.
৮.
মেয়েটির প্রতি তার শত প্রেমাবেগ থাকা সত্ত্বেও একদিন একটি ঘটনায় তার আরসুলার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে মেরিয়াস। একদিন মঁসিয়ে লেবলাঁ তার মেয়ের সঙ্গে বেঞ্চ থেকে উঠে পায়চারি করছিল বাগানের পথে। তখন জোর বাতাস বইতে থাকায় গাছের মাথাগুলো নুইয়ে পড়ছিল। বাবা আর মেয়ে হাতধরাধরি করে হাঁটতে হাঁটতে মেরিয়াসের বেঞ্চের কাছে এসে পড়ায় মেরিয়াস আবেগের বশে উঠে পড়ে তাদের দিকে তাকাতে থাকে।
সহসা একঝলক জোর দমকা বাতাস মেয়েটির পোশাকগুলোকে এলোমেলো করে দিল এবং মেয়েটি তখন ব্যস্ত হয়ে তার জামার উড়ন্ত আঁচলগুলোকে ঠিক করে নিতে লাগল। কেউ তখন তাকে না দেখলেও সে ভাবছিল কেউ তার অনাবৃত পাদুটোকে দেখেছে। তার অনাবৃত পায়ের লাবণ্য ঈর্ষার আগুন ধরিয়ে দিল যেন মেরিয়াসের মধ্যে। তার ওপর তার প্রতি মেয়েটির ঔদাসীন্য আর অনাগ্রহ দেখে রাগ হচ্ছিল তার। প্রথমে তারা মেরিয়াসের বেঞ্চটার সামনে দিয়ে পথটার অন্য প্রান্তে চলে গেল। তার পর সেই পথেই আবার ফিরতে লাগল। ফেরার সময় তারা আবার মেরিয়াসের সামনে এসে পড়ল। মেয়েটি কাছে আসতেই তার মুখপানে এমন ভ্রুকুটিকুটিল দৃষ্টিতে তাকাল যাতে কিছুটা চমকে উঠল মেয়েটি। তার চোখের পাতাগুলো এমনভাবে কাঁপতে লাগল তাতে মনে হল সে বলতে চাইছে, কী হল তার?
এই যেন তাদের চোখে-চোখে প্রথম ঝগড়া।
তাদের এই দৃষ্টি বিনিময়পর্ব শেষ হতে না হতেই সেখানে এক অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ সৈনিক পঞ্চদশ লুই-এর ধরনের পোশাক পরে বাগানের সেই পথটায় এসে হাজির হল। যুদ্ধে একটা পা তার গেছে এবং সে পা-টা কাঠের তৈরি। মাথার চুল সব পাকা। সেন্ট লুই ক্রস পুরস্কারের ব্যাজ আছে জামার উপর। লোকটাকে দেখে মেরিয়াসের মনে হচ্ছিল সে যেন নিজের অবস্থায় তৃপ্ত এবং গর্বিত। কিন্তু তার এই তৃপ্তি বা গর্বের কারণটা কী, তা বুঝতে পারল না মেরিয়াস। তার মনে হল লোকটা কি তবে তাদের দৃষ্টিবিনিময়ের ব্যাপারটা দেখে ফেলেছে! তার ঈর্ষাকাতর মনটা আরও বেশি ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠল।
কিন্তু কালক্রমে আরসুলার ওপর রাগ কমে গেল মেরিয়াসের। তাকে সে ক্ষমা করল মনে মনে। তবে এর জন্য তাকে চেষ্টা করতে হয়েছিল এবং তিন দিন ধরে সে এই দুঃখটা মনে মনে লালন করে রেখেছিল।
এ সব সত্ত্বেও আবার অনেকটা এইজন্যই মেয়েটির প্রতি তার আসক্তিটা বেড়ে গেল।
.
৯.
মেরিয়াসের মনে হল মেয়েটির নাম সে জানতে পেরে গেছে এবং সে নাম হল আরসুলা। কিন্তু নাম জানাটাই সব নয়, যথেষ্ট নয়। তার ভালোবাসার ক্ষুধাটা বেড়ে যেতে লাগল দিনে দিনে। এই নাম জানার তৃপ্তিটা কয়েক সপ্তার মধ্যে সব ক্ষয় হয়ে গেল এবং সে আরও কিছু জানতে চাইল। সে জানতে চাইল মেয়েটি কোথায় থাকে।
দুটো ভুল আগেই করেছিল মেরিয়াস। প্রথম ভুল হল এই যে মঁসিয়ে লেবলাঁ তার মেয়েকে নিয়ে আগের বেঞ্চ ছেড়ে অন্য বেঞ্চে গিয়ে বসলেও সে তাদের কাছে সরে গেছে। এর দ্বারা তার মনোভাব বুঝতে পেরে গেছে মঁসিয়ে লেবলাঁ। মেরিয়াসের দ্বিতীয় ভুল হল এই যে মঁসিয়ে লেবলাঁ যেদিন একা আসত বাগানে অর্থাৎ তার মেয়েকে সঙ্গে আনত না সেদিন আসার সঙ্গে সঙ্গে বাগান থেকে চলে যেত মেরিয়াস। এরপর মেয়েটি কোথায় থাকে তা জানতে গিয়ে এক অসংযত কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে সে আর একটা ভুল করে বসেছে।
সে দেখল মেয়েটি থাকে র্যু দ্য লা কোয়েস্ট অঞ্চলে। বড় রাস্তার শেষ প্রান্তে এক শান্ত পরিবেশে অবস্থিত তাদের বাড়িটা দেখতে সত্যিই সুন্দর। সে ভাবল তাদের বাড়িটা আবিষ্কার করতে পারার ফলে তাকে দেখার আনন্দটা বেড়ে যাবে। বাগানে মেয়েটিকে দেখার পরেও সে তাদের বাড়ির কাছে গিয়ে তার পাশ থেকে তাকে দেখতে পারবে। তার নামের প্রথম পদটা সে জানতে পেরেছে। তার নামটা বড় সুন্দর। সে কোথায় থাকে তা-ও জানতে পেরেছে। এবার তাকে জানতে হবে সে কী করে, তার পরিচয় কী।
একদিন সন্ধ্যার সময় মেয়েটির পিছু পিছু গিয়ে মেরিয়াস দেখল তারা পোর্তে কশেরে নামে একটা হোটেলে গিয়ে উঠল। মেরিয়াসও হোটেলে গিয়ে দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করল, যে ভদ্রলোক এইমাত্র ঢুকলেন তিনি কি দোতলায় থাকেন?
দারোয়ান বলল, না মঁসিয়ে। তিনি থাকেন চারতলায়।
চারতলার সামনের দিকে।
গোটা বাড়িটাই তো রাস্তার দিকে। সামনেই বড় রাস্তা।
তিনি কী ধরনের মানুষ?
ব্যক্তিগত আয়ের ওপর তার চলে। ভদ্রলোক সরল অন্তঃকরণের লোক। তিনি গরিবদের যথাসাধ্য সাহায্য করেন, যদিও তিনি নিজে ধনী নন।
মেরিয়াস বলল, ভদ্রলোকের নাম কী?
দারোয়ান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেরিয়াসের দিকে তাকাল। বলল, মঁসিয়ে কি পুলিশের লোক?
এ কথায় চুপ করে গেল মেরিয়াস। তবু সে খুশি হয়ে ভদ্রলোক সম্বন্ধে খোঁজখবর দিতে লাগল।
পরদিন অল্প কিছুক্ষণের জন্য লুক্সেমবুর্গ বাগানে এল মঁসিয়ে লেবলাঁ। তার মেয়েও সঙ্গে ছিল। কিন্তু সন্ধ্যার আগেই চলে গেল। মেরিয়াস তাদের পিছু পিছু হোটেল পর্যন্ত গেল। কিন্তু মেয়েটিকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে মঁসিয়ে লেবলাঁ দরজা থেকে ফিরে অন্যত্র চলে গেল। যাবার সময় মেরিয়াসের দিকে একবার কড়াভাবে তাকাল।
পরদিন মঁসিয়ে লেবলাঁ তার মেয়েকে নিয়ে লুক্সেমবুর্গ বাগানে গেল না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর হোটেলে চলে গেল মেরিয়াস। মেরিয়াস গিয়ে দেখল তাদের ঘরে আলো জ্বলছে। হোটেলের বাইরে পায়চারি করতে লাগল সে। মঁসিয়ে লেবলাঁ’র ঘরে আলোটা নিবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেরিয়াস চলে গেল।