“দর আফসায়ে আলম বগাশতম বসে,
বসর বোরদাম আ’য়ামে বহর কাসে,
তামাত্তায় যে হরগোশা ইয়াফতাম,
যে হর খিরমানে খোশা ইয়াফতাম।”
অর্থাৎ–
“ভ্রমিয়াছি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রদেশ,
মিলিয়াছি সর্বদেশে সবাকার সনে,
প্রতি স্থানে জ্ঞানে রেণু করি আহরণ,
প্রতি মৌসুমে শস্য করেছি ছেদন।”
বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের মধ্য দিয়ে শেখ সাদী (রঃ) অর্জন করেছিলেন বিবিধ জ্ঞান; তাঁর চোখের সামনে ঘটেছিল বহু বিচিত্র ঘটনা, তিনি অবলোকন করেছিলেন জাতির উত্থান, পতনের ইতিহাস। কর্ডোভার মুসলিম সাম্রাজ্য যার ঐশ্বর্যে একদিন এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা প্রভাবান্বিত হয়েছিল তা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শেখ সা’দী (রঃ) এর চোখের সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে ধরা পৃষ্ট হতে মুছে গিয়েছিল। এ শতকেই সেলজুক এবং খাওয়ারিজম শাহীর আত্মদ্বন্দু উভয় সাম্রাজ্যের মূল উৎপাটন করে ফেলেছিল। বনি আব্বাসদের রাজ বংশ যা প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ বছর বিপুল বিক্রমে রাজত্ব করেছিল, তাও এ শতকে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সা’দী (রঃ) দেখেছিলেন দুর্ভিক্ষের হাহাকার। মিসর ও পারস্যের দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ হানি দেখে তার হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছিল। যে দুর্ধর্ষ চেঙ্গিস খাঁর নামে আজও সমগ্র এশিয়ার লোক শিহরিত হয়, তারই পোত্র নৃশংস হালাকু খান এক বিরাট তাতার বাহিনী নিয়ে ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের উপর আপতিত হয়েছিল। বর্বরদের নির্মম অক্রমণে ইসলামের শেষ খলিফা মোতাসেম বিল্লাহ নির্দয় ভাবে নিহত হলেন। এরপর শুরু হল নির্মম গণহত্যার অভিনব। নারী পুরুষের অকলঙ্ক শোণিতে রাজপথ, গৃহ ও টাইগ্রাসের পানি রঞ্জিত হল। বাগদাদ পরিণত হল এক মহা শ্মশানে। ইবনে খালদুন লিখেছেন, বিশ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে প্রায় ষোল লক্ষ লোক এ আক্রমণে নিহত হয়েছিল। শেখ সাদী (রঃ) গুলিস্তার প্রথম অধ্যায়েই এ সকল জালেমদের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী পরিচালনা করেছেন। তাঁর প্রায় সমগ্র কাব্য গ্রন্থের ভিতরই জালেম বাদশাহর উপর তার শ্লেষ বাক্য ও অবজ্ঞার চিহ্ন বিচ্ছুরিত দেখতে পাওয়া যায়।
দেশ ভ্রমণে নিষ্ঠুর, জালেম ও বর্বরদের হাতে সা’দীকে কতবার যে কষ্ট লোগ করতে হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। দ্বাদশ শতাব্দীতে ফিলিস্তিনীতে খিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে ধর্মযুদ্ধ যখন চরম আকার ধারণ করে তখন খ্রিস্টানদের আক্রমণ থেকে। পাবার জন্যে শেখ সা’দী (রঃ) নিকটস্থ এক নির্জন জঙ্গলে আশ্রয় নেন। খ্রিস্টানগণ জঙ্গল থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং বুলগেরিয়া ও হাঙ্গেরী হতে আনীত ইহুদিদের সাথে তাঁকে পরিখা খননে নিযুক্ত করে। তখন তাঁর দুরাবস্থার সীমা ছিল না। একদিন আলিপ্পো শহরের এক সম্ভ্রান্ত বণিক (সাদীর এক সময়ের পরিচিত) সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। শেখ সা’দী (রঃ) তাকে দেখে সমুদয় ঘটনা বললেন। এতে বর্ণিত দয়াপরবশ হয়ে মনিবকে ১০ দিনার ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাঁকে মুক্ত করে সাথে করে আলিপ্পো শহরে নিয়ে যান। কিন্তু আলিপ্পো শহরেও তিনি সুখ পাননি। বণিকের এক বদমেজাজী ও বয়স্কো কন্যা ছিল। তার বদমেজাজের কারণে কেউ তাকে বিয়ে করতে রাজি হত না। বণিক ১০০ দিনার মোহরের বিনিময়ে কন্যাকে শেখ সা’দীর নিকট বিয়ে দেন এবং মোহরের অর্থ বণিক নিজেই পরিশোধ করেন। সা’দী বিপদে আপদে কখনো ধৈৰ্য্যহারা হতেন না। বিয়ের পর কবি শেখ সাদী (রঃ) আর সুখের মুখ দেখতে পেলেন না। বদমেজাজী রমণী একদিন সহসা বলে ফেলল যে, তুমি কি সেই হতভাগ্য নও, যাকে আমার পিতা অনুগ্রহ করে ১০ দিনার মূল্য দিয়ে স্বহস্তে মুক্ত করেছিলেন? উত্তরে শেখ সা’দী (রঃ) বললেন, “হ্যাঁ সুন্দরী! আমি সেই হতভাগ্য, যাকে তোমার পিতা ১০ দিনার দিয়ে মুক্ত করেছিলেন, কিন্তু পুনরায় ১০০ দিনার দিয়ে তোমার দাসত্বে নিযুক্ত করে দিয়েছেন। সম্ভবত আল্লাহ পাক তার প্রিয় বান্দাদেরকে এভাবে অভাব অনটন ও দুঃখ কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা করে থাকেন।
আল্লামা শেখ সা’দী (রঃ) বহু কাব্যগ্রন্থ রচনা করে যান। তাঁর এ সকল কাব্যে রয়েছে মানুষের নৈতিক ও চরিত্র গঠনের অমূল্য বাণী। শেখ সাদীর অলঙ্কারময় ভাষা ও প্রকাশের জাদু পাঠকদের মনকে বিস্ময় বিমুগ্ধ করে রাখত। আজও তার লেখা কাব্য গ্রন্থ কারিমা, গুলিস্তা ও বোস্তা বিশ্বের বিভিন্ন কওমী মাদ্রাসায় পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীরা পবিত্র কোরআন শিক্ষার পরই তাঁর রচিত কাব্য গ্রন্থ কারিমা, গুলিস্তা ও বোস্তা শিক্ষা লাভ করে থাকে। তাঁর সমস্ত রচনাই অতি সরল ও প্রাঞ্জল। আলেমগণ বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল ও ধর্মীয় সভায় শেখ সা’দীর কবিতা আবৃত্তি করে থাকেন। তাঁর কবিতা আবৃত্তি না করলে আলেমগণ যেন ওয়াজ মাহফিল জমাতে পারেন না। শিশুরা শেখ সাদীর কারিমা গ্রন্থের কবিতা সুললিত কণ্ঠে পাঠ করতে থাকে–
“কারিমা ব–বখশায়ে বর হালে মা
কে হাস্তম আসীরে কামান্দে হাওয়া।
দারেম গায়ের আর্য ফরিয়াদ রাস্
তু–য়ী আসীয়ারা খাতা বখশ ও বাস্।
নেগাদার মারা যে রাহে খাতা
খাতা দার গোযার ও সওয়াবম নমা।”
অনুবাদ : হে দয়াময় প্রভু! আমার প্রতি রহম কর। আমি কামনা ও বাসনার শিবিরে বন্দী। তুমি ব্যতীত আর কেউ নেই, যার নিকট আমি প্রার্থনা করব। তুমি ব্যতীত আর কেউ ক্ষমাকারী নেই। তুমি আমাকে পাপ থেকে রক্ষা কর। আমার কৃত পাপ ক্ষমা করে পুণ্যের পথ প্রদর্শন কর।