তখন আবুল হাশেম পায়ের নিচে পিষ্ট হওয়া কাচপোকাটাকে দেখে। পোকাটার শরীর চকচক করছে, পাখনা খুলে পড়ে আছে অথচ জৌলুস তখনো কমেনি। ওর ইচ্ছে করে পোকাটাকে হাতে উঠিয়ে মুঠোর মধ্যে ধরে রাখতে। পরক্ষণে দু’পা পিছিয়ে যায়। যে জিনিসটি জবেদ আলীর বাপের পায়ের নিচে যায়, সেটা আবুল হাশেম হাতে ওঠায় না। ও নদীর পাড়ে পায়চারি শুরু করে।
দেখতে দেখতে ছোট ঘরটির চারদিকে বেড়া দাঁড়িয়ে যায়। দ্রুত কাজ করে ওরা। জবেদ আলীর উৎসাহ অন্তহীন। ও এক মুহূর্তও জিরোবার জন্য দাঁড়ায় না। ও রোদ উপেক্ষা করছে, পরিশ্রম উপেক্ষা করছে, দরদরিয়ে ঘাম ঝরছে তাও উপেক্ষা করছে। ও যেন একটা মৌমাছি–ব্যস্ত, ভীষণ ব্যস্ত আপন সঞ্চয়ের জন্য। রোদে ওর মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে। চারদিকে একটা গাছ নেই, কোথাও কোনো ছায়া নেই। ছায়া না থাকা যে কি ভীষণ ভয়াবহ আবুল হাশেম তা মর্মে মর্মে টের পায়। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত তাড়না–কিসের ও তা বুঝতে পারে না। তখন ওর খুব খারাপ লাগতে থাকে।
একটু পর জবেদ আলীর বাপ আবার ওর কাছে আসে। হাঁটাতে বিনম ভঙ্গি। খানিকক্ষণ আগের লোকটি সে আর নয়। বিনীতভাবে বলে, মহাজন লন বাড়িত যাই। আমনহের মুখটা রোদে পুইড়া গেইলো।
আবুল হাশেম মৃদু হাসে। লোকটির বিনীত ভঙ্গি দেখে ওর ওপর আবুল হাশেমের আর কোনো রাগ নেই।
লোকটি আবার মৃদু স্বরে বলে, এই রোদে আমনহের কষ্ট অয় মহাজন। লন যাই। দুপুরের ভাত খাঅনের বেলা অইছে।
আবুল হাশেম পুলকিত বোধ করে। বলে, তুমি মোরে মহাজন কও ক্যা?
মহাজনরেতো মহাজনই কওন লাগে। মুই কি করুম? মোগ তো এক কুড়াও জমি নাই। আমনহেরতো আছে। অহনতো আবার চর জাগছে। আমনহেরে আর পায় কে। লন, নৌকায় যাই মহাজন।
নৌকায়? সাগরে মাছ ধরতে গেলে তো মোর রইদ লাগে না। রইদে মোর মুখও পড়ে না।
লোকটি হি-হি করে হেসে উঠে বলে, তহনতো আমনহে মহাজন থাহেন না। তহন আমনহে মহাজনের নৌকায় মাছ ধরেন। আমনহে তহন জাইল্যা। মাছ মারার কামলা।
লোকটি হাসতেই থাকে। খানিকক্ষণ আগে লোকটি রেগে গিয়েছিল, এখন ও হাসছে। কিছুক্ষণ আগে ওর শরীরে আগুন ছিল, তাই ও দ্রুত নেমে গিয়েছিল নদীতে। এখন ওর শরীর নদী, ও আর নদী চায় না। ও কণ্ঠের বিদ্রুপে তাতিয়ে দিচ্ছে আবুল হাশেমকে, আবুল হাশেমের এখন জলের স্পর্শ প্রয়োজন। আবুল হাশেম ওকে কিছু না বলে হাসার সময় দেয়। ও লোকটির দিকে কঠিন চোখেও তাকায় না। বরং কৌতুক বোধ করে। ঠোঁটের ওপর সূক্ষ্ম হাসির রেখা জাগিয়ে রেখে ও লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকে। আবুল হাশেমের কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে একসময় লোকটির হাসি থেমে যায়। ও দ্রুত কণ্ঠে বলে, লন মহাজন যাই।
আবুল হাশেম মৃদু হেসে বলে, মহাজন মুই না তুমি?
লোকটি না শোনার ভান করে। লাফিয়ে নৌকায় ওঠে। আবুল হাশেম মাঝখানে বসে। জবেদ আলীর বাপ মাঝির বিপরীত দিকের গলুইয়ে চলে যায়। ওর মাথায় সাদা টুপি, ক্রুশে বোনা টুপি, হয়তো ওর বউ কিংবা মেয়ের তৈরি। সবুজ লুঙ্গি পরেছে লোকটা, নিচের দিকের খানিকটা অংশ ফাটা। ছোটবেলা থেকে মাঠে কাজ করতে করতে পায়ের আকার নষ্ট হয়ে গেছে। আঙুলগুলো ফাঁক ফাঁক। লোকটার মুখে অসংখ্য কুঞ্চন। চোখ বসে গেছে। বয়স কত বোঝা যায় না। লোকটা হাঁটুর ওপর দু’হাত জড়ো করে বসে আছে। ওর ভঙ্গিটা দেখে আবুল হাশেমের হাসি পায়, ও আচমকা হা-হা করে হেসে ওঠে। চমকে ওঠে জবেদ আলীর বাপ, বোকার মতো আবুল হাশেমের দিকে তাকায়। ভুরুজোড়া কপালের ওপর তোলা, কিন্তু কোনো প্রশ্ন করে না।
ওর হাসি থেমে গেলে মাঝি জিজ্ঞেস করে, মহাজন হাসেন ক্যা?
এউক্কা কতা মনে অইলো।
জবাব শুনে জবেদ আলীর বাপের ভুরু স্বাভাবিক জায়গায় ফিরে আসে, যেন কোনো কারণে আশ্বস্ত হয়েছে, এমন একটা ভাব। আবুল হাশেম দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফাতরার চরের গাছগুলো কালচে সবুজ হয়ে বেড়ে উঠেছে, দূর থেকে ঘন জঙ্গলের মতো দেখায়, মনে হয় আকাশের নিচে সবুজ পাথরের দেয়াল। ডানে অনেকদূরে বঙ্গোপসাগরের বিস্তার। কেবলই দিশপাশহীন পানি। যে পানি আবুল হাশেমের ধ্বংস, যে পানির সঙ্গে ওর সখ্য।
সাগরের দিকে তাকালে আবুল হাশেমের বুকের ছাতি প্রসারিত হয়। ঘৃণা এবং ভালোবাসা দুটোই প্রবল হয়। কারণ সাগরের সঙ্গে ওর শত্রু ও বন্ধুর সম্পর্ক।
জোয়ার আসছে। জোয়ারের বিপরীত যেতে হচ্ছে বলে নৌকার দুলুনি বেড়ে যায়। আবুল হাশেম শক্ত হয়ে বসে। নিজের অজান্তেই শরীর কেমন সতর্ক হয়ে যায়। সামনেই নদীর এক অদ্ভুত সমান্তরাল আছে–মিঠে পানি এবং নোনা পানির সমান্তরাল। নদীর এ এক আশ্চর্য মিলন। এ জায়গার ঢেউয়ে উথাল-পাথাল বেশি। তবু এ জায়গায় এলে আবুল হাশেমের মনে হাজার রকম দার্শনিক চিন্তা আসে। এই সমান্তরালকে ও জীবনের নানাক্ষেত্রে মিলনের সঙ্গে এক করে দেখতে ভালোবাসে। ওর মনে হয় এভাবেই মানুষ ও প্রকৃতি এক হয়। এইসব ভাবনা নিয়ে ও দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
জবেদ আলীর বাপও শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। গতকাল টাকা ধার করে আবুল হাশেমের জন্য একটা ইলিশ মাছ কিনেছিল। তার কয়েক টুকরো আছে আজ দুপুরের জন্য–বউ বলে দিয়েছে সন্ধ্যায় হাটে যেতে হবে। হাটে যাওয়ার ইচ্ছে ওর নেই, কারণ পকেটে পয়সাও নেই। তাই দুপুরে খাইয়ে-দাইয়ে আবুল হাশেমকে বিদায় করার জন্য ও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। লোকটিকে ও আর সহ্য করতে পারছে না। অথচ ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হচ্ছে–নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ আর কি? নিজের ছেলের ওপর রাগ বাড়তে থাকে জবেদ আলীর বাপের। কী একটা মেয়েকে দেখে এসে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। অন্য জায়গায় বিয়ে করলে বেশ কিছু জিনিসপত্ৰতো ঘরে আসত। এই বিয়ে মানে ডডকলা–বউছাড়া বাকিটা শূন্য। রাগে, বিরক্তিতে জবেদ আলীর। বাপের ভুরু আবার কপালে ওঠে। সাদা টুপি কপালে এঁটে আছে–টুপির ফুটোর ফাঁকে চুল বেরিয়ে খাড়া হয়ে আছে। ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য টুপিটা একবার খোলে এবং আবার পরে। ওর হাত নিশপিশ করে, ও একটা কিছু করতে চায়, নাগালের মধ্যে পানি ছাড়া কিছু নেই, ফলে ও বসে হাতটা নদীতে ড়ুবিয়ে দিয়ে পানি নাড়াচাড়া করে। তারপর ভেজা হাতটা মুখে বুলিয়ে নেয়। ওর এইসব দেখে আবুল হাশেমের হাসি পায় এবং আচমকা হা-হা করে হেসে ওঠে।