- বইয়ের নামঃ চাচা কাহিনী
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- প্রকাশনাঃ স্টুডেন্ট ওয়েজ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের
কর্নেল
কুরফুর্স্টেনডাম বার্লিন শহরের বুকের উপরকার যজ্ঞোপবীত বললে কিছুমাত্র বাড়িয়ে বলা হয় না। ওরকম নৈকষ্য-কুলীন রাস্তা বার্লিনে কেন, ইয়োরোপেই কম পাওয়া যায়। চাচার মেহেরবানিতে হিন্দুস্থান হৌস’ যখন গুলজার, তখন কিন্তু বার্লিনের বড় দুরবস্থা। ১৯১৪-১৮-এর শ্মশান-ফেরতা বার্লিন ১৯২৯-এও পৈতে উল্টো কাঁধে পরছে, এবং তাই গরীব ভারতীয়দের পক্ষেও সম্ভবপর হয়েছিল কুরফুর্স্টেনডামমের গা ঘেঁষে উলান্ডস্ট্রাসের উপর আপন রেস্তোরাঁ ‘হিন্দুস্থান হৌস’ পত্তন করার।
বহু জর্মন-অজর্মন ‘হিন্দুস্থান হৌসে’ আসত। জর্মনরা আসত নূতনত্বের সন্ধানে কলকাতার লোক যে রকম ‘চাইনীজ’ বা ‘আমজদিয়ায়’ খেতে যায়। ভারতীয়েরা নিয়ে আসত জর্মন-অজর্মন বান্ধবীদের—মাছ-ভাত বা ডাল-রুটির স্বাদ বালাবার জন্য, আর বুলগেরিয়ান, রুমানিয়ান, হাঙ্গেরিয়ানরা আসত জর্মনদের সঙ্গে নিয়ে, তাদের কাছে সপ্রমাণ করার জন্য যে তাদের আপন আপন দেশের রান্না ভারতীয় রান্নার চেয়ে ভালো। কিন্তু ভারতীয় রান্না এমনি উচ্চশ্রেণীর সত্তা যে তার সঙ্গে শুধু ভগবানের তুলনা করা যেতে পারে। ভগবানের অস্তিত্ব যে রকম প্রমাণ করা যায় না, অপ্রমাণও করা যায় না, ভারতীয় রান্নাও জর্মনদের কাছে ঠিক তেমনিতর প্রমাণ বা বাতিল কিছুই করা যায় না। কারণ ভারতীয় রান্নার বর্ণনাতে আছে:
তিন্তিড়ী পলা লঙ্কা সঙ্গে সযতনে
উচ্ছে আর ইক্ষুগুড় করি বিড়ম্বিত
অপূর্ব ব্যঞ্জন, মরি, রান্ধিয়া সুমতি
প্র-পঞ্চ-ফোড়ন দিলা মহা আড়ম্বরে।
এবং সে গ্রাম্ভারী রান্না কেন, মামুলী রান্নায় সামান্যতম মশলা দিলেও জর্মনরা সেখাদ্য গলাধঃকরণ করতে পারে না। আর মশলা না দিলে আমাদের ঝোল হয়ে যায় আইরিশ স্ট, ডাল হয় লেন্টিল সুপ, তরকারি হয় বয়ে ভেজ, মাছভাজা হয় ফ্রাইড় ফিশ। আমাদের চতুর্বর্ণ তখন শুধু বর্ণ নয়, রস-গন্ধ-স্বাদ সব কিছু হারিয়ে একই বিস্বাদের আসনে বসেন বলে চণ্ডালের মতো হয়ে যান। কাজেই আমাদের রান্না জর্মনদের কাছে এখনো ভগবানেরই ন্যায় সিদ্ধাসিদ্ধ কিছু নন। দাবাখেলায় এই অবস্থাকেই বলে চালমাত।
তবে হাঁ, আমাদের ছানার সন্দেশ ছিল কান্টের কাটেগরিশে ইম্পেরাটিফের মতো অলঙ্ঘ্য ধর্ম। তার সামনে জর্মন-অজর্মন সকলেই মাথা নিচু করতেন। ছানা-তত্ত্বে অবাঙালির অবদান অনায়াসে অবহেলা করা যেতে পারে।
‘হিন্দুস্থান হৌসে’র সবচেয়ে বড় আড়কাঠি ছিলেন চাচা। হিন্ডেনবুর্গের গোঁপের পরেই বার্লিনের সবচেয়ে পরিচিত বস্তু ছিল চাচার বেশ—তার সঙ্গে ভূষা’ শব্দ জুড়লে চাচার প্রতি অন্যায় করা হবে। সে বেশ ছিল সম্পূর্ণ বাহুল্যবর্জিত।
কারখানার চোঙার মতো গোলগাল পাতলুন, গলা-বন্ধ হাঁটু-জোকা কোট আর ভারিভারি এক জোড়া মিলিটারি বুট। লোকে সন্দেহ করত, তার কোটের তলায় কামিজ কুর্তা নাকি নেই। তবে এ কথা ঠিক কোট, পাতলুন, বুট ছাড়া অন্য কোনো তৃতীয় আবরণ বা আভরণ তার শ্যামাঙ্গে কেউ কখনো বিরাজ করতে দেখেনি। বার্লিনের মতো পাথর-ফাটা শীতেও তিনি কখনো হ্যাট, টুপি, ওভারকোট বা দস্তানা পরেননি। খুব সম্ভব শীতের প্রকোপেই তার মাথার ঘন বাবরী চুল পাতলা হয়ে আসছিল, কিন্তু চাচা সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন।
সেই অপরূপ পাতলুন, গণ্ডারের চামড়ার মতো পুরু গলাবন্ধ কোট, আর একমাথা বাবরী নিয়ে চাচা হঠাৎ থমকে দাঁড়াতেন কুরফুর্স্টেনডামের ফুটপাতে। পেছনের দিকে মাথা ঠেলে, উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন উড়ন্ত মেঘের পানে। কেন, কে জানে? হয়তো বিদেশের অচেনা-অজানা দালান-কোঠা রাস্তাঘাটের মাঝখানে একমাত্র আকাশ আর মেঘই তাকে দেশের কথা স্মরণ করিয়ে দিত। দেশ ছেড়েছেন বহুকাল হল, কবে ফিরবেন জিজ্ঞাসা করলে হাঁ-না কিছু কবুল না করে কলকাতার উড়িষ্যাবাসীদের মতো শুধু বলতেন ‘ললাটঙ্ক লিখন!’
বার্লিনের লোক শহরের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে কাব্যি করে না। দু’মিনিট যেতে না যেতেই চাচার চতুর্দিকে ভিড় জমে যেত। তাঁর অদ্ভুত বেশ, বাবরী চুল, ঘনশ্যাম দেহরুচি আর বেপরোয়া ভাব লক্ষ্য না করে থাকবার যো ছিল না।
ফিসফিস শুনেই চাচার ঘুম ভাঙত। ভিড়ের দিকে তাকিয়ে ‘বাও’ করে একটু মৃদু হাসির মেহেরবানি দেখাতেন। ভিড় তখন ফাঁক হয়ে রাস্তা করে দিত। চাচা আবার ‘বাও’ করে হিন্দুস্থান হৌস রওয়ানা দিতেন। কেউ ‘গুটেন মর্গেন’ (সুপ্রভাত) ধরনের কিছু বললে বা পরিচয় করবার চেষ্টা দেখালে চাচা গলাবন্ধ কোটের ভিতর হাত চালিয়ে তার একখানা ভিজিটিং কার্ড বের করে এগিয়ে ধরে ফের ‘বাও করতেন—যেন অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসী নবাব কাউকে ডুয়েলে আহ্বান করছেন। সেকার্ডে চাচার ঠিকানা থাকত ‘হিন্দুস্থান হৌসে’র। জর্মনরা চালাক। বুঝত, চাচা রাস্তার মাঝখানে নীরব কাব্য করেন বলে কথা বলতে চান না। কাজেই তারা চাচার আড্ডায় এসে উপস্থিত হতো।
মেঘ দেখবার জন্য অন্য জায়গা এবং অন্য কায়দা থাকতে পারে, কিন্তু হিন্দুস্থান হৌসে’র রান্নার খুশবাই ছড়াবার জন্য এর চেয়ে ভালো গ্যোবে আর কী হতে পারে?
শ্রীধর মুখুয্যে বলছিল, সংস্কৃতের নতুন ছোকরা প্রফেসর এসেছে য়ুনিভার্সিটিতে। পড়াচ্ছে গীতা। আজ সকালে প্রথম অধ্যায় পড়াবার সময় বলল, কুলক্ষয়-ফুলক্ষয় সব আবোল-তাবোল কথা। বর্ণসঙ্কর না হলে কোনো জাতের উন্নতি হয় না। তার থেকে আবার প্রমাণ করার চেষ্টা করল যে গীতার প্রথম অধ্যায়টা গুপ্তযুগে লেখা। বর্ণসঙ্করের জুজু নাকি বৌদ্ধযুগের পূর্বে ছিল না।’