- বইয়ের নামঃ কত না অশ্রুজল
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অল-মসজিদ-উল-আকসা
আজকের দিনে বিশ্ব মুসলিম প্রধানত তিনটি তীর্থ দর্শনে যান। মক্কায় আল্লার ঘর কাবাতে, মদিনায় পয়গম্বরের কবরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে এবং তৃতীয় জেরুজালেমে– যেখানে ইহুদি, খ্রিস্ট ও ইসলাম তিন ধর্মের সমন্বয় হয়।
প্রকৃত শাস্ত্র বিধান অনুযায়ী কিন্তু বিশ্ব মুসলিমকে যে তিনটি পুণ্যভূমি স্বীকার করতে হয় তার একটি মক্কার কাবা এবং তার পর যে পুণ্যস্থানের উল্লেখ করা হয়েছে তার দুইটিই জেরুজালেমে। এর প্রথমটি একাধিক নামে পরিচিত। ইংরেজিতে একে ডোম অব দি রক্ (রক = প্রস্তরের উপর নির্মিত ডোম = গুম্বুজ, ঐতিহাসিক ভ্রান্তিবশত ওমর মও বলা হয়; আরবিতে এটিকে কুব্বতুস্ সখরা (কুৎ–ডোম; স = প্রস্তর বলা হয়)। এটিকে ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান সকলেই সম্মান প্রদর্শন করে। কারণ এই তিন ধর্মেরই সম্মানিত রাজা সুলেমানের প্রসিদ্ধ মন্দির একদা এস্থলেই দণ্ডায়মান ছিল। এই সলমনের টেম্পল একাধিকবার বিনষ্ট হয় এবং সর্বশেষে সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয় ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানদের দ্বারা। ভগ্নস্তূপের উপর তাবৎ শহরের ময়লা স্তূপীকৃত হতে থাকে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বৎসর ধরে। ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর খ্রিষ্টানদের হাত থেকে জেরুজালেম অধিকার করে জঞ্জাল সরিয়ে একটি ক্ষুদ্র মসজিদ নির্মাণ করেন এবং এর পঞ্চাশ বত্সর পর আমাদের শাজাহানের মতো বিত্তশালী ও স্থাপত্যে সুরুচিসম্পন্ন খলিফা আব্দুল মালিক যেখানে যে পৃথিবীর অন্যতম অনবদ্য ইমারত নির্মাণ করেন সেইটিই ১২০০ বৎসর ধরে সেখানে অটুট অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে বিশ্বজনের সৌন্দর্যস্তৃতি ও শ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রহণ করছে। আমি যতদিন জেরুজালেমে ছিলুম তার প্রায় প্রতিদিন একবার না একবার একা একা ঘুরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওর বিরাট আরকিটেক্টনিকাল বৈভব থেকে ক্ষুদ্রতম অলঙ্করণ দেখে মুগ্ধ হতুম।
১, কাবা, ২. উপরে উল্লিখিত এই মসজিদ–তার পরেই আসে ৩. মসজিদ-উল-আসা, সংক্ষেপে আসা মসজিদ। এই আক্র উল্লেখ কুরান শরিফে আছে (সূরা ১৭:১)।
এস্থলে কিঞ্চিৎ ইতিহাসের প্রয়োজন।
আরব ও ইহুদি একই সেমিতি বংশ (রেস) জাত, একই রক্ত ধারণ করে। আরবি ও হিব্রু (ইহুদিদের এই ভাষাতেই তাদের বাইবেল রচিত) ভাষা দুই ভগ্নী, অর্থাৎ কগৃনেট। এবং সবচেয়ে বড় কথা বাইবেলে বর্ণিত ইহুদি প্রফেটগণ যথা, আব্রাহম, দায়ুদ, সুলেমান ইত্যাদি কুরান শরীফেও স্বীকৃতিলাভ করেছেন। হজরত নবী তাই যখন ইসলাম প্রচার করেন তখন তিনি ইহুদি আরবের কেন্দ্রভূমি জেরুজালেমের দিকে মুখ করে নামাজ পড়তে আরম্ভ করেন। কিন্তু হজরতের মদিনা শহরে বসতি স্থাপন করার দুই বৎসর পর আল্লার আদেশে মক্কার দিকে মুখ করে নামাজ পড়েন এবং আজও সে রীতি প্রচলিত আছে। এরই ফলে জেরুজালেমের সলমন-মন্দিরভূমি মুসলিম জগতে দ্বিতীয় স্থান পেল বটে তবু কোনও কোনও জাত্যাভিমানী আরব সেটিকে বহু শতাব্দী ধরে প্রথম স্থানেই রেখেছিলেন– বিশেষত উম্মই (ওমাইয়া খলিফারা। অদ্যকার দিনে কিন্তু মুসলিম জাহান প্রথম স্থান দেয় মক্কার কাবা শরিফকে এবং দ্বিতীয় স্থান জেরুজালেমের সলমন মন্দিরকে যার উপর প্রতিষ্ঠিত আব্দুল মালিক নির্মিত এমারতের বয়ান এইমাত্র দিয়েছি এবং এর পরই বলেছি, তৃতীয় পুণ্যক্ষেত্র–মসজিদ-উল-আকসা।
কিন্তু তৃতীয় হলে কী হয়, এই আত্সার সঙ্গে বিজড়িত আছে বিশ্ব মুসলিমের রোমহর্ষক উত্তেজনাদায়ী ঐতিহ্য, পরমাত্মার সঙ্গে মানবাত্মার সম্মিলিত হবার অবিস্মরণীয় অভিযান এবং তার চরম ফলপ্রাপ্তি-নজাৎ, মোক্ষ, মহা পরিনির্বাণ, যা-খুশি বলতে পারেন।
কুরান শরিফে এ অভিযানের যে বয়ান লেখা আছে, হদিসে তার যে টীকা-টিপ্পনী আছে (কুরান হিন্দুদের বেদস্থানীয় শ্রুতি; হদিসকে স্মৃতিশাস্ত্রের সঙ্গে সচরাচর তুলনা করা হয়, আশাকরি কোনও মুসলমান এ তুলনার জন্য অপরাধ নেবেন না)। বস্তৃত ইয়োরোপীয় কাব্যের ইতিহাসে ইসলামের এই অনুচ্ছেদটি তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। দান্তের মহাকাব্য ডিভাইন কমেডি এর কাছে ঋণী–অপর্যাপ্ত ইয়োরোপীয় আরবি তথা ইতালিয়ান ভাষা-সাহিত্যের গুণীজ্ঞানী আলঙ্কারিক পণ্ডিত এই মত পোষণ করেন।
কুরানে আছে, পয়গম্বর সাহেব মক্কাতে ইসলাম প্রচার আরম্ভ করার কিছুকালের মধ্যেই স্বয়ং আল্লাতালা তাকে পরিপূর্ণ জ্ঞান এবং পরম সত্যধর্মের নিগুঢ়তম তত্ত্বে দীক্ষিত করার জন্য তার প্রধান ফেরেশতা (দেবদূত ইংরেজিতে আর্কেঞ্জেল জিবরাইল = গেব্রিয়েলকে) পাঠান মুহম্মদকে (দ.) তার সমীপে নিয়ে আসতে।(১) কুরান শরিফে স্পষ্টাক্ষরে বলা হয়েছে,
সেই (ব্যক্তিই) ধন্য যিনি এক রাত্রেই তাঁর অনুচরসহ মসজিদ-উল-হারাম (অর্থাৎ মক্কার কাবা) থেকে একই রাত্রে মসজি-উ-আক্সা (জেরুজালেম) পর্যন্ত ভ্রমণ করেন, যার চতুর্দিক আমরা পূত করেছি। এবং যাতে করে আমরা তাকে আমাদের চিহ্ন দেখাতে পারি। (কুরান শরিফ; সূরা ১৭:১)
অন্বয় এবং টীকা : সেই ব্যক্তি হজরত। একই রাত্রে– তখনকার দিনে যানবাহন যা ছিল তাতে করে মক্কা থেকে জেরুজালেম পৌঁছতে অন্তত (উটে চড়েও) পনেরো দিন লাগার কথা। এটা আমার অনুমান মাত্র। কম তো হতে পারে না; বেশিই হবে।
আমাদের চিহ্ন দেখাতে পারি–অর্থাৎ আল্লাতালা স্বয়ং তাঁকে সত্যধর্মের গভীর তত্ত্বে দীক্ষিত করবেন– পূর্বোক্ত নজাৎ মোক্ষ ইত্যাদি।
এস্থলে প্রশ্ন, মসজিদ-উল-আকসা কোন স্থলে অধিষ্ঠিত মুসলিম-অমুসলিম (অমুসলিম এই কারণে বলছি, প্রচলিতাৰ্থে অহিন্দু মাক্সমুলার যেরকম বেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন, ঠিক সেই জিনিসই করেছেন একাধিক ইয়োরোপীয় অমুসলিম পণ্ডিত কুরান-হদিস নিয়ে) সকলেই তার অধিষ্ঠান জেরুজালেমে ছিল বলে স্থিরনিশ্চয়– তাই আমি অনুবাদ এবং টীকাতে একই রাত্রে মক্কা থেকে জেরুজালেম ভ্রমণের কথা বলছি।
পণ্ডিতদের বক্তব্য, মক্কা শরিফের বাইরে এমন এক জায়গা যেটি আল্লা স্বয়ং পূতপবিত্র করেছেন, সে শুধু জেরুজালেমই হতে পারে। কারণ ইসলামের প্রথম অ্যুদয়ের সময়ই হজরত ওইদিকে মুখ করে নামাজ পড়েছিলেন। অতএব সেই জেরুজালেমের সলমনের মন্দিরের সঙ্গে সংযুক্ত ভূমিতেই আছে মসজিদ-উল্-আক্সা।
পূর্বেই বলেছি খলিফা ওমর সলমন মন্দিরের সেই ভগ্নস্তূপ পরিষ্কার করে নির্মাণ করেন একটি মসজিদ এবং পরবর্তীকালে আব্দুল মালিক নির্মাণ করেন ডোম অব দি রক এবং তারই অতি কাছে আরেকটি বৃহত্তম বিরাট মসজি-উ-আক্সা।
ডোম অব দি রক একটা পাথরের চতুর্দিকে গড়া হয়েছিল বলে স্থপতি সেটাকে হাজার হাজার নমাজার্থী মুসলমানের জন্য বিরাট কলেবর দিতে পারেননি। তাই তিনি সেটিকে করেছিলেন সুন্দর, মধুর। অবশ্য মসজিদের চতুর্দিকে দিয়েছিলেন প্রশস্ততম অঙ্গন (এদেশের মন্দিরে সঙ্কীর্ণ গর্ভগৃহের চতুর্দিকে যেরকম বিস্তীর্ণ অঙ্গন রাখা হয়, কিন্তু গ্রীষ্মকালে, জেরুজালেমের দ্বিপ্রহর রৌদ্রে সেখানকার অনাচ্ছাদিত মুক্তাঙ্গনে– যেখানে মস্তকোপরি সূর্যের প্রতাপের চেয়ে পদতলের পাষাণ ঢের বেশি পীড়াদায়ক– সেখানে জুম্মা নামাজ পড়া অহেতুক পীড়াদায়ক হবে বলে তিনি নির্মাণ করেছিলেন, তার প্রাণ যা চায় সেই পরিমাণে বিস্তৃত, মসজিদ-উল্-আকসা।
কিন্তু এহ বাহ্য।
আসলে বিশ্ব মুসলিমের কাছে মসজি-উ-আসা তাবৎ পুণ্যভূমির মধ্যে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর।
কুরান হদিসের সঙ্গে যে মুসলিমের সামান্যতম পরিচয় আছে, সে-ই আপন মনে কল্পনা করে, সেই সুদূর মক্কা থেকে আল্লা তার প্রিয় নবীকে রাতারাতি নিয়ে এলেন মসজি-উ আসাতে (শব্দার্থে মক্কা থেকে সবচেয়ে দূরে পুণ্যক্ষেত্রে), সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল, বুর নামক পক্ষিরাজ অশ্ব এবং তার মুখ মানবীর ন্যায় সেই অশ্বে সোয়ার হয়ে নবীজি পৌঁছলেন বেহেশতের দ্বারপ্রান্তে।
এই নিয়ে সে মনে মনে কত না কল্পনার জাল বোনে! স্বয়ং আল্লার সঙ্গে সশরীরে সাক্ষাৎ!
অবশ্য একথাও সত্য যে, বহু মুসলিম দার্শনিক সুফি (রহস্যবাদী ভক্ত = মিষ্টিক) এ প্রশ্ন বার বার শুধিয়েছেন, এই যে হজরতের স্বর্গারোহণ এটা বাস্তব না স্বপ্ন; তিনি কি সশরীরে স্বর্গে গিয়েছিলেন, না তাঁর আত্মা মাত্রই আল্লার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কিন্তু মোলাকাত যে হয়েছিল সে সম্বন্ধে সবাই নিঃসন্দেহ।
যাই হোক, যা-ই থাক, এই মসজিদ-উল্-আক্সা থেকেই, আল্লাতালা হজরতকে দিয়ে স্থাপন করলেন মর্তভূমি ও স্বর্গভূমিতে যোগ-সেতু।
সেই সেতুর পার্থিব প্রান্ত পুড়িয়ে দিয়ে সে সেতু বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা অজ্ঞ-বিজ্ঞ যে কোনও মুসলমানকেই বিচলিত করার কথা।
———–
১. কুরান শরিফে জিব্রাইলের উল্লেখ নেই। একাধিক হদিসে সবিস্তর আছে।
আধুনিকের আত্মহত্যা
১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দের কথা। ১৯১৪-১৮ বিশ্বযুদ্ধে যত যুবক ইয়োরাপের ভবিষ্যৎ খ্রিস্টধর্মের ব্যর্থতা এবং স্ব স্ব আদর্শবাদ সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তা করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, কেন জানিনে, তার দশমাংশও করেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথ যখন ইয়োরোপের ভিন্ন ভিন্ন নগর, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও ভারতের শাশ্বত বাণী প্রচার করে বক্তৃতা দেন তখন বিশেষ করে মুগ্ধ হন তারাই, যারা একদা খ্রিস্টধর্মে গভীর বিশ্বাস ধরতেন কিন্তু যুদ্ধের কল্পনাতীত বর্বরতা দেখে সে ধর্মের কার্যকারিতা অর্থাৎ খ্রিস্টধর্ম ইয়োরোপের খ্রিস্টানগণকে দ্ৰমানুষে পরিবর্তিত করতে পারবে কি না, সে-বিষয়ে অত্যন্ত সন্দিহান হয়ে গিয়েছিলেন। অনেকেই নৈরাশ্যবশত সাতিশয় বিরক্তিসহ চার্চে যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এমনকি তাদের ঈশ্বরবিশ্বাসের দৃঢ়ভূমি পর্যন্ত যেন তাদের পায়ের তলা থেকে ক্রমেই শিথিল হয়ে সরে যাচ্ছিল। শুধু যুবক সম্প্রদায়ই নয়, অপেক্ষাকৃত বয়স্ক গুণীজ্ঞানী পণ্ডিতরা পর্যন্ত ইয়োরোপের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন ভিক্টোরীয় যুগে তাদের যে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে মনুষ্যজাতি, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গগণ সভ্য থেকে সভ্যতর পর্যায়ে উঠছে এবং ফলে একদিন আর এ-সংসারে দুঃখদৈন্য অনাচার-উৎপীড়ন থাকবে না, সেটি লোপ পেল। বিশেষ করে যারা ইতিহাসের দর্শন নিয়ে হেগেলের যুগ থেকে প্রশ্ন করছেন যে, ইতিহাসে আমরা শুধু অসংলগ্ন, চৈতন্যহীন মূঢ় কতকগুলি ঘটনা-সমষ্টি পাই, না এর পিছনে কোনও সচেতন সত্তা ঘটনাপরম্পরাগত ক্রমবিকাশের মাধ্যমে শুধু যে মানুষকে উন্নততর এবং সভ্যতর পন্থায় নিয়ে যাচ্ছে তাই নয়, নিজেকেও সপ্রকাশ করছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অনেকেই দ্বিতীয় সমাধানটি অগ্রাহ্য করলেন, এবং অন্যতম সুপ্রসিদ্ধ ইতিহাস-দর্শনের সুপণ্ডিত অসন্ট স্পেঙলার তাই লিখলেন, য়ুরোপের সূর্যাস্ত (ড্যার উন্টেরগাঙ ডেস্ আবেন্টলাভের)। বইখানার খ্যাতি সে যুগে পঞ্চমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু আমি যুবকদের কথা বলছিলুম। তাদের অনেকেই রবীন্দ্রনাথের বাণীর মাধ্যমে অনুত্ব করল যে প্রচলিত খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাস না করেও শাশ্বত সত্য ধর্মনিরপেক্ষ ঈশ্বরবিশ্বাসের উচ্চতম পর্যায়ে ওঠা যায়, এঁদের একাধিক জন তখন প্রাচ্যভূমিতে এসে স্থায়ী বসবাস নির্মাণ করতে উস্ত্রী হন।
এঁদেরই একজন মসিয়ো ফের্না বেনওয়া। রবীন্দ্রনাথ যে-কজন ইয়োরোপীয়কে বিশ্বভারতীতে কয়েকজনকে অন্তত সাময়িকভাবে শিক্ষাদানের জন্য আহ্বান করেছিলেন তাদের সকলেই শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন : যেমন লেভি, ভিটারনিস, দুচ্চি ইত্যাদি। খাঁটি সাহিত্যিক ছিলেন একমাত্র অধ্যাপক বেনওয়া এবং তিনি ফ্রান্সেও সুপরিচিত ছিলেন। তার প্রকৃত পরিচয় আমরা পাই, যখন মনীষী রমারল তার জীবনের ষষ্টিতম বত্সরে পদার্পণ করার শুভলগ্নে বিশ্ববাসী গুণীজ্ঞানীগণ একখানা পুস্তক তাকে উৎসর্গ করেন। বইখানার নাম তারা দেন লাতিনে লিবার আমিকরু- অর্থাৎ সখাগণপ্রদত্ত (উৎসর্গিত) পুস্তক। এদেশ থেকে লেখেন মহাত্মা গান্ধী, জগদীশচন্দ্র বসু ইত্যাদি। পৃথিবীর প্রায় সর্ব সভ্যদেশ থেকে কেউ-না-কেউ ওই শুভলগ্নে রাকে অভিনন্দন জানিয়ে তার সম্বন্ধে প্রবন্ধ লেখেন। আমার এখনও মনে আছে এক আরব রলাঁকে উদ্দেশ করে লিখেছিলেন, তুমি লৌহসম্মার্জনী দ্বারা ইয়োরোপের কুসংস্কার জঞ্জাল দূর করেছ। বলা বাহুল্য, এই লেখনী সঞ্চয়নে আপন রচনা দিয়ে শ্লাঘাপ্রাপ্তির জন্য যখন সর্ববিশ্বের সহস্র সহস্র গুণীজ্ঞানী উগ্রীব, তখন প্যারিস থেকে সসম্মানে আমন্ত্রণ জানানো হয় অধ্যাপক বেনওয়াকে, তার রচনার জন্য। তিনি তার স্বাভাবিক বিনয়শত আশ্রমের কাউকে কিছু বলেননি, কিন্তু ওই লিবার আমি যখন আমাদের লাইব্রেরিতে পৌঁছল তখন আমরা সেটিতে আমাদেরই অধ্যাপকের রচনা দেখে বিস্মিত ও আনন্দিত হই। তিনিও আবার তার প্রবন্ধে কোনও গুরুগম্ভীর বিষয়ের অবতারণা করেননি আমরা ঠিক সেই সময়ে তার ক্লাসে রলর এক স্বল্পখ্যাত পুস্তিকা পিয়ের এ লস- পিটার ও লসি পড়ছিলাম। চটি বই। বিরাট জা ক্রিস্তফ লেখার পর রল দুই তরুণ-তরুণীর একটি বিশুদ্ধ প্রেমের কাহিনী লিখে জা ক্রিরে মতো বিরাট পুস্তকের কঠিন কঠিন সমস্যা, ইয়োরোপীয় সভ্যতা নিয়ে আলোড়ন-বিলোড়ন থেকে নিষ্কৃতি পেতে চেয়েছিলেন। বেনওয়া তাঁর প্রবন্ধ লিখেছিলেন শান্তিনিকেতনে পিয়ের এ লাস–যতদূর মনে পড়ছে, এই শিরোনামা দিয়ে, এবং পিয়ের এ স পড়ে শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীর মনে কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তার সবিস্তার বর্ণনা দেন। রলাকে উৎসর্গিত লিবার আমিকম্পু স্তকের কোনও কোনও অংশ সেসময়ে কালিদাস নাগ অনুবাদ করে এদেশে প্রকাশ করেন।
অধ্যাপক বেনওয়ার গত হওয়ার দিবস বিস্ময়সূচক। যে গুরুর কাছ থেকে তিনি অকৃপণ স্নেহ ও সম্মান পেয়েছিলেন তারই জন্মশতবার্ষিকীর দিনে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
এস্থলে আমি অধ্যাপক বেনওয়ার জীবনী লিখতে যাচ্ছিনে। বস্তুত ১৯২১ থেকে এবং সঠিক বলতে গেলে যবে থেকে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন সেই সময় থেকে ১৯৪১ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত যেসব গুণীজ্ঞানীরা এখানে অধ্যয়ন-অধ্যাপনা করেছিলেন তাদের পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখার ভার আমার স্কন্ধে নয়। কার, সেটা বলা বাহুল্য। বছর দশেক পূর্বে লাইপসিক বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রভবনকে লেখে, তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রদের জীবনী প্রকাশ করছেন, জনৈক মার্ক কলিন্স সম্বন্ধে শান্তিনিকেতনের কেউ কিছু জানে কি না? (কলিন্স এখানে অধ্যাপনা করেছিলেন। অন্যরা তাদের ছাত্রদের সম্বন্ধে লেখে আর আমরা আমাদের অধ্যাপকদের বৃথা বাক্য থাক! (স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই বলেছেন।)(১)
সেই বেনওয়া সাহেব কয়েকদিন ফরাসি ক্লাস নেওয়ার পর বললেন, তোমরা যে মলিয়ের, ফ্লবের, যুগো (Hugo), জিদ, ফ্রাস পড়তে চাও সে তো খুব ভালো কথা। কারণ আজকালকার ইয়োরোপীয় ছাত্রছাত্রীদের এসব লেখকের বই পড়ানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা লাতিন-গ্রিক তো শিখতেই চায় না, তার অনুবাদেও বিরাগ, এমনকি এই একটু আগে যাদের নাম করলুম, তাদের লেখার প্রতিও কোনও উৎসাহ নেই, তাদের কারণ তারা লেখেন ক্লাসিকাল পদ্ধতিতে। তার অন্যতম মূল সূত্র যে জিনিস স্বচ্ছ (ক্লিয়ার, পরিষ্কার যার অর্থ অতি সহজেই বোঝা যায়) নয়, সে জিনিস ফরাসি নয় (সূ কি নে পা ক্ল্যার নে পা ফ্রাসে!) আর এ-যুগের পাঠকরা চায় আধা-আলো-অন্ধকার। তাদের বক্তব্য, তোমরা জীবনটাকে যতখানি সহজ সরল স্বচ্ছ ধরে নিয়েছ এবং ফলে স্বচ্ছ সরল পদ্ধতিতে প্রকাশ করো জীবনটাকে বাস্তবে সে তা নয়, জীবন ওরকম হয় না। সর্ব মানবজীবনেই আছে আলো-আঁধারের দ্বন্দ্ব তাই তার প্রকাশও পরিষ্কার হয়ে ধরা দেবে না। আমরা আজ যা লিখছি সেটা পুরনো স্টাইলকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়েছে, এবং তোমরা যারা প্রাচীন পদ্ধতিতে অভ্যও তারা তো এটাকে দুর্বোধ, অবোধ্য এমনকি অর্থহীন প্রলাপ বললেও বলতে পারো, কিন্তু আমরা তার কোনওই পরোয়া করিনে। আমরা আমাদের অপক্ষে এগিয়ে যাব, এবং এই করেই নতুন পথ বানাব।
এতদিন পরে কী আর সবকথা মনে থাকে! এটা হচ্ছে ১৯২১/২২/২৩-এর কাহিনী। তখনও এদেশে মডার্ন কবিতা জন্ম নেয়নি, (পরবর্তী যুগে যখন নিল, তখন হিসাব নিয়ে দেখা গেল, এসব মডার্ন কবিতাতে যে শব্দটি বার বার, এমনকি বলা যায় সর্বাধিকবার আসে সেটি ধূসর। তখন মনে পড়ল, ফ্রান্সের মডার্নদের সম্বন্ধে অধ্যাপক বেনওয়ার প্রাচীন দিনের বিবৃতি সেখানে মূল কথা ছিল অস্পষ্ট দ্বমুখর এবং সর্বোপরি আধা-আলো-অন্ধকার। সেই বস্তুই এদেশে এসে পরেছে ধূসর আলখাল্লা! তা হবেই-না কেন? এদেশটা তো বৈরাগ্যের গেরুয়া বসনধারী, আর গেরুয়া যা ধূসরও তা!) তবে মোটামুটি যা বলেছিলেন, সেটা মনে আছে এবং চোখের জলে নাকের জলে মনে আছে?
কারণ সর্বশেষে সাহেব বললেন, অতএব এই নতুন ফ্রান্সকেও ভোমাদের চেনা উচিত বিশেষ করে তার কাব্যপ্রচেষ্টাকে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফ্রান্স থেকে আনালেন–তখনকার দিনে জাহাজ-রেলে প্রায় দু সপ্তাহ লাগত বেশ মোটা মোটা দু-ভলুমে সম্পূর্ণ মডার্ন কবিতার চয়নিকা। শিরোনাম, পোয়েৎ দ জুই, পোয়েটস্ অব টুডে, হালের কবি, আজকের কবি যেটা আপনার প্যারা লাগে বাংলাতে সেইটেই বেছে নিন।
বলছিলুম না, চোখের জলে নাকের জলে পড়েই যাচ্ছি, পড়েই যাচ্ছি, কোনও হদিস আর পাইনে। ক্লাসের পড়া তৈরি করতে আগে আমার লাগত তিন পো ঘন্টাটাক, এখন দু-ঘণ্টা তিন-ঘণ্টা অভিধান ঘেটেও কোনও হদিস পাইনে। একটা তুলনা দিয়ে জিনিসটা পরিষ্কার করি। আপনি কোনও বিষয়বস্তু পড়ছেন যেটা সরল, এবং লেখকের উদ্দেশ্যও সরল। সেখানে মনে করুন হঠাৎ এল একটা শব্দ যার অর্থ আপনি জানেন না, যেমন ধরুন কর। অভিধান খুলে মানে পেলেন করা ধাতুর রূপ বিশেষ, খাজনা হাত কিরণ হাতির গুড় হিন্দুর উপাধি বিশেষ। এতক্ষণ ধরে লেখকের সবকথাই আপনার কাছে পরিষ্কার ছিল বলে, পূর্বাপর প্রসঙ্গ বিবেচনা করে আপনি চট করে বুঝে গেলেন কোন অর্থটা লাগবে, লেগেও গেল ক্লিক করে। তাই বোধহয় অভিধানকে কুঞ্চিকাও বলা হয়। সেখানে আপনি পাবেন চাবি– এটা প্রয়োগ করে আপনি যে অচেনা শব্দরূপ খুলতে চান, সেটি খুলতে পারেন। এর পরে তুলনাটা হয়তো টায়-টায় মিলবে না, আমার বক্তব্য কিঞ্চিৎ খোলসা করবে। আপনার নিজের যে তালা আপনি নিত্যি নিত্যি খোলেন তার চাবি যদি হারিয়ে যায়, আর কেউ এসে একগুচ্ছ জাত-বেজাতের চাবি দেয়, তা হলে কোন চাবিটি দিয়ে আপনার তালাটি খোলা যাবে সেটা চট করে বেছে নেবেন– জোর, নিতান্ত একাকার হলে, দু-তিনটে ট্রায়েল নিয়েই কর্মসিদ্ধি।
আর এখানে, অর্থাৎ এই মডার্ন কবিতা নিয়ে হালটা কী? যেন তালাটিই দেখতে পাচ্ছিনে ভালো করে আদৌ আছে কি না সে ভি কসম খেয়ে বলতে পারব না, অর্থাৎ বিসমিল্লাতেই গয়লৎ (গলৎ)-কেমন যেন আবছা-আবছা গোছ, ওই যে সায়েব অধ্যাপক স্বয়ং বলেছিলেন কেমন যেন আধা-আলো-অন্ধকার, ফরাসিতে বলে ক্রেস্কুল (ইংরেজিতে বিশেষ্যটা চলে না বটে, কিন্তু বিশেষণটা ৫epuscular- মাঝে মাঝে পাওয়া যায়) এদেশের পরবর্তী যুগের ধূসর! এদিকে তালাটাই দেখতে পাচ্ছিনে ভালো করে, ওদিকে অভিধান আমার হাতে তুলে দিলেন চারটে চাবি এখন লাগাই কোনটা? এমনকি রাজাকে হাতির শুঁড় (কর) দিলুম অর্থও যদি রাজাকে খাজনা (কর) দিলুম এর বদলে বেরোয় তাতেও আমি খুশি। কথায় বলে হাতের একটা পাখি কানা মামার চেয়ে ভালো–ঐ যা, দুটো প্রবাদে গোবলেট করে ফেললুম নাকি? তা সঙ্গগুণে সবই হয়। অর্থাৎ সে-যুগের ফরাসি মডার্ন কবিতা শব্দ, অর্থ, অনুপ্রাস, এমনকি বানান নিয়েও, এক্ষুনি আমি যা গোবলেট পাকালুম, তার চেয়ে কোটি গুণে (ইনফিনিটি সিম্বলটি দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেটি বোধহয় ছাপাখানায় নেই) ওস্তাদ ছিল– গোবলেট পাকাতে।
বেশ কয়েকদিন, গলদঘর্ম পরিশ্রম করার পর আমি স্থিরনিশ্চয় হলুম, আমার মনে সন্দেহের অবকাশ মাত্র রইল না, এ বন্ধু কাব্য নয়, এটা নিশ্চয়ই দর্শন। কারণ দর্শনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে দার্শনিকশ্রেষ্ঠ শোপেনহাওয়ার বলেছেন (আমি অনুবাদের খাতিরে একটুখানি কনসুরা লাগাচ্ছি);
দর্শন হল গিয়ে অমানিশার অন্ধকার অঙ্গনে অন্ধের অনুপস্থিত অসিত অশ্ব অণ্ডের অনুসন্ধান।
কিন্তু এ তত্ত্বে পৌঁছনোর পরও আমি অত সহজে হাল ছাড়িনি– তার জন্য বয়সটাই দায়ী; এটা জেদির বয়স।
কারণ আমার মনে পড়ল, ছেলেবেলায় কাকার কাছে শোনা একটি তত্ত্বোপদেশমূলক কাহিনী। এক রাজার ছিল একটি অতি বিরল মহামূল্যবান, সাদা হাতি। সে দিন দিন কেন শুকিয়ে যাচ্ছে তার অনুসন্ধান করার ফলে ধরা পড়ল যে, তার মাহত শত সাবধানবাণী সত্ত্বেও অতি সঙ্গোপনে হাতির দানা চুরি করছে। রাজা ভয়ঙ্কর চটে গিয়ে তার প্রাণদরে হুকুম দিলেন। মাহুত যখন দেখল এ-হুঁকুম কিছুতেই রদ হবে না, রাজার সামনে নিবেদন করল, তাকে যদি এক বছরের সময় দেওয়া হয় তবে, একমাত্র তারই জানা গোপন কৌশল প্রয়োগ করে ওই সাদা হাতিটাকে দিয়ে মানুষের মতো কথা বলাতে পারবে। রাজা সম্মত হলেন। মাহুতের অন্তরঙ্গ বন্ধুরা যখন তাকে ওধাল হাতিকে দিয়ে সে কথা বলাবে কী করে, তখন সে বলল, ভাইরা সব, এক বছরের ভিতর কতকিছুই-না ঘটতে পারে। এক বছরের ভিতর রাজা মারা যেতে পারেন, কিংবা হাতি মারা যেতে পারে, কিংবা আমি মারা যেতে পারি এবং কে জানে, কিংবা হয়তো হাতিটা শেষমেশ কথাই বলে ফেলতে পারে!
আমিও সেই আশাতেই রইলুম, কে জানে এসব কবিতার মানে একদিন হয়তো বেরিয়ে গেলে যেতেও পারে। যদিও অকপট চিত্তে স্বীকার করছি, আমার তখন মনে হয়েছিল, এবং আজও মনে হয়, আচম্বিতে হাতির মানুষের মতো কথা বলতে পারাটার সম্ভাবনা এসব কবিতার অর্থ বোঝার সম্ভাবনার চেয়ে ঢের ঢের বেশি।
সত্যের অপলাপ হবে বলে স্বীকার করছি, সাহেব আমাদের বলেও ছিলেন, প্রাচীন যুগের ল্য কঁৎ দ্য লিল বা গোর কবিতার অর্থ যেরকম বর্ণে বর্ণে বোঝা যায়, এসব পোয়েৎ দ জ্বরদ্যুই- হালের কবিদের কাছ থেকে সেটা যেন প্রত্যাশা না করি- এর নাকি অনেকখানি সরাসরি, সোজাসুজি অনুভূতির যোগে চিত্তে গ্রহণ করতে হয়। কী প্রকারে সে যোগ করতে হয় সেটা অধ্যাপককে গুধিয়ে তাকে বৃথা হয়রান করতে চাইনি। কারণ যেখানে অনুভূতির কারবার সেখানে সে রসে উপনীত হওয়ার প্রক্রিয়া তো আর সিলজি দিয়ে বানোনা যায় না। যেমন মাকে কী করে ভালোবাসতে হয় এটা তো আর কাউকে ইন্সট্রাকশন দিয়ে শেখানো যায় না যেরকম বিস্কুটের টিনের উপরে ছাপা নির্দেশনানুযায়ী-প্রক্রিয়ায় টিনটি পরিপাটিরূপে খোলা যায়।
পাঠক শুধোবেন, তা হলে ক্লাসে কি অধ্যাপক সেগুলো বুঝিয়ে দিতেন না? এবারে ফেললেন মুশকিলে। সাহেব মোটামুটি একটি ইংরেজি অনুবাদ খাড়া করে দিতেন– কারণ ইংরেজি ও ফরাসির শব্দসম্পদ বিশেষ করে চিন্তা ও অনুভূতি সংশ্লিষ্ট বিমূর্ত শব্দ একই ভাণ্ডার থেকে নেওয়া হয় বলে বহু কবিতার শতকরা ষাটটি শব্দ দুই ভাষাতেই এক। অনুবাদ করা কঠিন নয়। কিন্তু তাই বলেই কি জিনিসটা সরল হয়ে যাবে? মডার্ন বাংলা কবিতার শব্দগুলো তো আপনি চেনেন, তাই বলে কি অর্থ বোধগম্য হয় তার ওপর সর্বক্ষণ ভয়, এখনও তো মামুলি ফরাসিটাই ঠিকমতো রপ্ত হয়নি, হয়তো গাড়োলের মতো এমন প্রশ্ন গুধিয়ে বসব যেটা বাঙলায় প্রকাশ করতে হলে বলি, সওকাও রামায়ণ পড়ে- ইত্যাদি।
তবে দুটো জিনিস লক্ষ করলুম। শোলডার শ্রা করা বা কাঁধ উঠিয়ে-নামিয়ে নিজের অসহায়তা প্রকাশ করার অভ্যাস সর্ব ইয়োরোপীয়েরই আছে, কিন্তু এর সবচাইতে বেশি কনজাশ ফ্রান্সে–শ্যাম্পেন বা ব্র্যান্ডির চেয়েও ঢের ঢের বেশি; এসব কবিতা বোঝাবার সময় বেনওয়া সাহেব যা শোভার শ্রাগ করলেন তার থেকে আমার মনে হল যে আগামী দশ বৎসরের রেশন তিনি ওই হালের কবিদের পাল্লায় পড়ে তিন মাসেই খতম করে দিচ্ছেন। এবং ওই শ্রাগ করার সঙ্গে সঙ্গে হাতের তেলোদুটো এমনভাবে চিত করতেন যে আমরা স্পষ্ট বুঝতুম, ইংরেজিতে যাকে বলে, ঘোড়াকে জলের যথেষ্ট কাছে আনা হয়েছে, এখন সে যদি না খায়—
দ্বিতীয়ত, সনাতন লেখকদের বেলা তিনি মাঝে মাঝে আমাদের অনুবাদ করতে বলতেন। কিন্তু এই মডার্ন কবিদের হাতে নিরীহ বঙ্গসন্তানদের বে-পনাহ অর্থাৎ একান্ত অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দিতে তিনি সাহস পেতেন না। নরখাদক না হলেও, যারা তাদের কবিতা বোঝবার চেষ্টা করে, তাদের মগজ যে কীরকম কুরে কুরে খেতে পারেন, সে তত্ত্বটি সায়েবের অজানা ছিল না। এবং ওই সময়ে শান্তিনিকেতনের একটি ছেলে পাগল হয়ে গেলে যে গুজব রটেছিল, তার বিরুদ্ধে তারস্বরে প্রতিবাদ জানিয়ে আমি আজ বলছি, সর্বৈব মিথ্যা; সে ছোকরা একদা ফরাসি ক্লাসে আসত বটে, কিন্তু ওইসব পোয়েৎ দ জ্বরদইদের প্রথম দর্শন পাওয়ামাত্রই সে বাপ্পো বাপ্পো রব ছেড়ে অধ্যাপক মিশ্রুজির পাণিনি ক্লাসে চলে যায়– যে ক্লাসটাকে আমরা বাঘের চেয়েও বেশি ভরাতাম এবং পরে মুক্তকণ্ঠে বলে, এসব হালের ফরাসিস কবিদের বোঝার চেয়ে পাণিনির সূত্র বোঝা ও কণ্ঠস্থ করা ঢের ঢের সহজ।
একে মডার্ন, তায় ফরাসিস, তদুপরি কোনও কোনও কবি পাস প্যারিসিয়ান উপস্থিত আবার বাংলা দেশে একটা বিশেষ রস বা ওই ধরনের একটা কিছু নিয়ে জোর আন্দোলন চলছে– কাজেই পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগা অসম্ভব নয়, এসব কবিরা কাব্যে শ্লীলতা-অশ্লীলতার মধ্যে কোনও পার্থক্য স্বীকার করতেন কি না? আমার তো শেষ প্রসা ছিল ওইটেই। এত যে মেহৎ করছি, তার ফলে আখেরে যদি এমন কিছু জুটে যায় যার প্রসাদাৎ সংস্কৃত-পড়নেওলাদের ঢিট দিতে পারি। ধ্যওর তোর চৌরপঞ্চশিকা আর কুট্টনীমত! আসল মাল এ্যাদ্দিনে, বাবা, এদেশে এসে পৌঁছেছে, নাক বরাবর প্যারিস থেকে। আয়, শুনে যা। কারণ এদের কেউ কেউ অল্পবিস্তর পাস পড়েছে, অবশ্য ইংরেজি অনুবাদে,(২) তাই (ওই বয়সে) আমার সরস আহ্বান শুনে যে আমার সামনে করজোড়ে আসন নিত সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু হায়, অধ্যাপক বেনওয়া স্বয়ং বহু বৎসর প্যারিসে কাটিয়েছিলেন বলে এ-বিষয়ে সাবধান হতে জানতেন। ক্লাসে দুটি মেয়ে ছিল বলে তিনি প্রথমদিনই বলে দিয়েছিলেন, কোন কোন কবিতা ক্লাসে পড়ানো হবে।
আমার নিজের কেমন জানি একটা অন্ধবিশ্বাস সেসময় জন্মেছিল যে অধ্যাপক বেনওয়া স্বয়ং এই নতুন একোল স্কুল বা রীতিটা পছন্দ করতেন না, বিশেষ রসও পেতেন না। তিনি আমাদের সঙ্গে মডার্ন ফ্রান্সের নবীন কাব্য-আন্দোলনের পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মাত্র অনেকটা যেন কর্তব্য পালনের জন্য।
তবু এই সুবাদে একটি তত্ত্বকথা বলে রাখা ভালো। এসব মডার্ন কবিদের সাধনা ছিল সত্যই বিস্ময়জনক। কারও কারও ছন্দহীন, লয়বিহীন, মিলবর্জিত বস্তৃত সর্ব অলঙ্কারশূন্য– এলোপাতাড়ি আবোল-তাবোল শব্দসমষ্টি দেখে যখন আমরা উদ্ভ্রান্ত তখন বেনওয়া সায়েব অপেক্ষাকৃত প্রাচীন কাব্য থেকে পড়ে শোনাতেন এদেরই আগেকার দিনের, প্রাচীন পদ্ধতিতে রচিত কবিতা– মডার্ন আন্দোলনে যোগ দেবার পূর্বে রচিত।
এবং সেগুলো শুনে, পরে পড়ে স্তম্ভিত হয়েছি। অনবদ্য এক-একটি কবিতা! কতখানি পরিশ্রম, কতখানি সাধনার প্রয়োজন এরকম অত্যুত্তম কবিতা রচনা করতে! অর্থাৎ, এরা ব্লাফ-মাস্টার নন। প্রাচীন পদ্ধতিতে কবিতা রচনা করার টেকনিক, স্কিল, কৌশল সম্পূর্ণরূপে করায়ত্ত করার পর এঁরা যে কোনও কারণেই হোক খুব সম্ভব নিজের সৃষ্টিতে ঈপ্সিত পরিতৃপ্তি না পেয়ে ধরেছেন অন্য টেকনি, বা বলা যেতে পারে, চেষ্টা করছেন নতুন এক টেকনিক আবিষ্কার করার। সেজানের ছবি দেখে অজ্ঞজন মনে করে, এরকম এলোপাতাড়ি তুলির বাড়ি ধাম-ধুপুস মারা তো যে কোনও পাঁচ বছরের বাচ্চাও দেখিয়ে দিতে পারে, কিন্তু সেজান যখন প্রাচীন অ্যাকাডেমিক টেকনিকে আঁকতেন তখনকার ছবি দেখলে চক্ষুস্থির হয়ে যায়। তখনকার দিনের অ্যাকাডেমিক যে কোনও চিত্রকরের সঙ্গে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারতেন, কারণ একে তো ছিল তাঁর বিধিদও অসাধারণ সৌন্দর্যবোধ ও স্পর্শকাতরতা, তদুপরি তার আঙুলগুলো যেন শুধু ছবি আঁকার জন্যই বিধাতা নির্মাণ করেছিলেন, এবং সর্বোপরি তার বহু বৎসরব্যাপী অক্লান্ত সাধনা, ওই প্রাচীন অ্যাকাডেমিক টেকনিক্ সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ আয়ত্ত করার জন্য। এদেশে তাই যখন দেখি, মাত্র দুটি বছর রেওয়াজ- কবিতা, গান, নাচ যাই হোক না কেন–করেছে কি না, তার আগেই সে লেগে যায় কম্পোজ করতে, এবং অন্যকে বিজ্ঞভাবে নবীন পন্থা বাঙ্গাতে, তখন– থাক্ গে।
ইতোমধ্যে আবার জর্মন ভাষার অধ্যাপক ছুটিতে চলে যাওয়ার দরুন বেনওয়া সায়েবের ঘাড়েই পড়ল জর্মন শেখাবার ভার, এবং তিনিও ফরাসি মডার্ন কবিদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পড়াতে আরম্ভ করলেন জর্মন মডার্ন কবিদের মডার্নতম রাইনের মারিয়া রিলুকে! সে আরেক নিদারুণ অভিজ্ঞতা, সুকুমার রায়ের ভাষায় ভুক্তভোগী জানে তাহা, অপরে বুঝিবে কিসে?–সে-কাহিনী আরেক দিনের জন্য মুলতবি রইল। শুধু এইটুকু নিবেদন, চেষ্টা দিয়েছিলুম, স্যর, সেই সতেরো-আঠেরো বছর বয়সেই চেষ্টা দিয়েছিলুম, এই কবিতা নামক জিনিসটির রসাস্বাদন করার। আর যে দোষ দেবেন দিন, শুধু এইটুকু বলবেন না যে, বুড়ো-হাবড়া হয়ে যাবার পর মডার্ন কবিতার প্রেম কামনা করে হতাশ-প্রেমিকরূপে পরিবর্তিত হয়েছি।
তার পর এল সেই শুভলগ্ন যেদিন মডার্ন কবিতার সঙ্গে আমাদের তালাকটি বেনওয়া সাহেব মঞ্জুর করলেন। আমরা সোল্লাসে ফিরে গেলুম দোদে, ফ্লুবেরের কাছে। শুনেছি, স্পেনের লোক নাকি বছরের প্রথম দিন এক গেলাস জল নিয়ে তাতে কড়ে আঙুলের ডগাটি ডুবিয়ে সেই আঙুল জিতে লাগিয়ে অতি সন্তর্পণে সভয়ে চাটার পর আঁতকে উঠে বলে, ওই সেই প্রাচীন দিনের পুরনো বিস্বাদ বস্তু; চ, ভাই, ফিরে যাই আমাদের মদের গেলাসেই। কেন যে পাদ্রি সায়েব মদ কমাতে আর বেশি জল খেতে বলেন বোঝা ভার। আমরাও স্পানিয়ার্ডদের মতো ফিরে গেলুম আমাদের ক্লাসিক্স-মদ্যে।
আমাদের মুখের ভাব দেখে নেওয়া সায়েব হেসে বললেন, তবু তো আমরা আছি ভালো, কারণ আমরা চর্চা করি সাহিত্যের। সেখানে উল্কষ্টে-নিকৃষ্ট পার্থক্য করা তেমন কিছু অসম্ভব কঠিন নয়। সেখানে রুচিবোধের অনেকখানি স্থিরতা আছে। কিন্তু হত যদি আমাদের বিষয়বস্তু চিত্র? তা হলে খানিকটে আভাস পেতে সে-ক্ষেত্রে রুচির কী আকাশ-পাতাল পরিবর্তন হয় রাতারাতি। আজ যার ছবি ভোলা নিলামে বিক্রি হল লক্ষ ডলারে, বছর ঘুরতে-না-ঘুরতে সেই ছবিই বিক্রি হল হাজার ডলারে। আজ যাকে বলা হচ্ছে গ্রামের গ্র্যান্ড মাস্টার বা মেসরো (ওস্তাদের ওস্তাদ) তিন বছর যেতে-না-যেতে তাঁর ছবি হয়ে গেল বিল, পিফল (রদি, চোতা)!আর এসব ছবিই কিন্তু অ্যাকাডেমিক স্টাইলে আঁকা; কোনও নতুন এক্সপেরিমেন্টের কথা উঠছে না।
তবেই ধারণা করতে পারবে মডার্ন পেন্টিং নিয়ে কী অসম্ভব রুচি পরিবর্তন, রীতিমতো খুনোখুনি মারামারি। আর সে ছবিগুলোতে আছে কী? ধোয়াটে, তামাটে, বিকুটে কী যেন কী, জানেন শুধু আটিই, বা হয়তো তার অন্তরঙ্গ সখামণ্ডলী, এতে আছে কী, আর্টিস্টের উদ্দেশ্য কী নিচে লেখা বসন্ত। আর, আজ ফার অ্যাজ আই অ্যাম্ কনসার্নড় সেখানে বসন্ত না লিখে অভিধানের ভিতরের বা বাইরের যে কোনও শব্দ লিখলেও আমার তাতে সুবিধা-অসুবিধা কিছুই হয় না। অধিকাংশ আর্টিস্টই আবার তাদের ছবির কোনও নামই দেন না। বলেন, তারা নাকি ডিক্সনারি ইলাসট্রেট করার জন্য আঁকেন না।
বেনওয়া সাহেব সেদিন আরও অনেক খাঁটি তত্ত্বকথা বলেছিলেন। কারণ খাস ফরাসিদের মতো তাঁর কৌতূহল ও উত্সাহ ছিল–কাব্য, সঙ্গীত, চিত্র, ভাস্কর্য ইত্যাদি নানা রসের নানা প্রকাশে, নানা বিকাশে। সর্বশেষ তিনি ইমপ্রেশনিজম, সুররিয়ালিজম, কুবিজম, দাদাইজম ইত্যাদি বহুবিধ ইজম-এর ইতিহাস শোনানোর পর শেষ করলেন বানরালের কীর্তিকাহিনী শুনিয়ে।
কাহিনীটি আমার চোখের সামনে আজও জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু পরম পরিতাপের বিষয় নাটকের যিনি হিরো তার নামটি ভুলে গিয়েছি। বানরালে-বানরালে গোছ কী যেন এক বিজাতীয় নাম– এ নামটা অনায়াসে আমারও হতে পারত, তবে এটুকু মনে আছে যে নামের মধ্যিখানে আন্ কথাটি ছিল। অবশ্য এ নাট্যের আদ্যন্ত আজও অতি সহজেই আবিষ্কার করা সম্ভবে, সামান্য কয়েক মাস কলকাতা-দিল্লি-বোম্বাই (এ ব্যাপারে বোম্বাই কোন পুণ্যবলে তীর্থভূমিতে পরিণত হলেন সে রহস্য পূতভূমির পাণ্ডারাও জানেন না) মাকু মারার পর নিরাশ হয়ে, শেষটায় ভিটেমাটি বেচে, কালোবাজারে ফরেন এক্সচেঞ্জ কিনে যদি প্যারিস চলে যান (ভুলবেন না, ফেরার সময় ম পলিয়ে থেকে একটা ডিলিট নিয়ে আসবেন; এদেশে কাজে লাগবে। প্ল্যাটফর্মেই বোধহয় সনদ বিক্রি হয়, নইলে হয়তো দু-একদিন বিশ্ববিদ্যালয়-পাড়ায় বাস করে, রেডিমেড থিসিস কিনে সেটা পেশ করা মাত্রই সনদটা পেয়ে যাবেন সঙ্গে সঙ্গে…ডট করা লাইনের সঠিক জায়গায় নাম সই করতে কিংবা টিপসই দিতে যেন ক্রটি না হয়…) তবে অদ্যকার বঙ্গসন্তানমাত্রই আনন্দিত হবে যে, কালোবাজার সেখানে নেই (সব খোলাখুলি, সামনাসামনি)।
প্যারিসের লোক সে কাহিনী এখনও ভোলেনি। আপনাকে নতুন করে বলার সুযোগ পেয়ে বড়ই উৎসাহের সঙ্গে সেটি কীর্তন করবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন মডার্ন আর্ট প্যারিসের অন্যসব প্রাচীন অর্বাচীন কলাসৃষ্টিকে ঝেটিয়ে মহানগরী থেকে বের করে দিয়েছে, তখন হঠাৎ একদিন উদয় হলেন গটগট করে, সূর্যোদয়ের গৌরব নিয়ে এই চিত্রকর চিত্রকর বললে অত্যল্পই বলা হয় যেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। এতদিন নাকি নির্জনে চিত্রসাধনায় নিযুক্ত ছিলেন বলে কোনও প্রদর্শনীতে ছবি পাঠাননি। কিন্তু এইবারে তার সময় হয়েছে। কারণ মডার্ন আর্ট তার নতুন পথ খুঁজে পেয়েছে, তার চরম সিদ্ধিতে পৌঁছে গেছে এরই চিত্রকলায়।
একইসঙ্গে প্যারিসের তিনখানা প্রখ্যাততম পত্রিকা মারফত শুধু কলাবিভাগের নয়, অসাধারণ জ্ঞাতব্য সংবাদরূপে কাগজের উত্তমাঙ্গেও প্রকাশিত প্যারিসবাসী এবং দু-তিন দিনের ভিতর তাবৎ ফরাসিস জাতি এই নব অরুণোদয়ের সংবাদ পেয়ে বিস্মিত, স্তম্ভিত ও মুগ্ধ হল। ক্রমে ক্রমে সর্ব আর্টজর্নলে, বিশেষ করে সেইসব আলট্রা-মডার্ন-আর্টজলে, যেগুলো খবরটা সর্বপ্রথমে পরিবেশন করতে পারেনি বলে ঈষৎ বিব্রত বোধ করছিল, সর্বত্রই এই নবীন আর্টিস্ট সম্বন্ধে কলামের পর কলাম, পাতার পর পাতা জুড়ে নানাপ্রকারের বিশ্লেষণ তথা তাঁর প্রথম চিত্রের জন্ম থেকে শেষ চিত্র অবধি তার ক্রমবিকাশের সুনিপুণ ইতিহাস সবিস্তার বর্ণিত হল। শেষটায় কিন্তু একে লুফে নিলেন আলট্রা-মডার্ন আর্টের ক্রিটিকদের চাইরাই। এরা অ্যাকাডেমিক আর্টের জন্মশত্র, কসমূ-খাওয়া-খুনি-দুশমন। অন্যপক্ষে প্রথমটায় কিঞ্চিৎ গাইগুই না-রাম-না-গঙ্গা ধরনের দু-একটা মন্তব্য করার পর আলট্রা মডার্নদের হাতে ঘোল খেয়ে চুপসে রঙ্গভূমি বা জঙ্গভূমি, যাই বলুন, পরিত্যাগ করলেন। ওদিকে সেই চিত্রকরের ছবি দেখবার জন্য যা ভিড়, সেটা সামলাতে গিয়ে প্যারিস পুলিশের মতো সহিষ্ণু প্রতিষ্ঠানও হিমশিম খেয়ে গেল। ওঁর ছবি না-দেখা থাকলে তো প্যারিসের শিক (chic) সমাজে মুখ দেখানো যায় না, ওঁর সম্বন্ধে বিজ্ঞভাবে কথা বলাটাই তখন দ্যনিয়ে ক্রি– dernier cri- শব্দে শব্দে অনুবাদ করলে শেষ চিৎকার কিন্তু তার থেকে আসল অর্থ ওত্রায় না, বরঞ্চ আখেরি কালাম বললে ওরই গা ঘেঁষে যায়। আর্টের ব্যাপারে ফরাসি হনুকরণ (to ape)-কারী ইংরেজও ওই দর্নিয়ে ক্রি-ই আপন ভাষাতে ব্যবহার করে, অর্থ uterunost refinement- এরকম দুটো শব্দ কিছুতেই অনুবাদ করা যায় না বলে।
এমন সময় সিন্দবাদের সেই সুদর্শন, নিটোল, নিখুঁত সি-মোরগের আণ্ডাটি গেল ফেটে, কিংবা কেউ দিলে ফাটিয়ে।
সঙ্গে সঙ্গে বেরুল উৎকট পচা দুর্গন্ধ। প্যারিসে তিষ্ঠনো কি সোজা ব্যাপার।
সেই যে বলেছিলুম একইসঙ্গে প্যারিসের তিনখানা প্রখ্যাততম পত্রিকা মারফত এই নবীন রবির প্রথম সংবাদ বেরোয়, এবং পরে সকলের অলক্ষ্যে এঁরা কেটে পড়েন সেই তিন সংবাদদাতা বা জালিয়াৎ আঙটি ফাটালেন– সর্বজনসমক্ষে ফটোগ্রাফসহ।
আসলে বানরালে নামে কোনও আর্টিস্টই নেই। এই তিন মিত্র একটা গাধাকে শক্ত করে বেঁধে নেন একটা খুঁটিতে। লম্বা ন্যাজে মাখিয়ে দেন সযত্নে, আর্টিস্টরা–বরঞ্চ বলা উচিত আলট্রামডার্ন আর্টিস্টরা যে রঙ, অয়েল কালার ব্যবহার করতে পছন্দ করেন, সেইসব রঙ। তার ন্যাজের কাছে, পিছনে, আটিস্টদের তেপায়া স্ট্যান্ড বা ইজলের উপর ক্যানভাস। তার পর সেই গাধাটাকে দে, বেধড়ক মার! সে বেচারি পিছনের ঠ্যাং দুটো তুলে যত লাফায়, ততই তার নানা-রঙে-রাঙা ন্যাজ থাবড়া মারে ক্যানভাসের উপর। সঙ্গে সঙ্গে আঁকা হয়ে যায় মোস্ট আলট্রামডার্ন ছবি! ভিন্ন ভিন্ন সাইজের ভিন্ন ভিন্ন ক্যানভাস নিয়ে, গাধার ন্যাজ কখনও বিনুনির মতো ভাগ করে, কখনও গোচ্ছ গোচ্ছা করে বেঁধে যার যথা অভিরুচি–রঙের ভিন্ন ভিন্ন সংমিশ্রণ করে আঁকা হল ছবির পর ছবি! এবং পাছে লোকে অবিশ্বাস করে তাই ছবির প্রতি স্টেজে তার ফটো, গাধার লম্পঝম্পের ফটো, গর্দভের পুচ্ছাংশসহ চিত্রাংশের ফটো– এককথায় শব্দার্ধে ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফ তোলা হয়েছে অপর্যাপ্ত।
তিন জালিয়াত বলা বাহুল্য, এরা তল্কালীন তথাকথিত মডার্ন আর্টিস্টদের গোঠ বেঁধে, দল পাকিয়ে চিৎকার ও অ্যাকাডেমিক আর্টের উদ্দেশে তাদের অশ্রাব্য কটুবাক্য শুনতে শুনতে হন্যে হয়ে গিয়ে শেষটায় উপযুক্ত সত্ত্বারটি করেছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে আবার সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দিলেন বানরালে নামটার মধ্যখানে ane- ফরাসিতে যার অর্থ গর্দভ শব্দটি গোপনে গা-ঢাকা দিয়ে বসে আছে। অর্থাৎ গাধাটিই এসব ছবির প্রকৃত আর্টিস্ট।
তস্য বিগলিতাৰ্থ, মোস্ট-আলট্রা-মডার্ন-আটিস্ট তথা তাদের মুখপাত্র আর্টক্রিটিকরা আদিন ধরে যাকে তাদের শিরোমণি করে, তাদের হিরো বানিয়ে বিনা বাদ্যে নেচেছেন (কী কল পাতাইছ তুমি! বিনা বাইদ্যে নাচি আমি।- লেখকের মাতৃভূমির প্রবাদ) তিনি একটি গর্দভ!
এ-জাতীয় ঘটনা আরও ঘটেছে। তার ফিরিস্তি দিতে যাবে কে আর উপরের উল্লিখিত ঘটনাটির পিছনে রয়েছে নষ্টামি। কিন্তু যেখানে কোনওপ্রকারের কুমতলব নেই, সেখানেও যে এরকমের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে সেটা বছর পাঁচেক পূর্বে সপ্রমাণ করে সুইডেনের মতো ঠাপ্ত দেশ।
সুইডেনের অন্যতম প্রখ্যাত অতি আধুনিক চিত্রকর কালক্ট্রোম ছবি আঁকার সময় একখানা ম্যাসোনাইটের টুকরোয় মাঝে মাঝে তুলি পুঁছে নিতেন। কাজেই সেটাতে হরেকরকম রঙ লেগে থাকার কথা। ওই সময় সুইডেনের ললিতকলা আকাঁদেমি এক বিরাট মহতী চিত্রপ্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন–স্বতঃস্ফূর্ত কলা (Spontaneous art বা স্পন্টানিসাস এর নাম এবং এটাকেই তখন সর্বাধুনিক কলাপদ্ধতি বলা হত) ও তার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ এই নাম দিয়ে সেই চিত্রপ্রদর্শনীতে থাকবে সুইডেন তথা অন্যান্য দেশের স্পন্টানিসমু কলার উত্তম উত্তম নিদর্শন। তখন হয়েছে কী, চিত্রকর ফালক্ট্রোম তার অন্য ছবি যাতে ডাকে যাবার সময় জখম না হয় সেই উদ্দেশ্যে পূর্বোল্লিখিত তুলি পৌঁছার রঙবেরঙের ম্যাসোনাইটের টুকরোখানা তার অন্য দু-খানা ছবির উপর রেখে প্যাক করে প্রদর্শনীতে পাঠিয়ে দেন– এস্থলে বলা উচিত ফালক্ট্রোম ছবি ক্যানভাসের উপর না এঁকে আঁকতেন ম্যাসোনাইটের উপর। আকাঁদেমির বড়কর্তারা ভাবলেন এটাও মহৎ আর্টিস্টের এক নবীন কলানিদর্শন, এবং পরম শ্রদ্ধাভরে সেই তুলি পোঁছার টুকরোটির নিচে আর্টিস্টের স্বনামধন্য নাম লিখে বুলিয়ে দিলেন তাঁর অন্য ছবির পাশে।
কেলেঙ্কারিটা কী করে বেরিয়ে পড়ে সে অন্য কাহিনী, কিন্তু যখন পড়ল তখন উঠল কাগজে কাগজে হইহই রব। শেষটায় খুদ আকাঁদেমির প্রেসিডেন্ট খুদাল্লার হাতে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বলেই ফেললেন, কী করি মশাইরা, বলুন। কে জানত শেষটায় এরকম ধারা হবে? অজিকাল নিত্যি নিত্যি এতসব নয়া নয়া এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে যে, কোনটা যে এক্সপেরিমেন্ট আর কোনটা যে অ্যাক্সিডেন্ট কী করে ঠাওরাই আমরা ভেবেছি গুণী ফালক্ট্রোম আর্টের ক্ষেত্রে একটা অভিনব নবীন পন্থা আবিষ্কার করতে পেরেছেন এবং সেই ভেবে ওই ছবিটাও প্রদর্শনীর অন্যান্য ছবির সঙ্গে টাঙিয়ে দিয়েছি।
রাস্তার লোক সব শুনে বলল, এতদিন যা শুধু সরস্বতীর বরপুত্ররাই বহু সাধনার পর, বহু তপস্যার ফলে সৃষ্টি করতে পারতেন, এখন দেখছি অ্যাক্সিডেন্টও (আকস্মিক যোগাযোগ) সেটা করতে পারে?
এর বহুপূর্বেই সংস্কৃতেও নাকি বলা হয়ে গিয়েছে, কোটি কোটি বৎসর ধরে উইপোকা কাঠ খেয়ে খেয়ে হিজিবিজি যে নকশা কাটছে, তার ভিতর হয়তো একদিন পূর্ণ প্রণব মন্ত্রটিই খোদাই হয়ে বেরিয়ে আসবে। পাঠক আদৌ ভাববেন না, আমি মডার্ন কবিতা বা আর্টের দুশমন। এর চেয়ে সত্যের অপলাপ ও অন্যায় অবিচার আমার প্রতি আর কিছুই হতেই পারে না। বস্তুত আমি মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করি, প্রকৃত শিল্পী প্রতিদিন সেই চেষ্টাতেই থাকবে, কী করে নতুন ভঙ্গিতে নবীন পদ্ধতিতে তার মহত্তম চিন্তা নিবিড়তম অভিজ্ঞতা মধুরতম ভাষায় প্রকাশ করতে পারে। নইলে তো আমরা প্রলয় পর্যন্ত পাখিসবের সঙ্গে সেই একই রব গেয়েও কূল পাব না।
কিন্তু গেল ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আমি বড় দুশ্চিন্তায় পড়েছি। পাবলো পিকাসোর নাম শুনলে আজকের দিনে শতকরা নিরানব্বই জনকি প্রাচীন কি অর্বাচীন সবাই অজ্ঞান। সেই পিকাসো গেল ফেব্রুয়ারি মাসের কাছাকাছি একটি বিবৃতি দেন। বোম্বায়ের Alvi Book Bulletin-এর ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় সেটি বেরিয়েছে। উপস্থিত আমি কোনও মন্তব্য করছি না। শুধু সেটি তুলে দিচ্ছি। বাংলায় অনুবাদও করব না, কারণ যারা ইংরেজি জানেন না তারা অযথা সন্তাপ থেকে বেঁচে যাবেন, আর যারা জানেন তাদের জন্য অনুবাদ নিষ্প্রয়োজন। আসল প্রধান কারণ অবশ্য, এটির সুষ্ঠু অনুবাদ আমার শক্তির বাইরে। তবে উভয় পক্ষকে অসন্তুষ্ট করার জন্য মোটামুটি একটি ব্যাখ্যা দেব।
Pablo Picasso, 83 years old Spanish-born father-figure of the modernist cult in art, has now made a sensational confession that he was simply amusing himself at the expense of his intellectual admirers with his bizarre creations. Says he :
The people no longer seek consolation and inspiration in art. But the refined people, the rich, the idle, seek the new, the extraordinary, the original, the extravagant, the scandalous. And myself, since the epoch of Cubism, have contended these people with all the bizarre things that have come into my head. And the less they understood it the more they admired it.
By amusing myself with all these games, all this nonsense, all these picture puzzles and arabesques, I became famous, and very rapidly. And celebrity, for a painter, means sales, profits, a fortune. Today, as you know, I am famous and very rich.
But when I am alone with myself I have not the courage to consider myself as an artist in the great sense of the word, as in the days of Giotto, Titian, Rembrandt, and Goya. I am only a public entertainer who has understood his time.
পিকাসো উক্তির বিগলিতাৰ্থ- আজকের দিনের মানুষ কলাসৃষ্টির দ্বারস্থ হয় না সান্ত্বনা বা অনুপ্রেরণার জন্য; আজকের দিনের নির্মা, তথাকথিত বিদগ্ধ ধনীরা চায়, নতুন, মৌলিক, অসাধারণ, বাড়াবাড়ির চরম, কেলেঙ্কারির কলা আর তিনি সেই ক্যুবিজেম-এর(৩) আমল থেকে তার মাথায় যতসব আবোল-তাবোল হযবরল (bizarre)(৪) এসেছে, সেগুলো দিয়ে ওইসব ধনীদের সন্তুষ্ট করেছেন। এবং তার ওইসব বিজার ছবি তারা যত কম বুঝতে পেরেছে, সেই অনুপাতে মুগ্ধ প্রশংসা করেছে ততই উচ্চমাত্রায়। আর তিনিও ফুর্তি পেলেন ওই ধরনের, ওদেরই প্রার্থিত খেলা খেলতে আঁকলেন অর্থহীন যা-তা (ননসেন্স), ছবির ধাঁধা, জ্যামিতিক ডিজাইন এবং তারই ফলে হয়ে গেলেন বিখ্যাত। আর আর্টিস্টের পক্ষে বিখ্যাত হওয়ার অর্থই, প্রচুর ছবি বিক্রির ফলে প্রচুরতর অর্থলাভ। এবং সবাই এখন জানেন, পিকাসো বলছেন, তিনি এখন বিখ্যাত এবং খুবই সম্পদশালী।
কিন্তু তার পরই বলছেন, কিন্তু তিনি যখন একা বসে আত্মচিন্তা করেন, তখন আর তার সাহস হয় না, নিজেকে সেই মহান অর্থে শিল্পী আখ্যা দিতে, যে অর্থে শিল্পী বোঝাত জিত্তো, তিসয়ান, রেমব্রান্ট, গোইয়া-র যুগে। তিনি শুধু দিয়েছেন সবাইকে ফুর্তি (পাবলিক এন্টারটেনার–তার রূঢ়তম অর্ধ ভাড়, সার্কেসের ক্লাউন, সঙ) কারণ তিনি যেমন কলি, তেমন চলি তত্ত্বটি বুঝতেন।
এই বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর পিকাসোর কর্তাভজা সম্প্রদায়ে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্ট হয়, সেটা আমার চোখে পড়েনি। তবে আমার কাছে পূর্বের অবোধ্য একটি সমস্যা সরল হয়ে গেল।
পিকাসো বৃদ্ধবয়সে এক তরুণীকে বিয়ে করেন। কয়েক বছর পর তরুণী তাকে ত্যাগ করে তালাক দেন (কিংবা হয়তো পিকাসোই এমন পরিস্থিতি নির্মাণ করেন যে তালাক ভিন্ন অন্য গতি ছিল না—কারণ তিনি গ্রেট আর্টিস্ট হন আর নাই হন, এ-তত্ত্বটি কিন্তু অনস্বীকার্য, গ্রেট আর্টিস্টদের যে-খামখেয়ালির বাতিক থাকে, মাথায় যে-ছিট থাকে সেটা তিনি পেয়েছেন ন-সিকে।) এবং পিকাসোর সঙ্গে তার দাম্পত্যজীবন সম্বন্ধে একখানি পুস্তক প্রচার করেন। পিকাসো নাকি সেটা ঠেকাবার চেষ্টা করে বিফল হন। সেই জীবনীটি যখন ধারাবাহিকভাবে কন্টিনেন্টের একটি সাপ্তাহিকে প্রকাশিত হয় তখন তার প্রায় সবকটা কিস্তিই আমি পড়ি, এবং আমার মনে সবচেয়ে বেশি বিস্ময় সৃষ্টি করল– আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলুম বললেও অত্যুক্তি হয় না যে, সে পুস্তিকায় পিকাসো তার তরুণী স্ত্রীকে আর্ট বলতে কী বোঝায় এবং এই বিষয় নিয়ে যেসব আলোচনা তার সঙ্গে করেন সেগুলো সব প্রাচীন যুগের কথা; অর্থাৎ সেই মাইকেল এঞ্জেলোর আমল থেকে প্রায় একশো বসর পূর্বপর্যন্ত আলঙ্কারিক, কলারসিকরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আর্টের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, আর্ট-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে যেসব অভিমত প্রকাশ করেছেন, পিকাসো মোটামুটি তারই পুনরাবৃত্তি করেছেন মাত্র!
আমি তখন চিন্তা করে বিহ্বল হয়েছি, এই যদি আর্ট সম্বন্ধে পিকাসোর ধারণা হয় তবে তাঁর আঁকা ছবির সঙ্গে এ ধারণার কোনও সামঞ্জস্যই তো খুঁজে পাচ্ছিনে! একদিকে লোকটি আর্ট সম্বন্ধে ক্ল্যাসিকাল, অ্যাকাডেমিক ধারণা পোষণ করেন, আর অন্যদিকে তিনি একে যাচ্ছেন তার ভাষাতেই বলি– বিজার গ্রোটেক যতসব মাল!
এ যেন, আপনি নামতা শিখেছেন ঠিকই, কিন্তু অঙ্ক কষার বেলা করছেন ৩x৪ = ৮২, ৭+৫ = ২!
পিকাসোর এই বিবৃতিটি পড়ে আমার মনের ধন্দ গেল। তার আদর্শ ছিলেন জিতো, রেমব্রান্টই, কিন্তু তিনি জানতেন প্রথমত, ওদের স্তরে আদৌ পৌঁছতে পারবেন কি না; দ্বিতীয়ত, পৌঁছতে পারলেও বাজারে সেই প্রাচীন ঢঙের ছবির চাহিদা আজ আর আদপেই নেই; তৃতীয়ত, তারও খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য অর্থের প্রয়োজন এবং সর্বশেষে, সেই অর্থের জন্য যখন ছবি আঁকব আপন আদর্শ বেহায়া বিসর্জন দিয়ে– তবে সেইটাই কবি পূর্ণমাত্রায় ইংরেজিতে যাকে বলে উইথ এ ভেনজেনস, উর্দুতে বলে, পড়ে তলওয়ার দামকে সম্ভালে কোই– তলওয়ার যখন ধরেইছি তখন রক্তের ছিটে পড়বে বলে কুর্তার দমন (প্রান্ত, অঞ্চল) অন্য হাত দিয়ে সামলানোটা বিলকুল বেকার।
অবশ্য এসব তর্কবিতর্কের অর্থ হয়, যদি আমরা নিঃসন্দেহে ধরে নিই যে পিকাসো এ-বিবৃতিতে প্রাণের কথা খোলাখুলিই বলেছেন, সজ্ঞানে সত্যভাষণই করেছেন। নইলে কাল যদি আরও পয়সা কামানোর জন্য, বা বিনা-কারণেই আরেকটা নয়া ফয়তা ঝেড়ে বলেন, না না, ওটা আমার সত্য বিবৃতি নয়। আমি শুধু রগড় দেখবার জন্য এই মস্করাটা করেছিলাম আমার অন্ধ স্তাবক, এবং ওইসব মূর্ষ ধনীরা যারা নৃত্য করতে করতে আমার ছবি কিনেছে হুজুগে মেতে, ন্যায্যমূল্যের শতগুণ বেশি টাকা ঢেলে, তারা তখন কী বলে?–সোজা ইংরেজিতে আই উয়োজ পুলিং দেয়ার লেগ!– তখন আজ যেসব প্রাচীনপন্থীরা এই হাটের মধ্যিখানে হাঁড়ি ভাঙাটা দেখে উল্লাসে চিৎকার করে উঠেছেন, তাঁরা লুকোবেন কোন ইঁদুরের গর্তে!
অবশ্য শেষপর্যন্ত কর্তাভজাদের কোনও দুশ্চিন্তা নেই। তারা বলবেন, আজ যদি শেক্সপিয়ারের স্বহস্তে লিখিত একখানা গোপন ডাইরি বেরোয় যাতে তিনি লিখেছেন, আমি হতে চেয়েছিলুম হোমার, ভার্জিলের মতো কবি, কিন্তু যখন দেখলুম এ যুগে সেসব কবিদের চাহিদা নেই তখন হয়ে গেলুম পাবলিক এন্টারটেনার- ভাঁড় তা হলেই কি আমরা সেটা মেনে নেব, আর বলব, শেক্সপিয়ার গ্রেট পোয়েট নন!,
মুসলমানদের ভিতর একাধিক সম্প্রদায়ের লোক বিশ্বাস করেন, তাঁদের সপ্তম ইমাম (পৃথিবীতে আল্লার প্রতিভূ) অদৃশ্য হয়ে যান, তিনি সত্যি সত্যি মারা যাননি– সময় হলেই তিনি অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে মাহূদি (কল্কি) রূপে আত্মপ্রকাশ করবেন। অন্য সম্প্রদায় বলেন, সপ্তম ইমাম না, অদৃশ্য হন দ্বাদশ ইমাম, তিনিই মাহদিরূপে ইত্যাদি। তৃতীয় সম্প্রদায় বলেন, দ্বাদশ না, চতুর্বিংশতি ইত্যাদি।
এদের সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে স্পেনের আন্দালুশ প্রদেশের মৌলানা ইবন হাজম যেন এদের বাবদে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে মাথা থাবড়াতে থাবড়াতে বলছেন, অলৌকিক এদের অন্ধবিশ্বাসের পঙ্ককুণ্ডে নিমজ্জিত হয়ে থাকবার ক্ষমতা! কারও ইমাম অদৃশ্য হয়েছেন অষ্টম শতাব্দীতে, কারও নবম, কারও-বা দশমে। যে জিনিস হারিয়ে গেছে (অদৃশ্য হয়েছে) দুশো তিনশো চারশো বছর আগে, এরা এখনও সেটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কেউবা আবার বলে, অদৃশ্য ইমাম আছেন একটা মেঘের আড়ালে। আহা, যদি জানতুম কোন মেঘটা! চিৎকারে চিৎকারে তাকে অতিষ্ঠ করে বলতুম, সশরীরে নেমে এসে কুলে বখেড়ার ফৈসালা করে দাও না, বাবা! তাজ্জব তাজ্জব!
পিকাসসোর আগের বিবৃতি যদি সত্য হয় তবে আমাদের বলতে হবে, ভক্তজনের উপাস্য পিকাসো তিনি আত্মহত্যা করলেন। আর ভক্তজন বলবেন, তিনি মেঘের আড়ালে অদৃশ্য হয়েছেন।
.
আর যেসব সরলজন বিশ্বাস করে ওইসব বিজারের বাজার বিলকুল ফুটা, মশকরা করে ছবির ধাঁধা বানিয়ে আর আরাবে একে প্রকৃত কলাসৃষ্টি হয় না, তার জন্য প্রচুর অক্লান্ত তপস্যার প্রয়োজন তাদের জন্য নিম্নের উদ্ধৃতিটি তুলে দিলুম; কিছুতেই লোভ সামলাতে পারলুম না আমার চোখে পড়েছে এই আজ : কিছুদিন আগে কোনও একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে আলাউদ্দিন সাহেব এবং গোলাম আলি সাহেবকে সংবর্ধনা জানানো হয়। অভিনন্দনের উত্তরে আলাউদ্দিন সাহেব বললেন– নাই বছর ধরে সঙ্গীতের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর দর্শনের আশায় সাধনা করে আসছি। একটিমাত্র আশায় দিনের পর দিন সাধনা করে আসছি। একদিন-না-একদিন তিনি প্রসন্ন হয়ে আমাকে অমরাবতীর সংগীত-মন্দিরে ঢোকবার অনুমতি দেবেন। আজও আমার সাধনার শেষ নেই। এতদিন সাধনার ফলে দূর থেকে শুধু মন্দিরের আবছায়া ছায়াটা যেন একটু একটু নজরে আসছে।
এর পর গোলাম আলি সাহেব অভিনন্দনের উত্তরে বললেন– আলাউদ্দিন খা সাহেব। মহাভাগ্যবান ব্যক্তি। দেবী সরস্বতী তার সাধনায় তুষ্ট হয়ে তাকে মন্দিরের ছায়া দেখিয়েছেন। কিন্তু আমি হতভাগ্য এতদিন সাধনা করার পরেও সঙ্গীত-মন্দিরের ছায়া দেখতে পাওয়া দূরে থাক–উপরে ওঠবার সিঁড়িটুকুও এখনও শেষ করতে পারিনি। জানি না কত সহস্র বছর আরও কঠিন কঠোর সাধনায় দেবী প্রসন্ন হবেন।
———–
১. এইসব অধ্যাপকদের সম্বন্ধে যেটুকু সামান্য বিবরণ পাঠক পাবেন সেটুকু শ্ৰীযুক্ত প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনীতে। কিন্তু তার মূল বক্তব্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ছিল বলে, বাধ্য হয়ে অধ্যাপকদের সম্বন্ধে বিবরণ দিয়েছেন সংক্ষিপ্তরূপে।
২. সব জিনিস মূল ভাষাতে পড়তে হবে এ উন্নাসিকতার কোনও অর্থ হয় না। আমার আপন অভিজ্ঞতা বলে, বহুক্ষেত্রে অনুবাদ মূলের চেয়ে ঢের সরেস হয়েছে। তার একাধিক কারণ আছে, কিন্তু সে-আলোচনা এস্থানে অবান্তর এবং সংক্ষেপে সারবার উপায় নেই।
৩. এদেশে গগনেন্দ্রনাথ সত্যই ছবি এঁকেছিলেন ওই ঢাবিজ পদ্ধতিতে।
৪. মডার্ন মাথামুণ্ডুহীন ছবির জন্যই যেন এই মোক্ষম bizarre শব্দটি নির্মিত হয়েছিল। ইংরেজ আভিধানিক এর প্রকৃত অর্থ বোঝাতে গিয়ে যেন দিশা না পেয়ে অনেকগুলো কাছেপিঠের শব্দ ও তাদের সমন্বয় করেছেন : eccentric, fantastic, grotesque, mixed in style, half barbaric. কিন্তু এদেশের সুকুমার রায় বিজার শব্দটির প্রকৃত অর্থ একটি কবিতার মারফতে যা বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন সেটি বিশ্বসাহিত্যে অতুলনীয়। আমি কয়েক ছত্র তুলে দিচ্ছি :
কেউ কি জানে সদাই কেন বোম্বাগড়ের রাজা
ছবির ফ্রেমে বাধিয়ে রাখে আমসত্ত্ব ভাজা?
রানীর মাথায় অষ্টপ্রহর কেন বালিশ বাঁধা?
পাউরুটিতে পেরেক ঠোকে কেন রানীর দাদা?
কেন সেথায় সর্দি হলে ডিগবাজি খায় লোকে?
জোছনা রাতে সবাই কেন আলতা মাখায় চোখে?
ওস্তাদের লেপমুড়ি দেয় কেন মাথায় ঘাড়ে?
টাকের পরে পণ্ডিতেরা ডাকের টিকিট মারে?
সভায় কেন চেঁচায় রাজা হুক্কা হুয়া বলে?
মন্ত্রী কেন কলসি বাজায় বসে রাজার কোলে?
সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি?
কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসি ইত্যাদি।
আন্ ফ্রাঙ্ক
অনেকেই জিগ্যেস করেন, নাৎসি পার্টির কি কোনও গুণ ছিল না, তারা কি সুন্দুমাত্র পাপাচারই করেছেএর উত্তরে একটি ক্লাসিক্যাল নীতিবাক্য সংবলিত ছোট্ট কাহিনী মনে আসে। এক দরিদ্র গ্রাম্য পাদ্রি গিয়েছেন শহরে বিশপের সঙ্গে দেখা করতে, সকালবেলা বিশপ তার চেহারা দেখেই বুঝে গেলেন, বেচারির পেটে তখনও কিছু পড়েনি। বাটলারকে হুকুম দিলে সে রুটি মাখন আর একটি ডিম-সেদ্ধ নিয়ে এল। পাদ্রি মৃদু আপত্তি জানিয়ে খেতে আরম্ভ করলে হঠাৎ বিশপের নাকে গেল পচা ডিমের গন্ধ। চশমার উপর দিকে অর্ধোনুক্ত পচা ডিম ও পাদ্রির দিকে যুগপৎ তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আই অ্যাম অ্যাফ্রেড, আপনাকে একটা পচা ডিম দিয়েছে। পাদ্রি সাহেব তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ করে বললেন, না হুজুর না, ইট ইজ অলরাইট তার পর একটু থেমে বললেন, — অ্যাট প্লেসে অর্থাৎ কোনও কোনও জায়গায়।
তাই পাদ্রি সাহেবের ডিম বলতে বোঝায়, পৃথিবীতে কি এমন কোনও পচা ডিম পাওয়া যাবে, যার সর্বশেষ অণুটুকুও পচে গিয়েছে তেমন করে খুঁজলে অন্তত দু-একটি পরমাণু পাওয়া যাবে, যেগুলো সম্পূর্ণ পচে যায়নি।
নির্গলিতাৰ্থ : ইহভুবনে এমন কোনও ব্যক্তি, বস্তু, প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে না যার ভিতর নেই কোনও গুণ, শুধু কপালে আগুন।
বস্তৃত হিটলার তথা নাৎসি পাটির অনেক গুণই ছিল, এবং আমার ব্যক্তিগত বিষাস, গত বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত শোন-মশানে পরিণত জর্মনি যে বছর-পাচেকের ভিতর আপন পায়ে দাঁড়াতে পারল, তার জন্য কিছুটা ধন্যবাদ পাবেন হিটলার ও তার নাৎসি পার্টি। সবদ্ধ হয়ে কঠোর তপস্যা দ্বারা কী প্রকারে একটা দেউলে দেশকে (১৯৩৩-এর জর্মনি) মাত্র পাঁচটি বৎসরের ভিতর পরিপূর্ণ শক্তিমান বিত্তবান করা যায় (১৯৩৮-এর জর্মনি) সেই ভানুমতীর খেল দেখিয়েছিলেন স্বয়ং হিটলার। সেই সঘবদ্ধ তপস্যালব্ধ চরিত্রবল বহুলাংশে প্রয়োগ করে যুদ্ধশেষে বিধ্বংসিত-জর্মনি পুনরায় শ্রী-সমৃদ্ধি লাভ করে।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও ভুললে চলবে না, নাৎসিরা পঞ্চাশ লক্ষ ইহুদিকে নিহত করে।
আবার তার পর এটা ভুলে গেলে আরও একটা মারাত্মক প্ৰম করা হবে যে, হিটলারের দৃষ্টান্ত থেকে বিশ্বমানবের মোশ্চম শিক্ষালাভ হয়ে গিয়েছে এবং ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি হবে না। বস্তুত রবের্গের মোকদ্দমার সময় যে-সেরা মার্কিন মনোসমীক্ষণবি, ডাক্তার কেলি প্রধান প্রধান আসামি গ্যোরিঙ, রিবেনট্রেপ, কাইটেল ইত্যাদির মনোসমীক্ষণ (সাইকো-অ্যানালেসিস) দীর্ঘকাল ধরে করেন, হিটলার সম্বন্ধে নানা দ্ব্যর্থহীন তত্ত্ব ও তথ্য এদের কাছ থেকে সগ্রহ করেন (আসামিদের সকলেই হিটলারকে বহু বৎসর ধরে অব্যবহিত অন্তরঙ্গভাবে চিনতেন) এই ডাক্তার কেলি আপন সোনার দেশ, ইহলোকে গণতন্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভূ মার্কিন মুলুকে ফিরে গিয়ে প্রামাণিক পুস্তক মারফত বলেন, এই মার্কিন মুলুকেই যে কোনও দিন এক নয়া-হিটলার নয়া-তাণ্ডব নৃত্য নাচাতে পারে, নাচতে পারে।
কেলি তার পুস্তক প্রকাশ করেন সম্ভবত ১৯৪৭-৪৮-এ। তার পর দীর্ঘ একুশ বৎসর পরে, খবরের কাগজে পড়লুম, এক গণ্যমান্য মার্কিন অধ্যাপক অস্ট্রেলিয়াতে বক্তৃতা-প্রসঙ্গে বলেন, (কাটিং রাখিনি, মোদ্দাটা সাদামাটা ভাষায় বলছি) এখনও বিস্তর হিটলার রয়েছে; তারা সুযোগ পেলেই আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।
এই মোক্ষম হক বাক্যটি আমরা যেন কখনও না ভুলি।
.
অনেকেই জিগ্যেস করেন, হিটলার কি শুধু ইহুদি এবং তার জর্মন-বৈরীদেরই (যেমন আমার সখা কার্ল, তথা কবীর-সখা ট্রটসু জলস) নির্যাতন করেছেন? দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হচ্ছে, শুধু তাই নয়। পোলিশ, চেকশ্লোভাক-বুদ্ধিজীবী, যুদ্ধে বন্দি রাশান অফিসার আরও বহুবিধ লোক তার দীর্ঘ হস্ত থেকে নিষ্কৃতি পায়নি। এমনকি, কয়েক হাজার নিতান্ত নিরীহ বেদের পালও কনসানট্রেশন ক্যাম্পে, গ্যাস-চেম্বারে প্রাণ দেয়; কী-এক অজ্ঞাত অখ্যাত ককেশাস না কোন এক অঞ্চলে ধৃত এক অতিশয় ক্ষুদ্র উপজাতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তারা স্লাভ
আর্য? জর্মন তথা বিশ্বের সর্ব বিশ্বকোষ এদের সম্বন্ধে কোনও খবর দেয় না। শেষটায় হিটলারের খাস-প্যারা হিমলার-চিত্রপ্ত–যিনি কনসানট্রেশন-নরকের কার্ড ইনডেক্সিং-এর চিফ সেক্রেটারি–তিনি রায় দিলেন, আল্লায় মালুম কোন দলিলদস্তাবেজ বিদ্যাবুদ্ধির ওপর নির্ভর করে যে, এরা স্লাভ, অর্থাৎ নাৎসি ধর্মানুযায়ী, বেকসুর বধ্য। ওরা মরে। যুদ্ধ শেষে তাবৎ খবর পাওয়ার পর বিশ্বপণ্ডিতরা নাকি ফতোয়া দিয়েছেন এরা আর্যদেরই কোন এক নাম-না-জানা উপজাতি। এবং কেউ কেউ বলেন, এই উপজাতি সমূলে নির্বংশ হয়েছে, কেউ কেউ বলেন, না, দু-একটা উটকো হেথা-হোথা বেঁচে আছে এবং বংশরক্ষার জন্য বন্ধু খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি সঠিক জানিনে।
কিন্তু এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, ইহুদিরাই-সুদ্ধমাত্র ইহুদি পরিবারে জন্ম নেবার অপরাধ-এর ফলেই– প্রাণ দিয়ে খেসারত দেয় সর্বাধিক।
এ বাদে অন্যতম উল্কষ্ট দলিল সৌভাগ্যক্রমে বাংলা ভাষাতেই উকষ্টরূপে অনূদিত হয়েছে। একটি তেরো-চৌদ্দ বছরের ইহুদি মেয়ের ডাইরি বা রোজনামচা। যুদ্ধের সময় লেখা। বাংলাতে বইখানির নাম আন্ ফ্রাঙ্কের ডায়ারি, অনুবাদক শ্রীঅরুণকুমার সরকার ও শ্রীলংশুকুমার চট্টোপাধ্যায়। আমি মেয়েটির রোজনামচা থেকে কিছুটা তুলে দিচ্ছি; পরে সুযোগ পেলে সবিস্তার আলোচনা হবে। ডাইরিকে উদ্দেশ্য করে মেয়েটি লিখছে–
শুক্রবার, ৯ অক্টোবর, ১৯৪২
আজ তোমাকে কেবল খারাপ খবর শোনাব। আমাদের ইহুদি বন্ধুদের দলে দলে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এইসব হতভাগ্য ইহুদিদের সাথে গেস্টাপো পুলিশ যে কী নির্দয় ব্যবহার করছে, তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। এদের গরু-ছাগলের গাড়িতে বোঝাই করে ড্রেন্টের (Drente) ওয়েস্টারবর্ক (Westerbark) বন্দিশালায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওয়েস্টারবর্কের নাম শুনলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। একশো লোকের জন্য মাত্র একটি হাত-মুখ ধোবার কল। পায়খানা নেই বললেই চলে। স্ত্রী, পুরুষ ও শিত্তদের একই জায়গায় শোবার ব্যবস্থা। এর ফলে, ব্যাপকভাবে নরনারীর চরিত্রস্থলন হচ্ছে। বহুসংখ্যক স্ত্রীলোক, এমনকি অল্পবয়সী মেয়েরাও গর্ভবতী হয়ে পড়ছে।
বন্দিশালা থেকে পালানো অসম্ভব। বন্দিশালার অধিবাসীর মার্কা হিসেবে এদের সকলের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়েছে। খাস হল্যান্ডেই যখন এই অবস্থা তখন দূরদেশে স্থানান্তরিত করে এদের ওপর যে কী অমানুষিক অত্যাচার করা হচ্ছে, তা সহজেই কল্পনা করা যায়। আমাদের বিশ্বাস যে, তাদের অধিকাংশকে হত্যা করা হচ্ছে। ব্রিটিশ রেডিও থেকে বলা হচ্ছে যে, তাদের গ্যাস দিয়ে মারা হচ্ছে।
বোধ করি, এইটিই হত্যা করার সবচেয়ে সহজ পন্থা। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছি। মিয়েপের মুখে এইসব ভয়ঙ্কর গল্প শোনার সময়, আমার রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছিল, অথচ না শুনেও পারছিলাম না।
সম্প্রতি একজন বৃদ্ধা স্ত্রীলোক তার বাড়ির দরজার সামনে বসে ছিল। হঠাৎ পুলিশের গাড়ি তার বাড়ির সামনে এসে থামল, আর গাড়ি থেকে গেস্টাপো পুলিশ নেমে তাকে হুকুম করল, গাড়িতে উঠে এস। পঙ্গু হতভাগিনী চলতে পারে না, কোনওরকমে হামাগুড়ি দিয়ে গাড়িতে উঠতে গিয়ে চাকার তলায় পড়ে গেল। জর্মনরা তার উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে তাকে পিষে মেরে ফেলল।
জর্মনদের আর একরকম অত্যাচারের নাম হল প্রতিশোধমূলক হত্যা। ব্যাপারটা এইরকম নিরীহ নাগরিকদের জামিনস্বরূপ জেলে পুরে রাখা হয়। যখনই হল্যান্ডের কোথাও জর্মনদের বিরুদ্ধে কোনও কার্যকলাপ অনুষ্ঠিত হয়, তখনই তার প্রতিশোধস্বরূপ, নির্দিষ্ট সংখ্যক লোককে জেল থেকে টেনে বের করে গুলি করা হয়। তার পর তাদের মৃত্যুসংবাদ কাগজে ছাপানো হয়। এই হল হিটলারতন্ত্রের আসল রূপ। এরা আবার নিজেদের আর্য বলে গর্ব করে।
—তোমারই আন
কত না অশ্রুজল
০১.
একখানা অপূর্ব সংকলনগ্রন্থ অধীনের হাতে এসে পৌঁছেছে। পুনরায়, বার বার বলছি অপূর্ব, অপূর্ব! এ বইখানিতে আছে, মানুষের আপন মনের আপন হৃদয়ের গভীরতম আত্মপ্রকাশ। কারণ মৃত্যুর সম্মুখীন মানুষ অতি অল্প অবস্থাতেই মিথ্যা কয় বা সত্য গোপন করে। এবং একটি দেশের একজন মানুষের সুখদুঃখের কাহিনী নয়; বহু দেশের বহুজনের। ফ্রান্স, জার্মান, ভারতবর্ষ, বেলজিয়াম, হলান্ড, রাশিয়া, আমেরিকা, ফিনল্যান্ড, ইংল্যান্ড, চীন, জাপান, কানাডা ইত্যাদি ইত্যাদি বস্তুত হেন দেশ প্রায় নেই যার বহু লোকের বহু কণ্ঠস্বর এই গ্রন্থে নেই।
যুদ্ধের সময় সৈন্য তো জানে না কোন মুহূর্তে তার মৃত্যু আসবে। সে যখন ওই সময় ট্রেনচে বসে আপন মা, বউ, প্রিয়া বা বোনকে চিঠি বা তাদের জন্যে ডাইরি লেখে তখনও সে মিথ্যা কথা বলছে, এ সন্দেহ করার মতো সিনিক বা ব্যঙ্গপ্রবণ অবিশ্বাসী আমি নই।
এ বইয়ে আছে গত বিশ্বযুদ্ধে যারা জড়িয়ে পড়েছিল, অর্থাৎ ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সৈনিকরূপে একে-অন্যকে নিধন করতে হয়েছিল, তাদের শেষ চিঠি, ডাইরির শেষ পাতা। এ বিশ্বযুদ্ধ থেকে অল্প দেশই রেহাই পেয়েছিল সেকথা আমরা জানি। শান্তিকামী ভারত, এমনকি যুদ্ধে যোগদান না করেও নিরীহ এসৃকিমাও এর থেকে নিষ্কৃতি পায়নি।
এবং শুধু তাদেরই লেখা নেওয়া হয়েছে যারা এ যুদ্ধে নিহত হয় বা যুদ্ধে মারাত্মকরূপে আহত হওয়ার ফলে যুদ্ধের কয়েক বৎসর পরেই মারা যায় কিংবা যারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহুদূরে শান্তিপূর্ণ দেশে বাস করার সময় যুদ্ধের বীভৎসতা, আত্মজন বিয়োগের শোকে কাতর হয়ে আত্মহত্যা করে।
কিন্তু এত দীর্ঘ অবতরণিকা করার কণামাত্র প্রয়োজন নেই। দু-একটি চিঠির অনুবাদ পড়ে সহৃদয় পাঠক বুঝে যাবেন, এ অবতরণিকা কতখানি বেকার।
গত যুদ্ধে ফ্রান্স পরাজিত হলে পর জর্মন সৈন্যরা সেখানে কায়েম হয়ে দেশটাকে অকুপাই করে। সঙ্গে সঙ্গে বহু ছেলেমেয়ে, তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা গড়ে তোলে আন্ডারগ্রাউন্ড মুভমেন্ট। তারা মোক পেলে জর্মন সৈন্যকে গুলি করে মারে, রেললাইন, তাদের বন্দুক-কামানের কারখানা ডাইনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয় এবং আরও কত কী! এ প্রতিষ্ঠানটি আমাদের আপন দেশেও ইংরেজদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ অজানা নয়।
এই আন্দোলনে যোগদান করার ফলে একটি মোল বছরের ফরাসি বালক জর্মনদের হাতে ধরা পড়ে এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়। মৃত্যুর কয়েক মিনিট পূর্বে সে তার জনক-জননীকে একখানি চিঠি লেখে। এবারে আমি সেটি অনুবাদ করে দিচ্ছি :
…আমার প্রতি যারা সহানুভূতিশীল, বিশেষ করে আমার আত্মীয় ও বন্ধুদের আমার ধন্যবাদ জানিও; তাদের বলল যে (মাতৃভূমি) ফ্রান্সের প্রতি আমার অনন্ত বিশ্বাস। আমার হয়ে ঠাকুর্দা, ঠাকুমা, কাকারা, মাসিরা ও ওদের মেয়ে আমার বোনেদের প্রগাঢ় আলিঙ্গন করো। আমার পাদ্রিসাহেবকে বলো আমি বিশেষ করে তাকে ও তাঁর আত্মজনকে স্মরণে রেখেছি; আমি মসেনার (প্রধান পাদ্রি)-কে ধন্যবাদ জানাই। তিনি আমাকে যেভাবে গৌরবান্বিত করেছেন, আশা করি, আমি যে তার উপযুক্ত পাত্র সেটা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। মৃত্যুর সময় আমি আমার স্কুলের বন্ধুদেরও আদর-সম্ভাষণ জানাই। আমার ক্ষুদ্র পুস্তক সঞ্চয়ন (লাইব্রেরিটি) পিয়েরকে,(১) আমার ইস্কুলের বই বাবাকে, আমার অন্যান্য সঞ্চয়ন আমার সবচেয়ে প্রিয় আমার মাকে দিয়ে গেলুম। আমার বাসনার ধন স্বাধীন ফরাসিভূমি এবং সুখী ফ্রান্সবাদী দস্ত্রী ফ্রান্স, পৃথিবীর সর্বাণী নেশন ফ্রান্স আমার কাম্য নয়; বরঞ্চ কর্মনিষ্ঠ ফ্রান্স,(২)-–কর্মনিষ্ঠ এবং আত্মমর্যাদাশীল ফ্রান্স। আমি প্রার্থনা করি ফ্রান্সবাসী যেন সুখী হয় সেইটেই সবচেয়ে বড় সত্য। তারা যেন শেখে জীবনে শিবকে আলিঙ্গন করতে।(৩)
আমার জন্য তোমরা কোনও চিন্তা কর না; জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি আমার সাহস ও সহজ রসবোধ (গুড হিউমার) বজায় রেখে যাব; আমি যাবার সময় সেই সাঁবর-এ-ম্যজ(৪) গানটি গেয়ে যাব, যেটি তুমি, আমার আদরের মা আমাকে শিখিয়েছিলে।
পিয়েরকে(৫) শাসনে রেখ কিন্তু স্নেহের সঙ্গে। আর লেখাপড়ার কাজ চেক আপ করে নিও এবং সে যেন ঠিকমতো খাটে(৬) তার ওপর জোর দিও। তাকে আলস্য-অবহেলা করতে দিও। আমি যেন তার শ্লাঘার পাত্র হই। সেপাইরা আসছে আমাকে নিয়ে যেতে। আমার হাতের লেখা হয়তো অল্প একটু কাঁপা-কাঁপা হয়ে গেল, তার কারণ পেনসিলটি বড় ছোট্ট; মৃত্যুভয় আমার আদৌ নেই; আমার আত্মা অত্যন্ত শান্ত।
বাবা, আমি তোমাকে অতিশয় অনুরোধ জানাই, প্রার্থনা করো। শুধু এই কথাটুকু বিবেচনা করো, এই যে আমি এখানে মরতে যাচ্ছি, সেটি আমাদের সক্কলের জন্য। এরচেয়ে শ্লাঘনীয় আমার কী মৃত্যু হতে পারত? আমি স্বেচ্ছায় পিতৃভূমির জন্য মৃত্যুবরণ করছি; স্বর্গভূমিতে আমাদের চারজনাতে(৭) ফের দেখা হবে। প্রতিহিংসাকামীদের মৃত্যুর পরও তাদের অনুগামী পাবে। বিদায় বিদায়! মৃত্যু আমাকে ডাকছে। আমার চোখে ফেটা বেঁধে আমাদের গুলি করবে সে আমি চাইনে, আমাকে হাতে-পায়ে বাধতেও হবে না। আমি তোমাকে সবাইকে আলিঙ্গন করি। তৎসত্ত্বেও কিন্তু বলি, বাধ্য হয়ে মরাটা কঠিন কাজ। সহস্র চুম্বন।
ফ্রান্স– জিন্দাবাদ!
ষোড়শ বসরে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত
এচ ফেরতে
হাতের লেখা আর ভুলচুকের জন্য মাফ চাইছি; আবার পড়ার সময় নেই।
পত্র-প্রেরক: আঁরি ফেরুতে, স্বর্গলোক, কেয়ার অব ভগবান।(৮)
———-
একাধিক পাঠক অনুযোগ করেছেন, অধমের রচনা ইদানীং বড্ডই টীকা কন্টকাকীর্ণ। আমার নিবেদন, টীকা না পড়লে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। যারা নিতান্ত একটু-আধটু আশকথা-পাশকথা জানতে চান কিংবা এই আক্রাগার বাজারে বই কিনেছেন বলে প্রতিটি পিঁপড়ে নিঙড়িয়ে নিঙড়িয়ে গুড় বের করতে চান– এ টীকা শুধু তাদের জন্য।
১. পিয়ের খুব সম্ভব পত্রলেখক আঁরির (Henri=Henry) ছোট ভাই। তাই পিয়েরকে তার ছোটখাটো পুস্তক সঞ্চয়ন দিয়ে যাচ্ছে।
২. ফ্রান্সে যুদ্ধ হবার পর অনেকেই বিশ্বাস করত, ফরাসিদের আলসেমিই তাদের ওই পরাজয়ের কারণ।
৩. শিবকে আলিঙ্গন- এটা মনে হচ্ছে, জর্মন কবি গ্যোটে থেকে উদ্ধৃত। পত্রলেখক আরি জর্মনদের হাতে নিহত হচ্ছে, অথচ সে বিশ্বপ্রেমিক বলে বিশ্বকবি– জর্মন-গ্যোটেকে উদ্ধৃত করছে।
৪. সাব এবং ম্য ফ্রান্সের দুই নদী। আমাদের যেরকম গঙ্গা-যমুনা। বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা তুলনীয়।
৫, এক নম্বর টীকা দ্রষ্টব্য।
৬. দুই নম্বর ও পাঁচ নম্বর দ্রষ্টব্য।
৭. স্বর্গে বাপ, মা, পিয়ের ও সে নিজে এই চারজন সম্মিলিত হবে আশা করছে।
৮. কনটিনেন্টে পত্রলেখককে তার ঠিকানা দিতে হয় (যেমন আমাদের ইনল্যান্ড-লেটার)। তাই আঁরি তার ঠিকানা দিয়েছে। এর থেকেই পাঠক বুঝতে পারবেন, সে যে গর্ব করেছে জীবনের শেষ মুহূর্ত অবধি (তার) হিউমার বজায় রেখে যাবে, সেটা কিছুমাত্র মিথ্যা দম্ভ নয়। কারণ এই-কটি শব্দই ইহজীবনে তার শেষ বাক্য।
যে-বই থেকে এই পত্রটি অনুবাদ করেছি তার নাম-ঠিকানা : Die Stimme des Menschen Briefe und Aufzeichnungen aus der ganzen Welt i 1939-1945 Gesam melt und herausgegeben von Hans Walter Baenl Piper Verlag, 1961, Muenchen.
.
০২.
এবারে একজন জাপানির চিঠি তুলে দিচ্ছি :
জিরুকু ইওয়াগায়া (Jinoku lwagaya), শিক্ষক, জন্ম ১৯২৩ সালে। ১৯৪৪ সালে ফিলিপাইন যাবার সময় যুদ্ধজাহাজডুবিতে সলিলসমাধি।
শিজুয়োকা, ১২ জুন ১৯৪৩
বুগাভিস(১) দ্বীপের কাছে যে নৌযুদ্ধ হয়ে গেল তার খবর আজ কাগজে বেরিয়েছে। প্রকাশ, একখানা বিরাট সৈন্যবাহী জাহাজ গুরুতরভাবে জখম হয়েছে ও একখানা জঙ্গি-জাহাজ সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়েছে। এভাবে মানুষ কেন সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়ে অতলে লীন হবে? জাপানিরা মারা গেলে শুধু জাপানিরাই, বিদেশিরা মারা গেলে শুধু বিদেশিরাই অবর্ষণ করে কেন? মানুষ শুধুমাত্র মানুষ হিসেবে সম্মিলিত হয়ে অবর্ষণ করে না কেন, আনন্দের সময় সম্মিলিতভাবে আনন্দ প্রকাশ করে না কেন? এ তত্ত্বটি যে কোনও শান্তিকামী জনের চিত্র আলোড়িত করবে। যেহেতু একটা বিদেশি মরেছে অতএব জাপানিরা বেশ পরিতৃপ্ত। এটা আমার কাছে চিরকাল অবোধ্য থেকে যাবে। তিন দিন চার দিন ধরে একটা লোক সমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে শেষটায় অবসন্ন হয়ে জলে ডুবে গেল এটা কী নিদারুশ! মৃত্যুর সঙ্গে আমার যদি সমুদ্রে কখনও দেখা হয় তবে কি আমি তাকে সজ্ঞানে চিনতে পারব?
৩ মার্চ ১৯৪৪
বিদায় নেবার পূর্বে আমি ক্লাসের ছেলেদের দিয়ে তাজিমামরি(২) গানটি গাওয়ালুম। আমি জানি না কেন, শুনে আমার বড় আনন্দ হল। এ গানটি আমি কখনওই ভুলব না; এটি আমাকে সবসময়ই স্মরণ করিয়ে দেবে যে আমি শিক্ষক ছিলুম।
মার্চ ১৯৪৪
আমি যুদ্ধে চললুম, কিন্তু আমি যুদ্ধ চাইনি। হয়তো আমার এ কথাটা কেউই বুঝবে না। কিন্তু কোনও মানুষকে হত্যা করার জন্য আমি কোনও তাগিদ অনুভব করি না। আমার মনে হয়, আমাকে যেন একটা দ টেনে নিয়ে ডুবিয়ে দিচ্ছে।
একাধিক জাতের বিশ্বাস এবং তারা যুদ্ধের সময় প্রোপাগান্ডা করে যে, জাপানিমাত্রই যুদ্ধের জন্য হামেহাল মারমুখো। এ চিঠি পড়ে পাঠক বুঝতে পারবেন, কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। এ ধরনের আরও চিঠি আছে। স্থানাভাবে তার অল্পাংশও তুলে দেওয়া সম্ভব নয়। আমার উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন দেশের, ভিন্ন ভিন্ন টাইপের চিঠি অনুবাদ মারফত বহুবিধ মানবের চিন্তাধারা, হৃদয়ানুভূতি এবং তৎসত্ত্বেও সেগুলো সর্বজনীন– এগুলোর সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
যুগোস্লাভিয়ার জনৈক নাম-না-জানা সৈনিক,
অজাত শিশুর প্রতি পত্র,
(যুদ্ধের সময়ে)
হে আমার সন্তান, এখনও তুমি অন্ধকারে ঘুমুচ্ছ এবং ভূমিষ্ঠ হবার জন্য শক্তি সঞ্চয় করছ; আমি তোমার সর্বমঙ্গল কামনা করি। তুমি এখনও তোমার প্রকৃত রূপ (Gestalt) পাওনি; তুমি এখনও শ্বাসগ্রহণ করছ না; তুমি এখনও অন্ধ। তবু, যখন তোমার সে লগ্ন আসবে, তোমার এবং তোমার মাতার সে লগ্ন আসবে (তোমার সে মাতাকে আমি সর্বহৃদয় দিয়ে ভালোবাসি) তখন তুমি বাতাস এবং আলো পাবার জন্য সংগ্রাম করার মতো শক্তিও পাবে। আলোকের জন্য অক্লান্ত সগ্রাম করার অধিকার তোমার ন্যায্য প্রাপ্য। সেই কারণেই তুমি নারীদেহ থেকে শিশুরূপে জন্মগ্রহণ করবে, অবশ্যই তুমি প্রকৃত কারণ না জেনেই জন্মগ্রহণ করবে।
বেঁচে থাকতে যে আনন্দ আছে সেটাকে তুমি রক্ষা কর, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুভয় ঝেটিয়ে বিদায় করে দিও। এই যে জীবন- এটাকে ভালোবাসা উচিত, নইলে এটা বৃথাই নষ্ট হয়, কিন্তু এটাকে মাত্রাধিক ভালোবাসা উচিত নয়।
নতুন নতুন জ্ঞান সঞ্চয়ের জন্য হৃদয় সর্বদা উন্মুক্ত রেখ; মিথ্যাকে ঘৃণা করার জন্য হৃদয় প্রস্তুত রেখ; অশিবকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বর্জন করার মতো শক্তি সর্বধা হৃদয়ে ধারণ কর। আমি জানি, আমাকে এখন মরতে হবে, এবং তোমাকে জন্মগ্রহণ করতে হবে এবং আমার। যতসব ভুলত্রুটির জঞ্জালের উপর তোমাকে দাঁড়াতে হবে। আমাকে ক্ষমা করো। আমি নিজের কাছে নিজে লজ্জিত যে তোমাকে এই অরাজক আরামহীন সংসারের পিছনে রেখে চলে যাচ্ছি। কিন্তু এছাড়া তো কোনও গতি নেই। আমি কল্পনায় তোমার কপালে চুম্বন রাখছি- শেষবারের মতো তোমাকে আশীর্বাদ জানাবার জন্য। গুনাইট, বাছা আমার গুড় মরনিং এবং শুভ প্রভাতে তুমি জাগ্রত হও।
মিসাক মানুচিয়ান, তুরস্ক
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে আদি-ইয়মনে (তুর্কি– আরমেনিয়ায়) জন্ম; ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪-এ প্যারিসে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪ [প্যারিস]
(আমার মৃত্যুর পর) যারা বেঁচে থাকবেন তারাই ধন্য, কারণ তারা মধুর স্বাধীনতা উপভোগ করবেন। আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই যে ফরাসি জাতি এবং অন্যান্য স্বাধীনতা যুদ্ধের সংগ্রামী আমাদের স্মৃতিকে যথোপযুক্ত সম্মান দেবে। মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমি পরিষ্কার ভাষায় বলছি, আমি জর্মন জাতের প্রতি কোনও ঘৃণা অনুভব করি না… প্রত্যেক মানুষ তার কর্মফল অনুযায়ী তিরস্কার পাবে। জর্মন ও অন্যান্য জাত যুদ্ধশেষে শান্তিতে, ভ্ৰাতৃভাবে জীবনধারণ করবে; এ যুদ্ধ শেষ হতে আর বিলম্ব নেই। বিশ্বজন সুখী হোক।
গভীর বেদনা অনুভব করি আমি যে, আমি তোমাকে সুখী করতে পারিনি। আমি চেয়েছিলুম, তুমি আমাকে একটি সন্তান দেবে, এবং তুমিও সবসময় তাই চেয়েছিলে। তোমার প্রতি তাই আমার অনুরোধ, আমার শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্য যুদ্ধের পর তুমি অতি-অবশ্য পুনরায় পরিণয় করে সন্তান লাভ করবে।
আজ রোদ উঠেছে। এরকম দৃশ্য আর সুন্দর প্রকৃতির পানে তাকিয়ে আমি তোমাকে নিত্যদিন কতই না ভালোবেসেছি। তাই বিদায় বিদায়! বিদায় নিচ্ছি এ জীবনের কাছ থেকে, তোমাদের সকলের কাছ থেকে, আমার প্রিয়াপেক্ষা প্রিয়তমা পত্নীর থেকে, এবং আমার ভালোবাসার বন্ধুজনের কাছ থেকে। আমি তোমাকে নিবিড় আলিঙ্গন করছি, তোমার ছোট বোনকেও এবং দূরের এবং নিকটের পরিচিত সব বন্ধুজনকে।
———–
১. সলমন দ্বীপপুঞ্জের বৃহত্তম দ্বীপ অস্ট্রেলিয়ার অধীনে।
২. তাজিমামরি গীতটি আমি জোগাড় করতে পারিনি কোনও গুণীন পাঠক যদি সেটি সংগ্রহ করে অনুবাদসহ প্রকাশক মহাশয়কে পাঠান তবে লেখক তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।
.
০৩.
একথা অনেকের কাছেই অবিদিত নয় যে, প্রাচ্যে মাতার প্রতি বয়স্ক পুত্রের যতখানি টান থাকে, পশ্চিমে বিশেষ করে ফ্রান্স জর্মনি ইংলন্ড প্রভৃতি দেশে পুত্রের টান তার চেয়ে অনেক কম। এসব দেশের কবিরা মাতার উদ্দেশে কবিতা রচেছেন অত্যল্পই। তার একটা কারণ বোধহয় এরা বিয়ে করে মার সঙ্গে বাস করে না–বউ নিয়ে আলাদা সংসার পাতে। আমাদের বড় এবং মাঝারি শহরেও এ রীতি কিছুটা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে।
তা সে যাই হোক, যুদ্ধের সময় অনেক সৈন্যই মাতাকে বার বার স্মরণ করে। হৃদয় খুলে তার সব কথা জানায়। তাই যুদ্ধের সময় ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে লেখা চিঠিতে পাঠক মানব-হৃদয়ের নতুন নতুন মর্মস্পর্শী পরিচয় পাবেন।
যুদ্ধ তার রুদ্রতম নিকটতম বদন দেখায় সিভিল উয়োর বা ভ্রাতযুদ্ধের সময় এবং আশ্চর্য সেসময় মানুষের করুণাধারাও যে কীরকম উছলে পড়ে সেটা বহু চিঠিতে বহুভাবে প্রকাশ পায়।
গত বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ইতালিতে ভ্রাতৃযুদ্ধ চলেছে। এ চিঠিটা সে সময়কার।
রবেতো নানিঃ ইতালি, বলনা স্কুলের ছাত্র।
জন্ম ১৯২৮। প্যারাশুট থেকে ভূপৃষ্ঠে সংঘর্ষে ২৮ মার্চ ১৯৪৫(১) সালে নিহত।
২১ জানুয়ারি ১৯৪৫
(মাতাকে লিখিত)
আজ এই প্রথম ইউনিফর্ম পরে গিঞ্জের উপাসনায় আমি যোগ দিয়েছিলুম।(২) আর বিশ্বাস কর মা আমার হৃদয় কী অনুভূতিতেই না ভরে উঠেছিল। ছেলেবেলায় তুমি যে আমাকে সঙ্গে করে গিঞ্জেয় নিয়ে যেতে সে-সময়কার কথা ভাবছিলুম। আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, যত দিন যায় মানুষের বয়স বাড়ে বটে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হৃদয়ের গভীরে সে ছেলেমানুষই থেকে যায়। আমরা সমবেত কণ্ঠে অসংখ্য জনের প্রার্থনা গীতি গাইবার সময় যখন পুণ্যময়ী মাতার নাম এল তখন শুধু যে আমারই দু চোখ জলে ভিজে গেল তাই নয়, আমার বন্ধুদেরও তাই হল। তোমার কাছ থেকে চিঠি পাবার যে সুযোগ সুবিধা ও আনন্দ পাবার অধিকার আমার আছে তার মূল্য আমি তখন বুঝতে পারলুম কারণ আমার বহু সাথীর পরিবারবর্গ শক্র-অধিকৃত এলাকায় আছে বলে তারা কোনও চিঠি পায় না।
আমার বিশ্বাস, যে নাম মানুষ বিপদের মুখোমুখি হলে সঙ্গে সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ডেকে ওঠে সে নাম মা।
শত্রুপক্ষের যাকে আমি দুবাহুতে করে ফার্স্ট এডের ঘাঁটিতে নিয়ে যাচ্ছিলুম সে চেঁচিয়ে ডেকেছিল মা। যেতে যেতে তার মনের মধ্যে শুধু ছিল একটিমাত্র চিন্তা : তার মা। কাতর হয়ে আমাকে শুধোচ্ছিল, আমরা তার মাকে কিছু করিনি তো? আমি যতই না বলছিলুম সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। আমাকে মিনতি জানাচ্ছিল আমি যেন সদা আমার মাকে অবশ্য অরণে রাখি, তোমার সম্বন্ধে খবর জানতে অনুরোধ করছিল, জিগ্যেস করছিল আমি তোমার কাছ থেকে চিঠি পাই কি না, তোমার কোনও ফটো আমার কাছে আছে কি না, কারণ তার আপন মায়ের কোনও ছবি তার কাছে ছিল না এবং তাই তোমার ফটোতে সে তার আপন মায়ের ছবিও দেখতে চেয়েছিল।
৮ সেপ্টেম্বর(৩) নিয়ে যারা অবহেলার সঙ্গে আলোচনা করে কণামাত্র জানে না ওইদিন আমাদের পিতৃভূমির জন্য কী দুর্ভাগ্য আর পরিপূর্ণ বিনাশ নিয়ে এসেছে। তারা যদি আমি যা এইমাত্র বর্ণনা করলুম সে দৃশ্যের সম্মুখে থাকত! কারণ, বুঝলে মা, যে লোকটাকে আমি গুলি করে আহত করতে বাধ্য হয়েছিলুম, যাতে করে সে আমার উপর আগেই গুলি না করতে পারে; সে আর আমি তো একই ভাষাতে কথা বলি, এবং মা বলে সে ডেকে উঠেছিল, এই এখন আমি তোমাকে যে নাম ধরে ডাকছি…
এবারে একটি কবিতার গদ্যানুবাদ
আমি হামজা : মালয়, রাজপরিবারজাত কবি।
জন্ম ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯১১, সুমাত্রায়। যুদ্ধাবসানের অরাজকতার সময় ১৯৪৬ সালে সুমাত্রায় নিহত।
(প্রিয়মিলন তৃষ্ণা)
কী মধুর! হে সমারোহময় মেঘরাশির শোভাযাত্রা
তুমি ঢেকে নিয়েছ সুনীল আকাশের নীলাঞ্জন।
দাঁড়াও ক্ষণেক তরে এই কুটিরের ’পরে
দূরের প্রবাসী তিয়াসী এক পথিকের কুটিরের ’পরে—
এক লহমার তরে, এক পলকের তরে
আমি তোমাকে শুধু শুধদতে চাই,
তোমাকে হে মেঘ তোমাকে শুধোতে চাই
তুমি কোন দিকে যাবে মনস্থির করেছ?
কোন দেশে গিয়ে তুমি দাঁড়াবে?
হে মেঘ, আমার প্রিয়ার কাছে নিয়ে যাও আমার বিরহ ব্যথা
তাকে কানে কানে বলো আমার বিরহ বেদনা
তার তরুণ সোনালি হাঁটু দুটিকে তুমি আলিঙ্গন করো,
যেন আমি নিজে সে দুটিকে আলিঙ্গন করছি।
এ কবিতা তো আমাদের বহুদিনকার চেনা কবিতা!!
———-
১. এর ঠিক এক মাস পরে ইতালিতে যুদ্ধের অবসান হয়। তাই বলে দুঃখ হয় যে সতেরো বছরের ছেলেটির মা যখনই একথাটা ভাববে তখনই তার শোক কত না গম্ভীর হবে।
২. জর্মন ইতালির ফ্যাসি সম্প্রদায় সৈন্যদের উর্দি পরে গিঞ্জে যাওয়াটা পছন্দ করত না। তারা গির্জেকে রাষ্ট্রের শত্রুভাবে দেখত এবং উর্দি না পরে গির্জে যাওয়াটাও অতি কষ্টে বরদাস্ত করত।
৩, ওইদিনই প্রথম খবর প্রকাশ পায়, ইতালির রাজা তার মিত্রশক্তি জনিকে ত্যাগ করে মার্কিন-ইংরেজের সঙ্গে সন্ধি করে ফেলেছেন, ফলে দেশে ভ্রাতৃযুদ্ধ আরম্ভ হয়। যে সৈন্য আহত হয় সে ছিল পার্টিজান দলের। (বর্তমান লেখকের ভেন্দেত্তা দ্রষ্টব্য)।
.
০৪.
ইভান লাকফ : বুলগারিয়া।
জন্ম দ্রিয়ানভো-তে ১ জানুয়ারি ১৯১৫। মৃত্যু ২২ নভেম্বর ১৯৪৩, বুলগারিয়ার পুলিশ কর্তৃক নিহত।
২১ নভেম্বর ১৯৪৩
যে একটিমাত্র বাসনা আমার আছে সেটি বেঁচে থাকার। তোমার খাস চেপে ধরে বন্ধু করে দিল, তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল, ধীরে ধীরে তোমার চৈতন্য লোপ পেল; গারদের কুটুরি আরও ছোট হয়ে গেল, এ কুটুরিতে কখনও বাতাস ঢোকে না। তৎসত্ত্বেও বেঁচে থাকবার জন্য কী অদম্য স্পৃহা!
আর আমার ছোট ছেলেটি! এখন থেকেই সে আমার অভাব অনুভব করতে আরম্ভ করে দিয়েছে। যে কথাগুলো সে আমায় বলেছিল সেগুলো এখনও আমার মনকে চঞ্চল করে তোলে : বাবা, তুমি যখন ফিরে আসবে তখন আমার জন্য একটা ট্রাম-লাইন কিনে দেবে আর ছোট একটি গাড়ি, আর একজোড়া জুতো!
আমার পুত্র আমার অনুপস্থিতি অনুভব করে। আমার আদরসোহাগ সে কামনা করে, আমার কথা ভেবে সে ব্যাকুল হয়। আমি যখন তাকে বললুম, এরা আমাকে তোর কাছে যেতে দেয় না, তখন সে আমাকে বলল, তুমি যে আমার কাছে আসতে চাও না, তার মানে তুমি আমাকে ভালোবাসো না– না বাবা? শিশুসন্তানের এ কী সরল ভালোবাসা, তার আত্মাটি কত না বিরাট ভালোবাসা ধরতে জানে!
কিন্তু এই এরা যারা আমাদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলেন, এদের কি তবে শিশুসন্তান নেই? এঁরা কি নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন না, অন্যের প্রতি কি এদের কোনও সমবেদনা নেই? অতি অবশ্যই সর্বদাই এরা কোনও কিছু দিয়ে নিজের মনকে বোঝাতে জানেন। যখন তাদের উচিত আমাদের মৃত্যুর চরম দণ্ডাদেশ না দিয়ে লঘুতর দণ্ড দেওয়া অন্যসব কারণ বাদ দিয়ে হোক না সে শুধু আমাদের শিশুসন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে তখন তারা বলেন, শাসনদণ্ডের আইন সে অনুমতি দেয় না। এ কী মূর্খতা। কিন্তু বোধহয় এঁরা আপন শিশুসন্তানের প্রতি আমাদের মতো এ গভীর ভালোবাসা পোষণ করেননি। কারণ তাই যদি হত তবে তাদের আচরণ অন্য রকমের হত। আমার এখনও স্মরণে আসছে জেনারেল কচো স্টয়ানফের কথা আমাকে কী বলেছিলেন : বিচারকেরা সন্তানদের কথা স্মরণ রাখেন। কিন্তু আমি এখনও বুঝতে পারছিনে, হয়তো কখনওই বুঝতে পারব না, তাই যদি হবে, সন্তানদের কথা যদি তারা স্মরণে রাখেন তবে এরকম দণ্ডাদেশ দেন কী প্রকারে?
রাষ্ট্র শক্তিমান এবং রাষ্ট্র কাউকে পরোয়া করে না (ডিফাই)। কিন্তু তাই যদি হবে তবে এরা আমাকে গুলি করে মারছে কেন?
২১ নভেম্বর ১৯৪৩
পুত্রকে–
আমি জানি পিতৃহীন হয়ে তোমার জীবনধারণ কঠিন হবে এবং তোমাকে অনেক দুঃখ-যন্ত্রণা সইতে হবে। কিন্তু যে সমাজতন্ত্রের জন্যে আমি এ জীবন আহুতি দিচ্ছি সে ব্যবস্থা আসবে(১) এবং তোমাদের জীবনযাপনের জন্য মহত্তর পরিবেশ সৃষ্টি করবে।
তুমিও সংগ্রামী হও এবং ন্যায়ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হও। তোমার মাকে ভালোবাসবে, হে প্রিয়পুত্র। জীবনের বিপদ-আপদে তিনি তোমাকে রক্ষা করবেন।
বুলগারিয়ার রাজনৈতিক পটভূমি বড়ই জটিল। পাঁচশো বৎসর তুর্কদের কবলে পরাধীনতার পর বুলগারিয়া ১৮৭২-এ রুশদের সাহায্যে স্বাধীনতা পায়, কিন্তু গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরম্ভে বুলগারিয়ার জনসাধারণ ছিল রুশ-মিত্র, পক্ষান্তরে রাজা বরিস ও তার ফৌজি অফিসাররা ছিলেন হিটলার-প্রেমী। কারণ এই রাজ্যবিস্তার লোভী দলকে হিটলার অনেক লোভ দেখিয়ে হাত করেন এবং প্রকৃতপক্ষে সেখানে তাঁরই চেলাচামুণ্ডারা বুলগার অফিসারদের সাহায্যে নৃশংসভাবে রাজত্ব চালাত। পত্রলেখক স্পষ্টত নাৎসিবৈরী জনসাধারণের অন্যতম ও নাৎসিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য মৃত্যুবরণ করেন।
জনৈক জর্মন সৈন্যদ্বারা লিখিত :
হেরবেরট ডুকস্টাইন : জর্মনি।
জন্ম ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯০৯ মাগডেবুরগ।
মৃত্যু ২ জুন, ১৯৪৪, যো আনিনা, গ্রিস-এ যুদ্ধে নিহত।
গ্রীষ্ম ১৯৪৪
ডিটমার বা মণিকা– আমার অজাত সন্তান!
যাত্রা এখনও আরম্ভ হয়নি তোমার যাত্রা আমার যাত্রা কারওরই না। সেই বিরাট ঘটনার প্রাক্কালে আমরা উভয়েই প্রতীক্ষমাণ, তুমি তোমার তোমার জন্মগ্রহণ করার, আর আমি আমার যুদ্ধ এবং কাল-ঘূর্ণাবর্ত আমাকে যেখানে টেনে নিয়ে যাবে। সেইহেতু এ পত্র প্রধানত তোমার মায়ের উদ্দেশে লেখা- যে মাতা তার আপন দেহ দিয়ে তোমার আমার মধ্যে সংযোগ স্থাপনা করেছেন। আমি তোমাকে ভালোবাসি যতদিন তোমার হৃৎপিণ্ড স্পন্দন তোমাকে নিয়তি-নির্দিষ্ট যে পথে যেতে হবে সে পথ দেখিয়ে দিয়ে যায়।
আমার হৃদয় সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে, যতখানি শক্তি সে ধরে– কিন্তু হায়, সে শক্তি বুঝিবা তার নেই যে তোমার বিরাট অভিযানের প্রথম পদক্ষেপগুলো দেখা যাবে শুভেচ্ছা জানায় তোমার মাতাকে ইহসংসারে তোমার সর্বশ্রেয়া যিনি এবং তোমাকে–
— এখনও যার সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়নি, তোমার পিতা।
হস্য হসিআও-হসিঅ্যান, চীন।
১৯৪৩-এ যুদ্ধে নিহত।
(একটি ক্ষুদ্র কবিতা)
সংঘ-প্রাচীরের পিছনে
আমাদের বন্ধুত্ব হল নিবিড়তর।
আমরা বিরাট বিরাট যত সব প্ল্যান করলুম
আমাদের আদর্শ আকাঙ্ক্ষা ছিল সুদূরব্যাপী…
কিন্তু বিদায়ের সময় শুধু নাড়লাম মাথা–
একটি মাত্র কথা না বলে একে অন্যের দিকে।
কেননা সেনাবাহিনী তখন এসে দাঁড়িয়েছে
প্রাচীর দুর্গতোরণের সম্মুখে ॥
———–
১. কিন্তু পত্ৰলেখকের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়েছিল। এর ঠিক এক বত্সর পর বিজয়ী রুশ সেনা নাৎসিদের বিতাড়িত করে বুলগারিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করে। ওই সময় বিস্তর নাসিমিত্র নবীন রাষ্ট্র কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়। আশা করি, পত্রলেখক যে কামনা করেছিলেন এবারে সেটা পূর্ণ হয়েছিল অর্থাৎ নবীন রাষ্ট্র পত্রলেখক বৈরী-নাসিমিত্রদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার পূর্বে তাদের শিশুসন্তানদের কথা ভেবেছিল।
.
০৫.
যুদ্ধের সময় মাতারাই যে তাদের সন্তান হারিয়েছে তাই নয়, শিশুও মাকে হারিয়েছে– বিশেষ করে গত যুদ্ধের সময়। তাই এ যুদ্ধে মাকে লেখা মেয়ের চিঠিও আছে।
হিটলার গদিতে বসার আগে থেকেই তাঁর শক্র কম্যুনিস্ট ও সোশ্যালিস্টরা তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে এবং গোপনে সগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। যারা ধরা পড়েন তাদের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে বিচারের নামে পরিহাস করা হত বটে, কিন্তু অধিকাংশকেই বিনা-বিচারে কনট্রেশন ক্যামূপে বন্ধ করে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হত।
যুদ্ধ না লাগলে হয়তো হিমলার হিটলার এদের অনেককে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করতেন না। কিন্তু হিটলার রুশ-রণাঙ্গনে যতই হারতে লাগলেন ততই তার নিষ্ঠুরতা জিঘাংসা উত্তেজিত হতে লাগল– এই বিদ্রোহী পক্ষের প্রতি। হিটলার তখন স্ত্রী-পুরুষে আর কোনও পার্থক্য রাখলেন না। এমনকি নবজাত শিশুর মাতাও তার বর্বরতা থেকে নিষ্কৃতি পেল না।
১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্বামী হানস কপপিসহ স্ত্রী হিলডে কপি গ্রেপ্তার হন। এঁরা দুজনেই হিটলারের বিরুদ্ধে সক্রিয় সোশ্যালিস্ট ছিলেন। কারাগারে হিডে একটি শিশুপুত্রের জন্ম দেন। পিতা নামেই এই শিক্ম নামকরণ করা হয় হাস–এ রেওয়াজ পৃথিবীর বহু দেশে আছে। ছোট হাসের ভূমিষ্ঠ হওয়ার এক মাস পর পিতা বড় হানকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়, এবং মাতা হিডেকে আট মাস পরে ১৯৪৩ সালের ৫ আগস্ট। তখন তার বয়স ৩৪।
মাতাকে লেখা কন্যার পত্র
আমার মা, গভীরতম ভালোবাসার মা-মণি,
সময় প্রায় এসে গিয়েছে যখন আমাদের একে অন্যের কাছ থেকে চিরতরে বিদায় নিতে হবে। এর ভিতর কঠিনতম ছিল আমার ছোট হানমের কাছ থেকে চিরবিদায় নেওয়া– সেটা হয়ে গিয়েছে। সে আমাকে কী আনন্দই না দিয়েছে! আমি জানি, সে তোমার মেহনিষ্ঠ মাতৃহস্তে অতি উত্তম রক্ষণাবেক্ষণ পাবে এবং আমার তরে মা-মণি- প্রতিজ্ঞা কর তুমি সাহসে বুক বাঁধবে। আমি জানি, তোমার বুকে বাজছে, এই বুঝি তোমার হৃদয় ভেঙে পড়বে, কিন্তু তুমি নিজেকে শক্ত করে নিজের হাতে চেপে ধর–খুব শক্ত করে। তুমি ঠিক পারবে–তুমি তো কঠিনতম বাধাবিঘ্নের সামনে সর্বদাই জয়ী হয়েছ– এবারেও পারবে না মা? তোমার কথা যতই ভাবি, তোমাকে যে নির্মম বেদনা আমি দিতে যাচ্ছি সেই কথা– এটাই আমার কাছে সবকিছুর চাইতে অসহনীয়– এই ভাবনা যে, জীবনের যে বয়সে আমাকে দিয়ে তোমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তখনই আমায় ছেড়ে যেতে হচ্ছে তোমাকে। তুমি কি কখনও কোনওদিন আমাকে ক্ষমা করতে পারবে? তুমি তো জান মা, আমার যখন বয়স কম ছিল– অনেকরাত্রে ঘুম আসত না– তখন যে-চিন্তা আমার মনকে সজীব করে তুলত সেটা–আমি যেন তোমার আগে ও-পারে যেতে পাই। এবং তার পরবর্তীকালে আমার মাত্র একটি আকাঙ্ক্ষা ছিল; সে আকাক্ষা দিবারাত্র, জানা-অজানায় আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকত– এ সংসারে একটি সন্তান না এনে কিছুতেই আমি মরব না। তা হলে দেখ মা, আমার এই দুই মহান কামনা এবং তাই দিয়ে আমার জীবন পরিপূর্ণ সফলতা পেয়েছে। এখন আমি যাচ্ছি আমার বড় হানসের মিলনে। ছোট হান– আমি আশা ধরি আমাদের দুজনার ভিতর যা ছিল ভালো, সেইটে পেয়েছে। এবং যখনই তুমি তাকে তোমার বুকে চেপে ধরবে, তোমার এই শিশুটি সর্বদাই তোমাকে সঙ্গ দেবে আমার চেয়ে বেশি, আমি তো আর কখনও তোমার অত কাছে আসতে পারব না। ছোট হাস্- আমার আশা যেন সুদৃঢ় শক্তিশালী হয়, সে যেন মুক্তহৃদয় হয়, দরদী সেবাশীল হৃদয় ধরে এবং তার বাপের অকলঙ্ক চরিত্র পায়। আমরা একে অন্যকে নিবিড়, বড় নিবিড়ভাবে ভালোবেসেছিলুম। প্রেমই আমাদের সর্বকৰ্ম নিয়ন্ত্রিত করেছিল।
শক্তি দিয়ে যুঝে যেবা দেহ করে দান,
প্রভু রাখে তার তরে মহান নির্বাণ—
মা আমার, আমার অদ্বিতীয় কল্যাণী মা, আর আমার ছোট হান, আমার সর্ব ভালোবাসা সর্বকাল তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকবে; সাহস ধর–আমি যেরকম সাহস রাখব বলে দৃঢ়প্রত্যয়। —-নিত্যকালের
তোমার মেয়ে হিলডে
মাতাকে নিহত করে যারা শিওকে মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত করে তাদের কী নাম দিয়ে ডাকি? হিটলার সর্বদাই ইহুদি বেদের পরিচয় দিতেন তাদের Untemensch= Undermen নাম দিয়ে অর্থাৎ মানুষ যে স্তরে আছে ইহুদি বেদে তাদের নিচের স্তরে। তাই তাদের গ্যাসচেম্বারে পুরে মারা হয়। অথচ আমার যেটুকু অভিজ্ঞতা তার থেকে বলতে পারি, এই দুই জাতই মাতা মাত্রকেই অবর্ণনীয় অসাধারণ প্রীতিম্নেহের চোখে দেখে। এইবারে পাঠক চিন্তা করুন Untermensch পদবি ধরার হক সবচেয়ে বেশি কার?
মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিই যে হিলডের যে দুটি চরম কামনা ছিল সে-দুটি পূর্ণ।
আর সান্ত্বনা দিই যে তাকে দীর্ঘকাল বৈধব্যশোক সইতে হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন ওই-কটি মাসই তার কী করে কেটেছে? আর ওই-কটি মাসেই তার পিতা বড় হানস কী গর্ব, কী বেদনাই না অনুভব করেছিল।
আর সান্ত্বনা দিই এই ভেবে যে মাত্র ন মাসের শিশু মাতৃবিচ্ছেদের শোক হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। কিন্তু প্রশ্ন, সে যে মাতৃদুগ্ধ না খেয়ে অন্য দুগ্ধ খাচ্ছে সেটা কি সে ইন্সটিক্ট দিয়ে (অনুভূতি-জাত সরাসরি জ্ঞান) বুঝতে পেরেছিল।
মনকে যতই চোখের ঠার মারি না কেন, যতই সান্ত্বনা খুঁজি না কেন, এ চিঠি গিলতে গিয়ে আমাদের সর্ব বুদ্ধি বিবেচনা সর্ব অনুভূতি চেতনা অসাড় হয়ে যায়।
এই পুণ্যশ্লোকা প্রাতঃস্মরণীয় কন্যা মৈত্রেয়ীর অনুজা। তিনি অমৃতের সন্ধানে ইহবৈভব ত্যাগ করেছিলেন (যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহমং তেন কুর্যাম)। ইনি মাতা ত্যাগ পুত্র ত্যাগ করলেন সত্যশিবের সন্ধানে।
এই অতিশয় অসাধারণ পত্রের পর অন্যের পত্র কি পাঠকের মনে সাড়া জাগাবে? কি আমি তো কোনও ক্লাইম্যাক্স সৃষ্টি করার জন্য চিঠিগুলো বাছাই করে করে ফুলের তোড়া সাজাচ্ছি না। যেমন যেমন পড়ে যাচ্ছি সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো আমার হৃদয় স্পর্শ করছে সেগুলো অনুবাদ করে দিচ্ছি এবং আমি বাঙালি বলে আশা করছি বাঙালি হৃদয়ও এগুলো গ্রহণ করবে।
তাই চীন দেশের একটি কবিতা।
বাচ্চাটির বয়স যখন পাঁচ তখন তার বাপ যুদ্ধে মারা যায়। এবং তাকেও কৈশোরে পৌঁছতে না পৌঁছতেই যুদ্ধে যেতে হল। কবিতাটি ঈষৎ মডার্ন স্টাইলে ফ্লাশ-ব্যাক করে রচিত। মডার্নদের বুঝতে কোনও অসুবিধা হবে না, ভূমিকা হিসেবে উপরের দুটি ছত্র লিখতে বাধ্য হলুম প্রাচীনপন্থী পাঠকদের জন্য।
য়েন যুই : চীন।
যুদ্ধের সময় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে আহত, তারই ফলে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু।
(সমরাঙ্গনের পুরোভূমিতে তরুণ)
এ তো একফোঁটা ছেলেমাত্র আর এরি মধ্যে যুদ্ধ।
হিম্মতে সে ভরপুর তবু হৃদয় থেকে যেন রক্ত ঝরছে।
তার বয়স তখন মাত্র পাঁচটি হেমন্ত– যখন বাপ যুদ্ধে মারা গেল।
বাড়ি দৈন্যে ঢাকা পড়ল, খাদ্য বস্ত্র খেলনা নেই।
ছেলেটির বয়স ক্ৰমে চোদ্দ হল, তাকেও যুদ্ধে নিয়ে গেল।
দুঃখ-বেদনায় মাতৃহৃদয় খণ্ড খণ্ড হয়ে গেল।
সমস্ত গ্রীষ্মকাল জুড়ে চলল রক্তপাত আর বহ্নি-দাহনের তাণ্ডব,
ছেলের সংবাদ– সে কোন সুদূরে মরে গেছে না জয়ী হবে।
তখন বিদায় নেবার সময় হায় রে নিষ্ঠুর নিয়তি
ছেলেটি জামাকাপড় পরেছিল বাচ্চাদের মতন তখনও।
তার পর সে বাড়ি ফিরল– বাপেরই মতো হয়েছে লম্বা
মায়ের চোখের দিকে তাকাল, মায়ের কোলে লুটিয়ে পড়ল।
চোখের জল ঝরে পড়ে মায়ের কাপড় দিলে ভিজিয়ে
অতীত কি কেউ কখনও ভুলতে পারে?
বাপ যা চেয়েছিল ছেলেকে সেটা এগিয়ে নিয়ে যেতে হল
আবার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে হল একটি কথাও বলেনি সে—
.
০৬.
জাঁদরেল থেকে জোয়ান –তা তিনি জর্মন হন বা ফিনই– বস্তৃত যারাই রুশদের বিরুদ্ধে লড়েছে তারা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছে কষ্টসহিষ্ণুতা আর দার্টে রুশ সৈন্যের জুড়ি নেই। যে অবস্থায় অন্য যে কোনও দেশের সৈন্য ভেঙে পড়বে– বোধহয় একমাত্র জাপানি ছাড়া সেখানে রুশ জোয়ান খানিকক্ষণ ঘাড় চুলকোবে কোনও কিছু ঠিক ঠিক ঠাহর করতে তার বেশ একটু সময় লাগে তার পর এক হাতের তেলোতে আর এক হাত দিয়ে যেন অদৃশ্য ধুলো ঝাড়ছে ওই মুদ্রাটি এঁকে বলবে নিচ্ছিভো। ইট ইজ নাথিং, ডাজুনট ম্যাটার-এর দূরের অনুবাদ। কুছ পরোয়া নহি কই বাত নহি তবু অনেক কাছের অনুবাদ।
কিন্তু দার্ঢ্য– ওইটেই আসল কথা। কিন্তু ওইটেই কি শেষ কথা?
(কবিতা)
সেমেন গোদসেন্কো : সোভিয়েত ইউনিয়ন।
জন্ম ১৯২২। মে ১৯৪২-এর যুদ্ধে আহত হওয়ার ফলে ১৯৫৩ সালে মৃত্যু।
কুড়িটি বচ্ছর আমাদের বয়স বল,
তার পর এই যুদ্ধের বৎসরে,
সর্বপ্রথম আমরা দেখলুম রক্ত, দেখলুম মৃত্যু
সরল, সোজাসুজি, মানুষ যেরকম স্বপ্ন দেখে অক্লেশে।
আমার স্মৃতিপট থেকে কিছুই মুছে যাবে না,
যুদ্ধে প্রথম মৃত জনের সঙ্গে দেখা,
বরফের উপর প্রথম রাত্রিযাপন, শীতে জমে গিয়ে
একে অন্যকে পিঠ দিয়ে ঘুমুলুম।
আমি আমার পুত্রকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব মৈত্রীর দিকে
তাকে যেন কখনো যুদ্ধ করতে না হয়–
সে যেন আমাদের মতো কাঁধে কাঁধ ছুঁইয়ে
মিত্রগণের সঙ্গে ধরণীর বুকে পা ফেলে চলে।
সে যেন শেখে : ন্যায্যভাবে
রুটির শেষ টুকরো ভাগাভাগি করতে।
…মসকোর হেমন্ত, স্মলেনসকের শীত ঋতু,
আমাদের অনেকেই মারা গিয়েছে।
কিন্তু সৈন্যবাহিনীর ঝঞ্ঝা, বসন্তের ঝঞ্ঝা
পরিপূর্ণ করে দিয়েছে এই নব ফাল্গুন।
বিরাট যুদ্ধ এই করে
মানুষের বুকের পাটা ভরে দেয় সাহস দিয়ে।
মুষ্টি হয় দৃঢ়তর, বাক্য হয় গুরু-ভার।
এবং বহু কিছু তখন হয়ে যায় পরিষ্কার।
…কিন্তু এখনও তুমি বুঝতে পারনি–
এইসব অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও আমি হয়েছি আগের চেয়ে কোমলতর।
অর্থাৎ বাইরের কার্যকলাপে, সগ্রামে শান্তিতে রুশজন যতই দার্চ ধরুক না কেন, অন্তরে সে পুষে রাখে কোমলতা, করুণা, মৈত্রী। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই বিশ্বাস ধরি।
আধুনিক রুশ সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচয় অতি অল্প। কাজেই বলতে পারব না, কবি গোদমেনুকো রুশ দেশে কতখানি খ্যাতিপ্রতিপত্তি ধরেন। তবে তার আর একটি কবিতা আমার বড় ভালো লেগেছে।
বাইরে যতই বড়ফট্টাই করুক না কেন, হিটলারের অনেক চেলাই যে ভিতরে ভিতরে গড়ড্যাম্ কাপুরুষ ছিল সেইটে কবি প্রকাশ করেছেন অতি অল্পতেই। ভলগা-অঞ্চলের স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ তখন (ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩) শেষ হয়ে গিয়েছে। বিশ্বজন, এমনকি জর্মন জাঁদরেলরাও তখন জেনে গিয়েছেন যে জর্মনির জয়াশা আর নেই। জয়াশা ত্যাগ করে মুণ্ডহীন দেহে যত্রতত্র বিচরণ করাটা তখন স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো ছিল না। কবিতাটি স্তালিত্যাদে লেখা।
স্তালিদগ্রাদ, মে–নভেম্বর, ১৯৪৩
ফেব্রুয়ারি শেষ হল।
নীলাকাশ
দেওয়ালের ফুটোগুলোর ভিতর দিয়ে
যেন চিৎকার করছে।
প্রতি চৌরাস্তায় তীরের চিহ্ন
জর্মন সৈন্যদের পথনির্দেশ করছে
কোথায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
এ তো ইতিহাস।
এ তো স্মরণের কাহিনী।
সংগ্রামের চিৎকার ভলগা-অঞ্চল থেকে সরে গিয়েছে।
এখন, কীভাবে ইস্কুলগুলো ফের বানাতে হবে
তাই নিয়ে দিবারাত্তির মহকুমা-শহরে গভীর আলোচনা হচ্ছে
বাচ্চারা নিয়ে এল অতিশয় সযত্নে
একখানা বেঞ্চি– কোনও জখম-চোট লাগেনি
যেন কাচের তৈরি পলকা মাল মাটির নিচের ঘর থেকে।
…সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
–হঠাৎ আলোতে-অন্ধপ্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল।
এক জর্মন সৈন্য।
ওহ্! কী কাঁপতে কাঁপতে সে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল।
তার ওভারকোট ছেঁড়া, টেনা টেনা– পা দুটো নড়বড়ে।
ওই শেষ জর্মন সৈন্য স্তালিনগ্রাদে।
একদা বার্লিনে সে যে হামাগুড়ি দিত হুবহু সেইভাবে।
(নাৎসি-প্রধানদের সম্মুখে অনুবাদক)
এভাল্ট ফন ক্লাইস্ট-শ্লেনৎসিন।
জন্ম ২২ মার্চ ১৮৮৯।
ফাঁসিতে মৃত্যু ১৫ এপ্রিল ১৯৪৫।
জনৈক ধর্মভীরু নিষ্ঠাবান ক্যাথলিক ক্রিশ্চানের পূত্রাংশ। ইনি হিটলারের আদেশে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন :
ভগবানের দিকে যে জাতি যতখানি নিয়োজিত করেছে, সেই দিয়ে তার মূল্য বিচার করতে হয়। একটা অ-ক্রিস্টান জাতও ক্রিস্টানদের তুলনায় (যেমন আমরা অনুবাদক) ভগবানের অনেক নিকটতর হতে পারে। আজকের দিনের ক্রিস্টানরা ভগবানের কাছ থেকে অনেক দূরে।
.
০৭.
কনসানট্রেশন ক্যাপের (ক. ক) কেলেঙ্কারি কেচ্ছা এতদিনে হটেনটটরাও শুনে গিয়ে থাকবে কিন্তু তার গৌরবময় যুগে সে তার কীর্তিকলাপ এতই ঢেকে চেপে সারতে পেরেছিল যে সাধারণ নিরীহ জর্মন ক-কর ভিতরে কী হয় না-হয় সে সম্বন্ধে নানারকম গুজব শুনতে পেত বটে, পাকা খবর পাবার কোনও উপায় ছিল না। তদুপরি সুবুদ্ধিমান জর্মনমাত্রই জানত, এ বাবদে অত্যধিক কৌতূহল প্রকাশ করা আপন স্বাস্থ্যের জন্য প্রকৃষ্টতম পন্থা নয়। যেমন ১৯৪৫-এ যখন যুদ্ধ জয়ের কোনও আশাই ছিল না তখন হিটলার-হিমলার আইন জারি করেন যে, কেউ যদি বলে যে এ যুদ্ধে জর্মনির জয়াশা নেই তার মুণ্ডচ্ছেদ করা হবে; ওই সময় এক জর্মন তার বউকে গোপনে বলে, যুদ্ধে জয়লাভ করার ভরসাটা বরঞ্চ ভালো। মুণ্ডুহীন ধড় নিয়ে হেথাহোথা ছুটোছুটি কাটা স্বাস্থ্যের পক্ষে আদপেই ভালো নয়।
গল্পটি সেই সময়কার।
ট্যুনিস আর শ্যেল দুই নিরীহ, সদাশান্ত জর্মন। দুজনাতে দোস্তি। পথিমধ্যে দেখা। ট্যুনিস শুধোল, যা রে শ্যেল, অ্যাদ্দিন কোথায় ছিলি বল তো!
হুঁহহ!
সে কী রে? কথা কইছিস না কেন? আমি তো শুনলুম, তোকে কনসানট্রেশন ক্যামপে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ওই জায়গাটা সম্বন্ধে তো নানান কথা শুনি! কীরকম ছিলি সেখানে
শ্যেল বলল, ফার্স্ট ক্লাস। উত্তম আহারাদি। পরিপাটি ব্যবস্থা। সকালে বেড়-টি। জামবাটি ভর্তি চা। একটি আপেল, দুখানা খাস্তা বিস্কুট। তার পর আটটা-ন্টায় ব্রেকফাস্ট। ডাবরভ সর-দুধ, কবৃফ্লেক, চাকতি চাকতি কলা, উত্তম মধু। সঙ্গে তো টোস্ট, মাখন, চিজ আছেই। তার পর দুখানা অ্যাবড়া আন্ত মাছভাজা ফ্রেশ মাখমে। তার পর দুটো ফুল-সাইজ পোচ, ডিম ভাজা বা মমলেট– যা তোর প্রাণ চায়– বেকনসহ, কিংবা হ্যামও নিতে পারিস। তার পর
ট্যুনিস সন্দিগ্ধ নয়নে তাকিয়ে বলল, সে কী করে?
হা হা হা। ন-সিকে খাঁটি কথা কইছি। ক-ক’র বাইরে বসে তোরা তো নিত্যি নিত্যি খাচ্ছিস lunch-এর নামে লাঞ্ছনা, supper-এর নামে suffer। আমরা খাচ্ছিলুম… পুনরায় সসিজ, কটলেট, এসপেরেগাস, চিকেন রোসটের সবিস্তর বর্ণনা।
ট্যুনিস বলল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনে। হালে মুলারের সঙ্গে দেখা। সে-ও মাস ছয় ক-কতে কাটিয়ে এসেছে। সে তো বলল সম্পূর্ণ ভিন্ন কাহিনী। সে বলল
বাধা দিয়ে বাঁকা হাসি হেসে শ্যেল বলল, বলতে হবে না, সে আমি জানি। তাই তো বাবুকে ফের ওখানে ধরে নিয়ে গিয়েছে।
শ্যেল আর ওখানে ফিরে যেতে চায় না। তাই ইংরেজিতে যাকে বলে সে তার বর্ণনা-টোস্টে প্রেমসে লাগাচ্ছে প্রয়োজনাতিরিক্ত গাদা গাদা মাখন।
কিন্তু শেল-বর্ণিত ঘটনা সত্য সত্যই ঘটেছিল ক-কতে তবে ভিন্নভাবে। যাকে বলে–
উল্টো বুঝলি রাম, ওরে উল্টো বুঝলি রাম।
কালে করলি ঘোড়া, আর কার মুখে লাগাম ॥
১৯৪৫-এর মে মাসে যুদ্ধশেষে বিজয়ী রুশ সেনা যেমন যেমন জর্মনির অন্তর্দেশে ঢুকল, সঙ্গে সঙ্গে ক-ক’র বন্দিদের খালাস করে ভ্রাতভাবে আলিঙ্গন করল– কারণ এই বন্দি ছিল হিটলারবৈরী, জমনের দুশমন।
ওই সময়কার অবস্থা বর্ণনা করে চিঠি লিখছে এক চেকোস্লোভাক বন্দি। চিঠিখানি দীর্ঘ। আমি কাটছাঁট করে অনুবাদ দিচ্ছি :
য়ারোস্লাভ য়ান পাউলিক; চেকোস্লোভাকিয়া।
জন্ম ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫।
মৃত্যু ১৩ মে ১৯৪৫।
উত্তর জর্মনি, মে ১৯৪৫
ওলাফ ঝড়ের বেগে, যেন হোঁচট খেয়ে ঢুকল আমার গারদে। রুপোলি চুলে মাথাভরা ওলাফ। খোঁড়া-পা ওলাফ, তার ক্রাচ দুটিয়ে নিয়ে। তার সেই মধুর হাসি হেসে সে আমায় আলিঙ্গন করল।
মুক্তি মুক্তি মুক্তি।
স্বাধীনতা স্বাধীনতা।
আমরা সবাই এখন মুক্ত, স্বাধীন। এমনকি ডাকাত, খুনিরাও মুক্তি পেয়েছে। সবাই মিলে লেগে গেল আশপাশে ডাকাতি লুটতরাজ করতে। আমি কিন্তু তাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারলুম না। ওই যে পেটুক মুলার বলে, আমি ওসব ব্যাপারে একটা আস্ত বুদ্ধ। তদুপরি আমি ভুগে ভুগে অত্যন্ত দুর্বল; রোগে কাতর, সর্ব নড়নচড়নে অথর্ব। আর এই হট্টগোলের মাঝখানে এই প্রথম অনুভব করছি সেটা কতখানি। এদিকে আসছে বাসন বাসন ভর্তি আলু, রুটি, চিনি। অমুক (পত্ৰলেখক ইচ্ছে করেই নামটা ফাঁস করেননি–অনুবাদক) একটা খাসা, বেড়ে সুটকেস লুট করেছে– ভেতরে আছে, শার্ট-কলার-গেঞ্জি-রুমাল এবং চিনি, কোকো, সিগার, মাখন, এক বোতল হৃদয়ভেদী ব্র্যান্ডি, হেনেসি ব্র্যান্ডির চেয়েও উৎকৃষ্ট। তার সোওয়াদটা আমার জিভে এখনও লেগে আছে।
ওদিকে আঙিনার উপর ডাই ভঁই আলু। তন্দুরের ভিতর গাদা গাদা পাউরুটি ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে, তৈরি হয়ে উড়ে উড়ে বাইরে চলে আসছে। পেপে আমাকে একটা ছেঁড়া সুয়েটার, একটা ছোরা আর একজোড়া জুতো দিয়েছে (ক-কর বন্দিরা দুরন্ত শীতে খড়, ন্যাকড়া দিয়ে পা বাধত অনুবাদক)। সত্যিকার জুতো! যতই চেয়ে দেখি প্রাণটা কী যে আনন্দে ভরে আসে।
রুশ সৈন্যবাহিনীর ট্যাঙ্ক, মোটরগাড়ি, বাইসিকল আমাদের সামনে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। নমস্কার নমস্কার! কীরকম আছেন? (জুদ্রাসভুইয়েতে, কাহ্ন পজিভাইয়িতে?) বলছে তারা। তারা তাদের গাড়ির থেকে আমাদের দিকে ছুঁড়ে ফেলছে সিগারেট, রুপোলি-মোড়কে প্যাচানো ৫০ গ্রামের তামাক, মিষ্টি, মাখন-চর্বি, টিনের যাবতীয় বাদ্য, পাজ, টুথপেস্ট, দুধের গুঁড়ো, সিরাপ।
সকালবেলা খেলুম; আন্ডাবেকন, জামবাটি ভর্তি পরিজ, সঙ্গে বিস্তর মার্মালেড, রুটি মাখন প্যাজ, সত্যিকার কফি, চিনিসহ।
(দ্বিতীয় চিঠি)
হয়েছে। আমার একটি অনবদ্য, পুরো পাক্কা আমাশা হয়েছে। ফরাসি পাঁচকরা কালকের দিনে যা বেঁধেছিল (এই সময়ে একাধিক ফরাসি পাঁচকও ক-কতে বন্দি ছিল ও দ্রব্যাদি তথা মালমসলা পেয়ে বহুদিন পর মুখরোচক জিনিস তৈরি করছিল–অনুবাদক) কলিজা-ভাজা তার সঙ্গে সরে-দুধে মাখানো আলুভাতে, তাবত বস্তু পাজ-ফোড়নে, ওহ, সে কী সুন্দর, কী মধুর!
এখন আমাকে কী করতে হচ্ছে, ওইসবের সামনে দাঁড়িয়ে?
দুধ আর আঙুর রস! এই আমার পথ্যি।
দুপুরের খাবার সময় হয়ে এসেছে।
হায় আমার খিদে নেই, রুচি নেই। আমার প্রিয়া, আমার ছোট্ট বউটি এখন কী করছে, কী ভাবছে।
কাল তাকে পাবার জন্য আমার বুক যা আকুলি-বিকুলি করছিল।
মনে হচ্ছে, এইবারেই নাক-বরাবর ওরই দিকে ছুটে যাব।
.
হায়, যুদ্ধশেষের পাঁচ দিন পরই হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
.
০৮.
ভিন্ন ভিন্ন জাতের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে বহু চুটকিলা প্রচলিত আছে।
জর্মনির দুই নম্বরের মোড়ল হারমান গ্যোরিঙ যখন বন্দি অবস্থায় রবেরগ মোকদ্দমায় আসামি তখন জেলের গারদে যেসব মার্কিন মনস্তাত্ত্বিক তাকে পর্যবেক্ষণ করতে আসতেন তাদের সঙ্গে দু-দণ্ড রসালাপ করে নিতেন। এক মোকায় তিনি বলেন,
তোমরা মার্কিন। ইয়োরোপীয় জাতগুলোর বৈশিষ্ট্য বুঝবে কী প্রকারে শোন :
একজন ইংরেজ শিকারি (ম্পোর্টসম্যান)
দুজন ইংরেজ একটা ক্লাব স্থাপন,
তিনজন ইংরেজ হার ম্যাজেটি কুইনের জন্য একটা কলোনি জয়।
তার পর হেসে বলতেন,
একজন ইতালীয় গাইয়ে,
দুজন ইতালীয়– ডুয়েট গাইয়ে
তিনজন ইতালীয় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন! হাঃ হাঃ হাঃ।
এবারে শুনুন,
একজন জর্মন–পণ্ডিত,
দুজন জর্মন একটি নতুন পলিটিকাল পার্টি স্থাপনা (এ বাবদে অবশ্য আমরা, বাঙালিরা এখন হেসে-খেলে জর্মনদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারি।
তিনজন জর্মন? হাঃ হাঃ- বিশ্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা! তার পর ফিসফিস করে বলতেন, আর জাপানিরা।
একজন জাপানি–রহস্যময়!
দুজন জাপানি সে-ও রহস্যময়!
তিনজন জাপানি? এবারে এসে গ্যোরিঙ রহস্যপূর্ণ দৃষ্টিতে শ্রোতাদের দিকে তাকাতেন, তার পর বলতেন,
তিনজন জাপনি–সে-ও রহস্যময়। বলেই ঠা ঠা করে উচ্চহাস্য করতেন– সঙ্গে সঙ্গে তার ভালুকি থাবা দুটো দিয়ে তার বিশাল উরুতে থাবড়াতেন– যে উরুর একটা দিয়ে অক্লেশে যে কোনও বঙ্গসন্তানের দুটো কোমর হোতে পারে।
আমার এবং আমার বন্ধুজনেরও ওই ধারণা। যেন অনুভূতির কোনও বালাই-ই জাপানিদের আদৌ নেই। কিন্তু পরের পৃষ্ঠার চিঠিটি পড়ুন :
গরু কিকিয়ু।
জন্ম : ১৯১০
মৃত্যু : ফিলিপিনের যুদ্ধে, ২০ আগস্ট ১৯৫৪
স্ত্রী য়াকোকে লেখা :
মানচুরিয়া
বেশিদিন তো হয়নি তোমার সঙ্গে ছিলুম অথচ ইতোমধ্যেই তোমার সঙ্গ পাবার জন্য আবার আমার কী দুরন্তু আকুলি-বিকুলি। আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি অল্পকালই, তবু তোমার সে-সময়কার চলাফেরা-ওঠাবসার কত না ছবি আমার চোখের সামনে ফুটে উঠছে। আর সবচেয়ে জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠ তুমি, যেখানে তুমি কোমল, মৃদু। আমাদের উভয়ের শিশুসন্তানটি জন্ম দেবার পর থেকে তুমি আরও সুন্দর হয়ে উঠেছ। তোমার সৌন্দর্যে যেটুকু শুষ্কতা ছিল সেটা রসঘন হয়ে গিয়েছে, তুমি পেয়ে গেলে এক নবীন পবিত্র সৌন্দর্য মাতৃত্বের সৌন্দর্য। আমার স্মরণে আছে সেদিনকার ছবি, যেদিন আমি টোকিও ছেড়ে চলে এলুম– সামান্য একটু প্রসাধন করে তুমি তখন বসে আছ খাটের উপর।
তখন কী সরল হাসিটি তোমার! অথচ যখন তুমি আমার কল্যাণ কামনা করে বিদায় নিতে এলে আমাদের আঙিনায়, তখন, এই বুঝি, এই বুঝি তুমি কান্নায় ভেঙে পড়বে। নিতান্ত সেই নীরবতা ভাঙবার জন্য আমি তোমাকে বললুম, সাবধান থেক। তার পর আমি ইজুমি আর প্রতিবেশীদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়লুম। আমি তখন মনে মনে আমাদের বাড়ির দিকে পিঠ ফিরিয়ে নিয়েছি। আমার ভাবনাচিন্তা তখন যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে। আমি হৃদয়ে হৃদয়ে অনুভব করছিলাম, আমার মাতৃভূমির সবকিছু যেন সেই সময়েই অন্তর্হিত হল। আমার এই অনুভূতিটি তোমার পক্ষে বোঝাটা হয়তো কঠিন হবে কিন্তু তুমি আমার হয়ে একবার আমার এই অবস্থাটি কল্পনায় বুঝতে চেষ্টা কর। আমার মনে হয়েছিল, ওই বিদায়মুহূর্তে যেন আমার দেহ উর্ধপানে ধেয়ে গিয়ে অনন্তে চলে গেল।
কিন্তু এখন? আজ রবিবারের এই সকালে আমার সর্ব দেহমন ধেয়ে চলেছে তোমা পানে।
বুঝিয়ে বলি; আমার হৃদয় কামনা করছে, তোমার অক্ষিপল্লব মৃদু মৃদু স্পর্শ করতে, তোমাকে শান্ত আলিঙ্গনে ভরে নিতে। তুমি যখন স্মিতহাস্য কর তখন তুমি বড় সুন্দর এবং সবচেয়ে সুন্দর তোমার দন্তপক্তি। হ্যাঁ, তোমার বর্ণ উজ্জ্বল শুদ্র নয়, কিন্তু মানতেই হবে, সে বর্ণ পরিপক্ক গোধূম বর্ণ–তোমার চর্ম সম্পূর্ণ অকুঞ্চিত কোমল। তোমার বক্ষ পূর্ণস্তন–মাতৃত্বের স্ফীতবক্ষ। এবং বর্ণ সেখানে প্রায় স্বচ্ছ ও। আমি তোমার বুকের উপর শিশুটির মতো ঘুমিয়ে পড়তে চাই। বহুবার কামনা করেছি, তোমার সুডৌল গোল বাহুতে মাথা রেখে আরাম লাভ করতে। তোমার সুন্দর সুবিন্যস্ত ওষ্ঠাধরে চুম্বন দিতে দিতে আমি মৃদু হাস্য করি আর তুমি প্রত্যুত্তরে মোহনীয়া মৃদু হাস্য দিয়ে আমাকে জাদু করছ। এরমধারা যত আমার কামনা এগিয়ে যায় ততই ভোমাকে কাছে পাবার বাসনা দুর্বার হয়ে ওঠে। না– এরকম ধরনে আমি আর লিখতে পারব না। এ লাইনটি পড়ে তুমি হয়তো হেসে উঠবে, কারণ এটা আমার স্বভাবের বিপরীত। কিংবা হয়তো তুমি আশ্চর্য হচ্ছ, তোমার কাছে আমার মূল্য বেড়ে যাচ্ছে নয় কি? কিংবা হয়তো ভাবছ, আমি শিও বুড়ো খোকা এবং তাই আমাকে সোহাগ করতে চাইছনা?
এসব নির্মল স্মৃতি আমার চোখের সামনে বার বার ভেসে ওঠে আর সে-সময়কার কথা বার বার মনে পড়ে।
তোমার পূর্ণ বক্ষ আমার চোখের সামনে মায়াময় কায়া ধরে ফুটে ওঠে। আমার ইচ্ছে যায় যে নিটোল বক্ষে হাত বুলোই ধীরে অতি ধীরে–তোমার মধুর নাসিকা, তোমার মুখ চুম্বনে চুম্বনে ভরে দিই। তুমি তখন মধুর হাসি হেসে উঠবে, আমাকে আদর-সোহাগ করবে। বল দেখি, অন্য কোথা; কোথায় আছে এই বিশ্বভুবনে, এরকম হৃদয়কাড়া সৌন্দর্য
সুস্থ শরীর-মনে থেক। তোমার চিত্তটিকে সৌন্দর্যময়, প্রেমময় করে রেখ। এরকম যে-মা তার কাছে আমি ফিরে আসছি শিগগিরই।
আমাকে আলিঙ্গন কর, তোমার পূর্ণ বক্ষ, উষ্ণ স্তন দিয়ে।
একটুখানি ধৈর্য ধরে থাক–ব্যস, ওইটুকু শুধু।
.
হায়! বহু যুগ পূর্বে শ্রীরাধার সখী তাকে বলেছিলেন, ধৈর্যং কুরু, ধৈর্যং কুরু গচ্ছং মম মথুরাবে কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ ফিরে আসেননি।
পূর্বে নিবেদন করেছি জাপানিরা রহস্যময়। কিন্তু এ চিঠি তো আদৌ রহস্যময় নয়। এ তো সেই রামগিরির বিরহী যক্ষ, মালয়ের কবি আমির হামজার মতো উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলছে!
আর এ পত্রে প্রেম ও কামের কী অনবদ্য সমন্বয়।
.
১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মে ফ্রান্সে সৈন্য অবতরণ করে জর্মনি জয়ের জন্য, ইংলভ তার তাবৎ কমনওয়েলথের এবং অন্যান্য সৈন্য সেখানে জমায়েত করেছিল। তারা এসেছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আরও মেলা দেশ এবং প্রধানত, সবচেয়ে বেশি আমেরিকা থেকে।
ওই সময়ে জনৈক ক্যানাডাবাসীর পত্র- তার বউকে।
ডনালড আলবেরট ডানকান, কানাডা।
১৯৪৪ সালে, জুলাই মাসের শেষের দিকে, ফ্রান্সে সৈন্যবিতরণের সময় নিহত।
ইংল্যান্ড, ১৪ মে ১৯৪৪
…ইংল্যান্ড এখন আর ইংরেজের (জমিদারি) নয়। এ দেশটা এখন সম্পূর্ণ দখল করেছে মার্কিনরা। একই সঙ্গে চার-চারটে বেস্ বল খেলার মাঠ তৈরি হয়েছে হাইড পার্কে। ইংরেজরা অবশ্যই অনেকখানি সহিষ্ণু, কিন্তু একথা নিশ্চিত মনে বলা যেতে পারে, তারা মার্কিনদের সঙ্গে গভীর পীরিতি-সায়রে নিমজ্জমান হয়নি! মার্কিনদের কাঁড়ি কাঁড়ি কড়ি! তদুপরি কেড়ে নিয়েছে হুঁড়িদের, বাসা বেঁধেছে সেরা সেরা হোটেলে। (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার দিকে ইংরেজও কড়ির পদে প্যারিসে তাই করেছিল। এই কলকাতাতেই আমরা মার্কিনদের সে রোওয়াব দেখেছি!) কিন্তু ইংরেজ করবে কী? ফ্রান্সে নেমে জর্মনিকে রাজিত করতে হলে যে ইয়াংকিদের প্রয়োজন।
ইংল্যান্ড, ২৪ জুন ১৯৪৪
…এসব তো হল, ওলো, প্রাচীন প্রিয়া (ওন্ড গারল)! বাচ্চাদের আমার হয়ে আদর দিয়ে বল, আমি ইউরোপ থেকে ওদের জন্য সুন্দর টুকিটাকি নিয়ে ফিরে আসব– যখন নিষ্প্রদীপ বিশ্ব আবার আলোকোজ্জ্বল হবে।
ফেরেনি। এক মাস পরে রণাঙ্গনে তার মৃত্যু।
.
০৯.
আডাম ফন ট্রটৎসু (Zu) জলৎসু, জর্মন।
জন্ম : ১৯০৯
মৃত্যু : ২৬ আগস্ট ১৯৪৪
হিটলারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য বার্লিনের প্ল্যোসেজে কারাগারে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত।
ইহলোক থেকে মাতার কাছে বিদায় জানিয়ে মৃত্যুর ক্ষণকাল পূর্বে লেখা শেষ পত্র।
বার্লিন-প্ল্যোসেনজে, ২৬ আগস্ট ১৯৪৪
সবচেয়ে আদরের মা!
তবু ভালো, তোমাকে সামান্য কয়টি ক্ষুদ্র ছত্র লেখার সুযোগ শেষটায় আমি পেয়েছি– তার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ; তুমি সবসময়ই আমার কাছে ছিলে, এবং এখনও আছ–আরও নিবিড় হয়ে কাছে আছ। তুমি-আমি যে অনন্ত অনন্তকালীন যোগসূত্রে বাধা, আমি সেটি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জোর আঁকড়ে ধরে আছি। এ কয়েক সপ্তাহ ধরে ঈশ্বর আমাকে তার দাক্ষিণ্য দিয়ে ভরে রেখেছেন এবং সব প্রায় সবকিছুর জন্য আমাকে আনন্দময় সরল-স্বচ্ছ শক্তি দিয়েছেন। এবং তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন এ জীবনে আমি কীভাবে, কোন কোন বিষয়ে কৃতকার্য হতে সক্ষম হইনি। কিন্তু এসবের চেয়েও সবচেয়ে বড় কথা : এই যে তোমাকে কঠিন শোক পেতে হবে, তার জন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করছি, এবং বৃদ্ধ বয়সে তুমি যে আমার ওপর নির্ভর করতে, সেই নির্ভর থেকে তোমাকে বঞ্চিত করার জন্য আমি ক্ষমা ভিক্ষা করছি।
তোমায়-আমায় আবার মিলন হওয়ার পূর্বে একটি শেষ চুম্বন–কৃতজ্ঞতা আর স্নেহ ভরা।
তোমার পুত্র তোমাকে যে বড় ভালোবাসে।
— আডাম
তোমার পূত আত্মায়, হে প্রভু আমি নিজেকে সমর্পণ করি…
ইহলোক থেকে পত্নীর কাছে বিদায় জানিয়ে মৃত্যুর ক্ষণকাল পূর্বে লেখা শেষ পত্র।
বার্লিন-গ্লোৎসেনজে, ২৬ আগস্ট ১৯৪৪
প্রিয়া কণিকা ক্লারিটা,
দুঃখের বিষয়, সম্ভবত এই আমার শেষ চিঠি। আশা করি ইতোপূর্বে লেখা আমার দীর্ঘতর পত্রগুলো তোমার কাছে পৌঁছেছে।
আর কিছু বলার পূর্বে এবং সর্বোপরি আমি যা বলতে চাই : নিতান্ত অবাঞ্ছিতভাবে তোমাকে যে গভীর শোক দিতে হল, তার জন্য আমি মাফ চাইছি।
আমি প্রত্যয় দিচ্ছি, আমি চিন্ময়রূপে পূর্বের মতো তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকব, এবং দৃঢ়তম প্রত্যয় ও বিশ্বাস নিয়ে মৃত্যুবরণ করছি।
আকাশ আজ নির্মল, ঘন নীল (পিকক ব্লু) এবং গাছে গাছে মর্মরধ্বনি। আমাদের আদর-সোহাগের মিষ্টি মিষ্টি কথা বাচ্চা দুটোকে শিখিয়ে, তারা যেন পরমেশ্বরের এ প্রতীকগুলো বুঝতে পারে এবং তাদেরও গভীরে যে-প্রতীকগুলো আছে, সেগুলোও চিনতে শেখে। –কৃতজ্ঞতাসহ, কিন্তু গ্রহণ করার সময় যেন থাকে সক্রিয় বীর্যবান সাহস।
আমি তোমাকে বড় ভালোবাসি।
তার পর অনেক অনেক কিছু বলার রইল। কিন্তু তার জন্য আর সময় নেই।
ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করুন (আমাদের ঈশ্বর রতু-অনুবাদক) আমি জানি, তুমি কক্ষনও পরাজয় স্বীকার করবে না। আমি জানি, তুমি জীবনসগ্রামে ক্রমাগত এগিয়ে যাবে, এবং যদিও সে সংগ্রামে তোমার মনে হয় তুমি একা, তবু জেনো, আমার অদেহী স্বরূপ অহরহ তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। আমি প্রার্থনা করছি, তুমি যেন শক্তিলাভ কর, তুমিও আমার জন্য সেই সেই প্রার্থনা করো। এই শেষের ক-দিনে পুরগাতোরিয়ো এবং মেরি স্টুয়ার্ট পড়বার সুযোগ আমার হয়েছিল।… এছাড়া পড়বার মতো এ ধরনের বিশেষ কিছু আমার ছিল না কিন্তু মনের ভিতর অনেককিছু উল্টে-পাল্টে দেখেছি এবং শান্তচিত্তে সেগুলো পরিষ্কার করে বুঝে নিয়েছি। তাই বলছি, আমার জন্য অত্যধিক শোক করো না–কারণ তলিয়ে দেখলে বুঝতে পারবে, সবকিছুই অত্যন্ত সরল, পরিষ্কার, যদিও সেগুলো গভীর বেদনাদায়ক।
আমার জানতে বড় ইচ্ছে করে, এই যা সব ঘটল, তার ফলে তোমাদের জীবনযাত্রায় কোনও পরিবর্তন হল কি না? তুমি কি রাইনবে যাবে, না যেখানে আছ, সেখানেই থাকবে? অবশ্যই তারা সকলে তোমাকে অত্যন্ত আদরের সঙ্গে গ্রহণ করবেন আমার প্রিয়া, ছোট্ট বউটি আমার! আমার পূর্বের পত্রগুলোতে তোমাকে বলেছিলুম আমার যে বহু বন্ধুবান্ধব আছেন তাদের শুভেচ্ছা জানাতে– এটা আমার অন্তরতম কামনা। তুমি ওদের সকলের সঙ্গে সুপরিচিত; তাই আমার সাহায্য ছাড়াও তুমি আমার শুভেচ্ছা ঠিকমতো তাদের জানাতে পারবে।
আমি সর্ব হৃদয় দিয়ে তোমাকে আলিঙ্গন করছি, অনুজ করছি তুমি আমার সঙ্গে আছ। ভগবান তোমাকে ও বাচ্চাদের আশীর্বাদ করুন।
তোমার প্রতি অবিচল প্রেমনিষ্ঠ,
–আডাম
এ চিঠি দুটি অন্যান্য চিঠির তুলনায় অসাধারণ বলে না-ও মনে হতে পারে। কিন্তু আম। ছিলেন অতিশয় অসাধারণ পুরুষ। অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ ছিলেন তিনি ছেলেবেলা থেকেই এবং হিটলার তার অভিযান আরম্ভ করার সময় থেকেই তিনি বুঝে যান, এইসব নীতি-বিবর্জিত অখ্রিস্টান আন্দোলন জর্মনি তথা তাবৎ ইয়োরোপকে মহতী বিনষ্টির পথে নিয়ে যাবে। আপন দেশে লেখাপড়া করার পর তিনি অক্সফোর্ডে রোর্ডস্ স্কলাররূপে বেলিয়েল কলেজে খ্যাতিলাভ করেন। খোলা-দিল সাদা মনের মানুষ ছিলেন বলে সেসময় তিনি একাধিক ভারতীয়ের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করেন। যুদ্ধের পর যখন তার পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখা হচ্ছিল তখন তাঁর অক্সফোর্ডের বন্ধু শ্ৰীযুত হুমায়ুন কবীরকেও মাল-মসলা দিয়ে সাহায্য করতে অনুরোধ করা হয়।
হিটলারকে সরাবার জন্য গ্রাফ ফ স্টাউনফেনবের্গ তার পায়ের কাছে, টেবিলের তলায়, পোর্টফোলিও ভিতর একটি মারাত্মক টাইম বম্ রেখে বাইরে চলে যান। কিন্তু কিম্মৎ হিটলারকে বাঁচিয়ে দিল। যদ্যপি সেই কনফারেন্সৰুমের একাধিক লোক সঙ্গে সঙ্গে নিহত হন, হিটলারের বিশেষ কিছুই হল না।
ক্রোধোন্মত্ত হিটলার এই চক্রান্তকারীদের ওপর দাদ নেবার জন্য দোষী-নির্দোষী প্রায় পাঁচ হাজার জনকে ফাঁসি দেন। আডাম ছিলেন স্টাউনফেনবের্গের অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং তাকে এই কর্মে সর্বপ্রকারের সাহায্য করেছিলেন। তারও ফাঁসি হয়।
অসাধারণ দৃঢ়-চরিত্র ধরতেন বলেই আডাম তার মা-বউকে শেষ চিঠি লেখার সময় সজ্ঞানে যতখানি পারেন অনুভূতি চেপে রেখেছিলেন- পাছে ওদের মনে আরও না লাগে। অথচ তিনি লিখতে পারতেন বড় সুন্দর মরমিয়া জর্মন।
.
ওই সময়ের অল্প পূর্বে একদল ছাত্র মুনিকে প্রথমত গোপনে, পরে অর্ধপ্রকাশ্যে হিটলারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালায়। তারই একজন ধরা পড়ে ফাঁসি যাওয়ার পূর্বে তার মাকে লেখে
মামণি,
তুমি আমাকে জন্ম দিয়েছিলে, আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি যখন আদ্যন্ত চিন্তা করে দেখি তখন মনে হয় আমার সমস্ত জীবন একই রাস্তা ধরে চলেছিল যার অন্তে আছেন– স্বয়ং ভগবান। এখন কিন্তু শোক করো না, যে, রাস্তার শেষাংশটুকু আমাকে এক লক্ষে পেরুতে হল। শিগগিরই আমি এ জীবনে তোমার যত না কাছে ছিলুম, তারচেয়ে অনেক বেশি কাছে চলে আসব।
ইতোমধ্যে তোমাদের সকলের জন্য একটি রাজকীয় অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করছি।
.
মৃত্যুর প্রাক্কালেও এরকম চিঠি! এতখানি রসবোধ! ফাঁসিতে লক্ষ দিতে হয় বই কি, আর স্বর্গপুরীতে মায়ের জন্য রাজসিক অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করবে সে।
শিশুকন্যাকে লেখা মায়ের চিঠি।
রোজে (গোলাপ) শ্যোএজিগারের জন্ম ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে। নাসবিরোধী আন্দোলন চালানোর সময় ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪২ তিনি বন্দি হন এবং ৫ আগস্ট ১৯৪৩-এ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। তার স্বামী বোডো শ্লোএজিগার ছিলেন জর্মন মিলিটারি পুলিশে দোভাষী। তার স্ত্রীর প্রাণদণ্ড হয়েছে, এ খবর পেয়ে তিনি পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করেন।
.
আমার সোহাগের ক্ষুদে, দড়(১) মারিয়াননে।
অনুমান করতে পারছিনে তুমি কবে এ চিঠি পড়তে পারবে। তাই এটি তোমার ঠাকুরমা বা বাবার কাছে রেখে যাচ্ছি, যাতে করে তুমি বড় হয়ে এটি পড়তে পার। এখন তোমার কাছ থেকে আমাকে বিদায় নিতে হবে, কারণ খুব সম্ভব আমরা একে অন্যকে আর দেখতে পাব না।
তা সে যাই হোক না কেন, তুমি যেন স্বাস্থ্যবতী, সুখী এবং সবলা হয়ে বড় হয়ে ওঠো। আমি আশা করছি, পৃথিবী তার যেসব সুন্দরতম জিনিস দিতে পারে সেগুলো তুমি উপভোগ করবে–আমি যেরকম উপভোগ করেছি এবং তোমাকে যেন সেসব দুঃখ-বেদনার ভিতর দিয়ে না যেতে হয়– যেগুলোর ভিতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা : তোমাকে কর্মদক্ষ ও অধ্যবসায়ী হতে হবে। এ দুটি থাকলে বাকি সব আনন্দ-সুখ আপনার থেকেই আসে।
তোমার স্নেহ-ভালোবাসা মুক্ত হস্তে বিলিয়ে দিও না। এ সংসারে তোমার বাবার মতো কম লোকই আছে যারা তার মতো সৎ এবং প্রেমে নির্মল। তাই সমস্ত প্রেম উজাড় করে দেবার আগে একটু ধৈর্য ধরতে শেখো। তা হলে প্রেমে ধোকা খাওয়ার যন্ত্রণা থেকে তুমি বেঁচে যাবে। কিন্তু এমন একজন যেদিন আসবে, যে তোমাকে এতই গভীর ভালোবাসে যে, তোমার সব যন্ত্রণা সে-ও সঙ্গে সঙ্গে সইবে এবং যার জন্য তুমিও সইতে প্রস্তুত–এরকম পুরুষকে তুমি তোমার প্রেম নিবেদন করতে পারো। আমি প্রত্যয় দিচ্ছি, তাকে পেয়ে তার সঙ্গে যে আনন্দ তৃপ্তি তুমি উপভোগ করবে তার থেকে তুমি বুঝতে পারবে, তার প্রতীক্ষায় তুমি যে ধৈর্য ধরে ছিলে, সেটা নিফল হয়নি।
তোমার জন্যে আমি বহু বৎসরের আনন্দ প্রার্থনা করছি; আমার কপাল মন্দ, আমি পেয়েছি অল্প কয়েক বৎসরই। এবং তোমাকে সন্তানের জন্ম দিয়ে মা হতে হবে : যখন তোমার নবজাত শিটিকে তোমার বুকের উপর রাখবে তখন হয়তো আমার কথা তোমার স্মরণে আসবে। তোমাকে যখন আমি প্রথমবারের মতো দুবাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলুম সেটি আমার জীবনের চরম মুহূর্ত তুমি তখন মাত্র একটি গোলাপি পুঁটুলি।
তার পরে স্বরণে আন, আমরা রাত্রে পাশাপাশি শুয়ে জীবনের কত না গভীর বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি আমি চেষ্টা করেছিলুম তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে। আবার স্মরণে আন, আমরা যে সমুদ্রপারে তিন হপ্তা কাটিয়েছিলুম–তিন মধুর সপ্তাহ। সেখানকার সূর্যোদয় এবং তোমাতে-আমাতে খালি পায়ে বেলাভুমি বেয়ে বেয়ে বাসিন থেকে উকেরিস গিয়েছিলুম; তার পর জলে রবারের দোলনাতে তোমাকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিলুম; তার পর আমরা দুজনাতে একসঙ্গে বই পড়তুম। বাছা, তোমাতে-আমাতে কতই না সৌন্দর্য উপভোগ করেছি এবং এগুলো তোমাকে নতুন করে উপভোগ করতে হবে, এবং তারও বাড়া অনেককিছু বেশি।
হ্যাঁ, তোমাকে আরও একটি কথা বলতে চাই, মৃত্যুবরণ করার সময় আমাদের মনে বড় বেদনা লাগে যে আমাদের প্রিয়জনকে অনেক অপ্রিয় কথা বলেছি। আমরা যদি দীর্ঘতর দিন বেঁচে থাকতে পারতুম তা হলে আমরা সেটা স্মরণে এনে নিজেদের অনেক বেশি সংযত করতে পারতুম। হয়তো আমার এ কথাটি তুমি স্মরণে রাখবে তাতে করে তোমার জীবন এবং সর্বশেষে তোমার মৃত্যু– তুমি নিজের জন্যে এবং অন্যদের জন্যেও সহজতর করে তুলতে পারবে।
এবং যতবার পার সুখী হও, আনন্দে থাক–প্রত্যেকটি দিন মহামূল্যবান!
যে প্রতিটি মুহূর্ত আমরা দুঃখে কাটাই তার জন্য হাহাকার!
আমার স্নেহ তোমার সমস্ত জীবনভর সঙ্গে সঙ্গে থাকবে– আমি তোমাকে চুমু খাচ্ছি এবং যারা সবাই তোমাকে ভালোবাসে। বিদায়! বিদায়!! ও আমার সোহাগের ধন– জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমারই কথা আমার গভীরতম মেহের সঙ্গে হৃদয়ে রেখে,
—তোমার মা
———-
১. মূলে আছে ক্লাইন গ্রোস (ইংরেজিতে হবে লিটল বিগ) স্পষ্টত পরস্পরবিরোধী। তবে জর্মনরা আদর করার সময় অনেক ক্ষেত্রে এরকমধারা বলে! কিংবা হয়তো মেয়েটি বয়সে শিশু হলেও গঠনে দার্চ ধরত, যার থেকে মা অনুমান করে যে, কালে সে তন্বঙ্গী না হয়ে পূর্ণাঙ্গী হবে।
.
১১.
য়োরমা হাইসকানেন, ফিনল্যান্ড
জন্ম : ৩১ জুলাই ১৯১৪
মৃত্যু : জুন ১৯৪১
সোভিয়েত-ফিন সগ্রামে সীমান্তে নিহত সৈনিকের রোজনামচা থেকে উদ্ধৃত।
ডিসেম্বর ১৯৩৯ (ফিনিশ সীমান্তে) যুদ্ধের প্রথমদিনই আমি সুভিলাহতির গির্জা-চুড়োয় উঠলুম; সেখান থেকে আবার পর্যবেক্ষণ করব সীমান্তে যেখানে সগ্রাম চলছে… এখান থেকে স্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে গোলাগুলির শব্দ; অকস্মাৎ একটা চিন্তা আমাকে যেন ঝাঁকুনি দিল : ওই যেখানে যুদ্ধ হচ্ছে সেখানে যে কোনও মুহূর্তে আমাদেরই একজন নিহত হতে পারে। তখন লক্ষ করলুম গির্জা-চুড়োতে আমি একা নই।
প্রতিরক্ষার জন্য রাখা একটা বালুর বস্তায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি নাবালক বাচ্চা–বয়স এই এগারো-বারো। পরনে চামড়ার কোট, হাতে একটা দুরবিন। ওইটে দিয়ে সে দক্ষিণ পানে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল– সেখান থেকে যুদ্ধের ক্ষীণ কোলাহল-ধ্বনি আসছিল। আমি তো অবাক এরকম অকুস্থলে তো ওর মতো ছোট্ট একটা বাচ্চার থাকার কথা নয়। বনের গাছগুলো ছাড়িয়ে উর্ধ্বে উঠেছে এই গির্জা-চুড়ো; যে কোনও মুহূর্তে শত্রুপক্ষের কামানের গোলা এটাকে হানতে পারে।
এখানে তুমি কী করছ?
বড় সুন্দর তাজা গলায় উত্তর এল : কেন? আমাকে তো জঙ্গি হাওয়াই জাহাজের গতিবিধি পাহারা দেবার জন্য এখানে পাঠানো হয়েছে।
তোমার বাড়ি কোথায়?
শান্তু কঠে উত্তর দিল, হাউটাভারা-য়।
আমি তাড়াতাড়ি শুধোলুম, তোমার বাপ-মা…?
অতি স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দিল, যেন এ নিয়ে কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না– বাড়িতে বইকি!
বাচ্চাটি আমার দিকে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকাল–দুরবিন দিয়ে তদারকি-কর্ম সে তখনকার মতো ক্ষান্ত দিয়েছে।
আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। আমি আর কোনও প্রশ্ন শুধোতে পারছিনে। বাচ্চাটি কি জানে তার বসগ্রাম হাউটাভারা শব্দার্থে সম্পূর্ণ চিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। ওই তো সীমান্তের শেষ গ্রাম। এটাতে কোনও সেনা-সেনানী নেই। কিন্তু ওরই উপর সকাল থেকে শত্রুপক্ষ সব কামান একজোট করে গোলা হেনেছে। এগ্রাম তো সম্পূর্ণ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। সেখানেই তো তার বাড়ি– সে বাড়ি কি আর আছে। তার বাপ-মা পরিবারের আর পাঁচজন? তাদের সঙ্গে এর কি আর কখনও দেখা হবে?
কিন্তু সে কি জানে এ সব? না, না, আমি এ প্রশ্ন ওকে শুধোতে পারব না।
ইতোমধ্যে যুদ্ধের আগুন আরও জোরে জ্বলে উঠেছে।
তুই কি এখানেই থাকবি না অন্য কোথাও যেতে চাস?
কেন? এখানেই তো আমার থাকবার কথা নয় কি? তবে আমাকে দিয়ে আর কোনও দরকার নেই? (অর্থাৎ সে চলে যেতে চায়নি অনুবাদক)।
বহুকাল ধরে তার এই শেষ কথাগুলো আমার কানে বেজে যেতে লাগল–বহুকাল ধরে, তার কাছ থেকে, সেখান থেকে বিদায় নেবার পরও।
.
জানেন শুধু ভগবান, এই পিতৃমাতৃহীন গৃহহীন শিশু যুদ্ধের তাড়নায় কোথায় ঘুরে মরেছিল– ফিনল্যান্ডের ডিসেম্বরের দারুণ শীতে–প্রভুই জানেন, সে অন্তত আশ্রয়টুকু পেয়েছিল কি না।
জেলে থেকে বোনেদের প্রতি লেখা বোনের শেষ পত্র– কবিতায়।
… আটদিন ধরে আমি শৃঙ্খলাবদ্ধ
আমার এ অবস্থা কি কখনও ভুলতে পারব?
শেকলগুলো আমাকে নিদারুণ যন্ত্রণা দিচ্ছে।
আমাকে নির্জন কারাগারে দণ্ডিত করা হয়েছে। হে প্রভু, তুমি আমাকে ত্যাগ করছ কেন?… (খ্রিষ্ট নাকি ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় এই হাহাকারই করেছিলেন অনুবাদক)
আমার বোনেরা মিমি, মিনা– তোমরা কি এখনও তোমাদের বোন লোরেনকে স্বরণে আন,
সে তোমাদের ভালোবাসে।
দুঃখবেদনা আমাদের সম্মিলিত করে একই পথে চালাবে,
এই তো ছিল আমাদের শপথ এবং একই অনুভূতি আমরা ভাগাভাগি করে নেব।
আমাকে তারা শিকল দিয়ে বেঁধেছে, কিন্তু আমার হৃদয়টাকে নয়।
আমি আশা রাখি, আমি বিশ্বাস রাখি, আলোকে আলোকে আলোকিত সূর্যরশ্মিময় ভবিষ্যৎ।
কাল যদি আমার মৃত্যু হয়।
তবে কীই-বা হবে?
শুধু আমি মুক্তি পাব আমার পায়ের শৃথল থেকে!
এই মেয়েটির নাম লোরেনস– বোনেদের নাম মিমি, মিনা। কিন্তু পারিবারিক নাম চিঠিতে নেই বলে এদের কাউকেই শনাক্ত করা যায়নি। যেটুকু জানা গিয়েছে তা এই :
ফ্রান্স জয় করার পর জর্মনি তার বৃহদংশে আপন রাজত্ব চালায়। তখন সে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যে আন্ডারগ্রাউন্ড সংগ্রাম চলে মাদমোয়াজেল লোরেন তারই একজন।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। অবশ্য মৃত্যু আসন্ন জেনে এই তার শেষ পত্র।
.
১২.
রণদামামা বাজিয়ে সগর্বে যখন ১৯৩৯-এর সেপ্টেম্বরে হিটলার পোলান্ড আক্রমণ করলেন তখন তিনি বার্লিনের প্রধানতম রাজপথের দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ ও নিরাশ হলেন। তার মনে পড়ল ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-সূচনার কথা। তখন কী উৎসাহ-উত্তেজনার সঙ্গে কাইজারের সেই যুদ্ধং দেহি আবানে জর্মনির জনগণ সাড়া দিয়েছিল।(১) তারা যে এবারে তার এবং গ্যোবেলস্-এর কর্ণপটহবিদারক শত প্রোপাগান্ডা সত্ত্বেও এরকম জড়ভরতের মতো চোখেমুখে নির্বিকার ঔদাসীন্য মেখে পোলাভগামী যুযুধানদের দিকে শুধুমাত্র তাকিয়েই থাকবে– ঘন ঘন সাধুবাদ, করতালি, স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম-সঙ্গীত, প্রজ্বলিত মশালসহ সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে কদম কদম বাড়িয়ে তাদের সকলকে শুভেচ্ছা জানানো, সৈন্যদের ধরে ধরে পথমধ্যে তরুণী যুবতীদের যদৃচ্ছা চুম্বনালিঙ্গন কিছু না, কিছু না, সব ঝুট সব ঝুট; হিটলার ও ইয়ার গ্যোবেস তো রীতিমতো মুষড়ে পড়েছিলেন।
আসলে জনগণ সংগ্রাম চায়নি; তারা চেয়েছিল শান্তি। বিশেষ করে হিটলার তার বুদ্ধিমত্তা, কর্মদক্ষতা, দূরদৃষ্টি-প্রসাদাৎ, বছর তিনেক পূর্বে দেশকে যে আর্থিক সাচ্ছল্য এনে দিয়েছিলেন তারা চেয়েছিল নির্বিঘ্নে শান্তিতে সেটি দীর্ঘকালব্যাপী উপভোগ করতে। আর ভবিষ্যতে সুখভোগের জন্য হিটলার যেসব গণ্ডায় গণ্ডায় অঙ্গীকার করে বসে আছেন, সেগুলোর তো কথাই নেই। তার অন্যতম, বছর তিনেকের মধ্যে তিনি জনির চাষি-মজুর প্রত্যেক পরিবারকে এক-একখানি সরেস ফল্কভাগেন (volkswagen-folk-car জনগণরথ) দেবেন– বস্তুত তখন থেকেই অনেকে আগাম কিস্তি-আমানত দিতে শুরু করেছে। মোটরগাড়ি তা হলে শিকেয় উঠল।
বললে প্রত্যয় যাবে না, সুশীল পাঠক, এই যে জনির প্রাশান অফিসারগোষ্ঠীকে বহু বহু যুগ ধরে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রণবিশারদ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে, তাদেরও অধিকাংশই এ সংগ্রাম চাননি। এদের একাধিক জন সগ্রাম আসন্ন জেনে, এরই এক বৎসর পূর্বে, হিটলারের সমুখে তীব্র প্রতিবাদ তুলে নিরাশ হয়ে আপন আপন পদে ইস্তফা দেন। আর অর্থনৈতিকদের তো কথাই নেই। শাখট-এর মতো অর্থনৈতিক জাদুকরও যখন দেখলেন হিটলার তার সাবধানবাণী শুনলেন না তখন তিনিও অবসর গ্রহণ করলেন। তার বক্তব্য ছিল হিটলার ক্ষুদ্র রাজ্য পোলাভকে আক্রমণ করে যদি আশা করেন যুদ্ধ সেই অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকবে তবে সেটা মারাত্মক ভ্রমাত্মক দুরাশা। সেই খণ্ড-যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হবেই হবে। এবং সেই সুদূরপ্রসারী দীর্ঘকালব্যাপী বিশ্বসংগ্রাম চালাবার মতো কাঁচামাল-মেটিরিয়েল জর্মনির নেই। (এবং শেষটায় প্রধানত এই কারণেই হিটলারের পতন হয়, এবং তিনি ক্রোধোন্মত্ত স্যামসনের ন্যায় সমস্ত গাঁজা– এস্থলে তাবৎ ইয়োরোপ– তাঁর বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে রসাতলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
শুনেছি, যেখানে হোক, যে কোনও প্রকারেই হোক একটা লড়াই বাধিয়ে দেবার জন্য হামেহাল ভেরিয়া হয়ে থাকে একটি গোদা দল অস্ত্রশস্ত্র-নির্মাণকারী বিরাট বিরাট কারখানার মালিকগণ। শুনেছি এরা নাকি গ্যাটের কড়ি খরচা করে অনুন্নত দেশে সিভিল উয়োর লাগিয়ে দিয়ে পরে হরষিত হৃদয়ে উভয় পক্ষকেই বন্দুক কামান বোমা বিক্রি করে খরচার হাজারগুণ মুনাফা তুলে নেয়। (শকুনির যদি এ প্রকারের সুবুদ্ধি থাকত তবে সে নিশ্চয়ই গো-কুলে মড়ক লাগাত।)
এস্থলে কিন্তু শুনেছি, সমরাস্ত্র নির্মাণকারী জর্মনরাও হিটলারের যুদ্ধ কামনা করেননি। এদের অধিকাংশই জানতেন, এ যুদ্ধে জয়াশা নেই। ফলে মুনাফা তো যাবেই যাবে, তদুপরি শত্রুপক্ষ দেশ দখল করে এস্তেক কারখানাগুলোর সমুচা যন্ত্রপাতি স স্ট ব্যারেল আপন আপন দেশে চালান দেবে।
তারা অবশ্য তখন জানতেন না, ধন তো যাবেই, প্রাণ নিয়ে টানাটানি লাগবে।
এবং তা-ও হয়েছিল– ইতোপূর্বে যা কখনও হয়নি যুদ্ধ শেষে মিত্রপক্ষ এইসব ডাঙর ডাঙর অস্ত্রপতিদের বিরুদ্ধে জোর মকদ্দমা চালায়; রিবেট্রপ, কাইটেল ইত্যাদিকে ফাঁসি দেবার পর। জেল তো এঁদের অনেকেরই হয়েছিল– ফাঁসি হয়েছিল কি না, আমার মনে নেই। (অবশ্য শুনেছি, এখন ফের তারা, অথবা তাদের বংশধররা—-বন্দুক কামান তৈরি করে ক্ষণে বেচেন মিশরকে ক্ষণে ইজরাএলকে!)
এবং পাঠক আরও প্রত্যয় যাবেন, হিটলারের আপন খাস চেলা-চামুণ্ডাদের অনেকেই এ যুদ্ধ চাননি!–মায় তার দুনম্বরি ইয়ার বিমান-বহরাধিপতি গ্যোরিং। এঁরা মোকা পেয়ে কলাকৌশলে তখন এতই ধনদৌলত জমিয়েছেন যে, বার্লিনের কুটি সম্প্রদায় এদের ঢপ-বেটপের ঢাউস মেরসেডেজ মোটর দেখতে পেলে কখনও চেঁচিয়ে, কখনও আপিসে মৃদুস্বরে বলত মহারাইশা!–মহারাজা শব্দের জর্মন উচ্চারণ। গ্যেবেস তো একবার উচ্চ কণ্ঠেই বললেন, এদের যদি এখন জুস্ প্রিমে নটি দেওয়া হয় তবেই এরা সর্বার্থে মধ্যযুগের ব্যারন হয়ে যাবে। জুস প্রিমে নটি আইনের অর্থ : প্রথম রাত্রির অধিকার। মধ্যযুগের বহু ব্যারনের অধিকার ছিল তার জমিদারিতে যত কুমারী কন্যা বিয়ে করবে, বিয়ের প্রথম রাত্রি তাদের কাটাতে হবে ব্যারনের শয্যায়।(২)
এরা অবশ্যই অন্তরে অন্তরে যুদ্ধ কামনা করেনি বাইরে যতই লম্বা কোঁচা চড়াক।
তবে একথা ঠিক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ হিটলারমন্ত্রে আবাল্য দীক্ষিত উষ্ণমস্তক (মস্তিষ্ক এদের ধোলাই করে ফেলা হয়েছে, যাকে বলে ব্রেনওয়াশ, তাই বললুম মস্তক, খুলি আরও ভালো) নিম্ন সরকারি সেনাদলের এস-এস-এর অনেকেই যুদ্ধ কামনা করেছিল।
কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের ওই তো একটা মস্ত সুবিধা অসুবিধা যা খুশি বলুন। ক্যাবিনেট ডাকতে হয় না, পার্লিমেন্ট নেই, আর প্লেবিসিটের তো কথাই ওঠে না। হিটলার, নেপোলিওন, স্তালিনকে রোকে কে?
.
মুসসোলিনির যুদ্ধ ঘোষণাটা হয়েছিল আরও মারাত্মক জনমতের বিরুদ্ধে। এমনকি তার আপন জামাই, তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী চাননা পর্যন্ত জর্মনদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে নামতে রাজি হননি। মুসসালিনি শেষটায় তাকে জাতিকান-এ রাজদূত বানিয়ে দেন। আর ইতালির রাজা এবং রাজপরিবার যে কট্টর হিটলারবিরোধী ছিলেন সেকথা ইতালির মাক্কারনি-খেকো চাষাটা পর্যন্ত জানত, স্বয়ং হিটলারের তো কথাই নেই। বার্লিনে যখন ইতালির রাষ্ট্রদূত হয়ে এলেন জর্মনির প্রতি মোটামুটি সহানুভূতিশীল–দুষ্টুবুদ্ধিতে অবশ্য রামপন্টক–দিনো আলফিয়েরি, তাকে পর্যন্ত কি হিটলার কি রিবেট্রপ তাদের পক্ষে কনভারট করতে পারেননি।
মুসসসোলিনির চলল একটানা পরাজয়ের পর পরাজয়। শেষটায় তার আপন ফাশি-মণ্ডলী দলীয় সভায় তার বিরুদ্ধে অনাস্থার প্রস্তাব পাস করল (এটা অবশ্য নাৎসি জর্মনিতে ছিল সম্পূর্ণ অকল্পনীয়) এবং তার প্যারা মেয়ের স্বামী শ্রীমান চাননা ছিলেন দুই নম্বরের ষড়যন্ত্রকারী। মোকা পেয়ে ইতালির রাজা মুসসোলিনিকে বন্দি করলেন। ফাশি রাজ্য লোপ পেল। কিছুদিনের মধ্যেই রাজা যুদ্ধবিরতির আদেশ দিলেন (৮ সেপ্টেম্বর ইতালির ভ্রাতুযুদ্ধের উল্লেখ করতে গিয়ে আমি পূর্ববর্তী অনুবাদে এ তারিখের গুরুত্বের কথা বলেছি)।
ইতোমধ্যে মিত্রশক্তি সম্পূর্ণ উত্তর আফ্রিকা জয় করে নেমেছে খাস ইতালিতে।
কিন্তু হিটলারও কিছু কম যান না। তার ছলাকৌশল ও দুঃসাহস পরিপূর্ণ মাত্রায় প্রয়োগ করে যে প্ল্যান বানালেন সেইটে প্রয়োগ করে, গত বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে দুঃসাহসী জন বিমানচালক করুদজেনি এক পাহাড়ের চুড়োয় অ্যারোপ্লেন নামিয়ে মুসসোলিনিকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে নিয়ে এলেন হিটলার সমীপে।
মুসসোলিনির তুবড়িতে কিন্তু এখন আর বৃত্তির বারুদ নেই। তিনি নির্বিবাদে জীবনের শেষ কটা দিন তার প্রিয়া কারা পেচ্চির সঙ্গে কাটাতে চান। কিন্তু হিটলার বাণ্ডার হয়ে আছেন; বাধ্য হয়ে মুসসোলিনিকে নতুন ফাশি পার্টি নির্মাণ করে উত্তর ইতালিতে রাজ্যস্থাপনা করতে হল। সেটা চলল পরিপূর্ণ জর্মন তাঁবেতে।
ইতালি তখন মার খাচ্ছে চতুর্দিক থেকে। মিত্রশক্তি জর্মনদের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে এগিয়ে চলেছে ইতালির ভিতরে। ইতালীয়রা লড়তে চায় না। দুই কুত্তা যখন একটা হাড়ি নিয়ে লড়ে তখন হাড্ডিটা (অর্থাৎইতালি) তো কোনও পক্ষ নিয়ে লড়ে না। কিন্তু জর্মন সৈন্য ইতালীয়দের জোর করে ধরে নিয়ে পিছনে সঙিন বসিয়ে তাদের লড়াল।
আর যারা বাধ্য হয়ে পড়ল তাদের মা-বউকে গায়ে গায়ে বিনা বিচারে গুলি করে মারল প্রধানত ফাশিবিরোধী কমুনিস্টরা। এরই একটি নিদারুণ কাহিনী আমি প্রকাশ করি ১৯৬১-৬২ সালে।
তখন অবতরণিকায় লিখি :
মিত্রপক্ষে ও জৰ্মনিতে তখন– জুলাই ১৯৪৪–জোর লড়াই চলছে। এবং জর্মনদের পিছনে ইতালীয় গেরিলারা (এদের কিছুটা কম্যুনিস্ট, বাকিটা ফ্যাসিস্ট ও নাৎসি-বিরোধী) যেমন জর্মনদের বিরুদ্ধে তীব্র গোপন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তেমনি আপন দেশবাসী ফ্যাশিস্ট ও জর্মন মিত্রদের (অধিকাংশ ক্ষেত্রে তোর চোটে) বিরুদ্ধেও। এবং দেশবাসীর বিরুদ্ধে লড়াইটাই হয়ে উঠেছিল তীব্রতর, তিক্ততর। রাজনৈতিক আদর্শবাদের জিগির তুলে সবাই আপন আপন শনিধনে লেগে আছে। ইতালি প্রতিশোধের দেশ এমনিতেই আইন আদালত থাকাকালীনও– আর এই অরাজকতার সময় তো কথাই নেই।
.
এমনিতে কিন্তু ইতালীয়রা শান্তিকামী।
তাই তারা খেল গত যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মার।
———–
১. হিটলার স্বয়ং সেই জনতায় ছিলেন। অধুনা এই মহানগরীতে প্রদর্শিত একটি হিটলার-ছবিতে সেটি দেখানো হয়েছে। আসলে যে ফটো থেকে এ অংশ তোলা হয়েছে সেটি পাঠক পাবেন, ফটোগ্রাফার হফমান রচিত হিটলার উয়োজ মাই ফ্রেন্ড পুস্তকে।
২. অনুসন্ধিৎসু পাঠক এ সঙ্গে হুতোম প্যাচার নক্শা কেতাবের গুরুপ্রসাদী অংশটুকু পড়ে দেখবেন।
.
১৩.
ব্যক্তিগত কথা বলতে বাধে। কিন্তু প্রাগুক্ত মহিলা তার শোক সংবরণ করে তার সম-দুঃখে-দুঃখী হৃদয়ের প্রকাশ দেওয়াতে আমিও কিঞ্চিৎ সাহস সঞ্চয় করে আপন অভিজ্ঞতা নিবেদন করি।
আমি বার্লিন যাই ১৯২৯-এ। হিটলার তখন মুনিকের স্থানীয় উষ্ণমস্তিষ্ক রাজনৈতিক পাণ্ড মাত্র। ১৯৩০-এ আমি রাইনল্যান্ডের বন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসি। সেখানে হিটলারের কোনও প্রতিপত্তি ছিল না বললেই চলে।
বন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার গভীর অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব হয় আমার এক সতীর্থ পাউল (Paul) হরস্টারের সঙ্গে। সে পড়ত আইনশাস্ত্র এবং সঙ্গে সঙ্গে তুর্কি ও আরবি-ইচ্ছা ছিল ডক্টরেট নেবার পর ফরেন আপিসে ঢুকবে। আমারও অপশনাল ছিল আরবি। সেই সূত্রে উভয়ের পরিচয় ও অত্যল্পকালের মধ্যেই গভীর সখ্য…। পাউলের বাপ-মা বাস করতেন নিকটবর্তী ডফ শহরে। এক উইক-এন্ডে সে আমায় নিয়ে গেল তাদের বাড়িতে। মা কখনও ইন্ডিয়ান দেখেননি। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মন স্থির করতে পারছেন না, আমার জন্য কোন কোন কন্তু রান্না করবেন। আমরা সবাই রান্নাঘরে বসে– কোন একটা কথাচ্ছলে পাউল বলল যে, আমার মা সুদূর ভারতে প্রতিদিন আমার প্রত্যাগমন প্রতীক্ষা করছে। শোনামাত্র পাউলের মা তার দু হাত দিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে দ্রুতপদে চলে গেলেন পাশের ঘরে।
অনেকক্ষণ পর ফিরে এসে ফের রান্নায় মন দিলেন।
সন্ধেবেলা ড্রয়িংরুমে কফি আর গৃহনির্মিত অতুলনীয় ক্রিমবান (পাটিসাপটার অতি দূর-সম্পর্কের ভাই) খাচ্ছি এমন সময় একটি অতিশয় সুপুরুষ যুবক এসে ঘরে ঢুকল। সঙ্গে একটি সুন্দরী। কিন্তু এ যুবক যত্রতত্র সর্বত্র যেরকম পুরুষ-নারী উভয়ের বিমোহিত দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, সঙ্গের যুবতীটি ততখানি না। পরস্পরের পরিচয়দির লৌকিকতা অবহেলে, সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সোজাসুজি আমার কাছে এসে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে বলল, আমি আপনাকে চিনি; পাউলের বন্ধু। আর আমি ওই রাসকেলটার দাদা কার্ল। এবং এই রমণীটি আমার শিরঃপীড়া, অর্থাৎ আমার ভামিনী।
আমি ঘন ঘন হাত ঝাঁকুনি দিতে দিতে বললুম, আমার কাছে শিরঃপীড়ার অত্যুত্তম ভারতীয় হেকিমি দাওয়াই আছে। দেব আপনাকে। কিন্তু ডাক্তারের ফি দিতে হবে। শিরঃপীড়াটি দূরীভূত হলে সেটি অপরাধ নেবেন না, স্যর সেটি কি আমি পেতে পারি?
কার্ল তো তার পাঁজরের দু পাশ দু হাত দিয়ে চেপে ধরে, কোমরে দু ভাজ হয়ে দুলে দুলে গমগম করে হাসে আর বার বার বলল, আমার তো ধারণা ছিল, পুরবীয়ারা (প্রাচ্যদেশীরা) রসিকতা করতে জানে না– সর্বক্ষণ মোক্ষ, নির্বাণ, স্যালভেশনের চিন্তায় মশগুল! তা, ব্রাদার, কিছু মনে কর না। আমার শিরঃপীড়ার একটি কনিষ্ঠা ভগিনী আছে- একেবারে কামানের গোলা। গেল বছরে মিস্ রাইনল্যান্ড হয়েছেন। নেবে সেটি?
ইতোমধ্যে লক্ষ করলুম কার্লের বউ লজ্জায় একেবারে পাকা টমাটো!
ঝপ করে একটা সোফাতে বসে বলল, কিন্তু তোমাতে-আমাতে আর আপনি চলবে না। বুঝলে? তার পর, হা, কী যেন বলতে এসেছিলুম। আজ সন্ধ্যায় আমার ফ্ল্যাটে পার্টি। পাউল তোমাকে নিয়ে আসবে। ঠিক আছে তো!
আমি বললুম, অতি অবশ্যই। প্লেজার অনার। কিন্তু সেই যে আরেকটি শিরঃপীড়ার কথা বলছিলেন, তিনিও আসবেন কি?
তার পর আর কাকে পায় কে? তার হাসি আর কিছুতেই থামতে চায় না।
শেষটায় কার্ল তার বউকে আমার পাশে বসিয়ে দিয়ে বলল, মায়ের সঙ্গে দুটি কথা কয়ে নিই। তার পর বউকে ফিসফিস করে শুধোল, ওকে তো ডাকা হয়নি। লাস্ট মোমেন্টে আসতে পারবে কি? তুমি দেখ তো।
উত্তরের প্রতীক্ষা না করে সোজা গিয়ে মায়ের কোলে দুম্ করে বসে পড়ল– ট্যারচা হয়ে। বাঁ হাত দিয়ে মায়ের বা বাহু চেপে ধরে, ডান হাত দিয়ে মায়ের ঘাড় পেঁচিয়ে নিয়ে মায়ের গালে ঘন ঘন চুম্বন।
স্পষ্ট শুনতে পেলুম, মা বলছেন, ওরে গরিল্লা, ওঠ, ওঠ, আমার লাগছে!
আমি জানতুম, তখন সে ঘরে সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় জন আমি- যদ্যপি আমি কোনও পির প্যাকম্ব নই– নিতান্ত বিদেশি এবং তারও বাড়া ভারতীয় বলে। তাই আমি অক্লেশে বুঝতে পারলাম, কার্ল আমাকে ছেড়ে তার মায়ের কাছে চলে গেল কেন। সামান্য ড্রইংরুমে কে কার পাশে বসে, তাতে কি-বা যায়-আসে! কিন্তু সে তার মাকে বোঝাতে চেয়েছিল, যে-ই আসুক যে-ই থাক, তার কাছে তার মা-ই সবচেয়ে আকর্ষণীয়।
কার্লের বউ ক্লারা আমাকে বলল, আমার বোন নিশ্চয়ই আসবে। তার অন্য এনগেজমেন্ট থাক আর না-ই থাক।
আমি বললুম, তার অন্য এনগেজমেন্ট হয়তো তার লাভার, তার ইয়ংমানের সঙ্গে। তাকে নিরাশ কাটা কি উচিত হবে, এই আনন্দের দিনে? তাকেও ডাকুন না অবশ্য যদি আপনাদের অন্য কোনও সুবিধা না থাকে।
ক্লারা আমার দিকে বিস্মিত নয়নে তাকাল।
আমি বুঝতে পেরেছি।
আমি শান্ত কণ্ঠে বললুম, আপনি ঘাবড়াচ্ছেন যে আমাতে আর আপনার বোনের লাভারেতে খুনোখুনি হবেনা? নিশ্চিন্ত থাকুন, কিচ্ছুটি হবে না। সে কি আপনার বোনকে বিয়ে করার প্রস্তাব পেড়েছিল?
এ যাবৎ করেনি। কেমন যেন গড়িমসি করছে।
দৃঢ় কণ্ঠে আমি বললুম, আজ রাত্রেই সে প্রস্তাব পাড়বে।
???
আমি আপনার বোনের সঙ্গে একটুখানি ভাবসাব করতেই সে রেগে, চটে, হিংসায় জর্জর হয়ে, আমাকে ঢিড় দেবার জন্য আজ রাতদুপুরেই সে প্রস্তাব পাড়বে। হল?
সে সন্ধ্যায় কার্লের বাড়িতে জব্বর পার্টি হল। আমার তিনটি জিনিস মনে আছে।
কার্ল যখন আমাদের নাচের জন্য পিয়ানো বাজাচ্ছিল তখন আমার নজর গেল তার হাত দু পানির দিকে। সেই হাতের আঙুলগুলো তঙ্গী দীর্ঘ, অথচ সেগুলোর তুলনায় বাকি হাত আরও ছোট। এতে যেন কোনও পোপরশন নেই। কিন্তু কী সুন্দর! এরকম হাতের বর্ণনা দেবার শক্তি আমার নেই। বারবার আমার চোখের সামনে ফুটে উঠল আমার মায়ের হাত দুটি।
.
গভীর রাত্রে বাড়ি ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়েছি।
এমন সময় কে যেন আমার খাটের বাজুতে এসে বসল। আধো ঘুমে শুধালুম, কে?
আমি পাউলের মা। আমি শুধু বলতে এসেছিলুম, এই যে আমার পাউল, সে সপ্তাহের ছ দিন থাকে বন শহরে, প্রতি শনিবার ছুটে আসে আমার কাছে। আর বন তো এখান থেকে দূরে নয়। ডাকগাড়িতে আধঘন্টার পথ মাত্র। তবু আমি এই ছ দিন কী ছটফটই না করি।
আর তোমার মা? তিনি থাকেন কত সমুদ্রের ওপার।
তার দিন কাটে কী করে?
তুমি খুব তাড়াতাড়ি পাস দিয়ে বাড়ি চলে যাও।
তার পর আমার কপালে চুমো দিলেন। আমার মনে হল, এ তো আমারই মায়ের চুমো।
.
১৪.
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে অকস্মাৎ অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে হিটলারের দল জর্মন পার্লিমেনটে এত অধিক সংখ্যক আসন পেয়ে গেল যে তার গুরুত্ব জর্মনির বাইরে তো বটেই, ভিতরে অল্প লোকই হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিল। কম্যুনিস্টরা ঠিক-ঠিকই বুঝেছিলেন কিন্তু স্তালিন তখন আপন ঘর সামলাতে ব্যস্ত এবং বিশ্বস্বনজোড়া প্রলেতারিয়া রাজ্য স্থাপনের সদিচ্ছা তিনি তখন প্রায় ত্যাগ করেছেন। জর্মন কম্যুনিস্টরা বাতুশকা স্তালিনের কাছ থেকে সাহায্য পেল অত্যল্পই।
পাঠক হয়তো আশ্চর্য হবে যে, আমার সতীর্থ পাউল হস্টারের অগ্রজ কাল কিন্তু ঠিক-ঠিক বুঝে গিয়েছিল, দেয়ালে কী লিখন লেখা হয়ে গেল
আকাশে বিদ্যুত্বহ্নি কোন অভিশাপ গেল লিখি।
১৯৩২-এর বড়দিনের পরবে গেলুম ড্যুসলডর্ফ।
রান্নাঘরে বসে কার্ল-পাউলের মার সঙ্গে রসালাপ করছি।
এমন সময় কার্ল এসে ঘরে ঢুকল। প্রথম মাকে গণ্ডা দুই চুমো খেয়ে আমাকে দিল গণ্ডাখানেক। কুশলাদির লৌকিকতা বর্জন করে সরাসরি শুধাল–
হেই, ভাইয়া, জর্মন পলিটিক্স কিছু রপ্ত করতে পেরেছিস?– এক বছর তো হয়ে গেল এই লক্ষ্মীছাড়া দেশে এসেছিস?
আমি উন্মা প্রকাশ করে বললুম, পফুই (অর্থাৎ ছিঃ!), এমন কথা বলতে নেই। মুখে ঘা (কুণ্ঠ ঘা-টা আর বললুম না) হবে। জর্মনি কান্ট-গ্যোটে, বেটোফেন ডুরারের দেশ। কিন্তু, বাওয়া, তোমাদের পলিটিক্সের জট ছাড়ানো আমাদের গান্ধীরও কম্ম নয়। হালে একখানা চটিবই কিনেছি। জর্মনের ছাব্বিশ না আঠাশখানা পার্টির (বাপস!) ঠিকুজি-কুলজি দপে দপে তাতে বয়ান আছে। পড়েছিলুম কবে! এখানও মাথাটা তাজ্জিম-মাজ্জিম করছে।
পরম অবহেলা ভরে বলল, ছেঃ! তোদের না থ্রি হানড্রেড মিলিয়ান গডেসেস আছে! হিসাব রাখিস কী করে? তোদের আবার লাকি দেশ– কার্ড ইনডেকসিঙের গব্বযন্তনা সেখানে এখনও পৌঁছয়নি। তা সেসব কথা যাক। ইতোমধ্যে তোকে একটি মহামূল্যবান সদুপদেশ দিচ্ছি– তোর সেই রাম আহাম্মুখীর সাক্ষাৎ ডক্টরেট-সার্টিফিকেট ওই পার্টি পঞ্জিটি সিকি দরে বিক্রি করে দে– তোর চেয়েও প্রাইজ-ইম্বোইল এ দেশে রাইন নদের সামোন মাছের মতো আবজাব করছে। নইলে শিকের হাঁড়িতে (ওদের ভাষায় মাটির নিচের সেলারের কয়লা গুদোমে) তুলে রেখে দে। দরকার মাফিক ওরই পাতা ছিঁড়ে ঘরের স্টোভে আগুন ধরাবি। কিন্তু সেকথাও থাক। আসল তত্ত্বকথাটা শোন।
তার পর সত্যি অত্যন্ত সিরিয়াস মুখে বলল– কার্লকে এই প্রথম আমি গম্ভীর হতে দেখলুম– বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। জানিস, হিটলার রাইখস্টাগে অনেকগুলো সিট পেয়ে গিয়েছে।
আমি হেসে উঠলুম। এ যেন পর্বতের মূষিকপ্রসব!
ইতোমধ্যে পাউল রান্নাঘরে ঢুকে মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আলুর খোসা ছাড়াচ্ছিল। লক্ষ করলুম, আমার হাসির সঙ্গে হামদরদী দেখিয়ে দোহারের মতো স্মিত হাস্য সে করল না– যা সে আকছারই করে থাকে। মায়ের মুখে কোনও ভাবের খেলা নেই।
কার্ল কোনওদিকে খেয়াল না করে আমাকে সরাসরি শুধোল, তুই হিটলারের মাইন কামপফ (বাঙলাতে মোটামুটি আমার সংগ্রাম) পড়েছিস?
আমি হাত জোড় করে বললুম, রক্ষে দাও বাবা! ও বই আদ্যন্ত পড়া আমার কর্ম নয়। একে তো তোমাদের এই জর্মন ভাষাটি এমনই প্যাচানো-জড়ানো, ইংরেজিতে যাকে বলে ইনভলভড, এবং নিদেন বিশ-ত্রিশটি লাইনের ন্যাজ না খেলিয়ে তোমাদের একটা সেনটেন্স সম্পূর্ণ হয় না, তদুপরি তোমাদের ওই হিটলারবাবু যেন মাথায় গামছা বেঁধে বেল্ট টাইট করে, মোজা উপর বাগে টেনে নিয়ে, গণ্ডারের চর্বির টনিক বেয়ে উঠেপড়ে লেগে গেছেন, সরল জিনিস কী কৌশলে দুরহ করা যায় অবশ্য আমার জর্মন জ্ঞান যা, সেটা তো নাথিং টু রাইট হোম এবাউট! তবে, হ্যাঁ, বিস্তর হোঁচট খেয়ে চোট-জখম হজম করে খাবলা মেরে মেরে মোদ্দা কথা কটি ধরে নিয়েছি।
কার্ল মাইন কামপফ-এর ভাষা বাবদ সায় দিয়ে বলল, তোর জর্মন ভাষা-জ্ঞানের কথা উঠছে না। ওই আকাট ব্যাটা হিটলার তো আসলে কথা কয় পশ্চিম অস্ট্রিয়ার অতিশয় চোতা জর্মন ডাইলেক্টে। তদুপরি তার গায়ে রয়েছে চেক রক্ত, কেউবা বলে দু-চার ফোঁটা ভ্যাগাবন্ড জিপসি নাপাক খুনও তাতে মেশানো রয়েছে। এরকম দু-আশলা, সাড়ে তিন আশলা লোক, তদুপরি উনিশটি বার ম্যাট্রিকে সে ঘায়েল হয়ে থামল শেষে সে আবার লিখবে জর্মন? তা তার লেখার ধরন যত না মারাত্মক, তার চেয়ে তার প্রোগ্রামটা ঢের ঢের বেশি মারাত্মক। ইহুদি জাতটাকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে, ফ্রান্স দেশটাকে উড়িয়ে দিতে হবে এবং সর্বশেষে রাশার বৃহদংশ দখল করে সেখানকার চাষাভুষোদের রীতিমতো গোলাম বানিয়ে, যাকে বলে স্লেভ লেবার, জর্মনদের জন্য ফোকটে দেদার দেদার রুটি মাখন আণ্ডা বেকন লুট করতে হবে। সে-ও না হয় বুঝি, এই বিরাট দুনিয়ায় কত না তরো-বেতরো গুণ্ডা-গ্যাংগস্টার হয়– অতি অবশ্য আমার ধর্ম-বুদ্ধি এতে একদম সায় দেয়, কিন্তু যে করাল বিভীষিকা আমি চোখের সামনে দেখছি সেটা এই যে, হিটলারের এই শয়তানি স্বপ্ন সফল তো হবেই না, মাঝখান থেকে লক্ষ লক্ষ জর্মন যুদ্ধে মারা যাবে, তাবৎ জর্মন দেশটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে এই যে–
আমি বাধা দিয়ে বললুম, ব্রাদার কার্ল, এসবের অধিকাংশ ভোট পাবার জন্য পোলিটিক্যাল প্রোপাগান্ডা। আমাদের রাজা ইংরেজ বলে, তাদের খেদমত করলে খুব শিগগিরই আমরা সবাই রাজা হয়ে যাব, কংগ্রেস বলে, ইংরেজকে তাড়িয়ে দিলে আমরা রাজা না, মহারাজা হয়ে যাব। আমি অবশ্য জিনিসটা বড্ড ক্রুড ভাষায় বলছি। কম্যুনিস্টরা বলে—
হঠাৎ লক্ষ করলুম, কার্লের মুখের উপর দিয়ে যেন একটা উড়ো মেঘের ছায়া পড়ে মিলিয়ে গেল। আমি শুধালুম, কার্ল, তুমি কি কমুনিস্ট
এককালে ছিলুম। বছর দুই হল পার্টি মেম্বারশিপ রিজাইন দিয়েছি। ওই সময় থেকে চাদাও আর দিইনি।
কেন?
সেকথা আরেকদিন হবে।
.
গোটা ১৯৩১টা আসন্ন পরীক্ষা নিয়ে আমি এমনই ব্যস্ত ছিলুম যে, ডুসলডর্ফ যেতে পারিনি। এমনকি ১৯৩১-এর বড়দিনটাতেও ফুরসত করে উঠতে পারলুম না।
১৯৩২ পরীক্ষা পাস করে জর্মনি ত্যাগ করার পূর্বে একদিনের তরে ডুসলডর্ফ গেম হরস্টার পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্য। আমার কপাল মন্দ, কার্ল শহরে ছিল না। বড় বিষণ্ণ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে, বন হয়ে ইতালিতে এসে জাহাজ ধরলুম।
১৯৩২ কেটে গেল। পাউলের চিঠিপত্র পাই।
১৯৩৩-এর জানুয়ারি মাসে হিটলার জর্মনির চ্যান্সেলর বা কর্ণধার হলেন।
তার দু মাস পরে পাউলের একখানা অতি ক্ষুদ্র চিঠি পড়ে আমি স্তম্ভিত। কালকে জর্মনির গোপন পুলিশ অ্যারেস্ট করে নিয়ে গিয়ে নির্জন কারাবাসে রেখেছে। বেল পাওয়ার কোনওই আশা নেই। তার বিরুদ্ধে গোপন বা প্রকাশ্য কোনও আদালতে যে মকদ্দমা উঠবে তার সম্ভাবনাও অতিশয় ক্ষীণ।
.
১৫.
১৯৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফেরার পর ৩৩-এর সম্পূর্ণ বছরটি কাটাই দেশের ছোট শহরে মায়ের সঙ্গে। সুদীর্ঘ, প্রায় তিন বছর পর ফের মায়ের কাছে ফিরে এসেছি। এর পূর্বেও, অর্থাৎ ১৯২১ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত আমি মায়ের কাছে এসেছি পুজো আর গরমের ছুটিতে, মাত্র কয়েকদিনের, কয়েক সপ্তাহের জন্য। আমি পেয়েছি মায়ের সঙ্গ-সুখ, মা-ও পেয়েছে আমার সঙ্গ-সুখ– ফের আমাকে দেশ ছাড়তে হবে, এই আসন্ন বিচ্ছেদের তীক্ষ্ণ তলওয়ার সূক্ষ্ম একটি চুলে ঝুলছে অবশ্য অহরহ মায়ের মাথার উপর। কে বেশি আনন্দ পেয়েছিল সেটির মীমাংসা আমি নিজে করবার হক ধরিনে। আমার পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে যেসব মাতা ও সন্তান আছেন তাদের হাতেই শেষরায়ের জিন্মেদারি ছেড়ে দিলুম। আর যেসব সন্তানের মা তাদের অল্প বয়সে স্বর্গলোকে চলে গেছেন সেসব দুঃখীদের কথা আমি মোটেই ভাবতে চাইনে।
আমি জানি, আমার যেসব পাঠিকা মা, তাঁরা আমাকে একটা মূর্খ ধরে নিয়ে (এবং আমি সে ধরে-নেওয়াটার বিরুদ্ধে সূচ্যগ্র পরিমাণ আপত্তি মুহূর্তে তরে তুলব না, কারণ আমার পিঠপিঠ দাদা এখনও আমাকে নিত্যনিয়ত অকাট্য যুক্তিপ্রমাণসহ পদ্মভূষণের পরিবর্তে গণ্ডমূর্খ অলিম্পিক ইডিয়েট খেতাব দেয়) বলবেন, অতি অবশ্যই মাতা পুত্রের সঙ্গসুখ পুত্রের তুলনায় বহুগুণে, বহু উৎকর্ষে, বহুতর আনন্দ-ঘন চরম তৃপ্তি পরমারাম পায়। শুধু তাই নয়, পুত্রের জন্যও সে সঙ্গে সঙ্গে এক মহামিলনের মহানন্দময় মহোৎসবের সৃষ্টি করে– কারণ মা তার স্বভাবজনিত নিঃস্বার্থপরায়ণতায় চায়, সন্তানও যেন তারই মতো এমনকি তারও বেশি পরিপূৰ্ণানন্দ লাভ করে। কিন্তু সন্তান কি সেটা পারে পুত্র যুবা। সে চায়, মায়ের ভালোবাসার বাইরেও অনেক কিছু খ্যাতি, প্রতিপত্তি, অর্থবৈভব; তদুপরি সে কামনা করে অন্য রমণীর যৌবন-মদিরারা প্রণয় এ-ও কি তখন সম্ভবে, যে, সে তখন শিকালে যেরকম একাগ্রচিত্তে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে মাতৃস্তন শোষণ করেছিল আজও সেইরকম : তার মাতৃস্নেহসিক্ত সঙ্গসুজাত আনন্দযজ্ঞ থেকে সেই প্রকারেই একাগ্রচিত্তে বাহ্যজ্ঞানশূন্য প্রতিটি মধুকণার সৌরভম্বন আনন্দরস নিঃশেষে শোষণ করবে। সেই শিশু জন্মলাভের পরই মায়ের বামস্তন ওষ্ঠাধর দ্বারা অবিরত নিষ্পিষ্ট করে যেন মাতৃদেহের শেষ রক্তবিন্দু লুণ্ঠন করে নিয়েছে, তার বামহস্ত মাতার দক্ষিণ স্তনের উপর রেখে সেই ক্ষুদ্র হস্তাঙ্গুলির কোমল পরশ দুইয়ে আরও দুগ্ধ আরও অমৃতের আহ্বান জানাচ্ছে।
ইতোমধ্যে মধ্যে মধ্যে তার অতি হ্রস্ব, অতিশয় ফীত বাম পদ দিয়ে মাতার দেহে মধুর মধুর পদাঘাত করছে।
সুশীল পাঠক! তুমি হয়তো ভাবছ, আমি যশোদানন্দন শ্রীশ্রীবালকৃষ্ণের কাব্যচ্ছদে বাধা মাতৃদুগ্ধ পান এতশত যুগ পরে কেন গদ্যময় নীরস ভাষায় পুনরায় পরিবেশন করছি। কিন্তু আমি জানি, প্রকৃত বৈষ্ণবজন বিশেষ করে আমার মুরুব্বি শ্ৰীযুত হরেকৃষ্ণ, আমার এ অনধিকার চর্চা অবহেলে এবং সস্নেহে ক্ষমা করবেন। নিবেদন, আমার বিশেষ উদ্দেশ্য আছে।
এই যে আমি আমার মাকে অনেকখানি হতাশ-নিরাশ করলুম (অবশ্য সব মা-ই সেটা মাফ করে দেয়), তার তুলনায় আমার মা কী করল?
আমার বয়স যখন চৌত্রিশ তখন আমার মা ১৯৩৮ সালে আমাকে ছেড়ে ওপারে চলে গেল। সেই বিচ্ছেদের পর আমি আরও চৌত্রিশ বৎসর ধরে এ সংসারে সেই মায়ের বিরহযন্ত্রণা কতখানি নিতে পারি, তারই চেষ্টা করছি।
এইবারে আমি পূর্বোল্লিখিত উদ্দেশ্য খুলে বলছি
যে-মা আমার দু মাস এক বৎসর এবং সর্বাধিক, পৌনে তিন বৎসরের বিচ্ছেদ সইতে পারত না বলে দিনে দিনে ফরিয়াদ করত, সেই মা-ই আমার জন্য রেখে গেল চৌত্রিশ বৎসরের বিচ্ছেদ-বেদনা।
করজোড়ে স্বীকার করছি আমার মা আমাকে যতখানি ভালোবেসেছিল তার তুলনায় আমার ভালোবাসা নগণ্য। কিন্তু মাকে দিয়েছিলুম মাত্র পৌনে তিন বৎসরের বেদনা। তার বদলে মা আমাকে দিল চৌত্রিশ বৎসরের বিরহ। আমি কোনও ফরিয়াদ, কোনও নালিশ করছিনে। আল্লা আমার মায়ের পূতাত্মা তার পদপ্রান্তে নিয়ে মাকে তার বহু দুঃখ বহু বিরহযন্ত্রণা থেকে শাশ্বত নিষ্কৃতি দিয়ে তাকে সর্বানন্দাতীত চরমানন্দ দিয়েছেন।
স্পর্শকাতরতাহীন পাঠক শুধোবেন, কার্লের কথা কও। তোমার মায়ের কথা এ স্থলে টেনে আনছ কেন?
কালকে জেলে নিয়ে যায় ১৯৩৩-এর বসন্তে। তার পর এল ইস্টারের পরব। ওই সময় আমি পাউলের সঙ্গে প্রতি বছর সডর্ফ গিয়ে সপরিবারে কার্ল এবং পাউল পরিবারের সঙ্গে পরব পালন করতুম। ওই সময়ে প্রভু যিশু ক্রুশবিদ্ধ হন এবং সপ্তাহান্তে তিনি পুনরুত্থান করেন।
১৯৩২-এর পরবের সময় আমি দেশে। কার্ল-পাউল আমাকে রঙিন কার্ড পাঠায়; সঙ্গে দীর্ঘ আবোল-তাবোল-ত্র নানাপ্রকারের কেচ্ছা-কাহিনী।
১৯৩৩, কার্ল জেলে। কিন্তু মানুষ অসম্ভবের আশা ত্যাগ করতে পারে? আমার ছিল দুরাশা, হয়তো হিটলার-রাজ এই সময়ে একটা মহানুভব ব্যত্যয় করে কার্লকে চিঠি লিখতে দেবে।
না। এমনকি পাউলও চিঠি লেখেনি। শুধু কার্ল-পাউলের পিতা আমাকে একটি পিকচার কার্ড পাঠিয়েছে। তার উপরে বৃদ্ধ পিতার কম্পিত হস্তে, কোনওগতিকে লেখা আমার প্রতি আশীর্বচন।
ইতোমধ্যে প্রতি সপ্তাহে প্রতি চিঠিতে বার বার পাউলকে শুধোই (তখন অ্যারমেল হয়নি), কালের খবর কী? কার্লের খবর জানাও।
পাউল উত্তরে আমার মূল প্রশ্ন এড়িয়ে যায়। তার বাপ-মা, কার্লের বউ-বাচ্চা সম্বন্ধে অনেককিছু লেখে।
তার পর একটা চিঠিতে লিখল, সডর্ফের জেলে সুপারিনটেনডেন্ট আমাকে একপাশে টেনে নিয়ে নিতে বলেছে, আমি যেন আমার দাদার অতখানি তত্ত্বতাবাশ না করি। নইলে আমাকেও তারা জেলে পুরতে বাধ্য হবে। আমি তাকে দেখতে যাচ্ছি।
তখনও নাৎসি পার্টি পরবর্তী যুগের চরমতম পৈশাচিক বর্বরতায় পৌঁছয়নি। তাই জেলের কর্তা পাউলকে এই সহানুভূতির উপদেশ দিয়েছিল।
এ চিঠি পেয়ে আমি দুর্ভাবনা দুর্ভাবনায় কাতর হয়ে পড়লুম।
তার পর দু মাস ধরে, পুর্ণ দু মাস ধরে পাউল সম্পূর্ণ নীরব। আমার তখন কী অবস্থা সেটা বোঝাই কী প্রকারে?
আমার মা আমার মনমরা ভাব বেশ লক্ষ করেছে। একদিন শুধোল, হ্যাঁ রে, তোর কী হয়েছে। বিদেশি চিঠি পেলেই তুই শুয়ে পড়িস কেন?
আমি সবকথা খুলে বললুম।
কার্লের মা-ও মা, আমার মা-ও মা।
আমার মা বলল, সে কার্লের জন্যে দোওয়া মেঙে তার জন্য নফল নামাজ পড়বে।
ততদিনে বড়দিন এসে গেছে। বড়দিন শেষ হল।
কিন্তু পাউল কিংবা তার বাপ-মা কারও কোনও চিঠি নেই।
ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকে পাউলের চিঠি এল।
সংক্ষেপে লিখেছেঃ
ক্রিসমাসের সন্ধ্যায় দাদা আত্মহত্যা করেছে। কোনও এক সদাশয় জেলগার্ড দাদাকে এক প্যাকেট সিগারেট দেয়- গোপনে। দেশলাই পুড়িয়ে পুড়িয়ে সিগারেটের খোলে সে লিখে গিয়েছে, মাকে সান্ত্বনা দিও। গার্ডটিই আমাকে সেটা পৌঁছিয়ে দেয়।
চিঠি যখন পড়ছি আমার মা তখন সম্মুখে ছিল। শুধোল, হ্যাঁ রে, কী খবর পেলি? তোর বন্ধু ভালো আছে তো?
আমি সত্য গোপন করিনি।
মা দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নামাজের ঘরের দিকে চলে গেল।
.
১৬.
কার্ল-এর কথা শেষ হয়েছে। তথাপি বিবেচনা করি কোনও কোনও সহানুভূতিশীল তথা কৌতূহলী পাঠক-পাঠিকা জানতে চাইবেন যে, কীসব দুর্দৈব কোন সব নিপীড়নের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে একদিন কারাগারের পাষাণপ্রাচীর ভেদ করে কার্লের কাছে দিব্যজ্যোতি উদ্ভাসিত হল যে এ জীবন নিরর্থক; কিংবা হয়তো কোনও কোনও মনস্তত্ত্ববিদ বিজ্ঞানসম্মত মীমাংসা প্রকাশ করে বললেন, কার্ল অংশত মতিচ্ছন্ন অবস্থায় স্বেচ্ছায় এ সংসার থেকে বিদায় নেয়–কার্ল সম্পূর্ণ সুস্থাবস্থায় কি কখনও তার সে মায়ের কাছ থেকে চিরবিদায় নিতে পারত, যে-মাকে সে এতখানি প্রাণঢালা সোহাগ করত, তার জায়া তার শিশুকন্যাকে সে প্রাণাধিক ভালোবাসত। কবি বলেছেন–
কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়?
এরই কাছাকাছি একটি অনুভূতি প্রকাশ করেছেন, কার্লেরই সমগোত্রীয় হিটলারবিরোধী এক শহিদ। ইনি জর্মনিতে কার্লের মতো অজানা-অচেনা জন নন। উলরিব ফন্ হাসেল ছিলেন ইতালিতে জর্মন রাজ্যের মহামান্য রাষ্ট্রদূত। বিদগ্ধ পণ্ডিতরূপে তিনি ইংল্যান্ড থেকে বুলগেরিয়া, রুমানিয়া পর্যন্ত সুপরিচিত ছিলেন এবং বহু দেশে বহু পণ্ডিতমণ্ডলীর আমন্ত্রণে বহু জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেন। হিটলারের প্রকৃত স্বরূপ সম্বন্ধে স্থিরচিয় হওয়ামাত্রই তিনি সেই সম্মানিত রাষ্ট্রদূতের পদ ত্যাগ করেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে হিটলারকে নিধন করার যে ষড়যন্ত্র নিল হয় তারই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার দরুন সেপ্টেম্বর মাসে তিনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। অর্থাৎ কার্লের আত্মহত্যার এগারো বৎসর পর।
ফন হাসেল কিন্তু এক হিসেবে কার্লের চেয়ে সৌভাগ্যবান ছিলেন। নির্জন কারাগারে তিনি কাগজ-কলম পেয়েছিলেন বলে তিনি তার আত্মচিন্তার কিছুটা লিখে যাবার সুযোগ পান।
সেই আত্মচিন্তা পাণ্ডুলিপির মার্জিনে আসন্ন মৃত্যু অনিবার্য জেনে তিনি মাত্র তিনটি ছন্দে গাধা ছত্রে মৃত্যু সম্বন্ধে তার আশাভরা অনুভূতি প্রকাশ করেন।
তুমি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারো মৃত্যুদ্বার দিয়ে
আমরা তখন যেন স্বপ্ন-সম্মোহিত
এবং অকস্মাৎ আমাদের করে দিলে মুক্ত।(১)
সেই রবীন্দ্রনাথের এই দুয়ারটুকু। এটি পার হতে কার্ল, ফন্ হাসেল কারও কোনও সংশয় ছিল না।
১৯৩৩-এর বড়দিনে কার্ল ওপারে চলে যায়।
১৯৬৪-এর গ্রীষ্মে আমি অপ্রত্যাশিতভাবে ফের জমনি যাই।
বন শহরের আমার এক প্রাক্তন অধ্যাপকের সঙ্গে বাস করছি। পাউলকে চিঠি লিখলুম। সে জানাল, ইতোমধ্যে তার মা কার্লের সান্নিধ্যে চলে গিয়েছেন। তার বাপ পেনশন পেয়েছেন। পাউল লিখেছে, না পেলেই ভালো হতো, বুড়ো একটা কিছু নিয়ে থাকতে পারত। এখন সে তার জাগ্রতাবস্থার অধিকাংশ সময় কাটায় রান্নাঘরের সেই ভাঙা কৌচটার উপর যেখানে বসে বসে মাকে সঙ্গ দিত; পূর্বেরই মতো– কিন্তু এখন একা একা, এবং প্রায় সমস্ত দিনরাত্রি আগে অন্তত ন ঘন্টাটাক আপিসে কাজকর্ম করত। আর সমস্তুক্ষণ আগেরই মতো সিগার ফোকে। তবে আগে ফুকত তামাম দিনে গোটা ছয় মোলায়েম সিগার; এখন গোটা আঠারো এবং এ দেশের সবচেয়ে কড়া সিগার। আমি অনুরোধ করাতে মাসি এসেছে। মাসি মায়েরই মতো ভালো রাঁধতে পারে। আগে বাবাই সেকথা বার বার স্বীকার করেছে। এখন শুধু খুঁতখুঁত করে। লক্ষ করলুম, পূর্বের প্রথামতো পাউল যথারীতি আমাকে ডুসলডর্ফ যাবার নিমন্ত্রণ জানায়নি।
বেদনা পাওয়ার কথা ছিল; আমি পেলুম শান্তি-স্বস্তি।
পাউল বন শহরে এসে আমাদের ছাত্রাবস্থার পাব-এ রাঁদেভু স্থির করল।
কুশল আলিঙ্গনাদির পর পূর্বের প্রথামতো সে আধলিটার বিয়ার অর্ডার দিয়ে গেলাসটার দিকে অনেকক্ষণ ধরে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। শেষটায় একচুমুকে আধগেলাস শেষ করে বলল, কীই-বা তোকে বলি, যা তুই শুনতে চাস। কার্ল ধরা পড়ার একমাস পর এল ইন্টার পরব। কর্মে তার বিশেষ মতিগতি ছিল না কিন্তু ধর্মের পরব, লৌকিকতা নিয়ে সে হই-হুঁল্লোড় করতে বড় ভালোবাসত। নানা রঙের কাগজের ডিম মুড়ে সেগুলোকে চিত্র-বিচিত্র করা থেকে শুরু করে, নিতান্ত বাচ্চাদের মতো সেগুলোকে কল্পনাতীত অদ্ভুত অদ্ভুত জায়গায় লুকনো, তার পর আমাদের সব্বাইকে নিয়ে বিকট চিৎকার লাফালাফি দাপাদাপি করে সেগুলো খেজা, তার বউ যেগুলো লুকিয়েছিল সেগুলো খুঁজে পাওয়াতে রেড-ইন্ডিয়ান স্টাইলে তার তা নৃত্য, তার উকট উদ্দাম জয়োল্লাস– এসব কথা সে নিশ্চয়ই জেলে বসে বসে ভেবেছিল।
আমার চোখে জল এল। বললুম, পাউল, তোর মনে আছে ৩২-এর পরবে কার্ল তোর মারফত আমাকে এক ডজন রঙিন ডিম পাঠিয়েছিল?
পাউল মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বলল, তুই তো সর্ব ধর্ম নিয়ে নাড়াচাড়া করিস তোর অজানা নয়, অনেক ক্যাথলিক ইস্টারকে বড়দিনের চেয়ে বেশি সম্মান দেয়। ওই সময় প্রভু যিশু মৃত্যুবরণ করার সময়েও তার নিপীড়নকারীদের ক্ষমা করে যান। এই ইন্টার সপ্তাহটি ক্ষমতা, দয়া, মৈত্রীর সপ্তাহ। আমার সব নৈরাশ্য তখন দুরাশা দিয়ে চেপে ধরে ইস্টার ফ্রাইডে থেকে ইস্টার মানডে অবধি চারদিন রোজ গিয়েছি জেলখানায়, যদি এই ক্ষমাদয়ার সপ্তাহে ওরা একটু নরম হয়। মাকে না জানিয়ে। পাউল থামল।
আমি বললুম, বুঝেছি, তুই বলে যা। আমি দেশে থাকতে সব শুনতে চেয়েছিলুম। এখন আর না। তুই সংক্ষেপে সার।
পাউল বলল, তার দু মাস পরে এল তার মেয়ের নামকরণ দিবস।(২)
কার্ল ওইদিনই করত তার বাড়ির সবচেয়ে জব্বর পরব। মেয়েকে সাজাত শুভ্রাতি সাদা রেশমি জামা-কাপড়ে আর হল্যান্ড থেকে কেনা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম লেস ঝালরে।
কার্ল জেলে। হয়তো ভাবছে মা কী করে বাচ্চাটিকে সান্ত্বনা দিচ্ছে যে আজ সেরকম পরব হচ্ছে না কেন?
তার পর এল কার্লের বাৎসরিক বিবাহোৎসব।
এসব কটা পরব পড়ে এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর মাসে। শুধু তার বউ আর আমাদের মার নামকরণ দিবস পড়ে জানুয়ারি থেকে মার্চে।
এ সব কটা দিনে কাল কারাগারে কী বেদনা অনুভ করেছিল তার খানিকটা কল্পনা আমি করতে পারি। আর সেই দরদী গার্ড আমাকে তার শেষ মেসেজ দিয়েছিল সে আমাকে কিছুটা বলেছিল। কার্ল নাকি তাকে তার পরিবারের প্রতি পর্বদিন ওকে ওই সম্বন্ধে একটু-আধটু বলত।
তার পর বড়দিন এল। সে আর যে সইতে পারল না। সেকথা তোক তো চিঠিতে লিখেছিলুম। তার দু-একদিন পর আমি একটু সুযোগ পেয়ে পাউলকে শুধালুম, আচ্ছা পাউল, কার্ল তো হিটলার জর্মনির সর্বেশ্বর হওয়ার দু বৎসর পূর্বে পার্টি ছেড়ে দেয়, চাদা বন্ধ করে! তবে ওকে ধরল কেন?
পাউল ক্ষণমাত্র চিন্তা না করে বলল, কিন্তু পার্টি কি ছাড়ে (আমাদের ভাষায় কমলি নহি ছোড়তি) কার্ল ছিল পার্টির সবচেয়ে সেরা যুক্তিতর্কসিদ্ধ মেম্বার এবং উত্তম বক্তা। হিটলার ফুর্যার হওয়ার পর যেসব মাতব্বর কমুনিস্টদের গ্রেফতার করা হয় তাদের প্রায় সক্কলেরই নোটবুকে কার্লের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেল। আমি ওদের দোষ দিইনে; কিন্তু নাসিরা স্বভাবতই ধরে নিল এরকম একজন সর্ব-কম্যুনিস্ট-মান্য লোককে বন্ধ করে রাখাই সেফার।
.
পাঠক হয় তো শুধোবেন ‘কত না অশ্রুজল’-এ আমি কার্লের শেষ চিঠিকে যথাযথ মূল্য দিয়ে গোড়ার দিকেই ছাপালুম না কেন? কিন্তু যেখানে আমি অত্যুকৃষ্ট শেষ বিদায়ের চিঠিগুলো অনুবাদ করছি, সেখানে মাকে সান্ত্বনা জানিয়ে তিনটিমাত্র শব্দ, সেগুলোর কী অধিকার ওদের সঙ্গে সমাসনে বসার
———–
১. অধুনা অনেকেই জৰ্মন শিখছেন, তাই মূল পাঠ তুলে দিলুম;
Du kannst uns durch des Todes Nueren
Trtaunend fuehren
Und machest uns Uns auf einmal frel.
২. ক্যাথলিকরা জন্মদিন পালন করে না। ঠাট্টা করে বলে, শ্যাল-কুকুরেরও তো জন্মদিন আছে। তারা পালন করে যে সন্তের নামে বাচ্চার নাম দেওয়া হয়েছে (যেমন পাউল, মারিয়া মেরি, ইত্যাদি) তার সেন্ট পদবি প্রাপ্তির দিন। এটাকে বলে, নামেন্সটাগ্।
চুম্বন
ঘটনাটা সাচ্চা না গুল, হলফ করে বলতে পারব না, কিন্তু তাতে কণামাত্র যায়-আসে না। রসের বিচারে সত্য না অসত্য, ভালো না মন্দ, প্রাকৃত না অপ্রাকৃত, এসব মাপকাঠি, কষ্টিপাথর সম্পূর্ণ অবান্তর। ডানালা অশ্ব অর্থাৎ পক্ষিরাজ ঘোড়া কখনও হয়?… রাক্ষসীই হয় না, তার ওপর তার প্রাণ নাকি কোন এক সাত সাগরের অতল তলে কৌটোর ভিতর রয়েছে তোমরা রূপে। সেই ভোমরাকে চেপটে তেলে না মারা পর্যন্ত ওই রাক্ষসীর উপর যতই খঞ্জর-খাস্তার, বন্দুক-কামান চালাও না কেন, সে মরবে না। এইসব অবাস্তব ব্যাপার নিয়ে যখন ঠাকুমা রূপকথা বলেন তখন কি সর্বাঙ্গে শিহরণ কম্পন রোমাঞ্চন হয় না? মধ্যরজনী অবধি ঠাকুমাকে জাবড়ে ধরে বিনিদ্রাবস্থায় কাটে না?
হালে জনৈক পাঠক আমায় জানিয়েছেন, আমার সদ্য প্রকাশিত উপন্যাসের শহর-ইয়ার নামক রমণী বঙ্গদেশের মুসলিম সমাজে কখনওই থাকতে পারে না। এ চরিত্রটি সম্পূর্ণ অবাস্তব। প্রত্যুত্তরে আমার বক্তব্য অবাস্তব হলেই যে রসের পর্যায়ে পৌঁছয় না, এ হুকুম দিয়েছেন কোন রসরাজ তা হলে পূর্বোক্ত পক্ষিরাজের বাচ্চা ঘোড়া, রাক্ষসীর কৌটোতে রাখা ভোমরা প্রাণ এসব কোনওপ্রকারেরই রসসৃষ্টি করতে পারে না। ওই অকরুণ পাঠক যদি বলতেন, শহর-ইয়ার বাস্তব হোক, অবাস্তব হোক, এটা রসের পর্যায়ে পৌঁছয়নি, তা হলে আমি চাঁদপানা মুখ করে সেটা সয়ে নিতুম। কারণ এটা রুচির কথা, রসবোধের কথা। আমার আরও পাঁচজন পাঠক-পাঠিকা রয়েছেন। তারা হয়তো বলবেন, না; শহর-ইয়ার রসসৃষ্টি করেছে। অতএব এ লড়াই করবেন আমার পাঠকমণ্ডলী। আমি মুক্তি বা ঝিনুক। আমার পেটে জন্মেছে শহর-ইয়ার মুক্তো। জহুরিরা এর মূল্য বিচার করবেন। ওই অকরুণ পাঠকের মতো কেউ বলবেন, এটার মূল্য একটা কানাকড়িও নয়। আবার কেউ কেউ হয়তো বলবেন, না হে না, অত হেনস্তা করো না। মুক্তোটা তো নিতান্ত হাবিজাবি বলে মনে হচ্ছে না।
এই মতভেদের মাঝখানে দুই পক্ষের কেউই তখন বলবেন না, ওই ঝিনুকটাকে ডাকো না কেন? সেই-ই তো এটার জন্ম দিয়েছে। সে-ই বলুক, এটার দাম কত?
বিচক্ষণ পাঠক, চিন্তা করো, সেই ঝিনুক, যে ইতোমধ্যে মরে দু ফাঁক হয়ে গিয়েছে, তাকে কোন মূর্থ নিয়ে আসবে নিউমার্কেটের জউরি বাজারে, কিংবা আমস্টারডামের মণিমুক্তোর মক্কা-মদীনায়। সে এসে ফাইনাল ফৈসালা করবে, মুক্তোটির মূল্য কী হবে! তাজব কি বাৎ!!
সহজতর উদাহরণ দিতে গেলে বলতে হয়, নেপোলিয়নকে যিনি জন্ম দিয়েছিলেন তার সে-জননীই কি নেপোলিয়নের সর্বোত্তম জীবনী লেখবার হক ধারণ করেন।
কিন্তু এসব কচকচানি থাক। যে কাহিনীটি বলতে যাচ্ছিলুম সেইটে নিবেদন করি।
ইয়োরোপের কোনও এক বিখ্যাত নগরে মোকদ্দমা উঠেছে এক চিত্রকরের বিরুদ্ধে। তিনি একটা এজিবিশনে একাধিক ছবির মধ্যে দিয়েছেন সম্পূর্ণ নগ্না এক যুবতীর চিত্র। পুলিশ মোকদ্দমা করেছে, নগ্না রমণীর চিত্র অশ্লীল, ভালগার, অসিন, পর্নগ্রাফিক। এ-ধরনের ছবি সর্বজনসমক্ষে প্রদর্শন করা বেআইনি, ক্রিমিনাল অফেন্স।
আদালতের এজলাসে বসেছেন গণ্যমান্য বৃদ্ধ জজসাহেব, এবং জুরি হিসেবে ছ জন সম্মানিত নাগরিক।
এককোণে সেই নগ্ন নারীর লাইফ সাইজ তৈলচিত্র। তাবৎ আদালত সেটি দেখতে পাচ্ছে। দুই পক্ষের উকিলদের তর্ক-বিতর্কের মাঝখানে হঠাৎ জজ-সাহেব চিত্রকরের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি বলছেন, এ ছবিটা অশ্লীল নয়। আচ্ছা, তা হলে অশ্লীল ছবি কাকে বলে সেটা কি এই আদালত তথা জুরি মহোদয়গণকে বুঝিয়ে বলতে পারেন?
চিত্রকর ক্ষণমাত্র চিন্তা না করে উত্তর দিলেন, নিশ্চয়ই পারি, হুজুর। তবে অনুগ্রহ করে আমাকে মিনিট-দশেক সময় দিলে বাধিত হব।
জজ-সাহেব বললেন, তথাস্তু!
চিত্রকর তার উকিলের কানে কানে ফিসফিস করে কী বললেন সেটা বাদবাকি আদালত শুনতে পেল না।
সাত-আট মিনিট যেতে-না-যেতেই উকিলের এক ছোকরা কর্মচারী চিত্রকরের হাতে ছবি আঁকার একটা রঙের বাক্স তুলে দিল। চিত্রকর সঙ্গে সঙ্গে তার নগ্না রমণীর ছবির সামনে গিয়ে রঙতুলি দিয়ে একে দিলেন নগ্নার একটি পায়ে সিল্কের একটি মোজা।
জজের দিকে তাকিয়ে বলেন, হুজুর, এ ছবিটা এখন হয়ে গেল অশ্লীল!
তাবৎ আদালত থ। জজ বললেন, সেটা কী প্রকারে হল? আপনি তো বরঞ্চ মোজাটি পরিয়ে দিয়ে নগ্নার দেহ কঞ্চিৎ আবৃত করলেন?
চিত্রকর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, এই কথঞ্চিৎ আবৃত করাতেই দেওয়া হল অশ্লীলতার ইঙ্গিত। এতক্ষণ মেয়েটি ছিল তার স্বাভাবিক, নৈসর্গিক, নেচারেল নগ্নতা নিয়ে যে নগ্নতা দিয়ে সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেক নরনারী পশুপক্ষীকে ইহ-সংসারে প্রেরণ করেন। এবারে একটি মোজা পরে মেয়েটা আবরণ দিয়ে অশ্লীল সাজেশন দিল তার আবরণহীনতার প্রতি। এখন যদি কেউ এ ছবিটা দেখে মনে করে, কোনও গণিকা তার গ্রাহকদের লম্পট কর্ম-প্রবৃত্তি উত্তেজিত করার জন্য একটিমাত্র মোজা পরেছে তবে আমি দর্শককে কণামাত্র দোষ দেব না।
চিত্রকরের বিবৃতিতে সম্মানিত জজ তথা জুরি-মহোদয়গণ সন্তুষ্ট হয়েছিলেন কি না, সেকথা আমার মনে নেই, তবে আমার উনিশ বৎসর বয়সে যে-সময় কিশোর মাত্রেরই হৃদয়ানুভূতি নারী-রহস্য সম্বন্ধে কৌতূহল, কবিগুরু যা অপূর্ব ব্যঞ্জনা দিয়ে প্রকাশ করেছেন :
বালকের প্রাণে
প্রথম সে নারীমন্ত্র আগমনী গানে
ছন্দের লাগালো দোল
আধো-জাগা কল্পনার শিহরদোলায়,
আঁধার আলোর দ্বন্দে।
যে প্রদোষে মনেরে ভোলায়,
সত্য অসত্যের মাঝে
লোপ করি সীমা
দেখা দেয় ছায়ার প্রতিমা।
সে বয়সে পূর্বোক্ত চিত্রকর-কাহিনী আমার মনে গভীর দাগ কেটেছিল। তার সাত বৎসর পর কিম্মৎ আমাকে নিয়ে গেলেন প্যারিসে। কারও দোষ নেই, আমি স্বেচ্ছায় গেলুম, এ জীবনের প্রথম ক্যাবারে দেখতে।
বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, আমার সর্বপ্রথমই মনে হয়েছিল, এ কিশোরী যুবতীরা কী অনবদ্য সুন্দর স্বাস্থ্যই না ধরে! সুডৌল পরিপূর্ণ স্তনদ্বয়, তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে–মোটা-না-সৰু যুগল বাহু, নাতিক্ষীণ কটিচক্র, পুষ্টধর উরুযুগ এবং দেহের উত্তরাধের কুচদ্বয়ের সঙ্গে পরিমাণ রেখে তরঙ্গিত নিতম্বদ্বয়। আমি দীর্ঘ পাঁচ বৎসর ধরে স্বাস্থ্যবতী সাঁওতাল রমণী এবং অন্তত একটি মাস রাজপুতানী দেখেছি। এদের সঙ্গে আমি প্যারিসের ক্যাবারিনীদের সৌন্দর্যের তুলনা করছিনে। আমি করছি স্বাস্থ্যের। সেখানে প্যারিসিনীরা বিজয়িনী।…এবং আরেকটা জিনিস লক্ষ করেছিলুম। প্যারিসিনীরা যখন নাচছিল তখন তাদের নাভিকুণ্ডলীর চতুর্দিকে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাংসপেশি নাভিকে কেন্দ্র করে চক্ৰাধারে ঘুরে যাচ্ছিল। নদীতে যেরকম অতি ক্ষুদ্র দয়ের চতুর্দিকে স্রোতের চাপে ঘূর্ণায়মান আবর্ত সৃষ্ট হয়। ঠিক এই অদ্ভুত সৌন্দর্যটি আমি ইতোপূর্বে দেখেছিলাম একমাত্র রাজপুতানায়। সেখানকার কুমারীরা মাথার উপর দুটো-তিনটে জলে-ভর্তি ঘড়া-কলসি চাপিয়ে বাড়ি ফেরে। ওরা তো তখন হাটে না। যেন নাচতে নাচতে এগিয়ে যায়। তাই ওদের নাভিকুণ্ডলীর চতুর্দিকে প্যারিসিয়ান নর্তকীদের মতো সৃষ্ট হয় সেই দ, সেই আবর্ত। অপূর্ব সে দৃশ্য!
নমস্য চিত্রকর নন্দলাল, এই সচল ডাইনামিক চক্রাবর্তন তুলে নিয়েছেন এক অচল স্টাটিক ছবিতে। সেখানে সেই রাজপুতানীর নাভিকুণ্ডলীর দিকে খানিকক্ষণ তাকালেই চোখে ধাঁধা লাগে; মনে হয় নাভির চতুর্দিকে যেন চর্কিবাজি ঘুরেই যাচ্ছে, ঘুরেই যাচ্ছে।… এই হল সার্থক শিল্পীর কলাদক্ষতা। সচলকে অচলতা দিয়ে, অচলকে সচলতা দিয়ে মূর্তমান করতে পারেন।
কিন্তু এ-বর্ণনা আর বাড়াব না। আমার বক্তব্য বোঝাবার জন্য নিতান্ত যেটুকু প্রয়োজন। সেইটুকুই নিবেদন করি।
ক্যাবারিনীদের পরনে ছিল উক্তমার্ধে অতি সূক্ষ্ম, প্রায় স্বচ্ছ, শরীরের মাংসের সঙ্গে রঙ-মিলিয়ে চীনাংশুকের গোলাপি ব্রাসিয়ের। অধমার্ধে ছিল কটিসূত্র–সোজা বাংলায় যাকে বলে ঘুনসি। সেই ঘুনসি থেকে নেবে গিয়েছে চার আঙুল চওড়া, ঠিক, আমাদের পালোয়ানদের নেঙট, অবশ্য সাইজে তিনগুণের একগুণ, আকারে ত্রিকোণ, এবং সেটি ঘুরে গিয়ে পিছনের কটিমধ্যে যেখানে ঘুনসির সঙ্গে গিঠ খেয়েছে সেখানে সে ঠিক ঘুনসিরই মতো একটি সূক্ষ্ম সূত্ররূপ ধারণ করেছে।
নৃত্যের সর্বশেষ দৃশ্যে ক্যাবারিনীরা তাদের ব্রাসিয়ের খুলে খুলে স্টেজের চতুর্দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ছড়াতে আরম্ভ করলেন।
এস্থলে এসে পাঠক আমাকে লম্পট ভাবুন আর যাই ভাবুন, হক কথা বলতে গাফিলি করব না। যা থাকে কুল-কপালে!
এর পর আমি ভেবেছিলুম নর্তকীরা তাদের অধমার্ধের অঙ্গবাসও খুলে ফেলবেন। তা যখন হল না, তখন আমি আমার সঙ্গীকে শুধিয়ে জানতে পারলুম, আইনানুযায়ী স্টেজে সম্পূর্ণ নগ্ন হওয়া নিষিদ্ধ। অবশ্য বেআইনিভাবে গোপনে সম্পূর্ণ নগ্ননৃত্যের ব্যবস্থার অভাবও প্যারিসে নেই।
এরা যখন নাভির নিচের কাপড়টুকু খুলল না তখনই আমার মনে হল এবারে পাঠক নিশ্চয় বিস্মিত হবেন– এ নৃত্য এবারে হয়ে গেল অশ্লীল। আমার মনে হল, সেই চিত্রকরের আঁকা একটিমাত্র মোজা অশ্লীলতম ইঙ্গিত দিচ্ছিল, এখানেও হুবহু তাই, বরং বলব অশ্লীলতর, অশ্লীলতম। এরা যদি একেবারে নগ্ন হয়ে যেত তবে এরা সেই চিত্রকরের নগ্ন রমণীর মতো (একটি মোজা পরানোর পূর্বে) হয়ে যেত সরল স্বাভাবিক নৈসর্গিক নেচারেল। এদের সেই একচিলতে দক্ষিণার্ধবাস তখন দিতে লাগল অশ্লীলতম ইঙ্গিত চিত্রকরের মোজাটির ইঙ্গিত তার তুলনায় কিছু না।
তখন হঠাৎ মনে পড়ে গেল, এক নেটিভ স্টেটের জনৈক মহারাজা ভাস্কর্যশিল্পের প্রকৃত সমঝদার ছিলেন। তিনি ইয়োরোপ থেকে অনেকগুলো প্রথমশ্রেণির মূর্তির প্লাস্টার-কাস্ট নিয়ে এসে তার জাদুঘরটি সত্যকার দ্রষ্টব্য প্রতিষ্ঠান করে তুলেছিলেন। কিছু কিছু মূর্তি ছিল সম্পূর্ণ নগ্ন– পুরুষ রমণী দুই-ই। একদিন মহারানি গিয়েছেন সেই জাদুঘর দেখতে। তিনি তো শকড়। হুকুম দিলেন নগ্নমূর্তিগুলোর কোমরে গামছা বেঁধে দিতে? পাঠক ভাবুন, রোমান মূর্তির কোমরে (বাধিপোতার?) গামছা! সে কী বেপ দেখতে! কিন্তু এহ বাহ্য।… অজ পাড়াগাঁয়ে লোক, সে-শহরে এলে চিড়িয়াখানা এবং এই জাদুঘরটিও দেখতে আসত। এক ছুটির দিনে আমি জাদুঘরের এটা-সেটা দেখছি, এমন সময় একটি গামছা-পরা মূর্তির সম্মুখে তিনজন গামড়িয়া– চাষাই হবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আমি গুঁড়িগুড়ি তাদের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালুম এবং নিম্নোক্ত সরেস কথোপকথন শুনতে পেলুম।
প্রথম চাষা : মূর্তিটার কোমরে গামছা কেন? (আমি বুঝলুম, ওই অঞ্চলের একাধিক মন্দিরে নগ্নমূর্তি দেখেছে বলে এ-প্রশ্নটা তুলেছে।)
দ্বিতীয় চাষা : শুনেছি, মহারানি নাকি ন্যাংটো মূর্তি আদপেই বরদাস্ত করতে পারেন না। তারই ইকুমে গামছা পরানো হয়েছে।
পূর্ণ এক মিনিটের নীরবতা। তার পর—
তৃতীয় চাষা : (ফিসফিস করে) মহারানির পাপ মন।
আমার এই অভিজ্ঞতা সমর্থন করেন, এই জাদুঘরের ধুরন্ধর পণ্ডিত জর্মন উচ্চতম কর্তা! জাদুঘরে গাইয়াদের ভিড় লাগলেই তিনি তার একাধিক কর্মচারীকে নিযুক্ত করতেন ওদের পিছনে গা-ঢাকা দিয়ে ছবিমূর্তি সম্বন্ধে ওদের টীকাটিপ্পনী শুনে তাঁকে রিপোর্ট দিতে।… এ-দেশ ছাড়ার সময় তিনি আমাকে বলেন, শহুরেদের তুলনায় এদেশের জনপদবাসীদের সরল স্পর্শকাতরতা অনেক বেশি। এরা যেমন কালীঘাটের পট দেখে আনন্দ পায়, ঠিক তেমনি ইউরোপীয় মডার্ন ছবি দেখেও সুখ পায়। এবং বললে বিশ্বাস করবেন না, গগন ঠাকুরের কিউবিস্ট ছবিও এদেরকে হকচকিয়ে দিতে পারে না। তবে এগুলো সম্বন্ধে মতামত দেবার পূর্বে এবং আকছারই লোহার উপর হাতুড়িটি মারে মোক্ষম–অনেকখানি চিন্তা করে তবে বলে। আরও একটা মোস্ট ইনট্রিসটিঙ এবং ক্যারাকটেরিস্টিক ফ্যাক্ট–এরা থ্রি-ডাইমেনশনাল, রিয়ালিস্টিক, রঙিন ফটোগ্রাফের মতো ছবি বাবদে উদাসীন (যেগুলো শহুরেরা পছন্দ করেন)। এই হল আমার কর্মচারীদের রিপোর্ট। অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। কারণ, হা-হতোস্মি, এই কর্মচারীরা অন্যান্য শহুরেদের মতো পছন্দ করে রঙিন ফটোগ্রাফের মতো ছবি।
আমি শুধালুম, নিউড?
যার ডিরেক্টর তাজ মেনে বললেন, নিউড। এসব গ্রাম্য লোক সুস্থ স্বাভাবিক যৌনজীবন যাপন করে। উত্তম বলদের সঙ্গে জাতগাভীর সম্বন্ধ করায়। পথেঘাটে কুকুর-বেড়ালের সম্পর্ক দেখে ছেলেবেলা থেকেই। এদের ভিতরে তো কোনও ঢাক-ঢাক গুড়গুড় নেই। এরা তো শহুরেদের মতো সেক্সার্ভড় বা পার্ভার্স নয়। এরা নড দেখে সরলচিত্তে, রস পায় অনাবিল হৃদয়ে।
কী বলতে গিয়ে কী বলে বলে কহাঁ কহা মুলুকে চলে এলুম! কিন্তু বিচক্ষণ গ্রাম্য পাঠক অনায়াসে বুঝতে পারবেন আমার এসব আশকথা-পাশকথা আমার মূল বক্তব্যের সৎ বুনিয়াদ নির্মাণ করছে।
তা হলে ফিরে যাই ফের সেই ক্যাবারেতে; বরঞ্চ বলি, ততক্ষণে আমি সখাসহ নৃত্যশালা ত্যাগ করে রাস্তায় নেমে পড়েছি। আমি পুরিটান নই, নটবরও নই। তাই এসব অশ্লীল ইঙ্গিত আমার ভালো লাগে না। ওই জর্মন পঞ্জিতের ভাষায় বলতে গেলে আমি গ্রামাঞ্চলের সাধারণ স্বাভাবিক জনপদপ্রাণী। তদুপরি আমি বুদ্ধ। আমি চট করে উত্তেজিত হইনে, ঝপৃ করে মাটির সঙ্গে মিলিয়েও যাইনে।
রাস্তায় নামার পর সখা বলল, তা হলে চলো, পুরোধাক্কা উলঙ্গ নৃত্যে।
আমি আঁতকে উঠে বললুম, সর্বনাশ! সে জায়গার টিকিটের মূল্য তো বিলেতের পঞ্চম জর্জের মুকুটের কূ-ই-নূরের চেয়ে খুব কিছু একটা কম হবে না। আমার পকেটে সে-রেও নেই।
সখা জানতেন আমি বুদ্ধু। তাই শান্তকণ্ঠে বললেন, একদম নগ্ননৃত্যের আসরে টিকিটের দাম ঢের টের কম। ওগুলো বিলকুল পপুলার নয়।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলুম, যেটি এ-লেনে আমার একমাত্র বক্তব্য।
সম্পূর্ণ নগ্ননৃত্য তা অত্যন্ত স্বাভাবিক, নৈসর্গিক নেচারেল জিনিস। সেটা দেখতে যাবে কে? প্যারিসে বেড়াতে আসে সাধারণত বিদেশিরা। তাদের অনেকেই মরবিড়, নপুংসক পার্ভার্স। তারা, এবং অম্লাধিক ফরাসিরা যায় ওইসব অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ নৃত্যে। তারা তো নেচারেল নগ্ননৃত্য দেখতে চায় না। এইটেই আমার মূল বক্তব্য।
সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি খোলা অতিষ্ঠ হয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। সে-বিবৃতিতে তিনি একটা অশ্লীল ফিল্মের সাতিশয় ভসনাপূর্ণ বর্ণনা দিয়েছেন। যুবক নায়ক যুবতী নায়িকা একটা টিলার সানুদেশে একে অন্যের অতিশয় পাশাপাশি লম্ববান হয়ে গড়গড়িয়ে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছেন এবং একে অন্যের প্রতি কুৎসিততম জঘন্যতম যৌনইঙ্গিত দিচ্ছেন। এটা কেন হল, তার বিশ্লেষণ শ্ৰীযুত খোলা করেননি। বোধহয় প্রয়োজন বোধ করেননি। পাঠকদের সহৃদয়, অনুমতি নিয়ে আমি তার বিশ্লেষণ করি।
যেহেতু এ-দেশের ফিল্মে চুম্বন, আলিঙ্গন, নগ্নতা দেখানো বেআইনি তাই ফিলু-নির্মাতা রগরগে ছবি বানিয়েছেন যৌন-সম্পর্কের প্রতি অশ্লীল ইঙ্গিতের আশ্রয় নিয়ে বহু যেরকম নগ্লাকে মোজা পরিয়ে, কাব্যের নৃত্যের শেষ কটিবস্ত্র উন্মোচন না করে।
আমার মনে প্রশ্ন জাগে, চুম্বন নগ্নতার বাধা-নিষেধ যদি আজ তুলে দেওয়া হয় আর্টের খাতিরে (অবশ্যই সেটা কঠিন প্রশ্ন, ফিল্মে আর্ট বলতে আমরা কী বুঝি, এ নিয়ে সুযোগ পেলে পরবর্তীকালে আলোচনা করব), তবে কি আমাদের ফিল-নির্মাতারা সঙ্গে সঙ্গে উদোম নৃত্য আরম্ভ করে তাদের ফিল্ম চুম্বনে নগ্নতায় ভরপুর, টইটম্বুর করে দেবেন?
হয়তো গোড়ার দিকে কিছুটা বাড়াবাড়ি হবে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, তারা শিগগিরই বুঝে যাবেন যে, সাধারণ দর্শক তিন মিনিটব্যাপী চুম্বন, পাঁচ মিনিটব্যাপী নগ্নতা প্রদর্শন দেখবার জন্য অত্যধিক ব্যাকুল নয়। ঠিক যেরকম পূর্বেই নিবেদন করেছি, প্যারিসের পরিপূর্ণ নগ্ননৃত্য দেখবার জন্য মানুষ হই-হুঁল্লোড় লাগায় না।
আইন দরকার, ব্যান্-এরও আয়োজন আছে।
কিন্তু মনে রাখা উচিত, কোনও কোনও দেশে মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়ার পরও সেসব দেশে খুনের সংখ্যা বেড়ে যায়নি।
হালে ডেনমার্কে সর্বপ্রকার অশ্লীল সাহিত্যের উপরকার ব্যান তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে কোথায় না অশ্লীল সাহিত্যের বিক্রি হুশ হুশ করে বেড়ে যাবে, রাম ব্যাপারটা উল্টো বুঝেছেন। অশ্লীল মালের পাবলিশাররা মাথায় হাত দিয়ে ফুটপাতে বসে গেছেন। তাঁদের বিক্রি শতকরা ৭০ ভাগ কমে গেছে। কারণ মানুষের লোভ নিষিদ্ধ ফলের প্রতি। ইংরেজিতে প্রবাদ : A stolen kiss is sweeter than any other.
এ বাবদে শেষ আপ্তবাক্য বলেছেন একটি সুরসিকা ফরাসি মহিলা। আমেরিকায় তখন লরেন্স মহাশয়ের লেডি চ্যাটারলি পুস্তক অশ্লীল কি না, সেই নিয়ে মোকদ্দমা চলছে। লেডি চ্যাটারলি পক্ষের উকিল (লেডি চ্যাটারলির লাভার না, লেডি চ্যাটারলির লয়ার) হুতাশনসদৃশ প্রজ্বলিত ভাষায় তাঁর বক্তৃতা শেষ করে অনুপ্রেরণিত কণ্ঠে বললেন, লেখকরাজ লরেন্স এই পুস্তক দ্বারা যৌন-সম্পর্ককে অকল্পনীয় স্বর্গীয় স্তরে (স্পিরিচুয়াল লেভেলে) তুলে ধরেছেন।
এই বিবৃতিটি পড়ে সেই ফরাসি মহিলাটি একটু দুষ্টহাসি হেসে বললেন, সর্বনাশ। এখন তা হলে যৌন-সম্পর্কের অর্ধেক আনন্দই মাঠে মারা গেল। আমি তো অ্যাদ্দিন জানতুম, এটা পাপাচার!
ত্রিমূর্তি
প্রখ্যাত রুশ ঐতিহাসিক মিখাইল গুস্ একটি বড় খাঁটি তত্ত্বকথা বলেছেন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাবলির কথা আজ আমরা স্মরণ করি এজন্য যে, যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য আমরা তা থেকে শিক্ষা নিতে পারি। এরকম একটা শিক্ষা হল যে, আমাদের যুগে বিশ্ব আধিপত্য বিস্তারের যে কোনও রকম দাবি এক সামগ্রিক ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। হিটলারের পদানুসরণ যারা করতে চায়, তাদের সকলের প্রতি এ হল এক গুরুতর হুশিয়ারি। (১)
কমরেড পণ্ডিত গুসের কথার পিঠ-পিঠ আমি কোনও মন্তব্য করার দস্তু ধরিনে। আমি অন্য এক মনস্তত্ত্ববিদের একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি মাত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে নরনবের্গ শহরে যখন গ্যোরিঙ, হে, কাইটেল প্রভৃতি জনা বিশেকের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা চলছিল তখন প্রখ্যাত মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ ডাক্তার কেলি দিনের পর দিন হাজতে ওদের মনঃসমীক্ষণ করার পর দেশে ফিরে গিয়ে বলেন, হিটলারের মতো ডিক্টেটর এবং নাসি পার্টির মতো পার্টি পৃথিবীর যে কোনও দেশে যে কোনও সময়ে পুনরায় দেখা দিতে পারে। তাই আমার মনে ভয় লাগে, কমরেড় গুসের গুরুতর হুশিয়ারি সত্ত্বেও এ গর্দিশ পুনরায় যে কোনও দিন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তবু যদি রুশ তরিশ গুস্-এর এ হুশিয়ারি (অস্তরজ্বননা!) মেনে নেন তবে ক্রমে ক্রমে চীন এমনকি মার্কিনও হয়তো রুশের সৎ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবেন এরকম একটা আশা করা যেতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইয়োরোপের পঞ্চপ্রধান ছিলেন, হিটলার স্তালিন মুসসোলিনি রোজোভেন্ট এবং চার্চিল। এদের প্রথম তিনজন ছিলেন কট্টর ডিক্টেটর; বাকি দুজন গণতন্ত্রের প্রতিভূ। প্রথম তিনজন রণাঙ্গ(২)নে নামেননি বটে, কিন্তু তাবং যুদ্ধের নীতি পদ্ধতি ইত্যাদি (স্ট্র্যাটেজি; মাঝে-মধ্যে ট্যাটিক পর্যন্ত) সম্বন্ধে তারা পরিষ্কার, কঠিন নির্দেশ দিতেন রণাঙ্গনে অবতীর্ণ জঙ্গিলাটদের। রোজোভেল্ট চার্চিল সেরকম করেননি। এরা তাদের জঙ্গিলাটদের যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য এবং নীতি সম্বন্ধে নির্দেশ দিয়ে বাদবাকি সবকিছু ওদেরই হাতে ছেড়ে দিতেন। তবে বলা হয়, রণাঙ্গনে যুদ্ধে লিপ্ত জঙ্গিলাটদের রুটিন কর্মে নাক গলাতেন (ইনটারফিয়ার করতেন) ডিক্টেটরদের ভিতর হিটলার প্রচুরতম ও গণতন্ত্রের প্রতিভূ চার্চিল অনেকখানি।
এই পঞ্চপ্রধানের যে তিন জঙ্গিলাট খ্যাতি অর্জন করলেন তারা মার্কিন আইজেনহাওয়ার, ইংরেজ মন্টগামেরি। ডিক্টেটররা সর্বদাই সর্বকৃতিতু সম্পূর্ণ পেতে চান বলে তাদের সৈন্যবাহিনীর কোনও সর্বময় কর্তা নিযুক্ত করতে চাইতেন না। তৎসত্ত্বেও ডিক্টেটরের অধীনে থেকেও যিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন তিনি রুশের জঙ্গিলাট মার্শাল গ্রিগরি জুক।
এই তিন জঙ্গিলাট সম্মুখসগ্রামে নেমেছিলেন। এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার কিয়কাল পরেই মার্কিন আইজেনহাওয়ার ও ইংরেজ মন্টগামেরি যুদ্ধক্ষেত্রে আপন আপন অভিজ্ঞতা সবিস্তর বর্ণনা করে গ্রন্থ লেখেন। তৃতীয় বীর জুকফু এ-তাবৎ কিছু লেখেননি। (হয়তো স্তালিন চাননি যে জুক কোনওকিছু লেখেন যাতে করে তার কৃতিত্ব ক্ষুণ্ণ হয়। আমার মনে হয় সেখানে তিনি করেছিলেন ভুল। সেকথা পরে হবে।
এই তিনজনেই হিটলারের সৈন্যবাহিনীকে সম্মুখসগ্রামে পরাজিত করেন। এবং একাধিক মার্কিন, ইংরেজ (ফরাসিও) যদ্যপি স্বীকার করতে রাজি হন না, আমার নিজের বিশ্বাস, হিটলারকে পরাজিত করার প্রধান কৃতিত্ব রুশ জনগণ, স্তালিন ও মার্শাল জুফের। সুতরাং গত বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গন-ইতিহাস জুফের বিবরণীহীন ইতিহাস যেন হামলেটকে বাদ দিয়ে হ্যামলেট নাটক! স্তালিনের মৃত্যুর পর জুকফ অবশ্যই তার গ্রন্থ লিখতে পারতেন। কিন্তু তখন আরম্ভ হয়ে গিয়েছে স্তালিনের চরিত্রের ওপর কলঙ্ক-লেপন। রুশের বড় কর্তারা তখন যে-প্রোপাগান্ডা আরম্ভ করলেন তার মূল বক্তব্য, স্তালিন ছিল সংগ্রামনীতিতে একটা আস্ত বুন্ধু। তার ভ্রান্ত নির্দেশের ফলেই লক্ষ লক্ষ রুশ সে যুদ্ধে মারা যায়। নইলে যুদ্ধ অনেক পূর্বেই খতম হয়ে যেত।
যুদ্ধের পর স্তালিন যদিও জুকফকে নানাপ্রকার নিপীড়ন করেন তবু তিনি এই প্রোপাগান্ডাতে সায় দিতে পারেননি। স্তালিনকে তিনি তার ন্যায্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করতে চাননি। তাই সে সময়েও তিনি কোনওকিছু লিখলেন না।
এর পর স্তালিন-স্মৃতিবিরোধীরাও গদিচ্যুত হলেন।
ধীরে ধীরে স্তালিন সম্বন্ধে রাখার জনসাধারণেরও ধারণা বদলাতে লাগল।
তাই যুদ্ধের চব্বিশ বৎসর পর জুকফ ভার স্মৃতিচারণ ও প্রতিচিন্তা প্রকাশ করেছেন ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে। (এক নম্বর ফুটনোট দ্রষ্টব্য)
যুদ্ধশেষের এই সুদীর্ঘ চব্বিশ বৎসর পর আইজেনহাওয়ার, মন্টগামেরি ও জুকফ এই ত্রিমূর্তির কল্যাণে এখন যুদ্ধক্ষেত্রে হাতেকলমে এরা কোন কোন রণনীতি রণকৌশল অবলম্বন করে অবশেষে জয়লাভ করলেন তার পূর্ণতর ইতিহাস লেখা সম্ভবপর হবে– কোনও যুদ্ধেরই পূর্ণতম ইতিহাস এ পর্যন্ত লেখা হয়নি, এ বেলাও হবে না।
জুকফের মূল গ্রন্থ বা তার পূর্ণ অনুবাদ আমার হাতে কখনও পৌঁছবে না। ইতোমধ্যে রুশ মার্শাল ভাসিলেফস্কি এই গ্রন্থের যে পরিচিতি অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত সারাংশ দিয়েছেন একমাত্র তারই ওপর নির্ভর করে–কথায় বলে অভাবে পড়লে স্বয়ং শয়তানও মাছি ধরে ধরে খায়–ঘরমুখো বাঙালিকে রণমুখো সেপাইয়ের অভিজ্ঞতা শোনাবার চেষ্টা দেব। একেবারে নিষ্ফল হব না। কারণ রণমুখো না হলেও বাঙালি যে ইতোমধ্যে বেশ মারমুখো হয়ে উঠেছে সে তত্ত্ব কি কলকাতা কি মফঃস্বল সর্বত্রই স্বপ্ৰকাশ। শুনতে পাই এর পর তারা নাকি রণমুখো হয়ে লড়াই লড়ে এদেশে প্রলেতারিয়া রাষ্ট্র প্রবর্তন করবে। কিন্তু সেটা আ লা রুস্ (রুশ পদ্ধতিতে রান্না স্যালাড) না, আ লা শিন (চীন পদ্ধতিতে রান্না ফ্রাইড রাইস) হবে সেটি নিয়ে মতভেদ আছে।
রুশ রাজনীতি তথা চীন রাজনীতি সম্বন্ধে আমার কোনওই জ্ঞানগম্যি নেই।
কিন্তু বিস্তর রসানুভূতি আছে উভয়ের সরেস খাদ্যাদি সম্বন্ধে।
তাই ভালোবাসি রাশান স্যালাড, রাশান কাভিয়ার, রাশান বর্শসুপ, রাশান পানীয় (আমি কড়া ভোদকা সইতে পারিনে; পছন্দ করি এবং স্তালিনও ওই খেতেন–উত্তম ওয়াইন, তা সে স্তালিনের জন্মভূমি জর্জিয়ারই হোক বা ককেশাসেরই হোক)।
সঙ্গে সঙ্গে পছন্দ করি চীনা ফ্রাইড রাইস (চীনা হোটেল-বয় বলে ফ্রাইড লাইস অর্থাৎ ভাজা উকুন), স্প্রিং চিকিন, ব্যাঙের ছাতার অমলেট ইত্যাদি।
.
কলকাতার রুশপন্থী কম্যুনিস্টরা একটা মারাত্মক ভুল করছেন। ওঁদের উচিত এ শহরে অন্তত দু গণ্ডা রাশান রেস্তোরাঁ বসানো।
কারণ Love does not go through heart, but through stomach- প্রেম হৃদয়ে সঞ্চারিত হয় না, সঞ্চারিত হয় উদরে–আপ্তবাক্যটি বলেছেন একটি ফরাসিনী সুরসিকা নাগরিক।
———-
১. ভারতে অবস্থিত বিদেশি একাধিক দূতাবাস একাধিক ভাষায় বিস্তর প্রোপাগান্ডা লেখেন প্রকাশ করেন, আমার মতো স্বল্পজ্ঞাত লোকও খান-দশেক পায়। এগুলো পড়তে হলে অনেকখানি ধৈর্যের প্রয়োজন কারণ এদের অধিকাংশই বড় একঘেয়ে।…এরই মধ্যে হঠাৎ একখানি উত্তম চটি পুস্তিকা আমাদের হৃদয়মনকে বড়ই আলোড়িত করেছে। সোভিয়েত সমীক্ষা ৯,৯.৬৯ সংখ্যা, সম্পাদক কোলোকোলো, যুগ্ম সম্পাদক প্রদ্যোৎ গুহ, সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের কলিকাতাস্থিত দূতস্থানে প্রকাশিত।
এই সংখ্যায় আছে দুটি সুলিখিত রচনা :১. মিখাইল গুস কর্তৃক ইতিহাসের শিক্ষা এবং ২, সোভিয়েট ইউনিয়নের জনৈক মার্শাল কর্তৃক সোভিয়েত সৈন্যের উদ্দেশে (মার্শাল জুকভের গ্রন্থ স্মৃতিচারণ ও প্রতিচিন্তার সমালোচনা)। বলা বাহুল্য, আমি যে সব সময় এদের সঙ্গে একমত হতে পেরেছি তা নয়। সান্ত্বনা নিই এই ভেবে যে দেশে-বিদেশের একাধিক কমরেডও হয়তো কোনও কোনও স্থলে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন। বাংলা অনুবাদ কে বা কারা করেছেন তাঁদের নাম নেই। অনুবাদ স্থলে স্থলে ঈষৎ আড়ষ্ট হলেও অতিশয় বিদগ্ধ উচ্চাঙ্গের।
২. মাত্র কয়েকদিন পূর্বে হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড (৩ অক্টোবর ৬৯)-এ জেনারেল শ্রীযুক্ত চৌধুরীর ডিফেন্স স্ট্র্যাটেজি শিরোনামায় লিখিত একটি অতুলনীয় অনবদ্য রচনা পুনর্মুদ্রিত হয়েছে, এটির বাংলা অনুবাদ হওয়া প্রয়োজন। অনেকে হয়তো বলবেন, সাধারণজন, (সিভিলিয়ানরা) যতই সগ্রামশাস্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হবে ততই সে মারমুখো হয়ে পদে পদে লড়াই করতে চাইবে– জিঙ্গোইস্ট বনে যাবে। আমি ভিন্নমত পোষণ করি। আমার বিশ্বাস রাজনীতি কোথায় সমরনীতিতে পরিণত হয়, এ জ্ঞান সাধারণজনের যতই বাড়বে ততই যুদ্ধ সম্বন্ধে তার দায়িত্ববোধও বাড়বে। ঐতিহাসিক মাত্রই জানেন, এ দুনিয়ায় কত-শত বার সিভিলিয়ান পলিটিশিয়ানরা লড়াই করার জন্য যখন হন্যে হয়ে উঠেছে, তখন সেনাবাহিনীর জঙ্গিলাট জাদরেলরা (প্রফেশনাল সোলজাররা) তাদেরকে ঠেকিয়ে সগ্রাম ঘোষণা করতে দেয়নি এবং পরে দেখা গেল ওই করে জঙ্গিলাট জাদরেল দেশকে সর্বনাশ থেকে বাঁচিয়েছেন। অথচ সাধারণজন ভাবে, এরা কথায় কথায় লড়াই শুরু করে দিয়ে পদোন্নতি, মেডেলের জন্য মুখিয়ে আছেন।
৩, কয়েকজন জর্মন জেনারেল লিখেছেন বটে, কিন্তু এদের কেউই সব রণাঙ্গনের পূর্ণাধিকার কখনও পাননি। আর ইতালিয়ান জাদরেলদের সম্বন্ধে নীরবতা হিরন্ময়।
দর্পণ
বছর পনেরো পূর্বে সেই সোনার বাংলা মেতে উঠেছিল রম্যরচনা মারফত রম্যসাহিত্য সৃষ্টি করতে। তার পর সে হুজুগ কেটে যায় তার কারণ বর্ণন উপস্থিত মুলতুবি রাখলুম। বছর পাঁচ-সাত পূর্বে দেখলুম, কেষ্টবিষ্টু তো বটেই, পাঁচু-পেঁচি তক্ ছেড়ে কথা কইছেন না– সবাই লেগে গেছেন, আত্মজীবনী প্রকাশ করতে। সে মোকায় আমারও মনে বাসনা যায় একখানি সরেস আত্মজীবনী ছেড়ে আর পাঁচজনকে ঘায়েল করে দিই, কিন্তু বিধি বাম। ইংরেজিতে প্রবাদ আছে ম্যান প্রোপোজেস, গড় ডিসপোজেস- মানুষ প্রস্তাব পাড়ে (কোনকিছুর কামনা করে) আর ভগবান সমাধান করেন, তার ইচ্ছেমতো। এটা ইংরেজ আমাদের শিখিয়েছেন আর পাঁচটা ভুল জিনিস শেখাবার সঙ্গে সঙ্গে। আপনারা সরলচিত্ত ধরেন, আর ভাবেন, ইংরেজ আমাদের ইংরেজি শিখিয়েছে। বিলকুল ভুল। ইংরেজ নিজে শেখে কিংস ইংলিশ, তার অর্থ, তাদের রাজা- উপস্থিত, রানি যে ইংরেজি ব্যবহার করে। আর আমাদের শিখিয়েছে ব্যাবু ইংলিশ বা বাবু ইংলিশ! আসলে প্রবাদটা ম্যান প্রোপোজেস, উম্যান ডিসপোজেস অর্থাৎ পুরুষ প্রস্তাব করে, স্ত্রীলোকে ফৈসালা করে। প্রবাদে ভেজাল কর্ম কিছু নতুন নয়; স্মরণ করুন বেদনিষ্ঠ সদাচারী ব্রাহ্মণসন্তান দ্রোণাচার্য তার শিশুতনয়কে দুধের পরিবর্তে কী দিয়েছিলেন। কিংবা সদাশয় সরকার– থাক গে আবার শ্বশুরবাড়ি যেতে চাইনে।
শ্বশুরবাড়ি যেতে চাইনে! হেন বাঙাল আছে কি যে শ্বশুরবাড়ি যেতে চায় না? অসার খলু সংসারে সারং মন্দির দেবভাষায় আপ্তবাক্য। ওই তো করলেন ব্যাকরণে ভুল!
আত্মজীবনী লিখি-লিখছি লিখি-লিখছি করছি এমন সময় এক রমণীর পাল্লায় পড়ে আমাকে কয়েক বছর জেলে কাটাতে হয়।
শুনেছি, জরাসন্ধ নাকি চৌদ্দ বছর আলীপুর জেলে কাটান। তার কয়েক বছর পর একদা বাসে করে এই জেলের পাশ দিয়ে যাবার সময় তার বালকপুত্র চিৎকার করে সোল্লাসে তাকে শুধোয়, বাবা, ওইবেনে তুমি চোদ্দ বছর ছিলো না?
বাস-সুদ্ধ লোক তার পানে কটমটিয়ে তাকায়। যদ্যপি গাঁটকাটার চোদ্দ বছর জেল হয় না, তবু সবাই অচেতন মনে আপন আপন পকেটে হাত দিয়ে মনিব্যাগ পাকড়ে ধরে। তা ধরুক। কিন্তু বেচারি জরাসন্ধ বাস-সুদ্ধ লোককে বোঝান কী প্রকারে যে, তিনি জেলে চোদ্দ বছর সুপারিনটেনডেনটের কর্ম করেছেন। বুঝুন ঠ্যালাটা! তাই তো ঋষি বলেছেন, দারা পুত্র পরিবার কে তোমার তুমি কার? পুত্র না হয়ে আর কেউ হলে শান্তস্বভাব তিতিষ্ণু জরাসন্ধ বসিয়ে দিতেন নাকে মোক্ষম এক ঘুষি!
না। আমি জেলে যাই, আইনত, খাস জজসাহেবের হুকুমে। সেকথা যথাসময়ে হবে।
জেলে একজন আরবের সঙ্গে আলাপ হয়–আমি পোরট সইদের একটা গোপন নাইটক্লাবে চাকরি করার সময় কিছুটা আরবি শিখে যাই, ওই ভাষায় কটুকাটব্য করতে ততোধিক।
আরবটি বেশ লেখাপড়ি করেছে। তবু যে কেন জেলে এল তার কারণ একটি সরে ফারসি কবিতাতে আছে।
এক বৃদ্ধ বাজিকর তার ছেলেকে বলছে, দ্যাখ ব্যাটা, এই বয়সেই তুই আমার মতো হুনুরির কাছে সব এলেম রপ্ত করে নে। কী করে পাঁচটা বল নিয়ে লুফোলুফি করতে হয়; টুপির ভিতর থেকে জ্যান্ত খরগোশ বের করতে হয়, হাত-পা বেঁধে বাক্সে ভরে সমুদ্রে ফেলে দিলে বেরিয়ে আসতে হয়।
শুনবি না বুড়ো বাপের কথা তা হলে আল্লার কসম, খুদার কিরে কেটে বলছি, তোকে পাঠাব পাঠশালে, তার পর ইস্কুলে, তার পর কলেজে। এম-এ, পি-এইচ-ডি করে বেরোনোর পর যখন দোরে দোরে ভিক্ষে মাগবি, লাথি-ঝাটা খাবি তখন বুঝবি রে, ব্যাটা, তখন বুঝবি, বুড়ো বাপ হক কথা বলেছিল কি না।
আরবের বেলাও বোধহয় তাই হয়েছিল। কলেজের বিদ্যেতে যখন পেট ভরল না তখন শিখতে গেল বড় বিদ্যে-ল্যাটে গেল, ল্যাটে গেল! বুড়ো বয়সে বিয়ে করা আর বড় বিদ্যে শিখতে যাওয়া একই আহাম্মুকী!
পিরসাহেব সেজে আরবিস্থান থেকে সোনা পাচার করতে গিয়ে শ্রীঘর।
সেকথা থাক। তার কাছে কিন্তু একখানা বই ছিল। সেটি পবিত্র কুরান শরিফ বলাতে জেল-কর্তৃপক্ষ সেটিকে তার কাছে হামেহাল রাখবার অনুমতি দিয়েছিলেন।
অতখানি আরবি বিদ্যে আমার নেই যে, স্বচ্ছন্দে কেতাবখানা পড়ি। তাই আরব বাবাজিই আমাকে পড়ে শোনাত। লেখকের নামটা আমার এখনও মনে আছে। এরকম দেড়-গজি নাম ইহসংসারে বিরল বলে সেইটে বহু তকলিফ বরদাস্ত করে মুখস্থ করে নিয়েছিলুম : আবু উসমান আমর ইবন বহুর উল জাহিজ ধানাই-পানাই বাদ দিলে তার বিগলিতাৰ্থ দাঁড়ায় প্রলম্বিত চক্ষুপল্লব বিশিষ্ট এই জাহিজ লিখেছিলেন তার আত্মজীবনী।
এদেশে যে আরব্যরজনী খুবই প্রচলিত সে তথ্য আরব জানত না। আমি সে আরব্যরজনীর কথা বলছিনে যেটি আপনারা কলেজ স্ট্রিটে পান কেটেছেটে সেটিকে করা হয়েছে গঙ্গাজলে ধোওয়া তুলসী পাতাটির মতো পূতপবিত্র। আমি বটতলা সংস্করণের কথা বলছি। অশ্লীলতায় মূল আরব্যরজনী-ওই যে কী বলে, লেডি চ্যাটারলি না কী- তেনাকে ঢিড-দুয়ো দিতে পারে, হেসে-খেলে। পারলে সত্য গোপন করতুম, কিন্তু সুচতুর পাঠক বহু পূর্বেই ধরে ফেলেছেন ওই কারণেই বইখানা আমাকে ছেলেবেলায়ই আকৃষ্ট করেছিল। আহা, ওই যে নিগ্রো ছোকরা গোলাম আর সুন্দরী প্রভুকন্যার কেচ্ছা–না, থাক আবার আলীপুর যেতে চাইনে।
আরব বলছিল, জাহিজ নাকি আরব্যরজনীর খলিফা হারুন-অরু-রশিদের নাতি না কে যেন, সেই খলিফার উজিরের নেক্-নজরের আশকারা পেয়ে আপন বউকে পর্যন্ত ডরাতেন না। ব্যস, ওই এক কথাই কাফি। কথায় বলে, বাঘের এক বাচ্চাই ব্যস্।
আত্মজীবনী আরম্ভ করার গোড়াতেই মনে পড়ল, জাহিজ যে অবতরণিকা দিয়ে তার জীবনী আরম্ভ করেছেন সেইটে দিয়ে আমিও আরম্ভ করলে আমারও যাত্রা হবে নিরাপদ
যেমতি মূষিক ভ্রমে সাগরে বন্দরে
নৃপতরী আরোহিয়া—
এমন সময় খটকা লাগল। জাহিজের কিঞ্চিৎ পরিচয় তো দিতে হয়। নিদেন তার জন্মকাল লীলাভূমি তো বালাতে হয়।
অধমের বাসভবনে যারাই পায়ের ধূলি দিয়েছেন, তারাই জানেন সেখানে আর যা থাক, না-থাক, বই সেখানে একখানাও নেই। শুনেছি এক বিদ্যাসাগর নেটিভ মহারাজা ভাইয়ের সামনে আপন কিম্মৎ বাড়াবার জন্য একটি কলেজ খোলেন। প্রিন্সিপল নিযুক্ত হয়ে দেখেন, কলেজ লাইব্রেরি নামক কোনওকিছু সেখানে নেই। তিনি টাকা চাইতেই মহারাজা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, নিকালো হারামিকো অভি স্টেটসে। লেখাপড়া শিখে আসেনি, এখন বুঝি বই পড়ে কলেজে পড়াবে! আমাকে কি উলু পেয়েছে নাকি?
এর থেকে আমার শিক্ষা হয়ে গিয়েছে।
অবশ্য নতমস্তকে বার বার স্বীকার করব, একখানা বইয়ের সন্ধানে আমি সংবরণের মতো পত্নীর কামনা করে
–তপতীর আশে
প্রখর সূর্যের পানে তাকায়ে আকাশে
অনাহারে কঠোর সাধনা কত—
করেছি। কী সে বই ধর্মগ্রন্থ, আয়ুর্বেদ, কামশাস্ত্র –?
এসব কিছু না। একখানা চেক্ বই। সে দুঃখের কথা আর তুলব না।
কিন্তু পুলিশের হুলিয়ার হুড়ো খেয়ে উপস্থিত যেখানে গা-ঢাকা দিয়ে আছি সেই এলাকায় এক অসাধারণ পণ্ডিত ব্যক্তি বাস করেন। তদুপরি তিনি অতিশয় অমায়িক। আমি তার কাছে নিবেদন করলুম, স্যার, জাহি নামক আরবি লেখক কবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন?
চট করে একখানা বই টেনে নিলেন। ঠিক ওই ঢপের আরও খান পঁচিশেক ভলুম শেলফে বিরাজ করছিল। বই থেকে পড়ে বললেন, মৃত্যু হয় ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে
আমার কেমন যেন ধোকা লাগল। বললুম, ১৮৬৯; হারুন-রশিদের নাতির অমিলের লোক তিনি এই কথাই ভো শুনেছি।
ঠিকই তো! দেখি, হারুনের নাতি- বলে আরেক ভলুম পাড়লেন যা, অল ওয়াসিক-৮৪২ থেকে ৮৪৭। একটু চিন্তা করে বললেন, অহ্ হে, বুঝেছি। ১৮৬৯-এর প্রথম ১-টা বাদ দিতে হবে! ওয়াসিকের মৃত্যুর পর আরও বাইশ বছর বেঁচেছিলেন আর কি। তা থাকুন আর নাই থাকুন। মোদ্দা কথা, কিন্তু ইনি নবম শতাব্দীর লোক, আর এই পণ্ডিতদের বেদ বলো, কুরান বলল, পরম পূজনীয় এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বেচারিকে টেনে নিয়ে এলেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে! তোবা! তোবা!! নির্জলা পূর্ণ এক হাজার বছরের ডিফরেন্স্।
যেরকম সরলভাবে তিনি আমাকে স্ক্যান্ডালটা বুঝিয়ে বললেন যে মনে হয়, কলকাতার ডিটেকটিভ পর্যন্ত সেখানে থাকলে বুঝে যেত।
জাহিজ অবতরণিকায় বলেছেন, চতুর্দিকে আমার দুশমন আর দুশমন–দুশমনে দুশমনে আবজাব করছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আমার মুরুব্বি; কেউ ডরের মারে আমার রাজহাঁসটাকে পর্যন্ত করতে সাহস পায় না। কিন্তু আমি বিলক্ষণ অবগত আছি, আমার দেহাস্থি গোরস্তানে প্রোথিত আমার পুণ্যশ্লোক পিতৃপুরুষগণের জীর্ণাস্থির সঙ্গে শুভযোগে সম্মিলিত হওয়ার পূর্বেই (মেহেরবান খুদা সে ভমিলন আসন্ন করুন!) আমার দুশমন-গুষ্টি অশেষ তৎপরতার সঙ্গে লিপ্ত হয়ে যাবে আমি এবং আমার ঊর্ধ্বতন তথা অধস্তন চতুর্দশ পুরুষের পুতিগন্ধময় নিন্দাবাদ করতে এবং তার শতকরা ন-সিকে কপোলকল্পিত, আকাশপুরীষ-চয়িত বেহ গুলগঞ্জিকার ঝুটমুট।
যেমন, আমি জানি, আর পাঁচটা নিন্দাবাদের মাঝখানে, অতি কুচতুরতাসহ তারা কীর্তন করবে– আমি নাকি অতিশয় প্রিয়দর্শন সুপুরুষ ছিলুম, সাক্ষাৎ ইউসুফ-পারা হেন দেবদুর্লভ চেহারা নাকি কামনা করেন স্বয়ং বেহস্তের ফেরেস্তারা।
ক্রোধান্ধ হয়ে জাহিজ এস্থলে হুঙ্কার ছাড়ছেন, মিথ্যা, মিথ্যা, সর্বৈব মিথ্যা। আমার প্রতি অন্যায় অবিচার! আমি অভিসম্পাত দিচ্ছি, যে এ অপবাদ রটাবে তার পিতা নির্বংশ হবে। আমি আদৌ সুশ্রী নই। বস্তৃত টেকো মর্কটটার চেহারা পেলে আমি বর্তে যাই। আমার মুখমণ্ডল নামক বদনাদন চেহারার বিভীষিকা দেখে অসংখ্য শিশু ভিরমি গেছে। আমার–
সরল পাঠক! অধম অবগত আছে তুমি জাহিজের এই আত্মকথন শুনে ধন্ধে পড়ে গ্রীবা কয়নে লিপ্ত হয়েছ। তোমার মনে হচ্ছে, এ তো বিচিত্র ব্যাপার! কেউ যদি জাহিকে প্রিয়দর্শন বলে মন্তব্য করে তবে সেটা নিন্দা হতে যাবে কেন, আর যে মন্তব্যটা করেছে সেই-বা দুশমন হতে যাবে কেন? আর জাহিজ্ব যদি কুৎসিতই হন তাতেই-বা কী? তার গোর হয়ে যাওয়ার পর কে আর মিলিয়ে দেখতে পারবে তিনি সুরূপ না কদ্রুপ ছিলেন। কথায় বলে, মড়ার উপর এক মণও মাটি শ মণও মাটি। তবে কি জাহিজ নিরতিশয় সত্যনিষ্ঠ ছিলেন? তার সম্বন্ধে কেউ মিথ্যে বলুক, এটা তিনি সইতে পারতেন না?– তাও সে মিথ্যে প্রিয়ই হোক, আর অপ্রিয়ই হোক।
এসবের উত্তর আমি দেব কী প্রকারে বেলা গড়িয়ে গেল, আর তুমি এখনও বুঝতে পারনি, আমার পেটে সে-এলেম নেই। বিশেষত আমার সেই মুরুব্বি পণ্ডিত যিনি দশটি ভাষায় ত্রিশ-ভলুমি সাইক্লোপিডিয়া নিয়ে কারবার করেন এবং যার বাড়তিপড়তি মাল ভাঙিয়ে আমি হাঁড়ি চড়াই, তিনি গায়েব। তবে শেষ দেখার সময় মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আমাকে বলেন, রেনেসাঁসের পূর্বেই এই লোকটা লিখল আত্মজীবনী! আশ্চর্য আশ্চর্য! রেনেসাঁসের পুর্বে তো শুধু রাজরাজড়া আর ডাঙর ডাঙর সাধুসন্ত। সাধারণ মানুষেরও যে একটা ব্যক্তিগত অস্তিত্ব আছে সেটা আবিষ্কৃত হল রেনেসাঁসের সময়। সাধারণ লোকের আত্মজীবনী তো প্রথম লেখেন আবেলরাড় দ্বাদশ শতাব্দীতে, তার পর দাতে নবজীবন (ভিটা নুওভা) লেখেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষে। আর তোমার ওই জাহিজ না কে লিখে ফেললে নবম শতাব্দীতে? বড়ই বিস্ময়জনক, প্রায় অবিশ্বাস্য।
সরল পাঠক, তোমার কুটিল প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারলাম না। তবে একটা ভরসা তোমাকে দিতে পারি। ইংরেজিতে প্রবাদ আছে- এক্সট্রিম মিট– দুই অন্তিম প্রান্ত একত্র হয়ে যায়। যেমন দেখতে পাবে গ্রাম্য গাড়ল (ভিলেজ ইডিয়ট) দাওয়ায় বসে সমস্ত দিনটা কাটিয়ে দেয় একটা শুকনো খুঁটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে, আর যোগীশ্রেষ্ঠও তাবৎ দিবসটা কাটিয়ে দেন একাসনে বসে বসে। উভয়েই কর্মস্পৃহা জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। বিদ্যাবুদ্ধিতে আমি এক প্রান্তে, জাহিজ অন্য প্রান্তে উভয়ের সম্মিলন অবশ্যম্ভাবী।
এতএব আমার আত্মজীবনী যদি অবহিতচিত্তে পাঠ কর তবে হয়তো তোমার প্রশ্নগুলোর কিছুটা সদুত্তর পেয়ে যাবে।
জাহিজ তার কেতাব আরম্ভ করেছেন এই বলে যে, তার দুশমনের অভাব নেই। এইখানে তার সঙ্গে আমার হুবহু মিল। বাকিটা সবিস্তার নিবেদন করি। আত্মজীবনী-লেখক মাত্রই আপন বাল্যকাল নিয়ে রচনা আরম্ভ করেন। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথও এই পন্থা অবলম্বন করেছেন। এবং সেই সুবাদে সকলেই আপন আপন বংশ-পরিচয় দেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যতটা পারেন, পরিবারের মান-ইজ্জত বাড়িয়েই বলেন। এ নিয়ে বাক্যব্যয় সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন। স্বদেশ, স্বজাতি, মাতৃভাষা নিয়ে অযথা অহেতুক বড়াই করে না, এমন মানুষ বিরল।
আমাকে কিন্তু ক্ষমা করতে হবে। তার কারণ এ নয় যে, আমি হীন পরিবারের লোক। সত্য কারণটা পাঠক একটু ধৈর্য ধরলেই বুঝতে পারবেন।
বস্তুত, পরিবার আমাদের খানদানি। আমাদের পূর্বপুরুষ শাহ আহমদের (শাহ এস্থলে বাদশা নয়- সৈয়দকে মধ্যযুগে শাহ বলা হতো) দরগা এখনও তরপ পরগনাতে আমাদের দ্রাসনে বিরাজিত সেখানে প্রতি বৎসর উস্ হয়। তারই অল্প দূরে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের মাতুলালয়- মাতা শচী দেবীর জন্ম সেখানেই। আমাদের বংশ পিরের বংশ- এরা কিন্তু যজমানগৃহে অন্ন পর্যন্ত গ্রহণ করতেন না। আমার পিতামহ, মাতামহ, আমার অগ্রজদ্বয় সুপণ্ডিত। আমার অগ্রজ প্রায় কুড়ি বৎসর পরিশ্রম করে সম্প্রতি চর্যাপদের একখানি নতুন টীকা রচনা করছেন। আমার কনিষ্ঠা ভগ্নীর ফকিরি, মারিফতি গীত ঢাকা বেতারে শুনতে পাবেন।
কিন্তু থাক, আর না। এ বিষয়টাই আমার কাছে মর্মান্তিক পীড়াদায়ক। কুলমর্যাদার প্রস্তাব উঠলেই আমার পিতা বলতেন, বাপ-ঠাকুর্দার শুকনো হাড় চিবিয়ে কি আর পেট ভরবে? আমিও চিবোইনি। চিবোনো দূরে থাক, আমাদের পিতৃপুরুষ যে গোরস্তানে শুয়ে আছেন তার পাশ দিয়ে যেতে হলে আমি মাথা হেঁট করি।
আমি এই গোষ্ঠীর একমাত্র ব্ল্যাকশিপ- কালা ম্যাড়া!
শব্দার্থে আমার বর্ণ ঘোরতর কৃষ্ণ তো বটেই–বাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বর্ণনা আর দেব না। তবে এইটুকুন বলতে পারি পরবর্তীকালে উচ্চ-শিক্ষার অজুহাত দেখিয়ে জন্মদাতা ও শিক্ষাদাতা দুই উরুর কিল-কানমলা থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যখন শান্তিনিকেতনে আশ্রয় নিই তখন ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর শ্ৰীযুত রামকিঙ্কর বায়েজ আমাকে দেখামাত্রই সোল্লাসে চিৎকার করে ওঠেন, হুরে হুরুরে। কেল্লা মার দিয়া। কিষ্কিন্ধ্যার মহারাজ সুগ্রীবের বংশধর শ্ৰীযুক্ত আহাদী কুঞ্চিতপদ আমাকে বায়না দিয়েছেন শয়তানের একটি মূর্তি গড়ে দেবার জন্য। মানসসরোবর থেকে কন্যাকুমারী, হিংলাজ থেকে পরাম কুণ্ডু অবধি খুঁজে খুঁজে হয়রান–মডেল আর পাইনে। গুরুদেবের কৃপায় আজ তুই হেথায় এসে গেছিস। আয় ভাই আয়। চ কলাবনে।
ইহুদিদের সদাপ্রভু য়াহভের বেহেশতে শয়তানের প্রবেশ নিষেধ। সেখান থেকে যদি শয়তানের মূর্তি গড়ার ফরমায়েশ আসত সেটাও না হয় বুঝতুম কিন্তু কিষ্কিন্ধ্যা থেকে। সেখানকার মেয়েমা দুই-ই বুঝি দারুণ খুবসুরত হয়!
পরবর্তীকালে কিষ্কিন্ধ্যা গিয়েছিলাম। দ্রাবিড় অঞ্চলে প্রবাদ আছে, রমণীরা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে কামের প্রলোভন থেকে আমাদের রক্ষা কর। তাদের প্রার্থনা পরিপূর্ণ করে ভগবান কিষ্কিন্ধ্যার পুরুষ সৃষ্টি করেন।
কিষ্কিন্ধ্যায় গিয়ে দেখি, দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার। অসিছে রবিবারে যমের পূজা উপলক্ষে অলিম্পিকের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় টাউন হলে একটি টুর্নামেন্ট হবে। যে সবচেয়ে বেশি বিকট মুখ-ভেংচি কাটতে পারবে সে পাবে হাজার টাকার পুরস্কার।
আমি কম্পিট করিনি। নিরীহ দর্শক হিসেবে ছিলম মাত্র। অবশ্য বিকট বিকট গরিল্লাপারা নরদানবরাই এই ভেংচি প্রদর্শনীতে হিস্যে নিয়েছিলেন কার্তিক যতই ভেংচি কাটুন না কেন, তাকে তো আর মর্কটের মতো দেখাবে না!
সে কী ভেংচির বহর। এক-একটা দেখি আর আমার পেটের ভাত চাল হয়ে যায়। আর সে কী দুর্দান্ত নে-টু-নে রে! কোথায় লাগে তার কাছে নিন-হামফ্রের ঘোড়দৌড়!
পালা সাঙ্গ হল। হঠাৎ দেখি তিনজন অজই মল্লদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দর্শকদের গ্যালারি পানে এগিয়ে আসছেন। তার পর ওমা, দেখি, ঠিক আমারই সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমার গলায় জবাফুলের মালা পরিয়ে দিয়ে বললেন, যদ্যপি আপনি এই কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করেননি তবু আপনাকে প্রথম স্থান না দিলে অবিচার হবে। ভেংচি না কেটেও আপনার মুখে বিধিদত্ত যে ভেংচি সদাই বিরাজ করছে সেটা অনবদ্য, দেব-না, না– যমদুর্লভ। তবে আপনি এই কম্পিটিশনে পার্ট নেননি বলে আইনত টাকাটা দেওয়া যায় না। সেটা যমপূজায় ব্যয় হবে। হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ পত্ৰপুষ্পদি ভগবান শ্রীকৃষ্ণে পৌঁছায়, বিকটের পুজো মাত্রই আপনাকে পৌঁছবে। এ বাবদে শেষ কথা। আমি আজও কেন আইবুড়ো আছি, সেটা বুঝতে কারওরই অসুবিধা হবে না।
পাঠক! এ লেখন প্রধানত তোমার অখণ্ড-সৌভাগ্যবান বংশধরদের জন্য। তারা যদি প্রত্যয় না যায় তবে যেন একবার কলাভবনে সন্ধান নেয়। ওই মূর্তির একটা ফটো তুলে রেখেছিলেন– আশ্চর্য, লেন্সটা কেন চৌচির হল না- ভবিষ্যভ্রষ্টা রামকিঙ্কর। ছবিটা তিনি দেখালেও দেখাতে পারেন। তবে তারা যেন গ্যাসমাস্ক তথা ধুয়ে মাখানো কাঁচ সঙ্গে নিয়ে যায়। মূর্তিটা গায়েব হয়েছে। পুজোরব শিল্পী রদার প্রেতাত্মা সেটি সরিয়েছে।
পাড়ার ভটচার্য মহাশয়ের কাছে শুনেছি, বিয়ের সময় কনে নাকি বরের রূপ কামনা করে (আমার রূপের বর্ণনা দিলুম), বন্ধুবান্ধব বরের উত্তম কুল কামনা করে সেটাও ইল), পিতা সুশিক্ষিত বর চায়– এইবারে আমরা এলুম ইংরেজিতে যাকে বলে ধিক্ অব দ্য ব্যাট বা রণাঙ্গনের কেন্দ্রভূমিতে।
ডাক্তার অবশ্য পরিবারবর্গকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, স্লো বাট স্টেডি উইন্স দ্য রেস- বিলম্বিত চালেই চলুক না, সেই চাল যদি সদা বজায় রাখে তবে সে জিতবে। অর্থাৎ হোক না গদত, সে যদি গর্দভি চাল বজায় রেখে চলে তবে আখেরে ডাবি ঘোড়ার রেস জিতবে।
জীবনের অষ্টম বর্ষাবধি আমি শুধু একটানা ভাত খাব, ভাত খাব বলেছি। একদম স্টেডি সুরে। ডাক্তারের স্তোকবাক্যে আত্মজন পরিতৃপ্ত না হয়ে মেনে নিলেন যে আমি স্লোউইটেড জড়ভরত। অষ্টম বর্ষে (চাণক্যকে ঢিঢ় দিয়ে পঞ্চমে নয়) আমাকে পাঠানো হল পাঠশালে।
হাতেখড়ির প্রথম দিবসান্তে গুরুমশাই যে-শ্লোকটি আবৃত্তি করেন সেটি মমাগ্রজ লিখে নেন :
কাকঃ কৃষ্ণঃ পিকঃ কৃষ্ণঃ কো ভেদঃ পিককাকয়েঃ।
বসন্তসময়ে প্রাপ্তে কাকঃ কাকঃ পিকঃ পিকঃ ॥
কাক কোকিল দুই-ই কালো, কিন্তু মাইকেল মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলেন পিকঘর রব নব পল্লব মাঝারে, আর আমার কণ্ঠস্বর শুনেই গুরু বুঝে গেলেন এটা এক্কেবারে জাত দাঁড়কাকের। সবিস্ময়ে দাদাকে শুধোলেন, এটা তোর ভাই।
তার পর তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, কস্মিনকালেও শুনিনি, কাক কোকিলের বাসায় ডিম পাড়ল! এইবারে একটা ব্যত্যয় দেখলুম– হরি হে, তুমিই সত্য।
এস্থলে তড়িঘড়ি আমি একটি সম্ভাব্য ভ্রম সংশোধন করে রাখি। আমার দাদারা ফর্সা। আর আমি বিটকেল কৃষ্ণবর্ণ। অথচ আমরা একই বর্ণের, অর্থাৎ একই কুলের, অন্তত এই আমার বিশ্বাস ছিল বহুদিন ধরে।
কালের সঙ্গে আমার আরও একটা জবরদস্ত দোস্তি দেখা গেল অচিরাত। আমি নিরবচ্ছিন্ন সেল্ফ পট্রেট আঁকলুম ঝাড়া তিনটি বছর ধরে। অর্থাৎ পাততাড়িতে বছরের পর বছর কাগের ছা বগের ছা লিখে গেলুম।
আমার বিস্ময় লাগে, শিক্ষামন্ত্রী ত্রিগুণা সেনের জন্মনগরী করিমগঞ্জ, আমারও দ্বৎ। তাঁর আমার জন্ম একই বৎসর। আজ তিনি তাবৎ দেশের শিক্ষাদীক্ষা তরণীর কর্ণধার, আর আমি সুর করে একটানা গেয়ে যাচ্ছি–এক বাও মেলে না, দুবাও মেলে না।
আমি যে শিক্ষা-দীক্ষার নিরঙ্কুশ ডডনং হয়ে রইলুম তার জন্য কবিগুরু দেবও খানিকটা দায়ী। অবশ্য তার প্রতি আমার ভক্তি আমৃত্যু অচলা থাকবে। কারণ–
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়।
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।
কবিগুরু বাঙালি তথা ভারতবাসীর সমুখে উত্তম উত্তম আদর্শ রেখে গেছেন, কিন্তু যে-আদর্শ এলেন আমার দ্বারে/ডাক দিলেন অন্ধকারে এবং সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুল্পেখার মতো আমার চিত্তাকাশ উদ্ভাসিত করে দিল সেটি এই :
নেই বা হলেম যেমন তোমার
অম্বিকে গোসাঁই।
আমি তো, মা, চাইনে হতে
পণ্ডিতমশাই।
নাই যদি হই ভালো ছেলে,
কেবল যদি বেড়াই খেলে,
তুতের ডালে খুঁজে বেড়াই
গুটিপোকার গুটি,
মুর্খ হয়ে রইব তবে?
আমার তাতে কীই বা হবে,
মুর্খু যারা তাদেরি তো
সমস্তখন ছুটি।
পুনরায় :
যখন গিয়ে পাঠশালাতে
দাগা বুলোই খাতার পাতে,
গুরুমশাই দুপুরবেলায়
বসে বসে ঢোলে,
হাঁকিয়ে গাড়ি কোন গাড়োয়ান
মাঠের পথে যায় গেয়ে গান
শুনে আমি পণ করি যে
মুর্খ হব বলে।
আমাকে অবশ্য কোনও উচাটন মন্ত্রোচ্চারণ করে কোনওপ্রকারেই পণ করতে হয়নি। সর্বেশ্বর প্রসাদাৎ ভূমিষ্ঠ হওয়ার লগ্ন থেকেই আমি কর্মমুক্ত। গোড়ায় ভেবেছিলাম, এটা বুঝি জডুত্রে লক্ষণ। পরে শুনি দক্ষিণ ভারতের মহর্ষি ছন্দে গেঁথে বলেছেন, কর্ম কিং পরং। কর্ম তড়ম্ ॥ কর্ম তো স্বতন্ত্র নয়, কর্ম সে তো জড়! তবে আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কর্মাতে কমাতে অম্বিকে গোসাঁই হয়ে গিয়ে কোন তুর্কিস্থানের বাখারার আজব মেওয়া আলু-বুখারা লাভ হবে?
অবশ্য নতমস্তকে স্বীকার করব, আমি পাঠশালা পাস করেছিলাম।
শুনেছি, নাৎসি যুগে এমনও চৌকশ স্পাই ছিল যে বিশ গজ দূরের থেকে শুধুমাত্র ঠোঁট নাড়া দেখে দুজনের ফিসফিসিনিতে কী কথাবার্তা হচ্ছে আদ্যন্ত বুঝে যেত এবং পকেটে হাত খুঁজে প্যাডের উপর সেটা আগাপাশতলা শর্টহ্যান্ডে তুলে নিতে পারত। আমি কিন্তু সে লাইনে কাজ করিনি। শ্যেনের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকলে আমরা সে ব্যক্তিকে বলি সেয়ানা। আমি সেই দৃষ্টিশক্তির আনুকূল্যে দশ হাত দূরের ব্রিলিয়ান্ট বয়ের পাতা থেকে টুকলি করে তর তর করে পেরিয়ে গেলুম পাঠশালার ভব-নদী।
বুদ্ধিমান জন আপন বুদ্ধির জোরে তরে যায় বলে ভাগ্যবিধাতা মূর্খকে সাহায্য করেন, নইলে তিনিও বিলকুল বেকার হয়ে পড়বেন যে! মৌলা আলীকে শিনি চড়াবে কে, কালীঘাটে মানত মানবে কোন মূর্খ আর বুদ্ধিমান যে করে না, সে তো জানা কথা।
পাঠশালা পাস করার পর করলুম জীবনের চরম মূর্ধমো! কলকাতার বেম্বো-সমাজের বাবু-বিবিরা সে-যুগে পাড়াগাঁয়ে আসতেন আমাদের পেট্রানাইজ করার জন্যে। তাদের চোখে কত না ঢঙ-বেঢঙের রঙ-বেরঙের চশমা। আমারও শখ গেল অপ-টু-ডেট হওয়ার। ভান করতে লাগলুম আমি ব্ল্যাক বোর্ড দেখতে পাইনে। ডাক্তারকে পর্যন্ত ঘায়েল করলুম– কিংবা সে ছিল ঝটপট দু পয়সা কামাবার তালে।
সেই বেকার চশমা ব্যবহার করে গেল আমার শ্যেনদৃষ্টি। ফল ওত্রালো বিষময়। একই ইস্টিশানে যেমন আগ্রা সিটি, আগ্রা ফোর্ট, আগ্রা জংশন– গাড়ি দাঁড়াতে লাগল তিন তিন বার করে। শ্যেন দৃষ্টি গেছে, টুকলি করতে পারিনি– একই ক্লাসে কাটাই তিন-তিনটি বছর করে।
ইতোমধ্যে কিন্তু আমি দিব্য অকালপকু জ্যেষ্ঠতাতত্ত্ব লাভ করেছি– তারই একটি উদাহরণ দিই। ফেল মেরে দু কান কাটার মতো শহরের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি এমন সময় এক গুরুজন, মরালিটি প্রচারে নিরেট পাদরি সাহেব, আমাকে দাঁড় করিয়ে বললেন, ফেল মেরেছিস? লজ্জাশরম নেই? তোর দাদারা, তোদের বংশ
একগাল হেসে বললুম, কী যে বলেন, স্যার! অ্যামন ফার্স্ট ক্লাস অ্যানসার লিখেছিলুম যে এগজামিনার মুগ্ধ হয়ে খাতায় লিখলে এনকোর এনকোর! তাইতেই তো ফের পরীক্ষা দিচ্ছি!
সম্পর্কে তিনি আমার জ্যাঠা। কিন্তু আমার পকু-নিতম্ব জ্যাঠামো শুনে তিনি থ মেরে গেলেন– আমাদের স্টেট বাস যেরকম আকছারই যত্রতত্র থ মারে বুঝে গেলেন এ পেল্লাদকে ঘায়েল করার মতো পাষাণে, সমুদ্রে নিক্ষেপ পদ্ধতি তাঁর শস্ত্রাগারে নেই। গত যুদ্ধের ফ্লেম থ্রোয়ারের মতো একবার আমার দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, এ ছেলে বাঁচলে হয়!
গুরুজনের আশীর্বাদ কখনও নিষ্ফল হয়! দিব্যপুরুষ্টু পাঁঠাটার মতো ঘোঁত ঘোত করে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছি।
মেঘে মেঘে বেলা হয়ে গেল। হঠাৎ উপলব্ধি করলুম বয়স ষোল। ওদিকে ক্লাস ফাইভের যোগাসন আর পরিবর্তিত হচ্ছে না। দুনিয়ায় যত ডানপিটেমি নষ্টামির মামদো উপযুক্ত পীঠস্থান পেয়ে আমার স্কন্ধে কায়েমি আসন গেড়েছে। আমার তথাকথিত অপকর্মের বয়ান আমি দফে দফে দেব না। তবে এইটুকু বলতে পারি, পরীক্ষার হলে বেঞ্চি-ডেসকো ভাঙা, ট্রামবাস পোড়ানোর কথা শুনলে আমার ঠা ঠা করে উচ্চহাস্য হাসতে ইচ্ছে যায়। আরেকটি কথা বলতে পারি, আজ যে শ্রীহট্ট বার-এর আসামি পক্ষের উকিলরূপে সর্ববিখ্যাত মৌলতি সইফুল আলম খান– তিনি বাল্য বয়সেই কোথায় পেলেন তার প্রথম তালিম? আমার অপকর্ম পদ্ধতি (মডুস অপারেনডি) অপকর্ম গোপন করার কায়দা যে নব-নব রূপে দেখা দিত সেগুলো কি তিনি আমার সহপাঠী কনফিডেন্ট রূপে আগাপাশতলা নিরীক্ষণ করে তারই ফলস্বরূপ আজ উকিল সভায় স্বর্ণাসনে বসেননি!
তবু যদি পেত্যয় না যান তবে তঙ্কালীন আসামের আই.জি, অবসরপ্রাপ্ত শ্ৰীযুত–দত্তকে শুধোবেন। শুটনিক আর কতখানি উঁচুতে গিয়েছিল। তাঁর দফতরে মৎ-বাবৎ যে ফাইল উঁচু হয়েছিল তার সঙ্গে সে পাল্লা দিতে পারে এবং সানন্দে আপনাদের জানাচ্ছি প্রত্যেকটি ফাইলের উপর মোটা লাল উড পেন্সিলে লেখা প্রমাণাভাব প্রমাণাভাব। বেনিফিট অব ডিউটি নামক প্রতিষ্ঠানটি যে মহাজন আবিষ্কার করেছিলেন তাকে বার বার নমস্কার।
কিন্তু দুস্তর সন্তাপের বিষয়, ইহসংসারের হেডমাস্টারকুল এই প্রতিষ্ঠানটিকে যথোচিত সম্মান শ্রদ্ধা করেন না। সে সৎসাহস তাদের নেই। থাকলে আমার সোনার মাতৃভূমি শিক্ষাদীক্ষায় আজ এতখানি পশ্চাৎপদ কেন। আমার নাম দু-দুবার ব্ল্যাক বুক-এ উঠল পর্যাপ্ত প্রমাণাভাব সত্ত্বেও। হেডমাস্টার নাকি মরালি সারটন হয়ে যে কোনও চার-আনি বটতলার মোকতারও বলবে, এটা ঘোর ইলিগালি অনসারটন- আমার নাম কালো কেতাবে তুলেছেন। আরেকটা ঘটনা নাকি তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন। এটা যে কীরকম সংবিধান বিরোধী উল্টা ভিরেস (গাড়ল ইংরেজের উচ্চারণে আলট্রা ভাইয়ারিজ বেআইনি স্বেচ্ছাচারিতা, সেটা বুঝিয়ে বলতে হবে না : হেডমাস্টার তো সেখানে সাক্ষী, তিনি সেখানে বিচারক হন কোন আইনে? এ স্বতঃসিদ্ধটা তো স্কুল-বয় জানে। জানেন না শুধু হেডমাস্টার। তাই বিবেচনা করি, যে স্কুল-বয় এ তত্ত্বটা জানে না সে-ই আখেরে হেডমাস্টার হয়।
তৃতীয়বার কোনও অপকর্ম করলে কালো কেতাবে নাম ওঠে না। তাকে গলাধাক্কা দিয়ে সুর্মা নদীর কালো চোখের সুর্মা কালো) জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সোজা বাংলায় তাকে রাস্টিকেট করে দেওয়া হয়। তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। যদি সেটা শব্দার্থে নেওয়া হয়। রাস্টিকেট শব্দের প্রকৃত অর্থ, গ্রামের ছেলে শহরের স্কুলে এসে গ্রাম্য অভদ্র আচরণ করেছিল বলে তাকে ফের গ্রামে পাঠানো হল, তাকে রাস্টিকিট করে দেওয়া হল, তাকে কাট্রিফাই করে দেওয়া হল। আমি চাঁদপানা মুখ করে সুর্মার ওপারে গ্রামে বাস করে ইস্কুলে আসতে রাজি আছি। বিস্তর ছেলে ওপর থেকে খেয়া পেরিয়ে সরকারি ইস্কুলে পড়তে আসে। আমাদের পাদ্রি সাহেবের কাছে শোনা, লাতিন রুত্তিকারে (গ্রামে বাস করা) শব্দ থেকে রাস্টিকেট কথাটা এসেছে। কিন্তু এসব গুণগর্ভ সুভাষিত শুনে হেডমাস্টার যে আসন ছেড়ে আমি-সত্যকামকে গৌতম ঋষির মতো আলিঙ্গন করবেন এমত আশা তিন লিটার ভাঙ পেটে নামিয়েও করা যায় না। চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। এস্থলে ধার্মিকও শুনতে চায় না ধর্মের কাহিনী- নইলে পৃথিবীতে এত গণ্ডায় গণ্ডায় ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম কেন ভট্টচাষ যান মসজিদে ধৰ্মকাহিনী শুনতে এবং বিপরীতটা? হু?
সেসব দিনে না, রাতের আকাশে উত্তমকুমারাদি তারকা আকাশে দীপ্যমান হয়নি। আমার পরবর্তী যুগের সখা দেবকী-পাহাড়ীও তখন অসংখ্য বিমল উজল রতনরাজির মতো খনির তিমির গর্তে। নইলে গাগারিন বেগে চলে যেতুম মোহময়ী মুম্বই বা টলিউডে হেসেখেলে পেয়ে যেতুম যম বা শয়তানের মেন্ রোল।
ভাঙের কথা এইমাত্র বলেছি : তখন স্থির করলুম স্কুলের দরওয়ানজি হনুমান পুজন তেওয়ারি– যিনি কি না পালপরবে ওই বস্তু সেবন করেন এবং সেই সুবাদে আমাকে তথা ফ্রেন্ড স্বদেশ চক্রবর্তীকে ওই বিদ্যায় হাতেখড়ি দেন– তেনাকে ভাঙ খাইয়ে বেহুস করে হেডমাস্টারের ঘরে লাগাব আগুন। গায়ে আগুন লেগে গেঞ্জিটা পুড়ে গেল আর পাঞ্জাবিটা পুড়ল না– এ কখনও হয়! ব্ল্যাক বুক তার মিথ্যা সাক্ষ্যসহ পুড়ে ছাই হবে। সেই ছাই দিয়ে পরব বিজয়-টিকা? ওয়াহু, ওয়াহ্!
ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে–
কিচ্ছুটি করতে হল না। অতি ভৈরব হরষে ওই সময়ে এল অসহযোগ আন্দোলন।
আমারে আর পায় কেডা?
দ্বন্দ্ব-পুরাণ
মহাপুরুষদের জীবনধারণ প্রণালি, তাদের কর্মকীর্তি এমনকি দৈবেসৈবে তাদের খামখেয়ালির আচরণ দেখে তাদের শিষ্য-সহচর তথা সমকালীন সাধারণ জন আপন আপন গতানুগতিক ক্ষুদ্র বুদ্ধি দ্বারা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না, কী করে একটা মানুষের পক্ষে এরকম কীর্তিকলাপ আদৌ সম্ভবে। এ-প্রহেলিকার সমাধান না করতে পেরে শেষটায় বলে, ওহ! বুঝেছি। এরা অলৌকিক ঐশী শক্তি ধারণ করেন। তখন আরম্ভ হয় এদের সম্বন্ধে কিংবদন্তি বা লেজেন্ড নির্মাণ। কোন পির ধূলিমুষ্টি স্বর্ণমুষ্টিতে পরিবর্তিত করতে পারতেন, কোন গুরু চেলাদের আবদার-খাইয়ে অতিষ্ঠ হয়ে রাগের বশে এক কুষ্ঠরোগীকে পদাঘাত করা মাত্রই তনুহূর্তেই, সে সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে যায়–হরি হে তুমিই সত্য।
ফারসি ভাষাতে তাই প্রবাদ আছে, পিরেরা ওড়েন না, তাদের চেলারা ওঁদের ওড়ান পিরহা নমিপরন্দ, শাগির্দান উন্হারি মি পরানন্দ–অর্থাৎ আমাদের পির উড়তে পারেন। তবে কি না সে অলৌকিক দৃশ্য সবাই দেখতে পায় না।
অর্থাৎ,
অদ্যাপিও সেই লীলা খেলে গোরা রায়।
মধ্যে মধ্যে ভাগবানে দেখিবারে পায়
এস্থলে লক্ষণীয় আপনার-আমার মতো পাঁচু-ভূতোকে নিয়ে কেউ ক্ষুদ্রস্য ক্ষুদ্র লেজেন্ডও নির্মাণ করে না। করবার কোনও প্রয়োজন বোধ করে না।
তাই আশ্চর্য হলুম একটা ব্যাপার দেখে। কিছুদিন পূর্বে এই গৌড়ভুমির এক মহাপুরুষকে নিয়ে জনৈক সুপণ্ডিত গভীর গবেষণামূলক একখানি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। তাঁর বক্তব্য থিসিস–ওই মহাপুরুষকে নিয়ে যেসব অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ আছে সেগুলো নিছক রূপকথা, সোজা বাংলায় গাঁজা-গুল; আসলে উনি ছিলেন অত্যন্ত সাদামাটা সাধারণ জনের একজন।
এ থিসিস ধোপে কতখানি টেকে কি না-টেঁকে সেটা আমি বলতে পারব না– আমার পশ্চাদ্দেশে লোহার শিকলি দিয়ে টাইম বম বেঁধে দিলেও প্রাণ বাঁচাবার জন্যও (যদ্যপি পয়গম্বর সাহেব বলেছেন, জান্ বাঁচানো ফর্জ। নামাজ রোজার মতোই ফর্জ অর্থাৎ অবশ্য-কৰ্তব্য কর্ম, না করলে সখৎ শুনাহ বা কঠিন পাপ হয়!
তাই আমি ওই লেখককে (তিনি যে সত্যই সুপণ্ডিত সে-বিষয়ে আমার মনে কোনও দ্বিধা নেই, কারণ আমি তার একাধিক গভীর গবেষণাময় সুচিন্তিত পুস্তক পড়েছি) মাত্র একটি প্রশ্ন শুধোতে চাই। সেই আলোচ্য মহাপুরুষ যদি আসলে অতই সাদামাটা সাধারণজন হন তবে তার সম্বন্ধে অত লেজেন্ড, অত অলৌকিক কাহিনী নির্মাণ করবার দায় পড়েছিল কোন গণ্ডমূর্খ-মণ্ডলীর ওপর। লেজেন্ডগুলো সত্য না মিথ্যা সে বিচারের গুরুভার বিধাতা এ হীনপ্রাণের স্কন্ধে রাখেননি। আমি শুধু জানি, সাধারণজনকে দিয়ে মানুষ অলৌকিক কর্ম করায় না; যদি বা অতি, অতিশয় দৈবেসৈবে, দু-একজনকে নিয়ে লেজেন্ড তৈরি করে, তবে প্রথম পরশুরামের বিরিঞ্চি স্মরণে এনে তার পর কাশীরামদাসের শরণ নিতে হয় :
কতক্ষণ জলের তিলক থাকে ভালে।
কতক্ষণ থাকে শিলা শূন্যেতে মারিলে—
তাবৎ লেজেন্ডই যে নৈসর্গিক নিয়মভঙ্গকারী অলৌকিক কর্ম, মিরাকল হবে, এমন কোনও পুদার কসম বা কালীর কিরে নেই। সাদামাটা, হার্মলেস লেজেন্ড আজকের দিনেও নির্মিত হয়। পাঠক হয়তো প্রত্যয় যাবেন না, কিন্তু হয়, হয় এই বিংশ শতাব্দীর ষষ্ঠ সপ্তম দশকে। অন্তত নব লেজেন্ডের ফাউন্ডেশন স্টোন পোঁতা হয়।
ওই তো সেদিন পত্রান্তরে পড়লুম, জনৈক লেখক লিখেছেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ চা পান করতেন না। আমি তো বিস্ময়ে স্তম্ভিত। আমি তাকে বহু-বহুবার চা খেতে দেখেছি, এ-দেশি চা, যাকে সচরাচর ব্ল্যাক টি বলা হয়, উত্তম গোত্রবর্ণের অর্থাৎ, উজ্জ্বল সোনালি রঙের চা হলে তারিফ করতে শুনেছি। একবার চীন দেশ থেকে গ্রিন টি (যদিও গরম জলে ঢালার পর রঙ এর হয়ে যায় ফিকে লেমন ইয়োলো) আসে গুরুদেবের কাছে। সে চায়ের শেষ পাতাটুকু পর্যন্ত তাঁকে সদ্ব্যবহার করতে দেখেছি।
তা হলে এ লেজেন্ডের মূল উৎস কোথায়? এ শতাব্দীর গোড়ার দিকে চা-বাগানের কুলিদের উপর বর্বর ইংরেজ ম্যানেজার (আই.সি.এস.-দের তাচ্ছিল্যব্যঞ্জক ভাষায় বক্স-ওয়ালা–কারণ তারা চায়ের বাক্স নিয়ে কারবার করে) কী পৈশাচিক অত্যাচার করত সে-সংবাদ বাঙালি জনসাধারণের কানে এসে পৌঁছয়। তখন চায়ের নামকরণ হয় কুলির রক্ত এবং অনেকেই এই কুলির রক্ত চায়ের পাতা বাড়ি থেকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠান, কাউকে চা পান করতে দেখলে ঘৃণামিশ্রিত উচ্চকণ্ঠে সর্বজনসমক্ষে বলতেন, লজ্জা করে না মশাই, কুলির রক্ত পান করতে। রবীন্দ্রনাথ এ আন্দোলনের খবর রাখতেন; বিশেষ করে যখন স্মরণে আনি, যে-স্বর্গত শশীন্দ্র সিংহ তাঁর সাপ্তাহিক ইংরেজি খবরের কাগজে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে অকুতোভয়ে চা-বাগানের টমকাকার কুটির লিখে লিখে বাঙালির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সুপরিচিত ছিলেন। অতএব আজ যিনি এক লেজেন্ডের প্রথম চিড়িয়া ওড়ালেন যে রবীন্দ্রনাথ চা খেতেন না, তিনি হয়তো ধরে নিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় তখন আর পাঁচজন সহানুভূতিশীল বাঙালির মতো চা বয়কট করেছিলেন এবং জীবনে আর কখনও চা খাননি। বয়কট হয়তো তিনি করেছিলেন–কিন্তু নিশ্চয়ই সেটা কিয়ৎকাল (এবং স্মরণে রাখা উচিত সে-যুগে চায়ের এত ছড়াছড়ি ছিল না বোধহয় মোটামুটি গত শতাব্দীর শেষ দশক পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ স্টিমার প্যাসেনজারদের মুফতে চা পান করানো হত), কারণ পূর্বেই নিবেদন করেছি ১৯২১ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত আমি তাকে বহুবার চা পান করতে দেখেছি।(১) তবে চায়ের প্রতি রবীন্দ্রনাথের কোনও আসক্তি ছিল না।
প্রায়ই চা ছেড়ে দিয়ে কিছুকালের জন্য অন্য কোনও পানীয়তে চলে যেতেন। গরমের দিন বিকালে চা বড় খেতেন না– বদলে খেতেন বেলের, তরমুজের শরবত (নিমপাতার শরবতের কথা সকলেই জানেন)। সকাল-বিকেল ছাড়া অবেলায় টিপিকাল বাঙালির মতো তাকে আমি কখনও বেমক্কা চা খেতে দেখিনি। এবং
বর্ণনাটা ক্ষান্ত করি, অনেকগুলো কাজ বাকি,
আছে চায়ের নেমন্তন্ন, এখনও তার সাজ বাকি।(২)
স্মরণে আনুন। অবশ্য চায়ের নেমন্তনে চা খেতেই হবে এমন আইন হিটলারও করেননি যদ্যপি তিনি দিনে-রাতে এভলেস (অসংখ্য, অন্তহীন) কাপস্ অব টি পান করতেন অতিশয় হালকা, মিন-দুধ।
বস্তুত কি চা, কি মাছ-মাংস কোনও জিনিসেই রবীন্দ্রনাথের আসক্তি ছিল না–যা সামান্য ছিল সেটা মিষ্ট-মিষ্টান্নের প্রতি। টোস্টের উপর প্রায় কোয়ার্টার ইঞ্চি মধুর পলেস্তরা পেতে জীবনের প্রায় শেষ বৎসর অবধি তিনি পরম পরিতৃপ্তি সহকারে ওই বস্তু খেয়েছেন।(৩) মিষ্টান্ন তো বটেই বিশেষ করে নলেন গুড়ের সন্দেশ। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের মতো ভোজনবিলাসী আমি কমই দেখেছি। এবং প্রকৃত ভোজনবিলাসীর মতো পদের আধিক্য ও বৈচিত্র্য থাকলেও পরিমাণে খেতেন কম– তার সেই পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি দৈৰ্ঘ্য ও তার সঙ্গে মানানসই দোহারা দেহ নিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে ঢের কম। ফরাসিতে বলতে গেলে তিনি ছিলেন গুরূমে (ভোজনবিলাসী, খুশখানেওলা); সুরমা (পেটুক) বদনাম তাঁকে পওহারী বাবা (এই সাধুজি নাকি শুধুমাত্র পও = বাতাস খেয়ে প্রাণধারণ করতেন) পর্যন্ত দেবেন না।
লেজেন্ড সম্বন্ধে এইবারে শেষকথাটি বলে মূল বক্তব্যে যাব।
লেজেন্ডের একটা বিশেষ সুস্পষ্ট লক্ষণ এই; দার্শনিক বৈজ্ঞানিক গুণীজ্ঞানীরা যতই কট্টর কট্টর অকাট্য যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করুন না কেন যে, বিশেষ কোনও একটা লেজেন্ড সম্পূর্ণ ভ্রমাত্মক, তবুও তারা সে লেজেন্ড আঁকড়ে ধরে থাকে। এখনও বিস্তর লোক বিশ্বাস করে পৃথিবীটা চেপ্টা, শোনে ভূতপ্রেত, গোরস্তানে মামদো আছে; ইংরেজ বিশ্বাস করে সে পৃথিবীর– সরি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বোৎকৃষ্ট নেশন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এস্থলে আরও বলে নিই; মহাপুরুষদের যারা বিরুদ্ধাচরণ করে তারাও তাদের সম্বন্ধে বিপরীত লেজেন্ড তৈরি করে। যেমন খ্রিস্টবৈরী ইহুদিরা বলেছে প্রভু খ্রিস্ট ছিলেন মাতাল, তিনি শুঁড়িদের (পাবৃলিকাস ইতরজনের সাহচর্যে উল্লাস বোধ করতেন, এবং নর্তকী বেশ্যাদের সেবা গ্রহণ করতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না (মেরি ম্যাগডলিন)।
বাঙলা দেশে একটা দল আছে। সেটা কতু-বা বর্ষার প্লাবনে দুর্বার গতিতে বন্যা জাগিয়ে জনপদভূমির সর্বনাশ করে যায় আর কভু বা বৎসরের পর বৎসর ফধারা পারা অন্তঃসলিলা থাকে। এ দল পরপর রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, ঈশ্বরচন্দ্র এবং সর্বশেষে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধাচরণ করে উপস্থিত ফরু-পন্থানুযায়ী অন্তঃসলিলা। মোকা পেলে বুজবু করে বেরুতে চায়। এদের জন্ম নেবার কারণ সম্বন্ধে এস্থলে আলোচনা করব না।
রবীন্দ্রনাথ চা খেতেন না– এটা নিরীহ, হামলেস লেজেন্ড। কিন্তু এই দল প্রচার করে যে, রবীন্দ্রনাথ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক অক্ষরও জানতেন না, তিনি ছিলেন সুরকানা, মামুলি রাগরাগিণী তিনি ঘুলিয়ে ফেলতেন এবং বিলিতি গান-বাজনার প্রতি তার ছিল অন্ধ ভক্তি। তাই গোড়ার দিকে তার গানের কথাতে সুর দিতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং পরবর্তীকালে তাবৎ রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর দিয়েছেন দিনেন্দ্রনাথ!! এস্থলে পুনরায় বলতে হয় : হরি হে তুমিই সত্য।
দ্বিতীয় লেজেন্ড : আমাদের জাতীয় সঙ্গীত জনগণমন রবিঠাকুর রচনা করেন রাজা পঞ্চম জর্জের উদ্দেশে। এদের যুক্তি এই প্রকার :
(১) জনগণমন-অধিনায়ক তারতভাগ্যবিধাতা একজন রাজা (কারণ রাজাই তো জনগণের ভাগ্যনির্ণয় করেন)।
(২) পঞ্চম জর্জ রাজা।
অতএব জনগণমন-অধিনায়ক ভারতভাগ্যবিধাতা স্বয়ং পঞ্চম জর্জ।
কুয়োট এরাট ডেমনস্ট্রাভুম (g. E. D.)। আমেন আমেন। সুশীল পাঠক, অবধারিত হোন, যে দল এ-লেজেডের বিষবৃক্ষ রোপণ করেছিল তারা সেটা সত্য জানা সত্ত্বেও সজ্ঞানেই করেছিল। এরা জ্ঞানপাপী। এবং এরা বিলক্ষণ অবগত ছিল, সমসাময়িক বিশ্বাসভাজন শ্রদ্ধেয় গুণীজ্ঞানীরা এই কিম্ভূতকিমাকার থিয়োরিকে দলিলদস্তাবেজ, প্রমাণপত্র, সাক্ষীসাবুদ, যুক্তিতর্ক দ্বারা নস্যাৎ ধূলিসাৎ তো করবেনই, তদুপরি করলারি বা ফাউ হিসেবে আরও প্রমাণ করে দেবেন, এই বিষবৃক্ষরোপণকারীরা হস্তীমূর্খ রামপন্টক (কন্টক থেকে কাটা, পন্টক থেকে পাঠা– জ্ঞানবৃদ্ধ রসসিদ্ধ সুনীতি উবাচ)। কিন্তু এ-দলের চর্ম কাজিরাঙার গণ্ডারবিনিন্দিত বৰ্মসম স্কুল। তাই আমার যখন একদা চর্মরোগ হয় তখন আমার সখা ও শিষ্য চর্মরোগ-বিশেষজ্ঞ ড. লি আমাকে সলা দেন, আপনি পরনিন্দা আরম্ভ করুন। চামড়াটি গারের মতো হয়ে যাবে। গণ্ডারের চর্মরোগ হয় না।
তাই যখন অধুনা খবরের কাগজে দেখতে পাই শ্রীযুক্তা ইন্দিরাকে জনগণমন অধিনায়িকারূপে উল্লেখ করা হয়েছে তখন আমি রীতিমতো শঙ্কিত হই। আজ ইন্দিরা, কাল জ্যোতিবাবু, পরও আপনার মতো নিরীহ পাঠককে হয়তো জনগণমন-অধিনায়ক বলে বসবে, অর্থাৎ পরমেশ্বরের পর্যায়ে তুলে দেবে। কিন্তু এ পয়েন্টটি থাক।
কিন্তু প্রশ্ন এই, জাতীয় সঙ্গীতটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে পঞ্চম জর্জকে শোনালে কি হিজ ম্যাজেস্টি আপ্যায়িত হতেন মোটেই না।
আইস পাঠক! গানটি বিশ্লেষণ করহ।
ভারতভাগ্যবিধাতা যে তিনি, সেকথা শুনে রাজা নিশ্চয়ই মনে মনে শুকনো হাসি হাসতেন। তিনি বিলক্ষণ জানেন, তিনি তার মাতৃভূমি ইংলন্ডেরও ভাগ্যবিধাতা নন। তাঁর আপন ভাগ্যই নির্ণয় করেন তাঁর (হ্যাঁ তারই- মশকরা আর কারে কয়?) প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টের চুড়োয় বসে। তিনি অবশ্য তখন জানতেন না যে তার যুবরাজ রাজা হবার পর যখন এক এড়িকে (লগ্নচ্ছি = ডিভোর্সড় = তালাকপ্রাপ্তা) বিয়ে করতে চাইবেন তখন তার (!) প্রধানমন্ত্রী তাকে কানটি ধরে দেশ থেকে বের করে দেবেন। এবং তার নাতনি যখন রানি হবেন তখন তার স্বামী রানা (রাজার স্ত্রীলিঙ্গ রানি কিন্তু রানির স্বামী যদি রাজা না হন তবে রানি শব্দ থেকে পুংলিঙ্গ নির্মাণ করে রানা শব্দ ব্যবহার করা হয়। তাই রানি এলিজাবেথের স্বামী রাজা নন, তিনি রানা) ডুক অ এড়া ভিখিরির টোল-খাওয়া মাখনের টিন হাতে করে পার্লামেন্ট বাড়ির সামনে এসে হাঁকবেন দুটো চাল পাই না, আর গেরস্তু-গিন্নি প্রধানমন্ত্রী বাড়ির দরজা এক বুড়ো আঙুল ফাঁক করে (অবশ্য অষ্টরম্ভা দেখিয়ে বিরক্তকণ্ঠে বলবেন ঘরে চাল বাড়ন্ত। প্রধানমন্ত্রী মুসলমান হলে বলবেন, ফিরি মাঙো–অর্থাৎ অন্য বাড়ি যাও।
এর পর যখন অনুবাদক চারণ বলবে, হুজুরকে জনগণ ঐক্যবিধায়ক বলা হয়েছে তখন তিনি বহুযুগসঞ্চিত রাজগৌরব প্রসাদাৎ তার ঠা ঠা করে অট্টহাস্য করার অদমনীয় উচ্ছলাচরণ দমন করে মনে মনে মৃদু হাস্য করে বলবেন, বটে! আমাদের নীতি আমাদের ধর্ম ডিভাইড অ্যান্ড রুল দ্বিধা করে সিধা রাখো। আর এ প্রাইজ ইডিয়ট বলে কী? আমি নাকি ঐক্যবিধায়ক। হোলি জিজস!
এর পর চারণ কাচুমাচু হয়ে বলবে, হুজুর মধ্যিখানের প্যারা খুঁজে পাচ্ছিনে। দুসরা কপি এখুনি এল বলে। ইতোমধ্যে শেষ প্যারাটি অনুবাদ করি। রাজা আমনে শুনতে শুনতে হঠাৎ খাড়া হয়ে বসবেন। কী বললে? পূর্ব গিরিতে রবি উদিল? রবি তো রবীনডর ন্যাট ট্যাগোর– দ্যাট নেটিভ?
চারণ সভয়ে বলবে, এজ্ঞে হ্যাঁ। কারণ একথা তো বিলকুল খাঁটি যে রবি কবি পূর্বদেশে, প্রাচ্যে জন্মেছেন, পূর্ব উদয়গিরিভালে তিনি রাজটীকা।
রাজা জর্জ তো রেগে টঙ। কী, কী-আস্পদ্দা। কাউকে যদি পূর্বদেশে, ভারতে উদয় হইতেই হয় তবে সে হব আমি। তার পর গরগর করে বলবেন, ভাইসরয়টাকে বলে গে, পুবের মণিপুর পাহাড়ের উপর সিংহাসন যেন পাতা হয়। আমি যেখানে উদিত হব। আশ্চর্য, এত বড় একটা ফশন ডংকিগুলো বেবাক ভুলে গেছে। চিফ অব্ প্রটোকল মাস্টার অব সেরিমনিজকে এক্ষুনি ডিসমিস কর।
ইতোমধ্যে মিসিং দুই প্যারা এসে গেছে। অনুবাদক তো ভয়ে কাঁপছে। অনুবাদ করে কী প্রকারে শেষটায় ভয়ে না নির্ভয়ে ইত্যাদি ফরমুলা কেতাদুরস্ত করে বলল, হুজুর, কবি বলছে, আপনি চিরসারথি, আপনি শখ বাজাচ্ছেন (হে চিরসারথি তব…শঙ্খধ্বনি বাজে)।
রাজা তো রেগে টঙ। ক্রোধে জিঘাংসায় বেপথুমান হয়ে হুঙ্কারিলেন, কী! এত বড় বেআদবি, বেইজ্জতি বেত্তমিজি! এ তো লায়েসা মাজেস্টাস (laesa majestas)। হিজ ম্যাজেস্টিকে অপমান। অবশ্য নেটিভটা লাতিন লায়েসা মাজেষ্টাস জানে না। কিন্তু এটাও কি জানে না, এর চেয়ে শতাংশের একাংশ অপরাধ করেও, কোনও কোনও স্থলে না করেও ব্রিটিশ রাজে লক্ষ লক্ষ লোক ফাঁসি গেছে।
অসহ্য অসহায়। আমাকে বলছে সারথি। মোটর ড্রাইভার। আমার বাবা এডওয়ার্ড যখন ইহজগতের স্বপ্নাতীত অকল্পনীয় সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বপ্রথম ডেমলার গাড়ি নিয়ে তাঁর কাজিন কাইজারকে বার্লিনে দেখতে যান তখন কাইজার বিস্ময়ে অভিভূত ছোট বাচ্চাটার মতো নাগাড়ে সাড়ে-তেরো ঘণ্টা গাড়িটার পালিশের উপর হাত বুলিয়েছিলেন। বাবা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন একটা গাড়ির জন্য বারোটা ড্রাইভার। আর আজ আমাকে রাজাকে বলছে আমি মোটরড্রাইভার, ফোর। আমার আস্তাবলে ক-শো ড্রাইভার আছে তার খবর আমার প্রাইভেট সেক্রেটারি পর্যন্ত জানে না। আর আমি নাকি ওহ্।
তার পর বিড়বিড় করে যেন আপন মনে বললেন, আর বলছে কী, আমি নাকি চিরসারথি। আমি চিরকাল ড্রাইভার থাকব। পার্মেনেন্ট পোস্ট। আমার প্রমোশন তক হবে না। আমি এমনই নিষ্কমা চোতা রদী ড্রাইভার! হোলি মৈরি– হ্যাঁ, নেটিভরা মাইরি বলে বটে–আমি যদি এ লোকটাকে আমার রোলসের চাকায় বেঁধে না, আগে তো বলডুইনের এজাজৎ চাই। ড্যাম বলডুইন! আর আমি শাঁখ বাজাই। পল্টনের বিউগলে ফুঁ দি। ছি ছি।
চারণ আবার সভয় নির্ভয় করে নিয়ে বলল, হুজুরকে বলেছে স্নেহময়ী মাতা।
এবারে রাজা লক্ষ দিয়ে সিংহাসন ত্যাগ করলেন। অবশ্য অন্য কারণও ছিল।
সিংহাসনে কোচের মতো স্প্রিং থাকে না। থাকে পাতলা একখানি কুশন। কংগ্রেসের সম্মানিত সিডিশাস মেম্বার ভারতীয় ছারপোকার পাল সেখানে বাসা বেঁধে হুজুরের কোমলাঙ্গে তখন ব্যাংকুয়েট পরবের মাঝখানে।
কম্পিত কণ্ঠে রাজা বললেন, আমি এখুনি ফিরে যাচ্ছি দেশে। সব সইতে পারি। কিন্তু আমি মা, আমি স্ত্রীলোক! বুঝেছি লোকটার ইনসলেন্স। বলতে চায়, কূটনৈতিক কারণে, রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য–rasion d tat– আমি মাগী হওয়া সত্ত্বেও মেকডনান্ড বলডুইন আমাকে মন্দার বেশে সাজিয়েছে। আমি আসলে মেনি, ওরা আমাকে পরিয়েছে হুলোর ছদ্মবেশ।
কাঁপতে কাঁপতে রাজা কার্পেটে বসে পড়লেন। প্রায় কান্নার সুরে বললেন, সেদিন শিকারের সময় এক নেটিভ শিকারি বলেছিল, এক আসামি নাকি দারোগাকে বলেছিল, হুজুর, আমার মা বাপ। দারোগা নাকি বলেছিল, বাপ হতে পারি, কিন্তু আমাকে মা বলছিস কেন? আমি কী স্যারি (শাড়ি পরি। শিকারি আমাকে বলেছিল, হুজুর, আসামি যদি শুধু বাপ বলত তবে দারোগা ছেড়ে দিত। মা বলেছিল বলে সেশনে সোপর্দ করল। ফাঁসি হল। … দারোগাকে মেনি বলাতে সামান্য দারোগা ফাঁসিকাষ্ঠে চড়াল। আর আমি ইংলন্ডেশ্বর, অ্যান্ড অব্ দি ডমিনিয়নস বিওন্ড দি সিজ, ডিফেন্ডার অব ফেথ, এপারার অব্ ইন্ডিয়া। আর এই শেষেরটা কী কারসিকতা! আমি কি বকিংহম পেলেসে নিভৃতে পেটিকোট পরি, ঠোঁটে নখে আলতা মাখি! ওহ! অসহ্য অসহ্য!
তার পর রাজা কোর্ট-গেজেট প্রকাশ করলেন, ওই নেটিভ টেগোরের গান আমার উদ্দেশে লেখা নয়।
তথাপি এ-লেজে মরে না।
কিন্তু এ কাহিনী এখানে বন্ধ করি। হালে বঙ্কিমচন্দ্রের রামায়ণ-সম্বন্ধে একটি রচনা হিন্দিতে অনুবাদিত হলে তার বিরুদ্ধে দিল্লির আদালতে ডবল ফৌজদারি মোকদমা রুজু হয়েছে। বঙ্কিমবাবু নাকি বিস্তর ছুটোছুটি করেও একটা বটতলার চারআনি মোক্তারও পাচ্ছেন না– অথচ একদা তিনি স্বয়ং দুদে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তাবৎ ছাতুখোর খোটা চুরনবেচনে-ওলাকে বংশধর লালাজি ব্যারিস্টার দারুণ চটিতং … পাঠক, তিষ্ঠ ক্ষণকাল টেলিফোন বাজছে।
হ্যাঁ, যা ভেবেছিলুম তাই। এক হিন্দিপ্রেমী সোল্লাসে জানালেন, আজ সকালে বঙ্কিমবাবুর ফাঁসি হয়ে গিয়েছে।
আমার এ লেখন হিন্দিতে অনুদিত হলে আমার নির্ঘাত ছ মাসের ফাঁসি।
.
মে মাসের ২৯ তারিখ ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গাঁধী শান্তিনিকেতন আশ্রমে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। বলা বাহুল্য এই তাদের প্রথম পরিচয় নয়। গাঁধীজি যখন দক্ষিণ আফ্রিকা ত্যাগ করে ভারতে আসেন তখন তিনি প্রায় চার মাস শান্তিনিকেতন ব্রহ্মবিদ্যালয় পরিচালনা করেন। ওই সময়ে ৬ মার্চ ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে উভয়ের প্রথম সাক্ষাৎ হয়।(৪) এর পর ১৯২১-এর পূর্বে উভয়ের আর কোনও মালাকাত হয়েছিল কি না জানি নে। তবে ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩১-এ গাঁধীজি জোড়াসাঁকোর বিচিত্রা ভবনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে আলাপ-আলোচনা করেন। গাঁধীজির উদ্দেশ্য ছিল সত্যাগ্রহ আন্দোলনের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ যে বিরুদ্ধমত প্রকাশ করেছিলেন সেটা বন্ধ করা এবং কবি যেন সত্যাগ্রহকে অন্তত তাঁর আশীর্বাদটুকু জানান।(৫) বলাবাহুল্য গাঁধীজি অকৃতকার্য হন। এই আলোচনা হয়েছিল রুদ্ধদ্বারে। কবি ও গাঁধীজি ছাড়া এ আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন মাত্র আর একজন দীনবন্ধু এনড্রজ। বস্তুত তিনিই এ-দুজনকে একত্র করেছিলেন; তার আশা ছিল, সামনাসামনি আলাপচারি হলে হয়তো দুজনের মতের মিল হয়ে যেতে পারে। ভারতবর্ষের মঙ্গলের জন্য তিনি এই দুই প্রখ্যাত ব্যক্তির মধ্যে প্রকাশ্য সংঘর্ষ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন।(৬)
এ মোলাকাত সম্বন্ধে একটি হাফ-লেজেন্ড আছে। তবে সেটা অবনীন্দ্রনাথকে দিয়ে। তিনি বললেন, এত বড় জব্বর একটা পেল্লাই ব্যাপার এলাহি কাণ্ড হয়ে যাচ্ছে আর আমরা দেখতে পাব না, শুনতে পাব না? আচ্ছা দেখি। অর্থাৎ শব্দার্থেই তিনি দেখে নিলেন কি-হোল দিয়ে, কীভাবে দুই জাদরেল ও তাঁদের মধ্যিখানের সেতুবন্ধ এনড্রজ আসন গ্রহণ করেছেন। বিচিত্রা বাড়িতে বিলিতি কেতায় কি-হোল আছে কি না জানিনে; তবে হয়তো তিনজনের আসন নেওয়ার পর বাইরের থেকে দরজায় খিল দেওয়ার পূর্বে তিনি একঝলক দেখে নিয়েছিলেন। আপন বাড়িতে ফিরেই তিনি একে ফেললেন একখানা বেশ বড় সাইজের গ্রুপ ছবি। মুখোমুখি হয়ে বসেছেন দুজনা দু প্রান্তে। তাদের বসার ধরন টিপিকাল- ঠিক এই ধরনেই তারা আকছারই বসতেন। আর গাঁধীর পিছনে একপাশে বসেছেন এনড্রজ। এর তিন মাস পরে বাৎসরিক কলাপ্রদর্শনীতে অবনবাবু ছবিখানি এক্সিবিট করলেন। দাম দেখে তো বিশ্বজনের চক্ষুস্থির। সেই আমলে– আবার বলছি সেই আমলে– পনেরো হাজার টাকা! কে একজন বলল, দামটা বড্ড বেশি হয়ে গেল না? অবনবাবু শেয়ানা বেনের মতো হেসে বললেন, বা রে! আমি তো সস্তায় ছাড়ছি। এদের প্রত্যেকের দাম পাঁচ-পাঁচ হাজারের চেয়ে ঢের ঢের বেশি নয় কি? এ ছবি যখন কেউ কিনল না, তখন অবনবাবু বললেন, এটা কাকে দেওয়া যায়? রবিকাকা হেথায়, গাঁধী হোথায়। তবে কি না এনড্রজের নিবাস বলতে যদি কিছু থাকে তবে সেটা তো রবিকাকার ছায়াতেই। দুজন যখন শান্তিনিকেতনে তখন এটা যাক ওখানকার কলাবনে। এ ছবি অনেকেই নিশ্চয় কলাভবনে দেখেছেন। তবে দীর্ঘ ৪৮ বৎসর পর রঙ বড় ফিকে হয়ে গিয়েছে।
১৯২৫-এর ২৯ মে গাঁধীজি আবার রবীন্দ্রনাথকে স্বপক্ষে টানবার জন্য শান্তিনিকেতন আসেন এবং দুদিন সেখানে থাকেন। ইতোমধ্যে শান্তিনিকেতনেই ৯০ খানা চরকা ও তকলি চলিতেছে– বিধুশেখর, নন্দলাল প্রভৃতি সকলেই চরকা কাটিতেছেন। আবহাওয়া তা হলে অনুকূল। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখছেন : তিনি (গাধী) শান্তিনিকেতনে আসিতেছেন, রবীন্দ্রনাথের সহিত চরকা সম্বন্ধে আলোচনাই প্রধান উদ্দেশ্য। গাঁধীজি জানিতেন কবি তাহার সহিত চরকা সম্বন্ধে একমত নহেন, তবুও বোধহয় বিশ্বাস ছিল যে, নিজের ঐকান্তিকতার বলে তিনি কবিকে তাহার পথে আনিতে পারিবেন। দুই দিন তাহাদের দীর্ঘ আলোচনা চলে, বলা বাহুল্য কেহ কাহাকেও নিজ মতে আনিতে পারেন নাই। তৎসত্ত্বেও এখানে বলিয়া রাখি, উভয়ের প্রতি পূর্ববই অক্ষুণ্ণ রহিল।*[* * প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী, ৩য় খণ্ড : পৃ. ১৬৪।]
২৯-এ গ্রীষ্মবকাশের মাঝখানে পড়ে। আমি তখন দেশে, সিলেটে।
ফিরে এসে কী আলোচনা হয়েছিল সে সম্বন্ধে নানা মুনির নানা কীর্তন শুনলুম। কিন্তু সেসব রসকষহীন আলোচনা নিয়ে লেজেন্ডের গোড়াপত্তন হয় না। আমি বলতে চাই অন্য জিনিস।
ফিরে এসেই গেলাম আমার মুরুব্বি গাঙ্গুলীমশাইকে আদাব-তসলিমাত জানাতে। শুনেছি, ইনি রবীন্দ্রনাথের অতি প্রিয় বউদির (জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী আত্মীয় ছিলেন। গাঙ্গুলীমশাই ছিলেন শান্তিনিকেতন গেস্ট হাউসের ম্যানেজার। সে আমলে শান্তিনিকেতন মন্দিরের কাছে যে পাকা দোতলা বাড়ি (এইটেই আশ্রমে মহর্ষি-নির্মিত প্রথম বাড়ি এবং বর্তমান বোধহয় বিশ্বভারতীর দর্শন বিভাগের আস্তানা) সেইটেই ছিল গেস্ট হাউস। তারই নিচের তলায় একটি ছোট্ট কামরায় মিলিটারি বুট তথা হাফ মিলিটারি ইউনিফর্ম পরিহিত, হীতলাল প্রভৃতি দাসবংশ কর্তৃক সমাদৃত হয়ে সাতিশয় ফিটফাট রূপে বিরাজ করতেন মহাপ্রতাপান্বিত মহারাজ প্রমোদ গঙ্গোপাধ্যায় বা গাঙ্গুলীমশাই। বিরাজ করতেন বললে বড়ই অগ্লোক্তি করা হয়– রামায়ণী ভাষায় বলতে গেলে শ্রীরামচন্দ্রের ন্যায় গাঙ্গুলিমশাই ম্যানেজার পদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া অপ্রতিহতভাবে রাজ্যশাসন ও অপত্যনির্বিশেষে অতিথিশালায় পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ তথা অষ্টকূলাচল সপ্তসমুদ্র থেকে রবিমন্দ্রিত দেশ দেশ নন্দিত করি ভেরীর আহ্বানে সমাগত হিন্দু বৌদ্ধ জৈন পারসিক মুসলমান খ্রিস্টানি অতিথি সজ্জনকে যেন প্রজাপালন করিতেন। তার দাপট তাঁর রওয়াবের সামনে দাঁড়াতে পারেন এমন লোক আশ্রমে সে আমলে ছিলেন কমই। লোকে বলে, তিনি যখন গেস্ট হাউসে বসে হীতলাল! বলে হুঙ্কার ছাড়তেন তখন এক ফার্লং দূরে রতন কুটিতে প্রফেসর মার্ক কলিগের ছোকরা চাকর পঞ্চা আঁতকে উঠত তার পিলে চমকে উঠে এপেনডিসের সঙ্গে স্ট্যাম্বুলেটেড হয়ে যেত।
গাঙ্গুলীমশাই ম্যাট্রিক অবধি উঠতে পেরেছিলেন কি না সেকথা বলতে পারি না। তাই পাঠক পেত্যয় যাবেন না যে এঁর আবাল্য অতিশয় অন্তরঙ্গ সখা ছিলেন বহুভাষাবিদ হরিনাথ দে, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জ্যেষ্ঠা কন্যা হেমলতা দেবীর পুত্র ব্যঙ্গসুনিপুণ অভূতপূর্ব সাহিত্য-সমালোচক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, সম্পাদকমণ্ডলীর মুকুটমণি পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরও অনেক ইনটেলেকচুয়েল বা বুদ্ধিজীবী।
গাঙ্গুলীমশাইয়ের মতো সর্বাঙ্গসুন্দর, নিটোল পারফেক্ট রাকোঁতর স্টোরিটেলার মজলিসতোড় কেচ্ছাবলনেওলা এ পৃথিবীতে আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। রাকোতর হিসেবে ওসকার ওয়াইল্ড ছিলেন এ কলার ম্রাট। সে বাবদে যা কিছু লেখা হয়েছে, বিশেষ করে গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদক, ১৯৪৮-এ নোবেল প্রাইজ বিভূষিত আঁদ্রে জিদ (এই হালে, ২২ নভেম্বর ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী মহাড়ম্বরে ইয়োরোপে উদ্যাপিত হল, কিন্তু হায়, কৌলিক রচনার যে প্রখ্যাত লেখক আপন সৃজনকর্ম স্থগিত রেখে গীতাঞ্জলির অনুবাদ করলেন তিনি অন্য কোনও মহান লেখকের রচনা অনুবাদ করে তাকে এভাবে সম্মানিত করেছেন বলে শুনিনি যে আঁদ্রে জিদ ইয়োরোপে অজ্ঞাত বাঙালি নামক জাতের শ্রেষ্ঠ ধন ইয়োরোপের বিদগ্ধতম জাতের প্যারিস সমাজে প্রচার করলেন, তাঁকে এই উপলক্ষে কোনও বাঙালি স্মরণ করেছে বলে কানে আসেনি। তাঁর অন্তরঙ্গ সখা ওয়াইল্ড সম্বন্ধে যা লিখেছেন সেসব পড়ার পর রাকোতর হিসেবে গাঙ্গুলীমশাইয়ের প্রতি আমার ভক্তি বেড়েছে বই কমেনি। বস্তুত আ লা রিডারস্ ডাইজেন্ট বলতে হলে ইনিই আমার মোট অনফরগেটবল ক্যারেকটার। এঁর কাছ থেকে আমি সবচেয়ে বেশি বাংলা ভাষায় চালু ইডিয়ম, প্রবাদ এবং কলকাতার কনি শব্দ শিখেছি। আমার মতো তার অন্য এক সমঝদার–সাপুড়ে সম্মোহিত সর্পের মতো মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন আনন্দবাজার গ্রুপের শ্রীযুক্ত কানাইলাল সরকার। আমার কথা পেত্যয় না পেলে ওয়াকে শুধোবেন।
বলা বাহুল্য, বিলকুল বেফায়দা বেকার, আমি গাঙ্গুলীমশাইয়ের সে বয়ানের বন্যা, টৈটম্বুর রসের ছিটেফোঁটাও এই হিম-শীতল, রসকষহীন সিসের ছাপা হরফে প্রকাশ করতে পারব না। একমাত্র লোক যিনি পারতেন তিনি আমার রসের দুনিয়া-আখেরের পিরমুরশিদ পরশুরাম রাজশেখর বসু।
আমি তাকে মায়ের দেওয়া এক বোতল অত্যুকৃষ্ট সিলেটি আনারসের মোরব্বা দিলে পর তিনি আমার ললাটে চুম্বন দিলেন, মস্তকাঘ্রাণ করলেন। বেলা তখন একটা। তিনি আহারাদি সমাপন করে খাটে শুয়ে আলবোলায় ফুরুৎ ফুরুৎ মন্দমধুর টান দিচ্ছিলেন। আমাকে আদর করার পর ফের লম্বা হয়ে শুয়ে নলটি তুলে নিলেন। চোখ দুটি বন্ধ করে, কবির ভাষায় আকাশ পানে হানি যুগল ভুরু বললেন, গেরো হে গেরো। এমন গেরো আমার পঞ্চাশ বছরের আয়ুতে কখনও আসেনি। পুলিশের সঙ্গে মারপিট করে অসহ্য মশার কামড়ের মধ্যিখানে তেরারি হাজতে কাটিয়েছি, চন্নগর মাহেশের ফেস্তাতে যাবার পথে মাঝগঙ্গায় নৌকোডুবিতে হাবুডুবু খেয়েছি জলে পড়লে আমি আবার নিরেট পাথরবাটি-থিয়েডারের এক হাফ-গেরস্ত মাগী আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে চেয়েছিল ইত্যাকার বহুবিধ যাবতীয় ফাড়া-মুশকিল গেবো-গর্দিশ বয়ান করার পর বললেন, ওসব লস্যি হে লস্যি। ওহ্! এ গেরো যা গেল।
আমি বললুম, এ আশ্রম তো শান্তির নিকেতন। এখানে আবার গেরো?
গাঙ্গুলীমশাই নল ফেলে দিয়ে যুক্তকরে, মহর্ষির উদ্দেশে প্রণাম করে বললেন, তিনি পিরিলি বংশের প্রদীপ, আর সেই পিরিলি বংশের এ অধম পিলসুজ দেলকোর ছায়া। পাপ মুখে কী করে বলি, এখানেও মাঝে মাঝে অশান্তির উপদ্রব দেখা দেয়। কিন্তু বাবা, আমা হেন সামান্য প্রাণীকে বলির পাঁঠার মতো বেছে নেওয়া কেন?
আমি হুঁকোর নলটা তার হাতে তুলে দিয়ে বললুম, কোটা ল্যান, খুলে কন।
গাঙ্গুলীমশাই বললেন, গাঁধী হে, গাধী! তোমরা যাকে মহাত্মা ঠহাত্মা বল। তার পর ফের যুক্তকরে বললেন, তারা ব্রহ্মময়ী মা, বজ্রযোগিনী মা, রক্ষে দাও মা এসব মহাত্মাদের লেক লজর থাকে।
আমি তাজ্জব মেনে বললুম, গান্ধীজি তো অতিশয় নিরীহ, নিরুপদ্রবী, ভালো মানুষ। তিনি আপনার গেরো হতে যাবেন কেন?
গাঙ্গুলীমশাই বললেন, এই বুঝলেই তো পাগল সারে। তোমাকে তা হলে ভালো করে বুঝিয়ে বলি।
জানো তো বাপু, দেশ-বিদেশের হোমরা-চোমরা এখানে এলে আকছারই ওঠেন উত্তরায়ণে; বাস করেন হয় গুদেবের (প্রাচীন-পন্থীরা গুরুদেব না বলে বলতেন গুর্দের্ব) পাশে, নয় রথীবাবুর ওখানে। আমি তো নিশ্চিন্দি মনে দিব্য গায়ে ফুঁ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি আর উত্তরায়ণের নায়েব গোমস্তা চাকরবাকরদের দেখলেই মনে মনে ফিকফিক করে হেসে ভাবি, সব ব্যাটা বলির পাঠা। গাঁধী মাছ মাংস খান না বটে, কিন্তু মা কালীকেই কী তার উদ্দেশে বলি দেওয়া পাঠা কেউ কখনও খেতে দেখেছ; গাঁধী খাবেন না, সত্যি কথা, কিন্তু তাই বলে চাকর নফরের বলি নির্ঘাত। তখন কেমন জানি, কিংবা জানিনে, একটা অহেতুক অজানা শঙ্কা আমার ব্রেন-বক্সের-ব্ৰহ্মতালুতে ঢুকে সর্বাঙ্গ শিরশিরিয়ে পায়ের চেটো দিয়ে বেরিয়ে গেল তোমারই মুখে শোনা,
পাঁঠার বলি দেখে পাঠী নাচে।
(পাঁঠা বলে) ও পাঠী তোমার লাগি বিবির শিরনি আছে।
আমি তখন পাঠীর মতো আপন মনে ফিকফি হাসছি, বিলকুল খেয়াল নেই যে পির বিবির দর্শাতে পাঠা বলি হয় না, বলি হয় পাঠী, শিরনি চড়াবার জন্যে। সাদামাটা রাঢ়ীতে বলে, ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে, সবার একদিন আছে শেষে। (৮) উত্তমরূপে প্রবাদটি হৃদয়ঙ্গম করার পূর্বেই দ্যাখ-তো-না-দ্যাখ সঙ্গে সঙ্গে এওলাফরমান উপস্থিত! আমি কি তখন আর জানতুম যে এই ফরমান-পুষ্পগুচ্ছের ভিতর লুকিয়ে আছে গোখরোর বাচ্চা। আমি তো নাপাতে নাপাতে উত্তরায়ণ পৌঁছলুম। পকেট থেকে ডাস্টার বের করে বুটজোড়া পরিষ্কার করে খোলা দরজায় হাফ মিলিটারি মোলায়েম টোকা দিয়ে গুর্দেবের ঘরে ঢুকলুম।
গুর্দেব লেখা বন্ধ করে আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বললেন, বসো গাঙ্গুলী। আমি সিভিলিয়ান কায়দায় তার পায়ের ধুলো নিয়ে মিলিটারি কেতায় দাঁড়িয়েই রইলুম।
গুর্দেব অত্যন্ত প্রসন্ন বদনে আমাকে বললেন, যবে থেকে তুমি এখানে এসেছ, বুঝলে গাঙ্গুলী, আমার ঘাড় থেকে অন্তত একটা বোঝা নেমে গেছে, ভিজিটারদের আরাম-আয়েসের জন্যে আমাকে আর মাথা ঘামাতে হয় না। তুমি একাই একশো; সব সামলাতে পার। আমি তো মনস্থির করে বসেছিলুম গান্ধীজিকে এই উত্তরায়ণেই গেস্টরুমে তুলব। কিন্তু আজ এইমাত্র তার কাছ থেকে চিঠি পেলুম, তিনি দুটি দিন এখানে নির্জনে শান্তিতে বাস করতে চান। তুমি তো জানো, আমার এখানে উদয়াস্ত ভিজিটারের ভিড় লেগেই আছে। তাদের আনাগোনা, বারান্দায় চলাফেরা, আঙিনায় হাঁকডাক গাঁধীর শান্তিভঙ্গ করবে। তাই স্থির করেছি, তোমার গেস্ট হাউসের দোতলাই তার জন্য সবচেয়ে ভালো আবাস হবে; আর তুমি যা-তা ভিজিটারকে ঠেকাতে যে কতখানি ওস্তাদ সে আমি ভালো করেই জানি। তোমার হাতে গাধীকে সঁপে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হলুম।
গাঙ্গুলীমশাই সেই ফাঁসির হুকুমের স্মরণে একটুখানি কেঁপে উঠে কাঁপা গলায় বললেন, বাব্বা! আমি আমার ওই গেস্ট হাউস আস্তাবলে গাঁধীকে রাখব কী করে? একটা শোবার ঘরে আছে দুখানা স্পিঙের খাট। সে এমনই স্প্রিং যে তার উপর রামমূর্তি সার্কাসের ফেদার-ওয়েট বামনাবতার গুলৈও সে-স্প্রিং ক্যাচর-ম্যাচর করে মেঝের সঙ্গে মিশে যায়। আমাদের পাড়াতে এক পাদ্রি সাহেব লেকচার দিতে গিয়ে বলেন, প্রফেট নোআর আমলে সর্ববিশ্বব্যাপী এক বিরাট বন্যা হয়। ঈশ্বরসৃষ্ট তাবৎ প্রাণী, বৃক্ষ, তৈজসপত্রাদি যাতে সেই বন্যায় লোপ না পায় তাই তিনি নোকাকে আদেশ দেন, তিনি যেন একটা বিরাট নৌকা গড়ে তার উপর প্রত্যেক প্রাণী, প্রত্যেক জীব, এমনকি প্রত্যেক আসবাবপত্র জোড়ায় জোড়ায় হেপাজতির সঙ্গে তুলে রাখেন। গুরুগম্ভীর হয়ে এতখানি শাস্ত্রালোচনা করার পর গাঙ্গুলীমশাই ঈষৎ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। জিরিয়ে নিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, আমার মনে রত্তিভর সন্দ নেই যে আমার গেষ্ট হাউসের উপরের তলায় যে দুটি খাট আছে সেগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বময় ঘোরাঘুরি করে শেষটায় আশ্রয় পেল দেবেন্দ্রনাথের চরণপ্রান্তে। আফটার অল্ তিনি তো প্রফেট–নোআরই মতন গত শতাব্দীর প্রফেট।
এস্থলে বলে রাখা প্রয়োজন, গাঙ্গুলীমশাই ছেলেবেলা থেকেই সে যুগের বিলিতি এদেশে একদম বেখাপ্পা– ডবল খাট, ড্রেসিং টেবিল, এসৃক্রিতোয়ার, বিদে, চায়না ইত্যাদিতে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনিই আমাকে একদিন বলেছিলেন যে তার ধনী ঠাকুন্দা তার ভিলাটি সাজিয়েছিলেন নসিকে বিলিতি কায়দায় একমাত্র ডাবল সি টা ছিল ব্যত্যয়, নেটিভ স্টাইলে গোড়ালির উপর বসে কর্মটি সমাধান করতে হত। তা সে যাই হোক, গাঁধীজির অভ্যর্থনার জন্য যেটুকু মিনিমামেস্ট দরকার সে তিনি পাবেন কোথায়, গাঙ্গুলীমশায়ের ভাষায় আফটার অল লোকটা তো বিলেতে ব্যারিস্টারি পাস করেছে।
গাঙ্গুলীমশাই বলে যেতে লাগলেন, গুদে বোধহয় আমার হতভম্ব ভাব দেখে তরসা দেবার জন্য বললেন, তোমার যা যা দরকার আমার এখান থেকে, রথী আর বউমার বাড়ি থেকে নিয়ে যেও। আহ্! কথাটি শুনে পেরানটি জুড়িয়ে গেল। ওঁয়ার আছেটা কী? এরকম কম আসবাবপত্র নিয়ে তার ক্রিচারস কম্ফর্ট পোয় কী করে জানেন ব্রহ্মময়ী।(৯) অবশ্য রথীবাবুর বাড়িতে এটা-সেটা আছে, কিন্তু একটা ভদ্রলোকের বাড়ি তো আর লাজারসের গুদাম নয় যে প্রত্যেক আইটেম দু-তিন দফে করে থাকবে। ও বাড়ি থেকে আমার যা দরকার– খাট সোফা কোচ, নতুন পর্দা, লেখা-পড়ার জন্য উত্তম টেবিল-চেয়ার, একটা পেনট্রির আসবাবপত্র যেখানে খাবার জড় করা হবে, ডাইনিংরুমের জন্য একটা সাইডবর্ড যেখানে পেনট্রি থেকে আসা খাবারের ডিস ডিনার টেবিলে সার্ভ করার পূর্বে রাখা হয়, হল-মার্কওলা উত্তম রুপোর ছুরি-কাঁটা–।
আমি বাধা দিয়ে বললুম, অবাক করলেন, গাঙ্গুলীমশাই! আপনি আমাকে সেই বু সব ইংরেজের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। ফরাসি ভাষা জানে না; প্যারিসের রেস্তোরাঁয় তাই আঙুল দিয়ে মেনুতে দেখিয়ে দিল প্রথম পদ। এল সুপ। এবার অব আঙুল দিল মেনুর মধ্যিখানে। ভাবল, মাছ-মাংস ওই ধরনের কিছু একটা সলিড় সাবসৃটেনশাল আসবে– ফরাসিতে যাকে বলে পিয়েস দ্য রেজিসাস অর্থাৎ যে বস্তু (পিস) আপনার ক্ষুধাকে মোক্ষম রেজিসটেন্স দেবে। ও হরি! ফের এল সুপ। খানাপিনা বাবদে হটেনটট গোত্রের ইংরেজ জানবে কী করে বিদগ্ধ ফরাসি জাত মেনুতে নিদেন ত্রিশ রকমের সুপ রাখে (হটেনটট গোরা বলে, উই ইট টু লিভ, আর বিদগ্ধ ফরাসি বলে, উই লিভ টু ইট)। এদিকে ইংরেজের রেস্ত ফুরিয়ে এসেছে। পুডিং মুডিং-এর আশায় দেখাল সর্বশেষ আইটেম। এল টুথ পেক–খড়কে। বুঝুন ঠ্যালা। তরলতম দু-কিস্তি সুপ খেয়ে, পান করে বললে সঠিকতর হয়, খড়কে দিয়ে দাড়ি খোটা! আপনি যে ইংরেজটাকেও হার মানাতে চললেন। করমচান্দের সুযোগ্য সন্তান মোহনদাস গাঁধী তো শুনি খান বা পান করেন– পাজের শুরুয়া বা সুপ, সে-ও অতি হালকা আর বকরির দুধ। ওই দুই তরল দ্রব্য মুখে পৌঁছে দেবার জন্য আপনি ওঁকে হাতে তুলে দেবেন হামিলটন কোম্পানির হল মার্কওলা রুপোর ছুরি আর কাঁটা! ভাগ্যিস আপনি চীনের ইম্পিরিয়াল পেলেস থেকে হীরে পান্না বসানো চপ ঠিক রেকুইজেশন করেননি।
গাঙ্গুলীমশাই ঠোঁটের এককোণ দিয়ে কিস্তিতে কিস্তিতে ধুয়ো ছাড়তে ছাড়তে বললেন, তোমার যেমন আঙ্কেল। যে ভিখিরি কুকুরের সঙ্গে মারামারি করতে করতে ডাস্টবিন থেকে খুঁজে খুঁজে খুঁটে খুঁটে অখাদ্য খায়, তাকে খেতে ডাকলে কী রাস্তা থেকে বাড়িতে একটা ডাস্টবিন তুলে এনে সেই ময়লার ভিতর সেই অখাদ্যই রাখ নাকি, যেটা সে নিত্যি নিত্যি খায়? আর দু-তিনটে যেয়ো কুকুর লড়াই করার জন্য।
আরে বাপু, যার যা বেষ্ট, মেহমানকে সেইটে দিতে হয়। আমি তাই দিন তিনেক উদয়াস্ত খেটে উপরের তলার তিনখানা ঘর সাজালুম। খুব যে মন্দ হল তা বলব না। অবশ্য দুর্গা নাম জপ এক সেকেন্ডের তরেও কামাই দিইনি।
মহারাজ আসবার আগের দিন বেলা প্রায় দশটার সময় গর্মি তখন নিদেন ১১২ ডিগ্রি দেখি, কে যেন মিন-ছাতায় রোদ্দুর ভেঙে ভেঙে আসছে। কে চোখ কচলে দেখি– সর্বনাশ– জাব্বাজোব্বা পরা গুর্দেব। প্রথমটায় ভেবেছিলুম মহর্ষিদেবের ছায়া-শরীর। জানো, বোধহয়, অনেকেই জ্যোৎস্নারাতে দেখেছে, সাদা আলখাল্লা পরা তার ছায়াকায়া মন্দির থেকে বেরিয়ে তার মর্তের বাসভবনে এই গেস্ট হাউসের দিকে আসছেন। এবার বুঝি ঠা ঠা রোদূরে। তবে ভরসা এই, কাছে গেলেই উপে যাবেন।
আমি বললুম, যত সব গাঁজা। মহর্ষিদে এ মন্দির কখনও দেখেননি। শুনেছি, মহর্ষির আদেশে হাভেল সাহেব না কে যেন আর অবন ঠাকুরে মিলে এটার প্ল্যান করেন। এটার প্রতি পরলোকে গিয়েও তার মোহ থাকবে কেন?
গাঙ্গুলীমশাই বললেন, আমি তো পড়িমরি হয়ে ছুটলাম গুদেবের দিকে, রঙচটা বাঁশের ছাতাখানা নিয়ে। তিনি ছাতাখানা উপেক্ষা করে মৃদু হেসে বললেন, দেখি গাঙ্গুলী, অতিথি সল্কারের কী ব্যবস্থা করেছ।
গাঙ্গুলী মহাশয়ের সর্বাঙ্গে সভয় কম্পনের শিহরণ খেলে গেল– গুরুদেবের ওই অত্যন্ত হামলেস ইচ্ছা প্রকাশের স্মরণে। বললেন, সবাই আমাকে ভরসা দিয়েছিল, গাধী কিছুতেই গুর্দেবকে এ বাড়িতে তকলিফ বরদাস্ত করে আসতে দেবেন না। তিনি যাবেন স্বয়ং–যতবার প্রয়োজন হয় উত্তরায়ণে, যাত্রী যেরকম ভক্তিভরে তীর্থস্থলে যায়। কাজেই গুর্দেব আমার জোড়াতালির ঘর-সাজানো দেখতে পাবেন না। এখন উপায়? এক ঝটকায় মা কালীর ঘুষ ডবল করে দিলুম– দুটোর বদলে চারটে মোষ।
হায়, হায়, হায়। গেরো, গেরো, গেরো। গুদে ঘরে ঢুকেই বললেন, এসব করেছ কী হে! সব যে বিলিতি মাল। ব্রাস রড়ওলা শ্রিং খাট! সর্বনাশ। বের কর, বের কর টেনে। এখনি। আর লোক পাঠাও, দেরি কর না– অমুকের বাড়িতে বিয়ের সময়ে সে পেয়েছিল চীনে মিস্ত্রির হাতে খোদাই করা করা একখানা জবরদত্ত কাঠের পালঙ্ক। আনাও সেটা। আর এসব যে একেবারে বিলিতি বেড় শিট, বালিশের ওয়াড়। তুমিই যাও, গাঙ্গুলী, হা তুমিই যাও, বউমার কাছে। তার গুদামঘরে আমার একটা মস্ত বড় সিন্দুক আছে। তার ভিতর খদ্দরের সব জিনিস পাবে। আমি যখন গেলবার আহমদাবাদ গিয়েছিলুম তখন সবাই আমাকে চেপে ধরল খন্দর পরার জন্য। আমি বললুম অত মোটা কাপড় আমার সয় না। তারা যেন চ্যালেন্জটা তুলে নিল। ধুতি, পাঞ্জাবির অতি মিহিন কাপড় থেকে আরম্ভ করে বিছানার চাদর, ওয়াড়–এমনকি খদ্দরের মশারি। না হে না, তুমি ভাবছ ওর ভিতর মানুষ দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে। মোটেই না। এমনই মিহিন যেন মলিন। ভিতরে যে ওয়ে আছে। তার দিকে বাইরের থেকে তাকালে মনে হয় মাঝখানে কোনও মশারি নেই।
হঠাৎ কার্পেটের দিকে নজর যেতে ফের ইকম, ফেলে দাও এটাও। তার পর কী যেন ভাবতে গিয়ে উপরের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল বিজলিবাতির বাব। চিন্তিতভাবে যেন আপন মনে বললেন, এটাকে নিয়ে কী করা যায়? আমাকে বললেন, যা, বউমার ওখানে যাবার সময় নন্দলাল আর ক্ষিতিমোহনবাবুর স্ত্রীকে এখানে পাঠিয়ে দিও। আমি সব আদেশ তামিল করার সময় ভাবলুম, হনুমানজিকে কে বলে সরল? তিনি তার মুনিটিকে হাড়ে হাড়ে চিনতেন। এখন বলছেন, লে আও বিশল্যকরণী। আনা মাত্রই হয়তো ফের হুকুম-ওই যু-যা। বিবতারিণীর কথা বেবাক ভুলে গিয়েছিলুম। যাও তো বস পবননন্দন হনুমান পবনগতিতে। নিয়ে এস ওই বস্তুটি। তখন ঘষ্টাতে ঘটাতে যাও ফের ওই মোকামে। ক-বার যেতে আসতে হবে সে কি স্বয়ং প্রভু রামচন্দ্রই জানেন? অতএব নিয়ে চল সমুচা গন্ধমাদনটাকে। আর এস্থলে স্মরণ কর, আমাদের ওর্দেবের বাবামশাই কী করতেন? ঘড়ি ঘড়ি মত বদলাতেন বলে তার খাস সহচর দুদিন অন্তর অন্তর বিদেশ থেকে টেলি পাঠাতেন, বাবু চেনজেস হিজ মাইন্ড। পুত্রের যে সেটা অর্সায়নি কী করে জানব? আমি নিয়ে চললুম গন্ধমাদন প্রমাণ সেই বিরাট সিন্দুকটাকে। আমার অবশ্য সুবিধে, আমাকে তো ওটা বইতে হবে না। বইবে ব্যাটা হীতলাল, কালো, ভোলা, বঙ্কা গয়রহ।
গেস্ট হাউসে পৌঁছে দেখি, চীনা পালঙ্ক তখনও আসেনি। খবর পেলুম সক্কলের পয়লা এসে পৌঁছেছেন ঠানদি (ক্ষিতিমোহনবাবুর স্ত্রী)। সেটা অতিশয় স্বাভাবিক। তার নাম কিরণ। তার টাটু ঘোড়ার মতো চলন দেখে ক্ষিতিবাবুই একদিন বলেছিলেন, সার্থক নাম কিরণ! কী run দেখেছ?
উপরে গিয়ে দেখি তুলকালাম কাও। ঠানদি এবং জনা তিন-চার এক্সপার্ট মহিলা লেগে গেছেন ঠিক সেন্ট্রাল বাতিটার নিচে দুনিয়ার যত কঠিন কারুকার্য ভরা বিরাট গোল একটা আল্পনা আঁকতে। শুর্দেব এককোণে চুপ করে বসে বসে সব দেখছেন। এমন সময় নন্দলাল এলেন। গুর্দেব তাঁকে বললেন, এক কাজ কর তো নন্দলাল। ওই বালবটাকে আড়াল করতে হবে। তুমি এটার নিচে একটা পেতলের চেপ্টা ফ্লাওয়ার ভাজ ছাত থেকে সরু সরু চেন দিয়ে বুলিয়ে দাও তো। ঠিক মানানসই সাইজ ও শেপের ও-রকম একটা ভা বউমার আছে। আর ভাজ ভর্তি করে দাও পদ্মফুল দিয়ে, কুঁড়িগুলো যেন গোল হয়ে বাইরের দিকে মাথা ঝুলিয়ে দেয়। বিজলির আলো আসবে পদ্ম পাপড়ির ফাঁকে ফাঁকে। কী বললে? পদ্ম না-ও পাওয়া যেতে পারে! নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। একটু দূরে লোক পাঠালেই হবে। নইলে মানানসই অন্য ফুল? নন্দলাল মাথা নেড়ে জানালেন হয়ে যাবে।
ইতোমধ্যে সেই মানওয়ারি জাহাজ সাইজের পালঙ্ক এল।
আমি এ কাপড়, ও শিট দেখাই। তিনি নামঞ্জুর করেন। শেষটায় না পেরে বললুম, সিন্দুকটা নিচে রয়েছে। উপরে নিয়ে আসব কি? এক ঝলক হেসে বললেন, না, আমি নিচে যাচ্ছি। সেখানে চেয়ারে বসে শেষ রুমাল অবধি নেড়ে-চেড়ে পরখ করলেন, বাছাই করলেন। তার পর ফের উপরে এসে চেয়ারে বসে বিছানা তৈরি করা বাবদে পই পই করে বালালেন, কোন শিটটা উপরে যাবে, কোনটা নিচে ইত্যাদি ইত্যাদি। আরও মেলা মেলা বায়নাক্কা ঝামেলা। জলের কুঁজোটা কোথায় থাকবে, নাইট-টেবিলের পাশে ছোট্ট শেলফে কী কী বই থাকবে– সেসব কথা বলতে গেলে বাকি দিনটা, চাই কি রাতটাও কাবার হয়ে যেতে পারে। সংক্ষেপে সারি। হঠাৎ বললেন, চল গাঙ্গুলী, স্নানের ঘর দেখে আসি। ঢুকেই বললেন, একী কাণ্ড! সরাও এখুনি ওই জিন টাটা। নিয়ে এস আমার স্নানের ঘর থেকে পেতলের বড় গামলাটা। আর এখানেই একটা বোয়ামে আছে বেসন। নিয়ে এস একটা রুপোর কৌটোতে করে। সাবানটা সরাও। আমি বললুম, ওটা গডরেজের ভেজিটেবল সোপ। তা হোক। ফেলে দাও ওটা। আর ওই টার্কিশ টাওয়েলটাও সরাও। সিন্দুক থেকে নিয়ে এস খদ্দরের ভোয়ালে, আর একখানা সবচেয়ে সরেস গামছা। নিমের দাঁতন কই? আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, ওঁর তো দাঁত নেই, আর্টিফিসিয়াল আছে কি না জানিনে। তা হোক, নিয়ে এস দাঁতন। আর ক্ষিতিমোহনবাবুর স্ত্রীকে বল, আজই যেন সুপরি পুড়িয়ে বাকি সব তিনি জানেন টুথ পাউডার বানিয়ে পাঠিয়ে দিতে। বুঝলুম, কোনও নবীন দশনসংস্কারচুর্ণ ক্ষিতিমোহনের স্ত্রী বদ্যি-গিন্নি তো।
করে করে সবকটা তৈরি হল। সেই ১১৪ গরমে আর ক্লান্তিতে আমি আর দাঁড়াতে পারছি না। বৃদ্ধ প্রভু কিন্তু খুট খুট করে দিব্য এ-ঘর ও-ঘর করছেন।
দম নিয়ে গাঙ্গুলীমশাই বিরাট এক তাওয়া সাজাতে সাজাতে বললেন, তোমার প্রাণ যা চায় সেই দিব্যি, কসম, কিরে আমাকে কাটতে বললে আমি এখুনি সেইটে কেটে বলব আমার দৃঢ়তম বিশ্বাস কোনও বধূ তার বরের জন্য, কোনও প্রেমিক তার প্রিয়ার জন্য কস্মিনকালেও এরকম বাসরঘর মিলনশয্যা তৈরি করেনি। আর গুর্দেবও এ কর্ম পূর্বে কখনও করেননি সে বিষয়ে আমি আদালতে তিন সত্যির দোহাই দিয়ে কসম খেতে রাজি আছি।
আরেকটা কথা শোন, সৈয়দ। গুদেবের মতো স্পর্শকাতর, সুন্দরের পূজারি যখন সব হৃদয় ঢেলে দিয়ে কোনও কিছু সুন্দর করে গড়ে তুলতে চান–এই যেমন এ বাড়িটাকে তার চরম সুন্দর রূপ দেওয়া তখন তার হাজার মাইল কাছেও আসতে পারে কোন প্রফেশনাল ডেকোরেটরের গোঁসাই।
আর সমস্ত জিনিসটা ছিল অত্যন্ত সিমপল অথচ প্রত্যেকটি জিনিস থেকে উথলে উঠছিল সৌন্দর্য।
আমি শুধালুম, তার পর?
গাঙ্গুলীমশাই শান্তকণ্ঠে বললেন, এবানেই কাহিনীটি শেষ করতে পারলে ভালো হত। কিন্তু তুমি যখন আদ্যন্ত শুনতে চাও তবে কী আর করি বলি।
গাঁধীজিকে উপরের তলায় নিয়ে গেলেন স্বয়ং গুর্দেব। আমি তার ধরা-ছোঁওয়ার ভিতরে– যদি-বা কোনও কিছুর দরকার হয়। তাই সব দেখেছিলুম, সব শুনেছিলুম। দুই হিমালয়ের সাক্ষাৎ উভয়ের মধ্যে গভীরতম প্রীতি– এমনকি সংঘাত। সেই মোকা ছাড়ব আমি! হে!
বেশ পরিষ্কার স্পষ্ট লক্ষ করলুম, গাধী যেন দু-চারটে জিনিস দেখলেন, কিন্তু কোনও কিছুই লক্ষ করলেন না। আল্পনা, মাথার উপরে ফুলের ডালি, তাজমহলের মতো খাটবিছানা, বেডকভারের ঠিক মাঝখানে বাটিকে কাজ করা নিটোল গোল মেডালিয়নের ভিতর সেই অজন্তার ছবি, যেখানে একটি তরুণী দু-ভাজ হয়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রভু বুদ্ধের পদতলে পদ্মফুলের অঞ্জলি দিচ্ছে।
কোনও কিছুই যেন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারল না।
তার পর তিনি আস্তে আস্তে উত্তরের খোলা জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। তার দৃষ্টি যেন মন্দির পেরিয়ে টাটা বিলডিং ছাড়িয়ে কোন সুদূরে চলে গেছে। হঠাৎ গুদেবের দিকে ফিরে বললেন, এরই কাছে ছাতে যাবার সিঁড়ি আছে না? চলুন।ছাতে গিয়ে দুজনাতে অল্প একটু পাইচারি করার পর গাধী একগাল হেসে বললেন, আমি এই ছাতেই বাসা বাঁধব। ভারি চমৎকার!
আমি অবাক হয়ে বললুম, তার মানে?
মানে আর কী? পড়ে রইল সব নিচে। আমি তাকে কখনও ওই বেডরুমের একটিমাত্র জিনিস ব্যবহার করতে দেখিনি। অবশ্য একথা ঠিক, যে দুটি দিন এখানে ছিলেন তার অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন উত্তরায়ণে, ঋর্দেবের সঙ্গে আর বড়বাবুর (দ্বিজেন্দ্রনাথের) সান্নিধ্যে। বড়বাবুর কাছ থেকে বুড়ো ফিরছিলেন হাসিখুশি ভরা ডগমগ মুখে, আর গুদেবের কাছ থেকে চিন্তাকুল বদনে। রাত্রি কাটাতেন ছাতে। গাঙ্গুলীমশাই থামলেন।
অনেকক্ষণ গভীর চিন্তা করার পর বললেন, আমি পলিটিক্স একবর্ণও বুঝিনে। গাধীর লেখা এক ছত্রও পড়িনি আর গুদেবের সামান্য যেটুকু পড়েছি সেটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। আমার মতামতের কোনও মূল্য নেই। তবু বলি, এবারও গাঁধী-গুর্দেবে মনের মিল হল না। কিন্তু আমার মনে হয় এবারেই ছিল বেস্ট চান্স। আমার মনে হয়, গাধী যদি ওই আল্পনা, পদ্মফুলের আলো এবং সুদেবের আরও পাঁচটা সযত্নে সাজানো নেড়েচেড়ে দেখতেন, একটুখানি কদর দেখাতেন তা হলে গুদেবের দিলটা একটু মোলায়েম হত। লোকে বলে গাধী সত্যের পূজারি আর শুর্দেব নাকি সুন্দরের পূজারি! কিন্তু গুর্দেব যে সত্যেরও পূজারী সে-ও তো জানা কথা। গাধীও নিশ্চয়ই সুন্দর জিনিস ভালোবাসেনকে বাসে না, কও! কিন্তু তার কোনও লক্ষণ আমার পাপ চোখে পড়েনি। তাই আমার মনে হয় গাঁধী যদি তার জন্য সাজানো ঘরটাকে একটু পুজো করতেন। মানে একটু আদর করতেন তা হলে গুর্দেব ভাবতেন, এ লোকটা ভিতরে ভিতরে সুন্দরেরও পূজা করে। আমার বংশের না হোক, আমার গোত্রেরই লোক। তাই হয়তো একটা সমৰাও হয়ে যেত।
আবার দেখ, গাধীজি তাঁর সত্য-উপলব্ধির প্রতীক চরকা সবাইকে বিলোচ্ছেন। আমরা হাত পেতে নিচ্ছি কিন্তু আমরা কোনও প্রতিদান দিচ্ছিনে কারণ আমাদের মতো সাধারণ লোকের কীই-বা আছে যে তাঁকে দেব? কিন্তু গুদেবের বেলা তো সেকথা নয়। তিনি সুন্দরের পূজা করে অনেককিছু পেয়েছেন। কই, গাঁধী তো তার কাছ থেকে নিলেন না! এমনকি এই যে সামান্য সাজানো কামরা কটি– তার ফুল, কিছু আল্পনা কোনওকিছুই লক্ষ করলেন না– গ্রহণ করলেন না।
তাই বলি, সৈয়দ, সংসারটা চলে গিভ অ্যান্ড্র টেকের ওপর।
.
উপসংহারে নিবেদন, বলা বাহুল্য, গুরুদেবকে নিয়ে যে আমি উত্তম পুরুষে কথা বলিয়েছি তার অধিকাংশই আমার কল্পনাপ্রসূত। কারণ যদিও গাঙ্গুলীমশাই গুরুদেবের কথাবার্তার চো আনা আমাকে সে সময়ে ঠিক ঠিকই বলেছিলেন তবু ভুললে চলবে না, পূর্বেই নিবেদন করেছি, গাঙ্গুলীমশাই ছিলেন পয়লা নম্বরি কীর্তনিয়া–রাকোতর। নিশ্চয়ই তার বর্ণনায় বেশ খানিকটে রঙচঙ চড়িয়ে ছিলেন– ইচ্ছা-অনিচ্ছায়।
তদুপরি তিনি আমাকে কাহিনীটি বলেন, ১৯২৫-এ। আর আমি এ কাহিনী লিখছি ১৯৬৯-এ!! কিন্তু মূল ঘটনাগুলো যে সত্য তার গ্যারান্টি আমি দিচ্ছি (কারণ এ ঘটনা পরে আরেকবার ঘটে- তবে সেখানে পাত্র গাঁধী ও মুসসোলিনির প্রতিভূ এক জাহাজ-কাপ্তান)।
অবশ্য আমি দুই লাইনেই এ কাহিনী শেষ করতে পারতুম। যথা : গুরুদেব অতিশয় সযত্নে ঘর সাজালেন। তার সৌন্দর্য গাঁধীজির চোখে পড়ল না। কিন্তু তা হলে তো লেজেন্ডের গোড়াপত্তন হয় না–রবিপুরাণ কাহিনী নির্মিত হয় না।
আরেকটি কথা বলার খুব যে একটা প্রয়োজন আছে তা নয়। তবু বলি। সুচতুর পাঠক অতি অবশ্যই বুঝে গিয়েছেন, গুরুদেবের মুখে আমি যে ভাষা বসিয়েছি, অতি অবশ্যই গুরুদেব ওরকম কাঁচা বাংলা বলতেন না। এবং সহৃদয় পাঠক বুঝে গিয়েছেন বলেই আমাকে মাফ করে দিয়েছেন। প্রবাদ আছে- টু আন্ডারস্টেন্ড ইজ টু ফরগি।
এবং গাঙ্গুলীমশাইয়ের ভাষারও জেল্লাই জৌলুস জ্যান্ত জিন্দা করতে পারিনি আমি–দীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছর পর।
সর্বশেষে বক্তব্য এটা লেজেন্ড, রূপকথা, পুরাণ। ইতিহাস নয়।
.
দ্বন্দপুরাণ উপরেই শেষ হল। কিন্তু গাঁধী-পুরাণের অন্য এক কাহিনীর ইঙ্গিত আমি এইমাত্র দিয়েছি। সেটি বলিনি। সে-ও মজাদার।
দ্বন্দপুরাণের ছ বছর পরের ঘটনা। ১৯৩১ রাউন্ড-টেবিল সেরে গাধীজি দেশে ফেরার জন্য বেছে নিলেন একখানা ইতালির জাহাজ। ইল দুচে বেনিতো মুসসোলিনি তো ড্যাম গাড়ি। (ওদিকে জর্মন জাত বড় নিরাশ হয়েছিল। গাধী বলেছিলেন, রাউন্ড-টেবিলে তিনি যদি সফলতা লাভ করেন তবে ইয়োরোপে যে একটিমাত্র জায়গা দেখার তার ঐকান্তিক কামনা আছে সেটিকে তিনি তীর্থযাত্রীরূপে শ্রদ্ধা জানিয়ে দেশে ফিরবেন– ভাইমার, কবি গ্যোটের লীলাভূমি ও সমাধিস্থল। কিন্তু গোলটেবিলে নিষ্ফল হলেন বলে সোজা দেশে ফেরেন।) মুসসোলিনি খবর পাওয়া মাত্র বললেন, যে জাহাজে গাঁধী যাবেন সেটা অত্যুত্তম, কিন্তু তার সেরার সেরা কাবিনা লুসোরিয়োজা (সাধু সাবধান! ইতালীয় ভাষার সঙ্গে আমার অতি সামান্য নমস্কার-প্রতিনমস্কারের পরিচয়– ভুল হতে পারে। অর্থ হচ্ছে কাবিন দ্য ল্যুকস, লাকসারি কেবিন, সবচেয়ে আক্রা ভাড়ার বিলাস কেবিন) নিশ্চয়ই রাজা মহারাজা ফিল্টারের পক্ষে যথেষ্টরও বেশি, কিন্তু গাঁধী এখানে এসে তিনি যে অলঙ্কার ব্যবহার করলেন তার ইংরেজি আছে- গাঁধী? হি ইস নট এভরিবডিজ কাপ অব্ টি– বাংলাতে মেরেকেটে বলা যেতে পারে, ভিন্ন গোয়ালের একক গোমাতা, মা ভগবতী কিংবা আমরা যেরকম বলি কানু ছাড়া গীত নেই, তার সঙ্গে মিলিয়ে গাধী ছাড়া নর নেই। আরবরা বলে, গাঁধী মহারাজের কাহিনী সব কাহিনীর মহারাজা। তার পর হুকুম দিলেন, গাঁধীকে সবসে বঢ়িয়া কেবিন দাও একটা না, সুইট অব কেবিন। বেডরুম, ড্রয়িংরুম, এন্টিরুম (ভিজিটরদের জন্য প্রতীক্ষাগৃহ), আপন খাস ডাইনিংরুম ইত্যাদি ইত্যাদি। লক্ষপতিদের বুকিং কেনসেল করে। আর তোমাদের দ্য লুকস্ কেবিনের সোফা কোচ বিছানা বাথরুম লক্ষপতিদের জন্য গুড ইনাফ, মলটো বুয়োনো (ভেরি গুড়) কিন্তু গাধীর জন্য নয়। পালাদসো ভেনেসিয়া (ভেনিস পেলেস–ইটালির প্রায় সর্বোত্তম প্রাসাদ) থেকে তাবৎ ফার্নিচার পাঠাও। সর্বশেষে বললেন, ওই অচ্ছি অচ্ছি তাগড়ি বকরি, দুধকে লিয়ে। এই ফার্নিচার পাঠানোর পিছনে হয়তোবা কিঞ্চিৎ ইতিহাস আছে। এখানে আবার গুরুদেব প্রধান পাত্র।
যারা কবিগুরুর মৃত্যুর পর তার বধূমাতা স্বর্গীয় প্রতিমা দেবীর নির্বাণ পুস্তিকা পড়েছেন, তারাই জানেন, অসুস্থাবস্থায় তিনি কিছুদিন কাটান তার এক প্রিয়া শিষ্যার বাড়িতে, দক্ষিণ আমেরিকার আরজেনটিনায়। এর নাম ভিকরিয়া (অর্থাৎ বিজয়া এবং কবি দেশে ফিরে একেই তার পরের গ্রন্থ উৎসর্গ করেন। কবির সঙ্গে তোলা এঁর ছবি পাঠক পাবেন পূরবী কাব্যে, বিশ্বভারতী সংস্করণ রবীন্দ্ররচনাবলী চতুর্দশ খণ্ড, ১০৫ পৃষ্ঠার মুখোমুখি। একে উদ্দেশ করে কবি একগুচ্ছ কবিতা লিখেছেন পূরবীতে বিদেশি ফুল অতিথি ও অন্যান্য কবিতা দ্রষ্টব্য) ও কাম্পো। কবি দেশে ফেরেন ইটালিয়ান জুলিয়ো চেজারে (জুলিয়াস সিজারের ইতালির উচ্চারণ) জাহাজে করে। জাহাজে বিদায় দিতে এসে ভিকরিয়া দেখেন (পূরবীর বদল ও গীতবিতানের তার হাতে ছিল গান দ্রষ্টব্য শ্ৰেতব্য) যে, যদিও কবিকে সর্বোত্তম দ্য লুকস্ কেবিন দেওয়া হয়েছে তবু সদ্য রোগমুক্ত জনের জন্য হেলান দিয়ে বসার আরামকেদারা সেখানে নেই। তিনি তদণ্ডেই লোক পাঠালেন বাড়িতে; যে আরাম কেদারায় অসুস্থ কবি বসতে ভালোবাসতেন সেইটে নিয়ে আসতে। বিরাট সে কেদারা, তাই কেবিনের ছোট দরজা দিয়ে ঢোকে না। ভিকরিয়া ডেকে পাঠালেন জাহাজের কাপ্তানকে। বিরাট জাহাজের কাঁপতেন হেজিপেজি লোক নয়– তাকে ডেকে পাঠানো যে সে লোকের কর্ম নয়। তাই এস্থলে বলে রাখা ভালো, তার অর্থসম্পত্তি ছিল প্রচুরতম এবং তাৰং আর্জেন্টাইনের রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারিত। তিনি সুসাহিত্যিক, প্রভাবশালী মাসিকের সম্পাদিকা এবং পরবর্তীকালে তিনি ইউনাইটেড নেশনসের একাধিক বিভাগে তার দেশের প্রতিভূ হয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। টাইম সাপ্তাহিকে আমি সে বিবরণী পড়েছি ও তার ছবি সেখানে দেখতে পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিক উত্সবে আরজেনটাইন ডাকবিভাগ কবির ছবিসহ বিশেষ স্ট্যাম্প প্রকাশ করে ভিকরিয়ারই জোরদার প্রস্তাবে। এবং তিনি নির্দেশ দেন, ডাকবিভাগ যেন কবির কোন ছবি ছাপা হবে তাই নিয়ে মাথা না ঘামায়। ভারত যে ছবি ছাপাবে সেটা তিনি কবিপুলের কাছ থেকে আনিয়ে ডাকবিভাগকে দেবেন। ডাকবিভাগ মাতার সুপুত্রের মতো তাবৎ নির্দেশ মেনে নেয়। এই স্ট্যাম্প খামে সেঁটে ভিকরিয়া কবিপুত্রকে একখানা চিঠি লেখেন; আমি সেটি দেখেছি। যা বলছিলুম : কাপতানকে ভিকরিয়া হুকুম দিল কেবিনের দরজা কেটে কেদারা ঢোকাও।* [** এ কেদারার শেষ ইতিহাস পাঠক পাবেন, কবির সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ শেষলেখাতে। এ ঘটনার দীর্ঘ ষোল বৎসর পরে, কবি তার মৃত্যুর পাঁচ মাস পূর্বে রোগশয্যায় সেই কেদারাখানা খুঁজে নিয়ে (ছাপাতে আছে খুঁজে দেব– হবে খুঁজে নেব) তার উদ্দেশে একটি মধুর কবিতা লেখেন। শেষলে কাব্যের ৫ নং কবিতা পণ্য।] বলে কী? দ্য লস কেবিনের দেয়াল করাত দিয়ে কেটে তার অঙ্গহানি করা। কাপতান গাইগুই করছে দেখে জাতে দজ্জাল সেই স্পেনিশ রমণী আরম্ভ করলেন ভর্ৎসনা, অভিসম্পাত, কাপতানের আসন্ন পতনের ভবিষ্যদ্বাণী-মুষলধারার বাক্যবাণে তাকে জর্জরিত করতে। এ ঘটনা স্বয়ং কবি কনফার্ম করেছেন। তিনি পুরো ঘটনাটির বর্ণনা দিতে গিয়ে এস্থলে, বলেন, আমি স্পেনিশ ভাষা জানিনে। কিন্তু তিকরিয়ার সেই জ্বালাময়ী ভাষার কটুবাক্যের রসগ্রহণে আমার কণামাত্র অসুবিধা হয়নি।
কাপতান পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচায়। বংশরক্ষার জন্য সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের মিস্ত্রিকে পাঠিয়ে দেয়।
হয়তো এ ঘটনা মুসসোলিনির কানে পৌঁছয়। হয়তো তাই এ ঘটনার ছ বছর পর গাঁধীজি যখন তার জাহাজে চড়লেন তখন তিনি পালাসো ভেনেসিয়া থেকে সেরা সেরা আসবাবপত্র পাঠান।
যে জাহাজে করে গাঁধী দেশে ফেরেন তার এক ইতালীয় স্টুয়ার্ড আমাকে এ কাহিনীটি বলে। আমি তার সবিস্তর বর্ণনা আমার বড়বাবু গ্রন্থে গান্ধীজির দেশে ফেরা নাম দিয়ে লিখেছি। এস্থলে সংক্ষেপে সারি।
গাঁধীজি জাহাজে উঠলেন। ভয়ে আধমরা (কারণ নির্মম ডিকটেটর মুসসোলিনির কানে যদি খবর পৌঁছয়– গুজব হোক আর না-হোক, লেজেন্ড হোক আর সত্য ইতিহাসই হোক যে– গাঁধীর পরিচর্যায় ক্রটি-জখম ছিল তা হলে বারোটা রাইফেলের গুলি খেয়ে তাকে যে ওপারে যেতে হবে সে বিষয়ে তিনি স্থির নিশ্চয়) তথাপি সগর্বে সদম্ভে গাঁধীজিকে দেখালেন তার জন্য স্পেশালি রিজার্ভড় প্রাসাদসজ্জায় গৌরবদীপ্ত আরাম-আয়েসের ইন্দ্রপুরী সদৃশ্য কেবিনগুলো। গাঁধীজির অনুরোধে তার পর তিনি তাকে দেখালেন বাদবাকি তাবৎ জাহাজ।
সর্বশেষে গাঁধী শুধোলেন, সবচেয়ে উপরে খোলা ডেক-এ (ছাতে যাওয়া যায় কি না?
কাপ্তান সানন্দে তাকে সেখানে নিয়ে গেলেন। উন্মুক্ত আকাশের নিচে বিরাট বিস্তীর্ণ ডেক।
গাঁধী বললেন, আমি এখানে তাবু খাঁটিয়ে বাস করব।
কাপ্তান বদ্ধ পাগলের মতো হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে গোঙরাতে গোঙরাতে বলল, অসম্ভব, অসম্ভব, সম্পূর্ণ অসম্ভব। এই ভূমধ্যসাগরে রাত্রে তাপমাত্রা নামবে শূন্যে। সুয়েজ খাল আর লোহিত সাগরে দুপুরের গরমি উঠবে ১১৪ তক। এমন কর্ম থেকে আপনাকে ঈশ্বর রক্ষতু।
গাঁধী ঝাড়া তেরোটি দিনরাত্রি কাটিয়েছিলেন উপরে। প্রতি সকালে মাত্র একবার নেমে আসতেন নিচে। প্রার্থনা করতে। সর্বশ্রেণির প্যাসেনজার নিমন্ত্রিত হতেন। শুনেছি খালাসিরাও বাদ যায়নি।
কিন্তু গাঁধীজির এই দুই প্রত্যাখ্যানের ভিতর অতলস্পর্শী পাতাল এবং গগনচুম্বী আকাশের পার্থক্য রয়েছে।
মুসসোলিনির ভেট ছিল আরাম-আয়েস বিশাল-ঐশ্বর্য। গাঁধী যে সেগুলো সবিনয় প্রত্যাখ্যান করবেন সেটা কিছু বিচিত্র নয়। কিন্তু রবি কবি গাঁধীর সামনে ধরেছিলেন সরল, অনাড়ম্বর সৌন্দর্য। কবিরই ভাষায় বলি,
দুয়ারে এঁকেছি
রক্তরেখায়
পদ্ম-আসন,
সে তোমারে কিছু বলে?
হায়, বলেনি।
———
১. ১৯২১-২২ রবীন্দ্রনাথ বাস করতেন দেহলী বাড়ির উপরের তলায়, নিচের তলায় সস্ত্রীক দিনেন্দ্রনাথ। তার সঙ্গে একেবারে লাগোয়া নতুন বাড়ি হসটেল ঘর। সেখানে শ্রীযুক্ত ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ, বিনোদবিহারী ইত্যাদিরা বাস করতেন। শেষ কামরায় স্বর্গত অনাথনাথ বসু এবং আপনাদের স্নেহধন্য এ অধম। সর্বশেষ কামরা রবীন্দ্রনাথের পেরিরূপে ব্যবহৃত হত। অর্থাৎ প্রতিমা দেবী, মীরা দেবী, কমলাদি (দিনুবাবুর স্ত্রী) রবীন্দ্রনাথের যে দৈনন্দিন আহার্য পানীয় পাঠাতেন সেগুলো প্রথম এ পেরিতে জড়ো করে (চাকরের নাম ছিল সাধু; বনমালী পরে আসে) রবীন্দ্রনাথকে সার্ভ করা হত। ওই ঘর পেরুবার সময় সবসময়ই চোখে পড়ত আহারাদি কী কী। আমার জানার কথা।
২. এই কবিতাটি নিয়ে আমার মনে ধন্দ আছে। এ দু লাইন থেকে বোঝা যায় কবি ব্যস্ত, চাষের নেমন্তন্নের জন্য এখনও সাজ করা হয়নি; অথচ তার ঠিক ষোল লাইন পরেই বলেছেন, বিশেষ কারণে তিনি যে বৃদ্ধ নন সেটা তিনি বুঝতে পেরেছেন। (তখন তার বয়েস ৬২) এবং বলেছেন,
এই ভাবনায় সেই হতে মন এমনিতরো খুশ আছে,
ডাকছে ভোলা খাবার এল আমার কী তার হুঁশ আছে?
এখন প্রশ্ন, কবি এই বললেন তিনি চায়ের নিমন্ত্রণে যাচ্ছেন এবং তার পরই নাকি ভোলা খাবার নিয়ে এসেছে। তবে কি লখনৌওলাদের মতো বাড়ি থেকে উত্তমরূপে খেয়ে নিয়ে দাওয়াতে যেতেন যাতে করে সেখানে খানদানি কায়দায় কম-সে-কম খাবেন। কিংবা ফরেসডাঙার এক বিশেষ সম্প্রদায়ের মতো যেখানে নিমন্ত্রিত মাত্র ভোজ্যবস্তুর প্রতি নজর বুলিয়ে জলস্পর্শ না করে বাড়ি ফিরে যান। বিশ্বাস না হয়, অবধূত রচিত নীলকণ্ঠ হিমালয়ে মল্লিখিত মুখবন্ধে এ বাবদে সবিস্তর বর্ণনা পড়ন।
৩, সিলেট ও খাসিয়া সীমান্তে একরকম অতুলনীয় মধু পাওয়া যায়। এ মধু মৌমাছিরা সুদ্ধমাত্র কমলালেবুর ফুল থেকে সংগ্রহ করে (সিলেটি কমলালেবুও পৃথিবীতে সবচেয়ে মিষ্ট এবং সবচেয়ে সুগন্ধি, যদিও জাফার নেবুর চেয়ে সাইজে ছোট)। ছুটিতে দেশে যাবার সময় গুরুদেব আমাকে বললেন, পারিস যদি আমার জন্য কিছু কমলামধু নিয়ে আসিস। আমি খুশি হয়ে বললুম, নিশ্চয়ই আনব কিন্তু কাশ্মিরের পদ্মমধু কি এর চেয়ে আরও ভালো নয়। শুরুদেব স্মিত হাস্য করলেন। ভাবখানা কিসে আর কিসে।
৪. শ্ৰীযুক্ত প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তার রবীন্দ্রজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ডে (পরিবর্ধিত সংস্করণ ১৩৫৫) লিখছেন : দুই মহাপুরুষের প্রথম সাক্ষাক্তার হইল (৬ মার্চ ১৯১৮)। পৃ. ৩৭৭। এটা বোধহয় ছাপার তুল। হবে ১৯১৫।
৫. রবীন্দ্রনাথের সর্বগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ (একুশ বছরের বড়। কিন্তু গোড়ার থেকেই সত্যাগ্রহ আন্দোলন সমর্থন করে গাঁধীকে পত্র লেখেন। গান্ধীজির ভক্তেরা, আশা করি অপরাধ নেবেন না, যদি বলি, হিন্দু শাস্ত্র গ্রন্থরাজির সঙ্গে গান্ধীজির খুব নিবিড় পরিচয় ছিল না। ওদিকে দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন সর্বশাস্ত্ৰ তথা সর্বদর্শন বিশারদ। তাই গান্ধীজি খুব একটা বল পেয়েছিলেন যে তার আন্দোলন শাস্ত্রসম্মত এবং হিন্দু-ঐতিহ্যপন্থী। দ্বিজেন্দ্রনাথকে গাধী ডাকতেন বড়দাদা বলে। ১৬ জুলাই (অর্থাৎ গাঁধী ভেটের প্রায় মাস দেড়েক পূর্বে ১৯২১-এ) রবীন্দ্রনাথ ইয়োরোমেরিকা ভ্রমণের পর আশ্রমে ঢুকেই দ্বিজেন্দ্রনাথকে প্রণাম করতে যান। কুশলাদি জিগ্যেস করার পর তিনি একাধিকবার রবীন্দ্ৰনাথের সঙ্গে অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করবার চেষ্টা দেন– কারণ তিনি জানতেন, রবীন্দ্রনাথ এ আন্দোলনের বিরোধী কিন্তু অতিশয় তার সঙ্গে এবং দৃঢ়ভাবে রবীন্দ্রনাথ সে আলোচনার গোড়াপত্তন করতে দিলেন না। অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলুম।
৬. এ আলোচনার বিবরণী কখনও প্রকাশিত হয়নি। তবে এনডুজ সাহেব আশ্রমে ফিরে ঘরোয়া বৈঠকে আমাদের একটা প্রতিবেদন দেন কিন্তু আমাদের নোট নিতে মানা করেন। আমি ঘরে ফিরে যতখানি মনে ছিল গরমাগরম লিখে ফেলি। সে পাণ্ডুলিপি কাবুলে বিদ্রোহের সময় বরিয়ে যায়। তাতে করে বিশেষ ক্ষতি হয়নি। এ আলোচনার সারাংশ না হোক, বিষয়বস্তু পাঠক প্রাগুক্ত পুস্তকের ৮২-৮৩ পৃষ্ঠায় পাবেন।
৭. পিরিলি খেতাবটি নাকি মুসলমান বাদশা ঠাকুর গোষ্ঠী এবং তাঁদের আত্মীয়দের দেন। কথাটা পির এবং আলী শব্দের অশুদ্ধ সন্ধি। আমি যখন শান্তিনিকেতনে ছিলুম তখন গুরুদেবের এক পিরিলি আত্মীয় ছোকরা আমাকে বলে, ভাই তোর নাম মুজতবা আলী, আর আমার বংশের নাম পির আলী। দুজনারই পদবি আলী। আর ওই সিলেটি রাকেশ বলছিল তুই নাকি পির বংশের ছেলেও বটিস। তবেই দ্যাখ, তুই আমার কাছের কুটুম।
৮, শ্রদ্ধেয় সুশীলকুমার দের অত্যুত্তম বাংলা প্রবাদ গ্রন্থে আছে (নং ৪৯৯৯) পাঠায় কাটে, পাঠী নাচে, পাঠা বলে মগধেশ্বরী আছে। সুশীলবাবু এর টীকা লিখতে গিয়ে জে, ডি, এনডারসেন-এর ওপর বরাত দিয়ে বলেছেন, মগধেশ্বরী পুজোতে চট্টগ্রামে পাঠী বলি দেওয়া হয়।
৯. কথাটা খুবই সত্য। প্রাগুক্ত দেহলী বাড়িতে যখন কবি থাকতেন তখন দেখেছি তার ছিল (১) দু-খানা তক্তপোশ জুড়ে একটি ফরাস- তার গদি কোয়ার্টার ইঞ্চি পুরু হয় কি না হয় (২) মেসে পড়াশোনার জন্য যেরকম মিনিয়েচার টেবিল দেয় তারই এক প্রস্থ ও একখানা চেয়ার (৩) সামনে ন্যাড়া ছাতের উপর দু-একখানা বেতের কুশনহীন চেয়ার এবং (৪) বোধহয় উপাসনা করার জন্য একখানা হেলানো-হাতাহীন জলচৌকির মতো কাষ্ঠাসন। গোসলখানায় কী কী মহামূল্যবান জিনিস ছিল দেখিনি, তবে এমনই একটা সঙ্কীর্ণ করিডরের মতো ফালি জায়গায় সেটা ছিল যে সেখানে নূরজাহানের হাম্মাম থাকার কথা নয়।
ধন্য অবাঙালি!
ভিন্ন ভিন্ন জাত সম্বন্ধে পৃথিবীর লোক কতকগুলি ধারণা করে বসে আছে। যেমন স্কচ্ কিপ্টে, ফরাসি দুশ্চরিত্র, জর্মন ভোতা, ইংরেজ অবিশ্বাসী, এমনকি প্রখ্যাত ফরাসি সাংবাদিক মাদাম তাবুই-এর একখানা বই আছে যার শিরোনামা লা পেরফিড আলবিয়ে (বিশ্বাসঘাতক ইংরেজ) দিয়ে আরম্ভ। (অবশ্য তিনি তার পুস্তকে প্রমাণ করার চেষ্টা দিয়েছেন যে, এ কুসংস্কারের জন্য ইংরেজ সম্পূর্ণ দায়ী নয়, ফরাসিও অনেকখানি)।
এরকম ঢালাও জাতিবিচার থেকে ওই যে ধারকর্জ দেনেওলা আমাদের নিরীহ কলকাত্তাই পাঠানও (চলতি ভাষায় কাবুলিওয়ালা) মুক্ত নয়। আমাদের পার্ক সার্কাসের বাড়িতে আসত দুই ঈদের দিনে এক পাঠান। একবার কথায় কথায় বলল, আপকা কলকাত্তা শহমে বহুৎ আচ্ছা আলু, চান্না হোতা হৈ। আমরা তো অবাককলকাতা শহরের রাস্তার উপর যত লক্ষ লক্ষ গভীর গর্ত থাক না কেন, কোনওটাতেই তো আজ অবধি আলু বা চানা ফলতে দেখিনি সরকারের অধিক ফসল ফলাও কান ঝালাপালা-করা প্রপাগান্ডা সত্ত্বেও! পাঠান ফের বলল, ঘর ঘর মে। আমরা তো আরও সাত হাত পানিমে। শেষটায় বোঝ গেল পাঠান আলু চান্না বলতে আলোচনা বোঝাতে চেয়েছিল।
পাঠানের এই ঢালাও জাতিবিচার কিন্তু এস্থলে ভুল নয়। রকবাজি আড্ডাবাজিতে কলকাত্তাইয়া এখনও অলিম্পিকের গোল্ড মেডেল ধারণ করে। এই যে হালে আমরা নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ক্রিকেট খেললুম ঠিক তার উল্টোটি। ক্রিকেটের সঙ্গে তুলনা দিয়ে বলতে হলে আমাদের রক-আড্ডাবাজির টিমে আছেন চারটে রণজি, তিনটে ব্রাডম্যান, দুটো লারউড, একটা নিসার আর গুগলির জন্য ওই একটা বসাকে। তা সে-কথা থাক। পাঠান বাস করে খাঁটি বাঙালিপাড়ায়– সাম্-বাজারে। রাস্তার পর রাস্তা পেরুতে পেরুতে সুবোম নিতি নিত্যি দু-পাশে দেখে রকের পর রক–মহাসভা, কানে যায় আলু চান্না।
কিন্তু পাঠানের দ্বিতীয় জাতবিচারটা একদম ভুল বেরুল। বলল, কলকত্তেমে বহুত অচ্ছি ফারসি বোলি জাতি– হর রাস্তে পর। বলে কী? আলু আর চানা তবু না হয় বুঝি, হয়তো-বা পাঠান কলকাতার মুদির দোকানে ওই দুই বস্তু অত্যুত্তম সরেস জাতের পেয়েছিল। কিন্তু কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় অচ্ছি ফারসি বলা হয় এটা কেমনতরঃ পাঠান বোঝাল, দিনে অন্তত একশোবার সে শুনতে পায় বহু কণ্ঠে, কিন্তু সর্বদাই অনবদ্য ফারসি উচ্চারণে বৃ-তালাশে বক্রি। এস্থলে বাঙালি পাঠককে বোঝাই বৃ = with এবং for (যেমন বৃ কলমে বকলমে শেখ ফিরোজ, বা বহাল = বহাল তবিয়ং, বমল = বমাল গ্রেফতার তালাশ = তল্লাসি; এবং বক্রি = ছাগল। অর্থাৎ কোনও লোক বক্রির তল্লাসিতে (for বক্রি) বেরিয়েছে।
এ কী কথা! আমরা তো কখনও শুনিনি।
এমন সময় বাইরে ফেরিওয়ালার হাক শোনা গেল। পাঠান লম্ফ দিয়ে সোল্লাসে বলল, ওই তো বলছে বৃ-তালাশে বক্রি।
ওমা! ইয়াল্লা! ও হরি? ফেরিওলা চেঁচাচ্ছে বোতল আছে বিক্রি!
তাই বলছিলুম, এস্থলে পাঠানের জাতবিচারে ভুল হয়ে গেল।
এগুলোর নিষ্পত্তি তত সহজেই হয়ে গেল কিন্তু অন্যগুলোর বেলা? যেমন মনে করুন, লোকে বলে ফ্রান্সের লোক অসচ্চরিত্র। এবং সেই সূত্রে বহু বহু চুটকিলা প্রচলিত আছে। তারই একটি :
এক ফরাসি নিমন্ত্রিত হয়েছে এক মার্কিন পরিবারে। বিস্তর হইহুল্লোড়। ফরাসি সঠিক বুঝতে পারেনি পরবটা কিসের। পাশে বসেছিল এক মার্কিন। তাকে কানে কানে শুধোল, ব্যাপারটা কী? মার্কিন বুঝিয়ে বলল, ওই যে দেখতে পাচ্ছেন বুড়ো-বুড়িএরা পঞ্চাশ বত্সর সুখে সহবাস করার পর আজ তাদের বিবাহের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছেন। ফরাসি বলল, অ বুঝেছি। এরা পঞ্চাশ বছর সহবাস করার পরই এই এখন বিয়ে করতে যাচ্ছেন। তার পর খানিকক্ষণ ঘাড় চুলকে বলল, তা– তা ওই নিয়ে এত তুলকালাম কাণ্ড কেন? আমরা তো আকছারই করে থাকি।
পাঠানের গল্প যেরকম জাতিবিচারের ব্যাপারে পরখ করা গেল, এখানে তো তা করা যাচ্ছে না। তবে কি সত্যিই হুদো হুদো ফরাসি ত্রিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ বৎসর সহবাস করার পর বিয়ে করে প্রধানত জারজ সন্তানদের আইনত সন্তানরূপে স্বীকৃতি দেবার জন্যে?
কিন্তু এ বিষয়ে ফরাসিদের নিয়েই এ গল্পটা তৈরি হল কেন? আমরা একটি সত্য ঘটনা জানি, এবং সেটা অস্ট্রিয়া দেশের ব্যাপার।
জনৈক অস্ট্রিয়ার লোক, যোহান গেও হিটলার যখন একটি কুমারীকে বিয়ে করলেন, তখন সেই কুমারীর একটি পাঁচ বছর বয়সের ছেলে ছিল। বিয়ের পাঁচ বছর পর ওই মহিলার মৃত্যু হয়। সঙ্গে সঙ্গে য়োহান হিটলার অস্ট্রিয়া থেকে অন্তর্ধান করলেন। তার সুদীর্ঘ ত্রিশ বৎসর পর তিনি আবার ফিরে এলেন মাতৃভূমিতে এবং একজন উকিল ও দুজন সাক্ষীর সামনে শপথ নিয়ে বললেন, তার বিয়ের পাঁচ বছর পূর্বে ওই যে সন্তান জন্মেছিল সে তারই ঔরসের সন্তান।
এই লোকটি জর্মনির ফুরার আডলফ হিটলারের পিতা।*[* W. Shirer; Aufsteg unid Fall in S. W. TOT 91]
.
এতক্ষণ ধরে আমি শুধু পটভূমি নির্মাণ করেছিলুম। এইবারে দেখি, সেয়ানা পাঠক, তোমার পেটে এলেম কতখানি।
মার্কিনরা চাঁদে গেছে শুনে আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারের আত্মসম্মানবোধ হুঙ্কার দিয়ে বলল, ভারতীয়েরাও যাবে। কিন্তু শ্ৰীযুত সত্যেন বসু এ বাবদে উদাসীন। তাই কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন বেরুল, চাদে যারা যেতে চান তারা আবেদন করুন। বিস্তর দরখাস্ত এল। শেষ পর্যন্ত মাত্র তিনজনকে ইন্টারভুর জন্য ডাকা হল, একজন বাঙালি, বাকি দুজন ভিন্ন প্রদেশের।
যে কর্তা ইন্টারভ নিচ্ছিলেন তিনি প্রথম ডেকে পাঠালেন বাঙালিকে। শুধোলেন, চাদে যাওয়ার জন্য কত টাকা চান?
পাঁচ লাখ।
অত কেন?
এজ্ঞে, বুড়ো মা-বাপ রয়েছে। বোনটির বিয়ে দিতে হবে। দুটো ছোট ভাই ইস্কুলে যায়। বিধবা পিসিও রয়েছেন। চাঁদ থেকে ফিরে না আসতে পারলে ওই টাকাতেই তাদের চলে যাবে।
কর্তা : আচ্ছা, পরে জানাব।
তার পর ডাকা হল দ্বিতীয় জনকে। সে প্রদেশের লোক, একটু ফুর্তিফার্তি করতে ভালোবাসে। বলল, দশ লাখ।
কর্তা : অত কেন?
হানজি পাঁচ লাখ দিয়ে মদ্যপানাদি, কাবারে গমন, হে হে রমণীসঙ্গ ইত্যাদি ইত্যাদি। ফিরে তো না-ও আসতে পারি; তাই সর্বশেষ শখটখ। বাকি পাঁচ লাখ রেখে যাব বুড়ো মা, বাপ, অবিবাহিত ভগ্নী, দুই ভাই, বিধবা পিসির জন্য
কর্তা : আচ্ছা, পরে জানাব।
এর পর এলেন তৃতীয় এক প্রদেশের লোক। ইনি চাইলেন পনেরো লাখ।
কর্তা তাজ্জব মেনে বললেন, অত বেশি কেন?
সঙ্গে সঙ্গে লোকটি ডাইনে-বাঁয়ে দরজার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে টেবিলের উপর বুকে ফিসফিস করে বলল–
বাবুজি, পনেরো লাখের পাঁচ লাখ তো তোমার। পাঁচ লাখ আমার। আর বাকি পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে ওই ব্যাটা বাঙালিকে চাঁদে পাঠিয়ে দেব।
এইবারে পাঠক, বের কর তো, দোসরা আর তেসরা ওমেদার কোন কোন প্রদেশের লোক? কিন্তু সাবধান! প্রকাশককে এ বাবদে চিঠি দেবে না। তিনি ছাপাবেন না। আমাকেও লিখবে না। আম্মো উত্তর দেব না।
নট গিলটি
সর্বপ্রথম যেদিন আমার লেখা ছাপাতে বেরুল তার কয়েক দিন পরই আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক মহাশয় আমাকে একখানি চিঠি রিডাইরেক্ট করে পাঠালেন। চিঠিখানা আমার উদ্দেশে লেখা। পত্রলেখক আমার ঠিকানা জানেন না বলে সেটি সম্পাদকের C/o করে লিখেছেন। এইটেই বিচক্ষণের লক্ষণ। এবং বহু বত্সরের অভিজ্ঞতা-সঞ্চিত আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিবলে, যেসব স্পর্শকাতর পাঠকপাঠিকা কারও লেখা পড়ে মুগ্ধ হন, বিরক্ত হন বা বিচলিত হন তারা যেন তাদের মানসিক, হার্দিক প্রতিক্রিয়া সম্পাদকের মারফতে লেখকের কাছে পাঠান। এবারে বাকিটা বলছি।
প্রথম গোটা পাঁচেক চিঠি তো আমাকে অভিনন্দন জানাল। তার ধরন অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন। কোনও কোনও পত্ৰলেখক আমাকে সবিনয়, সসম্মান, সশ্রদ্ধ আনন্দভিবাদন জানাল, আর কোনও কোনও লেখক আমার পিঠ চাপড়ে মুরুব্বিয়ানা মোগলাই কণ্ঠে বললেন, বেশ লিখেছিস ছোঁড়া, খাসা লিখেছিস। লেগে থাক। আখেরে টু-পাইস কামাতেও পারবি।
দ্বিতীয় পক্ষের মুরুব্বিয়ানা আমাকে ঈষৎ বিরক্ত করেছিল, সেকথা আমি অস্বীকার করব না। কিন্তু সেটা ক্ষণতরে। কারণ, আমি কাগজে লেখা আরম্ভ করি, বিয়াল্লিশ বছর বয়সে। ততদিনে বাস্তব জীবনে নানা প্রকারের চড়-চাপাটি খেয়ে খেয়ে আমার দেহে তখন দিব্য একখানা গণ্ডারের চামড়া তৈরি হয়ে গিয়েছে। বিস্তর মুরুব্বি এতদিন ধরে, আমার কর্মজীবনে আমার পিঠ চাপড়ে আমাকে এন্তের সদুপদেশ দিয়েছেন। কই? আমি তো তখন চটিনি। অবশ্য এনারা উপদেশ দিয়েছিলেন বাচনিক; উপস্থিত যেসব এই জাতীয় মুরুব্বিয়ানার চিঠি আসছে সেগুলো লেখনিক।
তাতে কীই-বা যায়-আসে!
কিন্তু আমার মনে তখন প্রশ্ন জাগল, এসব তাবৎ ব্যক্তিগত চিঠির প্রত্যেকটির উত্তর আমাকে স্বহস্তে লিখতে হবে কি না?
তা হলেই তো হয়েছে! কতখানি সময়, শক্তিক্ষয়, ডাকটিকিটের ব্যয়, কে জানে?
আমার টাইপরাইটার আছে। আমি অবশ্যই আধঘন্টার ভিতর খান তিরিশেক কার্বন কপি তৈরি করতে পারি। তার বক্তব্য হবে Many Thanks for your good wishes.
.
উঁহু! হল না।
যারা চিঠি লিখেছেন তারা সাহিত্যরসিক-রসিকা। তারা চান, সাহিত্যিক উত্তর। লড্রির চিঠিতে প্রশ্ন, আপনার অত অত নম্বরের জামাকাপড় ছাড়াচ্ছেন না কেন? আপনি তখনই ওই গদ্যময় বেরসিক ভাষায়ই উত্তর দেবেন। কিন্তু এনারা তো সাহিত্যিক উত্তর চান।
ইতোমধ্যে আরেকখানি মোলায়েম চিঠি। তার বক্তব্য, মোটামুটি যা মনে আসছে, কারণ চিঠিখানি আমার বউ পুড়িয়ে ফেলেছেন :
মহাশয়, আমার মনের গভীরতম কথাটি আপনি কী মরমিয়া ভাষায়ই না প্রকাশ করেছেন! ইত্যাদি ইত্যাদি প্রায় তিন পাতা জুড়ে। পড়ে আমিও রোমাঞ্চিত হলুম। লেখিকাকে মনে মনে শুকরিয়া জানালুম।
কিন্তু ইয়াল্লা! আমি খেজুরগাছের শেষ আড়াই হাতের দিকে আদৌ খেয়াল করিনি। কিংবা বলতে পারেন, বন থেকে বেরুবার পূর্বেই হর্ষধ্বনি করে বসে আছি।
চিঠির সর্বশেষে আছে, আমি পঞ্চদশী। এ চিঠির উত্তর আপনাকে স্বহস্তে দিতেই হবে। এবং তার পরেই, সর্বশেষে মোক্ষম কথা : এখন থেকে আমি পিওনের পদধ্বনির প্রতীক্ষায় প্রহর গুনব।
সর্বনাশ, এস্থলে আপনি কী করবেন? আরবি ভাষায় প্রবাদ আছে : অল ইতিজারু আপা মিনাল মউত। অর্থাৎ প্রতীক্ষা করাটা (ইনতিজার) মৃত্যুর চেয়েও কঠোরতর।
অনেক ভেবেচিন্তে একটি চিঠি লিখে পত্রলেখিকাকে ধন্যবাদ জানালুম এবং সর্বশেষে একটা অতি সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনাময় প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিলুম যে, আমার বয়স বাড়তির দিকে, শক্তি কমতির দিকে, অতএব চিঠিচাপাটি লেখা বাবদে আমাকে যেন একটু সদয় নিষ্কৃতি দেওয়া হয়–ইত্যাদি ইত্যাদি।
তার পর কী হল? আমি আশা করেছিলুম, এখানেই শেষ। মূর্খ আমি, জানতুম না, এইখানেই আরম্ভ।
দিন পনেরো পর ওই পঞ্চদশীর পাড়া থেকে এল আরও পাঁচখানা চিঠি! সবকটা চিঠি যে একই পাড়া থেকে, সেটা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য আমাকে ব্যোমকেশ-হোমস্ হতে হয়নি। মসজিদবাড়ি পাড়া, কলকাতা-৬ আমার বিলক্ষণ চেনা।
স্পষ্ট বোঝা গেল, পঞ্চদশীটি আমার চিঠিখানা তার পাড়ার তাবৎ বান্ধবীকে দেখিয়েছেন।
এস্থলে পাঠকদের কাছে আমার একটি অতিশয় ক্ষুদ্র আরজি আছে। এবং সেটি যদি তারা মঞ্জুর না করেন তবে আমি সত্য সত্যই মর্মাহত হব। এটা কথার কথা নয়, হৃদয়ের কথা। আমি জানি, আমি মোকা-বেমোকায় ঠাট্টা-মশকরা করি, কিন্তু আমার এ আরজি মোটেই মশকরা-রসিকতা নয়- সিরিয়াস। আমার নিবেদন :
এই যে এতক্ষণ ধরে আমি আমাকে লেখা চিঠিপত্র নিয়ে যে আলোচনা করেছি সেটা আমার মূল্য বাড়াবার জন্য নয়।
আমি আল্লা মানি। আল্লার কসম খেয়ে একথা বলছি।
আপনারা তারাশঙ্করাদি প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের শুধোন মিথ্যা বিনয় নয়, আমি তো ওঁদের অনেক পিছনে তারা কত না কত রঙের কত ঢঙের, কত না কল্পনাতীত জায়গা থেকে, কত না অবিশ্বাস্য ধরনের চিঠি পান।
ওঁরা যত চিঠি পান, তার শতাংশের একাংশও আমি পাই না।
এখানে এসে আমাকে আরেকটি কথা বেশ জোর গলায় বলতে হবে।
অদ্যাবধি কি দেশে, কি বিদেশে আমি একটি লেখকও পাইনি যিনি অপরিচিত পাঠকের স্বতঃপ্রবৃত্ত পত্র পেয়ে আনন্দিত হন না। এমনকি কড়া চিঠি পেয়েও লেখকরা খুব একটা বিমুখ হন না। তবে এ ধরনের চিঠি আসে কমই। কারণ স্বয়ং কবিগুরু বলেছেন,
আমার মতে জগৎটাতে
ভালোটারই প্রাধান্য
মন্দ যদি তিন-চল্লিশ
ভালোর সংখ্যা সাতান্ন।
তবে লেখককুল তিন-চল্লিশখানা মন্দ চিঠি পান না, পান তার চেয়ে ঢের ঢের কম। তবে অন্য মন্দ চিঠিগুলো যায় কোথায়? সেগুলো যায় সোজা সম্পাদক মহাশয়ের নামে। সেগুলোতে থাকে নানা প্রকারের প্রতিবাদ, মন্দমধুর সমালোচনা বা তীব্র কঠোর মন্তব্য। সম্পাদক আপন দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন বলে কোনওটা ছাপান, কোনওটা ছাপান না।
এই ব্যবস্থাই উত্তম। বুঝিয়ে বলি :
আপনি আমাকে সরাসরি চিঠি লিখলেন (সম্পাদক মহাশয়কে না), মহাশয়, আপনার শহ-ইয়ার নিতান্তই কাল্পনিক রচনা। এরকম মুসলমান মেয়ে বাঙালা দেশে সম্পূর্ণ অসম্ভব। তার পর আপনি সুচারুরূপে আপন অভিজ্ঞতাপ্রসূত সম্পদ যুক্তিযুক্তভাবে প্রকাশ করলেন।
এস্থলে আমি করি কী?
আপনি এম্বুলে বলেছেন, তুমি, আলী, অপরাধী!
এস্থলে চিন্তা করুন তো, কোন অপরাধী সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, হ্যাঁ, আমি অপরাধী, স্যার!–গিলটি, মিলাট (মাই লর্ড)!
ব্যাপার যদি এতই সরল হবে তবে তো আদালতের শতকরা নব্বইটি মোকদ্দমা সঙ্গে সঙ্গে ফৈসালা হয়ে যেত।
কিন্তু আমি নট গিলটি বললেই তো অনুযোগকারী পত্ৰলেখক (প্রসিকিউশন, ফরিয়াদি) সঙ্গে সঙ্গে সেটা মেনে নেবেন না।
তাই পুনরায় প্রশ্ন, এস্থলে আমি করি কী?
এইবারে আমি আমার মোদ্দা কথাতে এসে গিয়েছি।
পত্ৰলেখক যদি তাঁর অনুযোগ আমাকে সরাসরি না লিখে সম্পাদক মশাইকে জানাতেন, তবে আমি বেঁচে যেতুম। সম্পাদকমশাই না ছাপালে তো ল্যাঠাই চুকে যেত। অর্থাৎ মোকদ্দমা আদৌ আদালতে উঠল না।
কিন্তু তিনি ছাপালেও আমি খুশি। কারণ, তখন যারা এ বাবদে ভিন্নমত পোষণ করেন। তারা আমার পক্ষ নিয়ে সাক্ষ্য দেবেন। ভূরি ভূরি প্রমাণ পেশ করবেন যে, শহর-ইয়ার আদৌ কাল্পনিক নয়।
আমার মনে হয়, এই পন্থাই (প্রসিডিয়র সর্বোত্তম।
এ বাবদ ভবিষ্যতেও লেখার আশা পোষণ করি।
.
ইতোমধ্যে, দোহাই পাঠক, তুমি আদৌ ভেবো না, আমি সরাসরি চিঠি পেতে আদপেই পছন্দ করি না। খুব পছন্দ করি, বিলক্ষণ পছন্দ করি।
কিন্তু সেগুলোর উত্তর দেওয়াটা যে বড়–।
ন্যাকামো
প্রতি বৎসর আনুষ্ঠানিকভাবে সাড়ম্বর প্রাথমিক শিক্ষা, পাঠশালার মাস্টারমশাইদের দুরবস্থা, দেশ থেকে কেন নিরক্ষরতা দূর হচ্ছে না এই নিয়ে বিরাট বিরাট মিটিং হয়, বিস্তর চেল্লাচেল্পি হয়, ঘটি ঘটি চোখের জল ফেলা হয়। তার পর সারা বসর নিশ্চুপ।
এ যেন কস শ্বশুরের জামাইষষ্ঠী করার মতো। নিতান্ত না করলেই নয় বলে। তার পর পরিপূর্ণ একটি বৎসর কিপ্টে শ্বশুর নিশ্চিন্দি।
উহু! তুলনাটা টায়-টায় মিলল না। শ্বশুর যতই হাড়ে টক শাইলক হোক না কেন, এবং জামাই যতই হতভাগ্য দুঃখী হোক না কেন, সে বেচারি অন্তত একবেলার মতো পেট ভরে খেতে পায় এবং শুনেছি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে একখানা কাপড়ও পায়। আমি সঠিক বলতে পারব না কারণ আমি মুসলমানি বিয়ে করেছি। যদ্যপি সম্পর্কে তার এক বারে কনিষ্ঠ ভ্রাতা এই কলকাতা শহরেই পুরুষ্টু পাঁঠাটার মতো ঘোঁত ঘোত করে ঝাঁ-চকচকে একাধিক মোটর দাবড়ে বেড়ায় তবু শালা… আমি অশ্রাব্য অছাপা গালিগালাজ করছিনে(১)– স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন ব্যাটা সম্পর্কে আমার বড়কুটুম (শ্যালক আমাকে জামাইষষ্ঠীর দিনে স্মরণ করে না। কারণ তার পিতা আমার ঈশ্বর স্বর মহাশয় তাঁর সাধনোচিত ধামে চলে যাওয়ার পর এই শ্যালকটি তার পিতার তাবৎ সব গ্রহণ করেছেন নৃত্য করতে করতে। (সত্যের খাতিরে অনিচ্ছায় বলছি দাভাকর্ণ শ্বশুরমশাই বিশেষ কিছু রেখে যাননি, এবং সামান্য যেটুকু জ্ৰাসন রঙপুরে রেখে গিয়েছিলেন সেটুকুও পার্টিশনের ফলে শ্যালকের হস্তচ্যুত হয়। (বেশ হয়েছে, খুব হয়েছে!!) কিন্তু পিতৃদেবের দায়দায়িত্ব বেবাক এড়িয়ে গেছে। তাই সে জামাইষষ্ঠীর একমাস আগের থেকে এড়িয়ে চলে। হিন্দু কায়দাকানুন আমি জানিনে, কিন্তু আমি যে অঞ্চলের মুসলমান সেখানে রীতি, স্বর গত হওয়ার পরেই তার পুত্র জামাইয়ের শ্বশুর হয়ে যান। হয়তো হিন্দুদের ভিতর এ রেওয়াজ নেই। আমি জানব কী করে? কিন্তু আমাদের এই হিন্দু-মুসলমান, ভারতীয় ঐক্যবিধান নিয়ে যখন সব্বাই মাথা ঘামাচ্ছেন তখন উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কিঞ্চিৎ লেনদেন গিভূ-অ্যান্ড-টেক করা উচিত নয়।
এই দেখুন না, ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার সময় আমার দু-তিনটি হিন্দু বোন আমাকে নেমন্তন্ন জানায়– নেমন্তন্ন কথাটা বোধহয় ঠিক নয়। আমাকে তখন তারা ডাক দেয়-হক্কা হিসেবে, অ্যাজ এ ম্যাটার অব রাইট। আমি তখন বিশ-পঁচিশ টাকার শাড়ি নিয়ে যাই।
কিন্তু আমার জ্যেষ্ঠপুত্র, প্রিন্স অব ওয়েলস, ফিরোজ মিঞা বড়ই ঘোর আত্মাভিমানী। সে নিমন্ত্রণ পায় তার তিন-চার হিন্দু বোনদের কাছ থেকে। আমি বিলক্ষণ বুঝি সেই সরলা হিন্দু কুমারীরা মনে মনে ভাবে, সব হিন্দু ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার পরব করছে আর এই ছোট ভাইটি একা একা দিন গোয়াবে তদুপরি একথাও তো সত্য, এই কুমারীদের কোনও কোনও হিন্দু ভাই মুসলমান ফিরোজের চেয়ে কোনও গুণে শ্রেষ্ঠতর নয়। আমার মনে পড়ল, ওই ফিরোজই তার কোনও এক দিদির জন্মদিনে তার প্রিয় ফুল কেয়া আনতে গিয়ে শান্তিনিকেতনের দক্ষিণ দিকে গোয়ালপাড়ার কেয়াবনের মধ্যিখানে গোখরো সাপের ছোবল খেতে খেতে বেঁচে যায়।
অতএব বাবু ফিরোজ আমাকে বললেন, আব্ব, আমি ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায় যাচ্ছি। কিন্তু তার পূর্বে দিদিদের জন্য কিছু শাড়ি কিনতে হবে। আমি দালাল কোম্পানিতে যাচ্ছি।
সর্বনাশ! দালাল কোম্পানি অকাতরে সব দেবে। অবশ্য, বাচ্চা ফিরোজ কেন, ওরা কাউকেই ঠকায় না। তবে কি না আমি ওদের একবার ঠকিয়েছি।
কত টাকার বিল এনেছিল জানেন? ১৮০ টাকা!
পাঠক হয়তো ভাবছেন, আমি কী নিয়ে আরম্ভ করেছিলুম, আর কোথায় এসে পৌঁছলুম। বুঝিয়ে বলি। এ লেখাটি যখন আরম্ভ করি তখন ভীষণ রৌদ্র, দারুণ গরম। তারই সঙ্গে তাল রেখে আমি রুদ্র তথা ব্যঙ্গরসের অবতারণা করি। কিন্তু দু লহমা লেখার পূর্বেই হঠাৎ অন্ধকার করে নামল ঝমাঝম বৃষ্টি। তার পর মোলায়েম রিমঝিম। তার পর ইলশেগুড়ি। সঙ্গে সঙ্গে রুদ্ররসের অন্তর্ধান। বাসনা হল আপনাদের সঙ্গে দু-দণ্ড রসালাপ করি, একটুখানি জমজমাট আড্ডা জমাই।
ইতোমধ্যে আবার চচ্চড়ে রোদ উঠেছে। ফিরে যাই রুদ্ররসে।
.
আমাকে যদি কেউ শুধোয়, আমি কোন জিনিসে সবচেয়ে গুরুত্ব আরোপ করি, তবে নির্ভয়ে বলব, শিক্ষা।
কোন শিক্ষা?
প্রাইমারি স্কুল, অর্থাৎ পাঠশালা।
তার পর?
হাইস্কুল। তার পর কলেজ, বি,এ, এম.এ,। তার পর? পি.এইচ.ডি.। আমার মনে সবচেয়ে বিরক্তির সঞ্চার হয়, যখন ডক্টরেট করার জন্য কেউ আমার কাছে এসে সাহায্য চায়।
পাঠক অপরাধ নেবেন না যদি এস্থলে আমি কিঞ্চিৎ আত্মজীবন প্রকাশ করি।
বঙ্গসাহিত্যে আমার যেটুকু সামান্য লাস্ট বেঞ্চের আসন জুটেছে (অর্থাৎ আমার প্রথম পুস্তক দেশে বিদেশে প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে আমি একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখি, মরহুম হুমায়ুন কবীর সাহেবের চতুরঙ্গে ১৯৪৮ সালে। প্রবন্ধটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। আমি প্রমাণ করতে চেয়েছিলুম, যে-যাই বলুক না কেন, আখেরে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলাই হবে। কিন্তু এহ বাহ্য। আমি তখন প্রাইমারি এডুকেশনের ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে বলি :
আমাদের পাঠশালার পণ্ডিতমশাইদের কিছু কিছু জমিজমা মাঝে-মধ্যে থাকে, কিন্তু সে অতি সামান্য, নগণ্য। কেউ কেউ হালও ধরে থাকেন। এবং তৎসত্ত্বেও তারা যে কী নিদারুণ দারিদ্র্যের ভিতর দিয়ে জীবনযাপন করেন সে নির্মম কাহিনী বর্ণনা করার মতো ভাষা ও শৈলী আমার নেই। লেখাপড়া শিখেছেন বলে এবং অনেক স্থলেই উত্তম বিদ্যার্জন করেছেন, যেটা আমরা শহরে বসে সঠিক বুঝিনে গ্রামের আর পাঁচজনের তুলনায় এদের সূহ্মানুভূতি, স্পর্শকাতরতা এবং আত্মসম্মানজ্ঞান হয় অনেক বেশি। মহাজনের রূঢ় বাক্য, জমিদার জোতদারের রক্তচক্ষু এদের হৃদয়-মনে আঘাত দেয় ঢের ঢের বেশি। এবং উচ্চশিক্ষা কী বস্তু তার সন্ধান তারা কিছুটা রাখেন বলে মেধাবী পুত্রকে অর্থাভাবে উচ্চশিক্ষা না দিতে পারাটা এদের জীবনের সবচেয়ে মারাত্মক ট্র্যাজেডি। ইত্তিহাদ আজাদ (পশ্চিমবঙ্গের বেলায় বলব, আনন্দবাজার দেশ- এটা এখানে জুড়ে দিচ্ছিলেখক মাঝে মাঝে এদের হস্তগত হয় বলে এরা জানেন যে যক্ষ্মরোগী স্বাস্থ্যনিবাসে বহুক্ষেত্রে। নিরাময় হয়, হয়তো তার সবিস্তর আশাবাদী বর্ণনাও কোনও রবিবাসরীয়তে তারা পড়েছেন এবং তার পর অন্নাভাবে চিকিৎসাভাবে পুত্র অথবা কন্যা যখন যক্ষ্মারোগে চোখের সামনে তিলে তিলে মরে তখন তারা কী করেন, কী ভাবেন, আমার জানা নেই। বাইবেলি ভাষায় বলতে ইচ্ছা যায়, ধন্য যাহারা অজ্ঞ, কারণ তাহাদের দুঃখ কম। পাঠশালার গুরুমশাইয়ের তুলনায় গাঁয়ের আর পাঁচজন যখন জানে না, স্বাস্থ্যনিবাস (সেনেটরিয়াম) সাপ না ব্যাঙ না কী, তখন তারা যক্ষ্মারোগকে কিস্যুতের গর্দিশ বলে মেনে নিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারে। হতভাগা পণ্ডিত পারে না।
কিন্তু প্রশ্ন, প্রবন্ধের গোড়াতেই জামাইষষ্ঠীর কথা তুলেছিলুম কেন?
শুনেছি, সঠিক বলতে পারব না, গায়ের পণ্ডিতদের নিমন্ত্রণ করে বছরে একদিন শহরে এনে ওই যে বিরাট বিরাট সভা করা হয়, ঘটি ঘটি চোখের জল ফেলা হয় তখন জামাইষষ্ঠীর দিনের মতো তাদেরকে একপেট খেতেও দেওয়া হয় না।
এবং তৎপর ৩৬৪ দিনের গোরস্তানের নীরবতা।
.
এই শেষ নয়। দাঁড়ান না। সুযোগ পেলে আরেকদিন আরেক হাত আমি নেবই নেব।
স্বামী বিবেকানন্দকে গুরু মেনে, সাক্ষী মেনে।
———-
১. আমার প্রতি অকারণ সহৃদয় পাঠক, যারা আশকথা-পাশকথা শুনতে ভালোবাসেন, তাঁদের কাছে অবান্তর একটি ঘটনার উল্লেখ। আমার বৃদ্ধ পিতা তখন ছোট একটি মহকুমার অনারারি হাকিম। একদিন আদালত থেকে ফিরে আমায় বললেন, সিতু, আজ আদালতে কী হয়েছিল, জানিস? এক মূর্ব আরেক গাধার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা এনেছে ওই দোসরাটা নাকি তাকে সদর রাস্তায় শালা বলে গালাগালি দিয়েছে (এতদিন পরে আমার মনে নেই সেটা এবুজিত ল্যানইজ না ডিফেমেশন ছিল– লেখক)। তার পর বাবা বললেন, আসামি পক্ষে মোক্তারের বক্তব্য, যাকে সে শালা বলেছে সে সম্পর্কে সত্যিই তার শালা; অতএব কোনও অপরাধ হয়নি। বিপক্ষ কিন্তু বলছে, রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আসামি যখন শালা বলেছে তখন মধুভরা সোহাগ-পোরা সে শালা বলেনি; বলেছে অপমান করার জন্য। ইতোমধ্যে বাবার মগরিবের (সন্ধ্যার নামাজের জন্য অজুর জল এসে গিয়েছে। আমি তাই তাড়াতাড়ি শুধোলুম, আপনি কী রায় দিলেন? বাবা বললেন, দুই পক্ষকে আদালত থেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলুম। বললুম, মশকরা করার জায়গা পাওনি!… আমার মনে এখন সন্দেহ জাগে, বাবার এই হুকুম ঠিক আইনসম্মত হয়েছিল কি না। তবে একথা জানি, দুই পক্ষই কোনও প্রতিবাদ না জানিয়ে সুড় করে বেরিয়ে গিয়েছিল। কারণ বাবা ছিলেন রাশভারী, আচারনিষ্ঠ বৃদ্ধ। আসামি ফরিয়াদি মোক্তার সবাইকে দেখেছেন উলঙ্গাবস্থায় আমাদের বাড়ির আঙিনায় বেলাধুলো করতে।
বনে ভূত না মনে ভূত
আমাকে অনেকেই জিগ্যেস করেন, দেশ-বিদেশ তো অনেক ঘুরলেন, বয়সও হয়েছে, অতিপ্রাকৃত অলৌকিক কিছু দেখেছেন কি? সোজা বাংলায় ভূত, প্রেত, মামদো (মানুষ মরে ভূত হয় এটা ইসলাম অস্বীকার করে কিন্তু কোনও কোনও হিন্দুর বিশ্বাস অয়, অয় রনিতি পার না। মুহম্মদি মানুষ অর্থাৎ মুসলমান মরে গিয়ে মামদো হয়– মুহম্মদি শব্দ গ্রাম্য বাংলায় হয়ে গিয়েছে মামদো। এস্থলে Zনতি কথাটা ঠিক ঠিক ব্যবহৃত হয়েছে কারণ মামদো বলুন, ভূত বলুন, এনাদের তো চট করে চোখে দেখা যায় না– অতএব এনারা আছেন, ওনারাও আছেন, শুধু আমরা Zনতি পারি না এবং অন্যান্য বিভিন্ন জাতবেজাতের ভূতের কোনও একটা আমি দেখেছি কি না?
জর্মন ভাষায় দুটি শব্দ বাংলায় বেশ চালু হয়ে গিয়েছে। একটা কিন্ডারগার্টেন আরেকটা যদিও অতখানি চালু না– রিভারপেস্ট পশুচিকিত্সক মাত্রই চেনেন। আরেকটি শব্দ প্রচলিত হওয়ার বড়ই প্রয়োজন– পটারগাইস্ট। ভুতুড়ে বাড়িতে যে দমাদ্দম ইটপাটকেল এবং মাঝেমধ্যে কচুপাতায় মোড়া নোংরা বস্তুও বর্ষিত হয় সেটি করেন পন্টারগাই। পটার ক্রিয়ার অর্থ দুদ্দাড় দুমদাম শব্দ করা আর গাইষ্ট = ইংরিজি গোস্ট (ghost)।
এর থেকে আরেকটা তত্ত্ব সুস্পষ্ট হয়। ভূত-প্রেত সম্বন্ধে দেশ-বিদেশের যেখান থেকেই হোক না কেন, কোনও গুজব, জনরব– একুনে শুজোরব– পৌঁছনোমাত্রই সরল মানুষ সঙ্গে সঙ্গে সেটা বিশ্বাস করে ফেলে এবং সেই নয়া ভূতকে অবিচারে জাতে তুলে নেয়। ইংরেজের মতো অবিশ্বাসী (অনবিলিভিং টমাস) জাতও তাই তার দুশমন জর্মন জাতের পটারগাইন্টকে আলিঙ্গন করে আপন ভাষায় স্থান দিয়েছে। বিশ্বাস না হয়, যে কোনও ইংরেজি দিকসুন্দরীর (যে সুন্দরী নারী দিক দেখিয়ে দেন, অর্থাৎ ডিশনারি) আশ্রয় গ্রহণ করে সন্দেহ ভঞ্জন করুম। প্রেসিদ্ধ কোনও কোনও গুণীন নাকি ভূতপ্রেতকে দিয়ে অনেক কিছু কাজকর্ম করিয়ে নেন। মহাত্মা কালীপ্রসন্ন তার নক্শাতে এদের সম্বন্ধে সবিস্তার তাজ্জব বয়ান দিয়েছেন। কোনও কোনও পীর সাহেবও নাকি এখনও এই অলৌকিক তিলিসমাৎ দেখাতে পারেন। শীতকালে বোম্বাই আম, যে কোনও কালে কাবুলি মেওয়া পয়দা করতে পারেন।
দুঃখের বিষয় মহাকবি গ্যোটের সেই সুন্দর কবিতাটি আমি ভুলে গিয়েছি। যদূর মনে পড়ছে তাতে এক চেলা পরিপূর্ণ ভূতসিদ্ধ হওয়ার পূর্বেই উচাটন মন্ত্রে ভূতকে আবাহন জানায়। তার পর কী একটা হুকুম করে–খুব সম্ভব জল আনতে–তার পর ভূত জল আনছে তো আছেই, জলে জলে ছয়লাপ। ওদিকে বিপদ হয়েছে কী, চেলা কিন্তু গুরুর কাছ থেকে শেষ উচাটন মন্ত্রটি যেটি দিয়ে ভূতকে ঠেকাবে, সেটি শেখার পূর্বেই চলে এসেছে। এখন বন্যার জলে ডুবে মরে আর কি!… শেষটায় কাতরকণ্ঠে সে গুরুকে স্মরণ করল। গুরু এসে এই ভূতকে অন্য হুকুম দিলেন, আমি এসব চ্যাংড়াদের গুরু। প্রথমে আমার মোক্ষম হুকুম শোন। তার পর অন্য কাজ। এই বলে তিনি ভূতকে অন্য হুকুম দিয়ে বন্যা বন্ধ করলেন।
কিন্তু এ বাবদে আমাদের দেশে প্রচলিত গল্পটি এরচেয়ে ঢের ঢের ভালো। সে গল্পের গোড়াপত্তন ওই একই। আমাদের গল্পে গুরুর কাছ থেকে সম্পূর্ণ বিদ্যা আয়ত্ত করার পূর্বেই চেলা তার ভূতকে আবাহন করেছে। ভূতের সঙ্গে তার কিন্তু একটা শর্ত ছিল। ভূতকে সর্বক্ষণ কোনওকিছু একটা কাজ দিতে হবে। সে বেকার থাকতে পারে না। কাজ না দিতে পারলে সে ওর ঘাড়টি মটকে দেবে।
অস্মদ্দেশীয় কাহিনীতে চেলা ভূতকে ডেকে বলল, আমার জন্য একটা রাজপ্রাসাদ তৈরি করে দাও। দু-মিনিট যেতে না যেতেই রাজপ্রাসাদ চোখের সামনে তৈরি। ভূত বলল, তার পরের হুকুম চেলা তো তাজ্জব। তাড়াতাড়ি বলল, গোটা দশেক সুন্দরী রমণী। ভূত কটমটিয়ে তাকিয়ে বলল, সে তো প্রাসাদে অলরেডি রয়েছে। বুদু! হেরেম ভিন্ন প্রাসাদ হয় নাকি? চেলা বলল, তা হলে প্রাসাদের সামনে একটা হ্রদ তৈরি করে দাও। এক মিনিটে তৈরি। ভূত শুধোল, তার পরের কাজ? চেলা তখন আরও মেলাই অর্ডার দিল। সেগুলোও ঝটপট হয়ে গেল। আর প্রতিবারেই ভূত তার কাছে এসে কটমটিয়ে তাকায়। ভাবখানা সুস্পষ্ট। কাজ না দিতে পারলে শর্তানুযায়ী তোমার ঘাড়টা মটাস করে ভাঙব। চেলা তখন পড়েছে মহাসঙ্কটে। নতুন অর্ডার খুঁজে পায় না। কবি গ্যোটের চেলার মতোই সে ভূত বিদায় দিতে জানে না। তখন হন্যে হয়ে, না পেরে, কবি গ্যোটেরই চেলার মতো সে তার গুরুকে স্মরণ করল।
এইখানেই আমাদের কাহিনী গ্যোটের কাহিনীর চেয়ে ঢের সরেস।
আমাদের গুরু তার প্রাচীনতার, ফাস্ট প্রেফারেন্সের দোহাই পাড়লেন না। চেলাকে বললেন, ভূতকে হুকুম দাও একটা বাঁশ পুঁততে। সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল। শুরু চেলাকে বললেন, এবারে ভূতকে হুকুম দাও, সে যেন ওই বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠে। এবং উপরে ওঠামাত্রই যেন নিচে বেয়ে নামে। ফের উপর। ফের নিচে। ফের উপর। ফের নিচ।
গুরু চেলাকে কানে কানে বললেন, ওই করুক, ব্যাটা অনন্ত কাল অবধি। অবশ্য যখন তোমার অন্য কিছুর প্রয়োজন হয় তখন তাকে ওঠানামা ক্ষণতরে ক্ষান্ত দিয়ে সে কাজ করতে বলবে। তার পর ফের হুকুম দেবে, ওঠো নামো, ওঠো নামো।
কিন্তু এহ বাহ্য।
এ-গল্পের একটা গভীর অর্থ আছে।
মানুষের মন ওই ভূতের মতো। তাকে সর্বক্ষণ কোনও কর্মে নিয়োজিত না করতে পারলে সে তোমার ঘাড় মটকাবে। ইংরেজিতে তাই প্রবাদ অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। অতএব যখন যা দরকার মনকে দিয়ে তাই করিয়ে নিয়ে ফের তাকে একটা বাঁশে ওঠানামার মতো মেকানিকাল কাজে লাগিয়ে দিতে হয়। মানুষ সর্বক্ষণ মনের জন্য নতুন নতুন কাজ সৃষ্টি করতে পারে না।
এইবারে, সর্বশেষে, আমি শান্তনু পাঠকের হাতে খাবো কিল।
মহাত্মাজি চরকা কাটতেন।
রবীন্দ্রনাথ আপন লেখার কপি করতেন। গোরার মতো বিরাট গ্রন্থ তিনি তিন-তিনবার কপি করেছেন। যদিও ওই মেকানিকাল কর্ম করার জন্য আশ্রমে লোকাভাব ছিল না।
আইনস্টাইন ব্যালা বাজাতেন।
বিশ্বভারতী প্রাগ
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্বভারতীর জন্য এদেশে বিশ্ববিখ্যাত একাধিক পণ্ডিত আনিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতনামা ছিলেন অধ্যাপক মরিৎস্ ভিটারনিস। একে এদের অনেক সংস্কৃতপণ্ডিত চিনতে পারবেন। ১৯০৯ থেকে ১৯২২ জুড়ে জর্মন ভাষায় প্রকাশিত হয় তার ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস। এরই ইংরেজি অনুবাদ বেরোয় এদেশে ১৯২৭ থেকে ১৯৩২। এছাড়া আছে, গৃহ্যসূত্র প্রাচীন ভারতে বিবাহ অনুষ্ঠান ভারতীয় ধর্মে রমণী ইত্যাদি তার প্রচুর গ্রন্থরাজি।
এ সবকটি বই-ই পণ্ডিতদের জন্য।
কিন্তু তিনি আমাদের মতো সাধারণজনদের একখানি পুস্তিকা লিখে গিয়েছেন–কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে। এ-পুস্তিকা সম্বন্ধে ইতোপূর্বে, অন্য অবকাশে, আমি দু-একটি কথা বলেছি। এস্থলে পুনরায় বলি, রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত যত লেখা বেরিয়েছে তার ভিতরে আমি এটিকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচনা করি। তার প্রধান কারণ অধ্যাপকের সমস্ত জীবন কাটে বেদ, উপনিষদ, সংস্কৃত কাব্য নিয়ে। এদেরই ভেতর দিয়ে যে ঐতিহ্য ভারতবর্ষে চলে আসছে তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কতখানি সংযুক্ত, কতখানি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তার ধর্মমত কীভাবে গড়ে উঠেছিল এ সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি বলার অধিকার ছিল অধ্যাপক তিনটারনিৎসেরই। তিনি বাংলা ভাষা জানতেন।
বইখানি অতিশয় সরল জর্মন ভাষায় রচিত। ইংরেজি বা বাংলায় এর অনুবাদ হয়েছে বলে শুনিনি। হওয়া উচিত। বইখানি একখণ্ড শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রনাথ ভবনে আছে।
চেকোস্লোভাকিয়ার জনসাধারণ অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরীয় জর্মন এবং পরবর্তী যুগে খাস জর্মনির জর্মনগণ দ্বারা নিপীড়িত হওয়া সত্ত্বেও তাদের কৃষ্টি-সভ্যতার অনেকখানি জন সভ্যতার কাছে ঋণী। তাছাড়া অনেক জর্মনও চেকোস্লোভাকিয়ায় বাস করত।
অধ্যাপক ভিনটারনিৎস চেক নন। তিনি জন্মেছিলেন দক্ষিণ অস্ট্রিয়ায় ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি যখন টুকরো টুকরো হয়ে যায় তখন তার জন্মভূমি পড়ে নবনির্মিত রাষ্ট্র চেকোস্লোভাকিয়ার প্রত্যন্ত প্রদেশে, অবশ্য অস্ট্রিয়াই (হিটলারেরও জন্ম এই অঞ্চলে এবং তার ধমনীতে নাকি কিঞ্চিৎ চেক রক্তও ছিল; মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন, চেকদের যে তিনি সর্বনাশ করতে চেয়েছিলেন তার কারণ, ওই করে তিনি তাঁর চেক রক্ত অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, সেইটে আসল কথা নয়। তিনি ভালোবাসতেন প্রাগ শহরকে। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে সেখানে তিনি অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে চেকোস্লোভাকিয়া জন্মগ্রহণ করে মাত-উদর থেকে যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তখন তিনি ইচ্ছে করলেই ভিয়েনা (এইমাত্র বলেছি, তার মাতৃভূমি পড়েছিল অস্ট্রিয়ায় এবং অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা তখন প্রাগ ইত্যাদি শহর থেকে তার আপনজনকে নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে) বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যেতে পারতেন কিন্তু তিনি যাননি।
অধ্যাপক ভিটানিস ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ থেকে বরাবর ১৯৩৭–তার পরলোকগমন অবধি আগেই থেকে যান।
তিনি ছিলেন জাতে, ধর্মে ইহুদি।(১) ইহুদিরা কোনও জায়গায় পত্তন জমালে সেখানে যেসব ইহুদি পরিবার আছে তাদের সঙ্গে মিলেমিশে এমনই এক হয়ে যায় যে পরে ভিন্ন জায়গায় উৎকৃষ্ট সুযোগ-সুবিধা পেলেও এদের ত্যাগ করাটা নিমকহারামি বলে মনে করে। এই একই কারণে ইজরায়েলের শত ক্রন্দনরোদন সত্ত্বেও আমেরিকার লক্ষ লক্ষ ইহুদি পরিবার-সমাজ-দেশ ছেড়ে ওই দেশে যেতে চায় না।(২)
প্রাগ শহর বড় বিচিত্র শহর। সেখানে চেক আছে, জর্মন আছে, ইহুদি আছে, আরও কত জাত-বেজাতের লোক আছে এবং বড় মিলেমিশে থাকে।
আর, পূর্বেই বলেছি, শহরটি বাস্তবিকই বড় সুন্দর।
মধ্যিখান দিয়ে মলডাও নদী চলে গিয়েছে। ঠিক যেরকম ভিয়েনার মাঝখান দিয়ে ড্যানুয়ব, প্যারিসের মধ্যিখান দিয়ে শেন, বুড়াপেস্ট-এর মাঝখান দিয়ে ড্যানুয়ব।
অধ্যাপক ভিনটারনিৎসকে নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাব।
হোটেলওলাকে শুধোলুম, হোথায় কোন ট্রামে বা বাসে যেতে হয়।
সেদিন কী-একটা পরব ছিল। ভিড়ে ভিড়ে হুজুন।
অতএব বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চয় বন্ধ। কিন্তু একটা স্কেলিটেন স্টাফ থাকবে তো! তারা নিশ্চয়ই অধ্যাপকের বাড়ির ঠিকানা দিতে পারবে।
ইতোমধ্যে এই হুজুম না কাটা পর্যন্ত ট্রাম-বাস তো চলবে না।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডান হাত দিয়ে ঘাড়ের বাঁ দিকটা চুলকোচ্ছি, এমন সময়ে এক অপরূপ সুন্দরী এসে আমাকে শুধোল, আপনার কি কোনও সাহায্যের প্রয়োজন?
এ শুধু প্রাগেই সম্ভবে!
অন্য দেশের মেয়েরা পুরুষকে মদত দেবার জন্য এরকম এগিয়ে আসে না।
———-
১, আমি শুনেছি তিনি যখন শান্তিনিকেতনে ভিজিটিং প্রফেসাররূপে ছিলেন তখন কলকাতার ইহুদি সম্প্রদায়ের নিমন্ত্রণে সেখানকার ইহুদি ধর্মমন্দিরে তাদের বাৎসরিক পূজায় উপস্থিত থাকেন।
২. অন্য কারণও হয়তো আছে। ১৯৩৪ সালে যখন আমি প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের কেন্দ্রভূমি তেল আভিভ শহরে যাই তখন এক ইহুদি আমাকে বলেন– মশকরা করে, না কি, বলা কঠিন– কাকে কাকের মাংস খায় না। সব ইহুদি, সব কাক, এক জায়গায় জড় হলে তো উপবাসে মরতে হবে। দুনিয়ার কুল্লে জাত স্বজাতের সঙ্গে থাকতে চায়। আমরা ব্যত্যয়।
ব্রেন-ড্রেন
যারা এদেশে গবেষণা করার সুযোগ পান না, তাদের অনেকেই ইংলন্ডে চলে যান। আবার বিলিতি খবরের কাগজে প্রায়ই দেখতে পাবেন, সেখানেও ওই একই ব্যাপার; মেধাবী বৈজ্ঞানিক তার জুতো থেকে ইংলন্ডের ধুলো ঝেড়ে ফেলে মার্কিন মুলুকে চলে যায়। সেখানে বেশি মাইনে তো পাবেই, এবং তার চেয়েও বড় কথা, সেখানে গবেষণা করার জন্য পাবে আশাতিরিক্ত অর্থানুকুল্য। অধুনা গৌরীসেন মার্কিন সিটিজেনশিপ গ্রহণ করে সেখানেই ডলার ঢালেন।… জর্মন কাগজেও মাঝে মাঝে দেখতে পাই, ওদের তরুণ বৈজ্ঞানিকদেরও কিছু কিছু মার্কিন-মক্কায় চলে যাচ্ছে।
থাকি মফস্বলে। কলকাতায় পৌঁছলুম ল্যাটে। তবু দেখি, পাড়ায় ব্যতম রক পুরানা সায়েবের মার্কিন নাগরিকতা গ্রহণ নিয়ে সরগরম, মালুম হল, মতভেদ ক্ষুরস্য ধারার ন্যায় সুতীক্ষ্ণ। রকের পলিফে-বেঞ্চ বলছেন, যে-যেখানে কাজের সুযোগ পাবে, সে সেখানে যাবে বাংলা কথা। পক্ষান্তরে তালেবর-বেঞ্চ যুক্তিতর্কসহ সপ্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, পুরানা মহাশয়ের উচিত ছিল দেশে থেকে দেশের সেবা করা। এবং উচিত-অনুচিতের কথাই যখন উঠল তখন বলতে হবে এদেশের কর্তৃপক্ষই পয়লা নম্বরের আসামি। নিজেরা তো কিছু করবেনই না, যারা করতে চায় তাদেরও কিছু করতে দেবেন না। একেবারে উগ অ্যানড দি ম্যানেজার
তালেবর পক্ষেরই এক ব্যাক-বেঞ্চার ক্ষীণকণ্ঠে শুধোল, প্রবাদটা কি ডগ অ্যানড দি মেইনজার নয়?
আলবৎ নয়। এখন এরা সব ম্যানেজার।
এর পর কর্তাদের নিয়ে আরম্ভ হল কটুকাটব্য। আমি প্রাচীনযুগের লোক—-ডাইনে-বাঁয়ে চট করে একবার তাকিয়ে নিলুম। টেগার্ট সায়েবের প্রেতাত্মা আবার কোথাও পঞ্চভূত ধারণ করেননি তো!
খলিফে পক্ষের এক চাঁই মাথা দুলোতে দুলোতে বললেন, সেই কথাই তো হচ্ছে। কাজ করতেও দেবে না। তবে শোনো আমাদেরই এক প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নীতি যদিও সেটা তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেন না ভিন্ন রাষ্ট্রের কাউকে আপন রাষ্ট্রে চাকরি দেবেন না। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও এক সাবজেক্টে ঝাড়া বিশটি বছর ধরে কেউ মাস্টার্স ডিগ্রিতে ফার্স্ট ক্লাস পায়নি। বুড়ো-হাবড়া অধ্যাপকরা রিটায়ার করতে চান না। এদিকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েটে কাউকে লেকচারার তক নেবেন না–যদি ফার্স্ট ক্লাসের হরিন্নাম তার সঙ্গে ছাপা না থাকে। এদিকে চন্দনের বাটিটি বিশটি বছর ধরে তারা ঝুলিয়ে লুকিয়ে রেখেছেন সযত্নে। শুধোলে অবশ্য বলেন, ঘোর কলিকাল মোশয়, ঘোর কলিকাল। পাষণ্ড, পাষণ্ড, পাষন্দ্রে পাল। অধ্যয়নে কি এদের কোনওপ্রকারের আসক্তি আছে? পড়েননি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থানের প্রতিবেদন–স্পষ্টাক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে ছাত্রসমাজে, বিশেষ করে ছাত্রসমাজে, মদ্যাদি সেবন দ্রুতগতিতে শনৈঃ শনৈঃ বর্ধমান!– এদের গায়ে কাটব হরিন্নামের ছাপ! মাথা খারাপ!
খলিফে পক্ষের আরেক খাজা বললেন, বিলক্ষণ! ভালুকের সব্বাঙ্গে লোম। এম-এর তেড়ি কাটবে কোথায়?
প্রথম চাঁই সোল্লাসে বললেন, বিলকুল! সে দেশের মোর পুত্রবৎ ছাত্রকে স্নাতকোত্তর করতে চায় না, সে দেবে তাকে রিসার্চ করতে! ওই আনন্দেই থাকো।
বলিফের খাজা বললেন, যথা, পিতার প্রেতাত্মা দাবড়ে বেড়াবেন বিশ্বময়, কিন্তু পুত্রকে দেবেন না– এস্তেক পিণ্ড-দাদনদানে–পি দিয়ে অশৌচ সমাপ্তি করতে।
তালেবর বেঞ্চ ঢিড খেয়ে যাবার খাবি খাচ্ছে দেখে তাদের এক ঝানু তখন ফিলিঙের শরণাপন্ন হলেন।
এস্থলে আমাকে একটু বুঝিয়ে বলতে হয়। দরদ, সহানুভূতি, সমবেদনা, সহব্যথা, হৃদয়বেদনা এ শব্দগুলো বড়ই মোলায়েম মরমিয়া। অপিচ ফিলিঙ কথাটা ফ হরফে কট্টর জোর দিয়ে (অবশ্যই ইংরাজি F-এর মতো উচ্চারণ না করে) শব্দটা বললে তবেই না গভীর ভাবানুভূতির খানিকটে প্রকাশ পায়!(১)
সেই ফ উচ্চারণ করে ঝানু-তালেবর ভাবাবেগে বললেন pfi-লিঙ নেই, pfi-লিঙ নেই, সব ফলানা ফলানা খুরানাদের কারওরই ফিলিঙ নেই দেশের প্রতি। দেশে বসে কী রিসার্চ করা যায়–
কথা শেষ না হতেই খলিফে পক্ষের আরেক গুণীন মিনমিনিয়ে বললেন, নৌকোতে বসে কি গুন টানা যায় না!
ওই পক্ষের আরেক জাহাবাজ বললেন, কিংবা মাতৃগর্ভে শুয়ে শুয়ে দেশভ্রমণ!
.
এইবারে রকের বারোয়ারি মামা মুখ খুললেন। ইনি আমাদের রকের প্রেসিডেন্ট। এঁরই রকে আমরা দু-দণ্ড রসালাপ করি। কিন্তু ইনি থাকেন প্রাচীন দিনের একটি সোফাতে শুয়ে ঘরের ভিতরে। অনেকটা কবিগুরুর রাজা নাটকের রাজার মতো। অবরে-সবরে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু-একটি লবজো ছাড়েন।
বললেন, সেরকম নিষ্ঠা থাকলে কি দেশে থেকেই রিসার্চ করা যায় না? সেইটেই হচ্ছে মোদ্দা কথা।
বিজ্ঞানের বেলা অর্থাৎ এপ্লায়েড সায়েন্সের বেলা আজকাল বিস্তর যন্ত্রপাতি, মালমসলার প্রয়োজন। তার জন্য প্রচুর আয়োজন প্রচুরতর অর্থ না থাকলে এসব হয় না। অবশ্য, একথাও সত্য জগদীশচন্দ্র বসু, মার্কনি এবং আরও মেলা লোক এসব না থাকা সত্ত্বেও এন্তের কেরামতি দেখিয়ে গেছেন। কিন্তু সেসব দিন হয়তো গেছে। আজকের দিন স্বয়ং লেওনারদো দা ভিচিও সরকারি গৌরীসেনের সাহায্য ছাড়া এটম বম্ বানাতে পারবেন বলে মনে হয় না।
কিন্তু পিওর সায়েন্স পিওর ফিজিক্স, ম্যামিটিক্স, আরও বিস্তর বিষয়বস্তু আছে যার জন্যে কোনওই যন্ত্রপাতি টাকা-পয়সার প্রয়োজন হয় না সেগুলোর বেলা কী? তা হলে শোন, একটা গল্প বলি, সত্যি-মিথ্যে জানিনে, বাবা! একদা কালিফনিয়ার এক বিরাট ইনস্টিটুটে বিরাটতর টেলিস্কোপ লাগানো উপলক্ষে মাদাম আইনস্টাইনকে নিমন্ত্রণ করা হয়। সরলা মাদাম সেই দানবপ্রমাণ যন্ত্রটা দেখে তো একেবারে স্তম্ভিত।
যেহোভার দোহাই! প্রায় চিৎকার করে উঠলেন মাদাম : এ যন্তরটা লাগে কোন কাজে
বড় কর্তা হাত কচলাতে কচলাতে খুশিতে ফাটোফাটো হয়ে বললেন, মাদাম, এই যে বিরাট ব্রহ্মাণ্ড তার পরিপূর্ণ স্বরূপ (Gestalt) হৃদয়ঙ্গম করার জন্য এটি অপরিহার্য। এ বাবদে আপনার স্বামী, আমাদের গুরুর অবদানও তত হেঁ, হে।
ঈষৎ ভ্রুকুঞ্চিত করে মাদাম বললেন, সে কী! আমার কর্তা তো ওয়েস্ট পেপার বাসকেট থেকে একটা পুরনো ধাম তুলে নিয়ে তার উল্টো পিঠে এসব করে থাকেন।
তবেই দেখ, হয়ও অনেক কিছুই যন্ত্রপাতি ছাড়াও।
কিন্তু এসব বাদ দাও এবং চিন্তা কর দর্শন, ন্যায়, ইতিহাস, প্রাচ্যতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, অলঙ্কার শব্দতত্ত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি এন্তের এন্তের সবজেক্ট রয়েছে যার জন্য কোনও ক্ষুদে গৌরীসেনেরও প্রয়োজন হয় না।
মামা দম নিয়ে বললেন, এবারে বাবা বল, তোমরা তো অনেক সবজেক্টে অনেক পাস দিয়েছ; গত তিরিশ বছরে এই পুণ্য বঙ্গভূমিতে কোন কোন মহাপ্রভুর দর্শন ইত্যাদি সবজেক্ট গবেষণার বিশল্যকরণী সমেত গন্ধমাদন উত্তোলন করে ভুবন তিখাতে হয়েছেন। বাঙালা দেশের কথা বিশেষ করে বলুন, কারণ একদা এদেশ হিন্দুস্থানের লিডার ছিল।
মামার চোখে-মুখে ব্যঙ্গভরা বেদনা।
এইবারে আমি মুখ খোলার একটু মোক পেয়ে বললুম, তা মামু-সায়েব-রিসার্চের জন্য কড়ি লাগুক আর না-ই লাগুক, যে লোকটা রিসার্চ করবে তার পেটে, তার সমাজের আর পাঁচজনের পেটে যদি দু মুঠো অন্ন না থাকে তবে কি রিসার্চ হয়? আজ এই কলকাতা শহরে আর সকলের পেটেই অন্ন আছে– নেই শুধু বাঙালির।
মামা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, যেন আপন মনে বিড়বিড় করে ১৮২০ থেকে ১৯২০। ওই সময়টায় কলকাতায় বাঙালি সচ্ছল ছিল। যা কিছু করেছে ওই সময়েই করেছে। আজকের দিনে দু-পাঁচটা প্রফেসরের দু-মুঠো অন্ন জোটে, একথা সত্যি। কিন্তু তার আর পাঁচটা ভাইবেরাদর, মোদ্দাকথা তার গোটা সমাজ (Gestalt) যদি নিরন্ন হয় তবে এই দু-পাঁচটা প্রফেসরও কোনওকিছু দেখার মতো করে উঠতে পারে না। সি-লেভেল থেকে আচমকা এভারেস্ট মাথা উঁচু করে খাড়া হয় না; তবে লেভেল অর্থাৎ তার সমাজ অনেকখানি উঁচু না হলে সে আকাশচুম্বী হবে কী করে?
আস্তে আস্তে মামা চোখ খুললেন। কড়া গলায় বললেন, ১৮২০ থেকে ১৯০০ কিংবা ১৯২০ পর্যন্ত কলকাতার ব্যবসা-বাণিজ্য– আর ওইটেই তো সমাজের সচ্ছলতা আনে– কাদের হাত থেকে কাদের হাতে গেল সেইটে একটু খুঁজে দেখ তো। হেসে বললেন, ওই নিয়ে একটা রিসার্চ কর না।
———-
১, অর্থাৎ প্রফুল্ল শব্দ আমরা যেভাবে উচ্চারণ করি সেভাবে নয়। মারওয়াড়িরা যেভাবে পর-ফু (pf) লু উচ্চারণ করেন তারই ফ।
ভরাডুবি (আন্ ফ্রাঙ্ক)
আজকালের মধ্যেই তো ৬ জুন। শুধু ইয়োরাপের না, বিশ্বের ইতিহাসেও এটি একটি অবিস্মরণীয় দিন। আজ থেকে পঁচিশ বৎসর পূর্বে ওইদিন হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ সৈন্যে জাহাজ ভর্তি করে ফ্রান্সের নরমাদি উপকূলে মার্কিন-ইংরেজ অবতরণ করে। এরকম বিরাট নৌবহর নিয়ে এ আকারের একটা অভিযান পৃথিবীর ইতিহাসে ইতোপূর্বে হয়েছে বলে আমার জানা নেই। সারা বিশ্বে এটা ডি ডে নামে পরিচিত এবং সুদ্ধমাত্র কূলে অবতরণের ওই একটি দিবস নিয়েই এত কেতাব লেখা হয়েছে যে, একটা মানুষ দশ বছরেও সেগুলো পড়ে শেষ করতে পারবে না। এবং নতুন নতুন বই লেখা হচ্ছে। এর বুঝি শেষ নেই। তাই বোধহয় এটাকে দীর্ঘতম দিবসও বলা হয়, যদ্যপি জ্যোতিষ অনুযায়ী এটি দীর্ঘতম দিবস নয়।
ফিল্মও হয়েছে। তারই বদৌলত যাদের যুদ্ধ বাবদে কৌতূহল সীমাবদ্ধ তাঁরাও অনেকখানি ওয়াকিফহাল হয়ে গিয়েছেন। যদ্যপি ফিল্মটি বড়ই একপেশে ও অসম্পূর্ণ। কিন্তু সুশীল পাঠক তোমাকে অভয় দিচ্ছি, আমি এ কাহিনীর পুনরাবৃত্তি করব না যেসব মহারথীরা এ বিষয়ে বিরাট বিরাট ভুলুম ভুলুম কেতাব লিখেছেন পার্কার শিফার ম ব্লা ফাউনটেন পেন দিয়ে তার সঙ্গে পাল্লা দেবে আমার ভোতা কঞ্চির কলম।
আমার বর্তমান উদ্দেশ্য ভিন্ন।
ওই ১৯৪৪ সালের মার্কিনিংরেজ অভিযানের প্রায় দেড়-দুই বৎসর পূর্বের থেকেই সারা ইয়োরোপময়–এমনকি প্রাচ্যে– জল্পনা-কল্পনা হচ্ছিল ওরা জনিকে হুড়ো দেবার জন্য ইংলিশ চ্যানেল ক্রস করে জর্মন নির্মিত আটলানটিক উয়োলে হানা দেবে কবে, কোন জায়গায় এই জল্পনা-কল্পনা সর্বাপেক্ষা উল্কণ্ঠ আকণ্ঠ আগ্রহে, আশা-নিরাশার দোদুল্যমান ইয়োরোপের সর্বত্র লুক্কায়িত কিংবা কনসানট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি ইহুদিরাই ছিল প্রধানতম।
আন ফ্রাঙ্ক তার ডাইরিতে মার্চ মাসে অর্থাৎ ডি ডের তিন মাস পূর্বে লিখছে :সেটা ছিল রবিবার, রাত্রি নটা। উইনস্টন চার্চিল সেদিন বেতার বক্তৃতা দিয়েছিলেন সে বক্তৃতার মধ্যে সত্যিকারের আশার আলো দেখতে পেয়েছিলাম। তার মধ্যে মিথ্যা বাগাড়ম্বর ছিল না–ছিল হিটলার-নিপীড়িত অগণিত নরনারীর প্রতি অশ্বাসের বাণী। সেই সময়টা মনে হয়েছিল যে আমাদের এই গোপন-আবাসে আমরা অসহায় ও নিঃসঙ্গ নই। এক বিশাল দুনিয়া জুড়ে আমাদের উদ্ধার করার জন্য তোড়জোড় চলছে।
কিন্তু আন্ সরলা হলেও এ বাবদে রীতিমতো বুদ্ধিমতী। ওই গোপন আবাসে যে আটটি প্রাণী প্রতিদিন জল্পনা-কল্পনা করছে তার নীর সরিয়ে ক্ষীরটুকু সযত্নে সংগ্রহ করে তার ডাইরিতে লিখে রাখছে, এদের ভিতর বয়সে যে সবচেয়ে ছোট, সেই আন্। আর খাসা রসিয়ে রসিয়ে
একজন হয়তো বলল, কয়েকদিনের মধ্যেই দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলা হবে। ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে আক্রমণ করা কি এতই সোজা! আবার একজন বলল, একবার ফ্রান্সে নামতে পারলে, এক মাসের মধ্যে বার্লিন পৌঁছে যাবে। আর একজন রণবিশারদ বলে উঠলেন, এক বৎসরের কম কিছুতেই বার্লিন পৌঁছতে পারবে না। আন্ এর অভিমত দিয়ে এ অনুচ্ছেদ শেষ করেছে। এবং এর কথা আখেরে ফলেছিল। ডি ডে হয় ৬ জুন; তার এগারো মাস পরে ৮ মে জমনি বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করে। যাহা বাহান্ন, তাহা তিপ্পান্ন, ইংরেজিতে নাকি সিসেস্ অ্যান্ড সেনে, ফারসিতে শশ (ষষ্ঠ) ও পন্জ (পঞ্চ) বলে– অবশ্য অল্প ভিন্নার্থে। মোদ্দা : এগারো মাস যা, বারো মাস তা।
কিন্তু এইমাত্র বলেছি, আন্ সুচতুরা বালা।
কারণ যদ্যপি সে বলেছে, এক বিশাল দুনিয়া জুড়ে আমাদের উদ্ধার করবার জন্য তোড়জোড় চলেছে, তথাপি যে অন্তরে অন্তরে জানে মার্কিনিংরেজ বাবুরা নিছক খয়রাতি কর্ম করার জন্য, দুহাতে চ্যারিটেবল হসপিটাল ছড়াতে ছড়াতে ডি ডেতে ফ্রান্সে নামবেন না। তাই এই দিবসের এক মাস পূর্বে লিখছে, আমাদের এখানে সকলেই এখন আশা করছে যে, মিত্রপক্ষের (অর্থাৎ মার্কিনিংরেজ) অভিযান খুব তাড়াতাড়ি আরম্ভ হবে; কারণ রাশিয়া সমস্ত ইউরোপ দখল করে নেবে, এ তারা কিছুতেই হতে দেবে না।
অতিশয় হক কথা। আন্ এই বয়সেই বাবুদের সচ্চরিত্রের কিছুটা চিনে গিয়েছে, নিছক ঈশ্বরপ্রসাদাৎ! আমরা ইংরেজকে বিলক্ষণ চিনি, চোখের জলে নাকের জলে হাড়ে হাড়ে।
কিন্তু মুক্তি পাবার আশা উষ্ঠা উত্তেজনার মাঝখানেও দেখুন, এই কুমারীটি কীরকম শান্তভাবে উভয় পক্ষের দায়িত্ব ওজন করে দেখছে। ডি ডের ঠিক এক পক্ষ পূর্বে সে লিখছে : ..আশা এবং উষ্ঠা চরমে পৌঁছে গেছে। কেন এখনও আক্রমণ হচ্ছে না, ইংরেজরা কেন এত দেরি করছে, তারা কি কেবল তাদের নিজের দেশের জন্য লড়ছে, হল্যান্ডের প্রতি কি তাদের কোনও দায়িত্ব নেই। কিন্তু ইংরেজদের আমাদের প্রতি কীই-বা দায়িত্ব আছে। আমরা আমাদের নিজেদের মুক্তির জন্য কতটুকু চেষ্টা করেছি। জর্মন অধিকৃত দেশগুলোর মধ্যে কবার কটা বিদ্রোহ হয়েছে। নিজের মুক্তি নিজেরই অর্জন করতে হয়– অন্য দেশের কী মাথাব্যথা পড়েছে যে, কেবলমাত্র আমাদের উদ্ধার করার জন্যে সৈন্যসামন্ত পাঠাবে আক্রমণ একদিন হবেই, কিন্তু তা আমরা চাইছি বলে নয়, ইংরেজ এবং আমেরিকার নিজেদের স্বার্থে।
এই চরম দ্বন্দ্বের মাঝখানে মেয়েটির ভগবানে বিশ্বাস, অন্তিমে সত্যের সর্বজয় সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ প্রত্যয় এবং সর্বোপরি তমসাচ্ছন্ন পাশ্চাত্যে নবীন উষার উদয়, নবীন জীবনের অত্যুদয় সম্বন্ধে এ বালাটির পরিপূর্ণ আশাবাদ– তার পরিচয় আমার এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে কিছুতেই প্রকাশ পাবে না।
তবু মাঝে মাঝে মেয়েটি কিন্তু ভেঙে পড়ত।
একদিন লিখছে, প্রিয় কিটি, এক নিদারুণ হতাশা এবং অবসাদ আমায় আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এখন মনে হচ্ছে যে এ যুদ্ধ বুঝি আর কখনও শেষ হবে না। যুদ্ধ মিটে যাওয়া যেন বহু দূরের রূপকথার রাজ্যের ব্যাপার বলে এখন মনে হচ্ছে। তার দেড় মাস পরে বলছে, আবার আমার অবস্থা ভেঙে পড়বার মতো হয়েছে। এই গোপন আবাসে এখন সবই বিষাদময়।… হয় মুক্তি, নয় মৃত্যু–দুটোর যে কোনও একটা তাড়াতাড়ি ঘটুক। ভগবান এই আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা থেকে আমাদের রেহাই দাও।
—তোমারই আন
কিন্তু এর মাত্র এগার দিন পরেই–
কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ,
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ
তাতা থৈথৈ তাতা তৈথৈ তাতা থৈথৈ।
মঙ্গলবার, ৬ জুন, ১৯৪৪ (অর্থাৎ ডি ডে–লেখক)
প্রিয় কিটি,
আজ একটি অবিস্মরণীয় দিন। অবশেষে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলা হল। ফরাসি উপকূলের বিভিন্ন জায়গায় মিত্রপক্ষের সৈন্যদল অবতরণ করছে।…
জর্মনির খবরেও স্বীকার করা হয়েছে যে, ফরাসি উপকূলে ব্রিটিশ প্যারাশুট বাহিনী অবতরণ করেছে।…
আমাদের গোপন আবাস চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সেই বহু প্রতীক্ষিত মুক্তি যা এতদিন আমাদের কাছে ছিল সুদূর স্বপ্নরাজ্যের কাহিনীর মতো, তা কি সত্যিই আমাদের কাছে এল? সত্যিই কি ১৯৪৪ সালের মধ্যে বিজয়লাভ করব?
হতাশার অন্ধকার ছিন্ন করে আবার আশার আলোক জেগেছে।
কিন্তু পাঠক, এর পর দিনের পর দিন, মিত্রশক্তি যেমন যেমন ফ্রান্স জয় করে এগিয়ে আসতে লাগল, আর আন্ সোল্লাসে তার ডাইরিতে সেগুলো লিপিবদ্ধ করল তার উদ্ধৃতি আমি দেব না। আপনারা ডাইরিখানা পড়ে দেখবেন। সে প্রতিদিন আশা করছে মিত্রশক্তি হল্যান্ড জয় করে তাদের মুক্তিদান করবে। এবং এইটুকু বলব, এ যুদ্ধের শেষাঙ্ক সম্বন্ধে যেসব বই লেখা হয়েছে তার মধ্যে আন্ ফ্রাঙ্কের ডাইরি সর্বপ্রথম সর্বপ্রধান পর্যায়ে পড়ে।
কিন্তু হায়! হায়! শেষরক্ষা হল না।
২১ জুলাই আন বেতারে শুনল, হিটলারকে হত্যা করবার চেষ্টা করা হয়েছিল, আর হিটলার হন্যে হয়ে দোষী-নির্দোষী হাজার হাজার জনকে ফাঁসি দিচ্ছেন। আন্ লিখছে, এইরকম করে হতভাগারা যদি নিজেরা মারামারি করে মরে, তা হলে ইংরেজ-আমেরিকা আর রুশদের কাজটা খুব সহজ হয়ে যায়। আমাকে কি বড় খুশি মনে হচ্ছে সত্যি, আমি যে আনন্দ চেপে রাখতে পারছি না। কেবলই মনে হচ্ছে এই অক্টোবর মাসেই আবার আমার পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে।
একে তুমি আকাশ-কুসুম কল্পনা বলছ? বার্লিনের দিকে ধাবমান সৈন্যদের পদধ্বনি বলছে, না এ আকাশ-কুসুম নয়। এ সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
কিন্তু হায়, পাড়ে এসে ভরাডুবি হল। এর কয়েকদিন পরেই জর্মন পুলিশ আন্দের গুপ্তাবাস আবিষ্কার করে সবাইকে গ্রেফতার করে কনসানট্রেশন ক্যাম্পে পাঠাল। তার পর কী হয়েছিল সেটা, কঠোর পাঠক, দয়া করে আমাকে পুনরাবৃত্তি করার হুকুম দিও না।
আন্ ফ্রাঙ্ক সম্বন্ধে আমার হয়তো আরও অধিক কিছু লেখাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। কারণ ইতোমধ্যেই হাতে-কলমে সপ্রমাণ হয়ে গিয়েছে যে, একাধিক দরদী পাঠক-পাঠিকার দৃষ্টি আন্-এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ বাবদে আমার মতো নগণ্য লেখক একজন প্রখ্যাত বাঙালি লেখকের সহৃদয় একখানি চিঠি পেয়েছে। তিনি লিখেছেন :
সম্প্রতি এর্নাকুলাম থেকে একটি মহিলা (ইনি আমার –এর মালায়ালাম অনুবাদ প্রকাশ করেছেন) জানতে চেয়েছেন–আন্ ফ্রাঙ্কের লেখা The Diary of a Young Girl বইখানার বাংলা অনুবাদ কে করেছেন, তার ঠিকানা কী এবং প্রকাশক কারা। এখানে বসে কী করে খবরটা সগ্রহ করা যায় যখন ভাবছি, দেশ পত্রিকার বর্তমান সংখ্যায় আপনার পঞ্চতন্ত্রে এ বিষয়ে অনুবাদকের নাম পেয়ে গেলাম। এদের ঠিকানা কি আপনি জানেন? ইত্যাদি।
আন্ সম্বন্ধে যখন সেই সুদূর কেরালায়ও এতখানি কৌতূহল রয়েছে তখন আমার পক্ষে হয়তো এ নিয়ে আর অত্যধিক বাগৃবিন্যাস করা উচিত হবে না। কিন্তু মাঝে মাঝে কোনও কোনও কাঁচা লেখক একটি বিষয়েই এমনি মজে যান যে, সে দ থেকে আর সহজে বেরুতে পারেন না। আমার হয়েছে তাই। কিংবা বলতে পারেন, একে তো ছিল নাচপাগলী বুড়ি, তার ওপর পেল মৃদঙ্গের তাল। কিংবা তারও বাড়া :
কী কল পাতাইছ তুমি
বিনা বাইদ্দে (বাদ্যে) মাছি আমি!!
অতএব বন্দাশীল পাঠকের সামনে আন্-এর আরও একটু সামান্য পরিচয় নিবেদন করি।
আন্-এর রসিকতাবোধ ছিল অসাধারণ। তার তেরো বৎসর বয়সে ক্লাস টিচার আদেশ দিয়েছেন বাঁচালতা সম্বন্ধে রচনা লিখতে। আন-এর বাঁচালতার শাস্তিস্বরূপ।
ফাউন্টেন পেনের ডগা কামড়াতে কামড়াতে ভাবতে লাগলাম–কী লেখা যায়। হঠাৎ আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল, বরাদ্দ তিন পাতা লিখে ফেলে আমি নিশ্চিন্ত বোধ করলুম। আমার যুক্তি হল, বক বক করা নারীজাতির বৈশিষ্ট্য। যদিও বাঁচালতাকে সংযত করার চেষ্টা করা উচিত, তবুও এই দোষ থেকে আমার একেবারে মুক্ত হওয়া উচিত হবে না, কারণ আমার মা, আমারই মতো এবং সময় সময় আমার চেয়েও বেশি কথা বলেন। সুতরাং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত স্বভাবধর্ম কী করে ত্যাগ করতে পারি আমার যুক্তি শুনে মি. কেল্টরকে (শিক্ষককে) হাসতে হল।
আমরাও হাসছি। কিন্তু আন্-এর শেষ দুর্গতির কথা স্মরণে আছে বলে চোখের জলের ফাঁকে ফাঁকে। সেই প্রাচীন দিনের এক হতভাগ্যের গান,
I am dancing with tears in my eyes.
সবেমাত্র চৌদ্দ বছর পূর্ণ হওয়ার সময় আন্ তাদেরই সঙ্গে লুক্কায়িত একটি ইহুদি ছোকরার প্রেমে পড়ে। তখন লিখছে– আমি কেটে-হেঁটে সংক্ষেপে উদ্ধৃত করছি।
রবিবার, ১৬ এপ্রিল ১৯৪৪
প্রিয় কিটি,
কালকের দিনটা আমার জীবনের এক স্মরণীয় দিন। প্রথম চুম্বন। প্রত্যেক মেয়ের জীবনেই এক স্মরণীয় ঘটনা এবং সেই জন্যেই কালকের দিনটা আমার চিরকাল মনে থাকবে। কাল সন্ধ্যাবেলা পিটারের ঘরে আমরা দুজনা চৌকির উপর বসে ছিলাম। খানিকক্ষণ পরে ও আমার কাঁধের উপর হাত রাখল। আমিও ওর কোমর জড়িয়ে ধরলাম। ও তখন আমাকে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল। এর আগেও আমরা অনেকবার এইরকম পরস্পরকে জড়িয়ে বসেছি, কিন্তু এবার আমার সান্নিধ্য অনেক নিবিড় ও উষ্ণ। আমার বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছিল।… ওই সময় আমার যে কী আনন্দ হচ্ছিল, তা লিখে বোঝাতে পারব না… তার পরের মুহূর্তগুলো আমার ঠিক মনে নেই। নিচের দিকে যাবার জন্য যখন পা বাড়িয়েছি, ও তখন হঠাৎ আমায় চেপে ধরে আমার কপাল, গালে, গলায় এবং বুকে বার বার চুমু খেতে লাগল। আমি কোনওরকমে ওর হাত ছাড়িয়ে ছুটে নিচে পালিয়ে এলাম।
আজকে আবার ওই মুহূর্তগুলোর জন্য প্রতীক্ষা করছি।
–তোমারই আন।
ছেলেটির বয়স তখন মাত্র সাড়ে সতেরো। মনে হচ্ছে, এটি নিষ্পাপ কিশোর-কিশোরীর প্রথম প্রণয়।
এর পূর্বে আন অতিশয় সরলতার সঙ্গে বর্ণনা করেছে তার দেহের বহির্ভাগে বিস্ময়কর যা ঘটেছে, কিন্তু বলছে; দেহের অভ্যন্তরে যা ঘটেছে তা আরও রহস্যঘন বিস্ময়। ইতোমধ্যে আমি তিনবার ঋতুমতী হয়েছি।…এখন আমার মনের মধ্যে অদ্ভুত সব কামনা জাগছে। কোনও কোনও দিন রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে নিজের স্তনদুটোকে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে আমার ভীষণ ইচ্ছে হয়। এ বক্ষের ছন্দোময় স্পন্দন শোনবার জন্য আমি কান পেতে থাকি।…।
এস্থলে উদ্ধৃতিটি অসম্পূর্ণ রেখে বলি, ধন্য ধন্য কবীন্দ্র রবীন্দ্র। তিনি কী করে জানলেন বালিকা যখন কিশোরী হয় তখন তার দেহানুভূতি হৃদয়ানুভূতি!
ওগো তুমি পঞ্চদশী,
পৌঁছিলে পূর্ণিমাতে।
মৃদুশ্রিত স্বপ্নের আভাস তব বিহ্বল রাতে।
ক্বচিৎ জাগরিত বিহঙ্গকাকলী
তব নবযৌবনে উঠিছে আকুলি ক্ষণে ক্ষণে।
প্রথম আষাঢ়ের কেতকীসৌরত তব নিদ্রাতে।
যেন অরণ্যমর্মর
গুঞ্জরি উঠে তব বক্ষে থরথর।
অকারণ বেদনার ছায়া ঘনায় মনের দিগন্তে,
ছলো ছলো জল এনে দেয় তব নয়নপাতে।
এই যে যেন অরণ্যমর্মর গুঞ্জরি উঠে তব বক্ষে থরথর ঠিক সেই অনুভূতিই তো আন্ প্রকাশ করছে যখন সে বলছে এ বক্ষের ছন্দোময় স্পন্দন শোনবার জন্য আমি কান পেতে থাকি।
ততোধিক আশ্চর্য, ঠিক ওই সময়েই প্রেমবোধের সঙ্গে সঙ্গে তার ধর্মবোধও জাগ্রত হয়েছে। তার দয়িত পিটারের কথা ভাবতে ভাবতে বলছে,
এর ওপর আরও বিপদ, ও ধর্ম ও ভগবান মানে। ধর্ম মানুষের এক বিরাট অবলম্বন স্বর্গীয় বিধানের ওপর কজন লোক পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখতে পারে
(রবীন্দ্রনাথের আমার গুরুর আসন কাছে/ সুবোধ ছেলে কজন আছে?–লেখক) কিন্তু যারা পারে, তারা সত্যিই সুখী। আর নিজের বিবেক যখন ধর্মের বিধানের সঙ্গে যোগ খেয়ে যায় তখন যে শক্তি ও আনন্দ পাওয়া যায়, তার তুলনা নেই।
এ অধম যুক্তিত। ধর্মের বিধানের সঙ্গে যে প্রায়ই বিবেকের দ্বন্দ্ব লাগে সেটা সে ওই অতি অল্প বয়সে হৃদয়ঙ্গম করল কী করে!
.
বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে ইয়োরোপীয় ইহুদিদের অন্যতম কেন্দ্রভূমি ছিল রাইন নদীর পারের ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর। এরই এক পরিবারে আন্ ফ্রাঙ্কের জন্ম ১২ জুন, ১৯২৯-এ(১)। ১৯৩৩-এ হিটলার গদিনশীন হলে পর আ-এর পিতা সপরিবার হল্যান্ডের আমসটের্ডাম চলে যান। (আইনস্টাইনও ওই বছরে আমেরিকা যান)।
স্বয়ং আন লিখছেন (তখন তার বয়স তেরো : আমাদের অন্যান্য আত্মীয় স্বজন, যারা জর্মনিতে রয়ে গেছেন তারা নাসিদের হাতে নানাভাবে লাঞ্ছিত হতে লাগলেন। তখন আমার দু-মামা আমেরিকায় পালিয়ে গেলেন। তাদের জন্য আমরা সর্বদাই উদ্বিগ্ন থাকতাম। ১৯৩৮ সালৈ যখন ইহুদিদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা লাগানো রু হল, তখন আমার বুড়ি দিদিমা আমাদের কাছে চলে এলেন। তাঁর বয়স ৭৩।
১৯৪০-এর মে মাস থেকে আরম্ভ হল হল্যান্ডবাসী তাবৎ ইহুদিদের বিপর্যয়। হিটলার হল্যান্ড দখল করে এমন সব আইন পাস করলেন যাতে করে ইহুদিদের জীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠল।
হিটলার হল্যান্ড বিজয়ের দুই বত্সর পরও আন্ লিখছেন :
হাজাররকম বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে আমাদের জীবন কাটতে লাগল। আমাদের স্বাধীনতা বলতে কিছুই রইল না। তবুও তখন অবস্থাটা একেবারে অসহ্য হয়নি।
বেচারি আন্- আন্ কেন, কজন ওই ১৯৪২-এ জানত যে হিটলার ১৯৩৯ সালেই মনস্থির করে গোপনে হুকুম দিয়েছেন, নির্যাতন উৎপীড়ন দিয়ে আরম্ভ করে শেষটায় ইহুদিদের সবংশে ও সমূলে নিধন করতে হবে। বিশেষ করে হল্যান্ড দেশটিতে যেন একটি ইহুদিও জীবন্ত না থাকে।
কিন্তু আন্-এর পিতা বুঝতে পেরেছিলেন যে দুর্দিন ঘনিয়ে আসছে। ৫ জুলাই ১৯৪২ সালে আন্ লিখেছেন,
একদিন বাবার সঙ্গে পার্কে বেড়াচ্ছিলাম, বাবা হঠাৎ আমাকে বললেন, শোন অন্, এখন যত পারো আনন্দ করে নাও, কেননা খুব তাড়াতাড়ি আমাদের এখান থেকে চলে গিয়ে কোনও নতুন জায়গায় লুকোতে হবে। আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন বাবা, এখান থেকে কোথায় যাব? লুকোতেই-বা হবে কেন? তিনি বললেন, জর্মনরা এসে আমাদের ধরবার আগেই আমরা লুকিয়ে পড়ব। ব্যাপারটা এখনও ভালো করে বুঝতে পারলাম না, কিন্তু একটা অস্পষ্ট বিষাদে মনটা আচ্ছন্ন হয়ে গেল।
এর পাঁচ-সাত দিন পরই ফ্রাঙ্ক পরিবারকে তাদের বাসস্থান ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে শহরের অন্যপ্রান্তে চারতলার পিছনের দিকে গুটিকয়েক কুইরিতে গোপন আশ্রয় নিতে হল। এদের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি ইহুদি পরিবারও আশ্রয় নেয়। সবসুদ্ধ আটটি প্রাণী। প্রায় দুই বৎসর এখানে লুকিয়ে থাকার পর এদের সকলেই ধরা পড়ে। এর পরের কাহিনী অত্যন্ত মর্মন্তুদ।
এই দুই বত্সর ধরে আন তাঁর ডাইরিটি লিখে যান। যখন ডাইরিটিতে লিখতে আরম্ভ করেন তখন তার বয়স তেরো, যখন ধরা পড়েন তখন তার বয়স পনেরো বত্সর। ষোল পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই আন্ জর্মন কনসানট্রেশন ক্যাম্পে টাইফাস জ্বরে অসহ্য যন্ত্রণা ভুগে মারা যান। তার আঠারো বছরের দিদি মারগট (মারগারেট)-এরও টাইফাস হয়েছিল এবং ক্যাম্পের একই কামরায় রোগ-যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে উপরের বাঙ্ক থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান। ওই একই সময়ে এদের মা-ও ক্যাম্পে মারা যান। তখন তার বয়স পঁয়তাল্লিশের মতো। পরিবারের মাত্র একজন, পিতা অটো দৈববলে অবলীলাক্রমে বেঁচে যান।
এই ডাইরিখানার বৈশিষ্ট্য কী?
যুদ্ধশেষে মোটামুটি ১৯৪৯ সালে ডাইরিখানা ডাচ ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৫০ সালে বইখানি জমনে অনূদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইয়োরোপ-আমেরিকাতে প্রচুরতম খ্যাতিলাত করে। কয়েক বছরের ভিতরই বইখানা নূনাধিক ত্রিশ-চল্লিশটি ভাষায় অনূদিত হয়। অনবদ্য বাংলা অনুবাদ করেছেন শ্রীঅরুণ সরকার ও শ্রীঅংকুমার চট্টোপাধ্যায়।
ইতোমধ্যে ডাইরিটি অবলম্বন করে যে নাটকটি রচিত হয়– সেই জর্মন বিশ্বকোষের ভাষায় বিশ্বের সর্বমঞ্চে অভিনীত হয়েছে (য়্যবার ডি বুনেন ড্যার ভেলট)। ফিলজগতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কম, তবে শুনেছি এর ফিল্ম নাকি এদেশেও এসেছিল।
ভাবতে আশ্চর্য বোধহয়, চোদ্দ-পনেরো বছরের মেয়ের লেখা একটি রোজনামচা কী করে এতখানি খ্যাতি অর্জন করল। এ যেন সেই বালকবীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়, এ কী গো বিস্ময়!
বইখানা যতবার পড়ি ততবার মনে হয় এর পাতার পর পাতা তুলে দিয়ে কত না অশ্রুজল পর্যায়ের সমাপ্তি টানি। কিন্তু স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে সেটা সম্ভবপর নয়। তবে আন্-এর কিছুটা ব্যক্তিগত পরিচয় দেবার জন্য অত্যল্প তুলে দিচ্ছি। কিন্তু তার পূর্বে তুলে দিই আন্ কীভাবে রোজনামচা লেখা রু করেন।
শনিবার, ২০ জুন ১৯৪২ (জর্মনি কর্তৃক হল্যান্ড দখলের দুই বৎসর পরে– লেখক)
আমার ডায়েরি লেখার খেয়াল একটু অদ্ভুত। আমার বয়সী কোনও মেয়ে ডাইরি লেখে বলে তো আমি শুনিনি। আর তেরো বছরের মেয়ের মনের কথা জানবার কারই-বা মাথাব্যথা পড়েছে। কিন্তু তবুও আমি লিখছি। আমার মনের গহনে যেসব ভাব রয়েছে, সেগুলোকে আমি প্রকাশ করতে চাই।
একটি প্রবাদ আছে : মানুষের থেকে কাগজ অনেক বেশি সহিষ্ণু। একদিন নিরানন্দ অলিস্যের মধ্যে গালে হাত দিয়ে যখন ভাবছিলাম, কী করে সময় কাটানো যায়, সেই সময় এই কথাটা আমার মনে এল।
এখন আমার সত্যিকারের বন্ধু কেউ নেই।
এর পর আন্ বলছেন তাঁর বাপ, মা, বোন এবং প্রায় ত্রিশজন বন্ধু আছেন। এবং আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ইহুদিরা আসলে প্রাচ্যদেশীয় বলে আমাদেরই মতো শুষ্টিসুখ অনুভব করতে খুবই ভালোবাসে।
তবু আন্ বলেছেন, কিন্তু তবু আমি নিঃসঙ্গ। সুতরাং এই নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্যে আমি এই ডাইরি লিখছি; কিন্তু এই ডাইরি আমি চিঠির আকারে লিখব। আমি এক কাল্পনিক বন্ধু ঠিক করেছি তার নাম কিটি (ইংরেজিতেও কিটি, ক্যারিন –লেখক), আমার এই ডায়েরি কিটিকে লেখা চিঠির আকারে লিপিবদ্ধ হবে।
পাঠকের মনে এস্থলে প্রশ্ন উঠতে পারে, আন্ কি জানতেন তাঁর এ রোজনামচা একদিন প্রকাশিত হবে?
আনকেই বলতে দিন :
বুধবার, ২৯ মার্চ ১৯৪৪
প্রিয় কিটি,
বলকেস্টাইন নামে একজন মন্ত্রী লন্ডন থেকে একদিন বেতার-বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তার বক্তৃতার বিষয় ছিল হল্যান্ডের যুদ্ধের পরিকল্পনা। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বললেন– জর্মন অধিকৃত অঞ্চলের লোকেদের ডায়েরি জোগাড় করতে হবে; তা যদি হয় তা হলে আমার এই ডায়েরির খুব কদর হবে। ভাবতে কী মজাই না লাগছে! বাস্তবিক দশ বছর পরে আমার এই ডাইরি যদি লোক পড়ে (প্রকৃত প্রস্তাবে দশ নয় পাঁচ বছর পরেই বিশ্বজন এই বইখানিকে হৃদয়ে টেনে নিয়ে তার প্রভূততম কদর দিয়েছে লেখক) তা হলে আমরা এখানে কী অবস্থায় কাটিয়েছি, তা জেনে তারা অবাক হবে।
এর দেড় মাস পর আন আবার কিটিকে জানাচ্ছেন :
কিন্তু জীবনের চরম লক্ষ্য সাংবাদিক ও বড় লেখিকা হওয়া– সেকথা মুহূর্তের জন্যেও ভুলি না। আমার এই অলীক আশা কোনওদিন সফল হবে কি না, তা ভবিষ্যই জানে। কিন্তু আমার ডাইরি যুদ্ধ শেষ হলে আমি ছাপিয়ে বার করব- এ সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত।
–তোমারই আন
বস্তুত লেখিকা হতে হলে যে কটি গুণের প্রয়োজন আন্-এর সবকটিই ছিল, কিন্তু বিধাতা তার জন্য রেখেছিলেন অকালমৃত্যু।
জানি না, আমার দরদী পাঠক এর থেকে কোনও সান্ত্বনা পাবেন কি না। যে আন্-এর মৃত্যুর জন্য হিটলার-হিমলার দায়ী, তাদের দুজনকেই আত্মহত্যা করতে হয় আন্-এর মৃত্যুর দু মাসের মধ্যে।
যে নাৎসি নেতা সাইস-ইনভারট ফ্রাঙ্ক পরিবার গ্রেফতার হওয়ার সময় হল্যান্ডের শাসনকর্তা ছিলেন তিনি প্রধানত হল্যান্ডে কৃত তার কুকীর্তির জন্য নরবের্গ মোকদ্দমার বিচারের পর আন্-এর মৃত্যুর দেড় বৎসর পর ঝোলেন ফাঁসি কাঠে। গেস্তাপো নেতা কাটলেন নারও ওইদিন একই পন্থায় ওপারে যান এবং তার সহকর্মী আইকমানকে ফাঁসি দেয় ইহুদিরা কয়েক বৎসর পরে–জরায়েলে।
———-
১. আন তিন-তিনবার তাঁর ডাইরিতে লিখেছেন তার জন্মদিন ১২ জুন। অথচ প্রামাণিক জর্মন বিশ্বকোষ ড্যারগ্রসে ব্ৰহহাউস (১৯৫৮, অ্যারাসুংসবাট, পৃ. ১৫৭) লিখছেন ১৪ জুন। জর্মন-প্রবাসী কোনও বঙ্গসন্তান যদি অনুসন্ধান করে পাকা খবর জানান তবে উপকৃত হই। তবে কি ইহুদি ক্যালেন্ডারের সঙ্গে চালু ক্যালেন্ডারের কোনও ফেরফার আছে।
মরহুম অধ্যাপক ডক্টর আব্দুল হাই
এ লেখাটি আমাকে লিখতে হবে, এবং আজই লিখতে হবে। অথচ অন্তর্যামী জানেন, এটি লিখতে গিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে আমার অক্ষম লেখনী কতখানি পর্যদস্ত হচ্ছে। ভাবাবেগে আমি এমনই মতিচ্ছন যে অনেক কিছু একসঙ্গে বলতে চাই, এবং শেষ পর্যন্ত কিছুই বলতে পারি না।
সরল পাঠক ভাবে, সাহিত্যিকের ভাবনা কী? ভাষা তার আয়ত্তে, বেদনা হোক, আনন্দ হোক, সে সবকিছুই সহজ সরলতার সঙ্গে প্রকাশ করতে পারে। কথাটা ভুল নয়। কিন্তু এ বিষয়ে মাত্র একটি ব্যত্যয় আছে।
উপস্থিত আমার কথা ভুলে যান। সার্থক সাহিত্যিকদের কথাই বলব।
তার কল্পনারাজ্যে বিচরণ করে যুবক-যুবতীর মধ্যে বিরহ ঘটান, বিধবার একমাত্র শিশুপুত্রের মৃত্যু ঘটান এবং এগুলোর চেয়েও নিদারুণতর ট্র্যাজেডি নির্মাণ করেন। তার পর অতিশয় সহানুভূতিপূর্ণ স্পর্শকাতর হৃদয় দিয়ে বিরহকাতরা যুবতাঁকে, পুত্রহীনা বিধবাকে কখনও যুক্তি, কখনও অনুভূতির মারফতে সান্ত্বনা জানান।
এসব কল্পনারাজ্যের কথা।
কিন্তু যখন সার্ধক সাহিত্যিকের আপন জীবনে নিদারুণ শোক আসে তখন তিনি কী করেন। তখন তার অবস্থা হয় সত্যই শোচনীয়। একটি সামান্য দৃষ্টান্ত দিই। আমার চেয়ে অন্তত কুড়ি বছরের বড় জনৈক যশস্বী লেখক একদিন ঢুকলেন আমার ঘরে কাঁদতে কাঁদতে। আমি কোনওকিছু বলার পূর্বেই তিনি বললেন, ভাই আমার ছোট মেয়ে মাধবী কাল বিধবা হয়েছে। লক্ষ্ণৌ থেকে টেলিগ্রাম এসেছে। তুমি ভাই, আমার হয়ে একটা চিঠি লিখে দাও। আমি কী লিখব কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি নে।
সেইদিনই আমি প্রথম বুঝতে পারলুম, ব্যক্তিগত বেদনায় সাহিত্যিক কী নিদারুণ অসহায়। অপরের বেদনা সে দূর থেকে দেখে কিছুদিন ধরে সেটাকে মনের ভিতর থিতোয় এবং বেশ কিছুদিন পর সেটাকে সাহিত্যরূপে প্রকাশ করে। কিন্তু নিজের বেলায় হায়, সে অসহায়। এবং সাধারণ অসাহিত্যিক জনের চেয়েও সে নিরুপায়। সাধারণ
অসাহিত্যিক-জন তখন বিধবা কন্যাকে সাদামাটা চিঠি লিখে সান্ত্বনা জানায়। মেয়েও সে চিঠি বুকে চেপে কাঁদে, সান্ত্বনা পায়।
কিন্তু সার্থক সাহিত্যিক? সে তো অনেক বেশি স্পর্শকাতর। এরকম সাদামাটা চিঠি সে তো লিখতে পারে না। তার তো সে অভ্যাস নেই।
সার্থক যশস্বী সাহিত্য-নির্মাতার যদি এই বিপাক হয়, তবে আমার মতো অতিশয় সাধারণ লেখকের কথা চিন্তা করুন।
আমি যে কী মতিচ্ছন্ন সেটি রচনারম্ভেই নিবেদন করেছি।
ভোরবেলা আমার এক চেলা ঘরে ঢুকল, আনন্দবাজার হাতে নিয়ে প্রায়ই আসে। আপন মনে খবরের কাগজ পড়ে।
আজ শুধোল, আপনি তো বাঙাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ এবং পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলনের জোর লড়নেওলা অধ্যাপক আব্দুল হাইকে আপনি চিনতেন?
আমি বললুম, চিনতুম মানে? এখনও চিনি। আমার চেয়ে বছর পনরো ছোট। তা হলে কী হয়! লোকটা অসাধারণ পণ্ডিত, এবং সঙ্গে সঙ্গে তার সাহিত্যরসে কী সুন্দর স্পর্শকাতরতা। তদুপরি, তুমি যা বললে, ভাষা আন্দোলনে জোর লড়নেওলা, আমার বন্ধু–
চেলা আমাকে আনন্দবাজার এগিয়ে দিল। তাতে দেখি আব্দুল হাইয়ের ছবি এবং নিচে লেখা :
ঢাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে ডক্টর হাই-এর মৃত্যু।
ভাষা ও ধ্বনিবিদ বলতে শেষ পর্যন্ত বিধাতার কৃপায় বেঁচে রইলেন পণ্ডিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও মৌলানা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। এরা উভয়েই পশ্চিম বাংলার কৃতী সন্তান।
দেশবিভাগের ফলে একজন রইলেন কলকাতায়, অন্যজন ঢাকায়। যেন গঙ্গার একভাগ জল এল ভাগীরথী দিয়ে, অন্য হিস্যার পানি চলে গেল পদ্ম দিয়ে পাকিস্তান। তার পর এই বাইশ বৎসর ধরে বিস্তর পানি জল(১) দুধারা দিয়ে বয়ে গেল।
ইতোমধ্যে শ্ৰীযুত চাটুয্যের ওপর নানাবিধ দায়িত্বপূর্ণ কাজের চাপ পড়ল। বয়সও হয়েছে। কাজেই তার প্রাণে যে কামনা ভাষাতত্ত্বের চর্চা– তার জন্য হাতে সময় থাকে অল্পই। তবে বিশ্বস্ত সূত্রে শুনেছি, শব্দতত্ত্বে জ্ঞানার্থীজনকে তিনি সদাসর্বদা পথনির্দেশ করে দেন। ভরতনাট্যেও বলে, একটা বিশেষ বয়সের পর তুমি আর নৃত্যগীত করবে না, তোমার শিষ্যশিষ্যাদের দেহ দিয়ে তোমার নৃত্যকলা দেখাবে।
ওদিকে, ওপারে ঘটল আরও মর্মন্তুদ ঘটনা। মৌলানা শহীদুল্লাহ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বৎসর দুই পূর্বে আচম্বিতে শয্যা নিলেন(২)– বহু কাজ অসম্পূর্ণ রেখে। গত বৎসর যখন তাকে ঢাকা হাসপাতালে সেলাম দিতে যাই তখন তিনি আমাকে চিনতে পারলেন, অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে– যদ্যপি আমাদের পরিচয় গত অর্ধ শতাব্দী ধরে।
উভয় বাংলাতে আমরা সকলেই আশা করেছিলুম, আব্দুল হাই একদিন শহীদুল্লাহর আসন গ্রহণ করবেন। আমি কোনও সরকারি, বেসরকারি উচ্চপদের কথা ভাবছি না। আমার দৃঢ় প্রত্যয় ছিল একদিন তার গবেষণা আরও বিস্তৃত সুপরিচিত হবে, তার পথনির্দেশ গৌড়জনকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে।
কিস্মৎ কিস্মৎ –সবই কিস্মৎ! একটি সামান্য উদাহরণ দি :
হাই শব্দের অর্থ জীবন্ত প্রাণবন্ত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় জাগ্রত ভগবান। আব্দুল হাই শব্দদ্বয়ের অর্থ ভাই জাগ্রত (জীবন্ত) ভগবানের (অনুগত) দাস।
যিনি তার নামকরণ করেছিলেন তিনি নিশ্চয়ই আশা পোষণ করেছিলেন এ শিশু যেন অতি, অতিশয় দীর্ঘজীবী হয়।
সে চলে গেল পঞ্চাশে। যারা তাকে চিনতেন না, তারা হয়তো ভাবলেন, পঞ্চাশ তো খুব অল্প বয়স নয়। কিন্তু আমার মতো তাকে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ-পরিচয়ে সোনার সৌভাগ্য যাদেরই হয়েছিল তারাই শুধু জানেন পঞ্চাশেও এই লোকটি ছিলেন কী অসাধারণ প্রাণবন্ত (হাই,) বিদ্যাচর্চা রসগ্রহণে সদাজাগ্রত এমনকি মূর্তমান চাঞ্চল্য বললেও অত্যুক্তি হয় না– অবশ্য সদর্থে। এরা সকলেই একবাক্যে বলবেন, আব্দুল হাইয়ের মৃত্যুর মতো অকালমৃত্যু– এ শোক বিধাতা যেন দয়া করে আমাদের অত্যধিক না দেন।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অকালমৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ গভীর শোক প্রকাশ করেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যজীবনে যখন এক নবীন ভুবনে প্রবেশ করেছিলেন তখন তার মৃত্যু হয়। আব্দুল হাই যখন জ্ঞানান্বেষণে এক নতুন জগতের সম্মুখীন তখন তার মৃত্যু হল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের গুরু। আজ শুধু আব্দুল হাইয়ের শুরুই তার সম্বন্ধে সার্থক সর্বাঙ্গসুন্দর প্রশস্তি রচনা করতে পারবেন।
তাঁর শিষ্যসম্প্রদায়, আমি, আমরা শুধু আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করতে পারি।
আব্দুল হাইয়ের চরিত্রের একটিমাত্র বৈশিষ্ট্য আমি এস্থলে নিবেদন করি। তার সঙ্গে পাণ্ডিত্যের বিশেষ কোনও সম্পর্ক নেই বলে হয়তো আব্দুল হাইয়ের চরিত্রের এ মহান্ দিকটা অধিকাংশের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না। অতি সংক্ষেপে নিবেদন করি।
এ বঙ্গে আমাদের চেয়েও বেশি যদি আজ কেউ প্রিয়বিয়োগ-কাতর হয়ে থাকেন তবে তিনি যদিও আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, তবু তার অবস্থার কিছুটা অনুমান করতে পারি– ডক্টর হরেন্দ্রচন্দ্র পাল, এম-এ (ট্রিপল) ডি-লিট (ক্যাল), রিপন, হুগলি মহসিন, কৃষ্ণনগর কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যাপক। তিনি পূর্ববঙ্গের লোক, কিন্তু বহুকাল ধরে এদেশবাসী।
অধুনা তার একখানি অভিধান বাংলা সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দ– ডক্টর আব্দুল হাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রকাশ করেন। পূর্বতন পঞ্চতন্ত্র-এ আমি এ-গ্রন্থের উল্লেখ করেছি। কিন্তু আমার কথা থাক। এ অভিধান প্রকাশ করার সময় আব্দুল হাই একটি ক্ষুদ্র ভূমিকা লেখেন। তার থেকে আমি কয়েকটি ছত্র তুলে দিচ্ছি।
হাই সাহেব ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে লিখছেন : কয়েক বছর পূর্বে ডক্টর সুকুমার সেন সাহিত্য পত্রিকায় (এ পত্রিকাটি অধ্যক্ষ আব্দুল হাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমৃত্যু সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন) প্রকাশের জন্য ডক্টর হরেন্দ্রচন্দ্র পালের বাংলা সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দ সঙ্কলন নামে একটি প্রবন্ধ আমাকে পাঠিয়ে দেন। ডক্টর পালের এ প্রবন্ধটি আমি ১৯৬৮ সালের শীত সংখ্যা সাহিত্য পত্রিকায় সানন্দে প্রকাশ করি এবং যতদূর সম্ভব বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে অভিধান আকারে এ কাজটি সম্পন্ন করার জন্য তাকে অনুরোধ জানাই।
ডক্টর পাল পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী। তাঁর শিক্ষাদীক্ষা পূর্ব পাকিস্তানে। এ কারণে পূর্ব পাকিস্তানে তার কর্মক্ষেত্র হওয়া উচিত ছিল কিন্তু অদৃষ্টচক্রে তিনি সীমান্তপারে বসবাস করছেন।(৩) তা হলেও তিনি মুসলিম জীবন ও সংস্কৃতিমূলক সাধনাতেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। মধ্যযুগ থেকে এ কাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার দেখিয়ে এ বিরাট সংকলন গ্রন্থটি প্রণয়ন করে ডক্টর পাল বাংলা-ভাষী সকলকে এবং বিশেষভাবে বাঙালি মুসলমান সমাজকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পক্ষ থেকে প্রথমে সাহিত্য পত্রিকায় ও পরে পুস্তকাকারে তার এ মূল্যবান গবেষণামূলক সংকলন গ্রন্থটি প্রকাশ করে বাঙালি সুধী সমাজের হাতে তুলে দিতে পেরে আমি আজ সত্যিই আনন্দিত।
মুহম্মদ আব্দুল হাই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগ
আমি শুধু এইটুকুই নিবেদন করতে পেরেছিলুম, পণ্ডিত আব্দুল হাই নিজে, তত জ্ঞানচর্চা করেছেনই, কিন্তু তার চেয়েও ঢের ঢের বেশি উৎসাহ দিয়েছেন অন্যজনকে শুধু পূর্ববঙ্গে নয়, এ বঙ্গেও।
আর, আজ যেসব যুবক জ্ঞানচর্চা গবেষণা করতে গিয়ে নানাবিধ অন্যায় অসত্য, মনুষ্যকৃত স্বার্থপ্রণোদিত নীচ-হীন প্রতিবন্ধকের সম্মুখে পদে পদে বিড়ম্বিত হচ্ছে তারা অন্তত এই ব্যত্যয়টি, উৎসাহদাতা আব্দুল হাইয়ের এই চরিত্রমূল্যটি মজ্জায় মজ্জায় অনুভব করবে। আমেন।
———–
১. জলপানি বললুম না, তার অর্থ ভিন্ন। বস্তুত আমি পানি শব্দের দুশমন নই। অতি অবশ্যই আমি জল-পাঁড়ে নামক কাল্পনিক সমাস ব্যবহার করব না। পক্ষান্তরে জজমের জল না বলে জমজমের পানি বলাই ভালো। গঙ্গা পানি কানে খারাপ শোনায়। কিন্তু সেও না হয় সয়ে নিলুম। মুশকিল হবে জলপানি নিয়ে। কেউ জলপানি পেলে সে কি পানি-পানি পায়? যদিও সে খুশিতে পানি পানি হতে পারে, তার জান ত-নৃ– হতে পারে।
২. তবে ইনি এখনও সম্পূর্ণ অচল নন। এবং তাঁর গুণগ্রাহী তথা শিষ্যজনকে সানন্দে জানাই তার তত্ত্বাবধানের ভার নিয়েছেন একটি তরুণ ডাক্তার চট্টগ্রামের চিরঞ্জীব বড়ুয়া। মানুষ বুঝি পিতাকেও অতখানি সেবা করে না।
৩. আব্দুল হাই মুর্শিদাবাদের লোক। অদৃষ্টচক্রে তাকেও সীমান্তপারে বসবাস করতে হল। তাই সমদুখীজনব্যথিতবেদন অনুভব করার মতো অভিজ্ঞতা ও স্পর্শকাতরতা ছিল। তার আপন দুঃখ তিনি ডক্টর পালের মারফত প্রকাশ করেছেন।
মাভৈঃ
বাঙালি সবদিক দিয়েই পিছিয়ে যাচ্ছে, এরকম একটা কথা প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়। কথাটা ঠিক কি না, হলপ খেয়ে বলা কঠিন, কারণ দেশ-বিভাগের ফলে তার যে খানিকটে শক্তিক্ষয় হয়েছে সে বিষয়ে তো কোনও সন্দেহই থাকতে পারে না। পার্লামেন্টে যদি আপনার সদস্যসংখ্যা কমে যায় তবে সবকিছুই কাটতে হয় ধার দিয়ে ভার দিয়ে কাটার সুযোগ আর মোটেই জোটে না।
দিল্লিতে থাকাকালীন আমি একটি বিষয় নিয়ে কিঞ্চিৎ চিন্তা করেছিলুম। কেন্দ্রে অর্থাৎ ইউপিএসসি-তে বাঙালি যথেষ্ট চাকরি পাচ্ছে কি না? ওই অনুষ্ঠানের সদস্য না হয়েও যারা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের বিশ্বাস, বাঙালির এতে যতখানি কৃতকার্য হওয়া উচিত ততখানি সে হচ্ছে না। একদা বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমাকেও সেখানে ডাকা হয়েছিল; আমি তখন চোখকান খোলা এবং খাড়া রেখে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করেছিলুম।
দিল্লিতে এখন যারা বসবাস করেন তারা বিলিতি কিংবা বিলিতি-ঘেঁষা পোশাক পরেন, ছুরিকাটা দিয়ে খাওয়া প্রচুর বাড়িতে চালু হয়েছে, ইংরেজি আদব-কায়দা, বিশেষ করে, ইংরেজি এটিকেট এদের কাছে আর সম্পূর্ণ অজানা নয়।
ইউপিএসসি-র তাবৎ মেম্বারই সায়েবিয়ানা পছন্দ করেন, একথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু যেখানে যে আবহাওয়া বিদ্যমান, মানুষ ইচ্ছা-অনিচ্ছায় তার থেকেই প্রাণবায়ু গ্রহণ করে। তাই যদি বাঙালি ছেলের পোশাক ছিমছাম না হয়, চেয়ার টেনে বসার সময় সে যদি শব্দ করে, মোকামাফিক গার্ডন, থ্যা না বলতে পারে এবং সর্বক্ষণ ঘন ঘন পা দোলায় তবে সদসারা আপন অজানতেই যে তার প্রতি কিঞ্চিৎ বিমুখ হয়ে ওঠেন সেটা কিছু আশ্চর্যজনক বস্তু নয়।
কিন্তু আসল বিপদ অন্যত্র। বাঙালি উমেদার ইংরেজিতে ভাব প্রকাশ করতে পারে না। পাঞ্জাবি, হিন্দিভাষী কিংবা মারাঠি যে ইংরেজি বলে সেটা কিছু আ-মরি আ-মরি করবার মতো নয়। বিশেষত পাঞ্জাবি, হিন্দিভাষী ও সিন্ধিদের ইংরেজিজ্ঞান শিলিং-শকার ও পেনি-হরার থেকেই আহরিত। তা হোক, কিন্তু ওইসব বুঝে না-বুঝেই যারা বেশি পড়ে তাদের কথা বলার অভ্যাস হয়ে যায় বেশি, অন্তত থ্যাঙ্কু, পার্ডন, আই এম এফ্রেড তারা তাগমাফিক লাগিয়ে দিতে কসুর করে না।
এস্থলে ইতিহাসের দিকে একনজর তাকাতে হয়।
মুসলমান আগমনের পর থেকে ১৮৪০-৪২ পর্যন্ত বাঙলা দেশের ব্রাহ্মণ তথা বৈদ্য সম্প্রদায়ের বিস্তর লোক সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা করেন এবং মুসলমান ও কায়স্থরা ফারসি (এবং কিঞ্চিৎ আরবির) চর্চা করেন। এদেশের বড় বড় সরকারি চাকরি, যেমন সরকার (চিফ সেক্রেটারি), কানুনগো (লিগেল রিমেমব্রেন্সার), বখুশি (একাউন্টেন্ট জেনারেল পে মাস্টার) অর্থাৎ এডমিনস্ট্রেটিভ তাবৎ ডাঙর ডাঙর নোকরিই করেন কায়স্থরা। ইংরেজের আদেশে এঁরাই কলকাতাতে প্রথম ইংরেজি শিখতে আরম্ভ করেন। বস্তুত ফারসি তাঁদের মাতৃভাষা ছিল না বলে তারা সেটা অনায়াসে ত্যাগ করে ইংরেজি আরম্ভ করে দিয়েছিলেন এবং ফলে হাইকোর্টটি তাদের হাতে চলে যায়। ব্রাহ্মণরা আসেন পরে; তাই তারা পেলেন বিশ্ববিদ্যালয়। মুসলমান আসেন সর্বশেষে, তাদের কপালে কিছুই জোটেনি।
তা সে যাই হোক, আমরা বাঙালি প্রথমেই সাততাড়াতাড়ি ইংরেজি শিখেছিলুম বলে বেহার, উড়িষ্যা, যুক্তপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এস্তক সিন্ধুদেশ পর্যন্ত আমরা ছড়িয়ে পড়ি।
এর পর অন্যান্য প্রদেশেও বিস্তর লোক ইংরেজি শিখতে আরম্ভ করেন এবং ক্রমে ক্রমে আমাদের চাহিদা ও কদর কমতে লাগল, এসব কথা সকলেই জানেন, কিন্তু এর সঙ্গে আরেকটি তত্ত্ব বিশেষভাবে বিজড়িত এবং সেই তত্ত্বটির প্রতি আমি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
যে দুটি জাতীয় সঙ্গীত ভারতের সর্বত্র সম্মানিত সে দুটিই বাঙলা দেশেই রচিত হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রাম সর্বপ্রথম আরম্ভ হয় বাঙলা দেশেই। এটা কিছু আকস্মিক যোগাযোগ নয়। এর কারণ বাঙালি আপন দেশ ভালোবাসে এবং সে বিদ্রোহী।(১) দেশকে ভালোবাসলে মানুষ তার ভাষাকেও ভালোবাসতে শেখে।
আশ্চর্য, ইংরেজি ভালো করে আসন জমাবার পূর্বেই বাঙলা দেশে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আরম্ভ হয়। (ঠিক সেইরকমই ফারসি যখন একদা আসন জমাতে যায় তখন কবি সৈয়দ সুলতান আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন,
আল্লায় বলিছে মুই যে-দেশে যে-ভাষ,
সে-দেশে সে-ভাষে করলুম রসুল প্রকাশ।
যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন।
সেই ভাষা তাহার অমূল্য সেই ধন ॥)
এবং আরও আশ্চর্যের বিষয়, সে বিদ্রোহের কাণ্ডারি ছিলেন সে যুগের সবচেয়ে বড় ইংরেজি (ফরাসি, লাতিন, গ্রিক) ভাষার সুপণ্ডিত মাইকেল। কাজেই যদিও সে উইলসেন, কেশবসেন ও ইস্টিসেন এই তিন সেনের কাছে জাত দিয়ে দুরি কাটা ধরতে শিখল (আজ যা দিল্লিতে বড়ই কদর পাচ্ছে) তবু সঙ্গে সঙ্গে ওর বিনাশের চারাকে জল দিয়ে বাঁচাতে আরম্ভ করল। এটাকে বাঙালির স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। এসময় সে গাছেরও খেয়েছে, তলারও কুড়িয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই চোখে পড়ল, বাঙালি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজি বইয়ের আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যেরকম কাতর হয়ে পড়েছিল এবার সে সেরকম হাঁসফাস করল না। স্বরাজ লাভের সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল, বাঙালি ইংরেজি ভাষা, আচার-ব্যবহার, কায়দা-কেতা থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছে এবং ফলে দিল্লিতে আর কল্কে, সরি, সের্ভিয়েট পায় না।
তর্ক করে, দলিল-দস্তাবেজ দিয়ে সপ্রমাণ করতে হলে ভূরি ভূরি লিখতে হবে।
তা না হয় লিখলুম, কিন্তু পড়বে কে? তাই সংক্ষেপে বলি।
পৃথিবীর সভ্যাসভ্য কোনও দেশই বিদেশি ভাষা দিয়ে বেশিদিন কারবার চালায় না। আজকের দিনে তো নয়ই। ফারসি এদেশে ছ-শো বছর ধরে রাষ্ট্রভাষা ছিল– আমরা একে চিরন্তনী ভাষা বলে গ্রহণ করিনি।
তাই হিন্দি, গুজরাতি, মারাঠিওয়ালারাও একদিন ইংরেজি বর্জন করে আপন আপন মাতৃভাষায় কাজ-কারবার করতে গিয়ে দেখবেন, আমরা বাঙালিরা অনেক দূরে এগিয়ে গিয়েছি, মেঘে মেঘে বেলা হয়ে গিয়েছে কারণ আমরা অনেক পূর্বে আরম্ভ করেছিলাম। তখন যখন কেন্দ্রে আপন আপন মাতৃভাষায় পরীক্ষা দিতে হবে তখন আবার আমরা সেই যুগে ফিরে যাব, যখন একমাত্র বাঙালিই ইংরেজি জানত। হিন্দি কখনও ব্যাপকভাবে বাধ্যতামূলক হবে না, আর হলেও বাঙালিকে যেমন মাতৃভাষার ওপর হিন্দিতে পরীক্ষা দিতে হবে, হিন্দিওলাকে হিন্দি ভিন্ন অন্য একটি ভাষায় পরীক্ষা দিতে হবে। অমাতৃভাষা অমাতৃভাষায় কাটাকুটি গিয়ে রইবে বাঙলা বনাম হিন্দি। তাই অবস্থা একই দাঁড়াবে আমরা এগিয়ে যাব।
তাই মাভৈঃ!
———-
১, বিদ্রোহী আমি কথার কথারূপে বলছি না। বস্তুত বাঙালি যে বিদ্রোহী তার ইতিহাস এখনও লেখা হয়নি। (ক) দোয়াবের ব্রাহ্মণ্যধর্ম তাকে অভিভূত করতে পারেনি, ফলে সে সংস্কৃত উচ্চারণ গ্রহণ করেনি, (খ) বৌদ্ধ-জৈনের নিরামিষ সে গ্রহণ করেনি, (গ) মুসলমান আমলে বাঙলা দেশেই সবচেয়ে বেশি লড়াই দিয়েছে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ইত্যাদি বিস্তর বিষয়বস্তু নিয়ে সে ইতিহাস লিখতে হবে।
রহস্য লহরি
২২ সেপ্টেম্বরের হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড কাগজের ক্যালকাটা নোটবুক-এ দীনেন্দ্র কুমার রায় সম্বন্ধে ওই নোটবুকের বিদগ্ধ লেখকের করুণ-মধুর কৃতজ্ঞতাপূর্ণ অনুচ্ছেদটি পড়ে আমি সত্যই ঈষৎ লজ্জায় মাথা নিচু করলুম। ঈষৎ বললুম এই কারণে যে, আমিও স্থির করেছিলাম যে আগস্ট-সেপ্টেম্বর (দীনেন্দ্রকুমারের জন্ম ২০ আগস্ট ১৮৬৯) তার জন্মশতবার্ষিকীতে আমিও তার স্মৃতির উদ্দেশে আমার নগণ্য শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করব। তার পর বার্ধক্যে যা হয়, বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমের জন্মদিন যখন সে ভুলে যায় তখন তরুণ অকরুণ পাঠক তার ক্ষীণ স্মৃতিশক্তির দিকে কটাক্ষ করে তাকে বিড়ম্বিত করবেন না এই তার ক্ষীণতর আশা।
তরুণ পাঠক যদি ২২ সেপ্টেম্বরের ওই হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডটি জোগাড় করতে পারেন তবে তিনি যেন সেই অনুচ্ছেদটি বাংলায় অনুবাদ করে তার ঠাকুর-দিদিমাকে শোনান। আমি কথা দিচ্ছি, তাদের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠবে, ক্ষণতরে তারা আবার কিশোর হয়ে যাবেন, দু-ফোঁটা চোখের জলও ফেলতে পারেন। কারণ পুনরায় বলছি, অনুচ্ছেদটি এ লেখকের চৌদ্দ আনা লেখাতে যা হয় তাই হয়েছে–বড়ই সুন্দর হয়েছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে তাড়াতাড়ি যোগ করছি, আমি লেখক হিসেবে ওঁকে দন্তপূর্ণ সার্টিফিকেট দিচ্ছিনে সামান্য পাঠক হিসেবে আমার দিলরা তারিফ জানাচ্ছি। সে হক সকল পাঠকেরই আছে। আর লেখক হিসেবে বললেই-বা কী? কাগে কাগের মাংস খায় না, এ প্রবাদ জানি। কিন্তু কাগে কাগের মাংস প্রশংসা করে না একথা কখনও শুনিনি।
গুরুজনদের মুখে যা শুনেছি। (বিশেষত মমগ্রজের বাচনিক। কারণ তিনি কুষ্টিয়ার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন) সেসব তত্ত্ব ক্ষীণ স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে বলেছি। ভুল হয়ে যেতে পারে।
দীনেন্দ্রকুমার রায়ের জন্ম কুষ্টিয়ার কাছেই। সেই জায়গাতেই বা তার অতিশয় কাছে জন নেন বা বিরাজ করেন, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্র, সাহিত্যিক জলধর সেন (যাকে শরশ্চন্দ্র বড়দা বলে সম্বোধন করে সম্মান দেখাতেন এবং এ যুগের প্রথম মুসলমান লেখক মুশরফ হোসেন। তাঁর বিখ্যাত পুস্তক বিষাদসিন্ধু এখনও মুসলমানদের– এবং অনেক হিন্দুদের কাছে সুপরিচিত।
তদুপরি ছিলেন কাঙাল হরিনাথ। এঁর শ্যামাসঙ্গীত আমি শুনি বাল্যবয়সে, পদকীর্তন শোনার সময়ে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার বহু পূর্বে। হায়, সে গানের কথাগুলো আমার ঠিক ঠিক মনে নেই। তার বক্তব্য ছিল, কাঙাল (অর্থাৎ হরিনাথ) যদি ছেলের মতো ছেলে ইত তবে তুমি জানতে। কাঙাল জোর করে কোল কেড়ে নিত, তুমি পারতে না মা ছাড়তে। গ্রামোফোন কোম্পানির সে রেকর্ড বোধহয় এখন আর নেই।
এবং এই অঞ্চলেরই মহাত্মা লালন ফকির। তাঁর পরিচয় দেবার মতো প্রগলভতা আমার নেই।
.
.
ওই সময়ে গোপনে গোপনে কেমন যেন একটা দ্বন্দ্ব ছিল নদীয়া জেলায় এবং কলকাতাতে। নদীয়ার লোক তো বলতই, এখনও বলে, তাদের বাংলাভাষা সবচেয়ে শুদ্ধ ও মধুর। ওদিকে রাঢ়ের ঈশ্বরচন্দ্র-বঙ্কিম প্রভৃতি তখন কলকাতাকে কেন্দ্র করে, তারা যে ভাষা জানেন, বলেন, সেই ভাষাকেই বাংলা সাহিত্যের বাহনরূপে প্রবর্তিত করেছেন। তাই এখনও নদীয়া তথা পূর্ববঙ্গের বহু গুণী খেদ করেন যে, মীর মু ফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু যখন প্রকাশিত হল, তখন বঙ্কিমচন্দ্র তার বঙ্গদর্শনে পুস্তকটির পরিপূর্ণ সম্মান দেখাননি।
ওই সময়ে, অর্থাৎ গত শতাব্দীর শেষের দিকে, এ শতাব্দীর গোড়াতে দীনেন্দ্র কুমার তার সামান্য কয়েকটি পল্লিচিত্র (নোটবুকের ভাষায় he wrote sketches of village life in a reminicent mood… Generally he starts with a festival and goes on to describe its impact on the different sections of the village population. His pleasant vignettes-পল্লিচিত্রের জন্যে এই ভিনেং শব্দটি একদম mot juste-born out of acute personal observation, present a microscopic picture of life.) ভারতী পত্রিকাকে পাঠান। তখন সম্পাদিকা ছিলেন খুব সম্ভব সরলা দেবী কিংবা তার মাতা স্বর্ণকুমারী দেবী। এই ভিন্নগুলো সম্পাদিকা সানন্দে লুফে নেন এবং বহু বহু গুণী এগুলোর সর্বোত্তম প্রশংসা করেন। এ যেন হঠাৎ একঝলক গাঁয়ের মিঠে মেঠো হাওয়া নগরে ঢুকে শহরের নিরুদ্ধ-নিম্বাস বাতাসকে মোলায়েম করে দিল। এই চিত্রগুলো ওই সময়ে পুস্তকাকারে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়।
এর পরের ইতিহাস আমি সঠিক কালানুক্রমিক বলতে পারব না। যতদূর মনে আছে তাই নিবেদন করি।
ওই সময়ে শ্রীঅরবিন্দ বরোদার চাকরি নিয়ে বাঙলা দেশে লিখে পাঠান, তাকে বাংলা শেখাবার জন্য যেন একজন উপযুক্ত শিক্ষক পাঠানো হয়। শেষ পর্যন্ত যে দীনেন্দ্রকুমারকেই পাঠানো হয় এর থেকেই আজকের দিনের পাঠক বুঝে যাবেন, সেদিন বাংলা সাহিত্যে তার আসন কতখানি উচ্চ ছিল। এবং হয়তো যাঁরা তাঁকে মনোনীত করেন তারা চেয়েছিলেন শ্রীঅরবিন্দের উচ্চারণটিও যেন খাঁটি নদের মিষ্টি উচ্চারণ হয়।(১)
কিন্তু দীনেন্দ্রকুমার বরোদায় খুব বেশিকাল থাকেননি।
কারণ ইতোমধ্যে বরোদার মহারাজা, শ্রীঅরবিন্দ, অন্যতম বরোদাপ্রধান খাসে রাও যাদব এবং (বোধহয়) দেশপাল্পে মধ্যে কী-সব গুপ্ত মন্ত্রণা হয়, সে সম্বন্ধে আমি সঠিক জানিনে। ফলে শ্রীঅরবিন্দ বরোদা ত্যাগ করে কলকাতায় এসে বিপ্লবী আন্দোলন আরম্ভ করেন। কিন্তু এ ভিন্ন কাহিনী।
দীনেন্দ্রকুমার বাঙলায় ফিরে এলেন।
এর পর তাঁর জীবন-কাহিনী আমার কাছে আরও অস্পষ্ট।
তবে আমার মনে সন্দেহ হয়, একালেও যখন বাঙালি সাহিত্যস্রষ্টা শুধুমাত্র সাহিত্য সৃষ্টি করে দ-উদর-জ্বালা শান্ত করতে পারে না(২), তা হলে ভদ্রলোক বোধহয় খুবই অর্থকষ্টে ছিলেন। তখন ১৯১৫, এরকম সময় দীনেন্দ্রকুমার গত্যন্তর না দেখে ডিটেক্টিভ স্টোরি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করতে আরম্ভ করলেন। তারই নাম রহস্য লহরি। সঠিক অনুবাদ বললে বোধহয় একটু ভুল হয়। যেখানেই সুযোগ পেতেন, সেখানেই কিঞ্চিৎ বঙ্গোপযোগী বাঙালি ধরনধারণ ঢুকিয়ে দিতেন।
এই রহস্য লহরি এদেশে তখন যে উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিল, তার বয়ান আজ দেবে কে সাধুবাদসহ বলি, নোটবুক তার যথাসাধ্য চেষ্টা দিয়েছেন।
কিন্তু এই উন্মাদনার প্রধান কারণ কী?
আমি দৃঢ়প্রত্যয়, সত্যনিশ্চয় যে-ভাষাতে দীনেন্দ্রকুমার তার রহস্য লহরি লিখলেন, ওরকম ঝরঝরে, ছিমছাম সরল স্বচ্ছ শীতের নদীস্রোতের মতো শান্ত প্রবহমান বাংলা ভাষা এই দেড়শো বছরের ভিতর অতি অল্প লোকই লিখেছেন।
তা না হলে বলুন তো, বারো বছরের বাঙাল বালক তার সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা বিলাতের গল্প পড়ে অর্ধমিনী অবধি বিদ্রি অবস্থায় শিহরিত, কস্পিত, রোমাঞ্চিত হয়ে রইল কেন?
ভাষা, ভাষা, ভাষা! ভাষা বহু তিলিসমাং বহু মিরাকল, বহু অলৌকিক কর্ম করতে পারে।
———–
১. বরোদাতে বাঙালি নাম দিয়ে একটি গ্রন্থ লেখা যায়। ঔপন্যাসিক বেদজ্ঞ সুপণ্ডিত রমেশচন্দ্র দত্ত, শ্রীঅরবিন্দ থেকে আরম্ভ করে সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথের নাতি সুপ্রকাশ গাঙ্গুলী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পুত্র বিনয়তোষ ভট্টাচার্য এবং আরও উত্তম উত্তম বাঙালিকে বরোদার মহারাজা সয়াজি রাও কর্ম দেন।… এস্থলে একটি ব্যক্তিগত নিবেদন আমার আছে। আমার প্রতি দরদী পাঠক ভিন্ন অন্যেরা যেন বাকিটুকু না পড়েন। ১৯৩৪-এ আমি যখন কাইরোতে শাস্ত্র অধ্যয়ন করছি তখন ওই সয়াজি রাও আমাকে পাকডুকে বরোদায় নিয়ে এসে একটি অত্যুত্তম কর্ম দেন। মহারাজা একদিন আমাকে রমেশচন্দ্র দত্ত, শ্রীঅরবিন্দের অনেক কাহিনী বলার পর আমি দুঃখ করে বলেছিলুম- Your Highness! I am your latest and worst choice.মহারাজ তখন গুন গুন করে সেকালের একটি song-hit a you are not my fist love, but you could be my last love!… কিছুদিন পরেই মহারাজ গত হন। এ বাবদে শেষ কথা, এই সর্বগুণে গুণী মহারাজ ভারতের নানা জাতের ভিতর সবচেয়ে ভালোবাসতেন বাঙালিকে।
২. নবীনরা হয়তো জানেন না এ বিষয়ে ইতোপূর্বে কী কী মনোবেদনা বাংলা এবং সংস্কৃতে প্রকাশিত হয়েছিল। অর্থকষ্টে যখন মাইকেল মারা যান তখন হেমচন্দ্ৰ লেখেন :
হায় মা ভারতী,
চিরদিন তোর কেন এ কুখ্যাতি ভবে,
যে জন সেবিবে ও-রাঙা চরণ সেই সে দরিদ্র হবে।
এবং বিদ্যাসাগর মশাই সংস্কৃতে বলেছেন,
অস্য দগ্ধেদরস্যার্থে কিং কিং ন ক্রিয়তে ময়া।
বানরীমিব বাগৃদেবীং নর্তয়ামি গৃহে গৃহে।
অধমের তার অক্ষম অনুবাদ :
ওরে পোড়া পেট, কত না কিছুই করি আমি তোর তরে।
বাঁদরীর মতো সরস্বতীরে নাচাচ্ছি ঘরে ঘরে।
রাবাৎ-ইনসল্ট
প্রখ্যাত লেখক রেমার্ক-এর উপন্যাস পশ্চিম রণাঙ্গন নিপ (অল কোআএট)-এর এক জায়গায় আলোচনা হচ্ছে কয়েকজন নিতান্তু সাধারণ সেপাইয়ের মধ্যে। ক্ষীণ স্মৃতিশক্তি ওপর নির্ভর করে প্রতিবেদন নিবেদন করছি। একজন সেপাই শুধোলে, লড়াই লাগে কেন? আরেকজন বলল, দূর বোকা! এক দেশ আরেক দেশকে অপমান করে। তখন লাগে লড়াই। প্রথম সেপাই তখন বলল, কিন্তু আমি তো মোটেই অপমানিত বোধ করছিনে। যারা করছে তারা প্রাণভরে লড়ুক। আমাকে আমার বাড়ি, ক্ষেতখামারে ফিরে যেতে দেয় না কেন?
রাবাৎ সম্মেলনে নাকি ভারতবর্ষ ইন্সন্টেড হয়েছেন। কই, আমি তো মোটেই অপমানিত বোধ করছিনে। তদুপরি আরেকটি তত্ত্ব এস্থলে আমার স্মরণে আসে। আমার বাল্যবয়সে আমার এক গুরুজনের সামনে বাইরের এক ব্যক্তি আমাকে অযথা কড়া কড়া কথা শোনায়। আমি তখন চটে গিয়ে বলি, আমাকে অপমান করছেন কেন? সে ব্যক্তি কোনও উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল। আমার সেই মুরুব্বি তখন বলেন, এই তো করলে ব্যাকরণে– পোতোকলে– ভুল। তুমি স্বীকার করে নিলে তুমি অপমানিত হয়েছ। তার পর যে অপমান করেছে সে মাফ না চেয়ে চলে গেল। তুমি রয়ে গেলে অপমানিত। সুতরাং কখনও নিজের মুখে মেনে নিতে নেই, আমি অপমানিত হয়েছি। নিতান্তই যদি তখন তোমাকে কিছু বলতে হয়, তবে বলবে, আপনি এরকম অভদ্র আচরণ করছেন কেন? দোষটা চাপাবে তার ঘাড়ে। এবং আরও নিতান্তই যদি অপমান বোধ করে থাক তবে সেটা জোর গলায় স্বীকার না করে, চুপসে সেটা হজম করে নেবে এবং তক্কে তক্কে থাকবে কখন ব্যাটার ওপর মোক্ষম দাদ তুলতে পারবে-যদ্যপি আল্লাতালার আদেশ সবু (সহিষ্ণুতাসহ ক্ষমা– যার থেকে বাংলার সবুর কথাটা এসেছে। রাবাতের ব্যাপারটা আগাপাশতলা মুসলমানি ছিল বলে মুসলমানি শাস্ত্রের নজির দিলুম।
এর ওপর আরেকটা কথা আছে। অপমান করতে পারে কে, কাকে? আমি গেলুম আপনার বাড়িতে। আপনার চাকর আমাকে খামোখা কতকগুলি কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দিল বৈঠকখানায় ঢুকতেই দিল না। এস্থলে সে আমাকে অপমান করেনি, করেছে রূঢ় ব্যবহার আমাকে অপমান করার মতো সামাজিক আসন তার কোথায়? আবার দেখুন, অন্য আরেকদিন আপনার ঠাকুরদা বসেছিলেন বারান্দায়। আমাকে দেখেই খাপ্পা হয়ে আমাকে নাহক বকতে শুরু করলেন। সেস্থলেও আমি অপমানিত নই। কারণ আমি আপনার বন্ধু। আমার পিতামহের বিলক্ষণ হক আছে আমাকে কড়া কথা বলার।… অপমান হয় সমপর্যায়ে। যেমন মনে করুন, সন্তোষ ঘোষ। তিনি লেখক, আমিও লেখক। তিনি আমাকে অপমান করতে পারেন, আমিও তাকে অপমান করতে পারি। আরেকটি নজির দিই। যদ্যপি আইনে বারণ তথাপি ইতালি প্রভৃতি কোনও কোনও দেশে ডুয়েল লড়ার প্রথা প্রচলিত আছে। কিন্তু সেখানেও যদি আপনার ভৃত্য ইতালির প্রধানমন্ত্রীকে ডুয়েলে চ্যালেন্জ করে, সে খবর জানিয়ে দুজন প্রতি চাকরের প্রতিভূদের সঙ্গে দুমিনিট আলোচনা করেই, একবাক্যে চারজনাই রায় দেবেন, এ ডুয়েল হতে পারে না। দুজনার পদমর্যাদা এক নয়। চাকরটা শুধু তার পদমর্যাদা বাড়াবার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে চ্যালেন্ করেছে।
মরক্কো দেশ কোথায়, মশাই? শুনেছি সেখান থেকে মরক্কো লেদার নামক পুরু চামড়া রপ্তানি হয়। পুরু চামড়া নিশ্চয়ই। নইলে সেখানকার লোক এই সুদূর ভারতবর্ষের লোককে নিমন্ত্রণ করে তাদের অর্বাচীন ইতিহাসে (প্রাচীন ইতিহাস এদের নেই) এই বোধহয় তারা কাউকে কখনও নিমন্ত্রণ করল– এরকম পুরু চামড়ার আচরণ করবে কেন? তদুপরি শুনেছি, মরক্কো দেশকে নাকি এখনও বহু বাবতে ফ্রান্স এবং স্পেনের কথামতো চলতে হয়, এবং সর্বশেষে শুনেছি, স্পেন ও ফ্রান্সের ঝগড়ার সুযোগ দিয়েই এদেশের যেটুকু স্বাধীনতা আছে সেটুকু বেঁচেবর্তে আছে। আমার কেমন যেন সন্দেহ জাগে, মুসলিম রাষ্ট্রদের নিমন্ত্রণ করে এরা যেন সেই ইতালির ডুয়েলকামীর মতো পদমর্যাদা বাড়াতে চেয়েছিল। আমার তো মনে হয় না, আ মসজিদের আগুন মরক্কোর বুকে কোনও আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
কোথায় মরক্কো, কোথায় ভারত পদমর্যাদায় কোথায় ভারত আর কোথায় সেই ধেড়ধেড়ে গোবিন্দপুর টা-পেনি হে-পেনি মরক্কো! সে আমাদের ইনসল্ট করবে কী করে?
ফখরুদ্দীন সাহেব, দীনেশবাবু, আমাদের ফরেন আপিস যা করলেন সেটা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। আমার দুঃখ, খবরের কাগজে প্রবন্ধ লিখে চিঠিপত্র ছাপিয়ে এদেশের মুসলমানরা এদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন না কেন? বলেন না কেন যে, এদেরই হয়ে একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ভারত সরকার ওই একটা থার্ড ক্লাস দেশে গিয়েছিল।
যদ্যপি-বা স্বীকার করি– আমি করি না যে ভারত রাবাতে ইনসল্টেড হয়েছে তথাপি বলব, মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে অপমানিত হওয়াতে লজ্জার কিছু নেই। ক্ষুদ্র স্বার্থপর উদ্দেশ্য নিয়ে জয়ী হলেও উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করার কিছু নেই।
সিংহ-মূষিক কাহিনী
চল্লিশ বৎসর বয়সের ঘাটের থেকে যৌবনতরী বিদায় দেওয়ার পরও কখনও আশা করতে পারিনি, স্বপ্নেও সে আকাশ-কুসুম চয়ন করতে পারিনি যে এ অধমের জীবদ্দশাতেই স্বরাজ আসবে, স্বাধীন জীবন কাকে বলে তা এই চর্মচোখেই দেখে যেতে পারব।
কিন্তু প্রভু যখন দেন, তিনি তখন চাল-ছাত চৌচির করে ঐশ্বর্য-বৈভব (নিয়াম গণীমৎ) ঢেলে দেন। হঠাৎ একদিন হুড়মুড়িয়ে স্বরাজ এসে উপস্থিত–বন্যার প্লাবনের মতো। ফলে আমরা সবাই যে কহাঁ হাঁ মুল্লুকে ভেসে গেলুম এবং এখনও এমনই যাচ্ছি যে তার দিকচক্রবালও দেখতে পাচ্ছিনে। আমি ইচ্ছে করেই এই অতিশয় প্রাচীন, সাদামাটা তুলনাটি পেশ করলুম, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তুলনা তিন ঠ্যাঙের উপর ভর করে দাঁড়ায়, কিন্তু এস্থলে তুল্য ও তুলনীয় এমনই টায়-টায় মিলে গেছে- স্বরাজ এবং বন্যা, যে এটি সত্যি চার ঠ্যাঙের উপর দাঁড়িয়েছে। তুলনাটি যে কীরকম মোক্ষম ড্রেনপাইপ পাতলুনের মতো টাইটফিট তার আরেকটি নিদর্শন দিই। এই প্রলয়জলধিতে যেসব কর্তাব্যক্তিরা নৌকো ভেলা পেয়ে গেলেন তারা বানে ভেসে-যাওয়া বেওয়ারিশ মাল (দেশের সম্পদ, কোম্পানি কা মাল, যদি বেওয়ারিশ না হয় তবে বেওয়ারিশ আর কারে কয়!) আঁকশি দিয়ে ধরে ধরে আপনআপন ভল্টে বোঝাই করলেন। এখানে আরও একটা মিল রয়েছে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, গুটিকয়েক অ্যাভূরি ইয়ং টার্ক-এর অবিমৃষ্যকারিতার ফলে ব্যাঙ্ক ভল্ট বাবদে এমনসব ব্যবস্থা নেওয়া হল যে সেগুলো সেই বানের জলে উৎক্ষিপ্ত প্রক্ষিপ্ত হয়ে ভেসে ভেসে চলেছে। কোন কূলে ভিড়বে– আমরা তো অনুমান করতে পারছিনে। তবে মাভৈঃ! এসব ঘড়েল কুমিরগুষ্টি যখন জলের অতল থেকে নির্বিচারে অবলা কুমারী থেকে গোবর-গামার ঠ্যাং কামড়ে ধরে বদান্ন ভক্ষণ করতে পারেন, তখন এইসব বেওয়ারিশ প্রাণহীন তল্ট কামড়ে ধরে সেগুলোকে নদীর অর্ধনিমজ্জিত গহ্বরে নিয়ে যাওয়া তো এদের কাছে শনির অপরাহ্নের পিকনিকের মতো নির্দোষ সহজ সরল, কিংবা বলতে পারেন অত্যাবশ্যকীয় রাজকার্যের অনুরোধ হাওয়াই দ্বীপে বসন্তযাপন অথবা শীতে মন্তে কার্লো ভ্রমণ।
সন্দেহপিচেশ পাঠক হয়তো ভাবছ, আমি নিজে সেই হালুয়ার কোনও হিস্যে পাইনি বলে বন্ধ্যা রমণীর ন্যায় শতপুত্রবতীদের অভিসম্পাত দিচ্ছি। মোটেই না। আমার কপালেও ছিটেফোঁটা জুটেছে! ইরানের প্রখ্যাত কবি মৌলানা শেখ সাদি বলেছেন, ইহ-সংসারে মহাজন ব্যক্তি মাত্রই (সাদি গুণীজ্ঞানী অর্থে বলেছেন এস্থলে কিন্তু আপনাকে যখ সম্প্রদায়ের বেনেদের কথা ভাবতে হবে যেন আতরের ব্যবসা করেন। তোমাকে মিন-পয়সায় আতর না দিলেও তাবৎ আতরের বাক্সে ডবল তালা মেরে বন্ধ রাখলেও বাড়িময় যে আতরের খুশবাই ম-ম করছে এবং তোমার নাসিকা-রন্ধ্রে প্রবেশ করছে, সেটা ঠেকাবেন কী প্রকারে? এস্থলে তাই। এ মহাজনরা যদ্যপি বাইশ বৎসর ধনদৌলত ব্রা গোটা আষ্টেক লোহার সিন্দুকের উপর ডবল ডানলোপিলোতে বিচ্ছি যামিনী যাপন করেছেন তথাপি এগুলো বাধ্য হয়ে মাঝে মাঝে এদের খুলতে হয় তখন পাকা বেল ফেটে গিয়ে যে কাককুল প্রবাদানুযায়ী এ রস থেকে বঞ্চিত তারাও তার হিস্যে পেয়ে যায়।
এই ধরুন কিছুদিন আগেকার কথা। এক টাকার-কুমিরের উচ্চাশা হয়েছে তিনি সমাজেও যেন গণ্যমান্য ব্যক্তিরূপে উচ্চাসন লাভ করেন। হঠাৎ একদিন আমার কুটিরের সম্মুখে এসে দাঁড়াল এক বিরাট মোটরগাড়ি। তার দৈর্ঘ্য এমনই যে সেটার ন্যাজামুড়ো করতে হলে হঠাৎ পিছনের লাগেজ কেরিয়ার থেকে সম্মুখের বনেটের নাক অবধি সেখানে পদাধিকারলব্ধ পতাকা পৎ পৎ করে, এর গাড়িতে অবশ্য পতাকা ছিল না যেতে হলে আরেকটা মোটরগাড়ি ভাড়া করতে হয়! তা সে যাই হোক, যাই থাক, যেই যক্ষ (অবশ্য ইনি কালিদাসের একদারনিষ্ঠ বিরহী যক্ষ নন–এর নাকি ভূমিতে আনন্দ; থাক শঙ্করের চৌরঙ্গী পশ্য) এসে এই অধমকে আলিঙ্গন করে একখানা চেয়ারে আসনপিড়ি হয়ে বসলেন।
নিম্নলিখিত রসালাপ হল :
যক্ষ ॥ আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় হওয়াতে বড় আনন্দিত হলাম। আমি বহুকাল ধরে আপনার একনিষ্ঠ পাঠক। আপনার অগ্নিবীণা আপনার বিদ্রোহী উপন্যাস আমি পড়েছি, কতবার পড়েছি বলে শেষ করতে পরব না। ওহ। কী করুণ, কী মধুর!
হরি হে, তুমিই সত্য।
আমি ॥ (মনে মনে) সর্বনাশ! ইনি আমাকে কবিবর নজরুল ইসলামের সঙ্গে গোবলেট করে ফেলেছেন! যে ভুল পাঠশালার ছোকরাও যদি করে তবে সে খাবে ইস্কুলের বাদবাকি পড়ুয়াদের কাছে বেধড়ক প্যাদানি। তদুপরি যক্ষবর বলছেন, বিদ্রোহী কবিতাটি নাকি উপন্যাস এবং সেটি নাকি বড়ই করুণ আর মধুর! এস্থলে আমি করি কী! যে ব্যক্তি গাধাকে (এস্থলে আমি) দেবে বলে এটা রেসের ঘোড়া (এস্থলে কাজী কবি কবি-পরিবার যেন অপরাধ না নেন, আমি নিছক রূপকার্থে নিবেদন করছি) সে ব্যক্তি গাধাকে তো চেনেই না, ঘোড়াকেও চেনে না। ইতোমধ্যে পুনরপি,
যক্ষ ॥ (স্মিতহাস্য করে) আপনার বড় ভাই সৈয়দ মুস্তাফা শিরাজ এই যিনি তালতলার খ্যাতনামা পুস্তক প্রকাশক- তিনিও আমার ছোট ভাইয়ের কাছে প্রায়ই আসেন। বড় অমায়িক বৃদ্ধ। শুনেছি আমাদের বাড়ির পাশেই তার বিরাট তেতলা বাড়ি।
হরি হে, তুমিই সত্য! তুমিই সত্য।
আমি ॥ (মনে মনে) এই আমার জীবন সর্বপ্রথম আমার পিরামিড-দৃঢ় হরিভক্তিতে চিড় ধরল। হরি যদি সত্যই হবেন তবে তাঁকে সাক্ষী রেখে এই লোকটা মিথ্যার জাহাজ বোঝাই করে যাচ্ছে আর তিনি টু ফুঁ করছেন না, এটা কী প্রকারে হয়? ওদিকে শিরাজ মিঞা খাঁটি বিদগ্ধ রাঢ়ের ঘটি, আর আমি সিলট্যা খাজা বাঙাল। ওর সঙ্গে আমার কোনও আত্মীয়তা নেই– থাকলে নিশ্চয়ই শ্লাঘা অনুভব করতুম। অবশ্য আমরা সবাই আদমের সন্তান; সে হিসেবে তিনি আমার আত্মীয়। তদুপরি বেচারি পুস্তক প্রকাশক নয়, ঢাউস বাড়িও তার নেই, যদুর জানি আমারই মতো দিন-আনি-দিন-খাই চাকরিতে পুরো-পাক্কা-পার্মানেন্ট। এবং বাচ্চা শিরাজ– যে আমার পুত্রের বয়সী সে নাকি আমার অগ্রজ এবং বৃদ্ধ! বৃদ্ধ! বুঝুন ঠ্যালা। আশা করি এ লেখন বাবাজির গোচর হলে তিনিও সব্যসাচীর ন্যায় আমাকে মাফ করে দেবেন। ইতোমধ্যে পুনরপি,
যক্ষ ॥ (তার দেওয়া বিবিধ-ভারতীর মতো বিবিধ সংবাদ যে আমাকে একদম হতবাক করে দিয়েছে সেইটে উপলব্ধি করে, পরম পরিতোষ সহকারে আচ্ছা, আপনি কি শান্তিনিকেতনে লেখাপড়া করেছিলেন?
আমি ॥ (মনে মনে, যা মিথ্যের জাহাজ সত্যের চড়াতে এসে কিছুটা ঠেকেছে) আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে বিশেষ ফলোদয় হয়নি সে তো দেখতেই পাচ্ছেন।
– আহা কী যে বলেন! আচ্ছা, আপনার হাতের লেখা নাকি রবিঠাকুরের মতো
— অনুকরণ করেছিলুম। সে সুন্দর লেখার কাছে আমার লেখা কি কনিকালেও পৌঁছতে পারে।
–আচ্ছা, কিন্তু আপনি নাকি হুবহু তাঁর নাম সই করতে পারেন? একবার নাকি তার নাম সই করে ভুয়ো নোটিশ মারফত আশ্রমকে একদিনের ছুটি দেন। পরে নাকি আপনি নিজেই সেটা ফাঁস করে দেন।
আমি কীর্তিটি অস্বীকার করলুম না। কিন্তু যক্ষরাজ কোনদিকে নল চালাচ্ছেন সেঁটে বসে, তখনও বুঝিনি। জানালা-দরজার দিকে ঘুরে এবারে চেয়ার ছেড়ে তক্তপোশে আমার গা সেঁটে বসে, জানালা দরজার দিকে ঘোর সন্দিগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ফিসফিস করে আমার কানে কানে বললেন, বাবু, তোমার হাল তো দেখতে পাচ্ছি। তোমার দু-পয়সা হবে : আমারও ফায়দা হবে। কিন্তু কাককোকিল পোকাপরিন্দায়ও যেন জানতে না পায়।
আমার প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথের একখানা সার্টিফিকেট। আমি যে তার জীবিতাবস্থায় গোপনে গোপনে দেশসেবা, পলিটিক্যাল কাজ এবং বিশ্বভারতাঁকে সাহায্য করছিলাম সেই মর্মে একখানা চিঠি। শেষ বয়েসে তার প্রায় সব চিঠিই ইংরেজিতে টাইপ হতো, তিনি শুধুমাত্র সই করে দিতেন।
আপনাকে কিছুটি করতে হবে না। আমি সেই জরাজীর্ণ টাইপরাইটার মেলা জাঙ্কের সঙ্গে নিলামে কিনেছি, অবশ্যই দালাল মারফত। আমার কপাল ভালো। ওইসব হাবিজাবির ভিতর তাঁর প্রাচীন দিনের একগুচ্ছ লেটারহেড সমেত হলদে ফ্যাকাসে নোটপেপারও পেয়ে গিয়েছি। টাইপরাইটারটা সযতে মেরামত করেছি। এখন এটা ঠিক ১৯৩৮/৩৯/১-এর মতোই ছাপা ফোঁটায়। আমি পাকা লোককে দিয়ে সার্টিফিকেটের মুশাবিদা করাব, টাইপ করাব। তার পর কবির দস্তখতটি হয়ে গেলে দলিলটি রেখে দেব আঁকাড়া চালের বস্তার ভিতর। ব্যস! আর দেখতে হবে না। টাইপের কালি, দস্তখতের কালি সব ম্যাটমেটে মেরে গিয়ে ১৯৪১ সালের চেহারা নিয়ে বেরুবে সেই খানদানি চেহারা নিয়ে।
এই চূড়ান্তে পৌঁছে যক্ষ হঠাৎ থেমে গিয়ে আমার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে রইলেন।
সাংসারিক বুদ্ধি আমার ঘটে আছে, এহেন অপবাদ যেসব পাওনাদারদের আমি নিত্যি নিত্যি ফাঁকি দিয়ে অদ্যাবধি বেঁচেবর্তে আছি তারাও বলবেন না। তৎসত্ত্বে এ নাটকের শেষাঙ্কে আমি যেন অকস্মাৎ অর্জুনের দিব্যদৃষ্টি প্রসাদাৎ কৃষ্ণাবতারের বিশ্বরূপ দেখতে পেলুম।
সংক্ষেপে বলিতে গেলে হিং টিং ছট! অর্থাৎ পূর্বোক্ত দলিলে আমাকে জাল করতে হবে কবির সিগনেচর, স্বাক্ষর, দস্তখত। দস্ত কথা শব্দটির অর্থ হাত (যার থেকে দস্তানা এসেছে); আমাকে দস্তখত করতে হবে না, করতে হবে দক্ষত অর্থাৎ জাল করে হাতে ক্ষত আনতে হবে।
আমার মুখে কোনও কথা যোগাল না।
যক্ষ বললেন, আপনার দক্ষিণা কী পরিমাণ হবে?
আমার মাথায় তখন নলজিদেহনির্গত কলি ঢুকেছে, অর্থাৎ দুষ্টবুদ্ধি চেপেছে। দেখিই না, শ্রাদ্ধ কতদূর গড়ায়।
ব্ৰীড়াময়ী কুমারীর মতো কিংবা ধোয়া তুলসীপাতাটির মতোও বলতে পারেন ক্ষিতিলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিবেদন করলুম, আপনি বলুন।
সঙ্গে সঙ্গে না তাকিয়েই অনুত্ব করলুম যক্ষের সর্বাঙ্গে শিহরণ রোমাঞ্চন উত্তাল তরঙ্গ তুলেছে। এত সহজে যে নিরীহ একটা লেখক এহেন ফেরেব্বাজিতে রাজি হবে, এ দুরাশা তিনি আদপেই করেননি। ভেবেছিলেন আমাকে বহুং উলাইমলাই করতে হবে। সোল্লাসে বললেন, পাঁচশো।
আমি তুলসীপাতার কোমল রূপটি সঙ্গে সঙ্গে ত্যাগ করে সুতীক্ষ্ণ তালপাতার আকার ধারণ করে বললুম, আপনি কি ছাগীর দরে হাতি কিনতে চান তার চাইতে যান না যে কোনও আদালতের সামনে বটতলায়। পাকা জালিয়াত পাঁচটি টাকায় ওই কর্মাট করে দেবে!
আমার চাই পাঁচ হাজার।
আমি বেশ বুঝে গিয়েছিলুম, যক্ষ প্রফেশনাল জালিয়াতের কাছে যেতে চান না। সেটা মোস্ট ডেনজরস।
ইতোমধ্যে এই প্রথম তার পরিপূর্ণ সপ্রতিভ ভাব কেটে গিয়ে তিনি হয়ে গেছেন স্তম্ভিত হতভম্ব। কিছুক্ষণ পরে রাম ইডিয়টের মতো বিড়বিড় করে বললেন, পাঁচ হাজার
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললুম, বড়বাজারের নাপিতকে দিয়ে আপনার কান সাফ করাতে হবে না। ঠিকই শুনেছেন।
অতঃপর গৃহমধ্যে সূচিভেদ্য নৈস্তব্ধ।
খানিকক্ষণ পর আমিই বললুম, আপনি বাড়ি গিয়ে চিন্তা করুন, স্লিপ ওভার ইট। আমিও তাই করব।
আমি জানতুম, এসব ঘড়েলদের সবচেয়ে বড় গুণ এদের ধৈর্য। তাই এই ধৈর্য কাজে লাগাবার ফুরসত-মোকা পেলেই এরা সোল্লাসে রাজি হয়। ধৈর্য দ্বারা ঘষতে ঘষতে এরা অন্যপক্ষের প্রস্তরও ক্ষয় করতে পারে।
আর আমারও তো কোনও স্টক নেই। এদের ধৈর্য যদি অফুরন্ত হয়, তবে আমার ধৈর্য অনন্ত। দেখাই যাক না, শ্রাদ্ধ কদ্দুর গড়ায়।
.
তাই গোড়াতেই বলছিলুম আমাদের মতো নগণ্যগণও এসব ছিটেফোঁটার সুযোগ পায়, কিন্তু হায়, যার অদৃষ্টে অর্থ নেই তার কপালে স্বয়ং মা-লক্ষ্মী ঠাকুরানিও ফোঁটা আঁকতে এলে সে মূর্খ তখন যায় নদীতীরে, কপাল ধুতে। ফিরে এসে দেখে, লক্ষ্মী অন্তর্ধান করেছেন। তাই তার নাম চপলা!
স্পাই
আশ্চর্য!
মানুষ কত সহজে বিশ্বখ্যাত লোককে ভুলে যায় বিশ্ববিখ্যাত লোককে ভোলাটা মানুষের পক্ষে অবশ্যই স্বাভাবিক।
মাতা হারিকে সচরাচর পৃথিবীর লোকে পয়লা নম্বরি পাই খেতাব দিয়েছে কিন্তু অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, সে খ্যাতির চৌদ্দ আনা পরিমাণ গুজব আর কিংবদন্তির ওপর নির্ভর করছে। বাকি দু-আনাও বিশ্বাসযোগ্য কি না বলা কঠিন।
কিন্তু গত বিশ্বযুদ্ধের স্পাইদের রাজার রাজা রিষার্ট জরগে সম্বন্ধে অনেক কিছু পাকা খবর জানা গিয়েছে। অবশ্য এ সত্য প্রতিভাসিত যে, যে কোনও স্পাই সম্বন্ধে সব খবর কোনওদিনই পাওয়া যায় না। স্পাই ধরা পড়ার পর তার সম্বন্ধে সব খবর যদি খুঁড়ে বের করা যায় তবে সে চা পাই।
কিন্তু তার পূর্বে আরেকটি কথা বলে নিই। গুপ্তচরবৃত্তি বা এসপিয়োনাজের প্রথম অলিখিত আইন, গুপ্তচর যদি বিদেশে ধরা পড়ে তবে যেদেশের হয়ে সে কাজ করছিল সেদেশ কিছুতেই স্বীকার করে না যে ওই লোক তাদের গুপ্তচর। তার কারণ, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে এক দেশ অন্য দেশে সরকারিভাবে গুপ্তচর রাখতে পারে না– অথচ আশ্চর্য, প্রায় সব দেশই সেটা করে থাকে।
পৃথিবীর ইতিহাসে জরগে একমাত্র ব্যত্যয়। রুশের হয়ে ইনি জাপানে সুদীর্ঘ দশ বৎসর কৃতিত্বের সঙ্গে স্পাইগিরি করে ১৯৪১-এ ধরা পড়েন এবং ১৯৪৪-এ তার ফাঁসি হয়। যুদ্ধশেষে যখন তার কর্মকীর্তির অনেকখানি প্রকাশ পেল তখন তাবৎ ইয়োরোপে হইচই পড়ে গেল এবং বহু ভাষায় তার সম্বন্ধে বিস্তর সিরিয়াল রগরগে কেতাব, সিনেমা, নাট্য ইত্যাদি তাবৎ পূর্ব-পশ্চিমকে রোমাঞ্চিত করে তুলল। বিশেষ করে জাপানকে। কারণ এইমাত্র বলেছি তার শেষ কর্মভূমি ছিল জাপান।
এবং এই ডামাডোলের মধ্যিখানে কোথায় না রুশ তার গোরস্তানের নৈস্তব্ধ্য বজায় রেখে নিস্তব্ধতা হিরণয়–সাইলেন্স ইজ গোল্ডেন নীতি পুনরায় সপ্রমাণ করবে, উল্টো পৃথিবীর সব রাজনৈতিক-ঐতিহ্য ধূলিসাৎ করে সগর্বে সদম্ভে সরকারিভাবে স্পাই জরগের স্মৃতির উদ্দেশে বলশেভিক রুশ দেশের সর্বাধিপতি সর্বোচ্চ সম্মান মেডেল ইত্যাদি অর্পণ করলেন– এ মেডেল রুশ দেশের যুদ্ধকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ বীরদেরই দেওয়া হয় মাত্র। যতদূর মনে পড়ছে তার ছবিসহ স্ট্যাম্পও বেরিয়েছিল।(১) কিন্তু হায়, সে মেডেল গ্রহণ করার জন্য জরগের দারাপুত্র পরিবার কেউ ছিল না। তার স্ত্রীকে তিনি বহু পূর্বেই তালাক দিয়েছিলেন– তার গুপ্তচরবৃত্তিতে সম্পূর্ণ একনিষ্ঠ আত্মনিয়োগ করার জন্য। অনেকটা হিটলারের মতো। তিনিও ওই কারণে আদৌ বিয়ে করেননি– করলেন, যখন তার রাজনৈতিক নাট্যমঞ্চের বৃহৎ কৃষ্ণ যবনিকা নটগুরু মহাকাল কামান গর্জনের অট্ট করতালির মাঝখানে নামিয়ে দিলেন, এবং সে বিবাহ সেই কৃষ্ণ যবনিকার অন্তরালে। আত্মহত্যার পিস্তলধ্বনি সে বিবাহের আতশবাজির বোম। স্ত্রীও নাট্যমঞ্চের জুলিয়েতের মতো বিষপান করলেন।… মার্কিন খবরের কাগজের নেকড়েরা এড়ি (পূর্ব বাঙলার মুসলমানি ভাষায়, তালাকপ্রাপ্তা রমণীকে এড়ি–ডিভোর্সে–এবং বিধবাকে বাড়ি বলে) জরগেকে খুঁজে বের করুল। রমণী স্বল্প- তথা সত্য-ভাষিণী। তার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, ন-সিকে খাঁটি স্পাইদের মতো জরগে তার স্ত্রীকে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করতে দেননি তিনি কী নিয়ে দিবারাত্র লিপ্ত থাকেন।
জরগের জীবন এমনই বৈচিত্র্যময় এবং ঘটনাবহুল যে, সুদ্ধমাত্র তার সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দিতে গেলেই একখানা মিনি সাইজের মহাভারত লিখতে হয়।… আমি গুপ্তচর জরগেকে নিয়ে গুপ্ত পদ্ধতিতে দিব্য একখানা রগরগে সিরিয়াল লিখতে পারি- যত কাঁচা ভাষা ততোধিক বেটপ শৈলীতে লিখলেও বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যবশত সেটা উৎরে যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু বয়স হয়েছে। আমার জীবনদুর্গে প্রাচীরের বাইরে, গভীর রাত্রে যমদুতের পদধ্বনি প্রায়ই নতে পাই। মাঝে মাঝে ইদানীং ক্রমেই টেম্পো বেড়ে যাচ্ছে-প্রাচীরের উপর সাহেবি কায়দায় নকুও করে। এহেন অবস্থায় সিরিয়াল অসম্পূর্ণ রেখে উল্টোরথহীন রথযাত্রায় বেরুতে চাইনে–মমেকসদয় সম্পাদকমণ্ডলীকে ক্ষিপ্ত পাঠক সম্প্রদায়ের অভিসম্পাতকুণ্ডে নিমজ্জিত করে। কাজেই সম্ভাব্য ক্ষিপ্ত পাঠকমণ্ডলীর জন্য সংক্ষিপ্ত পাঠ দিচ্ছি– সাতিশয় সংক্ষিপ্ত (২)
দুই কারণে সোভিয়েত দেশ জরগের কাছে চিরঋণী। অবশ্য রুশের আরও বহু সেবা তিনি করেছেন।
প্রথম : হিটলার রুশদের আক্রমণ করার বেশ কয়েক মাস অর্থাৎ পর্যাপ্তকাল পূর্বে জরগে জাপান থেকে গোপন বেতারযোগে (বেতারযন্ত্রটি চালাতেন তার এক সহ-স্পাই) স্তালিনকে খবর পাঠান, হিটলার চুক্তিভঙ্গ করে রুশ আক্রমণ করবে। শুধু তাই নয়, কোন মাসে, কোন সপ্তাহে সে খবরও পাকাপাকিভাবে জানান। আশ্চর্য, যখন খুদ জর্মনির মাত্র গুটিকয়েক ডাঙর ডাঙর জাদরেল জানতেন যে হিটলার রুশ আক্রমণ করার জন্য সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করেছেন এবং তারাও জানতেন না, কবে কোন মাসে হিটলার সে হামলা শুরু করবেন, তখন জর্মনি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের জাপানে বসে জরগে এই পাকা খবরটি পেলেন কী করে? মনে রাখা উচিত, ১৯৩৯-এ যুদ্ধার পর থেকে জাপান এবং জর্মনির মধ্যে কোনও যাতায়াত পথ ছিল না। (সুভাষচন্দ্র যে কতখানি বিপদের ঝুঁকি মাথায় তুলে জর্মনি থেকে জাপান পাড়ি দিয়েছিলেন সেকথা সবাই জানেন।) সুইজারল্যান্ড থেকে গোপন বেতারেও যেমন মনে করুন খবরটা প্রথম জনি থেকে নিরপেক্ষ সুইজারল্যান্ডে গুপ্তচর মারফত গেল– সেটা পাঠানো প্রায় অসম্ভব ছিল। ওরকম বেআইনি জোরদার বেতার ট্রান্সমিটার সুইস সরকার ধরে ফেলতই ফেলত। এস্থলে আরও বলি, হিটলার তার যুদ্ধের প্ল্যান তার দূর-মিত্র জাপানকে তো বলতেনই না, তার অতিশয় নিকট-মিত্র ভৌগোলিক ও হার্দিক উভয়ার্থে মুসসোলিনিকেও আগেভাগে জানাতেন না। এবং জাপানে অবস্থিত জর্মন রাজ-দূতাবাসও আর-পঞ্চাশটা দেশে অবস্থিত জর্মন রাজ-দূতাবাসের মতোই যে এ ব্যাপারে কিছুই জানত না সে তো বহু ক্ষেত্রে সপ্রমাণ হয়ে গেছে। হিটলার যে তার ফরেন আপিস এবং তাঁর রাজদূতদের অবিশ্বাস করতেন তাই নয়, এদের রীতিমতো ঘৃণা করতেন। এবং এ তত্ত্বটি হিটলার কোনওদিন গোপন রাখার কণামাত্র প্রয়োজন বোধ করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন একমাত্র তার আপন খাস প্যারা ফরেন মিনিস্টার রিবেট্রপকে। ইনি জাতে শুড়ি। কূটনীতিতে তার কোনও শিক্ষাদীক্ষা বা অভিজ্ঞতা ছিল না। তত্সত্ত্বেও হিটলার গদিনশিন হওয়ার সামান্য কয়েক বৎসর পর তার পার্টি, ফরেন আপিস, এমনকি তার দক্ষিণ হস্ত গ্যোরিঙ, বাম হস্ত গ্যোবেলস সক্কলের তীব্র প্রতিবাদ উপেক্ষা করে রিবেট্রপকে দুম করে বসিয়ে দিলেন ফরেন আপিসের মাথার উপর মহামান্য পররাষ্ট্র সচিবরূপে।
জরগের দ্বিতীয় অবদান : যে রাত্রে জাপানি মন্ত্রিসভা এক অতিশয় গোপন বৈঠকে স্থির করলেন হিটলার রুশ আক্রমণ করার পর জাপানকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান, তারা যেন রুশের পূর্বসীমান্ত আক্রমণ করে যে তারা কোনও অবস্থাতেই রুশ দেশ আক্রমণ করবেন না, তার পরদিন ভোরবেলা জরগে সেই সাতিশয় গুরুত্বপূর্ণ গোপনতম সিদ্ধান্তটির বর পেয়ে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে স্তালিনকে পূর্ব পদ্ধতিতে সংবাদটি জানান। স্তালিনের বুকের উপর থেকে জগদ্দল জগরনট নেমে গেল। জাপানি আক্রমণের ভয়ে পূর্ব সীমান্তে ভার যে সেনাবাহিনী মোতায়েন ছিল সেটাকে তদ্দশ্যেই পশ্চিম সীমান্তে এনে হানলেন হিটলারের উপর মোক্ষম হামলা। দুই সীমান্তে একইসঙ্গে কে লড়তে চায়? ওই করে সর্বনাশ হল কাইজারের। হিটলারেরও আখেরে সেই গতিই হয়েছিল। রুশ বেঁচে গেল।
পত্রান্তরে বেরিয়েছে : গত ৬ নভেম্বর পূর্ব জনির পূর্ব বার্লিনের একটি রাস্তার উপর প্রাক্তন রুশ স্পাইদের একটি সম্মিলিত অনুষ্ঠান হয় প্রকাশ্যে। রয়টার বিস্ময় প্রকাশ করেছেন : স্পাইদের সম্মেলন– তা-ও প্রকাশ্যে।
এরা সমবেত হয়েছিলেন তাদের গুরুর গুরু জরগের স্মরণে।
পঁচিশ বৎসর পূর্বে বিশ্ব কনিজমের জন্য টোকিয়োতে প্রাণ দেন।
যে রাস্তাতে ভঁরা সমবেত হন সেখানে সেনাবাহিনীর ব্রাসব্যান্ডের সঙ্গীতসহ রাস্তাটির নতুন নামকরণ হয়।
রিষার্ট জরগে স্ট্রাসে।
.
রিষার্ট জরগে খাঁটি জর্মন নাম। রিষার্টের পিতা ছিলেন খাঁটি জর্মন, মা রুশ। জরগের জন্ম রুশদেশে। জাপানে থাকাকালীন জরগে সর্বজনসমক্ষে বলতে কসুর করতেন না যে, রুশের প্রতি তার বিশেষ শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি আছে। তৎসত্ত্বেও কেউ কখনও সন্দেহ করেননি যে তিনি রুশের শাই, অতখানি কী করে হয়। এদিকে তার মূল কর্ম ছিল জাপান সম্বন্ধে স্তালিনকে খবর দেওয়া এবং দ্বিতীয় সেই সুদূর জাপান থেকে জর্মনির অভ্যন্তরীণ গুপ্ত খবরও সহ করে তাকে জানানো কী করে তিনি সংগ্রহ করতেন সেটা প্রাশাটে (প্ল্যানচেটে) শার্লক হোমসকে আবাহন জানালে হয়তো জানা যেতে পারে। জরগে ধরা পড়ার পর জাপানে প্রবাসী জর্মন-অজর্মন সবাই একবাক্যে বলেছেন, জরগে কস্মিনকালেও তাদের কাছ থেকে জর্মনি সম্বন্ধে কোনও খবরাখবর পাম্প তো করতেনই না, উল্টো নয়া নয়া খবর দিয়ে তাদের পিলে চমকে দিতেন; পরে সেগুলো কনফারড হত।
জরগের চেহারাটি ছিল সুন্দর এবং পুরুষত্বব্যঞ্জক। দীর্ঘ বলীয়ান দেহ। নাক চোখ ঠোঁট যেন পাথরে খোদাই অতি তীক্ষ্ণ। তাঁকে দেখে মনে হতো যেন চ্যাম্পিয়ন বক্সার বিরাট কোনও মেলাতে চ্যালেঞ্জ করে বেড়াচ্ছেন, কেউ তার সঙ্গে লড়তে রাজি আছে কি না–
বলছেন এরিষ করট, জাপানে অবস্থিত জর্মন রাজ-দূতাবাসের দুই নম্বরের কর্মচারী। অবশ্য টোকিয়োতে তিনি সবাইকে চ্যালেঞ্জ করতেন তর্কযুদ্ধে এবং জিততেন হামেশাই। কারণ তার তূণীর ভর্তি থাকত তথ্যের লেটেস্ট ইনটেলিজেন্সের শরচ্ছে। অর্থাৎ নেকেড় ফ্যাক্টস।
সেই যে গল্প আছে, গ্রামাঞ্চলের দুই ইরাকি জমিদার মোকদ্দমা লড়তে লড়তে আপিল করেছেন বাগদাদের শেষ আদালতে অর্থাৎ স্বয়ং খলিফা হারুন-উর-রশিদ এর শেষ ফাইনাল বিচার করবেন। এক জমিদার বাগদাদে এসে উঠলেন তার সখা বাদশার প্রধানমন্ত্রীর প্রাসাদে। প্রতিবাদী উঠলেন তার বাল্যের বান্ধবী বাদশার খাস প্যারা রক্ষিতার বাড়িতে। বাদী মোকদ্দমা হেরে গ্রামে ফিরলে পর সবাই বিস্ময় মেনে শুধোল, প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে উঠেও আপনি মোকদ্দমার সুরাহা করতে পারলেন না? তিনি বিজ্ঞজনোচিত কণ্ঠে বললেন, তাঁরা যে উঠেছিলেন রাজরক্ষিতার বাড়িতে। আমার কোনও যুক্তি কোনও নজির দাঁড়াতে পারে উলঙ্গ যুক্তির বিরুদ্ধে, এগেনস্ট নেকেড আরগুমেন্ট!
জরগের বেশভূষা ছিল অপরিপাটি; তিনি বাস করতেন টোকিওর সবচেয়ে খাঁটির খাঁটি ঘিঞ্জি জাপানি মহল্লায় এবং বাড়িটা চোখে পড়ার মতো নোংরা। কিন্তু জাপানিদের আকর্ষণ করার মতো কেমন যেন একটু চুম্বকের শক্তি তার সর্বাঙ্গ থেকে বিচ্ছুরিত হত। তারা তাকে পুজো করত বললে কমই বলা হয়। এদিকে তার চালচলন ছিল ভ্যাগাবন্ড, বেদে বা বোহেমিয়ান ধরনের। রমণীবাজি করতেন প্রচুর এবং মদ্যপান করতেন বেহ। তিনটে বোতল হুইস্কি ঘণ্টা কয়েকের ভিতর সাবড়ে দিতেন তিনি অক্লেশে- চোখের পাতাটি না কাঁপিয়ে এবং তাঁর চোখের সেই তীক্ষ্ণ জ্যোতিটির উপর সামান্যতম ঘোলাটে পৌঁছ পড়ত না।
অর্থাভাব তার লেগেই থাকত। ধরা পড়ার পর অনুসন্ধান করে জানা যায়, তার আমদানি যে কোনও মাঝারি রাজ-দূতাবাসের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের মতো অতি সাধারণ। পরিষ্কার বোঝা যায়, তিনি কখনও তার স্পাইবৃত্তি এক্সপ্লয়েট করেননি। তিনি স্পাই হয়েছিলেন কম্যুনিজমের প্রতি তার আন্তরিক আদর্শবাদে প্রবুদ্ধ হয়ে।
জরগে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন রুশ এবং জনি উভয় দেশে। তার স্বৰ্গত ঠাকুর্দা ছিলেন কার্ল মার্কসের সেক্রেটারি। শিক্ষা সমাপনান্তে, প্রথম যৌবনে, এ শতকের দ্বিতীয় দশকে তিনি পশ্চিম জর্মনিতে একটি কম্যুনিস্ট পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। অতঃপর তাঁকে তৃতীয় ইন্টারনেশনালের বৈদেশিক গুপ্তচর বিভাগে কর্ম দিয়ে স্কানডিনেভিয়া ও পরে তুর্কিতে গুপ্তচরবৃত্তি করতে পাঠানো হয়। তুর্কিরা এসব বাবদে অসাধারণ চালাক। গন্ধ পেয়ে যায়। অচিরায়। জরগে কিয়ৎকাল জেল খাটলেন– তার গুপ্তচরবৃত্তিতে এই একটিমাত্র কলঙ্ক; সর্বসাধারণ অবশ্য যুদ্ধশেষের অনেক পরে এসব জানতে পায়। ১৯৩০ সালে রুশ সরকারের আদেশে তাকে পাঠানো হয় সাংহাইয়ে। এখান থেকে আরম্ভ হয় তার কৃতিত্বময় জীবন। …জরগেকে যে জাপানি কোর্ট মারশালের সামনে দাঁড়াতে হয় সে মোকদ্দমার নথিপত্র মার্কিনরা জাপান অধিকার করার পর হস্তগত করে। তার থেকে জানা যায়, জরগে সাংহাইয়ে যেসব দেশি-বিদেশি কম্যুনিস্টদের সংস্পর্শে আসেন তাদের অন্যতম হজুমি ওসাকি নামের জনৈক জাপানি। এরপর এরা মস্কোর আদেশে টোকিও চলে আসেন।
প্রকাশ্যে তার পেশা ছিল নাৎসি-নির্দেশচালিত (অবশ্য তখন তাবৎ জর্মন প্রেসই গ্যোবেলসের কজাতে) ফ্রাঙ্কফুর্টের আলগে-মাইনে সাইটুঙের সংবাদদাতারূপে। তবে তাঁর অনেক প্রবন্ধই ছাপাবার মতো সাহস সম্পাদকমণ্ডলীর ছিল না। তারা সেগুলো না ছেপে চেপে যেতেন। সহকর্মীরূপে তাঁকে ক্লাউজেন নামক আরেক জর্মন গুপ্তচর দেওয়া হয়েছিল। প্রকাশ্যে তাঁর ব্যবসা ছিল মোটর মেরামতি। ওদিকে ছিলেন সেরার সেরা রেডিয়োর ওস্তাদ। অবশ্য জাপান থেকে কুশের পূর্বতম সীমান্তে রেডিয়োবার্তা পাঠাতে জোরদার ট্রান্সমিটারের দরকার হয় না– ধরা পড়ার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম। ক্লাউজেনও ধরা পড়েছিল কিন্তু তাকে জাপানিরা ফাঁসি দেয়নি; যুদ্ধশেষে রুশ দেশে ফিরে যাবার অনুমতি দেয়।
জরগে যখন ধরা পড়লেন এবং সামান্যমাত্র অনুসন্ধানের ফলে জানা গিয়েছে তিনি বাঘা স্পাই, তখনই জাপান মন্ত্রিমণ্ডলী বিশ্বয়ে হতবাক। এ যে একেবারে অবিশ্বাস্য! এইমাত্র যে জাপানি হজুমি ওসাকির নাম বললুম সে লোকটি কী করে হয়ে গিয়েছিলেন প্রিন্স কনোয়ের সাতিশয় বিশ্বাসভাজন সহকর্মী। এই কনোয়েটি যে-সে ব্যক্তি নন। একে তো জাপানের তিন-চারটি খানদানিতম ঘরের একটির প্রিন্স ডিউক, তদুপরি তিনি তিন-তিনবার জাপানের প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন– এঁর আদেশেই জাপান ত্রিশক্তি চুক্তিতে যোগ দেয়, হিটলার ও মুসসোলিনির সঙ্গে এবং এরই রাজত্বকালে পাকা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। যদিও ঘোষণা করা হয় তার পদত্যাগের পরে। এবারে পাঠক তারিখগুলো লক্ষ করবেন। ১৯৪০-এর জুলাই থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪১ পর্যন্ত (ক্যাবিনেট পুনর্গঠনের জন্য মাত্র দুটি দিন বাদ দিয়ে) কনোয়ে ছিলেন জাপানের সর্বময় কর্তা এবং হজুমি ওসাকি ছিলেন তাঁর পরম বিশ্বাসী অন্তরঙ্গজন। বলা বাহুল্য গোপন মন্ত্রণাসভার আলোচনা–সিদ্ধান্ত ওসাকি কনোয়ের কাছে পেয়ে কমরেড জরগেকে গরম-গরম সরবরাহ করতেন এবং এই চোদ্দ মাসেই জাপানের এ যুগের ইতিহাসে সবচেয়ে মোক্ষম-মোক্ষম মরণ-বাচন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় (হিটলারের সঙ্গে দোস্তি, মার্কিনের সঙ্গে লড়াই)। একেবারে গাঁজাখুরি অবিশ্বাস্য ঠেকে যে, হিটলার-সখা কনোয়ের পরম বিশ্বাসী সহচর ছিলেন হিটলারবৈরী রুশের গুপ্তচর এবং তিনি জাপানের গোপনতম সিদ্ধান্ত স্তালিনকে পাঠাচ্ছেন হিটলারের বিনাশসাধনের জন্য। এবং হিটলার বিনষ্ট হলে যে আপন মাতৃভূমি জাপানের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী সে তত্ত্বটি বোঝার মতো এলেম নিশ্চয়ই এই ঝানু গুপ্তচরের পেটে ছিল। তিনি নাকি গুপ্তচরবৃত্তিতে তালিম পেয়েছিলেন জরগের কাছ থেকে। জরগে যে স্পাইদের গুরুর গুরু সেকথা তো পূর্বেই বলেছি।
১৭ অক্টোবর ১৯৪১-এ জরগে গ্রেফতার হন। ঠিক তার ৩২ দিন পূর্বে কনোয়ে মন্ত্রিত্ব পদে ইস্তফা দেন। এ দুটোতে কোনও যোগসূত্র আছে কি না আমার কাগজপত্র কেতাবাদি সে সম্বন্ধে নীরব। আমার মনে হয় পুলিশ কোনও গুপ্তচর সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়ামাত্রই তাকে গ্রেফতার করে না। বেশ কিছুদিন তাকে অবাধে চলাফেরা করতে দেয়। তার সহকর্মী চরদের চিনে নেয়। তার পর এক শুভ প্রভাতে বিরাট পেয়াজাল ফেলে সবকটা মাছ ধরে। ইতোমধ্যে কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান কনোয়েকে অবশ্যই জানানো হয়েছে যে, তার বিশ্বাসী ওসাকিই অশেষ পাপের পাপী পঞ্চম পাতকী। তার চেয়ে বেশি পাপী বিশ্বাসঘাতকী।
এত বড় কেলেঙ্কারির পর প্রধানমন্ত্রী থাকা যায় না। কনোয়ের রাজনৈতিক জীবন এখানেই চিরতরে খতম। ১৯৪৫-এ তিনি আত্মহত্যা করেন। কনোয়ে ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি খানদানি উচ্চকর্মচারীকে, জরগের নির্দেশে ওসাকি পারদর্শিতার সঙ্গে দিনের পর দিন পাম্প করেছিলেন।
সামসনের মতো জরগে পুরো এমারত ধূলিসাৎ না করতে পারলেও জাপান রাষ্ট্রের ভিতে যে ফাটল ফাটিয়ে যান সেটা কখনও মেরামত হয়নি।
———-
১. কোনও ফিলাটেলিস্ট পাকা খবর জানালে বাধিত হব।
২. শ্রদ্ধেয় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী-লেখকের উপকারার্থে মসলা নিবেদন। একখানা বৃহৎ ব্যাকরণ রচনা করার কয়েক বৎসর পর তিনি তারই একখানি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করেন। আমার সঙ্গে দেখা হলে পর দুষ্টু হাসি হেসে বললেন, এটা হল সংক্ষিপ্ত ব্যাকরণ; আগেরটা ছিল ক্ষিপ্ত ব্যাকরণ।
হিটলারের শেষ প্রেম
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১ মে রাত দশটার সময় হামবুর্গ বেতার কেন্দ্র তার উচ্চাঙ্গ সংগীত প্রোগ্রাম হঠাৎ বন্ধ করে দিয়ে ঘোষণা করলো–
আমাদের ফুরার আডলফ হিটলার বীরের ন্যায় মৃত্যুবরণ করেছেন।
যে সময়ে এ নিদারুণ ঘোষণাটি করা হয়, তখন প্রোগ্রামমাফিক কথা ছিল, ইঁদুর ধ্বংস করার উপায়। এই নিয়ে হিটলার-বৈরীরা এখনও ঠাট্টা-মশকরা করেন।
যেসব জর্মন বেতার-ঘোষণাটি শুনেছিল, তাদের অনেকেই যে বিরাট শক পেয়েছিল, সে নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। এদের অনেকেই সরলচিত্তে বিশ্বাস করত, আশা রাখত–যে হিটলার ক্রমাগত পঁচিশ বৎসর বহু উৎকৃষ্ট সংকটে যেন ভাগ্যবিধাতার অদৃশ্য অঙ্গুলি সংকেতে, অবলীলাক্রমে বিজয়পতাকা উড্ডীয়মান করে সেসব সংকট উত্তীর্ণ হয়েছেন, এবারেও তিনি আবার শেষ মোক্ষম ভেল্কিবাজি দেখিয়ে তাবৎ মুশকিল আসান করে দেবেন। তার অর্থ; যেসব রুশ-সৈন্য বার্লিন অবরোধ করেছে তারা স্বয়ং হিটলারচালিত আক্রমণে খাবে প্রচণ্ডতম মার, ছুটবে মুক্ত হয়ে মস্কো বাগে। সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন-ইংরেজ সৈন্যও পড়ি-মরি হয়ে ফিরে যাবে আপন আপন দেশে। রাহমুক্ত ফুরার পথপ্রদর্শক সর্বোচ্চ নেতা পুনরায় ইয়োরোপময় দাবড়ে বেড়াবেন।
এরা যে মোক্ষম শ পেয়েছিল সে তো বোঝা গেল। কিন্তু তার চেয়েও মোক্ষমতর শক্ পেল কয়েকদিন পর, যখন বেতার ঘোষণা করল, হিটলার আত্মহত্যা করার পনেরো ঘণ্টা পূর্বে এফা ব্রাউন নামক একটি কুমারীকে বিয়ে করেন। কারণ, জর্মনির দশ লক্ষের ভিতর মাত্র একজন হয়তো জানত যে, হিটলারের একটি প্রণয়িনী আছেন এবং তার সঙ্গে তিনি স্বামী-স্ত্রীরূপে বছর বারো-তেরো ধরে জীবনযাপন করছেন। নিতান্ত অন্তরঙ্গ যে কয়েকজন এই গুপ্তি প্রেমের খবর জানতেন, তারা এ বাবদে ঠোঁট সেলাই করে কানে ক্লফর্ম ঢেলে পুরো পাক্কা নিশ্চুপ থাকতেন। কারণ হিটলারের কড়া আদেশ ছিল, তার এই গুপ্তিপ্রেম সম্বন্ধে যে-কেউ খবর দেবে বা গুজব রটাবে, তিনি তার সর্বনাশ করবেন। তার কারণও সরল। তাঁর প্রপাগান্ডা মিনিস্টার গ্যোবেলস দিনে দিনে বেতারে খবরের কাগজের মারফতে হিটলারের যে মূর্তি গড়ে তুলেছিলেন (আজকের দিনের ইংরেজিতে তার যে ইমেজ নির্মাণ করেছিলেন সেটি সংক্ষেপে এই : হিটলার আজীবন ব্রহ্মচারী, তার ধ্যানধারণাসাধনা সর্বশক্তি তিনি নিয়োগ করেন, একমাত্র জর্মনির মঙ্গলসাধনে, হিটলার স্বয়ং অন্তরঙ্গ জনকে একাধিকবার বলেছেন, জর্মনিই আমার বধু (বাগদত্তা দয়িতা)। এমনকি তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজনেরও তত্ত্বতাবাশ করেন না। এটা সত্য, এ নিয়ে কোনও ঢাক ঢাক গুড় গুড় ছিল না। গোড়ার দিকে তিনি তাঁর বিধবা একমাত্র সদিদিকে মিউনিকের নিকটবর্তী তার বেৰ্ষটেশগার্ডেনের বাড়ি বের্গহকে গৃহকত্রীরূপে রাখেন। কিন্তু কিছুকালের মধ্যে সে বাড়িতে এসে পৌঁছলেন এফা ব্রাউন। যা আকছারই হয়- ননদিনী-ঠাকুরঝির সঙ্গে লাগল কোদল। হিটলারের অন্যতম বন্ধু বলেন, এস্থলে আরও আকছারই যা হয় তাই হল। পুরুষমানুষ, তায় হিটলারের মতো কর্মব্যস্ত পুরুষ, এসব মেয়েলি কোঁদলে কিছুতেই প্রবেশ করে একটা ফৈসালা করে দিতে সম্পূর্ণ নারাজ। তিনি চুপ করে বসে যাত্রাগান দেখলেন–অবশ্য অতিশয় বিরক্তিভরে। শেষটায় দিদিই হার মানলেন। হিটলার-ভবন ত্যাগ করে মিউনিকে আপন একটি ছোট্ট বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। হিটলার এর পর তাকে আর কখনও তার নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেননি। তার কিছুদিন পর সৎদিদি দ্বিতীয় বিবাহ করেন। হিটলার এটাতে ভয়ঙ্কর চটে যান। কেন, তা জানা যায়নি। বিবাহ-উৎসবে উপস্থিত তো হলেনই না, সামান্য একটি প্রেজেন্টও পাঠালেন না। উভয়ের মধ্যে যোগসূত্র চিরতরে সম্পূর্ণ ছিন্ন হল।
হিটলারের আপন মায়ের পেটের একটি সুন্দরী বোনও ছিল। তাঁকেও তিনি একবার তার বাড়ি বের্গহকে নিমন্ত্রণ করেন। তিনি ওই বাড়ির আরাম-আয়েসে এতই সুখ পেলেন যে, কাটালেন মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘকাল। হিটলার বিরক্ত হলেন এবং শেষ পর্যন্ত বোনের বিদায় নেওয়ার পর তাকে আর কখনও নিমন্ত্রণ জানাননি। এ নদীর সঙ্গে এফা ব্রাউনের কলহ হয়েছিল কি না সে বিষয়ে ঐতিহাসিকরা নীরব। ভাইবোন বলতে ইনিই হিটলারের একমাত্র মায়ের পেটের বোন। তার বিখ্যাত ভ্রাতা আডলফ হিটলারের মৃত্যুর পরও অবহেলিত এই বোন কয়েক বৎসর বেঁচে ছিলেন।
এই আপন বোন ও পূর্বে বর্ণিত সেই সংদিদি ছাড়া হিটলারের ছিলেন একটি বৈমাত্রেয় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, ওই সংদিদির বড় ভাই। নানা দেশে বহু কর্মকীর্তি করার পর ইনি এলেন বার্লিনে তাঁর সৎভাই জনির কর্ণধার হয়েছেন খবর শুনে। নাৎসি পার্টির দু-একজনকে চিনতেন বলে তাদের কৃপায় পারমিট জোগাড় করে খুললেন বার্লিনের উপকণ্ঠে একটা মদের দোকান বার। পার্টি-মেম্বাররা সেখানে যেতেন তো বটেই, তদুপরি বিশেষ করে সেখানে হুল্লোড় লাগাতেন দুনিয়ার যত খবরের কাগজের রিপোর্টার। ওনাদের মতলব, হিটলারের বাল্যজীবন সম্বন্ধে তস্য অগ্রজ ভ্রাতার কাছ থেকে গোপন তথ্য, রসালো চুটকিলা সংগ্রহ করে আপন আপন কাগজে টকঝাল পরিবেশন করা।
কিন্তু ব্রাদার আলওয়া হিটলার ছিলেন ঝাণ্ডু শুঁড়ি। পাছে তার কোনও বেফাঁস কথা কনিষ্ঠ ফুরার আডলফের কানে পৌঁছে যায় এবং তিনি চটেমটে তার মদের দোকানের পারমিটটি নাকচ করে দেন সেই ভয়ে তিনি ফুরার সম্বন্ধে একটিমাত্র কথা বলতে রাজি হতেন না। অনুজ যে কারণে-অকারণে ফায়ার হয়ে যান সেটা বড় বেরাদার বিলক্ষণ জানতেন।…হিটলারও তার সম্বন্ধে কখনও কোনও কৌতূহল দেখাননি।
পূর্বেই বলেছি, হিটলারের দাদা-দিদি-বোনের সঙ্গে তার যে কোনওপ্রকারের সম্পর্ক ছিল না, সেটা দিদি-বোনের পাড়াপ্রতিবেশী সখাসখী সবাই জানতেন। তাঁরাও সেটা আর পাঁচজনকে বলতেন। আহা! ফুরার জর্মনির ভবিষ্যৎ নিয়ে এমনই আকণ্ঠ নিমগ্ন যে তিনি তার আত্মীয়-স্বজন সম্বন্ধেও অচেতন। ক্রমে ক্রমে, গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে মৈত্র মহাশয় যাবে সাগরসঙ্গমে, এ স্থলে জর্মনির নগরে নগরে গ্রামে গ্রামে সংবাদটি রটে গেল, আবাল্য ব্রহ্মচারী জিতেন্দ্রিয় প্রভু হিটলার তার সব আত্মজনকে বিসর্জন দিয়ে একমাত্র জনির জন্য আত্ম-বিসর্জন দিচ্ছেন।
প্রপাগান্ডা মন্ত্রী গ্যোবেলস ঠিক এইটেই চাইছিলেন। তিনি সেই গুজবের দাবাগ্নিতে দিলেন ঘন ঘন কুলোর বাতাস। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ুক এ সত্য তত্ত্ব। বিশ্বজন আগের থেকেই জানত, হিটলারের জীবনধারণ পদ্ধতি ছিল চার্চিল এবং স্তালিন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। চার্চিলের মুখে জাগ্রতাবস্থায় সর্বক্ষণ অ্যাখোটা সিগার এবং বেলা-অবেলায় এক পেট খাঁটি স্কচ হুইস্কি। স্তালিনের ঠোঁটেও তদ্বৎ- তবে সিগারের বদলে খাঁটি রাশান পাপিসি (সিগারেট) এবং স্কচের বদলে তিনি অষ্টপ্রহর পান করতেন, হুইস্কির চেয়েও কড়া মাল ভোদকা শরাব। দুজনই সর্ববিধ গোশত গব গব করে গিলতেন। পক্ষান্তরে হিটলার ধূম্র এবং মদ্যপান করতেন না এবং তিনি ছিলেন ভেজিটারিয়ান। কাজেই তাকে জিতেন্দ্রিয় ব্রহ্মচারীরূপে বিশ্বজনের সম্মুখে তুলে ধরতে ড. গ্যোবেলুসের কল্পনার আশ্রয় অত্যধিক নিতে হয়নি।
হিটলারের মৃত্যুসংবাদ জর্মন জনগণকে যে শক দিয়েছিল, তার পর তারা যে মোক্ষমতর শ পেল তার সঙ্গে এটার কোনও তুলনাই হয় না।
যুদ্ধ-শেষে কয়েকদিন পর (মে ১৯৪৫) যে রুশ সেনাপতি জুকফ বার্লিন অধিকার করে তিনি প্রচার করলেন, আত্মহত্যা করবার পূর্বে হিটলার তার এক রক্ষিতাকে বিয়ে করেন।
সর্বনাশ! বলে কী! সেই জিতেন্দ্রিয় ব্রহ্মচারী যিনি
দারাপুত্র পরিবার
কে তোমার তুমি কার?
কিংবা কা তব কান্তা কত্তে পুত্রঃ ধ্যানমন্ত্রস্বরূপ গ্রহণ করে সুদীর্ঘ পঞ্চবিংশ বৎসর জর্মনির জন্য বিদ্রি ত্রিযামা যামিনী যাপন করলেন তিনি কি না শেষ মুহূর্তে ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্যবশত ধর্মচ্যুত হয়ে বিবাহ করলেন একটা রক্ষিতাকে! এ যে মস্তকে সর্পদংশন।
আজ যদি শুনতে পাই (এবং এটা অসম্ভব তথা আমি মাপ চেয়ে নিয়ে বলছি) যে ডিউক অব উইনজার তার দয়িতার সঙ্গে পরিপূর্ণ মিলনার্থে অবহেলে ইংলন্ডের সিংহাসন ত্যাগ করেন, তিনি তার সেই বিবাহিতা পত্নীকে ত্যাগ করে প্যারিসের কোনও গণিকালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তবে কি সেটা পয়লা ধাক্কাতেই বিশ্বাস করব।
জর্মনির জনসাধারণ প্রথমটা এ সংবাদ বিশ্বাস করতে চায়নি।
কিন্তু ব্যাপারটা তখন দাঁড়িয়েছে এই; যতক্ষণ ম্যাজিশিয়ান তার ভানুমতি খেল দেখায় ততক্ষণ দর্শক বেবাক নির্বাক হয়ে তাই দেবে, কিন্তু যে মুহূর্তে বাজিকর গুড নাইট বলে অন্তর্ধান করে তনুহূর্তেই আরম্ভ হয় বিপুল কলরব। কী করে এটা সম্ভব হল, কী করে এটা সম্ভব হল?–তাই নিয়ে তুমুল বাক-বিতণ্ডা! এবং দু-একটি লোক যারা ম্যাজিকের সঙ্গে কিছু কিছু পরিচিত তারা অল্পবিস্তর পাকা সমাধানও তখন দেয়।
এ স্থলেও তাই হল। হিটলার ম্যাজিশিয়ান যখন তার শেষ খেল দেখিয়ে ইহলোক থেকে অন্তর্ধান করলেন তখন আরম্ভ হল তুমুলতর অট্টরোল। এবং এ স্থলেও যারা হিটলারের অন্তরঙ্গজন– হিটলারি ম্যাজিকের অর্থাৎ এফা ব্রাউনের সঙ্গে তার সম্পর্ক সম্বন্ধে অল্পবিস্তর জানতেন– তারা এ বাবদে ঈষৎ ছিটেফোঁটা ছাড়তে আরম্ভ করলেন। এঁদের কাহিনী অবিশ্বাস করার উপায় ছিল না।
ইতোমধ্যে হিটলারের খাস চিকিৎসক ডাক্তার মরুল ধরা পড়েছেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি যা বলেন সেটা আমাদের ভাষায় বলতে গেলে, হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ- এফা ব্রাউন আর হিটলার একসঙ্গে বাস করতেন বইকি — হেঁ হেঁ হেঁ হে– এবং কিছু একটা হতে হয়তো–হেঁ হেঁ হেঁ হে।
এ সময়ে হিটলারের উইল দলিলটি আবিষ্কৃত হয়। এটি তিনি তার বিবাহের পরমুহূর্তেই ডিকটেট করে টাইপ করান এবং আপন স্বাক্ষর দেন। তাতে অন্যান্য বক্তব্যের ভিতর আছে;
যদ্যপি আমার সংগ্রামের সময় বিবাহ এবং তজ্জনিত দায়িত্ব গ্রহণ করার মতো আস্থা আমার ছিল না, তথাপি এখন, আমার মৃত্যুর পূর্বে আমি মনস্থির করে একটি রমণীকে বিবাহ করছি। আমাদের ভিতর ছিল বহু বৎসরের বন্ধুত্ব (ফ্রেন্ডশিপ = জনে ফ্রয়েন্টশফট) এবং বার্লিন যখন চতুর্দিক থেকে শত্রুসৈন্য দ্বারা পরিবেষ্টিত তখন তিনি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় আমার অদৃষ্টের অংশীদার হবার জন্য এখানে এসেছেন। তিনি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় আমার স্ত্রীরূপে আমার সঙ্গে মৃত্যুবরণ করবেন। আমি জনসেবায় নিয়োজিত ছিলুম বলে যে ক্ষতি হয়েছিল (অর্থাৎ একে অন্যের সঙ্গসুখ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলুম–অনুবাদ) তার ক্ষতিপূরণ এর দ্বারা হবে। (১)
এই এফা ব্রাউন রমণীটি কে?
আমি ইতোপূর্বে হিটলারের শেষ দশ দিবস তথা হিটলারের প্রেম সম্বন্ধে নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লেখার সময় উল্লেখ করি যে আমার জানামতে হিটলার তার জীবনে সবসুদ্ধ ১/২+১ + ১/২ = দুইবার ভালোবেসেছিলেন। প্রথম হাফ প্রেমকে ইংরেজিতে কাফ লাভ বলে। বাছুরের মতো ড্যাবডেবে চোখে দয়িতার দিকে তাকানো আর উদভ্রান্ত প্রেমের মতো গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলা বাঙাল দেশে যাকে বলে ঝুলে মরা। কারণ হিটলার তার হৃদয়েশ্বরীর সঙ্গে কখনও সাহসভরে আলাপচারী তো করেনইনি, এমনকি চিঠিপত্রও লেখেননি। হিটলার তখন ইংরেজিতে যাকে বলে টিনএজার। এ প্রেমটাকে সত্যকার রোমান্টিক পুতনিক প্রেম বলা যেতে পারে।
এর প্রায় বাইশ বৎসর পরে, যৌবনে, হিটলার পুরো-পাক্কা ভালোবেসেছিলেন গেলি রাউবাল নামক এক কিশোরীকে। এটিকে আমি পুরো এক নম্বর দিয়ে পূর্বোল্লিখিত হিটলারের প্রেম প্রবন্ধ রচনা করি। এটি স্থান পেয়েছে মল্লিখিত রাজা উজির পুস্তকে। এ অধম পারতপক্ষে কাউকে কখনও আমার নিজের লেখা পড়ার সলা-উপদেশ দেয় না, তবে যারা রগরগে রোমান্টিক প্রেমের গল্প ছাড়া অন্য রচনা পড়তে পারেন না, তারা এটি পড়ে দেখতে পারেন।
এই কিশোরী আত্মহত্যা করেন। হিটলারও হয়তো সেই শোকে আত্মহত্যা করতেন যদি না তার কতিপয় অন্তরঙ্গ বন্ধু–তার ফটোগ্রাফার বন্ধু, হমান প্রধানত যদি তাকে শব্দার্থে তিন দিন তিন রাত্রি চোখে চোখে রাখতেন।
এই দুটি—১/২+১ প্রেম হয়ে যাওয়ার পর হিটলার আরেক ১/২ প্রেমে পড়েন জীবনে শেষবারের মতো। এফা ব্রাউনের সঙ্গে। এটাকে আমি হাফ প্রেম বলছি এই কারণে যে, আজ পর্যন্ত উভয়ের কোনও অন্তরঙ্গজনই এদের ভিতর সঠিক কী সম্পর্ক ছিল সেটা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে বলতে পারেননি। একা ছিলেন অতিশয় নীতিনিষ্ঠ মধ্যবিত্ত ভদ্রঘরের কুমারী। হিটলার ভিন্ন অন্য কোনও পুরুষের প্রতি তিনি কদাচ আকৃষ্ট হননি। যে রমণী তার দয়িতের সঙ্গে সহমরণ বরণ করার জন্য স্বেচ্ছায় শক্ৰবেষ্টিত পুরীতে প্রবেশ করে, তাকে রক্ষিতা আখ্যা দিলে নিশ্চয়ই তার প্রতি অবিচার করা হয়।
পক্ষান্তরে এ তত্ত্বটিও নিষ্ঠুর সত্য যে, হিটলার সুদীর্ঘ বারো বৎসর ধরে একাকে বিয়ে করতে রাজি হননি। তিনি অবশ্য তার জন্য একাধিক যুক্তি দেখিয়েছিলেন। সেগুলো বিশ্বাস করা-না-করা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও রুচির ওপর নির্ভর করে। আমার মনে হয় তার সবকটা ভুয়ো নয়। এবং হিটলার সর্বদাই এ জাতীয় আলোচনার সর্বশেষে মধুরেণ সমাপয়েত করে বলতেন, জর্মনি ইজ মাই ব্রাইড = জর্মনি আমার (জীবনমরণের) বধূ। এরই ইঙ্গিত তিনি দিয়েছেন, তার শেষ উইল-এ।
অতএব এফা না ছিলেন হিটলারের রক্ষিতা, না ছিলেন তার বিবাহিতা স্ত্রী। সর্ব ঐতিহাসিক তাই বলেছেন, এ মোস্ট আনডিফাইন্ড স্টেট অর্থাৎ এদের ভিতর ছিল এমন এক সম্বন্ধ যেটা কোনও সংজ্ঞার চৌহদ্দিতে পড়ে না।
হিটলারের সঙ্গে এফার প্রথম পরিচয় হয় ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে। বাঘা ঐতিহাসিক (যদ্যপি আমার বিচারে তিনি ট্রেভার রোপার, বুলক, নামিরের ইত্যাদির কাছেই আসতে পারেন না) শয়রার যার নাৎসিদের সম্বন্ধে বিরাট ইতিহাসের ওপর নির্ভর করে নির্মিত একটা অতিশয় রসকষহীন ফিল ১৯৬৯-এর গোড়ার দিকে কলকাতা তক পৌঁছেছিল–ইনি বলছেন, যে গেলি রাউবালের সঙ্গে হিটলারের প্রণয় হয় তার আত্মহত্যার এক বা দুই বত্সর পর হিটলারের সঙ্গে এফা ব্রাউনের পরিচয় হয়। এ তথ্যটা সম্পূর্ণ বিশ্বাস্য নয়। কারণ একাধিক ঐতিহাসিক বলেন, আত্মহত্যা করার কয়েকদিন পূর্বে গেলি তার মামা (সম্পর্কে) হিটলারের স্যুট সাফসুরো করার সময় পকেটে হিটলারকে লিখিত এফা ব্রাউনের একখানা প্রেমপত্র পেয়ে যায়। গেলি আত্মহত্যা করার পর তার মা বলেন, এই চিঠিই গেলিকে আত্মহত্যার দিকে শেষ ঠেলা দেয়–অবশ্য একথা কারুর কাছেই অবিদিত ছিল না, গেলির মা এফাকে এমনই উৎকট ঘৃণা করতেন যে পারলে তার চোখদুটো ছোবল মেরে তুলে নিয়ে, রোস্ট করে তার প্যারা কুকুরকে খেতে দিতেন।
গেলি হয়তো চিঠিখানা পেয়েছিল কিন্তু সে-চিঠি যে তার হৃদয়ে কোনও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল সে বিশ্বাস আমার হয় না। কারণ গেলিকে যিনি সবচেয়ে বেশি চিনতেন সেই হান বলেছেন, গেলি ভালোবাসত ভিয়েনাবাসী এক কলেজের ছোকরাকে, সে প্রকৃতপক্ষে কখনও তার মামার প্রেম নিবেদনের প্রতিদান দেয়নি। তদুপরি আরেকটি কথা আছে, হিটলার তখন গেলির প্রেমে অর্ধোদি। এফার সঙ্গে এমনি গতানুগতিক আলাপ হয়েছে। সে মজে গিয়ে হিটলারকে প্রেমপত্র লিখেছে- তরুণীরা আকছারই এরকম করে থাকে এবং হিটলার এ ধরনের চিঠি পেতেন গণ্ডায় গণ্ডায় এবং নিশ্চয়ই এফার এ চিঠি সিরিয়াসলি নেননি।
হিটলারের সঙ্গে এফার প্রথম পরিচয় হল হিটলার-সখা ফটোগ্রাফার হমানের স্টুডিয়োতে। মধ্যবিত্ত সমাজের কুমারী কন্যা যতখানি লেখাপড়া করে সেইটে সেরে তিনি হফমানের স্টুডিয়োতে অ্যাসিসটেন্টের কর্ম নেন। তার কাজ ছিল, খদ্দেরদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা এবং ডার্করুমে কিছুটা সাহায্য করা। সেই সূত্রে হফমান নিতান্ত প্রফেশনালি হিটলারের সঙ্গে এফার আলাপ করিয়ে দেন।
হিটলারের কৈশোর ও প্রথম যৌবন কাটে ভিয়েনা নগরে। সে নগরের নাগরিকরা ডানসিং, ফ্লার্টিং, প্রণয়-মিলন, পরকীয়া শিভালরিতে অনায়াসে প্যারিসের সঙ্গে পাল্লা দেয়। হিটলারও রমণীসঙ্গ খুবই পছন্দ করতেন। জর্মনির সর্বময় কর্তা হওয়ার পর তিনি তার অন্তরঙ্গজনকে একাধিকবার গল্পচ্ছলে বলেছেন, এসব বড় বড় হোটেলের গাড়োলরা যে পুরুষ ওয়েটার রাখে, তার মতো ইডিয়টিক আর কী হতে পারে! এটা তো জলের মতো স্বচ্ছ যে, সুন্দরী যুবতী ওয়েট্রেস রাখলে ঢের ঢের বেশি খদ্দের জুটবে। আমার জীবনে ট্র্যাজেডি যে, রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে যখন আমি কোনও স্টেট-ব্যাঙ্গুয়েটে বসি, আমাকে বাধ্য হয়ে ডাইনে এবং বায়ে বসাতে হয় দুই বুড়ি-হাড়িকে। কারণ তাদের স্বামীরা দুই বুড়ো-হাবড়া রাষ্ট্রমন্ত্রী বা ভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি … ওহ, সে কী গযন্ত্রণা। খুশ-এখতেয়ার থাকলে তার বদলে আমি যে কোনও অবস্থায় ছোট্ট একটি নাম-নাজানা রেস্তোরাঁয় একটি উঁকি ওয়েট্রেসের সঙ্গে মেয়েদের বেতন কম বলে কন্টিনেন্টে ছোট রেস্তোরাঁই শুধু ওয়েট্রেস রাখে) দু-দণ্ড বসালাপ করতে করতে না হয় সামান্য ডাল-ভাতই (ওদের ভাষায় দুই পদী খানা) খাব–জাহান্নামে যাক স্টেট ব্যাঙ্গুয়েটের বাহান্ন পদি কোর্মা-কালিয়া, বিরয়ানি-তন্দুরি (ওদের ভাষায় শ্যাম্পেন কাভিয়ার ইত্যাদি ইত্যাদি)।
তাই হিটলারের অ্যারোপ্লেনে রাখা হতো খাবসুরৎ হুরি, স্টুয়ার্ডেস। কিন্তু একথা সবাই বলেছেন, হিটলার উচ্ছল চরিত্রের লোক ছিলেন না।
এস্থলে নাগর পাঠককে সবিনয় নিবেদন করি, এফা ব্রাউন ছিলেন সত্য সত্যই চিত্তহারিণী অসাধারণ সুন্দরী। কিশোরী-যুবতীর সেই মধুর সঙ্গমস্থলে। কিন্তু এ-বেরসিক লেখক নারী-সৌন্দর্য বর্ণনে এযাবৎ বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি বলে নাগর রসিক পাঠককে এস্থলে সে রস থেকে সে বঞ্চিত করতে বাধ্য হল।
এফা সুন্দরী তো ছিলেনই তদুপরি স্টুডিয়োতে যেসব খানদানি বিত্তশালিণী তরুনী যুবতী ছবি তোলাতে আসতেন, এফা তাদের আচার-আচরণ থেকে অনেক কিছু শিখে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে তাদের বেশভূষা এবং অলঙ্কারাদি।… পরবর্তীকালে যখন তার অর্থের কোনওই অভাব ছিল না তখনও তার বেশভূষাতে রুচিহীন আড়ম্বরাতিশয্য প্রকাশ পায়নি। তাঁর অর্থবৈভব শুধু একটি অলঙ্কারে প্রকাশ পেত। তার বাঁ হাতে বাঁধা থাকত মহার্ঘ বিরল হীরেতে বসানো একটি ছোট্ট রিস্টওয়াচ। জনির মতো দেশের ফুরার যদি প্রিয়াকে তার জন্মদিনে একটি হাতঘড়ি উপহার দেন, তবে সেটি কী প্রকারের হবে, সেটা কল্পনা করার ভার আমি বিত্তশালী পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিচ্ছি।
গোড়ার দিকে হিটলার এফাকে খুব বেশি একটা লক্ষ করেননি।
এদিকে গেলির মৃত্যুর পর হিটলারের জীবন বড়ই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল।
সখা হফমান তখন তার চিত্তবিনোদনের জন্য সুযোগ পেলে হিটলারের প্রিয় অবসর যাপন পদ্ধতি অবলখন করতেন। হিটলারকে নিয়ে যেতেন মিউনিকের আশপাশের হ্রদবনানীতে পিকনিকে। সঙ্গে থাকতেন হমানের স্ত্রী, ফটো স্টুডিয়োর দু-একজন কর্মচারী এবং এফা ব্রাউন।
ক্রমে ক্রমে হিটলার শ্রীমতী এফা ব্রাউনের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলেন।
এর পর দেখা গেল, হমান যদি পক্ষাধিককাল কোনও পিকনিকের ব্যবস্থা না করতেন তবে স্বয়ং হিটলার তার ফ্ল্যাটে উপস্থিত হয়ে বলতেন, হেঁ হেঁ, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলুম, তাই আপনার এখানে ঢুঁ মারলুম। তার পর কিঞ্চিৎ ইতিউতি করে বলতেন, যা ভাবছিলাম… একটা পিকনিকের ব্যবস্থা করতে হয়, আপনারা তো আছেনই, আর হে হেঁ, ওই ফ্রলাইন ব্রাউনকে সঙ্গে নিয়ে এলেও মন্দ হয় না–কী বলেন?
তখনও হিটলার এফার প্রেমে নিমজ্জিত হননি এবং কখনও হয়েছিলেন কি না, সে-বাবদে আমার মনে গভীর সন্দেহ আছে। পরবর্তী কাহিনী পড়ে সুচতুর অন্তত আমার চেয়ে চতুর– পাঠক-পাঠিকা প্রেম বাবদে আপন আপন অভিজ্ঞতাপ্রসূত কূটবুদ্ধি দ্বারা আপন আপন সুচিন্তিত এবংকিংবা সহৃদয় অভিমত নির্মাণ করে নিতে পারবেন।
ইতোমধ্যে কিন্তু শ্রীমতী এফা হিটলার প্রেমের অতলান্ত সমুদ্রের গভীর থেকে গভীরতরে বিলীন হচ্ছেন। আর হবেনই-না কেন? যদ্যপি হিটলার তখনও রাষ্ট্রনেতা হননি, তথাপি তাবৎ জর্মনির সবাই তখন জানত, রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবুর্গ যে কোনও দিন তাকে ডেকে বলবেন প্রধানমন্ত্রীরূপে দেশের শাসনভার গ্রহণ করতে। তদুপরি, পূর্বেই বলেছি, হিটলার ছিলেন রমণীচিত্তহরণের যাবতীয় কলাকৌশলে রপ্ত।… এবং সর্বোপরি তিনি প্রায়ই অবরোবরে এফাকে দিতেন ছোটখাটো প্রেজেন্ট। বিত্তশালীজন তার দয়িতাকে যেরকম দামি দামি ফার কোট, মোটরগাড়ি দেয়, সেরকম আদৌ ছিল না–তিনি দিতেন চকলেট, ফুল বা ভ্যানিটি কেস (আমাগো রাষ্ট্রভাষায় যারে কয় ফুটানি কি ডিবিয়া)।
সব ঐতিহাসিক বলেছেন, এফা ছিলেন রাদার এমৃটি-হেডেড অর্থাৎ সরলা বুদ্ধিহীনা। কিন্তু তাতে কী এসে-যায়? অম্মদেশীয় এক বৃদ্ধ চাটুয্যে মহারাজকে জনৈক অর্বাচীন শুধিয়েছিল প্রেমের খবর তিনি রাখেন কি, তিনি বৃদ্ধ, তার কটা দাঁত এখনও বাকি আছে? গোস্সাভরে তিনি যা বলেন তার মোন্দা– ওরে মূর্খ, প্রেম কি চিবিয়ে খাবার জিনিস যে দাঁতের খবর নিচ্ছিস? প্রেম হয় হৃদয়ে। বিলকুল হক কথা। এবং সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলতে পারতেন, প্রেম নামক আদিরসটি মস্তিষ্ক থেকে সঞ্চারিত হয় না।
তাই এফা ওইসব চকলেটাদি সওগাত বান্ধবী, সহকর্মীদের ফলাও করে দেখাত, পিকনিকের বর্ণনা ফলাওতর করে সবিস্তর বাখানিত এবং ভাবখানা এমন করত যে, হিটলার তার প্রেমে রীতিমতো ডগোমগোজরোজরোমরোমরো।
এস্থলে ইয়োরোপীয় সরল কুমারীরা যা সর্বত্রই করে থাকে এবং অধুনা কলকাতা-ঢাকাতে তাই হচ্ছে) একা তাই করলেন। নির্জনে একে অন্যে যখন দুই দুহ, কুহু কুহু তখন আশকথা-পাশকথার মাঝখান দিয়ে যেমন টেবিলের ফুলদানির দেখা-না-দেখার ফুলের মাঝখান দিয়ে জনে একে বলে প্রু দ্য ফ্লাওয়ারস- বিবাহ নামক সেই প্রাচীন সনাতন প্রতিষ্ঠানের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা দিলেন। নিশ্চয়ই একাধিকবার।
পূর্বেই বলেছি, হিটলার কিন্তু পৈতে চুয়ে কসম খেয়ে বসে আছেন, বিবাহবন্ধন নামক উদ্বন্ধনে তিনি কাট্যা ফালাইলেও দোদুল্যমান হতে নিতান্তই অনিচ্ছক। এবং ঝাৎ ডিপ্লোমেট এই অস্বস্তিকর বাক্যালাপ কী করে এড়াতে হয়, সেটা খুব ভালো করেই জানতেন।
এটা বুঝতে সরলা, নীতিশীল পরিবারে পালিতা এফার একটু সময় লেগেছিল। ইতোমধ্যে তার রক্ষণশীল পিতামাতা এফার সঙ্গে হিটলারের ঢলাঢলির খবর পেয়ে গিয়েছে। তারা মেয়েকে বুঝিয়ে দিলেন হয় হিটলার তোমাকে বিয়ে করুক, নয় তুমি তার সঙ্গ ত্যাগ কর।
পিতামাতার প্রতি বিঘ্ৰা এই কুমারী তখন কী করে?
হঠাৎ ওই সময়ে একদিন হফমান সখা হিটলারকে টেলিফোন করলেন যদুর সম্ভব তাড়াতাড়ি আমার বাড়ি চলে আসুন।
হিটলার : কেন, কী হয়েছে?
হফমান : আসুন না, সবকথা এখানে হবে। হফমান এবং হিটলার দুজনেই জানতেন তাদের টেলিফোনের কথাবার্তা পুলিশ ট্যাপ করে।
হিটলার কয়েক মিনিটের মধ্যেই হমানের ফ্ল্যাটে পৌঁছলেন। শুধোলেন, কী হয়েছে ব্যাপার কী?
হফমান : বড় সিরিয়াস। এফা পিস্তল দিয়ে বুকে গুলি মেরে আত্মহত্যা করার চেষ্টা নেয়। তাকে অচৈতন্য অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়–
বিদুৎস্পৃষ্টের ন্যায় হিটলার বাধা দিয়ে বললেন, কিন্তু জানাজানি হয়নি তো- তা হলেই তো সর্বনাশ!
এস্থলে লক্ষণীয় যে, হিটলার দুঃসংবাদ পাওয়ামাত্রই সর্বপ্রথম নিজের স্বার্থের কথাই ভেবেছেন। তার পার্টি এবং বিশেষ করে গ্যোবেলস সাধারণ্যে তার যে ইমেজ গড়ে তুলছিলেন, সেটা জিতেন্দ্রিয় ব্রহ্মচারীর। এখন যদি তার দুশমন কম্যুনিস্টরা জেনে যায় যে, তিনি গোপনে একটা মেয়ের সঙ্গে ঢলাঢলি করতেন এবং সেই সরলা কুমারী যখন যুক্তিসঙ্গত নীতিসম্মত পদ্ধতিতে হিটলারকে সেই ভাব-ভালোবাসার অন্তে যে প্রতিষ্ঠান থাকে, অর্থাৎ বিবাহ, সেটা প্রস্তাব করে তখন তিনি ধড়িবাজ, কাপুরুষ, বেইমানের মতো মেয়েটাকে ধাপ্পা মারেন, এবং ফলে ভগ্নহৃদয় কুমারী আত্মহত্যার চেষ্টা করে, তবেই তো চিত্তির! যে নাৎসি পার্টির নেতা এরকম একটা পিশে সে পার্টির কী মূল্য এই বেইমান পার্টিতে আস্থা রাখবে কোন দ্ৰ ইমানদার জর্মন এবং তুললে চলবে না, মাত্র বছর দুই পূর্বে গেলি রাউলও আত্মহত্যা করে। যদিও সে সময় কম্যুনিস্টরা সেই সুবর্ণ সুযোগের সিকি পরিমাণ ফায়দাও ওঠাতে পারেনি, অর্থাৎ একসপ্লয়েট করতে পারেনি।
কিন্তু মাভৈঃ! কন্দর্প নির্মিত এসব সংকটে প্রায়শ তিনি বিধাতার ন্যায়নীতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে প্রেমিক-প্রেমিকার তাবৎ মুশকিল আসান করে দেন।
হফমান সঙ্গে সঙ্গে হিটলার তথা নাৎসি পার্টির জীবনমরণ সমস্যা সমাধান করে বললেন, নিশ্চিন্ত থাকুন। জানাজানি হয়নি। কারণ এফাকে অচৈতন্য অবস্থায় যে সার্জনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তিনি আমার নিকট-আত্মীয়। তাকে এমনভাবে কড়া পাহারায় রেখেছেন যে, পুলিশ পর্যন্ত সেখানে পৌঁছতে পারেনি। তিনি স্বয়ং আমাকে খবরটা জানিয়েছেন।
তখন, এই প্রথম হিটলার প্রেয়সীর অবস্থা সম্বন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। না– ফাড়াকেটে গিয়েছে, তবে এফা রক্তক্ষরণহেতু বড়ই দুর্বল।
শুধু এফার ফাঁড়া কেটে গেল তাই নয়, স্বয়ং হিটলার এবং নাৎসি পার্টিরও ফাড়া কেটে গেল। অবশ্য কিছুটা কানাঘুষো হয়েছিল, কিন্তু জানাজানি হয়নি।
ব্যক্তিগত সম্পর্কে হিটলার যে খুবএকটা নেমকহারাম ছিলেন তা নয়। এই আত্মহত্যার প্রচেষ্টা থেকে হিটলার বুঝে গেলেন এফার প্রেম কতখানি গভীরবতার ব্রেন-বায়ে কিছু থাক আর না-ই থাক, তার গলা থেকে নাভিকুণ্ডলী অবধি জুড়ে বসে আছে একটা বিরাট যুদয় সেখানে না আছে ফুসফুল, না আছে লিভার সৃপ্লিন কিডনি না আছে অন্য কোনও যন্ত্রপাতি।
এ হেন হৃদয়কে তো অবহেলা করা যায় না।
এতদিন হিটলার যে প্রেম করতেন এফার সঙ্গে সেটার পদ্ধতি ছিল মোটামুটি জন কলেজ-স্টুডেন্টরা তাদের বান্ধবীর (ফ্রয়েভিন–গার্ল ফ্রেন্ডের সঙ্গে যেভাবে করে থাকে। অর্থাৎ সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর একা তার নাইটগাউন ইত্যাদি রাত্রের পোশাক একটি অতি ছোট্ট সুটকেসে পুরে চুপিসাড়ে ঢুকতেন হিটলারের ফ্ল্যাট বাড়িতে। বাড়ির পাঁচজন জেগে ওঠার পূর্বেই, ভোরবেলা, ফের চুপিসাড়ে চলে যেতেন আপন ফ্ল্যাটে।
এবার হিটলার করলেন ভিন্ন ব্যবস্থা। ততদিনে তিনি রীতিমতো বিত্তশালী হয়ে গিয়েছেন। হিটলারের আপন কর্মস্থল মনিক শহরে তিনি এষার জন্য ছোট্ট একটি ভিলা, মোটর কিনে দিলেন এবং মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিলেন।
অর্থাৎ তিনি হিটলারের একমাত্র রক্ষিতা হিসেবে হিটলারমণ্ডলীতে আসন পেলেন। এস্থলে রক্ষিতা বলাটা হয়তো ঠিক হল না। কারণ ইয়োরোপের প্রায়ই অনেকে কয়েক বৎসর পরে এই রক্ষিতাকে বিয়ে করে তাকে সমাজে তুলে নেন। এবং সমাজপতিরাও বধূর অতীত সম্বন্ধে কোনও প্রশ্ন তোলেন না। আরেকটি দৃষ্টান্ত দিই : এদেশে যদি বিয়ের তিন-চার মাস পর কোনও রমণী বাচ্চা প্রসব করে, তবে হইচই পড়ে যায়। ইয়োরোপে আদৌ না। আমার যতদূর জানা গির্জা পর্যন্ত কোনও প্রশ্ন না তুলে বাচ্চাটাকে ব্যাপ্টিস্ট করে তাকে ধৰ্মত সমাজে তুলে নেয়।
অবশ্য হিটলার সমস্ত ব্যবস্থাটা করলেন অতিশয় গোপনে। পূর্বেই বলেছি, তার এবং এফার চাকর মেড় তথা অতিশয় অন্তরঙ্গজন হাড়ে-মাসে জানতেন তারা যদি এই প্রণয়লীলা নিয়ে সামান্যতম আলোচনা করেন–বাইরের লোককে খবরটা জানাবার তো কথাই ওঠে না তা হলে তিনি পার্টির জব্বর পাণ্ডাই হন আর জমাদারণীই হোক, তাঁরা যে তদ্দশ্বেই পদচ্যুত বহিস্কৃত হবেন তাই নয়, কপালে গুম-খুনও অনিবার্য। কারণ হিটলার বহু বিষয়ে নির্মম। এদেশের কর্ণধার হওয়ার পূর্বে এবং পরেও হিটলার- হিলার বিস্তর গুম-খুন করিয়েছেন।
ওদিকে এফার যে ধার্মিক চরিত্ৰশীল জনক-জননী হিটলারের সঙ্গে তাদের কুমারী কন্যার অন্তরঙ্গতার কঠোর কঠিনতম প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তারাও এ ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত স্বীকার করে নিলেন। এটাকে প্রতিরোধ করলে একওয়ে মেয়ে যদি আবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে, এবং যদি সফল হয়ে যায়!
আমার দুঃখ শুদ্ধ-পাঠটি আমাদের মনে নেই : মোটামুটি যে মেয়ে–
মরণেরে করিয়াছে জীবনের প্রিয়।
কারও কোনও উপদেশ কান দিবে কি ও?
এফার নিতান্ত ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গজন ছাড়া আর সবাই বিশ্বাস করত, এফা ফটোগ্রাফ দোকানে কাজ করেন। তিনি হমানের স্টুডিয়োতে প্রতিদিন হাজিরা দিতেন।
.
এর কিছুদিন পরে ১৯৩৩-এর ৩০ জানুয়ারি হিটলার হয়ে গেলেন জর্মনির কর্ণধার– প্রধানমন্ত্রী চ্যানসেলার। তাকে তখন স্থায়ীভাবে বাস করতে হল বার্লিনে–্যুনিক পরিত্যাগ করে। এখন তিনি এফাকে নিয়ে পড়লেন বিপদে। এতদিন শুধু কম্যুনিস্টরাই তাদের আধা-পাকা গোয়েন্দাগিরি করেছে হিটলারের। এবারে জুটলো তাবৎ মার্কিন খবরের কাগজের দুদে দুদে রিপোর্টার পূর্বোক্ত ঐতিহাসিক শায়রারও তাদেরই একজন। এদের চোখ দু-নলা বন্দুকের মতো গভীর অন্ধকারেও এক্স-রে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে জানে শিকারের দিকে। এবং কারও যে কোনও ব্যক্তিগত জীবনের প্রাইভেসি থাকতে পারে সেটা তাদের শাস্ত্রে-আদৌ যদি তাদের কোনও শাস্ত্র থাকে লেখে না। পাঠক শুধু স্বরণে আনুন ইংল্যান্ডের রাজা যখন মিসেস সিমনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে তখন সে কেচ্ছাকে তারা কী কেলেঙ্কারির রূপ দিয়ে দিনে দিনে রসিয়ে রসিয়ে মার্কিন কাগজে প্রকাশ করেছে। তার তুলনায় হিটলার কোন ছার! ব্যাটা আপস্টার্ট যুদ্ধের সময় ছিল নগণ্য করপোরেল– তার আবার প্রাইভেট লাইফ! সেটাকেও আবার রেহাই দিতে হবে! হোঃ!
কাজেই এফাকে বার্লিনে আনা অসম্ভব।
ফলস্বরূপ ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫-এ হিটলারের আত্মহত্যা করা পর্যন্ত সুদীর্ঘ বারোটি বৎসর কবির ভাষায় নারীজীবনের শ্রেষ্ঠ দ্বাদশ বৎসর একা পেলেন আগের তুলনায় অল্পই, এবং ক্রমশ হ্রাসমান। তাই সহমরণের বহু আগে থেকেই একা একাধিক বন্ধুবান্ধবীকে বিষণ্ণকণ্ঠে বলেছেন, ১৯৩৩-এর জানুয়ারি (অর্থাৎ হিটলার যেদিন চ্যানসেলর হন) আমার জীবনের সর্বাপেক্ষা নির্মম দিবস ট্র্যাজিক ডে, ট্রাগিশা টাখ।
যেদিন মিত্রপক্ষ ফ্রান্সে অবতরণ করে কালক্রমে জমনি জয় করে সেটাকে বলা হয় ডি-ডে (DDay)। সেটা ৬ জুন ১৯৪৪। ১৯৩৩-এর ৩০ জানুয়ারিতেই কিন্তু আরম্ভ হয় অভাগিনী এফার ডি-ডে। কিন্তু এসব কথা পরে হবে।
বার্লিনে কর্মব্যস্ত হিটলার অ্যানিকে আসার সুযোগ পেতেন কমই। কিন্তু প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা মনিকে ট্রাককল করে তার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ ধরে আলাপ করে নিতেন। এবং টেলিফোন লাইনটি এমনভাবে নির্মিত ছিল যে, এফা-হিটলার কনেকশান হয়ে যাওয়া মাত্রই দুই প্রান্তের টেলিফোন অপারেটররা কিছুই শুনতে পেত না।… এবং যে স্থলে ট্রাকলের অষ্টপ্রহরব্যাপী এহেন সুবিধা সেখানে চিঠিচাপাটির বিশেষ প্রশ্ন ওঠে না– ওদিকে আবার চিঠিপত্র লেখার ব্যাপারে হিটলার ছিলেন হাড় আলসে। (জর্মনে স্টিভঙ্কেতের শ্রাইবফাউল দুর্গন্ধময় লেখন-আলসে)। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন আক্ষরিক অর্থে হিটলারের দম ফেলার ফুরসত নেই, ক্রমাগত একটার পর আরেকটা মিলিটারি কনফারেন্স হচ্ছে–তখন তিনি তার অন্তরঙ্গতম ভ্যালে লিঙেকে বলতেন, হে লিঙে, তুমি ঝপ করে একাকে দুটি লাইন লিখে দাও না। তখন প্রায় ঘন্টায় ঘন্টায় হিটলারের কোনও-না-কোনও কর্মচারী প্লেনে করে মনিক যাচ্ছে। ঘন্টা তিনেকের ভিতর চিঠি এফার হস্তগত হত।
ভ্যালে বলতে ভৃত্যও বোঝায়। কাজেই পাঠক নিশ্চয়ই মর্মাহত হয়ে শুধাবেন, কী! চাকরদের দিয়ে প্রিয়ার উদ্দেশে চিঠি লেখানোর সৎ বেআদবি তো বটেই তার চেয়ে বটতলার সচিত্র প্রেমপত্র থেকে দু-পাতা কেটে নিয়ে খামে পাঠিয়ে দেওয়া ঢের ঢের বেশি শৃঙ্গাররসসম্মত! কিন্তু পাঠককে স্বরণ করিয়ে দিই- হিটলার, এফা ও ভ্যালে লিঙে তিনজনই ছিলেন নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক। এমনকি লিঙের সামাজিক (রাজনীতির কথা হচ্ছেনা) প্রতিষ্ঠা ছিল হিটলারের চেয়ে উচ্চতর পর্যায়ের। তদুপরি, হিটলারের হাজার হাজার খাস সেনানীর (এস-এ) মাঝখান থেকে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর লিঙেকে বেছে নেওয়া হয়েছিল এবং সেনাবাহিনীতে তিনি ছিলেন প্রায় কর্নেলের কাছাকাছি। এবং সর্বশেষ বক্তব্য, হিটলার মনিকে এলেও তার অধিকাংশ সময় কাটত রাষ্ট্রকার্যে। সে সময় ঘন্টার পর ঘন্টা এফাতে-লিঙেতে সময় কাটাতেন গালগল্প করে। এফা জানতেন, পুরুষদের ভিতর লিঙেই দশ-বারো বছর ধরে হিটলারের সবচেয়ে নিকটবর্তী এবং হিটলারও তার সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতেন। একা মেয়েদের ভিতর সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তিনী। অতএব দুজনার ভিতর একটা অন্তরঙ্গতা জমে ওঠা খুবই স্বাভাবিক। আমার মনে হয়, একা এই লিঙেকে তার হৃদয়বেদনা যতখানি খুলে বলেছেন, অন্য আর কাউকে অতখানি বলেননি।(২)
অন্যত্র সবিস্তর লিখেছি, হিটলারের মৃত্যুর পর লিঙে শহন্তে বন্দি হন এবং দীর্ঘ বসর রুশ-কারাগারের দুঃসহ ক্লেশ সহ্য করার পর জর্মনিতে ফিরে এসে হিটলার সম্বন্ধে একখানি চটিবই লেখেন। এফা সম্বন্ধে কৌতূহলী পাঠক এই পুস্তিকায়ই তার সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে বিশ্বাস্য খবর পাবেন। হিটলার সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন নিরপেক্ষ দৃষ্টিবিন্দু থেকে, কিন্তু এফা সম্বন্ধে লিখেছেন বড়ই দরদ-ব্র ভাষায়। তিনি ইচ্ছে করলেই হিটলার-এফার সম্পর্ক সম্বন্ধে রগরগে মার্কিনি ভাষায় কেলেঙ্কারি কেচ্ছা লিখতে পারতেন– কোনও সন্দেহ নেই তিনি রুশ দেশ থেকে পশ্চিম জর্মনিতে ফেরা মাত্রই মার্কিন রিপোর্টাররা তাকে চেপে ধরে, অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে হিটলার-এফার নব বিদ্যাসুন্দরের জন্য আপ্রাণ পাম্প করেছিল কিন্তু সেসময় বিশেষ কিছু তো বলেনইনি, পরেও পুস্তিকা রচনাকালে লিখেছেন যেটুকু নিতান্তই না লিখলে সত্য গোপন করে এফার প্রতি অবিচার করা হয়। এই অন্তর্নিহিত শালীনতাবোধ ছিল বলেই হিটলার ও এফা উভয়েই তাকে বন্ধুর চোখে দেখতেন। এটা এমন কিছু সৃষ্টিছাড়া আজগুবি ব্যাপার নয়। এ দেশের পাঠান দাসবংশের ইতিহাস যারা মন দিয়ে পড়েছেন, তারাই এর সত্যতার নজির সে ইতিহাসে পাবেন এবং লিঙে তো কিছু ক্রীতদাস নন!!
তাই এফাতে-লিঙেতে এমনিতেই চিঠিপত্র চলত। হিটলার সেটা জানতেন। তাই তিনি যে কাজকর্মে আকণ্ঠ নিমগ্ন, তিনি যে কোন করার জন্য মন্ত্রণাকক্ষ ত্যাগ করে পাঁচ মিনিটের তরেও আপন খাস কামরায় যেতে পারছেন না, এটা তার গাফিলতি নয়, বস্তুত তার এই অপারগতা সম্বন্ধে তিনি নিজেকে দোষী মনে করেন এসব কথা লিঙেকে গুছিয়ে লিখতে বলতেন।
হিটলার যে এফাকে কখনও বার্লিনে আসতে দিতেন না, তা নয়। অবশ্য অতিশয় কালেকশ্বিনে। জব্বর পার্টি-পরবের স্টেট ব্যাঙ্কুয়েট না থাকলে অন্তরঙ্গজন তথা এফার সঙ্গে তিনি ডিনার-লাঞ্চে বসতেন। এফাকে তার বাঁ দিকের চেয়ারে বসাতেন। এফা ঠিকমতো খাচ্ছেন কি না, তার পছন্দসই খানা তৈরি হয়েছে কি না তাই নিয়ে পুতুপুতু করতেন এবং সবাই বুঝতে পারত তিনি এষাকে সর্বাপেক্ষা বেশি সম্মান দেখাচ্ছেন। কিন্তু যেদিন স্টেট ব্যাঙ্কুয়েট বা বাইরের লোক খানা খেতে আসত, সেদিন এফাকে উপরের তলায় হিটলারের চারজন মহিলা সেক্রেটারি ও তার খাদ্যরন্ধনের অধিকত্রীর(৩)সঙ্গে খানা খেতে হত। অবশ্য এ ব্যবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হল, যখন হিটলারের দফতরের এক উক্ত অফিসার, ফেগেলাইন বিয়ে করলেন এফার এক বোনকে। তখন হিটলার-সমাজের একটুখানি বৃহত্তর চক্রে এফাকে পরিচয় দেওয়া হত, সম্মানিত অফিসার ফেগেলাইনের শ্যালিকারূপে? মায়ের ছেলে নয়, শাড়ির মেয়ের বর!
বিরাট বিরাট লক্ষজন পরিপূর্ণ সভাতে, যেখানে হিটলার ওজস্বিনী বস্ত্রভাষিণী খাপ্তারি লেকচার ঝাড়বেন, সেখানে তাকে বিশেষ আসন দেওয়া হত না। তার এবং হিটলারের আর পাঁচজন কর্মচারীর সঙ্গে তিনি সবার সঙ্গে মিশে গিয়ে দয়িতের জনগণমনচিত্তহারিণী বক্তৃতা শুনতেন।
হায়! একে কী বলব বড় দুঃখে সুখ বা বড় সুখে দুঃখ? আমি এবাবদে মূর্খ–আবার বিদ, সম্মানিত সখা ব্রিাম এরকম একটা মোকা পেলে ঝপ করে একটা অকল্পনীয় পান করে খ করে একটা আরও অচিন্তনীয় সুমধুর সুভাষিত ম্যাক্সিম বানিয়ে ফেলতেন পুরো দেড় গণ্ডা শব্দ ব্যবহার না করেই। এই একটা ব্যাপারে লোকটা মখি-চো কস। অভিধানের শব্দভাণ্ডার যেন ব্যাঙ্কের ভল্টে লুকানো চিত্রতারকাদের সকলের না কারও-কার ইনকাম-ট্যাক্স অফিসারকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শক সম্পদ।
আমি কিন্তু দেখছি, এর ট্রাজিক দিকটা। পিতামহ ভীষ্মের পরই যে বীরকে এ ভারত সর্বসম্মত স্বীকৃতি দিয়েছে তিনি একচক্রা ভদ্রোত্তম কমান্ডার-ইন-চিফ ফিল্ড মার্শাল কর্ণ। তিনি যখন কুরুপ্রাঙ্গণে শৌর্যবীর্য দেখাচ্ছেন, তখন মাতা কুন্তী তার প্রতি-সাফল্যে কি তার মাতৃগর্ব, মাতৃশ্লাঘা প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। শাস্ত্রোদ্ধৃতি দিতে পারব না, তবে বাল্যবয়সে আমার সংস্কৃত শিক্ষার প্রথম গুরু আমাকে সঙ্গোপনে কেমন যেন ভয়ে ভয়ে বলেছিলেন, মাতা কুন্তীর সর্বাপেক্ষা প্রিয়সন্তান ছিলেন কর্ণ।
এফা ব্রাউনের ওই একই ট্র্যাজেডি। সর্বজনসমক্ষে তিনিও গাইতে পারেন না– বধু তুহরি গরবে গরবিণী হয়, রূপসী তুহরি রূপে।
অভিমানিনী পাঠিকা, তুমি হয়তো শুধোবে, এ হেন ভণ্ডামির অপমানজনক পরিস্থিতি একা মেনে নিলেন কেন? এর উত্তরে আমার নিজের কোনও মন্তব্য না দিয়ে শুধু নিবেদন :
চত্রাবলি কুঞ্জে গিয়ে
সারা নিশি কাটাইয়ে
প্রভাতে এসেছ, শ্যাম,
দিতে মনোবেদনা।
———-
১. বৈদিক যুগে আমাদের ভিতর সহমরণ প্রথা প্রচলিত ছিল কি না, তার সমাধান এখনও হয়নি। এস্থলে লক্ষণীয়, হিটলার নিজেকে আর্য বলে শ্লাঘা অনুভব করতেন। তাই হয়তো প্রথমে কিছুটা আপত্তি জানানোর পর এই সতীদাহে সম্মত হন। পাঠক এ নিয়ে চিন্তা করতে পারেন।
২. এফার সঙ্গে লিঙের আরেকটা মিল আছে। বার্লিন যখন প্রায় চতুর্দিক থেকে বেতি, শেষ পরাজয় সুনিশ্চিত, কিন্তু পালাবার পথ তখনও ছিল, সে সময় হিটলার লিঙেকে ডেকে বলেন, তুমি আপন বাড়ি চলে যাও। লিঙে অসম্মতি জানান এবং সংক্ষেপে যা বলেন তার মোদ্দা : যাকে আমি এত বৎসর ধরে সেবা করেছি তাকে তার শেষ মুহূর্তে আমি ত্যাগ করতে পারব না। এবং সবাই জানেন, এফাও হিটলারের কড়া আদেশ সত্ত্বেও তাকে ত্যাগ করেননি।
৩. ইংরেজের বারির বামনাইয়ের দুটি চূড়ান্ত বেশরম, বেহায়া উদাহরণ পাঠক এস্থলে পাবেন। হিটলার নিরামিষাশী ছিলেন ও তদুপরি তাকে বিশেষ বিশেষ খাদ্য খেতে হত; অর্থাৎ তিনি ডায়েট খেতেন। সেসব বিষয়ে রান্না বড় বড় হোটেলের শেফ রাও স্বাধতে জানে না। তাই ডাক্তারদের আদেশে তাকে নিযুক্ত কতে হয় একটি অতিশয় উচ্চশিক্ষিতা মহিলাকে। ইনি সর্বোচ্চ সম্মানসহ এম.ডি. পাস করার পর বিশেষভাবে স্পেশালাইজ করেন কীভাবে বিশেষ বিশেষ খাদ্য দিয়ে রুগীকে সারানো যায়। (আমাদের কবিরাজ ঠাকুমা দিদিমারা যা করে থাকেন) এবং যারা শীতের দেশে নিরামিষাশী তাদের খাদ্য কীভাবে তৈরি করতে হয় যাতে করে মাছ-মাংসের অভাব পরিপূরণ করা যায়। ইংরেজ এই সম্ভ্রান্ত মহিলাকে বার বার কুক, পাচিকা, রাধুনী বানী, বাবুর্চি বলে তাচ্ছিল্যভরে উল্লেখ করে ব্যঙ্গপি করেছে। তিনি প্রায়ই এর সঙ্গে ডিনার বেতেন। ভাবটা এই, ছোট জাতের হিটলার আর রাধুনী, বাবুর্চি ছাড়া কার সঙ্গে হৃদ্যতা করবে! এবং সঙ্গে সঙ্গে অকস্মাৎ ইংরেজের স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যায় এবং মহিলার পাণ্ডিত্যের কথা বলতে বেবাক ভুলে যায়। এবং ভুলে যায় বলতে, মহিলাতে-হিটলারেতে খেতে খেতে মোচার ঘন্টে কতখানি গুড় দিতে হয় সে নিয়ে আলোচনা হত না। আলোচনা হত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান নিয়ে।… এবং পূর্বেই বলেছি, লিঙের শিক্ষাদীক্ষা পদমর্যাদা ভুলে গিয়ে ঠিক এই উদ্দেশ্য নিয়ে ভ্যালে চাকর নামে তাকে হীন করার চেষ্টা করেছে। …হিটলারের আদেশ সত্ত্বেও তিনি লিঙেই মতো হিটলারকে ত্যাগ করতে সম্মত হননি। আমার যতদূর জানা, তিনি বার্লিনে নিহত হন। প্রভুভক্তির ফলস্বরূপ।