১. এক খণ্ড বৃহৎ মেঘ
০১.
মাথার ওপর কৃষ্ণকায় এক খণ্ড বৃহৎ মেঘ, দুপাশে নিবিড় অরণ্য আর অন্ধকার ফণা-তোলা সাপের মতন এতক্ষণ যেন অবনীকে তাড়া করে নিয়ে যাচ্ছিল। অনেকক্ষণ ধরে সে এই অসহায় ও উদ্বেগজনক অবস্থা থেকে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছিল; পারছিল না। উভয় পাশের স্থির নিস্তব্ধ বৃক্ষলতাপূর্ণ পার্বত্য উচ্চভূমি, ঘন অন্ধকার, মসিময় মেঘখণ্ড তাকে ঘিরে ফেলেছে। অবনীর মনে হচ্ছিল, এই পথ বুঝি আর সে অতিক্রম করতে পারবে না, কোথাও থেমে যেতে বাধ্য হবে।
হঠাৎ, অধাবৃত্তাকার একটি বিপজ্জনক বাঁক পেরিয়ে কাঠের সাঁকোর মুখে গাড়ি আসতেই মনে হল, কী যেন তার চারপাশ থেকে সরে যাচ্ছে। আরও কিছুটা পথ এগিয়ে সেই আকাঙিক্ষত দীর্ঘ ঢাল পাওয়া গেল। মাখারিয়ার পাহাড়ি জঙ্গল তবে শেষ হয়েছে। এখন পথ ক্রমশই নীচে নেমে যাবে। অবনী অনুভব করতে পারল, তার মাথার ওপর সেই কুণ্ডলীকৃত মেঘটিও আর নেই। সন্ধ্যার অন্ধকার এখন দুঃসহ নয়; বাতাস আরও কিছুটা প্রবল হয়েছে। এতক্ষণ যে অরণ্য তাকে ক্রমাগত দুপাশ থেকে গ্রাস করার, এবং কৃষ্ণকায় মেঘখণ্ড তাকে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছিল তারা পিছনে সরে যাচ্ছে; বনভূমি আর তত নিবিড় নয়, ক্রমশই পাতলা হয়ে আসছে। ভীত এবং বিপন্ন অবনী এতক্ষণে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
বিকেলে, অবনী যখন শহরের হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে তখন, দমকা বৃষ্টি এসেছিল। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটায়, এলোমেলো ঝাঁপটায় তার গাড়ি ভিজে গিয়েছিল, অবনীও পুরোপুরি শুকনো থাকতে পারেনি। তার জিপগাড়ির ক্যানভাসগুলো অকেজো হয়ে গেছে, বাতাসে ফটফট করে ওড়ে। গাড়ির পিছন দিকটা ভিজে গেল বিকেলের বৃষ্টিতেই। সেই দমকা বৃষ্টির মধ্যেই মাইলটাক পথ পেরিয়ে আসতে আসতে বিকেল পড়ে এল, বৃষ্টি ধরে গেল। আকাশ পরিষ্কার হল না। কোথাও একটু কালো, কোথাও ধূসর, কোথাও বা ঈষৎ রক্তাক্ত মেঘ ছিল। অবনী এসব খেয়াল করে দেখেনি, তবু যেন চোখে পড়েছিল। আকাশ ও মেঘের সঙ্গে তার চোখের সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল, সে উদাসীন হয়ে ছিল, তবু মনে মনে ক্রমশই কোনও এক বিষণ্ণতায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। হীরালালের কথা তার মনে স্থায়ী কোনও ছায়ার মতন পড়ে ছিল। বেচারি হীরালাল! এখনও তাকে হাসপাতালের বিছানায় দেখা যাবে, দুপাশে পরদা ফেলে দেওয়া হয়েছে, অক্সিজেন চলছে, হয়তো সন্ধ্যায় বা রাত্রে কিংবা কাল সকালে শেষবারের মতন একটু অক্সিজেন নিয়ে সে চলে যাবে, তার শয্যা শূন্য হবে। কোথায় যাবে হীরালাল? আকাশে? আকাশে নয়। দ্বিপদ জীব, মেঘ নয়, বাতাস নয়, ধূলিকণাও নয় যে ওই আকাশে তার ঠাঁই হবে। তবু অবনী উদাস চোখে শেষ বর্ষার অপরাহ্নের বিক্ষিপ্ত মেঘমালা দেখেছিল।
ওই সময়, আসার পথে শহরের শেষ প্রান্তে সেন্ট জোসেফ স্কুলের সামনে তার গাড়ি কেমন মন্থর হয়ে গিয়েছিল। হয়তো অবনী সামান্য সময় দাঁড়িয়ে পড়েছিল। স্কুল কম্পাউন্ডের একটা পাশ অসাড়, ক্লাসরুমের দরজা জানলা বন্ধ; অন্য পাশে মস্ত মাঠ আর পুকুর, পুকুরের গা ঘেঁষে হোস্টেল। ঘণ্টা পড়ছিল হোস্টেলে, কয়েকটা বাচ্চা ছেলে পুকুর থেকে উঠে সপসপে ভিজে গায়ে ছুটছিল; খেলার মাঠ ছেড়ে সবুজ ভিজে ঘাসের ওপর দিয়ে জলকাদা-মাখা কটা ছেলেও হোস্টেলে ফিরে যাচ্ছিল। অবনী ওদের দেখতে দেখতে হীরালালের কথা ভাবছিল। হীরালাল ছেলেবেলায় ওই স্কুলে পড়েছে। একবার এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় হীরালাল তার পাশে বসে স্কুলের ঘরবাড়ি মাঠ পুকুর দেখাতে দেখাতে অবনীকে তার ছেলেবেলার গল্প শুনিয়েছিল। পুকুরে সাঁতারকাটা শিখতে গিয়ে হীরালাল একবার ডুবতে ডুবতে কী করে বেঁচে গিয়েছিল সে-গল্প শুনিয়ে হীরালাল বলেছিল: মাগর দো সাল বাদ হাম জুনিয়ার গ্রুপমে সুইমিং চামপিয়ান হুয়া থা৷ সিনিয়ার গ্রুপেও হীরালাল মেডেল পেয়েছিল সাঁতারের।
স্কুলের পুকুরটিতে বাদলা-অন্ধকারের ছায়া পড়ে গিয়েছিল, অবনী দূর থেকে জল দেখতে পাচ্ছিল না, তবু তার মনে হল, সেন্ট জোসেফ স্কুলের পুকুরটিকে কোনও রকমে হীরালালের কথা যদি জানানো যেত অবনী জানাত।
স্কুল ছাড়িয়ে আসতেই অবনী কেমন এক আক্রোশ অনুভব করল। হয়তো অনেকক্ষণ থেকে ক্রমশই কোনও ক্ষোভ তার মনে জমছিল, মেঘলা জমে আসার মতন কোনও গুমট এবং ভার। জীবন এই রকমই, তার থাকা না থাকার কোনও নিয়ম নেই; স্থিরতাও নেই। অকারণে অপ্রয়োজনে থাকে, আবার অকারণেই চলে যায়। মানুষ তাকে রাখব বললেই রাখতে পারে না। হীরালাল শক্ত সমর্থ যুবক, বছর পঁয়ত্রিশ বয়স হয়েছিল মাত্র, উদ্যোগী, পরিশ্রমী, প্রসন্ন-স্বভাব, কাজকর্ম চমৎকার বুঝত, ঠাকুর দেবতায় ভক্তি ছিল, মদগাঁজা খেত না, কুসংসর্গে পড়েনি, ঘুষ নিতে তার বিবেকে বাধত। এইসব সাধারণ সৎ গুণ রক্ষা করে হয়তো সে ভাবত জীবনের খাতায় কিছু জমাচ্ছে। অথচ, সেই জীবনের হিসেবের পাতাটা কত অনায়াসে এবং সহজে কে যেন ধুত বলে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে বাতাসে উড়িয়ে দিল। হীরালাল মিশ্র, পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির কাঠামো, দেড় মণের ওপর ওজন, সাঁতারু শক্ত হাত এবং স্থির উদ্দেশ্যে নিয়েও অন্য একটি পুকুরের সামান্য পথ এগিয়েই থেমে গেল। কেন?
কখন যেন বিকেল পড়ে গিয়ে আলো মুছে আঁধার জমছিল। গাড়ি অনেক দুর এসে পড়েছিল। তাকে পাশ কাটিয়ে, তার সামনে দিয়ে আরও কত গাড়ি চলে গেল। অবনী লক্ষ করল, অন্যমনস্কতার মধ্যেই সে কখন নিজের অজ্ঞাতেই গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে। ঠাণ্ডা বাদলা বাতাস আসছে হুহু করে, গাড়ির পিছন দিকের ক্যানভাস বাতাসের দমকায় উড়ে উড়ে আছড়ে পড়ছে, কেমন এক শব্দ হচ্ছে যেন কেউ অবনীর পিছু পিছু বুক চাপড়াতে চাপড়াতে চলেছে। অসহ্য মনে হওয়ায় গাড়ি থামাল অবনী। শহরের দিকের বাসটা তার পাশ কাটিয়ে উলটো দিকে চলে গেলে ঘড়ি দেখল, প্রায় সাড়ে ছয়। এখনও অনেকটা পথ, মাইল পনেরোরও বেশি। গাড়ির ইঞ্জিনে কোথাও একটা বেয়াড়া শব্দ হচ্ছে। নামল অবনী, ইঞ্জিন দেখল। ঠিক বোঝা গেল না। একটা টর্চ আনা উচিত ছিল, সাধারণত সঙ্গে থাকে। আজ তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যাবার সময় টর্চের কথা খেয়াল হয়নি। গাড়িতে ফিরে এসে উঠে বসার আগে পিছনের ক্যানভাস বাঁধার চেষ্টা করল, উঠে এসে সিগারেট ধরাল অবনী। কেমন একটা অবসাদ এসেছে, ছোটাছুটি করার জন্যে হতে পারে, মনের ভারের জন্যেও হতে পারে। প্রায় আধখানা সিগারেট চুপচাপ বসে বসেই শেষ করে গাড়িতে আবার স্টার্ট দিল, দিয়ে ডান দিকের পথ ধরল। মাইলটাক এগিয়েই মাখারিয়ার জঙ্গল শুরু হবে। পথটা সাবধানে পেরিয়ে যাওয়াই রীতি। জঙ্গলের দিকে বৃষ্টি হয়েছে কিনা বোঝা গেল না। বাসটার গায়ে জল ছিল, ঠিক কোথায় বৃষ্টি পেয়েছে কে জানে, জঙ্গলে বৃষ্টি থাকলে খুব সাবধানে এই পথটা পেরোতে হবে।
সাবধান হওয়া না হওয়ায় খুব কি একটা যায় আসে? হীরালাল কখনওই বেপরোয়া ছিল না। প্রতিটি কাজ সে ভেবেচিন্তে সাতপাঁচ ভেবে করত। ঠাণ্ডা মাথার লোক যেমন হয়। এই এলাকায় সে আজ চার বছর ওভারহেড ইলেকট্রিক লাইন লাগাবার তদারকি করছিল। জরিপনকশা, পথঘাট বন পাহাড় তার সব জানা, কাগজ পেনসিল দিলে চোখ বুজে ছক করে কোথায় কী আছে বলে দিতে পারত। অথচ সেই হীরালাল সামান্য একটা ট্রাক নিজের হাতে পথের পাশে সরিয়ে রাখতে গিয়ে কেমন করে যেন কালভার্টের পাশে গাড়িটাকে গড়িয়ে দিল, ঢালু পথে গাড়িটা মালপত্র সমেত উলটে গেল, হীরালাল জখম হল। প্রথমে মনে হয়েছিল, তার আঘাত গুরুতর নয়, শরীরের বাইরে তেমন একটা ভাঙাচোরা রক্তারক্তির চিহ্ন ছিল না। ছোকরা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর জানা গেল, মাথায় জোর চোট লেগেছে, রক্তক্ষরণ হচ্ছে ভেতরে। আজ নিয়ে দুদিন ওই রকম, অজ্ঞান অবস্থা। আশা ভরসা আর নেই। বিন্দুমাত্রও নয়।
কেমন এমন হয়? কেন?
.
অবনী হঠাৎ অনুভব করল সে মাখারিয়ার জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে, সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এবং তার মাথার ওপর এক খণ্ড কালো ভয়ংকর মেঘ। থমথমে সেই মেঘের পুঞ্জ ক্রমশই ধোঁয়ার মতন কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশ ঢেকে ফেলতে চাইছে। জঙ্গলের মাথার ওপর দিয়ে যেন সাঁতার কেটে চলেছে মেঘটা। ক্রোধ, তিক্ততা, আক্রোশ সমস্তই যেন আচমকা অবনীকে কেমন বেপরোয়া করে তুলল। পাথরের মতন শক্ত হয়ে সে বুঝি কারও বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চায়, অন্ধ হিংস্র দৃঢ় হয়ে। গিয়ার বদলে নিল। অ্যাকসিলারেটারে চাপ বাড়াতে লাগল, স্টিয়ারিং ধরল শক্ত মুঠোয়। তারপর মনে মনে অদৃশ্য কোনও শত্রুকে যেন ঘৃণার সঙ্গে কিছু বলল।
শাণিত তরোয়ালের মতন আলোর দীর্ঘ ফলা অরণ্য ও অন্ধকারকে চিরে পথ দেখিয়ে দিচ্ছিল, অবনী সাবধানে গাছের সারি বাঁচিয়ে, মাঝ বরাবর পথ ধরে, উঁচুনিচু লক্ষ রেখে, এবং প্রতিটি বিশ্রী বিপজ্জনক বাঁক অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পেরিয়ে যাচ্ছিল। হঠকারিতা করে সে কখনও পথের পাশে সরছিল না। উভয় পাশেই বৃক্ষলতাকীর্ণ গভীর খাদ অন্ধকারে ফাঁদ পেতে রেখেছে, অসতর্ক হলে অবনী সেই ফাঁদে ধরা পড়বে। সম্ভবত বিকেলের দিকে বৃষ্টি হয়ে গেছে জঙ্গলে, কালো পিচের রাস্তা এখনও ভিজে, গাড়ির আলোয় দীর্ঘ কোনও সরীসৃপের পিচ্ছিল শরীরের মতন কুৎসিৎ দেখাচ্ছিল। রাস্তার দু পাশে দীর্ঘকায় প্রাচীন বৃক্ষ। অবনী জানে, অসাবধান হলে এই পথে গাড়ির চাকা পিছলে যেতে পারে, পিছলে গিয়ে সরাসরি গাছের সঙ্গে প্রচণ্ড ধাক্কা খেতে পারে। তার সে রকম কোনও স্পৃহা নেই। লক্ষ স্থির তীক্ষ্ণ রেখে, শরীরে অঙ্গগুলি অস্বাভাবিক কঠিন করে, দক্ষতার সঙ্গে সে পথ অতিক্রম করছিল।
যেতে যেতে কখন যেন অবনী অনুভব করল, তার চতুর্দিকের স্তব্ধতা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া কোথাও কোনও রকম শব্দ নেই, সেই একঘেয়ে যান্ত্রিক শব্দও দীর্ঘ সময় কানের কাছে বাজতে বাজতে কখন যেন সয়ে গেছে, স্বতন্ত্রভাবে আর শোনা যায় না। এই নিরালোক অসাড় জগতের নৈঃশব্দ এক অবর্ণনীয় প্রাণহীনতা সৃষ্টি করেছে। অবনী হঠাৎ কেমন আতঙ্ক অনুভব করল।
তারপর সহসা তার দৃঢ়তা ভাঙল, যে অবজ্ঞা আক্রোশে সে অজ্ঞাত এক শত্রুর সঙ্গে যুঝতে নেমেছিল মনে হল–সেই অবজ্ঞা এখন তাকে উপহাস করছে। কপালে ঘাম ফুটল, মেরুদণ্ড সামান্য নুয়ে পড়ল। দ্বিধা ও সন্দেহবশে তার মনে হল, গাড়ির আলো ক্রমশই নিষ্প্রভ হয়ে আসছে, এবং সে যেন কোনও গুহার মাঝ বরাবর এসে আটকে পড়েছে। যে কোনও মুহূর্তেই আলোটুকু ফুরিয়ে যেতে পারে, যে কোনও মুহূর্তে সর্বগ্রাসী এই অন্ধকার ও অখণ্ড স্তব্ধতা তাকে আক্রমণ করবে। অবনী ভীত হয়ে অকারণে গাড়ির হর্নে হাত দিল। তীব্র তীক্ষ্ণ এক শব্দ সদ্য ভূমিষ্ঠের মতন যেন এই উদ্বেগের মধ্যে চিৎকার করে উঠল। …অবনী অনেকক্ষণ আর হর্ন বন্ধ করল না বন্ধ করতে তার সাহস হল না, নিতান্ত অন্তরঙ্গ সঙ্গীর মতন তাকে অনুভব করতে করতে এক সময় অর্ধবৃত্তাকার একটি বাঁক পেরিয়ে কাঠের সাঁকোর মুখে এসে হঠাৎ অনুভব করল কী যেন তার চারপাশ থেকে সরে যাচ্ছে। আরও সামান্য এগিয়ে সে বুঝতে পারল মাখারিয়ার জঙ্গল এবং সেই কৃষ্ণকায় মেঘের সীমানা সে অতিক্রম করে চলে এসেছে।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল অবনী। কপাল গাল-গলার ঘাম মুছল। ধীরে সুস্থে সিগারেট ধরাল।
.
এখন আর সে কোনও দুশ্চিন্তা অনুভব করছে না। মাইল সাতেক পথ এখনও তাকে যেতে হবে, এবং রাস্তা অধিকাংশ সময় এই রকম নির্জন ও লোকালয়হীন। তবু অবনী বিন্দুমাত্র উদ্বেগ বোধ করল না। কেননা এর পর রাস্তা ভাল, পাহাড় জঙ্গল নেই, ঝোপঝাড় মাঠঘাট, কোথাও বা বালিয়াড়ির মতন স্তূপ। বড় বড় পাথরের চাঁই ইতস্তত দেখা যাবে। এখানটায়, অবনীর খেয়াল হল, সরকারি নতুন রিজার্ভ ফরেস্ট তৈরি হচ্ছে, গাছপালা লাগিয়েছে বিস্তর, কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রেখেছে। কাছেই নদী।
দূরে আড়াল থেকে যেন হামাগুড়ি দিয়ে একটি আলোর রেখা লাফিয়ে উঠে এল। আলোটা উঁচুনিচু হয়ে নাচতে নাচতে সামনে এগিয়ে আসছিল, তারপর জোরালো হল। অবনী মাঝরাস্তা থেকে ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল। গাড়ি আসছে। দেখতে দেখতে কাছাকাছি এসে গেল। কখনও অবনী,কখনও আগতগাড়ির চালক জোরালো আলো নিবিয়ে এবং জ্বেলে পরস্পরকে যেন দেখে নিল, তারপর আলোর রশ্মি হ্রাস করে পরস্পরকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। পলকের মধ্যেই অবনী বুঝতে পারল, চলে যাওয়া গাড়িটা বড় এবং ভারী, কয়েকজন লোক রয়েছে ভেতরে।
ওরা শহরে যাচ্ছে। পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে। হঠাৎ অবনী কেমন নির্বোধের মতন কুণ্ঠিত হাসি হাসল। যারা গেল তাদের মাখারিয়ার পাহাড় জঙ্গল ভেদ করেই যেতে হবে, হামেশাই ওই পথে গাড়ি যায়, তবু আজ অবনী কেন যে অত ভীত ও ত্রস্ত হয়ে উঠল।
আসলে আজ তার কিছু যেন হয়েছিল। কী হয়েছিল? মন খারাপ? হীরালালের মৃত্যুর চিন্তা তাকে ভাবপ্রবণ করে তুলেছিল? সে আহত হয়েছে? বিরক্ত ও বীতশ্রদ্ধ? মৃত্যুর চিন্তা কি গোপনে তাকে ভীত ও উদভ্রান্ত করে তুলেছিল?
.
যে কোনও কারণেই হোক অবনী তখন অতিরিক্ত চঞ্চল ও বিভ্রান্ত হয়েছিল। তার সমস্ত হৃদয় ভারাক্রান্ত ও বিষণ্ণ ছিল। সে ছেলেমানুষের মতন ক্ষুব্ধ হয়ে মৃত্যুর প্রতি আক্রোশ অনুভব করেছিল, এবং উন্মাদের তুল্য মৃত্যুকে তার বিপক্ষ খাড়া করে তার সঙ্গে লড়বার চেষ্টা করছিল। এইসব মিলেমিশে তার স্বাভাবিক বোধ অস্বাভাবিক এত ভীতির সম্মুখীন হয়েছিল। নিজের একাকিত্ব, অসহায়তা, আঘাত, ক্রোধ, বিভ্রান্তি মাখারিয়ার নির্জন নিস্তব্ধ আরণ্যক পরিবেশে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে অত্যন্ত প্রখর হয়ে উঠেছিল।
অবনী ভাবল, শ্মশান দর্শনে যেমন সাময়িক বৈরাগ্য, শ্রাবণের মেঘ দর্শনে মন যেমন ক্ষণিক উদাস হয়–এও সেই রকম। স্বাভাবিক, অথচ অর্থহীন। হীরালালের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর জন্যে বেদনা অনুভব করলেও, অবনী এখন আর সেই উৎপীড়ন বোধ করছিল না। সংসারে এরকম হয়, শত সহস্র হচ্ছে। কেন হচ্ছে, এ প্রশ্ন অবান্তর? জীবনের অনেক প্রশ্নেরই উত্তর থাকে না। সান্ত্বনার জন্যে স্বীকার করে নাও, হীরালালের মৃত্যু দুর্দৈব, দুর্ভাগ্য।
ছেলেমানুষের মতন অবনী শক্ত একটা ঢোঁক গিলল। বাঁ হাতে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল।
.
ছড়ানো ছিটোনো পেঁজা পাতলা তুলোর মতন কয়েকটি মেঘ আকাশে, ধীরে ধীরে কোমল জ্যোৎস্না ফুটে উঠল। শিশিরের মতন এই আলো ভিজে এবং মিহি রঙের। অন্ধকারে প্রান্তরগুলি ক্রমশ কেমন পুঞ্জ পুঞ্জ ছায়ার মতো স্পষ্ট হল। দুর্বল রেখায় আঁকা ছবির মতো কাছের দু-একটি অসাড় গ্রামও দেখা যাচ্ছিল। কোথাও জোনাকির মতন আলোর বিন্দু জ্বলছে।
অবনী অনুভব করল, তার মনে এখন আর উদ্বেগের বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। যেন সে কোনও দুরূহ অঙ্কের হিসেব শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে নিয়েছে, নিয়ে স্বস্তি অনুভব করছে। একটি বিষণ্ণতা অবশ্য থেকে যাচ্ছে। থাকুক। থাকতে থাকতে কোনওদিন এও চলে যাবে।
মিহি ও আর্দ্র জ্যোৎস্নার মধ্যে শিথিল ভঙ্গিতে গাড়ি চালাতে চালাতে অবনী আরও কিছুটা পথ এগিয়ে এল। সামনে এক জনবসতি, আলো জ্বলছে মিট মিট করে, চালা বাড়ি, শিবমন্দিরও চোখে পড়ছে। আর মাত্র মাইল দুই পথ।
মোড়ের কাছাকাছি আসতে অবনীর চোখে পড়ল লাল রঙের একটি বাস রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। এক দল তোক নীচে রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাছাকাছি একটা দোকান, লণ্ঠন জ্বলছে। কে যেন গলা ছেড়ে কাউকে ডাকছিল।
প্রায় কাছাকাছি আসতে অবনীর চোখে পড়ল, ধুতি-জামা পরা এক ভদ্রলোক রাস্তার প্রায় মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে, সামান্য ঝুঁকে তার গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। অবনী হর্ন দিল। লোকটা আহাম্মকের মতন পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে অবনী দাঁড়াল। লোকটি হাত তুলেছে, দাঁড়াতে বলছে।
গাড়ির পাশে আসতেই অবনী চিনতে পারল মানুষটিকে। সুরেশ্বর। কাছে এসে মুখ বাড়াতে অবনীকেও চিনল সুরেশ্বর। আরে, আপনি?
কী ব্যাপার? অবনী বলল।
আর কী, বাস খারাপ হয়ে গেছে।
অবনী বুঝতে পারল। এরকম দৃশ্য দেখার অভ্যাস তার আছে।
আমি একটু বিপন্ন হয়ে পড়েছি-সুরেশ্বর বিব্রঙ্কণ্ঠে বলল, বাস কখন ঠিক হবে বুঝতে পারছি; চেষ্টা করছে ওরা, তবু…।
কোথায় গিয়েছিলেন?
স্টেশনে। সন্ধের গাড়িতে এক মহিলা এসেছেন। তাঁকে আনতে গিয়েছিলাম।
অবনী সুরেশ্বরের মুখ লক্ষ করার চেষ্টা করল। অবনীকে দেখতে পেয়ে ভদ্রলোকের যেন কিঞ্চিৎ আশার সঞ্চার হয়েছে। অবনী বলল, কোথায় যাবেন? আপনার আশ্রমে? আশ্রম শব্দটা উপেক্ষা ও কৌতুকের স্বরে বলবার চেষ্টা করল অবনী।
সুরেশ্বর বলল, বেশি দূর নয়, কাছেই; মাইল খানেকের সামান্য বেশি। একা হলে আমি হেঁটে চলে যেতাম। মেয়েটির জন্যে বিপদে পড়েছি, সঙ্গে কিছু মালপত্রও রয়েছে।
অবনী বিশেষ প্রসন্ন হল না। সুরেশ্বরকে তার আশ্রমে পৌঁছে দেওয়া অবনীর দায়িত্ব নয়। তা ছাড়া এতটা পথ–শহরে যাওয়া এবং ফিরে আসায় সে ক্লান্তি অনুভব করছে। তবু, বিপন্ন এক মহিলার কথা ভেবে অবনী সুরেশ্বরের অনুরোধ এড়িয়ে যাওয়ার কৈফিয়ত খুঁজে পেল না। তার বিরক্তিও প্রকাশ করল না, নিস্পৃহ গলায় শুধু বলল, আসুন তা হলে..একটু তাড়াতাড়ি।
সুরেশ্বর আর দাঁড়াল না, বাসের দিকে চলে গেল।
অবনী চুপচাপ বসে সিগারেট ধরাল। ধরিয়ে পাশ ফিরে বাসের দিকে তাকিয়ে থাকল! জ্যোৎস্না অনাবিল নয়, তবু দেখা যায় সব। বাসের ড্রাইভার ইঞ্জিনের ঢাকা খুলে যন্ত্রপাতি দেখছে, হাতে লণ্ঠন নিয়ে তার পাশে অন্য একজন দাঁড়িয়ে। বাস থেকে নেমে পড়ে একদল দেহাতি এদিকে ওদিকে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছে, বিড়ি ফুকছে, দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ পানটান খাচ্ছে। বাস খারাপ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ায় এদের তেমন কোনও ব্যাকুলতা আছে বলে এখন অন্তত মনে হচ্ছে না।
অবনীর চোখে পড়ল, বাসের পিছন দিকে একটি মেয়ে এসে দাঁড়াল। হয়তো এতক্ষণ বাসের মধ্যেই বসে ছিল, সুরেশ্বরের কথামতন নীচে নেমে এসেছে। সামান্য দূর থেকে স্পষ্ট করে মেয়েটিকে দেখা গেল না। অনুমান করা গেল।
কৌতূহল অনুভব করল অবনী। বৃদ্ধা অথবা বয়স্কা বলে মনে হচ্ছে না। সুরেশ্বর বলেছিল মহিলা: অবনীর ধারণা হয়েছিল, বৃদ্ধা বা বয়স্কা। পরে সুরেশ্বর বলেছে মেয়েটি; অবনী তখন তেমন খেয়াল না করলেও ঠিক এই ধরনের কোনও মেয়ের কথা ভাবেনি। সুরেশ্বরের কোনও আত্মীয়া নাকি? এই বনজঙ্গলের মধ্যে তার আশ্রমে একটি মেয়েকেই বা সে টেনে আনবে কেন?
মেয়েটি তফাতে দাঁড়িয়ে অবনী গাড়ির দিকে তাকিয়েছিল, তারপর বাসের দরজার কাছে সরে গেল আবার। বোধ হয় সুরেশ্বরকে জিনিসপত্র নামাতে সাহায্য করতে গেল।
সুরেশ্বরই প্রথমে একটা সুটকেস এনে গাড়ির পিছন দিকে রাখল। বলল, বাক্স বেডিং আর কাঠের পেটি আছে একটা, কিছু খুচরো-খাচরা জিনিসও।
দুটি দেহাতি ধরাধরি করে বাক্স বেডিং এনে ফেলল গাড়ির মধ্যে। সম্ভবত এরা সুরেশ্বরকে চেনে। কথাবার্তা থেকে সেই রকম মনে হল। জিপের পিছনের কাটা-দরজাটা খোলা অসুবিধেজনক বলে কোনও রকমে চাপিয়ে দিল।
শেষে পেটিবাক্স, আর পিছু পিছু সুরেশ্বর ও সেই মেয়েটি। দুজনের হাতেই খুচরো জিনিসপত্র: ছাতা, মেয়েলি কাঁধব্যাগ, টর্চ, জলের ফ্লাস্ক।
অবনী বলল, এদিক থেকে উঠুন। …গাড়ির পেছন দিকটা ভিজে থাকতে পারে, দেখে নিয়ে বসবেন। বলে সে সামনে দিয়ে ওঠার ব্যবস্থা করে দিল।
সুরেশ্বর বলল, হেম, তুমি ওঠো। সাবধানে। এই নাও, চর্ট জ্বেলে একবার দেখে নিয়ো।
হেম মাথা নিচু, পিঠ কুঁজো করে টর্চ জ্বেলে গাড়িতে উঠছিল। অবনী তাকে অনেকটা স্পষ্ট করে দেখতে পেল। হেম যখন আসছিল, কাছে এসে গাড়ির সামনে কয়েক মুহূর্তের জন্যে দাঁড়িয়েছিল, অবনী সঠিকভাবে কিছু অনুমান করতে পারেনি। হেম যুবতী, দীর্ঘাঙ্গী, তার সাজসজ্জা শহুরে এইমাত্র বুঝতে পেরেছিল। এখন, হেম যখন টর্চ জ্বেলে, অবনীর গায়ের পাশে পিঠমাথা নুইয়ে গাড়ির পেছনের দিকটা দেখছে কোথায় বসবে ভেবে নিচ্ছে–তখন অবনী চকিতের জন্যে যেটুকু দেখল, তাতে বিস্মিত হল। কী যেন অবনীকে আকর্ষণ করল, এক ঝলক ফুলের তীব্র গন্ধ সহসা অ-স্থানে অন্যমনস্ক পথচারীকে যেমন আকর্ষণ করে অনেকটা সেই রকম।
হেম পিছনে গিয়ে বসল।
অবনী সুরেশ্বরকে ডাকল, আপনি সামনে আসুন। দোমড়ানো সিটটা সোজা করে দিল। সুরেশ্বর উঠে এল।
গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে অবনী বলল, আমি আপনার রাস্তা চিনি না, চিনিয়ে দেবেন।
সুরেশ্বর বলল, সামনে এগিয়ে ডান দিকের রাস্তা।
বাসটা খারাপ হয়েছিল ঠিক তেমাথা একটা মোড়ে। হয়তো আরও সামান্য আগেই ওটা বিগড়েছিল, সকলে মিলে ঠেলেঠুলে একেবারে মোড়ে এনে রেখেছে। অবনী এ বিষয়ে তেমন কোনও আগ্রহ বোধ করল না, গাড়ি ঘোরাল।
সুরেশ্বর কুণ্ঠার সঙ্গে বলল, আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। …বাসটা স্টেশন ছাড়ার পর থেকেই গোলমাল করছিল।
এটাই তো শেষ বাস?
হ্যাঁ। আমাদের দিকে যাবার শেষ বাস…আপনি কি টাউনে গিয়েছিলেন?
অবনী হ্যাঁ বলল। সুরেশ্বরদের রাস্তা পাকা নয়, চওড়াও নয়। পাথুরে পথ। অবনী শুনেছে, এই রাস্তা খুবই কম, মাইল দেড়েক বড় জোর। সারা দিনে দুতিনটে মাত্র বাস স্টেশন, টাউন এবং ফুলগিরের দিকে যাবার পথে এই পথটুকু পাক দিয়ে আবার ফিরে যায়। অর্থাৎ যে বাস যায় তাকে আবার সামান্য পরেই এই পথ ধরে ফিরতে হয়।
গাড়ি বেশ লাফাচ্ছিল। পিছনের সিটে ঝাঁকুনি খেয়ে হেম কেমন একটু শব্দ করে উঠল। সুরেশ্বর ঘাড় ফিরিয়ে অন্ধকারে হেমকে লক্ষ করে বলল, কিছু একটা ধরে থেকো। ওষুধের বাক্সটা আলাদা আছে তো?
ওপরে রেখেছে, হেম বলল। হেমের গলার স্বর পরিণত, ভরা-ভরা।
সুরেশ্বরের যেন হঠাৎ খেয়াল হল কিছু। সরল, সরস গলায় অবনীকে বলল, নতুন মানুষটির সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিই। ওর নাম হৈমন্তী, আমরা বলি হেম। হৈমও বলে কেউ কেউ। চোখের ডাক্তারি পাশ করেছে। এখানে নিয়ে এলাম। বলে সুরেশ্বর ঘাড় ফিরিয়ে হৈমন্তীকে উদ্দেশ করে বলল, হেম, ইনি আমাদের বন্ধুবিশেষ, অবনীবাবু–অবনীনাথ মিত্র। এখানেই থাকেন। ওঁর কনস্ট্রাকশান দেখা শোনার কাজ, ইঞ্জিনিয়ার মানুষ।
পরিচয় হল; সদ্য পরিচিতরা কেউ কারুর মুখ দেখতে পেল না। স্বভাবতই সৌজন্যসুলভ বাক্যালাপও নয়। হৈমন্তী শুধু গলা পরিষ্কারের শব্দ করল সামান্য। অবনী বুঝতে পারল না, সুরেশ্বর তাকে বন্ধু হিসেবে পরিচিত করাল কেন! সে সুরেশ্বরের বন্ধু নয়, পরিচিত মাত্র; এবং এই পরিচয়ও এমন নয়, যাতে সুরেশ্বর তাকে পছন্দ করতে পারে। সুরেশ্বর কি উপকার পাচ্ছে বলে অবনীকে আপ্যায়ন করার চেষ্টা করছে? নাকি এটা নিছক ভদ্রতা! অবনী কিছু বুঝতে পারল না। সুরেশ্বরের অনেক কিছুই বোঝা যায় না। যেমন এখন পর্যন্ত বোঝা গেল না, হৈমন্তী সুরেশ্বরের আত্মীয় কি না! মেয়েটি যে তার পূর্ব-পরিচিত, এবং সুরেশ্বরের স্বার্থেই এখানে এসেছে, তা বোঝা যায়। কিন্তু স্বেচ্ছায় এসেছে, না সুরেশ্বর তাকে আনিয়েছে? কী সম্পর্ক উভয়ের মধ্যে?
বর্ষায় এদিকের রাস্তাটা নষ্ট হয়ে গেছে একেবারে। ভারী বাস চলে চলে কাঁচা রাস্তার দুপাশের অবস্থা নালার মতন হয়েছে, মাঝে মাঝে গর্ত, জল জমে আছে। লাফিয়ে লাফিয়ে টাল খেয়ে জিপটা যাচ্ছিল। যেতে যেতে একবার কাত হয়ে উলটে যাবার মতন হল। হৈমন্তী টাল সামলাতে না পেরে আঁতকে ওঠার মতন শব্দ করল, সঙ্গে সঙ্গে তার হাত অন্ধকারে অবনীর পিঠের পিছনে এসে কিছু আঁকড়ে ধরল। কাঁধের কাছে অবনী হৈমন্তীর হাত অনুভব করতে পারল। হৈমন্তী তার সিটের ওপরটা ধরে আছে।
সুরেশ্বর বলল, এদিকে দুপুরে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। …ওদিকে কেমন দেখলেন?
বিকেলে বৃষ্টি হয়েছে, আবার হচ্ছে হয়তো।
এরকম বৃষ্টিবাদলা মাথায় করে টাউন ছুটলেন? কাজ হচ্ছে নাকি?
অবনী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না; পরে বলল, আমাদের হীরালালকে চিনতেন?
সুরেশ্বর একমুহূর্ত ভাবল, হীরালাল! …ও, হ্যাঁ–চিনতাম।
ছেলেটি মারা যাবে।
সুরেশ্বর মুখ ফিরিয়ে অবনীর দিকে তাকিয়ে থাকল।
অবনী খানিকটা সময় যেন জোর করে হীরালালের কথা ভুলে যাবার চেষ্টা করেছিল: সেই জোর কোনও সিদ্ধান্ত অথবা সাহসবলে নয়; যেহেতু চিন্তাটা তাকে পীড়ন ও অসুখী করছিল, ভীত ও উদভ্রান্ত করছিল–সেহেতু অবনী সাময়িক কিছু সাধারণ সান্ত্বনা আশ্রয় করে দূরে সরে আসার চেষ্টা করেছে। এখন পুনরায় সে বেদনা ও কাতরতা অনুভব করল।
কী হয়েছিল? হঠাৎ? সুরেশ্বর শান্তস্বরে শুধোল।
অ্যাকসিডেন্ট অবনী বলল। খুব সংক্ষেপে হীরালালের দুর্ঘটনার বিবরণ দিল, শেষে বলল, কী বলবেন একে? ভাগ্য? ঈশ্বরের বিধান?
অবনীর কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত এক তিক্ততা ছিল। এই তিক্ততা তার পূর্বেকার ভাবপ্রবণতা নয়, ভীতিও নয়। কিন্তু এই তিক্ততার মধ্যে যেন সুরেশ্বরের মতন মানুষের প্রতি কোনও উপহাস ও বিতৃষ্ণাও আছে।
সুরেশ্বর নীরব। অবনীর দিকে না তাকিয়ে সে বাইরে তাকিয়ে আছে। নির্জন নিস্তব্ধ মাঠ, ছোট ছোট ঝোপ, একটি-দুটি পলাশ কি তেঁতুল গাছ, জল জমেছে কোথাও, ঝিল্লিস্বর, ভেকরব, জলবিন্দু মেশানো দুর্বল জ্যোৎস্না। তাকিয়ে থাকতে থাকতে সুরেশ্বর মৃদু গলায় বলল, আপনাকে একটা কথা বলি, সাধক-মানুষেই বলেছেন। বলেছেন: যাকে আমরা হারাই, সে আমাদের অন্দরমহলে কোথাও শুয়ে ঘুমিয়ে আছে–এরকম ভেবে নেওয়াই ভাল। তাকে ডাকাডাকি করে জাগাবার চেষ্টা অনর্থক। কান্নাকাটি আমরা করি, কিন্তু তাতে সে জাগে না। চেঁচামেচি করলে কিছু পাওয়া যায় না, শুধু প্রমাণ হয়, প্রকৃতির অলঙ্ঘ্য নিয়মের কথা আমরা কিছু জানি না, জেনেও বুঝি না।
অবনী বিন্দুমাত্র আকর্ষণ বোধ করল না কথাটায়। মামুলি কথা। সান্ত্বনা পাবার চেষ্টা। কিন্তু সুরেশ্বরের বলার ভঙ্গি ও কণ্ঠস্বর থেকে সে অনুভব করল, লোকটা বিচলিত হয়ে থাকলেও নিজেকে বেশ সংযত রেখেছে। সুরেশ্বরকে ঠিক এই মুহূর্তে অবনীর ঘৃণা হচ্ছিল। এরা শুধু ঘায়ের ওপর ব্যান্ডেজ বেঁধে ঘা আড়াল করে রাখে, রোগীকে দেখতে দিতে চায় না। অবনী বিরক্ত হয়ে উপহাসের গলায় বলল,–হ্যাঁ–সবই প্রকৃতির অলঙ্ঘ্য নিয়ম৷ বলে হঠাৎ গাড়িটাকে জমা জলের বিশ্রী ডোবা থেকে বাঁচাতে ডান দিকে কাটিয়ে নিল। হেলে পড়তে পড়তে গাড়িটা মাঠে উঠে গেল। হৈমন্তী দুলে উঠে অবনীর কাঁধের কাছটা ধরে ফেলেছে। মাঠ থেকে আবার পথে নেমে অবনী বলল, গাড়িটা ডোবায় পড়লে আমরা উলটে যেতে পারতাম। হয়তো হীরালালের মতন আমাদের কেউ জখম হত, হাসপাতালে মরত। প্রকৃতির সেই অলঙ্ঘ্য নিয়মটা আপনি কীভাবে নিতেন?
সুরেশ্বরের কপালে সামান্য লেগেছিল। হাত বুলিয়ে নিল। বলল, জানি না। এখন তা বলতে পারব না। শান্ত সরল গলায় সে বলল, যেন অবনীর সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে তর্ক করার ইচ্ছে তার নেই। শেষে কী ভেবে, অনেকটা যেন স্বগতোক্তির মতন, অনেকটা যেন কবিতা আবৃত্তি করার মতন বলল, আকাশ ও পৃথিবী মানুষের শবাধার। সূর্য, চন্দ্র তার শবশয্যার সাজ, নক্ষত্রগুলি আমার গায়ে ছড়িয়ে দেওয়া ফুল। সমস্ত জীব আমার শবযাত্রার সঙ্গী। মৃত্যুর কাছে সকলেই আমাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে।
অবনী কেমন অন্যমনস্ক হল। শুনতে ভাল লাগল বলে, না-কি রুক্ষ ও নির্মম কিছু হঠাৎ আজ অন্য কোনও রূপে দেখা দিল বলে। কাব্য নাকি? অবনী শুধোল।
না কাব্য নয়, তবে কাব্যও হতে পারত। আপনি ভাববেন না কথাটা আমার। প্রাচীন এক চীনা দার্শনিক এই রকম বলেছিলেন। সুরেশ্বর আস্তে আস্তে জবাব দিল। অল্প থেমে আবার বলল, সংসারের সমস্ত জিনিস নিয়েই বাহুল্য করা যায়। জন্ম নিয়ে মৃত্যু নিয়ে, ভালবাসা নিয়ে, শঠতা নিয়ে সমস্ত নিয়েই। বাহুল্য যদি করতেই হয় তবে নিকৃষ্ট বাহুল্য করা কেন? নাটকটা খারাপ লিখে লাভ কী!
অবনী কোনও জবাব দিতে পারল না। হয়তো সে তখনও সবটা ভাল বুঝতে পারেনি।
ততক্ষণে সুরেশ্বরের আশ্রমে চলে এসেছে ওরা। সুরেশ্বর আশ্রমের আলো দেখিয়ে বলল, ওটাই আমার আস্তানা। আপনি তো আগে কখনও আসেননি। আজও বড় অসময়ে আপনাকে টেনে আনলাম।
অবনী হেসে বলল, কী নাম আপনার আশ্রমের? …অন্ধজনে দেহ আলো?
গাড়িটা আশ্রমের মধ্যে ঘুরিয়ে ব্রেক করার পর অবনী আবার কাঁধের ওপর হৈমন্তীর হাতের স্পর্শ পেল। যেন অন্ধকারে হৈমন্তী তার কাঁধে ভর না দিয়ে উঠতে পারছে না।
.
০২.
সকালে ঘুম ভাঙার আগে অবনী হীরালালকে স্বপ্ন দেখছিল। ঘুম ভেঙে গেলে সে কয়েক মুহূর্ত হীরালালকে খুঁজল, যেন ভিড়ের মধ্যে হীরালাল কোথাও অদৃশ্য হয়েছে এখুনি ফিরে আসবে। হীরালাল এল না; অপেক্ষা অন্তে হতাশ হয়ে ফেরার মতন আস্তে আস্তে চোখ খুলল অবনী। সকাল হয়েছে, সে বিছানায়, মশারির আড়াল থেকেও বোঝা যায় বাইরে মেঘলা হয়ে আছে, ঘরের মধ্যে আলোর মালিন্য, মাথার ওপর পাখা ঘুরছে শব্দ করে।
বিছানা ছেড়ে উঠতে অবনীর আগ্রহ হল না। শুয়ে শুয়েই হাই তুলল। কেমন অবসাদে ভরে আছে সব। মাঝে মাঝে এক ধরনের অদ্ভুত অবসাদ বোধ করে অবনী। এই অবসন্নতা মদ্যপানজনিত নয়, ক্লান্তিবশতও নয়। কী যেন তার শরীর ও মনকে এমন এক অবস্থার মধ্যে টেনে আনে যখন প্রতিটি বিষয়ে সে অনাসক্তি বোধ করে। তার ইন্দ্রিয়গুলি কোনও কিছুতেই উৎসাহ অনুভব করে না। এই অবস্থায় অবনী নির্বিশেষে এমন এক অবহেলা, বিরক্তি আর উপেক্ষার মধ্যে ডুবে থাকে যে তাকে জড়বৎ মনে হয়।
আজ অবনী অন্য এক ধরনের গভীর অবসাদ বোধ করছিল। অবহেলা, উপেক্ষা বা বিরক্তির সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। বরং উদাসীনতার সঙ্গে রয়েছে। যেন গতকাল কোনও শব বহন করে সৎকার শেষে সে অতীব ক্লান্ত হয়েছিল, এবং দুঃখভারের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, আজ এখন ঘুম ভেঙে জেগে উঠে কেমন এক শূন্যতা অনুভব করছে।
আরও কিছুক্ষণ অবনী চুপচাপ শুয়ে থাকল। হীরালালের কথা ভাবল। হীরালালের কথা ভাবতে গিয়ে কাল সন্ধ্যা ও রাত্রের কথাও তার মনে পড়ল। নিসর্গ চিত্রের বিবিধ দৃশ্যগুলির মতন তার চোখে মাখারিয়ার জঙ্গল, অস্ফুট জ্যোৎস্না, সুরেশ্বর, হৈমন্তী ঝাপসা হয়ে আসছিল। শেষে অবনী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখের সামনে মশারি সরিয়ে উঠে পড়ল।
বাইরে মেঘলা খুব গাঢ় নয়, জলের মতন হালকা রঙের। জানলার কাচের শার্সিগুলো পুরোপুরি খোলা নয়, শার্সিতে জলবিন্দু, বাইরে বৃষ্টির আঁশ ঝরছে, দূরে স্টেশনে ইঞ্জিনের হুইসল বাজল, বাদলার কাক ডাকছে কোথাও, বাইরে চাকর বাকরের গলা শোনা গেল।
অবনী খাটের তলা থেকে চটিটা খুঁজে পায়ে গলিয়ে নিল। বাথরুমে যাবার আগে ঘরের দরজা খুলে চাকরকে হাঁক দিয়ে চা আনতে বলল।
সামান্য পরেই ফিরল অবনী। ততক্ষণে মহিন্দর মশারি তুলে বিছানা পরিষ্কার করে দিয়েছে, ঘরের জানলার শার্সিগুলো একে একে খুলে দিচ্ছিল। অবনী অন্যমনস্কভাবেই দেখল, বাতাসে ময়দার গুঁড়োর মতন বৃষ্টির কণাগুলি এলোমেলো হয়ে উড়ছে।
চা নিয়ে এল নন্দ। জানলার কাছাকাছি টিপয়ে চা নামিয়ে রাখল, রেখে চলে যাচ্ছিল, অবনী পাখাটা বন্ধ করে দিয়ে যেতে বলল।
অন্যদিন এতক্ষণে সকালের নিত্যকর্মের অনেক কিছুই সারা হয়ে যায়, অবনী এ-সময় অফিস যাবার জন্যেও মোটামুটি তৈরি হতে পারে। আজ কোনও কিছুতেই আগ্রহ হচ্ছিল না। পট থেকে চা ঢেলে নিল অবনী, যৎসামান্য চিনি মেশাল। বাইরে সেই একই ধরনের বৃষ্টি।
এ বছরে এদিকে বৃষ্টি বেশিই হচ্ছে। গত বছর এতটা হয়নি। তবু এখন বর্ষার শেষ; মাঝ বর্ষায় অবনী রীতিমতো বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। গত তিন মাস কাজকর্ম প্রায় কিছুই হয়নি। হবার উপায় ছিল না। প্রায় প্রত্যহ মুষলধারায় বৃষ্টি। শুরু হলে থামতে চায় না; একঘেয়ে ক্লান্তিকর কী বিশ্রী বৃষ্টি! মাঠ-ঘাট জলে জলময়, নদী-নালায় বান ডাকত, জঙ্গলে কাজ করা অসম্ভব ছিল। তার ওপর কুলিমজুরের অভাব; রাস্তা বন্ধ, মালপত্রও পাঠানো যেত না। লোকালয় ছেড়ে কোনও জঙ্গলে তাঁর পড়েছে। কুলিমজুরের, হঠাৎ দেখো ঝড়ে-জলে তাঁবু উড়ে গেল, চাল-ডাল ভেসে গেল জলে, মালপত্র তছনছ হল। ব্যাস, কাজ বন্ধ করে বসে থাক। অসুখ-বিসুখ, সাপ-বিছে, ভালুক-টালুক তো আছেই। এত রকম বাধাবিঘ্নের জন্যে এ সময় কাজ চলে মন্থর গতিতে। এবার আরও মন্থর। এই এলাকাটা পাহাড়ে জঙ্গলে নদীনালায় ভরা, এর মধ্য দিয়ে পথ পরিষ্কার করে খুঁটি পুঁতে পুঁতে ওভারহেড ইলেকট্রিক লাইন টেনে নিয়ে যাওয়া সময় সাপেক্ষ।
মাত্র দুবছর হল অবনী এখানে এসেছে। প্রথমে সমস্ত ব্যাপারটাই তার কাছে অদ্ভুত মনে হয়েছিল। সাবেকি কিছু কোদাল গাঁইতি শাবল কুড়ুল দড়িদড়া আর দেহাতি কিছু কুলিমজুর-জোয়ান গোছের দুচারজন পাঞ্জাবি, খাকি হাফপ্যান্ট পরা এক সুপারভাইজারবাবু। সবাই মিলে যা করছে তাকে। অসাধ্যসাধন বললেও অন্যায় হয় না। হীরালালের কাঁধে রাজ্যের বোঝা। তবু আশ্চর্য, ওই সাবেকি সম্পদ নিয়েও দেখতে দেখতে কাজ অনেকটা এগিয়ে গেল।
অবনী নিজে ঠিক এ কাজের মানুষ নয়। তার আগের অভিজ্ঞতার বেশিটাই ছিল কাগজপত্রে। বিদেশি এক ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের যন্ত্রপাতি বসানোর কাজে ডিজাইন করত। সাত ঘাটে জল খেত না। ওই কাজে বছর আষ্টেক কাটিয়ে হঠাৎ সব ছেড়েছুঁড়ে চলে এল এখানে। আসার পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ ছিল অনেক। মোটামুটি কারণটা এই যে, তার আর ভাল লাগত না, নিজের বৃত্তি বা পেশায় সে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল, ওপরঅলাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি, সহকর্মীদের সঙ্গে মনোমালিন্য দিনে দিনে বাড়ছিল। অসন্তোষ আর তিক্ততা, গ্লানি আর ক্ষোভ বাড়তে বাড়তে ক্রমেই একটা অসহ্য অবস্থা হল।
বাড়িতেও মানসিক তৃপ্তি বা আরাম বলে কিছু ছিল না। ললিতার সঙ্গে তার সম্পর্ক চরমে উঠেছিল। বাহ্যত তারা স্বামী-স্ত্রী হলেও ভেতরে পরস্পরের সঙ্গে তাদের সম্বন্ধ হয়েছিল বিরক্তির এবং ক্লান্তির। ঘৃণার। দাম্পত্য সম্পর্ককে মনে হত পায়ের কাছে ছড়ানো কাচের ভাঙা বাসনের মতন, টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে আছে, ধারালো কানা চকচক করছে, পা রাখলেই ক্ষত-বিক্ষত না হয়ে উপায় নেই। এই তিক্ততা সন্তানের মধ্যেও সংক্রামিত হয়ে উঠছিল। অবনীর পক্ষে সেটা কাম্য ছিল না। ললিতা আইন-আদালতের শরণাপন্ন হবার পক্ষপাতী, অবনীও অনিচ্ছুক নয়। সৌভাগ্যক্রমে একটা ভদ্রলোকের চুক্তি-মতন বোঝাপড়া হয়ে যাওয়ায় আপাতত তারা বিচ্ছিন্ন হতে পারল। স্ত্রীকে মুক্তি দিয়ে অবনী দূরে সরে এল। ললিতা মেয়েকে রেখে দিল। ভরণপোষণের টাকাটা সে কোনওভাবেই হাতছাড়া করতে চায় না।
চায়ের পেয়ালা শেষ হয়েছিল। অবনী সিগারেট ধরাল। তারপর আরও এক পেয়ালা চা ঢেলে নিল।
এখানের চাকরিটা পেতে তার সময় লাগেনি। যেহেতু সে বাইরে পালাতে চায়, কিছু একটা হলেই হবে–এই মনে অবনী চাকরি খুঁজছিল, কিছু খুঁটিয়ে না দেখেই এখানে দরখাস্ত করেছিল। কয়েক দিনের মধ্যেই জবাব এল। অবনী দ্বিধা করল না। চলে এল। চাকরিটা আধা-সরকারি বললেও বলা যায়। দায়দায়িত্ব তেমন কিছু নেই। হাতে কলমে কাজও নয়। শুধুমাত্র তদারকির আর চিঠিপত্র লেখালেখির। নির্ঝঞ্ঝাট কাজ। ওপরঅলা বলতে মাথার ওপর যিনি আছেন তাঁর অফিস অন্যত্র, বছরে দু-চারবার মুখোমুখি দেখা হয়। একেবারে অপদার্থ, তবে মানুষটি ভাল। অবনীর এই কাজে একটা মাত্র অসুবিধে এই যে, প্রায়ই তাকে কাজকর্ম দেখতে যত্রতত্র যেতে হয়। কিছুটা ছোটাছুটি রয়েছে। তা থাক। সুবিধের তুলনায় অসুবিধে প্রায় কিছুই নয়। থাকার বাড়ি পেয়েছে, অ্যালাউন্স আছে। মাইনে অবশ্য খুব কিছু না। অবনীর তাতে ক্ষোভ নেই।
দ্বিতীয় কাপ চা শেষ করে অবনী উঠল। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘলা কখনও খুব ফিকে, কখনও আবার গাঢ় হয়ে আসছে। বাতাস রয়েছে বেশ, মনে হচ্ছে, বেলায় কিংবা দুপুর নাগাদ মেঘলা। কেটে যাবে।
সামান্য বেলায় অবনী যখন অফিস যাবার জন্যে তৈরি হয়ে বাড়ির বারান্দায় বেরিয়ে এল তখন তাকে খানিকটা ঝরঝরে দেখাচ্ছিল। সদ্য দাড়ি কামানো মুখ, মাথার চুল সামান্য ভিজে, গায়ে হালকা রঙের বুশ কোট, পাটভাঙা ট্রাউজার পরনে, হাতে ওয়াটারপ্রুফ। বৃষ্টি পড়ছিল না, পথ ভিজে, গাছের পাতায় জল জমে আছে; বাগানের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় অবনী দেখল, কদমতলায় দাঁড়িয়ে মহিন্দর ডিম কিনছে। কাঠের ফটক খুলে অবনী রাস্তায় উঠল।
অবনীকে দেখলে তার বয়স সঠিক অনুমান করা মুশকিল। মনে হয় বছর পঁয়তাল্লিশ। কিন্তু তার বয়স চল্লিশের কিছু বেশি। মাথায় বেশ দীর্ঘ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি লম্বা ছাঁদের, মুখ লম্বা এবং শক্ত, কপাল উঁচু, নাক দীর্ঘ, চোখ গভীর করে বসানো। গলাও সামান্য লম্বা। বয়সের মেদবাহুল্য নেই শরীরে, যেটুকু আছে তা না থাকলেও তাকে বেমানান দেখাত না। মনে হয়, অবনী বরাবরই ছিপছিপে গড়নের ছিল, শক্ত ছিল। পিঠের কাছটায় ঈষৎ নুয়ে থাকে, কাঁধ তেমন ভরাট নয় বলেই হয়তো অমন দেখায়। অবনীর মাথার চুল পাতলা, কোঁকড়ানো, ধূসর রঙের। গায়ের রং ময়লা।
প্রথম দর্শনে অবনীকে রূঢ় ও গম্ভীর প্রকৃতির বলে মনে হয়। সম্ভবত তার চোখের দৃষ্টির জন্যে। তার চোখে অস্বাভাবিক কিছু আছে, বোঝা যায় না, তবু মনে হয়, অবহেলা এবং উপেক্ষার চোখে সব কিছু দেখাই যেন তার অভ্যেস। নম্রতা বা সৌজন্য, কৌতূহল বা উৎসাহ সহসা তার দৃষ্টিতে দেখা যায় না। অথচ অবনীর সঙ্গে মেলামেশা করতে পারলে বোঝা যায়, তার হালকা কালো রঙের চোখের মণি এবং ঈষৎ হলুদ রঙের চোখের জমিতে জমিতে কেমন এক মমতা মাখানো আছে। এমনকী কোনও কোনও সময় এই চোখ এবং তার উজ্জ্বল দৃষ্টি অবনীর সুতীব্র কোনও আবেগকেও প্রকাশ করে। সে যে কখনও কখনও অসহায় বালকের মতন বিক্ষুব্ধ, কাতর হতে পারে–আবার মন হালকা থাকলে গলা ছেড়ে হাসতে পারে, অনর্গল কথা বলে, তাস খেলতে পারে–এ অনেকের জানা নেই। যাদের আছে তারা মনে করে অবনী মজাদার মানুষ, চমৎকার লোক। যারা জানে না তারা অবনীকে ভদ্রজন বলে মনে করে না, ভাবে লোকটা অহংকারী, অসভ্য, ইতর শ্রেণীর। এই দুবছরে এখানে সুনাম দুর্নাম দুইই কিছু হয়েছে তার। সুনাম করেছে তারা যারা কমবেশি অবনীর অন্তরঙ্গ হতে পেরেছে, দুর্নাম করেছে তারা যারা ওর ঘনিষ্ঠ হতে পারেনি। সুনাম অথবা দুর্নামের প্রতি এখন পর্যন্ত তেমন কোনও মোহ জন্মায়নি অবনীর।
.
অফিসের কাছাকাছি পৌঁছে বিজলীবাবুর সঙ্গে দেখা অবনীর। সাইকেলে চেপে বিজলীবাবু কোথাও যাচ্ছিলেন, নেমে পড়লেন। এখানকার বাস-সার্ভিসের ম্যানেজার। প্রায় প্রৌঢ়, তবু শখ শৌখিনতা ছাড়েননি। কাঁচাপাকা চুলে অ্যালবার্ট টেরি কাটেন, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা; মালকোঁচা মারা ধুতির সঙ্গে সাদা শার্ট, শার্টের দুদিকে বুক পকেট। বেঁটেখাটো গোলগাল মানুষ, ধবধব করছে গায়ের রং। গোটা তিনেক আংটি আঙুলে। পান খান প্রচুর। গৃহে যুগল স্ত্রী, বাইরেও নারীসঙ্গ করে থাকেন বলে লোকের বিশ্বাস। বিজলীবাবুর ধারণা, পুরুষমানুষকে স্বাস্থ্য টিকিয়ে রাখতে হয়, তার জন্য শুধু কর্মঠ হলেই যথেষ্ট নয়, পানভোজন ও আনুষঙ্গিকের প্রয়োজন আছে। যেটুকু পাও হাত বাড়িয়ে, ভোগ করে নাও-রেখ না লেশ, নইলে পরে হায় তুমিও করবে কখন ধুলোয় প্রবেশ। ভদ্রলোক ওমর খৈয়মের বাংলা অনুবাদ প্রাণভরে মুখস্থ করেছেন, সুযোগ মতন তার থেকে দুচার লাইন আওড়ে জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণাটা অকপটে বুঝিয়ে দেন। অবনীর সঙ্গে বিজলীবাবুর এক ধরনের বন্ধুত্ব আছে। বিজলীবাবু তাঁর বাসের ড্রাইভারকে দিয়ে মাঝে মাঝেই কখনও শহর কখনও অন্য কোনও বড় জায়গা থেকে অবনীর মদ্যাদি আনিয়ে দেন, অবনীর নিমন্ত্রণ রক্ষা করেন, পালটা আপ্যায়নেও ইতস্তত করেন না।
বিজলীবাবু সাইকেল থেকে নেমে বললেন, মিত্তিরসাহেবকে দেখলাম কাল রাত নটা নাগাদ ফিরছেন…কোথায় যাওয়া হয়েছিল? টাউনে?
হাসপাতালে।
ও! হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ; সেই ছোকরা…। কেমন আছে?
ভাল না, খুবই খারাপ।
আশা নেই?
কোথায় আর!
বিজলীবাবু দুপলক অবনীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কোনও কিছু মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করার সময় তাঁর নাক সামান্য কুঁচকে ওঠে, মনে হয় তিনি শুধু চোখ দিয়ে দেখছেন না–গন্ধটাও শুঁকে নিচ্ছেন। ইতর প্রাণীদের মতন বিজলীবাবু ঘ্রাণক্ষমতায় যেন অনেক কিছু বোঝান। সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝোলানো ছাতার বাঁটে হাত বুলিয়ে নিলেন অকারণে। তারপর কপাল দেখাবার ভঙ্গি করে বললেন, নিয়তি। …বলেছে না, নিয়তি কেন বাধ্যতে…। ওখানে মিত্তিরসাহেব, মানুষ ঠুটো, জারিজুরি চলে না।
অবনী কোনও কথা বলল না। অন্য দিকে তাকিয়ে থাকল।
এই দুনিয়ার এটাই খেলা– বিজলীবাবু এবার হাসবার চেষ্টা করলেন, মাথার ওপর এক শালা পেয়াদা বসে আছে, ঠিক সময় শমন ধরিয়ে দিয়ে কাছারিতে টেনে নিয়ে যাবে। তাই তো বলি, যে কদিন আছ বাপু, খেয়েদেয়ে ফুর্তি-আরাম করে কাটিয়ে দাও। চার্বাক ঋষিটিষি বলেছেন, যাবৎ জীবেৎ সুখ জীবেৎ… খাঁটি কথা।
অবনীর হঠাৎ এ সময় সুরেশ্বরের কথা মনে পড়ল। কী যেন বলেছিল কাল সুরেশ্বর…? পৃথিবী এবং আকাশ আমার শবাধার…চন্দ্র সূর্য তারা…
বিজলীবাবু ততক্ষণে পকেট থেকে সিগারেট বের করে এগিয়ে দিয়েছেন। আসুন–একটা কড়া খান।
অবনী অন্যমনস্কভাবেই সিগারেট নিল। বিজলীবাবু তাঁর সিগারেট কে-এ মিক্সচারঅলা সিগারেট পাকিয়ে রাখেন, বন্ধুবান্ধবকে দিতে হয় বলে পাকানোর সময় উচ্ছিষ্ট করেন না।
দুজনেই সিগারেট ধরাল। অবনী বলল, আপনার বাস যে মশাই প্রায়ই দেখি রাস্তায় খারাপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কাল ফেরবার পথে এক ঝামেলা। সুরেশ্বর একটি মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছিল, পথে আটকা পড়েছে। তাদের আবার পৌঁছে দিলাম।
আজ সকালে শুনলাম। বাসের আর কী দোষ বলুন, ভাগে মা-মালিক থেকে শুরু করে ক্লিনারসব বেটাই কিছু কিছু করে ভাগ মারছে, আমিও মারিভাগে মা গঙ্গা পাবে কোথায়! এই লং ট্রিপ, প্রপার মেনটেনান্স করতে হলে খরচটা কেমন লাগে ভাবুন। জোড়াতালি মেরে চালানো। ওই রকমই হবে। আমার আর কী! …তা কাল আমাদের মহারাজজিকে আপনি পার করলেন! বিজলীবাবুর চোখে কেমন কৌতূহল ও হাসি ফুটল।
অবনী বলল, জায়গাটার কী নাম যেন?
গুরুডিয়া।
রাত্তিরে ঠিক বুঝলাম না, তবে অনেকগুলো ঘরটর করেছে দেখালাম।
দিব্যি করেছে। আপনার বুঝি ওদিকে আগে যাওয়া হয়নি। দিন-দিন যাবেন একদিন, দেখবেন। সুরেশ-মহারাজ, বুঝলেন মিত্তিরসাহেব, বেশ কাজের লোক। তিন-চার বছর লেগে পড়ে এখন মোটামুটি দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন।
ভদ্রলোককে আপনি সুরেশ-মহারাজ, মহারাজজি–এসব বলেন কেন? অবনী একটু হেসে বলল। বলার মধ্যে তেমন কোনও কৌতূহল ছিল না, থাকার কথা নয়; বিজলীবাবু বরাবরই ওই ভাবে কথা বলেন, এবং আগেও দু-চার বার অবনী তাঁকে পরিহাস করে জিজ্ঞেস করেছে কথাটা।
আগে যেমন, এবারও বিজলীবাবু হেসে হেসে জবাব দিলেন, বলব না! গেরুয়া না পরলেও সুরেশ-মহারাজ যে সন্নেসী মানুষ। ভেক যোগী নয়, কর্মযোগী… গীতাটি পড়েছেন নাকি আপনি মিত্তিরসাহেব? আমি পড়িনি, বাড়িতে একটা আছে, হিন্দুর ছেলে, মরার সময় মাথার পাশে রাখতে হবে তো! বিজলীবাবু আপন রসিকতায় মজে গিয়ে হাসলেন। হাসি থামলে হঠাৎ বললেন, সুরেশ-মহারাজ কাল এসেছিলেন, আমার বাস-অফিসে পা দিয়েছিলেন দুদণ্ড। বললেন, কাকে যেন নামাতে এসেছেন। দেখলাম তো, বেশ ডাগর একটি মেয়ে নিয়ে বাসে চাপলেন, মালপত্র সমেত। …তা শুনলেন কিছু? মেয়েটি কে?
চোখের ডাক্তার।
মেয়েরাও চোখের ডাক্তার হয়?
হবে না কেন?
তা ঠিক। পুরুষের চোখ মেয়েরা ভালই বোঝে…মেয়েদের চোখও মেয়েরা আন্দাজ করে ভাল। বাড়িতে তো দেখছি… তা যিনি এলেন তিনি কি সধবা না কুমারী?
জানি না।
সুরেশ-মহারাজের কেউ হয় না কি?
চেনাশোনা।
নিজের কেউ নয়?
বুঝলাম না।
চুপচাপ। দুজনেই বোধ হয় মনে মনে মেয়েটিকে দেখছিল। অবনী হঠাৎ যাবার তাড়া অনুভব করল। বলল, চলি…।
বিজলীবাবুও যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দেখেছেন কাণ্ড, আপনাকে লেট করিয়ে দিলাম। আচ্ছা, মিত্তিরসাহেব, চলি। আমি একবার গোপীমোহনের কাছে যাব। …বিকেলে দেখা-সাক্ষাৎ হবে।
বিজলীবাবুর সাইকেল সামনে থেকে সরে যেতেই অবনী অফিসের দিকে পা বাড়াল।
অল্প এগিয়েই অবনীর অফিস। দেখলে অফিস বলে মনে হয় না, কোনও বন্ধ-হয়ে-যাওয়া ছোটখাটো কারখানা যেমন দেখায় অনেকটা তেমনি চেহারা। কাঁটাগাছের কিছু কিছু বেড়া, তার গা-ঘেঁষে জালি-তার দিয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে ফেন্সিং; প্রায় মাঝ-মধ্যে ইটরঙের ঘন লাল এক ছোটখাটো বাড়ি, মাথায় টালির ছাউনি। ফাঁকা জায়গাটায় নানান জিনিস ছড়িয়ে আছে–লোহার খুঁটি, শালের খুঁটি, হরেক রকম তার, কে-এর চাকা, ভাঙা বাক্স, চিনেমাটির ইনসুলেটার, দু-একটা ভাঙাচোরা ট্রাক, মায় একটা ক্রেনও। আর কত বিচিত্র বস্তু। ওরই মধ্যে কোথাও কয়েকটা করবী গাছ, কলাফুলের ঝোপ। মস্ত একটা হরীতকী গাছ একপাশে তার গায়েই ইঁদারা। বাড়িটা যে ভাড়া নেওয়া বুঝতে কষ্ট হয় না।
অবনী কোনওদিকে না তাকিয়ে সোজা অফিসে চলে গেল। এখন এখানে কুলিমজুর বা ভিড় থাকার কারণ নেই। অফিসের চাকরবাকর, কেরানি আছে কয়েকজন। মোটামুটি জায়গাটা শান্ত। বর্ষার জলে কাদা হয়েছে যেমন, ঘাসও হয়েছে প্রচুর। সবই ভিজে ভিজে দেখাচ্ছিল।
নিজের ঘরে গিয়ে অবনী চেয়ারে বসল। বেয়ারা টেবিল চেয়ার মুছে পরিষ্কার করে রেখেছে, জানলাও খোলা। সামনের দেওয়ালেই নানান রকম ব্লু-প্রিন্ট ঝোলানো, একটা ক্যালেন্ডারও ঝুলছে, বড় বড় তারিখ।
অবনী চেয়ারে বসে হাত বাড়িয়ে ঘন্টি টিপল। বেয়ারা এল। সকালে আসা ডাকের চিঠিগুলো কেরানিকে দিয়ে দিতে বলল। চিঠিপত্র তার দেখতে ইচ্ছে করছে না।
উন্মনা হয়ে বসে থাকল অবনী। জানলা দিয়ে কখনও আকাশ দেখল, কখনও জামগাছ। মুখ ফেরালেই দেওয়ালে টাঙানো নকশাগুলো চোখে পড়ছিল। বিজলীবাবুর সঙ্গে দেখা হবার পর কেন যেন তার সুরেশ্বরদের কথাই মনে পড়ছে। হয়তো হৈমন্তীর জন্যে। বিজলীবাবুর মতন তারও অসীম কৌতূহল মেয়েটি সম্পর্কে। ও কে, কেন এখানে এল? সুরেশ্বরের সঙ্গে কী সম্পর্ক হৈমন্তীর?
সুরেশ্বরের আশ্রম থেকে আসার সময় সুরেশ্বর বলেছিল, আজ সকালে তার শহরে দরকার আছে, বৃষ্টি বাদলা না হলে যাবে, শহরে গেলে হীরালালের খোঁজ নেবে। সুরেশ্বর কি শহরে গিয়েছে? না কি, কাল অবনী পথের বিপন্ন মানুষকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে বলে ওটা সুরেশ্বরের ভদ্রতা, স্তোক দিয়েছে।
মানুষটাকে আর যাই হোক, ঠিক বাজে, ধাপ্পা-মারা তোক বলে অবনী মনে করতে পারে না। আজকের দিনে কী করে একজন প্রাপ্তবয়স্ক, শিক্ষিত, জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন পুরুষমানুষ আশ্রম খুলে বসতে পারে অবনীর তা মাথায় না ঢুকলেও লোকটাকে এসব ব্যাপারে একেবারে অবিশ্বাস করা যায় না। হয়তো সুরেশ্বর সত্যিই শহরে গেছে।
কাল ওই অবস্থার মধ্যেও অবনী কিন্তু বেশ অবাক হয়েছে। কোথাকার কোন গুরুডিয়া–যেখানে যাওয়া-আসার ভাল পথ নেই, চারদিক জঙ্গল আর পাহাড়ি গাঁ গ্রাম সেখানে সুরেশ্বর আজ তিন-চার বছর ধরে আস্তে আস্তে সত্যিই একটা অন্ধ আশ্রম করে ফেলল। সুরেশ্বরদের নামিয়ে দিয়ে ফেরার সময় কতটুকু আর ঠাওর করা যায়–তবু ওরই মধ্যে ম্লান জ্যোৎস্নায় যেটুকু দেখেছে অবনী তাতে অবাক হয়েছে। মানুষটা কাজের, অন্তত একথা বলা যাবে না, সুরেশ্বর ধুনি জ্বেলে সেখানে বাবাজি হয়ে বসে আছে।
এই সুরেশ্বর, বছরখানেক আগে একবার অবনীর কাছে কিছু সাহায্যের জন্যে অনুরোধ জানিয়েছিল। অবনী যতটুকু পারে, যা পারে। অবনী সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিল, বলেছিল–ক্ষমা করবেন; ওসব আমি দিই না। …হয়তো এভাবে প্রত্যাখ্যান না করেও অবনী কিছু দিতে পারত, যেমন অন্যান্য জায়গায় দিয়ে থাকে, ভদ্রতা করে বা দয়া করে। সুরেশ্বরের বেলায় অবনী ইচ্ছে করেই মুখের ওপর না বলেছিল। কারণ এই ধরনের মানুষকে সে আঘাত করতে চায়।
সুরেশ্বর কী ধরনের মানুষ?
আশ্রম-ফাশ্রমে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই, আমি ও-সব বিশ্বাস করি না। অন্ধদের জন্যে কিছু করতে হলে দরকার হাসপাতালের। দরকার ডাক্তার। আপনি কি ডাক্তার? হাসপাতাল খুলবেন জঙ্গলে?
আমার তো কোনও সম্বল নেই। চেষ্টা করছি। আস্তে আস্তে যতটা পারি।
সম্বল যখন নেই তখন করছেন কেন?
আপনাদের সাহায্য পাব এই আশায়।
তা হলে করুন। আমি কিন্তু আপনাকে নিরাশ করলুম।
তাতে কী!
আশ্চর্য, লোকটা অপমানিত হওয়া সত্ত্বেও রাগল না, কটু কথা বলল না, আগের মতনই সরল হাসিমুখ করে থাকল, অবনীর দেওয়া চা খেল, অন্য পাঁচটা গল্প করল। তারপর নমস্কার জানিয়ে চলে গেল। অথচ, অবনী প্রায় নিঃসন্দেহ এই অপমান সুরেশ্বরকে ভেতরে বিচলিত করেছিল। ওপরে সে তা প্রকাশ করেনি।
এর পরও কয়েকবার দেখা হয়েছে দুজনের, হঠাৎই। সুরেশ্বর প্রসন্ন মুখে কথা বলেছে, গল্প করেছে, তার আশ্রমে যাবার নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। অবনীই কেমন যেন সঙ্কুচিত হয়েছে সামান্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গায়ে মাখেনি।
আসলে সুরেশ্বরদের মতন মানুষের ওপর অবনীর পরম বিতৃষ্ণা ছিল। ব্যক্তিগতভাবে সুরেশ্বর যাই হোক, ওরা একটা গোষ্ঠী, সামাজিক দিক থেকে পরিকল্পিত সম্প্রদায়, সুরশ্বরকে তা থেকে আলাদা করা যায় না। জীবনের যাবতীয় রুক্ষ যন্ত্রণা থেকে এরা ভীরুর মতন পাশ কাটিয়ে পালিয়ে গেছে। ধর্মের নামে, সেবার নামে, মুক্তির নামে। এমন নয় পালিয়ে গিয়ে এরা পরিচ্ছন্ন হয়েছে। সংসারের সমস্ত রকমের স্বার্থ, ইতরতা, আকাঙ্ক্ষা, মোহকে পালন ও লালন করছে। তবে এই ভেক কেন? এই মিথ্যা কেন?
সাধারণ মানুষের মতন ওদের অন্নের জন্যে পরিশ্রম নেই, প্রাত্যহিক গ্লানি নেই; দায় নেই কোথাও, দায়িত্ব নেই: পিতামাতা স্ত্রী-পুত্র পরিজনের জন্যে চিন্তা নেই, উদ্বেগ নেই; যে-সব রূঢ় সমস্যা সাধারণ মানুষকে নোখ দিয়ে নিয়ত আঁচড়ায়, গলা টিপে ধরে, আয়ু নিঃশেষ করে নেয় তোমরা সেখান থেকে পালিয়ে গেছ। অথচ ওই বেচারিদের শ্রদ্ধার চাঁদায় তোমরা দিব্যি বেঁচে আছ, আশ্রম গড়ছ, মঠ বানাচ্ছ, মন্দির তুলছ–আর ভক্ত-শিষ্য পরিবৃত হয়ে ধর্মজ্ঞান বিতরণ করছ। অকর্মণ্য, আত্মপরায়ণ, ধাপ্পাবাজ সব।
অবনী প্রায় নিঃসন্দেহ ছিল, সুরেশ্বর কিছুই করবে না, করতে পারবে না। বড় জোর একটা আখড়া তৈরি করবে নিজের, কাউকে ধরে-পাকড়ে একটা মন্দিরও তুলবে হয়তো, তারপর শাঁখ ঘণ্টা কাঁসর বাজিয়ে, ভক্তসমাগম ঘটিয়ে ছোটখাটো মহাপুরুষ হয়ে অধিষ্ঠান করবে।
অথচ লোকটা ভদ্র, শিক্ষিত, বুদ্ধিমান। অবনী বুঝতেপারে না, কী করে তার প্রায় সমবয়সী একজন, আজকের দিনে এমন করে নিজেকে প্রবঞ্চনা করতে পারে এই জঙ্গল কি তার অন্ধ-আশ্রম খোলার জায়গা? যদি তোমার মহৎ উদ্দেশ্যই থেকে থাকে–কেন তুমি নিজে ভাল চোখের ডাক্তার হলে না? কেন শহরে-গঞ্জে লোকালয়ে চেম্বার খুলে বসলে না? কেন কোনও হাসপাতালের সঙ্গে থাকলে না?
তুমি ধর্মপ্রাণ, ঈশ্বর বিশ্বাসী। অবনীর তাতে কোনও আগ্রহ নেই। উৎসাহও নেই। বরং উপেক্ষা আছে। মানুষের যার যা পছন্দ তা বিশ্বাস করতে পারে, ভূত-প্রেত, পরজন্ম দীন-দয়াল অবতার কারুর কিছু বলার নেই। অবনী এসব গ্রাহ্য করে না। সে অন্য কিছু বিশ্বাস করে, বিজলীবাবুর আবার অন্য ধারণা।
কিন্তু, অবনী বুঝতে পারল না, সুরেশ্বর কী করে বাস্তবিকই গুরুডিয়ার জঙ্গলে অন্ধ আশ্রম গড়ে তুলতে পারল। কিছুনা হোক–হঠাৎ দেখলে অবাক হবার মতন খানিকটা নিশ্চয় করেছে। কেমন করে করল?
কেমন করেই বা হৈমন্তীর মতন একটি মেয়েকে সুরেশ্বর এখানে টেনে আনল? হৈমন্তীই বা কেন এল? সুরেশ্বর কি তাকে ভুলিয়ে এনেছে? ভাসিয়ে এনেছে? যেমন করে নিজে ভেসে এসেছে–তেমন করেই কী ভাসিয়ে এনেছে হৈমন্তীকে? নাকি সুরেশ্বরকে ভালবেসে এসেছে ও? ভা…ল…বা…সা…?
কী যে সম্পর্ক দুজনের কিছুই বোঝা যায় না। সুরেশ্বরকে রহস্যময় পুরুষ বলেই মনে হচ্ছিল অবনীর। তার আশ্রমে যুবতী সমাগমের পরিণতি কী হবে তাও বোঝা যাচ্ছিল না।
.
আরও খানিকটা বেলায় পোস্টঅফিসের ফোন মারফত অবনীর কাছে খবর এল, হীরালাল কাল রাত্রে মারা গেছে।
সুরেশ্বর শহর থেকে ফোন করেছিল।
.
০৩.
এক সময়ে জায়গাটার কোনও নামই ছিল না, গুরুডিয়া ছিল আরও একটু তফাতে। সুরেশ্বরের অন্ধ আশ্রম গড়ে ওঠার সময় গুরুডিয়া যেন পা বাড়িয়ে এইটুকুও চলে এল। তখন গুরুডিয়া বললে বোঝাত গ্রাম, এখন বোঝয় অন্ধ আশ্রম। তখন ঠিক এই অঞ্চলটায় কোনও লোকবসতি ছিল না, জঙ্গল আর মাঠ ছিল পড়ে; সারা শীত শালের জঙ্গলে কাঠ কাটতে আসত কাঠুরিয়া, কাঠ কাটার শব্দ আর বয়েল গাড়ির আসা-যাওয়াতে সকাল দুপুর সাড়া দিত। যুদ্ধের শেষাশেষি এদিককার বনজঙ্গল কিছু পরিষ্কার হয়, কাঁচা রাস্তাও খানিকটা হয়েছিল। সঠিক বিবরণ কেউ জানে না, তবে ব্যারাক হয়েছিল কিছু, কাঁটাতারের বেড়াও পড়েছিল। কেউ বলত গুর্খা সেপাইদের চাঁদমারি হয়েছিল, কেউ বলত কয়েদি মাঠ। সম্ভবত যুদ্ধের শেষাশেষি কিছু হবার উপক্রম হয়েছিল এখানে, যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় সব বন্ধ হয়ে গেল। যেটুকু হয়েছিল ফেলে দিয়ে চলে গেল ওরা। তারপর দীর্ঘদিন ব্যারাকের কাঁচা বাড়িগুলো পড়েই থেকেছে, দেহাতিরা ক্রমে ক্রমে ইট কাঠ খসিয়ে নিয়ে গেছে কিছু, বাকিটা ঝড়ে জলে রোদে বৃষ্টিতে মাটিতে মিশেছে।
দেখেশুনে সুরেশ্বর এই জায়গাটাই পছন্দ করেছিল। কারণ তার সামর্থ্য ছিল পরিমিত। নিজের কিছু সঙ্গতি আর অন্যের অনুগ্রহের ওপর যেখানে নির্ভর সেখানে এর বেশি কিছু প্রত্যাশা করা যায় না। নামমাত্র মূল্যে অনেকটা জমি পেল এখানে সুরেশ্বর, কাঁচা রাস্তা পেল, মোেটামুটি আশপাশ পরিষ্কার আর সামান্য দূরে একটা গ্রাম পেল। ভাঙাচোরা ব্যারাকের কিছু অবশেষ, তাও বা মন্দ কী!
ভেবে দেখতে গেলে সুরেশ্বর জায়গাটা মোটামুটি ভালই পছন্দ করেছিল। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ চমৎকার। ছোটনাগপুরের পার্বত্য এলাকার প্রকৃতি যেমনটি হতে পারে। অজস্র বনসম্পদ। শাল পলাশ মহুয়ার যেন শেষ নেই, অজস্র হরীতকী আর অর্জুন গাছ ঘোড়া নিম আর গরগল। উঁচুনিচু প্রান্তর; কোথাও সেই অনুর্বর ভূমি ঢেউয়ের ফণার মতন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, কোথাও আনত নম্র হয়ে গেছে। মাটি শক্ত, কাঁকর আর নুড়িভরা, বাতাসে আর্দ্রতা নেই, শুকনো, বনগন্ধে পূর্ণ। গুরুডিয়ার কাঁচা রাস্তাটুকু ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলেই সরকারি পাকা রাস্তা। এই রাস্তা ধরে তিনদিকে চলে যাওয়া যায়, দক্ষিণ আর মধ্য বিহারের অনেকখানি এই রাস্তার জালে জড়ানো। গুরুডিয়া থেকে রেল স্টেশনও এমন কিছু দুরে নয়, ব্যাপারীরা আসা-যাওয়া করে সবসময়।
সুরেশ্বর যা চেয়েছিল, নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ, আশেপাশে দেহাত, নাগালের মধ্যে পথঘাট, যোগাযোগের সুবিধে–এখানে মোটামুটি তা সবই পেয়েছিল।
আশ্রম তৈরি করার আগে সুরেশ্বর কোথায় ছিল সে কথা এখানের কেউ জানে না। ঘোরাঘুরি সে অনেক করেছে তা অবশ্য বোঝা যেত। আজ প্রায় চার বছর সুরেশ্বর এখানে। প্রথমে থাকত শহরের দিকে, তারপর এল স্টেশনের কাছে। শহরে তার নানা রকমের যোগাযোগ ছিল। ক্রিশ্চান মিশনারিদের সঙ্গে, সেবাসঙ্ঘের কর্মীদের মধ্যেও তার মেলামেশা ছিল।
স্টেশনের দিকে যখন চলে এল সুরেশ্বর তখন থেকেই সে যেন কিছু খুঁজছিল। প্রথম প্রথম বোঝ যেত না সুরেশ্বর কী খুঁজছে। মনে হত, অধিকাংশ বাঙালিই এদিকে এলে যেমন করে–ঘরবাড়ি জমি বাগানসুরেশ্বরও তাই করবে, বরাবরের মতন থেকে যাবে। ক্রমে ক্রমে বোঝা গেল, সুরেশ্বর জমি জায়গা খুঁজছে অন্য উদ্দেশ্যে। অন্ধ আতুর জনের জন্যে কিছু করবে। কী করবে? হাসপাতাল না আশ্রম?
মনে মনে যা ভাবত সুরেশ্বর অন্যের কাছে তা প্রকাশ করত না। সামান্য যা করত তা থেকে স্পষ্ট কিছু বোঝা যেত না। অন্ধদের জন্যে তার এত বিচলিত হবার কারণ কী, সে যে কী করতে চাইছে তা কখনও বিস্তারিত করে বলেনি। প্রথমটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার; দ্বিতীয়টা সম্পর্কে তার ধারণা, যা সে করেনি, যা শুধুমাত্র তার ইচ্ছা তা বিস্তারিত করে বললে নিজের কল্পনাশক্তির পরিচয় দেওয়া হয়, তার বেশি আর কিছু নয়। সুরেশ্বর অলস স্বপ্ন দেখতে এবং তার বিবরণ শুনিয়ে কাউকে চমৎকৃত করতে পছন্দ করত না।
প্রথমাবধিই তার সংশয় ছিল। নানা রকমের দ্বিধাও ছিল। অনেক দিন পর্যন্ত অনিশ্চিত বোধ করেছে। নিজের কর্মের সাফল্য সম্পর্কে এই সংশয়বোধ তাকে চিন্তিত করলেও হতাশ করতে পারত না।
নিজের সঙ্গতি ও সামর্থ্য মতন সুরেশ্বর তার অন্ধ আশ্রমের ভিত পাতল। অন্ধ আশ্রম নামটা সে দেয়নি; এটা লোকমুখে রচিত হয়েছে। দেহাতের মানুষ এখনও বলে, দাবাইখানা।
গুরুডিয়ায় এসে প্রথমে নিজের মাথা গোঁজার মতন এক চালা করে নিয়েছিল সুরেশ্বর, আর ছোট মতন এক কুঁড়েঘর করেছিল পাশেই, সেটাই ছিল চোখের হাসপাতাল। শহর থেকে সপ্তাহে একদিন বাসে চেপে আসতেন এক মাদ্রাজি ক্রিশ্চান, প্রায় বৃদ্ধ মামেনসাহেব। মিশনারি হাসপাতালে চোখের ডাক্তারি করেছেন দীর্ঘকাল। এখন অবসর নিয়েছেন। তবু যথাসাধ্য সাহায্য করেন আতুর অনাথকে। হাটের দিন দেহাত থেকে আসা-যাওয়ার পথে গ্রাম্য মানুষগুলি সুরেশ্বরের চোখের হাসপাতালে চোখ দেখিয়ে নিয়ে যেত। সুরেশ্বরকে সাইকেল চেপে দেহাতের গ্রামে গ্রামে এক সময় ঘুরে বেড়িয়ে তার চোখের হাসপাতালের কথা বলতে হয়েছে। এ অঞ্চলে চোখের ব্যাধি কম নয়। বাচ্চাকাচ্চা থেকে শুরু করে জোয়ান মজুররাও নানা রকম চক্ষুরোগে ভোগে।
আশ্রমের গোড়াপত্তন হয়েছিল এইভাবে, অতি দীন চেহারা নিয়ে। ক্রমে ক্রমে সে চেহারা বদলে আসছে। এখনও এমন কিছু হয়নি যা দেখে বিমূঢ় বা হতবুদ্ধি হতে হয়; নিতান্ত সাধারণ সাদামাটা একটা আকার নিতে পেরেছে। তবু, এখানে বনে জঙ্গলে দেহাতে–যেখানে কোনও কিছুই ঘটে না, প্রাকৃতিক নিয়মে শুধু গাছপালা বাড়ে আর জৈবিক নিয়মে মানুষের জন্মমৃত্যু ঘটে–সেখানে সাধারণ যা ঘটল, যতটুকু ঘটল তাতেই অনেকে বিস্মিত হয়, হয়তো মুগ্ধও হয়। সুরেশ্বরের অন্ধ আশ্রম অনেকটা সেই রকম বিস্ময়কর ঘটনা।
অন্ধ আশ্রমের সব কথা হৈমন্তীর জানা ছিল না, কিছু কিছু শুনেছিল, চিঠিপত্রেও জেনেছিল। গুরুডিয়ায় এসে দেখছিল সব।
কেমন দেখছ? সুরেশ্বর পরের দিনই জিজ্ঞেস করেছিল হৈমন্তীকে।
বেশ সুন্দর। হৈমন্তী তখনও তেমন করে কিছু দেখেনি।
জায়গাটা সুন্দরই। …আমাদের ব্যবস্থা কেমন দেখছ?
আমি আর কতটুকু বুঝি। ভালই লাগছে।
তোমার হাসপাতাল?
সবই তো আছে। অসুবিধে খুব একটা হবে না।
প্রথম যখন হয়েছিল, তখন একটা কুঁড়েঘর আর টিনের চেয়ার। হাটবারের দিন মামেনসাহেব আসতেন। একটা সুটকেস হাতে, যন্ত্রপাতি বয়ে আনতেন।
এখন অনেক হয়েছে।
সাহেব নিজেই অর্ধেক জিনিস দিয়েছেন, বাকি কিনতে হয়েছে। …গত বছরে সাহেব মারা গেছেন। এখন যিনি আসেন, তাঁর নানা অসুবিধে। সাহেব বেঁচে থাকতে তাঁর পছন্দমতনই হাসপাতালটা করিয়েছিলেন।
কাজের মানুষ।
নিষ্ঠাবান ব্যক্তি। দয়া ধর্ম প্রেম–তিনগুণে তিনি যথার্থ ক্রিশ্চান ছিলেন: সুরেশ্বর সশ্রদ্ধায় বলল। তারপর আবার বলল, কুড়ি বছর শুধু এদিকের, সমস্ত মিশন হাসপাতালে দীনদরিদ্রের চোখ দেখে বেড়িয়েছেন। বলতেন: যিশু অন্ধকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, আমরা পাপীজন–মানুষকে দৃষ্টিহীন করি।
হৈমন্তী নীরব থাকল।
সুরেশ্বর পরে জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন লাগছে তোমার?
ভাল।
থাকতে পারবে?
হৈমন্তী চোখ তুলে তাকাল, দেখল সুরেশ্বরকে, অল্প করে মাথা নোয়াল পারব।
তারপর থেকে আজ কদিন হৈমন্তী নতুন আবহাওয়া এবং পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছে।
.
দু চোখ ভরে ঘুম জড়িয়ে আসছিল। বাসের ঘন ঘন হর্নে চোখের পাতা খুলল হৈমন্তী, আবার সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজল। তার ঘোরে কয়েক দণ্ড কাটল, তারপর আধবোজা চোখে জানলার দিকে তাকাল, খানিকটা দূরে জামতলায় বাস এসে থেমেছে, লোজন তুলে নিচ্ছে, এখুনি আবার হর্ন দিয়ে চলে যাবে। বিছানায় শুয়ে হৈমন্তী কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না, কিন্তু সবই বুঝতে পারছিল। আজ আট-দশ দিনে মোটামুটি এখানকার সবই তার জানা হয়ে গেছে। এই বাসটা দুপুরের, এখন প্রায় তিনটে বাজে, কিংবা বেজে গিয়েছে।
শেষ কয়েকবার হর্ন দিয়ে বাসটা চলে গেল। হৈমন্তী আলস্যভরে হাই তুলল, চোখের দৃষ্টি এখনও পরিষ্কার নয়, তন্দ্রাজড়িত সামান্য ছলছলে ভাব রয়েছে।
এইভাবে আরও সামান্য সময় শুয়ে থেকে চোখ মুছে হৈমন্তী বিছানায় উঠে বসল। বড় করে হাই তুলল। দুপুরে সে ঘুমোতে চায় না, তবু এখানে–এত নিরিবিলি এবং নির্জনতার মধ্যে শুয়ে থাকতে থাকতে, কাগজপত্র বই পড়তে পড়তে কখন যেন দু চোখ জড়িয়ে আসে। ঘুমিয়ে পড়লে রাত্রে আর ঘুম আসতে চায় না। এখানে রাত্রে জেগে থাকা কেমন যেন! হৈমন্তীর ভয় করে। মনে হয়, বিশ্বসংসারে কেউ কোথাও নেই, জনপ্রাণী না, শুধু সে একা; চারপাশের অবর্ণনীয় স্তব্ধতা তার চেতনাকে এত নগণ্য, হেয় ও তাৎপর্যহীন করে তোলে যে হৈমন্তী কেমন এক আতঙ্ক অনুভব করে মৃতপ্রায় হয়ে থাকে।
এ-রকম দু দিন হয়েছিল। তারপর থেকে হৈমন্তী দুপুরে ঘুমোতে চায় না। এমনকী একটু বেশিক্ষণ তন্দ্রার ঘোরে শুয়ে থাকলেও বিকেল থেকে সে কেমন অস্বস্তি বোধ করে, রাত্রের কথা ভেবে তার উদ্বেগ হয়। হয়তো এসব কিছুই না, আর কদিন পরে সবই অভ্যাস হয়ে যাবে। একেবারে নতুন জায়গা, পুরনো অভ্যস্ত জীবনের সঙ্গে কোথাও কোনও মিল নেই, সাদৃশ্য নেই, এমন করে আগে সে আর কখনও থাকেনি–তাই নতুন নতুন এ রকম লাগে। পরে আর লাগবে না।
হৈমন্তী বিছানা থেকে নামল। জানলায় দাঁড়ালে দুরে জামতলা দেখা যায়। জামতলা এখন নির্জন, কেউ নেই। দুপুরে ওখানে একে একে লোক জমে, পাঁচ সাত দশ–কিছু ঠিক নেই। গাঁ-গ্রাম থেকে লোক আসে; এখানে যারা চোখ দেখাতে আসে তারাও বাস-আসার সময় সময় জামতলায় ফিরে গিয়ে গাড়ির অপেক্ষা করে। বাসটা চলে গেলে সব ফাঁকা–জামতলা নির্জন।
আবার বাস আসবে একবার; সন্ধে নাগাদ। আসবে আর যাবে। ওই বাসেই হৈমন্তীরা এসেছিল। অবশ্য শেষ পর্যন্ত আর আসা হয়ে ওঠেনি, বাস খারাপ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, সেই ভদ্রলোক, অবনীবাবু, জিপে করে তাদের পৌঁছে দেন। ভদ্রলোকের কথাবার্তা কেমন যেন!
পাশের দিকের জানলা থেকে সরে হৈমন্তী বিছানার পায়ের দিকের জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। জানলার আধখানা ঢেকে, নীচের দিকে, নতুন পরদা দিয়েছে; কচিকলাপাতা রঙের পরদা। হাতের কাছে কিছু ছিল না, আধ-পুরনো শাড়ি থেকে পরদা করা। বোঝা যায় না অবশ্য। এখানে কোথাও পরদা নেই, সব ফাঁকা, খোলামেলা। হাসপাতালের ঘরেই যা পরদা দেখা যায়। হৈমন্তী কেমন অস্বস্তি বোধ করছিল, কাছাকাছি কেউ কোথাও থাক না থাক–তবু ওইটুকু আড়াল না থাকলে তার স্বস্তি হচ্ছিল না।
জানলার কাছে দাঁড়িয়ে অলস চোখে হৈমন্তী সামনে তাকিয়ে থাকল। বর্ষার জলে মাঠের ঘাস বড় বড়, সবুজ হয়ে আছে। মোলায়েম জাজিমের মতন আশে-পাশে বিছানো। বিকেলের পরিষ্কার রোদে খুব ফিকে হলদের মতন একটা রং ধরেছে মাঠে। এখানে ওখানে গাছপালা, মস্ত একটা শিরীষ, হাসপাতাল-ঘরের কাছে একজোড়া অর্জুন গাছ। এখান থেকে হাসপাতাল-ঘরের অর্ধেকটা দেখা যায়, বাকিটা গাছের আড়ালে।
অন্যমনস্কভাবে হৈমন্তী আঙুল দিয়ে চুল ছাড়িয়ে পিঠময় ছড়াতে লাগল। চুল প্রায় শুকিয়ে এসেছে। শব্দ করে আবার একটু হাই তুলল। হাসপাতাল-ঘরের সামনে দিয়ে পাতলা মতন ছায়া ভেসে গেল, টুকরো মেঘ ভেসে যাচ্ছে, নিচু দিয়ে। বর্ষা বোধহয় ফুরিয়ে এল।
চোখ মুখ ধোবার জন্যে হৈমন্তী ঘর ছেড়ে বাইরে এল। তার ঘরের গায়ে গায়ে কাঁচা বারান্দা, পাশেই হলঘর। ওর ঘরের গা লাগিয়ে মালিনীর ঘর, মালিনীর ঘরের দরজা জানলা হাট করে খোলা, মালিনী পশ্চিমের মাঠে শুকনো কাপড় জামা তুলছে, তুলে বুকের কাছে জড়ো করছে।
কলঘর থেকে ফিরে হৈমন্তী ভিজে চোখ মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকল। এখান থেকে গোটা এলাকাটাই মোটামুটি দেখা যায়। জায়গা বড় কম নয়–হৈমন্তী জমির হিসেব বোঝে না, সুরেশ্বরের কাছে শুনেছে, প্রায় বিঘে পাঁচেক। সমস্ত জমি এখনও বেড়া দেওয়া হয়নি, কিছু হয়েছে, কিছুটা ফেলে রাখা হয়েছে ভবিষ্যতের জন্যে। শাল কাঠের খুঁটি আর তার দিয়ে বেড়া, কোথাও কোথাও বুনো কাঁটালতা ঘন হয়ে উঠেছে বেড়ার গায়ে। পুব পশ্চিম দক্ষিণ তিন দিকে ঘর উঠেছে। একে ঠিক পাকা বাড়ি বলা যায় না, আবার কাঁচা বাড়িও নয়। ইটের গাঁথুনি করা দেওয়াল, মাটির বাড়ি মাত্র একটি, মাথায় টালি বা খাপরা। হাসপাতাল বাড়িটার মাথায় শুধু অ্যাসবেস্টাস। সব সুষ্ঠু ছোট বড় খান পাঁচেক দালান, লম্বা লম্বা। জামরুল বা কাঁঠাল কাঠের দরজা জানলা।
পুবের দিকে সুরেশ্বরের ঘর। মাটির বাড়ি, মাথায় খাপরা, সামনে লতাগাছের জাফরি। এক সময়, সুরেশ্বর যখন প্রথম এখানে এসে আশ্রয়ের জন্যে ঘর বাঁধে তখন কাঠকুটো কঞ্চি দিয়ে বেড়া দিয়েছিল সামনে, লতাপাতা লাগিয়েছিল। দিনে দিনে লতাপাতা বেড়ে সামনেটা জাফরির মতন আড়াল পড়েছে, বেড়া ভেঙে গেছে কবে। ওখানে কিছু ফুলের গাছ-জবা, করবী, বেল, দোপাটি। জুই গাছের ডালপালা বাড়ির মাথায় গিয়ে উঠেছে। সুরেশ্বরের বাড়ির একপাশে সিমেন্ট বাঁধানো ছোট একটু বেদি।
মফস্বলের স্কুল বাড়ির মতন লম্বা লম্বা কয়েকটা দালান বেশ খানিকটা তফাত তফাত পুব পশ্চিম দক্ষিণে ছড়ানো। সামান্য উঁচু করে ভিত, ইটের গাঁথনি, মাথায় খাপরা কিংবা টালি, বড় বড় জানলা আর দরজা। কোথাও কোনও রকম বাহুল্য নেই, নিতান্ত যেটুকু প্রয়োজন তার অতিরিক্ত কিছু না। দালানগুলোর সামনে কোথাও করবী ঝোপ, কোথাও কলাফুলের গাছ, টিপফুল, কাঠচাঁপা গাছ, রঙ্গন ফুল। আর অজস্র সবুজ ঘাস।
পশ্চিমের দালানটায় যারা থাকে তারা কজনই পুরোপুরি অন্ধ। কাছাকাছি একটা ঘরে ওরা হাতের কাজ করে। পেছন দিকে বাগান। পুব-দক্ষিণ ঘেঁষে যে দালানটা সেটা তেমন বড় নয়, ছোটই; ওখানে পাঁচ-সাতজন রোগী আছে, বাচ্চাকাচ্চাই বেশি। তারই পাশে মেয়ে রোগী জন দুই তিন।
দক্ষিণের ঘোট দালানটায় হৈমন্তী আর মালিনী থাকে। দেহাতি কটা চাকরবাকর থাকে অল্প তফাতে।
জল বলতে দুটো ইঁদারা। খুব কাছেই নদীর একটি শীর্ণ স্রোতোধারা আছে অনেকেই সেখানে যায়; এখন বর্ষার শেষে জলভরা সেই শীর্ণ ধারাটিকে ছোটখাটো নদী বলেই মনে হয়।
এখানে এসে হৈমন্তীর ভালই লাগছিল। সকালটা কাজেকর্মে কেটে যায়, দুপুর থেকে নিরিবিলি, আলস্য আর বিশ্রামে কাটে, বিকেলটাও মন্দ না কখনও ঘুরে বেড়ায়, কখনও সুরেশ্বরের সঙ্গে কথাবার্তা বলে, গল্প করে; কখনও তার সঙ্গী হয় মালিনী। সন্ধে হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সারাদিনের ভাললাগাটুকু ফিকে হয়ে আসতে থাকে। তখন আর মন বসাতে পারে না এখানে। বড় নির্জন, ফাঁকা, শূন্য মনে হয় সব। রাত যত বাড়ে ততই কেমন অস্বস্তি বোধ করে, উদ্বেগ জমতে থাকে, শেষে ভয় ভয় করে।
সবই অভ্যেস। আর কটা দিন কেটে যাক, তখন হৈমন্তী এই নির্জনতা, নিস্তব্ধতা, হ্যারিকেনের মিটমিটে আলো, বাইরের নিবিড় অন্ধকারে অস্বস্তি অনুভব করবে না, ভয় পাবে না।
হৈমন্তী মাঠে নেমে এল। নরম ঘাসে তার পায়ের চটি ডুবে আছে। বড় বড় ঘাসের ডগা গোড়ালি পর্যন্ত; হাঁটার সময় মনে হয় যেন অল্প জলে পা দিয়ে হাঁটছে, এত নরম আর কোমল।
সামান্য এগিয়ে হৈমন্তী দাঁড়াল। মালিনী আসছে।
মালিনী তাড়াতাড়ি হাঁটে, দেখলে মনে হয় ছুটে ছুটে হাঁটছে। হাঁটার সময় ওর সমস্ত শরীর দোলে। অল্প দুর থেকে মালিনীকে বৈশ দেখাচ্ছিল। রং কালো হলেও মালিনীর গড়নটি নরম, মাথায় মাঝারি, চোখমুখ টলটলে। মালিনী হাসতে হাসতে আসছিল। তার সাদা ধবধবে দাঁত, মাথা ভর্তি এলো চুল, পরনের সাদা শাড়ি রোদের আভায় যেন আরও দেখার মতো হয়ে উঠেছিল। বুকের কাছে কাপড় জামা জড়ো করে এমনভাবে ছুটে ছুটে আসছে যে মনে হচ্ছে যেন কিছু চুরি করে পালাচ্ছে। হৈমন্তীর হাসি পেল।
কাছে এসে মালিনী বলল, যাবেন?
হৈমন্তী চোখে চোখে চেয়ে থাকল। কোথায়?
আমাদের বাড়ি।
মালিনীর বাড়ি রেলস্টেশনের কাছে। বাড়িতে মা আছে, ছোট ভাই আছে, বোন আছে।
তুমি বাড়ি যাচ্ছ?
মালিনী মাথা নাড়ল, মুখভরা হাসি। কপালে গালে ঘাম ফুটে আছে।
যাবে কী করে?
বাস।
বাস তো চলে গেছে। হৈমন্তী অবাক হয়ে বলল।
যে বাস গেল সেটা কি স্টেশনের? দূর…ওটা শহরে যাবার। এত করে শিখিয়েও মালিনী যেন এই নতুন মানুষটিকে কিছু মনে রাখতে পারল না। কাঁচা রাস্তাটুকু হেঁটে গেলে মোড়ের মাথা থেকে স্টেশন যাবার বাস যে এখন পাওয়া যাবে–হেমদিদি তাও ভুলে গেছে। কখন কী বাস পাওয়া যায় তার একটু দ্রুত বিবরণ আবার মনে করিয়ে দিয়ে মালিনী বলল, তিনটের বাস শহরে যায়, চারটের বাস যায় স্টেশন, লাটঠার মোড়ে গিয়ে বাস ধরতে হবে। যাবেন?
হৈমন্তী হ্যাঁ-না কিছু বলল না। সুরেশ্বরকে বলতে হবে, মাইল খানেকের ওপর হাঁটা, অত সময় কই! তারপর ফেরার বাস। ফিরবে কখন?
তুমি ফিরবেনা আজ? হৈমন্তী শুধোল। মালিনী না থাকলে তাকে একলা থাকতে হবে। এক ঘরে না থাকলেও তারা পাশাপাশি থাকে, রাত্রে এ একটা বড় স্বস্তি হৈমন্তীর। মালিনী না ফিরলে হৈমন্তী থাকবে কী করে?
ফিরব।
হৈমন্তীর দুর্ভাবনা গেল। বলল, আজ আর সময় কই! পরে একদিন যাব।
মালিনী বলল, আজই চলুন। চারটেয় বাস আসে না, বলে চার, আসতে আসতে সাড়ে চার। ঢের সময় আছে।
হৈমন্তীর ইচ্ছে হচ্ছিল যায়, অথচ ছুটোছুটি করে যেতে হবে বলে যেন ভরসা পাচ্ছিল না। তার কিছু কেনাকাটা করার দরকারও ছিল। মাথার তেলের শিশিটা হাত ফসকে পড়ে ভেঙেছে, যেটুকু তেল বেঁচে ছিল তাতে এ কদিন কোনও রকমে হয়েছে। গায়ে মাখার সাবান ফুরিয়ে এল। দরজার পরদার জন্যে খানিকটা কাপড় কিনতে হবে। এই ধরনের সব টুকটাক। সুরেশ্বরকে বললে আনিয়ে দেবে, কিন্তু হৈমন্তী বলতে চায় না। সঙ্কোচ অনুভব করে। মালিনী তাকে চা তৈরি করে খাওয়ায়, সেই চা হৈমন্তীর ভাল লাগে না। খানিকটা ভাল চা আনতে হবে। কিছু বিস্কুট।
সুরেশ্বরকে হৈমন্তীর সুখ-সুবিধের কথা বলা যায় না। বললে হয়তো সব হবে, কিন্তু কী ভাববে সুরেশ্বর! তার জন্যে বাড়তি খরচে সুরেশ্বর আপত্তি করবে না, তবে মনে মনে হাসবে। তেল, সাবান, চায়ের মতন তুচ্ছ কটা জিনিসের জন্যে এত খুঁতখুঁতুনি!
হৈমন্তী মালিনীর দিকে তাকাল। মালিনীকে দিয়েও এসব আনানো যায়। কিন্তু মালিনীর কি অত সময় হবে? সে কি পছন্দমতন সব আনতে পারবে?
মালিনীর তাড়া ছিল। চঞ্চল হয়ে উঠে মালিনী বলল, আপনার যে কত ভাবনা! চলুন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
যাবার মন হৈমন্তীর ছিল। আসবার দিন স্টেশনের কিছুই প্রায় সে ভাল করে দেখেনি; বাসে এসে বসেছিল, সটান চলে এসেছে; ওরই মধ্যে দেখেছে, দোকান-পশার আছে স্টেশনে, লোকজন, আলো মোটামুটি যা হৈমন্তীর দেখা অভ্যেস, যার মধ্যে সে এতকাল থেকেছে। এখানে এসে পর্যন্ত সে এসব আর দেখেনি! দেহাতি রোগীদের মুখ ছাড়া আর-একটা নতুন মুখ নয়।
মালিনী হাঁটতে শুরু করেছিল, হৈমন্তীও পাশে পাশে চলতে লাগল। বলল, আজ আর যাব না। কাল পরশু যাব। আমার কিছু কেনাকাটা করতে হবে।
মালিনী হেসে বলল, একলা?
তুমিও যাবে।
না ।
কেন?
রোজ রোজ বাড়ি গেলে দাদা রাগ করবে। মালিনী সুরেশ্বরকে দাদা বলে।
হৈমন্তী মালিনীকে দেখল। মালিনীর মুখে কোনও রকম ক্ষোভ নেই।
আজ দাদা টাকা দিয়েছে। মাকে দিয়ে আসব। …আমার ভাইটা, বলেছি না আপনাকে, বিজলি-অফিসে চাকরি করে, ছোট চাকরি, টাকা না পেলে মার কষ্ট হয়।
মালিনী এখানে টাকা পায় হৈমন্তী জানত না। মাইনে হিসেবে পায়, না সাহায্য? হৈমন্তী কৌতূহল বোধ করলেও কিছু জিজ্ঞেস করল না।
ঘরের কাছে এসে মালিনী বলল, এর পর যখন টাকা পাব, আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। আমায় একটা শাড়ি কিনে দেবেন। মিলের শাড়ি না, ভাল শাড়ি।
হৈমন্তী কথা বলল না, মাথা হেলিয়ে সায় দিল।
মালিনীর কথায় কোনও কোনও সময় সে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। মালিনী ছেলেমানুষ নয়, বোধবুদ্ধিহীনও নয়, কিন্তু খুব সরল আর সাধাসিধে। বছর বাইশ বয়স হয়েছে, লিখতে পড়তেও একেবারে না জানে এমন নয়, তবু কখনও কখনও অবোধের মতন কথা বলে।
শাড়ি কেনার কথাটা এমন কিছু নয়, কিন্তু ওর কথার সুরে ছেলেমানুষের মতন কোথায় যেন একটু ক্ষোভ ছিল। এর আগে একদিন মালিনী বলেছিল: আপনি কত লোককে চিঠি লেখেন হেমদি, আমায় একটা খাম দেবেন–আমার একজনকে চিঠি লিখব।
হৈমন্তী নিজের ঘরে এল। মালিনীকে দেখলে কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু তার সঙ্গে মিশলে বোঝা যায়, এখানে সে পুরোপুরি মনোসুখে নেই, কোথায় যেন তার একটা অভাব রয়েছে। এই অভাব, ওপর ওপর থেকে দেখলে মনে হবে, তুচ্ছ কটা বাস্তব জিনিস, যা সহজলভ্য, অথচ সে পায় না তার জন্যে; ভেতরে চোখ ফেললে মনে হবে মালিনীর অভাব অন্য কোথাও। সুরেশ্বরের অন্ধ আশ্রমে সে কত, রকমের কাজ করছে, এই কাজে তার মুখ ভার হয় না, বরং বেশির ভাগ সময়েই হাসি হাসি ভাব, অথচ সন্দেহ হয়, মনে মনে মালিনী কোনও দুঃখ নিয়ে আছে। কী দুঃখ?
আর-একদিন মালিনী জিজ্ঞেস করেছিল: আপনি এখানে কেন এলেন হেমদি?
হৈমন্তী এ-ধরনের প্রশ্নে অস্বস্তি বোধ করেছিল, সরাসরি কোনও জবাব দেয়নি, দায়সারা একটা জবাব দিয়েছিল। কিন্তু সে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল।
মালিনী ঘরে এল। তাড়াতাড়ি করে কাপড় বদলে নিয়েছে, চুল বেঁধেছে এলো করে, হাতে চায়ের কাপ। বলল, আমি চলি হেমদি, সন্ধের বাসে ফিরব। …আপনার জন্যে ছাঁচি পান নিয়ে আসব, আমাদের ওখানে একজন যা পান করে দেখবেন… মালিনী চলে গেল।
সামান্য পরেই হৈমন্তী জানলা দিয়ে দেখল, মালিনী যেন ছুটতে ছুটতে যাচ্ছে, পরনে মিলের সাদা শাড়ি, গায়ে সাদা জামা, পায়ে পুরনো চটি, একহাতে একটা ছাতা। খোঁপার গোড়ায় লাল ফিতে বাঁধা।
দেখতে দেখতে মালিনী অনেকটা চলে গেল। হৈমন্তীর মন কেমন ভার হয়ে এল হঠাৎ।
বিকেল পড়ে গিয়েছিল। হৈমন্তী অন্য দিনের মতন আশ্রমের বাইরে এসে জামতলার পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে বেড়াচ্ছিল। আকাশ পরিষ্কার, হালকা পাতলা পেঁজা তুলোর মতন ভেঁড়া এক-আধ টুকরো মেঘ ভেসে যাচ্ছে, রোদ ফুরিয়ে গেছে, দূরে টিলার গায়ে গায়ে শেষ একটু আলো, ঠাণ্ডা বাতাস বইছিল, পুবের বাতাস, পাখির ঝাঁক গাছ ডিঙিয়ে চলে যাচ্ছে।
কাঁচা রাস্তা ধরে খানিকটা পথ হেঁটে আসার পর হৈমন্তী একটু দাঁড়াল। সাইকেলে করে কে যেন আসছে। দূর থেকে চেনা গেল না। কাছাকাছি এলে হৈমন্তী চিনতে পারল, শিবনন্দনজি। শিবনন্দনজি সুরেশ্বরের পরিচিত, আশ্রমে অন্ধদের হাতের কাজকর্ম শিখিয়েছেন–বেতের কাজ, গামছা বোনা, বাঁশের টুকটাক জিনিস, খেলনা এই সব। জিনিসগুলো বেচা কেনার ব্যবস্থা তিনিই করেন। যেতে যেতে শিবনন্দনজি সাইকেল থেকে না নেমেই সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন, এদিকে কোথায় যাচ্ছে হৈমন্তী, সন্ধে যে হয়ে এল।
কথাটা শুনলেও অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিল। আরও খানিকটা পথ এগিয়ে এসে হৈমন্তী হঠাৎ দাঁড়াল। আলো এত ম্লান হয়ে এসেছে যে দূরের জিনিস আর দেখা যায় না, ঝাপসা অন্ধকারে সব একাকার হয়ে আছে। সন্ধ্যার কালিমা অগোচরে শূন্যের রং ধূসর ও আঁধার করে তুলছে।
হৈমন্তী আকাশের দিকে তাকাল, পরে চোখ নামিয়ে সামনের দিকে। দূরের আর কিছুই তার দৃষ্টিগোচর হল না।
আর সহসা, মালিনীর সেই প্রশ্ন, এখন এই নির্জনে, নিঃসঙ্গ অবস্থায় তার মনে পড়ল: আপনি এখানে কেন এসেছেন, হেমদি?
হৈমন্তী কিছুক্ষণ নিঃসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। সে কেন এসেছে? কেন?
যেমন দুরের কিছু আর দেখা যাচ্ছিল না, হৈমন্তীও যেন সেই রকম কিছু দেখবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে কিছু ভাবতে পারছিল না। সে কেন এসেছে? কার কাছে? কোন প্রত্যাশায়?
ভীত মানুষের মতন হৈমন্তী হঠাৎ ফিরতে লাগল, তাড়াতাড়ি।
.
০৪.
সুরেশ্বর বাগানের কয়েকটা গাছপালা পরিষ্কার করে মাটিমাখা হাতে দাঁড়িয়েছিল, হৈমন্তী এল।
এসো– সুরেশ্বর সহজ সরল অভ্যর্থনা করল।
বাগানই দেখছিল সুরেশ্বর, দেখতে দেখতে আঙুল দিয়ে একটা জায়গা দেখাল, ভাবছি ওখানটায় মাটি একটু খুঁড়িয়ে নিয়ে কিছু মরশুমি ফুলের বীজ ছড়িয়ে দেব। সামনে শীত আসছে–খুব ফুল ফুটবে।
হৈমন্তী বাগানের দিকে তাকাল। এ কোনও সাজানো বাগান নয়, এখানে ওখানে গাছপালা বেড়েছে। সুরেশ্বর যে বাগান নিয়ে মাথা ঘামায় তেমন, তা বোঝা যায় না। হৈমন্তী চোখ তুলে সুরেশ্বরকে কপলক দেখল, অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরাল: মরশুমি ফুলের বীজ ছড়ানোর কথাটা হৈমন্তীর কানে ছেলেমানুষের মতন শুনিয়েছিল।
কথা বলতে হয় বলেই যেন হৈমন্তী বলল, শীতের এখন অনেক দেরি।
সুরেশ্বর আস্তে মাথা নাড়ল, হাসি মুখে বলল, না হেম, এ তোমাদের কলকাতা নয়। এখানে দেখতে দেখতে শীত এসে যাবে। পুজোর পরপরই।
হৈমন্তী কিছু বলল না।
সুরেশ্বর দুহাত রগড়ে রগড়ে শুকনো মাটি হাত ঝেড়ে ফেলে দিতে দিতে বলল, এখানে বর্ষাটা যেমন খারাপ লাগে, শীতটা আবার তেমনি সুন্দর…। আছো তো, দেখতেই পাবে। …চলো, বারান্দায় গিয়ে বসি।
কয়েক পা এগিয়ে সিঁড়ি, ছোট ছোট পাঁচ ছ ধাপ। সিঁড়ি উঠে সুরেশ্বর বলল, বসো, হাতটা ধুয়ে আসি।
হৈমন্তী বসল না, দাঁড়িয়ে থাকল।
বর্ষ যে ফুরিয়ে গেছে বেশ বোঝা যায়। আজ চার পাঁচদিন বৃষ্টি নেই। শরতের বৃষ্টির মতন এল-গেল এক আধ পশলা যা হয়েছে তা কিছুই না। আকাশের রং বদলে গেছে; ধোয়ামোছা হালকা নীল। রোদ খুব পরিষ্কার আর ঝকঝকে। বিকেলও যেন দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যাচ্ছে।
হৈমন্তী চোখ তুলল। আকাশের তলায় যেটুকু ধূসর আলো তা ক্রমশই কালোয় মিশিয়ে যাচ্ছিল, মিশে চোখের পাতার মতন আকাশের পট ঢেকে দিচ্ছিল। তারা ফুটছে। স্নিগ্ধ এলোমেলো বাতাস পাচ্ছিল হৈমন্তী।
সুরেশ্বর এল। তুমি না আজ স্টেশনের দিকে বেড়াতে যাবে বলেছিলে। গেলে না?
আজ হল না। কাল পরশু যাব।
সুরেশ্বর বেতের চেয়ারটা হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে দিল, বসো৷ নিজে ক্যাম্বিসের চেয়ার টেনে নিল। বসল।
হৈমন্তী বসতে বসতে বলল, আজ মার আর-একটা চিঠি পেয়েছি।
কী লিখেছেন?
ওই কেমন আছি, কেমন লাগছে।
মাসিমার ধারণা আমরা বনেজঙ্গলে আছি, বাঘভালুকের মধ্যে, সুরেশ্বর সহাস্যে বলল। আমায় কতবার করে যে সাবধান করে দিয়েছেন।
আবার চিঠি দিয়েছে মা? হৈমন্তী সুরেশ্বরের চোখের দিকে তাকাল। মা যে কখন কী লিখে ফেলবে কে জানে!
না না; আগের চিঠির কথাই বলছি।
হৈমন্তী চোখ ফিরিয়ে নিল। মার খুব আপত্তি ছিল হৈমন্তী এখানে আসে। মা এ-সব গোড়াগুড়ি থেকেই চায়নি। ডাক্তারি পড়ার সময়ে নয়, তারপর এই চোখ নিয়ে আবার সময় নষ্ট, এখানে আসা। কোনওটাতেই মার ইচ্ছে ছিল না। কী হবে? এই যে পড়ছ আর পড়ছ, কী হবে তোমার?
মার অনিচ্ছাসত্ত্বেও সব হয়ে আসছিল হৈমন্তীর; এখানে আসার বেলাতেও মার অমতে এসেছে।
সুরেশ্বর আগের প্রসঙ্গেই বলল, আমাদের অনেক অহেতুক ভয় থাকে।
হৈমন্তী কিছু বলল না। মনে মনে ভাবল: যে বলছে হয়তো তারও আছে।
সুরেশ্বরের ঘরের মধ্যে নড়াচড়ার, এটা ওটা সরিয়ে রাখার এবং পায়ের শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। ঘরের কাজ করছিল ভরতু।
সুরেশ্বর বলল, তুমি আমার মাকে দেখনি, হেম। আমার মার বরাবর ভয় ছিল আমি নির্ঘাত একদিন তেতলার ছাত থেকে পড়ে যাব। মার হুকুমে তেতলার ছাতের দরজায় তালা দেওয়া থাকত।
সুরেশ্বরের মাকে হৈমন্তী দেখেনি। দেখার কথাও নয়। গল্প শুনেছে নানারকম। বরাবরই নাকি একটু পাগলাটে ভাব ছিল; পরে বেশ পাগল হয়ে যান।
হৈমন্তী বলল, সব ভয়েরই একটা কারণ থাকে।
সুরেশ্বর হৈমন্তীকে লক্ষ করল। বলল, থাকে। ভয়ের ধারণা থেকে ভয় হয়। বনে জঙ্গলে বাঘ থাকে এই ধারণা থেকেই মানুষের জঙ্গলে ভয়। কিন্তু সব সময় তো তা সত্যি নয়। আমি এখানে যতদিন আছিবাঘভালুক কিছুই দেখিনি। শেয়াল-টেয়াল অবশ্য দেখেছি। সুরেশ্বর শেষ কথায় হাসল।
ভরতু লণ্ঠন এনে দিল। বাইরে সব সময়ে দু-একটি চেয়ার, ছোট চৌকি মতন টুল পড়ে থাকে। টুল টেনে লণ্ঠন রেখে আবার চলে গেল ভরতু।
সুরেশ্বর নরম গলায় বলল, ছেলেবেলায় ছাতে উঠতে আমার খুব ভাল লাগত। দেশের বাড়ি– ছাতটা ছিল মস্ত, ঘুলঘুলি দেওয়া, আলসে উঁচু। আলসেটা আমার প্রায় মাথায় মাথায়। একদিকে ছিল নদীর চরা, সামনে আমবাগান আর দূরে রথতলার মাঠ। ছাতে উঠলে মনে হত, কে যেন আমায় এতক্ষণ আটকে রেখেছিল, আমি ছাড়া পেয়ে গেছি। পায়ে ভর দিয়ে নদী আর রথতলার মাঠ দেখতাম, পা ব্যথা করলে বসে বসে ঘুলঘুলি দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। একদিন আমি আলসেতে অল্প একটু উঠে বুক ঝুঁকিয়ে কিছু দেখছিলাম, কে যেন দেখে ফেলেছিল। সেই যে ধরা পড়ে গেলাম, মা আর ছাতে উঠতে দিত না একলা।
ভয়ে। হৈমন্তী বলল; এমনভাবে বলল যাতে মনে হল সুরেশ্বরের মার ভয় অকারণ ছিল না।
ছাতে আমি ছুটোছুটি করতাম না, আলসের ওপর ওঠাও আমার সাধ্য ছিল না। তবু মার কী ভয়! সুরেশ্বর একটু হাসল। দু মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমার এক মাসি ছিল–বিনুমাসি, মার দেখাশোনা করত, বিনুমাসি আমায় কপালকুণ্ডলার গল্প বলেছিল; আমার কেমন একটা ভয় ছিল, ওই নদীর চরা দিয়ে কাঁপালিকটা রোজ আসা-যাওয়া করে। একবার এক সাধুবাবাকে নদীতে দেখে ভয়টা আরও বেড়ে গিয়েছিল।
সুরেশ্বরের ছেলেবেলার কথা হৈমন্তী যেটুকু শুনেছে তাতে মানুষটির ওপর তার কেমন সহানুভূতি ছিল; ওর মা ছিলেন অসুস্থ, মাথা পাগল; বাবা ছিলেন যেমন রাশভারী তেমনি দুর্জন। অর্থ ছিল, অত্যাচারও ছিল। স্ত্রীর সঙ্গে বড় একটা সম্পর্ক রাখেননি। সুরেশ্বরের মা বেঁচে থাকার সময়েই তিনি অন্য এক স্ত্রীলোককে স্ত্রী হিসেবে রেখেছিলেন। এই উপপত্নীটি থাকতেন কলকাতায়। কাজেকর্মে সুরেশ্বরের বাবাকে প্রায়ই কলকাতায় এসে থাকতে হত। বাসা ছিল, ব্যবস্থাও ছিল। মহিলার একটি পুত্রসন্তান হয়। সুরেশ্বরের বাবার মৃত্যুর পর সম্পত্তি দাবি করে মামলার ভয় দেখিয়েছিল ওরা। সুরেশ্বর মামলা চালায়নি, দাবি মিটিয়ে দিয়েছিল।
হৈমন্তী এ সমস্তই মার কাছে শুনেছে। মার ধারণা, সুরেশ্বর আগাগোড়া বোকামি করেছে। সম্পত্তির অংশ দেবার কোনও দরকার তার ছিল না। আইন সুরেশ্বরের পক্ষে ছিল।
হৈমন্তী অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, সতর্ক হল।
সুরেশ্বর কথা বলল। আমার মার আর-একটা অদ্ভুত ভয় কী ছিল জানো? মা কোথাও দড়ি টাঙানো দেখতে পারত না। দড়ি দেখলেই মার কী যেন হত, চেঁচামেচি হইচই করে সে এক কাণ্ড করত। মা ভাবত, হাতের সামনে দড়ি থাকলেই মা বুঝি কিছু করে বসবে। …অথচ মা সুরেশ্বর বলতে গিয়েও থেমে গেল। তারপর কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, তুমি মাসিমাকে লিখে দিয়ো এখানে সত্যিই বাঘভালুকের ভয় নেই।
কথার পিঠে কথা বলতে হৈমন্তীর ভাল লাগে না। এখানে শেয়াল আছে না বুনো কুকুর আছে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছেও এখন তার নেই। চিঠিতে মা একটা কথা লিখেছে–সেটা কি জানিয়ে দেবে? জানানো নয়; মা যা জানতে চেয়েছে ঘুরিয়ে হৈমন্তীও যেন তা জেনে নিতে চায়। অথচ সুরেশ্বরের কাছে কথাটা বলা যায় না।
সুরেশ্বর হৈমন্তীর দিকে তাকিয়েছিল। কী যেন দেখছিল। লণ্ঠনের আলো এখনও তেমন করে ফুটে ওঠেনি, অন্ধকার কিছুটা হালকা।
তোমার মুখের সঙ্গে মাসিমার মুখের খুব মিল আছে। সুরেশ্বর বলল।
কথাটা সুরেশ্বর কেন বলল হৈমন্তী বুঝতে পারল না। মার সঙ্গে তার মুখের মিল যেটুকু আছে সেটুকু আদলে, আর কোথাও নয়।
মার সঙ্গে আমার অমিলও অনেক– হৈমন্তী হঠাৎ বলল, বলে হাসবার চেষ্টা করল।
সুরেশ্বর অস্বীকার করল না, ঘাড় হেলিয়ে জবাব দিল, তা তো থাকবেই। সুরেশ্বরও হাসল।
হৈমন্তী হাত বাড়িয়ে লণ্ঠনটা সরিয়ে রাখল সামান্য। কেরাসিন তেলের গন্ধ এখনও তার নাকে লাগে। বলল, এখানে কোনওদিন আলো হবে না, না?
কীসের আলো? সুরেশ্বর অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, কথাটা খেয়াল করেনি।
ইলেকট্রিক।
তোমার খুব অসুবিধে হচ্ছে।
আমার সুবিধের জন্যেই কি লাইট হবে। …এমনি জিজ্ঞেস করছি। এখানে ইলেকট্রিক হবার আশা নেই, না?
এখন নয়। দু-চার বছরের মধ্যেও হবে না। তারপর যদি হয়।
হৈমন্তী অতটা দুরের কথা ভাবতে পারল না। সমস্ত জিনিসই কি পাঁচ সাত দশ বছরের পরের চেহারা নিয়ে ভাবা যায়। এভাবে সে অনেক ভেবেছে, আর নয়।
সুরেশ্বর বলল, পাঁচ জায়গা থেকে কুড়িয়ে আমায় দিন চালাতে হয়, আলো করার পয়সা কোথায়, হেম।
হৈমন্তীর ইচ্ছে হল বলে, কেউ তোমায় কুড়োতে বলেনি, তুমি নিজেই হাত পেতে কুড়োতে এসেছ।
অভাব জিনিসটা– সুরেশ্বর একটু হেসে বলল, ভয়ের মতন; যত ভাববে তত বাড়বে।
এধরনের অর্থহীন কথা হৈমন্তীর পছন্দ হল না। ঠাট্টার গলায় বলল, তবে আর কী, মানুষকে কিছুই বোধ করতে হবে না, খিদে পেলেও নয়, অন্ধকারে থাকলেও নয়, কিছুতেই নয়।
আমি অমন বাড়াবাড়ির কথা বলিনি। যা পেলে মোটামুটি আমার প্রয়োজন মেটে তার বেশি চাইলেই মুশকিল হয়।
মোটামুটিই বা কজনের মেটে! …তা ছাড়া সব অভাবই তো খাওয়া পরার নয়– হৈমন্তী বলল। মনে পড়ল: মালিনীর যে অভাব সে-অভাব কীসের কে বলতে পারে। আমি কোন অভাব বোধ করি তুমি কী করে বুঝবে?
সুরেশ্বর মাথা নাড়ল আস্তে করে। কী ভাবছিল কে জানে। সামান্য সময় চুপচাপ, তারপর বলল, সংসারটা সুখের নয় হেম; জগৎটাও নিখুঁত নয়। অ-সুখের সংসারেই আমাদের জন্ম, খুঁতখুঁতুনি থাকবেই। …আমার মনে হয়, আমরা অনেক জিনিস ঢাক পিটিয়ে চাই, যেন সেগুলো ফেরার হয়েছে, কোতোয়ালিতে ধরে এনে দিতে হবে।
হৈমন্তী কিছু বুঝল না; বলল, সংসারে সবাই সুখ চায়।
তা তো চাইবেই।
তবে?
সুখের কোনও চেহারা নেই। যে যেমন করে তাকে গড়ে নেয়।
তাই বা পায় কোথায়?
না পেলে উপায় নেই।
হৈমন্তী চকিতের জন্যে সুরেশ্বরের দিকে তাকাল। এই নিস্পৃহতা সুরেশ্বরের চরিত্রে কিছুটা নতুন। আগেও ছিল, তবে এভাবে নয়। অথচ সংসারের সমস্ত ব্যাপারে সুরেশ্বরের এই নিস্পৃহতা তো এখনও নেই। শুধু…।
সুরেশ্বর নিজের থেকেই বলল, তুমি এখানে এসেছ, আমার পক্ষে সেটা মস্ত লাভ। আমি একটু স্বার্থপরের মতন কথা বলছি। যদি এখানে থাকতে তোমার ভাল না লাগে, আমি তোমায় জোর করে আটকে রাখব না! তোমায় যদি আমরা না পাই উপায় কী বলল। আমাদের হাতে সব কিছু তো থাকে না—হাতের বাইরেও থাকে।
হৈমন্তী কোনও কথা বলল না। কোথায় যেন সে অনুভব করল, সুরেশ্বরের কাছে আজ তার মূল্য আশ্রমের ডাক্তার হিসেবে। এর বেশি–এর বাইরে সুরেশ্বর কিছু ভাবে না নাকি?
কোনও কোনও মানুষ আছে যারা অনেকটা আয়নার মতন, তাদের নিজের কিছু দেখা যায় না। সুরেশ্বরকে অনেক সময় হৈমন্তীর ওই রকম মনে হয়। মানুষটির সামনে দাঁড়ালে নিজেকে শুধু প্রতিফলিত দেখা যায়। কখনও কখনও হেমন্তী অধৈর্য হয়ে ওই আয়নাতে বোকার মতন আলো ফেলে ভেতরটা দেখতে গিয়ে দেখেছে নিক্ষিপ্ত আলোর ঝলকটাই ফিরে আসছে। সুরেশ্বর কি এখন এইরকম এক সুদৃশ্য আয়না হয়ে থাকবে।
হৈমন্তী বিরক্তি বোধ করল। সুরেশ্বর তার কাছে যদি একেবারেই অপরিচিত হত তবে অন্য কথা। তুমি অচেনানও, অজানাও নয়–মনে মনে হৈমন্তী বলল: এক সময় আমি তোমার অনেকটা দেখেছি। তখন তুমি আরশি ছিলে না।
হৈমন্তী বলল, কী জানি, আমার এত ভাল লাগে না।
কী? সুরেশ্বর মুখ ফিরিয়ে তাকাল।
হৈমন্তী সরাসরি কোনও জবাব দিল না, বলল, সব মানুষই নিজের কথা ভাবে।
পরের কথাও ভাবে। সুরেশ্বর শান্ত, কেমন এক হাসির গলায় জবাব দিল।
নিজের ভাবনা বাদ দিয়ে নয়।
সুরেশ্বর আর কোনও জবাব দিল না। পরে এক সময়ে বলল, তা ঠিক।
হৈমন্তীর ইচ্ছে হল না অকারণ কথা বাড়ায়। আরও অল্পক্ষণ বসে থাকল চুপচাপ। তারপর বলল, আমি উঠি।
উঠবে কেন, আর খানিকটা বসো।
মার চিঠিটা লিখে রাখি গিয়ে, সকালে সময় পাব না।
কাল হাটবার, তোমার খাটুনি বাড়বে।
ওদের কথাবার্তা আমি বুঝতে পারি না কী যে বলে।
যুগলবাবুকে বলল, বুঝিয়ে দেবে।
উনিই দেন।
যুগলবাবু কম্পাউন্ডার গোছের মানুষ। হাসপাতালের কাজকর্ম প্রায় সবই দেখাশোনা করেন। এখানে থাকেন না। সাইকেলে যাওয়া-আসা করেন।
হৈমন্তী উঠে দাঁড়াল। সুরেশ্বরও উঠল। হৈমন্তী আপত্তি করতে যাচ্ছিল। সুরেশ্বর অল্প একটু পথ তাকে এগিয়ে দেবে, দিয়ে ফিরবে, কিংবা পায়চারি করে বেড়াবে মাঠে। এরকম সৌজন্য অকারণ।
নীচে নামল হৈমন্তী, সুরেশ্বরও নেমে এল পেছনে।
হাঁটতে হাঁটতে সুরেশ্বর বলল, কাল সকালে আমি টাউনে যাব। সরকারি একটা গ্রান্ট পাওয়া যাবে শুনছি। দেখি…।
অভ্যাস মতন অল্প একটু পথ এগিয়ে দিয়ে সুরেশ্বর দাঁড়াল, হৈমন্তী আর দাঁড়াল না, এগিয়ে গেল। পিছন দিকে তাকাবার ইচ্ছেও তার ছিল না, ইচ্ছাকৃতভাবে দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করল। ব্যর্থতার অনুশোচনা অথবা গ্লানির মতন তার মনে বিরক্তি জমছিল।
এইরকমই হচ্ছে প্রায়। এখানে আসা পর্যন্ত হৈমন্তী মাঝে মাঝে অত্যন্ত হতাশ ও বিমর্ষ হয়ে পড়ছে। এখন তার বিন্দুমাত্র ভাল লাগছিল নাঃ সুখ না, তৃপ্তি না, স্বস্তিও নয়। নিজের ওপরেই সে অসন্তুষ্ট, বিরক্ত হয়ে উঠছিল।
কোনও কিছু লক্ষ না করে ঝোঁকের মাথায় খানিকটা পথ হেঁটে এসে হৈমন্তী দাঁড়াল। সামনে হাসপাতাল-ঘর চোখ তুলে দেখল, দেখে বিতৃষ্ণা অনুভব করল। নিজের সঙ্গে এই হাসপাতালের কোনও রকম সম্পর্ক আছে বলেও তার মনে হল না।
কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে হৈমন্তী অন্য দিকে মুখ ফেরাল, তারপর ফিরতে লাগল। মা জানতে চেয়েছে, তারপর হৈমন্তী কী করবে? স্পষ্ট করে মা ঠিক সে কথাটা বলেনি, তবে মার কথার ওই রকমই মানে দাঁড়ায়, তুমি বরাবরই তোমার মতে কাজ করলে, আমার কোনও কথাই শুনলে না। এখনও যদি তুমি তোমার ভালমন্দ না বোঝ আর কবে বুঝবে। তোমার বেশ বয়েস হয়েছে, এভাবে ভেসে বেড়ানো আমার আর পছন্দ নয়।
মার চিঠির আরও কোনও কোনও কথা মনে পড়ায় হৈমন্তী অতি তিক্ত অসন্তোষ অনুভব করল। সুরেশ্বর শিশু নয়, অজ্ঞান নয়। হৈমন্তী কেন এখানে এসেছে সুরেশ্বর যে বোঝে না তাও নয়। এই আশ্রম বল, আদর্শ বল, এর ভালমন্দ কিছু থাক তা সুরেশ্বরের। অন্ধ-আতুরের সেবার জন্যে হৈমন্তী এখানে আসেনি। ডাক্তারিটা তার পেশা, জীবন-নয়। এই পেশার জন্যে হৈমন্তীর মাথা ব্যথা ছিল না, এখনও নেই। যদি সে পেশার জন্যে কাতর হত, তবে এখানে এই জঙ্গলে আসত না, কলকাতায় থাকত; তাতে রোজগার হলে হত, না হলেও সে মরে যেত না।
সুরেশ্বর সমস্তই বোঝে। বোঝে বলেই নিজের প্রয়োজন মেটাতে হৈমন্তীকে এখানে এনেছে। অথচ কত নিস্পৃহ হয়ে বলতে পারল, হৈমন্তীর যদি এখানে ভাল না লাগে–সে চলে যায়, সুরেশ্বর তাকে আটকাবে না।
মানুষ কত বদলে যায়। আজকের সুরেশ্বরকে দেখলে হৈমন্তীর অতিপরিচিত সেই সুরেশ্বরকে আর চেনাই যায় না।
হৈমন্তী চোখ তুলল; বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মালিনী বারান্দায় বসে আপনমনে গান গাইছে, সন্ধেবেলায় মাঝে মাঝে সে এইভাবে গান গায়। মালিনীর গলা মেঠো, কিন্তু মিষ্টি। গানের সুরটা শুধু হৈমন্তীর কানে গেল, কী গাইছে বুঝল না, শোনার আগ্রহও অনুভব করল না। মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল হৈমন্তী, তারায় তারায় ভরা, চোখের মণির মতো কালো যেন আকাশটা।
ঠাণ্ডা বাতাসে সামান্য সময় দাঁড়িয়ে থাকল হৈমন্তী। মালিনী গান থামাল, কী যেন বলল, হৈমন্তী অন্যমনস্কতাহেতু শুনতে পেল না। অন্ধকারে কোথাও কিছু উড়ে গেল, কোনও পাখি, সে বারান্দায় উঠে এল।
মালিনী অল্প তফাত থেকে বলল, বৃষ্টি বাদলার দিনে অন্ধকারে মাঠে অত ঘুরবেন না, হেমদি।
হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না।
ঘরের দরজায় শিকল তোলা ছিল, খুলে ভেতরে এল হৈমন্তী। লণ্ঠন জ্বলছে মিট মিট; সবই অস্পষ্ট। জানলার কাছে এসে দাঁড়াল, তারপর বিছানায় গিয়ে বসল; শেষে গা এলিয়ে বিছানার পাশে পা রেখে শুয়ে পড়ল।
সুরেশ্বর এ-রকম ছিল না। বড় বেশি রকম পরিবর্তন হয়েছে। স্বাভাবিক পরিবর্তন নয়, অস্বাভাবিক। হৈমন্তী এতটা কল্পনা করেনি, চিন্তাও করেনি। আজ সুরেশ্বরকে দেখলে বা তার কাছাকাছি বসলে হৈমন্তীরই সন্দেহ হয়, ওই মানুষটি এক সময় দিবারাত্র হেম হেম করেছে কি না! তখন মনে হত, হেম ছাড়া সুরেশ্বর কিছু ভাবতে পারে না।
হৈমন্তীর বুকের তলায় সব যেন আস্তে আস্তে অসাড় হয়ে আসছিল, এবং অদ্ভুত এক শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছিল। এই শূন্যতা এত বেশি রকম নিজস্ব যে একমাত্র অস্পষ্টভাবে অনুভব করা যায় মাত্র, বলা যায় না, চিন্তা করা যায় না।
কিশোরী বয়স থেকে হৈমন্তী সুরেশ্বরকে দেখছে। তখন সুরেশ্বরর বয়স কম ছিল, সমস্ত চেহারার মধ্যে অত্যন্ত স্বচ্ছ নির্মল এক সৌন্দর্য যেন মাখানো থাকত, দেখতে ভাল লাগত, মন প্রসন্ন হত। চরিত্রে কোথাও এমন এক মিষ্টতা ছিল সুরেশ্বরের যা সকলকেই আকর্ষণ করত আনন্দ দিত। মামা ঠাট্টা করে বলতেন, ছোকরা সুর অসুর নয়–একেবারে সুরাসুর।
সুরেশ্বর পুরোপুরি সুপুরুষ ছিল না। তবে সুদর্শন ছিল। ওর মা অসামান্য সুন্দরী ছিলেন। মার সেই রূপ সুরেশ্বর পায়নি, মুখের সৌন্দর্যমাত্র পেয়েছিল। যেন ওর মা ইচ্ছাকৃতভাবে সন্তানকে নিজের সবটা দিতে চাননি, দিলে সুরেশ্বরের অমঙ্গল হত। বাবার মতনই ময়লা রং পেয়েছিল ও; বাবার মতনই মাথায় কিছুটা খাটো ছিল, দোহারা গড়ন। নিতান্ত পুরুষ বলে সুরেশ্বরের মুখে সৌন্দর্য ছিল, লাবণ্য ছিল না। লাবণ্য থাকলে তাকে মেয়ে বলেও মনে হতে পারত। জোড়া ভুরু, টলটলে দুটি চোখ, মণি ঈষৎ নীলচে, কোমল, নিবিড় দৃষ্টি, নিখুঁত দুটি ঠোঁট। সুরেশ্বরের তখন যৌবন। সুরেশ্বর সামনে এলে হৈমন্তীর মনে হত, খোলা জানলা দিয়ে যেন আলো বাতাসভরা এক সকাল এসেছে।
সেই সুরেশ্বর দেখতে দেখতে বয়সের বাহ্য চাঞ্চল্য কাটিয়ে উঠল। হৈমন্তীও কিশোরী বয়স উত্তীর্ণ হয়েছে। সুরেশ্বরের সঙ্গে তাদের পারিবারিক সম্পর্ক যা সেটা নিকট আত্মীয়তার নয়; হৈমন্তীর মা দূর সম্পর্কে সুরেশ্বরের মার বোন হতেন। যোগাযোগও বড় একটা ছিল না শেষের দিকে। থাকার কথাও নয়। হৈমন্তীরা কলকাতায়, সুরেশ্বরের মা দেশের বাড়িতে।
তা ছাড়া উনি ততদিনে মারাও গেছেন। মার কাছে শুনেছে হৈমন্তী, মৃত্যুটা নাকি স্বাভাবিক ছিল না। সুরেশ্বরের যখন বছর ত্রিশ বয়েস ওর বাবাও মারা গেলেন। হৈমন্তীদের কলকাতার বাড়িতে সুরেশ্বরের আসা-যাওয়া তখন থেকেই বাড়ে, তার আগে কলেজে পড়ার সময় কয়েক বছর নিয়মিত আসা-যাওয়া করলেও মধ্যে কয়েক বছর সুরেশ্বর তেমন আসেনি, তখন সে কলকাতায় থাকত না। বলতে গেলে হৈমন্তী প্রথম কৈশোরে কিছু দিন সুরেশ্বরকে বাড়িতে আসতে যেতে দেখেছিল, তারপর দেখল বছর পাঁচ পরে, যখন সে কৈশোর উত্তীর্ণ হয়ে যৌবনে পা দিয়ে দাঁড়িয়েছে। আগের দেখাটা তেমন যদি নাও হয়, তবে বিরতির পর নতুন করে সুরেশ্বরকে দেখাটা হঠাৎ যেন কিছু আবিষ্কারের মতন। তখন যে কী হয়েছিল আজ আর তা মনে করতে পারে না হৈমন্তী, শুধু মনে পড়ে নিজের শরীরের ছায়া যেমন সর্বক্ষণের সঙ্গী, সুরেশ্বরের চিন্তাটাও তেমনই তার চেতনা-অর্ধচেতনার মধ্যে সর্বদা বিরাজ করত।
তারপর যা ঘটল সেটা যেন বজ্রপাত। কোথাও কোনও মেঘ না, আভাস নয়, জ্বর গায়ে ব্যথা যন্ত্রণা নিয়ে শুয়ে হৈমন্তী হঠাৎ একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বসে কাশতে কাশতে রক্তবমির মতন রক্ত ফেলল। তারপর অল্প অল্প। ডাক্তার মুখ ভার করল। মামা বেচারি ভয়ে ভাবনায় নীল। মা সারাক্ষণ বিছানার পাশে বসে। সুরেশ্বর ছিল, ছোটাছুটি শুরু করল।
তিন চারটি সপ্তাহ সবাই উদ্বেগের মধ্যে বসে থাকল। কী হয়েছে সঠিক করে বলার সাহস যেন কারও নেই। শেষে বোঝা গেল ব্যাধিটা রাজব্যাধি। বড় ভাইচা বাগানে চাকরি করত, বিয়ে করেছিল চার-আনি মেমসাহেব। মনি-অর্ডারে শদুই টাকা পাঠিয়ে কর্তব্য শেষ করল। অন্য ভাই ছোট, স্কুলে পড়ে। মামার উপার্জনেই সংসার চলত। বিয়ে-থা করেননি মামা। কিন্তু তাঁর উপার্জন এত নয় যে, ডাক্তারদের পরামর্শ মতন রাজচিকিৎসা হতে পারে।
এ-সময় যা করার সুরেশ্বরই করেছিল। বল, ভরসা, আশা বলতে সে ছিল বারো আনা। প্রথমে বাড়িতে সাময়িক চিকিৎসা, বাইরের হাসপাতালে দেড় বছর, আবার বাড়ি, শেষে কিছুদিন ঘাটশিলায় থেকে তবে হৈমন্তী মুক্তি পেল।
এই ব্যাধি হৈমন্তীকে দুটো জিনিস দিয়েছিল: সুরেশ্বরের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা ও প্রেম, আর সে অনুভব করেছিল সংসারের আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতন কর্মক্ষম না হতে পারলে তার হীনতাবোধ সে অতিক্রম করতে পারবে না।
সুরেশ্বর বলল, ডাক্তারি পড়তে। এক সময়ে হৈমন্তীর ওটা সাধ ছিল। পড়ার কথা উঠলে মা আপত্তি করল। মামাও সন্দেহও করল শরীরে কুলোবে কি না। যে ডাক্তার হৈমন্তীকে সাময়িক চিকিৎসা করেছিলেন তিনি বললেন, চমৎকার পারবে। না পারলে আত্মবিশ্বাস হারাবে, পারলে তুমি জিতে গেলে। তা ছাড়া তোমার শরীর তো চমৎকার হয়েছে।
হৈমন্তী জীবন ফিরে পেয়ে তাকে পুনৰ্ষত করতে চায়নি; আবার এখন ঠিক ডাক্তারি পড়তেও নয়, অন্য কিছু হলে ভাল হত। সুরেশ্বরের আগ্রহে সে ডাক্তারি কলেজে ভরতি হল। যেন সুরেশ্বরের মনোবাসনা বা শখ পূর্ণ করাতেই সে বাধিত হবে।
অসুস্থতার দু-আড়াই বছর হৈমন্তী যে সুরেশ্বরকে দেখেছে সে সুরেশ্বর হৈমন্তীর নিকটাত্মীয়েরও অধিক। সুরেশ্বরের জীবন যেন তার মরা বাঁচার ওপর নির্ভর করেছে। হেম বেঁচে থেকে সুরেশ্বরকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সুরেশ্বরও হেমের আয়ু-দীপ হয়ে থেকেছে।
হেম, তুমি সবসময় বাঁচার ব্যাকুলতা নিয়ে বাঁচবে, ব্যাকুলতা ছাড়া বাঁচা যায় না। ..হেম মনে কখনও সন্দেহ এনো না সন্দেহ করে বাঁচা যায় না। সুরেশ্বর এই সব বলত, চিঠিতে লিখত। ছুটে ছুটে দেখতে যেত হাসপাতালে অশেষ কষ্ট করে, বলত: দুর…একটা রাত জাগা কি কষ্ট নাকি! তোমাকে দেখতে আসছি ঘুমটুম চোখের দশ হাত দূরে থাকে। বা, অনেক ইম্প্রভ করেছ। মার্ভেলাস!
ঘাটশিলায় বাড়ি নিয়ে থাকার সময় মা ছিল, আর সুরেশ্বর। শীতের সকালে গরম কাপড়ে সতর্কে ও সাবধানে হৈমন্তীকে ঢেকে নিয়ে সুরেশ্বর বেড়াতে যেত। দুপুরে গ্রামোফোন বাজিয়ে শোনাত, গল্পের বই পড়ত, বিকেলে আবার বেড়াতে নিয়ে যেত, সন্ধেবেলায় কত রকম গল্প। এই সাহচর্য এবং সঙ্গ এত অন্তরঙ্গ ও উষ্ণ ছিল যে, হৈমন্তীর মনে হত তার বসনে, অঙ্গে, হৃদয়ে এবং ত্বকেও যেন সুরেশ্বরের সর্বক্ষণ স্পর্শ আছে।
হৈমন্তী যখন আর অসুস্থ নয়, রাহুমুক্ত, জীবনের স্বাদ উপভোগ করে প্রতিনিয়ত সুখী, নির্ভার, নিশ্চিন্ত, ডাক্তারি কলেজে পড়তে ঢুকেছে তখনও সুরেশ্বরকে দেখে বোঝা যেত না তার দিক থেকে হৈমন্তীর প্রতি কোনও উপেক্ষা আছে।
ডাক্তারি পড়ছে যখন হৈমন্তী-মাঝামাঝি–তখন সুরেশ্বর কলকাতা ছাড়ল। বলল, একটু বেড়িয়ে আসি। মাস দুই পরে ফিরল, তারপর আবার বাইরে গেল, বলল: একটা কিছু করব ভাবছি, দেখি। কলকাতা আর ভাল লাগছে না। তখন থেকেই সুরেশ্বর কেমন যেন। আসে, আবার চলে যায়। চাকরি বাকরিতে ওর কোনওকালেই গা ছিল না। কখনও এটা করত, কখনও সেটা।
এই যে সুরেশ্বর কলকাতা ছেড়ে উধাও হত, দুচার ছ মাস আর আসত না, কিন্তু যোগাযোগ নষ্ট করত না। চিঠিপত্র লিখত। হৈমন্তী এটা পছন্দ করত না। সুরেশ্বরের অদর্শন প্রথম প্রথম তাকে ব্যথিত ও চিন্তিত করত। পরে সহ্য হয়ে গেল। পড়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল, ছেড়ে দিতেও ইচ্ছে হত না, অথচ যার জন্যে এত আগ্রহ করে পড়া সে কাছে না থাকায় মন বিমর্ষ থাকত।
ডাক্তারি পাশ করার পর সুরেশ্বর আবার তাকে চোখের ডাক্তারি পড়ে নিতে লিখল। নিজেও এসেছিল একবার। হৈমন্তীর আর ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু সুরেশ্বরের অনুরোধ ও ইচ্ছা সেনা রেখেও পারল না। ততদিন সুরেশ্বর গুরুডিয়ায় এসে বসেছে। হৈমন্তীকে তার প্রয়োজন ছিল।
হৈমন্তী ভেবেছিল, সে সুরেশ্বরের সমস্ত ইচ্ছা পূর্ণ করেছে, সুরেশ্বরও তার ইচ্ছা পূর্ণ করবে। কেন যে, আজকাল তার দ্বিধা এসেছিল, মনে হত সেই সুরেশ্বর–যে তাকে মৃত্যু থেকে জীবনে ফিরিয়ে এনেছে বিস্বাদ, বিবর্ণ, মুখে-মাছি বসা এক জগৎ থেকে–সে যেন আড়ালে কোথাও সরে যাচ্ছে। হৈমন্তীর এটা সহ্য হত না। মা বুঝতে পেরেছিল, সুরেশ্বরকে আর অকারণ কাছে টানার চেষ্টা। হৈমন্তী বোঝেনি, বুঝতে রাজি হয়নি। একরকম বেপরোয়া হয়ে, এবং কিছুটা আশা নিয়েই হৈমন্তী এসেছিল এখানে এসে দেখেছে, সুরেশ্বর অন্য মানুষ।
নিজের জীবনের জন্যে হৈমন্তী সুরেশ্বরের কাছে এত বেশি রকম কৃতজ্ঞ যে, কখনও ওই মানুষটিকে সে বেদনা দিতে চায়নি। এখনও চায় না। সুরেশ্বরকে আঘাত করলে বা তাকে পরিত্যাগ করলে সুরেশ্বর সহ্য করে নেবে, কিন্তু হৈমন্তীর মর্যাদা থাকবে না। সুরেশ্বর তাকে সমস্ত দিক থেকে ছোট, হীন করতে পারে না। যদি এমন হয়, সুরেশ্বর তার প্রতি করুণা করে এসেছে, যদি এমনও হয় যে সুরেশ্বর যে সাহায্য হৈমন্তীকে করেছিল আজ তার প্রতিদান চাইছে মনে মনে–তবু হৈমন্তী সুরেশ্বরকে এই মর্যাদার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যেতে দেবে না। তুমি মহানুভব, উদার; আমি স্বার্থপর, ঋণী, প্রবঞ্চক–এই অহঙ্কার যেন তোমার না থাকে।
হৈমন্তী শুয়ে শুয়ে অনুভব করল দমকা প্রবল বাতাসে তার জানলার পরদা ফুলে উঠেছে, শব্দ হচ্ছে, যেন হঠাৎ পরদাটা ছিঁড়ে গিয়ে অবরুদ্ধ বাতাস ঘরে ঢুকে সব তছনছ করে দেবে।
.
০৫.
পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে না থেকে হৈমন্তী একা একাই ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছিল। তার হাতে সামান্য কটা জিনিসপত্র, বাকি সবই মালিনীর কাছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে অল্প একটু এসেই মালিনীর কী যেন হল, অপ্রতিভ মুখে বলল: আমায় একবার বাড়ি যেতে হবে হেমদি; আপনি বেড়াতে বেড়াতে এগোন, আমি আসছি।
আশপাশ দেখতে দেখতে হৈমন্তী এগোচ্ছিল। বেশ লাগছে চোখে। পাথর বাঁধানো রাস্তা, দু ধারে অনেকটা তফাতে তফাতে কাঠের খুটির মাথায় ইলেকট্রিক তার টেনেছে, গাছগাছালিও কম নয়, পথের দু দিকেই ছাড়া ছাড়া বাড়ি, খোলামেলা, বাগান-টাগান আছে, খুব শৌখিন বাড়িগুলো একেবারে ফাঁকাফটক বন্ধ; নানারকম নাম। ছোটখাটো বাড়িগুলোতে মানুষজন আছে।
পাড়াটা খুবই ভাল, মালিনীদের বাড়ি অবশ্য খানিকটা পিছিয়ে, সদর রাস্তা থেকে চার পাঁচটা বাড়ি ভেতরে। এক সময় মালিনীর বাবা যখন বাড়ি করেছিলেন তখন নাকি এখানে লোক আসত না, তারপর হুড়মুড় করে কত পয়সাঅলা লোক এসে গেল, বাড়ি করল, ফেলে রাখল, ছুটিছাটায় আসা-যাওয়া করতে লাগল। কে জানত বলুন হেমদি, শেয়াল রাজার এত বড় লেজ গজাবে। …তবু রক্ষে বাবা এই মাথাগোঁজার জায়গাটুকু করেছিল, নয়তো আমরা রাস্তায় দাঁড়াতাম। কথাটা ঠিকই বলেছে মালিনী; হোক না কেন দু খুপরির ঘর, শ্যাওলা ধরা চেহারা, চিটদেওয়াল টালিছাওয়া বাড়ি–তবু তো বেচারিদের মাথা গোঁজার আশ্রয়। এই আশ্রয় ওদের কাছে কতটা তা ওরাই বোঝে।
রাস্তাটা ভাল, কিন্তু ধুলো ওড়ে বড়। এলোমেলো, ঘোট ঘোট ঘূর্ণি বাতাসে মাঝে মাঝে ধুলো উড়ছিল। হৈমন্তী নাকেমুখে রুমাল চাপা দিল না। কেন যেন ধুলোর গন্ধটা তার ভালই লাগছিল। শৌখিন বাড়িগুলোর ফটকে মাধবীলতা, জুই, আরও কত লতাপাতা। এক বাড়ির গেটের দুপাশে ইউক্যালিপটাস গাছ। লিকলিকে চেহারা, সোজা উঠে গেছে। হৈমন্তী গাছ দুটোর গা মাথা দেখতে গিয়ে আকাশ দেখল। চমৎকার এক টুকরো লাল মেঘ, হাঁসের মতন গড়ন। যেন পাখা গুটিয়ে ভাসতে ভাসতে চলেছে।
আরও কয়েক পা এগিয়ে এসে হৈমন্তীর হঠাৎ নজরে পড়ল, তার খুব কাছাকাছি, মুখোমুখি এক ভদ্রলোক, তার দিকে তাকিয়েই এগিয়ে আসছেন।
চেনা, নাকি চেনা নয়, কোথায় যেন দেখেছি, চোখ এবং স্মৃতি অকস্মাৎ ঘোলাটে হয়ে আবার পরিষ্কার হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে হৈমন্তী থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। উলটো দিকের ভদ্রলোকও মুখের সামনে।
ঈষৎ বিমূঢ়তা এবং অস্বস্তি যেন উভয়পক্ষই অনুভব করল।
আপনি! অবনী বিস্মিত হয়ে বলল।
হৈমন্তীর তখনও পুরোপুরি বিমূঢ়তা কাটেনি। ইতস্তত ভাব করল। এই তো
এদিকে কোথায়? অবনী স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
একজনের সঙ্গে এসেছিলাম– হৈমন্তী ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে দূরের পানে ইঙ্গিত করল; তারপর হাসবার মতন মুখ করে বলল, একটু কাজে সে বাড়ি গিয়েছে, আসবে এখুনি। …আপনি এখানে?
অবনী হাত বাড়িয়ে রাস্তার পাশে একটা বাড়ি দেখাল, বলল, আমার বাড়ি। অফিস থেকে ফিরছি।
হৈমন্তী মুখ ফিরিয়ে বাড়িটা দেখল। একেবারে তার ডান পাশে। বাগান খানিকটা, তারপরই বাড়ি, বারান্দা দেখা যাচ্ছে।
হৈমন্তী কী বলবে ঠিক করতে না পেরে সাধারণ আলাপ করার গলায় বলল, এদিকে বেশ ভাল ভাল বাড়ি দেখছি।
তা দেখবেন। কিছু পয়সাঅলা লোক আছে, বাড়ি করে রেখেছে, এখানে থাকে না, ছুটিতে আসে। …তবে, এদিকের অ্যারিসট্রোকেট পাড়া ওপাশে, কলকাতা-পাটনার ধনী ব্যক্তিদের ব্যাপার… অবনী হাসির মুখ করল। কী ভেবে লঘু সুরে অবনী আবার বলল, আমি কিন্তু বাড়ির মালিক নই, ভাড়াটে।
হৈমন্তী কিছু বলল না, হাসল।
অবনী সামান্য অপেক্ষা করে আবার বলল, কেমন লাগছে নতুন জায়গা?
তাকাল হৈমন্তী, অবনী নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে, দৃষ্টিটা কৌতূহলের না কৌতুকের ঠিক বোঝা যায় না। মন্দ না।
বাইরে থেকে এসে প্রথম প্রথম ভালই লাগে—
হ্যাঁ, খুব ফাঁকা। জঙ্গলই প্রায়।
আপনাদের আশ্রম তা হলে ভালই চলছে! অবনী ঠাট্টা করছে কি না বোঝা গেল না।
চলছে হৈমন্তী সসঙ্কোচে হাসল সামান্য; আপনি তো কই আর এলেন না?
অবনী কিছু বলতে যাচ্ছিল, সংযত হল; বলল, যাব একদিন। সুরেশ্বরবাবুর নেমন্তন্ন আছে।
হৈমন্তী পিছন দিকে তাকাল। মালিনীর এখও দেখা নেই। কী যে করছে কে জানে।
অবনী লক্ষ করল: হৈমন্তী সামান্য অধৈর্য হয়ে উঠেছে। বলল, আমার বাড়িতে বসবেন খানিক?
না না, থাক; অন্য একদিন বসব। …বেড়াতে আমার ভালই লাগছে।
এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা যায় কতক্ষণ। অবনী বলল, চলুন তা হলে আপনাকে খানিকটা এগিয়ে দিই।
থাক না…আপনি অফিস থেকে ফিরছেন আবার এখন কষ্ট করে. হৈমন্তী আপত্তি জানাবার চেষ্টা করল।
কী আর কষ্ট, চলুন, আস্তে আস্তে হাঁটি–ততক্ষণে আপনার সঙ্গী এসে পড়বে। হাঁটতে হাঁটতে আবার বলল, কে এসেছে সঙ্গে–?
একটি মেয়ে, ওখানেই থাকে, বাড়ি এখানে।
অবনী তেমন কোনও মেয়েকে খেয়াল করতে পারল না। সুরেশ্বরের কি একটা নারী-আশ্রমও আছে নাকি? অবনী মনে মনে কৌতুক বোধ করল।
হৈমন্তী হঠাৎ শুধোল, আপনি এখানে অনেক দিন থেকেই আছেন?
না; দু বছর।
তবে তো অল্প দিনই। …কেমন লাগে আপনার?
খারাপ কী!
হৈমন্তী মুখ ফিরিয়ে অবনীকে লক্ষ করবার চেষ্টা করল। শেষে বলল, এদিকটা মন্দ নয়; লোকজন, হাটবাজার, আলো বেশ শহর-শহর ভাব। আমাদের ওদিকটায় একেবারে চুপচাপ। কলকাতা থেকে এসে মনে হয়, জলে পড়ে গিয়েছি! হৈমন্তীর হাসল।
অবনী হৈমন্তীকে দেখতে চাইল। এই আলোয় তেমন করে হৈমন্তীর চোখ দেখা যায় না। অবনী বলল, কোথায় থাকতেন কলকাতায়?
ভবানীপুর। …আপনিও কি কলকাতায়…
বাদুড়বাগানে। অবনী হাসল হঠাৎ, তারপর বলল, প্রায় বাদুড়ের মতনই।
হৈমন্তী কিছু বুঝল না, কিন্তু অবনীর হাসিটা কানে লাগল। কিছু না বুঝেও কেমন হাসির মুখ করল হৈমন্তী।
চুপচাপ আরও কয়েক পা এগিয়ে এসে অবনী বলল, আপনার ডাক্তারি কেমন চলছে?
এবারে হৈমন্তী হেসে ফেলল। অবনী এমন ভাবে কথাটা বলেছে যেন মনে হয় হৈমন্তী সদ্য একটা ডিসপেনসারি খুলে বসেছে। হৈমন্তী বলল, এখনও হাতযশ হয়নি।
অবনী বোধ হয় বুঝতে পারল, বুঝতে পেরে হালকা গলায় হাসল।
হৈমন্তী বেশ সপ্রতিভ হয়ে উঠেছিল। বলল, ডাক্তার উকিলদের কেমন পশার তা নাকি রুগি আর মক্কেলদের জিজ্ঞেস করতে হয়। আমার তো পশার নেই।
ছুটতে ছুটতে মালিনী এসে পড়েছে ততক্ষণে। এসে অবনীকে দেখে বোকা হয়ে গেছে যেন।
হৈমন্তী বলল, এতো দেরি তোমার!
মালিনী আড়ষ্ট, কোনও কথা বলল না। অবনী মালিনীকে দেখল। দেখা মুখ।
বাস পাব তো? হৈমন্তী শুধোল।
মাথা হেলিয়ে মালিনী জানাল, হ্যাঁ–পাওয়া যাবে।
অবনী ঘড়ি দেখল হাতের, এখনও মিনিট পনেরো আছে। তাড়াতাড়ি যান–পেয়ে যাবেন। আচ্ছা–
হৈমন্তী চঞ্চল হয়ে উঠল। অবনীর দিকে চকিতে তাকাল, আসবেন একদিন।
অবনী মাথা হেলিয়ে হাসল। যাব।
এগিয়ে এসে মালিনী সবিস্ময়ে শুধোল, ওঁকে আপনি চেনেন, হেমদি?
হৈমন্তী মালিনীর মুখ লক্ষ করল। হ্যাঁ, ওঁর গাড়িতেই আমরা সেদিন গিয়েছিলাম। কেন?
মালিনী জানে হেমদিরা প্রথম যেদিন আশ্রমে আসেন গাড়ি করেই এসেছিলেন। বাস খারাপ হয়ে যাবার গল্পও সে শুনেছে। কিন্তু জানত না অবনীর গাড়িতেই হেমদিরা এসেছিলেন। সে কাছে ছিল না, অবনীকেও দেখেনি।
মালিনী বলল, আমার ভাই ওঁর অফিসে চাকরি করে।
ও! হৈমন্তী বুঝতে পারল।
খানিকটা এগিয়ে এসে মালিনী বলব কি বলবনা করে আবার বলল, লোক কিন্তু ভাল না।
হৈমন্তী মুখ ফেরাল।
খুব মদটদ খায়.. মালিনী বলল।
মালিনীর মুখ দেখছিল হৈমন্তী, যেন তার চোখ বলছিল: কী করে জানলে তুমি?
মালিনী গলা একটু নামিয়ে বলল আবার, বাড়িতে একলা থাকে।
মালিনীর গলার স্বরে এমন এক ইঙ্গিত ছিল যা কানে খারাপ লাগে। হৈমন্তী হঠাৎ কেমন বিরক্তি বোধ করল মালিনীর ওপর, অসন্তুষ্ট হল।
ভর্ৎসনার মতন করে হৈমন্তী বলল, পরচর্চা করতে হবে না এখন, চলো।
মালিনী চুপ করে গেল।
.
সন্ধের পর বিজলীবাবু এলেন। এই সময়টা তাঁর পক্ষে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াবার উপযুক্ত সময় নয়। যেদিনই আসেন হেঁটে আসেন, হেঁটেই ফেরেন।
হাতে কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট, দেখলে মনে হয় কোনও জিনিস কিনে ফিরছেন। বাগানটুকু পেরিয়ে বারান্দায় ওঠার আগে বিজলীবাবু সিঁড়ির পাশের বেলঝাড় থেকে কয়েকটা বেলফুল তুলে নিলেন, তুলে ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বারান্দায় এসে ডাকলেন–মিত্তিরসাহেব।
অবনী বেরিয়ে এল। আরে, এই যে আসুন–!
বিজলীবাবু ডান হাতের মুঠো থেকে বেলফুল দেখালেন। আপনার বাগানের বেলিফুলের খাসা গন্ধ তো, মিত্তিরসাহেব। মাটিতে কিছু দেন নাকি? বিজলীবাবু ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসলেন। যাবার সময় আরও কটা নিয়ে যাব। আমার দ্বিতীয়টির আবার লুকিয়েচুরিয়েও দু-চারটে বেল মাথায় গোঁজার শখ এখনও আছে।
অবনী হেসে ফেলল। যাবেন; পুরো বেলগাছটাই উপড়ে নিয়ে যেতে পারেন। বিজলীবাবু মজার মুখ করে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, আমার বাড়ির মাটিটা তেমন সরেস নয় বুঝলেন মিত্তিরসাহেব, রসের মাটি থেকে দু-চারটে ফুলই ভাল।
হাসতে লাগল অবনী। বিজলীবাবুও হাসলেন।
অবনী বলল, চলুন, বসা যাক।
মধ্যের ঘর দিয়ে পাশের এক ঘরে এল অবনী। ছোট, চৌকো ঘর; দুদিকে জানলা। বাতি জ্বলছিল। বসার জন্যে নিচু, গোটা তিনেক চেয়ার, এক পাশে কালো রঙের এক আর্মচেয়ার, একটা গোল সেন্টার টেবিল। একদিকে কাঠের ছোট একটি দেরাজ, বেতের বুককেসে কিছু এলোমেলো বই, দেওয়ালে একটি ক্যালেন্ডার।
ঘরে আসবাবপত্র যা আছে তা সামান্য হলেও এই ঘরের পক্ষে যথেষ্ট। অবনীর এটা ঠিক বসার ঘর নয়, অবসর সময় কাটানোর নিভৃত ঘর। পানাদি এই ঘরে বসেই করে থাকে অবনী।
বিজলীবাবু বসলেন। হাতের প্যাকেটের কাগজ খুললেন, একটা ভোয়ালে; তোয়ালে জড়ানো নতুন বোতলটি তিনি অবনীর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। গয়া থেকে আনিয়েছি। …এ-সব জিনিস, বুঝলেন মিত্তিরমশাই, কখনও-সখনও এদিকে দু-একটা পাওয়া যায়। একেবারে গলা কেটে দাম নেয় বেটারা।
অবনী দেখল। হুইস্কি: ডিমপল স্কচ। বলল, ভাল জিনিস।
কুলীন।
বসুন, সোড়া আছে বোধ হয় দেখছি– অবনী চলে গেল।
বিজলীবাবু সিগারেট ধরিয়ে এপাশ-ওপাশ তাকালেন। একটা বই পড়ে ছিল, উঠিয়ে নিয়ে দেখলেন, রেখে দিলেন। ইলাস্ট্রেটেড উইকলির পাতা ওলটাতে লাগলেন বিজ্ঞাপনের মেয়েদের ছবি দেখলেন খুঁটিয়ে। চশমা খুলে মুছে নিলেন।
খেতে খেতে বিজলীবাবু বললেন, আরে, আপনাকে তো আসল খবরটা দিতেই ভুলে গিয়েছি, মিত্তিরসাহেব। …আজ কার দর্শন পেলাম বলুন তো?
কার–? অবনী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।
সেই চোখের ডাক্তারনির…। এদিকে এসেছিল। ফিরছে। বাসে চাপল।
আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে। অবনী বলল।
তাই নাকি? কোথায় দেখলেন? বিজলীবাবু উৎসাহ অনুভব করলেন।
রাস্তায়। বাড়ির কাছেই। …অফিস থেকে ফিরছিলাম, দেখা হল। …এদিকের একটি মেয়ের সঙ্গে এসেছিল।
মালিনী। …আরে, ওই তো প্রণবকুটিরের পাশ দিয়ে যে গলিমতন রাস্তাটা নেমে গেছে তার মধ্যে থাকে; শশধর বাঁড়ুজ্যের মেয়ে। বাপ মরে গেছে কবে। ওর ভাইটা তো আপনার অফিসে কাজ করে।
কে?
কেষ্ট। ভাল নামটা যেন কী..অনাদি-টনাদি হবে।
অবনী চিনতে পারল।
বিজলীবাবু বললেন, মেয়েটা সুরেশমহারাজের আশ্রমে থাকে আজকাল। বলে একটু থেমে অবনীর দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, আপনাকে একবার বলেছিলুম মিত্তিরসাহেব, একটি মেয়ে দিচ্ছি রাখুন রান্নাবান্না করবে, ঘরদোর দেখবে…তা আপনি রাজি হলেন না। রাখলে আরামই পেতেন। ওই মেয়েটির কথা ভেবেই বলেছিলাম।
অবনী বিজলীবাবুর চোখ এবং মুখ দেখল।
বিজলীবাবু অপ্রতিভ হলেন না, বললেন, ওই সব মেয়ে, দেখতে দেখতে বর্ষার কলাগাছ হয়ে উঠেছে। বিজলীবাবুর চোখের তারা চিকচিক করে উঠল। ফেমিনাইন জেন্ডারের ওপর তেমন ভক্তি নেই কেন, মিত্তিরসাহেব?
অবনী কৌতুক অনুভব করল। বিজলীবাবু বরাবরই শব্দটা ওইভাবে বলেন। মাঝে মাঝে কথাটা জিজ্ঞেসও করেন। অবনীর ব্যাপারে তাঁর কোথাও যেন এক ধরনের কৌতূহল ও অবিশ্বাস রয়েছে। বিজলীবাবুর কাছে অবনী নিজের পারিবারিক পরিচয়টা এমনভাবে দিয়েছিল যাতে বিজলীবাবু কোনও কিছুই ঠিক মতন বুঝতে পারতেন না।
অবনী পাত্রটুকু শেষ করল। চাপা হাসি মুখে বলল, আপনার কী মনে হয়?
পাঁচ রকম সন্দেহ হয়
যেমন! অবনী সিগারেট ধরাল।
বিজলীবাবু মাথা নিচু করে অভ্যস্ত হাতে উভয়ের পাত্রে হুইস্কি ঢাললেন মাপমতন। সোড়া মেশাতে মেশাতে বললেন, কোথাও কোনও ব্রেকডাউন আছে নাকি?
অবনী হাসল। জোরে নয়।
অসুখ-বিসুখও তো আপনার থাকার কথা নয়। বিজলীবাবু এক টুকরো ওমলেট, কয়েকটা আদার কুচি মুখে দিলেন, দিয়ে চিবোতে লাগলেন। বিজলীবাবুর ধারণা, ডিমে উত্তেজনা বৃদ্ধি হয়।
অবনী অনেকটা ধোঁয়া গলায় টেনে নিল।
বিজলীবাবু বললেন, অনেকে শুদ্ধাচারী থাকতে ভালবাসে, সাধুসম্নেসী মানুষ-টানুষের কথা বলছি। তারা, মিত্তিরসাহেব, ব্রেহ্মচারী, বেটাদের সব তাতেই পাপ পাপ ভাব। …আরে–মুখ্য পাপ কীসের? পাপটা তুই দেখলি কোথায়? নপুংসক হয়ে জন্মেছি নাকি জগতে। বলবে, লালসা…। আলবাৎ লালসা. দেহের লালসা সখি পাপ বলে গণ্য করে যারা–একথা কি ভুলে যায় তারা সেলালসা সৃজিয়াছে নিজে ভগবান…।
বিজলীবাবু ওমর খৈয়ম আওড়াতে শুরু করেছেন। লালসা পাপ কি না বলা যায় না। তবে, অবনী ভাবল, লালসাও শেষ পর্যন্ত থাকে কোথায়? ভাবতে গিয়ে পানীয়ে তেমন জুত করে চুমুক দিতে না পেরে কেমন অস্বস্তি অনুভব করল।
মানুষের ইন্দ্রিয়গুলো কি বাক্সে তুলে রাখবার জিনিস, মিত্তিরসাহেব? বিজলীবাবুবড় করে একটা চুমুক দিলেন, দিয়ে সিগারেট ধরালেন, দেশলাই কাঠি কানে দিয়ে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বললেন, মুখ, শালারা সব মুখ। আমি বোকা নয়, গাধার বাচ্চা নই। মুখ্যরাই এ জগতের মর্ম বোঝে না। আমার স্ট্রেট কথা, যে কদিন বেঁচেবর্তে থাকব, আমি শালা রাজার মতন থাকব। চোখ বুজলে কে কার আমাদের আসা-যাওয়া কে বা খোঁজ নেবে? সিন্ধুজলে বিন্দুসহ মিশে যাব সবে।
বিজলীবাবুর মুখের ভাবটা আস্তে আস্তে বদলে আসছে: ফরসা মুখের চামড়ায় সামান্য লালচে ভাব, কপালে কয়েক বিন্দু ঘাম, চোখ ঈষৎ অলস। চশমাটা তিনি খুলে ফেলেছেন।
অবনী হেসে বলল, ড্রিংক, ফর ওয়ানস ডেড, ইউ শ্যাল নেভার রিটারন…
উ… হ্যাঁ হ্যাঁ…নেভার রিটারন। মাথা ঝাঁকালেন বিজলীবাবু, ছেলেবেলায় পদ্য পড়েননি– সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়–যে জন না বোঝে তারে ধিক শত ধিক। আপনার সময় চলে যাচ্ছে…গ্রোয়িং ওলড়…; শেষ কালে আফশোস হবে মিত্তিরসাহেব।
আপনার কোনও আফশোস নেই?
এমনিতে নেই, বিজলীবাবু হাত তুলে নাড়লেন। একটা প্রাইভেট আফশোস অবশ্য আছে: আমার ডান বাঁ দু দিকেই শূন্য কুম্ভ। বুড়ো আঙুল দিয়ে বিজলীবাবু তাঁর ডান বাঁ দেখালেন।
অবনী ঠিক বুঝতে পারল না, তাকিয়ে থাকল। জিবের স্বাদের জন্যে কয়েকটা ভাজা আলু মুখে দিল।
বিজলীবাবু হাত বাড়িয়ে দেশলাই তুলে নিলেন, চোখের পাতা আধবোজা করে হাসলেন, বউয়ের কথা বলছি। আমার দুটো বউই বাঁজা। পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা। …আমার ভার্যাতে কিছছু হল না।
অবনী বিজলীবাবুকে দেখছিল: বোঝা যায় না তেমন তবু সন্দেহ হয় বিজলীবাবুর মনে গভীর একটি ক্ষোভ আছে। সহসা অবনীর চোখের সামনে কুমকুমের মুখ ভেসে উঠল, একমাথা চুল, রিবন বাঁধা, সামনের দাঁতটা পড়ে গেছে। মেয়েটা এখন আরও বড় হয়েছে, দাঁত উঠে গেছে এতদিনে।
বিজলীবাবু শুধোলেন, ভগবান-টগবানে বিশ্বাস আছে, মিত্তিরসাহেব?
অবনী যেন কুমকুমকে টুপ করে ডুবে যেতে দেখল। বিজলীবাবু সিগারেট ধরালেন আবার।
দু-একটা জায়গায়– বিজলীবাবু বললেন, যা মারার–ওই ভগবান শালাই মারে।
অবনী একটু হাসার মুখ করল, করে তার গ্লাসের বাকি পানীয়টুকু শেষ করল।
সামান্য সময় চুপচাপ। বাইরের জানলা দিয়ে বাতাস আসছে, মাথার ওপর পাখা চলছে, তবু গরম লাগছিল। বিজলীবাবু মুখ মুছলেন। চশমাটা পরলেন আবার। অবনীর চোখের তলা যেন ঈষৎ স্ফুরিত হয়েছে, সাদা জমিটা সামান্য লালচে। স্বেদ জমেছে মুখে।
অবনী উঠে গিয়ে পাখাটা বাড়িয়ে দিল। দিয়ে ভেতরে চলে গেল। সামান্য পরে ফিরল আবার। বিজলীবাবু চোখ বন্ধ করে কোনও পুরনো বাংলা গানের সুর আলাপ করার চেষ্টা করছিলেন গুনগুন করে। ফিরে এসে অবনী আবার দুজনের গ্লাস তৈরি করল।
বিজলীবাবু বললেন, কথায় কথায় আসলটাই ভুলে যাচ্ছি, মিত্তিরসাহেব। …ওই যে মেয়েটি চোখের ডাক্তার–ওঁর ব্যাপারটা কী?
কীসের ব্যাপার?
এখানে এসে জুটল যে। সুরেশ-মহারাজের আত্মীয় নাকি?
জিজ্ঞেস করিনি।
কী নাম?
হৈমন্তী।
উপাধিটা কী?
জানি না। …জিজ্ঞেস করিনি!
কোথ থেকে আসা?
কলকাতা।
বিজলীবাবু কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ থেকে শেষে বললেন, একটু বয়েস হয়ে গেছে, তা হোক, চেহারাটা আছে। …বিয়েটিয়ে করেছে বলে তো মনে হল না।
অবনী মাথা নাড়ল, জানি না। বোধহয় না। …বিয়ে করলেও আজকাল অনেকে মাথায় সিঁদুর দেয় না। ব্রাহ্ম হতে পারে, ক্রিশ্চান হতে পারে। এরাও অনেকে সিঁদুর পরে না। অবনী পরিহাস করে বলল।
সুরেশ-মহারাজ পাকা হিন্দু। বিজলীবাবু যেন মনে মনে হিসেব করলেন, না, মহারাজজির স্ত্রী হলে সিঁদুরটা থাকত।
অবনী সিগারেট ধরাল। গা এলিয়ে বসে উলটো দিকের জানলার দিকে তাকিয়ে থাকল, বাইরে পেয়ারা ডাল নড়ছে অন্ধকারে, বারান্দার আলোর মৃদু আভায় ডালের কয়েকটি পাতা শাড়ির আঁচলের মতন মনে হচ্ছে।
বিজলীবাবু বললেন, শুনেছি আজকাল আশ্রমটাশ্রম করতে হলে একজন করে মা লাগে। সুরেশ-মহারাজ কি মা আমদানি করলেন…?
অবনী কোনও জবাব দিল না।
উত্তরের অপেক্ষা করে শেষে বিজলীবাবু আবার বললেন, না–মিত্তিরসাহেব, আমাদের মহারাজজি আবার ও-সব সাধনাফাধনাও করে না। মা আমদানিই বা করবেন কেন!
অবনী এবার কথা বলল, সেবা-টেবা করতে এসেছে হয়তো। আপনার সুরেশ-মহারাজের ভক্ত।
ভক্তরাই সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়। এ তো তারও বেশি–ভক্তি…। আপনার মতন মানুষ আর কটা পাবেন, ফেমিনাইন জেন্ডার বাদ দিয়ে চলে।
অবনী হেসে ফেলল। আপনার সুরেশ-মহারাজ কি মেয়েতে ভুলবে?
ভোলা উচিত নয়। …তবে দেবী কেমন তার ওপরেই দেবতার সেলফ কনট্রোল। এ তো আমার কথা নয়, শাস্ত্ৰতেই দেখুন–অমন বোমতোলা খেপা শিব–সেও উমাকে দেখে মজে গেল। দেবীতেই সৃষ্টি-দেবীতেই প্রলয়। কিছু বলা যায় না, এই দেবীটি সুরেশ-মহারাজের চোখ ফুটিয়ে দিতে পারে আবার বন্ধ করে দিতেও পারে।
অবনী চেয়ারের কাঁধে মাথা হেলিয়ে চোখের পাতা বন্ধ করল। মাথা ভারী হয়ে আসছে। বিজলীবাবুর কথায় হাসবার চেষ্টা করল, তেমন হাসতে পারল না।
রাত হয়েছে। বিজলীবাবু এইমাত্র চলে গেলেন। যাবার সময় তাঁর বেলফুলের কথা মনে থাকল না, অবনীরও নয়। ফটক পর্যন্ত বিজলীবাবুকে এগিয়ে দিয়ে অবনী ফিরল।
আজ একটু বেশি রকম খাওয়া হয়ে গিয়েছে, চোখে পরিষ্কার কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না অবনী, ঝাপসা গাছপালা, বারান্দার একটু আলো, অভ্যস্ত পথে এলোমেলো হেঁটে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ঠাণ্ডা বাতাসে দাঁড়াল সামান্য, পায়ে জোর পাচ্ছে না, হাত যেন কাঁপছে। সিগারেটের টুকরোটা অনাবশ্যক জোরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। স্টেশনের দিক থেকে ভারী একটা শব্দ ভেসে আসছে মালগাড়ি চলে যাচ্ছে নিজের নিশ্বাস-প্রশ্বাস হঠাৎ কেমন কষ্টকর লাগল। মাথা তুলে আকাশ দেখার, অথবা ঊর্ধ্বমুখে নির্মল বাতাস টানার বাসনা হল, মাথা তুলতে গিয়ে অসম্ভব ভারী এবং বেসামাল লাগায় অবনী মাথা তুলল না। চোখের পাতা জুড়ে আসছিল।
সিঁড়ির কাছাকাছি আসতে সহসা তার মনে হল কে যেন ডাকল। দাঁড়াল অবনী। আস্তে আস্তে পিছন ফিরল। পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না, অল্প একটু আলো সামনে, তারপর অন্ধকার। কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকল অবনী, অপেক্ষা করল। না, কেউ নয়।
সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে হঠাৎ তার মনে হল, গলার স্বরটা তার চেনা। কার যেন, কার? ললিতার। অবনী সঙ্গে সঙ্গে আবার ঘুরে দাঁড়াল। যথাসম্ভব উজ্জ্বল চোখে তাকাল। না, কেউ না।
অবনী এবার হাসল। জোরে নয়, মৃদু শব্দ করে, যেন নিজেকে শোনাল। অদ্ভুত এক চিন্তা এল মাথায়: কখনও কখনও নাকি দূরে কোনও আত্মীয়-টাত্মীয় মরে গেলে হঠাৎ তার ডাক শোনা যায়। প্রিমোনিশান? টেলিপ্যাথি? ললিতা কি মারা গেল নাকি হঠাৎ? …ননসেন্স! হুইস্কিটা ভালই। মনিঅর্ডারে ললিতা এখনও তার আত্মীয়।
ঘরে ঢোকার সময় অবনী যেন সহসা তার পাশে বিজলীবাবুকে অনুভব করতে পারছে সামান্য মুখ ফেরাল। বিজলীবাবু তার মুখের পাশে মুখ লাগিয়ে যেন চলেছেন। সারা মুখে একটা হাসি।
হাসিটা ভাল লাগল না অবনীর। বিজলীবাবুর মুখ হাসিতে ফুলে উঠছে ক্রমশ, বেলুনের মন বাড়ছে, শেষ পর্যন্ত ফেটে যাবে।
বিরক্ত হয়ে অবনী মুখ ফিরিয়ে নিল।
কানের পাশে বিজলীবাবু যেন ফিসফিস করে বললেন, ও কে?
কে আবার, ললিতা। অবনী কোনওদিকে তাকাল না।
বিজলীবাবুর মুখ যেন ফেটে যাবার অবস্থা: ফেমিনাইন জেন্ডারের মজা কী জানেন, ওটা কী বোঝ যায় না, কখন কাকে দেখছেন কী ভাবছেন…
অবনী ঘরে চলে এল। বিজলীবাবুর হাসি পিচকিরির রঙের মতন যেন তার চেতনার কোথাও ছিটিয়ে পড়েছে।
বিছানায় এসে বসল অবনী। বসল এবং বিজলীবাবুকেই যেন মনে মনে বলল:
ললিতাকে আপনি দেখেননি বিজলীবাবু, শরীরে আঙুল ছোঁয়ালে এক সময় আমার সমস্ত কিছু জ্বলে যেত। পাকা বড় আঙুরের মতন শরীর, নোখের দাগ লাগলে যেন ফেটে রস গড়িয়ে পড়বে। ললিতার জন্যে আমি পাগল হয়েছিলাম। ওকে বিয়ে করার পর, আগেও তিন-চারটে বছর, ললিতাকে আমি রাক্ষসের মতন ভোগ করেছি। …তখন, আমার ধারণা, আমি তাকে ভালবাসতাম। …অথচ, পরে আমার ওর প্রতি আকাঙ্ক্ষা চলে গেল, আস্তে আস্তে; ভালবাসাও থাকল না। তৃষ্ণার্তের পিপাসা মিটে গেলে যেমন হয়। তখন আর ললিতাকে ভাল লাগত না, অকারণ, অপ্রয়োজনীয় মনে হত। আমাকেও ললিতার প্রয়োজন ছিল না। ভোগস্পৃহা মরে গেলে ভোগ্যবস্তু ভোগ করা যায় না, উপভোগও নয়। আমার ভোগস্পৃহা মরে গিয়েছিল।
১. চারজনের আর জায়গা
০১.
পাশাপাশি চারজনের আর জায়গা হল না। মালপত্রেই গাড়ির বারো আনা ভরে গিয়েছিল; শরদিন্দু যেরকম লটবহর জুটিয়েছেন, মনে হচ্ছিল, আধখানা সংসারই তুলে এনেছেন। হাওড়া স্টেশনের ট্যাক্সিঅলাদের যা ধরন, তাতে এই পর্বতপ্রমাণ মালপত্র তারা কিছুতেই এক গাড়িতে নিত না। কাঠফাটা দুপুররোদে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি-ট্যাক্সি করতে হত। ছেলেটার কষ্ট হত খুব, চোখের যন্ত্রণায় হয়তো ছটফট করত। শরদিন্দুও রোদে-তাতে অস্থির হয়ে উঠতেন। সাতপাঁচ ভেবে নীহার বাড়ি থেকে বেরুবার সময় একটা প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে এসেছিলেন; দেবু দত্তদের গাড়ি, কখনও-সখনও তাঁকে এরকম দু-চার ঘণ্টার জন্যে ভাড়া নিতে হয়। ড্রাইভার কেষ্ট ছেলেটিও ভাল, দরকারে সাহায্য করে সবরকম। সোয়া এগারোটার গাড়ি এল পৌনে একটায়। এতক্ষণ হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা, গরমে পচে যাওয়া; তবু কেষ্ট একটুও বিরক্ত নয়। নীহার কুলিদের বাবা বাছা করে, কেষ্টর খবরদারিতে মালপত্র সব তুলিয়ে নিয়ে শরদিন্দুকে সামনে বসতে বললেন। সামনেও কিছু মালপত্র রাখতে হয়েছে। নীহাররা বসলেন পেছনে; নীহার, তনুশ্যাম আর রিনি।
গাড়ি ছাড়লে নীহার মাথার কাপড় নামিয়ে ঘাড়-গলার ঘাম মুছতে লাগলেন; চেহারা দিন দিন ভারী হয়ে উঠেছে, তার ওপর এই দুপুরের রোদ, গরম, প্ল্যাটফর্মে বসে অপেক্ষা, ভিড়।
নীহারের পাশে তনুশ্যাম। ছেলেটাকে জানলার পাশে বসাতে সাহস হয়নি নীহারের। গরমের হলকা যদি চোখে লাগে বেচারার খুব কষ্ট হবে। তনুর পাশে ডান দিকের দরজা ঘেঁষে বসে আছে রিনি, নীহারের মেয়ে। রিনি নিজেই হাওড়া স্টেশনে আসতে চেয়েছিল। নীহারও চেয়েছিলেন রিনি আসুক। তিনি একলা আসার চেয়ে মা-মেয়ে মিলে শরদিন্দুদের নিতে আসছেন, এটাই ভাল দেখায়।
রিনি যে শরদিন্দুদের দেখার পর থেকে আগাগোড়া হেসে মরে যাচ্ছে–এটা তেমন বোঝার উপায় নেই। হাসিটাকে সে নানাভাবে কখনও মুখ ফিরিয়ে, কখনও একেবারে উলটো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে, কখনও বা ঠোঁট কামড়ে, মুখ আড়াল করে লুকিয়ে রাখছে। যখন আর সামলাতে পারছে না, হেসেই ফেলছে। নীহারের অবশ্য মেয়ের অত হাসি দেখার সময় কই! কুলি আর মালপত্রের দিকেই নজর তাঁর। শরদিন্দুও যেন নীহারের ব্যবস্থাপনা দেখছেন। আর তনুশ্যাম অবাক হয়ে দেখছে হাওড়া স্টেশন, লোকজন, ট্যাক্সিস্ট্যান্ড, আশপাশ।
শরদিন্দুর সাজপোশাকটাই রিনির কাছে খুব হাস্যকর লাগছিল। চার-পাঁচ, কি বড়জোর ছশো মাইল দূর থেকে আসছেন শরদিন্দুমামা; কিন্তু পোশাক দেখলে মনে হবে, খাস বিলেত থেকে এইমাত্র উড়ে এসে নেমেছেন। তাও আবার এখনকার বিলেত নয়, কেননা সেটা রিনি ছবি-টবিতে সিনেমায় দেখেছে। মামার পোশাকটা যেন ডেভিড কপারফিল্ডের লোকজনের মতন। রিনি ইংরেজি সিনেমায় সেকেলে বিলেতি পোশাক-আশাক চক্ষে দেখেছে বলে তার এই রকম মনে হচ্ছিল। এই পচা গরমেও বিচিত্র সুট, টাই, ভেস্ট এবং টুপি। মার ধমকে টুপিটা অবশ্য এখন মামার কোলে; কিছু কাঁচা, কিছু পাতলা সাদা চুল টুপির চাপে পাট হয়ে বসে আছে মাথায়।
মামার ছেলেটি যদিও পোশাকে-আশাকে মামার মতন নয়, তবু তার প্যান্টের কাটছাঁট, চেককাটা জামাটার বাহার দেখলে মনে হবে, এ একেবারেই খোট্টাই ছাঁট। নামেরই কী বাহার ছেলেটার। তনুশ্যাম! ঘনশ্যাম হতে দোষ ছিল কোথায়? রিনিদের কলেজে এক ঘনশ্যাম ছিল, ঘণ্টা বাজাত। রিনিরা তাকে বলত, ঘণ্টাশ্যাম। একে তো আর তা বলা যায় না। শরদিন্দুমামার ছেলে, মার খুব আদরের জন। অথচ মা ছেলেটাকে নাকি দেখেইনি; একবার মাত্র দেখেছিল, তখন তনুশ্যাম একেবারে বাচ্চা, হাফপ্যান্টও হয়তো ঠিক মতন পরতে পারত না। তা হলে রিনি তখন কত? মানে বয়েস কত রিনির? মা বলে, রিনি তখন কাঁথা ভেজাত। দমকা হাসি এসে গেল রিনির, সে হেসে ফেলে গলা চাপবার চেষ্টা করল, রুমালটা কোলের আশেপাশে কোথায় পড়ে গেছে, আঁচলটাই মুখে চেপে ধরল।
নীহার এবার ঘাড় ফিরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। হাসছিস?
রিনির জবাব দেবার কিছু ছিল না; সে খুব বুদ্ধি করে আঙুল দিয়ে দরজার বাইরেটা দেখাল। হাসির উপাদানটা কোথায় তা জানার উপায় থাকল না। গাড়ি চলছে। রিনি তার জানলার দিকেই আঙুল দিয়ে বাইরে কিছু দেখিয়েছে। কাজেই উপাদান যদি কিছু থেকেই থাকে সেটা পেছনে পড়ে গেছে এবং আড়ালে। নীহার কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি বরং দেখলেন, গাড়িটা হাওড়া ব্রিজ দিয়ে যাচ্ছে। তনুশ্যামকে হাওড়া ব্রিজ আর গঙ্গা দেখাতে লাগলেন নীহার। তনুশ্যামও অবাক হয়ে হাওড়া ব্রিজ দেখতে লাগল।
শরদিন্দু সামনে থেকে বললেন, আমাদের সময়ে ছিল কাঠের পুল–ফ্লোটিং ব্রিজ। নতুনটা সবে তৈরি হচ্ছিল। বলে শরদিন্দুও যেন সেই পুরনো ব্রিজটার ছিটেফোঁটা অস্তিত্ব খুঁজতে লাগলেন। ধরতে পারলেন না।
নীহার বললেন, তোমাদের সময়ের কলকাতার কতটুকুই আর আছে। সে কলকাতার সঙ্গে এখানকার আর মিল খুঁজে পাবে না।
তাই শুনি, শরদিন্দু বললেন আস্তে করে, পুরনো কলকাতা মরে গেছে।
রিনির পায়ের কাছে একটা বাস্কেট, তার ওপর একটা হাত দেড়েকের সুটকেস, কোনও রকমে রিনি পায়ের আঙুলগুলো রেখে গোড়ালি তুলে বসে আছে। তার কোমরের তলার দিকের বিশ্রী চাপ পড়ছিল তনুশ্যামের ওপর। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল রিনির। একদিকে ভার দিয়ে বসেও সে নিজেকে সামলাতে পারছিল না। তনুশ্যামও নড়তে পারছে না; তার ওপাশে মা, জলের ফ্রেমসমেত কুঁজোটা তনুর পায়ের তলায়, কোলের ওপর টাইমটেবল, কাগজপত্র, বই। রিনির পা যদি ভার রাখতে পারত তাকে এভাবে হেলে পড়তে হত না ছেলেটার দিকে। তবু রিনি চেষ্টা করল যাতে তার পায়ের দিকের চাপটা আলগা করা যয়। মার তনুশ্যামের তনুটি রোগা-সোগা, বড় জোর বলা যায় ছিপছিপে। গায়ের চেককাটা পুরো হাতার মোটা শার্টটার জন্যে রোগাটে ভাব অতটা বোঝা যাচ্ছে না। ছেলেটার রং শ্যামলা, প্রায় কালচে। বোধহয় সেইজন্যেই নাম হয়েছে তনুশ্যাম। মুখটি খুব মোলায়েম, মেয়েমেয়ে ঢঙের, মানে–মেয়েলি নয়, কিন্তু নরম, শান্ত ধরনের। সারা মুখে পাতলা দাড়ি, মাথার চুলগুলো রুক্ষ, লালচে, পাতলা। চোখে মোটা কাচের চশমা, সাদা কাচের চশমা নয়, রঙিন চশমা–তাতে আবার কানের দিকটাও আড়াল করা। চশমাটা এমনই যে চোখ পুরোপুরি ঢাকা তনুশ্যামের, চোখ দেখা যায় না। রিনি যতবার চোখ দেখার চেষ্টা করেছে, ঘন নীলচে কাঁচ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি। অথচ তনু তার গগলস ধরনের চশমার ভেতর থেকে নিশ্চয় রিনিকে দেখতে পাচ্ছে। রিনির এতে কেমন এক আপত্তি হচ্ছিল, তুমি আমায় দিব্যি দেখবে আর আমি তোমায় দেখব না তা হয় না।
গাড়িটা হাওড়া ব্রিজ ছাড়িয়ে এসেছে কখন। ডান দিকে আসতে আসতে আবার যখন বাঁয়ে মোড় নিল, রিনি একেবারে আচমকা বালিশের মতন ধপ করে তনুশ্যামের কোলে ঢলে পড়ল। তার মাথাটা তনুর বুকের ওপর দিয়ে গড়িয়ে একেবারে কোলে কাগজপত্রের ওপর।
রিনি ভীষণ অপ্রস্তুত। তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে শুনল তনুই হাসছে।
নীহার মেয়ের গড়িয়ে পড়া দেখে অবাক। তারপর হেসে ফেললেন, ঘুমে ঢুলছিলি নাকি?
রাগ করে রিনি বলল, ধত, এভাবে বসা যায়?
নীহার বললেন, কেন যাবে না। আমরা বসে নেই? তুই যদি বসে বসে ঢুলিস, তবে আর বসার দোষ কী!
রিনি বলল, আমি মোটেও ঢুলিনি। মার চেয়েও তার বেশি রাগ হল, তনুর ওপর। ছেলেটা কেমন করে হাসল! অসভ্য একেবারে। রিনি যেন জেদ করেই তনুকে পাশ থেকে চেপে কোমর দিয়ে ঠেলে ঠেলে নিজের বসার জায়গা করতে লাগল। তনু আরও গুটিয়ে নিতে লাগল নিজেকে। শরদিন্দু হঠাৎ বললেন, নীহার, হাইকোর্ট।
নীহার হেসে বললেন, তুমি দেখো তোমরা তো কোনও কালে বাঙাল ছিলে শুনেছি।
তনু এদিক ওদিক তাকিয়ে হাইকোর্ট খুঁজছিল, রিনি চট করে আঙুল দিয়ে ইডেন গার্ডেনসের দিকটা দেখিয়ে দিল। বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো আর কী! তারপর মুখ ফিরিয়ে হাসতে লাগল।
গড়ের মাঠের কাছে এসে নীহার তনুকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখাচ্ছিলেন, রিনি দাঁতে ঠোঁট কেটে টুক করে বলল, পাশেই সবটা গড়ের মাঠ। বলে, মুখ ফিরিয়ে হাসল।
শরদিন্দু বললেন, নীহার, আমি কখনও ওই মেমোরিয়ালের ভেতরে যাইনি।
নীহার হেসে বললেন, কলকাতায় থাকতে তুমি বাপু দুটি মাত্র জিনিস দেখেছিলে, এক তোমার কলেজ আর ঠনঠনিয়ার কালীবাড়ি।
শরদিন্দু হাসির গলায় বললেন, আরে না না, আরও কত কী দেখেছি। আমি বছরে বার-দুই করে জু-য়ে বেড়াতে যেতাম।
নীহার বেশ জোরেই হেসে ফেললেন। হেসে কী মনে হল, তাড়াতাড়ি ছেলেমেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তুমি তো শিবপুরেই বেশি যেতে।
হ্যাঁ, বটানিকসে।
তা তো যাবেই; ওই গাছ-গাছড়াই তোমার জিনিস…এলে যখন আর একবার দেখে যেয়ো৷
যাব, একবার।
মামা, রিনি বলল, আমি আপনাকে এবার একদিন ভিক্টোরিয়ায় ঘুরিয়ে নিয়ে যাব।
শরদিন্দু বললেন, বেশ তো, একদিন সবাই মিলে বেড়াতে আসা যাবে।
শুধু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কেন–নীহার বললেন, তোর মামাকে নিয়ে সারা কলকাতা চষে বেড়াস। কবে কলেজে পড়ার সময় কলকাতায় ছিল, সে কলকাতা আর নেই। কত দেখার জিনিস হয়েছে! বলে তনুর দিকে তাকালেন, ছেলেটাও কলকাতায় এল প্রথম, ওকে সব দেখাতে হবে।
গাড়ি পি জি হাসপাতালের কাছাকাছি আসতে তনুশ্যাম আস্তে করে নীহারকে বলল, আমি চশমাটা খুলব একটু?
নীহার মাথা নেড়ে তাড়াতাড়ি বললেন, না না, না বাবা। এই দুপুর, রোদ গনগন করছে, গরম বাতাস, দেখছ না।
শরদিন্দু ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, চোখে জল পড়তে শুরু করবে, শ্যাম; ট্রেনেই যথেষ্ট অত্যাচার হয়ে গেছে।
তনুশ্যাম আর কোনও কথা বলল না।
রিনি মুখ ফিরিয়ে তনুশ্যামকে দেখছিল। মার কাছে সবই শুনেছে রিনি। তনু চোখের অসুখে ভুগছে অনেকদিন ধরে। বাচ্চা বয়স থেকেই। কয়েক বছর বাড়াবাড়ি যাচ্ছে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে, চিকিৎসা করেছে; কিছু হয়নি। শরদিন্দুমামা ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় এসেছেন চোখের চিকিৎসার জন্যে। রিনির বাবা নিজেই চোখের ডাক্তার ছিলেন কিন্তু তিনি তো আর নেই, রিনির বছর তেরো বয়সে তিনি চলে গেছেন। বাবা থাকলে বাবাই তনুর চোখ দেখতে পারত। বাবা না থাকলেও কলকাতায় অনেক বড় বড় ডাক্তার রয়েছেন, তাঁরা দেখবেন, বাবার বন্ধু হিসেবেও দু-একজনকে মা চেনেন, তাঁরা দেখবেন।
তনুশ্যামের জন্যে রিনির দুঃখই হল। মার কাছে যখন শরদিন্দুমামার চিঠি আসত, মা যখন এই ছেলেটির চোখের অসুখের কথা বলত-টলত, রিনি হয়তো সহানুভূতি বোধ করত কিন্তু তার তেমন কোনও কৌতূহল ছিল না। তারপর সে শুনল শরদিন্দুমামারা কলকাতায় আসছেন। ইদানীং তার খানিকটা কৌতূহল হচ্ছিল। আজ তনুশ্যামকে দেখে রিনি বুঝতে পারছে বেচারির সত্যিই বড় কষ্ট। চোখ দুটো থেকেও যেন না থাকার মতন হয়ে আছে। রিনি তনুর চোখ দুটি কেমন তা দেখার জন্যে কেমন উদগ্রীব হয়ে উঠল।
হরিশ মুখার্জি রোডে গাড়িটা ঘুরে যাবার পর রিনি বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল। ফুটপাথ ঘেঁষে ছায়া পড়েছে খানিকটা, গাছের ছায়া। অন্যদিকে রোদ ঝলসে যাচ্ছে। একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় কিছু খই পড়ে আছে ছিটিয়ে, কয়েকটা শুকনো ফুল। বোধহয় খানিকটা আগে হাসপাতাল থেকে কারও মৃতদেহ চলে গেছে, তারই কিছু চিহ্ন। রিনি বাইরের দিকেই তাকিয়ে থাকল।
বাড়ি এসে মালপত্র তুলতে তুলতে দুটো বেজে গেল। নীহার খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জিনিসপত্র টানাহেঁচড়া খোলাখুলি করতে দিলেন না। মাঝদুপুর পেরোতে চলল, এখন রোদে-তাতে পোড়া মানুষগুলো আগে একটু জিরিয়ে স্নান-খাওয়া করে নিক, শরীরটা জুড়োক, তারপর বাক্স-বিছানা খুললে হবে।
ব্যবস্থার কোনও ত্রুটি নীহার রাখেনি। বাড়িটা এমন কিছু ছোট নয়। বাঁ দিকটায় দুঘর ভাড়াটে; তাদের সঙ্গে এদিকটার কোথাও কোনও সম্পর্ক নেই। ওপাশটা আলাদা। এপাশে ডান দিকে নীচের তলায় একটা নার্সারি স্কুল, দোতলায় নীহাররা থাকেন, তিনতলাতেও দেড়খানা ঘর রয়েছে। নীহারদের দিকটা পড়েছে দক্ষিণে। বারান্দা ঘেঁষে পর পর ঘর, পুবের দিকে একটা বাঁক মতন আছে। শরদিন্দুর জন্যে তেতলার ঘরটাই রেখেছে নীহার। গরমের দিনে দুপুরটায় খানিক কষ্ট হলেও বিকেল পড়ে গেলে বেশ ভালই লাগবে। ঘরের লাগোয়া ছোট এক ফালি ছাদ, টবের কিছু গাছপালা, ফাঁকা, নিরিবিলি কাজ চালাবার মতন বাথরুমও আছে একটা। বাকি আধখানা ঘরে এ বাড়িটার নানান অব্যবহার্য জিনিস জমা করা ছিল। সেটা কিছু পরিষ্কার করা হয়েছে, দরকারে জিনিসপত্র রাখা যেতে পারে।
দোতলায় একটা ঘর ঠিক করা হয়েছে তনুশ্যামের জন্যে। কোনার দিকের ঘর। ঘরটা ছিল রিনির পড়াশোনার, একপাশে তার গানবাজনার কিছু সরঞ্জাম থাকত, আর যত টুকিটাকি। সেই ঘরটা পরিষ্কার করিয়ে জিনিসপত্র সরিয়ে খাট পেতে তনুর ঘর করে দেওয়া হয়েছে; পাশেই নীহারের ঘর। নীহারের ঘরের গায়ে গায়ে রিনির শোবার ঘর।
চওড়া বারান্দার সামনে উঁচু রেলিং; রেলিংয়ের মাথায় মাথায় রোদ-জল বাঁচাবার জন্যে কাঠের ফ্রেমে কাচের মোটা শার্সি বসানো, আগাগোড়া। সাদা এবং নীলচে রঙের শার্সিগুলো বাহারি। বারান্দার একদিকে বসার অন্যদিকে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। নীহারের হাতের গুণে সবই পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি।
স্নান খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে করতে তিনটে বেজে গেল। তারপর নীহার বসলেন খেতে, রিনিও মার সঙ্গে বসল। শরদিন্দুকে তাঁর ঘরে পাঠানো হয়েছে বিশ্রামের জন্যে। তনুশ্যাম তার ঘরে শুয়ে আছে বোধহয়।
রিনি বলল, মা, আজ আর আমার মাধুরীদের বাড়ি যাওয়া হবে না। এরপর আর কখন বেরুব?
নীহার বললেন, আজ আর কী করে বেরুবি; বাড়িতে মানুষজন এল। বিকেলে ওদের গোছগাছ করে দিতে হবে না?
গোছগাছের আছে কী? তুমি তো সবই গুছিয়ে রেখেছিলে। ওরা যে কেন গন্ধমাদন বয়ে আনল বাপু কে জানে!
নীহার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, ওই রকম মানুষ যে!
বলে একটু থেমে আবার বললেন, কতদিন থাকবে তার তো কিছু ঠিক নেই, পনেরো দিন একমাস হতে পারে আবার বেশিও হতে পারে। তাই লটবহর বয়ে এনেছে।
রিনি এবার একটু দই মুখে দিল। স্বাদ পরখ করে সামান্য নুন মেশাল। বারান্দার শার্সিগুলো প্রায় সব বন্ধ। কাচের নীলচে রঙের জন্যে ছায়া পুরু হয়ে আছে: খোলা দু-এক পাট শার্সি দিয়ে আলো আর বাতাস আসছিল। মাথার ওপর হু হু করে পাখা ঘুরছে। বারান্দার বেসিনের দিকে পেতলের টবে একটা অর্কিড, তার প্রায় মাথার ওপর রিনির হাতের মানিপ্ল্যান্টের লতানো নকশা।
রিনি আরামের মুখে দই খেয়ে জিবের শব্দ করল বার কয়েক, তারপর বলল, এক মাসেরও বেশি! বাব্বা, ছেলেটার চোখে এত কী হয়েছে?
নীহার মেয়ের দিকে তাকালেন। ছেলেটা কীরে? তুই কি ওর নাড়ি কেটেছিস?
হেসে ফেলল রিনি। ভদ্রলোক বলব নাকি?
এর নাম নেই! অমন সুন্দর নাম-
ঘনশ্যাম।
নীহার প্রথমটায় বুঝতে না পারলেও পরে রিনির ঠাট্টাটা বুঝতে পেরে বললেন, রাখ; তোদের আজকালকার নামের যা ছিরি, নাম না খাঁড়ার ঘা, বোঝা যায় না। ও আমাদের তনুশ্যামই ভাল। আমিও তো শ্যাম বলি; তুই শ্যামদা বলবি।
রিনি হি হি করে হেসে উঠল। হাসির দমকে তার সারা গা কাঁপছিল। তুমি মা একেবারে যাচ্ছেতাই, রিনি বলল, ওকে আমার শ্যামদা বলতে বয়ে গেছে।
নীহারেরও খাওয়া শেষ হয়ে আসছিল। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, বলবি না?
ধ্যুত!
শ্যাম তোর চেয়ে বয়সে বড়।
কত বড়? দু-এক বছর? আবার কী?
না–নীহার বেশ হেলিয়ে মাথা নাড়লেন, কম করেও বছর তিনেকের। আমার বেশ মনে আছে, আমি যখন ওকে দেখি তখন ওর বছর পাঁচ বয়েস। তুই তখন কতটুকু। মার কাছে গেলাম তোকে নিয়ে, বাবা বলল–হ্যাঁরে নীহার, এ যে মাথায় দেড় ফুটও হয়নি। আমার বাবা তোকে বলত, ফুটকি। …
রিনি চেয়ার ঠেলে উঠি উঠি ভাব করল। আঃ মা–তোমার বাপের বাড়ির গল্প আর আমি শুনতে পারি না।
নীহার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক পলক, তারপর বললেন, আমার বাপের বাড়ির গল্প তোকে আমি কত শোনাই রে? খুব যে বলছিস?
রিনি হেসে বলল, রোজ শোনাও।
রোজ?
বেশ, রোজ না হয় না হল, একদিন অন্তর।
নীহার যেন অতিরিক্ত মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। রিনি, তুই মার সঙ্গে চালাকি করছিস?
এবার রিনি উঠে দাঁড়াল। তার খুব হাসি পাচ্ছিল। মার বাপের বাড়ির গল্প সে এত শুনেছে যে, মার বদলে সে নিজেই দাদুদের বাড়ির, পাড়ার, মানুষজনের, কে কবে জন্মেছে, কবে মরেছে, কোন আমগাছে কোন বছরে বাজ পড়েছিল সব বলে দিতে পারে। রিনি জানে, মার কাছে বাপের বাড়ি বড় বেশি নিজের জিনিস। মাকে সে মাঝে মাঝে রাগাতে চাইলেও সত্যি কি আর দুঃখ দিতে চায়! রিনি হেসে বলল, বেশ বাবা, হপ্তায় একবার, না-হয় মাসে একবার তোমার বাপের বাড়ির গল্প শুনেছি, হল তো? যাক গে, তোমার শ্যামচাঁদের বয়েস আমার চেয়ে এমন কিছু বেশি নয়। এ বড়জোর তেইশ; আমি কুড়ি। আমি ওকে দাদা-টাদা বলতে পারব না। আজকাল মেয়েরা কথায় কথায় অত দাদা বলে না। আমি ওকে শ্যামচাঁদ বলে ডাকব। বলে রিনি হাসি চেপে বেসিনে মুখ ধুতে চলে গেল।
নীহার খানিকটা চুপ করে বসে থেকে ঘাড় ফিরিয়ে মেয়ের মুখ ধোওয়া দেখলেন। তারপর বললেন, তোর খুব ইয়ার্কি হয়েছে। শ্যামকে তুই শ্যামচাঁদ বলবি কেন? চাঁদটা তুই পেলি কোথায়?
রিনি বেসিনের কল বন্ধ করল। বলল, তোমার আঁচল থেকে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, কুড়িয়ে নিয়েছি, বলে খিল খিল করে হেসে উঠল।
.
০২.
শরদিন্দু তখনও আলস্য বোধ করছিলেন। বেলা পড়ে গিয়েছে, বিকেলেও হয়ে গিয়েছিল। ঘরের দরজাটা ভেজানেনা। মাথার দিকের জানলাটা বন্ধ, পাশের জানলা খানিকটা ভোলা, পরদা ঝুলছে গাঢ় রঙের। পরদার ওপর দিয়ে বিকেলের ঝিমোনো রোদ দেখা যাচ্ছিল।
অল্প করে দরজা খুলে নীহার ঘরে পা বাড়ালেন। তাঁর প্রথমে মনে হয়েছিল, শরদিন্দু ঘুমোচ্ছেন, পরে সিগারেটের গন্ধে বুঝলেন মানুষটি নিশ্চয় জেগে আছেন।
ঘুমোচ্ছ? নীহার বললেন। ঘুমন্ত মানুষকে কেউ ঘুমোচ্ছ বলে না, নীহার নিজেই যেন মনে মনে হাসলেন।
সাড়া দিলেন শরদিন্দু।
দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন নীহার; সাড়া পাবার পর দরজার পাট খানিকটা খুলে দিলেন। চৌকাঠ থেকে রোদ অনেক দূরে সরে গেছে। ঘরের মধ্যে এগিয়ে এসে নীহার বললেন, ওপরের ঘরে শুতে কষ্ট হল? গরম পেলে খুব?
না। তোমাদের কলকাতায় আর গরম কোথায়! গরম আমাদের দিকে।
তোমাদের ওদিকে তো বলো পাহাড়।
পাহাড় মানে পাঁচমারি হিলসের একটা রেঞ্জ। আমাদের ওখান থেকে মাইল দশা শরদিন্দু বিছানা থেকে সামান্য উঠে বালিশে ভর দিলেন। এম পির ক্লাইমেট সব জায়গায় এক রকম নয়। কোথাও কোথাও বেজায় গরম পড়ে, আমাদের বিহারের মতন। কোনও কোনও জায়গায় মডারেট ক্লাইমেট। তবে শীতটা বেশিই হয়।
নীহারের মনে হল ঘুম থেকে শরদিন্দু বেশিক্ষণ ওঠেননি৷ হাই তুলছেন বড় বড়। জল খাবে? নীহার জিজ্ঞেস করলেন।
দাও। তোমাদের ঠাণ্ডা-জল নয়।
ঘরেই জলের পাত্র ছিল। নীহার জল গড়িয়ে দিলেন।
শরদিন্দু তৃষ্ণার্ত হয়েছিলেন; জল খেয়ে আরামের শব্দ করলেন। তারপর কী মনে করে বললেন, আমার পেটে কলকাতার জল পড়ল কত বছর পরে বলো তো?
নীহার মুচকি হাসলেন। সে তো তোমারই মনে রাখার কথা।
শরদিন্দু যেন হিসেব করছিলেন নীহারের মুখের দিকে তাকিয়ে। বললেন, বছর আটাশ হবে। হবে না?
নীহার সায় দেওয়া ঘাড় নাড়লেন, ওই রকমই হবে।
আমি কলকাতা ছাড়লাম, যুদ্ধের মাঝামাঝি। ফরটি টুয়ে, অগাস্ট রেভুলেশনের বছর।
ছিলেই বা কবছর। নীহার এবার মাথার দিকের জানলা খুলে দিচ্ছিলেন। পাশের জানলাও পুরোপুরি মেলে দিলেন। ঘরে পড়ন্ত বিকেলের স্বাভাবিক আলো এল।
শরদিন্দু বললেন, কলকাতায় আমার বছর চারেক থাকা। কলেজের কটা বছর। যুদ্ধ লেগে সব এলোমেলো হয়ে গেল; আমি হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে চলে গেলাম।
নীহার সবই জানেন। তাঁর কাছে শরদিন্দুর জীবনের অন্তত গোড়ার ছাব্বিশ সাতাশটা বছর নিজের জীবনের মতোই জানা। বিছানার পায়ের দিকের দেওয়াল ঘেঁষে মালপত্র ডাঁই করা আছে, সেদিকে তাকিয়ে থাকলেন নীহার। তারপর বললেন, মুখ টুখ ধুয়ে এসো; চা খাও।
চা হয়ে গিয়েছে?
হচ্ছে। পাঁচটা বাজতে চলল।
পাঁচ? …আমি বেশ খানিকটা ঘুমিয়ে নিয়েছি তা হলে! শরদিন্দু এবার ছোট মাপের হাই তুললেন। তুমি এত খাওয়ালে, খেয়েদেয়ে আমি সেই যে এসে ব্যাঙের মতন চিত হলাম, আর এপাশ ওপাশ করতে পারি না শরদিন্দু হাসতে গিয়ে কাশি বাধিয়ে ফেললেন।
নীহার মজা করে বললেন, তুমি আর খেলে কোথায়? মাছের কাঁটা বাছতে ভুলে গেছ, খাবে কী?
বিছানা থেকে নেমে পড়তে পড়তে শরদিন্দু বললেন, লোক আগে আমাদের ছাতু বলত, মনে আছে নীহার। এখন আবার বলে মাছু। কেন যে বলে কে জানে। তা মাড়ুদের দেশে থাকতে থাকতে মাছ খাওয়া ভুলে গিয়েছি। …তবে তুমি আজ যত রকম মাছ খাইয়েছ সব বলতে পারি।
নীহার হেসে বললেন, আচ্ছা,.সে আর বলবে কী? খাবার সময়েই তো আমরা বললাম।
শরদিন্দু ভুরু কুঁচকে বললেন, বললে নাকি! তবে তো আমার আর বলার উপায় থাকল না। পারশে মাছের ঝালটা আমার মুখে লেগে আছে এখনও। কত বছর পরে পারশে মাছ খেলাম। শরদিন্দু যেন ঝালের স্বাদটা এখনও জিবের কোথাও রেখে দিয়েছেন এমন এক মুখ করলেন।
নীহার বেশ শব্দ করেই হেসে উঠলেন। বুড়ো বয়সে কত যে করছ। যাও মুখ ধুয়ে এসো।
শরদিন্দু পরিতৃপ্ত মুখে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
সামান্য পরে শরদিন্দু ফিরে এসে দেখলেন নীহার ঘরে নেই। চশমাটা খুঁজে নিয়ে বেতের হেলানো চেয়ারটায় তিনি বসলেন। বেতের ওপর পাতলা গদি পাতা রয়েছে: তুলোর গদি। গদিটা নতুন নতুন লাগছে। একরঙা একটা পিঠ কাপড়ও রেখেছেনীহার। শরদিন্দুর মনে হল, তাঁর জন্যেইনীহারের এত ব্যবস্থা। জানলার গা ঘেঁষেই বসলেন শরদিন্দু। পাখাটা আগের মতন ঘুরে যাচ্ছে।
বাইরে নীহারের গলা পাওয়া গেল। তেতলায় পা দিয়ে ঝি কিংবা চাকরকে কিছু বলছিলেন হয়তো, তারপর ঘরে এলেন।
তোমাকে আর নীচে নামালাম না, চা নিয়ে এলাম নীহার বললেন। তাঁর হাতে শরদিন্দুর চা।
শ্যাম কী করছে? শরদিন্দু জিজ্ঞেস করলেন।
চা খেয়ে এই তো উঠল,নীহার শরদিন্দুর চা ঢালতে ঢালতে বললেন, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট দেখছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে। কলকাতা দেখছে।
শরদিন্দু চায়ের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে বললেন, ওর কলকাতা দেখার খুব সাধ ছিল।
কার না থাকে, তোমারও ছিল. নীহার যেন মুচকি হাসলেন, চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে শরদিন্দুর পাশেই দাঁড়িয়ে থাকলেন। কলকাতায় পড়তে আসার জন্যে তোমার কী বায়না! আমার বাপু বেশ মনে আছে। জ্যাঠামশাইয়ের মোটে ইচ্ছে ছিল না তুমি কলকাতায় পড়তে আস। তিনি চাইছিলেন পাটনা পাঠাতে। কাছে হত। কলকাতা ওঁদের পছন্দ ছিল না। তা তোমার একেবারে ধনুকভাঙা পণ, সেই কলকাতাতেই এলে। জেদে তোমায় কে হারায়।
শরদিন্দু যেন পুরনো কথাটাকে তেমন করে গায়ে মাখলেন না, বললেন, আমি শখ করে কলকাতায় আসিনি। কলকাতায় পড়ার আমার খুব ইচ্ছে ছিল। পুরো সাধটা আর মিটল কই। তার আগেই পালাতে হল। বলে চায়ের কাপে মুখ দিতে গিয়ে বললেন, তোমার চা?
আমি সন্ধের আগে চা খেতে পারি না আর। বলে সামান্য সরে এসে জানলার পরদাটা আরও গুটিয়ে দিলেন নীহার। রোদ আসছে না। বাতাসই আসছিল। মধ্যে অম্বল-টম্বল নিয়ে খুব ভুগেছিলাম। আলসারের মতন হয়ে গিয়েছিল। ধরাকাটা করে থাকতে হত। বিকেলে চা খেলে বুকটা জ্বালাজ্বালা করে। সন্ধেবেলাতেই খাই।
শরদিন্দু আয়েশ করে ধীরে সুস্থে চা খেতে লাগলেন। নীহার বললেন, আমি ভাবলাম, তুমি বসে বসে চা খাবে, আমি তোমার মোটঘাট খুলে যা-যা দরকার বের করে গুছিয়ে দেব।
শরদিন্দু বললেন, দেবেখন; একটু বোসো৷
বসব তো। আমি বসে বসেই কাজ করব। আমার কি আর দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থা আছে। দেখছ না, কেমন ভারী হয়ে গিয়েছি।
ভারী–? শরদিন্দু হাসি হাসি মুখ করলেন।
মোটা বলবে তো? বলল। নীহার হাসলেন।
শরদিন্দুনীহারকে দেখতে লাগলেন। এই নীহারের সঙ্গে পুরনোনীহারের তুলনা করা ঠিক নয়, বয়স মানুষকে স্বাভাবিক ভাবেই বদলায়, কখনও কখনও অতিমাত্রায়, চেনাই যায় না। নীহারকে কিন্তু চেনা যায়। মুখের অদলবদল সত্ত্বেও আদলটি তেমন কিছু পালটায়নি। চৌকো ধরনের মুখে সামান্য চাপা থুতনি নীহারকে চিনিয়ে দিত, আজও দেয়। তফাতের মধ্যে, তখন যা ছিল ছিমছাম পরিষ্কার এখন তা ভরাট হয়ে গিয়েছে। সমস্ত মুখটাই প্রায় গোল দেখায়। নাকটি আরও ফুলে গিয়েছে, চোখ দুটি একেবারে সংসারী, মমতা মাখানো, মাসিপিসি ধরনের। নীহারের মাথার চুলও কোথাও কোথাও সাদাটে হয়ে আসছে। শরদিন্দুর মনে হল না, নীহারকে ঠিক মোটা বলা যায়, তবে বয়েসের মেদে কেমন এক গড়নভাঙা চেহারা হয়ে গিয়েছে নীহারের। নীহার এখনও সাদা থান পরে না, সরু কালো পাড়ের ধুতি পরে। হালকা হলুদ পাড়ের ধুতি পরে সে স্টেশনে গিয়েছিল। গায়ের জামা সাদা। গলায় সরু হার, হাতে সরু চুড়ি দু গাছা করে।
শরদিন্দু হেসে বললেন, তুমি আর মোটা কোথায়? ওই একটু..
নীহার হেসে জবাব দিলেন, মোটা নয়, তবে মোটামুটি–এই তো?
কথাটা উপভোগ করে শরদিন্দু হাসতে লাগলেন।
নীহার সামান্য অপেক্ষা করে বিছানার পায়ের দিকে এগিয়ে গেলেন, মালপত্রের কাছে। তুমি কি সমস্ত সংসার উঠিয়ে এনেছ?
বাইরে বেরুলে কখন কী লাগবে বোঝা তো যায় না, নীহার। আমি দরকারিগুলোই নিয়েছি।
এত জিনিস তোমার দরকারি! মোটা মোটা বিছানাগুলো বয়ে এনেছ কেন? আমি না তোমায় বিছানাপত্র আনতে বারণ করেছিলাম।
শরদিন্দু কী যে বলবেন বুঝতে না পেরে বললেন, তুমি লিখেছিলে ঠিকই। তবে আমি ভাবলাম, বেডিং-ফেডিং নেওয়া ভাল, দরকারে কাজে লাগবে।
তোমার ওই রকম ভাবনা। আমার বাড়িতে আর দুজনের বাড়তি বিছানা নেই!
শরদিন্দু অপ্রস্তুত বোধ করলেন। তুমি যে কী বলো! ব্যবস্থা যা করে রেখেছ এ একেবারে রাজসূয়…।
তোমাদের বিছানা আমি খুলছি না। কাল রোদে দিয়ে আবার সব বেঁধেবঁধে রেখে দিতে বলব নারানদের। বেডিংয়ের মধ্যে তোমাদের দরকারি যদি কিছু রেখে থাকো কাল বের করে নিয়ো।
কী আছে আমার ঠিক মনে পড়ছে না। কাল দেখব।
ওই বড় ট্রাংকটা কার? তোমারই তো?
আমার। খোকারটা বোধহয় নীচেই থেকে গেছে।
আর-একটা ছোট ট্রাংক?
ওতে আমার জিনিস রয়েছে।
কী জিনিস? চাবি কোথায় তোমার?
চাবি জামার পকেটে।
সুটকেসে কী আছে?
খুচরো জিনিস। ওষুধপত্র আছে কিছু।
তোমার ওষুধ?
হ্যাঁ।
কী অসুখ তোমার?
ডেফিনিট কিছু নয়। ওই জেনারেল কমপ্লেন। বয়স বাড়লে যা হয়। এখানে ওখানে ব্যথা, অল্পসল্প দুর্বলতা, মাঝে মাঝে ঘুম না হওয়া–এই আর কি! ওষুধ-টষুধ তেমন একটা কিছু নেই, ক্রুশনসল্ট, হজমের দু-চারটে ওষুধ। তবে মাঝে মাঝে নিশ্বাসের একটা কষ্ট হয়, ব্রিদিং ট্রাবল..
নীহার দু পা এগিয়ে শরদিন্দুর ঝোলানো কোটের পকেটে হাত ডোবালেন। চাবি খুঁজতে খুঁজতে বললেন, নিশ্বাসের কষ্ট ভাল নয়। এখানে বড় কাউকে দেখিয়ে নাও। বুক নিয়ে অবহেলা করতে নেই।
শরদিন্দু চা খেতে লাগলেন।
পকেট হাতড়ে চাবিটা শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হল। নীহার চাবি নিয়ে সোজা বাক্সর সামনে মাটিতে বসে পড়লেন।
তোমার কটা কাপড়-চোপড় আগে বের করে দিই। কোন ট্রাংক খুলব বলো?
শরদিন্দু বললেন, তুমি অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? আমি নিজেই বার করে নিতে পারতাম।
নীহার ট্রাংকের তালার সঙ্গে চাবি মেলাতে লাগলেন। কথার কোনও জবাব দিলেন না।
শরদিন্দু উঠে গিয়ে সিগারেট, লাইটার নিয়ে এসে আবার চেয়ারে বসলেন।
তোমায় দুটো পাজামা বের করে দিই, গেঞ্জিনীহার বললেন, কোন জামা পরবে? হাফ-হাতা ঢোলাগুলো?
দাও, যা হয় দাও; বাড়িতেই রয়েছি
নীহার বাক্স হাতড়ে কাপড়-চোপড় বের করতে লাগলেন।
সিগারেট ধরিয়ে নিলেন শরদিন্দু৷ আরও খানিকটা চা নিজেই কাপে ঢেলে নিতে নিতে বললেন, তোমাদের এই বাড়িটি বেশ। পাড়াটাও নিরিবিলি দেখছি।
নীহার হাতের কাজ সারতে সারতে জবাব দিলেন, নিরিবিলি আর কোথায়? এখন এখানে গায়ে গায়ে বাড়ি, একটুকরো জমি পড়ে নেই। কত লোক তরে এমনিতে পাড়াটা শান্ত-টান্ত। নীহার বাক্স হাতড়ে শরদিন্দুর পাজামা বের করে কোলের ওপর রাখলেন, একটা তোয়ালেও পাওয়া গেল। গেঞ্জি তাঁর চোখে পড়ছিল না।
শরদিন্দু নীহারকে দেখছিলেন। মাথার কাপড় নেমে কাঁধে পড়ে আছে। নীহারের চুল বেশ কোঁকড়ানো ছিল, এখন চুলের দীর্ঘতা কমে গিয়েছে, ঘনতা কমেছে, দু-এক জায়গায় ধূসর রং ধরেছে।
শরদিন্দুর মনে পড়ল নীহার একবার দুর্গামণ্ডপে পড়ে গিয়ে মাথার পেছনে কান ঘেঁষে বেশ জখম হয়েছিল। অনেকটা কেটে গিয়েছিল বেচারির। সেলাই পড়েছিল, জ্বর হয়েছিল বেশ। দাগটা নিশ্চয় এখনও আছে। শরদিন্দু প্রায় বলতে যাচ্ছিলেন কিছু, এমন সময় নীহার কথা বললেন।
নীহার বললেন, তুমি যদি আর দশ বারোটা বছর আগেও এখানে আসতে, ফাঁকা কাকে বলে বুঝতে পারতে! সন্ধের পর শেয়াল ডাকত। বিয়ের পর আমিই যখন এলাম, তখন সবে শ্বশুরমশাই একতলাটুকু করেছেন। আমাদের এই বাড়ি, আর ধরো আঙুলে গুনে তিনটে কি চারটে বাড়ি। রাজ্যের গাছপালা, বাদাড়, এঁদো পুকুর। অন্ধকার হল তো এই তল্লাট জুড়ে শুধু শিয়ালের ডাক, কানের পাশে ঝিঁঝি শুনছি সারাক্ষণ। ঘুটঘুট করত সব। ভয়ে আমি মরতাম বাপু। কী বিচ্ছিরি যে লাগত?
তোমার শ্বশুরমশাই না ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন?
ডিজাইনার; সাহেব কোম্পানিতে কাজ করতেন। আমি যখন বিয়ের পর এলাম, তখন তাঁর বাতে অঙ্গ পড়ে গেছে। ডান হাতটা আর তুলতেও পারেন না উঁচু করে। ওঁর মুখে শুনেছি, এই জমি উনি হাজার দেড়েক করে কাঠা কিনেছিলেন। অনেক আগেই। আমাদের বাড়ি যখন হচ্ছে তখনই জমির দর চার-টার হয়ে গেছে। এখন তো জমিই নেই। বছর কয়েক আগেও পনেরো আঠারো হাজার টাকা কাঠা হয়ে গিয়েছিল।
শরদিন্দু মোটামুটি নীহারের শ্বশুরবাড়ির কথা জানেন। নীহারের শ্বশুর মোটামুটি সচ্ছলই ছিলেন। মানুষটিও খুব ভাল ছিলেন নিশ্চয়, নয়তো কে আর ডাক্তার ছেলের বিয়েতে একটা পাই-পয়সাও দাবি জানায় না। শরদিন্দুনীহারের শ্বশুরকে দেখেননি। তবে সবই শুনেছেন। নীহারের শ্বশুর স্বাস্থ্য বদলাবার জন্যে মাস দুয়েকের জন্যে বাইরে বেড়াতে যান। জায়গাটা অবশ্য মধুবনী শরদিন্দু আর নীহারের জায়গা। নীহারের কাকার সঙ্গে ভদ্রলোকের পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়। সেই সূত্র ধরেই নীহারের বিয়ে। শরদিন্দুর তখন মনে হত, পৃথিবীতে এত জায়গা থাকতে, ভদ্রলোক তাদের শহরে কেন জলহাওয়া বদলাতে এসেছিলেন? তিনি না এলেও কি ভাগ্যের অদলবদল কিছু হত? বোধহয় হত না।
নীহার কথা বললেন। শরদিন্দু মুখ ফিরিয়ে দেখলেন, বাক্সর ডালা বন্ধ করেছেন নীহার।
এই বাড়ি নীহার বললেন, বারো আনাই শ্বশুরমশাই শেষ করে গিয়েছিলেন। তখন খরচপত্রও কম ছিল। বাবা নিজে সব জানতেন-টানতেন–তাঁর হাতে না হলে এ বাড়ি আর এমনটি হত না। বাক্সটায় তালা দিয়ে এবার স্যুটকেসটা টেনে নিলেন নীহার। খুললেন না। আমরা আর কতটুকু করেছি। এদিকে এই তেতলার ঘরটা আর ওদিকে দোতলার ছাদটাদ, বাকি কিছু টুকটাক করতে হয়েছে। বাড়িতে ভাড়াটে বসাতে হলে কিছু সুখসুবিধে দেখতে হয়।
তোমাদের ওপাশটায় পুরোটাই ভাড়া?
হ্যাঁ; দুঘর ভাড়াটে থাকে, নীচে আর ওপরে। ওদিকটা দোতলা। আর আমার এদিকে, নীচে গ্যারেজ আর খান-দুই ঘর নিয়ে মিসেস বাগচি নার্সারি স্কুল করেছেন। স্কুল আর কী, কাচ্চাবাচ্চা আসে কিছু পাড়ার, চেঁচামেচি করে, দোলনা দোলে, লাফালাফি করে খানিকটা, তারপর বাড়ি ফিরে যায়। বাড়ির মা মাসিরা দুপুরে জিরোতে পারে নিঝঞ্ঝাটে তারই ব্যবস্থা। নীহার হাসলেন।
শরদিন্দু ঠাট্টা করে বললেন, তুমি নার্সারি স্কুলের প্রেসিডেন্ট?
দূর দূর– নীহার মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালেন। কোলের জিনিসগুলো ঘরের আলনায় গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, আমার নিজের দিকটায় আর ভাড়াটে বসাবার ইচ্ছে ছিল না। বড় ঝঞ্ঝাট করে। আগে বার-দুই ছিল। বাবা, সে কী বায়নাক্কা। তার ওপর হইচই, গণ্ডগোল। এ তোমার অনেক নির্ঝঞ্ঝাট। সকালের দিকে ঘণ্টা দুই-তিন, তারপর তো ফাঁকা।
কথা বললেন না শরদিন্দু; সিগারেট শেষ হয়ে এসেছিল, ছাইদান খুঁজতে লাগলেন। নীহারের চোখে পড়ল শরদিন্দু এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। নীহার ছাইদান তুলে নিয়ে টিপয়টা শরদিন্দুর চেয়ারের পাশে টেনে দিলেন।
এবার তোমার ওষুধপত্রগুলো বের করে রেখে দিই, নীহার বললেন।
থাক না, আমি নিয়ে নেব।
না না, ঘর জোড়া করে সব পড়ে আছে; পরিষ্কার করে দিলে তুমিও হাঁটাচলা করতে পারবে, দেখতে ভাল লাগবে। নীহার আবার মাটির ওপর বসে পড়লেন।
খানিকটা চুপচাপ থেকে শরদিন্দু বললেন, নীহার তুমি দেখছি বেশ ভাল ভাবেই হালটা ধরতে পেরেছে সংসারের, নয়তো কী যে হত…!
সুটকেসের চাবি বাছতে বাছতে নীহার শরদিন্দুর দিকে তাকালেন। মাথার কাপড় আর তিনি তুলে দেননি, সেই রকমই ঘাড়ের কাছে পড়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, আমি না ধরলে আর কে ধরবে বলো? আমার আর কে ছিল? শ্বশুরমশাইয়ের ওই একটি মাত্র ছেলে, মেয়েটি বিয়ে থা করে তার বরের সঙ্গে সেই যে বিদেশ চলে গেল, আর ফিরল না। ফিরবেও না। আজকাল খোঁজখবরও করে না। বছরে এক আধখানা চিঠিও পাই না। শ্বশুরমশাই মারা যাবার পর আমরাই তো ওর সব ছিলাম। কী দোষ করেছি জানি না সম্পর্কটাও রাখল না আর।
শরদিন্দু অন্যমনস্কভাবে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কলকাতায় নীহার এতটা একা তাঁর যেন জানা ছিল না। কী মন করে জিজ্ঞেস করলেন, কলকাতায় তোমার শ্বশুরবাড়ির আরও আত্মীয়স্বজন ছিলেন শুনেছিলাম!
একেবারে নিজের কেউ নেই; জ্ঞাতিগোষ্ঠী আছে। আমার এক দেওর আছে, রিনির বাবার মাসতুতো ভাই; আর আছে এক বড় ননদ, ওদের জ্যাঠতুতো দিদি। দেওরটিই যা মাঝে সাঝে এসে খোঁজখবর করে যায়। সে বড় পাগলা। তেমন আপদে বিপদে সেই সম্বল। তবে গজেন ঠাকুরপো থাকে অনেক দুরে, পাতিপুকুরে। যখন তখন আসতে পারে না। ওদের ওদিকে আসা যাওয়াও মুশকিল, নিত্যি গণ্ডগোল। তা ছাড়া মানুষ আজকাল নিজেকে নিয়েই পারে না তো জ্ঞাতিগোষ্ঠী! নীহার কথা বলতে বলতে কাজ শুরু করলেন। ওষুধপত্রর শিশি, হট ওয়াটার ব্যাগ, এটা-সেটা বার করতে লাগলেন।
শরদিন্দু খানিকটা সোজা হয়ে বসলেন। শেষ বেলার এক ফলা আলো মেঝেতে পড়ে আছে, নীহারের বেশ কাছাকাছি। চারপাশে জিনিসপত্র ছড়ান। শরদিন্দু অলস চোখে নীহারকে দেখছিলেন: সব গোছগাছ শেষ না করে নীহার উঠবে না। এখনও যেন তার একরোখা ভাবটা রয়েছে।
ওরা কেউ আসে-টাসে? শরদিন্দু জিজ্ঞেস করলেন, দুলালদা, মণি?
দাদা গত বছর এসেছিল একবার। মণিরা তো দিল্লি চলে গেছে..বাপ-মা যতদিন থাকে ততদিন মেয়েদের বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক, তারপর সবাই ভুলে যায়, বুঝলে না। মা মারা যাবার পর আমিও আর ওদিকে যাই নি।
শরদিন্দু ঠাট্টা করে বললেন, বাপের বাড়ির দোষ দিয়ো না, নীহার। এই তো আমি এলাম। তোমার বাপের বাড়ির মানুষ।
নীহার ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। কাঁধ, ঘাড়, গলা খানিকটা মোটা হয়ে যাওয়ায় এখন ভাল করে ঘাড় ফেরাতে পারেন না। সামান্য পাশ ফিরেই বসতে হল। বললেন, তা ঠিক। তবে কত বছর পরে তার হিসেবটা করো।
কত বছর? শরদিন্দু নতুন করে সময়টার হিসেবটা করলেন না। হিসেব করাই আছে। আস্তে করে বললেন, বছর কুড়ি।
তার বেশি ছাড়া কম নয়। তোমায় আমি শেষ দেখেছি, রিনি যখন কোলে। মার কাছে গিয়েছিলাম। তুমি এসেছিলে ছুটিতে। শ্যাম তখন বছর চারেকের। তাই না?
শরদিন্দু অন্যমনস্কভাবে বললেন, হ্যাঁ। তাই হবে।
বউদিকে সেই আমি প্রথম দেখলাম। কী সুন্দর মানুষ ছিল বউদি। কী কপাল তোমার অমন বউটিকে হারালে।
শরদিন্দু নীরব থাকতে থাকতে এক সময় নিশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার কপালটাই বা ভাল কোথায়?
রিনির চুল বাঁধা শেষ হয়ে এসেছিল; লম্বা বিনুনিটা বুকের ওপর টেনে নিয়ে সাদা রিবনের ফাঁস জড়াতে জড়াতে বারান্দায় এসেছিল, বেসিনে গিয়ে হাতটা একটু ধুয়ে নেবে, হেয়ার ক্রিমে হাত চটচট করছে। আচমকা ভেতর থেকে হাসি শুনল। বারান্দায় হাসবার মতন কেউ নেই। সরলাদি রান্নাঘরের দিকে কী একটা কাজ করছে, নারান নীচে। বেসিনের কাছে দাঁড়িয়ে রিনি হাসির শব্দটা কান পেতে শুনল। মার ঘনশ্যাম হাসছে। তার ঘরে বসে বসে হাসছে। হেসে যেন গড়িয়ে পড়ছে। রিনির মাথায় এল না, নেহাত পাগল ছাড়া একলা ঘরে বসে কে আর হাসতে পারে! ছেলেটার মাথাও খারাপ নাকি?
হাত ধুয়ে, রিনি তনুর ঘরে গিয়ে দাঁড়াল। তনু জানলার কাছে দাঁড়িয়ে। রাস্তা দেখছে। কিংবা চিলড্রেন পার্কে বাচ্চাকাচ্চাদের খেলাধুলো দেখছে হয়তো। রাস্তায় কিছু দেখে তনুর হাসি পেয়েছে নিশ্চয়।
রিনি সাড়া দিল।
তনু ফিরে তাকাল। এখন আর তার চোখে সেই দিনের বেলার চশমা নেই। রঙিন, চোখ-ঢাকা চশমার বদলে তার চোখে পুরু কাচের সাধারণ চশমা। তনুর চোখ দেখা যাচ্ছিল।
রিনি এমন চোখ করে তাকিয়ে থাকল, যেন জিজ্ঞেস করছিল, ব্যাপার কী? এত হাসির কী হয়েছে?
তনু নিজের থেকেই বলল, কলকাতায় বহুত মজা আছে।
এবার রিনির নিজেরই হাসি পেল: শ্যামের কথাতেও মজা কম নয়। রিনি ভুরু তুলে যেন তনুশ্যামের মাথার মাপটা, কিংবা মগজের পরিমাপটা অনুমান করতে করতে বলল, মজাটা হল কোথায়? সে মজার স্থান কাল-পাত্র জানতে চাইছিল।
তনু জানলা দিয়ে বাইরের দিকটা দেখাল।
রিনি এগিয়ে গিয়ে বাইরে তাকাতে তেমন কিছু দেখতে পেল না। হঠাৎ সে পাখি-ডাকের শব্দ শুনল, তীব্র ডাক। রিনি যেন সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা বুঝতে পারল। চিলড্রেন্স পার্কের গেটের সামনে একটা আধ-পাগলা ছেলে মাঝে মাঝে এসে বসে; মুখের সামনে মুঠো পাকিয়ে নানা ধরনের পশুপাখির ডাক ডাকে, রাজ্যের বাচ্চাকাচ্চা তাকে ঘিরে জটলা পাকায়, কেউ বলে, ঘুঘু ডাকো, কেউ বলে, কোকিল ডাকো। ঘুঘু, কোকিল, টিয়া, ময়না, কুকুর, বেড়াল, শেয়াল ডাকতে ডাকতে ছেলেটার দম ফুরিয়ে গেলে সে চুপ করে বসে বসে বিড়ি খায়। বাচ্চাগুলোও অদ্ভুত। তাদের যার যা থাকে, চিনেবাদাম, ডালমুট, চুইং গাম, লেবু লজেন্স–ছেলেটাকে উদার হাতে বিতরণ করে দেয়। দু-চারজন যে জ্বালাতন না করে তাও নয়, তবে সেটা তেমন কিছু না। ওই পাগলা ছেলেটা নাকি শীতকালে সার্কাসের দলে কাজ করেছে।
রিনি বুঝতে পারল, সেই পাগলা ছেলেটার চারপাশে বাচ্চাকাচ্চার ভিড় আর ছেলেটার বিচিত্র সব ডাক শুনে তনুর হাসি পেয়েছে। এতে হাসির যে কী আছে রিনি বুঝল না।
রিনি বলল, ও আধ-পাগলা। জীবজন্তুর ডাক ডাকে।
তনু বলল, পাগলরা খুব ট্যালেন্টেড হয়।
রিনি প্রথমে অবাক হল, তারপর আড়চোখে তনুর দিকে তাকিয়ে থাকল। তার হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু হেসে ফেললে তনুকে খোঁচা মেরে ঠাট্টা করা যাবে না বলে হাসিটা চেপে কী বলবে কী বলবে ভাবছিল।
তনু নিজেই বলল, আমাদের ওখানে একটা পাগলা আছে, ফার্স্ট ক্লাস ডিজাইনার।
ডিজাইনার? কী ডিজাইন করে?
সব। তনু কথার শেষে বেশ একটা জোর দিল শব্দে, রিনিরা ঠিক এভাবে সব বলে না। আমাদের কলেজে আগে মালী ছিল বানোয়ারি; এখন পাগলা হয়ে গেছে। গার্ডেনের ডিজাইন করে, গেট ডিজাইন করে, প্যাণ্ডেল বানাতে পারে, দেওয়ালিতে দীপ সাজায়…ভেরি ট্যালেন্টেড।
রিনি চোখ বাঁকা করে খোঁচা মেরে বলল, তোমার ডিজাইনও ও করেছে?
তনু কেমন থমকে গেল। তারপর হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, এ ম্যান ইজ ডিজাইনড অ্যান্ড ডেস্টিনড বাই গড।
রিনি আর হাসতে পারল না। তার অমন ঠাট্টাটা মাঠে মারা যাওয়ায় যেন বিশ্রী লাগছিল।
তনুর সঙ্গে রিনির আলাপ-সালাপ হয়ে গিয়েছে আগেই, নীহার যেমন ওপরে গিয়েছিলেন শরদিন্দুর জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার ফাঁকা করে দিতে তেমন মেয়েকে ভার দিয়েছিলেন তনুর জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘরটাকে পরিষ্কার করার। অবশ্য নিজেই তিনি মেয়েকে দিয়ে খানিকটা খানিকটা গুছিয়ে দিয়েছিলেন, বাকিটা রিনি সেরে ফেলেছে। তনুর ঘরে লটবহর কমই জমা ছিল।
তনু আর রিনির মধ্যে আলাপটা তখনই ঘটে যায়। তারপর চায়ের সময় রিনি নিজের হাতে চা ঢেলে তনুকে নিয়েছে, দুজনে এক সঙ্গে বসে বসে চা খেয়েছে, গল্প করেছে।
রিনি তনুর চোখের দিকে তাকাল। চা খাবার সময়ই তনু চশমা বদল করে ফেলেছিল; রোদের আলোর ঝাঁঝ কমে গেলে রঙিন চশমাটা পরার কিংবা চোখ ঢেকে রাখার দরকার তার হয় না। তনুর চোখের চারপাশ তার গায়ের রঙের চেয়ে ফরসা। চোখ আড়াল রেখে রেখে এরকম হয়েছে। চামড়াটা পাতলা দেখায় চোখের পাশে, কেমন দুর্বল, বড় বড় চোখ করে সমস্ত পাতা মেলে তনু তাকাতে পারে না, চোখ ছোট করে তাকায়। রিনি লক্ষ করেছে তনুর চোখের পাতা যেন অনেকটা আধবোজা হয়ে থাকে, পলক পড়ে তাড়াতাড়ি। চোখের মণি খানিকটা কটা রঙের। আশ্চর্য লাগে কিন্তু চোখ দুটির দিকে তাকালে-কেমন যেন নরম, সরল, নিরীহ, সকৌতুক। পুরু কাচের চশমার আড়াল থেকেও ওর বিস্ময়, হর্ষ, ছেলেমানুষি স্পষ্ট ধরা পড়ে।
রিনি তনুর চোখ দেখতে দেখতে এবার বলল, বিদ্যের জাহাজ!
জাহাজ?
যা বড় বড় কথা শুনছি।
বড় কথা কেন! বইয়ে এমন কথা পড়তে হয়। কোথাও পড়েছি
থাক, আর শিক্ষা দিতে হবে না। রিনি মজার ভঙ্গি করে হাত নেড়ে বলল, পড়াশোনার কথা শুনলে, আমার জ্বর হয়।
মগর, তুমি কলেজে পড়।
আমি কলেজে যাই বেড়াতে, হুল্লোড় করতে, ফুচকা খেতে।
তনু ছেলেমানুষের মতন কৌতুক বোধ করে হাসছিল। তোমাদের কলেজ কোথায়?
রিনি ঠাট্টা করে বলল, কমনরুমে, গড়িয়াহাটার মোড়ে, চায়ের দোকানে…
তনু কিছু বুঝল, কিছু বুঝল না। হাসতে লাগল।
কী ভেবে রিনি হঠাৎ সদয় হল, বলল, আমাদের কলেজটা কোথায় তুমি বুঝবে না। কলকাতার কী চেন তুমি? এখান থেকে কলেজ খানিকটা দূরে।
তনু বলল, আমাদের কলেজ আর কোয়ার্টার্স পাশাপাশি। আমাদের কলেজের কম্পাউন্ড খুব বড়। পাশেই প্রফেসরদের কোয়ার্টার্স।
বুঝতে পারছি, রিনি এবার বিনুনিটা হাতের ঝাঁপটায় পিঠের দিকে ঠেলে দিল, ঘাড় নাড়ল। সামান্য, ঠাট্টা করে বললে, নয়তো গায়ে অত বিদ্যের গন্ধ থাকত না।
তনু হাসিমুখে রিনিকে দেখছিল; কোনও কথা বলল না।
রিনি ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়েই বুঝতে পারছিল, বিকেল শেষ হয়ে যাচ্ছে, বাইরে আর রোদ-টোদ নেই; ছায়া জমেছে। রাস্তায় বোধহয় বাতি জ্বলে ওঠার সময় হয়ে গেল।
কী মনে করে রিনি বলল, আমি একটু বাইরে যাব। যাবে?
সঙ্গে সঙ্গে তনু মাথা নেড়ে সায় দিল। রিনি বলল, ঠিক আছে; যাবার সময় ডাকব।
রিনি ঘর ছেড়ে চলে এল। নিজের ঘরে আসতে আসতে রিনির হাসি পাচ্ছিল। মার শ্যাম বা শ্যামচাঁদ বেশ ক্যাবলা; হাঁদা টাইপের।
এমন বোকা, গণেশ মার্কা ছেলে, বাবা আর দেখা যায় না। কলকাতার ছেলেদের পাশে একেবারে অচল, গেঁয়ো। তনুকে যদি একবার রিনিদের কলেজের কমনরুমে নিয়ে যাওয়া যায়–মেয়েরা ওকে ঠুকরে ঠুকরেই শেষ করে দেবে। হেনা তো প্রথমেই বলবে, কোথাকার ডেসপ্যাঁচ রে রিনি, অ্যাস আইল্যান্ড থেকে? হেনাটা যেমন ফাজিল, তেমনই চতুর। মেয়েদেরই যা পেছনে লাগে, কাঁদিয়ে ছাড়ে, তা ছেলে! হেনা অদ্ভুত অদ্ভুত কথা তৈরি করে। তার মতন ঠোঁট কাটা মেয়েও বাবা দুটি নেই।
রিনি তাড়াতাড়ি শাড়ি জামাটা বদলে নিতে লাগল। তাকে একবার দোকানে যেতে হবে। মনিহারি দোকানে। কয়েকটা জিনিস আনতে হবে। মা বলেছে। রিনিরও দু একটা জিনিস রয়েছে নিজের। কটা ক্লিপ দরকার, এক ডজন জামার হুক, গরমে ঘাড়ের কাছে ঘামাচি হচ্ছে, বোরেটেড পাউডার নিতে হবে। রিনি একটা ফোন করবে মাধুকে।
শরদিন্দুমামার ছেলেটি বোকাসোকা, হাঁদা যাই হোক এমনিতে কিন্তু বেশ। খুব সরল। রিনির সঙ্গে ভাব হবার পর গড়গড় করে নিজের কথা বলে গেল। তার চোখ ছেলেবেলা থেকেই খারাপ। স্বাস্থ্যও ছিল রোগা। আগে মাথা ধরত খুব, তারপর দূরের জিনিস দেখতে পেত না। আট ন বছর বয়স থেকেই চশমা উঠেছে চোখে। চশমার পাওয়ার বছর বছর এত বেড়ে চলল, সেই সঙ্গে আরও নানা উপসর্গ এমন হয়ে দেখা দিল যে তনুকে হরদম চোখের ডাক্তারের কাছে ছুটতে হত। তার শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে মামাও ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সাধারণ স্বাস্থ্যের জন্যে অনেক ওষুধপত্র খেয়েছে তনু; তাতে শরীরে উপকার হলেও চোখের কিছু হয়নি। এক এক ডাক্তার এক এক রকম বলে, চিকিৎসা করে, শেষে চোখ দুটোর যায়-যায় অবস্থা। বাবার সঙ্গে তনু নানা জায়গায় চিকিৎসা করাতে গেছে। কিছু উপকার হয়নি। এক সময় তনুর এমন হয়েছিল যে, বই পর্যন্ত ছোঁয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকতে হত। তারপর একজন ডাক্তার সন্দেহ করলেন, উলটোপালটা চিকিৎসার জন্যে চোখ অন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। পুরনো সব চিকিৎসা বন্ধ করতে হবে। করে দেখতে হবে চোখ আবার কতটা স্বাভাবিক হয়। তিনি কয়েকটা সাধারণ স্বাস্থ্যের ওষুধ দিলেন, আর চোখের কয়েকটা একসারসাইজ শিখিয়ে দিলেন। তাতে সত্যিই খানিকটা উন্নতি হল। লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল তনুকে; আবার সে কলেজ যাতায়াত, পড়াশোনা শুরু করল। কিন্তু তার চোখের ব্যাধিটা যাচ্ছে না, নানারকম কষ্ট হয়, উপসর্গ দেখা দেয়। চোখের দৃষ্টিশক্তি আরও ক্ষীণ হয়ে আসছে। চশমার পাওয়ার বাড়িয়ে আর কতকাল চলবে! বাবা তাই কলকাতায় নিয়ে এসেছেন বড় ডাক্তার-টাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করাবেন।
রিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে আলতো করে পাউডার বুলিয়ে গায়ের কাপড়টা ঠিক করে নিল। সে এমন কোথাও যাচ্ছে না, যাবে পাড়ার দোকানে, সাজসজ্জায় ঘটা করল না। এমনিতেও সে সাজগোজের ঘটা বড় একটা করে না। তার ভাল লাগে না তেমন। রিনি ঘরের বাইরে এসে তেতলার সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে ওপরে উঠে গেল, মার কাছে। কথা বলে নীচে নেমে এসে আবার মার ঘরে গেল, টাকা পয়সা নিয়ে বাইরে আসতে আসতে ডাকল তনুকে। নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে দোলাতে দোলাতে বাইরে এসে দেখে তনু বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে।
সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে রিনি হেসে বলল, মা বলল, তোমায় সব সময় চোখে চোখে রাখতে, হাত ধরে নিয়ে যেতে। রিনি একটু বাড়িয়ে বলল অবশ্য।
তনু বলল, কেন?
কলকাতার রাস্তা, গাড়িঘোড়ার ভিড়, কে জানে কোন বিপদ বাধিয়ে বসো৷
কথাটা তনু হালকাভাবেই নিল, বলল, না না, আমি ঠিক আছি।
নীচে নার্সারি স্কুলের ঘরগুলো বন্ধ। সিঁড়িতে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে রিনি৷ নার্সারির পাশে এক চিলতে জমি, একটা দোলনা ঝোলানো রয়েছে। দশ পনেরো পা হেঁটে এসে ছোট কাঠের গেট। তারপর রাস্তা।
রাস্তায় এসে রিনি বলল, আমাদের পাড়াটা কিন্তু এখনও অন্য জায়গার চেয়ে ফাঁকা। খুব হইচই নেই। ফুটপাথ ধরে রিনি হাঁটতে লাগল।
তনু পাশে পাশে হাঁটছিল। বলল, এখানকার বাড়িগুলো খুব ডিসেন্ট। কত উঁচু-উঁচু। আমাদের শহরে ওল্ড টাউনে বিলকুল পুরনো বাড়ি। নিউ টাউনে বিশ-পঁচিশটা ভাল বাড়ি হয়েছে। আমরা থাকি টাউনের ওয়েস্ট সাইডে কলেজ এরিয়ায়। আমাদের দিকটা লোনলি।
রিনি শুধোল, খুব ফাঁকা?
বহুত ফাঁকা। পিচ রোড। দুপাশে গাছ। একটা পুরনো চার্চ আছে। চার্চটার খুব বিউটি। পাহাড়ের মতন উঁচু জমিতে চার্চ, চারদিকে গাছ, নীচে চার্চের তলায় ক্রিসমাসে ফিয়েস্টা হয়। …
ফিয়েস্টা?
মেলা, তনু রিনির দিকে তাকাল, কোনও সেন্টস ডে সেলিব্রেট করাকে ফিয়েস্টা বলে। খুব আমোদ আহ্লাদ নাচগান করে ফিয়েস্টা হত। স্পেন-টেনে এখনও হয়। আরও অনেক জায়গায় হয়। ওটা একরকম ফেস্টিভ্যাল। আমাদের ওখানে মেলার মতন হয়, বহুত লোক আসে।
রিনি ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, তোমাদের ক্রিশ্চান কলেজ তো?
হ্যাঁ; ওদিকে অনেক জায়গায় মিশনারি স্কুল কলেজ আছে। আমাদেরটা মেথডিস্ট চার্চের হাতে। ছোট কলেজ, মেনলি রেসিডেনসিয়াল।
রিনি আর কিছু বলল না। রাস্তায় মানুষজন কম নয়, সন্ধে হয়ে এল, বাতি-টাতি জ্বলে উঠেছে চারপাশে। আজ গরমটা মাঝামাঝি, তবু পিচের রাস্তার একটা ভাপ যেন অনুভব করা যাচ্ছে এখনও। বাতাসে ধুলোর গন্ধ। শুকনো বকুল গাছটার তলায় ফুটপাথ ঘেঁষে একজোড়া ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। সেজেগুজে মেয়েরা এসে উঠছে, বিয়ে বাড়ি-টাড়িতে যাবে হয়ত।
তনুকে মোটামুটি নজরে রেখে রিনি ফুটপাথ ধরে হাঁটছিল। তনু অন্ধ নয়, তবু অন্ধেরই মতন। একেই তো হাঁদার মতন হাঁটছে, তার চোখ যে কোনদিকে তা খেয়াল করতে পারছে না রিনি। তনু রাস্তাঘাট, আলল, দোকান, বাড়ি, মানুষ কখন যে কোনটা দেখছে, দেখতে দেখতে দাঁড়িয়ে পড়ছে, এর তার গায়ে গিয়ে পড়ে সামলে নিচ্ছে–রিনি বুঝে উঠতে পারছিল না। দু-চারবার রিনিকে ডাকতে হল, সাবধান করতে হল। এরকম মানুষ নিয়ে পথ হাঁটা মুশকিল। তাও তো এই রাস্তায় বাস-টাস চলে না, নয়তো রিনিকে সত্যিসত্যিই তনুর হাত ধরে নিয়ে হাঁটতে হত।
তনু আর একটু হলেই খোঁড়া রাস্তার গর্তে পা ফেলত। রিনি বাঁচিয়ে দিল। তারপর ধমকের গলায় বলল, রাস্তা দেখে হাঁটো। এ তোমার এতোয়ারপুর নয়।
তনু রাস্তা দেখে হাঁটতে লাগল।
এখানটায় জাদা ভিড়।
ভিড় হবে না! সন্ধেবেলায় লোকে বাইরে বেরিয়েছে, মানুষজন অফিস-টফিস থেকে ফিরছে, এখন তো ভিড় হবেই।
সামনেই রিনিদের মনিহারি দোকান। রিনি দোকানের দিকে এগুল না। তনুকে ট্রামরাস্তা পর্যন্ত নিয়ে যাবে বেড়াতে, তারপর ফিরবে। সোজা হাঁটতে লাগল রিনি। রাস্তায় নানা ধরনের জটলা। মোড়ের মাথায় এলে একেবারে দাঁড়িয়ে পড়ছে সে তনুকে নিয়ে, তারপর দুপাশ ভাল করে দেখে রাস্তা পেরোচ্ছে।
একটা আইসক্রিমের দোকান হয়েছে নতুন, সেখানে মেয়েদের খুব ভিড়। যত রাজ্যের পাড়ার মেয়ে বউ ভিড় করে আইসক্রিম খায়। তনুকে কলকাতার একটা আইসক্রিম খাওয়াতে ইচ্ছে হল রিনির। নিজেরও লোভ রয়েছে। কিন্তু ওই মেয়েলি ভিড়ে তনুকে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করল না। রিনি তফাত থেকেই চেনা মুখ দেখতে পাচ্ছিল। কেউ ডেকে ফেলতে পারে ভেবে রিনি অন্যমনস্কর ভান করে জায়গাটা পেরিয়ে গেল।
ট্রামরাস্তার কাছাকাছি এসে রিনি সেই ছোঁড়াদের জটলাটাকে দেখতে পেল। চায়ের দোকানের সামনে এই জটলা রিনি তার বাচ্চা বয়স থেকেই দেখছে। কিছু কিছু মুখ অদল বদল হয়েছে এইমাত্র, নয়তো সেই একই ধরনের জটলা। এক দঙ্গল ছেলে নানা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, এ ওর গলাটলা জড়িয়ে সারাটা সন্ধে এখানে আড্ডা মারে। রিনি এদের কাউকে কাউকে চেনে, এই পাড়ারই ছেলে, ছেলেবেলায় এক সঙ্গে খেলাধুলোও করেছে। এখনও ওই ছেলেগুলোর বাড়িতে কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে রিনিদের যেতে হয় সামাজিকতা রাখতে। রাস্তায় কিন্তু পরস্পরের মধ্যে ব্যবহারটা অচেনার মতন। রিনি ওদিকে খুব কমই তাকায় না তাকিয়েও বুঝতে পারে কারা কারা আছে। ওই দলের মধ্যে একজনকে শুধু পছন্দ করে রিনি, শঙ্করদা। লম্বা চওড়া চেহারা, বছরে তিনবার চুল কাটে, হপ্তায় বার দুই দাড়ি কামায়, গলার আওয়াজ গমগম করছে, রাস্তা কাঁপিয়ে হাসে। আজকাল আবার হাতে বালা পরে, হিপিদের মতন জামা-টামা গায়ে চাপায়। রিনিকে মাঝেমধ্যে ডাকে শঙ্করদা। তবে জটলার মধ্যে ঠিক নয় এই রিনি বলে ডেকে নিজেই বন্ধুদের ভিড় থেকে এগিয়ে আসে, কাছাকাছি এসে দু-চারটে কথা বলে, খবরাখবর নেয়, তারপর অক্লেশে পঁচিশটা পয়সা চেয়ে বসে। রিনি দিয়ে দেয়। আসলে পঁচিশটা পয়সা সেই মুহূর্তে সিগারেট কেনার জন্যে দরকার, বন্ধুদের চা সিগারেট খাইয়ে, কাউকে আবার ট্রামভাড়া বাসভাড়া দিয়ে শঙ্করদার পকেট ফাঁকা। আপাতত রিনির পঁচিশ পয়সায় কটা চারমিনার হবে। তারপর আবার কাউকে ধরবে রাস্তায়। চেনা অচেনা বড় একটা গ্রাহ্য করে না। দিব্যি আছে শঙ্করদা। বলে, বুঝলি রিনি, আমার হচ্ছে মডেস্ট লাইফ, এ মংক ইন মডার্ন সোসাইটি। রিনি ভেঙিয়ে বলে মংকস লাইফ না আর কিছু! তার সাহস হয় না যে বলবে, এ তোমার মাংকিস লাইফ।
জটলাটাকে রিনি তফাতে রেখে চলে যেতে যেতে আড়চোখে একবার দেখে নিল। রিনি এবং তনুকে ওরা দেখছে। কে একজন আর-একজনকে হঠাৎ এমনভাবে তাড়া করলে যে তাড়া-খাওয়া ছোঁড়াটা ছুটে এসে প্রায় রিনিদের পাক খেয়ে আবার ফিরে গেল। এই রগড় বা ইতরামির অর্থ রিনি জানে। শঙ্করদা নিশ্চয় ওখানে নেই, থাকলে ওদের এই সাহস হত না।
বিরক্ত বোধ করে রিনি একটু তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল। সামান্য এগিয়েই যমুনার সঙ্গে দেখা। যমুনা মুখ নিচু করে একপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ মুখ তুলতেই রিনির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
কী রে? রিনি বলল।
রিনি।
কোথায় গিয়েছিলি?
এই একটু কাজে– যমুনা বলল, তাকে কেমন চঞ্চল, বিব্রত দেখাচ্ছিল। রিনিকে এড়িয়ে যেতে পারলেই যেন বাঁচে।
রিনি যমুনার এই বিব্রতভাব বুঝতে পারছিল না। অথচ ওটা এমনই যে চোখে না পড়ে যায় না। যমুনার সাজপোশাকটাও রিনির কাছে দৃষ্টিকটু লাগছিল। গলায় পাথরের মালা, হাতে একগাদা প্লাস্টিকের চুড়ি, চোখে বড় করে পেনসিল টেনেছে, মাথার চুলে ফোলানো খোঁপা। শাড়িটাও খুব বাহারে।
যমুনার সঙ্গে দু-একটা কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও তার হাবভাব দেখে রিনি কিছু বলতে পারছিল না।
আমি যাই রে যমুনা পাশ কাটাবার জন্যে ব্যস্ত হল খুব। তারপর জবাবের জন্যে দাঁড়াল না, চলে গেল।
রিনি বেশ অবাক হল। যমুনাকে দেড় মাসের মধ্যে আর দেখেনি রিনি। মিল্ক বুথে চাকরি করত যমুনা, ছেড়ে দিয়েছে। কলেজ তো অনেক আগেই ছেড়েছে। ওর বাড়িতে নানারকম গোলমাল যাচ্ছিল রিনি শুনেছে। কিন্তু যমুনাকে আজ যেরকম মনে হল, বাড়ির গোলমালের জন্যে সেরকম হবার কথা নয়।
তনুকে ঘাড় ফিরিয়ে ডাকতে গিয়ে রিনি দেখে তনু নেই। আশেপাশে তাকিয়েও সে তনুকে দেখতে পেল না। আরে! দু পা পিছিয়ে গেল রিনি, ভাল করে দেখল, না, তনুকে দেখা যাচ্ছে না। এখানে এমন কিছু মানুষজনের ভিড় নেই যে, তনুকে দেখা যাবে না। কোথায় গেল তনু? কী আশ্চর্য। আচমকা কেমন এক উদ্বেগ বোধ করল রিনি। পেছনের দিকে না এগিয়ে রিনি তাড়াতাড়ি সামনের দিকে হাঁটতে লাগল। অদ্ভুত ছেলে তো! এরকম মাথা খারাপ ছেলে সে আর দেখেনি, বাবা। এই পেছনে পেছনে আসছিল, পলকের মধ্যে বেপাত্তা! গেল কোথায়? রিনি চারদিকে খুঁজতে খুঁজতে সামনে এগিয়ে চলল, যতদূর সম্ভব দ্রুত পায়ে। তনু যেভাবে রাস্তা হাঁটে তাতে ভরসা করা যায় না। সামনে ট্রামরাস্তা, ডবলডেকার বাস ছুটছে সবসময়, আরও হাজার রকম গাড়িঘোড়া। একটা বিপদ না বাধিয়ে বসে। বিপদের কথা মনে আসতেই রিনির বুক ধক করে উঠল। ট্রামরাস্তার দিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল রিনি৷
হঠাৎ রিনির নজরে পড়ল, বড় রাস্তার মোড়ে, আদ্যিকালের পাকুড়গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে তনু খুব বিমুগ্ধচিত্তে কলকাতার সন্ধে দেখছে। ট্রামের আসাযাওয়া, তার চাকার শব্দ, ঘন্টি, ডবলডেকার বাসের আকাশ কাঁপানো গর্জন, প্রাইভেট বাসগুলোর গায়ে কন্ডাক্টরদের দামামা বাজাবার আওয়াজ, মানুষজন, রিকশা–সমস্ত যেন তনুকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। ট্রামের মাথায় ফুলকি জ্বলে উঠল, আলো ঝলসে গেল, বাসের পেছনে কালো ধোঁয়া উড়ে রাস্তা অন্ধকার করে দিল, নীলচে রঙের টিউব আলোর বিজ্ঞাপনটা জ্বলে উঠেছে–তনু সবই কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ করছে।
রিনি একেবারে তনুর গায়ের পাশে গিয়ে ডাকল, এই! ডাকবার সময় তার খেয়াল ছিল না যে, সে তনুকে বেশ একটু ঠেলা মেরে দিয়েছে।
তনু তাকাল।
রিনি খানিকটা ধমকের গলায় বলল, বাঃ, অদ্ভুত ছেলে তো! আমি দাঁড়িয়ে আছি, আর তুমি দিব্যি হন হন করে এগিয়ে এলে? আমি এক্কেবারে বোকা। এদিক খুঁজছি, ওদিকে খুঁজছি। আশ্চর্য।
তনু বলল, আমি এইটুকু এগিয়ে এসে দাঁড়ালাম।
এইটুকু? রিনি পাশ ফিরে তারা যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেই দূরত্বটা হাতের ইশারায় দেখাল।
তনু বলল, কতটুকু আর?
রিনি ধমক দিল, কতটুকু আর! খুব মজা পেয়েছ। …একটা কিছু হলে তোমার নীহারপিসি আমার গলা কুপিয়ে দিত। খুব হয়েছে, আর বেড়িয়ে দরকার নেই। চলো।
তনু হেসে বললে, আমি সামনের রাস্তা পেরোইনি। তোমার জন্যে দাঁড়িয়েছিলাম।
রিনি তার অভিভাবকত্বর মর্যাদা রেখে বলল, বেশ করেছিলে, এখন ফিরে চলো।
তনুকে নিয়ে রিনি আবার ফিরতে লাগল। তনু মাঝে মাঝে কথা বলছিল। রিনি জবাব দিচ্ছিল না। তেমন। তনুর কথার জবাব তার জানা ছিল না। যেমন, ট্রামের চাকা কতগুলো? ডিজেল ইঞ্জিনের এই ধোঁয়া শহরের বাতাস নষ্ট করছে কেমন করে ইত্যাদি ইত্যাদি।
হাঁটতে হাঁটতে রিনি তাদের বাড়ির কাছাকাছি এসে মনিহারি দোকানটার সামনে থামল। তনুকে বলল, এখানে দাঁড়াও, কোথাও যাবে না; আমি জিনিসগুলো কিনে আনি।
তনু দোকানের সামনে সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে থাকল।
জিনিসপত্র কিনে রিনি কোথায় যেন আড়ালে চলে গেল ফোন করতে। ফোন সেরে রাস্তায় নেমে এল, হাতে ব্রাউন পেপারের প্যাকেট।
তনু হাত বাড়াল, আমায় দাও।
থাক।
দাও, আমি নিচ্ছি।
রিনি হঠাৎ তার ডান হাতের মুঠো তনুর হাতের ওপর আলগা করে দিল। তনু দেখল, রিনি তার হাতে পুরু একটা চকোলেট বার ফেলে দিয়েছে। হেসে ফেলল তনু। বলল, চকোলেট আমার খুব ফেভারিট। তুমি জানলে কী করে?
ঘাড় বেঁকিয়ে রিনি বলল, হাত গুনে।
তোমার শেয়ার নাও।
তুমি খাও। তোমার এখনও টফি-চকোলেট খাবার বয়েস রয়েছে।
তোমারও আছে।
তনু হাত বাড়িয়ে রিনির জিনিসপত্রের প্যাকেটটা ততক্ষণে নিয়ে নিয়েছে। রিনির হাতে সামান্য কটা জিনিস।
বাড়ির কাছাকাছি এসে রিনি বলল, পার্কে যাবে? না থাক..দেরি হয়ে যাচ্ছে, মা ভাববে।
তনু বলল, কটা বেজেছে?
রিনি হাতে ঘড়ি পরেনি। তা হলেও তার অনুমান, সাতটা বেজেছে হয়তো। না, রাত নিশ্চয় হয়নি; কিন্তু নুকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে, মা ভাবতে পারে। কী মনে করে রিনি বলল, আচ্ছা চলো, পাঁচ-দশ মিনিটে কী আর হবে–একটা পাক দিয়ে যাই।
রিনিদের বাড়ির সামনে চিলড্রেনস পার্কটা সন্ধের পর পাড়ার বড়দের একটু হাওয়া খাওয়ার জায়গা হয়ে ওঠে। গরমের দিনে অনেকেই এসে বসে থাকে, গল্পগুজব করে। সকালে বুড়োরা চক্করবে।
পার্কে এসে রিনি দেখল, বসার জায়গা কোথাও নেই। ছোট পার্ক। ঘাসের চিহ্নও বড় একটা দেখা।
যাচ্ছে না। রিনি হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় এসে দাঁড়াল। বসবে? দরকার নেই বসে, যা ধুলো।
তনু বলল, তোমাদের কলকাতায় ঘাস নেই।
রিনি টপ করে বলল, আমাদের কলকাতায় গোরুঘোড়া কম।
তনু প্রথমটায় বোঝেনি, পরে বুঝল। বুঝে জোরে হেসে উঠল। আমি যদি বলি, বেশি। বেশি বলেই এই হাল।
রিনি আর জবাব দিতে পারল না। মার শ্যামচাঁদ একেবারে নেহাত গাধা নয়। বুদ্ধি ধরে।
তনু এর মধ্যে কখন চকোলেটটা ভেঙে ফেলেছে। রিনির হাতে আধখানা গুঁজে দিয়ে, নিজে বাকি আধখানা মুখে দিল।
ঠিক এমন সময় একটা বাচ্চা মতন ছেলে বেলফুলের মালা বেচতে সামনে এসে দাঁড়াল। রিনি মাথার চুলে মালা জড়ানো তেমন পছন্দ করে না, সেরকম কোনও সুযোগও তার আজ নেই, তবু কী মনে করে একটা মালা কিনে হাতব্যাগের মধ্যে রেখে দিল।
পার্কের বাইরে এসে রাস্তা পেরোবার সময় রিনি আবার যমুনাকে দেখল। রিকশায় বসে আছে, পাশে যেন একটা অবাঙালি লোক। রিকশাটা ঠুনঠুন করে ঘন্টা বাজিয়ে চলে গেল। রিনি অবাক হয়ে রিকশার পেছনটা দেখতে দেখতে রাস্তা পেরিয়ে এল।
.
০৪.
তেতলায় ঘরের সামনে ছাদটুকুতে শরদিন্দু বসেছিলেন। আকাশটা খুব পরিষ্কার, চারদিক জুড়ে তারা ফুটে আছে। শরদিন্দুর সামনে কিছু টবের গাছ, ফুল নেই, পাতাই চোখে পড়ে। সিঁড়ির দিকের বাতিটা জ্বলছিল। তার সামান্য আলো ছাদের অন্ধকারে পাতলা ভাবে মিশে আছে।
রিনি খানিকটা আগে ছাদে ছিল। শরদিন্দু তার সঙ্গে কথা বলছিলেন। তনুশ্যাম ছাদের আলসের কাছে দাঁড়িয়ে আশপাশের বাড়ি, দুরের নারকোল গাছ, আকাশ দেখছিল। মাঝে মাঝে বাবা এবং রিনির কথাবার্তা তার কানে আসছিল। বাবা যে খুব গম্ভীর মানুষ তা নয়, কিন্তু কলেজে বাবাকে বেশ গম্ভীর, ভারিক্কি মনে হয়, বাড়িতে বাবা অনেক হালকা। তবু তনু বুঝতে পারছিল, বাবা রিনির সঙ্গে গল্প করার সময় আরও হাসিখুশি মজার মানুষ হয়ে যাচ্ছিল। বাবা যেসব গল্প করছিল, তার অর্ধেকই পুরনো গল্প, নিজেদের বাড়িঘরের গল্প, নীহারপিসির গল্প। তনুর সঙ্গে বাবা বড় একটা এসব গল্প করে না। নীহারপিসি কেমন করে একবার নাকের মধ্যে সেফটিপিন ঢুকিয়ে ফেলেছিল, ডাক্তারখানায় নিয়ে গিয়ে তবে সেটা বার করা গেল: কবে যেন এক সাধু এসে পিসির মুঠোয় ছাই দিয়ে হাতের রুলি খুলে নিয়ে পালিয়েছিল–এইসব গল্প। রিনি যে কতটা অবাক হচ্ছিল কে জানে, মাঝে মাঝে খিলখিল করে হেসে উঠছিল। তনুর মনে হল, রিনি এসব গল্পের বেশিটাই জানে। সে প্রায়ই বাবাকে বলছিল: এটা আমি জানি, ও গল্প আমি শুনেছি। নিজেই কোনও কোনও কথার খেই ধরিয়ে দিচ্ছিল। শেষে তনু ছাদ থেকে নেমে গেল।
রিনি গেল আরও খানিকটা পরে, নীহার ওপরে আসার পর। নীহার ছাদে এসে মেয়েকে বললেন, রিনি, তোর মামাকে একটু শরবত করে এনে দে। আর শ্যামকে জিজ্ঞেস কর, শরবত খাবে, না এখন দুধ খাবে খানিকটা। যদি দুধ খায়, ওভালটিন দিয়ে দিবি।
মনে মনে রিনি একটা সংলাপ সঙ্গে সঙ্গে ভেবে নিল। নীচে নেমে মার শ্যামকে সে বলবে: এই যে আসুন খোকাবাবু, মা আপনাকে দুধ খাইয়ে দিতে বললেন। কথাটা মনে করে নিজের মনেই রিনি হেসে ফেলল।
হাসিটা নীহার দেখতে পেয়েছিলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, হাসছিস যে?
রিনি চট করে বলে ফেলল, না, মামার জন্যেও দুধ দিয়ে আসি বরং।
শরদিন্দু তাড়াতাড়ি বললেন, না দুধ নয়। দুধ আমি একবারই খাই, রাত্রে। তুমি আমায় বরং শরবতই করে দাও। সন্ধেবেলায় আমি ইশবগুলের শরবতই খাই লেবু আর মিছরি দিয়ে। …সে পরে হবে, আজ এমনি শরবত খাই।
রিনি চলে গেল।
শরদিন্দু বললেন, তুমি নাকি পুজোপাঠ করতে বসেছিলে?
নীহার গিয়েছিলেন জলের ট্যাঙ্কটার দিকে। রিনির ভিজে শাড়িটা বাতাসে জাপটে গিয়েছিল। তারে-মেলা শাড়িটা ছড়িয়ে দিলেন ভাল করে। সন্ধেবেলায় গা ধোয়ার অভ্যেসটা মেয়ের গেল না, বিকেলে গা ধুয়ে নিলে ক্ষতি কীসের! অনেক বলেও মেয়েকে এই অভ্যেস ছাড়ানো গেল না। গরম-ঠাণ্ডায় মাসের মধ্যে কুড়িদিন ওর গলা খুসখুস, টনসিল ব্যথা লেগে আছে। একসময় গানের গলা করেছিল চমৎকার, বেশ মিষ্টি, আজকাল সে-পাটও তুলে দিয়েছে। কী বলবেন আর মেয়েকে! নিজের মরজিতে ও চলে। একেবারে বাপের মতন। এই গরম বাতিক এখন চলল। খুব বাড়াবাড়ি করে বর্ষা নামার পর বাতিকটা ঘুচবে। শাড়ির পাশে ব্লাউজ, টপটপ করে জল পড়ছে এত ভিজে। নীহার জলটা নিংড়ে দিয়ে ফিরে এলেন।
আমায় কিছু বললে? নীহার শুধোলেন।
বলছিলাম, তুমি নাকি পুজোপাঠ করছ আজকাল?
তা একটু করছি বইকি। বুড়ি হয়ে গেলাম, এখনও যদি না করি, তবে আর কবে করব? নীহার মৃদু হাসলেন।
নীহারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শরদিন্দু দুহাত মাথার ওপর তুলে ক্যাম্বিসের চেয়ারের মাথায় রাখলেন। তুমি বুড়ি হয়ে গেলে? শরদিন্দু যেন সস্নেহে, এবং সকৌতুকে হাসলেন।
শরদিন্দুর মুখোমুখি বেতের চেয়ার ছিল একটা; পাশে মোড়া। নারান সন্ধের মুখে বাইরে বের করে রেখে গেছে সব। বেতের ছোট টেবিলে শরদিন্দুর চশমার খাপ, সিগারেট, দেশলাই, ছাইদান।
নীহার বেতের চেয়ারটায় বসলেন। বুড়ি হতে আমার কিছু বাকি দেখছ নাকি?
শরদিন্দু সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিলেন না। সামান্য পরে বললেন, তোমার কত বয়েস হল, বলল তো?
নীহার শরদিন্দুর চোখ, মুখ, আলস্যভরা চেহারা, বিশ্রাম উপভোগের হালকা ভাবটা লক্ষ করতে করতে বললেন, তুমিই বলো না। আমি বললে তো বয়সে কমাব।
কেন, কেন?
মেয়েরা যে নিজেদের বয়েস কমিয়েই বলে, নীহার মুচকি হাসলেন।
শরদিন্দু হেসে ফেললেন। তোমার পঞ্চাশ হয়নি। পঞ্চাশ হতে এখনও দেরি আছে দু-চার বছর।
তোমার কি ষাট হয়ে গেল? নীহার কৌতুক করে বললেন।
আমার ফিফটি ফোর চলছে। তোমাতে আমাতে ছ সাত বছরের তফাত।
মেয়েদের বুড়ি হতে বয়েস শুনতে হয় না গো, এবেলার ফল ওবেলায় গলে যায়।
শরদিন্দু নীহারকে দেখলেন। যতটা নীহার বলছে অতটা বুড়ো হয়ে যাবার লক্ষণ তার চেহারায় নেই। এখনও ওর মুখে লাবণ্য আছে, বরং সাংসারিক সুখ-দুঃখের স্পর্শে সে লাবণ্য আরও ঘরোয়া আরও কোমল হয়েছে। তোমার কি গুরু-টুরু আছে?
গুরু–?
দীক্ষা নাওনি?
না, সেভাবে আমার দীক্ষা নেওয়া হয়নি। শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে রামকৃষ্ণ আশ্রমের অনেকের মেলামেশা ছিল। আশ্রম থেকেই যেটুকু…
ও! শরদিন্দু চেয়ারের মাথার ওপর থেকে হাত দুটো নামিয়ে নিলেন।
নীহার খানিকটা হালকা করেই শুধোলেন, তা তুমি কিছু করো না?
পুজোটুজো? না– মাথা নাড়লেন শরদিন্দু না, আমার ও পাট নেই। ঠাকুরদেবতা নিয়ে বসবার সময় কই?
নীহার ঠাট্টার গলায় বললেন, ছেলেবেলায় তো খুব ঠাকুর ভক্তি ছিল। দুর্গাপূজায় অষ্টমীতে অঞ্জলি দিতে, কালীপুজোয় রাত জেগে বসে থাকতে, সরস্বতীপুজোয় মাতব্বরি করতে। সে সব গেল কোথায়?
শরদিন্দু যেন স্মৃতির কেমন এক স্পর্শ অনুভব করে মুদু হাসলেন। ভক্তি আমার এখনও যে একেবারে নেই নীহার তা নয়, আছে। বারো-চোদ্দো মাইল ঠেঙিয়ে দুর্গাপুজো দেখতে যাই। কিন্তু ঘরবাড়ি ছেড়ে বির্ভুইয়ে থাকতে থাকতে আমাদের সংসারের আচার আচরণ অর্ধেক নষ্ট ঘরে ফেলেছি। আমাদের বাঙালি হিন্দুবাড়িতে মেয়েরা থাকলে তবু একটা আচার-ধর্ম চোখে দেখা যায়। সেসব পাটও চুকেছে আমার। তার ওপর ছেলেটা। ওর জন্যে মাথায় যে কতরকম ভাবনা থাকে। বলতে বলতে শরদিন্দু চুপ করে গেলেন, তাঁর গলার স্বর গাঢ় শোনাচ্ছিল। দীর্ঘ করে নিশ্বাস ফেললেন। সামান্য পরে বললেন, চাকরি-বাকরি শেষ হয়ে এল। আর দু চারটে বছর, তারপর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসে ওই ভগবান-টগবান করেই জীবনটা কাটাতে হবে।
নীহার কিছু বললেন না। শরদিন্দুর মনের বারো আনা ছেলের মধ্যে রয়েছে। সারাদিন হয়তো সেই চিন্তাতেই কাটে। বোধহয় এখন ভগবান-টগবানে ভরসাও নষ্ট হয়ে এসেছে।
কাল একবার গুপ্তসাহেবের কাছে যাই, কী বলো? নীহার বললেন।
একটা খবর দিতে হবে না?
কিছু না। আমার সবই বলা কওয়া আছে। কালকেও আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। আমি বলেছি, তোমরা আজ এসে পৌঁছোচ্ছ। উনি জানেন সব। কাল সকালে রিনিকে দিয়ে না হয় বাড়িতে একটা ফোন করিয়ে দেব।
কখন যেতে হবে?
বিকেলে। সকালে হাসপাতালে থাকেন। বিকেলে ওঁর চেম্বারে যাব। পার্ক স্ট্রিট।
শরদিন্দু অন্যমনস্ক হয়ে ফুলের টব-গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, উনি তোমাদের খুব জানাশুনো?
হ্যাঁ নীহার ঘাড় হেলালেন, মানুষটি খুব ভাল। রিনির বাবার সিনিয়ার ছিলেন। একই হাসপাতালে ছিলেন একসময়। খুব ভালবাসতেন ওঁকে।
শরদিন্দু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, একেই গেরো বলে বুঝলে নীহার, সেই কলকাতায় আসতে হল, আগে যদি আসতুম, তোমার স্বামী থাকতে, কত সাহায্য পেতাম, হয়তো ছেলেটা এতদিনে ভাল হয়ে যেত।
নীহার বললেন, এলে না কেন।
কেন যে শরদিন্দু আসেননি, তা তিনিও জানেন না। তাঁর তো সব জানা ছিল, নীহারের স্বামীর কথা, নীহারের ঠিকানা; এটাও জানতেন ছেলেকে নিয়ে আসতে চাইলে কোনও অনাদর তাঁর হত না। তবু শরদিন্দু আসেননি! সেটা কি অভিমান বশে? ক্ষোভটা দূর করতে পারতেন না? নাকি তাঁর মনে হত, নীহারের স্বামীর কাছে আসায় তাঁর কোনও গ্লানি, আছে? শরদিন্দু, যে কোনও কারণেই হোক, দূরে দূরেই থাকতে চেয়েছিলেন, কাছে আসতে চাননি। নীহার তখনও তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে, যেন জানতে চাইছেন–এলে না কেন?
শরদিন্দু বললেন, তখন যে এরকম অবস্থা ছিল না। ভুগছিল অবশ্য শ্যাম, কিন্তু চোখ খারাপ চোখ খারাপ করে কেটেছে। জেনারেল হেলথ আর চশমার ওপরই নজর ছিল। ওখানকার ডাক্তাররা আমায় কিছু অ্যাডভাইস করেনি। আস্তে আস্তে অন্যরকম দাঁড়িয়ে গেল। তারপর তো কত রকম করলাম। কলকাতায় পেশেন্ট নিয়ে আসা, থাকা, চিকিৎসা করিয়ে ফিরে যাওয়া, এ তো আমাদের পক্ষে সহজ ব্যাপার নয়, এই দেখো না, তোমাকে কবে থেকে লিখছি শীতের শেষাশেষি আসব। বলেছিলাম শীত, আসতে আসতে সামার পড়ে গেল।
রিনি আসছিল। তার পায়ের আওয়াজ হচ্ছিল সিঁড়িতে। বাড়িতে অর্ধেকসময় পায়ে চটি রাখে না রিনি, খালি পায়ে হাঁটতে নাকি তার আরাম লাগে খুব। সাদা ডিশের ওপর শরবতের গ্লাস নিয়ে সে দেখা দিল।
হাত বাড়িয়ে শরদিন্দু শরবত নিলেন। রিনি মার জন্যে পান সেজে এনেছে, নীহারের হাতে পান দিল।
শরদিন্দু রিনিকে বললেন, শরবতে বরফ-উরফ দাওনি তো?
না, রিনির মাথা নাড়ল, খাবেন বরফ? এনে দেব?
না না।
ও বলল, আপনি বরফ-টরফ খান না, গলা ধরে যায়।
শরদিন্দু রিনির ও শব্দটা শুনলেন, ও মানে শ্যাম। কানে কেমন যেন লাগল তাঁর, দুপুর থেকে সন্ধের মধ্যে শ্যাম আর রিনির সম্পর্ক বেশ হৃদ্য হয়ে উঠেছে।
নীহারও একসময় তাঁকে এই ভাবে ও বলত। শরদিন্দু কেমন স্নিগ্ধ বোধ করলেন।
নীহার মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, শ্যামকে দুধ-টুধ দিয়েছিস?
দুধ খাবে না। শরবত খাচ্ছে।
দুধ খাবে না কেন?
কে জানে! আমি জানি না।
দুধ খাওয়া নিয়ে তোরা ছেলেমেয়েরা যা করিস বাপু, আমার মাথা গরম হয়ে যায়। রাত্তিরেই খাবে তবে– নীহার বললেন।
শরদিন্দুর কী যেন মনে পড়ে গেল। নীহারের দিকে সকৌতুক চোখে তাকিয়ে বললেন, তোমারও তো দুধ নিয়ে কত বাতিক ছিল।
নীহার বললেন, আমার সঙ্গে ওদের তুলনা কোরো না। ওদের এই বয়সে—
বাধা দিয়ে শরদিন্দু বললেন, আমি কিন্তু তোমার ওই বয়েসের কথাই বলছি। এটা আমার জানার মধ্যে পড়ে কিনা।
নীহার বোধহয় জব্দ হয়ে চুপ করে গেলেন। তাঁর পান-খাওয়া ঠোঁটে রসের সঙ্গে হাসি এসে মিশে গেল।
রিনি হেসে ফেলেছিল। আর দাঁড়াল না। চলে গেল।
শরদিন্দু আস্তে আস্তে শরবত খেতে লাগলেন। তাঁর কয়েকগুচ্ছ পাকা চুল কানের পাশের কপালের ওপর এলোমেলো হয়ে ছিল।
নীহার ধীরে ধীরে পান চিবোচ্ছেন। মাথায় কাপড় নেই। চুলের খোঁপাটা এলো করে জড়ানো।
বসে থাকতে থাকতে নীহার বললেন, তুমি যেন কী বলছিলে?
কীসের? শ্যামের কথা?
না, শ্যামের কথা নয়। শ্যামকে কাল নিয়ে যাই আগে তারপর। …তুমি অন্য কী বলছিলে না? রিটায়ার করে আবার নিজের বাড়ি-টাড়িতে ফিরে গিয়ে বসবে।
ও, হ্যাঁ; বলছিলাম। আমার সেইরকম ইচ্ছে। প্রবাসেই তো জীবনের বারো আনা কেটে গেল। এবার জীবতারা খসে যাবার আগে নিজের জায়গায় ফেরা ভাল। কী বলো? শরদিন্দু পরিহাস করে বললেন।
নীহার জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ির এখন খবর কী? তোমার আসা-যাওয়া ছিল বলে তো শুনিনি।
একেবারে ছিল না, তা বোলো না। মা যতদিন বেঁচে ছিল পুজোর ছুটিটা বাড়িতেই কাটাতাম। মা মারা যাবার পর দিদির জন্যে যেতে হত। দিদিও চলে গেল, আমারও আসা-যাওয়া ফুরোল। শরদিন্দু সামান্য থেমে আবার খানিকটা শরবত খেলেন। আমাদের সাধুকে তোমার মনে আছে। সাধুই বাড়িটা দেখাশোনা করত, থাকত। আমি কখনও-সখনও গিয়েছি। গত বছর পুজোতে গিয়েছিলাম। বাড়িটার কড়ি, দেওয়াল-টেওয়াল অনেক নষ্ট হয়েছে। বাগানটুকু জঙ্গল। অল্পসল্প মেরামত করিয়ে এসেছি। সাধুই করাচ্ছে, আমি টাকা-পয়সা পাঠিয়ে দিই। ও থাকতে থাকতে বাড়িটা আবার বাসযোগ্য করিয়ে নিলে আমার ঝঞ্জাট বেঁচে যায়।
নীহার প্রত্যেকটি কথা মন দিয়ে শুনছিলেন। শরদিন্দুদের বাড়ির ছবিটি তাঁর মনে ভাসছিল। আমিও শুনছিলাম, তুমি বাড়িকাড়ি সারাচ্ছ।
আস্তে আস্তে সারিয়ে নিই, আমার তাড়াহুড়োর কোনও দরকার নেই।
ভালই করছ। বাইরে বাইরে আর কতকাল থাকবে!
শরবতের গ্লাসটা রেখে দিলেন শরদিন্দু, বেশ তৃপ্তি পেয়েছেন মনে হল শরবতটুকু খেয়ে। এবার হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট, দেশলাই তুলে নিলেন। দেখো নীহার, বুড়ো হয়ে গেলে মানুষের মধ্যে একটা কেমন ভয়-ভয় ভাব হয়। তখন ইচ্ছে করে জানাশোনাদের মধ্যে থাকতে। যাদের চিনি-জানি তাদের মধ্যেই ভরসা খুঁজি। আমি যেখানে চাকরি করেছি এতকাল, সেখানে মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা করতে পারতাম। অনেকেই বলেছিল। কিন্তু আমার ইচ্ছে হল না। ভালও লাগে না ওভাবে পড়ে থাকতে। তা ছাড়া ছেলেটা? তার কথা ভাবলে দুশ্চিন্তায় রাত্রে ঘুম হয় না। আমার নিজের মানুষ বলতে আর কেউ নেই। তবু নিজের জায়গায় ফিরে আসতে পারলে ছেলেটাকে অন্তত দেখার লোক জুটবে।
নীহার সমস্তই অনুভব করতে পারছিলেন: শরদিন্দুদের দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, দুঃখ। মানুষটিকে সান্ত্বনা ও ভরসা দিতে বড় ইচ্ছে হল, বললেন, তোমার অত দুর্ভাবনা করার কিছু নেই। এখনও তো একেবারে থুথুরে বুড়ো হয়ে যাওনি। হেসেখেলে কুড়িটা বছর কাটিয়ে দিতে পারবে। শ্যামও বড়টি হয়ে গেছে। দু-চার বছরের মধ্যে সে মানুষ হয়ে যাবে। তোমার ভাবনা কী?
শরদিন্দু দেশলাই জ্বেলে সিগারেটটা ধরিয়ে নিলেন। নীহারের দিকে না তাকিয়েই বললেন, আরও কুড়িটা বছর বেঁচে থাকতে বলছ?
নীহার পায়ের দিকের কাপড়টা গুছিয়ে নিতে হেঁট হয়েছিলেন, ঘাড় তুলে বললেন, ওমা, তা কেন থাকবে না! তোমার এমন কী বয়েস হয়েছে বাপু! সত্তর, পঁচাত্তর বছর পর্যন্ত মানুষ বেঁচে থাকে না? বলছ কী তুমি! আমার শ্বশুরমশাই তো আটষট্টি বছর বয়সে গিয়েছেন।
শরদিন্দু নীহারের দিকে তাকালেন। সামান্য অপেক্ষা করে বললেন, বেঁচে থাকার কথা কেউ কি জোর করে বলতে পারে নীহার? তুমি নিজের অবস্থা দেখে বুঝতে পারছ না, সংসারে ওই জিনিসটার সময় বলে কিছু নেই।
নীহার নীরব থাকলেন। জীবনে এই সত্যটা তাঁর অজানা নয়। শরদিন্দুর জীবনেও তেমন দুর্ভাগ্য না ঘটেছে এমন নয়, নীহার যেমন স্বামীকে হারিয়েছেন, শরদিন্দুও হারিয়েছেন স্ত্রীকে। নিজের বেদনা, শরদিন্দুর বেদনা–দুইই যেন নীহারের মধ্যে কেমন পাশাপাশি দুটি ধারার মতন বয়ে যেতে যেতে একসময় একত্রে মিশে যাচ্ছিল।
শরদিন্দু অন্যমনস্কভাবে সিগারেট খেতে খেতে পিঠ হেলিয়ে বসলেন আবার। তিনি যে কোন দিকে তাকিয়ে ছিলেন বোঝা যাচ্ছে না; আকাশের দিকে, নাকি অনেকটা দূরে–যেখানে নারকোল গাছের মাথায় অন্ধকার জমে মেঘের আকার নিয়েছে সেদিকে তাকিয়ে আছেন!
নীহার শরদিন্দুকে দেখছিলেন। মুখটি চৌকো ধরনের, গালের চামড়ার টান পাতলা হয়ে আসছে, চোখের তলা কুঁচকে যাচ্ছে, চিবুক বেশ পাতলা। মাথায় পাকা চুলের মাত্রাটাই বেশি। চোখ দুটি অনেক স্তিমিত। গলার চামড়া ঝুলে এসেছে যেন। বয়স হিসেবে শরদিন্দুকে আরও প্রৌঢ় মনে হয়। গলার স্বরটি কিন্তু এখনও ভরাট।
নিশ্বাস ফেলে নীহার বললেন, তুমি পুরুষমানুষ। তোমার অত ভয়-ভাবনা সাজে না। কথাটা বলার পর নীহারের নিজের কাছেই কেমন অর্থহীন শোনাল।
শরদিন্দু মুখ ফিরিয়ে নীহারের দিকে তাকালেন। আমি অনেক সময় তোমার কথা ভাবতুম। লোকে বলত, তুমি খুব বুদ্ধিমতী, বিচক্ষণ, সাংসারিক বোধবুদ্ধি তোমার কম নয়। আজ এখানে এসে তোমাদের দেখে আমি সত্যিই বেশ অবাক হয়েছি। তুমি তো মেয়ে হয়ে একলা বেশ টেনে এনেছ এই সংসার। তোমার সংসারটিও বড় সুন্দর লাগছে।
নীহার কেমন এক মুখ করে সামান্য হাসলেন। বললেন, মেয়েদের কি আর ছটফট করলে চলে গো? আমাদের পা-ছড়িয়ে বসে কাঁদার সময় কই! বলে বাঁ পা আস্তে করে চেয়ারের ওপর তুলে হাঁটু মুড়ে নিলেন। পা ঝুলিয়ে বেশিক্ষণ বসে থাকতে তাঁর কষ্ট হয়, বাঁ হাঁটুতে একবার জল জমেছিল। মৃদু গলায় বললেন, উনি যখন যান তখন আমি বড় একলা, অসহায় হয়ে পড়েছিলুম। হঠাৎই চলে গেলেন, দুদিন আগেও বুঝতে পারিনি। কী যে ব্যাধি পুষছিলেন পেটে, রক্ত পড়তে শুরু করল সকাল থেকে, বিকেলে নিয়ে গেল হাসপাতালে। পরের দিন ভোরে চলে গেলেন। আমার তখন যা অবস্থা–চোখের সামনে শুধু অন্ধকার দেখেছি। ভগবানের পায়ে শুধু মাথা খুঁড়েছি। ওই কচি মেয়ে, সম্বল বলতে এই বাড়িটা, আর সহায় বলতে নিজের কেউ না, বাইরের দু-একজন। কিন্তু বসে বসে কাঁদলে তো দিন চলে না। বুক বেঁধে উঠে দাঁড়িয়েছি। এখন আমার যা ভাবনা ওই মেয়েকে নিয়ে, আর কিছু নয়।
শরদিন্দু স্থির, শান্ত, সস্নেহ দৃষ্টিতে নীহারকে দেখছিলেন।
দুজনেই কিছুক্ষণ আর কথা বলার মতন কিছু পেলেন না। শরদিন্দু সিগারেটের টুকরোটা ছাইদানে ফেলে দিলেন।
নীহারই কথা বললেন আবার, আমাদের ওখানে পালিতবাবুদের বাড়িতে এক সন্ন্যাসী এসেছিল একবার তোমার মনে আছে?
শরদিন্দুর খেয়াল করতে সময় লাগল। খেয়াল হলে মাথা নাড়লেন আস্তে করে।
সেই সাধু আমার হাত দেখে বলেছিলেন, কোনও কালেই আমার মনের শান্তি হবে না, নীহার বললেন।
নীহারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শরদিন্দু শুধোলেন, হয়নি?
কোথায় আর হল?
শরদিন্দু নীরব থাকলেন। নীহারের দুর্ভাগ্যই কি সব? তার সৌভাগ্যের দিনে সে কি শান্তি পায়নি? কথাটা পালটে নিয়ে নীহারকে ভরসা দেবার মতন করে বললেন, তোমার দায় তো শেষ হয়ে এসেছে।
ব্যস্ত ভাবে হাত নেড়ে নীহার বললন, বোলো না বোলো না। মেয়েটা আছে আমার গলার সঙ্গে জড়িয়ে। ওর বরাতে কী আছে–সেই ভেবে ভেবে আমার রাত কাটে।
শরদিন্দু নীহারের উদ্বেগটুকু অনুভব করলেন। তারপর হালকা করেই বললেন, তোমার মেয়েকে দেখলে তোমায় খানিকটা বোঝা যায়।
আমায়? নীহার অবাক হয়ে চেয়ে থাকলেন।
ওর বয়সে তুমিও অনেকটা ওই রকম ছিলে।
আমি আবার ওর মতন ছিলাম কোথায়! নীহার আপত্তি জানিয়ে বললেন, আমার চোখমুখ ও পায়নি, ওর বাবারটা পেয়েছে।
শরদিন্দু নরম গলায় হাসলেন। তোমারও পেয়েছে। তোমার গায়ের রং, কোঁকড়ানো চুল, ছিপছিপে গড়ন–সবই দেখছি তোমার মেয়ে পেয়েছে। কথাবার্তা বলার ধরনটাও প্রায় তোমার মতন।
নীহার হেসে ফেললেন। মাথা নেড়ে বললেন, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে, আমি ওর মতন ছিলাম না।
শরদিন্দু কোনও প্রত্যুত্তর করলেন না, হাসিমুখে তাকিয়ে থাকলেন। তাঁর মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, নীহার অতীতে কেমন ছিলেন তিনি তা বিলক্ষণ জানেন।
নীহার যেন হঠাৎ কেমন আনমনা হয়ে গিয়েছিলেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক পলক, চোখ নামিয়ে শরদিন্দুর দিকে তাকালেন। তারপর আচমকা বললেন, তুমি আমায় ভুলে গেছ।
শরদিন্দুর মুখের ভাব বদলাল না। নীহারের চোখে চোখ রেখে মৃদু গলায় বললেন, ভুলে গিয়েছি?
দুজনেই নীরব। যেন দুজনের মধ্যে দিয়ে কুড়ি বাইশটা বছরের জল গড়িয়ে যাচ্ছিল।
শেষে নীহার বললেন, ভুলে যাওয়া আশ্চর্য কী। কতকাল পরে আবার আমায় দেখলে বলল তো?
তুমিই বলো।
আঠারো উনিশ বছর পরে। কুড়ি বছরই ধরো– নীহার অন্তরঙ্গ গলায় বললেন। তোমাকে আমি শেষবার দেখেছি, শ্যাম তখন বাচ্চা, বছর চার পাঁচ বয়েস। আমি মেয়ে কোলে করে বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম, একেবারে কচি তখন রিনি, দাঁত উঠেছে সবে। তুমি শীতের ছুটিতে বাড়ি এসেছিলে। বউদিকেও আমি সেই প্রথম দেখলাম। এসব কি আজকের কথা! আজ রিনির বয়েস কুড়ি হতে চলল, শ্যামের তেইশ-টেইশ হবে। প্রায় দু যুগ পরে আবার আমায় দেখছ। ভুল হওয়ারই তো কথা।
শরদিন্দু বাঁ হাতটা পাতলা চুলের ওপর দিয়ে বুলিয়ে নিচ্ছিলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টিতে কেমন এক মমতা জড়ানো। ধীরে ধীরে বললেন, হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা। দু যুগ বলতে পারো। পুষ্প তখন বেঁচে ছিল। …তারপর অবশ্য দেখাসাক্ষাত আর হয়নি। কিন্তু খবরটবর পেতাম সবই।
নীহার আবার পা নামিয়ে নিলেন। হাঁটুতে সাড়া পাচ্ছেন না, চাপ লেগে যেন অস্বস্তি হচ্ছিল, ব্যথাও করছিল। সরল গলায় বললেন, তা হলে আমি মন্দটা আর কী বলেছি বলো! আমার বিয়ের পর সেই আমায় প্রথম দেখলে, বিয়ের সময় তুমি ছিলে না, তার আগে যা দেখেছ। অতদিনের চেহারা কি তোমার মনে থাকার কথা?
শরদিন্দু সকৌতুক অথচ শান্ত গলায় বললেন, মনে না থাকলে আজ আমি তোমায় হাওড়া স্টেশনে চিনতে পারলাম কী করে?
নীহার যেন একথাটা ভেবে দেখেননি আগে। সামান্য থতমত খেয়ে গেলেন। তারপর হেসে বললেন, থাক, ও বড়াই আর কোরো না। তুমি আমায় চেনার আগেই আমি তোমায় খুঁজে নিয়েছি।
শরদিন্দু মৃদু হেসে বললেন, তোমার সেই পুরনো অভ্যেস আজও আছে নীহার। এখনও তুমি তোমারটা আগে দেখবে। বেশ, তাই হল। তুমিই আমায় আগে খুঁজে নিয়েছ, আমি তোমায় পরে চিনেছি। ..খুশি হলে তো?
নীহার নীরব হয়ে গেলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি স্নান, বিমর্ষ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ পরে নিশ্বাস ফেলে বললেন, কে কাকে আগে চিনেছে সে ঝগড়া আর আমি করব না গো। তুমি ছেলেটাকে নিয়ে আমার কাছে এসেছ, এতকাল পরে, এতেই আমি খুশি।
.
০৫.
দোতলার বারান্দায় বসে শরদিন্দু কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলেন; তারপর ওপরে তেতলায় নিজের ঘরে চলে গেলেন। নীহার গেলেন গা ধুতে; গা ধুয়ে পুজোয় বসবেন। তনুশ্যাম বসে থাকল। তারা চোখের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল বিকেলে, ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গিয়েছে।
দোতলার বারান্দায় এই বসবার জায়গাটুকুতে তনু দিনের বেশির ভাগ সময়টাই আজ কাটিয়ে দিল। সকালে অনেকটা বেলা পর্যন্ত বসে বসে কথা বলেছে, কাগজ দেখেছে, বই পড়েছে খানিকটা। বারান্দার রেলিংয়ের ওপর বসানো কাঠের পাল্লা আর শার্সি বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে আসছিল, এখন কিন্তু সবই প্রায় খোলা, বাতাস আসছে, মাথার ওপর পাখাও চলছে।
হাত কয়েক দূরে খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রিনি কিছু একটা ইস্ত্রি করছিল। ইস্ত্রি শেষ হলে সাজসরঞ্জাম নিয়ে সে তার ঘরের দিকে চলে গেল; সামান্য পরে ফিরে এসে তনুর মুখোমুখি দাঁড়াল।
একেবারে চুপটি করে বসে আছ যে–? রিনি শুধোল; একবার পার্ক স্ট্রিট গিয়েই হাঁপিয়ে পড়লে!
তনু রিনিকে দেখতে দেখতে বলল, না। চোখ দেখাবার পর মাথা ধরে যায়।
রিনি রগড় করে বলল, শির দরদ?
তনু হেসে ফেলে বলল, আমি তোমাদের কলকাতার বাঙালিদের চেয়ে খারাপ বাংলা বলি না।
তা দেখতেই পাচ্ছি। রিনি সোফার ওপর বসে পড়ল।
তনু রিনির হাসিভরা মুখ, ঝকঝকে চোখ, লতাপাতা করা ছাপা শাড়িটা দেখতে দেখতে তার বাঙালিত্ব প্রমাণ করার জন্যই যেন বলল, আমাদের ওখানে বাঙালি অনেক আছে। কলেজে তিন চার জন। গভর্নমেন্ট সারভিসে আছে আট দশ জন। বিজনেস আছে বাঙালির, সেলস-এজেন্ট কত আসে।
রিনি আগের মতোই মুখ করে বলল, তোমাদের ওখানে মানে পুরো মধ্যপ্রদেশ তো?
তনু সামান্য জোরেই হেসে ফেলল। বলার কিছু নেই। রিনি আজ সকাল থেকেই তার খুঁত ধরে তাকে খেপাবার চেষ্টা করছে। দু-চারটে শব্দ বা দু-চারটে কথায় কিছু হিন্দুস্থানি টান থেকে গেলে দোষের যে কী আছে তনু বুঝতে পারছেনা। রিনি যে নিজে চিঠিকে চিটি বলে তাতে কোনও দোষ নেই। আজ দুপুরে খাবার সময় টেবিলে বাবা, নীহারপিসি, রিনি আর তনু এই নিয়ে খুব হাসি-রগড়, মজা করেছে।
বাবাই সবচেয়ে মজার কথা বলেছিল। বলেছিল: নীহার তোমার আমার বাড়ি ছিল বিহারে, আমরা হলাম বেহারি বাঙালি, তুমি আমাদের দলে, রিনি হল পুরোপুরি কলকাতা। কলকাতাকে আমরা বলতাম, হালুম-হুঁলুমের দেশ, ওরা খেলুম, গেলুম, শুলুম করেই কাটায়। রিনি এখন বুঝে দেখুক কোন দেশেতে আছে।
তখনকার কথা মনে পড়ায় তনু একটু হাসল। রিনিদের কলকাতা হালুম-হুঁলুমের দেশ তবে!
তনু কিছু বলার আগেই রিনি বলল, মাথা ধরেছে বলে প্যাঁচার মতন মুখ করে বসে আছ! একটা ট্যাবলেট এনে দিই, খেয়ে নাও।
খেতে হবে তনু বলল, কপালটা ফেটে যাচ্ছে।
রিনি ওষুধ আনতে উঠি উঠি ভাব করছিল, তনু বলল, চোখের ডাক্তাররা চোখ নিয়ে টরচার করে, ভীষণ স্ট্রেন হয়।
আমায় চোখ শিখিও না, আমি চোখের ডাক্তারের মেয়ে।
জানি, তনু হাসল, শুনেছি আমি।
তা তোমার চোখের কথা গুপ্তসাহেব কী বললেন?
আমায় কিছু বলেননি। বাবার সঙ্গে কীসব কথা হয়েছে আসবার সময় ট্যাক্সিতে বাবা আর পিসি কথা বলছিল। মালুম হল, কমপ্লিকেটেড কেস। কী কী সব টেস্ট করতে হবে।
রিনিরও সেই রকম মনে হল। শরদিন্দুমামা এবং মার দু-একটা কথা শুনে, মুখ-চোখ দেখে তারও মনে হয়েছে, দুজনেই যেন খানিকটা মনমরা। তনুর সত্যিই খুব মাথা ধরেছে, না বেচারি খুব হতাশ হয়ে গেছে–মুখে সেটা বলছে না, রিনি বুঝতে পারল না, তবে চোখ দেখার সময় ডাক্তার যা করে তাতে ভাল চোখও টনটন করে ওঠে। মাথাও ধরে যায়। রিনি তনুর জন্যে মাথাধরার বড়ি আনতে উঠল।
তনু সোফার মধ্যে ডুবে পা টানটান করে বসে থাকল। বারান্দার ওপাশের বাতিটা নিবিয়ে দিয়েছে রিনি, এপাশেরটা জ্বলছে। খোলা শার্সি দিয়ে সামনের বাড়ির সিঁড়ির প্যাসেজটা চোখে পড়ে। বাতি জ্বলছে। চারপাশে একটা কলরব যেন ভেসেই আছে। বেজায় জোরে কোথাও রেডিয়ো বাজছে। রিনি একসময় বাহারি মাছ পুষেছিল, অ্যাকুরিয়ামটা এখন ফাঁকা, একপাশে রাখা আছে, তার মধ্যে কীসের এক গাছ পুঁতে রেখেছে রিনি, পাতাগুলো বাড়ছে বেশ।
রিনি ওষুধ এনে দিল, জলের গ্লাস।
তনু ট্যাবলেটটা খেয়ে ফেলল। পুরো গ্লাস জলও।
রিনি বসে পড়ল। মা পুজো সেরে এসে চা খাবে। তখন তোমার পিসিকে ম্যানেজ করতে পারলে এক কাপ চাও পেতে পারো। মাথা ধরা ছেড়ে যাবে।
তনু বলল, চা পেলে গ্র্যান্ড হয়।
হয় ঠিকই; কিন্তু তোমার পিসি তোমায় হরিণঘাটা খাওয়াতে চাইবে।
তনু বুঝতে পারল না। হরিণঘাটা কী?
হরিণের দুধ, রিনি মুখটা গম্ভীর করে বলল, কলকাতায় আমরা হরিণের দুধ খাই। বলে মুহূর্ত পরে গাম্ভীর্য হারিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, কলকাতার মানুষকে যা ছোটছুটি করতে হয় তাতে গোরুমোষের দুধে চলে না, বুঝলে।
তনু ঠাট্টাটা বুঝতে পেরে হেসে ফুলেছিল: বলল, তুমি হরিণ দেখেছ?
অনেক।
কোথায় দেখেছ?
চিড়িয়াখানায়।
আমি হরিণের জঙ্গল দেখেছি। মোস্ট বিউটিফুল।
রিনি চোখের তারা বেঁকা করে নিরীহ গলায় শুধোল, হরিণের জঙ্গলে কারা থাকে।
তনু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। কারা?
মানে কী থাকে? শুধু হরিণ?
না শুধু হরিণ কেন! আরও জীবজন্তু থাকে। হরিণ বেশি।
তা হলে আর হরিণের জঙ্গল বলছ কেন, বলো জঙ্গলের হরিণ। বনে থাকে বাঘ, খাটালে থাকে মোষ, বলতে বলতে রিনি উচ্চস্বরে হেসে উঠল। তনুও হাসতে লাগল।
রিনি এবার অন্য কথা পাড়ল। পার্ক স্ট্রিটে তো গেলে চোখ দেখাতে: পার্ক সার্কাস কেমন লাগল?
তনু সকৌতুকে বলল, জাস্ট লাইক এ সার্কাস। গ্র্যাঞ্জার, ডেকোরেশান, লাইট, শো।
ইয়ার্কি?
ইয়ার্কি নয়। সত্যিই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। যাবার সময় আমি দেখেছিলাম। আসবার সময় চোখের যা হাল, চাইতে পারছিলাম না। বড় ভিড়, আর শব্দ।
বাঃ, সার্কাসে ভিড় হবে না। ওটা সাহেবপাড়া। তুমি যদি বড়দিনের সময় আসতে পার্ক সার্কাসের চেহারা দেখতে।
তনু তার দু হাত ঘাড়ের তলায় রেখে খানিকটা আরামের চেষ্টা করল। বলল, বাবা তোমাদের কলকাতা দেখে খুব অবাক হয়ে যাচ্ছে। বাবা যখন কলকাতায় থাকত স্টুডেন্ট লাইফে–তখন কলকাতা এরকম ছিল না। বাবা পিসিকে বলছিল, কলকাতার রাস্তায় বেরুলেই দম আটকে আসছে। বাবার।
মজার চোখ করে রিনি জিজ্ঞেস করল, তোমারও দম আটকে যাচ্ছে নাকি? তা হলে আগেভাগেই বলে রাখো, বাবা! এরপর তোমায় কলকাতা বেড়াতে নিয়ে গিয়ে আমি ফ্যাসাদে পড়ব নাকি?
তনু ঘাড় নাড়ল। আমার দেখতে ভাল লাগে বহুৎ। কিন্তু ক্রাউড দেখলে আমি নার্ভাস হয়ে যাই। আমার চোখের নার্ভগুলো সহ্য করতে পারে না, কেমন একটা ফিলিং হয়। বলতে বলতে তনু থামল, হঠাৎ বোধহয় কপালে তীব্র ব্যথা এসেছিল, চোখ বুজে কপাল কুঁচকে ব্যথাটাকে সে সইয়ে নিল। তারপর বলল, তোমাদের কলকাতায় ডবল ডেকার বাসগুলো দেখলে আমার ভীষণ ভয় হয়। মনে হয়, এই বুঝি সব চাপা পড়ল।
রিনি যেন তনুর ওপর করুণা করে হাসল। বলল, তুমি একেবারেই গাঁইয়া।
ট্রাম দেখতে আমার ভীষণ ভাল লাগে–তনু বলল, ভেরি নাইস। আজ আমরা যখন যাচ্ছিলাম, আসছিলাম–গাছপালার গা দিয়ে মাঠের পাশে পাশে ট্রাম যাচ্ছিল। খুব নাইস লাগছিল।
রিনি হাসল খানিকটা। বলল, তোমায় কলকাতা দেখাতে নিয়ে আমিই পড়ব বিপদে। তোমার যে কোনটা নাইস হবে আর হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে কে জানে! কলকাতার ট্রাফিক পুলিশও তোমার কাছে নাইস হয়ে যাবে হয়তো, কে জানে!
আমায় আগে তুমি প্ল্যানেটোরিয়ামটা দেখাও।
গেলেই হল একদিন, কাগজটা সকালে দেখে নিতে হবে, রোজ খোলা থাকে না।
তনু রিনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল, খানিকটা অন্যমনস্ক। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি, বুঝলে রিনি, আমার খুব ইচ্ছে ছিল অ্যাস্ট্রনমি পড়ব। ছেলেবেলা থেকেই আকাশ, তারা, ওই এন্ডলেস স্পেস দেখতে খুব ভাল লাগে আমার। ইট অ্যাট্রাক্টস মি। আমার চোখের জন্যে আমি আকাশটাও ভাল করে দেখতে পেতাম না। তবু আমার ভীষণ ভাল লাগত। খালি চোখে আমরা দু হাজারের মতন তারা দেখতে পাই, বুঝলে। আমি কত পেতাম কে জানে। পাঁচশো, সাতশো হয়তো। একটা তারা আছে সাড়ে ছশো লাইট-ইয়ার দুরে, তার মানে এখান থেকে কোটি কোটি মাইল দূরে, সেই তারাটা আমাদের সুর্যের চেয়ে একানব্বই হাজার গুণ আলো ছড়ায়। তুমি ইমাজিন করতে পারো? কত দূর থেকে এই আলো আসছে ভাবলে গায়ের মধ্যে তোমার শিউরে ওঠে না? আমার গা শিউরে যায়…বুঝলে রিনি, আমাদের এই জগৎটাই কত বড়, কত রকম মিষ্ট্রি এর মধ্যে। কিন্তু ওই যে মাথার ওপর এটারন্যাল স্পেস ওটা আরও মিস্টিরিয়াস। ভাবাই যায় না। তোমায় একটা কথা শোনাই, প্রতিদিন ওখানে কত কী ঘটে যাচ্ছে ভাবতে পারবে না। ওখানে–ওয়ান্ডর্স ইন দি মেকিং, ওয়ার্ডস ডেড অ্যান্ড অ্যারিড, হোয়ারলিং ফ্রাগমেন্টস অব ওয়ান্ডর্স–অল পাস অ্যাবাভ আস ফ্রম নাইট টু নাইট।
রিনি তনুর মুখ দেখছিল। তনু যতটা পেরেছে চোখের পাতা খুলে ফেলেছে কথা বলতে বলতে, মুখটি যেন আবেগে ভরে উঠেছে। গলার স্বর বড় সুন্দর। রিনি বলল, তুমি অ্যাস্ট্রনমি পড়লে না কেন?
এই চোখ নিয়ে? চোখের জন্যে আমার পড়াশোনাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তনু একটু থামল, তারপর আবার বলল, বাবা বটানির প্রফেসার, বাবার ইচ্ছে ছিল আমি বটানিটা যদি পড়তে পারি। তাও হল না।
তুমি এখন কী পড়ছ? ফিলজফি।
রিনি মুখ হাঁ করে চোখ বড় বড় করে অদ্ভুত এক মজার ভঙ্গি করে বলল, দর্শন! ও বাব্বা, তাই বললা; তুমি হলে ফিলজফার। তাই তোমার মুখে অত জ্ঞান। রিনি হাসতে লাগল।
তনু কেমন অপ্রস্তুত বোধ করে চুপ করে গেল। তার মুখেও স্নান হাসি।
রিনি বেশ নজর করে তনুকে দেখল। ঠাট্টাটা তনু ভাল মনে নেয়নি। কী ছেলে রে বাবা! রিনি বলল, বড় হয়ে তুমি তা হলে ফিলজফার হচ্ছ?
তনু রিনির দিকে তাকিয়ে বলল, না, আমি অন্ধ হচ্ছি।
এবার রিনি যেন রাগ দেখিয়ে তনুকে ভেঙাল, বলল, অত শখে কাজ নেই। তুমি ফিলজফারই হও, তাও তো অন্ধ হওয়া।
নীহার ততক্ষণে এসে পড়েছেন। তাঁর পুজোপাঠ শেষ হয়েছে। গা ধুয়ে, কাপড়জামা বদলে, পুজো সেরে আসতে আজ তাঁর বেশি সময় লাগল না। তাঁকে খুব শুভ্র সতেজ দেখাচ্ছিল। তনুদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে নীহার মেয়েকে বললেন, সারাদিন তুই কী যে হিহি করে হাসিস রিনি, দু দণ্ড শান্তিতে পুজো করাও দায় হল। অত হাসির কী হল?
রিনি বলল, যার পুজোয় মন থাকে সে হাসি শোনে না।
তুই থাম। আমায় জ্ঞান দিচ্ছে। আমি তোর পেটে জন্মাইনি, তুই আমার পেটে জন্মেছিস।
রিনি হেসে ফেলল। পরে বলল, তোমার চা করে দিই। বলে রিনি উঠে পড়ল। চোখ দেখিয়ে এসে তোমার শ্যামের মাথা ধরে গিয়েছে। একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়েছি। এক কাপ চা খেতে চাইছে।
নীহার তনুর পাশে এসে দাঁড়ালেন। তোর মাথা ধরেছে?
তনু ঘাড় নাড়ল।‘ যা করে ডাক্তাররা চোখ নিয়ে, মাথা ধরতেই পারে। তা তুই জামাকাপড় পরে বসে আছিস কেন তখন থেকে? যা হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে থাক খানিকটা, ধকল কাটলেই সেরে যাবে। বলে নীহার আদর করে তনুর মাথার এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
রিনি আড়চোখে সেটা দেখল, দেখে চলে গেল। মার তনুশ্যাম এবাড়িতে এসেই মার কাছে তুই হয়ে গেছে। বলা যায় না, এরপর মা হয়তো তার শ্যামের মাথা টিপতে বসে যাবে!
তনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নীহার ডাকলেন, শ্যাম।
উঁ–
তোর চোখ ভাল হয়ে যাবে। কলকাতায় কত বড় বড় ডাক্তার আছে। তুই দেখ না, আমি সকলকে দিয়ে তোকে দেখাব। ভাবিস না। …যা হাতমুখ ধুয়ে নিগে যা।
তনু জামাকাপড় ছেড়ে, বাথরুম থেকে ফিরে এসে তার ঘরে বিছানায় শুয়ে ছিল। মাথার ব্যথাটা যে তার কাছে আরও অসহ্য হয়ে উঠেছে তা নয়, বরং রিনির কাছ থেকে অ্যাসপিরিনের বড়ি খেয়ে, ঠাণ্ডা জলে হাতমুখ ধুয়ে এসে এখন তার আরামই লাগছিল। কিন্তু শরীরটা কেমন ক্লান্ত লাগছিল তনুর। চুপ করে শুয়ে ছিল। শুয়ে শুয়ে এই ঘর দেখছিল, তাদের ঘরবাড়ির কথা ভাবছিল, চোখের ডাক্তারের চেম্বার, গুপ্ত সাহেবের জাঁদরেল চেহারা, আরও কত কী তার মাথায় আসছিল। হঠাৎ রিনির গলা কানে এল।
চা নিয়ে এসে রিনি বলল, এই যে ফিলজফার মশাই, উঠুন; চা নিন; দেখুন চায়ে চিনি হল, না নুন হল!
তনু বিছানার ওপর উঠে বসে চা নিল। তার পা খাটের পাশে ঝুলছে।
চা দিয়ে রিনি চলে গেল না। মার চা সে ওপরে দিয়ে এসেছে; চা আর পান। মা বলেছিল। শরদিন্দুমামার ইসবগুলের শরবত তৈরি করে মা নিজে ওপরে নিয়ে গেছে আগেই।
রিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঠাট্টা করে বলল, চায়ে চিনি-নুন ঠিক হয়েছে?
তনু চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, নাইস।
তা হলে তুমি চা খাও, আমি যাই।
বোসো না। তুমি এখন কী করবে?
গ্রাস কাটিং।
গ্রাস!
ঘাস কাটব। রিনির গলায় হাসির দমক উঠল।
তনু হেসে ফেলল। তুমি হরবখত তামাশা করো।
হরবখতই করি।
বোসো না। তনু আবার বলল।
রিনি বাস্তবিকই যাবার জন্যে আসেনি। চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। বসে বলল, আমি ঘাস কাটতে যাব শুনে তুমি ইয়ার্কি ভাবলে। জানো, আমায় গিয়ে এখন পড়তে বসতে হবে।
তনু অবাক হয়ে বলল, পড়তে বসা, আর ঘাস কাটা এক হল?
আলাদা হবে কেন! আমার কাছে দুই-ই সমান। আমি কি তোমার মতন স্টুডেন্ট? আমি বইয়ের পাতা খুলে কচকচ করে কাটব। ব্যাস…। পড়াশোনা আমার ধাতে সয় না। কী হবে পড়ে। আমার কাঁচকলা হবে। কারুরই কিছু হয় না আমাদের। এক্সামিনেশনের সময় কী টুকলি! সে-ঘটা তো দেখনি?
তনু হাসছিল। তুমি টোকো!
ওমা, টুকব না। কেনা টোকে! রিনি তনুর কথায় যেন একটু নাক সিঁটকে নিল।
তনু বলল, পেপারে দেখি, তোমাদের এখানে এক্সামিনেশনের সময় গোলমাল হয় বহুত?
রিনি বিনা প্রতিবাদে ঘাড় এক পাশে হেলিয়ে বলল, হয়। বহুত হয়। তোমাদের ওখানে হয় না?
হয়। কম হয়। তনু রিনির পা নাচানো দেখতে দেখতে বলল। রিনি স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে না, পা নাচায় অনবরত। তনুর এই বদঅভ্যাস একেবারে নেই। সে চুপচাপ বসে থাকার সময় মাঝে মাঝে ডান হাতটা মুখের কাছে নিয়ে দাঁতে নখ কাটে। তনু এবার জিজ্ঞেস করল, তোমার সাবজেক্ট কী?
আমার আলাদা কোনও সাবজেক্ট নেই। অনার্স-ফনার্স নেই, স্যার। আমার শুধু পাস।
অনার্স নাওনি?
আহা নিতে চাইলেই দিত আর কী! আমি চাইনি, ওরাও দেয়নি। লেখাপড়ায় আমার মাথা নেই। কী হবে আমার পড়ে! আমি দিদিমণিও হব না, চাকরিও করব না।
তনু হেসে ফেলে বলল, তা হলে তুমি কী করবে?
রিনি এমন সহজ প্রশ্নটা আগে নিশ্চয় ভেবে নেয়নি৷ জবাব দেবার সময় হঠাৎ কেমন থতমত খেয়ে গেল। তারপর বলল, কিছুই করব না। বলে একটু থেমে কী যেন ভাবল, বলল, বাবা থাকলে আমার এত সুখ আর হত না। আমায় ডাক্তারি পড়তে হত। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল আমায় ডাক্তারি পড়াবে। হয় আমায় ডাক্তারি পড়তে হত, না হয় বায়ো-কেমিস্ট্রি। বাবা বলত, আমাদে দেশে বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে কেউ ভাবে না। আমি বাবা, বায়ো-কেমিস্ট্রি যে কী তা একেবারে জানি না।
তনু বলল, আমিও ঠিক জানি না। বায়োলজি আর কেমিস্ট্রি মিলিয়ে সামথিং কিছু হবে। মালুম, ইট ইজ রিলেটেড টু মেডিক্যাল সায়েন্স।
সামথিং কিছু! ঘাড় দুলিয়ে ভেঙচে দিল রিনি, চোখ বাঁকা করে বলল, কী যে এক মালুম মালুম করো। ছাতু কোথাকার!
তনু হেসে উঠল।
রিনিও মুখ ভেঙিয়ে বলল। আমাকে তো তখন খুব হালুম হলুম করলে, তুমিও বা কোন দেশের বাঘ?
চায়ের কাপটা তনু নামিয়ে রাখল। তারপর বলল, তুমি ডাক্তার হলে রেপুটেশান হত। তোমার ট্যাবলেটটা ভাল। মাথা ধরা কমে এসেছে।
রিনি সামান্য চুপ করে থেকে জবাব দিল, বাবারই শখ ছিল আমায় ডাক্তারি পড়াবে। ডাক্তারি পড়লে আমি আই স্পেশ্যালিস্ট হতাম। অন্য কিছু আমি হতাম না। আমি আই স্পেশ্যালিস্ট হলে তোমার চোখ সারিয়ে দিতাম।
সরল মুখে হাসল তনু। ঠাট্টা করে নিজের কপালটা দেখাল। আমার কপাল খারাপ। বলে মুহূর্তখানেক পরে জিজ্ঞেস করল, পিসেমশায় অনেকদিন মারা গেছেন, না?
বাবা! বাবা মারা গেছে অনেকদিন। আমার তখন তেরো বছর বয়েস। সাত বছর হতে চলল। রিনি ধীরে ধীরে বলল, অন্যমনস্কভাবে।
তনু বলল, আমার মা মারা গেছে আরও আগে। আমার সাত কি আট বছর বয়েস তখন। বলে তনু যেন উদাস মুখ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল। পরে বলল, নীহারপিসি আমার মাকে দেখেছে।
রিনি যেন তার বাবার কথা ভাবছিল। বলল, আমার বাবার ছবি তুমি দেখেছ। মার ঘরে আছে, আমার ঘরে আছে। আমার বাবাকে দেখলে তুমি অবাক হয়ে যেতে। কেমন লম্বা চেহারা, গায়ের রং ধবধব করত। বাবা যা মজা করতে পারত না, কী বলব! বাবা নীচের তলায় বসে হাসলে ওপরে আমরা শুনতে পেতাম। কী ভাল মানুষ ছিল বাবা, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।
তনু রিনির কথা শুনতে শুনতে তার মার কথা ভাবছিল। তাদের বাড়িতেও মার ছবি আছে। মার কথা মনে পড়লে মার ছবির মুখটাই চোখের সামনে ভাসে। তনু বলল, আমার মার নাম ছিল পুষ্প পুষ্পলতা। মার রং ফরসা ছিল। মাথায় যা চুল ছিল–হাঁটু পর্যন্ত। লম্বা লম্বা চোখ। মা খুব বাইবেল জানত। আমায় কত গল্প বলত বাইবেলের।
রিনি বলল, তোমার মা কী করে মারা গেলেন?
তনু চুপ করে থাকল। তার চোখ-মুখের বিষণ্ণতা নজরে পড়ছিল। মাথার চুলে অন্যমনস্কভাবে হাত বুলিয়ে সে বলল, মার ডেলিভারি হচ্ছিল। কিছু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল, সাম কমপ্লিকেশানস। দুজনেই মারা গেল। আমি তখন খুব ছোট। আমার সব মনে নেই।
রিনি অপলকে তাকিয়ে তাকিয়ে তনুর কথা শুনছিল। তার পা নাচানো বন্ধ ছিল কিছুক্ষণ। হঠাৎ রিনি বলল, তোমার মা, আমার বাবা! অদ্ভুত, না?
তনু কিছু বলল না, রিনির দিকে তাকিয়ে থাকল।
রিনি বড় করে নিশ্বাস ফেলল। আবার তার পা নাচানো শুরু হয়ে গেল। ঘাড়ের পাশ থেকে চুলের বিনুনিটা বুকের কাছে এনে হাতের ঝাঁপটায় দুলিয়ে খেলার মতন করল, তারপর হেসে ফেলে বলল, কী রকম মজা দেখো, আমার মনে হচ্ছে, আমার বাবা আর তোমার মা এখন স্বর্গে খুব গল্প করছে।
বলে রিনি থামল, যেন স্বর্গের সেই গল্প করার আসরটা উঁকি মেরে দেখে নিল; তারপর তনুর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে বলল, আর এখানে আমার মা আর তোমার বাবা তেতলায় বসে কথা বলছে। আমরাও বলছি–তুমি আর আমি। তিন জায়গায় তিন পেয়ার। কী অদ্ভুত, না?
তনু যেন খুব ধীরে মাথা দুলিয়ে জানাল, হ্যাঁ–বেশ অদ্ভুতই।