- বইয়ের নামঃ গেরিলা ও বীরাঙ্গনা
- লেখকের নামঃ সেলিনা হোসেন
- প্রকাশনাঃ প্রথমা প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. ঘরের মধ্যে দুভাইবোন
ঘরের মধ্যে দুভাইবোন অন্য যোদ্ধাদের জন্য অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করছে আরও দুজন বয়সী মানুষ।
আকমল হোসেন গেরিলারা কোন পথে ঢুকবে তার হিসাব করছেন। পথের হিসাব। কাগজে আঁকিবুঁকি করে নিজেই একটি ম্যাপ বানিয়েছেন, যেন পথটি সহজেই তাঁর মাথায় থাকে। যেন তিনি চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন গেরিলাদের অবস্থান কোথায়—পথ ও সময় একটি সূত্রে এক হয়ে মিশে থাকবে তার চিন্তায়। আর এই অনুষঙ্গে তিনি স্বস্তি বোধ করবেন।
আয়শা খাতুন রান্নাঘরে। প্রতিদিন তিনি রান্নাঘরে ঢোকেন না। বাইরে তাঁর কাজ থাকে। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তিনি রান্নাঘরে প্রায়ই কাজ করেন। যেদিন গেরিলাদের আসার খবর থাকে, সেদিন তিনি নিজে রান্না করেন। নিজ হাতে রান্না করে নিজেকে যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভাবেন। তিনি মনে করেন, এটিও একটি বড় ধরনের কাজ। যুদ্ধে জেতার প্রক্রিয়ার সঙ্গে রান্নার একধরনের সরল উপস্থিতি আছে। কারণ, গেরিলাদের খেতে হবে। শক্তির জন্য। তাই প্রতিদিনের রান্নার পরও অনেক সময় তিনি অন্য সময়ের জন্যও রান্না করে ফ্রিজে রাখেন। অনেক সময় ওরা খবর না দিয়েও আসে। তাই ঘরে খাবার রেডি রাখা তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাড়াহুড়ো করে একটা কিছু করে দিলেন, এই মনোভাবে তিনি পরাস্ত হতে চান না। আজও তিনি বাড়তি রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত।
সন্ধ্যা নেমেছে।
শহরে সন্ধ্যা নামলে রাস্তার বাতি জ্বলে ওঠে। টিমটিমে বাতির আলোয় শহরের রাস্তায় ম্লান ছায়া পড়ে। মারুফ বন্ধ জানালা সামান্য ফাঁক করে রাস্তার দিকে তাকায়। জানালা বরাবর বাড়ির সীমানাপ্রাচীর আছে। জানালা দিয়ে সরাসরি রাস্তা দেখা যায় না। মারুফকে একটি টুলের ওপর দাঁড়াতে হয়। পর্দা সরিয়ে জানালার শিকে মাথা ঠেকায়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে মেরিনাকে নিয়ে রাস্তায় ঘুরতে যেত। এখন সেটা বন্ধ। আর্মির গাড়ির টহল আছে চারদিকে। যুদ্ধ শুরুর আগে এই রাস্তার ম্লান আলোর একধরনের অর্থ ছিল ওর কাছে। ও মেরিনাকে বলত, এ সময় রাস্তা খুব বিষণ্ণ থাকে। আমার মনে হয়, এই স্লান ছায়া রাস্তার বিষণ্ণ সৌন্দর্য। যে এটা অনুভব করে, সে এই শহরের বন্ধু। আমি এই শহরের বন্ধু। এটা ভাবতে আমার দারুণ লাগে।
মেরিনা হেসে গড়িয়ে পড়ত। জোর হাসিতে ঘর ভরিয়ে দিয়ে বলত, মাকে বলি যে তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছ? তোমার চিন্তার ব্যালান্স নষ্ট হচ্ছে।
তোর তা-ই মনে হচ্ছে? তুই এমন একটি কথা বলতে পারলি?
হ্যাঁ, তাই তো। বলতে তো পারলামই। আমার এমনই মনে হচ্ছে।
আমার এই আবিষ্কারে তুই কোনো সৌন্দর্যই দেখলি না।
মেরিনা আরও জোরে হাসতে হাসতে বলত, ভাইয়া, তোমার পিপাসা পেয়েছে। আমি তোমার জন্য পানি আনতে যাচ্ছি। তুমি এখানেই বসে থাকো। নড়বে না।
মেরিনা ছুটে গিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি এনে গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলত, এক চুমুকে শেষ করবে।
কেন, তোর মতলব কী, বল তো?
তাহলে তোমার পাগলামি ঠান্ডা হয়ে যাবে। তুমি গুড বয় হবে।
তুই এনেছিস, সে জন্য পানি খাব। কিন্তু আমার কোনো পাগলামি নেই, মেরিনা।
মেরিনা এই কথা শুনে আর হাসতে পারত না। বলত, তাহলে তোমার কথা ঠিক। আমিও একদিন শহরের রাস্তা চিনতে শিখব।
এখন ওরা দুভাইবোন শহরের রাস্তা আরেকভাবে চিনতে শিখেছে। মেরিনাই প্রথমে বলে, এখন শহরের রাস্তা আর বিষণ্ণ নয়। শহরের রাস্তা প্রাণবন্ত। উজ্জ্বল।
মারুফ মেরিনার দুহাত ঝাঁকিয়ে ধরে বলে, এখন শহরের রাস্তায় গেরিলাযুদ্ধের সৌন্দর্য। এই রাস্তায় চলাচল করতে শত্রুপক্ষ ভয় পায়।
আর রাস্তা কাঁপিয়ে হেঁটে আসে গেরিলারা।
ওহ, মেরিনা, দারুণ বলেছিস! আয়, আমরা রাস্তা দেখি। টিমটিমে বাতির দীপ্ত সৌন্দর্য দেখি।
দুভাইবোন জানালার পাল্লা সামান্য ফাঁক করে বাইরে তাকায়। রাস্তায় যান চলাচল কম। হাঁটার লোক নেই বললেই চলে। খুব জরুরি হলে কাউকে রাস্তায় থাকতে হয়। হঠাৎ হঠাৎ গাড়ি চললেও খুব জোরে হর্ন বাজায় না। জোরে হর্ন বাজলে ঘরের ভেতরের লোকেরা বোঝে যে ওটা শত্রুপক্ষের গাড়ি। ওই সব গাড়ি হয় পাকিস্তানি সেনাদের, নয়তো ওদের পক্ষের বেসামরিক লোকদের। শহরের মানুষ এখন দুভাগে বিভক্ত। মুখ ফিরিয়ে মারুফ বলে, যুদ্ধের সময় শহরের রাস্তা এমনই থাকা উচিত।
তুমি কি ভয়ের কথা বললে, ভাইয়া?
মোটেই না। এটা কৌশলের কথা।
হবে হয়তো। তুমিই ঠিক।
রাস্তা দেখে দুভাইবোন জানালা বন্ধ করে। হাঁটতে হাঁটতে দুজনে বারান্দায় আসে। বাড়িতে কোনো শব্দ নেই। দুভাইবোন পরস্পরের নিঃশ্বাস টের পায়। বারান্দায় দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মারুফ বলে, গেরিলাদের আসতে খুব ঝামেলা হবে না। ফাঁকা রাস্তায় শাই করে চলে আসবে গাড়ি। ঝটপট নেমে পড়বে। দৌড়ে কোথাও যেতে হলে সেটাও সুবিধা।
ভাইয়া, আমার মনে হয় রাস্তায় গাড়ি এবং লোক চলাচল বেশি হলেই ভালো। অনেক মানুষের ভিড়ে নিজেকে আড়াল করা যায়।
মারুফ চুপ করে থাকে। মনে হয় মেরিনা ঠিকই বলেছে। বেশি ফাঁকা রাস্তায় ওদের ভয় বেশি। ওত পেতে বসে থাকা আর্মির গাড়ি চট করে ছুটে আসবে। টেনে নামাবে। জিজ্ঞাসাবাদ করবে।
মেরিনা আস্তে করে বলে, আজকের রাস্তা দেখে আমার গা ছমছম করছিল। হঠাৎ কণ্ঠস্বর পাল্টে ফেলে জোরালোভাবে বলে, আমাদের এসব না ভাবাই ভালো। আমার মায়ের দেবদূতের মতো ছেলেরা এলেই ভালো। বাড়িতে স্বস্তি থাকবে। বাবা-মায়ের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে থাকবে যতক্ষণ ওরা এ বাড়িতে থাকবে।