- বইয়ের নামঃ জলে ডাঙায়
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়ার কর্মটি
০১.
বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়ার কর্মটি সবসময়ই এক হুলস্থুল ব্যাপার, তুমুল কাণ্ড! তাতে দুটো জিনিস সকলেরই চোখে পড়ে; সে দুটো– ছুটোছুটি আর চেঁচামেচি।
তোমাদের কারও কারও হয়তো ধারণা যে সায়েব-সুবোরা যাবতীয় কাজকর্ম সারা করে যতদূর সম্ভব চুপিসারে আর আমরা চিৎকারে চিৎকারে পাড়ার লোকের প্রাণ অতিষ্ঠ না করে কিছুই করে উঠতে পারিনে। ধারণাটা যে খুব ভুল সেকথা আমি বলব না। সিনেমায় নিশ্চয়ই দেখেছ, ইংরেজরা ব্যাঙকুইট (ভোজ) খায় কীরকম কোনও প্রকারের শব্দ না করে। বাটলাররা নিঃশব্দে আসছে যাচ্ছে, ছুরিকাঁটার সামান্য একটু ঠুং-ঠাং, কথাবার্তা হচ্ছে মৃদু গুঞ্জরণে, সবকিছু অতিশয় পরিপাটি, ছিমছাম।
আর আমাদের দাওয়াতে, পাল-পরবের ভোজে, যুগ্যির নেমন্তন্নে?
তার বর্ণনা দেবার ক্ষমতা কি আমার আছে। বিশেষ করে এসব বিষয়ে আমার গুরু সুকুমার রায় যখন তার অজর অমর বর্ণনা প্ল্যাটিনামাক্ষরে রেখে দিয়ে গিয়েছেন। শোনো :
এই দিকে এসে তবে লয়ে ভোজভাণ্ড
সমুখে চাহিয়া দেখ কি ভীষণ কাণ্ড;
কেহ কহে দৈ আন্ কেহ হাঁকে লুচি
কেহ কাঁদে শূন্য মুখে পাতখানি মুছি।
হোথা দেখি দুই প্রভু পাত্র লয়ে হাতে
হাতাহাতি গুতাগুতি ধরণে মাতে।
কেবা শোনে কার কথা সকলেই কর্তা
অনাহারে কত ধারে হল প্রাণহত্যা।
বলে কী! ভোজের নেমন্তনে অনাহারে প্রাণহত্যা! আলবাৎ! না হলে বাঙালির নেমন্তন্ন হতে যাবে কেন পছন্দ না হলে যাও না ফাপ্পোতে। খাও না আলোনা, আধাসেদ্ধ ওয়োরের মুণ্ডু কিংবা কিসের যেন ন্যাজ!
কিন্তু জাহাজ ছাড়ার সময় সব শেয়ালের এক রা।
আমি ভেনিসে দাঁড়িয়ে ইটালির জাহাজ ছাড়তে দেখেছি– জাহাজে বন্দরে, ডাঙায় জলে উভয় পক্ষের খালাসিরা মাক্কারনি-খেকো খাঁটি ইটালিয়ান; আমি মার্সেলেসের বন্দরেও ওই কর্ম দেখেছি–উভয় পক্ষের খালাসিরাই ব্যাঙ-খেকো সরেস ফরাসিস; আমি ডোভারে দাঁড়িয়ে ওই প্রক্রিয়াই সাতিশয় মনোযোগ সহকারে নিরীক্ষণ করেছি– দু পক্ষের বাঁদরগুলোই বিফস্টেক-খেকো খাটাশ-মুখো ইংরেজ; আর গঙ্গায়, গোয়ালন্দে, চাঁদপুরে, নারায়ণগঞ্জে যে কত শত বার এই লড়াই দেখেছি তার তো লেখাজোখা নেই। উভয় পক্ষে আমারই দেশভাই জাতভাই দাড়ি-দোলানো, লুঙি-ঝোলানো, সিলট্যা, নোয়াখাল্যা।
বন্দরে বন্দরে তখন যে চিৎকার, অট্টরব ও হুঙ্কারধ্বনি ওঠে সে সর্বত্র একই প্রকারের। একই গন্ধ, একই স্বাদ। চোখ বন্ধ করে বলতে পারবে না, নারায়ণগঞ্জে দাঁড়িয়ে চাটগাইয়া শুনছ, না হামবুর্গে জর্মন শুনছ।
ডেকে রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে প্রথমটায় তোমার মনে এই ধারণা হওয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নয় যে, জাহাজ এবং ডাঙ্গার উভয় পক্ষের খালাসিরা একমত হয়ে জাহাজটাকে ডাঙ্গার দড়াদড়ির বন্ধন থেকে নিষ্কৃতি দিতে চায়। কিন্তু ওই তো মারাত্মক ভুল করলে দাদা। আসলে দু পক্ষের মতলব একটা খণ্ডযুদ্ধ লাগানো। জাহাজ ছাড়ানো-বাঁধানো নিছক একটা উপলক্ষ মাত্র। যে খালাসি জাহাজের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি তুর্কি ঘোড়ার তেজে ছুটছে, সে যে মাঝে মাঝে ডাঙার খালাসির দিকে মুখ খিঁচিয়ে কী বলছে তার শব্দ সেই ধুন্ধুমারের ভিতর শোনা যাচ্ছে না সত্যি কিন্তু একটু কল্পনাশক্তি এবং ঈষৎ খালাসি মনস্তত্ত্ব তোমার রপ্ত থাকলে স্পষ্ট বুঝতে পারবে তার অতিশয় প্রাঞ্জল বক্তব্য, ওরে ও গাডুম ইস্টুপিড, দড়িটা যে বাঁ-দিকে গিট খেয়ে গিয়েছে, সেটা কি তোর চোখে মাস্তুল খুঁজে দেখিয়ে দিতে হবে। ওরে ও (পুনরায় কটুবাক্য)
এই মধুরসবাণীর জুতসই সদুত্তর যে ডাঙার কনেপক্ষ চড়াসে দিতে পারে না, সেকথা আদপেই ভেবো না। অবশ্য তারও গলা শুনতে পাবে না, শুধু দেখতে পাবে অতি রমণীয় মুখভঙ্গি কিংবা মুখ-বিকৃতি এবং বুঝতে হবে অনুমানে।
জাহাজের দিকে মুখ তুলে ফাঁচ করে খানিকটে থুথু ফেলে বলবে, ওরে মর্কটস্য মর্কট, তোর দিকটা ভালো করে জড়িয়ে নে না। জাহাজের টানে এ দিকটা তো আপনার থেকে খুলে যাবে। একটা দড়ির মনের কথা জানিসনে আর এসেছিস জাহাজের কামে। তার চেয়ে দেশে গিয়ে ঠাকুরমার উকুন বাছতে পারিসনে? ওরে ও হামানদিস্তের খাতলামুখো (পুনরায় কটু বাক্য)
একটুখানি কল্পনার সাবান হাতে থাকলে ওই অবস্থায় বিস্তর বাস্তবের বুদ্বুদ ওড়াতে পারবে।
ওদিকে এসব কলরব–মাইকেলের ভাষায় রথচক্ৰ-ঘর্ঘর-কোদণ্ড-টঙ্কার ছাপিয়ে উঠছে ঘন ঘন জাহাজের ভেপুর শব্দ ভে, ভোঁ ভোঁ, ভোঁ–
তার অর্থ, যদি সে ছোট জাহাজের প্রতি হয়, ওরে ও ছোকরা, সরু না। আমি যে এক্ষুণি ওদিকে আসছি দেখতে পাচ্ছিসনে? ধাক্কা লাগলে যে সাড়ে বত্রিশভাজা হয়ে যাবি, তখন কি টুকরোগুলো জোড়া লাগাবি গাদাপাতার রস দিয়ে? আর যদি তোমার জাহাজের চেয়ে বড় জাহাজ হয়, তবে তার অর্থ, এই যে, দাদা, নমস্কার। একটু বাঁ দিকে সরতে আজ্ঞা হয়, আমি তা হলে ডান দিকে সুড়ত করে কেটে পড়তে পারি। এবং এই ভেঁপু বাজানোর একটা তৃতীয় অর্থও আছে। প্রত্যেক জাহাজের মাঝিমাল্লারা আপন ভেঁপুর শব্দ চেনে। কেউ যদি তখনও বন্দরের কোনও কোণে আনন্দরসে মত্ত হয়ে থাকে, তবে ভেঁপুর শব্দ শুনে তৎক্ষণাৎ তার চৈতন্যোদয় হয় এবং জাহাজ ধরার জন্য উর্বশ্বাসে ছুট লাগায়।