লুক লিখিত সুসমাচারেও অনুরূপই বর্ণিত রয়েছে, উপরন্তু সেখানে বলা হয়েছে, “এ যুগের লোকেরা দুষ্ট, এরা লক্ষণের অন্বেষণ করে, কিন্তু যোনার লক্ষণ ছাড়া দৃশ্য কোন লক্ষণই এদের দেয়া যাবে না। কারণ, যোনা যেমন নীনবাসীদের নিকট লক্ষণস্বরূপ হয়েছিলেন, মনুষ্য-পুত্রও এ যুগের লোকদের নিকট সেরূপ হবেন।” (১১: ২৯-৩০)।
মথি ও লুক লিখিত সুসমাচার এবং বাইবেলে সন্নিবেশিত “যোনা ভাববাদীর পুস্তক” নামে আর একখানি স্বতন্ত্র পুস্তক থেকে জানা যায় যে,
(১) যোনা ভাববাদী বা ইউনুস (আঃ) নবী তিনদিন-তিনরাত্রি একটি তিমি মাছের উদরে অবস্থান করেছিলেন।
(২) মাছটি তাঁকে তার জীবিতাবস্থায় গ্রাস করেছিল এবং তিনদিন তিনরাত্রি জীবন্ত ও সম্পূর্ণ সচেতন অবস্থায় তাকে তার উদরে রেখেছিল।
(৩) মাছের উদরে অবস্থানকালে যোনা ভাববাদী নিজের মুক্তির জন্য সদাপ্রভুর নিকট প্রার্থনা করেছিলেন এবং সদাপ্রভু তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন।
(৪) অবশেষে মাছটি তাঁকে সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্ববলাবস্থায় সমুদ্রের কিনারায় উগড়ে দিয়েছিল। অতঃপর তিনি নিজের নবুওয়াতের মিশন সম্পূর্ণ করার জন্য নিনিবা অঞ্চলে যান এবং তাঁর দীর্ঘকালের সাধনা ও প্রার্থনার ফলে ঐ জনপদটি ও তার অধিবাসীরা আত বিনাশের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং তাদের মধ্যে সত্যিকারের ধর্মীয় জীবন ফিরে আসে।
তাই বলা যায়, যোনা ভাববাদী যেমন তার পরীক্ষাকালে প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত বেঁচেছিলেন এবং কখনও প্রাণত্যাগ করেননি, তেমনি যীশুও তার পরীক্ষাকালে বেঁচেছিলেন এবং একমুহূর্তের জন্যও প্রাণত্যাগ করেননি। তাছাড়া, যোনা ভাববাদীকে যেরূপ চিহ্ন দেয়া হয়েছিল, মনুষ্য-পুত্র যীশুকে সেরূপ চিহ্ন দেয়া হবে। এছাড়া, আর কোন চিহ্নই দেয়া হবে না বলে যীশু নিজেই দৃঢ়তার সাথে ধর্মগুরু ও ফরীশীদের কাছে প্রকাশ্যভাবেই ঘোষণা করেন। সুতরাং, বাইবেলে বর্ণিত যীশুর ঘোষণানুসারে তাঁর ক্রুশে নিহত হওয়ার বিবরণটি মিথ্যে বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে।
২। বাইবেলের বর্ণনানুসারে জানা যায়, ইহুদী প্রধানরা যীশুর বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছিল এবং তার প্রাণবধ করাই ছিল এই ষড়যন্ত্রের মুখ্য উদ্দেশ্য। এই ষড়যন্ত্র ক্রমশ সফলতার দিকে এগিয়ে চলছে দেখে যীশু অত্যন্ত বিচলিত হতে থাকেন। যীশুর এই চঞ্চলতাকে অনেকেই তার স্বাভাবিক মানবীয় দুর্বলতা বলে বর্ণনা করেছেন। মনুষ্য-পুত্রের’র মধ্যে সাধারণত অনেকসময় মানবীয় দুর্বলতা সঞ্চারিত হওয়া আদৌ অসম্ভব নয়। যদিও আল্লাহর নবীদের কথা আলাদা। যীশু বিচলিত হয়ে পড়ে বাইবেলের সাক্ষ্যানুসারে এটা সত্য কথা।
কিন্তু আল্লাহর তরফ থেকে নবুওয়াতের ভারপ্রাপ্ত রসূলের মনে এমন বিব্রতকর অবস্থায় অথবা অন্যকোন মহৎ কারণেও এ ধরনের একটি হতাশার সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। যীশু দেখছিলেন:
(১) অচিরেই তাঁর পার্থিব জীবনের অবসান হতে যাচ্ছে, অথচ তার নবুওয়াতের মিশন এখনও সম্পূর্ণভাবে অসমাপ্ত রয়ে গেছে; ইস্রায়ীলের হারিয়ে যাওয়া বাকী গোত্রগুলো সম্পর্কে কোনপ্রকার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা তখনও তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি; কারণ, তার আগমনের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল বনি-ইস্রায়ীলের হারিয়ে যাওয়া গোত্রগুলোকে খুঁজে বের করা; অথচ,
(২) ক্রুশে নিহত করে ইহুদীরা তাঁকে অভিশপ্ত বলে প্রমাণ করতে চাচ্ছে। মনে হয়, এ দুটো কারণেই যীশুর মনে এই চাঞ্চল্যের উদ্রেক হয়েছিল।
যাহোক, চরম বিপদের সম্মুখীন হয়ে যোনা ভাববাদী যেমনই কাতরকণ্ঠে সদাপ্রভুকে উদ্ধারের জন্য ডেকেছিলেন, যীশুও তেমনি বিপদ-মুক্তির জন্য সদা প্রভুকে আকুলকণ্ঠে ডাকলেন–তাঁর হুজুরে প্রার্থনা জানালেন:
“প্রার্থনা কর, তোমাদের দেয়া হবে; অন্বেষণ কর, পাবে, দ্বারে করাঘাত কর, তোমাদের জন্য খুলে দেয়া হবে। কারণ, যে কেউ প্রার্থনা করে সে গ্রহণ করে; যে অন্বেষণ করে সে পায়; যে দ্বারে করাঘাত করে তার জন্য দ্বার খুলে যায়।” (মথি, ৭: ৭-৮)।
পরে কিছুদূর এগিয়ে তিনি ভূমিতে পড়ে প্রার্থনা করলেন : যদি সম্ভব হয়, তবে যেন সেই মুহূর্ত তার নিকট থেকে দূরে চলে যায়। তিনি বললেন, আব্বা, পিতঃ, তোমার পক্ষে সবই সম্ভব। এ পান পাত্র আমার নিকট থেকে দূর কর, কিন্তু আমার ইচ্ছানুসারে নয়, তোমার ইচ্ছানুসারে হোক।” (মার্ক, ১৪ : ৩৫-৩৬)।
“তিনি আবার দ্বিতীয়বার গিয়ে প্রার্থনা করলেন, পিতা আমার, আমি পান না করলে যদি ইহা দূর না হতে পারে, তবে তোমার যা ইচ্ছা তাই হোক।” (মথি, ২৬ : ৪২)।
যেকোন কারণেই হোক, নিজের প্রাণরক্ষার জন্য যীশু বারবার আল্লাহ’র দরবারে কাতরকতে আবেদন জানাতে থাকেন। “তখন স্বর্গ থেকে এক দূত দেখা দিয়ে তাকে সবল করলেন। মর্মান্তিক যন্ত্রণায়, তিনি আরও একান্তভাবে প্রার্থনা করলেন তাঁর ঘাম রক্তের ফোঁটার মত হয়ে মাটিতে পড়তে লাগল।” (লুক, ২২ : ৪৩-৪৪)।
সুসমাচার রচয়িতার বর্ণনানুসারে, যীশুর অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে দাঁড়ায় যে, “তার ঘাম রক্তের ফোঁটার মত মাটিতে ঝরতে লাগল।” যীশুর মৃত্যুভয় ও তাঁর অতিমাত্রার চাঞ্চল্য সম্বন্ধে সুসমাচার রচয়িতাদের কিছু অতিরঞ্জন থাকুক বা-না-থাকুক, তাদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, আল্লাহর নেক বান্দাদের মত যীশুও এক সর্বশক্তিমান ও সর্বমঙ্গলময় সদাপ্রভু-পরোয়ারদিগারে সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করতেন এবং তিনি যে তার সকল প্রার্থনা গ্রহণ করেন এ বিশ্বাস তিনি দৃঢ়তার সাথে পোষণ করতেন, আর শিষ্যদের কাছেও তিনি তা প্রকাশ করতেন। একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি সদাপ্রভুকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলছেন :