- বইয়ের নামঃ হাতকাটা তান্ত্রিক
- লেখকের নামঃ তৌফির হাসান উর রাকিব
- সিরিজঃ সেবা হরর সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী বই
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প
হাতকাটা তান্ত্রিক
হাতকাটা তান্ত্রিক – মুহম্মদ আলমগীর তৈমূর
এক
আমার বি. এ. ফাইনাল পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি দেশ জুড়ে চলছে যুদ্ধের ডামাডোল। সব কিছু স্বাভাবিক আছে এইটে দেখানোর জন্যে পাকিস্তান আর্মি এই ধুন্ধুমারের ভেতরই টিচারদের দিয়ে একরকম জোর করেই ক্লাস নেয়াচ্ছে। সেনাবাহিনীর লোক লাগিয়ে গার্ড দেয়াচ্ছে পরীক্ষার হল। গুজব রটল পরীক্ষার হলে গার্ড দেয়া সেপাইরা আসলে একদম মাথামোটা। হলে দেদারসে নকল করলেও ব্যাপারটা একেবারেই ধরতে পারে না তারা। তাদের সাথে যেসব নরমাল টিচাররা থাকে, তারা এসব দেখেও, ভান করে না দেখার! কার গোহালে কে দেয় ধুয়ো!
নকল করে পাশ করার এমন স্বর্ণযুগ অতীতে আর কখনও আসেনি। বছর-বছর ফেল-করা ছাত্র যারা পরীক্ষার সময় এগিয়ে এলে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর মত নির্জীব হয়ে যেত, নকল করে পাশ করার উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে লাগল তারাও। উত্তেজনার কারণ অবশ্য আরও একটা ছিল। সেই সময় বি. এ. পাশ ছেলের বিয়ে হত ভাল ঘরের সুন্দরী মেয়েদের সাথে। কোনওমতে একবার বি. এ. পাশ করতে পারলেই হয়-সুন্দরী বউ, লাগোয়া বাথরুমসহ ছোট্ট দুরুমের বাসা, ফিলিপ্স রেডিয়ো, শনি-রবি ঘোরাঘুরি, এন্তার খাওয়া হাতকাটা তান্ত্রিক দাওয়া!
যা হোক, লুঙ্গিতে মালকোঁচা মেরে আমিও রেডি হতে লাগলাম পরীক্ষার জন্যে। যেসব প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করতে পারিনি, সেগুলোকে চিরকুটের মত কাগজে লিখে নকলের চোথা বানালাম। চোথা হলো চিকন করে কাটা কাগজের ইয়া লম্বা ফালি। অনেকে ফালি কেটে ছোট-ছোট টুকরো করে। তবে এতে সমস্যা আছে। কোনটা আগে আর কোনটা পরে বোঝার জন্যে চিরকুটের গায়ে সিরিয়াল নাম্বার দিতে হয়। না হয়, একটার পর একটা সাজিয়ে সুই সুতো দিয়ে সেলাই করতে হয়। তারপরেও টানাহেঁচড়ায় এলোমেলো হওয়ার ভয় থাকে। যদি হয়, তা হলে সিরিয়ালি টুকরো সাজাতেই পেরিয়ে যাবে পরীক্ষার অর্ধেক টাইম! চোথা তৈরি করতে গিয়ে দেখলাম পড়ে পাশ করার থেকে নকল করে পাশ করা ঢের বেশি কঠিন! প্রচুর লেখালেখি করতে হয় একাজে। অতিরিক্ত পরিশ্রমী ছাত্রেরাই কেবল নকলবাজ হতে পারে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এত খাটনি খাটতেই পারবে না!
জুলাই মাসের গোড়ার দিকে বন্যার জলে ডুবে গেল সারা দেশ। রাস্তায় যদি মাজা সমান জল হয়, তো পরীক্ষার হলে হাঁটু সমান। জলকে যমের মত ভয় পেত খান সেনারা। ছাউনি থেকে বেরই হলো না তারা। লাটে উঠল পরীক্ষা। কী আর করা, এদিক-সেদিক ঘুরতে লাগলাম আমি। তবে সেখানেও সমস্যা আছে। যখন-তখন খান সেনারা রাস্তায় ধরে জিজ্ঞেস করে, তোম্ মুক্তি হ্যায়? আরে, বাবা, আমি যদি মুক্তি হইও, তবুও সেইটে তোকে বলব নাকি রে, গর্দভ! কলেজের আইডি কার্ড শো করার পরেই কেবল ছাড়া পেয়েছি। সেই আইডির মেয়াদও পার হয়ে গেছে এখন। দেখলাম, আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব ঘুরতে যাচ্ছে ইণ্ডিয়ায়। বর্ডার নাকি ওপেন করে দেয়া হয়েছে। ওখানে গিয়ে পৌঁছতে যতক্ষণ, ব্যস তারপরেই ওপার। তবে হ্যাঁ, হেঁটে যেতে হবে। গাড়ি-ঘোড়া নেই। আমার বাড়ি থেকে বর্ডারের দূরত্ব পঞ্চান্ন কি. মি.! ঐকিক নিয়মে অঙ্ক কষে দেখলাম, হাঁটার গতিবেগ ঘণ্টায় তিন কি. মি. হলে পঞ্চান্ন কি, মি. পাড়ি দিতে লাগবে আঠারো পূর্ণ একের তিন ঘণ্টা! বুঝলাম ওপারে বেড়াতে যাওয়া সহজ নয় মোটেও।
ইণ্ডিয়ায় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না, তবুও যেতে অনেকটা বাধ্যই হলাম। অগাস্টের শুরুতেই দেখা দিল মঙ্গা। পিস কমিটির লোকেরা নৌকোয় চড়ে ছোট-ছোট পলিথিন ব্যাগে ভীম মোটা আতপ চাল আর মসুরির ডাল দিয়ে যেতে লাগল। দিলে কী হবে! দুদিনেই শেষ হয়ে যায় রিলিপ। ওদিকে পরবর্তী রিলিপ আসতে আরও সাত দিন বাকি! বলতে গেলে, ইউসুফ নবীর ভাইদের মত খাওয়ার অভাবেই দেশান্তরী হতে হলো আমাকে।
পাকিস্তান ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ভেঙে সাত টাকা বারো আনা পেলাম। আগের বছর উল্টোরথের মেলা থেকে মাটির ওই ব্যাঙ্কটা কিনেছিলাম। খুচরো পয়সাগুলো আবুল মিয়ার বিড়ি সিগারেটের দোকানে নিয়ে নোট বানালাম। এরপর সেরখানেক চিড়ে আর পোয়াটাক আখের গুড় কিনে রওনা হলাম। পরনে রুহিতপুরি লুঙ্গি, হাওয়াই শার্ট। পায়ে স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল। হেঁটে সাঁতরে পেরিয়ে গেলাম জলে ডুবে থাকা ফসলের মাঠ, কলাগাছে ঘেরা গ্রাম, কালো ক্যানেস্তারা দিয়ে। বানানো টঙ-দোকানঅলা বাজার। এভাবেই চলল পুরো একদিন। পরদিন সন্ধের সময় টনটনে পা আর বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে পৌঁছলাম বর্ডার থেকে পাঁচ কিলো দূরে মালিথা পাড়ায়। নদীর ধারে ইয়া বড় বটগাছের তলায় চা-মুড়ি খেতে-খেতে শুনলাম: বড় মালিথার বাড়িতে রাতে অতিথি থাকতে দেয়।
আঠারো বিঘে জমির ওপর বিশাল এক বাড়ি। পাকা কুঠি, টিনের চালা, খড়ের ছাউনি-স্থাপত্যকলার সব নিদর্শনই আছে এখানে। বড় মালিথার লম্বা দাড়ি, সিংহের থাবার মত প্রকাণ্ড হাতের পাঞ্জা। তবে কনুই থেকে নেই একটি হাত। পাথর কুঁদে বানানো ঝামা কালো চেহারা যেন। ইমাম সাহেবদের চেকচেক উড়ুনিতে ঘাড়-মাথা ঢাকা। কথা-বার্তা শুনে মনে হলো অসম্ভব ভদ্র আর জ্ঞানী এই লোক। বান-ডাকা নদী থেকে খ্যাপলা জালে ধরা ডিমঅলা রায়েক মাছের ঝোল দিয়ে গরম ভাত খেলাম। এত স্বাদের তরকারি জীবনেও খাইনি। পরদিন সকালে নুন-ঝাল আর চাকচাক করে কাটা বেগুনভাজি দিয়ে খিচুড়ি খেয়ে আরও জনা আষ্টেক শরণার্থীর সাথে রওনা হলাম বর্ডারের উদ্দেশে। তবে তার আগে বিদায় নিতে গেলাম বড় মালিথার কাছে। ভদ্রলোক বললেন, ঘরে ফেরার পথে আপনার সাথে আবার দেখা হয়েও যেতে পারে। কে জানে! ভাল থাকেন।