- বইয়ের নামঃ অন্ধকারের গল্প
- লেখকের নামঃ তৌফির হাসান উর রাকিব
- সিরিজঃ সেবা হরর সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী বই
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প
অন্ধকারের গল্প
নীল রক্ত – আফজাল হোসেন
এক
শাহজাহান ঘটক এসেছে। সোফার উপর পা তুলে আসন করে বসেছে। ভরপুর চা-নাস্তার পর এখন সে পান চিবুচ্ছে। একসঙ্গে দুই খিলি পান। গাড়ির টায়ারের মত মোটা ঠোঁট দুটো পানের রসে জবজবে। কুচকুচে কালো চেহারায় পানের রসে ভেজা লাল টুকটুকে ঠোঁট জোড়া দেখতে ভালই লাগছে। থুতনিতে থাকা এক গোছা ছাগুলে দাড়ি বেয়েও পানের রস নেমেছে।
শাহজাহান ঘটকের দেয়া এক গাদা বায়োডাটা ফটো নেড়ে-চেড়ে দেখছেন সুলতানা বেগম। সব বিবাহযোগ্য মেয়েদের বায়োডাটা আর ফটো।
সুলতানা বেগমের একটিও পছন্দ হচ্ছে না। তিনি একেকটা ফটো দেখছেন আর ভুরু কুঁচকাচ্ছেন। তিনি তাঁর একমাত্র ছেলে সুমনের জন্য পাত্রী খুঁজছেন। যেমন-তেমন মেয়ে হলে চলবে না। রাজকন্যার মত মেয়ে চাই। শুনেছেন সুন্দরী মেয়েদের খোঁজ বের করতে শাহজাহান ঘটকের তুলনা নেই। এজন্যেই শাহজাহান ঘটককে খবর দিয়ে এনেছেন।
সুলতানা বেগম যেসব মেয়ের বায়োডাটা আর ফটো দেখছেন তারা সবাই-ই বেশ সুন্দরী, শিক্ষিত, আর ভাল . পরিবারের। তারপরও আরও কিছু খুঁজছেন তিনি। ছোট পরিবার। তাঁদের যেমন মা-ছেলের ছোট পরিবার, তেমন কোনও পরিবারের একমাত্র মেয়ে পাওয়া গেলে ভাল হত। ছোট পরিবারে ঝামেলা কম থাকে। তাঁর ছেলে সুমন অত্যন্ত নম্র-ভদ্র-লাজুক স্বভাবের। তাঁর একার হাতে মানুষ করা। ঝুট-ঝামেলার মধ্যে কোনও দিনও জড়াতে দেননি। বাইরের মানুষের সঙ্গে মেলামেশাও কম। লেখাপড়া শেষ করে এখন চাকরিতে ঢুকেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। বাসা-অফিসের মধ্যেই তার জীবন সীমাবদ্ধ। এমন নিরীহ প্রকৃতির ছেলের জন্য তেমন একটা মেয়েই দরকার।
সুমনের বাবার অবর্তমানে সুলতানা বেগম অনেক কষ্ট করে তাঁর এই ছেলেকে মানুষ করেছেন। বলা যায় শরীরের সমস্ত রক্ত পানি করে। সারা দিন-রাত সেলাই মেশিনে ঘটর-ঘটর শব্দ তুলে কোনওক্রমে ছেলের পড়ার খরচ, সংসার খরচ চালিয়েছেন। সেই দিন এখন আর নেই। তাঁদের অবস্থা ফিরেছে। আর্থিক অনটন দূর হয়েছে। ছেলে বড় চাকরি পেয়েছে। যা বেতন পায় তাতে খেয়ে-পরে খুব ভাল আছেন তাঁরা। চব্বিশশো স্কয়ার ফিটের বড় বাসা ভাড়া নিয়েছেন। বাসায় ফ্রিজ, টিভি, আলমিরা, সোফা…অভিজাত সব কিছুই কেনা হয়েছে।
এত কিছুর পরও সুলতানা বেগমের বুকের গভীরে একটা কষ্ট রয়েই গেছে। সুমনের বাবার শূন্যতা। সুখের এই দিনগুলো যেন তাঁর কথা আরও বেশি মনে করিয়ে দেয়।
সুমনের বাবা আমজাদ হোসেন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কেরানির চাকরি করতেন। সামান্য ক’টা টাকা বেতন পেতেন। কিন্তু তাতে সুখের অভাব ছিল না। ছোট্ট সুমনকে নিয়ে হাসি-খুশিতে ভরপুর ছিল তাঁদের সংসার।
সেদিনের কথা কখনও ভুলতে পারবেন না সুলতানা বেগম। তাঁদের বিবাহ বার্ষিকীর দিন ছিল ওটা। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে গোসল করে প্রথমেই বিয়ের শাড়িটা পরেছিলেন। সামান্য একটু সাজগোজও করেছিলেন। চোখে কাজল দিয়েছিলেন। ভুরু এঁকেছিলেন। লিপ লাইনার দিয়ে ঠোঁট এঁকে হালকা গোলাপি লিপস্টিক লাগিয়েছিলেন। একমাত্র কানের দুল জোড়াও পরেছিলেন। হাতে কাচের চুড়ি। এরপর রান্নাঘরে ঢুকে চটপট খিচুড়ি আর ডিম ভাজা করেন। এমনিতে প্রতিদিন নাস্তার জন্য আলু ভাজি আর রুটি করতেন। কিন্তু সেই বিশেষ দিনটার জন্য বিশেষ আয়োজন করেছিলেন।
রান্না শেষে ঘুম থেকে জাগান সুমনের বাবাকে। ঘুম থেকে জেগে ড্যাব-ড্যাব করে তাকিয়ে ছিলেন মানুষটি।
অবাক গলায় বলেছিলেন, ‘কোথাও বেড়াতে যাচ্ছ?’ সুলতানা বেগম রহস্যময় হাসি দিয়ে বলেন, ‘না।’
‘তা হলে এত সেজেছ কেন?’
সুলতানা বেগম মুখ ভার করে বলেন, ‘এমনিতেই সেজেছি।’
তখন বোধহয় মনে পড়ল লোকটার। জিভে কামড় দিয়ে, ‘হায়, হায়, সব ভুলে বসে আছি!’ বলতে-বলতে বিছানা থেকে লাফিয়ে নামলেন। কেমন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। যেন এখনই তাঁকে কিছু করতে হবে।
সুলতানা বেগমকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন। সুলতানা বেগম লাজুক কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘আরে! এ কী করছ তুমি! ছেলে জেগে উঠে দেখে ফেলে যদি?’
আমজাদ হোসেন বলেন, ‘দেখলে দেখুক। দেখে শিখুক। বড় হয়ে ও যখন বিয়ে করবে, তখন তো ওকেও এসব করতে হবে।’
সুলতানা বেগম হাতের চেটো দিয়ে উল্টো ভাবে স্বামীর গালে ঘষা দিয়ে বলেন, ‘যখন শেখার এমনিতেই শিখে যাবে। তোমাকে আর শেখাতে হবে না। যাও, তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢোকো। শেভ করে গোসল করে এসো। আজ কিন্তু পাঞ্জাবি পরবে।’
আমজাদ হোসেন সুলতানা বেগমের কপালে আর একটা চুমু খেয়ে বলেন, ‘অফিসে যেতে হবে না? পাঞ্জাবি পরলে হবে?’
‘পাঞ্জাবি পরেই যাবে।’
‘পাঞ্জাবি পরে অফিসে যাব?!’
‘হ্যাঁ, আজ পাঞ্জাবি পরেই যাবে।’
‘অফিসের কলিগরা কী বলবে?’
‘কী আবার বলবে! কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, আজ তোমার বিবাহ বার্ষিকী। তাই পাঞ্জাবি পরে এসেছ। ব্যস। তাড়াতাড়ি বাথরুমে যাও। আমি সুমনকে উঠিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি করছি। তাড়াতাড়ি এসো। খিচুড়ি রান্না করেছি। গরম-গরম খাবে।’