পাণ্ডিত্য ও সাহিত্য সচরাচর একসঙ্গে যায় না। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে মুগ্ধ হয়েছি মৌলানার সাহিত্য রসবোধে, সাহিত্যসৃষ্টি দেখে। মৌলানার সঙ্গে লোকমান্য টিলকের বহু সাদৃশ্য বর্তমান, কিন্তু টিলকের চরিত্রে ছিল দার্ঢ্য, মৌলানার চরিত্রে ছিল মাধুর্য, টিলককে যদি বলা হয় কট্টর কঠিন শৈব, তবে মৌলানাকে বলতে হয় মরমিয়া মধুর বৈষ্ণব। কারণ মৌলানা ছিলেন সুফি অর্থাৎ ভক্ত রহস্যবাদী (মিসটিক)। তাঁর সাহিত্যের উৎস ছিল মাধুর্যে, এবং কে না জানে মধুর রসই সর্বশ্রেষ্ঠ রস।
তাই তাঁর চেহারায় ছিল লাবণ্য, কুরান-ভাষ্যের মতো পণ্ডিত্যপূর্ণ পুস্তকে মাধুর্য, এবং তাঁর বক্তৃতায় অদ্ভুত অবর্ণনীয় সরলতার সৌন্দর্য।
কিন্তু তাঁর যে সরল সৌন্দর্যবোধ তার পরম প্রকাশ পেয়েছে তাঁর রম্য রচনাতে। উর্দুতে এরকম রচনা তো নেই-ই, বিশ্বসাহিত্যে এরকম সহৃদয় রসে ভরপুর লেখা খুঁজে পাইনে। তার সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়া বক্ষ্যমাণ অক্ষম লেখকের সাধ্যাতীত।
তবে এই শোকের দিনে একটি সান্ত্বনার বাণী জানাই। সাহিত্য আকাদেমি এ পুস্তকের বাঙলা অনুবাদকর্মে লিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু এর সঙ্গে একটি সাবধানবাণীও শুনিয়ে রাখি। সে অনুবাদে বাঙালি পাবে কাশ্মিরি শালের উল্টো দিকটা। পাবে মূলের অসম্পূর্ণ পরিচয়, এবং হয়তো পাবে, অসম্পূর্ণের উল্টো সম্পূর্ণ পরিচয় পাবার আকাঙ্ক্ষা। তাই যদি হয়, তবে হয়তো কোনও কোনও বাঙালির অনাদৃত উর্দু ভাষা শেখার ইচ্ছাও হতে পারে। আমাদের সে প্রচেষ্টা হয়তো শোকদুঃখের অতীত অমর্ত্য লোকে মৌলানা আবুল কালাম মহীউদ্দীন আহমদ আল-আজাদকে আনন্দ দান করবে।
মামদোর পুনর্জন্ম
সংস্কৃত ভাষা আত্মনির্ভরশীল। কোনও নতুন চিন্তা, অনুভূতি কিংবা বস্তুর জন্য নবীন শব্দের প্রয়োজন হলে সংস্কৃত ধার করার কথা না ভেবে আপন ভাণ্ডারে অনুসন্ধান করে, এমন কোনও ধাতু বা শব্দ সেখানে আছে কি না যার সামান্য অদলবদল করে কিংবা পুরনো ধাতু দিয়ে নবীন শব্দটি নির্মাণ করা যায় কি না। তার অর্থ অবশ্য এ নয় যে, সংস্কৃত কস্মিনকালেও বিদেশি কোনও শব্দ গ্রহণ করেনি। নিয়েছে, কিন্তু তার পরিমাণ এতই মুষ্টিমেয় যে, সংস্কৃতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা বলাতে কারও কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়।
প্রাচীন যুগের সব ভাষাই তাই। হিব্রু, গ্রিক, আবেস্তা এবং ঈষৎ পরবর্তী যুগের আরবিও আত্মনির্ভরশীল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বয়ংসম্পূর্ণ।
বর্তমান যুগের ইংরেজি ও বাঙলা আত্মনির্ভরশীল নয়। আমরা প্রয়োজনমতো এবং অপ্রয়োজনেও ভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ নিয়েছি এবং নিচ্ছি। পাঠান-মোগল যুগে আইন-আদালত খাজনা-খারিজ নতুনরূপে দেখা দিল বলে আমরা আরবি ও ফারসি থেকে প্রচুর শব্দ গ্রহণ করেছি। পরবর্তী যুগে ইংরেজি থেকে এবং ইংরেজির মারফতে অন্যান্য ভাষা থেকে নিয়েছি, এবং নিচ্ছি।
বিদেশি শব্দ নেওয়া ভালো না মন্দ সে প্রশ্ন অবান্তর। নিয়েছি, এবং এখনও সজ্ঞানে আপন খুশিতে নিচ্ছি এবং শিক্ষামাধ্যমরূপে ইংরেজিকে বর্জন করে বাঙলা নেওয়ার পর যে আরও প্রচুর ইউরোপীয় শব্দ আমাদের ভাষায় ঢুকবে, সে সম্বন্ধেও কারও কোনও সন্দেহ নেই। আলু-কপি আজ রান্নাঘর থেকে তাড়ানো মুশকিল, বিলিতি ওষুধ প্রায় সকলেই খান, ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন ওষুধ খাবেন বলেই মনে হয়। এই দুই বিদেশি বস্তুর ন্যায় আমাদের ভাষাতেও বিদেশি শব্দ থেকে যাবে, নতুন আমদানিও বন্ধ করা যাবে না।
পৃথিবীতে কোনও জিনিসই সম্পূর্ণ অসম্ভব নয়। অন্তত চেষ্টা করাটা অসম্ভব না-ও হতে পারে। হিন্দি উপস্থিত সেই চেষ্টাটা করছেন– বহু সাহিত্যিক উঠে-পড়ে লেগেছেন, হিন্দি থেকে আরবি, ফারসি এবং ইংরেজি শব্দ তাড়িয়ে দেবার জন্য। চেষ্টাটার ফল আমি হয়তো দেখে যেতে পারব না। আমার তরুণ পাঠকেরা নিশ্চয়ই দেখে যাবেন। ফল যদি ভালো হয় তখন তাঁরা না হয় চেষ্টা করে দেখবেন। (বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ স্বচ্ছন্দে লিখেছেন, ‘আব্রু দিয়ে, ইজ্জত দিয়ে, ইমান দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে।’ নজরুল ইসলাম ‘ইনকিলাব’ ইনক্লাব’ নয়– এবং ‘শহীদ’ শব্দ বাঙলায় ঢুকিয়ে গিয়েছেন। বিদ্যাসাগর ‘সাধু’ রচনায় বিদেশি শব্দ ব্যবহার করতেন না, বেনামিতে লেখা ‘অসাধু’ রচনায় চুটিয়ে আরবি-ফারসি ব্যবহার করতেন। আর অতিশয় নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হরপ্রসাদ আরবি-ফারসি শব্দের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা ‘আহাম্মুখী’ বলে মনে করতেন। ‘আলাল’ ও ‘হুতোম’-এর ভাষা বিশেষ উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল; সাধারণ বাঙলা এ সোতে গা ঢেলে দেবে না বলে তার উল্লেখ এস্থলে নিষ্প্রয়োজন এবং হিন্দির বঙ্কিম স্বয়ং প্রেমচন্দ্র হিন্দিতে বিস্তর আরবি-ফারসি ব্যবহার করছেন।
এস্থলে আরেকটি কথা বলে রাখা ভালো। রচনার ভাষা তার বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে। শঙ্করদর্শনের আলোচনায় ভাষা সংস্কৃতশব্দ-বহুল হবেই, পক্ষান্তরে মোগলাই রেস্তোরাঁর বর্ণনাতে ভাষা অনেকখানি ‘হুতোম’ ঘ্যাঁষা হয়ে যেতে বাধ্য। ‘বসুমতী’র সম্পাদকীয় রচনার ভাষা এক– তাতে আছে গাম্ভীর্য, ‘বাঁকা চোখে’র ভাষা ভিন্ন– তাতে থাকে চটুলতা।
***
বাঙলায় যেসব বিদেশি শব্দ ঢুকেছে তার ভিতরে আরবি, ফার্সি এবং ইংরেজিই প্রধান। সংস্কৃত শব্দ বিদেশি নয় এবং পর্তুগিজ, ফরাসিস, স্প্যানিশ শব্দ এতই কম যে, সেগুলো নিয়ে অত্যধিক দুশ্চিন্তা করার কোনও কারণ নেই।