দ্য লাস্ট ডন

০১. জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত

দ্য লাস্ট ডন / মারিও পুজো / অনুবাদ : মোঃ বুলবুল আহমেদ

উৎসর্গ

ভার্জিনিয়া অ্যাল্টম্যান
ডোমেনিক ক্লেরি

.

প্রস্তাবনা

কুওগ ১৯৬৫

ডন ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবেন বলে মনে স্থির করলেন। সান্তাডিও’র বিরুদ্ধে ব্যাপক যুদ্ধের ঠিক এক বছর পরের ঘটনা। ইস্টার উৎসবের অব্যবহিত পূর্বের এক পাম সানডেতে ডন ক্লেরিকুজিও আমন্ত্রণ জানালেন যুক্তরাষ্ট্রে তার বৃহৎ গোষ্ঠীর পারিবারিক প্রধানদের। ডন জীবনের পরিশুদ্ধির জন্য যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ক্লেরিকুজিও নিতে যাচ্ছেন, তাতে বাদ পড়ল না তারই প্রবাহিত রক্তের দুটি শিশুও।

ক্লেরিকুজিও আমন্ত্রণ জানালেন ভেগাসে জানাদু হোটেলের স্বত্ত্বাধিকারী আলফ্রেড গ্রোনিভেল্টকে এবং যুক্তরাষ্ট্রে মাদক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাকারী ডেভিড রেডফেলোকেও। মূলত ডন তার এই ব্যাপক প্রসারিত গোষ্ঠীর পারিবারিক প্রধানদের নতুন পথে উপাধিভুক্ত করতে চান।

বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে শক্তিশালী মাফিয়া দলের প্রধান ক্লেরিকুজিও তার ক্ষমতা পরিত্যাগ করতে চান। তিনি ভাবছেন ক্ষমতা হস্তান্তরের এটাই সময় এবং নিশ্চিতভাবেই এটা অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল। তবে যে কোনো হাতে এই ক্ষমতায়নও হবে ভয়াবহ, বিষয়টি সম্পর্কে ক্লেরিকুজিও অনেকটা নিশ্চিত। তবে তাকে এটা করতে হবে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সহৃদয়তাপূর্ণ মানসিকতায় এবং সর্বোপরি নিজের এতদিনকার অর্জিত ব্যক্তিগত সুনামের মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, ডন তার ক্ষমতা হস্তান্তর বা পরিত্যাগের বিষয়টি করতে চান তার আপন আস্তানায়।

ডন ক্লেরিকুজিও’র আস্তানাটি কুওগ-এ কুড়ি একর জায়গা নিয়ে অবস্থিত। এই আস্তানার চারদিক ১০ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন, লাল ইটের দুর্ভেদ্য দেয়াল তার ওপর কাঁটা তারের টানাবেড়া, বৈদ্যুতিক সংযোগও দেয়া হয়েছে তাতে। এই দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মাঝে ডনের আবাসন। অদূরে তার তিন পুত্রের তিনটি বাড়ি এবং বিশ্বস্ত জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর জন্য সব মিলিয়ে আরো কুড়িটি ঘর নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন মাফিয়া ডন ক্লেরিকুজিও নিবাস।

পাম সানডের এই বিশেষ দিনে আমন্ত্রিত অতিথিদের আসার আগেই উন ও তার পুত্ররা এই কুওগ আস্তানার প্রধান ম্যানসনের ঠিক পেছনে বাগান বাড়িতে বসে আলোচনা করছিলেন। তাদের মাঝে ছিল মাটির ওপর স্থায়ীভাবে বসানো লৌহশক্ত সাদা টেবিল, আরো মাথার ওপর লোহার জালের ছাদ।

ডনের জ্যেষ্ঠপুত্র জর্জিও’র বয়স ২৭ বছর। ইংলিশ জেন্টেলম্যানের মতো ছিপছিপে গড়ন। চেহারায় নিষ্ঠুরতার একটা ছাপ। বিশেষ করে তার নাকের নিচে মোছটুকু চেহারায় এই ক্রভাব এনে দিয়েছে। পরিচ্ছন্ন ও সদ্য তৈরি করা পরিধেয় পড়ে মুখে এক বিষণ ভাব নিয়ে জর্জিও বসে ছিল উন ক্লেরিকুজিও’র সবচেয়ে কাছে।

ডন জর্জিওকে নির্দেশ দিলেন যে জর্জিও যেন হোয়ার্টন স্কুলে ব্যবসা সংক্রান্ত পড়াশোনার জন্য আবেদন করে। সেখানে আইনানুসারে বিভিন্ন জটিলতার ফাঁক-ফোকরে অর্থ চুরির বিভিন্ন কলাকৌশল যাতে সে শিখতে পারে এটাই চান ডন।

বাবার এই পরিষ্কার নির্দেশের বিরুদ্ধে বা পক্ষে কোনো প্রশ্নই করল না জর্জিও। অবশ্য গুরুজনের কোনো নির্দেশের বিরুদ্ধে তাৎক্ষনিক মন্তব্য করা ডন পরিবারের রয়্যাল নিয়মের পরিপন্থী। জর্জিও বাধ্য ছেলের মতো মাথা হেট করে একরকম সায় দিয়ে গেল।

এরপর ডন তার ভগ্নি-পুত্র জোসেফ পিপি ডি লিমার দিকে তাকালেন। পিপিকে তিনি তার ছেলেদের মতোই ভালোবাসেন। যদিও পিপি তার রক্তের সম্পর্কের নয়। তাকে ভালোবাসার কারণ হচ্ছে, ডনের প্রয়াত বোনের পুত্র পিপি। এছাড়া সান্তাডিও’র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়লাভের পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে পিপি। এক কথায় সান্তাডিও’র বিরুদ্ধে যুদ্ধে গ্রেট জেনারেল পিপির কারণেই জয়লাভ সম্ভব হয়।

তুমি ভেগাসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও। সেখানেই তুমি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করবে। ডন গম্ভীর নির্দেশ ছুঁড়ে দিলেন পিপির দিকে। তারপর শুরু করলেন এই নির্দেশের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে। তিনি বললেন, তুমি সেখানে আমাদের জানা হোটেলের আয়-ব্যয় দেখাশুনা করবে। এখন আমরা আমাদের কর্মকাণ্ড গুটিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছি। সে কারণে কুওগে তোমার তেমন কাজ নেই। তবে তুমি অবশ্যই আগের মতোই আমাদের পরিবারের পক্ষে মুগুর হয়ে থাকবে।

ডনের কথায় পিপি হয়তো খুশি হতে পারেনি পিপির দিকে তাকিয়ে ডন বুঝতে পারলেন। এবার ডন তার উদ্দেশ্য খোলাসা করে বললেন, এই পরিবারের বাতাবরণ তোমার স্ত্রী ন্যালিনির জন্য উপযুক্ত নয়। সে এই ব্রঙ্কস এনক্লেভ-এ বাস করতে পারবে না। ডন বলে চললেন, আমার ধারণা, ন্যালিনি সবার চেয়ে অতিমাত্রায় আলাদা। এখানে সে কোনোমতেই খাপ খাওয়াতে পারবে না। সবার কাছে তিও হতে পারে। তার চেয়ে বরং এ পরিবেশ থেকে দূরে গিয়ে তোমরা নতুন জীবন শুরু কর।

ডন পিপির উদ্দেশ্যে যে কথাগুলো বললেন, তার হয়তো সবটাই সত্য। তবে শুধুমাত্র এ উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্য উনের নয়। ডন আরো ব্যক্তিক্রমী তিনি অন্য কোনো বৃহ উদ্দেশ্যে এমন পরিকল্পনা আটছেন। অন্তত পিপির মতো একজন বীরযোদ্ধাকে ক্লেরিকুজিও পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে রাখা ডনের উদ্দেশ্য হতে পারে না। ডন জানেন ব্রঙ্কস এনক্লেভে পিপি যদি মেয়রের জন্য চেষ্টা করে তবে সে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী মেয়র হবে। ডন যখন জীবিত থাকবেন না তখন তার অনুপস্থিতিতে ডন-পুত্রদের জন্যও পিপি হবে অন্যতম রক্ষক।

পিপির উদ্দেশ্যে ডন এবার স্পষ্ট বললেন, পশ্চিমে তুমিই হবে আমার অন্যতম প্রতিনিধি। ডন বললেন অচিরেই তুমি ধনী হয়ে উঠবে, তবে এর জন্য স্পষ্ট তোমার কিছু কাজের সাথে জড়িত হওয়াও গুরুত্বপূর্ণ।

লাস ভেগাসের একটি বাড়ির দলিল পিপির হাতে তুলে দিলেন ডন। এরপর ডন তার কনিষ্ঠ পুত্রের দিকে দৃষ্টি দিলেন।

২৫ বছরের যুবক ভিনসেন্ট ক্লেরিকুজিও ত্রি-রত্নের সর্বকনিষ্ঠ হচ্ছে এই ভিনসেন্ট। ভিনসেন্ট শুধু অবস্থানগত বা বয়েসের পার্থক্যেই কনিষ্ঠ নয় উচ্চতাতেও বড় দু ভাইয়ের চেয়ে খাটো, তবে গড়নে-গঠনে বেশ শক্ত। ভিনসেন্টের আরেকটি প্রশংসিত বিষয় হচ্ছে তার পরিমিত ব্যবহার ও সহানুভূতিশীল হৃদয়।

ভিনসেন্টের রয়েছে আরেকটি মজার গুণ। খুব ছোটবেলায়, যখন সে তার মায়ের হাঁটু সমান তখন থেকেই মায়ের কাছে রপ্ত করেছিল বিভিন্ন ক্ল্যাসিক ইটালীয় খাবার তৈরির কৌশল। সেই মমতাময়ী মা যখন মারা গেলেন তখন ভিনসেন্ট কিশোর মায়ের মৃত্যুতে খুব কেঁদেছিল সে। মায়ের অভাববোধ কাটিয়ে উঠতে তার অনেক দিন সময় লেগেছিল।

ডন ভিনসেন্টের দিকে উজ্জ্বল দৃষ্টিতে তাকালেন। হাসিমুখে বললেন, তোমার ভবিষ্য সম্পর্কেও আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি বললেন, এবং ভাবছি, তুমি তোমা, লব্ধ পথেই এগিয়ে যাবে। নিউইয়র্কে তুমি সুন্দর একটি রেস্টুরেন্ট খুলবে। এর জন্য খরচের কোনো ত্রুটি করবে না। আমি চাই, তুমি দেখিয়ে দাও যে, ফ্রেঞ্চ খাবার সবখানেই পাওয়া যায়।

ডনের এমন নির্দেশ শুনে পিপিসহ উপস্থিত ডনপুত্ররা হেসে উঠল। ভিনসেন্টও হেসে ফেলল সবার সাথে। ডনের চেহারাও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি হাসি হাসি মুখেই ভিনসেন্টকে উদ্দেশ্য করে বললেন, রান্না শিক্ষার জন্য তুমি ইউরোপীয় কোনো স্কুলে এক বছর মেয়াদী কোর্সে ভর্তি হবে।

ভিনসেন্ট বাবার সিদ্ধান্তে মনে মনে খুশি হলেও ইউরোপীয় স্কুলে প্রশিক্ষণ গ্রহণের বিষয়টি ঠিক তার মনোপুত হলো না। ডনের এই নির্দেশের বিরুদ্ধে বিড়বিড় করে সে বলল, তারা আমাকে কি শেখাবে? ভাবখানা এমন যে, ভিনসেন্ট তাদের চেয়ে অনেক বেশি জানে।

ডন তার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন, তোমার অহমিকার যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে, তবে … একটু থেমে ডন আবার বললেন, তবে তোমার প্রশিক্ষণ গ্রহণের বিষয়টি আসছে এজন্য যে, তুমি যথাযথ অর্থ বিনিয়োগ করে একটি প্রতিষ্ঠান চালাতে সক্ষম হবে। এর জন্য তোমার শিক্ষার অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। তিনি ভিনসেন্টের ভবিষ্য সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করে বললেন, কে জানে একদিন হয়তো তুমি হবে বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্টের মালিক। এ ব্যাপারে জর্জিও তোমাকে অর্থের যোগান দেবে।

সবশেষে ডন তাকালেন তার দ্বিতীয় পুত্র পেটি-এর দিকে। পেটি হচ্ছে ডনের সবচেয়ে হাসিখুশি ও সদা-উৎফুল্ল পুত্র। পেটি তার ছাব্বিশ বছর বয়সেও একজন বালকের মতোই উচ্ছল সদালাপী ও অমায়িক। তবে উন জানেন, এই উচ্ছল পুত্রটিকেও তার পূর্বপুরুষ সিসিলীয় ক্লেরিকুজিও’র ধারায় ফিরে আসতে হবে।

পেটি ডন বললেন, এখন যেহেতু পিপি পশ্চিমের দায়িত্ব নিচ্ছে, তুমি ব্রঙ্কস এনক্লেভের মেয়র হবে। তোমার কাজ হবে পরিবারের জন্য তুমি সব সৈন্য সরবরাহ করবে। এছাড়াও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানি কিনে দেব। তুমি নিউইয়র্কে নির্মাণ করবে আকাশচুম্বী উঁচু উঁচু দালান। রাষ্ট্রের পুলিস ব্যারাকগুলোও হতে হবে তোমার প্রতিষ্ঠানের তৈরি। শহরের রাস্তাগুলোও ইটপাথর দিয়ে মসৃণ করে সাজাতে হবে তোমাকেই।

ডন বলে চললেন, এই ব্যবসা প্রায় নিশ্চিত। তবে আমি আশা করব এমন প্রতিষ্ঠান তুমি নিজ যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠা করবে। তোমার সৈন্য-সামন্তরা হবে তোমার বৈধতাপ্রাপ্ত বা আইনসম্মত চাকুরে। আরো এর জন্য তোমাকে হতে হবে প্রচুর টাকার মালিক।

এই লক্ষ্যে প্রথমেই তুমি হবে এমন একটি কোম্পানি নিয়োগপ্রাপ্ত চাকুরে। তবে মনে রেখো, তোমার প্রাথমিক কর্তব্য হচ্ছে পরিবারের সৈন্য সরবরাহ ও তাদের ওপর তোমার কমান্ড পরিচালনা করা।

একটু থেমে জর্জিও’র পূর্ণ মনযোগ আকর্ষণ করার জন্য তার নাম ধরে ডাকলেন ডন, জর্জিও।

ডন বললেন, তোমাকেই আমার উত্তরসূরি নির্বাচিত করছি। তবে মনে রেখো শুধুমাত্র পরিবারের ওপর আসন্ন বিপদের সময় তুমি ও ভিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। দীর্ঘ সময়ের জন্য তোমাদের সক্রিয় থাকার প্রয়োজন নেই।

ডন বললেন, পরবর্তী প্রজন্মের কথাও আমাদের ভাবতে হবে। তোমার সন্তান-সন্ততি, আমার সন্তান-সন্ততি, এমনকি ছোট্ট ডেন্টি ও ক্রকসিফিজিও যেন এই মাফিয়া পরিবেশে বেড়ে না ওঠে।

আমরা ধনী নিঃসন্দেহে। দীর্ঘদিন আমাদের জীবন হুমকির মাঝে রাখতে চাই না। আরো এই রিস্কের মধ্যে আমরা আমাদের প্রতিদিনের রুটিটুকুও রোজগার করতে চাই নাই। আমাদের পরিবার এখন কেবল সকল পরিবারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবেই কাজ করে যাবে। আমরা চাহিদানুসারে তাদের রাজনৈতিক সমর্থন ও সহযোগিতা যোগাব, ঝগড়া-ফ্যাসাদে মধ্যস্থতা করে যাব। তবে এর জন্য আমাদের হাতে পর্যাপ্ত কার্ড থাকতে হবে। আমাদের থাকবে আমি এবং আমরা অবশ্যই সকলের অর্থ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করব। এর জন্য অবশ্য তারাও আমাদের গলা ভিজিয়ে যাবে।

অকস্মা ডন নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। কি যেন ভাবতে লাগলেন। উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার সূক্ষ্ম দৃষ্টি দেয়া চোখ দুটো। কণ্ঠে প্রত্যয়ের সুরে বলতে শুরু করলেন– এখন থেকে কুড়ি-ত্রিশ বছর আমরা আমাদের বর্তমান অবস্থান থেকে অন্তর্হিত হয়ে একটি আইনসম্মত বৈধ পৃথিবীতে প্রবেশ করব এবং আমরা আমাদের সম্পদগুলো তখন নির্দ্বিধায়, ভীতিহীন চিত্তে উপভোগ করতে সক্ষম হবো। আমাদের পরিবারের ঐ দুটি শিশুও যাদের ধর্মীয় দীক্ষায়-দীক্ষিত করতে যাচ্ছি, তাদেরকে যেন আমাদের বর্তমান অপরাধী জীবনের দায়ভার বহন করতে না হয়। আমাদের জন্য তারা যেন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে না ওঠে।

তবে কেন এই ব্রঙ্কস এনক্লেভ ধরে রাখা? প্রশ্ন করল জর্জিও।

ডন বললেন, আমরা কোনো এক সময় ধার্মিক হয়ে যাব বলে বিশ্বাস করি। তার আগে শহীদ হয়ে যেতে চাই না।

এক ঘন্টা পর ডন ক্লেরিকুজিও তার বাড়ির বেলকনিতে উঠে এলেন। তারপর সেখান থেকে তাকিয়ে থাকলেন নিচে উৎসবমুখর আয়োজনের দিকে।

বেলকনি থেকে নিচের বিশাল লনটি যেন মনে হচ্ছিল পিকনিক-টেবিল দিয়ে কার্পেটের মতো বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। টেবিলগুলো ঘিরে প্রায় দুশর মতো আমন্ত্রিত অতিথি। টেবিল ঘিরে আমন্ত্রিত অতিথিদের দৃশ্যটি বেলকনি থেকে ডনের মনে হচ্ছিল যেন এক-একটি মুকুট। অতিথিদের অনেকেই ব্রঙ্কস এনক্লেভের সেনা। এই উৎসব মুখর আয়োজনে চাঞ্চল্য থাকলেও ডন-এর মাঝে কোনো প্রাণ খুঁজে পেলেন মা–মনে হচ্ছিল সবকিছু যেন মেকি, সাজানো।

সান্তাডিও’র বিরুদ্ধে জয় পেলেও ডন ক্লেরিকুজিওকে মূল্য দিতে হয়েছিল অনেক। সে লড়াইয়ে ডন হারিয়েছিলেন তার সবচেয়ে স্নেহের পুত্র সিলভিয়োকে। তার কন্যা রোজ ম্যারি হারিয়েছে স্বামীকে।

উদাস দৃষ্টিতে ডন তাকিয়েই রইলেন নিচের উৎসবমুখর লনটির দিকে। লনে ফেলা দীর্ঘ টেবিল ঘিরে বসে আছেন অতিথিরা। টেবিলের ওপর সাজানো গাঢ় লাল রঙের সুরাভর্তি ক্রিস্টাল গ্লাস। মাঝে মাঝে উজ্জ্বল সাদা বাটিতে পূর্ণ সুপের লাইন। বিভিন্ন ধরনের পাস্তা, বারকোশে সাজানো বিভিন্ন রকমের স্লাইস করা মাংস-পনির এবং সতেজ ও মচমচে বিভিন্ন আকারের ব্রেড। এমন উৎসবে ভন ক্লেরিকুজিও অবশ্য নেপথ্যে ছোট-খাটো একটি ব্যান্ড দলের সফট মিউজিক পরিবেশেনেরও অনুমতি দিয়েছিলেন।

লনে সাজানো পিকনিক টেবিলগুলোর মাঝামাঝি একটি স্থানে গিয়ে ডনের দৃষ্টি স্থির হলো। শিশুবহনকারী ছোট দোলনা-গাড়িতে মোটা নীল পশমী কাপড়ে মোড়া দুটি শিশু। তিনি দেখলেন, ধর্মীয় পথের জন্য তাদের যখন পবিত্র পানির ছটা দেয়া হচ্ছিল, তখন, শিশু দুটি মোটেও ভয় পায়নি। তাদের পেছনেই ছিল তাদের দুই মা- রোজম্যারি এবং পিপির স্ত্রী ন্যালিনি ডি লিনা। তাদের সন্তান দুটির নাম ডেন্টি ক্লেরিকুজিও ও ক্রকসিফিজিও ডি লিনা। বেলকনি থেকে শিশু দুটির নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মনে মনে ভাবতে লাগলেন তাদের যেন ভবিষ্যতের কথা ভাবতে না হয়, এই নিশ্চয়তার জন্য তিনি যথাযথ দায়িত্ব পালন করছেন। ধর্মের পথে ধর্মের জন্যই আজকে তাদের নিয়ে এই আয়োজন। ডনের এই পদক্ষেপ যদি সফল হয় তবে স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য একটি সুন্দর সমাজে তারা প্রবেশ করতে পারবে। তিনি অত্যন্ত কৌতূহলের সাথে লক্ষ্য করলেন যে, এই জনসমাবেশের একটি লোকও শিশু দুটির প্রতি অনুগত্য স্বীকার করছে না।

তিনি বেলকনিতে দাঁড়িয়েই দেখতে পেলেন ভিনসেন্টকে। গ্রানাইটের মতো কঠোর মুখে সে ছোট ছোট বাচ্চাদের হটডগ খাওয়াচ্ছে। শিশুদের জন্য এই আইটেমটি ভিনসেন্ট নিজের হাতেই তৈরি করেছে। হটডগ রাখার ঘোড়া গাড়িটির সাথে নিউ ইয়র্কের পথে পথে ঘুরে বেড়ানো ঘোড়া গাড়িটির তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তবে ভিনসেন্টের গাড়িটি আকারে আয়তনে একটু বড় এই যা। গাড়ির উপরিভাগে বসানো রয়েছে উজ্জ্বল রঙের একটি ছাতা। ভিনসেন্ট তার গাড়ি থেকে ভালো ভালো খাবারগুলো তুলে আনছে। তার পরণে রয়েছে সাদা এপ্রোন। হটডগের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই সে বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে হটডগ তৈরি করে যাচ্ছে। লোভনীয় এই খাবারটি পেতে প্রত্যেক শিশু ভিনসেন্টের গালে একটি করে চুমু দিচ্ছে।

বাহ্যিক দৃষ্টিতে ভিনসেন্ট দেখতে কঠোর বা ককৰ্শ হলেও প্রকৃত পক্ষে সে বেশ সহানুভূতিসম্পন্ন যুবক। ডনের পুত্রদের মধ্যে ভিনসেন্টই সবচেয়ে দয়ালু প্রকৃতির বিষয়টি ডন ক্লেরিকুজিও ভালোভাবেই জানেন।

সেন্সর ক্যামরার মতো ডনের চোখ দুটো প্রত্যক্ষ করছিল লনের উপস্থিত আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দের ওপর। তার চোখ পড়ল বকসি কোর্টের ওপর। সেখানে দেখা গেল, পেটি, পিপি ডি লিনা, ভারজিনো ব্যালাজো ও আলফ্রেড গ্রোনিভেল্টের  সাথে বকসি বল খেলায় মত্ত। পেটি স্বভাবগত জোকার। পেটির এই স্বভাব ডনের পছন্দ নয়। জুনের মনে হয় পেটির এই স্বভাব যে কোনো সময় তার জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এমন কথা ভাবতে ভাবতেই ডন দেখতে পেলেন বকসি গেমটি পেটির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় সে তাৎক্ষণিক তা ভণ্ডুল করতে বলটি প্রথম হিটেই পিসে পাঠিয়ে দিল।

ভারজিনো ব্যালাজো ক্লেরিকুজিও পরিবারের একজন নির্বাহী কর্মকর্তা ডনের আন্ডার বস। বকসি-বলের গেমটিতে অত্যন্ত তেজস্বী এই ব্যালাজো পেটিকে মোকাবেলা করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে লাগল। ডন জানেন, তার পুত্র পেটি জন্মগত একজন কৌশলী গুপ্তঘাতক এবং আমোদপ্রিয় ব্যালাজো তার আত্মঅধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিশ্চিত সুনাম রয়েছে।

তবে এদের কারো সাথেই পিপির কোনো তুলনা চলে না।

ডন দেখতে পেলেন অদূরে একদল মহিলা ক্ষণে ক্ষণে পিপির ওপর চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। তবে এদের দলে নেই সেই দুই মা রোজম্যারি ও ন্যালিনি।

সত্যিকার অর্থেই পিপি একজন সুদর্শন মানুষ। ডনের মতোই উঁচু-লম্বা সুপুরুষ। পেশিবহুল শক্ত শরীর–সব মিলিয়ে আকর্ষণীয় হ্যান্ডসাম পুরুষ। শুধু মহিলারাই নয় উপস্থিত অনেক পুরুষও তাকে লক্ষ্য করছিল। এদের মধ্যে অনেকে ব্রঙ্কস এলক্লেভ থেকে আসা তারই সৈন্য। তারা দেখছিল পিপির নির্দেশনা, শারীরিক অভিব্যক্তির নমনীয় অ্যাকশন। অনেকেই তাকে লিজেন্ড হিসেবেই জানে যে কোনো পুরুষের চেয়ে তাকে সবচেয়ে কোয়ালিফাইড মানব এবং শক্ত-সামর্থ্য, পেটানো শরীরের জন্য তাকে দি হ্যাঁমার নামেও ডাকা হয়।

ডেভিড রেডফেলো, একজন যুবক। গোলাপের পাপড়ির মতো চিবুক। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মাদক ব্যবসায়ী। দোলনা-গাড়িতে রাখা শিশু দুটির গাল টিপে আদর করছিল রেডফেলো।

বকসি-বলের অদ্ভুত এ খেলায় অবশেষে আলফ্রেড গ্রোনিভেল্ট হাঁপিয়ে উঠল। তার পরিষ্কার পরিধেয় জ্যাকেট ও টাই ময়লায় মাখামাখি হয়ে গেল। গ্রোনিভেল্টের  বয়স ডনের বয়সের কাছাকাছি, প্রায় ষাটের মতো।

আজকের এই দিনটির মাধ্যমেই ডন ক্লেরিকুজিও তার পরিবারের সবার জীবন পরিবর্তন করে ফেলতে চান–তিনি আশা করছেন ভবিষ্যতের পথ মঙ্গলময় হয়ে উঠবে।

জর্জিও বেলকনিতে তার বাবার কাছে উঠে এলো। মনে করিয়ে দিল আজকের দিনের প্রথম মিটিংয়ের কথা।

ডন ম্যানশনের ছোট একটি কক্ষে উপস্থিত হয়েছে শীর্ষস্থানীয় দশ জন মাফিয়া প্রধান। জর্জিও ইতিমধ্যেই ক্লেরিকুজিও’র প্রস্তাবনা সম্পর্কে তাদের জানিয়ে দিয়েছে। ডনের মাথা থেকে উদ্ভূত এই পরিশুদ্ধির বিষয়টি সভার জন্য নতুন ও বিশেষ বিষয় হলেও তারা ঠিক সমর্থন করতে পারছে না। এর কারণ ক্লেরিকুজিও’র সাথে তাদের প্রকৃত সামাজিক সম্পর্ক নেই। আর তাই তারা তাদের পথেই অগ্রসর হতে চায়।

ডনের এই সভাকক্ষটি জানালাবিহীন। ছোট্ট এই ডেন আকারের কক্ষে উন্নত মানের আসবাব। তাছাড়া কক্ষের কোণে রয়েছে একটি স্যাঁতসেতে পানশালা। কক্ষের মাঝামাঝি প্রায় কালো মার্বেল পাথরের কনফারেন্স টেবিল ঘিরে আসন গ্রহণকারী দশ জনের চেহারায় একটি বিষণ্ণ ভাব ফুটে উঠেছিল। ইতিমধ্যেই ডন প্রবেশ করলেন এবং সবাইকে অভিবাদন জানান। উপস্থিত মাফিয়া প্রধানরা ডন ক্লেরিকুজিও’র মুখ থেকে কিছু শোনার আশায় উদগ্রীব হয়ে উঠল।

ডন ক্লেরিকুজিও’র অতিথিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আর সামান্য কিছু সময় অপেক্ষা করার অনুরোধ জানালেন। আর তার পুত্রের প্রতি নির্দেশ দিলেন এ সভায় ভিনসেন্ট, ডনের এক্সিকিউটিভ অফিসার ব্যালাজো ও পিপি ডি লিনাও যেন উপস্থিত হয়। কাঙ্ক্ষিত জনেরা যখন সবাই উপস্থিত হলো, তখন জর্জিও শীতল ও খসখসে কণ্ঠে এই সভার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করল।

আর এরই ফাঁকে ফাঁকে ডন তার সামনে উপস্থিত সকল মাফিয়া সদস্যদের অভিব্যক্তি পড়ার চেষ্টা করছিলেন। তিনি ভাবছিলেন, তার সামনে বসা অবৈধ সমাজের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই মানুষগুলো জনগণের সত্যিকার প্রয়োজনে যথাযথ অবদান রাখতে পারে।

ডন এবার শুরু করলেন তার বক্তব্য—আমার পুত্র, জর্জিও আপনাদের কাছে সবই বর্ণনা করেছে। আপনারা কিভাবে কাজ করবেন, সে সম্পর্কে তার বক্তব্য নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়েছে আপনাদের কাছে।

ডন বললেন, আমার প্রস্তাবটি মূলত এটাই। অপরাধ জগতের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা থেকে আমি অবসর নিতে যাচ্ছি। আর আমার নিউইয়র্কের সমস্ত কর্মকাণ্ড আমি তুলে দেব আমার পুরনো বন্ধু ভারজিনো ব্যালাজোর হাতে। তিনি তার নিজের মতো করে ফ্যামিলি গঠন করবেন। ক্লেরিকুজিও’র সমস্ত স্বাধীনতা ভোগ করবেন তিনি। আর দেশের অবশিষ্টাংশে আমার ইউনিয়ন, পরিবহন, এলকোহল, টোবাকো ও ড্রাগের যেসব ব্যবসা ও কর্মকাণ্ড রয়েছে সেসবও পরিত্যাগ করে আমি আপনাদের ফ্যামিলির মাঝে বিলিয়ে দেব। তবে সবকিছুর প্রতি আমার আইনানুগ অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকবে। যদি আমি কখনো ফিরে আসি তখন সেসব আয়-উপার্জনের অধিকারও আমাকে আপনারা দেবেন। ব্যালাজোর কর্তৃত্বে আপনারা নিরাপদ পন্থা অবলম্বন করে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাবেন। আরেকটি বিষয়, সরকারকে আয়ত্বে রাখতে আপনাদের খুব বেশি বেগ পেতে হবে না হয়তো। এর জন্য সরকারের সাথে পাঁচ শতাংশ কমিশন আমাদের বরাদ্দ রাখতে হবে। বিষয়টি আমি ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি।

ডনের এই চুক্তি ছিল উপস্থিত দশ মাফিয়া প্রধানের জন্য স্বপ্নের। তারা মনে মনে বেশ খুশি হলো। ক্লেরিকুজিও’র জন্য তাদের খুশি বা কৃতজ্ঞাবোধের কারণ–ক্লেরিকুজিও’র চক্রটি যখন গোটা অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণে অগ্রসর কিংবা ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছিল–এমন সময়েই ক্লেরিকুজিও অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন।

ভিনসেন্ট আমন্ত্রিত অতিথিদের ওয়াইন পরিবেশন করতে শুরু করল। অতিথিরা তাদের মদপূর্ণ গ্লাসগুলো উঁচিয়ে ডনের অবসর গ্রহণে তার সুস্বাস্থ্য কামনা করল।

.

মাফিয়া ডনের বিদায় অনুষ্ঠানের পর সেই সভাকক্ষটিতে ডেভিড রেডফেলোর সাথে দেহরক্ষীর মতো প্রবেশ করল পেটি। ডনের বিপরীত পাশে চামড়ার নির্মিত একটি শূন্য আর্মচেয়ারে বসল। ভিনসেন্ট তাৎক্ষণিক তার হাতে তুলে দিল একটি সুরার গ্লাস।

রেডফেলো দাঁড়াল মাফিয়া প্রধানদের আসন থেকে একটু পৃথক দূরত্বে। এর কারণ সে সবসময়ই ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রমী সে তার দীর্ঘ চুলের জন্য। শুধু তাই নয়, এ সময় তার পোশাকও ছিল ব্যতিক্রম। তার কানে শোভা পাচ্ছিল হীরার ইয়ার রিং, পরনে ছিল ডেনিম জ্যাকেট এবং পরিষ্কার প্রেসড জিনস। ব্যতিক্রমী এই রেডফেলোর ব্যতিক্রম হওয়ার আরো একটি কারণ তার শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে স্ক্যান্ডিন্যাভিয়ান রক্ত। রেডফেলোর প্রতি আকর্ষণের অন্য কারণগুলোর মধ্যে তার স্বর্ণালী চুল ও স্বচ্ছ নীল দুটি চোখ, সেই সাথে সদা প্রাণোচ্ছল অভিব্যক্তি।

এই ব্যতিক্রমী রেডফেলোর প্রতি ডন যারপরনাই কৃতজ্ঞ ও ঋণী। এর কারণ রেডফেলো হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে প্রমাণ করে দেখিয়েছে টাকা দিয়ে ড্রাগের মতো ব্যবসারও বৈধ অনুমোদন সক্ষম।

ডেভিড, ডেভিডের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন ডন ক্লেরিকুজিও। তাকে বললেন, তুমি তোমার ড্রাগ ব্যবসা থেকে অবসর গ্রহণ করছে। তোমার জন্য আমার কাছে এর চেয়ে ভালো কিছু আছে …।

রেডফেলো কোনো আপত্তি জানাল না। তবে প্রশ্ন করল, সেটা এখনই কেন?

নাম্বার ওয়ান…, ডন প্রতি উত্তরে বললেন, সরকার আমাদের এই ব্যবসায় ছাড় দিতে অনেক সময় উৎসর্গ করেছে। যে কোনো সময় এ ব্যবসায় সঙ্কট দেখা দিতে পারে। হতে পারে, তোমার বাকি জীবনটা অত্যন্ত দুঃসহ ও দুশ্চিন্তাযুক্ত হয়ে উঠবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এটা অত্যন্ত ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। আমার পুত্র পেটি এবং তার সৈন্য-সামন্তরা তোমার দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে এটা আমি বেশি দিন অনুমোদন দিতে পারি না। কলম্বিয়ানরা খুব সহিংস, বোকার মতো এক হয়ে ও বন্য হয়ে থাকে। তাদের হাতেই এ ব্যবসা ছেড়ে দাও। তুমি এখান থেকে অবসর নিয়ে ইউরোপ চলে যাও। আমি সেখানে তোমার সুরক্ষার ব্যবস্থা করব। তুমি ইতালির একটি ব্যাংক কেনার কাজে ব্যস্ত থাকবে এবং অবস্থান করবে রোমে। ইউরোপে তুমি আরো অনেক ব্যবসা ফেঁদে বসতে পারো।

চমৎকার, রেডফেলো বিস্মিত হলো, আমি ইতালির ভাষাও জানি না, আর ব্যাংকের ব্যবসায় কোনো অভিজ্ঞতাও আমার নেই।

তুমি সবই শিখবে। ডন প্রতিউত্তরে বললেন, এবং রোমে তুমি সুখী জীবনযাপন করবে। অথবা তুমি যদি চাও, এখানেও থাকতে পারো। তবে এক্ষেত্রে হয়তো তুমি খুব বেশি দিন আমার সমর্থন গ্রহণ করতে পারবে না। এখন তোমার পথ তুমিই বেছে নাও।

ডনের এমন শর্তে রেডফেলো প্রশ্ন করল। আমার এই ড্রাগ ব্যবসার ভার কে নিচ্ছে? আমি কি তবে এটা কিনতেও সক্ষম হব না?

কলম্বিয়ানরা তোমার ব্যবসার দায়িত্ব নেবে। ডন বললেন, ব্যবসাটি সুরক্ষিত নয়, সেটা হচ্ছে ইতিহাসের স্রোত। তবে সরকার তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে। এখন বলল, হ্যাঁ অথবা না?

রেডফেলো কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর আকস্মিক হেসে ডনের উদ্দেশে বলল, তাহলে আমাকে কিভাবে শুরু করতে হবে?

জর্জিও তোমাকে রোমে নিয়ে আমার লোকদের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেবে। ডন রেডফেলোর উদ্দেশ্যে আরো বললেন, এবং পুরো একটা বছর সে তোমাকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে যাবে।

রেডফেলোর দিক থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়ে ডন তাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, আমার উপদেশে সম্মতি দেয়ায় তোমাকে ধন্যবাদ। আমরা অংশীদার হিসেবেই থাকব। বিশ্বাস করো, এটা হবে তোমার জন্য একটা উন্নত জীবন।

.

ডেভিড রেডফেলো সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। ডন তার পুত্র জর্জিওকে পাঠালেন আলফ্রেড গ্রোনিভেল্টকে ডেকে আনতে।

ভেগাসে জানাদু হোটেলের মালিক হিসেবে গ্রোনিভেল্ট ছিলেন বর্তমানে ক্লেরিকুজিও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সান্তাডিও ফ্যামিলির নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষায়।

কক্ষে প্রবেশ করল গ্রোনিভেল্ট। মি. গ্রোনিভেল্ট। তাকে উদ্দেশ্য করে ডন বললেন, আপনি আমার প্রোটেকশনে জানাদু হোটেল পরিচালনা করে যাবেন। আপনার সম্পত্তি ও নিজের সুরক্ষার জন্য চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

হোটেলের আয় থেকে একান্ন শতাংশ আপনি রাখবেন যথাযথ নিয়মে। সান্তাডিও ও একই পরিবারে পরিচয়ে অবশিষ্ট ঊনপঞ্চাশ শতাংশের মালিকানা আমারই থাকবে। এ ব্যাপারে আপনি সম্মত আছেন তো?

গ্রোনিভেল্ট তার বয়স অনুপাতে অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন ও শারীরিক দিক দিয়ে বলিষ্ঠ ব্যক্তি। বেশ কৌশল ও সতর্কতা অবলম্বন করে তিনি ডনের  প্রস্তাবের প্রতিউত্তরে বললেন, যদি আমি থাকি, তবে আমি অবশ্যই একই কর্তৃপক্ষের সাথে হোটেলটি পরিচালনা করব। অন্যথায় আমি আমার অংশীদারিত্ব আপনার কাছেই বেচে দেব।

সোনার খনি বেচবেন! চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন ডন গ্রোনিভেল্টের  দিকে। অবিশ্বাস্য সুর ফুটে উঠল ডনের কণ্ঠে। তিনি বললেন, না না, আমাকে ভয় পাবেন না। আমি মোটের ওপর একজন ব্যবসায়ী। সান্তাডিও যদি পরিমিত বা সংযত হয়ে ওঠে তবে তো কোনো অপ্রীতিকর ঘটনাই কখনো ঘটবে না।

অস্তিত্ব আর বেশি দিন নেই। তবে আপনি এবং আমি দায়িত্ববান। আমার প্রতিনিধি ইতিমধ্যেই সান্তাডিও’র কাছে কিছু দাবির প্রস্তাব দিয়েছে। জোসেফ ডি লিনা, পিপি তার সম্মানে ছাড় দিতেও প্রস্তুত। পিপি হবে পশ্চিমে আমার প্রতিনিধি ব্ৰুগলিওন। এর জন্য বছরে সে সেই হোটেলের আয় থেকে ভোগ করবে দশ লক্ষ। যদি আপনি কখনো কোনো বিপদের আঁচ করেন তবে সোজা চলে যাবেন তার কাছে। অবশ্য আমার ধারণা আপনার যে ব্যবসা, তাতে পদে পদেই আপনাকে বিপদের মুখোমুখি হতে হয়।

গ্রোনিভেল্ট, একজন দীর্ঘমানব, সেই তুলনায় বেশ ধীর। ডনের উদ্দেশ্যে তিনি এবার প্রশ্ন করলেন, আপনি আমাকেই কেন এত সমর্থন দিচ্ছেন? আপনার তো অন্যান্য আরো অনেক লাভজনক ক্ষেত্র আছে।

ডন ডোমেনিকে গ্রোনিভেল্টের  প্রশ্নে গম্ভীর হলেন। ধীর-স্থীর ও আরো ব্যক্তিত্বের আভা কণ্ঠে এনে বললেন, এর কারণ আপনি একজন জিনিয়াস। বিশেষত আপনার এই ক্ষেত্রটিতে। আমি জানি লাস ভেগাসে অনেকেই আপনাকে জিনিয়াস ভাবে এবং এটা প্রমাণ করতে আমিই আমার কিছু বিষয় আপনাকে ফিরিয়ে দেব।

গ্রোনিভেল্ট এ কথা শুনে হাসলেন।

আপনি আমাকে যথেষ্ট দিয়েছেন—আমার হোটেল। এছাড়া আর কি এমন গুরুত্বপূর্ণ থাকতে পারে? গ্রোনিভেল্ট বললেন।

ডন তার বদান্যতায় স্মিত হেসে পলকেই ভাবতে লাগলেন গ্রোনিভেল্ট যতই বিপজ্জনক মানুষ হোক না কেন তার বিশেষ ক্ষমতা এমন যে কোনো মানুষ আকস্মিক তার সাথে সাক্ষাতে পরিতপ্ত হবে।

ডন বললেন, নাভাদা গেমিং কমিশনের পরবর্তী নিয়োগে আপনি আপনার নাম দাখিল করতে পারেন। সেখানে একটি ভ্যাকেনিস আছে।

গ্রোনিভেল্ট তার জীবনে খুব কম সময় চমৎকৃত হয়েছে। এমন আকস্মিক প্রাপ্তির ঘটনা তার জীবনে খুব কম। তবে আজকে ডনের কাছ থেকে এই প্রাপ্তি অবশ্যই অনাকাক্ষিত। গ্রোনিভেল্ট মুগ্ধ হলেন। তিনি এতই আনন্দিত হলেন যে, ভবিষ্যতে যদি তার কাছ থেকে হোটেল কেড়েও নেয়া হয় তবে তিনি কোনো দাবি করবেন না– এমনই ভাবলেন গ্লোনিতে মনে মনে।

ডনের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, যদি আপনি তা করেন, তবে আসন্ন কয়েক বছরেই আমরা সবাই ধনী হয়ে উঠব।

ডন বললেন, তাই হবে। এখন আপনি উৎসবে ফিরে যান এবং ইনজয় করুন।

গ্রোনিভেল্ট বললেন, আমি এখনই ভেগাসে ফিরে যেতে চাই। আমি যে এখানে একজন অতিথি হয়ে এসেছি। বিষয়টি জানাজানি হওয়াটা আমার মনে হয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

ডন এ কথায় মাথা নত করলেন। পেটির উদ্দেশ্যে বললেন, মি. গ্রোনিভেল্টকে নিউইয়র্কে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা।

.

গ্রোনিভেল্ট সভাকক্ষ ত্যাগ করার পরপরই বেরিয়ে গেল পিপি ডি লিনা ও ভারজিনো ব্যালাজো। ডনের প্রস্তাবে আমন্ত্রিত অতিথিদের অধিকাংশই হয়তো তেমন একটা আস্থা রাখতে পারেনি। মুখাবয়বে একটা চিন্তার ছাপ নিয়েই বেরিয়ে গেল তারা।

শূন্য কক্ষ নয়-কক্ষজুড়ে অতিথিদের ক্ষণিক আগের উপস্থিতির রেশ। ডন ক্লেরিকুজিও আগের অবস্থানেই বলিষ্ঠ। পাশে তার বড় ছেলে জর্জিও। অন্য সবার মতো জর্জিও আস্থাহীন নয়। তার চোখে-মুখে বাবার সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার দৃঢ় বিশ্বাসের আভা। অবশ্য জর্জিও’র মতো অন্য সদস্যরা ডনের পরিকল্পনার পূর্ণ উদ্দেশ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়।

ব্ৰুগলিওন হিসেবে ব্যালাজোকে অপরিপক্কই মনে করছেন ডন। সে পিপির চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের বড়। তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ইউনিয়ন, গার্মেন্টস সেন্টার ও পরিবহনসহ কিছু ড্রাগ ব্যবসা। ডন ডোমেনিকো তাকে জানিয়েছেন, ব্যালাজো তার ব্যবসা সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডগুলো এখন থেকে স্বাধীনভাবেই পরিচালনা করবে। তবে এসব থেকে মোটের ওপর সে ডনকে দশ শতাংশ সম্মানী প্রদান করবে। আরো তা না হলে সে তার নিজ দায়িত্ব ও নিয়ন্ত্রণে তার ব্যবসা পরিচালনা করবে। ডনের দিক থেকে কোনো রকমের সহযোগিতা প্রদান করা হবে না।

ডনের এই প্রস্তাব একরকম জয় করেই নিল ভারজিনো ব্যালাজো। স্বভাবে সে বেশ উজ্জ্বল প্রকৃতির। যে কোনো বিষয়ে কৃতজ্ঞতা বা নালিশ প্রকাশে রীতিমতো হৈচৈ বাধিয়ে বসে। তবে ডনের প্রস্তাবে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে বিনয়ী হলেও উজ্জ্বল প্রকাশভঙ্গি তার ভেতর থেকে ঠিকরে বেরুল, যখন সে ডনকে জড়িয়ে ধরল।

ডন দশ শতাংশের যে শর্ত আরোপ করেছেন ব্যালাজোর প্রতি তার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছিলেন তিনি।

দশ শতাংশের মধ্যে অর্ধেকাংশ অর্থাৎ পাঁচ শতাংশ তোমার বার্ধক্য অথবা অনাকাক্ষিত কোনো সময়ের বা দুঃসময়ের জন্য জমা থাকবে।

ডন বললেন, ক্ষমা করবে– মানুষের পরিবর্তন ঘটছে। তাদের স্মৃতিশক্তিরও বিভ্রম ঘটছে। পূর্ব পুরুষের উদারতার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতাবোধও ম্লান হয়ে যাচ্ছে ক্রমেই। এবার এসো, তোমাকে আমি মনে করিয়ে দেই তোমার সঠিক হিসাব-নিকাশ সম্বন্ধে।

অল্প সময়ের জন্য থামলেন ডন। তারপর বললেন, আসলে আমি কোনো ট্যাক্স সংক্রান্ত দফতরের লোক নই। আর এ কারণে আমি সে রকম কোনো পেনাল্টি বা উৎকোচ গ্রহণও তোমার কাছে করব না।

ব্যালাজো ডনের কথার আচ বুঝতে পারল। ব্যালাজো জানে ডনের যে কোনো পানিশমেন্ট কার্যকর হয় অত্যন্ত দ্রুত ও নিশ্চিতভাবেই। এমনকি এসব পানিশমেন্টের কোনো পূর্ব সতর্কতামূলক বাণীও শোনানো হয় না। আর ডনের পানিশমেন্ট বা শাস্তি মানে সর্বদাই অবধারিত মৃত্যু। এর কারণ ডনের কাছে শাস্তিযোগ্য অপরাধীরা ছাড় পেলে যে কোনো শত্রুপক্ষের সাথে যোগ দিয়ে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ব্যালাজোর উদ্দেশ্যে ডন আর তেমন কিছু বললেন না। ব্যালাজোকে বিদায় দিতে ডন যখন পিপিকে দেহরক্ষী হিসেবে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, আকস্মিক থমকে দাঁড়ালেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর পিপিকে কাছে টেনে কানে কানে বললেন, তোমার ও আমার মাঝে এ বিষয়গুলো গোপন থাকবে। মনে রেখো, তুমি অবশ্যই এসব আজীবন গোপন রাখবে। আমি তোমাকে কখনোই এমন কোনো নির্দেশ দেব না।

ম্যানশনের বাইরে লনের এক কোণে রোজ ম্যারি ক্লেরিকুজিও পিপি ডি লিনার জন্য অপেক্ষা করছিল। পিপির সাথে তার জরুরি কথা আছে।

রোজ ম্যারি বিধবা হলেও নবীনা ও আকর্ষণীয়া। অপেক্ষমাণ রোজ ম্যারির পরনে কালো ড্রেস– একেবারেই বেমানান লাগছে। তার এই শোকাবহ পরিধেয়র কারণ সান্তাডিওর। আজকে রোজ ম্যারির গায়ে এই শোকাবহ পোশাক তার ভেতরের প্রকৃত সৌন্দর্য ও অল্প বয়সের প্রাণময়তা ঢেকে দিয়েছে।

রোজ ম্যারির ডাগর বাদামি চোখ দুটোতে শোকের গহিন ছাপ নেমে এসেছে। ত্বকের জলপাই রঙ এই শোকাবহ কালো পোশাকের জন্য মনে হচ্ছে আরো পিঙ্গল। শুধুমাত্র তার নবজীবনের সূচনায় উদ্দীপ্ত কোলের সন্তান ডেন্টি যেন রোজ ম্যারির শোক ঢেকে কিছুটা আভা ছড়াচ্ছে। ডেন্টির মাথায় নতুন জীবনের আভাপূর্ণ নীল ফিতা বাঁধা।

সারাটা দিন রোজ ম্যারি আজ তার বাবার কাছ থেকে সতর্কতার সাথে দূরত্ব বজায় রেখেছে। এ দূরত্ব শুধু তার সাথেই নয় তার অপর তিন ভাই জর্জিও, ভিনসেন্ট ও পেটির কাছ থেকেও। তাহলেও, এখন রোজ ম্যারি অপেক্ষা করছে পিপি ডি লিনার মুখোমুখি হওয়ার জন্য।

পিপি ও রোজ ম্যারির মূল সম্পর্কটি কিন্তু রক্তের, উভয় উভয়ের কাজিন।

তবে রোজ ম্যারির সাথে পিপির বয়সের পার্থক্য প্রায় দশ বছরের। টিনএজার বয়সেই বোজ ম্যারি তার প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু অপরদিকে পিপি ছিল সর্বদা পৈতৃক ধারার রোজ ম্যারির আহ্বানে সে কখনোই স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। পিপি ছিল সব সময়ই বিপরীতমুখী। এর কারণ হচ্ছে রোজ ম্যারি তার ডনের কন্যা। বলিষ্ঠদেহী পিপি তার প্রতি দুর্বল হলেও শুধুমাত্র একটি কারণে এই দুর্বলতা ঝেড়ে-মুছে দূর করেছে।

পিপিকে আসতে দেখে বোজ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, হ্যালো পিপি, তারপর শুভেচ্ছা জানাল, কংগ্র্যাচুলেশন।

স্মিত হেসে পিপি তাকাল রোজ ম্যারির দিকে। তার এই মিষ্টি হাসি খুব ভালো লাগল রোজ ম্যারির।

পিপি এগিয়ে এলো বরাজের কাছে। মাথা নিচু করে তার কোলের শিশুটির কপালে আলতো চুমু দিল। শিশুটির শরীর থেকে তখনো চার্চের ধূপ-ধুনার হালকা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। শিশুটির দিকে তাকিয়ে পিপির মনে হলো– তার চুলগুলো একটি প্রায় নবজাতক শিশু হিসেবে বেশ ঘন।

পিপি শিশুটিকে উদ্দেশ্য করে রোজ ম্যারিকে বলল, ডেন্টি ক্লেরিকুজিও। চমৎকার নাম।

রোজ ম্যারির কাছে পিপির এ প্রশংসা ঠিক মনঃপূত হলো না। চুপিসারে রোজ অবশ্য তার পিতৃহীন সন্তানের নাম ঠিক করে রেখেছে। তার নিজের ক্ষেত্রেও কুমারী নামটিই প্রচার করতে ইচ্ছুক। বিষয়টি তার বাবা ডন ক্লেরিকুজিও’র কানে গেছে। ডন আপত্তি করেননি– মেনেই নিয়েছেন যুক্তির খাতিরে। তবে রোজ ম্যারি কিন্তু এখনো বিষয়টির সাথে খাপ খাওয়াতে পারেনি– নিজকে অপরাধী ঠাওরাচ্ছে বারবার।

এসব ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো বোজ। সে বলল, তুমি কিভাবে তোমার প্রটেস্ট্যান্ট স্ত্রীকে এই ক্যাথলিক উৎসবের জন্য সম্মত করালে, আর তোমাদের শিশুর ক্ষেত্রেও এমন ধর্মীয় নামেইবা তার সম্মতি এলো কেন?

পিপি তার কথায় আবারো হেসে ফেলল। আমার স্ত্রী আমাকে ভালোবাসে, আর তাই সব সময় আমাকে খুশি রাখতে চায়।

কথাটি সত্য। রোজ ম্যারি ভাবল। তার ধারণা পিপির স্ত্রী তাকে ভালোবাসে কারণ পিপি সম্পর্কে খুব বেশি জানে না। রোজ ম্যারি যে এক সময় পিপির প্রেমে পড়েছিল–এটিও সে জানে না।

রোজ ম্যারি বলল, তুমি তোমার ছেলের নাম রেখেছ কসিফিজিও। তুমিও তো তাকে খুশি করতে পারতে তোমার শিশুর একটি আমেরিকান নাম রেখে।

-আমি তোমার বাবাকে সন্তুষ্ট করতে তোমার দাদার নামে নাম রেখেছি।

হাসিমুখে রোজ ম্যারি বলল, ঠিক তাই, আমরাও অবশ্য তাই-ই করে যাব।

রোজ ম্যারির মুখে হাসি থাকলেও ভিতরে ভিতরে সে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল। রোজ ম্যারির মুখে এই মুখোশপূর্ণ কষ্টের হাসি যেন বাতাসে মিষ্টি আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছিল। তার মুখের সব কথা, অভিব্যক্তি মধুর লাগছিল পিপির কাছে।

রোজ ম্যারির মুখে কোনো কথা নেই।–দ্বিধাগ্রস্ত সে। আকস্মিক বলল, আমার জীবন রক্ষার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।

পিপি রোজ ম্যারির ভাবলেশহীন মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। আকস্মিক উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল।

কোমল স্বরে বলল, তোমাকে কখনোই কোনো বিপদের মুখে পড়তে হবে না।

কথাটি বলেই পিপি তার বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরল রোজ ম্যারির কাঁধ। তারপর বলল, বিশ্বাস করো। … আর, একটু থেমে পিপি বলতে লাগল, এখন থেকে আর কখনোই এমন কিছু ভাববে না। ভুলে যাও সব কিছু। আমাদের সামনে একটি সুখী জীবন অপেক্ষা করছে। অতীতের সবকিছু ভুলে যাও, একটু একটু করে।

রোজ ম্যারি তার কোলের সন্তানটিকে চুমু খেতে মাথা নিচু করল, কিন্তু পিপির কারণে পারল না।

পিপির কথার প্রতিউত্তরে ইতিবাচক মনোভাব এনে বলল, আমি সবই বুঝি।

রোজ ম্যারি জানে, এই কথোপকথনে পিপির মুখে তার বাবা ও ভাইদের কথা আবারো হয়তো আসবে। তাই বিষয়টি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করল সে।

বলল, আমি বর্তমান অবস্থাতেই বেশ মানিয়ে গেছি।

রোজ ম্যারি চায় পরিবারের সকলে জানুক সে তাদের খুব ভালোবাসে এখনো। পরিবারের সবাই জানুক রোজ ম্যারি তার সন্তান নিয়ে সন্তুষ্ট এবং প্রকৃত অর্থেই রোজ ম্যারি তার সন্তানের জন্য এই ধর্মীয় উৎসব ব্যাপ্টাইজিং-এ সন্তুষ্ট। পবিত্র পানির পরশে তার সন্তান নরকের পথ থেকে এসেছে এবং ভবিষ্যৎ জীবনও হবে তার ধর্মীয়– এমন বোধ থেকে সে মনে মনে কৃতজ্ঞও।

এমন সময় ভারজিনো ব্যালাজো হৈচৈ করতে করতে লনে এসে প্রবেশ করল। রোজ ম্যারি ও পিপিকে একরকম জোর করেই ঠেলে পাঠালে লনের মাঝামাঝি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডন ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও তার ম্যানশন থেকে বের হলেন– পেছনে তাকে অনুসরণ করছিল তিন পুত্র।

দেখতে দেখতে লনে সমাবেশ ঘটল আমন্ত্রিত-অনামন্ত্রিত সব লোকের। পুরুষদের পরনে ছিল ফরমাল ড্রেস, মহিলাদের গাউন আর বাচ্চারা পরে ছিল সার্টিন।

ক্লেরিকুজিও পরিবারের সদস্যরা অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড়াল ফটোগ্রাফারের সামনে। উপস্থিত সমাবেশ থেকে ভেসে আসতে লাগল করতালি। অনেকে শুভেচ্ছাবাণীর স্লোগানও দিতে থাকল। স্লোগানগুলো ছিল এ রকম : মুহূর্তটি শান্তির, বিজয়ের এবং ভালোবাসার।

পরবর্তীতে এই ছবিটি বড় করে ফ্রেমে সংযুক্ত করা হয়েছিল। আর তা টাঙানো হয়েছিল ডনের স্টাডিরুমে, সান্তাডিও’র বিরুদ্ধে যে যুদ্ধে ডনের প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র সিলভিও নিহত হয়, সেই সিলভিওর ছবির পাশে।

উৎসবের অবশিষ্টাংশ ডন তার বেডরুমের বেলকনি থেকে প্রত্যক্ষ করছিলেন।

রোজ ম্যারি তার পুত্রকে দোলনা গাড়িতে করে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল ঠিক বোলিং পিঠের পাশ দিয়ে। অপর দিক থেকে পিপির স্ত্রী ন্যালিনি তার শিশুকে নিয়ে লনের দিকে আসছিল। ক্রকসিফিজিওর মা ন্যালিনি। স্লিম, লম্বা, মার্জিত। রোজ ম্যারির পুত্র ডেন্টির মতোই একটি ট্রলিতে করে ন্যালিনি তার ক্রকসিফিজিওকে নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। এক সময় উভয়ে পরস্পরের কাছাকাছি এসে গল্পে মেতে ওঠে।

ডন প্রত্যক্ষ করছিলেন সবই। এই দুই শিশুকে দেখে তিনি বেশ নিশ্চিন্ত হলেন। শিশু দুটি যে আশ্রয়েই বড় হচ্ছে এবং নিরাপদে–এ ভেবেই তার এই নিশ্চিন্ত। তিনি এটাও ভাবলেন যে, এদের সুখী ভবিষ্যতের জন্য যে এত মূল্য দিতে হয়েছে বা হচ্ছে- তা তারা কখনোই জানবে না।

ডনের দৃষ্টি গেল আকস্মিক হাসাহাসির শব্দের দিকে। সেখানে দেখতে পেলেন পেটিকে। সে তার স্বভাবসুলভ কৌতুক প্রদর্শনের জন্য একটি দুধের বোতল ডেন্টি ও ক্রকসিফিজিওর ট্রলির মাঝে ফেলে দিল। এ অবস্থায় বোতলটির জন্য শিশু দুটি আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগল। এ দৃশ্যই সকলের হাসির কারণ।

এক সময় বোজ ম্যারি ট্রলি থেকে ডেন্টিকে কোলে তুলে নিল। ডনেরও মনে পড়ে গেল সেদিনকার সেই ছোট্ট ডন। ডন ভাবতে লাগলেন– ভালোবাসায় নারীর চেয়ে সুন্দর কিছু নেই, এমনকি কষ্টেও। স্বামী নিহিত হওয়ায় রোজ ম্যারি যখন বিধবা হয়ে পড়ল, তখন উন ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন মেয়ের জন্য।

রোজ ম্যারি যখন খুব ছোট- খুব আদুরে চেহারা ছিল তার। যেমন ছিল তার গায়ের রঙ তেমনি ছিল উৎফুল্ল। কিন্তু সেই শিশু আর আজকের রোজ ম্যারির মধ্যে বিশাল ফারাক।

সান্তাডিও’র লড়াইয়ে ভাই ও স্বামী নিহত হওয়ার পর থেকে বদলে গেছে রোজ ম্যারি আমূল।

ডনের অভিজ্ঞতা বলে, প্রকৃত প্রেমিকরা আবারো ভালোবাসার জন্য হাত বাড়ায় আর বিধবারা কেবলই কালো পোশাকে হাঁপিয়ে উঠতে থাকে। মেয়ের জন্য কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিল ডনের। তবে সান্ত্বনা দিতে আপন মনেই এলো– রোজ ম্যারির এখন একটি সন্তান আছে। সে তাকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখবে– লালন-পালন করবে।

ডন তার ফেলে আসা জীবনে চলে গেলেন। অতীত জীবনের পর্যায়ক্রমিক সফলতায় তিনি নিজেই আশ্চর্য হয়ে উঠলেন।

তার মনে হলো– ক্ষমতা এবং সম্পদের জন্য তার সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবে সঠিক ছিল। তবে এর জন্য তাকে কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে। তাছাড়া সবই ছিল প্রয়োজনীয় ও প্রমাণিত।

যদি কোনো মানুষ তার অপরাধে বা পাপের জন্য অনুশোচনায় ভোগে, তবে ডন তাকে অন্তত এতটুকু নিশ্চয়তা দেবেন যে, ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাও। ডন জানেন, ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করবেন।

ডনের দৃষ্টি পড়ল পিপির দিকে। তার ব্রঙ্কস এনক্লেভের তিন সৈন্যের সাথে বকসি খেলায় ব্যস্ত সে। এরা পিপির চেয়ে বয়সে কিছুটা বড়ই হবে। তবে, তারপরও তারা পিপির অনুগত।

পিপি তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং দক্ষতার জন্য সর্বদাই মধ্যমনি হিসেবে সহজেই স্থান করে নিতে সক্ষম। সে প্রকৃতই একজন লিজেন্ড। সে সান্তাডিও’র বিরুদ্ধেও বকসি খেলেছিল।

ডনের চোখে পিপি প্রাণবন্ত, উজ্জ্বল যুবক। যখন তার বল বিপক্ষীয়দের বলে আঘাত হানে তখন সে আনন্দে চিৎকার দিয়ে ওঠে। কত প্রাণের ছোঁয়াই না তার মাঝে–ডনের খুব ভালো লাগে। তিনি ভাবেন– একজন বিশ্বস্ত সৈন্য একটি উষ্ণ সঙ্গিনীর মতো শক্তিশালী এবং দ্রুত, চালাক এবং সংযত হচ্ছে পিপি।

ডনের প্রিয় বন্ধু, ভারজিনো ব্যালাজোও উপস্থিত ছিলেন বকসি কোটে। এই একমাত্র ব্যক্তি যিনি পিপির প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন দক্ষতার সাথে। ব্যালাজো যখন পিপির বলে জোরে আঘাত করতে সমর্থ হন তখন প্রায় সাথে সাথেই উল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠেন তার সফল হিটের জন্য। তারপর বেলকনির দিকে হাত উঁচিয়ে ডনের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন। ডনও করতালি দিয়ে তাকে উৎসাহিত করেন।

ডনের এই ভেবে খুব ভালো লাগে যে, এই মাত্র একটা দিন পাম সানডে, এ দিনটিতে তার নিয়ন্ত্রণাধীন সব লোক একে-অপরের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করছে। কুওগে মিলিত হয়ে আনন্দে মেতে উঠেছে। ডন মনে মনে গর্ববোধও করেন।

তিনি ভাবেন– হয়তো তার আজকের এই দুরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনা আসন্ন কঠিন সময়গুলোয় রক্ষাকবচ হয়ে দেখা দিবে।

তার আপন মানুষের মনে শয়তানের বীজ ইতিমধ্যেই সংগঠিত হয়েছে কি-না তা হয়তো ডন আগে থেকেই বুঝতে পারেননি।

.

পর্ব– এক

হলিউড
লাস ভেগাস ১৯৯০

০১.

ক্যালিফোর্নিয়ার বসন্ত।

সূর্যের আলোয় হলুদ আভা। বজ স্কানেট তার চুলগুলো স্প্রে করে হলুদ করে নিয়েছে। সূর্যের হলুদ, আরে স্প্রে করা হলুদে মিলে স্কানেটের চুল হয়েছে আরো উজ্জ্বল।

তার টান টান ও পেশিবহুল শরীরের পেশিগুলো একটি আসন্ন লড়াইয়ের উত্তেজনায় আন্দোলিত হচ্ছিল।

উত্তেজনার একরাশ আবেগ মনে। সারা বিশ্বের কয়েক কোটি দর্শক তাকে দেখবে টিভির পর্দায় দেখবে তার কাজ। উত্তেজনা হওয়া তো স্বাভাবিক।

স্কানেটের কোমরে এলাস্টিকের কোমরবন্ধ আর তাতে রয়েছে ছোট একটি পিস্তল। গায়ের জিপারযুক্ত পাতলা জ্যাকেট স্কানেটের কোমর ছাড়িয়ে নেমে গেছে আরেকটু নিচে। তাতে বেশ স্বাভাবিকভাবে গোপন রয়েছে তার কোমরে বাঁধা পিস্তলটি।

জ্যাকেটটি সাদা রঙের, তার ওপর অগ্নিশিখার লাল তীর নিচ থেকে উপরে উঠছে। এমন প্রিন্ট করা জ্যাকেটের সাথে ম্যাচ করে নীল ডটেড ব্যান্ড বেঁধেছে চুলে।

স্কানেটের ডান হাতে ধরা আছে বড় ধরনের রুপালি-রঙা অভিযান বোতল। পারতপক্ষে শো-বিজ দুনিয়ার একজন হিসেবে বজ স্কানেট নিজকে যতটা সম্ভব সাজিয়েছে। এর কারণ শো-বিস দুনিয়ার তারকা খচিত কলা কুশলীদের সম্মিলন অ্যাওয়ার্ড গিভিং সেরেমনি।

লস অ্যাঞ্জেলেসে ডরোথি চ্যান্ডলারে নির্মিত হয়েছে প্যাভিলিয়ন। এই প্যাভিলিয়ন ঘিরে কৌতূহলী জনতার ভিড়। একাডেমি অ্যাওয়ার্ড সেরেমনিতে যোগ দিতে আসা মুভি স্টারদের জন্যই ভক্তরা ভিড় করে আছে। এ ভিড়ের ঘনত্ব বাড়ছে ক্রমেই। রাস্তার দুধারে দর্শক-শ্রোতাদের ব্যাপক সমাবেশকে আটকে রাখা হয়েছে।

সড়কগুলো পরিপর্ণ হয়ে আছে বিভিন টিভি সংস্থার ক্যামেরা ও রিপোর্টারে। এই অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান ঘিরে খুঁটিনাটি সকল সংবাদ ক্যামেরার মাধ্যমে রিপোর্টাররা পাঠিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর কোণায় কোণায়।

আজ রাতে মানুষ দেখবে তাদের গ্রেট মুভি-স্টারদের সশরীরে। তাদের থাকবে না কোনো কৃত্রিমতা। পছন্দের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জয়-পরাজয়ের ফয়সালাও হবে আজ রাতে– এত মানুষের সমাগম এ কারণেই।

পোশকি নিরাপত্তা কর্মীরা দর্শকের ঢল নিয়ন্ত্রণে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যে পথ দিয়ে মুভি-স্টাররা ঢুকবে তা মানবশূন্য রাখতে কত কৌশলের অবতারণা। নিরাপত্তা কর্মীদের হাতে হাতে চকচকে বাদামি ব্যাটন। মাঝে-মধ্যে দর্শকদের উত্তেজনা দমন করতে ব্যাটন উঠিয়ে ভীতি প্রদর্শন করছে।

বজ স্কানেট অবশ্য নিরাপত্তা কর্মীদের দেখে মোটেও বিব্রত নয়। সে আকারে-আয়তনে বিশাল। শুধু তাই নয়, অনেকের চেয়েই সে অনেক বেশি গতিশীল ও ক্ষিপ্রতাসম্পন্ন। তাছাড়া আকস্মিক চমকে দেয়ার মতো স্কানেট কৌশলীও বটে।

নিরাপত্তা কর্মীদের ব্যাপারে সে উদাসীন হলেও টিভি রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যানদের নিয়ে দ্বিধান্বিত। কলা-কৌশলীরা তাদের পথে আসলেই তো শুরু হবে রিপোর্টারদের বিভিন্ন তৎপরতা। তখন তারা সেলিব্রেটিদের সুরক্ষার চেয়ে নিজেদের সংবাদ, সাক্ষাৎকার এসব রেকর্ড নিয়েই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়বে।

এসব চিন্তা করতে করতেই একটি সাদা লিমুজিন দেখতে পেল স্কানেট। প্যাভিলিয়নের প্রবেশ দ্বারের কাছে এসে থেমেছে লিমুজিনটি। আর তা থেকে নেমে এলো বিশ্বের সেরা সুন্দরীর খেতাবপ্রাপ্ত অভিনেত্রী অ্যাথেনা অ্যাকুইটেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিনের জরিপে অ্যাথেনা অব্যাহত বিশ্বসেরা সুন্দরী রমণী।

স্কানেট দেখল– অ্যাথেনা অ্যাকুইটেন গাড়ি থেকে নেমে আসার সাথে সাথেই দর্শকদের ভিড় ক্রমেই অভিনেত্রীর কাছাকাছি চলে আসছিল। নিরাপত্তা কর্মীরাও গলদঘর্ম হয়ে, ব্যাটন পিটিয়ে যুদ্ধ করে তাদের নির্ধারিত সীমানায় আটকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। অ্যাথেনার নাম ধরে ভক্তকুল স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তুলেছিল প্রাঙ্গণ।

অপরদিকে অভিনেত্রীর সাক্ষাৎকার, ছবি তোলা ও ক্যামেরায় ধারণ করে রাখতে ফেউ লাগল রিপোর্টাররা। এক রকম ঘিরেই ধরল তারা অ্যাথেনাকে। ভক্ত ও টিভি ক্যামেরার সামনে অ্যাথেনা হাত উঁচিয়ে অভিবাদনের সাড়াও দিয়ে যাচ্ছিল থেমে থেমে ক্রমাগত।

স্কানেট নিরাপত্তা ঘের কৌশলে টপকে বেরিয়ে এলো। তারপর শুরু করল ট্র্যাফিক গার্ড এড়িয়ে আঁকাবাঁকা দৌড়। আকস্মিক এ দৌড় দেখে কয়েকজন নিরাপত্তা গার্ডও তার পিছু নিল। কিন্তু স্কানেট ছিল তাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

কয়েক বছর আগে, কোনো এক ফুটবল ম্যাচে স্কানেট যেমন বিপক্ষীয় দলের কঠিন ডিফেন্স ভেঙে গোল করেছিল, ঠিক তেমনি এই নিরাপত্তা কমীদের জিগজ্যাগ সঙ্কুল পথ অনায়াসেই অতিক্রম করছিল। এভাবেই অবশেষে সে একেবারে যথাযথ মুহূর্তে এসে পৌঁছল প্যাভিলিয়নে।

অ্যাথেনা তখন সবেমাত্র মাইক্রোফোনটি হাতে তুলে নিতে যাচ্ছে। ফটোগ্রাফাররাও তার সৌন্দর্যপূর্ণ অ্যাঙ্গেলের অভিব্যক্তি ক্যামেরায় বন্দি করতে ব্যস্ত। অ্যাথেনার পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনজন দেহরক্ষী টাইপের মানুষ।

স্কানেট নিশ্চিত হলো যে কিছু ক্যামেরার লেন্স তার ওপরও পড়েছে। এমন সময় কাটে তার বোতল থেকে কিছু লিকুইড আকস্মিক অ্যাথেনা অ্যাকুইটেনের মুখে ছুঁড়ে মারল।

শুধু তাই নয়, চেঁচিয়ে উঠল এখানে কিছু অ্যাসিড আছে। যেন অন্য কোনো দুর্বত্ত এই অ্যাসিড ছোঁড়ার মতো গর্হিত কাজ করেছে এমন মনোভাব প্রদর্শন করে স্কানেট অজানা দুৰ্বত্তের উদ্দেশে গালাগাল দিতে লাগল–ইউবিন বলে। তারপরই সে সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকাল–তার চেহারায় ছিল চিন্তাশীল, ভাবগম্ভীর ও মর্যাদাশীল এক ব্যক্তিত্বের অভিব্যক্তি।

এক সময় স্কানেট গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠে বলল, এটা তার পাওনা ছিল। এর পরপরই ব্যাটন হাতে কয়েক জন খাকি পোশাকের নিরাপত্তা কর্মী তাকে ঘিরে ধরল। স্কানেট বসে ছিল হাঁটু গেড়ে।

এই নাটকীয় ঘটনার শেষে অ্যাথেনা অবশেষে স্কানেটের দিকে তাকাল। সে স্কানেটের চেঁচানোর আওয়াজ শুনেছিল কিন্তু লিকুইড তার কানে ও মাথায় পড়ায় সাথে সাথে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল বলে ঠিক ঠাহর করতে পারেনি।

কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনাটি কোটি কোটি টিভি দর্শক ইতিমধ্যেই দেখে ফেলেছে।

দারুণ লাভলি চেহারা অ্যাথেনার। তার গালে এখনো রুপালি রঙের দাগ। এই অ্যাসিড ছোঁড়া ব্যক্তিটির দিকে যখন অ্যাথেনার চোখ পড়ল, তখন সে বিস্মিত, মর্মাহত এবং কিছুটা ভয়ও পেল। আর এই বিস্ময় ও ভীতির ভাব অ্যাথেনার সৌন্দর্যের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল দ্বিতীয় বারের মতো।

টিভি ক্যামেরাগুলো তখনও সবল। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ দেখছে পুরো বিষয়টি। স্কানেটকে এক রকম টেনে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ।

বিষয়টি অনাকাঙিক্ষত হলেও দর্শক অনেকটা ফিলি ঘটনার মতোই উপভোগ করছিল। আপাতদৃষ্টিতে স্কানেট অপরাধী হলেও তাকে ঠিক মুভি স্টারের মতোই দেখাচ্ছিল। দু-হাতে হাতকড়া পরা অবস্থাতেই সে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে একটি জয়সূচক স্যালুট দিল।

এ সময় এক পুলিশ কর্মকর্তা স্কানেটের কোমর হাতড়ে পেল লুকিয়ে রাখা ছোট পিস্তলটি। এরপরই পুলিশ কর্মকর্তাটি তার কিডনিসদৃশ স্থান লক্ষ্য করে আঘাত করল। সাথে সাথেই ঝাঁকিয়ে উঠে স্কানেট বেঁকে গেল কিছুটা।

এদিকে অ্যাথেনা অ্যাকুইটেন তখনও অপ্রত্যাশিত ঘটনায় বিমর্ষ। তবে তার চিবুকে লেগে থাকা রুপালি রঙ ইতিমধ্যে শুকিয়ে যাওয়ায় ঝরে পড়ল। আসলে সেগুলো অ্যাসিড ছিল না– অ্যাসিডে ত্বক ঝলসে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটল না আর তার হাতে ছিটে-ফোঁটা লিকুইডগুলোও সরে গেল। কিন্তু এতক্ষণে বেশ কিছু মানুষ তাকে ঘিরে ফিলেছে তার নিরাপত্তার খাতিরে। তাকে হয়তো সেখান থেকে সরিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যেও।

অ্যাথেনা স্বাভাবিক হলো। শান্ত কণ্ঠে ঘিরে থাকা মানুষগুলোর উদ্দেশ্যে বলল, এটা ছিল শুধু পানি। নিশ্চিত হওয়ার জন্য হাতে পড়া কয়েক ফোঁটা রঙ মিশ্রিত পানি পরখ করে দেখল সে।

এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় বিরাজমান পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতে স্মিত হেসে অ্যাথেনা বলল, কি আশ্চর্য মানুষ আমার স্বামীটি।

অ্যাথেনা আর দেরি করল না। ঘটনাটির মোড় ঘুরিয়ে নিতে সে তাৎক্ষণিক প্যাভিলিয়নের দিকে এগিয়ে গেল। এমন একটা ঘটনার পরও অ্যাথেনার এই স্বাভাবিক মূর্তি দর্শকদের আন্দোলিত করেছিল। ভক্তকুলের কাছে তার জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছিল, হয়তো এ কারণেই।

এরপর অ্যাথেনা যখন একাডেমি অ্যাওয়ার্ড কর্তৃপক্ষের মনোনয়নে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে অস্কার পেল, তখন উপবিষ্ট দর্শকরা দাঁড়িয়ে করতালি দিতে লাগল।

লাস ভেগাসে জানাদু ক্যাসিনো হোটেলের পঁচাশি বছর বয়স্ক মালিক মড়ার মতো শুয়ে আছেন। তিনি শুয়ে আছেন মোল তলার চিলেকোঠার মতো একটি শীতল কক্ষে। শুয়ে শুয়ে তিনি ভাবছেন; এই ষোল তলা থেকেও ক্যাসিনো কক্ষের সব ইভেন্টে অংশগ্রহণকারী মানুষগুলোর হর্ষধ্বনি যেন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

আজকের এই বসন্ত দিনে, এই ক্ষণটিতে তিনি যেন স্পষ্ট শুনতে পারছেন রুলথ হুইলে ঘূর্ণায়মান লাল-কালো গজদন্তী বলের ঘর্ষণের শব্দ। তার কানে ভেসে আসছে ক্র্যাপ শুটারদের পাইয়ে দিতে কিংবা হারানোর জন্য গুটির খটাখট আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন চকচকে রুপালি কয়েন গেলা মেশিনের ঝনাঝনাৎ শব্দ, সবই যেন স্পষ্ট ভেসে আসছে তার কানে এই মোল তলার পেন্থ হাউসেও।

আলফ্রেড গ্রোনিভেল্ট, যে কোনো মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের মতোই সুখী! ইতিমধ্যেই তিনি অতিবাহিত করেছেন জীবনের প্রায় আশিটি বছর। নব্বই ছুঁই উঁই গ্রোনিভেল্টের  সময় অতিবাহিত হয়েছে কেবল ব্যস্ততা আর ব্যস্ততায়। অনুরাগী ব্যভিচারী দূত, বহু হত্যাকাণ্ডের সক্রিয় মদদদাতা, রাজনৈতিক ফিক্সার এবং সর্বপরি জানা হোটেলের কঠোর অথচ দয়ালু লর্ড হিসেবে কেটে গেছে তার বর্ণাঢ্য জীবন।

বিশ্বাসঘাতকের ভয়ে আলফ্রেড় কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারেননি। তবে অনেকের প্রতি দয়া দেখিয়েছেন নীরবে। মানুষের ভালোবাসার ধার ধারেন না তিনি কোনো আক্ষেপও নেই তার এজন্য। সম্প্রতি তিনি মাঝে মাঝেই তার জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোয় উঁকি মারেন তবে এও যেন বিকেলবেলায় তার ক্যাসিনো আড্ডায় সফরের মতো।

গত পাঁচ বছর ধরে ক্রকসিফিজিও ডি লিনা, অর্থাৎ ক্রস গ্রোনিভেল্টের দক্ষিণ হস্ত। শয্যাকক্ষে প্রবেশ করল ক্রস আলফ্রেড, তুমি রেডি? ক্রসের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলেন, প্রতিউত্তরে কেবল মাথা ঝাঁকিয়ে ইতিবাচক সাড়া দিলেন আলফ্রেড গ্রোনিভেল্ট।

ক্রস গ্রোনিভেল্টকে বিছানা থেকে টেনে তুলল, তারপর সতর্কতার সাথে নিয়ে বসাল হুইল চেয়ারে। একজন নার্স বৃদ্ধ গ্রোনিভেল্টকে নরম ব্লাঙ্কেট ভাঁজ করে ঢেকে দিল। একটি বালিশ ক্রসের হাতে ধরিয়ে দিয়ে পেন্থ হাউসের দরজা খোলার জন্য রওনা হলো সে।

গ্রোনিভেল্টের  হুইল চেয়ারের পেছনেই থাকার কথা নার্সটির। তবে আজকের এই সুন্দর বিকেলে ভ্রমণের জন্য গ্রোনিভেল্ট আর নার্সের জন্য অপেক্ষা করতে পারলেন না।

পেন্থ হাউসের বাগানে গ্রোনিভেল্টের  হুইল চেয়ারটি অনায়াসেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল। বাগানে কার্পেট করা কৃত্রিম সবুজ ঘাসে চোখ পড়ল গ্রোনিভেল্টের । আবারো তার মন ছুটে গেল মোল তলার নিচের ক্যাসিনো কক্ষে। সেখানেও এমন একটা মোলায়েম মেঝে আছে মনে পড়ল তার।

সটান বসে আছেন গ্রোনিভেল্ট তার হুইল চেয়ারটিতে, আর বামে-ডানে অনবরত তাকাচ্ছেন পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে-~~ এটাই তার আপাতত আনন্দ। তার আনন্দিত ও গর্বিত হওয়ার আরেকটি কারণ–তার জন্য এতগুলো মানুষ সংগ্রাম করে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে যাবে তার কাঙ্ক্ষিত ক্যাসিনোয়।

গ্রোনিভেল্টের  বহনকারী হুইলচেয়ার অত্যন্ত ধীর লয়ে এসে পৌঁছল ব্ল্যাকজ্যাক ও রুলথ এরিয়ায়। এরপর পরিদর্শন করল একে একে ব্যাকার্যাট পিট ও জাঙ্গল অব ক্র্যাপ টেবিল। এই পরিদর্শনের সময় জুয়াড়িরা তীর্যক উক্তিও করছিল বুড়ো গ্রোনিভেল্টের  উদ্দেশে। বিষয়গুলো এড়িয়ে যায়নি গ্রোনিভেল্টের  সদা প্রস্তুত চোখ ও কান। তবে মুচকি হেসে তার যথাযথ উপলব্ধির কথা জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। অনেকে তাকে নতুন পঙ্গু-জুয়াড়ি হিসেবেও মনে করেছে। কেননা ভেগাসে এমন অনেকেই আছে যারা হুইলচেয়ারে করেই আসে জুয়ার আড্ডায়। অবশ্য এমন পঙ্গু জুয়াড়িরা অনেকের করুণাও পেয়ে থাকে। করুণার দৃষ্টি দিয়ে যেমন কিছুক্ষণ আগে কেউ মন্তব্য করেছিল- আহা, বেচারা, ভাগ্য তার সাথে শত্রুতা করে কি হাল করেছে।

অবশেষে গ্রোনিভেল্টের  হুইল চেয়ারটি এসে পৌঁছল কফি হাউসে। এটি ডাইনিং রুম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কক্ষের প্রহরী তাদের রিজার্ভ করা বুথে পৌঁছে সেখানে অন্য গ্রাহকের দখল করা টেবিল খালি না হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে লাগল।

গ্রোনিভেল্ট স্বচ্ছ গ্লাসের দেয়ালের অপর প্রান্তে দেখতে পেলেন একটি বিশাল আকারের সুইমিংপুল। নীল রঙের কাঁচের কারণেই সেই সুইমিংপুলের পানিগুলো হয়তো নীল দেখাচ্ছিল। গ্রোনিভেল্টের  মনে হলো– পানিগুলো যেন তপ্ত, সেখান থেকে ধোঁয়া উড়ছে। তবে কিছু যুবতী ও শিশুও দেখতে পেলেন। তারা দাঁড়িয়েছিল ধোয়া ওড়া সারফেসের কাছেই। একটা ব্যতিক্রম দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছিল গ্রোনিভেল্টের  দৃষ্টিতে। যুবতী ও শিশুদের রঙিন খেলনার মতো লাগছিল তার। হঠাৎ তার মনে হলো- এ ছোট্ট পরিসরে আনন্দ ও বিনোদনের জায়গা– এর সব কিছুই তার সৃষ্টি।

আলফ্রেড গ্রোনিভেল্টের  চিন্তায় ছেদ ধরাল ক্রস ডি লিনা। বলল, আলফ্রেড একটা কিছু খাও।

গ্রোনিভেল্ট ফিরে এলেন বাস্তবে। ক্রসের দিকে হাসি মুখে তাকালেন। ক্রসের সব কিছুই তার ভালো লাগে। তিনি তাকে ভালোবাসেন। আসলে ক্রস এমনই এক ব্যক্তি যার প্রতি পুরুষ ও মহিলা উভয়েই আকর্ষণ বোধ করে। গ্রোনিভেল্ট তাকে পছন্দ করার পেছনে কারণ সে অত্যন্ত আস্থাবান ও বিশ্বস্ত। গ্রোনিভেল্টের  জীবনে তার মতো বিশ্বস্ত আর একজনকেও পাননি।

ক্রসের উদ্দেশে গ্রোনিভেল্ট বললেন–আমি আমার এই ব্যবসাকে খুব ভালোবাসি।

একটু হেসে আবার বললেন, ক্রস, তুমিই হবে এই হোটেলে আমার উত্তরসূরি। আমি জানি তোমাকে নিউইয়র্কে আমাদের পার্টনারের সাথেও কাজ করে যেতে হবে। তবে কখনো জানাদু ছেড়ে যেও না।

ক্রস বৃদ্ধ গ্রোনিভেল্টের  হাত চেপে ধরল। তার হাতের নরম অস্থিতে আলতো চাপ দিল, উল্টো পৃষ্ঠের নরম চামড়ায় হাত বুলিয়ে আশ্বাসের সুরে বলল, আমি যেতে চাইও না।

গ্রোনিভেল্ট অনুভব করলেন সূর্যের রশ্মি রঙিন কাঁচ ভেদ করে যেন তার শরীর ঝলসে দিচ্ছে। তিনি ক্রসের উদ্দেশ্যে বললেন, ক্রস, আমি তোমাকে সবকিছু শেখাব। আমি কিছু কঠিন কাজ করেছি– সত্যিই সেসব ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। তবে কখনো পিছন ফিরে তাকাবে না। তুমি হয়তো জানো পার্সেন্টেজের কাজগুলো হয় একটু ভিন্ন পথে। তুমি তোমার সাধ্যমতো ভালো কাজ করে যাবে। অবশ্যই সেখান থেকেও তুমি পাবে বিস্তর। আমি কিন্তু ভালোবাসায় ব্যর্থতা কিংবা এক্ষেত্রে ঘৃণাকেই প্রশ্রয় দেবে এমন কোনো উপদেশ দিচ্ছি না। এগুলো থেকে অবশ্য খুব একটা ভালো পার্সেন্টেজ আসে না জীবনে।

টেবিলে রাখা কফির কাপে চুমুক দিল দুজনে। গ্রোনিভেল্ট কফির সাথে আসা একটি প্যাস্ট্রি তুলে নিলেন। আর ক্রস তার কফির সাথে অরেঞ্জ জুস।

মধ্যবর্তী স্বল্প সময়ের নীরবতা ভাঙলেন গ্রোনিভেল্ট, একটি বিষয় ….

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, যতক্ষণ অব্দি তোমার হাতে মিলিয়ন ড্রপটুকু না আসে ততক্ষণ তুমি একটি ভিলাও ছাড়বে না। কখনো ভুলে যেও না যেন ভিলা অর্থাৎ পূর্বপুরুষের বাগানবাড়িগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে সুদূর অতীতের স্মৃতি, সেগুলো পৌরাণিকই অন্তত আমার কাছে সে সবের গুরুত্ব অনেক।

ক্রস গ্রোনিভেল্টের  হাতের ওপর হাত রেখে আশ্বস্ত করল। গ্রোনিভেল্টের  প্রতি ক্রসের অনুভূতি দুর্বার। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্রস তাকে তার বাবার চেয়েও বেশি ভালোবাসে।

চিন্তা করো না–ক্রস বলল, ভিলাগুলো নিরাপদই থাকবে, এর জন্য যা কিছুই ঘটুক না কেন?

গ্রোনিভেল্টের  চোখটি অস্পষ্ট হয়ে উঠল। তীব্র জ্বালা অনুভব করল সে তার চোখ দুটিতে। পুরুষ না হয়ে কোনো নারী হলে হয়তো অঝোর ধারায় নেমে আসত অশ্রু। সামলে নিল গ্রোনিভেল্ট নিজেকে। বলল, সাবধানী হও। সব সময় সতর্ক থাকার চেষ্টা করবে।

অবশ্যই–ক্রস আশ্বস্ত করল তাকে। তারপর বৃদ্ধ গ্রোনিভেল্টকে এই বৈষয়িক প্রসঙ্গ থেকে সরিয়ে আনতে নতুন বিষয়ের উত্থাপন করল।

ক্রস বলল, সেই স্ট্যান্টাডিও যুদ্ধের কাহিনী তুমি আমাকে কখন শোনাবে? আমাকে সে বিষয়ে কখনো কেউ কিছু বলেনি। শুনেছি সে সময় নাকি তুমি তাদের সাথে সান্তাডিও’র কাজ করতে।

বৃদ্ধ গ্লোনিভেন্টের দীর্ঘশ্বাস কেঁপে উঠল। সেই সাথে বিড়বিড় করে তিনি যেন কিছু আওড়ে যাচ্ছিলেন উদাস দৃষ্টিতে। ক্রসের উদ্দেশে বললেন, আমি জানি আমার সময় ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে আমি সেসব ঘটনা তোমাকে শোনাতে পারব না।

একটু দম নিয়ে গ্রোনিভেল্ট আবার বলল, তুমি বরং তোমার বাবার কাছেই শুনে নিও।

ক্রস নাছোড়বান্দার মতো বলল, আমি পিপির কাছে শুনতে চেয়েছি। কিন্তু সেও কেন যেন এড়িয়ে গেছে।

অতীতকে অতীত হিসেবেই রেখে দাও না গ্রোনিভেল্ট প্রতিউত্তরে বলল, কখনো পেছন ফিরে তাকিও না। ক্ষমার জন্যও নয়, নয় বিচারের জন্য কিংবা সুখ খুঁজে পেতে। তুমি এখন যা আছ তা নিয়ে ভাব ভাব এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড নিয়ে।

পেন্থ হাউস কক্ষে ফিরে এলেন গ্রোনিভেল্ট, নার্স তার বিকেলের গোসল পরবর্তী আনুষঙ্গিক কাজ সমাধা করল।

রাতে একটা পরিপূর্ণ ঘুম দিলেন গ্রোনিভেল্ট। খুব ভোরে তার ঘুম ভেঙে গেল। নার্সকে অনুরোধ করলেন তাকে বেলকনি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য।

নার্স তাকে একটি বড় চেয়ারে বসিয়ে ব্লাঙ্কেট দিয়ে ঢেকে দিল। পাশে বসে নার্স গ্রোনিভেল্টের  পালসও পরখ করে নিল এই ফাঁকে।

নার্সের কোলেই ছিল গ্রোনিভেল্টের  হাত। পালস চেক করার পর নার্স যখন তার কোলে ফিরিয়ে দিতে গেল, গ্রোনিভেল্ট অসম্মত হলেন। এক পর্যায়ে নার্স আর বাধা দিল না।

পাশাপাশি দুজন বসেই আকাশে সূর্য উদয়ের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে লাগল।

সূর্যের রক্তিম বলয়ের আভা যখন আকাশে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছিল তখন মেঘগুলোর রঙও পাল্টে যাচ্ছিল বিস্ময়করভাবে– কালো-নীলাভ মেঘগুলোতে সূর্যোদয়ের আভা লেগে হয়েছিল গাঢ় কমলা রঙ। ভোরের আকাশে এই রঙের খেলায় মেতে ছিল উভয়ে।

বেলকনি থেকে গ্রোনিভেল্টের  দৃষ্টি গেল নিচের ভূ-পৃষ্ঠে। একেবারে আকাশ থেকে নেমে এলেন মাটিতে। দেখতে পেলেন–টেনিস কোর্ট, অদূরে গলফ-এর মাঠ, পাশে সুইমিং পুল, দূরে আবছা ভিলাগুলো যেন থেকে থেকে জ্বলে উঠছিল দূর আকাশের মিটিমিটি তারার মতো।

গ্রোনিভেল্টের  দৃষ্টি গেল জানাদু হোটেলে টাঙানো পতাকাগুলোর দিকে। জানাদুর নিজস্ব প্রতীক গাঢ় সবুজের মাঝে সাদা পায়রা সংবলিত ফ্ল্যাগের দিকে তিনি তাকিয়ে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর তার দৃষ্টি গেল সবশেষে অসীম বালিপূর্ণ সমুদ্র– মরুভূমির দিকে। যেখানে দিগন্তরেখা ভেদ করে একটু আগে উঠেছে আজকের দিনের সূর্য।

বেলকনি থেকে গ্রোনিভেল্টের  এই প্রত্যক্ষ অবলোকনে তার মনেও উদিত হয়েছে গর্বের আভা। তিনি ভাবতে লাগলেন– এসবই তার সৃষ্টি। গর্বভরে মনে মনে বলতে লাগলেন, একটি পতিত জমিতে আমিই এনেছি একটি আনন্দের বিনোদনের ভুবন এবং আমি নিজেই আমার সুখী জীবনের স্রষ্টা, বাইরের কেউ নয়।

এই বিশ্বে আমি সর্বদা যথাসাধ্য একজন ভালো মানুষ হিসেবে থাকার চেষ্টা করেছি।

গ্রোনিভেল্ট ফিরে গেলেন তার কিশোর জীবনে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল তার চৌদ্দ বছর বয়স্ক দার্শনিক বন্ধুর কথা। সে বয়সেই তারা আলোচনায় মেতে উঠতেন ঈশ্বর ও তার অস্তিত্বের নৈতিক মূল্যায়নের মতো কঠিন সব বিষয় নিয়ে।

গ্রোনিভেল্টের  সেই অন্তরঙ্গ দার্শনিক বন্ধুটি একবার তাকে প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা কেউ যদি তোমাকে এক মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে একটি বাটন পুশ করতে বলে যা করলে দশ লাখ চীনা মারা যাবে, তুমি কি তা করবে? অসম্ভব ও অযাচিত এমন প্রশ্নের অবতারণা করে নিজ থেকেই সে শুরু করত তার নাতিদীর্ঘ বিশ্লেষণ। অবশেষে সে সম্মতিও আদায় করে নিত যে— এমন গর্হিত কাজ অসম্ভব। তবে গ্রোনিভেল্ট তার যুক্তিতে খুব একটা সায় দিতেন না। তিনি হয়তো হত্যাকাণ্ডের পক্ষেই থাকতেন দার্শনিক বন্ধুর সাথে বিতর্কে।

আজ প্রায় পঁচাশি বছর পর জানাদু হোটেলে তার নিজ পেন্থ হাউসের বেলকনিতে বসে ভাবছেন–সে বিতর্কে গ্রোনিভেল্টই ছিলেন সঠিক। এ চিন্তা তার এই সফল জীবনের জন্য নয়–এর কারণ, এমন বিশাল ধরনের একটি হেঁয়ালিপূর্ণ বিতর্ক কোনো কিছুকেই থামিয়ে দিতে যথেষ্ট নয়। এটি দীর্ঘ সময় ধরে উভয় সঙ্কটে ফেলার মতো বিষয়ও নয়।

এখন গ্রোনিভেল্ট বেশ ভালোই বুঝতে পারেন কিশোর কালেও তার সিদ্ধান্তই ছিল সঠিক। দার্শনিক বন্ধুর বিতর্ক থামিয়ে দিয়ে, প্রশ্নটিতে কেন চায় নাম্যানদের হত্যার কথা বলা হলো? আরো এর জন্য দশ লক্ষ ডলারইবা কেন? এই প্রশ্নগুলোই তখন সেই দার্শনিক বন্ধুকে থামিয়ে দিতে প্রতিপ্রশ্ন। এমন চিন্তা গ্রোনিভেল্ট সে বয়সেও করেছেন।

গ্রোনিভেল্ট বাস্তবে ফিরে এলেন। পৃথিবীতে আলোর তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে লাগল। পাশে বসা নার্সকে অনুরোধ করলেন, তিনি তাকালেন সূর্যের প্রখরতার দিকে। চোখে ছানি পড়েছে তার, আর সেটাই তার চোখের বর্ম। নয়তো তিনি যেভাবে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সুস্থ চোখ হলে এতক্ষণে ধাধিয়ে যেত।

ঠায় বসে গ্রোনিভেল্ট তার পূর্বজীবনের কথা ভাবতে লাগলেন। তার মনে এলো নিশ্চিত সেই নারীর কথা, যাকে নিয়ে নিশ্চিতভাবেই কিছু পূর্ণাঙ্গ চিন্তাও করেছিলেন।

তার মনে ভেসে উঠল একে একে সেসব মানুষের ছবি, যাদের তিনি নির্দয়তার সাথে পরাস্ত করেছিলেন। তবে তার প্রতিও যে অনেকে করুণা করেছে, সহানুভূতি দেখিয়েছে সেসব কথাও ভাবনায় এলো গ্রোনিভেল্টের । পুত্রসম ক্রসের কথা মনে এলো। সে এখনও তার প্রতি সহানুভূতিশীল। সহানুভূতি পেয়েছেন গ্রোনিভেল্ট সান্তাডিও ও ক্লেরিকুজিও পরিবারের সবার কাছ থেকেও। এমন বর্ণাঢ্য জীবন পিছনে রেখে এ বয়সে তিনি বেশ সুখী। এমন জীবন-চিন্তা নিয়ে আজ তাই গ্রোনিভেল্টের  মনে প্রশ্নের উদয় হয়েছে আসলে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য কোনটা কাম্য, সুখী জীবন না কি নৈতিকতাপূর্ণ জীবন?– এই দ্বিধা তার মনকে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করল।

ধীরে ধীরে শীতল হয়ে পড়ল গ্রোনিভেল্টের শরীর। নার্সের কোলেই রাখা তার একটি হাত। নার্সের মনে হলো বৃদ্ধ গ্রোনিভেল্টের  হাতটি ক্রমেই শীতল হয়ে উঠছে। পেশিগুলোও কেমন নিথর। নার্স তাৎক্ষণিক গ্রোনিভেল্টের  অপরিহার্য চিহ্নগুলোর পরীক্ষা শুরু করল। নিশ্চিত হলো নার্স— তিনি আর নেই।

গ্রোনিভেল্টের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য ব্যবস্থা করল তার উত্তরসূরি ক্রস ডি লিনা। এই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য হাজির হলেন লাস ভেগাসের সব জ্যোতিষ্ক স্থানীয় মহাজনরা। হাজির হতে লাগল শীর্ষস্থানীয় জুয়াড়ি, গ্রোনিভেল্টের  বহু নারীবন্ধু এবং হোটেল জানাদুর কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। তারা উপস্থিত হলেন তার মতো একজন মহান ব্যক্তির শ্রদ্ধায়, যিনি গ্যাম্বলিংকে একটি শৈল্পিক ও বৈধ রূপ দিয়ে গেছেন।

পাশাপাশি গ্রোনিভেল্ট তার জীবনে সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের চার্চের জন্য ব্যয় করে গেছেন বিপুল পরিমাণে অর্থ। এই দান প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, যারা ধর্ম এবং জুয়ায় বিশ্বাসী এই চার্চ তাদের জন্য উপহারস্বরূপ। গ্রোনিভেল্ট ধর্মীয় বিশ্বাস ও জুয়ায় বিশ্বাসকে এক করে দেখাতে চেয়েছেন।

গ্রোনিভেল্ট ভেগাসে বস্তি এলাকা প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছিলেন। তিনি নির্মাণ করেছেন প্রথম শ্রেণীর হাসপাতাল এবং উন্নতমানের স্কুল। এসব কাজে সর্বদা তিনি ছিলেন আত্মতুষ্টির দাবিদার। পার্শ্ববর্তী আটলান্টিক শহরের প্রতি গ্রোনিভেল্টের  ছিল অবজ্ঞা। তিনি মনে করতেন, শহরের কর্তৃপক্ষ কেবল নিজের পকেটে টাকা পুরতেই ব্যস্ত। সামাজিক উন্নয়নের জন্য তারা কিছুই করেনি।

মানুষকে গ্রোনিভেল্ট বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে গ্যাম্বলিং কোনো নোংরা পন্থা বা দোষের কিছু নয়। এটি গলফ, বেসবলের মতোই মধ্যমান বিনোদনের উৎস। অমেরিকায় তিনি গ্যাম্বলিংকে একটি বৈধ শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এসব কারণে লাস ভেগাসের সবাই তাকে শ্রদ্ধা জানাতে হাজির হয় তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে।

ক্রস সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিরালায় এক কোণে চোখের জল ফেলছিল। গ্রোনিভেল্টের  মৃত্যু যেন তাকে নিঃস্ব করে ফেলেছে। গ্রোনিভেল্টের সাথে তার খাঁটি অন্তরঙ্গতা ছিল, তেমনটি আর হয়নি আগে। তবে ক্রস এখন হোটেল জানাদুর একান্ন শতাংশের মালিক, যার অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচশ মিলিয়ন ডলারের মতো।

ক্রস জানে, এই উত্তরাধিকার তার জীবনের অবশ্যই আমূল পরিবর্তন ঘটবে। ধীরে ধীরে সে যতই ধনী ও ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠবে, সাথে সাথে সে ততই হবে বিপজ্জনক। ডন ক্লেরিকুজিও ও তার পরিবারের সাথে ক্রসের সম্পর্কও কেবল প্রতিনিধিত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, বাড়বে দূরত্ব।

ক্রসের এখন প্রথম কাজ কুওগের সাথে যোগাযোগ করা। সেখানে তাকে আলোচনা করতে হবে জর্জিও’র সাথে। জর্জিও তাকে দেবে কিছু নির্দেশনা।

জর্জিও’র সাথে দেখা হলো ক্রসের। জর্জিও তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিল একমাত্র পিপি ছাড়া গ্রোনিভেল্টের  অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ক্লেরিকুজিও পরিবারের কোনো সদস্য উপস্থিত হতে পারবে না। ডেন্টিও নয়। কারণ ডেন্টি তার নির্ধারিত মিশন কমপ্লিট করার জন্য বাইরে যাচ্ছে। কিন্তু জর্জিও’র তো অতিরিক্ত কোনো কাজ নেই। সে-ও যে গ্রোনিভেল্টের  শেষকৃত্যে অংশ নিচ্ছে না তা পরিষ্কার জানিয়ে দিল ক্রসকে। আসলে এর কারণ হলো– ক্রস যে হোটেলের অর্ধেক মালিকানা হাতিয়ে নিচ্ছে তা সে জানায়নি।

এদিকে ক্রস তার বোন ক্লডিয়ার কাছ থেকে একটি ম্যাসেজ পেল। এর প্রতিউত্তরে ক্রস যখন যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল, তখন ক্লডিয়া আর কোনো সাড়া দেয়নি। আরেকটি ম্যাসেজ পেল সে আর্নেস্ট ভেইলের কাছ থেকে। ভেইলকে ক্রস খুব পছন্দ করে, কিন্তু ভেইলও কেন যেন বিরূপ প্রতিক্রিয়াই দেখাল।

গ্রোনিভেল্টের  সারা জীবনের বন্ধু ছিল পিপি। ক্রসের বাবা পিপি। পিপির কাছ থেকেও ক্রস পেল একটি ম্যাসেজ। সে ম্যাসেজেটি ছিল– ক্রস তার ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে কেমন উপদেশ আশা করছে। আর, তাছাড়া ক্রসের নতুন স্ট্যাটাস কিংবা সম্পদ সম্পর্কে তার বাবা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে?

ক্রস তার বাবার ম্যাসেজে আরো জানতে পারল– ডন ক্লোরিকুজিওর সাথে কাজ করতে গেলে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। ক্লেরিকুজিও চান পশ্চিমে তার প্রতিনিধি ব্ৰগলিওন হবে তার নিজস্ব লব্ধ অধিকারে ক্ষমতাবান ও সম্পদশালী।

এসব নিয়ে ডন খুব পরিষ্কার সিদ্ধান্ত আশা করেন। ক্রসেরও এতে কোনো সন্দেহ নেই। ক্রস অবশ্য আশা করছে যে, তার বাবা তাকে যথাসাধ্য সমর্থন ও সহযোগিতা যুগিয়ে যাবেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ডনের তিন পুত্রকে নিয়ে জর্জিও, ভিনসেন্ট ও পেটি এবং ডনের অপর নাতি ডেন্টি। এদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, এটাই এখন ক্রসের চিন্তার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ডনের স্ব-নির্মিত পারিবারিক চ্যাপেলে যেদিন ক্রস ও ডেন্টির ব্যাপটাইজ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হচ্ছিল, সেদিন থেকেই তারা পরস্পরের শত্রু- এমন একটি জোক এখনও ডন পরিবারে চালু আছে।

সেই ডেন্টি বর্তমানে ভেগাসে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভেগাসে সে বিগ টিম নামে একটি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিতে চাকরি করবে। বিষয়টি ক্রসের জন্য বিরক্তির কারণ, কেননা ডেন্টি বিগ টিমের জন্য আগ্রহী নয়– ব্যাপারটি ভালোভাবেই জানে ক্রস। কিন্তু বেচারা ডেন্টি! তার করার কিছুই নেই। ডন নিজেই ডেন্টির ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন এই ক্ষেত্রটিতে। এ বিষয়ে ক্রসের চিন্তা এখন একটাই— কিভাবে ডেন্টি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাকরিটি করবে।

আলফ্রেড গ্রোনিভেল্টের  অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান ঘিরে যে সমাগম, তা এ যাবৎ কালের সবচেয়ে বড়। গ্রোনিভেল্টের  মতো একজন জিনিয়াসকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সমবেত হয়েছেন অনেক লোক!

গ্রোনিভেল্টের  মৃতদেহ সটান শুইয়ে রাখা হয়েছে তারই অর্থে নির্মিত প্রটেস্ট্যান্ট চার্চে। এই চার্চটিতে তিনি পুরোহিত নিয়োগ করেছিলেন ইউরোপ থেকে আর এর নির্মাণশৈলী ছিল খোদ আমেরিকার নিজস্ব শিল্প থেকে নেয়া। ভেগাসের এই চার্চের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো চার্চটির বাইরে পার্কিংয়ের জন্য বিশাল লন। তাছাড়া এখানে ইউরোপীয়দের চেয়ে ন্যাটিভ আমেরিকান বোধকেই প্রাধান্য দেয়া হয় এ বিষয়টিও বিখ্যাত হওয়ার একটি অন্যতম কারণ।

চার্চের গায়ক দলের কণ্ঠে সুরের মূর্ঘনায় ভারী হয়ে ওঠে পুরো প্রাঙ্গণ। ঈশ্বরের স্তুতি সঙ্গীতে যেন পবিত্রতার পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিল। গায়ক দল গ্রোনিভেল্টের  স্বর্গ যাত্রার জন্য প্রার্থনা করছিল– সুরে সুরে হৃদয়ের সবটুকু আবেগ উজাড় করে।

অদূরে শোকাহত শত শত গ্রাজুয়েট ছাত্র সমবেত হয় চার্চে। এসব ছাত্রের জন্য গ্রোনিভেল্ট প্রচুর অর্থ সহযোগিতা করেছিলেন। তাদের এই দাতার মৃত্যুতে অনেকেই ভেঙে পড়ে কান্নায়। কেউ কেউ হোটেলের ভবিষ্যৎ চিন্তায় ব্যাকুল আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল। মধ্যবয়সি কিছু মহিলা গ্রোনিভেল্টের  চিরবিদায়ে নীরব অশ্রুপাত করে যাচ্ছিল। এই মহিলাদের অনেকে ইহুদি উপাসনালয় সিনাগগের কর্মী, অনেকে আবার ক্যাথলিক অনুসারী। গ্রোনিভেল্ট সকল ধর্মাবলম্বীদের সহযোগিতা করেছিলেন, উপাসনালয় নির্মাণে দিয়েছিলেন অর্থ।

নাভাদা রাজ্যের গভর্নর ওয়াল্টার ওয়াভেনও গ্রোনিভেল্টের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত হলেন। তিনি এলেন মেয়র প্রদত্ত এসকর্টে। আলফ্রেড গ্রোনিভেল্টের  শবযাত্রার জন্য ব্যাপক মানুষের উপস্থিতি দেখে ওয়াভেন তার দেহরক্ষী গুটিয়ে নিলেন। সিমেট্রি বা কবরস্থানের উদ্দেশ্যে শবযাত্রার দীর্ঘ লাইনে তিনিও শামিল হলেন। গ্রোনিভেল্টের  মৃতদেহ বহনকারী গাড়ি এগিয়ে চলল সিমেট্রির উদ্দেশ্যে। পলকে তিনি ছেড়ে যাচ্ছিলেন তার তৈরি পৃথিবী–এ যাত্রাই তার শেষ যাত্রা।

সে রাতে ভেগাসের শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাদের অন্তরে অন্তস্তল থেকে জানাল শেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তাদের ভালোবাসা প্রকাশের অভিনব উন্মত্ততা রেকর্ড সৃষ্টি করল, যা কেবল বর্ষবরণ নিউ ইয়ার ইউ এ-ই হয়ে থাকে। গ্রোনিভেল্টের  কফিন যখন কবরে রাখা হলো তখন অনেকে তাদের অর্থও শ্রদ্ধার সাথে রাখল কফিনের ওপর। তারপর ঢেকে দেয়া হলো মাটি দিয়ে গ্রোনিভেল্টকে।

দিনের সমাপ্তি ঘটল, আরো ক্রস ডি লিনা তার নতুন জীবন শুরু করার জন্য শুরু করল প্রস্তুতি। সেই রাতে, ম্যালিবু কলোনিতে অ্যাথেনা অ্যাকুইটেন তার বিচ হাউসে ছিল একাকী। মনে হাজারো প্রশ্নের দোলা– কি করবে সে, কি করার আছে তার?

সম্মুখ সমুদ্র থেকে হিমেল হাওয়া প্রবেশ করছিল সামনের খোলা দরজা দিয়ে। কোচে বসা অ্যাথেনা সাগরের শীতল হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল– কেঁপে উঠছিল একই সাথে তার অনিশ্চিত জীবনের কথা ভেবে কষ্টে।

শিশুকাল থেকেই অ্যাথেনা স্বপ্ন দেখত বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হবার এবং তা সে খুব অল্প সময়েই অর্জন করতে সমর্থ হয় যার ফল আজকের বিশ্ব কাঁপানো অ্যাথেনা অ্যাকুইটেন। অ্যাথেনা নিজের কথা ভেবে অবাক হয়।

অবাক হয় সে একজন পরিপূর্ণ নারী হিসেবে নিজকে ফুটিয়ে তুলতে কত কি-ই না তাকে করতে হয়েছে। একজন মুভিস্টারের ক্যারিশমা হয় অত্যন্ত শক্তিশালী। বিশেষ করে কোনো নায়কের সাথে বিশেষ এডাল্ট দৃশ্যে অভিনয়ের ক্ষেত্রে নায়িকাকে অবশ্যই পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে হবে– শারীরিক ও মানসিকভাবেও থাকতে হবে তাদের সৌন্দর্যের সব কলা। তাদের কখনোই থাকবে না বিছানা-সঙ্গী হওয়ার ইতিহাস। মুখে কখনো থাকবে না কোনো দাগ; কুৎসিত চেহারা তো কাম্য নয়ই, তাছাড়া চেহারার ত্বকে থাকবে না কোনো ভাজ। তারা কখনোই মৈথুনে অভ্যস্ত হবে না কিংবা হতে পারবে না ভালোবাসার ভিখেরী। অত্যন্ত কঠিন জীবন পার করতে হবে তাদের শুধুমাত্র বিখ্যাত হওয়ার জন্যই।

অ্যাথেনা জন্মেছে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান দুটি মানুষের ঘরে। সেখানে সবকিছুই ছিল তার জন্য স্বাভাবিক। অ্যাথেনা ভাবতে লাগল– তার আছে অত্যন্ত ভালো মনের একজন বাবা ও মা যারা তার জন্য উপহারস্বরূপ। পূজনীয়। অ্যাথেনা তার বাবা-মার কথা ভেবে গভীর শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে ফেলল। তার মনে একের পর এক স্মৃতি ভেসে উঠতে লাগল সিনেমার পর্দার মতো– বাবা-মা অ্যাথেনার শারীরিক-মানসিক সৌন্দর্য এবং শিক্ষিত করে তুলতে সাধ্যের সবটুকু করেছেন। বাবা ছিলেন তার ক্রীড়া বিষয়ক শিক্ষক। মা শেখাতেন সাহিত্য এবং কলা। অ্যাথেনা তার শিশুকাল হাতড়ে মনে করতে পারে না যে সে ক্ষণিক সময়ের জন্যও তার বাবা-মার কাছে অসুখী ছিল, এমনকি সে তার কিশোর উত্তীর্ণ সতের বছর পর্যন্তও নয়।

এরপর আকস্মিক বজ স্কানেটের প্রেমে পড়ল অ্যাথেনা। তার চেয়ে মাত্র চার বছরের বড় স্কানেট। আঞ্চলিক ফুটবলের তারকা খেলোয়াড় সে।

হাস্টনের সবচেয়ে বড় ব্যাংকটি তাদের। অ্যাথেনা যেমন রূপসী তেমনি অপরদিকে স্কানেট সুন্দর ও যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। সেই সাথে সদা উচ্ছল ও মজার মানুষ সে। স্কানেট ও অ্যাথেনা যখন পরস্পর মুখোমুখি হতো, মনে হতো, যেন উভয় উভয়কে ম্যাগনেটের মতো আকর্ষণ করছে। উভয়ের নার্ভগুলো উত্তেজিত হতো উচ্চমাত্রার ভোল্টেজে-মিশে যেত একে-অপরের মাঝে, হারিয়ে যেত শিহরণে শিহরণে, সুখের অমিয় ধারার মাঝে। এভাবেই খুঁজে পেয়েছিল তারা একে-অপরকে। এই স্বর্গীয় সুখের ধারায় চিরকাল অবগাহন করতে অবশেষে তারা বিয়ে করল।

বিয়ের কয়েক মাস যেতে না যেতেই অ্যাথেনা গর্ভবতী হলো। কিন্তু তারপরও তার শারীরিক সৌষ্ঠব বজায় ছিল। তবে কিছুটা যে পরিবর্তন হয়নি তা নয়– শরীরের ওজন একটু বেড়েছিল বৈকি। এতে তার খুব একটা সমস্যা হয়নি, কখনো অসুস্থ বোধও হয়নি তার সন্তান লাভের বিষয়টি বরং সে ইনজয়ই করেছে। কলেজেও গিয়েছে নিয়মমাফিক, ড্রামার ক্লাস করেছে– গলফ ও টেনিস খেলেছে নিয়মিত।

টেনিসে বরাবরই ছিল বজ অ্যাথেনার চেয়ে ভালো। তবে গলফে খুব সহজেই অ্যাথেনা হারিয়ে দিত বজ স্কানেটকে।

বজ তার বাবার ব্যাংকে কাজ করত। আর এদিকে তাদের ঘরে এলো একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান। নাম রাখা হলো ব্যাথেনি। ব্যাথেনির জন্মের পরও অ্যাথেনা স্কুল যাওয়া অব্যাহত রেখেছিল। এ অবস্থায় নবজাতকের পরিচর্যার জন্য বিত্তশালী স্কানেট নিযুক্ত করল একজন ধাত্রী ও একজন মেইড সার্ভেন্ট।

বিবাহোত্তর অ্যাথেনা যেন জ্ঞান আহরণে আরো বেশি মরিয়া হয়ে উঠল। অধ্যয়ন করত যেন ক্ষুধার্তের মতে, বিশেষ করে খেলাধুলা সম্পর্কিত বিষয়ে ছিল তার দারুণ অনুরাগ। তারকাখচিত খেলোয়াড় পিরানডেলোর অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হতে, উইলিয়ামসের জন্য অ্যাথেনা ছিল রীতিমতো পাগল।

অ্যাথেনা ক্রমেই পরিপক্ব হয়ে উঠছিল। তার বুদ্ধিমত্তা, তার সৌন্দর্যকে একই ফ্রেমে বেঁধেছিল, যা তাকে করেছিল আরো মহৎ। অ্যাথেনার এই বুদ্ধিমত্তার কাছে কখনো কখনো তার সৌন্দর্যও ম্লান হয়ে যেত।

অবশ্য অনেকেই যুবক, তরুণ থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত অনেকেই অ্যাথেনার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তাকে একদণ্ড কাছে পেতে ব্যাকুল হয়ে থাকত। ভালোবাসত তাকে। প্রেম নিবেদনও করেছে অনেকে। বিষয়টি অ্যাথেনার কাছে বিস্ময়ের ছিল না কিছু।

অ্যাথেনার মতো এমন বুদ্ধিমতী, শিক্ষিত, রুচিশীল এবং সর্বোপরি সুন্দরী একজন স্ত্রীর কারণে স্কানেট তার বন্ধুমহলে ছিল ঈর্ষার পাত্র। অ্যাথেনাও নিজের নিপুণতায় ছিল গর্বিত। পরবর্তী প্রায় বছর খানেক সে দেখেছে তার এই নিপুণতা অনেক মানুষের উত্তেজনার কারণ হয়েছে। এ থেকে বাদ যায়নি তার বন্ধু-বান্ধব ও প্রেমিকরাও।

বজ প্রায়ই জোক করে বলত, কি আর করা! অ্যাথেনার হাজারো গুণগ্রাহীর জন্য এখন আমাকে পথে পথেই কাটাতে হবে প্রতিটি রাত। বজ স্কানেটও যথেষ্ট বুদ্ধিমান। সে জানত তার এই গুণবতী স্ত্রী জীবনের একটা বড় কিছু প্রাপ্তির দিকে ছুটছে। সে জানত অ্যাথেনা একজন অতিনারী এবং বজের এই বোধ থেকেই সে স্বয়ং বুঝতে পারত তার স্ত্রীকে আজীবন ধরে রাখা কঠিন হবে। স্কানেট অনুভব করত অ্যাথেনাকে নিয়ে তার দীর্ঘদিনের স্বপ্নও হয়তো একসময় ধূলিসাৎ হবে। তার এই কৌতূহলকে প্রমাণ করার জন্য কোনো বিশেষ যুদ্ধের দরকার নেই। অন্তত স্কানেটের নিজের তরফ থেকে কোনো ক্রটি নেই বলে সে নিশ্চিন্ত। তারপরও অ্যাথেনাকে নিয়ে তার সন্দেহ। তবে মাঝে মাঝে অ্যাথেনার চেয়ে নিজেকে বেশ দুর্বল ভাবত বজ। নিজের মাঝে উঁকি দিয়ে সে খুঁজত— এমন কি আছে তার মাঝে? কিছুই পেত না, কেবল উচ্ছলতা ও তার শারীরিক ফিটনেস ছাড়া। বিশেষ কোনো মেধাও সে খুঁজে পেত না তার নিজের মাঝে। আর স্কানেট তার ভবিষ্যতে ব্যাপক প্রাচুর্য কিংবা প্রাপ্তির প্রতিও খুব একটা আগ্রহী ছিল না।

ধীরে ধীরে স্কানেটের মনে অ্যাথেনার বিরুদ্ধে হিংসার জন্ম নিতে শুরু করল। অ্যাথেনার জনপ্রিয়তা, বিশ্বে তার যে একটা নিশ্চিত অবস্থান হতে যাচ্ছে। এসব নিয়ে তার মনে তোলপাড় শুরু হলো।

স্কানেট তার অনিশ্চিত ভাগ্যের সাক্ষাৎ লাভে এগিয়ে গেল আরেক ধাপ। শুরু হলো তার অতিরিক্ত মাত্রায় মদপান। কলিগদের স্ত্রীদের সাথে শুরু হলো তার মেলামেশা। এই ফাঁকে বাবার ব্যাংকে তার কাজে অবহেলায় হিসাব নিকাশে দেখা গেল গরমিল। নিজেকে সে বুদ্ধিমান হিসেবে আখ্যা দিয়ে। গর্ববোধ করত। যেমন কোনো মানুষ কোনো কিছুতে দক্ষ হয়ে ওঠার প্রাথমিক পর্যায়ে করে থাকে। আর এসবের পাশাপাশি স্ত্রী অ্যাথেনার বিরুদ্ধেও স্কানেটের বিদ্বেষ বৃদ্ধি পেতে শুরু করল।

শরীরের প্রতি তুমুল অনিয়ম সত্ত্বেও স্কানেটের স্বাস্থ্যহানী ঘটেনি বিন্দুমাত্র। তার শরীর ছিল এক্সট্রা অর্ডিনারি।

স্কানেট আকস্মিক নিজের শরীরের প্রতি যত্নবান হয়ে উঠল– দুর্বার নিয়মিত শরীর চর্চা। মুষ্টিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিল। মেতে উঠল সে সরাসরি রিংয়ে নেমে প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখে আঘাত করতে–ধূর্ততার সাথে শিখল বক্সিং-এর ষোল কলা। নিজেকে কষ্ট দিতে ক্রমেই আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। শিকারের প্রতি বাড়ল তার আগ্রহ হত্যার খেলায় মেতে উঠল স্কানেট।

এক পর্যায়ে অ্যাথেনাকে শায়েস্তা করতে ব্যাকুল হয়ে উঠল। অভিনব এক পন্থা অবলম্বন করল স্কানেট। মাথায় এলে তাদের আরো সন্তান জন্ম দিতে হবে। পাঁচ-ছটি সন্তান তাদের ঘরে এলেই হয়তো তারা আবার আগের মতো কাছাকাছি আসতে পারবে। আর অ্যাথেনার ঊর্ধ্বগামী উচ্চাকাঙ্ক্ষারও পতন ঘটবে, ফিরে আসবে বজ স্কানেটের বুকে। কিন্তু স্কানেটের এই দূরভিসন্ধি বুঝতে পেরে অ্যাথেনা তার সন্তান বৃদ্ধির প্রস্তাব নাকচ করে দিল। সে বলল, তুমি যদি আরো সন্তান চাও তবে অন্য কোনো নারীর কাছে যেতে পারো। তুমি ক্রমেই দুর্বোধ্য হয়ে উঠছ স্কানেট …

অ্যাথেনার এটাই ছিল স্কানেটের প্রতি বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করার প্রথম ঘটনা। স্কানেট এতে মোটেও বিস্মিত হয়নি যে, অ্যাথেনা স্কানেটের অনাস্থার বিষয়টি জেনে গেছে। অবশ্য স্কানেট এটা লুকানোরও চেষ্টা করেনি। আসলে সে চালাকিই করেছিল। এতে স্কানেট তার স্ত্রীকে নিজের পথে চালিত করতে পারত।

অ্যাথেনার কাছে বজ ক্রমেই দুর্বোধ্য হয়ে উঠছিল। বজকে বোঝা তার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠছিল। কিন্তু অ্যাথেনার বয়স ছিল এতই কম যে বজের প্রতি তার প্রয়োজনীয় মনোযোগ দেয়ার মতো বুদ্ধি বা চিন্তা তার আর করা হলো না। এমন কলহ তাদের জীবনে নেমে এলো, যখন অ্যাথেনার বয়স মাত্র কুড়ি। তখন কেবল তার চরিত্রের গঠন পর্ব শুরু হয়েছে।

বজ শুরু করল নতুন খেল। সে এমন কিছু ঘটনার সূত্রপাত ঘটাল, যা সত্যিকার অর্থেই নারীরা ঘৃণা করে থাকে। স্কানেট নিজেকে অ্যাথেনার কাছে এমনভাবে উপস্থাপন করল, যেন সে একেবারেই বিচার-বুদ্ধিই পড়েছিল।

বজ স্কানেট নিয়মিত তাদের কাপড়-চোপড়গুলো ড্রাই ক্লিনিংয়ের জন্য নিয়ে যেতে শুরু করল। নিজের কাজ শেষে পরিবারের আনুষঙ্গিক কাজে অ্যাথেনাকে সহযোগিতা করতে লাগল। অ্যাথেনা অভিনয় করে যেতে লাগল। অ্যাথেনার উদ্দেশ্যে বলত, হানি, আমার চেয়ে তোমার সময়ের মূল্য অনেক বেশি। তোমাকে তোমার ডিগ্রির পাশাপাশি মিউজিক ও ড্রামার ক্লাসও চালিয়ে যেতে হচ্ছে …

স্কানেটের এমন উক্তিতে অ্যাথেনার কোনো ভাবান্তর হতো না। এর কারণ বজ স্কানেটের কণ্ঠে থাকত না কোনো প্রাণ। তার সবকথাই অ্যাথেনার কাছে। মেকি মনে হতো।

একদিন অ্যাথেনা যখন গোসল করছিল বজ বগলদাবা করে তার কাপড় নিয়ে হাজির হলো সেখানে। চোখে পড়ল অ্যাথেনার নগ্ন সৌন্দর্য। সোনালি চুল, নিখুঁত ফরসা ত্বক, সুডৌল স্তন আরো সুগঠিত পশ্চাৎদেশ। অ্যাথেনার সারা সৌন্দর্য ঢেকে রয়েছে ফিনফিনে ফেনিল সাবানে। কয়েক পলক তাকিয়ে ছিল বজ অ্যাথেনার সৌন্দর্যের দিকে। তারপর স্বাভাবিক হলো সে। সূক্ষ্ম কণ্ঠে বলে উঠল, তোমার এই ড্রেসগুলো যদি তোমার মতোই বাথটাবে ভিজিয়ে দেই কেমন হয় বলে তো! কিন্তু, বজ তা করল না। অ্যাথেনার কাপড়গুলো ঝুলিয়ে দিল ক্লোসেটে। বাথটাব থেকে তাকে উঠে আসতে সাহায্য করল। গোলাপি টাওয়েল জড়িয়ে দিল নগ্ন শরীরে। তারপর ভালোবাসার আস্বাদ গ্রহণ করল সে অ্যাথেনার কাছ থেকে। কয়েক সপ্তাহ পর এমনই এক ঘটনার পুনরাবৃদ্ধি হলো। কিন্তু এবার বজ অ্যাথেনার কাপড়গুলো আর ক্লোসেটে ঝুলাল না বাথটাবের পানিতেই ভিজিয়ে দিল। হতভম্ব হলো অ্যাথেনা। কাপড় আর শরীরে মতো ভিজে গেল তার চোখও।

বজ আর অ্যাথেনার মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলতে লাগল এভাবেই। এক রাতে বজ আকস্মিক ডিনার সেটের সমস্ত বাসন-কোসন ভেঙে ফেলতে উদ্যত হলো— কিন্তু শেষ অবধি তা সে করেনি। সপ্তাহ খানেক পর সে কিচেনের সব জিনিসপত্র আছড়ে ভেঙে ফেলতে লাগল। অবশ্যই এমন ঘটনা ঘটাবার কিছুক্ষণ পরই বজ অনুশোচনায় ভুগত এবং অবশেষে অ্যাথেনার কাছে ক্ষমা চাইত। সর্বদাই এমন ঘটনার পর ভালোবাসার চেষ্টা করত বজ। কিন্তু অ্যাথেনার কাছ থেকে সাড়া পেত না– এড়িয়ে চলতে লাগল অ্যাথেনা। পৃথক কক্ষে ঘুমাতে শুরু করল।

এর রাতের ঘটনা– ডিনারের সময় বজ তার হত মুষ্টিবদ্ধ করে অ্যাথেনার মুখের কাছাকাছি নিয়ে বলল, তোমার মুখটি হবে পারফেক্ট। যদি আমি ঘুষি মেরে তোমার নাকটি ভেঙে দিই, তবে সেটি হবে নতুন চরিত্রের সৃষ্টি দেখতে হবে অনেকটা মারলন ব্র্যান্ডের মতো।

বজের এমন উক্তির পর অ্যাথেনা তাৎক্ষণিক ছুটে গেল কিচেনে– পেছনে পেছনে ছুটল বজও। অ্যাথেনা ভীষণ ভয় পেয়েছিল। পেছনে বজকে দেখে একটি ছুরি তুলে ধরল বজের দিকে। বজ অ্যাথেনার এমন আচরণে উচ্চস্বরে হেসে উঠল। বলল, পৃথিবীতে এটা হচ্ছে এমন একটা কর্ম যা তোমার দ্বারা হবে না কখনো। সত্যিই অ্যাথেনা তা পারবে না কখনো। বজ খুব সহজভাবে অ্যাথেনার হাত থেকে ছুরিটি সরিয়ে নিয়ে বলল, আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করেছি, কিন্তু তুমি করলে ভুল– আসলে তোমার সেনস অব হিউমার বলতে নেই।

এভাবে অ্যাথেনা দিন দিন বজের বিকৃত আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিল। তখন তার বয়স মাত্র কুড়ি। ইচ্ছে করলে অ্যাথেনা তার বাবা-মার সাহায্য কামনা করতে পারত। কিন্তু তা সে করল না। এমনকি সে তার বন্ধুদের সাথেও এ নিয়ে আলোচনা করেনি কখনো। তার চেয়ে বরং সে নিজেই এর যথাযথ সমাধান বের করতে চিন্তায় ডুবে গেল– অবশ্য নিজের বুদ্ধিমত্তার ওপর অ্যাথেনার ছিল চরম আস্থা। তারপর অ্যাথেনা কখনোই তার কলেজের পাট শেষ করতে পারবে না। ক্রমেই পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।

অ্যাথেনা বুঝতে পেরেছিল, তার কলেজ কর্তৃপক্ষও তাকে নিরাপত্তা দিতে পারবে না। তাই সে মনে মনে বজের প্রতি ব্যাপক ছাড় দেয়ার কথা ভাবল। বজকে সত্যিকার ভালোবাসতে পুনরায় পুরনো বজকে ফিরে পেতে অ্যাথেনা চেষ্টা করতে লাগল। প্রথমে সে তৈরি করার চেষ্টা করল নিজেকে। কিন্তু পারল না। বজের প্রতি অ্যাথেনার বিরূপ ভাব এমনই প্রকট রূপ নিয়েছিল যে, সে তার মুখোমুখি দাঁড়ানো তো দূরের কথা, বজ তাকে স্পর্শ করবে এমন কথা চিন্তাও করতে পারল না। অ্যাথেনার মধ্যে অতি সন্তর্পণে যে ঘৃণার বীজ ধীরে ধীরে রোপিত হচ্ছিল, এতদিন পর তা সে উপলব্ধি করতে সক্ষম হলো। উপলব্ধি করল ভালোবাসা পেতে সে আর কখনো কাউকে প্রমাণ প্রয়োগে বিশ্বাস জন্মাতে পারবে না।

তার চেয়ে বরং বজের সংসার থেকে সরে এলে কেমন হয়– অ্যাথেনা ভাবল। চূড়ান্ত একটি সিদ্ধান্ত যদি অ্যাথেনা নিতে চায় তবে বজ কি এ পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে? হয়তোবা। একমাত্র কন্যা সন্তান ব্যাথেনিকে নিয়েই সমস্যায় পড়বে অ্যাথেনা। এত সহজে ব্যাথেনিকে ছেড়ে দেবে না বজ। একের পর এক সমস্যার চিন্তা মাথায় এসে জড়ো হতে লাগল। অ্যাথেনা বিভ্রান্ত হতে থাকল।

বজ প্রায়ই তাদের এক বছরের সন্তানকে নিয়ে ভয়াবহ খেলায় মেয়ে উঠত। ব্যাথেনিকে শূন্যে ছুঁড়ে আবার তাকে শূন্য থেকে লুফে নিত। মাঝে মাঝে অ্যাথেনাকে দেখিয়ে এমন ভাব করত যেন ব্যাথেনিকে শূন্যে ছুঁড়ে তাকে আর ধরবে না। একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে ব্যাথেনিকে লুফে নিত। এভাবেই একদিন শূন্যে ব্যাথেনি ছুঁড়ে বজ আর ধরতে পারল না। শিশুটি পড়ে গেল মেঝেতে। ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে ছুটে এলো অ্যাথেনা, মেঝে থেকে বুকে তুলে নিল শিশুটিকে। বিভিন্নভাবে পরখ করে দেখল সে। কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো মা অ্যাথেনা। তবে মেয়ের শয্যাপাশে ঠাই জেগে কাটিয়ে দিল সারাটি রাত— তেমন কোনো অঘটন ঘটেনি। ব্যাথেনি সুস্থ ছিল, নিশ্চিন্ত হলো অ্যাথেনা। তবে মাথায় সামান্য আঘাত পেয়েছিল তাদের শিশু কন্যাটি। একটু ফুলেও উঠেছিল। কন্যার এ অবস্থা দেখে মারাত্মক বিপর্যস্ত হলো বজ। অনুশোচনার কেঁদেই ফেলেছিল। অ্যাথেনার কাছে অশ্রুসজল নয়নে চেয়েছিল ক্ষমা এই প্রতিশ্রুতিতে যে, সে আর কখনো এমন ভয়াবহ কাণ্ড করবে না। অ্যাথেনাকেও আর কষ্ট দেবে না। কিন্তু অ্যাথেনা আর বজের কথায় কর্ণপাত করল না। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা ভাবল।

পরের দিন অ্যাথেনা তার ব্যাংকের সমস্ত হিসাব-নিকাশ পরিষ্কার করল, অর্থাৎ ব্যাংক থেকে তার টাকা-পয়সা তুলে নিল। তারপর চিন্তা করল সে এমন এক অজ্ঞাত স্থানে চলে যাবে যেখানে কোনোমতেই পিছু নিতে পারবে না বজ। ঠিকানার বিন্দুবিসর্গও রেখে যাবে না অ্যাথেনা বজের জন্য। এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার পর অ্যাথেনা আর দেরি করেনি।

দুদিন পর বজ যখন তার কাজ শেষে ফিরে এলো তখন স্ত্রী অ্যাথেনা বা কন্যা ব্যাথেনি কাউকেই পেল না বজ।

দীর্ঘ প্রায় ছয় মাস পর অ্যাথেনা লস অ্যাঞ্জেলেসে আত্মপ্রকাশ করল। ব্যাথেনি ছিল না সঙ্গে।

অ্যাথেনা অ্যাকুইটেন শুরু করল তার কাঙ্ক্ষিত ক্যারিয়ারের জন্য সংগ্রাম। খুব সহজেই একটি মধ্যমানের এজেন্টও পেয়ে গেল অ্যাথেনা এবং প্রাথমিক অবস্থায় ছোটখাটো থিয়েটার গ্রুপগুলোতে কাজ শুরু করল। মার্ক ট্যাপার ফোরামে একটি নাটকে অভিনয়ের সুবাদে অ্যাথেনা একটি ছোট ব্যানারের মুভিতে ছোট চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেল।

ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটতে লাগল যে অ্যাথেনাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সেই ছোট চরিত্রের পর সুযোগ এলো একটি এ গ্রেড ছবির সহযোগী চরিত্রে অভিনয়ের। এ ছবিতেও অ্যাথেনা জনপ্রিয় হলো। আর পরবর্তী ছবিতে নায়িকা চরিত্রে প্রশংসিত হবার পর থেকেই একের পর এক ছবিতে অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হতে থাকল। সেই সাথে বজ স্কানেটও তার জীবনে ধীরে ধীরে পুনরায় প্রবেশ করতে লাগল।

বজ চলচ্চিত্র একাডেমিতেও তার অনুপ্রবেশ ঘটাল। এতে অবশ্য অ্যাথেনা খুব একটা বিস্মিত হয়নি। তবে সেদিনকার সেই অ্যাসিড বলে রুপালি রঙ ছুঁড়ে মারার বিষয়টি আপাত দৃষ্টিতে শুধুমাত্র জোক বা কৌতুক বলে মনে হলেও অ্যাথেনা সন্দিহান। বজকে অ্যাথেনার চেয়ে বেশি আর কে চেনে। সে জানে, এবারের বোতলে পানি থাকলেও পরবর্তী কোনো দিন বজের হাতে থাকবে সত্যিকারের অ্যাসিডপূর্ণ বোতল।

স্টুডিওতে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ক্লডিয়া ডি লিনার উদ্দেশ্যে বলল মলি ফ্লান্ডারস।

সকালের আলোপচারিতা শুরু হয়েছিল স্টুডিওকে ঘিরেই। মলি ফ্লাডারসের কণ্ঠে ঝরে পড়ল এক অনিশ্চয়তার সুর অ্যাথেনা অ্যাকুইটেন বেশ সমস্যার মধ্যে রয়েছে। এর কারণ সেই একাডেমি অ্যাওয়ার্ড ঘোষণার দিন অ্যাথেনাকে লক্ষ্য করে কথিত অ্যাসিড ছোঁড়ার ঘটনাটি। অনেকেই সন্দেহ পোষণ করছে, অ্যাথেনা হয়তো তার ছবির কাজে আর ফিরে যেতে পারবে না। অথচ বানজ হোমাকে স্টুডিওতে চায়। তারা চায় তুমি যেন অ্যাথেনার সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করো।

ক্লডিয়া আর্নেস্ট ভেইলকে সাথে করে প্রতিউত্তরে বলল, যত শিগগির সম্ভব এখানকার কাজ শেষ করার জন্য আমি তাকে বলব। তবে আমার মনে হয় সে ঘাবড়ে যায়নি।

মলি ফ্লান্ডার একজন বিনোদন বিষয়ক আইনজীবী এবং শহরের অনেকেই তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। চলচ্চিত্র জগতের আইনজীবী হিসেবে তার নামডাক রয়েছে বেশ। আদালত কক্ষে মোকদ্দমার লড়াই মলি বেশ উপভোগ করে। অধিকাংশ মোকদ্দমায় তার জয়লাভের সুখ্যাতি রয়েছে। তার এই যশের কারণ মলি নিজেও একজন অভিনেত্রী ছিলেন এবং চলচ্চিত্র জগতের অনেক খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে সে বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল, যা তার আইন প্রয়োগে সহায়ক।

এন্টারটেইনমেন্ট লয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগে মলি ক্যালিফোর্নিয়ার প্রতিরক্ষা বিষয়ক দফতরের প্রধান অ্যাটর্নি হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। সেই সময় সে খুনের মামলার প্রায় কুড়িজন আসামিকে গ্যাস চেম্বারে প্রেরণের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। কিন্তু এ ধরনের মামলায় সত্যিকারের খুনির বিরুদ্ধেও এমন শাস্তি প্রদানে তার স্নায়ু কেঁপে উঠেছিল। সে সেখান থেকে ইস্তফা দিয়ে অবশেষে এন্টারটেইনমেন্ট লয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশকেই অধিকতর পছন্দের মনে করল। মলি প্রায়ই বলে থাকে এক্ষেত্রে নিষ্ঠুরতার বালাই নেই এবং এখানকার অপরাধীরা বেশ রসিক ও বুদ্ধিমান।

এন্টারটেইনমেন্ট লয়ার ছাড়াও মলি এখন পরিচালক, কলাকৌশলী, চিত্রনাট্য লেখক সরবরাহ করে থাকে। আজকের এই সকালেও সে এমনসব কর্মকাণ্ড নিয়েই ব্যস্ত ছিল। তবে চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে প্রিয় ক্লায়েন্ট ক্লডিয়া ডি লিনাকে সশরীরের তার অফিসে উপস্থিত হতে দেখে আনন্দিত হলো মলি ফ্লান্ডারস। ক্লডিয়ার সাথে সে ব্যক্তিটি উপস্থিত হয়েছ, সে বর্তমানে ক্লডিয়ার চিত্রনাট্য রচনার পার্টনার, একজন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট ভেইল।

ক্লডিয়া ডি লিনা ফ্ল্যাভারের শুধু প্রিয় ক্লায়েন্টই নয়, অনেক পুরনো একজন বন্ধুও। তাদের মধ্যে রয়েছে বেশ আন্তরিকতা এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। তাই ক্লডিয়া ভেইলের বিষয়টি মলি ফ্লাভারসকে দেখতে অনুরোধ করায় সে তাৎক্ষণিক তাতে সম্মতি প্রকাশ করল।

তবে ভেইলের যে সমস্যা তা শুনে মলি নিরাশ হলো। ভেইলের এ সমস্যার সমাধান তার দ্বারা সম্ভব নয় বলে আক্ষেপ করল মলি। তবে আর্নেস্টকে তার খুব একটা পছন্দ হলো না। একজন পুরুষ হিসেবে তার প্রতি কোনো আকর্ষণবোধও করল না সে।

আর্নেস্টের মামলাটি ছিল হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত। মলির কাছে দেয়া সমস্ত কাগজপত্র ঘেঁটে আর্নেস্টকে দুঃসংবাদ ছাড়া কিছুই দিতে পারল না আইনজীবী মলি ফ্লান্ডারস।

সে আর্নেস্টের উদ্দেশে বলল, আমি তোমার কন্ট্রাক্ট ও বৈধতার সব কাগজপত্র ঘেঁটে দেখলাম। সেখানে লডস্টোন স্টুডিওর বিরুদ্ধে নালিশ করার জন্য কোনো পয়েন্ট পাওয়া গেল না। তবে একটি উপায়ে তুমি তোমার অধিকার ফিরে পেতে পারো। এর জন্য মেয়াদোত্তীর্ণ কপিরাইটটি তোমাকে বের করতে হবে। সময়টি পরবর্তী পাঁচ বছর পরের হলে ভালো হয়।

এক দশক আগেও আর্নেস্ট ভেইল ছিল আমেরিকার একজন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক। সমালোচিতও হয়েছিল সে। ব্যাপক পঠিত হয়েছিল তার লেখা। একটি নোভেলের চরিত্র নিয়েই পরে সমস্যা বাধে। লডস্টোন বইটির স্বত্ব কিনে নেয় এবং এর ওপর একটি ছবিও নির্মিত হয়। ছবিটি ব্যাপক সফলতা লাভ করে। পরপর দুটি ধারাবাহিক নির্মিত হয়, ব্যবসায় লাভ হয় ব্যাপক। পরবর্তীতে আরো চারটি সিকুয়েলের ছবি বোর্ডে আগমন ঝুলিয়ে রাখা হয়।

দুর্ভাগ্যক্রমে ভেইল তার সব উপন্যাসের স্বত্ব প্রথম দফাতেই দিয়ে দিয়েছিল স্টুডিওর কাছে। কিন্তু সে চুক্তির পর চলচ্চিত্র থেকে একটি কণাও এ পর্যন্ত পায়নি সে।

আর্নেস্ট ভেইল সর্বদা একজন কদাকার মানুষ। সবসময়ই তার চেহারায় ফুটে থাকে এক তিক্ততার অভিব্যক্তি। এটি অবশ্য ভিন্ন একটি কারণে ভালো বলতে হবে। সমালোচকদের সাথে খুব একটা মিশতে হয়নি তার। তবে তারা ভেইলের সমালোচনায় অব্যাহতভাবে মুখর। তাদের মন্তব্য পাঠক তার বই পড়ে বেশি দিন মনে রাখবে না। ভেইলের মেধা সত্ত্বেও তার জীবন একটু ছন্নছাড়া। বিগত বিশ বছরের মধ্যে দাম্পত্য জীবন হয়েছে বিচ্ছেদের তার তিন সন্তানও চলে গেছে স্ত্রীর সাথে।

আর্নেস্ট ভেইলের একটি বই চলচ্চিত্রে বেশ সফলতা পায়। সেটি থেকেই ভেইলের কেবল এক দফা প্রাপ্তি আসে। অপরদিকে স্টুডিও ভেইলের ছবি করে বছরের পর বছর কামিয়ে নিচ্ছে দেদারসে বঞ্চিত হচ্ছে কেবল ভেইল।

আমাকে খুলে বলো, ভেইল বলল।

তোমার চুক্তিগুলো বোকা প্রমাণিত হবে–ভিত্তিহীন, মলি বলল। স্টুডিও তোমার লেখাগুলোর স্বত্ত্ব নিয়ে নিয়েছে। সেগুলো তাদের এখন ইচ্ছেমাফিক ব্যবহারের অধিকার আছে। কপিরাইটের আইন অনুযায়ী, তোমার মৃত্যুর পর তোমার সমস্ত কাজের অধিকার পাবে তোমার উত্তরাধিকারী।

এতক্ষণ সময়ে প্রথমবারের মতো হাসল ভেইল। একটি ছোট্ট শব্দ উচ্চারণ করল তারপর মুক্তি।

ক্লডিয়া কৌতূহলী হলো। প্রশ্ন করল, কেমন পরিমাণ অর্থ আমরা দাবি করতে পারি?

অন আ ফেয়ার ডিল, মলি বলল, মোটের ওপর পাঁচ শতাংশ। যেহেতু তারা চুক্তিবহির্ভূত পাঁচটির বেশি ছবি নির্মাণ করেছে এবং এর জন্য তারা বিপদগ্রস্তও নয়। তাছাড়া নিয়মিত বিশ্বব্যাপী সফল ব্যবসা তো তাদের রয়েছেই। আমরা ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিলিয়নের কথা ওঠাব।

কিছুক্ষণের জন্য মলি ফ্লাডার থামল। কি যেন ভেবে মিষ্টি একটা হাসি ঠোঁটে এনে বলল, যদি তুমি মৃত হয়ে থাকো, তবে তোমার উত্তরাধিকারী তৈরি করে এর চেয়েও বেশি এনে দিতে পারি হয়তোবা। আমাদের সত্যিকার অর্থেই তাদের মাথায় ধরার মতো বন্দুক আছে।

তাহলে লডস্টোনে তাদের ডাকো। আমি তাদের সাথে কথা বলতে চাই। আমি তাদের বোঝাতে চেষ্টা করব। যদি তাতেও তারা সম্মত না হয়, তবে নিজেকে মেরে ফেলা ছাড়া তো আরো উপায় নেই। বলল ভেইল।

প্রতিউত্তরে মলি বলল, তারা তোমাকে বিশ্বাস করবে না।

তাহলেও আমি এটা করব। ভেইলের সাফ জবাব।

যুক্তির সাথে কথা বলো ভেইল, দৃঢ় প্রত্যয়ী মলির উত্তর, তুমি মাত্র ছাপ্পান্ন বছরের একজন লোক। অর্থের জন্য এ মৃত্যুর এ বয়স খুব বেশি নয়। ভালোর জন্য, দেশের জন্য, ভালোবাসার জন্য, বয়সে মৃত্যু মেনে নেয়ার মতো, কিন্তু অর্থের জন্য নয়।

আমাকে অন্তত আমার স্ত্রী ও সন্তানের জন্য যোগান দিতে হবে। ভেইল বলল।

মলির উত্তর, তোমার প্রাক্তন স্ত্রী এবং ঈশ্বরের কসম তুমি তো দ্বিতীয় বিয়ে করে ফেলেছ।

আমি আমার প্রকৃত স্ত্রীর কথা বলছি। আমি আমার সেই স্ত্রীর কথা বলছি যার দুটি বাচ্চা আছে।

মলি এবার বুঝতে পারল আর্নেস্ট ভেইলকে– কেন তাকে হলিউডের সবাই এত অপছন্দ করে। সে বলল, তুমি যা চাও তা স্টুডিও তোমাকে দেবে না। তারা ভালো করেই জানে যে তুমি মোটেও আত্মহত্যা করার মতো মানুষ নও। শুধুমাত্র একজন লেখকের এই ঘটনা গুরুত্ব পাবে না। হ্যাঁ, তুমি যদি অভিনয় শিল্পী হতে, তবে মানা যেত। একজন এ গ্রেডের পরিচালক হলেও হয়তো হতো, তবে একজন লেখক হিসেবে নয়।

মলি আকস্মিক ক্লডিয়ার উদ্দেশ্যে বলল, স্যরি ক্লডিয়া, আমার দ্বারা সম্ভব নয়।

ক্লডিয়া বলল, আমি জানি আর জানে আর্নেস্ট। এক টুকরো শূন্য কাগজে মৃত্যুর সংবাদ এই শহরের সবাইকে যদি আতঙ্কিত না করে, তবে তারা। সম্পূর্ণরূপে আমাদের কাছ থেকে মুক্তি পাবে। তাও কি তুমি কিছুই করতে পারবে না মলি?

মলি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। লডস্টোনের প্রেসিডেন্ট ববি বানজের বিরুদ্ধে। আঘাত হানার যথেষ্ট ক্ষুদ্র উপকরণ হয়তো তার আছে কিন্তু … আপাতত সে এলি ম্যারিয়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল— এক নতুন মামলা।

পোলো লাউঞ্জে তারপর ভেইল এবং ক্লডিয়া বসল ড্রিংকসের জন্য। ভেইল আচ্ছন্ন ছিল তখনও মলি ফ্লাডারসের দেয়া তথ্যগুলোর মধ্যে। ক্লডিয়ার দিকে উদাসী দৃষ্টি হেনে বলল, মলি একজন বিশাল আকৃতির মানুষ। আরো এমন মানুষের সাথে পরকীয়া বেশ সহজ। ছোটখাটো নারীদের চেয়ে এরা বিছানাতেও চমৎকার যে কোনো ধরনের পূর্ব ইঙ্গিত ছাড়াই।

ক্লডিয়া বিস্মিত হলেও, ভেইলের কথায় এমন চুলচেরা বিশ্লেষণের স্বাদ সে আগেই পেয়েছে। ভেইলের এই অতি-মেধাকে ভালোবাসে ক্লডিয়া–এসব  কারণেই তার প্রতি ক্লডিয়ার এত আগ্রহ। এমন জিনিয়াস ক্লডিয়ার জীবনে খুব একটা নেই।

ক্লডিয়া এখনও ভালোবাসে ভেইলের উপন্যাস। সে বলল, তুমি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছ, ভেইল।

আমি ঠিক বোঝাতে চাইছি যে, এমন বড়সড় মহিলারা বেশ মিষ্টি স্বভাবের হয়ে থাকে। তারা তোমাকে ব্রেকফাস্ট বিছানা পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। এছাড়াও ছোটখাটো অনেক কিছুই তারা করে দেবে দ্বিধাহীন- জাস্ট নারীসুলভ আর কি।

ক্লডিয়া একটু নড়েচড়ে বসল।

ভেইল বলল, বড় মহিলারা ভালো মনেরও হয়ে থাকে। একদিন এমনই একজন আমাকে পার্টি শেষে তার বাসায় নিয়ে গেল। সেই রাতে আমাকে নিয়ে যে সে কি করবে, বুঝতেই পারিনি প্রথমে। পরে দেখলাম এমনভাবে সে তার বেডরুমটি পরখ করছে– মনে পড়ে গেল আমার মায়ের কথা। মা ঠিক সেই মহিলাটির মতোই তার রান্নাঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়াত কিছু একটা খাবার তৈরির জন্য। এরপর তা সবার সামনে পরিবেশন করত। মহিলাটিও ছিল আশ্চর্য রকমের– আমাকে অভিভূত করেছিল। আমরা কিভাবে সে রাতটি সুন্দরভাবে কাটাব ব্যস্ত ছিল এই আয়োজনে।

ক্লডিয়া ও ভেইল তাদের ড্রিংকসে চুমুক দিতে শুরু করল। প্রত্যেক বারের মতো ক্লডিয়া আজও ভেইলের বন্ধুভাবাপন্ন আচরণে মুগ্ধ হলো। সে বলল, আমি ও মলি কিভাবে পরস্পরের বন্ধু হলাম, তুমি কি জানো?

ক্লডিয়া এবার শুরু করল তার কথা, একবার সে এমন এক লোকের পক্ষে কাজ করেছিল যে তার গার্লফ্রেন্ডকে না কি হত্যা করে। আর এই কাজে আদালতে অপরাধীদের পক্ষে মলির প্রয়োজন ছিল কিছু ভালো সংলাপের। উদ্বিগ্ন মলিকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেলাম আমি। ঠিক সিনেমার যেমন সংলাপ লেখা হয় আমি সেভাবেই লিখেছিলাম। মলির উপস্থাপনায় লোকটি অনিচ্ছাকৃত হত্যার রায় পেয়ে বেঁচে যায়। তারপর থেকেই আমাদের বন্ধুত্বের শুরু।

ভেইল বলল, আই হেইট হলিউড।

হলিউডের প্রতি তোমার বিদ্বেষের কারণ লডস্টোন তোমাকে একটা বেকায়দা অবস্থায় ফেলেছে প্রতারণা করেছে, বলল ক্লডিয়া।

ভেইল বলল, না, ঠিক সে কারণেই নয়। দেখো ক্লডিয়া আমি হচ্ছি সেই পুরনো সভ্যতার অনুসারী একজন মানুষ— চীনা সম্রাট কিংবা নেটিভ আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের আমলের মানুষদের প্রতি দরদি একজন, যাদের ওপর উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল।

আমি একজন প্রকৃত লেখক, আমি আমার লেখার মধ্য দিয়ে মানুষের মনোস্তত্ত্বে আবেদন করি। আমার এসব লেখা খুব সেকেলে। মুভির জন্য এগুলো ঠিক দাঁড়ায় না। মুভির জন্য আছে ক্যামেরা, আছে দৃশ্যপট সাজানোর সেট, আছে সঙ্গীত– এসব দিয়ে বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু একজন লেখক সামান্য কটা শব্দ সাজিয়ে কিভাবে তা সম্ভব করবে? বিশেষ করে যুদ্ধের দৃশ্যে হয়তো নিখুঁত সব দৃশ্যও তৈরি করা সম্ভব মুভির মাধ্যমে। তবে একটি ব্যাপার, মুভি মস্তিষ্ক জয় করলেও হৃদয় জয় করতে পারবে না।

ফাঁক ইউ, আমি লেখক নই। ক্লডিয়ার আক্ষেপ। সে বলল, একজন চিত্রনাট্যকার কখনোই লেখক নয়। তুমি এমন আক্ষেপ দেখাচ্ছ কারণ তোমার সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। এ অবস্থায় তুমি কখনোই এর পক্ষে বলতে পারবে না।

ভেইল ক্লডিয়ার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, আমি তোমাকে ঠিক নিচে নামিয়ে ফেলছি না। আমি কেবল একটি সংজ্ঞা তৈরির চেষ্টা করছিলাম।

ভাগ্যের বিষয় এই যে, আমি তোমার লেখা খুব পছন্দ করি, ক্লডিয়া বলল, কিন্তু এখানে কি কেউই তোমাকে পছন্দ করে না?

ভেইল হাসল, বলল, না, না তারা আমাকে অপছন্দ করে না। আমার প্রতি তাদের ঘৃণাবোধ আছে। তবে দেখো, যখন আমি আমার মৃত্যুতে লেখার স্বত্ব ফিরে পাব, তখন তারাই আমাকে শ্রদ্ধা জানাবে।

ক্লডিয়া বলল, তুমি একটুও সিরিয়াস নও।

আমি ভাবি, আমি যথেষ্ট সিরিয়াস। ভেইল বলল, আত্মহত্যা একটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এখন রাজনৈতিকভাবেও এটা সঠিক নয় বলে ভাবা হচ্ছে। তাই নয় কি?

ওহ শিট ক্লডিয়া তার একটি বাহু দিয়ে ভেইলের গলা জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল, লড়াই কেবল শুরু হচ্ছে। আমি যখন তোমার পয়েন্টগুলো তাদের সামনে উত্থাপন করব, আমি নিশ্চিত তারা শুনবে। এবার হলো তো!

ভেইল ক্লডিয়ার কথায় মুচকি হাসল। তাড়াহুড়োর কিছু নেই ভেইল বলল। এই করতে করতে ছয় মাসের মতো সময় লেগে যাবে। আর তখন আমিও আমার করণীয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যাব। আসলে সহিংসতা আমার একেবারেই অপছন্দ।

ক্লডিয়া এবার নিশ্চিত হলো যে, ভেইল সত্যি সত্যিই সিরিয়াস। আকস্মিক আতঙ্কিত হয়ে পড়ল ভেইলের মৃত্যুর কথা ভেবে। এমন ভাবনা, ক্লডিয়ার শুধু ভেইলকে ভালোবাসার জন্যই নয়, যদিও তাদের সম্পর্কের বিষয়টি সে পর্যায়েই চলে গেছে। ভেইলের প্রতি অতিমাত্রায় অনুরক্তের কারণেও ক্লডিয়ার এই আতঙ্ক নয়। তার খারাপ লাগছে এই ভেবে যে, তার লেখা এত সুন্দর সুন্দর বই সামান্য কটা টাকার জন্য গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে। ভেইলের এই শিল্প হয়তো অর্থকে জয় করে নেবে এক সময়। ক্লডিয়া তার এমন চিন্তা ঝেড়ে বেরিয়ে এলো। ভেইলের উদ্দেশে বলল, যদি খারাপ পরিস্থিতি একেবারে নগণ্য মাত্রায় নেমে আসে তবে আমরা ভেগাসে আমার ভাই ক্রসের সাথে যোগাযোগ করব। সে তোমাকে পছন্দ করে। সে নিশ্চয়ই কিছু একটা করতে পারবে।

ভেইল হেসে উঠে বলল, সেও আমাকে ততটা পছন্দ করে না। ক্লডিয়া বলল, সে খুব ভালো মনের মানুষ। আমি আমার ভাইকে জানি। ভেইল এবার বলল, না ক্লডিয়া, তুমি তাকে চেনো না।

অ্যাথেনা অ্যাকুইটেন সে রাতে ডরোথি চ্যান্ডলার প্যাভিলিয়নে অনুষ্ঠিত একাডেমি অ্যাওয়ার্ড সেরেমনি থেকে সরাসরি ফিরে এসেছিল। অবসাদগ্রস্ত অ্যাথেনা ঘরে ফিরেই সোজা চলে গিয়েছিল তার বিছানায়। কয়েক ঘণ্টা সময় সে বিছানায় শুধু এপাশ-ওপাশ করেই কাটাল- বিন্দুমাত্র ঘুম এলো না চোখে। শরীরের পেশিগুলোও যেন টেনে টেনে ধরছিল।

কেবল একটাই চিন্তা তার মাথায় চিন্তা নয় দুশ্চিন্তা। বজ স্কানেটের। আতঙ্কের রেশ তার তখনও কাটেনি। আপন মনে বিড়বিড় করে বলে উঠল এ কাজের পুনরাবৃত্তি আর করতে দেয়া যাবে না। সে ভাবল, এমন ত্রাসের মধ্যে সে তার জীবন অতিবাহিত করতে চায় না।

আকস্মিক অ্যাথেনা উঠে বসল। সামান্য কয়েকটা মুহূর্তমাত্র। তারপর বিছানা থেকে নেমে সে তার পোশাক পরিবর্তন করল। গায়ে চড়াল খেলার পোশাক, পায়ে টেনিস জুতা। খুব ভোরে সূর্য উদয়েরও আগে এবং সৈকতে মানুষজনের পদচারণার অনেক পূর্বে অ্যাথেনা দৌড়াতে শুরু করল। তার দৌড়ের গতি হলো দ্রুত থেকে দ্রুততর।

সমুদ্র সৈকতের শক্ত ভেজা বেলেতে অ্যাথেনার দৌড় যেন অশরীরী মনে হতে লাগল। সমুদ্রের তীর ঘেঁষে দৌড়ানোর সময় অ্যাথেনার পায়ের ওপর আছড়ে পড়েছিল ঢেউ। নরম বেলেতে পা কদাচিৎ আটকেও যাচ্ছিল– তবুও থামেনি সে। সেই সাথে থামেনি তার মস্তিষ্কের স্নায়ুতে স্নায়ুতে বজকে নিয়ে চিন্তার দৌড়।

অ্যাথেনা চায় না বজ তাকে কখনো আঘাত করতে সমর্থ হোক। মাথায় যেমনই আসছে বজের চিন্তা, অ্যাথেনার পরিশ্রমও বেড়ে যাচ্ছে সাথে সাথে। চিন্তার রেশ থামেনি মোটেও। অ্যাথেনা ভাবতে লাগল–বজ যে তাকে একসময় হত্যা করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তার আগে সে অ্যাথেনাকে খেলিয়ে নেবে, তারপর অবশেষে তাকে বিকৃত করে ফেলবে– অ্যাথেনাকে কুৎসিৎ কদর্য করাই বজের অন্যতম অভিপ্রায়। এর কারণ, যদি অ্যাথেনাকে সে আবারো ফিরে পায়– অ্যাথেনা এভাবেই কথাগুলো বিড়বিড় করে আওড়ে যাচ্ছিল। এক সময় সমুদ্রের শীতল ছটা তার মুখে এসে পড়ল। আপন মনেই বলে উঠল– এ হয় না, এটা হতে দেয়া যায় না।

অ্যাথেনা আবার ভাবতে লাগল স্টুডিওর কথা তারা উন্মত্ত হয়ে উঠবে। তারা তাকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ফেলতে দ্বিধাগ্রস্ত হবে না। আরো এসব করা হবে কেবল অর্থের জন্য, নিশ্চয় অ্যাথেনার জন্য নয়, স্টুডিওর লোকরা অর্থের লাভ লোকসানে বেশ সতর্ক।

অ্যাথেনার ধারাবাহিক ভাবনায় এলো তার বন্ধু ক্লডিয়া। তার মনে এলো স্টুডিওর আরো কিছু মানুষের কথা। সে জানে, সে নিজের জন্য সবার কাছ থেকে সহানুভূতি আদায় করতে পারবে না। বজ খুব বেশি উচ্ছল, খুব বেশি সাহসী। সে এত বেশি স্মার্ট যে, অনায়াসেই যে কোনো লোককে আপন করে নিতে সক্ষম। মানুষের সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে অ্যাথেনা নিজের জন্য কোনো সুযোগই সৃষ্টি করতে পারবে না।

এভাবেই চিন্তায় মগ্ন হয়ে, দৌড়াতে দৌড়াতে অ্যাথেনা এক সময় এসে পৌঁছল একটি টিলাসম পাথরখণ্ডের কাছে, যার অর্থ উত্তর সৈকতের সীমানা এখানেই শেষ।

এতক্ষণ অর্থাৎ দীর্ঘ সময় ধরে দীর্ঘপথ অতিক্রম করায় মনের জোরও প্রায় ফুরিয়ে গেল অ্যাথেনার ফিরে যাবার মানসিক ইচ্ছেও শেষ হয়ে গেল। দম ফুরিয়ে অ্যাথেনা বসে পড়ল বেলেতেই। হৃদয়ের স্পন্দনকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করল সে।

আকস্মিক সি-গালের শব্দে তার সম্বিত ফিরে এলো। দেখল কয়েকটি সি গাল শূন্য থেকে উড়ে এসে পানি ছুঁয়ে আবারো উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। খুব ভালো লাগল তার অনেকটা সময় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল পাখিগুলোর খেলা। কিন্তু তাকে ফিরে যেতে হবে। মুখ শুকিয়ে এসেছিল, জিহ্বা বের করে ঠোঁট ভিজানোর চেষ্টা করল সে।

অকস্মাৎ দীর্ঘদিন পর তার প্রথমবারের মতো মনে হলো— সে ইচ্ছে করলেই তো তার বাবা-মার আশ্রয় নিতে পারে। বিষয়টি এমন কিছু কঠিন নয়। তার মনে হলো তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি কোনো শিশুর পথ ভুলে যাবার মতো ঘটনা। ইচ্ছে করলেই আবারো ফিরে যাওয়া যায় নিরাপদে, নিরাপদ আশ্রয়ে। যেখানে গেলে কেউ দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরবে তাকে, তার ভালোর জন্য করবে যা কিছু দরকার।

খুব ভালো লাগল অ্যাথেনার। মনে জোর পেল– হেসে উঠল শিশুর মতো। তার মধ্যে বিশ্বাস জন্মাল– এটা অসম্ভবের কিছুই নয়।

বর্তমানের অ্যাথেনা অনেকের ভালোবাসার, পছন্দের এমনকি শ্রদ্ধারও। তবে সে মনে করে, সে একেবারেই শূন্য। বিশেষ করে কোনো মানুষের ভালোবাসার যথাযথ অনুভূতি তাকে আরো দোলা দেবে না কখনো। অ্যাথেনা প্রায়ই নিজেকে বড় একাকী মনে করে যেন এ পৃথিবীতে তার কেউ নয় আপন।

কখনো অ্যাথেনার পাশ কাটিয়ে একজন সাধারণ মহিলা তার স্বামী সন্তানের সাথে হেঁটে যায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে সে এমন একটি সহজ জীবনের জন্য। ঈর্ষা হয় তার সেই সাধারণ নারীটির ওপর। থামো– চিন্তার রেশ থামাতে চিৎকার করে ওঠে অ্যাথেনা। মনে মনেই বলে– ভাবো, এমন একটা জীবন ইচ্ছে করলেই পাওয়া যায়। এর জন্য অ্যাথেনা, তোমার প্রয়োজন পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন।

সকালের মধ্যভাগে অ্যাথেনা ফিরে এলো তার বাড়িতে। গর্বের সাথে, বুক ফুলিয়ে, সোজা হনে সে ফিরে এলো। তার মধ্যে উপলব্ধি হলো তার আত্মবিশ্বাস ফুরিয়ে যায়নি। অ্যাথেনা জানে তাকে এখন কি করতে হবে।

বজ স্কানেটকে সারা রাত পুলিশ কাস্টোডিতে রাখা হলো। স্কানেট কাস্টোডি থেকে ছাড়া পাবার পর তার আইনজীবী প্রেস কনফারেন্সের ব্যবস্থা করল। স্কানেট সাংবাদিকদের জানাল, অ্যাথেনা অ্যাকুইটেনকে সে বিয়ে করেছিল। দীর্ঘ দশ বছরেও সে অ্যাথেনার দেখা পায়নি। সেদিন দেখা হওয়ায় বজের এই কাণ্ডটি ছিল কেবল একটি বাস্তব কৌতুক। লিকুইডটি ছিল পানি।

সংবাদ সম্মেলনে বজ জানাল যে, নিশ্চিতভাবেই অ্যাথেনা তার বিরুদ্ধে কোনো নালিশ করবে না। বাস্তবে ঘটলও তাই। অ্যাথেনা এ বিষয়ে কোনো মামলা বা সংবাদ সম্মেলন করেনি।

.

তবে সেদিন অ্যাথেনা লডস্টোন স্টুডিওকে বিষয়টি জানিয়েছিল। লডস্টোন স্টুডিওর সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে ছবি নির্মাণের রেকর্ড আছে। এ কারণে স্টুডিওটির নাম-ডাকও ব্যাপক। অ্যাথেনা স্টুডিও কর্তৃপক্ষকে জানাল, লডস্টোনে চুক্তিবদ্ধ কাজ সে আর করবে না। এর কারণ হিসেবে অ্যাথেনা লিখল, তার ওপর যে কৌতুককর হামলা চালানো হয়েছে, তাতে সে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে– আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।

অ্যাথেনা ছাড়া লডস্টোনের ব্যানারে নির্মিতব্য ঐতিহাসিক ছবি ম্যাসেলিনা সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এ অবধি ছবিটির জন্য যে পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে তার পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এবং অ্যাথেনা এই স্টুডিওতে কাজ না করার অর্থ, পরবর্তীতে কোনো বড় স্টুডিওতেই কাজ করার সুযোগ হারাবে সে।

অ্যাথেনার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে লডস্টোন স্টুডিও থেকেও একটি স্টেটমেন্ট ছাড়া হলো। তাতে লেখা হলো তাদের তারকা অভিনেত্রী চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। অথচ চুক্তিবদ্ধ ছবির শুটিং-এর কাজ এখনও সিংহ ভাগ বাকি। তাকে এক মাসের মধ্যেই অবশিষ্ট কাজটুকু করতে হবে।

০২. লডস্টোনের সাথে অ্যাথেনা

০২.

লডস্টোনের সাথে অ্যাথেনা অ্যাকুইটেনের কাজ না করার ঘোষণাটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ প্রতারণা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, যার সাথে জড়িত বিশাল পরিমাণে অর্থের বিনিয়োগ ব্যাপক মূল্য দিতে হতে পারে এজন্য অ্যাথেনা অ্যাকুইটেনকে।

লডস্টোন পুরো হলিউডের এমনই এক প্রভাবশালী ও বৃহৎ স্টুডিও যে, সাধারণত কোনো অভিনয় শিল্পীই অ্যাথেনার মতো নেতিবাচক আচরণের সাহস দেখায় না।

ঐতিহাসিক কাহিনীনির্ভর ম্যাসেলিনা চলতি বছর ক্রিসমাস মৌসুমের যথেষ্ট গতিশীল প্রযোজনা। শুধু তাই নয়, এমন বড় ছবি পুরো দীর্ঘ ও কঠিন শীতকালে স্টুডিওর সব ছবির পরিপূরক হিসেবে বিবেচিত। আর এতেই প্রধান চরিত্রে কাস্ট করা হয়েছে অ্যাথেনাকে।

অ্যাথেনার ওপর লডস্টোন স্টুডিওর ক্ষেপে যাওয়ার আরো একটি কারণ হচ্ছে এমন এক সময় অ্যাথেনা ছবিতে কাজ না করার ঘোষণা দিয়েছে যখন বার্ষিক চলচ্চিত্র উৎসবের সমস্ত আয়োজন প্রায় সম্পন্ন। পরের রোববার এলি ম্যারিয়নের বেভারলি হিলস এস্টেটে এই বার্ষিক উৎসব ঘিরে ব্রাদারহুড চ্যারিটি পার্টির দিন নির্ধারিত। এলি ম্যারিয়ন হচ্ছেন লডস্টোন স্টুডিওর সিংহভাগের অংশীদার এবং চেয়ারম্যান।

সমতল ভূমি থেকে অনেক উঁচুতে বেভারলি হিলসে এলি ম্যারিয়নের ম্যানশনটি আদতে একটি প্রদর্শনী ক্ষেত্র হিসেবেও অনায়াসে চালিয়ে দেয়া যায়। বাড়িটিতে রয়েছে বিশাল বিশাল কুড়িটি কক্ষ। তবে সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয়, এত বড় বাড়িতে মাত্র একটি শয্যাকক্ষ বা বেড চেম্বার। এর কারণ এলি ম্যারিয়ন কখনোই চান না তার বাড়িতে কেউ ঘুমাক। তবে গেস্টদের জন্য অবশ্যই রয়েছে বাংলো-বাড়ি, রয়েছে টেনিস কোর্ট এবং বড়সড় আয়তনের সুইমিং পুল। ম্যারিয়নের বিশ কক্ষ বিশিষ্ট ম্যানশনটির প্রায় ছয়টি কক্ষই সাজানো হয়েছে অত্যন্ত মূল্যবান সব পেইন্টিংস দিয়ে। ম্যারিয়ন এ বিষয়ে প্রায় বলে থাকেন– আমার ম্যানশনের কয়েকটি কক্ষ পেইন্টিংসের জন্য উৎসর্গকৃত।

সেই বেভারলি হিলসের চ্যারিটি উৎসবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে হলিউডের বাঘা বাঘা প্রায় পাঁচশ ব্যক্তিত্বকে। আমন্ত্রণ রক্ষা করতে অতিথিদের প্রত্যেককে এক হাজার ডলার করে অ্যাডমিশন ফিও দিতে হয়েছে।

উৎসবের জন্য ম্যারিয়ন ম্যানশনের বাইরে পৃথকভাবে বসানো হয়েছে পানশালা। খাবারের স্থান, নাচের জায়গা ও মিউজিক ব্যান্ডের স্থান। এর বাইরে পুরো স্থান জুড়েই আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য এই আয়োজন। তবে ম্যানসনে অতিথিদের অবাধ বিচরণ সংরক্ষিত। আরেকটি বিষয়, অতিথিদের টয়লেট সিস্টেমেও আনা হয়েছে অভিনবতু— এর জন্য একটি বহনযোগ্য গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেটি বেশ কৌতুককর।

ম্যানশন, অতিথিদের বাংলো, টেনিস কোর্ট ও সুইমিং পুলগুলো ঘিরে দড়ির সীমানা টানানো হয়েছে। বসানো হয়েছে নিরাপত্তা রক্ষী। কোনো অতিথিরই এমন নিরাপত্তা ডিঙিয়ে সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এলি ম্যারিয়ন ব্যক্তি হিসেবে এতটাই প্রসিদ্ধ যে, এমন নিরাপত্তা ও আড়ম্বরপূর্ণ ব্যবস্থা না নিলে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা অসম্ভব কিছু নয়।

আমন্ত্রিত অতিথিদের লনে গল্প-গুজব, নাচ-গানের জন্য মাত্র তিন ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। আর ম্যারিয়ন ছিলেন ম্যানশনের একটি বড় সম্মেলন কক্ষে। সেখানে একদল হলিউড ব্যক্তিত্বের সাথে তিনি ম্যাসেলিনা ছবিটি সম্পন্নের বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন।

বেভারলি হিলসে এই আয়োজনের পুরোটাই এলি ম্যারিয়ন নিজেই সম্পাদনা করছিলেন। আশি বছর বয়সেও ম্যারিয়নের স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। এতটা বয়স তিনি অত্যন্ত সতর্কতা ও ধূর্ততার সাথেই লুকিয়ে রাখতে পারেন। যে কেউ তাকে দেখে ষাটের বেশি মনে করবে না কখনো। তার ধূসর চুলগুলো নিখুঁতভাবে ছাঁটা এবং খুব সামান্যই তাতে রুপালি আভা। কালো সুট পরলে ম্যারিয়নের কাঁধ আরো প্রশান্ত মনে হয়। শরীরের টান টান ভাব আরো প্রস্ফুটিত হয়। সাথে ঠোঁটে ধরা চিকন পাইপ হারিয়ে দিতে পারেন প্রায় যুবকদের ইমেজও। তার পায়ে মাহোগ্যানি জুতা যেন ভূপৃষ্ঠ আঁকড়ে থাকে। লম্বভাবে কাটা সাদা শার্ট ও সাথে গোলাপি টাইয়ের বাঁধনে তার সামান্য ধূসর পাণ্ডুবর্ণও গোলাপি হয়ে ওঠে। তবে লডস্টোনে তার নিয়ম ও আইন পরিচালিত হয় তার নির্দেশমতোই। একটা সময় অবশ্য ছিল, যখন মানুষের ইচ্ছার স্বাধীন মতামতের ওপর ভিত্তি করেই পরিচালিত হতো স্টুডিওর কার্যক্রম। এখন আর সে দিন নেই– কর্তৃত্ব ম্যারিয়নেরই।

একটি ছবির মাঝপথে অ্যাথেনা অ্যাকুইটেনের অস্বীকৃতি মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে এলি ম্যারিয়নকে। এতে বিপর্যস্ত হয়েছে ম্যারিয়নের দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত নিয়ম, শৃঙ্খলা ও সর্বোপরি তার মনোযোগ।

ম্যাসেলিনা শত মিলিয়ন ডলারের প্রযোজনা, স্টুডিওর গতি প্রকৃতি। এর অর্থায়ন বিভিন্ন বিদেশী ভিডিও, টিভি, ক্যাবল ইত্যাদি মাধ্যমের সাথে সম্পৃক্ত— যেন এক-একটি স্বর্ণের ভাণ্ডার। আর এই ভাণ্ডার স্প্যানিশ জাহাজ (গ্যালিওন) ডুবির মতো সাগরের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে যেন, তা আর কখনোই উদ্ধার করা সম্ভব নয়। এই ভাণ্ডার হচ্ছে অ্যাথেনা নিজেই। তিরিশ বছরে অ্যাথেনা– একজন মেগাস্টার। অ্যাথেনা শুধু ম্যাসেলিনার জন্যই নয়, লডস্টোনের পরবর্তী আরেকটি ব্লকবাস্টার ছবিতেও চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ম্যারিয়নের মতে, অ্যাথেনা একটি প্রকৃত মেধার নাম, তার মাঝে মেধা ছাড়া আর কি-ইবা আছে! তবে ম্যারিয়ন যে কোনো মেধার পূজারী।

মেধাকে তিনি ডিনামাইট হিসেবে মনে করেন। ডিনামাইটের মতোই ভয়ঙ্কর এই মেধা, তবে এর নিয়ন্ত্রণও রাখতে হবে। ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক এই ডিনামাইটের নিয়ন্ত্রণ রাখতে প্রয়োজন ভালোবাসার। তার নিয়ন্ত্রণে হতে হবে তোষামোদী– বিশ্বে প্রচার করতে হবে এর যত কিছু ভালো সব। এর জন্য হতে হবে বাবা, হতে হবে মা। এর জন্য নিজেকে একজন বোন হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে, এমনকি প্রয়োজনে সাজতে হবে একজন প্রেমিক। তবে খুব বেশি ছাড়ও দেয়া যাবে না। কিন্তু ম্যারিয়নের এখন এমন একটি কঠিন সময়, যখন ডিনামাইট অ্যাথেনার প্রতি কোনো কিছুই সাজতে পারছেন না– দুর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি কোনোভাবেই ক্ষমা করতে পারছেন না অ্যাথেনাকে।

কনফারেন্স রুমে উপস্থিত সবাই তাকিয়ে আছেন এলি ম্যারিয়নের দিকে। সবাই ম্যারিয়নের মনোভাব জানতে উদগ্রীব। আজকের এ সভায় উপস্থিত আছে ববি বানজ, স্কিপি ডিরি, মেলো স্টুয়ার্ট ও ডিটা টমি।

এলি ম্যারিয়ন তাকালেন তার কনফারেন্স রুমের কুড়ি মিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যমানের পেইন্টিংস, টেবিল, চেয়ার, সোফা, ক্রিস্টালের ওয়াইনপূর্ণ ধারক আরো মর্গগুলোর দিকে। তার এই দৃষ্টি ছিল উদাসীন। এসব যেন তারই শরীরের খণ্ড খণ্ড টুকরো। ম্যারিয়নের মনে হলো, যেন শরীরের টুকরোগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।

এলি ম্যারিয়ন নিজেই অবাক হয়ে ভাবেন কতটা কৌশলের সাথে তিনি নিজেকে একজন শক্তিশালী, প্রভাবশালী হিসেবে সারা বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করে থাকেন। খুব কঠিন মনে হয় তার বিশ্বের অপর পাওয়ারফুল ব্যক্তিদের সাথে তাল মিলিয়ে চলা।

ম্যারিয়নের সকালগুলো কখনোই পুরোপুরি অবসাদমুক্ত হওয়ার সুযোগ পায় না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয় তাকে। ক্লান্তিভরা শরীর নিয়ে শেভ করেন, কোটের বোম লাগান একে একে। তারপর বাঁধেন টাই–টাইয়ের নটটা সামলাতেও বেগ পেতে হয় তার। তবে মনের জোরেই করতে থাকেন সবকিছু। তিনি জানেন মানুষের মানসিক দুর্বলতা হচ্ছে সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয়। এটা সক্রিয় হলে যে কোনো মানুষ তার জীবনের ছন্দ হারিয়ে ফেলবে, ক্ষমতাহীন হয়ে পড়বে। তবে এ বয়সে ম্যারিয়ন আর কত দিন তার মনের জোর ধরে রাখবেন?

তিনি এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ববি বানজকে ব্যবহার করছেন। তার কাছে ধীরে ধীরে গছিয়ে দিচ্ছেন ক্ষমতা। বানজ প্রায় তিরিশ বছরের ছোট হলেও তাকে বন্ধুসুলভ দৃষ্টিতেই দেখেন ম্যারিয়ন। সবচেয়ে কাছের বন্ধু মনে করেন তাকে। এর কারণ দীর্ঘ সময় ধরে বানজ ম্যারিয়নের আনুগত্য।

স্টুডিওর প্রেসিডেন্ট এবং চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসারের দায়িত্বে রয়েছে বানজ। প্রায় তিরিশ বছর যাবৎ বানজ যেন ম্যারিয়নের কুড়াল। এই দীর্ঘ সময় ধরে তাদের সম্পর্কে একটি নতুন মাত্রাও যোগ হয়েছে। সেটি পিতা-পুত্রের অনেকেই এমন মন্তব্য করে থাকেন আজকাল। ম্যারিয়নের সত্তর বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর থেকে, ক্রমেই তিনি স্বভাবগত কোমল হতে থাকেন। ঠিক ততটুকুই করেন যতটুকু না করলেই নয়। তবে বানজ এক্ষেত্রে সদা সক্রিয়।

বানজ ছিল এক সময় ছবির পরিচালক। সেই পরিচালক থেকে ম্যারিয়ন তাকে তুলে এনেছেন সমগোত্রে। ম্যারিয়নের সাথে যৌথ ছবি নির্মাণ করে দর্শকের জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর থেকেই উভয়ের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। বানজ লডস্টোন স্টুডিওর একটি নিন্দনীয় নাম। এই সেই বানজ, যে ছবির পরিচালক, স্টার ও লেখকদের পারিশ্রমিক প্রদানে ঠকিয়ে যাচ্ছে অনবরত। কেউ বিদ্রোহ করে উঠলে আদালতের আশ্রয় নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। এই সেই বানজ যে যে কোনো ট্যালেন্টকে কঠিন শর্তে চুক্তিবদ্ধ করতে বাধ্য করে। এটি ঘটে বিশেষ করে লেখকদের ক্ষেত্রে।

লেখকদের একটি সাধারণ মাত্রার সম্মানী দিতেও তার কার্পণ্যের সীমা নেই। অনেক ক্ষেত্রে লেখকদের স্ক্রিপ্ট তার হাতে যাওয়ার পরপরই অস্বীকারও করে বসে। তবে বানজের কাছে মোটামুটি একটা মূল্য পায় পরিচালক। পরিচালকের গুরুত্ব তার কাছে একটু বেশিই। এর কারণ তারা হচ্ছে ছবির কলকাঠি নাড়নেঅলা–ইচ্ছে করলেই অন্ধ বানিয়ে ফেলতে পারে তারা। প্রযোজকদের ক্ষেত্রেও বানজের মনোভাব কিছুটা নমনীয়। চুরিবৃত্তির গলদ না পাওয়া পর্যন্ত বানজের কাছে প্রযোজকরা হচ্ছে ছবি তৈরির মানসিক শক্তির উৎস।

কিন্তু লেখকরা? বেচারা লেখকদের চুক্তিবদ্ধ হতে হয় বানজের কাছে শূন্য সাদা কাগজে। এতে সায় না থাকলে এমন অনেক লেখক বের করে নেয়া যায় বলে একটা হুমকিও শোনা যাবে তার মুখে। লেখা নির্বাচিত হওয়ার পর প্রযোজক বিভিন্ন দৃশ্যের জন্য প্লট সাজান। পরিচালক দেন তার বাণিজ্যিক ভিত্তি এবং স্টাররা সংলাপের অভিব্যক্তিতে ফুটিয়ে তুলতে থাকেন দৃশ্যের পর দৃশ্য। কোনো কারণে কোনো দৃশ্যে যদি সংলাপ না থাকে তবে সে লেখকের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে বানজ। কেটে নেয়া হবে তার সম্মানীর অংশ। এভাবে পূর্বে বহু লেখককে বঞ্চিত করার ঘটনা ঘটেছে, যা একত্রে করলে কয়েক মিলিয়ন ডলার হতে পারে। তবে লেখকদের ক্ষেত্রে বানজের চেয়ে ম্যারিয়ন অনেকটাই নমনীয়। এর কারণ ছবি নির্মাণে চুক্তিবদ্ধ করাতে স্টার, কলাকুশলীদের চেয়ে লেখকরাই সবচেয়ে সহজ বলে মনে হয় তার।

ম্যারিয়ন এবং বানজ সারা বিশ্বের ফিল্ম ফ্যাস্টিভেলের আয়োজন করে ছবি বিক্রির চেষ্টা চালিয়েছে একসাথে। তাদের ছবির বিশ্ব বাজার তৈরির জন্য তারা কখনো গেছেন লন্ডন, কখনো প্যারিসে, কানসে–কখনোবা টোকিও কিংবা সিঙ্গাপুরে। সারা বিশ্ব সফর করে তাদের কাছে ছবি সংশ্লিষ্ট লেখক, সাধারণ আর্টিস্ট, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভূমিকাকে একেবারেই নগণ্য মনে হয়েছে। এর পরই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই বঞ্চিতকরণ ধারার। সাম্রাজ্য বিস্তারের নতুন আইন তৈরি হয়েছে তাতে একজন হয়েছেন সম্রাট আর অপরজন তার প্রধান আজ্ঞাবাহী।

এলি ম্যারিয়ন এবং ববি বানজ দুজনে একমতে পৌঁছেছেন। তাদের মনে হয়েছে লেখক, অভিনয় শিল্পী এবং পরিচালক শ্রেণীর লোকরা বিশ্বের সবচেয়ে অকৃতজ্ঞ। বানজ ও ম্যারিয়ন বলে উঠেছেন, আহা এরা যদি একটু সক্রিয় হতো, তাদের ভালো সুযোগের জন্য যদি একটু কৃতজ্ঞ হতো। তারা যদি নিজেদের তুলে ধরতে একটু চেষ্টা করত! একটু বিখ্যাত হলেই তারা কিভাবে যে এত পরিবর্তন করে ফেলে নিজেদের, বোঝা মুশকিল।

তাদের ধারণা ছবি সংশ্লিষ্ট এই নগণ্য, অকৃতজ্ঞরা যেন মধু তৈরির মৌমাছিদের প্রতি ক্রুদ্ধ ভিমরুলের মতো আচরণ করতে শুরু করে। আর এদের প্রকৃতিস্থ করতে ম্যারিয়ন-বানজ কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। কুড়ি সদস্যবিশিষ্ট একটি আইনজীবীর দল রেখেছেন বিদ্রোহীদের ওপর জাল ফেলার জন্য।

তারা সব সময় শুধু শুধু সমস্যার সৃষ্টি করবে কেন? কেন অসুখী থাকবে তারা সর্বদা? এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, যেসব মানুষ শিল্পের চেয়ে অর্থের পেছনে সবসময় ছুটতে থাকে তাদের সে ক্যারিয়ার দীর্ঘ হতে পারে, জীবনে প্রচুর আনন্দ ও উপভোগ করতে পারে কিন্তু মনের প্রশান্তি তাদের ক্রমেই দূরে সরতে থাকে। কিন্তু যারা সত্যিকার অর্থেই শিল্পের পূজারী তারা যেমন নিজেও স্বর্গীয় সুখ পায়, অপরকেও করতে পারে সুখী। শিল্প ছাড়া ছবি তৈরি হতে পারে কিন্তু তার মধ্যে প্রাণ থাকবে না, ভালোবাসা থাকবে না। আর মানুষও সেটা কিনতে আগ্রহী হবে না।

.

ববি বানজ ম্যানশনের বাইরে উৎসবমুখর আমন্ত্রিত অতিথিদের কনফারেন্স রুমে আসন গ্রহণের আহ্বান জানাল। এ আহ্বান থেকে বাদ গেল না একমাত্র মহিলা অতিথি ডিটা টমি। ডিটা টমি লডস্টোনের চলমান ছবি ম্যাসেলিনার পরিচালক।

ডিটা টমি একজন এ-ক্লাস পরিচালক এবং সমকামী নারী, অভিনেত্রীদের নিয়ে ছবি পরিচালনার তার সুখ্যাতি রয়েছে। আজকাল হলিউডে এই সমকামী শব্দটি প্রায় উঠেই গেছে। বৈধতা পেয়েছে সমলিঙ্গের যৌন বিনোদন। নারী সমকামীদের তাই এখন লেসবিয়ান না বলে ফেমিনিস্ট হিসেবে আখ্যা দেয়া হচ্ছে। ডিটা টমি নিজেও একজন সমকামী নারী। আর কনফারেন্স রুমে পুরুষদের ভিড়ে টমির উপস্থিতি অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে–একেবারেই বেমানান।

ডিটা টমি সবসময় বেশ কম বাজেটে ছবি তৈরি করে থাকে। ছবিগুলো প্রচুর অর্থও বয়ে নিয়ে আসে স্টুডিওর জন্য। সবচেয়ে সুবিধা হলো এই, তার ছবিতে নেয়া নারী অভিনেত্রীদের নিয়ে তাকে খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয় না, যা একজন পুরুষ পরিচালকের জন্য অত্যন্ত কষ্টের। আরেকটি বিষয় হলো ডিটা টমি তার সমকামী অভিনেত্রীদের দিয়ে খুব সহজে দৃশ্যের পর দৃশ্যে কাজ করিয়ে নিতে পারে।

কনফারেন্স টেবিলের শীর্ষস্থানীয় আসন দখল করে বসে আছেন এলি ম্যারিয়ন। তার পাশে ববি বানজ সম্মেলনের বিষয়াদি আলোচনা করছিল।

বানজ ডিটার উদ্দেশে বলল, স্টুডিওতে যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে আমাদের কি করা উচিত? এ বিষয়ে তোমার কোনো নিজস্ব চিন্তা থাকলে আমাদের বলো। এ সমস্যার মাথা-মণ্ডু কিছুই ঢুকছে না আমার মাথায়।

টমি আকারে একটু ছোটখাটো, তবে বেশ দৃঢ়তাসম্পন্ন, কথা বলে সবসময় যুক্তি দিয়ে। টমি বানজের কথার প্রতিউত্তরে বলল, অ্যাথেনাকে তার মৃত্যুভয় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। যতক্ষণ না আপনারা তার এই ভীতি দূর করতে সক্ষম হবেন, তার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে সক্ষম হবেন–আমার ধারণা, সে ততক্ষণ তার কাজে ফিরে আসতে পারবে না। আর সে যদি ফিরে না আসে তবে আপনাদের পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার নিশ্চিতভাবে গোল্লায় যাবে। সে ছাড়া ছবির কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।

একটু সময় নিল টমি। তারপর বলল, গত সপ্তাহে আমি তাকে নিয়ে কাজ করেছি। সেখানেও আমি আপনাদের সাশ্রয় করেছি।

দিস ফাকিং পিকচার টমির কথা শেষ না হতেই বানজ এক রকম উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলল, আমি কখনোই এটা বানাতে চাইনি।

ববি বানজের এই কথা উপস্থিত সকলের মনোযোগে আঘাত করল। প্রযোজক স্কিপি ডিরি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলল, ফাঁক ইউ ববি।

অ্যাথেনা অ্যাকুইটেনের এজেন্ট মেলো স্টুয়ার্ট ক্ষেপে গিয়ে ববির উদ্দেশে বিশেষণ ছুড়ল বুলশিট বলে।

সত্য কথা হলো ম্যাসেলিনা তৈরির জন্য সবাই খুব বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিল। এর কারণ ছবিটির কাহিনী প্রাচীনতম ঐতিহাসিক হলেও খুব সহজেই এটি ব্যবসায় সফলতা আনতে সক্ষম হবে–এই ভেবেই ছবিটি নির্মাণে সবুজ সংকেত দেয় প্রায় সবাই।

ম্যাসেলিনা ছবিটির কাহিনী প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের। তখন রোমের সম্রাট ছিলেন ক্লডিয়াস। সমকামী দৃষ্টিকোণ থেকেই ছবিটির বিষয়বস্তু মূলত প্রাধান্য পেয়েছে। তবে এই গল্পের লেখক একজন পুরুষ। লেখক যেভাবে লিখেছে–

সম্রাজ্ঞী ম্যাসেলিনা ছিলেন দুর্নীতিপরায়ণা, হন্তক এবং বহুগামী নারী। এক রাতে সম্রাজ্ঞী ম্যাসেলিনা রোমের সব মানুষকে যৌনাবেদনের মাধ্যমে বিপথে নিয়ে গিয়েছিলেন।

ঘটনাটি এমন হলেও ম্যাসেলিনা ছবির কাহিনী নির্মিত হয়েছে একটু ব্যতিক্রম করে প্রায় দুই হাজার বছর আগের ঘটনা। যেখানে ম্যাসেলিনাকে দেখানো হয়েছে একজন বিষাদগ্রস্ত নায়িকা হিসেবে। এ গল্পে ম্যাসেলিনা এমন একজন নারী যার অস্ত্র কেবল তার নারীত্ব। আর এই অস্ত্র কাজে লাগিয়ে সারা বিশ্বে পুরুষ কর্তৃত্বের অবসান ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। পরিবর্তন করা হয়েছে সামাজিক ব্যবস্থায়। নারীকে যারা শুধু যৌন সম্ভোগের বস্তু হিসেবে মনে করে থাকে এমন কর্তৃত্বের অবসানের লক্ষ্যই ছবি নির্মাণের মূল বিষয়বস্তু।

ছবির ধারণাটি চমৎকার-সম্পূর্ণ রঙিন ও যৌননির্ভর দৃশ্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং জনপ্রিয় বিষয়বস্তু। কিন্তু নিখুঁতভাবে সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু তুলে ধরাই হবে সাফল্যের ব্যাপার।

প্রথমে স্ক্রিপ্টটি লিখেছিল ক্লডিয়া ডি. লিনা–গল্পের নিখুঁত অনুসরণ করে চমৎকার একটি পাণ্ডুলিপি দাঁড় করায় সে। ডিটা টমি এই চিত্রনাট্যের চলমান দৃশ্য নির্মাণের দায়িত্ব পায়। প্রায়োগিক ও রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর ওপর ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে ডিটার নিযুক্তিও একেবারে সঠিক। সে হচ্ছে একজন শুষ্ক বুদ্ধিজীবী এবং পরীক্ষিত পরিচালক। এদিক থেকে অ্যাথেনা অ্যাকুইটেন ম্যাসেলিনা চরিত্রের জন্য আরো বেশি গ্রহণযোগ্য। পুরো ছবিতে তার চরিত্রটিই মূলত কর্তৃত্ব করেছে। অ্যাথেনার রয়েছে চেহারা ও শরীরের সৌন্দর্য, আর সেই সাথে তার অভিনয়ের দক্ষতা ও মেধা সবকিছুর পরিপূরক। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অ্যাথেনা সারা বিশ্বে সেরা তিন সুন্দরী ও মেধাবী অভিনেত্রীর একজন। এদিকে ক্লডিয়া নেপথ্যের সেরা একজন জিনিয়াস। ম্যাসেলিনা চরিত্রটিকে অ্যাথেনার উপযোগী করে তুলতে চমৎকার সব কাজ অন্তর্ভুক্ত করেছে তার পাণ্ডুলিপিতে।

কনফারেন্স কক্ষের সভায় স্কিপি ডিরি বলল, অ্যাথেনাকে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত ছবির কাজ আমাদের বন্ধই রাখতে হবে। তবে এর জন্য প্রতিদিন আমাদের প্রায় দেড়শ ডলার পরিমাণ বড় অংকের ভর্তুকি দিতে হবে।

এই হচ্ছে এখন অবস্থা। ইতিমধ্যেই আমরা ব্যয় করেছি পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার আর এদিক থেকে কাজের অগ্রগতি কেবল মাঝপথে। আমরা নতুন স্ক্রিপ্ট তৈরি করে অ্যাথেনাকে বাদও দিতে পারব না, আবার তার মতো আরেক অ্যাথেনা তৈরি করতে পারব না। এ অবস্থায় সে যদি আর ফিরে না আসে তবে এ পর্যন্ত নির্মিত ছবি আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

এ ছবি বাতিল করতে পারি না আমরা, বানজ বলল। তারকাদের কাজ করতে অস্বীকৃতির বিষয়ে ইস্যুরেন্স কোনো পদক্ষেপই নিতে চাইবে না। যদি তাকে প্লেন থেকে ফেলে দিই, সেক্ষেত্রে ইন্স্যুরেন্স এগিয়ে আসবে।

এবার মেলোর দিকে তাকিয়ে বানজ বলল, মেলো তাকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্বটা তোমার। অ্যাথেনার সব দায়-দায়িত্ব তোমাকেই বহন করতে হবে।

মেলো স্টুয়ার্ট বলল, আমি শুধুমাত্র তার এজেন্ট। তার মতো নারীর প্রতি আমার আগ্রহ আছে। আমি বলতে চাই অ্যাথেনার আতঙ্কিত হয়ে ওঠার বিষয়টি জেনুইন। বিষয়টি তোমার বোধগম্য হবে না হয়তো। কেননা তুমি সে প্রকৃতির নও। সে সত্যিই আতঙ্কিত, তবে সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। এক্ষেত্রে বুঝতে হবে আকস্মিক এই আচরণের নিশ্চয়ই কারণ আছে। পরিস্থিতি সত্যিই বেশ ভয়াবহ ও সঙ্কটপূর্ণ।

বানজ বলল, এই শত মিলিয়ন ডলারের ছবিটি যদি তার জন্য নস্যাৎ হয়ে যায়, তবে সে আরো কখনোই ফিরে আসতে পারবে না, সে কি এটা জানে?

খুব ভালো করেই জানে।

বানজ এবার বলল, এমন কেউ কি নেই যে তাকে ফিরিয়ে আনতে পারে। স্কিপি, তুমিও তো চেষ্টা করেছ, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছ। মেলো, তুমিও চেষ্টা করেছ। ডিটা, আমি জানি, তুমি তোমার সাধ্যমতো তাকে বুঝিয়েছ। এমনকি আমিও। আমাকেও সে প্রত্যাখ্যান করেছে।

বানজের প্রতি উত্তরে টমি বলল, ববি, তুমি তো গুনতিতেই পড়ো না। সে তোমাকে ঘৃণা করে।

বানজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। বলল, অবশ্যই, অনেকেই আমার কথা বলার ধরণ পছন্দ করে না। তবে তারা আমার কথা শোনে।

টমির কণ্ঠে সহানুভূতি। সে বলল, এমন কোনো ট্যালেন্ট নেই যে তোমাকে পছন্দ করে না। কিন্তু অ্যাথেনার বিষয়টি আলাদা। সে তোমাকে ব্যক্তিগতভাবেই ঘৃণা করে।

বানজ বলল, অথচ আমিই তাকে স্টার বানিয়েছি।

মেলো স্টুয়ার্ট শীতল কণ্ঠে বানজের বিরোধিতা করে বলল, সে জন্মগত একজন স্টার। তুমিই বরং তাকে পেয়ে ধন্য হয়েছ।

বানজ ডিটার উদ্দেশে বলল, তুমি তো তার বন্ধু। তাকে কাজে ফিরিয়ে আনার কাজটুকু তুমিই করো।

অ্যাথেনা আমার বন্ধু নয়, টমি বলল। সে আমার একজন সহকর্মী। সে আমাকে শ্রদ্ধা করে। এর কারণ আমিই তাকে তৈরি করেছি। সে যখন আমার প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে আমি খুব মর্মাহত হয়েছি। আমি তোমার মতো নই, ববি। তুমি বছরের পর বছর চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারো।

বানজ আর ধরে রাখতে পারল নিজকে। ডিটার উদ্দেশ্যে বলল, হু দি হেল ইজ নট টু ফাঁক আজ।

এলি ম্যারিয়নকে উদ্দেশ্য করে বলল, আইনের আশ্রয় নেয়া ছাড়া উপায় নেই। তোমাকে এর একটা বিহিত করতে হবে।

উপস্থিত সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো কনফারেন্স টেবিলের সবচেয়ে বয়োজ্যষ্ঠ এলি ম্যারিয়নের দিকে। এতক্ষণের আলোচনায় ম্যারিয়ন বেশ বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। তার বিশাল মাথাটা নড়াচড়া করছিল উপস্থিত অতিথিদের দিকে। এ মুহূর্তে তার মাথা আরো বড় মনে হচ্ছিল। তার এই বড় মাথার জন্য কোনো এক স্টার জোক করে বলেছিল– তার মাথাটা একটু হেঁটে নেয়া দরকার।— এই মন্তব্যে যতটা না ছিল জোক, তার চেয়ে বেশি ছিল বিদ্বেষ।

ম্যারিয়নকে দেখতে অনেকটা গরিলার মতো। তবে বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ সে– ছড়ানো নাক, মাংসল ঢাউস মুখ। কনফারেন্স টেবিলে তিনি অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক চেহারা নিয়ে বসে আছেন। অত্যন্ত ভদ্র অবয়ব তার, শারীরিক বৈশিষ্ট্যে হ্যান্ডসাম না বলে উপায় নেই। তবে তার চোখ দুটো কিন্তু ব্যক্তিত্বের উৎস। শীতল-ধূসর চোখ দুটোতে একটা বুদ্ধিমত্তার ছাপ এবং তা যে কোনো মানুষের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম। আরেকটি বিষয় হচ্ছে তিনি তার ফার্স্ট নেমটি লোকমুখে শুনতে পছন্দ করেন।

ম্যারিয়নের কন্ঠে কোনো আবেগ প্রকাশ পেল না। তিনি বললেন, অ্যাথেনা যদি আপনাদের কারো কথাই কর্ণপাত না করে, তবে সে আমার কথাতেও একই উত্তর দেবে। আমার যে অবস্থান তাতে তাকে ইমপ্রেস করার প্রচেষ্টা মানায় না। তবে একজন বোকা টাইপের বিবেকহীন লোকের হামলায় অ্যাথেনার আতঙ্কিত হওয়ার বিষয়টি আমার কাছে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। আমরা কি অন্য কোনো পথের কথা চিন্তা করতে পারি না?

আমরা চেষ্টা করব, বলল বানজ। তবে অ্যাথেনার মনোভাবের খুব একটা পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।

প্রডিউসার স্কিপি ডিরি বলল, আমরা অন্যভাবেও, বিশেষ করে পুলিশ প্রয়োগ করে অ্যাথেনার আটককারীকে শায়েস্তার চিন্তা করে দেখেছি। এতেও ব্যর্থ হয়েছি। কারণ বিষয়টি খুব সহজ নয়। তার বাবার আছে অঢেল টাকা ও রাজনৈতিক যোগাযোগ।

স্টুয়ার্ট প্রশ্ন করল, এই ছবিটি যদি আমরা বাতিল করে ফেলি তবে স্টুডিওর ঠিক কতটা ক্ষতি হতে পারে? একটু থেমে তার কণ্ঠে প্রতিশ্রুতির সুর ভেসে এলো, স্টুডিওর পরবর্তী কাজে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব যেন এই ক্ষতি পুষিয়ে যায়।

স্টুডিওর ক্ষতির বিষয়টি স্টুয়ার্ট মেলোর কাছে মেলে ধরাটা একটা সমস্যা। বিশেষ করে অ্যাথেনার এজেন্ট হিসেবে তো এটা প্রকাশ করা বোকামি। ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ প্রকাশ পেলে সুবিধে হবে অ্যাথেনার, এমনটি স্টুয়ার্টেরও। ম্যারিয়ন মেলোর প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না, তবে এ বিষয়ে বানজের মতামতের প্রতিই আগ্রহ ছিল তার। ম্যারিয়ন কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালেন বানজের দিকে।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও বানজ মুখ খুলল, প্রকৃত ব্যয়ের হিসাব পঞ্চাশ মিলিয়ন। ঠিক আছে, মেনে নিলাম যে আমরা এর পুরোটাই পেটে ঢুকিয়েছি। কিন্তু বিদেশী সংস্থাগুলোকে তো তাদের অর্থ ফেরত দিতে হবে, ফেরত দিতে হবে ভিডিও কোম্পানিগুলোকে। তাছাড়া ক্রিসমাসের কোনো লোকোমটিভও আমাদের হাতে এখন নেই। এটা ভিন্নভাবে আমাদের কৌশলগত দিক দিয়ে ক্ষগ্রিস্ত করবে।

কি যেন একটা ভাবল বানজ–কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তার পর বলল, আমরা যদি লাভের দিকটা দেখি তবে সব মিলিয়ে দুশ মিলিয়ন ডলার। এই বিশাল পরিমাণ অর্থ পুষিয়ে দিতে তোমার কি যথেষ্ট প্যাকেজ আছে মেলো?

স্টুয়ার্ট মেলো হেসে উঠল। তার এই হাসির কারণ স্টুডিওর কর্ণধাররা অ্যাথেনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব মেলোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছে। মেলো বলল, প্রকৃত অর্থ তোমাদের কাছ থেকে বেরিয়েছে, তোমাদের হিসেবে পঞ্চাশ মিলিয়ন।

ম্যারিয়নের স্বর কঠিন হয়ে উঠল। কণ্ঠের ভদ্র ভাবও কেটে গেল। ম্যারিয়ন প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠলেন, মেলো, তুমি এই পরিমাণ অর্থের কতটা তোমার ক্লায়েন্টের কাছ থেকে নিয়ে দিতে পারবে?

সবাই বুঝতে পারল কি হতে যাচ্ছে। ম্যারিয়ন সিদ্ধান্ত নিলেন, এমন চাপ সৃষ্টি করে যদি কিছু উদ্ধার করা যায়।

স্টুয়ার্টও ভালো করেই বুঝল–এই ছোট্ট স্কিমের জন্য তাকে কতটা কাঠ খড় পোড়াতে হবে। বানজের সামনে খরচের হিসাব চাওয়া এবং পরবর্তীতে পুষিয়ে দেয়ার বিষয়টি উত্থাপন ছিল মেলোর একটা ন্যায়পরায়ণতা, কিন্তু এর জন্য যে তাকেই এর মাশুল দিতে হবে–এমন অভিপ্রায় নিশ্চয়ই ছিল না তার। সঙ্কটপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে ম্যারিয়নের সাথে, যদি বানজের সাথে ঘটত, তবে নিঃসন্দেহে রুষ্ট আচরণ করত মেলো।

মুভি ওয়ার্ল্ডে স্টুয়ার্ট মেলোও একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি। ম্যারিয়নকে তোয়াজ করে চলার মতো লোক সে নয়। হলিউডে তার নিজের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পাঁচ-পাঁচটি এ ক্লাস পরিচালক। তারা শুধু ব্যাংকেবল স্টারই নয়, অত্যন্ত শক্তিশালীও। এদের মধ্যে রয়েছে দুজন ব্যাংকেবল পুরুষ তারকা ও একজন নারী— অ্যাথেনা। আর এমন স্টার থাকার অর্থ সে যে কোনো সময় যে কোনো ছবির জন্য সবুজ সংকেতের সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু নেপথ্যে যার এত ক্ষমতা, সে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেই যাচ্ছে ম্যারিয়নের প্রতি। ম্যারিয়নের ক্ষুব্ধতায় সেও প্রতিউত্তর দেয়নি। আর এমন মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করার কারণেই সে ধীরে ধীরে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে।

মেলো স্টুয়ার্টের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার বিচক্ষণতা। সে যা দেবে তা সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করে। তার বিশ্বাস আছে অ্যাথেনার মেধার প্রতি দশ বছর আগেও, অ্যাথেনা যখন এ জগতে অপরিচিত মুখ, তখনও তার বিশ্বাস ছিল অ্যাথেনার মেধায়। এখনও আছে আগের মতোই। তবে কিভাবে তার মনোভাব পরিবর্তন করে ক্যামেরার সামনে নিয়ে আসবে? মেলোর মন বলছে– নিশ্চিতভাবেই অ্যাথেনা কোনো বিশেষ সমস্যার মধ্যে আছে। আরো এই সমস্যার জন্য তার মতো মেধাবীকে শেষ হতে দেয়া যায় না।

এখানে অর্থের কোনো বিষয় নয়, স্টুয়ার্টের কণ্ঠে প্রচণ্ড ভাবাবেগ ফুটে উঠল। সে নিজেই উপলব্ধি করল তার বিচক্ষণতার উল্লাস। বলল, তোমরা অ্যাথেনাকে অতিরিক্ত এক মিলিয়নের প্রস্তাব দাও। আমার মনে হয় সে আর ফিরে যাবে না। তোমাদের অবশ্যই সেই দীর্ঘ দিন ধরে অনুপস্থিত তথাকথিত স্বামী সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করতে হবে।

স্টুয়ার্ট মেলোর কথাগুলো যেন অমঙ্গলসূচক বার্তা বয়ে আনল- সারা ঘরে পিনপতন নীরবতা। সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিল মেলোর কথাগুলো। যেখানে উপস্থাপন করা হয়েছে আরো কিছু অর্থের বিনিয়োগ। এটাই কি তাহলে অ্যাথেনাকে আটকানোর প্রারম্ভিক গোজ?

স্কিপি ডিরি বলল, সে টাকা চায় না।

ডিটা টমি গজগজ করে উঠল। স্টুয়ার্টের প্রতি ডিটার মোটেও আস্থা নেই। বিশ্বাসও করে না তাকে। তবে এই অর্থ তো আর তার পকেট থেকে যাচ্ছে না। বানজ বিস্ফারিত চোখে তাকাল স্টুয়ার্টের দিকে। কিন্তু স্টুয়ার্ট সূক্ষ্ম দৃষ্টি হেনে যাচ্ছিল ম্যারিয়নের ওপর। অত্যন্ত শীতল চোখে তাকিয়ে ছিল স্টুয়ার্ট।

স্টুয়ার্টের যুক্তিকে যথাযথ মনে করলেন ম্যারিয়ন। তার বিশ্লেষণে স্টুয়ার্টকে সঠিক বলেই মনে হলো। কিন্তু অ্যাথেনা কি ফিরে আসবে? টাকার জন্য অ্যাথেনা ফিরে আসবে না। ট্যালেন্টরা খুব বেশি চালাক হয় না। ম্যারিয়ন সভার এখানেই সমাপ্তি টানার সিদ্ধান্ত নিলেন।

তিনি বললেন, মেলো, খুব সতকর্তার সাথে তুমি তোমার ক্লায়েন্টের কাছে ব্যাখ্যা দেবে। এতে যদি সে এক মাস সময়ের মধ্যেও ফিরে না আসে তবে স্টুডিও এ ছবি বাতিল করবে। তারপর সে যা এ পর্যন্ত অর্জন করেছে তার সব কিছু আমরা কেড়ে নেব। সে অবশ্যই অবগত আছে যে, এরপর সে আমেরিকার কোনো বড় স্টুডিওতে কাজ করতে পারবে না।

কথাগুলো বলেই টেবিল ঘিরে বসে থাকা অতিথিদের দিকে তাকিয়ে রক্তশূন্য হাসি হাসলেন। বললেন, যা গেল, তা মাত্র পঞ্চাশ মিলিয়ন।

উপস্থিত সবাই বুঝতে পারল ম্যারিয়ন এ বিষয়ে আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন এবং নিশ্চিতভাবেই এ ছবি আর হবে না। তবে ডিটা টমি ম্যারিয়নের এমন মন্তব্যে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। একটি ছবিকে টমি অন্য সবার চেয়ে আলাদা চোখে দেখে থাকে। তার কাছে একটি ছবি তার সন্তানের মতো। ছবিটি যদি সফল হতো তবে টমিও ব্যাংকেবল পরিচালকদের সারিতে উঠে আসত।

টমি বলল, ক্লডিয়া ডি লিনাকেই এই প্রস্তাবের জন্য পাঠানো সমীচীন হবে। ক্লডিয়া অ্যাথেনার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম।

ববি বানজ অনিশ্চয়তার সুরে বলল, আমি বুঝতে পারছি না আসলে আমাদেরকে কোন চুলোয় যেতে হচ্ছে। একজন স্টার সবাইকে লাইনচ্যুত করে ফেলেছে। তার সাথে আবার লেখকের বন্ধুত্ব! ফাকিং স্টার! শ্লেষ ঝাড়ল বানজ।

একথায় ম্যারিয়ন আরো অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। ববি, এমন একটি বাণিজ্যিক সভায় অপ্রাসঙ্গিক কথা কখনো বলবে না। ক্লডিয়াকে তার সাথে কথা বলতে দাও। তবে এটাকে এক রকম মুড়েই রাখো। আমাদের অন্য ছবির জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।

কিন্তু পরের দিন লডস্টোন স্টুডিওর নামে একটি পাঁচ মিলিয়ন ডলারের চেক এসে পৌঁছল। চেকটি পাঠিয়েছে অ্যাথেনা অ্যাকুইটেন। ম্যাসেলিনাতে অভিনয়ের জন্য অ্যাথেনা যে অর্থ অগ্রিম নিয়েছিল তা সে ফেরত পাঠিয়েছে।

এখন ব্যাপারটি সম্পূর্ণ চলে গেল লয়ারদের হাতে।

.

পশ্চিম উপকূলের স্বনামখ্যাত নিরাপত্তা সংস্থা প্যাসিফিক ওশেন সিকিউরিটি কোম্পানি। মাত্র পনেরো বছরে এন্ড্রিও পোলার্ড সংস্থাটি গড়ে তুলছেন। তার কর্মজীবনের শুরু হয় একটি হোটেলের সুইটে। সেই থেকে পোলার্ড এখন সান্তা মনিকায় চার তলা ভবনের মালিক। সেখানে তার রয়েছে পঞ্চাশ জন হেড কোয়ার্টার স্টাফ। এছাড়াও প্রায় পাঁচশ জনের মতো ইনভেস্টিগেটর ও গার্ড যারা যে কোনো কন্ট্রাক্টের সহযোগী– তাদেরকে ফ্রি-লান্স স্টাফ হিসেবে গণ্য করা হয়। আরো রয়েছে একদল ভাসমান রিজার্ভ গ্রুপ। এরা বছরের বিশেষ শুভ অংশে এন্ড্রিও পোলার্ডের জন্য কাজ করে থাকে।

প্যাসিফিক ওশেন সিকিউরিটি সংস্থাটি এর সার্ভিসের জন্য বিখ্যাত এবং যথেষ্ট ব্যয়বহুল। কর্ণধারদের বাড়ি-ঘরের নিরাপত্তা বিধানে সংস্থা রীতিমতো সশস্ত্র রক্ষী ও সাথে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসেরও যোগান দিয়ে থাকে। প্রযোজক ও তারকা শিল্পীদের জন্য এদের আছে দক্ষ দেহরক্ষীর ইউনিট। একাডেমি অ্যাওয়ার্ড কিংবা বড় কোনো ফ্যাস্টিভেলের উচ্ছল জনতার ঢল নিয়ন্ত্রণে আনতে অত্যন্ত শক্তিশালী ইউনিফর্ম কর্মীরও সরবরাহ দিয়ে থাকে। এছাড়া ব্ল্যাকমেইলিং কিংবা এ ধরনের সঙ্কট নিরসনে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের দক্ষদের যোগান দিয়ে তদন্তমূলক কাজের সুষ্ঠু সমাধার ক্ষেত্রেও সংস্থাটির যথেষ্ট সুনাম রয়েছে।

এন্ড্রিও পোলার্ডের এত সুখ্যাতির কারণ সে যে কোনো দায়িত্ব পালনে নিখুঁত এবং তার কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণমূলক। তার কোনো ধনী ক্লায়েন্টের বাড়িতে নিরাপত্তা বিধানে সে প্রথমেই যেটা করবে তা হলো– আর্মড রিসপন্স সাইন মাটিতে বসিয়ে দেবে। এতে রাতের আঁধারে কোনো অস্ত্রবহনকারী গুপ্তঘাতক এলে মাটিতে পেতে রাখা ডিভাইসগুলো সাথে সাথে রঙিন আলো জ্বেলে সিগন্যাল দিতে থাকবে। এছাড়া ম্যানশনে ওয়াল ঘিরে নিরাপত্তারক্ষীদের টহল তো থাকবেই।

পোলার্ড তার কর্মীদের যথেষ্ট ভাতা দিয়ে থাকে। এর কারণ তাদের জীবন সবসময় হুমকির মুখে। যে কোনো ঘাতকের আক্রমণে তার কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে মৃত্যুর আশঙ্কাও অমূলক নয়। তবে তার ক্লায়েন্টরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রভাবশালী ক্ষমতাবান ও অর্থ সম্পদের মালিক। লস অ্যাঞ্জেলেসের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের খুব কাছাকাছি থেকে কাজ করার সুবিধাও সে চতুরতার সাথে আদায় করে নেয়। এক্ষেত্রে তাকে পুলিশের সাথেও সদ্ভাব গড়ে নিতে হয়েছে। ডিপার্টমেন্টের একেবারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নিম্নমান পুলিশের সাথেও তার ও তার সংস্থার রয়েছে ভালো সম্পর্ক-আর এখানেই তার শতভাগ কৃতিত্ব।

এন্ড্রিও পোলার্ডের লস অ্যাঞ্জেলেসের খ্যাতিমান গোয়েন্দা জিম লুজির সাথেও ভালো সম্পর্ক রয়েছে–তাদের সম্পর্কটা ব্যবসায়িক। একে-অপরের পরিপূরক হিসেবেও বিবেচিত। জিম লুজি প্রকৃতই একজন গোয়েন্দা হিরো। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে-ক্লেরিকুজিও পরিবারের মদদপুষ্ট।

পনেরো বছর আগের কথা। তখন পোলার্ড ছিল একজন সামান্য পুলিশ কর্মকর্তা— খুব স্বাভাবিকভাবেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার অসচেতনতা ছিলই। নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের চক্রান্তেও পড়তে হয়েছিল তাকে। পোলার্ডের অপরাধ খুব বড় ছিল না তবে তা একেবারে উপেক্ষা করার উপায়ও ছিল না। যে ঘটনাটি তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল পোলার্ড তা সরাসরি অস্বীকার করে। তবে বিষয়টি তার ঊর্ধ্বতন বসকে না জানানোটা ছিল একটা বড় ভুল। এ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ সমস্ত খবরাখবর জানত ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলি। পোলার্ডের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে তারা। আইনজীবী নিযুক্ত হয়। মোটকথা ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে, অবশেষে এন্ড্রিও পোলার্ড রক্ষা পায় নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের নিশ্চিত পানিশমেন্টের হাত থেকে। তবে সে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়।

নিউইয়র্ক সিটি থেকে পোলার্ড তার স্ত্রী ও শিশুসহ চলে আসে লস অ্যাঞ্জেলেসে। আজকের এই বিশাল প্যাসিফিক ওশেন সিকিউরিটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পেছনে শতভাগ অবদান ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির। লস অ্যাঞ্জেলেসে আসার পর ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলি তাকে এই প্রতিষ্ঠান তৈরির জন্য অর্থ সহযোগিতা দিয়েছিল– সহযোগিতা করেছিল পুঙ্খানুপুঙ্খ। সেই সাথে সাবধানও করে দিয়েছিল এই বলে যে, তার ক্লায়েন্টরা যেন তার সংস্থার লোকদের কাছে কখনো উৎপীড়নের শিকার না হয়। তাদের বাড়ি-ঘরে চৌৰ্য্য বৃত্তির ঘটনা যেন না ঘটে, সংস্থার কারণে তাদের ক্লায়েন্টরা যেন বিপদগ্রস্ত বা ফাঁদে না পড়ে। কোনো রকমের জুয়েলারি বা অর্থ আত্মসাতের ঘটনাও যাতে না ঘটে। নিরাপত্তাজনিত কারণে যদি ক্লায়েন্টের অগোচরে সেসব সরাতেও হয়, তবে তা যেন আবার ফিরিয়ে দেয়া হয়। ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির এমন সতর্কতামূলক শর্ত আরোপের কারণ— যে আর্মড রিসপন্স সাইন সংস্থা অপরাধীদের জন্য পেতে রাখবে, তাতে যেন তারা নিজেরাই আটকে না পড়ে। অর্থাৎ রক্ষক যদি ভক্ষক হয় তবে সংস্থাটির অঙ্কুরেই বিনাশ ঘটবে।

ম্যাজিকের ছোঁয়ায় যেন সফলতা পেয়েছিল এন্ড্রিও পোলার্ড। ক্লেরিকুজিও’র শর্তের কখনো লঙ্ঘন হয়নি। ক্লায়েন্টদের নিরাপত্তা রক্ষা ছাড়া কখনো তাদের একটি জিনিসও স্পর্শ করেনি পোলার্ডের লোকরা। তার সংস্থার দেহরক্ষীরা এফবিআইয়ের মতো উন্নত ও অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাই কোম্পানির বিরুদ্ধে কখনো কোনো বিরূপ মন্তব্যও করেনি কানো ক্লায়েন্ট। তার সদস্যদের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের কোনো নালিশ নেই, সে শিশুই হোক আর নারী। যা কিছু করেছে সংস্থা, শুধুমাত্র নিরাপত্তার জন্য। তবে ব্ল্যাকমেইল কিংবা গুপ্তচরবৃত্তির মতো কিছু অভিযোগ এসেছিল ক্লায়েন্টের কাছ থেকে সেসব যথাযথ শুরুত্বের সাথে পরখ করা হয়েছে–অপরাধীকে দেয়া হয়েছে শাস্তি। মোটের ওপর পোলার্ড ছিল সর্বদা নিষ্কণ্টক, পরিচ্ছন্ন।

এদিকে পোলার্ডের কোম্পানির কাছে ছিল বিভিন্ন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বৃত্তান্ত। এগুলো কম্পিউটারের মাধ্যমে সংরক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত হতো। তবে তা সর্বদা গোপন রাখা হতো। কেবল একটি ক্ষেত্রে এসব সংরক্ষিত ডাটার গোপনীয়তা লঙ্ঘন হতো। আর সেটি ক্লেরিকুজিও’র ক্ষেত্রে। শুধুমাত্র ক্লেরিকুজিও’র কাছেই এসব ডাটা সরবরাহ করার নিয়ম ছিল। পোলার্ডের ক্লেরিকৃজিও ফ্যামিলির কাছে পোলার্ড ছিল অতিমাত্রায় কৃতজ্ঞ। যদি কেউ তার কাছে চাকরির জন্য আসত, পোলার্ড সরাসরি ক্লেরিকুজিও’র পশ্চিমাঞ্চলীয় ব্ৰুগলিওনের কাছে তাদের বৃত্তান্ত ও দরখাস্ত পাঠিয়ে দিত। সেখানকার অনুমোদনের পর শক্তিশালী অস্ত্রসহ তাদের নিয়োগ দেয়া হতো।

একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের পরদিন এন্ড্রিও পোলার্ডের ডাক পড়ল ববি বানজের অফিসে।

বজ স্কানেটের চরিত্রের সব তথ্য উঘাটনের দায়িত্ব আমি তোমাকে দিতে চাই, বানজ পোলার্ডের উদ্দেশে বলল। আমি অ্যাথেনা অ্যাকুইটেনের ব্যাক গ্রাউন্ডও জানতে চাই। একজন বড় তারকা হিসেবে তার সম্পর্কে খুব সামান্য তথ্যই আমাদের কাছে আছে। আর বজ স্কানেটের সাথে একটি চুক্তির পরিকল্পনা করছি আমরা। আসলে আমরা চাই আগামী তিন থেকে ছয় মাস অ্যাথেনা আমাদের স্টুডিওর ছবিতে নির্বিঘ্নে কাজ করুক। এ সময়টায় যাতে স্কানেট অ্যাথেনার কাছ থেকে দূরে থাকে, সে চেষ্টাই চালাব আমরা তার সাথে চুক্তি করে। এর জন্য, প্রথমে প্রতি মাসে কুড়ি গ্রান্ডের অফার করবে, তবে তুমি সর্বোচ্চ একশ পর্যন্ত যেতে পারো।

কিন্তু এর পরেও যদি সে কিছু চায়? কণ্ঠে সন্দেহের সুর তুলে বলল পোলার্ড।

এর পরের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের, বানজ বলল প্রতিউত্তরে। তোমাকে কিন্তু খুব সতর্ক থাকতে হবে এন্ড্রিও। অত্যন্ত ক্ষমতাবান পরিবারের লোক সে। মনে রেখো, মুভি ইন্ডাস্ট্রির ওপর যেন কোনো রকমের আঁচ না লাগে। তাহলে ছবি তো ধ্বংস হবেই, স্টুডিও-ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একটু থামল বানজ। এরপর বলল, আমরা অ্যাথেনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য তোমার সংস্থাকে ব্যবহার করতে চাই।

পোলার্ডের পাল্টা প্রশ্ন, যদি স্কানেট তোমাদের সাথে চুক্তিতে সম্মত না হয়…?

তাহলে অ্যাথেনার দিবা-রাত্রী নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকবে তোমার। ছবির কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমরা এ দায়িত্ব পালন করে যাবে। বলল বানজ।

ঠিক আছে, আমি স্কানেটের ওপর খুব সামান্যই চাপ প্রয়োগ করব, পোলার্ড বলল। তবে অবশ্যই তা বৈধ উপায়েই। তাকে কোনো বিষয়ে উপদেশও দেব না।

বানজ বলল, খুব উপরের স্তর পর্যন্ত তার যোগাযোগ আছে। পুলিশ বিভাগ তাকে একটু বাঁকা চোখেই দেখে। এমন কি জিম লুজিও তাকে ঘাঁটতে চায় না। তার মানে এই নয় যে, তুমি তার সাথে একেবারে ফুলের মতো আচরণ করো, কিন্তু…।

পোলার্ড যা বোঝার বুঝে গেল। অর্থাৎ একজনকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে বেড়াতে হবে, অবশ্য এজন্য তার চাহিদার প্রতি নজরও দেয়া হবে।

পোলার্ড বলল, আমার সেই চুক্তিটি প্রয়োজন।

বানজ তার ডেস্কের ড্রয়ার খুলে একটি খাম বের করল। তারপর পোলার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে তিনটি কপি আছে। তাকে সবগুলোতে স্বাক্ষর করতে হবে। আর এর বিনিময়ে ডাউন-পেমেন্ট হিসেবে আছে পঞ্চাশ হাজার ডলারের একটি চেক। চুক্তির জন্য ডলারের পরিমাণ উন্মুক্তই রাখা হলো। শুধু সে চুক্তিতে সম্মত হলেই তুমি এই ফরমগুলো পূরণ করবে।

পোলার্ড চুক্তিপত্রের খামটি নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলো। পিছু ডাকল বানজ, একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের দিন তোমার লোকেরা নিষ্ক্রিয় ছিল। তারা তাদের অথর্ব পাগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছিল।

পোলার্ড বানজের বিরোধিতা করল না। কারণ বানজকে সে চেনে ভালোভাবেই। শুধু বলল, তারা ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য নিযুক্ত গার্ড ছিল চিন্তা করো না, মিস অ্যাকুইটেনের জন্য আমি সর্বোচ্চ ক্রু নিয়োগ করব।

মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে প্যাসিফিক ওশেন সিকিউরিটির কম্পিউটারে বজ স্কানেটের সমস্ত তথ্য সংগ্রহ হয়ে গেল। স্কানেটের বয়স চৌত্রিশ বছর। টেক্সাস-এ অ্যান্ড এম থেকে গ্র্যাজুয়েট। সেখানকার অল-স্টার নামে একটি দলের পৃষ্ঠপোষক এবং একটিমাত্র মৌসুমে ফুটবলের প্রফেসনাল খেলোয়াড়। হাস্টনে তার বাবার রয়েছে একটি ব্যাংক। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তার এক চাচা টেক্সাসে রিপাবলিকান দলের প্রধান। শুধু তাই নয়, প্রেসিডেন্টের সাথেও তার চাচার রয়েছে খুব আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সব মিলিয়ে তারা অঢেল অর্থের মালিক।

বাবার ব্যাংকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদবিপ্রাপ্ত হওয়ার সুবাদে তেল ইজারা বিষয়ক এক কেলেঙ্কারি থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যায় স্কানেট। বিভিন্ন মার দাঙ্গা গুণ্ডামির জন্য তাকে এ পর্যন্ত ছয়বার অ্যারেস্ট করা হয়েছে। এর মধ্যে একবার স্কানেট দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে এমনভাবে পিটিয়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত তাদের গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। এসব ঘটনার জন্য তাকে কখনো আদালতে যেতে হয়নি। কারণ ঘটনার পর পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাদের পুষিয়ে দিয়েছে। তার ছয়টি গ্রেফতারের মধ্যে একটি ছিল যৌন নিপীড়নের ঘটনায় অভিযুক্ত।

স্কানেটের এই উচ্ছল জীবন ছিল অ্যাথেনা অ্যাকুইটেনকে বিয়ে করার আগে। অ্যাথেনার সাথে বিয়ের পর এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়নি– অন্তত বিয়ের এক বছরে তাদের কন্যা সন্তান ব্যাথেনি জন্মের কয়েক মাস পর্যন্ত। অ্যাথেনা তার কুড়ি বছর বয়সে কন্যা সন্তান ব্যাথেনিকে নিয়ে স্কানেটের ঘর ছেড়ে চলে আসে।

স্কানেট সম্পর্কিত এই তথ্যগুলো ছবির মতো স্পষ্ট হয়ে গেল এড়িও পোলার্ডের কাছে। খুব খারাপ মানুষ হিসেবেই চিহ্নিত হলো স্কানেট, পোলার্ডের চোখেও! পোলার্ডের দৃষ্টিতে স্কানেক্ট এমন একজন মানুষ যে দশ বছর ধরে অ্যাথেনার ওপর হিংসা-বিদ্বেষ মনে মনে পোষণ করে আসছে। এমনই এক মানুষ যে সশস্ত্র পুলিশকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। এই ধরনের মানুষকে ভীতি প্রদর্শন করে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানোর সুযোগ একেবারে নেই বললেই চলে। তাকে অর্থ দিয়ে, চুক্তি সই করিয়ে দূরে সরিয়ে রাখা এতই কি সহজ?

জিম লুজির শরনাপন্ন হলো পোলার্ড। লস অ্যাঞ্জেলেসে লুজি আগে স্কানেটের কেস নিয়ে কাজ করেছে। লুজি ও পোলার্ডের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আছে যথেষ্ট, আর তাদের মধ্যে আছে সংশ্লিষ্ট কাজের সম্পর্ক। প্রত্যেক ক্রিসমাসে লুজি একটি হ্যান্ডসাম উপহার পেয়ে থাকে পোলার্ডের প্যাসিফিক ওশেন সিকিউরিটি থেকে। যেহেতু তারা একে-অপরের পরিপূরক, পোলার্ড সেই সম্পর্ককে কাজে লাগাতে চায়। স্কানেটের ওপর চলমান মামলা ও তার ব্যক্তিগত জীবনের আরো বিস্তারিত জানতে চায় পোলার্ড।

জিমের উদ্দেশে পেপালার্ড বলল, বজ স্কানেটের বিস্তারিত তথ্য তুমি কি আমাকে দিতে পারবে? তার লস অ্যাঞ্জেলেসের ঠিকানাও আমার প্রয়োজন এবং আমি তার সম্পর্কে আরো জানতে চাই।

অবশ্যই, লুজির প্রতিউত্তর। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে কোনো অভিযোগ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। তুমি কেন এ বিষয়ে এগুচ্ছ?

প্রতিরক্ষার দায়িত্ব, পোলার্ডের বিস্মিত উত্তর, কি ভয়াবহ এই লোকটি?

সে মারাত্মক ধরনের উচ্ছল, জিম বলল। তোমার দেহরক্ষীদের বলে দিও, সে কাছাকাছি এলেই যেন তারা গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করে।

আর এই অপরাধে তুমি আমাকে অ্যারেস্ট করো আর কি? পোলার্ড রসিকতা করে বলল। এটা আইনবিরুদ্ধ কাজ।

তা আমি ভালো করেই জানি, লুজিও হাসল। পারলে তা-ই করতাম। তবে তোমার সাথে একটু জোক করলাম আর কি।

সান্তা মনিকায় একটি ছোটখাটো হোটেল ওশেন এভিনিউয়ে উঠেছে বজ স্কানেট। এটিই পোলার্ডের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ম্যালিবু কলোনিতে অ্যাথেনা অ্যাকুইটেনের বাড়ি থেকে ওশেন এভিনিউয়ে গাড়ি চালিয়ে আসতে লাগে মাত্র পনেরো মিনিট।

স্কানেটের হোটেলে আসার আগে পোলার্ড অ্যাথেনার বাড়িতে চার জন গার্ডের একটি দল নিযুক্ত করল। আর স্কানেটের হোটেলে রাখল দুই জনের একটি দল। এরপর সেদিন বিকেলে স্কানেটের সাথে দেখা করতে গেল পোলার্ড।

পোলার্ডের সাথে ছিল আকার-আকৃতিতে বড় ও প্রচণ্ড শক্তিশালী তিন জন রক্ষী। স্কানেট যেমন আকস্মিক পোলার্ডের আগমন হেতু বুঝতে পারেনি, তেমনি পোলার্ডও বুঝতে পারছিল না কি ঘটতে যাচ্ছে।

স্কানেট তাদেরকে তার হোটেলের সুইটে নিয়ে গেল। মিষ্টি হেসে, বিনয়ের সাথে তাদের অভ্যর্থনা জানাল। কিন্তু তাদের আপ্যায়নের জন্য কোনো আগ্রহই দেখাল না সে। পোলার্ডের চোখে স্কানেটের পরিধেয় বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি করেছিল। তার পরনে ছিল শার্ট, টাই এবং জ্যাকেট, মোটের ওপর যেন একজন ব্যাংকার। পোলার্ড নিজের এবং তার তিন দেহরক্ষীর পরিচয় দিল। দেহরক্ষীদের গলায় ঝুলছিল প্যাসিফিক ওশেন সিকিউরিটির আই.ডি.।

স্কানেট পোলার্ডের দেহরক্ষীদের দিকে হাস্যকর ভঙ্গিতে তাকাল। তারপর বলল, তোমরা নিশ্চিতভাবেই বেশ বড়-সড়। তবে আমি একশটি ছাগল বিট রেখে বলতে পারি, যদি পক্ষপাতহীন লড়াই হয় তবে তোমাদের এক একজনকে কিক মেরে উড়িয়ে দেব।

উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পোলার্ডের তিন দেহরক্ষী-ই শুধু মুচকি হেসে স্কানেটের কথা মেনে নিল। কিন্তু পোলার্ড বেশ শান্ত হয়ে স্কানেটের বিরোধিতা করল– নিয়ন্ত্রণ করল তার উত্তেজনা।

আমরা এখানে বাণিজ্যিক কারণে এসেছি মি. স্কানেট। পোলার্ড বলল। হুমকির জন্য নয়। লডস্টোন স্টুডিও আপনাকে এই মুহূর্তে পঞ্চাশ হাজার ডলার ডাউন-পে করতে প্রস্তুত আছে, সেই সাথে আগামী আট মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে কুড়ি হাজার ডলার। আর এসব এজন্য যে, আপনাকে লস অ্যাঞ্জেলেসে ছেড়ে যেতে হবে।

কথাগুলো শেষ করেই পোলার্ড তার ব্রিফকেস থেকে চুক্তিপত্র এবং সবুজ সাদা রঙের একটি ঢাউস চেক স্কানেটের সামনে তুলে ধরল।

স্কানেট চুক্তিপত্রটিতে মনোযোগর সাথে চোখ বুলাল। বলল, নগণ্য একটি চুক্তি। এর জন্য আমার আইনজীবীরও প্রয়োজন নেই। ডলারের পরিমাণটাও একই সাথে নগণ্য। আমি আশা করছি একশ গ্র্যান্ড ডাউন পেমেন্ট আর প্রতি মাসে পঞ্চাশ হাজার।

অনেক হয়েছে, পোলার্ড বলল, আপনাকে দমিয়ে রাখার জন্য আমাদের কাছে আদালতের নির্দেশ আছে। অ্যাথেনার ইচ্ছে থাকলে আপনার জেলও হতে পারে। অ্যাথেনাকে ঘিরে চব্বিশ ঘণ্টা আমাদের প্রহরা থাকবে। সেই সাথে আপনার দৈনন্দিন যে কোনো কর্মকাণ্ডের সার্বক্ষণিক খবর রাখবে আমাদের বিশেষ নিরীক্ষণ দল। আর তাই, এই বরাদ্দকৃত অর্থই আপনার জন্য উপযুক্ত।

স্কানেট বলল, আমার তো খুব শিগগিরই ক্যালিফোর্নিয়ায় আসা উচিত। এর সড়কগুলো সোনা দিয়ে মোড়ানো। তবে আমাকে আপনারা কেন এত কিছু দিতে চাচ্ছেন?

স্টুডিও মিস অ্যাকুইটেনের নিশ্চয়তা চায়। পোলার্ডের প্রতিউত্তর।

সে আসলেই একজন বড়… একজন স্টার, উদাস মনে হলো স্কানেটকে। একটু থেমে আবার বলল, ঠিক আছে, সে সব সময়ই স্পেশাল। এবার পরিবর্তন হলো স্কানেট। আবারো সেই উচ্ছলপনা উক্তিতে সে বলল, আমার মনে আছে আমি প্রতিদিন তার সাথে পাঁচ বার মিলিত হতাম।

এবার তিন দেহরক্ষীর দিকে হাস্যকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্কানেট বলল, সে এক্ষেত্রেও ছিল বেশ চালাক।

বিস্মিত পোলার্ড কৌতূহলী দৃষ্টি হেনে তাকিয়ে থাকল স্কানেটের দিকে। যথেষ্ট হ্যান্ডসাম এবং মালবোরো সিগারেটের বিজ্ঞাপন মডেলের মতো তার শরীর। মার্লবোরো মডেলের সাথে তার পার্থক্য কেবল শরীরের রঙে। স্কানেটের ত্বক লালচে এবং উজ্জ্বল। মদপায়ী এবং বিশাল বপুর অধিকারী।

দক্ষিণাদের মতো স্কানেট টেনে টেনে খুব প্রাণবন্ত স্বরে কথা বলে– বিষয়টি একদিকে যেমন মানবীয় অন্যদিকে তেমনই বিপজ্জনক। বহু নারীই এমন মানুষের প্রেমে পড়ে যায়। নিউইয়র্কে অবশ্য স্কানেটের মতো দেখতে বেশ কিছু পুলিশ আছে, যাদেরকে দস্যু হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। কোনো খুনের মামলায় যদি তাদের তদন্তের জন্য পাঠানো হয়, তবে এক সপ্তাহের মধ্যেই তারা স্বামীহারা নারীদের সান্তনা দিয়ে ফিরে আসত। জিম লুজিও এমনই এক কর্মকর্তা। পোলার্ডের অক্ষেপ যে, সে তাদের মতো ভাগ্যবান নয়।

আসুন আমরা আমাদের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করি। পোলার্ড বলল। স্কানেটকে দিয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষরই পোলার্ডের মূল উদ্দেশ্য। পোলার্ড চেকটি তার সামনে রাখল।

স্কানেট টেবিলের এক কোনায় বসে ছিল। আপনার কাছে কি একটি কলম ধার পেতে পারি?

পোলার্ড তার ব্রিফকেস থেকে কলম বের করে চুক্তিপত্রে প্রতি মাসে কুড়ি হাজার সংখ্যাটি লিখে ফেলল। এরপর স্কানেট উল্লসিত হয়ে বলল, এর মানে। আশি আরো বেশি পেতে পারি। চুক্তিপত্রের তিনটি কপিতেই স্বাক্ষর করল স্কানেট।

বলল, আমাকে ঠিক কখন লস অ্যাঞ্জেলেস ছাড়তে হবে?

আজ রাতেই, পোলার্ড জানিয়ে দিল। আমি আপনাকে আপনার প্লেন ধরিয়ে দেব।

না তার আর দরকার হবে না, ধন্যবাদ। স্কানেটের অস্বীকার। আমি ভাবছি আমি নিজেই ড্রাইভ করে লস অ্যাঞ্জেলেসে চলে যাব। আর এই চেক দিয়ে জুয়ার দান মারব।

পোলার্ড বলল, তা আমার লক্ষ্য থাকবে। কিন্তু এখন তার মনে হলো স্কানেটকে তার শক্তি ও প্রভাব দেখানোর প্রয়োজন। পোলার্ড সতর্ক করে দিল, আমি আপনাকে সতর্ক করে দিতে চাই, লস অ্যাঞ্জেলেসে যদি আপনাকে কখনো দেখা যায় তবে অবশ্যই অ্যারেস্ট করা হবে এবং টাকা আদায় করা হবে।

স্কানেটের লাল মুখ উচ্ছলিত হয়ে উঠল। বলল, আমি সেটাই পছন্দ করব। আমিও অ্যাথেনার মতো বিখ্যাত হতে চাই।

সেই রাতে পোলার্ডের নিরীক্ষণ দল রিপোর্ট করল–বজ স্কানেট ওশেন এভিনিউ ছাড়লেও বেভারলি হিলস হোটেলে গিয়ে উঠেছিল। সেখানে সে পঞ্চাশ হাজার ডলারের চেকটি দি ব্যাংক অব আমেরিকার একটি অ্যাকাউন্টে ডিপোজিট করেছে। এই রিপোর্টের মাধ্যমে পোলার্ড নিশ্চিত হলো যে, স্কানেটের ওপর কিছুটা হলেও তার প্রভাব পড়েছে।

পোলার্ড এই তথ্যগুলো রিপোর্ট আকারে ববি বানজের কাছে পাঠাল এবং পরবর্তী নির্দেশনার আহ্বান জানাল। এ বিষয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য না করার নির্দেশ দিল বানজ। এরপর স্কানেটের স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্রটি অ্যাথেনার কাছে পাঠানো হলো। স্টুডিওতে আবারো অ্যাথেনার ফিরে আসার নিশ্চয়তা দিতে যে এমন কৌশলের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা বোঝাতেই এই চুক্তিপত্রের প্রদর্শন। কিন্তু চুক্তিপত্রটি দেখে যে অ্যাথেনা হেসেছিল তা বানজ ও পোলার্ড কেউ বুঝেনি।

পোলার্ড বলল, তুমি চেকটি বাতিল করে ফেলতে পারো।

না, বানজের নেতিবাচক জবাব। সে ক্যাশ ভাঙবে আর সাথে সাথেই আমরা তাকে জালিয়াতির মামলায় ফাঁসিয়ে দেব। আমি শুধু চাই অ্যাথেনা যেন না জানুক যে স্কানেট এ শহরেই আছে।

অ্যাথেনার জন্য আমি ডাবল-সিকিউরিটি বসাব। পোলার্ড বলল। যদি সে উচ্ছল হয়ে ওঠে এবং সত্যিই যদি তার ক্ষতি করতে চায়, তবে কোনোভাবেই তাকে আটকানো যাবে না।

স্কানেট একজন প্রতারক। বানজ বলল, তার এমন ঘটনা প্রথম নয়। এত কিছুর পরেও সে এই প্রতারণা করল কেন?

আমি তোমাকে বলছি কেন। পোলার্ড বলল। আমরা তার কক্ষে চুপিসারে ঢুকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। জানো কি পেয়েছি। একটি কন্টেইনার ভর্তি অ্যাসিড।

ওহ শিট, বানজ প্রায় আঁৎকে উঠল। বলল, বিষয়টি কি পুলিশকে জানানো যায় না? অন্তত জিম লুজিকে তো জানানো যায়।

পোলার্ড বলল, এসিড রাখা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ নয়। বরং চুপিসারে তার কক্ষে প্রবেশটাই অপরাধের বিষয়টি প্রকাশ পেলে স্কানেট আমাকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বে।

তুমি কখনো কিছু বলেনি আমাকে, বনজ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। আমরা কখনো এসব আলোচনা করিনি এবং তুমি যা জানো, সব ভুলে যাও।

অবশ্যই, মি, বানজ পোলার্ড আশ্বাস দিল। এবং, আমি এর জন্য তোমার কাছে কোনো বিলও দাখিল করিনি।

অসংখ্য ধন্যবাদ, যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বানজ। তবে আমার সাথেই থেকো দয়া করে।

স্কিপি ডিরির কাছ থেকে ক্লডিয়া ধারণা নিচ্ছিল। ছবিতে প্রযোজক ও লেখকের পাণ্ডুলিপি থেকে পরিচালক যেমন নিখুঁত অভিনয়ের জন্য দৃশ্যপট বুঝিয়ে দেয় ক্লডিয়াকে ঠিক সেভাবেই নির্দেশনা দিচ্ছিল ডিরি।

ডিরি বলল, অ্যাথেনাকে খুব আন্তরিকভাবে তোমার চুমু দিতে হবে। তুমি হবে তার কাছে একেবারেই নত। প্রয়োজনে তোমাকে কাঁদতে হবে, তুমি নার্ভাস হয়ে ভেঙে পড়বে। তুমি তার জন্য যা করেছ তা মনে করিয়ে দেবে। মনে করিয়ে দেবে তুমি তার কত অন্তরঙ্গ একজন সত্যিকারের বন্ধু এবং একই পেশার কর্মী। তোমাকে এ ছবির জন্য অ্যাথেনাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে।

ক্লডিয়া স্কিপিকে প্রশ্ন করল, কিন্তু এর জন্য আমাকেই কেন? শান্ত ও প্রশ্রয়ের কণ্ঠে আরো বলল, তুমি হচ্ছ একজন প্রযোজক, ডিটা একজন পরিচালক, লডস্টোনের প্রেসিডেন্ট বানজ– তোমরা তাকেচুমু দাও গিয়ে। এসব ক্ষেত্রে আমার চেয়ে তোমরা ঢের বেশি অভিজ্ঞ।

তুমি যাবে কারণ লেখাটা তুমি এমনভাবে লিখেছ যে, অ্যাথেনা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। বলল ডিরি, এই চিত্রনাট্যের জন্য তুমি নিয়েছ আমাকে, নিয়েছ অ্যাথেনাকে। এ অবস্থায় যদি প্রজেক্টটি ব্যর্থ হয় তবে সেই ব্যর্থতার সাথে সর্বদা তোমার নামও উঠে আসবে।

ডিরি চলে গেল কিন্তু তার কথাগুলো বেজেই চলেছিল ক্লডিয়ার মস্তিষ্কে। ক্লডিয়া জানে ডিরির কথাগুলোই ঠিক। তবে এলোমেলো বেপরোয়া হয়ে উঠছিল যেন তার মন। এমন অবস্থায়, সে প্রায়ই যা-কবে তাই করল ক্লডিয়ার ভাই ক্রসের কথা ভাবল। ক্রসই হচ্ছে একমাত্র লোক যে তাকে এমন সমস্যার সমাধান দিতে পারে। অ্যাথেনার প্রতি বজের এই আক্রমণাত্মক মনোভাব দূর করতে প্রয়োজন কেবল ক্রসের সহযোগিতা এতটাই বিশ্বাস ক্লডিয়ার তার ভাইয়ের প্রতি।

অ্যাথেনার সাথে সম্পর্ককে বাণিজ্যিক করে ভোলাটা ক্লডিয়া কোন মতেই মেনে নিতে পারছে না– ঘৃণার চোখে দেখছে সে। তাছাড়া অ্যাথেনা তাকে নাকচ করে দিতে পারে। কিন্তু ক্রস তাকে সাহায্য করতে অবশ্যই এগিয়ে আসবে– সে বিশ্বাস ক্লডিয়ার আছে।

ক্লডিয়া ভেগাসে জানাদু হোটেলে ফোন করল। তবে সে সেখান থেকে জানতে পারল ক্রস সম্ভবত কুওগে রয়েছে। পরের দিন হয়তো সে ফিরে আসবে।

জানাদু হোটেলে থেকে এই ব্যর্থতার পর তার মনের পর্দায় ভেসে উঠল সেই শিশুকাল। অথচ সবসময় ক্লডিয়া তা ভুলে থাকতে চায়। কুওগে ক্লডিয়া কখনোই তার ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করত না। ক্লেরিকুজিও পরিবারের সাথে কোনোরকম স্বেচ্ছাসেবী কর্মকর্মেও সে নিজেকে জড়াতে চায় না। এমনকি কুওগে তার ছেলেবেলার স্মৃতিটুকুও মুছে ফেলতে চায়। কখনোই মনে করতে চায় না তার বাবার কথা অথবা কোনো ক্লেরিকুজিও’র কথা।

০৩. রিকুজিও অ্যান্ড পিপি ডি লিনা

পর্ব–২

দ্য ক্লেরিকুজিও অ্যান্ড পিপি ডি লিনা

০৩.

ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির দুর্দান্ত উত্থান ঘটে সিসিলিতে। এ উত্থানের ইতিধ্যেই অতিবাহিত হয়েছে শত বর্ষেরও বেশি সময়। আর এই দীর্ঘ সময়ে প্রথমার্ধের প্রায় কুড়িটি বছর কেটেছে কেবল যুদ্ধে আর যুদ্ধে। একটি বনের সামান্য একটি অংশের অধিকার নিতে ক্লেরিকুজিও হারিয়েছে তার অসংখ্য লোক। তেমনি অপর প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষও খুইয়েছে তাদের আপনজন, ভালোবাসার মানুষ।

ক্লেরিকুজিও উত্থানের পরবর্তী সময়ের ঘটনা। প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন ডন পিয়েত্রো ফোরলেঞ্জার। ক্লেরিকুজিও গোষ্ঠীর সাথে দীর্ঘ বিবাদ ফ্যাসাদের মধ্য দিয়ে ফোরলেঞ্জার পঁচাশিটি বছর অতিবাহিত হয়। এ বয়সে এসে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সময় তার শেষ হয়ে এসেছিল। চিকিৎসকও তার জীবনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন বড়জোর এক সপ্তাহ বাঁচবেন তিনি। এক সময়ের প্রচণ্ড দাপটে ফোরলেঞ্জার শেষ দিনগুলো কাটবে কেবল বিছানায় শুয়ে থেকে তাও আবার চিকিৎসকের বেঁধে দেয়া সময়ের প্রহর গুনতে গুনতে। অসহায়ের মতো শুধু স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো ছাড়া কিই বা করার আছে তার?

কিন্তু এক সপ্তাহ অর্থাৎ সাতটি দিনও যেন অনেক বেশি মনে হলো প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লেরিকুজিও’র লোকজনের। ফোরলেঞ্জার অসহায়ত্বের সুযোগ নিল তারা। আকস্মিক ক্লেরিকুজি ওর লোক তার শয্যাকক্ষে প্রবেশ করে ফোরলেঞ্জাকে আতঙ্কিত করে তুলল। তারপর আঘাতের পর আঘাত করে নির্মম মৃত্যু উপহার দিল। এ সময় অসহায় অবস্থা পক্ষাঘাতগ্রস্ত বৃদ্ধ ফোরলেঞ্জা আত্মরক্ষায় কেবল যন্ত্রণাকাতর চিৎকারই দিতে পেরেছিলেন এর বেশি কিছু নয়। তারপর চিরদিনের জন্য বিদায়।

ডন ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও প্রায়ই এই পুরনো গল্পের অবতারণা করতেন। এই হত্যাকাণ্ডকে তিনিও মন থেকে সায় দিতে পারেননি কোনো দিন। তিনি বলতেন, সেকালের হত্যাকাণ্ডের ধরন ছিল অত্যন্ত নির্মম ও বোকার মতো। একথা বলে তিন মূলত বোঝাতে চাইতেন– অসহায়ের ওপর আক্রমণ বা হিংস্রতা সম্পূর্ণরূপে বৃথা-দম্ভ মূল্যহীন বীরত্বের অহং। অস্ত্রের ব্যবহার ছাড়া কোনো আক্রমণেরই মূল্য নেই- এটা সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।

ডন ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও আসলে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তৎকালীন ক্লেরিকুজিওদের এমন বৃথা দম্ভের নীতিই তাদের পতন ঘটিয়েছিল।

ইতালিতে মুসোলিনি ও তার ফ্যাসিবাদী সংগঠনগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় আসার পর তারা বুঝতে পেরেছিলেন সর্বপ্রথম মাফিয়াদেরই ধ্বংস করতে হবে। এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে তারা কিছু আইনের পরিবর্তন করেন এবং অত্যন্ত শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী নামিয়ে দেয়া হয়। যার ফলে মাফিয়াদের মেরুদণ্ড নড়বড়ে হয়ে যায়। শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর তুমুল অভিযানে হাজার-হাজার নিরপরাধ মানুষকেও মূল্য দিতে হয়। অনেকেই কারাবরণ করে, আবার মাফিয়াদের সাথে নির্বাসনে যেতে হয় অনেককে, অনেকের মৃত্যুও হয়।

মুসোলিনির কৌশলে ইতালির মাফিয়া সংগঠনগুলোর বিনাশ ঘটলেও একমাত্র ক্লেরিকুজিও গোষ্ঠীটি ফ্যাসিবাদী আইন ও এর সেনা মোতায়েনের বিষয়টিকে মেনে নিতে পারেনি। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তারা শুরু করে প্রচণ্ড বিদ্রোহ। স্থানীয় ফ্যাসিস্ট নেতাদের একে একে হত্যা করতে থাকে, ফ্যাসিস্ট গ্যারিসনে হামলা চালায়। ক্লেরিকুজিওদের এমন তৎপরতাকে আরো প্রবল করে মুসোলিনি। পালামোতে দেয়া এক ভাষণে তিনি বলেন, ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা তার বোলার হ্যাট ও ছাতা চুরি করে নিয়েছে এই দস্যুরা।

মাফিয়াদের দমন করতে এটি ছিল সে সময় মুসোলিনির অত্যন্ত ফলপ্রসূ রটনা ও একই সাথে অবমাননাকর উক্তি। অবশ্য এর জন্য মুসোলিনি বেশ হাস্যাস্পদ হয়েছিলেন সিসিলিতে, তবে তাদের ধ্বংসের সূত্রপাতও হয়েছিল এ থেকে। এর পরপরই সিসিলি প্রদেশে সশস্ত্র বাহিনী ব্যাপক অভিযান শুরু করে। এ অভিযান ঠেকাতে ক্লেরিকুজিও গোষ্ঠীর পাঁচ শতাধিক সদস্যের মৃত্যু ঘটে। আরো প্রায় পাঁচশ সদস্য ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী একটি অনুর্বর অঞ্চলে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে সে অঞ্চলকে দণ্ডিত অরাধীদের উপনিবেশ পেনাল কলোনি হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।

সেই অভিযানে প্রচণ্ড ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েও বেঁচে যান শক্ত প্রাণের ক্লেরিকুজিও। তার পরিবারের কয়েক সদস্যও একই সাথে রক্ষা পায়। ক্লেরিকুজিও, তার সন্তান ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্য আমেরিকায় নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

কিন্তু যে মাফিয়া ডন ক্লেরিকুজিও’র রক্ত ডোমেনিকোর শরীরে সে কি এত সহজে ছাড়তে পারে পরম্পরা? ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও’র রক্তও পূর্বপুরুষের ধারাতেই আত্মপ্রকাশ করল। আমেরিকায় সে গড়ল তার আপন সাম্রাজ্য। পূর্বপুরুষর ঘটনা, ইতিহাস ঘাত-প্রতিঘাতের অভিজ্ঞতায় ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও হলেন আরো ধূর্ত, আরো কৌশলী ও শক্তিশালী। তবে তিনি মনে করতেন, আইন-শৃঙ্খলাহীন রাষ্ট্র সব সময়ই শক্রস্বরূপ, আর এদিক থেকে আমেরিকা তার পছন্দের। তিনি আমেরিকা ভালোবাসেন।

আমেরিকান বিচারকদের উদ্দেশে তিনি একটি প্রবাদ বাক্য প্রায়ই বলতেন। একজন নিরপরাধী ব্যক্তির শাস্তি হওয়ার চেয়ে একশ অপরাধীর মুক্তি দেয়া ভালো। সুন্দরের কাছে আঘাত ম্লান আসলে ক্লেরিকুজিও একজন উদ্দীপনাময় দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠেন। আমেরিকাকে তিনি নিজের দেশ হিসেবেই মনে করেন– আমেরিকার বাইরে কোনো দেশের প্রতিই তার কোনো আগ্রহ নেই। আমেরিকার প্রতি ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ক্লেরিকুজিও সেই ছেড়ে আসা পূর্বপুরুষের দেশ সিসিলির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও খাঁটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সে দেশের সব রাজনৈতিক ও বিচার বিভাগের বিভিন্ন সংস্থাকে ক্লেরিকুজিও প্রচুর অর্থ দিয়ে বন্ধুত্ব নিশ্চিত করতে সমর্থ হন।

ব্যবসায় ডন কখনো একটি কিংবা দুটি ক্ষেত্রে সন্তুষ্ট ছিলেন না। আমেরিকা জুড়ে সবচেয়ে উন্নত ব্যবসাগুলোয় তিনি সরাসরি অন্তর্ভুক্ত হন। বিভিন্ন কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি, পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশের পুনর্গঠন, বিভিন্ন পরিবহন ব্যবস্থায় ডন সহজাত অংশীদারিত্ব গ্রহণ করেন। তবে তার এসব ব্যবসার চেয়ে গ্যাম্বলিং থেকে আয় এর বহুগুণ। এটা ছিল ডনের ভালোবাসা। পাশাপাশি মাদকদ্রব্যের ব্যবসা থেকেও জুয়ার চেয়ে কোনো অংশেই কম আসত না। তবে এক্ষেত্রে খুব একটা আস্থা ছিল না তার। জুয়ার প্রতি ভালোবাসার কারণেই ডন পরবর্তীতে তার পরিবারের লেকজনকেও এতে জড়িত হতে সম্মতি দিয়েছেন। ক্লেরিকুজিও এই ক্ষেত্রটি থেকে নিতেন মাত্র পাঁচ শতাংশ।

আমেরিকায় ডন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পঁচিশ বছরে ক্লেরিকুজিও’র পরিকল্পনা ও স্বপ্ন সত্য হতে শুরু করে। গ্যাম্বলিং আমেরিকায় এখন প্রতিষ্ঠিত, ক্রমেই বৈধতা পেতে শুরু করেছে। এটা এখন সবারই শ্রদ্ধার এবং সবার কাছেই এর গুরুত্বও বাড়তে শুরু করেছে দিন দিন। এমনকি সরকারও অনেক সময় লটারির মাধ্যমে গ্যাম্বলিংয়ে উৎসাহিত করছে। তবে এক্ষেত্রে পুরস্কার দেয়া হচ্ছে একে একে টানা কুড়ি বছর ধরে। যার ফলে মোটের ওপর কোনো অর্থ দিতে হচ্ছে না আয়োজক প্রদেশগুলোর কর্তৃপক্ষকে। তবে মোট পরিমাণ অর্থের সুদের ওপর নামমাত্র একটা কর প্রদান করতে হয়। ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার এ এক মজার জুয়া। ডন ডোমেনিকো এ বিষয়ে খুঁটিনাটি সবই জানেন। কারণ তার পরিবারের কেউ এমনই এক প্রতিষ্ঠানের একটির মালিক। এ কোম্পানি বিভিন্ন রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে সফলতার সাথে লটারি পরিচালনা করে আসছে। ডন সেখান থেকেই জেনেছেন সব।

অন্যান্য স্পোর্টসের ওপর জুয়া যখন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্রই প্রায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, ডন তখন গ্যাম্বলিংকে শুধুমাত্র নাভাদায় বৈধ প্রতিষ্ঠা দিতে সক্ষম হয়েছেন। তবে তিনি জানেন নাভাদার গ্যাম্বলিং বিভিন্ন স্পোর্টসের ওপর গ্যামলিংয়ের চেয়ে পৃথক। কোনো ফুটবল ম্যাচের ওপর জুয়ার দান ধরে একদিনে বিলিয়ন ডলার আয় হতে পারে তবে তা মাত্র একদিনের জন্য। ডনের গ্যাম্বলিং বৈধতা পেলে এমন আয় হতে পারে প্রতিদিন। ডন জানেন গ্যাম্বলিং গোটা যুক্তরাষ্ট্রে বৈধতা একদিন পাবে অবশ্যই হয়তো সেই সোনালি দিন পর্যন্ত তিনি এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবেন না। তবে তার পরবর্তী প্রজন্ম উপভোগ করবে নিঃসন্দেহে।

রেনেসাঁ যুগের প্রিন্সের সাথে ডন ক্লেরিকুজিও’র তুলনা করা চলে নির্দ্বিধায়। ১৪শ থেকে ১৬শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের শিল্প ও সাহিত্যের যে পুনভুদয় ঘটিয়েছিলেন সে সময়ের শ্রদ্ধাভাজনরা। যার জন্য আজও তারা স্থান পেয়েছেন ইতিহাসে। শ্রদ্ধায় যাদের জন্য আমাদের এখনও মাথা নত হয়ে আসে, ঠিক তেমনি নিশ্চিতভাবেই ডনও একটি সভ্য সমাজের সভ্য এই সারা পৃথিবীর দ্রষ্টা। গাছ যেমন ফুলের সৌরভে মানুষকে মাতিয়ে রাখো ফল দেয়, ছায়া দেয়, তেমনই বৃক্ষের সহস্র বীজ ডন এ পৃথিবীতে বুনে যাচ্ছেন। একে একে এসব গাছ বড় হবে– ফুল দেবে, ফল দেবে, ছায়া দেবে– এসব বীজ বিনষ্ট হবে না কখনো।

.

যদি পুরো আমেরিকায় মাফিয়া সম্রাটদের পবিত্র চার্চ হিসেবে ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলিকে গণ্য করা হয়ে থাকে তবে সে চার্চের ডন ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও হচ্ছেন পোপ। তার এই খ্যাতি শুধু তার বুদ্ধিমত্তার জন্য নয়, তার দৃঢ়তার জন্যও।

ডন ক্লেরিকুজিও তার দৃঢ় নৈতিকতার জন্য তার পরিবারের কাছেও সমান শ্ৰদ্ধার। পরিবারের প্রত্যেকটি পুরুষ, মহিলা এবং শিশু তার যে কোনো নির্দেশের প্রতি দায়িত্বশীল। যে কোনো ব্যাপারে অনুশোচনাই হোক, বাধ্যবাধকতাই হোক কিংবা বৈরী পারিপার্শ্বিকতা হোক– ডনের আদেশের প্রতি অনুগত হতেই হবে। যদি কেউ তার বিরোধিতা করতে চায় তবে সে কথাগুলো কেবল বাতাসেই উড়ে বেড়াবে। ডন ঘৃণা করেন সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞানের মতো যত বিষয়। তিনি একজন গোঁড়া ক্যাথলিক– তার বিশ্বাস, কর্মের ফল পেতে হবে এ পৃথিবীতেই, আর ক্ষমা, এর পর। তিনি বিশ্বাস করেন, সবাইকে তাদের ঋণ শোধ করে যেতে হবে এবং বিশ্বে তার বিচারে তিনি অত্যন্ত কঠোর।

তার আনুগত্য প্রথমেই তার প্রতি, যার রক্ত শরীরে প্রবহমান। দ্বিতীয়ত, তার প্রভুর প্রতি (তিনি কি তার বাড়ির নিজস্ব প্রার্থনালয়ে অবস্থান করছেন না?) এবং তৃতীয়ত, ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলি যে ভূখণ্ডে বর্তমানে সমস্ত বাধ্যবাধকতার শিকার এটি হতে পারে তার সমাজ, সরকার, সর্বোপরি দেশ।

ডন ক্লেরিকুজিও সিসিলিতে জন্মগ্রহণ করেন যেখানে সমাজ ও সরকার ছিল পরস্পরের শত্রু। তার মুক্তচিন্তার ধারণাটি বেশ পরিষ্কার- কেউ তার রোজগার, আয়ের জন্য মর্যাদা ও আশা বেচে তার ইচ্ছা পূরণ করতে পারে। অপরদিকে শ্রদ্ধার সাথে, মর্যাদার সাথে পূরণ করতে পারে তার রোজগার চাহিদা।

ডন প্রায়ই বলেন, তোমার পরিবার হচ্ছে তোমার সমাজ, তোমার প্রভু তোমার ফলদানকারী এবং তোমার অনুসরণকারী তোমাকে রক্ষা করবে।

ডন তার সাম্রাজ্য শুধু এই জন্য প্রতিষ্ঠা করে নি যে তার সন্তান এবং নাতি-নাতনিরা কেবল তা ভোগ করবে এবং মানবতাবোধ থেকে সরে আসতে থাকবে কিংবা একসময় পরিবারের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। ডন এমনভাবে তার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন যেন তার ফ্যামিলির নাম এবং ভাগ্য চার্চের মতোই মানুষের মনে পবিত্রতার সাথে ঠাই পাবে। তিনি ভাবেন রুটি রোজগার ছাড়া এই বিশ্বে আরো অনেক কিছু করার আছে মানুষের, যা পরবর্তীতে (মৃত্যুর পর) যাবতীয় অপরাধের ক্ষমার জন্য নিজেকে উপস্থাপন করবে ঈশ্বরের কাছে।

ডন ডোমেনিকো তার পরিবারকে ক্ষমতার শীর্ষে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। এর জন্য তাকে হতে হয়েছে কখনো বর্গিয়ানের মতো হিংস্র এবং ম্যাকিয়াভেলির মতো সূক্ষ্ম। সেই সাথে আমেরিকান বিজনেস সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করতে হয়েছে তাকে। তব এত সব কিছুর পরও তাকে তার অনুসারীদের ভালোবাসতে হয়েছে বাবার মতো। পুণ্য করলে তার ফলও ভোগ করা যায় আর পাপে করতে হবে প্রায়শ্চিত্য এটাই সত্য, জীবনের পরম বাস্তবতা।

অবশেষে ডনের পরিকল্পনায় দেখা গেল ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলি ক্ষমতার এমন এক পর্যায়ে উঠে এসেছে, সেখান থেকে আর কোনো অপরাধের সাথে তাদের জড়িত থাকা সম্ভব নয়, কেবলমাত্র ভয়াবহ ঘটনার সম্মুখীন না হওয়া পর্যন্ত। তবে ক্লেরিকুজিও সাম্রাজ্যের মাফিয়া প্রধান যেমন ব্যায়রন কিংবা ব্ৰুগলিওনরা (ইতালীয় শব্দ) ডনের যে কোনো বিপদে পাশে এসে দাঁড়াবে। এটাও ডনেরসুদূর প্রসারী পরিকল্পনার ফল। এর জন্য ডন সমস্ত মাফিয়া প্রধানদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাদের জেল থেকে মুক্ত করেছেন, ইউরোপে অনেকের প্রাপ্ত অবৈধ অপরাধের নিশ্চিত শাস্তি থেকে মুক্ত করেছেন, আমেরিকায় সমঝোতার মাধ্যমে তাদের মাদক চোরাচালানের নিরাপদ পথ তিনি অনায়াসেই তৈরি করেছেন মাফিয়া দলগুলোর জন্য। পৌর এলাকাতেও তাদের ঠাঁই হয়েছে বিনা বাধায়।

ডন ফ্লেরিজিওর জ্যেষ্ঠ পুত্র জর্জিও একজন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে ফ্যামিলির অন্যতম ক্ষমতাবান। কালো টাকাকে সাদা করার পদ্ধতি যেন তার নখদর্পণে। একাজ সে এমন ভাবে করে থাকে যেন কোনো স্বর্গীয় ধোপা টাকাগুলো ক্রমেই ধুয়ে দিচ্ছে আর তা বৈধ ও সভ্যতার কল থেকে কেবল বেরিয়েই যাচ্ছে। এই হচ্ছে জর্জিও, যে তার বাবার সাম্রাজ্যকে বাবার পরিকল্পনানুসারে নিয়ন্ত্রণের জন্য সদাসচেষ্ট। সবচেয়ে বড় কথা, ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির ওপর জনগণের তীক্ষ্ণ ও অশুভ দৃষ্টি এড়ানোর জন্য জর্জিও কঠোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এ কারণেই ফ্যামিলির অস্তিত্বও বহাল রয়েছে গতানুগতিক। ফ্যামিলির ওপর অনবরত তীক্ষ্ণদৃষ্টি, অপবাদ, ফ্যামিলিকে ঘিরে ভয়াবহ ও বিপজ্জনক যেসব তৎপরতা চলছে তা অত্যন্ত সফলতার সাথেই মোকাবেলা করছে জর্জিও। পাশাপাশি ফ্যামিলির একটা সুখ্যাতি প্রতিষ্ঠাতেও সে সম্পূর্ণ সফল।

ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির গাঁথা-গল্প-অপরাধের ঘটনা এফবিআই কিংবা পুলিশের নথিতে একের পর এক যুক্ত হলেও সংবাদ মাধ্যমে তা কখনোই প্রকাশ হয়নি। এমনকি সেসব সাহসী প্রকাশনা বা ম্যাগাজিনেও এই পরিবারকে নিয়ে কখনো দুকলম লেখা হয়নি। এই সংস্থাগুলো অবশ্য আমেরিকার অন্যান্য মাফিয়া দলের বিরুদ্ধে বিস্তর লিখেছে। যারা এই মাধ্যম এবং পুলিশকে মোটেও পাত্তা দেয়নি তাদের অবনতিই হয়েছে। অথচ জর্জিও’র মেধা, কৌশল ফ্যামিলিকে রেখেছে নিরাপদে।

তাই বলে ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলি যে দাঁতহীন বাঘ এটা মনে করা হবে বোকামি। জর্জিও’র ঘোট দুভাই ভিনসেন্ট এবং পেটি– এরা বড় ভাইয়ের মতো চালাক না হলেও, ডনের রক্ত আছে তাদের শরীরে। ব্রঙ্কসের সীমাবদ্ধ গণ্ডীতে তারা পূর্ণ শক্তি নিয়ে বসবাস করছে। সর্বদা ইতালীয় সংস্কৃতিতে শক্তির সঞ্চয় হচ্ছে তাদের দিন দিন। ব্রঙ্কসের এই পরিসরটি দুভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এমন চল্লিশটি ব্লক যা যে কোনো পুরনো ইতালির সংস্কৃতির ওপর ছবি নির্মাণে সহায়ক পরিবেশ। সেখানে নেই কোনো দীর্ঘ দাড়িঅলা হাসিডিক ইহুদি, নেই কৃষ্ণাঙ্গ কিংবা এশীয়, অথবা নেই কোনো বোহেমীয় জাতির জনগণ নেই তাদের সাথে সম্পৃক্ত কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিংবা লেনদেন। সেখানে কোনো চায়নিজ রেস্তোরাঁ নেই। ক্লেরিকুজিও ব্রঙ্কসের পুরো রিয়েল এস্টেট নিয়ন্ত্রণ করেন তার নিজ কর্তৃত্বে।

ছোটখাটো এই ইতালীয় উপনিবেশে দেখা যাবে ইতালীয় কিছু পরিবারের লম্বা চুলের তরুণ যুবক গিটার হাতে মেতে রয়েছে আপন উচ্ছলতায়। তবে খুব শিগগিরই ক্যালিফোর্নিয়ায় তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে গছিয়ে দেয়া হবে। প্রতি বছর ইতালির সিসিলি থেকে ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির পরিধি বৃদ্ধি করতে নতুন নতুন পরিবার আসছে সতর্কতার সাথে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে ক্লেরিকুজিও সাম্রাজ্যের কোনো আস্তানায়। সারা বিশ্বে ব্রঙ্কস এনক্লেভ ঘিরে রয়েছে হাজারো অপরাধের গুঞ্জন, কিন্তু এই ব্রঙ্কস এনক্লেভে বিন্দুমাত্র অপরাধ সংঘটনের নজির নেই ব্রঙ্কস এনক্লেভ সদা পবিত্র, যেন শান্তির স্বর্গধাম।

পিপি ডি লিনা ব্রঙ্কস এনক্লেভের মেয়র থেকে লাস ভেগাসে ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির ব্রুগলিওন হিসেবে নিযুক্ত হয়েছে। কিন্তু তারপরও সে ক্লোরিকুজিওর সরাসরি নির্দেশের অনুগত। তাকে এখনো ডনের বিশেষ মেধার ওপর নির্ভর করে থাকতে হয়।

তবে পিপি ব্রুগলিওন হিসেবে অত্যন্ত যোগ্য। তার ক্ষমতা গ্রহণের পর্বটিও শুরু হয়েছে সময়ের চেয়ে একটু আগেই- অর্থাৎ মাত্র সতেরো বছরে। যখন তার শরীরের গঠনও তেমন শক্ত হয়নি তখন থেকেই পিপি ক্লেরিকুজিও’র ক্ষমতার ছোটখাটো ছটা পেতে শুরু করে।

পিপি শারীরিকভাবে বেশ শক্ত-সামর্থ্য, তার উচ্চতা ও গঠন যে কোনো লোকের সমীহ আদায় করার মতো। সেই সাথে অবশ্যই তার এক্সপ্লোসিভ ও আগ্নেয়াস্ত্র চালনায় রয়েছে নিখুঁত দক্ষতা। জীবনকে উপভোগ করার মতো প্রাণশক্তি ও উচ্ছলতা পিপির যেন সহজাত। মানুষ মুগ্ধ হয় তার এই প্রাণময়তায়, তার সাহসিকতায় অভিভূত হয় নারী। এদের মধ্যে সেই সিসিলীয় বংশোদ্ভূত মানুষই হোক কিংবা আমেরিকার মুভি তারকা। কাজের প্রতি পিপি অত্যন্ত একনিষ্ঠ, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে বিশ্বাস করে জীবনটা আনন্দের, উপভোগের।

পিপির দুর্বল দিকগুলোর মধ্যে অতিরিক্ত মদপান আর নিয়মিত গ্যাম্বলিং— নারীর প্রতি রয়েছে তার অতিমাত্রায় দুর্বলতা। এসব কারণে ডন যে তাকে সর্বদা প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন তা নয়– তবে পিপির এই উচ্ছল জীবনে খুব একটা অন্যায় হয়ে দাঁড়াল না ডন। পিপির এসব দুর্বল দিক তাকে কখনো সমস্যায় ফেলেনি বরং তাকে করেছে আরো শক্তিশালী, আরো বলবান।

তার প্রাণময়তা, উপভোগের জীবন তাকে ক্যরিয়ার গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে, কারণ সে ডনের ভগ্নীপুত্র। সে হচ্ছে রক্তের এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পিপি ফ্যামিলির ঐতিহ্য ভঙ্গ করে দিয়েছে নতুন দিকের সূচনা।

প্রত্যেক মানুষের জীবনেই থাকে কিছু কিছু ভুল। পিপির জীবনও বাদ যায়নি। তার যখন কুড়ি বছর বয়স সে প্রেমে পড়েছিল বিয়েও করেছিল সেই প্রেমিকাকে। তবে সে মেয়ে ছিল পিপি ডি লিনার মতো একজন যোগ্য ছেলের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত।

ন্যালিনি জেসাপ ছিল লাস ভেগাসে জানা হোটেলের একজন সামান্য ড্যান্সার। পিপি ন্যালিনি সম্পর্কে প্রায়ই গর্ব করে বলে, সে কোনো শো-গার্লের মতো তার শরীর প্রদর্শন করে না। ভেগাস স্ট্যান্ডার্ডে ন্যালিনি বেশ বুদ্ধিমতী নারী। বইপড়ুয়া মেয়ে, রাজনীতিতে তার রয়েছে আগ্রহ। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ন্যালিনি ক্যালিফোর্নিয়া পুরনো দিনের স্যাকরামেন্টো ওয়াসপ সংস্কৃতির একটি মেয়ে তার গোড়াপত্তনও সেখানেই।

পিপি ও ন্যালিনির মধ্যে পার্থক্য ছিল বিস্তর– দুজন যেন দুই মেরুর। পিপির পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল না তেমন। কদাচিৎ সে বইয়ে চোখ বুলাত। গান-বাজনা, নাটক-থিয়েটারের প্রতিও তার খুব এটা আগ্রহ নেই। পিপি যেন একটা ঝাড়ের মতো, অপরদিকে ন্যালিনি একটি ফুল। পিপি উচ্ছল, প্রাণবন্ত, কখনো ভয়ঙ্করও, বিপরীতে ন্যালিনি স্বভাবগত নম্র, ভদ্র। ন্যালিনির সাথে কখনোই তার সহকর্মী শোগার্ল কিংবা ড্যান্সারদের বিবাদ হয়নি। বরং সহকর্মীদের সাথে তার রয়েছে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অবসর সময়ে তারাই ন্যালিনির ভালো সঙ্গী।

একটি বিষয়ে ন্যালিনির সাথে পিপির মিল রয়েছে বেশ। সেটি হলো ড্যান্স। পিপি ডি লিনার ক্ষেত্রে ড্যান্সেও রয়েছে ডন ক্লেরিকুজিও’র নেতিবাচক মনোভাব। তবে পিপি যখন বলরুমে ড্যান্সের উদ্দেশ্যে নেমে পড়ে, তখন ভুলে যায় সব। এই একটি মাত্র ক্ষেত্রে পিপি নিজেকেও ঠিক বুঝতে পারে না। ড্যান্স যেন তাকে টানে এক অদৃশ্য ভালোলাগায়। অথচ কবিতা, গান, সাহসিকতা, স্নেহশীলতা, যৌনাচারে সূক্ষ্ম বিশুদ্ধতা– এমন যে কোনো বিষয়েই পিপি নিজেকে অনায়াসেই সংযত রাখতে পারে।

ন্যালিনি জেসাপের ক্ষেত্রে এই ড্যান্স তার অন্তরতম আত্মায় আলোর ঝলক ফেলে। অভাবনীয় সুখ পায় ন্যালিনি যখন পিপির সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ঘণ্টাব্যাপী নাচতে থাকে। এই ঘনিষ্ঠতা তাদের মধ্যে তৈরি করে ভালোবাসার আবেগ উভয়ের যৌন সম্পর্কে তৈরি হয় স্বর্গীয় সেতুবন্ধন দুজনের মাঝে সহানুভূতির আত্মিক সম্পর্কের যোগাযোগ শুরু হয়। এই স্বর্গীয় সুখের সময়টুকুতে তারা চোখে চোখে, কথার মাধুরীতে মেতে ওঠে। এই সময়টি আসে কখনো ন্যালিনির অ্যাপার্টমেন্টে অথবা ভেগাসে হোটেলের কোনো ড্যান্স ফ্লোরে।

খুব গুছিয়ে গল্প করতে পারে পিপি এবং তার ভাণ্ডারও বেশ সমৃদ্ধ। ন্যালিনির প্রতি তার আবেগ ব্যক্ত করতে, ন্যালিনির ভক্তি কুড়াতে পিপি মাঝে মাঝেই হয়ে ওঠে একজন তোষামোদকারী হয়ে ওঠে একজন রসিক প্রেমিক। ন্যালিনি যখন কিছু বলে পিপি মুগ্ধ হয়ে শোনে। ন্যালিনির কোলে মাথা রেখে পিপির চোখ দুটো নিবদ্ধ হয় তার চোখে আগ্রহ নিয়ে শুনতে থাকে। যখন ন্যালিনি তাকে বইয়ের কোনো কথা শোনায়, থিয়েটারের গল্প বলে, রাজনীতির কথা বলে, বলে গণতন্ত্রের উত্থানের কথা, কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের কথা, দক্ষিণ আফ্রিকার চলমান যুদ্ধের কথা, এমনকি তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর অভাবপীড়িত, দুর্গত মানুষের কথা পিপি তখন মনে মনে গর্ববোধ করে স্ত্রীর অসীম জ্ঞান ও বুদ্ধির জন্য। পিপি ন্যালিনির কথায় রোমাঞ্চ বোধ করে, যা এতদিন অবধি পিপির জন্য ছিল কেবল বাইরের বিষয়।

পিপি ও ন্যালিনির মধ্যে ভাবের এই আদান-প্রদানে উভয়ে উভয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়, ভালোবাসার সম্পর্ক হয় আরো দৃঢ় উভয়ের মধ্যে যৌন সম্পর্কের সূত্রপাতও হয় এ থেকে। এ থেকে ন্যালিনি কেবল বুঝতে পারে একজন সুন্দর মনের প্রেমিককে, তার ভালোবাসার মানুষ স্বামী পিপিকে। সত্যিকারের আরেক ভুবনের পিপি ন্যালিনির কাছে রয়ে যায় আবৃত। ন্যালিনি শুধু বুঝতে পারে তার স্বামী তাকে কত ভালোবাসে, যে তার জীবনের উৎকৃষ্ট উপহারস্বরূপ।

ন্যালিনির যখন মাত্র আঠারো বছর তখন তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের প্রায় এক সপ্তাহ পর তারা মিলিত হয়েছিল। ন্যালিনি অবশ্য তখন পিপি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানত না। পিপির বয়স ছিল আটাশ এবং সত্যিই যে সে ন্যালিনিকে ভালোবাসত– একটুকুই বুঝত ন্যালিনি। ন্যালিনিকে বিয়ের পর পিপিও ক্রমে সেই পুরনো সংস্কৃতির মূল্যবোধে বেড়ে উঠতে থাকে। তারা উভয়েই একটি পরিবারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

ন্যালিনি ছিল অরফ্যানের, অপরদিকে পিপি ক্লেরিকুজিও পরিবারের হলেও ন্যালিনির সংস্পর্শে তার ভালোবাসায় ক্রমেই হারিয়ে গিয়েছিল– ক্লেরিকুজিও বিমুখ হয়ে উঠেছিল। তাকে বিয়ে করে পিপি বুঝতে পেরেছিল তাদেরকে ক্লেরিকুজিও পরিবার মেনে নেবে না। পরিবারের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে সেখান থেকে সরে আসাই সমীচীন মনে করে পিপি। গোপনে ভেগাসের এক প্রার্থনালয়ে তারা বিয়ে করে।

পিপির সমস্ত জল্পনা-কল্পনা, ভয় ও সন্দেহ দূর করে ক্লেরিকুজিও মেনে নেন তাদের। তিনি প্রায়ই একটি কথা বলতেন, একজন মানুষের প্রাথমিক কর্তব্যই হচ্ছে তার জীবনযাপনের জন্য নিজের রোজগারটুকুতে সক্ষম হওয়া। কিন্তু এর জন্য তার যদি না থাকে স্ত্রী কিংবা পুত্র?– এমন প্রশ্নে ডন বেশ অসম্মানবোধ করতেন। তিনি কখনোই এমন পরামর্শ দেননি যে, ক্লেরিকুজিও পরিবারে স্বাধীন বিয়েকে মেনে নেয়া হবে না। মোটের ওপর পিপির শরীরেও ছিল ক্লেরিকুজিও ধারার রক্ত।

পিপি-ন্যালিনির বিয়ে মেনে নিলেও মন থেকে সায় দিতে পারেনি ডন ক্লেরিকুজিও। তিনি যে তাদের বিয়েতে সন্তুষ্ট ছিলেন না তা তার খুঁতখুঁতে কিছু মন্তব্য থেকে বোঝা যায়। তিনি বলতেন তারা সাগরের তলদেশে গিয়ে যেন নেচে বেড়ায়। তা সত্ত্বেও ডন ক্লেরিকুজিও তাদের বিয়ে উপলক্ষে দিয়েছিলেন মুক্ত হস্তে অঢেল। ডন একটি কোম্পানির মালিকানা দিয়েছিলেন পিপিকে তাদের বিয়ে উপলক্ষে যা থেকে প্রতি বছর আয় ছিল এক লাখ ডলার। এই আয় পিপির সে সময়ের সব আয়কে ছাড়িয়ে গিয়েছিল– এটা ডনের দৃষ্টিতে পিপির পদোন্নতি। তবে পিপি পশ্চিমে ক্লেরিকুজিও পরিবারের ব্রুগলিওন হিসেবে বহাল ছিল আগের মতোই। এক্ষেত্রে তার পদবির কিংবা দায়িত্বের কোনো হেরফের হয়নি। তাকে ব্রঙ্কস এনক্লেভ থেকে কেবল সরে যেতে হয়েছিল।

ব্রঙ্কস এনক্লেভে পিপিকে ছেড়ে যেতে হয়েছিল শুধু ন্যালিনি জেসাপকে বিয়ে করার জন্য। ব্রঙ্কস এনক্লেভে ন্যালিনি একজন বিদেশিনী, এজন্য ভিন্ন গোত্রের মানুষ– মুসলিম, কৃষ্ণাঙ্গ, ইহুদি এবং এশীয়দের মতোই তারও উপস্থিতি ব্রঙ্কস এনক্লেভে নিষিদ্ধ, যেন অচ্ছুত কোনো সম্প্রদায়। আর এ সম্প্রদায়ের জায়গা ক্লেরিকুজিও’র ইতালীয় উপনিবেশ ব্রঙ্কসে অন্তত নেই। ন্যালিনির কারণেই ক্লেরিকুজিও’র মুগুর হওয়া সত্ত্বেও, স্থানীয় একটি মাফিয়া দলের প্রধান ব্যারন হওয়া সত্ত্বেও পিপিকে হারাতে হয়েছে কুওগে তার স্বাভাবিক জীবনযাপন।

ডন শুধু তাদের বিয়ে উপলক্ষে যথাযথ পুরস্কার দিয়েই খালাস। এক্ষেত্রে তাদের বিয়েকে উৎসবমুখর করতে এগিয়ে এসেছিলেন জানাদু হোটলের মালিক, ডনের আরেক কাছের লোক আলফ্রেড গ্রোনিভেল্ট। পিপি-ন্যালিনির বিয়ে উপলক্ষে গ্রোনিভেল্ট তার হোটেলে আয়োজন করেছিলেন ছোট একটি ডিনার পার্টি। সে পার্টির অন্যতম আয়োজন ছিল বর ও কনের সৌজন্যে সারা রাত নাচের। এ থেকেই বছরখানেকের মধ্যে গ্রোনিভেল্টের  সাথে পিপির তৈরি হয়েছিল অত্যন্ত সুসম্পর্ক তারা একে-অপরের শ্রদ্ধাভাজনও হয়ে উঠেছিলেন ক্রমেই।

পিপি-ন্যালিনির দীর্ঘ বৈবাহিক জীবনে এসেছে দুটি সন্তান– একজন ছেলে আর আরেকজন মেয়ে। ধর্মীয় বোধে উদ্দীপ্ত ককসিফিজিও পিপির জ্যেষ্ঠ পুত্র— ক্রস নামেই সে বেশি পরিচিত। তার যখন দশ বছর বয়স অবিকল সে দেখতে হয়েছিল তার মায়ের মতো। শরীরে ছিল লাবণ্য এবং আচার-আচরণে ছিল তার মেয়েলীপনা। এখন অবশ্য শারীরিক সৌষ্ঠব, সাহসিকতায় সে তার বাবার মতোই।

ক্রসের ছোট তার বোন ক্লডিয়া। নয় বছর বয়সে ক্লডিয়া পেয়েছিল বাবার চেহারা। তবে আচারে-গুণে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে মা ন্যালিনির মতো। বাবার চেয়ে মায়ের প্রতিই তার ভালোবাসা বেশি। মায়ের মতো বইপড়া, মিউজিক, থিয়েটারের প্রতি রয়েছে তার ভালোবাসা এবং মহানুভবতায়, তেজস্বীতায় ন্যালিনি জেসাপের মতোই তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। ক্রস যেমন তার বাবা পিপির ভক্ত, তেমনি অপরদিকে ক্লডিয়া তার মায়ের ভক্ত।

এগারো বছর আগেও ডি লিনা পরিবারটি ক্লেরিকুজিও পরিবার থেকে পৃথক হয়ে বেশ সুখে কাটাচ্ছিল জীবন। পিপি ভেগাসে ব্রুগলিওন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে, একই সাথে জানাদু হোটেলের কালেক্টরের দায়িত্বও পালন করতে থাকে; আর ডন ক্লেরিকুজিও’র মুগুর হিসেবে তো সে ছিলই। ধীরে ধীরে পিপি ধনী হয়ে ওঠে, জীবনযাপনে আসে উন্নতির ধারা– অবশ্য এর সবকিছুই ছিল ডনের বদৌলতে। তবে তার জীবনযাপন ঘিরে থাকে পরিবারের ছোঁয়া। মদপান আর জুয়া থেকে নিজেকে মুক্ত করতে না পারলেও তার সুখের জীবন অতিবাহিত হয় স্ত্রী ন্যালিনির সাথে নেচে, সন্তানদের সাথে খেলে। সন্তানদের মানুষ করতে পিপি ও ন্যালিনি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়।

তবে সুখ যে মানুষের দীর্ঘস্থায়ী হয় না পিপি তা বেশ অনুধাবন করত। সে তার এতদিনের বিপদসঙ্কুল জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পেরেছিল– সামনেও তার জন্য হয়তো অপেক্ষা করছে কোনো অপ্রীতিকর, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এর কারণ একমাত্র তার জীবনের সফলতা। আর তাই পিপি তার ছেলে ক্রসকেই অবলম্বন মনে করতে শুরু করল। সে মনে-প্রাণে আকাক্ষা করল তার ভবিষ্যৎ মানুষটিই যেন তার সহযোগী হয়ে ওঠে। অথবা সে ব্যতিক্রমও খুঁজতে থাকল এর এমন একজন মানুষ তার কাছে আকাক্ষিত হয়ে উঠল যার ওপর সম্পূর্ণরূপে আস্থা রাখা যায়।

এসব চিন্তা থেকেই পিপি ক্রসের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠল। শুরু হলো প্রশিক্ষণ পিপি তাকে শেখাল জুয়ার বিভিন্ন কলা-কৌশল, তাকে ঘনঘন গ্রোনিভেল্টের  সাথে ডিনারে নিয়ে যেতে লাগল পিপি। গ্রোনিভেল্টের  সংস্পর্শে নেয়ার উদ্দেশ্য ক্রস যাতে ক্যাসিনোর ব্যতিক্রমী ও বিভিন্ন ধারা গ্রোনিভেল্টের কাছ থেকে রপ্ত করতে পারে। গ্রোনিভেল্ট সবসময়ই ক্রসের জন্য ছিলেন মুক্ত। ক্রসকে তিনি বলতেন, প্রতি রাতেই হাজার হাজার লোক আমার ক্যাসিনোর সাথে প্রতারণা করতে জেগে বসে থাকে।

পিপির কাছ থেকে ক্রস শিখেছিল শিকারের কৌশল। শিখেছিল কিভাবে, কোন লক্ষ্যে আঘাত করলে জন্তু-জানোয়ার কুপোকাত হবে তাদের রক্তের গন্ধ সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিল পিপি। বিভিন্ন জানোয়ারের রক্ত পিপি ক্রসের হাতে লাগিয়ে তাকে ধারণা দিয়েছিল। মুষ্টিযুদ্ধের প্রশিক্ষণও বাবার কাছ থেকে পায় ক্রস। বন্দুকের ব্যবহার এবং এর যত্নের কলা-কৌশল শিখিয়েছিল পিপি।

নেভেদার পার্বত্যাঞ্চলে ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির রয়েছে বিশাল হান্টিং লজ। ছুটির দিনগুলোতে পিপি ও তার পরিবার প্রায়ই বেড়াতে যেত। এ সময় ন্যালিনি যখন বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকত তখন পিপি সন্তান দুটিকে নিয়ে মেতে উঠত শিকারের খেলায়। এসব শিকারে ক্রস এমনভাবে হাত পাকিয়ে নিয়েছিল যে, ভালুক, হরিণ এমনকি পাহাড়ি সিংহ কিংবা কোনো হিংস্র প্রাণী খুব সহজেই ধরাশায়ী হতে লাগল ক্রসের নিশানার কাছে। বাবা পিপি ডি লিনার ছেলের যোগ্যতায় ধীরে ধীরে আস্থা জন্মাতে লাগল। পিপি বুঝতে পারল ছেলের দৌরাত্ম্য। সেই সাথে বুঝল জন্তু-জানোয়ারের প্রতি তার যত্নবান। হওয়ার মনোভাবও। পিপির কাছে ক্রস যেন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও শান্ত মস্তিষ্কের ছেলে– কোনো শিকারে ক্রস কখনোই উত্তেজিত নয়– অত্যন্ত ধীর ও লক্ষ্যে আঘাত হানতে বেপরোয়া মনোযোগ।

ক্লডিয়া ছিল এসবে একেবারেই আগ্রহহীন। বন্দুকের গুলি খেয়ে যখন কোনো হরিণ লাফিয়ে উঠত ক্লডিয়া যেন মর্মাহত হতো। এমনই কিছু অবসর যাপনে ক্লডিয়া আর তার বাবা-ভাইয়ার সাথে যেত না, বরং লজে মায়ের সাথেই বসে গল্প করে কাটত। ক্লডিয়ার মাছ ধরতেও ছিল আপত্তি।

পিপি ছেলের প্রতিই বেশি মনোযোগ দিতে শুরু করল। তাকে চরিত্রের মূল বিষয়গুলো শেখাত পিপি। ক্রসের উদ্দেশ্যে বলত– কখনো খুব সামান্যতেই রেগে যাবে না, আর নিজের সম্পর্কে কিছুই বলবে না কখনো। তোমার কাজের মাধ্যমেই তুমি আদায় করে নেবে অন্যের সমীহ, কথার মাধ্যমে নয়। সব সময় শ্রদ্ধা করবে তোমার রক্তের সম্পর্ককে। গ্যাম্বলিংকে কখনোই পেশা হিসেবে নয়, এটাকে মনে করবে তোমার শান্তি, বিনোদন হিসেবে। ভালোবাসবে তোমার বাবাকে, মাকে, বোনকে কিন্তু নিজের স্ত্রীর চেয়ে অন্য কোনো নারীর ভালোবাসায় থাকবে সদাসতর্ক। তোমার স্ত্রী, হতে পারে এমন একজন নারী যে তোমার সন্তানের জন্য বিরক্তিকর হয়ে উঠতে পারে– আর যদি তা তোমার ক্ষেত্রে হয়ই তবে তোমার জীবন হয়ে উঠবে দুর্বিষহ– তুমি ব্যর্থ হবে তাদের দুমুঠো খাওয়াতেও।

বাবার কথার অন্যথা করেনি ক্রস– পদে পদে সে মনে রেখেছে পিপির উপদেশ। ক্রসের সাথে তার মা ন্যালিনির চেহারার অদ্ভুত মিল থাকার কারণে পিপি ছেলেকে ভালোবাসে খুব। ক্রসের মাঝে ন্যালিনির উপস্থিতি খুঁজে পায় পিপি।

ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির পরবর্তী প্রজন্ম যে একটি বৈধ, আইনসম্মত সমাজের মধ্যে মিশে যাবে– ডন ক্লেরিকুজিও’র এমন স্বপ্নে পিপির কোনো বিশ্বাস নেই। এটা যে ভালো ফলাফলের দিগন্ত রচনা করবে- এমন বিশ্বাসও পিপি করে না কখনো। তবে সে বৃদ্ধদের অতিকৌশলী বুদ্ধিকে স্বীকার করে, তবে তা-ও কেবল গ্রেট ডন ক্লেরিকুজিও’র প্রতি। আসলে সব বাবাই চায় সন্তানরা যেন তাদের সাথেই কাজ করে, তাদের অনুসারী হয়ে ওঠে। রক্তের সম্পর্ক এক হবেই– এটা লঙ্ঘন করা যায় না— সত্য কথা।

আর এ ক্ষেত্রে পিপি তা সঠিক বলেই প্রমাণ করেছে। ডন ক্লেরিকুজিও’র দৃঢ় পরিকল্পনার পরও, তার আপন নাতি ডেন্টি তার নিজস্ব পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যস্ত। ফেলে আসা সিসিলীয় রক্তের দুরন্তপনার ধারা ডেন্টির শরীরে, ক্ষমতার জন্য ব্যাকুল। সে কখনো সমাজের ও ঈশ্বরের বিধি-বিধান লঙ্ঘনে ভীত নয়।

ক্রসের যখন সাত বছর বয়স এবং ক্লডিয়ার ছয়, ক্রস ছিল ছোটবেলায় বেশ আক্রমণাত্মক। ছোট বোন ক্লডিয়াকেও ছাড়ত না। পাঞ্চিংয়ের অভ্যাস করত ক্লডিয়ার পাকস্থলি বরাবর আঘাত করে বাবা-মার সামনেই সে এমন দুরন্তপনার সাহস দেখাত। ক্লডিয়া দক্ষ ভাইয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য কেঁদে ফেলত। ক্রসের এই আচরণকে দমন করতে পিপি তখন ভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিত।

ক্রসকে তার পাঞ্চিং অভ্যাস থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিত পিপি প্রথম। এতেও যদি ক্রস না থামত, তখন পিপি, তার ঘাড় ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখত– এমনটা প্রায়ই করত পিপি। অথবা ক্লডিয়াকে নির্দেশ দিত— যেভাবে ক্রস তাকে আঘাত করেছে, ঠিক সেভাবে ক্লডিয়া যেন আঘাত করে। ক্রসের জ্বালাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পিপি তাকে ওয়ালে পাঞ্চ করার নির্দেশ দিত– এতে সে এক-দুবারের বেশি করতে পারত না। এক সময় সে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ত। কিংবা ন্যালিনি তাদের ওপর অতিষ্ঠ হয়ে কখনো রেগে উঠত। কিন্তু পিপি তখন একটি সিগারেট ধরিয়ে শান্ত কণ্ঠে ক্রসের উদ্দেশে বলত, সব সময় তুমি তোমার বোনকে মারছ। এবার থেকে তুমি তাকে যত মারবে ক্লডিয়া আমার কাছ থেকে ততবার একটি করে ডলার পাবে। এরপর ক্রস ক্ষেপে গিয়ে আবারো ক্লডিয়াকে আঘাত করতে শুরু করত, আর পিপি ক্লডিয়াকে সাথে সাথেই দিত একটি করে ডলার। অবশেষে হিংসায় হোক, কিংবা ক্লান্ত হয়ে ক্রস থামতে বাধ্য হতো।

উপহারে উপহারে ভরে দিয়েছিল পিপি তার স্ত্রীকে, কিন্তু সেসব উপহার যেন ন্যালিনিকে পরিণত করেছিল পিপির ক্রীতদাসীতে– পিপির হয়ে জীবন চলার পথে সেগুলো ছিল ছদ্মবেশ ধারণের উপকরণ। হিরের আংটি, পশুর লেসের মূল্যবান মোলায়েম কোট, ইউরোপ সফরসহ বিভিন্ন মূল্যবান উপহার ছিল ন্যালিনির জন্য অযাচিত। ভেগাস ন্যালিনির পছন্দ নয় বলে পিপি তার জন্য স্যাকরামেন্টোতে কিনে দিয়েছিল অবকাশ যাপনের একটি বাড়ি। আর সেই সাথে দিয়েছিল একটি গাড়িও। স্যাকরামেন্টোর বাড়িটিতে পিপি নিজেই শোফারের ইউনিফর্ম পরে স্ত্রী ন্যালিনিকে নিয়ে গিয়েছিল। বিয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে পিপি তাকে দিয়েছিল বর্গিয়া কালেকশনের মূল্যবান একটি অ্যান্টিক রিং। এত কিছু দেয়ার পরও পিপি একটি বিষয়ে ছিল বেশ কৃপণ। পিপি ন্যালিনিকে কখনোই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে দেয়নি।

এই একটি বিষয় ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে পিপির ছিল যথেষ্ট উদারতা– পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ছিল ন্যালিনির। ইতালীয় স্বামীদের মতো পিপি স্ত্রীর প্রতি সন্দেহপ্রবণ ছিল না কখনোই। যদিও ব্যবসায়িক কাজে নিতান্ত প্রয়োজনে তাকে বিদেশে যেতে হতো, তবে তার মন পড়ে থাকত স্ত্রীর প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসায়। পিপি ছাড়া ন্যালিনি অবশ্য ইউরোপের বেশ কিছু দেশ ঘুরেছে– পিপি বাধা দেয়নি। সেসব সফরে ন্যালিনির সফরসঙ্গী হয়েছিল তার বান্ধবীরা। ন্যালিনির দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল লন্ডনের মিউজিয়াম ঘুরে দেখার, প্যারিসের ব্যালে আরো ইতালির অপেরা উপভোগ করার। তার এসব স্বপ্ন, ইচ্ছা পিপি পূরণ করেছে দ্বিধাহীন।

পিপির মধ্যে স্ত্রীর প্রতি সন্দেহের বিন্দু-কণাও না পেয়ে অভিভূতই হয়েছিল ন্যালিনি। তবে কয়েক বছরের মধ্যেই ন্যালিনি এও বুঝতে পেরেছিল যে ভেগাসের এই পরিমণ্ডলে পিপিকে ছাপিয়ে কোনো লোকই তার প্রতি সহান ভূতি কিংবা ভালোবাসা জানাতে আসবে না। এমন কোনো মানুষ নেই সেই তল্লাটে যে এমনকি পিপির স্ত্রীর বন্ধুও হতে পারে।

পিপি-ন্যালিনির বিয়ে এবং তাদের দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন নিয়ে উন ক্লেরিকুজিও ছিলেন সন্দিহান। তিনি একবার মন্তব্য করেছিলেন, তারা কি মনে করে যে তাদের সারাটা জীবন নেচে নেচেই কাটিয়ে দিতে পারবে?

এ প্রশ্নের প্রমাণিত উত্তর হবে না। ন্যালিনি এমন কিছু সেরা নাচিয়ে ছিল যে একেবারে তারকা বনে যাবে। তার পাগুলো ছিল ড্যান্সের জন্য অনুপযুক্ত। তাছাড়া পার্টি গার্ল হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে তার ছিল মারাত্মক রকমের অনীহা। আর এসব কিছুই স্থায়িত্ব পায় পিপির সাথে তার বিয়ে হওয়ার পর।

বিয়ের প্রথম চার বছর ন্যালিনি ছিল খুব সুখী। সন্তানদের যত্ন-আত্তি, পড়াশোনা আর ইউনিভার্সিটি অব নেভেদার ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত ছিল সে। কিন্তু পিপি তার এ সুখে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। রাজ্যের সার্বিক পরিস্থিতির কথা ভেবে বেশি দিন সেখানে থাকতে তার ছিল দ্বিধা। পিপি বুঝতে পেরেছিল– যে কোনো সময় তাদের জীবনে নেমে আসতে পারে বিপদের কালো মেঘ। সে জানত রাজ্যের উছুল কৃষ্ণাঙ্গরা কোনো কিছু না ভেবেই কেড়ে নিতে পারে অনেক কিছু। ন্যাটিভ আমেরিকানদের সম্পর্কেও খুব ভালো ধারণা ছিল না তার– সে যে কেউ হোক না কেন, পিপি-ন্যালিনি ও তাদের সন্তানকে একেবারে সাগরের তলদেশে নামিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না মোটেও। আরো তাছাড়া বই এবং মিউজিক সম্পর্কেও পিপির খুব একটা আগ্রহ ছিল না বিধায় ন্যালিনির এই ইচ্ছায় বাদ সাধল পিপি।

সন্তানদের প্রতি ন্যালিনির মনোভাব ছিল বেশ কঠোর। তাদের সভ্য করে গড়ে তুলতে পিপির প্রতি অভিযোগ করে বলত ছেলেমেয়েদের শাসন না করলে পরে নিজেই তাদের আচার-আচরণে হতবুদ্ধি হয়ে পড়বে। শিশুরা পশুর মতো হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় তাদের শাসন না করলে, কিভাবে তাদের এই আচরণ-ব্যবহার শোধরাবে? ন্যালিনির এ অভিযোগের পরও পিপি তার সন্তানদের গায়ে কখনো টোকাটাও দেয়নি।

তাদের বিয়ের চতুর্থ বছরে সন্তানদের প্রশিক্ষণ দিতে ন্যালিনির জন্য পিপি মিস্ট্রেস নিযুক্ত করল। আর এ নিয়োগও ছিল উল্লেখ করার মতো। এদের একজন লাস ভেগাসের, একজন নিউইয়র্কের এবং আরেকজন লস অ্যাঞ্জেলেসের। এই তিন মিস্ট্রেসের কাছে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে ন্যালিনি হয়ে উঠল দক্ষ।

সন্তান মানুষ করতে শুধু ন্যালিনিই নয় পিপিও যোগ দিল একই সাথে। কঠোর পরিশ্রম আর ভালোবাসায় সন্তানদের জীবনও হয়ে উঠল মধুর। সন্তানদের লেখাপড়া, গান-নাচে দক্ষ করে তুলতে ন্যালিনিও তাদের পেছনে অতিবাহিত করতে লাগল ঘন্টার পর ঘণ্টা। পিপির উন্নত মনোভাবে তাদের দাম্পত্য জীবনও হয়ে উঠল মধুর। পিপির যত গুণ হচ্ছে, তার জীবনীশক্তি ও পশুর মতো উচ্ছলতা। কোনো স্বামী-স্ত্রীর বিবদমান সম্পর্ককে সহজ করতে এমন গুণ অবশ্যই ফলপ্রসূ।

পিপি-ন্যালিনির যেমন তাদের সন্তানের প্রতি ছিল প্রচণ্ড ভালোবাসা, সন্তানদেরও ছিল ঠিক তেমনই তাদের বাবা-মার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। তারা ভালোবাসত তাদের মাকে আর শ্রদ্ধাপূর্ণ অনুসরণ করত বাবাকে। ন্যালিনিকে ভালোবাসার কারণ মা হিসেবে সে সন্তানদের কাছে ছিল খুব মিষ্টি স্বভাবের, নম্র, সুন্দরী তো বটেই, সেই সাথে একেবারেই নির্ভরযোগ্য। অপরদিকে বাবা ছিল বেশ দৃঢ় ও শক্তিশালী।

বাবা ও মা খুব ভালো শিক্ষকে পরিণত হয়েছিল। মায়ের কাছে তারা শিখত সামাজিক রীতি-নীতি, ভালো আচার-ব্যবহার, নৃত্য, পোশাক পরিচ্ছদের নিয়ম-কানুনসহ জীবন চলার পথের বিভিন্ন আদব-কায়দা। বাবা তাদের শেখাত কিভাবে ছেলেমেয়েরা তাদের শারীরিক বিপদ-আপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করবে, এথলেট হিসেবে শারীরিক গঠনের কলা-কৌশল, আর এসবের সাথে গ্যাম্বলও। বাবার কাছে এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে ছেলেমেয়েদের বেশ কষ্ট হতো, কিন্তু কখনোই বাবার প্রতি তারা বিরক্ত বোধ করত না। এর কারণ পিপিও তার সন্তানদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিত না কিছু যা কিছু সে করত অত্যন্ত নিয়ম-শৃঙ্খলার মাঝে। রাগ হতো না সে কখনো, শেখাত স্নেহের সাথে। বন্ধুর মতো।

ক্রস ছিল একেবারে ভয়-ভীতিহীন দুর্দান্ত চঞ্চল এবং স্বভাবগত নমনীয়। এদিক থেকে ক্লডিয়া তার ভাইয়ের মতো শারীরিক আচরণে খুব একটা উৎসাহিত না হলেও নিশ্চিতভাবেই ছিল একটু একগুঁয়ে।

কিছুদিনের মধ্যেই একটি বিষয়ে ন্যালিনির খটকা লাগল। প্রথম প্রথম বিষয়টিকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি সে। কিন্তু পরে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। তাসের বিভিন্ন রকমের খেলা যেমন পোকার, ব্ল্যাক জ্যাক, জিন এসব যখন বাচ্চাদের শেখাত পিপি, ন্যালিনি তেমন গা করেনি। কিন্তু খেলাগুলো শেখাতে গিয়ে পিপি তাদের যখন কার্ডের ফাঁক-ফোকর চুরিবিদ্যা, প্রতারণামূলক দিকগুলো তুলে ধরত, তাদের বরাদ্দকৃত অর্থ যখন সে কৌশলে, নিয়ে নিত তখন ক্ষেপে যেত ন্যালিনি। ক্রসের চেয়ে এ বিদ্যায় ক্লডিয়া এগিয়ে গিয়েছিল অনেক বেশি পারদর্শীও হয়ে উঠেছিল বেশ। পিপি অবশ্য পরে ছেলে-মেয়ের সাথে যে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল তা সবিস্তারে বর্ণনা করত। ন্যালিনি তখন রাগ হয়ে পিপিকে বলত–আমি মনে করি, তুমি ছেলে-মেয়ের জীবন নিয়ে খেলছ, যেভাবে তুমি খেলছ আমার সাথে। পিপি তখন প্রতিউত্তরে বলত, এটাও তাদের শিক্ষার একটা অংশ। ন্যালিনি বলত, এটা কোনো ভালো শিক্ষা নয়, দুর্নীতির প্রশিক্ষণ। তখন পিপি বলত– আমি চাই সন্তানরা যাতে জীবনের বাস্তব দিকগুলো শেখে এবং এখন থেকেই তার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু ন্যালিনি তা চাইত না। ন্যালিনির ইচ্ছে— সন্তানরা যাতে জীবনের সুন্দর দিকগুলোর প্রতি উৎসাহিত হয়ে ওঠে।

পিপির টাকা রাখার একটি ওয়ালেট ছিল। তা সবসময় পরিপূর্ণ থাকত পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থে। ন্যালিনি মনে করত, একজন ট্যাক্স কালেক্টর হিসেবে এটা অসম্ভব কিছু নয়, তবে সন্দেহও যে হতো না, তা নয়। এটা সত্য যে পিপি একটি বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক একটি কালেকশন এজেন্সি। কিন্তু এ থেকে পিপির যা আয়, তার চেয়ে তারা অনেক বেশি সচ্ছল, ধনী— বিষয়টি প্রায়ই ন্যালিনিকে ভাবিয়ে তুলত।

অবকাশ যাপনে কিংবা অন্যান্য ভ্যাকেশনে তারা কখনো যেত পূর্বে, কখনো ক্লেরিকুজিও’র বিস্তৃত পরিবারের আশপাশের কোনো অঞ্চলে। সেসব জায়গায় তীক্ষ্ণ ধীসম্পন্ন ন্যালিনি দেখত সবাই তাদের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল এই শ্রদ্ধা একেবারেই ভিন্ন। কখনো কখনো পিপি সেই পরিমণ্ডলের লোকজনের সাথে দীর্ঘ সময় ধরে গোপনীয় আলোচনায় ডুবে যেত– সেখানে ন্যালিনির প্রবেশাধিকার থাকত না। এসব দেখে বিস্মিত হতো ন্যালিনি। তার মনে বিভিন্ন প্রশ্নের অবতারণা হতো।

আরেকটি ছোট বিষয় নিয়েও ন্যালিনির মনে প্রশ্ন জাগত। সেটা হচ্ছে পিপির প্রায়ই অর্থাৎ প্রতি মাসেই অন্তত একবারের জন্য হলেও ব্যবসায়িক কারণে বাইরে সফর। কিন্তু ন্যালিনি এসব সম্পর্কে কখনোই বিস্তারিত কিছু জানতে পারেনি। পিপিও এ বিষয়ে কখনো কিছু বলত না। সে বৈধভাবেই লাইসেন্সকৃত আগ্নেয়াস্ত্র ও বহন করত– একজন কালেক্টর হিসেবে বড় পরিমাণ অর্থ লেনদেন বিষয়ে অস্ত্র সাথে রাখাটা অযৌক্তিক নয়– অন্তত ন্যালিনি এ ব্যাপারে এমন একটি যুক্তি মনে মনে দাঁড় করিয়েছে। পিপি যথেষ্ট সতর্ক মানুষ। তার আগ্নেয়াস্ত্রের কোনো অংশই পিপি ন্যালিনি কিংবা সন্তানদের হাতের নাগালে রাখত না, বুলেটগুলো তালাবন্দি করে রাখত পৃথক এক স্থানে।

এভাবেই বছর চলে যাচ্ছিল আর পিপিরও ব্যবসায়িক সফর বাড়ছিল ক্রমেই। ন্যালিনি বেশিরভাগ সন্তানদের নিয়েই একাকী থাকতে লাগল সময়। যতই দিন যাচ্ছিল, পিপি-ন্যালিনির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কে অবনতি ঘটছিল ক্রমেই। স্বামী-স্ত্রীর যৌন সম্পর্কে দেখা দিয়েছিল টানাপোড়েন। পিপি যেন তার স্বভাবসুলভ কামনা সম্ভোগ থেকে দূরে সরে পড়ছিল– হয়ে উঠছিল সংযত এবং সহানুভূতিশীল। দুজনার দূরত্ব বেড়ে গেল আরো বেশি।

একজন মানুষের পক্ষে তার সহজাত প্রবৃত্তি অত্যন্ত আপনজনের কাছে, অন্তত যার সাথে সে তার জীবনের সবচেয়ে সান্নিধ্য সময় অতিবাহিত করেছে, সেই প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে লুকিয়ে রাখা অসম্ভব। ন্যালিনির চোখে ধরা পড়ল পিপি যেন নিজেকে লুকাতে ব্যস্ত সে তার উচ্ছলতাটুকুও ঢেকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পিপি প্রকৃতির উচ্ছ্বাস লঙ্ঘন করেছে কখনো, কিন্তু ন্যালিনিকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। তবে তার এই লুকানো প্রবণতাকে ঢাকতে নিজের স্বভাবজাত উচ্ছ্বাস, উচ্ছলতা প্রকাশের চেষ্টা করত সেটা ছিল। নিছক মেকি– ছদ্মবেশ। স্ত্রীর প্রতি তার আচরণ ছিল আগের মতোই অমায়িক, তবে ন্যালিনি পেত বিপদের আভাস–স্বাভাবিক মনে হতো না তাকে।

পিপির ছোটখাটো কিছু নির্বুদ্ধিতা তাকে মানুষের কাছে আরো গ্রহণযোগ্য করে তুলত আনন্দ পেত অনেকে এই নির্বুদ্ধিতায়। কিছু কিছু বিষয়ে সে বোকার মতো আনন্দ করত কিংবা কষ্ট পেত। আর তার এই অনুভূতি সহানুভূতি হতো অনেক মানুষ কিংবা অনেকের অনুভূতি-উপলব্ধিকে সে তাদের মতো করেই নিত। একবার এক দম্পতিকে ইতালীয় এক রেস্তোরাঁয় ডিনারের নিমন্ত্রণ করে সে। দম্পতিটি ইতালীয় খাবারত দামের কারণে বেছে বেছে খেতে শুরু করে। পিপি এ অবস্থা দেখে নিজের খাবার আর শেষ করতে পারেনি।

ন্যালিনিকে পিপি ভেগাসে তার কালেকশন এজেন্সি সম্পর্কে, তার কাজ সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিয়েছে। ভেগাসের বড় বড় হোটেলগুলো তার ক্লায়েন্ট। এই হোটেলগুলোয় যে গ্যাম্বলিং চলে তার নির্দিষ্ট একটা আয় পিপির এই এজেন্সিকে দিতে হয়। জুয়াড়িদের কাছ থেকে আয়ের অংশ নেয়া দুরূহ বিধায় পিপি নতুন কৌশলে গ্যাম্বলিং মেকার অর্থাৎ যারা গ্যাম্বলিংয়ের পয়েন্ট লিপিবদ্ধ করে, তাদের কাছ থেকে আদায় করে নেয়।

একটি বিষয়ে পিপি ন্যালিনিকে প্রায় বলত, জোর করে কখনো ভালো কিছু আদায় সম্ভব নয়- অব্যাহত চলতে থাকা বিশেষ কিছু বিষয় বা ক্ষেত্র ছাড়া। যারা ঋণ শোধ করবে, এটা তাদেরও একটি মান-সম্মানের বিষয়। আসলে, প্রত্যেকেই যার যার কাজে দায়িত্বশীল এবং এই দায়িত্বশীলতাই তাকে রক্ষা করে যদি সে প্রতিনিয়ত বাধ্যবাধকতার মুখোমুখি না হয়।

বিশেষ করে চিকিৎসক, আইনজীবী কিংবা করপোরেশনের প্রধান কর্মকর্তারা এক্ষেত্রে তাদের সম্মান বজায় রাখতে প্রশংসনীয় আচরণ করে থাকে– মোটামুটি দর কষাকষিকে পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে। তাদের কছ থেকে অর্থ আদায় করে নেয়াটা কঠিন নয়। আচরণ যদি তাদের নেতিবাচক হয়, তবে তাদের কর্মক্ষেত্রে গিয়ে একটু উচ্চবাচ্য করলেই হলো– তাদের ক্লায়েন্টরা শুনবে, জানবে তাদের ভদ্রতার পোশাকের নিচে ভিন্ন জগতের কথা। এজন্য সাধারণত তারা সতর্কতার সাথেই লেনদেন করে থাকে।

তবে যারা ছোটখাটো ব্যবসা করে, তারা এক ডলারে জুয়ার দানে লাগায় এক পেনি। আবার এদের মধ্যে অনেকে একটু বেশিই চালাক—- তারা এমনভাবে চেকে অর্থের পরিমাণ লেখে, যা বাউন্স হবার সম্ভাবনাই বেশি। এটা একটা চমৎকার কৌশল। যেমন জুয়ার দানে এই শ্রেণীর লোক একটি দশ হাজার ডলারের চেক প্রদান করল কিন্তু দেখা গেল তার ব্যাংকের একাউন্টে রয়েছে আট হাজার। এই ক্ষেত্রে তার ব্যাংক একাউন্টটি পিপি পূর্বেই দেখে নেয় এবং চেকটি যাতে বাউন্স না হয় সে জন্য দশ হাজার পূরণ করতে অতিরিক্ত দুহাজার ডলার জমা করে ফেলা হয় তার নামে। দান ধরা লোকটি হেরে গেলে তার একাউন্ট অনায়াসেই শূন্য করা যায়। এমন সব কাহিনী ন্যালিনিকে শুনিয়ে হেসে উঠত পিপি।

এক রাতে পিপি ন্যালিনিকে তার জীবনের একটি মজার কাহিনী বলেছিল– কাহিনীটি ছিল পিপির কাছে হাস্যকর। জানাদু হোটেলের কাছে ছোট একটি শপিং মলের মতো কালেকশন এজেন্সিতে বসে কাজ করছিল পিপি। অফিসে বসেই শুনতে পেল গুলির শব্দ। সাথে সাথে বেরিয়ে এলো সে। দেখল পাশের একটি জুয়েলারি দোকান থেকে মুখোশধারী দুজন ডাকাত পালিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কোনো কিছু চিন্তা না করেই পিপি তার বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। তবে ডাকাত দুটি তাদের জন্য অপেক্ষমাণ গাড়িতে লাফিয়ে উঠে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে পৌঁছল ঘটনাস্থলে এবং আশপাশের মানুষের কাছে জিজ্ঞেসাবাদের পর তারা পিপিকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল– যদিও নিশ্চিতভাবেই তারা জানত পিপির অস্ত্রটি লাইসেন্সকৃত। কিন্তু গায়ে পড়ে এমন আচরণ একটি অপরাধ বলেই বিবেচিত। অবশ্য আলফ্রেড গ্রোনিভেল্ট থানায় গিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনেন।

গল্পটি বলতে বলতেই পিপি নিজের কাছেই প্রশ্ন করল, আমি জঘন্য কাজটি কেন করেছিলাম? আলফ্রেড আমাকে বলেছিল, আমার মধ্যে নাকি শিকারে তীব্র আকাঙ্ক্ষা কাজ করেছিল তখন। কিন্তু আমি তা বুঝতে পারিনি। এই আমিই কি ডাকাতদের গুলি করেছিলাম? সমাজ রক্ষায় আমি কি এ কাজ করেছিলাম? যে উদ্দেশ্যেই হোক আমার অপরাধের সাজা তারা আমাকে গ্রেফতার করে দিয়েছিল। এই আমাকেই তারা থানায় আটকে রেখেছিল।

কিন্তু এই ছোট ঘটনাটিই, পিপির চরিত্রের একটি সামান্যতম অংশের এই খুনে মনোভাব ন্যালিনির মনে দাগ কেটেছিল। পিপির চরিত্রের গোপনীয় এই সত্যটি ন্যালিনিকে ওলট-পালট করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে যা অবশেষে ন্যালিনিকে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে …

.

সান্তাডিও ফ্যামিলির ড্যানি ফিউবার্টা। নিজের উপার্জনের ওপর লোন নিয়ে নিউইয়র্ক ট্রাভেল এজেন্সি নামে একটি পরিবহন সংস্থা চালাচ্ছে সে আপন মালিকানায়। লুপ্তপ্রায় সান্তাডিও ফ্যামিলির এই সদস্যটির আয়ের বেশিরভাগ অর্থই আসে ভেগাসে অভ্যাগত অতিথিদের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা করে। অফিসিয়াল পদবিতে যাকে বলা হয় জাঙ্কেট মাস্টার। ড্যানি ফিউবার্টার পদবি এটি।

বিভিন্ন শহরের গ্যাম্বলারদের জন্য ভেগাসে অবকাশ যাপনের সুবন্দবস্ত করে থাকে একজন জাঙ্কেট মাস্টার। ফিউবার্টার কাজটিও তেমনই–গ্যাম্বলারদের ধরে রাখতে সে তার পরিবহন সংস্থার ব্যবহার তো করেই, ভেগাসের হোটেলগুলোর সাথেও তার রয়েছে চুক্তি। ফিউবার্টার রয়েছে নিজস্ব একটি ৭৪৭ জেট। প্রতি মাসে এতে সে বহন করে দুই শতাধিক যাত্রী, যারা কেবল ভেগাসের জানাদু হোটেলে আসে শৌখিন গ্যাম্বলার হয়ে।

ফিউবার্টার দেয়া এই বিশেষ প্যাকেজ সুবিধায় গ্রাহককে দিতে হয় কেবল হোটেল রেন্ট। একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া মোটে এক হাজার ডলার। আর এর বিনিময়ে ফিউবার্টার গ্রাহকরা পায় নিউইয়র্ক থেকে ভেগাসে বিমানের ফ্রি রাউন্ড ট্রিপ, যাতায়াতকালে বিমানের ফ্রি খাওয়া-দাওয়া, হোটেলে ফ্রি কক্ষ এবং খাদ্য ও পানীয়। ফিউবার্টা সবসময় তার গ্রাহকদের খুশি করতে সচেষ্ট গ্যাম্বলিংয়ে উচ্চতর পর্যায়ে খেলার সুবিধাসহ প্রতিদিন ক্যাসিনোয় গ্রাহকরা পায় নিশ্চিতভাবে চার ঘণ্টা করে সময়। ফিউবার্টার গ্রাহকরা হোটেল জানাদুর ক্যাশে ক্রেডিট কার্ডের সুবিধাও পেয়ে থাকে।

ফিউবার্টার সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো সমাজের ভয়ানক অপরাধীদের সথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এদের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক ডাকাত, মাদক ব্যবসায়ী, সিগারেট চোরাচালানিসহ নিউইয়র্কের নিকৃষ্ট পেশাজীবীর লোক। আর এই লোকগুলোই ফিউবার্টার সবচেয়ে ভালো গ্রাহক। আসলে এই পেশাজীবীর লোকজন তাদের কর্মকাণ্ডের জন্যই সবসময় মারাত্মক মানসিক চাপের মধ্যে দিন অতিবাহিত করে। এই একঘেয়ে জীবন থেকে কিছুটা সময়ের জন্য মানসিক পরিতৃপ্তি পেতে তারা জানাদু হোটেলে তাদের অবকাশ যাপনের জন্য ছুটে আসে। কালো পথে উপার্জিত তাদের প্রচুর কালো টাকা জুয়ায় উড়িয়ে দেয়, কিংবা আয়ও করে এ থেকে— গ্যাম্বল যেন তাদের মানসিক তৃপ্তির এক অসাধারণ উপায়।

জানাদু হোটেলে প্রতিদিন দুশ যাত্রী সরবরাহ করতে পারলে ড্যানি ফিউবার্টা তার কমিশন হিসেবে পায় কুড়ি হাজার ডলার। অনেক সময় জানাদু হোটেলের তরফ থেকে কিছু বোনাস অর্থও পেয়ে থাকে সে। যদি ফিউবার্টার কাস্টমাররা গ্যাম্বলিংয়ে প্রচুর পরিমাণ অর্থ হেরে যায় তাহলে এই অর্থের একটা ভাগও সে পায় বোনাস হিসেবে। অর্থাৎ প্রতিদিন ফিউবার্টা তার প্যাকেজ থেকে পায় বিশাল পরিমাণের একটা অংক। তবে দুর্ভাগ্যবশত ফিউবার্টাও গ্যাম্বলিংয়ে মারাত্মক রকমের আসক্ত। আর এর ফলে তার আয়ের অধিকাংশই তাকে খোয়াতে হয় জুয়ায় অনেক সময় তার আয়ের অতিরিক্তও চলে যায়

তবে, যার রয়েছে এমন আয়ের সুবিধা, গ্যাম্বলিংয়ে ব্যাপক হারের পরও এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে তার বেগ পেতে হয় না। নতুন ভাবে পুনরায় সচ্ছলতার পথ ফিউবার্টা সফলতার সাথেই বের করে নেয় আবারও সচ্ছল হয়ে ওঠে। তবে ক্যাসিনোর জাঙ্কেট মাস্টারের দায়িত্ব পালনকালে ফিউবার্টা আগেই তার ক্যাসিনো কাস্টমারদের ক্রেডিট কার্ড কিংবা ব্যাংক একাউন্ট পরীক্ষা করে নেয়।

ফিউবার্টার রয়েছে একেবারেই উপযুক্ত একটি সশস্ত্র পাণ্ডা দল। তাদের সাথে সে একবার জানা হোটেলের আট লাখ ডলার চুরির পরিকল্পনা করে। এ প্রেক্ষিতে সে তার চার জন লোককে গার্মেন্টের মালিক সাজিয়ে অত্যন্ত উচ্চ রেটিংয়ের নকল ক্রেডিট কার্ড দিয়ে হোটেলে পাঠায়। আর এদের বিস্তারিত জীবন বৃত্তান্ত ফিউবার্টা তার এজেন্সি থেকে সরবরাহ করে, যাতে অন্তত জানাদু হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। ফিউবার্টা তার এজেন্সির রিপোর্টে জানায়– এই চার ব্যক্তির প্রত্যেকের ক্রেডিট কার্ডের লিমিট দুই লাখ ডলার করে। যার ফলে তারা ক্যাসিনোতে অংশগ্রহণে সক্ষম।

ক্যাসিনোতে এই চারজনের উচ্ছ্বাস-উদ্যম যেন মাতিয়ে রাখে। তাদের এই উৎসবপূর্ণ অবস্থা দেখে গ্রোনিভেল্ট বলেছিলেন– ওহ, এ যেন এক পিকনিকের আমেজ।

ফিউবার্টার এই অর্থ চুরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে তার লোকজনকে হোটেলে থাকতে হয়েছিল দুদিন। এই দুদিনে ফিউবার্টা ও তার দলের রুম সার্ভিস বিল হয়েছিল প্রচুর। তারা ডিনারে আমন্ত্রণ জানাত সুন্দর সুন্দর মেয়ের দলকে।

গিফট শপগুলোতে নামের সই-স্বাক্ষর করেই সেই রূপসীদের পাঠিয়ে দেয়া হতো। ক্যাসিনো থেকে তারা নিত সব সময় ব্ল্যাক টিপস।

দুটো ভাগে ভাগ করেছিল ফিউবার্টা তার দলকে। ক্যাসিনোয় একটি দল খেলত ডাইসের বিরুদ্ধে, আর অপর দলটি পক্ষে। এ উপায়ে তারা হেরেও যেত। আর তাই হারতে হারতে এক সময় তারা দশ লাখ ডলারের দান বসাত। এটা করার কারণ ছিল, ফিউবার্টা এই দান দেখে এক পর্যায়ে ক্যাশ যাচাইয়ের জন্য যেতে উদ্যত হবে। আসলে এ সবই ছিল অভিনয়। ফিউবার্টার লোকজনের ভাব দেখে মনে হতো তারা যেন মারাত্মকভাবে ডুবে গেছে জুয়ায়। অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তারা এ অভিনয় চালিয়ে যেত- ডাইসের কাছে গিয়ে তারা যেন প্রার্থনা করতে শুরু করত। দান হেরে গেলে মারাত্মক মুষড়ে যেত এবং জিতলে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত।

এভাবেই শেষদিন অর্থাৎ দ্বিতীয় দিন তারা ফিউবার্টার কাছে ক্যাশ করানোর জন্য তাদের পুরনো চিপসগুলো দিয়ে নতুন চিপস সংগ্রহ করল। এই হাস্যকর অবস্থার যখন সমাপ্তি ঘটল তখন দেখা গেল সিন্ডিকেট আট লাখ ডলারের ধনী– যারপরনাই খুশিও হয়েছিল তারা এই আয়ে।

ড্যানি ফিউবার্টা, এই অভিনব কৌশলের পরিকল্পনাকারী। দুদিন শেষে তার ঝোলায় ভরেছিল চার লাখ ডলার আর অবশিষ্ট অংশের অংশীদার সেই চার-ডাকাতও তাদের পাওনা বুঝে পেয়ে খুশি হয়েছিল। বিশেষ করে ফিউবার্টা প্রতিশ্রুতি মোতাবেক যখন তার ডাকাত দলের সদস্যদের ফ্রি খাদ্য, মদপান, সুন্দরী ললনা এসব শর্ত পূরণ করেছিল তখন তাদের বসের ওপর নির্ভরতা বেড়ে গিয়েছিল আরো বেশি।

কিন্তু ফিউবার্টার এই ডাকাতির সব কিছুই ধরা পড়েছিল গ্রোনিভেল্টের  কাছে। দুদিনব্যাপী ডাকাতির পরের দিন গ্রোনিভেল্ট সব কিছুই জনসমক্ষে প্রকাশ করে ফেলেন। জনদু হোটেলের সার্ভিলেন্স ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছিল এসব— এই ক্যামেরায় বাদ যায়নি ফিউবার্টার ক্যাসিনো জাঙ্কেটর কর্মকাণ্ডও। সার্ভিলেন্স ক্যামেরাকে তিনি আখ্যা দিয়েছিলেন আকাশের চোখ। অবশ্য গ্রোনিভেল্ট এই সার্ভিলেন্স ক্যামেরাগুলো চালু করে দিয়েছিলেন মূল অপারেশনের দশ মিনিট আগে– ক্যাসিনোর ক্যাশে অস্বাভাবিক অর্থ হ্রাসের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তিনি তৎপর হয়েছিলেন।

গত কয়েক বছরে জানাদু হোটেলে এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে। গ্রোনিভেল্ট বেশ অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিলেন। বিশেষ করে ফিউবার্টার ডাকাতি চক্রান্তটি ছিল বিগত বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ধরনের ঘটনা। দীর্ঘ দিন ধরে একের পর এক এমন অর্থচুরির ঘটনায় গ্রোনিভেল্ট উপায়ন্তর না দেখে অবশেষে সার্ভিলেন্স ক্যামেরার সাহায্য নিতে বাধ্য হন। গুরুতর অপরাধ ধরা পড়ার পরও তিনি ফিউবার্টার বিরুদ্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি, তাকে ভালোবাসতেন গ্রোনিভেল্ট। এর কারণ মানুষটি জানাদু হোটেলের আয়ের অন্যতম উৎস। তাছাড়া গ্রোনিভেল্টও যে মাঝে মাঝে নকল আইডি প্রদর্শন করেন, তা ফিউবার্টা বেশ ভালোই জানে। বিষয়টি তার কাছ থেকে ফাঁস হয়ে যাওয়ারও ভয় আছে। তবে ফিউবার্টার সেই ডাকাতি পরিকল্পনার সমস্ত তথ্য গ্রোনিভেল্ট প্রথমে পিপি ডি লিনাকে জানান। পিপি ফিউবার্টাকে চেনে কিন্তু সেই চার সদস্য সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। গ্রোনিভেল্ট পৃথক পৃথক গোপন ক্যামেরা ও স্থির চিত্র ধারণ করে পিপির কাছে ছবি ও ভিডিও ফুটেজগুলো দেন।

গ্লোনিভেন্টের কাছে তথ্য ও প্রমাণগুলো পেয়ে পিপি মাথা নেড়ে বলল, ড্যানি কি করে ভাবল যে এমন এক অপরাধ করে সে পার পেয়ে যাবে? আমি তাকে জানাদু হোটেলের একজন স্মার্ট প্রতিনিধি ভেবেছিলাম।

সে একজন জুয়াড়ি গ্রোনিভেল্ট বললেন। তারা মনে করে তাদের কার্ডগুলো সব সময়ই জয়ের কার্ড। একটু থামলেন। তারপর বললেন, ড্যানি হয়তো তোমাকে ফুসলানোর চেষ্টা করবে। সে হয়তো বলবে সে এসবের কিছুই জানে না। তবে মনে রেখো, ফিউবার্টাকে প্রমাণ করতে হবে এ বিষয়ে। সে হয়তো বলবে, সে যে এই বিপুল পরিমাণে অর্থের হেরফের করেছে, তা তাদের আইডির ওপর ভিত্তি করেই। অবশ্য একজন জাঙ্কেট মাস্টারকে যে কোনো অংশগ্রহণকারী ব্যক্তির সমস্ত তথ্য প্রমাণ করতে হয়।

পিপি গ্রোনিভেল্টের  কথায় হাসল। গ্রোনিভেল্টের গায়ে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করে বলল, চিন্তা করো না, সে আমাকে ফুসলাতে পারবে না।– এ কথায় পিপি ও গ্রোনিভেল্ট উভয়ে হেসে উঠল। ড্যানি ফিউবার্টা যদি অপরাধী হয়েও থাকে, তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাকে দায়ী করা হচ্ছে তার ভুলের জন্য।

কুওগে ক্লেরিকুজিও পরিবারের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য পিপি পরদিনই নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা হলো।

.

প্রহরী-সুরক্ষিত প্রধান ফটক পেরিয়ে ইট বিছানো রাস্তার ওপর দিয়ে নিজেই। গাড়ি ড্রাইভ করে এগিয়ে যাচ্ছিল পিপি। রাস্তার দুধারে হেঁটে দেয়া ঘাসের মসৃণ সবুজ খোলা মাঠ। চারপাশের দেয়ালগুলোয় কাঁটাতারের বেড়া, তাতে রয়েছে বৈদ্যুতিক সংযোগ এবং স্বয়ংক্রিয় কিছু আগ্নেয়াস্ত্র।

ম্যানসন পর্যন্ত পৌঁছেই পিপি দেখতে পেল একেবারে ফটক বরাবর দাঁড়িয়ে আছে একজন গার্ড, এর অর্থ এখন এখানে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে।

ম্যানশনের কাছে পৌঁছতেই বেরিয়ে এলো জর্জিও। পিপিকে অভিনন্দন জানাল সে। তারপর পিপিকে নিয়ে হেঁটে এলো পাশের একটি বাগানে। বাগান ভরা টমেটো ও শসার গাছ, সুন্দরভাবে বিন্যস্ত লেটুস ও তরমুজের পৃথক পৃথক ক্ষেত। তবে এত বড় এই বাগানে নেই কোনো ফুলের গাছ। ফুলের জন্য এখানে কোনো জায়গাই রাখেননি ক্লেরিকুজিও।

বাগানেরই এক পাশে মনোরম পরিবেশে পেতে রাখা কাঠের টেবিল। টেবিল ঘিরে বসে রয়েছে ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির সদস্যরা। দিনের প্রথমার্ধের লাঞ্চের সময়। ভন স্বয়ং উপস্থিত রয়েছেন নির্ধারিত আসনে। সত্তর বছরের বার্ধক্য তাকে ছোয়নি– উজ্জ্বল, সতেজ এবং সকালের রক্তিম আভা ঘিরে ছিল। তার পূর্ণ অবয়বে। দূর থেকে ভেসে আসছিল ডুমুর জাতীয় ফল দিয়ে তৈরি পানীয়ের মিষ্টি সুবাস।

ডন তার দশ বছরের নাতি ডেন্টিকে কিছু একটা খাওয়াচ্ছিলেন স্নেহের সাথে। ক্রসের সমবয়সি ডেন্টি। বয়স অনুপাতে সুস্বাস্থ্যেরও অধিকারী, তবে সবেমাত্র বালক হিসেবে দাম্ভিকতাই যেন তার প্রধান ভূষণ। ডন নিজ হাতে তাকে খাইয়ে দিচ্ছিলেন, আর আলোড়িত ডেন্টি বিভিন্ন মুখভঙ্গিমা আর আহাদি বিলাপ বকে যাচ্ছিল। দাদু-নাতির এ তামাশা দেখে বিব্রত বোধ করছিল ভিনসেন্ট এবং পেটি।

পিপি টেবিল ঘিরে একটি শূন্য চেয়ার দখল করে বসল। ডেন্টির খাওয়ার পর্ব শেষ না হওয়া অবধি মিটিং শুরু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অবশেষে ডেন্টির মা রোজ ম্যারির হস্তক্ষেপে সে পর্বের সমাপ্তি ঘটল। ডেন্টি যখন তার মায়ের সাথে হেঁটে চলে যাচ্ছিল ডন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ডেন্টির দিকে হয়তো খানিকটা উদাসও হয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে ফিরে এলেন, তাকালেন পিপির দিকে। তবে ডেন্টির রেশ তখনও ছিল তার মননে– কুলরক্ষক ভবিষ্যতের ডন ডেন্টির উদ্দেশে একটা দীর্ঘশ্বাসই ফেললেন ক্লেরিকুজিও।

পিপির উদ্দেশে বললেন, ওই ফিউবার্টা, রাসকেলটার সম্পর্কে কি ভাবছ তুমি? আমরা তাকে দিয়েছি জীবিকা। আমাদের খরচেই তাকে আমরা পেটুক বানিয়ে তুলছি।

জর্জিও স্বভাবসুলভ শান্ত কণ্ঠে বলল, আত্মসাৎকৃত অর্থগুলো যদি সে ফিরিয়ে দেয় তবেই সে আগের মতো আমাদের হয়ে কাজ করতে পারবে। জর্জিও’র এই ছিল ফিউবার্টার জন্য একমাত্র ক্ষমা পাওয়ার পথ।

এটা কোনো ছোট অংকের টাকা নয়, ডন বললেন, টাকাটা তার কাছ থেকে অবশ্যই আমাদের ফিরিয়ে নিতে হবে। ডন পিপির মতামত জানতে চাইলেন।

ফিউবার্টার উদ্দেশ্যে গালাগাল করে পিপি বলল, আমি চেষ্টা করতে পারি তবে তার মতো মানুষ তাদের দুঃসময়ের জন্যও একটি পেনিও জমা করে রাখে না।

ভিনসেন্ট ফিউবার্টার উদ্দেশে বিড়বিড়িয়ে শ্রাগ করল। বলল, দেখি ছবিগুলো দেখাও তো পিপি এক এক করে ছবিগুলো দেখাতে লাগল। ভিনসেন্ট এবং পেটি গভীর মনোযোগে দেখছিল সেই অস্ত্রধারী চার ডাকাতের ছবি। কিছুক্ষণ পর উজ্জ্বল হয়ে উঠল ভিনসেন্টের মুখ। সে বলল, আমি এবং পেটি তাদের চিনি।

পিপি উল্লসিত হয়ে বলল, দারুণ! তাহলে তোমরা এখনই ওই চারজনের তথ্য খুঁজে বের করো। ডনের উদ্দেশ্যে পিপি প্রশ্ন করল, ফিউবার্টার ব্যাপারে কি করা যায়?

ডন বললেন, তারা আমাদের উদ্দেশ্যে ঘৃণা প্রদর্শন করেছে। তারা কি জানে না আমাদের পরিচয়? যারা নির্বোধ, শক্তিহীন তারা যাবে পুলিশের কাছে। ভিনসেন্ট এবং পেটির উদ্দেশে ডন বললেন, তোমরা পিপিকে সহযোগিতা করো। আমি তাদের কাছ থেকে আমাদের অর্থ ফেরত পেতে চাই। আর ওই বিচ্ছগুলো তাদের উপযুক্ত শাস্তি পাবে।

ডনের নির্দেশ ও মনোভাব উপস্থিত সবাই বুঝল। পিপির চেহারা ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করল। সবাই বুঝতে পারল ডনের উপযুক্ত শাস্তির অর্থ পাঁচ জনের অবধারিত মৃত্যু।

ডন সভা থেকে উঠে গেলেন। শরীর ধরে রাখতে এ সময়টায় তিনি বাগানে কিছুটা সময় পায়চারি করে কাটান। সে উদ্দেশ্যেই সরে পড়লেন তিনি।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জর্জিও, আমাদের সময় অনুপাতে এই বৃদ্ধ অত্যন্ত কঠোর। তার যতগুলো কঠোর দিক আছে তার চেয়ে এই নির্দেশটি আমাদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।

অবশ্যই। তবে এতে ভিনি এবং পিটি যদি না জড়াত, তবেই হয়তো ভালো হতো, পিপি বলল। ভিন্স, তুমি কি বলো?

ভিনসেন্টও দ্বিধান্বিত। জর্জিও’র উদ্দেশ্যে বলল, বুড়োর সাথে তোমাকেই এ বিষয়ে আলাপ করতে হবে। ভিনসেন্ট যুক্তি দিয়ে বুঝাল জর্জিওকে যে, তাদের কাছ থেকে এমনিতে একটি পেনিও আদায় করা যাবে না। তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে আমরা তাদের সাথে চুক্তি করব, তারা যেন এই পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে যায় এবং উপার্জন করে যেন আমাদের অর্থ ফিরিয়ে দেয়। এছাড়া যদি তাদেরকে আগেই মাটি চাপা দেয়া হয় তবে একটি পেনিও আদায় করা সম্ভব হবে না।

ভিনসেন্ট যথেষ্ট বাস্তববাদী। সে কখনোই রক্তের জন্য পিপাসু নয়। এর চেয়ে অন্য কোনো বাস্তব উপায়ে সমাধান বের করতেই তার উৎসাহ বেশি।

ঠিক আছে, আমি না হয় বাবাকে বুঝাব যে তারা প্রকৃত দোষী নয়। তারা ছিল কেবল সাহায্যকারী। কিন্তু ফিউবার্টার ঘাড়ে যে চেপে যাবে আরো বড় অপরাধ, তার নিয়তি ঠেকাবে কিভাবে?

পিপি এবার মুখ খুলল, জাঙ্কেট মাস্টারকে এ খবরটি এখনই জানিয়ে দিতে হবে।

কাজিন, পিপি, জর্জিও ঈষৎ হেসে ফেলল। বলল, এর জন্য তুমি কেমন বোনাস আশা করছ?

কাজিন বলে সম্বোধন করলে পিপি মনোক্ষুণ্ণ হয়, ঘৃণা করে সে এই পরিবারকে, বিশেষ করে জর্জিও ডাকলে তার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। কারণ সে পিপির সাথে কেবল কোনো বিষয়ে সমঝোতায় আসার সময় এ সম্বোধন করে থাকে। ভিনসেন্ট এবং পেটি কাজিন ডাকলে পিপির ততটা খারাপ লাগে না। সে জানে তারা কোনো রকম আকর্ষণ কিংবা উদ্দেশ্য ছাড়াই কাজিন বলে ডাকে।

জর্জিও’র প্রশ্নের জবাবে পিপি বলল, ফিউবার্টার বিষয়টি আমার। ধরো তোমরা আমাকে কালেকশন এজেন্সি দিয়েছ। এই সুবাদে আমি জানাদু থেকে একটা মজুরি পাই। তবে এখন যদি আমাকে প্রাপ্ত অর্থ ফিরিয়ে দিতে বলা হয়, তা হবে অত্যন্ত কঠিন– আর তাই আমারও উচিত হবে সেখান থেকে একটা অংশ নেয়া, যেমনটি ভিন্স এবং পেটি তাদের নির্ধারিত ক্ষেত্র থেকে পেয়ে থাকে।

সেটা ঠিক, জর্জিও বলল। কিন্তু এ বিষয়টি তো তোমার কালেকটিং মাকারের মতো নয়। তাছাড়া তুমি পঞ্চাশ শতাংশ আশা করতে পারো না।

না, না, তা তো নয়ই, পিপি বাধা দিয়ে উঠল। বলল, আমি কেবল একটা উদাহরণ দিলাম। আমাকে একটু আমার ঠোঁটটা তত ভেজাতে দাও!

পিপির কথায় হেসে উঠল সবাই। পেটি জর্জিওকে উদ্দেশ্য করে বলল, মূল্যহীন কথা বলল না। আর তাছাড়া তুমি চাও না যে আমি এবং ভিনসেন্ট বাটালি হই।

ব্রঙ্কস এনক্লেভের পূর্ণ দায়িত্বে রয়েছে পেটি– এনক্লেভের প্রধান কর্মকর্তা পেটির বড় গুণ হচ্ছে সমাজের নিচু স্তরের লোকজনদের ধনী করে তোলার জন্য সে সচেষ্ট অনুপ্রেরণা যুগিয়ে থাকে সবসময়। এ প্রক্ষিতে তার অংশও পেটি মাঝে দিয়ে দেয়।

তোমরা হচ্ছ পেটুক ধরনের লোক, জর্জিও তিরস্কারের হাসি হাসল। বলল, তবে আমি বুড়োর জন্য কুড়ি শতাংশের সুপারিশ করব।

পিপি জানে জর্জিও’র এই কুড়ি শতাংশের মানে হবে দশ কিংবা পনের শতাংশ। এমন কৌশলের অবতারণা জর্জিও’র অনেক পুরনো দিনের অভ্যাস।

ভিনসেন্ট পিপিকে প্রশ্ন করল, তা নির্ণয় করব? এর মানে ফিউবার্টা কিংবা তার লোকদের যার কাছ থেকে যত টাকাই আদায় করা হোক না কেন, তা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে- এটা একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ইঙ্গিতও বটে। অর্থাৎ যাদের কপালে অবধারিত মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করেছেন ডন, তাদের বেঁচে থাকার একটা সুযোগ করে দিতে চায় তার পুত্ররা, সেই আত্মসাৎকৃত টাকা উদ্ধার করে। এতে প্রাণে বেঁচে যাবে ফিউবার্টা ও তার চার সদস্য, আর আর্থিক লাভ হবে ডনপুত্রদের। ভিনসেন্ট বুঝতে পারল পিপির কথার সারমর্ম।

পিপি ভিনসেন্টকে আশ্বস্ত করে বলল, নিশ্চিন্ত থাকো ভিন্স। আমিই তা নির্ধারণ করে দেব।

ছোট্ট ডেন্টির দিকে চোখ গেল পিপির। সে দেখল ডনের হাত ধরে ডেন্টি বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছে। ততক্ষণে টেবিলে বসা সবার চোখ সেদিকেই স্থির হলো। পিপি জর্জিও’র মন্তব্য শুনতে পেল আকস্মিক। জর্জিও বলল, ডেন্টি এবং আমার বাবার এই একাকী হেঁটে বেড়ানোটা এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। স্বপ্নের মতো মনে হয়। অথচ বাবা কখনো আমার সাথে এমন বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেননি। তাদের দিকে তাকিয়ে উদাসভাবে জর্জিও বলল, তারা সব সময় গিসগিসিয়ে কি যেন অনবরত বলে চলেছে। এক দিক থেকে এটা ভালোই, বুড়ো যথেষ্ট স্মার্ট ও জ্ঞানী, ছোট ডেন্টি তার কাছে শিখবে অনেক কিছু।

পিপির চোখে পড়ল ডেন্টি যেন মাথা উঁচিয়ে ডনের দিকে তাকিয়ে কিছু বলছে। তাদের এই কথোপকথনকে মনে হলো ডন এবং ডেন্টি যেন এমন কিছু গোপন পরামর্শ করছে, যা পৃথিবী এবং স্বর্গের কর্তৃত্বপূর্ণ কোনো বার্তার আদান-প্রদান।

অত্যন্ত সতর্ক পিপি ডি লিনা, সতর্ক তার পরিকল্পনা। অল্প সময়ের মধ্যেই পিপি ড্যানি ফিউবার্টার কেস দক্ষতার সাথে সম্পাদন করতে শুরু করল। এর জন্য সে শুধু গরিলার মতো ছোটাছুটি করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে হতে হয়েছে রীতিমতো দক্ষ কারিগর। প্রতিটি ক্ষেত্রে পিপি মনোস্তাত্ত্বিক বিষয়ের অবতারণা করেছে শক্তি প্রয়োগ করে নয়। তবে ফিউবার্টা ও তার সঙ্গীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে প্রাথমিক অবস্থায় পিপিকে তিনটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তার লক্ষ্য প্রথমত, তাকে আত্মসাৎকৃত সমস্ত টাকা উদ্ধার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভিনসেন্ট এবং পেটির সাথে সতর্কতামূলক সমন্বয় সাধন করতে হবে (অবশ্য এই পর্বটি খুব কঠিন নয়। পেটি এবং ভিনসেন্ট উভয়েই তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষ। দুই দিনের মধ্যেই তারা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিনিধিদের নামিয়ে দিল অপরাধীদের অনুসরণ করতে। কৌশলে অপরাধীদের কাছ থেকে তাদের অপরাধের স্বীকারোক্তিও নেয়া হলো। তারপর শুরু হলো ক্ষতিপূরণ আদায়ে মোলকলার প্রয়োগ) এবং তৃতীয়ত, ড্যানি ফিউবার্টাকে হত্যা।

ফিউবার্টাকে হত্যা করার কৌশল পিপি অন্যরকমভাবেই চিন্তা করে রেখেছে। সড়ক কিংবা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় ফিউবার্টার মৃত্যু পিপির জন্য সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি। আর এর জন্য পিপি তাঁকে বিাঞ্চলীয় একটি চায়নিজ রেস্তোরাঁয় নিমন্ত্রণ করবে। তার আগে কৌশলে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে পিপি নিজের প্রতি তার আস্থা অর্জন করে নেবে। হলোও তাই। পিপির নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারল না ফিউবার্টা। সে জানে, পিপি জানা হোটেলের পক্ষে কালেক্টর হিসেবে নিয়োজিত। চায়নিজ হোটেলে নিমন্ত্রণ পিপি যে ব্যবসায়িক স্বার্থেই করছে, এটুকু বুঝতে অসুবিধে হয়নি ফিউবার্টার।

চায়নিজ হোটেলে মুখোমুখি হলো দুজন। স্বাভাবিক, সাবলীল ও ধীর ছিল পিপির আচরণ। রেস্তোরাঁর ওয়েটার আসার অপেক্ষায় ছিল তারা। এর মঝে পিপি বলল, গ্রোনিভেল্টের  কাছ থেকে আমি জেনেছি সব। ক্রেডিট কার্ডধারীর শনাক্তের দায়িত্ব বরাবর তোমার। আর এ প্রেক্ষিতে সেদিনের সেই চার অপরাধীর দায়ভারও তোমাকেই বহন করতে হবে।

পিপির দাবি বেমালুম অস্বীকার করল ফিউবার্টা। পিপি একটু ঝুঁকে এলো ফিউবার্টার মুখোমুখি। আলতো করে কাঁধ চাপড়ে পিপি কমরেডের মতো বলল, কাম-অন ড্যানি, কেন মিছেমিছি ভান করছ? গ্লোনিভেন্টের কাছে একেবারে চলমান প্রমাণ রয়েছে। তাছাড়া সেই চারজন তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে। একটু থেমে স্বাভাবিক হলো পিপি। আগের মতোই ধীর কণ্ঠে বলল, তুমি কিন্তু দারুণ বিপাকে জড়িয়ে পড়েছ। তবে ইচ্ছে করলে আমি তোমাকে মুক্তি দিতে পারি, যদি তুমি টাকাগুলো ফিরিয়ে দাও। হতে পারে আমি তোমাকে তোমার সেই পুরনো জাঙ্কেট ব্যবসায় পুনরায় ফিরিয়ে আনতে পারি।

এই কথাগুলোর সত্যতা প্রমাণ করতে পিপি চারটি ছবি তুলে ধরল ফিউবার্টার সামনে, এরা হচ্ছে তোমার সেই সাঙ্গ-পাঙ্গ, পিপি বলল। এবং এরা এদের সব দোষ উগরে দিয়েছে। আর সব অপরাধ এখন চেপেছে তোমার ঘাড়ে। এ অবস্থায়, তুমি যদি তোমার ভাগের চার লাখ ডলার ফিরিয়ে দাও, এটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। সবার কাছে তুমি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

ফিউবার্টা ছবিগুলো দেখে বলল, আমি অবশ্য এই ছবির চার ব্যক্তি সম্পর্কে জানি। কিন্তু এরা হচ্ছে প্রচণ্ড রকমের কঠিন লোক তারা কখনোই এমন কথা বলবে না।

পিপি এবার বলল, যে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন, তিনি স্বয়ং ক্লেরিকুজিও।

হায় কপাল! ড্যানির কণ্ঠে উৎকণ্ঠা। সরাসরি অস্বীকার করে সে বলল, আমি তখন জানতামই না যে সেই চার ব্যক্তি হোটেলে আছে।

এখন তো জানলে, সাড়াশির মতো চেপে ধরেছে যেন পিপি। বলল, তারা যদি তাদের টাকাগুলো ফেরত না দিত তবে তুমি আরো বিপদে পড়তে।

তোমার সামনে থেকে আমার উঠে যাওয়াটাই ভালো, অপ্রস্তুত হলো ফিউবার্টা।

উঁহু, পিপির শান্ত অথচ কঠিন স্বরে দমানোর চেষ্টা। পিপি বলল, লাভ করতে পারবে না। চারদিকে লাঠি, তাছাড়া পিকিংয়ের হাঁসগুলো কিন্তু বেশ! দেখো, আমি খুব বড় কোনো চুক্তির প্রস্তাব করছি না। সবারই জীবনে এরকম কিছু ভুল হয়ে থাকে, ঠিক? তোমারও হয়েছে। তুমি শুধু টাকাগুলো ফিরিয়ে দাও।

আ-আমার কাছে তার কোনো অবশিষ্টই নেই। আমতা, আমতা করে বলল ফিউবার্টা।

আকস্মিক উত্তেজিত হলো পিপি এতক্ষণ সময়ের কথোপকথনে এটাই তার প্রথম ক্ষুব্ধ আচরণ। পিপি বলল, তোমার অন্তত এতটুকু শ্রদ্ধা দেখানো উচিত ছিল। ঠিক আছে, তুমি এক লাখ দাও আপাতত, বাকি তিন লাখের জন্য আমরা তোমাকে সময় ও ব্যবস্থা দুটোই করে দেব।

অক্টোপাসের আকরে আটকা পড়েছে ফিউবার্টা– পালাতে পারবে না। চিন্তার রেখা কপালে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। মুখ শুকিয়ে যেন ছোট গোল পিঠের মতো হয়ে গেছে। বেশ কিছুটা সময় নীরব থেকে আকস্মিক বলে উঠল, আমি পঞ্চাশ হাজার ফিরিয়ে দিতে পারি।

এই তো, দারুণ, চমৎকার। উল্লসিত হলো পিপি। তবে বাকি অংশের জন্য তুমি তোমার চলমান জাঙ্কেট থেকে প্রাপ্য অর্থ ছেড়ে দেবে। ঠিক আছে?

আমি রাজি। ফিউবার্টা প্রতিউত্তরে বলল।

আর চিন্তা করো না। এবার নাও, সামনের খাবারগুলো উপভোগ করো। একথা বলেই পিপি একটি প্যানকেকের মধ্যে হাঁসের মাংস এবং মিষ্টি সসের মিশ্রণ দিয়ে রোল তৈরি করল। ফিউবার্টার হাতে রোলটি দিয়ে বলল, বিষয়টি খুব ভয়ানক, ড্যানি। ঠিক আছে, আগে খাও তারপর হবে ব্যবসার আলাপ।

তৃপ্তির সাথে খেল পিপি চায়নিজ খাবার। খাওয়ার শেষে চকলেট আইসক্রিমের স্বাদও নিল দুজনে। তারপর পকেট থেকে ডলার বের করে চুকিয়ে দিল বিল। অফিসিয়াল ওয়ার্কিং আওয়ার শেষে ফিউবার্টার ট্রাভেল এজেন্সি থেকে পঞ্চাশ হাজার ডলার পাবার আশায় চায়নিজ ছেড়ে বেরিয়ে গেল তারা দুজনে। পিপি যথাবিহিত সম্মান দেখিয়ে এগিয়ে দিল ফিউবার্টাকে।

ড্যানি ফিউবার্টা তার আটচল্লিশ বছরের জীবনে সহজভাবে কখনোই কিছু করেনি। চরম অবস্থায় না পৌঁছানো অবধি সে সহজে ছাড় দেয়নি কোনো ক্ষেত্রে। পিপির সাথেও তেমনই আচরণ করল ফিউবার্টা। চায়নিজে পিপির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার পর সেই যে ডুব দিল আর দেখা মিলল না তার। তবে একটি ম্যাসেজ ঠিকই পাঠিয়েছে পিপিকে। পিপির কাছে পাঠানো বার্তায় সে লিখেছে– জানাদু হোটেলের কাছে সে যে ঋণী হয়ে পড়েছে, সেই ঋণ শোধে অর্থ সংগ্রহের জন্য তাকে এলাকা ছেড়ে যেতে হলো।

ফিউবার্টার এ আচরণে পিপি বিস্মিত হয়নি। এমন ক্ষেত্রে সে যে তার পুরনো অভ্যাসের অবতারণা করবে, তা আর নতুন কি? তবে পিপি বুঝতে পারল, ফিউবার্টার কাছে কোনো অর্থ নেই এবং ভিনসেন্ট ও পেটি তাদের নিজ দায়িত্বে ফিউবার্টার চার সঙ্গীর কাছ থেকে ডলার আদয় না করা পর্যন্ত কোনো বোনাস প্রাপ্তিও হবে না।

ফিউবার্টার খোঁজে পিপি ব্রঙ্কস এনক্লেভের কিছু লোক লাগিয়ে দিল। তাকে অপরাধী হিসেবে আখ্যা দিয়ে ঘোষণা করা হলো– ফিউবার্টা ক্লেরিকুজিও’র মোস্ট ওয়ান্টেড লোক। পিপির তৎপরতা তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল এনক্লেভের লোকজন এ গলি, সে গলি, উপশহর, শহরতলি– সম্ভাব্য সব জায়গায়। কিন্তু লাভ হলো না তেমন।

এভাবেই কেটে গেল একটি সপ্তাহ। দিনের পর দিন, সপ্তাহ পেরিয়ে যেতে লাগল, আরো সেই সাথে বাড়তে লাগল পিপির ক্ষুব্ধতা।

সপ্তাহ পেরিয়ে এলো আরেক সপ্তাহ। কিন্তু কোনো ফল এলো না। তবে পিপি অত্যন্ত অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। তার ধৈর্যের সমস্ত বাধ যেন ভাঙল। আগের চেয়ে আরো ভয়ানক হয়ে উঠল তার মানসিকতা।

এদিকে ড্যানি ফিউবার্টা আত্মগোপন করে ছিল আপার ওয়েস্ট সাইডের একটি ছোট হোটেলে। ব্যাপারটি আঁচ করতে পেরেছিল একজন ক্লেরিকুজিও প্রতিনিধি। ফিউবার্টার সম্ভাব্য খোঁজ পেয়ে সৈন্যটি জানাল পিপিকে। পিপি সেখানে এসে পৌঁছল তাৎক্ষণিক। কিন্তু ততক্ষণে ফিউবার্টা হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। ফিউবার্টার খোঁজে পিপি তখন মরিয়া। আকস্মিক শব্দে পিপি বিস্মিত হলো। ফিউবার্টার আসলে আগ্নেয়াস্ত্র চালনায় কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। খুব দ্রুত কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলতে চেয়েছিল ফিউবার্টা। তাই যখন সে পিপিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে লাগল–বুলেটগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। অবশ্য ততক্ষণে পিপিও ফিউবার্টাকে লক্ষ্য করে যে কয়টি গুলি ছুঁড়েছিল, তার পাঁচটিই বিদ্ধ করেছিল তাকে।

তবে ঘটনাটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে পিপির বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। কয়েকটি বিষয়ের কারণে পিপি বিপদে পড়ে যায়। বিষয়গুলো হলো– এক. ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তো ছিলই। দুই, ঘটনার পর পালিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেই টহল পুলিশের উপস্থিতি। তিন. পিপি এমন হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নিয়ে সেখানে পৌঁছেনি। সে চেয়েছিল, নিরাপদ কোনো স্থানে ফিউবার্টার সাথে আরো এক দফা আলোচনায় বসবে। চার বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারত পিপি। কিন্তু, প্রত্যক্ষদর্শীরা স্পষ্ট সাক্ষী দিয়েছিল প্রথমেই গুলি চালায় পিপি। আর এটাই এখন ঘটনার প্রধান অপরাধের সূত্র যে, প্রথম গুলিটি যাবে যার কাছ থেকে অইনত সেই সবচেয়ে ভয়ানক ও অপরাধী ব্যক্তি। পিপি অবশ্য তর অস্ত্রে সাইলেন্সর সংযুক্ত করেছিল। সে ভেবেছিল, নিরাপদ কোনো স্থানে আলোচনাকালে প্রয়োজনে ফিউবার্টাকে হত্যা করে সরে পড়বে।

ফিউবার্টাকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় টহল পুলিশের উপস্থিতিতে পিপি আর কোনো চেষ্টাই করল না। এমনকি নিজের পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা পরিষ্কার করতে সে কোনো কর্মকর্তাকে হত্যাও করল না। এ বিষয়ে ডন ক্লেরিকুজিও’র স্পষ্ট ও কঠোর নির্দেশ পিপি সেই বিশৃঙ্খল মুহূর্তেও পালন করেছিল, সম্মানের সাথে। ডনের নির্দেশ ছিল, কখনো, কোনো অবস্থাতেই যেন আইনের কোনো কর্মকর্তাকে হত্যা করা না হয়। পিপি অক্ষরে অক্ষরে পালন করল তা। পুলিশ দেখে থমকে দাঁড়াল সে, তারপর তার হাতের অস্ত্রটি রাখল পায়ের কাছে লাথি মেরে অস্ত্রটি পৌঁছে দিল পুলিশ কর্মকর্তাদের দিকে। অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করল পিপি। কিন্তু স্পষ্ট অস্বীকার করল পথের ওপর পড়ে থাকা মৃত মানুষটির সাথে তার কোনো সম্পর্কের কথা।

এমনভাবে ঘটনাগুলো ঘটে গেল, যেন সবকিছুই ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। কোনো দৈব ঘটনা নয়, আকস্মিক ঘটনা নয়। পিপির জীবনটাই এমন। সে যতই পরিকল্পনা করুক, সম্ভাব্য বিপদ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে যত্নশীল হোক– সমস্যা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরবেই। দুর্ভাগ্য যেন তার নিত্য সঙ্গী। পুলিশ কাস্টোডিতে বসে পিপির এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে যেন, সে অস্বচ্ছ ভাগ্যের ঘূর্ণি আবর্তে ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে। তবে এ চিন্তায় ভেঙে পড়েনি সে। বরং সে জানে, এমন অবস্থায় তাকে থাকতে হবে যথাসম্ভব শান্ত-মস্তিষ্ক। আরেক ভরসা ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলি– তারা তাকে ঘূর্ণি আবর্ত থেকে তুলে এনে তীরে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করবে।

তীরে তরী ভেড়াতে সম্ভাব্য পদক্ষেপগুলো নিমেষেই ভাসতে লাগল পিপির মনে– প্রথমেই পিপির জামিন লাভের জন্য নিয়োগ করা হতে পারে উঁচু দরের উকিল তারপর হবে আইনি মারপ্যাঁচ। বিজ্ঞ বিচারক ও আইনজীবীরা অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে, সাহসিকতার সাথে পিপিকে সুরক্ষার জন্য উপস্থাপন করবে একে একে যুক্তি তর্ক। এসব যুক্তি তর্কে পিপির বিরুদ্ধে হয়তো দাঁড়াবে প্রত্যক্ষদর্শীরা। আইনজীবীরা তাদের দেখা ঘটনাকে ভিত্তিহীন বলে প্রমাণ করার চেষ্টা চালাবে। তাদের স্মৃতিশক্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। এমনকি যে আমেরিকান আইনজীবী তাদের পেশায় বিশ্বস্ত, অনুগত বলে পরিচিত, তারাও হয়তো পিপিকে সরাসরি অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করবে না– কিঞ্চিৎ উৎসাহী হবে কর্তৃপক্ষকে পরাজিত করতে।

ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির পক্ষে দীর্ঘজীবনে পিপি ডি লিনার এটাই প্রথম আদালতে উপস্থিতি এবং সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থা তার জন্য এই যে, আদালতে মামলা চলাকালীন পিপির সাথে তার স্ত্রী ও সন্তানদেরও উপস্থিত থাকতে হবে। এই নিরপরাধ পরিবারের জন্য একটি আনন্দদায়ক রায়ের ব্যবস্থা আইনজীবীরা অবশ্যই করবে।

পিপি ডি লিনার বিরুদ্ধে যে মামলার রায় যাবে না এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ সে। তারপরও এক অজানা আশঙ্কা।

রায়ের দিন সেই পুলিশ কর্মকর্তারা পিপি ডি লিনাকে ঘটনাস্থলেই দেখেনি বলে সাক্ষী দিল। পিপির বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়ার জন্য উপস্থিত হয়েছিল পাঁচজন প্রত্যক্ষদর্শী। তাদের তিনজন আইনজীবীদের চাপে পিছিয়ে গেলেও অপর দুজন পিপির বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নিয়েছিল। তবে তারাও একসময় নিজেদের একরোখা মনোভাব থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। তারা বুঝতে পারে, এ মামলার আইনজীবীরা, এমনকি পুলিশ, বিচারক সবাই একই সূত্রে গাঁথা।

যে হোটেলে ফিউবার্টা আশ্রয় নিয়েছিল, তার মালিকও ক্লেরিকুজিও’র সামন্ত। পিপির পক্ষে সাক্ষী দিতে গিয়ে সে বলল ফিউবার্টা হোটেলের বিল পরিশোধ না করে পালিয়ে যেতে উদ্যত হলে সে তার পিছু নেয়, এ সময় কোত্থেকে যেন বুলেট এসে লাগে তার গায়ে। তবে তার হত্যাকারী যে পিপি নয়, এটা নিশ্চিত। ফিউবার্টা নামে লোকটির হত্যাকারী অন্য কেউ।

আকস্মিক একটা হোঁচট খেল পিপি। তার শরীর শিথিল হয়ে এলো। চারদিকে যেন নেমে এলো ঘোর। পলকেই পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য উধাও হয়ে গেল। শুধু পিপিই নয়, ন্যালিনি নিজেও এমন এক অসারতা অনুভব করতে লাগল। ন্যালিনি মোটেও কিছু রেখে-ঢেকে বলেনি। পিপিকে একজন খুনি হিসেবে আখ্যা দিয়ে সাফ বলে দিয়েছিল তাকে বিছানার পাশে নিয়ে কখনোই আর শুতে পারবে না। তার কোনো আনন্দে অংশীদার হতে পারবে না।

তবে পিপি মানসিকভাবে কিছুটা শান্তি পেয়েছিল এই ভেবে, ন্যালিনির কাছে তার জীবনের এই কালো অধ্যায় আর বেশি দিন লুকাতে হবে না। এই লুকোচুরির খেলায় পিপি খুব অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিল।

ন্যালিনির ডিভোর্স কথাটি তখনও পিপির মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত করার চেষ্টায় বিভোর সে। এভাবেই বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। এক পর্যায়ে স্বাভাবিক হলো পিপি। শান্ত কণ্ঠে বলল, ঠিক আছে, তাহলে আমরা ডিভোর্সের পথেই এগুবো। এক পলক থামল সে, তারপর বলল, আমি আমার সন্তানদের হারাতে চাই না।

আমি তোমার সম্পর্কে স্পষ্টই সব জেনে ফেলেছি। প্রতিউত্তরে বলল ন্যালিনি। তোমার মুখোমুখি আর হতে চাই না আমি এবং আমার সন্তানদেরও তোমার মতো মানুষের সাথে থাকতে দেব না।

এবার পিপি সত্যিই বিস্মিত হলো। এই কি সেই ন্যালিনি যে প্রয়োজন ছাড়া কখনোই কিছু বলেনি। যে কখনো মুখরাও ছিল না কিংবা পিপির ঘাড়ে কখনোই চাপিয়ে দেয়নি কিছু জোর করে। সেই শান্ত, সহিষ্ণু রমণী আজ পিপি ডি লিনার মতো একজন দাপটে ব্যক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলছে, তাও আবার দাবির সুরে সত্যিই হতবাক পিপি।

মনে মনে একরোখা হয়ে উঠলেও পরক্ষণেই সে পরিহার করল সেই মনোভাব। তার মনে হলো নারীমাত্রই তাদের পরিণাম সম্বন্ধে উদাসীন। পিপির মস্তিষ্কে উদয় হতে লাগল বিভিন্ন ধরনের ভাবনা। সে উপলব্ধি করল এগার বছরের ক্রস এবং দশ বছরের ক্লডিয়াকে তাদের মায়ের মতো করে গড়ে তুলতে পারবে না। তাছাড়া এ-ও বুঝতে পারল, তার সাথে ক্রসের ঘনিষ্ঠতা আছে সত্য, কিন্তু দুই সন্তানই ন্যালিকে খুব ভালোবাসে।

এমন ভাবনা থেকেই মনে মনে সে ন্যালিনির প্রতি উদারতা দেখাতে সম্মত হলো। প্রকৃত অর্থে তার কাছ থেকে পিপি পেয়েছে একটি গোছানো সংসার, সন্তান, পায়ের নিচে শক্ত এক খণ্ড মাটি যা সব পুরুষেরই জীবনের চরম চাওয়া-পাওয়া। ন্যালিনি যদি তার জীবনে না আসত তবে কে জানে পিপির জীবনের স্রোত কোন দিকে প্রবাহিত হতো?

আগের মতো শান্ত কণ্ঠে বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে, এ প্রসঙ্গটি বাদ দাও। এই বিচ্ছেদের মুহূর্তে পরস্পরের মধ্যে যেন তিক্ততার সৃষ্টি না হয়। তারপর আরো স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করল পিপি। বলল, জাহান্নামে যাক আমাদের এই বারোটি বছর। এ সময়টি ছিল আমাদের সুখের, আনন্দের। এই ছোট্ট পরিসরে আমরা পেয়েছি দুটি ফুটফুটে সন্তান– এ সবের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। কিছুক্ষণের জন্য থামল পিপি। তারপর আবারো ন্যালিনির কঠোর চেহারার দিকে তাকাল।

বলল, কাম অন ন্যালিনি, আমিও তো তাদের বাবা হিসেবে খারাপ ছিলাম না। তারাও আমাকে ভালোবাসে। আর তুমি যা চাও, সেভাবেই আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। তুমি বরং ভেগাসেই থেকে যাও। আর আমি তোমাকে জানাদু হোটেলেই একটি দোকান দেয়ার ব্যবস্থা করছি, কাপড়, জুয়েলারি কিংবা অ্যানটিক, যে কোন প্রকারের। এ থেকে প্রতি বছর তুমি দুহাজার গ্রান্ড আয় করতে পারবে। এর ফলে আমরা খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও আমাদের সন্তানদের সাথে শেয়ার করতে পারব।

আই হেইট ভেগাস। সব সময় আমি ভেগাসকে ঘৃণা করে এসেছি।

এতক্ষণে মুখ খুলল ন্যালিনি। আমার শিক্ষকতার ডিগ্রি আছে এবং স্যাকরামেন্টোতে আমি একটা কাজও জুটিয়ে নিয়েছি। ইতিমধ্যে বাচ্চারা সে স্কুলে যাওয়া-আসাও শুরু করেছে।

এবার পিপির অবাক হওয়ার পালা। এতক্ষণে সে বুঝতে পারল এই নারী ছিল ভেতরে ভেতরে সর্বদাই তার বিরোধী এবং মারাত্মক। নারী সম্পর্কে পিপির এত দিনের ধারণাকে ভুল বলে প্রমাণিত করল ন্যালিনি। তার কাছে নারী কখনোই ভয়াবহ বলে কিছু ছিল না। সে যে নারীই হোক না কেন। স্ত্রীকে তো সে ভয়াবহ মনে করেইনি, মিসট্রেস থেকে শুরু করে মা, চাচি, খালা কিংবা কোনো বন্ধুর স্ত্রী, এমনকি ডনের কন্যা রোজ ম্যারিকেও তার কখনো সাংঘাতিক কিছু মনে হয়নি। পিপি তার এই দীর্ঘ জীবনে এমনই এক পৃথিবীতে বাস করে এসেছে, যেখানে নারীরা কখনোই শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়নি।

ন্যালিনির আচরণে ধাক্কা খেলেও, চট করে বদলে গেল পিপি। কেউ যখন তাকে নিয়ে খেলতে আরম্ভ করে, কিংবা তার বন্ধুত্বকে অস্বীকার করে– এমনকি তার উচ্চাসকে দমাতে চেষ্টা করে তখন সে আর আত্মসংবরণ করতে পারে না। মাথায় আগুন ধরে যায়। ন্যালিনির আচরণেও তার এমন হলো।

স্পষ্ট জানিয়ে দিল পিপি, আমি স্যাকরামেন্টো গিয়ে আমার সন্তানদের সাথে দেখা করতে পারব না। পিপি ভীষণভাবে চটে গেল। তবে নিজেকে সংযত রেখে গম্ভীরভাবে কথাগুলো বলল সে। ন্যালিনি যে গোপনে এতদূর এগিয়েছে, পরিকল্পনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে– একথা ভেবে পিপি সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়েছে।

পিপি বলল, একটু আগেই বলেছ যে তুমি আমার সম্পর্কে জেনে গেছ। তাই বলছি, সতর্ক হও। স্যাকরামেন্টো যাও, আর সমুদ্রের তলদেশে যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাও, আমার আপত্তি নেই। তবে তুমি কেবল একজনকে নিয়ে যেতে পারবে। অপরজন থাকবে আমার কাছে।

খুব শীতল দৃষ্টিতে ন্যালিনি তাকাল পিপির দিকে। বলল, আদালতই এর রায় দেবে। আমার মনে হয় তোমার একজন লয়ার নিয়োগ করা উচিত, যে আমার লয়ারের সাথে আলোচনা করবে।

বিস্ময়ে বিস্ময়ে হতবাক পিপি। যতই সময় যাচ্ছে সে যেন নতুন থেকে নতুন ভুবনে প্রবেশ করছে, আর আশ্চর্য হচ্ছে। ন্যালিনির এমন উপদেশে পিপি যখন বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে তখন ন্যালিনি হেসেছে তার ক্রুর হাসি।

তুমি উকিলও নিয়োগ করেছ!পিপির বিস্ময়। তুমি? আইনের ভয়ও দেখালে?

এবার আর বিস্ময় নয়, নিজেকে আরেক দফা পরিবর্তন করল পিপি। অকস্মাৎ উচ্চস্বরে হেসে উঠল। দীর্ঘ সময় ধরে পিপির এ হাসি যেন উন্মাদের মতো, ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কাযুক্ত। ন্যালিনি চমকে গেল কিছুটা। প্রচণ্ড ঘৃণাবোধ হলো তার পিপির প্রতি। মনে হলো সে এক বিকারগ্রস্ত মানুষ।

বারো বছর ধরে সে এই মানুষটির সাথে কাটিয়েছে। প্রেমিক সেজে তার শরীরের একটু উষ্ণতা পেতে এই লোকটিই তার কাছে কত অনুনয়-বিনয়ই না করেছে, অবশেষে তার কাছে সঁপে দিয়েছে সে নিজের দেহ, মন, প্রাণ। হায় কপাল! একটুও বুঝতে পারেনি সে। চুড়ান্ত মুহূর্তে এসে আজ ন্যালিনি বুঝতে পারল সব– কেন সবাই পিপিকে শ্রদ্ধা করে এত, কেন তাকে ভয় পায় সবাই।

পিপির সার্বিক আচরণে ন্যালিনি যতটা না পেয়েছে ভয়, তার চেয়ে অনেক বেশি পেল কষ্ট। আর খুব সহজেই পিপির প্রতি তার ভালোবাসাও নিঃশেষ হয়ে গেল। বারোটা বছরের সমস্ত স্মৃতি, সমস্ত ভালোলাগা ভালোবাসা যেন নিমেষেই মিলিয়ে গেল ন্যালিনির মন থেকে।

শান্ত কণ্ঠে পিপি বলল, তুমি যা-ই সিদ্ধান্ত নাও না কেন, আই ডোন্ট কেয়ার। জাজের সিদ্ধান্তেও আমার কিছু যায়-আসে না। যদি সোজা পথে আসো, তবে আমার কাছেও অনুরূপ আচরণ পাবে। যদি বাঁকা হতে চাও তবে তোমার কপালে দুর্ভোগ আছে।

এই প্রথমবারের মতো ন্যালিনির মনে হলো পিপির সারা অঙ্গ যেন বিশ্রী রকমের পেশিবহুল বিদঘুটে। অথচ এই শক্ত-সমর্থ শরীরের প্রতি এক সময় ন্যালিনির ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ, অপার ভালোবাসা। পিপিকে ভালোবাসার আরেকটি কারণ হলো তাদের বারো বছরের এই দাম্পত্য জীবনে পিপি কখনোই ন্যালিনির সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলেনি, ন্যালিনির কোনো ব্যয়ে কৌতুক করেও কখনো কিছু বলেনি এবং এটাও সত্য, পিপি ছিল সন্তানদের জন্য সত্যিকার একজন ভালো বাবা। তাদের প্রতি তখনই পিপি রেগে যেত, যদি ক্রস কিংবা ক্লডিয়ার মধ্যে কেউ মায়ের অবাধ্য হতো।

কিছুটা নমনীয় হয়ে আসছিল ন্যালিনি কিন্তু পিপি যেন ক্রমেই হয়ে উঠছিল কঠোর। চেহারার বিকৃতি ঘটতে শুরু করেছিল। প্রচণ্ড রকমের মানসিক বিপর্যস্ত পিপির চিবুকে যেন অতিরিক্ত কিছু মাংস যোগ করে দিয়েছে কেউ। ন্যালিনির মনে হলো পিপির কপালে যেন কেউ খাজ কেটে তৈরি করে দিয়েছে রেখা। চিকন ঐ-জোড়া কপালের ভাঁজে মিশে ফর্সা করে ফেলেছে অংশটুকু। মাথার চুলগুলো যেন রুক্ষ মেজাজের সাথে ঘোড়ার মতো ঝরঝরে হয়ে উঠছে। সুন্দর নিষ্পাপ চোখ দুটোতে আগুনের লহমা– তাতে বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই নমনীয়তার ভাব।

ন্যালিনির কণ্ঠ ভিজে এলো। বলল, আমি জানতাম তুমি আমাকে ভালোবাস। কিন্তু কিভাবে তুমি আমার সাথে এতটা রুক্ষ আচরণ করতে পারছ? ন্যালিনি নিজেকে আর সামলাতে পারল না, কেঁদে ফেলল।

ন্যালিনির অশ্রুতে কিছুটা হলেও ভিজল পিপি, আমি, যা বলছি, শোনো। বলল, লয়ারের সাথে নয়, তুমি যদি কোর্টে যাও, তবে সব কিছু লক্ষ্মন করেই তোমাকে যেতে হবে। আর এখনই তুমি আমাদের সন্তানদের দুজনকে পাচ্ছ না। শোনো ন্যালিনি, আমাকে খেপিও না, আমি তা চাই-ও না।

একটু থেমে পিপি আবার বলল, আমি বেশ বুঝতে পারছি, তুমি আমার সাথে আর কোনো মতেই থাকতে চাইছ না। সব সময় আমি মনে করতাম তোমার মতো একজন নারী পেয়ে আমার জীবন ধন্য হয়েছে। সারা জীবন তোমাকেই আঁকড়ে থাকব। তোমাকে সুখ দিয়ে ভরে দেব তুমিও সুখী করবে আমাকে। আর আজ আমার সেই ভালোবাসার মানুষটিই আমার কাছ থেকে তো সরছেই, আমাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে আদালতের কাঠগড়ায়।

কয়েক পলক থামল পিপি। কণ্ঠ ভারী হয়ে এলো, আমি এখন বার্ধক্যে। পরিবার ছাড়া আমি থাকতে চাই না।

তোমার আছে ক্লেরিকুজিও পরিবার, ন্যালিনি বলল।

হ্যাঁ, তা আছে, প্রতিউত্তর পিপির, তোমার এটা মনে করা উচিত। যাই হোক, আমি আমার বার্ধক্য জীবন একাকী কাটাতে চাই না।

হাজার হাজার লোক আছে তোমার, ন্যালিনি বলল, নারীও আছে।

তারা আমার সহযোগী নয়। কোনো একজন আছেন, যিনি তাদের জীবনের সিদ্ধান্ত দেন। আর অনেকে তাদের অস্তিত্বে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আমি তাদের মতো হতে চাই না।

উপহাসের স্বরে ন্যালিনি বলল, তুমিও তাদের পক্ষে ভেটো দাও!

ঠিক তাই হয়তো করা উচিত, হেসে ফেলল পিপি। ন্যালিনির দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ।

ন্যালিনি বলল, ঠিক আছে যখন তোমার ইচ্ছে, তুমি সন্তানদের দেখে আসতে পারবে। তবে দুজনই থাকবে আমার কাছে।

একথা শুনে পিপি ন্যালিনির দিকে পেছন ফিরে দাঁড়াল এবং বলল, তোমার যা ইচ্ছে হয় করো। বলেই পিপি চলে যেতে উদ্যত হলো।

দাঁড়াও, ন্যালিনির ডাকে ঘুরে দাঁড়াল পিপি। তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল ন্যালিনি কিছুক্ষণ। প্রাণহীন এক ফ্যাকাশে মুখ দেখে ন্যালিনির খুব মায়া হলো। বলল, ঠিক আছে, সন্তানদের কেউ যদি তোমার সাথে যেতে চায়, আমি মেনে নেব।

পিপি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। নিমেষেই যেন সমস্ত বিপর্যস্ত ভাব উবে গেল তার চেহারা থেকে। পিপির মনে হলো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে খুব কঠিন। কোনো সমস্যার সমাধান হলো এই মাত্র।

চমৎকার, চেঁচিয়ে উঠল পিপি। তোমার শিশুটি ইচ্ছে হলেই ভেগাসে এসে আমার সাথে দেখা করবে। আর আমারটাও যাবে স্যাকরামেন্টো তোমার সাথে দেখা করতে। দারুণ হবে। চলো, আজ রাতেই আমরা প্রস্তুতি নিয়ে ফেলি।

ন্যালিনি পিপিকে নতুন জীবন শুরু করার জন্য আরেক দফা শেষ প্রস্তাব দিতে কার্পণ্য করল না। বলল, চল্লিশ বছর এমন কোনো বয়স নয়। তুমি আবার নতুন করে শুরু করতে পারো।

পিপি মাথা নেড়ে বলল, কখনোই না। তুমিই ছিলে আমার জীবনে একমাত্র নারী! তুমি ছিলে আমার কাছে সেই ভারতীয় বধূদের মতো। আমি তোমাকে বিয়ে করেছিলাম একটু দেরিতেই। তবে আমি জানি আমি আর কখনোই বিয়ে করব না। ঠিক যেভাবে তোমাকে আমি ধরে রাখতে পারিনি, সেভাবে নতুন করে কোনো কিছুই শুরু করা হবে না আমার।

হয়তোবা, ন্যালিনির সন্দিগ্ধ উত্তর। আর তুমি আমাকে পুনরায় ভালোও বাসতে পারবে না।

তবে তোমাকে হত্যা করতে পারব। ন্যালিনির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল পিপি। কথাটি কৌতুক করেই বলল সে।

কিন্তু পিপির চোখের দিকে তাকিয়ে বিশ্বাস করল ন্যালিনি। সে বুঝতে পারল এটা পিপির একটা ক্ষমতার সূত্র। যদি সে কাউকে হুমকি দেয়, তাতে বাস্তবতার মিশেল তো থাকেই।

তবে প্রসঙ্গ পাল্টে ন্যালিনি আবারো পিপির উদ্দেশ্যে বলল, মনে রেখো, যদি সন্তানরা দুজনই আমার সাথে থাকতে চায় তবে তুমি বাধা দিতে পারবে না।

তারা তাদের বাবাকেও ভালোবাসে, পিপির নিশ্চিত উত্তর। সে বলল, তাদের যে কোনো একজন থাকবে এই বুড়ো মানুষটির সঙ্গে।

ডিনার পর্ব শেষ হলো। সারাটা ঘরে ছিল বরফ শীতল ঠাণ্ডা। অপরদিকে বাইরের আবহাওয়া যেন মরুভূমির তপ্ত প্রবাহ। এমনই এক পরিমণ্ডলে আজ হতে চলেছে দুটি জীবনের চূড়ান্ত ফয়সালা।

এগার বছরের ক্রস আর দশ বছরের ক্লডিয়া। বাবা-মায়ের পরিণাম ভোগ করতে হবে তাদেরও, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের রেশ পোহাতে হবে তাদেরও। তারাও একরকম প্রস্তুত। ইতিমধ্যেই সব কিছু খুলে বলা হয়ে গেছে ক্রস এবং ক্লডিয়াকে। এখন শুধু তাদের মতামতের অপেক্ষা- কে যাবে কার সাথে।

সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, বাবা-মায়ের ডিভোর্সের এই সিদ্ধান্তে ক্রস কিংবা ক্লডিয়ার চোখে-মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। ভাবনা কেবল এই, তারা কার সাথে যাবে, বাবা, না-কি মায়ের সাথে?

ক্রস হ্যান্ডসাম। তার মায়ের মতোই সুন্দর। তবে তার ভেতরে যে দৃঢ়তা, তা বাবার মতো। এ মুহূর্তে সে সম্পূর্ণরূপে ভীতিহীন। দৃঢ়তার সাথে ক্রস বলল, আমি মার সাথেই থাকছি।

ক্লডিয়া একটু ঘাবড়ে গিয়েছে– কি বলবে সে? ভেবে পাচ্ছে না। তবে ক্রসের মতামত শুনে এই ছোট্ট শিশু ক্লডিয়া বলল, আমি ক্রসকে ছেড়ে যাব না।

হোঁচট খেল, পিপি সাথে বিস্মিতও হলো। ক্রস ছিল পিপির সবচেয়ে কাছের। ন্যালিনির চেয়েও বেশি। ক্রস হচ্ছে সেই ছেলে যে পিপির সাথে হতো শিকারের সঙ্গী। সে বাবার সাথে কার্ড খেলতে পছন্দ করত– খেলত গলফ এবং বক্সিং। ন্যালিনির বই পড়া কিংবা মিউজিক শোনায় তার কোনো আগ্রহই ছিল না। এই সেই ক্রস! পিপি ভেবেছিল অন্তত ক্রস তাকে ফেলে যাবে না।

বিস্মিত হলো ক্লডিয়ার অত্যন্ত কৌশলী উত্তরে। এ মেয়েটি অনেকটাই তার নিজের মতো দেখতে অবশ্যই স্মার্ট। তবে সে যে তার মায়ের দিকটাই টানবে, এটা যুক্তিযুক্ত। এর কারণ– ন্যালিনি যা করে ক্লডিয়া তাই ভালোবাসে। বাবার কর্মকাণ্ডের প্রতি তার আগ্রহ নেই বললেই চলে। এমন সন্তান নিয়ে পিপি কি করবে?

গভীরভাবে লক্ষ্য করতে লাগল পিপি তার সন্তানদের। মনে মনে গর্বিত হলো সে। অন্তত সন্তানরা তাদের মাকে চিনতে পেরেছে।

ন্যালিনি আজ সেজেছে বিশ্রী কালো পোশাকে কালো ট্রাউজারের সাথে কালো পুলওভার। মাথার সোনালি চুলগুলোও ঢেকে দিয়েছে কালো হেডব্যান্ড বেঁধে। চিকন, লম্বাটে দেখাচ্ছে ন্যালিনির মুখ– কালোর মাঝে সাদা এক লম্বাটে বৃত্ত।

এ অবস্থায় সচেতন পিপি— অন্তত শিশুদের সামনে তার নির্দয় আচরণ ও অভব্যক্তি থেকে স্বভাবসুলভ স্বাভাবিক থেকে পিপি শিশুদের উদ্দেশে বলল, সব কিছুর পরও আমি তোমাদের মধ্য থেকে অন্তত একজনকে পেতে চাই। কথা দিচ্ছি, ইচ্ছে করলেই তোমরা যে কোনো সময় দুজন দুজনের সাথে দেখা করতে পারবে। তোমরা আমাকে এই ভেগাসে একা ফেলে যেও না।

স্থির দৃষ্টি হেনে দুজনই তাকিয়ে থাকল বাবার দিকে। পিপি ন্যালিনির দিকে তাকাল। কণ্ঠে অনুনয়ের স্বর। বলল, এ ব্যাপারে তোমাকেই সহযোগিতা করতে হবে। তোমাকেই নির্ধারণ করতে হবে কাকে তুমি নেবে।

উত্তেজিত হয়ে উঠল পিপি, আমাকেই কেন ছাড়তে হবে সব?

তুমি কিন্তু কথা দিয়েছিলে– তাদের দুজনই যদি আমার সাথে যেতে চায় তবে তুমি বাধা দেবে না। ন্যালিনি মনে করিয়ে দিল পিপিকে তার প্রতিশ্রুতির কথা।

পিপির অনুভূতিগুলো যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে সব কিছু শেষ হয়ে যাবে অল্প সময়ে। তবে সে জানে তার সন্তানরা তাকে ভালোবাসে। মাকে ভালোবাসে একটু বেশি, এই যা। তার অর্থ এই নয় যে শিশুরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা একেবারে সঠিক। অবজ্ঞাভরে ন্যালিনি বলল, এর পর আর কিছুই বলার থাকে না। তুমি যেখানে কথা দিয়েছ

পিপি বুঝতে পারছে না তার সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলোর চোখে তাকে কেমন দেখাচ্ছে। তবে সে নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত রাখার চেষ্টা করেছে। কথায়-আচরণে স্বাভাবিকই থাকার চেষ্টা চালিয়ে গেছে, যেন নিজের বিরুদ্ধে নিজের যুদ্ধ। কিন্তু অপর পক্ষের আচরণ কেন এত কঠিন?

সংযত কণ্ঠেই পিপি বলল, আমি তো আমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিনি। আমি শুধু তোমার সহযোগিতা চেয়েছি। শেষ চেষ্টাটুকুতেও কি তোমার এত আপত্তি?

ন্যালিনি অনমনীয়। মাথা নেড়ে বলল, নাহ, তুমি অসম্ভব হয়ে উঠছ। আমাদের শেষ পর্যন্ত আদালতের দ্বারস্থই হতে হবে।

পিপি এবার বুঝতে পারল এই মুহূর্তে তার কি করা উচিত। খুব ধীর কণ্ঠে যেন ফোয়ারা ছুড়ল পিপি ন্যালিনির উদ্দেশে, তুমি যা চাইছ, আমার জন্য তা কঠিন কোনো ব্যাপারই নয়। তুমি তোমার পথে যেতে পারো। তবে আজকের এ বিষয়টি মনে রেখো। মনে করে দেখো আমাদের জীবনের কথা। একটু ভেবে দেখো–তোমার পরিচয় কি, আরো আমিইবা কে? আমি তোমার কাছে কাকুতি করে ভিক্ষে চেয়েছি। এই চাওয়া আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই। ক্রস আমার মতো, পক্ষান্তরে ক্লডিয়া পেয়েছে তোমার গুণ। ক্রস আমার সাথেই থাকবে ভালো, আর ক্লডিয়া তোমার সাথে, তোমার পরিমণ্ডলে। এটাই হচ্ছে আমার চাওয়ার উদ্দেশ্য।

কয়েক পলক থামল পিপি। তারপর বলল, সন্তানরা যে আমার চেয়ে তোমাকেই বেশি ভালোবাসে এটা জেনেও কি তোমার জন্য যথেষ্ট হয়নি?

পিপির এ কথায় যেন ঘরের সমস্ত পরিবেশ রুদ্ধ হয়ে গেল। থেমে গেল পিপির থমথমে গলা। সে চায় না যে সে যা বলছে তা তার সন্তানরা বুঝুক। তবে ন্যালিনি বুঝতে পারল। সব কিছু উড়ে গেল, পিপির ওপর যে ভীতি ভাব ছিল তা-ও সরে গেল। ন্যালিনি যেন ছোঁ মেরে টেনে নিল ক্লডিয়াকে তার বুকের মাঝে।

আর ক্লডিয়া তাকিয়ে রইল তার ভাই ক্রসের দিকে। মিনতিভরে শুধু একবার ডাকল, ক্রস…।

ক্রসের মুখমণ্ডলে ছিল উদাসীন সৌন্দর্য। মায়ের দিক থেকে ঘুরে দাঁড়াল ক্রস। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বাবার দিকে। পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। শান্ত কণ্ঠে বলল, আমি তোমার সাথেই যাব, ড্যাড। উচ্ছ্বসিত পিপি কৃতজ্ঞ চিত্তে ক্রসের হাত তুলে নিল নিজ হাতে।

অনাকাক্ষিত এ দৃশ্যে হতবাক ন্যালিনি ডুকরে কেঁদে উঠল। বলল, যখন তোমার ইচ্ছে হবে আমাকে দেখতে এসো, ক্রস। স্যাকরামেন্টোয় তোমার একটা আলাদা বেডরুম থাকবে সাজানো। সেটা কেউই ব্যবহার করবে না।

যা ঘটার ছিল— ঘটল না, ঘটল উল্টোটা। অন্তত ন্যালিনি কয়েক মুহূর্ত আগেও ভাবেনি যে ক্রসকে তার ছেড়ে যেতে হবে!

কিন্তু পিপি যেন উচ্ছ্বসিত। যেন ফিরে পেয়েছে তার জীবনের সব কিছু। মনের একটা ভারী বোঝা যেন নেমে গেল মুহূর্তেই। বোধশক্তিও লোপ পেল তার। অকস্মাৎ বলে উঠল, আমাদের এবার সেলিব্রেট করা উচিত।

একটু থেমে আবার বলল, এটা সত্য যে আমাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেল। তবে এখন থেকে একটি সুখী পরিবারের বদলে আমাদের দুটি সুখী পরিবার হব এবং পরবর্তী যে কটা দিন বাঁচব, সুখেই থাকব।

পিপির এ কথা শুনে কঠিন মুখে তাকিয়ে থাকল সবাই তার দিকে। নিজেকে সামলে সে বলল, ঠিক আছে, যা ঘটেছে তা তো ঘটেছেই। আমরা সুখী হবার চেষ্টা করব।

প্রথমে দুবছর ভেগাস-স্যাকরামেন্টো যোগাযোগ মোটামুটি নিয়মিত ছিল। এরপর থেকে ক্লডিয়া আর কখনোই ভেগাসমুখো হয়নি। ক্রস কিন্তু অব্যাহত রেখেছিল ন্যালিনি ও তার বোন ক্লডিয়াকে দেখতে যাওয়া। ক্রসের যখন পনের বছর বয়স, তখন থেকে তার স্যাকরামেন্টো সফরও কমে যায়। শুধু ক্রিসমাসের ছুটিতেই সে যেত মা ও বোনের সাথে দেখা করতে।

এভাবেই দুই শহরে পৃথক থেকে বাবা ও মা তাদের প্রাপ্ত সন্তান নিয়ে কাটিয়ে যাচ্ছিল। ক্লডিয়া যতই বেড়ে উঠতে লাগল, তার মধ্যে ধীরে ধীরে দেখা গেল মায়ের গুণ। সে ভালোবাসে স্কুল, ভালোবাসে বই পড়তে, থিয়েটার তার পছন্দ, মায়ের মতো সে-ও ভালোবাসে ফিল্ম কিংবা মিউজিক। মোট কথা, মায়ের সব পছন্দ, ভালোলাগাগুলো তার মধ্যে দেখা গেল। আর ন্যালিনি তার মাঝে দেখতে পেল বাবার তেজোদীপ্ত চরিত্র ও উচ্ছ্বাস। বেশ সুখী ছিল মা ও মেয়ে স্যাকরামেন্টোতে।

সে তার বন্ধু-বান্ধব নিয়ে এক প্রকার সুখী জীবনই কাটিয়ে যাচ্ছিল। ইতিমধ্যেই তার পদোন্নতি হলো। একটি পাবলিক হাই স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রিন্সিপাল হলো ন্যালিনি।

অপর দিকে পিপি ও ক্রস ও কাটিয়ে যাচ্ছিল সুখী জীবন। তবে ন্যালিনি ক্লডিয়ার চেয়ে ভিন্ন ভিন্ন তাদের জীবন পদ্ধতি, ভিন্ন তাদের প্রেক্ষাপট। পিপি তার মতো করে গড়ে তুলছিল ক্রসকে। ক্রস যখন হাই স্কুলে, তখন পিপি বুঝতে পারল, এথলেটে সে তার সব বন্ধুদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আর লেখাপড়ায় ঠিক ততটাই পিছিয়ে। হাই স্কুলের পাট চুকিয়ে ক্রস আর কলেজের লেখাপড়ায় আগ্রহী হলো না। তাছাড়া তার মধ্যে আরেকটি বিষয় ছিল লক্ষ্য করার মতো একজন সুদর্শন যুবক হয়েও ক্রসের নারীর প্রতি তেমন একটা আসক্তি ছিল না।

ক্রস তার বাবার সাথে উপভোগ করছিল জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র। পিপির যে কোনো সিদ্ধান্ত যতই খারাপ হোক না কেন ক্রস যেন উৎসাহিত হয়ে উঠত, উপভোগ করত। ক্লডিয়ার কাছে যেমন তার মা তেমনি পিপিও ক্রসের কাছে। একজন ভালো বাবা, একজন ভালো বন্ধু হয়ে উঠল। ক্রসের মাঝে পিপি বিলিয়ে দিল তার সবটুকু তৈরি করল সম্পূর্ণ তার মতো করে।

ক্রস মেতে উঠল জানাদু হোটেলের কাজকর্ম নিয়ে। শো-গার্লদের প্রতি তার ছিল খুব সাধারণ প্রবৃত্তি। এসব ক্ষেত্রে অবশ্য পিপি তার পুত্রের ওপর জোর করে কোনো বাধা-নিষেধ আরোপ করেনি। তবে তার ইচ্ছে ক্রস যাতে ক্লেরিকুজিও পরিবারে তার অবস্থান করে নেয়। আর ডন ক্লেরিকুজিও’র একটি উদ্ধৃতির প্রতি পিপির দারুণ বিশ্বাস। ডন প্রায়ই বলতেন, প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তার রুটিটুকু আয় করে নেয়া।

ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই পিপি তাকে কালেকশন এজেন্সির অংশীদার করে নিল। তাছাড়া প্রায়ই ক্রসকে নিয়ে সে যেত গ্লোনিভেন্টের সাথে ডিনার করতে। এই সাক্ষাতে, আলাপ-আলোচনায় যাতে গ্রোনিভেল্ট তার দিকে শুভ দষ্টি দেয়। এভাবে ধীরে ধীরে ক্রস গ্রোনিভেল্টের  গলফ সঙ্গীতে পরিণত হলো। ক্রসের মাত্র সতের বছর বয়সে যেভাবে গলফের বল নির্দিষ্ট গর্তে পৌঁছে দিত, দেখে মুগ্ধ হতে গ্রোনিভেল্ট। আর তাই সে ক্রসকেই তার পার্টনার করত প্রায় সময়। দুপার্টনার মিলে জিততে শুরু করল একের পর এক চ্যালেঞ্জ। পিপি উচ্ছ্বাস নিয়ে তাদের এই জয়ের আনন্দ উপভোগ করত, গর্বিতও হতো।

গ্রোনিভেল্টকে জয় করার পর পিপি ক্রসকে নিয়ে গেল নিউইয়র্কে ক্লেরিকুজিও পরিবারে। সে দিনটি ছিল ৪ এপ্রিল- ক্লেরিকুজিও পরিবারের সার্বিক হলিডে। অর্থাৎ এই দিনটিতে ফ্যামিলির সমস্ত বিয়ে এবং মৃত্যুবার্ষিকী একসাথেই পালন করা হয়। আর এই দিনে উপস্থিত হয় ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির সব সদস্য। ক্রসের শরীরের ক্লেরিকুজিও’র রক্ত। তারও অধিকার আছে এ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার।

ক্রমেই ক্রস তার বাবার সাথে থেকে শিখছিল নতুন নতুন সব বিষয়। প্রতি সপ্তাহে একবার পিপি জানাদু ক্যাসিনোয় তার আট হাজার ডলারের জন্য যায়। এবার ক্রসকেও নিয়ে গেল সাথে। ক্রস বসে বসে দেখছিল আর সব আয়ত্ত করে নিচ্ছিল। পিপি তাকে গ্যাম্বলিংয়ের সমস্ত কলা-কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছিল। ক্রসকে শিখিয়েছিল, যদি কখনো মন সায় না দেয়, যেন গ্যাম্বলিং টেবিলে না বসে ক্রস। দিনে যাতে দুঘণ্টা আর সপ্তাহে তিন দিনের বেশি যাতে কিছুতেই না খেলে। আর জিদ করে যেন কখনোই বড় দান না বসায়।

একজন বাবা হয়ে ছেলেকে পৃথিবীর এই ঘৃণ্যতম বিষয় শেখানোটা অনেকের দৃষ্টিতেই ঠিক পছন্দসই হলো না। তবে পিপির যুক্তি, কালেকশন এজেন্সির জুনিয়র পার্টনার হিসেবে ক্রসের জন্য এই শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি পিপি তার ছেলের জন্য নিজেই করতে চায়।

কতটুকু শিক্ষা পেল ক্রস? এবার তার যাচাইয়ের পালা। পিপি তাকে পাঠাল ক্যালিফোর্নিয়ায় মাফিয়া ব্ৰুগলিওনের কাছে। এখান থেকে কালেকশন করাটা খুব সহজ নয়। ক্রসকে শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল, সে যাতে জোর করে সেখান থেকে আদায়ের চেষ্টা না করে। প্ররোচনার মাধ্যমেই যেন চেষ্টা করা

ক্যালিফোর্নিয়ার এই ব্ৰুগলিওনের ক্ষমতা পিপির মতো নয়। ছোটখাটো একটা প্রতিনিধি ক্লেরিকুজিও’র। মাত্র হাজার গ্রান্ড জানাদু হোটেলে প্রেরণ করে সে। ক্লেরিকুজিও’র নাম ফলাও করার মতোও সে নয়।

খুব খারাপ সময় ক্রস মাফিয়া ব্যারনকে পাকড়াও করল। ফ্যালকো নামের এই ব্যারন বা ক্ৰগলিওন প্রথমে ক্রসের কথা শুনল তারপর অকস্মাৎ তার অস্ত্রটি সোজা কেড়ে নিয়ে গেল ক্রসের কণ্ঠনালি বরাবর। বলল, আর একটি কথাও যদি তোমার মুখ থেকে বের হয় তবে গুলি করে তোমার ওই টনসিল এফোঁড়-ওফোঁড় করব।

এমন অবস্থাতেও ক্রস বিস্মিত হলো তার নিজের মতো করে। অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল তার অভিব্যক্তি। ভয়ের চিহ্নমাত্রও ছিল না তার চেহারায়। স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল, মাত্র পঞ্চাশ গ্রান্ডের জন্য এ অবস্থা? আমার বাবা এটা পছন্দ করবে না।

কে তোমার বাবা? ফ্যালকোর অস্ত্রটি আগের মতোই ক্রসের কণ্ঠ বরাবর ধরে জিজ্ঞেস করল।

পিপি ডি লিনা, প্রতিউত্তরে কৌতুক করে বলল ক্রস। এই ফিফটি গ্রান্ডের সমাধা না হলে বাবা আমাকে গুলি করবে।

ফ্যালকো হেসে ফেলল। তার অস্ত্রটি রেখে দিল যথাস্থানে। বলল, ঠিক আছে, তাকে বলো আমি নিজেই ভেগাসে গিয়ে পরিশোধ করে আসব।

আসার আগে আমাকে জানিও কিন্তু। আমি তোমাকে তোমার প্রচলিত আচরণ মোতাবেক অভ্যর্থনা জানাব। পুনরায় ক্রসের কৌতুকপূর্ণ উত্তর।

পিপিকে চিনতে পারল ফ্যালকো। তবে ক্রসের চেহারায় এমন কিছু একটা ছিল যা ফ্যালকোকে খুব সহজেই নিরস্ত্র করতে বাধ্য করল। ক্রসের মধ্যে ছিল না ভয়ের লেশমাত্র ভাব, অত্যন্ত শীতল তার প্রতিউত্তর এবং ছোটখাটো রসালো কথাবার্তা, ক্রসের এমন সপ্রতিভ আচরণ যেন বন্ধুত্বের আহ্বান। তবে এ ঘটনা থেকে ক্রস শিক্ষা পেল যে ভবিষ্যতে কোনো সংগ্রহে তার সাথে অবশ্যই থাকতে হবে একটি অস্ত্র এবং দেহরক্ষী।

ক্রসের এই সাহসিকতার কাহিনী শুনে খুশি হলো পিপি! এক ছুটির দিনে ক্রসকে উৎসাহ দিতে জানাদু হোটেলে করা হলো ছোট একটি আয়োজন। গ্রোনিভেল্ট বাপ-বেটা দুজনকেই অভিনন্দন জানালেন। উপহার দিল দুজনকেই চমৎকার দুটি সুট। ক্রসকে পৃথকভাবে দিলেন ব্ল্যাক টিপসের একটি পার্স।

গ্রোনিভেল্টের  বয়স তখন আশি। মাথার চুলগুলো সব পেকে গেছে। তবে শরীরের সতেজতা হারায়নি তখনও। ক্রসের হাতে পার্সটি তুলে দিয়ে গ্রোনিভেল্ট বলেছিলেন, এভাবে যদি জয় না আসে তবে এটি আমি ফেরত নেব। এবার মন দিয়ে শোনো, তোমার সামনে মাত্র একটি সুযোগ। আমার হোটেলের কয়েকটি ক্ষেত্র আছে। এর মধ্যে একটি বড় গলফ কেস। জুয়াড়িরা সুদূর জাপান থেকে এখানে আসে গলফের ওপর দান ধরতে। আমাদের আছে ভোজন রসিকদের জন্য অত্যাধুনিক রেস্তোরাঁ আর আছে সুন্দরী শো-গার্ল, যারা চলচ্চিত্র এবং সঙ্গীত জগতের তারকা। আমাদের আছে সুন্দর টেনিস কোর্ট, সুইমিং পুল এবং হোটেলের নিজস্ব বিমান। এ বিমান তোমাকে সাত সমুদ্র ঘুরিয়ে আনবে– এ সবই ফ্রি। এর জন্য তোমার ওই পার্সের পাঁচ গ্র্যান্ডও খরচ করতে হবে না। শুধু জুয়াড়ি হবে না।

তিনদিনের ছুটিতে ক্রস সম্পূর্ণরূপে সময় দিল গগ্ৰানিভেল্টকে। কাটাল গ্রোনিভেল্টের  উপদেশ অনুসরণ করে। এই তিন দিনের প্রতিটি সকাল ক্রস কখনো গ্রোনিভেল্ট, কখনো তার বাবা কিংবা জানাদু হোটেলের উঁচু দরের বোর্ডারদের সাথে গলফ খেলে কাটাল। গ্রোনিভেল্ট ক্রসের প্রত্যেকটি স্ট্রোক লক্ষ্য করে দেখল, সে যখন উঁচু করে নির্দিষ্ট গর্তের দিকে স্টেক করে তখনই তার লক্ষ্য হয় সুনিপুণ। এটা উপলব্ধি করার সাথে সাথে গ্রোনিভেল্ট বিস্ময় ও আনন্দের সাথে চেঁচিয়ে উঠল, ইস্পাতের মতো স্নায়বিক অবস্থা।

খুব কাছে চলে এলো ক্রস গ্রোনিভেল্টের । কয়েক বছরের মধ্যে ক্রস বুঝতে পারল পিপি এবং গ্রোনিভেল্টের মধ্যে কতটা আন্তরিক সম্পর্ক। উভয়েই উভয়ের খুব ভালো বন্ধু। প্রতি সপ্তাহ অন্তর তাদের অন্তত একবার দেখা হওয়া চাই-ই। দিনে অবসর না হলেও অন্তত ডিনারে। তাছাড়া পিপির কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও সে অন্তত গ্ৰোনিভেল্টের পরামর্শ নেবেই, যদিও ব্যবসায়িক প্রতিটি পদক্ষেপ ক্লেরিকুজিও ছাড়া নেয়া হয় না। অপর দিকে গ্রোনিভেল্টও জানাদু হোটেলের সমস্ত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পিপির সাথে শেয়ার করে দ্বিধাহীন চিত্তে। তবে ভিলাগুলোর ব্যাপারে অবশ্য গ্রোনিভেল্টের  যত রাখ-ঢাক।

এদিকে ক্রস সতর্কতার সাথে উপলব্ধি করল, গ্রোনিভেল্ট তার প্রতি বেশ আগ্রহী। ক্রসের জন্য সে অতিরিক্ত একটা প্রশ্রয় যেন তুলে রাখে। বৃদ্ধ বয়সেও গ্রোনিভেল্টের  নারী আসক্তি ছিল। ক্রস তা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারল। জানা হোটেলের স্বত্বাধিকারী গ্রোনিভেল্টের পেন্থ হাউস সুইটে যে প্রায়ই শো-গার্লদের আনাগোনা ছিল তা বুঝতে পেরেছিল ক্রস। প্রথম দিকে বিষয়টি গোপন রাখলেও পরে বন্ধু ভেবেই, ক্রসের কাছে প্রকাশ করেছিল সব, পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল শো-গার্লদের সাথে। তবে এ বিষয়ে ক্রস সুদর্শন হওয়া সত্ত্বেও খুব একটা আগ্রহী ছিল না। বরং মেয়েরাই ছিল তার প্রতি দুর্বল।

গ্রোনিভেল্টের  সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টির পর থেকে ক্রস প্রায়ই একান্তে আলোচনা করত ব্যবসায়িক দিক সম্পর্কে। এমনই এক আলোচনায় একদিন শিক্ষকের মতো নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিলেন গ্রনিভেল্ট। জানা হোটেলের ক্যাসিনো এবং এর বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক সম্পর্কে দীক্ষা নিচ্ছিল ক্রস। আলোচনার এক পর্যায়ে ক্রস একটু দ্বিধা নিয়েই জানতে চাইল, জানা হোটেলের যেসব মেয়ে কাজ করছে তাদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অর্থাৎ জানাদু হোটেলে তাদের কাজের সম্পর্ক কিংবা গ্রোনিভেল্টের  সাথেই তাদের সম্পর্কটা আদতে কেমন?

হেসে ফেললেন গ্রোনিভেল্ট। ক্রসের কথার প্রতিউত্তরে বললেন, হোটেলের বিভিন্ন শো-তে এই মেয়েদের আমি বিনোদনের জন্য ছেড়ে দেই। আবার কিছু কিছু মেয়ের সাথে আমি আচরণ করি পুরুষের মতো। এখন তুমি যদি তোমার ভালোবাসাপূর্ণ জীবনের জন্য আমার কাছে উপদেশ চাও, তাহলে তোমাকে আমি বলতে বাধ্য হব যে, একজন বুদ্ধিমান, নির্ভরশীল মানুষ হিসেবে নারীদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।

একটু থামলেন গ্রোনিভেল্ট। তারপর আবার শুরু করলেন, তোমাকে অবশ্যই দুটি ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। নাম্বার ওয়ান এবং একই সাথে অত্যন্ত বিপজ্জনক হচ্ছে সেসব মেয়ে যাদের বয়স ও সঙ্গতি উভয়েরই অভাব বর্তমান। দ্বিতীয়ত, সেই সব মেয়ে যারা তোমার চেয়েও বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী।

এসব বলছি, তাই বলে আবার ভেবে বসো না যে আমি একেবারে হৃদয়হীন। আমি ইচ্ছে করলে একটি মেয়েকে এমন অবস্থায় ফেলে দিতে পারি। তবে সেটা আমাদের কাজ নয়। আমি অবশ্যই নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি, কারণ বিশ্বের যে কোনো পার্থিব বিষয়ের মধ্যে জানাদু হোটেল আমার সবচেয়ে ভালোবাসার জিনিস। তবে হ্যাঁ, আমার যে সন্তান নেই, তার জন্য আমার আক্ষেপ আছে। এ কথা আমি তোমার কাছে অস্বীকার করব না।

তাহলে তোমার মতে, এটাই পার্ফেক্ট লাইফ। ক্রস বলল। তুমি কি তাই ভাবছ? গ্রোনিভেল্টের  রসিকতাপূর্ণ প্রশ্ন। বেশ, আমি তাহলে এর জন্য বিল চুকিয়ে যাব।

কুওগে ব্যাপক টানাহেঁচড়া শুরু হয়ে গেল ক্রসকে নিয়ে। ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির মেয়েদের মধ্যেই ক্রসকে নিয়ে এই উত্তেজনা।

ক্রসের বয়স তখন মোটে কুড়ি। হ্যান্ডসাম তো বটেই, সুদর্শন, টানটান শক্ত শরীর বয়স অনুপাতে এমন পুরুষ সঙ্গীর স্বপ্ন সব মেয়েরাই দেখে থাকে। ক্রসকে দেখে ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির সবাই কৌতুক করে বলেছিল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে সে দেখতে তার মায়ের মতো হয়েছে, বাবার মতো নয়…! এমন রসিকতা অবশ্য তাকে হেয় করার জন্য নয়, কিংবা তার বাবার উদ্দেশ্যেও নয়।

ইস্টার সানডের দিন, যখন সবাই সানডে উৎসবে মেতে ছিল, কাজিন ডেন্টির কাছ থেকে ক্রস জানতে পারল ফ্যামিলিতে তার বাবার প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে।

বিশাল প্রাচীর ঘেরা বাগান– যেন দিগন্ত জুড়ে। শেষ নেই যেন এ প্রাচীরের। বাগানের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে ফ্যামিলির সদস্যদের অবাধ বিচরণ। ক্রস এবং ডেন্টি লক্ষ্য করছিল দূর থেকে। হঠাৎ ক্রসের চোখে পড়ল একটি চমৎকার মেয়ে। তাকে ঘিরে রয়েছে একদল যুবক।

অপরদিকে ক্রস লক্ষ্য করল, পিপি একটি বাফেট টেবিল থেকে বারকোশে করে মাংসের কাবাব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে একদল যুবতীর দিকে। দেখা গেল, সুন্দরী মেয়েটি পিপিকে দেখে যেন সংকুচিত হয়ে পড়েছে। নারী মহলে বাবা যে প্রিয় তা ক্রস জানে। পিপির কুৎসিত দিকগুলোর সাথে সাথে তার চমৎকার রসবোধ, তেজস্বীতা এবং ব্যক্তিত্ব যে কোনো নারীকে খুব সহজেই কাবু করে ফেলে।

ক্রসের সাথে সাথে ডেন্টিরও চোখ পড়ল মেয়েটির দিকে, আর সাথে সাথেই বলে উঠল, চমৎকার মেয়ে। ক্রসের উদ্দেশ্যে বলল, চলো, তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।

কাছে গিয়ে মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ডেন্টি ডাকল, লিলা, এসো পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে আমাদের কাজিন ক্রস।

ডেন্টি কিংবা ক্রসেরই সমবয়সি লিলা। তবে তার শারীরিক কাঠামোয় এখনও নারীত্ব ফুটে ওঠেনি। এই বয়ঃসন্ধিক্ষণ কিংবা তার নব যৌবনের এই সময়ের কারণেই লিলার সৌন্দর্যে যেন একটা খুঁত রয়ে গেছে কোথাও। মধুরঙা চুল লিলার, ত্বকে যেন সদা সতেজতার আভা। সে তুলনায় মুখমণ্ডল পরিপূরক নয় মনে হবে যেন এখনো পরিপূর্ণ গঠনই হয়নি তার।

লিলার পরনে ছিল অ্যাঙ্গোরা সোয়েটার। এই পরিধেয়টি তার সফেদ ত্বককে করে তুলেছে স্বর্ণাভ। মুখোমুখি হতেই যেন ক্রস লিলার প্রেমে পড়ে গেল।

কিন্তু ক্রস যখন তার সাথে কথা বলতে আগ্রহী হলো, লিলা কেন যেন এড়িয়ে গেল তাকে। ক্রস ও ডেন্টির কাছ থেকে সরে লিলা গিয়ে বসল আরেক টেবিলে।

মর্মাহত হলো ক্রস। ডেন্টিকে বলল, আমার মনে হয় সে আমাকে ঠিক পছন্দ করেনি। মুখে একটা শুষ্ক হাসি টেনে ক্রসকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করল ডেন্টি। ধূর্ততার সাথে অপর এক দল সমবয়সি যুবকদের দিকে হাত উঠিয়ে অভিবাদন জানাল।

কোকড়ানো ঘন-কালো চুল ডেন্টির। অনেকটা ডন ক্লেরিকুজিও’র মতো। আর তা প্রদর্শনের জন্য সে ক্যাপ পরলেও অভিনব কায়দায় কিছুটা বের করে রাখে, যেমন রেখেছে এ মুহূর্তে। বেশ খাটো আকৃতির, উচ্চতা পাঁচ ফুটের দু এক ইঞ্চি বেশি হতে পারে বড়জোর। তবে তার আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা প্রখর। আর এর মূলে রয়েছে স্বয়ং ডন ক্লেরিকুজিও’র প্রচ্ছন্ন নির্ভরতা ও ভালোবাসা। এ বয়সেও ডন প্রায়ই ডেন্টিকে নিয়ে মুক্ত বাতাসে হাঁটতে বের হন।

ক্রসের উদ্দেশ্যে ডেন্টি বলল, মেয়েটির নামের শেষে রয়েছে এনাকস্তা! ক্রস তার স্মৃতি হাতড়ে নামটি মনে করার চেষ্টা করল। মনে পড়ল তার বছর খানেক আগে এক এনাকস্তা পরিবার ট্র্যাজেডির মুখে পড়েছিল।

মিয়ামি হোটেলের এক কক্ষে পরিবারটির কর্তা এবং তার বয়োজ্যেষ্ঠ পুত্রকে কেউ যেন হত্যা করেছিল। মনে করতে পারল ক্রস। কিন্তু এই ঘটনার সাথে মেয়েটির সম্পর্ক কি?

ডেন্টি ক্রসের চিন্তাযুক্ত সংকুচিত মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার কাছ থেকে কোনো প্রশ্ন কিংবা উত্তর আশা করছিল ডেন্টি।

বিস্মিত ক্রসের সপ্রশ্ন কণ্ঠে বলল, এর মানে?

তুমি তো তোমার বাবার হয়েই কাজ করছ, তাই না? ডেন্টির সহজাত প্রশ্নঃ হ্যা! ক্রসের বিস্ময়বোধ যেন বাড়ছে।

লিলার সাথে নিশ্চয়ই সম্পর্ক গড়তে চাও? মুচকি হেসে বলল ডেন্টি। তুমি দুর্বল হয়ে পড়েছ।

ক্রস জানে এর উত্তর দেয়াটা বিপজ্জনক হতে পারে। ডেন্টির এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না ক্রস।

ডেন্টি এবার বলল, তুমি কি জানো না তোমার বাবার কাজটা কি?

সে একজন মানি কালেক্টর। তাৎক্ষণিক জবাব দিল ক্রস।

ডেন্টি মাথা নেড়ে নেতিবাচক উত্তর দিল। বলল, তোমার জানা দরকার। তোমার বাবা ফ্যামিলির জন্য মানুষদের একেবারেই সরিয়ে ফেলে।

এক ঝটকা ঝড়ো হাওয়ায় সব কিছু যেন পরিষ্কার হয়ে গেল। ক্রস এত দিনে বুঝতে পারল, কেন তার মা বাবাকে পছন্দ করত না। কেন বন্ধুরা বাবাকে এত শ্রদ্ধা করত, শ্রদ্ধা করত ক্লেরিকুজিও পরিবারকে। ক্রসের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, কেন তার বাবার সার্বক্ষণিক অস্ত্র এবং দেহরক্ষীর প্রয়োজন হয়।

ক্রস স্পষ্ট মনে করতে পারছে তার বাবার হত্যা মামলার রায়ের ঘটনা। এটি প্রায় ভুলেই যেতে বসেছিল ক্রস। বিশেষ করে সেদিন রাতে বাবা যখন তার হাতটি নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল গভীর স্নেহে, ক্রস ভুলে গিয়েছিল সব। তবে এসব ভেবেও বীতশ্রদ্ধ হলো না সে তার বাবার প্রতি। বরং উষ্ণ এক আবেগ যেন আরো ঘনীভূত হলো। উপলব্ধি করতে পারল, এখন যতই নগ্ন হোক না কেন, বাবার সুরক্ষায় তাকেই এগিয়ে যেতে হবে।

ডেন্টির ওপর ভয়ানক ক্ষুব্ধ হলো ক্রস। বাবার এই গোপনীয় সত্যতা সে তাকে না বললেও পারত।

ডেন্টির উদ্দেশে বলল, না, আমি সে সব জানি না এবং তুমিও কিছুই জানো না। কেউই জানে না কিছু।

ভয়ানক ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল ক্রস। সংযত করার চেষ্টা করল নিজেকে। কিছুটা সময় থামল মাত্র কয়েক পলক। তারপর রসিকতা করে বলল, তোমার ওই ফাঁক-ইন হ্যাটটি কোত্থেকে পেলে?

.

ইস্টার সানডের ইস্টার এগ হান্টিং ইভেন্টে বাচ্চাদের সাথে তুমুল হৈচৈয়ের মধ্যে মেতে ছিল ভার্জিনো ব্যালাজো। শিশুদের সাথে এ খেলায় এমনভাবে মগ্ন হয়ে গিয়েছিল, যেন সে জন্মসূত্রেই একজন ভাড়। আর শিশুরাও মজে গিয়েছিল তার ভাঁড়ামিতে। তাকে ঘিরে ধরেছিল সবাই। ছোট্ট শিশুগুলোকে ফুলের মতো দেখাচ্ছিল– ছোট ছোট মুখ, ডিমের খোলসের মতো সাদা ত্বক, মাথায় গোলাপি সুদৃশ্য টুপি আর বাহারি পোশাক– চমৎকার এক দৃশ্যের অবতারণা। ব্যালাজো শিশুদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছিল খর ভর্তি একটি করে ছোট বাক্স, বিনিময়ে শিশুরা ব্যালাজোর গালে এঁকে দিচ্ছিল একটি করে চুমু। বাক্স নিয়েই শিশুরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল ব্যালাজোর সামনে থেকে।

বেশ পরিপাটি হয়ে ইস্টার সানডের এ উৎসবে এসেছে ভার্জিনো ব্যালাজো। তার পরনের সুটটি লন্ডনের তৈরি, জুতো জোড়া ইতালির, শার্ট ফ্রান্সের। চুলগুলো কাটিয়েছে ম্যানহাটানের মাইকেল এঞ্জেলোতে। তাকে দেখে যে কেউ মনে করবে অত্যন্ত আশীর্বাদপুষ্ট সুখী জীবন তার। সুখী তার মেয়েও। সার্বক্ষণিক বাবার পাশে রয়েছে। শিশুদের সাথে আনন্দে মেতে রয়েছে সে-ও।

ত্বরিত-চঞ্চলা ব্যালাজো কন্যা লুজিলি। সবাই তাকে সেইল করে ডাকে। আঠার বছরের কুমারী সেইল এ অনুষ্ঠানে তার বাবার সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে খোশ মেজাজে। পরনে তার রয়েছে সাদা রঙের ব্লাউস আর শর্টস। ঘোলাটে ফিকে ত্বক। মাথার চুলগুলো প্যাচিয়ে প্যাচিয়ে এমনভাবে গোলাকার করেছে, দূর থেকে দেখেই মনে হবে যেন মাথায় পরেছে কোনো মুকুট।

সুন্দরী সেইল, তার ওপর অর্ধবক্ষা। সামান্য দূরের কিছু যুবক হা করে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। কেউ কেউ যৌবনের উন্মাদনায় সাড়া পেতে সিটি বাজিয়ে আহ্বানও জানাচ্ছে। সেদিকে খেয়াল নেই তার। হয়তো খেয়াল করেছে কিন্তু পাত্তা দেয়নি। প্রয়োজন মনে করেনি।

হঠাৎ করে সেইলর চোখ গেল বাগানের এক কোণায়। সেখানে ঝগড়া বাধিয়ে বসেছে ক্রস এবং ডেন্টি। দীর্ঘ সময় ধরেই চলছে তাদের চুড়ান্ত পর্যায়ের বাদানুবাদ, বিতর্ক হয়তো হাতাহাতিও। সেইলর মনে হলো ক্রস যেন আঘাত পেয়েছে; কুঞ্চিত হয়ে গেছে তার মুখমণ্ডল।

খরভর্তি একটি বাস্কেট ছিল সেইলর হাতে। সেটি নিয়েই তুরিত ছুটে গেল ক্রস ও ডেন্টির দিকে। তাদের অপ্রীতিকর অবস্থার মাঝখানে গিয়ে উপহাস করে বলল, তোমাদের মধ্যে কে ডিম শিকারে আগ্রহী? চমৎকার মোহিত হাসি সেইলর। হাসি মুখে তার হাতের বাস্কেটটি তুলে ধরল তাদের দিকে। অপ্রত্যাশিত এই সুন্দরীর আগমন দুজনকেই হতভম্ব করে ফেলল। দুজনেই তার দিকে তাকিয়ে রইল বিস্ময়ের দৃষ্টিতে।

সকালের সোনালি আলো সেইলর ত্বকেও যেন ছড়াচ্ছিল স্বর্ণ আভা। দুষ্টুমিতে ভরা চোখ দুটো নাচছিল। ব্লাউসের উপরাংশের দুধরঙা স্তনের আবৃত্ত যুগল তাদের ছন্দপতন ঘটাল। আমন্ত্রণ জানাল সেইলের কুমারিত্ব।

ঠিক এমনই এক মুহূর্তে একটি ছোট্ট শিশুর তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এলো। মোহভঙ্গ হলো সবার। তাকাল শিশুটির দিকে। লাল ও নীল রঙের ছোপ দেয়া বিশাল আকৃতির একটি ডিম পেয়েই শিশুটির এই চিৎকার। সেই বিশাল আকৃতির ডিমটি সে তার খরপূর্ণ বাস্কেটে পুরে রাখার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। এই চেষ্টা করতে গিয়ে তার মাথার সুন্দর গোলাপি টুপিটি বারবার চোখ মুখ ঢেকে দিচ্ছিল। বিরক্ত হয়ে পড়েছিল সে। এই গলঘর্ম প্রচেষ্টার এক পর্যায়ে ডিমটি গেল ভেঙে। আর তা থেকে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল একটি ছোট পাখি। আর সাথে সাথেই শিশুটির চিৎকারও যেন ধাওয়া করল পাখিটির পিছু পিছু।

কৌতুককর এ পরিস্থিতি অনেক সময় ধরেই লক্ষ্য করছিল পেটি। লন পেরিয়ে ছুটে এলো সে। কোলে তুলে নিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করল।

আসলে এই পাখি উড়ে যাওয়ার এমন পরিকল্পনা তারই। আর এ মুহূর্তে শিশুটিকে সান্ত্বনা দেয়ার হাস্যকর ধরন দেখে উপস্থিত সবাই হেসে উঠল।

সবাইকে হাসতে দেখে শিশুটি তার মাথা থেকে খসে যাওয়া হ্যাটটি এক হাতে চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠল। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে পেটির উদ্দেশ্যে বলতে লাগল, তুমিই আমার সাথে দুষ্টুমি করেছ। পেটি অসহায়ের মতো তাকাল শিশুটির দিকে। আরেক দফা হেসে উঠল সবাই। শিশুটি তার কোল থেকে নেমে দৌড়ে যাচ্ছিল। পেটিও পিছু নিল তার। অসম্ভব মন খারাপ হয়েছিল তার। কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়ার জন্য পিছু পিছু ছুটতে লাগল পেটি। অবশেষে তাকে ধরে কোলে তুলে নিল। তাকে শান্ত করতে দিল একটি রত্ন খচিত ইস্টার এগ। শিশুটি তা পেয়ে খুব খুশি হলো, পেটির গালে দিল সস্নেহে একটি চুমু।

সবার দৃষ্টি যখন পেটি এবং ছোট শিশুটির দিকে নিবদ্ধ তখন সেইল শক্ত করে ধরল ক্রসের হাত। ম্যানশন থেকে শখানেক দূরের এক আড়ালে টেনিস কোর্টের দিকে নিয়ে গেল তাকে। তিন দিকে দেয়াল ওঠানো খেলোয়াড়দের বিশ্রামের জন্য তৈরি টেনিস কুটিরে গিয়ে বসল দুজন। ম্যানশনের হৈ হট্টগোল থেকে বেশ খানিকটা নির্জন। এখানে তাদের দুজনের একান্ত সান্নিধ্যে কেউ ব্যাঘাত ঘটাতে আসবে না।

কারো নজরে তেমন একটা না পড়লেও ডেন্টির শ্যেনদৃষ্টিকে এড়াতে পারল না তারা। ডেন্টির চেয়ে ক্রস অনেক বেশি আকর্ষণীয়। এ বিষয়ে ডেন্টির একটা হিংসাবোধও আছে ভেতরে ভেতরে। তবে এ মুহূর্তে সে তার। এই হ্যান্ডসাম কাজিনকে নিয়ে গর্বিত। তবে সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, এতক্ষণে সে বুঝতে পারল তার হাতে রয়েছে সেইলের সেই বাস্কেটটি। মনে মনে হেসে উঠল ডেন্টি– সেইল কৌশলে তার বাস্কেটটি বসিয়ে দিয়েছে ডেন্টির হাতে, আর ক্রসের হাতে তুলে দিয়েছে তার নিজ হাত।

ম্যানশনের আড়ালে টেনিস কুটিরে দুজন খুব কাছাকাছি হলো। সেইল ক্রসের মুখে ছোঁয়াল সেইলের নরম দুটি হাত। ক্রসের ঠোঁট স্পর্শ করল সেইলের ঠোঁট। উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে লাগল ক্রমেই। ধীরে ধীরে সরে গেল। পার্থিব যত বিষয়। সম্পূর্ণ মনোসংযোগ ঘটল চুম্বনরত ঠোঁটের মাধ্যমে শিহরিত শিরায় শিরায়, উপশিরায়। চঞ্চল হয়ে উঠল ক্রসের হাত। নিখুঁতভাবে সেইলের সমস্ত শরীরের আস্বাদের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। শেষ অবধি সংযত করতে না পেরে সেইলের কুমারী স্তনে উঠে এলো ক্রসের একটি হাত। তৎক্ষণাৎ ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল সেইল। দুষ্টু হাসিতে ক্রসের দুষ্টুমিকে পরাস্ত করল যেন।

বলল, আজকের এই চুম্বনের জন্য আমি প্রতীক্ষায় ছিলাম দীর্ঘ দিন, আমার দশ বছর বয়স থেকে। এত দিন পর পেলাম এই শুভ দিন।

সেইলের চুম্বনের রেশ ক্রসের মন থেকে সরেনি তখনো। তারপরও সেইলের আকস্মিক এই উক্তিতে সে প্রশ্ন করল, কেন?

কারণ তুমি দারুণ সুন্দর এবং পার্ফেক্ট। সেইলের সহজ উত্তর। ক্রসের মুখ থেকে তার হাত দুটো সরিয়ে নিল। তারপর চোখের দিকে টানা দৃষ্টি হেনেই ক্রসের হাতে রাখল তার হাত।

বলল, আজকের মতো এমন ভুল একটি দিনের জন্যও আমার হয়নি।

একটু থেমে আবার সে বলল, আমাদেরও কি একটি সুন্দর পরিবার হতে পারে না?

ক্রস নিরুত্তর। তবে স্বাভাবিক। সেইলের কপালে কুঞ্চিত রেখা দেখা গেল মাত্র কয়েক পলকের জন্য। আকস্মিক বলল, আচ্ছা, তুমি তোমার বাবার সাথে কেন থাকছ?

ঠিক এমন একটি বিষয়ের জন্যই তুমি হয়তো আমাকে এখানে আনতে পেরেছ? সপ্রতিভ উত্তর ক্রসের।

বিষয়টি এতক্ষণে পরিষ্কার হলো সেইলের। পাল্টা প্রশ্ন করল ক্রসের উদ্দেশ্যে, তাই বুঝি ডেন্টির সাথে ঝগড়া বাধিয়ে বসেছিলে? সেইল বলল, সে কি তোমাকে খুব আঘাত দিয়ে কিছু বলেছে?

না, ডেন্টি সঠিক ছিল, ক্রস বলল প্রতিউত্তরে। শিশুদের মতো তর্ক করছিলাম আমরা। ডেন্টি একজন সাক্ষাৎ জোকার, ঠিক আমার পেটির মতো।

জোকার না কচু! খুব উগ্র সে, সেইলের প্রতিবাদী উত্তর। তারপর আবার আকস্মিক ক্রসের ঠোঁটে চুমু দিল সেইল। বলল, প্রচুর অর্থ করেছে আমার বাবা। কেন্টাকিতে একটি বাড়ি কিনেছে। ১৯২০ রোলস রয়েস গাড়িও কিনেছে। এমনিতেই তার রয়েছে তিনটি অ্যান্টিক গাড়ি, আবার কেন্টাকিতে ঘোড়াও কেনার পরিকল্পনা করছে। তুমি বরং কালই আমাদের ওখানে বেড়াতে চলো– আমাদের গাড়িগুলোও দেখতে পাবে। আর তাছাড়া তুমি ছোটবেলা থেকে আমার মায়ের রান্না পছন্দ করতে।

সম্ভব নয়। আগামীকালই আমাকে ভেগাসে ফিরে যেতে হবে। বলল ক্রস। আমি সেখানে জানাদু হোটলে কাজ করি।

ক্রসের হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিল সেইল, অ ভেগাস। আমার মতে একটি বিরক্তিকর শহর ভেগাস।

কিন্তু আমার কাছে সেরা, পাল্টা জবাব ক্রসের। তুমি যদি সেখানে না-ই গিয়ে থাকো, তবে এত ঘৃণা কেন?

কারণ সেখানকার মানুষ তাদের কষ্টের উপার্জন নিমেষেই শেষ করে আসে, ঘৃণামিশ্রিত শিশুসুলভ অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলল সেইল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে আমার বাবা গ্যাম্বলের আগে-পাছে নেই। এমনকি সেই শো গার্লদের প্রতিও আগ্রহী নয়।

হেসে ফেলল ক্রস। বলল, আমি এত কিছু জানি না। আমি কেবল গলফ কোর্টে ছুটাছুটি করি। ক্যাসিনোর অভ্যন্তরে কি ঘটে না ঘটে সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।

সেইল জানে ক্রস তার সাথে মজা করছে। তারপরও সে বলল, আচ্ছা আমি যেদিন কলেজের পাট চুকিয়ে বের হবে, সে দিন যদি তোমাকে ইনভাইট করি, তুমি আসবে?

অবশ্যই, ক্রস আশ্বাস দিল। এমন বিষয়ে ক্রস সেইলের চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ। মেয়েটির এই সরলতায় মুগ্ধ হলো ক্রস। মুগ্ধ হলো এখনো তার হাত দুটি যেভাবে সেইল ধরে রেখেছে, তা ভেবে। তবে ক্রস বুঝতে পেরেছে সেইলের এই আমন্ত্রণ তাদের অর্থ, গাড়ি-বাড়ি, প্রতিপত্তি প্রদর্শনেরই দাবি। ক্রস এ-ও বুঝতে পারল, সেইলের এই মিষ্টি স্পর্শ, প্রাণহীন মেকি চুম্বন ও তার নারীত্ব দিয়ে ক্রসকে জয় করার প্রচেষ্টা।

ক্রস এবার বলল, আমাদের বোধ হয় এবার ম্যানশনের দিকে যাওয়া উচিত।

টেনিস কুটির থেকে বেরিয়ে এলো দুজন। দুজনে দুজনার হাত ধরে এগিয়ে চলল পিকনিক এরিয়ার দিকে। সেইলের বাবা তাদের দিকে তাকিয়ে প্রথমে মুখ বাঁকিয়ে ফেলল। তারপর এক আঙুল বাকিয়ে ছিঃ! ছিঃ! লজ্জা বলেই হো হো করে হেসে ফেলল। এগিয়ে গেল তাদের দিকে, জড়িয়ে ধরল দুজনকেই।

এই দিনটির কথা ক্রসের মনে গেঁথে থাকবে দীর্ঘদিন। শুধু এ জন্যই নয় যে সে সেইলের ঘনিষ্ঠতা পেয়েছে। ক্রসের মনে এই ইস্টার সানডের দিনটি আরেকটি কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ এ দিনই ডেন্টির কাছে সে তার বাবার প্রকৃত স্বরূপ জানতে পেরেছে। সেই সাথে ছোট্ট শিশুটির সেই ডিম ভেঙে পাখি উড়ে যাওয়ার ঘটনাও দাগ কেটেছে ক্রসের মনে।

ক্রস এবং পিপি ইস্টার সানডের পর দিনই ফিরে গেল ভেগাসে। তবে তাদের মানসিক সম্পর্কে এবার দেখা দিল একটু ভিন্নতা। পিপি নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারল যে এত দিনের গোপন তথ্যের অনেক কিছুই ক্রসের কাছে ফাঁস হয়ে গেছে। আরো তাই নিজের দুর্বল মনকে শক্ত করতে ক্রসের প্রতি সে মনোযোগী হলো আর বেশি। তবে ক্রস বিস্মিত হলো, এত নেতিবাচক তথ্যের পরও বাবা সম্পর্কে মনোভাবের এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। এখনও তাকে আগের মতোই ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে ক্রস। বাবা ছাড়া সে যেন তার পৃথিবী কল্পনাও করতে পারে না, যেমন কল্পনাতীত ক্লেরিকুজিও পরিবার ছাড়া গ্রোনিভেল্ট ছাড়া এবং জানাদু হোটেল ছাড়া। এ সবই ক্রসের জীবনে জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে এবং সত্যিকার অর্থেই সে সুখী এই জীবনধারায়।

তবে কেমন যেন এক অসহিষ্ণুতা বাসা বেঁধেছে ক্রসের মনে-বুঝে উঠতে পারছে না সে কিছুতেই। এটুকু তার মনে এসেছে যে, হয়তো নতুন কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে তাকে। কি সেই পদক্ষেপ, জানে না সে।

০৪. ক্লডিয়া ডি লিনা

পর্ব– তিন

ক্লডিয়া ডি লিনা
অ্যাথেনা অ্যাকুইটেন

০৪.

ক্লডিয়া ডি লিনা প্যাসিফিক প্যালিস্যাডিসে তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে নিজেই গাড়ি চালিয়ে রওনা হলো ম্যালিবুতে অ্যাথেনা অ্যাকুইটেনের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে। মনে মনে ভাবতে লাগল– ম্যাসেলিনার জন্য কিভাবে অ্যাথেনাকে রাজি করাবে? কিভাবে ক্লডিয়া নিজেকে উপস্থাপন করবে অ্যাথেনার কাছে?

ম্যাসেলিনায় অভিনয়ের জন্য তাকে ফিরিয়ে আনাটা যেমন ক্লডিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ স্টুডিওর জন্যও। আসলে ম্যাসেলিনা ক্লডিয়ার লেখা প্রথম অরিজিনাল স্ক্রিপ্ট। এর আগেও বিভিন্ন ছবির চিত্রনাট্য সে করেছে, তবে সেগুলোর কোনোটি ছিল কোনো নভেল থেকে নেয়া নকল পাণ্ডুলিপি, কিংবা মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির ঘষা-মাজা স্ক্রিপ্ট।

ক্লডিয়ার কাছে এ ছবির গুরুত্ব আরেক কারণে। সেটি হলো–এই ম্যাসেলিনার মাধ্যমেই সে প্রথমবারের মতো কো-প্রডিউসার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। এ সুযোগ আগে তার আসেনি। লেখক এবং কো-প্রডিউসার হিসেবে ক্লডিয়ার ভাগ্যে যে উজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে তার সাথে যোগ হবে গ্রস প্রফিটের একটা অংশও। এত প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়াটা শুধু ক্লডিয়ার কেন, কোনো রক্ত-মাংসের মানুষেরই কাম্য নয়।

এ ছবি থেকে যে বড় লভ্যাংশের প্রত্যাশা ক্লডিয়া করছে তা তার কর্ম জীবনের পরবর্তী আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার পাথেয় হবে। প্রকৃতপক্ষে সে হচ্ছে, মিসিসিপির পশ্চিমাঞ্চলের এমন একজন যে সরাসরি কখনোই কিছু চায়নি, আশাও করেনি। মানুষের হিংস্রতা, বিবাদ, কলহ থেকে ক্লডিয়া নিজেকে রেখেছে সব সময় পৃথক করে। বিবাদপূর্ণ সম্পর্কের সৃষ্টি হোক, তা চায় না সে।

অ্যাথেনার সাথে ক্লডিয়ার সম্পর্ক অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ, আন্তরিক। শুধুমাত্র চলচ্চিত্র জগতের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট সম্পর্ক নয় তাদের। অ্যাথেনা জানে তার বাকি জীবনটায় কতগুলো ছবিতে কাজ করতে পারবে। অবশ্যই বুদ্ধিমতী সে। শুধু বজ স্কাটে তার জীবনে একটা অশুভ ছায়া ফেলে রেখেছে, যার কারণে অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে সে প্রতিনিয়ত। তবে এও সত্য, অ্যাথেনা কখনোই কারো ভয়ে কিংবা কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত নিয়তির ভয়ে ভীত ছিল না– এখনো নয়।

ক্লডিয়া ঠিক করে নিল অ্যাথেনার কাছে গিয়ে তার আচরণ কি হবে, কি বলবে সে অ্যাথেনাকে। অ্যাথেনার এই আতঙ্কিত হওয়ার প্রকৃত কারণ তাকে উদ্ধার করতেই হবে। হয়তো ক্লডিয়া এ ব্যাপারে তার সহযোগিতায় এগিয়ে যাবে। না, হয়তো নয়, নিশ্চিতভাবেই। অ্যাথেনার ক্যারিয়ার এভাবে ধ্বংস হতে দেয়া যায় না তাকে অবশ্যই এগিয়ে যেতে হবে। ক্লডিয়া তাকে নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা দেবে। তবে কে জানে এই মুভি ব্যবসায় কত রকমের জটিলতা কিংবা ফাঁদ তার জন্য অপেক্ষা করছে।

ক্লডিয়া ডি লিনা নিউইয়র্ক থেকেই লেখিকা হওয়ার স্বপ্ন দেখে আসছে। একুশ বছর বয়সে কুড়িটি প্রকাশকের কাছে তার প্রথম নভেল উপেক্ষিত হয়েছে। কিন্তু নিরাশ হয়নি সে। মানসিক দৃঢ়তা নিয়ে সে পাড়ি জমিয়েছে লস অ্যাঞ্জেলেস। হলিউডে চলচ্চিত্রের পাণ্ডুলিপি লেখার কাজে মনোনিবেশ করেছে।

ক্লডিয়া উচ্ছল, প্রাণবন্ত এবং মেধাবী। লস অ্যাঞ্জেলেসে খুব শিগগিরই সে তার অবস্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে, জুটেছে অনেক গুণী বন্ধু।

লস অ্যাঞ্জেলেসের ইউসিএলএ-তে যখন সে স্ক্রিপ্ট রাইটিংয়ের কোর্স করছিল তখন সেখানকার এক যুবকের সাথে তার পরিচয় হয়। যুবকটির বাবা ছিল বিখ্যাত প্রাস্টিক সার্জন। খুব অল্প দিনেই তাদের মধ্যে তৈরি হলো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এ সম্পর্ক রূপ নিল ভালোবাসায়। ক্লডিয়ার শরীর, মেধা এবং বুদ্ধিমত্তায় মোহিত হলো সে। দিনের পর দিন শয্যাসঙ্গী হয়ে উভয়ের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেতে লাগল ক্রমান্বয়ে।

এক রাতে ডিনারে নিমন্ত্রণ করে যুবকটি নিয়ে গেল তার বাসায়। ক্লডিয়াকে দেখে তার সাথে কথা বলে যুবকের বাবা মুগ্ধ হলো। ডিনার শেষে ক্লডিয়ার মুখে হাত বুলিয়ে যুবকের বাবা বলল, তোমার মতো একজন যুবতীর যতটুকু সুন্দরী হওয়া উচিত ছিল, ততটা তুমি নও।

আকস্মিক এ মন্তব্যে ক্লডিয়ার ভ্রূজোড়া কুঞ্চিত হলো। তাকে দেখে যুবকের বাবা বলল, আমার এ কথার বিরূপ ধারণা করো না। এটা একটা নিশ্চিত দুর্ভাগ্য। আর আমার ব্যবসা বা দক্ষতা যা-ই বলল, আমি তোমাকে সুন্দর একটা চেহারা দিতে পারি।

ক্লডিয়া প্রেমিকের বাবার কথায় প্রতিবাদ করল না, তবে একটু রুষ্ট হলো, বলল, কেন আমাকে সুন্দরী হতে হবে? কি হবে এই সুন্দর দিয়ে? হেসে ফেলল ক্লডিয়া। বলল, আমি আপনার পুত্রের জন্য যথেষ্ট সুন্দরী।

এ পৃথিবীর সবই সুন্দর, সার্জন বলল। তোমার ঐ চেহারায় যখন হাত পড়বে, তখন তুমি আমার ছেলের জন্য হয়ে উঠবে আরো সুন্দর। তুমি সত্যিই একটি মিষ্টি এবং বুদ্ধিমতী মেয়ে, আর এর সাথে সৌন্দর্য যোগ হলে তোমার ক্ষমতা আরো বাড়বে। তুমি কি সত্যিই তোমার বাকি জীবনটা উপভোগ করতে চাও না যেখানে সব পুরুষ সুন্দরীদের ঘিরে থাকবে অথচ তোমার মতো মেধাবীর দিকে হয়তো কেউ তাকাবেও না? তোমাকে হয়তো একটি ডামির মতো বসে থাকতে হবে, কারণ তোমার নাকটি বোচা এবং মাফিয়াদের মতো তোমার চিবুকটিও যেন থ্যাবড়ানো। এ কথাগুলো সার্জন ক্লডিয়াকে আঘাত করে বলেনি, বরং তাকে উৎসাহ দেয়ার জন্যই বলল। তোমাকে পরিবর্তন করতে আমার খুব বেগ পেতে হবে না। তোমার খুব সুন্দর দুটি চোখ আছে, আছে সুন্দর একটি মুখ। আর একজন মুভিস্টার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার মতো তোমার রয়েছে যথেষ্ট সুন্দর শরীর।

মাফিয়া শব্দটি ক্লডিয়ার শিরায় শিরায় অনুরণিত হলো। মুখ ফিরিয়ে নিল সে সার্জনের কথায়। স্পষ্ট উপলব্ধি হলো তার, সে জানে বাবার মতোই দেখতে সে।

সার্জনকে উদ্দেশ্য করে বলল, এটা কোনো ব্যাপার নয়। আর তাছাড়া, আমি আপনার সম্মানী দিতে পারব না।

সেটা পৃথক বিষয়, সার্জন বিরোধিতা করল। মুভি ব্যবসা সম্পর্কে আমার ধারণা আছে। চলচ্চিত্র জগতের অনেক নারী-পুরুষ তারকার ক্যারিয়ার আমি দীর্ঘায়িত করেছি। আর এক্ষেত্রে তুমিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। জানি না আমার প্রস্তাবে তুমি কতটুকু অনুপ্রাণিত হচ্ছ, তবে তোমার মেধা সম্পর্কে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

মনে রেখো, তোমার ক্ষেত্রটি চলচ্চিত্র জগতের। তোমাকে কিছুটা হলেও পেশাদারি মনোভাবের হতে হবে- এটা কোনো নারী বা পুরুষ বলেই শুধু নয়। যদিও এটা এ জগতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

এত কিছু বলার পরও ক্লডিয়ার চোখে-মুখে দ্বিধা লক্ষ্য করল সার্জন। বলল, তোমার কাজটি আমি বিনা পারিশ্রমিকে করতে চাই। এ কাজটি আমি করব তোমার জন্য এবং আমার পুত্রের খাতিরে। যদিও আমি জানি তুমি তোমার বর্তমান রূপ হারাবে, সুন্দরী হয়ে উঠবে। আর আমার ছেলে হারাবে তার গার্লফ্রেন্ড।

ক্লডিয়ার মনে একটা বোধ ছিল সে সুন্দরী নয়। এ মুহূর্তে তার মনে এলো ক্রসের প্রতি তার বাবার অতিরিক্ত আগ্রহের বিষয়টি। একটু আফসোস হলো তার– যদি সে সুন্দর হতো, হয়তো তার লক্ষ্যও হতো ভিন্ন। এমন ভাবনা থেকেই ক্লডিয়ার প্রথমবারের মতো সার্জনকে ভালো লাগল। হ্যান্ডসাম পুরুষ সে, আকর্ষণীয়ও। চোখ দুটোতে সদা ভদ্রতার চাহনি। সার্জনের প্রস্তাবে সম্মতি জন্মালো তার মনে। হেসে ফেলল ক্লডিয়া।

বলল, ঠিক আছে! আমাকে সিনড্রেলা বানিয়ে ফেলুন।

সার্জন সিনড্রেলা করল না ক্লডিয়াকে তবে তার বোঁচা নাক, চিবুক আর মুখের ত্বকে আনল ব্যতিক্রমতা। সার্জারির পর যখন সে ফিরে এলো, তাকে খুব আকর্ষণীয় মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন এক গর্বিত নারী—নিখুঁত তার নাক, সাবলীল কর্তপূর্ণ তার উপস্থাপনা ও প্রকৃতপক্ষে খুব সুন্দরী রমণীর পর্যায়ে না গেলেও আগের চেয়ে ক্লডিয়া হলো অনেক বেশি আকর্ষণীয়।

খুব অল্প সময়েই ক্লডিয়ার পেশাগত ক্ষেত্রেও ফল এলো ম্যাজিকের মতো। মেলো স্টুয়ার্ট ব্যক্তিগতভাবে তার সাক্ষাৎ প্রার্থী হলো। তার এজেন্ট হিসেবে নিজেকে প্রস্তাব করল স্টুয়ার্ট। খুব অল্প বয়সেই ছোটখাটো রিরাইট করা স্ক্রিপ্ট নিয়ে ক্লডিয়ার যাতায়াত বাড়ল চলচ্চিত্র জগতের নামি-দামি প্রযোজক, পরিচালক ও তারকাদের সম্মিলিত বিভিন্ন পার্টিতে। উচ্ছ্বসিত হলো তারা ক্লডিয়ার সৌন্দর্য ও মেধায়। পরবর্তী পাঁচ বছরে ক্লডিয়া অবস্থান করে নিল প্রথম শ্রেণীর লেখিকা হিসেবে। প্রথম শ্রেণীর ছবিগুলোতে তার চিত্রনাট্য সমানে কদর পেতে লাগল।

ব্যক্তিগত জীবনেও ম্যাজিকের মতো প্রভাব পড়ল ক্লডিয়ার। মর্মে মর্মে সে উপলব্ধি করল সার্জনের কৃতিত্ব বুঝতে পারল, সার্জনের চিন্তাধারাই ছিল সঠিক। কিন্তু যার কারণে সার্জনের কাছ থেকে এত কিছু সে পেয়েছে সেই যুবকও পিছিয়ে গেল প্রতিযোগিতায়। যৌন আবেদনে ক্লডিয়ার জয়জয়কার অবস্থা ধারালো এ অস্ত্রের ব্যবহারে যুক্তিসম্মতভাবে ঘায়েল হলো সবাই। অবশ্য এমন সফলতায় সব স্টারই গর্ববোধ করে থাকে। যৌন আবেদন এবং যৌনতা সত্যিকার অর্থেই চলচ্চিত্র জগতে টিকে থাকার গৌরব।

চলচ্চিত্র জগৎ ক্লডিয়ার ভালোবাসা। সে ভালোবাসে বিভিন্ন লেখকদের সাথে কাজ করতে, ভালোবাসে প্রডিউসারদের সাথে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে তর্ক করতে। আরো পরিচালকের তোষামোদ করতে তার আনন্দ। একটি ছবির সাথে জড়িয়ে তার প্রথম কাজ হচ্ছে কিভাবে সার্বিক ব্যয় কমানো যায়, তার পথ বের করা, আর একই সাথে এই ব্যয়ে নির্মিতব্য ছবিকে কিভাবে সর্বোচ্চ শৈল্পিক পর্যায়ে উপস্থাপন করা যায়। তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে ক্লডিয়ার রয়েছে বিস্ময়কর চিন্তা-ভাবনা, কিভাবে একটি ছবির কলা-কুশলী তার স্ক্রিপ্টের প্রতিটি শব্দকে সার্থকভাবে উপস্থাপন করবে, কণ্ঠের মাধুর্যতায় ফুটিয়ে তুলবে দৃশ্যের পর দৃশ্য। ক্লডিয়ার ভালোবাসা চলচ্চিত্রের জাদুকরি সেট-সজ্জায়। অথবা অনেকেই এ বিষয়টিকে সবচেয়ে অপছন্দের কাজ বলে মনে করে। কিন্তু ক্লডিয়া এনজয় করে প্রতিটি কর্মকাণ্ড। সম্পূর্ণ কাজ শেষে প্রেক্ষাগৃহগুলোতে যখন ছবি মুক্তির অপেক্ষায় থাকে তখন ক্লডিয়া রোমাঞ্চিত হয় সবচেয়ে বেশি— তার এই রোমাঞ্চের কারণ ছবির ব্যর্থতা কিংবা সফলতা।

ক্লডিয়া বিশ্বাস করে, চলচ্চিত্র হচ্ছে শিল্প মাধ্যমের একটি বিশাল অবকাঠামো। তাই যখন কোনো ছবির পাণ্ডুলিপি পুনর্লিখন কিংবা রিরাইটের জন্য তার ডাক পড়ে, ক্লডিয়া অত্যন্ত উৎসাহের সাথে এগিয়ে যায়। ছবির মূল ভাবার্থ ঠিক রেখে সে চেষ্টা করে নতুনত্বের ছোঁয়া দিতে। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই ক্লডিয়া পেয়ে যায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা। শুধু তাই নয়, তার মেধা, সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অনেক তারকাই তার বন্ধু হয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তার অ্যাথেনা অ্যাকুইটেনের সাথে।

পুরুষের সাথে সম্পর্কের প্রধান আকর্ষণ ক্লডিয়ার উচ্ছ্বসিত যৌনতা। খুব সহজে সাবলীল যৌনতা ক্লডিয়া যেমন উপভোগ করে, তেমনি তার পুরুষ সঙ্গীও দ্বিধাহীন, খাঁটি অমিয় ধারার সুখে নিমজ্জিত হয়। মাঝে মাঝে বিস্মিত হয় তার শয্যাসঙ্গীরা। এত ঘনিষ্ঠতা স্ত্রীর কাছেও পাবে কি-না সন্দেহ জাগে। তবে ক্লডিয়া এই যৌন উপভোগের মাধ্যমে কখনোই বাড়তি কোনো সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেয়নি– এটি তার নীতিবিরুদ্ধ। মাঝে মাঝে তার শয্যাসঙ্গীর সাথে কৌতুক করে, আজকের এই সেক্স আমার পরবর্তী পাণ্ডুলিপিতে স্থান পাবে শৈল্পিকভাবে।

ক্লডিয়ার প্রথম রোমাঞ্চকর মানুষ হচ্ছে তার সেই সার্জন। পুত্রের চেয়ে অনেক বেশি প্রাণবন্ত ও সুপুরুষ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে সে ক্লডিয়ার কাছে। ধীরে ধীরে ছেলেকে ছাপিয়ে সার্জন নিজেই বন্ধু সেজেছে ক্লডিয়ার। আর নিজের উচ্ছ্বাসের জন্যই সে তাকে প্রস্তাব দিয়েছে একটি অ্যাপার্টমেন্টের, সাথে সাপ্তাহিক ভাতা। সার্জনের প্রস্তাব শুধু তার সাথে যৌন উপভোগের জন্য নয়, তার মেধাবী ও সুন্দর মানসিকতাপূর্ণ সঙ্গলাভের জন্যও।

কিন্তু সার্জনের প্রস্তাব সুকৌশলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে ক্লডিয়া। সে বলেছিল, আমি ভাবছি, এ ব্যাপারে অন্তত ফি দিতে হবে না। তাই নয় কি?

সহাস্যে সার্জন বলেছিল, তুমি তো ইতিমধ্যে দিয়ে ফেলেছ অনেক। তবে আমি ভাবছি, আমার এ প্রস্তাব আমাদের দুজনের যে কোনো সময় সাক্ষালাভের সুযোগ করে দেবে।

ক্লডিয়া স্বীকৃতি দিয়ে বলেছিল, অবশ্যই।

ক্লডিয়া বিভিন্ন ধরনের ভিন্ন ভিন্ন বয়সের মানুষের সাথে সম্পর্ক রেখেছিল। বন্ধুত্বের সম্পর্ক তো বটেই, সাথে যৌনতার মিশেল। তবে সার্জনের মধ্যে সে পেত ভিন্ন স্বাদ, ভিন্ন অনুভূতি, অন্যরকম সুখ। এক অর্থে সার্জনই তাকে শিখিয়েছে জীবন উপভোগ করার এমন কৌশল। সার্জনের কাছেই পেয়েছে সত্যিকারের উপভোগের জীবন দর্শন। ভিন্ন ভিন্ন বয়সের, ভিন্ন দর্শনধারীর সাথে শয্যাসঙ্গী হয়ে সে খুঁজে পেত ভিন্ন সুখ। এক অর্থে স্বেচ্ছা-পতিতার মতোই হয়ে উঠেছিল ক্লডিয়া। আনাড়ি অভিনেতা কিংবা চিত্রনাট্যকারের সাথেও তার সম্পর্ক ছিল। প্রকৃতপক্ষে এমন পদক্ষেপ ছিল তার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার পুষ্ট করার মানসে। সবখানেই ছিল তার শেখার আগ্রহ। তার স্বল্প বিস্তর এই প্রবৃত্তিতে বয়স্কদের সান্নিধ্যে সে পেয়েছে সবচেয়ে বেশি আনন্দ এটা অভিজ্ঞতার ফসল তো বটেই।

একটি দিনের কথা স্মরণীয় হয়ে থাকবে ক্লডিয়ার। বিখ্যাত এলি ম্যারিয়ন স্বয়ং ক্লডিয়াকে আহ্বান জানিয়েছিলেন লর্ডস্টোনের বাংলোয়। উপভোগ করেছিল ক্লডিয়া সে রাত, তবে সত্যিকার অর্থে সফল হয়নি। লডস্টোনের এক পার্টিতে চলচ্চিত্র জগতের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এলি ম্যারিয়েনের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল ক্লডিয়ার। তার মতো প্রভাবশালী ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য ক্লডিয়াকে মোটেও ভীত করেনি। পার্টিতে বরং ম্যারিয়নের সাথে সে ছিল প্রাণবন্ত। বিষয়টি বেশ কৌতূহলী করে তোলে ম্যারিয়নকে। এর কারণ, সে সময় স্টুডিওর এক প্রোডাকশনের আলোচনায় ক্লডিয়ার কিছু উক্তি ছিল অসঙ্গতিপূর্ণ। আর এরই জের ধরে ববি বানজ তাকে কটাক্ষ করে অশ্লীল মন্তব্য করে। এর পরও ক্লডিয়ার অভিব্যক্তিতে কোনো ছাপ পড়েনি। বরং স্বাভাবিকই ছিল এবং প্রতি উত্তরে ক্লডিয়াও শুনিয়ে দিয়েছিল সমান অশ্লীল উক্তি। এই অশ্লীল উক্তিগুলো ছিল একটু ভিন্ন রকমের। ক্লডিয়ার তেজোদীপ্ত ও উচ্ছল উপস্থাপনাই ম্যারিয়নের অতিরিক্ত উৎসাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এলি ম্যারিয়ন তার বার্ধক্যজনিত কারণে বিগত কয়েক বছর ধরে সেক্স থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। শারীরিক দৌর্বল্যের সাথে সাথে যৌনতার বিষয়টিও উঠে গিয়েছিল মন থেকে। তারপরও আকস্মিক ক্লডিয়াকে ডাকলেন বেভারলি হিলসের বাংলোয়। ম্যারিয়ন ভেবেছিলেন ক্লডিয়া হয়তো তার প্রভাব ও ক্ষমতার ভয়েই যেতে বাধ্য হবে। কিন্তু তার যে সেক্স সম্পর্কে কতটুকু কৌতূহল সে যে বয়সেরই হোক না কেন, তা জানা ছিল না বেচারা বৃদ্ধ ম্যারিয়নের। ম্যারিয়নের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তির সাথে বিছানায় যাওয়াটা কেমন দেখাবে, যে একই সাথে বৃদ্ধও?

ম্যারিয়নের যেখানে ছিল দ্বিধা, ক্লডিয়ার সেখানেই ততখানি কৌতূহল। বৃদ্ধ ম্যারিয়নের মাঝেও সে এক আকর্ষণ অনুভব করেছিল। ম্যারিয়ন তার গরিলাসদৃশ চেহারা নিয়ে যখন হেসেছিলেন, খুব আকর্ষণীয় এবং হ্যান্ডসাম মনে হয়েছিল তাকে।

ক্লডিয়াকে পরীক্ষামূলক যাচাই করতে, অর্থাৎ তাকে যৌন ঔৎসুক্য থেকে নির্বাচিত করতে ম্যারিয়ন কৌশলে বলেছিলেন, সবাই আমাকে এলি নামেই ডাকে, এমনকি আমার নাতি-নাতনিরাও। ক্লডিয়াকে ম্যারিয়ন নাতির বয়সি হিসেবেই বোঝাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বেচারা বৃদ্ধের এই বুদ্ধিদীপ্ত প্রকৃত উচ্ছ্বাসে ক্লডিয়া যেন আরো কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। ম্যারিয়ন সম্পর্কে সে শুনেছিল সে মারাত্মক নির্দয় লোক, কিন্তু তার সান্নিধ্যে এসে ক্লডিয়ার মোটেও তা মনে হয়নি, ম্যারিয়নের সাথে যৌনতায় বরং আগাম রোমাঞ্চ অনুভব করতে লাগল।

বেভারলি হিলসে হোটেলের বাংলোয় বসে ছিলেন ম্যারিয়ন। ক্লডিয়ার আগমনের অপেক্ষাতেই ছিলেন। দ্বিধা ছিল মনে, ছিল সংকোচ। টগবগে যুবতী ক্লডিয়ার সাথে কতটুকু তাল মেলাতে পারবেন তিনি? কিংবা আদৌ পারবেন কি?

ম্যারিয়ন তার অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন বাংলোর নিচতলায়। ক্লডিয়া যখন প্রবেশ করল ম্যারিয়ন তখনও দ্বিধান্বিত, স্পষ্ট চিন্তার ছাপ তার কপালে। আর ক্লডিয়া তার স্বভাবসুলভ স্বতঃস্ফুর্ত, প্রাণবন্ত। বৃদ্ধ ম্যারিয়নের সহযোগিতায় এগিয়ে এলো সে। সমস্ত দ্বিধা-সংকোচ ঝেড়ে ফেলে ম্যারিয়নের পরিধেয় খুলে ফেলল সে নিজ হাতে। তারপর সেগুলো সুন্দর ভাঁজ করে রাখল একটি চেয়ারে।

এবার বিবস্ত্র হওয়ার পালা তার নিজের। একে এক পরিধেয় সরতে লাগল ক্লডিয়ার, সম্পূর্ণ নগ্ন হলো সে। কিন্তু ততক্ষণে নগ্ন ম্যারিয়ন নিজেকে লুকিয়েছে বিছানার চাদরে। নগ্ন ক্লডিয়া জড়িয়ে ধরল ম্যারিয়নকে। নিজের সংকোচ কাটাতে এবং কিছুটা স্বাভাবিক হতে ম্যারিয়ন কৌতুক করে বলল রাজা সলোমন যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন তাকে উষ্ণ রাখতে তার শয্যায় পাঠানো হয়েছে কুমারী…

বেশ, আপনার যদি এমনই মনোভাব, তবে খুব বেশি সহযোগিতা করা সম্ভব হবে না আমার পক্ষে। ক্লডিয়া বুড়োকে উজ্জীবিত করতে তাৎক্ষণিক বলল। এ কথায় সাগ্রহে বুড়ো ম্যারিয়নকে জড়িয়ে ধরল এবং স্পর্শ করল তার ঠোঁট। ম্যারিয়নের ঠোঁটের উষ্ণতা পেল ক্লডিয়া। তবে শরীরে পেল শুষ্কতা এবং বার্ধক্যের নরম পেশি। সব মিলিয়ে ক্লডিয়ার একেবারে খারাপ লাগেনি বুড়োর সাথে শরীর মিশিয়ে রাখতে।

এর মধ্যে কেটে গেছে বেশ কিছু সময়। অবাক হলো ক্লডিয়া। এতটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া নেই ম্যারিয়নের। অবাক হলো এই ভেবে, হাজার ডলারের সুট-বুটের ম্যারিয়ন কতই না সুপুরুষ, কতই না ক্ষমতাবান, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। অথচ জীবনের এই শেষ লগ্নে ক্লডিয়ার আহ্বানে কতটাই তার অক্ষমতা। আরো মিনিট দশেক মরিয়া চেষ্টা চালাল ক্লডিয়া চুমুতে চুমুতে ভরে দিল সারা অঙ্গ, আলিঙ্গনের মোল কলার বাদ গেল না কিছুই। কিন্তু ম্যারিয়ন তথৈবচ। অবশেষে উপলব্ধি করল ম্যারিয়নের আর কিছুই হবার নয়।

ক্লডিয়ার বাহুতে তখনও ম্যারিয়নের মাথা। আফসোস হলো তার। ভাবতে লাগল- এই শেষ। জীবনের সর্বশেষ নারী। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। ক্লডিয়া তাকে বিন্দুমাত্র শ্লেষাত্মক উক্তি করল না। বরং স্নেহের সাথেই শরীরে নিজের উষ্ণতা বিলিয়ে দিতে লাগল আরো কিছুটা সময়।

এক সময় ক্লডিয়া প্রসঙ্গ এড়াতে বলল, ওকে এলি। আমি আপনার সাথে, একটি বিষয়ে আলোচনা করতে চাই। আসলে, আপনাকে আমি বলতে চাই ব্যবসায়িক এবং শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে আপনার ছবিগুলো কেন এত অবহেলিত হচ্ছে? আগের মতোই ম্যারিয়নকে আলিঙ্গনে রেখেছিল, তার চুলে হাত বুলিয়ে যাচ্ছিল। ম্যারিয়নের সমস্যাগুলো এবার তুলে ধরল সে। দায়ী করল তার কিছু চিত্রনাট্যকার, কলাকুশলী ও পরিচালককে। ক্লডিয়া বলল, আপনার ছবিগুলো যে শুধু নিম্নমানের তাই নয়, দেখার মতোও নয় আপনার এসব ছবি। ভয়াবহ বিশ্লেষণ ক্লডিয়ার, যা আজ অবধি কেউ ম্যারিয়নের সামনে মুখ ফুটে এভাবে বলার সাহস পায়নি।

ক্লডিয়া স্বাভাবিকভাবেই বলে চলল, এর কারণ, ছবিগুলোতে গল্পের কোনো সেন্স নেই। তাছাড়া আপনার কিছু ফাঁকি পরিচালক আছে, যারা শুধু তাদের কল্পিত গল্পের স্লাইড শোগুলো উপস্থাপন করে আপনার সম্মতি আদায়ের জন্য। আর অভিনয় শিল্পীরা ছবিগুলোতে অভিনয় করে হয়তো অর্থের লোভে কিংবা অন্য কোনো স্বার্থে। ঠোঁটে প্রসন্ন হাসি ছড়িয়ে ম্যারিয়ন শুনছিল ক্লডিয়ার বিশ্লেষণ। বেশ আয়েসেই শুনছিল সে। কিছুক্ষণ আগের দ্বিধা-সংকোচ সরে গেছে তার মন থেকে। উপলব্ধি হলো— তার জীবনের প্রয়োজনীয় কিছু অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে গেছে ইতিমধ্যেই– এটা এক রকমের মানসিক মৃত্যুর সমতুল্য। বুঝতে পারল, সে আর কখনোই কোনো নারীর ভালোবাসা পাবে না, শত চেষ্টা করলেও নয়। কিংবা পারবে না তার পৌরুষত্ব দিয়ে কোনো নারীকে অপদস্থ করতে– এ অধ্যায়ে মৃত্যু ঘটেছে ম্যারিয়নের।

সে জানে, আজকের এই রাতের কথা ক্লডিয়া হয়তো কখনোই কারো কাছে প্রকাশ করবে না। আর যদি করেই, তাতেইবা কি এমন আসে-যায়? ম্যারিয়ন জানে তার এখনো আছে পার্থিব ক্ষমতা। এখনো এ বয়সেও হাজার হাজার লোকের জীবনের পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষমতা তার আছে। যত দিন সে বেঁচে থাকবে ততদিনই থাকবে তার এ ক্ষমতা। তবে ক্লডিয়ার সুখের পরশ, সাথে ফিল্ম নিয়ে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ বেশ আগ্রহ নিয়েই শুনছে, শুনতে ভালো লাগছে ম্যারিয়নের।

এতক্ষণে মুখ খুলল সে, তুমি বুঝতে পারছ না, বলল ম্যারিয়ন। আমি কেবল একটি ছবির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সহযোগিতা করতে পারি, ছবির নির্বাহের কাজ আমার নয়– আমার পক্ষে সেটা সম্ভবও নয়। তোমার মন্তব্য সম্পূর্ণরূপে সঠিক—-আমি আর কখনোই সেসব পরিচালককে নিযুক্ত করব না। ট্যালেন্টদের তো আর অর্থের ক্ষতি হয় না হয় আমার। অবশ্য তাদেরকে এর দায় নিতে হবে। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে— শৈল্পিক ছবি কি সত্যই অর্থ আনবে?

কথা বলতে বলতেই ম্যারিয়ন বিছানা ছেড়ে নেমে এলো। চেয়ারে রাখা কাপড়গুলো চড়াতে শুরু করল একে একে।

নগ্নতা ঢেকে যাবার পর পোশাকি ভদ্রতা উভয়ের আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটাল। এতক্ষণের স্বাভাবিকতায় ছেদ পড়ল। তবে ক্লডিয়ার এ মিশন সফল না হলেও, নগ্ন ম্যারিয়নকে কিন্তু তার যথেষ্ট শক্তিশালী এবং আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। তরুণদের মতো টানা দুটি পা, মেদহীন চিকন শরীর, তুলনামূলক বড় মাথা– এর সব কিছুই ছিল ম্যারিয়নের প্রতি ক্লডিয়ার আকর্ষণের উৎস। শুধু একটি অঙ্গই হতাশ করেছে ক্লডিয়াকে। বুড়ো ম্যারিয়নের যৌনাঙ্গ সতেজ করার জন্য আদৌ কোনো চিকিৎসা আছে কি-না, ক্লডিয়া তার সার্জন প্রেমিকের পরামর্শ নেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

এ মুহূর্তে ম্যারিয়নের ক্লান্ত শরীরে শার্টের বোম লাগানো বোম দেখে তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে এলো ক্লডিয়া। তারপর নিজ হাতে গুলো লাগিয়ে দিল একে একে।

ক্লডিয়ার নগ্নতায় গভীর দৃষ্টি ফেলল ম্যারিয়ন। বিগত যৌবনের অনেক ভাসা ভাসা স্মৃতি উঁকি মেরে গেল তার মনে। এ পর্যন্ত যত স্টারদের সাথে সে বিছানায় গেছে তাদের অনেকের চেয়ে ক্লডিয়ার শরীর আকর্ষণীয়। কিন্তু এ মুহূর্তে ক্লডিয়ার নগ্ন সৌন্দর্য ম্যারিয়নকে মোটেও বিচলিত করতে পারল না– আর, পারবেও না কোনো দিন। তবে এর জন্য তার যেমন নেই আফসোস, তেমনই নেই কোনো উচ্ছ্বাস।

ক্লডিয়া সুন্দর করে বেঁধেছিল ম্যারিয়নের মেরুন রঙ্গা টাই। চেয়ারে বসে পড়েছিলেন ম্যারিয়ন। ক্লডিয়া কোল ঘেঁষে উষ্কখুষ্ক চুলে আঙুল চালিয়ে যাচ্ছিল। চুলগুলো নির্দিষ্ট সিঁথিতে এনে ম্যারিয়নের ঠোঁটে আবারো উষ্ণ স্পর্শ দিল ক্লডিয়া। বলল, সুন্দর একটি সময় কাটালাম আজ।

কথাটি ম্যারিয়নের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। ক্লডিয়ার কণ্ঠে বিদ্রুপের কোনো লেশমাত্র পেলেন না বুড়ো ম্যারিয়ন। সত্যিই কি ক্লডিয়া সুন্দর সময় কাটিয়েছে? ম্যারিয়নের বিশ্বাস হয় না—-বিশ্বাস হবার কথাও নয়। এ পর্যন্ত ক্লডিয়ার সাথে যতটুকু হয়েছে, তার আদ্যপান্ত ব্যর্থতায় ভরা হাস্যকর একটা সময় গেছে। তবে ক্লডিয়ার কণ্ঠে যে এক আবেগ ছিল তাতে অবলম্বন যেন পাওয়া গেল কিছুটা। ক্লডিয়াকে মোহিত করা সেই বিখ্যাত হাসি ফুটে উঠল বুড়োর মুখে।

ম্যারিয়ন বুঝতে পারলেন যুবতী ক্লডিয়া সত্যিই নিষ্পাপ। তার সত্যিই আছে একটি সুন্দর হৃদয়। আর বুড়ো ম্যারিয়নের প্রতি তার এই ভালো লাগাটাও হচ্ছে যুবতী বয়সের উচ্ছল আবেগ। ম্যারিয়নের আফসোস হলো এই ভেবে যে, ক্লডিয়ার মতো এমন স্বচ্ছ, সুন্দর ও মেধাবী একটি মেয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম একটি ক্ষেত্রে বিচরণ করছে- এ পৃথিবী তার আমূল পরিবর্তন করে ফেলবে। নিঃশেষ করে ফেলবে তাকে।

ক্লডিয়ার আচার-আচরণ, ব্যবহারে মুগ্ধ ম্যারিয়ন। তিনি বললেন, বেশ, অন্তত আজ আমি তোমাকে খাওয়াতে চাই। বলেই টেলিফোনের রিসিভার তুলে রুম-সার্ভিস বিভাগে নির্দেশ দিলেন তিনি।

সত্যিই ক্ষিদে পেয়েছিল ক্লডিয়ার। খাবার আসার পর গোগ্রাসে গিলল অধিকাংশ খাবার। নিমেষে শেষ করল সুপের বাটি ও হাঁসের মাংস দেয়া ভেজিটেবল। তারপর বড় আকারের বাটি ভর্তি স্ট্রবেরি আইসক্রিম তৃপ্তির সাথে খেল সে। অপরদিকে ম্যারিয়ন খেল খুব সামান্যই, তবে মদের বোতলের অনেকটাই সে শেষ করল। খেতে খেতে তাদের মাঝে আলাপ হলো মুভি এবং নভেল নিয়ে। এ আলাপ থেকে ক্লডিয়া আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করল– তার চেয়ে ম্যারিয়ন অনেক ভালো পড়ুয়া। অগাধ জ্ঞান আছে তার নভেলে।

লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম আমি, ম্যারিয়ন বললেন। এখনো আমার দুর্বলতা রয়েছে এর প্রতি। পড়তেও ভালো লাগে। বই সত্যিই আমাকে দেয় আনন্দ। তবে, তুমি কি জানো এমনই একজন লেখক আছে আমার পছন্দের তালিকায়, যার সাথে আমি ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করেছি। এমনকি তার লেখা বইগুলো আমি রীতিমতো পূজা করি। শুনবে তার নাম? একটু থামলেন ম্যারিয়ন। আবার সচকিত হয়ে উঠলেন তিনি। বললেন, সেই লেখকের নাম আর্নেস্ট ভেইল। অনেক সুন্দর সুন্দর বই লিখেছে সে। তবে তার ব্যক্তিগত জীবনটা বেশ ব্যথাতুর। কিভাবে তার পক্ষে এমন লেখা সম্ভব- অবাক হই।

এর কারণ, লেখকরা তাদের লেখা বইয়ের মতো পারে না। ক্লডিয়া প্রায় তাৎক্ষণিক জবাব দিল। আবার বলল, জীবনের অনেক রস ঘেঁকে হেঁকে একজন লেখক পূর্ণ করে তোলে অন্যের উপভোগের জন্য। বিশাল বিশাল পাথরের বোঝ তাদের জীবনে, যেন এক একটা খনি। আর সেখান থেকে ছোট মূল্যবান হীরে পেতে, প্রচণ্ড রকমের বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে একের পর এক–এত সহজ নয়।

আর্নেস্ট ভেইলকে তুমি চেন ম্যারিয়নের প্রশ্নে ক্লডিয়া ইতিবাচক মাথা নাড়ল। ম্যারিয়নের প্রশ্নে এমন কোনো অশ্লীল আভাস ছিল না। ভেইলের সাথে যে ক্লডিয়ার সম্পর্ক আছে তা কোনো মতে ম্যারিয়নের জেনে ফেলা অসম্ভব কিছু নয়। তবে সে ম্যারিয়নকে অবশ্যই জানাতে চায় যে, ভেইলের সাথে তার একটা সম্পর্ক আছে- যে সম্পর্ক ভালোবাসার। ক্লডিয়া বলল, আমি তার লেখা ভালোবাসি, খুব পছন্দ করি কিন্তু আমি তার জন্য একা দাঁড়াতে পারব না। একটু রহস্য রেখেই বলল ক্লডিয়া, তার সাথে স্টুডিও অবিবেচনাপূর্ণ আচরণ করেছে। অনিচ্ছাপূর্বক তার অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে।

ক্লডিয়া আকস্মিক ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। হাতের অশ্লীল ভঙ্গি প্রদর্শন করে সে ম্যারিয়নের উদ্দেশে বলল, স্টুডিওর প্রতি অধিকাংশ ট্যালেন্টেরই রয়েছে। ক্ষোভ। এটি কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয় এবং আপনার সামনেই আজ বলছি, ব্যবসায়িক সম্পর্কের দিক দিয়ে আপনিও তাদের সুইট হার্ট নন। তবে, আমি হচ্ছি এ শহরের একমাত্র রাইটার যে প্রকৃতই আপনাকে পছন্দ করি।

এ কথায় দুজনই হেসে উঠল।

ক্লডিয়ার আজকের এই সুন্দর মুহূর্তটি থেকে বিচ্ছেদের সময় ঘনিয়ে এলো। বেভারলি হিলস হোটেলের বাংলো ত্যাগের আগে ক্লডিয়ার উদ্দেশে ম্যারিয়ন বললেন, তোমার যে কোনো সমস্যায় দয়া করে আমাকে জানিও। এটি ম্যারিয়নের এমনই এক অভাবনীয় ম্যাসেজ যা এ পর্যন্ত তার সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের খুব কম মানুষের ভাগ্যেই জুটেছে।

ক্লডিয়া বুঝতে পারল বিষয়টি। বলল, এমন সময় উপভোগ করে আমি কখনোই আমার সুবিধা আদায় করতে অভ্যস্ত নই। বরং কোনো স্ক্রিপ্ট নিয়ে যদি আপনি কখনো সমস্যায় পড়েন, আমাকে কল করবেন। সে ক্ষেত্রে উপদেশ হবে বিনা পয়সায়, আর যদি আমাকে লিখতে হয় তবে এর জন্য পে করতে হবে।

অত্যন্ত কাঠখোট্টা প্রফেশনাল জবাব শুনিয়ে দিল হলিউডের প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান বৃদ্ধ ম্যারিয়নকে। এমন একটা ভাব দেখাল সে যেন ক্লডিয়ার প্রয়োজনে নয়, ম্যারিয়নেরই প্রয়োজন পড়তে পারে ক্লডিয়াকে এবং খুব একটা সত্য কথা না হলেও গর্ব ভরে ম্যারিয়নকে সে বলল, আমার নিজের মেধার প্রতি যথেষ্ট আস্থা রয়েছে।

বন্ধু হয়েই সেদিনের মতো বিদায় নিল ক্লডিয়া। ম্যারিয়নের মনেও ছেয়ে রইল ক্লডিয়ার ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব।

সমুদ্র উপকূলের হাইওয়ে ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল ক্লডিয়া। এখানে গাড়ির গতিসীমা কম। বাম পাশে সমুদ্র সৈকত। রোদের আলোয় সমুদ্রের ঢেউয়ের ঝিলিক। আপন মনেই দৃষ্টি চলে গেল সেদিকে। সৈকতে অর্ধনগ্ন মানুষের শান্ত ঘোরাফেরা। তাকিয়ে রইল সেদিকে ক্লডিয়া। মনে পড়ে গেল সেই ছোটবেলার কথা– কতবারই না এসেছে সে বেড়াতে। মাথা উঁচু করে দৃষ্টি গেল সৈকত পেরিয়ে, সাগরের উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে আরো অনেক দূর একেবারে দিগন্তরেখা অবধি। সেখানে যেন সাগরের উত্তালতা নেই। সর্ষে বিন্দুর মতো কিছু মাস্তুল চোখে পড়ল তার। দৃষ্টি ফিরে এলো হাইওয়ের ডান ডিকের এক জটলায়। ক্যামেরা, বোর্ড আর সাউন্ড সিস্টেম ঘিরে উৎসুক জনতা, হয়তো কোনো ছবির শুটিং চলছে। সৈকত তীরের এমন হাইওয়ে ধরে গাড়ি চালাতে ক্লডিয়ার খুব ভালো লাগে। আর ঠিক ততটাই এ বিষয়ে বিতৃষ্ণা আর্নেস্ট ভেইলের। ক্লডিয়ার মনে পড়ে গেল। ভেইল প্রায় বলত, এই হাইওয়ে ধরে গাড়ি চালানো যেন নরকের জন্য ফেরি ধরা।

আর্নেস্ট ভেইলের সাথে তার প্রথম সাক্ষাতের কথা স্পষ্ট মনে আছে ক্লডিয়ার। ভেইলের বহুল জনপ্রিয় নভেলের গল্প অবলম্বনে চিত্রনাট্য তৈরির জন্য যেদিন ডাক পড়ল ক্লডিয়ার, সেদিনই প্রথম দেখা। আগে থেকেই ভেইলের ভক্ত ছিল ক্লডিয়া। কিন্তু কখনো এই স্বপ্নের লেখকের সাথে সাক্ষাৎ হয়নি। দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হলো একেবারে লেখকের গল্পের চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্ব পেয়ে।

ভেইলের লেখা প্রতিটি বাক্যে ক্লডিয়া পেত ভিন্ন স্বাদ, যেন মিউজিকের একটা ছান্দিক ভাব ফুটে উঠত লেখায়। পরবর্তীতে এ ছন্দেই দুজন গড়ে নেয় জীবনের কাব্য। ভেইলের লেখাগুলো হতো সর্বদাই বিয়োগান্তক চরিত্রের বিয়োগান্তক পরিণতি ছাড়া যেন কিছুই বোঝে না সে। তবে এর মাঝেও ছিল তার লেখার অভিনবত্ব। নতুন নতুন লেখায় অভিনব কৌশলে মুগ্ধ হয়েছিল ক্লডিয়া।

.

ছোটবেলা থেকেই সে পড়ছে ভেইলের লেখা। আর যতই বড় হচ্ছিল সে, ততই যেন স্বপ্নের এই লেখকের সাথে সাক্ষাৎ লাভের বাসনা প্রগাঢ় হয়ে উঠেছিল। তার কথা চিন্তা করে রোমাঞ্চ অনুভূত হতো তার। কিন্তু যখন তাকে সামনে পেল, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ হয়ে দেখা দিল ক্লডিয়ার কাছে।

ভেইলের তখন পঞ্চাশ বছর বয়স। শারীরিক অবকাঠামোকে তার লেখা গদ্যের মতো মনে হলো না ক্লডিয়ার। বোটে, মোটা এবং টাক মাথা। ক্লডিয়ার মনে হলো, তার এই টাক ঢাকার কোনো চেষ্টাই যেন সে করেনি কখনো। এমনকি তার দৈনন্দিন জীবনে নিজের সামান্যতম সৌন্দর্যের যত্ন নেয়নি কখনো। অথচ গল্পের চরিত্রগুলোর জন্য ছিল তার অপার স্নেহ, অশেষ যত্ন। হয়তো এটাই ছিল তার ব্যক্তি জীবনের সবচেয়ে উচ্ছ্বাসের বিষয়, শিশুর মতো সরলতা। বুদ্ধিমত্তাকে ছাপিয়ে যে সরলতা ক্লডিয়া ভেইলের মাঝে খুঁজে পেয়েছিল, তাতেই সে দুর্বল হয়ে পড়ল।

পোলো লাউঞ্জের প্রতি আর্নেস্ট ভেইলের রয়েছে সীমাহীন দুর্বলতা। সে মনে করে, পোলো লাউঞ্জে যদি অন্তত এক বেলা সকালের নাস্তা করতে পারত, তবে সে হতো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। এই হচ্ছে তার মানসিক সরলতা। গুটিয়ে রাখাই যেন তার স্বভাব। তবে লেখক হিসেবে মোটেও নয়– নিখুঁত এবং প্রাণখোলা তার সব সৃষ্টি।

এ পর্যন্ত ভেইলের লেখা নভেলের সমালোচনা হয়েছে ব্যাপক। সমালোচকদের আকুণ্ঠ উদ্ধৃতি তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে, সে তুলনায় অর্থের প্রাপ্তি কিন্তু নগণ্যই বলা যায়। অর্থ প্রাপ্তি যাই হোক, শীর্ষ জনপ্রিয় ভেইলের নভেল অবশেষে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য মনোনীত হয়েছে। আর এই উদ্যোগ বিখ্যাত লডস্টোন স্টুডিওর।

লডস্টোনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ববি বানজ। ভেইলের লেখাগুলো যেন তার হৃদয় স্পর্শ করেছে এভাবেই প্রশংসা করেছিল বানজ। তার সাথে তাল মিলিয়েছিল স্কিপি ডিরিও। তারা প্রায় এক সাথেই বলেছিল– চমৎকার তোমার লেখা। মুখোমুখি এমন প্রশংসায় লজ্জায় মাথা নত করে ফেলেছিল ভেইল। স্বপ্নের লেখক ভেইলের এমন সরলতায় সেদিন ক্লডিয়াও তাজ্জব বনে। গিয়েছিল।

লেখক ভেইলের সাথে সেটাই প্রথম মিটিং। ক্লডিয়ারও প্রথম সাক্ষাৎ। এরপর আবারও স্টুডিও কার্যালয়ে বসল তারা। কয়েকটা ঘণ্টা মাত্র অতিবাহিত হয়েছে এর মাঝে, অথচ কেমন বেমালুম পাল্টে গেল সুর বানজ-ডিরির মনোভাব, সামগ্রিক বাতাবরণ। যে মুখে ভূয়সী প্রশংসা করেছিল বানজ সেদিন, সে মুখেই দ্বিতীয় দিনের আলোচনায় ভেইলের উপন্যাসকে আকাশ থেকে একেবারে আছড়ে ফেলল মাটিতে। বলা হলো– সাদা কাগজ ভরে আবল তাবল কিছু আঁকিবুকি ছাড়া আর কিছুই নয়। এমন কথা অবশ্য ভেইলের অগোচরেই বলা হলো। শুধু জানল ক্লডিয়া, আর অবাক হলো বানজ ও ডিবির ধূর্ততায়।

ভেইলের সরলতায় তখনও ক্লডিয়া আঁচড় দেয়নি, অর্থাৎ জানায়নি বানজদের প্রকৃত মনোভাবের কথা। বরং ভেইলের সরলতা, বিশ্বাসপ্রবণতা এবং চলচ্চিত্রে তার আগ্রহ নিয়ে ক্লডিয়া মনে মনে বেশ মজাই পাচ্ছিল।

আলোচনার টেবিলে বানজ বলল আর্নেস্ট, তোমাকে সহযোগিতা করার জন্য আমরা ক্লডিয়াকে এনেছি। তার ব্যাপক কারিগরি জ্ঞান রয়েছে এ বিষয়ে ছবি কিভাবে ব্যবসা সফল হবে সে বিষয়েও ভালো ধারণা আছে তার। এ ছবি যে সুপার-ডুপার হিট করবে, তার গন্ধ পাচ্ছি। তবে মনে রেখো, এ ছবির লভ্যাংশের টেন পার্সেন্ট পাবে তুমি।

এমন প্রস্তাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ভেইলের মুখ। ক্লডিয়া কিন্তু মোটেও খুশি হতে পারল না। গভীরভাবে লক্ষ্য করল ভেইলকে। মনে মনে ভাবল, এই হাবলাটা বুঝতেও পারছে না যে, মোটের ওপর দশ শতাংশ যে শূন্যও হয়ে যেতে পারে নিমেষে বানজদের চক্রান্তে।

তবে ভেইল এই প্রস্তাবে দারুণ কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল তাদের প্রতি। আর এই কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ঘটল যখন সে ক্লডিয়াকে উদ্দেশ করে তাদের বলল, অবশ্যই, আমি তার কাছে শিখব। ছবির জন্য স্ক্রিপ্ট লেখা অবশ্যই বই লেখার চেয়ে অনেক বেশি মজার হবে, যদিও বিষয়টি আমার কাছে একেবারেই নতুন।

ভেইলকে আশ্বস্ত করতে স্কিপি ডিরি এবার বলল, আর্নেস্ট, তোমার মাঝে আমরা সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধির আভাস দেখতে পেয়েছি। আমাদের এ প্রতিষ্ঠান থেকে তুমি ব্যাপক কাজ পেতে পারো। এ ছবি থেকেই তোমার সচ্ছলতাও ফিরে আসতে পারে, সত্যিই যদি ছবিটি হিট করে এবং একাডেমি অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়।

ক্লডিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হেনে দেখতে লাগল ডিরি ও বানজকে। দুজনই আজব ঠেকল ক্লাডিয়ার কাছে। তার মনে হলো––এ টেবিলে উপস্থিত তিনজনই অর্থাৎ বানজ-ডিরির সাথে গোবেচারা ভেইলও হলিউডে যেন তেমন একটা অপরিহার্য নয়– তারা না থাকলেও হলিউড চলবে আপন গতিতে এবং সগর্বেই। ক্লডিয়ার মনে পড়ে গেল তখনও সেই সার্জনের ছুরির পোচ পড়েনি তার। মাফিয়াদের মতো চিবুক নিয়েই ধুকে ধুকে চলছে তার স্বপ্নের জগতে পদচারণা। সবার চোখে সুন্দরী হয়ে ওঠেনি তখনও ক্লডিয়া। স্পষ্ট মনে আছে তার-~ এই ডিরি কি তাকে কম ঘটিয়েছে?

ক্লডিয়া জানে এই প্রকল্পটি হাতে নেয়ার সাথে সাথেই হাজারো সমস্যা এসে জুটেছে। যাই হোক সে রাতে ভেইল তাকে ডিনারের প্রস্তাব দিল। খুব সাদামাটা উদ্দেশ্য। নতুন স্ক্রিপ্ট নিয়ে তারা কিভাবে কাজ করবে, তার একটা পরিকল্পনার জন্যই ভেইলের এ প্রস্তাব। ক্লডিয়া সম্মত হলো। কিন্তু সে নিজেকে মোটেও আকর্ষণীয় করে উপস্থিত হলো না সে সাক্ষাতে। কৌশলে এড়িয়ে গেল রোমান্টিক সব বিষয়। কাজের সময় এসব রোমান্স-টোমান্স ক্লডিয়ার একেবারে পছন্দ নয়। বিশেষ করে লেখালেখির সময় এ ধরনের বিষয় যোগ হলে কাজে মারাত্মক সমস্যা হয় ক্লডিয়ার।

সেই রাতের ডিনার থেকে শুরু হলো একসাথে স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ। দেখতে দেখতে কেটে গেল দুটি মাস। আর আশ্চর্যের সাথে ক্লডিয়া লক্ষ্য করল তাদের সম্পর্ক অনায়াসে বন্ধুতে পরিণত হয়েছে।

কাজ করতে করতে একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল তারা। মনে হলো যেন কিছুটা অবসরের দরকার। দুজনেরই এক দশা। মনোস্থির করল ভেগাসে যবে। ক্লডিয়া ভেইল একসাথেই রওনা হলো ভেগাসের উদ্দেশে গ্যাম্বলিংয়ে বেশ দুর্বলতা রয়েছে ক্লডিয়ার। ভেইলও একই পথের পথিক, এ লাম্পট্যে দুর্বলতা তারও।

ভেগাসে ক্লডিয়া ভেইলকে পরিচয় করিয়ে দিল তার ভাই ক্রসের সাথে এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করল তাদের সম্পর্কটি যেন তেলে আর জলে– কোনো দিনই তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই। বেশ বুঝতে পারল ক্লডিয়া।

আর্নেস্ট প্রকৃতই একজন বুদ্ধিজীবী। গলফের প্রতি তার আগ্রহই নেই। অপরদিকে ক্রস বছরেও একটা বই পড়ে কি-না সন্দেহ। ভাই ক্রসকে ভেইলের কেমন লাগল– এমন প্রশ্নের জবাবে ভেইল বলল, সে হচ্ছে শ্রোতা আর আমি যেন বক্তা।

এটা কোনো প্রকৃত ব্যাখ্যা হলো না। ক্লডিয়া হতাশ হলো। এরপর ভেইল সম্পর্কে ক্রসের কাছে জানতে চাইল ক্লডিয়া। ক্রসের উত্তর যেন আরো দুর্বোধ্য, আরো রহস্যময় মনে হলো।

ক্লডিয়ার প্রশ্নে ক্রসের ভেতর যেন তোলপাড় করে উঠল। বেশ কিছুটা সময় নীরব ছিল সে। অবশেষে বলে উঠল, তার প্রতি তোমার একচোখা দৃষ্টি দেয়া ঠিক হবে না। আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি তার যেন কিছুই চাওয়ার নেই। এবং সে ক্লডিয়াকে হুঁশিয়ার করে দিল সে খুব শিগগিরই তা বুঝতে পারবে। খুব অবাক ঠেকল ক্রসের এই খোলামেলা মন্তব্য। আর্নেস্ট ভেইল এমনই এক দুর্ভাগা যে তার কোনো কিছুই গোপনীয় নয়, এমনকি ভবিষ্যৎ কর্মপন্থাও।

আর্নেস্ট ভেইলের সাথে ক্লডিয়ার সম্পর্কটি একটু ভিন্ন ধরনের। সারা বিশ্বের অত্যন্ত জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হলেও, হলিউডে তার কোনো ক্ষমতাই নেই। এছাড়া তার যেমন নেই কোনো সামাজিক প্রাপ্তি তেমনি সে মারাত্মক ধরনের সদাবিরুদ্ধচারী। পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিনে তার আর্টিকেলগুলো সব সময়ই জাতীয় বিরোধের উস্কানিমূলক এবং দেখা গেছে তার অনুমানগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল হয়ে থাকে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোকে বেশ তাতিয়ে তোলে তার লেখাগুলো। আমেরিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করে তার লেখাগুলো। নারীবাদের ঘোর সমালোচক ভেইল। এক লেখায় সে স্পষ্টই উল্লেখ করেছিল শারীরিক কাঠামোগত দিক দিয়ে সমান না হওয়া পর্যন্ত নারীরা পুরুষদের বশীভূত হয়ে থাকবে। নারীবাদীদের প্রতি তার উপদেশমূলক উক্তি হলো–তাদের পার্লামেন্টারি প্রশিক্ষণ দল প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

শুধু নারীদের ক্ষেত্রেই নয়, আমেরিকা জুড়ে যে বর্ণ বৈষম্য বিরাজ করছে সে প্রসঙ্গেও ভেইল একবার এক দীর্ঘ আর্টিকেল লিখেছিল। তাতে সে জোর দিয়ে উল্লেখ করেছিল— কৃষ্ণাঙ্গরা যেন নিজেদের রঙিন বলে আখ্যায়িত করে। এটাই হবে তাদের জন্য উচিত কাজ। কেননা এই কৃষ্ণবর্ণ অর্থাৎ ব্ল্যাক বিবিধ অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন কালো চিন্তা, কালো নরকের মতে, কালো সমর্থন, কালো টাকা– এ সবই নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত। ভেইল শুধু আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের উদ্দেশ করেই বলেনি, তার লেখা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ইতালীয় স্প্যানিয়ার্ডস, গ্রিকসহ বেশ কিছু জাতির কৃষ্ণাঙ্গদেরও আঘাত করে। এসব অঞ্চলের কৃষ্ণাঙ্গ নিজেদের রঙিন হিসেবে ঘোষণা করার ব্যাপারে জোর আপত্তি জানায়। বেশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি হয়েছিল। ভেইলের এসব লেখায়।

চিত্রনাট্যের পাণ্ডুলিপি নিয়ে কাজ করতে করতে বেশ অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব গড়ে উঠল ক্লডিয়া ও ভেইলের মাঝে। ভেইল ছিল ক্লডিয়ার যেন অত্যন্ত মনোযোগী ছাত্র। একেবারেই ব্যতিক্রমী ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করল সে ক্লডিয়ার কাছে। তবে সামাজিক বোধের ওপর ভেইলের যে মারাত্মক চিন্তা চেতনা রয়েছে, সেসব বিষয়ে ক্লডিয়া উৎসাহিত হলেও, প্রায়ই তিক্ত রসিকতায় মেতে উঠত।

অর্থ বিষয়ে ভেইলের যে বেপরোয়া অসচেতনতা, বিষয়টি কিন্তু ক্লডিয়া মেনে নিতে পারেনি। তবে মোটের ওপর তাদের মাঝে সম্পর্কটি ছিল বেশ মজার।

ক্লডিয়া ডি লিনাও যে ইতিমধ্যে নিজেকে ঔপন্যাসিক হিসেবে প্রকাশ করেছে, তা জানিয়েছিল ভেইলকে। হলিউডের চিত্রনাট্য লেখক হিসেবেই সুনামের কারণেই হয়তো তার লেখা বই শেষ পর্যন্ত প্রকাশ হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে তার লেখা বইয়ের মন্তব্য করতে বলেছিল ক্লডিয়া। যেদিন কুডিয়ার এজেন্ট মেলো স্টুয়ার্ট তার লেখা নভেলের ওপর প্রকাশিত সমালোচনাগুলো এনে হাজির করে, সেদিনই আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হয় তার। ভেইলকে তাই একটি বই দিয়ে ক্লডিয়া মন্তব্য আশা করেছিল।

ক্লডিয়ার লেখা নভেলের অনেকে প্রশংসা করলেও, সমালোচিত হয়েছে ব্যাপক। বাজারে খুব একটা কাটতি ছিল না। তবে তাতে সে আশাহত নয়। কেউ তার বই কিনুক কিংবা না কিনুক অথবা তার বই চলচ্চিত্রের জন্য যদি মনোনীত নাও হয়, তবুও তার নিজের লেখার প্রতি আস্থা রয়েছে ক্লডিয়ার। ভালোও বাসে সে তার নিজের সৃষ্টিকে। ক্লডিয়া তার এই উপন্যাসটি অবশ্য ভেইলকেই উৎসর্গ করেছিল। তাতে সে লিখেছিল– আমেরিকার জীবন্ত কিংবদন্তি নভেলিস্টকে।

যাই হোক, ভেইল কিন্তু ক্লডিয়ার সমালোচনাই করেছে। এক সাক্ষাতে সে বলল, তুমি খুব ভাগ্যবতী নারী। একজন স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে সত্যিই তুমি ভাগ্যবান কিন্তু ঔপন্যাসিক তুমি নও, আর কখনো হবেও না।

সে দিন প্রায় আধা ঘন্টা ধরে ভেইল ক্লডিয়ার উপন্যাসের সমালোচনা করে। নভেলের অঙ্গচ্ছেদ করে সে বুঝিয়ে দেয়– এটা কোনো লেখাই নয়-~~~ সমালোচনায় নগ্ন করে ছাড়ে তাকে। ক্লডিয়ার লেখাকে সে একটা ছেলেখেলা পাণ্ডুলিপি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ক্লডিয়াকে বুঝিয়ে দিয়েছে তার লেখায় যেমন আছে কাঠামোগত সমস্যা তেমনি অগভীর। নেই চরিত্র গঠনের শাব্দিক উৎকর্ষ, এমনকি সংলাপেও নেই আকর্ষণ। অথচ এই সংলাপই হচ্ছে তার সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। এতে বুদ্ধিদীপ্ত সরলতা আছে কিন্তু প্রাণ নেই। ভেইলের এমন সমালোচনায় ক্লডিয়া আঘাত পেলেও, তার কথায় যে সত্যতা আছে, আছে যুক্তি এটা মেনেই তর্ক করল না।

এত সমালোচনার পর দয়াপরবশ হয়ে ভেইল শুধু এটুকুই বলল, তোমার লেখা বইটি অষ্টাদশী মেয়েদের জন্য হবে বেশ চমঙ্কার। আর আমি এতটা সময় ধরে তোমার লেখার যে সমালোচনা করলাম তা আমার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে। তোমার লেখায় এমন কিছু সমস্যা আছে যা তুমি কখনোই শোধরাতে পারবে না। পারবে না মেরামত করতেও। তোমার আসলে ভাষা জ্ঞানের দারুণ অভাব।

ভেইলের এতক্ষণের কঠোর সমালোচনায় আঘাত পেলেও ভেঙে পড়েনি। কিন্তু এবার আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারল না– ভেঙে একেবারে যেন খান খান হয়ে গেল। তারপরও শেষ চেষ্টা চালাল যারা তার বইয়ের প্রশংসা করেছে। তাদের দেয়া কৃতিত্বের কথা বলে। ক্লডিয়া বলল, তবে কি যারা প্রশংসনীয় সমালোচনা করেছে তাদের সমালোচনাও ভুল? আমি তো যথাসাধ্য সাবলীল বাক্যই লেখার চেষ্টা করেছি। আরেকটি বিষয়, আমি মূলত তোমার লেখার ছান্দিক ভাষাকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি।

এই প্রথম বারের মতো হাসল ভেইল, ধন্যবাদ তোমাকে বলল ভেইল। আমি কিন্তু আমার লেখায় ছান্দিক ভাষারীতি আনার চেষ্টা করিনি। চরিত্রের আবেগেই এমন ভাষা চলে এসেছে। আর তোমার এসেছে জোর করে, যা অবশ্যই ভুল এবং মেকি।

ক্লডিয়া আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। অঝোর ধারায় নেমে এলো অশ্রু। তুমি কি ধরনের মানুষ কেঁদে কেঁদেই বলতে লাগল ক্লডিয়া। এত কঠোর ভাবে কিভাবে তুমি আমাকে বলতে পারলে?

ক্লডিয়াকে স্বাভাবিক করতে ভেইল তৎপর হলো। বলল, একটা প্রকাশনা থেকে প্রকাশ করার মতো মান তোমার লেখায় আছে। তুমি একজন স্বনামধন্য চিত্রনাট্যকার হয়েও ঔপন্যাসিক হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ কেন? আমার মতো অনাহারে মরবে তুমি। তুমি চিত্রনাট্যকার হিসেবে অবশ্যই জিনিয়াস।

একটু থামল ভেইল। তারপর আবার বলল, আমার যা মনে হয়েছে, আমার অভিজ্ঞতা থেকে মন্তব্য করেছি। আমার মতে আমি যা বলেছি তা সঠিক। হতে পারে আমি ভুলও বলেছি, কিন্তু

ক্লডিয়া ধাতস্থ হলো। বলল, না, তুমি ভুল বলোনি, কিন্তু তোমার কথাগুলো আঘাত করেছে আমাকে।

সতর্কতার সাথে ক্লডিয়ার চোখে চোখ রাখল ভেইল। তারপর ধীরে ধীরে তার উদ্দেশে বলল ভেইল, তোমার কাছে প্রকৃতি প্রদত্ত কিছু বিষয় আছে। মুভির সংলাপ তৈরির ব্যাপকগুণ আছে তোমার, স্টোরি লাইন তৈরিতেও তুমি পারদশী –প্রকৃত অর্থে চলচ্চিত্রে তোমার রয়েছে উৎকৃষ্ট ধারণা। অটোমোবাইলের জন্য উচ্চ প্রযুক্তি থাকতে তুমি কেন যাবে কামারের কাছে? তুমি হচ্ছ চলচ্চিত্রের ব্যক্তিত্ব, ঔপন্যাসিক না।

বিস্ফারিত নেত্রে ভেইলের দিকে তাকাল ক্লডিয়া। এতক্ষণে সত্যিকারের সুখের হিমেল পরশ বুলিয়ে গেল তার হৃদয়ে। তবে একই গোঁ ধরে ক্লডিয়া বলল, তুমি জানো না কতটা কঠোরভাবে অপমান করেছ তুমি।

হ্যাঁ অবশ্যই। আমি মানছি, স্বীকার করল ভেইল। তবে যা বলেছি তোমার ভালোর জন্যই।

তোমার, লেখা বইয়ের সাথে তোমাকে আমি কিছুতেই মেলাতে পারছি না। বিশ্বাসই হচ্ছে না তুমিই সেই লোক! ক্লডিয়ায় কণ্ঠে এখনো বিদ্বেষ। তোমার সাথে কথা বলে কেউই বিশ্বাস করবে না যে তোমার লেখাগুলোর স্রষ্টা তুমি।

কর্কশ কণ্ঠে হেসে উঠল ভেইল, একেবারেই খাঁটি কথা বলেছ তুমি। এটাই কি মজার বিষয় নয়?

ভেইলকে দমাতে পারল না ক্লডিয়া। পরবর্তী সপ্তাহের প্রথম কয়েকটা দিন ক্লডিয়া বেশ গম্ভীর থাকল। ক্লডিয়ার এ গাম্ভীর্য উভয়ের বন্ধুত্বে কোনো ছাপ ফেলল না। বরং আরো প্রগাঢ় হতে থাকল। কিন্তু ক্লডিয়ার এই পরিবর্তন ভেইলকে কিছুটা দমিয়ে ফেলল। সে ভাবল– এই বুঝি হতে চলেছে তাদের সম্পর্কের ইতি।

সব কিছুকে ছাপিয়ে ক্লডিয়া ভেইলকে সতর্ক করে দিল পরবর্তী দিনগুলোর জন্য। বলল, আর্নেস্ট, সেদিনের মতো এতটা রুক্ষ আচরণ করবে না আরো কখনো। আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি। যদিও আমি জানি তোমার কথাগুলোই ছিল সঠিক। তাই বলে এতটা নির্দয় হওয়া উচিত হয়নি তোমার।

আরেকটু রুক্ষ হলো ক্লডিয়া। বলল, অপদস্থ করে তাতে প্রলেপ দিতে আমাকে বিছানায় নিয়ে যাওয়ার মনোবাসনা তোমার? অবশ্য আমি যতদূর জানি, এ ক্ষেত্রে তুমি একেবারেই আনাড়ি। ঈশ্বরের দোহাই, তোমার ঐ তিক্ত ওষুধের সাথে অন্তত একটু মিষ্টি দিও।

বিড়বিড় করে উঠল ভেইল, এই একটি বিষয়ে আমি নিজের মতো। ক্লডিয়ার উদ্দেশে বলল, এসব বিষয়ে যদি আমার সততা না থাকে তবে আমার তো কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। আর সত্যি কথা বলতে, তোমার প্রতি আমি যে পশুবৎ আচরণ করেছি তা তোমার সাথে আমার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলেই। সত্যিই আমি তোমার অনুরাগী। তুমি হয়তো নিজেও জান না তুমি কতটা ব্যতিক্রমী।

ক্লডিয়া হেসে ফেলল। প্রশ্ন করল, তোমার এই অনুরাগ কি আমার টেলেন্টে না-কি আমার সরলতা এবং বুদ্ধিমত্তায়? না-কি আমায় সৌন্দর্যে?

হাত নেড়ে বিরোধিতা করল ভেইল। বলল, এগুলোর কোনোটাই নয়। তুমি আশীর্বাদপুষ্ট, অত্যন্ত সুখী একজন। এমনকি আমার মনে হয় কোনো বিমর্ষতাই তোমাকে যেন ছোঁয়নি এবং ছেবেও না এটাই তোমার ক্ষেত্রে বিরল, আর তোমার প্রতি আমার অনুরাগের কারণ।

ভেইলের এমন মন্তব্যে ক্লডিয়ার কপাল কুঞ্চিত হলো। কি যেন ভাবল কিছুটা সময়। তারপর বলল, তোমার এ কথাতেও অস্পষ্ট অপমানের আভাস। তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছ, আমি নির্বোধ একটা ব্যক্তি? কয়েক পলক থামল ক্লডিয়া। আবার বলল, তোমার এ কথা তো আরো হতাশাজনক।

ঠিক ধরেছ তুমি, ভেইল বলল, আমি নিজেও বিষাদগ্রস্ত এবং তোমার চেয়ে অনেক বেশি স্পর্শকাতর। ভেইলের এ কথায় কি ছিল কে জানে, ক্লডিয়া হেসে ফেলল। ভেইলও হেসে উঠল তার সাথে। আর ক্লডিয়া তাকে জড়িয়ে ধরল।

ক্লডিয়া বলল, তোমার সতোর জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।

লডস্টোন স্টুডিওর জন্য পাণ্ডুলিপির কাজ অব্যাহত রয়েছে—- তখনো শেষ হয়নি। কিন্তু ভেইল-ক্লডিয়ার সম্পর্ক এগিয়েছে ইতিমধ্যেই, অনেক দূর। ক্লডিয়ার স্বতঃস্ফুর্ত উৎসাহে বিছানা পর্যন্ত গেছে তাদের সম্পর্ক। নতুনভাবে ভেইলকে আবিষ্কার করেছে ক্লডিয়া। বিনা কাপড়ে ভেইলকে আরো অনুরাগী মনে হয়েছে তার। ক্লডিয়ার এই স্বভাবজাত কৌশল ভেইলের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছেছে। ভেইলও পেয়েছে ক্লডিয়ার হৃদয়-সান্নিধ্য। নিজেদের মধ্যে একে অপরের প্রতি আস্থাও জন্মেছে–বিনিময় করেছে নিজেদের প্রগাঢ় আস্থার ভাব।

ক্লডিয়ার চোখে, ভেইল যৌন সম্ভোগে আগ্রহান্বিত হলেও বিশেষ দক্ষ নয়। মানুষ হিসেবে সে যতটা না ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, তার চেয়ে অনেক বেশি কৃতজ্ঞ। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, সেক্সের পর ভেইল হৃদয় খুলে কথা বলত ক্লডিয়ার সাথে। তার নগ্নতা এমন আলোচনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, এমনকি ক্লডিয়ার প্রতি সমালোচনাতেও নয়। আর অপর দিকে ক্লডিয়াও ভেইলের এমন আলোচনা পছন্দ করেছে। ভেইলের নগ্নতাও ছিল তার পছন্দের পরিধেয় ছাড়া ভেইল যেন বন্য-বানরের মতো ক্ষিপ্র এবং প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ। সর্বোপরি তার লোমশ এবং জট পাকানো পেশিবহুল শরীরে কেমন যেন একটা বানরের আদল। নগ্ন শরীরে গাছে ঝুলিয়ে রাখলে মানুষ তার লোমশ শরীর দেখে বানরই মনে করবে। তবে ভেইলের এই বানর প্রবৃত্তির ক্ষিপ্রতায় ক্লডিয়া মুগ্ধ। ভেইলের সাথে যৌনতায় সে খুঁজে পেয়েছে এক রকমের কৌতুককর আনন্দ।

ভেইলকে এর আগে বেশ কয়েকবার টিভিতে দেখেছে ক্লডিয়া–হয়তো কোনো সাক্ষাৎকারে কিংবা কোনো আলোচনায়। সেসব অনুষ্ঠানে ভেইলের পোশাক-পরিচ্ছেদ, আভিজাত্যপূর্ণ ঠোঁটে ধরা পাইপ বাচনভঙ্গি– সব মিলিয়ে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষই মনে হয়েছে ক্লডিয়ার তবে টেলিভিশনের ভেইলের চেয়ে। শয্যাসঙ্গী ভেইল ক্লডিয়ার কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয়।

সত্যিকারের প্রেমময় কথোপকথন বলতে যা বোঝায়, তা কখনোই হয়নি দুজনার মাঝে। ক্লডিয়াও এমন আলোচনার প্রয়োজন মনে করেনি। আর ভেইলের মানসিকতা কেবল সাহিত্যের। ভেইলের আলোচনায় আবেগ এসেছে, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গে। আর বিশ্বের এত নামকরা ঔপন্যাসিক হয়েও ভেইল কখনোই তা ফলাও করে জাহির করার চেষ্টা করেনি। ক্লডিয়ার সাথে ভেইলের মানসিকতায় এই সাহিত্য বিষয় ছাড়া আর কোনো কিছুতেই মিল নেই তেমন। তারপরও তাদের পারস্পরিক মানিয়ে চলার প্রবণতা থেকে তারা অবশেষে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে মনস্থির করে উভয়ের সম্মতিক্রমেই।

ক্লডিয়ার সাথে ভেইলের সাহিত্য বিষয়ে বিতর্ক না হলেও, বিতর্ক হতে মুভি নিয়ে। চলচ্চিত্র কোনো শিল্পই নয় ভেইলের দৃষ্টিতে। আর এতেই ছিল ক্লডিয়ার জোর আপত্তি। চলচ্চিত্রের মতো চিত্রশিল্পও ভেইলের দৃষ্টিতে কোনো শিল্প নয়।

ভেইলের এমন উস্কানিমূলক উক্তির বিরোধিতা করে ক্লডিয়ার যুক্তি, যদি চিত্রশিল্প তোমার দৃষ্টিতে আর্ট না হয় তবে বাখ বা বিথোভেনের কাজগুলোও শিল্প নয়, মাইক্যাল এঞ্জেলোর কাজও শিল্প নয়। তুমি একটা ষাঁড়ের মতো কথা বলছ। আরো এরপরই ক্লডিয়া বুঝতে পেরেছিল যে, ভেইল তাকে ক্ষেপানোর জন্যই এমন বিষয়ের অবতারণা করেছে। ক্লডিয়ার সাথে ভেইলের এরকম কৌতুককর আলোচনা হতো বেশিরভাগ সেক্সের পর।

স্ক্রিপ্টের কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়ে এলো। এবার ফিরে যাবার পালা ভেইলের। নিউইয়র্কে ফিরে যাবার আগে ক্লডিয়াকে উপহার দিল ছোট্ট একটি এনটিক রিং। চারটি ভিন্ন রঙের এক দিকে হেলানো জুয়েলের রিংটির মূল্য খুব বেশি নয় কিন্তু যে কোনো মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম। ভেইলের কাছ থেকে রিংটি পাওয়ার পর ক্লডিয়া আর কখনোই খুলেনি। সবসময় তার হাতে দেখা গেছে ভেইলের দেয়া এ উপহার। আংটিটি যেন তার মনে সৌভাগ্যের প্রভাব ফেলেছিল।

ভেইলও চলে গেল, ক্লডিয়ার সাথে তার যৌন সম্পর্কের ইতি ঘটল। কখনো কদাচিৎ ভেইল ফিরে এসেছে লস অ্যাঞ্জেলেসে। সে দেখতে পেয়েছে উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের যেন একটা অবনতি ঘটেছে। তাদের সেক্স সেক্সচুয়াল সম্পর্কে ভাবাবেগের চেয়ে বেশি বন্ধুত্বের আবেগ। প্রকৃতপক্ষে ক্লডিয়া তখন। অন্য কারো সাথে প্রেম-প্রেম খেলার মধ্যগগনে।

ভেইলের প্রতি ক্লডিয়ার বিদায়ের উপহারটি ছিল যেন হলিউডের পথে একটি নিদারুণ শিক্ষা। ক্লডিয়া তাকে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে জানিয়ে দিল— তাদের লেখা স্ক্রিপটি পুনর্লিখনের জন্য বিখ্যাত বিনিম্নাইয়ের কাছে পাঠানো হয়েছে। বিনিস্লাই হলিউডের একজন লিজেন্ড স্ক্রিপ্ট রাইটার। কয়েক দফা সে এ ক্ষেত্রে একাডেমি অ্যাওয়ার্ডেও ভূষিত হয়েছে। আর তাকে দিয়ে কাজ করিয়ে অবাণিজ্যিক গল্পটি একশ মিলিয়ন ডলারের ব্লকবাস্টার ছবিতে ব্যবহার করা হবে। ভেইল নিঃসন্দেহ যে তার বইয়ের গল্পটি এবার সত্যিই মুভিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। বিষয়টি ভেইলের খুব পছন্দের নয়। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে তার দ্বিধার অবকাশ নেই যে, ছবিটি তৈরি হলে নিশ্চিত অনেকগুলো ডলার তার হস্তগত হবে।

ক্লডিয়ার কাছে তথ্যগুলো শুনে ভেইলের মাথা নুয়ে পড়েছিল। এবার মাথা তুলল সে। বলল, ঠিক আছে, আমি, দশ শতাংশ তো পেতে যাচ্ছি। এতেই আমার সচ্ছলতা ফিরে আসবে।

অভিজ্ঞ ক্লডিয়ার কণ্ঠে ঝরে পড়ল বিস্ময়। দশ শতাংশ? কণ্ঠস্বরকে আরো তীক্ষ্ণ করে বলল, তুমি একটি পেনিও চোখে দেখবে না। মুভির ব্যবসা যতই হোক না কেন তুমি আদৌ এর ধারে-কাছে ভিড়তে পারবে কি-না সন্দেহ। লডস্টোনের এই ঠগ প্রবণতার দীর্ঘ রেকর্ড রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা সত্যিই জিনিয়াস।

একটু থামল ক্লডিয়া। বলল, আমার কথা শোনো, ইতিমধ্যেই আমি লডস্টোনের প্রায় পাঁচটি ছবিতে কাজ করেছি। ছবিগুলো প্রচুর অর্থ আয় করেছে। অথচ আজ অবধি আমি একটি পেনিও চোখে দেখিনি। আর তোমার তো প্রশ্নই আসে না।

ভেইল আহত হলো। মাথা তুলে তাকাল ক্লডিয়ার দিকে। তবে খুব একটা চিন্তিত হলো না সে। গত কয়েক বছর ধরে তার জীবনটা এক ফেরের মধ্যেই কেটেছে– সব কিছুতেই যেন একটা জট। ক্লডিয়ার কথাগুলো কিছুটা ভাবিয়ে তুলল ভেইলকে।

আর্নেস্ট ভেইল একবার ক্লডিয়াকে তার মায়ের একটি কথিত উদ্ধৃতি শুনিয়েছিল। উদ্ধৃতিটি হলো– জীবন হচ্ছে এক বাক্স হ্যান্ড গ্রেনেডের মতো। ভেইলের মায়ের এই উদ্ধৃতিটি ক্লডিয়ার ক্ষেত্রে যেন যথাযথভাবে মিলে গেছে।

ক্লডিয়া-গ্রেনেডের পরবর্তী বিস্ফোরণ অর্থাৎ প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হলো। ক্লডিয়ার মনের অবিরাম ধারার প্রেম আটকে রাখতে পারল না ভেইল, ভেইলের ভালোবাসা এমনকি ভেইলের এন্টিক রিং। যথেষ্ট মেধাবী ক্লডিয়া এই প্রথমবারের মতো জড়াল এমন এক ব্যক্তির সাথে, যে ক্লডিয়ার তুলনায় মোটেও যথার্থ নয়। তবে সে যুবক এবং জনসাধারণের কাছে স্বীকৃত জিনিয়াস পরিচালক। শুধু এই পরিচালকের সাথে প্রেম করেই ক্ষান্ত দেয়নি ক্লডিয়া, এরপর সে আবারো প্রেমে পড়ল। এবারের সম্পর্কটি ছিল যেন আরো গভীর এবং বেপরোয়া। কিন্তু ক্লডিয়ার মেধার কাছে একেবারেই নগণ্য। এ ব্যক্তি হচ্ছে চলচ্চিত্র জগতের এমনই এক সুদর্শন পুরুষ, যার কাছে যে কোনো নারী নির্দ্বিধায় বিলিয়ে দেবে সব।

আলফা, বিটা, গামা পর্যায়ের এই আলফা, অর্থাৎ, বিখ্যাত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ের পুরুষদের সাথে ক্লডিয়ার সম্পর্ক তৈরির পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। অন্যতম কারণ হলো, এসব পুরুষ মানসিক, শারীরিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্লডিয়ার সাথে কেমন আচরণ করে, কতটুকুইবা তাদের দক্ষতা কিংবা মেধা- এসব যাচাই করা এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা।

ক্লডিয়ার চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের বড় ছিল সেই পরিচালক। মাত্র তিনটি ছবি বানিয়েই খ্যাতি পেয়েছিল সে। পরিচালকের এই ছবিগুলো সমালোচনাতে সফলতা তো পেয়েছিলই, আর্থিক দিক থেকেও হয়েছিল ব্যবসা সফল। আর এই সফলতার পর হলিউডের বিভিন্ন স্টুডিও তার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। এ প্রেক্ষিতে লডস্টোনও বসে থাকেনি। নতুন এই পরিচালকের সাথে তিনটি ছবি তৈরিতে চুক্তিবদ্ধ হয়। এর সাথে যুক্ত হয় ক্লডিয়া– লডস্টোন স্টুডিওর আগ্রহেই।

জিনিয়াস হিসেবে খ্যাতি পাওয়ার পেছনে পরিচালকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গুণ হলো যে কোনো চাট, যে কোনো দৃশ্য, সংলাপ সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণা। প্রথম পরিচয়েই পরিচালক ক্লডিয়ার প্রতি প্রসন্ন হলো। তার এই প্রসন্নতার কারণ প্রথমত ক্লডিয়া একজন নারী এবং লেখক। আর এ দুটো সম্মিলন হলিউডে পদমর্যাদায় নগণ্যতম ধরা হয়ে থাকে। এদিক থেকে একটি বাড়তি সুবিধা আদায়ের মানসিকতা তত তার ছিলই। তবে পরিচালকের আশায় গুড়েবালি। ক্লডিয়া শক্ত বিরোধিতা করল তার চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কিছু পরিকল্পনার। আর এতে খুব শিগগির উভয়ের মাঝে দেখা দিল দ্বন্দ্ব।

যে প্লটের ওপর যে দৃশ্য বর্ণনার নির্দেশ দিল পরিচালক, ক্লডিয়া তা প্রত্যাখ্যান করে বসল। ক্লডিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে, এমন দৃশ্য মোর্টেও শৈল্পিক নয় এবং অযথা অবতারণা।

আমি এ দৃশ্য লিখতে পারব না। অস্বীকার করল ক্লডিয়া। বলল, এটা গল্পের ক্ষেত্রে কোনো যুক্তিই বহন করে না। অযাচিত কিছু অ্যাকশন এবং ক্যামেরার কাজ হবে। আর কিছু নয়।

ক্লডিয়ার বিরোধিতায় পরিচালক ধীর কণ্ঠেই বলল, এটাই ছবির নিয়ম। আমি যেভাবে বলছি তুমি তা-ই লিখ।

আমি চাই না তোমার সময় নষ্ট হোক, সেই সাথে আমারও, ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল ক্লডিয়া। বলল, তুমি নিজেই তোমার কাজ ভালো করতে পারবে, আশা করি।

ক্লডিয়ার আচরণে পরিচালক আর তর্ক বাড়াল, এমনকি ক্ষুব্ধও হলো না। হাততালি দিয়ে ক্যামেরা বন্ধ করার নির্দেশ দিল সে। তারপর ক্লডিয়ার উদ্দেশ্যে বলল, তুমি অযথাই রেগে গেলে।

ক্লডিয়ার বিরোধিতার কারণে কাজ বন্ধ হয়ে গেল। অবশেষে স্কিপি ডিরি এবং ববি বানজের হস্তক্ষেপে ক্লডিয়া ও পরিচালক আবারও শুরু করল তাদের কাজ। ক্লডিয়ার একগুয়েমিই মেনে নিতে বাধ্য হলো সে। মুখ বুজে পরিচালক মেনে নিল ক্লডিয়ার বেশ কিছু যৌক্তিক নির্দেশ। ছবির কাজ শেষ হলো। অবশেষে দেখা গেল ছবিটি সফলতা পেয়েছে। আর এর কৃতিত্বের অন্যতম অংশীদার ক্লডিয়া। যৌক্তিক, শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে কুডিয়ার লেখা পাণ্ডুলিপির কারণেই মূলত ছবির এ সফলতা। বিষয়টি পরিচালককেও মুগ্ধ করল। এরপর আর থেমে থাকেনি উভয়েই–সম্পর্ক এগুলো বিছানা অবধি।

সেখানে গিয়েও দুজনের মধ্যে বাধল সমস্যা। সেক্সের সময় পরিচালক সম্পূর্ণ নগ্ন হতে রাজি নয়। কোমর থেকে নিচের পরিধেয় সরালেও গায়ের শার্ট সে কোনো মতেই খুলবে না। বিষয়টি ক্লডিয়াকে ক্ষুব্ধ করে তুলল। তবে সে এ কারণে খুব একটা উচ্চবাচ্য করল না। এর কারণ এই পরিচালকের সাথে করতে হবে আরো দুটি ছবির কাজ। ক্লডিয়া নিশ্চিতভাবেই উপলব্ধি করল। প্রথমটির মতো পরবর্তী ছবিগুলোও সফলতা পাবে। সম্পর্কের অবনতি ঘটলে ছবিগুলোতে আর সুষ্ঠুভাবে কাজ করা হবে না। পরিচালকের আবরণেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো ক্লডিয়াকে। অবশেষে একে একে দুটি ছবিই মুক্তি পেল। যথানিয়মেই ক্লডিয়ার গুণে এগুলোও হলো ব্যবসা সফল।

এরপর ক্লডিয়ার সাথে পরিচালকটির সম্পর্ক টিকে ছিল মাত্র এক মাস। সম্পর্কের যা-ই ঘটুক, হলিউডে পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে দুজনেরই খ্যাতি বেড়ে গেল। ম্যাসেলিনা ছবির জন্য স্ক্রিপ্টের কাজ ক্লডিয়া তখনও শেষ। করতে পারেনি। স্ক্রিপ্টটি সেই পরিচালককে দেখাল। আগা-গোড়া পড়ে পরিচালক মন্তব্য করল, নারীবাদী তথ্য সংবলিত একটি বুলশিট ছাড়া আর কিছুই নয় এটি। যেখানে যৌন সুড়সুড়ির বাহুল্য শুধু।

পরিচালক প্রচণ্ড রকমের বিরোধিতা করে বলল, এখানে যদিও তোমার বুদ্ধিমত্তার সমন্বয় ঘটিয়েছ, তারপরও এটা আমার কাছে ছবির যোগ্য কোনো পাণ্ডুলিপিই নয়। এ ছবির জন্য আমি আমার জীবনের মূল্যবান একটি বছর নষ্ট করতে চাই না।

ক্লডিয়া বলল, এটা একটা খসড়া পাণ্ডুলিপি।

ওহ ঈশ্বর আমি তাদেরকে ঘৃণা করি, যারা ব্যক্তিগত সম্পর্কের অজুহাতে কাজ বাগিয়ে নিতে চায়, যেন ক্লডিয়াকে আঘাত করাই ছিল পরিচালকের উদ্দেশ্য। আকাশের দিকে তাকিয়ে ক্রুর কণ্ঠে কথাগুলো বলল সে।

আর ক্লডিয়া যেন মিশে গেল মাটিতে। মুহূর্তেই মানুষটির ওপর থেকে ক্লডিয়ার সমস্ত ভালোবাসা উবে গেল। ঝাঝালো কণ্ঠে সে বলল, আই ডোন্ট হ্যাভ টু ফাঁক ইউ টু মেক এ মুভি।

নিশ্চিতভাবেই তোমার তা দরকার নেই, সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল পরিচালক। বলল, তুমি তো মেধাবী, সেই সাথে ইদানীং আবার জনপ্রিয়তাও বেড়েছে। সে সবকে তো কাজে লাগাবেই, আর বস্তাপচা এসব গেলাবে মানুষকে।

পায়ের রক্ত মাথায় চড়ে গেল ক্লডিয়ার। দুচোখ ঠিকরে যেন আগুন বেরুতে লাগল। যে ক্লডিয়া তার সেক্সয়াল পার্টনার সম্বন্ধে কিংবা তাদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো মন্তব্য করেনি, সেই ক্লডিয়াই পরিচালকের বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠল।

বলল, তোমারও মেধা আছে তবে যে মানুষ সেক্সের সময় তার শার্ট গায়ে চাপিয়ে রাখে তার নিশ্চয়ই খারাপ কিছু দোষ আছে। আজ প্রতিজ্ঞা করছি, এমন মানুষের শয্যাসঙ্গী হওয়ার আগে অবশ্যই তার স্ক্রিন টেস্ট করিয়ে নেব।

পরিচালকের সাথে সম্পর্কের ইতি ঘটল এ থেকেই। আর ম্যাসেলিনার জন্য পরিচালক হিসেবে ক্লডিয়ার মনে এলো ডিটা টমির নাম। ক্লডিয়া বুঝতে পারল, একমাত্র নারী পরিচালকই তার স্ক্রিপ্টের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারবে।

ক্লডিয়া ভাবল, কি অসহ্য বিরক্তিকর নিরানন্দ সময় কাটিয়েছে সে পরিচালকের সাথে। যৌন মিলনের আনন্দঘন মুহূর্তগুলোতে অস্বস্তি বোধ করত ক্লডিয়া।

চলচ্চিত্র পরিচালনায় সে যত বড় প্রতিভাধর পরিচালকই হোক না কেন, প্রণয়ঘটিত ব্যাপারে সে একটা পাষণ্ড বৈ কিছু নয়।

যৌন মিলনের সময় সে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হতো না এবং সঙ্গম শেষে কোনো প্রণয়ালাপও করত না। তার যত প্রতিভা শুধু চলচ্চিত্র বিষয়ে, এর বাইরে সে ছিল প্রকৃতপক্ষেই বিরক্তিকর একজন মানুষ।

ভাবনার দৌড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ক্লডিয়ার গাড়ি প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ের বিশাল বাঁকে পৌঁছল, তার বাম পাশে উন্মুক্ত বিস্তৃত সমুদ্র, ডান পাশে সুউচ্চ পর্বত চূড়া, সমুদ্রটাকে মনে হলো বিশাল এক আয়না, সুনীল জলের বুকে পর্বতশৃঙ্গের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে।

স্থানটি ক্লডিয়ার অন্যতম প্রিয় স্থান। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে চমকিত করে। এখান থেকে অ্যাথেনার বাসস্থান ম্যালিবু কলোনি মাত্র দশ মিনিটের পথ। অ্যাথেনাকে পুনরায় ম্যাসেলিনার শুটিংয়ে ফিরিয়ে আনার জন্য সে মনে মনে একটা উপায় খুঁজতে লাগল। তার মনে পড়ল, অ্যাথেনার এক সময়কার প্রেমিকের সাথে তারও প্রণয় সম্পর্ক হয়েছিল। এটা ভাবতে ক্লডিয়া কিছুটা গর্ববোধ করে, কারণ অ্যাথেনার মতো সুন্দরী, তারকা অভিনেত্রীর প্রেমিক ক্লডিয়ার প্রেমে পড়েছিল এবং তাকে ভালোবেসেছিল।

মাথার উপর জ্বলন্ত সূর্য। সূর্যের আলো সমুদ্রের টেউয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। পুরো সমুদ্রটাই যেন বিশাল এক হীরকখণ্ডে পরিণত হয়েছে। একজন গ্লাইভারকে তার গাড়ির সামনে নেমে আসতে দেখে ক্লডিয়া হঠাৎ করেই ব্রেক কষল। সে গ্লাইডারকে দেখতে পেল একজন তরুণী, ক্লডিয়া লক্ষ্য করল, তার ব্লাউজের ফাঁক গলে একপাশের স্তন বেরিয়ে পড়েছে। অবতরণের সময় এক ঝলকের জন্য ওই দৃশ্যটি ক্লডিয়ার চোখে পড়েছিল।

ক্লডিয়া ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে না, এদেরকে কেন গ্লাইডিংয়ের অনুমতি দেওয়া হয়, পুলিশ কেন এগুলো দেখে না? মাথা নেড়ে ক্লডিয়া এই চিন্তা ঝেড়ে ফেলে গ্যাস প্যাডেলে চাপ দেয়, রাস্তার ভিড় কমে আসছে। হঠাৎ করেই হাইওয়ে এমন একটা বাঁক নিয়েছে যার ফলে সে আর সমুদ্র দেখতে পারছে না, তবে সে জানে আধ মাইল পর আবারও সমুদ্র দেখা যাবে। সত্যিকারের ভালোবাসা যেমন বারবার ফিরে আসে ঠিক তেমনি, এই ভাবনায় ক্লডিয়ার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তার জীবনেও সত্যিকার ভালোবাসা বারবার ধরা দিয়েছে।

ক্লডিয়া সত্যিকারভাবে স্টিভ স্টেলিংয়ের প্রেমে ডুবেছিল। সারা বিশ্বের মেয়েদের আরাধ্য চলচ্চিত্র তারকা, ব্যবসা সফল তুখোড় অভিনেতা স্টেলিং ছিল অত্যন্ত পৌরুষদীপ্ত সৌন্দর্যের অধিকারী। তার চেহারায় ছিল নিখাদ আকর্ষণ, প্রাণোচ্ছল তেজোদীপ্ত উজ্জ্বলতা ছিল তার মাঝে। অভিনয় প্রতিভায়ও সে ছিল অসামান্য। সতর্কতার সাথে সীমিত মাত্রায় কোকেন সেবন করত স্টেলিং। যা তাকে সবসময় হাস্যোজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত রাখত। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় যে গুণ ছিল তা হলো নারীবশীকরণ ক্ষমতা। এ দিক দিয়ে সে ছিল স্পেনিশ কিংবদন্তির ডন জুয়ান। যে কোনো রমণীকে সে তার শয্যাসঙ্গী করতে পারত। পৃথিবীর যে কোনো স্থানে আফ্রিকা, আমেরিকার ঘোট কোনো শহর, বোম্বে, সিঙ্গাপুর, টোকিও, লন্ডন, রোম, প্যারিস সবখানেই অনায়াসে, অবলীলায় নারীদেরকে যৌনসঙ্গ দিয়েছে। দান করার অনুপ্রেরণায়ই সে নারীদেরকে যৌনসঙ্গ দিত, একজন ভদ্রলোক যেমন ভিক্ষুককে ভিক্ষা দিয়ে যেমন খ্রিস্টীয় পুণ্যের আত্মপ্রসাদ লাভ করে, সেভাবেই স্টেলিং মেয়েদের সাথে যৌনতা উপভোগ করত। যৌন সম্পর্ক স্থাপনে তার কোনো বাছ-বিচার ছিল না। স্টেলিংয়ের পৌরুষদীপ্ত সৌন্দর্যে ক্লডিয়া বিমোহিত হয়েছিল, তার প্রতি প্রচণ্ড দুর্বল হয়েছিল এবং তার প্রেমে ডুবে গিয়েছিল। কিন্তু সেই সত্যিকারের ভালোবাসার সম্পর্ক মাত্র সাতাশ দিন টিকে ছিল।

ক্লডিয়ার জীবনে ওই সাতাশ দিন অত্যন্ত আনন্দঘন হলেও তা ছিল অপমানজনক। স্টেলিংয়ের ভালোবাসায় যন্ত্রণা সয়েছে ক্লডিয়া কিন্তু সেই সাথে অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছে সে।

স্টেলিংয়ের কাছে প্রচণ্ড ভালোবাসা পেয়েছে ক্লডিয়া। তার সান্নিধ্যে পেয়েছে পরিতৃপ্ত সুখানুভূতি। কোকেনের প্রভাবে স্টেলিং দুর্বারভাবে ভালোবাসতে পারত, নগ্নতার ক্ষেত্রে ক্লডিয়ার চেয়েও অধিক সাবলীল ছিল স্টেলিং। সঙ্গমের সময় সুনিপুণভাবে দৈহিক সামঞ্জস্য বজায় রেখে সে যৌন সম্ভোগ করত যা ক্লডিয়ার আনন্দানুভূতিকে বাড়িয়ে দিত। ক্লডিয়া প্রায়ই লক্ষ্য করছে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে স্টেলিং নিজেকে পর্যবেক্ষণ করছে। একজন মহিলা যেভাবে তার মাথার হ্যাট ঠিক করে ঠিক তেমনি সে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করত।

ক্লডিয়া জানত স্টেলিংয়ের কাছে সে একজন অবসর যাপনের সঙ্গীমাত্র, একজন রক্ষিতা। রাতের শয্যাসঙ্গী হিসেবেই ক্লডিয়াকে নিয়েছিল স্টেলিং। এছাড়া অন্য কোনো আকর্ষণ ছিল না তার, কিংবা ক্লডিয়ার প্রতি তার কোনো অনুভূতিও কাজ করত না। প্রায় সময়ই দেখা যেত ক্লডিয়াকে ফোন করে সে জানিয়ে দিত তার আসতে এক ঘণ্টা দেরি হবে কিন্তু দেখা গেল ছয় ঘণ্টা পর সে এলো। কখনো কখনো এখনও তাদের রাত্রি যাপনের পরিকল্পনাই বাতিল করে দিয়েছে স্টেলিং।

এছাড়াও দুজনে মিলিত হওয়ার সময় স্টেলিং তাকে কোকেন সেবন করার জন্য পীড়াপীড়ি করত। তাতে অবশ্য মিলনের আনন্দ বেড়ে যেত কিন্তু কোকেনের প্রভাব ক্লডিয়ার মস্তিষ্কে কয়েক দিন পর্যন্ত তাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। সে কোনো কাজ করতে পারত না এবং যা সে লিখত তা তার মনোপূত হতো না। এক সময় ক্লডিয়া উপলব্ধি করল, একজন পুরুষ মানুষের খামখেয়ালির ওপর তার সমস্ত জীবন নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে এবং এই বিষয়টাকেই সে সর্বাধিক অপছন্দ করত।

ক্লডিয়া ছিল স্টেলিংয়ের চতুর্থ অথবা পঞ্চম পছন্দ। এই বিষয়টিই ক্লডিয়াকে অপমানিত করেছিল। কিন্তু এজন্য কখনোই স্টেলিংকে দায়ী করেনি সে, তার এই অপমানকর পরিস্থিতির জন্য সে নিজেকেই দায়ী করেছিল। কারণ স্টিত স্টেলিং তার খ্যাতির সুবাদে আমেরিকার প্রায় যে কোনো মহিলাকেই পেতে পাত এবং সেই স্টেলিং ক্লডিয়াকে পছন্দ করেছে এটা ক্লডিয়ার জন্য গর্বের বিষয় মনে হয়েছিল। স্টেলিংয়ের বয়স বাড়বে, তার সৌন্দর্য, খ্যাতিও কমে আসবে, তার কোকেন সেবনের পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে যাবে। তাই স্টেলিং তার খ্যাতির শিখরে থাকতেই সবকিছু অর্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তারই প্রেমে ক্লডিয়া পড়েছিল। তার জীবনের কিছু দুঃসময়ের মধ্যে এই প্রেমের কয়েকটি দিন অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছিল।

সাতাশতম দিনে স্টেলিং ফোন করে ক্লডিয়াকে যখন জানাল যে তার আসতে এক ঘণ্টা দেরি হবে। ক্লডিয়া তাকে বলল, কষ্ট করো না। স্টিভ, আমি তোমার রঙমহল ছেড়ে চলে যাচ্ছি।

অপর প্রান্তে স্টেলিং কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিল, আশা করি আমাদের বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ণ থাকবে, সে আরও বলল, আমি সত্যিই তোমার সাহচর্য উপভোগ করেছি। ক্লডিয়ার চলে যাওয়ার কথা শুনে সে মোটেও আশ্চর্য হয়নি।

সিওর, বলল ক্লডিয়া এবং চুপ করে থাকল। এই প্রথম কোনো সম্পর্ক শেষ করার পর তার সাথে বন্ধুত্ব ধরে রাখতে চাইল না ক্লডিয়া। আসলে নিজের নির্বুদ্ধিতার কারণেই ক্লডিয়া পীড়িত হচ্ছিল। এটা নিশ্চিত বুঝল ক্লডিয়া, তাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার কৌশল হিসেবেই স্টেলিং তার সাথে ওই ধরনের আচরণ করেছিল। কিন্তু তা বুঝতে ক্লডিয়ার অনেক সময় লেগেছে। এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক। সে কিভাবে এতটা নির্বোধ হয়েছিল? অপমান ও আঘাতে বিপর্যস্ত ক্লডিয়া খুব কেঁদেছিল। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই সে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। সে দেখল ভালোবাসার শূন্যতা তাকে মোটেও পীড়িত করছে না। সে উপলব্ধি করতে পারল, তার সমস্ত সময় একান্তই তার নিজের। সেখানে কারো যন্ত্রণাময় স্মৃতির অনুপ্রবেশ নেই এবং সে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারছে। কোকেন এবং সত্যিকার ভালোবাসা থেকে মুক্ত মস্তিষ্ক নিয়ে লিখতে পারায় উৎফুল্ল ক্লডিয়া।

পরিচালক ক্লডিয়ার চিত্রনাট্য বাতিল করে দেওয়ার পর, পূর্ণোদ্যমে ম্যাসেলিনা-এর চিত্রনাট্য নতুন করে লেখায় মনোনিবেশ করে সে। ছয় মাসে একাগ্র প্রচেষ্টায় চিত্রনাট্য সম্পন্ন করে সে। ক্লডিয়া ডি লিনা পাঁচ বছর চলচ্চিত্র বাণিজ্যের সাথে জড়িত, তার এই স্বল্প সময়ের অভিজ্ঞতায় সে জেনেছিল যে কোনো মানবিক মূল্যবোধ এবং জীবনবোধ, যৌনতা, হত্যা প্রভৃতির মাধ্যমেই চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করতে হয়। নতুন লেখা ম্যাসেলিনার চিত্রনাট্যে ক্লডিয়া তার অভিজ্ঞতার সর্বোচ্চ সমন্বয় ঘটিয়েছিল। ফলে ম্যাসেলিনার চূড়ান্ত চিত্রনাট্য হয়ে উঠেছিল নারীবাদী প্রচারণায় অনবদ্য ও উপভোগ্য। ক্লডিয়া তার চিত্রনাট্যে প্রধান নারী চরিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী অ্যাথেনা অ্যাকুইটেনকে নির্বাচিত করেছিল এবং ম্যাসেলিনাকে অ্যাথেনার মধ্যে বিমূর্ত করেছিল। তার পাশাপাশি আরো তিনজন তারকা অভিনেত্রীর জন্য, পার্শ্ব নারী চরিত্রের অবতারণা করেছিল সে। দামি তারকা অভিনেত্রীদের আকৃষ্ট করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নারী চরিত্র সৃষ্টি করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ এবং প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ক্লডিয়া তা করেছিল। চিত্রনাট্যে একজন শক্তিমান খলনায়ক একান্ত অপরিহার্য। ক্লডিয়া তার বাবার স্মৃতি স্মরণ করে সৃষ্টি করেছিল খলনায়কের চরিত্র, মোহনীয়, নিষ্ঠুর সুদর্শন এবং উপভোগ্য। ক্লডিয়া প্রথমে একজন প্রভাবশালী ও বিত্তশালী মহিলা প্রযোজকের খোঁজ করেছিল। কিন্তু বেশিরভাগ স্টুডিওর প্রধান যারা চিত্রনাট্যের অনুমোদন দেবে তারা ছিল পুরুষ। চিত্রনাট্য হিসেবে ম্যাসেলিনা পছন্দ করলে ও অত্যন্ত খোলামেলা নারীবাদী প্রচারণামূলক কাহিনী এবং মহিলা প্রযোজক ও মহিলা পরিচালকের বিষয়ে তারা রাজি হয়নি। তারা চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনো একটি ক্ষেত্রে পুরুষের অংশগ্রহণ আশা করেছিল। ক্লডিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ডিটা টমিকে দিয়েই ম্যাসেলিনার পরিচালনা করাবে। ডিটা টমিকে নির্বাচনের পেছনে আরেকটি কারণ হলো– মহিলাদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেতে পছন্দ করে ডিটা টমি এবং ম্যাসেলিনার কাজে সে চারজন খ্যাতিমান সুন্দরী অভিনেত্রীর সঙ্গ লাভ করতে পারবে। এছাড়া কয়েক বছর আগে একটি ছবির কাজে তারা দুজন একসঙ্গে কাজ করেছে। সেই সুবাদে উভয়ের মধ্যে একটা সুসম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। ডিটা টমি একজন প্রতিভাবান পরিচালক, অত্যন্ত স্পষ্টবাদী এবং মজার ব্যক্তিত্ব। চলচ্চিত্র জগতে ডিটাটমি কখনই চিত্রনাট্যকারের কৃতিত্বে নিজের কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অথবা নতুন করে চিত্রনাট্য লেখার দাবী জানাত না। তার সুনির্দিষ্ট অবদান ছাড়া কোনো বিষয়ে নিজের কৃতিত্ব দাবী করত না। চিত্রনাট্যকারকে কখনোই হেয় করত না ডিটা টমি। তার ওপর অন্যান্য পরিচালক ও তারকাদের মতো সে যৌন নিপীড়ক নয়। যদিও চলচ্চিত্র বাণিজ্যে যৌন নিপীড়ন বলে কিছু নেই, কারণ চলচ্চিত্র জগতে যৌনতা এবং যৌনাবেদন কাজেরই একটি অংশ।

স্কিপি ডিরিকেই তার চিত্রনাট্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় ক্লডিয়া এবং এক শুক্রবারে চিত্রনাট্যটি ডিরির কাছে পাঠিয়ে দেয় সে। কারণ সপ্তাহের শেষে ছুটির অবসরে ডিরি যত্নসহকারে ক্রিপ্ট দেখে থাকে। ডিরি তার স্ক্রিপ্ট অনুমোদন নাও করতে পারে, তা সত্ত্বেও ক্লডিয়া তার কাছে স্ক্রিপ্ট পাঠায় কারণ সে সবচেয়ে ভালো একজন প্রযোজক। তাছাড়া ক্লডিয়া কোনো পুরনো পরিচিত প্রযোজকের কাছে যেতে চায়নি। এতে ফল হলো। রোববার সকালে ডিরির ফোন পেল সে, সেই দিন দুপুরে ডিরি তাকে মধ্যাহ্নভোজনের জন্য আমন্ত্রণ জানাল।

ক্লডিয়া ঝটপট কাজের জন্য নিজেকে তৈরি করে নিল, ব্লু জিন্স শার্ট, ফেডেড ব্লু জিন্স পরল সে, পায়ে পরে নিল একজোড়া স্পোর্ট সু, চুলগুলোকে বেঁধে নিল লাল স্কার্ফ দিয়ে। ল্যাপটপটা মার্সিডিজের সিটে ছুঁড়ে দিয়ে দ্রুত ড্রাইভিং সিটে বসে স্টার্ট দিল তার মার্সিডিজ। সান্টা মনিকার ওশেন এভিনিউ ধরে ছুটে চলল ক্লডিয়া। প্যালিসেডস পার্কের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে দেখল সান্টা মনিকার গৃহহীন নারী-পুরুষরা তাদের সাপ্তাহিক মধ্যাহ্নভোজের জন্য পার্কে সমবেত হচ্ছে। প্রতি রোববার স্বেচ্ছাসেবী সমাজকর্মীরা দরিদ্র গৃহহীন এই সমস্ত মানুষকে পার্কের খোলা পরিবেশে খাদ্য এবং পানীয় পরিবেশন করে থাকে। সারি সারি কাঠের টেবিল-চেয়ারে বসে গৃহহীন মানুষরা তাদের খাদ্য গ্রহণ করে। ক্লডিয়া এই মানুষগুলোকে দেখার জন্য এই পথ দিয়ে যাতায়াত করে। এই মানুষগুলোর মাঝে সে অন্য এক পৃথিবীর সন্ধান পায়, এদের মার্সিডিজ নেই, সুইমিং পুল নেই, রোড ও ড্রাইভে কেনাকাটা করার সামর্থ্য এদের নেই। প্রথম দিকে গৃহহীন মানুষগুলোকে খাবার ও পানীয় পরিবেশনের কাজে সেও অংশ নিত। কিন্তু তার নিজস্ব জগৎ থেকে ওই দরিদ্র মানুষগুলোর পৃথিবীতে যাওয়া তার জন্য কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছিল। তাদের কষ্ট ও অভাব ক্লডিয়াকে বিষণ্ণ করে তুলত। তার মাঝে সাফল্যের আকাঙ্ক্ষা স্তিমিত হয়ে যেত। তাই সে এখন তাদের খাওয়ানোর দায়িত্বে নিয়োজিত চার্চে কেবল আর্থিক অনুদান দেয়। কিন্তু ছিন্ন বস্ত্রে আচ্ছাদিত ঝরে পড়া ওই মানুষগুলোকে দেখা সে ত্যাগ করতে পারেনি। তাদের মধ্যে আশ্চর্য রকমভাবে কিছু জ্ঞানী ব্যক্তিও রয়েছে যারা সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র। কোনো রকম প্রত্যাশা ছাড়া এ রকমভাবে বেঁচে থাকটা ক্লডিয়ার কাছে আশ্চর্য মনে হয়। কিন্তু তার পরও অর্থ উপার্জনের প্রশ্নটা থেকেই যায়। চলচ্চিত্রের জন্য গল্প লিখে সে সহজেই ভালো উপার্জন করে। সে ছমাসে যে টাকা উপার্জন করে এই মানুষগুলো তাদের সারাজীবনেও তত টাকা দেখেনি।

বেভারলি হিলসে স্কিপি ডিরির ম্যানশনে ক্লডিয়া পৌঁছলে ম্যানশনের হাউসকিপার তাকে সুইমিং পুলে নিয়ে যায়। উজ্জ্বল নীল আর হলুদ চমৎকার সুইমিং পুল। একটি কুশন ও লাউঞ্জ চেয়ারে ডিরি বসা। তার চোখে লাল ফ্রেমের রিডিং গ্লাস। এই চশমা সে শুধু বাড়িতেই ব্যবহার করে। তার পাশে ঘোট মার্বেলের টেবিলের ওপর টেলিফোন ও একগাদা স্ক্রিপ্ট। ডিবির হাতে একটি দীর্ঘকায় গ্লাসে হিমায়িত ইন্ডিয়ান ওয়াটার ছিল। ক্লডিয়াকে দেখে সে চট করে উঠে দাঁড়াল এবং ক্লডিয়াকে আলিঙ্গন করে বলল, ক্লডিয়া, আমাদের আলাপ দ্রুত সারতে হবে।

ক্লডিয়া সতর্কতার সাথে তার কণ্ঠস্বর নিরীক্ষণ করছিল। তার স্ক্রিপ্ট সম্পর্কে কারো প্রতিক্রিয়া কি হবে তা সে কণ্ঠস্বর শুনেই বলে দিতে পারে। কেউ যদি সতর্কতার সাথে স্ক্রিপ্টের কৃত্রিম প্রশংসা করে, তার অর্থ নিশ্চিত না। আবার অনেকে হাসিমুখে আন্তরিকভাবেই স্ক্রিপ্টের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে, সেক্ষেত্রে দেখা গেছে অন্তত তিনটি কারণে তারা স্ক্রিপ্টটা ক্রয় করতে অপারগতা প্রকাশ করে–

অন্য একটি স্টুডিও একই বিষয়ের ওপর কাজ করছে, স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী উপযুক্ত অভিনেতা-অভিনেত্রী জোগাড় করা সম্ভব না, কিংবা স্টুডিও স্ক্রিপ্টের বিষয়বস্তু যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারে না।

কিন্তু ডিরির কণ্ঠে অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীর সুর– এটা ভালো লক্ষণ। সে অর্থায়ন ও বিভিন্ন শর্ত নিয়ে কথা বলছিল, এটা অনেক বড় বাজেটের ছবি হবে, ডিরি ক্লডিয়াকে বলল, অনেক-অনেক বড় বাজেটের ছবি। প্রকৃতপক্ষে এখানে বাজেট কমানোর কোনো সুযোগ নেই, আমি জানি তুমি কি ভাবছ, তুমি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মেয়ে। যৌনতানির্ভর চলচ্চিত্র করার জন্য আমি স্টুডিওকে রাজি করাব এবং নারীবাদী চরিত্রের জন্য তারকা অভিনেত্রীরও ব্যবস্থা করব। পুরুষ তারকাও আমরা পেতে পারি যদি তুমি তাকে একটু সময় দিয়ে নমনীয় করতে পারো। আমি মনে করছি তুমি এই কাজে সহযোগী প্রযোজক হতে চাও, কিন্তু আমার পরামর্শ তুমি পরিচালনার দায়িত্ব নাও। তবে তুমি তোমার বক্তব্য খোলামেলাভাবে বলতে পারো। তোমার যুক্তিসঙ্গত প্রস্তাব আমি মেনে নেব।

ক্লডিয়া বলল, পরিচালকের ব্যাপারে আমার নিজস্ব পছন্দ আছে। ডিরি হাসতে হাসতে বলল, তুমি, স্টুডিও এবং তারকার ব্যবস্থা তাহলে হয়ে গেল।

ক্লডিয়া বলল, পরিচালকের অনুমোদন ছাড়া এই স্ক্রিপ্ট আমি ছাড়ছি না।

ডিরি বলল, ঠিক আছে, তাহলে প্রথমে তুমি স্টুডিওকে জানাবে যে পরিচালনা তুমি করছ, পরে তুমি পরিচালনা থেকে সরে এসো, তখন তারা তোমাকে অনুমোদন দেবে। সে ক্ষণিক থেমে জিজ্ঞেস করল, পরিচালক হিসেবে তুমি কাকে ঠিক করেছ? ডিটা টমি, ক্লডিয়া বলল।

গুড, বুদ্ধিমতী, ডিরি বলল, মেয়ে তারকারা তাকে ভালোবাসে। স্টুডিওগুলোও তাকে পছন্দ করে। পরিচালক হিসেবে সে সবকিছু বাজেটের মধ্যেই সম্পন্ন করে এবং কখনও মাঝপথে কাজ ছেড়ে দেয় না। তবে তার কাছে যাওয়ার আগে আমরা দুজনে মিলে অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচনের কাজটা সেরে ফেলতে পারি।

ক্লডিয়া জিজ্ঞেস করল, তুমি কাকে আনতে চাও?

লডস্টোন ডিরি বলল, তারা আমাকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। তাই পাত্র-পাত্রী নির্বাচন ও পরিচালনা নিয়ে আমাদের মধ্যে খুব একটা সমস্যা হবে না। ক্লডিয়া, তুমি একটা নিখুঁত স্ক্রিপ্ট লিখেছ। আগের দিনের নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ওপর তোমার এই স্ক্রিপ্ট অত্যন্ত চমকপ্রদ এবং উপভোগ্য। বর্তমান সময়ে বিষয়টি খুবই জনপ্রিয়—-যৌনতাকে তুমি ম্যাসেলিনা ও অন্যান্য নারী চরিত্রের মাঝে সঙ্গতিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তুলেছ। আমি মেলো এবং মলি ফ্লান্ডার্সের সাথে তোমার বিষয়ে আলাপ করব, তারা যাতে লডস্টোনের সাথে চূড়ান্ত ব্যবসায়িক আলোচনা সেরে ফেলতে পারে।

ক্লডিয়া বলল, ইউ সান অব এ বিচ, তুমি এর মধ্যেই লডস্টোনের সাথে কথা বলেছ, তাই নয় কি?

ডিরি তার হাসি বিস্তৃত করে বলল, হ্যাঁ, গত রাতে আলাপ হয়েছে। আমি তাদেরকে স্ক্রিপ্ট দেখিয়েছি। যদি আমি সবকিছু জোগাড় করতে পারি তাহলে তারা ম্যাসেলিনার কাজ হাতে নেবে বলে আমাকে আশ্বস্ত করেছে। শোনো ক্লডিয়া, আমাকে ভুল বুঝো না, আমি জানি ম্যাসেলিনার-ক্ষণিক থেমে সে আবার বলল, আমি লডস্টোনকে এসব জানিয়েছি। এখন চলো কাজ শুরু করা যাক।

এভাবেই এই বিশাল প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল। এখন ক্লডিয়া কিছুতেই সেটা ভেস্তে যেতে দেবে না।

ক্লডিয়া ট্রাফিক সিগন্যালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, সেখান থেকে সে বাঁয়ে ঘুরে একটি সাইডে উঠবে, ওই রাস্তাই তাকে ম্যালিবু কলোনিতে নিয়ে যাবে। এই প্রথম ক্লডিয়ার মনে সংশয় মিশ্রিত ভয়ের উদ্রেক হলো।. সে যদি অ্যাথেনাকে রাজি করাতে না পারে। অ্যাথেনা অত্যন্ত দৃঢ় সিদ্ধান্তের মেয়ে, হয়তো সে কখনোই তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে না। তারকারা এমনই হয়ে থাকে। ক্লডিয়া ভাবল, অ্যাথেনা যদি তাকে বিমুখ করে তাহলে সে ভেগাসে যাবে। সেখানে তার ভাই ক্রসের সাহায্য নেবে। ক্রস সবসময়ই তাকে সাহায্য করেছে এবং কখনও তাকে নিরাশ করেনি। তারা দুই ভাইবোন যখন ছোট ছিল তখন থেকে নিয়ে তাদের মা মারা যাওয়া পর্যন্ত সবসময়ই সে ক্রসের সাহায্য পেয়েছে।

ক্লডিয়ার মনে তার শৈশবকালের স্মৃতি ভেসে উঠল। লং আইল্যান্ডে ক্লেরিকুজিও ম্যানশনে তার হাস্যোজ্জ্বল, আনন্দঘন শৈশবস্মৃতি। চারদিকে প্রাচীর ঘেরা ম্যানশন তার কাছে এখন গ্রিমসের রূপকথার প্রাসাদের মতো মনে হয়। সেখানে ফিগ বাগানের মধ্যে দুই ভাইবোন একসাথে খেলেছে, ছুটোছুটি করেছে, কত মজাই না তারা করত ছেলেবেলায়। ক্লেরিকুজিও ম্যানশনে আট থেকে বারো বছরের ছেলেদের মধ্যে দুটি গ্রুপ ছিল। এক গ্রুপের নেতৃত্ব দিত তার ভাই ক্রস এবং প্রতিপক্ষ গ্রুপের নেতৃত্ব ছিল উনের নাতি ডেন্টি ক্লেরিকুজিও। আর বৃদ্ধ ডন ওপর তলার এক জানালার পেছন থেকে ড্রাগনের মতো সবকিছু দেখত।

ডেন্টি ছিল মারমুখো হিংস্র প্রকৃতির। সে সবসময় মারামারি করতে পছন্দ করত এবং নিজেকে একজন জেনারেল ভাবত। একমাত্র ডেন্টিই তার ভাই ক্রসের সাথে মারামারি করার সাহস রাখত। খেলার মাঠে ক্লডিয়াকে একা পেলে ডেন্টি তাকে মারধর করত এবং ক্লডিয়াকে তার বশ্যতা স্বীকার করাতে চেষ্টা করত। সে সময় ক্রস সেখানে হাজির হলে ডেন্টি ও ক্রসের মধ্যে মারামারি বেধে যেত। তখনই ক্লডিয়া ডেন্টির আক্ৰমণত্মক হিংস্র চেহারার বিরুদ্ধে তার ভাই ক্রসের অসামান্য আত্মবিশ্বাস দেখে আশ্চর্য হতো এবং ক্রস সহজেই জয়ী হতো। ভাইয়ের প্রতি ক্লডিয়ার ছিল প্রচণ্ড টান।

কিন্তু ক্লডিয়া ভেবে পেত না তার মা কেন ক্রসকে অধিক পছন্দ করতেন না। কিভাবে তার মা ক্রসকে অধিক ভালো না বেসে থাকতে পারতেন! অধিক ভালোবাসা পাওয়ার মতো অনেক গুণই ক্রসের ছিল। তা সে প্রমাণও করেছে। মা-বাবা যখন আলাদা হয়েছিল তখন ক্রস বাবার কাছে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে তার মহৎ গুণ প্রকাশ করেছিল। কারণ ক্রস তার মা ও বোনের সাথেই থাকতে চেয়েছিল, এই বিষয়ে ক্লডিয়ার কোনো সন্দেহ ছিল না। বাবার ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সেই ছোটবেলাতেই ক্রস তার নিজের ইচ্ছার বিসর্জন দিয়েছিল।

তাদের মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পরও বেশ কয়েক বছর পরিবারের মধ্যে এক ধরনের সম্পর্ক ছিল, যোগাযোগ ছিল। সেই সময় ক্লডিয়া তাদের আশপাশের লোকের সাথে আলোচনায় এবং তাদের হাবভাবে জানতে পেরেছিল ক্রস তার বাবার আদলেই বেড়ে উঠছে। তার মধ্যে বাবার গুণাবলিগুলোই অনেকাংশে ফুটে উঠেছে। যদিও বর্তমানে ক্রস ও ক্লডিয়ার প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন, তথাপি তাদের মধ্যে ভাইবোনের সেই স্নেহের টান, ভালোবাসার সম্পর্ক অটুট রয়েছে। ক্লডিয়া এটা ভালো কারেই জানে ক্রস ক্লেরিকুজিও পরিবারের অংশ, কিন্তু সে নয়।

ক্লডিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসে চলে আসার দুবছর পর তার মা ন্যালিনির ক্যান্সার ধরা পড়ে। তখন ক্লডিয়ার বয়স তেইশ। সে সময় ক্রস ক্লেরিকুজিও পরিবারের জন্য নিজেকে উপযুক্ত করেছিল এবং জানাদু হোটেলে গ্রোনিভেল্টের  সাথে কাজ করত। মায়ের ক্যান্সারের খবর পেয়ে ক্রস শেষের দুটো সপ্তাহ সেক্রামেন্টোতে তার মা ও বোনের সাথে কাটিয়েছিল। একদিনের মধ্যে সে। তার মায়ের জন্য একজন নার্স, একজন বাবুর্চি ও একজন হাউসকিপারের ব্যবস্থা করে।

তাদের পরিবার ভেঙে যাওয়ার পর প্রথমবারের মতো মা-ভাই-বোন তিনজনে একসাথে হয়েছিল। ন্যালিনি পিপিকে আসতে বারণ করে দিয়েছিল।

ক্যান্সারের কারণে ন্যালিনির দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়েছিল, তাই ক্লডিয়া সবসময় তাকে বই, ম্যাগাজিন, খবরের কাগজ পড়ে শোনাত। ক্রস বাজার-ঘাট করত, মাঝে মাঝে হোটেলের কাজে একবেলার জন্য ভেগাসে যেত, তবে সবসময়ই সন্ধ্যায় ফিরে আসত।

রাতে ক্রস ও ক্লডিয়া পালা করে মায়ের সেবা করত। মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তার হাত ধরে বসে থাকত। যদিও ডাক্তাররা ন্যালিনিকে কড়াডোজের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত তবুও তিনি সবসময় তার সন্তানদের হাত খুঁজতেন ধরে রাখার জন্য। মাঝে মাঝে তিনি হ্যালুজিনেশনে ভুগতেন, তিনি মনে করতেন তার সন্তানরা এখনও ছোটই আছে।

একদিন রাতে ন্যালিনি কেঁদে উঠলেন। কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি ক্রসের কাছে ক্ষমা চাইছিলেন, ক্রসের প্রতি তিনি যে অবিচার করেছেন তার জন্য তিনি অনুতপ্ততা প্রকাশ করতে থাকেন, ক্রস মাকে বাহুতে জড়িয়ে ধরে আশ্বস্ত করে যে তিনি কোনো ভুল বা অপরাধ করেননি। যা হয়েছে তা ভালোর জন্যই হয়েছে।

ওষুধের প্রভাবে কোনো কোনো রাতে ন্যালিনি গভীর ঘুমে নিগম্ন থাকলে দুই ভাইবোন দীর্ঘরাত বসে গল্প করেছে। ক্রস ও ক্লডিয়া তাদের জীবনের সব ঘটনা একে-অপরকে জানিয়েছে।

ক্রস ক্লডিয়াকে বলেছে যে সে কালেকশন এজেন্সি বিক্রি করে দিয়েছে এবং ক্লেরিকুজিও পরিবার ত্যাগ করেছে। তবে জানাদু হোটেলে কাজ পাওয়ার জন্য সে ওই পরিবারের নাম ও প্রভাবের সাহায্য নিয়েছিল। ক্রস তার নিজের ক্ষমতার ঈষৎ আভাসও দেওয়ার জন্য ক্লডিয়াকে বলেছিল, জানাদু হোটেলে তুমি সবসময় আমন্ত্রিত। তোমার জন্য আরএফবি রুম, খাবার এবং পানীয় সব ফ্রি। এই কথা শুনে ক্লডিয়া জিজ্ঞেস করেছিল সে কিভাবে তা করতে পারে। ক্রস সামান্য গর্বের সুরে উত্তর দিয়েছিল, আমার হাতে সে ব্যবস্থা রয়েছে।

ক্লডিয়ার কাছে তার ভাই ক্রসের গর্ব কৌতুককর ও বিষণ্ণ মনে হয়েছিল।

মায়ের মৃত্যুতে স্বাভাবিক কারণেই ক্রসের তুলনায় ক্লডিয়া অনেক বেশি আঘাত পেয়েছিল কিন্তু এর ফলে দুই ভাইবোন আবারো মিলে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে শৈশবকালের সেই ঘনিষ্ঠ সাহচর্য, হৃদ্যতা পুনরায় জেগে ওঠে। পরবর্তী বছরগুলোতে ক্লডিয়া প্রায়ই ভেগাসে তার ভাইয়ের কাছে গিয়েছে, সেখানে সে গ্রোনিভেল্টের  সাথে দেখা করেছে। ক্লডিয়া গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে ওই বৃদ্ধ লোকটির সাথে ক্রসের এক ধরনের ক্ষমতা আছে, যার সাথে ক্লেরিকুজিও পরিবারের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। ক্লডিয়া যখন থেকে ওই পরিবারের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছে তখন থেকেই সে পরিবারের কোনো সামাজিক কর্মকাণ্ড। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, বিবাহ এবং খ্রিস্টেনিংয়ে অংশগ্রহণ করত না। তবে ক্লেরিকুজিও পরিবারের সামাজিক কর্মকাণ্ডে যে তখনও ক্রসের অংশগ্রহণ ছিল তা সে জানত না। আরো ক্রসও এ বিষয়ে ক্লডিয়াকে কিছু জানায়নি। ভেগাসে কদাচিৎ ক্লডিয়া তার বাবাকে দেখেছে। কিন্তু মেয়ের প্রতি বাবার (পিপি) কোনো আগ্রহ ছিল না।

নববর্ষের উৎসব ভেগাসের সবচেয়ে বড় উৎসব। সারাদেশ থেকে আমুদে মানুষের ঢল নামে ভেগাসে। কিন্তু ক্লডিয়ার জন্য হোটেল জানাদুতে সবসময় একটি সুইট রেখে দিত ক্রস। ক্লডিয়া বড় কোনো জুয়াড়ি নয়। শখের জুয়াড়ি। জানাদুতে বেড়াতে এলে একটু আধটু খেলে। অনেকটা সময় কাটানোর মতো। এক নববর্ষের উৎসবে ক্লডিয়া এক উদীয়মান তারকা অভিনেতাকে নিয়ে আসে জানাতে। সঙ্গী অভিনেতাকে ইমপ্রেস করার জন্য ক্লডিয়া সে বার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। জুয়ার বোর্ডে সে পঞ্চাশ হাজার ডলারের মার্কার চায়। যদিও সে মুহূর্তে তার অত টাকার সামর্থ্য ছিল না। ক্রস তার জন্য নিজে মার্কার নিয়ে আসে। ক্রস কৌতূহলী দৃষ্টিতে ক্লডিয়ার দিকে তাকায়। সে ক্লডিয়াকে বলল, ক্লডিয়া আমি তোমাকে আমার চেয়ে চৌকস ভাবতাম, তুমি এসব কি করছ? সেই মুহূর্তে ক্লডিয়া উপলব্ধি করেছিল– তবে মনে হয়েছিল ক্রস নয়, কথাগুলো তার বাবাই তাকে বলছে।

ক্রসের কথায় ক্লডিয়া বিব্রতবোধ করে। ক্রস প্রায়ই তাকে সতর্ক করে বলত, সবসময় ছোট স্টেকে দান ধরতে। সে আরও বলত, যখন বুঝবে তুমি হারছ তখনও দানের পরিমাণ বাড়াবে না এবং প্রতিদিন দুই তিন ঘণ্টার বেশি জুয়া খেলবে না। কারণ জুয়াতে সময় হচ্ছে সবচেয়ে বড় ফাঁদ। ক্লডিয়া ক্রসের সব সতর্কতাই লঙ্ন করেছিল।

সে বলল, ক্রস, আমাকে দুসপ্তাহ সময় দাও, আমি তোমার এই টাকা পরিশোধ করে দেব। ক্লডিয়ার এই কথায় উত্তেজিত হয়ে ওঠে ক্রস। সে ক্লডিয়াকে বলে, তুমি টাকা শোধ করতে এলে আমি তোমাকে খুন করব। ক্রসের এমন প্রতিক্রিয়ায় ক্লডিয়া আশ্চর্য হয়ে যায়। ক্রস স্বাভাবিকভাবে মার্কারের স্লিপটি ছিঁড়ে নিজের পকেটে রাখল। সে বলল, দেখো ক্লডিয়া, আমি তোমাকে দেখার জন্য এখানে আসতে বলি, তোমার টাকা নেওয়ার জন্য নয়। এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। তুমি জুয়াতে কখনোই জিতবে না। এখানে ভাগ্য বলে কিছু নেই। এটা দুইয়ে দুইয়ে চারের মতো সহজ ব্যাপার। ক্লডিয়া বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে।

এতগুলো মার্কার হেরে যাওয়ার জন্য আমি কিছু মনে করিনি, কিন্তু তোমার নির্বুদ্ধিতা দেখে আমি আশ্চর্য হয়েছি। ক্রস বলল।

অতঃপর এ বিষয়ে তারা আর কোনো কথা বলল না। তবে ক্লডিয়া অবাক হয়েছিল এই ভেবে, অতগুলো টাকা পরিশোধের সামর্থ্য কি সত্যিই ক্রসের আছে? গ্রোনিভেল্ট কি অতগুলো টাকা ক্রসকে অনুমোদন করবে? কিংবা আদৌ কি গ্রোনিভেল্টকে এই টাকার ব্যাপারে কিছু জানানো হবে?

লরেটা ল্যাঙ নামের একজন মহিলাকে নিয়েও একটি সমস্যা দেখা দিয়েছিল। সেই সমস্যার সমাধানও ক্রস করেছিল অনায়াসে। সেখানেও তার একটা অদৃশ্য ক্ষমতা উপলব্ধি করেছিল ক্লডিয়া এবং ওই বিষয়টিই ক্লডিয়াকে সবচেয়ে বেশি হতবাক করেছিল– সত্যিই কি তার ভাই ক্রস এতটা ক্ষমতাবান?

লরেটা ল্যাঙ জানাদু হোটেলের স্টেজ পার্ফরমার ছিল। সে হোটেলের স্টেজে গান গাইত এবং নাচত। তার ছিল অফুরন্ত প্রাণশক্তি। তার পারফরমেন্সে ফুটে উঠত তার সহজাত প্রাণোচ্ছলতা, যা ক্লডিয়াকে আকৃষ্ট করেছিল। শো শেষে একদিন ক্লডিয়ার সাথে লরেটার পরিচয় করিয়ে দেয় ক্রস। পরিচিত হওয়ার পর ক্লডিয়া বুঝল, লরেটা স্টেজে যতটা প্রাণোচ্ছল এবং আকর্ষণীয় বাস্তবেও সে ততটাই উচ্ছল এবং প্রাণময়। ক্লডিয়া একটা বিষয় লক্ষ্য করল, লরেটার প্রতি ক্রস খুব একটা আগ্রহী নয় বরং তার উচ্ছলতায় ক্রস একটু বিরক্তি বোধ করে।

পরের বার ক্লডিয়া যখন ভেগাসে বেড়াতে এলো লরেটার শো দেখানোর জন্য সে মেলো স্টুয়ার্টকে সঙ্গে নিয়ে আসে। মেলো অবশ্য ক্লডিয়ার পীড়াপীড়িতে তাকে খুশি করানোর জন্যই ভেগাসে আসে। অনেক বড় কিছু প্রাপ্তির প্রত্যাশা তার মোটেই ছিল না। সে আর দশজন স্টেজ পারফরমার কিংবা ক্যাবারে ড্যান্সারের চাইতে বেশি কিছু ধারণা করেনি লরেটা সম্পর্কে। মেলো স্টুয়ার্ট মেয়ের সত্যিকারের মেধা আছে। সেই মেধা তার নাচ অথবা গানের মধ্যে নেই বরং তার মধ্যে মানুষকে আনন্দ দেওয়ার মতো সহজাত প্রতিভা রয়েছে। আর এই প্রতিভার অধিকারী মেয়েরা হলো সোনা।

মেলো লরেটাকে আশ্বস্ত করল, সব সমস্যাই সমাধান যোগ্য। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সমস্যা অত্যন্ত জটিল। লরেটার শো বিজ এজেন্সি চুক্তি শেষ হওয়ার আগে কিছুতেই লরেটাকে ছাড়তে রাজি নয়।

এই সময় থেকে বের হওয়ার কোনো উপায়ই খুঁজে পাচ্ছিল না ক্লডিয়া। এমন সময় লরেটা ক্লডিয়াকে তার ভাই ক্রসের কাছে এই ব্যাপারে সাহায্যের আবেদন করার কথা বলে। লরেটার কথায় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় ক্লডিয়া। সে লরেটাকে বলল, এই ব্যাপারে ক্রস কি করতে পারে?

লরেটা বলল, এই শহরে তার যথেষ্ট প্রভাব আছে। আমাকে চুক্তি থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সে নিশ্চয় একটা ব্যবস্থা করতে পারবে। প্লিজ, তুমি ক্রসকে সাহায্য করার জন্য বলল।

ক্লডিয়া হোটেলের পেন্থ হাউস সুইটে ফিরে এসে ক্রসকে লরেটার সমস্যার কথা জানাল। ক্রস বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। সে বলল, কেন আমি এই সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাব? উত্তরে ক্লডিয়া বলল, আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না, আমি তোমাকে এই সমস্যার সমাধান করতে বলেছি তাই মি করবে। দ্যাটস অল।

ক্রস বলল, তুমি বোকা। আমি লরেটার মতো অনেক অকৃতজ্ঞকে দেখেছি যারা তোমার মতো বন্ধুর ঘাড়ে পা দিয়ে উপরে উঠে যায় এবং পরে সেই বন্ধুকে ইতিহাসের মতো ভুলে যায়।

তাতে কি হয়েছে? ক্লডিয়া বলল, সে সত্যিকার অর্থেই প্রতিভাবান। এটা তার সম্পূর্ণ জীবনকেই উন্নততর জীবনে পাল্টে দিতে পারে।

ক্রস আবারো মাথা নেড়ে বলল, আমাকে এটা করার জন্য বলো না।

ক্লডিয়া জিজ্ঞেস করল, হোয়াই নট?

তাকে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য অপর এক প্রতিষ্ঠান নিতে চাচ্ছে, এটা চলচ্চিত্র ব্যবসারই অংশ।

ক্রস বলল, আমি বিষয়টাতে হস্তক্ষেপ করতে চাচ্ছি না কারণ যদি আমি তা করি তাহলে আমাকে সমস্যা সমাধানে সফল হতে হবে। ক্লডিয়া বলল–

তোমাকে সফল হতেই হবে আমি তা বলছি না। আমি শুধু তোমাকে তোমার সাধ্যমতো চেষ্টা করতে বলছি। তাহলে অন্তত লরেটাকে আমি বলতে পারব আমরা চেষ্টা করেছিলাম।

ক্রস হেসে উঠল, বলল, সত্যিই তুমি বোকা। ঠিক আছে, তুমি লরেটা ও তার এজেন্সিকে আগামীকাল আমার সাথে দেখা করতে বলে। ঠিক সকাল দশটায়। এবং তুমিও সেখানে থেকো।

পরদিন সকালের মিটিংয়ে ক্লডিয়া প্রথমবারের মতো লরেটার শো বিজ এজেন্টের সাথে পরিচিত হলো। তার নাম টলি নাভান্স। লোকটির পরনে ছিল ভেগাস স্টাইলের সাধারণ পোশাক। তবে গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ের জন্য পোশাকের প্রতি বিশেষ যত্ন নিয়েছিল। কলারবিহীন সাদা শার্টের ওপর ব্লু ব্লেজার এবং ব্লু ডেনিম প্যান্ট।

টলি নাভান্স বলল, ক্রস, তোমার সাথে পুনরায় দেখা হওয়ায় আনন্দিত বোধ করছি।

আমাদের কি ইতোপূর্বে দেখা হয়েছে? ক্রস জিজ্ঞেস করল। কারণ স্টেজ শো বিজনেসের বিষয়গুলো সে নিজে দেখাশোনা করে না।

নাভান্স অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জানাল, অনেক দিন আগে। লরেটা যখন প্রথম জানাদু হোটেলে শো  করেছিল তখন।

ক্লডিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসের এজেন্ট ও টলি নাভান্সের মধ্যে পার্থক্যগুলো যাচাই করছিল। লস অ্যাঞ্জেলেসের এজেন্ট মেলো স্টুয়ার্ট দীর্ঘদিন ফিল্ম ট্যালেন্টদের নিয়ে কাজ করেছে আর টলি নাভান্স অল্প কিছুদিন থেকে নাইটক্লাব বিনোদনের জগতে পা দিয়েছে। নাভান্সকে বেশ নার্ভাস মনে হচ্ছিল। তাকে বাহ্যিক দৃষ্টিতে খুব একটা কর্তৃত্বপূর্ণ, আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছিল না। মেলো স্টুয়ার্টের মতো তার নিজের ওপর পূর্ণ আস্থা ছিল না।

লরেটা ক্রসের গালে আলতো চুমু দিল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। এমনকি তার মধ্যে বিন্দুমাত্র উচ্ছলতার প্রকাশ ছিল না। লরেটা ক্লডিয়ার পাশে বসল। ক্লডিয়া তার মনের অবস্থা বুঝতে পারছিল।

ক্রস গলফ খেলার পোশাকে ছিল-সাদা ট্রাউজার, সাদা টি শার্ট এবং পায়ে সাদা জুতো। তার মাথায় ছিল নীল বেসবল ক্যাপ। ক্রস ওয়েটবার থেকে সবাইকে পানীয় অফার করল কিন্তু সবাই অসম্মতি জানাল। ক্রস শান্তভাবে বলল, লরেটা তোমার সমস্যার একটা নিষ্পত্তি করা যাক, কি বলো?

কম্পিত কণ্ঠে লরেটা বলল, আমি যা আয় করব তার একটা পার্সেন্টেজ চায় টলি। এমনকি চলচ্চিত্র থেকে যে আয় আমি করব তার পার্সেন্টেজও টলিকে দিতে হবে। কিন্তু লস অ্যাঞ্জেলেসের এজেন্টকে চলচ্চিত্রে কাজের উপার্জন থেকে পূর্ণ পার্সেন্টেজ দিতে হবে। আমি দুজায়গায় পার্সেন্টেজ দিতে পারব না। তাছাড়া টলি চায় আমার সবকাজ সে নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু লস অ্যাঞ্জেলেসের এজেন্ট তা মানতে রাজি নয় এবং আমি তা মানব না।

নাভান্স শ্রাগ করে বলল, আমাদের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে। আমরা চাই সে চুক্তি অনুযায়ী চলবে।

লরেটা বলল, সেক্ষেত্রে আমার ফি এজেন্ট আমার সাথে চুক্তি করবে না। ক্রস বলল, আমার কাছে এটা খুব সামান্য বিষয় মনে হচ্ছে লরেটা, চুক্তি থেকে বের হওয়ার পথ তুমি কিনে নাও, নাভান্স বলল, লরেটা খুব বড় মাপের পারফরমার, সে আমাদের প্রচুর অর্থ উপার্জন করে দিয়েছে। আমরা সবসময়ই তাকে প্রমোট করেছি। আমরা তার প্রতিভার মূল্যায়ন করেছি। আমরা তার পেছনে প্রচুর অর্থ ইনভেস্ট করেছি। এখন সে টাকা দিলেই আমরা তাকে ছেড়ে দিতে পারি না।

লরেটা প্রায় আর্তনাদ করে বলল, আমি দুটো পার্সেন্টেজ দিতে পারব না। এটা চরম নিষ্ঠুরতা।

ক্লডিয়া অনেক কষ্টে তার হাসি চেপে রাখল কিন্তু ক্রস তা পারল না। নাভান্সকে আহত দেখাচ্ছিল।

শেষে ক্রস বলল, ক্লডিয়া, তোমার গলফ গিয়ারে নিয়ে এসো। আমি তোমার সাথে নাইন হোল খেলতে চাই। আমি এখানকার কাজ সেরে সিঁড়ির নিচে ক্যাশিয়ারের কক্ষে তোমার সাথে দেখা করব।

মিটিংয়ে খেলার পোশাক পরে দায়সারাভাবে ক্রসের উপস্থিতি দেখে ক্লডিয়া অবাক হয়েছিল। তার আচরণে মনে হয়েছিল সে মিটিংটাকে কোনো গুরুত্বই দেয়নি। এটা ক্লডিয়াকে আঘাত করেছিল এবং সে জানত লরেটাও এতে আহত হয়েছে। কিন্তু এতে টলি আশ্বস্ত হয়েছিল। লোকটি সমঝোতার কোনো প্রস্তাব জানায়নি।

ক্লডিয়া বলল, আমি এখানেই থাকব। আমি দেখতে চাই সলমন কিভাবে কাজ করে।

ক্রস কখনোই তার বোনের ওপর রাগ করতে পারে না। ক্লডিয়ার কথা শুনে সে হাসল। ভাইয়ের হাসির প্রতিউত্তরে সেও হাসল। ক্রস নাভান্সের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি দেখছি তুমি কিছুতেই মানছ না। আমার মনে হয় তুমিই সঠিক। লরেটা এক বছরে চলচ্চিত্রে যা উপার্জন করবে তাতে তোমার পার্সেন্টেজ কত আসবে? তবে তার ওপর তোমার কর্তৃত্ব পরিত্যাগ করতে হবে অন্যথায় তুমি পার্সেন্টেজ পাবে না।

লরেটা রাগে ফেটে পড়ল। সে বলল, আমি কিছুতেই তাকে পার্সেন্টেজ দেব না।

নাভান্স উত্তরে বলল, আমি তা চাইও না। পার্সেন্টেজের বিষয়টা না হয় ছেড়েই দিলাম কিন্তু আমরা তোমার শোর জন্য বড় বায়না করি আর তখন যদি তুমি মুভির কাজে ব্যস্ত থাকো, তখন কি হবে? আমাদের টাকা লোকসানে যাবে।

ক্রস গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দুঃখের সাথে বলল, টলি, আমি চাই তুমি লরেটাকে চুক্তি থেকে নিষ্কৃতি দেবে। এটা আমার অনুরোধ। তোমার সাথে আমাদের এই হোটেলের অনেক ব্যবসা আছে। আমার জন্য এই উপকারটুকু তুমি করো।

প্রথমবারের মতো নাভান্সের চেহারায় সতর্কতা ফুটে উঠল। সে কাতর কণ্ঠে ক্রসকে বলল, তোমার এই উপকার আমি করতে চাই ক্রস, কিন্তু এজেন্সির অন্যান্য পার্টনারের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। ক্ষণিক থেমে সে বলল, হয়তো চুক্তি কেনার ব্যবস্থা আমি করতে পারব।

না, ক্রস বলল, আমি তোমাকে উপকার করতে অনুরোধ করছি, চুক্তি কেনার কথা বলিনি।

দেখো, আমি এখন খেলতে যেতে চাই, তোমার যা বলার এখনই বলো। তুমি আমার এই উপকারটুকু করবে কি-না। হ্যা অথবা না-এ তোমার জবাব আশা করছি।

ক্রসের কথায় ক্লডিয়া হতাশ হয়েছিল, আলোচনা পণ্ড হতে যাচ্ছে এই ভেবে ক্লডিয়া আহত হয়েছিল। ক্রসের আচরণে ক্লডিয়ার মনে হচ্ছিল সে পুরো ব্যাপারটাই যেনতেনভাবে শেষ করতে চাচ্ছে। মনে হচ্ছিল সে তার ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ক্লডিয়া লক্ষ্য করল ক্রসের কথায় নাভান্স কেঁপে উঠল।

নেভান্সের উত্তর শুনে ক্লডিয়া বিস্মিত হলো। নাভান্স বলল, এটা ঠিক নয়। সে সমর্থনের আশায় পরাজিত দৃষ্টিতে লরেটার দিকে একবার তাকাল। লরেটা তার দৃষ্টি নামিয়ে নিল।

ক্রস আত্মবিশ্বাসের সাথে কিছুটা গর্বিত ভঙ্গিতে তার মাথার ক্যাপটি একপাশে টেনে এনে বলল, এটা আমার অনুরোধ। তুমি আমাকে ফিরিয়েও দিতে পারবে। সেটা তোমার অভিরুচি।

নাভান্স ব্যস্তভাবে বলল, না, না, ক্রস, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। আমি বুঝিনি তুমি আমার কথায় কষ্ট পাবে। কারণ আমরা খুব ভালো বন্ধু।

ক্লডিয়া লক্ষ্য করল হঠাৎ করেই তার ভাইয়ের মধ্যে চমকপ্রদ পরিবর্তন ঘটে গেল। ক্রস সামনের দিকে ঝুঁকে টলি নাভান্সের কাঁধে একটি হাত রেখে আন্তরিকভাবে তাকে কাছে টেনে নিল। উষ্ণ হাসিতে তার চেহারা ঝলমল করছে।

ক্লডিয়া ভাবল ক্রস সত্যিই সুদর্শন। ক্রস কৃতজ্ঞভরা কণ্ঠে নাভান্সকে বলল, টলি আমি তোমার এই উপকার কখন ও ভুলব না। শোনো টলি, জানা হোটেলের স্টেজ তোমার জন্য উন্মুক্ত। তোমার যে কোনো নতুন ট্যালেন্টের শো  সর্বনিম্ন চার্জে সেখানে করতে পারবে। আমিও তোমার এজেন্সির সব ট্যালেন্টদের নিয়ে একটি স্পেশাল শো আয়োজন করব এবং সেই রাতে তুমি এবং তোমার পার্টনাররা আমার সাথে হোটেলে ডিনার করবে। তোমার যে কোনো প্রয়োজনে আমাকে স্মরণ করো। আমি তা দেখব, ঠিক আছে?

ক্লডিয়া দুটি বিষয় উপলব্ধি করলক্রস খুব পরিকল্পিতভাবেই ক্ষমতা প্রদর্শন করেছিল। সেই সাথে সে সতর্কতার সাথে নেভান্সের কিছুটা ক্ষতিও পুষিয়ে দিয়েছিল। তবে তা ক্রসের কর্তৃত্ব মেনে নেওয়ার পরেই করেছিল, তার আগে নয়। টলি নাভান্স তার স্পেশাল নাইট উপভোগ করবে। এক রাতের জন্য সে নিজেকে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী ভেবে গর্বিত হবে।

ক্লডিয়া আরেকটি বিষয় উপলব্ধি করল, তার প্রতি ক্রসের ভালোবাসার গভীরতা বোঝানোর জন্য তার প্রভাব প্রদর্শন করেছে এবং তার ভালোবাসার একটা বাস্তব ক্ষমতা আছে। ক্রসের সুন্দর চেহারায় বিধাতা যেন নিজ হাতে তাকে গড়েছেন, তার ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। সেই শৈশবে তাকে যেমন দেখেছিল––কোমল একজোড়া ঠোঁট, নিখুঁত নাক, পটলচেরা আয়ত দুটি চোখ। বয়সের সাথে তার চেহারায় একটা দৃঢ়তা এসেছে—মনে হয় যেন মার্বেল পাথরের খোদাই করা প্রাচীন কোনো ভাস্কর্য।

ক্লডিয়া প্যাসিফিক হাইওয়ে থেকে বাঁক নিয়ে সাইড রোড ধরে ম্যালিবু কলোনির গেটে পৌঁছল। সাগর সৈকতে ম্যালিবু কলোনি। কলোনির সামনে বিস্তৃত ঝলমলে সমুদ্র। যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। ক্লডিয়ার খুব পছন্দ এই কলোনি। ক্লডিয়া আবারও পেছনের পর্বতশৃঙ্গের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল সাগরের জলে। সে অ্যাথেনার বাসার সামনে গাড়ি পার্ক করল।

ম্যালিবু কলোনির দক্ষিণ দিকের ঘেরার বাইরে পাবলিক বীজ উন্মুক্ত সৈকতে বজ কানে শুয়ে আছে। ম্যালিবু কলোনি তীরের জালে ঘেরা। তারের জাল সৈকত ছাড়িয়ে প্রায় দশ গজ পানি পর্যন্ত বিস্তৃত। তারের জালের এই ঘেরা খুবই সাধারণ একটা বাধা। যে কেউ ইচ্ছে করলেই পানিতে সাঁতরে। ঘেরার ভেতরে যেতে পারবে।

অ্যাথেনার ওপর আবারও আক্রমণ চালানোর জন্য বজ আগে থেকেই চারপাশ ভালো করে দেখে নিচ্ছে। আকস্মিক আক্রমণ চালানোর জন্য সবকিছু খতিয়ে দেখতে আজ সে পাবলিক বিচে এসেছে সমুদ্রে গোসল করার সাজে। তার পরনে বাথিং সুট, তার ওপর একটি টি শার্ট পরে আছে। পায়ে টেনিস খেলার জুতো। একটা টেনিস ব্যাগ তার সাথে। তার ভেতরে তাওয়াল দিয়ে জড়ানো একটা এসিডপূর্ণ বোতল।

বজ যেখানে শুয়ে আছে সেখান থেকে তারের জালের ভেতর দিয়ে অ্যাথেনার বাসা দেখা যায়। সে দেখল দুজন ব্যক্তিগত রক্ষী সৈকতে পাহারা দিচ্ছে। রক্ষী দুজনই সশস্ত্র। যেহেতু বাড়ির পেছনে পাহারার ব্যবস্থা আছে সেহেতু বাড়ির সামনেও রক্ষীরা প্রহরারত, এটা নিশ্চিত।

বজ প্রয়োজনে রক্ষীদেরকেও আঘাত করতে প্রস্তুত। কিন্তু সে একজন উন্মাদের মতো সবাইকে মেরে ফেলতে চায় না। কারণ তাহলে অ্যাথেনার ওপর তার ন্যায্য প্রতিহিংসার বিষয়টি বাধাগ্রস্ত হবে এবং মানুষ ঘটনাটিকে একটি সাধারণ অপরাধ হিসেবে দেখবে।

বজ স্কানেট জুতো এবং টি-শার্ট খুলে ফেলে ব্লাঙ্কেটের ওপর শুয়ে পড়ল। সূর্যের উষ্ণতা তাকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করল। সে অ্যাথেনার ভাবনায় ডুবে গেল।

কলেজ জীবনে একজন প্রফেসর এমারসনের প্রবন্ধের ওপর লেকচার দেওয়ার সময় একটি উক্তির উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন Beauty is its own excuse. কিন্তু এমারসন বা সৌন্দর্য কোনো কিছুই বজ ভাবতে পারছে না। তার মাথায় এখন কেবলই অ্যাথেনার ভাবনা।

অ্যাথেনার মতো এত সুন্দর আর কিছু হতে পারে না। অ্যাথেনার বিরল সৌন্দর্য নিয়ে বজ নিমগ্ন। একজন মানুষের দৈহিক গড়নের সৌন্দর্যের সাথে চারিত্রিক অন্যান্য গুণাবলির সচরাচর সমন্বয় দেখা যায় না। কিন্তু অ্যাথেনা ছিল ব্যতিক্রম। তার দৈহিক সৌন্দর্যের সাথে মিশেছিল মেধা, প্রাণোচ্ছলতা, মানুষকে আকৃষ্ট করার অসাধারণ ক্ষমতা। কৈশোরেই লোকে তাকে থেনা বলে ডাকত।

বজ তার যৌবনে প্রচণ্ডভাবে ভালোবাসত অ্যাথেনাকে। অ্যাথেনাও তাকে ভালোবাসত এই ভাবনায় সে সুখের স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল। জীবন যে এত মধুর হয় তা সে কখনোই জানত না। কিন্তু একটু একটু করে সবকিছু নষ্ট হয়ে গেল।

সে কেন এত সুন্দর হলো? তাকে কেন এত ভালসেছিলাম? কেন সবাই তাকে এত ভালোবাসত? এটা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা কি সে জানত না?

বজ নিজের কথা ভেবে বিস্মিত হলো, অ্যাথেনার প্রতি তার তীব্র ভালোবাসা কিভাবে ঘৃণায় পরিণত হলো?

এটা অত্যন্ত সহজ এবং স্বাভাবিক ব্যাপার। কারণ সে জানত, সে সারা জীবন অ্যাথেনাকে ধরে রাখতে পারবে না এবং একদিন অ্যাথেনা তাকে ছেড়ে চলে যাবে। একদিন বজের সুখের স্বর্গ ভেঙে দিয়ে অ্যাথেনা অন্য পুরুষের শয্যাসঙ্গী হবে এবং আর কোনো দিনও তার জীবনে ফিরে আসবে না অ্যাথেনা।

সে অনুভব করল তার মুখের ওপর ছায়া পড়েছে। সে চোখ মেলে দেখল, একটা ফোল্ডিং চেয়ার হাতে পরিপাটি পোশাকের একজন লোক তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। বজ লোকটিকে চিনতে পারল। জিম লুজি ডিটেকটিভ থেনার মুখে প্রথমবার পানি ছুঁড়ে মারার পর এই লোকই তাকে জিজ্ঞেসাবাদ করেছিল।

রোদের কারণে বজ তার দিকে চোখ কুঁচকে তাকাল। লুজিকে সে বলল, কি আশ্চর্যের বিষয়। আমরা দুজনই একই সৈকতে সাঁতার কাটতে এসেছি। কিন্তু তুমি আমার কাছে কেন এসেছ?

লুজি চেয়ার পেতে বসল। আমার এক্স-ওয়াইফ এই চেয়ারটা আমাকে দিয়েছিল। আমি নাকি অনেক সাফারকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞেসাবাদ করি। তাই আমার একটু আরামের জন্য সে আমাকে এটা দিয়েছিল। লুজি বজ স্কানেটের দিকে দয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আমি শুধু তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। প্রথমত মিস অ্যাথেনা একুইটিনের বাড়ির এত কাছে তুমি কি করছ? তুমি বিচারকের নিষেধাজ্ঞা জ্ঞান করেছ।

আমি পাবলিক বিচে আছি এবং অ্যাথেনা ও আমার মাঝে তারজালের বেষ্টনী রয়েছে। আমি এখানে সাঁতারের জন্য এসেছি। আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে আমি অ্যাথেনাকে উৎপীড়ন করছি?

বজ উত্তর দিল।

লুজি তার মুখে সহানুভূতির হাসি এনে বলল, হেই, শোনো তার সাথে যদি আমার বিয়ে হতো তাহলে আমিও তার কাছ থেকে দূরে থাকতে পারতাম না। আমি কি তোমার ব্যাগটা দেখতে পারি?

বজ ব্যাগটা টান দিয়ে তার মাথার নিচে রাখল এবং বলল, না, ওয়ারেন্ট ছাড়া তুমি তা পারো না।

লুজি বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি হেসে বলল, তোমাকে গ্রেফতার করতে আমাকে বাধ্য করো না। তাই বলছি মাথা থেকে দুর্বুদ্ধি ঝেড়ে ব্যাগটা আমাকে দাও। এই কথায় বজ উঠে দাঁড়াল। সে ব্যাগটা লুজির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সাথে সাথে আবার তা দূরে সরিয়ে নিল।

সে বলল, চেষ্টা করে দেখো নিতে পারো কি-না।

লুজি বজের কাণ্ড দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। এ পর্যন্ত কেউ-ই তার সাথে এমন আচরণ করার সাহস পায়নি। অন্য কোনো পরিস্থিতি হলে এতক্ষণে সে তার ব্ল্যাকজ্যাক (হান্টার) অথবা বন্দুক বের করে লোকটিকে পিটিয়ে দলা বানিয়ে ফেলত। কিন্তু পায়ের নিচে বালু থাকায় সে অনিশ্চয়তায় ভুগছে কিংবা বজ স্কানেটের ভীতিহীন আচরণ তাকে দ্বিধাগ্রস্ত করে দিয়েছে। বজ তার দিকে তাকিয়ে হাসল, বলল, আমার কাছ থেকে ব্যাগ নিতে হলে তোমাকে গুলি করতে হবে এবং যদি তুমি আমাকে গুলি করো তাহলে গুলি করার উপযুক্ত কারণ দর্শাতে পারবে না তুমি। কেননা আমি তোমার চেয়ে শক্তিশালী এবং তোমার মতোই লম্বা-চওড়া।

বজের পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও বিচক্ষণতাকে লুজি মনে মনে প্রশংসা করল। তার সাথে দৈহিক সংঘাতের বিষয়টি নিয়ে যেখানে সংশয় দেখা দিতে পারে সেখানে অস্ত্র বের করার প্রশ্নই ওঠে না।

লুজি বলল, ঠিক আছে, সে তার চেয়ার ভাজ করে চলে যেতে উদ্ধত হলো। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশংসার সুরে বলল, তুমি সত্যিই একজন কঠিন লোক। তুমিই জিতলে কিন্তু এমন কিছু করো না যাতে আমি উপযুক্ত কারণ পাই। তুমি লক্ষ্য করেছ অ্যাথেনার বাড়ি থেকে তোমার দূরত্ব আমি মেপে দেখিনি, হয়তো তুমি বিচারকের নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে আছ।

বজ হেসে বলল, চিন্তা করো না, আমি তোমাকে কোনো সুযোগ দেব না।

সে দেখল লুজি সৈকত দিয়ে হেঁটে গিয়ে তার গাড়িতে উঠল এবং গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেল। বজ তার ব্লাঙ্কেটটি তুলে ব্যাগে ভরল এবং সেও তার গাড়িতে ফিরল। গাড়ির বুটে ব্যাগটি রাখল। গাড়ির চাবিটি রিং থেকে খুলে নিয়ে সামনের সিটের নিচে লুকিয়ে লাখল!

তারপর সে ফেন্সের (ঘেরার) চারপাশে সাঁতার কাটতে সৈকতে ফিরে গেল।

০৫. গতানুগতিক নিয়ম

০৫.

অ্যাথেনা অ্যাকুইটেন গতানুগতিক নিয়মে তারকার স্তরে সাদামাটাভাবে উপার্জন করছিল। জনগণ কদাচিৎ তাকে মূল্যায়ন করত। সে বছরের অনেক সময় প্রশিক্ষণে ব্যয় করত। অভিনয়ের ক্লাস, নাচ ও হাঁটা-চলার ক্লাস, কণ্ঠ পরীক্ষা, নাট্য, সাহিত্য বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা এবং অভিনয়ের যাবতীয় প্রয়োজনীয় বিষয়ে সে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। আরও অনেক ছোটখাটো কাজ করত সে।

সে এজেন্টদের চারপাশে ঘুরত, পরিচালকদের তাকে নেবার জন্য বলত। প্রযোজক ও পরিচালকদের শান্তভাবে কামাসক্তে জড়াত এবং ডাইনোসরের মতো স্টুডিও চক্র ও প্রধান ব্যক্তিদের যৌন কামনায় আসক্ত হতে বাধ্য করত।

প্রথম বছরে কিছু কমার্শিয়াল কাজ ও কিছু মডেলিং করে যা উপার্জন করেছিল, তা দিয়ে কোনোমতে তার জীবিকা নির্বাহ করত। খুবই কৃপণতার সাথে তাকে চলতে হতো। এরকম শুধু তার প্রথম বছরই হয়েছিল। এরপর তার অভিনয়ের দক্ষতা বেড়ে গেল।

যারা তাকে গহনা ও টাকা উপহার হিসেবে দিত সে তাদের শুধু প্রেমিক ভাবত। তাদের কেউ কেউ বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিল। এই সম্পর্ক ছিল খুবই স্বল্পকালের এবং বন্ধুত্বের মধ্য দিয়েই একদিন তা শেষ হয়ে যেত।

এর কোনোটাই তার কাছে যন্ত্রণাদায়ক বা অবমাননাকর ছিল না। এমনকি রোলস রয়েস গাড়ির বিক্রেতাও ধরে নিয়েছিল, সে গাড়ির সাথে আসবে না। সে কৌতুক করে বলেছিল এ দামের মধ্যে এমন গাড়ি হলে আমি কিনব। সে মানুষের প্রিয় ছিল। সে সেক্স দারুণভাবে উপভোগ করত। তার অত্যাধিক প্রচেষ্টার ফলেই সে ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র জগতে স্থান করে নিয়েছিল। অভিনয়ই তার জীবন।

তার নিজস্ব বোধগম্য ক্ষমতা ছিল অন্যদের চেয়ে বেশি। তেমন কোনো বোধগম্য ছিল। বিশ্বের বিপদ-আপদ ছিল তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার জীবনটা প্রথমেই অভিনয় দিয়ে শুরু করেছিল। ছোট পর্দায় তার পদযাত্রা তেমন ছিল না। বেশ কিছু বড় নাটকের বড় চরিত্রে সে কিছুদিন অভিনয় করেছিল।

আর এর পরেই চলচ্চিত্রে তার একটা পরিচিতি আসে। এর ফলশ্রুতিতে বড় চলচ্চিত্রে ভালো চরিত্রে অভিনয় করার তার সুযোগ আসে।

তার বাস্তব জীবন ছিল তার অভিনয়েরই অংশ। সে অধিকতর সজীবতা অনুভব করত তার চরিত্রের নিজের জীবনটা ফুটিয়ে তুলবার জন্য। সে বারংবার চেষ্টা করত।

তার ভালোবাসার বিষয় ছিল আনন্দের মতো গলফ ও টেনিস খেলার মতো, বন্ধুদের সাথে আড্ডার মতো, স্বপ্নের মতো ছিল তার অস্তিত্ব। তার বাস্তব জীবন থিয়েটারের মধ্যে দিয়েই সামনের দিকে ধাবিত হতে লাগল।

অ্যাথেনা একটা নতুন খবর পেয়ে পুরোপুরি আশ্চর্য ও অভিভূত হলো।

সে জানল যে, তাকে বড় অভিনয়ে নির্বাচন করা হয়েছে। কিন্তু সে জানে কেন তাকে পছন্দ করা হলো। আসলে তার এজেন্ট মেলো স্টুয়ার্ট তাকে আলোকিত করার জন্য প্রথম থেকে চেষ্টা করে আসছিল।

তুমি একজন বড় অভিনেত্রী। কিন্তু তুমি এই শহরে অল্প কয়েক বছর ধরে আছ, তোমার মেধা থাকা সত্ত্বেও তুমি কিছুটা অনভিজ্ঞ। তাই আমি যা বলব তাতে তুমি অপরাধ নিও না–যা ঘটে এখানে তা বিস্তৃত হয়।

সে কিছুক্ষণ বিরতি নিল। সাধারণভাবে আমি কখনো এটা ব্যাখ্যা করব না; কারণ ব্যাখ্যাটা ততটা জরুরি নয়।

কিন্তু আমি অত্যন্ত অনভিজ্ঞ অ্যাথেনা হেসে বলল।

না, ঠিক অনভিজ্ঞ নও বলে কোনো কথা নয়, মেলো বলল।

তুমি তোমার অভিনয়ের প্রতিই মনোযোগী, তবে চলচ্চিত্র শিল্পের অভ্যন্তরীণ জটিলতা সম্পর্কে তুমি অসচেতন।

অ্যাথেনা বেশ মজা পেল। আমাকে বলল আমি কিভাবে এমন সুযোগটা পেলাম।

মেলো বলল, স্টেলিংয়ের এজেন্ট আমাকে ডেকেছিল। সে বলল, সে তোমাকে ট্যাপার নাটকে দেখেছিল। তোমার পারফমেন্সে সে অভিভূত হয়েছিল। সে এখন নিশ্চিতভাবে তার চলচ্চিত্রে তোমাকে অভিনয় করাতে চায়। পরে প্রযোজক আলোচনা করার জন্য আমাকে ডাকল।

প্রযোজকের সাথে আমার চূড়ান্ত আলোচনা হয়েছে। বেতনভুক্ত হয়ে তুমি কাজ করবে। তোমার পারিশ্রমিক দুশত গ্রান্ড। এমন কোনো শর্ত নেই যা তোমার পরবর্তী ক্যারিয়ারে সমস্যা সৃষ্টি করবে, অন্য যে কোনো ছবিতে কাজ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। এটা তোমার জন্য সত্যিই ভালো সুযোগ।

ধন্যবাদ অ্যাথেনা বলল।

মেলো বলল, স্টিভেন তার সহঅভিনেত্রীর সাথে পাগলের মতো ভালোবাসায় প্রায়ই জড়িয়ে পড়ত। আন্তরিকভাবে কিন্তু সে ভালো লোক।

অ্যাথেনা তাকে থামাল। মেলো, এটা আর বলো না।

আমি মনে করি এটা অবশ্যই তোমাকে অবগত করা দরকার, মেলো বলল।

আমাকে কী বলতে চেষ্টা করছ যে আমি প্রথমেই তার ঘাড়ে লাফ দিয়ে। উঠে পড়েছি! এমন কি মনে হচ্ছে তোমার?

অ্যাথেনা কঠোরভাবে বলল, আমার কি অভিনয়ের প্রতিভা নেই যে তার সঙ্গে আমাকে অন্তরঙ্গ হয়ে অভিনয় করতে হবে?

অবশ্যই নয়, মেলো বলল।

ব্যাপারটা তেমন নয়। অভিনয় ছাড়াও অনেক খুঁটিনাটি বিষয় আছে। কিন্তু তুমি জানো কিভাবে একজন লোক চলচ্চিত্রে বড় তারকা হয়?

কখনো কখনো কেউ কেউ ভালো অভিনেত্রী না হয়েও বড় চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পায়। আর এটা হলো তোমার জন্য বড় চরিত্র। তুমি এটাকে হাতছাড়া করো না। আর স্টিভেন স্টেলিংয়ের সাথে ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়াটা কী খুব কঠিন? সমগ্র বিশ্বের একশত মিলিয়ন মহিলা তাকে ভালোবাসে, তুমি কেন বাসবে না? তোমাকে অভিভূত হতে হবে।

আমি আনন্দিত বোধ করছি, শান্তভাবে অ্যাথেনা বলল।

কিন্তু আমি আসলেই তাকে ঘৃণা করলে পরে কী ঘটবে?

কাকে ঘৃণা করবে? সে আসলেই একজন সুন্দর মানুষ, আমি তোমাকে শপথ করে বলতে পারি। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত তার সাথে ফষ্টিনষ্টি করতে হবে যতক্ষণ ছবিতে তোমার যথেষ্ট পরিমাণ দৃশ্য না নেয় এবং যখন আর তোমাকে বাদ দিতে পারবে না।

আমি খুব ভালো করলে কী তারা আমাকে বাদ দিতে চাইবে? অ্যাথেনা বলল।

মেলো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সত্য কথা, স্টিভেন অত লম্বা সময় অপেক্ষা করবে না। তিনদিনের মধ্যে তার ভালোবাসায় না পড়লে, তুমি তার ছবি থেকে বাদ পড়ে যাবে।

এটা যৌন হয়রানি, অ্যাথেনা হেসে বলল।

চলচ্চিত্র জগতে এটা যৌন হয়রানি হতে পারে না। মেলো বলল, এক বা অন্যভাবে তোমার পশ্চাৎদেশ বিক্রির সুযোগ দেবে, অবশ্য এখানে ঢোকার পর।

আমি মনে করি আমি তার ভালোবাসায় আসক্ত হলাম, অ্যাথেনা বলল।

যৌন কাজ করা স্টিভেনের জন্য যথেষ্ট নয়? সে যাকে চায় তার সঙ্গে যৌন কাজ করতে পারে। মেলো বলল।

সে তোমার সাথে ভালোবাসায় মগ্ন হবে, পরিবর্তে সেও ভালোবাসা চাইবে।

সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

তুমি কাজের বাইরে ভালোবাসা করতে পারো, কারণ তুমি তখন কাজে খুব ব্যস্ত থাকবে না। সে কিছুক্ষণ বিরতি নিল। এটা তোমার সম্মানহানিব কথা হচ্ছে না। সে বলল।

মেলো, তুমি কি মনে করো না করো তা আমি জানি না। আমার শরীর বিক্রি ছাড়াই আমি যথেষ্ট ভালো করতে পারব? অ্যাথেনা শক্তভাবে বলল।

অবশ্যই তুমি পারবে মেলো বলল। তুমি পঁচিশ বছরের যুবতী। তোমাকে দুই থেকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। তোমার প্রতিভায় আমার চুড়ান্ত বিশ্বাস আছে। কিন্তু একটা সুযোগ দাও। সবাই স্টিভেনকে ভালোবাসে।

আমি মেলোকে নিজের করে ভাবতে গিয়েছিলাম। অ্যাথেনা প্রথম দিন আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করেছিল। তার পরও সে আর আমার কোনো কথা, কোনো কিছু সাদরে গ্রহণ করেনি। কারণ তারপর সে স্টিভ স্টেলিংয়ের প্রতি দুর্বল হয়েছিল। তার পর তারা একে-অপরের প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করতে থাকে, পরিশেষে তারা একে-অপরের সঙ্গে গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়ে। ফলে আমার সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যায়। কারণ তখন স্টিভ স্টেলিংয়ের আকাশ ছোঁয়া গুডউইল ছিল। তার গুডউইলের কাছে আমার সব কিছু স্রোতে ভেসে যায়। আমি অ্যাথেনা বুঝতে অক্ষম হই।

এবং শেষ দিন স্টিভ স্টেলিং তার ভালোবাসায় মৌখিকভাবে সাড়া দেয়। আমি মনে করি একটি ভালো ছবির কারণে তারা একে-অপরকে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ফেলে। সে কিছুক্ষণ বিরতি নিল, তারপর একটু হেসে বলল, আমি বেশ আছি।

ধন্যবাদ তোমাকে। অ্যাথেনা বলল, কোথায় এবং কখন? তৎক্ষণাৎ স্টিভের চেহারা তার চোখের সামনে ভাসতে লাগল, আরে না, সে বলল, তোমার পছন্দ।

সেই মুহূর্তে সে একজন সুপার তারকা, আর অ্যাথেনা এই পথে নতুন– তাছাড়া সে তার দায়িত্বে তার কর্তব্যে কখনোই কোনো প্রকার অবহেলা করেনি। তুমি কি আমার স্থানে আসতে পারবে? অ্যাথেনা জিজ্ঞেস করল, আমরা একসঙ্গে আজ রাতের খাবার খাব তারপর বাকি কাজের ব্যাপারে কথা বলব। সে কিছুক্ষণ বিরতি নেওয়ার পর বলল, রাত সাত টার সময়।

তারপর অ্যাথেনা শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে আরম্ভ করল। আসলেই আমার কোনো কাজই যৌনতার কারণে পড়ে থাকতে পারে না। তারা রাতের খাবার খাওয়ার পর সাদা মদ খেল এবং তারা একত্রে কোক খেল।

তখন তার পরনে ফেডেড ব্লু জিন্স পরা ছিল। তার শার্টটি ছিল বু কালারের। আর অ্যাথেনার পরনে ছিল সিল্কি হাউজ, তার সঙ্গে স্রেক পরেছিল। তার পায়ে ছিল উঁচু হিলের জুতা। যা তাকে আরো বেশি সুন্দর দেখাচ্ছিল। সব কিছু মিলে তাকে দেখতে সুন্দরী মনে হয়েছিল। স্টিভ স্টেলিং সঙ্গে করে রেড মদের বোতল এনেছিল। কিন্তু সে রাতের খাবারের পর এটা খেল না। সে এটা আগামী দিন রাতের খাবারের পর খাওয়ার জন্য রেখে দিল।

সে তখন ব্যবসায়ী পোশাক পরে ছিল। তখন তার পরনে ছিল বেগি ব্রাউন রঙের টাওজার, ব্লু ডেনিম শার্ট, তার কালো চুল বাতাসে উড়ছিল। তার পায়ে ছিল ইতালি জুতা যা তাকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলল।

তারপর তারা রাতে খেতে খেতে তাদের স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা করল। তারা স্ক্রিপ্টের বিভিন্ন দিক পরিবর্তন করার জন্য ভালোভাবে স্ক্রিপ্টটি পড়তে লাগল। রাতের খাবারের পর তারা তাদের লিভিং রুমে গেল এবং পুনরায় স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনায় মগ্ন হলো। তারা দুজনই স্ক্রিপ্ট নিয়ে বেশ উত্তেজনার মধ্যে ছিল। তাই তারা সেটা পরিবর্তন করে আরো ভালো কিছু করার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখল।

অ্যাথেনা লক্ষ্য করে দেখল স্টিভ স্টেলিং প্রত্যেককে চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। সেটি ক্যামেরার সামনে মুভ করার আগে বারবার নিজকে সংশোধন করার চেষ্টা করে। সে পরিচালকের সঙ্গে বারবার চরিত্রের ব্যাপারে আলোকপাত করে। কখনো কখনো সে নিজেই চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার জন্য নিজে নিজেই ক্যামেরা টেক করার জন্য চেষ্টা করে অর্থাৎ তার চরিত্র তার পছন্দমতো না হওয়া পর্যন্ত সে চেষ্টা অব্যাহত রাখে।

দীর্ঘক্ষণ চরিত্র নিয়ে আলোচনার পর তারা পাশাপাশি বসল। তারপর অ্যাথেনা নিচু হয়ে তার বুকে চুমু দিল। এটা ছিল তার নিত্যদিনের ভালোবাসার সংকেত। চুম্বন খেয়ে স্টিভ স্টেলিং একটু শিহরিত হলো। সেও তার ভালোবাসায় সাড়া দিল। আরো এতেই প্রমাণিত হলো সে বড় মাপের তারকা। তারা দুজনেই দক্ষ।

তারপর তারা দুজনই আলোড়িত হলো। স্টিভ স্টেলিং তার সারা শরীরে হাত বুলাতে লাগল, এতে অ্যাথেনা আর বেশি সংবেদনশীল হলো, সেটা তাকে বেড়ে যাওয়ার জন্য সংকেত দিল।

তারপর সিনেমার ভঙ্গিমায় একে-অপরকে আদর করতে আরম্ভ করল। তারা আস্তে আস্তে উত্তেজনার চরম শিখরে আরোহণ করল …

কিছুক্ষণ পরে তারা ফ্রেস হলো। অ্যাথেনা তার জন্য কিছু খাবারের আয়োজন করল। তারা পুনরায় খাবার খাওয়ার সময় আলোচনায় ফিরে এলো। অ্যাথেনা বলল, শুধু চরিত্র ফুটানোর চেষ্টা করলেও চলবে না– চরিত্র ভালো করে ফুটিয়ে তোলার জন্য গল্পেরও প্রয়োজন। তারা উভয়েই একমত হলো। এখন থেকে তারা কোনো ছবি করলে অবশ্যই অনেক আগে থেকেই স্ক্রিপ্ট সংগ্রহ করবে। কারণ গল্প ভালো না হলে চরিত্র ফুটানো যাবে না আর চরিত্র ফুটানো না গেলে ছবি হিট হবে না। এতে করে সবার চাইতে আমরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হব।

স্টিভ স্টেলিং তার প্রতি আরো বেশি ভালোবাসায় আসক্ত হলো। কিন্তু সে পুনরায় তাদের পেশা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত হলো। অ্যাথেনা বলল, আসলে ভালো ঘটনার চমকপদ বিশ্লেষণ না হলে কোনো পরিচালকই ছবিকে ফুটিয়ে তুলতে পারবে না। তাই সবার আগে চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গল্প বা কাহিনীর দিকে ভালোভাবে খেয়াল রাখতে হবে।

স্টিভ স্টেলিং নতুন ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কারণে আনন্দ উপভাগ করল। সে নতুন করে নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস অর্জন করার চেষ্টা করল। কিন্তু সে সর্বদাই অ্যাথেনার প্রতি ভালোবাসা দেখিয়েছিল। শত ব্যস্ততার মধ্যেও সে অ্যাথেনাকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করত। কারণ সবকিছুর চাইতে সে অ্যাথেনার প্রতি বেশি দুর্বল ছিল। কারণ তার জীবন চরিত্রে অ্যাথেনার মতো কখনো এমন সুন্দরীর সাক্ষাৎ পায়নি। কিন্তু মাঝে মাঝে অ্যাথেনার আচরণে সে বেশ ক্ষুব্ধ হতো। তখন সে নিজেই তার সমস্যা দূর করার জন্য উঠে পড়ে লাগত।

পরবর্তী ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে যে ঘটনার সন্নিবেশ হলো– তারা দুজনই বেডের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। চলো আমরা আমাদের কাজে ফিরি। তারা স্ক্রিপ্টটি হাতে নিল এবং জোরেসোরে পড়তে লাগল।

স্টিভ স্টিলিং যখনই ক্যামেরার সামনে পোজ দেয় তখনই অ্যাথেনা তা ভালোভাবে খেয়াল করে। সে চেষ্টা করে কিভাবে ভালো অভিনেত্রী হওয়ার জন্য আরো ভালোভাবে পোজ দেওয়া যায়। সে স্টিভ স্টিলিংয়ের প্রতিটি কাজকে পাগলের মতো অনুসরণ করে। আর যদি কোনো পোজ তার পছন্দ না হয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে স্টিভ স্টিলিংকে তা অবগত করে, অনুরূপভাবে স্টিভও অ্যাথেনার পোজ দেওয়ার সময় ক্যামেরার পেছনে থাকে, তার প্রতিটি কাজকে নিখুঁতভাবে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখে। প্রকৃতপক্ষে এটিই একজন ভালো অভিনেতার ও অভিনেত্রীর গুণ। অ্যাথেনা বলল, স্টিভ তুমি আমাকে যা শিখিয়েছ তা আমি কখনো ভুলব না। প্রকৃতপক্ষে আমার আজকের অবস্থানের জন্য সব কৃতিত্ব তোমার। আমি অ্যাথেনা যা সারা জীবন স্মরণ করব।

তারপর সে মৃদুভাবে বলল, আসলে এটা একটি বোধগম্য হওয়ার ব্যাপার।

তোমার ধারণা ঠিক, স্টিভেন বলল, তারা দুজনই ছিল একে-অপরের প্রতি কৃতজ্ঞ।

তার কাজ ও চলচ্চিত্র দুটোই খুব বড় ধরনের সাফল্য। অ্যাথেনা প্রথম কাজের মাধ্যমে তারকা খ্যাতি অর্জন করল। পাঁচ বছরে একটি ছবি করার সিদ্ধান্ত নিল সে কারণে সফলতা লাভ করল। তারকার জন্য কাজ, সফলতার জন্য কাজ। অ্যাথেনা ও স্টিভেন পরস্পরকে ভালোবাসে এবং পরশকে সংলাপ বলার ক্ষেত্রে সাহায্য করে। কিন্তু তাদের ভালোবাসার মূলে ছিল মজা করা, বিখ্যাত হওয়া বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ভালোবাসা মানুষকে উজ্জীবিত করতে পারে এবং কোনো ভালোবাসার মৃত্যু থেকে ফেরাতে পারে না, ভৌগোলিক প্রশ্নও সেখানে ছিল। ছবি শেষ, তাদের ভালোবাসাও শেষ। অ্যাথেনা মালিবুতে চলে গেল এবং স্টিভেন ইতালিতে। তাদের এই মুহূর্তে বিয়ে করা উচিত কিন্তু এটা ছিল অসম্ভব। অ্যাথেনা সম্পর্কটাকে খুব উপভোগ করত কিন্তু সে এটাকে গৌণভাবে নিয়েছিল। এটাকে পেশা হিসেবে নিলেও স্টিভেনকে সে অনেক বেশি ভালোবাসে। তার পক্ষে এটা অতিক্রম করা অসম্ভব। স্টিভেন খুব সচেতন, সঠিক এবং দায়িত্বশীল প্রেমিক। তার একটি ছবির কাজ চলে গেলেও সে এটা করবে।

সে তার শারীরিক সম্পর্ক উপভোগ করে কিন্তু এটা তার প্রশংসা ধরে রাখতে পারে না। স্টিভেনের বিয়ের প্রস্তাব তার কাছে বড় পাওয়া ছিল। কিন্তু সে তা প্রত্যাখ্যান করল। কারণ সে জানত স্টিভেন তার ছবির ও হলিউডে অবস্থানের জন্য এটা করে। যখন ড্রাগ সমস্যাটি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল তখন সে এটাকে তার জীবনের একটি অংশ হিসেবে পেতে চাইল। স্টিভেন তার প্রত্যাখ্যান ভালোভাবেই গ্রহণ করল। এটা ছিল তার অতিরিক্ত কোকেন গ্রহণের ফল। তাই সে এটা থেকে মুক্ত হলো। পরবর্তী পাঁচ বছরে অ্যাথেনা তারকা খ্যাতির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাল। স্টিভেন পুনরায় মেয়েদের প্রতি দুর্বল হতে লাগল দুর্ভাগ্যবশত এটা তাকে অভিনয়ে অমনোযোগী করে তুলল। ড্রাগ-অ্যালকোহল তাকে কাজের প্রতি দায়িত্বহীন করে তুলল। শেষ বছরে অ্যাথেনা সবার সাথে সুসম্পর্ক রেখেছিল। তার মধ্য এলি ম্যারিওনের একমাত্র পুত্র তরুণ প্রযোজক কেভিন ম্যারিওন। কেভিন ম্যারিওন ছিল তার সমবয়সি কিন্তু সে ছিল ছবি ব্যবসার সাথে জড়িত। তার প্রথম ছবি খুব সাফল্য পায় এবং ছবিতে তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। সেই সময়ে তার তিনটি ছবি ফ্লপ করে এবং তার বাবাই শুধু তাকে এ ব্যবসায় সাহায্য করে। কেভিন ম্যারিওন খুব সুদর্শন ছিল। এলি ম্যারিওনের প্রথম স্ত্রী খুব সুন্দর ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতভাবে ক্যামেরার সামনে ভালো দেখাত না, ফলে তার ভবিষ্যৎ তৈরি হলো একজন প্রযোজক হিসাবে।

অ্যাথেনার সাথে কেভিনের দেখা হলো এবং তখন সে তাকে তার নতুন ছবির তারকা হওয়ার জন্য অনুরোধ করল। সে যে নিষ্পাপ তা অ্যাথেনা র‍্যাপ পার্টিতে হতাশা ও উদ্বিগ্নতার মধ্য শুনেছিল। এটা চলচ্চিত্রের সেরা সংলাপ আমি এটি পড়েছি, কেভিন বলল। আমি অবশ্যই তোমাকে বলব এবং পুনরায় লিখতে সাহায্য করব। অ্যাথেনা তুমি সত্যিই এই চরিত্রের জন্য উপযুক্ত। তোমার মতো অভিনেত্রীকে আমি আমার ব্যবসায় চাই। সে তাকিয়ে থাকল এবং অ্যাথেনা তার ছবির সংলাপ দেখে উৎসাহিত হলো। এটা ছিল গৃহহীন রাস্তার মেয়ের গল্প। তার বসবাস গার্বেজপূর্ণ এলাকায় হলেও সে তার কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আমেরিকার গৃহহীনদের নেতা হয়ে গিয়েছিল।

কেভিন বলল, তুমি যদি অভিনয় করো তাহলে আমি আনন্দে মরেই যাব। অ্যাথেনা চিন্তা করল আমি উন্মাদ কিন্তু সে একজন ক্ষমতাবান প্রযোজক এবং সে সবকিছু ঠিকঠাকভাবে করতে পারে। সে হতাশায় মেলো স্টুয়ার্টের দিকে তাকাল এবং মৃদ হাসল। কিন্তু কিছু না বলেই চলে গেল। খুব ভালো ধারণা মেলো বলল, এটা একটি ক্লাসিক অর্থবহ কাহিনী কিন্তু কেভিন তুমি কি জানো অ্যাথেনার জন্য কতটা গুরুত্ববহ হবে। চলো আমরা সংলাপটি পড়ি তার পর নাট্যরূপ দিই।

অবশ্যই, কেভিন বলল একশর মতো কপি এই সংলাপের। আমি জানি তুমি এটাকে পছন্দ করবে। মেলো, অ্যাথেনাকে মেলরোজের একটি ছোট থাই রেস্টুরেন্টে নিল।

তারা তাদের খাবারের অর্ডার দিল এবং স্ক্রিপ্টের দিকে নজর দিল। অ্যাথেনা বলল, আমি প্রথমে নিজেকে হত্যা করব। কেভিন ফিরে আসবে। তুমি চলচ্চিত্র ব্যবসা ঠিক বুঝনি, মেলো বলল। কেভিন খুব বুদ্ধিমান আমার করার কিছু ছিল না কিন্তু কিছু করলাম। তাই আমার খারাপ লাগছে। কোথায়, কখন, অ্যাথেনা বলল। মেলো বলল, আমি তাকে পুনরায় ডাকতে পারি না। তুমি একজন বড় মাপের তারকা, তোমাকে না করতে নেই, এটা প্রয়োজনীয় কিছু নয়।

ক্লডিয়া অ্যাথেনাকে বলল, সবকিছুই তোমার নিজস্ব অ্যাথেনা, তা তোমারও আছে। এটা এক প্রকার বন্ধুত্ব। ক্লডিয়া এটাকে বুঝতে পারলেও বন্ধুত্বের জন্য তাকে খুব সহজে গ্রহণ করল। ক্লডিয়া বলল, স্টিভ স্টেলিংয়ের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আছে। অ্যাথেনা উচ্চ স্বরে হাসতে লাগল, যা সেখানকার সবাই লক্ষ্য করছিল, তারা সবাই এককথায় অকপটে বিশ্বাস করত, স্টিভ স্টেলিং বিছানায় বড়ই পারদর্শী একজন দামি অভিনেতা এবং একজন মজার মানুষ।

সে সর্বদা তোমার মতো সুন্দর, ক্লডিয়া বলল, মানুষ তার সৌন্দর্যের ভীষণ প্রশংসা করে। অ্যাথেনা না শোনার ভান করল। এটা এক প্রকার কারও কারও অভ্যাস, যারা কোনো কারণ ছাড়াই আমার প্রশংসা করে।

এতেই কি সে একজন বড় মাপের অভিনেতা প্রমাণিত হয়? অ্যাথেনা বিরক্তি সহকারে বলল।

আরে না, তুমি আসলেই একজন বড় মাপের অভিনেত্রী, ক্লডিয়া বলল। তারপরই অ্যাথেনা একটু শান্ত হলো। সে আরও বলল, কিন্তু সে তোমার চাইতে একজন সুখী মানুষ।

সত্যিই? অ্যাথেনা বলল। তা হয়তো ঠিক কিন্তু কিছু দিন সে আমার চাইতে অসুখী জীবনযাপন করেছিল যা আজ আমার মনে পড়ে।

হ্যাঁ, ক্লডিয়া বলল। সে এখন আর ভালো কিছু করতে যাচ্ছে না। কিন্তু সে বুদ্ধিমান, সম্ভবত তার আরো চালাক হওয়া প্রয়োজন। সে যা করতে যাচ্ছে তা সম্পর্কে আমি আগে কিছু জানতাম।

অ্যাথেনা বলল, তাছাড়া আমি তেমন কিছু চাই না।

তুমি আমার না, ক্লডিয়া বলল, কিন্তু তুমি কখনও তোমার প্রতিভা ধরে রাখতে পারবে না।

আমি জানি তুমি মদ পান করতে চাওনি। বজ তোমাকে জোর করে মদ পান করিয়েছে। তা তুমি নিজের মধ্যেই গোপন রেখেছ।

অ্যাথেনা হাসল। আমার গোপনীয়তাই আমার আস্থা। সে বলল, আমার গোপনীয়তার চেয়ে আরো বেশি আস্থাশীল, আরো বেশি রক্ষণশীল আমরা ছবির তারকা, আমাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্ববোধ থাকা উচিত।

প্রত্যেক শুক্রবার সকালে তাদের সাধারণত কোনো কাজ থাকে না, তাই তারা সেদিন একসঙ্গে কেনাকাটার জন্য শপিংমলে যায়।

সে শারীরিক সৌন্দর্যকে আরও আকর্ষণীয় করার জন্য কালো উইগ এবং ঢিলা ব্ল্যাক পরিধান করল। তার চেহারাকে একটু মোটা করার জন্য মেকাপ গ্রহণ করল। তার ঠোঁট একটু মোটা, তারপরেও সুন্দর। সবকিছু মিলে মেকাপ করার পর তাকে বেশি ভালো লাগত ছিল। সে তার চোখে কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করল যাতে তাকে আরও বেশি বুদ্ধিমতী মনে হলো। তার গলার স্বর আরও নরম ও মসৃণ হলো।

অ্যাথেনা কিছু কিনল, তারপর সে জিনিসগুলো ক্লডিয়ার ব্যাগে রাখল। এভাবে কেনাকাটা শেষ করার পর তারা দুজনে দুপুরের খাবার খেল। এটা ছিল একটি বেশ বড় রকমের রেস্টুরেন্ট, সেখানে সাধারণত সবাই প্রবেশ করতে পারত না। তাই কেউ-ই তাদের চিনতে পারল না।

প্রতি মাসের দুই সপ্তাহ ক্লডিয়া অ্যাথেনার ম্যালিবুর বাড়িতে সম্পূর্ণভাবে কাটাত। তারা একসঙ্গে সাঁতার কাটত, টেনিস খেলত, আরো অনেক আনন্দপূর্ণ কাজ করত।

ক্লডিয়া অ্যাথেনাকে ম্যাসিলিনার দ্বিতীয় চ্যাপটার পড়ার জন্য আদেশ করল। তখন অ্যাথেনা তাকে চরিত্র কেমন সে ব্যাপারে জানার জন্য জিজ্ঞেস করল। যদিও তখনও সে বড় মাপের তারকা হতে পারেনি। তাই যখন ক্লডিয়া পুনরায় ম্যালিবুতে পৌঁছল তখন অ্যাথেনা তার ছবির কাজে বেশ ব্যস্ত, তাছাড়া অ্যাথেনার ক্যারিয়ার তখন হুমকির মুখে যা হয়েছিল ক্লডিয়ার সূক্ষ্ম ভুলের জন্য।

সর্বদা প্যাসিফিক হোটেলের দুজন নিরাপত্তা প্রহরী অ্যাথেনার বাড়ির গেটে পাহারারত থাকত। আরো দুজন নিরাপত্তা প্রহরী তার বাড়ির বাগানের মধ্যে সর্বদা পাহারারত থাকত।

অ্যাথেনা ক্লডিয়াকে জানাল, আমি তোমাকে মিস করছি সে বলল, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি চলে যাব।

তুমি কেন এত উন্মাদ হচ্ছ? ক্লডিয়া বলল, তুমি সামান্য ভুলের জন্য তোমার জীবনটাকে হুমকির মুখে নিয়ে যাচ্ছ এবং মনে রেখো, আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি না, শোনো, আমি আজ তোমার সঙ্গে থাকব এবং আগামীকাল আমি আমার প্রশিক্ষণ শুরু করব।

অ্যাথেনা হাসল এবং তার কাধ বাকা করে সম্মতি জানাল। তোমার মধ্যে থেকে মাফিয়া চক্রর গন্ধ বের হয়ে আসছে। কারণ তুমি হাজার হলেও ক্লেরিকুজিও পরিবারের একজন সদস্য।

তারা একসঙ্গে মদ পান করল। তারপরও তারা পাশাপাশি বসে আরো কিছু সবুজ জাতীয় পানীয় পান করল।

তুমি আমার মনকে পরিবর্তন করতে পারবে না কারণ আমি অবুঝ শিশু নই, অ্যাথেনা বলল।

এখন তুমি তোমার যাবতীয় কথা আমাকে বলতে পারো, আমি মনে করি আমি তা অবশ্যই বুঝতে পারব।

তারপর সে ক্লডিয়াকে তার বিবাহ সম্পর্কে যাবতীয় কথা বলল। আসলে বজ স্কানেট দীর্ঘদিন আমার অপেক্ষার প্রহর গুনছিল, আমি পরিশেষে জীবনের দিকে তাকিয়ে সাড়া দিতে বাধ্য হলাম। ক্লডিয়া অ্যাথেনার গল্পে কিছু ভুল ধরল। সে বলল, তুমি পুনরায় কিছু গোপন করতে যাচ্ছ। এটা ঠিক না– প্রাণ খুলে বলতে পারো। তাছাড়া তোমার কথা সত্য হলে, আমাকে বলল তোমার শিশুর ঘটনাটা কি?

অ্যাথেনা বলল, তোমাকে আমি বলেছি- তাই সত্য এর চেয়ে আমার কাছে আর কিছু জানার চেষ্টা করো না, কারণ প্রত্যেকেরই নিজস্ব বলে কিছু থাকে। তুমি পারলে ছবি এবং স্টুডিওর ব্যাপারে আমার সঙ্গে আলাপ করতে পারো। তাছাড়া আমি বর্তমানে কিছুটা হতাশার মধ্যে আছি, পরিস্থিতি অনুকূলে এলে আমি তোমাকে বলার চেষ্টা করব। তবে এতটুকু বলতে পারি তুমি তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়েছ। তাছাড়া এর বাইরে কিছু ঘটেছে তা একান্তই আমার নিজস্ব ব্যাপার। সেদিকে তুমি নাক না গলালে আমি খুবই খুশি। হব।

ঠিক এই মুহূর্তে একজন লোক একটি বিশাল ট্রাঙ্ক নিয়ে তাদের ঘরে প্রবেশ করল। নিরাপত্তা প্রহরীরা তাকে থামাতে পারেনি। অপর দিকে বাগানের দুজন প্রহরীও ছুটে আসছিল– তার পরেও সে নিরাপত্তা প্রহরীর বাধাকে অতিক্রম করে ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

অ্যাথেনা দাঁড়াল, সে ক্লডিয়াকে মৃদু সুরে বলল, এটা বজ, সে তাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিল, এটা তার আসল চেহারা না। সে পাশে তাকিয়ে আরও পাঁচজন লোক দেখল। ক্লডিয়া তাদের অনুসরণ করার চেষ্টা করছিল।

বজ স্কানেট তাদের দিকে তাকিয়েছিল, তার চোখ দিয়ে যেন রক্ত বের হয়ে আসছে। তার চেহারা রোদে পুড়ে তামা হয়ে গেছে। তার দেহটা, ট্রাঙ্ক বহন করার জন্য একটু হেলিয়ে গেছে। সে হেসে বলল, হাই অ্যাথেনা, মদ পান করার জন্য আমাকে দাওয়াত করলে কেমন হতো? অ্যাথেনা একটি হাসি দিল, আমি চাই না আমার জন্য কেউ নেশা জাতীয় কিছু গ্রহণ করুক– তাছাড়া তুমি অনেক পূর্বেই আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছ।

তোমার ধারণা ঠিক না, বজ বলল, আমরা একে-অপরের কাছের মানুষ। আমাদের মধ্যে অনেক গোপন অভিমান আছে। তারপরও তুমি এমনভাবে কথা বললে, তারপর সে কিছুটা হাসল। সে তার দিকে তাকিয়ে থাকল।

একজন নিরাপত্তা প্রহরী বলল, সে আমাদের সাঁতার কাটাতে বাধ্য করেছে, সে আমাদের হয়রানি করেছে, এখন আমরা তাকে হাতকড়া পরাব।

না, অ্যাথেনা বলল, তার গাড়ির কাছে যাও।

তার পরও বজ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তার শরীর অবশ হয়ে এলো। অ্যাথেনা বলল, আমি তোমাকে দেখে নেব। তারপর সে চলে গেল।

সত্যিই তুমি সুপুরুষ। তা না হলে তুমি চার জন নিরাপত্তা প্রহরীকে অতিক্রম করে আসতে পারতে না, ক্লডিয়া বলল। আমি তোমাকে বাবা দিচ্ছি।

ক্লডিয়া আমি আগামীকাল আমার ভাই ক্রসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য ভেগাসে যাচ্ছি। সে অনেক সুদর্শন লোকজনকে চেনে। আমি নিশ্চিত যে, সে আমাকে সাহায্য করতে পারবে। তাছাড়া সে আমাকে সাহায্য করা ব্যতীত সেখান থেকে আমাকে আসতেও দেবে না। সে কেন সাহায্য করবে, অ্যাথেনা বলল, এবং কিভাবে? সে ও কি মাফিয়া চক্রের কেউ?

ক্লডিয়া জোর দিয়ে বলল, অবশ্যই না, সে আমাকে সাহায্য করবে, কারণ সে আমাকে ভালোবাসে। সে বেশ গর্বের সাথে কথাটা বলল, আমি একমাত্র মানুষ যাকে সে পিতার পরেই বেশি ভালোবাসে।

অ্যাথেনা তার দিকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকল। তোমার ভাই তোমার পেছনে ছায়ার মতো লেগে আছে। তুমি ছবি ব্যবসার জন্য খুবই উঁচু মানের একজন মেয়ে, আর এ জন্য তুমি অনেকের সঙ্গে রাত্রি যাপনও করেছ, তুমি তো অভিনেত্রী নও, তুমি একজন সাধারণ ছবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।

সেটা কোনো ব্যাপার নয়, ক্লডিয়া বলল, আমি ভেগাসে যাচ্ছি, ছবি শুটিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি ফিরব না।

রাতটা অ্যাথেনা ডেস্কের সামনে বসে সাগর, চন্দ্রবিহীন কালো রাত্রি দেখে কাটাল। সে সারারাত ক্লডিয়ার চিন্তা-ভাবনার প্রতি অনড় থাকল– সে ভাবল ক্রস তাকে হয়তো সাহায্য করতে পারে, কিন্তু কিভাবে তাকে ভালোবাসে?

যখন ক্লডিয়া স্কিপি ডিরির সঙ্গে বিকেলে বসে অ্যাথেনার গল্প বলছিল, তখন তারা সবাই নিশুপ ছিল। তারপর ডিরি বলল। কিছুদিনের মধ্যে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে আমি দেখেছি, সে অনেক দিন বজ স্কানেটের সঙ্গে জীবনযাপন করেছে। সে যদি আজ বজকে প্রত্যাখ্যান করে তাহলে সে কিভাবে তার শিশুকে পেল।

ক্লডিয়া বলল, আমি আমার ভাইয়ের কাছে ভেগাসে যাচ্ছি। সবকিছু সম্পর্কে তার অনেক অভিজ্ঞতা আছে। সে একটি সমাধান বের করতে পারবে।

আমি ভাবতে পারি না সে কিভাবে বজ স্কানেটকে প্রত্যাখ্যান করল, ডিরি বলল। আমরা অবশ্যই ইতিমধ্যে তা জানার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমাদের জানার অন্য কোনো সুযোগ নেই।

সে জানত, একমাত্র ক্রস ব্যাপারটাকে পরিষ্কার করতে পারে। কারণ ক্রস দীর্ঘদিন তার সঙ্গে ছবি ব্যবসায় জড়িত ছিল। তাছাড়া ক্রস তার সঙ্গে আরো ব্যাপারে জড়িত ছিল, তাই ক্রসই তার সম্পর্কে ভালো বলতে পারবে। আমি মনে করি ক্রস সব ব্যাপার জানলেও তোমার কাছেও সবকিছু পরিষ্কার করে বলবে না।

স্কিপি ডিরি কিছুক্ষণ বিরতি নেওয়ার পর বলল, আমিও তোমার সঙ্গে যাব।

ডিরি তার আধা মিলিয়ন ডলার মেরে দেবার পরও ক্লডিয়া তাকে ভালোবেসেছিল। সে ডিরিকে ভালোবাসে তার দোষ ও দুর্নীতির জন্য। স্কিপি ডিরি এমন একজন ব্যক্তি যার মধ্যে একজন প্রযোজক হিসেবে সব গুণ বিদ্যমান।

কয়েক বছর আগে তারা একত্রে একটা ছবিতে কাজ করছিল। এমনকি ডিরি হলিউডের একজন খুবই সফল প্রযোজক। এক সময় চলচ্চিত্রের একজন তারকা ডিরির স্ত্রীকে ধর্ষণ করার গর্ব করেছিল। এটা শুনে সে তার কাঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল।

ক্লডিয়ার আরো অনেক কিছু মনে পড়ল। তারা দুজনেই গাড়ি করে যাচ্ছিল, হঠাৎ ক্লডিয়া একটি সুন্দর ব্লাউজ গাড়ির জানালায় দেখল। সে কখনও এমন ব্লাউজ আগে দেখেনি।

কিন্তু ক্লডিয়া সে ব্যাপারে ডিরিকে কিছু বলল না। তারপরও ডিরি ক্লডিয়ার মনোভাব বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু সেও তাকে সে ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করল না।

যখন তারা স্থানীয় একটি দোকানে গেল দোকানের কর্মচারী তাদেরকে পাঁচশত ডলার মূল্যের একটি ব্লাউজ দেখাল, ক্লডিয়া বলল, একটি ব্লাউজ পাঁচশ ডলার?

আমাকে হাসাবেন না।

কর্মচারী বলল, এটা খুব দামি কাপড়ের এবং হাতে তৈরি। তাছাড়া এ ধরনের ব্লাউজ পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যাবে না, একমাত্র আমরাই এটা সরবরাহ করি। তাছাড়া এটার দামও তেমন বেশি বলে আমরা মনে করি না।

ডিরি হাসছিল, সে বলল, ক্লডিয়া এটা কেনার প্রয়োজন নেই। তুমি কি জান দুপুরের খাবার খেতে কত টাকা লাগবে। তাছাড়া তুমি সর্বদা এটা ৩০ ডলার দিয়ে কিনতে পারবে এবং বাকি টাকা তুমি অন্য কাজে ব্যয় করতে পারবে।

ক্লডিয়া ক্লার্কের দিকে তাকিয়ে হাসল, আমাকে শেষ বারের মতো বলুন এটার দাম কমাতে পারবেন কি-না।

ক্লার্ক বলল, ঠিক আছে আপনারা আসতে পারেন।

তারা দোকান থেকে বের হয়ে এলো যেহেতু তারা দোকান থেকে বের হয়ে আসছিল, ক্লার্ক পুনরায় তাদের পেছন থেকে ডাকল, তখন ক্লডিয়া হেসে বলল, আসি।

তারপর তারা গাড়ি করে যেতে শুরু করল। স্কিপি ডিরি বলল, তুমি ভাগ্যবতী, তুমি এটা এমনি এমনি পেয়ে গেলে।

পরের দিন যখন ক্লডিয়া কাজের জন্য স্টুডিওতে পৌঁছল, তার টেবিলে উপহারের বক্স দেখল। সে বক্সটি খুলে দেখল সেখানে এক ডজন ব্লাউজ এবং যা স্কিপি ডিরি পাঠিয়েছে।

ক্লডিয়া ভাবল, দোকানে ক্লার্ক আর ডিরি আমাকে বোকা বানিয়েছে। সে বক্সের মধ্যে আরও একটি সুন্দর পোশাক এবং টেনিস ব্যাট দেখতে পেল।

সেখানে আরো দুজন প্রযোজক তার সঙ্গে রাতের খাবার খেল। তারপর তারা সকলেই মদ পান করল। ক্লডিয়া ভাবল হয়তো ডিরি তার সঙ্গে মজা করছে, কিন্তু যখন ডিরি দুজন প্রযোজককে বলল, আমাকে প্রতি বছর আমার সন্তানের জন্য পাঁচ মিলিয়ন ডলার সঞ্চয় করতে হয়। তারপরও আমি ভাবি হয়তো আমি তাদের ভরণপোষণ করতে পারব না।

ক্লডিয়া হঠাৎ হতাশ হয়ে গেল, ডিরি তখন তাকে বলল, আমি সৎ, সবাই তা ভাবে কিন্তু কেউই চিৎকার করে বলতে পারে না।

স্কিপি ডিরি তার ছবি ব্যবসার বাকি টাকা পরিশোধ করল। একজন রাজমিস্ত্রির ছেলে হিসেবে এই প্রথম কেউ হলিউডের ছবি ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করল।

সে কঠোর পরিশ্রমী, সে ছোট ঘরের ছেলে হলেও ছবির জগতের সবকিছুই বুঝত। সে সব কাজ যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার সঙ্গ সম্পন্ন করত। কিভাবে পরিচালক, তারকার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হয়, তাও সে আত্মস্থ করেছিল। তার ব্যবহার ছিল খুবই ভালো। সে ছবির জগতের সঙ্গে জড়িত সকলের সঙ্গেই ভালো আচরণ করত। সে সবকিছু বুদ্ধিমত্তা আর ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলা করত। ছবির ব্যবসার জন্য তার মধ্যে কোনো কিছুর ঘাটতি ছিল না। সে ছবির কাজের জন্য বিভিন্নভাবে তার লগ্নি করা টাকাকে বিভিন্ন খাত অনুযায়ী ভাগ করত। ফলে সে একজন ভালো প্রযোজক হতে পেরেছিল। সে ছবির স্ক্রিপ্টের জন্য পঞ্চাশ শতাংশ এবং চিত্র গ্রহণের জন্য সত্তর শতাংশ টাকা বিনিয়োগ করেছিল।

সে যত্ন করে সব কাজ করত। সে নিজেই তার প্রয়োজনে সকল স্ক্রিপ্ট পড়ত। সে চরিত্র ও তারকা অনুযায়ী যাকে যে চরিত্র দেওয়ার দরকার তাকে সেই চরিত্র দিত। তাছাড়া সে ছবির প্রয়োজনে টাকা খরচ করেও বিভিন্ন লোকেশনে তার ছবির দৃশ্য চিত্রায়ণ করত। সে কখনো কোনো কাজে বিন্দু পরিমাণ ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করত না। আর এত কিছুর বিনিময়েই সে একজন সফল তারকা হওয়ার সাফল্য অর্জন করেছিল। ছবি তৈরি করার সময় সে বারবার তার টাকা ওঠানোর জন্য খুব ব্যস্ত থাকত। তার চিন্তা-ভাবনা থাকত যে করেই হোক তার ছবিকে সাফল্য পেতেই হবে।

তাছাড়া ছবির জন্য বিজ্ঞাপন ব্যয় বেশি করত। যাতে করে ছবি শেষ হওয়ার আগেই দর্শকদের মধ্যে ছবির প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়।

তাছাড়া অনেক সময় ছবির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ, প্রতিনিধিদের ক্রিসমাস কার্ড ও বিভিন্ন উপহার পাঠাত।

তাছাড়া সে সাড়া ফেলানোর জন্য আগে থেকেই পত্রিকা, ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপন দিত। আর এই সব কাজে ক্লডিয়া তাকে সর্বাত্মক সাহায্য করত। ক্লডিয়া সঙ্গে সঙ্গে তা শুধরিয়ে দিত। আর এই সব কারণেই শত কিছুর পরেও তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল। যখন ক্লডিয়া তাকে ভুল বুঝত, তখন ডিরি নিশ্চুপ থাকত এবং ভুল বোঝার চেষ্টা করত। কখনোই ক্লডিয়ার প্রতি রাগ করত না সে।

স্কিপি ডিরি প্রায় বলত, আমি যখন একজন পরিপূর্ণ মানুষ হব তার পরেই বিয়ে করব। কিন্তু সে ভালোবাসার প্রতি যথেষ্ট আসক্ত ছিল।

কিন্তু ডিরি সত্যিই ক্লডিয়াকে ভালোবাসত। যখন সে ক্ষমতাবান প্রযোজক ছিল তার ছবির কাজ বড় বড় তারকাদের নিয়ে করত। সে প্রায় ছবির তারকা, পরিচালক ও অন্যান্য কলাকৌশলীদের নিয়ে প্রায়ই মিটিং করত। সে এখন আস্তে আস্তে ভাটির দিকে ধাবিত হচ্ছে, তাই আর তার কাজের প্রতি তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বর্তমানে সে তার সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে সুখী জীবন করার চেষ্টা করছে।

স্কিপি ডিরি সমস্ত সফল প্রযোজকের মতো খুবই ব্যস্ত। তার প্রযোজিত ছবিগুলো দেখাশোনার জন্য, অর্থ সংগ্রহ ও প্রকল্প বাড়ানোর জন্য সমগ্র বিশ্ব জুড়ে তাকে ভ্রমণে যেতে হয়। অনেক সুন্দরী, উচ্ছল নারীরা তার সাথে যোগাযোগ করে বন্ধুত্ব করতে চায়। কিন্তু সে এখনো তার স্ত্রীকে ভালোবাসে।

একদিন এক বালিকা তার কাছে একটা স্ক্রিপ্ট নিয়ে এসে বলল, এটা একটি খ্রিস্টিও ভালো কাহিনী। সে ছিল খুবই প্রতিভাধর, সে বলল–এটা একটা কালো ছবি, এখানেই এক যুবক কবির প্রতি ভালোবাসায় আসক্ত হয় এক নারী। পরে সে স্বামীকে হত্যা করে কবির সঙ্গে চলে যেতে চায়।

স্কিপি ডি বলল, এই ছবি করার জন্য একটি আলাদা স্টুডিও ভাড়া করতে হবে। খ্রিস্টকে এই চরিত্রে অভিনয় করে বাস্তবিকতা ফুটিয়ে তুলতে হবে।

সে তার সমস্ত অর্থ শেষে ফিরিয়ে আনল। সব কিছু স্বপ্নের মতো সম্পন্ন। হলো। খিস্ট তার চরিত্রটিতে ভালোভাবে অভিনয় করল। ডি ছবিটা যথাযথভাবে প্রযোজনা করল। এটা বাজেটের নব্বই শতাংশেই পর্দায় পাঠানো সম্ভব হলো।

সেই সময় ডি কখনো তার স্ত্রীর প্রতি অবিশ্বস্ত হতে পারছিল না। শুধু একটা রাত ছাড়া যখন সে লন্ডনে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজনে ছিল।

তখন সে একটা খুব স্লিম ইংলিশ মেয়ের ভালোবাসায় আসক্ত হয়েছিল।

এই ভালোবাসা তার কাজে সাহায্য করেছিল। ছবিটি আর্থিক সাফল্য এনেছিল। খিস্টি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে একাডেমি পুরস্কার পেল।

স্কিপি ডিবি পরে ক্লডিয়াকে বলল, হ্যাপিলি ইভার আফটার ছবিটি কোথায় শেষ হওয়া উচিত ছিল। দেখল তার আসল আত্মমর্যাদা। এখন সে তার সত্য মূল্য অনুভব করল। সত্য হলো সে এখন একজন পরিপূর্ণ ব্যস্ত তারকা। সে এখন পরিচালকের পাঠানো স্ক্রিপ্ট পায়।

অধিক ভালো কিছু খোঁজার জন্য ডি তাকে পরামর্শ দিল। পরের ছবিটা হবে জটিল। তার জীবন সম্পর্কে সে কখনো উদ্বিগ্ন ছিল না। কিন্তু পুরস্কার। পাওয়ার কয়েক মাস পর সম্মানীয় অভিনেত্রী হিসেবে তাকে সর্বশীর্ষ স্থানীয় পার্টিতে দাওয়াত করল। চলচ্চিত্র ব্যবসায়ের গুরুত্বপূর্ণ সারিতে তাকে দেখা গেল। সে সদ্য যুবতী মেয়েটির সাথে অন্তরঙ্গ হয়ে গেল। খেয়ালখুশিভাবে পনের বছরের জুনিয়র অভিনেতার সাথে অন্তরঙ্গভাবে সে বাইরে চলে যেত। চিত্র সাংবাদিকরা তার বিবরণ নিল, নারীবাদীরা তা নিয়ে খুব আনন্দিত হলো।

স্কিপি ডিরি বাহ্যিকভাবে এটাকে খুব ভালোভাবে নিল। সে সমস্ত বিষয়টা বুঝল।

সর্বোপরি কেন সে নিজে নিজেই যুবতী মেয়েটাকে প্যাঁচের মধ্যে রাখল? আবার কেন সে তার অসাধারণ প্রচেষ্টা খ্রিস্টির ক্যারিয়ারে যোগ করবে? বিশেষ করে, সে আসলে তার কাছে তার এক যুবক প্রেমিকের জন্য চরিত্রটা চেয়েছিল। তার জন্য স্ক্রিপ্ট খোঁজা বন্ধ করল। সে অন্য প্রযোজক, পরিচালক, স্টুডিও প্রধানদের সাথে তার জন্য প্রতিযোগিতা বন্ধ করে দিল। তারা বয়স্ক লোক হিসেবে খ্রিস্টিকে কোনো প্রকার সুযোগ দিল না।

খ্রিস্টি প্রধান চরিত্র হিসেবে আরো দুইটি ছবি নির্মাণ করল। আর দুটি ছবিই ফ্লপ করল কারণ তার চরিত্র ছিল ভুলে ভরা।

আর সে কারণেই সে পুরস্কার থেকে যা পেয়েছিল তা ব্যবসায়ে ব্যয় করল।

তিন বছরের মধ্যে সে তৃতীয় পর্যায়ে চলে এলো।

এই সময়ে সে একজন লোকের সাথে ভালোবাসায় আসক্ত হলো। লোকটার ইচ্ছে ছিল প্রযোজক হওয়ার। বাস্তবিক একেবারে তার স্বামীর মতো, কিন্তু তার মূলধন দরকার। তাই খ্রিস্টি তাকে ডিভোর্স দিল। বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পত্তি এবং বছরে পাঁচ লাখ ডলার খোরপোশ হিসেবে পেল। তার আইনজীবী ইউরোপে স্কিপির সম্পদ সম্পর্কে কোনো খোঁজ পেল না। অতএব, তারা বিচ্ছিন্ন বন্ধু। সাত বছর পর খ্রিস্টি এক দুর্ঘটনায় মারা গেল। যদিও সে ডির খ্রিসমা