুযোগ পেলেই একে অন্যের কলোনিতে আক্রমণ করত। দু’শো বছর ধরে একনাগাড়ে চলে এই রক্তক্ষয়ী লড়াই। কখনও অবিরাম, কখনও বা সাময়িক বিরতি দিয়ে।
অবশেষে মালানিদের কোন এক আচরণে প্রচণ্ড বিরক্ত হন আলোর দেবতা অলুরাং। মালানিদের ক্ষমতা কমিয়ে দেন তিনি, ভাগ করে দেন বিভিন্ন উপদলে। সেই উপদলগুলোই পরবর্তীতে বানর, হনুমান, শিম্পাঞ্জি, গরিলা এবং বেবুনে পরিণত হয়।
বাওয়ারা জানত, সেই যুদ্ধে প্রচুর বীর যোদ্ধা প্রাণ দিয়েছিল। কিন্তু তাদের কঙ্কাল এভাবে কোথাও একত্রে জমা করা আছে, এটা তারা কখনও কল্পনাও করেনি। আজ চোখের সামনে ওগুলোকে দেখতে পেয়ে, যুগপৎ শ্রদ্ধায় এবং বিস্ময়ে পুরোপুরি নির্বাক হয়ে গেল ওরা।
‘এখানে তোমাদের পূর্বপুরুষদের প্রায় সবাই-ই আছে। শুধু একজন ছাড়া,’ বলে উঠলেন দেবদূত।
‘কে, হুজুর?’ মৃদুস্বরে জানতে চাইল কিকা
‘বীর যোদ্ধা, লাক্রা। তার কঙ্কালই তোমাকে এখানে ফিরিয়ে আনতে হবে, কিকা। এটাই তোমার প্রথম কর্তব্য।’
‘আমি অবশ্যই ফিরিয়ে আনব, হুজুর। কোথায় আছে সেটা?’
‘পবিত্র গুহায়।’
ছয়
সপ্ত পাহাড়ে দুটো কিম্ভূতকিমাকার শৈলশিরার ঠিক মাঝখানটায় পবিত্র গুহার অবস্থান। বন্ধুর পথ, ভয়ানক বিপদসংকুল। আদিমকাল থেকেই পবিত্র গুহা জয় করাটাকে বাওয়ারা বিশেষ সম্মানের চোখে দেখে আসছে। তাই এযাবৎকালে ওপথে যাত্রা করা বাওয়া যোদ্ধাদের সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়। তবে তাদের বেশিরভাগই আর কখনও ফেরত আসেনি লোকালয়ে।
শুধু কয়েক যুগ আগে একজন শক্তিশালী বাওয়া সর্দার ফিরে আসতে পেরেছিল পবিত্র গুহা জয় করে। প্রয়াত সর্দার শাংকুর দাদা, কিকা তারই বংশধর। তার আনা পবিত্র গুহার বালি এখনও দেবতাদের পূজা-অর্চনায় ব্যবহার করা হয়। অজ্ঞাত কারণে এই বিশেষ বালি দেবতারা খুবই পছন্দ করেন।
শাংকুর দাদার কাছ থেকেই পবিত্র গুহার গমন পথের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা জানতে পেরেছিল বাওয়ারা। তারপর থেকে কেউ আর পবিত্র গুহায় যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। খানিকটা বাড়তি সম্মান অর্জনের জন্য পৈত্রিক প্রাণটা খোয়াতে রাজি নয় কেউ।
কিন্তু কিকার এখন ওসব ভাবার সুযোগ নেই, তাকে যেতেই হবে। অন্য কোন পথ খোলা নেই তার সামনে। দেবতাদের নাম নিয়ে সপ্ত পাহাড়ের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল সে। দিনের আলো থাকতে-থাকতেই পৌঁছে যেতে চায় গন্তব্যে।
চেনা নদীপথ, ঘন জঙ্গল, বেশ সহজেই পেরিয়ে গেল সে। তেমন কোন বিপদ-আপদের সম্মুখীন হতে হলো না তাকে।
একটা দাঁতাল মাদী শুয়োর অবশ্য অনেকদূর পর্যন্ত তাড়া করেছিল তাকে। তবে চিতার গতিতে ছুটতে পারা কিকার টিকিটা ছোঁয়ারও সাধ্য হয়নি ওটার। চাইলেই ওটাকে মেরে ফেলতে পারত কিকা। তাতে অহেতুক দৌড়নোর ঝক্কিটা এড়ানো যেত। কিন্তু শুয়োরটার ছোট দুটো বাচ্চা দেখেছে সে। বাচ্চাদের নিরাপত্তার জন্যই প্রাণ বাজি রেখে কিকাকে তাড়া করেছিল ওটা। একটা স্নেহবৎসল মাকে মারতে মন সায় দেয়নি তার। ওটাকে মারলে, কয়েকদিনের মধ্যে বাচ্চাগুলোও মরে যেত নির্ঘাত।
সপ্ত পাহাড়ের গোড়ায় পৌঁছে প্রথম বিপদটার মুখোমুখি হলো কিকা। খুব সরু একটা পিচ্ছিল গিরিপথ পাড়ি দিতে হবে তাকে, যার দু’পাশেই গভীর খাদ। একবার পা ফসকালেই আর দেখতে হবে না, এক লহমায় কম্ম কাবার। পথটা এতটাই সরু যে, পাশাপাশি দুটো পা রেখেও দাঁড়ানো যায় না, আগুপিছু করে এগোতে হয়। সেই পথও আবার নিরবচ্ছিন্ন নয়, এখানে-ওখানে মস্ত ফাটল। ওগুলোতে পা পড়লেও খেল খতম, টুক করে হারিয়ে যেতে হবে মাটির গভীরে।
কিছুদূর চলার পরই হাড়ে হাড়ে টের পেল কিকা, এভাবে এগোলে পুরো পথ পাড়ি দেয়া কিছুতেই সম্ভব হবে না তার পক্ষে। ধীরে চললে শরীর বেশি হেলে পড়ে, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর সম্ভাবনা থাকে। তাই দ্রুতলয়ে ছুটতে শুরু করল সে। তীক্ষ্ণ নজর রাখল, ঠিক কোথায় পা ফেলছে। কদম ছোট-বড় করে আলগা নুড়ি এবং ফাটলগুলো এড়িয়ে চলার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে সে। তবুও বেশ কয়েকবারই পা হড়কাল তার। কোনমতে পড়তে-পড়তে বাঁচল। তবে শেষ অবধি পথটা পেরোতে পারল সে, মোটামুটি অক্ষত অবস্থায়ই। পরের বিপদটা এল অতর্কিতে, কোনরকম সতর্ক বার্তা ছাড়া। একটা তীক্ষ্ণ বাঁক ঘুরতেই একপাল বানরের মুখোমুখি হতে হলো তাকে। এখানে-ওখানে, গাছের ডালে, পাথরে, শত- শত বানর। এক নজরেই বুঝতে পারল কিকা, এটাই ওদের আবাসস্থল। ওদের বাড়ির উঠন চিরেই এগিয়ে গেছে পথটা।
কিকাকে দেখামাত্রই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল বানরের দল। নিজের বাসায় অনাহূত অতিথির অনুপ্রবেশ, কে-ই বা পছন্দ করে?
নেতৃস্থানীয় গোটা কয়েক বানর এগিয়ে এল কিকার দিকে। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বিকট ভেংচি কাটছে ওগুলো। বাকিরাও নিশ্চুপ নেই, যে যার জায়গায় বসে থেকেই ভয়ানক চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে সবক’টা মিলে। ওদের সম্মিলিত চিৎকারে কানের পর্দা ফাটার জোগাড় হলো কিকার। প্রচণ্ড ভয় পেলেও মাথা ঠাণ্ডা রাখল সে। জানে, একটামাত্র ভুল পদক্ষেপই মুহূর্তের ব্যবধানে লাশে পরিণত করবে তাকে। একপাল ক্রুদ্ধ বানর একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়লে, মাংসের দলায় পরিণত হতে খুব একটা সময় লাগবে না।
আগুয়ান বানরগুলোর চোখে-চোখে তাকাল কিকা। সে ভয় পেয়েছে, এটা যেন ওরা কিছুতেই বুঝতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখল। শিকার ভয় পেয়েছে · বুঝতে পারলে, অতি উৎসাহী হয়ে সময়ের আগেই আক্রমণ করে বসতে পারে দলের কোন অনভিজ্ঞ তরুণ। আর একবার ব্যাপারটা শুরু হয়ে গেলে বাকিরাও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না।
খুব ধীরে-ধীরে চার হাতপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে বসল কিকা। বারদুয়েক চোখ বুজে দেবতাদের স্মরণ করতেও ভুলল না। মুখ খুলে লম্বা দম নিতে শুরু করল সে, যতটা সম্ভব বাতাস ভরে নিতে চায় ফুসফুসে। যে একমাত্র অস্ত্রটা প্রয়োগ করতে চলেছে সে, তাতে দেবতাদের অনুগ্রহের পাশাপাশি বুক ভরা বাতাসও তার খুবই দরকার। আচমকা গলা ফাটিয়ে ভয়ঙ্কর গর্জন করে উঠল কিকা! চিতাবাঘের ডাক নকল করছে সে। অনেক পশুপাখির ডাকই অনুকরণ করতে পারে বাওয়ারা, শিকারের সময় কাজে লাগে। আজ নিজে শিকার হওয়ার হাত থেকে বাঁচতেও হয়তো কাজে লাগতে পারে বিদ্যাটা।
চিতাবাঘকে যমের মত ভয় পায় বানরেরা। কারণ তাদের মত গাছে চড়ার বিদ্যাটা চিতাবাঘেরও জানা আছে। চট করে গাছের মগডালে চড়ে অন্য শিকারি প্রাণীর হাত থেকে বাঁচা সম্ভব হলেও, চিতাবাঘের হাত থেকে নিস্তার পায় না ওরা। এহেন শত্রুকে ভয় না পেয়ে উপায় কী?
এক লহমায় থেমে গেল বানরের দলের চেঁচামেচি। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওরা কিকার দিকে। অন্তরের অন্তস্তল থেকে অনুভব করছে, ভয় পাওয়া উচিত। কিন্তু সামনে দাঁড়ানো প্রাণীটাকে ঠিক চিতাবাঘের মত লাগছে না ওদের কাছে, তাই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।
সুযোগটা কাজে লাগল কিকা। গর্জন করতে-করতে এক কদম সামনে বাড়ল। সেই সঙ্গে ডানহাতের থাবাটা সজোরে নামিয়ে আনল মাটির উপর। যেন ভয়ানক রেগে গেছে সে!
আর কোন দ্বিধা রইল না বানরদের। পড়িমরি করে ছুট লাগল। চোখের নিমিষে লুকিয়ে পড়ল ঘন পাতার আড়ালে, সন্দেহের বশবর্তী হয়ে প্রাণ খোয়াতে রাজি নয় কেউ।
চটজলদি জায়গাটা পেরিয়ে গেল কিকা। জানা আছে, যে কোন মুহূর্তে সাহস সঞ্চয় করে ফিরে আসতে পারে বানরের দল। দ্বিতীয়বার একই কৌশল খাটবে না ওদের উপর।
কিছুদূর এগোনোর পর দস্তুরমতন ঘামতে শুরু করল কিকা। প্রথমটায় ভাবল, খানিকক্ষণ আগের উত্তেজনার কারণেই এমনটা হচ্ছে। মনের উপর দিয়ে ধকলটা তো আর কম যায়নি! তবে অল্পক্ষণের মধ্যেই ভুলটা ভাঙল তার।
একটা মাঝারি আকারের প্রান্তরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে, যার পুরোটাই ঢেকে আছে গনগনে লাভায়! ফুটন্ত পানির মতই টগবগ করে ফুটছে ওগুলো, কালচে ধোঁয়ারও কোন কমতি নেই। সেই সঙ্গে গোটা জায়গাটা ঘিরে আছে তীব্র ঝাঁঝাল এক বিচ্ছিরি গন্ধ। শ্বাস টানতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে।
প্রচণ্ড উত্তাপে পাগল হওয়ার জোগাড় হলো কিকার। ভেবেই পেল না, কী করে পার হবে জায়গাটা। উদ্ভ্রান্তের মত এদিক-ওদিক তাকাল সে। কিন্তু বিকল্প কোন পথই তার নজরে পড়ল না। এতদূর এসে খালি হাতে ফিরতে হবে, এটা ভাবতেই বুকটা হু-হু করে উঠল তার। সেখানেই বসে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল সে। বারকয়েক চিৎকার করে দেবতাদের ডাকল সে, পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলল তার আহাজারি। কিন্তু কোন জবাব মিলল না।
তবে শেষমেশ দেবতারা বোধকরি তার ডাক ঠিকই শুনলেন। আচমকা একঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে হাজির হলো ওখানটায়। উত্তাপ কমে গেল অনেকখানি, শ্বাস নেয়ার কষ্টটাও আর রইল না। সেই সঙ্গে দূর হলো বাষ্পের ভারী পর্দা। আর তাতেই প্রান্তরটা পেরোবার একটা উপায় খুঁজে পেল কিকা!
তরল লাভার এখানে-ওখানে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত মাথা তুলে আছে কিছু পাথরের চাঁই। চেষ্টা করলে হয়তো ওগুলোর উপর দিয়ে লাফিয়ে-লাফিয়ে প্রান্তরটা পেরোনো যাবে।
চট করে উঠে পড়ল কিকা। সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই, যে কোন মুহূর্তে ভারী বাষ্প আর কালচে ধোঁয়ায় আবারও ঢেকে যেতে পারে পাথরগুলো। ঠাণ্ডা বাতাস খুব বেশি সময় ধরে লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে না। গাছের ছাল-বাকল দিয়ে মোজামতন তৈরি করে পায়ে জড়িয়ে নিল কিকা। কোন সন্দেহ নেই, ভয়ানক গরম হয়ে আছে সবক’টা পাথর। খালি পায়ে দাঁড়ানো মাত্রই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে পায়ের পাতা। বাধ্য হয়েই তখন উত্তপ্ত লাভায় আত্মাহুতি দিতে হবে।
একপলক পাথরগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা সরলরৈখিক পথ ঠিক করে নিল সে। তারপর ছুটতে শুরু করল। লাফিয়ে-লাফিয়ে এগোচ্ছে, কোন পাথরেই দাঁড়াচ্ছে না। একবার ক্ষণিকের জন্য পিছলে গেল পা, ধপাস করে আছড়ে পড়ল সে পাথরের উপর। পরক্ষণেই হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল সে। ততক্ষণে তার শরীরের এখানে-ওখানে ফোসকা পড়ে গেছে। গরম পাথরের ছোঁয়া লেগেছে জায়গাগুলোয়।
পাথরটা আকারে বিশাল ছিল বলেই এযাত্রা প্রাণে বেঁচে গেল সে। অন্যথায় লাভা সরোবরেই অক্কা পেতে হত তাকে।
অবশেষে গুহামুখে যখন পৌঁছল ও, সূর্য ততক্ষণে বিদায় নেবার তোড়জোড় করছে। পাহাড়ের উপরে বলে এখনও খানিকটা আলো পাওয়া যাচ্ছে, নীচের দিকে ইতোমধ্যেই সাঁঝ ঘনিয়ে গেছে। গুহামুখের আশপাশে প্রচুর কুফলু পাখির পালক পড়ে থাকতে দেখল কিকা। কিন্তু একটা পাখিকেও দেখা গেল না কোথাও।
প্রায়ই কি পবিত্র গুহায় আসে কুফলুরা? কেন আসে?
গাছের মোটা একটা ডাল দিয়ে, চটজলদি ছোট একটা মশাল বানিয়ে নিল কিকা। আলো ছাড়া পবিত্র গুহায় ঢোকার কোন মানে হয় না। ততক্ষণে পুরোপুরি নেমে এসেছে আঁধারের চাদর, কয়েক হাত দূরের জিনিস ঠাহর করাও কষ্টকর এখন।
দুরু-দুরু বুকে পবিত্র গুহার দিকে পা বাড়াল কিকা। উত্তেজনায় কাঁপছে তার গোটা শরীর। অবশেষে পৌঁছতে পেরেছে সে পবিত্র গুহায়, বাওয়াদের সবচেয়ে আরাধ্য জায়গায়। কত বীর যোদ্ধা এখানে আসতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে, তার খবর কে বলতে পারে!
মশালের আলোয় গুহার ভিতরকার জমাট আঁধার দূর হতেই তীব্র আতঙ্কে পুরোপুরি জমে গেল কিকা! শীতল শিহরণ বয়ে গেল তার শিরদাঁড়া বেয়ে। নিজের চোখজোড়াকেও অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। পবিত্র গুহার দেয়ালে- দেয়ালে অসংখ্য আঙটা গাঁথা। তার একটাও খালি নেই, প্রত্যেকটাতেই ঝুলছে কোন না কোন নরকঙ্কাল! সবক’টা বহুদিনের পুরানো, ক্ষয়া।
দেয়ালগুলোয় কালচে রঙের কালিতে বিজাতীয় ভাষায় কিছু লেখা রয়েছে। অক্ষরজ্ঞান নেই কিকার, তাই লিপিগুলোর মর্ম উদ্ধার করা সম্ভব হলো না তার পক্ষে। তবে এটুকু ঠিকই বুঝতে পারল, তাজা রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছিল কথাগুলো। কালের আবর্তে এখন কালচে হয়ে গেছে রঙ।
ঝকঝকে-তকতকে গুহার প্রতিটি দেয়াল, যেন নিয়মিত ঝাঁট দেয় কেউ! কোথাও একরত্তি মাকড়সার ঝুলও নেই। বদ্ধ গুমট বাতাস এতটাই ভারী, যেন হাতের মুঠোয় ধরা যাবে ওগুলোকে!
পুরো ব্যাপারটাই ভয়ানক অশুভ। প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে কিকা। ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয় জানান দিচ্ছে তাকে, পালিয়ে যাও এখান থেকে, জলদি পালাও।
কিকা ভেবেছিল রাতটা এখানেই কাটিয়ে দিয়ে সাতসকালে ফিরতি পথ ধরবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হলো সে। যত দ্রুত এখান থেকে পালানো যায়, ততই মঙ্গল।
পবিত্র গুহার বালির আলাদা কদর আছে, তাই দ্রুতহাতে কিছু বালি থলেতে পুরে কোমরে বেঁধে নিল সে। দেবতাদের উপাসনায় কাজে দেবে।
পরক্ষণেই একটা সমস্যা প্রকট হয়ে ধরা পড়ল তার মাথায়।
কোটা বীর যোদ্ধা লাক্রার কঙ্কাল? এতগুলো কঙ্কালের ভিতর থেকে কেমন করে খুঁজে বের করবে সে ওটাকে? অনেক ভেবেচিন্তে গুহামুখের সবচেয়ে কাছের কঙ্কালটাকে তুলে নিল সে। মন বলছে, এটাই হবে। যদি না হয়, আর কী-ই বা করার আছে তার?
কঙ্কালটাকে কষে নিজের পিঠের সঙ্গে বেঁধে নিল কিকা। অনেক জায়গাতেই ছুটতে হবে তাকে, হাতে বহন করা সম্ভব নয় ওটাকে।
কাজ শেষে জ্বলন্ত মশাল হাতে বাইরে বেরিয়ে এল কিকা। ফিরতি পথে রওনা দেয়ার জন্য মানসিকভাবে তৈরি।
তবে বাইরের পরিস্থিতি ততক্ষণে আমূল বদলে গেছে। কিকাকে অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষা করছে একদল শিকারি!
ওদের উপর চোখ পড়তেই পিলে চমকে উঠল কিকার! বাঁচার আশা পুরোপুরি ছেড়ে দিল সে। অসংখ্য কুফলু পাখি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে চারপাশে। গুহার ভিতরে থাকায়, তাদের আগমনের ব্যাপারটা এতটুকুও টের পায়নি কিকা।
কুফলুরা এমনিতেই নিঃশব্দে চলাচল করে। তার উপর নিজের ভাবনা-চিন্তায় এতটাই মজে ছিল কিকা, বাইরের মৃদু শব্দগুলো সহজেই তার কান এড়িয়ে গেছে।
ওকে দেখতে পেয়ে কুফলুদের প্রায় সবার চোখেই তীব্র আগ্রহ দেখা দিল। যদিও ভরপেট খাবার খেয়েই ঘরে ফিরেছে সবাই, তবে বাড়তি ডেজার্ট হিসেবে কিকাকে খেতে মোটেও আপত্তি নেই ওদের। মানুষ কি আর রোজ-রোজ মেলে?
বিড়ালের মত মৃদু গর-গর শব্দ বেরিয়ে আসছে কুফলুদের গলার গভীর থেকে। ধীরে-ধীরে কিকার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল ওরা।
পিছিয়ে যেতে চাইল কিকা, আপাতত গুহাতেই আবার ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে তার।
কিন্তু বিধি বাম। হঠাৎই খেয়াল করল, পিছন দিক থেকেও এগিয়ে আসছে কুফলুরা, গুহায় ফিরে যাওয়ার কোন উপায়ই নেই তার।
আদতে বিশাল একখানা বৃত্তের মতই তাকে ঘিরে ফেলেছে কুফলুরা। এখন আস্তে-ধীরে বৃত্তের পরিধিটা গুটিয়ে আনছে।
প্রাণভয়ে এদিক-ওদিক বারকয়েক তাকাল কিকা, যদি মুক্তির কোন উপায় মেলে। ঠিক তখনই বৃত্তের ছোট একটা ফাঁক আবিষ্কার করতে পারল তার অনুসন্ধানী চোখ। ওদিকটায় নিচু পাথরের দেয়াল, তার ওপাশে বিশাল খাদ। উপর থেকে তাকালে তল পর্যন্ত দৃষ্টি পৌঁছয় না, এতটাই গভীর।
কিন্তু আচমকা ওদিকেই দৌড়তে শুরু করল কিকা, প্রবল বেগে ছুটে গেল নিচু দেয়ালটার দিকে। প্রয়োজনে পাথরে থেঁতলে মরবে, তবুও কুফলুদের খাবার হতে রাজি নয় সে।
শিকারিরা সতর্ক হওয়ার আগেই ফাঁকটা পেরিয়ে গেল কিকা। দেয়ালটা টপকে অন্ধের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল উল্টোপাশে।
অনন্তকাল শূন্যে ভাসার পর গাছের ডালের উপর পতনের তীব্র যন্ত্রণাটা ঠিকই অনুভব করল সে, তারপর আর কিছু মনে নেই তার।
সাত
জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে একটা খাঁড়ির বালিয়াড়িতে আবিষ্কার করল কিকা। ততক্ষণে বিশ্রাম শেষে ঊর্ধ্বগগনে ফিরে এসেছে ভোরের সূর্য, আলো বিলাতে শুরু করেছে। বুকে-পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছে কিকা, হাড় ভেঙেছে কি না কে জানে!
গোটা শরীরের এমন কোন জায়গা নেই, যেখানটায় কাঁটা-ঝোপের আঁচড় লাগেনি। পাহাড়ের উপর থেকে গড়িয়ে পড়ার সময় জঙ্গলের কাছ থেকে ওগুলো উপহার পেয়েছে সে।
কেমন করে লানু নদীতে ভাসতে ভাসতে এই খাঁড়িতে এসে পৌঁছেছে, এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই তার। প্রাণে বেঁচে গেছে, এতেই খুশি সে। সে-ই সম্ভবত প্রথম বাওয়া মানুষ, একদল কুফলুর সামনে পড়েও যে বেঁচে ফিরে এসেছে!
তার খুশির সীমাটা মাত্রা ছাড়াল, যখন সে আবিষ্কার করল, পিঠে বাঁধা কঙ্কালটা এখনও যথাস্থানেই আছে! এত ঝক্কির পরও স্থানচ্যুত হয়নি ওটা! কয়েকটা হাড় অবশ্য ভেঙে গেছে, তবে বেশিরভাগটাই এখনও অক্ষত। খাঁড়িটা কিকার চেনা। এখান থেকে সাসাকো ঘণ্টা দুয়েকের পথ। তবে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটাপথ পরিহার করে, নদীপথেই গাঁয়ে ফিরবে বলে ঠিক করল সে। এতে সময় খানিকটা বেশি লাগবে, তবে শরীরের উপর দিয়ে ধকলটা অনেকখানি কমে যাবে। সারা দেহে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে, বুনো পথে হাঁটার ইচ্ছে মোটেও নেই তার। পাকা বাঁশ দিয়ে কোনমতে চলনসই একটা ভেলা বানাল কিকা। পেটের খিদে মেটাল বুনো জাম দিয়ে। তারপর আয়েশ করে নদীর জলে ভেলা ভাসাল। ভাটির পথ, পরিশ্রম বলতে গেলে নেই-ই। হালটা কেবল ধরে রাখতে হবে তাকে।
সাসাকোয় ফিরে বাওয়াদের উষ্ণ অভ্যর্থনায় সিক্ত হলো কিকা। দেবদূত নিজেও তাকে অভিনন্দন জানাতে এগিয়ে এলেন। তাঁকে দেখে মনে হলো, ভীষণ অবাক হয়েছেন। সত্যি-সত্যিই পবিত্র গুহা থেকে কঙ্কালটা উদ্ধার করতে পারবে কিকা, এতটা বোধকরি কখনওই আশা করেননি তিনি। পথের বিপদগুলো সম্পর্কে অন্য যে কারও চেয়ে তাঁর জ্ঞান বেশি বৈ কম নয়।
দেবদূতের নির্দেশে মাটির উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল সাসাকোর সব মহিলা ও শিশুরা। গায়ে গা ঠেকিয়ে পাশাপাশি শুয়েছে সবাই, তৈরি করেছে একধরনের মানব গালিচা। এর উপর দিয়েই টামবারানের দরজা পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে কিকাকে, সমর্পণ করতে হবে বয়ে আনা পূর্বপুরুষের দেহপিঞ্জর। এটা বিশেষ একধরনের সম্মান। মৃতের জন্য এবং কিকার নিজের জন্য। ·
মন সায় না দিলেও প্রথাটা পালন করতে হবে তাকে, প্রত্যাখ্যানের কোন সুযোগ নেই।
যথাসম্ভব দ্রুত গালিচাটা অতিক্রম করল কিকা। শিশুদের শরীর এড়িয়ে গেছে সে, কেবল মহিলাদের দেহেই পা রেখেছে। এখনও পূর্ণবয়স্ক পুরুষ হয়ে ওঠেনি সে, ওজনও খুব একটা বেশি নয়। তাই মহিলাদের খুব বেশি কষ্ট হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না।
আট
সেদিন বিকেলে পরবর্তী কাজ বুঝিয়ে দেয়ার জন্য কিকাকে কাছে ডাকলেন দেবদূত। শান্তস্বরে জানালেন, কী করতে হবে তাকে।
শুনতে-শুনতে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ল কিকা। কোন ফল পাবে না জেনেও, অনেক কাকুতি-মিনতি করল দেবদূতের কাছে। সমস্তটাই শেষমেশ অরণ্যে রোদন হলো, সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন না দেবদূত।
ভগ্নপ্রায় হৃদয় নিয়েই পাশের গ্রাম মারাকোর উদ্দেশে যাত্রা করল কিকা।
তাকে এবার মারাকোর সর্দার ভীমনাকে খুন করতে হবে!
নয়
মারাকোয় পৌঁছে ভীমনার কুঁড়েতে গেল না কিকা, গেল জুরু বুড়োর ডেরায়।
আশপাশের সমস্ত গাঁয়ের বাওয়ারা জুরুকে একনামে চেনে। সবার চোখে পরম সম্মানিত একজন মানুষ সে। জীবিত বাওয়াদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ, সবচেয়ে জ্ঞানী। যে কোন মুশকিল কেবল জুরুই আসান করতে পারে, বাওয়া সমাজে খুবই প্রচলিত একটা কথা এটা।
জুরুর সামনে গিয়ে জড়সড় হয়ে বসল কিকা, হাত রাখল বুড়োর পায়ের কনিষ্ঠ আঙুলে। বাওয়া সমাজে জ্ঞানীদেরকে এভাবেই সম্মান জানানো হয়।
‘কী হে, সর্দার? তোমার মাথার মুকুট কোথায়? সর্দারকে কি তার মুকুট ছাড়া মানায়?’
‘আমি এখনও সর্দার হইনি, জুরু। ভীষণ বিপদে পড়ে তোমার সাহায্য চাইতে এসেছি।’
‘অন্য কেউ সর্দার হতে চাইছে? কে সে? তোমাদের ওঝা কী বলে এই ব্যাপারে?’
‘ওসব কিছু নয়, অন্য ব্যাপার। আশা করি, তোমার কাছ থেকে সঠিক পরামর্শই পাব।’
‘তোমার সমস্যাটা আগে শুনতে তো দাও।’
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল কিকা। বুঝতে পারছে না ঠিক কীভাবে শুরু করবে। তারপর দ্বিধা কাটিয়ে উঠে বলতে শুরু করল।
‘মনে করো, পূর্বপুরুষদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার একটা সুযোগ এসেছে আমার সামনে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে নিজের জাতভাই কাউকে হত্যা করতে হবে আমার। এখন আমি যদি কাজটা না করে পালিয়ে যাই, পূর্বসুরিরা খুব কি অসন্তুষ্ট হবে আমার উপর? তাদের অভিশাপে আমাকে কি অনন্তকাল নরকের আগুনে জ্বলতে হবে?’
নড়েচড়ে বসল জুরু। তার চোখের তারায় স্পষ্ট আগ্রহ ফুটে আছে।
‘পুরো ঘটনাটা খুলে বলো, খোকা। কেন যেন মনে হচ্ছে, ভয়ানক কোন জালে জড়িয়ে পড়েছ তুমি।’
জুরুকে সবকথা বলতে কোন আপত্তি নেই কিকার। জানে, শতভাগ বিশ্বস্ত সামনের মানুষটা। সারাজীবন কারও বিশ্বাসের অমর্যাদা সে করেনি, কখনও করবেও না। কেবল নিজের চারিত্রিক গুণেই সমস্ত বাওয়াদের প্রিয় পাত্রে পরিণত হতে পেরেছে সে।
একে-একে তাকে সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করতে লাগল কিকা। দেবদূত আসার পর থেকে এ পর্যন্ত যা-যা হয়েছে, তার কোন কিছুই বাদ দিল না সে। শেষটায় যোগ করল মারাকোর সর্দার ভীমনাকে হত্যা করার আদেশের কথা।
বাওয়াদের ভবিষ্যৎ শান্তি-সমৃদ্ধির জন্য ভীমনাকে প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখছেন দেবরাজ জারাল। দেবরাজের আরাধনা থেকে বাওয়াদের দূরে সরাতে ভীমনার পূর্বপুরুষরাই মূলত দায়ী, এটাও তাকে জানিয়েছেন দেবদূত। তাই দেবলোক থেকেই ঘোষণা করা হয়েছে ভীমনার মৃত্যুদণ্ড।
পুরোটা শুনতে-শুনতে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল জুরুর। বেশ কিছুক্ষণ চোখ মুদে রইল সে। ঘন-ঘন শ্বাস নিচ্ছে। প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছে বুড়ো, বাইরেও সেটা চাপা থাকছে না।
‘দেবদূতের কাঁধে দুটো কুফলু পাখির বাচ্চা আছে নাকি? দেখেছ কখনও?’ আচমকা জানতে চাইল জুরু।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছে তো। কিন্তু তুমি জানলে কেমন করে?’
বেশ অবাক হলো কিকা। দেবদূতের কোন বর্ণনা সে দেয়নি জুরুকে, ঘটনাগুলোই কেবল সবিস্তারে বলেছে এতক্ষণ।
‘চুল ধূসর? অনেক লম্বা?’
‘হ্যাঁ।’
‘দু’পায়ে সোনার বেড়ি পরা?’
‘হ্যাঁ।’
‘তার কাছে রঙিন একটা খুলি আছে?’
‘আছে। কিন্তু তুমি এতসব কীভাবে বলতে পারছ? সাসাকো থেকে আমার আগে কেউ কি এসেছিল এখানে?’
আবারও চোখ বন্ধ করল জুরু। ‘কেউ আসেনি, কিকা। অনেক আগে থেকেই একে চিনি আমি। তবে চর্মচক্ষু দিয়ে দেখিনি কখনও, কেবল তার গল্প শুনেছি।’
‘এই তাহলে ব্যাপার! দেবদূত সম্পর্কেও জ্ঞান রাখো তুমি! সত্যিই তুমি জ্ঞানের ভাণ্ডার, জুরু। এখন আমাকে বলে দাও, কী করা উচিত আমার। ভীমনাকে খুন করব? নাকি পালিয়ে যাব দূরে কোথাও?’
‘লোকটা কোন দেবদূত নয়, কিকা। ভয়ঙ্কর শক্তিশালী এক জাদুকর, একটা রাক্ষস!’
পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে গেল কিকা। এ কী বলছে জুরু? নাকি শুনতে ভুল হলো তার?
আবারও মুখ খুলল জুরু, ‘কয়েকশো বছর পর-পর সে আসে বাওয়া অঞ্চলে। কেউ জানে না তার সত্যিকারের বয়স কত। হাজার হতে পারে, তারচেয়ে বেশিও হতে পারে। তার জাদুর ক্ষমতা অসীম। জাদুবলেই নিজেকে বছরের পর বছর বাঁচিয়ে রাখার শক্তি পেয়েছে সে।
‘সে একটা রাক্ষস, কারণ কেবল মানুষকেই খাবার হিসেবে গণ্য করে সে, অন্য কিছু মুখে রোচে না তার। পাতাল নদীতে কিংবা পবিত্র গুহায়, যত নরকঙ্কাল তুমি দেখেছ, তার বেশিরভাগই সম্ভবত ওই পিশাচের হাতেই মারা পড়েছে।
‘কুফলুরা তার পোষা। কারণ ওদেরকে খাবারের জোগান দেয় সে-মানুষ! কুমিররাও একই কারণে তার আজ্ঞাবহ। আমাদের ধারণার চাইতেও অনেক- অনেক বেশি তার ক্ষমতার পরিধি।’
শূন্য দৃষ্টিতে জুরুর দিকে তাকিয়ে রইল কিকা। পুরোপুরি নির্বাক।
আবারও বলতে শুরু করল জুরু, ‘সাসাকোয় পা দিয়েই সে কৌশলে তোমাদের ওঝাকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দিয়েছে। সরিয়ে দিতে চেয়েছিল তোমাকেও, পবিত্র গুহার বিপদসংকুল পথে একাকী পাঠিয়ে। কিন্তু দেবতাদের আশীর্বাদে বহাল তবিয়তে ফিরে এলে তুমি। বিফলে গেল তার পরিকল্পনা।
‘কিন্তু নতুন ছকে জাল ফেলল রাক্ষসটা। তোমাকে দিয়েই ভীমনাকে মারার পরিকল্পনা করল সে। অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মত। সুবিধামত সময়ে তোমাকেও কোন এক ছুতোয় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করত সে। তারপর অভিভাবকহীন দুটো গাঁয়ে নির্বিবাদে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করত। সবক’টা মানুষ খাওয়ার আগ পর্যন্ত নড়ার নামও মুখে আনত না।’
বজ্রাহতের মতই ঠায় বসে রইল কিকা। এরচেয়ে বেশি বিস্ময়কর কিছু এ জীবনে শোনেনি সে। কোনমতে বলল, ‘কিন্তু সাসাকোয় আসার পর আজ অবধি একজন মানুষও খায়নি সে। ক’দিন খাবার ছাড়া কাটাতে পারে সে?’
‘কে বলেছে খায়নি? তোমাদের ওঝার লাশটা কোথায়?’
চট করে মনে পড়ল কিকার। ওঝার লাশটা নিজেই টামবারানের ভিতরে নিয়ে গিয়েছিল জাদুকর। আর রাতে টামবারানের ভিতরেই থাকে সে, একা।
ওঝার জন্য বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠল কিকার। কী নিদারুণ কৌশলে তাকে খুন করিয়েছে রাক্ষসটা!
চট করে উঠে দাঁড়াল কিকা। রাগে বিষধর সাপের মতই ফুঁসছে সে।
‘নিজ হাতে শয়তানটাকে হত্যা করব আমি, জুরু। যদি ব্যর্থ হই, সবার সামনে তার মুখোশ উন্মোচন করার জন্য তুমি তো রইলে।’
ঘর থেকে বেরোতে উদ্যত হলো কিকা।
‘তাকে কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে মারতে পারবে না, কিকা,’ পিছন থেকে বলে উঠল বুড়ো।
কাঁধের উপর দিয়ে ফিরে তাকাল কিকা। ‘কেন?’
‘কারণ তার প্রাণ নিজের দেহপিঞ্জরে রাখে না রাক্ষসটা, ওটা বন্দি থাকে সাথের রঙিন খুলিটার ভিতর। ওটাই তার সমস্ত শক্তির আধার। তাকে মারতে হলে, ওটাকে নষ্ট করতে হবে তোমার।’
মুখে হাসি ফুটল কিকার। ‘অনেক ধন্যবাদ, জ্ঞানী বুড়ো। যে কোন মুশকিল কেবল জুরুই আসান করতে পারে।’
ও বেরিয়ে যাবার পর তার সুরক্ষার জন্য প্রার্থনায় বসল জুরু। ভাবছে, বাবার মতই সাহসী হয়েছে ছেলেটা।
দশ
টামবারানের দরজায় কোন হুড়কো থাকে না, তাই ঢুকতে কোন বেগ পেতে হলো না কিকার। নিশুতি রাত, পুরো সাসাকো গভীর ঘুমে অচেতন। অন্য সবার মত জাদুকরও বেঘোরে ঘুমোচ্ছে একটা পাটাতনে শুয়ে। টামবারানের এক কোণে একটা মশাল জ্বলছে। সেই আলোয় ঘরের বেশিরভাগটাই আলোকিত হয়ে আছে। একপাশে থরে-থরে সাজানো খুলিগুলোর দিকে একপলক তাকাল কিকা পরক্ষণেই তাকাল ওঝার আধখাওয়া লাশটার দিকে। ইতোমধ্যেই অনেকখানি সাবাড় করে ফেলেছে রাক্ষসটা।
অবদমিত ক্রোধে শরীরটা বারকয়েক কেঁপে উঠল কিকার। চারপাশে তাকিয়ে রঙচঙে খুলিটা খুঁজতে শুরু করল সে।
সহজেই পাওয়া গেল ওটাকে, জাদুকরের মাথার কাছে একটা তাকিয়ার উপর বসে আছে। অশুভ একটা অবয়ব। দেখেই রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল কিকার।
দ্রুতপায়ে ওটার দিকে এগিয়ে গেল সে। হাতে ধরে রেখেছে মস্ত একখানা পাথর। শেষবারের মত জাদুকরের মুখের দিকে একবার তাকাল কিকা। তারপর দেহের সর্বশক্তি দিয়ে পাথরটা নামিয়ে আনল খুলিটার উপর।
অনুভব করল, হাতের তলায় পুরোপুরি গুঁড়িয়ে গেছে ওটা। পাটাতনে শুয়ে থাকা জাদুকরের মাথাটাকেও একই সঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হতে দেখে মনে অদ্ভুত এক শান্তি পেল কিকা।
শেষ অবধি রাক্ষসটাকে শাস্তি দিতে পেরেছে সে। অবসান হয়েছে হাজার বছর ধরে চলতে থাকা মানুষ শিকারের খেলা।
ভোরের আগেই একখানা নৌকায় চেপে সাসাকো ছাড়ল কিকা! গাঁয়ের সীমানা পেরোবার সময় হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল সে। বার-বার ফিরে-ফিরে তাকাল ঝাপসা চোখে।
প্রাণ বাঁচানোর তাগিদেই সাসাকো ছেড়ে পালাতে হচ্ছে তাকে। হাতেনাতে ধরতে পারলে নির্ঘাত তাকে প্রাণদণ্ড দেবে বাওয়ারা।
কারণ শাশ্বতকালের নিয়ম ভেঙেছে সে, রাতের বেলায় প্রাণী হত্যা করেছে সাসাকোর সীমানায়! এক্ষেত্রে শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ করে না বাওয়ারা। পরম শত্রুকে হত্যা করলেও বাঁচার কোন উপায় নেই। প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, সবার ক্ষেত্রে একই নিয়ম।
যা গাঁয়ের সর্দারের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
এটাই আইন।
এটাই রীতি।
.
হয়তো কোন এক সময় এই রীতিতে পরিবর্তন আসবে। বাস্তবতা বুঝতে শিখবে বাওয়ারা, শত্রু-মিত্র চিনতে শিখবে।
তবে ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যাবে।
সিংহ হৃদয়ের অধিকারী, অকুতোভয় কিকাকে ফেরারী হয়েই বাকি জীবনটা পার করতে হবে!
ক্ষুধানল
যে বয়সে বাচ্চারা নিত্য-নতুন খেলনার সাথে পরিচিত হয়, মানুকে সে বয়সে প্রতি পদে-পদে মোলাকাত করতে হয়েছে ‘অভাব’ নামের বিচ্ছিরি একটা বিষয়ের সাথে। যখন থেকে বুঝতে শিখেছে, তখন থেকেই খেয়াল করেছে মানু, ত্রিভুবনে অভাবের চেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী আর দ্বিতীয়টি নেই!
কত বন্ধু-বান্ধব তাকে সামান্য ছুতোয় ছেড়ে চলে গেল, কতজন তাকে অস্পৃশ্য মনে করে দূরে-দূরে রইল, কিন্তু কোন অছিলায়ই এই অভাব তাকে এক মুহূর্তের জন্যও একলা করেনি; নিতান্ত আপনজনের মত পরম মমতায় জড়িয়ে রেখেছে প্রতিটা ক্ষণ। মানুর আসল নাম মাঈনুদ্দীন, মাঈনুদ্দীন আহমেদ। কিন্তু লোকের মুখে-মুখে কখন যে নামটা মাঈনুদ্দীন থেকে মানু হয়ে গেছে, সেটা সে নিজেও জানে না।
ছোটলোকের ছেলেকে আসল নামে ডাকার জন্য কার এত ঠেকা পড়েছে? তার মা অবশ্য তাকে পুরো নামেই ডাকে, তবে তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। লোকের কাছে মানু নামটাই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, মাঈনুদ্দীন নয়।
তার বদ দাদীটা তো এমনকী মানুও ডাকে না তাকে; সে ডাকে-মাইন্যা! ‘কই গেলি, মাইন্যা? কনে গেলি রে, হারামির পুলা?’-বলে যখন চেঁচায় বুড়িটা, রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে যায় মানুর।
এমন করে কেউ কারও একমাত্র নাতিকে ডাকে?
মানু মাঝে-মাঝে ভাবে, হতচ্ছাড়া বুড়িটাকে মোড়ের আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়ে এলে কেমন হয়? দু’দিন পর-পর ময়লা নিতে আসে সিটি কর্পোরেশনের নোংরা ট্রাকটা। অন্য আবর্জনার সাথে ওরা যদি বুড়িকেও নিয়ে যেত, বেশ হত কিন্তু। বাড়ির সবাই তাহলে শান্তিমতন বাকি জীবনটা কাটাতে পারত।
শুধু মানু একা নয়, ঘরের সবাইকেই ত্যক্ত করে বুড়িটা; কাউকে রেহাই দেয় না। সর্ব সাকল্যে জনা পাঁচেক মানুষ নিয়ে মানুর সংসার। মানু আর তার ছোটবোন টুনি, বুড়ো দাদা-দাদী আর মা।
বাবা নামের একজন মানুষও এককালে এই পরিবারের অংশ ছিল, সংসারে এখনকার মত অভাব ছিল না তখন; এসব কথা রূপকথা মনে হয় মানুর কাছে, বাস্তব নয়। তাকে অবশ্য এটা নিয়ে দোষারোপ করারও কোন উপায় নেই। শহরে কেরানীর কাজ করা তার বাবা মাসে কেবল একদিনই ছুটি পেত। ওই একদিনের স্মৃতি, ছোট একটা বাচ্চার মনে কতটুকুই বা আর দাগ কাটে?
রোড অ্যাক্সিডেন্টে লোকটা যখন মারা গেল, মানুর বয়স মোটে দেড়; টুনি তখনও তার মায়ের পেটে।
বাবার উপর প্রায়ই খুব অভিমান হয় মানুর। কেন লোকটা অকালে ওদেরকে ফেলে চলে গেল এভাবে? কেন তার জায়গাটা স্বেচ্ছায় দখল করে নিল ‘অভাব’? কেন প্রতিটা দিন এতটা কষ্টে কাটে তাদের?
নিজের পছন্দসই সালন দিয়ে ভরপেট ভাত খেয়েছে, নিকট অতীতে এমন কোন স্মৃতি নেই মানুর। রোজই একবেলা করে অভুক্ত থাকতে হয় ওদের সবাইকে। বাকি দুই বেলা যেটুকু খাবার একজনের ভাগে জোটে, সেটাও এক রকম না জোটার মতই।
অবশ্য পরের বাড়িতে ঝি-গিরি করে কতটুকুই বা আর রোজগার করতে পারে মা? পাঁচটা মুখে দিনের পর দিন অন্ন জোগানো কি সহজ কথা?
মা’কে লোকে মন্দ বলে। অসতী-ছিনাল বলে গালি দেয়।
শব্দগুলোর মানে বোঝে না মানু; তবে এটুকু ঠিকই বোঝে যে, ওই নিষ্ঠুর শব্দগুলো মায়ের অন্তরটাকে চিরে ফালা ফালা করে দেয়। না হলে কি আর রোজ রাতে লুকিয়ে-লুকিয়ে কাঁদত মা?
যে মানুষটা দিন-রাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে চারটে অসহায় প্রাণীকে বাঁচিয়ে রেখেছে, কেমন করে খারাপ মানুষ হয় সে? বোঝে না মানু।
মায়ের দুঃখে বুক ফেটে যায় তার। ইচ্ছে হয়…ইচ্ছে হয়, মরে যেতে। তাতে অন্তত একটা ক্ষুধার্ত মুখ তো কমবে, তাই না? মায়ের যন্ত্রণা কি কিছুটা হলেও লাঘব হবে না? সত্যি-সত্যিই বেশ কয়েকবার মরার চেষ্টা করেছে মানু। কতবার যে ওদের বাড়ির পাশের রেললাইনটায় গিয়ে আড়াআড়িভাবে শুয়ে থেকেছে ও, তার কোন ইয়ত্তা নেই। একটা ট্রেন তীব্র গতিতে এগিয়ে যাবে, সঙ্গে-সঙ্গে কাটা পড়বে মানুর শীর্ণ দেহটা। আর তাতেই এই পৃথিবীর তাবৎ দুঃখ-কষ্ট থেকে এক লহমায় মুক্তি মিলবে। ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করাটা যে কতটা কঠিন, সেটা কি আদতেই কেউ কখনও অনুধাবন করতে পারবে?
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর লাইনের উপর শুয়ে থাকা হয় না মানুর। ট্রেনের হুইসেল শোনা মাত্রই বার-বার তড়িঘড়ি করে লাইন ছেড়ে পালিয়ে আসে সে।
ভয় হয়; মরণের পর যদি আরও বেশি কষ্ট ভোগ করতে হয়, তখন?
এখানে তো তাও মা আছে, টুনি আছে, দাদা আছে। ওপারে একা-একা কেমন করে দিন কাটাবে সে?
দাদা মোতালেব মিয়া ভীষণ ভালবাসে ওদের দু’জনকে। সকাল-সকাল বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায় লোকটা। কোথায় যায়, কে জানে! হয়তো ভিক্ষেই করে সে। তবে চেনা ভিখারি বলে পয়সা-কড়ি খুব একটা মেলে না; দিতে চায় না লোকে।
তারপরও দিন শেষে যে কয়টা টাকা পাওয়া যায়, তা দিয়েই সাধ্যমত সদাই- পাতি নিয়ে ফেরে সে। কখনও আধ সের চাল, কখনও চারটে মুলো, কখনওবা পাতলা পলিথিনে ভরে খানিকটা সয়াবিন তেল। খালি হাতে বাড়ি ফেরার কোন নজির নেই তার।
মাঝে-মধ্যে মানু-টুনির জন্য দুটো সস্তা লালরঙা চকোলেট আনে বুড়ো। ওতেই ভীষণ খুশি হয় ওরা, হল্লা করে গোটা বাড়ি মাথায় তোলে।
আর তাতেই মোতালেব মিয়ার উপহার আনার খবরটা ফাঁস হয়ে যায়; বুড়ি সাবেরা খাতুনের কাছেও আর সেটা গোপন থাকে না।
স্বামীর এই ব্যাপারটা একদমই পছন্দ করে না সাবেরা খাতুন। দু’বেলা যাদের কপালে ভাত জোটে না, নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায়; তাদের আবার কীসের মণ্ডা-মিঠাইয়ের বায়না?
শরীরের ডান পাশটা অবশ সাবেরার, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না সে। তবে দেহে জোরের ঘাটতি থাকলেও গলার জোরটা এখনও বহাল তবিয়তেই আছে। ক্যানক্যানে গলায় চেঁচাতে শুরু করে সে, ‘আরে ও, বুইড়া হারামি, আবার বুঝি তুই লজেস আনসস্? লজেস…? কই রে, মিনসে, আমার বাতের দুইডা বড়ি তো কোনদিন তোর হাতে ওড়ে না! ডেলি-ডেলি লজেস ওডে ক্যামনে? কম দিসিরে তোরে আমি? কোনদিন কম পাইসস্ আমার কাছ থাইকা?’ কাশির দমকে খানিকটা হয়তো বিরতি নিতে বাধ্য হয় সে, তারপর আবার নতুন উদ্যমে শুরু করে।
‘বয়সকালে তো রক্ত চুইষ্যা খাইসস্ আমার। অহন এত বিতিষ্ণা ক্যান? হারামি কোনহানকার…মরস না ক্যান তুই? আজরাইল তোরে চউক্ষে দেহে না? নাকি আমার মরণ নিজের চউক্ষে না দেখলে কইলজা ঠাণ্ডা হইব না তোর? মনের খায়েশ কিতা, খুইল্লা কস্ না ক্যারে, হারামজাদা?’
এরপরই উচ্চস্বরে বিলাপ শুরু করে সাবেরা খাতুন। তার বাবার বাড়ি থেকে এযাবৎকালে কী-কী এনেছে সে মোতালেবের সংসারে, পাড়া-প্রতিবেশী কারোরই আর জানার বাকি নেই সেটা। ইনিয়ে-বিনিয়ে সুরেলা কান্নায় বহুবার বলা কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করে সাবেরা।
চুপসানো মুখ নিয়ে ঘরের দাওয়ায় নিশ্চুপ বসে থাকে মোতালেব মিয়া, স্ত্রীর কথার কোন প্রতিবাদ করে না। কী লাভ?
বিনাবাক্যব্যয়ে কথাগুলো হজম করে নেয়াই মঙ্গলজনক। কিছু বলতে গিয়ে অযথা নিজের চোদ্দ গোষ্ঠীকে গাল খাওয়ানোর কোন মানে হয় না। সাবেরার সঙ্গে বচসা করে জিততে পারে, এমন মানুষ ইহজগতে খুঁজে পাওয়া ভার।
দাদীর গালাগাল তবু সহ্য হয়, কিন্তু দাদার গোমড়া মুখটা কিছুতেই সহ্য হয় না মানুর। কবে মরবে বুড়িটা? কবে?
বাতের ব্যথায় ঠিকমত ঘুমুতে পারে না সাবেরা খাতুন, প্রায় সারাটা রাতই জেগে কাটাতে হয় তাকে। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে ককায়, আর নিচুস্বরে একনাগাড়ে বিলাপ করে। কাকে যে গালাগাল দেয়, খোদা মালুম!
কখনও-কখনও মাঝরাতে প্রকৃতির ডাকে ঘুম ভেঙে গেলে, সন্তর্পণে দাদীর ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় মানু। দেখতে চায়, অক্কা পেয়েছে কিনা বুড়িটা।
কিন্তু কী করে যেন প্রতিবারই ব্যাপারটা টের পেয়ে যায় সাবেরা খাতুন। মানুকে দেখেই আঁতকে ওঠে সে।
‘কী রে, হারামজাদা? এত রাইতে এইহানে কী করস্? খিদা লাগসে? খাইবি আমারে? খাইবি..?
‘তোর মা যেমুন কচি পুলাগুলারে চিবাইয়া-চিবাইয়া খায়, তেমুন কইরা তুইও কি খাইবার চাস আমারে?
‘নে, খা; খা কইলাম, হারামজাদা। ডাইন পাওডা আগে খা। কাইন্যা আঙুলডা দিয়া শুরু কর। নাকি বুইড়া আঙুলডা আগে খাইবি?
‘আইচ্ছা থাউক, পাও বাদ দে। ডাইন হাতড়া খা। কুড়মুড় কইরা হাড্ডিগুলান চিবাইয়া-চিবাইয়া খা। মজা পাইবি।
‘নাকি অইন্য মজা চাস? অইন্য কিছু খাইবি? কত বড় হইসস্ রে তুই, খা…র পুলা?’
কোন জবাব দেয় না মানু, এক অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দাদীর দিকে। খোলা জানালা গলে অবাধে ঢুকে পড়া চাঁদের আলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিছানার একপাশে। গাছের পাতার দীর্ঘ ছায়াগুলো তির-তির করে কাঁপে মৃদু বাতাসে। কাছে-ধারে কোথাও অবিকল মানুষের গলায় কেঁদে ওঠে একটা রোমশ হুলো বেড়াল। অকারণেই গায়ে কাঁটা দেয় মানুর। কলিমের মায়ের কাছে শোনা ভয়ঙ্কর সব ভূতের গল্পগুলো বার-বার উঁকি দেয় মনের কোণে। শাঁকচুন্নি, পেত্নী, স্কন্ধকাটা…আরও কত জানা-অজানা অশরীরীরা ছড়িয়ে আছে চারপাশে। যারা মড়া পছন্দ করে, আধমরা পছন্দ করে। ওদের কেউ যদি আসত একদিন, আর বজ্জাত দাদীটাকে মেরে রেখে যেত…
মানুর চোখের দিকে তাকিয়ে সাবেরা খাতুনের বুকটা ধক্ করে ওঠে। কীসের যেন অশুভ একটা ছায়া ছেলেটার দু’চোখে; বড্ড ভয় করে। নিরুপায় হয়ে উচ্চস্বরে চেঁচাতে শুরু করে সাবেরা, ‘ও, বউ…কই গেলি? কই গেলিরে, হারামজাদী? তোর লোচ্চা পুলারে লইয়া যা এইহান থাইকা। শিগির লইয়া যা কইলাম। অক্ষণ লইয়া যা। হারামজাদা আমারে খাইয়া ফালাইব। হাছাই একদিন খাইয়া ফালাইব আমারে বেজন্মাডা। লইয়া যা হেতেরে। লইয়া যা…’
চোখভরা কাঁচা ঘুম নিয়ে টলতে টলতে বিছানা ছেড়ে উঠে আসে মানুর মা। জোর করে মানুকে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় আবার। কখনও-কখনও উপরি হিসেবে হালকা চড়-চাপড়ও জোটে মানুর কপালে। পিছন থেকে তীক্ষ্ণ বাণের মত ধেয়ে আসে সাবেরার চিৎকার, ‘অর চউখগুলার দিকে একবার চাইয়া দেখ, বউ। দুইন্যার খিদা হারামজাদার চউক্ষে। সবকিছু যেন গিল্যা খাইবার চায় হারামির পুলা।’
ছেলের চোখের দিকে তাকানোর কোন প্রবৃত্তি হয় না মানুর মা’র। ঘুমে তার নিজের চোখই ভেঙে আসছে; রাত-বিরেতে এসব হাঙ্গামা সহ্য হয়?
‘যন্ত্রণা দিয়েন না তো, আম্মা। ঘুমান। সারা জীবন বহুত যন্ত্রণা দিসেন, এইবার একটু ক্ষান্ত দেন। নিজেও শান্তিতে থাকেন, আমাগোরেও একটু শান্তিতে থাকবার দেন।’
সাবেরা খাতুন মোটেও চুপ থাকার বান্দা নয়। শান্ত হওয়ার বদলে উল্টো তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে সে। ‘দেমাগ দেহাইস না, মাগী। দেমাগ দেহাইস না আমার লগে। যন্ত্রণা দেই আমি, না? যন্ত্রণা দেই তোগোরে? তোর গতর বেচা টেকার কপালে উশটা মারি আমি। কাইল থাইকা আর খামুই না তোর ভাত। গুষ্টি কিলাই তোর দেমাগের।’
তার কথায় পাত্তা না দিয়ে একখানা তেল চিটচিটে বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে মানুর মা। তার ভালই জানা আছে, দুপুর গড়ানোর আগেই ভাতের’ জন্য চেঁচামেচি জুড়ে দেবে সাবেরা খাতুন।
.
শহরতলীর সবচেয়ে ঘিঞ্জি এলাকায় মানুদের বসবাস। গায়ে-গা ঠেকিয়ে সারিবদ্ধভাবে ঘরগুলো দাঁড়িয়ে আছে একের পর এক। সীমানা প্রাচীর কিংবা আঙিনার বালাই নেই, ঘর থেকে বেরিয়ে দুটো কদম এগুলেই সদর রাস্তা।
একসারি কুঁড়েঘরের মধ্যেও দুটো ঘর বেশ আলাদা করেই চোখে পড়ে। দুঃখ-দারিদ্র্যের ছাপ বেশ প্রকট হয়ে ফুটে আছে ও দুটোর অবয়বে। বাইরের বেহাল দশা থেকেই ভিতরে বাসিন্দাদের শোচনীয় অর্থনৈতিক অবস্থাটা স্পষ্ট ঠাহর করা যায়। অবধারিতভাবে এ দুটো ঘরের একটা মানুদের; অন্যটায় বসবাস করে মানুর প্রাণের বন্ধু জাফরের পরিবার।
জাফর, মানুর সমবয়সী; সব কাজের দোসর। দু’জনে সারাদিন একসঙ্গে ডাংগুলি কিংবা গোল্লাছুট খেলে; কখনওবা অদূরের শীর্ণ নোংরা খালটায় গিয়ে লাফ-ঝাঁপ দেয়। আর গুজুর-গুজুর গল্প করে; ভাতের গল্প, খেলনার গল্প।
জাফরেরও বাবা নেই। তবে মরেনি লোকটা, পালিয়ে গেছে। শহরে গিয়ে আরেকটা বিয়ে করে আবার সংসার পেতেছে। উড়ো খবর পাওয়া যায়, নতুন সংসারে তার দুটো সন্তানও আছে।
সেই যে এক আশ্বিন মাসে গায়েব হয়ে গেল, এরপর আর একটিবারের জন্যও ফিরে আসেনি লোকটা। জাফররা বেঁচে আছে কি মারা গেছে, কিছুতেই যেন কিছু যায়-আসে না তার!
গার্মেন্টসে কাজ করে ছয় সদস্যের পরিবারের দেখভাল করে জাফরের মা। মানুর দাদা-দাদীর পরিবর্তে জাফরের আছে নানা-নানী। সম্পর্কটা আলাদা বটে, তবে চরিত্রগুলোর মধ্যে খুব একটা ফারাক চোখে পড়ে না।
খিটখিটে মেজাজের ওই বুড়ো-বুড়িও রাত-দিন হাড় জ্বালিয়ে মারে জাফরকে। একে-অন্যকে সান্ত্বনা দেয় মানু-জাফর, দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়।
দুটো আধপেটা গল্প ওদের অজান্তেই মিলেমিশে একাকার হয়ে ভরপেটা হয়ে যায়।
.
আপাতদৃষ্টিতে সাদামাঠা একটা সকাল, আচমকা ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠল জাফরের জীবনে। দীর্ঘকাল ক্ষয়রোগে ভুগে সেই সকালে মারা গেল তার বুড়ো থুথুড়ে নানী। মহিলার মানসিক অত্যাচার থেকে মুক্তিটাই যথেষ্ট ছিল জাফরের জন্য; উপরন্তু এই উপলক্ষে অভাবনীয় একটা উপহার পেল সে খাবার!
মরা বাড়িতে প্রথম চারদিন চুলা জ্বালানো নিষেধ, এমন একটা কুসংস্কার প্রচলিত আছে সমাজে। ওই দিনগুলোতে আশপাশের প্রতিবেশীরাই তিনবেলার খাবার পৌঁছে দেয় শোকসন্তপ্ত পরিবারটিতে।
মৃত্যুর মত বিশাল একটা ব্যাপারকে সামনে রেখে ক্ষুৎপিপাসা নিবারণের তুচ্ছ আয়োজনে ব্যস্ত থাকাটা মানায় না মৃতের স্বজনদের; এহেন একটা ধারণা থেকেই হয়তো গড়ে উঠেছে এই সামাজিক প্রথাটা।
সে যা-ই হোক, শোকের পরিবর্তে সুখের সাগরেই নিমজ্জিত হলো জাফরের পরিবারের সবক’টা মানুষ!
নিত্য যাদের অভুক্ত থাকতে হয়, তাদের যদি ভাল-মন্দ পদ দিয়ে তিনবেলার আহার জোটে, ব্যাপারটা কি আদতেই ভীষণ আনন্দের নয়?
তবে বাইরের মানুষজনের সামনে অবশ্য শোকের অভিনয়টাই অব্যাহত রাখল ওরা। কারণ অভিনয় করেই টিকে থাকতে হয় মানব-সমাজে। মানুষ সেটাই প্রকাশ করে, যা করা উচিত; সত্যিটা নয়।
চাকচিক্যময় এই সমাজ ব্যবস্থার পুরোটাই আসলে মেকি; ফাঁপা।
.
জীবনে প্রথমবারের মত বন্ধুর সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠল মানু। ওদের মধ্যকার বন্ধুত্বের অটুট বন্ধনেও বুঝি খানিকটা ফাটল ধরল। রোজ-রোজ জাফরের মুখে সুস্বাদু খাবারের গল্প কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়?
বাড়ির বাইরে যাওয়া একরকম বন্ধই করে দিল মানু। দিনরাত ঘরের দাওয়ায় গোমড়া মুখে বসে থাকে, আর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সাবেরা খাতুনের ঘরের দিকে। বুড়িটা এখনও মরে না কেন? বেঁচে থেকে কী লাভ হচ্ছে তার? কেন এখনও বুড়ো কচ্ছপের মত মাটি কামড়ে পড়ে আছে সে?
মানুর প্রতি ভয়টা আগের চেয়েও বহুগুণে বেড়ে গেছে সাবেরা খাতুনের। মানুকে দেখলেই সারা শরীর কেঁপে ওঠে তার। আগের মত কারণে-অকারণে আর মানুকে গালমন্দ করে না সে। তবে আপনমনে কী যেন বিড় বিড় করে সারাক্ষণ।
মানুর সাথে চোখাচোখি হলেই আঁতকে ওঠে, চটজলদি চোখ সরিয়ে নেয়। ছেলেটার চোখে রাজ্যের ক্ষুধা; তাকিয়ে থাকতে ভীষণ অস্বস্তি লাগে।
আগে দিনের বেলায় অন্তত খানিকটা ঘুম হত তার, এখন আর সেটুকুও হয় না। সর্বক্ষণ অজানা একটা তীব্র আতঙ্ক গ্রাস করে রাখে তাকে।
জাফরের নানীর মৃত্যুটা, তার শক্ত ভিতের অনেকখানি নাড়িয়ে দিয়েছে। প্রায়ই এখন অদ্ভুত একটা আওয়াজ শুনতে পায় সে। ওপারের ডাক; কেউ যেন তার নাম ধরে ফিসফিস করে ডেকে চলেছে অনবরত।
ছাতের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়েই এখন রাত পার করে সে। মাঝে-মাঝে তারস্বরে স্বামীকে ডাকে, ‘ওই, মোতালেব হারামজাদা। কই গেলি তুই? জানালাডা বন্ধ কইরা দিয়া যা কইলাম। ডর করে। তাগদা আয়, ডর করে আমার।
বারান্দায় কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে-থাকা মোতালেব মিয়া বিরক্ত মুখে এপাশ- ওপাশ করে। কিন্তু স্ত্রীর ডাকে সাড়া দেয় না।
সেই যে বিয়ের দিন থেকে সিন্দাবাদের রাক্ষসটার মত কাঁধে চড়ে বসেছে হারামজাদী, আজ অবধি আর নামানো যায়নি। কোন্ কুক্ষণে যে বিয়েটায় মত দিয়েছিল, এ নিয়ে আজও আফসোস হয় তার। এই দজ্জাল মহিলাকে বিয়ে না করলে, জীবনটা হয়তো অন্যরকম হতে পারত…
.
শেষতক অবশ্য সাবেরা খাতুনের সমস্ত সতর্কতা বিফলে যায়, বাস্তবতার কাছে হার মেনে নিতে হয় তাকে।
এক কাকডাকা ভোরে, মানুর মা’র বুকফাটা আর্তনাদে ভর করে খবর পৌঁছে যায় সবার কাছে, মারা গেছে সাবেরা খাতুন। কট্টর বুড়িটার চেঁচামেচি আর কখনও শোনা যাবে না এই মহল্লায়। দুপুর গড়ানোর আগেই শেষ হয়ে যায় দাফন-কাফনের সমস্ত ক্রিয়াকর্ম। যৎসামান্য যে কয়জন আত্মীয়-স্বজনের সমাগম হয়েছিল, বিকেল নাগাদ তারাও বিদায় নেয়। অনেক-অনেকদিন পর উপাদেয় তরিতরকারি দিয়ে সে রাতে ভাত জোটে মানুর কপালে।
বড়-বড় লোকমায় ভাত গেলে মানু, যেন দেরি করলেই যে কোন সময় হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে দুষ্প্রাপ্য খাবারগুলো! সস্নেহে টুনিকেও মুখে তুলে খাইয়ে দেয় সে।
মনে-মনে বলে, এত সহজ ভাত জোগাড় করা? এত্ত সহজ!
নিজেকে নিয়ে ভীষণ গর্ব হয় তার!
দাদীকে খুন করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি মানুকে! মুখে যতই চটাং- চটাং কথা বলুক না কেন, শরীরে একরত্তি শক্তিও ছিল না বুড়ির।
মুখের উপর বালিশ চাপা দিয়ে মেরেছে তাকে মানু। খানিকক্ষণ শুধু বাম দিকের হাত-পা নেড়ে তড়পেছে বুড়ি, তারপরই খেল খতম।
কেউ বুঝতেই পারেনি, কত সহজে ঘরের সবার জন্য অন্নের সংস্থান করেছে সে! কিন্তু দেখতে-দেখতেই কেটে যাবে সামনের চারটে দিন। তারপর তো আবারও সেই পুরনো ছকে ফিরে যেতে হবে। তাহলে?
বার কয়েক আড়চোখে মোতালেব মিয়ার দিকে তাকায় মানু।
মাঝে-মধ্যে একটা করে মিষ্টি চকোলেট, নাকি টানা চারদিন ভরপেট ভাত; সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে!
ইনফার্নো
এক
নিতান্ত সাদাসিধে ধরনের মানুষ বিমল কর; সাত চড়েও রা করে না। জগৎ- সংসার সম্পর্কে এতটা নির্লিপ্ত মানুষ কদাচিৎই চোখে পড়ে।
ভিতরে অনুভূতি যেমনই হোক না কেন, বাইরে তার চেহারা সারাক্ষণই ভাবলেশহীন। জাগতিক কোন ব্যাপারে চোখে পড়ার মতন কোন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বিমল, এমনটা কেউ কখনও দাবি করতে পারবে না।
তীব্র আনন্দ কিংবা তীব্র বেদনায়, একই রকম নির্বিকার লোকটা। মানুষ হয়েও আদতে একটা রোবট-জীবন যাপন করে চলেছে সে।
সকালে ঘুম ভাঙার পর বাড়িতে কোন নাস্তা জোটে না বিমলের। স্ত্রী মালতি দু’চোখে দেখতে পারে না তাকে। সাতসকালে বিমলের জন্য নাস্তা বানানোর কথা কল্পনাও করতে পারে না মহিলা।
এর নেপথ্যের কারণ হিসেবে অবশ্য বছর কয়েক আগে ঘটে যাওয়া একটা দুর্ঘটনাকে দায়ী করে লোকে। তবে কেবল মালতিই জানে, এই সীমাহীন বিতৃষ্ণার পিছনে ওই ঘটনাটার চাইতেও বড় আরেকটা কারণ রয়েছে।
এক সকালে একমাত্র ছেলে অমলকে নিয়ে তড়িঘড়ি করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বিমল। ছেলেকে স্কুলে পৌছে দিয়ে তবেই অফিসে যায় সে। মোটর সাইকেল থাকায়, পথের যানজট খুব একটা বড় বাধা ছিল না ওদের জন্য।
তবে আদতেই সেদিন বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল, কেবল মিনিট পাঁচেকই বাকি ছিল অমলের অ্যাসেম্বলি শুরু হওয়ার। নিতান্ত বাধ্য হয়েই অন্যান্য দিনের তুলনায় খানিকটা জোরে বাইক ছুটিয়েছিল সেদিন বিমল। তবে তার জানা ছিল না, বিধাতা ঠিক কী লিখে রেখেছিল তার ভাগ্য লিপিতে!
বড় রাস্তার মোড়ে পৌছতেই সিগন্যাল ভাঙা একটা ট্রাক বেপরোয়া গতিতে ছুটে এল ওদের দিকে। চোখের পলকে ওটার তলায় চাপা পড়ে গেল ছোট্ট বাইকটা।
ট্রাকের দানবীয় চাকায় পিষে গেল অমলের ছোট্ট দেহটা, প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই মারা গেল সে।
তবে উপস্থিত সবার চক্ষু চড়কগাছ করে দিয়ে, প্রায় বহাল তবিয়তে ট্রাকের তলা থেকে বেরিয়ে এল বিমল! এখানে-ওখানে খানিকটা কেটে-ছড়ে গেছে বটে, তবে বলার মত বড় ধরনের কোন চোট পায়নি সে।
একমাত্র সন্তানের রক্তাক্ত মৃতদেহ সহ্য করার ক্ষমতা পৃথিবীর কোন মায়েরই নেই; মালতিও তার ব্যতিক্রম নয়। গগনবিদারী আর্তনাদ করে সেদিন ধুলোয় লুটিয়ে পড়েছিল সে।
তীব্র যাতনার মধ্যেও হতবাক হয়ে লক্ষ করেছিল, চোখে এক ফোঁটা জল নেই বিমলের; নিস্পৃহ চেহারা নিয়ে ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা!
লোকটা কি সত্যিই মানুষ? নাকি আস্ত একটা পিশাচ?
সন্তান হারানোর ক্ষতে সময়ের প্রলেপ পড়ল ঠিকই, তবে সেদিনের সেই নির্লিপ্ততার জন্য বিমলকে কোনদিনও আর ক্ষমা করতে পারল না মালতি। তবে কেবল অমলের জন্যই এখনও লোকটার ঘর করছে সে। নাহয় বহু আগেই বিমলের কপালে লাথি মেরে যেদিকে দু’চোখ যায়, সেদিকে চলে যেত মালতি।
মহল্লার এক কোণে একটা কানাগলির মুখে আবুল মিয়ার চায়ের দোকান। চা-বিড়ির পাশাপাশি সেদ্ধ ডিম আর গুলগুলাও বিক্রি করে আবুল।
রোজ সকালে অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে ওই দোকানে গিয়ে হাজির হয় বিমল। দোকানের লাগোয়া একটা বাঁশের বেঞ্চিতে জুত করে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আবুলের দিকে।
তার দিকে এক পলকের জন্য তাকায় বটে আবুল, কিন্তু পরক্ষণেই আবার মুখ ফিরিয়ে নেয় সে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে অন্যান্য খদ্দেরদের সঙ্গে বেচাকিনি নিয়ে। দোকান একেবারে খালি হওয়ার আগ পর্যন্ত আর একটিবারের জন্যও বিমলের দিকে দৃষ্টি ফেরায় না সে।
নিয়মিত কাস্টোমার হওয়া সত্ত্বেও বিমলকে ভীষণ অপছন্দ করে আবুল। সে চায় না যে লোকটা রোজ-রোজ তার দোকানে আসুক। একারণেই এতটা অবহেলা করে সে। চায়, লোকটা বিরক্ত হোক; মানে-মানে কেটে পড়ুক এখান থেকে।
অন্য কিছু নয়, মানুষটার মূক পশুর মত আচরণটাই অসহ্য লাগে আবুলের। সকাল-সকাল এমন একটা পাথুরে মুখ দেখতে কারই বা মন চায়?
কিন্তু কখনওই আবুলের এই মনোবাসনাটা পূরণ করেন না বিধাতা; শত লাঞ্ছনার পরও ঠিকই রোজ সকালে এসে উপস্থিত হয় বিমল!
বিরস বদনে তাকে দু’খানা টোস্ট বিস্কিট আর এক কাপ চা এগিয়ে দিতে হয় আবুলকে। ওই দিয়েই নাস্তা সারে বিমল। তারপর বিনাবাক্যব্যয়ে দাম মিটিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় বড় রাস্তার উদ্দেশে; অফিসগামী বাস ধরার জন্য।
পিছন থেকে অস্ফুটে খিস্তি আওড়ায় আবুল। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বিমলের অপসৃয়মাণ অবয়বটার দিকে। কেবল দৃষ্টি দিয়ে কাউকে ভস্ম করে দেয়া সম্ভব হলে, অনেক আগেই অঙ্গার বনে যেত বিমল কর!
দুই
রোজ অফিসে ঢুকতেই নিজের টেবিলে রাখা বিশাল একখানা ফাইলের স্তূপের সাথে মোলাকাত হয় বিমলের। তার মাঝারি আকারের দেহটা রীতিমত হারিয়ে যায় ওগুলোর আড়ালে; চট করে বোঝা যায় না, আদৌ ওখানটায় কেউ আছে নাকি নেই!
দর্শনার্থীদেরকে কথা বলতে হয় জিরাফের মত গলা বাড়িয়ে, নইলে বিমলের চেহারা দেখার সৌভাগ্য হয় না ওদের।
এতখানি কাজ করার কথা নয় বিমলের; তবুও তাকে করতে হয়। বলা ভাল, নিতান্ত বাধ্য হয়েই করতে হয়। কখনওবা বসের নির্দেশ, কখনওবা সহকর্মীদের অনুরোধ!
‘আজকের মধ্যে ফাইলগুলো দেখে দিন, বিমল বাবু…’
‘আজ একটু দেরি করে বাসায় ফিরলে কোন সমস্যা হবে আপনার?’
‘অডিট আসছে। বাড়তি কাজ করতে হবে। উপায় নেই।’
‘দাদা, আজ আমার শালীর জন্মদিন। না গেলেই নয়। আমার কাজগুলো একটু করে দেবেন, প্লিজ?’
‘ছোট ছেলেটাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব। চারটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। আপনি যদি একটু সাহায্য করেন, তাহলে তিনটায় অফিস থেকে বেরিয়ে পড়তে পারি, দাদা। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে ছেলেটা।’
‘ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাব। আজ একটু জলদি ফিরতেই হবে, দাদা। আমার এই দুটো ফাইল কিন্তু আপনাকে দেখে দিতে হবে আজ। না বললে শুনব না কিন্তু, দাদা।’
‘আপনার ভাবীকে নিয়ে শপিঙে যেতে হবে। জানেনই তো, সংসারে কাদের রাজত্ব চলে। আজ একটু সাহায্য করতে হয় যে, দাদা। এই জীবন আর ভাল লাগে না একদম।’
‘রানু পিসিটা হঠাৎ করে মরে গেল! আপনি যদি একটু সাহায্য করেন আমাকে, মরামুখটা দেখার সৌভাগ্য হবে আমার।’
এভাবেই আসে একের পর এক আবদার, কাউকেই মানা করে না বিমল। নির্বিকার ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে লোকের ফাইলগুলো নেয় সে, অনেক রাত অবধি বেগার খেটে কাজগুলো ঠিকঠাক করেও দেয়।
সবার জন্য এত করে, তবুও কারও প্রিয় মানুষের তালিকায় বিমলের নামটা খুঁজে পাওয়া যায় না! কেন যেন কেউই বিশেষ পছন্দ করে না তাকে।
প্রায়ই বিভিন্ন উপলক্ষে কারও না কারও বাড়িতে ছোটবড় পার্টি হয়। অফিসের প্রায় সবাই সেখানে নিমন্তন্ন পেলেও, বিমল কখনও পায় না!
যদিও এ নিয়ে কাউকে কখনও কিছু জিজ্ঞেস করেনি সে, তবুও মাঝেমধ্যে নিজ থেকেই তাকে কৈফিয়ত দেয় লোকজন। চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে, নাকি? সময়ে-অসময়ে প্রায় সবারই তো উপকারে আসে মানুষটা।
অবশ্য অজুহাতগুলোর সবই ভীষণ খেলো ধরনের; কোন বৈচিত্র্য নেই!
‘একেবারে তাড়াহুড়োর মধ্যে হয়েছে পুরো আয়োজনটা। হুলস্থুলের ভিতরে কী থেকে যে কী হয়ে গেল! আপনাকে বলা হয়নি! লজ্জায় একেবারে মরে যাচ্ছি, দাদা।’
‘ছোট আয়োজন। পরিবার আর খুব কাছের কিছু মানুষজন ছাড়া বলতে গেলে আর তেমন কেউই ছিল না।’
‘আপনাকে তো, দাদা, ফোনে পাওয়াই যায় না। কতবার বললাম, অপারেটর পাল্টান। আপনি তো কানেও তোলেন না আমাদের কথা!’
মুখে মৃদু হাসি নিয়ে সমানে দু’হাত চালাতে-চালাতে লোকজনের মিথ্যে অজুহাতগুলো শোনে বিমল, কখনও কোন প্রতিবাদ করে না। কী লাভ?
পাহাড় প্রমাণ কাজ করেও দিন শেষে তার প্রাপ্তির খাতাটা প্রায় শূন্যই বলা চলে। চার বছর হতে চলল, প্রমোশনের শিকেটা এখনও ছিঁড়ল না তার ভাগ্যে।
তার অনেক পরে জয়েন করা একেকজন ফাঁকিবাজ জুনিয়র, কেবল তেলবাজির জোরে পদোন্নতি পেয়ে-পেয়ে বড় অফিসার বনে গেল। কিন্তু এখনও ঠিক আগের চেয়ারেই বহাল রয়েছে বিমল।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অবশ্য প্রতি সপ্তাহেই আশ্বাসের বাণী শোনায় তাকে; তার ধৈর্যের প্রশংসা করে।
‘হবে, হবে। এবারে আপনারটা হবেই হবে। মন্ত্রণালয় থেকে ফাইনাল কাগজটা এই এল বলে…’
দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস পেরিয়ে নতুন বছর চলে আসে। রোজ শত-শত সরকারী আদেশ-নিষেধও আসে; বিমলের পদোন্নতির নির্দেশটাই কেবল আসে না!
বিমলের নিজের অবশ্য এ নিয়ে তেমন কোন মাথাব্যথা নেই। একমনে নিজের কাজ করতেই অভ্যস্ত সে। প্রমোশনের জন্য আজকাল যে আর কেবল কাজ করাই যথেষ্ট নয়; খানিকটা ছোটাছুটি, খানিকটা তেলবাজিও যে করতে হয়, এটা তাকে কে বোঝাবে!
অবশ্য একেবারেই যে এ নিয়ে কেউ কিছু বলেনি তাকে, ব্যাপারটা ঠিক তেমনও নয়। সহানুভূতিশীল হয়ে কেউ-কেউ আকারে-ইঙ্গিতে বিষয়টা খোলসা করেছে তাকে। কিন্তু তাতে কোন ফল হয়নি। এক বাক্যে জানিয়ে দিয়েছে বিমল, এসব কাজ সে কস্মিনকালেও করতে পারবে না; এগুলো তার ধাতেই নেই।
এরপর আর কী-ই বা বলার থাকে? হতাশ হয়েই হাল ছেড়ে দিয়েছে লোকে যার প্রয়োজন, তারই যদি গরজ না থাকে, অন্য কারও সেটা নিয়ে ভাববার কী এমন ঠেকা পড়েছে?
কেবল সহকর্মীরাই নয়, অফিসের পিয়ন রাঘবও ভীষণ বিরক্ত বিমলের ওপর। অন্য কেউ ডাকলে চিতার বেগে ছুটে যায় সে। অথচ বিমল ডাকলে শুনেও না শোনার ভান করে থাকে, জায়গা ছেড়ে এক চুলও নড়ে না।
অনেকক্ষণ হাঁকডাকের পর যা-ও বা যায়, অনাগ্রহের স্পষ্ট ছাপ থাকে তার চেহারায়। হয় উদাসীন হয়ে ছাতের দিকে তাকিয়ে থাকে সে, নয়তো গোমড়া মুখে নোংরা নখ দিয়ে ফাইলের কোনা ছেঁড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে! বিমল কী বলে না বলে, সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপই থাকে না তার।
রাঘবের তখনকার হাবভাব দেখলে মনে হয়, বিমল কর সাধারণ একজন পিয়ন আর সে নিজেই বুঝি মস্ত কোন অফিসার!
প্রায়ই বড় স্যরের বিভিন্ন কাজের অজুহাত দেখিয়ে রিমলের দেয়া কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায় সে। যদিও তখন তার হাতে কোন কাজই থাকে না!
বিষয়টা বিমলের নিজেরও জানা আছে, তবুও এটা নিয়ে কখনও কোন উচ্চবাচ্য করে না সে। রাঘবকে সবসময় নম্র স্বরেই অনুরোধ করতে অভ্যস্ত সে।
সুযোগটার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে রাঘব; যতভাবে পারে হেনস্তা করে বিমলকে। সিঙ্গাড়া আনতে বললে আনে চমচম, জুস আনতে বললে আনে কোক! তবে তাতে বিশেষ কোন লাভ হয় না। নির্লিপ্তই থাকে বিমল, রাগে না।
সারাদিন সর্ব সাকল্যে একবেলা মালতির হাতের রান্না খাওয়ার সৌভাগ্য হয় বিমলের; রাতে। তবে খাবারটা তাকে একা-একাই খেতে হয়, মালতি কখনও তাকে সঙ্গ দেয় না। অমল মরার পর থেকেই এই ব্যবস্থা।
একই বাড়িতে একই ছাদের নীচে বসবাসরত এই দুটো প্রাণীর মধ্যে লোক দেখানো সামাজিক সম্পর্কটা ছাড়া, আদতে আর কোন সম্পর্কই নেই। না শারীরিক, না মানসিক।
ওই দুর্ঘটনাটার পর থেকে আজ অবধি মালতিকে কখনও ছুঁয়েও দেখেনি বিমল। মালতির মধ্যেও ঘনিষ্ঠ হওয়ার কোনরকম আগ্রহ প্রকাশ পায়নি।
লোকে ভাবে, ওদের বর্তমান সম্পর্কটা খানিকটা শীতল বটে, তবে অচিরেই এই অচল অবস্থা পাল্টে যাবে। সংসারে আবার ছেলেপুলে এলেই ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু। আবারও সুখের সুবাসে ভরে উঠবে ঘর-বাড়ি।
তবে সন্তান জন্মদানের প্রাকৃতিক উপায়টা থেকে যে তারা দু’জন যোজন- যোজন দূরে সরে আছে, এটা কারও কল্পনাতেও নেই।
মাথাব্যথার ব্যারাম আছে মালতির। অতি অল্প শব্দেই চট করে মাথা ধরে যায় তার। টিভির দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারে না; চোখ জ্বলে। তাই টিভি বলতে গেলে দেখেই না সে।
তবে রাতের আহার পর্ব সমাপ্ত হলে টিভিতে খানিকক্ষণ খবর দেখে বিমল সেটাও অবশ্য পুরোপুরি শব্দহীনভাবে, যেন মালতির কোন অসুবিধে না হয়।
এভাবে নিঃশব্দে টিভি দেখতে-দেখতে লিপ রিডিঙে অনেকখানি দক্ষ হয়ে উঠেছে বিমল। বহু দূর থেকেও কেবল ঠোঁট নাড়ানো দেখে মানুষজনের কথোপকথন বুঝতে পারে সে।
তার অফিসের কলিগদের কারও ধারণাও নেই যে, ওদের প্রত্যেকের কত- শত হাঁড়ির খবর জানা আছে বিমলের!
তিন
এক ছুটির দিনের সকালে বিমল করের নিস্তরঙ্গ জীবনটা হঠাৎ করেই আমূল বদলে গেল। ভোরবেলায় চোখ মেলা মাত্রই তার মনে হলো, এভাবে সবার অপছন্দের পাত্র হয়ে গোটা জীবনটা পার করে দেয়ার কোন মানেই হয় না!
সর্বজনবিদিত বাইরের মেকী খোলসটা ভাঙতে হবে তাকে; পুরোপুরি পাল্টে ফেলতে হবে নিজেকে। অন্য কারও জন্য নয়, কেবল নিজের জন্যই বাঁচতে হবে তাকে।
জীবন যদি রোমাঞ্চকরই না হয়, অহেতুক অক্সিজেনের অপচয় করে কী লাভ?
স্টোর রুমের আবর্জনার দঙ্গল ঘেঁটে মান্ধাতা আমলের একটা সিন্দুক বের করল বিমল। খুব একটা বড় নয় জিনিসটা; বহুদিন সেঁতসেঁতে জায়গায় পড়ে থাকার কারণে ডালার এখানে-ওখানে রঙ চটে গেছে।
সিন্দুকটা ওর দাদার সম্পত্তি, উত্তরাধিকার সূত্রে ওটার মালিক হয়েছে বিমল। দাদার নিজের হাতে লেখা একটা জরাজীর্ণ ডাইরি ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই ওটার ভিতরে। বোতাম আকৃতির ছোট-ছোট কিছু পাথর অবশ্য আছে; তবে ওগুলো যে ঠিক কী কাজে লাগে, খোদা মালুম!
বিমলের দাদাকে লোকে পাগল বলত। ঘর-সংসার বাদ দিয়ে অদ্ভুতুড়ে সব কাজে মেতে থাকত লোকটা।
তন্ত্র-মন্ত্রর চর্চা করত; বেশ কয়েকবার বহুদিনের জন্য গায়েবও হয়ে গিয়েছিল সে। কোথায় যেত, কী করত, সেটা কখনও কাউকে খোলসা করেনি সে।
এমন মানুষের সঙ্গে জীবন কাটানো যায় না। তাই বাধ্য হয়েই তার দাদীকে আবারও বিয়ে দিয়েছিল তার ভাইয়েরা। ততদিনে অবশ্য বিমলের বাবা বেশ বড় হয়ে গিয়েছিল।
মায়ের নতুন সংসারে উপদ্রব হতে চায়নি বলে অর্ধ-উন্মাদ বাবার সঙ্গেই রয়ে গিয়েছিল সে। তবে বাবার কোন প্রভাব নিজের ওপর পড়তে দেয়নি লোকটা, অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মতই ঘরকন্না সামলেছে সে।
স্বভাবতই বাবার সিন্দুক কিংবা ডাইরির প্রতি কোনরকম আগ্রহ ছিল না তার। কেবল পূর্বপুরুষদের আত্মাকে কষ্ট দিতে চায়নি বলেই সিন্দুকটাকে ঘরে রেখে দিয়েছিল সে, নাহয় বহু আগেই আঁস্তাকুড়ে ঠাঁই পেত ওটা।
ডাইরিটা বগলদাবা করে বৈঠকখানায় চলে এল বিমল। সোফায় আয়েশ করে বসে পড়তে শুরু করল।
(মূল ডাইরিটাতে সবকিছু সাধু ভাষায় থাকলেও, বোঝার সুবিধার্থে এখানে চলিত ভাষা ব্যবহার করা হলো।)
দাদার হাতের লেখা চমৎকার, একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার। পড়তে কোন অসুবিধাই হলো না বিমলের।
প্রথম পাতাতেই গোটা-গোটা অক্ষরে লেখা
‘হে, আমার প্রাণপ্রিয় বংশধর, তোমাকে আজ এক রহস্যময় পথের সন্ধান দিতে চলেছি আমি। তবে আগে বাড়ার পূর্বে তোমাকে সতর্ক করছি, কোনরকম পিছুটান থাকলে এখনই পঠনে ইস্তফা দাও; এই পথ তোমার জন্য নয়। ডাইরিটা রেখে দাও যথাস্থানে, সংসার বিবাগী অন্য কোন সাধকের জন্য; যে একদিন আমার এই সাধনার অংশ হবে।
‘একবার এই পথে পা বাড়ালে, পিছিয়ে আসার আর কোন পথ থাকবে না। এলে ভয়াবহ অভিশাপ নেমে আসবে তোমার ওপরে।
‘অতএব, ভেবেচিন্তে অগ্রসর হও। জাদুর নেশা, এ পৃথিবীর সবচাইতে বড় নেশা। একবার এই নেশায় মজলে, সাধারণ জীবন অর্থহীন মনে হবে।
‘সচেতন অনুসারীই কাম্য আমার, পথহারা পথিক নয়। তোমাকে শুভেচ্ছা।’ ডাইরিটা পাশে রেখে চোখ মুদে খানিকক্ষণ ভাবল বিমল। সত্যিই কি তার কোন পিছুটান আছে?
না। নেই।
দিন কয়েকের জন্য সে বেমালুম গায়েব হয়ে গেলে কিছুই যাবে-আসবে না মালতির। এমনকী চিরকালের জন্যও যদি গুম হয়ে যায় বিমল, একরত্তি দুঃখও পাবে না সে; উল্টো মুক্তি দেয়ার জন্য দিনরাত মনে-মনে তাকে ধন্যবাদ দেবে!
আচ্ছা, তার বাবা কি দাদার লেখা এই ডাইরিটা পড়েছিল? মনে হয়, পড়েনি। যদিও বা কখনও হাতে নিয়ে থাকে, নিশ্চয়ই এই প্রথম পাতাটা পড়েই ক্ষান্ত দিয়েছিল সে।
সংসারী মানুষ ছিল বাবা, বৈরাগী হওয়ার কোন খায়েশ ছিল না তার। চারিত্রিক নির্লিপ্ততার অনেকখানি বাবার কাছ থেকেই পেয়েছে বিমল।
সাতপাঁচ ভেবে আবার ডাইরিটা হাতে তুলে নিল বিমল। মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করল।
‘হে, শিষ্য, তোমাকে অভিনন্দন। আজ থেকে সজ্ঞানে রোমাঞ্চকর এক নয়া জীবন বেছে নিয়েছ তুমি। এই সাধক জীবন বড় বিচিত্র, বড্ড আনন্দময়। তোমাকে আশীর্বাদ করছি, নিশ্চয়ই তুমি সফলকাম হবে।
‘শুধু একটা বিষয় মাথায় রাখবে, তোমাকে ধারাবাহিকভাবে পড়তে হবে এই পুস্তক। ভুলেও কখনও এক পৃষ্ঠার কাজ সমাপ্ত না করে অন্য পৃষ্ঠায় যাওয়া চলবে না। তাহলে সমস্ত সাধনাই বৃথা যাবে।
‘দেবতারা আকাশে থাকেন, দানবেরা পাতালে। আর আমরা মানুষ জাতি, এই দুয়ের মধ্যখানে অসহায়ের মত আটকে আছি।
‘লক্ষ-কোটি বছর আগে দেবতাদের সঙ্গে দানবেরা এক মরণপণ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। তার পরপরই নিজেদের সুবিধামত এলাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছিল ওরা। স্বর্গ স্থাপন করা হয় অন্তরীক্ষে আর নরকের ঠাঁই হয় পাতালে।
‘নভোমণ্ডলের পরিধি অসীম, তবে পাতালের ব্যাপ্তি অসীম নয়। তাই স্বৰ্গ দর্শন মানুষের জন্য প্রায় অসম্ভব হলেও, নরকের খোঁজ পাওয়া ততটা কঠিন নয়।
‘মানুষের খুব কাছাকাছি বসবাস করে, আবার পাতালের সঙ্গেও নিবিড় যোগাযোগ আছে, এমন কোন প্রাণীর কথা কি মনে পড়ে তোমার? পড়ছে না?
‘আমিই বলে দিচ্ছি তাহলে; মূষিক। যাকে আমরা সচরাচর ইঁদুর বলে ডাকি। মাটির ওপরে ওদের নিত্য আনাগোনা, তবে মাটির নীচেই ওদের স্থায়ী বসবাস।
‘আমাদের চোখের আড়ালে সুরঙ্গ খুঁড়ে বিশ্বের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে চলে যেতে পারে ওরা। বিনা বাধায় চষে বেড়াতে পারে গোটা পৃথিবী।
‘পাতালপুরী সম্পর্কে ওদের চেয়ে বেশি জ্ঞান আর কারোরই নেই। এই জ্ঞান ওরা পেয়েছে বংশানুক্রমে; সেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে। একজোড়া ইঁদুরকে ঠিকঠাক বংশ বিস্তার করতে দিলে বছর শেষে সংখ্যাটা সর্ব সাকল্যে প্রায় হাজারে গিয়ে ঠেকবে। বুঝতে পারছ, আমাদের অগোচরে কত লক্ষ-কোটি ইঁদুর ছড়িয়ে আছে এই বিশ্বজগতে?
‘হাজার-হাজার বছর ধরে পাতালপুরী সম্পর্কিত জ্ঞান আহরণ করেছে ইঁদুরেরা, লুকিয়ে রেখেছে নিজেদের ভিতরে। অন্য কোন প্রাণীর সঙ্গে ভাগাভাগি করেনি, মানুষের সাথে তো নয়ই।
‘তবুও বুদ্ধিমান মানুষ ঠিকই জেনেছে ওদের বিভিন্ন ক্ষমতার কথা। যুগে- যুগে এর উপযুক্ত সম্মান দিতেও কখনও কার্পণ্য করেনি। তবে আজও তাদের সবচেয়ে বড় ক্ষমতাটার কথা গোপন রয়ে গেছে সিংহভাগ মানুষের কাছে।
‘মানুষ জানে না, নিয়মিতই নরকে আসা-যাওয়া করে ইঁদুরেরা; ওরাই নরকের আসল পাহারাদার!
‘আজ আমরা যাকে আগ্নেয়গিরি বলি, সেগুলো আর কিছুই নয়, নরকের একেকটা খোলা মুখ। মানুষকে শায়েস্তা করার জন্যই ইঁদুরেরা কালে-কালে খুলে দিয়েছে ওগুলো। লাভার উদ্গিরণ শেষে এমনভাবে বন্ধ হয়ে যায় পথগুলো যে, ওপথে আর নরকের হদিস মেলে না। কিংবা হয়তো গোটা নরকটাকেই সরিয়ে ফেলা হয় ওখান থেকে। কেবলমাত্র ইঁদুরেরাই জানে নরকের সঠিক অবস্থান এবং ঠিক কীভাবে ওখানে যেতে হয়।
‘ইঁদুরেরা ক্ষমতাবান, ভীষণ ক্ষমতাবান। যুগে-যুগে পৃথিবীর নানা প্রান্তের নানা লোকগাথায় ওদের সামর্থ্যের বয়ান আমরা পেয়েছি।
‘ক্ষমতা এবং উন্নয়নের দেবতা গণেশ। লোকে বিদ্যার দেবী সরস্বতী কিংবা সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর চেয়ে তাঁর পুজো কোন অংশে কম করে না। তিনি যে একটা ইঁদুরের পিঠে চড়ে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে ঘুরে বেড়াতেন, সেটা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়। কিন্তু এটা কি জানো, ওই বাহন ইঁদুরটা আদতে কী ছিল?
‘গণেশ পুরাণের মতে, দেবতা ইন্দ্রের দরবারে একজন সঙ্গীতজ্ঞের নাম ছিল, ক্রাঞ্চা। একদিন ভুলক্রমে মুনি ভামাদেভাকে অপমান করে ফেলেন তিনি। অভিশাপ দেয়া হয় তাঁকে; শেষটায় একটা ইঁদুরে পরিণত হন তিনি।
‘কিন্তু তাঁর ছিল প্রচণ্ড রাগ আর সেই সঙ্গে দানবীয় শারীরিক কাঠামো। ক্রোধান্বিত হয়ে ঋষি পরোশারার আশ্রমে হামলা চালান তিনি, তছনছ করে দেন গোটা আশ্রম। নিরুপায় ঋষি গণেশের দরবারে আর্জি জানান; তাঁর ডাকে সাড়া দেন গণেশ। বিশাল শুঁড় দিয়ে তিনি চেপে ধরেন ক্রাঞ্চার গলা; সিদ্ধান্ত নেন, এখন থেকে ওই ইঁদুরের পিঠেই সওয়ার হবেন।
‘কিন্তু গণেশের বিশালকায় দেহের ভার বহন করার সামর্থ্য ছিল না ওই ইঁদুরটার। তাই গণেশ পিঠে চড়া মাত্রই ব্যথায় ককিয়ে ওঠে ওটা। এতে গণেশের মনে দয়ার উদ্রেক হয়, তাই নিজেকে অনেকটা হালকা করে নেন তিনি। এরপর থেকে আর তাঁকে বইতে কোনরকম সমস্যা হয়নি বাহক ইঁদুরটার।
‘একজন মহা পরাক্রমশালী দেবতা হয়েও সামান্য একটা ইঁদুরের পিঠে সওয়ার হতে কুণ্ঠাবোধ করেননি গণেশ; উল্টো ইঁদুরটাকে প্রাপ্য সম্মান দিয়েছিলেন তিনি। নিজের ভাগের লাড্ডু খেতে দিতেন ওটাকে, ওটার এঁটো করা খাবারও খেয়ে নিতেন নির্দ্বিধায়। সর্বদাই একান্ত একজন বন্ধুর মতন আচরণ করতেন প্রাণীটার সঙ্গে।
‘গণেশের শরীর ছিল প্রকাণ্ড, মাথা ছিল হাতির। যতই তিনি নিজেকে হালকা করুন না কেন, অতবড় একখানা পাহাড়সম দেহ বইতে পারাটা, ইঁদুরটার শারীরিক সামর্থ্যেরই প্রমাণ। পরবর্তীতে গণেশের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতারই প্রতীক হয়ে উঠেছিল ইঁদুরটা। আপাতদৃষ্টিতে সামান্য একটা ইঁদুর আদতে কতখানি গুরুত্ব বহন করে, সবাইকে সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন গণেশ। অবশ্য হিন্দুদের কেউ-কেউ ইঁদুরকে অপদেবতা কিংবা শয়তানের প্রতিমূর্তি হিসেবেও বিবেচনা করে থাকে।
‘চীনদেশে লোকে শূ নামে ডাকত ইঁদুরকে। ওরা বিশ্বাস করত, যে কয়টি প্রাণী সূর্য থেকে আলো বহন করে নিয়ে আসে মর্ত্যে, ইঁদুর তার মধ্যে অন্যতম। ইঁদুরকে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের রক্ষাকর্তাও ভাবত ওদের কেউ-কেউ।
‘মিসরে ওদেরকে ভাবা হত ধ্বংসের দেবতা। মিসরীয়রা বিশ্বাস করত, ইঁদুরদের অবাধে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সর্বময় ক্ষমতা দিয়েছেন ঈশ্বর।
‘আইরিশরা মনে করত, শিল্প-সাহিত্য সম্বন্ধে বেশ ভাল ধারণা রাখে ইঁদুরেরা। কোন চমৎকার কবিতা কিংবা সুরেলা গানের প্রতি সহজেই ওরা আকৃষ্ট হয়! তখন সম্মোহিত করে ওদের দিয়ে যে কোন কাজ করিয়ে নেয়া যায়। সম্ভবত এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই এককালে হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার মত গল্পগুলো রচিত হয়েছিল।
‘রোমানদের বিশ্বাস ছিল, ইঁদুরেরা সৌভাগ্য বয়ে আনে। তবে খ্রীষ্টানদের কেউ-কেউ আজও শয়তানের প্রতীক হিসেবেই দেখে ইঁদুরকে।
‘জাপানে ওদেরকে বলা হত, নাজুমি। ভাবা হত, দেবতা দাইককুর বার্তাবাহক এই ইঁদুরেরা। জাপানীদের বিশ্বাস ছিল, নতুন বছরের কেক যদি ইঁদুরেরা স্বেচ্ছায় খেয়ে যায়, তাহলে সে বছর বেশ ভাল ফলন হবে।
‘কিছু-কিছু আফ্রিকান উপজাতি এখনও যুদ্ধের ময়দানে ইঁদুরের লোমের মুকুট পরে। তারা বিশ্বাস করে, এই মুকুট ওদেরকে সকল প্রকারের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবে। এমনকী শত্রুর ছোঁড়া তীর-বল্লমও ওদের গায়ে না লেগে পিছলে যাবে!
‘ইঁদুরদের নিয়ে আগ্রহের কমতি ছিল না মায়ানদের। ইঁদুরের গতিবিধির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখত ওরা। শত্রুর হাত থেকে বাঁচার পরিখা, মাটির নীচে সুরঙ্গ খোঁড়া, এসবকিছু সম্ভবত ইঁদুরদের কাছ থেকেই শিখেছিল মায়ানরা। এমনকী প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে ইঁদুরদের দেখাদেখি মাটির নীচে সম্পূর্ণ শহরও গড়ে তুলেছিল ওরা। শহরগুলোয় ঢোকার মুখে যে ধাতুর তোরণ থাকত, প্রায়শই সেটায় আঁকা থাকত বিশাল কোন ইঁদুরের ছবি। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ প্রায়ই ইঁদুরদের জন্য ভোজসভার আয়োজন করত মায়ানরা!
‘ইঁদুর আকৃতির বিশাল-বিশাল সব মূর্তি শহরে স্থাপন করেছিল অ্যাজটেকরা। আপাতদৃষ্টিতে নিরেট মনে হলেও, এর বেশিরভাগই ছিল পুরোপুরি ফাঁপা। নগর রক্ষকের দল অনায়াসে ওগুলোর ভিতরে লুকিয়ে থাকতে পারত। শত্রুকে বিভ্রান্ত করতে যুদ্ধের ময়দানেও ব্যবহার করা হত এসব ইঁদুরের মূর্তি।
‘সুমেরীয়দের বিশ্বাস ছিল, ইঁদুরেরা মূলত চাঁদে বসবাস করে। আর চাঁদের গায়ের কৃষ্ণ গহ্বরগুলো আসলে ওদেরই সৃষ্টি!
‘আপাতত আর এসব নিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না, নয়তো এগুলো বলতে বলতেই এই পুস্তকের সবক’টি পাতা ফুরিয়ে যাবে। তুমি নিজেই বরঞ্চ ইঁদুরদের সম্পর্কে খানিকটা পড়াশুনা করে নাও। তারপরও যদি এই ব্যাপারে তোমার আগ্রহ অব্যাহত থাকে, তবেই কেবল পরবর্তী অধ্যায়ের দিকে অগ্রসর হবে। সেখানে আমি তোমাকে মূষিক-সাধনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানাব। তোমাকে শেখাব, কী করে এই মহা ধুরন্ধর প্রাণীকুলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হয়। কীভাবে ওদেরকে তোমার আজ্ঞাবহ করতে হয় এবং কেমন করে ওদের সাহায্যে খুঁজে পেতে হয় নরকের দরজা! আপাতত, বিদায়!’
চার
অসুস্থতার দোহাই দিয়ে অফিস থেকে দিন কয়েকের ছুটি নিল বিমল। আবেদন করা মাত্রই ছুটি মঞ্জুর হয়েছে তার, কোনরকম ঝক্কি পোহাতে হয়নি। দীর্ঘকালের চাকরি জীবনে ইতিপূর্বে একদিনের জন্যও অফিস কামাই দেয়নি সে!
ইঁদুর বিষয়ক কিতাবের খোঁজে পুরো শহর চষে বেড়াল বিমল। সদ্য প্রকাশিত ঝকঝকে বই থেকে শুরু করে প্রাচীন আমলের রদ্দিমাল, যেখানে যা পেল, খুঁজে-খুঁজে জড় করল। তারপর নাওয়া-খাওয়া শিকেয় তুলে একনাগাড়ে পড়তে শুরু করল।
মালতি বুঝল, কোথাও কোন একটা গণ্ডগোল হয়েছে; কিন্তু পরোয়া করল না সে। উচ্ছন্নে যাক ব্যাটা, কী আসে যায়?
তবে আগের তুলনায় কাজের পরিমাণ খানিকটা বেড়েছে তার, এক বেলার পরিবর্তে এখন দু’বেলার খাবার রাঁধতে হয় তাকে। তবে বেশিরভাগ সময় দিনে একবারই কেবল খাবার খায় বিমল, সেটাও একেবারে ভর সন্ধ্যায়। বাকিটা সময় মুখ গুঁজে থাকে বইয়ের পাতায়।
মালতিকে দেখেও যেন দেখে না সে; সবসময় চোখে-মুখে কীসের যেন একটা ঘোরলাগা দৃষ্টি তার! বিমলের চোখের দিকে চোখ পড়লে খানিকটা অস্বস্তিতে ভোগে মালতি; পাগল হয়ে যাচ্ছে না তো লোকটা?
অবশেষে সপ্তাহ খানেক বাদে মূষিক সম্বন্ধীয় জ্ঞান আহরণ শেষ হলো বিমলের। অনেকটা সময় নিয়ে স্নান সারল সে, তারপর ভরপেট ভাত খেল। মালতির দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসিও দিল; গত কয়েক বছরে যে কাজটা একবারও করেনি সে!
নিজেকে ভীষণ হালকা লাগছে তার; শেষতক খুঁজে পেয়েছে নিজের জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। দাদার মত মূষিক সাধক হবে সে, জানবে অন্ধকার জগতের নানা খুঁটিনাটি। সাধারণ একঘেয়ে জীবনের প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে তার। কী লাভ এভাবে অহেতুক দিনের পর দিন শ্বাস নিয়ে?
যতদিন বাঁচবে, জীবনটাকে পুরোদমে উপভোগ করবে সে। জীবিত মানুষ হিসেবে নরক পরিদর্শনের সুবর্ণ সুযোগটা হেলায় হারানোর কোন ইচ্ছেই নেই তার। বিফল হলেও ক্ষতি নেই তেমন; মাঝখানের উত্তেজনাটাই বা কম কীসে?
সেই সন্ধ্যায় আবারও দাদার ডাইরিটা পড়তে শুরু করল বিমল। একে-একে জানতে লাগল মূষিক-সাধনার যাবতীয় নিয়ম কানুন। কিছু-কিছু বিবরণ এতটাই বীভৎস যে, পড়তে গিয়েই শরীরের সবক’টা লোম দাঁড়িয়ে গেল তার; চোখ-মুখ কুঁচকে গেল।
তবুও হাল ছাড়ল না বিমল, লেগে রইল। মনে-মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল, যেভাবেই হোক, এর শেষ দেখে ছাড়বে সে। মাঝামাঝি গিয়ে সটকে পড়ার লোক নয় সে মোটেও; অন্য দশজন মানুষের চেয়ে তার ধৈর্যের পরিমাণ বেশি বৈ কম নয়। আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হলেও যজ্ঞগুলো করতে পিছপা হবে না সে।
এক রাতে কৌতূহলবশত বিমলের ঘরে উঁকি দিল মালতি। দরজাটা ভেজানো, লক করেনি বিমল। ঘরের সবক’টা বাতি নেভানো; তবে জানালা- দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে বাইরের খানিকটা আলো ঠিকই ঢুকে পড়ছে ঘরে। তাতে অবশ্য ভিতরের গুমট অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি, তবে চেনা ঘরে অতটুকু আলোই যথেষ্ট মালতির জন্য।
অন্দরের দৃশ্যটায় চোখ পড়তেই ভীষণ চমকে উঠল মালতি। অকারণেই ধক্ করে উঠল বুকের ভিতরটা। যা দেখছে, ঠিক দেখছে তো?
ঘরের মধ্যখানটায় চোখ মুদে পদ্মাসনে বসে আছে বিমল। পুরোপুরি দিগম্বর, একরত্তি সুতোও নেই তার পরনে। গায়ে কী যেন একটা মেখেছে সে। আবছা আলো-আঁধারিতেই রীতিমত চকচক করছে তার শ্যামবরণ দেহটা।
ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আছে অচেনা একটা গন্ধে। গন্ধটা ভীষণ বিশ্ৰী, চট করে নাকে লাগে। বিমলের শরীরে মাখা, তেলটা থেকেই এই বিচ্ছিরি গন্ধের উৎপত্তি কিনা, খোদা মালুম!
চোখজোড়া বন্ধ থাকলেও ঠোঁটদুটো অনর্গল নড়ছে তার। নিচু স্বরে কী যেন জপে চলেছে সে। শ্বাসের সঙ্গে বুকের ওঠানামার গতিটা এতটাই ক্ষীণ যে, ভালমত না তাকালে প্রায় নজরেই পড়ে না। কেবল ওই ঠোঁটজোড়া অনড় থাকলে, অবলীলায় একখানা পাথুরে মূর্তি বলে চালিয়ে দেয়া যেত তাকে।
চটজলদি ওখান থেকে সরে এল মালতি; সারা শরীর ঘামছে তার। নাড়ির গতি বেড়ে গেছে অনেকখানি; হাঁটু দুটোতেও ঠিক জোর পাচ্ছে না সে। দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে, চোখের তারায় স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ। কোনমতে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে নিজের ঘরে ফিরে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিল সে।
কী হয়েছে লোকটার? মাথা-টাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো? পাগল তো সে আগেই ছিল, এখন কি তাহলে বদ্ধ উন্মাদ বনে গেছে? কী করা উচিত এখন মালতির? ভাইদেরকে সবকিছু খুলে বলবে?
বহুদিন ধরেই বিমলকে ডিভোর্স দেয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছে মালতির আত্মীয়-স্বজনেরা, কিন্তু মালতি কখনও রাজি হয়নি। লোকটাকে পছন্দ না করলেও, কেমন যেন একটা মায়া পড়ে গেছে। অতীতে একে অপরকে ভালবাসত ওরা, সুখের একটা সংসার ছিল। চাইলেই সেসব দিনের অজস্র টুকরো-টুকরো সুখের স্মৃতিগুলো মন থেকে তাড়ানো যায় না।
ভালবাসা নেই; কিন্তু বিমলকে ছেড়ে অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে নতুন করে ঘর বাঁধার কথা কল্পনাও করতে পারে না মালতি। স্বামীকে ছাড়া যায় ঠিকই, কিন্তু নিজের সন্তানের পিতাকে কি অস্বীকার করা যায় কখনও?
এতদিন ঘরে সুখ ছিল না সত্যি, তবে জীবন ঠিকই চলছিল তার নিজস্ব গতিতে। কিন্তু এখন? একজন উন্মাদের সঙ্গে সংসার করাটা কতটা নিরাপদ?
আজ অবধি মালতির শীতল আচরণের জন্য কখনও কৈফিয়ত চায়নি বিমল, নীরবেই সহ্য করে গেছে সমস্ত অবহেলা। এজন্যই হয়তো তাকে ছেড়ে যেতে মন সায় দেয়নি মালতির। তার অবচেতন মন হয়তো দেখতে চেয়েছে, তাকে ঠিক কতটা ভালবাসে বিমল!
পরের সন্ধ্যায় বিমল খেতে বসলে, নিজের অজান্তেই টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল মালতি। নিজ হাতে খাবার তুলে দিল বিমলের টিনের থালায়।
ব্যাপারটা বহু বছর পর ঘটলেও, খুব স্বাভাবিকভাবেই নিল বিমল। এমন ভাব করল, যেন রোজই তাকে খাবার বেড়ে দেয় মালতি!
হালকা গলায় বলল, ‘তুমি খাবে না?’
মুখ তুলে তার দিকে তাকাল মালতি। জবাব দেবে কিনা, সেটাই বোধহয় ভাবল খানিকক্ষণ। তারপর বলল, ‘পরে খাব। তুমি খাও।’
আলতো করে মাথা নাড়ল বিমল, মুখে কিছু বলল না। প্লেটের খাবারের দিকে মনোযোগ দিল সে। হাত বাড়িয়ে খানিকটা নুন তুলে নিয়ে, ভাত মাখিয়ে,
খেতে শুরু করল।
হতবাক মালতি, কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল বিমলের নিরাসক্ত চেহারার দিকে। তারপর হতাশ গলায় বলল, ‘তোমার সমস্যাটা কী?’
খাওয়া অব্যাহত রাখল বিমল। ‘কই! কোন সমস্যা নেই তো!’
‘সমস্যা না থাকলে অফিসে যাচ্ছ না কেন? চাকরি চলে গেছে?’
‘চাকরি চলে যাবে কেন! কয়েক দিনের ছুটি নিয়েছি।
‘কেন? কী করো তুমি সারাদিন ঘরে বসে?’ সতর্ক গলায় জিজ্ঞেস করল মালতি।
এতক্ষণে মুখ তুলে তাকাল বিমল; আগ্রহ ফুটে উঠেছে দু’চোখে। ‘জীবনটা পাল্টাতে চাইছি, বুঝলে…ভীষণ একঘেয়ে হয়ে পড়েছিল সবকিছু।’
‘ও আচ্ছা। ভাল,’ নিরুত্তাপ গলায় বলল মালতি। ‘তা কীভাবে করতে চাচ্ছ কাজটা, শুনি?’
চওড়া হাসি ফুটল বিমলের চেহারায়। ‘দাদার লেখা একটা ডাইরি খুঁজে পেয়েছি। ওতেই বিশদভাবে লেখা আছে সমস্ত নিয়মকানুন। ‘
‘দাদা! তোমার দাদা?’ দ্রুত বলে উঠল মালতি। ‘আমি তো জানতাম, পাগল ছিলেন উনি।
নিমেষেই হাসি মুছে গেল বিমলের মুখ থেকে, চোখ-মুখ কঠিন হয়ে গেল। ‘ভুল জানতে। মোটেও পাগল ছিলেন না তিনি। লোকে খামোকাই তাঁর নামে ভুলভাল বলত। সত্যি বলতে, অনেক বড় একজন মূষিক-সাধক ছিলেন তিনি।’
‘কী ছিলেন?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল মালতি।
‘মূষিক…ইঁদুর, ইঁদুর। ইঁদুরের সাধনা করতেন তিনি।’
‘ইঁদুরের সাধনা!’ আপনমনে বিড়-বিড় করল মালতি। ‘তাহলে তো ঠিকই বলত লোকে! সত্যিই দেখছি বদ্ধ উন্মাদ ছিল লোকটা!’
‘মোটেও না, মালতি। একেবারেই সুস্থ একজন মানুষ ছিলেন তিনি। আমাদের যে কারও চেয়ে বেশি বুদ্ধি রাখতেন মাথায়,’ চটজলদি বলে উঠল বিমল। ‘ইঁদুরদের ক্ষমতা সম্পর্কে তেমন কোন ধারণাই নেই মানুষের। একারণেই হয়তো সবার কাছে এতটা অস্বাভাবিক লাগে ব্যাপারটা।’
‘তাই বুঝি?’ ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল মালতির কণ্ঠে। ‘তা কী-কী ক্ষমতা আছে মহা পরাক্রমশালী ইঁদুরদের?’
তার গলার উপহাসের সুরটা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করল বিমল। ‘অনেক ক্ষমতা, অনেক। সারা রাত বর্ণনা করেও শেষ করা যাবে না সেসব। তবে তুমি জানতে চাইলে, ওদের একটা বিশেষ ক্ষমতার কথা বলতে পারি তোমাকে।’
‘বলো তাহলে। শুনে ধন্য হই।’
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল বিমল; পুরো বিষয়টায় খানিকটা বাড়তি গুরুত্ব আরোপের প্রয়াস পাচ্ছে। ‘নরকের সন্ধান জানে ইঁদুরেরা। এই সাধনায় সফল হলে, জীবিত মানুষ হয়েও নরক দর্শন করতে পারব আমি।
‘অন্যদেরকে নরক দেখানোর ক্ষমতা তো তোমার এখনই আছে,’ চিবিয়ে- চিবিয়ে বলল মালতি। ‘আমার জীবনটা কোন দোজখের চাইতে কম কীসে?’
চমকে উঠল বিমল। কথাটার মর্মার্থ অনুধাবন করতে, বেশ খানিকটা সময় লাগল তার। পরক্ষণেই চেহারাটা রক্তবর্ণ ধারণ করল, ভীষণ রেগে গেছে।
তবে সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপও করল না মালতি; অনল বর্ষণ অব্যাহত রাখল। ‘এক সপ্তাহ সময় দিলাম তোমাকে। ভাল চাইলে এসব পাগলামি ছেড়ে ছুড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরত এসো। নইলে ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে তোমার জন্য, এই আমি বলে দিলাম।’
এক মুহূর্তের বিরতি নিয়ে আবারও মুখ খুলল সে, ‘যদি ভেবে থাকো, বাপের বাড়িতে চলে যাব আমি; তাহলে ভুল ভাবছ। যেতে চাইলে অনেক আগেই যেতে পারতাম, এতদিন অপেক্ষা করতাম না। আমি নই, তোমাকেই বরঞ্চ জায়গামত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। সেটা কোথায়, বুঝতে পারছ তো? পাগলা গারদে। আমার মনে হয়, দিনে-দিনে মানব সমাজে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছ তুমি!’
সশব্দে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল মালতি, হন হন করে হেঁটে চলে গেল তার শোবার ঘরের উদ্দেশে।
.
আরও বহুক্ষণ সেখানেই ঠায় বসে রইল বিমল, উথলে ওঠা ক্রোধটাকে দমন করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।
মধ্যযুগে বন্দিদের ওপর ইঁদুরদের দিয়ে অত্যাচার চালাত সম্রাটরা। একটা ইঁদুরকে কয়েকদিন ধরে অভুক্ত রাখা হত, এতে করে ভীষণ ক্ষুধার্ত আর হিংস্র হয়ে উঠত জানোয়ারটা।
নির্দিষ্ট দিনে একজন বন্দিকে নগ্ন করে হাত-পা বেঁধে ফেলা হত। তারপর একটা খাঁচা সমেত ইঁদুরটাকে এনে রাখা হত লোকটার পেটের ওপর!
লোহার তৈরি খাঁচাটার অন্য সবদিক বন্ধ থাকলেও, কেবল নীচের দিকটা খুলে দেয়া হত। অনেকটা বাধ্য হয়েই বন্দির পেটের নরম চামড়া খুঁড়তে শুরু করত ইঁদুরটা, ধীরে-ধীরে সেঁধিয়ে যেত উদরের গভীরে! বাঁচার পথ এবং খাবার, দুটোই চাই তার।
পুরোটা সময় সজ্ঞানে ওই ভয়াবহ যন্ত্রণাটা অনুভব করত হতভাগা মানুষটা। তারপর একসময় তীব্র বেদনা অথবা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যেত। কিংবা বলা ভাল, মুক্তি পেত।
মালতিকে এখনই ওই ধরনের কোন শাস্তি দিতে ইচ্ছে করছে বিমলের!
রোমান সম্রাটদের মত ক্ষুধার্ত ইঁদুর ভর্তি একটা গোপন কুঠুরি যদি তার থাকত, নির্ঘাত এখন মালতিকে ওটাতে ঠেলে ফেলে দিত সে।
শত-সহস্র ইঁদুর একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ছে মালতির নধর দেহটার ওপর; দৃশ্যটা মানসপটে কল্পনা করতেই ভীষণ পুলক অনুভব করল বিমল!
পাঁচ
প্রয়াত মূষিক-সাধকের ডাইরির ভাষ্য অনুযায়ী, সাধনার পরবর্তী ধাপের জন্য বেশ কিছু জিনিসপত্র জোগাড় করল বিমল।
একেকটা উপকরণ খুঁজে বের করতে রীতিমত গলদঘর্ম হতে হলো বেচারাকে। সাধনার জন্য যে এসব জিনিসেরও প্রয়োজন পড়তে পারে কখনও, এটা সে কস্মিনকালেও কল্পনা করেনি।
মিয়ানো মুড়ি
খানিকটা ঝোলা গুড়
গোটা দুয়েক পচা ডিম
মাকড়সার ঝুল
দুটো নোনতা বিস্কিট
চালের রুটি
ডুবো তেলে ভাজা সিঙ্গাড়া
গোটা চারেক বাতাসা
একটা মরা টিকটিকি
বাসি পাউরুটি
খানিকটা মাখন
কয়েক বছরের পুরনো গম
আধ কাপ মোরগের রক্ত
কয়েক ছটাক আমন ধানের চিটা
এক মুঠো শুকনো দূর্বাঘাস
কয়েক গাছি বিড়ালের লোম
খানিকটা লাল মাটি
আরও কত কী…!
এসব জোগাড়যন্ত্র করা কি চাট্টিখানি কথা?
তবুও শেষতক ঠিকই সবকিছু এক জায়গায় জড় করল বিমল। একখানা বড় পোড়ামাটির পাত্র খুঁজে নিয়ে, তাতে আধ লিটার পানি ভরে নিল। তারপর সবগুলো উপকরণ ভালমত মিশিয়ে এক ধরনের শরবত মতন তৈরি করল।
জিনিসটা দেখতে অবিকল থকথকে কাদার মত। আর গন্ধটা এমন যে, মরণাপন্ন কোন মানুষের নাকের সামনে ধরলেও লাফিয়ে উঠে পালিয়ে যেতে দিশা পাবে না বেচারা!
একটা বড় মগে তরলটা ছেঁকে নিল বিমল, তারপর কিচেনের মিটসেফে তুলে রাখল সকালে ব্যবহার করার জন্য। ওটাকে পুরো রাত নিজের কাছে রাখার কোন উপায় নেই; রসুইঘরের আলমারিতে লুকিয়ে রাখাটাই নিয়ম। সারা রাতের পর ভোরের একেবারে শুরুর দিকে একদমে পান করতে হবে তাকে জিনিসটা, এর কোন অন্যথা করা যাবে না।
যদিও ওটা গেলার কথা কল্পনা করামাত্রই ভিতর থেকে সমস্তকিছু বেরিয়ে আসার উপক্রম হচ্ছে বিমলের। কিন্তু করার কিছুই নেই তার; হাত-পা বাঁধা। সাধনার উপরিস্তরে উন্নীত হওয়ার জন্য অদ্ভুত এই শরবতটা গলাধঃকরণের কোন বিকল্পই নেই।
প্রত্যূষে পা টিপে-টিপে রান্নাঘরে গিয়ে মগটা বের করে আনল বিমল। বাইরে তখনও পুরোপুরি আলো ফোটেনি; নিজের ঘরে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে মালতি।
খানিকক্ষণ ইতস্তত করে ঠিকই শেষটায় নিজের গলায় ঢেলে দিল বিমল নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসতে চাইল তার, শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো; তবুও হাল ছাড়ল না সে। নিজের ওপর জোর খাটিয়ে গিলে নিল সবটুকু শরবত, খালি করে ফেলল মগটা। তারপর চোখ বুজে বসে রইল নিজের জায়গায়; শরীরটা কেমন- কেমন যেন করছে তার।
এহেন অখাদ্য একটা জিনিস পেটে চালান করার পর প্রচণ্ড অস্বস্তি লাগার কথা, পেট নেমে যাওয়ার কথা। উল্টো নিজের ভিতরে রাজ্যের ক্ষুধা অনুভব করল বিমল! এই মুহূর্তে প্রাগৈতিহাসিক ম্যামথ সামনে পেলেও যেন কাঁচা চিবিয়ে সাবাড় করে ফেলতে পারবে সে!
ঠিক এমনটাই অবশ্য লেখা ছিল ডাইরিটায়!
অপরিমেয় ক্ষুধা একটা প্রাণীকে ঠিক কতটা বিচলিত করে তুলতে পারে, সেটাই এখন অনুভব করবে বিমল। কোন সাধারণ খাবারেই এই বিশেষ ক্ষুৎপিপাসা মিটবার নয়। গোটা একটা দিন দুর্যোগটা কাটানোর পর, রাতে খুলতে হবে ডাইরির পরবর্তী পাতাটা; ওতেই মিলবে সমাধান।
বহুদিন পর আবারও সেদিন অফিসের উদ্দেশে তৈরি হলো বিমল। যাত্রাপথে আবুল মিয়ার টঙ দোকানে রোজকার এক কাপ চা আর দুটো টোস্ট বিস্কিটের বদলে, ভরপেট খাবার খেল সে।
চার প্যাকেট মিষ্টি বিস্কিট, দুটো বড় পাউরুটি, দশ কাপ চা আর গোটা পনেরো সেদ্ধ ডিম খেয়ে, আবুল মিয়ার ছানাবড়া চোখজোড়াকে পেছনে রেখে অফিসের উদ্দেশে পা বাড়াল বিমল। তখনও তার পেটের আগুন একরত্তিও নেভেনি!
কিন্তু আবুলের দোকানে এর বেশি আর খাওয়ার উপায় ছিল না। কারণ কেবল দোকানীই নয়, অন্য সব খদ্দেররাও বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে ছিল তার দিকে! এতগুলো মানুষ অপলক তাকিয়ে থাকলে, কারই বা আর খেতে ইচ্ছে করে!
অফিসে ঢুকেই রাঘবকে উচ্চস্বরে বার কয়েক ডাকল বিমল। কান দিল না রাঘব; বিমলকে পাত্তা না দিয়েই অভ্যস্ত সে। গড়িমসি করে অনেকটা সময় কাটিয়ে, তবেই বিমলের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে।
মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘কী কাম?’
‘কিছু খাবার এনে দাও। জলদি।’
‘অহন পারুম না। অন্য কাম আছে। বড় সাব যে কোন সময় ডাকবার পারে।’
নিজের ভাগ্যের লিখন সম্পর্কে যদি বিন্দুমাত্রও ধারণা থাকত রাঘবের, ভুলেও, আজ বিমলের সঙ্গে বেয়াদবি করত না সে!
বিদ্যুৎ গতিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বিমল, সজোরে চেপে ধরল রাঘবের ইউনিফর্মের কলার। তারপর দেহের সর্বশক্তি দিয়ে একখানা রামচড় বসিয়ে দিল তার ডান গালে। ছিটকে দু’হাত দূরে গিয়ে পড়ল রাঘব, মাথাটা বোঁ-বোঁ করে ঘুরছে তার। বিমলের হাতটা তার গাল ছোঁয়ার আগ পর্যন্ত ঘটনার কিছুই আঁচ করতে পারেনি সে।
কোনমতে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল সে, চেয়ারের হাতল খামচে ধরে নিজেকে ফের পতনের হাত থেকে রক্ষা করল। তারপর হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকাল বিমলের অগ্নিশর্মা চেহারাটার দিকে।
চার চোখের মিলন হতেই আতঙ্কে রীতিমত কুঁকড়ে গেল রাঘব। চোখ তো নয়, যেন এক জোড়া অঙ্গার!
কী হয়েছে লোকটার? রাতারাতি এভাবে বদলে গেল কেমন করে? আজ কেবল ভগবানই পারেন এই দানবের হাত থেকে তাকে রক্ষা করতে।
‘ছোটলোকের বাচ্চা,’ হিসহিসিয়ে বলল বিমল। ‘আর কখনও যদি আমার মুখে-মুখে কথা বলিস, জুতোর তলা দিয়ে তোর ঠোঁট দুটো একদম থেঁতলে দেব আমি।’
তীব্র আতঙ্কে কাঁপতে-কাঁপতে বিমলের কথাগুলো শুনল রাঘব; নড়াচড়া করার সাহসটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। অবশ্য ভয় কেবল সে-ই নয়, অফিসের বাদবাকি সবাই-ই পেয়েছে। উপস্থিত সবক’টা চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার চেষ্টায় মত্ত; পলক পড়ছে না কারও চোখে! নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছে সব ক’জন মানুষ, সত্যিই কি খানিকক্ষণ আগে কিছু ঘটেছিল এখানে? নাকি সবটাই ভ্ৰম?
সেদিন অন্তত দশ বার বিমলের জন্য খাবার আনতে বাইরে গেল রাঘব, ভুলেও একটা সেকেণ্ড বাড়তি সময় নষ্ট করেনি সে। অন্য কেউও রাঘবকে সেদিন কোন কাজের ফরমায়েশ দিল না; পাছে ওকে না পেয়ে রেগে যায় বিমল!
মিনিট পাঁচেকের জন্য বিমল একবার টয়লেটে যেতেই জাদুমন্ত্রের মত উধাও হয়ে গেল তার টেবিলের বেশিরভাগ ফাইল! সবাই আজ নিজেদের কাজ নিজেরাই করবে; জলদি বাড়ি ফেরার তাড়া নেই আজ কারও!
সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার আগে অন্তত পাঁচটা রেস্টুরেন্টে ঢু মারল বিমল। প্রতিটাতেই অন্তত দশ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের খাবার পেটে চালান করল সে।
বিরিয়ানি, সাদা ভাত, মোরগ-পোলাও, মণ্ডা-মিঠাই, কিছুতেই কিছু হলো না; উদরের এক কোনাও ভরল না তার। পিপাসায় বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো; প্রশান্ত মহাসাগরের সমস্ত জল গিললেও যেন সেই রাক্ষুসে পিপাসা মিটবার নয়!
বিফল মনোরথে ঘরে ফিরে আবারও দাদার ডাইরিটা হাতে তুলে নিল বিমল, তড়িঘড়ি করে খুলল সমাধান লেখা সেই বিশেষ পাতাটা।
পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে কেবল একটামাত্র শব্দই লেখা ছিল, তাতে, ‘মানুষের মাংস!’
ছয়
গভীর রাতে নিজের জন্য রাঁধতে বসল বিমল। পুরো মহল্লা ততক্ষণে ঘুমিয়ে কাদা, সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে চরাচরে।
অন্যান্য দিন রাত-বিরেতে চৌকিদারের হাঁকডাক শোনা যায় বটে, তবে আজ সেটাও অনুপস্থিত। নেড়ি কুকুরের দল কোথায় কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে, কে জানে! ওদেরও কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
আপনমনে খানিকক্ষণ হাসল বিমল। বহুদিন পর আজ উনুনে হাঁড়ি চড়িয়েছে সে; অথচ একটা সময় রোজই তাকে কিছু না কিছু রাঁধতে হত। রান্নার হাত বরাবরই ভাল ছিল তার। যে-ই খেয়েছে, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা না করে পারেনি।
তবে বিয়ের পর আর খুব একটা বাবুর্চিগিরি করার মওকা পায়নি সে। পুরুষ মানুষ রসুই ঘরের হাঁড়ি-পাতিলের চারপাশে ঘুর-ঘুর করবে, ব্যাপারটা ভীষণ অপছন্দ ছিল মালতির।
সে রাতে তৃপ্তি সহকারে উদরপূর্তি করে আহার করল বিমল। মূষিক-সাধকের নিদান অনুযায়ী, তার পেটের রাক্ষুসে খিদেটাও মিটে গেল পুরোপুরি!
মাংসের সালনটা অবশ্য বেশ ঝাল হয়েছিল, তবে তাতে খুব একটা সমস্যা হয়নি বিমলের।
বেঁচে থাকতে যে পরিমাণ ঝাঁঝ ছিল মালতির, খানিকটা বাড়তি ঝাল না দিলে তার মাংস মুখে রুচত কিনা কে জানে!
সাত
এক বিকেলে বাক্স-পেটরা নিয়ে নিজের গ্রাম, বিজয়পুরে গিয়ে হাজির হলো বিমল। সীমান্তের কাছাকাছি টিলাটক্কর আর খানাখন্দে ভরা একটা পাহাড়ি গ্রাম, বিজয়পুর। বিমলের পৈতৃক ভিটাটা এখনও রয়ে গেছে, বিক্রি করেনি সে।
তার বেশ কিছু চাষবাসের জমিও আছে ওখানে, তবে ওগুলোর খোঁজ খুব একটা রাখে না সে। দূরসম্পর্কের চাচা-জ্যাঠারাই আজতক ভোগদখল করে আসছে জমিনগুলো।
বাড়িটাও এতদিনে জবরদখল হয়ে যেত নির্ঘাত; তবে একটা পুরানো কুসংস্কারই রক্ষা করে চলেছে ওটাকে।
আড়ালে আবডালে পাগল বললেও, বিমলের দাদাকে ঠিকই ভয় পেত লোকে। সেই ভয়টা এখন অবধি কাটেনি। তার যে বিশেষ কিছু ক্ষমতা ছিল, এ নিয়ে দ্বিমত নেই কারও। এমন একজন কামেল তান্ত্রিকের বসতভিটা দখলের কথা কল্পনাও করতে পারে না ওরা। জরাজীর্ণ একটা ইমারতের লোভে নিজেকে নির্বংশ করার কোন মানে হয় না।
আদতেই বেহাল দশা বাড়িটার। কী করে যে এখনও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটাই বিস্ময়কর! সীমানা প্রাচীর বহু আগেই মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, ফটকের কোন বালাই নেই। পুরো বাড়ি জুড়ে ঝোপঝাড় আর আগাছার দঙ্গল, পায়ে হাঁটার পথটুকুও নেই।
দালানটার মুমূর্ষু দশা, রীতিমত ধুঁকছে। বাতাসের একটা জোরদার ধাক্কায়, হুড়মুড় করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। রঙের কোন বালাই নেই, পলস্তারা খসে দেয়ালের হাড় বেরিয়ে পড়েছে বেশিরভাগ জায়গায়।
এক সময় যেখানে দরজা-জানালা নামের বস্তুগুলো ছিল, এখন সেখানে শুধুই শূন্যতা; কালো ফোকর। খানিকটা ডান দিকে হেলে আছে রুগ্ন ছাত; জমিনের আহ্বানে সাড়া দিতে পুরোপুরি প্রস্তুত!
হাজার টাকা সাধলেও কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এ বাড়িতে জীবন যাপন করতে রাজি হবে বলে মনে হয় না।
তবে আজ রাতটা বিমলকে এখানেই কাটাতে হবে! কারণ ডাইরির বয়ান মোতাবেক, সাধনার শেষ লগ্নে এ বাড়িরই কোথাও উন্মুক্ত হবে নরকের পথটা!
বিমলের এই আকস্মিক আগমনে তার আত্মীয়স্বজনদের কেউই ঠিক খুশি হতে পারল না। তারা বিমলের সঙ্গে দেখা করতে এল মুখ ভার করে। সবার বদ্ধমূল ধারণা, বিমল এবারে নির্ঘাত সমস্ত জমিজমা বিক্রি করতে এসেছে! হয়তো কোন কারণে টাকাপয়সার টানাটানি চলছে তার, তাই দেখতে এসেছে এখানকার সহায়সম্পত্তি বিক্রিবাট্টা করে কিছু পাওয়া যায় কিনা।
এতদিন ভোগদখল করতে-করতে জমিগুলো নিজেদেরই ভাবতে শুরু করেছিল ওরা। ভাবতেও পারেনি, ন্যায্য দাবি নিয়ে কোন একদিন আচমকা এসে হাজির হবে ওগুলোর প্রকৃত মালিক!
শঙ্কর জ্যাঠার মুখটাই বেজার বেশি; বিমলের সিংহভাগ জমি তার দখলেই আছে কিনা!
শুকনো স্বরে বিমলকে জিজ্ঞেস করল সে, ‘তা হঠাৎ কী মনে কইরা গেরামে আইলা, ভাতিজা?’
হাসল বিমল। ওদের মনে কী চলছে, আন্দাজ করতে কষ্ট হচ্ছে না তার। ‘এমনিতেই এলাম। বিশেষ কোন কারণ নেই। অনেকদিন আসার সুযোগ হয়নি। তাই ভাবলাম, একবার এসে ঘুরে যাই। আপনাদের সবার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই। আপনারা ছাড়া আপন বলতে আর কে-ই বা আছে আমার।’
ঠোঁটে হাসি ফোটানোর বৃথা চেষ্টা করল শঙ্কর। ‘ভালাই করসো, ভাতিজা। সেই যে শহরে চইলা গেলা, আর তো গেরামে পা-ও ফেললা না।’
সেজন্যই এলাম এবার। দিন দুয়েক থাকব, তারপর আবার ফিরে যাব শহরে।’
‘জমি-জিরাতের কোন কারবার আছেনি, ভাতিজা?’ খুব সাবধানে প্রশ্নটা করল শঙ্কর।
‘আরেহ, না, না,’ তাকে আশ্বস্ত করল বিমল। ‘আমি কেবল দাদার ভিটায় দুটো দিন থাকতে এসেছি। অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই।’
এবারে দাঁত কেলানো হাসি ফুটল শঙ্করের মুখে; অন্যদেরও যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। আচমকা বিমলকে সমাদর করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই।
‘এই বাড়িতে তো আর রাইতে থাহনের উপায় নাই। তুমি আমাগো বাড়িতে চলো। সকালে নাহয় সবকিছু ঘুইরা দেইখো,’ বলে উঠল বিমলের চাচা, আদিত্য।
মাথা নাড়ল বিমল। ‘না, খুড়ো মশাই। আমাকে রাতে এই বাড়িতেই থাকতে হবে। যদি একটা ঘর খানিকটা পরিষ্কার করে দেন, আর রাতে জ্বালানোর মত একটা লণ্ঠন পাওয়া যায়; তাহলেই চলবে।’
‘কও কী তুমি! এইহানে ক্যামনে থাকবা রাইতে! ভূত-প্রেতের কথা নাহয় বাদই দিলাম, সাপ-খোপেরও তো অভাব নাই পুরা বাড়িতে।’
কাঁধ ঝাঁকাল বিমল; হাসছে। ‘সমস্যা হবে না, খুড়ো মশাই। সঙ্গে করে কার্বলিক এসিড নিয়ে এসেছি আমি।’
একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল সমবেত জনতা, ঠোঁটে কোন রা নেই কারও। কেন এই পোড়ো বাড়িতে রাত কাটাতে গোঁ ধরেছে বিমল, এটা কারোরই মাথায় আসছে না!
বয়স্ক একজন মানুষকে তো আর জোরও করা যায় না তেমন। কী বলবে, কিছুই মাথায় আসছে না ওদের।
অবশেষে অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভাঙল শঙ্কর। হতাশ গলায় বলল, ‘খাওন? রাইতের খাওড়া তো অন্তত আমাগো লগে খাইবা, নাকি?’
‘তা খাওয়া যায়। এতে কোন আপত্তি নেই আমার,’ হাসিমুখে জবাব দিল বিমল।
হাঁফ ছাড়ল সবাই। সদলবলে বিমলকে এগিয়ে নিয়ে গেল শঙ্করের বাড়ির উদ্দেশে।
অল্প সময়ে বেশ জমকালো আয়োজনই করা হলো বিমলের জন্য। জানা- অজানা অজস্র পদে বোঝাই হয়ে গেল খাবার টেবিল।
আরও বহুবছর ফসলের খেতগুলো ভোগদখল করতে পারবে, এই নিশ্চয়তা পেয়ে হাত খুলে খরচ করেছে শঙ্কর; কোন কার্পণ্য করেনি
দ্বিগুণ মাইনেতে ঠিক করা দু’জন দিনমজুর গিয়ে বাড়িটার সবচেয়ে বড় ঘরটা যথাসম্ভব সাফসুতরো করে দিল; ওটাতেই রাত কাটাবে বিমল। একটার বদলে দুটো লণ্ঠনের ব্যবস্থা করা হলো, সারা রাত ধরে আলো দেবে ওগুলো। চারপাশে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দেয়া হলো কার্বলিক এসিড; সাপের দল এই জিনিসটা একেবারেই সহ্য করতে পারে না।
অবশেষে ভূরিভোজের পর গ্রামের মান্যগণ্য মানুষজনের সঙ্গে ভাব বিনিময় শেষে, নিজের বাড়ির উদ্দেশে পা বাড়াল বিমল। দু’জন জোয়ানমর্দ লোক তাকে বাড়িটার সীমানা অবধি এগিয়ে দিয়ে গেল। ঘড়ির কাঁটায় সময় রাত এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট।
.
নিশুতি রাতে আগের চেয়েও অনেক বেশি ভুতুড়ে দেখাচ্ছে বাড়ির কাঠামোটাকে কোণের ঝাঁকড়া নিম গাছটার ডালগুলো এমনভাবে দুলছে, যেন প্রচণ্ড আমোদে মাথা ঝাঁকাচ্ছে কোন দুষ্ট প্ৰেত!
আকাশে চাঁদ আছে, তবে জোছনাটা কেমন যেন ঘোলাটে। পাতলা মেঘের সার্বক্ষণিক আনাগোনা স্বচ্ছন্দে আলো বিলাতে বাধা দিচ্ছে ওটাকে।
দ্রুত কাপড়-চোপড় ছেড়ে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে গেল বিমল। হাত বাড়িয়ে কমিয়ে দিল লণ্ঠনগুলোর আঁচ। এখন আর কেউ আচমকা ঘরে ঢুকলে আবছা আলো- আঁধারিতে চট করে দেখতে পাবে না তাকে।
অবশ্য কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামবাসীদের কেউই যে মাঝরাতে এ বাড়িমুখো হবে না, এই ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত বিমল। তবুও সতর্ক থাকা ভাল। গাঁয়ে একটা সম্মান আছে তার, অযথা সেটা খোয়ানোর ঝুঁকি নেয়ার কোন মানেই হয় না।
পুঁটলির ভিতর থেকে দুর্গন্ধময় একটা তেলের শিশি বের করল বিমল; আচ্ছামতন মেখে নিল সারা শরীরে। সিন্দুকে পাওয়া বোতাম আকৃতির পাথরগুলো বের করে বড় একটা বর্গ তৈরি করল মেঝেতে। তারপর ওর ভিতর গিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ছাতের একটা ফাটলের দিকে; মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করছে।
তারপর ধীরে-ধীরে চোখ মুদল সে; মূষিক-সাধনার মন্ত্র জপতে শুরু করল। পুরো দেহটা মূর্তির মত অনড় তার, শুধু ঠোঁটদুটো ক্রমাগত ওঠানামা করছে।
দেখতে-দেখতে পেরিয়ে গেল অনেকটা সময়, কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। শুধু ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেল বিমলের বিবস্ত্র শরীরটা।
এক মুহূর্তের জন্যও মন্ত্র জপা থামাল না সে, ঠোঁটজোড়া নড়ে চলল অনর্গল। বাইরে ততক্ষণে একাকী চাঁদকে ঘিরে ধরেছে দস্যু মেঘেরা।
অনেক-অনেকক্ষণ পর মাটির গভীরে মৃদু একটা কম্পন অনুভব করল বিমল; সেই সঙ্গে দূরাগত মেঘের গর্জনের মতন ভোঁতা একটা আওয়াজ। যেন বহুদূর থেকে ধেয়ে আসছে বিশাল একটা অশ্বারোহীর দল!
পলকের জন্য এক চিলতে হাসি ফুটল বিমলের ঠোঁটের কোনায়, মন্ত্র জপার গতি আরও বাড়িয়ে দিল সে। অন্ধকার জগতের সমস্ত মূষিক অপশক্তিকে আহ্বান করছে সে। আগের মতই বুজে রেখেছে চোখ দুটো; খোলার সময় হয়নি এখনও।
ধীরে-ধীরে বাড়তে লাগল কম্পনটা, মেঘের গর্জনটাও যেন অনেকখানি কাছিয়ে এল। মন্ত্র জপা চালিয়ে গেল বিমল।
অবশেষে একটা বোটকা গন্ধ ভক্ করে এসে ধাক্কা দিল তার নাকে। গন্ধটা তার অতি চেনা, ইঁদুরের গন্ধ!
নিজের ওপর অসংখ্য চোখের দৃষ্টি অনুভব করল বিমল, একেকটা সুচের মতই যেন ছুটে এসে শরীরে বিঁধছে ওগুলো!
বার কয়েক কেঁপে উঠল বিমলের নেত্র-পল্লব; ধীরে-সুস্থে চোখ মেলল সে। জানে, কী দেখতে পাবে; তবুও এপাশ-ওপাশ মাথা ঘুরাল ও।
লক্ষ-কোটি ইঁদুর সারিবদ্ধভাবে ঘিরে রেখেছে বর্গটাকে। কুঁতকুঁতে চোখে তার দিকেই অপলক তাকিয়ে আছে নরকের বাসিন্দাগুলো!
ওকে চোখ মেলতে দেখেই নড়ে উঠল ইঁদুরের দল; সার বেঁধে এগিয়ে গেল বাইরের দিকে।
দ্রুত উঠে দাঁড়াল বিমল। ইঁদুরের দলের পিছু নিয়ে সম্মোহিতের মত বেরিয়ে এল খোলা বারান্দায়।
আকাশের চাঁদ ততক্ষণে হার মেনে নিয়েছে কালো মেঘের কাছে, তবে সামনের দৃশ্যটা ঠিকই পরিষ্কার দেখতে পেল বিমল।
আগাছার দঙ্গলের মধ্যখান দিয়ে প্রশস্ত একখানা রাস্তা তৈরি হয়েছে, এই পথেই ঘর অবধি এগিয়ে এসেছে অগণিত ইঁদুর।
পথটা গিয়ে শেষ হয়েছে আঙিনার একেবারে শেষ প্রান্তে, একটা কুয়োর মুখে। আজ বিকেলেও কুয়ার চাড়িটা আবর্জনা আর জংলায় ঢাকা ছিল। আগে থেকে জানা না থাকলে, কেউ ভাবতেও পারবে না, ওখানে একটা মান্ধাতা আমলের কুয়োমুখ লুকিয়ে আছে!
কিন্তু এই মুহূর্তে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ওটাকে। কোন সন্দেহ নেই, ওই কুয়োর ভিতর দিয়েই পাতাল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে ইঁদুরের দল; ওটাই নরকে যাওয়ার পথ!
মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গিয়ে কুয়োটার ভিতরে উঁকি দিল বিমল, তাকে সঙ্গ দিল সুশৃঙ্খল মূষিকের পাল।
কুয়োর ভিতরের দেয়ালটা আগে একেবারে মসৃণ ছিল। এখন সেখানে খানিক বাদে-বাদে খোঁড়ল তৈরি করে একটা মইমতন বানানো হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা ইঁদুরদেরই কাজ।
এক মুহূর্তের জন্যও ইতস্তত করল না বিমল, ধাপগুলো বেয়ে নীচে নামতে শুরু করল। দ্রুত হাত-পা চালাচ্ছে সে; যত জলদি সম্ভব কুয়োর তলায় পৌঁছতে চায়।
ছায়ার মত তার সঙ্গে সেঁটে রইল মূষিকের পাল, জলস্রোতের মত কুয়োর দেয়াল বেয়ে নামতে শুরু করেছে ওরা।
বিমল নামছে তো নামছেই; এই অবরোহণের যেন কোন সমাপ্তি নেই! তার হাত-পায়ের পেশিগুলোঁ প্রচণ্ড ব্যথা করছে, মস্তিষ্কের আদেশ আর শুনতে চাইছে না।
মাথার ওপরের কুয়োমুখটা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে-হতে একসময় একটা বিন্দুর আকার ধারণ করল, তবুও শেষ হলো না উলম্ব পথটা। অবশেষে যে-ই না হাল ছেড়ে দিয়ে নীচের অন্ধকারে নিজেকে সঁপে দিতে যাবে বিমল, ঠিক তখনই কুয়োর তলায় পৌঁছে গেল সে!
মেঝেতে শরীর এলিয়ে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিল বিমল। শ্বাসের তালে-তালে হাপরের মতন ওঠানামা করছে তার পাঁজরের হাড়। টনটন করছে গোটা দেহের সবক’টা মাংসপেশি।
আচমকা একটা গুঞ্জন কানে এল তার। গুঙিয়ে উঠেছে ইঁদুরের দল, যেন তাড়া দিচ্ছে তাকে!
ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল বিমল। কুয়োর বাম পাশে একটা সুরঙ্গমুখ দেখতে পেয়ে হাঁটা শুরু করল ওটা ধরে। পথটা নতুন, সদ্যই খোঁড়া হয়েছে। ভিতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, খুব একটা প্রশস্তও নয়। খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে বিমলকে।
চোখে তেমন কিছু দেখতে না পেলেও আশপাশে ইঁদুরদের উপস্থিতি স্পষ্ট টের পাচ্ছে সে। এখনও তার চলনদারের ভূমিকা পালন করে চলেছে ওরা।
সুরঙ্গ পথে মাটির তলা দিয়ে ক্রমাগত দক্ষিণে এগিয়ে চলেছে বিমল। গাঁয়ের সবচেয়ে বড় পাহাড়টা ওদিকেই। ওখানকার মাটিতে কী যেন একটা সমস্যা আছে; কখনওই ওখানে ফসল ফলানো যায় না! এমনকী জুম চাষের চেষ্টাও বিফল হয়েছে প্রতিবার।
বিমলের মনে হচ্ছে, অনন্তকাল ধরে বুঝি পথ চলছে সে। তেপান্তরের মাঠ পেরোতেও তো এর চেয়ে কম সময় লাগার কথা!
আচমকা দৃষ্টিসীমার শেষপ্রান্তে খানিকটা আলোর আভা দেখতে পেল বিমল, সেই সঙ্গে অনুভব করল অদ্ভুত এক ধরনের খরতাপ!
যতই সে সামনে এগুতে থাকল, ততই বাড়তে লাগল ব্যাপারটার তীব্রতা। তাহলে কি সত্যিই অবশেষে নরকের দেখা পেতে চলেছে সে? নাকি আদতে কোন সুপ্ত আগ্নেয়গিরি ওটা?
এদিকে তার মাথার ওপর আমূল বদলে গেছে প্রকৃতি! বিনা নোটিশে ভয়াবহ এক ঝড় আঘাত হেনেছে বিজয়পুর গ্রামে। গাঁয়ের ছেলে-বুড়ো কেউই নিজেদের জীবদ্দশায় এতখানি তীব্র ঝড় ইতিপূর্বে কখনও চাক্ষুষ করেনি।
দমকা হাওয়ার প্রথম ঝাপটাতেই বিমলের পৈতৃক বসতবাড়িটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। শতবর্ষী গাছগুলো হেলে পড়ে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলল রুগ্ণ দালানটাকে।
বানের জল তীব্র বেগে ছুটে গেল কুয়োটার দিকে। প্রচণ্ড আক্রোশে ভেঙে খান-খান করে ফেলল ফুট চারেক উঁচু চাড়িটা, তারপর ভয়ানক তর্জন-গর্জন করতে-করতে রওয়ানা হলো পাতাল অভিমুখে!
ধেয়ে আসা জলের গর্জনটা যতক্ষণে শুনতে পেল বিমল, কিছুই আর তখন করার নেই তার।
আচমকা সুনসান পাতালপুরীতে নিজেকে ভীষণ একা লাগল তার। মূষিকের পাল কোন্ ফাঁকে বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে, সেটা সে টেরও পায়নি। পরক্ষণে মালতির মায়াকাড়া মুখ আর অমলের নিষ্পাপ চাহনি ভেসে উঠল তার মনের পর্দায়। পাষাণ মাটির বুকে গড়িয়ে পড়ল দু’ফোঁটা অশ্রুজল।
ঘোরলাগা দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ পিছনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল বিমল। মাথার ওপরের চেনা পৃথিবীটাতে আর কখনও ফেরা হবে না তার; ভাবনাটা ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে তাকে।
আচমকা প্রাণপণে সামনের দিকে ছুটতে শুরু করল সে; জীবিত অবস্থায় একটিবারের জন্য হলেও নরক দেখতে চায়!
জলের স্তম্ভটা তাকে ছুঁয়ে ফেলার আগ পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যও হাল ছাড়েনি বিমল কর!
প্রাগৈতিহাসিক
ডক্টর ব্যারনের এই বাড়িটা অনেকটা দুর্গের মত। শহর থেকে দূরে টিলার ওপর অনেকখানি জায়গা জুড়ে বিশালকায় দালান, চারপাশে আকাশছোঁয়া সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। পুরো এলাকায় প্রাচীরটাকে সঙ্গ দিচ্ছে সুগভীর একটা পরিখা। শোনা যায়, এককালে এই পরিখায় জীবন্ত কুমিরের বসবাস ছিল; কোথাও- কোথাও ছিল প্রাণঘাতী চোরাকাদা।
প্রধান ফটকটা ছাড়া বাড়িটা থেকে বেরনোর দ্বিতীয় কোন পথ নেই। ওখানটায় পরিখার ওপর লোহার একটা ঝুলসেতু আছে, প্রয়োজনমত ওঠানো-নামানো যায়।
সম্ভবত কাৰ্কান দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যই এহেন নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করার প্রয়োজন হয়েছিল।
পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া বাড়িটা তৈরি করেছিলেন ডক্টর ব্যারনের প্রপিতামহ। তাঁর আমলে প্রায়ই এদিকটায় কার্কানদের উৎপাতের কথা শোনা যেত। ওদের নৃশংসতার কাহিনিগুলো এতটাই নির্মম যে, আজও ওগুলো শুনলে যে কারও গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাবে।
বাড়ির লনটা বিশাল। যত্ন নেয়ার জন্য বাঁধা মালি রয়েছে, তাই পুরো আঙিনার সবুজ ঘাসের গালিচা একই রকম পুরু।
লনের শেষপ্রান্তে গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একসারি ইউক্যালিপটাস গাছ; আচমকা তাকালে গা ছম ছম করে ওঠে। মনে হয়, অশুভ একদল প্রেত এসে হাজির হয়েছে জায়গাটায়, যে কোন মুহূর্তে হামলে পড়বে সবার ওপর!
সবচেয়ে অদ্ভুত বাড়িটার বেজমেন্ট। এতটা বিরাট সেলার সাধারণত দেখা যায় না। অনায়াসে ওটাকে একটা ইনডোর স্টেডিয়াম বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। আলাদা কোন পার্টিশান নেই, পুরোটাই ফাঁকা। কেবল নিয়মিত বিরতিতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকাণ্ড থামগুলো ছাদটার ভার বহন করছে।
ঠিক কী কারণে জায়গাটাকে এতটা বিশাল আকৃতি দেয়া হয়েছিল, আজ আর সেটা জানার উপায় নেই। তবে এতে যে ডক্টর ব্যারনের মস্ত উপকার হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই!
খাস কামরায় নিজের স্টাডি টেবিলে বসে আপনমনে কী যেন ভাবছেন ডক্টর। চেহারা থমথমে; হৃদয়ের বিষণ্ণতা বক্ষ পিঞ্জর ভেদ করে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা অবয়বে।
টেবিল ল্যাম্পটা ছাড়া আপাতত আর কোন বাতি জ্বলছে না ঘরে। আলোর রেখার বাইরের আবছা অন্ধকার, সেই সাথে বাড়ির মালিকের বিমর্ষতা, পুরো পরিবেশটাকে অনেকখানি ভারী করে তুলেছে। তবে সুখের বিষয়, সেটা দেখার জন্য এই মুহূর্তে দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি উপস্থিত নেই ঘরটায়।
একাকী জীবন যাপন করেন ডক্টর ব্যারন। বিয়ে করেননি, তাই ছেলেমেয়েও নেই। বলতে গেলে গোটা জীবনটাই বিজ্ঞান সাধনায় কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি।
ল্যাবোরেটরিতে কাটিয়েছেন দিনের পর দিন, অভিযানে গেছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। দেখতে-দেখতে কীভাবে যে ছোট্ট জীবনটার সিংহভাগ কেটে গেল, সেটা তিনি টেরও পাননি। তবে তাঁর এ নিয়ে কোন আফসোস নেই। নিজের কাজে যতটুকু আনন্দ পেয়েছেন, জীবনের কাছে এর বেশি কিছু চাওয়ার ছিল না তাঁর।
আত্মীয়দের কারও সাথেই তেমন একটা যোগাযোগ নেই। একজন ছন্নছাড়া অসামাজিক বিজ্ঞানীর সাথে কে-ই বা আর যেচে পড়ে দিনের পর দিন যোগাযোগ রাখবে? আজকাল তো প্রত্যেকেই নিজের জীবন নিয়ে ভীষণরকম ব্যস্ত।
তাছাড়া ঘরোয়া আড্ডার সঙ্গী হিসেবে খুব একটা সুবিধার নন ডক্টর ব্যারন। প্রচলিত চটকদার বিষয়-আশয় সম্পর্কে কোনরকম ধারণা না থাকায়, প্রায় সারাক্ষণই মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। তখন পেটে বোমা মারলেও তাঁর মুখ দিয়ে কথা বের করা যায় না।
এহেন মুখ ভার করে থাকা প্রায়-বোবা একজন অতিথিকে নিমন্ত্রণ করে নিজের সাধের পার্টির বারোটা বাজাতে কারই বা ইচ্ছে হবে?
দৈহিক শক্তিতে ভাটা পড়ায় বৈজ্ঞানিক সম্মেলনগুলোও আজকাল এড়িয়ে চলেন ডক্টর। তাই বন্ধুদের সাথেও এখন আর খুব একটা দেখা হয় না তাঁর। নিঃসঙ্গ জীবনে, বলতে গেলে বই-ই এখন তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী।
সাতপাঁচ ভেবে নিয়ে চিঠি লেখার প্যাড আর নিজের প্রিয় কলমটা কাছে টেনে নিলেন ডক্টর ব্যারন। তারপর মাথা নিচু করে লিখতে শুরু করলেন…
প্রিয় বন্ধু,
জানি, আমার এ চিঠিখানা তোমাকে ভীষণ অবাক করবে। যে মানুষটা গত পাঁচ বছরে একটিবারের জন্যও তোমার খোঁজ নেয়নি, সে যদি অভিমান ভুলে আচমকা বিশাল একখানা চিঠি লিখে বসে, বিস্মিত হওয়াটা সেক্ষেত্রে দোষের কিছু নয়।
নাহয় ঝগড়াটা সেদিন আমিই বাধিয়েছিলাম, হয়তো আমার রাগারাগিটাও মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল; তাই বলে তোমারও কি রাগটা এতদিন পুষে না রাখলে চলছিল না, বাপু?
আমাদের বয়স বেড়েছে ঠিকই, তবে ভিতরে-ভিতরে আমরা এখনও ছেলেমানুষই রয়ে গেছি। তাই না, প্রফেসর?
এই মুহূর্তে তোমার সাহায্য আমার ভীষণ প্রয়োজন, বন্ধু। বলতে পারো, এ কারণেই তোমার প্রতি পুঞ্জীভূত অভিমানটুকু স্বার্থপরের মত জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে আমাকে।
ভেবে দেখলাম, চোখ বুজে বিশ্বাস করে সব কথা খুলে বলা যায়, তুমি ছাড়া এমন আর কেউ নেই আমার। অন্য যারা বিশ্বাসী আছে, অন্তত এ ব্যাপারটায় কিছুতেই ওদেরকে জড়ানো যাবে না।
না বুঝে ঝামেলা বাধিয়ে বসতে পারে ওরা, ঝুঁকিটা নেয়ার কোন ইচ্ছে নেই আমার।
বিষয়টা গোপন, অনেক বেশি স্পর্শকাতর। আশা করি, বিস্তারিত শোনার পর সবকিছু জলের মত পরিষ্কার হয়ে যাবে তোমার কাছে।
ঠিক একারণেই তুমি মহাবিরক্ত হবে জানা সত্ত্বেও আমার সর্বশেষ অভিযানের আদ্যোপান্ত তুলে ধরতে চলেছি এ পত্রে। তেতো ওষুধ গেলার মত করেই নাহয় গিলে নাও চিঠিটা। পড়েছ মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে; কী আর করা!
আরকেইন ন্যাশনাল পার্কে তুমি কখনও যাওনি, জানা আছে আমার। বেশ কয়েকবারই আমার অভিযানের সঙ্গী হতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম তোমাকে। কিন্তু প্রতিবারই আমাকে তুমি যারপরনাই নিরাশ করেছ।
আচ্ছা, বিশ্ববিদ্যালয়ের একগাদা ইঁচড়ে পাকা ছেলেমেয়েকে তোতাপাখির মত লেকচার দিয়ে কী সুখ পাও তুমি, বলো তো? কেন অহেতুক জীবনটাকে এভাবে অপচয় করলে?
অথচ কী দারুণ মেধাবীই না ছিলে তুমি! পৃথিবীকে কত কিছুই না দেয়ার ছিল তোমার! আর তুমি কিনা বেছে নিলে বাচ্চা পড়ানোর চাকরি!
আচ্ছা, থাক, থাক, ঘাট হয়েছে আমার। রাগে ফুলকো লুচির মত আর ফুলতে হবে না তোমাকে; কাজের কথায় ফিরছি।
নামে ন্যাশনাল পার্ক হলেও আরকেইন পুরোপুরি বুনো; নামের মতই রহস্যময়। ওখানে এমন অনেক জায়গা আছে, আজতক যেখানে সভ্য মানুষের পা পড়েনি।
কিছু-কিছু অঞ্চলে এখনও বজায় আছে প্রাগৈতিহাসিক পরিবেশ, সময়ের কোন আঁচড় লাগেনি সেখানে।
ওখানকার মাটি-উদ্ভিদ-পাথর সবকিছুই আলাদা, একেবারে অন্যরকম। তোমাকে কেউ যদি চোখ বেঁধে ওখানটায় নিয়ে যায়, নির্ঘাত দৃষ্টি ফিরে পাওয়া মাত্র হতবিহ্বল হয়ে পড়বে তুমি। মনে হবে, টাইম মেশিনে চড়ে বুঝি প্যালিওলিথিক যুগে পৌঁছে গেছ!
ঠিক কী কারণে বিবর্তনের ধারাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জায়গাটা হাজার বছর ধরে অবিকল একইরকম রয়ে গেছে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ওসব অপ্রাসঙ্গিক সায়েন্টিফিক থিওরির কচকচানি তোমার অসহ্য লাগবে বলে সেদিকে আর গেলাম না এখন। তবে সাক্ষাতে তোমার সাথে এসব নিয়ে জম্পেশ আড্ডা দেয়ার খায়েশ আছে আমার। কিছু-কিছু ব্যাপারে তোমার মতামত জানতেও আগ্রহী আমি।
যা হোক, আরকেইনে ডেথ লেক নামে প্রকাণ্ড একখানা প্রাকৃতিক লেক আছে। ওটা এতটাই বিশাল যে, অনায়াসে ছোটখাট একটা উপসাগর বলে চালিয়ে দেয়া যাবে।
অসংখ্য ছোট-ছোট দ্বীপ আছে ওটায়, যার বেশিরভাগই এখনও অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। কারণ ডেথ লেক ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ, নামকরণটা অকারণে করা হয়নি। ক্ষণে-ক্ষণেই ওটার পানিতে প্রচণ্ড ঘূর্ণি তৈরি হয়, অনেকটা নদীর জোয়ার-ভাটার মত। তবে তফাৎ শুধু এটুকুই যে, জোয়ার-ভাটার মত নির্দিষ্ট কোন নিয়ম মানে না ঘূর্ণিটা। কখন এবং কোথায় যে আচমকা উদয় হবে ওটা, আগে থেকে বলার কোন উপায় নেই।
টানা তিরিশ দিন গবেষণা করেও নির্দিষ্ট কোন প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি ওটার।
বেশ কয়েকবার ওটার কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ। তাই আপাতত জলপথ এড়িয়ে চলছেন বিজ্ঞানীরা, আকাশপথে যেসব দ্বীপে যাওয়া সম্ভব কেবল সেগুলোতেই গবেষণা চালাচ্ছেন।
তবে আমাকে তো তুমি চেনই, ঘাড়ের রগ কতখানি বাঁকা সেটাও জান। সেই একগুঁয়েপনা থেকেই কিনা কে জানে, আমি ঠিক করলাম নৌপথেই দ্বীপগুলো চষে বেড়াব; উড়ুক্কু যান ব্যবহার করব না।
কোনরকম পিছুটান না থাকায় সিদ্ধান্তটা নেয়া আমার জন্য খুব একটা কঠিন ছিল না। তাছাড়া হাওয়াই যান ভীষণ ব্যয়বহুল, ল্যান্ডিং-এর সুবিধা না থাকলে সব জায়গায় যাওয়াও যাবে না ওগুলো দিয়ে। তাই অহেতুক ঝক্কি পোহানোর চেয়ে ঝুঁকি নেয়াটাই বরং সমীচীন মনে হলো আমার কাছে।
আমাকে অবশ্য একাই যেতে হলো, সফরসঙ্গী হিসেবে পেলাম না কাউকে। অনিশ্চিত যাত্রায় জান খোয়ানোর ঝুঁকি নিতে নারাজ সবাই।
প্রায় সবাই বিবাহিত, পরিবার-পরিজন রয়েছে, তাই আমিও কাউকে জোর করিনি। কী দরকার? একাকী মানুষ একসময় নিজের সঙ্গ উপভোগ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। একারণেই সঙ্গী-সাথীর অভাব কখনও কোন কাজে পিছপা করতে পারেনি আমাকে।
কোনরকম বিপত্তি ছাড়াই কাঙ্ক্ষিত প্রথম দ্বীপটায় পৌছলাম। আকারে ছোট, প্রায় ন্যাড়া। পুরোটা রেকি করতে ঘণ্টা দুয়েকের বেশি সময় লাগল না। উৎসাহব্যঞ্জক কিছু খুঁজে না পেয়ে রওয়ানা হলাম পরবর্তী দ্বীপটার উদ্দেশে।
পুরো এলাকাটার একটা ম্যাপ ছিল আমার কাছে, তবে ওটা ছিল আকাশ থেকে করা। পানির গভীরতা কিংবা ডুবো পাথরের কথা উল্লেখ ছিল না ওতে। তাই খুব সাবধানে দেখে-শুনে এগোতে হচ্ছিল আমাকে।
দ্বিতীয় দ্বীপটাতে পৌঁছতে-পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেল। তক্ষুণি আর কাজে নামলাম না। বোটের কেবিনেই রাত কাটানোর প্রস্তুতি নিলাম।
নিজের রাঁধা খাবার দিয়ে উদরপূর্তি করে শুয়ে পড়লাম। রান্নাটা আমি ভালই করি, কখনও সুযোগ পেলে চেখে দেখো।
ক্লান্ত ছিলাম, তাই চোখের পাতা ভারী হতে সময় লাগল না। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঠিক কতক্ষণ পর ঘুমটা ভেঙে গেল, নিশ্চিত করে বলতে পারব না; শোয়ার সময় ঘড়ি দেখিনি। তবে খুব বেশি সময় পেরোয়নি, ঘুমটা তখনও কাঁচা ছিল, এটুকু জোর গলায় বলতে পারি। কী কারণে ঘুমটা ভাঙল, ভাবছিলাম; ঠিক তখনই শুনতে পেলাম আওয়াজটা।
অদ্ভুত একটা চিৎকার; হাতি আর সিংহের গর্জন একত্রে মেশালে যেমন শোনাবে, অনেকটা ওরকম। একঘেয়ে, বিষণ্ণ, টানা-টানা।
অকারণেই ঘাড়ের কাছটা শির-শির করে উঠল।
তড়াক করে বিছানা ছাড়লাম। কোত্থেকে ভেসে আসছে, কীসে করছে চিৎকারটা, জানতে হবে আমাকে।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, মনে-মনে বেশ ভয় পাচ্ছিলাম আমি। তবে বৈজ্ঞানিকের সহজাত কৌতূহলী মন ভয়টাকে জয় করতে পেরেছিল।
সাথে শক্তিশালী টর্চ লাইট ছিল, বোটের ডেকে দাঁড়িয়ে আলো ফেললাম পাশের দ্বীপটার ওপর। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম চেনা-অচেনা গাছ, পাথুরে টিলা, কাঁটাঝোপের দঙ্গল। সেই সাথে কান পেতে রইলাম চিৎকারটা আবার শুনতে পাবার আশায়।
কিন্তু হতাশ হতে হলো আমাকে। অনেকক্ষণ সময় পেরিয়ে গেলেও আর শোনা গেল না ডাকটা। খোঁজাখুঁজিও সার হলো, কোন প্রাণীর দেখা পাওয়া গেল না।
গোটা কয়েক ব্যাঙ অবশ্য টর্চের আলোয় বিরক্ত হয়ে স্বেচ্ছায় ঝাঁপ দিয়েছিল লেকের জলে। তাদের ঝাঁপাঝাঁপি থেমে যাওয়া মাত্রই নীরব হয়ে গেল গোটা চরাচর, কোথাও কোন শব্দ নেই। যেন চির নৈঃশব্দ্যের রাজত্ব ওখানে!
ভেবে দেখলাম, চিৎকারটা দূরের কোন দ্বীপ থেকেও ভেসে আসতে পারে। একে নিশুতি রাত, জলের ওপর দিয়ে শব্দও অনেক দ্রুত ছোটে। তাই সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেয়ার কোন জো নেই। শুনে হয়তো অবাক হবে, বেশ খুশি মনেই সে রাতে দ্বিতীয়বারের মত বিছানায় গিয়েছিলাম আমি। নতুন কিছু খুঁজে পাবার আশাতেই আরকেইনে গিয়েছিলাম, অভিযানের শুরুতেই এতটা আগ্রহ জাগানিয়া কোন কিছুর সন্ধান পেয়ে যাব, কখনও কল্পনাও করিনি। উত্তেজনায় বলতে গেলে ঘুমই এল না আর, ছটফট করতে-করতেই কেটে গিয়েছিল বাকি রাতটা।
ভোরে হালকা নাস্তা সেরেই কাজে নেমে পড়লাম। দ্বীপটার এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত চষে বেড়ালাম পরম ধৈর্যের সাথে। জঙ্গল, ঝোপঝাড়, খানা- খন্দ, কিছুই বাদ দিলাম না। কিন্তু শিকে ছিঁড়ল না ভাগ্যে, পেলাম না কিছুই।
দুপুরের পর সিদ্ধান্ত নিলাম পাশের দ্বীপটায় চলে যাব। দৃষ্টিসীমার মধ্যেই ওটা, মাঝখানের দূরত্বটা বেশ কম।
গোছগাছ করে দ্রুত রওয়ানা হয়ে গেলাম, বিকেলটাও কাজে লাগাতে চাই।
এতসব উত্তেজনায় প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম কোথায় আছি আমি আর কেনই বা জায়গাটাকে ডেথ লেক বলা হয়! যখন মনে পড়ল, সতর্ক হওয়ার কোন সুযোগই ছিল না আমার।
আচমকাই দেখতে পেলাম জলের ঘূর্ণিটাকে, একেবারে বোটের নাকের ডগায়! হলফ করে বলতে পারি কয়েক মুহূর্ত আগেও ওটা ছিল না ওখানটায়, চোখের পলকে উদয় হয়েছে মূর্তিমান রাহুর মত!
বোটটাকে সামলানোর প্রাণপণ চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোন ফল হলো না! তীব্র স্রোতের টানে ধীরে-ধীরে ওটা এগিয়ে যাচ্ছিল যমদূতের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হতে!
ওটাকে আর সামলানো যাবে না বুঝতে পেরে নিজেকে বাঁচানোর একটা শেষ চেষ্টা করলাম আমি। একছুটে চলে গেলাম বোটের পিছন দিকটায়, দ্রুত পরে নিলাম লাইফ জ্যাকেট। পরক্ষণেই ইষ্টনাম জপে ঝাঁপ দিলাম হ্রদের জলে। বোটসুদ্ধ মরণঘূর্ণিতে তলিয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিল না আমার।
প্রাণপণে সাঁতরে সবেমাত্র কয়েক ফুট দূরে সরতে পেরেছি, ঠিক তখনই এক ঝটকায় পুরো বোটটা অদৃশ্য হয়ে গেল ঘূর্ণির ভিতরে। দমবন্ধ করে অপেক্ষায় রইলাম কয়েক মুহূর্ত, ওটাকে আবারও দেখতে পাবার আশায়। কিন্তু না, একটিবারের জন্যও আর ভেসে ওঠেনি ওটা!
ঝাঁপ দিতে আর কয়েক সেকেণ্ড দেরি করলে কী যে হাল হত আমার, ভাবতে গিয়ে অথৈ জলে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকেও অন্তরাত্মা শুকিয়ে গিয়েছিল আমার।
ঘূর্ণিটা থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে ধীরে-ধীরে সাঁতরাতে শুরু করলাম দ্বীপটার উদ্দেশে। দুটো দ্বীপের মাঝখানের যে দূরত্বটা এর আগে যৎসামান্য মনে হয়েছিল, সেটাই তখন আমার কাছে তেপান্তরের মাঠের শামিল!
এই বুড়ো শরীর নিয়ে অতখানি পথ সাঁতরাতে পারব কিনা, তা নিয়েই তখন সন্দিহান হয়ে পড়েছিলাম। তবে ঈশ্বর সহায় ছিলেন বলেই সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম আমি। সূর্য ডোবার ঠিক আগ মুহূর্তে গিয়ে পৌছলাম দ্বীপটায়।
আগেরগুলোর তুলনায় আকারে অনেক বড় ছিল ওটা। বনজঙ্গল, পাহাড়, গুহা, কোনকিছুরই অভাব ছিল না।
অন্ধকার নামার আগেই রাত কাটানোর জন্য একটা আশ্রয় খোঁজার প্রয়াস পেলাম। একেবারে খোলা আকাশের নীচে অরক্ষিত থাকাটা ঠিক হবে না।
খুব একটা খুঁজতে হলো না, জুতসই একটা গুহা পেয়ে গেলাম। আকারে মাঝারী, খটখটে শুকনো।
আশপাশ থেকে কিছু ঝরা পাতা খুঁজে এনে বিছানা পাতলাম। পরনের ভেজা কাপড়গুলো শুকানোর জন্য ছড়িয়ে দিয়ে পুরোপুরি দিগম্বর হয়ে নেতিয়ে পড়লাম। শরীরে তখন আর এক বিন্দু শক্তিও অবশিষ্ট ছিল না আমার।
কিছু খাবারের সন্ধান করা, নিদেনপক্ষে আগুন জ্বালার চেষ্টা করা উচিত ছিল বটে, কিন্তু জোর পাচ্ছিলাম না। বুড়ো হাড় আর কতই বা ধকল সইবে, তুমিই বলো!
শেষ কবে এতটা গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম, জানা নেই আমার। আবছাভাবে মনে পড়ে, মাঝরাতের দিকে ওই অদ্ভুত ডাকটা আবারও শুনতে পেয়েছিলাম আমি। অনেক বেশি স্পষ্ট, অনেক বেশি কাছে।
মনে হলো, এই দ্বীপেই আছে প্রাণীটা। হয়তো খানিকটা খুঁজলেই পাওয়া যাবে ওটাকে। শতভাগ ইচ্ছে থাকলেও, তখন কাজটা করার কোন উপায় ছিল না আমার। একে শরীরের বেহাল দশা, তার উপর একটা টর্চ পর্যন্ত ছিল না সাথে। খুঁজব কী করে?
তাই মটকা মেরে পড়ে রইলাম। সকাল হোক আগে, তারপর দেখা যাবে কী করা যায়।
ভোরের আলো ফোটার অনেক পরে সেদিন ঘুম ভাঙল আমার। বেঁচে থাকার সহজাত প্রবৃত্তি জানান দিল, খাবার চাইছে শরীর, খিদেয় চোঁ-চোঁ করছে পেট।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা রুটিফল গাছ পেয়ে গেলাম। কোন একসময় ঝড়ের কবলে পড়েছিল গাছটা, কাণ্ডটা বেঁকে গিয়ে প্রায় মাটির কাছাকাছি চলে এসেছে। তবে শিকড় উপড়ে যায়নি বলে বেঁচে আছে এখনও, ফলও ধরেছে।
পেটের আগুন নেভামাত্রই ভাবতে বসলাম, কীভাবে এখান থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। বাইরে থেকে কোন সাহায্য আসবে না, জানা ছিল আমার। যা করার নিজেকেই করতে হবে।
সারভাইভাল সম্পর্কিত বইগুলো চিরকাল আগ্রহ নিয়েই পড়তাম। কিন্তু কল্পনাও করিনি কখনও, আমাকেও একদিন এমন পরিস্থিতিতে ফেঁসে যেতে হবে!
বাঁশ দিয়ে ভেলা বানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। এছাড়া আর কোন পথও নেই। দড়ি হিসেবে কাজ চালানোর মত শক্ত লতার অভাব ছিল না, আঠার জোগান দিল রুটিফল গাছের কাণ্ড।
যন্ত্রপাতি ছাড়া কাজ করাটা যে কতটা ঝক্কির, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম সেটা। কয়েক ঘণ্টার কাজ সারতে লেগে গেল কয়েক দিন!
প্রায় প্রতি রাতেই ওই অদ্ভুত ডাকটা শুনতে পেয়েছিলাম। তবে ওটাকে আর খুঁজতে যাওয়ার সাহস ছিল না আমার। ওই কয়দিনে মানসিক শক্তির প্রায় পুরোটাই হারিয়ে ফেলেছিলাম বলা যায়।
আগে তো নিজে বাঁচি, তারপরই না গবেষণা! একবার বেঁচে ফিরতে পারলে, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আবারও আসা যাবে, অসুবিধে নেই। তখন নাহয় খোঁজা যাবে ওটাকে। অবশেষে পাঁচদিনের মাথায় শেষ হলো ভেলা বানানোর কাজটা।
ঈশ্বরকে স্মরণ করে বহু কায়দা-কানুন করার পর ওটাকে জলে নামাতে পারলাম। রওয়ানা হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে দেখতে পেলাম ওটাকে!
কিম্ভূতকিমাকার একটা প্রাণী, গাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখছে আমাকে!
আকারে খুবই ছোট ছিল ওটা; একটা কুকুর ছানার চেয়ে বড় হবে না কিছুতেই। তবে দেখতে অদ্ভুত ছিল, ভীষণ অদ্ভুত। না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না তুমি।
একটা গিরগিটির শরীরে যদি বাঘের মাথা বসিয়ে দেয়া হয়, সাথে জুড়ে দেয়া হয় হাতির কানের মত চ্যাপ্টা দুটো কান; দেখতে যেমন হবে, ওটা অনেকটা ওরকমই।
এহেন নমুনা চোখের সামনে পেয়েও ভাল করে না দেখে ফিরে আসতে মন সায় দিল না। নেমে পড়লাম ভেলা থেকে, ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম প্রাণীটার দিকে। ভয় পাচ্ছিলাম, কখন না আবার ছুটে পালিয়ে যায়!
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ওখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল জানোয়ারটা। চোখের তারায় ভয়ের বদলে ফুটে উঠেছে কৌতূহল!
হাঁটু গেড়ে বসলাম ওটার কাছে, বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে রইলাম অদ্ভুত দেহটার দিকে।
কী বুঝল ওটা কে জানে, কুঁই-কুঁই করতে-করতে এগিয়ে এসে আমার গায়ে মুখ ঘষতে শুরু করল! হাত বুলিয়ে খানিকটা আদর করতেই পুরোপুরি ন্যাওটা হয়ে গেল; যেন কতকাল ধরে চেনে আমাকে!
কী ওটা? কোন্ যুগের প্রাণী? তৃণভোজী না মাংসাশী?
অনেকগুলো প্রশ্ন ততক্ষণে কড়া নাড়তে শুরু করেছে মনের দরজায়, যার একটারও জবাব জানা নেই আমার।
জানার একটাই উপায়, প্রাণীটাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা। হয় আমাকে ওটার সাথে ওখানেই থেকে যেতে হবে, নয়তো ওটাকে নিয়ে আসতে হবে সঙ্গে করে। এ দুটো ছাড়া ভিন্ন কোন পথ খোলা ছিল না আমার জন্য।
ওই মুহূর্তে ওখানে থেকে যাওয়াটা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ছিল, তাই দ্বিতীয় পথটা বেছে নিতে বাধ্য হলাম। ওটাকে নিয়েই রওয়ানা হলাম ফিরতি পথে।
প্রথমটায় খানিকটা হকচকিয়ে গেলেও, কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেলার দুলুনির সাথে মানিয়ে নিল ওটা।
স্রষ্টার অপার রহমতে কোনরকম বিপত্তি ছাড়াই তীরে ফিরতে পারলাম। তবে প্রাণীটাকে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে বাড়ি পর্যন্ত আনতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমাকে। সাক্ষাতেই ওসব নিয়ে বিস্তারিত আলাপ হবে। তবে এটুকু জানিয়ে রাখি, তোমার বন্ধুর উপস্থিত বুদ্ধির তারিফ না করে পারবে না তুমি।
বাড়ি ফেরার পর প্রথম ক’দিন ভালই কাটল। একটা আদুরে বিড়ালছানার মতই সারাক্ষণ আমার সাথে সেঁটে রইল ওটা। ভীষণ লক্ষ্মী ছিল, কোনকিছু নষ্ট করত না।
আমার কথা বুঝতে পারত, চুপ করে বসে থাকতে বললে এক জায়গাতেই বসে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। শুধু সময়মত খাবার পেলেই হলো, আর কোন ঝামেলা করত না।
ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম, মাংসাশী প্রাণী ওটা; মোষের মাংসের প্রতিই আগ্রহটা বেশি।
তবে গোটা ব্যাপারটা ক্রমেই জটিল হয়ে উঠল। যখন থেকে ডাকাডাকি শুরু করল, ঝামেলার অন্ত রইল না আর। প্রতিবেশীরা নানারকম প্রশ্ন করতে লাগল। আমিও বাধ্য হলাম শহরের বাড়িটা ছেড়ে এই পারিবারিক বাড়িতে এসে বসবাস করতে।
নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, দ্বীপে যে অদ্ভুত চিৎকারটা আমি শুনতে পেতাম, ওটা এই প্রজাতির প্রাণীরাই করত। ওই দ্বীপে যে এই প্রজাতির অন্তত একজোড়া পূর্ণবয়স্ক প্রাণী রয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই আমার। হয়তো গোটা একটা পালই বসবাস করছে ওখানকার জঙ্গলে, কে জানে!
এই বাড়ির জংলা পরিবেশে এসে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বড় হতে শুরু করল ওটা। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বড়সড় একটা বলদের আকৃতি পেয়ে গেল ওটার দেহ!
ভীষণ অবাধ্য হয়ে গেল। চাকরবাকর দূরে থাক, আমার কথাও আর শুনতে চাচ্ছিল না কিছুতেই! শেষে একরকম বাধ্য হয়েই ওটাকে নিয়ে সেলারে পুরলাম। ভাবলাম, জায়গাটা বিশাল, চরে বেড়াতে কোন অসুবিধে হবে না ওটার। পরিচারকদের উপর দায়িত্ব ছিল, সময়মত যেন ওটার খাবার পৌঁছে দেয়।
তবে অচিরেই আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল পরিস্থিতি। ভীষণ হিংস্র হয়ে গেল জানোয়ারটা। খাবার দিতে গিয়ে মারাত্মক আহত হলো এক পরিচারক, কামড়ে তার সারা শরীর রক্তাক্ত করে ফেলেছিল ওটা!
তারপর থেকে আর কখনও সেলারের দরজাটা খোলা হয় না। উপরের পকেট ডোর দিয়েই এখন খাবার দেয়া হয় ওটাকে।
মাঝেমধ্যে নীচ থেকে ভেসে আসা ওটার হিংস্র গর্জন শুনতে পাই। শব্দটা স্নায়ুর ওপর চাপ তৈরি করে, অস্বস্তি লাগে। জানি, বেরিয়ে আসতে পারলে কী-কী করতে পারে ওটা। আকারে জলহস্তীকেও ছাড়িয়ে গেছে এখন ওটার দেহ। আরও বড় হবে ওটা। কতটা, কোনদিন কল্পনাও করতে পারবে না তুমি!
খাল কেটে মানুষ আনে কুমির, আমি এনেছি প্রাগৈতিহাসিক যুগের একটা রাক্ষস! কীভাবে এতকাল পরেও এই প্রজাতি পৃথিবীর বুকে টিকে রইল, ব্যাপারটা সত্যিই বিস্ময়কর।
ওরা ভয়ঙ্কর, ভীষণ ভয়ঙ্কর।
শরীরে মাংস আছে, এমন সবকিছুই আছে ওদের খাদ্য তালিকায়; এমনকী মানুষও!
এটাকে লোকালয়ে নিয়ে এসে মস্ত ভুল করেছি আমি, বন্ধু। কাজটা করা মোটেও উচিত হয়নি আমার। মায়া পড়ে গেছে ওটার ওপর, মারতেও মন সায় দিচ্ছে না এখন।
তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ফিরিয়ে নিয়ে যাব ওটাকে আরকেইনে; পৌঁছে দেব ডেথ লেকের সেই দ্বীপটায়।
এ ব্যাপারে তোমার সাহায্য আমার ভীষণ প্রয়োজন, বন্ধু। কীভাবে কী করব, কিছুই মাথায় আসছে না। বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেলে, এতবছর ধরে বিজ্ঞানী হিসেবে আমার যা-যা অর্জন, এক নিমিষে সবকিছু ধুলোয় মিশে যাবে। এত বড় ঝুঁকি নেয়ার জন্য বিজ্ঞানী মহল থেকে শুরু করে সরকার, কেউই আমাকে ক্ষমা করবে না। সভ্য মানুষদের চোখে রীতিমত ভিলেনে পরিণত হব আমি।
এসব ভাবতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে মাথা আরও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আমার। একারণেই তোমাকে ভীষণ দরকার, বন্ধু। তুমি পাশে থাকলে অনেকখানি ভরসা পাব আমি।
দয়া করে চিঠিটা পাওয়া মাত্রই এখানে চলে এসো। পরবর্তী করণীয় দু’জনে মিলেই ঠিক করতে চাই।
তোমার অপেক্ষায়…
ডক্টর ব্যারন
.
মানুষের সব কাজ কি পরিকল্পনামাফিক হয় কখনও? চিরস্থায়ী কালিতে লেখা নিয়তি সামনে নিয়ে মুচকি হাসেন ঈশ্বর; ভাবেন, মানুষ যদি জানত কী লেখা রয়েছে তার ভাগ্যে!
ডক্টর ব্যারনের চিঠিটা সময়মত পেলেন না প্রফেসর কারমেল। নিজের বাড়িতে ছিলেন না তিনি, একটা শিক্ষক সম্মেলনে যোগ দিতে ফ্রান্সে গিয়েছিলেন।
সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে প্রায় সারা বছরই এখানে-ওখানে লেকচার দিতে হয় তাঁকে। খুব কম সময়ই বাড়িতে থাকার সুযোগ পান।
তবে বন্ধুর চিঠিটা হাতে পেয়ে একদমই সময় নষ্ট করেননি তিনি, পরদিনই রওয়ানা দিয়েছেন ডক্টর ব্যারনের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে।
তবে ততদিনে ঘটে গেছে মেলা ঘটনা, যার কিছুই জানা নেই তাঁর!
এক বিকেলে হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ডক্টর ব্যারন। সাথে-সাথেই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় শহরের হাসপাতালে। তারপর থেকে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের কারণে প্রায় অচেতন অবস্থায় ওখানেই পড়ে আছেন তিনি।
পরিচারকদের সবাই তাঁর সেবা শুশ্রূষায় ব্যস্ত থাকায় কেবলমাত্র মালিই রয়ে গিয়েছিল পাহাড়ের ওপরের বনেদী বাড়িটায়। জানোয়ারটাকে খাবার দেয়া আর বাড়িটার দেখভালের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল তার ওপর।
আগে কখনও ওটাকে খাবার দেয়নি মালি, তাই নিয়মটাও জানা ছিল না তার। দরজাটা খোলা যে উচিত হয়নি, এটা অনেক দেরিতে বুঝতে পেরেছিল বেচারা।
মানুষের মাংসের স্বাদ কেমন হয়, মালিকে দিয়েই সেটা প্রথম বুঝতে পেরেছিল প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ারটা। তাকে সাবাড় করতে বেশ খানিকটা সময় নিয়েছিল ওটা। তারপর বহুদিন বাদে সেলার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল মুক্ত পরিবেশে, আকারে ততদিনে হাতিকেও ছাড়িয়ে গেছে ওটা! তবে আকাশছোঁয়া সীমানা প্রাচীর আর বন্ধ ফটকের কারণে বাড়িটা ছেড়ে পালাতে পারল না ওটা, ভিতরেই বন্দি থাকতে হলো। এ কয়দিনে ক্ষুধার তাড়নায় রীতিমত পাগল হওয়ার দশা হলো ওটার।
তার রাগের খেসারত দিতে হয়েছে বহু যত্নে গড়া বাগানটাকে। লণ্ডভণ্ড হওয়া গাছগুলো দেখে আর বোঝার জো নেই, এককালে কত সুন্দর ছিল জায়গাটা।
.
বাড়ির গেটে বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করেও ভিতর থেকে কারও সাড়া পেলেন না প্রফেসর কারমেল। হলোটা কী? ভর সন্ধ্যাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি সবাই?
এগিয়ে গিয়ে দেয়াল হাতড়ে একটা সুইচ টিপে দিলেন তিনি। আগেও বহুবার এখানে এসেছেন, ফটক খোলার সুইচটা কোথায় লুকানো থাকে, ভালই জানা আছে তাঁর।
সুটকেস নিয়ে ভিতরে ঢুকেই চমকে উঠলেন প্রফেসর। বাড়িটা এত অন্ধকার কেন?
কেউ নেই নাকি? কোথাও বেড়াতে গেছে?
বাগানটার দিকে চোখ পড়তেই রীতিমত আঁতকে উঠলেন তিনি। একটা গাছও আর আস্ত নেই, যেন বড়সড় কোন ঝড় বয়ে গেছে জায়গাটার ওপর দিয়ে!
মনটা কু ডাকছে তাঁর। কেন যেন মনে হচ্ছে, এখানে আসাটা মোটেও উচিত হয়নি। শহর থেকে রওয়ানা দেয়ার আগে অন্তত একটু খবরাখবর নেয়া উচিত ছিল।
আচমকা জমাটবাঁধা নিস্তব্ধতা চিরে দিল. একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার! নিমিষেই তীব্র আতঙ্কের একটা শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল তাঁর গোটা দেহে। কেঁপে উঠলেন তিনি।
চোখের কোণে নড়াচড়ার আভাস পেয়ে ফিরে তাকালেন প্রফেসর। পরক্ষণেই বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেলেন।
কিম্ভূতকিমাকার একটা পাহাড়প্রমাণ জানোয়ার এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে। কোন সন্দেহ নেই, চিঠিতে এটার কথাই লিখেছিল তাঁর বন্ধু।
কিন্তু এটা বাইরে বেরোল কী করে? এত প্রকাণ্ডই বা হলো কীভাবে?
মারা যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে আরেকবার ওটার হুঙ্কার শুনতে পেলেন প্রফেসর কারমেল। নিজের জন্য নয়, গেটটা বন্ধ না করার জন্যই তখন আফসোস হচ্ছিল তাঁর। ওটা এখান থেকে বেরিয়ে গেলে কতজন মানুষ প্রাণ হারাবে, কে জানে!
এসকর্ট
এক
আপনি যদি জেফ কার্টারকে তার পেশা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, জবাব পাবেন, ছোটখাট একটা ব্যবসা করি। কিংবা সে বলবে, আমি একজন আইটি ইনচার্জ। অথবা বলবে, বীমার দালাল।
মোদ্দাকথা, সত্যি কথাটা কিছুতেই আপনি তার মুখ দিয়ে বের করতে পারবেন না।
এমন নয় যে তার পেশা নিয়ে লজ্জিত সে, নিজেকে নিয়ে রীতিমত গর্ববোধ করে জেফ। তবুও সবার কাছে নিজের কাজের ক্ষেত্রটা গোপন রাখতেই পছন্দ করে সে। তার মতে, এই পেশায় গোপনীয়তার বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা রয়েছে এবং কখনও-কখনও এটাই সাফল্যের চাবিকাঠি।
আদতে জেফ কার্টার একজন মেল এসকর্ট। নারীরা অর্থের বিনিময়ে তার সঙ্গ কেনে। এই পেশায় সে একজন সুপারস্টার, আর তাই তার সঙ্গ পেতে চাইলে বেশ চড়া মূল্যই গুণতে হয় আগ্রহীদের।
নারীসঙ্গ কেনাবেচা, সম্ভবত পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসা। তবে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে, যখন নারীরা প্রায় সব ব্যাপারেই পুরুষদের সমকক্ষ হতে চাইছে, তখন আর ব্যবসাটা একমুখী নেই। অর্থের বিনিময়ে পুরুষদের উপর আধিপত্য করার সুযোগটা বিত্তবান নারীরা বেশ উপভোগ করে বলেই মনে হয়।
তাই নিতান্ত পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হওয়া এই মেল এসকর্টের ব্যবসাটা খুব তাড়াতাড়িই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে। এখানে-ওখানে গড়ে উঠেছে বহু এসকর্ট এজেন্সি।
যদিও লেনদেনের বেশিরভাগ অংশ এখনও গোপনেই সারা হয়, তবুও এর বিস্তৃতি যে কোন অসচেতন মানুষের পিলে চমকে দেবার জন্য যথেষ্ট
শহরের অভিজাত এলাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জেফের অ্যাপার্টমেন্টটা বেশ বিলাসবহুল। এই মুহূর্তে নিজের ফ্ল্যাটের নরম গদিমোড়া কাউচে আধশোয়া হয়ে আছে সে। হাতে শোভা পাচ্ছে বিয়ারের বোতল। আধঘণ্টা ধরে একটা বিশেষ ফোনের অপেক্ষায় আছে সে।
ফোনটা করবেন তার বস, রবার্ট জনসন। সাধারণত সন্ধ্যা ছ’টা থেকে সাতটার মধ্যেই ফোন করেন তিনি। সাতটার পরও তাঁর ফোন না এলে, ধরে নিতে হবে আজ রাতে জেফকে দেয়ার মত কোন কাজ নেই তাঁর হাতে। তবে এমন ঘটনা গত দু’মাসে মাত্র একবারই ঘটেছে।
বিয়ারের তৃতীয় বোতলটা শেষ হবার আগেই ফোনটা বেজে উঠল।
‘হ্যালো, জেফ। ঠিকানা লিখে নাও।’
কাগজ-কলম নিয়ে তৈরিই ছিল জেফ। ঠিকানাটা টুকে নিতে সময় লাগল না।
‘আজকের ক্লায়েন্ট একজন কুমারী। ফর্মে অন্তত তিনি সেটাই লিখেছেন। তাঁর বিয়ে হবার কথা সামনের সপ্তাহে। তাই সিঙ্গেল লাইফটাকে শেষবারের মত উপভোগ করতে চান। তোমার বায়োডাটা দেখেই পছন্দ হয়ে গেছে তাঁর। পিক টাইম-ইলেভেন পিএম। বুকিং-ফুল নাইট। জব-এনিথিং। ক্লিয়ার?’
‘ইয়েস, স্যর।’
‘গুড। এবার শপথ বাক্যটা বলে ফেলো জলদি।’
‘এজেন্সির সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখা এবং ক্লায়েন্টের সন্তুষ্টি অর্জনই আমার প্রধান কর্তব্য, নিজে উপভোগের সুযোগ পাওয়াটা বাড়তি পাওনা। আমি সদা সতর্ক থাকব, যেন আমার কোন আচরণের জন্য পুরো এজেন্সির অস্তিত্ব হুমকির মুখে না পড়ে। এর কোন ব্যত্যয় ঘটলে, এজেন্সি কর্তৃক প্রদত্ত যে কোন শাস্তি মাথা পেতে নিতে বাধ্য থাকব।’
যন্ত্রের মত গড়গড় করে বলে গেল জেফ। প্রতিটা কাজ বুঝে নেয়ার সময়ই এটা বলতে হয় তাকে। রুটিন ওয়ার্ক।
‘বেস্ট অভ লাক, জেফ।’
ফোন কেটে দিলেন রবার্ট জনসন।
মনে-মনে খুশি হয়ে উঠল জেফ। সে খেয়াল করেছে, এ পর্যন্ত যতবার বিদায় নেয়ার সময় ‘বেস্ট অভ লাক’ বলেছেন বস, ততবারই নিজের কাজটা উপভোগ করেছে সে। তাহলে আজকের রাতটাও কি তেমনই একটি স্মরণীয় রাত হতে যাচ্ছে?
তৈরি হতে চলল জেফ। ক্লায়েন্টদের কাছে সবসময় নিজেকে পরম কাঙ্ক্ষিত একজন সঙ্গী হিসেবেই উপস্থাপন করতে চায় সে। আর এজন্য সময়সাপেক্ষ একটি প্রস্তুতিপর্বের কোন বিকল্প নেই।
দুই
জেফের আজকের ক্লায়েন্টের নাম, মিরাণ্ডা। রওনা হবার আগে ঠিকানা লেখা কাগজটায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল জেফ। ১৩/৪ মিডল জোন।
ভ্রূজোড়া খানিকটা কুঁচকে গেল তার। এর আগে ব্যাপারটা খেয়াল করেনি ও। এই প্রথম মিডল জোনের কোন ক্লায়েন্টকে সঙ্গ দিতে যাচ্ছে সে।
ওখানে সাধারণত নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা বসবাস করে। তাদের কাছে এসকর্ট সার্ভিসের চার্জটা গগনচুম্বী লাগার কথা। নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায়, তাদের এহেন বিলাসিতার সুযোগ কোথায়?
তাহলে মিরাণ্ডা অতগুলো টাকা পেল কোথায়? লটারি জিতেছে?
তবে ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই জেফের। তার ক্লায়েন্ট ধনী নাকি দরিদ্র, তাতে তার কী আসে-যায়? তাকে কাজের জন্য পেমেণ্ট করে এজেন্সি, সরাসরি ক্লায়েন্ট নয়।
তাছাড়া ব্যাপারটা হয়তো ততটা গোলমেলেও নয়। কারণ অনেকেই ভুল ঠিকানা ব্যবহার করে এ ধরনের গোপনীয় কাজে। যদিও তার এজেন্সি শতভাগ বিশ্বস্ততার সঙ্গেই এযাবৎকাল কাজ করে এসেছে, তারপরও সঠিক পরিচয় প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেক ক্লায়েন্টেরই আপত্তি থাকে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আবার এমনও হতে পারে, এই বিশেষ রাতের জন্যই সারাজীবন ধরে অর্থ সঞ্চয় করেছে মেয়েটা!
নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌছে মিরাণ্ডার নাম্বারে ফোন করল জেফ। তার গাড়ির রঙ এবং পার্কিং লটের ঠিক কোথায় সেটা অবস্থান করছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাল মেয়েটাকে। তারপর দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে যতটা সম্ভব আরাম করে বসল। অভিজ্ঞতা থেকে জানে, মেয়েদের সাজগোজের শেষ পর্বটাই সাধারণত সবচেয়ে লম্বা হয়। এক ক্লায়েন্টের জন্য ঝাড়া তিনঘণ্টা অপেক্ষা করার রেকর্ডও আছে তার!
তবে মিরাণ্ডা খুব একটা অপেক্ষা করাল না তাকে। মিনিট দশেকের মধ্যেই নীচে নেমে এল। জেফের জন্য তৈরি হয়েই অপেক্ষা করছিল মেয়েটা। বিশেষ রাতের একটা মুহূর্তও অপচয় করার ইচ্ছে নেই তার।
তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল জেফ। তার ডান হাতটা মুঠোয় নিয়ে, হাতের উল্টোপিঠে আলতো করে চুমু খেল।
‘নিঃসন্দেহে আমার দেখা সেরা সুন্দরীদের একজন আপনি, মিস মিরাণ্ডা।’
হাসল মেয়েটা। ‘আপনিও কম হ্যাণ্ডসাম নন, মিস্টার জেফ কার্টার।’
‘শুধু জেফ,’ বলতে-বলতে প্যাসেঞ্জার সিটের দরজাটা মিরাণ্ডার জন্য খুলে দিল জেফ। মেয়েটা উঠে বসার পর ড্রাইভিং সিটে এসে বসল সে।
মনে-মনে হাসছে ও। ক্লায়েন্টদের খুশি করার জন্য কত কিছুই না বলতে হয়! এমন ভাব করতে হয়, যেন পৃথিবীর সবচেয়ে আরাধ্য মেয়েটিকে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে সে। অন্য কারও সঙ্গেই যার তুলনা চলে না। এমন কিছু করা যায় না, যাতে মেয়েটি নিজেকে ছোট ভাবে।
অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বলা কথাগুলো হয় নির্জলা মিথ্যা! যার জ্বলন্ত উদাহরণ, কিছুক্ষণ আগে মিরাণ্ডাকে বলা তার স্তুতিবাক্যটা। শতভাগ মিথ্যা, সত্যের লেশমাত্রও নেই ওতে।
মেয়েটা দেখতে বিশ্রী। মুখের গড়ন দেখলে মনে হয়, কেউ রাগের মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আচ্ছামত পিটিয়েছে তাকে! তাতেই ওটা অমন এবড়ো-খেবড়ো হয়ে গেছে!
গায়ের রঙ ফ্যাকাসে। যেন বহুদিন একনাগাড়ে কয়লা খনিতে কাজ করতে বাধ্য হয়েছে সে, সূর্যের দেখা পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি!
শরীরটা স্থূলকায়। দূর থেকে দেখলে হাতির বাচ্চা বলে ভুল করবে যে কেউ। শরীরের মতই ইয়া মোটা একজোড়া ঠোঁট, মুখের অনেকটা জায়গা দখল করে রেখেছে। আর তাতে মাখানো টুকটুকে লাল রঙের লিপস্টিক আরও বেশি করে চোখে লাগছে। হাতের লম্বা নখেও একই রঙের নেলপলিশের প্রলেপ। কোন সন্দেহ নেই, এটা মিরাণ্ডার পছন্দের রঙ।
দুই কানে আরব্য রজনীর দানবদের পরার উপযোগী একজোড়া রিং ঝুলিয়েছে সে। ওগুলোর ভারে কখন যে কানদুটো ছিঁড়ে পড়বে, কে জানে!
অত্যন্ত নিম্নমানের রুচি মেয়েটার। তবুও আজ রাতটা এর সঙ্গেই কাটাতে হবে জেফকে।
মিরাণ্ডাকে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিল সে। ‘বলুন, কোথায় যাব এখন? কোন হোটেলে যেতে চান? আপনি চাইলে ডিসকাউন্টের ব্যাপারে আমি সাহায্য করতে পারি।’
রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসল মিরাণ্ডা। ‘ক’দিন পরেই আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে। এই অবস্থায় হোটেলে রাত কাটানো কি ঠিক হবে? যদি কারও চোখে পড়ে যাই! কোন বিশ্বস্ত বন্ধুর বাসায় গেলে কেমন হয়?’
‘আপনার যেমন ইচ্ছে, মিস।’
‘ঠিক আছে। তাহলে প্রথমে নর্থ হাইওয়েতে চলুন। ওখান থেকেই আমার বান্ধবীকে তুলে নেব।’
নর্থ হাইওয়ে! চমকে উঠল জেফ। ওখানে কেন?
গত কয়েকমাসে ওই রাস্তায় বেশ কিছু রহস্যময় খুনের ঘটনা ঘটেছে ভিকটিমদের লাশগুলো কেবল পাওয়া গেছে, খুনি এখনও ধরা পড়েনি। লাশ বলতে অবশ্য শুধুই কঙ্কাল, গায়ে একরত্তি মাংসও ছিল না কারও! তাই চেনার জো নেই, কাদের লাশ ওগুলো। তবে শেষ অবধি ডিএনএ টেস্ট করে বেশ কিছু ভিকটিমের পরিচয় বের করতে পেরেছে পুলিশ।
সব ক’জনই সাধারণ মানুষ, কারোরই অতীতে কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। প্রাণে মেরে ফেলতে পারে, এমন বড় কোন শত্রুও খুঁজে পাওয়া যায়নি কারও।
তাই পুলিশের ধারণা, বিকৃত মস্তিষ্কের কোন সিরিয়াল কিলারের আবির্ভাব ঘটেছে ওই এলাকায়। তবে গোয়েন্দা বিভাগের মতে, খুনি একজন নয়, একাধিক। তাই ওই এলাকায় চলাচলের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে জনসাধারণকে। বাড়ানো হয়েছে পুলিশি নজরদারি।
কোন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি, তবুও সন্ধ্যার পর পারতপক্ষে ওই রাস্তাটা এড়িয়ে চলে এখন লোকজন। আর রাত দশটার পর তো রীতিমত খাঁ-খাঁ করে পুরো তল্লাট।
এই রাতদুপুরে অপরিচিত দুটো মেয়েসহ যদি পুলিশের কোন টহল দলের সামনে পড়তে হয়, কী জবাব দেবে জেফ?
ওদেরকে আলাদা করে মাত্র মিনিট দুই জেরা করলেই প্রকৃত সত্যটা বের করে ফেলতে পারবে পুলিশ। আর তাতে করে এজেন্সির অস্তিত্ব ফাঁস হয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা তৈরি হবে।
‘অন্য কোথাও থেকে আপনার বান্ধবীকে পিক করা যায় না? জানেনই তো, আজকাল নর্থ হাইওয়েতে পুলিশের বড্ড কড়াকড়ি চলছে।’
‘লারা ওখানেই একটা বারে কাজ করে। রাত বারোটায় তার শিফট শেষ হয়। আমি ওকে কথা দিয়েছি, যাবার সময় তুলে নেব। অপেক্ষায় থাকবে ও। তাছাড়া ওর বাসাতেই যাচ্ছি আমরা, জায়গাটা নর্থ হাইওয়ের একেবারে শেষ মাথায়।’
জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলল জেফ। সে মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে, এটা ক্লায়েন্টকে বুঝতে দিতে চায় না। ‘চলুন তাহলে। কী আর করা। প্রার্থনা করুন, কোন পেট্রোল কারের সামনে যেন পড়তে না হয়।’
‘কিংবা সেই সাইকো খুনিটার সামনে,’ যোগ করল মিরাণ্ডা।
হাসল জেফ। সাইকোকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না সে, তার যত ভয় পুলিশকেই। একবার হাতেনাতে ধরতে পারলে, ঠিকই কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের করে আনবে হতচ্ছাড়ার দল।
কিন্তু জেফের জানা নেই, টহল দেবার মত একজন পুলিশও আজ নেই নর্থ হাইওয়েতে! পুলিশ কমিশনারের ছেলের বিয়ে, ওখানেই ফুর্তি করছে বেশিরভাগ অফিসার। আর যাদেরকে দুঃখজনকভাবে আজকের এই বিশেষ রাতে বাধ্যতামূলক ডিউটি দেয়া হয়েছে, তারাও টহল চৌকিতে বসে তাস পেটাচ্ছে। অন্যরা মৌজ করবে, আর তারা বুঝি রাস্তায় ঘুরে মরবে? উঁহু, সেটি হচ্ছে না। কোথাও কিছু ঘটলে, দেখা যাবে ‘খন। অন্তত আজকের রাতে অহেতুক পণ্ডশ্রম করতে রাজি নয় কেউ।
তিন
লারা যেখানে কাজ করে, সে বারটাকে দেখে অবাক না হয়ে পারল না জেফ। গ্র্যাণ্ড স্ট্রীটের বারগুলোর সঙ্গে এটার আকাশ-পাতাল ফারাক। ওগুলোর ঝকমকে সাইনবোর্ডের বদলে এখানে ঝুলছে রঙজ্বলা একখানা নেমপ্লেট। আলোক স্বল্পতার কারণে সেটিও ভাল করে পড়ার উপায় নেই।
গ্র্যাণ্ড স্ট্রীটের বর্ণিল আলোর জৌলুশের বিপরীতে এখানে ঝুলছে কম পাওয়ারের একখানা হলদে বাতি। ভিতর থেকে ভেসে আসছে না কোন কোলাহল, বাজছে না কোন মিউজিক!
একজন খদ্দেরও বোধহয় নেই ভিতরে, কর্মচারীরাই হয়তো বসে মাছি মারছে। অথচ গ্র্যাণ্ড স্ট্রীটে রাত বারোটা মানে কেবলই সন্ধ্যারাত। প্রতিটা বারে লোকজন রীতিমত গিজগিজ করে।
লারার জন্য মায়াই লাগল জেফের। মেয়েটা ঠিকমত বেতন পায় কি না কে জানে।
বারের মত লারা নিজেও অবশ্য জেফকে কম অবাক করেনি! মিরাণ্ডার সঙ্গে মেয়েটার একরত্তি মিলও নেই। ছিপছিপে দেহের গড়ন, যেন হাড়ের উপর সরাসরি চামড়ার প্রলেপ দেয়া, মাংসপেশীর কোন বালাই নেই। এতটা শুকনো একজন মানুষ হয় কী করে?
গায়ের রঙ দুধে আলতা মেশানো, প্রচণ্ড সুন্দরী। একবার তাকালে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না।
মুক্তোর মত ধবধবে সাদা দু’সারি দাঁত, মুখ খুললেই ঝিলিক দিয়ে ওঠে তবে উপরের পাটির ক্যানাইন দুটো খানিকটা বেশি লম্বা মেয়েটার। তাই হাসার সময় খুব সাবধানে হাসে সে, যেন চট করে ব্যাপারটা কারও চোখে না পড়ে। মাপা হাসিতে আরও বেশি সুন্দর লাগে তাকে।
জেফ নিজেকে মনে করিয়ে দিল, তার ক্লায়েন্ট মিরাণ্ডা, লারা নয়। তাই মিরাণ্ডাই তার পূর্ণ মনোযোগের একমাত্র দাবিদার। যদিও এর উল্টোটা হলেই বেশি খুশি হত সে।
‘এবার কোথায় যাব, মিস?’ মিরাণ্ডাকে জিজ্ঞেস করল জেফ।
‘চলুন, পথ দেখাচ্ছি।’
গাড়ি ছেড়ে দিল জেফ। লারা পিছনের সিটে বসলেও, মিরাণ্ডা এখনও সামনের সিটে তার পাশেই বসে আছে। বান্ধবীকে সঙ্গ দিতে পিছনে গিয়ে ওঠেনি।
তবে একটা ব্যাপার ঠিকই খেয়াল করল জেফ। লারা আসার পর থেকে মিরাণ্ডার হাবভাবই পাল্টে গেছে।
দু’জনের মুখেই সার্বক্ষণিক চাপা হাসি লেগে আছে, দু’জনেই প্রচণ্ড উত্তেজিত। একটু পর-পরই চোখে-চোখে কথা হচ্ছে ওদের। যদিও আলাপের বিষয়বস্তু ঠিক পরিষ্কার না জেফের কাছে।
এতটা উত্তেজিত কেন ওরা? অনাগত রাতের অ্যাডভেঞ্চারের কথা ভেবে? এটাই হবে। দু’জনের জন্যই যে ব্যাপারটা নতুন, এতে কোন সন্দেহ নেই।
রিয়ারভিউ মিররের দিকে তাকাতেই লারার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল জেফের। তার মুখের দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। তার চোখে যুগপৎ লালসা আর ঈর্ষা দেখতে পেল জেফ।
লালসা কার প্রতি, সেটা বুঝতে মোটেও কষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু ঈর্ষা? বান্ধবীর ভাগ্যের প্রতি?
তার চোখে চোখ রেখেই নিজের শুকনো ঠোঁটে জিভ বুলাল লারা।
মনে-মনে হাসল জেফ। মেয়েটা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কোনমতেই। কতদিন পুরুষবিবর্জিত জীবন কাটাচ্ছে কে জানে!
নিজের উপর জোর খাটিয়ে রিয়ারভিউ মিরর থেকে চোখ সরাল জেফ। উপলব্ধি করছে, মিরাণ্ডাও তার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে এখন। মিরাণ্ডার চোখেও চকচক করছে লোভ!
ওদের উত্তেজনার মূল কারণটা কিছুটা হলেও এখন আঁচ করতে পারছে জেফ। সম্ভবত ওদের সম্মিলিত কোন ফ্যান্টাসি আছে, যা ওকে দিয়ে আজ পূরণ করাতে চলেছে ওরা। নিষিদ্ধ আনন্দ আহরণের সম্ভাবনা চিরকালই উত্তেজনাকর। ওদের আর দোষ কী?
আচমকা ঘাড়ের কাছে উষ্ণ একটা স্পর্শে চমকে উঠল জেফ। পরক্ষণেই বুঝতে পারল, লারা হাত বুলাচ্ছে ওখানে! ঝট করে ঘাড়টা সরিয়ে নিল জেফ। শিরদাঁড়া সোজা করে বসল সিটের উপর।
পিছন থেকে অস্ফুট শব্দ করে উঠল লারা। স্পষ্ট বোঝা গেল, ব্যাপারটায় অসন্তুষ্ট হয়েছে সে। তবে পরোয়া করল না জেফ। তার ক্লায়েন্ট মিরাণ্ডাকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে বাধ্য সে, লারাকে নয়।
গোটা ব্যাপারটা খুব ভালভাবে লক্ষ্য করলেও, মুখে কিছু বলল না মিরাণ্ডা শুধু লারার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকাল একবার। ভাবখানা এমন, তর সইছে না, না?
চার
লারার অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংটার পুরোপুরি বেহাল দশা। অনেক পুরানো একটা দালান, দেয়ালের জায়গায় জায়গায় ছাল-চামড়া উঠে গেছে। পলেস্তারা খসে গিয়ে ভিতরের লোহার কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে। যে কোন সময় ভেঙে পড়ার শঙ্কা নিয়েই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে ওটা।
নিরাপত্তার কোন বালাই নেই। সিকিউরিটি ক্যামেরা দূরে থাক, একজন দারোয়ান পর্যন্ত নেই!
সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় জেফ ভাবল, মিরাণ্ডার ভার সইবে তো জরাজীর্ণ সিঁড়িগুলো?,
তবে কোনরকম বিপত্তি ছাড়াই পাঁচতলায় লারার ফ্ল্যাটে উঠে এল ওরা।
ফ্ল্যাটটা ছোট, তবে বেশ পরিপাটি করে সাজানো। বাইরে থেকে কল্পনাও করতে পারবে না কেউ, ভিতরটা এতটা সুন্দর। মনে-মনে লারার রুচির প্রশংসা না করে পারল না জেফ।
ঘরে ঢোকার পর আর একটা সেকেণ্ডও নষ্ট করতে চাইল না মিরাণ্ডা। উত্তেজনায় রীতিমত কাঁপছে সে।
‘তুমি ভাল করেই জানো, আমি কেন তোমাকে এখানে এনেছি। তাই না, জেফ?’
মাথা নেড়ে সায় জানাল জেফ। জানে সে, বেশিরভাগ ক্লায়েন্ট তার কাছে এটাই চায়।
‘আমরা দু’জন একসাথে থাকলে তোমার কোন আপত্তি নেই তো?’ বলে উঠল লারা।
‘মিস মিরাণ্ডা রাজি থাকলে, আমার কোন অসুবিধে নেই,’ শান্ত স্বরে জবাব দিল জেফ।
জবাব দিতে একটুও সময় নিল না মিরাণ্ডা। ‘আমি রাজি। আসলে, আইডিয়াটা আমারই।’
শ্রাগ করল জেফ। ক্লায়েন্ট যা বলবে, তা-ই করতে বাধ্য সে।
তার চোখের সামনেই চটজলদি কাপড় ছাড়তে শুরু করল মেয়ে দুটো। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল জেফ।
নিজের ভিতরকার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনাটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে সে। কত সহজেই না শিকার মিলছে আজকাল! কেবল ঝোপ বুঝে কোপ মারতে পারলেই কেল্লা ফতে।
স্বীকার করতেই হয়, বস রবার্ট জনসনের এই এসকর্ট এজেন্সি খোলার আইডিয়াটা দুর্দান্ত ছিল। কেননা বেশিরভাগ মানুষই এসকর্ট এজেন্সির সার্ভিস নেয়ার ব্যাপারটাকে নিজেদের স্বার্থেই গোপন রাখে। তাই পুলিশের পক্ষে কখনওই ব্যাক-ট্র্যাক করে এজেন্সি পর্যন্ত পৌঁছনো সম্ভব হয় না।
গাড়িতে বসেই কথার ছলে জেনে নিয়েছে জেফ, মিরাণ্ডা আর লারাও আজকের ব্যাপারটাকে নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে, আর কাউকে জানায়নি।
একজন মেল এসকর্টের সঙ্গে রাত কাটাতে যাচ্ছে, এটা কি আর জনে-জনে বলে বেড়ানোর বিষয়?
লম্বা দম নিল জেফ। অনুভব করছে, দেহের প্রতিটি কোষ থেকে দানবীয় শক্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। পরিবর্তনের জন্য সম্পূর্ণ তৈরি সে!
আঁধারের দেবতাকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলল না জেফ। বহুদিন বাদে তার ভাগ্যে জোড়া শিকার মিলেছে।
বিবস্ত্র মিরাণ্ডার চর্বিসর্বস্ব শরীরের দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল তার। থলথলে মাংসপিণ্ডগুলো তার অনেকদিনের খিদে মেটানোর জন্য যথেষ্ট!
লারার ফর্সা ত্বকের নীচে বয়ে চলা উষ্ণ রক্তের শিরাগুলোও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে এখন। আর তাতেই তার পিপাসা বেড়ে গেল বহুগুণে! তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো।
আর সময় নষ্ট করতে ইচ্ছুক নয় জেফ। ধীরপায়ে এগিয়ে গেল সে পুরোদস্তুর নগ্ন মেয়ে দুটোর দিকে।
একধরনের ঘোরের মধ্যে থাকায়, জেফের দানবে রূপান্তরিত হওয়াটা দু’জনের কেউই লক্ষ করেনি। যতক্ষণে ওদের টনক নড়ল, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
পরদিন নর্থ হাইওয়েতে পাওয়া লাশের তালিকায় যুক্ত হলো আরও দুটো নতুন নাম।
মার্জার সমাচার
আফতাব সাহেব বিড়াল পছন্দ করেন না। একদমই না। দানবীয় ট্রাকগুলোর পেছনে যেমন গাঢ় কালিতে লেখা থাকে, ‘একশো হাত দূরে থাকুন’, পৃথিবীর তাবৎ বিড়ালের শরীরেও অনেকটা ওরকম অদৃশ্য একটা লেখা দেখতে পান তিনি।
শৈশবে, কোন এক ঘুঘু ডাকা দুপুরে, খেপাটে একটা মা বিড়াল তাঁর ডান হাতের কড়ে আঙুলে একখানা রাম কামড় বসিয়ে দিয়েছিল। বেচারা বুঝতেও পারেননি, বেখেয়ালে কখন তিনি একটা সদ্য জন্মানো বিড়াল ছানার আঁতুড় ঘরের হাতছোঁয়া দূরত্বে পৌঁছে গিয়েছিলেন! আর ঠিক সেকারণেই, অতর্কিতে সন্তানের নিরাপত্তার জন্যে হুমকি হয়ে ওঠা মানুষটাকে প্রাপ্য পাওনা বুঝিয়ে দিতে কোনরকম কসুর করেনি বিড়াল-মাতা।
হাতের ব্যথাটা অবশ্য সেরে যেতে খুব একটা সময় লাগেনি, তবে বিড়ালের প্রতি বিদ্বেষটা চিরকালের জন্য গেঁথে গিয়েছিল আফতাব সাহেবের হৃদয়ে। কালে- কালে সেটা বেড়েছে বৈ কমেনি।
বিড়াল দেখলে মাথায় রক্ত চড়ে যায় তাঁর। ওটাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করার আগ পর্যন্ত শান্তি পান না কিছুতেই।
কারও বাসায় পোষা বিড়াল থাকলে, ওই বাড়ির চৌহদ্দিতে আর ঘেঁষেন না তিনি, দূরে-দূরে থাকেন।
বিড়ালওয়ালা বাড়ির বাসিন্দাদের কাছ থেকেও দূরত্ব বজায় রাখেন, উৎসব- পার্বণে এড়িয়ে চলেন। ওদের শরীর থেকেও কেমন একটা বিড়াল-বিড়াল গন্ধ পান তিনি! সারাক্ষণ বিড়ালদের আশপাশে ঘুর-ঘুর করলে এমনই তো হওয়ার কথা, তাই না?
তাঁর এই অদ্ভুতুড়ে বাতিকটার ব্যাপারে সব আত্মীয়-স্বজনই ওয়াকিবহাল। বলা বাহুল্য, এটা নিয়ে খুশি নয় কেউই, ভীষণ বিরক্ত।
বাড়াবাড়িরও তো একটা সীমা আছে, নাকি? সামান্য বিড়াল নিয়ে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ মানুষ এহেন হাঙ্গামা করলে, কাঁহাতক সেটা সহ্য করা যায়? এ নিয়ে এযাবৎকালে কেলেঙ্কারিও তো কম হয়নি!
কথাটা অক্ষরে-অক্ষরে সত্যি। বিড়াল নিয়ে বেশ কয়েকবারই বড়সড় ঝামেলা বাধিয়েছেন আফতাব সাহেব। তাঁর ভাতিজী মিলির বিয়েতে কী কাণ্ডটাই না হলো!
মিলির বাবা নেই, বহুকাল আগেই মারা গেছেন। তারপর থেকে অভিভাবকত্বের গুরু দায়িত্বটা একমাত্র চাচা হিসেবে আফতাব সাহেবের কাঁধেই বর্তেছিল 1
বুকে হাত রেখে বলা যায়, দায়িত্বটায় কোনরকম গাফিলতি করেননি তিনি নিজের ছেলেমেয়েদের মতই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন মিলিকে। পোশাক- আশাক থেকে শুরু করে খাবার-দাবার, কোনকিছুতেই বিন্দুমাত্র বৈষম্য করেননি কখনও।
সেদিনের সেই ছোট্ট মিলি বলতে গেলে একরকম তাঁর চোখের সামনেই ধীরে-ধীরে যুবতী হয়েছে। আফতাব সাহেবের কাছে মনে হয়, এই তো সেদিনও মেয়েটা হাফপ্যান্ট আর ফ্রক পরে আঙিনায় ছোটাছুটি করত। কেমন করে এত বড় হয়ে গেল মেয়েটা?
মিলির বিয়ের আয়োজনটা গোটা তল্লাটে রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সে এক এলাহি কারবার, রাজকীয় ব্যাপার-স্যাপার। এলাকার একটা পরিবারও বাদ যায়নি দাওয়াতের লিস্ট থেকে।
দু’হাতে পয়সা খরচ করেছিলেন আফতাব সাহেব, কোনরকম খামতি রাখেননি। আপ্যায়নের চোটে বরযাত্রীর দল রীতিমত হাঁপিয়ে উঠেছিল। গর্বে আধ-হাত ফুলে উঠেছিল ঘটক তমিজুদ্দিনের বুক, সারাক্ষণ মুখে লেগে ছিল দাঁত কেলানো হাসি।
সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, তবে আচমকা গজব হিসেবে আবির্ভূত হলো একটা হোঁৎকা মোটা হুলো বিড়াল!
বাড়ির পিছনের খড়ের গাদার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ওটা, পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল খাবারের প্যাণ্ডেলের দিকে।
শামিয়ানার খোলা মুখটার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াল বিড়ালটা। খাবারের সন্ধানে ইতিউতি তাকাল, বারকয়েক নাক কুঁচকে গন্ধ শুঁকল বাতাসের।
কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে ছিলেন আফতাব সাহেব, অতিথিদের খাওয়া-দাওয়ার তদারক করছিলেন। হাতে বিশাল একখানা দইয়ের হাঁড়ি; মুরুব্বী গোছের মেহমানদের পাতে নিজ হাতে দই তুলে দেবেন, এমনটাই ইচ্ছে ছিল তাঁর।
বিড়ালটার ওপর চোখ পড়তেই জায়গায় জমে বরফ হয়ে গেলেন তিনি। এক লহমায় দাঁড়িয়ে গেল শরীরের সবক’টা লোম।
পরক্ষণেই সবাইকে চমকে দিয়ে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন আফতাব সাহেব! হাতে ধরা পাতিলটা সজোরে ছুঁড়ে মারলেন বিড়ালটার উদ্দেশে।
উত্তেজনায় সর্বাঙ্গ ভীষণ কাঁপছিল তাঁর, তাছাড়া ছুঁড়ে মারার জন্যে দইয়ের হাঁড়ি জিনিসটাও খুব একটা সুবিধের নয়। ফলে যা হওয়ার, তা-ই হলো।
চোখের পলকে উধাও হয়ে যাওয়া বিড়ালটার বদলে পাতিলটা গিয়ে পড়ল বরের বাবার মাথার ওপর!
মুরগির রান চিবুনো শেষ করে সবেমাত্র খাসীর কালিয়ার বাটিটার দিকে হাত বাড়াচ্ছিলেন ভদ্রলোক, ঠিক তখনই তাঁর ওপর গজবটা নাযিল হলো।
খুলির হাড়ের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে সশব্দে ভেঙে গেল মাটির পাতিলটা; মিষ্টি দইয়ে ঢেকে গেল বেচারার গোটা অবয়ব!
উপস্থিত দর্শকদের কাছে মনে হলো, কয়েক মুহূর্তের জন্য বুঝি থমকে গেছে পৃথিবী! যে যার জায়গায় ঠায় বসে রইল সবাই, কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না কেউই।
তবে আকস্মিক চমকের রেশটা কাটতেই সংবিৎ ফিরে পেল সবাই, একযোগে হল্লা করে উঠল। আফতাব সাহেব সহ বেশ কয়েকজন মানুষ দ্রুত ছুটে গেলেন ভিক্টিমের দিকে।
ভদ্রলোক ততক্ষণে আহারে ইস্তফা দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন; রাগে গর্জাতে- গর্জাতে হাঁটা শুরু করেছেন বেসিনের উদ্দেশে। আপাদমস্তক লেপ্টে থাকা দইয়ের প্রলেপ থেকে যতটা সম্ভব মুক্তি পেতে চান।
ঘটনাটা নিয়ে প্রচুর জল ঘোলা হলো। কীভাবে-কীভাবে যেন রটে গেল, দোষ আছে আফতাব সাহেবের মাথায়; তিনি মৌসুমি পাগল!
বেঁকে বসলেন ছেলের বাবা, একটা উন্মাদের পরিবারের সাথে কিছুতেই তিনি আত্মীয়তা করতে রাজি নন! পাগলামো বংশগতও হয়; কনের মধ্যেও যে এর ছিটেফোঁটা রেশ নেই, এর কী নিশ্চয়তা আছে?
বিস্তর বচসার পর শেষতক এলাকার মুরুব্বীদের হস্তক্ষেপে বরপক্ষকে শান্ত করা গেল। সন্ধ্যার ঠিক আগে-আগে বিয়ে হয়ে গেল মিলির। মেয়েটা ভীষণ কেঁদেছিল সেদিন, বাবার মত চাচার অপমান কিছুতেই সহ্য হচ্ছিল না তার।
বরযাত্রী বিদায় নেয়ার আগ পর্যন্ত নিজেকে ঘরেই বন্দি করে রেখেছিলেন আফতাব সাহেব। সবার সামনে মুখ দেখানোর আর জো ছিল না তাঁর।
বিড়াল নিয়ে তাঁর বাতিকটার কথা যে ক’জন মানুষের জানার বাকি ছিল, সেদিনের হাঙ্গামায় তাদেরও জানা হয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটার আদ্যোপান্ত।
তাঁকে দেখলে অনেকেই এখন উপহাস করে, মুখ টিপে হাসে। দুষ্টু ছেলের দল আড়াল থেকে ‘ম্যাও, ম্যাও’ বলে চিৎকার করে।
এসব কিছু দেখেও না দেখার ভান করেন আফতাব সাহেব, নীরবে সহ্য করেন। এছাড়া আর কী-ই বা করার আছে তাঁর?
এই ঘটনার পর থেকে বিড়ালদের প্রতি রাগটা আরও অনেকখানি বেড়ে গেল তাঁর। রীতিমত নৃশংস আচরণ করতে শুরু করলেন তিনি। একবার কোত্থেকে যেন শুনলেন, বিড়ালদের নাকি পিটিয়ে মারা যায় না; যেভাবেই হোক পালিয়ে যায় ওরা! সাধে তো আর বলে না, একটা বিড়ালের নয়টা জীবন!
রোখ চেপে গেল আফতাব সাহেবের, যে কোন মূল্যে একটা বিড়ালকে পিটিয়ে মারবেন! নইলে নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাবেন তিনি। বাসর রাতে বিড়াল মারার ব্যর্থতার কারণে আজও খেসারত দিতে হয় তাঁকে; একই ভুল দ্বিতীয়বার করতে চান না!
তবে সহসাই কাজটা করার সুযোগ মিলল না তাঁর, বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হলো। কোন এক অগ্রহায়ণে দূরসম্পর্কের এক শালীর বিয়ে উপলক্ষে ঘরসুদ্ধ লোক গ্রামের বাড়িতে চলে গেল। অনেক পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও কিছুতেই পরিবারের সঙ্গী হতে রাজি হলেন না তিনি। ব্যবসার কাজের চাপের দোহাই দিয়ে শহরেই রয়ে গেলেন। বিড়াল নিধনের এহেন সুবর্ণ সুযোগটা হেলায় হারানোর কোন মানে হয়?
বাড়ি খালি হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই কাজে নেমে পড়লেন তিনি। গোটা কয়েক বাটিতে বেশ যত্ন করেই খাবার সাজালেন। মাছ, মাংস, দুধ…মোদ্দাকথা বিড়ালরা পছন্দ করে এমন কোনকিছুরই কমতি ছিল না তাঁর আয়োজনে।
বাড়ির সবক’টা দরজা-জানালা বন্ধ করে দিলেন আফতাব সাহেব, খোলা রইল কেবল সদর দরজাটা।
দরজার পাশেই বিশাল একখানা কাঠের বাক্স রাখা। পুরনো, বেশ পোক্ত। শীতের পোশাক-আশাক আর কাঁথা-কম্বলে বোঝাই থাকে ওটা। দেয়াল থেকে খানিকটা সরানো বলে মাঝখানে একটা ফোকরমতন তৈরি হয়েছে।
জায়গাটা অন্ধকার; ভাল করে না তাকালে কিংবা আগে থেকে জানা না থাকলে চট করে কারও চোখে পড়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
ওখানটাতেই আত্মগোপন করলেন আফতাব সাহেব। শুরু হলো তাঁর প্রতীক্ষার পালা। ঘড়ির কাঁটায় সেকেণ্ড পেরিয়ে মিনিট হলো, মিনিট পেরিয়ে ঘণ্টা; কিন্তু শিকারের টিকিটিরও দেখা মিলল না। যেন দৈববলে এলাকার সমস্ত বিড়াল বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে! অথচ আজ সকালেও বাজার থেকে ফেরার পথে অন্তত গোটা তিনেক বিড়ালের দেখা পেয়েছেন আফতাব সাহেব।
অপেক্ষার প্রহর বরাবরই দীর্ঘ হয়, তাঁর কাছে সেটা রীতিমত অসহ্য ঠেকতে লাগল। উত্তেজনা থিতিয়ে এল, ধীরে-ধীরে অধৈর্য হয়ে উঠলেন তিনি।
ইতোমধ্যেই ঝিঁঝি ধরে গেছে পায়ে, কায়দামত পেয়ে মশারাও সমানে কামড়ে চলেছে। শেষমেশ তিতিবিরক্ত হয়ে যেই না তিনি উঠে পড়তে যাবেন, ঠিক তখনই অভাগা বিড়ালটা চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকল।
গায়ের রঙ বাদামি, এখানে-ওখানে রোম উঠে গেছে; ভীষণ নোংরা।
হাড়জিরজিরে বেহাল দশা দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না, পেটে নিয়মিত দানা- পানি পড়ে না ওটার। কোনমতে ধুঁকে-ধুঁকে বেঁচে আছে।
তবে অচিরেই ক্ষুৎপিপাসার নিগড় থেকে মুক্তি পেতে চলেছে বিড়ালটা! হয়তো একারণেই ওটাকে আজ এখানে টেনে এনেছে নিয়তি!
বাঘের মত হুঙ্কার দিয়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন আফতাব সাহেব, ঝড়ের বেগে বন্ধ করে দিলেন দরজাটা।
সিনেমায় দেখা সামুরাইদের ভঙ্গিমায় হাতের লাঠিটা অনবরত ঘোরাচ্ছেন; চোখজোড়া রীতিমত জ্বল-জ্বল করছে তাঁর।
কয়েক মুহূর্তের জন্য হতবিহ্বল হয়ে পড়ল বিড়ালটা, অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আফতাব সাহেবের দিকে। যুগপৎ আতঙ্ক আর বিস্ময় খেলা করছে চোখের তারায়, কী করবে ঠিক ঠাহর করতে পারছে না।
তবে সাময়িক ঘোরটা ভাঙতেই প্রাণভয়ে ভিতর বাড়ির দিকে ছুট লাগাল ওটা; পালাতে চাইছে। রণ নিনাদ ছেড়ে ওটার পিছন-পিছন তেড়ে গেলেন আফতাব সাহেব। আজ তাঁর হাত থেকে কে বাঁচাবে বিড়ালটাকে?
প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে চলল এই বিড়ালে-মানুষে হুটোপুটি। ইতোমধ্যে আক্ষরিক অর্থেই গোটা বাড়িটা লণ্ডভণ্ড করে ফেললেন আফতাব সাহেব।
এহেন আকস্মিক ছোটাছুটি করতে গিয়ে নিজেও বেজায় ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। ঘন-ঘন শ্বাস নিতে লাগলেন, গোটা দেহ ঘেমে-নেয়ে একাকার।
তবুও হাল না ছেড়ে ছায়ার মতন ওটার পিছনে সেঁটে রইলেন তিনি। একটা ব্যাপার কিছুতেই তাঁর মাথায় আসছে না, এতগুলো মারাত্মক আঘাত সহ্য করেও এখনও বহাল তবিয়তে ছুটছে কী করে ওটা? প্রথম কয়েকটা ঘা খাওয়ার পরপরই তো অক্কা পাওয়ার কথা!
তাঁকে পুরোপুরি হতবাক করে দিয়ে আচমকা বাথরুমের ভেন্টিলেটর গলে পালিয়ে গেল বিড়ালটা! নিজের ছানাবড়া চোখজোড়াকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। অতটুকু একটা ফুটো দিয়ে কেমন করে গোটা একটা বিড়াল সেঁধিয়ে গেল?!
হতাশায় রীতিমত ভেঙে পড়লেন আফতাব সাহেব; শরীরটা এলিয়ে দিলেন বিছানায়। মাথার ওপর ফুলস্পিডে ফ্যান ঘুরছে, তবুও ভীষণ হাঁসফাঁস লাগছে তাঁর।
আদতেই কি বিড়ালদের নয়টা জীবন? ওদেরকে পিটিয়ে মারা সত্যিই কি অসম্ভব?
মারাত্মক জখম হওয়া মুমূর্ষু বিড়ালটা পরে ঠিকই মারা গিয়েছিল। একটা এঁদো ডোবার ধারে মানকচুর ঝোপের আড়ালে পড়ে ছিল ওটার মৃতদেহ। তবে সেটা আর কোনদিনও জানা হয়নি তাঁর।
.
সাধারণত একটু বেলা করেই বিছানা ছাড়েন আফতাব সাহেব। নিজের ঠিকাদারি ব্যবসা আছে, তাই সকাল-সকাল অফিস ধরার তাড়া নেই তাঁর.১ক
নাস্তা বানানো শেষে স্ত্রী রোকেয়া বেগম ডেকে তোলার আগ পর্যন্ত চোখ মুদেই থাকেন তিনি, ভোরের ঘুমটা বেশ উপভোগ করেন।
এক সকালে অন্যান্যদিনের তুলনায় খানিকটা আগেভাগেই ঘুমটা ভেঙে গেল তাঁর। চোখ খোলা মাত্রই খানিকটা ভড়কে গেলেন তিনি! ঘরটা এমন বড়-বড় লাগছে কেন?
ঘরের সিলিঙটা মনে হচ্ছে যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে, আসবাবগুলোকে তো রীতিমত দানবীয় লাগছে! খাটটাও যেন দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে বেড়ে গেছে অনেকখানি!
প্রথমটায় ভাবলেন, হয়তো স্বপ্ন দেখেছেন। তাই রেশটা কাটাতে বার কয়েক চোখ কচলালেন আফতাব সাহেব; এখনই নিশ্চয়ই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তাঁকে তাজ্জব করে দিয়ে অবিকল একই রইল দৃশ্যপট!
খাটের পাশেই কাঠের একখানা বনেদী ড্রেসিং টেবিল শোভা পাচ্ছে। আয়নাটা বিশাল, ‘ফ্রেমে পিতলের কারুকাজ করা। উত্তরাধিকার সূত্রে ‘ওটার মালিক হয়েছেন আফতাব সাহেব। বিছানায় পাশ ফিরতেই আয়নাটার ওপর চোখ পড়ল তাঁর। পরক্ষণেই পুরোপুরি হকচকিয়ে গেলেন তিনি!
আয়নাটায় দেখা যাচ্ছে, একটা সাদা রঙের বিড়াল শুয়ে আছে বিছানায়! নিষ্পলক তাঁর দিকেই এখন তাকিয়ে আছে ওটা!
লাফিয়ে উঠে বসলেন আফতাব সাহেব, ইতিউতি তাকিয়ে খুঁজতে শুরু করলেন বিড়ালটাকে। কিন্তু কীসের কী! কোন বিড়াল নেই ঘরে।
কিন্তু আয়নায় তাকাতেই ফের ওটাকে দেখতে পেলেন আফতাব সাহেব! শুয়ে নেই আর ওটা এখন, উঠে বসেছে বিছানায়! নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাঁরই চোখের দিকে! নির্মম সত্যটা উপলব্ধি করতে মিনিট খানেক সময় লাগল তাঁর। পুরোটা সময় পাথরের মূর্তি হয়ে আয়নাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি।
প্রতিবিম্বটা আর কারও নয়, তাঁর নিজের! তিনি নিজেই পরিণত হয়েছেন একটা রোমশ বিড়ালে! তীব্র আতঙ্কে সজোরে চেঁচিয়ে উঠলেন আফতাব সাহের। ভয়ে সারা শরীর কাঁপছে। চিৎকারটা তাঁর গলা চিরে বেরোল ঠিকই, কিন্তু সেটা শোনাল হুবহু বিড়ালের আর্তনাদের মত, মানুষের সাথে যার কোন মিলই নেই!
আরও ঘাবড়ে গেলেন আফতাব সাহেব। তাঁর দু’চোখ বেয়ে জল গড়াতে শুরু করল। রান্নাঘর থেকে তড়িঘড়ি ছুটে এলেন রোকেয়া বেগম, বিড়ালের ডাকটা ঠিকই শুনতে পেয়েছেন তিনি। হতচ্ছাড়াটা কোত্থেকে এসে জুটেছে, কে জানে! ওটাকে দেখতে পেলে নির্ঘাত এখন চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে তাঁর স্বামী, তুলকালাম কাণ্ড বাধাতে সময় লাগবে না। যত জলদি সম্ভব আপদটাকে দূর করতে হবে।
ঘরে ঢুকে বেশ অবাক হলেন রোকেয়া বেগম। বিছানা খালি; আফতাব সাহেবকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। মেঝের ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটা মোটাসোটা সাদা বিড়াল।
সাত-সকালে কোথায় গেল লোকটা?
মর্নিং ওয়াকে? কখন গেল?
স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললেন রোকেয়া বেগম। আফতাব সাহেব বাড়িতে না থাকায় বিরাট একটা হাঙ্গামার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে।
একটা শলার ঝাড়ু তুলে নিয়ে বিড়ালটার দিকে তেড়ে গেলেন তিনি।
স্ত্রীর সাথে কথা বলতে চাইলেন আফতাব সাহেব, কিন্তু মিউ মিউ ছাড়া আর কিছুই বেরোল না তাঁর মুখ দিয়ে।
শেষটায় স্ত্রীর হাতে বেদম প্রহৃত হয়ে নিতান্ত প্রাণ বাঁচানোর তাগিদেই তাঁকে জানালা গলে বাইরে বেরোতে হলো।
মনের দুঃখে বাড়ির আঙিনার আমতলায় বসে-বসে কাঁদলেন কিছুক্ষণ, তারপর ওখান থেকেও পালাতে হলো তাঁকে!
রোকেয়া বেগমের নির্দেশে কাজের বুয়া আমেনা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তেড়ে এসেছিল ঝাঁটাপেটা করতে। কোন্ সাহসে আর ওখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন আফতাব সাহেব?
.
পিছনের বারান্দায় একটা বিড়ালকে বসে থাকতে দেখে প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে উঠল মনু গোয়ালা। রোজ-রোজ তার গরুর দোয়ানো দুধ খেয়ে যায় একটা বজ্জাত বিড়াল, কখনওই ওটার নাগাল পাওয়া যায় না।
বহুদিন তক্কে তক্কে থাকার পর অবশেষে আজ ওটার দেখা পাওয়া গেল।
পা টিপে-টিপে বিড়ালটার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল সে, হাতে তুলে নিয়েছে মস্ত একটা রামদা।
অন্য বিড়ালদের মত নয়টা জীবন থাকলে, এ যাত্রায় হয়তো প্রাণে বেঁচে যেতেন আফতাব সাহেব!
প্ৰণয়
একগাদা তেল চিটচিটে কাঁথার দঙ্গলে মুখ গুঁজে রেখেছে মানিক। শ্যামলা মুখখানা লালচে হয়ে গেছে তার। সেই সন্ধ্যা থেকেই একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে সে। ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে, শিশুদের মত। সত্যিকারের পুরুষ মানুষরা কাঁদতে শেখেনি, চায়ের দোকানে বসে হাজারবার শোনা বেঁটে মাস্টারের অমোঘ বাণীটাও আজ তার কান্না রুখতে পারেনি।
বেঁটে মাস্টারকে এখন হাতের কাছে পেলে, চাবকে নির্ঘাত তার পিঠের ছাল- চামড়া তুলে নিত মানিক। তাতে যদি লোকটার নাম বেঁটে মাস্টার থেকে ছালছাড়া মাস্টারও হয়ে যেত, তাতেও কোন পরোয়া করত না সে।
সত্যিকারের পুরুষ মানুষেরা তাদের স্ত্রীকে ভালবাসে। আর সেই ভালবাসার মানুষের মৃত্যুতে গলা ফাটিয়ে কাঁদতেও পারে তারা!
মরিয়ম, মানিকের বউ, মাটির উপর বসবাস করা তার সর্বশেষ আপনজন, তিনদিনের জ্বরে ভুগে আজ দুপুরবেলা মারা গেছে। আজকাল জ্বরজারিতে কেউ মরে? সদরে গিয়ে ডাক্তার দেখানোর সুযোগটাও স্বামীকে দেয়নি সে। চার বছর আগে অগ্রহায়ণের এক বিকেলে, জনা পঞ্চাশেক লোককে সাক্ষী রেখে মরিয়মকে ঘরে তুলেছিল মানিক। লাল শাড়ি ছিল তার পরনে, গলায় ইমিটেশনের ভারী গয়না। পুরোদস্তুর নববধূর সাজে কী সুন্দরই না লাগছিল তাকে সেদিন।
আর আজ কি না গুটিকয়েক লোক মিলে তাকে পুঁতে দিয়ে এল কবরস্থানে! পরনে সাদা কাফন, শুধুই আবরণ, আভরণের বালাই নেই। মরিয়মের এহেন রূপ, কেমন করে সহ্য করবে মানিক? কেমন করে ঠেকাবে দু’চোখের বাঁধভাঙা বানের জল?
তাই তো সমবেদনা জানাতে আসা শেষ মানুষটিও যখন বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে দূরে চলে গেল, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাল মানিক। মরিয়মের শূন্য বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল সে।
ঘড়িতে ঘণ্টা কয়েক পেরিয়ে যাবার পর দেহের শক্তিতে ভাটা পড়ল সত্যি, তবে দুঃখের ভাণ্ডার তখনও কানায় কানায় ঠিকই পূর্ণ। তাই গর্জন কমে এলেও বর্ষণ কমল না এতটুকুও। ঘড়ির কাঁটা যখন বারোটা ছুঁই-ছুঁই, তখনই কেবল সে রাতে প্রথমবারের মত মাথা তুলল মানিক।
বাইরে তখন ঝিঁঝি পোকারা ডেকে চলেছে অনর্গল। অন্যান্য দিন যে শব্দটায় সে ভীষণরকম বিরক্ত হত, আজ সেই একই শব্দ তার কানে মধু বর্ষণ করল। কারণ ঝিঁঝি পোকার এই ডাকটা খুব পছন্দ করত মরিয়ম।
কতদিন যে ঘরে ফিরে মরিয়মকে জানালার পাশে চুপটি করে বসে থাকতে দেখেছে মানিক, তার কোন ইয়ত্তা নেই। পরে জেনেছে, ঝিঁঝি পোকাদের এই সম্মিলিত নিনাদ মরিয়মকে নেশাতুর করে তুলত। অনেকটা নিশিতে পাওয়া মানুষদের মত। কাজকর্ম সব শিকেয় তুলে রেখে নিজের অজান্তেই নাকি জানালার পাশে বসে পড়ত সে! কতটা সময় কেটে যাচ্ছে, সেটা নাকি টেরও পেত না।
আর নেশা ছাড়াতে চুলের মুঠি খামচে ধরার চেয়ে ভাল কোন পদ্ধতি জানা ছিল না মানিকের! কারণে-অকারণে মরিয়মকে পেটাত সে। সপ্তাহে অন্তত দু’বার। এক সাধুর আখড়ায় শুনেছিল, নিয়মিত না পেটালে স্ত্রীরা কখনও স্বামীর বশে থাকে না। কথাটা মানিকের অবচেতন মনে বেশ ভালভাবেই গেঁথে গিয়েছিল।
ঘরে ফিরে মরিয়মের সঙ্গে নরম করে দুটো ভালবাসার কথা বলেছে মানিক, এমনটা কেউ কখনও দেখেনি। ঠোঁট ফাঁক করে মরিয়মের উদ্দেশে একটা জিনিসই কেবল ওগরাত সে-খিস্তি! অশ্রাব্য সব খিস্তি করতে গোটা তল্লাটে তার জুড়ি মেলা ভার।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার চিরন্তন দৈহিক ব্যাপারটাও অবধারিতভাবে নির্ভর করত মানিকের মর্জির উপর। মরিয়মের ইচ্ছা-অনিচ্ছার থোড়াই কেয়ার করত সে।
সেই মরিয়ম কী কৌশলে, কেমন করে মানিকের পাষাণ হৃদয় দখল করে নিয়েছিল, সেটা মানিকের নিজেরও জানা নেই। আজ বুকের মধ্যখানে আচমকা তৈরি হওয়া শূন্যতাটুকু রীতিমত অসহ্য ঠেকছে তার কাছে।
সহসাই আবিষ্কার করেছে মানিক, স্ত্রীকে যারপরনাই ভালবাসত সে! যদিও আচার-আচরণে এর উল্টোটাই সে প্রকাশ করেছে সবসময়, তবুও ওটা ভালবাসাই। অন্য দশজনের চেয়ে আলাদা, অনেকখানি অন্যরকম, তবে পুরোপুরি নিখাদ।
রোজ সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার সময় হাত দুটো কখনও খালি থাকত না তার। আলতা, চুড়ি, নাকফুল কিংবা বিলেতি সাবান, কিছু না কিছু সে নিয়ে আসতই মরিয়মের জন্য। যদিও কখনও নিজহাতে ওগুলো বউকে দেয়নি সে! চৌকাঠ পেরিয়েই সজোরে খাটের উপর ছুঁড়ে ফেলত সে হাতের সদাই। তারপর লাল গামছাটা কাঁধে ফেলে বেরিয়ে যেত পুকুর ঘাটের উদ্দেশে। এটাই ছিল তার রোজকার রুটিন।
গোসল শেষে ফিরে এসে খাটের উপর গরম খাবার সাজানো পেত সে। কারণ মরিয়মের জানা ছিল, ক্ষুধার্ত মানিকের হাতের চড় গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ ফেলে দেয়!
গঞ্জের বাজারে ছোট একখানা মুদি দোকান চালায় মানিক। আর বাজার মাত্রই নানা কিসিমের লোকজনের আনাগোনা, সেই সঙ্গে হরেক রকম কানকথার উড়োউড়ি। মরিয়মকে নিয়েও অমন উড়ো খবর বেশ কয়েকবারই কানে এসেছে তার! শুনেও না শোনার ভান করেছে মানিক। পুরোপুরি নির্লিপ্ত থেকেছে, কোনরকম উচ্চবাচ্য করেনি।
এমনকী মরিয়মকে এসব নিয়ে একটি প্রশ্নও কখন করেনি সে। তার ভয় হত, যদি দুম করে স্বীকার করে বসে মরিয়ম! যদি বলে দেয়, সব সত্যি! তাহলে কেমন করে বেঁচে থাকবে মানিক? কাকে নিয়ে বেঁচে থাকবে?
যদি সত্যিই রতন চোরার সঙ্গে মরিয়মের কোন সম্পর্ক থেকে থাকে, তাতে বাগড়া দিতে চায়নি মানিক! প্রতিটি মানুষেরই সুখী হবার অধিকার আছে, তাই না? বিধাতা কার সুখ কোথায় লিখে রেখেছেন, কে বলতে পারে!
তাই দুপুরের পর বাজার ক্রেতাশূন্য হয়ে গেলেও কখনও সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরত না মানিক। সবসময় একই রুটিন মেনে চলত, কখনও এর ব্যতিক্রম করেনি সে। সদা সতর্ক থাকত, উল্টোপাল্টা কোন কিছু যেন তার নজরে না আসে। তার চোখের আড়ালে যা খুশি হোক, কী করার আছে তার?
তবে গেল সপ্তাহে যখন সর্দার বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে গণধোলাই খেয়ে পটল তুলল রতন চোরা, স্বস্তির নিঃশ্বাসটা ঠিকই ফেলেছিল মানিক। যাক, বাবা, এবার বুঝি সমস্ত নষ্ট কথার ইতি ঘটল। দিন কয়েক পর মরিয়মও যে তাকে ফাঁকি দিয়ে ওপারে পাড়ি জমাবে, এটা তো আর তার জানা ছিল না।
কাছেপিঠে কোথাও একটা শিয়াল ডেকে উঠল। রাতের নিস্তব্ধতাকে যেন চিরে দিল ডাকটা। ঝিঁঝি পোকার দলের সঙ্গে চমকে উঠল মানিকও।
ডাকটা কবরস্থানের ওদিক থেকেই এসেছে। আর সেখানেই শুয়ে আছে মরিয়ম, একা। যে কি না বেঁচে থাকতে শিয়ালকে প্রচণ্ড ভয় পেত। দূরে কোথাও শিয়াল ডাকলেও ভয়ে রীতিমত কুঁকড়ে যেত মেয়েটা।
খুব ছোটবেলায় ভর সন্ধ্যায় একবার শিয়ালের তাড়া খেয়েছিল মরিয়ম। ছুটে ‘পালাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে গর্তমতন একটা জায়গায় পড়ে গিয়েছিল সে। শিয়ালটা গর্তের মুখে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে, জ্ঞান হারাবার আগে এটাই ছিল তার সর্বশেষ স্মৃতি। স্বভাবতই মনের গভীরে শিয়ালের ভয়টা ঢুকে গিয়েছিল তার। বড় হবার পরও ভয়টা আর কোনদিনও কাটেনি।
আর এখন এই মধ্যরাতে, এসব ভাবনাই রীতিমত অস্থির করে তুলল মানিককে। শিয়ালটাকে দেখতে পেয়ে খুব কি ভয় পাচ্ছে মরিয়ম? আতঙ্কে কবরের এক কোনায় জড়সড় হয়ে নেই তো মেয়েটা? কাঁপছে থর-থর করে? নাকি নিঃশব্দে কাঁদছে? কার বুকে মুখ লুকাবে সে এখন? হাত বাড়িয়ে মানিককে না পেলে কী করবে পাগলি মেয়েটা?
আচ্ছা, শিয়ালটা মরিয়মকে খেতে আসেনি তো? সে জানে, শিয়ালের দল কবর খুঁড়ে লাশ বের করে খেয়ে ফেলে। তাহলে কি সেটাই হতে চলেছে এখন? নতুন কবরের খবর পেয়ে খাবারের সন্ধানে হাজির হয়ে গেছে শিয়ালের পাল?
আর ভাবতে পারল না মানিক। নিজের অজান্তেই সটান উঠে দাঁড়াল। পড়িমরি ছুটল দরজার দিকে। অসাবধানতায় দরজার চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে হাত- পা ছড়িয়ে মাটিতে পড়ল সে। প্রথমটায় ব্যথার চোটে ককিয়ে উঠলেও, তড়িঘড়ি আবার উঠে দাঁড়াল সে। সারা শরীর ধুলোয় মাখামাখি, সেদিকে তার বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপও নেই। তার সমস্ত চিত্ত জুড়ে রয়েছে মরিয়ম, যত দ্রুত সম্ভব তার কাছে পৌছতে চায় সে।
আকাশে ভাঙা থালার মত আধখানা চাঁদ উঠেছে। তার ঘোলাটে আলোয় কেটে গেছে জমাট অন্ধকার। শীত এখনও পুরোপুরি আসেনি। তবে তার আগমনী বার্তা নিয়ে হাজির হয়ে গেছে মিহি কুয়াশা। আর সেই শিশিরের আলতো স্পর্শে ভিজে আছে খেতের আইলের ঘাস।
তাই চেনা পথে ডাকহরকরাদের মত গতি তুলে ছুটতে গিয়ে বার কয়েক হোঁচট খেল মানিক। তবে তাতে তার চলার গতি এতটুকুও মন্থর হলো না। মিনিট পাঁচেকের মাথায়ই সে পৌছে গেল গোরস্তানের প্রবেশদ্বারে।
আজ বিকেলেই মরিয়মকে দাফন করতে গাঁয়ের লোকের সঙ্গে এখানে এসেছিল মানিক। কিন্তু এখন এই মধ্যরাতে, কুয়াশাভেজা চাঁদের আলোয়, চারপাশটা কেমন যেন অচেনা ঠেকছে তার কাছে! তবে মরিয়মের কবরটা সে চেনে ঠিকই। সোজাসুজি কিছুদূর গিয়ে হাতের ডানদিকে ঝাঁকড়া একখানা জারুল গাছ। সেটা পেরিয়ে দ্বিতীয় সারির প্রথম কবরটাই মরিয়মের।
রতন চোরাকে বাদ দিলে গত ক’দিনে নতুন কবর বলতে গেলে ওই একটাই। যে কারোরই চিনতে পারার কথা। দু’সারি কবরের মধ্যখান দিয়ে হাঁটতে শুরু করল মানিক। এগুলো সব গ্রামের সম্ভ্রান্ত মানুষজনের কবর। বেঁচে থাকতে সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠিতে যারা পিছিয়ে ছিল, মরে গিয়েও তারা সে ব্যবধান ঘুচাতে পারেনি! তাই তাদের কবরগুলো ঠাঁই পেয়েছে গোরস্তানের অপেক্ষাকৃত পিছনের অংশে।
বড়-বড় গাছের ডালপালার আড়ালে চাঁদের আলোর অনেকটাই ঢাকা পড়ে গেছে ওখানে। তবে আলোর বার্তাবাহক হয়ে আছে অগণিত জোনাকির দল। এখানে-ওখানে, ঝোপ-জংলায়, মনের সুখে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা।
জারুল গাছের নীচে, তেমন একটা জোনাকিছাওয়া ঝোপ পেরোতেই মরিয়মের কবরটা নজরে এল মানিকের। পরক্ষণেই আচমকা থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হলো সে।
মরিয়মকে কবরের ভিতরে আশা করেছিল সে, বাইরে নয়!
ধবধবে সফেদ কাফনে জড়ানো মরিয়মের লাশটা এই আবছা আঁধারেও বেশ স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে মানিক। সদ্য খোঁড়া কবরটার পাশেই পড়ে আছে লাশটা। আর যা কিছুই কবরটা খুবলে খুঁড়ে থাকুক না কেন, ওটা এখনও এখানেই আছে! ঝুঁকে আছে শ্বেতবসনা মরিয়মের উপর!
ওটা কি শিয়াল? নিজেকেই প্রশ্ন করল মানিক।
উঁহুঁ। গঠনে মেলে না।
ছায়ামতন কিম্ভূতকিমাকার একখানা অবয়ব, চেনাজানা কোন কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যাচ্ছে না ওটাকে। তবে আর যা-ই হোক না কেন, শিয়াল যে নয়, একথা ঈশ্বরের দিব্যি করে বলতে পারে মানিক। তাহলে কী ওটা? নিজের অজান্তেই অস্ফুট শব্দ করে উঠল মানিক। আর ঠিক তখনই নড়ে উঠল ওটা!
আঁতকে উঠে চোখজোড়া বন্ধ করতে বাধ্য হলো মানিক। কয়েক মুহূর্ত পর আবার যখন খুলল, ওটাকে আর ওখানে দেখতে পেল না সে। শুধু মরিয়মের লাশটাই দৃশ্যপটে পড়ে আছে প্রকট হয়ে। এখানে-ওখানে আগের মতই দাবড়ে বেড়াচ্ছে জোনাকির দল।
সত্যিই কি কিছু ছিল ওখানটায়? নাকি সবই চোখের ভুল?
নিশুতি রাতে একা-একা গাঁয়ের শেষ মাথার গোরস্তানে আসাটা সহজ কাজ নয়। নির্ঘাত মনের উপর ভীষণ চাপ পড়েছে তার। আর তাতেই হয়তো ভুলভাল দেখতে শুরু করেছে সে। তাই না? নিজেকে প্রবোধ দেয়ার প্রয়াস পেল মানিক।
চকিতে কঠিন একখানা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে। মরিয়মকে কিছুতেই এখানে একাকী ফেলে রাখা যাবে না। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে সে। ঘরের উঠনে কবর দেবে। যেন দিবানিশি নিজেই পাহারা দিতে পারে।
তার ভালবাসার ধনকে শিয়ালে খাবে আর সে কি না আরামসে পৃথিবীর মজা লুটবে? কক্ষনো না।
কোন সন্দেহ নেই, লোভী শিয়ালগুলোই মরিয়মকে কবর থেকে বের করে এনেছে। নইলে এই মাঝরাতে আর কে-ই বা কবরের মাটি খুবলাতে যাবে?
নিশিতে পাওয়া মানুষের মত এলোমেলো পায়ে লাশটার দিকে এগিয়ে গেল মানিক। মরিয়মের শরীর থেকে এখনও আতর লোবানের গন্ধ বেরোচ্ছে। কাছাকাছি যেতেই সেই গন্ধের তীব্র একটা ঝাপটা এসে লাগল মানিকের নাকে। কেমন যেন অস্বস্তি লাগতে শুরু করল তার।
পরোয়া করল না সে। দেহের সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরল লাশটা। তারপর সেটা ডান কাঁধে ফেলে উঠে দাঁড়াল। অনেকটা ঘোরের মধ্যেই ফিরতি পথ ধরল সে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘরে ফিরতে চায়।
যদিও পুরো গ্রাম এখন ঘুমিয়ে কাদা, ভোর হতে এখনও ঢের দেরি। তবুও কারোর চোখে পড়ার ঝুঁকিটা নিতে চায় না সে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যে কেউ জেগে উঠতে পারে যখন-তখন। যদি তাদের কারও চোখে পড়ে যায় ঘটনাটা?
কিছুদূর এগোতেই পিছনে একটা আওয়াজ শুনতে পেয়ে সচকিত হয়ে উঠল মানিক। খুব ক্ষীণ একটা শব্দ, যেন আলতো পায়ে কেউ তার পিছন-পিছন আসছে!
কে?
চেনাজানা কেউ? নাকি ভিনগাঁয়ের কেউ?
ভয়ে-ভয়ে ঘাড়ের উপর দিয়ে ফিরে তাকাল মানিক। জানা নেই, ঠিক কাকে দেখতে পাবে। যে-ই হোক, কপালে দুঃখ আছে মানিকের।
মাঝরাতে বউয়ের লাশ কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক লোক, গ্রামের মানুষের জন্য এরচেয়ে বেশি মুখরোচক গল্প আর কী হতে পারে?
মানিক অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, তার পিছনটা পুরোপুরি ফাঁকা! যতদূর চোখ যায়, কোন জনমানব দূরে থাক, একটা ঘেয়ো কুকুর পর্যন্ত নেই। এখানে- ওখানে, দূরে-দূরে কিছু মিটমিটে আলো জ্বলছে। গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন মানুষজনের কাছারি ঘরের বাইরে ঝোলানো বাতি ওগুলো। সারা রাত ধরে জ্বলে, ফজরের আজানের পরই কেবল নেভানো হয়।
আবারও হাঁটতে শুরু করল মানিক। ডান কাঁধটা প্রায় অবশ হয়ে এসেছিল তার। তাই ভার বদলে মরিয়মকে বাম কাঁধে চালান করে দিয়েছে সে।
আর খানিকটা পথ পেরোলেই নিজের বাড়ির আঙিনায় পৌঁছে যাবে, তাই দ্রুত পা চালাল মানিক।
কিন্তু কিছুদূর যেতেই আবারও থামতে হলো তাকে। এবার কেবল পদশব্দ নয়, ভারী নিঃশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছে সে পিছনে! যেন তার দ্রুতগতির চলনের সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে অনুসরণকারী! আর সেজন্যই লম্বা দম নিতে বাধ্য হচ্ছে সে!
সীমাহীন আতঙ্কে জমে বরফ হয়ে গেল মানিক। স্পষ্ট বুঝতে পারছে, গোরস্তানের সেই ভয়ানক অবয়বটাই পিছু নিয়েছে তার! এহেন ভয়ঙ্কর নিঃশ্বাসের শব্দ কিছুতেই কোন মানুষের হতে পারে না।
কী এটা? মড়াখেকো পিশাচ?
ছোটবেলা থেকে শুনে আসা কবরস্তানের পিশাচদের লোমহর্ষক সব গল্পগুলো একের পর এক মনে আসতে লাগল তার। সদ্য গোর দেয়া লাশের প্রতি একটা আলাদা আকর্ষণ থাকে ওদের। কে কার আগে চেটেপুটে খাবে, তারই প্রতিযোগিতায় মাতে পিশাচের দল। তারই একটা হয়তো এখন খেতে এসেছে মরিয়মের লাশ।
ভাবনাটা অনেকটা শক্তি জোগাল মানিককে। প্রাণ থাকতে মরিয়মকে কোন পিশাচের খোরাক হতে দেবে না সে। কোনমতেই না।
পিছন ফিরে তাকানো থেকে অনেক কষ্টে নিজেকে নিবৃত্ত করল সে। ভয়ঙ্কর কোন চেহারার মুখোমুখি হয়ে সাহস হারানোর ঝুঁকিটা নিতে চায় না ও। তাহলে মরিয়মকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না তার পক্ষে।
মরিয়মকে দু’হাতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল মানিক। তারপর আল্লাহর নাম নিয়ে আচমকা সজোরে দৌড়তে শুরু করল! ভেজা ঘাসে বারকয়েক পিছলে পড়তে-পড়তেও কোনমতে বেঁচে গেল সে। যতটা সম্ভব দ্রুত ছুটছে, দম ফুরাবার আগে আমার ইচ্ছে নেই তার।
ছুটতে-ছুটতেই অনুধাবন করল, মড়াখেকোটা ঠিকই এখনও ছায়ার মত পিছনে লেগে আছে! ওটার ছুটে আসার শব্দটাও খুব একটা পিছিয়ে নেই।
কীভাবে নিজের বাড়ি পৌঁছেছে, সেটা মানিক নিজেও জানে না। সে শুধু জানে, প্রাণ বাজি রেখে জীবনের সবচেয়ে দ্রুতগতির দৌড়টা আজ দৌড়েছে।
ঘরে ঢুকে মরিয়মকে আলগোছে খাটের উপর নামিয়ে রাখল সে। চেনা খাট, চেনা শরীর, শুধু অমূল্য প্রাণটাই অনুপস্থিত।
দ্রুত হাতে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল মানিক। পরিশ্রমে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে সে। বুকটা হাপরের মত ওঠানামা করছে ক্রমাগত।
ভয়টা এখনও কাটেনি ওর। জানে, তার পিছু-পিছু এখান পর্যন্ত ঠিকই পৌঁছে গেছে পিশাচটা। ঘরে ঢোকার ঠিক আগমুহূর্তেও পিছনে ওটার তেড়ে আসার শব্দ শুনতে পেয়েছে সে। উঠনের কোন ঝোপেই হয়তো ঘাপটি মেরে বসে আছে এখন।
অনিশ্চয়তার সময়টা খুব একটা দীর্ঘ হলো না। কেননা কিছুক্ষণের মধ্যেই ওটা তার উপস্থিতি জানান দিল! দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, সেই সঙ্গে আলতো থাবার আঘাত। মানিকের দেহে কাঁপুনি তুলতে এর বেশি কী লাগে আর?
কাঁপতে-কাঁপতেই দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল সে। কাঠের এই পাটাতন কতক্ষণ বাইরের রাক্ষসটাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে, কে জানে!
কেবল মরিয়মের কথা ভেবেই এখনও চিৎকার করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে মানিক। প্রকাণ্ড একখানা আর্তচিৎকার গলার কাছটায় এসে দানা বেঁধে আছে অনেক আগে থেকেই।
থেমে গেল দরজায় করাঘাতের আওয়াজ। ওটা সরে গেছে ওখান থেকে, ঘুরে বেড়াচ্ছে এখন ঘরের চারধারে।
বেড়ার দেয়ালের এখানে-ওখানে ওটার আঁচড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। যেন নখ দিয়ে আঁচড়ে-আঁচড়ে দেয়ালের দুর্বল জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে ওটা।
শব্দটাকে ভিতর থেকে অনুসরণ করে চলল মানিক। হাতে তুলে নিয়েছে ভয়ালদর্শন একখানা রাম-দা। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে, মরতে যদি হয়, লড়াই করেই মরবে।
আচমকা ঘরের ছাদটা মচমচ করে উঠল! কিছু একটা আছে ওখানে!
পিশাচটা কি ওখানে উঠে গেছে? কীভাবে উঠল?
যেভাবেই হোক, উঠেছে ওটা। আর এখন হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে রান্নাঘরের দিকে।
বিদ্যুচ্চমকের মত কথাটা মনে পড়ে গেল মানিকের। রান্নাঘরের ছাদে একটা ফোকর আছে!
অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উপরে তুলে রাখার জন্যই করা হয়েছিল ফোকরটা। চাইলেই ওই পথে নেমে আসতে পারবে পিশাচটা। সম্ভবত এটাই করতে চলেছে ওটা এখন।
পড়িমরি রান্নাঘরে ছুটে গেল মানিক। রাম-দাটাকে সজোরে আঁকড়ে ধরে তাকিয়ে রইল কালো ফোকরটার দিকে। থর-থর কাঁপছে তার গোটা শরীর।
মিঁয়াও।
তাকে হতভম্ব করে দিয়ে সিলিং থেকে নেমে এল একটা হোঁতকা মোটা হুলো বিড়াল! অচেনা নয়, অনেকবারই ওটাকে দেখেছে মানিক। তাই আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা সশব্দেই ছাড়ল সে।
আর ঠিক তখনই শুনতে পেল সদর দরজা খোলার শব্দটা! কেউ একজন দরজাটা খুলে ফেলছে। কে?
ফিরে এসে দরজার কবাটগুলো পুরোপুরি খোলাই দেখতে পেল সে। খোলা দরজা দিয়ে বাইরের চাঁদের আলো অবাধে ঢুকে পড়ছে ঘরে।
সেই সঙ্গে ঢুকে পড়েছে লম্বামতন একখানা ছায়া!
ছায়াটা রতন চোরার, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এক পলকে তাকিয়ে আছে সে মানিকের হতবাক চেহারার দিকে! সারা দেহে এখানে-ওখানে মাটি লেগে আছে রতনের। চোখদুটো আধবোজা। মুখে ঝুলে আছে ভয়ানক অশুভ একচিলতে হাসি।
মানিকের বেহাল দশা দেখে বেশ আমোদ পাচ্ছে সে।
সপ্তাহখানেক আগে কবর দেয়া একজন মানুষকে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পুরোপুরি নির্বাক হয়ে গেল মানিক। তাছাড়া কিছুতেই তার মাথায় আসছে না, বাইরে থেকে রতন দরজাটা খুলল কীভাবে। দরজার হুড়কোগুলো সব ভিতরের দিকে, বাইরে থেকে খোলার কোন উপায়ই নেই।
জবাবটা খুব তাড়াতাড়িই পেয়ে গেল মানিক।
তার পিছন থেকে ভেসে এল হালকা হাসির শব্দ!
খাটের উপর বসে আছে মরিয়ম!
সফেদ কাফনের পরিবর্তে তার দেহে জড়িয়ে আছে টুকটুকে লাল একখানা বেনারসি শাড়ি। গা-ভর্তি সোনার গয়না।
ঘোমটা সরিয়ে মানিকের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল মরিয়ম।
কিন্তু যখন মুখ খুলল, বোঝা গেল হাসিটা মানিকের জন্য নয়, ছিল তার পিছনে দাঁড়ানো রতনের জন্য!
‘কেমুন আছেন, রতন বাই?’
এরপর আর কিছু মনে নেই মানিকের!
ট্যাবু
রিজের ওপর এক চিলতে খোলা জায়গাকে ঘিরে রেখেছে একসারি কটনউড গাছ। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে ঘন মেসকিটের ঝোপ।
পরিশ্রান্ত সূর্যটা পশ্চিমের পর্বতমালার আড়ালে ডুব মেরেছে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক আগে। তবে ফ্যাকাসে আলো পাতলা একখানা চাদরের মত ঠিকই এখনও ঝুলে আছে খোলা প্রেইরিতে।
ফাঁকা জায়গাটার একেবারে মধ্যখানে ছোট মতন একটা ক্যাম্পফায়ার জ্বলছে। তাতে রান্না চড়িয়েছে কম বয়সী এক কাউবয়। সবেমাত্র তার ঠোঁটের ওপর পাতলা গোঁফের রেখার আবির্ভাব ঘটেছে; তবে ছেলেটার শীতল চোখজোড়া জানান দেয়, পৃথিবীর কদর্যের অনেকখানি দেখা হয়ে গেছে তার।
রান্নার আয়োজন আহামরি কিছু নয়। গরুর শুকনো জার্কি আর সদ্য শিকার করা একটা সেজ মুরগির মাংস মিশিয়ে, থকথকে কাদার মত অর্ধতরল একধরনের খাবার তৈরি করা হচ্ছে।
জিনিসটা দেখতে যেমন বিদঘুটে, খেতেও তেমনই বিচ্ছিরি। রাঁধুনি নিজে অবশ্য এটাকে স্টু বলেই দাবি করে এসেছে এযাবৎকাল। তবে আজ অবধি, তাকে সমর্থন দেয়া দ্বিতীয় কারও সার্টিফিকেট জোগাড় করতে পারেনি সে।
আগুনের আঁচ থেকে খানিকটা দূরে, নিজের বেডরোলে শুয়ে কাতরাচ্ছে একজন মুমূর্ষু মানুষ। লোকটার বয়স ষাটের কোঠায়; তবে পেটা শরীরে ভাঙন ধরেনি এখনও। অন্তত গোটা চারেক তীর ঢুকেছিল তার দেহে; প্রচুর রক্ত হারিয়েছে। এখনও সে বেঁচে আছে কী করে, সেটাই বিস্ময়কর!
ইণ্ডিয়ান টেরিটরির ভিতর দিয়ে পথ চলার সময় আচমকা একটা কোমাঞ্চি ওয়ার পার্টির সামনে পড়ে যায় সে। কাল বিলম্ব না করে ওকে ধাওয়া করে ইণ্ডিয়ানরা। ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে এই মেসার ওপরে পালিয়ে আসার আগ পর্যন্ত অন্তত দশ জন ইণ্ডিয়ান প্রাণ হারিয়েছে তার রাইফেলের গুলিতে।
শেষ বিকেলে একটা রক্তমাখা ট্র্যাক দেখতে পেয়ে, এই টিলার ওপর তাকে আবিষ্কার করে তরুণ কাউবয়। লোকটা তখন অচেতন অবস্থায় ঝুলছিল নিজের স্যাডল থেকে।
মালিকের কাছ থেকে বহুক্ষণ কোন দিক নির্দেশনা না পেয়েই হয়তো দাঁড়িয়ে পড়েছিল তার ঘোড়াটা। তবে ঘন হয়ে জন্মানো ওখানকার কচি ঘাসগুলোও যে তাকে সিদ্ধান্তটা নিতে প্রলুব্ধ করেছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
প্রৌঢ়ের নাম হিউগো; আর তরুণ কাউবয়কে লোকে মিচেল বলেই চেনে। ঘণ্টাখানেক সেবা-শুশ্রূষার পরই কেবল হিউগোর চেতনা ফেরাতে সক্ষম হয়েছিল বেচারা।
তীরগুলো খুলে নিয়ে, ক্ষতস্থানে পট্টি বেঁধে দেয়া হয়েছে। রক্তপাত আপাতত বন্ধ হয়েছে বটে; তবে ইতোমধ্যেই ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। হিউগো এবারের ধকলটা ঠিকঠাক সামলে নেবে; এহেন বাজি ধরার লোক এই মুহূর্তে গোটা পশ্চিমে একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
স্যাডল ব্যাগ হাতড়ে একটা পুরনো বাটি বের করল মিচেল। মগভর্তি তেতো কফি আর বাটিভরা স্টু নিয়ে এগিয়ে গেল হিউগোর বেডরোলের দিকে
বহু কসরত করে তাকে আধশোয়া করল মিচেল; তারপর মুখে তুলে খাইয়ে দিতে লাগল। খানিকক্ষণ নীরবেই বিনা প্রতিবাদে খাবারটা গলাধঃকরণ করল হিউগো, তারপর হাত তুলে বাধা দিল। ইশারায় কফি দিতে বলে হেলান দিল পিছনে রাখা স্যাডলে; ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
‘ঈশ্বর আমার ওপর এতটা নাখোশ হয়ে আছেন, সেটা আজকের আগে কখনও বুঝতেই পারিনি! বলতে বাধ্য হচ্ছি, এতটা জঘন্য খাবার এই জনমে আর খাইনি আমি। সত্যিই এটাকে মানুষের খাবার বলো তুমি?’
দাঁত কেলিয়ে হাসল মিচেল। কফি মগটা ধরিয়ে দিল হিউগোর হাতে।
‘যদি নরকে যাও, ওখানকার খাবার কেমন হতে পারে, সে সম্পর্কে একটা ধারণা হয়ে গেল তোমার,’ হাসিমুখে বলল সে। ‘জন্মের পর-পরই অনাথ হয়েছি; বলতে গেলে পথে পথেই মানুষ হয়েছি আমি। একটি দিনের জন্যও কোন সভ্য পরিবারের সঙ্গে বসবাস করার সুযোগ পাইনি। কে আর আমাকে রাঁধতে শেখাবে, বলো? পেটের তাগিদে কোনরকমে স্রেফ সেদ্ধ করাটা শিখে নিয়েছি। ওতেই দিব্যি চলে যায় আমার। যতদিন বেঁচে আছ, তোমাকেও ওই খেয়েই থাকতে হবে।’
হাসার চেষ্টা করল হিউগো, কিন্তু যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে হাসিটা ঠিকঠাক ফুটল না। ‘অতটা অভাগাও বোধহয় নই আমি। সকাল অবধি টিকব বলে মনে হয় না। তোমার হাতের রান্না, তুমিই খাও, বাপু!’
চুপ করে রইল মিচেল, কোন প্রতিবাদ করল না। তার নিজেরও ধারণা, রাত ফুরাবার আগেই মারা যাবে হিউগো। কাশির সঙ্গে এখনও সমানে রক্ত আসছে লোকটার; নিশ্চয়ই ভিতরে কোথাও মস্ত ক্ষত হয়ে গেছে।
প্রসঙ্গ পাল্টানোর প্রয়াস পেল সে। ‘এই বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছিল নাকি? কী মনে করে ওই ইণ্ডিয়ান টেরিটরিতে ঢুকতে গেলে? এই উপত্যকায় আসার বিকল্প পথ যেহেতু রয়েছে; প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ইণ্ডিয়ানদের মুখে হামলে পড়ার কোন মানে হয়?’
‘বিকল্প পথ ধরলে অনেকটা ঘুরপথে এখানে আসতে হত আমাকে। নিতান্ত বাধ্য হয়েই শর্টকাট ধরেছিলাম, সময় ছিল না হাতে,’ শান্ত গলায় জবাব দিল হিউগো। ‘অনেক দূর থেকে আসছি আমি, অহেতুক বাড়তি পথ পাড়ি দিতে মন সায় দিচ্ছিল না। ইণ্ডিয়ানদের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকার কৌশল জানতাম। নিরাপদে টেরিটরি পার হতে পারব, সেই বিশ্বাসটাও ছিল। কিন্তু কপাল মন্দ; ওয়ার পার্টির সামনে পড়ে গেলাম। নাহয় ঠিকই অক্ষত দেহে পাড়ি দিতে পারতাম ট্রেইলটা।’
‘হুম। বুঝলাম,’ সমঝদারের ভঙ্গিতে মাথা দোলাল মিচেল। ‘তা এত হন্তদন্ত হয়ে যাচ্ছিলে কোথায়?’
‘এদিকেই আসছিলাম। ওক কাউন্টি থেকে রওনা দেয়ার পর আর একদিনের বেশি বিশ্রাম নিইনি কোথাও।’
‘এদিকে?! কিন্তু কেন? দলে দলে লোকে যখন আরও পশ্চিমে পাড়ি জমাচ্ছে, তুমি কেন উল্টোদিকে ফিরে এলে?’
‘ভাগ্য ফেরাতে, বাছা। ভাগ্য ফেরাতে,’ হতাশ গলায় বলল হিউগো। বার কয়েক খুক-খুক করে কাশল; কাশির দমকে আবারও ছলকে বেরিয়ে এল খানিকটা তাজা রক্ত। নিজের ব্যাণ্ডানা দিয়ে পরম যত্নে সেগুলো মুছে দিল মিচেল। বুড়োর জন্য অন্তরের অন্তস্তল থেকে মমতা অনুভব করছে সে।
নিচু স্বরে বলল, ‘ভাগ্য ফেরানোর মত কী-ই বা আছে এদিকে? মাইলের পর মাইল বিরান প্রান্তর ছাড়া আর তো কিছু চোখে পড়েনি আমার।’
নড়েচড়ে খানিকটা সোজা হয়ে বসার প্রয়াস পেল হিউগো। তারপর বলল, ‘সারাটা জীবনই প্রচণ্ড দরিদ্রতার ভিতর দিয়ে কাটালাম, বাছা। তারুণ্যে স্বপ্ন ছিল একখানা র্যাঞ্চ গড়ব; বিয়ে করব, সংসার পাতব। পাহাড়ের গহীনে পছন্দসই একটা জায়গাও ঠিক করে রেখেছিলাম বসতি গড়ার জন্য।
‘কিন্তু কী থেকে যে কী হয়ে গেল, টেরই পেলাম না! বিনা দোষেই ফেঁসে গেলাম একটা ওয়াগন ট্রেন লুটের কেসে। সবার চোখে আউট’ল বনে গেলাম।
‘তারপর থেকে শুধু ছুটে চলা আর নিজেকে লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রাখা। এভাবেই কেটে গেল অনেকটা সময়। বেঁচে রইলাম ঠিকই, কিন্তু জীবনটাকে আর উপভোগ করা হলো না কখনও।
‘আদতে আউট’ল ছিলাম না বলে অর্থনৈতিকভাবে চরম অসচ্ছল ছিলাম। কোন শহরেই বেশিদিন থাকতাম না, পাছে আমার আউটল পরিচয় লোকের কাছে ফাঁস হয়ে যায়! তাই স্থায়ী কোন কাজও জোটেনি কপালে।
‘এই ছন্নছাড়া জীবনের সঙ্গে কাউকে জড়াতে চাইনি বলে, বিয়ে থা করা হয়নি। র্যাঞ্চ গড়ার স্বপ্নটাও চিরকাল স্বপ্নই রয়ে গেল। ..
‘অবশেষে এই বুড়ো বয়সে এসে গভর্নরের ক্ষমা পেলাম; আউট’ল তালিকা থেকে নাম কাটা গেল আমার। ভাবলাম, শেষ একটা চেষ্টা করে দেখি, ভাগ্যটা ফেরানো যায় কিনা। যদি আচমকা কিছু পয়সাকড়ি পেয়ে যাই, বাথান গড়ার ইচ্ছেটা হয়তো আর অপূর্ণ থাকবে না! সেজন্যই একটানা মরুভূমি পাড়ি দিয়ে এখানটায় ছুটে এসেছি আমি।’
হতভম্ব দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল মিচেল। এই বিজন প্রান্তরে একজন মানুষের ভাগ্য ফেরানোর মতন কী আছে! ‘কীসের খোঁজে? স্বর্ণখনি?’
দ্রুত মাথা নাড়ল হিউগো। ‘খনিতে সোনা যা ছিল, সেসব বহু আগেই মাইনাররা চেটেপুটে সাফসুতরো করে ফেলেছে। তোমার-আমার জন্য সামান্য একটা শিরাও আর অবশিষ্ট নেই কোথাও।’
‘তাহলে?’
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল হিউগো। তারপর বলল, ‘গোল্ড ক্রীকের নাম শুনেছ কখনও?’
এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল মিচেল; শোনেনি। ‘কী আছে ওই ক্রীকে? সোনা?’ মৃদু হাসল ধূর্ত বুড়ো। ‘অনেকটা ওরকমই। তবে ঠিক সোনা নয়, সোনা বানানোর পরশপাথর।’
‘মানে?’
ওই ক্রীকের জলের তলায় এমন একটা জিনিস আছে, যার স্পর্শে যে কোন কিছু খাঁটি সোনায় পরিণত হয়।’
‘গাঁজাখুরি গল্প বলার আর জায়গা পেলে না তুমি? এখন বুঝি রসিকতা করার সময়?’ প্রচণ্ড বিরক্তি ঝরে পড়ল মিচেলের কণ্ঠে 1
নিমেষেই গম্ভীর হয়ে গেল হিউগো; চেহারায় ভর করল বিষাদের কালো ছায়া। ভারী গলায় বলল, ‘একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ তোমার সঙ্গে মজা করবে না, বাছা। রসিকতা করার মত মানসিক অবস্থা থাকে না তার।’
লজ্জা পেল মিচেল; বুড়ো ঠিকই বলেছে। মৃদু গলায় বলল, ‘ক্রীকটা কোথায়?’
হাত তুলে পিছনের একটা মাঝারি উচ্চতার পাহাড় দেখাল হিউগো। ‘ওই টিলার ওপাশে একটা ক্যানিয়ন পাবে। ওটা ধরে সোজা উত্তরে গেলে সামনে পড়বে একটা শুষ্ক উপত্যকা। জায়গাটা পার হয়ে মাইল দশেক সামনে এগুলেই পেয়ে যাবে গোল্ড ক্রীক।’
আঁতকে উঠল যুবক। ‘ওটা তো রীতিমত ভুতুড়ে এলাকা। ইণ্ডিয়ানদের পুরনো গোরস্থানটা ওদিকেই না?
‘হ্যাঁ। তবে শুধু গোরস্থানই নয়, ইণ্ডিয়ান উপকথা অনুসারে, আস্ত দুটো গ্রামই সুদূর অতীতে বিলীন হয়ে গেছে গোল্ড লেকের অতলে।’
‘গোল্ড লেক! ওদিকটায় কোন হ্রদ আছে বলে তো শুনিনি কখনও!’
‘একসময় ছিল, এখন নেই। অতীতের গোল্ড লেকই পরিণত হয়েছে আজকের গোল্ড ক্রীকে।’
‘আর ওই ক্রীকের জলেই বুঝি লুকানো আছে সোনা বানানোর পরশপাথর?’ হালকা গলায় জানতে চাইল মিচেল।
—হুম। ঠিক তাই,’ শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল হিউগো। দম নেয়ার জন্য কয়েক মুহূর্ত বিরতি নিল সে; কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। ‘তবে ওটা কিন্তু কোন জড় বস্তু নয়; মস্ত দেহের বিশাল একটা প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী!’
‘হায়, ঈশ্বর! বলছ কী এসব!’ রীতিমত চেঁচিয়ে উঠল মিচেল।
খানিকক্ষণ সরু চোখে তাকে নিরীখ করল হিউগো। তার চোখের তারায় নিখাদ বিস্ময় ব্যতীত উপহাসের ছায়াও খুঁজে পেল না কট্টর বুড়ো। তাই সন্তুষ্টচিত্তে বলতে শুরু করল, ‘চিপেওয়া উপকথায় পাওয়া যায়, গোল্ড লেকের একেবারে মধ্যখানটায় প্রাচীন কালে মাঝারি আকারের একটা দ্বীপ ছিল। ওতে বসবাস করত বিশালকায় এক জলজ চিতাবাঘ! অন্যান্য সাধারণ চিতার সঙ্গে মস্ত তফাৎ ছিল তার; জলে-ডাঙায় সমান স্বচ্ছন্দ ছিল প্রাণীটা!
‘ইণ্ডিয়ানদের জলদেবতা ছিল ওই অদ্ভুতুড়ে চিতাবাঘ। ওরা ওটাকে ডাকত মিশিবিঝিউ বলে।
‘ওদের বিশ্বাস ছিল, নদী-হ্রদ-ক্রীক এমন সমস্ত প্রাকৃতিক জলাধারে একটা করে মিশিবিঝিউ বসবাস করে! তবে গোল্ড লেকের মিশিবিঝিউই কেবল লোকচক্ষুর সামনে আসে। প্রয়োজনে শত-শত বছর ধরে না খেয়ে থাকতে পারে মিশিবিঝিউ; কারণ খাদ্য হিসেবে ডুবন্ত মানুষ ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ করে না ওরা!
‘ওদের পুরো দেহ লাল-লাল লোমে ঢাকা; আকারে একটা পূর্ণবয়স্ক মোষের মতই প্রকাণ্ড। একেবারে কপালের মধ্যখানে একটা লোমে ঢাকা পেল্লায় শিঙ থাকে ওদের; তার ঠিক নীচেই থাকে রক্তবর্ণের মস্ত একখানা কুঁতকুঁতে চোখ। ‘কুমিরের মত লম্বা একটা লেজ আর হাঙরের মত ত্রিকোণ একটা পাখনা আছে ওদের পিঠে। একারণেই জলের তলায় ইচ্ছেমতন সাঁতরাতে পারে ওরা। মেরুদণ্ড বরাবর করাতের মত ধারাল একসারি দাঁত বসানো, যেগুলো ছড়িয়ে আছে একেবারে লেজের ডগা পর্যন্ত। সম্ভবত নিজের আত্মরক্ষার্থেই ওগুলো ব্যবহার করে মিশিবিঝিউ।
‘গোল্ড ক্রীকের দুই তীরে বসতি গেড়েছিল দুই দল সিয়ক্স ইণ্ডিয়ান। বংশানুক্রমে একে অপরের জাত শত্রু ছিল ওরা। প্রতিপক্ষের প্রতি ঘৃণা কিংবা মিশিবিঝিউ-এর প্রতি ভয়, যে কারণেই হোক, দুই গ্রামের কেউই কখনও হ্রদের জলে নামত না।
‘লোকে বলে, প্রায়ই তখন দেখা দিত মিশিবিঝিউ; আর তার ক্ষুধার্ত চেহারা যে কারও পিলে চমকে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই ইণ্ডিয়ান যোদ্ধারা দিন-রাত পালা করে পাহারা দিত হ্রদের ধারে; যেন কম বয়সী কেউ ভুল করেও জলে নেমে পড়তে না পারে।
‘তবে এক উৎসবের রাতে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। ভরপেট ঘরে বানানো মদ গিলে বেহেড মাতাল হয়ে পড়ল দুই গাঁয়ের সব ক’জন পুরুষ মানুষ; প্রহরার কথা আর মনে রইল না কারও!
‘সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগাল ভিন গাঁয়ের দুই দস্যি মেয়ে। সবার সামনে শত্রুতার অভিনয় করলেও, একে-অন্যের প্রাণের সখী ওরা। দেখা করার এহেন সুবর্ণ সুযোগ কী করে হাতছাড়া করে ওরা?
‘দুটো ক্যানু নৌকা নিয়ে যে-ই না ওরা হ্রদের মধ্যখানটায় একত্রিত হয়েছে, ঠিক তখনই জল ফুঁড়ে বেরিয়ে এল মিশিবিঝিউ! তার পাহাড় প্রমাণ দেহটা ধীরে- ধীরে জেগে উঠল পানির ওপরে; অতিকায় ছায়ার আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়ে গেল ছোট্ট নৌকো দুটো। উৎসবের ঢাকের বিকট আওয়াজে চাপা পড়ে গেল মেয়ে দুটির আর্তচিৎকার; দুই গ্রামের কারও কানেই পৌছল না, তাদের গলার স্বর!
‘মরিয়া হয়ে হাতের বৈঠা দিয়ে মিশিবিঝিউকে আঘাত করে বসল একটা মেয়ে; ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চায় আজব জন্তুটাকে! কিন্তু তার ছানাবড়া চোখের সামনেই এক পলকে কেটে দু’টুকরো হয়ে গেল বৈঠাটা। সম্ভবত ওই প্রথম কোন মানুষ স্বচক্ষে মিশিবিঝিউ-এর পিঠের ধারাল দাঁতের কামাল দেখল!
‘ভয়ানক রেগে গেল চিতাটা, প্রচণ্ড আলোড়ন তুলে ডুব দিল পানিতে। খানিকক্ষণ নিথর হয়ে রইল চরাচর, সময়ও যেন থমকে গিয়েছিল তখন। পরক্ষণেই ফুঁসে উঠল গোটা হ্রদ; ধীরে-ধীরে বাড়তে লাগল জলের উচ্চতা।
এক লহমায় বিক্ষুব্ধ একটা সমুদ্রে পরিণত হলো গোল্ড লেক। নিমিষেই জলের অতলে হারিয়ে গেল আস্ত দুটো ইণ্ডিয়ান গ্রাম! তবে আশ্চর্যের বিষয়, নৌকায় থাকা মেয়ে দুটোর একটুও ক্ষতি করেনি মিশিবিঝিউ! প্রাণে বেঁচে যাওয়া ওই মেয়েগুলোর কাছেই পরবর্তীতে ঘটনাটার আদ্যোপান্ত শুনতে পায় লোকে।’
‘হায়, ঈশ্বর! হায়, ঈশ্বর!’ বার কয়েক নিচুস্বরে বিড়-বিড় করল মিচেল। ‘এত ভয়ঙ্কর একটা প্রাণীকে সোনা বানানোর পরশপাথর বলার কারণ কী? ওটা কি সোনার ডিম দেয়?’
মৃদু হাসল হিউগো। ‘না, সোনার ডিম দেয় না। তবে ওটার স্পর্শে সবকিছু সোনা হয়ে যায়। সেদিন ওই মেয়েটার হাতে থাকা বৈঠাটার বাকি অংশ নিখাদ সোনায় পরিণত হয়েছিল! ওটা বিক্রি করে বাকি জীবনটা বেশ সুখেই কাটিয়েছিল ওরা।
‘এর পরেও বেশ কয়েক জন মানুষ গোল্ড ক্রীকে গিয়ে বিভিন্ন জিনিস সোনায় পরিণত করেছে; অন্তত আমার কাছে এমনটাই দাবি করেছে এক সিয়ক্স চিফ। একবার একটা সিংহের কবল থেকে লোকটাকে বাঁচিয়েছিলাম আমি। প্রাণ বাঁচানোর প্রতিদান স্বরূপ আমাকে এই গোপন তথ্যগুলো উপহার দিয়েছে সে। কীভাবে কী করতে হবে, সবকিছু পই পই করে বলে দিয়েছে।’
‘আর তুমি সেগুলো বিশ্বাসও করেছ?’ সতর্ক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মিচেল।
‘করেছি,’ চটজলদি জবাব দিল হিউগো। ‘জগতে কত অদ্ভুত কিছুই তো ঘটে, তাই না? তাছাড়া হারানোর কী-ই বা ছিল আমার? এমনিতেই এক পা কবরে দেয়া ছিল, ক’বছরই বা বাঁচতাম আর! শেষকালে একবার ভিন্ন পথে ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টা করতে দোষ কী?’
জবাব দিল না মিচেল। কী বলবে?
স্থবিরতা নেমে এল আলাপনে; হঠাৎই যেন সব কথা ফুরিয়ে গেছে ওদের!
আচমকা বলে উঠল মিচেল, ‘কী কী করতে হবে গোল্ড ক্রীক থেকে সোনা পেতে হলে?’
খানিকক্ষণ ওর দিকে অপলক তাকিয়ে রইল পোড় খাওয়া বুড়ো; আপনমনে কী যেন ভাবছে। তারপর ধীর গলায় বলল, ‘তোমার ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না, বাছা। সারা জীবন পড়ে রয়েছে তোমার সামনে, এখনই শর্টকাট খোঁজার কী দরকার! একটু ভুলভাল হলেই আর রক্ষা নেই, প্রাণ খোয়াতে হবে মিশিবিঝিউ- এর হাতে। অযথা ঝুঁকি নেয়ার কোন মানে হয় না।’
হাসল মিচেল। ‘আপাতত ওই পথ মাড়ানোর কোন ইচ্ছে নেই আমার। তবে পদ্ধতিটা জেনে রাখতে চাই। যদি বুড়ো বয়সে এসে তোমার মত জীবন নিয়ে কোন আক্ষেপ থাকে, তখন নাহয় একবার ঘুরে আসব গোল্ড ক্রীক থেকে। ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে। তবে আমাকে কথা দাও, বাছা; নিতান্ত ঠেকায় না পড়লে তুমি কখনও গোল্ড ক্রীকের ট্রেইল ধরবে না।’
‘কথা দিলাম,’ হাসিমুখে বলল মিচেল।
স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল হিউগো। তার জন্য এই ছেলেটা অযথা প্রাণ হারালে, নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারত না সে। ‘পদ্ধতিটা খুব জটিল নয়। পূর্ণিমার রাতে ক্রীকে নেমে কোমর পানিতে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তারপর চোখ বন্ধ করে পর-পর তিনবার চিৎকার করে বলতে হবে, ‘মিশিবিঝিউ, আমি হাজির হয়েছি। আমার উপহার গ্রহণ করুন।’ তারপর যে জিনিস তুমি সোনা বানাতে চাও, সেটা বাড়িয়ে ধরতে হবে সামনের দিকে
‘এরপর চারপাশে যত অদ্ভুত শব্দই শুনতে পাও না কেন, ভুলেও চোখ খোলা চলবে না। সবকিছু মিটে গেলে পরিবেশ যখন শান্ত হয়ে যাবে, চোখ বন্ধ রেখেই ধীরে-ধীরে পিছিয়ে আসতে হবে। হাঁটু পানিতে পৌছনোর পর চোখ খোলা যাবে।
‘তারপর তীরে উঠে যত জলদি সম্ভব ওখান থেকে চলে আসতে হবে। সোনা- যেটুকু পাবে, তা দিয়ে তুমি রাতারাতি মস্ত ধনী হতে পারবে না; তবে বাকি জীবনটা বেশ সচ্ছলভাবেই কাটাতে পারবে। এক জীবনে দ্বিতীয়বার আর কখনও গোল্ড ক্রীকের পাড়ে যাওয়া যাবে না। রক্তের সম্পর্ক আছে, এমন কোন স্বজনকেও পাঠানো চলবে না।’
‘পাঠাব না,’ হেসে তাকে আশ্বস্ত করল মিচেল। ‘তা সোনা বানানোর জন্য কী নিয়ে যাচ্ছিলে তুমি গোল্ড ক্রীকে?’
‘চারটে রূপার স্পার; স্যাডল ব্যাগে আছে। তোমাকে জিনিসগুলো উপহার দিলাম, বাছা। রোডিওতে ওগুলো পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলাম আমি। আর কখনও ওগুলো ব্যবহারের সুযোগ হবে না আমার।’
থমকে গেল মিচেল। আরও খানিকটা এগিয়ে এসে নিজের মুঠোয় তুলে নিল হিউগোর হাত দুটো। ‘ভবিষ্যতের কথা কে-ই বা বলতে পারে, হিউগো! হয়তো আবারও সুস্থ হয়ে উঠবে তুমি; ঘোড়া দাবড়ে বেড়াবে। তখন নাহয় স্পারগুলো ফিরিয়ে দেব তোমাকে।’
মাথা দোলাল বুড়ো; আধশোয়া থেকে পুরোপুরি চিত হয়ে শুয়ে পড়ল বেডরোলে। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে তার, ক্ষতগুলো ভীষণ জ্বালা করছে। মৃদুস্বরে বলল, ‘এখন গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমাকে খানিকটা একা থাকতে দাও। ঈশ্বরকে বলার মত এখনও অনেক কথা বাকি রয়ে গেছে আমার।’
ঘাড় কাত করে সায় জানাল যুবক। নিজের বাড়তি কম্বলটা এনে চাপিয়ে দিল হিউগোর আহত শরীরে। অসুস্থ মানুষ; খানিকটা বাড়তি উষ্ণতায় আরাম পাবে।
ক্যাম্পফায়ারে আরও খানিকটা লাকড়ি চড়িয়ে দিয়ে নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল মিচেল। আজ সারাদিনই রাইড করেছে সে। গলা ফাটিয়ে ক্লান্তির ঘোষণা দিচ্ছে পরিশ্রান্ত দেহের সবক’টা পেশি।
মস্ত থালার মত চাঁদ উঠেছে আকাশে; আর একদিন বাদেই পূর্ণিমা। চন্দ্ৰদেবীকে সঙ্গ দেয়া তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখের পাতা ভারী হয়ে এল তার; কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।
.
শেষরাতের দিকে মারা গেল হিউগো; ভোরে ঘুম থেকে জেগে তাকে মৃত অবস্থাতেই পেল মিচেল। লাশটাকে জড়িয়ে ধরে অনেকটা সময় অঝোরে কাঁদল ছেলেটা।
অল্প সময়ের মধ্যেই বুড়োকে ভীষণ ভালবেসে ফেলেছিল সে। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে যাদের আপন বলতে কেউ থাকে না, তারা একে অন্যকে খুব সহজেই আপন করে নিতে পারে।
মেসার গোড়ায় একটা অগভীর অ্যারোইয়োতে হিউগোকে কবর দিল মিচেল। ফিউনেরালের আচার অনুষ্ঠান কীভাবে সম্পন্ন করতে হয়, এ ব্যাপারে বিশদ জানা নেই তার। তবে হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসা সমর্পণ করতে কার্পণ্য করল না সে।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জিনিসপত্র গোছগাছ করে রওনা হওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেল মিচেল। কাছের শহর সিটাডলে যাবে। নতুন কিছু বাথান গড়ে উঠেছে ওখানে, কাজ পেতে সমস্যা হবে না।
যাত্রা শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তেই আচমকা থমকে দাঁড়াল সে। বিদ্যুৎ চমকের মত একটা সম্ভাবনা মাথায় এসেছে তার। এই এলাকা পরিত্যাগ করার আগে, একবার স্বচক্ষে গোল্ড ক্রীকটা দেখে গেলে কেমন হয়? আর কখনও এ তল্লাটে আসার সুযোগ হবে কিনা, কে জানে!
তাছাড়া আজ রাতেই পূর্ণিমা! কীসের মোহে জীবন উৎসর্গ করল বুড়ো মানুষটা, একবার যাচাই করে দেখলে মন্দ হয় না।
হিউগোকে দেয়া প্রতিশ্রুতির কথা বেমালুম ভুলে গেল মিচেল। রোমাঞ্চকর এক অভিযানের নেশা তখন পুরোদমে চেপে বসেছে তার মাথায়। দুটো ঘোড়া নিয়ে নিষিদ্ধ এলাকার দিকে যাত্রা শুরু করল তরুণ কাউবয়।
আবছা একটা ট্রেইল ধরে অনুচ্চ পাহাড় সারিটা পার হলো মিচেল। বহুকাল অব্যবহৃত থাকায়, প্রায় বুজে এসেছে ট্রেইলটা। ধুঁকতে-ধুঁকতে সামনে এগিয়ে পাহাড়ের শেষপ্রান্তে গিয়ে অক্কা পেয়েছে ওটা।
তবে এ নিয়ে কোন ঝক্কি পোহাতে হলো না মিচেলকে। কারণ ইতোমধ্যেই হিউগোর নির্দেশনা অনুসারে ক্যানিয়নটার দেখা পেয়ে গেছে সে।
ক্যানিয়নটা বেশ সরু। দু’পাশের টিলাগুলো প্রায় গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশাপাশি দু’জনের বেশি পথ চলা যাবে না এখানে। জায়গায় জায়গায় বেশ অন্ধকার; মেঝে ভীষণ সেঁতসেঁতে। টিলার বাঁকা চূড়ার কারণে সূর্যের আলো ঠিকমত পৌঁছয় না ওসব জায়গায়।
একনাগাড়ে এগিয়ে গেল মিচেল, এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম নিল না কোথাও। অবশেষে দুপুর নাগাদ ক্যানিয়নটা অতিক্রম করতে পারল সে।
সামনের ধু-ধু প্রান্তরটার দিকে তাকিয়ে খানিকটা ভড়কে গেল মিচেল আদতেই ভীষণ রুক্ষ ময়দানটা। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে দানবীয় সব পাথুরে বোল্ডার আর পুরো এলাকা ছেয়ে আছে বিষাক্ত চয়ায়। এই চয়ার কাঁটা শরীরে বিধলে ভীষণ ব্যথা হয়; ঘোড়াকেও অবলীলায় খোঁড়া করে ফেলতে পারে চয়া।
একটা পাথুরে চাতালের ছায়ায় যাত্রাবিরতি টানল মিচেল। ক্যান্টিন বের করে পানি খেল, হ্যাটে ঢেলে ঘোড়া দুটোকেও খাওয়াল। কেবল সে নিজে নয়, অবলা জানোয়ার দুটোও বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। খানিকক্ষণ বিশ্রাম না নিলে, সামনে পথ চলা দায় হয়ে পড়বে ওদের জন্য।
গোল্ড ক্রীকের পাড়ে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেল। ক্রীকের ধারে একটা পাইনের জটলায় ক্যাম্প করল মিচেল।
ক্রীকটা বিশাল, অনেকখানি প্রশস্ত। এতটা বিস্তৃত ক্রীক এর আগে কখনও দেখেনি সে। দু’পাশে অনেকদূর পর্যন্ত কোন গাছগাছালি নেই; ডানা ছড়ানো একটা বাদুড়ের আকৃতি পেয়েছে এলাকাটা।
সাপারের পর খানিকক্ষণ ইতিউতি খুঁজল মিচেল, কিন্তু মিশিবিঝিউ-এর টিকিটিরও সন্ধান মিলল না। দানবীয় কোন প্রাণী বসবাস করে এখানে, তেমন কোন আলামতও চোখে পড়ল না কোথাও।
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা দোলাল মিচেল। আপনমনে বিড়-বিড় করল, ‘অযথাই একটা ভ্রান্তির পিছনে ছুটেছে বুড়ো হিউগো। নিছকই রূপকথা এসব; বাস্তবে ওই জলার চিতাবাঘের কোন অস্তিত্বই নেই।’
.
রুপোর থালার মত চাঁদ উঠেছে আকাশে, চরাচরে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিষাদমাখা জোছনা। আচমকা হিউগোকে দেয়া আশ্বাসের কথা মাথায় আসাতে, মনটা ভীষণ ভার হয়ে গেল মিচেলের।
একবার ভাবল, ফিরে গেলে কেমন হয়? কিন্তু মনের ভিতর থেকে সায় মিলল না। এতখানি এসে ফিরে যাওয়ার কোন মানে হয়? কে জানে, নিজের অসমাপ্ত কাজটা অন্য কেউ করে দিলে হয়তো খুশিই হবে হিউগোর আত্মা! অন্যলোকে বসে এই মুহূর্তে কি তার দিকেই অপলক তাকিয়ে আছে অদম্য বুড়ো?
হিউগোর উপহার দেয়া স্পারগুলো হাতে নিয়ে ধীর কদমে পানিতে নামল মিচেল। ক্রীকের জল বেজায় ঠাণ্ডা; রীতিমত কেঁপে উঠল তার সমস্ত শরীর।
শৈত্যের শিহরণ উপেক্ষা করে দ্রুত কোমর পানি অবধি পৌছে গেল তরুণ কাউবয়। যা করার তাড়াতাড়ি করতে চায়; সারা রাত এই বরফ শীতল জলে দাঁড়িয়ে থাকার প্রশ্নই আসে না।
আলতো করে চোখ মুদল সে; হাত দুটো বাড়িয়ে ধরল সামনের দিকে। তারপর চিৎকার করে বলল, ‘আমি হাজির হয়েছি, মিশিবিঝিউ! আমার উপহার গ্রহণ করুন।’ পর-পর তিনবার কথাটা বলে, চুপ মেরে গেল সে। প্রতীক্ষায় রইল; যদি কিছু ঘটে!
প্রথম কয়েক মুহূর্ত কিছুই ঘটল না। তবে গুমট হয়ে গেছে পরিবেশ; ঝিঁঝি পোকারাও থামিয়ে দিয়েছে তাদের একঘেয়ে ডাক!
পরক্ষণেই আলোড়িত হতে শুরু করল ক্রীকের জল। প্রথমটায় খুব ধীরে- ধীরে, পরবর্তীতে তীব্র বেগে। যেন অতল থেকে মাথাচাড়া দিচ্ছে অতিকায় কোন জলদানব!
আতঙ্কে জায়গায় জমে বরফ হয়ে গেল মিচেল। বুকের গভীর থেকে উঠে আসা চিৎকারটা গলার কাছটায় এসে থমকে গেল। সামনে বাড়িয়ে রাখা হাত দুটো অনবরত কাঁপছে তার।
চোখ বন্ধ থাকা সত্ত্বেও সমগ্র চেতনায় মিশিবিঝিউকে অনুভব করল মিচেল। প্রাণীটার ক্ষমতার বিস্তৃতি আঁচ করতে পেরে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল তার। এমনকী অল্প সময়ের জন্য ওটার মোলায়েম গর্জনও শুনতে পেল সে!
ধীরে-ধীরে মিচেলের সামনে এসে দাঁড়াল মিশিবিঝিউ; অনেকটা সময় নিয়ে নিরীখ করল তাকে। তারপর আলগোছে লেজটা বাড়িয়ে দিল মিচেলের হাতে ধরা স্পারগুলোর দিকে; ছুঁয়ে দিয়ে সোনায় পরিণত করবে জিনিসগুলোকে।
ঠিক তখনই মারাত্মক একটা ভুল করে বসল মিচেল! দানবটাকে দেখার তীব্র ইচ্ছাটাকে দমন করতে ব্যর্থ হলো সে। চোখ মেলে সরাসরি তাকাল প্রাগৈতিহাসিক চিতাটার একমাত্র অক্ষিগোলকের দিকে!
সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল মিশিবিঝিউ-এর রক্তবর্ণ চোখ; ঝলসে উঠল পিঠের সবক’টা কাঁটা। ভয়ানক রেগে গেছে সিয়াদের জলদেবতা!
তড়িৎ গতিতে প্রকাণ্ড লেজটাকে নিজের দিকে ধেয়ে আসতে দেখল মিচেল; পরক্ষণেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত মসৃণভাবে দু’টুকরো হয়ে গেল তার গোটা দেহটা! যেন একখণ্ড নরম মাখনে ছুরি চালিয়েছে মিশিবিঝিউ!
চট করে জলের তলায় ডুবে গেল টুকরো দুটো। কারণ ততক্ষণে নিজেই নিখাদ সোনায় পরিণত হয়েছে মিচেল!
অগণিত দ্বিখণ্ডিত মানুষের সঙ্গে মিচেলও চিরকালের জন্য ঠাঁই পেল গোল্ড ক্রীকের তলায়। বুড়ো হিউগোর নির্দেশ অমান্য করে এই নিষিদ্ধ এলাকায় এসে মোটেও ঠিক করেনি সে।
আচমকা তীরে দাঁড়ানো একটা অবয়বের দিকে তাকিয়ে বিকট একটা হাঁক ছাড়ল মিশিবিঝিউ; রাগ নেই তাতে, আছে কৃতজ্ঞতা।
হাত নেড়ে প্রাণীটাকে আশ্বস্ত করল বুড়ো হিউগো; তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল! মিশিবিঝিউ-এর জন্য নতুন শিকার খুঁজতে যাচ্ছে!
আরও অনেকক্ষণ পর আবারও ডাকতে শুরু করল ঝিঁঝি পোকার দল। একমাত্র ওরাই জানে, খানিকক্ষণ আগে ঠিক কী ঘটেছিল এই গোল্ড ক্রীকে!
***