- বইয়ের নামঃ পদশব্দ
- লেখকের নামঃ সেলিনা হোসেন
- প্রকাশনাঃ এশিয়া পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. রোজ ভোরে সালমার ঘরে প্রজাপতি আসে
রোজ ভোরে সালমার ঘরে প্রজাপতি আসে। এক এক দিন এক এক রঙের। কখনো সাদা দেয়ালের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণটায় চুপচাপ বসে থাকে, কখনো ঘরময় উড়ে বেড়ায়। তখন সালমার ঘুম ভেঙে যায়। বালিশট বুকের তলে চেপে উপুড় হয়ে পা নাচায় আর প্রজাপতি দেখে। রঙিন প্রজাপতি। চমৎকার রঙে চিত্রিত ডানা। ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ায়। সালমা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে, তুমি আমার বন্ধু। আমার ইচ্ছেগুলো ঠিক তোমারই মতো রঙিন। কেবল তোমার মতো উড়াল দিতে পারি না, এই যা। এ কী আমার কম দুঃখ! ঘুরে ঘুরে একসময়ে প্রজাপতিটা জানালা দিয়ে বেরিয়ে যায়। বাগানের বোগেনভিলার ঝোপে গিয়ে বসে। রঙে রঙে মিলে যায়। সালমা আর দেখতে পায় না। বালিশে মুখ গুজে চুপচাপ শুয়ে থাকে। পাশের ঘর থেকে ছোট ভাই সাকিবের স্প্যানিশ গিটারের সুর ভেসে আসে। মৃদু। সাগরপারের গানের মতো ফিসফিসানি যেন। সালমার বুকের তল টিপটিপ করে। দরজায় সবুজ পর্দা কাঁপে। কাঠ-বোঝাই নৌকার মতো সালমার ঘরটা আস্তে আস্তে বিরাট এক রোদ-বোঝাই নৌকা হয়ে যায়।
সালমা শুয়ে শুয়ে শোনে দোতলার ঘরে হাঁটাচলার শব্দ। নাসিমা আপা উঠেছে। বোধহয় তৈরি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার জন্য। নাসিমা আপার কথা উঠলেই সালমার মনটা টানটান হয়ে যায়। ধুৎ, পাপ বুঝি না। পাপ আবার কী? মানুষ যতক্ষণ নিজের বিবেকের কাছে অপরাধী নয় ততক্ষণ কোনো পাপ নেই। আসলে পাপ-পুণ্য নামক বায়বীয় শব্দগুলো অভিধান থেকে উঠিয়ে দেওয়া উচিত। কেনো এই শব্দ দুটো নিয়ে ভাবনা করতে গেলে সালমা কেমন তলিয়ে যেতে থাকে জলে-ডোবা মানুষের মতো।
হাজার চেষ্টা করেও আর ভেসে উঠতে পারে না। তখন বাবার মুখ মনে পড়ে। আস্তে আস্তে বাবার মুখটা এক তিমি মাছ হয়ে যায়। সালমা শেষ তৃণখণ্ড আঁকড়ে ধরার মতো চিৎকার করে ওঠে, বাবা, তুমি পাপের যে সংজ্ঞা দাও তা আমি বুঝি না। আমার মাথা ঘোলাটে হয়ে যায়। কেমন ম্যাজম্যাজ করে স্নায়ু। আমি কোনো বোধ হাতড়ে পাই না। বলো তুমি, তোমার মেয়ে সালমা আমি। তোমার আর মার ভাষায় একরত্তি মেয়ে। পৃথিবী সম্পর্কে কিছু বুঝি না। তবু কেন তোমার জ্ঞানের তলায় এত অন্ধকার দেখি, বাবা?
স্প্যানিশ গিটারের আওয়াজ এবার দ্রুত আসছে। সালমা চঞ্চল হয়। চমৎকার বাজায় সাকিব। ওর এই একটা গুণ আছে। সালমা কান পেতে থাকে। আওয়াজটা কেমন নেচে নেচে আসছে। মনে হয়, কোনো এক বিরাট আঙুর ক্ষেতের ওপর দিয়ে আসছে। আঙুরের টক-মিষ্টি স্পর্শ নিয়ে। মাতাল মাতাল স্বাদ। (আঃ, কেমন অবশ হয়ে আসে। ওই আওয়াজটার মতো সালমার সমস্ত জীবনটা যদি টক-মাতাল গন্ধে ভরপুর হয়ে থাকত! আর বিষণ্ণ হয়ে যায় ও। এবার কেমন ঢিমেতালে শব্দ আসছে। সমুদ্রের বুকে ক্লান্ত পাখির মতো। বুকে একটা ব্যথা হয় প্রায়ই। একটা ব্যথা টের পায় ও। আর ওই ব্যথা উঠলেই রাগ হতে থাকে। বালিশগুলো ছুঁড়ে ফেলে মেঝের ওপর। দ্রুতলয়ের বাজনার মতো ব্যথাটা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। সালমা খাটে বসে স্যান্ডেলে পা গলায়। স্প্যানিশ গিটার থেমে গেছে। ওর ঘর থেকে রোদ সরে গেছে। ঝিম ধরে আছে চার দেয়াল। মা একবার ডেকে গেছে। সালমা ওঠেনি। আবার ডাকছে। সালমা চুপচাপ বসে থাকে। সাড়া দেয় না। মাঝে মাঝে ওই কণ্ঠ ভীষণ কর্কশ লাগে। দয়ামায়াহীন নিষ্ঠুর জল্লাদের মতো। মা এবার দরজা ধাক্কা দিচ্ছে।
লিমা। ও লিমা?
আমি উঠেছি।
ক্লাসে যাবি না? নটা বাজে।
বাজুক। যত খুশি বাজুক। আমি ক্লাসে যাব না।
দরজা খোল না! দেখি শরীর খারাপ কি না?
আমি ঠিক আছি। তুমি যাও।
চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। তার বাবা বসে রয়েছে তোর জন্য।
বাবাকে খেয়ে নিতে বলল।
মা এবার রেগে যায়।
কেমন মেয়ে যে পেটে ধরেছি বাবা! আমার সাতজন্ম উদ্ধার করে ছাড়ল।
মা দুপদাপ চলে যায়।
সালমা বিনুনি খুলে মাথা আঁচড়ায়। সারারাতে বালিশের ঘষায়। চুলগুলো কেমন পাকিয়ে যায়। সকালে উঠে ঠিকমতো না আঁচড়ালে আর রক্ষা নেই। সালমা জানালার ধারে এসে দাঁড়ায়। মা ওকে নাসিমা আপার বাসায় যেতে দেয় না। নাসিমাকে বিশ্রী ভাষায় গালি দেয়। ওপরের রুম দুটো বাড়িওয়ালা কেন নাসিমাকে ভাড়া দিয়েছে এ জন্য বাড়িওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করেছে মা। নাসিমা চুপচাপ। কিছু বলে না। নোংরা কথাও বলে না। সালমাকে দেখে হাসে। ঝকঝকে দাঁতের হাসি। বড় বড় টানা চোখ নামিয়ে বলে, কেমন আছিস সালমা? নাসিমার ওইটুকু কথায় বিগলিত হয়ে যায় সালমা। মাথা ঝাঁকিয়ে বড় করে উত্তর দেয়, ভালো। মার অবর্তমানে চুপে চুপে নাসিমার বাসায় যায়। চেঞ্জারে গান শোনে। কী যেন একটা আছে নাসিমার মধ্যে। কিছু একটা অসাধারণ। কিন্তু সেটা কী ধরতে পারে না সালমা। কিসের আকর্ষণ? বড় বড় চোখের? গোছ গোছা চুলের? ঝকঝকে দাঁতের? নাঃ, সব মিলেয়ে কিছু একটা, যা সালমা ধরতে পারে না। আর ধরতে গেলেই সালমার মাথা ঘোলাটে হয়ে যায়। তখন নাসিমা আপার মুখটা মুছে গিয়ে বড় একটা গোলাপ ফুল ভেসে ওঠে। লাল টকটকে গোলাপ। রেড রোজ। সালমা বিড়বিড় করে। সত্যি, নাসিমা একটা রেড রোজ। চমৎকার রেড রোজ, যেমন সুগন্ধি, তেমন আকর্ষণীয়। নাসিমার গুণের শেষ নেই।
মা নাসিমাকে দেখতে পারে না। কেনো নাসিমা প্রচলিত সংস্কারের বেড়ি ভেঙেছে। তাই মার যত রাগ। সালমা জানালার কাছ থেকে সরে এসে খাটের ওপর পা গুটিয়ে বসে। হাঁটুর ওপর থুতনি রাখে। বাবা ক্লাসে যাবে। সাড়ে নটায় ক্লাস। বাবা দর্শনের অধ্যাপক হলে কী হবে, বাবা একদম ছেলেমানুষ। বাবা যখন ইচ্ছে করে একটা সত্যকে এড়িয়ে যেতে চায় তখন রাগ হয় সালমার। শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য বাবা নিয়মের অনেকটা বেমালুম হজম করে দিতে পারে। বাবার কোথাও বাধে না। মাও তাই। নিজস্ব গণ্ডির বাইরে মার কোনো ভাবনা নেই। ভাবতে গেলে স্বার্থ নামের নরম পনিরের একখণ্ড যদি ছুটে যায়। যদি হাতছাড়া হয়। আর সহ্য হয় না। হাউকাউ করে ওঠে। যেন হৃৎপিণ্ডের এক অংশ কেউ খুলে নিয়ে গেছে। মা অধ্যাপক গিনি। নিজে মেয়ে স্কুলের টিচার। মনে অহংকার। দেশের সেবায় নিয়োজিত আছেন। সালমা একলা ঘরে বসে ভেংচি কাটে। সেবা না কচু! ব্যাঙের ছাতা! দরজার মৃদু টুকটুক শব্দ হয়।