- বইয়ের নামঃ টানাপোড়েন
- লেখকের নামঃ সেলিনা হোসেন
- প্রকাশনাঃ সাহিত্য বিলাস
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. কুয়োকাটার জেলে
কুয়োকাটার জেলে আবুল হাশেমের করোটিতে যে-কোনো অবসরে একটি চমৎকার রঙিন মাছ সাদা পাখনা মেলে ভেসে বেড়ায়। ছাই রঙের শরীরে রূপালি বুটি–কী অপরূপ ভঙ্গি—মুখের দু’পাশে লাল রঙের দুটি দাঁড়া। তখন হাশেমের মাথায় সাগরের ঢেউ–ঢেউয়ের মাথায় মাছ। নাচতে নাচতে ছুটে আসছে তটরেখায়–সৈকতের কাছাকাছি এখন আকাশজুড়ে লাল মেঘ–সূর্য নরম আলো ছড়িয়ে ড়ুবে যাচ্ছে। তখন রঙিন মাছ হাশেমের স্বপ্নের মধ্যে লাল দাঁড়া বিস্তৃত করে। আঁকিবুকি রেখায় ভরে যায় করোটি। আবুল হাশেমের ভাবনা গাঢ় হয়। ভাবে, জীবনের এই একাকিত্বের শূন্যতা প্রকৃতি ভরিয়ে দেয় বলেই ওর স্বপ্নে এমন রঙিন মাছের আনাগোনা। ওর অবসরের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। গভীর সমুদ্রে ট্রলারে বসে মাছভর্তি জাল টানার মুহূর্তেও ও ক্ষণিকের জন্য অবসরে চলে যেতে পারে। আনমনে নিজেকে গভীর উপলব্ধির মধ্যে ছেড়ে দিতে পারাটাই ওর অবসর। মহাজনকে মাছের হিসাব বুঝিয়ে দেওয়ার ফাঁকেও ও অবসর ভোগ করে। জাল মেলে দিয়ে ঘরে ফেরার সময়টাতো ওর সবটুকু অবসর। ওর মনে হয় ওর একাকিত্বই অবসর। এবং তাকে কেন্দ্র করে রঙিন মাছের খেলা। এ খেলা এক অদৃশ্য সুতোর খেলা–নিজের সঙ্গে নিজের এক্কাদোক্কা। একজন জেলের এমন জীবন হবার কথা নয়, তবু হয়েছে। কারণ মাছ ধরা ওর পেশা নয়, নেশা–সাগর ওর রক্তের হাতছানি। জীবন তো ওর ধানি জমিতে বাঁধা আছে, বছরের খোরাক হয়ে যায় সে জমি থেকে। তবু মাটি ওর বন্ধন নয়, বন্ধন সাগর। এই বন্ধন নাড়ির পরতে পরতে–কোথায় এর শুরু, কোথায় শেষ তা বলতে পারে না। শুধু অনুভব করে, এই না বুঝে ওঠাটাই ওর কাছে খেলা।
আবুল হাশেম এই সাগরের কাছাকাছি থাকার জীবনের জন্য নির্জন অবসরে ওর পূর্ব পুরুষের কাছে কৃতজ্ঞতা জানায়। জানানোর ভঙ্গিটি দারুণ। কারণ তখন ও শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে–যেহেতু সেই কথাটি ওর মুখের নয়, কথাটি চৈতন্যের–তখন ও অন্য মানুষ হয়ে যায় এবং পরিষ্কার ভাষায় বলে, তোমার কাছে আমার ঋণ শোধ করবার নয়। এও ওর কাছে সেই অদৃশ্য সুতোর খেলা। টানানো সুতোর ওপর উঠে আসে সেই মানুষটি, যার কাছে ও কৃতজ্ঞ, যে শ্বশুরের সম্পত্তির লোভে ঘরজামাই হয়ে রাঙাবালি থেকে এই কুয়োকাটায় চলে এসেছিল। লোকটি কোনোদিন সম্পত্তির মালিক হতে পারেনি–শ্বশুর তাকে বিশ্বাস করেনি। মৃত্যুর আগে সব সম্পত্তি একমাত্র মেয়ের নামে লিখে দিয়েছিল। সব সম্পত্তির মালিক বউ থাকলেও, এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি ও। ধরে নিয়েছিল যেহেতু সে নিজের স্ত্রীর আলিক, অতএব তার সম্পত্তিরও মালিক, এই বোধেই সে রগরগে থাকত–সম্পত্তির ভোগদখলদারিতে সিদ্ধহস্ত ছিল। বউ তার দাবড়ানোর চোটে কোনোদিন মুখ খুলতে পারেনি। আবুল হাশেমের বাবা ছিল বাপের একমাত্র ছেলে। সেই সূত্রে মায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকার হয়েছিল। এখন সে সম্পত্তি আবুল হাশেমের দখলে।
ওর বাপ-দাদা ওকে যে জীবনযাপনের সুযোগ দিয়েছে, সে সুযোগ নিয়ে এখন ওর রাতদিনের খুনসুটি–আবুল হাশেম উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে থাকে–নিশিপাওয়া লোকের মতো সে হাঁটা। কখনো কেউ ওর পাশ দিয়ে যাবার সময় সালাম দিলে ও উত্তর দেয় না, অর্থাৎ শুনতে পায় না–অর্থাৎ আনমনা থাকে বলে খেয়াল করে না। ভাবনা ওকে বধির করে ফেলে।
জংলা পথটুকু পেরিয়ে এখানে দাঁড়ালে স্পষ্ট দেখা যায় সাগরের পানি তোলপাড় করে। হাশেম নিজেও বুঝতে পারে না যে এই পানির তোলপাড় দেখতে ও এখানে আসে কি না। তোলপাড়ের ভেতরে একটা গম্ভীর ডাক আছে, একটা গাঢ় ছায়া আছে কিংবা কঠিন শব্দ আছে। সবকিছুই হাশেমের নিজস্ব। কত বছর ধরেই তো এভাবেই চলে যাচ্ছে। ও হেঁটে আসে, দু’হাতে গাছের ডাল সরায়। উঁচু ঢিবির ওপর বসে। বসলে দেখতে পায় পানির তোলপাড় কালচে সবুজ হয়ে যায়–দূর থেকে ছুটে এসে গড়িয়ে যাওয়াটা মনে হয় এক ধরনের পাগলামি–যে পাগলামি বুকের ভেতর অনবরত দপদপায়। তখন চরাচরে জ্যোৎস্না–গোল চাদ মাথার ওপর নেমে আসে–শূন্য প্রান্তর বিস্তৃত হতে থাকে–তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গোল চাদ বাড়ে–যেন এত বড় চাঁদ পৃথিবীর কোথাও আর হয় না। ঘোর পূর্ণিমা আবুল হাশেমের আচ্ছন্নতা বাড়িয়ে দেয়। ও দিগন্তে চোখ ফেললে দেখতে পায় নিরল শূন্যতা। পেছনে তাকালে গাছের মাথাগুলো জমাট বেঁধে থাকে, সে মাথায় অন্ধকার–অন্ধকারের মধ্যে মানুষের গুঞ্জন। সে গুঞ্জন ভেদ করে উঠে আসতে থাকে রঙিন মাছ। আঁক-বাঁধা মাছের সারি বিন্দুর মতো স্থির হয়ে যায় পূর্ণিমায়–ভরা যুবতী চাদের কাছে–সে চাদ আবুল হাশেমের বিচিত্র শব্দভরা করোটির ভেতর রঙিন মাছসহ প্রবেশ করে। মুহূর্তে ওর চেতনার চরাচর আলোকিত হয়ে যায়।
আবুল হাশেম সৈকতে নেমে আসে। সেখানে হাটুজল, সে জলে লবণ নেই, সেখানে মিঠে-পানির মাছের নির্বাস। সৈকতে টুকরো টুকরো জলাশয়–অজস্র, অসংখ্য। ওর পেছনে হাজার হাজার মোষের সারি, ওরা ঘরে ফিরছে। খুরের চাপে বালুর মধ্যে ছোট ছোট গর্ত হচ্ছে। আবুল হাশেম বালকের মতো সেই গর্তগুলো পা দিয়ে ভরিয়ে দেওয়ার খেলায় মাতে। জোয়ার আসে। এখন জোয়ারের সময়। এ সময়েই ছাই রঙের মাছ আবুল হাশেমকে সোনালি দিগন্তে নিয়ে যায়। ও তখন জেলে থাকে না–একজন রূপকথার রাজকুমার হয়। ওর ট্র্যাকের বিড়ি উঠে আসে ঠোঁটে। দিয়াশলাইর বারুদ জ্বলে ওঠে। মোষের পায়ের গর্তগুলো সব মুছে দেয় ও ভাবে, এখনই আমার যৌবনের সময়। সব গর্ত মুছে গিয়ে সমান হয়ে যাক দিনগুলো। মোষ ঘরে ফিরলে আমরা মোষ দুইয়ে মাটির পাতিলে ঘন দই বানাবো। তারপর দইয়ের ভাঁড় নিয়ে চলে যাব হাটে। সেই দই নীলগঞ্জ নদী দিয়ে চলে যাবে দূরে–অনেক দূরের মানুষের কাছে। সেই সব মানুষেরা জানবে না, একজন স্বাপ্নিক আবুল হাশেম মোষের ঘন দুধের দই বানিয়ে বেসাতি করে–তার দই শুধুই দই নয়–তা শুধু গলনালী বেয়ে পেটে যায় না, সেটা মগজেও পৌঁছে। সেই দই খেলে মানুষ স্বপ্ন দেখে, স্বাপ্নিক হয়ে ওঠে। ও সব মানুষের ভেতর স্বপ্নের ছড়াছড়ি দেখতে চায়–স্বপ্ন দেখতে শিখলে মানুষ দুঃখ ভোলে।