কিন্তু, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিরীক্ষা-গবেষণা ও আবিষ্কার বাইবেলের ওই বক্তব্যকে মেনে নিতে পারছে না। অন্যদিকে, হযরত মুসার (আঃ) মিসর ত্যাগের যে বিবরণ বাইবেলে বিদ্যমান, তাতে আমরা এমনকিছু তথ্য পাই যা আধুনিক মিসরীয় স্থাপত্য বিজ্ঞানের দ্বারা সত্য হিসেবে সাব্যস্ত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাইবেলের ওই বিবরণ থেকে আমরা হযরত মুসা (আঃ) এবং ফেরাউনের সঠিক ইতিহাসও অনেকাংশে সনাক্ত করতে পারি।
যাহোক, বাইবেলের রচয়িতাবৃন্দ মানবসৃষ্টি ও হযরত আদমের (আঃ) বংশধারা এবং ইহুদীদের বিবরণ সম্পর্কে ধর্মীয় যে ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে গেছেন, প্রথমেই তা পর্যালোচনা করা উচিত। কেননা, শুধু এইক্ষেত্রেই বিচার পর্যালোচনার কিছু অবকাশ বিদ্যমান। এর প্রথমেই আসে মানুষের আদি উৎসের কথা; দ্বিতীয় পর্যায়ে আসে পৃথিবীতে মানুষের প্রথম আবির্ভাবের ইতিহাস। প্রথমটা সম্পর্কে বাইবেলে মোটামুটিভাবে কিছুটা বিশদ বর্ণনা বিদ্যমান। দ্বিতীয় বিষয়টা সম্পর্কে বাইবেলে সরাসরি কোন বক্তব্য নেই বটে; তবে, বাইবেলে পুরাতন নিয়মে প্রদত্ত সময়কালের হিসেব থেকে পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের সময় সম্পর্কে মোটামুটিভাবে একটা ধারণা খুঁজে নেয়া যায়। সেইসঙ্গে, যদিও অনেকটা ভিন্নভাবে উপস্থাপিত, তবুও বাইবেলের নতুন নিয়মের বিভিন্ন সুসমাচার বিশেষত লুক-রচিত সুসমাচার থেকেও এই বিষয়ের কিছু বরাত বা সূত্র খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
বাইবেল পুরাতন নিয়মের ‘আদিপুস্তকে’ মানুষের আদি উৎস সম্পর্কিত বক্তব্য ওই একইঅধ্যায়ে পরিবেশিত সৃষ্টিতত্ত্বের বিবরণের মধ্যেই বিদ্যমান। তবে, বিষয়টা বিশদভাবে বুঝার জন্য এ বিষয়ে সরাসরি আলোচনা প্রয়োজন। সেই চেষ্টাই এখানে করা হবে।
২৩. সৃষ্টিতত্ত্ব : আদিপুস্তক
ফাদার ডি ভক্স-এর গবেষণা অনুসারে, বাইবেলের ‘আদিপুস্তক’-সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে দুটি ভিন্নধর্মী রচনা একইসঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে। সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে এই যে দুটি আলাদা রচনা–এই বিষয়টির উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা। কেননা, এই বিষয়টি সম্পর্কে অনেক বাইবেল-পাঠকেরই তেমন কোন ধারণা নেই।
আগেই বলা হয়েছে, সৃষ্টিতত্ত্ব-সম্পর্কিত ‘আদিপুস্তকের প্রথম বক্তব্যের রচয়িতা হলেন, জেরুজালেম উপাসনালয়ের যাজক-পুরোহিতবর্গ। এসব রচনার সময়কাল হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী। এসব রচনা ‘সেকেরডোটাল’ পাঠ হিসেবে পরিচিত। আদিপুস্তকের দুটি বিবরণের মধ্যে এই সেকেরডোটাল রচনা বেশ দীর্ঘ। আদিপুস্তকের দুটি বিবরণের মধ্যে এই রচনার শুরু। এতে একে একে স্থান পেয়েছে আকাশমণ্ডলের সৃষ্টি, পৃথিবীর সৃষ্টি, প্রাণিজগতের সৃষ্টি এবং শেষ পর্বে বা চূড়ান্ত পর্যায়ে স্থানলাভ করেছে মানুষের সৃষ্টি-সম্পর্কিত বিবরণ। তবে, মানবসৃষ্টির এই বর্ণনা খুবই সংক্ষিপ্ত।
সৃষ্টিতত্ত্ব-সম্পর্কিত বাইবেলের দ্বিতীয় বর্ণনাটি হচ্ছে, জেহোভিস্ট আমলের রচনা। এই রচনার সময়কাল হচ্ছে, খ্রিস্টপূর্ব নবম অথবা দশম শতাব্দী। সেকেরডোটাল বিবরণের পরপরই আদিপুস্তকে স্থানলাভ করেছে এই জেহোভিস্ট রচনা এবং এই জেহোভিস্ট রচনায় মানবসৃষ্টি-সংক্রান্ত বিবরণ তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ। যাহোক, এখানে ‘রিভাইজড স্ট্যান্ডার্ড ভার্সন অব দি বাইবেল’ থেকে ‘আদিপুস্তকের’ এই বিবরণ তুলে ধরা হচ্ছে। (বাংলা রূপান্তরে বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলা “পবিত্র বাইবেল–পুরাতন ও নতুন নিয়ম”-এর ‘আদিপুস্তকের’ প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে উদ্ধৃত) :
“আদিতে ঈশ্বর আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করিলেন। পৃথিবী ঘোর ও শূন্য ছিল। এবং অন্ধকার জলধির উপরে ছিল, আর ঈশ্বরের আত্মা জলের উপরে অবস্থান করিতেছিল।”–অধ্যায় ১, বাণী ১ ও ২ :
“পরে ঈশ্বর কহিলেন, দীপ্তি হউক, তাহাতে দীপ্তি হইল। তখন ঈশ্বর দীপ্তি উত্তম দেখিলেন এবং ঈশ্বর অন্ধকার হইতে দীপ্তি পৃথক করিলেন। আর ঈশ্বর দীপ্তির নাম দিবস ও অন্ধকারের নাম রাত্রি রাখিলেন। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে প্রথম দিবস হইল।”–বাণী ৩ থেকে ৫ :
“পরে ঈশ্বর কহিলেন, জলের মধ্যে বিতান হউক ও জলকে দুইভাবে পৃথক করুক। ঈশ্বর এইরূপে বিতান করিয়া বিতানের উস্থিত জল হইতে বিতানের অধঃস্থিত জল পৃথক করিলেন, তাহাতে সেইরূপ হইল। পরে ঈশ্বর বিতানের নাম আকাশমণ্ডল রাখিলেন। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে দ্বিতীয় দিবস হইল।”–বাণী ৬ থেকে ৮ :
“পরে ঈশ্বর কহিলেন, আকাশমণ্ডলের নিচস্থ সমস্ত জল এক স্থানে সংগৃহীত হউক ও স্থল সপ্রকাশ হউক; তাহাতে সেইরূপ হইল। তখন, ঈশ্বর স্থলের নাম ভূমি ও জলরাশির নাম সমুদ্র রাখিলেন। আর ঈশ্বর দেখিলেন যে, তাহা উত্তম। পরে ঈশ্বর কহিলেন, ভূমি, তৃণ, বীজোৎপাদক ঔষধি ও সজীব স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী ফলের উৎপাদক ফলবৃক্ষ, ভূমির উপরে উৎপন্ন করুক; তাহাতে সেইরূপ হইল। ফলতঃ ভূমি-তৃণ স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী বীজোৎপাদক ঔষধি স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী সজীব ফলের উৎপাদক বৃক্ষ উৎপাদন করিল, আর ঈশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল উত্তম। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে তৃতীয় দিবস হইল।”–বাণী ৯ থেকে ১৩ :
“পরে ঈশ্বর কহিলেন, রাত্রি হইতে দিবসকে বিভিন্ন করণার্থে আকাশমণ্ডলের বিতানে জ্যোতির্গণ হউক; সে-সমস্ত চিহের জন্য, ঋতুর জন্য এবং দিবসের ও বৎসরের জন্য হউক, এবং পৃথিবীতে দীপ্তি দিবার জন্য দীপ বলিয়া আকাশমণ্ডলের বিতানে থাকুক, তাহাতে সেইরূপ হইল। ফলতঃ ঈশ্বর দিনের উপর কর্তৃত্ব করিতে এক মহাজ্যোতিঃ ও রাত্রির উপরে কর্তৃত্ব করিতে তদপেক্ষা ক্ষুদ্র এক জ্যোতিঃ এই দুই বৃহৎ জ্যোতিঃ, এবং নক্ষত্রসমূহ নির্মাণ করিলেন। আর পৃথিবীতে দীপ্তি দিবার জন্য, এবং দিবস ও রাত্রির উপরে কর্তৃত্ব করণার্থে, এবং দীপ্তি হইতে অন্ধকার বিভিন্ন করণার্থে ঈশ্বর ঐ জ্যোতিসমূহকে আকাশমণ্ডলের বিতানে স্থাপন করিলেন এবং ঈশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল উত্তম। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে চতুর্থ দিবস হইল।”–বাণী ১৪ থেকে ১৯ :