- বইয়ের নামঃ চতুরঙ্গ
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
অনুকরণ না হনুকরণ
আগে-ভাগেই বলে রাখছি, এ-লেখা সমালোচনা নয়।
সমালোচনা লেখবার মতো শক্তি–দুষ্টলোকে বলে, শক্তির অভাব আমার এবং আমার মতো অধিকাংশ লোকের নেই। গল্পচ্ছলে নিবেদন করি :–
প্রতি রোববারে এক বঁড়শে সকাল থেকে সন্ধে অবধি মাছ ধরে। বড় মাছের শিকারি, তাই ফাতনা ডোবে কালেকস্মিনে, আকছার রোববারই যায় বিন-শিকারে। তারই একটু দূরে আরেকটা লোক প্রতি রোববারে এসে বসে, এবং তামাম দিনটা কাটায় গভীর মনোযোগের সঙ্গে ওর মাছধরা দেখে দেখে। দু জনায় আলাপ-পরিচয় নেই। মাস তিনেক পর শিকারি লোকটার ‘আলসেমি’ দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার পর একটু বিরক্তির সুরে শুধাল, ‘ওহে, তুমি তা হলে নিজেই মাছ ধর না কেন?’
লোকটা আঁতকে উঠে বলল, ‘বাপস! অত ধৈর্য আমার নেই।’
সমালোচনা লেখার ধৈর্য আমার নেই।
আর কীই-বা হবে সমালোচনা লিখে ক’টা সুস্থ লোক সমালোচনা পড়ে? কটা বুদ্ধিমান-মাছ টোপ গেলে? আলগোছে তফাতে থেকে সমালোচক প্রবন্ধে একটু-আধটু ঠোক্কর দেয় অনেককেই– অর্থাৎ রোক্কা পয়সা ঢেলে মাসিকটা যখন নিতান্তই কিনেছে। তখন পয়সার দাম তোলবার জন্য একটু-আধটু খোঁচাখুঁচি করে। ফলে, চারের রস যত না পেল বঁড়শির খোঁচাতে তার চেয়ে বেশি জখম হয়ে ‘দুত্তোর ছাই’ বলে তাস-পাশাতে ফিরে যায়।
সমালোচকরা ভাবেন, পাঠকসাধারণ বোকার পাল। ওরা তাদের মুখে ঝাল চেখে বই কেনে। তা হলে আর দেখতে হত না। মারোয়াড়িরা সস্তায় রাবিশ পাণ্ডুলিপি কিনে পয়সা দিয়ে উক্তৃষ্ট সমালোচনা লিখিয়ে রাবিশগুলো খুচকারি (অর্থাৎ খুচরোর লাভে, পাইকারির পরিমাণে) দরে বিক্রি করে ভুঁড়ি বাড়িয়ে নিত–ফাও হিসেবে দেশে নামও হয়ে যেত, সসাহিত্য’ তথা সমালোচকদের পৃষ্ঠপোষকরূপে।
আমার কথা যদি চট করে বিশ্বাস না করতে পারেন তবে চিন্তা করে দেখুন আপ্তবাক্য নিবেদন করছি, ‘পয়সা দিয়ে সমালোচনা লেখানো যায়, পয়সা দিয়ে কবিতা লেখানো যায় না।’ নাহলে আমেরিকায় ভালো কবির অভাব হত না। সমালোচকের অভাব সেখানে নেই এবং বর্ণে-গন্ধে তাঁরা অম্মদ্দেশীয় সমালোচকদেরই মতো।
পলিটিশিয়ানরাও ভাবেন প্রোপাগান্ডিস্ট (অর্থাৎ সমালোচকদের দিয়ে নিজ পার্টির প্রশংসা কীর্তন করিয়ে নিয়ে বাজিমাত করবেন। কিন্তু ভোটার ভোটার যা পাঠকও তা– আহাম্মক নয়, যদিও সরল বলে সত্য বুঝতে তার একটু সময় লাগে। নাহলে আওয়ামীরা মুসলিম লীগকে কস্মিনকালেও হটাতে পারত না।
আমিও মাঝেমধ্যে সমালোচনা পড়ি, কারণ আমিও আর পাঁচজন পাঠকের মতো পয়সা ঢেলেই কাগজ কিনি। তবে আমার পড়ার ধরন নিয়ার্ডদের রুটি খাওয়ার মতো। শুনেছি, স্পানিয়ার্ডরা বছরের পয়লা দিন গির্জায় উপাসনা সেরে এসে একটুকরো রুটি চিবোয়– কারণ প্রভু যিশুখ্রিস্ট তাঁর প্রার্থনায় বলেছেন, ‘আর আমাদের অদ্যকার রুটি দাও।’ খানিকটে চিবিয়ে থু থু করে ফেলে দিয়ে বলে, ‘তওবা, তওবা, সেই গেল বছরে রুটিরই মতো যাচ্ছেতাই সোয়াদ।’ তার পর বছরের আর ৩৬৪ দিন সে খায় কোর্মাকালিয়া কটলেট মমলেট। আমিও সমালোচনার শুকনো রুটি বছরের মধ্যে চিবুই মাত্র একদিন এবং প্রতিবারই হৃদয়ঙ্গম হয়, সমালোচনার স্বাদ-গন্ধ সেই গেল বছরের মতো এক বছরে কিছুমাত্র উন্নতি করতে পারেনি।
কথাটা যেভাবে বর্ণনা করলুম, তাতে পাঠকের ধারণা হওয়া বিচিত্র নয় যে, এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। কিন্তু মোটেই তা নয়। অভিজ্ঞতাটা পাঠক-সাধারণ মাত্রেরই নিদারুণ নিজস্ব। অবশ্য সমালোচকদের কথা স্বতন্ত্র। তারা একে অন্যের সমালোচনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মনোযোগ সহকারে পড়ে থাকেন। কেন পড়েন? জ্ঞান সঞ্চয়ের জন্য? রাম রাম! শুধুমাত্র দেখবার জন্যে কে তার মতে সায় দিয়েছে, কে দেয়নি এবং সেই অনুযায়ী দল পাকানো, ঘোট বাড়ানো, শক্তি সঞ্চয় করে রুটিটা আণ্ডাটা– থাক।
অবশ্য সমালোচকদের সমালোচনা করার কুবুদ্ধি যদি আমার কখনও হয়– এতক্ষণ যা করলুম সেটা তারই সেতার বাধা মাত্র– তা হলে সেটা আপনাদেরই পাতে নিবেদন করব। তবে ধর্মবুদ্ধি তখনও আপনাদের সাবধান করে দেবে, ও লেখাটা না পড়তে।
***
মূল বক্তব্যে আসি। ইদানীং আমি বাংলার বিভিন্ন জায়গা থেকে, এবং বাঙলার বাইরে থেকেও কয়েকখানা চিঠি পেয়েছি। এঁরা প্রশ্ন জিগ্যেস করেছেন, কী প্রকারে ভালো লেখক হওয়া যায়?
প্রথমটায় উল্লসিত হয়েছিলুম। যাক, বাঁচা গেল। বাঙলা দেশ তা হলে স্বীকার করেছে, আমি ভালো লেখক। এবারে তা হলে কলকাতা-দিল্লিতে গিয়ে কিঞ্চিৎ তদ্বির করলেই দু চারটে প্রাইজ পেয়ে যাব, লোকসভার সদস্যগিরি, কলচেরল ডেলিগেশনের মেম্বারি এসবও বাদ যাবে না। বিদেশ যাবার সুযোগও হয়ে যাবে– বিলেত দেখার আমার ভারি শখ, অর্থাভাবে এতদিন হয়ে ওঠেনি। ইংরেজিটা জানিনে, এতদিন এই একটা ভয় মনে মনে ছিল। এখন বুলগানিন, চু-এন-লেইয়ের কল্যাণে সেটাও গেছে। এঁরা ইংরেজি না জেনে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু হায়, এত সুখ সইবে কেন? আমার গৃহিণী নিরক্ষরা টিপসই করে হালে আদালতে তালাকের দরখাস্ত করেছেন। তালাকটা মঞ্জুর না হওয়া পর্যন্ত আমার সঙ্গেই আছে। তাঁর কাছে চিঠিগুলো পড়ে নিজের মূল্য বাড়াতে গিয়েছিলুম। তিনি করলেন উল্টো অর্থ। সেটা আরও সরল। ব্যবসাতে যে দেউলে হয়েছে, তারই কাছে আসে লোক সলার সন্ধানে; ফেল-করা ছেলে পাস-করার চেয়ে ভালো প্রাইভেট ট্যুটর হয়।
এর উত্তর আমি দেব কী? গৃহিণী যে ক’টা গল্প জানেন সব কটাই আমার সঙ্গে টায়-টায় মিলে যায়। মনে হয় আমার পূজ্যপাদ শ্বশুর-শাশুড়ি ছেলেবেলা থেকে তাকে এই তালিমটুকুই শুধু দিয়েছেন, স্বামীর গোদা পায়ের গোদটি কী প্রকারে বারে বারে দেখিয়ে দিতে হয়। অবশ্য তার জন্য যে বিশেষ তালিমের প্রয়োজন হয় সেটা অস্বীকার করলেও চলে। ওটা তাদের বিধিদত্ত জন্মলব্ধ অশিক্ষিতপটুত্ব। যেসব সমালোচকদের কথা পূর্বে নিবেদন করেছি, তাদের বেলাও এই নীতি প্রযোজ্য।
ব্রাহ্মণীয় আপ্তবাক্য আমি মেনে নিয়েছি। তিনি তালাকের দরখাস্তটি উইথড্র করেছেন– শুনে দুঃখিত হবেন।
***
শঙ্করাচার্য দর্শনরণাঙ্গনে অবতীর্ণ হয়ে বলেছিলেন, ‘সাংখ্যমল্লকে আহ্বান কর। সে-ই মল্লদের অধিপতি। তাকে পরাজিত করলে অন্যান্য সফরি-গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধ করে অযথা কালক্ষয় করতে হবে না।’ আমি শঙ্কর নই! তাই সবচেয়ে সরল প্রশ্নটির উত্তর দেবার চেষ্টা করব।
প্রশ্নটি এই : ‘মপাসাঁ’র ছোটগল্প অপার আনন্দ দেয়, কিন্তু তাঁর অনুকরণকারীদের গল্প এত বিস্বাদ কেন? অপিচ, মপাসাঁ ছোটগল্প লেখার যে কাঠামো তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন তার অনুকরণ না করে গল্প লিখিই-বা কী প্রকারে?”
যাঁরা সঙ্গীত আয়ত্ত করবার চেষ্টা করেছেন তাঁরাই জানেন, ওস্তাদ যেভাবে গান গান তারই হুবহু অনুকরণ করতে হয় ঝাড়া দশটি বছর ধরে। ভারতনৃত্য শিখতে গেলে মীনাক্ষীসুন্দর পিল্লের নৃত্য অনুকরণ করতে হত ততোধিক কাল। স্যাকরার শাগরেদকে কত বছর ধরে একটানা গুরুর অনুকরণ করে যেতে হয়, তার ঠিক ঠিক খবর আমার জানা নেই। ভারতবর্ষে এই ছিল রেওয়াজ।
সাহেবরা এ দেশে এসে বলল, ‘এত বেশি অনুকরণ করলে নিজস্ব সৃজনশক্তি (অরিজিনালিটি) চাপা পড়ে যায়। ফলে কোনও কলার আর উন্নতি হয় না।’ কথাটা হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর মধ্যে অনেকখানি সত্য লুকনো আছে।
কিন্তু তার বাড়াবাড়িতে কী হয়, সেটাও তো নিত্য নিত্য স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। গুণীজনের উচ্চাঙ্গ সৃষ্টি অধ্যয়ন না করেই আরম্ভ হয়ে যায়, ‘এপিক’ লেখা, দু কদম চলতে না শিখেই ডানস্ ‘কম্পোজ’ করা, আরও কত কী, এবং সর্বকর্মে নামঞ্জুর হলে সমালোচক হওয়ার পন্থা তো সবসময়েই ভোলা আছে। সেই যে পুরনো গল্প– শহর-পাগলা ভাবত, সে বিধবা মহারানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী। পাগল সেরে গেছে এই রিপোর্ট পাওয়ার পর পাগলাগারদের বড় ডাক্তার তাকে ডেকে পাঠিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে শুধালেন, ‘তা তুমি খালাস হওয়ার পর করবে কী?’ সুস্থ লোকের মতো বলল, ‘মামার বড় ব্যবসা আছে, সেখানে ঢুকে যাব।’ ‘সেটা যদি না হয়?’ চিন্তা করে বলল, ‘তা হলে আমার বিএ ডিগ্রি তো রয়েছেই– টুইশনি নেব।’ তার পর একগাল হেসে বলল, ‘অত ভাবছেন কেন, ডাক্তার? কিছু নাহলে যেকোনো সময়ই তো আবার মহারানির স্বামী হয়ে যেতে পারব।’ সমালোচক সবসময়ই হওয়া যায়।
তৃতীয় দল অন্য পন্থা নিল। ওস্তাদদের হুবহু নকল তারা করল না– তাতে বয়নাক্কা বিস্তর। আবার বিন-তালিমের ‘অরিজিনালিটি’ পাঠক-সাধারণ পছন্দ করে না। উপায় কী? তাই তারা ওস্তাদদের কতকগুলো বাছাই বাছাই জিনিস অনুকরণ করল এবং শুধু অনুকরণেই না, বাছাই বাছাই জিনিসগুলোর মাত্রা দিল বাড়িয়ে।
চার্লি চ্যাপলিন একবার নাম ভাঁড়িয়ে গোপনবাসের জন্য গেছেন চিলির এক অজানা শহরে। বেড়াতে বেড়াতে দেখেন, দেয়ালের গায়ে বিজ্ঞাপন ‘সোমবার রাত্রে শহরের কনসার্ট ঘরে চার্লি চ্যাপলিনের নকল করার প্রতিযোগিতা হবে। ভ্যাগাবন্ড চার্লির বেশভুষা পরিধান করে ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে স্টেজের ইসপার উসপার হতে হবে চার্লি ধরনে। সর্বোৎকৃষ্ট অনুকরণের পুরস্কার পাঁচ শ টাকা।
চার্লি ভাবলেন, এখানে তো কেউ তাকে চেনে না, দেখাই যাক না, প্রতিযোগিতায় ছদ্মনামে কী হয়।’
ছাব্বিশজন প্রতিযোগীর ভিতর চার্লি হলেন তেরো নম্বর।
তার সরল অর্থ, ওই ছোট শহর, ধেড়ধেড়ে ডিহি গোষ্ঠীপুরে বারোজন ওস্তাদ রয়েছেন যাঁরা চার্লিকে হাতে-কলমে দেখিয়ে দিলেন চার্লির পার্ট কী করে প্লে করতে হয়।
চার্লি শিরে করাঘাত করে বলেছিলেন, ‘হে ভগবান, আমার অভিনয় যদি এই বারোজনের মতো হয় তবে আমি আত্মহত্যা করে মরব।’
ব্যাপারটা হয়েছে, চার্লি যেখানে সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা দিয়ে হৃদয়ের গভীর অনুভূতি প্রকাশ করেন এঁরা সেটাকে দশগুণ বাড়িয়ে দিয়ে মশকরাতে পরিণত করেছেন; চার্লি যেখানে চোখের জলের রেশ মাত্র দেখিয়েছেন, এঁরা সেখানে হাউমাউ করে আসমান-জমিন ফাটিয়ে আড়াই ঘটি চোখের জল ফেলেছেন; চারুকলার ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য রেখে চার্লি যেখানে অখণ্ড সৌন্দর্য সৃষ্টির প্রশান্ত শিব সৃষ্টি করেছেন সেখানে তারা প্রত্যেক অঙ্গে ফাইলেরিয়ার গোদ জুড়ে বানিয়ে তুলেছেন এক-একটি বিকট মর্কট।
ঘরোয়া উপমা দিতে হলে বলি, ভেজাল সরষের তেলেরই বড় বেশি সোনালি ঝাঁঝ– মারাত্মক তুখোড়।
রবীন্দ্রনাথের ‘দোদুল-দোলা’, ব্যা’কুল রেণু’, ‘উদাস হিয়াকে’ ‘দোলাতর’, ‘বেণুতর’ করে নিত্য নিত্য কত না নব নব মশকরা হচ্ছে। কিন্তু তবু চার্লি বেঁচে গেছেন। কারণ আর যা-ই হোক মার্কিন মুলুক পরশুদিনের গড়া নবীন দেশ। ভেজালে এদের অভিজ্ঞতা আর কতটুকু? প্রাচীন চীনের কাহিনী শ্রবণ করুন।
একদা চীন দেশে এক গুণীজ্ঞানী, চরিত্রবলে অতুলনীয় বৌদ্ধ শ্রমণের আবির্ভাব হয়। যেমন তার মধুর সরল শিশুর মতো চলাফেরা-জীবনধারা, তেমনি তাঁর অদ্ভুত বচনবিন্যাস। বুদ্ধের কীর্তিকাহিনী তিনি কখনও বলতেন বলদৃপ্ত কণ্ঠে, কখনও সজল করুণ নয়নে– তথাগতেরই মতন তখন তার সৌম্যবদন দেখে, আর উৎসাহের বচন শুনে বহু শত নরনারী একই দিনে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করত। ক্রমে ক্রমে তাঁর মাতৃভূমির সর্বত্র বৌদ্ধধর্মের জয়ধ্বনি বেজে উঠল, বুদ্ধের জীবনাদর্শ বহু পাপীতাপীকে ধর্মের মার্গ অনুসরণে অনুপ্রাণিত করল।
দীর্ঘ পঞ্চাশ বৎসর ধরে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করার পর তাঁর মৃত্যুক্ষণ কাছে এল। তাঁর মন কিছু শান্ত, তাঁর চিত্ত নিষ্কম্প প্রদীপশিখাবৎ। শুধু একটি চিন্তাবাত্যা ক্ষণে ক্ষণে তাঁর মুমূর্ষ প্রদীপশিখাকে বিতাড়িত করছে। শিষ্যেরা বুঝতে পেরে সবিনয় জিগ্যেস করলে, সেবাতে কোনও ত্রুটি হচ্ছে কি না।
গুরু বললেন, ‘না। ইহলোক ত্যাগ করতে আমার কোনও ক্ষোভ নেই। আমার মাত্র একটি ভাবনা। আমার মৃত্যুর পর আমার কাজের ভার কে নেবে?’
শিষ্যেরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তাঁর চরিত্রবল কে পেয়েছে, তাঁর বক্তৃতাশক্তি কার আছে যে এ কঠিন কাজ কাঁধে তুলে নেবে?
গুরু দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।
এমন সময় অতি অজানা এক নতুন শিষ্য সামনে এসে বলল, ‘আমি এ ভার নিতে পারি।’
গুরুর বদনে প্রসন্নতার দিব্য জ্যোতি ফুটে উঠল। তবু ঈষৎ দ্বিধার কণ্ঠে শুধালেন, কিন্তু বৎস তোমাকে তো আমি চেনবার অবকাশ পাইনি। তুমি কি সত্যই এ কাজ পারবে? ওই দেখ, আমার দীর্ঘদিনের শিষ্যেরা সাহস না পেয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা দেখি, তুমি অমিতাভের জীবনের যেকোনো বিষয় নিয়ে একটি বক্তৃতা দাও তো।’
বিস্ময়! বিস্ময়!– সেই শিষ্য তখন গলা খুলে, গাধার মতো– হুবহু গাধার মতো চেঁচিয়ে উঠল। কিছু না, শুধু গাধার মতো চেঁচাল।
সবাই বাক্যহীন নিস্পন্দ।
ব্যাপার কী?
গুরুর মাত্র একটু সামান্য ত্রুটি ছিল। তিনি বক্তৃতা দেবার সময় অন্য বক্তাদের তুলনায়। একটু বেশি চিৎকার করে কথা বলতেন, উঁইফোড় শিষ্য ভেবেছে ভালো করে চেঁচাতে পারাতেই উত্তম বক্তৃতার গূঢ় রহস্য। ওই কর্মটি সে করতে পারলে তাবৎ মুশকিল হবে। আসান। তাই সে চাঁচানোর চ্যাম্পিয়ন রাসভরাজের মতো চেঁচিয়ে উঠেছে।
আমার গুরুদেবের পিতৃতুল্য অগ্রজ সত্যদ্রষ্টা, প্রাতঃস্মরণীয় ঋষি দ্বিজেন্দ্রনাথ বলেছেন,
‘To imitate-এর বাঙলা, অনুকরণ।
To ape-এর বাংলা, হনুকরণ।’
এস্থলে রাসভকরণ।
আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন
আমরা যারা বাল্য বয়স থেকে আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের স্নেহচ্ছায়ায় বড় হয়েছি এবং আশ্রমবাসী সকলেই যাঁকে সেদিনও পর্যন্ত এলাকার সর্বজন পূজ্য আচার্যশ্রেষ্ঠ রূপে পেয়ে সঙ্কটের সর্বশ্রেষ্ঠ কাণ্ডারী ও আনন্দের সর্বশ্রেষ্ঠ অধিকারী জেনে মনে মনে গভীর পরিতৃপ্তি অনুভব করতাম, আজ তাদের শোক সবচেয়ে বেশি।
ভারতবর্ষের সর্বত্র এবং ভারতের বাইরে তাঁকে অসংখ্য লোক কত না ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। হয়তো তাদের অনেককেই আমাদের চেয়ে তাকে পূর্ণতররূপে দেখেছেন, কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের এবং সমগ্রভাবে আশ্রমের সত্তাতে যে আঘাত লেগেছে। তার কঠোরতা আজ এই প্রথম আমরা বুঝতে আরম্ভ করলুম। একদিন আমাদের এমন একজন ছিলেন যিনি বিশ্বভারতীর কর্ম থেকে বিশ্রাম গ্রহণ করেছিলেন সত্য, কিন্তু তারপরেও সেদিন পর্যন্ত তিনি আশ্রমবাসীদের সর্বাগ্রণীরূপে আমাদের মধ্যে ছিলেন। আশ্রমের দৈনন্দিন সমস্যাতে তাঁকে জড়িত করা হত না, কিন্তু তিনিই ছিলেন গুরুতর সমস্যাতে আমাদের সর্বোত্তম পথপ্রদর্শক।
এখানকার শিক্ষাভবনের (অর্থাৎ স্কুলের শিক্ষকরূপে তিনি কর্মজীবন আরম্ভ করেন– স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যে স্কুলের প্রধান শিক্ষক সেখানে তাঁর এই কর্মভার গ্রহণ যে উভয়ের পক্ষেই পরম শ্লাঘার বিষয়, সেকথা দু জনেই জানতেন। পরবর্তীকালে উত্তর বিভাগ বা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে তিনি অধ্যাপক হলেন ও সর্বশেষে বিশ্বভারতী রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার পর তিনি উপাচার্যরূপে আশ্রম পরিচালনা করেন। ‘উপাচার্য’ শব্দ এখানে প্রয়োগ করাতে কেউ যেন ভুল না বোঝেন। এটি একটি রাষ্ট্রীয় অভিধা–বস্তুত তিনি আচার্যোত্তম ছিলেন। আমি বলতে পারি, পৃথিবীর যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে আচার্যরূপে পেলে ধন্য হত।
এবং এই তাঁর একমাত্র কিংবা সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয় নয়।
বস্তুত এরকম বহুমুখী প্রতিভাবান ব্যক্তি সর্বদেশেই বিরল। কেউ তাঁকে জানেন সংস্কৃতশাস্ত্রের পণ্ডিতরূপে, কেউ মধ্যযুগীয় সন্তদের প্রচারকরূপে, কেউ রবীন্দ্রপ্রতিভার সম্যক রসজ্ঞ ও টীকাকাররূপে, কেউ বাউল-ফকিরের গূঢ় রহস্যাবৃত তত্ত্বজ্ঞানের উন্মোচকরূপে, কেউ চৈনিক-ভারতীয় বৌদ্ধধর্মের লুপ্ত গৌরব উদ্ধারার্থী গবেষকরূপে, কেউ শব্দতত্ত্বের অপার বারিধি অতিক্রমণরত সন্তরণকারীরূপে, কেউ সুখ-দুঃখের বৈদিকার্থে পুরোহিতরূপে, কেউ এই আশ্রমের অনুষ্ঠানাদিকে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যানুযায়ী রূপ দিবার জন্য উপযুক্ত মন্ত্র আহরণে রত ঋষিরূপে– আমরা তাঁকে চিনেছি শুরুরূপে।
বিনয়বশত প্রকৃত গুণীজন তাঁর গুণ আচ্ছাদিত রাখেন, কিন্তু শিষ্যের কাছে তাঁর সর্বগুণ উন্মোচন করে দেন। তিনি সঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন, অলঙ্কারশাস্ত্র তাঁর নখদর্পণে ছিল এবং ভরতমম্মটসম্মত প্রাচীনমত আলঙ্কারিক সূত্র তিনি অতি সাধারণ, অতিশয় গ্রাম্য গীতিকাতে আরোপন করে সে যে রসোত্তীর্ণ হয়েছে সেকথা বারবার সপ্রমাণ করতে জানতেন। বৈদ্যসন্তান বৈদ্যরাজও ছিলেন। রন্ধনশাস্ত্রে তাঁর অনুরাগ ছিল। অভিনয়ে তিনি সুদক্ষ নট। ভারতের ঐক্যানুসন্ধানের পর্যটকরূপে চৈতন্য ও বিবেকানন্দের পরেই তাঁর নাম করতে হয়।
তাঁর আরও বহু গুণ ছিল। তাঁর সম্পূর্ণ পরিচয় দেওয়া আমার শক্তির বাইরে। আজ সেদিন নিশ্চয়ই নয়। এই এখন আমার কানে ভেসে আসছে ক্ষিতিমোহনের বিহারক্ষিতি শালবীথিকায় তাঁর স্মরণে শোকতপ্ত আশ্রমবাসীগণের সশ্রদ্ধ ‘আগুনের পরশমণি’ বৈতালিক গীতি।
***
চিত্রে নন্দলাল। সঙ্গীতে দিনেন্দ্রনাথ। শাস্ত্রে বিধুশেখর। শব্দতত্ত্বে হরিচরণ। শিক্ষকতায় জগদানন্দ। রসে ক্ষিতিমোহন।
শুনেছি বিশ্বভারতী এঁদের সম্বন্ধে প্রাথমিক পুস্তক প্রকাশ করেছেন। তার ভিতরই পাওয়া যাবে বিশ্বভারতীর নাতিসম্পূর্ণ ইতিহাস। এ কর্মে সংখ্যাতীত শিষ্যের সহযোগিতার প্রয়োজন। আমি শুধু সেটুকু বলতে পারি যা স্বচক্ষে দেখেছি।
শাস্ত্র এবং রসালোচনায় রবীন্দ্রনাথের দুই বাহু ছিলেন বিধুশেখর এবং ক্ষিতিমোহন।
সকলেই আশা করেছিলেন কাশীর শাস্ত্রী ক্ষিতিমোহন সংস্কৃত চর্চায় যশস্বী হবেন। কিন্তু তিনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত করে দিলেন বাঙলার জনবৈদগ্ধ্য চর্চায়। আজ আর মধ্যযুগের সন্তরা যে পৃথিবীর সর্বসন্তদের সমকক্ষ একথা নিয়ে কেউ তর্কাতর্কি করে না, এদেশের আউল-বাউলরা যে সাধনার গভীরতম অতলে পৌঁছে প্রাচীন যুগের মুনি-ঋষিদেরই ব্রহ্মানন্দ আস্বাদন করেছিলেন সেকথাও কেউ অস্বীকার করে না, এমনকি কোনও কোনও অর্বাচীন ওই বিষয়ে বিরাট গ্রন্থ লিখে এখন সপ্রমাণ করতে চায় যে, সে ক্ষিতিমোহনকেও ছাড়িয়ে গেছে, তার অসম্পূর্ণ জ্ঞান সম্পূর্ণতর করে দিয়েছে! বিরাটকায় ক্ষিতিমোহনের স্কন্ধে দাঁড়িয়ে বামনও হয়তো একটু বেশি দূর অবধি দেখতে পায় অস্বীকার করিনে, কিন্তু সে বামন ক্ষিতি-অতিকায়ের বিরাট মস্তিষ্ক আর বিরাটতর হৃদয় পাবে কোথায়! তবে আজ এই বিতর্কমূলক প্রস্তাব (অবশ্য আমার কাছে নয়) উত্থাপন করব না– আজ শোকের দিন।
এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, ক্ষিতিমোহন আউল-বাউল গান নিয়ে আলোচনা করার সময় যে পদ্ধতি অবলম্বন করলেন সেটি সম্পূর্ণ শাস্ত্র-চর্চা পদ্ধতি। অর্থাৎ উপনিষদ বা গীতার টীকা লেখার সময় শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত যেরকম অতি শ্রদ্ধার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পাঠোদ্ধার করেন, অন্যান্য শাস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেন, ওইসব শাস্ত্রের মূল উৎসের অনুসন্ধান করেন, ঠিক সেই পদ্ধতিতে তিনি আউল-বাউলের ‘শাস্ত্র’ অধ্যয়ন করে, টীকা লিখে তাদের জীবনদর্শন অধ্যাত্মদর্শন লোকচক্ষের সামনে তুলে ধরলেন।
এই কর্মে লিপ্ত হয়ে ক্ষিতিমোহন দেখতে পেলেন, আউল-বাউলের মূল উৎস যে শুধু বেদ উপনিষদ গীতা ভক্তিবাদে রয়েছে তা নয়, তার সঙ্গে মিলে গিয়েছে মুসলিম সুফিবাদ। তিনি তারই অনুসন্ধানে সুফিবাদের এমনই গভীরে পৌঁছলেন যে, বহু সুপণ্ডিত সুফি পর্যন্ত আশ্চর্য হলেন যে, সুফি আবহাওয়ার এত দূর থেকে এই লোকটি একে আপন প্রাণ-নিশ্বাসে ভরে নিল কী করে? রামমোহনকে যদি বলা হয় জবরদস্ত মৌলবি, এঁকে তা হলে বলতে হয় ‘খবরদস্ত’ বা ‘খবর-দার-সুফি’। পূর্ব বাঙলার অনাদৃত মুসলিম চাষিকে ক্ষিতিমোহন ছেলেবেলা থেকেই অন্তরঙ্গভাবে চিনতেন– তিনি প্রমাণ করলেন তার আধ্যাত্মিক সাধনা কুরান ও সুফিবাদের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত এবং আশ্চর্য প্রাণশক্তিবলে সে তার চতুর্দিকের ভিন্ন সাধনাও আপন করে নিতে পেরেছে। শুধু তাই নয় হিন্দু সাধকের কাছে সে ঋণীও বটে, উত্তমর্ণও বটে। এই সর্বশেষে সুপ্রমাণ করলেন, হিন্দু-মুসলমান সাধনার মিলন হয়েছে এই ‘চাষাভুষো’দের কল্যাণেই– মৌলভি-ভশচাযে যে ভাবনা-সাধনার আদান-প্রদান অতি অল্পেই হয়েছে সেটা পরিস্ফুট হয়ে উঠল।
গণসাধনার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা গভীরতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হিন্দু ক্রিয়াকর্মের দিকে আকৃষ্ট হলেন। ‘মেয়েলি’ বলে আমরা যেসব পালপার্বণ ব্রতপূজা অবহেলা করে আসছিলুম। সেগুলো একটি একটি করে বিশ্লেষণ করে তিনি দেখাতে লাগলেন যে, এগুলোর ভিতরও অতি প্রাচীন ঐতিহ্য লুকোনো রয়েছে, এর অনেকগুলোই চলে যায় আমাদের ধর্মানুসন্ধানের প্রাচীনতম যুগে। সঙ্গে সঙ্গে প্রমাণ করলেন যে, আমাদের অনেকগুলোই আবার আমাদের প্রতিবেশী অনার্যদের কাছ থেকে নেওয়া।
সে এক বিপরীত দর্পণ! আমরা যেসব পালপার্বণকে ভেবেছিলুম অতিশয় খানদানি ‘আর্য’, ক্ষিতিমোহন প্রমাণ করলেন তার অনেকই ‘অনার্য’ এবং তথাকথিত ‘অনার্য’ ক্রিয়াকর্মের মূল রয়েছে নৈকষ্য আর্য সাধনার গভীরে।
এর সবকিছুই প্রেমী গবেষককে নিয়ে যায় ভারতবর্ষের ধর্মানুপ্রাণিত দর্শনচর্চায়–কারণ একমাত্র দর্শনশাস্ত্রই বহুর বাহ্যরূপ উন্মোচন করে অন্তরের ঐক্যদর্শন করাতে পারে। সেখানে তিনি পেলেন জ্ঞানী দ্বিজেন্দ্রনাথের(১) উপদেশ এবং সহযোগিতা– গুণী রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য যে তিনি অহরহ পেতেন সে জানা কথা পূর্বেই নিবেদন করেছি। এরই ফলে তিনি আবিষ্কার করলেন যে, আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন ক্রিয়াকাণ্ড, যোগতন্ত্রের রহস্যবাদ ও দর্শনের মূল তত্ত্বে রয়েছে একই নির্ধ সত্য।
এই সত্যের ভানুমতী-দণ্ড হাতে নিয়ে ক্ষিতিমোহন প্রবেশ করলেন হীনযান, মহাযান এবং তারই ভিন্ন ভিন্ন তান্ত্রিক যান, নেপাল-তিব্বত-চীনের ভিন্ন ভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মজগতের ভিতর। সেই এক সত্য কখনও বৌদ্ধদর্শনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম চিন্তাধারায়, তন্ত্রের বিকৃত কর্মকাণ্ডের পিছনেও সেই সত্য ভস্মাচ্ছাদিত, সেই সত্যই চর্যাপদে, সেই সত্যই পূর্ববঙ্গের লোকসঙ্গীতে, পশ্চিমবঙ্গের আউল-বাউলের গানে কখনও স্বপ্রকাশ, কখনও শাস্ত্রানধিকারীর উৎপাতে লুক্কায়িত– কখনও সরলতম ভাষায় স্বচ্ছ, কখনও রহস্যাবৃতরূপকে আস্বচ্ছ কুহেলিকাঘন।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এতে আর নতুন কথা কি? আমরা তো চিরকালই স্বীকার করে এসেছি, সর্বধর্মেই সত্য সমাহিত।
সত্যই কি আমরা তা জীবনে স্বীকার করেছি? ধর্মের বাহ্যরূপে যে বিকট প্রভেদ অহরহ দেখতে পাচ্ছি, সে কি যুগ যুগ ধরে আমাদের ভিতর দ্বন্দ্ব-কলহের সৃষ্টি করেনি? নাহলে চৈতন্য, রামমোহন, রামকৃষ্ণের কী প্রয়োজন ছিল?
দ্বিজেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ এবং ক্ষিতিমোহন এঁদের মতো ধর্মসংস্কারক ছিলেন। এদের প্রধান কর্ম ছিল, যুগ যুগ সঞ্চিত আমাদের ঐতিহ্যের ধন যার প্রায় সবকিছুই আমরা দৈনন্দিন জড় অভ্যাসের ফলে সম্পূর্ণ অবহেলা করে বসে আছি, সাধনাবিহীন মন্ত্রতন্ত্রই সর্বপাপহর বলে বিশ্বাস করে বসে আছি, মুখে ‘সর্বভূতে নারায়ণ’, কর্মে সে ‘নারায়ণ’কে ডোম-চালের কলুষতার ভয়ে সমাজ থেকে দূরে ঠেলে রেখেছি, স্বর্ণেপর্ণে, ধর্মে-অধর্মে প্রভেদ করার শক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেছি– এই নিদারুণ অবস্থায় আমাদের দৃষ্টি সেই সত্যের দিকে আকৃষ্ট করা যে সত্য আমাদের হাতের কাছেই আছে–লালন ফকিরের ভাষায়–
‘হাতের কাছে– পাইনে খবর
খুঁজতে গেলেম দিল্লি শহর।’
যাকে চাইলেই পাওয়া যায়।
ক্ষিতিমোহনের প্রধান কর্ম ছিল, সমাজের তথাকথিত নিম্নতম সম্প্রদায়েও যে সে সত্য যুগপৎ লুক্কায়িত ও উদ্ভাসিত আছে, তারই দিকে তথাকথিত শিক্ষিতজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। মধ্যযুগের সন্তদের নিয়ে তিনি তাঁর সাধনা আরম্ভ করে নিচের দিকে নেমে এলেন আউল-বাউল এবং সেখানে সেসব মণিমুক্তা পেলেন, তাদের প্রাচীনত্বের সন্ধানে উপরের দিকে গেলেন বেদ-উপনিষদে। এই অবিচ্ছিন্ন তিন লোকে তাঁর গমনাগমন গতিধারা ছিল অতিশয় স্বতঃস্ফুর্ত আয়াসহীন। এটা পণ্ডিতজন-দুর্লভ–ধর্মলোকে বিধিদত্ত স্পর্শকাতরতা না থাকলে এ জিনিস সম্ভবে না।
ক্ষিতিমোহন পথ প্রদর্শন করার পর আরও অনেকেই আউল-বাউল নিয়ে চর্চা করেছেন, কিন্তু তৎসত্ত্বেও ক্ষিতিমোহন একক।
তার কারণ ক্ষিতিমোহনের এমন একটি গুণ ছিল যা এ যুগে আর কারও ছিল না–আমার অভিজ্ঞতায় পৃথিবীর কুত্রাপি আমি এ গুণটি দ্বিতীয় জনে দেখিনি।
কঠিনতম জিনিস সরল ভাষায় মধুর রূপে প্রকাশ করার অলৌকিক ‘খুদাদাদ’-বিধিদত্ত ইন্দ্রজাল-শক্তি।
ক্ষিতিমোহন লিখেছেন যতখানি, বলেছেন তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। কারণ তিনি জানতেন পুস্তক সর্বগামী নয়, লিখিত অক্ষরের শক্তি সীমাবদ্ধ।
বিদ্যালয়ের অজাতশ্মশ্রু বালক থেকে আরম্ভ করে শুভ্রকেশ বৃদ্ধ, অভ্যাগত রবাহত সকলকে, সভাস্থলে, বন্ধু-সমাগমে, ট্রেনে-জাহাজে, হিমালয়ের চটিতে, নর্মদার পারে পারে, দেশে-বিদেশে তিনি যেখানেই থেকেছেন, যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই তিনি এই অভূতপূর্ব বাচনভঙ্গি দ্বারা তাঁর বক্তব্য নিবেদন করে সকলকেই মুগ্ধ করেছেন। শত শত লোক হাজার হাজার গম্ভীর পুস্তক লিখেও যা করতে সক্ষম হবেন না, কথকসম্রাট ক্ষিতিমোহন একাই তা করে গেছেন তাঁর খুদা-দাদ এই সওগাতের দৌলতে।
সবিনয় নিবেদন করছি, আচার্য ক্ষিতিমোহনের বহুমুখী কর্ম এবং চিন্তাধারার সম্যক বিশ্লেষণ আমার সীমাবদ্ধ শক্তির বাইরে। যেটুকু আছে তা-ও শোকাচ্ছন্ন। তবু আশ্রমবাসী, তাঁর শিষ্যরূপে তাঁরই স্মরণে তাঁর অসংখ্য অনুরাগী পাঠক ও শ্রোতাদের উদ্দেশে এই কথা কয়টি নিবেদন করি।
আমার অক্ষমতার রচনাও তাঁর স্নেহাশীর্বাদ লাভ করত। পুণ্যলোক থেকে আগত তাঁর সে আশীর্বাদ থেকে আমার এ দীন শ্রদ্ধাঞ্জলি অকিঞ্চন গুরুদক্ষিণা বঞ্চিত হবে না– এই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
আর্ট না আ্যাকসিডেন্ট
আর্ট বলতে আমরা আজকাল মোটামুটি রস-ই বুঝি। তা সে কাব্যে, চিত্রে, ভাস্কর্যে সঙ্গীতে যে কোনও কলার মাধ্যমেই প্রকাশিত হোক না কেন।
এখন প্রশ্ন আর্ট বা রসের সংজ্ঞা কী? সে জিনিস কী? তার সঙ্গে দেখা হলে তাকে চিনব কী করে? অন্যান্য রস থেকে তাকে আলাদা করব কী করে? সরেস আর্ট কোনটা আর নিরসই-বা কোনটা?
প্রাচীন ভারত, গ্রিস এবং চীন– এই তিন দেশেই এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে এবং অধুনা পৃথিবীর বিদগ্ধ দেশ মাত্রেই এ নিয়ে কলহ-বিসংবাদের অন্ত নেই। বিশেষ করে যবে থেকে “মডার্ন আর্ট” নামক বস্তুটি এমন সব ‘রস’ পরিবেশন করতে আরম্ভ করল যার সঙ্গে আমাদের কণামাত্র পরিচয় নেই। এলোপাতাড়ি রঙের পোঁচকে বলা হল ছবি, অর্থহীন কতকগুলো দুর্বোধ শব্দ একজোট করে বলা হল কবিতা, বেসুরো বেতালা কতকগুলো বিদঘুঁটে ধ্বনির অসমন্বয় করে বলা হল সঙ্গীত। বলছে যখন তখন হতে পারে, কিন্তু না পেলাম রস, না বুঝলাম অর্থ, না দিয়ে গেল মনে অন্য কোনও রসের ব্যঞ্জনা বা ইঙ্গিত। তাই বোধহয় হালের এক আলঙ্কারিক মডার্ন ভাস্কর্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, যখন ভাস্কর এক বিরাট কাঠের গুঁড়ি নিয়ে তার উপর ছ মাস ধরে প্রাণপণ বাটালি চালানোর পর সেটাকে কাঠের গুঁড়ির আকার দিতে পারেন, এবং নিচে লিখে দেন ‘কাঠের গুঁড়ি’– তখন সেটা ‘মডার্ন ভাস্কর্য’।
ইতোমধ্যে এই মডার্ন আর্টের বাজারে একটি নতুন জীব ঢুকেছেন এবং সেখানে হুলস্থূল বাঁধিয়ে তুলেছেন– এর নাম অ্যাকসিডেন্ট, বাঙলায় দুর্ঘটনা, দৈবযোগ, আকস্মিকতা যা খুশি বলতে পারেন।
এঁর আবির্ভাব হয়েছে সুইডেনের মতো ঠাণ্ডা দেশে যেখানে মানুষ ঠাণ্ডাভাবে ধীরেসুস্থে কথা কয়, চট করে যা-তা নিয়ে খামখা মেতে ওঠে না।
***
সুইডেনের মহাসম্মানিত ললিতকলা আকাদেমির বিজ্ঞ বিজ্ঞ প্রফেসর, কলারসিক গুণীজ্ঞানীরা অকস্মাৎ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কর্ণমূলের পশ্চাদ্দেশ কয়ন করতে লাগলেন। তাঁদের মহামান্যবর প্রেসিডেন্ট তো খুদাতালার হাতে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে সোজাসুজি বলেই ফেললেন, ‘কী করি, মশাইরা, বলুন। কে জানত শেষটায় এরকমধারা হবে? আজকাল নিত্য নিত্যি এতসব নয়া নয়া এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে যে, কোনটা যে এক্সপেরিমেন্ট আর কোনটা যে অ্যাকসিডেন্ট কী করে ঠাওরাই? আমরা ভেবেছি, চিত্রকর ফালস্ট্রোম আর্টের ক্ষেত্রে একটা অভিনব নবীন পন্থা আবিষ্কার করতে পেরেছেন এবং তাই ভেবে ওই ছবিটাও একজিবিশনের অন্যান্য ছবির পাশে টাঙিয়ে দিয়েছি–’
ওদিকে আর্টিস্ট ফালস্ট্যোম রেগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সর্বত্র চেঁচামেচি করে বলতে লাগলেন, তাঁকে লোকচক্ষে হীন করার মানসে দুষ্ট লোক কুমতলব নিয়ে এই অপকর্মটি করেছে।
অপকর্মটি কী?
ফালস্ট্রোম ছবি আঁকার সময় একখানা ম্যাসনাইটের টুকরোয় মাঝে মাঝে তুলি পুঁছে নিতেন। কাজেই সেটাতে হরেকরকম রঙ লেগে থাকার কথা। ওই সময়ে সুইডিশ ললিত-কলা আকাদেমি এক বিরাট মহতী একজিবিশনের ব্যবস্থা করেন—‘স্বতঃস্ফূর্ত কলা (স্পন্টানিসমুস বা Spontaneous art) ও তার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ’ এই নাম দিয়ে সে চিত্র-প্রদর্শনীতে সুইডেন তথা অন্যান্য দেশের স্পন্টানিসমুস কলার উত্তম নিদর্শন তাতে থাকবে। (কুবিজম, দাদাইজমের মতো স্পন্টানিয়েজম-ও এক নবীন কলাসৃষ্টি পদ্ধতি আমি অবশ্য এখানে সে প্রশ্ন তুলছিনে যে সার্থক কলাসৃষ্টি মাত্রই স্পন্টানিয়াস বা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে থাকে বিশেষ পদ্ধতিতে এ নাম দিলে তাকে চেনবার কী যে সুবিধে হয় বোঝা কঠিন।)
এখন হয়েছে কী, আর্টিস্ট ফালস্ট্রোম তাঁর অন্য ছবি যাতে করে ডাকে যাবার সময় জখম না হয় সেই উদ্দেশ্যে রঙবেরঙের ম্যাসনাইটের টুকরোখানা তাঁর ছবির উপরে রেখে চিত্রপ্রদর্শনীতে পাঠিয়েছিলেন। আকাদেমির বড় কর্তারা ভাবলেন, এটাও মহৎ আর্টিস্টের এক নবীন মহান কলানিদর্শন এবং পরম শ্রদ্ধাভরে সেই ম্যাসনাইটের টুকরোটির নিচে আর্টিস্টের স্বনামখ্যাত নামটি লিখে ঝুলিয়ে দিলেন আর্টিস্টের অন্য ছবির পাশে!
ব্যাপারটা যখন ধরা পড়ল তখন আর্ট সমালোচকরা কী যে করবেন ঠিক করতে না পেরে চুপ করে গেলেন আর সুইডেনবাসী আপনার-আমার মতো সাধারণজন মুখ টিপে হাসল যে বাঘা বাঘা পণ্ডিতেরা ওই ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ রসিকতাটা ধরতে না পেরে ফাঁদে পা ফেলেছেন বলে।
কিন্তু এইখানে ব্যাপারটার গোড়াপত্তন মাত্র।
সুইডেনের কাগজে কাগজে তখন আলোচনা আরম্ভ হল এই নিয়ে : একখানা উটকো কাঠ জাতীয় জিনিসের উপর এলোপাতাড়ি রঙের ছোপকে যদি পণ্ডিতেরা আর্ট বলে মেনে নিতে পারেন তবে তাদের ঢাক-ঢোল-পেটানো এই মহাসাধনার ‘মডার্ন’ আর্টের মূল্যটা কী?
****
ওইভিন্দ ফালস্ট্রোম, সুইডেনের নামকরা তরুণ চিত্রকর। তিনি সম্প্রতি এই ‘স্বতঃস্ফূর্ত কলা-মার্গে’ প্রবেশ করেছেন এবং কলা নির্মাণের ক্রমবিকাশে তিনি ইতোমধ্যেই তাঁর ঢং একাধিকবার আগাপাশতলা বদলিয়েছেন। সুইডেনে এখন এই ‘কনক্রিট’, ‘স্থূল’ বা ‘বাস্তব’ মার্গের খুবই নামডাক; এঁরা নিজেদের অনুভূতি স্বতঃস্ফূর্ত অব্যবহিতভাবে রঙের মারফতে প্রকাশ করেন– সে প্রকাশে কোনও বস্তু বা কোনওকিছুর প্রতিকৃতি থাকে না, কোনওকিছু রূপায়িত করে না, ছবির নাম পর্যন্ত থাকে না– এবং দর্শক তাই দেখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, সরাসরি আর্টিস্টের অনুভূতি বুঝে গিয়ে তার অর্থ করে নেয়– কিংবা ওই আশা করা হয়।
এই হল মোটামুটি তার অর্থ—-অর্থাৎ অর্থহীন জিনিসকে যদি অর্থ দিয়ে বোঝাতে হয় তবে যে ‘অর্থ’ দাঁড়ায়।
ফালস্ট্রোম চিত্রপ্রদর্শনীতে দু খানি ছবি পাঠাতে চেয়েছিলেন, এবং পূর্বেই বলেছি, সে দু খানি ছবি যাতে করে পোস্টাপিসের চোট না খায় তাই সঙ্গে সেই ম্যাসনাইটের টুকরো দিয়ে সেগুলোকে প্যাক্ করে তিনি চলে যান গ্রামাঞ্চলে ছুটি কাটাতে। এদিকে আকাদেমির বাঘ-সিঙ্গিরা ছবি তিনখানা (আসলে অবশ্য দু খানা) ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার নিরীক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বাছাই করে নিলেন দু খানা এবং তার মধ্যে মনোনীত হয়ে গেল তুলি পোছার সেই ম্যাসনাইটের পট্টি! ক্রিটিকদের কারওরই কাছে ওই ম্যানসাইটের ‘অঙ্কিত তুলিপোছা রঙ-বেরঙ করা জিনিসটির স্টাইল বা বিষয়বস্তু অদ্ভুত বা মূল্যহীন ঠেকেনি। তার অর্থ একদিকে চিত্রকরের ‘ন্যায়ত’ ‘ধর্মসঙ্গত’ আঁকা ছবি ও অন্যদিকে তাঁর তুলি পোঁছার এলোপাতাড়ি রঙের ছোপ– এ দুয়ে কোনও পার্থক্য নেই।
তাই লেগেছে হুলস্থুল তর্কবিতর্ক, ‘সে আর্ট তবে কী আর্ট যেখানে “ভুল” জিনিস অক্লেশে খাঁটি আর্ট বলে পাচার হয়ে যায়?’
এটা ধরা পড়ল কী করে? ফালস্ট্রোম, ছুটি থেকে ফিরে একদিন স্বয়ং গিয়েছেন চিত্রপ্রদর্শনী দেখতে। সেখানে ওই ‘ম্যাসনাইট ছবি’র কাণ্ড দেখে যখন ভুলটা ধরা পড়ল তখন কোথায় না তিনি বিচক্ষণ জনের মতো চুপ করে থাকবেন তিনি উল্টো আরম্ভ করলেন তুলকালাম কাণ্ড!
ফলে জ্ঞানগর্ভ পণ্ডিতমণ্ডলী, তীক্ষ্ণচক্ষু কলাসমালোচকদের দল, ঝানু ঝানু আর্টসংগ্রহকারীগণ, সরলচিত্ত সাধারণ দর্শক এবং সর্বশেষে নিজেকে আর তামাম ওই ‘স্বতঃস্ফূর্ত-কলা-পন্থী’কে বিশ্বজনের সম্মুখে তিনি হাস্যাস্পদ করে ছাড়লেন।
এর কয়েক বছর পূর্বে এক বিদগ্ধ বিদূষক চিড়িয়াখানার শিম্পাঞ্জির ‘আঁকা’ একখানি ‘ছবি’ ওইরকম এক চিত্রপ্রদর্শনীতে পাঠিয়ে শহরের লোককে বোকা বানিয়েছিল– তখনও কেউ ধরতে পারেননি, ওটা বাঁদরের মশকরা।
কিন্তু প্রশ্ন, এই ধরনের তামাশা চলবে কতদিন ধরে? এই যে স্পন্টানিস্টের দল, কিংবা অন্য যে কোনও নামই এদের হোক– এরা আর কতদিন ধরে আপন ব্যবহার দিয়ে ইচ্ছায় প্রকাশ করবেন যে এদের আর্ট কোনওকিছু সৃজন করার দুরূহ শক্তিসাধনায় আয়ত্ত নয়, আকস্মিক দৈবদুর্বিপাকে বা অ্যাকসিডেন্ট বা ঘটনাকে এঁদেরই মতো উত্তম উত্তম ছবি আঁকতে পারে, শ্রেষ্ঠ গান গাইতে পারে, সার্থক কবিতা রচনা করতে পারে– এতদিন যা শুধু সরস্বতীর বরপুত্রেরাই বহু সাধনার পর করতে পারতেন?
এই প্রশ্নটি শুধিয়েছেন এক সরলচিত্ত, দিশেহারা সাধারণ লোক– সুইডেনের কাগজে।
উত্তরে আমরা বলি, কেন হবে না? এক কোটি বাঁদরকে যদি এক কোটি পিয়ানোর পাশে বসিয়ে দেওয়া হয়, এবং তারা যদি এক কোটি বংশপরম্পরা ওগুলোর ওপর পিড়িং পাড়াং করে তবে কি একদিন একবারের তরেও একটি মনোমোহন রাগিণী বাজানো হয়ে যাবে না? সে-ও তো অ্যাকসিডেন্ট।
আমার ব্যক্তিগত কোনও টীকা বা টিপ্পনী নেই। মডার্ন কবিতা পড়ে আমি বুঝি না, রস পাই না। সে নিয়ে আমার কোনও খেদ নেই। পৃথিবীতে যে অতশত ভালো জিনিস রয়েছে যার রসাস্বাদন আমি এখনও করে উঠতে পারিনি, ওগুলো আমার না হলেও চলবে।
ইভান সের্গেভিচ তুর্গেনেফ
গত ৩ সেপ্টেম্বর ইভান তুর্গেনেফের ৭৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে। এ-উপলক্ষে বহু দেশ তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে আপন আপন সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়েছেন। কলকাতা বেতার কেন্দ্র পর্যন্ত সেদিন তাঁকে স্মরণ করেছেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আজ এঁর, কাল ওঁর কত লোকের মৃত্যুবার্ষিকী, জন্মবার্ষিকী নিত্য নিত্য হয়ে যাচ্ছে, সেগুলোর হিসাব রাখতে যাবে কে?
যার যেরকম খুশি, এর বেশি কিছু বলা যায় না।
তাই জানি, আমরা যখন গোরস্তানে যাই, তখন খুঁজি আপন প্রিয় ও পরিচিতজনের কবর। যখন কোনও নতুন লাইব্রেরিতে ঢুকি তখন খুঁজি আপন প্রিয় লেখকের বই। তাই তুর্গেনেফের শতবার্ষিকী না হয়ে ৭৫তম মৃত্যুদিনও আমার ও আমার মতো বয়স্কদের মনে দোলা লাগিয়েছে। তরুণরা লাইব্রেরিতে যেরকম নতুন বইয়ের সন্ধান নেয়, ক্ল্যাসিস্ পড়ে না, ঠিক তেমনি তারা তুর্গেনেফ কিংবা হাইনের শতাব্দীপ্রয়াণও স্মরণ করে না; তারা স্মরণ করে ব্লাবো কবে হেঁচেছিলেন, ভেরেন কবে কেশেছিলেন।
তা তারা করুক। কিন্তু যখন দেখি অপেক্ষাকৃত বয়স্ক এবং তথাকথিত শিক্ষিত লোকও সদম্ভে বলে বেড়াচ্ছেন রাবোর কাছে রবিঠাকুর শিশু, মাইকেলের অমিত্রাক্ষর উডেন (কাষ্ঠরস) এবং সম্পাদকমণ্ডলীও সেগুলো পরম শ্রদ্ধাভরে ছাপাচ্ছেন তখন এঁরা যে তুর্গেনেফকে স্মরণ করবেন না সে তো জানা কথা। শুধু তাই নয়, এখন আপনার কাছে আমার পক্ষে তুর্গেনেফ কিংবা সত্যেন দত্তকে স্মরণ করতে হলে লন্ডনে রঙিন হওয়ার মতো রীতিমতো সঙ্কট-সঙ্কুল রাষ্ট্রভাষায় যাকে বলে খতরনাক– স্কন্ধোপরি যুগ্ম-শিরের প্রয়োজন!
আমি মুসলমান। আমার শাস্ত্রে আছে বিধর্মীর ভয়ে আল্লা-রসুলকে বর্জন করা মহাপাপ। আমার সাহিত্যধর্মে শুরু-মুর্শিদ হয়ে আছেন রবিঠাকুর, হাইনে, তুর্গেনেফ, মাইকেল। আজ এঁদের অস্বীকার করতে পারব না—র্যাঁবো-এলিয়ট সম্প্রদায় যতই শক্তিশালী হন না কেন।
এবং আমার মনের গোপন কোণে একটা অহেতুক ক্ষীণ আশা আছে যে তুর্গেনেফ-প্রীতিতে আমি একেবারে একা নই। ‘বুড়ো রাজা প্রতাপ রায়ে’র মতো বরজলালের হাত ধরে আমাকে একাকী সভাস্থল ত্যাগ করতে হবে না। প্রতাপ রায়ের সমকালীন শ্রোতা সে-সভাতে আর কেউ ছিল না। আমার কিন্তু এখনও অনেক মুরুব্বি আছেন। তাঁরা তুর্গেনেফ সম্বন্ধে আমার চেয়ে ঢের ভালো লিখতে পারেন, কিন্তু লেখেন না, কারণ তারা জানেন, পাগলাগারদে সুস্থ লোকের লক্ষণ দেখানো পাগলামি, ভেক যেখানে রব ছেড়েছে সেখানে কোকিলের পক্ষে মৌনতাই শ্রেয়– ‘ভদ্রং কৃতং কৃতং মৌনং কোকিল জলদাগমে।’
তুর্গেনেফের মন্দভাগ্য সম্বন্ধে তিনি নিজেই সচেতন ছিলেন। তিনি থাকতেন বিদেশে– জার্মানি এবং ফ্রান্সে– এবং সেখানে বসে বসেই তিনি জানতে পেতেন কীভাবে ক্রমে ক্রমে তিনি দসতেফস্কি তলস্তয় এমনকি কবি নেক্রাসফেরও বিরাগভাজন হয়েছেন। ‘বিরাগভাজন’ বললে বোধ করি কমই বলা হয়। তুর্গেনেফ শেষের দিকে রীতিমতো এঁদের বিদ্বেষভাজন হয়েছিলেন।
বিদ্বেষ আসে হিংসা থেকে। এঁদের সবাই বড় লেখক। জীবিতাবস্থায়ই এঁরা দেশে প্রচুরতম সম্মান পেয়েছিলেন। তবে দূর-দেশবাসী প্রবাসী নিরীহ (‘নিরীহ’ কেন সেকথা পরে হবে) তুর্গেনেফ তাঁদের ক্রোধের কারণ হয়েছিলেন কেন?
এ তত্ত্বটি বুঝতে পারলেই জানা যাবে লেখক হিসেবে তুর্গেনেফের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মাহাত্ম্য কোনখানে?
দসতেফস্কি ও তলস্তয় জানতেন সৃষ্টির ক্ষেত্রে এঁদের আপন মাহাত্ম কোনখানে। দসতেফস্কি তাঁর প্রতি চরিত্রের গভীরতম অন্তস্তলে পৌঁছে গিয়ে তার সুখদুঃখ, তার দুর্বলতা মহত্ত্ব, তার প্রচেষ্টা এবং ভাগ্যে দ্বন্দ্ব, সমাজপ্রবাহের খরস্রোতের বিরুদ্ধে তার উজান চলার আপ্রাণপ্রয়াস, কিংবা সে-স্রোতে গা ঢেলে দিয়ে ভেসে যেতে যেতে তাকে প্রাণভরে অভিসম্পাত– এ সবকিছু লোহার কলম দিয়ে পাথরের উপর খোদাই করতে পারেন, ভাস্করের মতো দৃঢ়পেশি সবল হস্তে। প্রত্যেকটি চরিত্র তাঁর হাতে যেন দৈত্যের হাতে প্রজাপতি। চোখে এরে, বুকে অসীম করুণা। তার লেখা পড়ে মনে হয়, একটা বিরাট এঞ্জিন আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। খেলার এঞ্জিন যত তেজেই এগিয়ে আসুক না কেন, জানি, ভালো করেই জানি, সামান্য কড়ে আঙুলটি তার সামনে ধরলেই সে থেমে যাবে, কিন্তু দসতেফস্কির এঞ্জিন পিঁপড়ের গতিতে এলেও তার সামনে যা পড়বে তার আর উদ্ধার নেই। অরসিকতম পাঠকেরও সাধ্য নেই, তার বর্ণনা পড়ে তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তা না শুনে বা বুঝে থাকতে পারে! কিংবা বলব, কুমির যেরকম ছাগলের বাচ্চার ঠ্যাং কামড়ে ধরে ডুব দেয় নদীতে, দসতেফস্কি সেরকম পাঠককে নিয়ে ডুব দেন মানবচরিত্রের অতল সায়রে। এবং আশ্চর্য, সেখানে মণি-মুক্তার সঙ্গে সঙ্গে যে ক্লেদ-পঙ্ক দেখি তার প্রতিও তো ঘৃণা হয় না। মাতাল বাপের উচ্ছলতায় সরলা কুমারী রাস্তার বেশ্যা হয়ে বাপকে মাতলামোর পয়সা যোগাচ্ছে–কই, লোকটাকে তো খুন করতে ইচ্ছে করে না। তার অসহায় অবস্থা দেখে শুধু ভগবানকে শোধাতে ইচ্ছে করে, ‘একে বিবেকহীন পাষণ্ডরূপে জন্ম দিলে না কেন? এরও তা হলে কোনও দুঃখ থাকত না, আমরাও অকরুণ হৃদয়ে তাকে খুন করতে পারতুম। কিন্তু এ সব বোঝে, এ তো সবকিছু জানে। তবে এই ঝঞ্ঝা-ঝড়ের ঘূর্ণিবায়ুর মাঝখানে মানুষকে তুমি প্রজাপতির মতো সৃষ্টি করলে কেন?’ কিংবা হয়তো অতখানি চিন্তা করার শক্তিই পাঠকের থাকে না। মোহ্যমান হয়ে যায় পাঠক সেই বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতার সামনে– সমস্ত জীবন বয়ে বেড়ায় তার অনপসরণীয় স্মৃতি।
তলস্তয়ের রঙ্গমঞ্চ ভুবন-জোড়া বিরাট। তার পাত্রপাত্রীদের নাম ভুলে যাই, কিন্তু চেহারা ভুলিনে। তারা রঙ্গমঞ্চে নাচছে যে যার আপন কোণে আপন আপন মণ্ডলী বানিয়ে। প্রত্যেকের আপন নৃত্য সামঞ্জস্য রেখেছে তার মণ্ডলীর সঙ্গে, মণ্ডলী সামঞ্জস্য রেখেছে আর আর মণ্ডলীর সঙ্গে কখনও-বা দুই কিংবা তিনটি মণ্ডলী এক অন্যকে ভেদ করে মিশে এক হয়ে গিয়ে আবার আলাদা হয়ে যাচ্ছে আর সবকটি মণ্ডলীর এ-কোণে ও-কোণে যে-কটি ছন্নছাড়া আপনমনে নাচছে তাদেরও সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছে সেই বিরাট ভুবন। বাস্তব জীবনেও আমরা এরকম ভুবনের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পাইনে। তলস্তয় কতখানি পেয়েছিলেন কে জানে কিন্তু তাতে কীই-বা যায় আসে। তাঁর কল্পনার ভুবন আমাদের বাস্তব ভুবনের চেয়ে ঢের বেশি প্রত্যক্ষ, অঙ্গে অঙ্গে প্রাণবন্ত।
তলস্তয় কখনও কবিতা রচনা করেছিলেন কি না জানি না, কিন্তু তিনি কবি। তাঁর ভানুমতী দণ্ড দিয়ে তিনি যেরকম আমাদের কল্পনার অতীত বস্তু সৃষ্টি করতে পারেন ঠিক তেমনি আমাদের নিত্যকার চেনা বস্তু যে বস্তু বহুদর্শনের ফলে তার বৈশিষ্ট্য তার নবীনতা হারিয়ে ফেলেছে– তিনি সামনে তুলে ধরেন সেই চেনা রূপেই, অথচ মনে হয়, ‘কী আশ্চর্য, একে এতদিন ধরে লক্ষ করিনি কেন?’ এর সঙ্গে সঙ্গে একথাও জেনে যাই যে, একে আর কখনও ভুলব না। তাই তার পাত্রপাত্রী দেশে কালে সীমাবদ্ধ নয়। দসতেফস্কির চাষা কভাস ভদকা না খেলেও সে রুশ চাষা; তলস্তয়ের চাষা অন্তহীন স্তেপের উপর দিয়ে ভেঙে চলেছে বরফের পাথর, সরাইয়ে ঢুকে সে তার চামড়ার ছেঁড়া ওভারকোট স্টোভের পাশে শুকোতে দেয়, আইকনের সামনে বিড়বিড় করে সে মন্ত্র পড়ে ডান হাতের তিন আঙুলে ডাইনে থেকে বাঁয়ে ক্রস করে, কিন্তু বারবার ভুলে যাই সে বাঙালি চাষা নয়। অবাক হয়ে ভাবি, বসিরুদ্দি, পাঁচু মোড়ল, নিজনি নভগরদের দিকে চলেছে কেন?
মহাভারতের পরেই ওয়ার অ্যান্ড পিস!
তুর্গেনেফ দসতেফস্কির মতো প্রত্যেক চরিত্রের গোপনতম অন্ধকারে বিদ্যুল্লেখা দিয়ে আলোকিত করতে চান না। তার কারণ বোধহয় তুর্গেনেফ নখ শির, আপাদমস্তক ভদ্রলোক। কোনও ভদ্রলোক পরিচিত-অপরিচিত কারও গোপন চিঠি পড়ে না– হাতে পড়লেও, কারও হাতে ধরা পড়ার ভয় না থাকলেও। ঠিক তেমনি তার চরিত্রের গোপন দুর্বলতা তার অজানাতে সে জানতে চায় না, প্রকাশ করতে তার মাথা কাটা যায়– সে তো দুশমনের কাজ, গোয়েন্দার ব্যবসা। ভদ্র তুর্গেনেফ তার নায়ক-নায়িকার দিকে তাকান শিশুর মতো সরল চোখে; তারা কথাবার্তায়, আচার ব্যবহারে যতখানি আত্মবিকাশ করে তাতেই তিনি সন্তুষ্ট, তাঁর পক্ষে সে-ই যথেষ্ট। শার্লক হোমসের মতো আতশি কাঁচ দিয়ে তিনি তার জুতোর দাগ পরীক্ষা করেন না, পোয়য়ারোর মতো তাকে ক্রস এগজামিনেশনের ঠেলায় কোণঠাসা করে অট্টহাস্য করে ওঠেন না, ‘ধরেছি, ধরেছি, তোর গোপন কথা কতক্ষণ লুকিয়ে রাখবি, বল!’
অথচ শিশুর কাছে কেউ কোনও জিনিস গোপন রাখে না। কবি মাত্রই শিশু। তার চোখে ছানি পড়েনি। প্রতি মুহূর্তে সে এই প্রাচীন ভুবনকে দেখে নবীনরূপে।
রুশদেশে পুশকিনের পর যদি কোনও কবি জনে থাকেন, তবে তিনি তুর্গেনেফ। তলস্তয় কবি সৃষ্টিকর্তা হিসেবে, আবিষ্কর্তারূপে আর তুর্গেনেফ কবি অন্য অর্থে। পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু কুৎসিত, কিংবা যার দিকে কারও দৃষ্টি যায় না এ সব-কিছু তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর কবিত্ব দিয়ে। তিনি অন্য কবির মতো অবাস্তবকে বাস্তব করেন না, বাস্তবকে অবাস্তব করেন না। বাস্তব-অবাস্তব দুই-ই তাঁর কবি-মনের স্পর্শ পেয়ে আপন আপন সীমা ছাড়িয়ে তৃতীয় সত্তায় পরিণত হয়। ঘৃত-প্রদীপ শুষ্ক কাষ্ঠ দুই-ই তাঁর কবিতুশিখার পরশে আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে। কিংবা বলব শীতের শিশির যেমন তার শুভ্র পেলব আস্তরণ দিয়ে মধুর করে দেয় সদ্যফোঁটা ফুলকে, শুকনো পাতার অঙ্গ থেকে ঘুচিয়ে দেয় তার সর্ব কর্কশতা। ওপারের ঝাউবন, এপারের কাশ-ঘাস, সর্বোচ্চ শাল বকায়ন থেকে আরম্ভ করে রাস্তার পাশের নয়ানজুলি– সবাই যেন সূক্ষ্ম মসলিনের অঙ্গাভরণ পরে সৌন্দর্যের গণতন্ত্রের কৌলীন্য পেয়ে গিয়েছে।
এই কবিত্বপ্রতিভাকেই হিংসা করতেন দসতেফস্কি, তলস্তয়, নেক্রাসফ ত্রিমূর্তি। নেক্রাসফ স্বয়ং কবি কিন্তু তিনি জানতেন যে জিনিসের পরশ পেয়ে শুকনো গদ্য গান হয়ে নেচে ওঠে সেইটির পূর্ণ অধিকার আছে একমাত্র তুর্গেনেফের। আঙ্গিকের ওপর এ রকম অখণ্ড অধিকার ত্রিমূর্তির কারও ছিল না। তাঁদের কোনও বিশেষ রচনা হয়তো তুর্গেনেফের রচনা অপেক্ষা উচ্চাঙ্গের কিন্তু তুর্গেনেফ তাদের শ্রেষ্ঠতর রচনাকে তাঁর আঙ্গিকের স্পর্শ দিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম রচনা করে দিতে পারতেন। দসতেফস্কি-তলস্তয় যেন লিখেছেন কবিতা। তুর্গেনেফ যেকোনো মুহূর্তে তার যেকোনো একটিকে সুর লাগিয়ে গানের রূপ দিয়ে দিতে পারতেন। আর তুর্গেনেফের প্রত্যেকটি রচনা যেন গান, তার গায়ে আর হাত দেবার উপায় নেই– তা সে গানের মূল্য কবিতার চেয়ে কম হোক আর বেশিই হোক।
সে-যুগে ভাষা, ছন্দের রাজা ছিলেন ফ্রান্সের ঔপন্যাসিক ফ্লবের। তাঁর শিষ্য এবং মানসপুত্র মপাসাঁ তখনও গুরুর মজলিসে আতরদান, গোলাপপাশ এগিয়ে দেন। তুর্গেনেফ ফ্লুবেরের বিশিষ্ট অন্তরঙ্গ বন্ধু। ফ্লবেরকে চিঠি লেখার সময় মপাসাঁ লেখেন ‘গুরুদেব’, তুর্গেনেফকে লেখার সময় লেখেন ‘গুরু এবং সখা’। ফ্লবেরের আকস্মিক মৃত্যুতে মপাসাঁ যখন শোকে অভিভূত হয়ে অন্ধের মতো এদিক-ওদিক হাতড়াচ্ছেন তখন তুর্গেনেফ শেষবারের মতো দেশের কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়েছেন রুশে। মপাসাঁ তাঁকে চিঠি লিখে খুঁজেছেন সান্ত্বনা। লিখেছেন, ‘জীবনের সবকটি আনন্দের দিনও তো আমার এই দুঃখের দিনটার ক্ষতিপূরণ করতে পারছে না।’
তার তিন বছর পর গত হলেন তুর্গেনেফ।
এবারেও হয়তো তিনি কোনও সাহিত্যিক বন্ধুকে চিঠি লিখে সান্ত্বনা খুঁজেছিলেন। তখনকার দিনের ফ্রান্সের সব বিখ্যাত সাহিত্যিকদের সঙ্গেই তুর্গেনেফ, ফ্লবের, মপাসাঁর বন্ধুত্ব ছিল। ভিক্তর হু(য়ু)গো, এদমোঁ দ গঁকুর, এমিল জোলা, আলফঁস দদে এঁদের কাউকে হয়তো তিনি লিখেছিলেন, কিন্তু আমার মনে হয়, ফ্লবের গত হলে শোক নিবেদন করা যায় তুর্গেনেফকে, কিন্তু তুর্গেনেফ গত হলে লেখা যায় আর কাকে? বঙ্কিমের মৃত্যুসংবাদ রবীন্দ্রনাথকে জানিয়ে হয়তো সান্ত্বনার বাণী চাওয়া যায়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ গত হলে বাঙালি জানাবে কাকে?
মপাসাঁ এর অনেক আগেই ফ্রান্সের বিখ্যাত পত্রিকায় তুর্গেনেফ সম্বন্ধে প্রশস্তি লিখেছিলেন। এবারে তিনি যেটি লিখলেন, সেটি বড়ই করুণ। মপাসাঁর পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থাবলিতে এ-দুটি থাকার কথা কিন্তু আজ যখন মপাসাঁকেই লোকে স্বীকার করতে চায় না– যদি-বা করে তা-ও তাঁর তথাকথিত অশ্লীল গল্পের জন্য– তখন তাঁর প্রবন্ধ পড়তে যাবে কে? তবু বলি আনাতোল ফ্রাঁসের রম্যরচনাকে যদি সত্য ও সুন্দরের অভূতপূর্ব অনির্বচনীয় সঙ্গম বলে ধরা হয়, তবে সে-দুটির উৎস খুঁজতে হবে মপাসাঁর রচনায়। তাঁর ছোটগল্পের সর্বত্র পরিচিত শৈলীতেই সেগুলো লেখা। ছোট ছোট শব্দ, ছোট ছোট বাক্য আর তার মাঝে মাঝে অকস্মাৎ দীর্ঘায়তন দীর্ঘকলেবর উদ্দাম উত্তাল শৈলধারার মতো দ্রুতগামী বাক্যবিন্যাস। মন্দাক্রান্তার পাঁচটা হস্বের পর দুটো দীর্ঘ এলে যে রসের সৃষ্টি হয়।
এর অনুবাদ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। সারাংশ নিবেদন করি।
‘রুশ দেশের মহান ঔপন্যাসিক ইভান তুর্গেনেফ ফ্রান্সকে আপন দেশ-রূপে বরণ করেছিলেন। এক মাস অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করার পর তিনি গত হয়েছেন।
‘এ-যুগের অত্যাশ্চর্য লেখকদের তিনি অন্যতম। সঙ্গে সঙ্গে সাধু, সৎ, অকপট ও বন্ধুবৎসল সমাজের তিনি ছিলেন সর্বাগ্রণী! এরকম লোকের দেখা মেলে না।
তাঁর বিনয় ছিল আত্মাবমাননার কাছাকাছি; কাগজে তাঁর সম্বন্ধে কেউ কিছু লিখলে তিনি তা একেবারেই বরদাস্ত করতে পারতেন না। একাধিকবার তাঁর সম্বন্ধে উচ্চপ্রশস্তি সংবলিত রচনা তাঁকে যেন মর্মাহত করেছে; কারণ তিনি কিছুতেই স্বীকার করতে রাজি হতেন না যে, শুদ্ধ সাহিত্য ভিন্ন অন্য কোনও বিষয় নিয়ে রচনা লেখা হোক। সাহিত্য কিংবা কলা-সমালোচনাকে পর্যন্ত তিনি প্রগল্ভ বাক্যবিন্যাস বলে মনে করতেন। একবার কোনও এক সাহিত্য-সমালোচক তাঁর একখানা বই সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে তাঁর জীবন নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করাতে তিনি রীতিমতো আহত হয়েছিলেন। তাঁর সে বেদনা-বোধে ছিল লেখকের ব্রীড়া– শুদ্ধ বিনয় তার কাছে নতমস্তক হয়।
‘আজ গত হয়েছেন এই মহান পুরুষ; তাঁর সম্বন্ধে সামান্য কিছু নিবেদন করি।
‘প্রথমবার তাকে দেখি গুস্তাফ ফ্লবেরের পার্টিতে।
দরজা খুলতে ঘরে ঢুকলেন দৈত্য বিশেষ। রুপালি মাথা–রূপকথায় যাকে বলে রজতশির। লম্বা-লম্বা সাদা চুল, রুপালি চোখের পলক আর বিরাট সাদা দাড়ি–সত্যই যেন খাঁটি রুপোর অতি মিহিন তার দিয়ে তৈরি। ঝকঝক চকচক করছে, প্রতিটি রশ্মিকণা যেন তার উপর থেকে ঠিকরে পড়ছে। আর সেই ধবলিমার মাঝখানে শান্ত সুন্দর মুখচ্ছবি। নাক-চোখ যেন একটু বড় বেশি ধারালো। সত্যই যেন বরুণদেবের শির–চতুর্দিকে ধবল জলের ঢেউ তুলেছেন কিংবা আরও ভালো হয় যদি বলি, অনন্তদেব, বিশ্বপিতার মুখচ্ছবি।
‘অতি দীর্ঘ দেহ– বিরাট, কিন্তু দেহে মেদচিহ্ন নেই। আর সেই বিশালবপু, অতিকায় পুরুষটির চলাফেরা নড়াচড়া একেবারে শিশুটির মতো– বড় ভীরু-ভীরু ভাব। অতি মিষ্ট মৃদু কণ্ঠে কথা বলেন, কেমন যেন মনে হয়, পুরু জিভ শব্দের ভার যেন সইতে পারছে না। কখনও কখনও কথা বলতে বলতে, একটু আটকে যান, যেন ঠিক মনের মতো কথাটি ফরাসিতে কী হবে সেটা খোঁজেন আর প্রতিবারেই চমৎকার ঠিক শব্দটি খুঁজে পান। এই সামান্য থমকে যাওয়াটা তার বাচনভঙ্গিতে লাবণ্য এনে দিত।
‘গল্প বলতে পারতেন অতুলনীয় মধুর ভঙ্গিতে। সামান্যতম ঘটনাকে তিনি সেই ভঙ্গির পরশ লাগিয়ে রসের স্তরে তুলে নিতে পারতেন। তাঁর অসাধারণ প্রতিভার মূল্য আমরা ভালো করেই জানতুম কিন্তু আসলে তিনি সর্বজনপ্রিয় ছিলেন অন্য কারণে। তাঁর চরিত্রে শিশুর মতো সরলতা ছিল সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য; একদিক দিয়ে এই প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক পৃথিবী পরিক্রমা করেছেন, তার যুগের তাবৎ গুণী-জ্ঞানীকে তিনি চিনতেন, মানুষের পক্ষে যা পড়া সম্ভব তার সবকিছুই তার পড়া ছিল, ইয়োরোপের সব ভাষা আপন মাতৃভাষার মতো বলতে পারতেন অথচ অন্যদিক দিয়ে তার আর পাঁচজন বন্ধুবান্ধবের কাছে যা-কিছু অতিশয় সামান্য সাধারণ তারই সামনে তিনি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে অবাক মানতেন, ভাবতেন এটা হল কী করে?
‘সাহিত্য বিচারের সময় তিনি আমাদের পাঁচজনের মতো সবকিছু বিশেষ গণ্ডির ভিতর আবদ্ধ হয়ে বিশেষ দৃষ্টিবিন্দু থেকে দেখতেন না। পৃথিবীর তাবৎ সাহিত্য তাঁর খুব ভালো করে পড়া ছিল বলে সর্বসাহিত্যের সমন্বয় করে তারই বিরাট পটভূমিতে তিনি পৃথিবীর একপ্রান্তে প্রকাশিত একখানা বই তুলনা করতেন অন্যপ্রান্তে প্রকাশিত অন্য ভাষায় লিখিত আরেকখানা বইয়ের সঙ্গে। তাই তার সমালোচনা আমাদের কাছে তার বিশেষ মূল্য পেত।
‘তাঁর বয়েস হয়েছিল, তাঁর সাহিত্যজীবন প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল অথচ সাহিত্য সম্বন্ধে তাঁর অভিমত ছিল আধুনিকতম এবং সর্বাপেক্ষা প্রগতিশীল। প্লটের প্যাঁচ আর থিয়েটারি কৌশলে ভর্তি উপন্যাস তিনি দু চোখে দেখতে পারতেন না, তিনি বলতেন, কিছু নয়, সুদ্ধমাত্র জীবন হবে উপন্যাসের উপাদান– তাতে প্লটের কলাকৌশল থাকবে না, থাকবে না অসম্ভব কীর্তিকাহিনী।
‘তাঁর মতে উপন্যাস আর্টের সর্বাধুনিক রূপ। গোড়ার দিকে রূপকথার ছলাকলা তাতে ব্যবহার করা হত এবং উপন্যাস এখনও তার থেকে সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি পায়নি। নানারকম রোমান্টিক আর আকাশ-কুসুম কল্পনা উপন্যাসকে এতদিন ধর্মভ্রষ্ট করেছে। এখন আস্তে আস্তে মানুষের রসবোধ শুদ্ধ হতে চলেছে। এখন ওসব সস্তা ছলাকলা বর্জন করে উপন্যাসকে করতে হবে সরল, তাকে জীবনের আর্ট রূপে তুলে ধরতে হবে, যাতে করে একদিন সে জীবনের ইতিহাসরূপে গণ্য হতে পারে।
‘আজ তাঁর প্রতিভাপ্রসূত কাব্যসৃষ্টির বিশ্লেষণ করা যাবে না– যদিও জানি তাঁর সৃষ্টি রুশ-সাহিত্যের সর্বোচ্চ সৃষ্টির সমপর্যায়ে স্থান পেয়েছে। তাঁর প্রিয়তম বন্ধু মহাকবি পুশকিন, লেরমন্তফ এবং ঔপন্যাসিক গগলের সৃষ্টির পাশাপাশিই তাঁর রচনার স্থান। রুশদেশ যাদের সৃষ্টি চিরকৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ রাখবে ইনি তাদেরই একজন। ইনি রুশকে দিয়েছেন চিরঞ্জীব সম্পদ, অমূল্য নিধি। ইনি দিয়েছেন এমনই সম্পূর্ণ আর্ট, এমন সব সৃষ্টি যার বিস্মরণ অসম্ভব; তিনি দিয়েছেন এমন এক গৌরব যে গৌরবের মূল্যবিচার অসম্ভব, যার আয়ু অন্তহীন এবং রুশদেশের অন্য সর্বগৌরব সে অনায়াসে অতিক্রম করে যায়। এর মতো লোকই দেশের জন্য এমন কিছু করে যান যার কাছে প্রিন্স্ বিসমার্ক তুচ্ছ; পৃথিবীর সর্বভূমির সর্বমহাজনের কাছে এরা নমস্য হন।
ক্রন্দসী
“শ্যামার নামের মন্ত্রগুণে
উতলা নগররক্ষী আমন্ত্রণ শুনে
রোমাঞ্চিত; সত্বর পশিল গৃহ মাঝে
পিছে বন্দী বজ্রসেন নতশির লাজে
আরক্ত কপোল। কহে রক্ষী হাস্য ভরে,
‘অতিশয় অসময়ে অভাজন পরে
অযাচিত অনুগ্রহ।”
ওহ্ ভাষার কী জেল্লা! ‘অতিশয় অসময়ে অভাজনে অযাচিত অনুগ্রহ–’
‘অ’য়ে ‘অ’য়ে ছয়লাপ! তা-ও ইন্সপেক্টর জেনরেল অব্ পুলিসের মুখে।
গল্পটি সকলেরই জানা। রবীন্দ্রনাথ এটি কণেবর জাতক থেকে নিয়েছেন। আজকের দিনের ভাষায় বলতে গেলে রাজ্যপালের মেয়ের আঙটি হারিয়েছে। তুমুল কাণ্ড। স্বয়ং আইজি যখন চোর ধরে গবর্নমেন্ট হৌসের দিকে যাচ্ছেন তখন মনে করুন মাতাহারি তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনি কি তখন ‘উতলা’ এবং ‘রোমাঞ্চিত’ হবেন না? তাঁর মুখে কি তখন থৈ ফুটবে না, চোখ দুটো পলকা নাচ নাচবে না! অবশ্য সামান্য ‘অ’ দিয়ে কবিত্বের প্রকাশ– রবীন্দ্রনাথ অতি মোলায়েম ইঙ্গিত দিয়েছেন যে পুলিস এর বেশি আর কী কবিত্ব করবে? তবে কি না রবীন্দ্রনাথ যখন কবিতাটি লিখেছিলেন সেদিনের তুলনায় আজকের পুলিস বড্ড বেশি লেখা-পড়া করে আপন সর্বনাশ টেনে আনছে।
আমার অবস্থা হয়েছিল বজ্রসেনের। সে চোর।
আমি তখন বোম্বায়ে। আমার এক বন্ধু ব্যাঙ্কার। নাম জভেরি– অর্থাৎ জহুরির গুজরাটি সংস্করণ। এক বাঙালি ‘ফিলিম-এস্টারে’র শাদি। তিনি তাঁর ব্যাঙ্কার জভেরিকে নেমন্তন্ন করেছেন। জভেরি ব্যাচেলর; আমার সঙ্গে চম্ করে। স্টার সেটি জানতেন। লক্ষৌয়ে প্রতিপালিত বঙ্গরমণী এটিকেট-দুরুস্ত হয়, যত না প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি। বিবেচনা করি আমারও নিমন্ত্রণ ছিল– কিন্তু কসম খেতে পারব না।
রোশনাই বাদ্যি-বাজনা যা ছিল তা এমন কিছু মারাত্মক খুনিয়া ধরনের নয়। কন্যা কুরূপা হলে এসবের প্রয়োজন। ইংরেজিতে বলে লিলি ফুলকে তুলি দিয়ে রঙ মাখাতে হয় না! আজকের দিনের ভাষায় লিপস্টিক্-রু মাখাতে হয় না। যাঁরা আছেন এবং যাঁরা আসছেন তাঁদের এক-একজনই একধামা লিলি–না, দুইধামা।
দরিদ্র আবুহোসেন ঘুম ভাঙতে দেখে, সে সুন্দরীদের হাটে। কূজনে গুঞ্জনে গন্ধে অনুমান করল সে খলিফা হারুন-অর-রশিদের হারেমের ভিতর। সাক্ষাৎ পরীস্তান।
আর আমি? অধুনা মৃত ভাস্কর এপস্টাইন আমাকে ‘বৃদ্ধ নিগ্রো’র মডেল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুন্দরীরা আমাকে অবহেলা করেননি। তাঁরা ভেবেছিলেন, আমিও বুঝি ফিলিম স্টার ‘স্যুটিঙে’র (‘শুটিঙ’ সাদামাটা সিনেমা বাবদে অজ্ঞজনের শুদ্ধ উচ্চারণঃ) ড্রেস না ছেড়েই দাওয়াতে এসেছি।
আমি ভালো করেই জানি, আপনারা সব স্টারদেরই চেনেন, কিন্তু সবাইকে একসঙ্গে দেখেছেন কি না সে-বিষয়ে সন্দেহ। তদুপরি আরেকটি ছোট কথা আছে। তারকার তুলনা দিয়েই নিবেদন করি। অরুন্ধতী আকাশের ক্ষুদ্রতম তারকা। কিন্তু তিনি বশিষ্ঠের পাশে বসে যখন সপ্তর্ষির সাতটি তারকার একজন হয়ে দেখা দেন তখন মনে হয় ইনি না থাকলে সপ্তর্ষির সাতটি তারকাই মিথ্যা হতেন।
শাদি মজলিসে তাই ক্ষুদ্রতম তারকাটিও চিত্তহারিণী হয়ে দেখা দিয়েছিলেন।
এলেন, মনে করুন– নামগুলো একটু উল্টেপাল্টে দিচ্ছি- শমশাদ বানু লায়লা। পরনে সাটিনের পাজামা। পায়ের এক-একটি ঘের অন্তত দু হাত। স্বচ্ছন্দে যে কোনও বঙ্গসন্তানের তিনটি পাজামা বা পাঁচটি পাতলুন হতে পারে। শমশাদ বানুর কোমরটি বঙ্গরমণীর কাঁকনের সাইজ। তাই কোমর থেকে পর্দার মতো ফোল্ডে ফোন্ডে সে পাজামা নেমে আসাতে বোঝা গেল না তিনি মাডাম পম্পাডুয়ের ফ্রক পরেছেন, না ভাওয়ালের জমিদারবাড়ির লুঙ্গি পরেছেন, না ইরানি বেদেনীদের তাম্বু-পানা ঘাঘরা পরেছেন। আসলে নাকি একে লক্ষৌঈ বড়া মুরি পাজামা বলে। তা সে যে নামই হোক, আমার মনে হল আমি যেন খাসিয়া পাহাড়ে মুশমই জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়িয়ে। বিজলির আলো প্রতি ফোন্ড বেয়ে যেন গলা রুপোর মতো ঝরনাধারায় পায়ের কাছে নেমে এসে শততরঙ্গে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে শমশাদ বানু লায়লা যেন আস্বচ্ছ দুগ্ধকুণ্ডে কটিতটটি ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
এর সঙ্গে সে-যুগে লম্বা কুর্তা পরা হত। ইনি পরেছেন কঞ্চুলিকা বা চোলি। আমি মাত্র একবার সেদিকে তাকিয়েছিলুম।
মোগল বাদশা মারা গেলে যে ছেলে রাজা হত সে অন্যদের চোখ চোখেরই সুরমা পরার শলা দিয়ে কানা করিয়ে দিত। আমার দুটি চোখই যেন কানা হয়ে গেল। ওরকম কিংখাব আমি দেশ-বিদেশের কোনও জাদুঘরেও দেখিনি। সোনা-রুপোর জরি দিয়ে সে কিংখাবে এমনই কারুকার্য করা হয়েছে যে কিংখাবের একটি টানাপড়েনের রেশমি সুতোও দেখা যাচ্ছে না।
ঘাঘরাটি ছিল যেন শীতল ঝরনা; এ যেন সাক্ষাৎ অগ্নিকুণ্ড।
চোলির হেথাহোথা দু একটি মুক্তো গাঁথা। যেমন বহ্নি নির্বাপিত করার জন্য ক্ষুদ্র হিমিকার নিষ্ফল প্রয়াস।
দু কাঁধ বেয়ে নেমে এসেছে বুলবুল-চশম্ ওড়না।
সেই ছেলেবেলায় দাদিমাকে বুলবুল-চশম শাড়ি পরতে দেখেছি। আর আজ তার-ই ওড়না অতি সূক্ষ্ম মসলিনের এখানে-ওখানে দুটি দুটি করে বুলবুলের চোখের (চশম) মতো ফুটো করে সে দুটি অতি ফাইন মুগা সিল্ক দিয়ে বোতামের ফুটোর মতো কাজ করা হয়। এ রমণীর রুচি আছে। ক্ল্যাসিস্ পড়ে। বুলবুল-চশম্ কালিদাসের যুগের, তার মূল্য ইনি জানেন।
আশ্চর্য! এলো খোঁপা! গামেটল রঙের কৃষ্ণনীল চুলের খোঁপাটি কাঁধে শুয়ে আছে যেন কৃষ্ণকরবীর স্তবক শুভ্র ফুলদানিতে ঘুমিয়ে আছে।
***
হঠাৎ দেখি এক চোখ-ঝলসানো সুন্দরী, বিধবার থান পরে! ইনি বিয়ের পরবে কেন? আমাদের দেশে তো কড়া বারণ। তখন আবার দেখি তার হাতে ফেনা-ভর্তি শ্যাম্পেনের গেলাস। নাহ, ইনি সদ্য স্টুডিয়ো থেকে শুটিঙ অর্ধসমাপ্ত রেখে এসেছেন।
আরও অনেকেই ছিলেন। বেবাক বর্ণনা দিতে হলে তামাম পুজো সংখ্যাটা আমাকেই লিখতে হয়। খর্চায় পুষবে না– সম্পাদক জানেন।
ইতোমধ্যে কৃষ্ণলাল জভেরি এসে আমাকে নিয়ে চললেন সেই তারকা যজ্ঞশালার প্রান্তদেশে অনাদৃতা ঊর্মিলার অবস্থা থেকে টেনেহিঁচড়ে অন্য প্রান্তে। কী ব্যাপার? জভেরি উত্তেজনার মধ্যিখানে ইংরেজি ভুলে গিয়ে গুজরাটিতে কী যেন ‘সুঁ সুঁ’ করলে। কে যেন আমাকে ইন্টারভু দেবে। আমি বেকার। বিধি তবে দক্ষিণ। অদ্য প্রভাতের সবিতা প্রসন্নোদয় হয়েছেন। আম্মো ইস্টার হব।
শমশাদ বানু লায়লা মৃদু হাস্য করলেন। ফিল্মস্টারের ধবধবে সাদা দাঁত নয়। গোলাপির চেয়েও গোলাপি রঙের অতি ক্ষীণ একটি ফিল-স্টারের দাঁতের উপর। কী সুন্দর! তাই বুঝি কালিদাস তাঁর নায়িকার দাঁতের সঙ্গে রাঙা অশোকের তুলনা দিয়েছেন– শুভ্র বন-মল্লিকার সঙ্গে দেননি। আগেই বলেছি, ইনি ক্ল্যাসিকস্। পানের রস গ্রহণ করতে জানেন। অন্য পান কিন্তু জানেন না। হাতে লেমন-স্কোয়াশ।
শুধালেন, ‘আপনি দার্শনিক?’
আমি জভেরিকে ধমক দিয়ে বললুম, ‘জভেরি!’
জভেরি ভীরু। বলল, ‘আমি কিছু বলিনি।’
আমি বিবি সাহেবাকে চালাকি করে শুধালুম, ‘আমাকে কি এতই বিজ্ঞ মনে হয়?’
‘বুদ্দু মনে হয়। বিজ্ঞ মনে হয় ফিল্মস্টারকে, ব্যাঙ্কারকে, পোকার খেলাড়িকে।’
বাধ্য হয়ে বললুম, ‘না। আমি দার্শনিক নই। আমি দর্শনের শত্রু, ধর্ম নিয়ে নাড়াচাড়া করি।’
শমশাদ বানুর মুখে তৃপ্তির চিহ্ন ফুটল।
এতদিনে আমার নীরস শাস্ত্রচর্চা ধন্য হল।
বললেন, ‘সে তো আরও ভালো। আমি তাই খুঁজছিলাম। আচ্ছা বলুন তো–’ বলে তিনি যেই একটু থেমেছেন, আমি তাড়াতাড়ি বললুম, ‘বিবি সাহেবা, এই জায়গা কি ধর্ম-চর্চার পক্ষে প্রশস্ত?’
অবহেলার সঙ্গে বললেন, ‘নয় কেন? পাপীরাই তো ধর্মচর্চা করবে। ধার্মিকদের তো ওসব হয়ে গিয়েছে। তেলো মাথায় ব্রিলেন্টাইন? সেকথা থাক। আমি শুধোতে চাই, কেউ যদি মরে যায় (আমার মনে হল শমশাদ কেমন যেন একটু শিউরে উঠলেন) তবে আমি মরে গেলে তাঁকে দেখতে পাব কি?’
আমি শুধালুম, ‘কোন্ ধর্মমতে?’
‘সে আবার কী?’
‘আমি “তুলনাত্মক ধর্মশাস্ত্র” চর্চা করি।’
‘তার মানে?’
‘এই মানে ধরুন পৃথিবীতে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান মেলা ধর্ম আছে। আমি প্রত্যেক ধর্মের জন্ম, যৌবন, বর্তমান অবস্থা,– কে কী বলে তাই পড়ি। যেমন প্রত্যেক দেশের ইতিহাস হয়, তেমনি প্রত্যেক ধর্মেরও ইতিহাস হয়।’
একটু অসহিষ্ণু হয়ে বললেন, ‘আমি অতশত বুঝি না। আমি ফিলমে কাজ করি আমি পণ্ডিত নই। আমি জানতে চাই, এতসব ধর্ম পড়ার পর এ বিষয়ে আপনার ব্যক্তিগত, পার্সনাল মতটা কী?’
মহা ফাঁপরে পড়লুম। বললুম, ‘আমি কখনও ভেবে দেখিনি। মুসলমান ধর্ম বলে– ’
বাধা দিয়ে বললেন, ‘থাক। আপনি তা হলে একটি আস্ত চিনির বলদ। ধর্ম বয়ে বেড়াচ্ছেন– কখনও কাজে লাগাননি।’
আমি বললুম, ‘ধর্ম কি মসলা বাটার জিনিস! নামাজের কার্পেট দিয়ে কি মানুষ বিছানা বাঁধে?’
অতি শান্তকণ্ঠে বললেন, ‘না। কিন্তু নামাজের কার্পেটে মানুষ নামাজ পড়ে; ওটা শিকেয় তুলে রাখে না।’
আমি বললুম, ‘আপনার সঙ্গে আলাপ হওয়াতে ফিলম-স্টারদের সম্বন্ধে আমার ধারণা বদলে গেল। আপনি নিশ্চয়ই বিস্তর লেখাপড়া করেছেন।’
‘কী আশ্চর্য! এ তো কম-সেসের কথা। এটা না থাকলে প্রসার, ডিরেক্টর, এডমায়ারার, লাভারের দল আমাকে কুটিকুটি করে ফেলত না! ওসব কথা থাক্। আপনি আমার কথার উত্তর বেশ চিন্তা করে দিন।’
তার পর জভেরির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওহে জভেরি, ওঁকে একটা শ্যাম্পেন দাও না?’
আমি মাথা নেড়ে বললুম, ‘থাক্। আপনার পাল্লায় পড়ে আমার বিশ বছরের নেশা কপ্পুর হয়ে গেছে। আড়াই ফোঁটাতে আর কী হবে, লায়লীবানু!’
একটু হেসে বললেন, ‘আপনার মুখে “লায়লী” বেশ মিষ্টি শোনায়।’
সববোনাশ! সববোনাশ!! এ যে ডবল এটাক! পিনসার মুভমেন্ট!
ওড়নাটি ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে চেয়ারে যেভাবে চেপে বসলেন তাতে বুঝলুম যে এর গায়ে কাবুলি রক্ত আছে। উত্তর না নিয়ে উঠবেন না।
মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, চোখ দুটি বন্ধ– বড় শান্ত প্রশান্ত নিস্তব্ধ ভাব। ওই বেশ পরা না থাকলে মনে হতো তপস্বিনী, কঠোর ব্রতচারিণী সুফি রমণী।
আমি আস্তে আস্তে বললুম, ‘আমার মনে হয়–,’ থামলুম। কোনও উত্তর নেই।
কিছুক্ষণ পর ফের বললুম, ‘আমার মনে হয়–’
অল্প একটু ‘উ’ শুনতে পেলুম।
‘–যে পুণ্যবান লোকের কোনও কামনা আল্লাতালা অপূর্ণ রাখেন না।’
***
আমি জানি, চতুর্দিকে তখন হই-হুল্লোড়। কিন্তু আমার মনে হল যেন আমি মরুভূমির মাঝখানে দুপুররাত্রে জেগে উঠেছি। দিবাভাগের আতপতাপে দগ্ধ সর্ব কাফেলার মানুষ উট গাধা মোড়া সবাই অকাতরে ঘুমুচ্ছে। আকাশের নৈস্তব্ধ্যকেও যেন মরুভূমির নৈঃশব্দ্য হার মানিয়েছে। কোথা থেকে এল এ শান্তি, এ বিধান? তাকিয়ে দেখি, লায়লার মুখ থেকে।
ততক্ষণে জভেরি শ্যাম্পেন নিয়ে ফিরেছে।
লায়লা উঠে বললেন, ‘আপনার কথা ঠিক।’
তার পর জভেরিকে রাজেশ্বরীর কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি থাকো। আমি এঁকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।’
গাড়িতে একটি কথাও হয়নি।
আমি নামবার সময় তাঁকে ‘আদাব আরজ, খুদা হাফিজ’ বললুম। তিনি সযত্নে আমার ডান হাত আপন দু হাতে ধরে মৃদু চাপ দিলেন। সে চাপে ছিল বন্ধুত্ব, সহৃদয়তা। ফি-স্টারের হাতের চাপ আমি এর আগে, এখন এবং এর পরেও কখনও পাইনি।
মধ্যরাত্রি অবধি খাটে শুয়ে শান্তি অনুভব করেছিলুম।
রাত তিনটেয়, বোধহয়, একবার ধড়মড় করে জেগে উঠে ফের শুয়ে পড়েছিলুম।
***
সকালে উঠে দেখি, জভেরি ব্যাঙ্কে চলে গিয়েছে।
তার পর দেখি, পূর্বরাত্রির প্রসন্নতা মন থেকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।
কী যেন এক অজানা অস্বস্তির ভাব সর্বদেহমন অসাড় বিকল করে দিয়েছে।
ফোন বাজল। জভেরি চিৎকার করে কী বলছে।
‘শোনো, কাল রাত তিনটেয় শমশাদ আত্মহত্যা করেছে। দুটো চিঠি রেখে গিয়েছে। একটা পুলিশকে, একটা তোমাকে। তোমার চিঠিটার নকল যোগাড় করেছি। লিখেছে, ‘মাই ডিয়ার এম, তোমার কথাই ঠিক। আমি চললুম। দেখা যখন তার সঙ্গে হবেই তখন আর দেরি করে লাভ কী? আমি জানি আত্মহত্যা পাপ। আমার পুণ্যের বদলে এটা মাফ হয়ে যাবে।’
এখন মনে পড়ছে সন্ধ্যার সময় জভেরি বাড়ি এসে আমার হাত থেকে ফোন নামিয়েছিল।
এ-জীবনে এই প্রথম ধর্মোপদেশ দিয়েছিলুম। আর এই শেষ।
গাঁজা
কিংবা গুলও বলতে পারেন। সদাশয় ভারত সরকার যখন আমাকে কিছুতেই ‘পদ্মশ্রী’ ‘পদ্মবিভূষণ’ জাতীয় কোনও উপাধিই দিলেন না, এবং শেষপর্যন্ত শিশির ভাদুড়ী পেয়েও সেটি বেয়ারিং চিঠির মতো ফেরত দিলেন তখন হাজরা রোডের রকফেলাররা (অর্থাৎ যাঁরা রকে অন্তত এক লক্ষ গুল মেরে লক্ষপতি রক্ফেলার হয়েছেন) সাড়ম্বরে আমাকে ‘গুলমগির’ উপাধি দিলেন।
হালের কথা। বর্ষার ছদ্মবেশ পরে শরৎ নেমেছেন কলকাতার শহরে। বাড়ির আঙিনায় হাঁটুজল, রাস্তায় কোমর। সেই জল ভেঙে ভিজে জগঝম্প হয়ে তাবৎ ‘ফেলাররাই’ উপস্থিত, এসেই বসলেন টেলিফোনটি মাঝখানে রেখে। তার পর সবাই আপন আপন আপিস আদালত কারখানা-শুড়িখানাতে খবর পাঠালেন, কী ভয়ঙ্কর জল দাঁড়িয়েছে রাস্তায়। বাড়ি থেকে বেরুনো সম্পূর্ণ অসম্ভব। নৌকো ভাড়ার চেষ্টা করছি। আপিসে আজ না আসতে পারলে কয়েকটা ভিজিটার ফিরে যাবে। সর্বনাশ হবে। কী করি বলুন তো?
মশাদা’র এরকম সকরুণ বেদনার গন্ধটলা আপিস-প্রীতি এর পূর্বে আমি কখনও দেখিনি। রকে আসতে তাকে বুক ভেজাতে হয়েছে, এখন তার চোখ ভেজা অথচ তার বাড়ি থেকে যেদিকে আপিস সেদিকে যেতে হাঁটু পর্যন্ত ভেজাতে হয় না।
আমাদের রকটি সংমিশ্রিত; অর্থাৎ দু-চারটি চিংড়ি সদস্যও আছেন। আবার ফণি-কাকার বয়স ষাট পেরিয়েছে, গুড়গুড়ির বয়স পাঁচ পেরোয়নি। এরা মাঝে-মধ্যে থাকলে আমাদের একটু সামলে-সুমলে কথা কইতে হয়।
মশাদার প্যাঁচটা দেখে টেটেন মারল ডবল প্যাঁচ। অজন সেনকে বলল, ‘অজনদা, আমার আপিসকে ঝপ করে একটা ফোন করে দিন তো, আমি আপিসে বেরিয়ে গিয়েছি, পৌঁছেছি কি না!’
অজনদা আরও তৈরি মাল। নম্বর পেয়ে খবরটা দিয়ে কী একটা শুনে আঁতকে উঠে বললে, ‘কী বললেন? পৌঁছয়নি? বলেন কী মশাই? বড় দুশ্চিন্তায় ফেললেন তো!’
নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।
অজনদার নিজের কোনও ভাবনা নেই। তার আপিসে মাত্র একটি কল। সেটা সে প্রায়ই আপিস ছাড়ার পূর্বে বে-কল করে আসে।
এবারে আমরা শান্ত মনে সমাহিত চিত্তে কর্তব্যকর্মে মন দিলাম।
অজন বুঝিয়ে বলে, ‘আলম অর্থাৎ দুনিয়া জয় করে পেলেন বাদশা আওরঙ্গজেব ওই আলমগির নাম। সেই ওজনে আপনি গুলমগির।’
আমি বললুম, ‘হাসালি রে হাসালি! এ আর নতুন কী শোনালি? প্রথম আমি পরীস্তানে ছিলুম গুল্-ই-বকাওলি, তার পর লন্ডনে নেমে হলুম ডিউক অব গুলস্টার, তার পর ফ্রান্সে হলুম দ্য গুল, তার পর পাকিস্তানে হলুম গুল মুহম্মদ, এখানে এসে হলুম গুলজারিলাল নন্দ। তা ভালো, ভালো। গুলমগির! বেশ বেশ।’
বড়দা উপর থেকে রকে নামেন ক্বচিৎ-কস্মিন। বললেন, ‘ল্যাটে– ল্যাটে বুঝলেন।’ বড়দার মুখ হামেহাল পানের পিকে ভর্তি। তারই মহামূল্যবান একফোঁটা পাছে বরবাদ হয়, সেই ভয়ে তিনি আকাশের দিকে মুখ তুলে স্বর্গের দিকে ঠোঁটদুটি সমান্তরাল করে সেই দুটিকে মুখের ভিতরের দিকে বেঁকিয়ে দিয়ে ‘ত’, ‘দ’-কে ‘ট’, ড’, করে কথা বলেন– অল্পই।
তার এসব কল-কায়দা করা সত্ত্বেও আমরা তখন পাখা, খবরের কাগজ হাতের কাছে যা পাই তাই দিয়ে মুখ ঢাকি। আমি স্বয়ং ছাতা ব্যবহার করি।
অজনদা বলল, এবারে আপনি আপনার উপাধি-প্রাপ্তির সম্মানার্থে একটি সরেস গুল ছাড়ুন তো, চাচা।’
মশা বলল, ‘কিংবা, গাঁজা।’
আমি বললুম, ‘যদি ছাড়ি গাঁজার গুল?’
ঘেন্টু বলল, ‘চাচাকে নিয়ে তোরা পারবিনে রে, ছেড়ে দে।’ ঘেন্টুর পাড়াদও নাম ঘন্টু। আমি নাম দিয়েছি ঘেন্টু। যবে থেকে আমার চর্মরোগ হয়েছে। ঘেন্টু চর্মরোগের জাগ্রতা দেবী। বিশ্বেস না হলে চলন্তিকা খুলে দেখুন।
আমি বললুম, ‘তবে শোন্। কিন্তু তার পূর্বে টেটেনকে সাবধান করে দিচ্ছি, সে যেন আমার গাঁজার গুল নিয়ে কোনও সোসিয়ো-পোলিটিকো-ইকনমিক-স্টাটিসটিকস সঞ্চয় না করে। সে আজকাল ওই নিয়ে মেতেছে।’
টেটেন নানাবটি কেস পড়ছিল। বলল, ‘আপনি কিসসুটি জানেন না, চাচা। আপনার জানা নেই, এ সংসারে মিথ্যাবাদী আছে এবং তার চেয়ে বড় মিথ্যাবাদীও আছে এবং সর্বশেষে স্টাটিসটিশিয়ানদের কথা ভুলবেন না। ওদের মাল নিয়েই তো সরকার গুল মারে। নিত্যি নিত্যি কাগজে দেখতে পান না? আমি আপনার দোরে যাব কেন?’
‘তবে শোন’, নিশ্চিন্ত হয়ে বলি।
‘পার্টিশেনের বছরখানেক পরের কথা। আমার মেজদা ওপার বাংলার কোথায় যেন কী একটা ডাঙর নোকরি করেন। তাঁর সঙ্গে দেখা। আমরা এখন দুই ভিন্ন ভিন্ন স্বাধীন দেশের অধিবাসী। কিন্তু আমাদের ভিতর কোনও ঝগড়া-কাজিয়া নেই। এই অ্যাদ্দিন বাদে নেহরুজি আর আইয়ুব খান সায়েব সেটা বুঝতে পেরে আমাদের শুভ-বুদ্ধি এক্তেয়ার করেছেন। তা সে যাক গে।
হিন্দুস্থানের বিস্তর দরদ-ভরা তত্ত্বতাবাশ করে মেজদা শুধাল, ‘তোদের দেশে গাঁজার কী পরিস্থিতি?’
আমি একগাল হেসে বললুম, ‘স্বরাজ পেয়ে বাড়তির দিকে।’
মেজদা আশ্চর্য হয়ে শুধাল, ‘সে কী রে! কোথায় পাচ্ছিস? আমি তো চালান দিতে পারছিনে!’
আমিও অবাক। শেষটায় বোঝা গেল, দাদা ছিলিম মেরে শিবনেত্র হওয়ার সত্যিকার গাঁজার কথা বলছে। আমি কী করে জানব? আমি পাষণ্ড বটি, –দাদা ধর্মভীরু, সদাচারী লোক।
দাদা বলল, ‘শোন্।’
পার্টিশেনের ফলে মেলা অচিন্তিত প্রশ্ন, নানা ঝামেলা মাথাচাড়া দিয়ে খাড়া হয়ে উঠল এবং তারই সর্বপ্রধান হয়ে উঠে দাঁড়াল গঞ্জিকা-সমস্যা।
গাঁজার এত গুণ আমি জানতুম না। শুনতে পেলুম, স্বয়ং জাহাঙ্গীর বাদশা নাকি গাঁজা খেয়ে উভয়ার্থে অচৈতন্য হয়েছিলেন। সেটা নাকি তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরিতে আছে। গাঁজা ছাড়েন শেষটায় তিনি মনের দুঃখে। এর দাম অতি সস্তা বলে সেটা পোষায় না রাজা-বাদশাদের রাজসিক জাত্যভিমানে। সে কথা যাক।
আমার এলাকায় পৃথিবীর বৃহত্তম গাঁজার চাষ এবং গুদোম। ভারতে গাঁজার চাষ প্রায় নেই। আমি এসব তত্ত্ব জানতুম না– সমস্ত জীবন কাটিয়েছি আসামে, বরঞ্চ চায়ের খবর কিছুটা রাখি; এসব গুহ্য রহস্যের খবর দিয়ে গাঁজা ফার্মের ম্যানেজার আমাকে একদিন দুঃসংবাদ দিল, সে বছরের গাঁজা গুদোমে পচে বরবাদ হব-হব করছে। ইন্ডিয়াতে চালান দেবার উপায় নেই অথচ সেখানেই তার প্রধান চাহিদা।’
আমি শুধলুম, ‘কেন? তুমি নিজে খাও না বলে অন্য লোকেও খাবে না? এ তো বড় জুলুম।’
দাদা বলল, ‘কী জ্বালা! আমি শ্রীঘরবাস পছন্দ করিনে; তাই বলে আমি জেল তুলে দিয়েছি নাকি? সাধে কি বলি তুই একটি চাইল্ড় প্রডিজি– ওয়ান্ডার চাইলড– চল্লিশ বছরে তোর যা জ্ঞানগম্যি হল, আল্লার কুদরতে পাঁচ বছর বয়েসেই সেটা তুই অর্জন করে নিয়েছিলি।’
আমি চটে গিয়ে বললুম, ‘আর তুমি বিয়াল্লিশে।’ দাদা আমার চেয়ে দু বছরের বড়।
দাদা বলল, ‘তোর রসবোধ নেই। ঠাণ্ডা হ।’
রকফেলারদের দিকে তাকিয়ে বললুম, ‘এসব মাইনর বর্ডার ইনসিডেন্ট আমাদের ভিতরে কালে-কস্মিনে হয়, কিন্তু মিটমাট হয়ে যায় ‘আকাশ-বাণী’, ‘ঢক্কা-ডিংডমে’ পৌঁছবার পূর্বেই।’
অজনদা শুধোল, ‘ঢক্কা-ডিংডমটা কী চাচা?’
‘ডিংডম্ মানে জগঝম্প, বিরাট ঢাক, যার থেকে ইংরেজি ‘টমটম’ ‘টমটমিং’ শব্দ এসেছে। অর্থাৎ ঢাকার বেতার কেন্দ্র। তার পর শোনো :
দাদা বলল, ‘ভয়ংকর পরিস্থিতি। ভারতের ষাট হাজার সন্ন্যাসী নাকি রাষ্ট্রপতির কাছে সই, হাতের টিপ দিয়ে আবেদন জানিয়েছেন, গাঁজার অভাবে তাঁদের নানাবিধ কষ্ট হচ্ছে, আত্মচিন্তার ব্যাঘাত হচ্ছে।–’
আমি গোশা করে বললুম, ‘দেখো দাদা, পিতা গত হওয়ার পর অগ্রজ পিতৃতুল্য। কিন্তু তুমি যদি আমাদের সন্ন্যাসীদের নিয়ে মশকরা করো—’
বাধা দিয়ে দাদা বেদনাতুর কণ্ঠে বলল, ‘দেখ ভাই, তুই কখনও দেখেছিস যে আমি কাউকে নিয়ে–’
এবারে আমি বাধা দিয়ে বললুম, ‘থাক থাক। তুমি বলো।’ দাদার ওই গলাটা আমি বড়ই ডরাই। ওটা দাদা ব্যবহার করে পঞ্চাশ বছরে একবার। দাদার বয়স তখন বিয়াল্লিশ।
দাদা তো আমাকে মাফ করবার জন্য তৈরি। চশমার পরকলা দুটো পুঁছে নিয়ে বলল, ‘পূর্বেই বলেছি, পার্টিশেনের ফলে বিস্তর অভাবিতপূর্ব সমস্যা দেখা দিল– এটা তারই একটা। পার্টিশেনের পূর্বে সান্তাহারের গাঁজা যেত হরিদ্বারে অক্লেশে, বাঙালোরের বিয়ার আসত ঢাকায় লাফিয়ে লাফিয়ে। এখন মধ্যিখানে এসে দাঁড়াল এক দুশমন। জিনিভাতে কবে কে আইন করেছিল বিশ্বজনের কল্যাণার্থে কল্যাণ না কচু তার সারমর্ম এই : আপন দেশে তুমি সার্বভৌম রাজা, যা খুশি করতে পার, যত খুশি তত আফিঙ ফলিয়ে বিক্রি করতে পার, গাঁজা চালাতে পার– কিন্তু ভুলো না, আপন দেশের চৌহদ্দির ভিতর। এস্পোর্ট করতে গেলেই চিত্তির। তখন জিনিভার অনুমতি চাই। যেমন মনে কর, ফিনল্যান্ড জিনিভার মারফতে তোদের কাছে চাইল দু মণ আফিঙ– ওষুধ বানাবার জন্য। জিনিভা সন্দেহে গোয়েন্দা লাগাবে জানবার জন্যে, সত্যি ওষুধ বানাবার জন্য ফিনল্যান্ডের অতখানি প্রয়োজন কি না, কিংবা ওরই খানিকটে আক্ৰা দরে বাজারে বিক্রি করে, দেশের লোককে আফিঙখোর বানিয়ে দু পয়সা কামিয়ে নিতে চায় কি না। কারণ কোনও কোনও দেশ নাকি বিদেশের ওষুধ বানানেওয়ালাদের সঙ্গে ষড় করে ওষুধের অছিলায় বেশি বেশি হশিশ, ককেইন রপ্তানি করে সেসব দেশের বহু লোকের সর্বনাশ করেছে। আইনগুলো আমি পড়ে দেখিনি, তাই ঠিক ঠিক বলতে পারব না– নির্যাসটি জানিয়েছিল গাঁজা ফার্মের ম্যানেজার। এখন নাকি জিনিভার পারমিশন চাই, সেটা পেতে কতদিন লাগবে তার ঠিকঠিকানা নেই, কতখানি পাঠানো যাবে তার স্থিরতা নেই।
ইতোমধ্যে উপস্থিত হল আরেক সঙ্কট।
গেল বছরের গাঁজাতে গুদোম ভর্তি। এদিকে হাল বছরের গাঁজা ক্ষেতে তৈরি। তুলে গুদোমজাত করতে হবে। নতুন গুদোম এক ঝটকায় তৈরি করা যায় না– শেষটায় হয়তো জিনিভা কোনও পারমিটই দেবে না, কিংবা এত অল্প দেবে যে বেবাক ব্যবসাই গুটোতে হবে। নয়া গুদোমের কথাই ওঠে না।
তখন নানা চিন্তা, বহু ভাবনা, ততোধিক কর্তৃপক্ষকে আলোচনা করে স্থির করা হল, ‘গেল বছরের গাঁজা পোড়াও–’
আড্ডার কেউই গঞ্জিকা-রসিক নয়। তবু সবাই– টেটেন ছাড়া– এক কণ্ঠে হায় হায় করে উঠল। খাই আর না-ই খাই, একটা ভালো মাল বরবাদ হতে দেখলে কার না দুঃখ হয়! রায়টের সময় পার্ক সার্কাসের মদের দোকানে বোতল ভাঙা হচ্ছে দেখে এক টেম্পারে পাদ্রিকে পর্যন্ত আমি শোক করতে দেখেছি।
স্টাটিসটিশিয়ান টেটেন বলল, ‘আপনারা এতে এমন কী নতুন শোক পাচ্ছেন? মার্কিনরা যে দু দিন অন্তর অন্তর অঢেল গম লিটুরিলি অ্যান্ড মেটফরিক্লি দরিয়ায় ভাসিয়ে দেয় সে বুঝি জানেন না?’ টেটেনই আমাদের মধ্যে ইংরেজিতে এম-এ। ওর উচ্চারণ আমাদের বুঝতে কষ্ট হয়।
সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ বলার পর আমি গল্পের খেই ধরে এবং সিগারেট ধরিয়ে বললুম, ‘তার পর?’ দাদা বলল, ‘গুদোমেতে নতুন মাল পোরা হবে। ম্যানেজারকে বললুম, আমি অমুক দিন যাব, সেদিন পুরনো মাল পোড়ানো হবে। কারণটা তাকে আমি আর বললুম না। সেই যে তুই জানিস নাকি? বড়দা তোকে বলেছেন, তিনি যখন জাপানি বোমার সময় ট্রেজারি অফিসার ছিলেন তখন হুকুম এল জাপানি বোমা পড়লে, ব্যাপক বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিলে ট্রেজারির তাবৎ করেনসি নোট পুড়িয়ে ফেলবে। ভাইজাগা না কোথাকার এক সুবুদ্ধিমান একটিমাত্র বোমা পড়ামাত্রই সরকারকে খবর দিল সে সব নোট পুড়িয়ে ফেলেছে। তার পর দু বছর বাদে তাজ্জবকি বাত, বাজারে সেসব নোটের দর্শন পাওয়া যেতে লাগল। পোড়ায়নি। সরিয়ে ফেলেছিল। আমার তাই ভয়, গাঁজার বেলাও ওই যদি হয়।
আগেভাগে দিনক্ষণ দেখে অর্থাৎ টুর প্রোগ্রাম যথা-যথাস্থানে পাঠিয়ে দিয়ে বেরোলুম গাঁজা পোড়াতে।’
আমি আঁতকে উঠে বললুম, ‘কী বললে?’
দাদা ঈষৎ চিন্তা করে বলল, ‘হ্যাঁ তা তো বটেই।’ “গাঁজা পোড়ানো” কথাটার অর্থ “গাঁজা খাওয়া”ও হয়। তাই শুনেছি, ছোকরা নাতির হাতে সিগারেট দেখে যখন ঠাকুরদা গম্ভীরকণ্ঠে তাকে বলল, ‘জানিস, সিগারেট মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু’– সে তখন শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিল, ‘তাই তো ওকে পোড়াতে যাচ্ছি।’
মোকামে পৌঁছে দেখি বিরাট ভিড়। বিশখানা গাঁয়ের বাছাই বাছাই লোক জমায়েত হয়েছেন সেখানে গাঁজা পোড়ানো দেখবেন বলে। আমি তো অবাক। বাঁশ-পাতা পোড়ানো আর গাঁজা-পাতা পোড়ানোতে এমন কী তফাত যে দুনিয়ার লোক হদ্দমুদ্দ হয়ে জমায়েত হবে? তা সে যাক গে।
হুদো হুদো গাঁজা ওজন করে হিসাব মিলিয়ে ডাঁই ডাঁই করে মাঠের মধ্যিখানে রাখা হল। তার পর চোখের জল মুছতে মুছতে ম্যানেজারই মুখাগ্নি করল। সে-ই তার জনক– একে দিয়ে তার বহু পয়সা কামাবার কথা ছিল।
সেদিন বাতাসটা ছিল একটু এলোমেলো। গাঁজার ধুঁয়ো ক্ষণে এদিকে যায়, ক্ষণে ওদিকে যায়। আর তখন দেখি অবাক কাণ্ড! পাতা পোড়াবার সময় যেদিকে ছুঁয়ে যায় মানুষ সেদিক হতে সরে যায়। আজ দেখি উল্টী বাত। জোয়ান-বুড়ো, মেয়েমদ্দে– হ্যাঁ, কয়েকটি মেয়ে-ছেলেও ছিল– ছোটে সেদিকে।
আর সে কী দম নেওয়ার বহর! সাঁই সাঁই শব্দ করে সবাই নাভিকুণ্ডুলী পর্যন্ত ভরে নিচ্ছে সেই নন্দন-কাননের পারিজাত-পাপড়ি পোড়ানোর খুশবাই– অন্তত তাদের কাছে তাই। আমার নাকে একবার একটুখানি ঢোকাতে আমি তো কেশে অস্থির। আর ওরা ফেলছে কী পরিতৃপ্তির নিশ্বাস—‘আহ, আহ্!’ কেউ খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে, কোমরে দু হাত রেখে, আকাশের দিকে জোড়া মুখ তুলে নাসারন্ধ্র স্ফীত করে নিচ্ছে এক-একখানা দীর্ঘ দম, আর ছাড়ছে দীর্ঘতর ‘আহ্–!’ শব্দ। কেউ-বা মাটিতে বসে ক্যাবলাকান্তের মতো মুখ হাঁ করে আস্য মার্গ দিয়ে যৌগিকধূম্র গ্রহণ প্রশস্ততর মনে করছে।
হঠাৎ হাওয়া ওলটাল। তখন পড়িমড়ি হয়ে সবাই ছুটল সেদিকে। আমি, ম্যানেজার, সেরেশতাদার ততোধিক পড়িমড়ি হয়ে ছুটলুম অন্যদিকে। দু একটি চাপরাসি দেখি মনস্থির করতে পারছে না। তাদের আমি দোষ দিইনে।
ভেবে দেখ, পৃথিবীতে এ ঘটনা ইতিপূর্বে আর কখনও হয়েছে? গাঁজা তো আর কোথাও ফলানো হয় না। তারই মণ মণ পুড়িয়ে একচ্ছত্র গঞ্জিকাযজ্ঞ। চতুর্দিকে গরিব-দুঃখী বিস্তর। এক ছিলিমের দম বাজারে কিনতে গেলে এদের দম বেরিয়ে যায়। আর এখানে লক্ষ লক্ষ তাওয়া পোড়ানো হচ্ছে আকাশ-বাতাস টইটম্বুর করে। হয়তো ধরণীর সুদীর্ঘ ইতিহাসে এই শেষ যজ্ঞ।
আমি তো সায়েন্সের ছাত্র ছিলুম। তোদের কোনও এক ঔপন্যাসিক নাকি সদর রাস্তায় মদের পিপে ফেটে যাওয়ার বর্ণনা দিয়েছে। আমি তার ট্রেলার বাইস্কোপে দেখেছি। কিছু না। ধুলোখেলা। সেখানে সবাই করছে মালের জন্য হুটোপুটি একই দিকে। এখানে বিরাট জিরগা-জলসার জনসমাজ দিকনির্ণয় যন্ত্রের অষ্টকোণ চষে ফেলছে– ধুয়ো যখন যেদিকে যায় সেদিকে। এবং সঙ্গে সঙ্গে উল্টোদিকে ছুটছি আমরা কয়েকজন। রবীন্দ্রনাথ নাকি “জাগ্রত ভগবান”কে ডেকেছিলেন তাঁকে “জনসমাজ-মাঝে” ডেকে নেবার জন্যে! আমি পরিত্রাহি চিৎকার ছাড়ছি, অবশ্য মনে মনে– আল্লাতালা যেন এই আমামুন্নাস, এই “জনসমাজ” থেকে আমাকে তফাত রাখেন।
আমি ততক্ষণে হাসতে হাসতে প্রায় কেঁদে ফেলেছি। দাদা আমার গম্ভীর রাশভারি প্রকৃতির লোক, চোখে-মুখে কোনওরকম ভাব প্রকাশ করে না, অবশ্য দরদি লোক বলে মাঝে মাঝে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাস্য দেখা যায়– যা-ই হোক, যা-ই থাক, আমার মতো ফাজিল-পঞ্চানন নয়। কোটপাতলুন তুর্কি টুপি পরা সেই লোক খনে এদিক খনে ওদিক ধাওয়া করছে, টুপির ফুন্না বা ট্যাসেল চৈতন্যের মতো খাড়া হয়ে এদিক-ওদিক কম্প্রমান এ দৃশ্যের কল্পনা মাত্রই বাস্তবের বাড়া।
দাদা বলল, ‘তুই তো হাসছিস। আমার তখন যা অবস্থা। শেষটায় দেখি, মাথাটা তাজ্জিম তাজ্জিম করতে আরম্ভ করেছে। এত হুটোপুটি সত্ত্বেও ঘিলুতে খানিকটে ধুঁয়ো ঢুকে গিয়েছে নিশ্চয়ই। তার পর মনে হল বেশ কেমন যেন ফুর্তি ফুর্তি লাগছে, কীরকম যেন চিত্তাকাশে উড়ু উড়ুক্কু ভাব। তার পর দেখি, ম্যানেজারটা আমার দিকে কীরকম বেয়াদবের মতো ফিক ফি করে হাসছে। ওর তা হলে হয়েছে। কিংবা আমার। অথবা উভয়ের।
আর এস্থলে থাকা নয়।
টলটলায়মান, পড়পড়ায়মান হয়ে জিপে উঠলুম। সে-ও এক বিপদ। দেখি দুখানা জিপ। দুটোই ধুয়োটে কিন্তু হুবহু একইরকম। কোনটায় উঠি? শেষটায় দেখি আমার পাশে আমারই মতো কে একজন দাঁড়িয়ে। হুবহু আমারই মতো, আর টুপির ফুন্নাটি পর্যন্ত। দু জনাতে দুই জিপে উঠলুম।’
আমি বললুম, ‘দুটো জিপ না কচু!’
দাদা বলল, ‘বুঝেছি, বুঝেছি, তোকে আর বুঝিয়ে বলতে হবে না। শান্ত হয়ে শোন্। তার পর গাড়ি যায় কখনও ডাইনে ঢাকা, আর কখনও বায়ে মতিহারী। তবে কি ড্রাইভারটা–? সে তো সর্বক্ষণ আমারই পিছনে ছিল। তার পর দেখি সেই অন্য জিপটাও ঢাকা-মতিহারী করছে একদম পাশে পাশে থেকে। ওমা! তার পর দেখি চারটে জিপ। সে ও না-হয় বুঝলুম। কিন্তু তার পর, মোশয়, সে কী কাণ্ড! চারখানাই উড়তে আরম্ভ করল।’
আমি শুধালুম, ‘উড়তে!’
‘হ্যাঁ, উড়তে। জিপটাই তো ছিল ঠায় দাঁড়িয়ে। ধুয়ো খেয়েছিল আমাদের চেয়েও বেশি।
হাওয়ায় উড়তে উড়তে ঘুমিয়ে পড়লুম। এবং শেষপর্যন্ত বাঙলোয় পৌঁছলুম।
ভাগ্যিস বেশি ধুঁয়ো মগজে যায়নি। আপন পায়েই ঘরে ঢুকলুম।
সামনেই দেখি তোর ভাবী। আমার দিকে একদৃষ্টে তাকালেন। বাপ! তার পর অতি শান্ত কণ্ঠে– কিন্তু কী কাঠিন্য কী দার্চ সে কণ্ঠে– শুধালেন, “আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?”
‘আমি কিছু বলিনি।’ দাদা থামলেন।
আমি আড্ডাকে বললুম, ‘আমার ভাবী সাহেবা অতিশয় পুণ্যশীলা রমণী, পাঁচ বেকৎ নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, তসবি টপকান। শমসুল-উলেমার মেয়ে।’
রক শুধাল, ‘ওটার মানে কী চাচা?’
আমি বললুম, ‘পণ্ডিত-ভাস্কর। তোদের মহামহোপাধ্যায়ের অপজিট নাম্বার।’
রক শুধাল, ‘তার পর?’
আমি বললুম, ‘তদনন্তর কী হল জানিনে। বউদি দাদার হাল থেকে কতখানি আমেজ করতে পেরেছিলেন তা-ও বলতে পারিনে, কারণ ঠিক সেই সময়ে ভাবী সায়েবা তাঁর স্পিশিলাটি চারপতি পরোটা ও দেখতে বজ্রের মতো কঠোর খেতে কুসুমের মতো মোলায়েম শবৃডেগ নিয়ে ঢুকলেন। আমরা খেতে পেলুম বটে কিন্তু কাহিনীটি অনাহারে মারা গেল।’
.
মশাদা বলল, ‘বিলকুল গুল।’
আমি পরম পরিতৃপ্তি সহকারে বললুম, ‘সাকুল্যে। তাই না বলেছিলুম, গাঁজার গুল। অর্থাৎ গুলের রাজা গুলমগির। তোরা আমাকে আজ ওই টাইটেলটি দিলি না?’
চার্লি চ্যাপলিন
আমার ছেলেবেলায় বায়স্কোপও ছেলেমানুষ ছিল। হরেকরকম ফিলিম তখন আসত; ছোট, বড়, মাঝারি– এখনকার মতো স্টান্ডার্ডাইজড নয়। সেনসর বোর্ড-ফোর্ডও তখন শিশু, এখনকার মতো ‘জ্যাঠা’ হয়ে ওঠেনি—’এটা অশ্লীল’, ‘ওটা কদর্য’, ‘সেটা বড়কর্তাদের নিয়ে মশকরা করেছে’ বলে দেশের-দশের রুচি মেরামত করার মতো হরিশ মুখুয্যে দি সেকেন্ড হয়ে ওঠেনি। কাজেই হরেক রুচির ফিলিম তখন এদেশে অক্লেশে আসত এবং আমরা সেগুলো গোগ্রাসে গিলতুম। তার ফলে আমাদের চরিত্র সর্বনাশ হয়েছে, একথা কেউ বলেনি। এবং আজ যে সেনসর বোর্ডের এত কড়াক্কড়ি, তার ফলে এযুগের চ্যাংড়া-চিংড়িরা যিশুখস্ট কিংবা রামকেষ্ট হয়ে গিয়েছে এ মশকরাও কেউ করেনি। তবু শুনেছি সেনসর বোর্ডের বিশ্বাস, বিস্তর ছবি ব্যান করলে শেষটায় ভালো ছবি বেরুবে। তাই যদি হয়, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একটা সেনসর বোর্ড লাগাও না কেন? কাকা-মামা-শালাদের চাকরি তো হবেই এবং সুবো-শাম হুদোহুদো বই ব্যান করার ফলে একদিন ইয়া দাড়িগোঁফ সমেত আরেকটি সমুচা রবিঠাকুর বেহেশত থেকে টুকুস্ করে ঢসকে পড়বেন– এই যেরকম হাওড়া ইস্টিশানের কল থেকে প্ল্যাটফর্ম টিকিট মিনস-ফর্সেপসে বেরিয়ে আসে।
আমি মাঝে মাঝে ভাবি, এরা কার রুচি রিফর্ম করতে চায়? আমার? সাবধান! পাড়ার ছোঁড়ারা আমায় মানে (ওরাই আমাকে মাঝেমধ্যে বায়স্কোপে নিয়ে যায়), শুনলে ক্ষেপে উঠবে। বোর্ডেরও প্রাণের ভয় আছে। তবে কি টাঙাওলা বিড়িওলাদের? ওহ! কী দম্ভ! ওদের রুচিতে ভণ্ডামি নেই। ওইটে পেলে আমি বর্তে যেতুম।
কিন্তু সে কথা থাক। এই সেনসরিং ব্যাপারটা দেশে-বিদেশে কী প্রকারে সমাধান হয় সে সম্বন্ধে আরেকদিন সবিস্তর আলোচনা করব। ইতোমধ্যে ছোট হিটলারদের স্মরণ করিয়ে রাখি বড়া হিটলাররা জার্মানিতে ‘অলকোয়ায়েট’ ফিলিম ব্যান করেছিল।
সেই যুগে হঠাৎ দেখা দিলেন মহাকবি চার্লি চ্যাপলিন– ভগবান তাঁকে দীর্ঘায়ু করুন।
সাহিত্য বলুন, সঙ্গীত বলুন, চিত্রকলা বলুন, ভাস্কর্য বলুন, এরকম একটি তাজমহলের সামনে-দাঁড়িয়ে-নটরাজ পৃথিবীতে আর কখনও উদয় হয়নি। এঁর প্রতিভা অতুলনীয়। বাপ্লেবী এর কণ্ঠে, উর্বশী পদযুগে, এঁর দক্ষিণ হস্তে বিষ্ণুর চক্র (গ্রেট ডিকটেটর), বাম হস্তে দাক্ষিণ্যের বরাভয় (সিটি লাইট)। ইনি বিশ্বকর্তা। (মডার্ন টাইমস), ইনি নীলকণ্ঠ (মসিয়ো ভেরদু)। ‘অতি বড় বৃদ্ধ’ বলেই ইনি ‘সিদ্ধিতে নিপুণ’ এবং লগ্ন এলে শঙ্করের মতো নবীন বেশে সজ্জিত হতে জানেন (লাইম লাইট)।
রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ করে শরৎচন্দ্র একদা বলেছিলেন, ‘তোমার দিকে চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের অন্ত নাই।’ সেই রবীন্দ্রনাথ সিন্ধুপারের হিস্পানি বিদেশিনীকে দেখে মুগ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন,
‘সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে
দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে।’
চার্লির দিকে তাকিয়ে সর্বক্ষণ এই দোহাটি মনে পড়ে।
সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে জগদ্বিখ্যাত হওয়ার পর টলস্টয় একখানি প্রামাণিক অলঙ্কার-শাস্ত্রের গ্রন্থ লেখেন। পুস্তকের প্রথম এবং শেষ প্রশ্ন, ‘হোয়াট ইজ আর্ট?’ অর্থাৎ ‘রস কী’, মধুর সঙ্গীত শুনে, উত্তম কাব্য পাঠ করে, দেবীর মূর্তি দেখে আমরা যে আনন্দরসে নিমজ্জিত হই সে বস্তুটি কী?
তার সংজ্ঞা দেওয়ার পর টলস্টয় বলেন, গুটিকয়েক উন্নাসিককে যে রস আনন্দ দান করে। সে রস হীন রস। আচণ্ডাল, (আ-সেনসর বোর্ড?)(১) জনসাধারণকে যে কাব্য আনন্দ দেয় সেই কাব্যই প্রকৃত কাব্য, উত্তম কাব্য। যথা, মহাভারত। পণ্ডিত-মূর্খ, বৃদ্ধ-বালক, পাপী-পুণ্যবান সকলেই এ কাব্য শুনে আনন্দ পায়।
অবশ্য সব পাঠক যে একই কাব্যে একই বস্তুতে আনন্দ পাবে এমনটা না-ও হতে পারে। বালক হয়তো কাব্যের কাহিনী বা পুট শুনে মুগ্ধ, বলদৃপ্ত যুবা হয়তো কর্ণার্জুনের যুদ্ধবর্ণনা শুনে বীর রসে লুপ্ত, বৃদ্ধ হয়তো শ্রীকৃষ্ণে অর্জুনের আত্মসমর্পণ দেখে ভক্তিরসে আপুত, এবং উদারচরিত সর্বরসে রসিকজন হয়তো প্রতি ঝঙ্কারে প্রতি মীড়ে প্রকৃত কাব্যরসে নিমজ্জিত।
তা হলে প্রশ্ন, মানুষের বর্বর রুচিকে কি মার্জিত করা যায় না? হয়তো যায়, কিংবা হয়তো যায় না, কিন্তু চেষ্টা আলবৎ করা যায়। সে চেষ্টা ভরত, দণ্ডিন, মম্মট, আরিস্ততেল, রবীন্দ্রনাথ, ক্রোচে করেছেন, কিন্তু এদের গলা কেটে ফেললেও এঁরা কোনও বোর্ডের মেম্বর হতে রাজি হতেন না। মানুষের রুচিপরিবর্তন এঁরাই করিয়েছেন– কোনও বোর্ড কখনওই কিছু পারেনি।
বর্তমান যুগে চার্লি সেই রসই সর্বজনকে উপহার দিয়েছেন। এ যুগের সাহিত্যে, কাব্যে, ভাস্কর্যে, রঙ্গমঞ্চেও কুত্রাপি কেউই চার্লির বৈচিত্র্য, বিস্তার, গভীরতা সর্বজনমর্মস্পর্শদক্ষতা দেখাতে পারেননি। এ যুগে শার্লক হোমস পৃথিবীর সর্বত্রই সম্মান পেয়েছেন, কিন্তু মানুষের কোমলতম স্পর্শকাতরতাকে তিনি তার চরম মূল্য দিতে পারেননি; ওমর খৈয়ামও প্রকৃত ধর্মভীরুকে বিচলিত করতে পারেননি।
চার্লিকে বিশ্লেষণ করি কী প্রকারে?
তাঁর সৃষ্টি, কিংবা তিনি নিজে, এই যে ‘লিটল ম্যান’, সামান্য জন, যেন পাড়ার জগা, টম্, ডিক, হ্যারি; ‘কেউ-কেটা’ তো নয়ই এক্কেবারে, ‘কেউ-না’ কী করে সকলকে ছাড়িয়ে এক অসাধারণ জন হয়ে সকলের হৃদয়ে এমন একটি আসন গ্রহণ করল যে আসন পূর্বে শূন্য ছিল এবং সেখানে আর কেউ কখনও আসতে পারবে না?
কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি?
ভ্যাগাবন্ড চার্লি একটা শুকনো ফুল দেখতে পেয়ে সেটি তুলে নিয়ে শুঁকতে লাগল। ঝাঁট-দিয়ে-ফেলে-দেওয়া ফুল– তার ফুল্ল যৌবন গেছে, সে পথপ্রান্তে অবহেলিত, পদদলিত। সামান্য যেটুকু গন্ধ এখনও তার অঙ্গে সুষুপ্ত ছিল চার্লি তাই যেন তার ‘সহৃদয়’ নিশ্বাস দিয়ে জাগিয়ে তুলে বুক ভরে নিচ্ছে। এ ফুল কি কখনও বিশ্বাস করতে পেরেছিল যে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে– রবীন্দ্রনাথের কবি যেরকম আত্মহত্যার পূর্বমুহূর্তে রাজকন্যার বরমাল্য পেল– সে তার চরম সম্মান পাবে?
এমন সময় রাস্তার দুষ্ট ছোঁড়ারা মোকা পেয়ে পিছন থেকে চার্লির ছেঁড়া পাতলুনের ভিতর হাত ঢুকিয়ে শার্টে দিল টান। চচ্চড় করে ছিঁড়ে গেল পাতলুনের অনেকখানি– এই তার শেষ পাতলুন, এটাও গেল– আর বেরিয়ে এল ছেঁড়া শার্টের শেষ টুকরো।
আস্তে আস্তে ঘাড় ফিরিয়ে ভ্যাগাবন্ড চার্লি ছোঁড়াদের দিকে তাকাল। তারা তখন ‘শুভকর্ম’ সমাধান করে ছুটে পালাচ্ছে।
তখন ভ্যাগাবন্ডের চোখে কী বেদনাতুর করুণ ভাব!
ভিয়েনা, বার্লিন, প্যারিস-প্রাগে আমি বিস্তর থিয়েটার প্রচুর অপেরা দেখেছি, কাব্যে সাহিত্যে টন মণ করুণ রসের বর্ণনা পড়েছি, কিন্তু ভ্যাগাবন্ডের সে করুণ চাউনি এদের সবাইকে কোথায় ফেলে কহাঁ কহাঁ মুল্লুকে চলে যায়।
আর সেই নীরব চাউনিতে বলছে, ‘কেন, ভাই, তোরা আমাকে জ্বালাস? আমি তো তোদের সমাজের উজির-নাজির হতে চাইনে। কুকুর-বেড়ালটাকে পর্যন্ত আমি পথ ছেড়ে দিয়ে কোনও গতিকে দিন গুজরান করছি। আমায় শান্তিতে ছেড়ে দে না, বাবারা!’ তারপরে যেন দীর্ঘনিশ্বাস– হে ভগবান!
এখানেই কি শেষ? তা হলে চার্লি দস্তয়েফস্কির মতো শুধুমাত্র করুণ রসের রাজা হয়ে থাকতেন।
অন্ধ ফুলওয়ালি মিষ্টি হেসে চার্লিকে একটি তাজা ফুল দিতে যাচ্ছে। তাকে? চার্লিকে? অবিশ্বাস্য!
আইনস্টাইন একবার কোনও শহরের বড় স্টেশনে নেমে দেখেন বিস্তর লোক তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে– যেন তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে চায়। বিনয়ী আইনস্টাইন শুধু পিছনের দিকে তাকান আর ডাইনে-বাঁয়ে সরে যান। নিশ্চয়ই তাঁর পিছনে কোনও ডাকসাইটে কেষ্টবিষ্ট আসছেন, সবাই এসেছে তাঁকেই বরণ করতে, আইনস্টাইন শুধু আনাড়ির মতো মধ্যিখানে বাধার সৃষ্টি করছেন।
কই? কেউ তো নেই? রাস্তা একদম ভোঁ– কলকাতার রেশনশপের গুদামের মতো। এরা এসেছে আইনস্টাইনের জন্যই।
আমাদের ভ্যাগাবন্ডটিও পিছনে তাকাল। এক্সট্রিমস মিটু। আইনস্টাইন খ্যাতির সর্বোচ্চ ধাপে, চার্লি নিম্নতম মাপে।
ফুল পেয়ে চার্লির মুখের ভাব। স্মিত হাস্যে মুখের দুই প্রান্ত দুই কানে ঠেকে গিয়েছে, শুকনো গাল দুটো ফুলে গিয়ে উপরের দিকে উঠে চোখ দুটো চেপে ধরেছে। চোখের কোণ থেকে রগ পর্যন্ত চামড়া কুঁচকে গিয়ে কাকের পায়ের নকশা ধরেছে, সে চোখ দুটো কিন্তু বন্ধ– আমার যেন মনে হল ভেজা-ভেজা ঠিক বলতে পারব না, কারণ আমার চোখও তখন। ঝাপসা হয়ে গিয়েছে।
সর্বক্ষণ ভয় হচ্ছিল, এইবার না চার্লি ভ্যাক করে কেঁদে ফেলে!
কে বলে সংসারে শুধু অকারণ বেদনা, নিদারুণ লাঞ্ছনা! পকড়কে লে আও উস্কো। এলিসের রানির হুকুম, ‘অফফফ উইদ হিজ হেড।’
মানুষের কলিজায় চার্লি পুকুর খোঁড়েন কী করে? দুঃখ, সুখ, করুণ, কৃতজ্ঞতা এসব রস আমাদের কলিজার গভীরতম প্রদেশে চার্লি সঞ্চারিত করেন কোন্ পদ্ধতিতে?
এক ইরানি কবি বলেছেন, ‘সর্ব জিনিসের হদ্দ– অর্থাৎ সীমা জানাটাই প্রকৃত সৃষ্টিকর্তার লক্ষণ।’
অর্থাৎ তাঁর বর্ণনায়, তাঁর অভিনয়ে চার্লি বাড়াবাড়ি করেন না। কারণ কে না জানে, একঘেয়েমির চূড়ান্তে পৌঁছয় মানুষ যখন ভ্যাচর-ভ্যাচর করে সবকিছু বলতে চায়, সামান্যতম জিনিস বাদ দিতে চায় না!
তাই অভিনব গুপ্ত, আনন্দবর্ধন বলেছেন, ‘ধ্বনি দিয়ে প্রকাশ করবে।’ ধ্বনি বলতে তারা ব্যঞ্জনা, ইঙ্গিত, সাজেসটিভনেস অনেক কিছুই বুঝেছেন।
যথা :
কুলটা রমণী পথিককে বলছে, ‘হে পথিক, এই ঘরে রাত্রিকালে আমার বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি শয়ন করেন, ওই ছোট ঘরে আমি একা থাকি, আমার স্বামী বিদেশে। তুমি এখন যাও।’
ইঙ্গিত সুস্পষ্ট।
অর্থাৎ চার্লি যেটুকু অভিনয় করেন, সে তো করেনই; সঙ্গে সঙ্গে আমরা সকলেই অনেকখানি অভিনয় করে নিই।
হালে চার্লি সুখবর দিয়েছেন, তিনি আবার সেই ‘লিটল ম্যান, সেই ভ্যাগাবন্ডকে পুনর্জন্ম দেবেন। তার যা বলবার তিনি তারই মারফতে শোনাবেন। শুনে আমরা উল্লসিত হয়েছি। ‘মঁসিয়ো ভের্দু’, ‘লাইম-লাইট’ উৎকৃষ্ট অতুলনীয় রসসৃষ্টি কিন্তু আমরা সেই ভ্যাগাবন্ডকে বড্ড মিস্ করছি।
চার্লি ভ্যাগাবন্ডকে বর্জন করেছিলেন কেন?
হয়তো ভেবেছিলেন সব কথা ওই একইজনের মারফতে বলা চলে না। আমাদের ভ্যাগাবন্ডের পক্ষে সবাইকে তো বিষ খাইয়ে খাইয়ে ‘বিজনেস্ ইস্ বিজনেস্’ বলে এলোপাতাড়ি বিধবাহনন করা যায় না– তাই ভের্দুর সৃষ্টি।
ঠিক এই কারণেই কোনান ডয়ল শার্লক হোমসকে মেরে ফেলে প্রফেসর চ্যালেঞ্জার সৃষ্টি করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথও তাই গদ্য কবিতা ধরেছিলেন। এই উদাহরণটাই ভালো।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পদে পদে দেখলেন তাঁর কবিতায় পদে পদে মিল এসে যাচ্ছে, ছন্দ এসে যাচ্ছে। যাবেন কোথায়? পঞ্চাশ বছরের অভ্যাস। নাচার হয়ে মিলগুলো লাইনের শেষে না এনে মাঝখানে ঢুকিয়ে দিতে লাগলেন– শাক ঢাকা দিয়ে মাংস খাওয়ার মতো।
শেষটায় বললেন, ‘দুত্তোচ্ছাই! যাই ফিরে ফের মিল ছন্দে।’ রবীন্দ্রনাথের গবিতা নিকৃষ্ট নয়, রবীন্দ্রনাথের গবিতা উত্তম কবিতা, এই বাঙলা দেশে একমাত্র তিনিই সার্থক ‘গবি’, কিন্তু সোজা কথা তিনি বুঝে গেলেন যে কবিতার মিল ছন্দ বজায় রেখেও তাঁর যা বক্তব্য তা তিনি বলতে পারবেন। ফিরে গেলেন কবিতায়।
চার্লি যখন ভের্দু করছেন, তখন আমরা পদে পদে দেখতে পাচ্ছি তাঁর পিছনে ভ্যাগাবন্ডকে। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তাকে লুকোবার জন্যে– রবীন্দ্রনাথ যেরকম মিল লুকোবার চেষ্টা করেছিলেন গবিতায়– কিন্তু আমরা তাকে বারবার দেখতে পাচ্ছি। বারবার মনে হয়েছে, ‘আহা এ জায়গায় যদি আমাদের ভ্যাগাবন্ডটি থাকত তবে সে সিচুয়েশনটা কী চমৎকারই না একসপ্লয়েট করতে পারত!’
চার্লিও সেটা বুঝেছেন। যে ভ্যাগাবন্ডকে এতদিন একটুখানি জিরিয়ে নিলেন, তাকে চার্লি আবার ঘরের ভিতর থেকে টেনে আমাদের চোখের সামনে তাকে দিয়ে বাউণ্ডুলেপনা করাবেন।
সুসংবাদ!!
————
১. পাঠক ভাববেন না, আমি কলকাতা বা দিল্লির বোর্ডের কথা ভাবছি। আমি সর্ববিশ্বের জীবিত ও মৃত সর্ব বোর্ডের কথা ভাবছি। শ’ যেরকম ‘কুইনজ রিডার অব প্লেজ’-এর স্মরণে আপন মন্তব্য বিশ্ব-বোর্ডের উদ্দেশে লিখেছিলেন।
ছুছুন্দর কা সিরপর চামেলি কা তেল
লিঙ্গোয়াফোন রেকর্ডের কথা অনেকেই শুনেছেন। এ রেকর্ডগুলোর সাহায্যে দেশি-বিদেশি যেকোনো ভাষা অতি চমৎকার রূপে শেখা যায়। রেকর্ডগুলোতে বড় বড় ভাষা এবং উচ্চারণবিদরা গোড়ার দিকে খুব সহজ ভাষায় কথাবার্তা বলেছেন ক্রমে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে শেষের রেকর্ডগুলোতে এমনি বেগে বলেছেন যে, সেটা আয়ত্ত করতে পারলে আপনি সে ভাষায় নিজেকে ওকিবহাল বলে পরিচয় দিতে পারবেন। প্রথম একখানা রেকর্ড নিয়ে বারবার সেটা শুনতে হয়। তার পর প্রশ্নকর্তা ও উত্তরদাতার সঙ্গে গলা মিলিয়ে, সামনে পাঠ্যপুস্তকের দিকে চোখ রেখে উচ্চারণ করে যেতে হয়। পাঠ্যপুস্তকে আবার ‘অনুশীলন’ও থাকে। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোও করতে হয়। ‘কি’ দেওয়া আছে। তাই দিয়ে ভুলগুলো মেরামত করে নিতে হয়।
বুদ্ধিশুদ্ধির বিশেষ প্রয়োজন নেই। শুধু গাধার খাটুনি আর সহিষ্ণুতা বা নিষ্ঠা কিংবা বলতে পারেন লেগে থাকার প্রয়োজন।
আমার অভিজ্ঞতাপ্রসূত ব্যক্তিগত সুদৃঢ় বিশ্বাস, পৃথিবীর বেশিরভাগ জিনিস শেখার জন্য আক্কেল-বুদ্ধি প্রয়োজন অতি সামান্য। আসলে প্রয়োজন গাধার খাটুনি। বাঙলায় বা অন্য যেকোনো ভাষাতে শব্দ-ভাণ্ডারের শ্রীবৃদ্ধি করতে হলে বুদ্ধির প্রয়োজন কোথায়? ‘পদ্ম’ শব্দের প্রতিশব্দ ‘কমল’ ‘সরোজ’ ‘পঙ্কজ’ শিখতে হলে কাউকে মাইকেলের মতো মেধাবী হতে হয় না, প্রয়োজন হয় ওই কর্মে রোজ লেগে থাকা। কারও মুখস্থ হয় একদিনে, কারও লাগে তিনদিন– তফাৎ ওইটুকু মাত্র। স্বয়ং মাইকেলই নাকি বলেছেন, জিনিয়াসের ৯৯% পাপরেশন, অর্থাৎ মাথার ঘাম পায়ে ফেলা, আর মাত্র এক পার্সেন্ট ইন্সপিরেশন অর্থাৎ বিধিদত্ত প্রতিভা।
শুধুমাত্র মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাইকেলের মতো কাব্য রচনা করা যায় না। কিন্তু নিছক খাটুনির জোরে যেকোনো ভাষার অন্তত এতখানি আয়ত্ত করা যায় যে, দেশের ৯৯% লোক তাকে ওই ভাষায় পণ্ডিত বলে মেনে নেয়।
এবং এই সোনার বাঙলার ৯৯% লোক খাটতে রাজি নয়। রেওয়াজ না করেই সে গাওয়াইয়া হয়ে যায়, নিত্য নবীন নাচ কম্পোজ করতে থাকে।
কিন্তু সেকথা থাক। পরনিন্দা বা আপন নিন্দা– আমিও তো বাঙালি বটি করে আমি পুজোর বাজারে রসভঙ্গ করতে চাইনে। তাই মূল কথা আরম্ভ করি।
এই লিঙ্গোয়াফোন রেকর্ড পত্তনের প্রথম যুগে বার্নার্ড শ’ চারটি বক্তৃতা দেন। সেগুলো কিনতে পাওয়া যায়। অতি সুস্পষ্ট উচ্চারণের সুমধুর ভাষণ। ব্যঙ্গকৌতুক, রসসৃষ্টি, আর তথ্য-পরিবেশ তো আছেই।
কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,
‘.. হয়তো তুমি চালাক ছেলে। আমাকে শুধালে, তা হলে কি আমি সবসময় একই ধরনে কথা বলি?’
‘আমি সঙ্গে সঙ্গেই স্বীকার করে নিচ্ছি, আমি করিনে। কেউই করে না। এই তো এই মুহূর্তে আমি হাজার হাজার গ্রামোফোনওয়ালাদের সামনে কথা বলছি, এদের অনেকেই আমার প্রত্যেকটি শব্দ, প্রত্যেকটি কথা প্রাণপণ বোঝবার চেষ্টা করছে। বাড়িতে আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে যেরকম বেখেয়ালে কথা কই, এখন যদি তোমাদের সঙ্গে সেরকম ধারা কথা কইতে যাই, তা হলে এ রেকর্ডখানা কারও এক কড়ির কাজে লাগবে না; আর এখন তোমাদের সঙ্গে যেরকম সাবধানে কথা বলছি, সেরকম যদি স্ত্রীর সঙ্গে বাড়িতে বলি তা হলে তিনি ভাববেন আমার বদ্ধ পাগল হতে আর বেশি বিলম্ব নেই।
‘জনসাধারণের সামনে আমাকে বক্তৃতা দিতে হয় বলে আমাকে সাবধান থাকতে হয় যে, বিরাট হলের হাজার হাজার লোকের শেষ সারির শ্রোতাও যেন আমার প্রত্যেকটি কথা পরিষ্কার শুনতে পায়। কিন্তু বাড়িতে ব্রেকফাস্টের সময় আমার স্ত্রী আমার থেকে মাত্র দু ফুট খানেক দূরে বসে আছেন। তাই বেখেয়ালে এমনভাবে কথা বলি যে, তিনি আমার কথার উত্তর না দিয়ে প্রায়ই বলেন, “ওরকম বিড়বিড় কর না; আর দেখ, কথা বলার সময় অন্যদিকে ঘাড় ফিরিয়ো না। তুমি যে কী বলছ আমি তার কিছু শুনতে পাচ্ছিনে।” এবং তিনি যে সবসময় সাবধানে কথা বলেন তা-ও নয়। আমাকেও মাঝে মাঝে বলতে হয়, কী বললে?’(১) আর তিনি সন্দেহ করেন যে, আমি ক্রমেই কালা হয়ে যাচ্ছি, অবশ্য তিনি সেটা আমাকে বলেন না। আমি সত্তর পেরিয়ে গিয়েছি– কথাটা হয়তো সত্যি।
‘কিন্তু এ বিষয়ে কণামাত্র সন্দেহ নেই যে, রাজরানির সঙ্গে কথা বলার মতো আমি যেন আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা কই এবং তারও বলা উচিত যেন তিনি রাজার সঙ্গে কথা বলছেন। তাই উচিত; কিন্তু আমরা তা করিনে।
‘আমাদের আদব-কায়দা দু রকমের একটা পোশাকি, অন্যটা ঘরোয়া। কোনও অপরিচিতের বাড়িতে গিয়ে যদি দরজার ফাঁক দিয়ে ওদের কথাবার্তা শোনো অবশ্য আমি আদপেই বলতে চাইনে যে এরকম অভদ্র আচরণ তোমার পক্ষে আদৌ সম্ভব। কিন্তু তবু, ভাষা শেখার অত্যধিক উৎসাহে তুমি যদি কয়েক মুহূর্তের তরে এরকম অপকর্ম করে শোনো, পরিবারের লোক বাইরে কেউ না থাকলে আপসে কী ধরনে কথা বলে এবং পরে যদি ঘরে ঢুকে ওদের কথা শোনো, তা হলে তোমার সামনে ওদের কথা বলার ধরন দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে যাবে। এমনকি, আমাদের ঘরোয়া কায়দা-কেতা পোশাকি কায়দার মতো উত্তম হলেও আসলে আরও ভালো হওয়া উচিত তাদের মধ্যে সবসময়ই পার্থক্য থাকে এবং সে পার্থক্য অন্যসব কায়দাকেতার চেয়ে কথাবার্তাতেই বেশি।
‘মনে কর ঘড়িটাতে দম দিতে ভুলে গিয়েছি; ওটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে! কাউকে তা হলে জিগ্যেস করতে হয়, কটা বেজেছে? অপরিচিত কাউকে জিগ্যেস করলে বলব, কটা বেজেছে, বলতে পারেন?’ সে তখন প্রত্যেকটি কথা পরিষ্কার শুনতে পায়, কিন্তু যদি স্ত্রীকে ওই কথাই শুধাই তবে তিনি সর্বসাকুল্যে শুনতে পান ‘ক’টা বেচ্চে?’ তাই তাঁর পক্ষে যথেষ্ট; কিন্তু তোমাকে জিগ্যেস করলে ওরকম বললে চলবে না। তাই এখন তোমাদের সামনে কথা বলছি স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার চেয়ে অনেক বেশি সাবধানে! কিন্তু লক্ষ্মীটি, ওঁকে সেটি বল না।’
***
শ’ কথাগুলো বলেছেন, প্রধানত উচ্চারণ সম্বন্ধে। কারণ, তিনি রেকর্ডের মারফতে বিদেশিকে ভালো ইংরেজি উচ্চারণ শেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু তার এই নীতি যে ‘আমরা সর্বত্রই একই উচ্চারণে কথা বলিনে’, ভাষা সম্বন্ধে আরও বেশি প্রযোজ্য। শব্দ, ইডিয়ম, প্রবাদ ইত্যাদি আমরা সকলের সামনে একইভাবে বাছাই করে প্রয়োগ করিনে।
শ্বশুরমশায়ের সামনে ঘাড় নিচু করে, হাত-পা দিয়ে বায়ু সমুদ্র মন্থন করা কিছুক্ষণের মতো স্থগিত রেখে বলি,
‘আজ্ঞে, রামবাবু বললেন, ওই ব্যাপার নিয়ে আমি যেন দুশ্চিন্তা না করি।’
পিতাকে বলি, রামবাবু বলল, ‘যাও ও-কথা তোমাকে ভাবতে হবে না।’
রকের ইয়ারকে বলি, ‘শ্লা রেমোটা কী বলল জানিস? বলল, “যা যা ছোঁড়া, মেলা ডোঁপোমি কত্তি হবে না; আপনার চরকায় তেল দে গে যা।”
শ’ সর্বোচ্চ উদাহরণ দিয়েছেন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে। সেটা কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়। তিনি যে তাঁর স্ত্রীকে সমঝে চলতেন, এমনকি ডরাতেনও, সেকথা কারও অজানা নেই। আর ডরায় না কে? ‘পঞ্চতন্ত্র’ পড়ে দেখুন– বিষ্ণুশর্মার লেখাটা নয়, অন্য একজনের। লাইব্রেরি থেকে ধার করে নয়, কিনে। লোকটা অন্নাভাবে আছে।
তাই প্রশ্ন উঠবে, উপরের যে রিপোর্টটি পাত্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করছে, সেটি যদি বউয়ের কাছে নিবেদন করি, তবে সেটা কী রূপ নেবে?
সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে, বউ কী শুনতে চান। তিনি যদি শুনতে চান, ‘রামবাবু ওই কাজের ভারটা আপন কাঁধে তুলে নিয়েছেন, আপনাকে তাই নিয়ে আর মাথা ঘামাতে হবে না, তা হলে তো আপনি নিষ্পরোয়া হয়ে গিয়ে তেরিয়া মেরে চড়াকসে বলবেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ গিন্নি, যা কয়েছ।” আমি যতই বলি, “রামবাবু, আপনাকে কিচ্ছুটি চিন্তা করতে হবে না। আমি সব বোঝা কাঁধে নিচ্ছি”, তিনি ততই আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন, “না ভায়া, ও কাজ আমার তোমাকে দেখতে হবে না।” কী আর করি? ওঁর হাতেই সব ছেড়ে দিয়ে এলুম।’
আর যদি গিন্নি উল্টোটা আশা করে থাকেন? অর্থাৎ আপনি যদি মিশনে ফেল মেরে এসে থাকেন? তা হলে? তা হলে ঈশ্বর রক্ষতু।
গলা সাফ করে ইদিক-উদিক তাকিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘–’
আবার বলছি তখন ঈশ্বর রক্ষতু। আমি আর কী বলব। চল্লিশ বছর হল বিয়ে করেছি। এখনও সে ভাষা শিখতে পারিনি।
মূল কথায় ফিরে যাই।
এ তো হল কথাবার্তায়। সাহিত্যে এ জিনিসটি আরও প্রকট।
সেখানে কাকে উদ্দেশ করে লিখছেন সেটা তো আছেই, তার ওপর আছে বিষয়বস্তু।
কালীপ্রসন্ন সিংহ যখন মহাভারতের অনুবাদ করেছেন তখন ব্যবহার করেছেন সংস্কৃত শব্দবহুল ভাষা, কারণ বিষয়বস্তু এপিক, গুরুগম্ভীর। ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’য় তিনি ব্যবহার করেছেন ‘রকে’র ভাষা। কারণ সেখানে বিষয়বস্তু ‘বেলেল্লাপনা’, অতএব চটুল এবং সেই কারণেই ‘মেঘনাদবধে’র ভাষা এক, ‘একেই কি বলে সভ্যতা’র ভাষা অন্য। ‘কৃষ্ণচরিত্রে’র ভাষা এক, ‘কমলাকান্তে’র ভাষা অন্য।
এমনকি ধরুন, বিষয়বস্তুও এক, কিন্তু সেখানে পরিবেশ এবং পাত্র ভিন্ন বলে ভাষাও ভিন্ন হল। ‘পারস্য ভ্রমণে’ রবীন্দ্রনাথ কথা বলছেন ওই দেশের অভিজাত সম্প্রদায়, গুণীজ্ঞানীদের সঙ্গে– তাই তার ভাষা এক এবং ‘মরুতীর্থ হিংলাজে’র পাত্রপাত্রী অতি সাধারণ জন– এমনকি রিফর্যাফ-–তাই তার ভাষা অন্য; ‘মরুতীর্থ’ ‘পারস্যে’র চেয়ে ভালো না মন্দ সেকথা। উঠছে না। দুটোই রসসৃষ্টি, কিন্তু দুটো আলাদা জিনিস।
অর্থাৎ বিষয়বস্তু—কনটেন্ট– তার শৈলী এবং ভাষা—স্টাইল– নির্বাচন করে। সেখানে উল্টোপাল্টা করলে রসসৃষ্টি হয় না।
‘বঙ্কিমের ভাষার অনুকরণ করবে’–ছেলেবেলা থেকেই সে উপদেশ শুনেছি এবং ধরে নিয়েছি সে ভাষা ‘রাজসিংহ’, ‘দুর্গেশনন্দিনী’র ভাষা।
ওই ভাষা দিয়ে পাড়ার কানাই-বলাইয়ের কাহিনী লিখতে গেলে ফর্ম ও কন্টেন্টের যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়, তার ফলে বারেবারে তাল কাটে। শরৎ চাটুজ্জের প্রথম যৌবনের লেখাতে তার নিদর্শন প্রচুর পাওয়া যায়। প্রৌঢ় বয়সে তিনি তাঁর আপন ভাষা পেয়ে বিষয়বস্তুর সঙ্গে তাল রেখে অদ্ভুত তবলা শোনালেন।
এমনকি ‘গোরা’, ‘যোগাযোগ’, ‘শেষের কবিতা’র ভাষা দিয়ে ‘কচিসংসদ’ লেখা যায় না।
তাই রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্কিমের অনুকরণ (ইমিটেশন) সহজেই হনুকরণ (এপিং) হয়ে যেতে পারে।
———–
১. এখানে শ’ ইচ্ছে করেই ‘আই বেগ ইয়োর পাৰ্ডন’ কিংবা ‘এক্সকিউজ মি’ বলেননি। ইঙ্গিত রয়েছে যে, বাড়িতে স্ত্রীকে আমরা পোশাকি আদবকায়দা দেখাইনে।
ত্রিমূর্তি (চাচা-কাহিনী)
বার্লিন শহরের উলান্ড স্ট্রিটের উপর ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘হিন্দুস্থান হৌস’ নামে একটি রেস্তোরাঁ জন্ম নেয়, এবং সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির যা স্বভাব, রেস্তোরাঁর সুদূরতম কোণে একটি আড্ডা বসে যায়। আড্ডার চক্রবর্তী ছিলেন চাচা বরিশালের খাজা বাঙাল মুসলমান আর চেলারা গোসাই, মুখুয্যে, সরকার, রায় এবং চ্যাংড়া গোলাম মৌলা, এই ক জন।
চাচার ন্যাওটা শিষ্য গোসাঁই বললেন, ‘যা বল, যা কও, চাচা না থাকলে আমাদের আড্ডাটা কীরকম যেন দড়কচ্চা মেরে যায়। তা বলুন, চাচা, দেশের– না, দ্যাশের– খবর কী? কী খেলেন, কী দেখলেন, বেবাক কথা খুলে কন।’
চাচা বরিশাল গিয়েছিলেন। তিন মাস পরে ফিরে এসেছেন। বললেন, ‘কী খেলুম? কই মাছ এক-একটা ইলিশ মাছের সাইজ; ইলিশ মাছ– এক-একটি তিমি মাছের সাইজ; আর তিমি মাছ– তা সে দেখিনি। তবে বোধহয়, তাবৎ বাকরগঞ্জ ডিসৃটিক্টাই তারই একটার পিঠের উপর ভাসছে। ওই যেরকম সিন্দবাদ তিমির পিঠটাকে চর ভেবে তারই পিঠের উপর রশুই চড়িয়েছিল।’
বাকি কথা শেষ হওয়ার পূর্বে সক্কলের দৃষ্টি চলে গেল দোরের দিকে। দুটি জর্মন চ্যাংড়া একটি চিংড়িকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢুকল। ভারতীয় রান্নার ঝালের দাপটে জর্মনরা সচরাচর হিন্দুস্থান হৌসে আসত না। পাড়ার জর্মনরা তো আমাদের লঙ্কা-ফোড়ন চড়লে পয়লা বিশ্বযুদ্ধের ডিসপোজেলের গ্যাস-মাস্ক পরত। তবে দু একজন যে একেবারেই আসত না তা নয়—‘ইন্ডিশে রাইস-কুরি’ অর্থাৎ ভারতীয় ঝোল-ভাতের খুশবাই জর্মনি-হাঙ্গেরি সর্বত্রই কিছু কিছু পাওয়া যায়।
আলতোভাবে ওদের ওপর একটা নজর বুলিয়ে নিয়ে আড্ডা পুনরায় চাচার দিকে তাকাল। চাচা বললেন, ‘খাইছে! আবার সেই ইটারনেল ট্রায়েঙ্গল!’
পাইকিরি বিয়ার খেকো সূয্যি রায় বলল, ‘চাচা হরবকতই ট্রায়েঙ্গল দেখেন। এ যেন ঘামের ফোঁটাতে কুমির দেখা। দ্য ত্রো নিয়ে কি কেউ কখনও বেরোয় না?’
রায়ের গ্রামসম্পর্কে ভাগ্নে, সতেরো বছরের চ্যাংড়া সদস্য লাজুক গোলাম মৌলা শুধাল, ‘মামু, দ্য ত্রো কারে কয়?’
রায় বললেন, ‘পই পই করে বলেছি ফরাসি শিখতে, তা শিখবি নি। ডি, ই দ্য; টি, আর, ও, পি জো-পি সাইলেন্ট। অর্থাৎ একজন অনাবশ্যক বেশি–One too many। এই মনে কর, তুই যদি তোর ফিয়াসেকে– একথাটাও বোঝাতে হবে নাকি?– নিয়ে বেরোস আর আমি খোদার-খামোখা তোদের সঙ্গে জুটে যাই, তবে আমি দ্য ত্রো। বুঝলি?’
গোলাম মৌলা মাথা নিচু করে সেই বার্লিনের শীতের বরাব্বর লজ্জায় ঘামতে লাগল।
আড্ডায় লটবর লেডি-কিলার পুলিন সরকার মৌলাকে ধমক দিয়ে বলল, তুই লজ্জা পাচ্ছিস কেন রে বুড়ব? লজ্জা পাবেন রায়, ডাণ্ডা-গুলি খেলার সময় গুলিকে ভয় দেখা নি ডাণ্ডাকে না ছোঁবার জন্য? তখন কী বলিস? ‘ভাগ্নে বউ দুয়ারে– কোনও কেটে ফালদি যা।’ বরঞ্চ সূয্যি রায় যদি তাঁর ম্যাডামকে নিয়ে বেরোন, আর তুই যদি সঙ্গে জুটে যাস, তবু কিন্তু তুই দ্য ত্রো নস্। রাধা কেষ্ট’র কী হন জানিস তো?’
গোলাম মৌলা এবারে লজ্জায় জল না হয়ে একেবারে পানি।
গোঁসাই বললেন, ‘চাচা, আপনি কিন্তু যেভাবে ঘন ঘন মাথা দোলাচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে, আপনি একদম শোয়ার, এ হচ্ছে দুটো-হুঁলো-একটা-মেনীর ব্যাপার। তা কি কখনও হওয়া যায়?’
চাচা বললেন, ‘যায়, যায়, যায়। আকছারই যায়, অবশ্য প্র্যাকটিস্ থাকলে।’
আজ্ঞা সমস্বরে বলল, ‘প্র্যাকটিস!’
চাচা বললেন, ‘হ। এবারে দেশে যাবার সময় জাহাজে হয়েছে।’
গল্পের গন্ধ পেয়ে আড্ডা আসন জমিয়ে বলল, ‘ছাড়ুন চাচা।’
চাচা বললেন, ‘এবার দেখি, জাহাজভর্তি ইহুদির পাল। জর্মনি, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া থেকে ঝেঁটাই করে সবাই যাচ্ছে সাংহাই। সেখানে যেতে নাকি ভিসার প্রয়োজন হয় না। কী করে টের পেয়েছে, এবারে হিটলার দাবড়াতে আরম্ভ করলে নেবুকাডনাজারের বেবিলোনিয়ান ক্যাপটিভিটি নয়, এবারে স্রেফ কচুকাটার পালা। তাই সাংহাই হয়ে গেছে ওদের ল্যান্ড অব মিল্ক অ্যান্ড হানি, ননীমধুর দেশ।
আমার ডেক-চেয়ারটা ছিল নিচের তলা থেকে ওঠার সিঁড়ির মুখের কাছে। ডাইনে এক বুড়ো ইহুদি আর বাঁয়ে এক ফরাসি উকিল। ইহুদি ভিয়েনার লোক, মাতৃভাষা জর্মন, ফরাসি জানে না। আর ফরাসি উকিল জর্মন জানে না সে তো জানা কথা। ফরাসি ভাষা ছাড়া পৃথিবীতে যে অন্য ভাষা চালু আছে সে তত্ত্ব জাহাজে উঠে সে এই প্রথম আবিষ্কার করল। এতদিন তার বিশ্বাস ছিল, পৃথিবীর আর সর্বত্র ভাঙা-ভাঙা ফরাসি, পিজিন ফেঞ্চই চলে– বিদেশিরা প্যারিসে এলে যেরকম টুকিটাকি ফরাসি বলে ওইরকম আর কি।
তিনজনাতে তিনখানা বই পড়ার ভান করে এক-একবার সিঁড়ি দিয়ে উঠনে-ওলা নামনে-ওলা চিড়িয়াগুলোর দিকে তাকাই, তার পর বইয়ের দিকে নজর ফিরিয়ে আপন আপন সুচিন্তিত মন্তব্য প্রকাশ করি।
একটি মধ্যবয়স্কা উঠলেন। জর্মন ইহুদি বলল, ‘হালব-উনট-হালব’–অর্থাৎ ‘হাফাহাফি’। ফরাসি বলল, “অ’ প্যো আঁসিয়েন’–‘একটুখানি এনশেন্ট’। জর্মন আমাকে শুধাল, ‘ফ্রেঞ্চি, কী বলল?’ আমি অনুবাদ করলুম। জর্মন বলল, ‘চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে। তা আর এমন কী বয়স- নিষট ভার–নয় কি?’ ফরাসি আমাকে শুধাল, ‘ক্যাস কিল দি—‘কী বলল ও?’’ উত্তর শুনে বলল, ‘মঁ দিয়ো– ইয়াল্লা– চল্লিশ আবার বয়স নয়! একটা কেথিড্রেলের পক্ষে অবশ্য নয়। কিন্তু মেয়েছেলে, ছোঃ!’
এমন সময় হঠাৎ একসঙ্গে তিনজনার তিনখানা বই ঠাস করে আপন আপন উরুতে পড়ে গেল। কোর্ট মার্শালের সময় যেরকম দশটা বন্দুক এক ঝটকায় গুলি ছোড়ে। কী ব্যাপার? দ্যাখ তো না দ্যাখ, সিঁড়ি দিয়ে উঠল এক তরুণী।
সে কী চেহারা! এরকম রমণী দেখেই ভারতচন্দ্রের মুণ্ডুটি ঘুরে যায় আর মানুষে-দেবতাতে ঘুলিয়ে ফেলে বলেছিলেন, ‘এ তো মেয়ে মেয়ে নয়, দেবতা নিশ্চয়।’
ইটালির গোলাপি মার্বেল দিয়ে কোঁদা মুখখানি, যেন কাজল দিয়ে আঁকা দুটি ভুরুর জোড়া পাখিটি গোলাপি আকাশে ডানা মেলেছে, চোখ দুটি সমুদ্রের ফেনার উপর বসানো দুটি উজ্জ্বল নীলমণি, নাকটি যেন নন্দলালের আঁকা সতী অপর্ণার আবক্ররেখা মুখের সৌন্দর্যকে দু ভাগে করে দিয়েছে, ঠোঁট দুটিতে লেগেছে গোলাপফুলের পাপড়িতে যেন প্রথম বসন্তের মৃদু পবনের ক্ষীণ শিহরণ।
চাচা বললেন, ‘তা সে যাক গে! আমার বয়েস হয়েছে। তোমাদের সামনে সব কথা। বলতে বাধো বাধো ঠেকে। কিন্তু সত্যি বলতে কী! অপূর্ব, অপূর্ব।’
দেখেই বোঝা যায়, ইহুদি প্রাচ্য-প্রতীচ্য উভয় সৌন্দর্যের অদ্ভুত সম্মেলন।
জর্মন এবং ফরাসি দু জনেই চুপ! আমো।
আর সঙ্গে সঙ্গে দুটি ছোকরা জাহাজের দু প্রান্ত থেকে চুম্বকে টানা লোহার মতো তার গায়ের দু দিকে যেন সেঁটে গেল। স্পষ্ট বোঝা গেল, এতক্ষণ ধরে দু জনাই তার পদধ্বনির প্রতীক্ষায় ছিল।
জাহাজে প্রথম দু একদিন ঠিক আঁচা যায় না, শেষ পর্যন্ত কার সঙ্গে কার পাকাপাকি দোস্তি হবে। কোন্ মঁসিয়ে কোন মাদৃমোয়াজেলের পাল্লায় পড়বেন, কোন হার কোন ফ্রাউ বা ফ্রলাইনের প্রেমে হাবুডুবু খাবেন, কোন মিসিস কোন মিস্টারের সঙ্গে রাত তেরোটা অবধি খোলা ডেকে গোপন প্রেমালাপ করবেন। এ তিনটির বেলা কিন্তু সবাই বুঝে গেল এটা ইটার্নেল ট্রায়েঙ্গল। আমি অবশ্য গোসাঁইয়ের মতো প্রথমটায় ভাবলুম, হার্মলেস ব্যাপারও হতে পারে।
মেয়েটা ফরাসিস, ছেলে দুটোর একটা মারাঠা, আরেকটা গুজরাতি বেনে! প্যারিস থেকেই নাকি রঙ্গরস আরম্ভ হয়েছে। বোম্বাই অবধি গড়াবে। উপস্থিত কিন্তু আমাদের তিনজনারই মনে প্রশ্ন জাগল, আখেরে জিতবে কে?
শুনেছি এহেন অবস্থায় দু জনাই স্পানিয়ার্ড হলে ডুয়েল লড়ে, ইতালীয় হলে একজন আত্মহত্যা করে, ইংরেজ হলে নাকি একে অন্যকে গম্ভীরভাবে স্টিফ বাও করে দু দিকে চলে যায়, ফরাসি হলে নাকি ভাগাভাগি করে নেয়।
প্রথম ধাক্কাতেই গুজরাতি, গেলেন হেরে। মারাঠা চালাকি করে ডবল পয়সা খর্চা করে দু খানি ডেক-চেয়ার ভাড়া করে রেখেছিল পাশাপাশি। বেনের মাথায় এ বুদ্ধিটা খেলল না কেন আমরা বুঝে উঠতে পারলুম না। মারাঠা নটবর সেই হুরীকে নিয়ে গেল জোড়া ডেক-চেয়ারের দিকে স্যর ওয়ালটার র্যালে যেরকম রমণী ইলিজাবেথকে কাদার উপর। আপন জোব্বা ফেলে দিয়ে হাত ধরে ওপারের পেভমেন্টে নিয়ে গিয়েছিলেন।
দু জনা লম্বা হলেন দুই ডেক-চেয়ারে। বেনেটা ক্যাবলাকান্তের মতো সামনে দাঁড়িয়ে খানিকটা কাঁই-কুঁই করে কেটে পড়ল।
আমার পাশের ফরাসি বলল ‘ইডিয়ট!’ জর্মন শুনে বলল, ‘নাইন, আখেরে জিতবে বেনে।’ ‘অ্যাঁপসিবল!’ ‘বেট?’ ‘বেট’ ‘পাঁচ শিলিঙ? ‘পাঁচ শিলিঙ’!
আড্ডার দিকে ভালো করে একবার তাকিয়ে নিয়ে চাচা বললেন, ‘বিশ্বাস কর আর না-ই কর, আস্তে আস্তে জাহাজের সবাই লেগে গেল এই বাজি ধরাধরিতে! বুকিরও অভাব হল না। আর সে বেট কী অদ্ভুত ফ্লাকচুয়েট করে। কোনওদিন ভোরে এসে দেখি জর্মনটা গুম্ হয়ে বসে আছে– যেন জাহাজ একটা কনসানস্ট্রেশন ক্যাম্প আর ফরাসিটা উল্লাসে ক্রিং ব্রিং করে পলকা নাচ নাচছে। ব্যাপার কী? পাক্কা খবর মিলেছে, আমাদের পরীটি কাল রাত দুটো অবধি মারাঠার সঙ্গে গুজুর-গুজুর করেছেন। বেনে মনের খেদে এগারোটাতেই কেবিন নেয়। ফরাসি এখন সক্কলের গায়ে পড়ে থ্রি টু ওয়ান অফার করছে। সে জিতলে পাবে কুল্লে এক শিলিং, হারলে দেবে তিন শিলিং। নাও, বোঝ ঠ্যালা! আর কোনওদিন বা খবর রটে, বেনের পো জাহাজের ক্যাম্বিসের চৌবাচ্চায় হুরীর সঙ্গে দু ঘণ্টা সাঁতার কেটেছে মারাঠা জলকে ভীষণ ডরায়। ব্যস, সেদিন বেনের স্টক স্কাই হাই!
ইতোমধ্যে একদিন বেনের বাজার যখন বড্ড ঢিলে যাচ্ছে তখন ঘটল এক নবীন কাণ্ড। হুরী ও মারাঠা তো বসত পাশাপাশি কিন্তু লাইনের সর্বশেষ নয় বলে হুরীর অন্য পাশে বসত এক অতিশয় গোবেচারি ভালো মানুষ নিগ্রো পাদ্রি। সে গিয়ে তার ডেক-চেয়ারের সঙ্গে বেনের ডেক-চেয়ারের বদলাবদলির প্রস্তাব করেছে। বেনে নাকি উল্লাসে ইয়াল্লা বলে আকাশ-ছোঁয়া লম্ফ মেরেছিল। বেটিঙের বাজার আবার স্টেডি হয়ে গেল।
ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠল, এ বেটিঙের শেষ ফৈসালা হবে কী প্রকারে? বহু বাক-বিতণ্ডার পর স্থির হল, যেদিন হুরী মারাঠা কিংবা বেনের সঙ্গে তার কেবিনে ঢুকবেন সেদিন হবে শেষ কৈলা। যার সঙ্গে ঢুকবেন তার হবে জিত।
দু একজন রুচিবাগীশ আপত্তি করেছিলেন কিন্তু ফরাসি উকিল হাত-পাত চোখ-মুখ নেড়ে বুঝিয়ে দিল, ‘C’est, c’est–, এটা, এটা হচ্ছে একটা লিগাল ডিসিশন, একটা আইনগত ন্যায্য হক্কের ফৈসালা। ঢলাঢলির কোনও কথাই হচ্ছে না।
রেসের বাজি তখন চরমে। কখনও বেনে, কখনও মারাঠা। সেই যে চতুখোর গল্প বলেছিল, পাখিকে গুলি মেরে সঙ্গে সঙ্গে শিকারি কুকুরকেও দিয়েছে লেলিয়ে। তখন বুলেটে কুকুরে কী রেস– ভি কুত্তা, কভি গুলি, কভি গুলি, কভি কুত্তা।
এমন সময় আদন বন্দর পেরিয়ে আমরা ঢুকলাম আরব সাগরে। আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আঠারো হাজার টনের জাহাজকে মারলে মৌসুমি হাওয়া তার বাইশ হাজারি টনের থাবড়া। জাহাজ উঠল নাগর-বেনাগর সবাইকে নিয়ে নাগরদোলায়। আর সঙ্গে সঙ্গে কী সি-সিকনেস! বমি আর বমি! প্রথম ধাক্কাতেই মারাঠা হল ঘায়েল। রেলিঙ ধরে পেটের নাড়ি-ভুঁড়ি বের করার চেষ্টা দিয়ে টলতে টলতে চলে গেল কেবিনে। বেনের মুখে শুকনো হাসি, কিন্তু তিনিও আরাম বোধ করছেন না। পরদিন সমুদ্র ধরল রুদ্রতর মূর্তি। এবারে হুরী পড়ে রইলেন একা। তাঁর মুখও হরতালের মতো হলদে। তার পরের দিন ডেক প্রায় সাফ। নিতান্ত বরিশালের পানি-জলের প্রাণী বলে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে কোনওগতিকে আমি টিকে আছি আর কি! খাবার সময় পেটে যা যায় সেসব রিটার্ন টিকিট নিয়ে মোকামে পৌঁছবার আগেই ফিরি-ফিরি করছে। হুরী নিতান্ত একা বলে ফরাসি বন্ধু তাকে আদর করে ডেকে এনে আমাদের পাশে বসাল।
সে রাত্রে জাহাজ থেলো ঝড়ের মোক্ষমতম থাবড়া। ফরাসি গায়েব। হুরী এই প্রথম ছুটে গিয়ে ধরল রেলিঙ। আমিও এই যাই কি তেই যাই। তবু ধরলুম গিয়ে তাকে। হুরী ক্ষীণকণ্ঠে বলল, ‘কেবিন’। আমি ধরে ধরে কোনওগতিকে তাকে তার কেবিনের দিকে নিয়ে চললুম। দু জনাই টলটলায়মান। আমার কেবিনের সামনে পৌঁছতেই ঝড়ের আরেক ধাক্কায় খুলে গেল আমার কেবিনের দরজা। ছিটকে পড়লুম দু জনাই ভিতরে। কী আর করি? তাকে তুলে ধরে প্রথম বিছানায় শোয়ালুম। তার পর কেবিন-বয়কে ডেকে দু জনাতে মিলে তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গেলুম তার কেবিনে। বাপস!
চাচা থামলেন। একদম থেমে গেলেন।
আড্ডার সবাই একবাক্যে শুধাল, ‘তার পর?’
চাচা বললেন, ‘কচু, তার পর আর কী?’
তবু সবাই শুধায়, ‘তার পর?’
চাচা বললেন, ‘এ তো বড় গেরো। তোরা কি ক্লাইমেকস বুঝিসনে? আচ্ছা, বলছি। ভোর হতেই বোম্বাই পৌঁছলুম। ডেকে যাওয়া মাত্রই সবাই আমাকে জাবড়ে ধরে কেউ বলে ফেলিসিতাসিয়ো মসিয়ো, কেউ বলে কনগ্রাচুলেশনস, কেউ বলে গ্রাতুলিয়েরে দুচ্ছাই, এসব কী? কিন্তু কেউ কিচ্ছুটি বুঝিয়ে বলে না।’
শেষটায় ফরাসি উকিলটা বলল, “আ মসিয়ো, কী কেরানিটাই না দেখালে। ওস্তাদের মার শেষ রাতে। মহারাষ্ট্র-গুজরাত দু জনাই হার মানল। জিতল বেঙ্গল। ভিতল্য বাঁগাল! লং লিভ বেঙ্গল!”
আমি যতই আপত্তি করি কেউ কোনও কথা শোনে না।
আর শুধু কি তাই? ব্যাটারা সবাই আপন আপন বাজির টাকা ফেরত পেল- বেনে কিংবা মারাঠা কেউ জেতেনি বলে। কিন্তু আমার দশ শিলিং স্রেফ, বেপরোয়া, মেরে দিল। বলে কি না, আমি যখন ঘোড়ায় চড়ে জিতেছি, আমার বাজি ধরার হক্ক নেই। টাকাটা নাকি তছরূপ হয়ে যায়।’
খানিকক্ষণ চুপ থেকে চাচা বললেন, ‘কিন্তু সেই থেকে আমার চোখ বলে দিতে পারে ইটার্নেল ট্রায়েঙ্গেল কোথায়।’
এমন সময় সেই দুই জর্মন ছোকরায় লেগে গেল মারামারি। সেটা থামাতে গিয়ে আড্ডা সেদিন ভঙ্গ হল।
দিল্লি স্থাপত্য
যারা এই শীতে প্রথম দিল্লি যাচ্ছেন কিংবা যারা পূর্বে গিয়েছেন কিন্তু পাঠান মোগলদের দালান-কোঠা, এমারত-দৌলত দেখবার সুযোগ ভালো করে পাননি, এ লেখাটি তাদের জন্য। এবং বিশেষ করে তাঁদের জন্য যাঁদের স্থাপত্য দেখে অভ্যাস নেই বলে ওই রস থেকে বঞ্চিত। লেখাটিতে কিঞ্চিৎ ‘মাস্টারি মাস্টারি’ ভাব থেকে যাবে বলে গুণীজনকে আগের থেকেই হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি তাঁরা যেন এটি না পড়েন।
কোনও কালে যে ব্যক্তি গান শোনেনি সে যদি হঠাৎ উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শুনে উদ্বাহু হয়ে মৃত্য না করে তা হলে চট করে তাকে বেরসিক বলা অন্যায়। বাঙলা দেশে এখানে-ওখানে ছিটেফোঁটা স্থাপত্য আছে বটে, কিন্তু একই জায়গায় যথেষ্ট পরিমাণে নেই বলে স্থাপত্যের যে ক্রমবিকাশ এবং সামগ্রিক রূপ তার রস বুঝতে সাহায্য করে তার সম্পূর্ণ অভাব। বিচ্ছিন্নভাবে যে বিশেষ একটি মন্দির, মসজিদ বা সমাধি রসসৃষ্টি করতে পারে না, তা নয়। তাই তুলনা দিয়ে বলতে পারি, জগতের কোনও সাহিত্যের সঙ্গে যদি আপনার কিছুমাত্র পরিচয় না থাকে, তবে সাধারণত ধরে নেওয়া যেতে পারে যে উটকো একখানা ফরাসি উপন্যাসের রস আপনি গ্রহণ করতে পারবেন না। রসবোধের জন্য ঐতিহাসিক ক্ৰমবিকাশ-জ্ঞান অপরিহার্য কি না এ প্রশ্ন নন্দনশাস্ত্রের অন্যতম কঠিন প্রশ্ন। সে গোলকধাঁধার ভিতর একবার ঢুকলে আর দিল্লি যাবার পথ পাবেন না– আর ‘দিল্লি দূর অস্ত’ তো বটেই।
কবিতা, সঙ্গীত, স্থাপত্য, ভাস্কর্যের মূল রস একই ইংরেজিতে যাকে বলে ইসথেটিক ডিলাইট। কিন্তু এক রসের চিন্ময় রূপ (যথা কাব্যের) যদি অন্য রসের মৃন্ময় রূপে (যথা ভাস্কর্য, স্থাপত্যে) টায় টায় মিলছে না দেখেন তবে আশ্চর্য হবেন না। এদের প্রত্যেকেই মূল রস প্রকাশ করে আপন আপন ‘ভাষায়’, নিজস্ব শৈলীতে এবং আঙ্গিকে। একবার সেটি ধরতে পারলেই আর কোনও ভাবনা নেই। তার পর নিজের থেকেই আপনার গায়ে রসবোধের নতুন নতুন পাখা গজাতে থাকবে, আপনি উড়তে উড়তে হঠাৎ দেখবেন তাজমহলের গম্বুজটিও আপনার সঙ্গে আকাশপানে ধাওয়া করেছে– নিচের দিকে তাকিয়ে দেখবেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল যেন ক্রমেই পাতালের দিকে ডুবে যাচ্ছে।
স্থাপত্যের প্রধান রস– প্রধান কেন, একমাত্র বললেও ভুল বলা হয় না, অন্যগুলো থাকলে ভালো, না থাকলে আপত্তি নেই তার কম্পজিশনে, অর্থাৎ তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, যেমন ধরুন, গম্বুজ, মিনার, আর্চ (দেউড়ি), ছত্রি (কিয়োসক, পেভিলিয়ন), ভিত্তি এমনভাবে সাজানো যে দেখে আপনার মনে আনন্দের সঞ্চার হয়। তুলনা দিয়ে বলতে পারি, সঙ্গীতেও তাই। কয়েকটি স্বর– সা, রে, গা, মা, ইত্যাদি এমনভাবে সাজানো হয় যে শোনামাত্রই আপনার মন এক অনির্বচনীয় রসে আপুত হয়।
এই সামঞ্জস্য যখন সর্বাঙ্গসুন্দর হয়, তখনই স্থাপত্য সার্থক। এবং স্থাপত্যের এই অনিন্দ্য সামঞ্জস্য যদি কাব্যে কিংবা উপন্যাসে পাওয়া যায় তবে বলা হয়, কাব্যখানিতে আরকিটেক্টনিকাল মহিমা আছে– মহাভারতে আছে, ফাউষ্টে আছে এবং উয়োর অ্যান্ড পিসে আছে; জ্যাঁ ক্রিস্তফ উত্তম উপন্যাস কিন্তু এ-গুণটি সেখানে অনুপস্থিত। লিরিক বা গীতিকাব্যে যদিও কম্পজিশন থাকে– তা সে যতই কম হোক না কেন, তাতে আরকিটেক্টনিকাল বৈশিষ্ট্য থাকে না।(১)
স্থাপত্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তার পর গুণীরা বলেন, এবং সার্থক স্থাপত্যে স্থপতি অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর নিখুঁত সামঞ্জস্য করার পর সেগুলোকে অলঙ্কার সহযোগে সুন্দর করে তোলেন। অধম একথা সম্পূর্ণ স্বীকার করে না। কিন্তু এ গোলকধাঁধায়ও সে ঢুকতে নারাজ। দিল্লির দিওয়ান-ই-খাস ও দিওয়ান-ই-আমে অলঙ্কারের ছড়াছড়ি, তুগলুক যুগের স্থাপত্যে অলঙ্কার প্রায় নেই– পাঠক দিল্লি দেখার সময় এই তত্ত্বটি সম্বন্ধে সচেতন থাকবেন।(২) অথচ দুই-ই সার্থক রসসৃষ্টি।
এই সামঞ্জস্য যদি খাড়াই-চওড়াই– অর্থাৎ মাত্র দুই দিক নিয়ে হয় তবে সেটা ছবি। শুধু সামনের দিক থেকে দেখা যায়। তিন দিক নিয়ে–তিন ডাইমেনশনাল–হলে সেটা ভাস্কর্য কিংবা স্থাপত্য। কিন্তু অনেক সময় মূর্তির পিছনদিকটা অবহেলা করা হয় বলে সেটাকে শুধু সামনের দিক থেকে দেখতে হয়। গড়ের মাঠের যেসব মূর্তি ঘোড়সওয়ার নয় সেগুলো পিছন থেকে দেখতে রীতিমতো খারাপ লাগে (বস্তুত এই সমস্যা সমাধানের জন্যই অনেক নিরীহ লোককে ঘোড়ায় চড়ানো হয়েছে) এবং বাসটগুলো পিছন থেকে রীতিমতো কদাকার বলে সেগুলোকে দেওয়ালের গায়ে ঠেলে দেওয়া হয় যাতে করে পিছন থেকে দেখবার কোনও সম্ভাবনাই না-থাকে। বিদ্যাসাগরের মূর্তিটি জলের কাছে রয়েছে বলেই ওই সমস্যাটির সমাধান হয়েছে– জলে সাঁতরাতে সাঁতরাতে মূর্তির পিছনদিকে তাকাবে কজন লোকে?
কিন্তু স্থাপত্যের বেলা সেটি হবার জো নেই। স্থাপত্য এমন হবে যে সেটাকে যেন সবদিক থেকে এবং বিশেষ করে যেকোনো দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। কোনও জায়গা থেকে যদি, ধরুন, মনে হয়, দুটো মিনার এক হয়ে গিয়ে কেমন যেন দেউড়িটাকে ঢেকে অপ্রিয়দর্শন করে তুলেছে তবে বুঝবেন স্থপতি আর্টের কোনও একটা সমস্যার ঠিক সমাধান করতে পারেননি বলেই এস্থলে তাল কেটেছেন, অর্থাৎ রসভঙ্গ করেছেন।
মসজিদ মাত্রেরই একটা খুঁত, ঠিক এই কারণে থেকে যায়। শাস্ত্রের হুকুম মসজিদের পশ্চিম দিক যেন বন্ধ থাকে, যাতে করে নমাজিদের সামনে কোনও বস্তু তার দৃষ্টিকে আকর্ষণ না-করতে পারে। ফলে বাধ্য হয়ে স্থপতিকে পশ্চিম দিকে দিতে হয় খাড়া পাঁচিল। এটার সঙ্গে আর বাদবাকি তিন দিক কিছুতেই খাপ খাওয়ানো যায় না বলে, মসজিদ শুধু তিন দিক থেকে দেখা যায়। ধর্মতলার টিপু সুলতানের মসজিদ কিছু উত্তম রসসৃষ্টি নয়– দক্ষিণি ঢঙের গম্বুজগুলোই যা দেখবার মতো কিন্তু পাঠক সেটাকে একবার প্রদক্ষিণ করলেই সমস্যাটা বুঝে যাবেন। দিল্লির পুরনো মসজিদে-মসজিদে পাঠক দেখবেন, স্থপতি কতরকম চেষ্টা করেছেন এই সমস্যা সমাধানের।
সমাধি, রাজপ্রাসাদ, বিজয়স্তম্ভ সম্বন্ধে শাস্ত্রের কোনও বাধাবন্ধক নেই। তাই সেগুলোতে এ অপরিপূর্ণতা থাকা মারাত্মক। সচরাচর থাকেও না।
পূর্বেই নিবেদন করেছি সার্থক স্থাপত্য যেকোনো জায়গাতে, যেকোনো দৃষ্টিবিন্দু থেকে দেখা যায়। কিন্তু তবু প্রশ্ন ওঠে, সবচেয়ে ভালো কোন জায়গা থেকে দেখা যায়? উচ্চাঙ্গ মোগলস্থাপত্য মাত্রেই স্থপতি এর নির্দেশ নিজেই দিয়ে গিয়েছেন। স্থাপত্যে পৌঁছবার। বেশকিছুটা আগে যে প্রধান তোরণদ্বার (দেউড়ি-গেটওয়ে) থাকে– এরই উপর নহবতখানা– তার ঠিক নিচে দাঁড়ালেই স্থাপত্যের পরিপূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। সাধারণত ছবি এ-জায়গা থেকেই ভালো ওঠে। আর যদি নিজের রসবোধ তার সঙ্গে সংযোজন করতে চান, তবে একটু পিছিয়ে গিয়ে দেউড়ির আচঁসুদ্ধ ছবি তুললে তাতে ইসথেটিক ইফেকট” আসবে– যদিও মূল স্থাপত্যের কিছুটা হয়তো তাতে করে কাটা পড়বে।
এ সম্বন্ধে আরও অনেক কিছু বলার আছে, কিন্তু আমার মনে হয় স্থাপত্য দেখার সঙ্গে সঙ্গে প্রসঙ্গত সে আলোচনা তোলাই সঙ্গত।
***
দিল্লির স্থাপত্য তার রাজবংশানুযায়ী ভাগ করা যায়।
॥১॥ দাস বংশ
কুতুব মিনার, কওতুল-ইসলাম মসজিদ, ইলতুতমিশের সমাধি। (কওওতুল-ইসলাম মসজিদের আঙিনায়– সেহন- চন্দ্ররাজা নির্মিত একটি শতকরা নিরানব্বই ভাগের লৌহস্তম্ভ আছে। এটি ও মসজিদের থামগুলো হিন্দুযুগের। –সবকটি কুতুবের গা ঘেঁষে।
॥ ২ ॥ খিলজি-বংশ
আলাউদ্দিন খিলজি নির্মিত ‘আলা-ই-দরওয়াজা’- কুতুবের গা ঘেঁষে। আলাউদ্দিন কিংবা তাঁর ছেলের (‘দেবল-দেবীর’ বল্লভ) তৈরি মসজিদ দিল্লি–মথুরা ট্রাঙ্ক রোডের উপর (নিউ দিল্লি থেকে মাইলখানেক) নিজামউদ্দিন আউলিয়ার(৩) দরগার ভিতর(৪)।
॥ ৩ ॥ তুগলুক-বংশ
গিয়াসউদ্দীন তুগলুক(৫) নির্মিত আপন সমাধি–-কুতুব থেকে মাইল তিনেক দূরে তাঁরই নির্মিত তুগলুকাবাদের সামনে। তুগলুকাবাদ।
ফিরোজ তুগলুক নির্মিত হাউজ খাস– দিল্লি থেকে কুতুব যাবার পথে রাস্তার ডানদিকে। ফিরোজ নির্মিত ফিরোজশাহ-কোটলা– দিল্লি এবং নয়াদিল্লির প্রায় মাঝখানে (অন্যান্য দ্রষ্টব্যের ভিতর এখানে আছে একটি অশোকস্তম্ভ; ফিরোজ এটাকে দিল্লিতে আনিয়ে উঁচু ইমারত বানিয়ে তার উপরে চড়ান)।
৪. সৈয়দ এবং লোদি-বংশ
লোদি গার্ডেনস নয়াদিল্লির লোদি এসটেটের গা ঘেঁষে– ভিতরে আছে, (ক) মুহম্মদ শাহ সৈয়দের কবর, (খ) সিকন্দর লোদির তৈরি মসজিদ এবং মসজিদের প্রবেশগৃহ, (গ) অজানা কবর এবং (ঘ) সিকন্দর লোদির কবর।
ইসা খানের কবর– হুমায়ুনের কবরের বাইরে। যদিও পরবর্তী যুগের, তবু লোদিশৈলীতে তৈরি।
॥ ৫॥ মোগল-বংশ
বাবুর কিছু তৈরি করার সময় পাননি। কেউ কেউ বলেন, পালম অ্যারপোর্টের সামনে যে দুর্গের মতো সরাই এটি তাঁর হুকুমে তৈরি। এতে দ্রষ্টব্য কিছুই নেই।
হুমায়ুনও এক পুরনো কিলা (ন্যাশনাল স্টেডিয়ামের পিছনে) ছাড়া কিছু করে যেতে পারেননি। পুরনো কেল্লারও কতখানি তার, কতখানি শের শা’র, বলা শক্ত। কেল্লার ভিতরে মসজিদটি কিন্তু শের শা’র তৈরি এবং এর শৈলী পাঠান-মোগল থেকে ভিন্ন। সাসারামে শেরের কবর সৈয়দ-লোদি শৈলীতে।
হুমায়ুনের বিধবার– আকবরের মাতার– তৈরি হুমায়ুনের কবর। নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগার সামনে, দিল্লি-মথুরা রোডের ওপাশে।
আকবরের কীর্তি-কলা আগ্রাতে– সেকেন্দ্রা ফতহ্-পুর সিক্রি, আগ্রা দুর্গ। ওই সময়ে তৈরি দিল্লিতে আছে আৎকা খান, আজিজ কোকলতাশ, আব্দুর রহীম খান-খানা ও আদহম্ খানের কবর।
শাহাজাহান– দিল্লি দুর্গ বা লাল কিলা। তার-ই সামনে চাঁদনি চৌকের কাছে জাম-ই মসজিদ।
ঔরঙ্গজেব– লাল কিলার ভিতর মোতি মসজিদ।
ঔরঙ্গজেবের ভগ্নী রৌশনারার নিজের তৈরি সমাধি– রৌশনারা-গার্ডেনসের ভিতর।
ঐতিহাসিক মাত্রেই জানেন, ঔরঙ্গজেবের পরের বাদশাদের অর্থ ও প্রভাব দুই-ই কম ছিল বলে এঁরা প্রায় কিছুই করে যেতে পারেননি। যেটুকু আছে তাতে আলঙ্কারিক সৌন্দর্য যথেষ্ট বটে, কিন্তু স্থাপত্যের লক্ষণ প্রায় নেই– স্থপতি সে-চেষ্টা করেনওনি। এর ভিতর উল্লেখযোগ্য জাহানারা, মুহম্মদ শাহ বাদশাহ রঙ্গিলা, এবং দ্বিতীয় আকবরের (ইনি রাজা রামমোহনকে ‘রাজা’ উপাধি দিয়ে বিলেত পাঠিয়েছিলেন) কবর। তিনটিই নিজামউদ্দিনের দরগার ভিতরে। মোগল স্থাপত্যের ‘শেষ নিশ্বাস’ সফদর-জঙ্গের সমাধি ও তৎসংলগ্ন মসজিদ– কুলোকে বলে এটার মার্বেল আব্দুর রহীম খানখানার কবর থেকে চুরি করা। ইমারতটি যদিও অপেক্ষাকৃত বৃহৎ তবু তার সৌন্দর্য নিম্নশ্রেণির, রুচির বিলক্ষণ অধোগতি এতে স্পষ্ট ধরা পড়ে। ছবিতে হুমায়ুনের কবর, তাজমহল, এমনকি আকা খানের ছোট কবরটির সঙ্গে তুলনা করলেই পাঠক আমার বক্তব্য বুঝতে পারবেন। আকা খানের কবরটি আমার বড় প্রিয় স্থাপত্য। দিল্লির লোক এ কবরটির খবর রাখে না, কারণ এটি নিজামউদ্দিনের দরগার এক নিভৃত কোণে পড়ে আছে।
দিল্লিতে তিনটি বড় দরগা আছে। প্রথমটি কুত্ত্বউদ্দিন বখতিয়ার কাকির। ইনি কুত্বউদ্দীন আইবকের গুরু ছিলেন। অনেকের ধারণা আইবক গুরুর স্মরণে কুতুব মিনার নির্মাণ করেছিলেন। দরগাটি কুতুব মিনারের কাছেই এবং ‘কুতুব সাহেব’ নামে পরিচিত।
দ্বিতীয়টি নিজামউদ্দিন আউলিয়ার এবং তৃতীয়টি নাসিরউদ্দিন ‘চিরাগ দিল্লি’র। দরগাটি দিল্লি থেকে মাইল তিনেক দূরে।
প্রথমটির পত্তন দাস-আমলে, দ্বিতীয়টির খিলজি আমলে এবং তৃতীয়টির তুগলুক আমলে। সেই যুগ থেকে শেষ-মোগল পর্যন্ত এসব দরগাতে বহু ভক্ত নানা ইমারত গড়েছেন বলে অল্পের ভিতর সব স্থাপত্যেরই নিদর্শন পাওয়া যায়। কিন্তু চোখ কিছুটা না বসা পর্যন্ত এসব জায়গায় গবেষণা করা বিপজ্জনক।
কুতুব মিনার পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মিনার। ইংরেজ পর্যন্ত একথা স্বীকার করেছে। আশ্চর্য মনে হয় যে, এর পূর্ববর্তী নিদর্শন এদেশে নেই, ইরান-তুরানেও নেই। বহু স্থপতির বহু একসপেরিমেন্টের সম্পূর্ণ ফায়দা উঠিয়ে তাজ নির্মিত হল– কিন্তু মিনারের ক্ষেত্রে কুতুব প্রথম এবং শেষ একত্সপেরিমেন্ট। এ ধরনের বিজয়স্তম্ভ পূর্বে কেউ করেনি; কাজেই গুণীজনের বিস্ময়ের অবধি নেই যে, হঠাৎ স্থপতি এ সাহস পেল কোথা থেকে? কানিংহাম, ফার্গুসন, কার স্টিফেন, স্যর সৈয়দ আহমদ অনেক ভেবে-চিন্তেও এর কোনও উত্তর দিতে পারেননি।
কুতুব পাঁচতলার মিনার। প্রথম তলাতে আছে ‘বাঁশি’ ও ‘কোণে’র পর-পর সাজানো নকশা। দ্বিতীয় তলাতে শুধু বাঁশি, তৃতীয় তলাতে শুধু কোণ; চতুর্থ ও পঞ্চম তলাতে কী ছিল জানার উপায় নেই, কারণ বজ্রাঘাতে সে দুটি ভেঙে যাওয়ায় ফিরোজ তুগলুক (যিনি ‘অশোকস্তম্ভ’ দিল্লি আনেন; ইনি যেমন নিজে সোসাহে ইমারত বানাতেন ঠিক তেমনি অকাতরে অন্যের ইমারত মেরামত করে দিতেন– দিল্লির অতি অল্প রাজাতেই এই দ্বিতীয় গুণটি পাওয়া যায়। সে দুটি মার্বেল দিয়ে মেরামত করে দেন। পঞ্চমটিতে নাকি আবার সিকন্দর লোদিরও হাত আছে। মিনারের মুকুটরূপে সর্বশেষে (যেখানে এখন আলো জ্বালানো হয়) কী ছিল সে সম্বন্ধে রসিকজনের কৌতূহলের অন্ত নেই।(৬) দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা মিনারকে স্থপতি কী রাজমুকুট পরিয়েছিলেন সেখানেও তিনি তাল রেখে শেষরক্ষা করতে পেরেছিলেন কি না, তার যে অদ্ভুত কল্পনাশক্তি মিনারের সর্বাঙ্গে স্বপ্রকাশ সে-কল্পনাশক্তি দিয়ে তিনি দর্শককে কোন দ্যুলোকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, কে জানে?
ইমারত তৈরি করা কত সোজা! কারিগরের হাতে সেখানে কত অজস্র মাল-মশলা! গম্বুজ, থাম, আর্চ, ছত্রি, মিনারেট, ছজ্জা (ড্রিপস্টোন), কার্নিস, ব্র্যাকেট কত কী! তার তুলনায় একটা সোজা খাড়া স্তম্ভে সৌন্দর্য আনা কত শক্ত! এখানে শিল্পী সফল হয়েছেন শুধু সেটাকে কয়েকটি তলাতে বিভক্ত করে, সামঞ্জস্য রেখে প্রতি তলায় তাকে একটু ছোট করে করে, গুটিকয়েক ব্যালকনি লাগিয়ে দিয়ে এবং মিনারের গায়ে কখনও ‘বাঁশি’, কখনও ‘কোণে’র নকশা কেটে। ‘প্রপশনে’র এরকম চূড়ান্ত পৃথিবীর আর কোনও মিনারে পাওয়া যায় না।
আর তার গায়ের কারুকার্যও অতি অদ্ভুত। বাঁশি এবং কোণের উপর দিয়ে সমস্ত মিনারটিকে কোমরবন্ধের মতো ঘিরে রয়েছে সারি সারি লতা-পাতা, ফুলের মালা, চক্রের নকশা। এগুলো জাতে হিন্দু এবং এর সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে একসারি অন্তর অন্তর আরবি লেখার সার– সেগুলো জাতে মুসলমান। কিন্তু উভয় খোদাইয়ের কাজই যে হিন্দু শিল্পী করেছেন সে বিষয়ে কণামাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। গোটা মিনারটির পরিকল্পনা করেছে মুসলমান, যাবতীয় কারুশিল্প করেছে হিন্দু ভারতবর্ষে মুসলমানদের সর্বপ্রথম সৃষ্টিকার্যে হিন্দু-মুসলমান মিলে গিয়ে যে অদ্ভুত সাফল্য দেখিয়েছিল সে-মিলন পরবর্তী যুগে কখনও ভঙ্গ হয়নি, কভু-বা মুসলমানের প্রাধান্য বেশি, কোনও ইমারতে হিন্দুর প্রাধান্য বেশি। আটশত বৎসর একসঙ্গে থেকেও হিন্দু-মুসলমান চিন্তার ক্ষেত্রে, রাজনীতির জগতে সম্পূর্ণ এক হয়ে যেতে পারেনি, কিন্তু কলার প্রাঙ্গণে (স্থাপত্য, সঙ্গীত এবং নৃত্যে) প্রথমদিনেই তাদের যে মিলন হয়েছিল আজও সেটি অটুট আছে।
কুতুবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর কোনও মিনার কখনও মাথা খাড়া করেনি। দীর্ঘ আট শতাব্দী ধরে বহু বাদশা বহু ইমারত গড়েছেন কিন্তু ‘কুতুবের চেয়েও ভালো মিনার গড়ব’ এ সাহস কেউ দেখাননি। যে ইংরেজ দিল্লিতে সেক্রেটারিয়েট, রাজভবন গড়ে, কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বানিয়ে নিজেকে অতুল বিড়ম্বিত করেছে সে-ও বিলক্ষণ জানত কুতুবের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কোনও স্থপতির কর্ম নয়। (৭)
আলাউদ্দিন খিলজির মতো দুঃসাহসী রাজা ভারতবর্ষে কমই জনেছেন। একমাত্র তিনিই চেয়েছিলেন, কুতুবের সঙ্গে পাল্লা দিতে। তাই কুতুবের দ্বিগুণ ঘের দিয়ে তিনি আরেকটি মিনার গড়তে আরম্ভ করেন– বাসনা ছিল মিনারটি কুতুবের দ্বিগুণ উঁচু হবে। ইমারত মাত্রেরই একটা অপটিমাম সাইজ আছে– অর্থাৎ যার চেয়ে বড় হলে ইমারত খারাপ দেখায়, ছোট হলেও খারাপ দেখায় (সর্ব কলাতেই এ সূত্র প্রযোজ্য; কিন্তু স্থাপত্যের বেলা এটা অন্যতম মূলসূত্র)– কাজেই আলাউদ্দিনের চূড়া ডবল হলে ফল কী ওতরাতো বলা কঠিন। তা সে যা-ই হোক, মিনারের কাঠামোর কিছুটা শেষ হতে-না-হতেই ওপারের ডাক খিলজির কানে এসে পৌঁছল, যে পারে খুব সম্ভব মিনার হাতে নিয়ে লাঠালাঠি চলে না।
আপন মহিমায় নিজস্ব ক্ষমতায় যে স্তম্ভ দাঁড়ায় তার নাম মিনার, এবং মসজিদ, সমাধি কিংবা অন্য কোনও ইমারতের অঙ্গ হিসেবে যে মিনার কখনও থাকে, কখনও থাকে না, তার নাম মিনারেট মিনারিকা। কুতুবের পর পাঠান-মোগল বিস্তর মিনারেট গড়েছে; কিন্তু সেগুলোও কুতুবের কাছে আসতে পারে না। তাজের মিনারিকা ভুবনবিখ্যাত; কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি শিল্পী সেখানে নতমস্তকে হার মেনে নিয়ে সেটাকে সাদামাটার চরমে পৌঁছিয়ে খাড়া করেছেন। পাছে লোকে তাঁর মিনারিকার সঙ্গে কুতুবের তুলনা করে লজ্জা দেয় তাই তিনি সেটাকে গড়েছেন এমন ন্যাড়া করে যে দর্শকের মন অজান্তেও যেন কুতুবকে স্মরণ না করে। না হলে যে তাজের সর্বাঙ্গে গয়নার ছড়াছড়ি তার চারখানা মিনারিকাস্তম্ভে ‘নোয়াটুকু’র চিহ্ন নেই কেন? ওদিকে দেখুন, হুমায়ুনের সমাধি-নির্মাতা ছিলেন আরও ঘড়েল–তিনি তাঁর ইমারতটি গড়েছেন মিনারিকা সম্পূর্ণ বর্জন করে।
দিল্লি-আগ্রার বহু দূরে, কুতুবের আওতার বাইরে, গুজরাতের রাজধানী আহমদাবাদে আমি একটি মিনারিকা দেখেছি যার সঙ্গে কুতুবের কোনও মিল নেই এবং বোধহয় ঠিক সেই কারণেই তার নিজস্ব মূল্য আছে। রাজা আহমদের– এঁরই নামে আহমদাবাদ– বেগম রানি সিপ্রির মসজিদে একটি মধুরদর্শন মিনারিকা বহু ভূপর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গুজরাত এবং রাজপুতানার মেয়েরা তাদের বাহুলতা মণিবন্ধে যে বিচিত্র-আকার, বিচিত্র-দর্শন অসংখ্য বলয়-কঙ্কণ পরে এ মিনারিকা যেন সেই কমনীয়তায় অনুপ্রাণিত। রাজেশ্বরী সিপ্রি যেন তাঁরই অনুপম হাতখানি নভোলোকের দিকে তুলে ধরেছেন ভুবনেশ্বরের ললাটে তিলক পরিয়ে দেবেন বলে।
কুতুবের সঙ্গে সঙ্গে– আসল কুতুব তৈরি হয় প্রথম তলা থেকে নমাজের আজানের জন্য– নির্মিত হয় কুওওতুল ইসলাম মসজিদ। এ মসজিদে এখন দর্শনীয় তার উন্নতদর্শন তোরণ (আর্চ) এবং স্তম্ভগুলো। ভারতীয় কারিগর তখনও জোড়ের পাথর (কি-স্টোন) তৈরি করে তার গায়ে গায়ে চৌকো পাথর লাগিয়ে আর্চ বানাতে শেখেনি বলে(৮) আর্চের সঙ্গে জোড়া বাকি ইমারত ভেঙে পড়েছে, কিন্তু রসের বিচারে এ আর্চটি এখনও অতুলনীয়। এর শান্ত গাম্ভীর্য, আপন কৌলীন্যেই সুপ্রতিষ্ঠিত ঋজু অবস্থিতি নিতান্ত অরসিকজনেরও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে। পরবর্তী যুগে বহু জায়গায় বিস্তর আর্চ নির্মিত হয়েছে, কিন্তু এর প্রসাদগুণ এখনও অতুলনীয়।
এবং এর গায়ে যে হিন্দু কারুকার্য তার সুনিপুণ দক্ষতা, সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এবং মন্দাক্রান্তা গতিচ্ছন্দ দেখে যেন শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। যেন অজন্তা-ইলোরার চিত্রকর শিলাকর দু জনে মিলে প্রাণের আনন্দে এর প্রতিটি রেখা প্রতিটি বক্র প্রতিটি চক্র এঁকে চলেছে। এদের নিশ্চয়ই বলা হয়েছিল যে মুসলমান স্থাপত্যে পশুপক্ষী আঁকা বারণ। সেইটে মেনে নিয়ে কী আশ্চর্য নৈপুণ্যে ‘শেষনাগ’ মতিফকে এরা সাপ না বানিয়েও সাপ এঁকেছে সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় কলার সঙ্গে এরা কুরানের হরফও খোদাই করেছে সমান দক্ষতা নিয়ে। উভয়ের সংমিশ্রণ অপূর্ব, রসসৃষ্টি অসামান্য।
কুওওতুল ইসলাম মসজিদের থামগুলো হিন্দু বৌদ্ধ ও জৈন মন্দির থেকে নেওয়া। এদের গায়ে দর্শক বিস্তর পশুপক্ষী, বুদ্ধ এবং তাঁর শিষ্য এবং অন্যান্য দেব-দেবীর নানা মূর্তি দেখতে পাবেন। মসজিদ গড়ার সময় এগুলোর গায়ে পলেস্তরা লাগিয়ে মূর্তিগুলো ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। পলেস্তরা খসে যাওয়াতে এখন আবার দেখা যাচ্ছে।
এভাবে প্রতিটি ইমারত নিয়ে খুঁটিয়ে আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তা হলে দশ-ভলুমি কেতাব লিখতে হয়– এবং সেগুলো কেউ পড়বে না। আমার উদ্দেশ্য– বাকি ইমারতগুলো দর্শক যেন নিজে আরও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন।
যেমন, কুওওতুল ইসলামের গম্বুজ রসের ক্ষেত্রে নগণ্য– তার পরের ইমারত ইলতুৎমিশের সমাধিতে সেটা ভেঙে পড়ে গিয়েছে– খিলজি যুগে সেটা সুন্দর হতে আরম্ভ করেছে, তুগলুক যুগে গম্বুজ রীতিমতো রসসৃষ্টি করে ফেলেছে; সৈয়দ-লোদি যুগে সে পৃথিবীর আর দশটা গম্বুজের সঙ্গে পাল্লা দিতে আরম্ভ করেছে, হুমায়ুনের গম্বুজকে তো কেউ কেউ তাজের চেয়েও ভালো বলেছেন, আর তাজের তন্বঙ্গ গম্বুজ, শুনি, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ। দেখলে পরে তার ক্ষীণ কটিকে নাকি জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে।
কিংবা আর্চের উত্থান-পতন দেখুন। কিংবা দেখুন ছত্রির আবির্ভাব ক্রমবিকাশ। হুমায়ুনের কবর ও তাজের ছাতের উপরকার ছত্রির মতো ছত্রি পৃথিবীর আর কোথাও পাবেন না। স্থাপত্যে ছত্রির ব্যবহার মুসলমানেরা এদেশে এসে শিখল। তাই এদেশের স্থাপত্যের স্কাই-লাইন ইরান-তুরানের স্থাপত্যকে এ-বাবদে অনায়াসে হার মানায়।
কিংবা দেখুন, ভিতরকার কারুকার্য, যার পরিসমাপ্তি তাজের ‘মর্মরম্বপ্নে’।
দাস-যুগের শেষের দিকে মুসলিম জিওমেট্রিক ডিজাইনের বাড়াবাড়ি হয়েছিল, খিলজি-যুগে ভারসাম্য ফিরে পেল।
তুগলুক যুগে পাবেন দার্চ–শক্তিশালী স্থাপত্যের পরিপূর্ণতা! অলঙ্কার এখানে বাহুল্যরূপে বর্জিত। দেয়াল বাঁকা– যেন পিরামিডের ঢঙে ট্যারচা করে একে আরও মজবুত করার চেষ্টা হয়েছে, গম্বুজও শক্তির পরিচায়ক। লাল পাথর, কালো শ্লেট (তখনও কালো মার্বেল এ-দেশে আসেনি) এবং মর্মরের ধবল– এই তিন রঙের খেলা নিয়েই স্থপতি এখানে অলঙ্কারহীন দৃঢ়তার একঘেয়েমি ভেঙেছেন। গিয়াসউদ্দিন তুগলুকের কবর এরই প্রকৃষ্টতম উদাহরণ।
সৈয়দ-লোদি বংশদ্বয়ের অর্থ ও প্রতিপত্তি দুই-ই ছিল সামান্য। তাই এঁদের কলা-প্রচেষ্টা ছোট ইমারতের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। ওদিকে ইরান-তুরানের সঙ্গে যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল বলে সে-দিক থেকে নব নব অনুপ্রেরণাও আসছিল না। ফলে তাদের স্থাপত্যে হিন্দুপ্রাধান্য বেশি এবং ছোট ইমারতে অলঙ্কারের প্রয়োজন বড় ইমারতের চেয়ে বেশি। কম্পজিশনেও এই প্রথম হিন্দুপ্রভাব স্পষ্ট হয়ে এল। বস্তুত এই আটকোণওলা ইমারত এবং আটদিকের ঘেরা বারান্দা বৌদ্ধস্তূপ এবং তার প্রদক্ষিণচক্রের কথাই মনে করিয়ে দেয়। হিন্দুরা স্তম্ভ-নির্মাণে চিরকালই দক্ষ, ছত্রিও তাদেরই সৃষ্টি। হিন্দু ছজ্জা (ড্রিপস্টোন এগিয়ে আসা কার্নিসের মতো) ছাতের বৃষ্টি ছড়িয়ে দেবার জন্য এদেশে প্রয়োজন–ইরানে দরকার নেই বললেও চলে– সে-সব এসে এখানে ইমারতের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। তুগলুক প্রভাব এখানে অতি সামান্য কেবলমাত্র ট্যারচা স্তম্ভে কিছুটা পাওয়া যায়। সৈয়দ-লোদি স্থাপত্য দেখে মানুষ হতবাক হয় না সত্য, কিন্তু এর এমন একটা কমপেক্টনেস বা ঠাস-বুনুনি আছে যা অন্য স্থাপত্যে বিরল। অল্প দিয়ে রসসৃষ্টিতে সৈয়দ-লোদি প্রথম না হলেও প্রধানদের একজন।
মোগল-যুগ আরম্ভ হল হুমায়ুনের কবর দিয়ে। সেখানে ইরান-তুরানের প্রাধান্য। কিন্তু ছবি এবং পদ্মফুলের ডিজাইন এখানে প্রচুর এবং কারুকার্যেও হিন্দুপ্রাধান্য বেশি। কিন্তু এতে ইরানি ভাব এত কমে গিয়েছে যে, কোনও কোনও ইমারতে কার প্রাধান্য বেশি কিছুতেই স্থির করা যায় না। সেকেন্দ্রার গম্বুজ শেষ করার পূর্বেই আকবর ইহলোক ত্যাগ করেন– তাই বলা শক্ত সম্পূর্ণ সমাধি মনে রসের কোন ভাবের উদয় করে দিত। দিওয়ান-ই-খাস্ ও আম্ যে অলঙ্কারের চূড়ান্তে পৌঁছে গিয়েছে সে সত্য তো পৃথিবীর সবাই স্বীকার করে নিয়েছে। এতদিন বলা হত, পাঠান স্থাপত্যে স্থপতি ও স্বর্ণকার একজোটে কাজ করেছেন। দিওয়ান-ই-খাস ও আম দেখে লোকে বলল, এইবারে এসে জহুরিও যোগ দিয়েছেন। মোগল-কলা এত বিচিত্র ও ভিন্নমুখী যে, তাকে গুটিকয়েক সূত্রে ফেলা প্রায় অসম্ভব। তবে স্থাপত্যের বিকাশ দেখতে হলে সবচেয়ে উত্তম পন্থা হুমায়ুনের কবর ও তাজ দুটি মিলিয়ে দেখা। দুটোর গম্বুজ মিলিয়ে দেখুন, ছত্রিগুলো কার ভালো (এখানে বলা উচিত হুমায়ুনের ছত্রিগুলো নীল টাইলে ঢাকা ছিল; এখন উঠে গিয়ে কালো হয়ে গিয়েছে– তাই আগে ছিল গম্বুজ মর্মরের সাদা, পুরো ইমারত লাল পাথরের আর ছত্রিগুলোর গম্বুজ নীল; তাজে তিনই মার্বেলের); হুমায়ুনের ভিত্তিতে এক সার আর্চ (তার ভিতর দিয়ে নিচে যাওয়া যায়), তাজে তার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে মাত্র; গুলদন্তাজ (মিনারিকারও ছোট মিনারিকা যার শেষ হয় অধস্কুট পদ্মকোরকে) দুই ইমারতেই একরকম; নির্মাণকালে হুমায়ুনে ছিল লাল-সাদা-নীলের সামঞ্জস্য, তাজ শুভ্র-ধবল এবং সবচেয়ে বড় পার্থক্য– হুমায়ুনে মিনারিকা নেই, তাজের চার কোণে চারটি। আপনার কোনটি ভালো লাগে? আর এই শৈলীর অধঃপতন দেখতে হলে দেখুন সফদরজঙ্গের কবর ওয়েলিংডন অ্যারোড্রামের কাছে।
স্পষ্ট দেখছি হুমায়ুনে দার্ঢ্য, তাজে মাধুর্য।
তার কারণ, অনেক ভেবে আমি মন স্থির করেছি, হুমায়ুনের সমাধি নির্মাণ করেছেন তার বিধবা স্বামীর জন্য। তাই তাতে পৌরুষ সমধিক। তাজ নির্মাণ করেছেন বিরহকাতর স্বামী– প্রিয়ার জন্য। তাই সেটিতে লালিত্য বেশি।
————
১. ‘আধেক ঘুমে নয়ন চুমে’ গানটি সার্থক, এবং এই নীতির প্রকৃষ্টতম উদাহরণ।
২. ‘তুলসীর মূলে যেন সুবর্ণ দেউটি উজলিল দশ দিক’– এবং পিকবরবর নব-পল্লব মাঝারে দুটিই সার্থক। প্রথমটিতে অলঙ্কার নেই। অলঙ্কারের বাড়াবাড়ি হলে কাব্য দুর্বল হয়ে পড়ে। মেঘদূতের তুলনায় যেরকম গীত-গোবিন্দ।
৩, ৪. ‘দৃষ্টিপাতে’ উল্লিখিত ‘দিল্লি দূর অস্ত’ কাহিনীর নায়কদ্বয়। গিয়াসের ছেলে ‘পাগলা’ রাজা মহম্মদ তুগলুকের তৈরি ‘আদিলাবাদ’-এর ভগ্নাবশেষে বিশেষ কিছু দেখবার নেই। মুহম্মদ এবং নিজামউদ্দিনের মিত্র কবি-ম্রাট আমির খুসরৌ (দেব-দেবীর প্রেমের কাহিনী ইনিই প্রথম ফারসিতে লেখেন) এবং প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরনির কবর নিজামউদ্দিনের দরগার ভিতর।
৫. ইলতুতমিশের কন্যা সম্রাজ্ঞী রিজিয়ার যে কবর দিল্লিতে আছে সেটি সম্বন্ধে ঐতিহাসিকেরা সন্দেহ প্রকাশ করেন।
৬. গেল শতকের গোড়ার দিকে এক ইংরেজ মেজরের হাতে কুতুবের মেরামতির ভার পড়ে। ব্যালকনি (গ্যালারির) রেলিঙগুলো ছিল বলে তিনি সেখানে চারপাপড়ির নিজস্ব নকশা দিয়ে রেলিঙ বানান নিচের হানিকুম্ অর্থাৎ মৌমাছির চাকের নকশা মূল স্থপতির এবং মাথায় নিজস্ব কল্পনাপ্রসূত একটা মুকুট পরান। সেইটে দেখে দিল্লি-ওলারা সত্রাসে তারস্বরে চিৎকার করেছিল। বহু বৎসর পরে লর্ড কার্জন সেই মুণ্ডটি কেটে নিচে নামিয়ে দূরে সরিয়ে রাখেন।
৭. অক্টরলনি মনুমেন্টে কোনো কলাপ্রচেষ্টা নেই বলে সেটাকে কুতুবের সঙ্গে তুলনা করা অন্যায়– সেটাকে চটকলের চোঙার সঙ্গে তুলনা করা যায়। বড়বাজারের দালানকোঠার সঙ্গে কেউ তাজের। তুলনা করে না।
৮, ইঞ্জিনিয়ারিঙ স্থাপত্যের অংশ বটে কিন্তু বিশুদ্ধ স্থাপত্য-রস আস্বাদনের সময় তার স্থান অতি নিচে। আর্চ, ডোম বানাতে ‘কি-স্টোন’ ইত্যাদি ইঞ্জিনিয়ারি ব্যাপার পাঠক চেম্বার অভিধান দেখেই বুঝে নিতে পারবেন। এসব স্থাপত্যের পশ্চাতে কী অদ্ভুত ইঞ্জিনিয়ারিং স্কিল আছে তার আলোচনা আমি আদপেই করিনি। যেমন, কুতুবের আসল কেরামতি যে এত অল্প গোড়া (বেস্) নিয়ে এত উঁচু মিনার আর কোথাও হয়নি। অদ্ভুত ভারসাম্যই (ব্যালান্স) তার কারণ। এ যেন বাজিকর হাতের আঙুলের ডগায় বিশগজি বাঁশ খাড়া করে রেখেছে। ইঞ্জিনিয়ারি হিসেবে কণামাত্র ভুল থাকলে কুতুব হুড়মুড়িয়ে পড়ে যেত।
নজরুল ইসলাম ও ওমর খৈয়াম
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, রাজমহল, শ্রীরামপুর, হুগলী এবং পরবর্তী যুগে কলকাতায় অনেকখানি আরবি-ফারসির চর্চা হয়েছিল বটে, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এ চর্চা খুব ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। তার প্রধান কারণ অতি সরল– ইসলাম পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে পূর্ববাংলার মতো ছড়িয়ে পড়তে পারেনি, কাজেই অতি সহজেই অনুমান করা যায়, চুরুলিয়া অঞ্চলে পীর দরবেশদের কিঞ্চিৎ সমাগম হয়ে থাকলেও মৌলবি-মৌলানারা সেখানে আরবি-ফারসির বড় কেন্দ্র স্থাপনা করতে পারেননি।
তদুপরি নজরুল ইসলাম স্কুলে সুবোধ বালকের মতো যে খুব বেশি আরবি-ফারসি চর্চা করেছিলেন তা-ও মনে হয় না। স্কুলে তিনি আদৌ ফারসি (আরবির সম্ভাবনা নগণ্য) অধ্যয়ন করেছিলেন কি না, সে সম্বন্ধেও আমরা বিশেষ কিছু জানিনে। শ্রীযুক্ত শৈলজানন্দ নিশ্চয়ই অনেক কিছু বলতে পারবেন।
তারো পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেওয়ার ফলে তিনি যে এসব ভাষায় খুব বেশি এগিয়ে গিয়েছিলেন তা-ও তো মনে হয় না। পল্টনের হাবিলদার যে জাব্বা-জোব্বা পরে দেওয়ানা-দেওয়ানা ভাব ধরে হাফিজ-সাদির কাব্য কিংবা মৌলানা রুমির মসনবি সামনে। নিয়ে কুঞ্জে কুঞ্জে ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়াবে তা-ও তো মনে হয় না। এমনকি রঙিন সদরিয়ার উপর মলমলের বুটিদার অঙ্গরখা পরে হাতে শিরাজির পাত্র নিয়ে সাকির কণ্ঠে ফারসি গজল আর কসিদা-গীত শুনছেন, এ-ও খুব সম্ভবপর বলে মনে হয় না। কসম খেয়ে এ বিষয়ে কোনওকিছু বলা শক্ত, তবে এটা তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, কাব্যে যদ্যপি ‘খাকি’ এবং ‘সাকি’ চমৎকার মিল, তবু বাস্তব জীবনে এ দুটোর মিল এবং মিলন সচরাচর হয় না।
তবু নজরুল ইসলাম মুসলিম ভদ্রঘরের সন্তান। ছেলেবেলায় নিশ্চয়ই কিঞ্চিৎ আলিফ, বে, তে করেছেন, দোয়া-দরুদ (মন্ত্র-তন্ত্র) মুখস্থ করেছেন, কুরান পড়াটা রপ্ত করেছেন। পরবর্তী যুগে তিনি কুরানের শেষ অনুচ্ছেদ ‘আমপারা’ বাঙলা ছন্দে অনুবাদ করেন- হালে সেটি প্রকাশিত হয়েছে। সে পুস্তিকাতে তাঁর গভীর আরবি-জ্ঞান ধরা পড়ে না– ধরা পড়ে তার কবি-জনোচিত অন্তর্দৃষ্টি এবং আমপারার সঙ্গে তাঁর যে আবাল্য পরিচয়। বিশেষ করে ধরা পড়ে, দরদ দিয়ে সৃষ্টিকর্তার বাণী (আল্লার ‘কালাম’) হৃদয়ঙ্গম করার তীক্ষ্ণ এবং সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা।
এরই ওপর আমি বিশেষ করে জোর দিতে চাই। ফারসি তিনি বহু মোল্লা-মৌলবির চেয়ে কম জানতেন, কিন্তু ফারসি কাব্যের রসাস্বাদন তিনি করেছেন তাদের চেয়ে অনেক বেশি। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই অনেক সংস্কৃত ব্যাকরণবাগীশদের চেয়ে কম সংস্কৃত জানতেন, কিন্তু তিনি লিরিকের রাজা মেঘদূতখানা জীবন এবং কাব্য দিয়ে যতখানি গ্রহণ করতে পেরেছিলেন ততখানি কি কোনও পণ্ডিত পেরেছেন? বহু লোকই বাঙলা দেশের মাটি নিখুঁতভাবে জরিপ করেছে, কিন্তু ওই মাটির জন্য প্রাণ তো তারা দেয়নি। কানাইলাল, ক্ষুদিরাম ভালো জরিপ জানতেন একথাও তো কখনও শুনিনি।
কাজী রোমান্টিক কবি। বাঙলা দেশের জল-বাতাস, বাঁশ-ঘাস যেরকম তাঁকে বাস্তব থেকে স্বপ্নলোকে নিয়ে যেত, ঠিক তেমনি ইরান-তুরানের স্বপ্নভূমিকে তিনি বাস্তবে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন বাঙলা কাব্যে। ইরানে তিনি কখনও যাননি, সুযোগ পেলেই যে যেতেন, সেকথাও নিঃসংশয়ে বলা যায় না (শুনেছি, পণ্ডিত হয়েও মাক্সমুলার ভারতবর্ষকে ভালোবাসতেন এবং তাই বহুবার সুযোগ পেয়েও এদেশে আসতে রাজি হননি। কিন্তু ইরানের গুল-বুলবুল, শিরাজি-সাকি তাঁর চতুর্দিকে এমনই এক জানা-অজানার ভুবন সৃষ্টি করে রেখেছিলেন যে গাইড-বুক, টাইম-টেবিল ছাড়াও তিনি তার সর্বত্র অনায়াসে বিচরণ করতে পারতেন। গুণীরা বলেন, প্রত্যেক মানুষেরই দুটি করে মাতৃভূমি– একটি তাঁর আপন জন্মভূমি ও দ্বিতীয়টি প্যারিস। কাজীর বেলা বাঙলা ও ইরান। কিটস-বায়রনের বেলা যেরকম ইংল্যান্ড ও গ্রিস।
আরবভূমির সঙ্গে কাজী সায়েবের যেটুকু পরিচয়, সেটুকু প্রধানত ইরানের মারফতেই। কুরান শরিফের ‘হারানো ইউসুফের’ যে করুণ কাহিনী বহু মুসলিম-অমুসলিমের চোখে জল টেনে এনেছে তিনি কবিরূপে তার সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন ফারসি কাব্যের মারফতে।
দুঃখ করো না, হারানো য়ুসুফ
কাননে আবার আসিবে ফিরে।
দলিত শুষ্ক এ-মরু পুনঃ
হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে ॥
ইউসুফে গুমগশতে বা’জ আয়দব কিনান
গম্ ম-খুর।
কুলবয়ে ইহজান শওদ রুজি গুলিস্তান
গম, ম-খুর ॥
কাজী সায়েবের প্রথম যৌবনের রচনা এই ফারসি কবিতাটির বাঙলা অনুবাদ অনেকেরই মনে থাকতে পারে। ‘মেবার পাহাড়, মেবার পাহাড়ে’র অনুকরণে ‘শাতিল আরব শাতিল আরব’ ওই যুগেরই অনুবাদ।
কোনও কোনও মুসলমান তখন মনে মনে উল্লসিত হয়েছেন এই ভেবে যে, কাজী ‘বিদ্রোহী’ লিখুন আর যা-ই করুন, ভিতরে ভিতরে তিনি খাঁটি মুসলমান। কোনও কোনও হিন্দুর মনেও ভয় হয়েছিল (যাঁরা তাঁকে অন্তরঙ্গভাবে চিনতেন তাঁদের কথা হচ্ছে না) যে কাজীর হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতি বোধহয় বাঙলার জন্য নয়–তাঁর দরদ বুঝি ইরান-তুরানের জন্য। পরবর্তী যুগে–পরবর্তী যুগে কেন, ওই সময়েই কবিকে যাঁরা ভালো করে চিনতেন, তাঁরাই জানতেন, ইরানি সাকির গলায় কবি যে বারবার শিউলির মালা পরিয়ে দিচ্ছেন তার কারণ সে তরুণী মুসলমানি বলে নয়, সে সুন্দরী ইরানের বিদ্রোহী কবিদের নর্ম-সহচরী বলে–ইরানের বিদ্রোহী আত্মা কাব্যরূপে, মধুরূপে তার চরম প্রকাশ পেয়েছে সাকির কল্পনায়।
সে বিদ্রোহ কিসের বিরুদ্ধে?
এস্থলে কিঞ্চিৎ ইতিহাস আলোচনার প্রয়োজন।
ইরানি ও ভারতীয় একই আর্যগোষ্ঠীর দুই শাখা। দুই জাতির ইতিহাসেই অনেকখানি মিল দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু ইরানিরা যেরকম দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে একদিকে মিশর-প্যালেস্টাইন, অন্যদিকে গ্রিস পর্যন্ত হানা দিয়েছিল, ভারতীয়েরা সেরকম করেনি। দ্বিতীয়ত বিদেশি অভিযানের ফলে ইরানভূমি যেরকম একাধিকবার সম্পূর্ণ লণ্ডভণ্ড হয়েছে, ভারতবর্ষের ভাগ্যে তা কখনও ঘটেনি। এসব কারণেই হোক বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, ইরানিরা সভ্যতার প্রথম যুগ থেকেই সে এক উগ্র স্বাজাত্যাভিমানের সৃষ্টি করে। ভারতবর্ষ যেখানে শান্তভাবে বিদেশির ভালো-মন্দ দেখে-চিনে নিজেকে মেলাবার, পরকে আপন করার চেষ্টা করেছে, ইরান সেখানে আদৌ সে চেষ্টা করেনি এবং শেষটায় যখন বাধ্য হয়ে সবকিছু মেনে নিতে হয়েছে তখন করেছে পরবর্তীকালে, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
গ্রিস-রোমের কাছে পরাজিত হওয়া এক কথা, আর প্রতিবেশী ‘অনুন্নত’, ‘অর্ধসভ্য’ আরবদের কাছে পরাজিত হওয়া আরেক কথা। তদুপরি গ্রিক-রোমানরা ইরানে যে সভ্যতা এনেছিল, তাতে গরিব-দুঃখীর জন্য নতুন কোনও আশার বাণী ছিল না। যে নবীন ধনবণ্টন পদ্ধতি দ্বারা হজরত মুহম্মদ আরব দেশের আপামর জনসাধারণকে ঐক্যসূত্রে গ্রন্থন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁর বাণী এসে পৌঁছল ইরানে। ফলে মুহম্মদ সাহেবের পরবর্তীগণ যখন একদিন অন্যান্য জাতির মতো দিগ্বিজয়ে বেরোল তখন ইরানি শোষক সম্প্রদায় দেখে মর্মাহত ও স্তম্ভিত হল যে, ইরানের জনসাধারণ আরবের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হল না। তার পর আরবরা বিজিত দেশের ধর্মজগতে যে সাম্যবাদ ও অর্থের ক্ষেত্রে যে ধনবণ্টন পদ্ধতি প্রচার করল, তাতে আকৃষ্ট হয়ে ইরানের জনসাধারণ মুসলমান হয়ে গেল। জ্ঞানাভিমানী ও ধর্মযাজক সম্প্রদায়ও শেষপর্যন্ত ওই ধর্ম গ্রহণ করল। তখনকার মতো ইরানি সভ্যতা-সংস্কৃতি প্রায় লোপ পেয়ে গেল।
কিন্তু বিদ্রোহ লুপ্ত হল না।
সেটা দেখা দিল প্রায় চার শ বছর পরে ফিরদৌসির মহাকাব্য ‘শাহনামা’তে। রাষ্ট্রভাষা আরবিকে উপেক্ষা করে ফিরদৌসি গাইলেন প্রাক্-মুসলিম যুগের ইরানি বীরের কাহিনী, রাজার দিগ্বিজয়, প্রেমিকের বিরহ-মিলন গাথা– নবীন অথচ সনাতন সেই ফারসি ভাষায়। যে ফারসি কাব্য-সাহিত্য পরবর্তী যুগে বিশ্বজনের বিস্ময় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়, তার প্রথম সার্থক কবি ফিরদৌসি।
এই নতুন ভাষাতে, নবীন প্রাণে উন্মত্ত হয়ে যেসব কবি কাব্যের সর্ব-বিষয়বস্তু নিয়ে নব নব কাব্যধারার প্রবর্তন করলেন তার কাছে প্রবর্তী যুগের ইউরোপীয় রেনেসাঁসও এতখানি সর্বমুখী বলে মনে হয় না। দু শো বছর যেতে-না-যেতেই বিশ্বের কাব্যজগতে ইরান তার অদ্বিতীয় আসন সৃষ্টি করে নিল।
এঁদের মধ্যে সত্য বিদ্রোহী কবি ওমর খৈয়াম।
***
ইরানে ইসলাম প্রচারিত হওয়ার ফলে শিক্ষিত তথা পুরোহিত সম্প্রদায়ের ভিতর বিভিন্ন আন্দোলনের সৃষ্টি হল। তার প্রথম :
(১) যাঁরা মুসলিম শাস্ত্রের চর্চা করে যশস্বী হলেন। ভাবলে আশ্চর্য বোধহয়, ইরানিরা আরবির মতো কঠিন ভাষা আয়ত্ত করে সে শাস্ত্রে এতখানি ব্যুৎপত্তি অর্জন করল কী করে? মুসলমানদের মনুর নাম ইমাম আবু হানিফা। পৃথিবীর শতকরা আশিজনেরও বেশি মুসলমান আজ নিজকে হানফি অর্থাৎ আবু হানিফার মতবাদে বিশ্বাসকারী বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু তাতে আশ্চর্য হবার মতো কীই-বা আছে? শ্ৰীশ্ৰীশঙ্করাচার্য তো শুনেছি ভারতবর্ষের দক্ষিণতম কোণের লোক, এবং তাঁর ধমনীতে যে অত্যধিক আর্যরক্ত ছিল তা-ও তো মনে হয় না, অন্তত একথা তো অনায়াসে বলা যেতে পারে যে, আর্য-উত্তর ভারতের তুলনায় মালাবারে সংস্কৃত-চর্চা ছিল অনেক কম। তবু যে তিনি শুধু তাঁর মাতৃভূমি মালাবারে বৌদ্ধদের পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাই নয়, আর্য উত্তর-ভারতেও তিনি তার বিজয়পতাকা উড্ডীয়মান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইরানি আবু হানিফার মতবাদও একদা ইসলামের জন্মভূমি মক্কা-মদিনা তথা আরব দেশ জয় করতে সক্ষম হয়েছিল। এরকম উদাহরণ পৃথিবীতে আরও আছে।
(২) যারা ক্রিয়াকাণ্ড, টীকা-টিপ্পনী, মন্ত্রতন্ত্রে সম্পূর্ণ আস্থা না দিতে পেরে ‘রহস্যবাদ’ বা সুফিতত্ত্বের প্রচার এবং প্রসার করতে লাগলেন; এঁরা ভগবানের আরাধনা করেন রসের মাধ্যমে এবং বাঙলার বৈষ্ণব তথা ‘মরমিয়া’দের সঙ্গে এঁদের তুলনা করা যেতে পারে।
মরম না জানে ধরম বাখানে
এমন আছয়ে যারা
কাজ নাই, সখী তাঁদের কথায়
বাহিরে থাকেন তারা।
***
ওই চাহনিতে বিশ্ব মজেছে
পড়িয়াছে কত অশ্রুধার
পাগল করলি এ প্রমত্ত আঁখি
কুলমান রাখা হৈল ভার।
এ ধরনের কবিতা সুফি ও বৈষ্ণবদের ভিতর এতই প্রচলিত যে, কোনটি সুফি কোনটা বৈষ্ণব ধরে ওঠা অসম্ভব। যদি বলি,
প্রেম নাই, প্রিয় লাভ আশা করি মনে
রাধিকার মতো ভ্রান্ত কে ভব-ভবনে।
তবে চট করে কেউ আপত্তি করবেন না। অথচ আসলে আছে,
প্রেম নাই, প্রিয় লাভ আশা করি মনে
হাফেজের মতো ভ্রান্ত কে ভব-ভবনে।
(‘সদ্ভাব-শতক’– কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের অনুবাদ)
বৈষ্ণবদের সঙ্গে এঁদের আরও বহু মিল আছে। এঁদের সুফিবাদ পরবর্তী যুগে তথাকথিত ‘তুর্কি’রা গ্রহণ করে। বাঙলা দেশে প্রথম যে মুসলমানরা আসেন তাঁদের আমরা ‘তুর্ক’, ‘তুরুক’ নাম দিই (প্রাচীন বাঙলায় ‘মুসলমান’ শব্দের প্রতিশব্দ ‘তুর্ক’,– তামিলে এখনও ‘তুরস্কম’) এবং তাঁদের চক্রাকারে নৃত্য করে আল্লার নাম জপ (‘জিকর’–যার থেকে বাঙলা ‘জিগির’ শব্দ এসেছে) করা দেখে ‘তুর্কি-নাচন-নাচা’ প্রবাদটি এসেছে। বৈষ্ণবদের মতো এঁরাও জপ করতে করতে ‘হাল’ (‘দশা’) প্রাপ্ত হন– অর্থাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েন, ও মুখ দিয়ে তখন প্রচুর ফেনা বেরোয়। পূর্ব ইয়োরোপে এই নাচ দেখে ইয়োরোপীয়রা এদের নাম দিয়েছিল ‘ডানসিং দরবেশ’। ইংরেজিতে কথাটা এখনও চালু আছে। কিন্তু এ সম্বন্ধে অত্যধিক বাগাড়ম্বর নিষ্প্রয়োজন, কারণ আউল-বাউল, ভাটিয়ালি-মুর্শিদিয়া গীত যাঁরাই শুনেছেন, তাঁরাই এই ফারসি, সুফি ভক্তিবাদের কিঞ্চিৎ গন্ধস্পর্শ পেয়েছেন।
(৩) দার্শনিক সম্প্রদায়। আর্যগোষ্ঠীর দুই সম্প্রদায় ভারতীয় ও গ্রিকরাই প্রধানত দর্শনের চর্চা করেছেন।
মাহমুদ বাদশার সভাপণ্ডিত ‘ভারতবর্ষ’ পুস্তকের (প্রাচীন তথা অর্ধার্বাচীন ভারতের বহুমুখী কার্যকলাপ, চিন্তা, অনুভূতির সঙ্গে যাঁরা পরিচিত হতে চান তাঁদের পক্ষে এ পুস্তক অপরিহার্য; বস্তুত বর্তমান লেখক ব্যক্তিগতভাবে এ পুস্তককে মহাভারতের পরেই স্থান দেয়) লেখক পণ্ডিত অল-বিরুনি মুক্তকণ্ঠে বলেছেন, ‘দর্শনের চর্চা করেছেন গ্রিক এবং ভারতীয়েরা– আমরা (অর্থাৎ আরবি লেখকেরা) যেটুকু দর্শন শিখেছি তা এঁদের কাছ থেকেই।’ কথাটা মোটামুটি সত্য, যদিও পণ্ডিতজনসুলভ কিঞ্চিৎ বিনয় প্রকাশ এতে রয়েছে, কারণ আরবরা গ্রিকদর্শনের আরবি অনুবাদ দিয়ে দর্শন-চর্চা আরম্ভ করেছিলেন সত্য কিন্তু পরবর্তী যুগে আভিচেন্না (বু আলি সিনা), আভেরস (আবু রুশদ) ও গজজালি (অল-গাজেল– এঁর ‘সৌভাগ্য স্পর্শমণি’ প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে বাঙলায় অনূদিত হয়ে রাজশাহীতে প্রকাশিত হয়) বহু মৌলিক চিন্তা দ্বারা পৃথিবীর দর্শনভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু স্মরণ রাখা ভালো, এঁদের দর্শন শঙ্কর-দর্শনেরই ন্যায় ধর্মাশ্রিত এবং যে-স্থলে কুরানের বাণীর সঙ্গে গ্রিকদর্শনের দ্বন্দ বেঁধেছে সেখানে তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন সে দ্বন্দ্বের সমাধান করার এবং সময়ে সময়ে তখন তারা নিও-প্লাতোনিজম অর্থাৎ ভারতের উপনিষদসম্মত অন্তর্দৃষ্টির ওপর নির্ভর করেছেন। এদের বিশেষ নাম ‘মুতকল্লিমুন’ এবং পরবর্তী যুগে এদেশের রাজা রামমোহন তাঁর বিশ্বদর্শন (ভেল্টানশাউউঙ) নির্মাণে এঁদের পরিপূর্ণ সাহায্য নিয়েছেন।
(৪) ঐতিহাসিক ও কবিগোষ্ঠী। ইতিহাস-চর্চায় আরবদের দক্ষতা সর্বজনমান্য, তবে ইরানিরাও এ শাস্ত্র তাঁদের কাছ থেকে শিখে নিয়ে এর অনেক উন্নতিসাধন করেন। কিন্তু আমরা যে যুগের আলোচনা করছি তখনও ইরানিদের কাছে ইতিহাস ও পুরাণের পার্থক্য সুস্পষ্টরূপে ধরা দেয়নি। ফিরদৌসির শাহনামা (রাজবংশ) কাব্যের রাজা-মহারাজা, নায়ক-নায়িকারা অধিকাংশই কবিজনসুলভ কল্পনাপ্রসূত অন্তত তাদের কীর্তিকলাপ তো বটেই। কিন্তু সবচেয়ে লক্ষ করার বিষয়, প্রাক ইসলামি এইসব অগ্নিউপাসক নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে ফিরদৌসির কী গগনচুম্বী গরিমা দম্ভ এবং সময় সময় আস্ফালন। এ যেন বিজয়ী আরবদের বারবার শুনিয়ে শুনিয়ে বলা, ‘কালনেমির বিরূপাবর্তনে আজ আমাদের পতন ঘটেছে বটে, কিন্তু এই কাব্যে দেখ, আমরা একদিন সভ্যতার কত উচ্চ শিখরে উঠেছিলুম। সে দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখো। ওখানে তোমরা কখনও পৌঁছওনি, পৌঁছবেও না।’ এ সুর কেমন যেন আমাদের চেনা চেনা মনে হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে হিন্দু এবং মুসলমান উভয়েই ইংরেজকে শুনিয়ে বারবার এই গান গেয়েছে। (‘অন্য জাতি দিশ্বসন পরিত যখন। ভারতে ঋগ্বেদ পাঠ হইত তখন’) কিন্তু, আফসোস। শাহনামার মতো মহাকাব্যের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারেনি। হেমচন্দ্র ও ইকবালকে ফিরদৌসির আসনে বসানো কঠিন এবং অন্যান্য কবিরা যে ‘নির্লজ্জতা’ দেখালেন (‘নির্লজ্জতা’ শব্দটি ভেবেচিন্তেই কোটেশনের ভিতর ফেললুম, কারণ কাব্যে রসস্বরূপে প্রকাশ পেলে চরম নির্লজ্জতাও পাঠকের মনে বিদ্রোহ সঞ্চার করতে পারে না। আমাদের দুই মাইডিয়ার হিরো পবননন্দন ভীমসেন ও হনুমান যেসব দম্ভ এবং আস্ফালন করেছেন তা স্বকর্ণে শুনতে হলে ‘রাম রাম’ বলতে হত, কিন্তু কাব্যে পাঠ করে আনন্দাশ্রু বিগলিত হয়, মনে হয়, ওই সময়ে, ওই অবস্থায় এ বাক্য ছাড়া অন্য কিছুই এদের মুখে মানাত না, বলতে ইচ্ছে করে, ‘ধন্য ধন্য যুগ্ম-কবি যাঁরা দম্ভকে বিনয়, লজ্জাকে শ্লাঘায় পরিণত করতে পারেন!’) সেটা ঢাকবার প্রয়াস আজও ইরানে-তুরানে সহজেই চোখে পড়ে। সকলেই জানেন, মুসলমান ধর্মে মদ খাওয়া মানা আর সেই মদও যদি খাওয়া হয় তন্বঙ্গী তরুণী সাকির সঙ্গে– যার সঙ্গে ‘বে-থা’ হয়েছে কি না সে সম্বন্ধেও কবিরা বড় মারাত্মক স্মৃতিশক্তিহীন– তায় আবার ঝরনাতলায়, নির্জনে, সাঁঝের ঝোঁকে, যখন কি না ‘মগরিবের আইন ওকতে’ নামাজ পড়ার কথা, আল্লা-রসুলের নাম স্মরণ করার আদেশ– এবং মনে মনে আওড়ানো,
‘মত্ত, মাতাল ব্যসনী আমি গো আমি কটাক্ষ বীর’
তা হলে অবস্থাটা কী রকমের হয়?
কথা সত্য, মোল্লারা সুবো-শাম ভালো ভালো কেতাবপুঁথি পড়েন, কিন্তু মাঝে-মধ্যে, নিতান্ত কালে-কম্মিনে দু একখানা কাব্যগ্রন্থের পাতাও তো তারা ওলটান। কবি হাফিজ অবশ্য বিস্তর ঢলাঢলির পর ওকিবহাল হয়ে অভয়বাণী বলেছিলেন,
‘মোল্লার কাছে কোরো না কিন্তু মোর পিছে অনুযোগ,
তারো আছে, জেনো, আমারি মতন, সুরামত্ততা রোগ।’
তবু, একথাও তো অজানা নয় যে, মোল্লারাই নীতিবাগীশ সাজে আর পাঁচজনের তুলনায় বেশি।
এবং কার্যত দেখা গেল তারা এবং তাদের চেলাচামুণ্ডার দল ঝোপে-ঝাপে বসে আছে, শরাব-কবাব জান-কি-সাকি সুদ্ধ কবিদের বমাল গ্রেপ্তার করার জন্য।
কবিরা এবং বিশেষ করে আমাদের মতো তাঁদের গুণগ্রাহীরা, উচ্চকণ্ঠে তখন বললেন, এসব কবিতা রূপকে নিতে হয়। মদ্য অর্থ ভগবদ্প্রেম, সাকি অর্থ যিনি সে প্রেম আমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দেন, অর্থাৎ পীর, গুরু, মুরশিদ, পয়গম্বর। এবং এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, হাফিজ, আত্তার, এমনকি ওমর খৈয়ামের বহু কবিতার কোনও অর্থই করা যায় না, যদি সেগুলো রূপক দিয়ে অর্থ না করা যায়। কিন্তু বাদবাকিগুলো?
আমাদের পদাবলীতেও তাই। এবং বিস্তর সব পদ আছে যাতে মর্ত্য আর অমর্ত্য প্রেম এমনভাবে মিশে গিয়েছে যে, দুটোকে আদৌ আলাদা করা যায় না– সমস্ত হৃদয়-মন এক অদ্ভুত অনির্বচনীয় নবরসে আপুত হয়ে যায়।
তোমার চরণে আমার পরানে
লাগিল প্রেমের ফাঁসি
সব সমর্পিয়া এক মন হৈয়া
নিশ্চয় হইলাম দাসী
মর্ত্যপ্রেমই যদি হবে তো ‘পরানে’ ‘পরানে’ প্রেমের ফাঁসি লাগবে। ‘পরানে’ আর ‘চরণে’ প্রেমের বাঁধ বেঁধে দিয়ে কী এক অপূর্ব অতুলনীয় ব্যঞ্জনার সৃষ্টি হয়েছে– যার অনুভূতি এ জগতে আরম্ভ, আর পরিপূর্ণতা লাভ করবে সেই অমর্ত্যলোকে, ‘ব্যর্থ নাহি হোক এ কামনা।’
কিন্তু মাঝে মাঝে মনে দ্বিধা জাগে, সর্বত্রই কি রূপকের শরণাপন্ন হতে হবে? যথা :
অদ্যাপ-শোক-নব-পল্লব-রক্ত হস্তাং
মুক্তাফল প্রলয়চুম্বিত-চুচুকাগ্ৰাম্।
অন্তঃস্মিতেন্দুসিত পাণ্ডুর গণ্ডদেশাং,
তাং বল্লভাং রহসি সংবলিতাং স্মরামি ॥
বিদ্যাপক্ষে
অশোক-পল্লব নব সম পাণিতলে।
কুচাগ্র শোভিত হয়েছে মুক্তা ফলে।
অন্তরে ঈষৎ হাস গণ্ডে বিকসিত।
শরতের চন্দ্র যেন ত্রিলোক-মোহিত ॥
নির্জনেতে বসি করি সদ্য সম্ভাবনা।
প্রাণাধিকা প্রেয়সীকে নিতান্ত কামনা ॥
তথাপি বিদ্যার নাহি পাই দরশন।
বিদ্যা তন্ত্র মন্ত্র করি ত্যজিব জীবন ॥
দ্বিতীয়ার্থ কালীপক্ষে
রুধির-খপর হস্তে দিবানিশি যার।
রক্তবর্ণ করতল হয়েছে শ্যামার।
উচ্চ পয়োধরপরি বান্ধিত কাঁচলী।
হীরক জড়িত হারে শোভে মুক্তাবলী ॥
অন্তরে গভীর হাস্য ঈষদ্ধাস্য কালে।
কিরণে আছয়ে গণ্ড পাণ্ডুবর্ণা ভালে ॥
অন্তর জগতে দেখি আলোক বিরাজে ॥
কি শোভা প্রকাশে কুলকুণ্ডলিনী মাঝে ॥
স্ববল্লভ-সংবলিতা বিশ্বের কারিণী।
নিদানে গর্জনে স্মরি তারে গো তারিণী।
(চৌরপঞ্চাশৎ, ভারতচন্দ্র, বসুমতী সংস্করণ, পৃ. ৮)
পূর্বোল্লিখিত এইসব তাবৎ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ওমরের বিদ্রোহ।
***
গিয়াসউদ্দিন আবুল ফৎহ, ওমর ইবন ইব্রাহিম অল-খৈয়াম ইরান দেশের নিশাপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মদিন কিংবা সন ঠিকমতো জানা যায়নি, এমনকি তাঁর মৃত্যুর সনও মোটামুটি ১১২৩ খ্রিস্টাব্দ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে।
খৈয়াম শব্দের অর্থ তাম্বু-নির্মাতা। এ ওজনের শব্দ বাঙলায় আরও আছে। ‘কত্তাল’ থেকে বাঙলা কোতয়াল, এবং ‘খম্মার’ থেকে ‘খোঁয়ারি’ (ভাঙা) শব্দ এসেছে। রান্নার মশলা বিক্রেতা অর্থে বককাল শব্দও একদা বাঙলাতে সুপ্রচলিত ছিল– আরবিতে শব্দটির অর্থ ‘মুদি’ বা ‘মশলা-বিক্রেতা’। ত্রিবর্ণের মূল ধাতুতে– যথা ‘দ-খ-ল’ ‘দখল করা’ ‘ক-ত-ল’ ‘কোতল করা’ দ্বিতীয় ব্যঞ্জনবর্ণকে দ্বিত্ব করে তাতে দীর্ঘ ‘আ’-কার যোগ করলে যে কর্তাবাচক শব্দ উৎপন্ন হয় তার অর্থ “ওই কর্ম সে পুনঃপুনঃ করে থাকে।’ তাই ‘খম্মার’ অর্থ ‘যে ঘন ঘন মদ খায়’ (বাঙলায় তাই সে সকালবেলা খম্মারি বা খোঁয়ারি ভাঙে) অর্থাৎ ‘পাইকারি মাতাল’, মদ খাওয়া তার ব্যবসা’। ‘কতল করা যার ব্যবসা সে কোতোয়াল (‘কত্তাল’), ‘জল্লাদ’ও ওই অর্থে ব্যবহার হয়। ‘খয়য়াম’ অর্থ ‘যে পুনঃপুন তাম্বু নির্মাণ করে’– ‘তাম্বু নির্মাণকারী’। বাঙলায় ‘খইআম’, ‘খইয়াম’ বা ‘খৈয়াম’ লিখলে মোটামুটি মূল উচ্চারণ আসে। অবশ্য ‘খ’-র উচ্চারণ বাঙলা মহাপ্রাণ ‘খ’র মতো নয়– আমরা বিরক্ত হলে যেরকম ‘আখ’-এর ‘খ’ অক্ষরটি উচ্চারণ করে থাকি অর্থাৎ ঘৃষ্ট্য কণ্ঠ্যব্যঞ্জন। স্কচের ‘লখ’ ও জর্মনের ‘বাখ’-এর ‘খ’-এর মতো। আসামিতে ‘অহমিয়া’র ‘হ’ অনেকটা সেইরকম।
কিন্তু কবি ওমর তাঁবুর ব্যবসা করতেন না। ওটা তাঁর বংশের পদবি মাত্র। আজকের দিনের কোনও সরকার যে-রকম রাইটারজ বিল্ডিঙে চিফ সেক্রেটারি (সরকার) নন কিংবা কোনও ঘটকপদবিধারী যেরকম সমাজে কুলাচার্যের কর্ম করেন না। ওমর কিন্তু তাঁর পরিবারের এই উপাধিটি নিয়ে তিক্ত ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি–
জ্ঞান-বিজ্ঞান ন্যায়-দর্শন সেলাই করিয়া মেলা
খৈয়াম কত না তাম্বু গড়িল; এখন হয়েছে বেলা
নরককুণ্ডে জ্বলিবার তরে। বিধি-বিধানের কাঁচি
কেটেছে তাম্বু– ঠোককর খায়, পথ-প্রান্তের ঢেলা।
(লেখকের এমেচারি অক্ষম অনুবাদে রসিক পাঠক অপরাধ নেবেন না। অন্য কারও অনুবাদ না পেয়ে বাধ্য হয়ে মাঝে-মধ্যে এ ধরনের ‘অনুবাদ’ ব্যবহার করতে হয়েছে।)
এস্থলে উল্লেখ প্রয়োজন রুবাঈ জাতীয় শ্লোকে প্রায়শ প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ ছত্রে মিল থাকে– তৃতীয় ছত্রান্ত স্বাধীন। ইরানি আলঙ্কারিকরা বলেন, তৃতীয় ছত্রে মিল না দিলে চতুর্থ ছত্রের শেষ মিলে বেশি ঝোঁক পড়ে এবং শ্লোক সমাপ্তি তার পরিপূর্ণ গাম্ভীর্য ও তীক্ষ্ণতা পায়। কথাটা ঠিক, কারণ আমরাও তেতাল বাজাবার সময় তৃতীয়ে এসে খানিকটা কারচুপি করলে সম মনকে ধাক্কা দেয় আরও জোরে। পাঠককে এই বেলাই বলে রাখি, তৃতীয় ছত্রে মিলহীন এই জাতীয় শ্লোক পড়ার অভ্যাস করে রাখা ভালো। নইলে নজরুল ইসলামের ওমর-অনুবাদ পড়ে পাঠক পরিপূর্ণ রসগ্রহণ করতে পারবেন না। কারণ কাজী আগাগোড়া ক ক খ ক মিলে ওমরের অনুবাদ করেছেন। কান্তি ঘোষ করেছেন বাঙলা রীতিতে, অর্থাৎ ক ক খ খ।
ভাগ্যক্রমে ওমরের জীবনী সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। পাকাপাকি শুধু এইটুকু বলা যেতে পারে যে তিনি গণিতশাস্ত্রে অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন এবং অবসর কাটাবার জন্য দৈবেসৈবে চতুষ্পদী লিখতেন… তাঁর নামে প্রচলিত গজল, মসনবি বা অন্য কোনও শ্রেণির দীর্ঘতর কবিতা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এইটুকু সংবাদ ছাড়া বাদবাকি কিংবদন্তি। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। যার জন্মের তারিখ কেন, সন পর্যন্ত জানা নেই, যাঁর পরলোকগমনের সন পর্যন্ত পণ্ডিতদের গবেষণাধীন, তাঁর সম্বন্ধে যে প্রচুর কিংবদন্তি প্রচলিত থাকবে তাতে বিস্মিত হবার কিছুই নেই।
তবে তিনি যে উত্তম গুরুর কাছে শিক্ষালাভ করেছিলেন সে বিষয়ে পণ্ডিতগণ একমত। স্মরণ রাখা ভালো যে, ছাপাখানার প্রচলন না হওয়া পর্যন্ত অল্প লোকই গুরুর সাহায্য বিনা উচ্চশিক্ষা লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন।
কথিত আছে, বিখ্যাত পণ্ডিত ইমাম মুওয়াফফকের কাছে একই সময়ে তিনজন অসাধারণ মেধাবী ছাত্র শিক্ষালাভ করেন। এদের ভিতর খেলাচ্ছলে চুক্তি হয় যে, এদের কোনও একজন পরবর্তী জীবনে প্রভাবশালী হতে পারলে তিনি অন্য দু জনকে সাহায্য করবেন। এঁদের একজন কালক্রমে প্রধানমন্ত্রী বা নিজাম-উল-মুল্ক-এর পদ প্রাপ্ত হন। খবর পেয়ে দ্বিতীয় বন্ধু হাসন বিন্ সববাহ তাঁর কাছে এসে তাঁর পূর্বপ্রতিজ্ঞা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উচ্চ রাজকর্ম চান। বন্ধুর কৃপায় আশাতীত উচ্চপদ পেয়েও হাসন তাঁকে সরিয়ে নিজে প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য ষড়যন্ত্র করতে লাগলেন। কিন্তু শেষটায় ধরা পড়ে বাদশার হুকুমেই রাজপ্রাসাদ থেকে বহিষ্কৃত হন। হাসন প্রতিশোধ নেবার জন্য এক গুপ্ত প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে গোপন আততায়ী দিয়ে অনেক লোককে হত্যা করিয়ে প্রচুর অর্থ ও প্রতিপত্তি অর্জন করেন। ক্রুসেডের একাধিক খ্রিস্টান নেতা এইসব গুপ্তঘাতকের হস্তে প্রাণ দেন। এরা ভাঙ জাতীয় একপ্রকার হশিশু সেবন করত বলে এদের নাম হয়েছিল ‘হশিশিয়য়ুন’ এবং ইংরেজি ‘অ্যাসাসিন’– গুপ্তঘাতক– এই শব্দ থেকেই অর্বাচীন লাতিন তথা ফরাসির মাধ্যমে এসেছে। অনেকে বলেন, পরবর্তীকালে নিজাম-উল-মুল্ক যে গুপ্তঘাতকের হস্তে প্রাণ দেন, সে-ও হাসন-সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এদের সম্বন্ধে লেখকের ‘অরিজিন অব দি খোজা’ পুস্তক লেখকের বাল্যরচনা বলে দ্রষ্টব্যের মধ্যে ধর্তব্য নয়।
ওমরকে যখন নিজাম-উল-মুল্ক উচ্চ পদ দিতে চাইলেন তখন তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে নির্জনে অনটনবিহীন জীবনযাপনের সুবিধাটুকু মাত্র চাইলেন এ তো জানা কথা। যে ব্যক্তি স্বর্গসুখ বলতে বোঝে,
সেই নিরালা পাতায় ঘেরা বনের ধারে শীতল ছায়,
খাদ্য কিছু, পেয়ালা হাতে, ছন্দ গেঁথে দিনটা যায়।
মৌন ভাঙ্গি মোর পাশেতে গুঞ্জে তব মঞ্জু সুর–
সেই তো সখী স্বপ্ন আমার, সেই বনানী স্বর্গপুর।
(কান্তি ঘোষ)
কিংবা
আমার সাথে আসবে যেথায়– দূর সে রেখে শহরগ্রাম
এক ধারেতে মরু তাহার, আর একদিকে শষ্প শ্যাম।
বাদশা-নফর নাইকো সেথা– রাজ্য-নীতির চিন্তা-ভার।
মামুদ শাহ?– দূরে থেকেই করব তাঁকে নমস্কার।
(কান্তি ঘোষ)
তার রাজপদ নিয়ে কী হবে? নিজাম-উল-মুল্ক বিচক্ষণ লোক ছিলেন, বুঝতে পারলেন, ওমরের খ্যাতি-প্রতিপত্তি প্রত্যাখ্যান মৌখিক বিনয় নয় এবং তার জন্য সচ্ছল জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করে দিলেন। কবিও কখনও তাঁর মত পরিবর্তন করেননি। বস্তুত তাঁর কাব্যের মূল সুর ওইটিই।
কিছুদিনের মধ্যে তাঁর ডাক পড়ল রাজদরবারে পঞ্জিকা সংশোধন করে দেবার জন্য। ইরানিদের ‘নওরোজ’ বা নববর্ষ আসে বসন্তঋতুতে, কিন্তু বহুশত বৎসর লিপইয়ার গোনা হয়নি বলে তখন আর নববর্ষ বসন্তঋতুতে আসছিল না। ওমর ওই কর্মটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করে দিলেন।
ভাবতে আশ্চর্য লাগে, কবিরূপে যে ব্যক্তি বিশ্বজগতে বিখ্যাত তিনি আসলে ছিলেন বৈজ্ঞানিক। শুধু তাই নয়, ফিটসজেরাল্ডের মাধ্যমে ইয়োরোপে প্রচারিত হবার পূর্বেই ওমরের বিজ্ঞানচর্চা ফ্রান্সে অনূদিত হয়ে সেখানে তাঁর খ্যাতি সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। বর্তমানে লেখক এসব লেখা দেখবার সুযোগ পায়নি, তাই এনসাইক্লোপিডিয়ার ‘কোনিক সেকশন’ অনুচ্ছেদ থেকে ইয়োরোপে ওমরের বৈজ্ঞানিক যশ সম্বন্ধে উদ্ধৃতি দিচ্ছি :
‘Greek mathematics culminated in Apollonius. Little further advance was possible without new methods and higher points of view. Much later, Arabs and other Muslims absorbed the classical science greedily; it was the Persian poet Omar Khayyam, one of the most prominent mediaeval mathematicians, with his remarkable classification and systematic study of equations, which he emphasized, who blazed the way to the modern union of analysis and geometry. In his “Algebra” he considered the cubic as soluble only by the intersection of conics, and the biquadratic not at all.’
শেষ ছত্রটির বাঙলায় অনুবাদ মূল ইংরেজি, এমনকি আধুনিক বাঙলা কবিতার চেয়েও শক্ত হয়ে যাবে বলে গোটা টুকরোটাই অতি অনিচ্ছায় ইংরেজিতেই রেখে দিতে বাধ্য হলুম। বৈজ্ঞানিক পাঠক বিনা-অনুবাদেই এটি বুঝতে পারবেন, প্রাঞ্জল অনুবাদেও আমাদের মতো বৈজ্ঞানিকের কোনও লাভ হবে না।
ইরানের অধিকাংশ গুণীই একমত যে, ওমর তাঁর জীবনের প্রায় সব সময়টুকুই কাটিয়েছেন বিজ্ঞানচর্চায় এবং অতি অল্প সামান্য সময় ‘নষ্ট’ করেছেন কাব্যলক্ষ্মীর আরাধনায়। তাই দীর্ঘ কবিতা লেখবার ফুরসত তাঁর হয়ে ওঠেনি– এমনকি রুবাঈগুলোও গীতিরস দিয়ে সরস করবার প্রয়োজন তিনি অনুভব করেননি।
গণিত এবং বিশেষ করে জ্যোতিষচর্চার ফল ওমরের কাব্যে পদে পদে পাওয়া যায়। বস্তুত গ্রহ-নক্ষত্র যে অলঙ্ প্রাকৃতিক নিয়মে চলে তার থেকেই তিনি দৃঢ় মীমাংসায় উপনীত হন যে, মানুষেরও কোনওপ্রকারের স্বাধীনতা নেই, তার কর্মপদ্ধতি স্বেচ্ছায় নিয়ন্ত্রণ করার কোনও অধিকারই সে পায়নি। তাই–
প্রথম মাটিতে গড়া হয়ে গেছে শেষ মানুষের কায়
শেষ নবান্ন হবে যে ধান্যে তারো বীজ আছে তায়।
সৃষ্টি সেই আদিম প্রভাতে লিখে রেখে গেছে তাই,
বিচার-কর্ত্রী প্রলয় রাত্রি পাঠ যা করিবে ভাই।
(সত্যেন দত্ত)
পৃথ্বী হতে দিলাম পাড়ি, নভঃগেহে মনটা লীন–
সপ্ত-ঋষি যেথায় বসি ঘুমিয়ে কাটান রাত্রি দিন।
বিদ্যাটা মোর উঠলো ফেঁপে কাটলো কত ধাঁধার ঘোর–
মৃত্যুটা আর ভাগ্যলিখন ওইখানে গোল রইল মোর।
(কান্তি ঘোষ)
কিন্তু এস্থলে আমি ওমর-কাব্যের মল্লিনাথ হবার দুরাশা নিয়ে পাঠকের সম্মুখে উপস্থিত হইনি। ওমরের নামে প্রচলিত প্রায় ছ শটি রুবাইয়াৎ ইরানি বটতলাতেও পাওয়া যায়– পার্টিশনের পূর্বে কলকাতায় ফারসি বটতলা তালতলা অঞ্চলেও পাওয়া যেত। তার অতি অল্পই অনুবাদ করেছেন ফিটসজেরাল্ড এবং সেই ছ শর কটি কবিতা ওমরের নিজস্ব, তাই নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বাক-বিতণ্ডা এখনও শেষ হয়নি আমার বিশ্বাস কখনও হবে না। সেই ছ শ চতুস্পদীর টীকা পড়ার উৎসাহ ও ধৈর্য রসিকজনের থাকার কথা নয়– পণ্ডিতের থাকতে পারে। আমি রসিকের সেবা করি।
আমিও ওমরের সামান্যতম ঐতিহাসিক পটভূমি নির্মাণ করার চেষ্টা করছি এবং তা-ও শুধু ওমরের বিদ্রোহী মনোভাব দেখাবার জন্য– কারণ ওইখানেই নজরুল ইসলামের সঙ্গে তিনি সখ্যসূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন।
ওমরের প্রধান বিদ্রোহ ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে :
খা’জা! তোমার দরবারে মোর একটি শুধু আর্জি এই
থামাও উপদেশের ঘটা, মুক্তি আমার এই পথেই।
দৃষ্টি-দোষে দেখছ বাঁকা আমার সোজা সরল পথ,
আমায় ছেড়ে ভালো করো, ঝাপসা তোমার চক্ষুকেই।
(কাজী সাহেবের অনুবাদ)।
O master! grant us only this, we prithee!
Preach not! But mutely guide to bliss,
we pritheel
‘We walk not straight- Nay,
it is thou who squintest!
Go, heal thy sight, and leave us in peace,
we prithee!
(কার্নের অনুবাদ)
পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক রাজা-রাজড়ার শৌর্যবীর্য নিয়ে যেসব কবি ফিরদৌসির ন্যায় আস্ফালন করে বর্তমানের আনন্দকে অবহেলা করতেন তাঁদের সম্বন্ধে বলছেন–
ভাগ্য-লিপি মিথ্যা সে নয়– ফুরোয় যা তা ফুরিয়ে যাক,
কৈকোবাদ আর কৈখসরুর ইতিহাসের নামটা থাক।
রুস্তম আর হাতেম-তায়ের কল্পকথা– স্মৃতির ফাঁস
সে-সব খেয়াল ঘুচিয়ে দিয়ে আজকে এসো আমার পাশ।
(কান্তি ঘোষ)
দরবেশ-সুফিরা করতেন কৃচ্ছ্রসাধন এবং যোগচর্চা। পূর্বেই নিবেদন করেছি, তাঁরা নৃত্যের সঙ্গে চিৎকার করতেন নাম-জপ, তাঁদের বিশ্বাস, ওই করেই ভগবদপ্রেম এবং চরম মোক্ষ পাওয়া যায়।
দ্রাক্ষালতার শিকড় সেটি তার না জানি কতই গুণ–
জড়িয়ে আছেন অস্থিতে মোর দরবেশি সাঁই যাই বলুন–
গগনভেদী চিৎকারে তাঁর খুলবে নাকো মুক্তিদ্বার,
অস্থিতে এই মিলবে যে খোঁজ সেই দুয়ারের কুঞ্চিকার।
(কান্তি ঘোষ)
কিন্তু সবচেয়ে বেশি চতুষ্পদী তিনি রচনা করেছেন দার্শনিক এবং পণ্ডিতদের বিরুদ্ধে। সেখানে তিনি জ্যোতির্বিদ ওমরকেও বাদ দেননি।
অস্তি-নাস্তি শেষ করেছি, দার্শনিকের গভীর জ্ঞান
বীজগণিতের সূত্র-রেখা যৌবনে মোর ছিলই ধ্যান;
বিদ্যারসে যতই ডুবি, মনটা জানে মনে (মানে?) স্থির–
দ্রাক্ষারসের জ্ঞানটা ছাড়া রসজ্ঞানে নেই গভীর।
অর্থহীন, অর্থহীন, সমস্তই অর্থহীন। তাই ওমরের বারবার কাতর রোদন, দরদী ফরিয়াদ–
হেথায় আমার আসাতে প্রভু হননি তো লাভবান
চলে যাবো যবে হবেন না তিনি কোনওমতে গরীয়ান।
এ কর্ণে আমি শুনিনি তো কভু কোনও মানবের কাছে
এই আসা-যাওয়া কী এর অর্থ– খামকা পোড়েন টান।
(লেখক)
তাই ওমরের শেষ মীমাংসা– একবার মরে যাবার পর তুমি আর এখানে ফিরে আসবে না। অতএব যতটুকু পারো, যতক্ষণ পারো দর্শন-বিজ্ঞান-সাঁই-সুফিদের ভুলে গিয়ে সাকি সুরা নিয়ে নির্জন কোণে আনন্দ করো।
মৃত্যু আসিয়া মস্তকে মোর আঘাত করার আগে
লে আও শরাব– লাও ঝটপট রাঙানো গোলাপি রাগে।
হায়রে মূর্খ! সোনা দিয়ে মাজা তোর কী শরীরখানা–?
গোর হয়ে গেলে ফের খুঁড়ে নেবে–? ছাই কী কাজে লাগে।
(লেখক)
কিন্তু একটা জিনিস ভুল করলে চলবে না। ওমর খাঁটি চার্বাকপন্থী এবং ওই জাতীয় লোকায়তীদের মতো নন। ‘ঋণ করে ঘি খাও, কারণ দেহ ভস্মীভূত হলে ঋণ তো আর শোধ করতে হবে না’, অর্থাৎ ইহসংসারে কিংবা পরলোকে অন্য কারও প্রতি তোমার কোনও নৈতিক দায়িত্ব– মরাল রেসপনসিবিলিটি নেই– এ তত্ত্বেও ওমর বিশ্বাস করতেন না। তাই তার একমাত্র উপদেশ–
কারুর প্রাণে দুখ দিও না, করো বরং হাজার পাপ,
পরের মনে শান্তি নাশি বাড়িও না আর মনস্তাপ।
অমর-আশি লাভের আশা রয় যদি, হে বন্ধু মোর,
আপনি সয়ে ব্যথা, মুছো পরের বুকের ব্যথার ছাপ।
(নজরুল ইসলাম)
গুণীরা বলেন, ‘কুরানই কুরানের সর্বশ্রেষ্ঠ টীকা’। তরুণদের আমি প্রায়ই বলি, ‘রবীন্দ্রনাথের রচনাই তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ টীকা– ওই কাব্যই বারবার অধ্যয়ন করো, অন্য টীকার প্রয়োজন নেই।’ ওমরই ওমরের সর্বশ্রেষ্ঠ মল্লিনাথ এবং কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী।
নসরুদ্দিন খোজা (হোকা)
ইস্তাম্বুল থেকে রয়টারের খবরে প্রকাশ, রসিক এবং মূর্খচুড়ামণি নসূরুদ্দিন খোজার সপ্তশত জন্মদিবস মহা-আড়ম্বরে উদ্যাপিত হয়েছে।
ইংরেজি বর্ণমালার কল্যাণে ‘খোজা’ কিন্তু বাঙলায় ‘হোকা’রূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। অধুনা তুর্কি ভাষা ইংরেজি (লাতিন) হরফে লেখা হয় বলে তার রূপ hoca; কিন্তু তুর্করা ‘এচ’ অক্ষরের নিচে একটি অর্ধচন্দ্র বা উল্টো প্রথম বন্ধনী দেয় এবং তার উচ্চারণ অনেকটা স্কচ ‘লখ’, জর্মন ‘বাখ’ বা ফারসি ‘খবরে’র মতো কিন্তু ‘হ’ ভাগটা বেশি এবং ‘সি’ অক্ষরের উপরে হুক দেয়– এবং তার উচ্চারণ হয় পরিষ্কার ‘জ’। ঠিক সেইরকম বাংলা শব্দ (আসলে আরবি) ‘খারিজ’ তুর্কি ভাষায় haic লেখা হয়, অবশ্য ‘হ’-এর নিচে পূর্বোল্লিখিত অর্ধচন্দ্র এবং ‘সি’-র উপরে হুক দেয়। ‘পররাষ্ট্রনীতি’ তাই তুর্কিতে ‘সিয়াসত খারিজ’।
রয়টারের টেলিগ্রামে এই অর্ধচন্দ্র ও হুক বাদ পড়াতে ‘খোজা’ হোকা হয়ে গিয়েছেন। খাজা নাজিমুদ্দিনের ‘খাজা’ ও আগা খানের ‘খোজা (সম্মানিত) সম্প্রদায়ের নামও একই শব্দ– এটি আমাদের সম্পূর্ণ অজানা নয়।
এই ধ্বনি পরিবর্তনে আমাদের রাগত হওয়ার কারণ নেই। ক্রিকেটার মাঁকড়ের নাম যখন আমরা হামেশাই ‘মনকদ’, ‘মানকদ’ অনেক কিছুই লিখে থাকি, এবং ফড়কর-কে ‘ফাদকর’ ‘ফদকর’ লিখি, এমনকি এই কলকাতা শহরেই গোখলে-কে ‘গোখেল’ লিখি এবং উচ্চারণ করি, তখন রসিকবর খোজা যে হোকা হয়ে আমাদের ধোঁকা দেবেন তাতে আর আশ্চর্য কী?
খোজার জন্মদিন যে-বাইশ তারিখে উদযাপিত হচ্ছিল সেইদিনই ইস্তাম্বুল থেকে রয়টার আরেকটি তার পাঠিয়েছেন; তাতে খবর এসেছে যে ওইদিন পাঁচ শ বছর পরে তুর্কিতে এক সুপ্ত অগ্নিগিরি জেগে উঠে হা-হা করে হেসে উঠেছে।(১)
তা হলে বোঝা গেল মা ধরণীর পাকা দু শো বছর লেগেছে খোজার রসিকতার মর্ম গ্রহণ করতে; তাই বোধহয় হাসতে হাসতে তার নাড়িভুড়ি এখন ভূগর্ভ থেকে ছিঁড়ে বেরিয়েছে!
.
এদেশে আরবি এবং ফারসি চর্চা একদা প্রচুর হয়েছিল। আকবর বাদশাহের আমলে ইরানের এমনই দুরবস্থা যে সেখানকার পনেরোআনা কবি দিল্লি ধাওয়া করেছিলেন। আকবরের সভাকবি আব্দুর রহিম খানাখানা নিজেই গা গণ্ডা ইরানি কবি পুষেছিলেন, আর স্বয়ং আকবর যে কবি ‘আমি’ ‘তুমি’ মিল দিয়ে ‘কবিতা’ রচনা করত তাকে পর্যন্ত নিরাশ করতে চাইতেন না।
ভারতবর্ষের ফারসি নাম হিন্দ বা হিন্দুস্তান। ‘হিন্দ’ শব্দের অর্থ কালো। তাই এক কবি তার দৈন্যের কালরাত্রি ইরানে ফেলে পূর্বাচল ভারতবর্ষ রওয়ানা হওয়ার সময় লিখলেন,
দুর্ভাবনার কালিমা ত্যজিয়া
চলিনু হিন্দুস্তান
কালোর দেশেতে কালো আমি কেন
করিতে যাইব দান?
তাই এক ইয়োরোপীয় ঐতিহাসিক ইরানের ওই যুগকে শব্দার্থে ‘ইন্ডিয়ান সামার’ বলেছেন। কারণ এরপরই ইরানি সাহিত্যের পতন আরম্ভ হয়।
তুর্কি ভাষার কিছুটা চর্চাও এদেশে হয়েছিল, কারণ বাবুর, হুমায়ুন এঁদের সকলেরই মাতৃভাষা তুর্কি। শেষ মোগল বাদশা-সালামৎ বাহাদুর শাহের হারেমেও কথাবার্তা তুর্কি ভাষাতেই হতো এবং তুর্কিসাহিত্যের সর্বোকৃষ্ট না হলেও অন্যতম অত্যুকৃষ্ট কেতাব বাবুর বাদশার আত্মজীবনী। কিন্তু এ তুর্কি ভাষা মুস্তাফা-কামালের টার্কির ওসমানলি তুর্কি নয়, বাবুরের ভাষা চুগতাই (বা জগতাই) তুর্কি। কোরমা, দোলমা এবং লড়াই-হাতিয়ারের মতো কিছু শব্দ চুগতাই তুর্কি থেকে বাঙলাতে এসেছে। ওদিকে মোগল দরবার ফারসিকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন বলে তাঁদের তুর্কি এদেশে প্রচার ও প্রসার লাভ করেনি। যদিও প্রাচীন বাঙলাতে ‘তুর্ক’ বলতে মুসলমান বোঝাত এবং তামিল ভাষাতে মুসলমান বোঝাতে হলে এখনও ‘তুরস্কম’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। বাঙালি বেকার এখনও চাকরির সন্ধানে ‘তুর্কি নাচন’ নাচে।
আমরা ইংরেজি-ফরাসি পড়ি, রাশান কথাসাহিত্যও আমাদের অজানা নয়, স্পেন পর্তুগাল দেনমার্কের লোক এদেশে এসেছিল এবং আরও অনেকেই– কিন্তু আশ্চর্য ওসমানলি তুর্কি ভাষা এবং সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের কণামাত্র পরিচয় নেই। আমার জানামতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে পাবনা জেলার কবি ইসমাঈল হোসেন শিরাজী নজরুল ইসলাম এর কাছে একাধিক বিষয়ে ঋণী বলে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন) তুর্কিকে সাহায্য করার জন্য একটি মেডিকেল মিশন নিয়ে সে দেশে গিয়েছিলেন এবং তুর্কি রাজনীতি, সমাজ, আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে বাঙলায় একাধিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তুর্কির সভাকবি হামিদ পাশার সঙ্গে সে সময়ে তাঁর হৃদ্যতা হয়, কিন্তু তুর্কিসাহিত্যের সঙ্গে বাঙলার পরিচয় করিয়ে দেবার পূর্বেই ইংরেজের চাপে তাকে দেশে ফিরে আসতে হয়।(২)
তুর্কির বাইরে ইরান, আফগানিস্থান, উজবেক, আজারবাইজান, তথা গ্রিস, বুলগারিয়া, রুমানিয়া ইত্যাদি দেশে নসরুদ্দিন খোজা সুপরিচিত। ইরানের স্বর্ণযুগের একাধিক সুরসিক কবির ওপর তার প্রভাব সুস্পষ্ট। বন্ধানের বাইরে ইয়োরোপে তিনি জর্মনিতে সবচেয়ে বেশি ভক্ত পাঠক পেয়েছেন। ইংরেজি এনসাইক্লোপিডিয়াতে তাঁর নাম নেই, জর্মন সাইক্লোপিডিয়া আকারে ইংরেজির অর্ধেক হওয়া সত্ত্বেও সেটাতে তাঁর সম্বন্ধে কয়েক ছত্র আছে। আর একাধিক অনুবাদ জর্মন ভাষাতে তো আছেই। অবশ্য আজকের দিনের রুচি দিয়ে বিচার করলে তাঁর বহু জিনিস শুধু কুট্টনীরসাশ্রিত লাতিনেই অনুবাদ করা যায়!
খোজার জীবনী নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করার উপায় নেই। কারণ তাঁর জীবন ও তাঁর হরেক রকমের রসিকতা এমনই জড়িয়ে গিয়েছে যে তার জট ছাড়ানো অসম্ভব। তাঁর সম্বন্ধে প্রচলিত দু আনা পরিমাণ কিংবদন্তি বিশ্বাস করলে আমাদের কালিদাস সম্বন্ধে প্রচলিত সবকটাই বিশ্বাস করতে হয়। এমনকি তিনি পাঁচ শ না সাত শ বছর আগে জন্মেছিলেন সেই সমস্যারই চূড়ান্ত সমাধান এযাবৎ হয়নি। তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে খোর্তো গ্রামে তাঁর জন্ম সম্ভবত ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এবং আকশেহিরে তাঁর মকবরহ বা সমাধিসৌধ দেখানো হয়। ইনি যে সুপণ্ডিত এবং সুকবি ছিলেন সে-বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই, কারণ ধর্মশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি না থাকলে ‘ইমাম’ (ইংরেজিতে অন্ততপক্ষে বিশপ) হওয়া যায় না। অন্যান্য একাধিক ব্যাপারেও তিনি সমাজের অগ্রণীরূপে তুর্কি এবং তুর্কির বাইরে সুপরিচিত ছিলেন।
স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে তাঁর নামে প্রচলিত গল্পের কটি তাঁর নিজস্ব ও কটি উদোর শিরনি বুধোর দর্গায় সে বিচার অসম্ভব। দেশ-বিদেশের পণ্ডিতগণ হার মেনে বিক্রমাদিত্যের নামে প্রচলিত গল্প যে ‘বিক্রমাদিত্য সাইকল’, খৈয়ামের নামে চলিত-অচলিত চতুষ্পদী ‘খৈয়াম চক্র’ নামে অভিহিত করেছেন, ঠিক সেইরকম এখন খোজার নামে লিখিত, পঠিত, শ্ৰত গল্পকে ‘খোজা চক্র’ নাম দিয়ে দায়মুক্ত হয়। কিন্তু গল্পগুলো বিশ্লেষণ করে সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে তার অনেকগুলোই আরবভূমি প্রাচীন ইরান ও ভারতবর্ষ থেকে গিয়েছে। সিরিয়াক এবং প্রাচীন বন্ধানেও এর অনেকগুলো প্রচলিত ছিল। অবশ্য এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে সেসব বাদ দিলেও খোজার তহবিলে প্রচুর হাস্যরসের উপাদান উদ্বৃত্ত থেকে যায়। এবং তার চেয়েও বড় কথা– সুখে-দুঃখে, উৎসবে-ব্যসনে, মসজিদে-সরাইয়ে, বাজারে-বৈঠকখানায় খোজা যেভাবে তাঁর গল্পে, আচরণে, ইঙ্গিতের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেছেন তারই একটি অতি সুস্পষ্ট হাস্যময়, সদানন্দ, দরদী ছবি তুর্কিদের বুকের ভিতর আঁকা। আজ যদি বেহশত থেকে ফিরিশতা (দেবদূত) ইস্তাম্বুলে নেমে বিশ্বজনের কাছে সপ্রমাণ করে যান যে ইমাম নসরুদ্দিন খোজা নামক কোনও ব্যক্তি এ ধরায় জন্মগ্রহণ করেননি তবুও তুর্কির লোক অচঞ্চল চিত্তে সেই তসবিরই ধারণ করবে, বিদেশির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার কয়েক লহমার ভিতরেই খোজার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেবে এবং যদি সেখানে একাধিক তুর্ক উপস্থিত থাকে, এবং আপনি যে খোজাকে চেনেন না সেকথা বুঝতে পারে তবে আপসে পাল্লা লেগে যাবে কে কত বেশি খোজার গল্প বলতে পারে। এদেশে যেমন বিস্তর রবীন্দ্রভক্ত আছেন যাঁরা প্রত্যেক ঋতু-পরিবর্তন এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির রূপরসগন্ধস্পর্শ বিবর্তন রবীন্দ্রনাথের কোনও না কোনও গান, বা একাধিক গান দিয়ে প্রকাশ করতে পারেন, ঠিক তেমনি জীবনের সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদ, দুর্ঘটনা, লটারি লাভ– সবকিছুই খোজার কোনও না কোনও গল্প দিয়ে রসরূপে প্রকাশ করা যায়। কারণ খোজা শুধু এলোপাতাড়ি রসসৃষ্টি করে যাননি তার মারফতে খোজার পরিপূর্ণ জীবনদর্শন বা ‘ভেল্টআনশাউঙ’ পাওয়া যায়।
খোজার গল্প তিন রকমের। সহজেই অনুমান করা যায়, তিনি যেখানে চালাকি করে অন্যকে বোকা বানাচ্ছেন, কিংবা মারাত্মক উত্তর দিয়ে প্রতিপক্ষকে নিরস্ত্র করেছেন তার সংখ্যাই বেশি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এন্তের গল্প আছে যেখানে তিনি একটি পয়লা নম্বরের ইডিয়েট, গাড়লস্য কুত্ত্বমিনার। এবং তৃতীয় শ্রেণি থেকে বোঝা যায় না, তিনি বোকা না আমরা বোকা।
যেমন মনে করেন, খোজাকে অমাবস্যার রাতে শুধানো হল পূর্ণিমার চাঁদ গেল কোথায়? খোজা একগাল হেসে উত্তর দিলেন, ‘তা-ও জানো না, পূর্ণিমার চাঁদকে প্রতি রাত্রে ফালি ফালি করে কেটে নেওয়ার পর এখন সেগুলো গুঁড়ো করে আকাশের তারা করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’
খোজা বোকা বনতে চান, না বানাতে চান?
অবশ্য খোজার গীতিরস বা লিরিকরস অসাধারণ ছিল। এই কবিতৃময় ব্যাখ্যাটি দিয়ে তিনি যে গীতির সৃষ্টি করতে চাননি, বা যেসব কবি অসম্ভব অসম্ভব তুলনা দিয়ে কাব্যরস সৃষ্টি করতে চান তাদের নিয়ে মশকরা করতে চাননি একথা বলা কঠিন। কারণ আমাদের অলঙ্কারশাস্ত্রেও আছে–
‘প্রিয়ে, আকাশে চন্দ্রের মুখ দেখে
মনে হল তোমার মুখ,
তাই আমি চাঁদের পিছনে পিছনে ছুটছি।’
এ ধরনের তুলনাকে ‘অসম্ভব তুলনা’ বলে আলঙ্কারিক দণ্ডিন কাব্যাদর্শে নিন্দা করেছেন। একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায় যে এতে হাস্যরসের অবতারণা হওয়া বিচিত্র নয়। কথা নেই, বার্তা নেই, একটা লোক যদি চাঁদের পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে হঠাৎ খোয়াই-ভাঙা মাঠ-ময়দান ভেঙে ছুটতে আরম্ভ করে আর বলতে থাকে ‘ওই আমার প্রিয়া, ওই আমার প্রিয়া’, তা হলে পাড়ার ডন জোয়ানদেরও হেসে ওঠা অসম্ভব নয়।
তবু না-হয় মেনে নেওয়া গেল, চাঁদকে গুঁড়ো করে খোজা ইচ্ছা করেই বোকা বনেছেন। কিন্তু এখন যেটা বলছি সেটাতে খোজা কী?
দোস্তের বাড়ির দাওয়াতে খোজা খেলেন এক নতুন ধরনের মিশরি কাবাব। অতি সযত্নে একটুকরো কাগজে লিখে নিলেন তার রেসিপি কিংবা পাকপ্রণালি কিংবা যাই বলুন। ততোধিক সযত্নে, ব-তরিবৎ সেটি রাখলেন জোব্বার ভিতরে গালাবিয়ার বুকপকেটে। রাস্তায় বেরিয়েই গেলেন তার প্যারা কসাইয়ের দোকানে। আজ সন্ধ্যায়ই গিন্নিকে শিখিয়ে দেবেন কী করে এই অমূল্যনিধি রাঁধতে হয়। আর খাবেনও পেট ভরে। বন্ধুর বাড়িতে মেকদারটা একটু কম পড়েছিল। গোশত কিনে খোজা রাস্তায় নামলেন।
হঠাৎ চিল এসে ছোঁ মেরে মাংস নিয়ে হাওয়া।
খোজা চিলের পিছনে ছুটতে ছুটতে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে চিলকে বলতে লাগলেন, ‘আরে কোরছ কী? শুধু মাংসটা নিয়ে তোমার হবে কী? রেসিপিটা যে পকেটে রয়ে গেছে। কী উৎপাত! দাঁড়াও না।’
কিন্তু এভাবে গল্পের পর গল্প বলতে থাকলে খোজার সম্পূর্ণ গ্রন্থ নকল করে দিতে হয়। সম্পাদক আপত্তি জানাবেন।
এবারে তা হলে যে ধরনের গল্পের জন্য খোজা সুপ্রসিদ্ধ তারই একটি নিবেদন করি।
কথিত আছে, একদা খোজা জন্মভূমি তুর্কির প্রতি বিরক্ত হয়ে দেশত্যাগ করে ইরান দেশে চলে যান। এতে আশ্চর্য হবার মতো কিছুই নেই। কারণ খোজা ছিলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন পরোপকারী–আমাদের বিদ্যাসাগরের মতো দাগা খাওয়া বিচিত্র নয়।
তা সে যাই হোক লোকমুখে ইরানের রাজা সে খুশখবর শুনে বে-এক্তেয়ার। তড়িঘড়ি লোকলশূকরসহ উজির-ই আলাকে পাঠিয়ে দিলেন খোজাকে পরম যত্নসহকারে রাজদরবারে নিয়ে আসতে। খোজা আসামাত্র তখৃত্-ই-সুলেমান ত্যাগ করে বাদশা তাঁকে আলিঙ্গন করে পাশে বসালেন। মাথায় সোনার তাজ পরিয়ে দিলেন, গায়ে কাশ্মিরি শাল জড়িয়ে দিলেন, কোমরবন্ধে দমশকি তলওয়ার ঝুলিয়ে দিলেন। চতুর্দিকে জয়জয়কার।
সভাভঙ্গের পর বাদশা নিভতে ইতি-উতি করে, আশ-কথা পাশ-কথা কাড়ার পর অতি সন্তর্পণে তাঁর জাগিরের প্রতি ইঙ্গিত করলেন। খোজা করজোড়ে ‘সে কী শাহ ইন-শাহ, আপনার যে পূত পবিত্র… ইত্যাদি(৩) বলে তিনি নিবেদন করলেন, রাজসম্মানই তাঁর পক্ষে যথেষ্ট।
বাদশাহ বিস্তর চাপাচাপি করার পর খোজা বললেন,’ হুজুরের যখন নিতান্তই এ হেন বাসনা তবে হুকুম জারি করে দিন কাল সকাল থেকে যারা বউকে ডরায় তারা আমাকে একটি করে ডিম প্রতি সকালে দেবে।’
দিন দুনিয়ার মালিক বাদশা তো তাজ্জব। ‘ওতে আপনার কী হবে? আমি খবর পেয়েছি, আপনি দান-খয়রাতে দাতাকর্ণ।’
খোজা এলবুর্জ পাহাড়ের মতো অচল অটল। তবে তাই সই। ইরানি ভাষায় বলতে গেলে আলোচনার কার্পেট তখন রোল করে গুটিয়ে ঘরের কোণে খাড়া করে রেখে দেওয়া হল।
পরদিন ফজরের নমাজের সময় থেকেই হৈ-হৈ-রৈরৈ। এস্তেক রাজবাড়িতেও মমলেট-অমলেট নেই। কী ব্যাপার? যাদের বাড়িতে মুরগি নেই তারা ফজরের আজানের পূর্বে ছুটেছে বাজারপানে। ডিম কিনে ধাওয়া করেছে খোজার ডেরার দিকে।
সেখানে ডাঁই ডাঁই হুদো হুদো আণ্ডার ছয়লাপ! আণ্ডার নবীন ব্রহ্মাণ্ড।
পাইকিরি ব্যবসায়ীরা চতুর্দিকে বসে!
সাতদিন যেতে-না-যেতে খোজা ঢাউস তেতলা হাওয়া-মঞ্জিল হাঁকালেন। পক্ষাধিককাল মধ্যেই বোখারার কার্পেট, সমরকন্দের রেশমি তাকিয়া, মুরাদাবাদি আতরদান, গোলাপ-পাশ, বিদরি আলবোলা, রাজস্থানের গোলাপি মার্বেলের ফোয়ারা, সরণ-দীপের (স্বর্ণদ্বীপ সিংহল) হাতির দাঁতের চামর, ব্যজনী!
বাদশা তো আজব তাজ্জব মানলেন।
কুলোকে বলে, দু একজন অমিতবীর্য সাহসী শের-দিল রুস্তম নাকি ডিম নিয়ে যায়নি। দেখে তাদের (অথবা তার স্ত্রী নাকি শুধিয়েছিল, ‘ও! তুমি বুঝি আমাকে ডরাও না?’ তার পর আর দেখতে হয়নি!
ইরানের বাদশা খুশিতে তুর্কির খাস খলিফাকে ছাড়িয়ে গেছেন।
এমন সময় রাজার মস্তকে বজ্রাঘাত। খোজা তিন-মাসের ছুটি চান দেশ থেকে বউ-বাচ্চা নিয়ে আসবেন বলে। খোজা মারাত্মক একদারনিষ্ঠ। রাজা আর কী করেন, অতি অনিচ্ছায় ছুটি দিলেন, অবশ্য, তিন মাস রিট্রেঞ্চ করে দু মাসের তরে। যাবার সময় বললেন ‘দোস্ত! দেরি করবেন না, আপনার বিরহে আমার’- বাদশার গলা জড়িয়ে এল। ততদিনে তাঁদের সম্পর্ক আর রাজা-প্রজায় নয়–দোস্তিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
দু মাসের কয়েকদিন পূর্বেই খোজা রাজসভায় পুনরায় উপস্থিত। রাজা পরমানন্দে রাজোচিত ভাষায় শুধালেন, ‘তবে কি পুণ্যশ্লোকা বেগম-সাহেবা স্ব-ভবনে অবতীর্ণ হয়েছেন?’
খোজা বললেন, ‘হ্যাঁ, হুজুর! তবে কি না, ভবনটি তার উপর অবতীর্ণ হলেই হত আরও ভালো।’
তদ্দণ্ডেই সভাভঙ্গের হুকুম হল। বাদশা নিয়ে গেলেন খোজাকে অন্দরমহলে।
‘শতেক বছর পরে বঁধুয়া আসিল ঘরে–’
বাদশার তখন ওই হাল। দোস্তের সঙ্গে নিভৃতে দুঁহু দুঁহু হয়ে কুহু কুহু করবেন।
দু পাত্র শিরাজি খেয়ে বাদশা খোজার কাছে ঘেঁষে বললেন, ‘দোস্ত! রাজ্যের আর সকলের সঙ্গে আমার রাজা-প্রজার সম্বন্ধ। তারা আমার কাছ থেকে চায়; আমি তাদের দিই। কিন্তু আপনি আমার দোস্ত আপনার সঙ্গে দোস্তির সম্পর্ক। দোস্ত যখন দেশে ফেরে তখন দোস্তের জন্য– ’ বাদশা গলা সাফ করে বললেন, ‘এই, ইয়ে, মানে, কোনওকিছু একটা সওগাত আনে। আপনি তো আনেননি।’
বলে বাদশা খ্যাঁক খ্যাঁক করে বিশ্রী রকমের হাসতে লাগলেন।
না-হক বেইজ্জত হলে মানুষ যেরকম বেদনাতুর কণ্ঠে ককিয়ে ওঠে, খোজা সেইরকম বললেন, ‘জাঁহাপনা কুল্লে দুনিয়ার ইমান-ইনসাফের মালিক, এ সংসারে আল্লা-তালার ছায়া (জিল্লুল্লা) আমার ওপর অবিচার করবেন না। এনেছি, আলবৎ এনেছি। দেশে পৌঁছে সক্কলের পয়লা হুজুরেরই সওগাত সংগ্রহ করেছি। আজ সঙ্গে আনিনি। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করতে হয়। কাল সন্ধ্যায় নিয়ে আসব।’
একেই বলে দোস্ত!
উগ্রীব হয়ে রাজা শুধালেন, ‘কী? কী? আমার যে তর সইছে না। আহ্, জীবনে এই প্রথম কিছু-একটা পেলুম।’
খোজা বললেন, ‘নিজের আনা সওগাতের প্রশংসা করতে বাধছে, কিন্তু সত্যি হুজুর অপূর্ব, অতুলনীয়। একটি অপরূপ সুন্দরী তুর্কি তরুণী আপনার জন্য এনেছি হুজুর।’(৪)
ঝঙ্কারের জন্য ফারসিটা শুনুন :
‘অগর আন্ তুর্ক-ই শিরাজি
বদস্ত আরদ দিল-ই মারা
ব-খাল-ই হিন্দো ওণ বখ শম্
সমরকন্দ ওয়া বুখারারা।’ (৫)
কথিত আছে এ দোঁহা লিখে হাফিজকে তিমুর লেনের সামনে বিপদে পড়তে হয়েছিল। সেটা বারান্তরে হবে।
তার পর খোজা উচ্ছ্বসিত হয়ে সেই তরুণীর রূপবর্ণনা আরম্ভ করলেন, একেবারে আমাদের বিদ্যাপতি স্টাইলে, নখ থেকে শির পর্যন্ত– যাকে বলে নখশির বর্ণন। ‘ওহো হো হো,–একটি তন্বঙ্গী চিনার গাছ হেন! কী দোলন, কী চলন!’
বাদশা বললেন, ‘আস্তে।’
কিন্তু খোজাকে তখন পায় কে, তিনি মৌজে। গলা চড়িয়ে বললেন, ‘চিকুর কেশ তো নয়, যেন অমা-যামিনীর স্বপ্নজাল– আর্দ্র, স্নিগ্ধ, মৃগনাভি সম।’
উৎসাহের তোড়ে খোজা তখন উঠে দাঁড়িয়েছেন। যেন রাজকবি দরবারের সবাইকে শুনিয়ে কবিতা পাঠ করছেন।
বাদশা ব্যাকুল হয়ে খোজার জোব্বা টেনে কাতরকণ্ঠে বললেন, ‘চুপ, চুপ, আস্তে আস্তে– পাশের ঘরে বেগম-সায়েবা রয়েছেন।’
ঝুপ করে বসে পড়ে খোজা বিনয় কণ্ঠে বললেন, ‘হুজুর, কাল সকাল থেকে একটি করে আণ্ডা পাঠিয়ে দেবেন। আমার পাওনা।’
এইখানেই খোজা-কাহিনী শেষ করলে ঠিক হত। কিন্তু তা হলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। তিনি পরলোকগমনের পূর্বে যে শেষ রসিকতাটি করে গিয়েছেন, সেটি বাদ পড়ে যায়। কারণ সেটি আজও প্রথমদিনের মতো তাজা, অতিশয় নব ফারসিতে যাকে বলে ‘তাজা ব-তাজা, নৌ-ব-নৌ’, দ্বিতীয়ত, আণ্ডার গল্পটি আমি শুনেছি আমার সর্বকনিষ্ঠা ভগিনী লুৎফুন্নিসার কাছ থেকে। আমার মতো তার পায়েও চক্কর আছে। সে শুনেছে লাহোর না পেশাওয়ার কোথায় যেন। এর থেকে এটাও বোঝা যায়, খোজার গল্প মুখে-মুখে কতখানি ছড়িয়ে পড়েছে। এখন বাঙলা দেশেও পৌঁছল। সপ্তদশ অশ্বারোহী গাঁজা; দশ বাদ দিয়ে সপ্ত শতাব্দীতেই হয়।
এবারে শেষ গল্প। এটাতে আপনি-আমি সবাই আছি।
যেমন মনে করুন, দৈবযোগে আপনি পৌঁছেছেন আশেহিরে, স্বভাবতই আপনার মনে বাসনা, দিলে ইরাদা জাগবে খোজার গোরস্তান দেখবার জন্য। একাই বেরিয়ে পড়ুন; কিচ্ছুটি ভাবনা নেই, সবাই রাস্তা চেনে।
সেখানে গিয়ে দেখবেন, সামনে এক বিরাট দেউড়ি– প্রবেশদ্বার। কোথায় লাগে তার কাছে ফতেহ-পুর-সিক্রিতে আকবর বাদশার বুলন্দ-দরওয়াজ। একেবারে শিশু। তা না-হয় হল, কিন্তু অবাক হবেন দেখে যে বন্ধ-দরজায় এক বিরাট তিন মণ ওজনের তালা!
গোরস্তানে আছেই-বা কী, যাবেই-বা কী? এই ভারতবর্ষেই লুটতরাজের ফলে যা-কিছু ইমারত বেঁচে আছে, সেগুলো হয় কবর নয় মসজিদ– ওসবে লুটের কিছু নেই বলে। তিনমণি তালা দিয়ে খোজার দেহরক্ষা–অন্যার্থে– করা হচ্ছে, মিশরি মমির মতো? কিন্তু ইসলামে তো হেন ব্যবস্থা নেই।
নাচার হয়ে তালাটা বন্ধ দোরে বারকয়েক ঠুকলেন, এদিক-ওদিক গলা বাড়িয়ে চেল্লাচেল্লি করলেন।
তখন দরাজ-দেউড়ির একপাশ দিয়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে বেরিয়ে এল পাহারাওলা। আপনাকে সবিনয় নিবেদন করবে, ‘কী হবে ওই বিরাট তালা খুলে। ওটা কখনও খোলা হয়নি। চলুন পাঁচিল ডিঙিয়ে যাই।’
মানে?
একশ ফুট উঁচু দেউড়ি– চতুর্দিকের পঁচিল উঁচুতে এক ফুট হয় কি-না হয়।
মানে?
খোজার আখেরি-শেষ মশকরা। উইলে এইভাবে তৈরি করবার আদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন।
বলতে চেয়েছিলেন, ‘এ জীবনে আমরা সামনের দিকটা আগলাতেই ব্যস্ত। ইতোমধ্যে আর সবদিক দিয়ে যে বেবাক কিছু চলে যায়, তার খবর রাখিনে।’
***
আমি আকশেহির যাইনি। কাজেই হলফ খেয়ে বলতে পারব না, খোজার দর্গা এই পদ্ধতিতে নির্মিত কি না। যদি না হয় তবে বুঝব খোজা আরও মোক্ষম রসিক। বিন-খর্চায় আমাদের এখনও হাসাচ্ছেন আর বোকা বানাচ্ছেন।
————
১. VOLCANIC ERUPTION AFTER FIVE CENTURIES
Istambul July 22–Mount Soutlubiyan, in the Kars Province of Turkey has burst into what is believed to be Turkey’s first volcanic eruption since the 15th century. A spokesman at the office of the Governor of Kars said the erup tion of rock and smoke had caused anxiety and excitement among people liv ing nearby, but there had been no serious damage yet.
২. সুপ্রভাত’ পত্রিকার সম্পাদিকা শ্রীমতী কুমুদিনী মিত্রকে (ইনি ‘সঞ্জীবনী’ সম্পাদক শ্রীঅরবিন্দের মেসোমশাই কৃষ্ণকুমার মিত্রের বড় মেয়ে) শিরাজী একটি কবিতা ও ছবি পাঠালে পর তিনি (কুমুদিনী) লেখেন, ‘আপনার কবিতা ও ছবি পাইয়া আমি পরম পুলকিত হইয়াছি। আপনার কবিতাটি “সুপ্রভাতে” প্রকাশিত হইবে। তুরস্কের নারীদিগের অতীত ও বর্তমান অবস্থা, স্বদেশের কার্যে ও উন্নতিতে তাহাদের সাহায্যদান, তাহাদের শিক্ষা ও স্বদেশপ্রেম প্রভৃতি সম্বন্ধে লেখা শীঘ্রই অনুগ্রহ করিয়া পাঠাইবেন। ভারতবর্ষ হইতে যে সকল যুবক আহতদিগের সেবার জন্য তথায় গমন করিয়াছেন, তাহাদের কার্যের বিবরণ লিখিবেন।’
বাঙলা একাডেমী পত্রিকা, প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, পৃ. ৫৭।
৩, ইরানে বাদশার সামনে কোন মন্ত্র দিয়ে নিবেদন আরম্ভ করতে হয়, তার পুরো বিবরণের জন্য ‘দেশে-বিদেশে’ অধ্যায় পশ্য।
৪. ইরানে তুর্কি রমণীর বড়ই কদর।
‘হে তরুণী, হে তুরস্কী, হে সুন্দরী সাকি
এমনি হৃদয় মুগ্ধ করিয়াছ তুমি,
তব কপোলর ওই কৃষ্ণ তিল লাগি
বোখারা সমরকন্দ দিতে পারি আমি।
অনুবাদটি ভালো নয়। কিন্তু হাফিজের এই কবিতাটি এতই বিখ্যাত যে, তার একাধিক ইংরেজি অনুবাদ আছে–
‘If that unkindly Shirazi Turk
would take my heart in her hand
I’d give Bukhara for the mole upon
her cheek, and Samarkand.’
কিংবা
‘Sweet maid, if thou wouldst charm my sight;
And bid these arms thy neck infold;
That rosy cheek, thy lily hand
Would give thy poet more delight
Than all Bokharas vaunted gold.
Than all the gems of Samarkhand.
৫. সত্যেন দত্তের অনুবাদ আছে।
পুষ্পধনু
রস কী?
অর্থাৎ যখন কোনও উত্তম ছবি দেখি, কিংবা রসের সঙ্গীত শুনি অথবা ভালো কবিতা পড়ি, কিংবা নটরাজের মূর্তি দেখি, তখন যে রসানুভূতি হয় সে রস কী, সৃষ্ট হয় কী প্রকারে?
এ রসের কাছাকাছি একাধিক রস আছে। গোয়েন্দা কাহিনী পড়ে, ধাঁধার উত্তর বের করে, মনোরম সূর্যোদয় দেখে, প্রিয়াকে আলিঙ্গন করে যেসব রসের সৃষ্টি হয় তার সঙ্গে যে পূর্বোল্লিখিত রসের কোনও মিল নেই সেকথা জোর করে বলা চলে না। এমনকি শোনা কথা বার্ট্রান্ড রাসূল নাকি বলেছেন, গণিতের কঠিন সমস্যা সমাধান করে তিনি যে আনন্দ অনুভব করেন সেটি নাকি হুবহু কলারসের মতোই। কিন্তু এসব রসে এবং অন্যান্য রসে পার্থক্য কী সে আলোচনায় এবেলা মেতে উঠলে ওপারে পৌঁছতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আমার জ্ঞানও অতিশয় সীমাবদ্ধ, প্রকাশশক্তি ততোধিক সীমাবদ্ধ। (তা হলে অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে, আমি আদৌ লিখতে যাচ্ছি কেন? উত্তরে সবিনয় নিবেদন, বহুদিন সাহিত্য রচনা করার ফলে আমার একটি নিজস্ব পাঠকগোষ্ঠী জমায়েত হয়েছেন; এদের কেউই পণ্ডিত নন– আমিও নই- অথচ মাঝে-মধ্যে এঁরা কঠিন বস্তুও সহজে বুঝে নিতে চান এবং সে কর্ম আমার মতো বে-পেশাদারি নন-প্রফেশনালই করতে পারে ভালো। রচনার গোড়াতেই এতখানি ব্যক্তিগত সাফাই হয়তো ঠিক মানানসই হল না, তবু পণ্ডিতজন পাছে আমার ওপর অহমিকা দোষ আরোপন করেন তাই সভয়ে এ ক’টি কথা কইতে হল)।
রস কী সে আলোচনা অল্প লোকেই করে থাকেন। আলঙ্কারিকের অভাব প্রায় সর্বত্রই। কারণ রসের প্রধান কার্যকারণ আলোচনা করতে হলে অন্তত দুটি জিনিসের প্রয়োজন। একদিক দিয়ে রসবোধ, অন্যদিক দিয়ে রসকষহীন বিচার-বিবেচনা যুক্তি-তর্ক করার ক্ষমতা। তাই এর ভিতর একটি দ্বন্দ্ব লুকনো রয়েছে। যারা রসগ্রহণে তৎপর তারা তর্কের কিচিরমিচির পছন্দ করে না, আর যারা সর্বক্ষণ তর্ক করতে ভালোবাসে তারা যে ‘শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠতি অগ্রে’ হয়ে রসিকজনের ভীতির সঞ্চার করে সে তো জানা কথা।
সৌভাগ্যক্রমে এদেশে কিন্তু কখনও আলঙ্কারিকের অনটন হয়নি। ভরত থেকে আরম্ভ করে, দণ্ডিন মন্মট ভামহ হেমচন্দ্র অভিনবগুপ্ত ইত্যাদি ইত্যাদি অন্তহীন নির্ঘন্ট বিশ্বজনের প্রচুর ঈর্ষার সৃষ্টি করেছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মুখে শুনেছি, তাঁকে যখন রাসূল প্রশ্ন শোধান, রস কী, হোয়াট ইজ আর্ট, তখন তিনি এঁদের স্মরণে রাসূলকে প্রচুর নতুন তত্ত্ব শোনান। অন্য লোকের মুখে শুনেছি, রাসল রীতিমতো হকচকিয়ে যান।
বিদেশি আলঙ্কারিকদের ভিতর জর্মন কবি হাইনরিষ হাইনের নাম কেউ বড় একটা করে না। কারণ তিনি অমিত্র অলঙ্কার নিয়ে আলোচনা করেননি। জর্মন কবিদের নিয়ে আলোচনা করার সময় মাঝে মাঝে রস কী তাই নিয়ে তিনি চিন্তা করেছেন, এবং রস কী তার সংজ্ঞা না দিয়ে তুলনার মারফত, গল্পচ্ছলে সবকিছু অতি মনোরম ভাষায় প্রকাশ করেছেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণ যেরকম কোনওকিছু বলতে গেলে সংজ্ঞা নিয়ে মাথা ফাটাফাটি না করে গল্প বলে জিনিসটা সরল করে দিতেন– অনেকটা সেইরকম!
বাগদাদের শাহ্ ইন-শাহ্ দিনদুনিয়ার মালিক খলিফা হারুন-অর-রশিদের হারেমের সর্বশ্রেষ্ঠা, সুন্দরী, খলিফার জিগরের টুকরো, চোখের রোশনী রাজকুমারীটি ছিলেন ‘স্বপনচারিণী,’ অর্থাৎ ঘুমের ঘোরে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতেন।
গভীর নিশীথে একদা তিনি নিদ্রার আবেশে মৃদু পদসঞ্চারণে চলে গিয়েছেন প্রাসাদ-উদ্যানে। সখীরা গেছেন পিছনে পিছনে। রাজকুমারী ন্দ্রিার ঘোরে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে সম্পূর্ণ মোহাবস্থায় ফুল আর লতা-পাতা কুড়োতে আরম্ভ করলেন আর মোহাবস্থায়ই সেগুলো অপূর্ব সমাবেশে সাজিয়ে বানালেন একটি তোড়া। আর সে সামঞ্জস্যে প্রকাশিত হয়ে গেল একটি নবীন বাণী, নতুন ভাষা। মোহাবস্থায়ই রাজকুমারী তোড়াটি পালঙ্কের সিথানে রেখে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়লেন।
ঘুম ভাঙতে রাজকুমারী দেখেন একটি তোড়া যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে। সখীরা বললেন, এটি তাঁরই হাতে তৈরি। কিছুতেই তাঁর বিশ্বাস হয় না। এমনকি ফুলপাতার সামঞ্জস্যে যে ভাষা যে বাণী প্রকাশ পেয়েছে সেটিও তিনি সম্পূর্ণ বুঝতে পারছেন না– আবছা আবছা ঠেকছে।
কিন্তু অপূর্ব সেই পুস্পস্তবক। এটি তা হলে কাকে দেওয়া যায়? যাঁকে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। খলিফা হারুন-অর-রশিদ। খোজাকে ডেকে বললেন, ‘বত্স, এটি তুমি আর্যপুত্রকে (খলিফাকে) দিয়ে এস।’
খোজা তোড়াটি হাতে নিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, “ও হো হো, কী অপূর্ব কুসুমগুচ্ছ! কী সুন্দর গন্ধ, কী সুন্দর রঙ! হয় না, হয় না, এরকম সঞ্চয়ন সমাবেশ আর কোনও হাতে হতে পারে না।’
কিন্তু সে সামঞ্জস্যে যে বাণী প্রকাশিত হয়েছিল সে সেটি বুঝতে পারল না। সখীরাও বুঝতে পারেননি।
খলিফা কিন্তু দেখামাত্রই বাণীটি বুঝে গেলেন। তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে গেল। দেহ শিহরিত হল। সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হল। অভূতপূর্ব পুলকে দীর্ঘ দাড়ি বেয়ে দরদরধারে আনন্দাশ্রু বইতে লাগল।
এতখানি গল্প বলার পর কবি হাইনরিষ হাইনে বলেছেন, ‘হায় আমি বাগদাদের খলিফা নই, আমি মহাপুরুষ মুহম্মদের বংশধর নই, আমার হাতে রাজা সলমনের আঙটি নেই, যেটি আঙুলে থাকলে সর্বভাষা, এমনকি পশুপক্ষীর কথাও বোঝা যায়, আমার লম্বা দাড়িও নেই, কিন্তু পেরেছি, পেরেছি, আমিও সে ভাষা সে বাণী বুঝতে পেরেছি।’
এস্থলে গল্পটির দীর্ঘ টীকার প্রয়োজন। কিন্তু পূর্বেই নিবেদন করেছি সে শক্তি আমার নেই। তাই টাপেটোপে ঠারেঠোরে কই।
রাজকুমারী = কবি; ফুলের তোড়া = কবিতা; ফুলের রঙ পাতার বাহার = তুলনা অনুপ্রাস, খোঁজা = প্রকাশক-সম্পাদক-ফিলিম-ডিস্ট্রিব্যুটর (তাঁরা সুগন্ধ সুবর্ণের রসাস্বাদ করতে পারেন, কিন্তু ‘বাণীটি’ বোঝেন না); এবং খলিফা = সহৃদয় পাঠক!
ফরাসি-বাঙলা
রবীন্দ্রনাথ নাকি কোনও এক স্থলে খেদ করেছেন আমরা ইয়োরোপের যেটুকু চিনলুম সেটা ইংরেজের মারফতে।
তিনি ঠিক কী বলেছিলেন মনে নেই বলে অপরাধ মেনে নিবেদন করি, ইংরেজ বরঞ্চ চেষ্টা করেছে আমরা যেন ইয়োরোপকে না চিনতে পারি।
ইংরেজ যখন এদেশে রাজত্ব করত তখন দুটি প্রচারকমে মেতে থাকতে সে বড় আনন্দ পেত। তার প্রথম, বিশ্বজনকে জানানো যে, ভারতীয়েরা ড্যাম নিগার, কালা আদমি, তাদের কোনওপ্রকারের কলচর নেই। দ্বিতীয়, ভারতীয়দের জানানো, ইংরেজ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জাত এবং তাই (আ ফর্তেরিয়রি) ইয়োরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ নেশন তো বটেই। প্রমাণস্বরূপ শেক্সপিয়রের নাম করল।
আমরা তখন আমাদের বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে যাচাই-পরখ করে দেখলুম, কথাটা ঠিক শেক্সপিয়রের মতো কবি পৃথিবীতে কম– নেই বললেও চলে। ইংরেজিতেই পড়লুম, ফরাসি-জর্মন-ওলন্দাজ-দিনেমার সবাই একথা স্বীকার করেছে। তাই আমরা ইংরেজের বাদবাকি দাবিগুলোও সুড়সুড় করে মেনে নিলুম। ঘড়েল মিথ্যে সাক্ষী– কনফিডেন্স ট্রিকস্টার– এইভাবেই সরল জনকে আপন সব পচা মাল পাচার করে দেয়।
ইংরেজ কিন্তু একথা বলতে ভুলে গেল, উপন্যাসে তার টলস্টয় নেই, গল্পে তার মপাসাঁ নেই, চিত্রকলায় তার রাফায়েল নেই, ভাস্কর্যে তার মাইকেল এঞ্জেলো নেই, দর্শনে কান্ট নেই, নৃত্যে পাভলোভা নেই, ধর্মে লুথার নেই, সঙ্গীতে বেটোফেন নেই।
বিশেষ করে বেটোফেনের কথাই তুললুম।
ইংরেজ জাত সুর-কানা। তাই সে বেটোফেনের নাম করে না। তাই ইংরেজের বাড়িতে সঙ্গীত-চর্চা নেই। যদি থাকত তবে এ দেশের বড় সায়েবদের বাড়িতেও সে চর্চা আসন পেত। আমরাও ইয়োরোপীয় সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত হতুম। ইংরেজ চর্চা করল এবং আমাদের শেখাল– জ্যাজু, যেটা তার খুড়তুতো ভাই মার্কিন শিখল তাদের গোলাম নিগ্রোদের কাছ থেকে।
অতি অবশ্য আমাদেরও দোষ আছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা হাজারে হাজারে ফ্রান্স-জর্মনি-ইতালি-রুশে যায়নি বটে, কিন্তু শতে শতে তো গিয়েছে। তাদের মধ্যে যে ক জন ইয়োরোপের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন তাঁদের সংখ্যা এক হাতের এক আঙুলে গোনা যায় (এবং আশ্চর্য, যে মহাজন আমাদের সঙ্গে ফরাসি সাহিত্যের ঘনিষ্ঠতম পরিচয় ঘটিয়ে দিলেন তিনি কখনও ফ্রান্সে যাননি তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
‘দেশ’ পত্রিকার এ সংখ্যা ফরাসিস সাহিত্য নিয়ে। অতএব সেই বিষয়বস্তুর ভিতরেই নিজেকে সীমাবদ্ধ করি।
ইংরেজি ভাষা গম্ভীর এবং জটিল কিন্তু তার প্রসাদগুণও আছে। ফরাসি চটুল ও রঙিন। অতিশয় গম্ভীর বিষয় আলোচনা করার সময়ও ফরাসি কেমন যেন একটুখানি তরল থেকে যায়। পক্ষান্তরে রসিকতা করার সময়ও ইংরেজি তার দার্চ সম্পূর্ণ বর্জন করতে পারে না। চার্লস ল্যাম, এমনকি জেরম্ কে জেরম্ পর্যন্ত যে ভাষা ব্যবহার করেছেন সেটা ধ্রুপদ। উড়হাউসে এসে আমরা সর্বপ্রথম চটুলতা পাই।
কিন্তু এই বাহ্য। ফরাসি ভাষার সর্বপ্রধান গুণ তার স্বচ্ছতা, তার সরলতা। ফরাসিরা নিজেই বলেন, ‘যে বস্তু স্বচ্ছ (ক্ল্যার, ক্লিয়ার) নয় সে জিনিস ফরাসি নয়।’ আমাদের দেশে আজকাল যে দুর্বোধ্য অবোধ্য পদ্য বেরোয় সে ‘মাল’ প্রথম যখন ফ্রান্সে বেরুতে আরম্ভ করল তখন গুণী আনাতোল ফ্ৰাস বলেছিলেন, ‘সে মধুর ললিত বয়সে মানুষ অবোধ জিনিস ভালোবাসে আমার সে বয়স পেরিয়ে গিয়েছে; আমি আলো ভালোবাসি।’ তাই আরেক গুণী শেষ কথা বলেছেন, ‘স্বচ্ছতা, স্বচ্ছতা পুনরপি স্বচ্ছতা।’
ফরাসি চটুলতা হয়তো অনেকেই অপছন্দ করতে পারেন কিন্তু ফরাসি স্বচ্ছতা বাঙলা ভাষা এবং সাহিত্যে যদি আসত তবে আর কিছু না হোক, আমাদের মনন-সাহিত্য যে অনেকখানি লোকপ্রিয় হত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। শ্ৰীযুত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যদি আরও একটুখানি ফরাসি আওতায় আসতেন তবেই ঠিক বোঝা যেত তাঁর দেবার মতো সত্যিই কিছু ছিল কি না। এ বিষয়ে বরঞ্চ বলব, শ্ৰীযুত অন্নদাশঙ্করের লেখা অনেকখানি ফরাসিস।
শব্দতত্ত্ব এবং ভাষাতাত্ত্বিকেরা ঠিক ঠিক বলতে পারবেন কিন্তু সাধারণ পাঠক হিসেবে আমার নিবেদন, বাঙলা ভাষার ওপর ফরাসি ভাষার (Language) প্রায় কোনও প্রভাবই পড়েনি। বাঙলাতে কটি ফরাসি শব্দ ঢুকেছে সেকথা প্রায় আঙুলে গুনেই বলা যায়। অবশ্য এইটেই শেষ যুক্তি নয়; আমরা বাঙলাতে প্রচুর আরবি এবং ফারসি শব্দ নিয়েছি বটে কিন্তু ওই দুই ভাষার প্রভাব আমাদের ওপরে প্রায় নেই। কিন্তু অন্য কোনও বাবদেও ফরাসি ভাষার প্রভাব বাঙলার ওপর আমি বড় একটা পাইনি।
সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমার ব্যক্তিগত দৃঢ়বিশ্বাস ইনি ফরাসি সাহিত্যের যতখানি চর্চা করেছেন ততখানি চর্চা বাঙলা দেশে তো কেউ করেনইনি, অল্প ইংরেজ জর্মন ইতালীয়ই– অর্থাৎ অফরাসিস–করেছে। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাট্য, কবিতা, ভ্রমণ-কাহিনী, কত বিচিত্র বস্তুই তিনি ফরাসি থেকে অনুবাদ করে বাংলায় প্রচার করেছেন। এই যে ইংরেজি এবং ফরাসি পাশাপাশি জাতের ভাষা– সেই ইংরেজিতেই পিয়ের লোতির লেখা ‘ভারত ভ্রমণ’ অনুবাদ করতে গিয়ে ইংরেজ অনুবাদক হিমশিম খেয়ে গিয়েছেন অথচ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অনুবাদে মূল ফরাসি যে ঠিক ঠিক ধরা পড়েছে তাই নয়, প্রাচ্যদেশীয় আবহাওয়াও সম্পূর্ণ বজায় রয়েছে।
এই জ্যোতিরিন্দ্রের বাঙলা ভাষাতেই ফরাসি ভাষার কোনও প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় না।
***
বরঞ্চ ফরাসি শৈলীর (style) প্রভাব বেশ কিছুটা আছে।
বাঙলা সাহিত্যের ঐতিহাসিকরা পাকাপাকিভাবে বলতে পারবেন, বাঙলার কোন লেখক সর্বপ্রথম ফরাসির সঙ্গে বাঙলার যোগসূত্র স্থাপন করেছিলেন; আমি শুধু সার্থক সাহিত্যিকদের কয়েকজনের কথাই তুলব।
মাইকেলের সার্থক সৃষ্টিমাত্রই গম্ভীর– সংস্কৃত এবং লাতিনের ক্লাসিকাল গুণের সঙ্গে তিনি তাঁর বীণার তার বেঁধে নিয়েছিলেন। ওদিকে তিনি আবার অতি উত্তম ফরাসি জানতেন নতুন ভাষা তিনি যে কত তাড়াতাড়ি শিখতে পারতেন, সেকথা আজকের দিনের ভাষার ব্যবসায়ীরা কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না কিন্তু সে ‘রঙিলা ঘরানা’ তাঁর ভাষার ওপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি।(১) তাই কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনে তিনি লা ফঁতেনের ধরনে ‘ফাবল’ (ফেবল) রচনা করলেন কেন? লা ফঁতেন তাঁর অনেক গল্প নিয়েছেন ঈশপের গম্ভীর গ্রিক থেকে, কিন্তু লিখছেন অতি চটুল ফরাসি কায়দায়। অথচ তাঁরই অনুকরণে যখন মাইকেল বাঙলাতে ‘ফাবল’ রচনা করেছেন তখন তিনি গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলছেন,
‘রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণলতিকারে–’
দুই সুর একেবারে ভিন্ন। অথচ মাইকেলের প্রায় সবকটি ‘ফাবলে’র উৎস লা ফঁতেন।
প্রহসনেও তাই। বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ-র মূলে মলিয়ের। অথচ শৈলীতে গম্ভীর।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা পূর্বেই নিবেদন করেছি। যদিও তার আপন ভাষাতে ফরাসি প্রভাব নেই তবু তিনি অনুবাদের মারফতে যে শৈলী এবং বিষয়বস্তুর অবতারণা করে গেলেন তার প্রভাব বাঙলা সাহিত্যের দূর-দূরান্ত কোণে পৌঁছে গিয়েছে এবং আরও বহুদিন ধরে পৌঁছবে।
তোয়েফিল-গতিয়ে, এমনকি বাজাও মপাসাঁ’র পূর্বে কয়েকটি সার্থক ছোটগল্প লিখেছেন কিন্তু আজ শুধু ফরাসিস না, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড স্বীকার করে, মোসই ছোটগল্পের আবিষ্কর্তা। তিনিই প্রথম দেখিয়ে দিলেন, দীর্ঘ উপন্যাস না লিখেও পাঠককে কী প্রকারে কাহিনী-রসে আপুত করা যায় (‘কণ্ঠহার’ গল্প নিয়ে সাত-ভলুমি ‘জাঁ ক্ৰিস্তফ’ লেখা যায়)। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জন্য ডসতেয়ফকির মতো ভলুম না লিখেও ‘সূত্ররূপে’ সেই রস পাঠকের মনে সঞ্চারিত করা যায়।
আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ছোটগল্প লেখক রবীন্দ্রনাথ যবে থেকে জ্যোতিরিন্দ্র ঠাকুরের মারফতে মপাসাঁকে চিনতে শিখলেন তবে থেকেই তাঁর গল্প ঋজু কাঠামো নিয়ে সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে আত্মপ্রকাশ পেল (অবশ্য প্রথম থেকেই তাঁর গল্পে থাকত প্রচুর গীতরস) এবং পরবর্তী যুগে তিনি অন্য এক মিসটিক নবরসে ছোটগল্পকে এক নবরূপ দান করেন।
***
দান্তে, শেক্সপিয়র, গ্যোটে, কালিদাস কেউই পৃথিবীর সুদূরতম সাহিত্যকে এতখানি প্রভাবান্বিত করতে পারেননি মপাসাঁ যতখানি করেছেন। এটম বম্ হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার কিন্তু বাইসি ও সেলাইয়ের কল যেরকম গ্রামে গ্রামে পৌঁছেছে এটম বম্। শেক্সপিয়র সেরকম সাহিত্যে সাহিত্যে নব নব সৃষ্টির অনুপ্রেরণা দিতে পারেননি।(২)
অথচ আজও যখন কোনও মানুষের জীবনের কোনও এক অদ্ভুত বিচিত্র অভিজ্ঞতা আসে সে তখন তার প্রকাশ দেবার চেষ্টা করে ছোটগল্পের মাধ্যমে, অর্থাৎ মপাসাঁ’র কাঠামো নিয়ে। ইংরেজ, জর্মন, রুশ, বাঙলা এসব অর্বাচীন সাহিত্যের কথা বাদ দিন, অতিশয় প্রাচীন চীন-আরবির মতো ক্লাসিকাল সাহিত্যেও আজকের দিনে মপাসাঁ ছোটগল্পে আদি গল্পগুরু বাল্মীকি। সবাই তারই রাজেন্দ্র সঙ্গমে, দীন যথা যায় দূর তীর্থ দরশনে।
***
বাংলা সাহিত্যে মপাসাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ শিষ্য প্রভাত মুখোপাধ্যায়। তিনি ফরাসি জানতেন কি শৈলী-আলোচনায় সে প্রসঙ্গ অবান্তর। তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তস্য শিষ্য রবীন্দ্রনাথ পড়েছিলেন এবং এদের মাধ্যমে মপাসাঁ’র শরণ নিয়েছিলেন। বাঙলা দেশের কোনও গল্পলেখকই প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের মতো মপাসাঁ’র এত কাছে আসতে পারেনি। মপাসাঁ’র মতো প্রভাতের ছিল সমাজের নানা শ্রেণি, নানা চরিত্র, নানা পরিস্থিতি নিয়ে নবীন নবীন গল্প গড়ে তোলার অসীম ক্ষমতা। মপাসাঁ’র মতো তিনিও কয়েকখানি উপন্যাস লিখেছিলেন। সেখানেও দু জনের আশ্চর্য মিল। ঔপন্যাসিক রূপে মোস ফ্রান্সে বিশেষ কোনও সম্মান পাননি; বাঙলা দেশে প্রভাত মুখোপাধ্যায়েরও সেই অবস্থা।
এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ নিবেদন, প্রভাত-পরবর্তী যুগের প্রায় সব বাঙালি গল্প-লেখকই মপাসাঁ’র অনুকরণ করেছেন প্রভাতের মাধ্যমে।
***
এই সময়ে ‘ভারতী’কে কেন্দ্র করে শক্তিশালী এক নতুন কথাসাহিত্যিক গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়। এ গোষ্ঠী অহরহ অনুপ্রেরণা পেত জ্যোতিরিন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। এঁদের ভিতর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সত্যেন্দ্র দত্ত, চারু বন্দ্যোপাধ্যায়, মণি গাঙ্গুলী ও সৌরীন্দ্র মুখোপাধ্যায়। এঁরা প্রধানত ফরাসি সাহিত্য থেকে অনুপ্রেরণা সঞ্চয় করে বাঙলা দেশে এক নতুন ফরাসিস ‘গুলস্তান’ বানাতে আরম্ভ করলেন। এঁদের একটা মস্ত সুবিধে ছিল এই যে, এঁরা রবীন্দ্রনাথের গড়া আধুনিকতম বাঙলার সম্পূর্ণ ব্যবহার করবার সুযোগ পেয়েছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সে সুযোগ পাননি বলে তাঁর ভাষা ছিল বিদ্যাসাগরী। এঁরা রবীন্দ্রনাথের সাবলীল ভাষা ব্যবহার করাতে তখনকার দিনের বাঙালি পাঠকের মর্মদ্বারে দরদী আঘাত হানতে পেরেছিলেন।
সবচেয়ে ‘তাজ্জব ভেল্কিবাজি’ দেখালেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। তা-ও আবার কাব্যে। এক ভাষার কবিতা যে অন্য ভাষাতে তার আপন রূপরসগন্ধস্পর্শ নিয়ে এরকমভাবে প্রকাশ পেতে পারে এর কল্পনাও বাঙালি পাঠক এর পূর্বে কখনও করতে পারেনি। সত্যেন্দ্রনাথের পূর্বে কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, হেম বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, এমনকি রবীন্দ্রনাথও বিদেশি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন কিন্তু এক ‘সম্ভাবশতক’ ছাড়া অন্য কোনও বই জনপ্রিয় হতে পারেনি। স্বামী বিবেকানন্দ নাকি বলেছেন, অনুবাদ মাত্রই কাশ্মিরি শালের উল্টোদিকের মতো; মূল নকশার সন্ধান হাতে পাওয়া যায় বটে, কিন্তু আর সব সৌন্দর্য উল্টো পিঠে ওতরায় না। সত্যেন্দ্রনাথ দেখিয়ে দিলেন, ওতরায়, এবং মাঝে মাঝে উল্টোদিকটাও মূলের চেয়ে বেশি মূল্য ধরতে জানে।
যাঁরা সত্যেন্দ্র দত্তের অনুবাদ মূলের সঙ্গে মিলিয়ে পড়েছেন তাঁরাই আমার কথায় সায় দেবেন। অন্যতম বিখ্যাত অনুবাদক কান্তি ঘোষ বহুবার একথা বলেছেন। তিনি নেই। তাই আজকের দিনের সবেধন নীলমণি নরেন্দ্র দেবকে আমি সাক্ষী মানছি।
তোয়েফিল গতিয়ে, রঁসার ল্যকঁৎ দ্য লিল, ভেরলেন, বদলের, য়ুগো (Hugo), শেনিয়ে, মিস্ত্রাল, ভেরেরেন, ভালমোর, বেরাজেঁ–কত বলব?–কত না জানা-অজানা কবির কত না কবিতা দিয়ে তিনি তাঁর কুম্ভ ‘তীর্থ সলিল’ পূর্ণ করলেন, কত দেশের কত ‘তীর্থরেণু’ বাঙালির কপালে ছুঁইয়ে দিলেন।
ঋগ্বেদে আছে, হে অগ্নি, তুমি আমাদের পুরোহিত, কারণ তুমি আমাদের সর্ব আহুতি দেবতাদের কাছে নিয়ে যাও। সত্যেন্দ্রনাথ বহু দেশের বহু কবির পুরোহিত।
***
কথাসাহিত্যেও ওই সময়ে প্রচুর ফসল ফলল। গতিয়ে, য়্যুগো, মেরিমে, দোদে, মপাসাঁ, দ্যুমা, বালজাক ইত্যাদি বহু লেখকের বহু ছোটগল্প এবং উপন্যাসও বাঙলায় অনূদিত হল। এ গোষ্ঠীর কার্যকলাপ বাঙলা সাহিত্যে কতখানি স্থায়ী মূল্য ধরে তার বিচার একদিন হবে; উপস্থিত বলতে পারি এঁরা বাঙলা সাহিত্যে যে ফরাসি উদারতার আমন্ত্রণ জানালেন তার ফলে পরবর্তী যুগের বাঙালি লেখক গোড়ার থেকেই সঙ্কীর্ণতামুক্ত হয়ে সাহিত্যের আরাধনা করতে পেরেছিলেন। হঠাৎ একদিন বাঙলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্রের আবির্ভাবের ফলে এঁদের লোকপ্রিয়তা ক্রমে ক্রমে কমে গিয়ে একদিন সম্পূর্ণ লোপ পায়। কিন্তু শরতের মোহ কেটে যাওয়ার পর আজ পর্যন্ত কেন যে কেউ এঁদের হেমন্তের সফলতা সন্ধান করে না সে এক আশ্চর্যের বস্তু।
***
বাঙলায় ফরাসি সাহিত্য প্রসঙ্গে শুধু প্রমথ চৌধুরী সম্বন্ধে পূর্ণাঙ্গ একটি প্রবন্ধ লিখতে হয়। ইনিই একমাত্র বাঙালি সাহিত্যিক যাঁকে সর্বার্থে ফরাসিস আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। একমাত্র এরই ভাষাটিতে ইভনিং ইন প্যারিসের খুশবাই পাওয়া যায়। এঁর শৈলী ফরাসি শ্যাম্পেনের মতো বুদ্বুদিত, ফেনায়িত। এমনকি এর বিষয়বস্তুও মাঝে মাঝে ফরেসডাঙার ধুতি পরে মজলিসে এসে বসে। বাংলা সাহিত্যে বহু পণ্ডিত, বহু দার্শনিক, বহু কলাবিদ এসেছেন, কিন্তু একমাত্র এঁকেই সত্য বিদগ্ধজন বলা যেতে পারে। এবং সে বৈদগ্ধ্য ফরাসি বৈদগ্ধ্য।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ফরাসিদের সঙ্গে বাঙালির চারি চক্ষের মিলন ঘটিয়েছিলেন; প্রমথনাথে দুই সাহিত্যের গভীরতম প্রণয়ালিঙ্গন।
এঁর সাহিত্যসৃষ্টি হয়তো বাঙলা দেশ একদিন ভুলে যাবে কিন্তু এই বাঙালি ফরাসিস চরিত্রকে বাঙালি কখনও ভুলবে না।
প্রমথনাথের শেষ বয়সে ভারতীয় গোষ্ঠীর মুমূর্ষ অবস্থায় রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে ফরাসি পণ্ডিত সিলভা লেভি এদেশে আসেন। তাঁর চতুর্দিকে তখন এক ফরাসি পণ্ডিতমণ্ডলীর সৃষ্টি হয়। এঁদের প্রধান ফণী বোস(৩), প্রবোধ বাগচী, মণি গুপ্ত, শশধর সিংহ, বিধুশেখর ভট্টাচার্য, ক্ষিতিমোহন সেন। এঁদের কেউই প্রচলিতাৰ্থে সাহিত্যে নামেননি কিন্তু এঁদের মাধ্যমে আমরা এদেশে সর্বপ্রথম ফরাসি পাণ্ডিত্যের সন্ধান পাই। এতদিন আমরা জানতুম, ইয়োরোপীয় ‘প্রাচ্য-বিদ্যামহার্ণব’ বলতে বোঝায় ইংরেজ। এরা প্রথম দেখিয়ে দিলেন, ফরাসি ভারতবর্ষে ব্যাপকভাবে রাজত্ব না করেও ভারতীয় শাস্ত্রের চর্চা করেছে প্রচুর।(৪) বিশেষ করে আমাদের চিত্রকলা সঙ্গীতাদি। প্রবন্ধের গোড়ার দিকেই বলেছি সাহিত্য ছাড়া অন্য রসে ইংরেজ বঞ্চিত। ফরাসিরা সেখানে যথার্থ গুণী। মণি গুপ্তের অনুবাদে বাঙালি তার সন্ধান পাবে। শান্তা দেবী এই সময়েই বিশ্বভারতীতে ফরাসি শেখেন।
এই গোষ্ঠীর বাইরে আর দু জন পণ্ডিতের নাম করতে হয়। মুহম্মদ শহীদুল্লা এবং সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। দিলীপ রায় আর কালিদাস নাগও এই যুগের লোক।
***
কিন্তু আমাদের জোড়া কুতুব-মিনার? বঙ্কিম এবং রবীন্দ্রনাথ? তা হলে দীর্ঘতম প্রবন্ধ লিখতে হয়। এ যুগের ঋষি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, imitation-এর বাঙলা অনুকরণ; aping-এর বাংলা কী? ‘হনুকরণ’! যাঁরা ফরাসির ‘হনুকরণ’ করেন তাঁদের উল্লেখ আমি এ প্রবন্ধে করিনি। পদস্খলন সকলেরই হয়। পূর্বোল্লিখিত লেখকদের কেউ কেউ হয়তো অজানাতে মাত্রাধিক্য করেছেন কিন্তু এ দুটি লোক সম্বন্ধে অধম নিঃসংশয়।
বঙ্কিম কিঞ্চিৎ ফরাসিস জানতেন। কিন্তু তিনি ইংরেজির মাধ্যমে কঁৎ-কে চিবিয়ে খেয়েছিলেন। পূর্বসূরিগণের প্রসাদাৎ কঁৎ ফরাসি তর্কালোচনায় যে শুভবুদ্ধির (rationality-র) চরমে পৌঁছেন, বঙ্কিম সেই শাণিত অস্ত্র নিয়ে হিন্দুধর্ম রণাঙ্গনে প্রবেশ করেন। এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে তার সবিস্তর আলোচনা অসম্ভব। তাই এই আক্ষেপ দিয়েই বঙ্কিমালোচনা শেষ করি, হায়, তাঁর এই শুভবুদ্ধির অনুসরণ আর কেউ করল না কেন? যে লোক ইস্তেক দয়াসাগরের খেলাফে তলোয়ার খাড়া করেছিল তার অনুকরণ অনুসরণ, এমনকি ‘হনুকরণ’ও কেউ করল না কেন?
রবীন্দ্রনাথের ওপর মপাসাঁর ছায়া পড়েছিল সেকথা পূর্বেই বলেছি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সহকর্মীরূপে তিনি ফরাসি কবিতানাট্য এমনকি ‘শারাদ’-ও পড়েছিলেন। তারই ফলে–
Celui qui me lira, dans les
siecle, un soir,
Troublant mes vers
ইত্যাদি ইংরেজিতে শব্দে শব্দে অনুবাদ :
One who will read me, after centuries, one evening, turning over my verses
‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ হয়ে বেরুল। কিন্তু প্রথম কয়েক ছত্রের পরেই রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে চলে গিয়েছেন।
ঠিক সেই সময় মেটারলিঙ্কের ‘নীলপাখি’ যে কাঠামোতে(৫) লেখা রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’, ‘অরূপরতন’ সেই কাঠামো নিয়ে, কিন্তু উভয় নাটকের বিষয়বস্তু নির্বাচনে এবং রসনির্মাণে রবীন্দ্রনাথ মেটারলিঙ্ককে অনেক পিছনে ফেলে গিয়েছেন। এবং সর্বশেষ নাটকদ্বয় ‘মুক্তধারা’ এবং ‘রক্তকরবী’-র কাঠামোও রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ নিজস্ব ভাষা, শৈলী, রসনির্মাণ পদ্ধতি রাবীন্দ্রিক তো বটেই।
আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, অরবিন্দ ঘোষ (ইনি উত্তম ফরাসি জানতেন)– এঁদের মতো প্রতিভাবান লেখকের রচনাতে এর প্রভাব, ওঁর ছায়াপাতের অনুসন্ধান করে কোনও লাভ নেই। হীনপ্রাণ লেখক সর্বক্ষণ ভয়ে মরে, ওই বুঝি লোকে ধরে ফেলল, সে অমুকের কাছ থেকে ধার নিয়েছে; তাই সে মহাজনদের বাড়ির ছায়া মাড়ায় না। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ নিজেরাই এত বড় মহাজন যে, তারা যত্রতত্র অনায়াসে বিচরণ করেন। ক্ষুদ্রতম লেখকের বাড়িতেও পাত ফেলতে তাদের কণামাত্র ভয় নেই। তাদের ঘানিতে যাই ফেল না কেন, স্নেহঘন হয়ে বেরিয়ে আসবে।
এইবারে শেষ প্রশ্ন : ফরাসির ওপর বাঙলা কোনও প্রভাব ফেলতে পেরেছে কি?
রলাঁ যেরকম বহু বাঙালি লেখককে প্রভাবান্বিত করেছেন, ঠিক তেমনি, তিনিও বাঙালি গুণী-জ্ঞানীদের সন্ধান রাখতেন। ব্রাহ্ম আন্দোলন, শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তার জ্ঞান এবং এঁদের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। বহু ফরাসি এঁরই মারফতে বাঙলা দেশের অনেক কিছু চিনতে শিখেছে।
পূর্বেই বলেছি, লেভির সঙ্গ পেয়ে বাঙালি গুণী ফরাসি পাণ্ডিত্যের চর্চা করেছিল। লেভি নিজে করলেন উল্টোটা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গ পেয়ে তাঁর সাহায্যে করলেন ‘বলাকা’র ফরাসি অনুবাদ। আজ যদি শুনি, পাণিনি কোনও এক চীনা কবির রচনা সংস্কৃতে অনুবাদ করেছিলেন তা হলে যেরকম আশ্চর্য হব।
শ্রীমতী আঁদ্রে কারপেলেজ ফরাসিতে একখানা সঞ্চয়িতা বের করেন। তার নাম ‘ফ্যই দ্যা ল্যাঁদ’—’লিভজ অব ইন্ডিয়া’। এই চয়নিকায় বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য নিয়েই আলোচনা ছিল প্রধানত। দুর্ভাগ্যক্রমে বইখানা আমার হাতের কাছে নেই।
এবং নেই, শান্তিনিকেতনে ফরাসি ভাষার প্রাক্তন অধ্যাপক ফের্না বেনওয়ার রচনাবলি। অমিয় চক্রবর্তীর সহযোগিতায় তিনি ‘মুক্তধারা’র ফরাসি অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন ‘লা মাশিন’ (দি মেশিন) নাম দিয়ে। এর পরবর্তী যুগে বাঙলা সম্বন্ধে আরও বিস্তর লেখা ফরাসিতে প্রকাশ ও প্রচার করেছিলেন।
এবং মারাত্মক নেই, রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে ফরাসি প্রেসের অভিমত, অভ্যর্থনা, অকুণ্ঠ প্রশংসা। রবীন্দ্রনাথ যতবার ফ্রান্সে গিয়েছেন, যখনই তার চিত্রকলার প্রদর্শনী হয়েছে, ফ্রান্স তখনই বাঙলা দেশ সম্বন্ধে সচেতন হয়ে তাঁকে স্বীকার করেছে। প্যারিসে স্বীকৃতি পাওয়া সহজ কর্ম নয়– এসব প্রেস-কাটিংস্ অনুসন্ধিৎসু পাঠক শান্তিনিকেতন লাইব্রেরিতে পাবেন। সে এক বিরাট ব্যাপার!
অর্থাৎ হাতের কাছে কিছুই নেই– ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই’—
তাই আর কেউ বলার পূর্বেই স্বীকার করে নিই, এ লেখা সম্পূর্ণ অসম্পূর্ণ।
————
১. বরঞ্চ গৌর বসাককে লেখা চিঠিগুলোতে প্রচুর ফরাসি ফ্রিভলিটি পাবেন।
২, হেমচন্দ্র বিস্তর শেক্সপিয়র অনুবাদ করেছিলেন, কিন্তু বাঙলাতে আজ পর্যন্ত কেউ শেক্সপিয়রের অনুকরণ করেননি।
৩. ইনি যৌবনেই দেহত্যাগ করেন, কিন্তু এঁর রচনা তখনই বাঙালির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
৪. পরবর্তী যুগে ভিটারনিৎস জর্মন পাণ্ডিত্যের সঙ্গে এবং তুচ্চি ইতালির পাণ্ডিত্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটান। এঁদের সবাই এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে, বিশ্বভারতীতে।
৫. ‘লোয়াজো ব্ল্য’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাঙলায় অনুবাদ করেন।
ফিল্মের ভাষা
থিয়েটারের কপাল মন্দ, পাঠান-মোগলের আপন দেশে ওটার রেওয়াজ নেই। তাই পাঠান রাজারা এদেশে জমে বসার পর গাইয়ে-বাজিয়েদের ডেকে পাঠালেন, পটুয়াদেরও ডাক পড়ল, নাচিয়েরাও বাদ গেল না আর এমারত বানানেওলাদের তো কথাই নেই। সংস্কৃত যদি তখন এ দেশের চালু এবং সহজ ভাষা হত তা হলে সংস্কৃত নাট্যও যে বাদশার দরবারে কদর পেত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কারণ হিন্দি কদর পেয়েছিল এবং এ দেশে বাঙলা কদর পাওয়ার ফলে পরাগল খান, ছুটি খানের মহাভারত লেখা হয়েছিল।
সংস্কৃতে লেখা আমাদের নাট্য ঠিক মুসলিম আগমনের শুরুতে এদেশে কতখানি চালু ছিল বলা কঠিন। ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা বলেন, সংস্কৃত তখন মৃত ভাষা, ওসব নাট্য তখন প্রায় উঠে গিয়েছে। আমি কিন্তু কিঞ্চিৎ ভিন্নমত পোষণ করি।
পূর্বেই স্বীকার করেছি, পাঠান আমলে সংস্কৃত মৃত ভাষা, কিন্তু সংস্কৃত নাটক তো সম্পূর্ণ সংস্কৃতে লেখা হয়। তুলনা দিয়ে কথাটা পরিষ্কার করি।
শেক্সপিয়র জানতেন, তিনি রাজা-রাজড়া এবং শিক্ষিতজনদের জন্যই আপন নাটক লিখছেন। কিন্তু অন্য একটি তত্ত্বও বিলক্ষণ জানতেন যে তাঁদের সংখ্যা কম, এবং বেঞ্চি গ্যালারি ভরভরাট করে নাটকটাকে জম-জমাট করে তোলে টাঙাওলা-বিড়িওয়ালার দল। কাজেই তাঁর নাটকে ওদেরই মতো চরিত্র ওদেরই ভাষায় কথা কয়, বিশেষ করে ভাঁড়টি সবসময়ই রাজা-প্রজা দু দলকেই খুশি করতে জানে।
ঠিক সেইরকম গুপ্ত যুগের কালিদাসও জানতেন যে, তাঁর যুগের ‘টাঙাওলা’ ‘বিড়িওলা’ সংস্কৃত বোঝে না, অথচ রাজা-রাজড়ারা নাটক চান সংস্কৃতে। ওদিকে তিনি শেক্সপিয়রের মতো বুঝতেন যে, জনসাধারণকে খুশি না করে কোনও নাটকই বক্স-আপিস ভরতে পারে না। গোলাপফুল খাপসুরৎ জিনিস। কিন্তু পাতা-কাঁটা ওটাকে খাড়া করে না ধরলে ওটা শুধু শূন্যে শূন্যে ঝুলতে পারে না। তাই তিনি তাঁর নাটকে ব্রাহ্মণ আর রাজা ছাড়া আর সবাইকে দিয়ে কথা কওয়াতেন তখনকার দিনের চালু ভাষা প্রাকৃতে। আর শুধু কি তাই? রাজার সংস্কৃতে শোধানো প্রশ্নের উত্তর দাসী যখন প্রাকৃতে দিত তখন কালিদাস তার উত্তরের ভিতর রাজার প্রশ্নটি এমনভাবে জড়িয়ে দিতেন যে সংস্কৃত না-জাননেওলা শ্রোতাও দুই পক্ষের কথাই পরিষ্কার বুঝে যেত। দাসীর তুলনা দিয়েই যদি জিনিসটা বোঝাতে হয় তবে বলতে হবে, ‘এ যেন বাঁদীকে ঠেঙিয়ে বিবিকে সোজা রাখা’র মতো রাজা এবং প্রজা উভয় দর্শককে সোজা রাখা।
তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কালিদাসের নাটক সর্বজনপ্রিয় ছিল।
তার পর প্রশ্ন উঠতে পারে, ঠিক মুসলমান আগমনের প্রাক্কালে জনসাধারণ কি কালিদাসের আমলের প্রাকৃত বুঝত? এ প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো এলেম আমার পেটে নেই। তবে তার এক শ বছর পেরোবার পূর্বেই আমির খুসরৌ যে-হিন্দি ব্যবহার করেছেন সে হিন্দি অনেকটা ওই প্রাকৃতের মতোই। এবং এখানে আরও একটি কথা আছে। জনসাধারণ ততদিনে কালিদাসের নাটক দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে, এবং নিরক্ষর দর্শক একটা ফিলিম তিনবার দেখবার পর যে কতখানি মনে রাখতে পারে সেকথা শিক্ষিত জন জানেন না। আমার এক চাকর (বস্তুত এই গণতন্ত্রের ইনকিলাবি যুগে ‘মনিব’ বলাই ভালো) পাড়াতে নয়া ছবি এলেই একটানা সাত দিন ধরে সেই ছবি দেখতে যেত। আমি অবাক হয়ে ভাবতুম, নাগাড়ে সাতদিন ধরে একই ছবি দেখে কী করে? পরে তার গুনগুনোনি থেকে বুঝলুম, ছবির চৌদ্দখানা গানই সে রপ্ত করতে চায় এবং করে ফেলেছেও। অনেক হিন্দি গানের বিস্তর কথা না বুঝতে পেরেও! অবশ্য আমার এ মন্তব্যে ভুল থাকতেও পারে। কারণ আমি এ জীবনে তিনখানা হিন্দি ছবিও দেখিনি এবং অন্য কোনও পুণ্য করিনি বলে এই পুণ্যের জোরেই স্বর্গে যাব বলে আশা রাখি। তবে বলা যায় না, সেখানে হয়তো হিন্দি ছবি দেখতে হবে। কারণ এক ইরানি কবি মহাপ্রলয়ের পরে যে শেষ বিচার হবে তারই স্মরণে অনেকটা এই ভয়ই করেন–
‘শেষ-বিচারেতে খুদার সমুখে দাঁড়াব তো নিশ্চয়,
মানুষের মুখ আবার দেখিব। এইটুকু মোর ভয়।’
‘মরা ব রূজ-ই কিয়ামৎ গামি কি হস্ত ঈন অস্ত
কি রু-ই মরদুমে আলম দুবারা বায়দ দীদ।’(১)
যদি প্রশ্ন শোধান সে কী করে হয়?– তুমি হিন্দি ফিলিম্ বর্জন করার পুণ্যে স্বর্গে গেলে, সেখানে আবার তোমাকে ওই ‘মাল’ই দেখতে হবে কেন? তবে উত্তরে নিবেদন, কামিনীকাঞ্চনসুরা বর্জন করার ফলে আপনি যখন স্বর্গে যাবেন তখন কি ইন্দ্রসভায় ওইগুলোরই ছড়াছড়ি দেখতে পাবেন না?
তখন যদি আপনি এক কোণে মুখ গুমড়ো করে বসে থাকেন তবে কি সেটা খুব ভালো দেখাবে?
থাক্। কোথা থেকে কোথা এসে পড়লুম! মূর্খকে চটালে এই তো বিপদ! আবোল-তাবোল বকে।
মোদ্দা কথা এই, পাঠান-মোগল যুগে নাট্যাভিনয় রাজানুকম্পা পেল না বলে আমরা এখন তার খেসারতি ঢালছি। এবং দ্বিতীয় কথা– নাট্যে, ফিলিমে ভাষা জিনিসটাকে অবহেলা করলে ক্ষতি হয়। এমনকি যদিও বহু গুণী বলে থাকেন, ‘সাইলেন্স ইজ গোল্ডেন’ তবু সাইলেন্ট ফিলিম চলল না। বাঙলা ফিলিম যখন সেই সাইলেন্স্ ভাঙল তখন থেকে আজ পর্যন্ত যে ভাষা সে বলল তারই দিকে এ-প্রবন্ধের নল চালনা।
সাত শ বছর পরে ইংরেজ আমলে হল ঠিক তার উল্টো। কলাজগতে ইংরেজের প্রধান সম্পদ তার থিয়েটার। শেক্সপিয়রের মতো নাট্যকার নাকি পৃথিবীতে নেই। ইংরেজ বলল, ‘চালাও থিয়েটার।’ কিন্তু প্রশ্ন, কে করবে থিয়েটার?
ইতোমধ্যে বাঙালি বিলেত যেতে আরম্ভ করেছে। সেখানে একাধিক নেশার সঙ্গে সে থিয়েটারের নেশাটাও রপ্ত করে এল।
বাঙলা গদ্য এবং পদ্য তখন দুই-ই বড় কাঁচা।
আর জনসাধারণের ভাষা? তারও মা-বাপ নেই। একদিকে শেষ মোগলের ফারসি-উর্দুর শেষ রেশ, অন্যদিকে সুলতানুটি-গোবিন্দপুরের ঐতিহ্যহীন স্ল্যাঙ-দুয়ে মিলে তার যা চেহারা সেটা কিছুদিন পরে পাওয়া যায় হুতোমের নকশায়। অন্যদিকে বিদ্যাসাগরের অতি ভদ্র অতি মার্জিত ভাষা।
এ যুগের নাটকের ভাষা তাই শব্দতত্ত্বের স্বর্গভূমি। কিন্তু নাটকে যে স্বচ্ছন্দ ভাষার প্রয়োজন তার বড়ই অভাব। সব নাট্যকারই যেন ঠিক মানানসই ভাষাটির জন্য চতুর্দিকে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।(২)
মাইকেলের পৌরাণিক নাট্যে বিদাসাগরি ভাষা; তাঁর ‘একেই কি বলে সভ্যতা’তে কলকাতার স্ল্যাঙ; ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’তে গ্রামাঞ্চলের একাধিক ভাষা; এবং দীনবন্ধু মিত্রের ভাষাতে বিদ্যাসাগরি ও গ্রাম্য দুই-ই।
‘নীলদর্পণ’ সে যুগের বাঙলার বেদনা প্রকাশ করেই যে বিখ্যাত হয়েছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু আমার মনে হয়, বিদ্যাসাগরি ভাষা ও মুসলমান চাষার ভাষা এ দুয়ের সম্মেলনও তার জন্য অনেকখানি দায়ী। অবশ্য শুধুমাত্র ভাষার বাহার যদি শুনতে চান তবে ‘বুড়ো শালিকে’র মতো নাটক হয় না। হিন্দু গৃহস্থ, হিন্দু চাকর, মুসলমান চাষা, চাষার বউ, হিন্দু দাসী এদের সকলের আপন আপন ভাষার সূক্ষ্মতম পার্থক্য মাইকেল যে কী কৃতিত্বের সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন তার তুলনা বাঙলা সাহিত্যে কোথাও নেই। নাটক হিসেবে এ বই উত্তম– সাহিত্য হিসেবে ভাষার বাজারে এ বই কোহিনূর।
অবাঙালির জন্য পারসি থিয়েটার কবে প্রতিষ্ঠিত হয় আমি ঠিক জানিনে, কিন্তু বিস্তর বাঙালিও সেখানে যেত ও উর্দু-গুজরাটিতে মেশানো নাটক বুঝতে যে তাদের বিশেষ অসুবিধে হত না সে-তথ্য কিছু অজানা নয়। ‘ছি ছি এত্তা জঞ্জাল’ জাতীয় জনপ্রিয়, বাঙলা-উর্দুতে মেশানো খিচুড়ি ঠাট্টা ব্যঙ্গের ভাষা কিছুটা হুতোম আর কিছুটা পারসি থিয়েটারের কল্যাণে।
ইতোমধ্যে ভাষাসমস্যার অনেকখানি সমাধান হয়ে যায় বঙ্কিমের কল্যাণে। বঙ্কিমের ভাষানির্মাণে কোন কোন উপাদান আছে সেকথা আজ স্কুলের ছেলে পর্যন্ত জানে। ডি.এল. রায় শ্রেণি এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন।
এইখানে এসে আমাদের সবাইকে– বিশেষ করে রবীন্দ্র-শিষ্যদের একটু বিপদে পড়তে হয়। রবীন্দ্রনাথের চলতি ভাষা যে তার ছোটগল্প-উপন্যাসের মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন কথ্য ভাষাকে প্রভাবান্বিত করেছে সেকথা আমরা সবাই জানি, এবং তার প্রভাব যে আমাদের রঙ্গমঞ্চেও পড়েছে সে-ও প্রতি মুহূর্তে কানে বাজে। কিন্তু আমার মনে হয় তার নাটকের ভাষা এত বেশি মার্জিত, এত বেশি সূক্ষ্ম যে নাট্যশালার আটপৌরে কাজ তা দিয়ে চালানো যায় না। তাই বোধহয় তাঁর নাটকের মূল্য সাহিত্য হিসেবে যত না সম্মান পেয়েছে এবং পাবে, নাট্য হিসেবে ততখানি পায়নি, পাবে কি না সন্দেহ।
***
গোড়ার দিকে ফিলিমের কোনও দুশ্চিন্তা ছিল না। কারণ সে তখন ভাষণ না করে শোভা বর্ধন করত। টকি আসার সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাশীল চিত্ৰচালককেই মনস্থির করতে হল টকির ভাষা ও উচ্চারণ হবে কী? এ মুশকিলের একটা অতি সহজ সমাধান আছে। শরত্যাবুর ‘নিষ্কৃতি’ করতে হলে তার ডায়ালগের ভাষা দিলেই হল। এর আর ভাবনা কী?
মুশকিল আসান অত সহজ না। প্রথমত কোনও কোনও বর্ণনা ডায়ালগে প্রকাশ করতে হয়; তখন উপায়? সেটা তৈরি করে দেবে কে? সে কলম আছে কার? রবীন্দ্রনাথের বারোটি গান নিয়ে যখন দম্ভী লেখকেরা মাঝখানে মাঝখানে ‘আপন’ গদ্য জুড়ে দিয়ে কিমপিয়ার (কঁপের) করেন, এবং দুই পাকা গানের মাঝখানে সেই কাঁচা বাঙলা শুনতে হয় তখন মনে হয়, না, থাক বাবা, বাড়ি যাই?
কিন্তু সেইটেই প্রধান শিরঃপীড়া নয়। আসল বেদনা অন্যখানে। বইয়ের লেখা ডায়ালগ আর সিনেমায় উচ্চারিত কথাবার্তা এক জিনিস নয়। বই বন্ধুজনের সঙ্গে পড়ে শোনানো যায় তার পাল্লা অদূর অবধি। নাট্যে, পর্দায় সেটা অত্যধিক সাহিত্যিক। অবশ্য নিছক ফিলিমের জন্য লেখা রাবিশের কথা এখানে হচ্ছে না।
অন্যদিকে সিনেমার ভাষাতে যদি কোনও সাহিত্যিক মূল্যই থাকে তবে সে ইসথেটিক পর্যায়ে উঠতে পারবে না। এই হল আমাদের দু-মুখো সাপ, ডিলেমা, প্যারাডকস– যা খুশি বলতে চান বলুন।
প্রথম যখন মানুষ পাথরের বাড়ি তৈরি করতে শিখল তখন পূর্বতর যুগের কাঠের বাড়ির অনুকরণে পাথরের বাড়ি তৈরি করত; বাঙলা দেশে হঁট চালু হওয়ার পর প্রথমটায় সে খড়ের চাল অনুকরণ করেছে; বেতারের বয়স হয়েছে– এখনও সে নাটক করার সময় ‘থিয়েডারে’র (থিয়েটারের নয়) অনুকরণ করে– ফিলিম কেন অনুকরণ করতে যাবে?
————
১. The only thing which troubles me about the Resurrection day is this, That one will have to look once again on the faces of mankind.
২. শুনেছি সর্বপ্রথম নাকি এক রাশান এদেশে থিয়েটার করেন। তিনি তখন ইংরেজের পৃষ্ঠপোষকতা কতখানি পেয়েছিলেন, তার প্রভাব পরবর্তী যুগের বাঙলা থিয়েটারে কতখানি পড়েছিল, এসব প্রশ্ন ভাষার বিচারে অবান্তর।
বেজো না চরণে চরণে
বিখ্যাত সাহিত্যিকদের কাছে নাকি নবীন সাহিত্যিকরা তাঁদের লেখা নিয়ে গিয়ে চাইদের সার্টিফিকেট চান। বেচারিদের বিশ্বাস, চাঁইরা উত্তম সার্টিফিকেট দিলে সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি-প্রতিপত্তি পেয়ে যাবেন।
চাঁইদের কেউ-কেউ সার্টিফিকেট দেন, কেউ লেখকদের অন্য চাঁইদের কাছে পাঠিয়ে দেন, কেউ-বা অসুখের ভান করে দেখাই করেন না। এ বাবদে পূজনীয় রাজশেখরবাবু রাজকীয় পন্থাটি বের করে আরামসে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি সবাইকে অকাতরে সার্টিফিকেট দেন– এমনকি মাঝে-মধ্যে না চাইলেও দেন। তাঁর বয়স হয়েছে। শেষের কটি দিন শান্তিতে কাটাতে চান। সোজাসুজি ‘দেব না’ বললে তাঁকে আর বাঁচতে হবে না, এবং ‘দেব-দিচ্ছি, দেব-দিচ্ছি’ করে টালবাহানা দেবার মতো শক্তিও তাঁর নেই। রবীন্দ্রনাথ অমিতবীর্য পুরুষসিংহবৎ ছিলেন, উমেদওয়ারদের ঠেকাবার মতো তাঁর সেক্রেটারিও ছিলেন– তবু তিনিও অকাতরে সার্টিফিকেট দিতেন। প্রাণের প্রতি তাঁর অহেতুক কোনও মায়াও ছিল না- ‘মরণ রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান’, এ গান তিনি রচেছেন অল্প বয়সেই– তবু তিনি ‘না-চাহিতে যারে দেওয়া যায়’ ভাবখানা মুখে মেখে পিলপিল করে সার্টিফিকেট বিলোতেন। আমাকে পর্যন্ত তিনি একখানা দিয়েছিলেন– অবশ্য সাহিত্যের জন্য নয়, চাকরির জন্য। আমি তাঁর ‘কৃতী ছাত্র’ এ ধরনের বহুবিধ আগড়ম-বাগড়ম লিখে তিনি আমাকে শ্যামাপ্রসাদবাবুর কাছে পাঠিয়েছিলেন। শ্যামাপ্রসাদবাবু বিচক্ষণ লোক; তিনি আমাকে চাকরি দেননি। অন্যত্র চেষ্টা করার জন্য সার্টিফিকেটখানা ফেরত পেলুম না– কারণ চিঠিখানা ছিল নিতান্ত প্রাইভেট এবং পার্সনাল। শ্যামাপ্রসাদবাবু সার্টিফিকেটের মূল্য না দিলেও রবিবাবুর হাতের লেখা চিঠির মূল্য জানতেন। চিঠিখানা সযত্নে শিকের হাঁড়িতে তুলে রেখে দিয়েছিলেন।
এবং যাঁরা কিছুতেই সার্টিফিকেট দিতে রাজি হন না, তাঁদের দু একজনকে আমি চিনি। এবং একথাও বিলক্ষণ জানি, তাঁরা যেসব বইয়ের সার্টিফিকেট দেওয়া দূরে থাক, গালিগালাজ পর্যন্ত করেছেন তারই অনেকগুলো বাজারে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছে। রাজশেখরবাবুর ‘দুই সিংহ’ গল্পে আছে কোনও লেখক তার বই কিছুতেই বিক্রি হচ্ছে না দেখে কোনও এক বাঘা সাহিত্যিককে ঘুষ দিয়ে লিখিয়ে নেয়, বইখানা অতিশয় অশ্লীল এবং কদর্য। ফলে নাকি সে বইয়ের প্রচুর কাটতি হয়েছিল।
কিন্তু এসব শোনা কথা, কিংবা কাল্পনিক। রবিবাবু টাকের ওষুধের প্রশংসা করাতে ওষুধের বিক্রি বেড়েছিল কি না তার সঠিক স্টাটিটিস্ এখনও দেখিনি। উল্টোটাও সঠিক জানবার উপায় নেই। এ যেন আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো। বেতারে আলিপুর বলল, ‘সন্ধ্যায় বৃষ্টি হবে।’ আপনি অবিশ্বাস করে ছাতা না নিয়ে বেরুলেন। ফিরলেন ভিজে ঢোল হয়ে। তবেই দেখুন, এমনি লক্ষ্মীছাড়া দফতর যে, অবিশ্বাস করেও নিষ্কৃতি নেই, বিশ্বাস তো করা যায়ই না।
***
কিন্তু একখানা বই পড়ে আমি এ-সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ হদিস পেয়েছি।
বইখানার নাম ‘লিমিট অব আর্ট’। চল্লিশ টাকা দাম। ঢাউস মাল। কপিকল দিয়ে শেলফ থেকে ওঠাতে নাবাতে হয়।
কবিতার চয়নিকা। গ্রিক-লাতিন থেকে আরম্ভ করে, ফরাসি-জর্মন-ইংরেজি-স্প্যানিশ রুশ তাবৎ ইয়োরোপীয় ভাষা থেকে কবিতা সঞ্চয় করে এ চয়নিকাটি নির্মাণ করা হয়েছে।
গ্রন্থের ভূমিকায় সম্পাদক সবিনয় নিবেদন করেছেন, তিনি এ চয়নিকার মাধুকরী করার সময় নিজের ব্যক্তিগত রুচির ওপর নির্ভর করেননি। তবে কি তিনি বন্ধুবান্ধবদের রুচির ওপর নির্ভর করেছেন? তা-ও নয়। তিনি লিখেছেন বিখ্যাত প্রখ্যাত কবিরা যেসব অন্যান্য কবির কবিতার প্রশংসা করেছেন তাই দিয়ে তিনি এ সঞ্চয়িতা’ নির্মাণ করেছেন। যেমন মনে করুন, বায়রন বলেছেন ‘পোর্কের এ ছত্র কটি কী চমৎকার, কী অনির্বচনীয়!’ চয়নিকা-কার সেই কবিতাটি তুলে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আবার বায়রনের প্রশস্তিটিও তুলে দিয়েছেন। ঠিক এইভাবেই, শেকসপিয়র আছেন গ্যোটের প্রশংসাসহ, কিটস্ আছেন শেলির তারিফযুক্ত, এবং আরও বিস্তর চেনা-অচেনা কবি।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এর চেয়ে আর উত্তম ব্যবস্থা কী হতে পারে?
কিন্তু বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, এরকম রদ্দি, ওঁচা কবিতার সংকলন আমি জীবনে কোনও ভাষাতে কখনও দেখিনি।
এবং শুধু তাই নয়, পৃথিবীর সর্বোত্তম বেশ কয়েকটি কবিতা তাতে বাদ পড়েছে। তুলনা দিয়ে বলতে পারি, একবার এই বঙ্গভূমিতেই এ ঘটনা ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথের কোন কোন কবিতা বাঙালি পাঠকের ভালো লাগে তারই ভোট নিয়ে একখানি ‘চয়নিকা’ রচিত হয়েছিল। তাতে এত বেশি ভালো কবিতা বাদ পড়েছিল, এবং অপেক্ষাকৃত কাঁচা লেখা ঢুকে গিয়েছিল যে এরপর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যে চয়ন করেন সেটিই ‘সঞ্চয়িতা’ এবং বাজারে সেইটেই চালু। এস্থলে পাঠক অবশ্য বলবেন, ‘রাস্তার লোকের ভোট নিয়ে কি আর উত্তম কবিতা-সঞ্চয়ন হয়। ওদের কীই-বা বুদ্ধি, কীই-বা রুচি।’ অতএব যে বিদেশি চয়নিকা দিয়ে আরম্ভ করেছিলুম সেইটেতেই ফিরে যাই।
অর্থাৎ ভালো ভালো কবি কর্তৃক নির্মিত সঞ্চয়নও উত্তম হল না কেন?
তার প্রধান কারণ, সাধারণ এবং সুরুচিসম্পন্ন পাঠক কবিতা পড়ে কিংবা গান শুনে যদি আনন্দ পায় তবেই সে বলে, কবিতা কিংবা গানটি ভালো। অর্থাৎ তার কাছে যেকোনো বস্তু রসোত্তীর্ণ হলেই হল। কিন্তু কবি যখন অন্য কবির কবিতা পাঠ করেন তখন তাঁর নজর যায় কবিতার গঠন, ভাষা, ছন্দ, মিল– এক কথায় আঙ্গিকের দিকে। কবিতাটি রচনা করতে গিয়ে কবিতাকার কী কী মালমশলা নিয়ে আরম্ভ করেছেন, তাকে কোন কোন বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে সেগুলো তিনি কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন কি না পাঠক-কবির দৃষ্টি থাকে প্রধানত সেইদিকে। কিংবা মনে করুন, আপনি-আমি যখন গান শুনি তখন গানটি মিষ্টি এবং মর্মস্পর্শী হলেই হল। পক্ষান্তরে আকছারই দেখবেন, বদখদ গলা নিয়ে, বিকুটে মান্ধাতার আমলের একটা সম্পূর্ণ অজানা রাগ ধরল এক হাড়-চিমসে গাওয়াইয়া। তবলচিও বাজাতে লাগল এমন এক তাল যে তার কোথায় সম, কোথায় ফাঁক কিছুই মালুম হচ্ছে না। আপনি বিরক্তিতে উঠি-উঠি করছিলেন, এমন সময় দেখেন হঠাৎ মফিলের অন্য গাওয়াইয়া শ্রোতারা ‘আহা, আহা, ক্যাবৎ ক্যাবাৎ’ বলে অচৈতনি প্রায়। কী হল? ব্যাপারটা কী? না, এই ওস্তাদস্য ওস্তাদ এক অ্যাসন অতি-অতি কোমল এমন এক কঠিনস্য কঠিন জায়গায় লাগিয়ে দিয়ে অ্যাসা এক পানিপথ নাকি জয় করেছেন যা পূর্বে কেউ কখনও করতে পারেনি– না, তানসেন নাকি মাত্র দু বার পেরেছিলেন, ওস্তাদ আব্দুল করীম কুলে একবার! ব্যস, হয়ে গেল।
অবশ্য সব পাঠক-কবি কিংবা শ্রোতা-গাওয়াইয়াই যে শুদ্ধমাত্র আঙ্গিক এবং টেকনিকল স্কিলের দিকে এক-চোখা দৈত্যের মতো তাকিয়ে থাকেন সেকথা বলছি না– তবে ওই হল গিয়ে নিয়ম, এবং পূর্বোল্লিখিত ‘লিমিট অব আর্ট’ ওই পর্যায়ের বই।
সমসাময়িক লেখক যখন অন্য লেখকের লেখা পড়েন তখন আরেক মুশকিল। দৃষ্টান্ত দিয়ে কথাটা খোলসা করি।
এই মনে করুন, গৌরকিশোর ঘোষ রম্য-রচনা লিখে দেশে নাম করে ফেলেছেন। আমারও বাসনা গেল, ওই লাইনে যখন খ্যাতি আছে, পয়সাও থাকতে পারে, তখন আমিও-বা বাদ যাই কেন? গৌরকিশোরের লেখার অনুকরণে আমিও কয়েকটি রম্য-রচনা লিখে নিয়ে গেলুম তাঁর কাছে। তিনি দেখলেন, তাঁর এক নবীন শাকরে জুটল, তাঁর অনুকরণ এবার একটা ‘স্কুল’ ‘ঘরানা’ গড়ে উঠতে চলল। আমার রচনা যে আদপেই ‘রম্য’ হয়নি, এমনকি এরে ‘রচনা’ও কওয়া যায় না সেদিকে তাঁর নজরই গেল না। তিনি সার্টিফিকেট দিলেন, ‘তোফা লেখা, খাসা লেখা, বেড়ে লেখা!’ আমিও খুশি। অবশ্য এ সার্টিফিকেট আমি এখনও কাজে লাগাইনি। সাহিত্যিকের সার্টিফিকেট হাল-পাঠকের পানি পাবে কি না সে বাবদে আমার মনে এখনও ধোঁকা রয়ে গেছে।
পক্ষান্তরে ফরাসি কবি-সম্রাট মলিয়ের নাকি তার তাবৎ কৌতুকনাট্য পড়ে শোনাতেন তাঁর নিরক্ষরা বাড়িউলিকে। বাড়িউলি যেসব রসিকতা শুনে হাসত, তিনি সেসব রসিকতার মাত্রা বাড়িয়ে দিতেন; যেগুলো শুনে গম্ভীর মূর্তি ধারণ করত সেগুলো তিনি নির্মমভাবে কেটে দিতেন। অথচ আজ তো গুণীমূর্খ সবাই তার নাট্য দেখে আনন্দ লাভ করে। এই কয়েকদিন মাত্র হল, জ্যোতিরিন্দ্রনাথকৃত তাঁর বাঙলা অনুবাদ কলকাতার রসিক সমাজকে যা হাসাল তা দেখে স্বয়ং মলিয়েরই অবাক হতেন।
তবে কি ওই বাড়িউলি অতিশয় সুরসিকা ছিলেন? এ পর্যন্ত কেউ তো তা বলেনি। তবে কি ওঁকে না শুনিয়ে সে যুগের নামকরা সমঝদারকে শোনালে মলিয়েরের কাব্য আরও রসোত্তীর্ণ হত? বলা অসম্ভব।
***
যে নল চালিয়েছিলুম, সে তবে এখন এসে খাড়া হল কোথায়, পাকড়ালো কাকে? অর্থাৎ হরে-দরে দাঁড়াল কী?
আমার বিশ্বাস এ নল কোথাও দাঁড়াবে না। এ আলোচনায় কস্মিনকালেও কোনও হদিস পাওয়া যাবে না।
তবে যদি শোধান, আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস কী, তবে আমি নবীন, লেখককে অকুণ্ঠ ভাষায় বলব, সার্টিফিকেট কুড়োতে যেও না। ওতে কানাকড়ির লাভ নেই। ওই যে পাঠক-সম্প্রদায় নামক কিম ভূত কিম্ আকার জীব আছে সে যে কখন কার প্রতি সদয়, কার প্রতি নির্দয়, কখন কাকে আশা-গাছের শাখায় চড়ায়, আর কখন কাকে নির্মমভাবে জিলট করে তার হদিস কেউ কখনও পায়নি।
অবশ্য আপনি যদি ভবিষ্যৎ যুগের পাঠকের জন্য লেখেন তবে আপনার কোনও ভাবনা নেই। তবে সেকথাটা পুস্তকের অবতরণিকায় বলে দিলেই সাধু আচরণ হয়। এ বছরের তাজা মাছকে আসছে বছরের শুঁটকি বলে চালানোটা জোচ্চুরির শামিল। পঞ্চাশ বছর পরে যে র মাল মেচ্যোর লিকোর হবে সেটা আজ বাজারে ছাড়া ধাপ্পা। তার জন্য আজ যে লোক সার্টিফিকেট দেয় সে-ও ধাপ্পাবাজ।
***
হালে আকাশে এক নয়া চিড়িয়া উদয় হয়েছে।
নিজের সার্টিফিকেট নিজে লিখে, কিংবা এবং চেলা-চামুণ্ডাদের সামনে নিজের লেখার গুণকীর্তন করতে গিয়ে পয়েন্ট বাতলে বিজ্ঞাপন লিখিয়ে নিয়ে কিংবা এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজের অন্যান্য লেখাতে সে লেখা সম্বন্ধে দারুণ-দারুণ রেফরেস্ ঝেড়ে সবকিছু প্রকাশককে দিয়ে। বিজ্ঞাপনরূপে ছাপিয়ে দেওয়া।
এ সিস্টেমের সঙ্গে ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’র বেশ মিল আছে। বাঙলা ভাষায় লেখা দেখে পড়তে গিয়ে মালুম হল যে কিছুই মালুম হচ্ছে না– এ ভাষায় শব্দরূপ, ধাতুরূপ কৃৎ তদ্ধিত আপনি কিছুই জানেন না। অর্থাৎ বন্ধু বাঙলা ভাষার মুখোশ পরে অজানাজন এসে মেরেছে চাকু।
প্রকাশকের মুখোশ পরে এখানে আসে লেখক– হাতে চাক্কু! পাঠক সাবধান!!
রবীন্দ্রনাথ কী যেন গেয়েছেন, দুখের বেশে এসেছ বলে তোমাকে ডরাব না? এ তার উল্টো পিঠ; মিত্রের বেশে এসেছ বলে তোমাকেই যত ভয়।
এ সিসটেম পাঠক-ব্যাঙ্কারের চালানো জুয়ো-ভূমি মন্টে কার্লোর ব্যাংক ভাঙতে পারবে কি না, সেই খবরের প্রত্যাশায় আছি। এযাবৎ তো কোনও সিস্টেম পারেনি।
আর যা করুন, করুন, কিন্তু পাঠকসাধারণকে আহাম্মুখ ঠাউরে আপন আহাম্মুখির পচা ডিম হাটের মধ্যিখানে ফাটাবেন না!!
মরহুম মৌলানা
মরহুম (স্বর্গত) মৌলানা আবুল-কালাম মহীউদ্দীন আহমদ আল আজাদ সম্ভ্রান্ত বংশের যোগ্য সন্তান। এ বংশের পরিচয় এবং বিবরণ বাদশা আকবরের আমল থেকে পাওয়া যায়।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে এঁর পিতা জড়িয়ে পড়েন। দিল্লির ওপর ইংরাজের বর্বর অত্যাচার আরম্ভ হলে পর তিনি তার অন্যতম ভক্ত রামপুরের নবাবের সাহায্যে মক্কা শরিফে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি এক আরব কুমারীকে বিবাহ করেন। আবুল কালাম এই বিবাহের সার্থক সন্তান।
তাঁর মাতৃভাষা আরবি, পিতৃভাষা উর্দু। পরবর্তী যুগে তিনি ফারসি এবং তুর্কিতেও অসাধারণ পাণ্ডিত্য সঞ্চয় করেন। ইংরেজি থেকেও তিনি সে সঞ্চয়ে সাহায্য গ্রহণ করেছেন। তবে এদেশে ফেরার পর তিনি উর্দু সাহিত্যের এমনি একনিষ্ঠ সাধক ও প্রেমিক হয়ে যান যে শেষের দিকে আরবি বা ফারসিতে নিতান্ত বাধ্য না হলে কথাবার্তা বলতেন না।
তাঁর বয়স যখন দশ তখন তাঁর পিতা ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। সমগ্র ভারতবর্ষেই তাঁর বহু শিষ্য ও ভক্ত ছিলেন। এই কলকাতা শহরেই তার প্রচুর অনুরাগী শিষ্য ছিলেন এবং তাদেরই অনুরোধে তিনি এখানে স্থায়ী বাসভবন নির্মাণ করেন। পুত্র আবুল কালাম এখানেই তাঁর শিক্ষা সমাপ্ত করেন। তাঁর পরলোকগমনের পর বেতারে যে একাধিকবার বলা হয়, তিনি মিশরের অল আজহর বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন সে সংবাদ ভুল। উপরন্তু মৌলানা সাহেব নিজেকে সবসময়ই কলকাতার অধিবাসী ও বাঙালি বলেই পরিচয় দিয়েছেন। বাঙলা তিনি বলতেন না, কিন্তু বাঙলা কথোপকথনের মাঝখানে তিনি উর্দুতে প্রশ্নোত্তর করতেন এবং কিছুক্ষণ পর কারওই খেয়াল থাকত না যে তিনি অন্য ভাষায় কথা বলছেন।
চৌদ্দ বছর বয়সেই তিনি ‘লিসান উল্-সিদক’ (সত্য-বচন) নামক কাগজের সঙ্গে সংযুক্ত হন এবং অতি অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর খ্যাতি ভারতবর্ষের সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে। চব্বিশ বৎসর বয়সে তার ‘অল্ হিলাল’ (অর্ধচন্দ্র) পত্রিকা ইংরেজের মনে ভীতির সঞ্চার করতে আরম্ভ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর তাঁর কাগজ ইংরেজের শত্রু তুর্কি এবং মুসলিম বিশ্ব-আন্দোলনের অকুণ্ঠ প্রশংসা করার ফলে তাঁকে অন্তরীণ হতে হয়। মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মহাত্মা গান্ধী ও অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত হন এবং সে আন্দোলনের সঙ্গে সাদ জগলুল পাশার মিশরের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং গাজী মুস্তফা কামাল পাশার তুর্কির নবজাগরণের সঙ্গে সেতু নির্মাণ করেন।
এরপরের ইতিহাস ভারতীয় মাত্রই জানেন।
শ্বেত সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ এবং বিশ্ব-মুসলিম প্রেম মৌলানা আজাদের পরিবারের অবিচ্ছিন্ন অংশরূপে গণ্য করা হত। তিনি জন্মগ্রহণ করেন মক্কায়– যেখানে হজ উপলক্ষে বিশ্বের তাবৎ মুসলিম প্রতি বৎসর সম্মিলিত হয়ে প্রাচ্যভূমি থেকে কী করে শ্বেতাঙ্গ ও শ্বেত-স্বৈরাচার দূরীভূত করা যায় তার পরিকল্পনা করত এবং ভারত, মালয়, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশকে আপন কর্তব্য ও জিম্মাদারি ভাগ করে দেওয়া হত। এ পরিকল্পনা কোনও বিশেষ দেশে সীমাবদ্ধ ছিল না বলে একে ন্যাশনালিজম না বলে প্যান্ইসলামিজম (বিশ্ব-মুসলিম-সংহতি) নামে পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্রই সুপরিচিত ছিল। দশ বৎসর বয়স পর্যন্ত মৌলানা এ মন্ত্রই অহরহ শুনেছিলেন।
কলকাতা আসার সঙ্গে সঙ্গেই মৌলানার পরিবর্তন আরম্ভ হয়। একথা সত্য যে বিশ্ব-মুসলিমের প্রতি তাঁর দরদ কখনও শুকিয়ে যায়নি, কিন্তু ক্রমে ক্রমে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় উৎসাহ ও উদ্দীপনার উৎস হয়ে উঠল স্বদেশপ্রেম। উর্দু ভারতবর্ষের ভাষা। তাঁর মাতৃভাষা আরবিকে তার জীবনাদর্শ এবং রাজনৈতিক সাধনার মাধ্যমরূপে গ্রহণ না করে তিনি সর্বান্তঃকরণে বরণ করে নিলেন উর্দুকে। এ বড় সহজ কুরবানি বা আত্মবিসর্জন নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগেই শুধু নয়, আজও দেখতে পাই বহু লোক স্বার্থলাভের জন্য স্বদেশি ভাষা বর্জন করে বিদেশি ভাষার সাধনা করেন এবং আমাদের মতো বাঙালি তাঁদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে না বলে আমাদের প্রতি রুষ্ট হন।
এবং সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি, এই উর্দু গ্রহণের জন্য জীবনসায়াহ্নে মৌলানাকে আবার অকরুণ কটুবাক্য শুনতে হল সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকমণ্ডলীর কাছ থেকে। হিন্দি ভাষা কেন রাতারাতি ভারতবর্ষের তাবৎ ভাষার কণ্ঠরুদ্ধ করে ‘জাতীয় ভাষা’ রূপে জগদ্দল প্রতিমার মতো ভারতের মন্দিরে মন্দিরে পূজা পাচ্ছেন না, অপেক্ষাকৃত অনুন্নত শিশু ভাষাগুলোকে কেন কচি কচি পাঁঠার মতো তাঁর সামনে বলি দেওয়া হচ্ছে না, তার কারণ অনুসন্ধান করে তাঁরা আপন ‘বুদ্ধি’তে আবিষ্কার করলেন ‘হিন্দি-বিদ্বেষী’ ‘হিন্দি-ভাষাকা কট্টর দুশমন’ মৌলানা আজাদকে। যেহেতু মৌলানা উর্দু-ভাষী তাই তিনি শিক্ষামন্ত্রীরূপে হিন্দির প্রচার এবং প্রসার কামনা করেন না– এই হল তখন তাদের ‘যুক্তি’। হিন্দি যে দুর্বল, কমজোর ভাষা সেকথা স্মরণ করবার অস্বস্তিকর প্রয়োজন কেউ বোধ করলেন না। পণ্ডিত নেহরুও যে উর্দুভাষী একথা বলতে তাঁরা সাহস পেলেন না– একথা বললে উভয়ের হৃদ্যতা বেড়ে যাবে যে!
মাত্র একবার মৌলানা লোকসভায় তাঁর বক্তব্য সুস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন। এবং যাঁরা সেদিন এই সভায় ছিলেন তাঁরা সবাই দেখেছিলেন মৌলানার আবেগময়ী আন্তরিক বক্তৃতার ফলে প্রতিপক্ষ কীরকম লজ্জায় আধোবদন হয়েছিলেন- শত্রু-মিত্র কারও দিকেই মুখ তুলে তাকাবার সাহস পর্যন্ত সেদিন তাদের আর হয়নি।
জগলুল পাশা, কামাল আতাতুর্কের সঙ্গে মৌলানার পত্রবিনিময় সবসময়ই ছিল, কিন্তু মৌলানা ক্রমে ক্রমে তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়োগ করলেন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে। সেই ইতিহাস লেখবার শক্তি আমার নেই; আমি শুধু এস্থলে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, মক্কা শরিফের প্যান-ইসলামি বালক যৌবনে পরিপূর্ণ জাতীয়তাবাদী হয়ে গেল। মৌলানার যেসব বিপক্ষ দল একদা মুসলিম জাহানের স্বপ্ন দেখতেন তাঁরা পর্যন্ত আজ কঠিন অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়ে বুঝতে পেরেছেন, সে স্বপ্ন গেছে– এখন তাঁরা পুরো পাকিস্তানি হয়ে গিয়ে জাতীয়তাবাদের আদর্শই বরণ করেছেন। দুঃখ এই, তাঁরা এ আদর্শটি কয়েক বৎসর আগে বরণ করে নিলেই তাদের মঙ্গল, আমাদের মঙ্গল, সকলেরই মঙ্গল হত।
এস্থলে কিন্তু আরেকটি বিষয় লক্ষ করা উচিত।
স্বরাজলাভের পর মৌলানা তাঁর জাতীয়তাবাদ বিশ্ব-মানবের কল্যাণে নিয়োগ করেছিলেন। দেশপর্যটন মৌলানা অত্যন্ত অপছন্দ করতেন, কিন্তু বিশ্বজনের সঙ্গে সক্রিয় যোগস্থাপনার জন্য তিনি কয়েক বৎসর পূর্বে পাকিস্তান-ইরান হয়ে ইয়োরোপে যান– পূর্বে বহুবার বহু দেশে নিমন্ত্রিত হয়েও যাননি। এবং সবচেয়ে বড় কথা, জাতিসজ সম্মেলন (ইউ.এন.ও.) এবং তার ভিন্ন ভিন্ন শাখার যে প্রতিনিধি ভারতে এসেছেন তাঁরা তাঁদের সর্বোত্তম সখারূপে চিনতে শিখলেন মৌলানা আজাদকে। তাঁরা আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, যে মৌলানা ইংরেজের বিরুদ্ধে তিক্ততম লড়াই করেছেন আজীবন, তার ভিতর সে তিক্ততা আর নেই। ইংরেজ হোক, মার্কিন হোক আর রুশই হোক, যেজন বিশ্বকল্যাণের জন্য সম্মুখীন হয়, তার বহু দোষ থাকলেও সে আজাদের বন্ধুজন। এবং আরও আশ্চর্য! ইংরেজ দেখে, মৌলানা ইংরেজি না বলেও ইংরেজের মিত্র, রাশা দেখে, তার ভাষা না জেনেও অন্যের তুলনায় মৌলানা রাশাকে চেনেন অনেক বেশি। তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলতেন উর্দুতে, কিন্তু সে উর্দু তো উর্দু নয়। সে উর্দু বিশ্বপ্রেমের সর্বজনীন ভাষা, কিংবা বলব, বিশ্বপ্রেমের ভাষা উর্দুর মাধ্যমে স্বপ্রকাশ হল। একদা তিনি আরবি বর্জন করে উর্দু গ্রহণ করেছিলেন; এখন তিনি উর্দু বর্জন করে অন্য এক ভাষা গ্রহণ করেছেন, যার নামকরণ এখনও হয়নি, কারণ সে ভাষাতে কথা বলতে আমরা এখনও শিখিনি।
অথচ তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁরই নির্দেশ অনুযায়ী চলত তিনখানি ত্রৈমাসিক। প্রথমখানি আরবিতে– আরবভূমির সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক যোগসূত্র স্থাপনা ও প্রাচীন যোগ দৃঢ়তর করার জন্য, দ্বিতীয়-খানা ফারসিতে– ইরান ও আফগানিস্তানের জন্যে; তৃতীয়খানা ইংরেজিতে বৌদ্ধ জগতের সঙ্গে যোগস্থাপনা করার জন্য (বৌদ্ধভূমি এক ভাষায় আশ্রিত নয় বলে তিনি মাধ্যমরূপে ইংরেজি গ্রহণ করেছিলেন)। এই তিনটি পত্রিকাই ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস দিল্লি থেকে প্রকাশিত হয় এবং মৌলানা ছিলেন তার প্রধান। শুধু প্রধান বললেই যথেষ্ট বলা হয় না কোন দেশে কখানি পত্রিকা যাবে সেটুকু পর্যন্ত তার নির্দেশানুযায়ী হত। আজ ভাবি, এ সবকটি পত্রিকার নীতি-নির্দেশ, মানরক্ষা, তাদের সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারে এমন সর্বগুণ মেশানো আরেক পণ্ডিত পাওয়া যাবে কোথায়? ভারতবর্ষের ভিতরে, বাইরে?
বস্তুত আসলে এ লোকটি হৃদয় এবং মস্তিষ্কের অন্তস্তলে ছিলেন পণ্ডিত। স্বাধীন মক্কা ত্যাগ করে পরাধীন ভারতে না এলে তিনি যে রাজনীতির চতুঃসীমানায় যেতেন না, সেকথা আমি স্থিরনিশ্চয় জানি। স্বাধীনতা লাভের পরও তিনি জ্ঞানমার্গেই ফিরে যেতেন কিন্তু দেশে তখন (এবং এখনও) উপযুক্ত লোকের অভাব। মৌলানা কখনও কর্তব্য অবহেলা করতে চাইতেন না। এমনকি যখন তার বিরুদ্ধপক্ষ মুখর হয়ে উঠতেন, এবং আমরা ভাবতুম তিনি পদত্যাগ করলেই পারেন, এখনও তিনি কর্তব্যবোধের দায়েই আপন কাজ করে যেতেন- লোকনিন্দার তোয়াক্কা-পরোয়া না করে। পূর্বেই বলেছি, মাত্র একবার তিনি হিন্দিওয়ালাদের কর্কশ-কণ্ঠে ব্যথিত হয়ে, আপন কাহিনী নিবেদন করেছিলেন। এ অবসরে আরেকটি ঘটনা মনে পড়ল। সেটা কিন্তু কিঞ্চিৎ হাস্যরসে মেশানো।
বিরুদ্ধ দল শিক্ষা-দফতরের বিরুদ্ধে দুনিয়ার তাবৎ অভিযোগ-ফরিয়াদ জটল্লা করে শেষটায় বলল, ‘শিক্ষা-দফতরের দ্বারা কিছুই হবে না তাদের মগজের বাক্সটি (ব্রেনবটি ) একদম ফাঁপা।’
মৌলানা স্পর্শকাতর লোক– পণ্ডিতগণ সচরাচর তা হন। উষ্মা প্রকাশ করে তিনি কিন্তু দাঁড়ালেন হাস্যমুখে। বার কয়েক ডান হাত দিয়ে মাথার ডান দিক চাপড়ে বললেন, না জি, এখানে তো আছে’, তার পর হাত নামিয়ে নিয়ে দীর্ঘ আগুলফলম্বিত আচকানের ডান পকেটে থাবড়া মারতে মারতে বললেন, ‘এখানে নেই, এখানে কিছু নেই।’ অর্থাৎ মগজে মাল যথেষ্ট আছে, কিন্তু পকেটে কিছুই নেই। তার আরও সরল অর্থ, কেবিনেট শিক্ষাবিভাগকে যথেষ্ট পয়সা দেয় না।
পূর্বেই বলেছি, মৌলানা আসলে পণ্ডিত। কর্তব্যের তাড়নায় তিনি প্রবেশ করেছিলেন রাজনৈতিক মল্লভূমিতে অতি অনিচ্ছায়। তার সে পাণ্ডিত্যের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিতে আমার কুণ্ঠা বোধ হচ্ছে, কারণ তার সে পাণ্ডিত্য-সায়রে সন্তরণ করার মতো শক্তি আমার নেই।
আরবি এবং সংস্কৃত জ্ঞানচর্চায় বহু সাদৃশ্য রয়েছে। তার প্রধান মিল, উভয় সাহিত্যের পণ্ডিতগণই অত্যন্ত বিনয়ী। কারও কোনও নতুন কিছু বলার হলে কোনও প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের সাহায্যে তারা সেটি প্রকাশ করেন। লোকমান্য টিলক গীতার ভাষ্য লিখে সপ্রমাণ করলেন, কর্মযোগই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগ এবং এদেশ থেকে ইংরেজকে বিতাড়নই সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম; মহাত্মা গান্ধী তাঁর গীতাভাষ্য দিয়েই প্রমাণ করতে চাইলেন যে অহিংসাই সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম, এবং শ্রীঅরবিন্দ গীতাপাঠ লিখে প্রমাণ করতে চাইলেন যে জ্ঞানযোগের দ্বারা চিত্তসংযম আত্মজয় করতে পারলেই স্বাধীনতা লাভ অনিবার্য। মৌলানা আজাদ তাঁর ‘কুরান ভাষ্য’ দিয়ে বিশ্ব-মুসলিমকে মুক্ত করতে চাইলেন তার যুগ-যুগ সঞ্চিত অন্ধসংস্কার এবং ক্রিয়াকাণ্ডের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে। এবং তারই সঙ্গে সঙ্গে অতি কৌশলে তিনি তাকে তার কর্তব্য কোন দিকে সেইটে সহজ সরল ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন।
এ ভাষ্য তিনি অনায়াসেই আরবিতে লিখতে পারতেন, এবং আরবি ভাষার মাধ্যমে তিনি পাঠকসংখ্যা পেতেন উর্দুর তুলনায় অনেক, অনেক বেশি। দ্বিতীয়, কুরান আরবি ভাষায় লেখা, এবং তাবৎ বিশ্বমুসলিম আরবিতেই তার ভাষ্য লিখে আসছে (গীতার ভাষ্য যেরকম এক শতাব্দী পূর্বেও সংস্কৃতেই রচিত হয়েছে) তৃতীয়ত, মুসলিম-জাহানের কেন্দ্রভূমি মক্কার ভাষা আরবি, চতুর্থত, সে ভূমি আজাদের জন্মস্থল– আপন জন্মস্থলে যশ প্রতিষ্ঠা করতে চায় না কোন পণ্ডিত?
এ সমস্ত প্রলোভন উপেক্ষা করে মৌলানা তার তফসির ভাষ্য লিখলেন উর্দুতে। মক্কাতে জন্ম নিয়েছিল তাঁর দেহ, কিন্তু তাঁর চৈতন্য এবং হৃদয় গ্রহণ করেছিল তাঁর পিতৃ-পিতামহের ভূমি ভারতকে স্বদেশরূপে। তাই স্বদেশবাসীর জন্য তাঁর ভাষ্য লিখলেন উর্দুতে (টিলকও ইচ্ছা করলে তার ভাষ্য সংস্কৃতে লিখতে পারতেন। কিন্তু লিখেছিলেন মারাঠিতে। পরবর্তী যুগে আজাদ-ভাষ্য আরবিতে অনূদিত হয়, এবং তখন আরব-ভূমিতে সে ভাষ্যের যে জয়ধ্বনি উঠেছিল তা শুনে ভারতীয় মাত্রই না কী গর্ব, কী শ্লাঘা অনুভব করেছিল। পাকিস্তানিরাও এই পুস্তক নিয়ে গর্ব অনুভব করেন। তাঁরা পাকিস্তান যাবার সময় তাজমহল ফেলে যাওয়ার মতো কিন্তু এ ভাষ্য ভারতে ফেলে যাননি। ১৯১৭-এর পরও আজাদ-ভাষ্য লাহোর শহরে লক্ষাধিক সংখ্যক ছাপা এবং বিক্রি হয়েছে।
পাণ্ডিত্য ও সাহিত্য সচরাচর একসঙ্গে যায় না। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে মুগ্ধ হয়েছি মৌলানার সাহিত্য রসবোধে, সাহিত্যসৃষ্টি দেখে। মৌলানার সঙ্গে লোকমান্য টিলকের বহু সাদৃশ্য বর্তমান, কিন্তু টিলকের চরিত্রে ছিল দার্ঢ্য, মৌলানার চরিত্রে ছিল মাধুর্য, টিলককে যদি বলা হয় কট্টর কঠিন শৈব, তবে মৌলানাকে বলতে হয় মরমিয়া মধুর বৈষ্ণব। কারণ মৌলানা ছিলেন সুফি অর্থাৎ ভক্ত রহস্যবাদী (মিসটিক)। তাঁর সাহিত্যের উৎস ছিল মাধুর্যে, এবং কে না জানে মধুর রসই সর্বশ্রেষ্ঠ রস।
তাই তাঁর চেহারায় ছিল লাবণ্য, কুরান-ভাষ্যের মতো পণ্ডিত্যপূর্ণ পুস্তকে মাধুর্য, এবং তাঁর বক্তৃতায় অদ্ভুত অবর্ণনীয় সরলতার সৌন্দর্য।
কিন্তু তাঁর যে সরল সৌন্দর্যবোধ তার পরম প্রকাশ পেয়েছে তাঁর রম্য রচনাতে। উর্দুতে এরকম রচনা তো নেই-ই, বিশ্বসাহিত্যে এরকম সহৃদয় রসে ভরপুর লেখা খুঁজে পাইনে। তার সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়া বক্ষ্যমাণ অক্ষম লেখকের সাধ্যাতীত।
তবে এই শোকের দিনে একটি সান্ত্বনার বাণী জানাই। সাহিত্য আকাদেমি এ পুস্তকের বাঙলা অনুবাদকর্মে লিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু এর সঙ্গে একটি সাবধানবাণীও শুনিয়ে রাখি। সে অনুবাদে বাঙালি পাবে কাশ্মিরি শালের উল্টো দিকটা। পাবে মূলের অসম্পূর্ণ পরিচয়, এবং হয়তো পাবে, অসম্পূর্ণের উল্টো সম্পূর্ণ পরিচয় পাবার আকাঙ্ক্ষা। তাই যদি হয়, তবে হয়তো কোনও কোনও বাঙালির অনাদৃত উর্দু ভাষা শেখার ইচ্ছাও হতে পারে। আমাদের সে প্রচেষ্টা হয়তো শোকদুঃখের অতীত অমর্ত্য লোকে মৌলানা আবুল কালাম মহীউদ্দীন আহমদ আল-আজাদকে আনন্দ দান করবে।
মামদোর পুনর্জন্ম
সংস্কৃত ভাষা আত্মনির্ভরশীল। কোনও নতুন চিন্তা, অনুভূতি কিংবা বস্তুর জন্য নবীন শব্দের প্রয়োজন হলে সংস্কৃত ধার করার কথা না ভেবে আপন ভাণ্ডারে অনুসন্ধান করে, এমন কোনও ধাতু বা শব্দ সেখানে আছে কি না যার সামান্য অদলবদল করে কিংবা পুরনো ধাতু দিয়ে নবীন শব্দটি নির্মাণ করা যায় কি না। তার অর্থ অবশ্য এ নয় যে, সংস্কৃত কস্মিনকালেও বিদেশি কোনও শব্দ গ্রহণ করেনি। নিয়েছে, কিন্তু তার পরিমাণ এতই মুষ্টিমেয় যে, সংস্কৃতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা বলাতে কারও কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়।
প্রাচীন যুগের সব ভাষাই তাই। হিব্রু, গ্রিক, আবেস্তা এবং ঈষৎ পরবর্তী যুগের আরবিও আত্মনির্ভরশীল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বয়ংসম্পূর্ণ।
বর্তমান যুগের ইংরেজি ও বাঙলা আত্মনির্ভরশীল নয়। আমরা প্রয়োজনমতো এবং অপ্রয়োজনেও ভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ নিয়েছি এবং নিচ্ছি। পাঠান-মোগল যুগে আইন-আদালত খাজনা-খারিজ নতুনরূপে দেখা দিল বলে আমরা আরবি ও ফারসি থেকে প্রচুর শব্দ গ্রহণ করেছি। পরবর্তী যুগে ইংরেজি থেকে এবং ইংরেজির মারফতে অন্যান্য ভাষা থেকে নিয়েছি, এবং নিচ্ছি।
বিদেশি শব্দ নেওয়া ভালো না মন্দ সে প্রশ্ন অবান্তর। নিয়েছি, এবং এখনও সজ্ঞানে আপন খুশিতে নিচ্ছি এবং শিক্ষামাধ্যমরূপে ইংরেজিকে বর্জন করে বাঙলা নেওয়ার পর যে আরও প্রচুর ইউরোপীয় শব্দ আমাদের ভাষায় ঢুকবে, সে সম্বন্ধেও কারও কোনও সন্দেহ নেই। আলু-কপি আজ রান্নাঘর থেকে তাড়ানো মুশকিল, বিলিতি ওষুধ প্রায় সকলেই খান, ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন ওষুধ খাবেন বলেই মনে হয়। এই দুই বিদেশি বস্তুর ন্যায় আমাদের ভাষাতেও বিদেশি শব্দ থেকে যাবে, নতুন আমদানিও বন্ধ করা যাবে না।
পৃথিবীতে কোনও জিনিসই সম্পূর্ণ অসম্ভব নয়। অন্তত চেষ্টা করাটা অসম্ভব না-ও হতে পারে। হিন্দি উপস্থিত সেই চেষ্টাটা করছেন– বহু সাহিত্যিক উঠে-পড়ে লেগেছেন, হিন্দি থেকে আরবি, ফারসি এবং ইংরেজি শব্দ তাড়িয়ে দেবার জন্য। চেষ্টাটার ফল আমি হয়তো দেখে যেতে পারব না। আমার তরুণ পাঠকেরা নিশ্চয়ই দেখে যাবেন। ফল যদি ভালো হয় তখন তাঁরা না হয় চেষ্টা করে দেখবেন। (বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ স্বচ্ছন্দে লিখেছেন, ‘আব্রু দিয়ে, ইজ্জত দিয়ে, ইমান দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে।’ নজরুল ইসলাম ‘ইনকিলাব’ ইনক্লাব’ নয়– এবং ‘শহীদ’ শব্দ বাঙলায় ঢুকিয়ে গিয়েছেন। বিদ্যাসাগর ‘সাধু’ রচনায় বিদেশি শব্দ ব্যবহার করতেন না, বেনামিতে লেখা ‘অসাধু’ রচনায় চুটিয়ে আরবি-ফারসি ব্যবহার করতেন। আর অতিশয় নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হরপ্রসাদ আরবি-ফারসি শব্দের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা ‘আহাম্মুখী’ বলে মনে করতেন। ‘আলাল’ ও ‘হুতোম’-এর ভাষা বিশেষ উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল; সাধারণ বাঙলা এ সোতে গা ঢেলে দেবে না বলে তার উল্লেখ এস্থলে নিষ্প্রয়োজন এবং হিন্দির বঙ্কিম স্বয়ং প্রেমচন্দ্র হিন্দিতে বিস্তর আরবি-ফারসি ব্যবহার করছেন।
এস্থলে আরেকটি কথা বলে রাখা ভালো। রচনার ভাষা তার বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে। শঙ্করদর্শনের আলোচনায় ভাষা সংস্কৃতশব্দ-বহুল হবেই, পক্ষান্তরে মোগলাই রেস্তোরাঁর বর্ণনাতে ভাষা অনেকখানি ‘হুতোম’ ঘ্যাঁষা হয়ে যেতে বাধ্য। ‘বসুমতী’র সম্পাদকীয় রচনার ভাষা এক– তাতে আছে গাম্ভীর্য, ‘বাঁকা চোখে’র ভাষা ভিন্ন– তাতে থাকে চটুলতা।
***
বাঙলায় যেসব বিদেশি শব্দ ঢুকেছে তার ভিতরে আরবি, ফার্সি এবং ইংরেজিই প্রধান। সংস্কৃত শব্দ বিদেশি নয় এবং পর্তুগিজ, ফরাসিস, স্প্যানিশ শব্দ এতই কম যে, সেগুলো নিয়ে অত্যধিক দুশ্চিন্তা করার কোনও কারণ নেই।
বাঙলা ভিন্ন অন্য যেকোনো ভাষার চর্চা আমরা করি না কেন, সে ভাষার শব্দ বাঙলাতে ঢুকবেই। সংস্কৃত চর্চা এদেশে ছিল বলে বিস্তর সংস্কৃত শব্দ বাঙলায় ঢুকেছে, এখনও আছে বলে অল্পবিস্তর ঢুকছে, যতদিন থাকবে ততদিন আরও ঢুকবে বলে আশা করতে পারি। স্কুল-কলেজ থেকে যে আমরা সংস্কৃতচর্চা উঠিয়ে দিতে চাইনে তার অন্যতম প্রধান কারণ বাঙলাতে এখনও আমাদের বহু সংস্কৃত শব্দের প্রয়োজন, সংস্কৃত চর্চা উঠিয়ে দিলে আমরা অন্যতম প্রধান খাদ্য থেকে বঞ্চিত হব।
ইংরেজির বেলাতেও তাই বিশেষ করে দর্শন, নন্দনশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা ইত্যাদি জ্ঞান এবং ততোধিক প্রয়োজনীয় বিজ্ঞানেরও শব্দ আমরা চাই। রেলের ইঞ্জিন কী করে চালাতে হয়, সে সম্বন্ধে বাঙলাতে কোনও বই আছে বলে জানিনে, তাই এসব টেকনিকল শব্দের প্রয়োজন যে আরও কত বেশি সে সম্বন্ধে কোনও সুস্পষ্ট ধারণা এখনও আমাদের মনের মধ্যে নেই। সুতরাং ইংরেজি চর্চা বন্ধ করার সময় এখনও আসেনি।
একমাত্র আরবি-ফারসি শব্দের বেলা অনায়াসে বলা যেতে পারে যে, এই দুই ভাষা থেকে ব্যাপকভাবে আর নতুন শব্দ বাঙলাতে ঢুকবে না। পশ্চিম বাঙলাতে আরবি-ফারসির চর্চা যাব যাব করছে, পুব বাঙলায়ও এসব ভাষার প্রতি তরুণ সম্প্রদায়ের কৌতূহল অতিশয় ক্ষীণ বলে তার আয়ু দীর্ঘ হবে বলে মনে হয় না এবং শেষ কথা আরব-ইরানে অদূর ভবিষ্যতে যে হঠাৎ কোনও অভূতপূর্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা আরম্ভ হয়ে বাঙলাকে প্রভাবান্বিত করবে তার সম্ভাবনাও নেই।
কিন্তু যেসব আরবি-ফারসি শব্দ বাঙলাতে ঢুকে গিয়েছে তার অনেকগুলো যে আমাদের ভাষাতে আরও বহুকাল ধরে চালু থাকবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই এবং দ্বিতীয়ত, কোনও কোনও লেখক নতুন বিদেশি-শব্দের সন্ধান বর্জন করে পুরনো বাঙলার চণ্ডী থেকে আরম্ভ করে ‘হুতোম’ পর্যন্ত– অচলিত আরবি-ফারসি শব্দ তুলে নিয়ে সেগুলো কাজে লাগাবার চেষ্টা করছেন। কিছুদিন পূর্বেও এই এক্সপেরিমেন্ট করা অতিশয় কঠিন ছিল কিন্তু অধুনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে বাধ্য হয়ে পুরনো বাঙলা পড়তে হয়– তারা এইসব শব্দের অনেকগুলো অনায়াসে বুঝতে পারবে বলে অচলিত অনেক আরবি-ফারসি শব্দ নতুন মেয়াদ পাবে।
এই পরিস্থিতির সামনে জীবন্মুত এসব শব্দের একটা নতুন খতেন নিলে ভালো হয়।
***
সংস্কৃত, গ্রিক, বাঙলা আর্য ভাষা, আরবি, হিব্রু সেমিতি ভাষা। ফারসি, উর্দু, কাশ্মিরি, সিন্ধিও আর্য ভাষা, কিন্তু এদের ওপর সেমিতি আরবি ভাষা প্রভাব বিস্তার করেছে প্রচুর। উত্তর ভারতের অন্যান্য ভাষাদের মধ্যে বাঙলা এবং গুজরাতিই আরবি ভাষার কাছে ঋণী, কিন্তু এই ঋণের ফলে বাঙলার মূল সুর বদলায়নি। গুজরাতির বেলাও তাই।
হিব্রু এবং আরবি সাহিত্যের ঐশ্বর্য সর্বজনবিদিত। ঠিক সেইরকম প্রাচীন আর্য ভাষা ফারসি তার ভগ্নি সংস্কৃতের ন্যায় খ্রিস্টের জন্মের পূর্বেই সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠেছিল। আরবরা যখন ইরান জয় করে তখন তারা ইরানিদের তুলনায় সভ্যতা-সংস্কৃতিতে পশ্চাৎপদ। কিন্তু তারা সঙ্গে আনল যে ধর্ম সেটি জরথুস্ত্রি ধর্মের চেয়ে প্রগতিশীল, সর্বজনীন এবং দুঃখীর বেদনা উপশমকারী। ফলে তাবৎ ইরান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল এবং আপন ভাষা ও সাহিত্য বর্জন করে আরবিকে রাষ্ট্রভাষা ও সংস্কৃতির বাহনরূপে স্বীকার করে নিল। আরবি ভাষা ও সাহিত্যে তাই ইরানিদের দান অতুলনীয়।
চারশত বৎসর পরে কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হল। ইরানিদের আপন ভাষা তখন মাহমুদ বাদশার উৎসাহে নবজন্ম লাভ করে নব নব সাহিত্য-সৃষ্টির পথে এগিয়ে চলল। বাল্মীকি যেরকম আদি এবং বিশ্বজগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, ফিরদৌসিও এই নব ইরানি (ফারসি) ভাষার আদি এবং শ্রেষ্ঠ কবি। আরবি থেকে শব্দ এবং ভাবসম্পদ গ্রহণ করে ফারসি সাহিত্য যে অভূতপূর্ব বিচিত্র রূপ ধারণ করল তা আজও বিশ্বজনের কাছে বিস্ময়ের বস্তু। রুমি, হাফিজ, সাদি, খৈয়াম আপন আপন রশিমণ্ডলে সবিতাস্বরূপ। সেমিতি আরবি এবং আর্য ফারসি ভাষার সংঘর্ষের ফলেই এই অনির্বাণ হোমানলের সৃষ্টি হল।
পরবর্তী যুগে এই ফারসি সাহিত্যই উত্তর ভারতে ব্যাপকরূপে প্রভাব বিস্তার করল। ভারতীয় মক্তব-মাদ্রাসায় যদিও প্রচুর পরিমাণে আরবি ভাষা পড়ানো হয়েছিল তবু কার্যত দেখা গেল ভারতীয় আর্যগণ ইরানি আর্য সাহিত্য অর্থাৎ ফারসির সৌন্দর্যে অভিভূত হলেন বেশি। উর্দু সাহিত্যের মূল সুর তাই ফারসির সঙ্গে বাঁধা– আরবির সঙ্গে নয়। হিন্দি গদ্যের ওপরও বাইরের যে প্রভাব পড়েছে সেটা ফারসি– আরবি নয়।
একদা ইরানে যেরকম আর্য ইরানি ভাষা ও সেমিতি আরবি ভাষার সংঘর্ষে নবীন ফারসি জন্মগ্রহণ করেছিল, ভারতবর্ষে সেই সংঘর্ষের ফলে সিন্ধি, উর্দু ও কাশ্মিরি সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। কিন্তু আরবির এই সংঘর্ষ ফারসির মাধ্যমে ঘটেছিল বলে কিংবা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, ভারতবর্ষীয় এ তিন ভাষা ফারসির মতো নব নব সৃষ্টি দিয়ে ঐশ্বর্যশালী সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারল না। উর্দুতে কবি ইকবালই এ তত্ত্ব সম্যক হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন ও নতুন সৃষ্টির চেষ্টা করে উর্দুকে ফারসির অনুকরণ থেকে কিঞ্চিৎ নিষ্কৃতি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
***
বাঙলা আর্যভূমি, কিন্তু এ ভূমির আর্যগণ উত্তর ভারতের অন্যান্য আর্যের মতো নন। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার স্থান এখানে নয়। তাই মাত্র কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি।
১. বাঙলা দেশকে যখনই বাইরের কোনও শক্তি শাসন করতে চেষ্টা করেছে তখন বাঙালি বিদ্রোহ করেছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আপন স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। পাঠান যুগে বাঙলা অতি অল্পকাল পরাধীন ছিল এবং মোগল যুগেও মোটামুটি মাত্র জাহাঙ্গীর থেকে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত বাঙলা দিল্লির শাসন মেনেছে।
২. অন্যান্য আর্যদের তুলনায় বাঙালি কিছুমাত্র কম সংস্কৃতচর্চা করেনি, কিন্তু সে চৰ্চা সে করেছে আপন বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে। আদিশূর থেকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সকলের বহু চেষ্টাতেও বাঙালি উত্তর ভারতের সঙ্গে স্ট্রিমলাইনৃড় হয়ে সংস্কৃত পদ্ধতিতে সংস্কৃত বর্ণমালার উচ্চারণ করেনি এবং বাঙলাতে সংস্কৃত শব্দ উচ্চারণ করার সময় তো কথাই নেই।
৩. বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যসৃষ্টি তার পদাবলি কীর্তনে। এ সাহিত্যের প্রাণ এবং দেহ উভয়ই খাঁটি বাঙালি। এ সাহিত্যে শুধু যে মহাভারত্নে শ্রীকৃষ্ণ বাঙলায় খাঁটি কানুরূপ ধারণ করেছেন তাই নয়, শ্রীমতী শ্রীরাধাও যে একেবারে খাঁটি বাঙালি মেয়ে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ভাটিয়ালির নায়িকা, বাউলের ভক্ত, মুর্শিদিয়ার আশিক ও পদাবলির শ্রীরাধা একই চরিত্র একই রূপে প্রকাশ পেয়েছেন।
বাঙালির চরিত্রে বিদ্রোহ বিদ্যমান। তার অর্থ এই যে, কি রাজনীতি, কি ধর্ম, কি সাহিত্য যখনই যেখানে সে সত্য শিব সুন্দরের সন্ধান পেয়েছে তখনই সেটা গ্রহণ করতে চেয়েছে; এবং তখন কেউ ‘গতানুগতিক পন্থা’ ‘প্রাচীন ঐতিহ্য’-র দোহাই দিয়ে সে প্রচেষ্টায় বাধা দিতে গেলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। এবং তার চেয়েও বড় কথা,– যখন সে বিদ্রোহ উচ্ছলতায় পরিণত হতে চেয়েছে, তখন তার বিরুদ্ধে আবার বিদ্রোহ করেছে।
এ বিদ্রোহ বাঙালি হিন্দুর ভিতরই সীমাবদ্ধ নয়। বাঙালি মুসলমানও এ কর্মে পরম তৎপর। ধর্ম বদলালেই জাতির চরিত্র বদলায় না।
***
পাঠান আমলে বাঙলা দেশে আরবি-ফারসির চর্চা ব্যাপকভাবে হয়নি। সে যুগে বাঙলাতে লিখিত সরকারি দলিলপত্রে পর্যন্ত আরবি-ফারসি টেকনিকল শব্দ প্রায় নেই। মহাপ্রভু এবং তাঁর শিষ্যদের কেউ কেউ মুসলমান ধর্মের সঙ্গে সুপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও সে যুগের বাঙলা সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দ অতি অল্প।
খাস পাঠান যুগে তো কথাই নেই, মোগল যুগের প্রারম্ভেও কবি আলাওল যে কাব্য রচনা করেছেন তাতে সংস্কৃত ভাষার প্রাধান্যই লক্ষণীয়—
উপনীত হৈল আসি যৌবনের কাল।
কিঞ্চিৎ ভুরুর-ভঙ্গে যৌবন রসাল ॥
আড় আঁখি বঙ্ক-দৃষ্টি ক্রমে ক্রমে হয়।
ক্ষণে ক্ষণে লাজে তনু যেন শিহরয় ॥
সম্বরয় গিম-হার, কটির বসন।
চঞ্চল হইল আঁখি, ধৈরয-গমন ॥
চোররূপে অনঙ্গ অঙ্গেতে আসে যায়।
বিরহ বেদনা ক্ষণে ক্ষণে মনে ভায় ॥
এ ধরনের কাব্য তখন মুসলমানদের ভিতর কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল তার বর্ণনা পাই অন্য এক কবির কাছ থেকে। সৈয়দ সুলতান বলেন,
আপনা দীনের বোল্ একা না বুঝিল।
পরস্তব-সকল লৈয়া সব রহিল ৷
(দীন = ধর্ম; পরস্তব = পরধর্ম কীর্তন। এর পূর্বেই মুসলমানরা পদাবলী কীর্তন রচনা আরম্ভ করেছেন এবং কাজী ফয়জউল্লার ‘গোরক্ষ বিজয়’ মুসলমানদের ভিতর লোকপ্রিয় হয়ে গিয়েছে।)
মুসলমানরা আপন ধর্মচর্চা না করে ‘হিন্দুয়ানি’ কাব্য নিয়ে মেতে আছে দেখে মুসলমান মোল্লা-মৌলবিগণ তারস্বরে আপন প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং আরবি-ফারসিতে ধর্মচর্চা করবার জন্য বারবার কড়া ফতোয়া জারি করেছেন।
তখন সৈয়দ সুলতান বললেন, ‘আমরা বাঙলা ছাড়ব না; কিন্তু মুসলমান শাস্ত্রচর্চাও করব। তাই বাঙলাতেই মুসলমান শাস্ত্রচর্চা হবে।’
আরবি-ফারসি ভাষে কিতাব বহুত।
আলিমানে বুঝে, না বুঝে মূর্খসুত।
যে সবে আপন বুলি না পারে বুঝিতে।
পাঁচালী রচিলাম করি আছয়ে দৃষিতে ॥
আল্লায় বলিছে, ‘মুই যে-দেশে যে-ভাষ,
সে-দেশে সে-ভাষে কইলুম রসুল প্রকাশ।’
(আলিমান = আলিমগণ = পণ্ডিতগণ; রসূল আল্লার প্রেরিত পুরুষ, পয়গম্বর।)
অতি মোক্ষম জবাব। সৈয়দ সুলতান কুরানের বচন উদ্ধৃত করে সপ্রমাণ করলেন, বাঙলাতেই বাঙালি মুসলমানের শাস্ত্রচর্চা করা ফরজ– অবশ্য করণীয়।
সৈয়দ সুলতান কিন্তু আটঘাট বেঁধে পয়গম্বর সাহেবের বাণী বাঙলাতে প্রকাশ করেছেন। নিতান্ত যে কটি আরবি শব্দ ব্যবহার না করলেই নয়, তিনি মাত্র সেগুলোই ব্যবহার করেছেন এবং প্রচলিত হিন্দু ধর্মের মাধ্যমেই ইসলাম প্রকাশ করেছেন।
তোমার সবের মুই জানো হিতকারী।
ইমান-ইসলামের কথা দিলাম প্রচারি ॥
যেরূপে সৃজন হইল সুরাসুরগণ।
যেরূপে সৃজন হইল এ তিন ভুবন ॥
যেরূপে আদম ইবা সৃজন হইল।
যেরূপে যতেক পয়গম্বর উপজিল ॥
বঙ্গেতে এসব কথা কেহ না জানিল।
নবী-বংশ পাঁচালীতে সকল শুনিল।
এস্থলে দ্রষ্টব্য, হিন্দু-মুসলমান উভয়কে মুসলমান ধর্ম বোঝাতে গিয়ে কবি এমন সব বস্তুর উল্লেখ করেছেন, যা মুসলমান ধর্মে নেই। ‘সুর’ ‘অসুর’ কল্পনা ইসলামে নেই। ‘তিন ভুবন’ ইসলামে নেই, আছে ‘দুই ভুবন’। তাঁর পুস্তকের নাম ‘নবীবংশ’ ও হিন্দু ‘হরিবংশের’ অনুকরণ– আরবিতে এই ধরনের নাম নেই।
এমনকি তিনি পয়গম্বর হজরত মুহম্মদকে ‘অবতার’ আখ্যা দিয়ে মোল্লাদের মতে পাপ করেছেন; কারণ মুসলিম শাস্ত্রমতে আল্লা মনুষ্যদেহ গ্রহণ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন না, তিনি মানুষদের একজনকে বেছে তাঁকে তাঁর মুখপাত্র করেন। সৈয়দ সুলতান কিন্তু বলছেন–
মুহম্মদ রূপ ধরি নিজ অবতার।
নিজ অংশ প্রচারিত হইতে প্রচার।
আর সবচেয়ে বড় তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন সৈয়দ সাহেব, এই দুইটি ছত্রে–
যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন।
সেই ভাষা তাহার, অমূল্য সেই ধন ॥
এই দুটি ছত্রে যে কত বড় সত্য নিহিত আছে, সে তত্ত্ব কি আমরা আজও বুঝতে পেরেছি? এই সৈয়দ সুলতানকে তখনকার দিনের মোল্লা-মৌলবিরা ইসলামের ঐক্য নষ্ট হয়ে যাবে, আরবির মর্যাদা লোপ পাবে এই ভয় দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁকে ‘মুনাফিক’ অর্থাৎ ‘ভণ্ড’ অর্থাৎ ‘ধর্মধ্বংসকারী’ আখ্যা দিয়ে ‘ফতোয়া’ পর্যন্ত জারি করেছেন। সাহসী কবি কিন্তু অকুণ্ঠ ভাষায় তাঁর মাতৃভাষা বাঙলার জয়গান গেয়ে গেছেন। এ লোক যদি প্রকৃত বাঙালি না হয়, তবে বাঙালি কে?
সে শুভবুদ্ধি, সে সাহস কি আজও আমাদের হয়েছে? কেউ বলে ‘রাষ্ট্রের অখণ্ডতার জন্য হিন্দি গ্রহণ কর’, কেউ বলে ‘ইংরেজি বর্জন করলে আমরা বর্বর হয়ে যাব।’ হায়, বাঙলার পদমর্যাদা কেউ স্বীকার করে না।
যখন দ্বন্দ্ব নেই, সংঘাত নেই, তখন মাতৃভাষার গৌরবগান গেয়ে লম্ফ-ঝম্ফ করে সবাই; কিন্তু যুগসন্ধিক্ষণে, নানা প্রলোভন-বিভীষিকার সম্মুখে মাতৃভাষাকে নিজের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা বলতে পারাতেই প্রকৃত সাহস, প্রকৃত জ্ঞান উপলব্ধির লক্ষণ। সৈয়দ সুলতানের দুইশত বৎসর পরে ইংরেজি ভাষা বাঙালিকে প্রলোভন দেখিয়েছিল আরেকবার। কিন্তু মুসলমান সুলতানের ন্যায় খ্রিস্টান মাইকেল তখন উচ্চকণ্ঠে বাঙলার জয়গান গেয়েছিলেন।
সৈয়দ সুলতানের অনুকরণকারীরা কিন্তু তাঁর মতো বিচক্ষণ ভাষাবিদ ছিলেন না : ফলে বাঙলাতে যে পরিমাণে আরবি-ফারসি শব্দ প্রবেশ করতে লাগল তাতে ভাষার বৈশিষ্ট্য বিপন্ন হতে লাগল। ইতোমধ্যে– মোগল যুগের শেষের দিকে–উর্দু ভাষাও বাঙলা দেশে প্রবেশ করেছে। তাই তখন যে বাঙলা পাচ্ছি তার উদাহরণ–
বিশ্বনাথ বিশ্বাসে বুঝায়ে বলে বাছা।
দুনিয়ামে এসাভি আদমি রহে সাঁচা।
ভালা বাওয়া কাহে তো মৃত্যুকাল কাছে।…
রাতদিন যৈসা তৈসা সুখ দুঃখ হোয়ে ॥
জানা গেল বাত যাওয়া জানা গেল বাত।
কাপড়া লেও আও আও মেরা সাথ ॥
যুক্তি নয়, অজুহাত হিসেবে বলা যেতে পারে, আকবরের আমল থেকে বহুল ফারসি শিক্ষাদানের ফলে বাঙলা দেশে তখন প্রচুর লোক বিস্তর আরবি-ফারসি শব্দ দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে। এটি কিন্তু কোনও সংযুক্তি নয়। কারণ আজ আমরা দৈনন্দিন জীবনে বিস্তর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি : তাই বলে সাহিত্যসৃষ্টির সময় বে-এক্তেয়ার হয়ে যত্র-তত্র ভূরি ভূরি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করিনে।
কিন্তু সত্য কবি পথভ্রষ্ট হন না। তার প্রকৃত নিদর্শন আমরা পাই, চট্টগ্রামের মহিলা কবি ‘শ্ৰীমতী রহীমুন্নিসা’র (আশা করি ‘শ্রীমতী’ লেখাতে কেউ আপত্তি করবেন না, কারণ তিনি নিজেই তাঁর কাব্যে আপন পরিচয় দেবার সময় লিখেছেন–
‘স্বামী আজ্ঞা শিরে পালি লিখি এ ভারতী।
রহিমুনিচা নাম জান আদ্যে ছিরীমতী ॥’)।
এই মহিলা কবির সঙ্গে হালে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সুপণ্ডিত ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, পূর্ববঙ্গের বাঙলা একাডেমীর প্রথম ডাইরেক্টর (বাঙলা-একাডেমী পত্রিকা, ১ম সংখ্যা, পৌষ ১৩৬৩, পৃ. ৫৩)। তাঁর মতে ‘১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ হইতে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই রহীমু’নিসা আবির্ভূত হয়েছিলেন।’ ইনিও সৈয়দ সুলতানের মতো সৈয়দ বংশের মেয়ে এবং পরিবারে প্রচুর আরবি-ফারসির চর্চা থাকা সত্ত্বেও সুস্থ-সবল এবং মধুর বাংলায় কবিতা রচনা করে গিয়েছেন।
এঁর হাতের লেখা খুব সম্ভব সুন্দর ছিল। তাই বোধ করি তার স্বামী তাঁকে কবি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ নকল করতে আদেশ দেন :
শুন গুণিগণ হই এক মন,
লেখিকার নিবেদন।
অক্ষর পড়িলে টুটা পদ হৈলে
শুধারিত সর্বজন ॥
পদ এই রাষ্ট্র। হেন মহাকষ্ট
পুঁথি সতী পদ্মাবতী।
আলাওল মণি বুদ্ধি বলে গুণী,
বিরচিল এ ভারতী ॥
পদের উতি বুঝি কি শকতি,
মুই হীন তিরী জাতি।
স্বামীর আদেশ মানিয়া বিশেষ
সাহস করিল গাঁথি ॥
রহীমুন্নিসার স্বরচিত কাব্য অল্পই পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে তাঁর একটি ‘বারমাস্যা’ বড়ই করুণ এবং মধুর। পূর্ববঙ্গের কবিরা সচরাচর প্রিয়বিরহে বারমাস্যা রচনা করেছেন– রহীমুন্নিসা ভ্রাতৃশোকে ভার তাঁর নব বারমাস্যা রচনা করেছেন।
আশ্বিনেতে খোয়াময় কান্দে তরুলতায়
ভাই বলি কান্দে উভরায়।
আমার কান্দনি শুনি বনে কান্দে কুরঙ্গিণী
জলে মাছ কান্দিয়া লুকায় ॥
খোয়া = কুয়াশা
অন্য এক স্থলে ‘কন্যাহারা জননী’র শোকাতুরার ক্রন্দন প্রকাশ করেছেন অতুলনীয় সরল বাঙলায়–
নয়া সন নয়া মাস ফিরে বারে বার।
মোর জাদু গেল ফিরি না আসিল আর ॥
এঁর রচনায় সত্যই মধুর কবি-প্রতিভা ‘বারেবার’ ধরা পড়ে। পাঠকদের মূল প্রবন্ধটি পড়তে অনুরোধ জানাই।
***
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বন্দ্ব প্রধানত ইংরেজির সঙ্গে। এবং সেই দ্বন্দ্ব বিদ্রোহরূপ ধারণ করল পুব বাঙলার ভাষা আন্দোলনে ১৯৫১-৫২ খ্রিস্টাব্দে। বাঙলা আবার জয়ী হল– কিন্তু এবারে তার জয়মূল্য দিতে হল বুকের রক্ত দিয়ে– কিন্তু আব্রু, ইজ্জত, ইমান দিয়ে নয়। পাকিস্তান হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব বাঙলার লোক বাঙলাতে আরেক দফে আরবি-ফারসি শব্দ আমদানি করে ভাষাকে ‘পাক’ করতে প্রলোভিত হল না!
তাই এই প্রবন্ধের নাম দিয়েছি ‘মামদো’র পুনর্জন্ম। ‘মামদো’রই যখন কোনও অস্তিত্ব নেই, তখন তার পুনর্জন্ম হবে কী প্রকারে? পুর্ব বাঙলার লেখকদের স্কন্ধে আরবি-ফারসি শব্দের মামদো ভর করবে, আর তারা বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে আরবি-ফারসিতে অর্থাৎ ‘যাবনী মেশালে’ কিচিরমিচির করতে আরম্ভ করবে, বিজাতীয় সাহিত্য সৃষ্টি করবে– যার মাথামুণ্ডু পশ্চিম বাঙলার লোক বুঝতে পারবে না, সে ভয় ‘স্বপ্ন, মায়া, মতিভ্রম’।
রবি-পুরাণ
রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে প্রচুর বক্তৃতা প্রচুরতর প্রবন্ধ এবং অল্প-বিস্তর বেতার কার্যকলাপের ব্যবস্থা এদেশের গুণী-জ্ঞানীরা করে থাকেন। সেই অবসরে কেউ কেউ আমাকেও স্মরণ করেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে এঁরা আমার কল্যাণ কামনা করেন; সরল জনের পক্ষে অনুমান করা অসম্ভব নয় যে এই করে হয়তো দেশে আমার নামটা কিঞ্চিৎ ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু আসলে যারা আমাকে স্মরণ করেন তাঁরা আমার প্রাণের বৈরী। এঁরা আমাকে সর্বজনসমক্ষে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলতে চান, ‘দেখো, এ লোকটা কত বড় গণ্ডমূর্খ; কবিগুরুর সংস্পর্শে এসেও এর কিছু হল না।’ সাধে কি আর তুলসীদাস রামচরিতমানসে বলেছেন,
‘মূরখ হৃদয় ন চেৎ, যদপি মিলয়ে
গুরু বিরিঞ্চি শত’
‘শত ব্রহ্মা গুরুপদ নিলেও মূর্খের ক
হৃদয়ে চেতনা হয় না’
আমি মূর্খ হতে পারি কিন্তু এতখানি মূর্খ নই যে তাঁদের দুষ্টবুদ্ধিজাত নষ্টামির চিন্তা ধরতে পারব না।
তাই ওই সময়টায় আমি গা-ঢাকা দিয়ে থাকি। নিতান্ত কারও সঙ্গে দেখা হলে বলি, এনৃজাইনা থ্রম্বোসিস হয়েছে। এনজাইনা পিক্টরিস কিংবা করোনারি থ্রম্বোসিস-এর যে-কোনও একটার নাম শুনলেই সুস্থ মানুষের হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম করে– আমার ওই দ্বন্দ্বসমাস শুনে আমাকে তখন আর কেউ বড় একটা ঘ্যাঁটায় না।
অথচ রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে দু একটি কথা বলবার সাধ যে আমার হয় না, তা-ও নয়। অবশ্য তাঁর কাব্য, নাট্য কিংবা জীবনদর্শন সম্বন্ধে নয়। অতখানি কাণ্ডজ্ঞান বা কমনসেনস্ আমার আছে। আমার বলতে ইচ্ছে করে সেই জিনিস, ইংরেজিতে যাকে বলে লাইটার সাইড। এই যেমন মনে করুন, তিনি গল্পগুজব করতে ভালোবাসতেন কি না, প্রিয়জনের সঙ্গে হাস্যপরিহাস করতেন কি না, ডাইনিঙ-রুমে বসে চেয়ার টেবিলে ছুরিকাঁটা দিয়ে ছিমছামভাবে সায়েবি কায়দায় খেতেন, না রান্নাঘরের বারান্দায় হাপুস-হুঁপুস শব্দে মাদ্রাজি স্টাইলে পাড়া সচকিত করে পর্বটি সমাধান করে সর্বশেষে কাবুলি কায়দায় ঘোঁতঘোঁত করে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বাঙালি কায়দায় চটি ফটফটিয়ে খড়কের সন্ধানে বেরোতেন? কেউ তাঁকে প্রেমপত্র লিখলে তিনি কী করতেন? কিংবা ডিহি শ্রীরামপুর দুই নম্বর বাই লেন তাদের কম্বল বিতরণী সভায় তাঁকে প্রধান অতিথি করার জন্য ঝুলাঝুলি লাগালে তিনি সেটা এড়াবার জন্য কোন পন্থা অবলম্বন করতেন? কিংবা কেউ টাকা ধার চাইলে?
ভালোই হল টাকা ধারের কথা মনে পড়ল।
‘দেহলী’র উপরে থাকতেন তিনি, নিচের তলায় তাঁর নাতি দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ওরফে দিনুবাবু।
তাঁরই বারান্দায় বসে আশ-কথা-পাশ-কথা নানা কথা হচ্ছে। হতে হতে টাকা ধার নেওয়ার কথা উঠল। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘বুঝলি দিনু, আমার কাছ থেকে একবার একজন লোক দশ টাকা ধার নিয়ে গদগদ কণ্ঠে বলল, আপনার কাছে আমি চিরঋণী হয়ে রইলুম।’ সভায় যারা ছিলেন তাঁরা পয়েন্টটা ঠিক কী বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলেন। আফটার অল, গুরুদেবের পক্ষেও কালে-কম্মিনে কাঁচা রসিকতা করা অসম্ভব না-ও হতে পারে।
খানিকক্ষণ পরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শুরুদেব বললেন, ‘লোকটার শত-দোষ থাকলেও একটা গুণ ছিল। লোকটা সত্যভাষী! কথা ঠিক রেখেছিল। চিরঋণী হয়েই রইল।’
শ্ৰীযুত বিধুশেখর শাস্ত্রী, নেপালচন্দ্র রায় ইত্যাদি মুরুব্বিরা অট্টহাস্য করেছিলেন। আমরা, অর্থাৎ চ্যাংড়ারা, থামের আড়ালে ফিকফিক করেছিলুম।
এ গল্পটি আমি একাধিক লোকের মারফত পরেও শুনেছি। হয়তো তিনি গল্পটি একাধিক সভা-মজলিসে বলেছেন। এবং গল্পটি আদৌ তার নিজের বানানো না অন্যের কাছ থেকে ধার-নেওয়া সেকথাও হলফ করে বলতে পারব না। কারণ কাব্যানুশাসনের টীকা লিখতে গিয়ে আলঙ্কারিক হেমচন্দ্র বলেছেন, ‘নাস্ত্য চৌরঃ কবিজন নাস্ত্য চৌরো বণিকজনঃ;–অর্থাৎ ‘বড় বিদ্যাটি বিলক্ষণ রপ্ত আছে স্যাকরার এবং কবি মাত্রেরই।’
তা হোক। মহাকবি হাইনরি হাইনে তাতে কণামাত্র আপত্তি না তুলে বলেছেন, ‘যারা কবির রচনাতে “নির্ভেজাল” অরিজিনালিটি খোঁজে তারা চিবাক মাকড়ের জাল, কারণ একমাত্র মাকড়ই তার জালটি তৈরি করে আপন পেটের মাল দিয়ে, মোল আনা অরিজিনাল; আমি কিন্তু খেতে ভালোবাসি মধু, যদিও বেশ ভালোভাবেই জানি মধুভাণ্ডের প্রতিটি ফোঁটা ফুলের কাছ থেকে চোরাই করা মাল।’
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে প্রচলিত গল্পের ভিতর আমার সবচেয়ে ভালো লাগে ‘গুরুদেব-ভাণ্ডারে’ কাহিনী! অবশ্য আমার মনে হয়, গল্পটির নাম ‘ভাণ্ডারে গুরুদেব’ কাহিনী দিলে ভালো হয়, কারণ কাহিনীটি সম্পূর্ণ নির্ভর করছে, ভাণ্ডারের একটি সৎকর্মের ওপর। তুলনা দিয়ে বলতে পারি, অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু যখন তাঁর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার জগজ্জন সম্মুখে প্রকাশ করলেন তখন কালা আদমির কেরানি বরদাস্ত না করতে পেরে ইংরেজ আবিষ্কারটার নামকরণ করল ‘আইনস্টাইন-বোস থিয়রি’। স্বয়ং আইনস্টাইন তখন নাকি প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, ওটার নাম হয় হবে শুধুমাত্র ‘বোস থিয়রি’ নয় ‘বোস-আইনস্টাইন থিয়রি’। এসব অবশ্য আমাদের শোনা কথা। ভুল হলে পুজোর বাজারের বিলাস বলে ধরে নেবেন।
রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাধারা ইংরেজ পছন্দ করত না বলে শান্তিনিকেতন আশ্রমটিকে নষ্ট করার জন্য ইংরেজ একটি সূক্ষ্ম গুজব বাজারে ছড়ায়– শান্তিনিকেতনের স্কুল আসলে রিফরমেটরি। অন্তত এই আমার বিশ্বাস।
খুব সম্ভব তারই ফলে আশ্রমে মারাঠি ছেলে ভাণ্ডারের উদয়।
স্কুলের মধ্য বিভাগে বীথিকা-ঘরে ভাণ্ডারে সিট পেল। এ ঘরটি এখন আর নেই, তবে ভিতটি স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। তারই সমুখ দিয়ে গেছে শালবীথি। তারই একপ্রান্তে লাইব্রেরি, অন্যপ্রান্তে দেহলী। গুরুদেব তখন থাকতেন দেহলীতে।
দেহলী থেকে বেরিয়ে, শালবীথি হয়ে গুরুদেব চলেছেন লাইব্রেরির দিকে। পরনে লম্বা জোব্বা, মাথায় কালো টুপি। ভাণ্ডারে দেখামাত্রই ছুটল তাঁর দিকে। আর সব ছেলেরা অবাক। ছোকরা আশ্রমে এসেছে দশ মিনিট হয় কি না হয়। এরই মধ্যে কাউকে কিছু ভালো-মন্দ না শুধিয়ে ছুটল গুরুদেবের দিকে।
আড়াল থেকে সবাই দেখল ভাণ্ডারে গুরুদেবকে কী যেন একটা বলল। গুরুদেব মৃদুহাস্য করলেন। মনে হল যেন অল্প অল্প আপত্তি জানাচ্ছেন। ভাণ্ডারে চাপ দিচ্ছে। শেষটায় ভাণ্ডারে গুরুদেবের হাতে কী একটা গুঁজে দিল। গুরুদেব আবার মৃদু হাস্য করে জোব্বার নিচে হাত চালিয়ে ভিতরের জেবে সেটি রেখে দিলেন। ভাণ্ডারে একগাল হেসে ডরমিটরিতে ফিরে এল। প্রণাম না, নমস্কার পর্যন্ত না।
সবাই শুধাল, ‘গুরুদেবকে কী দিলি?’
ভাণ্ডারে তার মারাঠি-হিন্দিতে বলল, ‘গুরুদেব কৌন? ওহ তো দরবেশ হৈ।’
‘বলিস কী রে, ও তো গুরুদেব হ্যায়!’
‘ক্যা “গুরুদেব” “গুরুদেব” কর তা হৈ। হম উসকো এক অঠন্নি দিয়া।’
বলে কী? মাথা খারাপ না বদ্ধপাগল? শুরুদেবকে আধুলি দিয়েছে!
জিগ্যেসাবাদ করে জানা গেল, দেশ ছাড়ার সময় ভাণ্ডারের ঠাকুরমা তাকে নাকি উপদেশ দিয়েছেন, সন্ন্যাসী-দরবেশকে দানদক্ষিণা করতে। ভাণ্ডারে তাঁরই কথামতো দরবেশকে একটি আধুলি দিয়েছে। তবে হ্যাঁ, দরবেশ বাবাজি প্রথমটায় একটু আপত্তি জানিয়েছিল বটে, কিন্তু ভাণ্ডারে চালাক ছোকরা, সহজে দমে না, চালাকি নয়, বাবা, এ একটি পুরি অঠন্নি!
চল্লিশ বছরের আগের কথা। অঠন্নি সামান্য পয়সা, একথা কেউ বলেনি। কিন্তু ভাণ্ডারেকে এটা কিছুতেই বোঝানো গেল না যে তার দানের পাত্র দরবেশ নয়, স্বয়ং গুরুদেব।
ভাণ্ডারের ভুল ভাঙতে কতদিন লেগেছিল, আশ্রম পুরাণ এ বিষয়ে নীরব। কিন্তু সেটা এস্থলে অবান্তর।
ইতোমধ্যে ভাণ্ডারে তার স্বরূপ প্রকাশ করেছে। ছেলেরা অস্থির, মাস্টাররা জ্বালাতন, চতুর্দিকে পরিত্রাহি আৰ্তরব।
হেডমাস্টার জগদানন্দবাবু এককালে রবীন্দ্রনাথের জমিদারি-সেরেস্তায় কাজ করেছিলেন। লেঠেল ঠ্যাঙানো ছিল তাঁর প্রধান কর্ম। তিনি পর্যন্ত এই দুঁদে ছেলের সামনে হার মেনে গুরুদেবকে জানালেন।
আশ্রম-স্মৃতি বলেন, গুরুদেব ভাণ্ডারেকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ-রে, ভাণ্ডারে, এ কী কথা শুনি?’
ভাণ্ডারে চুপ।
শুরুদেব নাকি কাতর নয়নে বললেন, ‘হ্যাঁরে ভাণ্ডারে, শেষপর্যন্ত তুই এসব আরম্ভ করলি? তোর মতো ভালো ছেলে আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। আর তুই এখন আরম্ভ করলি
এমন সব জিনিস যার জন্য সক্কলের সামনে আমাকে মাথা নিচু করতে হচ্ছে। মনে আছে, তুই যখন প্রথম এলি তখন কীরকম ভালো ছেলে ছিলি? মনে নেই, তুই দান-খয়রাত পর্যন্ত করতিস? আমাকে পর্যন্ত তুই একটি পুরো আধুলি দিয়েছিলি? আজ পর্যন্ত কত ছাত্র এল-গেল, কেউ আমাকে একটি পয়সা পর্যন্ত দেয়নি। সেই আধুলিটি আমি কত যত্নে তুলে রেখেছি। দেখবি?’
***
তার দু এক বৎসরের পর আমি শান্তিনিকেতনে আসি। মারাঠি সঙ্গীতজ্ঞ স্বর্গীয় ভীমরাও শাস্ত্রী তখন সকালবেলার বৈতালিক লিড করতেন। তার কিছুদিন পর শ্ৰীযুত অনাদি দস্তিদার। তার পর ভাণ্ডারে।
চল্লিশ বছর হয়ে গিয়েছে। এখনও যেন দেখতে পাই ছোকরা ভাণ্ডারে বৈতালিকে গাইছে,
এ দিন আজি কোন ঘরে গো
খুলে দিল দ্বার।
আজি প্ৰাতে সূর্য ওঠা
সফল হল কার ॥
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব
ধর্মের ইতিহাসে দেখা যায়, কোনও সভ্য জাতির বিত্তশালী সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা কিংবা অন্য কোনও বোধ্য ভাষাতে যদি ধর্মচর্চা না থাকে তবে সে সম্প্রদায় ক্রিয়া-কর্ম ও পাল-পার্বণ নিয়েই মত্ত থাকে! এই তত্ত্বটি ভারতবাসীর ক্ষেত্রে অধিকতর প্রযোজ্য। কারণ, তারা স্বভাবত এবং ঐতিহ্যবশত ধর্মানুরাগী। তার কোনও বোধ্য ভাষাতে সত্যধর্মের মূলস্বরূপ সম্বন্ধে কোনও নির্দেশ না থাকলে সে তখন সবকিছু হারাবার ভয়ে ধর্মের বহিরাচরণ অর্থাৎ তার খোলস ক্রিয়াকর্মকেই আঁকড়ে ধরে থাকে।(১)
কলকাতা অর্বাচীন শহর। যেসব হিন্দু এ শহরের গোড়াপত্তনকালে ইংরেজের সাহায্য করে বিত্তশালী হন, তাঁদের ভিতর সংস্কৃত ভাষার কোনও চর্চা ছিল না। বাঙলা গদ্য তখনও জন্মলাভ করেনি। কাজেই মাতৃভাষার মাধ্যমে যে তাঁরা সত্যধর্মের সন্ধান পাবেন তারও কোনও উপায় ছিল না। ওদিকে আবার বাঙালি ধর্মপ্রাণ। তাই সে তখন কলকাতা শহরে পাল-পার্বণে যা সমারোহ করল তা দেখে অধিকতর বিত্তশালী শাসক ইংরেজ-সম্প্রদায় পর্যন্ত স্তম্ভিত হল। এর শেষ-রেশ ‘হুতোমে’ পাওয়া যায়।
জাতির উত্থান-পতনেও এ অবস্থা বারবার ঘটে থাকে। এবং সমগ্রভাবে বিচার করতে গেলে তাতে করে জাতির বিশেষ কোনও ক্ষতি হয় না। গরিব-দুঃখীর তথা সমগ্র সমাজের জন্য এর একটা অর্থনৈতিক মূল্য তো আছে বটেই, তদুপরি এক যুগের অত্যধিক পাল-পার্বণের মোহকে পরবর্তী যুগের ঐকান্তিক ধ্যান-ধারণা অনেকখানি ক্ষতিপূরণ করে দেয়।
কিন্তু বিপদ ঘটে, যখন ওই ক্রিয়াকর্মের যুগে হঠাৎ এক বিদেশি ধর্ম এসে উপস্থিত হয়, তার চিন্তাধারা তার সত্যপথ সন্ধানের আন্দোলন-আলোড়ন নিয়ে। এবং ওই ধর্মজিজ্ঞাসার সঙ্গে সঙ্গে যদি অন্যান্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক (কঁৎ, মিল ইত্যাদি) প্রশ্নের যুক্তিতর্কমূলক, আলোচনা-গবেষণা বিজড়িত থাকে তবে ক্রিয়াকর্মাসক্ত সমাজের পক্ষে সমূহ বিপদ উপস্থিত হয়। বাঙালি সমাজের অগ্রণীগণ ইংরেজের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গিয়ে অনেকখানি ইংরেজি শিখে ফেলেছেন এবং খ্রিস্টধর্মের মূলতত্ত্ব, তার মহান আদর্শবাদ, সেই ধর্মে অনুপ্রাণিত মহাজনগণের সমাজসংস্কার প্রচেষ্টা তাঁদের মনকে বারবার বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে তাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, আমাদের ধর্মে আছে কী, আছে তো শুধু দেখতে পাই অন্তঃসারশূন্য পূজা-পার্বণ, আর ওদের ধর্মে দেখি, স্বয়ং ভগবান পিতারূপে মানুষের হৃদয়দ্বারের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁকে পেলে এই অর্থহীন জীবনযাপন চরম মূল্য লাভ করে, দুঃখ-দৈন্য আশা-আকাঙ্ক্ষা এক পরম পরিসমাপ্তিতে অনন্ত জীবন লাভ করে।
হিন্দুশাস্ত্রের অতি সামান্য অংশও যাঁরা অধ্যয়ন করেছেন তাঁরাই জানেন, এসব কিছু নতুন তত্ত্ব নয়। বস্তুত জীবনসমস্যা ও ধর্মে তার সমাধান এই অবলম্বন করেই আমাদের সর্বশাস্ত্র গড়ে উঠেছে। একদিকে দৈনন্দিন জীবনের অন্তহীন প্রলোভন, অন্যদিকে সত্যনিষ্ঠার প্রতি ধর্মের কঠোর কঠিন আদেশ–এ দুয়ের মাঝখানে মানুষ কী প্রকারে সার্থক গৃহী হতে পারে, সেই পন্থাই তো আমাদের শাস্ত্রকারগণ যুগে যুগে দেখিয়ে গেছেন।
কিন্তু এসব তত্ত্ব যাঁরা জানতেন তারা থাকতেন গ্রামে, তাঁরা পড়তেন পড়াতেন টোল চতুম্পাঠীতে এবং তাঁরা ইংরেজের সংস্পর্শে আসেননি বলে ওদের ধর্ম যে নাগরিক হিন্দুকে নানা প্রশ্নে বিচলিত করে তুলেছে সে সংবাদ তাঁদের কানে এসে পৌঁছয়নি!
আর সবচেয়ে আশ্চর্য, এইসব ‘টোলো’ ‘বিটলে বামুন’-রা যে শুধু পাদ্রি সাহেবদের। সঙ্গে তর্কযুদ্ধে আপন ধর্মের মর্যাদা মহিমা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারত তা নয়, তারা যে কান্ট-হেগেল-এর চেলাদের সঙ্গে বিশুদ্ধ দর্শনের ক্ষেত্রেও সংগ্রাম করতে প্রস্তুত ছিল এ তত্ত্বটিও নাগরিক হিন্দুদের সম্পূর্ণ অজানা ছিল। ‘ঘরের কাছে নিই নে খবর, খুঁজতে গেলাম দিল্লি শহর’ লালন ফকিরের অর্থহীন গীত নয়।(২) এঁরা সত্যই জানতেন না, আমাদের টোলে শুধু স্মার্ত নন, নৈয়ায়িকও ছিলেন, এবং স্মার্তরাও যে শুধু তৈলবট নিয়ে বিধান দিতেন তাই নয়, তারা সে বিধানের সামাজিক মূল্যও যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করতে পারতেন।
কলকাতায় চিন্তাশীল গুণীজন তখন এই পরিস্থিতি দেখে বিচলিত হয়েছিলেন।
সৌভাগ্যক্রমে এই সময় রাজা রামমোহন রায়ের উদয় হল। তাঁর ব্রাহ্ম-আন্দোলন যে বাঙালি জাতির কী পরিমাণ উপকার করেছে, এই ব্রাহ্মসমাজের কীর্তিমান পুরুষসিংহ রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যকে যে কী পরিমাণ ঐশ্বর্যশালী ও বহুমুখী করে গিয়েছেন, তার সম্পূর্ণ হিসাব-নিকাশ এখনও শেষ হয়নি। বাঙালি সাধক, বাঙালি লেখক, বাঙালি পাঠক সকলেই সেকথা স্বীকার করেছেন। স্বয়ং শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন–
এদানির ব্রাহ্মধর্ম যায় ছড়াছড়ি
তাহারেও বারবার নমস্কার করি।
‘ছড়াছড়ি’ শব্দে তখনকার দিনে প্রচলিত একটু ক্ষুদ্র তাচ্ছিল্য লুকানো রয়েছে। পরমহংসদেব সেটিকেও নমস্কার করেছেন।
রাজা রামমোহন খ্রিস্টধর্মে মহাপণ্ডিত ছিলেন, মুসলমান ধর্মের ‘জবরদস্ত মৌলভি’ ছিলেন এবং সবচেয়ে বড় কথা, সে যুগে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হলে যে বস্তু সম্পূর্ণ অবান্তর এমনকি অন্তরায়, সেই হিন্দু ধর্ম-শাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য, অতুলনীয় ব্যুৎপত্তি এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল।
রাজা জানতেন, সে যুগের হিন্দুকে তর্ক-বিতর্ক করতে হবে খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে। অর্থাৎ খ্রিস্টান মিশনারির সামনে ‘ক’ অক্ষরে ‘কৃষ্ণনাম’ স্মরণে ‘একঘটি’(৩) চোখের জল ফেললেই আপন ধর্মের মাহাত্ম্য সুপ্রতিষ্ঠিত হবে না- খুব বেশি হলে, ভদ্র মিশনারি হয়তো তাকে ভক্ত বলে স্বীকার করবে মাত্র। তাই তাকে প্রমাণ করতে হবে যে, কলকাতার হিন্দুর ক্রিয়াকর্মের পিছনে রয়েছে, হিন্দুর ষড়দর্শন, বুদ্ধ এবং মহাবীরের বিশ্বপ্রেম এবং সর্বপশ্চাতে রয়েছে অহরহ জাজ্বল্যমান বেদবেদান্তের অখও দিব্যদৃষ্টি।
দেশের আপামর জনসাধারণের ভিতর হিন্দুধর্মের নব উন্মাদনা আনতে হলে রাজা রামমোহন হিন্দুধর্মের কোন কোন সম্পদ গ্রহণ এবং প্রচার করতেন সেকথা বলা শক্ত; কিন্তু এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, সে যুগের কলিকাতাবাসী সুসভ্য অথচ আপন শাস্ত্রে অজ্ঞ হিন্দুর সামনে তিনি সর্বশাস্ত্র মন্থন করে উপনিষদগুলোই তুলে ধরে প্রকৃত ঋষির গভীর অন্তদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছিলেন। উপনিষদ থেকেই শঙ্কর-দর্শনের সূত্রপাত এবং শঙ্করের অদ্বৈতবাদ অতিশয় অক্লেশে, পরম অবহেলায় খ্রিস্টানের ট্রিনিটিকে সম্মুখ-সংগ্রামে আহ্বান করতে পারে। উপনিষদের গুণকীর্তন এ ক্ষুদ্র এবং অক্ষম রচনার উদ্দেশ্য নহে– অনুসন্ধিৎসু পাঠক তুর্কি পণ্ডিত অলবিরুনি, মোগল সুফি দারাশিকুহ, (ঔরঙ্গজিবের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা)(৪) এবং জর্মন দার্শনিক শোপেনহাওয়ারের রচনাতে তার ভূরি ভূরি উদাহরণ পাবেন।
ধর্মের যেসব বাহ্যানুষ্ঠান সত্যধর্ম থেকে অতি দূরে চলে গিয়ে অধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে রাজা সংগ্রাম আরম্ভ করলেন সতীদাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ করে এবং সে সংগ্রামের জন্য তিনি অস্ত্রশস্ত্র সঞ্চয় করলেন হিন্দু স্মৃতি থেকেই। এস্থলে রাজা বিশ্বজনীন যুক্তিতর্ক ব্যবহার না করে প্রধানত ব্যবহার করলেন হিন্দুশাস্ত্রসম্মত ন্যায় এবং উদাহরণ। রাজা প্রমাণ করলেন যে তিনি দর্শনের যেরকম বিদগ্ধ, ক্রিয়াকর্মের ভূমিতেও অনুরূপ স্মার্ত মল্লবীর।
শাস্ত্রালোচনায় ঈষৎ অবান্তর হলেও এস্থলে বাংলা সাহিত্যানুরাগীর দৃষ্টি তার অতি প্রিয় একটি বস্তুর দিকে আকর্ষণ করি। রাজাকে তাঁর আন্দোলন চালাতে হয়েছিল কলকাতার বাঙালিদের ভিতর। এঁরা সংস্কৃত জানেন না। তাই তাকে বাধ্য হয়ে লিখতে হয়েছিল বাঙলা ভাষাতে। পদ্য এসব যুক্তি-তর্কের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত বাহন। তাই তাঁকে বাঙলা গদ্য নির্মাণ করে তার-ই মাধ্যমে আপন বক্তব্য প্রকাশ করতে হয়েছিল। রাজার পূর্বে-যে বাঙলা গদ্য লেখা হয়নি এসব বলা আমার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু হিন্দুধর্মের এই তুমুল আন্দোলন আকর্ষণ মন্থনের ফলে যে অমৃত বেরুল তারই নাম বাঙলা গদ্য। পৃথিবীর ইতিহাসে এ জাতীয় ঘটনা বহুবার ঘটেছে; তথাগতের কৃপায় পালি, মহাবীরের কৃপায় অর্ধমাগধী। হজরত মুহম্মদের কৃপায় আরবি গদ্য, লুথারের কৃপায় জর্মন গদ্যের সৃষ্টি। পূর্বেই নিবেদন করেছি, গণবোধ্য মাতৃভাষাতে শাস্ত্রালোচনা না থাকলে ক্রিয়াকর্মের আত্যন্তিক প্রসার পায়; তার বিরুদ্ধে নবধর্ম পত্তন কিংবা সনাতন ধর্মের সংস্কার আন্দোলন আরম্ভ হয়;(৫) এবং সে আন্দোলনকে বাধ্য হয়েই গণ-ভাষার আশ্রয় নিতে হয়।
রাজার প্রচলিত সংস্কার উপনিষদে আপনার দৃঢ়ভঙ্গি নির্মাণ করার ফলে কতকগুলো জিনিস সে অস্বীকার করল। তার প্রথম, সাকার উপাসনা। দ্বিতীয় বৈষ্ণবধর্মের তদানীন্তন প্রচলিত রূপ; ক্রমে ক্রমে গণ-ধর্মের (Folk religion) প্রতি ব্রাহ্মদের অবজ্ঞা স্পষ্টতর হতে লাগল।(৬) প্রমাণ স্বরূপ বলতে পারি, তখনকার দিনে কেন, আজও যদি কেউ ব্রাহ্মমন্দিরের বক্তৃতা দিনের পর দিন শোনে তবু সে উপনিষদের পরবর্তী যুগের ধর্ম-সাধনার অল্প ইঙ্গিতই শুনতে পাবে। তার মনে হবে, উপনিষদ-আশ্রিত ধর্মদর্শনের শেষ হয়ে যাওয়ার পর আজ পর্যন্ত হিন্দুরা আর কোনও প্রকারের উন্নতি করতে পারেননি। এমনকি গীতার উল্লেখও আমি অল্পই শুনেছি। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণের কথা প্রায় কখনওই শুনিনি। বৃন্দাবনের রসরাজ-রসমতীর অভূতপূর্ব অলৌকিক প্রেমের কাহিনী থেকে কোনও ব্রাহ্ম কখনও কোনও দৃষ্টান্ত আহরণ করেননি।
ধর্ম জানেন, আমি ব্রাহ্মদের নিকট অকৃতজ্ঞ নই। পাছে তাঁরা ভুল বোঝেন তাই বাধ্য হয়ে ব্যক্তিগত কথা তুললুম এবং করজোড়ে নিবেদন করছি, আমি মুসলমান, আমার কাছে হিন্দু যা ব্রাহ্মও তা, আমি হিন্দু-ব্রাহ্ম উভয় পন্থার (আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস পন্থা ভিন্ন নয়) সাধু-সন্তদের বারবার নমস্কার করি।
ব্রাহ্মধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ যতই অধ্যয়ন করি ততই দেখতে পাই, ব্রাহ্মরা যেন ক্রমে ক্রমেই জনগণ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন। জনগণকে ব্রহ্মমন্ত্রে দীক্ষিত করে এক বিরাট গণ-আন্দোলন আরম্ভ করার প্রচেষ্টা যেন তাদের ভিতর ছিল না। এ যুগেও তার উদাহরণ পাইনি। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত আমি বহু ব্রাহ্ম পরিবারের আতিথ্য লাভ করেছি, ফলে গভীর হৃদ্যতা হয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও ব্রাহ্ম পরিবারের হিন্দু চাকর-বাকরদের ব্রহ্মমন্ত্রে দীক্ষিত করার প্রচেষ্টা দেখিনি। মুসলমান-খ্রিস্টানরা সর্বদাই করে থাকেন বলেই এটা আমার কাছে আশ্চর্যজনক বলে মনে হয়েছিল। আমার মনে হয়, ব্ৰহ্মমন্ত্র সার্বজনীন কিন্তু একথাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ব্রহ্মজ্ঞানীরা যেকোনো কারণেই হোক সর্বজনকে আহ্বান জানাতে পারেননি। মুসলমানের সমাজে মুটে-মজুর চাকর-বাকরের সংখ্যাই বেশি, হিন্দুর সংকীর্তনে ভাবোল্লাসে নৃত্য করে নিম্ন শ্রেণির প্রচুর হিন্দু আর মন্দিরে আরতির সময় শিক্ষিত হিন্দুকে তো আজকাল দেখতেই পাওয়া যায় না। অথচ পূর্ববঙ্গের ব্রাহ্ম-সম্মেলনে ব্রাহ্ম চাকর-নফর দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
তার জন্য আমি ব্ৰহ্মবাদীদের আদৌ ক্রটি ধরছি না। এঁরা অক্ষম ছিলেন, একথা আমি কখনও স্বীকার করব না। আমার মনে হয়, এঁরা প্রধানত সমাজের নেতৃস্থানীয়দের নিয়েই আপন আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন এবং তাদের মাধ্যমে যে আমাদের মতো বহু হিন্দু-মুসলমান প্রচুর উপকৃত হয়েছিলেন সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু এ বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই যে হিন্দু-ধর্মের গণরূপ তখন একেবারেই অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল। তার জন্য ব্রাহ্মদের দোষ দিলে অত্যন্ত অন্যায় হবে; দোষ হিন্দুদের। তাদের নেতৃস্থানীয়েরা তখন হয় দীক্ষা নিয়েছেন কিংবা ব্রাহ্মদের প্রতি সহানুভূতিশীল, আপন গরিব জাত-ভাই কী ধর্মকর্ম করছে এবং তার কল্যাণে সত্যধর্মের সন্ধান পাচ্ছে কি না এ বিষয়ে তাঁরা তখন উদাসীন। যেন গণধর্ম নয়, যেন ধর্মে একমাত্র শিক্ষিতজনেরই শাস্রাধিকার।
অতিশয় মারাত্মক পরিস্থিতি। দেশের দশের তা হলে সর্বনাশ হয়। শিক্ষিতজনকেও শেষ পর্যন্ত তার তিক্ত ফল আস্বাদ করতে হয়।(৭)
***
ঠিক সেই সময়ে করুণাময়ের কৃপায় শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আবির্ভাব।
পরমহংসদেবকে সমগ্র এবং সম্পূর্ণভাবে ধারণা করা আমাদের মতো অতি সাধারণ প্রাণীর পক্ষে অসম্ভব, কারণ, আমরা সবকিছুই গ্রহণ করি আমাদের বুদ্ধি দিয়ে– যুক্তিতর্কের ছাঁচে ফেলে। অথচ কেবলমাত্র বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে সাধু-সন্তদের ধারণা করতে গেলে আমরা পাই। বরফের সেই অতি অল্প অংশটুকুর খবর, যেটি জলের উপর ভাসছে। অর্থাৎ বেশিরভাগ বস্তুটি যে ষষ্ঠেন্দ্রিয় তৃতীয় চক্ষু দিয়ে দেখতে হয় সেটি আমাদের নেই। তৎসত্ত্বেও যারা তার বিচার করে তাদের নিয়ে মৃদু হাস্য করে বাউল গেয়েছেন–
ফুলের বনে কে ঢুকেছে সোনার জহুরি
নিকষে ঘষয়ে কমল, আ মরি আ মরি।
যার যেমন মাপকাঠি। স্যাকরার ক্রাইটেরিয়ন তার নিকষ পাথর। সে তাই দিয়ে পদ্মফুলের শুণ বিচার করতে যায়। কিন্তু এর চেয়েও মারাত্মক অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন স্বয়ং পরমহংসদেব– একাধিকবার। নুনের পুতুল সমুদ্রে নেমেছিল তার গভীরতা মাপবে বলে। তিন পা যেতে না যেতেই সে গলে গিয়ে জলের সঙ্গে মিশে গেল।(৮)
তাই নিয়ে কিন্তু কিছুমাত্র শোক করার প্রয়োজন নেই। স্বয়ং রামকৃষ্ণদেবই বলেছেন, তোমার এক ঘটি জলের দরকার। পুকুরে কত জল তা জেনে তোমার কী হবে?(৯)
তাই মাভৈঃ। যারা বলে আমাদের মতো পাপীতাপীর অধিকার নেই পরমহংসের মতো মহাপুরুষের জীবন নিয়ে আলোচনা করার– তারা ভুল বলে। অধিকার আমাদেরই এক মহাপুরুষ অন্য মহাপুরুষের জীবনী লিখতে যাবেন কেন? সে অধিকার গ্রহণ করতে গিয়ে ভুল-ত্রুটি হলে মহাত্মাদের কিছুমাত্র ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। হীন প্রাণকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই সমূহ বিপদের সম্ভাবনা।
পরমহংসদেবের কাছে আসার পূর্বেই চোখে পড়বে, লোকটি কী সরল। এগিয়ে এলে বোঝা যায়, এঁর বাহির-ভিতর দুই-ই সরল। এঁর শরীরটি যেমন পরিষ্কার, এঁর মনটিও তেমনি পরিষ্কার। মেদিনীপুর অঞ্চলে যাকে বলে ‘নিখিরকিচ’– চাঁচা-ছোলা। যেন এইমাত্র তৈরি হয়েছে কাঁসার ঘটিটি– কোনও জায়গায় টোল পড়েনি।
এঁর মতো সরল ভাষায় কেউ কখনও কথা বলেনি। এঁর ভাষার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্য খ্রিস্টের ভাষা ও বাক্যভঙ্গির। আমাদের দেশের এক আলঙ্কারিক বলেছেন, “উপমা কালিদাসস্য”। এর অর্থ শুধু এই নয় যে কালিদাস উত্তম উপমা প্রয়োগ করতে পারতেন, এর অর্থ উপমামাত্রই কালিদাসের, অর্থাৎ উপমার রাজ্যে কালিদাস একচ্ছত্রাধিপতি। আমাদের মনে হয়, উপমাবৈচিত্র্যে পরমহংসদেব কালিদাসকেও হার মানিয়েছেন। কালিদাস ব্যবহার করেছেন শুধু সুন্দর মধুর তুলনা সেগুলো কাব্যের অঙ্গসৌষ্ঠব বৃদ্ধি করে। রামকৃষ্ণের সেখানে কোনও বাছ-বিচার ছিল না। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, ‘তার জাঁতায় যাই ফেল না কেন, ময়দা হয়ে বেরিয়ে আসে।’ পরমহংসের বেলাও ঠিক তাই। কিছু একটা দেখলেই হল। সময়মতো ঠিক সেটি উপমার আকার নিয়ে বেরিয়ে আসবে। এমনকি, যেসব কথা আমরা সমাজে বলতে কিন্তু কিন্তু করি, পরমহংসদেব সর্বজনসমক্ষে অক্লেশে সেগুলো বলে যেতেন। ভগবানকে পেতে হলে কী ধরনের ‘বেগে’র প্রয়োজন সে সম্বন্ধে তাঁর তুলনাটি উল্লেখ এখানে না-ই বা করলুম।
ঠিক এইখানেই আমরা একটি মূল সূত্র পাব। তিনি জনগণের ধর্ম (ফোক রিলিজিয়ন), আচার-ব্যবহার, ভাষা– সব জিনিসকেই তার চরম মূল্য দেবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন বলেই জনগণের ভাষা, বাচনভঙ্গি সানন্দে ব্যবহার করে যেতেন। জনগণের অন্যায়-অধর্ম তিনি স্বীকার করতেন না। কিন্তু যেখানে শুধুমাত্র রুচির প্রশ্ন সেখানে তিনি ‘ধোপ-দুরন্ত’ ‘ফিটফাট’ হবার কোনও প্রয়োজন বোধ করতেন না। ভাষাতে সে-দিনকার ‘ছুঁৎবাই’ রোগ আমরা পেয়েছিলুম ভিক্টোরীয় রিটানিজম থেকে– তখন কে জানত পঞ্চাশ বছর যেতে-না-যেতেই লরেন্স জয়েস এসে আমাদের ছুঁৎবাইয়ের ‘ভণ্ডামি’ লণ্ডভণ্ড করে দেবেন।(১০)
পরমহংসদেব গণধর্ম স্বীকার করে তার চরম মূল্য দিলেন। সাকার উপাসনা গণধর্মের প্রধান লক্ষণ। বাঙালি সেই সাকারের পূজা করে প্রধানত কালীরূপে। কালীমূর্তি দেখলে অ-হিন্দু রীতিমতো ভয় পায়। পরমহংসদেব সেই কালীকে স্বীকার করলেন।
অথচ ‘দূরের কথা’ বিচার করলে আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি বলে পরমহংসদেব আসলে বেদান্তবাদী। কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি, এ তিন মার্গ তিনি আস্থাভেদে একে-একে বরণ করতে বলেছেন। কিন্তু সবকিছু বলার পর তিনি সর্বদাই বলেছেন, ‘কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত ব্রহ্ম ব্যতীত সবকিছু মিথ্যা বলে অনুভব করতে পারনি ততক্ষণ পর্যন্ত সাধনার সর্বোচ্চ স্তরে উঠতে পারবে না। ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা’ বড় কঠিন পথ। জগৎ মিথ্যা হলে তুমিও মিথ্যা, যিনি বলেছেন তিনিও মিথ্যা, তাঁর কথাও স্বপ্নবৎ। বড় দূরের কথা।’
‘কীরকম জানো, যেমন কর্পূর পোড়ালে কিছুই বাকি থাকে না। কাঠ পোড়ালে তবু ছাই বাকি থাকে। শেষ বিচারের পর সমাধি হয়। তখন “আমি” “তুমি”, “জগৎ”, এসবের খবর থাকে না।’
অথচ গণধর্মে নেমে এসে বলেছেন, “যিনি ব্রহ্ম, তিনিই কালী’। যখন নিষ্ক্রিয়, তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন সৃষ্টি স্থিতি, প্রলয় এইসব কাজ করেন, তাঁকে শক্তি বলে কই। স্থির জল ব্রহ্মের উপমা। জল হেলছে দুলছে শক্তি বা কালীর উপমা। ‘কালী সাকার আকার নিরাকার’। তোমাদের যদি নিরাকার বলে বিশ্বাস, কালীকে সেইরূপ চিন্তা করবে।(১১) আর একটি কথা– তোমার নিরাকার বলে যদি বিশ্বাস, দৃঢ় করে তাই বিশ্বাস কর কিন্তু মতুয়ার (dogmatism) বুদ্ধি কর না। তাঁর সম্বন্ধে এমন কথা জোর করে বল না যে তিনি এই হতে পারেন, আর এই হতে পারেন না। বল আমার বিশ্বাস তিনি নিরাকার, আর কত কী হতে পারেন তিনি জানেন। আমি জানি না, বুঝতে পারি না।(১২)
জনগণপূজ্য শক্তির সাকার সাধনা (‘পৌত্তলিকতা’ শব্দটা সর্বা বর্জনীয় এটাতে তাচ্ছিল্য এবং ব্যঙ্গের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে) স্বীকার করে পরমহংসদেব তৎকালীন ধর্মজগতের ভারসাম্য আনয়ন করলেন বটে কিন্তু প্রশ্ন, জড়সাধনার অন্ধকার দিকটা কি তিনি লক্ষ করলেন না?
এইখানেই তাঁর বিশেষত্ব এবং মহত্ত্ব। এই সাকার-সাধনার পশ্চাতে যে জ্ঞেয়-অজ্ঞেয় ব্রহ্মের বিরাট মূর্তি অহরহ বিরাজমান, পরমহংসদেব বারবার সেদিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এই ভারসাম্যই ব্ৰহ্মজ্ঞানী কেশব সেন, বিজয়কৃষ্ণ এবং তাদের শিষ্যদের আকর্ষণ করতে পেরেছিল। তিনি যদি ‘মতুয়া’ কালীপূজক হতেন তবে তিনি পরমহংস হতেন না।
বস্তৃত একটি চরম সত্য আমাদের বারবার স্বীকার করা উচিত : যেইখানেই যেকোনো মানুষ যেকোনো পন্থায় ভগবানের সন্ধান করেছে তাকেই সম্মান জানাতে হয়। এমনকি ক্ষুদ্র শিশু যখন সরস্বতীর দিকে তাকিয়ে তার সাহায্য কামনা করে (হায়, কলকাতায় সরস্বতী পূজার বাহ্য আড়ম্বর দেখে অনেক সময় মনে হয়, এরাই বুঝি এ যুগে দেবীর একমাত্র সাধক) তাকেও মানতে হয়– গাছের পাতা, জলের ফোঁটা যখন মানুষ মাথায় ঠেকায় তার বিলক্ষণ মূল্য আছে। গীতাতে এ সত্যটি অতি সরল ভাষায় বলা হয়েছে।
কিন্তু সাকার-নিরাকার নিয়ে আজ আর তর্ক করে লাভ কী? বাঙলা দেশে আজ আর কজন লোক নিরাকার পূজা করেন তার খবর বলা শক্ত কারণ সে পূজা হয় গৃহকোণে, নির্জনে। আর কলকাতায় বারোয়ারি সাকার পূজার যা আড়ম্বর তা দেখে বাঙলার কত গুণীজ্ঞানী যে বিক্ষুব্ধ হন তার প্রকাশ খবরের কাগজে প্রতি বৎসর দেখি। এইমাত্র নিবেদন করেছি, এরও মূল্য আছে– তাই আমার এক জ্ঞানী বন্ধু বড় দুঃখে বলেছিলেন, কিন্তু কী ভয়ঙ্কর স্ট্রেন করে এস্থলে সে সত্যটি স্বীকার করি।’
সাকার-নিরাকারের আধ্যাত্মিক মূল্য যা আছে তা আছে, কিন্তু এই দ্বন্দ্ব সমাধানের সামাজিক মূল্য কী?
হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ব্রাহ্ম সকলেই বাঙালি সমাজে সমান অংশীদার। এঁদের ধর্মাচরণ যা-ই হোক না কেন, সমাজে তারা মেলামেশা করছেন অবাধে। একবার ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে এই সহজ মেলামেশা না থাকলে খ্রিস্টান মাইকেল, মুসলমান মুশররফ হুসেন, নজরুল ইসলাম এবং জসীম উদ্দীন বাঙলা কাব্যে খ্যাতি অর্জন করতে পারতেন না। সমঝদার ও রসিক জনের গুণগ্রাহিতা ও উৎসাহ লাভ না করে কম কবিই এ সংসারে সার্থক কাব্য সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এবং এঁদের সকলেরই উৎসাহী পাঠক এবং গুণগ্রাহী বন্ধু ছিলেন প্রধানত হিন্দুরাই।(১৩)
আধ্যাত্মিক, সামাজিক, রাজনৈতিক যেকোনো মতবৈষম্যের ফলে যদি ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়। একই সমাজের ভিতর অন্তরঙ্গ ভাব বর্জন করেন তবে সেই অখণ্ড, সমগ্র সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি—‘মহতী বিনষ্টি’ হয়; এই তত্ত্বটি সম্বন্ধে সে যুগে কয়জন গুণী সচেতন ছিলেন। মুসলমান সাকার মানে না, কিন্তু তাই বলে তো সে যুগে বাঙালি সমাজের হিন্দু-মুসলমানের মিলন ক্ষুণ্ণ হয়নি? তবে কেন ওই কারণেই ব্রাহ্মে-হিন্দুতে সামাজিক অন্তরঙ্গ গতিবিধি বন্ধ হবে?
পরমহংসদেব এই বিরোধ নির্মূল করতে চেয়েছিলেন বলেই সাকার-নিরাকারের অর্থহীন, অপ্রিয় আলোচনা বর্জন করেননি। তাই বারবার দেখি; তিনি আপন হিন্দু ভক্তবৃন্দ নিয়েই সন্তুষ্ট নন। বারবার দেখি, তিনি উদগ্রীব হয়ে জিগ্যেস করছেন, বিজয় কোথায়, শিবনাথ যে বলেছিল আসবে, বলছেন কেশব আমার বড় প্রিয়। অথচ তিনি তো ব্রাহ্ম ভক্তদের ‘কালীকাল্টে’ কনভার্ট করার জন্য কিছুমাত্র ব্যগ্র নন। তিনি সর্বান্তঃকরণে কামনা করেছিলেন, এদের বিরোধ যেন লোপ পায়।(১৪)
আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস, এই দ্বন্দ্ব অপসারণে অদ্বিতীয় কৃতিত্ব পরমহংসদেবের।
সামাজিক দ্বন্দ সম্বন্ধে এতখানি সচেতন পুরুষ যে তার অর্থনৈতিক সমস্যা সম্বন্ধে সচেতন থাকবেন এ কখনওই হতে পারে না। পক্ষান্তরে, আবার অন্য সত্যও সর্বজন বিদিত– কামিনী-কাঞ্চনে পরমহংসের তীব্র বৈরাগ্য। তার থেকেই ধরে নিতে পারি, অর্থ সমস্যা আপন সত্তায় (Per se) তাঁর সামনে উপস্থিত হয়নি। যারা মুখ্যত অর্থ কামনা করে রামকৃষ্ণদেব তো তাদের উপদেষ্টা নন। যাঁরা মুখ্যত ধর্মজিজ্ঞাসু অথচ অর্থসমস্যায় কাতর তিনি তাদের সে দ্বন্দ্ব সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। কাজেই পরোক্ষভাবে তিনি সমাজের অর্থনৈতিক প্রশ্নেরও সমাধান দিয়েছেন। যে যতখানি কাজে লাগাতে পেরেছে ততখানি উপকার পেয়েছে।
রামকৃষ্ণদেব বহুবার বলেছেন, ‘কলিকালে মানবের অনুগত প্রাণ’। এর অর্থ আর কিছুই নয়– এর সরল অর্থ, ইংরেজের শোষণনীতির শোচনীয় পরিণাম বাঙালির মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় তখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে। অন্নাভাবে সে তখন এমনই কাতর যে অন্য কোনও চিন্তার স্থান আর তার মস্তকে নেই। যাঁরা ধর্মে অনুরক্ত তারা বারবার পরমহংসদেবকে প্রশ্ন করেছেন, ‘উপায় কী?’
পূর্বেই বলেছি তিনি ছিলেন বেদান্তবাদী। তা হলে তাঁর কাছ থেকে উত্তর প্রত্যাশা করতে পারি যে, জগৎ মায়া-মিথ্যা অনুমিত হলেই অর্থের প্রয়োজন আপনার থেকেই ঘুচে যাবে। কিন্তু তিনি বলেছেন, পাখির মতো দাসীর মতো সংসারের কাজ করে যাবে, কিন্তু মন পড়ে রইবে ভগবানের পায়ের তলায়। অর্থাৎ কলিযুগে সমাজের সে সচ্ছলতা নেই যে তোমাকে অন্ন জোটাবে আর তুমি নিশ্চিন্ত মনে জ্ঞানমাগে আপন মুক্তির সন্ধান পাবে। কলির মানুষের কর্ম থেকে মুক্তি নেই।
ওদিকে যেসব ব্রাহ্ম ভক্তের অর্থাভাব ছিল না, যাঁরা ব্রহ্মজ্ঞানের তপস্বী তাঁদের বারবার বলেছেন, ঈশ্বরকে ব্যাকুল হয়ে ডাকো। কলিযুগে ভক্তি ভিন্ন গতি নেই।
আর সকলকেই একথা বলেছেন, এই জন্মেই যারা সাধনার সর্বশেষ স্তরে পৌঁছতে চায়– রাখাল, নরেন্দ্রের মতো যারা জন্মাবধি জীবন্মুক্ত তাদের কজন বাদ দিলে, আর কটি প্রাণী সে স্তরে পৌঁছতে পারবে সে বিষয়ে তাঁর মনে গভীর সন্দেহ ছিল– তাদের হতে হবে নিরঙ্কুশ জ্ঞানমার্গের সাধক। শুদ্ধ জ্ঞানের সাহায্যে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে, ব্রহ্ম ভিন্ন নিত্যবস্তু কিছুই নেই।
পূর্বেই নিবেদন করেছি, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে সমগ্রভাবে উপলব্ধি করার ক্ষমতা আমার নেই। একথা স্বীকার করেও যদি দম্ভভরে কিছু বলি, তবে বলব, যে সাধক গীতোক্ত কর্ম, জ্ঞান এবং ভক্তির সমন্বয় করতে পেরেছেন তিনি সমগ্র পুরুষ– পরম পুরুষ। কোনও মহাপুরুষকে যদি দম্ভভরে যাচাই করতে চাই, তবে এই তিনটির সমন্বয়েই সন্ধান করব। তার কারণ গীতাতে এই তিন পন্থা উল্লিখিত হওয়ার পর আজ পর্যন্ত অন্য কোনও চতুর্থ পন্থা আবিষ্কৃত হয়নি। এ তিন পন্থার সমন্বয়কারী শ্রীকৃষ্ণের সহচর। তাঁর নাম শ্রীরামকৃষ্ণ।
***
যে পাঠক ধৈর্য সহকারে আমার প্রগলভতা এতক্ষণ ধরে শুনলেন তিনি কৌতূহলবশত স্বতই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন, ‘এ তো হল মানুষের সংসর্গে আগত সমাজে সমুজ্জ্বল রামকৃষ্ণদেব। কিন্তু যেখানে তিনি একা– তাঁর সাধনার লোকে তিনি কতখানি উঠতে পেরেছিলেন? সোজা বাংলায়, ‘তিনি কি ভগবানকে সাক্ষাৎ দেখতে পেয়েছিলেন?’
এর উত্তরে বলব, মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করি, এ প্রশ্নের উত্তর দেবার অধিকার আমাদের কারওরই নেই। এ প্রশ্নের উত্তর জ্ঞানবুদ্ধির অগম্য। রামকৃষ্ণের সমকক্ষজনই এর উত্তর দিতে পারেন।
রামকৃষ্ণদেব বলেছেন, ‘সাধনার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছনোর পরও কোনও কোনও মানুষ লোকহিতার্থে সংসারে ফিরে আসেন। যেমন নারদ শুকদেবাদি।’ একথা ভুললে চলবে না।
স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছি, একথাটি স্বামী বিবেকানন্দের মনে গভীর দাগ কেটে গিয়েছিল। লোকহিতার্থে তিনি যে বিরাট শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন নির্মাণ করে যান, এরকম সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান প্রভু তথাগতের পর এযাবৎ কেউ নির্মাণ করেননি।
***
এইবারে শেষ প্রশ্ন দিয়ে প্রথম প্রশ্নে ফিরে যাই।
পরমহংসদেব গীতার তিন মার্গের সমন্বয় করেছিলেন। প্রকৃত হিন্দু সেই চেষ্টাই করবে। কিন্তু তিনি যে ধুতিখানাকে লুঙ্গির মতো পরে আল্লা-আল্লাও করেছিলেন এবং আপন ঘরে টাঙানো খ্রিস্টের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতেন সেকথাও তো জানি। এসবের প্রতি তাঁর অনুরাগ এল কোথা থেকে? বিশেষত যখন একাধিকবার বলা হয়েছে, অ-হিন্দু মার্গে চলবার সময় পরমহংসদেব কায়মনোবাক্যে সেই মার্গকেই বিশ্বাস করতেন।
অনেকের বিশ্বাস চতুর্বেদে বহু দেব-দেবীতে বিশ্বাস অর্থাৎ পলিথেইজমের বর্ণনা আছে। কিন্তু ম্যাক্সমুলার দেখিয়েছেন ঋগ্বেদের ঋষি যখন ইন্দ্রস্তুতি করেন তখন তিনি বলেন—‘হে ইন্দ্র, তুমিই ইন্দ্র, তুমিই অগ্নি, তুমিই বরুণ, তুমি প্রজাপতি, তুমিই সব।’
আবার যখন বরুণমন্ত্র শুনি, তখন সেটিতেও তাই– ‘হে বরুণ, তুমিই বরুণ, তুমিই ইন্দ্র, তুমিই প্রজাপতি, তুমিই সব।’ অর্থাৎ ঋষি যখন যে দেবতাকে স্মরণ করেছেন তখন তিনিই তার কাছে পরমেশ্বররূপে দেখা দিয়েছেন। এ সাধনা বহু-ঈশ্বরবাদের নয়। এর সন্ধান অন্য দেশে পাওয়া যায় না বলে ম্যাক্সমুলার এর নতুন নাম করেছিলেন, ‘হেনোথেয়িজম’।
পরমহংসদেব বেদোক্ত এই পন্থাই বরণ করেছিলেন অর্থাৎ সনাতন আর্য-ধর্মের প্রাচীনতম শ্রুতিসম্পন্ন পন্থা বরণ করেছিলেন। তিনি যখন বেদান্তবাদী তখন বেদান্তই সব কিছু, আবার যখন আল্লা আল্লা করেছেন তখন আল্লাই পরমাল্লা।
এই করেই তিনি সর্বধর্মের রসাস্বাদন করে সর্বধর্ম সমন্বয় করতে পেরেছিলেন।
কোনও বিশেষ শাস্ত্রকে সর্বশেষ, অভ্রান্ত, স্বয়ংসম্পূর্ণ শাস্ত্র বলে স্বীকার করে তিনি অন্য সবকিছুর অবহেলা করেননি।
অনেকের বিশ্বাস, হিন্দু আপন ধর্ম নিয়েই সন্তুষ্ট, অন্য ধর্মের সন্ধান সে করে না।
বহু শতাব্দীর বিজয়-অভিযান ঘাত-প্রতিঘাতের ফলে এযুগের হিন্দু সম্বন্ধে একথা হয়তো খাটে। তাই পরমহংসদেব আপন জীবন দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, সনাতন আর্যধর্ম এ পন্থা কখনও গ্রাহ্য করেনি।
সত্য সর্বত্র বিরাজমান, ঋগ্বেদের এই বাণী, শ্রীরামকৃষ্ণে তারই প্রতিধ্বনি। সর্বত্র এর অনুসন্ধানে সচেতন থাকলে বাঙালি পরমহংসদেবের অনুকরণ অনুসরণ করে ধন্য হবে। বাকিটুকু দয়াময়ের হাতে।
————
১. বর্তমান লেখকের মনে সন্দেহ আছে, শাক্য মুনির আবির্ভাবের ঠিক পূর্বেই এই পরিস্থিতি হয়েছিল। বৈদিক ভাষা তখন প্রায় অবোধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলেই ক্রিয়াকর্ম-যাগযজ্ঞ-পশুহত্যা তখন সত্য-ধর্মের স্থান অধিকার করে বসেছিল। বুদ্ধদেব তখন এরই বিরুদ্ধে সত্যধর্ম প্রচার করেন ও সর্বজনবোধ্য লোকায়ত প্রাকৃত (পরে পালি নামে পরিচিত) ভাষার শরণ নেন।
২. শ্রীশ্রীপরমহংসদেবের গাওয়া গান এরই কাছাকাছি :
আপনাতে আপনি থেকো মন যেও নাকো কারু ঘরে
যা চাবি তা বসে পাবি, খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে।
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, অনিল গুপ্ত সংস্করণ, ১ম খণ্ড, ২১৩ পৃ.।
৩. শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় কথার আড়।
৪. দারা তাঁর অতুলনীয় ধর্মগ্রস্থ আরম্ভ করেছেন এই বলে : ‘হে প্রভু, তুমি তোমার সুন্দর মুখ কুফর (অবিদ্যা) কিংবা ইমান (বিদ্যা) দু পাশের কোনো অলকগুচ্ছ (জুলুফ) দিয়ে ঢেকে রাখনি’। এই শ্লোক ঈশোপনিষদের ‘অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেহ বিদ্যামুপাসতে। ততো ভূয় ইব তে তমো ষ উ বিদ্যায়াং রতাঃ ॥’-রই অনুবাদ
৫. বস্তুত, সম্পূর্ণ নতুন ধর্ম পৃথিবীতে কোনো মহাপুরুষ কখনোই আরম্ভ করেননি। বুদ্ধদেব বলতেন, তাঁর পূর্বে বহু বুদ্ধ জন্ম নিয়েছেন, মহাবীর জৈনদের সর্বশেষ তীর্থঙ্কর বা জিন। খ্রিস্ট বলেন, তিনি বিধির বিধান ভাঙতে আসেননি– তিনি এসেছেন তাকে পূর্ণরূপ দান করতে। হজরত মুহম্মদ বলতেন, তার পূর্বে সহস্র পয়গম্বর আবির্ভূত হয়েছেন। বস্তুত এঁদের কেউ বলেননি, আমি প্রথম। প্রায় সকলেই বরঞ্চ বলেছেন, আমিই শেষ।
৬. একটা অবিশ্বাস্য গল্প শুনেছি, কোনো ব্রাহ্ম ভক্ত নাকি কদম্বতরুকে ‘অশ্লীল বৃক্ষ’ নাম দিয়েছিলেন। কিন্তু এর থেকে অন্তত এইটুকু বোঝা যায়, হিন্দুরা ব্রাহ্মদের ‘গোঁড়ামি’ সম্বন্ধে তখনকার দিনে কী ধারণা পোষণ করতেন।
৭. রাজনীতির ক্ষেত্রে এই শিক্ষিত-অশিক্ষিতের ব্যবধানের জন্য আমরা যে কী কর্মফল ভোগ করেছি, সে তথ্যের উত্থাপন এস্থলে অবান্তর।
৮. আমাদের ব্যক্তিগত প্রার্থনা, তাই যেন হয়। বাউল গেয়েছেন, ‘যে জন ডুবল, সখী, তার কী আছে আর বাকি গো?’ ঠাকুরও প্রায়ই গাইতেন ‘ডোব ডোব, ডোব।’
৯. এক চীনা সাধক এরই কাছাকাছি এসে বলেছেন, ‘মাই কাপ ইজ স্মল; বাট আই ড্রিঙ্ক অফনার।’
১০. বিদ্যাসাগর মহাশয় এ দ্বন্দ্বের সমাধান না করতে পেরে দু রকম ভাষাই ব্যবহার করতেন। ‘সীতার বনবাসে’র ভাষা সকলেই চেনেন, কিন্তু যেখানে তিনি রামা-শ্যামাকে বিধবাবিবাহের শত্রুদের বিপক্ষে ক্ষেপাতে চেয়েছেন, সেখানে ‘কস্যচিৎ ভাই-পোষ্য’ এই বেনামিতে, ‘ফাজিল-চালাক’, ‘দিলদরিয়া তুখোড় ইয়ার’, ‘তার একটি বেদড়া মন্ত্রী আছে–এটি তারই ত্যাঁদড়ামি’, ‘লোকটা লক্ষ্মীছাড়া বক্কেশ্বর আনাড়ির চূড়ামণি বে অকুফের শিরোমণি’। ইত্যাদি গ্রাম্য বাক্য পরমানন্দে ব্যবহার করেছেন। তিনি যেসব আদিরসাত্মক গল্প ছাপায় (!) প্রকাশ করেছেন সেগুলো সমাজে বললে এখনো সমূহ বিপদের সম্ভাবনা।
১১. শক্তিকে নানা দেশের কবি এবং সাধকগণ নানারূপে কল্পনা করেছেন। কাব্যে বিবেকানন্দের কবিতাই শ্রেষ্ঠতম।
মৃত্যুরূপা মাতা
‘নিঃশেষে নিবিছে তারাদল, মেঘ এসে আবরিছে মেঘ,
স্পন্দিত, ধ্বনিত অন্ধকার, গরজিছে ঘূর্ণবায়ু-বেগ!
লক্ষ লক্ষ উন্মাদ পরান বহির্গত বন্দিশালা হতে,
মহাবৃক্ষ সমূলে উপাড়ি ফুঙ্কারে উড়ায়ে চলে পথে।
সমুদ্র সংগ্রামে দিল হানা, ওঠে ঢেউ গিরিচূড়া জিনি’
নভস্তল পরশিত চায়। ঘোররূপা হাসিছে দামিনী,
প্রকাশিছে দিকে দিকে তাঁর মৃত্যুর কালিমামাখা গায়
লক্ষ লক্ষ ছায়ার শরীর!– দুঃখরাশি জগতে ছড়ায়–
নাচে তারা উন্মাদ তাণ্ডবে; মৃত্যুরূপা মা আমার আয়।
করালী। করাল তোর নাম, মৃত্যু তো নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে;
তোর ভীম চরণ-নিক্ষেপ প্রতি পদে ব্রহ্মাণ্ড বিনাশে
কালী, তুই প্রলয়রূপিণী, আয় মা গো, আয় মোর পাশে
সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়– মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে
কালনৃত্য করে উপভোগ—-মাতৃরূপা তারি কাছে আসে’। (সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনুবাদ)
ইংরেজিতে এর প্রথম ছত্র ‘The Stars are blotted out!’– আশ্চর্য বোধহয় রবীন্দ্রনাথও অতি বাল্যবয়সে (১৪?) কালী সম্বন্ধে একটি কবিতা লিখেছিলেন।
১২. ডগমাটিজম না করে মনকে খোলা এবং জানা-অজানার মাঝখানেই যে সত্য পন্থা- এর উৎকৃষ্ট প্রকাশ কেনোপনিষদে :
‘নাহং মনন্য সুবেদেতি নো ন বেদেতি বেদ চ।
যো নস্তছেদ দে নো ন বেদেতি বেদ চ ॥’।
‘আমি এইরূপ মনে করি না যে, আমি ব্ৰহ্মকে উত্তমরূপে জানিয়াছি; অর্থাৎ “জানি না” ইহাও মনে করি না, এবং “জানি” ইহাও মনে করি না। ‘জানি না যে তাহাও নহে– এবং জানি যে তাহাও নহে’ আমাদের মধ্যে যিনি এই বচনটির মর্ম জানেন, তিনিই ব্রহ্মকে জানেন।’– গম্ভীরানন্দ।
১৩. পূর্ববর্তী যুগে পরাগল, ছুটি খাঁর মতো মুসলমান গুণগ্রাহী ছিলেন বলেই হিন্দুরা মহাভারত অনুবাদ করেছিলেন; পরবর্তী যুগে হিন্দু সমঝদার ছিলেন বলেই সৈয়দ মরতুজা প্রমুখ বহুতর মুসলমান বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শ্রীযতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবিগণ এ সম্বন্ধে অত্যুকৃষ্ট পুস্তিকা দ্রষ্টব্য।
১৪, এ বিষয়ে পরমহংসদেব কতখানি নাছোড়বান্দা ছিলেন তার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ অনুসন্ধিৎসু পাঠক পাবেন, অনিল গুপ্ত সংস্করণ, চতুর্থ খণ্ডের চতুর্থ ভাগে। পাঠক তখন ‘নাছোড়বান্দা’র সত্যপ্রয়োগ সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হবেন।
হরিনাথ দে’র স্মরণে
বহু ভাষা শিখতে পারলে বহু সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় হয়। তার মারফতে অনেক সভ্যতা, বিস্তর সংস্কৃতির সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপিত হয়– এসব কথা ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি।
উপস্থিত দেখতে পাচ্ছি, বাঙালি ছেলেকে বাধ্য হয়ে অন্তত তিনটে ভাষা শিখতে হয়– বাঙলা, ইংরেজি এবং সংস্কৃত (কিংবা আরবি অথবা ফারসি)। হয়তো তাকে হিন্দিও শিখতে হচ্ছে, কিংবা অদূরভবিষ্যতে শিখতে হবে। এ অবস্থায় আমি যদি প্রস্তাব করি, আরও গুটি দুই শিখলে হয় না? তা হলে ছেলেদের হাতে আমার প্রাণ বিপন্ন হবার সমূহ সম্ভাবনা বাঙলা দেশে না থাকলেও এ খবরটি আমি বিলক্ষণ রাখি। বিশেষত এই পুজোর বাজারে– মানুষ যখন বলির পাঁঠার সন্ধানে থাকে।
তাই হট্টগোল আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই আমি নিবেদন করছি, এ প্রস্তাবটি শুধু তাদেরই জন্য, যারা বুঝে গিয়েছে যে সংস্কৃতে তারা বিদ্যাসাগর হতে পারবে না, ওটাকে নিতান্ত পরীক্ষা পাসের জন্য যেটুকু সম্মান দিতে হয় তাই দেবে, বাঙলা মাতৃভাষা, এবং ইংরেজির চর্চা ততটুকুই করবে যতটুকু পাসের পর চাকরির জন্য নিতান্তই প্রয়োজন। এই সংজ্ঞা থেকেই সুচতুর পাঠক বুঝে যাবেন যে, আমি মোটামুটি থার্ড ইয়ার ফোর্থ ইয়ার ছেলেদের কথাই ভাবছি। অর্থাৎ এরা ক্লাসে (সেভেন-এটে) যেরকম পড়ি-মরি হয়ে তিনটে ভাষার পিছনে ছুটত এখন আর তা করে না। বিশেষত গোটা পাঁচেক ইয়ার্লি আর খান-দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পাস করে এরা ভাষা না শিখে কী করে তার পরীক্ষা পাস করতে হয় সে ‘বিদ্যায়’ বিলক্ষণ রপ্ত হয়ে গিয়েছে।
এতখানি বলার পরও যদি কেউ লেমনেডের বোতল খোঁজে তবে আমার দ্বিতীয় নিবেদন, গোটা দুই ভাষা শিখলে চাকরি জোটার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। হল? এখন তবে আশা করতে পারি, পাঠক বোতলটি আমার মাথায় ফাটিয়ে সেটার ভিতরকার জিনিস বরফের সঙ্গে মিশিয়ে আমাকে খাওয়াবার চেষ্টা করবেন।
দয়া করে সেটিও করবেন না। কারণ আমি যে প্রস্তাব করতে যাচ্ছি সেটা লটারির টিকিট কাটার চেয়ে মাত্র এক চুল ভালো– এই যা। ইংরেজিতে একেই বলে ‘চেজিং দি ওয়াইল্ড গিজ’–কিন্তু চাকরির বাজারে বাঙালির ছেলের সামনে যখন কোনও ‘গুজ’ই নেই তখন আশা করিতে পারি সে ঘরের না খেয়ে বনের হাঁস তাড়া করতে আপত্তি করবে না। বুঝিয়ে বলি।
স্বাধীনতা লাভের পূর্বে ভাষা শেখার কোনও অর্থকরী মূল্য এদেশের ছিল না। স্বরাজ লাভের পর অবস্থাটা বদলেছে। আমরা নানা দেশে আমাদের রাজপ্রতিনিধি, রাজদূত, হাইকমিশনার, কন্সাল-জেনারেল, কন্সল, ট্রেড-কমিশনার এবং তাদের দতরের জন্য কাউনসেলর, প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় সেক্রেটারি, মিলিটারি আতাশে, ট্রেড আতাশে, প্রেস আতাশে, কেরানি, দোভাষী ইত্যাদি পাঠাচ্ছি এবং দিল্লির পরদেশি দফতর বা ফরেন অফিসেও ভাষা জাননে-ওলা লোকের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া বেতার-কেন্দ্র ফরাসি, ইরানি, ফারসি, কাবুল-ফারসি, আরবি, পশতু, সুহেলি, গুর্খালি, বর্মি, ইন্দোনেশি ও চীনা ভাষায়-ও প্রোগ্রাম দেন। আমাদের ফৌজি স্কুলেও অনেক ভাষা শেখানো হয়।
এই তিনটি প্রতিষ্ঠানে যে গণ্ডায় গণ্ডায় চাকরি খালি পড়েছে তা নয়, তবু আমার ব্যক্তিগত ধারণা উপযুক্ত ভাষাজ্ঞান থাকলে যোগ্য লোককে এ তিনটি প্রতিষ্ঠান খাতির করবে। আর পূর্বেই নিবেদন করেছি, আমার এ প্রস্তাব তাদেরই জন্য, যারা চাকরির বাজারে একটুখানি রিস্ক, রতিভর ঝুঁকি নিতে রাজি আছে।
আমি যে খবরটি দিলুম সেটি কিছুমাত্র নতুন নয়। কারণ প্রায়ই বেকার ছেলেরা এসে আমাকে অনুরোধ জানায় তাদের ফ্রেঞ্চ-জর্মন শিখিয়ে দিতে। (এখানেই লক্ষ করে রাখুন। ‘ফ্রেজ-জর্মনই’ বলে, অন্য কোনও ভাষার নাম তোলে না) আমার সময়ের অভাব, দ্বিতীয়ত আমি বাঙালিটাই ভালো করে জানিনে– কাজেই ফরাসি-জর্মনের কথাই ওঠে না, তাই তাদের কিঞ্চিৎ সদুপদেশ দিয়ে বিদেয় দিই।
এদের প্রশ্ন করে দেখলুম, এরা জানে না (ক) কোন ভাষার চাহিদা বাজারে কতখানি, (খ) কোন ভাষা শক্ত আর কোনটা নরম, (গ) ভাষা শিখতে হয় কী করে এবং আরও অনেক কিছুই জানে না।
আমি দোষ দিচ্ছিনে। জানবার সুযোগ দিলে তো তারা জানবে। আর যদি জানতই তবে আজ আমি এ বিষয়ে লিখতে যাব কেন?
আমাকে এক উত্তম ব্যবসায়ী বলেছিল, ‘জিনিস বেচা সোজা, কেনা শক্ত।’ আমি তো তাজ্জব। বলে কী? তখন বুঝিয়ে বলল, ‘বাজারে ঠিক যে জিনিসের চাহিদা তাই দিয়ে যদি আমি আমার দোকান সাজিয়ে রাখি তবে সন্ধে হতে না-হতেই দোকান সাফ হয়ে যাবে। তাই বললুম, বেচা সহজ। কিন্তু আড়তদারদের কাছ থেকে যদি বে-আক্কেলের মতো বে-চাহিদার মাল কিনি তবে সেগুলো দোকানে পচবে, দোকান উঠে যাওয়ার পরও। তাই বললুম, “কেনা শক্ত”।’
এস্থলেও সেই নীতি প্রযোজ্য। অর্থাৎ প্রথম দেখতে হবে, আপনি কী মাল কিনবেন, অর্থাৎ কোন ভাষা শিখবেন।
সবাই বলে ‘ফেঞ্চ-জর্মন’। এ যেন কথার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফ্রেঞ্চ ভুবনবিখ্যাত ভাষা। এককালে ফ্রেঞ্চ না জেনে কূটনীতি মহলে যাওয়া বিনা পৈতেয় ব্রাহ্মণভোজে যাওয়ার মতো ছিল। এখনও পৃথিবীর যেকোনো দেশের পাসপোর্টে দেখতে পাবেন দুটি ভাষাতে সবকিছু ছাপা, প্রথমটি তার আপন ভাষা এবং দ্বিতীয়টি ফরাসি। কিন্তু এসব হচ্ছে উনবিংশ শতকের কথা। আপনি যদি সেই শতকের চাহিদা মেটাতে চান, তবে মেটান। আপনি যদি এক শ বছরের পুরনো বিজ্ঞাপন মাফিক চাকরির জন্য দরখাস্ত চান তো করুন।
তাই প্রথম দেখতে হবে : এখন, এই মুহূর্তে চাহিদা কী এবং চাহিদার গতিটি কোন দিকে, অর্থাৎ আপনি ভাষাটা শিখে দু তিন বছরে যখন বাজারে নামবেন তখন চাহিদাটা কী হবে?
ভাষার প্রাধান্য তার লোকসংখ্যা থেকে বিচার করা ভুল। দৃষ্টান্তস্বরূপ চীনা ভাষা নিন। ইংরেজি, রাশান, চীনা এ তিন ভাষায় কথা বলে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লোক একথা সত্য, কিন্তু চীনা ভাষায় লোক-সংখ্যা যত বেশিই হোক না কেন, তারা সবাই মাত্র একটি রাষ্ট্রের অধিবাসী! কাজেই ওই রাষ্ট্রে আমাদের থাকবে মাত্র একটি এম্বেসি। পক্ষান্তরে জর্মন ভাষার অবস্থা বিবেচনা করুন। জর্মন বলা হয় জর্মন রাষ্ট্রে (উপস্থিত সেটিও আবার দুই রাষ্ট্রে বিভক্ত), অস্ট্রিয়া রাষ্ট্রে এবং সুইজারল্যান্ডে। এই তিন দেশে আমাদের তিনটি রাজদূতাবাস আছে। তাছাড়া জর্মন বলা হয়, উত্তর ইটালির টিরোল, ফ্রান্সের আলসেস লরেন ও বেলজিয়ামের অয়পেন অঞ্চলে। এসব অঞ্চলে যদি কখনও রাজনৈতিক গোলমাল আরম্ভ হয়। এবং আপনাকে তার রিপোর্ট লিখতে সেখানে যেতে হয় তবে জর্মন ছাড়া এক পা-ও এগুতে পারবেন না। এবং সর্বশেষ কথা : জর্মনি, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড বেচে তৈরি মাল, ভারত বিক্রি করে কাঁচা মাল। এসব দেশের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা দ্রুতগতিতে বাড়তেই থাকবে; বিস্তর কনসুলেট ও ট্রেড-কমিশন ক্রমে ক্রমে ওসব জায়গায় আমাদের খুলতে হবে।(১) কিন্তু চীন ও ভারত সমগোত্রীয়, দু জনেই বেচে কাঁচামাল, অতএব ‘বৈবাহিক’ বৈষয়িক কাজ আমাদের চলে না।
আমরা যে স্বার্থ নিয়ে এ আলোচনা করছি তার দৃষ্টিবিন্দু থেকে দেখতে গেলে রাষ্ট্রীয় শক্তি ও ভাষার গুরুত্ব বিচার অবান্তর। সোভিয়েট রাশা বিরাট রাষ্ট্র কিন্তু ওই দেশে আছে এবং বহুকাল ধরে থাকবে আমাদের একটি মাত্র রাজদূতাবাস। রাশা আবার মারাত্মক রকমের কেন্দ্ৰপ্রাণ রাষ্ট্র-মস্কোর নাম বদলে তাকে ‘সেন্টার’ নাম দেবার প্রস্তাব ওই কারণেই একবার। হয়েছিল– তাই তার উপরাষ্ট্র যথা, তুর্কোমানিস্তান উজবেকিস্তানে যে আমাদের রাজদূত আস্তানা গাড়বেন তার আশু সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিনে। অবশ্যই উত্তম সাহিত্যরস আস্বাদনের জন্য রাশানের মতো ভাষা পৃথিবীতে বিরল।
পক্ষান্তরে রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে আরবরা আজ পৃথিবীতে উঁচু আসনে বসে না। তার প্রধান কারণ, তারা নানা রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এবং ঠিক ওই কারণেই আমাদের দৃষ্টিবিন্দু। থেকে তাদের প্রাধান্য বেড়ে গেল। উপস্থিত আরব জাতি এই কটি রাষ্ট্রে বিভক্ত :-ইরাক, সিরিয়া (শ্যাম), লেবানন, হাদ্ৰামুৎ, ট্রানসজর্ডন, সউদি আরব, ইয়েমেন, মিশর, সুদান, টুনিসিয়া, আলজিরিয়া, মরক্কো, লিবিয়া। তাছাড়া কুয়েত, বাহরেইন, ওমান ইত্যাদি। এদের সবকটি স্বাধীন নয়, কিন্তু ভগবানের আশীর্বাদে আমরা যেদিন অ্যাংলো-আমেরিকান আড়কাটির হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে আড়তদারের কাছ থেকে সোজা পেট্রল কেনবার দুই নম্বরের স্বরাজ’ পাব সেদিন আরবের আনাচে-কানাচেও আমাদের কনসুলেট বসাতে হবে। উপস্থিত, আমার যতদূর জানা, মিশর, সউদি আরব, ইরাকে আমাদের রাজদূতাবাস আছে। এদের সংখ্যা বাড়বে বই কমবে না।
কিন্তু রাষ্ট্রগুলোর এসব ‘মেল’ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেলাতে গেলে আমরা পুজোর বাজার পেরিয়ে শ্যামাপুজোয় পৌঁছে যাব। তাই সংক্ষেপে বলি, আমার মনে হয় আমাদের স্বার্থের জন্য উপস্থিত স্প্যানিশ-ই সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। আপনি বলবেন, ওইটুকু দেশ স্পেন– তার ‘ভাঙা নৌকায়’ আমাদের কতখানি ‘সোনার ধান’ ধরবে।
আমি স্পেনের কথা আদপেই ভাবছি না। আমি ভাবছি দক্ষিণ আমেরিকার কথা। সেখানে ডজনখানেক সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র। তাদের ভাষা স্প্যানিশ হিস্পানি। ওদের গুটিকয়েকে আমাদের রাজদূতরা বেশ কিছুকাল হল ডেরা গেড়ে বসেছেন। আমার বিশ্বাস সবকটাতে না হোক, বাকি অনেকগুলোতেই ক্রমে ক্রমে আমাদের রাজদূতাবাস বসবে। অতএব আমার সলা যদি নেন তবে স্প্যানিশ শিখুন।
ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে অধমের জ্ঞান অতিশয় অপ্রচুর। তবু বলব, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্রমে ক্রমে এদেরই সঙ্গে আমাদের বাড়বে। সংক্ষেপে তার কারণটা বলি– আমেরিকা, ইয়োরোপ এবং রাশা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, বলতে গেলে তাদের সম্পূর্ণ অর্থনীতি যুদ্ধ প্রস্তুতির চতুর্দিকে এমনি কেন্দ্রীভূত করেছে যে তারা কিনতে চায় যুদ্ধের জন্য তাদের যেসব মালের দরকার এবং বেচতে চায় যুদ্ধের জন্য যার প্রয়োজন নেই। আর যুদ্ধ যদি লেগে যায় তবে আপনার অর্ডারগুলো তারা শিকেয় তুলে রাখবে, আপনার কাঁচামাল বন্দরে বন্দরে পচবে। দক্ষিণ আমেরিকা এসব আওতার বাইরে। ওদের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েই যাবে– আমাদের তৃতীয় ‘স্বরাজ’ লাভের পর। দশটা রাজদূতাবাস যদি তিন শটা চাকরি দিতে পারে তবে ব্যবসা-বাণিজ্য দেবে তিন হাজার কিংবা ত্রিশ হাজার। আর চাকরি ছেড়ে দিয়ে যদি ভাষায় জোরে ব্যবসা চালান তবে তো আর কথাই নেই।
এস্থলে আরেকটি তত্ত্ব এবং তথ্যপূর্ণ ইঙ্গিত দিই। ভাষা শেখার সময় গোড়ার দিকে সমগোত্রের ভাষা শিখে তাড়াতাড়ি ভাষার সংখ্যা বাড়িয়ে দেবেন। উদাহরণস্থলে বলি আপনি বাঙালি, আজ যদি আপনাকে নিছক ভাষার সংখ্যাই দেখাতে হয় তবে আপনার পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে অসমিয়া এবং উড়িয়া নিয়ে। এ দুটি ভাষা বাঙলার এত কাছাকাছি যে আপনাকে বেগ পেতে হবে অতি কম। তার পর শিখবেন, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, গুরুমুখী, ঠিক ওইরকমই পর্তুগিজ, ইটালিয়ান ও ফ্রেঞ্চ ভাষা স্পেনিশ ভাষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আপনার বাঙলা জানা থাকলে অসমিয়া শিখতে কতদিন লাগার কথা? না হয় তারই ডবল ধরুন স্পেনিশ শেখা হয়ে গেলে পর্তুগিজ, কিংবা ফরাসিস শিখতে। ঠিক সেইরকম জর্মন ফ্লেমিশ এবং ডাচ পড়ে অন্য গোত্রে। একদা ব্রাসেলস্ শহরে আমি একখানা ফ্লেমিশ খবরের কাগজ কিনে পড়ে দেখি মোটামুটি বক্তব্যটা ধরে ফেলতে পেরেছি- অল্পস্বল্প যা জর্মন জানি তার-ই কৃপায়। এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। আপনি অসমিয়া শিশুশিক্ষা কখনও পড়েননি। একখানা অসমিয়া বই নিন। দেখবেন বারো আনা পরিমাণ অনায়াসে বুঝতে পারছেন। কিংবা বেতারে যখন ‘অসমীয়া বাতরি’ শোনেন তখন কি তার মোটামুটি অর্থ ধরতে পারেন না?
তাই এই অনুচ্ছেদের গোড়াতে ভাষার সংখ্যাবৃদ্ধির যেকথা তুলেছিলুম সেটাতে ফিরে যাই। অর্থাৎ শুরুর সাহায্যে যদি বিদ্যায়তনে আপনি স্পেনিশ আরম্ভ করেন তবে মাস দুই যেতে-না-যেতেই বাড়িতে, কারও সাহায্য ছাড়া পর্তুগিজ কিংবা ফরাসি আরম্ভ করে দেবেন। ব্যাকরণখানার দু দশপাতা ওলটাতে-পালটাতেই দেখবেন একসঙ্গে দুটো ভাষা আয়ত্ত করা কিছুমাত্র কঠিন কর্ম নয়। গোড়ার দিকে কিছুটা গুবলেট হয়ে যাবে সন্দ নেই। কিন্তু কিছুদিন পরে যদি সেটা কাটিয়ে না উঠতে পারেন তবে বুঝবেন ওইদিকে ভগবান আপনার প্রতি সদয় নয়, তখন না হয় লেগে যাবেন মানুষ মারার ব্যবসাতে– যাকে অজ্ঞজন বলে ডাক্তারি, কিংবা রেলকলিশনের পরিপাটি ব্যবস্থা করাতে– যাকে অজ্ঞজন নাম দিয়েছে ইঞ্জিনিয়ারি। কিন্তু নিবেদন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ম্যাট্রিক বড় কঠিন পরীক্ষা। আপনি যদি সেটা পাস করে থাকতে পারেন তবে গোটাতিনেক ভাষা শিখতে পারবেন না কেন?
গোত্রবিচারে ফিরে যাই।
১. লাতিন গোত্র স্পেনিশ, ফরাসিস, পর্তুগিজ, ইটালিয়ান।
২. জর্মন গোত্র– জর্মন, ডাচ, ফ্লেমিশ।
৩. তুর্কি গোত্র তুর্কি (ওসমানলি তুর্কি, অর্থাৎ টার্কির ভাষা– তুর্কমানিস্থানের ভাষা, জগতাই তুর্কি। প্রথমটা মুস্তফা কামালের মাতৃভাষা, দ্বিতীয়টা বাবুর বাদশার)
৪. হাঙ্গেরিয়ান ও ফিনিশ কিন্তু এক হলেও শাখাতে বর্ণ-বৈষম্য প্রচুর।
৫. রাশান গোত্র– রাশান, পোলিশ, ল্যাটাভিয়ান, স্লোভাক ইত্যাদি।
৬. ইরানি গোত্র–ইরানি ফারসি ও কাবুলি ফারসি পার্থক্য সামান্য।
৭. আরবি গোত্র– আরবি, হিব্রু, ইডিশ (অধুনা প্যালেস্টাইনে প্রচলিত প্রাচীন হিব্রুর অর্বাচীন রাষ্ট্রভাষা), আহমেরিক (আবিসিনিয়ান ভাষা)।
৮. চীনা গোত্র– চীনা, জাপানি, কোরিয়ান ইত্যাদি।
৯. এছাড়া টিবেটো-বর্মন গোত্রের বর্মি ইত্যাদি। মালয়, থাই, ইন্ডোনেশিয়ন ইত্যাদি।
অজানাতে এবং জানাতে ছোট এবং বড় কোনও কোনও ভাষা বাদ পড়ে গেল। তাই নিয়ে শোক করবেন না। উপস্থিত এগুলো শিখে নিন। তা হলে অন্যগুলোর খবর আপনার থেকেই জানা হয়ে যাবে।
এর ভিতর সহজ ১ এবং ৬নং গোত্রের ভাষা, তার চেয়ে কঠিন ২ এবং ৩নং গোত্রের ভাষা, তার চেয়ে কঠিন ৫ নম্বরের গোত্র, তার চেয়েও কঠিন ৭নং, পারতপক্ষে ৮ নম্বরের পাড়া মাড়াবেন না (অবশ্য জাপানি তেমন শক্ত নয়), ৪ আর ৯ নম্বরের খবর জানিনে, তবে খুব শক্ত হওয়ার কথা নয়।
দুই গোত্রের দুটো ভাষা একসঙ্গে শেখা যে খুব কঠিন তা নয়, তবে তার জন্য সপ্রতিষ্ঠান ও সগুরু প্রয়োজন। এই দুইটির বড়ই অভাব– এই দুঃসংবাদটি যতক্ষণ পারি চেপে গিয়েছিলুম; আর পারা গেল না। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে এই সুসমাচারটিও বিতরণ করছি যে ভারতবর্ষের কোথাও এমন সুব্যবস্থা নেই যে তার পাল্লায় পড়ে আপনি হেরে যাবেন। এই যে আমাদের রাজধানী দিল্লি শহর, সেখানকার লোক কেন্দ্রের নোকরি বাবদে হামেহাল তেজনজর ওকিবহাল সেখানে যে দু একটি প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলো অতিশয় রদ্দি অথচ টাকা লুটছে এন্তের। ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি, কলকাতায় নাকি গোটাদুৰ্ত্তিন প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে বিদেশি ভাষা শেখানো হয়। খোঁজ করলে দেখবেন, খুড়ো-জ্যেঠার আমল থেকে বাড়িতে দু চারখানা মার্লবর পড়ে আছে, কিন্তু ইংরেজি ছাড়া কোনও বিদেশি ভাষা কেউ শেখেননি। আমিও ভূ-ভারতে এমন প্রাণীর সংস্পর্শে আসিনি যিনি ওইসব প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে কলকাতাতে বসে কোনও বিদেশি ভাষা শিখেছেন। তবে ইদানীং অবস্থা একটু ভালো হয়েছে।
অধমের শেষ সাবধানবাণী : সবকটা আণ্ডা একই ঝুড়িতে রাখবেন না– কুল্যে শির্নি একই দরগায় উজোড় করে দেবেন না। তার সরল অর্থ বিএ, এমএ পাস অবহেলা করে হঠাৎ তেরিয়া হয়ে বিদেশি ভাষার পশ্চাদ্ধাবন করবেন না। এসব পড়াশুনো বিএ, এমএ, পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চালাবেন– আড্ডাটা সিকিটাক কমিয়ে দিয়ে ফুটবল দেখাটা একটু মুলতবি রেখে দিয়ে। একদম ছেড়ে দিতে বলব কেন, তওবা, তা হলে আপনার বাঙালিত্বই যে উপে যাবে। ভাষা শিখে পরীক্ষা দিয়ে যদি সেদিকে নোকরি না জোটে তবে বিএ, এমএ পাস করে যা করতেন তাই করবেন। তা হলে অন্তত আমার গলায় গামছার ফাঁস লাগিয়ে বলতে পারবেন না, ‘তবে রে–, তোর কথায় না– ইত্যাদি।’
————
১. এখানে এম্বেসি, হাই-কমিশন, লিগেশন ইত্যাদির পার্থক্য সম্বন্ধে সামান্য কিছু বলে দেওয়া ভালো। এই তিনটিই রাজনৈতিক যোগাযোগ এবং কূটনৈতিক কাজকর্ম চালায়। এম্বেসি এবং হাই-কমিশন পদমর্যাদায় একই- ব্রিটিশ ক্রাউনের আওতায় থাকলে এম্বেসির নাম হাইকমিশন, লিগেশন পদমর্যাদায় ছোট। কনসুলেটের কাজ ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনমতো একাধিক কনসুলেট থাকতে পারে কিন্তু একাধিক এম্বেসি হয় না এবং সে স্থানে কনসুলেট-জেনারেলও থাকে। ট্রেড-কমিশন কনসুলেটের চেয়ে জাতে ছোট্ট অনেকটা এক্সপেরিমেন্টাল পোস্ট-অফিসের মতো। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়লে তার পদবৃদ্ধি হয়। কোনো কোনো দেশে আমাদের কনসুলেট না থাকলে, সেখানকার এম্বেসি-হাই-কমিশন-লিগেশন ওই কাজও করে থাকে। এইসব তাবৎ প্রতিষ্ঠান আমাদের ফরেন অফিসের ভাবেতে থাকে।