- বইয়ের নামঃ গডফাদার
- লেখকের নামঃ মারিও পুজো
- প্রকাশনাঃ বাতিঘর প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর, ভূতের গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী
গডফাদার
১.১ তিন নম্বর ফৌজদারি আদালত
গডফাদার (ভলিউম-১) – মারিয়ো পুজো
রূপান্তর: শেখ আবদুল হাকিম
প্রথম পর্ব
০১.
নিউইয়র্ক। তিন নম্বর ফৌজদারি আদালত। বসে আছে আমেরিগো বনাসেরা। মনে আশা, সুবিচার পাবে সে। তার মেয়ের ওপর যারা অমানুষিক নির্যাতন করেছে, যারা বেচারীর ইজ্জত লুঠ করার অপচেষ্টা চালিয়েছে, আইনের মাধ্যমে তাদের উপর প্রতিশোধ নেয়া যাবে।
থমথম করছে বিচারকের মুখ। কালো পোশাকের আস্তিন গোটালেন তিনি, যুবক দুজনকে নিজের হাতেই যেন কষে ধোলাই দেবেন। ঘৃণাভরে তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।
তবু কেমন যেন একটা সন্দেহ জাগছে নাসেরার মনে। সঠিক কিছুই বুঝতে পারছে না, কিন্তু খুঁতখুঁত করছে মনটা: এসবের মধ্যে কোথায় যেন একটা ছলচাতুরি আছে।
তোমরা নরাধম! জঘন্য অপরাধ করেছ। রাগে কেঁপে উঠলেন বিচারক।
চকচক করছে ছোট করে ছাঁটা দুই যুবকের চুল! লাবণ্যের প্রলেপ মাখা পরিচ্ছা মুখ। অনুতাপে মিয়মান। মাথা হেঁট।
বুনো জন্তুর মত আচরণ করেছ তোমরা, কর্কশ গলায় রায় ঘোষণা করছেন বিচারক। সে বেচারীর সতীত্ব নষ্ট করতে পারোনি, এ তোমাদের সৌভাগ্যতা যদি করতে, তোমাদের প্রত্যেককে বিশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হত। থামলেন তিনি। তাঁর অদ্ভুত ঘন ভুক্ত জোড়া দেখে শ্রদ্ধা জাগে মনে। ভুরুর নিচে চকচক করছে দুটো চোখ। চোখের পাতা কুঁচকে তাকালেন তিনি। চকিতে বনাসেরার রক্তশূন্য মুখটা দেখে নিলেন একবার। টেবিলের উপর ফিরে এলো দৃষ্টি। কাগজপত্রের স্তূপ দেখলেন। মৃদু কুঞ্চিত হলো ভুরু জোড়া, কাঁধ ঝাঁকালেন। ভাবটা যেন, আর কোন উপায় নেই, তাই নিজের স্বাভাবিক ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে তাকে।
তোমাদেরকে আমি তিন বছরের কারাদণ্ড দিলাম, আবার শুরু করলেন বিচারক। কিন্তু তোমাদের বয়স কম। এ ধরনের অপরাধ আগে কখনও করোনি। অভিজাত পরিবারের ছেলে তোমরা। এবং আইনের অপার মহিমা তাই কখনও সে প্রতিশোধ গ্রহণ করে না। এই সব বিবেচনা করে তোমাদের এই দণ্ড মওকুফ করা হলো।
হতাশা আর ঘৃণায় স্তম্ভিত হয়ে গেল বনাসেরা। মেয়েটি এখনও হাসপাতালে, তার দিয়ে জোড়া লাগানো হয়েছে-ভাঙা চোয়াল। কুকুর দুটো বেকসুর খালাস পেয়ে গেল। ভাবছে সে, বেঈমানী করা হলো তার সাথে। ঠকানো হলো। এর নাম বিচার নয়, প্রহসন।
ছেলে দুটোর মা-বাবার দিকে তাকালসে! পরম আদরে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ছেলেদের। কত খুশি সবাই! হাসি আর আনন্দের প্লাবন বয়ে যাচ্ছে।
গলা দিয়ে টক টক একটা ভাব উঠে এলো আমেরিগোর। বমি পাচ্ছে তার। সাদা একটা রুমালে চেপে ধরুল মুখ।
দুপাশে বসাব বেঞ্চ, মাঝখানে অপ্রশস্ত পথ। লম্বা পা ফেলে চলে যাচ্ছে ছেলে দুটো। অনড় দাঁড়িয়ে থাকল নাসেরা। নড়ার শক্তি নেই। ছেলে দুটোর মুখে আনন্দের হাসি। দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে বুক ফুলিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার দিকে ভুলেও একবার তাকাল না।
ইতিমধ্যে ওদের মা-বাবারাও কাছে এসে পড়েছে। দুজন মহিলা, দুজন পুরুষ। সবাই ওর কাছাকাছি বয়সের পোশাক-আশাক, ওর চেয়ে একটু বেশি মার্কিনী। ওর দিকেই তাকিয়ে আছে চারজন। একটু যেন ইতস্তত ভাব রয়েছে সবর মধ্যে, কিন্তু চোখেমুখে বিজয়ের অদ্ভুত একটা বেপরোয়া ভাবও রয়েছে, দৃষ্টি এড়াল না বনাসেরার।
এতক্ষণ বহু কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছিল সে। হঠাৎ সংযমের বাঁধ ধসে পড়ল। সামনের দিকে ঝুঁকে বিকৃত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল সে, আমার মত তোমাদেরকেও কাঁদতে হবে। সে ব্যবস্থা আমি করব। চোখের উপর রুমাল চেপে ধরুল বনাসেরা। পানি মুছছে।
ঠিক পিছনেই রয়েছে বিপক্ষের উকিলরা, মক্কেলদের একধারে সরিয়ে নিয়ে একটা দল পাকিয়ে ফেলল তারা। মা-বাবাদের নিরাপজ নিশ্চিত করার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ছেলে দুটো, দলের সঙ্গে যোগ দিল তারাও। তাড়াতাড়ি ছুটে এলো একজন বেলিফ। নাসেরার বেরিয়ে আসার পথ বন্ধ করে দিল সে। তবে এসবের কোন প্রয়োজন ছিল না।
আমেরিকার আইন শৃঙ্খলার উপর কখনও আস্থা হারায়নি বসেরা সেজন্যেই বৈষয়িক উন্নতি করেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ঘৃণায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে তার সারা শরীরে। ছেলে দুটোকে কুকুরের মত গুলি করে খুন করার ইচ্ছে হচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে স্ত্রীর দিকে ডাকাল সে। স্ত্রী বেচারী কিছুই বোঝেনি তখনও। বোকা বানিয়েছে ওরা আমাদের, বলল সে। তার মাথার ভিতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল সে। যা থাকে কপালে, ডন কর্লিয়নির কাছেই যাব আমি। কেঁদে পড়ব তার কাছে। ন্যায্য বিচার চাই আমি।
.
লস এঞ্জেলস। প্রকাণ্ড এক হোটেলের সুইট। লাল একটা কাউচে শুয়ে রয়েছে জনি ফন্টেন। হাতে স্কচ হুইস্কির বোতল। বার বার বোতল কাত করে মুখে মদ ঢালছে সে। ঢোঁক গিলছে। পাশেই একটা কাঁচের পাত্র, তাতে পানি আর বরফের কুচি রয়েছে। ঢোঁক গিলেই ঠাণ্ডা পানি মুখে নিয়ে মদের তেতো স্বাদটা ধুয়ে ফেলছে সে।
ভোর রাত। চারটে বাজে। মাতাল জনি মতলব আঁটছে, কলঙ্কিনী স্ত্রী আজ বাড়ি ফিরলে হয়, খুন করে ফেলবে তাকে। কিন্তু বাড়ি যদি ফেরে, তবেই। প্রথমা স্ত্রীকে ফোনে ডেকে মেয়ে দুটোর খবর নেবে নাকি? নাহ, সময় নেই এখন, অনেক দেরি হয়ে গেছে। বন্ধুদের কাউকে ডাকলে কেমন হয়? উঁহু, মন সায় দিচ্ছে না। কে কি ভাববে কে জানে! সুখ্যাতি আর সাফল্যের সেই চূড়ায় এখন আর নেই সে। ধাপে ধাপে নামতে নামতে অনেক নিচে নেমে গেছে। এমন একদিন ছিল, ভোর চারটে কেন, যখন ইচ্ছা ডাকলেই পোষা কুকুরের মত লেজ নাড়তে নাড়তে ছুটে আসত সবাই। সেদিন আর নেই। এখন ওরা তার ডাক পেলে বিরক্তি বোধ করে। আপন মনে হাসল জনি ফন্টেন। মনে পড়ে যাচ্ছে, যখন নাম ডাক ছিল, হলিউডের সেরা তারকারাও ওর ব্যক্তিগত সুবিধে অসুবিধের কথা শোনার জন্যে ব্যর্থ হয়ে থাকত।