তাঁর উক্ত ভাষণে মানুষের আদি উৎস সম্পর্কিত কোরআনের যেসব বক্তব্য আলোচিত হয়েছিল, তা ছিল নিম্নরূপঃ
বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে কোরআনের বক্তব্য বাইবেলের বক্তব্য থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। শুধু তাই নয়, বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে কোরআনের ওইসব বক্তব্য আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণাজাত তথ্য-পরিসংখ্যানের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের জানাচ্ছে যে, সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী এককথায় গ্রহ-নক্ষত্র সবকিছুই মহাশূন্যে ঘূর্ণায়মান; এবং মহাশূন্যের ঘূর্ণায়মান প্রতিটি বস্তুই বিবর্তনের ধারায় ক্রমবিকাশমান। এসব বিষয়ে কোরআনের বক্তব্য বিজ্ঞানের সুপ্রমাণিত তথ্যের সাথে বলতে গেলে অভিন্ন।
পবিত্র কোরআন বহু আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, মানুষের দ্বারা মহাশূন্য বিজিত হবে।
পবিত্র কোরআনে চৌদ্দ শ’ বছর আগেই পানি-প্রবাহের গতিপথ ও ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কে যে-সব বক্তব্য দেয়া হয়েছে একমাত্র আধুনিক যুগে এসে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণার আলোকে সে-সব সত্য বলে প্রতিপন্ন হয়েছে।
নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যারা কোরআনের বক্তব্য বিশ্লেষণে আগ্রহী হবেন, পূর্বোক্ত তথ্যাবলী তাঁদের বিস্মিত না করে পারবে না। আমাদের এই গবেষণা পুস্তকে এসববিষয়ে আরো বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষিত ও পর্যালোচিত হবে। এখানে গোড়াতেই আবারও বলে নিতে চাই যে, আমাদের এই পর্যালোচনায় বৈজ্ঞানিক গবেষণার সেই মূল ধারাটি অক্ষুণ্ণ থাকবে–বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের যাবতীয় গবেষণা যে ধারায় পরিচালিত হয়। সেই নিরিখে আরো একটি কথা বলে নিতে চাই। তাহল, সার্ধ চৌদ্দশ’ বছর আগে অবতীর্ণ কোরআনের মত একটি ধর্মগ্রন্থে কিভাবে এহেন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা সুপ্রমাণিত এবং বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত সিদ্ধান্ত স্থানলাভ করতে পেরেছে–সেই বিষয়টিই মানুষের জ্ঞানবুদ্ধির কাছে বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে বিরাজ করছে।
২৮. মানব-সৃষ্টিতত্ত্ব প্রসঙ্গ
মানব-সৃষ্টিতত্ত্ব প্রসঙ্গে যেমন, বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে কোরআনে যে ধরনের তথ্য-উপাত্ত বিদ্যমান, সেই ধরনের কোন তথ্য-উপাত্ত কিন্তু বাইবেলের কোথাও পাওয়া যায় না। শুধু তাই নয়, পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব সম্পর্কে বাইবেলের যে বক্তব্য, কিংবা বাইবেলের আদিপুস্তকে আদি মানুষের বংশধারার যে বিবরণ, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান গবেষণা-আবিষ্কারের আলোকে তা আড়াগোড়াই ভ্রান্তিপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে। কোরআনে মানুষের আদি উৎস সম্পর্কে এ ধরনের ভ্রান্তিপূর্ণ কোন তথ্য নেই।
কথা উঠতে পারে যে, কোরআনের কোন প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে সম্ভবতঃ ওই ধরনের ভ্রান্তিপূর্ণ তথ্য ছিল; পরে যখন ওইসব তথ্য-উপাত্ত ভুল বলে প্রমাণিত হয় তখন পরবর্তী প্রকাশনার ক্ষেত্রে কোরআন থেকে ওইসব ভ্রান্তিপূর্ণ তথ্য পরিসংখ্যান বাদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু, এই বক্তব্য যে আদৌ সঠিক নয়, কোরআন সংরক্ষণের ইতিহাস বিচার-পর্যালোচনায় তা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।
প্রথমত, বাইবেলের ওইসব তথ্য-পরিসংখ্যান যে ভ্রান্তিপূর্ণ, তা যে ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা, আবিষ্কার ও বিচার-বিশ্লেষণের দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে, সেই ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা-বিশ্লেষণ কিন্তু একান্ত হালের ঘটনা।
দ্বিতীয়ত, কোরআনের সেই আদিযুগের প্রাচীনতম কপি এখনো বিদ্যমান। পুংখানুপুংখভাবে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, প্রায় দেড় হাজার বছরের প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপির সাথে যেমন, তেমন হাজার বছরের অধিককাল পূর্বের প্রচলিত কোরআনের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপির সাথেও বর্তমান চালু কোরআনের কোন সূরা কিংবা আয়াত তো দূরের কথা, একটা হরফেরও কোন গরমিল পাওয়া যায়নি।
সুতরাং, পুর্নবার ব্যক্ত করতে হচ্ছে, মোহাম্মদ (দঃ) নিজেই কোরআন রচনা করেছেন বলে যে অভিযোগ তা ভিত্তিহীন, তাহলে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন না উঠে পারে না যে, সে যুগে বসে বাইবেল নকল করে কোরআন রচনা করতে গিয়ে তিনি কিভাবে বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রত্যকটি ভুলত্রুটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সনাক্ত করলেন ও বাদ দিতে পারলেন? শুধু কি তাই? একইসঙ্গে মোহাম্মদ (দঃ) সে যুগে বসে কিভাবেই বা অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা গবেষণা ও আবিষ্কারের সাথে একান্ত সঙ্গতিপূর্ণ বক্তব্য রচনা করে নিয়ে বেছে বেছে সে-সব স্থানে বসাতে পারলেন?
এই পর্যায়ে আবার যে কথাটি অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে, তাহল, বাইবেল সঙ্কলনের কাল থেকে শুরু করে মোহাম্মদের (দঃ) আমল পর্যন্ত সময়ের যে সুদীর্ঘ ব্যবধান, সেই প্রেক্ষিতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমনকিছু তথ্য-পরিসংখ্যান আবিষ্কৃত হয়নি কিংবা বিজ্ঞানের কোন বিষয়ে এমন কোন গবেষণাও পরিচালিত হয়নি–যার দ্বারা বাইবেলের বিজ্ঞান-সংক্রান্ত ওইসব বক্তব্য ভুল বলে সাব্যস্ত হতে পারে এবং সঠিক বক্তব্য কারো হাতের নাগালে থাকতে পারে।
এই অবস্থায় বাইবেল কিভাবে প্রণীত ও সঙ্কলিত হল, সেই প্রশ্ন এসে পড়ে অনিবার্যভাবেই। ইতিপূর্বের পর্যালোচনায় জেনেছি, ইহুদী ও খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ববিদদের বক্তব্য এই যে, বাইবেলের পুরানো ও নতুন নিয়ম (অর্থাৎ প্রচলিত তাওরাত, জবুর ও ইঞ্জিল) রচিত হয় ঐশ্বরিক প্রেরণায়। কোরআন সম্পর্কে মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদদের বক্তব্য অবশ্য ভিন্ন। তাঁদের বক্তব্য, কোরআন সরাসরি ওহী বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে প্রাপ্ত বাণী। কিন্তু তবুও কোরআনের সেই বাণী কিভাবে প্রাপ্ত ও সংরক্ষিত এবং বিশেষত কোরআন সঙ্কলন সম্পর্কে ইতিহাসের বক্তব্য কি? এই গবেষণার স্বার্থেই তা বিচার-পর্যালোচনা করে দেখা দরকার।