“হাড় দেওয়ার কারণ?”
“শুনেছি হাড়টা বানরের। নীল বানরের…”
“নীল বানরের?” কিকিরা অবাক!
“তাই বলেছিল। নীল বানর দেখাই যায় না। এদেশে কেউ দেখেছে বলে শুনিনি।”
“কী হবে এই হাড়ে?”
“ভাগ্য! বাবার পরিবারকে চরম দুঃখ দুর্ভাগ্য থেকে বাঁচাবে।”
“বাঁচিয়েছে? এ তো কবচ-মাদুলি পাথর-টাথর পরার মতন ব্যাপার।”
“জানি না। আমার জন্যে আমি ভাবি না। মা আর দাদুর জন্যে ভাবি। দাদু হয়তো আর দু-চার বছরও নয়; কিন্তু মা! মা না থাকলে আমার আর কী থাকতে পারে!” রাজীব বড় করে নিশ্বাস ফেলল। কয়েক মুহূর্ত থেমে বলল, “বাবা হঠাৎ চলে যাওয়ার পর আমরা খুবই বিপদে পড়েছিলাম, দাদু না থাকলে কী হত জানি না। সেটাও তো ভাগ্য! এই হাড়ের কোন গুণ আছে না আছে জেনে আমার লাভ নেই; মায়ের কথা ভেবে ওটা আমি কাছছাড়া করি না। ওটা নাকি জীবনে মাত্র একবার একটি প্রার্থনাই পূর্ণ করতে পারে।”
কিকিরা কিছু বললেন না। যত অলৌকিক অবিশ্বাস্যই শুনতে হোক মায়ের ওপর ছেলের এই দুর্বলতা স্বাভাবিক। বিশেষ করে যে ছেলে কম বয়েসে বাবাকে হারিয়েছে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর চন্দন বলল, “আমরা এবার উঠতে পারি!”
কিকিরা মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ, ওঠা যেতে পারে।
নন্দবাবুই উঠে পড়লেন প্রথমে। মনে হল, তিনি যেন চলে যাওয়ার জন্যে বেশি ব্যস্ত।
.
বাড়ির বাইরে এসে নন্দবাবু একটা রিকশা নিলেন। তাঁর বাড়ি তেমন দূরে নয়, গলি দিয়ে চলে যাওয়া যায়।
কিকিরারা একটা ট্যাক্সির জন্য বড় রাস্তার দিকে হাঁটছিলেন। সঙ্গে রাজীব।
রাজীব হঠাৎ বলল, “নন্দবাবুর অনেক ক্ষতি হল!”
কিকিরা হাসলেন।
“হাসছেন?”
“আমি জানি। খোঁজ করে দেখেছি। দোকানটায় আগুন লাগলে ওঁর লাভ হত।”
“আমি কিন্তু আগুন লাগাতাম না।”
“তুমি লাগাতে না।… তবে সেদিন দোকানে গিয়ে তুমি ঝগড়াঝাটি করে আসার পর ওঁর মাথায় এই দুর্বুদ্ধি দেখা দেয়। দেওয়ার কারণও আছে। দোকানটা এখন টিমটিম করে চলে। কর্মচারীদের ঠিকমতন মাইনে দিতেও পারেন না। পৈতৃক বাড়ি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ছেলের কোনও উৎসাহ নেই দোকান সম্পর্কে। কী হবে ওই দোকান রেখে! তবে হ্যাঁ, দোকান ছাই হয়ে গেলে নন্দবাবুর নিশ্চয় প্রাণে লাগত। সেটা সহ্য করা কঠিন হত ওঁর পক্ষে। হয়তো ভেবেছিলেন লাখ তিন সাড়ে তিন টাকা যদি হাতে আসে এখন–দুঃখটা সামলে নিতে পারবেন।… মানুষ এইরকমই হয় রাজীব। পাকেচক্রে হতাশায় সে কখন যে অন্যায়ের সঙ্গে রফা করে বসে, কে জানে!… তা বলে তুমি ভেবো না নন্দবাবু মানুষটি সত্যিই অত খারাপ! ভাল কথা, তুমি সব জানতে নাকি?”
রাজীব হেসে বলল, “আমি তো আগেই বলেছি, আমার তরফেও একজনকে লাগিয়ে রেখেছিলাম দোকানে! সুশীল।”
তারাপদ আর চন্দন প্রায় একই সঙ্গে হেসে উঠে বলল, “আপনি মশাই আগুন লাগাতে পারলেন না, অথচ ধোঁয়া ছড়িয়েই খেলাটা শেষ করে দিলেন। কী যে করলেন!”
ততক্ষণে ট্যাক্সি দেখতে পেয়ে গিয়েছিলেন কিকিরা। হাত তুলে থামালেন গাড়িটাকে। ডাকলেন তারাপদদের, “এসো।… চলি রাজীব। তোমার দিঘার হোটেলের নামটা কিন্তু ‘সাগরসঙ্গম’ই দিও।”
রাজীব হাসল। “আপনারা কিন্তু আসবেন।”
ট্যাক্সি চলে গেল।
৩.৬ ভুলের ফাঁদে নবকুমার
কিকিরা ফোনে কথা বলছিলেন। এই যন্ত্রটি আগে তাঁর বাড়িতে ছিল না। রাখার চেষ্টাও করেননি। ফোনের কথা উঠলে তারাপদদের ঠাট্টা করে বলতেন, “তোমাদের ওই ‘টেলি ফোঁ’ কানে তুললেই আমার ব্রেন ড্যামেজ হয়ে যায়। ওঃ, কী বিদঘুঁটে সব শব্দ, হয় পটকা ফাটছে কানের পরদায়, না হয় সোঁ-সোঁ হাওয়া বইছে। এই জ্যান্ত, এই মৃত।…না, বাপু; এই বেশ আছি। নো ঝামেলা।”
কিকিরা টেলিফোনকে ‘টেলি ফোঁ’ বলেন। অনেক আগে নাকি ‘ফোঁ’ বলারই রেওয়াজ ছিল কারও কারও। কেন ছিল তিনি জানেন না। পুরনো বাংলা বইয়েই দেখেছেন কথাটা।
হালে, কিকিরারই এক চেলা, ম্যাজিশিয়ান চেলা, একটা ম্যাজিক বক্সের নকশা করিয়ে নেওয়ার পর, গুরুদক্ষিণা হিসেবে যন্ত্রটি বসাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তার মামা বা কাকার দৌলতে।
কিকিরা যখন ফোনে কথা বলেন, মনে হয় অ্যাক্টিং করছেন। গলার পরদা উঠছে, নামছে, ঢেউ খেলছে, হয় হাসছেন না হয় হায় হায় করছেন–সে এক অপূর্ব শ্রুতিনাট্য।
কিকিরা কথা বলছিলেন ফোনে, আর তারাপদরা নিজেদের জায়গায় বসে কখনও কথা বলছিল, কখনও বা কিকিরার কথা শুনছিল।
এমন সময় এক কমবয়েসি ভদ্রলোক এসে হাজির।
ফোন নামিয়ে রাখলেন কিকিরা।
“আরে লাটু?”
তারাপদরা ভদ্রলোককে দেখছিল। আগে দেখেনি। দেখার মতন অপূর্ব চেহারা অবশ্য নয়, কিন্তু সুদর্শন। লম্বাটে গড়ন, রং বেশ ফরসা। সাধারণ কাটা-কাটা চোখমুখ। পরনে ধুতি, গায়ে ঘি-রঙের সিল্কের হাফশার্ট। চোখে চশমা। কিকিরার চেয়ে বয়েসে ছোট। অনেকটাই।
“কী ব্যাপার লাটু? তুমি হঠাৎ?”
লাটু কিকিরাকে দেখছিল। তারপর তারাপদদের নজর করে নিল।
“এলাম। আপনাকে অনেকদিন দেখতে পাই না, রায়দা! পথ ভুলে গিয়েছেন।”
“না রে ভাই, যাব যাব করি, যাওয়া হয় না। বোসো, দাঁড়িয়ে রইলে যে!”
লাটু বসল। তার ইতস্তত ভাব তখনও যায়নি। তারাপদদের দেখছিল বারবার।
“কেমন আছ?” কিকিরা বললেন।
“চলে যাচ্ছে! বড়বাবুর শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। ব্লাড সুগারে কাহিল হয়ে পড়েছে। মেজদা ঠিক আছে।”