রোলাঁর বাবা ছিলেন শহরের নামকরা নোটারী। আর্থিক উর্পাজন ভালই হত। কিন্তু ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নোটারীর কাজে ইস্তফা দিয়ে প্যারিসে একটা ব্যাঙ্কে সাধারণ চাকরি নিয়ে বাস করলেন।
রোলাঁ ভর্তি হলেন প্যারিসের সবচেয়ে নামকরা স্কুল লিসেতে। কিন্তু স্কুলের নিয়মবাধা জীবন ভাল লাগত না তাঁর। মাঝে মাঝে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠত। এই স্কুলেই। পরিচয় হল পল ক্লডেলের সাথে। উত্তরকালে দুজনেই হয়ে উঠেছিলেন ইউরোপের চিন্তাজগতে খ্যাতিমান পুরুষ।
রোলাঁ ছাত্র অবস্থাতেই আকৃষ্ট হলেন সঙ্গীতশিল্পী ভাগনারের প্রতি। তাঁর মনে হয়েছিল তিনিও ভাগনারের মত শিল্পী হবেন। কিন্তু মা-বাবা চাইলেন ছেলে যেন নিজের পায়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে। তার জন্যে এমন কিছু শিক্ষার প্রয়োজন যা অর্থ উপার্জনে সাহায্য করবে।
লিসের স্কুলের পাঠ করে রোলাঁ ভর্তি হলেন নর্মাল স্কুলে। এই স্কুল ছিল ফ্রান্সের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্কুল। এখানে নিয়ম-শৃঙ্খলা পড়াশুনার মনোযোগের প্রতি জোর দেওয়া হত। এখানে সাহিত্য দর্শন ইতিহাসের মধ্যে প্রথম রোলাঁ খুঁজে পেলেন কয়েকজন অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং আদর্শ শিক্ষক। এই শিক্ষকদের কাছ থেকে রোলাঁ পেয়েছিলেন এক উদার সংস্কারমুক্ত মানসিকতা। তার বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন পরবর্তীকালে হয়েছিলেন ফ্রান্সের মুক্তিদের মুক্তিপথের দিশারী।
নর্মাল স্কুলে পড়বার সময় রোল ছিলেন গভীর মনোযোগী ছাত্র। ক্লাসের পাঠ্য পুস্তকের বাইরে পড়তেন তলস্তয়, শেকস্পীয়র, হোমার, শুনতে জাগনারের সঙ্গীত। সঙ্গীত আর সাহিত্য ধীরে ধীরে তার মধ্যে সৃষ্টি করছিল এক নতুন জগৎ। সঙ্গীতের সাথে সাহিত্যের প্রতিও ছিল তার আজন্ম আকর্ষণ। যখনই সময় পেতেন কবিতা লিখতেন। সাহিত্য, সঙ্গীতের উপর প্রবন্ধ লিখতেন।
এই সময় রোলাঁর মানস জগতে ঘটল এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। রোলাঁর আদর্শ ছিলেন মহান রুশ লেখক তলস্তয়। তাঁর রচনা সমস্ত তরুণদের উদ্দীপিত করত। প্রতিটি লেখা রোলাঁ মুগ্ধ বিস্ময়ে পড়তেন। হঠাৎ প্রকাশিত হল তলস্তয়ের একটি প্রবন্ধ ‘কি করতে হবে? (What is to be done)। এতে তলস্তয় সমস্ত শিল্প সাহিত্যকে তীব্রভাষায় আক্রমণ করলেন, বললেন, বিঠোফেনের সঙ্গীত ইন্দ্রিয়ের কামনা সৃষ্টি করে। শেকস্পীয়র একজন নিকৃষ্ট কবি, অকেজো ব্যক্তি। সঙ্গীত এক চূড়ান্ত বিলাসিতা যা মানুষকে তার কর্তব্যকর্ম থেকে বিচ্যুত করে।
তলস্তয়ের এ মন্তব্যে বিচলিত হয়ে পড়লেন রোলাঁ। তার চিন্তামানসলোকে এতখানি ঝড় তুলল শেষ পর্যন্ত তিনি তলস্তয়কে একটি চিঠি লিখলেন। উত্তর পাবেন এমন আশা ছিল না। কিন্তু কয়েক মাস পর অপ্রত্যাশিতভাবে চিঠি এল। ১৪ অক্টোবর ১৮৮৭…প্রিয় ভ্রাতা, তোমার চিঠি পেলাম…প্রকৃত শিল্পীর প্রেরণা শিল্পের প্রতি ভালবাসা থেকে জন্মায় না, জন্মায় মানবজাতির প্রতি ভালবাসা থেকে। একজন প্রকৃত মানবপ্রেমিকই পারে মহৎ সৃষ্টি করতে।
এই চিঠি রোলাঁর ভবিষ্যৎ জীবনে এক নতুন আলো দিয়েছিলেন–তিনি সমস্ত জীবন এই আদর্শকেই শিল্পীর ধর্ম বলে মনে করেছেন। তাই পৃথিবীর যে দেশে মানবতা নিষ্পেষিত হয়েছে…মানুষ বিপন্ন হয়েছে, তিনি নির্ভীক চিত্তে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
নর্মাল স্কুলের জীবন শেষ হল। প্রতি বছর এই স্কুলের কয়েকজন ছাত্রকে গবেষণার জন্য বৃত্তি দেওয়া হত। রোলাঁ সেই বৃত্তি পেলেন। তাঁকে প্রাচীন ইতিহাসের গবেষণার জন্য যেতে হল রোমে। পুঁথি-পত্র ঘেঁষে গবেষণায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না রোলাঁর। তিনি ইতালির বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে উপভোগ করতেন সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দেখলেন ইতালির বিখ্যাত শিল্পকলা। ধীরে ধীরে তার মানসলোক এক পরিপূর্ণতার পথে এগিয়ে চলে। রোমে শেকস্পীয়রের নাটকের অভিনয় দেখে তার মনের মধ্যে নাটক লেখবার অনুপ্রেরণা জেগে ওঠে। বেশ কয়েকটি নাটক লেখেন। এগুলোর সাহিত্যিক মূল্য ছিল নিতান্তই কম। তাই পরবর্তীকালে নিজেই এই নাটকগুলোকে বর্জন করেন রোলাঁ।
ইতালিতে থাকার সময় রোলাঁর সাথে পরিচয় হয় মালভিদাভন মাইসেনবুর্গের সাথে। বিপ্লবে অংশগ্রহণ করার জন্য এই মহিলাকে জার্মানী থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাকে সে যুগের সব বিখ্যাত মানুষেরাই শ্রদ্ধা করতেন। এই বৃদ্ধার সাথে পরিচয় রোলাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে আরো ব্যাপ্ত করে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। বৃদ্ধা মালভিদা প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন রোলাঁর মধ্যেকার প্রতিভা। তিনি লিখেছেন,”আমি এই তরুণের মধ্যে এমন এক উচ্চ আদৰ্শ ও মেধা দেখেছি, যার প্রকাশ দেখেছি শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়কদের মধ্যে।”
দু বছর ইতালিতে কাটিয়ে তিনি ফিরে এলেন প্যারিসে। নর্মাল স্কুলে সঙ্গীত শিক্ষকের চাকরি পেলেন। এখানে কিছুদিন শিক্ষকতা করবার পর ১৯০৩ সালে তিনি সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত ও ইতিহাসের অধ্যাপকের পদ পেলেন।
শিক্ষকতার সাথে সাথে সঙ্গীতের উপর বেশ কয়েকটি বই লিখলেন–Oid musi cians, Haended, History of opera, Musicians of today. এই বইগুলো মূলত ছাত্রদের জন্য লিখলেও তিনি এরই মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করলেন সঙ্গীদের মর্মবাণী। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে মানুষ দেশকাল সমস্ত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে। নিজেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে এক মহামানবের স্তরে।