১. এক খণ্ড বৃহৎ মেঘ
০১.
মাথার ওপর কৃষ্ণকায় এক খণ্ড বৃহৎ মেঘ, দুপাশে নিবিড় অরণ্য আর অন্ধকার ফণা-তোলা সাপের মতন এতক্ষণ যেন অবনীকে তাড়া করে নিয়ে যাচ্ছিল। অনেকক্ষণ ধরে সে এই অসহায় ও উদ্বেগজনক অবস্থা থেকে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছিল; পারছিল না। উভয় পাশের স্থির নিস্তব্ধ বৃক্ষলতাপূর্ণ পার্বত্য উচ্চভূমি, ঘন অন্ধকার, মসিময় মেঘখণ্ড তাকে ঘিরে ফেলেছে। অবনীর মনে হচ্ছিল, এই পথ বুঝি আর সে অতিক্রম করতে পারবে না, কোথাও থেমে যেতে বাধ্য হবে।
হঠাৎ, অধাবৃত্তাকার একটি বিপজ্জনক বাঁক পেরিয়ে কাঠের সাঁকোর মুখে গাড়ি আসতেই মনে হল, কী যেন তার চারপাশ থেকে সরে যাচ্ছে। আরও কিছুটা পথ এগিয়ে সেই আকাঙিক্ষত দীর্ঘ ঢাল পাওয়া গেল। মাখারিয়ার পাহাড়ি জঙ্গল তবে শেষ হয়েছে। এখন পথ ক্রমশই নীচে নেমে যাবে। অবনী অনুভব করতে পারল, তার মাথার ওপর সেই কুণ্ডলীকৃত মেঘটিও আর নেই। সন্ধ্যার অন্ধকার এখন দুঃসহ নয়; বাতাস আরও কিছুটা প্রবল হয়েছে। এতক্ষণ যে অরণ্য তাকে ক্রমাগত দুপাশ থেকে গ্রাস করার, এবং কৃষ্ণকায় মেঘখণ্ড তাকে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছিল তারা পিছনে সরে যাচ্ছে; বনভূমি আর তত নিবিড় নয়, ক্রমশই পাতলা হয়ে আসছে। ভীত এবং বিপন্ন অবনী এতক্ষণে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
বিকেলে, অবনী যখন শহরের হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে তখন, দমকা বৃষ্টি এসেছিল। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটায়, এলোমেলো ঝাঁপটায় তার গাড়ি ভিজে গিয়েছিল, অবনীও পুরোপুরি শুকনো থাকতে পারেনি। তার জিপগাড়ির ক্যানভাসগুলো অকেজো হয়ে গেছে, বাতাসে ফটফট করে ওড়ে। গাড়ির পিছন দিকটা ভিজে গেল বিকেলের বৃষ্টিতেই। সেই দমকা বৃষ্টির মধ্যেই মাইলটাক পথ পেরিয়ে আসতে আসতে বিকেল পড়ে এল, বৃষ্টি ধরে গেল। আকাশ পরিষ্কার হল না। কোথাও একটু কালো, কোথাও ধূসর, কোথাও বা ঈষৎ রক্তাক্ত মেঘ ছিল। অবনী এসব খেয়াল করে দেখেনি, তবু যেন চোখে পড়েছিল। আকাশ ও মেঘের সঙ্গে তার চোখের সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল, সে উদাসীন হয়ে ছিল, তবু মনে মনে ক্রমশই কোনও এক বিষণ্ণতায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। হীরালালের কথা তার মনে স্থায়ী কোনও ছায়ার মতন পড়ে ছিল। বেচারি হীরালাল! এখনও তাকে হাসপাতালের বিছানায় দেখা যাবে, দুপাশে পরদা ফেলে দেওয়া হয়েছে, অক্সিজেন চলছে, হয়তো সন্ধ্যায় বা রাত্রে কিংবা কাল সকালে শেষবারের মতন একটু অক্সিজেন নিয়ে সে চলে যাবে, তার শয্যা শূন্য হবে। কোথায় যাবে হীরালাল? আকাশে? আকাশে নয়। দ্বিপদ জীব, মেঘ নয়, বাতাস নয়, ধূলিকণাও নয় যে ওই আকাশে তার ঠাঁই হবে। তবু অবনী উদাস চোখে শেষ বর্ষার অপরাহ্নের বিক্ষিপ্ত মেঘমালা দেখেছিল।
ওই সময়, আসার পথে শহরের শেষ প্রান্তে সেন্ট জোসেফ স্কুলের সামনে তার গাড়ি কেমন মন্থর হয়ে গিয়েছিল। হয়তো অবনী সামান্য সময় দাঁড়িয়ে পড়েছিল। স্কুল কম্পাউন্ডের একটা পাশ অসাড়, ক্লাসরুমের দরজা জানলা বন্ধ; অন্য পাশে মস্ত মাঠ আর পুকুর, পুকুরের গা ঘেঁষে হোস্টেল। ঘণ্টা পড়ছিল হোস্টেলে, কয়েকটা বাচ্চা ছেলে পুকুর থেকে উঠে সপসপে ভিজে গায়ে ছুটছিল; খেলার মাঠ ছেড়ে সবুজ ভিজে ঘাসের ওপর দিয়ে জলকাদা-মাখা কটা ছেলেও হোস্টেলে ফিরে যাচ্ছিল। অবনী ওদের দেখতে দেখতে হীরালালের কথা ভাবছিল। হীরালাল ছেলেবেলায় ওই স্কুলে পড়েছে। একবার এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় হীরালাল তার পাশে বসে স্কুলের ঘরবাড়ি মাঠ পুকুর দেখাতে দেখাতে অবনীকে তার ছেলেবেলার গল্প শুনিয়েছিল। পুকুরে সাঁতারকাটা শিখতে গিয়ে হীরালাল একবার ডুবতে ডুবতে কী করে বেঁচে গিয়েছিল সে-গল্প শুনিয়ে হীরালাল বলেছিল: মাগর দো সাল বাদ হাম জুনিয়ার গ্রুপমে সুইমিং চামপিয়ান হুয়া থা৷ সিনিয়ার গ্রুপেও হীরালাল মেডেল পেয়েছিল সাঁতারের।
স্কুলের পুকুরটিতে বাদলা-অন্ধকারের ছায়া পড়ে গিয়েছিল, অবনী দূর থেকে জল দেখতে পাচ্ছিল না, তবু তার মনে হল, সেন্ট জোসেফ স্কুলের পুকুরটিকে কোনও রকমে হীরালালের কথা যদি জানানো যেত অবনী জানাত।
স্কুল ছাড়িয়ে আসতেই অবনী কেমন এক আক্রোশ অনুভব করল। হয়তো অনেকক্ষণ থেকে ক্রমশই কোনও ক্ষোভ তার মনে জমছিল, মেঘলা জমে আসার মতন কোনও গুমট এবং ভার। জীবন এই রকমই, তার থাকা না থাকার কোনও নিয়ম নেই; স্থিরতাও নেই। অকারণে অপ্রয়োজনে থাকে, আবার অকারণেই চলে যায়। মানুষ তাকে রাখব বললেই রাখতে পারে না। হীরালাল শক্ত সমর্থ যুবক, বছর পঁয়ত্রিশ বয়স হয়েছিল মাত্র, উদ্যোগী, পরিশ্রমী, প্রসন্ন-স্বভাব, কাজকর্ম চমৎকার বুঝত, ঠাকুর দেবতায় ভক্তি ছিল, মদগাঁজা খেত না, কুসংসর্গে পড়েনি, ঘুষ নিতে তার বিবেকে বাধত। এইসব সাধারণ সৎ গুণ রক্ষা করে হয়তো সে ভাবত জীবনের খাতায় কিছু জমাচ্ছে। অথচ, সেই জীবনের হিসেবের পাতাটা কত অনায়াসে এবং সহজে কে যেন ধুত বলে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে বাতাসে উড়িয়ে দিল। হীরালাল মিশ্র, পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির কাঠামো, দেড় মণের ওপর ওজন, সাঁতারু শক্ত হাত এবং স্থির উদ্দেশ্যে নিয়েও অন্য একটি পুকুরের সামান্য পথ এগিয়েই থেমে গেল। কেন?