- বইয়ের নামঃ চতুরঙ্গ
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
অনুকরণ না হনুকরণ
আগে-ভাগেই বলে রাখছি, এ-লেখা সমালোচনা নয়।
সমালোচনা লেখবার মতো শক্তি–দুষ্টলোকে বলে, শক্তির অভাব আমার এবং আমার মতো অধিকাংশ লোকের নেই। গল্পচ্ছলে নিবেদন করি :–
প্রতি রোববারে এক বঁড়শে সকাল থেকে সন্ধে অবধি মাছ ধরে। বড় মাছের শিকারি, তাই ফাতনা ডোবে কালেকস্মিনে, আকছার রোববারই যায় বিন-শিকারে। তারই একটু দূরে আরেকটা লোক প্রতি রোববারে এসে বসে, এবং তামাম দিনটা কাটায় গভীর মনোযোগের সঙ্গে ওর মাছধরা দেখে দেখে। দু জনায় আলাপ-পরিচয় নেই। মাস তিনেক পর শিকারি লোকটার ‘আলসেমি’ দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার পর একটু বিরক্তির সুরে শুধাল, ‘ওহে, তুমি তা হলে নিজেই মাছ ধর না কেন?’
লোকটা আঁতকে উঠে বলল, ‘বাপস! অত ধৈর্য আমার নেই।’
সমালোচনা লেখার ধৈর্য আমার নেই।
আর কীই-বা হবে সমালোচনা লিখে ক’টা সুস্থ লোক সমালোচনা পড়ে? কটা বুদ্ধিমান-মাছ টোপ গেলে? আলগোছে তফাতে থেকে সমালোচক প্রবন্ধে একটু-আধটু ঠোক্কর দেয় অনেককেই– অর্থাৎ রোক্কা পয়সা ঢেলে মাসিকটা যখন নিতান্তই কিনেছে। তখন পয়সার দাম তোলবার জন্য একটু-আধটু খোঁচাখুঁচি করে। ফলে, চারের রস যত না পেল বঁড়শির খোঁচাতে তার চেয়ে বেশি জখম হয়ে ‘দুত্তোর ছাই’ বলে তাস-পাশাতে ফিরে যায়।
সমালোচকরা ভাবেন, পাঠকসাধারণ বোকার পাল। ওরা তাদের মুখে ঝাল চেখে বই কেনে। তা হলে আর দেখতে হত না। মারোয়াড়িরা সস্তায় রাবিশ পাণ্ডুলিপি কিনে পয়সা দিয়ে উক্তৃষ্ট সমালোচনা লিখিয়ে রাবিশগুলো খুচকারি (অর্থাৎ খুচরোর লাভে, পাইকারির পরিমাণে) দরে বিক্রি করে ভুঁড়ি বাড়িয়ে নিত–ফাও হিসেবে দেশে নামও হয়ে যেত, সসাহিত্য’ তথা সমালোচকদের পৃষ্ঠপোষকরূপে।
আমার কথা যদি চট করে বিশ্বাস না করতে পারেন তবে চিন্তা করে দেখুন আপ্তবাক্য নিবেদন করছি, ‘পয়সা দিয়ে সমালোচনা লেখানো যায়, পয়সা দিয়ে কবিতা লেখানো যায় না।’ নাহলে আমেরিকায় ভালো কবির অভাব হত না। সমালোচকের অভাব সেখানে নেই এবং বর্ণে-গন্ধে তাঁরা অম্মদ্দেশীয় সমালোচকদেরই মতো।
পলিটিশিয়ানরাও ভাবেন প্রোপাগান্ডিস্ট (অর্থাৎ সমালোচকদের দিয়ে নিজ পার্টির প্রশংসা কীর্তন করিয়ে নিয়ে বাজিমাত করবেন। কিন্তু ভোটার ভোটার যা পাঠকও তা– আহাম্মক নয়, যদিও সরল বলে সত্য বুঝতে তার একটু সময় লাগে। নাহলে আওয়ামীরা মুসলিম লীগকে কস্মিনকালেও হটাতে পারত না।
আমিও মাঝেমধ্যে সমালোচনা পড়ি, কারণ আমিও আর পাঁচজন পাঠকের মতো পয়সা ঢেলেই কাগজ কিনি। তবে আমার পড়ার ধরন নিয়ার্ডদের রুটি খাওয়ার মতো। শুনেছি, স্পানিয়ার্ডরা বছরের পয়লা দিন গির্জায় উপাসনা সেরে এসে একটুকরো রুটি চিবোয়– কারণ প্রভু যিশুখ্রিস্ট তাঁর প্রার্থনায় বলেছেন, ‘আর আমাদের অদ্যকার রুটি দাও।’ খানিকটে চিবিয়ে থু থু করে ফেলে দিয়ে বলে, ‘তওবা, তওবা, সেই গেল বছরে রুটিরই মতো যাচ্ছেতাই সোয়াদ।’ তার পর বছরের আর ৩৬৪ দিন সে খায় কোর্মাকালিয়া কটলেট মমলেট। আমিও সমালোচনার শুকনো রুটি বছরের মধ্যে চিবুই মাত্র একদিন এবং প্রতিবারই হৃদয়ঙ্গম হয়, সমালোচনার স্বাদ-গন্ধ সেই গেল বছরের মতো এক বছরে কিছুমাত্র উন্নতি করতে পারেনি।
কথাটা যেভাবে বর্ণনা করলুম, তাতে পাঠকের ধারণা হওয়া বিচিত্র নয় যে, এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। কিন্তু মোটেই তা নয়। অভিজ্ঞতাটা পাঠক-সাধারণ মাত্রেরই নিদারুণ নিজস্ব। অবশ্য সমালোচকদের কথা স্বতন্ত্র। তারা একে অন্যের সমালোচনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মনোযোগ সহকারে পড়ে থাকেন। কেন পড়েন? জ্ঞান সঞ্চয়ের জন্য? রাম রাম! শুধুমাত্র দেখবার জন্যে কে তার মতে সায় দিয়েছে, কে দেয়নি এবং সেই অনুযায়ী দল পাকানো, ঘোট বাড়ানো, শক্তি সঞ্চয় করে রুটিটা আণ্ডাটা– থাক।
অবশ্য সমালোচকদের সমালোচনা করার কুবুদ্ধি যদি আমার কখনও হয়– এতক্ষণ যা করলুম সেটা তারই সেতার বাধা মাত্র– তা হলে সেটা আপনাদেরই পাতে নিবেদন করব। তবে ধর্মবুদ্ধি তখনও আপনাদের সাবধান করে দেবে, ও লেখাটা না পড়তে।
***
মূল বক্তব্যে আসি। ইদানীং আমি বাংলার বিভিন্ন জায়গা থেকে, এবং বাঙলার বাইরে থেকেও কয়েকখানা চিঠি পেয়েছি। এঁরা প্রশ্ন জিগ্যেস করেছেন, কী প্রকারে ভালো লেখক হওয়া যায়?
প্রথমটায় উল্লসিত হয়েছিলুম। যাক, বাঁচা গেল। বাঙলা দেশ তা হলে স্বীকার করেছে, আমি ভালো লেখক। এবারে তা হলে কলকাতা-দিল্লিতে গিয়ে কিঞ্চিৎ তদ্বির করলেই দু চারটে প্রাইজ পেয়ে যাব, লোকসভার সদস্যগিরি, কলচেরল ডেলিগেশনের মেম্বারি এসবও বাদ যাবে না। বিদেশ যাবার সুযোগও হয়ে যাবে– বিলেত দেখার আমার ভারি শখ, অর্থাভাবে এতদিন হয়ে ওঠেনি। ইংরেজিটা জানিনে, এতদিন এই একটা ভয় মনে মনে ছিল। এখন বুলগানিন, চু-এন-লেইয়ের কল্যাণে সেটাও গেছে। এঁরা ইংরেজি না জেনে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু হায়, এত সুখ সইবে কেন? আমার গৃহিণী নিরক্ষরা টিপসই করে হালে আদালতে তালাকের দরখাস্ত করেছেন। তালাকটা মঞ্জুর না হওয়া পর্যন্ত আমার সঙ্গেই আছে। তাঁর কাছে চিঠিগুলো পড়ে নিজের মূল্য বাড়াতে গিয়েছিলুম। তিনি করলেন উল্টো অর্থ। সেটা আরও সরল। ব্যবসাতে যে দেউলে হয়েছে, তারই কাছে আসে লোক সলার সন্ধানে; ফেল-করা ছেলে পাস-করার চেয়ে ভালো প্রাইভেট ট্যুটর হয়।