- বইয়ের নামঃ যাপিত জীবন
- লেখকের নামঃ সেলিনা হোসেন
- প্রকাশনাঃ ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. সন্ধ্যায় এসে পৌঁছুলো ওরা
কিছু কথা
২০১২ সালে পূর্ণ হলো ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর। ইতিহাসের একটি দীর্ঘ সময়ের চূড়ায় পৌঁছেছে এই ঐতিহাসিক দিন। এই দিনটি আমাদের সামনে অমর একুশে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আজ শুধু বাঙালির শহীদ দিবস নয়। ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে লিখেছিলাম উপন্যাস যাপিত জীবন। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮১ সালে। রচনাকাল ছিল ২৯ অক্টোবর ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯। মোটামুটি একটি বড় সময় নিয়ে লেখার পরও মনে হয়েছিল ঠিকমতো হলো না। ১৯৮৭ সালে পুনর্লিখন করলাম।
ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পূর্ণ হওয়ার প্রান্তে দাঁড়িয়ে মনে হলো এই উপন্যাসটির অণুপুঙ্খ বিবরণ আরো একটু বিস্তৃত পরিসর দাবি করে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আবার লিখতে শুরু করলাম। উপন্যাসে যোগ হলো আরো একশ পৃষ্ঠারও বেশি। এভাবেই ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা উপন্যাসটির পেছনে লেগে থেকেছি। এসবই একটি শিল্পের জন্য লেখকের অতৃপ্তি কিনা তা অনেক ভেবেছি। উত্তর পাইনি। কারণ এর শেষ নেই।
একত্রিশ বছর আগে লেখা উপন্যাসটি বেশ কয়েকবার পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। ভালোলাগার কথা জানতে পেরেছি পাঠকের কাছ থেকে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ পত্রে পাঠ্য হয়েছে এই উপন্যাস। তারপরও আবার পরিমার্জনা কতটা যুক্তিযুক্ত তাও ভেবেছি। এরও উত্তর জানা নেই। সে জন্য পাঠকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পূর্ণকালে এই উপন্যাসের পরিসর বাড়াতে পেরে আমি নিজে আনন্দিত। মনে হয়েছে শিল্পের জায়গা থেকে কাজটি করতে পারা অমর একুশের জীবনদায়ী ঘটনার প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নিবেদন।
এই উপন্যাসের পাঠককে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
সেলিনা হোসেন
২৫ ডিসেম্বর ২০১১
০১.
সন্ধ্যায় এসে পৌঁছুলো ওরা। নতুন দেশ। অচেনা, অজানা শহর। কখনো ভুতুড়ে একটা জায়গার মতো লাগছে—কখনো খানিকটুকু আপন, কখনো চেনা পরিবেশের মতো, যে পরিবেশকে আপন করতে হবে—বেঁচে থাকার তাগাদায়–স্বপ্নের ভূমি বানানোর প্রয়োজনে। এমন অনুভব নিয়ে ওরা পাঁচজন পরস্পরের দিকে তাকায়-ছোটবড় পাঁচজন। যাদের নিয়ে পুরো একটি পরিবার।
ওরা নিজেদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। সঙ্গে তেমন কিছু ছিল না, সামান্য কাপড়-চোপড় ছাড়া। আর ছিল বই। অনেকগুলো আয়ুর্বেদ বিষয়ক বই। আর রবীন্দ্রনাথের বই। যতটা নিতে পেরেছে—সবাই ভাগাভাগি করে টেনেছে। অনেক বই কিনে আনতে হয়েছে বলে সোহরাব আলি বারবার। চোখ মুছেছে। আফসানা কেঁদেছে ফেলে আসা সংসারের জন্য। তিন ছেলের বুকের ভেতর কি হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে না। গত মঙ্গলবার বাড়ি থেকে বেরুনোর পর পথে পুরো পাঁচ দিন কেটেছে। মহানন্দা পেরিয়ে গরুর গাড়িতে আমনুরা। সেখান থেকে ট্রেনে ফুলবাড়িয়া এসে নেমেছে ঘণ্টাখানেক আগে। অথচ রিকসায় এইটুকু পথ আসতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছে আফসানা খাতুনের। এই পাঁচদিনে বোবার মতো পথের দিকে তাকিয়ে ছিল কেবল, একটা কথাও বলেনি। বারবার চোখে আঁচল চাপা দিয়েছে। সোহরাব আলি তখনই ভয় পেয়েছিল খুব যে আফসানা খাতুন অসুস্থ হয়ে না যায়। আফসানা খাতুন শেষ পর্যন্ত অসুস্থ হয়নি। বেঁচে থাকাকে মনের জোর দিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছে। পুরোটা পথ নিজেকে সামলে রেখেছে। তার দিকে তাকিয়ে পরিবারের অন্যরা খুশি থেকেছে। দুঃখ ভোলার চেষ্টা করেছে।
শেষ পর্যন্ত একটি নতুন বাড়ির দরজা খুলেছে ওদের সামনে। ওরা বুঝতে পারে যে ওদের গৃহপ্রবেশ হচ্ছে। আজ আনন্দের দিন।
ঘরের এক কোনায় বইগুলো গুছিয়ে রাখে জাফর। আপাতত মেঝের ওপরে। বাবা-মায়ের হাত থেকে বইগুলো ও নিজেই নেয়। বাকি দুভাই। নিজেরাই এনে রাখে।
বাড়িতে পৌঁছুনোর পর হরেণ আর মালতী ব্যস্ত হয়ে এটা-ওটা এনে দিচ্ছে। ওরা সব আয়োজন করেই রেখেছিল। কোনো অসুবিধা হতো না। এখন মনে হচ্ছে পথের ক্লান্তি নয়, পালিয়ে আসার ধাক্কাতেই সকলের স্নায়ু বিকল। যতক্ষণ এসেছে সামনের কথা মনে ছিল না, কোথায় যাচ্ছি, কেমন হবে এমন কোনো ভাবনাও হয়নি। প্রাণের ভয়ে দিশেহারা ছিল সবাই। এখন ভয়। এই অচেনা পরিবেশে আত্মস্থ হবার সঙ্গে সঙ্গে কেমন ভয় করতে লাগল। নতুন জায়গা, বন্ধু না শত্রু? বুক ঢিপঢিপ করে সোহরাব আলির। আফসানা খাতুন চৌকির ওপর পা উঠিয়ে গুটিসুটি বসে আছে। মুখে কথা নেই। কপালের, গালের চামড়া কুঁচকে কালো হয়ে আছে। কেমন অন্য রকম দেখাচ্ছে। ঠোঁটজোড়া বিবর্ণ। মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠে। গভীর নিশ্বাস উঠে আসে বুক ফুড়ে। সোহরাব আলি ইজিচেয়ারে এলিয়ে থেকে এসব লক্ষ্য করে। আফসানা খাতুনের ওই পরিবর্তনে তার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। পরক্ষণে অস্বস্তি তাড়ায়। বুঝাতে চায় যে আফসানার বড় কিছু হবে না। হলে আগেই হতো। এখন ওকে সময় দিতে হবে। একটি গভীর কালো সুতোর ওপর দিয়ে চলে যাবে সে সময়। তারপর সুতোটি রঙিন হবে। কখনো লাল, কখনো নীল কিংবা সবুজ ও হলুদ। সেই সুতোর বুননে ফুটে উঠবে সংসারের নকশিকাঁথা।
পরম মমতায় স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার কেমন লাগছে গো?
আফসানা খাতুন কথা না বলে ঘাড় কাত করে। বলতে চায়, আছি একরকম। অপেক্ষা করছি কখন বলতে পারব, ভালো।