একটি জিন জনগোষ্ঠীতে এর সংখ্যাসূচক সফলতা অর্জন করে একক শরীরের উপর এর (ফিনোটাইপিক) প্রভাবের মাধ্যমে। দীর্ঘ সময়ব্যাপী বহু শরীরের দ্বারা প্রতিনিধিত্ব হবে একটি সফল জিন। এটি ঐসব শরীরগুলোকে যথেষ্ট দীর্ঘ পরিমান সময় বেঁচে থাকতে সাহায্য করে যেন পরিবেশে এটি প্রজনন করতে পারে। কিন্তু পরিবেশ মানে শুধুমাত্র শরীরের বাইরের পরিবেশ নয়, মাঠ, পানি, শিকারী প্রাণী ইত্যাদি, বরং অভ্যন্তরীণ পরিবেশও, এবং বিশেষভাবে অন্য জিনগুলো, জনগোষ্ঠীর মধ্যে যাদের সাথে একটি স্বার্থপর জিন পর্যায়ক্রমে প্রজন্মান্তরে বেশ কিছু শরীর ভাগাভাগি করে নেয়। সুতরাং প্রাকৃতিক নির্বাচন আনুকূল্য দেয় সেই সব জিনগুলোকে, যা প্রজননক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্য জিনের সাহচর্যে যে সফলভাবে। টিকে থাকে। জিনরা আসলেই এই অর্থে ‘স্বার্থপর, আর এই বইয়ে সেই ধারণাটিকে মূলত সংবর্ধিত করা হয়েছে। এই জিনগুলো অন্য জিনগুলোর সাথে সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করে যাদের সাথে এটি শুধুমাত্র বর্তমানের নির্দিষ্ট শরীরটিকে ভাগ করে না, বরং সাধারণভাবে বহু শরীর, যা প্রজাতির জিনপুল দ্বারা সৃষ্টি হয়। যৌন প্রজননের মাধ্যমে প্রজনন করে এমন জনগোষ্ঠী পরস্পরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, সহযোগী জিনদের একটি কার্টেল বা জোট : আজ তারা পরস্পরের সহযোগী, কারণ তারা পূর্বসূরি অতীতে বহু প্রজন্মে একই ধরনের শরীরের মধ্যে তারা সহযোগিতা করার মাধ্যমে সমৃদ্ধি লাভ করেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে বোঝা ( প্রায়শই যেটি ভুল বোঝা হয়) যে, এই সহযোগিতামূলক আচরণকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়, এর কারণ কিন্তু এমন নয় যে জিনদের একটি গ্রুপ সামগ্রিকভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়, বরং একক জিনগুলো পৃথকভাবে নির্বাচিত হয় অন্য জিনগুলোর সেই প্রেক্ষাপট থেকে, যাদের একটি শরীরে সম্মিলন হবার বেশী সম্ভাবনা থাকে, এর মানে প্রজাতির জিনপুলে অন্য জিনগুলোর প্রেক্ষাপটে। এই পুল, মানে, যেখান থেকে যৌন প্রজনন করে এমন কোনো প্রজাতির প্রতিটি একক সদস্য নমুনা হিসাবে এর জিনগুলো নির্বাচন করে নেয়। প্রজাতির এই জিনগুলো ( কিন্তু অন্য প্রজাতির জিনগুলো নয়) ক্রমাগত পরস্পরের সাথে মিলিত হচ্ছে এবং পরস্পরের সাথে সহযোহিতাপূর্ণ আচরণ করছে, পর্যায়ক্রমে আসা শরীরগুলোর মধ্যে।
যৌন প্রজননের উদ্ভব পরিচালিত করেছিল কি, সেটি এখনও আমরা আসলেই জানিনা। কিন্তু যৌন প্রজননের একটি পরিণতি হচ্ছে পারস্পরিক সঙ্গতিপূর্ণ জিনদের সহযোগিতাপূর্ণ কার্টেল বা জোটের বাসস্থান হিসাবে ‘প্রজাতি আবিষ্কার। “জিনের দীর্ঘ হাত’ শীর্ষক অধ্যায়ে (অধ্যায় ১৩) যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, সহযোগিতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, প্রতিটি প্রজন্মে শরীরের সব জিন একই ‘বটোলনেক’ বা সংকীর্ণ বের হবার একটি পথ ভাগাভাগি করে, যার মধ্যে দিয়ে তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শরীরে প্রবেশ করার ‘চেষ্টা করে, আর সেটি হচ্ছে: শুক্রাণু অথবা ডিম্বাণু। সহযোগিতপূর্ণ বা দ্য কোঅপারেটিভ জিনও সমানভাবে যথার্থ শিরোনাম হতে পারতো এই বইটির, এবং বইটিতে আদৌ কোনো পরিবর্তনও করতে হতো না। আমার সন্দেহ বহু ভ্রান্ত-ধারণা প্রসূত সমালোচনাও হয়তো এর মাধ্যমে এড়ানো সম্ভব হতো।
আরেকটি ভালো শিরোনাম হতে পারতো “দি ইমোর্টাল জিন’, ‘সেলফিশ’ শব্দটির চেয়ে অনেক বেশী কাব্যিক হওয়াসহ ইমোর্টাল (বা অমর) শব্দটি এই বইটির মূল যুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধারণ করতে পেরেছে। ডিএনএ অনুলিপন প্রক্রিয়ায় বিশ্বস্ততা– কারণ মিউটেশন দূর্লভ– প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের জন্যে অপরিহার্য। “হাই-ফিডেলিটি’ মানে জিনগুলো, সঠিক তথ্যবাহী অনুলিপি রুপে বহু মিলিয়ন বছর ধরে টিকে থাকতে পারে। সফল জিনগুলো, যদিও। অসফল জিনগুলো, সংজ্ঞানুযায়ী, সেটি করতে পারেনা। এই পার্থক্যটি গুরুত্বপূর্ণ হবে যদি এক টুকরো জিনগত তথ্যের সম্ভাব্য জীবনকাল খুব সংক্ষিপ্ত হয়ে থাকে, যাই হোক না কেন। অন্যভাবে যদি বিষয়টি দেখা যায়, জীবিত প্রতিটি সদস্য এর ভ্রূণবিকাশের সময় নির্মিত হয়েছে সেই জিনগুলো দ্বারা, যারা তাদের বংশঐতিহ্য অনুসরণ করতে পারবে বিশাল একটি সংখ্যার প্রজন্মান্তরে, বহু সংখ্যক একক জীবসদস্যদের মধ্যে। জীবিত প্রাণীরা উত্তরাধিকার সূত্রে সেই জিনগুলো পায় যা তাদের বহু সংখ্যক পূর্বসূরিদের বাঁচতে সহায়তা করেছিল। সেকারণে জীবিত প্রাণীদের সেটি আছে যা তাদের টিকে থাকতে এবং বংশ বিস্তারের জন্যে প্রজনন করতে সহায়তা করে। এর বিস্তারিত খুঁটিনাটি বিষয়গুলো প্রজাতি ভেদে ভিন্ন • শিকারী প্রাণী অথবা শিকার, পরজীবি অথবা পোষক, জলচর অথবা স্থলবাসী, মাটির নীচে অথবা জঙ্গলের ছাদ বা ক্যানোপিতে, কিন্তু সাধারণ নিয়মটি একই থাকে।
এই বইটির একটি কেন্দ্রীয় ভাবনা মূলত গড়ে তুলেছিলেন আমার বন্ধু, বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী ও তাত্ত্বিক বিল হ্যামিলটন, যা মৃত্যুতে আমি এখনও শোক অনুভব করি। প্রাণীরা নিজেদের সন্তানদের দেখাশুনা করবে শুধুমাত্র এমনটাই প্রত্যাশা করা হয় না, তারা তাদের জিনগত অন্য স্বজনদেরও দেখাশুনা করে। বিষয়টি প্রকাশ করার সরলতম একটি উপায়, আর যে উপায়টি আমার পছন্দের, সেটি হচ্ছে ‘হ্যামিলটনস’স রুল’: পার্থবাদের একটি জিন জনগোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়বে যদি একজন পরার্থবাদীর এর জন্য এর মূল্য ‘C, উপকারগ্রহীতার কাছে মূল্য ‘B’ এর মূল্য মানের চেয়ে কম হয়, যা অবমূল্যায়িত হবে তাদের মধ্যে কো-এফিসিয়েন্ট অব রিলেটেডনেস বা দ্বারা। r হচ্ছে ০ থেকে ১ এর মধ্যে আনুপাতিক একটি অংশ; এর মান ১ হবে যদি তারা হুবহু জমজ হয়, ০.৫ হবে সন্তান আর আপন ভাইবোন হয়, ০.২৫ হবে নাতি, সৎ ভাইবোন, ভাইবোনের ছেলে মেয়ে, ০.১২৫ হবে দূরবর্তী কাজিনদের ক্ষেত্রে। কিন্তু যখন এটি ‘শূন্য’? এই স্কেলে ‘শূন্যের’ মানে কি? বেশ কঠিন বলা বিষয়টি, কিন্তু এটি গুরুত্বপূর্ণ আর ‘দ্য সেলফিশ জিনের প্রথম সংস্করণে এটি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি। ‘শূন্য’ মানে এই যে দুজন জীব সদস্যের মধ্যে কোনো সাধারণ জিন থাকবে না। আমরা সব মানুষই আমাদের জিনের ৯৯ শতাংশ ভাগাভাগি করি, ইঁদুরের সাথে ৯০ শতাংশের চেয়েও বেশী আর মাছের সাথে ৭৫ শতাংশ জিন আমরা ভাগাভাগি করি। শতাংশগুলোর এই উচ্চ পরিমান বহু মানুষকে ‘কিন সিলেকশন’ সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণায় সংশয়াচ্ছন্ন করে তোলে, যার মধ্যে অনেক প্রখ্যাত বিজ্ঞানীরাও আছেন। কিন্তু এই সংখ্যাগুলো কিন্তু বলতে যা বোঝায় তা না। (ধরুন) যখন আমার ভাইয়ের জন্যে। হচ্ছে ০.৫, ‘এটি ০, জনগোষ্ঠীর অন্য যেকোনো একজন সদস্যদের সাথে, যাদের সাথে আমি হয়তো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। পরার্থবাদের বিবর্তন সম্বন্ধে কোনো তাত্ত্বিক প্রস্তাবনা করার ক্ষেত্রে, প্রথম কাজিনদের মধ্যে। হচ্ছে ০,১২৫, যখন তাদের কোনো রেফারেন্স ব্যাকগ্রাউন্ড জনগোষ্ঠীর সাথে তুলনা করা হয় (যেখানে r = 0), যা হচ্ছে বাকি জনগোষ্ঠী যাদের প্রতি পরার্থবাদ দেখানো যেতে পারে: স্থান এবং খাদ্যের জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বী, সেই প্রজাতির পরিবেশে সেই সময়ে তাদের সহযাত্রী। এই ০.৫ (০.১২৫ ইত্যাদি) ব্যাকগ্রাউন্ড জনগোষ্ঠীর চেয়ে বেশী আত্মীয়তার ইঙ্গিত করবে, যাদের সাথে আত্মীয়তা শূন্যের নিকটবর্তী।