- বইয়ের নামঃ সাধনা
- লেখকের নামঃ রিয়াজুল আলম শাওন
- সিরিজঃ সেবা হরর সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী বই
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প
সাধনা
খান্নাস
এক
‘এই, বড্ড ঠাণ্ডা লাগছে! জানালাটা বন্ধ করে দাও,’ সেজানের দিকে তাকিয়ে বলল রেহানা।
‘ঠাণ্ডা লাগছে! কী বলছ পাগলের মত!’
‘হ্যাঁ, খুব ঠাণ্ডা লাগছে।’
‘গরমে অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম। ইলেক্ট্রিসিটি নেই দুই ঘণ্টা। আর তুমি বলছ ঠাণ্ডা লাগছে?’
‘আমার মনে হয় জ্বর আসছে।’
‘কই, দেখি।’ সেজান রেহানার কপালে হাত রাখল। শরীর ঠাণ্ডা। জ্বরের ছিটেফোঁটাও নেই।
‘তোমার তো জ্বর নেই।’
‘তুমি প্লিজ জানালাটা বন্ধ করে দাও।’
বিরক্তমুখে জানালা বন্ধ করল সেজান। সেজান-রেহানার বিয়ে হয়েছে আড়াই মাস হলো। সেজানদের পাশের গ্রামের মেয়ে রেহানা। বয়স এখনও আঠারো হয়নি। দেখতে অস্বাভাবিক সুন্দর। এই জন্য সেজান বিয়ের ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিল। সে একটা কোম্পানিতে মার্কেটিং এগযেকিউটিভ হিসাবে কাজ করে। দেখতেও খুব সুদর্শন নয়। এমন সুন্দর মেয়ে বিয়ে করা তার চিন্তার বাইরে ছিল। তবে বিয়ের পর রেহানার আচরণে খুব বিরক্ত সেজান। আজব এক মেয়েকে বিয়ে করেছে ও। সারাদিন ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। কথায়-কথায় বলে, ঠাণ্ডা লাগছে। রাতের বেলা লাইট জ্বেলে ঘুমাতে যায়। লাইট ছাড়া ঘুমাতে নাকি তার আতঙ্ক লাগে। বিয়ের প্রথম থেকেই সেজান লক্ষ করেছে, শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারগুলোতে আগ্রহী নয় রেহানা। রান্না-বান্নাও ঠিকমত পারে না। সবসময় নিজের মনে থাকতে পছন্দ করে। সেজানের সাথে কথাবার্তাও বিশেষ বলে না। তবে রেহানার একটা ভাল দিক আছে। ও ঝগড়া করতে পারে না। তাই সেজান কোনও রূঢ় কথা বললেও চুপচাপ শোনে রেহানা।
ওরা যে বাড়িতে থাকে, তা শহরের একদম শেষ মাথায়। আশপাশে বেশি বাড়ি-ঘর নেই। বাড়ি ভাড়াও খুব বেশি নয়। এমন একটা বাড়িতে বসবাস করা ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু রেহানার এই বাড়ি ভাল লাগছে না। সে বারবার সেজানকে বাসা বদলে ফেলার কথা বলছে। পছন্দসই নতুন বাসা খুঁজে পাওয়া কত কঠিন, সে সম্পর্কে রেহানার কোনও ধারণা নেই। তাই সেজান ওর কথা কানে তুলছে না।
হঠাৎ চমকে উঠে রেহানা বলল, ‘জানালায় কেমন একটা শব্দ হলো না?’
‘বাতাসে শব্দ হয়েছে মনে হয়।’
‘ওই যে, আবারও হলো।’
‘আরে, তোমাকে নিয়ে ভারি মুশকিল হলো দেখি। চুপচাপ ঘুমাও।’
‘আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।’
‘মানে?’ সেজান দেখতে পেল রেহানা হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে। দ্রুত জানালা খুলে দিল সে। বাইরের বাতাস ঘরে ঢুকলে হয়তো ওর একটু ভাল লাগবে।
রেহানা চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘তুমি জানালার কাছে যেয়ো না! প্লিজ জানালার কাছে যেয়ো না!’
‘কেন?’
‘ওখানে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।’
‘তোমার কি মাথা খারাপ হলো? কে দাঁড়িয়ে থাকবে? আর দোতলায় জানালার ওদিকে দাঁড়ানোর কোনও জায়গা আছে?’
‘আমি জানি, ও আছে।’
‘কে আছে, বলো তো?’
‘না, কেউ না।’
এমন সময় শুরু হলো ঝোড়ো বাতাস। মনে হচ্ছে কেউ যেন প্রচণ্ড আক্রোশে আঘাত করছে জানালায়। কবাট পুরোপুরি খুলে গেল। পুরো ঘর একটু পর-পর কেঁপে উঠতে লাগল। ইলেক্ট্রিসিটি ছাড়াই হঠাৎ ঘুরতে শুরু করল ফ্যানটা। প্রথমে আস্তে-আস্তে, তারপর তুমুল গতিতে। সেজানের মনে হলো, যে-কোনও সময় ভেঙে পড়বে ফ্যানটা। দ্রুত উঠে বসল সেজান। ওকে জড়িয়ে ধরে আছে রেহানা। ওর চোখ বন্ধ। শরীরটা কাঁপছে। রেহানা কাঁপা স্বরে বলল, ‘তুমি উঠো না, প্লিজ উঠো না।’
সেজানেরও কেমন যেন ভয়-ভয় লাগছে।
রেহানা আবার বলল, ‘চোখ বন্ধ করে রাখো। বন্ধ করে রাখো। ভয়…ভয় লাগে…’
সেজান চোখের সামনে তীব্র আলোর এক ঝলকানি দেখল। টায়ার পোড়া গন্ধের মত বিশ্রী গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল ঘরের মধ্যে। ঘরের কোনায় থাকা চেয়ারটা উল্টে পড়ল মেঝেতে। আরও বেড়ে গেল ফ্যানের গতি। ঝোড়ো বাতাসটাও তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। উড়ছে টেবিলের উপর রাখা কাগজগুলো। এমন সময় বিকট শব্দ করে মেঝেতে পড়ে গেল ফ্যানটা। ঘরের ভিতর কারা যেন থপথপ করে হাঁটছে। রেহানাকে জড়িয়ে ধরে আছে সেজান। রেহানার মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে ফেনা। এমন সময় চলে এল ইলেক্ট্রিসিটি। স্তিমিত হয়ে এল ঝোড়ো বাতাসটা।
সেজানের গলা শুকিয়ে গেছে। পিপাসায় যেন ফেটে যাচ্ছে বুক। কিন্তু তবুও বিছানা থেকে নামার সাহস হচ্ছে না। রেহানার জ্ঞান নেই। বিছানায় এলিয়ে পড়ে আছে ওর দেহটা। সেজান দেখতে পেল, রক্ত ঝরছে রেহানার নাক দিয়ে। তেমন কোনও বাতাস নেই ঘরে। তবু উড়ছে ওর চুলগুলো। কী করবে বুঝতে পারল না সেজান। এমন সময় ঘরের বাল্বের দিকে চোখ গেল ওর। বাড়তে লাগল বাল্বের উজ্জ্বলতা। একসময় উজ্জ্বলতা যেন সর্বোচ্চ সীমায় পৌছে গেল। ঘুরতে শুরু করেছে মেঝেতে পড়ে থাকা ফ্যানটাও। ফটাস শব্দে ফেটে গেল বাল্বটা। মুহূর্তেই অন্ধকার হয়ে গেল পুরো ঘর। অন্ধকারেই সেজানের মনে হলো আস্তে-আস্তে উপরে উঠছে ফ্যানটা। একসময় ওর মাথার একটু উপরেই স্থির হলো। নড়ারও সাহস পেল না সেজান। ও একচুল নড়লেই ক্ষতবিক্ষত হবে ফ্যানের পাখায়। ওর নিঃশ্বাস যেন আটকে গেছে। কেউ যেন ওকে বোঝাতে চাইছে, চাইলেই তোমাকে মারতে পারি আমি, কিন্তু করুণা করে তোমাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছি। আবারও আলোর ঝলকানি দেখতে পেল সেজান। কেমন যেন এক ঘোরের মধ্যে চলে গেল ও।
দুই
ভয়াবহ জণ্ডিসে আক্রান্ত হয়েছে আনোয়ার। হাতের তালু, চোখসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ গাঢ় হলুদ বর্ণের হয়ে গেছে। ঘণ্টায়-ঘণ্টায় বমি করছে সে। বড় এক ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে ওকে। ওর খালাতো বোন নাদিয়া ওর দেখাশোনা করছে। নাদিয়ার মা নার্গিস জাহানও মেয়ের সাথে থাকছেন মাঝে-মাঝে। নার্গিস জাহান আনোয়ারের মায়ের ছোট বোন। নাদিয়ার যখন জন্ম হলো, তখন থেকে তাঁর মনে প্রবল ইচ্ছা আনোয়ারের সাথে মেয়ের বিয়ে দেবেন। নিজের বোনকে মনের কথাটা জানিয়েছিলেন তিনি। আনোয়ারের মা-ও সানন্দে রাজি ছিলেন। কিন্তু আনোয়ার ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে ওর মা মারা যান। নাদিয়া তখন ক্লাস থ্রির ছাত্রী। বোন মারা যাওয়ার পর নার্গিস জাহানের ইচ্ছাটা গোপনই থেকে যায়।