- বইয়ের নামঃ জলে ডাঙায়
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়ার কর্মটি
০১.
বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়ার কর্মটি সবসময়ই এক হুলস্থুল ব্যাপার, তুমুল কাণ্ড! তাতে দুটো জিনিস সকলেরই চোখে পড়ে; সে দুটো– ছুটোছুটি আর চেঁচামেচি।
তোমাদের কারও কারও হয়তো ধারণা যে সায়েব-সুবোরা যাবতীয় কাজকর্ম সারা করে যতদূর সম্ভব চুপিসারে আর আমরা চিৎকারে চিৎকারে পাড়ার লোকের প্রাণ অতিষ্ঠ না করে কিছুই করে উঠতে পারিনে। ধারণাটা যে খুব ভুল সেকথা আমি বলব না। সিনেমায় নিশ্চয়ই দেখেছ, ইংরেজরা ব্যাঙকুইট (ভোজ) খায় কীরকম কোনও প্রকারের শব্দ না করে। বাটলাররা নিঃশব্দে আসছে যাচ্ছে, ছুরিকাঁটার সামান্য একটু ঠুং-ঠাং, কথাবার্তা হচ্ছে মৃদু গুঞ্জরণে, সবকিছু অতিশয় পরিপাটি, ছিমছাম।
আর আমাদের দাওয়াতে, পাল-পরবের ভোজে, যুগ্যির নেমন্তন্নে?
তার বর্ণনা দেবার ক্ষমতা কি আমার আছে। বিশেষ করে এসব বিষয়ে আমার গুরু সুকুমার রায় যখন তার অজর অমর বর্ণনা প্ল্যাটিনামাক্ষরে রেখে দিয়ে গিয়েছেন। শোনো :
এই দিকে এসে তবে লয়ে ভোজভাণ্ড
সমুখে চাহিয়া দেখ কি ভীষণ কাণ্ড;
কেহ কহে দৈ আন্ কেহ হাঁকে লুচি
কেহ কাঁদে শূন্য মুখে পাতখানি মুছি।
হোথা দেখি দুই প্রভু পাত্র লয়ে হাতে
হাতাহাতি গুতাগুতি ধরণে মাতে।
কেবা শোনে কার কথা সকলেই কর্তা
অনাহারে কত ধারে হল প্রাণহত্যা।
বলে কী! ভোজের নেমন্তনে অনাহারে প্রাণহত্যা! আলবাৎ! না হলে বাঙালির নেমন্তন্ন হতে যাবে কেন পছন্দ না হলে যাও না ফাপ্পোতে। খাও না আলোনা, আধাসেদ্ধ ওয়োরের মুণ্ডু কিংবা কিসের যেন ন্যাজ!
কিন্তু জাহাজ ছাড়ার সময় সব শেয়ালের এক রা।
আমি ভেনিসে দাঁড়িয়ে ইটালির জাহাজ ছাড়তে দেখেছি– জাহাজে বন্দরে, ডাঙায় জলে উভয় পক্ষের খালাসিরা মাক্কারনি-খেকো খাঁটি ইটালিয়ান; আমি মার্সেলেসের বন্দরেও ওই কর্ম দেখেছি–উভয় পক্ষের খালাসিরাই ব্যাঙ-খেকো সরেস ফরাসিস; আমি ডোভারে দাঁড়িয়ে ওই প্রক্রিয়াই সাতিশয় মনোযোগ সহকারে নিরীক্ষণ করেছি– দু পক্ষের বাঁদরগুলোই বিফস্টেক-খেকো খাটাশ-মুখো ইংরেজ; আর গঙ্গায়, গোয়ালন্দে, চাঁদপুরে, নারায়ণগঞ্জে যে কত শত বার এই লড়াই দেখেছি তার তো লেখাজোখা নেই। উভয় পক্ষে আমারই দেশভাই জাতভাই দাড়ি-দোলানো, লুঙি-ঝোলানো, সিলট্যা, নোয়াখাল্যা।
বন্দরে বন্দরে তখন যে চিৎকার, অট্টরব ও হুঙ্কারধ্বনি ওঠে সে সর্বত্র একই প্রকারের। একই গন্ধ, একই স্বাদ। চোখ বন্ধ করে বলতে পারবে না, নারায়ণগঞ্জে দাঁড়িয়ে চাটগাইয়া শুনছ, না হামবুর্গে জর্মন শুনছ।
ডেকে রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে প্রথমটায় তোমার মনে এই ধারণা হওয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নয় যে, জাহাজ এবং ডাঙ্গার উভয় পক্ষের খালাসিরা একমত হয়ে জাহাজটাকে ডাঙ্গার দড়াদড়ির বন্ধন থেকে নিষ্কৃতি দিতে চায়। কিন্তু ওই তো মারাত্মক ভুল করলে দাদা। আসলে দু পক্ষের মতলব একটা খণ্ডযুদ্ধ লাগানো। জাহাজ ছাড়ানো-বাঁধানো নিছক একটা উপলক্ষ মাত্র। যে খালাসি জাহাজের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি তুর্কি ঘোড়ার তেজে ছুটছে, সে যে মাঝে মাঝে ডাঙার খালাসির দিকে মুখ খিঁচিয়ে কী বলছে তার শব্দ সেই ধুন্ধুমারের ভিতর শোনা যাচ্ছে না সত্যি কিন্তু একটু কল্পনাশক্তি এবং ঈষৎ খালাসি মনস্তত্ত্ব তোমার রপ্ত থাকলে স্পষ্ট বুঝতে পারবে তার অতিশয় প্রাঞ্জল বক্তব্য, ওরে ও গাডুম ইস্টুপিড, দড়িটা যে বাঁ-দিকে গিট খেয়ে গিয়েছে, সেটা কি তোর চোখে মাস্তুল খুঁজে দেখিয়ে দিতে হবে। ওরে ও (পুনরায় কটুবাক্য)
এই মধুরসবাণীর জুতসই সদুত্তর যে ডাঙার কনেপক্ষ চড়াসে দিতে পারে না, সেকথা আদপেই ভেবো না। অবশ্য তারও গলা শুনতে পাবে না, শুধু দেখতে পাবে অতি রমণীয় মুখভঙ্গি কিংবা মুখ-বিকৃতি এবং বুঝতে হবে অনুমানে।
জাহাজের দিকে মুখ তুলে ফাঁচ করে খানিকটে থুথু ফেলে বলবে, ওরে মর্কটস্য মর্কট, তোর দিকটা ভালো করে জড়িয়ে নে না। জাহাজের টানে এ দিকটা তো আপনার থেকে খুলে যাবে। একটা দড়ির মনের কথা জানিসনে আর এসেছিস জাহাজের কামে। তার চেয়ে দেশে গিয়ে ঠাকুরমার উকুন বাছতে পারিসনে? ওরে ও হামানদিস্তের খাতলামুখো (পুনরায় কটু বাক্য)
একটুখানি কল্পনার সাবান হাতে থাকলে ওই অবস্থায় বিস্তর বাস্তবের বুদ্বুদ ওড়াতে পারবে।
ওদিকে এসব কলরব–মাইকেলের ভাষায় রথচক্ৰ-ঘর্ঘর-কোদণ্ড-টঙ্কার ছাপিয়ে উঠছে ঘন ঘন জাহাজের ভেপুর শব্দ ভে, ভোঁ ভোঁ, ভোঁ–
তার অর্থ, যদি সে ছোট জাহাজের প্রতি হয়, ওরে ও ছোকরা, সরু না। আমি যে এক্ষুণি ওদিকে আসছি দেখতে পাচ্ছিসনে? ধাক্কা লাগলে যে সাড়ে বত্রিশভাজা হয়ে যাবি, তখন কি টুকরোগুলো জোড়া লাগাবি গাদাপাতার রস দিয়ে? আর যদি তোমার জাহাজের চেয়ে বড় জাহাজ হয়, তবে তার অর্থ, এই যে, দাদা, নমস্কার। একটু বাঁ দিকে সরতে আজ্ঞা হয়, আমি তা হলে ডান দিকে সুড়ত করে কেটে পড়তে পারি। এবং এই ভেঁপু বাজানোর একটা তৃতীয় অর্থও আছে। প্রত্যেক জাহাজের মাঝিমাল্লারা আপন ভেঁপুর শব্দ চেনে। কেউ যদি তখনও বন্দরের কোনও কোণে আনন্দরসে মত্ত হয়ে থাকে, তবে ভেঁপুর শব্দ শুনে তৎক্ষণাৎ তার চৈতন্যোদয় হয় এবং জাহাজ ধরার জন্য উর্বশ্বাসে ছুট লাগায়।
আমি একবার একজন খালাসিকে সাঁতরে এসে জাহাজে উঠতে দেখেছি। তখন তার আর সব খালাসি ভাইয়ারা যা গালিগালাজ দিয়েছিল তা শুনে আমি কানে আঙুল দিয়ে বাপ বাপ করে সরে পড়েছিলুম। ইংরাজিতে বলে, হি ক্যান সুএ্যার লাইক এ সেলার অর্থাৎ খালাসিরা কটুবাক্য বলাতে এ দুনিয়ার সবচাইতে ওস্তাদ। ওরা যে ভাষা ব্যবহার করে সেটা বর্জন করতে পারলে দেশ-বিদেশে তুমি মিষ্টভাষীরূপে খ্যাতি অর্জন করতে পারবে।
তোমার যদি– ফারসি পড়নে-ওলা ক্লাসফ্রেন্ড থাকে তবে তাকে জিগ্যেস কর, ইস্কর-ই-রুমিরা পুরসিদ–অর্থাৎ আলেকজান্ডার দি গ্রেটকে জিগ্যেস করা হয়েছিল— দিয়ে যে গল্প আরম্ভ, তার গোটাটা কী? গল্পটা হচ্ছে, সিকন্দরশাহকে জিগ্যেস করা হয়েছিল, তা আপনি কার কাছ থেকে শিখেছেন? উত্তরে তিনি বললেন, বে-আদবদের কাছ থেকে। সে কী প্রকারে সম্ভব? তারা যা করে আমি তাই বর্জন করেছি।
খুব যে একটা দারুণ চালাক গল্প হল তা বলছিনে। তবে জাহাজের খালাসিদের বিশেষ করে ইংরেজ খালাসিদের ভাষাটা বর্জন করলেই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
জাহাজের সিঁড়ি ওঠার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেখবে দু-একটা লোক এক লাফে তিন ধাপ ডিঙোতে ডিঙোতে জাহাজে উঠছে। এরা কি একটু সময় করে আগেভাগে আসতে পারে না? আসলে তা নয়। কোনও বেচারিকে কাস্টমস হাউস (যারা আমদানি-রপ্তানি মালের ওপর কড়া নজর রেখে মাশুল তোলে) আটকে রেখেছিল, শেষ মুহূর্তে খালাস পেয়েছে, কেউ-বা আধঘণ্টা আগে খবর পেয়েছে কোনও যাত্রী এ জাহাজে যাবে না বলে খালি বার্থটা সে পেয়ে গিয়েছে কিংবা কেউ শহর দেখতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিল, কোনও গতিকে এইমাত্র বন্দর আর জাহাজ খুঁজে পেয়েছে।
বদর বদর বলে জাহাজ বন্দরের বন্ধন থেকে মুক্তি পেল।
অজানা সমুদ্রের বুকে ভেসে যাওয়ার ঔৎসুক্য একদিকে আছে, আবার ডাঙা থেকে ছুটি নেবার সময় মানুষের মন সবসময়ই একটা অব্যক্ত বেদনায় ভরে ওঠে। অপার সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, সীমার শেষের দিথলয়ের দিকে তাকিয়ে মুক্ত মনের যত অগাধ আনন্দই পাও না কেন, ঝঞ্ঝাবাত্যার সঙ্গে দুর্বার সংগ্রাম করে করে ক্ষণে-বাচা ক্ষণে-মরার অতুলনীয় যত অভিজ্ঞতাই সঞ্চয় কর না কেন, মাটির কোলে ফিরে আসার মতো মধুময় অভিজ্ঞতা অন্য কিছুতেই পাবে না। তাই ভ্রমণকারীদের গুরু, গুরুদেব বহু নদ-নদী সাগর-সমুদ্র উত্তীর্ণ হওয়ার পর বলেছেন–
ফিরে চল, ফিরে চল মাটির টানে
যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে।
জাহাজ ছাড়তে ছাড়তে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এল।
আমি জাহাজের পিছন দিকে রেলিঙের উপর ভর করে তাকিয়ে রইলুম আলোকমালায় সুসজ্জিত মহানগরীর পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বন্দরের দিকে। সেখানে রাস্তায় রাস্তায়, সমুদ্রের জাহাজে জাহাজে আর জেলেদের ডিঙিতে ডিঙিতে কোথাও-বা সারে সারে প্রদীপশ্রেণি আর কোথাও-বা এখানে একটা ওখানে দুটো, সেখানে একঝাক যেন মাটির সাত-ভাই-চম্পা।
আমরা দেয়ালি জ্বালি বছরের মাত্র এক শুভদিনে। ওখানে সম্বৎসর দেয়ালির উৎসব। এদের প্রতিদিনের প্রতি গোধূলিতে শুভ লগ্ন। আর এদের এ উৎসব আমাদের চেয়ে কত সর্বজনীন! এতে সাড়া দেয় সর্ব ধর্ম সর্ব সম্প্রদায়ের নরনারী… হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন পারসিক-মুসলমান-খ্রিস্টান!
আমি জানি, বৈজ্ঞানিকেরা বলেন, কোনও কোনও ছোট্ট পাখির রঙ যে সবুজ তার কারণ সে যেন গাছের পাতার সঙ্গে নিজের রঙ মিলিয়ে দিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারে, যাতে করে শিকারে পাখি তাকে দেখতে পেয়ে ছোঁ মেরে না নিয়ে যেতে পারে! তাই নাকি আমের রঙও কাঁচা বয়সে থাকে সবুজ– যাতে পাখি না দেখতে পায়, এবং পেকে গেলে হয়ে যায় লাল, যাতে করে পাখির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে–যাতে সে যেন ঠুকরে ঠুকরে তাকে গাছ থেকে আলাদা করে দেয়, নিচে পড়ে তার আঁটি যেন নতুন গাছ জন্মাতে পারে।
বৈজ্ঞানিকদের ব্যাখ্যা ভুল, আমি বলি কী করে? বিজ্ঞানের আমি জানি কতটুকু, বুঝি কতখানি? কিন্তু আমার সরল সৌন্দর্য-তিয়াষী মন এসব জেনে-শুনেও বলে, না, পাখি যে সবুজ, সে শুধু তার নিজের সৌন্দর্য আর আমার চোখের আনন্দ বাড়াবার জন্যে। এর ভিতর ছোট হোক, বড় হোক, কোনও স্বার্থ লুকনো নেই। সৌন্দর্য শুধু সুন্দর হওয়ার জন্যই।
ঠিক তেমনি আমি জানি, পৃথিবীর বন্দরে বন্দরে প্রতি গোধূলিতে যে আলোর বান জেগে ওঠে, তার মধ্যে স্বার্থ লুকনো আছে। ওই আলো দিয়ে মানুষ একে অন্যকে দেখতে পায়, বাপ ওই আলোতে বাড়ি ফেরে, মা তার শিশুকে খুঁজে পায়, সবাই আপন আপন গৃহস্থালির কাজ করে; কিন্তু তবু যখনই আমি দূরের থেকে এই আলোগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি, তখনই মনে হয় এগুলো জ্বালানো হয়েছে শুধুমাত্র দেয়ালির উৎসবকে সফল করার জন্য। তার ভিতর যেন আর কোনও স্বার্থ নেই।
অকূল সমুদ্রে পথহারা নাবিক তারার আলোয় ফের পথ খুঁজে পায়। সেই স্বার্থের সত্য উপেক্ষা করে রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন–
তুমি কত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনে
কি উৎসবের লগনে।
বন্দরের আলোর দিকে তাকিয়ে যদি আমিও ভগবানের উদ্দেশে বলি–
মোরা কত আলো জ্বালিয়েছি ওই চরণে
কি আরতির গগনে।
তবে কি বড্ড বেশি ভুল বলা হবে?
অনেক দূরে চলে এসেছি। পাড়ের আলো ক্রমেই ম্লান হয়ে আসছে। তবু এখনও দেখতে পাই হুশ করে একখানা জেলেডিঙি আমাদের পাশ দিয়ে উল্টোদিকে চলে গেল। আসলে কিন্তু সে হুশ করে চলে যায়নি। সে ছিল দাঁড়িয়েই, কারণ তার গলুই সমুদ্রের দিকে মুখ করে। আছে, আমরা তাকে পেরিয়ে গেলুম মাত্র।
আশ্চর্য, এত রাত অবধি পাড় থেকে এত দূরে তারা মাছ ধরছে।
এখন যদি ঝড় ওঠে তবে তারা করবে কী? নৌকা যদি ডুবে যায় তবে তারা তো এতখানি জল পাড়ি দিয়ে ডাঙায় পৌঁছতে পারবে না। তবে তারা এরকম বিপজ্জনক পেশা নিয়ে পড়ে থাকে কেন? লাভের আশায়? নিশ্চয় নয়। সে তত্ত্ব আমি বিলক্ষণ জানি। আমি একবার কয়েক মাসের জন্য মাদ্রাজের সমুদ্রপাড়ে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে ছিলুম। তারই পাশে ছিল, একেবারে সমুদ্রের গা ঘেঁষে এক জেলেপাড়া। আমি পাকা ছটি মাস ওদের জীবনযাত্রা-প্রণালি দেখেছি। ওদের দৈন্য দেখে আমি স্তম্ভিত হয়েছি। আমাদের গরিব চাষিরাও এদের তুলনায় বড়লোক, এমনকি, আমাদের আদিবাসীরা, সাঁওতাল ভিলেরাও এদের চেয়ে অনেক বেশি সুখস্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করে। তোমাদের ভিতর যারা পুরির জেলেদের দেখেছ তারাই আমার কথায় সায় দেবে।
তবে কি এরা অন্য কোনও সুযোগ পায় না বলে এই বিপদসঙ্কুল, কঠিন অথচ দুঃখের জীবন নিয়ে পড়ে থাকে? আমার সেই মাদ্রাজি বন্ধু বললে, তা নয়, এরা নাকি ভোলা সমুদ্র এত ভালোবাসে যে তাকে ছেড়ে মাঠের কাজে যেতে কিছুতেই রাজি হয় না। ঝড়ের সময় মাছ ধরা প্রায় অসম্ভব বলে তখন উপোস করে দিন কাটাবে, ক্ষুধায় প্রাণ অতিষ্ঠ হলে, ভুখা কাচ্চাবাচ্চাদের কান্না সহ্য করতে না পারলে সেই ঝড়েই বেরোয় মাছ ধরতে আর ডুবে মরে সমুদ্রের অথই জলে। তবু জল ছেড়ে ডাঙার ধান্দায় যেতে রাজি হয় না।
এবং নৌকোর মাঝি-মাল্লা, জাহাজের খালাসিদের বেলাও তাই। এদের জীবন এতখানি অভিশপ্ত নয়, জানি, কিন্তু এরাও ডাঙায় ফিরে যেতে রাজি হয় না। এমনকি, যে চাষা সাতশো পুরুষ ধরে ক্ষেতের কাজ করেছে, সে-ও যদি দুর্ভিক্ষের সময় দু পয়সা কামাবার জন্য সমুদ্রে যায় তবে কিছুদিন পরই তাকে আর ডাঙার কাজে নিয়ে যাওয়া যায় না। আর পুরনো খালাসিদের তো কথাই নেই। গোপদাড়ি পেকে গিয়েছে, সমুদ্রের নোনা জল আর নোনা হাওয়ায় চামড়ার রঙটি ব্রোনজের মতো হয়ে গিয়েছে, আর কদিন বাঁচবে তার ঠিক নেই, জাহাজে কেউ চাকরি দিতে চায় না, তবু পড়ে থাকবে খিদিরপুরের এক ঘিঞ্জি আড্ডায় আর উদয়াস্ত এ-জাহাজ ও-জাহাজ করে করে বেড়াবে চাকরির সন্ধানে। ওদিকে বেশ দু পয়সা জমিয়েছে। ইচ্ছে করলেই দেশের গাঁয়ের তেঁতুলগাছতলায় নাতি-নাতনির পাখার হাওয়া খেতে খেতে গল্প-টল্প বলতে বলতে দুটি চোখ বুজতে পারে।
সমুদ্রের প্রতি এদের কেমন যেন একটা নেশা আছে, সে সম্বন্ধে তারা একটু লজ্জিত। কেন, জানিনে। তুমি যদি বল, তা, চৌধুরীর পো–চৌধুরীর পো বলে সম্বোধন করলে ওরা বড় খুশি হয়–দু পয়সা তো কামিয়েছ, আর কেন এ-জাহাজে ও-জাহাজে ঝকমারির কাজ করা। তার চেয়ে দেশে গিয়ে আল্লা-রসুলের নাম স্মরণ কর, আখেরের কথা ভাববার সময় কি এখনও আসেনি?
বড় কাচুমাচু হয়ে বুড়ো বলবে, না, ঠাকুর, তা নয়। দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে বলবে, আর দুটি বচ্ছর কাম করলেই সব সুরাহা হয়ে যাবে। দু পয়সা না নিয়ে নাতি-নাতনিদের ঘাড়ে চাপতে লজ্জা করে।
একদম বাজে কথা। বুড়ো জাহাজের কামে ঢোকে যখন তার বয়স আঠারো। আজ সে সত্তর। এই বাহান্ন বৎসর ধরে সে দেশে টাকা পাঠিয়েছে ভালো করে ঘর-বাড়ি বানাবার জন্য, জমি-জমা কেনার জন্য। এখন তার পরিবারের এত সচ্ছল অবস্থা যে রা জমিদারকে পর্যন্ত টাকা ধার দেয়। আর বুড়ো বলে কি না ব্যাটা-ভাইপো নাতি-নাতনি তাকে দু-মুঠো অন্ন খেতে দেবে না!
সমুদ্রের প্রতি কোনও কোনও জাহাজ-কাপ্তেনের এত মায়া যে বুড়ো বয়সে তারা বাড়ি বানায় ঠিক সমুদ্রের পাড়ে, এবং বাড়িটার ঢপও কিম্ভুতকিমাকার! দেখতে আদপেই বাড়ির মতো নয়, একদম হুবহু জাহাজের মতো অবশ্য মাটির সঙ্গে যোগ রেখে যতখানি সম্ভব। আর তারই চিলেকোঠায় সাজিয়ে রাখে, কম্পাস, দুরবিন, ম্যাপ, জাহাজের স্টিয়ারিং হুইল এবং জাহাজ চালাবার অন্যান্য যাবতীয় সরঞ্জাম। বাড়ির আর কাউকে বুড়ো সেখানে ঢুকতে দেয় না– ইউনিফর্ম পরা না থাকলে জাহাজের ও জায়গায় তো কাউকে যেতে দেওয়া হয় না– এবং সে সেখানে পাইপটা কামড়ে ধরে সমস্ত দিন বিড়বিড় করে খালাসিদের বকাঝকা করে। ঝড়বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। তখন সে একাই একশো। জাহাজ বাঁচাবার জন্য সে তখন ক্ষেপে গিয়ে ব্রিজময় দাবড়ে বেড়ায়, টেলিফোনে চিৎকার করে এঞ্জিন-ঘরকে হুকুম হাঁকে, আরও জলদি, পুরো স্পিডে, কখনও-বা বরষাতিটা গায়ে চাপিয়ে ব্রিজ খুলে ডেকের তদারকি করে ভিজে কাঁই হয়ে ফের ব্রিজে ঢুকবে। ঝড় না থামা পর্যন্ত তার দম ফেলার ফুরসত নেই, ঘুমুতে যাবার তো কথাই ওঠে না। ঝড় থামলে হাঁফ ছেড়ে বলবে, ওহ্, কী বাচনটাই না বেঁচে গিয়েছি। আমি না থাকলে সব ব্যাটা আজ ডুবে মরত। আজকালকার ছোঁড়ারা জাহাজ চালাবার কিস্-সু-টি জানে না। তার পর টেবিলে বসে আঁকাবাঁকা অক্ষরে জাহাজের ক্রুদের ধন্যবাদ জানাবে, তারা যে তার হুকুম তামিল করে জাহাজ বাঁচাতে পেরেছে তার জন্য। তার পর ঝড়ের ধাক্কায় জাহাজ যে কোথায় ছিটকে পড়েছে তার বেয়ারিঙ নেবে বিস্তর ল্যাটিটুড-লঙিটুড কষে এবং শেষটায় হাঁটু গেড়ে ভগবানকে ধন্যবাদ জানিয়ে পরম পরিতৃপ্তি সহকারে হাই তুলতে তুলতে আপন কেবিনে শুতে যাবে।
তিন দিন পরে গুম গুম করে জাহাজ থেকে নেমে সে পাড়ার আড্ডায় যাবে গল্প করতে– জাহাজ বন্দরে এসে ভিড়েছে কি-না! সেখানে সেই মারাত্মক ঝড়ের একটা ভয়ঙ্কর বর্ণনা দিয়ে শেষটায় পাইপ কামড়াতে কামড়াতে বলবে, আর না, এই আমার শেষ সফর। বুড়ো হাড়ে আর জলঝড় সয় না। সবাই হা-হা করে বলবে, সে কী, কাপ্তেন, আপনার আর তেমন কী বয়স হল? কাপ্তেনও হেঁ-হেঁ করে মহাখুশি হয়ে জাহাজে ফিরবে।
আমি আরও দুই শ্রেণির লোককে চিনি যারা কিছুতেই বাসা বাঁধতে চায় না।
দেশ-বিদেশে আমি বিস্তর বেদে দেখেছি। এরা আজ এখানে, কাল ওখানে, পরশু আরও দূরে, অন্য কোথাও। কখন কোন্ জায়গায় কোন্ মেলা শুরু হবে, কখন শেষ হবে, সব তাদের জানা। মেলায় মেলায় গিয়ে কেনাকাটা করবে, নাচ দেখাবে, গান শোনাবে, হাত গুনবে, কিন্তু কোথাও স্থির হয়ে বেশিদিন থাকবে না। গ্রীষ্মের খরদাহ, বর্ষার অবিরল বৃষ্টি সব মাথায় করে চলেছে তো চলেছে, কিসের নেশায় কেউ বলতে পারে না। বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাবার চাড় নেই, তাদের অসুখ-বিসুখ করলে ডাক্তার-বদ্যিরও তোয়াক্কা করে না। যা হবার হোক, বাসা তারা কিছুতেই বাধবে না। বাড়ির মায়া কী তারা কখনও জানেনি; কোনওদিন জানবেও না।
ইংলন্ড দুশো বছর ধরে চেষ্টা করে আসছে এদের কোনও জায়গায় পাকাপাকিভাবে বসিয়ে দিতে। টাকা-পয়সা দিয়েছে, কিন্তু না, না, না, এরা কিছুতেই কোনও জায়গায় কেনা গোলাম হয়ে থাকতে চায় না। ইংলন্ড যে এখনও তার দেশে প্রাথমিক শিক্ষার হার শতকরা পুরো একশো করতে পারেনি তার প্রধান কারণ এই বেদেরা। এরা তো আর কোনও জায়গায় বেশিদিন টিকে থাকে না যে এদের বাচ্চারা ইস্কুলে যাবে! শেষটায় ইংরেজ এদের জন্য ভ্রাম্যমাণ পাঠশালা খুলেছে, অর্থাৎ পাঠশালার মাস্টার শেলেট, পেন্সিল নিয়ে ভবঘুরে হয়ে তাদের পিছন পিছন তাড়া লাগাচ্ছে, কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা, তারা যেমন ছিল তেমনি আছে।
খোলামেলার সন্তান এরা– গণ্ডির ভিতর বন্ধ হতে চায় না।
কিন্তু এদের সবাইকে হার মানায় কারা জানো?
রবীন্দ্রনাথ যাদের সম্বন্ধে বলেছেন,
ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন
চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন।
এই যে আরবসাগর পাড়ি দিয়ে আদন বন্দরের দিকে যাচ্ছি এরা সেই দেশের লোক। সৃষ্টির আদিম প্রভাত থেকে এরা আরবের এই মরুভূমিতে ঘোরাঘুরি করছে। এরা এদিক-ওদিক যেতে যেতে কখনও ইরানের সজল উপত্যকার কাছে এসে পৌঁছেছে, কখনও লেবাননের ঘন বনমর্মরধ্বনিও শুনতে পেয়েছে কিন্তু এসব জায়গায় নিশ্চিন্ত মনে বসবাস করার কণামাত্র লোভ এদের কখনও হয়নি। বরঞ্চ মরুভূমির এক মরূদ্যান থেকে আরেক মরূদ্যানে যাবার পথে সমস্ত ক্যারাভান (দল) জলের অভাবে মারা গেল– এ বীভৎস সত্য তাদের কাছে অজানা নয়, তবু তারা ওই পথ ধরেই চলবে, কোনও জায়গায় স্থায়ী বসবাসের প্রস্তাব তাদের মাথায় বজ্রাঘাতের ন্যায়।
জানি, এককালে আরব দেশ বড় গরিব ছিল, কৃত্রিম উপায়ে জলের ব্যবস্থা করতে পারত না বলে সেখানে চাষ-আবাদের কোনও প্রশ্নই উঠত না। কিন্তু হালে নদ-হিজ্জাজের রাজা ইবনে সউদ পেট্রল বিক্রি করে মার্কিনদের কাছ থেকে এত কোটি কোটি ডলার পেয়েছেন যে সে কড়ি কী করে খরচা করবেন তার কোনও উপায়ই খুঁজে পাচ্ছেন না। শেষটায় মেলা যন্ত্রপাতি কিনে তিনি বিস্তর জায়গায় জল সেঁচে সেগুলোকে খেত-খামারের জন্য তৈরি করে বেদুইনদের বললেন, তারা যেন মরুভূমির প্রাণঘাতী যাযাবরবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে এসব জায়গায় বাড়িঘর বাঁধে।
কার গোয়াল, কে দেয় ধুনো!
সেসব জায়গায় এখন তালগাছের মতো উঁচু আগাছা গজাচ্ছে।
বেদুইন তার উট-খচ্চর, গাধা-ঘোড়া নিয়ে আগের মতোই এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়। উটের লোমের তাবুর ভিতর রাত্রিবাস করে। তৃষ্ণায় যখন প্রাণ কণ্ঠাগত হয় তখন তার প্রিয় উটের কণ্ঠ কেটে তারই ভিতরকার জমানো জল খায়। শেষটায় জলের অভাবে গাধা-খচ্চর, বউ-বাচ্চাসহ গুষ্ঠীসুদ্ধ মারা যায়।
তবু পা-জমিয়ে কোথাও নীড় বানাবে না।
এইসব তত্ত্বচিন্তায় মশগুল হয়েছিলুম এমন সময় হুশ করে আরেকখানা জেলেনৌকা পাশ দিয়ে চলে গেল। দেখি, ক্যাম্বিসের ছইয়ের নিচে লোহার উনুন জ্বেলে বুড়ো রান্না চাপিয়েছে। কল্পনা কি না বলতে পারব না, মনে হল ফোড়নের গন্ধ যেন নাকে এসে পৌঁছল। কল্পনা হোক আর যাই হোক, তত্ত্বচিন্তা লোপ পেয়ে তদ্দণ্ডেই ক্ষুধার উদ্রেক হল।
ওদিকে কবে শেষ ব্যাচের শেষ ডিনার খাওয়া হয়ে গিয়েছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিরীক্ষণ, তত্ত্বচিন্তায় মনোবীক্ষণ বিলক্ষণ সুখনীয় প্রচেষ্টা কিন্তু ভক্ষণ-ভিত্তিম উপেক্ষা করা সর্বাংশে অর্বাচীনের লক্ষণ!
তবু দেখি, যদি কিছু জোটে, না হলে পেটে কিল মেরে শুয়ে পড়ব আর কি।
দশ পা যেতে না যেতেই দেখি আমার দুই তরুণ বন্ধু পল আর পার্সি রামি খেলছে। আমাকে দেখে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, গুড ইভনিং, স্যার!
আমি বললুম, হ্যালো, অর্থাৎ এই যে।
তার পর ঈষৎ অভিমানের সুরে বললুম, আমাকে একলা ফেলে তাস খেলছ যে বড়! জানো, তাস ব্যাসন-বিশেষ, তাসে অযথা কালক্ষয় হয়, গুণীরা বলেন–
ওরা বাধা দিচ্ছে না বলে আমাকেই থামতে হল।
পার্সি বললে, যথার্থ বলেছেন, স্যার।
পল বললে, হক কথা। কিন্তু স্যার, আমরা তো এতক্ষণ আপনার ডিনার যোগাড় করে কেবিনে গুছিয়ে রাখাতে
আমি বললুম, সে কী হে?
পার্সি বললে, আজ্ঞে। যখন দেখলুম, আপনি ডিনারের ঘণ্টা শুনেও উঠলেন না, তখনই আমরা ব্যবস্থাটা করে ফেললুম।
সোনার চাঁদ ছেলেরা। ইচ্ছে হচ্ছিল দু জনকে দু-বগলে নিয়ে উল্লাসে নাগা-নৃত্য জুড়ে দিই। কিন্তু বয়সে কম হলে হবে কী, ওজনের দিক দিয়ে ওরা আমার চেয়ে ঢের বেশি ভারিক্তি মুরুব্বি। বাসনাটা তাই বিকাশ লাভ করল না। বললুম, তবে চল ব্রাদার্স, কেবিনে।
০২.
গড্ডলিকা-প্রবাহে অর্থাৎ ভিড়ের সঙ্গে মানুষ গা ভাসিয়ে দেয় কেন? তাতে সুবিধে এই; আর পাঁচজনের যা গতি, তোমারও তাই হবে। এবং সেহেতু সংসারের আর পাঁচজন হেসে-খেলে বেঁচে আছে, অতএব তুমিও দিব্য তাদেরই মতো সুখে-দুঃখে বেঁচে থাকবে।
আর যদি গড্ডলিকায় না মিশে একলা পথে চল তবে যেমন হঠাৎ গুপ্তধনের সন্ধান পেয়ে যেতে পার ঠিক তেমনি মোড় ফিরতেই আচমকা হয়তো দেখতে পাবে, ব্যাঘ্রাচার্য বৃহল্লাঙ্গুল থাবা পেতে সামনে বসে ন্যাজ আছড়াচ্ছেন!
গুপ্তধনটা একা পেয়েছিলে বলে সেটা যেমন তোমার একারই, ঠিক তেমনি বাঘের মোকাবেলা করতে হবে তোমাকে একাই।
তাই বেশিরভাগ লোক সর্বনাশা ক্ষতির ভয়ে অত্যধিক লাভের লোভ না করে গড্ডলিকার সঙ্গে মিশে যায়।
জাহাজেও তাই। তুমি যদি আর পাঁচজনের সঙ্গে ঘুম থেকে জাগো তবে সেই ভিড়ে তুমি ঝটপট তোমার বেড-টির কাপটি পাবে না। আর যদি খুব সকাল সকাল কিংবা আর সকলের চেয়ে দেরিতে ওঠ তবে চা-টি পেয়ে যাবে তনুহর্তেই, কিন্তু আবার কোনও দিন দেখবে, তখনও আগুন জ্বালা হয়নি বলে চায়ের অনেক দেরি, কিংবা এত দেরিতে উঠেছ যে, বেড-টির পাট উঠে গিয়ে তখন ব্রেক ফাস্ট আরম্ভ হয়ে গিয়েছে বলে তোমার বেড-টি হয় মাঠে, অর্থাৎ দরিয়ায় মারা গিয়েছে।
ইংরিজিতে একেই বলে, নো রিসক, নো গেন অর্থাৎ একটুখানি ঝুঁকি যদি নিতে রাজি না হও তবে লাভও হবে না। লটারি জিততে হলে অন্তত একটা টিকিট কেনার রিস্ক নিতে হয়।
সেদিন ঝুঁকিটা নিয়ে সুবিধে হল না। চা-টা মিস্ করে বিরসবদনে ডেকে এসে বসলুম।
এক মিনিটের ভিতর পল আর পার্সির উদয়।
পল ফিসফিস করে কানে কানে বলল, নতুন সব বার্ডিদের ( অর্থাৎ চিড়িয়াদের) দেখেছেন, স্যার?
এরা সব নবাগত যাত্রী। কলম্বোয় জাহাজ ধরেছে। বেচারীরা এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, ডেকে চেয়ার পাতবার ভালো জায়গার সন্ধানে। কিন্তু পাবে কোথায়? আমরা যে আগে-ভাগেই সব জায়গা দখল করে আসন-জমিন জমিয়ে বসে আছি– মাদ্রাজ থেকে।
এ তো দুনিয়ার সর্বত্র হামেশাই হচ্ছে। মিটিঙে, ফুটবলের মাঠে সর্বদাই আগে গিয়ে ভালো জায়গা দখল করার চেষ্টা সবাই করে থাকে। এমনকি রান্নাঘরের দাওয়ায় বসি ঠিক দরজাটির কাছে। মা রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে বেরিয়েই সক্কলের পয়লা দেবে আমাকে।
ভালো জায়গায় বসতে পারাতে দুটো সুখ। একটা ভালো জায়গা পেয়েছ বলে এবং দ্বিতীয়টা তার চেয়েও বড়। বেশ আরাম করে বসে চিনেবাদাম খেতে খেতে অলস নিরাসক্তভাবে তাকিয়ে দেখতে, অন্যেরা ফ্যা ফ্যা করে কীভাবে ভালো জায়গার সন্ধানে ঘুরে মরছে। পরিচিত এবং অপ্রিয় লোক হলে তো কথাই নেই। এই যে ভড় মশাই, জায়গা পাচ্ছেন না বুঝি? বলে ফিক করে একটুখানি সদুপদেশ বিতরণ করবে, কেন, ওই দিকে তো মেলা জায়গা রয়েছে, বলে হাতখানা মাথার উপর তুলে চতুর্দিকে ঘুরিয়ে দেবে। তার থেকে কেউই বুঝতে পারবে না, কোনদিকে জায়গা খালি। লোকটা দৃষ্টি দিয়ে বিষবৃষ্টি নিক্ষেপ করে গজরাতে গজরাতে তোমার দৃষ্টির আড়াল হবে!
আহ্! এ সংসারে ভগবান তার অসীম করুণায় আমাদের জন্যে কত আনন্দই না রেখেছেন। কে বলে সংসার মায়াময় অনিত্য? সে বোধহয় ফুটবলের মাঠে কখনও ভালো সিট পায়নি।
আমি পল-পার্সিকে জিগ্যেস করলুম, অদ্যকার প্রোগ্রাম কী?
পল বললে, প্রথমত, জিমনাসটিক-হলে গমন।
সেখানকার কর্মতালিকা কী?
একটুখানি রোইং করব।
রোইং সেখানে কি নৌকো, বৈঠে, জল আছে?
সব আছে, শুধু জল নেই।
?
বৈঠেগুলোর সঙ্গে এমনভাবে স্প্রিং লাগানো আছে যে জল থাকলে বৈঠাকে যতখানি বাধা দিত স্প্রিং ঠিক ততখানি দেয়। কাজেই শুকনোয় বসে বৈঠে চালানোর প্র্যাকটিস আর পরিশ্রম দুই-ই হয়।
আমি বললুম, উঁহু। আমার মন সাড়া দিচ্ছে না। আমাদের দেশে আমরা বৈঠা মারি দু হাত দিয়ে তুলে ধরে। তোমার কায়দাটা রপ্ত করে আমার কোনও লাভ হবে না।
পল বললে, তা হলে প্যারালেল বার, ডামবেল কিছু একটা?
উঁহু।
পার্সি বললে, তা হলে পলে-আমাতে বকসিং লড়ব। আপনি রেফারি হবেন।
আমি তো ওর তত্ত্ব কিছুই জানিনে।
আমরা শিখিয়ে দেব।
উঁহু।
পল তখন ধীরে ধীরে বলল, আসলে আপনি কোনওরকম নড়াচড়া করতে চান না। একসেরসাইজের কথা না হয় রইল কিন্তু আর সবাই তো সকাল-বিকেল জাহাজটাকে কয়েকবার প্রদক্ষিণ দেয় শরীরটাকে ঠিক রাখবার জন্য। আপনি তো তা-ও করেন না। কেন বলুন তো?
আমি বললুম, আরেকদিন হবে। উপস্থিত অদ্যকার অন্য কর্মসূচি কী?
পার্সি বললে, আজ এগারোটায় লাউঞ্জে চেম্বার মুজিক। তাই না হয় শোনা যাবে।
পল আপত্তি জানাল। বললে, যে লোকটা বেহালা বাজায় তার বাজনা শুনে মনে হয়, দুটো হুলো বেড়ালে মারামারি লাগিয়েছে।
পার্সি বললে, ওই তো পলের দোষ। বড় পিটপিটে। আরে বাপু, যাচ্ছিস তো সস্তা ফরাসি মেসাজেরি মারিতি জাহাজে আর আশা করছিস, ক্রাইজ্বলার এসে তোর কেবিনের জানালার কাছে চাঁদের আলোতে বেহালা দিয়ে সেরেনেড বাজাবেন!
আমি বললুম, আমাদের দেশে এক বুড়ি কিনে আনল এক পয়সার তেল। পরে দেখে তাতে একটা মরা মাছি। দোকানিকে ফেরত দিতে গিয়ে বললে, তেলে মরা মাছি। দোকানি বললে, এক পয়সার তেলে কী তুমি একটা মরা হাতি আশা করেছিলে?
পার্সি বলল, এইবার আপনাকে বাগে পেয়েছি, স্যার! আপনি যে গল্পটি বললেন তার যে বিলিতি মুদ্রণটি আমি জানি সে এর চেয়ে সরেস।
আমি চোখ বন্ধ করে বললুম, কীর্তন কর।
পার্সি বললে, এই আমাদের পলেরই মতো এক পিটপিটে মেমসায়েব গিয়েছেন মোজা কিনতে। কোনও মোজাই তার পছন্দ হয় না। শেষটায় সবচেয়ে সস্তায় এক শিলিঙে তিনি একজোড়া মোজা কিনলেন। দোকানি যখন মোজা প্যাক করছে তখন তার চোখে পড়ল মোজাতে অতি ছোট্ট একটি ল্যাডার
আমি শুধোলুম, ল্যাডার মানে কী? ল্যাডার মানে তো মই।
আজ্ঞে, মোজার একগাছা টানার সুতো যদি ছিঁড়ে যায় তবে ওই জাগায় শুধু পড়েনগুলো একটার উপর একটা এমনভাবে থাকে যেন মনে হয় সিঁড়ি কিংবা মই। তাই ওটাকে তখন ল্যাডার বলা হয়।
আমি বললুম, থ্যাঙ্কিউ; শেখা হল। তার পর কী হল?
মেম বললেন, ও মোজা আমি নেব না, ওতে একটা ল্যাডার রয়েছে।
দোকানি বললে, এক শিলিঙের মোজাতে কি আপনি একটা মার্বেল স্টেয়ারকেস আশা করেছিলেন, ম্যাডাম?।
আমি বললুম, সাবাস, তোমার বলা গল্পটি আমার গার্হস্থ্য সংস্করণের রাজসংস্করণ বলা যেতে পারে। তদুপরি তোমরা তো রাজার জাত।
পার্সি বললে, ও কথাটা নাই-বা তুললেন, স্যার!
আমি আমার চোখ বন্ধ করে বললুম, জাহাজের দুর্বিষহ গতানুগতিক জীবনকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করবার জন্য কোম্পানি অদ্য অন্য কী ব্যবস্থা করেছেন?
পার্সি বলল, সঙ্গীতে যখন পলের আপত্তি তখন আমি ভাবছি ওই সময়টায় আমি সেলুনে চুল কাটাতে যাব।
আমি হন্তদন্ত হয়ে বললুম, অমন কর্মটি গলা কেটে ফেললেও করতে যেয়ো না, পার্সি! তোমার চুল কেটে দেবে নিশ্চয়ই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তোমার হাজামও করে দেবে।
কথাটা বুঝতে পারলুম না, স্যর!
আমি বললুম, ওটা একটা উর্দু কথার আড়। এর অর্থ, তোমার চুল নিশ্চয়ই কেটে দেবে ভালো করে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মাথাটিও মুড়িয়ে দেবে।
পার্সি আরও সাত হাত জলে। শুধোল, চুল যদি ভালো করে কাটে তবে মাথা মুড়োবে কী করে?
আমি বললুম, তোমার চুল কাটবে শব্দার্থে, কিন্তু মাথা মুড়োবে বার্থে, অর্থাৎ মেটাফরিকেলি। মোদ্দাকথা, তোমার সর্বস্ব লুণ্ঠন করবে। জাহাজে চুল কাটানোর দর্শনী পঞ্চ মুদ্রা।
পল বললে, সে কী স্যর? চীন দেশে তো পাঁচ টাকায় কুড়ি বার চুল কাটানো যায়।
আমি বললুম, ভারতবর্ষেও তাই। এমনকি বিশ্বফ্যাশানের রাজধানী প্যারিসেও চুল কাটাতে পাঁচ টাকা লাগে না। ব্যাপারটা হয়েছে কী, জাহাজের ফার্স্টক্লাসে যাচ্ছেন পয়সাওয়ালা বড়লোকেরা। তারা পাঁচ টাকার কমে চুল কাটান না। কাজেই রেট বেঁধে দেওয়া হয়েছে পাঁচ টাকা। আমাদের কথা বাদ দাও, এখন যদি কোনও ডেকপ্যাসেঞ্জারও চুল কাটাতে যায় তবে তাকেও দিতে হবে পাঁচ টাকা।
তা হলে উপায়? একমাথা চুল নিয়ে লন্ডনে নামলে পিসিমা কী ভাববেন? তার ওপর পিসিমাকে দেখব জীবনে এই প্রথম, পিসিমার কথা উঠলে বাবা-মা যেভাবে সমীহ করে কথা বলেন তার থেকে মনে হয় তিনি খুব সোজা মহিলা নন। তা হলে পাঁচটা টাকা দরিয়ার জলে ভেসে গেল আর কি, একদম শব্দার্থে।
আমি বললুম, আদপেই না। জিবুটি বন্দরে চুল কাটাবে। বিবেচনা করি, সেখানে চুল কাটাতে এক শিলিংয়েরও কম লাগবে।
পল বললে, আমরা যখন বন্দরে রোদ লাগাব তখন পার্সিটা একটা ঘিঞ্জি সেলুনে বসে চুল কাটাবে। তা হলে তার উপযুক্ত শিক্ষা হয়।
পার্সি আমার দিকে করুণ নয়নে তাকাল।
আমি বললুম, তা কেন? বন্দর দেখার পর তোমাতে-আমাতে যখন কাফেতে বসে কফি খাব তখন পার্সি চুল কাটাবে। চাই কি, হয়তো সেলুনের বারান্দায় বসেই কফি খেতে খেতে পার্সিকে আমাদের মহামূল্যবান সঙ্গসুখ দেব, অমূল্য উপদেশ বিতরণ করব।
পার্সি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে বাও করে বললে, এ যাত্রায় আপনার সঙ্গে পরিচয় না হলে, স্যর, আমাদের যে কী হত–
আমি বাধা দিয়ে বললুম, কিছুই হত না। আমার সঙ্গে বজর বজর না করে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতে, পাঁচরকমের ছেলে-ছোকরাদের সঙ্গে আলাপচারি হত। অনেক দেখতে, অনেক শুনতে।
দু জনাই সঙ্গে সঙ্গে কেটে পড়ল!
আমি আরব সাগরের আবহাওয়া সম্বন্ধে একখানা বিরাট কেতাব নিয়ে পড়তে লেগে গেলুম।
.
০৩.
আরবের তুলনায় বাঙালি যে অতিশয় নিরীহ সে বিষয়ে কারও মনে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয় কিন্তু আরব সাগর, সাগর হয়েও বঙ্গোপসাগরের উপসাগরের চেয়ে অনেক বেশি শান্ত এবং ঠাণ্ডা। মাদ্রাজ থেকে কলম্বো পর্যন্ত অধিকাংশ যাত্রী সি-সিকনেসে বেশ কাবু হয়ে থাকার পর এখানে তারা বেশ চাঙা হয়ে উঠেছেন। উত্তর-পূর্ব দিকে মৃদু-মন্দ মৌসুমি হাওয়া বইছে তখনও– এই হাওয়ায় পাল তুলে দিয়েই ভাস্কো দা গামা আফ্রিকা থেকে ভারতে পৌঁছতে পেরেছিলেন। কিন্তু এই সময়ে ওই হাওয়া ভারতের দিকে বয় সে আবিষ্কার গামার নয়। আরবরা এ হাওয়ার গতিবিধি সম্বন্ধে বিলক্ষণ ওকিবহাল ছিল এবং বিশেষ ঋতুতে (মৌসুমে এ হাওয়া বয় বলে এর নাম দিয়েছিল মৌসুমি হাওয়া। ইংরেজি শব্দ মনসুন এবং বাঙলা মরশুম এই মৌসুম শব্দ থেকে এসেছে। কিন্তু মৌসুমি হাওয়ার খানিকটা সন্ধান পাওয়ার পরও গামা একা সাহস করে আরবসাগর পাড়ি দিতে পারেননি। আফ্রিকা থেকে একজন আরবকে জোর করে জাহাজে পাইলট রূপে এনেছিলেন।
রোমানরাও নিশ্চয়ই এ হাওয়ার খবর কিছুটা রাখত। না হলে আরবদের বহু পূর্বে দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে তারা এতখানি ব্যবসা-বাণিজ্য করল কী করে? এখনও দক্ষিণ ভারতের বহু জায়গায় মাটির তলা থেকে রোমান মুদ্রা বেরোয়।
তারও পূর্বে গ্রিক, ফিনিশিয়ানরা এ হাওয়ার খবর কতখানি রাখত আমার বিদ্যে অতদূর পৌঁছয়নি। তোমরা যদি কেতাবপত্র ঘেঁটে আমাকে খবরটা জানাও তবে বড় খুশি হই।
এই হাওয়াটাকেই ট্যারচা কেটে কেটে আমাদের জাহাজ এগোচ্ছে। এ হাওয়া যতক্ষণ মোলায়েমভাবে চলে ততক্ষণ কোনও ভাবনা নেই। জাহাজ অল্প-স্বল্প দোলে বটে তবু উল্টোদিক থেকে বইছে বলে গরমে বেগুন-পোড়া হতে হয় না। কিন্তু ইনি রুদ্রমূর্তি ধরলেই জাহাজময় পরিত্রাহি চিৎকার উঠবে। এবং বছরের এ সময়টা তিনি যে মাসে অন্তত দু তিনবার জাহাজগুলোকে লণ্ডভণ্ড করে দেবার জন্য উঠে-পড়ে লেগে যান সে সুখবরটা আবহাওয়ার বইখানাতে একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে।
আবহাওয়ার বিজ্ঞান ঝড় ওঠবার পূর্বাভাস খানিকটা দিতে পারে বটে কিন্তু আরব সাগরের মাঝখানে যে ঝড় উঠল সে যে তার পর কোনদিকে ধাওয়া করবে সে সম্বন্ধে আগে-ভাগে কোনওকিছু বলে দেওয়া প্রায় অসম্ভব।
তাই সে ঝড় যদি পূর্ব দিকে ধাওয়া করে তবে ভারতের বিপদ, বোম্বাই, কারওয়ার, তিরু অনন্তপুরম, (শ্রী অনন্তপুর, ট্রিভাণ্ডএম) অঞ্চল লণ্ডভণ্ড করে দেবে। যদি উত্তর দিকে যায় তবে পার্শিয়ান গালফু এবং আরব উপকূলের বিপদ আর যদি পশ্চিম পানে আক্রমণ করে তবে আদন বন্দর এবং আফ্রিকার সোমালিদের প্রাণ যায় যায়।
একবার নাকি এইরকম একটা ঝড়ের পর সোমালিদের ওবোক শহরে মাত্র একখানা বাড়ি খাড়া ছিল। সে ঝড়ে শহরের সব বাড়ি পড়ে যায়, তার সঙ্গে যদি মাঝদরিয়ায় আমাদের জাহাজের মোলাকাত হয় তবে অবস্থা কীরকম হবে খানিকটা অনুমান করা যায়।
তবে আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস, এরকম ঝড়ের সঙ্গে মানুষের একবারের বেশি দেখা হয় না। প্রথম ধাক্কাতেই পাতালপ্রাপ্তি!
পাতালপ্রাপ্তি কথাটা কী ঠিক হল? কোথায় যেন পড়েছি, জাহাজ ডুবে গেলে পাতাল অবধি নাকি পৌঁছয় না। খানিকটে নাবার পর ভারী জল ছিন্ন করে জাহাজ নাকি আর তলার দিকে যেতে পারে না। তখন সে ত্রিশঙ্কুর মতো ওইখানেই ভাসতে থাকে।
ভাবতে কীরকম অদ্ভুত লাগে! সমুদ্রের এক বিশেষ স্তরে তা হলে যতসব জাহাজ ডোবে তারা যতদিন না জরাজীর্ণ হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায় ততদিন শুধু যোরাফেরাই করবে!
জলে যা, হাওয়াতেও বোধ করি তাই। বেলুন-টেলুন জোরদার করে ছাড়তে পারলে বোধহয় উড়তে উড়তে তারা এক বিশেষ স্তরে পৌঁছলে ওইখানেই ঝুলতে থাকবে না পারবে নিচের দিকে নামতে, না পারবে উপরের দিকে যেতে। তারই অবস্থা কল্পনা করে বোধহয় মুনি-ঋষিরা ত্রিশঙ্কুর স্বর্গ-মর্তের মাঝখানে ঝুলে থাকার কথা কল্পনা করেছিলেন।
আমাকে অবশ্য কখনও কোনও জায়গায় ঝুলে থাকতে হবে না। দ্বিপ্রহরে এবং সন্ধ্যায় যা গুরুভোজন করে থাকি তার ফলে ডুবলে পাথরবাটির মতো তরতর করে একদম নাক বরাবর পাতালে পৌঁছে যাব। আহারাদির পর আমার যা ওজন হয় সে গুরুভার সমুদ্রের যে কোনও নোনাজলকে অনায়াসে ছিন্ন করতে পারে। আমার ভাবনা শুধু আমার মুণ্ডুটাকে নিয়ে। মগজ সেটাতে এক রত্তিও নেই বলে সেটা এমনি ফাপা যে, কখন যে ধড়টি ছেড়ে হুশ করে চন্দ্র-সূর্যের পানে ধাওয়া করবে তার কিছু ঠিক-ঠিকানা নেই। হাজারো লোকের ভিড়ের মধ্যে যদি আমাকে শনাক্ত করতে চাও তবে শুধু লক্ষ কোরো কোন লোকটা দু হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে নড়াচড়া করছে।
অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছিলুম আমার সখা এবং সতীর্থ– একই তীর্থে যখন যাচ্ছি তখন সতীর্থ বলাতে কারও কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়– শ্রীমান পল কোথা থেকে একটা টেলিস্কোপ যোগাড় করে একদৃষ্টে দক্ষিণ পানে তাকিয়ে আছে। ভাবলুম, ওই দিক দিয়ে বোধহয় কোনও জাহাজ যাচ্ছে আর সে তার নামটা পড়ার চেষ্টা করছে।
আমাকে দাঁড়াতে দেখে কাছে এসে বললে, ওই দূরে যেন ল্যান্ড দেখা যাচ্ছে।
আমি বললুম, ল্যান্ড নয়, আইল্যান্ড। ওটা বোধহয় মালদ্বীপপুঞ্জের কোনও একটা হবে।
পল বললে, কই, ওগুলোর নাম তো কখনও শুনিনি!
আমি বললুম, শুনবে কী করে? এই জাহাজে যে এত লোক, এঁদের সব্বাইকে জিগ্যেস কর ওঁদের কেউ মালদ্বীপ গিয়েছেন কি না? অদূরেই-বা কেন? শুধু জিগ্যেস কর, মালদ্বীপবাসী কারও সঙ্গে কখনও ওঁদের দেখা হয়েছে কি না? তাই মালদ্বীপ নিয়ে এ বিশ্বভুবনের কারও কোনও কৌতূহল নেই।
আপনি জানলেন কী করে?
শুনেছি, মালদ্বীপের লোকেরা খুব ধর্মভীরু হয়। এক মালদ্বীপবাসীর তাই ইচ্ছে হয়, তার ছেলেকে মুসলিম শাস্ত্র শেখাবার। মালদ্বীপে তার কোনও ব্যবস্থা নেই বলে তিনি ছেলেকে কাইরোর আজহর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান;- ওইটেই ইসলামি শাস্ত্র শেখার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। ছেলেটির সঙ্গে আমার আলাপ হয় ওইখানে। বহুবার দেখা হয়েছিল বলে সে আমাকে তার দেশ সম্বন্ধে অনেককিছুই বলেছিল, তবে সে অনেক কাল হল বলে আজ আর বিশেষ কিছু মনে নেই।
ওখানে নাকি সবসুদ্ধ হাজার দুই ছোট ছোট দ্বীপ আছে এবং তার অনেকগুলোতেই খাবার জল নেই বলে কোনও প্রকারের বসতি নেই। মালদ্বীপের ছেলেটি আমায় বলেছিল, আপনি যদি এরকম দশ-বিশটা দ্বীপ নিয়ে বলেন, এগুলো আপনার, আপনি এদের রাজা, তা হলে আমরা তাতে কণামাত্র আপত্তি জানাব না। অন্যগুলোতেও বিশেষ কিছু ফলে না, সবচেয়ে বড় দ্বীপটার দৈর্ঘ্য নাকি মাত্র দু মাইল। মালদ্বীপের সুলতান সেখানে থাকেন এবং তার নাকি ছোট্ট একখানা মটরগাড়ি আছে। তবে যেখানে সবচেয়ে লম্বা রাস্তার দৈর্ঘ্য মাত্র দু মাইল সেখানে ওটা চালিয়ে তিনি কী সুখ পান তা তিনিই বলতে পারবেন।
মালদ্বীপে আছে প্রচুর নারকেলগাছ আর দ্বীপের চতুর্দিকে জাত-বেজাতের মাছ কিলবিল করছে। মাছের শুঁটকি আর নারকেলে নৌকো ভর্তি করে পাল তুলে দিয়ে তারা রওনা হয় সিংহলের দিকে মৌসুমি হাওয়া বইতে আরম্ভ করলেই। হাওয়া তখন মালদ্বীপ থেকে সিংহলের দিকে বয়। সমস্ত বর্ষাকালটা সিংহলে ওইসব বিক্রি করে এবং বদলে চাল ডাল কাপড় কেরোসিন তেল কেনে। কেনাকাটা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তাদের নাকি সেখানে বহুদিন কাটাতে হয়, কারণ উল্টো হাওয়া বইতে আরম্ভ করবে শীতের শুরুতে। তার আগে তো ফেরার উপায় নেই।
পার্সি বললে, কেন স্যর, এখন তো শীতকাল নয়। আমরা তো হাওয়ার উল্টো দিকেই যাচ্ছি।
আমি বললুম, ভ্রাতঃ, আমাদের জাহাজ চলে কলে, হাওয়ার তোয়াক্কা সে করে থোড়াই। মালদ্বীপে কোনও কলের জাহাজ যায় না, খরচায় পোষায় না বলে। তাই আজ পর্যন্ত কোনও টুরিস্ট মালদ্বীপ যায়নি।
তাই মালদ্বীপের ছোকরাটি আমায় বলেছিল, আমাদের ভাষাতে অতিথি শব্দটার কোনও প্রতিশব্দ নেই। তার কারণ বহুশত বৎসর ধরে আমাদের দেশে ভিনদেশি লোক আসেননি। আমরা এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যা অল্পস্বল্প যাওয়া-আসা করি তা এতই কাছাকাছির ব্যাপার যে কাউকে অন্যের বাড়িতে রাত্রিযাপন করতে হয় না। তার পর আমায় বলেছিল, আপনার নেমন্তন্ন রইল মালদ্বীপ ভ্রমণের কিন্তু আমি জানি, আপনি কখনও আসবেন না। যদিস্যাৎ এসে যান তাই আগের থেকেই বলে রাখছি, আপনাকে এর বাড়ি ওর বাড়ি করে করে অন্তত বছর তিনেক সেখানে কাটাতে হবে। খাবেন-দাবেন, নারকেলগাছের তলাতে চাঁদের আলোয় গাওনা-বাজনা শুনবেন, ব্যস, আর কী চাই।
যখন শুনেছিলুম তখন যে যাবার লোভ হয়নি একথা বলব না। ঝাড়া তিনটি বচ্ছর (এবং মালদ্বীপের ছেলেটি আশা দিয়েছিল যে সেখানে যাহা তিন তাহা তিরানব্বই) কিচ্ছুটি করতে হবে না, এবং শুধু তিন বৎসর না, বাকি জীবনটাই কিছু করতে হবে না। একথাটা ভাবলেই যেন চিত্তবনের উপর দিয়ে মর্মর গান তুলে মন্দমিঠে মলয় বাতাস বয়ে যায়। একজামিনের ভাবনা, কেষ্টার কাছে দু-টাকার দেনা, সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এক মুহূর্তেই মুক্তি। অহহ!
কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
দিবা-রাত্রি নাচে মুক্তি, নাচে বন্ধ
সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে
তা তা থৈ থৈ তা তা থৈ থৈ তা তা থৈ থৈ ॥
এসব আত্মচিন্তার সবকিছুই যে পুল-পার্সিকে প্রকাশ করে বলেছিলুম তা নয়, তবে একটা কথা মনে আছে, ওরা যখন উৎসাহিত হয়ে মালদ্বীপে বাকি জীবনটা কাটাবে বলে আমাকে সে খবরটা দিল তখন আমি বলেছিলুম
বাকি জীবন কেন, তিনটি মাসও সেখানে কাটাতে পারবে না। তার কারণ যেখানে কোনও কাজ করার নেই, সেখানে কাজ না করাটাই হয়ে দাঁড়ায় কাজের কাজ। এবং সে ভয়াবহ কাজ। কারণ, অন্য যে কোনও কাজই নাও না কেন, যেমন মনে কর এগজামি– তারও শেষ আছে, বি-এ, এম-এ, পি-এইচ-ডি, তার পর কোনও পরীক্ষা নেই। কিংবা মনে কর উঁচু পাহাড়ে চড়া। পাঁচ হাজার, দশ হাজার, ত্রিশ হাজার ফুট, যাই হোক না কেন তারও একটা সীমা আছে। কিন্তু কাজ নেই– এ হল একটা জিনিস যা নেই, কাজেই তার আরম্ভও নেই শেষও নেই। যে জিনিসের শেষ নেই সে জিনিস শেষ পর্যন্ত সইতে পারা যায় না।
কিংবা অন্যদিক দিয়ে ব্যাপারটাকে দেখতে পার।
আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মনে কর একটা ঘর। ঘরে আসল জিনিস দি ইমপর্টেন্ট এলমন্ট হল তার ফাঁকাটা, আমরা তাতে আসবাবপত্র রাখি, খাই-দাই, সেখানে রৌদ্রবৃষ্টি থেকে শরীরটা বাঁচাই। ঘরের দেয়ালগুলো কিন্তু এসব কাজে লাগছে না। অর্থাৎ ইমপর্টেন্ট, হল ফাঁকাটা, নিরেট দেয়ালটা নয়। তাই বলে দেয়ালটা বাদ দিলে চলবে না। দেয়ালহীন ফাঁকা হল ময়দানের ফাঁকা, সেখানে আশ্রয় জোটে না।
তাই গুরুদেব বলেছেন, মানুষের জীবনের অবসরটা হচ্ছে ঘরের ফাঁকাটার মতো, সে-ই দেয় আমাদের প্রবেশের পথ কিন্তু কিছুটা কাজের দেয়াল দিয়ে সেই ফাঁকা অবসরটাকে যদি ঘিরে না রাখো তবে তার থেকে কোনও সুবিধে ওঠাতে পার না। কিন্তু কাজ করবে যতদূর সম্ভব কম। কারণ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছ, ঘরের মধ্যে ফাঁকাটা দেয়ালের তুলনায় পরিমাণে অনেক বেশি।
তার পর আমি বললাম, কিন্তু ভ্রাতৃদ্বয়, আমার গুরুদেব এই তত্ত্বটি প্রকাশ করেছেন ভারি সুন্দর ভাষায় আর সুমিষ্ট ব্যঞ্জনায়, কিছুটা উস্টার সসের হাস্যকৌতুক মিশিয়ে দিয়ে। আমি তার অনুকরণ করব কী করে?
কিন্তু মূল সিদ্ধান্ত এই মালদ্বীপের একটানা কর্মহীনতার ফাঁকাটা অসহ্য হয়ে দাঁড়াবে, কারণ তার চতুর্দিকে সামান্যতম কাজের দেয়াল নেই বলে।
একটানা এতখানি কথা বলার দরুন ক্লান্ত হয়ে ডেক-চেয়ারে গা এলিয়ে দিলুম।
তখন লক্ষ করলুম, পল ঘন ঘন ঘাড় চুলকোচ্ছে। তার পর হঠাৎ ডান হাতটা মুঠো করে মাথায় ধাই করে শুত্তা মেরে বললে, পেয়েছি, পেয়েছি, এই বারে পেয়েছি।
কী পেয়েছে সেইটে আমি শুধোবার পূর্বেই পার্সি বললে, ওই হচ্ছে পলের ধরন। কোনও একটা কথা স্মরণে আনবার চেষ্টা করার সময় সে ঘন ঘন ঘাড় চুলকোয়। মনে এসে যাওয়া মাত্রই ঠাস করে মাথায় মারবে এক ঘুষি। ক্লাসেও ও তাই করে। আমরা তাই নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে থাকি। এবারে শুনুন, ও কী বলে।
পল বললে, কোনও নতুন কথা নয়, স্যর! তবে আপনার শুরুর তুলনাতে মনে পড়ে গেল আমার শুরু কফুসর (আমার মনে বড় আনন্দ হল যে ইংরেজ ছেলেটা ক-ফু-সকে আমাদের গুরু বলে সম্মান জানাল–ভারতবর্ষের ইংরেজ ছেলে-বুড়ো বন্ধুকে কখনও আমাদের গুরু, বলেনি)–এ বিষয়ে অন্য এক তুলনা। যদি অনুমতি দেন।
আমি বললুম, কী জ্বালা! তোমার এই চীনা লৌকিকতা-ভদ্রতা আমাকে অতিষ্ঠ করে তুললে। কন্-ফু-ৎসর তত্ত্বচিন্তা শুনতে চায় না কোন মর্কট? জানো, ঋষি কন্-ফু-ৎস আমাদের মহাপুরুষ গৌতমবুদ্ধের সমসাময়িক? ওই সময়েই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, ইরানে জরথুস্ত্র, গ্রিসে সোক্রাতেস-প্লাতো-আরিস্ততেলেসে, প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের ভিতরে– তা থাক গে, তোমার কথা বল।
পল বললে, সরি, সরি। ক-ফু-ৎস বলেছেন, একটি পেয়ালার আসল (ইমপর্টেন্ট) জিনিস কী? তার ফাঁকা জায়গাটা, না তার পর্সেলেনের ভাগটা? ফাঁকা জায়গাটাতেই আমরা রাখি জল, শরবত, চা। কিন্তু পর্সেলেন না থাকলে ফাঁকাটা আদপেই কোনও উপকার করতে পারে না। অতএব কাজের পর্সেলেন দিয়ে অকাজের ফাঁকাটা ঘিরে রাখতে হয়। এবং শুধু তাই নয়, পর্সেলেন যত পাতলা হয়, পেয়ালার কদর ততই বেশি। অর্থাৎ কাজ করবে যতদূর সম্ভব সামান্যতম।
তার পর হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে আমাকে বাও-টাও করে অর্থাৎ চীনা পদ্ধতিতে আমায় হাঁটু আর মাথা নিচু করে অভিবাদন জানিয়ে বললে
আমি বাধা দিয়ে বললুম, ফের তোমার চীনে সৌজন্য?
বললে, সরি সরি। কিন্তু স্যর, ওই মালদ্বীপের কথা ওঠাতে আর আপনি আপনার গুরুদেবের কথা বলতে আমার কাছে কন্-ফু-ৎসর তত্ত্বচিন্তা আজ সরল হয়ে গেল। ওঁর এ বাণী বহুবার শুনেছি, অনেকবার পড়েছি কিন্তু আজ এই প্রথম
আমি বাধা দিয়ে বললুম, চোপ্।
.
০৪.
কোনও কোনও জাহাজে কী যেন এক রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় হাওয়াকে ঠাণ্ডা করে সেইটে জাহাজের সর্বত্র চালিয়ে দেওয়া হয়। মনে হয়, এই রৌদ্র-দগ্ধ, জ্বরতপ্ত বিরাট জাহাজরূপী লৌহদানবকে তার মা যেন ঠাণ্ডা হাত বুলিয়ে বুলিয়ে তার গায়ের জ্বালা জুড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু পারেন কতখানি? বরঞ্চ রেলগাড়ি প্ল্যাটফর্মে প্লাটফর্মে ছায়াতে দু-দশ মিনিট ঠাণ্ডা হবার সুযোগ পায়, কিংবা উপত্যকার ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় তার গায়ে এসে পাহাড়ের ছায়া পড়ে, ঘন শালবনের ভিতর দিয়েও গাড়ি কখনও কখনও বনানীর স্নিগ্ধছায়া লাভ করে, এবং সুড়ঙ্গ হলে তো কথাই নেই- সেখানকার ঠাণ্ডা তো রীতিমতো বরফের বাক্সের ভিতরকারের মতো কিন্তু জাহাজের কপালে এসব কিছুই নেই। একে তো দিগ-দিগন্তব্যাপী জ্বলছে রৌদ্রের বিরাট চিতা, তার ওপর সূর্য তার প্রতাপ বাড়িয়ে দিচ্ছেন সমুদ্রের জলের উপর প্রতিফলিত হয়ে। কালো চশমা পরেও তখন সেদিকে তাকানো যায় না। রাত্রে অল্প অল্প ঠাণ্ডা হাওয়া বয় বটে, কিন্তু সে ঠাণ্ডাতে গা জুড়োবার পূর্বেই দেখা দেন পূর্বাকাশে সূয্যি-মাস্টার ফের তাঁর রোদের চাবুক হাতে নিয়ে। ভগবান তাঁকে দিয়েছেন লক্ষ লক্ষ কর, এবং সেই লক্ষ লক্ষ হাতে তিনি নিয়েছেন লক্ষ লক্ষ পাকা কঞ্চির সোনালি রঙের চাবুক। দেখামাত্রই গায়ের সবকটা লোম কাঁটা দিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের জাহাজে ঠাণ্ডা বাতাস চালানোর ব্যবস্থা ছিল না অর্থাৎ সেটা অ্যারকন্ডিশনড় নয়। কাজেই কি দিনের বেলা কি রাত্রে কখনও ভালো করে ঘুমোবার সুযোগ বঙ্গোপসাগর, আরব সমুদ্র কিংবা লাল দরিয়ায় মানুষ পায় না।
দুপুররাত থেকে হয়তো ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে আরম্ভ করল। ডেকে বসে তুমি গা জুড়োলে। কিন্তু তখন যে কেবিনে ঢুকে বিছানা নেবে তার উপায় নেই। সেখানে ওই ঠাণ্ডা হাওয়া যেতে পারে না বলে অসহ্য গুমোট গরম। গড়ের মাঠে ঠাণ্ডা হয়ে ফিরে এসে গলিবাড়িতে ঘুমোবার চেষ্টা করার সঙ্গে এর খানিকটে তুলনা হয়।
ডেকে যে আরাম করে ঘুমোবে তারও উপায় নেই। ঘুমুলে হয়তো রাত দুটোর সময়। চারটে বাজতে না বাজতেই খালাসিরা ডেকে বালতি বালতি জল ঢেলে সেখানে যে বন্যা জাগিয়ে তোলে তার মাঝখানে মাছও ঘুমুতে পারে না। তখন যাবে কোথায়? কেবিনে ঢুকলে মনে হবে যেন রুটি বানানোর তন্দুরে-আভৃনে– তোমাকে রোস্ট করা হবে।
এই অবস্থা চলবে ভূমধ্যসাগর না পৌঁছনো পর্যন্ত।
তবে সান্ত্বনা এইটুকু যে, তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা ঠাণ্ডা-গরম সম্বন্ধে আমাদের মতো এতখানি সচেতন নয়। পল-পার্সি তাই যখন কেবিনের ভিতর নাক ফরফরাতো আমি তখন ডেকে বসে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে থাকতুম। তখন বই পড়তে কিংবা দেশে আত্মীয়-স্বজনকে চিঠি লিখতে পর্যন্ত ইচ্ছে করে না।
মাঝে মাঝে ডেক-চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়তুম।
একদিন কেন জানিনে হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই সামনে দেখি এক অপরূপ মূর্তি।
ভদ্রলোক কোট-পাতলুন-টাই পড়েছেন ঠিকই কিন্তু সে পাতলুন ঢিলে পাজামার চেয়েও বোধ করি চৌড়া, কোট নেবে এসেছে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত আর মান-মুনিয়া দাড়ির তলায় টাইটা আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে মাত্র। ওঁর বেশভূষায়—ভুল করলুম, ভূষা জাতীয় কোনও বালাই ওঁর বেশে ছিল না– অনেককিছুই দেখবার মতো ছিল কিন্তু প্রথম দর্শনেই আমি সব-কটা লক্ষ করিনি, পরে ক্রমে ক্রমে লক্ষ করে অনেক কিছুই শিখেছিলুম। উপস্থিত লক্ষ করলুম, তাঁর কোর্টে ব্রেস্ট পকেট বাদ দিয়েও আরও দু সারি ফালতো পকেট। তাই বোধহয়, কোটটা দৈর্ঘ্যে হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে।
একে তো এতদিন জাহাজে দেখিনি। ইনি ছিলেন কোথায়? তবে কি ইনি কলম্বোতে উঠেছেন। তা হলেও এ দুদিন ইনি ছিলেন কোথায়?
ভদ্রলোক সোজাসুজি বললেন, গুড নাইট।
বিলিতি কায়দা-কেতা যদিও আমি ভালো করে জানিনে তবু অন্তত এতটুকু জানি যে শুড় নাইট ওদেশে বিদায় নেবার অভিবাদন– আমরা যেরকম যে কোনও সময় বিদায় নিতে হলে বলি, তবে আসি। দেখা হওয়ামাত্রই কেউ যদি বলে, তবে এখন আসি তবে বুঝব লোকটা বাঙালি নয়। তাই তাঁর গুড নাইট থেকে অনুমান করলুম, ইনি যদিও বিলিতি বেশ ধারণ করেছেন তবু আসলে ভারতীয়।
আমি বললুম, বৈঠিয়ে।
আমার বাঁ দিকে পার্সির শূন্য ডেক-চেয়ার। তিনি তার-ই উপরে বসে পড়ে আমাকে বললেন, আমার নাম আবুল আসফিয়া নুর উদ্দিন মুহম্মদ আব্দুল করিম সিদ্দিকি।
আমার অজানাতেই আমি বলে ফেলেছিলুম, বাপস। কেন, সেকথা কি আর খুলে বলতে হবে? তবু বলি।
আমি মুসলমান। আমার নাম সৈয়দ মুজতবা আলী, আমার পিতার নাম সৈয়দ সিকন্দর আলী। আমার ঠাকুরদাদার নাম সৈয়দ মুশররফ আলী। ভারতীয় মুসলমানের নাম সচরাচর তিন শব্দেই শেষ হয়। তাই এর আড়াইগজি নামে যে আমি হকচকিয়ে যাব তাতে আর বিচিত্র কী?
বিবেচনা করি, তিনিও বিলক্ষণ জানতেন। কারণ চেয়ারে বসেই, তিনি তাঁর অন্যতম পকেট থেকে বের করলেন একটি সুন্দর সোনার কেস্। তার থেকে একটি ভিজিটিং কার্ড বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, নামটা একটু লম্বা। তাই এইটে নিন।
আমি তো আরও অবাক। ভিজিটিং কার্ডের কে হয় তা আমি জানি। কারণ, ভিজিটিং কার্ড সুন্দর সুচিকুণ। যাদের তা থাকে তাদের কেউ কেউ সেটা কেসে রাখেন। যেমন মনে কর, ইনশুওরেন্সের দালাল, খবরের কাগজের সংবাদদাতা কিংবা ভোটের ক্যানভাসার। কিন্তু ওঁদেরও তো কেস দেখেছি জর্মন সিলভারে তৈরি। ভিজিটিং কার্ডের সোনার কেস্ পূর্বে আমি কখনও দেখিনি।
সেই বিস্ময় সামলাতে না সামলাতেই তিনি আরেক পকেটে হাত চালিয়ে ডুবুরির মতো গভীর তল থেকে বের করলেন এক সোনার সিগারেট কে। ওরকম কে আমি শুধু স্বপ্নে আর সিনেমায় ফিলুস্টারদের হাতে দেখেছি, বাস্তবে এই প্রথম সাক্ষাৎ। ডেকের অপেক্ষাকৃত ক্ষীণ আলোতেও সেটা যা ঝলমল করে উঠল তার সঙ্গে তুলনা দেওয়া যায় শুধু স্যাকরা-বাড়ি থেকে সদ্য-আসা গয়নার সঙ্গে। কেসের এক কোণে আবার কী যেন এক নীল রঙের পাথর দিয়ে আল্পনা এঁকে ইংরেজি অক্ষরে ভদ্রলোকের সেই লম্বা নামের গুটি দু তিন আদ্যক্ষর। কেসটি আবার সাইজেও বিরাট। নিদেনপক্ষে ত্রিশটি সিগারেট ধরবে। আমার সামনে কেসটি খুলে ধরে আরেক পকেট থেকে বের করলেন একটি লাইটার। তার উপর জয়পুরি মিনার কাজ। হঠাৎ দেখলে মনে হয় জমিদারবাড়ির বড় গিন্নিমার কবচ কিংবা মাদুলি।
আমার মনের ভিতর দিয়ে হুড়-হুঁড় করে এক পলটন সেপাইয়ের মতো পঞ্চাশ সার প্রশ্ন চলে গেল।
তার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এরকম লজঝড় কোট-পাতলুনের ভিতর অতসব সুন্দর সুন্দর দামি দামি জিনিস লোকটা রেখেছে কেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন, এমন সব দামি মাল যার পকেটে আছে, সে ফার্স্ট ক্লাসে না গিয়ে, আমার মতো গরিবের সঙ্গে টুরিস্ট ক্লাসে যাচ্ছে কেন?
তৃতীয় প্রশ্ন– তা সে যাক গে। কারণ সবকটা প্রশ্নের পুরো ফর্দ এখানে দিতে গেলে আমার বাকি দিনটা কেটে যাবে। আর তোমাদেরও বুদ্ধিসুদ্ধি আছে, ভদ্রলোকের বর্ণনা শুনে তোমাদের মনেও সেইসব প্রশ্ন জাগবে যেগুলো আমার মনে জেগেছিল। তবে আর সেগুলো সবিস্তর বলি কেন?
কিন্তু প্রশ্নগুলোর উত্তর পাই কী প্রকারে?
তিনি বয়সে আমার চেয়ে ঢেড় বড়। তিনি যদি আলাপচারী আরম্ভ না করেন তবে আমি তাঁকে প্রশ্ন শুধাই কী করে? মুরুব্বিদের আদেশ, ছেলেবেলা থেকেই শুনেছি, বড়রা প্রশ্ন জিগ্যেস করবেন– ছোটরা উত্তর দেবে। সে আদেশ লজ্জন করব কী করে? বিশেষ করে বিদেশে, যেখানকার কায়দা-কেতা জানিনে। সেখানে দেশের গুরুজনদের আদেশ স্মরণ করা ভিন্ন অন্য পুঁজি আছে কি?
আধ ঘন্টাটাক কেটে গিয়েছে। ইতোমধ্যে আমি তার দু-দুটো সিগারেট পুড়িয়েছি। ফের যখন তৃতীয়টা বাড়িয়ে দিলেন তখন আমাকে বেশ দৃঢ়ভাবে না বলতে হল। সঙ্গে সঙ্গে সাহস সঞ্চয় করে শুধালুম, আপনি যাচ্ছেন কোথায়?
যেন প্রশ্ন শুনতে পাননি। আমিও চাপ দিলুম না।
আমি খানিকক্ষণ পরে বললুম, মাফ করবেন, আমি শুতে চললুম, গুড নাইট। বললেন, গুড নাইট।
কী জানি, লোকটা কেন কথা বলে না। বোধহয় জিভে বাত হয়েছে। কিংবা হয়তো ওর দেশে কথা বলাতেও রেশনের আইন চলে। যাক গে, কী হবে ভেবে।
পরদিন সকালবেলা পল-পার্সিকে নিয়ে আমি যখন সংসারের যাবতীয় কঠিন কঠিন প্রশ্ন এবং সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত, এমন সময় সেই ভদ্রলোক এসে আবার উপস্থিত। আমি ওদের সঙ্গে তার আলাপ করিয়ে দিতেই তিনি তার আরেকটা পকেটে হাত চালিয়ে বের করলেন একরাশ সুইস চকলেট, ইংরেজি টফি এবং মার্কিন চুইংগাম। পল-পার্সি গুটি কয়েক হাতে তুলে নিয়ে যতই বলে, আর না, আর না, তিনি কিন্তু বাড়ানো হাত গুটোন না। ওদিকে মুখে কোনও কথা নেই। শেষটায় বিষণ্ণ বদনে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন।
আমরা খানিকটে ইতি-উতি করে পুনরায় নিজেদের গল্পে ফিরে গেলুম। তখন দেখি, ভাষণে অরুচি হলেও তিনি শ্রবণে কিছুমাত্র পশ্চাদপদ নন। আমাদের গল্পের মাঝে মাঝে তাগমাফিক হু, হা দিব্যি বলে যেতে লাগলেন। তার পর আমাদের তিনজনকে কিছুতেই লাইম স্কোয়াশ খাওয়াতে না পেরে আস্তে আস্তে উঠে চলে গেলেন।
উঠে যাওয়া মাত্রই আমি পলকে শুধালুম, এ কীরকম চিড়িয়া হে?
পল বললে, কলম্বোতে উঠেছেন। পকেটভর্তি দুনিয়ার সব টুকিটাকি, মিষ্টি-মিঠাই। যার সঙ্গে দেখা তাকেই কিছু-না কিছু একটা অফার করেন। কিন্তু এ পর্যন্ত তাকে কথা বলতে শুনিনি।
আমি বললুম, জিগ্যেস করে দেখতে হবে তো।
পল বললে, উত্তর কি পাবেন?
বললুম, ঠিক বলেছ, কাল রাত্রে তো পাইনি।
এঁর সম্বন্ধে যে এত কথা বললুম, তার কারণ এর সঙ্গে পরে আমাদের খুব বন্ধুত্ব জমে। গিয়েছিল; সেকথা সময় এলে হবে।
০৫. কলম্বো থেকে আদন বন্দর
০৫.
পল বিজ্ঞকণ্ঠে বললে, কলম্বো থেকে আদন বন্দর ২০৮২ মাইল রাস্তা। জাহাজে ছদিন লাগে। মাঝখানে দ্বীপ-টীপ নেই, অন্তত আমার ম্যাপে নেই। তবে আদনের ঠিক আগেই সোকোত্রা দ্বীপ। সেটা হয়তো দেখতে পাব।
আমি বললুম, যদি রাত্রিবেলা ওই জায়গা দিয়ে যাই তবে দেখবে কী করে? আর দিনের বেলা হলেও অতখানি পাশ দিয়ে বোধহয় জাহাজ যাবে না। তার কারণ বড় বড় দ্বীপের আশপাশে বিস্তর ছোট ছোট দ্বীপও জলের তলায় মাথা ডুবিয়ে শুয়ে থাকে। এর কোনওটার সঙ্গে জাহাজ যদি ধাক্কা খায় তবে আর আমরা সামনের দিকে এগুব না– এগিয়ে যাব তলার দিকে।
এদিকে কথা বলে যাচ্ছি, ওদিকে আমার বার বার মনে হতে লাগল, সোকোত্রা নামটা যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। হঠাৎ আমার মাথার ভিতর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। আমার বাবার মাসি-মেসোমশাই তাঁদের দুই ছেলেকে নিয়ে গত শতকের শেষের দিকে মক্কায় হজ করতে গিয়েছিলেন এবং আমার খুব ছেলেবেলায় তাঁর কাছ থেকে সে ভ্রমণের অনেক গল্প আমি শুনেছিলুম। আমার এই দাদাটি ছিলেন গল্প বলার ভারি ওস্তাদ। রাত্রির রান্না না হওয়া পর্যন্ত তিনি আমাদের গল্প বলে দিব্যি জাগিয়ে রাখতে পারতেন এবং যেই চাচিরা খবর দিতেন, রান্না তৈরি, অমনি তিনি বেশ কায়দা করে গল্পটা শেষ করে দিতে পারতেন। আমরা টেরই পেতুম না, আমাদের সামনে তিনি একটা ন্যাজকাটা হনুমান রেখে চলে গেলেন। আমাদের মনে হত গল্পটা যেন একটা আস্ত ডানাকাটা পরী।
সেই দাদির মুখে শুনেছিলুম, সোকোত্রার কাছে এসে নাকি যাত্রীদের মুখ শুকিয়ে যেত। জলের স্রোতের তোড়ে আর পাগলা হাওয়ার থাবড়ায় জাহাজ নাকি হুড়মুড়িয়ে গিয়ে পড়ত কোনও একটা ডুবন্ত দ্বীপের ঘাড়ে আর হয়ে যেত হাজারো টুকরোয় খান খান। কেউ-বা জাহাজের তক্তা, কেউ-বা ডুবন্ত দ্বীপের শ্যাওলা মাখানো পাথর আঁকড়ে ধরে প্রাণপণ চিৎকার করত বাঁচাও, কিন্তু কে বাঁচায় কাকে, কোথায় আলো, কোথায় তীর। ক্রমে ক্রমে তাদের হাতের মুঠি শিথিল হয়ে আসত, একে একে জলের তলে লীন হয়ে যেত।
দাদি যেভাবে বর্ণনা দিয়ে যেতেন, তাতে আমি সবকিছু ভুলে দুশ্চিন্তায় আকুল হয়ে উঠতুম, দাদি বাঁচলেন না, দাদিও ডুবে গেলেন। মনেই হত না জলজ্যান্ত দাদি আমাকে কোলে বসিয়ে গল্প বলছেন। শেষটায় বলতেন, আমাদের জাহাজের কিছু হয়নি, এসব টেছিল অন্য জাহাজে। সে জাহাজে করে গিয়েছিলেন তোর বন্ধু ময়না মিয়ার ঠাকুর্দা। জানিস তো, তিনি আর ফেরেননি। খুদাতালা তাঁকে বেহেশতে নিয়ে গিয়েছেন। মক্কায় হজ্বের পথে কেউ যদি মারা যায় তবে তার আর পাপ-পুণ্যের বিচার হয় না, সে সোজা স্বর্গে চলে যায়।
দাদি এরকম গল্প বলে যেতেন অনেকক্ষণ ধরে আর একই গল্প বলতে পারতেন বহুবার। প্রতিবারেই মনে হত চেনা গল্প অচেনা রূপে দেখছি। কিংবা বলতে পার, দাদিবাড়ির রাঙা বউদিকে যেন কখনও দেখছি রাস-মণ্ডল শাড়িতে, কখনও বুলবুল-চশমে। (হায়, এসব সুন্দর সুন্দর শাড়ি আজ গেল কোথায়!)
দাদির গল্পের কথা আজ যখন ভাবি তখন মনে হয় দাদি তার বর্ণনাতে আরব্য উপন্যাসের সাহায্য বেশকিছু নিতেন। আরব্য উপন্যাসের রকম-বেরকমের গল্পের মধ্যে সমুদ্রযাত্রা, জাহাজডুবি, অচেনা দেশ, অজানা দ্বীপ সম্বন্ধে গল্প বিস্তর। সিন্দবাদ নাবিকের গল্প পড়ে মনে হয়, জলের পির বদর সাহেব যেন আইন বানিয়ে দিয়েছিলেন যে জাহাজ ডুববে সেটাতেই যেন সিন্দবাদ থাকে। বেচারি সিন্দবাদ!
আরব্য উপন্যাসে যে এত সমুদ্রযাত্রার গল্প, তার প্রধান কারণ, আরবরা এক কালে সমুদ্রের রাজা ছিল, আজ যেরকম মার্কিন-ইংরেজের জাহাজ পৃথিবীর বন্দরে বন্দরে দেখা যায়। তবে কারণ বুঝতে কিছুমাত্র বেগ পেতে হয় না। আরব দেশের সাড়ে তিন দিকে সমুদ্র, তাই আরবরা সমুদ্রকে ডরায় না, আমরা যেরকম পদ্মা-মেঘনাকে ডরাইনে, যদিও পশ্চিমারা গোয়ালন্দের পদ্মা দেখে হনুমানজির নাম স্মরণ করতে থাকে– বোধহয় লম্ফ দিয়ে পেরোবার জন্য। আরবদের পূর্বে ছিল রোমানরা বাদশা– আরবরা তাদের যুদ্ধে হারিয়ে ক্রমে ক্রমে তাদেরই মতো অবাধে অনায়াসে সমুদ্রে যাতায়াত আরম্ভ করল। ম্যাপে দেখতে পাবে, মক্কা সমুদ্র থেকে বেশি দূরে নয়। আরবরা তখন লাল দরিয়া পেরিয়ে মৌসুমি হাওয়ায় ভর করে ভারতবর্ষের সঙ্গে ব্যবসা জুড়ল।
এসব কথা ভাবছি এমন সময় হঠাৎ আবার সোকোত্রার কথা মনে পড়ে গেল। দাদিমার সোকোত্ৰা স্মরণ করিয়ে দিল গ্রিকদের দেওয়া সোকোত্রার নাম দিয়োকরিদেস, সঙ্গে সঙ্গে হুশ-হুঁশ করে মনে পড়ে গেল যে পণ্ডিতেরা বলেন এই দিয়োস্করিদে নাম এসেছে সংস্কৃত দ্বীপ-সুখাধার থেকে। আরবরা যখন এই দ্বীপে প্রথম নামল তখন ভারতীয় বোম্বেটেদের সঙ্গে এদের লাগল ঝগড়া। সে ঝগড়া কতদিন ধরে চলেছিল বলা শক্ত কারণ আমাদের সমাজপতিরা তখন সমুদ্রযাত্রার বিরুদ্ধে কড়া কড়া আইন জারি করতে আরম্ভ করেছেন। আমার মনে হয় এদেশ থেকে কোনও সাহায্য না পাওয়াতে এরা ক্রমে ক্রমে লোপ পেয়ে যায়, কিংবা ওই দেশের লোকের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে এক হয়ে যায় যেরকম শ্যাম, ইন্দোচীন ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে বহু শতাব্দীর আদান-প্রদানের পর একদিন আমাদের যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায়। খুব সম্ভব ওই সমুদ্রযাত্রা নিষেধ করারই ফলে। ভারতীয়েরা কিন্তু সোকোত্রায় তাদের একটি চিহ্ন রেখে গিয়েছে; সোকোত্রার গাই-গরু জাতে সিন্ধু দেশের। আশ্চর্য, সভ্যতার ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় কিন্তু তার পোষা গরু-ঘোড়া শতাব্দীর পর শতাব্দী বেঁচে থেকে তার প্রভুর কথা চক্ষুষ্মন ব্যক্তিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মোগল-পাঠানের রাজত্ব ভারতবর্ষ থেকে কবে লোপ পেয়ে গিয়েছে কিন্তু তাদের আনা গোলাপ ফুল আমাদের বাগানে আরও কত শত শত বৎসর রাজত্ব করবে কে জানে!
আমি চোখ বন্ধ করে আত্মচিন্তায় মগ্ন হলেই পল-পার্সি আস্তে আস্তে চেয়ার ছেড়ে অন্য কিছু একটায় লেগে যেত। আমি তাদের সন্ধানে বেরিয়ে দেখি তারা লাউঞ্জে বসে চিঠি লিখছে। আমাকে দেখে পার্সি শুধাল, জাহাজে যে ফরাসি ডাকটিকিট পাওয়া যায় তাই দিয়ে এ চিঠি চীন দেশে যাবে তো?
আমি বললুম, নিশ্চয়। এমনকি জিবুটি বন্দরের ডাকঘরেও যদি ছাড় তবু যাবে। কারণ জিবুটি বন্দর ফরাসিদের। কিন্তু যদি পোর্টসঈদ বন্দরে ছাড় তবে সে টিকিট মিশর দেশে বাতিল বলে চিঠিখানা যাবে বেয়ারিং পোস্টে।
কিন্তু যদি পোর্ট সঈদে পৌঁছে জাহাজের লেটার বকসে ছাড়ি?
তা হলে ঠিক।
তার পর বললুম, হু। তবে বন্দরে নেমে মিশরি ডাকটিকিট লাগানই ভালো।
কেন, স্যর?
আমি বললুম, বৎস, আমার বিলক্ষণ স্মরণ আছে, চীন দেশে তোমার একটি ছোট বোন রয়েছে। সে নিশ্চয়ই ডাকটিকিট জমায়। তুমি যদি বন্দরে বন্দরে ফরাসি টিকিট সাঁটো তার কী লাভ? মিশরি টিকিট পেলে কি সে খুশি হবে না? তা-ও আবার দাদার চিঠিতে!
পার্সি আবার ভ্যাচর ভ্যাচর আরম্ভ করলে চুলকাটা সমস্যার সমাধান যখন আমি করে দিয়েছিলুম ঠিক সেইরকম- আমার সঙ্গে দেখা না হলে
আমি বললুম, ব্যস, ব্যস। আর শোনো, স্ট্যাম্প লাগাবার সময়, এক পয়সা, দু পয়সা, এক আনা, দুপয়সা করে করে চৌদ্দ পয়সার টিকিট লাগাবে–দুম করে শুধু একটা চৌদ্দ পয়সার টিকিট লাগিয়ো না। বোন তা হলে এক ধাক্কাতেই অনেকগুলি টিকিট পেয়ে যাবে।
ততক্ষণে পল এসে আমার সঙ্গ নিয়েছে। আস্তে আস্তে গুধাল, সোকোত্রা দ্বীপের কথা ওঠাতে আপনি কী ভাবছিলেন?
আমি বললুম, অনেক কিছু। এবং তার খানিকটে তাকে শুনিয়ে দিলুম।
পল দেখেছি পার্সির মতো সমস্তক্ষণ এটা-ওটা নিয়ে মেতে থাকে না। মাঝে মাঝে জাহাজের এক কোণে বসে বই-টই পড়ে। তাই খানিকক্ষণ চুপ করে আমার কথাগুলো হজম করে নিয়ে বললে, বিষয়টা সত্যি ভারি ইনট্রেসটিঙ। সমুদ্রে সর্বপ্রথম কে আধিপত্য করলে, তার পর কে, তারাই-বা সেটা হারাল কেন, আজ যে মার্কিন আর ইংরেজ আধিপত্য করছে সেটাই-বা আর কতদিন থাকবে এবং তার পর আধিপত্য পাবে কে?
আমি একটু ভেবে বললুম, বোধহয়, আফ্রিকার নিগ্রোরা। ফিনিশিয়ান, গ্রিক, রোমান, ভারতীয়, চীনা, আরব, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ ইত্যাদি যাবতীয় জাতই তো পালা করে রাজত্ব করলে একমাত্র ওরাই বাদ গেছে। এখন বোধহয় ওদের পালা। আর ম্যাপে দেখছ তো, কী বিরাট মহাদেশ, ওতে কোটি কোটি লম্বা-চওড়া স্বাস্থ্যবান স্ত্রী-পুরুষ গমগম করছে।
পল বললে, কিন্তু ওদের বুদ্ধিসুদ্ধি?
আমি বললুম, সে তো দুই পুরুষের কথা। লেগে গেলে একশো বছরের ভিতর একটা জাত অন্য সবকটা জাতকে হারিয়ে দিতে পারে। বরঞ্চ পুরনো সভ্য জাত যারা আধমরা হয়ে গিয়েছে, তাদের নতুন করে বলিষ্ঠ প্রাণবন্ত করে রাজার আসনে বসানো কঠিন। একবার ছাঁচে ঢালাই করে যে মাল তৈরি করা হয়েছে তাকে ফের পিটে-টুকে নতুন আকার দেওয়া কঠিন– সেই তো হচ্ছে আজকের দিনের চীনা, ভারতীয় এবং আরও মেলা প্রাচীন জাতের নতুন সমস্যা।
পল জিগ্যেস করলে, ভারতীয়েরাও এককালে সমুদ্রে রাজত্ব করেছে নাকি?
আমি বললুম, সেকথা আজ প্রায় সবাই ভুলে গিয়েছে। কিন্তু সে জন্য তাদের দোষ দেওয়া অনুচিত। কারণ, ভারতীয়েরা নিজেরাই সে ইতিহাসের সন্ধান রাখে না। অথচ আমার যতদূর জানা, তাতে তারা লাল দরিয়া থেকে চীনা সমুদ্র পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে, শ্যাম, ইন্দোচীন, ইন্দোনেশিয়াতে রাজত্বও করেছে। তার পর একদিন আমাদের সমাজপতিরা সমুদ্রযাত্রা বারণ করে দিলেন খুব সম্ভব আমাদের সাম্রাজ্য বিস্তার তারা পছন্দ করেননি। তাই হয়তো তারা বলতে চেয়েছিলেন, যে দেশ জয় করছ তারই আর পাঁচজনের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যাও, আপন দেশে ফিরে আসার কোনও প্রয়োজন নেই।
পল বললে, আমার জীবনের এই ষোল বৎসর কাটল চীনে কিন্তু ভারতের সঙ্গে চীনের কখনও কোনও যোগ হয়েছিল বলে শুনিনি। শুধু শুনেছি বৌদ্ধধর্ম ভারত থেকে এসেছিল। কিন্তু সে তো কটমটে ব্যাপার!
আমি বললুম, অতিশয়। ও-পাড়া মাড়িয়ো না। কিন্তু চীন-ভারতের মধ্যে একবার একটি ভারি চমৎকার মজাদার দোস্তি হয়েছিল। শুনবে?
পল বললে, তা আর বলতে! কিন্তু পার্সিটা গেল কোথায়? কুকুরছানার মতো যেন সমস্তক্ষণ নিজের ল্যাজ খুঁজে বেড়ায়। ওরে, ও পার্সি!
.
জিরাফ কাহিনী
দিল্লিতে যখন পাঠান-মোগল রাজত্ব করত তখন সামান্যতম সুযোগ পেলেই বাঙলা দেশ স্বাধীন হয়ে যাবার চেষ্টা করত। বাঙলার প্রধান সুবিধে এই যে, সেখানে নদী-নালা বিল-হাওর বিস্তর এবং পাঠান-মোগলের আপন পিতৃভূমি কিংবা দিল্লিতে ওসব জিনিস নেই বলেই তারা যখনই বিদ্রোহ দমন করতে এসে বাঙলার জল দেখত তখনই তাদের মুখে জল যেত শুকিয়ে। দেশটা পিছলে, অভ্যাস না থাকলে দাঁড়ানো কঠিন।
এইরকম একটা সুযোগ পেয়ে বাঙলার এক শাসনকর্তা স্বাধীন হয়ে রাজা হয়ে যান। রাজাটি একটু খামখেয়ালি ছিলেন। তা না হলে কোথায় ইরান আর কোথায় বাঙলা দেশ। তিনি সেখানে দূত পাঠালেন বিস্তর দামি দামি সওগাত সঙ্গে নিয়ে ইরানের সবচেয়ে সেরা কবি হাফিজকে বাঙলা দেশে নিমন্ত্রণ করার জন্য। চিঠিতে লিখলেন, হে কবি, তোমার সুমধুর তথা উদাত্ত কণ্ঠে তামাম ইরান দেশ ভরে গিয়েছে। ইরান ক্ষুদ্র দেশ, তোমার কণ্ঠস্কৃর্তির জন্য সেখানে আর স্থান নেই। পক্ষান্তরে ভারতবর্ষ বিরাট দেশ, এখানে এস, তোমার কণ্ঠস্বর এখানে প্রচুর জায়গা পাবে। তার সরল অর্থ, ইরানে আর কটা লোক তোমার সত্যকার কদর করতে পারবে এ-দেশের লোকসংখ্যা প্রচুর। এইখানে চলে এস।
হাফিজের তখন বয়স হয়েছে। তার বুড়ো হাড়-কখানা তখন আর দীর্ঘ ভ্রমণ আর দীর্ঘতর প্রবাসের জন্য দেশ ছাড়তে নারাজ। তাই কবি একটি সুন্দর কবিতা লিখে না আসতে পারার জন্য বিস্তর দুঃখ প্রকাশ করলেন।
বাঙলা দেশের সরকারি দলিল-দস্তাবেজে এ ঘটনার কোনও উল্লেখ নাই। এর ইতিহাস পাওয়া গিয়াছে ইরানের খাতাপত্র থেকে।(১)
তার পরের রাজার দৃষ্টি গেল সেই সুদূর চীনদেশের দিকে। কিন্তু চীনসম্রাটকে তো আর বাংলা দেশে নিমন্ত্রণ করা যায় না। কাজেই রাজদূতকে বহু উত্তম উপঢৌকন দিয়ে চীনের সম্রাটকে বাঙলার রাজার আনন্দ-অভিবাদন জানালেন।
চীনসম্রাট সুদূর বাঙলা দেশের রাজার সৌজন্য-দ্রতার পরিচয় পেয়ে পরম আপ্যায়িত হলেন। চীন বিত্তশালী দেশ। প্রতিদানে পাঠালেন আরও বেশি মূল্যবান উপঢৌকন। সে রাজা কিন্তু ততদিনে রাজার দেশে চলে গিয়েছেন।
বাংলার রাজা তখন ভাবলেন, চীনের সম্রাটকে আমি কী দিতে পারি যা তার নেই। রাজদূতকে মনের কথা খুলে তার উপদেশ চাইলেন। রাজদূতটি ছিলেন অতিশয় বিচক্ষণ লোক। তিনি যখন চীনে ছিলেন তখন চীনদেশের আচার-ব্যবহার বিশ্বাস-অবিশ্বাস পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসন্ধান করেছিলেন। বললেন, চীনের বহু লোকের বিশ্বাস, গাছের চেয়ে উঁচু মাথাওলা যে এক পয়মন্ত প্রাণী আছে সে যদি কখনও চীনদেশে আসে তবে সে দেশের শস্য তারই মাথার মতো উঁচু হবে।
রাজা শুধালেন, কী সে প্রাণী?
রাজদূত বললেন, জিরাফ। আফ্রিকাতে পাওয়া যায়।
রাজা বললেন, আনাও আফ্রিকা থেকে।
যেন চাট্টিখানি কথা! কোথায় বাঙলা দেশ, আর কোথায় আফ্রিকা! আজ যে এই বিরাট বিরাট কলের জাহাজ দুনিয়ার সর্বত্র আনাগোনা করে তারই একটাতে জিরাফ পোরা কী সহজ! তখনকার দিনের পালের জাহাজে আফ্রিকা থেকে বাঙলা দেশ, সেখান থেকে আবার চীন–ক মাস কিংবা ক বছর লাগবে কে জানে? ততদিন তার জন্য ওই অকূল দরিয়ায় ঘাস পাতা পাবে কোথায় দেখতে পাচ্ছি এই কলের জাহাজেই আমাদের শাকশবজি স্যালাড় খেতে দেয় অল্প– তার অন্যান্য তদারকি কি সহজ?
তখনকার দিনে আরব কারবারীরা আফ্রিকা, সোকোত্রা, সিংহল হয়ে বাঙলা দেশে ব্যবসা করতে যেত। রাজা হুকুম দিলেন, জিরাফ নিয়ে এস।
জিরাফ এল। কী খেয়ে এল, কতদিনে এল, কিছুই বলতে পারব না। রাজা জিরাফ দেখে ভারি খুশি। হুকুম দিলেন, চীনসম্রাটকে ভেট দিয়ে এস।
সেই চীন! জাহাজে করে! কতদিন লাগল কে জানে!
চীনসম্রাট সংবাদ পেয়ে যে কতখানি খুশি হয়েছিলেন তার খানিকটে কল্পনা করা যায়। তিনি হুকুম দিলেন, প্রাণীর জন্য খুব উঁচু করে আস্তাবল বানাও।
বলা তো যায় না তার মুণ্ডুটা মেঘে ঠেকবে, না চাদে ঠোক্কর লাগাবে। দীর্ঘ ভ্রমণের পর জিরাফ যখন জিরিয়ে জুরিয়ে তৈরি তখন শুভদিন শুভক্ষণ দেখে, চীনসম্রাট পাত্র-অমাত্য-সভাসদসহ শোভাযাত্রা করে জিরাফ দর্শনে বেরুলেন। সঙ্গে নিলেন, বিশেষ করে, রাজচিত্রকর এবং সভাকবি।
সম্রাট জিরাফ দেখে গভীর আনন্দ লাভ করলেন। সভাসদ ধন্য ধন্য করলেন। আপামর জনসাধারণ গভীরতর সন্তোষ লাভ করল–তাদের গুরুজন বলেছিলেন যে এরকম অদ্ভুত প্রাণী পৃথিবীতে আছে, এবং সে একদিন চীনদেশে আসবে, সেটা কিছু অন্যায় বলেননি। যারা সন্দেহ করত তাদের মুণ্ডুগুলো এখন টেনে টেনে ওই জিরাফের মুণ্ডুটার মতো উঁচু করে দেওয়া উচিত।
সম্রাট চিত্রকরকে আদেশ দিলেন, এই শুভদিবস চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য তুমি এই জিরাফের একটি উত্তম চিত্র অঙ্কন কর।
ছবি আঁকা হল।
সম্রাট কবিকে আদেশ করলেন, তুমি এই শুভ অনুষ্ঠানের বর্ণনা ছন্দে বেঁধে ছবিতে লিখে রাখ।
তাই করা হল।
গল্প শেষ করে বললুম, সে ছবির প্রিন্ট আমি কাগজে দেখেছি। পল শুধাল, স্যর, আপনি কী চীনা ভাষা পড়তে পারেন?
আমি বললুম, আদপেই না। আমার এক বন্ধু চীনা শিখেছে সে ভাষাতে বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থ পড়ার জন্য। জান তো, আমাদের বহু শাস্ত্র এদেশে বৌদ্ধধর্ম লোপ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লুপ্ত হয়ে যায়, কিন্তু চীনা অনুবাদে এখনও বেঁচে আছে। আমার বন্ধু বৌদ্ধশাস্ত্র খুঁজতে খুঁজতে এই অদ্ভুত কাহিনীর সাক্ষাৎ পায়। তারই বাঙলা অনুবাদ করে, ছবিসুদ্ধ সেটা বাঙলা কাগজে ছাপায়। তা না হলে বাঙলা দেশের লোক কখনও এ কাহিনী জানতে পারত না, কারণ বাঙলা দেশে এ সম্বন্ধে কোনও ইতিহাস বা দলিলপত্র নেই।
পার্সি বললে, কিন্তু স্যর এটা তো ইতিহাসের মতো শোনাল না! এ যে গল্পকে ছাড়িয়ে যায়।
আমি বললুম, কেন বৎস, তোমার মাতৃভাষাতেই তো রয়েছে, টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান, ফিশ–সত্য ঘটনা গল্পের চেয়েও চমকপ্রদ।
এবং আমাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস যে ঘটনার বর্ণনা মানুষকে গল্পের চেয়েও বেশি সজাগ করে না তুলতে পারে, সে ঘটনার কোনও ঐতিহাসিক মূল্য নেই। কিংবা বলব, যে লোক ঘটনাটার বর্ণনা দিয়েছে সে সত্যকার ঐতিহাসিক নয়। আমার দেশে এরকম কাঠখোট্টা ঐতিহাসিকই বেশি।
.
০৬.
কলরব, চিৎকার, তারস্বরে আর্তনাদ! কী হল কী হয়েছে। তবে কী জাহাজে বোম্বেটে পড়েছে বায়স্কোপে যেরকম দেখি, বোম্বেটেরা দু হাতে দুই পিস্তল, দু পাটি দাতে ছোরা কামড়ে ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজ আক্রমণ করে। তার পর হঠাৎ কানের পর্দা ফাটিয়ে এক ভয়ঙ্কর প্রলয়ঙ্কর বিস্ফোরণ- বারুদ গুদামে আগুন লেগে সেটা ফেটে গিয়েছে। তারই আগুন জাহাজের দড়াদড়ি পাল মাস্তুলে লেগে গিয়ে সমস্ত জাহাজ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে।
নাহ! স্বপ্ন। বাঁচলুম। সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে গিয়েছে। চোখ মেলতে দেখি, কেবিনের সব-কটা আলো জ্বলছে। আর সামনে দাঁড়িয়ে পল আর পার্সি। পল দাঁড়িয়ে আছে সত্যি কিন্তু পার্সিটা জুলু না হটেনটট কী যেন এক বিকট আফ্রিকান নৃত্য জুড়েছে–আফ্রিকানই হবে, কারণ ওই মহাদেশেরই গা ঘেঁষে তো এখন আমরা যাচ্ছি।
তা আফ্রিকার হটেনটটীয় মার্তণ্ড-তাত্ব নৃত্যই হোক আর ইয়োরোপীয় মাসুকা কিংবা ল্যামবেথ-উয়োক্-ই হোক আমি অবশ্য এ দুটোর মধ্যে কোনও পার্থক্যই দেখতে পাইনে, সঙ্গীতে তো আদৌ না– পার্সি এ সময়ে আমার কেবিনে এসে বি-নোটিশে নাচ জুড়বে কেন?
নাহ, নাচ নয়। বেচারি উত্তেজনায় তিড়িংবিড়িং করছে আর যে কাতর রোদন জানাচ্ছে সেটার সামারি করলে দাঁড়ায়;
হায়, হায়, সবকিছু সাড়ে সর্বনাশ হয়ে গেল, স্যর! আপনি এখনও অকাতরে নাক ডাকাচ্ছেন। আমার জীবন বিফল হল, পলের জীবনও বৃথায় গেল। জাহাজ রাতারাতি ডুব সাঁতার কেটে জিবুটি বন্দরে পৌঁছে গিয়েছে। সবাই জামাকাপড় পরে, ব্রেকফাস্ট খেয়ে পারে নামবার জন্য তৈরি, আর আপনি– হায়, হায়!
(এই বইখানার যদি ফিল হয় তবে এ স্থলে অশ্রুবর্ষণ ও ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস)
আমি চোখ বন্ধ করলুম দেখে পার্সি এবার ডুকরে কেঁদে উঠল।
আমি শান্ত কণ্ঠে শুধালুম, জাহাজ যদি জিবুটি পৌঁছে গিয়ে থাকে তবে এখনও এঞ্জিনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি কেন?
পার্সি অসহিষ্ণুতা চাপাবার চেষ্টা করে বললে, এঞ্জিন বন্ধ করা, না করা তো এক মিনিটের ব্যাপার।
আমি বললুম, নৌভ্রমণে আমার পূর্ব-অভিজ্ঞতা বলে, এঞ্জিন বন্ধ হওয়ার পরও জাহাজ থেকে নামতে নামতে ঘণ্টা দুয়েক কেটে যায়।
পল, এই প্রথম মুখ খুললে; বললে, বন্দর যে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
আমি বললুম, দার্জিলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্খর চুড়োটা স্পষ্ট দেখা যায়, তাই বলে কি সেখানে দশ মিনিটে পৌঁছানো যায়?
তার পর বললুম, কিন্তু এসব কুতর্ক। আমি হাতে-নাতে আমার বক্তব্য প্রমাণ করে দিচ্ছি।
তার পর অতি ধীরেসুস্থে দাড়ি কামাতে আরম্ভ করলুম। পল আমার কথা শুনে অনেকখানি আশ্বস্ত কিন্তু পার্সি তখনও ব্যস্তসমস্ত। আমাকে তাড়া লাগাতে গিয়ে দাড়ি কামানো বুরুশটা এগিয়ে দিতে গিয়ে তুলে ধরে দাঁতের বুরুশ ওইটে দিয়ে গাল ঘষলে মুখপোড়া হনুমান হতে কতক্ষণ টাই ভেবে সামনে ধরে ড্রেসিংগাউনের কোমর বন্ধটা। তার পর চা-রুটি, মাখন-আণ্ডাতে অপূর্ব এক ঘ্যাঁট বানিয়ে আমার সামনে ধরে চতুর্দিকে ঘুরপাক খেতে লাগল– বাড়িতে জিনিসপত্র বাঁধাই-দাই করার সময় পাপিটা যেরকম এর পা ওর পা-র ভিতর দিয়ে ঘুরপাক খায় এবং বাড়িসুদ্ধ লোককে চটিয়ে তোলে।
শেষটায় বেগতিক দেখে আমি একটু তাড়াহুড়ো করে সদলবলে ডেকে এলুম।
উপরে তখন আর সবাই অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে তাস, পাশা, গালগল্পে ফিরে গিয়েছে।
পল চোখে দুরবিন লাগিয়ে বললে, কই, স্যর বন্দর কোথায়? আমি তো দেখতে পাচ্ছি, ধূ-ধূ করছে মরুভূমি আর টিনের বাক্সের মতো কয়েক সার একঘেয়ে বাড়ি।
আমি বললুম, এরই নাম জিবুটি বন্দর।
ওই মরুভূমিতে দেখবার মতো আছে কী?
কিচ্ছু না। তবে কী জানো, ভিদেশে পরদেশের ভিতর দিয়ে যাবার সময় অত-শত বাছবিচার করতে নেই– বিশেষত এই অল্প বয়সে। চিড়িয়াখানায় যখন ঢুকেছ, তখন বাঘ সিঙি দেবার সঙ্গে সঙ্গে খাটাশটাও দেখে নেওয়াই ভালো। আর কে জানে, কোনও মোড় ঘুরতে কোনও এক অপ্রত্যাশিত জিনিস বা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হবে না? মোকামে পৌঁছানোর পর না হয় জমা-খরচ করা যাবে, কোনটা ভালো লাগল আর কোনটা লাগল না।
জাহাজ থেকে তড়তড় করে সিঁড়ি ভেঙে ডাঙায় নামা যায় পৃথিবীর ভালো ভালো বন্দরেই। এখানে তাই পারে যেতে হল মোটরলঞ্চ করে। জিবুটির চেয়েও নিকৃষ্ট বন্দর পৃথিবীতে হয়তো আছে কিন্তু আমার দেখার মধ্যে ওইটেই সবচেয়ে অপ্রিয়দর্শন ও বৈচিত্র্যহীন বন্দর। মরুভূমির প্রত্যন্ত ভূমিতে বন্দরটি গড়ে তোলা হয়েছে একমাত্র রাজ্য বিস্তারের লোভে। এবং এ মরুভূমিকে কোনও প্রকারের শ্যামলিমা দেওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব জেনেই কেউ কোনওদিন কণামাত্র চেষ্টা করেননি একে একটুখানি আরামদায়ক করার।
ডাঙা থেকে সোজা চলে গিয়েছে একটা ধুলোয় ভর্তি রাস্তা বন্দরের চৌক বা ঠিক মাঝখানে। তার পর সেখান থেকে এদিকে-ওদিকে দু-চারটে রাস্তা গিয়েছে বটে কিন্তু বড় রাস্তাটা দেখার পর ওসব গলিতে ঢোকার প্রবৃত্তি সুস্থ লোকের হওয়ার কথা নয়। বড় রাস্তার দু দিকে সাদা কাম করা বাড়িগুলো এমনি মুখ গুমসো করে দাঁড়িয়ে আছে যে বাড়ির বাসিন্দারাও বোধ করি এসব বাড়িতে ঢোকার সময় দোরের গোড়ায় দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ শুকনো ঢোক গেলে কিংবা বাঁ হাত দিয়ে ঘাড়ের ডান দিকটা চুলকে নেয়। ছোট গলির মুখে পঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখি, মাটির তৈরি দেয়াল-ছাদের ছোট ছোট ঘর, না, ঘর নয়, গহ্বর কিংবা গুহাও বলতে পার। বৃষ্টি এদেশে এতই ছিটেফোঁটা হয় যে, ছাত গলে গিয়ে পড়ে যাবার সম্ভাবনা নেই। আর থাকলেই-বা কী, এদেশে তো আর ঘাস-পাতা গজায় না যে তাই দিয়ে চাল বানাবে?
এরই ভিতরে মানুষ থাকে, মা ছেলেকে ভালোবাসে, ভাই ভাইকে স্নেহ করে, জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ সবই হয়!
কিন্তু আমি এত আশ্চর্য হচ্ছি কেন? আমি কি কখনও গলির ঘিঞ্জি বস্তির ভিতর ঢুকিনি কলকাতায়। সেখানে দেখিনি কী দৈন্য, কী দুর্দশা! তবে আজ এখানে আশ্চর্য হচ্ছি কেন? বোধহয় বিদেশে এ জিনিস প্রত্যাশা করিনি বলে কিংবা দেশের দৈন্য দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি বলে বিদেশে তার অন্য রূপ দেখে চমকে উঠলুম।
এইখানেই মহামানব এবং হীনপ্রাণে পার্থক্য! মহাপুরুষরা দৈন্য দেখে কখনও অভ্যস্ত হন না। কখনও বলেন না, এ তো সর্বত্রই হচ্ছে, অহরহ হচ্ছে ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি। দৈন্য তাদের সবসময়ই গভীর পীড়া দেয় যদিও আমরা অনেক সময় তাদের চেহারা দেখে সেটা বুঝতে পারিনে। তার পর একদিন তারা সুযোগ পান, যে সুযোগের প্রতীক্ষায় তারা বছরের পর বছর প্রহর গুনছিলেন, কিংবা যে সুযোগ তারা ক্ষণে ক্ষণে দিনে দিনে আপন হাতে গড়ে তুলছিলেন, এবং এরই বর্ণনা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
অখ্যাত অজ্ঞাত রহি দীর্ঘকাল হে রাজবৈরাগী, গিরিদরী-তলে
বর্ষার নিঝর যথা শৈল বিদারিয়া উঠে জাগি পরিপূর্ণ বলে
সেই মত বাহিরিলে; বিশ্বলোক ভাবিল বিস্ময়ে যাহার পতাকা
অম্বর আচ্ছন্ন করে এত কাল এত ক্ষুদ্র হয়ে কোথা ছিল ঢাকা।
তাই যখন হঠাৎ একদিন এক অরবিন্দ ঘোষ, এক চিত্তরঞ্জন দাশ এসে আমাদের মাঝখানে দেখা দেন তখন আমাদের আর বিস্ময়ের অবধি থাকে না। আজন্ম, আশৈশব, অনটনমুক্ত বিলাসে জীবনযাপন করে হঠাৎ একদিন তারা সবকিছু বিসর্জন করে গিয়ে দাঁড়ান গরিব দুঃখী, আতুর অভাজনের মাঝখানে। যে দৈন্য দেখে ভিতরে ভিতরে গভীর বেদনা পেতেন, সেই দৈন্য ঘুচাতে গিয়ে তারা তখন পান গভীরতর বেদনা। কিন্তু সত্যের জয় শেষ পর্যন্ত হবেই হবে।
–তাই উঠে বাজি
জয়শঙ্খ তার? তোমার দক্ষিণ করে।
তাই কি দিলেন আজি কঠোর আদরে
দুঃখের দারুণ দীপ আলোক যাহার
জ্বলিয়াছে বিদ্ধ করি দেশের আঁধার
ধ্রুব তারকার মতো। জয় তব জয়।
কিন্তু এতসব কথা তোমাদের শোনাচ্ছি কেন? তার কারণ গত রাত্রে জাহাজে বসে আফ্রিকা মহাদেশ এবং বিশেষ করে যে সোমালি দেশের ভিতর জিবুটি বন্দর অবস্থিত তারই কথা ভাবছিলুম বলে। এবং সেই সোমালিদের দুঃখ-দৈন্য ঘোচাবার জন্য যে একটি লোক বিদেশি শক্রদের সঙ্গে প্রাণ দিয়ে লড়েছিল তার কথা বার বার মনে পড়ছিল বলে।
ইয়োরোপীয় বর্বরতার চূড়ান্ত বিকাশ দেখতে হলে পড়তে হয় আফ্রিকার ইতিহাস ইংরেজশাসিত ভারতের ইতিহাস তার তুলনায় নগণ্য।
পর্তুগিজ, ইংরেজ, জর্মন, ফরাসি, বেলজিয়াম– কত বলব। ইয়োরোপীয় বহু জাত, কমজাত, বজ্জাত এই আফ্রিকায় একদিন এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সাম্রাজ্য বিস্তারের বর্বর পাশবিক ক্ষুধা নিয়ে, শকুনের পাল যেরকম মরা গরুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভুল বললুম, শকুনিদের ওপর অবিচার করা হল, কারণ তারা তো জ্যান্ত পশুর উপর কখনও ঝাঁপ দেয় না। এই ইয়োরোপীয়রা এসে ঘেঁকে ধরল সোমালি, নিগ্রো, বান্টু, হটেনটটদের। তাদের হাতে-পায়ে বেঁধে মুরগিলাদাই কঁকার মতো জাহাজভর্তি করে নিয়ে গেল আমেরিকায়। কত লক্ষ নিগ্রো দাস যে তখন অসহ্য যন্ত্রণায় মারা গেল তার নিদারুণ করুণ বর্ণনা পাবে আঙ্কল টম ক্যাবিন পুস্তকে বইখানা পড়ে দেখ। ইংরেজি ভালো বুঝতে না পারলে বাংলা অনুবাদ টম্ কাকার কুটির পড়লেই হবে– আমি ছেলেবেলায় বাংলাতেই পড়েছিলুম।
আর আফ্রিকার ভিতরে যা করল তার ইতিহাস আজও লেখা হয়নি। বিখ্যাত ফরাসি লেখক আঁদ্রে জিদ কঙ্গো সম্বন্ধে একখানা বই লিখে এমনই বিপদগ্রস্ত হয়েছিলেন যে, তার মতো দুঃসাহসী না হলে ওই সম্বন্ধে কেউ আর উচ্চবাচ্য করতে সাহস পায় না। আর লিখলেই-বা কী, প্রকাশক পাবে না। প্রকাশক পেলেই-বা কী? কাগজে কাগজে বেরুবে তার বিরুদ্ধে রূঢ় মন্তব্য, অশ্লীল সমালোচনা। তখন আর কোনও পুস্তকবিক্রেতা তোমার বই তার দোকানে রাখবে না। তবু জেনে রাখা ভালো, এমন মহাজনও আছেন যারা এসব বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও বই লেখেন, ছাপান, প্রকাশ করেন এবং লোকে সেসব পড়ে বলে দেশে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সৃষ্টি হয়।
সোমালি দেশের ওপর রাজত্ব করতে এসেছিল বিস্তর জাত : তাদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত টিকে রইল ফরাসি, ইংরেজ ও ইতালীয়।
ব্রিটিশ-সোমালি দেশে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন মুহম্মদ বিন আবদুল্লাহ ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে। নিরস্ত্র কিংবা ভাঙাচোরা বন্দুক আর তীর-ধনুক সজ্জিত সোমালিরা তার চতুর্দিকে এসে জড় হল অসীম সাহস নিয়ে–ইয়োরোপীয় কামান মেশিনগানের বিপক্ষে। এদিকে ইতালীয় এবং ব্রিটিশে সোমালি দেশের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে মারামারি, ওদিকে কিন্তু দুই দলই এক হয়ে গেলেন মোল্লা মুহম্মদের স্বাধীনতা প্রচেষ্টাকে সমূলে উৎপাটিত করার জন্য।
দুই পক্ষেরই বিস্তর হার-জিত হল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মোল্লাই ইয়োরোপীয়দের খেদিয়ে খেদিয়ে লাল দরিয়ার পার পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিলেন। ইংরেজ তখন সোমালিদের ওপর রাজত্ব করার আশা ছেড়ে দিয়ে সমুদ্রপারে দুর্গ বানিয়ে তারই ভিতর বসে রইল লাল দরিয়ার বন্দরগুলো বাঁচিয়ে রাখবার জন্য।
সারা সোমালি দেশে জয়ধ্বনি জেগে উঠল– সোমালি স্বাধীন! তখন ইংরেজ তাকে নাম দিল, ম্যাড মোল্লা অর্থাৎ পাগলা মোল্লা, আমাদের গাঁধীকে যেরকম একদিন নাম দিয়েছেন, নেকেড ফকির অর্থাৎ উলঙ্গ ফকির। হেরে যাওয়ার পর মুখ ভ্যাংচানো ছাড়া করবার কী থাকে, বল?
কিন্তু হায়, খুব বেশি বৎসর গেল না। ১৯১৪-১৮-এর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইয়োরোপীয়রা অ্যারোপ্লেন থেকে বোমা মেরে মানুষকে কাবু করার কৌশল শিখে গিয়েছে। তাই দিয়ে যখন আবার তারা হানা দিলে তখন মোল্লাকে সে সময়কার মতো পরাজয় স্বীকার করে আশ্রয় গ্রহণ করতে হল ভিন্ দেশে।
মোল্লা সেই অনাদৃত অবহেলায় আবার সাধনা করতে লাগলেন স্বাধীনতা জয়ের নতুন সন্ধানে। কিন্তু হায়, দীর্ঘ বাইশ বৎসরের কঠিন যুদ্ধ, নিদারুণ কৃসাধনে তাঁর স্বাস্থ্য তখন ভেঙে গিয়েছে। শেষ পরাজয়ের এক বৎসর পর, যে ভগবানের নাম স্মরণ করে বাইশ বৎসর পূর্বে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে নেমেছিলেন তাঁরই নাম স্মরণ করে সেই-লোকে চলে গেলেন যেখানে খুব সম্ভব সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব নেই।
এই যে জিবুটি বন্দরে বসে বসে চোখের সামনে তাগড়া লম্বা জোয়ান সোমালিদের দেখছি, তারাও নাকি তখন চিৎকার করে কেঁদে উঠেছে।
বীরের কাহিনী থেকে আমরা উৎসাহ সঞ্চয় করব, তা না হলে আমি এ দুঃখের কাহিনী তুললুম কেন? তার কারণ বুঝিয়ে বলার পূর্বে একটি কথা আমি বেশ জোর দিয়ে বলতে চাই।
ফরাসিরা বড় খারাপ, ইংরেজ চোরের জাত এরকম কথার কোনও অর্থ হয় না। ভারতবর্ষে বিস্তর পকেটমার আছে, তাই বলে কেউ যদি গাল দেয় ভারতবাসীরা পকেটমার তা হলে অধর্মের কথা হয়। ইংরেজ জাত অত্যাচারী একথা বলার কোনও অর্থ হয় না।
তাই যখন অধর্ম অরাজকতা দেখি তখন সংযম বর্জন করে তদণ্ডেই অস্ত্রধারণ করা অনুচিত। বহু জাত বহু বার করে দেখেছে, কোনও ফল হয়নি; হিংসা আর রক্তপাত শুধু বেড়েই গিয়েছে।
তাই মহাত্মাজি অহিংসার বাণী প্রচার করেছেন। অহিংসা দিয়ে হিংসা জয় করতে হবে। এর চেয়ে মহৎ শিক্ষা আর কিছু নেই। ভারতবর্ষ যদি তাই দিয়ে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ-সংগ্রাম, লুণ্ঠন-শোষণ রুদ্ধ করতে পারে তবে পৃথিবীর ইতিহাসে সে সর্বসভ্য জাতি বলে গণ্য হবে।
এবং শেষ কথা– সবচেয়ে বড় কথা
আমাদের যেন রাজ্যলোভ না হয়। এদের অন্যায় আচরণ দেখে আমরা যেন সতর্ক হই। আমরা দুশো বৎসর পরাধীন ছিলুম। পরাধীনতার বেদনা আমরা জানি। আমরা যেন কাউকে পরাধীন না করি।
.
০৭.
পল জিগ্যেস করলে, একদৃষ্টে কী দেখছেন স্যর? আমি তো তেমন কিছু নয়নাভিরাম দেখতে পারছিনে।
বললুম, আমি কিঞ্চিৎ শার্লক হোমসগিরি করছি। ওই যে লোকটা যাচ্ছে দেখতে পারছ? সে ওই পাশের দোকান থেকে বেরিয়ে এল তো? দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা ফ্রিজোর; তাই লোকটার ঘাড়ের দিকটা দেখে অনুমান করছিলুম জিবুটি বন্দরের নাপিতদের কোন পর্যায়ে ফেলি?
পার্সি বললে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনার ঠিক মনে আছে। আমি তো চুল কাটাবার কথা বেবাক ভুলে গিয়েছিলুম। চলুন ঢুকে পড়ি।
আমি বললুম তা পার। তবে কি না, মনে হচ্ছে, এ দেশে কোদাল দিয়ে চুল কাটে।
পার্সি বললে, কোদাল দিয়েই কাটুক, আর কাস্তে দিয়েই কামাক, আমার তো গত্যন্তর নেই।
নাপিত ভায়া ফরাসি ভিন্ন অন্য কোনও ভাষা জানেন না। আমি তাকে মোটামুটি বুঝিয়ে দিলুম, পার্সির প্রয়োজনটা কী।
কিন্তু দোকানটা এতই ছোট যে, পল আর আমি সেখানে বসবার জায়গা পেলুম না। বারান্দাও নেই। পার্সিকে বললুম, তার চুল কাটা শেষ হলেই সে যেন বন্দরের চৌমাথার কাফেতে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
চৌমাথায় একটি মাত্র কাফে। সবকটা দরজা খোলা বলে স্পষ্ট দেখতে পেলুম, খদ্দের গিস গিস করছে। কিন্তু এইটুকু হাতের তেলো পরিমাণ বন্দর, এখানে মেলার গরুর হাট বসল কী করে?
ভিতরে গিয়ে দেখি, এ কী; এ যে আমাদের জাহাজেরই ডাইনিং রুম! খদ্দেরের সব-কজনই আমাদের অতিশয় সুপরিচিত সহযাত্রীর দল। এ বন্দর দেখা দশ মিনিটেই শেষ হয়ে যায় বলে, সবাই এসে জড়ো হয়েছেন ওই একটিমাত্র কাফেতেই। তাই কাফে গুলজার। এবং সবাই বসেছেন আপন আপন টেবিল নিয়ে। অর্থাৎ জাহাজের ডাইনিং রুমে যে চারজন কিংবা ছ জন বসেন এক টেবিল নিয়ে, ঠিক সেইরকম এখানেও বসেছেন আপন আপন গুষ্ঠী নিয়ে।
এক কোণে বসেছে গুটিকয়েক লোক, উদাস নয়নে, শূন্যের দিকে তাকিয়ে। জাহাজে এদের কখনও দেখিনি। আন্দাজ করলুম, এরাই তবে জিবুটির বাসিন্দা। জরাজীর্ণ বেশভূষা।
কিন্তু এসব পরের কথা। কাফেতে ঢুকেই প্রথম চোখে পড়ে এ দেশের মাছি। চোখে পড়ে বাক্যটি শব্দার্ধেই বললুম, কারণ কাফেতে ঢোকার পূর্বেই একঝাক মাছি আমার চোখে থাবড়া মেরে গেল।
কাফের টেবিলের উপর মাছি বসেছে আল্পনা কেটে, বারের কাউন্টারে বসেছে ঝাঁকে ঝাকে, খদ্দেরের পিঠে, হ্যাটে– হেন স্থান নেই যেখানে মাছি বসতে ভয় পেয়েছে।
দু গেলাস নিধু-পানি টেবিলে আসামাত্রই তার উপরে, চুমুক দেবার জায়গায়, বসল গোটা আষ্টেক মাছি। পল হাত দিয়ে তাড়া দিতেই গোটা কয়েক পড়ে গেল শরবতের ভিতর। পল বললে, ওই য যা।
আমি বললুম, আরেকটা অর্ডার দিই?
সবিনয়ে বললে, না স্যর, আমার এমনিতেই ঘিন ঘিন করছে। আর পয়সা খরচা করে দরকার নেই।
তখন তাকিয়ে দেখি, অধিকাংশ খদ্দেরের গেলাসই পুরো ভর্তি।
ততক্ষণে ওয়েটার দুটি চামর দিয়ে গেছে। আমরাও চামর দুটি হাতে নিয়ে অন্য সব খদ্দেরদের সঙ্গে কোরাসে মাছি তাড়াতে শুরু করলুম।
সে এক অপরূপ দৃশ্য! জন পঞ্চাশেক খদ্দের যেন এক অদৃশ্য রাজাধিরাজের চতুর্দিকে জীবনমরণ পণ করে চামর দোলাচ্ছে। ডাইনে চামর, বাঁয়ে চামর, মাথার উপরে চামর, টেবিলের তলায় চামর। আর তারই তাড়ায় মাছিগুলো যূথভ্রষ্ট কিংবা ছন্নছাড়া হয়ে কখনও ঢোকে পলের নাকে, কখনও ঢোকে আমার মুখে। কথাবার্তা পর্যন্ত প্রায় বন্ধ। শুধু চামরের সাইসাই আর মাছির ভনৃভন! রুশ-জর্মনে লড়াই। মাত্র সেই চারটি খাস জিবুটি বাসিন্দে নিশ্চল নীরব। অনুমান করলুম, মাছি তাদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে, এবং মাছিদের সঙ্গে লড়নেওলা জাহাজযাত্রীর দলও তাদের গা-সওয়া। এরকম লড়াইও তারা নিত্যি নিত্যি দেখে।
তখন লক্ষ করলুম তাদের শরবত পানের প্রক্রিয়াটা। তারা চামর তো দোলায়ই না, হাত দিয়েও গেলাসের মুখ থেকে মাছি খেদায় না। গেলাস মুখে দেবার পূর্বে সেটাতে একটু মোলায়েম ঠোনা দেয়, সঙ্গে সঙ্গে মাছিগুলো ইঞ্চি তিনেক উপরে ওঠামাত্রই গেলাসটি টুক করে টেনে এনে চুমুক লাগায়। ঘিনপিত এদের নেই।
পলও লক্ষ করে আমাকে কানে কানে শুধালে, এ লক্ষ্মীছাড়া জায়গায় এসব লোক থাকে কেন?
আমি বললুম, সে বড় দীর্ঘ কাহিনী। অর্থাৎ এদের প্রত্যেককে যদি জিগ্যেস কর তবে শুনবে, প্রত্যেকের জীবনের দীর্ঘ এবং বৈচিত্র্যময় কাহিনী।
এ সংসারের সর্বত্রই একরকম লোক আছে যারা রাতারাতি লক্ষপতি হতে চায়। খেত-খামার, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-মোকরি, কোনও কাজেই ওদের মন যায় না। অত খাটে কে, অত লড়ে কে?– এই তাদের ভাবখানা।
সিনেমায় নিশ্চয় দেখেছ, হঠাৎ খবর রটল আফ্রিকার কোথায় যেন সোনা পাওয়া গিয়েছে; সেখানে মাটির উপর-নিচে সর্বত্র তাল তাল সোনা পড়ে আছে আর অমনি চলল দলে দলে দুনিয়ার লোক সেই সোনা যোগাড় করে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার জন্য। সিনেমা কত রঙ-চঙেই না সে দৃশ্য দেখায়! অনাহারে তৃষ্ণায় পড়ে আছে, এখানে মড়া সেখানে মড়া। কোনও কোনও জায়গায় বাপ-মা, বেটা-বেটি চলেছে এক ভাঙা গাড়িতে করে ছেলেটার মুখ দিয়ে রক্ত উঠছে, মেয়েটা ভিরমি গেছে। বাপ টিনের ক্যানাস্তারা হাতে করে ধুঁকতে ধুঁকতে জল খুঁজতে গিয়ে এ পাথরে টক্কর খেয়ে পড়ে যাচ্ছে, ও পাথরে ঠোক্কর খেয়ে জখম হচ্ছে। মায়ের চোখে জলের কণা পর্যন্ত নেই– যেন অসাড় অবশ হয়ে গিয়েছে।
এগিয়ে চলেছে, এগিয়ে চলেছে, এরা এগিয়ে চলেছে। এ ছাড়া উপায় নেই। থামলে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু, এগুলে বাঁচলে বাঁচতেও পার।
কজন পৌঁছয়, কজন সোনা পায়, তার ভিতর কজন জনসমাজে ফিরে এসে সে ধন ভোগ করতে পারে, তার কোনও সরকারি কিংবা বেসরকারি সেনসাস কখনও হয়নি। আর হলেই-বা কী? যাদের এ ধরনের নেশা জন্মগত তাদের ঠেকাবে কোন্ আদমশুমারি?
কিংবা হয়তো এদেরই একজন লেগে গেল কোম্পানি বানিয়ে, শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলতে। কেন? কোনও এক বোম্বেটে কাপ্তান কোনও এক অজানা দ্বীপে কোটি কোটি টাকার ধন নিয়ে উধাও হয়ে যায়। যে দ্বীপ খুঁজে বের করতে হবে। সেই ধন উদ্ধার করে রাতারাতি বড়লোক হতে হবে। সেই সমুদ্রে ওই দ্বীপটায় থাকার কথা সেখানে যাত্রী-জাহাজ বা মাল-জাহাজ কিছুই যায় না। সে দ্বীপে নাকি খাবার জল পর্যন্ত নেই। ওই বোম্বেটে কাপ্তান নাকি জলতৃষ্ণায় মারা গিয়েছিল, আরও কতরকম উড়ো খবর।
যে কোম্পানি খুললে, সে বলে বেড়াচ্ছে তার কাছে ম্যাপ রয়েছে ওই দ্বীপে যাবার জন্য। সাধারণ লোক বলে, কই ম্যাপটা দেখি। লোকটা বলে, আব্দার। তার পর তুমি টাকাটা মেরে দাও আর কি? কিন্তু রাতারাতি বড়লোক হওয়ার দল অতশত শুধায় না। তারা কোম্পানির শেয়ারও কেনে না– পয়সা থাকলেও কেনে না। তারা গিয়ে কান্নাকাটি লাগায় লোকটার কাছে খালাসি করে, বাবুর্চি করে আমাদের নিয়ে চল তোমার সঙ্গে। আমরা মাইনে কিছু চাইনে। কাপ্তেনও ওইরকম লোকই খুঁজছে– শক্ত তাগড়া জোয়ান, মরতে যারা ডরায় না।
তার পর একদিন সে জাহাজ রওনা হল। কিন্তু আর ফিরে এল না।
কিংবা ফিরে এল মাত্র কয়েকজন লোক। কিছুই পাওয়া যায়নি বলে এরা তাকে খুন। করেছে। তখন লাগে পুলিশ তাদের পিছনে। মোকদ্দমা হয়, আরও কত কী?
পল কাফের সেই চারটি জিবুটিবাসীর দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে আমাকে শুধাল, এরা সব ওই ধরনের লোক?
আমি বললুম, না, তবে ওদের বংশধর। বংশধর অর্থে ওদের ছেলে-নাতি নয়, কারণ ও ধরনের লোক বিয়ে-থা বড় একটা করে না। বংশধর, বলছি, এরা ওই দলেরই লোক, যারা রাতারাতি বড়লোক হতে চায়। কিন্তু আজকের দিনে তো আর সোনা পাওয়ার গুজব ভালো করে রটতে পারে না তার আগেই খবরের কাগজগুলো প্লেনভাড়া করে সবকিছু তদারক করে জানিয়ে দেয়, সমস্তটা ধাপ্পা কিংবা জাহাজভাড়া করার কথাও ওঠে না। প্লেনে করে ঝটপট সবকিছু সারা যায়। হেলিকপ্টার হওয়াতে আরও সুবিধে হয়েছে। একেবারে মাটির গা ছুঁয়ে ভালো করে সবকিছুই তদারক করা যায়।
তাই এরা সব করে আফিং চালান, কিংবা মনে কর, কোনও দেশে বিদ্রোহ হয়েছে বিদ্রোহীদের কাছে বেআইনিভাবে বন্দুক-মেশিনগান ইত্যাদি বিক্রি।
যখন কিছুতেই কিছু হয় না, কিংবা সামান্য যে টাকা করেছিল তা খুঁকে দিয়েছে, ওদিকে বয়সও হয়ে গিয়েছে, গায়ে আর জোর নেই, তখন তারা জিবুটির মতো লক্ষ্মীছাড়া বন্দরে এসে দু পয়সা কামাবার চেষ্টা করে, আর নতুন নতুন অসম্ভব অ্যাডভেঞ্চারের স্বপ্ন দেখে। জিবুটির মতো অসহ্য গরম আর মারাত্মক রোগ-ব্যাধির ভিতরে কোন সুস্থ-মস্তিষ্ক লোক কাজের সন্ধানে আসবে? কিন্তু এদের আছে কষ্ট সহ্য করার অসাধারণ ক্ষমতা। তাই এদের জন্য এখানে কিছু একটা জুটে যায়। এই যেমন মনে কর, এখান থেকে যে রেললাইন শুরু হয়ে আবিসিনিয়ার রাজধানী আদ্দিস-আবাবা অবধি গিয়েছে প্রায় পাঁচশো মাইলের ধাক্কা– সে লাইনে তো নানারকমের কাজ আছেই, তার ওপর ওরই মারফতে ব্যবসা-বাণিজ্য যা হবার তা-ও হয়। ওইসব করে, আর একে অন্যকে আপন আপন যৌবনের দুঁদেমির গল্প বলে।
পাছে পল ভুল বোঝে তাই তাড়াতাড়ি বললুম, কিন্তু এই চারটি লোক বসে আছে, ঠিক এরাই যে এ ধরনের অ্যাডভেঞ্চারার সেকথা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে হওয়ার সম্ভাবনা আছে– ওইটুকু যা কথা।
ইতোমধ্যে মুখে একটা মাছি ঢুকে যাওয়াতে বিষম খেয়ে কাশতে আরম্ভ করলুম। শান্ত হলে পর পল শুধাল, এদের কথা শুনে এদের প্রতি করুণা হওয়া উচিত, না অন্য কোনও প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনে।
আমি অনেকক্ষণ ভেবে নিয়ে বললুম, আমার কী মনে হয় জানো? কেউ যখন করুণার সন্ধান করে তখনই প্রশ্ন জাগে, এ লোকটা করুণার পাত্র কি না? কিন্তু এরা তো কারও তোয়াক্কা করে না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এরা আশা রাখে, স্বপ্ন দেখে, রাস্তার মোড় ঘুরতেই নদীর বাঁক নিতেই সামনে পাবে পরীস্থান, যেখানে গাছের পাতা রুপোর, ফল সোনার, যেখানে শিশিরের ফোঁটাতে হাত দিলেই তারা হীরের দানা হয়ে যায়, যেখানে
আরেকটুখানি কবিত্ব করার বাসনা হয়েছিল কিন্তু ইতোমধ্যে পার্সি মাছি তাড়াতে তাড়াতে এসে উপস্থিত। চেয়ারে বসে টেবিলের উপর রাখল ও-দ্য কলনের এক ঢাউস বোতল। মুখে হাসি, দুনিয়ার সবচাইতে ডাকসাইটে ও-দ্য-কলন– খাস কলন শহরের তৈরি কলনের জল– Eau de Cologne! 4711 মার্কা!
পার্সি বললে, দাঁও মেরেছি স্যর! বলুন তো এর দাম বোম্বাই কিংবা লন্ডনে কত?
আমি বললুম, শিলিং বারো-চোদ্দ হবে।
লঙ্কা জয় এবং সীতাকে উদ্ধার করেও বোধহয় রামচন্দ্রজি এতখানি পরিতৃপ্তির হাসি হাসেননি। তবু হনুমান কী করেছিলেন তার খানিকটে আভাস পেলুম, পার্সির বুক চাপড়ানো দেখে।
তিন শিলিং স্যর, তিন শিলিং! সবে মাত্র, কুললে, জ, তিন শিলিং! নট, এ পেনি মোর, নট ইভন, এ রেড ফার্দিং মোর।
এমন সময় দেখি, কাফের আরেক কোণ থেকে সেই আবুল-আসফিয়া-কী কী যেন-সিদ্দিকি সাহেব তাঁর সেই লম্বা কোট আর ঝোলা পাতলুন পরে আমাদের দিকে আসছেন। ইনি আমাদের সেই বন্ধু যিনি সবাইকে লাইমজুস, চকলেট খাওয়ান–কিন্তু যার। কসি কথা কওয়াতে।
আমরা উঠে তাকে অভ্যর্থনা জানালুম।
তিনি বসেই বোতলটা হাতে তুলে নিয়ে ডাক্তাররা যেরকম একসরের প্লেট দেখে সেইরকম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন।
পার্সি পুনরায় মৃদু হাস্য করে বললেন, একদম খাঁটি জিনিস।
আবুল আসফিয়া মুখ বন্ধ রেখেই নাক দিয়ে বললেন, হুঁ।
তার পর অনেকক্ষণ পরে অতি অনিচ্ছায় মুখ খুলে শুধালেন, এটা কার জন্য কিনলে?
পার্সি বললে, পিসিমার জন্য।
আবুল আসফিয়া বললেন, বোতলটার ছিপি না খুললে বিলেতে নামবার সময় তোমাকে প্রচুর কাস্টমসের ট্যাক্স দিতে হবে। এমনকি এ জাহাজে ওঠার সময়ও তবে সে আমি ঠিক জানিনে।
পার্সি আমার দিকে তাকাল।
আমি বললুম, ছিপি খোলা থাকলে ওটা তোমার আপন ব্যবহারের জিনিস হয়ে গেল, তাই ট্যাক্স দিতে হয় না।
অনেকক্ষণ পর আবুল আসফিয়া বললেন, যখন খুলতেই হবে তখন এই বেলা খুলে ফেলাই ভালো।
আমরা সবাই পার্সিও–বললুম, সেই ভালো।
ওয়েটার একটা কর্ক স্ক্রু নিয়ে এল। আবুল আসফিয়া পরিপাটি হাতে বোতল খুলে প্রথম কর্কটার ভিতরের দিকে ঝুঁকলেন, তার পর বোতলের জিনিস।
একটু ভেবে নিয়ে আমাদের শোকালেন।
কোনও গন্ধ নেই!
যেন জল-প্লেন, নির্জলা জল!
পার্সি তো একেবারে হতভম্ব। অনেকক্ষণ পর সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে বললে, কিন্তু ছিপি, সিল সবই তো ঠিক?
আবুল আসফিয়া বললেন, এসব হোট বন্দরে পুলিশের কড়াকড়ি নেই বলে নানা রকমের লোক অনেক অজানা প্রক্রিয়ায় আসল জিনিস সরিয়ে নিয়ে মেকি কিংবা প্লেন জল চালায়।
আমি পলকে কানে কানে বললুম, হয়তো আমাদেরই একজন অ্যাডভেঞ্চারার।
পাশের টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখি, খাস জিবুটি-বাসিন্দারা দরদভরা আঁখিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অনুমান করতে বেগ পেতে হল না, এরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে।
পার্সিও খানিকটে বুঝতে পেরেছে। বললে, যাত্রীরা বোকা কি না, তাই এ শয়তানিটা তাদের ওপরই করা যায়। আর প্রতি জাহাজেই আসে এক জাহাজ
পল বাধা দিয়ে বললে, পার্সি!
পার্সি চটে উঠে বললে, ওহ্, আর উনিই যেন এক মহা! কন্-ফু-ৎস!
জাহাজে ফেরার সময়, আবুল আসফিয়াকে একবার একা পেয়ে শুধালুম, ছোঁড়াটাকে বড় নিরাশ করলেন।
বললেন, উপায় কী? না হলে প্রতি বন্দরে মার খেত যে!
.
০৮.
গুণীরা বলেন, অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে কথা বলবে।
জিবুটি ত্যাগ করার সময় পার্সি বন্দরের দিকে তাকিয়ে বললে, লক্ষ্মীছাড়া জায়গাটা। ও-দ্য কলনের খেদটা তখনও তার মন থেকে যায়নি। তাই অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করেই কথাটা বলল।
ঘন্টাখানেকের ভিতর উঠল ঝড়। তেমন কিছু মারাত্মক নয় কিন্তু সি সিকনেস দিয়ে মানুষের প্রাণ অতিষ্ঠ করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। পার্সিই প্রথম বিছানা নিল। বমি করতে করতে তার মুখ তখন শর্ষে ফুলের রঙ ধরেছে। ভাঙা গালদুটো দেখে মনে হয় সত্তর বছরের বুড়ো।
আমি নিজে যে খুব সুস্থ অনুভব করেছিলুম তা নয়। তবু পার্সিকে বললুম, তবে যে, বস, জিবুটি বন্দরকে কটুকাটব্য করছিলে? এখন ওই লক্ষ্মীছাড়া বন্দরেই পা দিতে পারলে যে দু মিনিটেই চাঙা হয়ে উঠতে। মাটিকে তাচ্ছিল্য করতে নেই– অন্তত যতক্ষণ মাটির থেকে দূরে আছ– তা সে জলের তলাতে সাবমেরিনেই হোক, উপরে জাহাজেই হোক, কিংবা তারও উপরে বাতাসে ভর করে অ্যারোপ্লেনেই হোক। তা সে যাক গে। এখন বুঝতে পারলে গুণীরা কেন বলেছেন, অগ্র-পশ্চাৎ ইত্যাদি?
পার্সি কিন্তু তৈরি ছেলে। সেই ছটফটানির ভিতর থেকে কাতরাতে কাতরাতে বলল, কিন্তু এখন যদি কোনও ডুবন্ত দ্বীপের মাটিতে ধাক্কা লেগে জাহাজখানা চৌচির হয়ে যায় তখনও মাটির গুণগান করবেন নাকি?
আমি বললুম, ওই য যা! এতখানি ভেবে তো আর কথাটা বলিনি।
পল তার খাটে বসে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল। আস্তে আস্তে বললে, জাহাজ যদি মাটিতে লেগে চৌচির হয়ে যায় তবে তো সেটা মাটির দোষ নয়। জাহাজ জোরের সঙ্গে ধাক্কা দেয় বলেই তো খান খান হয়ে যায়। আস্তে আস্তে চললে মাটির বাধা পেয়ে জাহাজ বড়জোর দাঁড়িয়ে যাবে। ভাঙবে কেন? মাকে পর্যন্ত জোরে ধাক্কা দিলে চড় খেতে হয়, আর মাটি দেবে না?
আমি উল্লসিত হয়ে বললুম, সাধু সাধু! তুলনাটি চমৎকার! তবে কি না আমার দুঃখ, বাঙলা ভাষায় এ নিয়ে যে শব্দদুটো আছে তার pun তোমরা বুঝবে না। মা হচ্ছেন মাদার আর মাটি হচ্ছেন দি মাদার কিংবা আর্থ।
পল বললে, বিলক্ষণ বুঝেছি, Good Earth!
পার্সি বিরক্ত হয়ে বললে, পলের তুলনাটা নিশ্চয়ই চোরাই মাল।
আমি বললুম, সাধুর টাকাতে দু সের দুধ, চোরের টাকাতেও দু সের দুধ। টাকার দাম একই। তুলনাটা ভালো। তা সে পলের আপন মালই হোক আর চোরাই মালই হোক। তা সেকথা থাক। তুমি কিন্তু সি সিকনেসে কাতর হয়ে ভয় পেয়ো না। এ ব্যামোতে কেউ কখনও মারা যায়নি।
পার্সি চিঁ চিঁ করে বললে, শেষ ভরসাটাও কেড়ে নিলেন, স্যরআমি তো ভরসা করেছিলুম আর বেশিক্ষণ ভুগতে হবে না, মরে গিয়ে নিষ্কৃতি পাব।
পল বললে, আগাছা সহজে মরে না।
আমি বললুম, থাক, থাক। চলো পল, উপরে যাই। আমরা তিনজন মিলে সি সিনেসকে বড্ড বেশি লাই দিচ্ছি।
পল বেরুতে বেরুতে বললে, হক কথা। পার্সির সঙ্গে একা পড়লে যে কোনও ব্যামো বাপ বাপ করে পালাবার পথ পাবে না।
উপরে এসে দেখি, আবুল আসফিয়া কোথা থেকে এক জোরদার দুরবিন যোগাড় করে কী যেন দেখবার চেষ্টা করছেন। এসব জাহাজ কখনও পাড়ের গা ঘেঁষে চলে না। তাই জোরালো দুরবিন দিয়ে বিশেষ কিছু দেখা যায় না। পল আমাকে শুধালে, কী দেখছেন উনি?
আমি বললুম, আবুল আসফিয়া মুসলমান এবং মনে হচ্ছে ধর্মে তাঁর অনুরাগও আছে। লাল দরিয়ার এক পারে সোমালি ভূমি, হাবসি মুলুক এবং মিশর, অন্য পারে আরব দেশ। মহাপুরুষ মুহম্মদ আরবদেশে জন্মেছিলেন, ওই দেশে ইসলাম প্রচার করেন। মক্কা মদীনা, সবই তো ওইখানে।
পল বললে, ইংরেজিতে যখনই কোনও জিনিসের কেন্দ্রভূমির উল্লেখ করতে হয় তখন বলা হয়, যেমন ধরুন সঙ্গীতের বেলায়, ভিয়েনা ইজ দি মেক্কা অব মিউজিক– এ তো আপনি নিশ্চয়ই জানেন। কিন্তু বিশেষ করে মক্কা বলা হয় কেন? মক্কা তো আর তেমন কিছু বড় শহর নয়।
আমি বললুম, পৃথিবীতে গোটা তিনেক বিশ্বধর্ম আছে, অর্থাৎ এ ধর্মগুলো যে দেশে জন্মগ্রহণ করেছে সেখানেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি–দূর-দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। যেমন মনে কর বৌদ্ধধর্ম, খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম। কিন্তু পৃথিবীর বহু বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান কোনও বিশেষ পুণ্যদিবসে এক বিশেষ জায়গায় একত্র হয় না– মুসলমানরা যেরকম হজের দিনে মক্কায় একত্র হয়। কোথায় মরক্কো, কোথায় সাইবেরিয়া আর কোথায় চীন পৃথিবীর যেসব দেশে মুসলমান আছে সেসব দেশের লোককে সেদিন তুমি মক্কায় পাবে। শুনেছি, সেদিন নাকি মক্কার রাস্তায় দুনিয়ার প্রায় সব ভাষাই শুনতে পাওয়া যায়।
তাতে করে লাভ?
আমি বললুম, লাভ মক্কাবাসীদের নিশ্চয়ই হয়। তীর্থযাত্রীরা যে পয়সা খরচ করে তার সবই তো ওরা পায়। কিন্তু আসলে সে উদ্দেশ্য নিয়ে একথা সৃষ্টি হয়নি। মুহম্মদ সাহেবের ইচ্ছা ছিল যে, পৃথিবীর সব দেশের মুসলমানকে যদি একত্র করা যায় তবে তাদের ভিতর ঐক্য এবং ভ্রাতৃভাব বাড়বে। আমরা যখন বাড়িতে উপাসনা না করে গির্জায় কিংবা মসজিদে যাই তখন তারও তো অন্যতম উদ্দেশ্য আপন ধর্মের লোকের সঙ্গে এক হওয়া। মুহম্মদ সাহেব বোধহয় এই জিনিসটাই বড় করে, সমস্ত পৃথিবী নিয়ে করতে চেয়েছিলেন।
পল অনেকক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, আমরা তো বড়দিনের পরবে প্রভু যিশুর জন্মস্থল বেথলেহেমে জড় হইনে। হলে কি ভালো হত না? তা হলে তো খ্রিস্টানদের ভিতরও ঐক্য সখ্য বাড়ত।
আমি আরও বেশি ভেবে বললুম, তা হলে বোধহয় রোমে পোপের প্রাধান্য ক্ষুণ্ণ হত।
কিন্তু থাক এসব কথা। আমার কোনও ক্যাথলিক পাঠক কিংবা পাঠিকা যেন মনে না করেন যে, আমি পোপকে শ্রদ্ধা করিনি। পৃথিবীর শত শত লক্ষ লক্ষ লোক যাকে সম্মানের চোখে দেখে তাকে অশ্রদ্ধা করলে সঙ্গে সঙ্গে সেই শত শত লক্ষ লক্ষ লোককে অশ্রদ্ধা করা হয়। অতটা বেয়াদব আমি নই। বিশেষত আমি ভারতীয়। ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি, সব ধর্মকে শ্রদ্ধা জানাতে হয়।
.
০৯.
ঝড় থেমেছে। সমুদ্র শান্ত। ঝড়ের পর বাতাস বয় না বলে অসহ্য গরম আর গুমোট। এ যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পাই কী প্রকারে।
নিষ্কৃতির জন্য মানুষ ডাঙায় যা করে, জলে অর্থাৎ জাহাজেও তা-ই। একদল লোক বুদ্ধিমান। কাজে কিংবা অকাজে এমনি ডুব মারে যে, গরমের অত্যাচার সম্বন্ধে অনেকখানি অচেতন হয়ে যায়। বোকার দল শুধু ছটফট করে। ক্ষণে এটা করে, ক্ষণে ওটা নাড়ে, ক্ষণে ঘুমাবার চেষ্টা করে, ক্ষণে জেগে থাকতে গিয়ে আরও বেশি কষ্ট পায়।
জাহাজেও তাই। একদল লোক দিবারাত্রি তাস খেলে। সকালবেলাকার আণ্ডা-রুটি খেয়ে সেই যে তারা তাসের সায়রে ডুব দেয়, তার পর রাত বারোটা-একটা-দুটো অবধি তাদের টিকি টেনেও সে সায়র থেকে ভোলা যায় না। লাঞ্চ সাপার খেতে যা দু একবার তাস ছাড়তে হয়, ব্যস্– ওই। তখন হয় বলে কী গরম, নয় ওই তাসের জেরই কানার টেবিলে টানে। চার ইস্কাপন না ডেকে তিন বে-তরুপ বললে ভালো হত, পুনরপি ডবল না বলে সে কী আহাম্মুকিই না করেছে?
জাহাজের বেসরকারি ইতিহাস বলে, একটানা ছত্রিশ ঘণ্টা তাস খেলেছে এমন ঘটনাও নাকি বিরল নয়। এরা গরমে কাতর হয় না, শীতেও বেকাবু হয় না। ভগবান এদের প্রতি সদয়।
দাবাখেলার চর্চা পৃথিবীতে ক্রমেই কমে আসছে। আসলে কিন্তু দাবাড়ুই এ ব্যাপারে দুনিয়ার আর সবাইকে মাত করতে পারে। দাবাখেলায় যে মানুষ কী রকম বাহ্যজ্ঞানশূন্য হতে পারে, সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। পরশুরাম লিখেছেন এক দাবাড়কে যখন চাকর এসে বললে, চা দেব কী করে?- দুধ ছিঁড়ে গেছে তখন দাবাড়ু খেলার নেশায় বললে, কী জ্বালা, সেলাই করে নে না!
আরেক দল শুধু বই পড়ে। তবে বেশিরভাগই দেখেছি, ডিটেকটিভ উপন্যাস। ভালো বই দিবা-রাত্র পড়ছে এরকম ঘটনা খুব কমই দেখেছি।
আরেক দল মারে আড্ডা। সঙ্গে সঙ্গে গুনগুন করে আড্ডার যেটা প্রধান মেনু পরনিন্দা, পরচর্চা। সেগুলো বলতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু পাছে কোনও পাঠক ফস করে শুধায়, এগুলো আপনি জানলেন কী করে, যদি নিজে পরনিন্দা না করে থাকেন? তাই আর বললুম না।
আরও নানা গুষ্ঠী নানা সম্প্রদায় আছে, কিন্তু আবুল আসফিয়া কোনও গোত্রেই পড়েন না। তিনি আড্ডাবাজদের সঙ্গে বসেন বটে, কিন্তু আড্ডা মারেন না– খেয়ানৌকার মাঝি যেরকম নদী পেরোয়, কিন্তু ওপারে নাবে না। একথা পূর্বেই বলেছি, কিন্তু আজ হঠাৎ তাকে দেখি অন্য রূপে। খুলে কই।
পার্সি সেরে উঠে আবার জাহাজময় লম্ফঝম্ফ লাগিয়েছে। যেখানেই যাই সেখানেই পার্সি। মাঝে মাঝে সন্দেহ জাগে, তবে কি পার্সির জন আষ্টেক যমজ ভাই আছে নাকি? একই লোক সাত জায়গায় একসঙ্গে থাকবে কী করে?
সে-ই খবরটা আনলে।
কী খবর?
জাহাজ সুয়েজ বন্দরে পৌঁছানোর পর ঢুকবে সুয়েজ খালে। খালটি একশো মাইল লম্বা। দু-পাড়ে মরুভূমির বালু বলে জাহাজকে এগুতে হয় ঘন্টায় পাঁচ মাইল বেগে। তা হলে লাগল প্রায় কুড়ি-বাইশ ঘণ্টা। খালের এ মুখে সুয়েজ বন্দর, ও মুখে সঈদ বন্দর। আমরা যদি সুয়েজ বন্দরে নেমে ট্রেন ধরে কাইরো চলে যাই এবং পিরামিড দেখে সেখান থেকে ট্রেন ধরে সঈদ বন্দর পৌঁছই, তবে আমাদের আপন জাহাজই আবার ধরতে পারব। যদিও আমরা মোটামুটি একটা ত্রিভুজের দুই বাহু পরিভ্রমণ করব– আর সুয়েজ খাল মাত্র এক বাহু তবু রেলগাড়ি তাড়াতাড়ি যাবে বলে আমরা কাইরোতে এটা-ওটা দেখবার জন্য ঘণ্টা দশেক সময় পাব।
কিন্তু যদি সুয়েজ বন্দরে নেমে সময়মতো ট্রেন না পাই, কিংবা যদি কাইরো থেকে সময়মতো সঈদ বন্দরের ট্রেন না পাই আর সেখানে জাহাজ না ধরতে পারি, তখন কী হবে উপায়?
পার্সি অসহিষ্ণু হয়ে বললে, সে তো কুক কোম্পানির জিম্মাদারি। তারাই তো এ টুর—না এক্সকাশন, কী বলব? বন্দোবস্ত করেছে। প্রতি জাহাজের জন্যই করে। বিস্তর লোক যায়। চলুন না, নোটিশবোর্ডে দেখিয়ে দিচ্ছি– কুকের বিজ্ঞাপন।
ত্রিমূর্তি সেখানে গিয়ে সাতিশয় মনোযোগ সহকারে প্রস্তাবটি অধ্যয়ন করলুম।
কিন্তু প্রস্তাবটির শেষ ছত্র পড়ে আমাদের আক্কেল গুড়ুম নয়, দড়াম করে ফেটে গেল। এই এক্সকার্শন-বন-ভোজ কিংবা শহর-ভোজ, যাই বলে, যাচ্ছি তো কাইরো শহরে– যারা করতে চান তাদের প্রত্যেককে দিতে হবে সাত পৌন্ড অর্থাৎ প্রায় একশো টাকা। পল বললে, হরি, হরি (অবশ্য ইংরেজিতে গুড হেভেন্স, মাই গুডনেস এইজাতীয় কিছু একটা) এত টাকা যদি আমার থাকবেই তবে কি আমি এই জাহাজে ফার্স্ট ক্লাসে যেতুম না?
আমি বেদনাতুর হওয়ার ভান করে বললুম, কেন ভাই, আমরা কি এতই খারাপ লোক যে আমাদের এড়াবার জন্য তুমি ফার্স্ট ক্লাসে যেতে চাও?
পল তো লজ্জায় লাল হয়ে তোতলাতে আরম্ভ করলে।
আর পার্সি? সে তো হনুমানের মতো চক্রাকারে নৃত্য করে বলতে লাগল, বেশ হয়েছে, খুব হয়েছে। কর মস্করা স্যারের সঙ্গে! বোঝ ঠ্যালা!
আমি বললুম, ব্যস্, ব্যস্! হয়েছে। হয়েছে। কিন্তু পার্সি, একশো টাকা তো চাট্টিখানি কথা নয়। আমাকেই তো টালমাটাল হয়ে টাকাটা টানতে হবে।
পার্সিকে দমানো শক্ত। বললে, অপরাধ নেবেন না, স্যর, কিন্তু আমিই-বা কোন হেনরি ফোর্ড কিংবা মিডাস রোটশিট? কিন্তু আমি মনস্থির করেছি, আমার জেবের শেষ পেনি দিয়ে আমি পিরামিড দেখবই দেখব। চীনা দেওয়াল দেখার পর পিরামিড দেখব না আমি? মুখ। দেখাব তা হলে কী করে? তার চেয়েও খারাপ, আয়নাতে নিজেরই মুখ দেখব কী করে?
অনেক আলোচনা, বিস্তর গবেষণা করা হল। শেষটায় স্থির হল, পিরামিড-দর্শন আমাদের কপালে নেই। গালে হাত দিয়ে যখন ত্রিমূর্তি আপন মনে সেই শোক ভুলবার চেষ্টা করছি এমন সময় আবুল আসফিয়া মুখ খুললেন।
তার সনাতন অভ্যাস অনুযায়ী তিনি আমাদের আলোচনা শুনে যাচ্ছিলেন। ভালো-মন্দ কিছুই বলেননি। আমরা যখন স্থির করলুম, আমরা ট্রিপটা নেব না তখন তিনি বললেন, এর চেয়ে সস্তাতেও হয়।
আমরা একসঙ্গে চেঁচিয়ে শুধালুম, কী করে? কী করে? বললেন, সেকথা পরে হবে।
তার পর আপন চেয়ার ছেড়ে খানা-কামরার দিকে চলে গেলেন।
১০. পল আর পার্সিকে
১০.
পল আর পার্সিকে এখন আর বড় একটা দেখতে পাইনে। ওরা আবুল আসফিয়ার কোটের উপর ডাকটিকিটের মতো সেঁটে বসেছে–চিনে-জোকের মতো লেগে গেছে বললে কমিয়ে বলা হয়, কারণ, রক্ত শোষা শেষ হলে তবু ছিনে-জোক কামড় ছাড়ে এরা খামের উপর ডাকটিকিটের মতো, যেখানেই আবুল আসফিয়া সেখানেই তারা। মুখে এক বুলি, এক প্রশ্ন–কী করে সস্তায় কাইরে গিয়ে সেখানে থেকে সস্তাতেই ফের সঈদ বন্দরে জাহাজ ধরা যায়? আবুল আসফিয়া বলেন, হবে, হবে, সময় হলে সবই হবে।
শেষটায় জাহাজ যেদিন সুয়েজ বন্দরে পৌঁছবে তার আগের দিন তিনি রহস্যটি সমাধান করলেন। অতি সরল মীমাংসা। আমাদের মাথায় খেলেনি।
আবুল আসফিয়া বললেন, কুক কোম্পানির লোক ট্যুরিস্ট সায়েব-সুবোদের নিয়ে যাবে গাড়িতে ফার্স্ট ক্লাসে করে– সুয়েজ থেকে কাইরো, এবং কাইরো থেকে সঈদ বন্দর। কাইরোতে যে রাত্রিবাস করতে হবে তার ব্যবস্থাও হবে অতিশয় খানদানি, অতএব মাগী হোটেলে। আমরা যাব থার্ডে, এবং উঠব একটা সস্তা হোটেলে। তা হলেই হল।
প্রথমটায় আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলুম। সংবিতে ফেরামাত্র আমার মনে আরেকটি কঠিন সমস্যার উদয় হল। যদি কোনও জায়গায় আমরা ট্রেন মিস করি কিংবা অন্য কোনও দুর্ঘটনার মুখে পড়ে যাই আর শেষটায় সঈদ বন্দরে ঠিক সময়ে পৌঁছে জাহাজ না ধরতে পারি তবে যে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। বরঞ্চ চা খেতে প্লাটফর্মে নেমেছি, আর গাড়ি মালপত্র নিয়ে চলে গেল সে সমস্যারও সমাধান আছে কিন্তু জাহাজ চলে গেলে কতদিন সঈদ বন্দরে পড়ে থাকতে হবে, তার কী খরচা, নতুন জাহাজে নতুন টিকিটের জন্য কী গচ্চা এসব তো কিছুই জানিনে। কুকের লোক এসব বিপদ-আপদের জন্য জিমেদার, কিন্তু আবুল আসফিয়াকে জিম্মেদার করে তো আর আমাদের চারখানা হাত গজাবে না? তাকে তো আর বলতে পারব না, মশাই, আপনার পাল্লায় পড়ে এত টাকার গচ্চা হল- আপনি সেটা ঢালুন।
শেষের কথাটা বাদ দিয়ে আমার সমস্যাটা নিবেদন করতে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেলেন। যাবার সময় মাত্র একটি বাক্য বললেন, নো রিসক, নো গেন–সোজা বাঙলায়, খেলেন দই রমাকান্ত আর বিকারের বেলা গোবদ্দন সে হয় না। তুমি যদি দই খেতে চাও তবে বিকারটা হবে তোমারই। মাগুরমাছ ধরতে হলে গর্তে হাত দিতে হবে তোমাকেই! কিছুটা ঝুঁকি নিতে রাজি না হলে কোনও প্রকারের লাভও হয় না।
আবুল আসফিয়ার নো রিস্ক নো গেন এই চারটি কথা– চাট্টিখানি কথা নয়– শুনে পল দুশ্চিন্তাভরা গলায় বললে, তাই তো!
পার্সি মাথা নাড়িয়ে বললে, সেই তো!
আমি বললুম, ওই তো!
পল বললে, কিংবা মনে করুন কাইরোতে পথ হারিয়ে ফেললুম। আবুল আসফিয়া কি কাইরোর ভাষা জানেন? সেখানকার লোকে কী বুলি বলে তার নামই তো জানিনে!
পার্সি বললে, দেখো পল, তুমি কী জানো না তার ফিরিস্তি বানাবার এই কি প্রশস্ততম সময়? তাতে আবার সময়ও তো লাগবে বিস্তর।
আমি পার্সিকে ফাঁকা ধমক দিয়ে বললুম, আবার! পলকে বললুম আরবি। কিন্তু কিছু কিছু লোক নিশ্চয়ই ইংরেজি-ফরাসি জানে। রাস্তা ফের খুঁজে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই।
পল বললে, যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু ততক্ষণে হয়তো জাহাজ বন্দর ছেড়ে চলে গিয়েছে।
আরও অনেক অসুবিধার কথা উঠল। তবে সোজা কথা এই দাঁড়াল, একটি দেশের ভাষার এক বর্ণ না জেনে, এতখানি কম সময় হাতে নিয়ে সে দেশে ঘোরাঘুরি করা কি সমীচীন? এতই যদি সোজা এবং সস্তা হবে তবে এতগুলো লোক কুকের ন্যাজ ধরে যাচ্ছে কেন? একা একা কিংবা আপন আপন দল পাকিয়ে গেলেই তো পারত। তাই দেখা যাচ্ছে আবুল আসফিয়ার নো রিসক, নো গেন প্রবাদে অন্তত এক্ষেত্রে রিসক ন সিকে গেন মেরে কেটে চোদ্দ পয়সা। রবিঠাকুর বলেছেন,
আমার মতে জগন্টাতে ভালোটারই প্রাধান্য
মন্দ যদি তিন-চল্লিশ, ভালোর সংখ্যা সাতান্ন।
যদি আমাদের রিসক সাতান্ন আর গেন তিন-চল্লিশ হত তা হলেও আমরা কানাইলালের মতো সোল্লাসে ইয়াল্লা বলে ঝুলে পড়তুম যাচ্ছি তো মুসলমান দেশে।
তখন স্থির হল, আবুল আসফিয়াকে পাকড়াও করে আরেক দফা সবিস্তার সওয়াল-জবাব না করে কোনওকিছু পাকাপাকি মনস্থির করা যাবে না।
ধুয়া-ভুয়া করে করে, বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর আমরা আবুল আসফিয়াকে পেলুম উপরের ডেকের এক কোণে, আপন মনে গুনগুনিয়ে গান গাইছেন। আমাদের দেখে, আমাদের কিছু বলার পূর্বেই বেশ একটু চড়া গলায় বললেন, আমি কোনও কথাই শুনতে চাইনে। আমি কোনও উত্তর দিতে পারব না। আমি কাইরো যাব। তোমরা আসতে চাও ভালো, না আসতে চাও আরও ভালো।
সঙ্গে সঙ্গে যেন আরও একটা শব্দ শুনতে পেলুম–শব্দটা ফারসি, বুজ-দিল–অর্থাৎ বকরির কলিজা, অর্থাৎ ভীতুরা সব।
এই শান্ত প্রকৃতি সদাশিব লোকটির কাছ থেকে আমরা এ আচরণ প্রত্যাশা করিনি। এ যেন সেনাপতির আদেশ, আমি তাহলে একাকী শত্রুসৈন্য আক্রমণ করব, তোমরা আসো আর না-ই আসো। ত্রিমূর্তি লড়াহত সারমেয়বৎ নিম্নপুচ্ছ হয়ে স্ব-স্ব আসনে ফিরে এলুম। কারও মুখে কথা নেই। নিঃশব্দে আহারাদি করে যে যার কেবিনে শুয়ে পড়লুম।
সিংহের ন্যাজে মোচড় দিতে নাই; কথাটি অতি খাঁটি, কিন্তু আবুল আসফিয়া সিংহ না মর্কট সেটা তো এখনও কিছু বোঝা গেল না। তার আচরণ তেজীয়ান না লেজীয়ানের লক্ষণ তার তো কোনও হদিস পাওয়া গেল না।
.
১১.
পরদিন নিদ্রাভঙ্গে কেবিন ছেড়ে উপরে আসতেই দেখি হৈ-হৈ-রৈরৈ কাণ্ড! একদল লোক আবুল আসফিয়াকে ঘিরে নানারকমের প্রশ্ন শুধোচ্ছে। কুক কোম্পানি কাইরো দেখবার জন্য চায় একশো টাকা আর আপনি বলেন, পঞ্চাশ টাকাতেই হয়, সেটা কী প্রকারে সম্ভব? আরেক দল বলে, তারাও আসতে রাজি কিন্তু যদিস্যাৎ কোনও প্রকারের গড়বড় সড়বড় হয়ে যায় আর তারা জাহাজ না ধরতে পারে তখন যে ভয়ঙ্কর বিপদ উপস্থিত হবে তার কী সমাধান?
অর্থাৎ ইতোমধ্যে আমাদেরই মতো আমাদের গরিব সহযাত্রীরা জেনে গিয়েছে সস্তাতেও কাইরো এবং পিরামিড দেখা যায়। কাজেই এখন আর পল, পার্সি, আমি, এই ত্রিমূর্তি, এবং আবুল আসফিয়াকে নিলে চতুর্মুখ– এখন আর তা নয়, এখন সমস্যাটা সহস্রনয়না হয়ে গিয়েছে, জনগণমন সাড়া দিয়েছে।
আবুল আসফিয়া কেবল মাঝে মাঝে বলেন, হো জায়গা, সব কুছ হো জায়গা।
হিন্দুস্তানি বলছেন কেন? তিনি তো ইংরেজি জানেন। তখন লক্ষ করলুম যেসব দল তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে তাদের ভিতর রয়েছে ফরাসি, জর্মন, স্পেনিশ, রুশ আরও কত কী? এরা সবাই বোঝে, এমন কোনও ভাষা ইহসংসারে নেই। তাই তিনি নিশ্চিন্ত মনে মাতৃভাষায় কথা বলে যাচ্ছেন। ইংরেজি বললে যা, হিন্দুস্তানি বললেও তা। ফল একই।
এমন সময় আমাদের দলের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা মধুর এবং দরদভরা গলায় বললেন, মসিয়ো আবুল, যদি কোনও কারণে আমরা জাহাজ মিস করি তখন যে আমরা মহা বিপদে পড়ব। আপনি তো আমাদের কাউকে তার অনিচ্ছায় জোর করে নিয়ে যাচ্ছেন না যে আপনাকে জিম্মাদার হতে বলব।
ক্লোদেৎ শেনিয়ের যা বললেন, তার মোটামুটি অর্থ, আপনি যে আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন তার জিম্মাদারি আপনার নয়, কিন্তু যদি কোনওরকমের বিপর্যয় উপস্থিত হয় তবে তার গুরুত্বটা আপনি ভালো করে বিবেচনা করে দেখলে হয় না কি?
উপস্থিত সকলের মনোভাব মহিলাটি যেন অতি ললিত ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন। সবাই চিৎকার করে সায় দিল আপন আপন ভাষায়।
ফরাসি দল– উঁই উঁই,
জর্মন দল–ইয়া ইয়া,
ইতালীয় দল– সি সি,
একটি রাশান–দা দা,
গুটিকয়েক ভারতীয়– ঠিক হৈ ঠিক হৈ,
পল-পার্সি–-ইয়েস ইয়েস,
আমি নিজে কিছু বলিনি– কিন্তু সেকথা যাক।
আবুল আসফিয়া উত্তরে ঘাড় নিচু করে বললেন, মৈ জিম্মেদার হুঁ।
তাকে যদিও কেউ জিম্মেদার হবার শর্ত চায়নি তবু তিনি জিম্মাদার, এটা সম্পূর্ণ। তাঁরই দায়িত্ব!
.
১২.
চাকরির সন্ধানে গিয়ে এক বাঙালি বড় সাহেব ইংরেজকে খুশি করার জন্য বলেছিল, হুজুর, আপনার বাঙলোতে আসবার জন্য ভয়ের চোটে পা আর ওঠে না। যদি এক পা এগোই তো তিন কদম পিছিয়ে যাই। বড় সায়েব মাত্রই যে গাধা হয় তা নয়– এ সায়েবের বুদ্ধি ছিল। বাবুর কথা শেষ হতে না হতেই শুধাল, তা হলে এখানে পৌঁছলে কী করে? সায়েব যে বাবুর বিনয় বচন এতখানি শব্দার্থে নেবেন বেচারী সেটা অনুমান করতে পারেনি। প্রথমটা হকচকিয়ে গিয়েছিল বটে কিন্তু চাকরির ফিকিরে বাঙালির কাছে কোনও কসরত কোনও কৌশল অজানা নেই। একটিমাত্র শুকনো টোক না গিলেই বললে, হুজুর, তাই আমি আপন বাড়ির দিকে মুখ করে চলতে আরম্ভ করলুম, আর এই দেখুন দিব্যি হুজুরের বাঙলোতে পৌঁছে গিয়েছি।
গল্পের বাকিটা আমার মনে নেই, তবে আবুল আসফিয়ার কাইরো ভ্রমণ প্রস্তাবে উমেদাররা যদি এক পা এগোন তবে তিন পা পিছিয়ে যান। পল, পার্সি আর আমি ছাড়া কেউই পাকাপাকি কথা দেন না, আমাদের পার্টিতে আসছেন কি না। অথচ ঘড়িঘড়ি তরো-বেতরো প্রশ্ন। গাড়ি যদি মিস্ করি, কাইরোতে হোটেলে যদি জায়গা না মেলে, যদি রাত্রিবেলা হয় আর আকাশে চাঁদ না থাকে তবে পিরামিড দেখব কী করে আরও কত কী বিদঘুঁটে সব প্রশ্ন। ওদিকে আবুল আসফিয়া আপন কেবিনে খিল দিয়ে শুয়ে আছেন। প্রশ্নের ঠেলা সামলাতে হচ্ছে আমাদেরই আমরা যেন ইংলন্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের ভারতীয় ভাইয়! শেষটায় আমরাও গা-ঢাকা দিতে আরম্ভ করলুম।
সন্ধের ঝোঁকে জাহাজ সুয়েজ বন্দরে পৌঁছল। সুয়েজ খালের মুখে এসে জাহাজ নোঙর ফেলতেই ডাঙা থেকে একটা স্টিমলঞ্চ এসে জাহাজের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তখন জানা গেল আবুল আসফিয়ার দলে সবসুদ্ধ আমরা নজন যাচ্ছি। তাঁকে নিয়ে দশ জন।
কুকের গাইড স্টিমলঞ্চে করে ডাঙা থেকে জাহাজে এসেছিল। দেখলুম, তার দলে বারো জন যাত্রী। তা হলে আমাদের দশ জন এমন মন্দ কী!
গাইড চড়চড় করে সিঁড়ি বেয়ে লঞ্চে নামল– পিছনে পিছনে তার দলের বারো জন নামল পাণ্ডা– গোরুর ন্যাজ ধরে পাপী যেরকম ধারা বৈতরণী পেরোয়। আমাদের আবুল আসফিয়াও চচ্চড় করে নামলেন যেন কত যুগের ঝানু গাইড!
কুকের গাইড এরকম ব্যাপার আগে কখনও দেখেনি। তার তদ্বিরি জিমেদারি উপেক্ষা করে একপাল লোক চলেছে আপন গোঠ বেঁধে– এতখানি রিস্ক নিয়ে এ ব্যাপার তার কাছে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। আবুল আসফিয়ার দিকে যে ধরনে তাকাল তাতে সে দুর্বাসা হলে তিনি নিশ্চয়ই পুড়ে খাক হয়ে যেতেন– উনিই তো তার মক্কেল মেরেছেন।
তখন ভালো করে দেখলুম আবুল আসফিয়ার নবীন বেশভূষা। সেই ঝুলে পড়া আঠারো-পকেটি কোট, মাটি-ছোঁয়া, চোঙা-পানা পাতলুন, তিনি বর্জন করে পরেছেন একদম ফার্স্ট ক্লাস নেভি ব্লু স্যুট-কোট, পাতলুন ওয়েস্ট কোট সমেত সোনালি বেনারসি সিঙ্কের টাই, তদুপরি ডাইমন্ড টাই-পিন, পায়ে পেটেন্ট লেদারের মোলায়েম জুতো, তদুপরি ফন্ রঙের স্প্যাট, মাথায় উচ্চাঙ্গের ফেল্ট ব্যাট, গরম বলে বা হাতে ধরে রেখেছেন, নেবু রঙের কিড় গ্লাভস, ডান হাতে চামড়ার একটি পোর্টফোলিয়ে।
বিবেচনা করলুম, এই সুটে আঠারোটা পকেট নেই বলে তিনি পোর্টফোলিয়োতে টফি চকলেট, সিগার সিগারেট ভর্তি করেছেন।
সুর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ঘন নীলাকাশ কেমন যেন সূর্যের লাল আর আপন নীলে মিলে বেগুনি রঙ ধরতে আরম্ভ করলে। তারই আভাতে লাল দরিয়ার আনীল জলে ফিকে বেগুনি রঙ ধরে নিচ্ছে। ভূমধ্যসাগর থেকে একশো মাইল পেরিয়ে আসছে মন্দমধুর ঠাণ্ডা হাওয়া। সে হাওয়া লাল দরিয়ার এই শেষ প্রান্তে তুলেছে ছোট ছোট তরঙ্গ। তারই উপর দিয়ে দুলে দুলে আসছে আমাদের স্টিমলঞ্চ। তার রঙ আসলে সাদা কিন্তু এই লাল-বেগুনির পাল্লায় পড়ে তারও রঙ যেন বেগুনি হতে আরম্ভ করলে।
স্টিমলঞ্চটি শুভ্রপুচ্ছ রাজহংসবৎ। রাজহাঁস সাঁতার কেটে যাবার সময় যেরকম শুভ্র বীচিতরঙ্গ জাগিয়ে তোলে, এ তরণীটিও তেমনি প্রপেলারের তাড়নায় জাগিয়ে তুলছে। শুভ্র ফেননিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য চক্রাবর্ত। বড় জাহাজের বিরাট প্রপেলার যখন এরকম আবর্ত জাগায় তখন সেদিকে তাকাতে ভয় করে, মনে হয় ওই দয়ে পড়লে আর রক্ষে নেই কিন্তু ক্ষুদ্র লঞ্চের ছোট্ট ছোট্ট দয়ের একটি সরল মাধুর্য আছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকা যায়।
সূর্য অস্ত গেল মিশর মরুভূমির পিছনে। পদ্মার সূর্যাস্ত, সমুদ্রের সূর্যাস্ত যেমন আপন আপন বৈশিষ্ট্য ধরে ঠিক তেমনি মরুভূমির সূর্যাস্তও এক দর্শনীয় সৌন্দর্য। সোনালি বালিতে সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে সেটা আকাশের বুকে হানা দেয় এবং ক্ষণে ক্ষণে সেখানকার রঙ বদলাতে থাকে। তার একটা রঙ ঠিক চেনা কোনও জিনিসের রঙ সেটা বুঝতে না বুঝতে সে রঙ বদলে গিয়ে অন্য জিনিসের রঙ ধরে ফেলে। আমাদের কথা বাদ দাও, পাকা আর্টিস্টরা পর্যন্ত এই রঙের খেলা দেখে আপন রঙের পেলেটের দিকে তাকাতে চান না।
সুয়েজ বন্দরে ইংরেজ সৈন্যদের একটি ঘাটি আছে, তাই রবিঠাকুরের ভাষায় বড় সায়েবের বিবিগুলো নাইতে নেমেছে। কেউ কেউ আবার ছোট্ট ছোট্ট নৌকো করে এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি করছে। নৌকোগুলো হালফ্যাশনের ক্যাম্বিসে তৈরি। নৌকোর পাঁজর ভেনেস্তা কাঠের দড় শলা দিয়ে বানিয়ে তার উপর ক্যা এজাতীয় নৌকো কলাপসিবল-পোর্টেবল অর্থাৎ নৌভ্রমণের পর ভেনেস্তার পাঁজর আর ক্যাম্বিসের চামড়া আলাদা আলাদা করে নিয়ে, ব্যাগের ভিতর প্যাক করে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। ওজন দশ সেরের চেয়েও কম। পরিপাটি ব্যবস্থা। অবশ্য নৌকোগুলো খুব ছোট। দু জন মুখোমুখি হয়ে কায়ক্লেশে বসতে পারে। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁকা জায়গা। সেখানে জল বাঁচিয়ে টুকিটাকি জিনিস রাখার ব্যবস্থা আছে। একজোড়া, গুণী দেখি সেখানে একটা পোর্টেবলের উপর রেকর্ড লাগিয়েছে ব্লু ডানয়্যুবের!
ওই তো মানুষের স্বভাব, কিংবা বলব বজ্জাতি। যেখানে আছে সেখানে থাকতে চায় না। যে জোড়া র ডানয়ুব বাজাচ্ছে তাদের যদি এক্ষুণি ডানয়ুব নদীর উপর ভাসিয়ে দাও তবে তারা গাইতে শুরু করবে, মাই হার্ট ইজ ইন দি হাইল্যান্ড, মাই হার্ট ইজ নট হিয়ার।
তাকে যদি তখন তুমি স্কটল্যান্ডের হাইল্যান্ডে নিয়ে যাও তবে সে গাইতে আরম্ভ করবে, ইম, রোজেন-গানে ফন্ সাঁসুসি অর্থাৎ সাসুসির গোলাপবাগানে–সাসুসি পদামে, বার্লিনের কাছে। তখন যদি তুমি তাকে বার্লিন নিয়ে যাও তবে সে গাইতে আরম্ভ করবে ভারতবর্ষের গান। জর্মানির বড় কবি কী গেয়েছেন শোনো,
গঙ্গার পার– মধুর গন্ধ ত্রিভুবন আলো ভরা
কত না বিরাট বনস্পতিরে ধরে
পুরুষ রমণী সুন্দর আর শান্ত প্রকৃতি-ধরা
নতজানু হয়ে শতদলে পূজা করে।
আম্ গাঙ্গোস ডুফটেটস লয়েস্টট
উনট রিসেনবয়মে ব্ল্যুয়েন,
উন্ট শোনে, স্টিলে মেনশেন
ফর লটসব্লুমেন ক্লিয়েন।
এবং সেখানে যখন মন ওঠে না তখন গেয়ে ওঠেন স্বপ্নপুরীর গান, যে পুরী কেউ কখনও দেখেনি, যার সঙ্গে আমাদের মতো সাধারণ জনের কোনওই পরিচয় নেই, কবিরাই শুধু যাকে মর্ত্যলোকে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেন–
কোথা হায় সেই আনন্দনিকেতন?
স্বপ্নেই শুধু দেখি সে ভুবন আমি,
রবির এল, কেটে গেছে হায়, যামী
ফেনার মতন মিলে গেল এ স্বপন।
আখ ইয়েনসে লান্ট ডের ভনে,
ডাস্ জে ই অফ ইম্ ট্রাউম,
ডখ কমট ডি মর্গেনজনে,
ফেরফ্লিস্টস্ ভি আইটেলশাউম্।
আমি কিন্তু যেখানে আছি সেখানেই থাকতে ভালোবাসি। নিতান্ত বিপদে না পড়লে আমি আপন গা ছেড়ে বেরুতে রাজি হইনে। দেশভ্রমণ আমার দু চোখের দুশমন। তাই যখন রবিঠাকুর আপন ভূমির গান গেয়ে ওঠেন তখন আমি উদ্ধাহু হয়ে নৃত্য আরম্ভ করি।
শোনো–
তোমরা বল, স্বর্গ ভালো
সেথায় আলো
রঙে রঙে আকাশ রাঙায়
সারা বেলা।
ফুলের খেলা
পারুল ডাঙায়!
হক না ভালো যত ইচ্ছে–
কেড়ে নিচ্ছে
কেউ বা তাকে বলল, কাকী?
যেমন আছি
তোমার কাছেই
তেমনি থাকি!
ঐ আমাদের গোলাবাড়ি
গোরুর গাড়ি
পড়ে আছে চাকা ভাঙা,
গাবের ডালে
পাতার লালে
আকাশ রাঙা।
সন্ধেবেলায় গল্প বলে
রাখো কোলে
মিটমিটিয়ে জ্বলে বাতি।
চালতা-শাখে
পেঁচা ডাকে।
বাড়ে রাতি।
স্বর্গে যাওয়া দেব ফাঁকি
বলছি, কাকী,
দেখব আমায় কে কী করে।
চিরকালই
রইব খালি
তোমার ঘরে।
এ ছেলে তার কাকিমার কোলে বসে গলা জড়িয়ে যা বলেছে সে-ই আমার প্রাণের গান, তাতে আমার সর্ব দেহ-মন সাড়া দেয়। বিস্তর দেশভ্রমণের পর আমি তাই এই ধরনের একটি কবিতা লিখেছিলুম। কত না ঝুলোঝুলি, তারও বেশি ধন্নে দেবার পরও যখন কোনও সম্পাদক সেটা ছাপাতে রাজি হননি– বসুমতীর সম্পাদকও তাঁদেরই একজন– তখন তোমাদের ঘাড়ে আজ আর সেটা চাপাই কোন অধম বুদ্ধিতে?
দুম করে ধাক্কা লাগতে সংবিতে ফিরে এলুম। লঞ্চ পাড়ে লেগেছে। কিন্তু এরকম ধাক্কা লাগায় কেন? আমাদের গোয়ালন্দ-চাঁদপুরে তো এরকম বেয়াদবি ধাক্কা দিয়ে জাহাজ পাড়ে ভিড়ে না!
আবার!
সেই পূর্ণিমা সন্ধ্যায়,
দেশ পানে মন ধায়।
.
১৩.
সুয়েজ বন্দর কিছু ফেলনা বন্দর নয়। বন্দরটার সামরিক গুরুত্ব স্ট্রাটেজিক ইম্পর্টেনস– আছে বলে ইংরেজকে তার নৌবহরের একটা অংশ এখানে রাখতে হয়। যেসব গোরাদের ক্যাম্বিসের নৌকোয় করে জলকেলি করতে দেখেছিলুম তারাই এইসব নৌবহরের তদারকি করে। ফলে তাদের জন্য এখানে দিব্য একটা কলোনি গড়ে উঠেছে।
কিন্তু কিছুই নয়, কিছুই নয়, পূর্বের তুলনায় আজ সুয়েজ বন্দরের কী আর জমক জৌলুস! কেপ অব গুড হোপের পথ না বেরুনো পর্যন্ত, এমনকি তার পরও ভারতবর্ষ, বার্মা, মালয়, যবদ্বীপ, চীন থেকে যেসব জিনিস রপ্তানি হত তার অধিকাংশই সমুদ্রপথে এসে নামত সুয়েজ বন্দরে এবং ভুললে চলবে না, তখনকার দিনে প্রাচ্যই রপ্তানি করত বেশি। এখান থেকেই ফিনিশিয়ানরা, তার পরে গ্রিক, তার পর রোমান, তার পর আরবরা ভারতের দিকে রওনা হত। ভারত থেকে মাল এনে সুয়েজে নামানো হত। সুয়েজ থেকে একটা খালে করে এসব মাল যেত কাইরোতে এবং সেখান থেকে নীল নদ বয়ে সে মাল পৌঁছত আলেকজেনড্রিয়ায় আরবিতে যাকে বলে ইসকনদরিয়া। সেখান থেকে ভেনিসের মাধ্যমে তাবৎ ইউরোপ।
এইসব মাল কেনাকাটা আমদানি-রপ্তানিতে ভারতবর্ষের প্রচুর সদাগর-শ্ৰেষ্ঠী, মাঝি-মাল্লার বিরাট অংশ ছিল। যে যুগে ভাস্কো-দা-গামা এ পথকে নাকচ করে দেবার জন্য আফ্রিকা ঘুরে ভারতে আসার পথ বের করলেন সে যুগের পূর্বে প্রাচ্যের তাবৎ ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল ভারতীয় এবং সুয়েজ অঞ্চলের মিশরীয়দের হাতে।
একদিকে ভারতীয় এবং মিশরীয়; অন্য দিকে ভাস্কো-দা-গামার বংশধর পর্তুগিজ দল।
জাত তুলে কথা কইতে নেই, তাই ইশারা-ইঙ্গিতে কই। এই যে পর্তুগিজ গুণ্ডারা গোয়া নিয়ে আজ দাবড়াদাবড়ি করছে এ কিছু নতুন নয়। ওদের স্বভাব ওই। এক কালে তারা জলে বোম্বেটে ছিল, এখন তারা ডাঙার গুণ্ডা। বোম্বেটে শব্দের মূল আর অর্থ অনুসন্ধান করলেই কথাটা সমপ্রমাণ হবে। বোম্বেটে কিছু বাঙালিদের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে বানানো আজগুবি কথা নয়। বোম্বেটে শব্দ এসেছে ওই পর্তুগিজদের ভাষা থেকেই (bombardeiro), অর্থাৎ যারা না-বলে না-কয়ে যত্র-তত্র bomba)– বোমা ফেলে। হয়তো বলবে, আমাদের কলকাতাতেই কেউ কেউ এরকম বোমা ফেলে থাকে, কিন্তু তাদের সংখ্যা এতই নগণ্য এবং ঘৃণ্য যে আজ তাবৎ কলকাতাবাসীকে কেউ বোম্বেটে নাম দেয়নি। কিন্তু তাবৎ পর্তুগিজরাই এই অপকর্ম করত বলে তাদের নাম হয়ে গেল বোম্বেটে।
ওদের দ্বিতীয় নাম—-আমাদের বাঙলা ভাষাতেই হারমদ সেটাও পর্তুগিজ কথা ama da থেকে এসেছে। বিখ্যাত কোষকার স্বর্গীয় জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তার সুবিখ্যাত অভিধানে এ শব্দের অর্থ করতে গিয়ে বলেছেন, পর্তুগিজ জলদস্যুরা যখন বাঙলা দেশের সুন্দরবন অঞ্চলে প্রথম হানা দেয় তখন তাদের অসহ্য অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাঙালিরা সুন্দরবন অঞ্চল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। আমাদের ঘরোয়া কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চণ্ডীকাব্যে আছে–
ফিরিঙ্গির দেশখান বাহে কর্ণধারে।
রাত্রিতে বহিয়া যায় হারমদের ডরে ॥
অর্থাৎ এইসব হারমদ–amada বোম্বেটে bombardeiro-দের ডরে তখন দক্ষিণ বাঙলার লোক নিশ্চিত মনে ঘুমুতে পারত না।
এস্থলে যদিও অবান্তর, তবু প্রশ্ন, বাঙালিরা এত ভয় পেয়ে পালাল কেন?
উত্তরে বলি, যে কোনও বন্দরে জাহাজ থেকে নেমে, একপাল লোক সেটাকে লুটতরাজ করতে পারে। এটা আদপেই কোনও কঠিন কর্ম নয়, যদি,
এইখানেই এক বিরাট যদি–
যদি সে রাজা তার সমুদ্রকূল রক্ষার জন্য নৌবহর মোতায়েন না করেন। জনপদ রক্ষা করার জন্য যেরকম পুলিশ-সেপাই রাজাকেই রাখতে হয়, ঠিক তেমনি সমুদ্রকূলবাসীদের হেপাজতির জন্য রাজাকেই নৌবহর রাখতে হয়।
কিন্তু হায়, তখন বাঙলা দেশ হুমায়ুন, আকবর মোগল বাদশাদের হুকুমে চলে। মোগলরা এদেশে এসেছে মধ্য এশিয়ার মরুভূমি থেকে। তারা শক্ত মাটির উপরে খাড়া পদাতিক, অশ্ববাহিনী, হস্তিযূথ, স্ত্রবাহিনী চতুরঙ্গ সৈন্যসামন্তের কী প্রয়োজন সে তত্ত্ব বিলক্ষণ বোঝে, কিন্তু নৌবহর রাখার গুরুত্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন। বাঙলা, উড়িষ্যা গুজরাত থেকে তাদের কাছে অনেক করুণ আবেদন-নিবেদন গেল–হুঁজুরেরা দয়া করে একটা নৌবহরের ব্যবস্থা করুন; না হলে আমরা ধনে-প্রাণে মানে-ইজ্জতে গেলুম।
কথাগুলো একদম শব্দার্থে আঁটি। ধন গেল, কারণ পর্তুগিজ বোম্বেটেদের অত্যাচারে ব্যবসা-বাণিজ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধ। প্রাণ যায়, কারণ তারা বন্দরে বন্দরে লুটতরাজের সময় যেসব খুনখারাবি করে তারই ফলে বন্দরগুলো উজাড় হতে চলল। মান-ইজ্জত? ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে পর্তুগালের হাটবাজারে গোলাম বাদি, দাসদাসীরূপে বিক্রয় করছে।
কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা! মোগল বাদশারা বসে আছেন পশ্চিম পানে, খাইবার পাসের দিকে তাকিয়ে। ওই দিক থেকেই তারা এসেছেন স্বয়ং, তাদের পূর্বে এসেছে পাঠান শক্-হুঁ-সিথিয়ান-এরিয়ান। তাই তাঁরা তৈরি করেছেন চতুরঙ্গ। ওদের ঠেকাবার জন্য। নৌবহর চুলোয় যাক গে। ভারতবর্ষ তো কখনও সমুদ্রপথে পরাজিত এবং অধিকৃত হয়নি। তার জন্য বৃথা দুশ্চিন্তা এবং অযথা অক্ষয় অতিশয় অপ্রয়োজনীয়।
ফলে কী হল? পর্তুগিজদের তাড়িয়ে দিয়ে ইংরেজ সমুদ্রপথেই মোগলদের মুণ্ডু কেটে এদেশে রাজ্য বিস্তার করল।
সেকথা পরের কথা। উপস্থিত আমরা আলোচনা করছি, ভারতীয় উপকূলবাসীরা পর্তুগিজদের সঙ্গে যে লড়াই দিয়েছিল তাই নিয়ে। এরা তো মোগলদের কাছ থেকে কোনও সাহায্যই পেল না, উল্টো যারা লড়ছিল, তাদের সঙ্গে আরম্ভ করলেন শক্রতা।
গুজরাতের রাজা বাহাদুর শাহ্ বাদশাহ তখন লড়ছিলেন পর্তুগিজ বোম্বেটেদের সঙ্গে। তার প্রধান কারণ, গুজরাতের সুরাট, ব্রউফ (ভৃগু, খন্বত Cambay, স্তম্ভপুরী) ভিতর দিয়ে উত্তর-ভারতের যাবতীয় পণ্যবস্তু ইয়োরোপে যেত। সে ব্যবস্থা তখন পর্তুগিজ বোম্বেটেদের অত্যাচারে মরমর। বাহাদুর শাহ্ বাদশার দুই শক্র। একদিকে সমুদ্রপথে পর্তুগিজ, অন্যদিকে স্থলপথে রাজপুত। প্রথম রাজপুতদের হারিয়ে দিয়ে পরে পর্তুগিজদের খতম করার প্ল্যান করে তিনি পর্তুগিজদের সঙ্গে করলেন– আর্মিসি-সমরকালীন সন্ধি। তার পর হানা দিলেন রাজপুতনায়।
দিল্লিতে তখন রাজত্ব করেন বাদশা হুমায়ুন। ইতিহাসে নিশ্চয়ই পড়েছ, তখন এক রাজপুতানি শাহ-ইন-শাহ দিল্লীশ্বর জগদীশ্বরকে পাঠালেন রাখী। সেই রাখীর সম্মানার্থে হুমায়ুন ছুটলেন রাজপুতনার দিকে। বুঝলেন না, বাহাদুর শাহ্ হেরে গেলে পর্তুগিজদের আর কেউ ঠেকাতে পারবে না। পূর্বেই বলেছি, নৌবহর নৌসাম্রাজ্য বলতে কী বোঝায়, মোগলরা সেকথা আদপেই বুঝত না।
হুমায়ুন রাজপুতনায় পৌঁছলেন দেরিতে। বাহাদুর শাহ বাদশাহ তখন রাজপূতনা জয় করে ফেলেছেন। রাজপুতানিরা জৌহতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। হুমায়ুন তখন আক্রমণ করলেন বাহাদুর শাহকে। বাহাদুর তখন পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন চম্পানির দুর্গে। সেখানে কী করে হুমায়ুন দুর্গ জয় করলেন সে কাহিনী অবশ্য ইতিহাসে পড়েছ। ইতোমধ্যে বাহাদুর দুর্গ ত্যাগ করে পালিয়েছেন গুজরাতে আপন রাজধানী আহমেদাবাদের দিকে। হুমায়ুন সেদিকে তাড়া লাগাতে তিনি পালালেন সৌরাষ্ট্র অর্থাৎ কাঠিওয়াড়ারের দিকে। সেখানকার কোনও কোনও উপকূলে তখন পর্তুগিজরা বেশ পা জমিয়ে বসেছে।
ইতোমধ্যে হুমায়ুন খবর পেলেন, বিহারের রাজা শেরশাহ দিল্লি জয় করার উদ্দেশ্যে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তদ্দণ্ডেই তিনি বাহাদুরকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে চললেন দিল্লির দিকে। সেখানে শেরশাহের কাছে মার খেয়ে তিনি পালালেন কাবুলে। তার পর শের শাহ ব্যস্ত হয়ে রইলেন, উত্তর-ভারতে আপন প্রতিষ্ঠা কায়েম করতে। বাহাদুরকে তাড়া দেবার ফুরসত তার নেই। বাহাদুর হাঁফ ছেড়ে বেঁচে বললেন, এইবার তবে পর্তুগিজ বদমায়েশদের ঠাণ্ডা করি। পর্তুগিজরা ততদিনে বুঝতে পেরেছে, বাহাদুরের পিছনে তখন আর শত্রু নেই তাই তারা আরম্ভ করল তাদের পুরনো বদমায়েশি। বাহাদুর শাহকে আমন্ত্রণ জানাল, তাদের জাহাজে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য সন্ধি-চুক্তি সম্বন্ধে যাবতীয় আলোচনা-পরামর্শ করার জন্য।
বাহাদুর আহাম্মুখের মতো কেন গেলেন সেই নিয়ে বিস্তর ঐতিহাসিকগণ বহু আলোচনা-গবেষণা করেছেন। সে নিয়ে আজ আর আলোচনা করে কোনও লাভ নেই।
তা সে যাই হোক, একথা কিন্তু সত্য, বাহাদুর জাহাজে ওঠামাত্রই বুঝতে পারলেন, তিনি ফাঁদে পা দিয়েছেন। পর্তুগিজদের বদমতলব তাঁকে খুন করার, তাঁর সঙ্গে সন্ধি সুলেহ করার জন্য নয়। তক্ষুনি তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন জলে সাঁতরে পাড়ে ওঠার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে দশ-বিশটা পর্তুগিজও হাতে বৈঠা নিয়ে তার পিছনে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেইসব বৈঠা দিয়ে গুজরাতের শাহ্-ই-শাহ্ বাদশাহ্ বাহাদুর শাহের মাথা ফাটিয়ে দিলে।
পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের এই শেষ লড়াই।
***
কিন্তু আজ সুয়েজ বন্দরে ঢোকার সময় আমি দেশ পানে ফিরে গিয়ে এসব কথা পাড়ছি কেন?
কারণ এই সুয়েজের রাজাকেই বাহাদুর তখন ডেকেছিলেন তার নৌবাহিনী নিয়ে এসে পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে তাঁকে নৌ-সমরে সাহায্য করতে। পূর্বে বলেছি, সুয়েজও বেশ জানত পর্তুগিজদের বোম্বেটেগিরি তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য কতখানি মারাত্মক। শুধু বাহাদুর নয় তাঁর পূর্বপুরুষগণও বার বার এঁদের ডেকেছেন। দুয়ে মিলে পর্তুগিজদের একাধিকবার ঝিঙে-পোস্ত চন্দন-বাটা করেছেন।
তারা তখন যেসব কামান এনেছিল সেগুলো ফেরত নিয়ে যায়নি। গুজরাতের বাদশা যখন বললেন, এগুলো রেখে যাচ্ছেন কেন? তখন তারা বলেছিল, এইসব পর্তুগিজ বদমায়েশরা আবার কখন হানা দেবে তার ঠিকঠিকানা কী? আবার তখন কামান নিয়ে আসার হাঙ্গাম হুজ্জোত ঠেলবার কী প্রয়োজন?
এ ঘটনার দশ বৎসর পর আকবর গুজরাত জয় করেন। তিনি কামানগুলো দেখে তাদের পূর্ববর্তী ইতিহাস জেনেও নৌবাহিনী নৌ-সমরের মূল্য বুঝতে পারেননি। তাই পর্তুগিজরা জিতল। তাদের হারিয়ে দিয়ে ইংরেজ জিতল। ক্রমে ক্রমে মাদ্রাজ কলকাতা হয়ে তাবৎ ভারতবর্ষে আপন রাজ্য বিস্তার করল।
***
আজ সুয়েজে ঢুকে সেই কথাই স্মরণে এল, এই সুয়েজের লোকই একদিন আমাদের সঙ্গে একজোট হয়ে পর্তুগিজ বর্বরতার বিরুদ্ধে কী লড়াই-ই দিয়েছিল।
.
১৪.
সম্বিতে ফিরে এলুম। দেখি বখেড়া লেগে গিয়েছে। বন্দরে নেমে যে দপ্তরের ভিতর দিয়ে যেতে হয় সেখানে আমাদের অর্থাৎ আবুল আসফিয়ার দলকে আটকে দিয়েছেন বন্দরের কর্তারা। কেন কী ব্যাপার? আমাদের হেলথ সার্টিফিকেট কই? সে আবার কী জ্বালা? দিব্যি তো বাবা লঞ্চ থেকে নেমে পায়ে হেঁটে এখানে এলুম, স্ট্রেচারে চেপে কিংবা মড়ার খাঁটিয়ায় শুয়ে আসিনি তবে আমাদের হেলথ সম্বন্ধে এত সন্দ কেন? উঁহু, কর্তারা বলছেন আমরা যে ভিতরে ভিতরে বসন্ত, প্লেগ, কলেরা, সেৎসেত সে জ্বর (সে আবার কী মশাই?) স্পটেড ফিভার (ততোধিক, সমস্যা আলপনা-কাটা জ্বর?) ইত্যাদি যাবতীয় মারাত্মক রোগে ভুগছি না তার সার্টিফিকেট কই। আমরা যে এসব পাপিষ্ঠ রোগ তাদের সোনার দেশ মিশরে ছড়াব না, তার কি জিম্মাদারি?
শুনে পার্সি বলছে, স্যর, এসব মারাত্মক রোগেই যদি ভুগব, তবে বাপ-মার সেবাশুশ্রূষা ছেড়ে পাদ্রিসাহেবের শেষ ধর্মবচন না শুনে এখানে আসব কেন?
দ্যাশের লোক প্রতুল সেন বলছে, মিশরের সঙ্গে এরকম ধারা দুশমনি আমরা করতে যাব কেন?
তার বউ রমা বলছে, পিরামিড তোমাদের গৌরবের বস্তু; আমাদের যেরকম তাজমহল। তার কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ সে বিচারের সুযোগ না দিয়ে আপনারা আপন দেশের প্রতি কী অবিচার করছেন বুঝতে পারছেন কি?
আমি কানে কানে রমাকে শুধালুম, তবে কুকের সঙ্গে যে সব লোক এসেছিল তারা পেরুল কী করে?
রমা বললে, চুপ করুন, ওরা যে ওই সব হলদে হলদে কাগজ দেখালে। আমাদেরও আছে। জাহাজে ফেলে এসেছি। আমরা তো জানতুম না এখানে ওসব রাবিশের দরকার হবে। কুকের লোক জানত, ওরা তাই সার্টিফিকেট এনেছিল।
ওহ! তখন মনে পড়ল পাসপোর্ট নেবার সময় ভ্যাকসিনেশন ইনকুলেশন করিয়েছিলুম বটে এবং ফলে একখানা হলদে রঙের সার্টিফিকেটও পেয়েছিলুম বটে। সেইটে নেই বলেই এখানে এ গর্দিশ।
কিন্তু এ শিরঃপীড়া তো আমাদের নয়। আবুল আসফিয়া যখন আমাদের দলের নেতা তখন তারই তো বোঝা উচিত ছিল ওই ম্যাটমেটে হলদে রঙের কাগজটা আমাদের সঙ্গে নিয়ে আসা অতিশয় প্রয়োজনীয়। এই সামান্য কাণ্ডজ্ঞান যার নেই–
চিন্তাধারায় বাধা পড়ল। দেখি, পল আমার হাত টানছে আর কানে কানে বলছে, চলুন জাহাজে ফিরে যাই।
কিন্তু আবুল আসফিয়া কোথায়?
তিনি দেখি নিশ্চিন্ত মনে, একে সিগারেট দিচ্ছেন, ওকে টফি খাওয়াচ্ছেন, তাকে চকলেট গেলাচ্ছেন। কোলে আবার একটা বাচ্চা। খোদায় মালুম কার?
লোকটা তা হলে বদ্ধ পাগল! পাগলের সংস্পর্শ ত্যাগ করাই ধৰ্মাদেশ।
পলের হাত ধরে পোর্ট-আপিস ছেড়ে সমুদ্রের কিনারায় পৌঁছলুম। তখন দেখি আমাদের জাহাজ ভোঁ ভোঁ করে গুরুগম্ভীর নিনাদে সুয়েজ খালে ঢুকে গিয়েছে।
১৫. দেশভ্রমণ আমি বিস্তর করেছি
১৫.
দেশভ্রমণ আমি বিস্তর করেছি। সামান্য কিছু ঘটতে না ঘটতেই আমি বিচলিত হয়ে পড়িনে। রিফ্রেশমেন্ট রুমে চা খেতে গিয়েছি, ওদিকে গাড়ি আমার বাক্স-তোরঙ্গ বিছানা-বালিশ নিয়ে চলে গিয়েছে, বিদেশ-বিভুঁইয়ে মানিব্যাগ চুরি যাওয়াতে আমি কপর্দকহীন, ইতালির এক রেস্তোরাঁয় দুই দলে ছোরা-ছুরি হচ্ছে– আমি নিরীহ বাঙালি এক কোণে দেয়ালের চুনকামের মতো হয়ে গিয়ে আত্মগোপন করার চেষ্টা করছি– এসব ঘটনা আমার জীবনে একাধিকবার ঘটেছে। কিন্তু এবার সুয়েজ বন্দরে, আবুল আসফিয়ার পাল্লায় পড়ে যে বিপদে পড়লুম তার সঙ্গে অন্য কোনও গর্দিশের তুলনা হয় না।
আমাদের জাহাজ তার আপন পথে চলে গিয়েছে। আমরা এখানে আটকা পড়েছি হেলথ সার্টিফিকেট নেই বলে। তা হলে এখানকার কোনও হোটেলে উঠতে হয় এবং প্রতি জাহাজে ধন্না দিতে হয়, আমাদের জায়গা দেবে কি না। খুব সম্ভব দেবে না। কারণ সেই পোড়ামুখো হেলথ সার্টিফিকেট না থাকলে জাহাজেও উঠতে দেয় না। এস্থলে জলে কুমির ডাঙায় বাঘ নয় এখানে জলে সাপ ডাঙায়ও সাপ।
জাপানি আক্রমণের সময়ে একটা গাঁইয়া গান শুনেছিলুম,
সা রে গা মা পা ধা নি
বোমা পড়ে জাপানি
বোমা-ভরা কালো সাপ
ব্রিটিশ কয় বাপ রে বাপ!
তাই মনে হল জাপানিরা যেন জলে-ডাঙায়, উভয়ত হেলথ সার্টিফিক্যেটের সাপ ফেলে গেছে।
আর ডাঙার হোটেলে থাকতে দেবেই-বা কদিন? আমাদের ট্যাকে যা কড়ি তার খবর হোটেলওয়ালা ঠিক ঠিক ঠাহর করতে পেরে নিশ্চয়ই আমাদের দুদূর করে তাড়িয়ে দেবে। তখন যাব কোথায়, খাব কী? তখন অবস্থা হবে সুয়েজ বন্দরের ধনী-গরিব সক্কলের কাছে ভিখ মাঙবার, কিন্তু কেউ কিছু দেবে কি? রেল ইস্টিশনে যখন কেউ এসে বলে, মশাই মানিব্যাগ চুরি গিয়েছে; চার গণ্ডা পয়সা দিন, বাড়ির ইস্টিশানে যেতে পারব, তখন কি কেউ শোনামাত্রই পয়সা ঢালে?
ইয়া আল্লাহ এ কোথায় ফেললে বাবা? এ যেন অকূল সমুদ্রের মাঝখানে দ্বীপবাস।
মানুষ যখন ভেবে কোনওকিছুর কূলকিনারা করতে পারে না তখন অন্যের ওপর নির্ভর করার চেষ্টা করে। পল-পার্সিকে নিয়ে ফিরে গেলুম আবুল আসফিয়ার কাছে।
তিনি দেখি ঠিক সেই মুহূর্তেই পোর্ট অফিসারকে শুধাচ্ছেন, তা হলে হেলথ সার্টিফিকেট কোথায় পাওয়া যায়?
এ যেন পাগলের প্রশ্ন! হেল্থ সার্টিফিকেট তো পাওয়া যায় আপন দেশে; এখানে পাব কী করে?
তাই আপন কানকে বিশ্বাস করতে পারলুম না যখন অফিসার বললেন, কেন ওই তো পাশের দফতরে।
তাহলে এতক্ষণ ধরে এসব টানাহ্যাঁচড়ার কী ছিল প্রয়োজন? ভালো করে শোনার পূর্বেই আমরা সব কটা প্রাণী ছুট দিলুম সেই দফতরের দিকে। জলের সাপ, ডাঙার সাপ, সা-রে-গা-মার জাপানি সাপ সব-কটা তখন এক জোটে যেন আমাদের তাড়া লাগিয়েছে।
দফতরের দরওয়াজা খোলাই ছিল। দেখি এক বিরাট বপু ভদ্রলোক ছোট্ট একখানা চেয়ারে তার বিশাল কলেবর খুঁজে-পুরে টেবিলের উপর পা দুখানি তুলে ঘুমুচ্ছেন। আমরা অট্টরোল করে না ঢুকলে নিশ্চয়ই তাঁর নাকের ফরফরানি শুনতে পেতুম। আমাদের হেলথ সার্টিফিকেট হেলথ সার্টিফিকেট, প্লিজ, প্লিজ, এ উৎকট সমবেত সঙ্গীতে অবশ্য ইয়োরোপীয় সঙ্গীত, যার এ সপ্তকে বাজে তোড়ি অন্য সপ্তকে পূরবী ভদ্রলোক চেয়ারসুদ্ধ লাফ মেরে উঠলেন।
শতকরা নিরানব্বই জন যাত্রী হেলথ সার্টিফিকেট নিয়ে বন্দরে নামে। সুতরাং এ ভদ্রলোকের শতকরা নিরানব্বই ঘণ্টাই কাটে আধো ঘুমে, আধো জাগরণে। তাই আমরা কী বেদনা-কাতর হয়ে তার কাছে এসেছি সেটা বুঝতে তার বেশ একটু সময় লাগল।
তাঁর ভাষা আমরা বুঝিনে, তিনি আমাদের ভাষা বোঝেন না। তৎসত্ত্বেও যে মারাত্মক দুঃসংবাদ তিনি দিলেন তার সরল প্রাঞ্জল অর্থ, যে ডাক্তার আমাদের পরীক্ষা করে সার্টিফিকেট দেবেন তিনি বাড়ি চলে গেছেন।
গোটা সাতেক ভাষায় তখন যে আরব উঠল তাকে বাঙলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়–
ওই য-যা!
ফরাসিরা বলেছিল মঁ দিয়ো, মঁ দিয়ো!
জর্মনরা বলেছিল, হের গট, হের গট!
ইরানিরা বলেছিল, ইয়াল্লা, ইয়া খুদা!
আর কে কী বলেছিল, মনে নেই।
কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অসীম করুণা, আল্লাতায়ালার বেহ মেহেরবানি, রাখে কেষ্ট মারে কে, ধন্যবাদ ধন্যবাদ। শুনি অফিসার বলছেন, কিন্তু আপনারা যখন বহাল তবিয়তে, দিব্য ঘোরাফেরা করছেন তখন আপনারা নিশ্চয়ই স্বাস্থ্যবান! সার্টিফিকেট আমিই দেব। এই নিন ফর্ম। ফিল্ আল্ করুন। বলেই এক তাড়া বিশ্রী নোংরা বাদামি ফরম আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন। কিন্তু আমার মনে হল, আহা কী সুন্দর! যেন ইস্কুলের প্রোগ্রেস রিপোর্ট, আর সব-কটাতে লেখা আছে আমি ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছি।
শকুনির পাল যেরকম মড়ার উপর পড়ে, আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লুম সেই গাজী মিয়ার বস্তানির উপর। উঁহু, ভুল উপমা হল, বীভৎস রসের উপমা দিতে আলঙ্কারিকরা বারণ করেছেন। তা হলে বলি, ফাঁসির হুকুম নাকচ করে দেবার অধিকার পেলে মা যেরকম নাকচের ফর্মের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
উৎসাহে, উত্তেজনায় আমাদের সবাইকার মাথা তখন ঘুলিয়ে গিয়েছে। ফর্মে প্রশ্ন, কোন সালে তোমার জন্ম? কিছুতেই মনে পড়ছে না, ১৮০৪– না ১৭০৪? প্রশ্ন, কোন বন্দরে জাহাজ ধরেছে? বেবাক ভুলে গিয়েছি, হংকং না তিব্বত। প্রশ্ন, যাবে কোথায়? হায়, হায়, টাকের বাকি আড়াই গাছা চুল ছিঁড়ে ফেললুম, তবু কিছুতেই মনে পড়ছে না, শনি গ্রহে না ধ্রুবতারায়!
তা সে যাক গে, আমরা কী লিখেছিলুম তাই নিয়ে উত্তষ্ঠিত হওয়ার কোনও প্রয়োজন ছিল না। পরে জানলুম, সেই সহৃদয় অফিসারটি ইংরেজি পড়তে পারেন না।
ঝপাঝপ বেগুনি স্ট্যাম্প মেরে তিনি আমাদের গণ্ডা আড়াই সার্টিফিকেট ঝেড়ে দিলেন। আমরা সেগুলো বসরাই গোলাপের মতো বুকে খুঁজে খোলা ধোঁয়াড়ের গরুর মতো বন্দরের অফিস থেকে সুড়সুড় করে স্বাধীনতার মুক্ত বাতাসে বেরিয়ে এলুম। এখন আমরা ইচ্ছে করলে কেপ করিন যেতে পারি, ইচ্ছে না করলে কোথাও যাব না।
পল বললে স্যর, কী লিখতে কী লিখেছি কিচ্ছটি জানিনে।
আমি বললুম, কিছু পরোয়া কর না ভাই! অম্মো তদবৎ!
ফরাসি রমণী হেসে বললেন, মঁসিয়ে পল, আমাকে যদি জিগ্যেস করত তুমি বকরি না মানুষ? তা হলে আমি প্রথম খানিকটে ব্যা ব্যা করে নিতুম, তার পর আপন মনে খানিকটে ফরাসি বলে নিয়ে দেখতুম কোনটা ভালো শোনাচ্ছে এবং সেই হিসেবে লিখে দিতুম বকরি না মানুষ।
তার পর খানিকটে ভেবে নিয়ে বললেন, অবশ্য বকরির সম্ভাবনাই ছিল বেশি।
আমার বুকে বড্ড বাজল। নিজের প্রতি এ যে অতিশয় অহেতুক অশ্রদ্ধা। বললুম, মাদমোয়াজেল বরঞ্চ কোকিল লিখলে আমি আপত্তি জানাতুম না। আপনার মধুর কণ্ঠ
ব্যস, ব্যস হয়েছে, হয়েছে; থ্যাঙ্ক্যু!
ততক্ষণে রেলস্টেশনের কাছে এসে পৌঁছেছি। দূর থেকে দেখি ট্রেন দাঁড়িয়ে। আমরা পা চালালুম। কিন্তু গেটের কাছে আসতে না আসতেই ট্রেনখানা ধ্যাৎ-ধ্যাৎ করে যেন আমাদের ঠাট্টা করে প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে গেল।
এবং একটা লোক– চেনা-চেনা মনে হল আমাদের দিকে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বিদায় জানালে তার পর যেন কত না বিরহ বেদনাতুর সেইভাবে দু হাতের উল্টো দিক দিয়ে অদৃশ্য অশ্রু মুছলে।
এ মস্করার অর্থ কী?
শুনলুম, আজ সন্ধ্যায় কাইরো যাবার শেষ ট্রেন এই চলে গেল। কাল সকালের ট্রেন ধরলে কাইরো মাথায় থাকুন সঈদ বন্দরে পৌঁছতে পারব না, অর্থাৎ নির্ঘাত জাহাজ মিস্ করব। এই শেষ ট্রেন ছিল আমাদের শেষ ভরসা।
এ দুঃসংবাদ শুনে আমি তো মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লুম।
কিন্তু ভগবান মানুষকে নিয়ে এরকম লীলা-খেলা করেন কেন? সেই যদি সুয়েজ বন্দরে আটক হতে হল, সেই যদি বোট মিস করতে হল, তবে ওই হেলথ সার্টিফিক্যেটের প্রথম খেয়াড়ে আটকা পড়লেই তো হত। সে ফাড়াকাটিয়ে এসে এখানে আবার কানমলা খাবার কী প্রয়োজন ছিল?
শুনেছি, কোনও কোনও জেলার ফাঁসির আসামিকে নাকি গারদের দরজা সামান্য খুলে রেখে জেল থেকে পালাবার সুযোগ দেয়। আসামি ভাবে, জেলার বেখেয়ালে দরজা খুলে রেখে গিয়েছে। তার পর অনেক গা ঢাকা দিয়ে, একে এড়িয়ে, ওকে বাঁচিয়ে যখন সে জেলের বাইরে মুক্ত বাতাসে এসে ভাবে সে বেঁচে গেছে, ঠিক তখনই তাকে জাবড়ে ধরে দুই পাহারাওয়ালা– সঙ্গে জেলার তাকে চুমো খেয়ে বলে, ভাই, জীবন কত দুঃখে ভরা। তার থেকে তুমি নিষ্কৃতি পাবে কাল ভোরে। আহামুখের মতো সে নিষ্কৃতি থেকে এই হেয় নিষ্কৃতির চেষ্টা তুমি কেন করছিলে, সখা?
পরদিন তার ফাঁসি হয়।
আমার মনে হয়, ফাঁসির চেয়েও ওই যে জেলের বাইরে ধরা পড়া সেটা অনেক কঠোর, কঠিন, নির্মম।
কারণ, মৃত্যু, সে তো কিছু কঠিন কঠোর অভিজ্ঞতা নয়। ডাক্তাররাও বলেন, রোগে মানুষ কষ্ট পায় কিন্তু ঠিক প্রাণত্যাগ করার সময় মানুষ কোনও বেদনা অনুভব করে না।
তাই গুরুদেব বলছেন–
কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়
জয় অজানার জয়!
ঠিক সেইরকমই এক মহাপুরুষ– হিটলারের নৃশংসতার বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত ছিলেন বলে এঁর ফাঁসির হুকুম হয়– জেলে বসে কবিতা লিখেছিলেন,
ডু কান্ স উনস্ ডুর্ষ ডেস টডেস ট্যুরেন
ট্রয়েমেন্ত ফুরেন্।
উন্ট মাখস্ট উস্ আউফ আইনমাল ফ্রাই।
তুমি আমাদের মৃত্যুর দ্বার দিয়ে হাতে ধরে নিয়ে চল।
— আমরা যেন স্বপ্নে চলেছি–
হঠাৎ দেখি, আমরা স্বাধীন।
এই বই ছোটদের জন্য লেখা। তারা হয়তো শুধাবে, মৃত্যুর কথা তাদের শোনাচ্ছি কেন? আমার মনে হয়, শোনান উচিত। সাধারণত বড়রা ছোটদের যত আহাম্মুখ মনে করেন আমি বুড়ো হয়েও সেরকম ভাবিনে।
আমার বয়স যখন তেরো, তখন আমার সবচেয়ে ছোট ভাই বছর দুয়েক বয়সে মারা যায়। ভারি সুন্দর ছেলে ছিল সে। আমার কোলে বসতে বড় ভালোবাসত। ওই দু বছর বয়সে সে আমার সাইকেলের রডে বসে হ্যাঁন্ডেল আঁকড়ে ধরে থাকত আর আমি বাড়ির লনে পাক লাগাতুম। মাঝে মাঝে সে খল খল করে হেসে উঠত আর মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে খুশি হয়ে আমাদের দিকে তাকাতেন কিন্তু মাঝে মাঝে বলতেন, থাক হয়েছে। এখন ওকে তুই নামিয়ে দে।
একদিন সে চলে গেল।
আমি বড্ড কষ্ট পেয়েছিলুম।
তখন আমায় কেউ বুঝিয়ে বলেনি, মৃত্যু কাকে বলে? তার অর্থ যদি তখন আমাকে কেউ বুঝিয়ে বলত তবে বেদনা লাঘব হত।
বড়রা ভাবেন, ছোটদের বেদনাবোধ কম। সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
তোমরা যারা আমার বই পড়ছ, তোমাদের কেউ কি ভাই-বোন হারাওনি? সে বুঝবে।
কবিগুরুর ছোট ভাই-বোন ছিলেন না। তাই বিস্ময় মানি তিনি কী করে লিখলেন–
কাকা বলেন, সময় হলে
সবাই চলে
যায় কোথা সেই স্বর্গপারে।
বল তো কাকী।
সত্যি তা কি একেবারে?
তিনি বলেন, যাবার আগে
তন্দ্রা লাগে
ঘণ্টা কখন ওঠে বাজি,
দ্বারের পাশে।
তখন আসে
ঘাটের মাঝি।
বাবা গেছেন এমনি করে
কখন ভোরে
তখন আমি বিছানাতে।
তেমনি মাখন
গেল কখন।
অনেক রাতে।* [* শিশু ভোলানাথ, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ত্রয়োদশ খণ্ড ১০৮-পৃ.।]
এই কাকাটি সত্যই ছোট ছেলের বেদনা বুঝতেন।
কিন্তু মূল কথা থেকে কত দূরে এসে পড়েছি। তাই মৃত্যু সম্বন্ধে শেষ কথা বলে মূল কথায় ফিরে যাই। ভগবানে আমার অবিচল বিশ্বাস। তাই আমি জানি, আমি যখন মরণের সিংহদ্বার পার হব তখন দেখব বাবা, ঠাকুরদা, তার বাবা তার বাবা আরও কত শত ঊর্ধ্ব-পুরুষ সৌম্যবদনে এগিয়ে আসছেন আমাকে তাদের মাঝখানে বরণ করে নেবার জন্য। এবং জানি, জানি, নিশ্চয় জানি, তাঁদের সকলের সামনে দাঁড়িয়ে আমার মা আমার ছোট ভাইকে হাসিমুখে কোলে নিয়ে। তার চেয়েও আশ্চর্য বোধহয় তখন মনের চোখে ছবি দেখি, আমার এই ছোট ভাই, একদা টলটলায়মান পায়ে আমার মায়ের দিকে এগিয়ে এসেছিল, তাঁকে আপনজনের মধ্যে নিয়ে যাবার জন্য, তার কোলে ওঠার জন্য। সে তো ও লোকে গিয়েছিল মায়ের বহু পূর্বে।
আমি যখন সে লোকে যাব তখন ভগবান শুধাবেন, তুমি কী চাও? আমি তৎক্ষণাৎ বলব, একখানা বাইসিকেল। পাওয়ামাত্রই তাতে ভাইকে রডে চড়িয়ে স্বর্গের লনে চক্কর লাগাব। সে খল খল করে হাসবে। মা দেখবে কিন্তু কখনও বলবে না, থাক্, হয়েছে। এখন ওকে তুই নামিয়ে দে।
***
অতএব সব বিপদ থেকেই নিষ্কৃতি আছে। গাড়ি গেছে তো তাতে ভয় পাবার অত কী?
দেখি, আবুল আসফিয়া নেই।
আমাদের এই অকূল সমুদ্র আর অন্তহীন মরুভূমির মাঝখানে ফেলে দিয়ে লোকটা পালাল নাকি?
স্টেশনের বাইরে তার খোঁজ করতে এসে দেখি, তিনি এক জরাজীর্ণ মোটরগাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে রসালাপ আরম্ভ করেছেন। অনুমান করলুম তিনি ট্যাকসিযোগে কাইরো পৌঁছবার চেষ্টাতে আছেন।
কিন্তু ট্যাকসিওয়ালা আমাদের মজ্জমান অবস্থা বিলক্ষণ বুঝে গিয়েছে এবং যা দর হাঁকছে তা দিয়ে দু খানি নতুন ট্যাক্সি কেনা যায়।
আবুল আসফিয়া তাকে বহুতর ধর্মের কাহিনী শোনাবার চেষ্টা করলেন, ততোধিক ভারত-মিশরীয় মৈত্রীর অকুণ্ঠ প্রশংসা করলেন এবং সর্বশেষে তিনি মুসলমান সে-ও মুসলমান, সে সত্যের দোহাই-কসম খেলেন কিন্তু ট্যাসিওয়ালাটি ধর্মে মুসলমান হলেও কর্মে খাঁটি দুর্যোধন। বিনা যুদ্ধে সে সূচ্যগ্র পরিমাণ ভূমি এগোবে না।
আবুল আসফিয়ার চোখে-মুখে কিন্তু কোনও উষ্মর লক্ষণ নেই। ভূ-পদাহত তিতিক্ষু শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় তিনি তখন চললেন হেলথ অফিসের দিকে। আমিও পিছু নিলুম।
সেই বিরাটবপু, ভদ্রলোক, যিনি আমাদের সার্টিফিকেট দিয়ে প্রথম ফাড়া থেকে উদ্ধার করেছিলেন তিনি ততক্ষণে আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন। এবার তাকে জাগাতে গিয়ে আবুল আসফিয়াকে রীতিমতো বেগ পেতে হল।
তাকে তখন তিনি যা বললেন, তার সরল অর্থ, তিনি ডাকাতকে ডরান না, ডাকাত বন্দুক উঁচালে তিনিও বন্দুক তুলতে জানেন কিন্তু এরকম বন্দুকহীন ডাকাতির বিরুদ্ধে লড়বার মতো হাতিয়ার তো তার নেই? অবশ্য তিনি ঘাবড়াননি, কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা করবেনই, তবে কি না অফিসারটি যদি একটু সাহায্য করেন তবে আমাদের উপকার হয়, তারও পুণ্য হয়।
অফিসার বললেন, চলুন।
তিনি ট্যাকসিওয়ালাদের সঙ্গে দু চারটি কথা বলেই আমাদের জানালেন কত দিতে হবে। হিসাব করে দেখা গেল, গাড়িতে ফার্স্ট ক্লাসে যা লাগত, ট্যাসিতে তাই লাগবে। আমরা তাতেই খুশি। কাইরো তো পৌঁছব, পোর্টসঈদে তো জাহাজ ধরতে পারব, তবে আর ভাবনা কী?
আমরা হুড়মুড় করে দু খানা ট্যাকসিতে কাঁঠালবোঝাই হয়ে গেলুম।
আমি অফিসারকে ধন্যবাদ দিয়ে ওঠার সময় বললুম, আপনি আমাদের জন্য এতখানি করলেন। সত্যই আপনার দয়ার শরীর।
তিনি ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে যা বললেন তা শুনে আমি অবাক। তার অর্থ তার শরীর আদপেই দয়ার শরীর নয়। তিনি কিছুমাত্র পরোপকার করেননি। আমরা একপাল ভিখিরি যদি সুয়েজ বন্দরে আটকা পড়ে যাই তবে শেষ পর্যন্ত তাঁদেরই ঘাড়ে পড়ব। আমাদের তাড়াতে পেরে তিনি বেঁচে গেছেন–ইত্যাদি।
আমি আপত্তি জানিয়ে মোটরে বসে ভদ্রলোকের কথাগুলো ভাবতে লাগলুম।
হঠাৎ বুঝতে পারলুম ব্যাপারটা কী—বহুদিন পূর্বেকার একটা ঘটনা মনে পড়ে যাওয়াতে।
রবীন্দ্রনাথের গানের ভাণ্ডারি ছিলেন তাঁর দাদার নাতি দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমার এক চিত্রকর বন্ধু বিনোদবিহারী একদিন তার দুরবিনটি ধার নিল- বেচারী চোখে দেখতে পেত কম। কয়েকদিন পরে সেটা ফেরত দিতে গেলে দিনুবাবু জিগ্যেস করলেন, কী রকম দেখলে?
আজ্ঞে, চমৎকার! বিনোদ এত দূরের জিনিস এর আগে কখনও দেখতে পায়নি। তবে ওটা তোমার কাছেই রেখে দাও। লোকে বড় জ্বালাতন করে। আজ ওটা এ চায়, কাল ওটা ও চায়, পরশু ওটা সে চায়। আমি পেরে উঠিনে। তোমার কাছে ওটা থাক।
বিনোদ একাধিকবার চেষ্টা করেও দুরবিন ফেরত দিতে পারেনি।
এই হল খানদানি লোকের পরোপকার পদ্ধতি। সে দেখায়, যেন সে আদপেই পরোপকার করেনি। নিতান্ত নিজের মঙ্গলের জন্য, আগাগোড়া সে স্বার্থপরের মতো কাজ করেছে।
বুঝলাম এ অফিসারটিও দিনুবাবুর সগোত্র। ইচ্ছে করেই সগোত্র শব্দটি ব্যবহার করলুম; আমার বিশ্বাস ইহসংসারের যাবতীয় ভদ্রলোক একই গোত্রের– তা তারা ব্রাহ্মণ হন আর চণ্ডাল হন, হিন্দু হন আর মুসলমান হন, কাফ্রি হন আর নর্ডিক হন।
ততক্ষণে আমরা বন্দর ছেড়ে মরুভূমিতে ঢুকে গিয়েছি। পিছনে তাকিয়ে দেখি, শহরের বিজলিবাতি ক্রমেই নিষ্প্রভ হয়ে আসছে– বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরনো স্মৃতি যেরকম আবছায়া আবছায়া হয়ে থাকে।
.
১৬.
মরুভূমির উপর চন্দ্রালোক। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। সে দৃশ্য বাংলা দেশের সবুজ শ্যামলিমার মাঝখানে দেখা যায় না। তবে যদি কখনও পদ্মার বিরাট বালুচড়ায় পূর্ণিমা রাতে বেড়াতে যাও–রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই যেতেন এবং নিশীথে গল্প তারি পটভূমিতে লেখা– তা হলে তার খানিকটে আস্বাদ পাবে।
সমস্ত ব্যাপারটা কেমন যেন ভুতুড়ে বলে মনে হয়। চোখ চলে যাচ্ছে দূর দিগন্তে অথচ হঠাৎ যেন ঝাপসা আবছায়ার পর্দায় ধাক্কা খেয়ে থেমে যায়। মনে হয়, যেন দেখতে পাচ্ছি, তবু ঠিক ঠিক দেখতে পারছিনে, চিনতে পারছি তবু ঠিক ঠিক চিনতে পারছিনে। চতুর্দিকে ফুটফুটে জ্যোৎস্নার আলো যেন উপচে পড়ে মনে হয় এ আলোতে অক্লেশে খবরের কাগজ পড়া যায়, অথচ এ আলোতে লাল-কালোর তফাত যেন ঘুচতে চায় না। মেঘলা দিনে এর চেয়ে অনেক ক্ষীণালোকে রঙের পার্থক্য অনেক বেশি ধরা পড়ে।
তাই, মনে হল পাখি, মনে হল মেঘ, মনে হল কিশলয়,
ভালো করে যেই দেখিবারে যাই মনে হল কিছু নয়।
দুই ধারে একি প্রাসাদের সারি, অথবা তরুর মূল।
অথবা এ শুধু আকাশ জুড়িয়া আমারই মনের ভুল?
মাঝে মাঝে আবার হঠাৎ মোটরের দু মাথা উঁচুতে ফুটে ওঠে, জ্বলজ্বল দুটি ছোট সবুজ আলো; ওগুলো কী? ভূতের চোখ নাকি? শুনেছি ভূতের চোখই সবুজ রঙের হয়। নাহ! কাছে আসতে দেখি উটের ক্যারাভান এদেশের ভাষাতে যাকে বলে কাফেলা (কবি নজরুল ইসলাম এ শব্দটি বাঙলায় ব্যবহার করেছেন) উটের চোখের উপর মোটরের হেডলাইট পড়াতে চোখদুটো সবুজ হয়ে আমাদের চোখে ধরা দিয়েছে। দেশে গরু-বলদের চোখে আলো পড়ে ঠিক এ রকমই হয়, কিন্তু বলদের চোখে যে লেভেলে দেখি উটের চোখে তার অনেক উপরে দেখতে পেলুম বলে এতখানি ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম।
আর কেনই পাব না বল? জনমানবহীন মরুভূমির ভিতর দিয়ে চলেছ, রাত্রিবেলা– আবার বলছি, রাত্রিবেলা। মরুভূমি সম্বন্ধে কত গল্প, কত সত্য, কত মিথ্যে পড়েছি ছেলেবেলায়। তৃষ্ণায় সেখানে বেদুইন মারা যায়, মৃত্যু থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য বেদুইন তার পুত্রের চেয়ে প্রিয়তর উটের গলা কাটে, সেখান থেকে উটের জমানো জল খেয়ে প্রাণ বাঁচাবার জন্য, তৃষ্ণায় মতিচ্ছন্ন হয়ে গিয়ে সে হঠাৎ কাপড়-চোপড় ফেলে দিয়ে উলঙ্গ হয়ে সূর্যের দিকে জিভ দেখিয়ে দেখিয়ে নাচে শুষ্ককণ্ঠে বীভৎস গলায় গান জোড়ে,
তুই (অশ্লীলবাক্য)– তুই ক্যা রে?
তুই আমার কী করতে পারিস তুই ক্যা রে?
এবং তার চেয়েও বদখদ বেতালা পদ্য।
যদি মোটর ভেঙে যায়? যদি কাল সন্ধে অবধি এ রাস্তা দিয়ে আর কোনও মোটর না আসে? পষ্ট দেখতে পেলুম এ গাড়ি রওনা হওয়ার পূর্বে পাঁচশো গ্যালন জল সঙ্গে তুলে নেয়নি; তখন কী হবে উপায়?
কিন্তু করুণাময়কে অসীম ধন্যবাদ, পল-পার্সি দেখলুম অন্য ধরনের ছেলে। তারা সেই জরাজীর্ণ মোটরগাড়ির কটকটহি মরকট বিকট ভট কোটি কোটিনহ ধাবহি (তুলসীদাস তার রামায়ণে বানরদের কলরোলের বর্ণনা দিতে গিয়ে ট-এর অনুপ্রাস ব্যবহার করেছেন) শব্দ ছাপিয়ে বিকটতর কটকট করছে। তাদের কী আনন্দ!
পল : সবকিছু ভালো করে দেখে নে; মাকে যাবতীয় জিনিস যেন গুছিয়ে লিখতে পারিস।
পার্সি : তোর জীবনে এই দুই প্রথম একটা খাঁটি কথা কইলি। কোনও জিনিস যেন বাদ না পড়ে। ওহ, মরুভূমির ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। জাহাজে চড়ার সময় কি কল্পনা করতে পেরেছিলুম। জাহাজে চড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোকটে মরুভূমির ভিতর দিয়ে চড়ে যাব?।
পল : ঠিক বলেছিস্। আর মা-বাবা কীরকম আশ্চর্য হবেন ভাব দিকিনি। কিন্তু, ভাই, ওনারা যদি তখন ধমক দেন, জাহাজ ছেড়ে তোমরা এরকম বাউণ্ডুলিপনা করতে গিয়েছিলে কেন? তখন?
পার্সি বললে : ওই তোর দোষ! সমস্তক্ষণ ভয়ে মরিস। তখন কি আর একটা সদুত্তর খুঁজে পাব না! ওই স্যর রয়েছেন। ওঁকে জিজ্ঞাসা কর না। উনি কী বলেন।
আমি বললুম, দোষ দেবেন, তো তখন দেবেন। এখন সে আলোচনা করতে গিয়ে দেখবার জিনিস অবহেলা করবে নাকি? বিশেষত, যদি আমাদের অভিযান অন্যায় কর্মই হয়ে থাকে, সেটাকে যখন রদ করার শক্তি আমাদের হাতে নেই।
পার্সি বললে : আর ফিরে গিয়েই-বা কী লাভ? আমাদের জাহাজ তো অনেকক্ষণ হল ছেড়ে দিয়েছে।
চালাক ছেলে; সর্বদিকে খেয়াল রাখে।
মরুভূমিতে দিনের বেলা যেরকম প্রচণ্ড গরম, রাত্রে ঠিক তেমনি বিকট শীত। বৈজ্ঞানিকেরা তার একটা অত্যুকৃষ্ট ব্যাখ্যা দেন বটে, কিন্তু ধোপে সেটা কতখানি টেকে আমি যাচাই না করে বলতে পারব না। উপস্থিত শুধু এইটুকু বলতে পারি, জাহাজে দিনের পর দিন রাতের পর রাত দুঃসহ গরমে হাড়মাংস যেন আচার হয়ে গিয়েছিল; ঠাণ্ডা বাতাসের পরশ পেয়ে সর্বাঙ্গ যেন জলে-ভেজা জুইফুলের মতো ফুলে উঠল।
এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে একাধিকবার হয়েছে। পেশাওয়ার, জালালাবাদের ১২০/১২২ ডিগ্রি সওয়ার পর আমি খা-ই-জব্বারের ৬০ ডিগ্রিতে পৌঁছতে কী আরাম অনুভব করেছিলুম সে বর্ণনা অন্যত্র করছি। কোথায়? উঁহু সেটি হচ্ছে না। বললেই বলবে, আমি সুযোগ পেয়ে আমার অন্য বইয়ের বিজ্ঞাপন এখানে নিখরচায় চালিয়ে দিচ্ছি।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলুম মনে নেই। যখন মোটরের হঠাৎ একটুখানি জোর ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙল তখন দেখি চোখের সামনে সারি সারি আলো। কাইরো পৌঁছে গিয়েছি। গাড়ির আর সবাই তখনও ঘুমোচ্ছে। আমার সন্দেহ হল ড্রাইভারও বোধ করি ঘুমোচ্ছে। গাড়ি আপন মনে বাড়ির দিকে চলেছে; সোয়ার ঘুমিয়ে পড়লেও ঘোড়া যেরকম আপন বাড়ি খুঁজে নেয়।
পার্সিকে ধাক্কা মেরে জাগিয়ে দিয়ে বললুম : তবে না, বস্ত্র, বলেছিলে, মরুভূমির সব টুকিটাকি পর্যন্ত মনের নোটবুকে টুকে নেবে? যেন আমি নিজে কতই না জেগে ছিলুম।
পার্সিও তালেবর ছেলে। তখুনি দিল পলের কানে ধরে একখানা আড়াই গজি টান। আমি পার্সিকে যা বলেছিলুম সে পলকে তাই শুনিয়ে দিল। পল বেচারী আর কী করে? সে আস্তে আস্তে মাদমোয়াজেল শেনিয়েকে জাগিয়ে দিয়ে বললে, কাইরো পৌঁছে গিয়েছি।
বাঙাল দেশে কথায় কয়– পশ্চিম বাঙলায় বলে কি না জানিনে– সায়েব বিবিকে মারলেন চড়, বিবি বাঁদিকে দিলেন ঠ্যাঙ্গা, বাঁদি বেড়ালকে মারলে লাথি, বেড়াল খামচে দিলে নুনের ছালাটাকে।
সংসারে এই রীতি!
এখানে অবশ্য প্রবাদ টায়টায় মিলল না। তাই পল অতি সবিনয়ে মেমসাহেবকে জাগিয়ে দিল।
মাদমেয়োজেল হ্যান্ডব্যাগ থেকে পাউডার বের করে নাকে ঘষতে ঘষতে ফরাসিতে শুধালেন, আমার বিশ্বাস ফরাসিনীরা ঘুমন্ত অবস্থায়ও ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে পারেন এবং লাগান–আমরা কোথায় পৌঁছলুম, মঁসিয়ে?
ল্য ক্যার।
পল বেশ খানিকটে ফরাসি জানত। আমাকে শুধাল : ল্য ক্যার অর্থ হল দি কাইরো। ল্যটা আবার পুংলিঙ্গ। একটা শহরের আবার পুংলিঙ্গ-স্ত্রীলিঙ্গ কী করে হয়?
আমি বললুম : অত বিদ্যে আমার নেই, বাপু! তবে এইটুকু জানি এ বাবদে ফরাসিই একমাত্র আসামি নয়। আমরা ব্ৰহ্মপুত্রকে বলি নদ, অর্থাৎ পুংলিঙ্গ এবং গঙ্গাকে বলি নদী অর্থাৎ স্ত্রীলিঙ্গ। কেন বলি জানিনে।
পার্সি বললে : আমরা ইংরেজরাই-বা জাহাজকে শি অর্থাৎ স্ত্রীলিঙ্গ দিয়েছি কেন?
আমি বললুম : উপস্থিত এ আলোচনা অক্সফোর্ডের জন্য মুলতুবি রেখে দাও– সেখানেই তো পড়তে যাচ্ছ– এবং নিশির কাইরোর সৌন্দর্যটি উপভোগ করে নাও।
সত্যি, এরকম সৌন্দর্য সচরাচর চোখে পড়ে না। আমরা যখন চন্দননগর থেকে কলকাতা পৌঁছই তখন মাঝখানে ঘনবসতি আর বিস্তর জোরালো বাতি থাকে বলে কলকাতার রোশনাই ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারিনে। এখানে মরুভূমি পেরিয়ে হঠাৎ শহর বলে একসঙ্গে সব-কটা আলো চোখে পড়ে এক অদ্ভুত মরীচিৎকার সৃষ্টি করে।
ছ-তলা বাড়ির উপরে অবশ্য বাড়িটা দেখা যাচ্ছে না– দেখি, লাল আলোতে জ্বালানো সেলাইয়ের কলের উঁচ ঘন ঘন উঠছে-নামছে, আর সবুজ আলোর চাকা ঘুরেই যাচ্ছে ঘুরেই যাচ্ছে। নিচে এক বিলিতি কোম্পানির নাম। আমার মনে হল, হায়! কলটার নাম যদি উষা হত। সেদিন আসবে যেদিন ভারতীয়– যাগে।
আরও কতরকমের প্রজ্বলিত বিজ্ঞাপন। এ বিষয়ে কলকাতা কাইরোর পিছনে।
করে করে শহরতলিতে ঢুকলুম। কলকাতার শহরতলি রাত এগারোটায় অঘোরে ঘুমোয়। কাইয়োর সব চোখ খোলা– অর্থাৎ খোলা জানালা দিয়ে সারি সারি আলো দেখা যাচ্ছে। আর রাস্তার কথা বাদ দাও। এই শহরতলিতেই কত না রেস্তোরাঁ কত না কাফে খোলা; খদ্দেরে খদ্দেরে গিসগিস করছে। (আমাদের যেরকম চায়ের দোকান, মিশরিদের তেমনি কাফে অর্থাৎ কফির দোকান! আমি প্রায়ই ভাবি কফির দোকান যদি কাফে হতে পারে তবে চায়ের দোকান চাফে হয় না কেন? চলো ভাই চাফেতে যাই বলতে কী দোষ?)।
আবার বলছি রাত তখন এগারোটা। আমি বিস্তর বড় বড় শহর দেখেছি কিন্তু কাইরোর মতো নিশাচর শহর কোথাও চোখে পড়েনি।
কাইরোর রান্নার খুশবাইয়ে রাস্তা ম-ম করছে। মাঝে মাঝে নাকে এসে এমন ধাক্কা লাগায় যে মনে হয় নেমে পড়ে এখানেই চাটি খেয়ে যাই। অবশ্য রেস্তোরাঁগুলো আমাদের পাড়ার চায়ের দোকানেরই মতো নোংরা। তাতে কী যায়-আসে? কে যেন বলছে, নোংরা রেস্তোরাঁতেই রান্না হয় ভালো; কালো গাই কি সাদা দুধ দেয় না?
আমার খেতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু ওইসব সায়েব-মেমরা যখন রয়েছেন তাঁরা ‘মঁ দিয়ো’, ‘হ্যার গট’ কী যে বললেন তার তো ঠিকঠিকানা নেই।
আচম্বিতে দুখানা গাড়িই দাঁড়াল। বসে বসে সবাই অসাড় হয়ে গিয়েছি। সব্বাই নেমে পড়লুম। সক্কলেরই মনে এক কামনা। আড়ামোড়া দিয়ে নিই, পা দুটো চালিয়ে নিই, হাত দু খানা ঘুরিয়ে নিই।
এমন সময় আবুল আসফিয়া আমাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, মাথা পিছনের দিকে ঈষৎ ঠেলে দিয়ে, হাত দুখানা সামনের দিকে সম্প্রসারিত করে, পোলিটিশিয়নদের কায়দায় শ্ৰদ্ধানন্দ-পার্কি লোর ঝাড়তে আরম্ভ করলেন, কিন্তু ভাঙা ভাঙা ফরাসিতে
মেদাম, মেমোয়াজেল এ মেসিয়ো–
(ভদ্রমহিলাগণ, ভদ্রকুমারীগণ এবং ভদ্রমহোদয়গণ)
আমরা সকলেই এক্ষণে তৃষ্ণার্ত এবং ক্ষুধাতুর। নগরী প্রবেশ করত আমরা প্রথমেই উত্তম কিংবা মধ্যম শ্রেণির ভজনালয়ে আহারাদি সমাপন করব। কিন্তু প্রশ্ন, সেখানে খেতে দেবে কী? জাহাজে যা দেয় তা-ই। সেই বিস্বাদ সুপ, বিস্বাদতর স্টু, তদিতর পুডিং। অর্থাৎ সেই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কিংবা অ্যাংলো-ইজিপশিয়ন– যাই বলুন– রস-সহীন খানা।
পক্ষান্তরে, এই শহরতলিতে যদি আমরা কিঞ্চিৎ আদিম এবং অকৃত্রিম মিশরীয় খাদ্য, মিশরীয় পদ্ধতিতে সুপকু খাদ্য ভোজন করি তবে কি এক নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হবে না?
আমরা কিছু বলার পূর্বেই তিনি হাত দুখানা গুটিয়ে নিয়ে বাঁ হাত দিয়ে ঘাড়ের ডান দিকটা চুলকোতে চুলকোতে বললেন : অতি অবশ্য, রেস্তোরাঁগুলো নোংরা। চেয়ার-টেবিল সাফসুরো নয়, কিন্তু মেদাম, মাদমোয়াজেল, মেসিয়ে, আমরা তো আর টেবিল-চেয়ার খেতে যাচ্ছিনে। আমরা খেতে যাচ্ছি খানা। জাহাজের রান্না যখন আমাদের খুন করতে পারেনি তখন এ রান্নাই-বা করবে কী করে? আপনারাই বলুন?
কেউ কিছু বলার পূর্বেই পার্সি চেঁচিয়ে উঠল : অফুঁকোস, অকোস্ –আলবৎ, আলবৎ আমরা নিশ্চয়ই খাব। আমরা যখন মিশরীয় হাওয়াতেই খাস নিচ্ছি, মিশরীয় জলই খাব, তখন মিশরীয় খাদ্য খাব না কেন?
মাদমোয়াজেল শেনিয়ে বললেন; যারা খেতে চান না, তারা খাবেন না। আমি যাচ্ছি।
আর আমি বুঝলুম, ফরাসি দেশটা কতখানি স্বাধীনতার দেশ। স্বাধীনতা ফরাসিদের হাড়ে-হাড়ে মজ্জায়-মজ্জায়।
শেনিয়ে ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ডেলিকেট প্রাণী। জাহাজের রান্না তার পছন্দসই ছিল না বলে তিনি টোস্ট, দুধ, ডিম, মটর, কপি, আলুসেদ্ধ খেয়ে প্রাণ ধারণ করতেন। তিনি যখন রাজি তখন–?
আমার মনে হয়, আমরা যে তখন সবাই নিকটতম রেস্তোরাঁয় হুড়মুড় করে ঢুকলুম তার একমাত্র কারণ এই নয় যে, মাদমোয়াজেল ঢুকতে প্রস্তুত, আমার মনে হয় আর সবাইও তখন মিশরি খানার এক্সপেরিমেন্ট করবার জন্য তৈরি। সর্বোত্তম কারণ সবাই তখন ক্ষুধায় কাতর। কোথায় কোন খানদানি রেস্তোরাঁয় কখন পৌঁছব তার কী ঠিক-ঠিকানা? সেখানে হয়তো এতক্ষণে সব মাল কাবার। খেতে হবে মাখন-রুটি, দিতে হবে মুরগি-মটনের দর। তার চেয়ে ভর-ভর খুশবাইয়ের খাবারই প্রশস্ততর। হাতের কাছে যা পাচ্ছি, তাই ভালো, সেই নিয়ে আমি খুশি।
রবিঠাকুর বলেছেন,
কাছের সোহাগ ছাড়বে কেন
দূরের দূরাশাতে?
ইরানি কবি ওমর খৈয়ামও বলেছেন,
Oh, take the Cash, and let the Credit go,
Nor heed the rumble of distant Drum!
কান্তি ঘোষ তার বাঙলা অনুবাদ করেছেন,
নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য থাক,
দূরের বাদ্য লাভ কী শুনে, মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক!
রেস্তোরাঁগুলো ছুটে এসে আমাদের আদর-কদর করে অভ্যর্থনা (ইসতিকবাল) জানাল। তার বয়-রা বত্রিশখানা দাঁতের মুলো দেখিয়ে আকর্ণ হাসল। তড়িঘড়ি তিনখানা ছোট ছোট টেবিল একজোড়া করে, চেয়ার সাজিয়ে আমাদের বসবার ব্যবস্থা করা হল, রান্নাঘর থেকে স্বয়ং বাবুর্চি ছুটে এসে তোয়ালে কাঁধে বার বার ঝুঁকে ঝুঁকে সেলাম জানাল। বসতে গিয়ে দেখি, শ্যামবাজারের সেই লোহার চেয়ার। শীত-গ্রীষ্ম উভয় ঋতুতেই বসতে গেলে ছ্যাকা দেয়।
আমি তখন আমার অভিজ্ঞতা গিলছি। অর্থাৎ দেখছি বয়গুলোর কী সুন্দর দাঁত। এরকম দুধের মতো সুন্দর দাঁত হয় কী করে? সে দাঁতের সামনে এরকম রক্তকরবীর মতো রাঙা ঠোঁট এরা পেল কোথা থেকে? এবং ঠোঁটের সীমান্ত থেকেই সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে কী অদ্ভুত এক নবীন রঙ! এ রঙ আমার দেশের শ্যামল নয়, এ যেন কী এক ব্রোঞ্জ রঙ! কী মসৃণ কী সুন্দর!
কিন্তু সর্বাধিক মনোরম বাবুর্চির ভুড়িটা। ওহ! কী বিশাল, কী বিপুল, কী জাঁদরেল!
তার থেকেই অনুমান করলুম আমরা ভালো রেস্তোরাঁতেই ঢুকেছি।
ইতোমধ্যে আবুল আসফিয়া এবং মাদমোয়াজেল শেনিয়ে বাবুর্চিকে নিয়ে খুদ রান্নাঘরে চলে গিয়েছেন, আহারাদির বাছাই তদারক করতে এবং গোটাচারেক ছোকরা এসে আমাদের চতুর্দিক ঘিরে চেঁচাচ্ছে, বুৎ, বালিশ, বুৎ বালিশ!
সে আবার কী যন্ত্রণা!?!
বুঝতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না; কারণ এদের সকলের হাতে কাঠের বাক্স আর গোটা দুই করে বুরুশ। ততক্ষণে আবার মনে মনে, ধ্বনিতত্ত্ব আলোচনা করে বুঝে নিয়েছি, আরবিতে ট নেই বলে বুট হয়ে গিয়েছে বুৎ এবং প নেই বলে পলিশ হয়ে গিয়েছে বালিশ–একুনে দাঁড়াল বুৎ বালিশ! তাই আরবরা পণ্ডিত জওহরলালের নাম উচ্চারণ করে বান্দিৎ জওয়াহরলাল। ভাগ্যিস আরবি ভাষায় ট নেই। থাকলে নিরীহ পণ্ডিত আরবিস্থানের ব্যান্ডিট হয়ে যেতেন! আদন অঞ্চলের আরবিতে আবার গ নেই, তাই তারা গান্ধীর নাম উচ্চারণ করে জান্দী। অবশ্য সেটা কিছু মন্দ নয়–সত্যের জন্য জান দিই বলেই তো তিনি প্রাণ দান করে দেহত্যাগ করলেন।
বাঙালি তেড়ি কাটতে ব্যস্ত, ইংরেজ সমস্তক্ষণ টাইটা ঠিক গলার মাঝখানে আছে কি না তার তদারকিতে ব্যস্ত, শিখেরা পাগড়ি বাঁধতে ঘণ্টাখানেক সময় নেয়, কাবুলিরা হামেহাল জুতোতে পেরেক ঠোকাতে ব্যতিব্যস্ত, আর কাইরোবাসীরা দেখলুম বুৎ বালিশের নেশাতে মশগুল। তা না হলে রাতদুপুরে গণ্ডায় গণ্ডায় বুৎ বালিশওয়ালারা কাফে-রেস্তোরাঁয় ধন্না দিতে যাবে কেন?
তবে হ্যাঁ, পালিশ করতে জানে বটে। স্পিরিট দিয়ে পুরনো রঙ ছাড়াল, সাবানজল দিয়ে অন্য সব ময়লা সাফ করল, ক্রিম লাগাল, পালিশ ছোঁয়াল, প্রথম হাল্কা ক্যাম্বিস পরে মোলায়েম সিঙ্ক দিয়ে জুতোর জৌলুস বাড়াল। তখন জুতোর যা অবস্থা! তাতে তখন আয়নার মতো মুখ দেখা যায়। বুরুশের ব্যবহার তো প্রায় করলই না– চামড়া নাকি তাতে জখম হয়ে যায়।
কিন্তু আশ্চর্য বোধ হল, সেই ঝাঁ চকচকে জুতোজোড়াকে সর্বশেষে কাপড় দিয়ে ঘষে অল্প– অতি অল্প– ম্যাটমেটে করে দিল কেন? এতখানি মেহনত করে চাকচিক্য জাগানোর পর সেটাকে ম্যাটমেটে করে দেবার কী অর্থ?
একটা গল্প মনে পড়ল :
এক সাহেব পেসট্রিওয়ালাকে অর্ডার দিলেন একটা জন্মদিনের কেক বানাবার জন্যে। কেকের উপর যেন সোনালি-নীলে তার নামের আদ্য অক্ষর পি. বি. ডাবলইউ লেখা থাকে। ডেলিভারি নেবার সময় দোকানদারকে বললেন, হু, কেকটি দেখাচ্ছে উত্তম, কিন্তু হরফগুলো বানানো হয়েছে সোজা অক্ষরে। আমি চাই ট্যারচা ধরনে, ফ্লুরাল ডিজাইনে।
দোকানি খদ্দেরকে সন্তুষ্ট করতে চায়। বললে এক্ষুণি করে দিচ্ছি। জন্মদিনের ব্যাপার চাট্টিখানি কথা নয়।
প্রচুর পরিশ্রম করে সে কেকের উপরটা চেঁচে নিল। তার পর প্রচুরতম গলদৃঘর্ম হয়ে তার উপর হরফগুলো বাঁকা ধরনের আঁকল, আরও মেলা ফুল ঝালর চতুর্দিকে সাজাল।
সায়েব বললেন, শাবাস, উত্তম হয়েছে।
দোকানি খুশি হয়ে শুধাল, প্যাক করে আপনাকে দেব, না কোনও বিশেষ ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে হবে?
সাহেব হেসে বললেন, কোনওটাই না। আমি ওটা নিজেই খাব।
বলেই ছুরি দিয়ে চালা চা করে গব-গব করে আস্ত কেকটা গিললেন। দোকানি তো থ। তা হলে অত-শত করার কী ছিল প্রয়োজন?
বুৎ বালিশের বেলাও তাই।
বুৎ বালিশওলাকে শুধালুম, পালিশ কমিয়ে দেওয়ার কারণটা কী?
একটুখানি হকচকিয়ে সামলে নিয়ে বললে, গাইয়ারাই শুধু অত্যধিক চাকচিক্য পছন্দ করে। শহরের ভদ্রলোক সব জিনিসেরই মেকদার মেনে চলেন।
অ-অ-অ-!
তখন মনে পড়ল, অবন ঠাকুরও বলেছেন, ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা আগের দিনে সোনার গয়না পরে পাল্কিতে বেরুবার সময় তার উপর মলমলের পট্টি বেঁধে দিতেন। বড় বেশি চাকচিক্য নাকি গ্রাম্যজনসুলভ বর্বরতা!
.
১৭.
আমরা তেতো, নোনা, ঝাল, টক, মিষ্টি এই পাঁচ রস দিয়ে ভোজন সমাপন করি। ইংরেজ খায় মিষ্টি আর নোনা; ঝাল অতি সামান্য, টক তার চেয়েও কম এবং তেতো জিনিস যে খাওয়া যায়, ইংরেজের সেটা জানা নেই। তাই ইংরিজি রান্না আমাদের কাছে ভোঁতা এবং বিস্বাদ বলে মনে হয়। অবশ্য ইংরেজ ভালো কেক-পেট্রি-পুডিং বানাতে জানে– তাও সে শিখেছে ইতালিয়ানদের কাছ থেকে এবং একথাও বলব আমাদের সন্দেশ রসগোল্লার তুলনায় এসব জিনিস এমনকি, যে নাম শুনে মূর্ছা যাব?
মিশরীয় রান্না ভারতীয় রান্নার মামাত বোন অবশ্য ভারতীয় মোগলাই রান্নার। আমি প্রমাণ করতে পারব না, কিন্তু বহু দেশে বহু রান্না খেয়ে আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে, মোগলরা এ দেশে যে মোগলাই রান্নার তাজমহল বানালেন (এবং ভুললে চলবে না সে রান্না তাঁর আপন দেশে নির্মাণ করতে পারেননি, কারণ ওঁদের মাতৃভূমি তুর্কিস্থানে গরম মসলা গজায় না) তারই অনুকরণে আফগানিস্থান, ইরান আরবিস্থান, মিশর-ইস্তেক স্পেন অবধি আপন আপন ক্ষুদে ক্ষুদে রান্নার তাজমহল বানাতে চেষ্টা করেছে। এ রান্নার প্রভাব পূর্ব-ইয়োরোপের গ্রিস, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, আলবেনিয়া, ইতালি পর্যন্ত পৌঁছেছে।
এসব তত্ত্ব আমার বহুদিনকার পরের আবিষ্কার। উপস্থিত আবুল আসফিয়া আর ক্লোদেৎ নিয়ে এলেন বারকোশে হরেকরকম খাবারের নমুনা। তাতে দেখলুম, রয়েছে মুরগি মুসল্লম, শিককাবাব, শামিকাবাব আর গোটা পাঁচ-ছয় অজানা জিনিস। জানা জিনিসগুলো যে ঠিক ঠিক কলকাত্তাই খুশবাই নিয়ে এল তা নয়, কিন্তু তাতেই-বা কী? জাহাজের আইরিশ স্টু আর ইটালিয়ান মাক্কারনি খেয়ে খেয়ে পেটে তো চর পড়ে গিয়েছে; এখন এসব জিনিসই অমৃত। আমার প্রাণ অবশ্য তখন কাঁদছিল চারটি আতপ চাল, উচ্ছে ভাজা, সোনামুগের ডাল, পটল ভাজা আর মাছের ঝোলের জন্য অত-শত বলি কেন, শুধু ঝোলভাতের জন্য, কিন্তু এসব জিনিস তো আর বাঙলা দেশের বাইরে পাওয়া যায় না, কাজেই শোক করে কী লাভ?
তাই দেখিয়ে দিলুম, আমার কোন কোন জিনিসের প্রয়োজন সেই বারকোশ থেকেই।
পাশের টেবিলে দেখি, একটা লোক তার প্লেটে দুটি শসা নিয়ে খেতে বসেছে। দুটি শসা– তা সে যত তিন ডবল সাইজই হোক না– কী করে মানুষের সম্পূর্ণ ডিনার হতে পারে বহু চিন্তা করেও তার সমাধান করতে পারলুম না। তা-ও আবার দোকানে ঢুকে, টেবিল-চেয়ার নিয়ে সস্-চাটনি সাজিয়ে। আর ইংলন্ডের মতো খানদানি দেশেও তো মানুষ রাস্তায় দুটো আপেল কিনে চিবোয় রেস্তোরাঁয় ঢুকে সস্-চাটনি নিয়ে সেগুলো খেতে বসে না। তবে কি এদেশ ইংল্যান্ডের চেয়েও খানদানিতর? এদেশে কি এমন সব সর্বনেশে আইন-কানুন আছে যে রাস্তায় শসা বিক্রি বারণ, যে রকম শিব ঠাকুরের আপন দেশে,
কেউ যদি পা পিছলে পড়ে,
প্যায়দা এসে পাকড়ে ধরে,
কাজীর কাছে হয় বিচার
একুশ টাকা দণ্ড তার।
সেথায় সন্ধে ছটার আগে,
হাঁচতে হলে টিকিট লাগে;
হাঁচলে পরে বিনা টিকিতে
দমদমাদম্ লাগায় পিঠে
কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে
একুশ দফা হাঁচিয়ে মারে।*
কী জানি কী ব্যাপার!
[* সুকুমার রায়, আবোল-তাবোল, পৃ. ৩২, তৃতীয় সিগনেট সংস্করণ।]
এমন সময় দেখি, সেই লোকটা শসা চিবুতে আরম্ভ না করে তার মাঝখানে দিল দুহাতে চাপ। অমনি হড়হড় করে বেরিয়ে এল পোলাও জাতীয় কী যেন বস্তু, এবং তাতেও আবার কী যেন মেশানো। আমি অবাক! হোটেলওলাকে গিয়ে বললুম, যা আছে কুলকপালে, আমি ওই শসাই খাব।
এল দু খানা শসা।*[* আসলে শসা নয়, একরকমের ছোট লাউ।] কাঁটা দিয়ে একটুখানি চাপ দিতেই বেরিয়ে এল পোলাও। সে পোলাওয়ের ভিতর আবার অতি ছোট ছোট মাংসের টুকরো (এদেশে যাকে বলা হয় কিমা) টমাটোর কুচি এবং গুঁড়নো পনির। বুঝলুম এসব জিনিস পুরেছে সেদ্ধ শসার ভিতর এবং সেই শসাটা সর্বশেষে ঘিয়ে ভেজে নিয়েছে। যেন মাছ-পটলের দোলমা শুধু মাছের বদলে এখানকার শসায় পোলাও, মাংস, টমাটো এবং চিজ! তার-ই ফলে অপূর্ব এই চিজ।
শসাকে চাক্তি করে পোলাওয়ের সঙ্গে মুখে দিয়ে বুঝলুম, একই সঙ্গে ভাত, মাংস, শবজি, ফল এবং সেভরি খাওয়া হয়ে গেল।
আর সে কী সোয়াদ! মুখে দেওয়ামাত্র মাখনের মতো গলে যায়।
এরকম পাঁচেক্কে পাঁচ পদ আমি পৃথিবীতে আর কোথাও খাইনি।
আরেকটা জিনিস খেলুম সে-ও অতুলনীয়। মিশরি শিম-বিচি। আলীবাবা বায়স্কোপে যে সব বিরাট বিরাট উঁচু তেলের জালা দেখছ তারই গোটা দু তিন সিমেতে ভর্তি করে সমস্ত রাত ধরে চালায় সিদ্ধক। সেই সিমে অলিভঅয়েল আর একরকমের মসলা মিশিয়ে খেতে দেয় সকালবেলা থেকে। আমরা খেলুম রাত্তিরে। তার যা সোয়াদ! এখনও জিভে লেগে আছে। আমাদের শিম-বিচি তার কাছে কিছুই না। পল-পার্সিও মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করল চীন দেশের সোয়াবিনও এর সামনে কেন, পিছনেও দাঁড়াতে পারে না।
শুনলুম এই শিম-বিচি গরিব থেকে আরম্ভ করে মিশরের রাজা দু-সন্ধ্যা খেয়ে থাকেন। হোটেলওলা বললে, পিরামিড নির্মাতা এক ফারাও মহারাজ নাকি এই বিন খেতে এত ভালোবাসতেন যে, প্রজাদের বারণ করে দিয়েছিলেন তারা কেউ যেন বিন না খায়! সাধে কি আর লোকে ফারাওদের খামখেয়ালি বলত?
শুনলুম এই বিনের আরবি শব্দ ফুল।
পরের দিন সকাল বেলাকার ঘটনা। কিন্তু এর সঙ্গে যোগ আছে বলে এই সুবাদেই বলে নিই।
কাইরোতে ফরাসি, গ্রিক, ইতালি, ইংরেজ বসবাস করে বলে এবং জাত-বেজাতের বিস্তর টুরিস্ট আসে বলে কাইরোর বহু দোকানি তরো-বেতনরা ভাষায় সাইনবোর্ড সাজায়। পরদিন সকালবেলা আমরা যখন শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরছি তখন দেখি, এক সাইনবোর্ডে লেখা–
FOOLS RESTAURANT
পল, পার্সি, আমি একসঙ্গেই বোর্ডটা দেখেছিলুম। একসঙ্গেই থ মেরে দাঁড়িয়ে গেলুম। একসঙ্গেই অট্টহাস্য করে উঠলুম।
আহাম্মুকদের রেস্তোরাঁ।
বলে কী?
তখন হঠাৎ ঝাঁ করে আমার মনে পড়ল Fool শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে ফুল অর্থাৎ বিন অর্থাৎ সিমের-বিচি অর্থে। আহাম্মুক অর্থে নয়। অর্থাৎ এ দোকানি উত্তম শিম-বিচি বেচে। তার পর দোকানের সামনে আমরা ত্রিমূর্তি উঁকি-ঝুঁকি মেরে দেখি, যে কটি খদ্দের সেখানে বসে আছে তাদের সক্কলেরই সামনে শুধু শিম-বিচি ফুল–Fool।
***
হাসলে তো?
আমিও হেসেছিলুম।
কিন্তু তার পর কলকাতা ফিরে– বহু বৎসর পরে দেখি, এক দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা–
কপির শিঙাড়া
অর্থাৎ ফুলকপির-পুর-দেওয়া শিঙাড়া। এই তো?
আমি কিন্তু কপি শব্দের অর্থ নিলুম বাদর। অর্থাৎ বাঁদরদের শিঙারা। তা হলে অর্থ দাঁড়াল, ও দোকানে যারা শিঙাড়া খেতে যায় তারা বাদর। অর্থাৎ Fools Restaurant-তে যেরকম আহাম্মুকরা যায়!
যেমন মনে কর, যখন সাইনবোর্ডে লেখা থাকে—
টাকের ঔষধ
তখন কী তার অর্থ, টাকা দিয়ে এ ঔষধ তৈরি করা হয়েছে। তার অর্থ এ ঔষধ টেকোদের জন্য। অতএব কপির শিঙাড়ার অর্থ ফুলকপি দিয়ে বানানো শিঙাড়া নয়, কপি–বাঁদরদের জন্য এ শিঙাড়া!
বিজ্ঞাপনে মানুষ জানা-অজানাতে– অজানাতেই বেশি– কত যে রসিকতার সৃষ্টি করে তার একটি সচিত্র কলেকশন করেছিল আমার এক ভাইপো। হবিটা মন্দ নয়। তার মধ্যে একটা ছিল;–
বিশুদ্ধ ব্রাম্ভনের হাটিয়াল।
মচ্ছ– (চার আনা)
মাঙ্গশ– (আট আনা)
নিড়ামিস- (ছয় আনা)
যাক গে এসব কথা। আবার কাইরো ফিরে যাই। আহারাদি সমাপ্ত করে আমরা ফের গাড়িতে উঠলুম। আবুল আসফিয়া দেখলুম ড্রাইভারদের নিজের পয়সায় খাওয়ালেন। তার পর গাড়িতে উঠে বললেন, কাইরোতে ট্যাক্সি চালাবার অনুমতি তোমাদের নেই। অথচ আমরা তোমাদের বাইরে থেকে নিয়ে এসেছি। আমাদের যেখানে খুশি নিয়ে গিয়ে দু পয়সা কামাতে পার।
তারা তো প্রাঞ্জল প্রস্তাবখানা শুনে আহ্লাদে আটখানা। কিন্তু আবুল আসফিয়া যে দর হাঁকলেন তা শুনে তাদের পেটের ফুল পর্যন্ত আচমকা লাফ মেরে গলা পর্যন্ত পৌঁছে গেল।
ব্যাপারটা হয়েছে কী, আবুল আসফিয়া ইতোমধ্যে কাইরোতে ট্যাক্সি ফি মাইলে কত নেয় খবরটা জেনে নিয়েছেন এবং হাঁকছেন তার চেয়ে অনেক কম। এবার তিনি ওদের বাগে পেয়েছেন। ওরা বেশি কিছু আপত্তি জানালেই তিনি অভিমানভরা কণ্ঠে বলেন, তা ভাই, তোমরা যদি না যেতে চাও তবে যাবে না। আমি আর তোমাদের বাধ্য করতে পারিনে। তোমাদের যদি, ভাই, বড্ড বেশি পয়সা হয়ে যাওয়ায় আর কামাতে না চাও, তা হলে আমি আর কী করতে পারি বল। আল্লাতালাও তো কুরআন শরিফে বলেছেন, সন্তুষ্টি সদ্গুণ।
তার পর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তবে, ভাইরা, আমরা তা হলে অন্য ট্যাক্সি নিই। তোমরা সুয়েজ ফিরে যাও। আল্লা তোমাদের সঙ্গে থাকুন। রসুল তোমাদের আশীর্বাদ করুন। কিন্তু ভাই, এ ক-ঘণ্টা তোমাদের সঙ্গে কেটেছিল বড় আনন্দে।
কেটেছিল আনন্দে না কচু! পারলে আবুল আসফিয়া ওদের গলা কাটতেন।
কিন্তু আশ্চর্য হলুম লোকটার ভণ্ডামি দেখে। গুটিকয়েক টাকা বাঁচাবার জন্য কী অভিনয়ই না লোকটা করল!
আর পায়রার মতো বকবকানি! এবং এ সেই লোক যে জাহাজে যেভাবে মুখ বন্ধ করে থাকত তাতে মনে হত কথা বলা রেশন্ড হয়ে গিয়েছে।
ঠিক আবুল আসফিয়ার দরে নয়, তার চেয়ে সামান্য একটু বেশি রেটে তারা শেষটায় রাজি হল।
আবুল আসফিয়া মোগলাই কণ্ঠে বললেন, পিরামিড। ততক্ষণে আমরা কাইরো শহরের ঠিক মাঝখানে ঢুকে গিয়েছি।
কোথায় লাগে কলকাতা রাত বারোটার সময় কাইরোর কাছে। গণ্ডায় গণ্ডায় রেস্তোরাঁ, হোটেল, সিনেমা, ডান্স-হল, ক্যাবারে। খদ্দেরে খদ্দেরে তামাম শহরটা আবৃজা করছে।
আর কত জাত-বেজাতের লোক।
ওই দেখ, অতি খানদানি নিগ্রো। ভেড়ার লোমের মতো কোঁকড়া কালো চুল, লাল লাল পুরু দুখানা ঠোঁট, বোঁচা নাক, ঝিনুকের মতো দাঁত আর কালো চামড়ার কী অসীম সৌন্দর্য! আমি জানি এরা তেল মাখে না কিন্তু আহা! ওদের সর্বাঙ্গ দিয়ে যেন তেল ঝরছে। এদের চামড়া এতই সুচিকূণ সুমসৃণ যে আমার মনে হয়, এদের শরীরে মশা-মাছি বসতে পারে না পিছলে পড়ে মশার পা ছ-খানা কম্পাউন্ড ফ্রেকচর হয়ে যায়, ছ মাস পট্টি বেঁধে হাসপাতালে থাকতে হয়।
ওই দেখো সুদানবাসী। সবাই প্রায়ই ছ ফুট লম্বা। আর লম্বা আলখাল্লা পরেছে বলে মনে হয় দৈর্ঘ্য ছ ফুটের চেয়েও বেশি। এদের রঙ ব্রোঞ্জের মতো। এদের ঠোঁট নিগ্রোদের মতো পুরু নয়, টকে লালও নয়। কিন্তু সবচেয়ে দেখবার জিনিস ওদের দুখানি বাহু। এক্কেবারে শাস্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে আজানুলম্বিত– অর্থাৎ জানুর শেষ পর্যন্ত যেখানে হাঁটুর হাড্ডি অর্থাৎ নি-ক্যাপ সেই অবধি।
শ্রীরামচন্দ্রের বাহু ছিল আজানুলম্বিত এবং তার রঙ ছিল নবজলধরশ্যাম, কিংবা নবদূর্বাদলশ্যাম। তবে কি শ্যামবর্ণ কিংবা ব্রোঞ্জবর্ণ না হলে বাহু এতখানি লম্বা হয় না। তবে কি ফর্সাদের হাত বেঁটে, শ্যামলিয়াদের হাত লম্বা? কে জানে! সুযোগ পেলে কোনও এক নৃতাত্ত্বিককে জিগ্যেস করতে হবে।
হঠাৎ দেখি, সম্মুখে হৈ-হৈ-রৈরৈ-কাণ্ড! লোকে লোকারণ্য!
সমস্ত রাস্তা জুড়ে এত ভিড় যে দুখানা গাড়িকেই বাধ্য হয়ে দাঁড়াতে হল। আমি বারণ করার পূর্বেই পল-পার্সি দু জনই লাফ দিয়ে উঠে গেল হুডের উপর। ওরা দেখতে চায় ভিড়ের মাঝখানে ব্যাপারটা কী। আমার ওসব জিনিস দেখবার বয়স গেছে। মাদমোয়াজেল ক্লদে শেনিয়ে পর্যন্ত উঠি উঠি করছিলেন; আমি তাকে বাইরে যেতে বারণ করলুম।
ইতোমধ্যে ঘোড়সওয়ার পুলিশ এসে রাস্তা খানিকটে সাফ করে দেওয়াতে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল। পুল-পার্সি হুড থেকে নেমে এসে আমার দু পাশে বসেছে।
আমাকে কিচ্ছুটি জিগ্যেস করতে হল না ব্যাপার কী। ওরা উত্তেজনায় তিড়িং তিড়িং করে লাফাচ্ছে। একসঙ্গে কথা বলছে। শেষটায় পলকে বাধা দিয়ে আমি বললুম, পার্সি তুমিই বল কী হয়েছিল?
ওই যে আপনি দেখালেন সুদানবাসীদের তাদেরই একজন একটা ইংরেজ সেপাইয়ের গলা ধরেছে বাঁ হাত দিয়ে আর ঠাস ঠাস করে চড় মারছে ডান হাত দিয়ে। গোরা কিছুই করতে পারছে না, কারণ সুদানির হাত লম্বা বলে গোরাকে এমনই দূরে রেখেছে যে, গোরা তার গাল নাগাল পাচ্ছে না। এরকম তো চলল মিনিট দু-তিন। তার পর পুলিশ এসে গোরাকে ধরে নিয়ে চলে গেল।
আমি আশ্চর্য হয়ে শুধালম, সুদানিই তো ঠ্যাঙাচ্ছিল, তাকে ধরে নিয়ে গেল না? যে মার খেল তাকে ধরে নিয়ে গেল, যে মার দিল তাকে ধরে নিয়ে গেল না, এটা কী করে হয়?
পল-পার্সি সমস্বরে বললে, সেই তো মজার কথা, স্যর। সাংহাই-টাংহাই কোনও জায়গাতে কেউ যদি গোরাকে ঠ্যাঙায়, তবে তাকেই ঠ্যাঙাতে ঠ্যাঙাতে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়। কেউ একবারের তরেও প্রশ্ন করে না দোষটা কার?
আমি তখন ড্রাইভারকে রহস্য সমাধান করার জন্য অনুরোধ জানালুম।
ড্রাইভার বললে, দারোয়ানির কাজ এ দেশে করে সুদানিরা। তাদের ওপর কাইরোবাসীদের অসীম বিশ্বাস। কোনও সুদানি কখনও কোনও বিশ্বাসঘাতকতা করেনি, একথা আমি বলতে পারব না, কিন্তু আমার কানে কখনও পৌঁছায়নি। এরা বড়ই ধর্মপ্রাণ। পাঁচওত নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, হজ যায়, তসবি জপে। আর বসে বসে বাড়ি আগলায়। এই যে সুদানি গোরাকে মার দিচ্ছিল, সে এক রেস্তোরাঁর দারোয়ান। গোরা রেস্তোরাঁয় খেয়ে-দেয়ে পয়সা না দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল বলে হোটেলওলা তাকে চ্যালেঞ্জ করে খেল ঘুষি। তখন সুদানি দারওয়ান তার যা কর্তব্য তাই করেছে। পুলিশ একবার জিগ্যেস করেই বিশ্বাস করেছে সুদানিকে, আর ধরে নিয়ে গিয়েছে গোরাকে। সবাই জানে, সুদানিরা বড় শান্ত স্বভাব, তারা মারপিটের ধার ধারে না।
যাক, সব বোঝা গেল। কিন্তু একটা কথা স্বীকার করব; একা একা কারও সাহায্য না নিয়ে পল্টনের গোরাকে ঠ্যাঙাতে পারে সুদানিই। পাঠান পারে কি না জানিনে, পারলে পারতেও পারে, কিন্তু তার বাহু আজানুলম্বিত নয় বলে সে-ও নিশ্চয় দু চার ঘা খাবে।
.
কাইরোতে বৃষ্টি হয় অতি দৈবাৎ। তা-ও দু এক ইঞ্চির বেশি নয়। তাই লোকজন সব বসেছে হোটেল-কাফের বারান্দায় কিংবা চাতালে। শুনলাম, এখানকার বায়স্কোপও বেশিরভাগ হয় খোলামেলাতে।
বাঙলা দেশে আমরাও চায়ের দোকানে বসে গালগল্প করে সময় কাটাই। কেউ কেউ হয়তো রোজ একই দোকানে গিয়ে ঘণ্টা দুয়েক কাটায়, কিন্তু কাফেতে বসে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটানোর রেওয়াজ আরম্ভ হয় ফ্রন্টিয়ার থেকে। কাবুলে দেখবে, চার বন্ধু চলেছেন বরফ ভেঙে চা-খানায় গিয়ে গল্পগুজব করবেন বলে যেমন বাড়িতে বসে ও-কর্মটি করা যায় না। ওদের জিগ্যেস করলে তারা বলে বাড়িতে মুরুব্বিরা রয়েছেন, কখন এসে কাকে ধমক লাগান তার ঠিক নেই। কিংবা হয়তো বলবেন, দেখ বাছা, ফিরোজ বস্তৃত যাও দিকিনি মামার বাড়িতে (আড়াই মাইলের ধাক্কা) সেখানে গিয়ে মামাকে বলো, আমার নাকের ফুস্কুড়িটা একটু সেরেছে, তিনি যেন চিন্তা না করেন। আর দেখো, আসবার সময় ধোপানিকে একটু শুধিয়ে এস (সে আরও দেড়-মাইলের চক্কর)– আমার নীল জোব্বাটা, ইত্যাদি।
এবং সবচেয়ে বড় কারণ, বাড়িতে মা-জ্যাঠাইমা ওরকম জালা জালা চা দিতে রাজি হন না। ওনারা যে কঞ্জুস তা নয়। আমি যদি এখুনি বলি, জ্যাঠাইমা, আমার বন্ধুরা এসেছে, ওরা বলেছে, পিসিমার বিয়ের দিনে আপনি যে দু-মুসল্লম করেছিলেন তারা সেইটে খাবে। কিন্তু ওদের বায়নাক্কা, দুম্বার ভিতর যেন কোফতা পোলাও আর মুরগি থাকে, মুরগির ভিতর যেন পোলাও আর আণ্ডা থাকে এবং আণ্ডার ভিতর যেন পোনা মাছের পূর থাকে–জ্যাঠাইমা তদ্দণ্ডেই লেগে যাবেন ওই বিরাট রান্না করতে। তাতে দশ-বিশ টাকা যা লাগে লাগুক।
অথচ আমাদের চায়ের খরচা এক সন্ধ্যায় কতটুকুন? দু আনা চার আনা, মেরে কেটে আট আনা। উঁহু, সেটি হচ্ছে না। ঘন ঘন চা খেলে নাকি ক্ষিদে মরে যায়, আহারের রুচি একদম লোপ পেয়ে যায়।
তাই, ভাই চায়ের দোকানই প্রশস্ততর। সেখানে একবার ঢুকতে পারলে বাবা-চাচার তম্বিতম্বার ভয় নেই, মামা-বাড়িতে গিয়ে বাবার নাকের ফুসকুড়িটার লেটেস্ট বুলেটিন ঝাড়তে হয় না, জালা জালা চা পাওয়া যায়, অন্য দু-চারজন ইয়ার-দোস্তের সঙ্গে মোলাকাতও হয়, তাস-দাবা যা খুশি খেলাও যায় সেখানে যাব না তো, যাব কোথায়?
প্রথমবারেই প্রথম কাবুলি ভদ্রসন্তান যে আমাকে এইসব কারণ এক নিশ্বাসে বুঝিয়ে বলেছিল তা নয়, একাধিক লোককে জিগ্যেস করে ক্রমে ক্রমে চায়ের দোকানে যাবার যাবতীয় কারণ আমি জানতে পেরেছিলুম।
আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই, এঁরা সত্য কথাই বলেছিলেন, এবং এঁরা যে ঘর ছেড়ে চায়ের দোকানে যান তাতে আপত্তি করবার কিছুই নেই।
কিন্তু প্রশ্ন, বাঙালিদের বেলাও তো এইসব আপত্তি-ওজুহাত টেকে? আমাদের মা-পিসিরাও চান না আমরা যেন বড় বেশি চা গিলি, বাবা-কাকাও ফাই-ফরমায়েস দেওয়াতে অতিশয় তৎপর; তবে আমরা চায়ের দোকানকে বাড়ির ড্রয়িংরুম করে তুলিনে কেন?
এর সদুত্তর আমি এ যাবৎ পাইনি। তা সে যাই হোক, এটা বেশ লক্ষ করলুম, রাত বারোটা-একটা অবধি কাফেতে বসে সময় কাটানোতে কাইরোবাসী সবচেয়ে বড় ওস্তাদ; বন্ধুর বাড়িতে জমানো আচ্ছা দশটা-এগারটার ভিতর ভেঙে যায়, কারণ বাড়িসুদ্ধ লোক তাড়া লাগায় খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়ার জন্য। এখানে সে ভয় নেই। উঠি-উঠি করে কেউই ওঠে না। বাড়ির লোকেরও অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তারা আর একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছে। শুনছি, এখানকার কোনও কোনও কাফে খোলে রাত বারোটায়!
মোটরগাড়ি বড্ড তাড়াতাড়ি চলে বলে ভালো করে সবকিছু দেখতে পেলুম না। কিন্তু এইবারে চোখের সামনে ভেসে উঠল অতি রমণীয় এক দৃশ্য! নাইল, নীল নদ।
আমি পুব বাঙলার ছেলে। যা তা নদী আমাকে বোকা বানাতে পারে না। আমি যে গাঙে সাঁতার কাটতে শিখেছি সেই ছোট্ট মনু নদ থেকে আরম্ভ করে আমি বিস্তর মেঘনা- পদ্মা, গঙ্গা-যমুনা এবং পরবর্তী যুগে গোদাবরী-কৃষ্ণা-কাবেরী তাপ্তী-নর্মদা-সিন্ধু, ইয়োরোপে রাইন-ডানয়ব-মোজেল-রোন দেখেছি। নদী দেখলে আর পাঁচ জন বাঙালের মতো আমিও গামছা খুঁজতে আরম্ভ করি– ওই নদীতে কটা লোক গত সাতশো বছরে ডুবে মরেছিল তার স্ট্যাটিসৃটিকসের সন্ধান না নিয়ে একটা ডিঙি কী কৌশলে চুরি করা যায় তার সন্ধানে মাথায় গামছা বেঁধে নিই, পাটনিকে কী প্রকারে ফাঁকি দিয়ে খেয়ানৌকো থেকে নামাতে হয় সেটা এক মুহূর্তেই আবিষ্কার করে ফেলি।
এই যে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর ভাটিয়ালি গীত! সৃষ্টিকর্তা যদি তাঁর পুব-বাংলার লীলাঙ্গনে শত শত নদীর আলপনা না আঁকতেন তবে কি কখনও ভাটিয়ালি গানের সৃষ্টি হত? আর একথাও ভাবি, তিনি রয়েছেন মোহনিয়া প্রবাহিনী আর আমরা তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রচেছি ভাটিয়ালি। অবশ্য তারই কাছ থেকে ধার করে। আমরা যখন ও-ও-ও বলে ভাটিয়ালির লম্বা সুর ধরি, মাঝে মাঝে কাঁপন জাগাই তখন কি স্পষ্ট শুনতে পাও না, দেখতে পাও না ও-র লম্বা টানে যেন নদী শান্ত হয়ে এগিয়ে চলেছে, যখন কাঁপন লাগাই তখন মনে হয় না, নদী যেন হঠাৎ থমকে গিয়ে দ-এর সৃষ্টি করেছে?
প্যারিস-ভিয়েনার রসিকজনের সম্মুখে আমি আমার হাজারোটা নদী কাঁধে বয়ে নিয়ে হাজির করতে পারব না, কিন্তু ভাটিয়ালির একখানা উত্তম রেকর্ড শুনিয়ে দিতে পারি।
আমি বে-আক্কেল তাই একবার করেছিলুম। তার কী জরিমানা দিয়েছিলুম শোনো।
ভিয়েনাতে পাশের ঘরে থাকত এক রাশান। সে এসেছিল সেখানে কন্টিনেন্টাল সঙ্গীত শিখতে। ভিয়েনা শহর বেটোফেন মোসার্টের কর্মভূমি– আমাদের যেরকম তানসেন, ত্যাগরাজ, বাঙালির যেরকম রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম।
ভিয়েনা ডানয়ুব নদীর পারে। বু ডানয়ুব তোমাদের কেউ কেউ হয়তো শুনেছ।
একদিন সেই রাশান বললে, ডানয়ুব-ফানয়ুব সব আজে-বাজে নদী। এসব নদী থেকে আর কী গান বেরিয়েছে যে পাল্লা দেবে, আমাদের রাশার ভলগা নদী থেকে যে ভলগার মাঝির গান উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে? তুমি গড়-ফড় কী সব মানো, না? আমি মানিনে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি প্রকৃতিকে। তারই অন্যতম মধুর প্রকাশ নদীতে। সেই নদীকে আমরা মাধুর্যে হার মানাই ভল্গা মাঝির গান দিয়ে।*[* রবীন্দ্রনাথও এই দম্ভ করেছেন তার বাদল দিনের প্রথম কদমফুল গানে। রেকর্ডে গেয়েছেন, শ্রীযুক্তা রাজেশেরী বাসুদেব।]
বাড়ি ফেরা মাত্রই সে ভলগা-মাঝির রেকর্ড শোনাল। আমি মুগ্ধ হয়ে বললুম, চমৎকার!
কিন্তু ততক্ষণে আমার বাঙাল রক্ত গরম হয়ে উঠেছে। বাঙালরা অবশ্য জানে, তার অর্থ কী? ঘটি অর্থাৎ পশ্চিম বাঙলার লোক তাই নিয়ে হাসাহাসি করুক। আমার তাতে কোনও খেদ নেই। ওরা তো আমাদের ভাটিয়ালি ভালোবাসে, আমরা তো ওদের বাউল শুনে বাউলে হয়ে যাই।
আমার গরম রক্ত তখন টগবগ করে বলছে, বাঙলা দেশ শত শত নদীর দেশ। রাশাতে আর কটা নদী আছে। তারই একটা ভলগা। সে নদী হারিয়ে দেবে বাঙলা দেশের তাবৎ নদীকে দাঁড়াও দেখাচ্ছি।
ভাগ্যিস, আব্বাস উদ্দিনের রঙিলা নায়ের মাঝি আমার কাছে ছিল। সেইটে চড়িয়ে দিলুম রাশানের গ্রামোফোনে।
সে চোখ বন্ধ করে শুনল। তার পর বললে– যা বললে তার অর্থ ধাপ্পা।
আমি বললুম, মানে?
সে বললে, সুরটি অতি উচ্চ শ্রেণির এবং তার চেয়েও বেশি কানে ধরা পড়ে ওর অভিনবত্ব। আমি করজোড় স্বীকার করছি, এরকম গীত আমি পূর্বে কখনও শুনিনি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলব, এ গীত লোক-গীত নয়। কারণ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনও ভূমিতেই গ্রাম্য গীতে এতগুলো নোট লাগে না। তাই বলছিলুম তুমি ধাপ্পা দিচ্ছ।
আমি বললুম, বাছা, ওই হল ভাটিয়ালির বৈশিষ্ট্য। ও যতখানি ওঠা-নামা করে পৃথিবীর আর কোনও লোক-গীত তা করে না।
কিছুতেই স্বীকার করে না ওটা লোকগীত। তার ধারণা ওটা লোকগীত এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাঝখানে উপস্থিত ঝুলছে, আর কয়েক বৎসর যেতে না যেতেই কোনও গুণী সেটাকে উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বরণ করে তুলে নেবেন।
তার পর একদিন সে স্বীকার করলে। বিবিসি-র কল্যাণে। বিবিসি পৃথিবীর লোকগীত শোনাতে শোনাতে ভাটিয়ালি শুনিয়ে বললে এটা পূর্ব বাংলার লোকগীত।
আমি লড়াই জিতলুম কিন্তু তখন থেকেই শুরু হল আমার জরিমানা। আশ্চর্য লাগছে না, যে জিতল সে দেবে জরিমানা? হয়, প্রায়ই হয়। মার্কিনিংরেজ জর্মনি জয় করে বহু বৎসর ধরে সেখানে ঢালছে এবং এখনও ঢালছে বিস্তর টাকা। সেকথা যাক, জরিমানাটা কীভাবে দিতে হল বুঝিয়ে বলি।
এর পর যখনই সে আমাকে সাজা দিতে চাইত তখনই তার বেয়ালাতে বাজাতে আরম্ভ করত ভাটিয়ালির সুর।
বোঝ অবস্থাটা! বিদেশে বিভূঁইয়ে একেই দেশের জন্য মন আঁকুপাঁকু করে তার ওপর ভাটিয়ালির করুণ টান!
রবীন্দ্রনাথের শ্রীকণ্ঠ বাবুর মতো আমি কাতর রোদনে তাঁকে বেয়ালা বন্ধ করতে অনুনয়-বিনয় করতুম।
কিন্তু আজও বলি, লোকটা যা বেয়ালাতে ভাটিয়ালি চড়াতে পারত তার তুলনা হয় না।
কত দেশ ঘুরলুম, কত লোক দেখলুম, কত অজানা জনের প্রীতি পেলাম, কত জানা জনের দুর্ব্যবহার, হিটলারের মতো বিরাট পুরুষের উত্থান-পতন দেখলুম, সেসব বড় বড় জিনিস প্রায় ভুলে গিয়েছি, কিন্তু এইসব ছোটখাটো জিনিস কিছুতেই ভুলতে পারিনে। মনে হয় যেন আজ সকালের ঘটনা।
চাঁদের আলোতে দেখছি, নীলের উপর দিয়ে চলছে মাঝারি ধরনের ভোলা মহাজনি নৌকা হাওয়াতে কাত হয়ে তেকোনা পাল পেটুক ছেলের মতো পেট ফুলিয়ে দিয়ে। হাওয়া বইছে সামান্যই, কিন্তু এই পেটুক পাল এর-ওর সবার হাওয়াই খাবার যেন কেড়ে নিয়ে পেটটাকে ঢাকের মতো ফুলিয়ে তুলেছে। ভয় হয়, আর সামান্য একটুখানি জোর হাওয়া বইলেই, হয় পালটা এক ঝটকায় চৌচির হয়ে যাবে, নয় নৌকোটা পেছনের ধাক্কা খেয়ে গোটা আড়াই ডিগবাজি খেয়ে নীলের অতলে তলিয়ে যাবে।
এই নীলের জল দিয়ে এ দেশের চাষ হয়। এই নীল তার বুকে ধরে সে চাষের ফসল মিশরের সর্বত্র পৌঁছিয়ে দেন। তাই এ দেশের কবি গেয়েছেন,
ওগো নীলনদ প্লাবিতা ধরণী আমি ভালোবাসি তোরে,
ওই ভালোবাসা ধর্ম আমার কর্ম আমার ওরে।
.
১৮.
পিরামিড! পিরামিড!! পিরামিড!!!
কোনও প্রকাশের আশ্চর্য প্রকাশ করতে হলে আমরা তিনটে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন–!!!– দিই। তাই কি চোখের সামনে দাঁড়িয়ে তিনটে পিরামিড কিংবা উল্টোটা? তিনটে পিরামিড ছিল বলে আমরা তিনবার আশ্চর্য হই।
এই পিরামিডগুলো সম্বন্ধে বিশ্বজুড়ে যা গাদা গাদা বই লেখা হয়ে গিয়েছে তার ফিরিস্তি দিতে গেলেই একখানা আস্ত জলে-ডাঙায় লিখতে হয়। কারণ এই তিনটে পিরামিড পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো কীর্তিস্তম্ভ যুগ যুগ ধরে মানুষ এদের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্তর জল্পনা-কনা করেছে, দেয়ালে খোদাই এদের লিপি উদ্ধার করে এদের সম্বন্ধে পাকা খবর সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছে, জান তো, পিরামিডের ঠিক মাঝখানে একটা কুঠুরিতে বিস্তর ধনদৌলত জড়ো করা আছে– তারই পথ অনুসন্ধান করছে পাকা সাড়ে ছ হাজার বছর ধরে। ইরানি, গ্রিক, রোমান, আরব, তুর্কি, ফরাসি, ইংরেজ পরপর সবাই এদেশ জয় করার পর প্রথমেই চেষ্টা করেছে পিরামিডের হাজার হাজার মণ পাথর ভেঙে মাঝখানের কুঠুরিতে ঢুকে তার ধনদৌলত লুট করার। এবং আশ্চর্য, যিনি শেষ পর্যন্ত ঢুকতে পারলেন তিনি ধন লুটের মতলবে ঢোকেননি। তিনি ঢুকেছিলেন নিছক ঐতিহাসিক জ্ঞান সঞ্চয়ের জন্য। ফারাওয়ের রাজমিস্ত্রিরা কুঠুরি বানানো শেষ করার পরে বেরোবার সময় এমনই মন্ত পাথর দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে বাইরের দেয়ালে পালিশ পলস্তরা লাগিয়ে দেয় যে, পৃথিবীর মানুষের সাড়ে ছহাজার বছর লাগল ভিতরে যাবার রাস্তা বের করতে!
মিশরের ভিতরে-বাইরে আরও পিরামিড আছে কিন্তু গিজে অঞ্চলের যে তিনটে পিরামিডের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে সেগুলোই ভুবনবিখ্যাত, পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম।
রাজা নির্মাণের সময় ভূমিতে দৈর্ঘ্য উচ্চতা
খুফু ৪৭০০ খ্রি. পূ. ৭৫৫ ফুট ৪৮১ ফুট
খাফরা ৪৬০০ ৭০৬ ৪৭১
সেনকাওরা ৪৫৫০ ৩৪৬ ২১০
প্রায় পাঁচশো ফুট উঁচু বললে, না দেখে চট করে পিরামিডের উচ্চতা সম্বন্ধে একটা ধারণা করা যায় না। এমনকি চোখের সামনে দেখেও ধারণা করা যায় না, এরা ঠিক কতখানি উঁচু। চ্যাপ্টা আকারের একটা বিরাট জিনিস আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে পাঁচশো ফুট উঁচু না হয়ে যদি চোঙার মতো একই সাইজ রেখে উঁচু হত তবে স্পষ্ট বোঝা যেত পাঁচশো ফুটের উচ্চতা কতখানি উঁচু।
বোঝা যায় দূরে চলে গেলে। গিজে এবং কাইরো ছেড়ে বহু দূরে চলে যাওয়ার পরও হঠাৎ চোখে পড়ে তিনটে পিরামিড সবকিছু ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। আর পিরামিড ছেড়ে যদি সোজা মরুভূমির ভিতর দিয়ে যাও তবে মনে হবে সাহারার শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাওয়ার পরও বুঝি পিরামিড দেখা যাবে।
তাই বোঝা যায়, এ বস্তু তৈরি করতে কেন তেইশ লক্ষ টুকরো পাথরের প্রয়োজন হয়েছিল। টুকরো বলতে একটু কমিয়ে বলা হল কারণ এর চার-পাঁচ টুকরো একত্র করলে একখানা ছোটখাটো এঞ্জিনের সাইজ এবং ওজন হয়। কিংবা বলতে পার ছ ফুট উঁচু এবং তিন ফুট চওড়া করে এই পাথর নিয়ে একটা দেয়াল বানালে সে দেয়াল লম্বায় ছ-শো পঞ্চাশ মাইল হবে। অর্থাৎ সে দেয়াল কলকাতা থেকে দার্জিলিং গিয়ে আবার ফিরে আসতে পারবে।
সবচেয়ে বড় পিরামিডটা বানাতে নাকি এক লক্ষ লোকের বিশ বত্সর লেগেছিল।
ভেবে কূলকিনারা পাওয়া যায় না, সে সম্রাটের কতখানি ঐশ্বর্য আর প্রতাপ ছিল, যিনি আপন রাজধানীর পাশে এক লক্ষ লোককে বিশ বচ্ছর খাওয়াতে-পরাতে পেরেছিলেন। অন্য খরচের কথা বাদ দাও, এই এক লক্ষ লোকের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য যে বিরাট প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন সেটা গড়ে তোলা এবং তাকে বিশ বছর ধরে চালু রাখা তারাই করতে পারে যারা সভ্যতার খুব একটা উঁচু স্তরে উঠে গিয়েছে।
এইবারে আমরা পিরামিড নির্মাণের কারণের কাছে পৌঁছে গিয়েছি।
প্রথম কারণ সকলেরই জানা। ফারাওরা (ম্রাটরা) বিশ্বাস করতেন, তাঁদের শরীর যদি মৃত্যুর পর পচে যায়, কিংবা কোনও প্রকারের আঘাতে ক্ষত হয় তবে তারা পরলোকে অনন্ত জীবন পাবেন না। তাই মৃত্যুর পর তাদের দেহকে মামি বানিয়ে সেটাকে এমন একটা শক্ত পিরামিডের ভিতর রাখা হত যে, তার ভিতরে ঢুকে কেউ যেন মামিকে ছুঁতে পর্যন্ত না পারে। কিন্তু হায়, তাঁদের এ বাসনা পূর্ণ হয়নি। পূর্বেই বলেছি, হাজার হাজার বছর চেষ্টা করে দুষ্ট (অর্থাৎ ডাকাত) এবং শিষ্টেরা (অর্থাৎ পণ্ডিতেরা) শেষ পর্যন্ত তাদের গোপন কবরে ঢুকতে পেরেছেন। তাই করে অবশ্য গৌণত কোনও কোনও ফারাওয়ের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে– পণ্ডিতেরা তাদের মামি সযত্নে যাদুঘরে সাজিয়ে রেখেছেন। সেখানে তারা অক্ষত দেহে মহাপ্রলয়ের দিন গুনছেন, যেদিন তারা নব দেহ নব যৌবন ফিরে পেয়ে অমৃতলোকে অনন্ত জীবন আরম্ভ করবেন।
কিন্তু যদি ইতোমধ্যে আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ লেগে যায়? ফলে গুটিকয়েক অ্যাটম বম্ পড়ে? তবে?
আমার মনে ভরসা, এঁরা যখন চোর-ডাকু ধনিক-পণ্ডিতদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে এত হাজার বৎসর অক্ষত দেহে আছেন, তখন মহাপ্রলয় পর্যন্ত পৌঁছে যাবেন-ই যাবেন। অ্যাটম বম পড়ার উপক্রম হলে আমি বরঞ্চ তারই একটার গা ঘেঁষে গিয়ে বসব। মামিটা রক্ষাকবচের মতো হয়ে তার দেহকে তো বাঁচাবেই, সেই সঙ্গে আমাকেও বাঁচিয়ে দেবে। চাই কি, গোটা শহরটাই হয়তো বেঁচে যাবে!
পিরামিড নির্মাণের দ্বিতীয় কারণ– এই কারণের উল্লেখ করেই আমি এ অনুচ্ছেদ আরম্ভ করেছি–
ফারাওরা বলতে চেয়েছিলেন সভ্যতার যে স্তরে আমরা এসে পৌঁছেছি, আমরা যে প্রতাপশালী রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছি, সেগুলো যেন এই পিরামিডের মতো অজর অমর এবং বিশেষ করে অপরিবর্তনীয় হয়ে থাকে। পরিবর্তন যেন না হয়, যা আছে তাই থাকবে, এই ছিল পিরামিড গড়ার দ্বিতীয় কারণ। পিরামিড জগদ্দল পাথর হয়ে অতি শব্দার্থে জগদ্দল পাথরই বটে- যুগ যুগ ধরে আমাদের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য, রাজবংশ, ধর্মনীতি সবকিছু, অপরিবর্তনীয় করে চেপে ধরে রাখবে।
তাই পিরামিড দেখে মানুষের মনে জাগে ভয়। আজ যদি সেই ফারাওরা বেঁচে থাকতেন তবে তাঁর প্রতি জাগত ভীতি। এই পিরামিড যে তৈরি করতে পেরেছে, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবার কল্পনাও তো মানুষ করতে পারে না।
তাজমহলের গীতিরস কঠিন মানুষের পাষাণ হৃদয়কেও গলিয়ে দেয়, কুতুবমিনারের ঋজু দেহ উন্নতশির দুর্বলজনকে সবল হয়ে দাঁড়াতে শেখায়– এই দুই রস কাব্যের, সঙ্গীতের প্রাণ। তাজমহল নিয়ে তাজমহলের মতো কবিতা রচনা করা যায়, কিন্তু পিরামিড নিয়ে কবিতা হয়েছে বলে শুনিনি। বরঞ্চ পিরামিডের দোহাই দিয়ে বেঙ্গল অর্ডিনানুসের অনুকরণে আজ এক নতুন ইজিপশিয়ান অর্ডিনান্স তৈরি করা যায়।
কিন্তু হায়, ফারাওরা অপরিবর্তনের যে অর্ডিনান্স জারি করে বিরাট পিরামিড গড়েছিলেন, সেটা টিকল না। ফারাও বংশ ধ্বংস হল, দূর ইরানের রাজারা মিশর লণ্ডভণ্ড করে দিল, তার পর গ্রিক, রোমান এবং শেষটায় সারা মিশরের লোক ইসলাম গ্রহণ করে সম্পূর্ণ নতুন পথে চলল। মুসলমানরা দেহ এবং আত্মার পার্থক্য চেনে। অনন্ত জীবন পাওয়ার জন্য দেহটাকে যে মামি করে রাখার কোনও প্রয়োজন নেই, সেকথা তারা বোঝে।
কিন্তু ফারাওদের দোষ দিয়ে কোনও লাভ নেই। প্রায় সব দেশেই মানুষ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে বলেছে, এই ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছেছি আর এগিয়ে যাবার প্রয়োজন নেই। যা সঞ্চয় করেছি তাই বেঁচে থাকুক, সেইটেই অপরিবর্তনীয় হয়ে থাক। ফলে হয়েছে পতন।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন এই বিষয় নিয়ে তাজমহলের মতো কবিতা লিখেছেন তখন আমার আর বাক্যব্যয় কী প্রয়োজন?
.
১৯.
চাঁদের আলোতে বিশ্বজন তাজমহল দেখবার জন্য জড়ো হয়।
পিরামিডের বেলাও তাই।
চতুর্দিকে লোকজন গিগি করছে। এদেশের মেলাতেও বোধ করি এত ভিড় হয় না।
অবশ্য তার কারণও আছে। নিতান্ত শীতকাল ছাড়া গরমের দেশে দিনের বেলা কোনও জিনিস অনেকক্ষণ ধরে রসিয়ে রসিয়ে দেখা যায় না। বিশেষ করে যেখানে কোনও সূক্ষ্ম কারুকার্য দেখবার বালাই নেই সেখানে তো আরও ভালো। তাজের মিহি কাজ চাঁদের আলোতে চোখে পড়ে না, তবু সবসুদ্ধ মিলিয়ে তার যে অপূর্ব সামঞ্জস্য চাঁদের আলোতে ধরা দেয় দিনের কড়া আলোতে সেটা দর্শককে ফাঁকি দেয় বলে মানুষ চাঁদের আলোতে তাজ দেখে। পিরামিডে সেরকম কোনও নৈপুণ্য নেই, তদপুরি পিরামিডের চতুর্দিকে মরুভূমি বলে সেখানে দিনের বেলাকার গরম পীড়াদায়ক, কাজেই নিতান্ত শীতকাল ছাড়া দিনের বেলা কম লোকই পিরামিড দেখতে যায়।
পক্ষান্তরে শীতের দেশে ব্যবস্থা অন্যরকম। আমি ফটফটে চাঁদের আলোতে কোন গির্জার পাশ দিয়ে শীতের রাতে হি-হি করে বহুবার বাড়ি ফিরেছি। কাক-কোকিল দেখতে পাইনি।
পল-পার্সি আর আমাদের দলের আরও কয়েকজন পিরামিডের মাঝখানকার কবর-গৃহ দেখতে গেছেন। আমি যাইনি।
আমি বসে বসে শুনছি জাত-বেজাতের কিচিরমিচির, স্যান্ডউইচ খোলার সময় কাগজের মড়মড়, সোডা-লেমনেড খোলার ফটাফট। ইয়োরোপীয়েরা খাবার ব্যবস্থা সঙ্গে না নিয়ে তিন পা চলতে পারে না। পিরামিড হোক আর নিমতলাই হোক, মোকামে পৌঁছানো মাত্রই বলবে, টম, বাস্কেটটা এই দিকে দাও তো। ডিক, তুমি ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালো আর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ডার্লিং, আপেলগুলো ভুলে যাওনি তো? ইতোমধ্যে হ্যারি হয়তো গ্রামোফোনের জাতা চালিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য যদি দলে মেয়েরা ভারি হন তবে কোনওকিছুই শুনতে পাওয়া যায় না। লাভলি, গ্র্যান্ড, সবলাইম ইত্যাদি শব্দে তখন যে ঘ্যাট তৈরি হয় তার কোনটা কী, ঠিক ঠাহর করা যায় না।
কোনও কোনও টুরিস্ট আমাকে বলেছেন, নায়াগ্রার গম্ভীর জলনির্ঘোষ শুনতে হলে নাকি মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে যেতে নেই। যে ধ্বনি তাদের ভিতর ওঠে তাতে নাকি নায়াগ্রার থাক, মেয়েরা আমার ওপর এমনিতেই চটে আছেন। কিন্তু আমার ওপর চটে আর লাভ কী? ওয়াদের খাস-পেয়ারা কবি রবিঠাকুরই এ বাবদে কী বলেছেন
ছেলেরা ধরিল পাঠ, বুড়ারা তামুক,
এক দণ্ডে খুলে গেল রমণীর মুখ।
পল-পার্সি ফিরে এসেছে। আমি শুধালুম, কী দেখলে, বাছারা? তার পর নোটবুক খুলে বললুম, গুছিয়ে বল, সবকিছু টুকে নেব; আমি তো বে-আক্কেলের মতো এই এখানে বসে বসে সময় কাটালুম।
পার্সি করুণ কণ্ঠে বললে, আর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেবেন না স্যর। দেখেছি কচু-পোড়া। মশালের আলোতে হাতের তেলো চোখে পড়ে না। তারই জোরে বিস্তর সুড়ঙ্গ পেরিয়ে একটা চৌকো ঘরে শেষটায় পৌঁছলুম। বেবাক ভোঁ ভো। এক কোণে একখানা ভাঙা ঝটা পর্যন্ত নেই! গাইড বললে, ব্যস্ ফিরে চলুন। আপনি তখনই বারণ করলেন না কেন?
আমি বললুম, বারণ করলে কি শুনতে? বাকি জীবন মনটা খুঁত খুঁত করত না, ফারাওয়ের শেষ শোওয়ার ঘর দেখা হল না? এ হল দিল্লির লাড্ডু।
শুধাল, সে আবার কী?
আমি বুঝিয়ে বললুম।
পল বললে, গাইড বলছিল, পিরামিডের যে বিরাট বিরাট পাথর সেগুলো নাকি টেনে টেনে নদীর ওপার থেকে এখানে আনা হয়েছিল। আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না ওর যা ইংরেজি!
আমি বললুম, ঠিকই বলেছে! নীলের এপারে পাথর পাওয়া যায় না। তাই ওপার থেকে পাথর কেটে ভেলায় করে এপারে নিয়ে আসা হত। আর সে যুগে মানুষ চাকা কী করে বানাতে হয় জানত না বলে সেই পাথরগুলো ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেত। কাঠ বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হত পিছলে নিয়ে যাবার সুবিধের জন্য। এবং শুনেছি, সে পথে নাকি ঘড়া ঘড়া তেল ঢালা হত, সেটাকে পিছলে করার জন্য। আশ্চর্য নয়! এর ছ-টা পাথরে যখন একটা এঞ্জিনের আকার ধরতে পারে, এবং স্পষ্ট দেখেছি, এঞ্জিন রেললাইন থেকে কাত হয়ে পড়ে গেলে তাকে খাড়া করবার জন্য আজকের দিনের কপিকল পর্যন্ত কীরকম হিমসিম খায়, তখন তো তেল-ঘি ঢালার কথা আর অবিশ্বাস করা যায় না।
তখন আলোচনা আরম্ভ হল চাকা আবিষ্কার নিয়ে। আগুন যেরকম মানুষকে সভ্যতার পথ দেখিয়ে দিল চাকাও মানুষকে ঠিক তেমনি বাকি পথটুকু অক্লেশে চলতে শেখাল। শুনেছি, ভারতের মোন-জো-দছড়াতে প্রথম চাকা আবিষ্কার হয় এবং ক্রমে ক্রমে সেটা সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।
আমরা এখনও যখন পাল্কি চড়ি তখন বোধহয় আদিম যুগে ফিরে যাই, যখন মানুষ চাকা আবিষ্কার করতে শেখেনি। ছ জন বেয়ারা একটি মেয়েকে বইতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে যায়, ঘড়ি ঘড়ি জিরোয় আর গামছা ঘুরিয়ে হাওয়া খায়; ওদিকে একজন রিকশাওলা দুটো লাশকে দিব্যি টেনে নিয়ে যায়– সবই চাকার কল্যাণে।
আবুল আসফিয়া বললেন, চাকা এরা আবিষ্কার করতে পারেনি সত্য, কিন্তু হাতের নৈপুণ্যে এরা আর সবাইকে হার মানিয়েছে। এই যে হাজার হাজার টনী লক্ষ লক্ষ পাথর একটার গায়ে আরেকটা জোড়া দিয়েছে, সেখানে এক ইঞ্চির হাজার ভাগের একভাগের ফাঁক। আজকের দিনের জহুরিরা, চশমা বানানেওলারাও এত সূক্ষ্ম কাজ করতে পারে কি না সন্দেহ। আর জহুরিদের কাজ তো এক ইঞ্চি আধ ইঞ্চি মাল নিয়ে। এরা সামলেছে লক্ষ লক্ষ ইঞ্চি।
আমরা শুধালুম, তা হলে তারা সে নৈপুণ্য কোনও সূক্ষ্ম কলা নির্মাণে, কোনও সৌন্দর্য সৃষ্টিতে প্রয়োগ করল না কেন?
আবুল আসফিয়া বললেন, সেটা দেখতে পাওয়া যায় তাদের মন্দিরগাত্রে, তাদের প্রস্তরমূর্তিতে।
হায়, সেগুলো এখন দেখার উপায় নেই।
পার্সি ততক্ষণে বালু জড়ো করে বালিশ বানিয়ে তারই উপর মাথা দিয়ে শুয়ে পড়েছে। তত্ত্বালোচনার প্রতি তার একটা বিধিদত্ত আজন্মলব্ধ নিরঙ্কুশ বৈরাগ্য আছে। স্বতই ভক্তিভরে মাথা নত হয়ে আসে।
আবুল আসফিয়া বললেন, অনেক রাত হয়েছে। শহরে ফেরা যাক।
পল অনেকক্ষণ ধরে গম্ভীর হয়ে কী যেন ভাবছিল। মোটরের দিকে যেতে যেতে বললে, আমার কিন্তু সমস্ত জিনিসটা একটা হিউজ ওয়েস্ট বলে মনে হয়। আমরা সবাই চুপ করে শুনলুম।
আমাদের দলের মধ্যে একটি প্রৌঢ়া মহিলা ছিলেন। তিনি বললেন, না, মসিয়ো পল। পিরামিডের একটা গুণ আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন। এর সামনে দাঁড়ালে, বয়সের দিক দিয়ে দেখতে গেলে, আমাকেও তরুণী বলে মনে হয়।
একটা কথার মতো কথা বটে।
আমি বললুম, শাবাশ!
২০. মানুষের চেহারা জাগ্রত অবস্থায় একরকম
২০.
মানুষের চেহারা জাগ্রত অবস্থায় একরকম, ঘুমন্ত অবস্থায় অন্যরকম। শহরের বেলাতেও তাই। জাগ্রত অবস্থায় কোনও মানুষকে বেশ চালাকচতুর বলে মনে হয়, কিন্তু ঘুমন্ত অবস্থায় তাকেই দেখায় আস্ত হাবা গঙ্গারামের মতো। দুপুরবেলা লালদিঘি গমগম করে রাত্রে সেখানে গা ছমছম করে। আমাদের পাড়া পার্ক সার্কাসের ট্রামডিপো অঞ্চল দুপুরবেলা ঘুমিয়ে পড়ে। সন্ধ্যায় হোটেলগুলো যেন কোরাসগান গেয়ে উঠে।
রসের ক্ষেত্রে আমি ছেলে-বুড়োতে তফাত করিনে। আট বছরের ছেলে মহাভারত পড়ে সুখ পায়, আশি বছরের বুড়োও আনন্দ পায়। আবার আট বছরের ছেলে দিব্য কীর্তন গেয়ে শুনিয়ে দিল, ষাট বছরের সুরকানা পণ্ডিত ধরতে পারল না, সেটা কীর্তন না বাউল অর্থাৎ রসবোধের ক্ষমতা বয়সের ওপর নির্ভর করে না।
কিন্তু কোনও কোনও ছোটখাটো রস বয়সের ওপর নির্ভর করে। আট বছরে সিগারেট খেয়ে কোনও লাভ নেই, আঠারোতেই রাস্তায় মার্বেল খেলার রস শুকিয়ে যায়। ঠিক তেমনি রাতের শহর ছোটদের জন্য নয়। তুলনা দিয়ে বলি, সকাল আটটায় আট বছরের ছেলেকে আটখানা ট্যাক্সি ডাকতে পাঠাতে পারি, কিন্তু রাত দশটায় দশ বছরের ছেলেকে দশ জায়গায় পাঠাতে পারিনে।
কিন্তু যেসব দুঁদে ছেলেরা যেমন পল-পার্সি– রাত দুটোর সময় জেগে আছে, তাদের নিয়ে কী করা যায়? আবুল আসফিয়া অভয় জানিয়ে বললেন, কাইরোতে এমন সব নাচের জায়গা আছে, যেখানে বাপ-মা আপন ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আনন্দ করতে যান।
তারই একটা ক্যাবারেতে যাওয়া হল।
খোলাতে। উপরে মুক্ত আকাশ। চতুর্দিকে জাপানি ফানুসে ঢাকা রঙ-বেরঙের আলোর জ্যোতি ক্ষীণ বলে উপরের দিকে খানিকক্ষণ তাকালে গম্ভীর আকাশের গায়ে চটুল তারার মিটমিট নাচ দেখা যায়।
শ খানেক ছোট ছোট টেবিল। এক প্রান্তে স্টেজ। ডাইনে-বাঁয়ে উইঙ নেই, পিছনে শুধু, হুবহু শুক্তির এক পাটির মতো কিংবা বলতে পার, সাপের ফণার মতো উঁচু হয়ে ডগার কাছে নিচের থেকে বেঁকে আছে স্টেজের বিরাট ব্যাকগ্রাউন্ড। শুক্তিতে আবার ঢেউ খেলানো– এরকম ছোট্ট সাইজের ঝিনুক সমুদ্রপাড়ে কুড়িয়ে পাওয়া যায় দেখতে ভারি চমৎকার। ব্যাকগ্রাউন্ডের পিছনে এরই আড়ালে গ্রিনরুম নাকি, না মাটির নিচে সুড়ঙ্গ করে?
হঠাৎ সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। ভাবছি ব্যাপার কী। পল-পার্সিকে কানে কানে বললুম, মানিব্যাগ চেপে ধরো!! বলা তো যায় না বিদেশ-বিভুই জায়গা।
নাহ্, আলো জ্বলতে দেখি, শুক্তির সামনে এক স্ফিনকস। পিরামিডের পাশে আমরা এই স্ফিনকসের পাথরের মূর্তি দেখেছি–অবশ্য এর চাইতে পাঁচশো শুণে বড়। কিন্স মিশরের সম্রাট ফারাওয়ের প্রতিমূর্তি। মুখটা রাজারই মতো, শুধু শক্তি আর প্রতাপ বোঝানোর জন্য শরীরটা সিংহের।
পিছন থেকে বেরিয়ে এল ছটি মেয়ে। গলা থেকে পা অবধি ধবধবে সাদা শেমিজের মতো লম্বা জামা পরা। রাস্তায় মিশরি মেয়েদের এরকম জামা পরতে দেখেছি। তবে অন্য রঙের।
আস্তে আস্তে তারা ফিসের চারদিকে ঘুরে ঘুরে নাচতে আরম্ভ করল। বড় মৃদু পদক্ষেপ। পায়রা যেরকম নিঃশব্দ পদসঞ্চারণে হাঁটে। চাঁদ যেরকম আকাশের উপর দিয়ে তারার ফুলকে না মাড়িয়ে আকাশের এপার-ওপার হয়।
পায়ে ঘুঙুর নেই, হাতে কাকন নেই। শুধু থেকে থেকে সমের একটু আগে তেহাইয়ের সময় থেকে বাঁশি, খঞ্জনি আর ঢোলের সামান্য একটুখানি সঙ্গীত। বড় করুণ, অতি বিষাদে ভরা। নীলনদের এপার থেকে মা যেন ওপারের ছেলেকে সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফেরার জন্য ডাকছে। এ ডাক আমি জীবনে বহুবার শুনেছি। যে মা-ই ডাকুক না কেন, আমি যেন সে ডাকে আমার মায়ের গলা শুনতে পাই।
সে ডাক বদলে গেল। এবারে শুনতে পাচ্ছি অন্য স্বর। এ যেন মা ছেলেকে ঘুম থেকে জাগাবার চেষ্টা করছে। এ গলায় গোড়ার দিকে ছিল অনুনয়-বিনয়। তার পর আরম্ভ হল আশা-উদ্দীপনার বাণী। সঙ্গীত জোরালো হয়ে আসছে। পদক্ষেপ দ্রুততর হয়েছে। ছটি নয়, এখন মনে হচ্ছে যেন ষাটটি মেয়ে দ্রুত হতে দ্রুততর লয়ে নৃত্যাঙ্গন অপূর্ব আলিম্পনে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে! আর পদক্ষেপের কণামাত্র স্থান নেই।
স্বপ্নে অজানা লিপি, অচেনা বাণী মানুষ যেমন হঠাৎ কোন এক ইন্দ্রজালের প্রভাবে বুঝে ফেলে, আমি ঠিক তেমনি হঠাৎ বুঝে গেলুম নাচের অর্থটা কী। এ শুধু অর্থবিহীন পদক্ষেপ নয়, ব্যঞ্জনাহীন হস্তবিন্যাস নয়। নর্তকীরা নব মিশরের প্রতীক। এরা প্রাচীন মিশরের প্রতীক ফিনসকে তার যুগ-যুগান্তব্যাপী ন্দ্রিা থেকে জাগরিত করতে চাইছে। সে তার লুপ্ত গৌরব নিয়ে সুপ্তিজাল ছিন্নভিন্ন করে আবার মিশরে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক, বিদেশি স্বৈরতন্ত্রের কুহেলিকা উদ্ঘাটন করে সেই প্রাচীন সবিতার নবীন মূর্তি দুলোক ভূলোক উদ্ভাসিত করুক।
তবে কি আমারই মনের ভুল? দেখি, ফিক্স মূর্তির মুখে যেন হাসি ফুটে উঠেছে। এ কি জাদুকরদের ভানুমতী, না সৃষ্টিকর্তার অলৌকিক আশীর্বাদ?
আবার অন্ধকার হয়ে গেল।
নিদ্রিতের চোখে যে রকম পড়ে, আমার চোখে ঠিক তেমনি এসে পড়ল পশ্চিমাকাশ থেকে চন্দ্রান্তের রক্তছটা আর পূর্বাকাশ থেকে নব অরুণোদয়ের পূর্বাভাস।
জয় মিশরভূমির জয়।
.
২১.
ইংরেজিতে কী যেন একটা প্রবাদ আছে, —
Early to bed and early to rise.
তার পর কী যেন সব হয়? হ্যাঁ, বাঙলাটা মনে পড়েছে–
সকাল সকাল শুতে যাওয়া সকাল বেলা ওঠা,
স্বাস্থ্য পাবে বিদ্যে হবে, টাকাও হয় মোটা।
গ্রামের তুলনায় শহরে টাকা বেশি, রাস্তায় রাস্তায় বিদ্যের ভাণ্ডার ইস্কুল-কলেজ আর শহরবাসীকে অজর অমর করে রাখবার জন্য কত ডাক্তার কবিরাজ হেকিম না খেয়ে মরছে তার হিসাব রাখে কে? তাই বোধহয় শহরের লোক সকাল সকাল শুতে যাওয়ার আর সকালবেলা ওঠার প্রয়োজন বোধ করে না। গ্রামের লোক তাই এখনও ভোরবেলা ওঠে। কাইরো শহর তাই এখনও ঘুমুচ্ছে– অবশ্য নাক ডাকিয়ে নয়।
আবুল আসফিয়া বললেন তা ঠিক, কিন্তু মুসলমানদের প্রথম নামাজ পড়তে হয় কাক-কোকিল ডাকার পয়লা। এদেশে তাদের বড় বড় মসজিদ মাদ্রাসা আজহর পাড়ায়। সেখানেই যাওয়া যাক। তারা নিশ্চয়ই ঘুম থেকে উঠেছে।
উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু মসজিদের নামাজিদের দেখবার জন্য এ সুদূর কাইরো শহরে আসা কেন? আপন কলকাতায় জাকারিয়া স্ট্রিটে গেলেই হয়!
উঁহু, সেইটেই নাকি কাইরোর প্রবীণ অঞ্চল। অবশ্য পিরামিডের তুলনায় অতিকায় নবীন বয়স মাত্র এক হাজার বৎসর। কিঞ্চিৎ এদিক-ওদিক। প্রাচ্যের রোমান্টিক নগরী কাইরো বলতে জগজ্জনের মনে আরবিস্থানের যে রঙিন তসবির ফুটে ওঠে সে বস্তু নাকি এখনও ওই অঞ্চলেই পাওয়া যায়।
ট্রাম কিন্তু তখনই চলতে আরম্ভ করেছে। কলকাতার ট্রামের তুলনায় অতিশয় লজঝড় এবং ছুটির দিনে ইস্কুল-কলেজের মতো ফাঁকা।
পয়লা ট্রাম দেখামাত্রই আবুল আসফিয়া তড়িঘড়ি ট্যাসিওলাদের পাওনা পয়সা বুঝিয়ে দিয়ে বিদেয় করে দিয়েছেন। পয়সা বাঁচাবার এ ফিকির সবাই জানে কিন্তু বিদেশে-বিভুইয়ে কে জানে কোন ট্রাম কোথায় যায়? আপন কলকাতাতেই যখন ট্রামের গুবলেটে নিত্যি নিত্যি কালীঘাট যেতে গিয়ে পৌঁছে যাই মৌলা আলী, কিংবা বলতে পার মর মর অবস্থায় মেডিকেল কলেজ না পৌঁছে ট্রাম ভিড়ল নিমতলায়। বল্ হরি, হরি বল!
আবুল আসফিয়া বললেন, আল্লা আছেন, ভাবনা কী!
তব সাথী হয়ে দগ্ধ মরুতে
পথ ভুলে তবু মরি
তোমারে ত্যজিয়া মসজিদে গিয়া
কী হবে মন্ত্র স্মরি!
তবু খুব ভরসা পেলুম না। হরিই বল আর আল্লাই বল, তারা সব-কজনা এই কটা বাউণ্ডুলের জন্য অন্য সবকিছু ছেড়ে দিয়ে এই অবেলায় ঠিক ট্রাম ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পাঠাবার তদারকিতে বসে আছেন– এ ভরসা করতে হলে যতখানি বিশ্বাসী হতে হয় আমি ঠিক ততখানি নই। তা হই আর না হই, আর পাঁচ জনের সঙ্গে সঙ্গে ট্রামেই উঠতে হল।
রাস্তা ক্রমেই সরু হয়ে আসছে। পৃথিবীর সর্বত্র যা হয়– খোলা-মেলার নতুন শহর থেকে নোংরা ঘিঞ্জি পুরনো শহরে শহরে ঢুকবার সময়।
রাস্তার দু দিকে দোকানপাট এখনও বন্ধ। দু-একটা কফির দোকান খুলি খুলি করছে। ফুটপাথের উপর লোহার চেয়ারের উপর পদ্মাসনে বসে দু চারটি সুদানি দারোয়ান তসবি টপকাচ্ছে, খবরের কাগজওলার দোকানের সামনে অল্প একটু ভিড়, চাকর-বাকররা হনহন করে চলেছে বড় সায়েবদের বাড়ি পৌঁছতে দেরি হয়ে গিয়েছে বলে।
তরল অন্ধকার সরল আলোর জন্যে ক্রমেই জায়গা করে দিচ্ছে। কালো চুলের মাঝখানে সাদা সিঁথি ফুটে উঠেছে। তার উপর দেখা যাচ্ছে লাল সিঁদুরের পোঁচ। আকাশ-বাতাসের এই লীলা-খেলাতে সবকিছু যে পাপষ্টি দেখা গেল তা নয়, কিন্তু ট্রামের জানালার উপর মাথা রেখে আধো ঘুমে আধো জাগরণে জড়ানো জড়ানো হয়ে সবকিছুই যেন কিছু কিছু দেখা হল। স্বপ্নে ঘুমে জাগরণে মেশানো অভিজ্ঞতা ভাষাতে প্রকাশ করা কঠিন। ছবিতে এ জিনিস ফোঁটানো যায় অনেক অক্লেশে। তাই বোধহয় চিত্রকরদের সূর্যোদয়ের ছবি সাহিত্যের সূর্যোদয়কে প্রায়ই হার মানায়।
সবচেয়ে সুন্দর দেখাচ্ছিল মসজিদের চুড়ো (মিনার)গুলোকে। কুতুবমিনার যারা দেখেছে তারাই জানে তার সৌন্দর্য কী। মনে হয় সে যেন পৃথিবীর ধুলো-মাটির প্রাণী নয়। সে যেন কোনও রাজাধিরাজের উষ্ণীষ দেশের আপামর জনসাধারণের বহু ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে ভগবানের আপন হাতের অভিষেক আশীর্বাদের পরশ পাচ্ছে।
তবু কুতুবের পা মাটিতে ঠেকেছে। এদের বহু মিনার দাঁড়িয়ে আছে আল্লার নামাজের ঘর মসজিদের উপর। কিন্তু এরা জানে উপরের দিকে আল্লার কাছে যাওয়ার অর্থ কী। সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যতই উপরের দিকে যাচ্ছে ততই ভয়ে জড়সড় হয়ে সরু হয়ে যাচ্ছে–ক্লাসের গাব্দা-গোলা ছেলেও যেরকম হেডমাস্টারের সামনে শরকাঠিটি হয়ে যায়। কিন্তু দ্যুলোক আর সবিতা যেন ওদের অভয় দিচ্ছেন আকাশ যেন তার আপন নীলাম্বরী তাদের পরিয়ে দিতে এসেছেন— পিছনের দিকটা পরা হয়ে গিয়েছে, আর সবিতা যেন অরুণালোকের লম্বা লম্বা দড়ির ফাঁস লাগিয়ে তাদের খাড়া রাখবার চেষ্টা করছেন। তাই দেখে ওমর খৈয়াম বললেন,
And lo! the Hunter of the East has caught
The Sultans turret in a noose of light. —(Fitzerald)
কান্তি ঘোষের ইংরেজি অনুবাদ সচরাচর উত্তম কিন্তু এ স্থলে আমি একটু আপত্তি জানাই। তাঁর অনুবাদে আছে–
পুব-গগনের দেব শিকারির স্বর্ণ-উজল কিরণ তীর
পড়ল এসে রাজপ্রাসাদের মিনার যেথা উচ্চ শির। (কান্তি ঘোষ)*
[*স্বর্গীয় কান্তি ঘোষ আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। আর বহু গুণীজনের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে এ অধমও তার অনুবাদে উচ্ছ্বসিত।]
আসলে কিন্তু সূর্যালোক তীরের মতো মিনারের উপর আঘাত দিতে পারে। আবার নূস–ফাঁসের মতোও তাকে জড়িয়ে ধরতে পারে। তফাত বিশেষ কিছু নেই আর পাগলা কবিরা কত যে উদ্ভট উপমা দেয় তার কি ইয়ত্তা আছে। তবে কি না অনুবাদের বেলা মূলের যত কাছে থাকা যায় ততই মঙ্গল।
প্রকৃতির গড়া নীল, আর মানুষের গড়া পিরামিডের পরেই মিশরের মসজিদ ভুবন বিখ্যাত এবং সৌন্দর্যে অতুলনীয়। পৃথিবীর বহু সমঝদার শুধুমাত্র এই মসজিদগুলোকেই প্রাণভরে দেখবার জন্য সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে কাইরোতে আসেন। পিরামিড যারা বানিয়েছিল তাদের বংশধররাই এসব মসজিদ তৈরি করেছে কিন্তু এদের গায়ে ইতোমধ্যে কিঞ্চিৎ ইরানি গ্রিক রোমান এবং পরবর্তী যুগে বিস্তর আরব রক্ত ঢুকে পড়েছিল বলে এরা বানিয়েছে ভিন্ন। শৈলীতে। বিশেষত পূর্বেই বলেছি– পিরামিড তার লক্ষ লক্ষ মণ ওজন নিয়ে মাটির উপর ভারিক্তি চালে বসে আছে, তার রাজা যেভাবে প্রজাদের বুকের উপর জগদ্দল পাথরের মতো বসতেন তারই অনুকরণ করে। পরবর্তী যুগের মসজিদ যারা বানিয়েছিল তারা মুসলমান। তারা রাজার রাজা সৃষ্টিকর্তাকে দেয় সর্বোচ্চ স্থান। তাই তাদের মসজিদের মিনারগুলো উপরের দিকে ধেয়ে চলেছে, দুলোকেশ্বরের সন্ধানে। কিংবা বলতে পার তারা দাঁড়িয়ে আছে, মুসলমান নামাজ পড়ার সময় যেরকম প্রতিদিন পাঁচ বার সোজা হয়ে আল্লার সামনে দাঁড়ায়। তাই পিরামিডে ভীতিরস, মসজিদে গীতিরস।
পল-পার্সি দেখলুম এ রসে ঈষৎ বঞ্চিত। আমরা পুরনো কাইরোর মাঝখানে পৌঁছাতেই ট্রাম ছেড়ে একটা মসজিদের অদৃষ্টপূর্ব সৌন্দর্য দেখতে আরম্ভ করেছি; ওরা দেখি, মা-মাসির তম্বিতে গিয়ে শীতের গঙ্গাস্নানের সময় আমরা যা করি তাই করছে। গঙ্গা যে সুন্দর সেটা স্বীকার করছে কিন্তু তাতে নিমজ্জিত হওয়ার আনন্দ সম্বন্ধে সন্দিহান।
পার্সি একটু ঠোঁটকাটা। হক্ কথা–অর্থাৎ যেটাকে সে হক ভাবে, সেটা টক হলেও ক্যাট ক্যাট করে বলতে পারে। পলের ভাবটা একটু আলাদা। অশ্বত্থামা যদি পিটুলি গোলা খেয়ে সানন্দে তাণ্ডব নৃত্য জোড়ে তবে পার্সি তাকে তনুহূর্তে বলে দেবে যে দুধের বদলে তাকে ঘোল দিয়ে ফাঁকি দেওয়া হয়েছে, আর পল ভাববে, কী হবে ওর ভুল ভাঙিয়ে তার আনন্দটি নষ্ট করতে, ও যে আনন্দ পাচ্ছে তাতে তো কারও কোনও লোকসান হচ্ছে না!
পার্সি বললে, হুঁহ! যত সব! পিরামিড? হ্যাঁ বুঝি। মোক্ষম ব্যাপার। চারটিখানি কথা নয়। পারি ওরকম একটা বানাতে? মানলুম, এ মসজিদটা সুন্দর কিন্তু এটা বানানো আর তেমন কী?
পার্সিও মসজিদ দেখে বে-এক্তেয়ার হয়নি! সেকথা পূর্বেই বলেছি। কিন্তু এ যুক্তিটি তারও মনঃপূত হল না। শুধাল, পার তুমি বানাতে?
আলবৎ।
আমি বললুম, সন্দেহের কিঞ্চিৎ অবকাশ আছে। আজকের দিনে যেসব কলকজা দিয়ে নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস তৈরি করা যায় তাই দিয়ে পিরামিড তৈরি করা অসম্ভব নয়। কিন্তু এ মসজিদে যে নিপুণ মোলায়েম কারুকার্য আছে সেরকম করবার মতো হাত আজকের দিনে আর কারও নেই। আর থাকলেই-বা কী? সেটা তো হবে নকল। তুমি যদি একটি বিরাট দিঘি খোঁড়ো তবে একথা কেউ বলবে না, এটা অমুক দিঘির নকল। তুমি যদি একটা পিরামিড বানাও তবে বলবে না এটা পিরামিডের নকল, কারণ সব পিরামিডই হুবহু একই প্রকারের, কোনওটা বেশি বড় কোনওটা কম বড়। কিন্তু তুমি যদি হ্যামলেট-খানা নকল করে মাসিক পত্রিকায় পাঠাও তবে তারা ছাপবে না, বলবে নকল। তুলনাটা মনঃপূত হল না? তবে বলি, তুমি যদি মোনালিজার ছবি পর্যন্ত হুবহু একে ফেল তবে সবাই বলবে, নকল, তবে ওস্তাদের হাত বটে, বাহ্! কেউ বলবে না, আহ্!
পল শুধাল, বাহু আর আহ্-এর মধ্যে তফাতটা কী?
আমি বললুম, যেখানে শুধুমাত্র হাতের ওস্তাদি কিংবা ওইজাতীয় কিছু একটা, যেমন মনে কর মাটির থেকে একশো হাত উপরে একটা দড়ির উপর হেঁটে চলে যাওয়া, কিংবা মনে কর সিঙ্গিটার মুখের ভিতর আপন মুণ্ডুটা ঢুকিয়ে দেওয়া, এক কথায় সার্কাসের তাবৎ কসরত দেখে আমরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলি, বাহ্! পিরামিডের বেলাও তাই বলি বাহ! কিন্তু অমিতাভের উত্তম প্রতিকৃতিতে তার শান্ত-প্রশান্ত মুখচ্ছবি কিংবা মান্নার মুখে বিগলিত মাতৃরস দেখে আমরা রসের সায়রে ডুবতে ডুবতে বলি, আহ্! কী আরাম! কী সৌন্দর্য! বাহু-এর কেরানি যতই কঠিন, যতই রোমাঞ্চকর হোক না কেন, তার শেষ মূল্য আহ-এর জিনিসের চেয়ে কম। এভারেস্টের চুড়োয় ওঠা যত কঠিনই হোক না, তার মূল্য তিয়াসী পথিককে একপাত্র জল দেওয়ার চেয়ে অনেক কম। এই যে পার্সি বললে, সে পিরামিড বানানোর মতো কঠিন কর্ম করতে পারে না, সেইটেই সবকিছু যাচাই করার শেষ পরশপাথর নয়। শেক্সপিয়র খুব সম্ভব দড়ির উপরে ধেই ধেই করে নৃত্য করতে পারতেন না। তাই বলে ওই কর্ম তার হ্যামলেটের চেয়ে মূল্যবান এ রায় কে দেবে? আসলে দুটো আলাদা জিনিস। তুলনা করাই ভুল। পিরামিডে আছে ইঞ্জিনিয়ারিং হুনোর হেকমত (স্কিল) আর মসজিদে আছে রসসৃষ্টি (আর্টিস্টিক ক্রিয়েশন)।
ইতোমধ্যে দেখি একটি মিশরীয় জাব্বা-জোব্বা পরা ছাত্র আজহর বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ থেকে বেরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসছে। চেহারা দেখে ভারতীয় বলেই মনে হল।
.
২২.
আজহর বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স পুরো-পাক্কা এক হাজার বৎসর। অক্সফোর্ড, কেজি, প্যারিস, বার্লিন এর চেয়ে কয়েকশো বছরের ছোট। তবু আজ যেসব গুণীজ্ঞানীর নাম পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এঁরা ওইসব ইয়োরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আজহর থেকে যারা বেরোন তাঁদের নাম তো শুনতে পাইনে। হ্যাঁ, মনে পড়ল, মিশরের গাঁধী বলতে যাকে বোঝায় সাদ জগলুল পাশা ছিলেন আজহরের ছাত্র। কিন্তু আর কারও নাম শুনতে পাইনে কেন?
আশ্চর্য! মুসলমানরা যখন স্পেন দখল করল তখন তারা সেখানে আজহরের অনুকরণে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ল। প্যারিস ইউনিভার্সিটির গোড়াপত্তন যারা করেন তাদের অনেকেই লেখাপড়া শিখেছিলেন স্পেনের মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবং প্রথম দিককার পাঠ্যপুস্তকগুলো পর্যন্ত আরবি বই থেকে লাতিনে অনুবাদ করা। আজ আর আজহরের নাম কেউ করে না, করে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের।
কিন্তু আশ্চর্য হই কেন? একদা এই ভারতবর্ষের জ্ঞান-বিজ্ঞান ভারতবর্ষের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল। গ্রিকরা আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছিল। পরবর্তী যুগে ইয়োরোপীয়রা আমাদের কাছ থেকে শূন্যের ব্যবহার শিখল (লক্ষ করেছ বোধহয় রোমান হরফে যখন I, I, X, X, C. M. লেখ তখন শূন্যের ব্যবহার আদপেই হয় না।) এবং তারই ফলে তাদের গণিত শাস্ত্র কী অসাধারণ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল। আরবরা চরক সুশ্রুতের অনুবাদ করল, আরও কত কী। একাদশ শতকে ভারত আক্রমণকারী সুলতান মাহমুদের সভাপণ্ডিত অল-বিরুনি সংস্কৃত শিখে ভারতবর্ষের জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্বন্ধে যে বই লেখেন তা পড়ে সে যুগের মুসলিম জগৎ অবাক হয়ে ভারতবর্ষের গুণগান করেছিল। তারও পরবর্তী যুগে সম্রাট আওরঙ্গজেবের বড় ভাই দারা শিকুর উপনিষদ সম্বন্ধে ফারসি বই লাতিনে তর্জমা হয়ে যখন ইয়োরোপে বেরুল তখন সে বই নিয়ে ইয়োরোপে কী তোলপাড়ই না হয়েছিল। সে যুগের সেরা দার্শনিক শোপেন হাওয়ার তখন বলেছিলেন, এ বই আমার জীবনের শেষ কটা দিন শান্তিতে ভরে দেবে। ওই সময়েই বিশ্বকবি গ্যোটে শকুন্তলার অনুবাদ পড়ে ঘন ঘন সাধু সাধু বলেছিলেন।
এখনও ভারতবর্ষের, আজহরের পুরনো সম্পদের সম্মান ইয়োরোপীয়রা করে কিন্তু আজকের দিনে যারা শুধু সংস্কৃত কিংবা মিশরের আরবির চর্চা নিয়ে পড়ে থাকেন তাদের নাম কেউ করে না। তাঁরা এমনকিছু সৃষ্টি করতে পারেন না কেন যা পড়ে বিশ্বজন বিমোহিত হয়ে পুনরায় সাধু, সাধু রবে হুঙ্কার তোলে?
হায়, এঁদের সৃজনীশক্তি ফুরিয়ে গিয়েছে। কেন ফুরল? তার একমাত্র কারণ, এক বিশেষ যুগে এসে এরা ভাবলেন, এঁদের সবকিছু করা হয়ে গিয়েছে, নতুন আর কিছু করবার নেই, পুরনো পুঁজি ভাঙিয়ে খেলেই চলবে।
এবং তার চেয়েও মারাত্মক কথা– এঁরা অন্যের কাছ থেকে আর কিছু শিখতে চান না। এঁদের দম্ভ দেখে তাই স্তম্ভিত হতে হয়।
আজহরের ছেলেটিকে জিগ্যেস করলুম, তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স কেমেস্ট্রি বটুনি পড়ানো হয়?
সে শুধাল, এসব কী?
অনেক কষ্টে বোঝালুম।
সে বললে, ধর্মশাস্ত্রে যা নেই, তা জেনে আমার কী হবে?
আমি বললুম, অতিশয় হক কথা। ধর্ম ছাড়া অন্য কোনও গতি নেই কিন্তু ভ্রাতঃ, তোমার পা যদি আজ আছাড় খেয়ে ভেঙে যায় আর ডাক্তার বলে, এক্সরে করে দেখতে হবে কোন্ জায়গায় ভেঙেছে, তখন কি ধর্মশাস্ত্রে এক্সরে-র কল বানাবার সন্ধান পাবে?
উত্তরে কী বলেছিল মনে নেই। ধর্ম রক্ষা করবেন এইজাতীয় কিছু একটা। কিন্তু ইতোমধ্যে দেখি পল-পার্সি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তত্ত্বালোচনা পার্সিকে বিকল করে সে কথা পূর্বেই বলেছি, কিন্তু এস্থলে পল পর্যন্ত বিচল হয়ে পড়ল। আমি যখন একটু থেমেছি তখন দেখি তারা এক দোকানির সঙ্গে দরদস্তুর করছে।
কী ব্যাপার? মিশরের পিরামিডের ভিতর যেসব টুকিটাকি জিনিস পাওয়া গিয়েছে তারই কিছু কিছু এখানে বিক্রি হচ্ছে। আমি বললুম, এসব তো মহামূল্যবান জিনিস গুলো কেনার কড়ি আমাদের কাছে আসবে কোত্থেকে, আর মিশরি সরকার সেগুলো জাদুঘরে সাজিয়ে না রেখে বাজারে বিক্রি করবার জন্য ছাড়বেই বা কেন?
দোকানি বললে, একই জিনিস এত অসংখ্য পিরামিডে এত বেশি পাওয়া গিয়েছে যে সেগুলো সরকার বাজারে ছেড়েছে–ভালগুলো অবশ্য জাদুঘরে সাজানো আছে এবং দামও তাই বেশি নয়।
আমি কিনি-কিনছি কিনি-কিনছি করছি, এমন সময় সেই আজহরের ছেলেটি আমার কানে কানে বললে, তাই যদি হবে তবে ওর দোকানের পিছনের কারখানাতে কী সব তৈরি হচ্ছে। চলুন না, কারখানাটা দেখে আসবেন।
আমি বললুম, কী আর হবে দেখে? জর্মনিতে তৈরি কাশ্মিরি শাল, জাপানে তৈরি খাঁটি অতিশয় খাঁটি ভারতীয় খদ্দর, কলকাতায় তৈরি জর্মন ওষুধ এসব তো বহু বার দেখা হয়ে গিয়েছে। ওর থেকে নতুন আর কী তত্ত্বলাভ হবে?
পল-পার্সিকে বললুম, পাশের ছেলের পাতা থেকে টুকলি করা আর এই জাল মাল তৈরি করাতে তফাত নেই।
পল বললে, মাস্টার ধরতে পারলে কান মলে দেন।
আমি বললুম, সরকারও মাঝে মাঝে এদের কান মলে দেয়।
তখন হঠাৎ খেয়াল হল, আজহরি ছেলেটি যে ফিসফিস করে কানে কানে কথা বলেছিল, সেটা বাঙলায়। তৎক্ষণাৎ তাকে শুধালুম, আপনি কি বাঙালি?
সে বললে, হ্যাঁ।
তার পর শুনলুম, বর্ধমানে বাড়ি, দশ বছর বয়সে এখানে সে এসেছে। বাঙলা প্রায় ভুলে গিয়েছে। আরও চার বছর অর্থাৎ সবসুদ্ধ বারো বছর এদেশে কাটিয়ে ফের বর্ধমানে ফিরে যাবে।
সেখানে ফিরে গিয়ে কী করবে? এই বিদ্যের কদর তো ভারতবর্ষে নেই। তাতে আশ্চর্য হবারই বা কী? কাশী থেকে বারো বছর সংস্কৃত শিখে বর্ধমানে ফিরলে তার পাণ্ডিত্যেরই-বা মূল্য দেয় কে? তাকেও তো সেখানে উপোস করতে হয়। একেও তাই করতে হবে। আজ আর প্রাচীন শাস্ত্রের পাণ্ডিত্যের কেউ সম্মান করে না।
কিন্তু ছেলেটির দেখলুম তাই নিয়ে কোনও দুর্ভাবনা নেই। বাপ ধার্মিক লোক, ছেলেকে ধর্মশিক্ষা করতে পাঠিয়েছেন, তাই শিখে সে দেশে ফিরে যাবে– তার পর যা হবার তাই হবে।
দলের কেউ এ দোকানের সামনে দাঁড়াচ্ছে, কেউ ও দোকানের সামনে দাঁড়াচ্ছে। কেনাকাটা হচ্ছে অতি সামান্য। টুকিটাকি নাড়াচাড়াতে আনন্দ অনেক বেশি খরচাও তাতে নেই। এই করে আমরা সমস্ত দিন কাটিয়ে দিতে পারতুম কিন্তু হঠাৎ দলের একজন স্মরণ করিয়ে দিলেন, আমাদের পোর্টসঈদের ট্রেন ধরতে হবে আটটায়। আবুল আসফিয়াকে স্মরণ করিয়ে দিতে তিনি বললেন, চলুন। কিন্তু তার হাবভাবে কোনও তাড়া নেই।
অতি অনিচ্ছায় ট্রামে উঠতে হল। আজহরের ছেলেটি আমার সঙ্গে বাঙলা কথা কইতে পেয়ে আমার সঙ্গ ছাড়তে চায় না। সে-ও চলল আমাদের সঙ্গে। আরবি ভাষা এখন তার জীবনের মূলমন্ত্র, কিন্তু তাই বলে কি মাতৃভাষা বাংলার মায়া এত সহজে কাটানো যায়?
খ্যাচাঙ করে ট্রাম দাঁড়াল। কী ব্যাপার? আগের একটা ট্রাম মোড় নিতে গিয়ে লাইন থেকে ছিটকে পড়েছে। বাদবাকি সব ট্রাম তার পিছনে গড্ডলিকায় দাঁড়িয়ে। লোহার ডাণ্ডা দিয়ে জনকয়েক লোক ছিটকে পড়া ট্রামটাকে লাইনে ফেরত নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। চেষ্টার চেয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি হচ্ছে বেশি। লম্বা লম্বা আলখাল্লা উড়িয়ে রাস্তার ছেলে-বুড়ো ট্রামটার চতুর্দিকে ছুটোছুটি লাগিয়েছে। আর কত প্রকারেরই না উপদেশ, আদেশ অনবরত ট্রামের ভিতর-বাহির দু দিক থেকেই উপচে পড়ছে। দেশের হরির লুট এর কাছে লাগে কোথায়?
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজাটা রসিয়ে রসিয়ে দেখছি, এমন সময় দলের একজনের হুশ হল আটটায় যে আমাদের ট্রেন ধরতে হবে। আমাদের দেহমন কিন্তু ওই রণাঙ্গন থেকে তখন কিছুতেই সরছিল না। কারণ ইতোমধ্যে দেখি ট্রামটি কী পদ্ধতিতে ফের লাইনে তোলা যায় তাই নিয়ে দুইটি দলের সৃষ্টি হয়েছে। যারা ডিপো থেকে এতক্ষণে এসে পৌঁছেছে তারা। বাতলাচ্ছে এক প্রকারের রণকৌশল, আর সব-কটা ট্রামের ড্রাইভার, কন্ডাকটরের দল সে রণকৌশলের বিরুদ্ধে ঘোষণা করছে অন্য জিহাদ। ব্যাপারটা তখন এমনি চরমে পৌঁছেছে যে, উভয় পক্ষ তখন লোহার ডাণ্ডা হাতে করে মুখোমুখি হয়ে সদম্ভে সগর্বে সর্বপ্রকারের আস্ফালনকর্ম সুষ্ঠু পদ্ধতিতে শনৈঃ শনৈঃ এগিয়ে নিয়ে চলেছে। দুই দলের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন ট্রামের যাত্রী এবং রাস্তার লোক। আর রাস্তার ছোঁড়ারা আলখাল্লা উড়িয়ে তাদের চতুর্দিকে পাই পাঁই করে ঘুরছে, বোঁ করে মধ্যিখান দিয়ে ইসপার-উসপার হয়ে যাচ্ছে, ধরা পড়ে কখনও-বা দু-একটা চড়-চাপড়ও খাচ্ছে।
একটা ফাসটো কেলাস লড়াইয়ের পূর্বরাগ কিংবা পূর্বাভাস!
কিন্তু হায়, পৃথিবীর কত সকর্মই না অসম্পূর্ণ রেখে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়। এই যে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলুম, নিধিরামকে একদিন মোকামাফিক আচ্ছাসে উত্তম-মধ্যম দেব, তার পূর্বেই তো ম্যাট্রিক পাস করে ইস্কুল ছাড়তে হল! আর নিধে রাস্কেলটা ফেল মেরে পড়ে রইল ইস্কুলে। কী অন্যায় অবিচার। নিধেটা লেখাপড়ায় একটা আস্ত বিদ্যাসাগর, সেকথা জানি, কিন্তু আরও কত খাটাশও তো ম্যাট্রিক পাস করে। ও করলেই-বা কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? আমিও তো দুটো কিল মারার সুযোগ পেতুম। এইসব অবিচার দেখে সংসারের প্রতি আমার তখন ঘেন্না ধরে গিয়েছিল।
আজও তাই হল। দলের লোকের তাড়ায়। তখন আর বেশি সময় হাতে নেই। ট্যাসি নিতে হল।
বুকিং অফিসের সামনে যাত্রার দলের হনুমানের ল্যাজের মতো প্যাঁচ পাকানো কিউ- Q। কেউ কেউ এটাকে U বলে বলে W-ও বলে থাকেন, কারণ জায়গার অভাব থাকলে কিউ সচরাচর এইরকম শেপ-ই নিয়ে থাকে। অথচ গাড়ি ধরার সময় তখন মাত্র পাঁচ মিনিট। আবুল আসফিয়া কিউ-এতে দাঁড়ালেন। আমি তাকে বললুম, ট্রেন মিস নির্ঘাত। তিনি বললেন, আপনারা স্টেশনে যান।
স্টেশনে কখন কোন প্লাটফর্ম থেকে গাড়ি ছাড়বে তার খবর নিয়ে যখন সেই প্লাটফর্মের মুখে দাঁড়ালুম, তখন গেট-চেকার ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে শুধাল–
আপনারা যাবেন কোথায়?
পোর্টসঈদ।(সমবেত সঙ্গীতে)
তবে ট্রেনে গিয়ে আসন নিচ্ছেন না কেন? তাই শুনে পড়ি-মরি হয়ে একদল দিল ছুট ট্রেনের দিকে, আরেক দল যাবে কি যাবে না এই ভাবে না যথৌ ন তন্থৌ হয়ে রইল দাঁড়িয়ে, নড়লুম না আমরা তিনজন, পল, পার্সি আর আমি।
পল বললে, আমাদের টিকিট এখনও কাটা হয়নি।
চেকার ছোকরা বললে, আপনারা যান।
মনে হল ছেলেটি বুদ্ধিমান। আমাদের চেহারা-ছবি দেখে বুঝেছে, আমরা ফাঁকি দিয়ে গাড়ি চড়ার তালে নই। আমরা যখন পয়সা দেবার জন্য তৈরি তখন আমাদের ঠেকিয়ে রাখার কোনও প্রয়োজন নেই।
আমার মন তখন যাব যাব করছে। তখন পলের কথাতে বুঝলুম, সে কতখানি ভদ্র ছেলে! আমাকে বললে, আবুল আসফিয়াকে ছেড়ে আমরা যাব না।
সেই উৎকট সঙ্কটের সময়ও আমার মনে পড়ল, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরও বিশেষ অবস্থায় স্বর্গে যেতে রাজি হননি।
আমাদের চোখের সামনে স্টেশনের বিরাট ঘড়ি। সেটা তখন দেখাচ্ছে, ৭, ৫৯।
কলাপসিবল গেটের ভিতর দিয়ে দেখছি, আমাদের ট্রেনের গার্ড বীরোচিত ধীর পদে টহল দিচ্ছে, আর মাঝে মাঝে ট্যাকঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।
মিশর তো প্রাচ্য দেশ, আরামের দেশ, অপনচুলায়িটির দেশ। ওরা আবার সময়মতো গাড়ি ছাড়ার যাবনিক পদ্ধতি শিখল কোথা থেকে? সংসারের অবিচারের প্রতি আবার আমার ঘেন্না ধরল। ট্রেন তো বাবা, সর্বত্রই নিত্য নিত্য লেট যায়। এই যে সোনার মুল্লুক ইংলন্ড, যার প্রশংসায় এ পোড়ার দেশের সবাই পঞ্চমুখ দশানন, সেই দেশ সম্বন্ধেই শুনেছি, এক ডেলি প্যাসেঞ্জারের ট্রেন রোজ লেট যেত এবং বেচারী তাই নিয়ে অনেক আবেদন-ক্রন্দন করার পর একদিন সত্যি সত্যি কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময়ে ট্রেন স্টেশনে এল। লোকটি উল্লাসভরে স্টেশনমাস্টারকে কনগ্রাচুলেট করাতে মাস্টার বিমর্ষ বদনে বললে, এটা গতকালের ট্রেন; ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা লেট।
সেই পরানের দ্যাশ বিলেতেই যদি এই ব্যবস্থা তবে এই খানদানি গেরেমভারী মিশরে মানুষ কি শুধুমাত্র আমাদের দলকে ভ্যাংচাবার জন্যই কণ্টকে কণ্টকে ট্রেন ছাড়তে চায়?
দেখি, গার্ড সাহেব দোদুল্যমান গতিতে আমাদের দিকে আসছে। চেকারকে কী যেন শুধাল তার পর উত্তর শুনে আমাকে বললে, আর তো সময় নেই, গাড়িতে উঠুন।
লোকটির সৌজন্যে আমি সমোহিত হয়ে গেলুম। কে আমরা, আমাদের জন্য ওর অত দরদ কিসের? স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, আমরা মার্কিন টুরিস্ট নই যে তাকে কড়া-কাঁড়া সোনার মোহর টিপস দেব। মিশরের ট্রেন লোহালক্কড়ের বটে, কিন্তু মিশরীয় গার্ডের দিল মহব্বতের খুনে তৈরি।
আমি পাগল-পারা খুঁজছি সৌজন্য ভদ্রতার আরবি, তুর্কি, ফারসি বাক্য, যা দিয়ে আমি তাকে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি। ইংরেজিতে তো আছে শুধু ছাই, থ্যাঙ্কু, ফরাসিতে মেসি, মেসি, জর্মনেও নাকি ডঙ্কি না ডাঙ্কে কী যেন একটা আছে কিন্তু ওই সামান্য একটা-দুটো শব্দ দিয়ে গার্ড সায়েবের সৌজন্যসমুদ্রে আমার হাল পানি পাবে কেন?
তবুও তেরিয়া হয়ে বলে গেলুম, আনা উশকুরুকুম চোক তশকুর এদরং এফেলং খৈলি তশকুর মিদমহাতান, কুরবান আরও কত কী, উল্টা-সুন্টা। তার মোদ্দা অর্থ, মহাশয় যে সৌজন্য দেখাইলেন, তাহা ভারতবর্ষের ইতিহাসে যুগযুগান্তব্যাপী অবিস্মরণীয় হইয়া থাকিবে কিন্তু হালফিল আমরা লৌহ-বর্মশকটে আরোহণ করিতে অক্ষম যেহেতুক আমাদের পরমমিত্র চরমসখা শ্রীশ্রীমান আবুল আসফিয়া নুরুউদ্দিন মুহম্মদ আব্দুল করীম সিদ্দিকিকে পরিত্যাগ করিয়া দেশান্তর গ্রহণ করিতে সম্পূর্ণ অক্ষম।
সঙ্গে সঙ্গে আরবি, তুর্কি, ফারসি তিন ভাষাতেই বিস্তর ক্ষমা ভিক্ষা করলুম।
আর মনে মনে মোক্ষম চটছি আবুল আসফিয়ার ওপর। লোকটার কি কণামাত্র কাণ্ডজ্ঞান নেই? দলের নেতা হয়ে কোনওরকম দায়িত্ববোধ নেই? সাধে কি ভারতবর্ষ স্বরাজ্য থেকে বঞ্চিত!
হঠাৎ পল-পার্সি দিল ছুট। তারা আবুল আসফিয়াকে দেখতে পেয়েছে। এবং আশ্চর্য, লোকটা তখনও নিশ্চিন্ত মনে রেলের এক কর্মচারীকে স্টেশনের বড় ঘড়িটা দেখিয়ে কী যেন বোঝাচ্ছে। বোঝাচ্ছে কচু! নিশ্চয়ই বোঝাচ্ছে, ওদের ঘড়ি ফাস্ট যাচ্ছে। তা যাচ্ছে তো যাচ্ছে, সেকথা বুঝিয়ে কী তোমার টাকেতে চুল গজাবে– ওদিকে ট্রেন মিস করে?
কথার মাঝখানেই পল আর পার্সি পিছন থেকে তাঁকে দু হাতে ধরে দিলে হ্যাঁচকা টান। তার পর দিল ছুট গাড়ির দিকে। আমিও পড়ি-মরি হয়ে সেদিকে। দলের যারা ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তারাও জয়োল্লাসে হুঙ্কার দিয়ে উঠেছে। আবুল আসফিয়া হাত ছাড়াবার চেষ্টা করছেন। স্টেশনের আন্তর্জাতিক জনতা যে যার পথ ভুলে তাকিয়ে রয়েছে আমাদের দিকে। পুলিশ দিয়েছে হুইসল। তবে কি দিনেদুপুরে কিন্যাপিং! কিন্তু এ তো,
উল্টো বুঝলি রাম, ওরে উল্টো বুঝলি রাম,
কারে করলি ঘোড়া, আর কার মুখে লাগাম?
এখানে তো বুড়ো-ধাড়িকে পাকড়ে নিয়ে চলেছে দুটো চ্যাংড়া!
গাড়ি ঠিক সময়ে ছেড়েছিল না লেটে, আবুল আসফিয়ার ঘড়ি ঠিক না রেলের ঘড়ি ঠিক এসব সূক্ষ্ম প্রশ্নের সমাধান হল না। গার্ড সায়েব যেভাবে পিছন থেকে পাকা হাতে আমাদের ধাক্কা দিয়ে দিয়ে গাড়িতে ওঠাল তার থেকে অনুমান করলুম, এ প্রকারের কর্ম করে করে তার হাত ঝানু হয়ে গিয়েছে।
আবুল আসফিয়া তখনও পলকে বোঝাবার চেষ্টা করছেন, তাঁর ওই ঘড়িটাই সুইজারল্যান্ডের ক্রনোমিটার পরীক্ষায় পয়লা প্রাইজ পেয়েছিল। মিশরিদের সময়জ্ঞান নেই। আমরাও অতিশয় সরল। চিলে কান নিয়ে গেল শুনেই—
.
২৩.
আহা! সুন্দর দেশ!
খালে-নালায় ভর্তি। গাড়ি মিনিটে মিনিটে গম্, গড়ম, গড়ড় করে সেসব নালার উপর দিয়ে পেরুচ্ছে। তার পর গাড়ি বলে বড়ঠাকুরপো-ছোট্ঠাকুরপো, বড়ঠাকুরপো-ছোটঠাকুরপো, তার পর ফের নালার উপর গ, গড়ম গড়ড়ম। আর গাড়ির শব্দ যে এত মিষ্টি কে জানত? এ ট্রেন মিস করলে আর দেখতে হত না!
খাল-নালা তো বললুম, কিন্তু এক-এক নদ-নদী এমনই চওড়া যে বোধ করি সেগুলো নীলেরই শাখা-প্রশাখা। আর সেগুলোতে জলে-ডাঙার মাঝখানে ফাঁক প্রায় নেই। নিতান্ত বর্ষাকাল ছাড়া আমাদের নদীর জল যান তলিয়ে, আর পাড়গুলো থাকেন খাড়া হয়ে। সে জল অত নিচু থেকে উপরে তোলা যায় না বলে সে জল থেকেও নেই। চাষি তাই দিয়ে শীতকালে আরেকটা ফসল তুলতে পারে না। এদেশের লোক সৃষ্টির সেই আদিম প্রভাতে চাষবাস শেখার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের একমাত্র নদী নীলের গা থেকে এত হাজার হাজার খাল নালা কেটে রেখেছিল যে সে নদী গম্ভীর হবার সুযোগ পায়নি এবং ফলে নীলের জল দেশটাকে বারো মাস টৈটম্বুর করে রাখে।
ক্ষেতভরা ধান গম কার্পাস! সবুজে সবুজে ছয়লাপ। মাঝে মাঝে খেজুরগাছের সারি, আর কখনও-বা এখানে একটা সেখানে একটা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষেতের পাহারা দিচ্ছে।
আর নদীর উপর দিয়ে চলেছে উঁচু উঁচু তেকোনা পাল তুলে দিয়ে লম্বা লম্বা নৌকো। এ দেশে বৃষ্টি প্রায় হয় না বলে নৌকোতে ছইয়ের ব্যবস্থা প্রায় নেই। জোর হাওয়ায় নৌকোগুলো চলেছে দ্রুতগতিতে। পালের দড়ি ছিঁড়ে গেলে নৌকো যে ডুবে যাবে সে ডরভয় এদের নেই। তবে বোধ করি এদেশে দমকা হাওয়া হঠাৎ এসে নৌকোকে এলোপাতাড়ি ধাক্কা লাগায় না।
সবুজ ক্ষেত, নানারঙের পাল, ঘোর ঘন নীল আকাশ, চন্চল্ ছলছল জল মনটাকে গভীর শান্তি আর পরিপূর্ণ আনন্দে ভরে দেয়। গাড়ির জানালার উপরে মুখ রেখে আধবোজা চোখে সে সৌন্দর্যরস পান করছি আর ভাবছি, এই সৌন্দর্য দেখার জন্যেই তো বহুলোক রেলগাড়ি চড়বে, আমি যদি এদেশে থাকবার সুযোগ পেতুম তবে প্রতি শনিবারে রেলে চড়ে যেদিকে খুশি চলে যেতুম। কিছু না, শুধু নৌকো, জল, ক্ষেত আর আকাশ দেখে দেখে দিনরাত কাটিয়ে দিতুম।
রাতের কথায় মনে পড়ল, চাঁদের আলোতে এ সৌন্দর্য নেবে অন্য এক ভিন্ন রূপ। সেটা দেখবার সুযোগ হল না– এখানটায়, এবারে।
মাঝে মাঝে নদী, নৌকো, খেজুরগাছ সবকিছু ছাড়িয়ে দেখতে পাই সেই তিনটে বিরাট পিরামিড। কত দূরে চলে এসেছি তবু তারা মাঝে মাঝে মুখ দেখিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলেছে আবার কাছের গাছের পিছনে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, আবার মুখ দেখাচ্ছে। তখনই বুঝতে পারলুম, পিরামিডগুলো কত উঁচু। কাছের থেকে যেটা স্পষ্ট বুঝতে পারিনি।
কম্পার্টমেন্টের মাঝখান দিয়ে চলাফেরার পথ– কলকাতার ট্রামগাড়িতে যেরকম। সেই পথ দিয়ে যে কতরকমের ফেরিওয়ালা এল গেল তার হিসাব রাখা ভার। কমলালেবু, কলা, রুটি থেকে আরম্ভ করে নোটবুক, চিরুনি, মোজা, ঘড়ি, লটারির টিকিট হেনবস্তু নেই যা ফেরিওলা দু চার বার না দেখলে মনে হল লোহার সিন্দুক এবং আস্ত মোটরগাড়ি মাত্র এই দুই বস্তুই বোধ করি ফেরি করা হল না।
এক কোণে দেখি জাব্বা-জোব্বা-পরা এক মৌলানা সায়েব হাত-পা নেড়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন আর তাকে ঘিরে বসেছে একপাল ছোকরা–তারাও পরেছে জাব্ব-জোব্বা, তাদের মাথায়ও লাল ফেজ টুপিতে প্যাচানো পাগড়ি। দু চারজন যাত্রীও দলে ভিড়ে বক্তৃতা শুনছে। পাশের এক ভদ্রলোককে জিগ্যেস করে জানতে পারলুম, ইনি আজহর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ছুটিছাটায় যখন গ্রামের বাড়ি যান তখন তাঁর প্রিয় শিষ্যেরা তার সঙ্গেই বাড়ি যায়। সমস্তক্ষণ চলে জ্ঞানচর্চা। ট্রেনের অন্য লোকও সে শাস্ত্রচর্চা কান পেতে শোনে।
উত্তম ব্যবস্থা। প্রাচীন যুগে গুরুগৃহে বাস এবং বর্তমান যুগের কলেজে গিয়ে পড়াশুনা করা দুটোর উত্তম সমন্বয়। মাঝখানে থার্ড ক্লাস গাড়ির প্যাসেঞ্জার, চাষাভূষোরাও এদের জ্ঞানের কিছুটা পেয়ে গেল। আমাদের দেশের চাষারা তো প্রফেসরদের জ্ঞানের একরত্তিও পায় না।
সঙ্গে সঙ্গে ফেরিওলার কাছ থেকে কলামুলো কিনে নিয়ে মৌলানা সায়েব খাচ্ছেন, ছেলেদেরও খাওয়াচ্ছেন। সে-ও পরিপাটি ব্যবস্থা।
হরেকরকম ফেরিওলাই তো গেল। এখন এলেন আরেক মূর্তি। মুখে একগাল হাসি– আপন মনেই হাসছে– পরনে লজঝড় কোর্ট-পাতলুন, নোংরা শার্ট, টাইয়ের নটটা ট্যারা হয়ে কলারের ভিতর ঢুকে গিয়েছে, আর হাতে একতাড়া রঙিন ছবিতে ভর্তি হ্যান্ডবিল প্যালিট।
কেন যে আমাকেই বেছে নিল বলতে পারব না। বোধহয় আমাকেই সবচেয়ে বেশি বোকা বোকা দেখাচ্ছিল। ফেরিওলারা বোকাকেই সক্কলের পয়লা পাকড়াও করে এ তো জানা কথা। একগাল হাসির উপর আরেক পোঁচ মুচকি হাসি লেপটে দিয়ে শুধাল, কোথায় যাওয়া হচ্ছে স্যর?
ইয়োরোপীয় জাহাজ চড়ে মেজাজ খানিকটে বিলিতি রঙ ধরে ফেলেছে; বলতে যাচ্ছিলুম, তোমার তাতে কী? কিন্তু মনে পড়ল, মিশর প্রাচ্য দেশ, এ প্রশ্ন শুনে অভদ্রতা কিংবা অনধিকার প্রবেশ নয়। বললুম, পোর্টসঈদ।
তার পর?
মোগলাই মেজাজ চেপে নিয়ে বাঙালি কণ্ঠে বললুম, ইয়োরোপ।
ওহ্, তাই বলুন। কিন্তু ইয়োরোপ তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না, তার আগে এই মিশরের পাশের দেশ প্যালেস্টাইনটা ঘুরে আসুন না। আমি তো এক্কেবারে থ। হরেকরকমের ফেরিওলা তো দেখলুম। কেউ বিক্রি করে ছপয়সার জুতোর ফিতে, কেউ বিক্রি করে পাঁচশো টাকার সোনার ঘড়ি কিন্তু একটা আস্ত দেশ বিক্রির জন্য তার আড়কাঠি ট্রেনের ভিতর ঘোরাঘুরি করবে, এ-ও কি কখনও বিশ্বাস করা যায়? তবু ব্যাপারটা ভালো করে জেনে নেবার জন্য শুধালুম, আপনি বুঝি দেশ বিক্রি করেন?
সে আমার কোনও কথার উত্তর না দিয়ে আরেক গাল হেসে তার হাতের তাড়ার ভিতর থেকে কী একটা খুঁজতে আরম্ভ করল। ইতোমধ্যে আমার পাশের ভদ্রলোক তাকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। সে ঝুপ করে বসে পড়ে তার হাতের উঁই থেকে বের করল প্যালেস্টাইনের হরেকরকম ছবিওলা একখানা রঙচঙ প্যাফ্লিট। তার উপর দেখি মোটা মোটা অক্ষরে লেখা প্যালেস্টাইন Palestine, the land of the lord প্রভুর জন্মভূমি, ইত্যাদি আরও কত কী! তার পর বললে, দেশ বিক্রি করি? হ্যাঁ তাই বটে, তবে কি না যেভাবে ধরেছেন, ঠিক সেভাবে নয়। কিন্তু সেকথা পরে হবে। উপস্থিত দেখুন তো, কী চমৎকার দেশে আপনাকে যেতে বলেছি। যে দেশে প্রভু জিসাস ক্রাইস্ট জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আপনি নিশ্চয় প্রভুর
আমার ভারি বিরক্তি বোধ হল। এসব লোক কী ভাবে? ভারতবর্ষের লোক যিশুর নাম শোনেনি? তেড়ে বললুম, The book of the generation of Jesus Christ, the son of David, the son of Abraham. Abraham begat- ইত্যাদি ইত্যাদি, –চড়চড় করে মথি-লিখিত সুসমাচার থেকে মুখস্থ বলে যেতে লাগলুম, প্রভু যিশুর ঠিকুজি কুলজি। লোকটা কিন্তু একদম না দমে গিয়ে বললে, ঠিক, ঠিক। এই দেখুন, সেই জায়গা যেখানে প্রভু জন্ম নিলেন। একটা সরাইয়ের আস্তাবলে। মা মেরি আর তার বর যোসেফ তখন প্যালেস্টাইন থেকে এই মিশরের দিকে পালিয়ে আসছিলেন। বেলেহেম গ্রামে সন্ধ্যা হল। সরাইয়ে জায়গা না পেয়ে মা মেরি আশ্রয় নিলেন আস্তাবলে। এই দেখুন, নাজারেত গ্রামের ছবি। কত চিত্রকরই না এ ছবি এঁকেছেন। কত যুগ ধরে। তার পর দেখুন, নাজারেত গ্রামের ছবি। যোসেফ সেখানে ছুতোরের কাজ করতেন, আর মা মেরি যেতেন জল আনতে। এই দেখুন–
আমি বললুম, ব্যস, ব্যস, হয়েছে। কিন্তু আপনি আমার মুশকিলটা আদপেই বুঝতে পারেননি। আমি যদি পোর্টসঈদ থেকে প্রভুর জন্মভূমি প্যালেস্টাইনে চলে যাই তবে সেখানে ফিরে এসে ইয়োরোপে যাবার জন্য আমাকে নতুন করে জাহাজের টিকিট কাটতে হবে। তার পয়সা দেবে কে?–না হয় প্যালেস্টাইন তীর্থ-দর্শন-খর্চা আমি কোনও গতিকে, কেঁদে-ককিয়ে সামলে নিলুম। এক জাহাজের টিকিট একই জায়গা যাবার জন্য দু দুবার কাটবার মতো পয়সা কিন্তু আমার নেই।
আড়কাঠি তো হেসেই কুটিকুটি। আমি বিরক্ত। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, জাহাজের ডবল ভাড়া লাগবে কেন? আপনি যে জাহাজে করে পোর্টসঈদে এসেছেন সেই কোম্পানিরই আরেকখানা জাহাজ পনেরো দিন পর সেখানে এসে ইয়োরোপ যাবে। আপনি সে জাহাজে গেলেন কিংবা এ জাহাজে গেলেন তাতে কোম্পানির কী ক্ষতি-বৃদ্ধি? ডবল পয়সা নিতে যাবে কেন? আর ওই পনেরো দিনে আপনি দেখে নেবেন প্যালেস্টাইন।
আমি বললুম হুঁ, হুঁ উ-উ-কিন্তু সে জাহাজে যদি সিট না থাকে।
লোকটার ধৈর্যও অসীম। সমুখে বুদ্ধদেবের মতো করুণার হাসি হেসে বললে, কে বললে থাকবে না? এখন তো অফ সিজন, স্ন্যাক পিয়েরিয়েড, অর্থাৎ যাত্রীর ভিড় নেই। আপনি যে জাহাজে এলেন তার কি অর্ধেকখানা ফাঁকা ছিল না? আসছে জাহাজ গড়ের মাঠ।
আমি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলুম। চিন্তাশীল লোক বলে নয়। আসলে সবকিছু বুঝতেই আর পাঁচজনের তুলনায় আমার একটু বেশি সময় লাগে। ব্রেন-বক্সে আল্লাতালা রিসিভিং সেটা দিয়েছেন অতিশয় নিকৃষ্ট পর্যায়ের। বাবগুলো গরম হতে লাগে মিনিট তিন। তার পরও চিত্তির। তিনটে স্টেশনে গুবলেট পাকিয়ে দেয় শুধু কড়া শিম্। কিছু বুঝতে পারিনে।
হঠাৎ মাথায় একটা প্রশ্ন এল। জানো বোধহয়, অগা বোকারা মাঝে মাঝে, অর্থাৎ বছরে দু একবার, পাকা স্যানার মতো দু-একটা প্রশ্ন ওঠাতে পারে। তাই শুধালুম, কিন্তু আমি প্যালেস্টাইন গেলে তোমার টাকে কি চুল গজাবে? তোমার তাতে কী লাভ?
লোকটা এইবারে একটু বিরক্ত হল। প্রশ্নটা মোক্ষম কঠিন বলে, না টাক টাক করলুম বলে ঠিক বুঝতে পারলুম না। আমার মগজ তখন ওই একটা কঠিন প্রশ্ন শুধাবার ধকল কাটাতে গিয়ে হাঁপাতে আরম্ভ করেছে।
বললে, আমার কী লাভ? আমার লাভ বিস্তর না হলেও অল্প। অর্থাৎ অল্প-বিস্তর। বুঝিয়ে বলি। আপনাকে নিয়ে যাব কুকের আপিসে। তাদের কাছ থেকে কাটবেন আপনার পয়লা গন্তব্যস্থল, প্যালেস্টাইনের রাজধানী জেরুজালেমের টিকিট। ন্যায্য ভাড়াই দেবেন। কিন্তু কুক্ আমাকে দেবে কমিশন
আমি শুধালুম, কুক্ তোমাকে কমিশন দিতে যাবে কেন?
আমার বুদ্ধির প্রাধর্য দেখে লোকটা প্রায় হতাশ হয়ে বললে, প্যালেস্টাইন সরকার কুকে পয়সা দেয়, তার দেশে টুরিস্ট নিয়ে যাবার জন্য তাতে করে সরকারের দু পয়সা লাভ হয়। তাই তারা কুককে দেয় কমিশন, কুক্ তার-ই খানিকটে দেয় আমাকে। তারা তো আর ট্রেনে ট্রেনে খদ্দেরের সন্ধানে টো-টো করতে পারে না। এ কর্মটি করি আমি। তাই আমার হয় কিঞ্চিৎ মুনাফা! বুঝলেন তো?
পাছে লোকটা আমাকে ফের বোকা বানিয়ে দেয়, তাই তাড়াতাড়ি বললুম, হ্যাঁ, হা, বুঝেছি, বিলক্ষণ বুঝেছি। যদিও আমি ততখানি সংসারী বুদ্ধি ধরিনে বলে ওইসব কমিশন-মিশনের মারপ্যাঁচ আদপেই ধরতে পারিনি।
কিন্তু লক্ষ করলুম, সে প্যাটপ্যাট করে আমার হ্যান্ডব্যাগটার দিকে তাকিয়ে আছে। তার উপরে মোটা মোটা হরফে লেখা ছিল– ALI, লোকটা শুধাল, ব্যাগটা আপনার?
আমি বললুম, হ্যাঁ।
বাহ্! তা হলে তো আপনি মুসলমান। আর জেরুজালেম মুসলমানদের তীর্থভূমি –মক্কার পরেই তার স্থান। আল্লাতালা মুহম্মদ সাহেবকে রাত্রে আরব থেকে জেরুজালেমে এনে সেখান থেকে স্বর্গদর্শনে নিয়ে যান। জেরুজালেমের সে জায়গাটার উপর এখন মসজিদ-উল-আসা। বিরাট সে মসজিদ, অদ্ভুত তার গঠন। এই কিছুদিন হল আপনাদের দেশেরই রাজা হাইদ্রাবাদের নিজাম সেটাকে দশ লক্ষ টাকা খরচ করে মেরামত করে দিয়েছেন। দেখতে যাবেন না সেটা?
তার পর বললে, আসলে কী জানেন? আসলে জেরুজালেম হল ধর্মের ত্রিবেণি। ইহুদি, খ্রিস্টান আর মুসলমান ধর্ম এখানে এসে মিলেছে। এক ঢিলে তিন পাখি।
তীর্থ দেখলে পুণ্য হয়, কি না হয় সেকথা আমি কখনও ভালো করে ভেবে দেখিনি। কিন্তু হিন্দুদের কাশী, বৌদ্ধদের রাজগির যখন দেখেছি, তখন এ তিনটেই-বা বাদ যাবে কেন? বিশেষ কোনও ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব আমি আদপেই পছন্দ করিনে। তাকেই বলে কমুনালিজম। সৃষ্টিকর্তা যখন তার অসীম করুণায় এতগুলো ধর্ম বানিয়েছেন তখন নিশ্চয়ই সব-কটাতেই কিছু-না-কিছু আছে। আর বিশেষ করে মা ভারি খুশি হবে, যখন শুনবে আমি বয়ত-উল-মুদ্দস (পুণ্যভূমি অর্থাৎ জেরুজালেম) দর্শন করেছি। তার বাবাও মক্কা অবধি পৌঁছতে পেরেছিলেন–বয়ত-উল-মুদ্দস দেখেননি। সেখানে শুনেছি, অতি উত্তম তসবি (জপমালা) পাওয়া যায়। এক-গাছ কিনে দিলে মা যা খুশি হবে। সাত বক নামাজ পড়ার সময় (মুসলমানরা সচরাচার পড়ে পাঁচ বক-মা পড়ে সাত) মা তসবি গুনবে, আর আমার ওপর ভারি খুশি হবে।
পল আর পার্সি অবশ্য অত্যন্ত দুঃখিত হল। পার্সি বললে, আমাদের ফেলে আপনি চলে যাচ্ছেন প্যালেস্টাইন! আপনি না বলেছিলেন, ভূমধ্যসাগরের নানা জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাবেন, ইটালি আর সিসিলি, তার পর কর্সিকা আর সার্ডিনিয়ার ভিতর দিয়ে জাহাজ যাবার সময়, ভিসুভিয়স, আরও কত কী দেখাবেন?
আমি স্বার্থপর, পাষণ্ড। পূর্বপ্রতিজ্ঞা ভুলে গেলুম। তবু হাতজোড় করে মাপ চাইলুম।
পল-পার্সির দিকে তাকিয়ে বললে, ছিহ, পার্সি! স্যর ধর্মের জায়গা দেখতে ভারি ভালোবাসেন। এ সুযোগ ছাড়বেন কেন?
তবু আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল।
একদিকে বন্ধুজন আরেক দিকে মায়ের তসবি।
সংসার কি শুধু দ্বন্দ্বেতেই ভরা?
.
পরিশিষ্ট
প্যালেস্টাইন ভ্রমণ যে এ পুস্তকের অংশ হতে পারত না তা নয়। কিন্তু পল আর পার্সি সঙ্গে না থাকলে সে বই তোমাদের বয়সী ছেলে-মেয়েদের কাছে ভালো লাগবে না বলে আমার বিশ্বাস। সে-বই হয়ে যাবে নিতান্তই বয়সীদের জন্য।
মানুষ বই লিখে বন্ধুজনকে উৎসর্গ করে। আমি প্যালেস্টাইন সম্বন্ধে না-লেখা ভ্রমণকাহিনী উৎসর্গ করলুম মিত্রদ্বয় পল এবং পার্সিকে।