“আমি সব ভালবাসি।” ভ্রমর হেসে বলল।
“সব কেউ ভালবাসতে পারে না।” অমল অতি নিশ্চিন্ত গলায় বলল, বলে পকেট থেকে আস্তে-আস্তে হাতের মুঠো বের করছিল।
ভ্রমর বোধ হয় আন্দাজ করতে পেরেছিল অমল বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু একটা ঢাকবার চেষ্টা করছে। অমলকে লক্ষ করল ভ্রমর ভালো করে; বলল, “তোমার ফন্দি আছে।”
“কিচ্ছু না।” অমল মাথা নাড়ল খুব জোরে-জোরে।
“তবে?”
“তোমার চেয়ে ভাল ফন্দি কারও নেই। কী মাথা একটা!…আমায়-বোকা বুদ্ধু করে দিয়েছ?”
ভ্রমর এবার ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল। ডালিমের দানার মতন দাঁত দেখা গেল। চোখ দুটি হাসিতে থইথই করছিল। যেন কিছু জানে না, এইরকম ভাব করে, ঠোঁটের কাছে আঙুল এনে ভ্রমর বলল, “তোমার ঘরেই সেই জিনিসটা ছিল তবে—!”
“বালিশের তলায়—”
ভ্রমর ঠোঁটের আঙুল তাড়াতাড়ি জোড়া-ওষ্ঠের ওপর রাখল। বলল, “আর বলবে না কিছু। বলেছি না, চুপচুপ থাকবে; কাউকে কিছু বলবে না।”
অমল গ্রাহ্য করল না। ভ্রমরের দিকে হেলে শুয়ে পড়ল যেন বিছানায়। বলল, “তোমার ছবি ছিল আমি জানতামই না। নয়ত কবেই স্টিলিং করতাম।”
“কি করতে?”
“চুরি। স্টিলিং বোঝো না! সেই মেয়েটা যা করেছে—” বলে অমল খুব সন্তর্পণে তার পকেট থেকে হাত বের করে সাঁতার দেওয়ার ভঙ্গিতে ভ্রমরের কোলের কাছে হাত বাড়াল। “ছবিটা, বুঝলে ভ্রমর, খুব বিউটিফুল। তোমায় যা সন্দর দেখাচ্ছে। কবে তুলেছ?”
“গত বছর ক্রীশমাসে।”
“ক্রীশমাসে?” অমল একমুহূর্ত, কি ভাবল, বলল, “তবে তুমি জানতে এ-বছর ক্রীশমাসে আমি আসব।” বলে অমল আশ্চর্য সুন্দর মুখ করে হাসল।
ভ্রমর জানত না অমল আসবে। গত বছর যখন তারা ছবি তোলায় ক্রীশ-মাসে, তখন মেঘলা-মেঘলা দিন, রোদ আলো দেখা যাচ্ছিল না তেমন, চারপাশ মনমরা হয়ে ছিল, বিষণ্ণ; এবারে এত রোদ এত আলো। এত হাসিখুশী হয়ে ক্রীশমাস আসবে, কে জানত! হয়ত ভ্রমরের সমস্ত জীবনে এই প্রথম এক ক্রীশ-মাস এল, যার সখ সে আর কখনও অনুভব করে নি।
অস্ফুট গলায় ভ্রমর কেমন আচ্ছন্নের মতন বলল, “ভগবান জানতেন।”
ঠিক এই সময় অমল ভ্রমরের কোলের ওপর তার মুঠো খুলে একটা কি যেন ফেলে দিল। দিয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে হঠাৎ বলল, “আরে বাবা, তোমার আজ খুব ভাল দিন। গায়ে প্রজাপতি বসছে।”
ভ্রমর অমলের চোখ দেখল, দেখে নিজের কোলের ওপর চোখ নামাল। তার কোলে ছোট্ট একটি প্রজাপতি, সোনার যেন। ভ্রমর কয়েক পলকের মতন বিহ্বল হয়ে থাকল। সে বুঝতে পারে নি প্রথমে, তারপর বুঝতে পারল। আস্তে করে ডানহাত বাড়িয়ে সেই প্রজাপতি তুলে নিল। রুপোর পাখনায় সোনার জল ধরানো, মিনের সুন্দর কাজ, প্রজাপতির চোখ দুটিতে সবুজ দুটি পাথরের কণা। ভ্রমরের মনে হল, সত্যিই যেন এক ছোট্ট প্রজাপতি তার হাতের মুঠোয় এসে বসেছে।
অমল ভ্রমরের মুখ দেখছিল। ভ্রমরের বিস্ময় খুশী এবং আনন্দ অনুভব করবার জন্যে সে নিষ্পলক নয়নে মুহূর্তে গুনছিল।
ভ্রমর চোখ ওঠাল, অমলের চোখে-চোখে তাকাল। যেন ভাবল একটু, কি বলবে। হঠাৎ তার কি মনে পড়ে যাওয়ায় মুখে চাপা হাসি নামল; বলল, “খুব বিউটিফুল।” অবিকল অমলের বলার ভঙ্গি নকল করে, অমলের মুদ্রাদোষটির মতন করেই বলল ভ্রমর। তারপর দুজনেই হেসে উঠল এক সঙ্গে।
অমল বলল, “তোমাদের এখানে কিছু পাওয়া যায় না। সব রন্দি জিনিস। ওই ব্রোচ কিনতে আমায় যা ভুগতে হয়েছে…”
অমলকে কথা শেষ করতে দিল না ভ্রমর, বলল, “অনেক দাম নিয়েছে।”
“ভাল জিনিস হলেই বেশী দাম।” অমল অভিজ্ঞের মতন বলল।
“বেশী দাম দিয়ে তুমি কিনলে কেন? তুমি কি চাকরি করো?”
ভ্রমরের গলায় বোধ হয় অমলের অবিবেচনার জন্যে সামান্য ভর্ৎসনা ছিল। অমল গ্রাহ্য করল না। বলল, “মেয়েদের নেচার খালি দামটাম দেখা! আমরা ও-সব কেয়ার করি না। যা ভাল দেখব নিয়ে নেব।” বলে অমল এবার বিছানার ওপর গড়িয়ে শুয়ে পড়ল। সিলিঙের দিকে চোখ রাখল কয়েক পলক, বলল, “আমি একটা ভোমরা খুঁজলাম কত! বলল—হয় না। হ্যাত, জানে না কিছু…। প্রজাপতি ব্রোচ হলে ভোমরা হবে না কেন?—যদি একটা ভ্রমর পেয়ে যেতাম, বুঝলে স্যার, তবে…’
“পেলে না?” ভ্রমর এবার সকৌতুক করে বলল।
“না। এখানে বিউটিফুল কিছু পাওয়া যায় না।”
এবার ভ্রমর ‘ইস্’—মতন শব্দ করলে জিবে। শব্দ শুনে অমল মাথা ফেরাল, ভ্রমরের দিকে তাকাল। ভ্রমরের মুখে বিচিত্র ও মনোহর হাসি, অথচ হাসির তলায় যেন কোনো একটা কৃত্রিম অভিমান রয়েছে। ভুরু, দুটি ঈষৎ বাঁকা, ঠোঁটের ডগাও সামান্য বঙ্কিম। অমল মুগ্ধ হয়ে সেই মুখ দেখছিল। দেখতে-দেখতে সে অনুভব করল ভ্রমর তাকে ঠাট্টা করছে। কিসের ঠাট্টা অমল তাও ধরতে পারল।
এবার অমল খুব বিচক্ষণের মতন যেন তার ভ্রম সংশোধন করে নিয়ে বলল, “আমার একটু, ভুল হয়েছে, এখানে একটা শুধু বিউটিফুল ভ্রমর পাওয়া যায়।” বলে কথাটা যেন ভ্রমরকে বুঝতে সময় দিল এক মুহূর্ত, তারপর জোরে হেসে উঠল।
ভ্রমর যদিও ওই কথাটি মনে-মনে শুনতে চাইছিল, তবু এখন সে লজ্জা পেল। লজ্জা তার মুখের সৌন্দর্য আরও কমনীয় করে তুলেছিল। চোখের পাতা নামিয়ে নিল ভ্রমর, যেন চোখ বুজে ফেলল।
অল্প সময় চুপচাপ কাটল। ভ্রমর একই ভাবে বসে থাকল, অমল অন্য-মনস্কভাবে কিছু ভাবল। নিঃশব্দ অবস্থাটি ক্রমে ঘন হয়ে এসে দুজনের চেতনায় কেমন উদাসীনতার বোধ জাগাল। কেন, কেউ বুঝল না। অমল নিশ্বাস ফেলল দীর্ঘ করে, ভ্রমর তার মুঠোর প্রজাপতিটি বালিশের পাশে রাখল।