লে মিজারেবল

০. ভূমিকা : লে মিজারেবল

লে মিজারেবল –ভিক্টর হুগো / অনুবাদ –সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ
LE MISEREB Bengali translation of the French historical novel “Les Miserables” by Victor Hugo Translated from English by Sudhanshu Ranjan Ghosh

.

ভূমিকা

প্রায় দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে লিখিত ভিক্টর হুগোর ‘লে মিজারেবল’ (১৮৪৫-৬২)। উপন্যাসখানি আয়তনের বিশালতায়, চরিত্রচিত্ৰনের বৈচিত্র্যে ও গভীরতায়, কাহিনীগত রূপকল্পনার সুউচ্চ উতুঙ্গতায়, ঘটনা সমাবেশের সুবিপুল সমারোহে ও কেন্দ্রগত যোগসূত্রের অবিচ্ছিন্ন গ্রন্থনৈপুণ্যে শুধু পাশ্চাত্য জগতের কথাসাহিত্যে নয়, সারা বিশ্বের কথাসাহিত্যের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টি হিসেবে কালোত্তীর্ণ মহিমায় মূর্ত ও অধিষ্ঠিত হয়ে আছে আজও। একমাত্র লিও টলস্টয়ের সুবৃহৎ ও প্রায় সমআয়তনবিশিষ্ট উপন্যাস ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ হুগোর ‘লে মিজারেবল’-এর সঙ্গে বিভিন্ন দিক থেকে এক তুলনীয় মর্যাদার দাবি করতে পারলেও উপন্যাস আর্টের গৌরব, গভীরতা ও শিল্পসৌকর্ষের দিক থেকে ‘লে মিজারেবল’ যে আরও উন্নত ধরনের সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

ফরাসি ভাষায় ‘লে মিজারেবল’ কথাটির শব্দগত অর্থ ‘দীন-দুঃখীরা’ হলেও লেখক ঊনবিংশ শতাব্দীর ফ্রান্সের সাম্রাজ্যতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের অধীনে সমাজের নিচতলার সেসব মানুষের এক সকরুণ জীবনকাহিনীর চিত্র এঁকেছেন, দুঃখ-দৈন্যের অভিশাপে বিকৃত যাদের জীবনচেতনা দারিদ্র্যসীমার শেষ প্রান্ত পার হয়ে ন্যায়নীতির সব জ্ঞান হারিয়ে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা আর অপরাধপ্রবৃত্তির অতল অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে যায়। জনদ্ৰেত্তে নামধারী থেনার্দিয়ের ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। তাদের মধ্য দিয়ে লেখক দেখিয়েছেন, দারিদ্র্যের অভিশাপজনিত মানুষের দেহগত ও মনোগত বিকৃতি তাদের প্রকৃতিকে এমন এক পাশবিক হিংস্রতা দান করে, যা তাদের সমস্ত প্রাণ-মন ও কর্মপ্রবৃত্তিকে শুধু অস্তিত্বরক্ষার এক সর্বাত্মক ও প্রাণবন্তকর প্রয়াসের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করে।

কোনও কোনও সমালোচকের মতে ‘লে মিজারেবল’ উপন্যাসের মূল কাহিনী বা আখ্যানবস্তু ও অজস্র উপকাহিনী আর চরিত্রগুলোর মধ্যে কেন্দ্রগত ঐক্য রক্ষিত হয়নি। দিগনের যে বৃদ্ধ বিশপ মিরিয়েল বা বিয়েনভেনু’র জীবন-কাহিনী নিয়ে এ গ্রন্থের শুরু, সেই বিশপের জীবন যত পুণ্যময়ই হোক না কেন, মূল কাহিনীর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে খ্রিস্টীয় জীবনচৈতন্য ও নীতিবোধের চূড়ান্ত আদর্শটিকে বিশপ মিরিয়েলের মধ্যে রূপায়িত করে তুলতে চেয়েছেন লেখক, বিশপের মৃত্যু হলেও সে আদর্শের মৃত্যু হয়নি। তাঁর অবিনশ্বর অমিতপ্ৰভব আত্মার আলো তাঁর প্রদত্ত দুটি রুপোর বাতিদানের মধ্যে এক শুচিশুভ্র অধ্যাত্মচেতনায় মূর্ত হয়ে উঠে নায়ক ভল’র আত্মিক সংকটের মধ্যে সারাজীবন তাকে পথ দেখিয়ে এসেছে। বিশপের আত্মিক উপস্থিতির প্রতীকস্বরূপ এই বাতিদান-দুটিকে সযত্নে নিজের কাছে। রেখে সারাজীবন বয়ে নিয়ে গেছে সে, একটি দিনের জন্যও তার প্রভাবকে সে অস্বীকার করতে বা এড়িয়ে যেতে পারেনি। এই দুটি বাতিদানের মধ্যে জ্বলতে থাকা মোমবাতির আলো তার মৃত্যুকালে তার মুখের উপর পড়ে এবং সে আলোর জ্যোতি মৃত্যুর অন্ধকার মহাসমুদ্রের উপর দিয়ে তার আত্মাকে পার করে নিয়ে যায় স্বর্গলোকের পথে। ওয়াটার লু যুদ্ধের যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ এ উপন্যাসে সংযোজিত হয়েছে, তা পাঠকদের কাছে ক্লান্তিকর ও অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও ইউরোপ ও বিশ্বের ইতিহাসে এ যুদ্ধের গুরুত্ব এবং নেপোলিয়ঁনের চরিত্র ও তার শেষ পরিণতির যে ব্যাখা দান করেছেন লেখক, তা সত্যিই বিস্ময়কর। তাছাড়া এ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র মেরিয়াসের পিতা কর্নেল মতপার্সি এই যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এবং তাকে মৃত্যুর কবল থেকে উদ্ধার করে অন্যতম চরিত্র থেনার্দিয়ের মেরিয়াসের মনে যে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব আনে, কাহিনীর মধ্যে তার একটি সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য আছে।

উপন্যাসের নায়ক জাঁ ভলজাঁ’র মতো এমন বিবর্তনধর্মী চরিত্র সারা বিশ্বসাহিত্যের মধ্যে বিরল। সে তার জীবনের চারটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এমন চারটি চরিত্রের সংস্পর্শে আসে, যারা তার আত্মিক সংকটকে ঘনীভূত করে তুলে তার জীবনের মোড় ফিরিয়ে দেয়। এই চারটি চরিত্র হল বৃদ্ধ বিশপ মিরিয়েল, ইনসপেক্টার জেভার্ত, ফাঁতিনের মেয়ে কসেত্তে আর তার প্রেমিক যুবক মেরিয়াস।

যে সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রে চোর ও অপরাধীদের জন্য নির্মম শাস্তির বিধান আছে, অথচ গরিবদের রুজিরোজগার ও অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা নেই, উনিশ বছরের কারাদণ্ড শেষে জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর সেই নিষ্ঠুর সমাজ ও রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে এক চরম ঘৃণা আর বিদ্রোহাত্মক প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়ে যখন ভলজাঁ’র সমগ্র অন্তরাত্মা, তখন বিশপ মিরিয়েলের অহেতুক এবং অপরিসীম দয়া সমস্ত বিদ্রোহের বিষ ও ঘৃণার গরল নিঃশেষে অপসারিত করে তার মন থেকে, হতাশা আর মৃত্যুর অন্ধকারের মাঝে এক

সৃষ্টিশীল আশাবাদে তাকে সঞ্জীবিত করে এক মহাজীবনের পথ দেখিয়ে দেয় তাকে। এরপর সমাজের আইন-শৃঙ্খলার প্রতিভূ কর্তব্যপরায়ণ ও নীতিবাদী ইনসপেক্টার জেভাৰ্ত আসে তার জীবনে। মন্ত্রিউল-সুর-মের অঞ্চলে কাঁচের কারখানার মালিক হিসেবে প্রভূত ধনসম্পদ ও যশমান অর্জন করে এবং সেখানকার মেয়র হয়ে ভলজাঁ যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন একদিন জেভার্ত এসে তাকে বলে শ্যাম্পম্যাথিউ নামে একটি লোকের কথা, যাকে জাঁ ভলজাঁ ভেবে সেইসব অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হচ্ছে যেসব অপরাধে ভলজাঁ নিজে অপরাধী। ফলে আবার এক আত্মিক সংকটের সম্মুখীন হয় ভলজাঁ। সে ভাবতে থাকে, ক্রমবর্ধমান সম্পদ ও সম্মানে পরিপূর্ণ আপাতস্বর্গসুখসমৃদ্ধ তার বর্তমান জীবনে প্রতিষ্ঠিত থেকে তিলে তিলে মৃত্যু তথা নরকযন্ত্রণা ভোগ করে যাবে, না শ্যাম্পম্যাথিউকে মুক্ত করে তার জায়গায় ধরা দিয়ে জেলে গিয়ে নরক ভোগ করতে করতে এক চরম আত্মতৃপ্তির অতিসূক্ষ্ম এক স্বর্গসুখের সুবাসিত সুষমায় বিভোর হয়ে থাকবে মনে মনে। অবশেষে আবার স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে কারাদণ্ড ভোগ করে সে। তার পর কয়েদি হিসেবে একটি জাহাজে কাজ করার সময় একটি বিপন্ন লোককে বাঁচাবার পর জাহাজ থেকে পড়ে গিয়ে সাঁতার কেটে পালিয়ে যায় ভলজাঁ। ঘটনাসূত্রে উপস্থিত লোকরা ভাবে সে সমুদ্রে ডুবে মারা গেছে। এরপর সে মঁতফারমেলে গিয়ে ফাঁতিনের অন্তিম ইচ্ছা পূরণের জন্য তার মেয়ে কসেত্তেকে থেনার্দিয়েরের হোটেল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এই কসেত্তের আবির্ভাবই ভল’র জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তার আশ্রয়হীন আত্মীয়স্বজনহীন উষর মরুজীবনে শিশু কসেত্তেই নিয়ে আসে সবুজ সজল এক আশ্বস, যে আশ্বাস থেকে ভলজাঁ’র শুষ্ক সতৃষ্ণ অন্তরবৃত্তিগুলো তাদের প্রাণরস আহরণ করে আশান্বিত ও উধ্বায়িত হয়ে উঠতে থাকে এক নতুন আশায়। জীবনের এক নতুন অর্থ ও মূল্যবোধ খুঁজে পায় সে কসেত্তের মধ্যে। একাধারে পিতা, ভ্রাতা ও স্বামীর সমন্বিত স্নেহ ভালোবাসার সুতো দিয়ে এমন এক জটিল ও দুচ্ছেদ্য সম্পর্ক জাল রচনা করে কসেত্তেকে ঢেকে রাখে, যে জাল ছিন্ন করে পৃথিবীর কোনও শক্তি কোনওদিন তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না তার জীবন থেকে। তাই সে যখন জানতে পারল। মেরিয়াস নামে এক যুবককে ভালোবাসে কিশোরী কসেত্তে, তখন এক নীরব নিরতিশয় মর্মবেদনার আঘাতে তার অন্তরাত্মার ভিত্তিমূলটি কেঁপে উঠল। তবে আবার সে যখন দেখল বিপ্লবী যুবক মেরিয়াস ব্যারিকেডে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং তার মৃত্যু অবধারিত তখন সে কসেত্তের কথা ভেবেই নিজে ব্যারিকেডে গিয়ে আহত অচেতন মেরিয়াসকে ব্যারিকেড থেকে উদ্ধার করে তার মাতামহ মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের বাড়িতে নিয়ে আসে। সহসা কসেত্তের প্রতি ভলজাঁ’র সর্বগ্রাসী সর্বাত্মক স্বার্থান্ধ ভালোবাসা আত্মত্যাগের এক বিরল মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠে কসেত্তেকে স্বেচ্ছায় তুলে দেয় মেরিয়াসের হাতে। তার সঙ্গে যৌতুক হিসেবে দেয় তার সারাজীবনের সব সঞ্চিত অর্থ। সেই সঙ্গে তাদের সুখের সংসারে থেকে বাকি জীবনটা অনাবিল শান্তিতে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য কসেত্তে ও মেরিয়াসের কাছ থেকে এক সাদর আহ্বান আসে ভলজাঁ’র কাছে। এই আহ্বানই আবার এক চরম আত্মসংকট নিয়ে আসে ভলজাঁ’র জীবনে এবং তার শেষ পরিণতিকে ত্বরান্বিত করে তোলে। একদিকে ন্যায় আর সত্যভিত্তিক আত্মত্যাগ, অন্যদিকে মিথ্যা আর প্রতারণাভিত্তিক জীবনের ভোগ-উপভোগ। ভলজাঁ’র জীবনে এই হল শেষ আত্মিক সংকট এবং এ সংকটে ন্যায় ও সত্যের খাতিরে চরম আত্মত্যাগ, আত্মনিগ্রহ ও স্বেচ্ছামৃত্যুর পথে ধীরে ধীরে নিজেকে ঠেলে দেয় ভলজাঁ। এইভাবে একে একে তার জৈবজীবনের সব কামনা-বাসনাকে জয় করে চরম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে পরম আত্মোপলব্ধির সর্বোচ্চ শিখরে উঠে গিয়ে মৃত্যুহীন এক মহাজীবনের দিগন্তবিসারী আলোকমালাকে উদ্ভাসিত দেখতে পায় সে তার চোখের সামনে।

ভলজাঁ ও বিশপ মেরিয়েল ছাড়া যে কয়টি চরিত্র রেখাপাত করে আমাদের মনে সেগুলো হল নিঃসীম অভাব আর অর্থলোলুপতার দ্বারা নিয়ত তাড়িত থেনার্দিয়ের, কর্মফলাকাঙ্ক্ষাহীন উদাসীন মেবুফ, উগ্র আভিজাত্যবোধ ও রাজনৈতিক মতবাদ আর স্নেহমমতাকেন্দ্রিক হৃদয়বৃত্তির দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ, মেরিয়াসের প্রতি অতৃপ্ত ও আত্মঘাতী প্রেমের আগুনে জ্বলতে থাকা পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া এপোনিনে আর তুলনাহীন বালকচরিত্র গাভ্ৰাশে। তার আত্মা যেন জীবন ও মৃত্যুর থেকে অনেক বড়। সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের মাঝে নাচগানের মধ্য দিয়ে মৃত্যুকে পরিহাস করতে করতে যেভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নেয় সে, একই সঙ্গে মৃত্যুকে জয় করে আবার পরাজিত হয়ে এবং পরিশেষে সমস্ত জয়-পরাজয়ের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে সেই আত্মার বিজয়গৌরব যেভাবে ঘোষণা করে, তা দেখে আমরা বিস্ময়ে অভিভূত না হয়ে পারি না।

‘লে মিজারেবল’ যেন উপন্যাস নয়, অর্ধশতাব্দীকালীন এক জাতীয় জীবনের জয়পরাজয়, উত্থানপতন, সুখদুঃখ ও আশা-আকাঙ্ক্ষাসংবলিত এক মহাকাব্য। মহত্তর কোনও সৃষ্টির গৌরব এই অনন্যসাধারণ উপন্যাসের কালোত্তীর্ণ মহিমাকে খর্ব করতে পারেনি আজও।

১.১ বিশপ পদ লাভ

১.১ প্রথম খণ্ড –প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮১৫ সালে মঁসিয়ে শার্লস ফ্রাঁসোয়া বিয়েনভেনু মিরিয়েল যখন দিগনের বিশপ হন তখন তার বয়স প্রায় পঁচাত্তর। ১৮০৬ সাল থেকে এই বিশপের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি।

যে কাহিনী আমি বলতে যাচ্ছি তার সঙ্গে এই ঘটনার কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকলেও তার বিশপ পদ লাভের সময় তাকে কেন্দ্র করে যেসব গুজব রটে, তার কিছু বিবরণ আমাকে অবশ্যই দিতে হবে। কোনও মানুষ সম্বন্ধে লোকমুখে যেসব গুজব শোনা যায়, তার কীর্তিকলাপের মতো এইসব গুজব বা জনশ্রুতিরও একটা বড় রকমের প্রভাব দেখা যায় তার জীবন ও ভাগ্যে। মঁসিয়ে মিরিয়েল ছিলেন আইকস পার্লামেন্টের কাউনূসেলার ও নোবলেসি দ্য রোব-এর সদস্যের পুত্র। শোনা যায় তার বাবা তার মৃত্যুর পর তাঁর পদে যাতে অধিষ্ঠিত হতে পারে তার জন্য ছেলের অল্প বয়সে অর্থাৎ আঠারো থেকে কুড়ি বছরের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করেন তার। পার্লামেন্টের সদস্যদের পরিবারে এই ধরনের প্রথাই প্রচলিত ছিল সেকালে। কথিত আছে এই বিয়ে সত্ত্বেও শার্লস মিরিয়েলকে কেন্দ্র করে অনেক গুজবের সৃষ্টি হয়। তার চেহারাটা বেঁটেখাটো হলেও তিনি বেশ সুদর্শন ছিলেন। প্রথম যৌবনে তিনি বিয়ে করে সংসারী হন এবং যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করেন।

তার পর ফরাসি বিপ্লব শুরু হতেই পার্লামেন্টের সদস্যদের পরিবারগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং মিরিয়েল দেশ ছেড়ে ইতালিতে চলে যান এবং সেখানে গিয়ে নতুনভাবে বসবাস করতে থাকেন। তাঁর স্ত্রী এই সময় বুকের গোলমালে ভুগে মারা যান। তাঁদের কোনও সন্তানাদি ছিল না। যাই হোক, এই বিপ্লবের পর কী ঘটল মিরিয়েলের জীবনে

তবে কি তার আপন পরিবার ও পুরনো ফরাসি সমাজব্যবস্থায় ব্যাপক ভাঙন, বিদেশ থেকে দেখা দেশের মধ্যে ঘটে যাওয়া ১৭৯৩ সালের মর্মান্তিক ঘটনাবলি এক বৈরাগ্যবাসনা আর নিঃসঙ্গতার প্রতি প্রবণতা জাগিয়ে তোলে? যেসব বিক্ষুব্ধ ঘটনাবলির উত্তাল তরঙ্গমালা তাঁর জীবনের বহিরঙ্গের ওপর আঘাত হেনে চলেছিল ক্রমাগত সেই আঘাত হয়তো তাঁর মধ্যে সঞ্চার করেছিল এক রহস্যময় জীবনবিমুখতা, যা তাঁর স্বভাবটাকে একেবারে পাল্টে দিয়ে পাহাড়ের মতো এমন এক উতুঙ্গ প্রশান্তি দান করে, যার ফলে জীবনের সকল ঝড়ঝঞ্ঝা ও দুঃখবিপর্যয়ের মাঝে অটল ও অবিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু এমন কথা কেউ ঠিকমতো বলতে পারে না। তার সম্বন্ধে শুধু এইটুকুই জানান যায় যে ইতালি থেকে দেশে ফিরে এসেই তিনি যাজকের পদ গ্রহণ করেন।

১৮০৪ সালে মিরিয়েল ব্রিগনোলের পল্লি গির্জার যাজক হন এবং সেখানে এক নির্জন পরিবেশের মধ্যে বসবাস করতে থাকেন।

সম্রাট নেপোলিয়ঁনের রাজ্যাভিষেকের সময় মিরিয়েলকে তাঁর গির্জার কিছু কাজের ব্যাপারে একবার প্যারিসে যেতে হয়। এই সময় যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, সম্রাটের কাকা কার্ডিনাল ফ্রেস্ক তাদের অন্যতম। একদিন তিনি যখন কার্ডিনালের ঘরের বাইরে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তখন সম্রাট নেপোলিয়ঁন তাঁর কাকার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন তার ঘরে। ঘরে যাওয়ার পথে নেপোলিয়ঁন মিরিয়েলকে তাঁর পানে সশ্রদ্ধভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করেন, কে আপনি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন?

মিরিয়েল উত্তর করেন, মহাশয়, আমার মতো একজন অতিসাধারণ ব্যক্তি আপনার মতো এক মহান ব্যক্তির পানে তাকিয়ে আছে। এতে হয়তো আমরা উভয়েই উপকৃত হতে পারি।

সেদিন সন্ধ্যায় ম্রাট নেপোলিয়ঁন কার্ডিনালকে মিরিয়েলের কথা জিগ্যেস করেন। তার কিছু পরেই একথা জানতে পেরে আশ্চর্য হয়ে যান মিরিয়েল যে তিনি দিগনের বিশপ পদে নিযুক্ত হয়েছেন।

মঁসিয়ে মিরিয়েলের বাল্যজীবন সম্বন্ধে কেউ কিছু জানত না বা জোর করে কোনও কিছু বলতে পারত না। ফরাসি বিপ্লবের আগে তাঁর পরিবার সম্বন্ধে যারা সব কিছু জানত তাদের কেউ ছিল না তখন। একটা সামান্য গাঁ থেকে একটা ছোট শহরে আসার পর তাকে নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। অনেকে অনেক কথা বলতে থাকে। কিন্তু পদমর্যাদার খাতিরে সব কিছু সহ্য করে যেতে হয় তাঁকে। তবে তাঁর সম্বন্ধে এইসব চর্চা নিতান্ত অর্থহীন গুজব আর মনগড়া কাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়।

যাই হোক, দিগনের বিশপ হিসেবে আসার পর থেকে বছর কয়েকের মধ্যে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়া সব গুজব আর যত সব গল্পকাহিনী স্তব্ধ হয়ে যায়। সেসব কথা ভুলে যায় সকলে। কেউ কোথাও সেসব কথা আর উল্লেখ করত না।

মঁসিয়ে মিরিয়েল যখন দিগনেতে আসেন তখন তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর অবিবাহিত বোন ম্যাদময়জেল বাপতিস্তিনে আর মাদাম ম্যাগলোরি। ম্যাদময়জেল বাপতিস্তিনে ছিল বিশপ মিরিয়েলের থেকে দশ বছরের ছোট আর ম্যালোরি ছিল বাপতিস্তিনের সহচরী দাসী আর সমবয়সী। ঘরসংসারের যাবতীয় কাজকর্ম সব ম্যাগলোরিই করত।

বিগতযৌবনা ম্যাদময়জেল বাপতিস্তিনের চেহারাটা ছিল বরাবরই লম্বা আর রোগা। যৌবনের কোনও সৌন্দর্য ছিল না তার দেহে। কিন্তু চেহারাটা রোগা হলেও তার চোখে-মুখে এমন এক শান্তশ্রী ছিল, যাতে তাকে এক নজরেই একজন সম্ভ্রান্ত মহিলা বলে মনে হত। সততা আর মহানুভবতার যে একটি নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, বাপতিস্তিনে সারাজীবন জনহিতকর কাজ করে আসার জন্য সেই সৌন্দর্যের একটি স্নিগ্ধ জ্যোতি সব সময় আচ্ছন্ন করে থাকত তার মুখমণ্ডলকে। যৌবনে তার যে দেহটি ছিল শীর্ণ ও অস্থিচর্মসার, প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক স্বচ্ছ উজ্জ্বলতার আধার হয়ে ওঠে সেই শীর্ণ দেহটি। তার চেহারা দেখে যৌবনেই মনে হত সে যেন কোনও কুমারী নারী, এক বিদেহী আত্মা, এক অবয়বহীন ছায়া, যে ছায়া থেকে সব সময় বিচ্ছুরিত হতে থাকে এক আশ্চর্য জ্যোতি। তার বড় বড় আয়ত দুটি চোখের দৃষ্টি সব সময় অবনত থাকত মাটির উপর। মনে হত তার আত্মা মাটির পৃথিবীতেই বিচরণ করে বেড়ায় সদাসর্বদা।

বিশপ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে দিগনেতে আসার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি বিধান অনুসারে প্রচুর সম্মান পেতে থাকেন মিরিয়েল। পদমর্যাদার দিক থেকে তিনি ছিলেন ফ্রান্সের সেনানায়কের নিচেই। তিনি দিগনেতে আসার পর যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি তার সঙ্গে দেখা করেন তারা হলেন মেয়র আর কাউনসিলার প্রেসিডেন্ট। আর তিনি যাদের সঙ্গে দেখা করেন তাঁরা হলেন প্রধান সেনাপতি আর পুলিশ বিভাগের প্রধান।

তিনি বিশপ পদ গ্রহণ করার পর থেকে তার কাজকর্ম দেখার জন্য উৎসুক হয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগল শহরের লোকেরা।

.

দিগনেতে বিশপের প্রাসাদোপম বাড়িটি ছিল হাসপাতালের পাশেই। আগাগোড়া পাথর দিয়ে গড়া প্রাসাদটি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের ডক্টর পুগেৎ আর দিগনের তদানীন্তন বিশপ সিমুরের অ্যাবটের দ্বারা নির্মিত হয় ১৭১২ সালে। আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যের সব রকম ব্যবস্থাই ছিল প্রাসাদের মধ্যে। সেখানে ছিল বিশপের নিজস্ব কামরা, বসার ঘর, শোবার ঘর আর সামনের দিকে ছিল বিস্তৃত এক উঠোন। উঠোনের চারদিকে ছিল ফুল ও ফলের সুন্দর সুন্দর গাছে ভরা এক বাগান। বাগানের কাছে একতলায় খাবার ঘরটি ছিল যেমন বড় আর তেমনি সুন্দরভাবে সাজানো। ১৭১৪ সালে মঁসিয়ে পুগেৎ এই খাবার ঘরেই কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে এক ভোজসভায় আপ্যায়িত করেন। সেইসব ব্যক্তির মধ্যে ছিলেন ফিলিপ দ্য ভেঁসেম, গ্রাদ প্রিয়র অব ফ্রান্স, চতুর্থ হেনরির প্রপৌত্র আর গ্যাব্রিয়েল দেস্ত্রি। সাতজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তির পূর্ণাবয়ব চিত্র এই ঘরের দেয়ালে টাঙানো ছিল এবং চিত্রগুলোর তলায় মর্মরপ্রস্তরের উপরে সোনার অক্ষরে লেখা ছিল ওই ব্যক্তিদের পরিচয়লিপি।

হাসপাতালের বাড়িটি ছিল দোতলা এবং তার সামনেও একটি বাগান ছিল। তবে বাড়িটা খুব একটা বড়সড় ছিল না।

দিগনেতে আসার পর তৃতীয় দিনে হাসপাতালটা দেখতে যান বিশপ মিরিয়েল। দেখার পর হাসপাতালের ডিরেক্টরকে তার প্রাসাদে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।

খাবার ঘরে বসে ডিরেক্টরকে প্রশ্ন করেন মিরিয়েল, কতজন রোগী আছে হাসপাতালে।

পঁচিশজন মঁসিয়ে।

রোগীর সংখ্যা তো দেখছি অনেক।

রোগীদের বিছানা ও খাটগুলো গাঁয়ে গায়ে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে স্থানাভাবে।

তা তো দেখছি। ওয়ার্ডগুলো এক একটি ছোট ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাতে আলো-বাতাস খেলে না।

হ্যাঁ। ব্যাপারটা তাই।

আবহাওয়াটা উজ্জ্বল থাকলেও একটু সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীদের বাগানে বসার জায়গা থাকে না।

আমারও তাই মনে হয়।

আর কোনও মহামারী দেখা দিলে যেমন এ বছর টাইফাস রোগ মহামারীর আকার ধারণ করে এবং বছর দুই আগে এক মারাত্মক সামরিক জ্বর দেখা দিলে একশো জন রোগীকে সামলাতে হয় আমাদের এই হাসপাতালে। তখন কী যে করব, তা বুঝে উঠতে পারি না।

মিরিয়েল বললেন, আমিও সে কথা ভেবেছি। আচ্ছা, এই ঘরটাতে কতগুলো রোগীর বিছানা ধরতে পারে?

ডিরেক্টর আশ্চর্য হয়ে বললেন, বিশপের খাবার ঘরে?

বিশপ ঘরখানার আয়তন ঘুরে দেখে আপন মনে বললেন, অন্তত কুড়িটা বিছানা ধরবে।

এরপর স্পষ্ট করে বললেন, শুনুন মঁসিয়ে ডিরেক্টর, একটা ভুল হয়ে গেছে। আপনাদের পাঁচ-ছ’টা ছোট ঘরে ছাব্বিশটা রোগী থাকে, অথচ আমাদের এই এত বড় বাড়িতে যেখানে ষাটজন লোক থাকতে পারে সেখানে আমরা মাত্র তিনজন থাকি। এমন অবস্থায় আমরা বরং ওই বাড়িতে চলে যাব আর আপনারা এই বাড়িটা হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করবেন।

পরদিনই বিশপের প্রাসাদে ছাব্বিশজন গরিব রোগী চলে এল আর বিশপ চলে গেলেন হাসপাতালের বাড়িতে।

মঁসিয়ে মিরিয়েলের ব্যক্তিগত কোনও সঞ্চয় ছিল না। বিপ্লবে তাঁর পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। তাঁর বোনের বার্ষিক যে পাঁচশো ফ্রাঁ আয় ছিল, গত এক বছরে সেই আয় নানা পারিবারিক প্রয়োজনে খরচ হয়ে যায়। কারণ সামান্য এক গ্রাম্য যাজক থাকাকালে তার আয় খুব কম ছিল। বিশপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাৎসরিক বেতন পনেরো হাজার ফ্রাঁতে দাঁড়ায়। এই টাকা থেকে সারা বছরে ব্যক্তিগত খরচ হিসেবে মাত্র এক হাজার ফ্রাঁ রেখে বাকি সব টাকা তার এলাকার মধ্যে নানা ধর্মীয় ও জনহিতকর কাজে ব্যয় করার একটি খসড়া তৈরি করেন। তার থেকে বোঝা যায় তার এলাকায় গরিব-দুঃখীদের দুঃখমোচন, গরিব ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নতি, কারাগারের উন্নতি, দুস্থ পরিবারের রোজগারি বন্দিদের মুক্তি, যত সব গ্রাম্য গির্জার ও যাজকদের উন্নতি প্রভৃতির ব্যাপারে তিনি তার আয়ের প্রায় সবটাই খরচ করতেন।

দিগনের গির্জায় মঁসিয়ে মিরিয়েল আসার পর থেকে তার সংসারের আয়-ব্যয় সম্বন্ধে যে ব্যবস্থা করেন তা তাঁর বোন ম্যাদময়জেল বাপতিস্তিনে অকুণ্ঠভাবে মেনে নিতে বাধ্য হন। বাপতিস্তিনের কাছে মিরিয়েল ছিলেন একাধারে বড় ভাই, মহামান্য বিশপ এবং পরম বন্ধু। মিরিয়েলকে তিনি এতই ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন যে বিশপ যখন কোনও কথা বলতেন বা কাজ করতেন তখন তাঁর বোন মাথা নিচু করে তার সব কথা শুনতেন, তার সব কাজ সমর্থন করতেন। একমাত্র ম্যাগলোরি মাঝে মাঝে ক্ষোভ প্রকাশ করত। বিশপের আয়-ব্যয়ের যে খসড়া পাই তার থেকে জানতে পারি তিনি বাইরে তাঁর ব্যক্তিগত খরচের জন্য মাত্র এক হাজার ফ্রাঁ রেখে দিতেন। তাঁর বোনের পাঁচশো ফ্রাঁ বাৎসরিক আয় ছিল। দু জনের মোট পনেরোশো ফ্রাঁ আয়ে তাদের সংসার চালাতে হত।

এই আয়ের মধ্যেই তাদের অতিথিদের আপ্যায়ন করতে হত। দিগনের গির্জায় যখন কোনও গ্রাম্য যাজক যোগদান করতে আসতেন বিশপের সঙ্গে তখন তারা সাধ্যমতো খরচ করে আদর-আপ্যায়ন করতেন।

দিগনেতে আসার তিন মাস পরে বিশপ একদিন বাড়িতে বললেন, এখনও আমার অর্থের টানাটানি চলছে।

ম্যাগলোরি বলল, আমারও তাই মনে হয়। মঁসিয়ে সরকারের কাছে আপনার ভ্রমণকার্যের জন্য যানবাহন খরচ বাবদ কিছু অর্থের জন্য আবেদন করতে পারেন।

বিশপ বললেন, ঠিক বলেছ ম্যাগলোরি।

সত্যি সত্যিই সরকারের কাছে আবেদন জানালেন বিশপ। কিছুদিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে বিশপের যানবাহন ও ডাকখরচের জন্য বাৎসরিক তিন হাজার ফ্ৰাঁ মঞ্জুর করলেন।

এই অর্থ মঞ্জুরির ব্যাপারটা শহরের বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে এক আলোড়ন সৃষ্টি করল। এক চাপা প্রতিবাদের গুঞ্জনধ্বনি শোনা যেতে লাগল অনেক জায়গায়। সম্রাটের কাউন্সিলার একজন সিনেটার মন্ত্রীর কাছে এর প্রতিবাদ জানিয়ে এক চিঠি লিখলেন। তিনি লিখলেন, যানবাহন খরচ? যে শহরে চার হাজারেরও কম লোক বাস করে সেখানে আবার যানবাহন খরচ কিসের? ডাকখরচ আর গ্রামযাত্রাই-বা কিসের? গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াবারই-বা কী দরকার? পার্বত্য অঞ্চলে যেখানে কোনও রাস্তাঘাট বা যাতায়াত ব্যবস্থা নেই সেখানে গাড়িতে করে নিয়মিত চিঠি বিলি করার কীই-বা প্রয়োজন? লোকে ঘোড়ায় চড়ে যাতায়াত করে। শাতো আর্নোতে দুরান্স নদীর উপর যে সেতু আছে তা বোধ হয় গরুর গাড়ির ভার সহ্য করতে পারবে না। সব যাজকই এক প্রকৃতির লোভী ও কৃপণ। এই বিশপটি প্রথম প্রথম কিছু গুণের পরিচয় দিয়ে এখন আবার আর পাঁচজন সাধারণ যাজকের মতই নিজমূর্তি ধারণ করেছে। তাঁর আবার গাড়ি চাই, যানবাহনের। ব্যবস্থা চাই। আগেকার আমলের বিশপরা যেসব বিলাসব্যসন ভোগ করতেন ইনিও তাই চান। এইসব যাজক দ্বারা কোনও কাজই হবে না।

ম্যাগলোরি কিন্তু অর্থ মঞ্জুরির কথাটা জানতে পেরে খুশি হল। সে একদিন বাপতিস্তিনেকে বলল, মঁসিয়ে প্রথমে পরের কথা খুব ভাবতেন, এখন তাকে নিজের কথা কিছু ভাবতে হচ্ছে। তিনি দানের কাজে সব অর্থ খরচ করে ফেলেছেন। এখন এই তিন হাজার ফ্রাঁ আমাদের হাতে থাকবে।

কিন্তু সেইদিন সন্ধ্যাতেই কিভাবে ওই তিন হাজার ফ্রাঁ খরচ করবেন তার একটা খসড়া তৈরি করে তার বোনের হাতে দিয়ে দিলেন বিশপ।

এছাড়া চার্চের ধর্মীয় ব্যাপারে ও দানের কাজে আরও যেসব খরচ হত সে খরচের অর্থ তিনি ধনীদের কাছ থেকে চাঁদা হিসেবে আদায় করতেন। ধনীদের কাছ থেকে অনেক সময় চাঁদা তুলে গরিবদের দান করতেন। যেসব ধনীর কাছে চাঁদা বা ভিক্ষা চাইতে যেতেন না মিরিয়েল, তারাও তার নামে দানের টাকা পাঠিয়ে দিতেন। এইভাবে অনেকেই সাহায্য করত। এক বছরের মধ্যেই দানের ব্যাপারে মোটা অঙ্কের অর্থ এসে জমল বিশপ মিরিয়েলের হাতে। কিন্তু এত সব টাকা হাতে আসা সত্ত্বেও মিরিয়েলের জীবনযাত্রার কোনও পরিবর্তন হল না। দানের জন্য জমা টাকা থেকে একটা পয়সাও ব্যক্তিগত ব্যাপারে খরচ করতেন না তিনি। তাছাড়া হাতে টাকা আসতে না আসতেই তা গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন মিরিয়েল। দানের থেকে দারিদ্র্য ও অভাব সব সময়ই অনেক বেশি বলে মাঝে মাঝে টাকার টানাটানি হত। তখন তাঁকে ব্যক্তিগত সংসারের খরচের টাকা থেকে সে টাকার অভাব পূরণ করতে হত।

তখনকার দিনের একটি প্রথা ছিল : বিশপরা যখন গ্রামাঞ্চলে তাঁদের কোনও চিঠি বা নির্দেশপত্র পাঠাতেন তখন সেই সঙ্গে তাঁদের খ্রিস্টীয় নামগুলো ও ডাকনামগুলোর একটি তালিকা দিতে হত তাঁদের। সেইসব নাম থেকে যে নামটি সবচেয়ে অর্থপূর্ণ মনে হত গ্রামবাসীদের, বিশপকে তারা সেই নামে ডাকত। বিশপ মিরিয়েলকেও তার এলাকার গ্রামবাসীরা ‘বিয়েনভেনু’ এই নামে ডাকত। ‘বিয়েনভেনু’ কথাটির অর্থ হল স্বাগত।

আমরা বিশপ মিরিয়েলের যে জীবন-চিত্র আঁকতে চলেছি তা হুবহু সত্য না হলেও তার সঙ্গে তাঁর জীবনের অনেক মিল আছে।

.

বিশপ যদিও যানবাহন খরচের টাকাটা গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন তবু গ্রাম পরিক্রমার বা পরিদর্শনের কাজে কোনওরূপ অবহেলা করতেন না তিনি। দিগনে অঞ্চলটা ছিল পাহাড়-পর্বতে ঘেরা এবং তার ভূমিপ্রকৃতি ছিল বন্ধুর। সমতল জায়গা খুব কমই ছিল। দিগনের অধীনস্থ এলাকার মধ্যে ছিল বত্রিশটা গ্রাম্য গির্জা, একচল্লিশটা ছোট গির্জা আর দুশো পঁচিশটা ব্যক্তিগত গৃহসংলগ্ন উপাসনাকেন্দ্র। এই সমস্ত গির্জা আর উপাসনাকেন্দ্র ঘুরে বেড়িয়ে দেখা কোনও লোকের পক্ষে সত্যিই এক কষ্টকর ব্যাপার। কিন্তু বিশপ মিরিয়েল শত কষ্টকর হলেও তা করতেন। তিনি নিকটবর্তী গ্রামগুলো পায়ে হেঁটে যেতেন, সমতল জায়গাগুলো মালবাহী গাড়িতে এবং পার্বত্য এলাকাগুলো ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া-আসা করতেন। তাঁর বোন ও ম্যাগলোরিও প্রায়ই তাঁর সঙ্গে যেতেন। তবে যেসব জায়গায় পথ খুবই দুর্গম সেখানে বিশপ একাই যেতেন।

একদিন সিনেজ নামে একটি ছোট শহরে যান বিশপ মিরিয়েল। সেখানে যাজকদের এক সরকারি অফিস ছিল। তিনি সেখানে একটি গাধার পিঠে চেপে যান। তাঁর হাতে তখন পয়সা বেশি না থাকায় অন্য কোনও যানবাহনের ব্যবস্থা করতে পারেননি। তাঁকে গাধার পিঠে শহর ঘুরতে দেখে মেয়র তাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসে আশ্চর্য হয়ে যায়। শহরের লোকরা হাসাহাসি করতে থাকে।

মিরিয়েল তখন শহরের সমবেত জনগণের উদ্দেশে বলেন, ভদ্রমহোদয়গণ, আমি বুঝতে পেরেছি, কেন আপনারা আশ্চর্য হয়েছেন। আপনারা ভাবছেন, আমার মতো সামান্য এক যাজক কেন যিশু খ্রিস্টের মতো গাধার পিঠে চড়ে এসেছে এবং ওটা তার অহঙ্কারের পরিচায়ক। কিন্তু আমি আপনাদের জানিয়ে দিচ্ছি, এ কাজ আমি অভাবের বশবর্তী হয়েই করেছি, অহঙ্কারের বশে নয়।

এইভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে শান্ত ও সহজভাবে কথাবার্তা বলতেন মিরিয়েল। প্রথাগত ধর্মীয় প্রচার বা বক্তৃতার পরিবর্তে সরলভাবে কথাবার্তার মধ্য দিয়ে জনগণকে শিক্ষা দিতেন। এমন কোনও গুণানুশীলনের কথা তিনি বলতেন না, যা সাধারণ মানুষের ক্ষমতার বাইরে।

এমন কোনও যুক্তি বা দৃষ্টান্তের উল্লেখ করতেন না, যা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে না। কোনও অঞ্চলের অধিবাসীর গরিবদের সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করলে তিনি প্রতিবেশীদের দৃষ্টান্ত দিয়ে তাদের বোঝাবার বা শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। ব্রিয়ানকলের লোকদের কথা একবার ভেবে দেখ। তার গরিব, নিঃস্ব ও বিধবাদের আর সকলের থেকে তিনদিন আগে খড় কেটে নেওয়ার সুযোগ দেয়। গরিবদের ঘরবাড়ি ভেঙে গেলে গাঁয়ের সঙ্গতিসম্পন্ন লোকেরা বিনা পয়সায় তাদের ভাঙা ঘর মেরামত করে দেয়। এইভাবে সেখানকার লোকেরা সুখে-শান্তিতে বাস করছে। তিনশো বছরের মধ্যে সেখানে কোনও খুন হয়নি।

যেসব গাঁয়ের লোকে নিজেদের ফসল লাভের ব্যাপারটাকেই বড় করে দেখত তাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য মিরিয়েল বলতেন, এমব্রামের অধিবাসীদের কথাটা একবার ভেবে দেখ তো। যেসব বাড়ির মালিক একা অর্থাৎ যাদের ছেলেরা সৈন্যবিভাগে কাজ করে এবং মেয়েরা শহরে চাকরি করে, ফসল কাটার সময় গায়ের লোকেরা সেইসব বাড়ির কর্তাদের সাহায্য করার জন্য নিজেরা তাদের ফসল কেটে দেয়। গায়ের কোনও লোক রুগ্‌ণ বা পঙ্গু হয়ে পড়লে অন্য সব লোকে তাকে সাহায্য করে এবং তার ফসল কেটে সব শস্য তার ঘরে এনে দেয়।

কোনও গায়ের কোনও পরিবারের উত্তরাধিকারের ব্যাপারে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ উপস্থিত হলে বিশপ তাদের বলতেন, একবার দোভোলির পার্বত্য অধিবাসীদের কথা ভেবে দেখ দেখি, ওই অঞ্চলটায় বারো মাসই শীত; বসন্ত আসে না কখনও। প্রায় পঞ্চাশ বছরের মধ্যে একটিবারের জন্যও কোনও নাইটিঙ্গেল পাখি ডাকেনি কখনও। সে গাঁয়ে এক ব্যক্তি মারা গেলে তার ছেলেরা সব পৈতৃক সম্পত্তি বোনদের বিয়ের জন্য রেখে শহরে চাকরি খুঁজতে যায়।

কোনও গাঁয়ের কৃষকরা মামলা-মোকদ্দমায় অনেক খরচপত্র করলে মিরিয়েল তাদের বলেন, একবার কেরাম উপত্যকার অধিবাসীদের কথা ভেবে দেখ। সেখানে তিন হাজার কৃষক বাস করে। যেন একটি ছোটখাটো প্রজাতন্ত্র, তাদের কোনও আদালত বা বিচারক নেই। সেখানে মেয়র সব কিছু করেন। তিনি অধিবাসীদের অবস্থা ও আয় অনুসারে কর ধার্য করেন, কর আদায় করেন, ঝগড়া-বিবাদ মিটিয়ে দেন, উত্তরাধিকারের সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করে দেন। বিভিন্ন অভিযোগের বিচার করেন, কিন্তু কারও কাছ থেকে কোনও পয়সা নেন না। তিনি ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি বলে সকলেই তাঁর কথা মেনে চলে।

কোনও গাঁয়ে কোনও স্কুলমাস্টার না থাকলেও বিশপ কেরাম উপত্যকার কথা উল্লেখ করেন। বলেন, ওখানকার অধিবাসীরা কী করে জান? যেসব ছোট ছোট গাঁয়ে মাত্র দশ-পনেরোটা পরিবার বাস করে, যেসব গাঁ একটা স্কুল চালাতে পারে না বা কোনও মাস্টার রাখতে পারে না, সেইসব গায়ের জন্য কেরাম উপত্যকার অধিবাসীরা নিজেরা চাঁদা তুলে কয়েকজন ভ্রাম্যমাণ শিক্ষক নিয়োগ করে। সেইসব শিক্ষক এক একটি গাঁয়ে গিয়ে এক এক সপ্তাহ করে কাটিয়ে সেইসব গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের বিনা বেতনে লেখাপড়া শেখায়। এইসব ভ্রাম্যমাণ শিক্ষক গ্রাম্য মেলাগুলোতেও যায়, আমি নিজে তা দেখেছি। যেসব শিক্ষক শুধু পড়তে শেখায় তাদের মাথার টুপিতে একটা করে কলম গোঁজা থাকে, যারা পড়তে এবং অঙ্ক কষতে শেখায় তাদের দুটো কলম আর যারা পড়তে, অঙ্ক কষতে আর লাতিন ভাষা শেখায় তাদের তিনটে করে কলম থাকে। তবে এই শেষোক্ত শিক্ষকরাই বেশি জ্ঞানী। কিন্তু অজ্ঞতা বা নিরক্ষরতা সত্যিই বড় লজ্জাজনক ব্যাপার। কেরাম উপত্যকার লোকদের মতো তোমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

এমনি করে গম্ভীরভাবে কথা বলে গ্রামবাসীদের শিক্ষা দিতেন বিশপ মিরিয়েল। যখন হাতের কাছে কোনও বাস্তব দৃষ্টান্ত খুঁজে পেতেন না তখন বাইবেল থেকে যিশুর কোনও কথামৃত তুলে ধরতেন। কোনও গুরুগম্ভীর শব্দ ব্যবহার না করে অল্প কথায় মূল শিক্ষণীয় বিষয়টি তুলে ধরতেন। বাগ্মিতা হিসেবে যিশুর কথকতার রীতি অবলম্বন করতেন। তিনি যখন কিছু বলতেন তখন অনুপ্রাণিত হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তা বলতেন। অন্তরের গম্ভীর হতে উৎসারিত সেসব কথা সহজেই অনুপ্রাণিত করে তুলত শ্রোতাদের।

.

বিশপ মিরিয়েলের সব আলাপ-আলোচনার স্রোত হালকা আর সরস সুরে এক বন্ধুত্বপূর্ণ আবহাওয়ায় প্রবাহিত হত। যে দু জন নারী অর্থাৎ তার বোন বাপতিস্তিনে আর ম্যাগলোরি তাঁর চিরজীবনের সাথি ছিল, তিনি তাদের থেকে কখনও বড় ভাবতেন না নিজেকে। তিনি নিজেকে তাদের স্তরের মানুষ হিসেবেই ভাবতেন। যখন তিনি কথা বলতে বলতে কোনও কারণে হাসতেন তখন মনে হত তিনি যেন কোনও সরলমতি বালক।

ম্যাগলোরি সব সময় মিরিয়েলকে ‘হে মহান বিশপ’ বলে সম্বোধন করত। একদিন বিশপ তার পড়ার ঘরে একটি আর্মচেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন। সহসা তার অন্য একটি বইয়ের দরকার হয়। কিন্তু বইটা সবচেয়ে উপরের তাকে থাকায় তিনি উঠে গিয়ে হাত বাড়িয়ে তাকটা নাগাল পেলেন না, কারণ তিনি বেঁটেখাটো ছিলেন। তাই তিনি ম্যাগলোরিকে বললেন, ম্যাগলোরি, দয়া করে একটা চেয়ার এনে দেবে? তার উপর দাঁড়িয়ে বইটা পাড়ব। তুমি আমাকে মহান বললেও আমার মাথাটা ওই তাকটার মতো উঁচু নয়।

কোঁতেসি দ্য লো নামে বিশপ মিরিয়েলের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় ছিল। কোঁতেসি প্রায়ই বিশপের কাছে এসে তার তিন ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করত। সুযোগ পেলেই বিশপের কাছে এসে সে শুধু তার ছেলেদের কথা তুলত। কোঁতেসির কয়েকজন ধনী বৃদ্ধ আত্মীয় ছিল যাদের মৃত্যুর পর তার ছেলেরা তাদের সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে। তার ছোট ছেলে তার বাবার এবং কাকার মৃত্যুর পর তার সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে; মেজ ছেলে তার কাকার সব সম্পত্তি পাবে পোষ্যপুত্র হিসেবে আর বড় ছেলে একজন লর্ডের সব বিষয়সম্পত্তি পাবে উত্তরাধিকারী হিসেবে। মিরিয়েল সাধারণত কোঁতেসির এইসব কথা দিনের পর দিন ধৈর্য ধরে শুনে যেতেন। আপন সন্তানদের ভবিষ্যতের আশায় উদ্দীপিত কোনও এক মায়ের নির্দোষ আবেগের সুরে বলা কথাগুলো একঘেয়ে হলেও সহ্য করে যেতেন তিনি। কিন্তু সেদিন অন্যমনা হয়ে কী ভাবছিলেন মিরিয়েল। কোঁতেসি তাই মৃদু রাগের সুরে বলল, কী যে ভাবছ তা ঈশ্বরের নামে বলছি বুঝতে পারছি না।

বিশপ বললেন, আমি ভাবছি সেন্ট অগাস্টিনের কথাটা। অগাস্টিন বলতেন, তোমার সব আশা সেই তাঁর হাতে সমর্পণ করো যাঁর কোনও উত্তরাধিকারী নেই।

আর একবার স্থানীয় কোনও এক ভদ্রলোকের মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে বিশপকে এক চিঠি পাঠায় মৃতের আত্মীয়রা। সে চিঠিতে মৃতের যত সব উপাধি আর তার পারিবারিক সম্মানের কথা লেখা ছিল। চিঠিখানা পড়ে মিরিয়েল বললেন, মৃত্যুর পিঠটা কত চওড়া! মৃতের কত সম্মানের বোঝ সে পিঠকে বহন করতে হয়। মানুষ তার গর্ব ও আত্মগরিমার পরিচয় দেওয়ার জন্য সমাধিস্তম্ভকেও মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে।

মাঝে মাঝে কোনও ব্যক্তিবিশেষ সম্পর্কে কিছু হাস্যপরিহাসের কথাও বলতেন বিশপ। একবার যুবকবয়সী এক গ্রাম্য যাজক দিগনে বড় গির্জায় ধর্মীয় প্রচারের কাজে আসে। একদিন দানশীলতা সম্বন্ধে আগেবপূর্ণ এক বক্তৃতা দেয়। ধনীরা যাতে মৃত্যুর পর নরকযন্ত্রণা পরিহার করে স্বর্গলাভ করতে পারে, তার জন্য তাদের মুক্ত হাতে গরিব-দুঃখীদের দান করতে উপদেশ দেয় সেই যুবক যাজক। নরকের বিভীষিকাটা সে ভাষা দিয়ে আবেগের সঙ্গে ফুটিয়ে তোলে। সেই সভায় মঁসিয়ে জেবোরাদ নামে এক কৃপণ ধনী ছিল। সে কাপড়ের ব্যবসা করে অনেক ধন সঞ্চয় করে, কিন্তু গরিবদের কোনও কিছু দান করত না। এই বক্তৃতা শোনার পর মঁসিয়ে জেবোরাদ প্রতি রবিবার উপাসনা শেষে গির্জা থেকে বার হওয়ার সময় ফটকের কাছে যেসব বৃদ্ধা ভিখারিণী ভিড় করে থাকত তাদের একটি করে পয়সা দিত। একথা বিশপ মিরিয়েলের কানে যেতে তিনি মন্তব্য করলেন তার বোনের কাছে, মঁসিয়ে জেবোরাদ এক পয়সার বিনিময়ে যতটুকু স্বর্গ পাওয়া যায় তাই কিনছেন।

ধনীদের কাছে দান চাওয়ার সময় অনেকে তাঁর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করত। তবু তাতে দমে যেতেন না বিশপ। একবার এক ধনী কৃপণ প্রকৃতির মানুষকে গরিবদের কিছু দান করতে বলেন মিরিয়েল। মাকুঁই-এর কাঁধের উপর হাত রেখে তিনি বলেন, আমাকে কিছু দান করুন মার্কুই।

মার্কুই যখন সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলেন, আমার নিজের অনেক গরিব আত্মীয় আছে বাড়িতে।

বিশপ তখন উত্তর করেন, ঠিক আছে, আপনার সেই গরিবদের আমার হাতে তুলে দিন।

একদিন গির্জার উপদেশ দানের সময় এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ফ্রান্সে কুড়ি হাজার তিনশো কৃষকের বাড়িতে একটা করে দরজা আর দুটো করে জানালা আছে প্রতি ঘরে। আঠারো হাজার আটশো বাড়িতে একটা করে জানালা আছে আর একটা করে দরজা আছে। আর ছেচল্লিশ হাজার তিনশো বাড়িতে প্রতি ঘরে একটা করে মাত্র দরজা আছে। প্রতি দরজা ও জানালা পিছু কর ধার্য থাকার জন্যই এই জানালা-দরজার সংখ্যার এই রকম তারতম্য দেখা যায়। ঈশ্বর বাতাস দান করেছেন, কিন্তু মানুষের আইন সেই বাতাস কেনাবেচা করছে, তা নিয়ে ব্যবসা করছে। আমি আইনকে আক্রমণ করছি না বা দোষ দিচ্ছি না, আমি শুধু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। ঈসেয়ার, ভার প্রভৃতি আল্পস পর্বতের নিম্নাঞ্চলে কৃষক অধিবাসীরা এমনই গরিব যে তাদের ময়লা ফেলার গাড়ি নেই, পিঠে করে তারা ময়লা ফেলে। রাত্রিতে জ্বালার মতো বাতি নেই। তারা শুকনো ডালপালা আর রেড়ির তেলে ভেজা সলতে পুড়িয়ে অন্ধকার দূর করে। ডফিনে প্রভৃতি উত্তরাঞ্চলে রুটি তৈরি করতে পারের না বছরের সব সময়। তারা ছয় মাস ঘুঁটের জ্বালে রুটি তৈরি করে রেখে দেয়। পরে ছয় মাস দারুণ শক্ত হয়ে যাওয়া সেই রুটিগুলো ধারালো দা দিয়ে কেটে চব্বিশ ঘণ্টা জলে ভিজিয়ে রেখে তবে খায়। সুতরাং হে আমার প্রিয় ভাইসব, দয়া করো, তোমাদের চারপাশে যারা আছে তাদের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি সহানুভূতিশীল হও।

বিশপ মিরিয়েলের গ্রামাঞ্চলে জন্ম হওয়ায় তিনি গাঁয়ের মানুষের কথা বুঝতে পারতেন। মিদি, ডফিনে, ল্যাঙ্গুয়েদক প্রভৃতি আল্পসের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের গ্রামবাসীদের ভালো বুঝতে পারতেন বলে তারা তাকে তাদের কাছের মানুষ বলে ভাবত। তিনি বড় বাড়িতে ও কুঁড়েঘরে সব জায়গায় সহজভাবে থাকতে পারতেন ও সকল শ্রেণির লোকের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারতেন। তিনি অনেক গুরুগম্ভীর কঠিন বিষয়কে সহজ সরল ভাষায় স্বল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিতদের বুঝিয়ে দিতে পারতেন। তাদের ভাষা বলতে ও বুঝতে পারায় তাদের অন্তরে সহজেই পথ করে প্রবেশ করতে পারতেন। শৌখিন ধনী অথবা সাধারণ লোক সকলকেই সমান জ্ঞান করতেন তিনি। তিনি তাড়াহুড়ো করে কোনও কিছু বিচার করতেন না। আনুপূর্বিক সমস্ত অবস্থা খুঁটিয়ে না দেখে কোনও বিষয়ে মন্তব্য করতেন না। কারও কোনও শোকের কথা শুনলে তিনি প্রথমেই বলতেন, আগে আমাকে দেখতে দাও, শোকটার উদ্ভব কী করে হল। তিনি নিজে অতীতে একদিন পাপ করায় পাপ সম্বন্ধে তাঁর নীতিটি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করার জন্য কোনও ভূমিকা না করেই বলতেন, মানুষের দেহের মাংস একই সঙ্গে তার বোঝা আর প্রলোভনের বস্তু। এই প্রলোভন সম্পর্কে সতর্ক থেকে তার লোভকে সংযত করে বলতে হবে। একমাত্র যখন কোনও মতেই তা সম্ভব নয় তখনই সে দেহের দাবি মেনে চলবে। এই দাবি মেনে চলার ব্যাপাটা শোকের হতে পারে, কিন্তু সে শোক তুচ্ছ। এতে মানুষের যে পতন হয় তা সম্পূর্ণ পতন নয়, এ পতন তার হাঁটুর কাছে এসে থেমে যায় অর্থাৎ সে নতজানু হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেই শোক থেকে মুক্ত হয় সে। সাধু হওয়াটা অবশ্য একটা ব্যতিক্রম, সবাই তা পারে না, কিন্তু সবাই ইচ্ছা করলেই সত্যবাদী হতে পারে। ভুল করো, দোষ করো, পাপ করো, কিন্তু সত্যবাদী হও, খাড়াখাড়ি ব্যবহার, অকপট সরলতার সঙ্গে তা প্রকাশ করো। যতদূর সম্ভব কম পাপ করাটাই হল মানবজগতের নীতি। কিন্তু একেবারে পাপ না করাটা দেবদূতদেরও স্বপ্নের বস্তু। সকল পার্থিব বস্তুই পাপের অধীন, যেন কোনও মাধ্যাকর্ষণজাত শক্তি তাদের পাপের দিকে টানতে থাকে।

কারও কোনও দোষ সম্বন্ধে মানুষের কোনও অবিবেচনাপ্রসূত ঘৃণা বা ক্রোধের অভিব্যক্তি দেখে তিনি হেসে বললেন, এ দোষ তো সকলেই করে। যারা ভণ্ড তারাই সে দোষ বা অপরাধ গোপন করে রাখতে চায়।

সামাজিক শাসনের দ্বারা প্রপীড়িত নারী ও শিশুদের প্রতি তিনি ছিলেন বিশেষভাবে সহানুভূতিশীল। তিনি বলতেন, নারী, শিশু, ভৃত্য, দরিদ্র, দুর্বল এবং অজ্ঞ ব্যক্তিদের অপরাধ বা কোনও পাপ হল আসলে স্বামী, পিতা, প্রভু, ধনী ও বলবানদেরই পাপ।

তিনি আরও বলতেন, অজ্ঞ ও অশিক্ষিতদের শিক্ষা দান করো যতদূর সম্ভব। সকলকে অবৈতনিক শিক্ষা দান না করার জন্য সমাজকেই দোষী সাব্যস্ত করতে হবে। সাধারণ মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখার জন্য সমাজই দায়ী। এ অন্ধকার সমাজেরই সৃষ্টি। অন্ধকারাচ্ছন্ন আত্মাই পাপ করে। কিন্তু প্রকৃত পাপী হল সে-ই যে সে অন্ধকার সৃষ্টি করে।

এইভাবে আমরা দেখতে পাই জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বিশপ মিরিয়েলের এক স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। আমার মনে হয় এ দৃষ্টিভঙ্গি তিনি লাভ করেন বাইবেলের উপদেশামৃত থেকে।

একদিন বিশপ যখন তাঁর বৈঠকখানা ঘরে বসে ছিলেন তখন কোনও এক লোকের অপরাধ সম্বন্ধে আলোচনা হচ্ছিল। এই অপরাধের কথাটা তখন শহরের সকলের মুখে মুখে আলোচিত হচ্ছিল। সেই অপরাধের জন্য অপরাধী অভিযুক্ত হয়েছিল আদালতে এবং অল্প দিনের মধ্যে সে বিচারের রায় বার হবে। অপরাধী লোকটি একটি মেয়েকে ভালোবাসত। তাদের একটি সন্তান হয়। লোকটির সঞ্চিত অর্থ সব ফুরিয়ে যাওয়ায় সে দারুণ অভাবে পড়ে এবং সেই অভাবমোচনের জন্য জাল নোটের কারবার করে। সেকালে জাল নোট ছাপার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। সেই লোকটার তৈরি প্রথম জাল মুদ্রাটি এক জায়গায় চালাতে গেলে মেয়েটি গ্রেপ্তার হয়। মেয়েটিকে আটক করা হলে সে কোথায় কার কাছ থেকে সে মুদ্রা পেয়েছে, সে কথা প্রকাশ করল না। তার হাতে সেই মুদ্রা ছাড়া আর কোনও তথ্য বা প্রমাণ পাওয়া গেল না। সে ইচ্ছা করলেই তার প্রেমিককে ধরিয়ে দিতে পারত এবং তার ধ্বংস ডেকে আনতে পারত। কিন্তু কোনও কথাই বলল না সে এবং এ বিষয়ে জেদ ধরে রইল। তখন সরকারপক্ষের উকিল এক ফন্দি আঁটল মেয়েটির কাছ থেকে আসল কথা বার করার জন্য। কতকগুলি জাল চিঠি বার করে সরকারপক্ষের উকিল মেয়েটিকে বলল, তার প্রেমিক অন্য এক মেয়েকে ভালোবাসে এবং তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। মেয়েটি সে কথা বিশ্বাস করে তার প্রেমিকের ওপর রেগে যায়। তখন সে ঈর্ষা ও প্রতিশোধ বাসনার বশবর্তী হয়ে সব কথা ফাঁস করে দিয়ে তার প্রেমিককে ধরিয়ে দেয়। দু জনেরই বিচার হবে আদালতে এবং লোকটির জেল অথবা ফাঁসি হবে। সরকারি উকিলের বুদ্ধি ও কৌশলের কথা উল্লেখ করে শহরের সব লোক উল্লসিত হয়ে উঠতে লাগল। এই উকিল ভদ্রলোক মেয়েটির ঈর্ষাকাতরতা এবং প্রতিশোধপ্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে আসল সত্যকে প্রকাশ করে ন্যায়ের মর্যাদা রক্ষা করে।

সব কিছু নীরবে শোনার পর বিশপ বললেন, ওদের বিচার কোথায় হবে?

উপস্থিত সবাই বলল, এইক্সের আদালতে।

বিশপ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, সরকারপক্ষের উকিলের কোথায় বিচার হবে?

দিগনেতে একবার একটি বড় সকরুণ ও মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে। এক খুনের আসামির মৃত্যুদণ্ড হয়। আসামিটি একেবারে নিরক্ষর নয়। আবার খুব একটা শিক্ষিতও নয়। তার বিচার শহরের লোকদের মনে এক বিরাট কৌতূহলের সৃষ্টি করে। লোকটির ফাঁসির দিনে এই কারাগারের যাজক অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফাঁসির সময় একজন যাজকের দরকার। স্থানীয় হোট গির্জার যাজককে ডাকা হলে সে বলে এটা তার কাজ নয়, তাছাড়া সে অসুস্থ। তখন বিশপ মিরিয়েলকে এই খবরটা জানানো হয়।

বিশপ তখন বলেন, যাজক ঠিকই বলেছেন, এ কাজ তাঁর নয়, আমার।

তিনি তৎক্ষণাৎ জেলখানায় সেই ফাঁসির আসামির ঘরে চলে গেলেন। তিনি লোকটির নাম ধরে ডেকে তার একটি হাত ধরে তার সঙ্গে পরম আন্তরিকতা ও অন্তরঙ্গতার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। কোনও কিছু না খেয়েই সারাটি দিন ও রাত। তিনি লোকটির সঙ্গে জেলখানাতেই রয়ে গেলেন। তার আত্মার শান্তি কামনা করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন তিনি। তাকে আত্মস্থ হওয়ার জন্য উপদেশ দিলেন। জীবন, মৃত্যু ও ঈশ্বর সম্বন্ধে গভীরতম সত্যের কথাটি খুব সহজ ও সরলভাবে তাকে বললেন। তিনি তার সঙ্গে এমনভাবে মেলামেশা করতে লাগলেন যাতে মনে হবে তিনি একেবারে লোকটির পিতা, ভ্রাতা এবং বন্ধু। আবার বিশপরূপে তাকে আশীর্বাদ করলেন। লোকটি ফাঁসির কথা শুনে হতাশ হয়ে পড়ে। নিবিড়তম হতাশার মধ্য দিয়েই। জীবনাবসান ঘটত তার। যে মৃত্যুকে সে এক অন্ধকার শূন্যতা বলে ভাবত সেই মৃত্যুর সামনে এসে এক অপরিসীম বিভীষিকার কথা চিন্তা করে কাঁপতে থাকে সে। যে রহস্যময় এক অবগুণ্ঠন মৃত্যুকে জীবন ও আমাদের চোখের দৃষ্টিপথ থেকে আড়াল করে ঢেকে রাখেন, লোকটির মৃত্যুদণ্ডের সংবাদ সে অবগুণ্ঠনকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। তখন সেই ছিন্নভিন্ন অবগুণ্ঠনের অচ্ছন্দ অবকাশের মধ্য দিয়ে মৃত্যুলোকের পানে তাকিয়ে সে শুধু দেখতে পেল রাশিকৃত এক বিপুল অন্ধকার। কিন্তু বিশপ সেই অন্ধকারের মাঝে আলো দেখালেন তাকে।

পরদিন সকালে আসামিকে যখন বধ্যভূমির দিকে হাতবাঁধা অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন বিশপও তার পাশে পাশে যাচ্ছিলেন। তাঁর মাথায় ছিল বিশপের মস্তকাচ্ছাদন আর গলায় ক্রসটা ঝোলানো ছিল। লোকটির যে মুখখানা গতকাল বিষাদে কালো হয়ে ছিল আজ সে মুখ এক অজ্ঞাত, অকারণ ও অনাবিল আনন্দের জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। জীবনের শেষ মুহূর্তে মৃত্যুলোকের দ্বারপ্রান্ত অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরকে পাওয়ার আশায় সহসা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে যেন তার প্রশান্ত ও স্থিতধী আত্মা। ঘাতকের খড়গ লোকটির উপর পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে বিশপ তাকে চুম্বন করে বললেন, মনে রেখো, মানুষ যাকে হত্যা করে ঈশ্বর তাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। ভাইরা কাউকে বন্দি করলে পরম পিতা ঈশ্বর তাকে মুক্ত করেন। এখন প্রার্থনা কর, ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখ এবং মহাজীবনের পথে গমন কর যেখানে আছেন তোমার পরম পিতা।

বিশপ যখন তাঁর কাজ শেষ করে বধ্যভূমি থেকে বেরিয়ে এলেন তখন তার চোখের দৃষ্টি দেখে সবাই বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল। সে দৃষ্টির মধ্যে তখন একই সঙ্গে ছিল এক সকরুণ গ্লানিমা আর উজ্জ্বল প্রশান্তি। কোনটা বেশি আকর্ষণ করছে তাদের, তা বুঝতে পারল না কেউ।

সেদিন বাড়ি ফিরে বিশপ তাঁর বোনকে বললেন, আমি এতক্ষণ আমার কর্তব্য পালন করছিলাম।

জীবনে এমন অনেক মহৎ কাজ আছে যার মানে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। দিগনে শহরের অনেক লোকও তেমনি বিশপ মিরিয়েলের অনেক মহৎ কাজের মানে বুঝতে পারত না। বলত, ওটা বিশপের এক কৃত্রিম আবেগ ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে বিপশ সম্বন্ধে একথা বিলাসী ধনী ব্যক্তিরাই তাদের বসার ঘরে বসে আলোচনা করত। শহরের সাধারণ মানুষ বিশপের দয়া-মমতার জন্য সত্যিই গভীরভাবে শ্রদ্ধা করত তাঁকে।

ফাঁসির যন্ত্র হিসেবে গিলোটিন প্রচলিত হতে ব্যক্তিগতভাবে বিশপ একটা জোর আঘাত পান মনে। এ আঘাতটা কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছিল তার।

সাধারণত যখন নতুন করে কোনও বধ্যভূমি নির্মাণ করা হয় তখন এক গভীর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় মানুষের মনে। তবে গিলোটিন বস্তুটি নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত মানুষের মৃত্যুদণ্ড নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতাম না আমরা। কিন্তু গিলোটিন দেখার পর হতে মৃত্যুদণ্ডের সপক্ষে বা বিপক্ষে আপন আপন মত প্রকাশ করতে শুরু করেছে সব মানুষ। জোসেফ দ্য মেন্তার মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করেন। কিন্তু সিজার দ্য বেকারিয়া মৃত্যুদণ্ডকে এক জঘন্য ব্যাপার বলে অভিহিত করেন। গিলোটিনকে অনেকে মানুষের অপরাধ সম্বন্ধে আইনের চূড়ান্ত অভিব্যক্তি হিসেবে গণ্য করলেও আসলে তা হল প্রতিহিংসার মূর্ত প্রতীক। তা কখনই নিরপেক্ষ হতে পারে না অথবা আমাদের নিরপেক্ষ থাকতে দিতে পারে না। যারা এই গিলোটিনকে দেখে নিজের চোখে, তারা ভয়ে হতবুদ্ধি হয়ে যায়, শিউরে ওঠে। গিলোটিনের ওই ধারালো খড়গের আঘাতে সব সামাজিক সমস্যা যেন এক শেষ পরিণতি লাভ করে। গিলোটিন লোহা, কাঠ আর দড়ি দিয়ে গড়া যেন এক নিষ্প্রাণ যন্ত্রমাত্র নয়, এটি যেন এক অবাধ অনিবারণীয় ইচ্ছার ভাবমূর্তি যে সব সময় তার কুটিল উদ্দেশ্যগুলো সাধন করে চলেছে একের পর এক করে। এ যন্ত্রের প্রতিটি অঙ্গ ও অংশ যেন মানুষের সব কথা শুনতে পায়, যেন বুঝতে পারে, দেখতে পায় সব কিছু। ঘাতকের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই গিলোটিন যেন মৃত মানুষের মাংস গ্রাস করে, তার রক্ত পান করে। এটি যেন বিচারক আর যন্ত্রনির্মাতার হাতে গড়া এক রাক্ষস, যে রাক্ষস সাক্ষাৎ মৃত্যুর ভেতর থেকে তার নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে নিজের প্রাণবস্তু আহরণ করে এক ভয়ঙ্কর জীবন যাপন করে চলে।

বিশপ মিরিয়েল যখন প্রথম গিলোটিন দেখেন তখন এই কথাই তার মনে হয়। গিলোটিনে কোনও এক লোকের এই প্রথম ফাঁসি দেখে দুঃখে শোকাভিভূত হয়ে পড়েন তিনি। বাড়িতে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ থেকে সেই ভয়ঙ্কর প্রশান্তিটা মিলিয়ে গেল। তার মনের মধ্যে সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার কথাটা ভূতের মতো আনাগোনা করছিল বারবার। সাধারণত তিনি কোনও কর্তব্য পালন করে বাড়ি ফিরলে এক তৃপ্তির অনুভূতি তাঁর চোখে-মুখে ফুটে থাকে। কিন্তু এবার তৃপ্তির পরিবর্তে তাঁর মন ছিল এক পাপচেতনার দ্বারা ভারাক্রান্ত। সাধারণত তিনি বাড়িতে অনেক সময় আপন মনে বিড় বিড় করে কথা বলতেন। সেদিনও তিনি এমনি করে এক একাত্মক সংলাপে মত্ত হয়ে উঠেছিলেন আর তার বোন সে সংলাপ মন দিয়ে শুনছিল।

বিশপ বলেছিলেন, আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা এত ভয়ঙ্কর। মানবজগতের বিধিনিষেধ ও নিয়মকানুনের প্রতি এভাবে উদাসীন থেকে শুধু ঐশ্বরিক বিধি নিয়ে এতখানি মগ্ন থাকা আমার উচিত হয়নি। মৃত্যু ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ঈশ্বরের হাতে। মৃত্যুর মতো এমন একটা অজ্ঞাত ও রহস্যময় ব্যাপারের ওপর খবরদারি করার কোনও অধিকার নেই মানুষের।

এইসব চিন্তা-ভাবনা কমে একে একে মিলিয়ে গেল বিশপের মন থেকে। তবে সেদিন থেকে বধ্যভূমির পাশ দিয়ে চলে যাওয়া পথটা যতদূর সম্ভব এড়িয়ে যেতেন তিনি।

বিশপ মিরিয়েলকে যে কোনও সময়ে ডাকলেই তিনি যে কোনও রুগ্‌ণ ও মুমূর্ষ ব্যক্তির শয্যাপাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। এটা যে তার জীবনের এক প্রধান আর মহান কর্তব্য একথা ভুলে যেতেন না তিনি। কোনও অনাথ বা বিধবার বাড়ি যাওয়ার জন্য তাঁকে ডেকে পাঠাবার কোনও প্রয়োজন হত না। কোনও মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেই চলে যেতেন। যে ব্যক্তি তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়েছে অথবা যে মাতা সন্তানহারা হয়েছে তার পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নীরবে বসে থাকতেন। তার শোকে সান্ত্বনা দিতেন। কখন কথা বলতে হবে বা কখন চুপ করে থাকতে হবে, তা তিনি বুঝতেন। তাঁর সান্ত্বনা দানের পদ্ধতিটা ছিল উন্নত ধরনের। তিনি কখনও শোকার্ত ব্যক্তিকে বিস্মৃতির অতলগর্ভে তার শোক-দুঃখকে বিলীন করে দেওয়ার উপদেশ দিতেন না, তিনি চাইতেন শোকার্ত ব্যক্তি এক নতুন আশা ও ঈশ্বরবিশ্বাসের সাহায্যে তার সব শোকদুঃখকে এক বিরল মহত্ত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে তুলুক। তিনি শোকসন্তপ্ত ব্যক্তিদের বলতেন, মৃতের প্রতি তোমারে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন কর। পচনশীল এক মানবদেহের জন্য শোক-দুঃখ করে কোনও লাভ নেই। তোমরা যদি স্থিরভাবে ভেবে দেখ তা হলে দেখবে তোমারে মৃত প্রিয়তমের অমর আত্মার আলো ঈশ্বরের বুকের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে।

তিনি জানতেন বিশ্বাসই মানুষকে শক্তি দেয়। শোকার্ত ব্যক্তিকে তিনি সব সময় ঈশ্বরের প্রতি নিবিড় আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে শান্তি পেতে বলতেন। যে দুঃখ শুধু মৃত্যুর অন্ধকার গহ্বরটাকে বড় করে দেখে সে দুঃখকে তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো হিসেবে দেখতে শেখাতেন।

.

মঁসিয়ে মিরিয়েলের ব্যক্তিগত জীবন আর সামাজিক জীবনের মধ্যে কোনও ভেদ ছিল না। দুটি জীবন সমান্তরালভাবে এক ধারায় চলত। যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখত তারা তাঁর সে জীবনের কঠোরতা আর আত্মনিগ্রহ দেখে মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে যেত।

বেশির ভাগ বৃদ্ধ ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মতো মিরিয়েল খুব কম ঘুমোতেন। কিন্তু যতটুকু সময় ঘুমোতেন তার ঘুমটা গম্ভীর হত। সকালবেলায় তিনি এক ঘণ্টা ধ্যান করতেন। তার পর তিনি বড় গির্জায় অথবা তার নিজস্ব বক্তৃতামঞ্চ থেকে সমবেত উপাসনাসভা পরিচালনা করতেন। সভার কাজ শেষে তিনি তাঁর নিজের গরুর দুধ আর রুটি খেয়ে তার কাজ শুরু করতেন।

একজন বিশপকে অনেক কাজ করতে হয়। সব সময় ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। তার অধীনস্থ নির্দিষ্ট অঞ্চলের বিভিন্ন চার্চের যাজকদের সঙ্গে দেখা করতে হয় প্রতিদিন। অনেক ধর্মীয় সভায় তাঁকে সভাপতিত্ব করতে হয়, বিধান দান করতে হয়, বিভিন্ন গির্জা থেকে প্রকাশিত কাগজপত্র দেখতে হয়, এই ধরনের অজস্র ধর্মীয় কাজকর্ম দেখাশোনা করতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন গ্রাম্য গরিব যাজকদের কাছে চিঠি দিয়ে পাঠাতে হয়, যাজকদের নীতি-উপদেশমূলক বক্তৃতার লিপিগুলো খুঁটিয়ে দেখতে হয়। বিভিন্ন জায়গায় মেয়র ও যাজকদের মধ্যে কোনও বিরোধ বাধলে তার মীমাংসা করতে হয়। তার পর পোপ ও সরকার-সংক্রান্ত চিঠিপত্রগুলো দেখে তার জবাব লিখতে হয়। মোট কথা, তাঁকে হাজার রকমের কাজকর্ম সম্পন্ন করতে হয়।

এইসব কাজকর্ম সম্পাদনা করে যেটুকু সময় পেতেন মিরিয়েল সেই সময় তিনি গরিব-দুঃখীদের দুঃখ-দুর্দশা মোচনের কাজে ব্যয় করতেন। এর পরেও যদি কিছু অবসর পেতেন তা হলে তিনি তার বাগানে গিয়ে গাছপালার যত্ন করতেন, অথবা ব্যক্তিগত লেখাপড়ার কাজ করতেন। পড়ালেখার কাজ আর বাগানের কাজ একই জাতীয় বলে তিনি মনে করতেন। তিনি বলতেন মানুষের মন বা আত্মাটাও এক বাগান। পড়াশোনা বা জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে যে বাগান পরিমার্জিত হয়।

দুপুরবেলায় তিনি যা খেতেন তা প্রাতরাশের থেকে সামান্য কিছু বেশি। বেলা দুটোর সময় আবহাওয়া ভালো থাকলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন তিনি। হয় তিনি গ্রামাঞ্চলে চলে যেতেন হাঁটতে হাঁটতে অথবা শহরের রাস্তা দিয়ে গরিব-দুঃখীদের বাড়ি যেতেন। একটা লম্বা ছড়ি হাতে মাথাটা নিচু করে চিন্তাষিতভাবে পথ হাঁটতেন তিনি। তাঁর জুতোজোড়া ছিল ভারী এবং মোজা দুটো ছিল নীলচে রঙের। মাথায় থাকত ঝালর দেওয়া বিশপের টুপি।

যে পথ দিয়ে তিনি যেতেন সে পথের দু’ধারে একটা আলোড়ন পড়ে যেত। যত সব শিশু আর বৃদ্ধরা তাদের বাড়ির দরজার কাছে বেরিয়ে এসে সাদর অভ্যর্থনা জানাত তাঁকে, শীতার্ত ব্যক্তিরা যেমন প্রতপ্ত সূর্যালোককে অভ্যর্থনা জানায়। যারা অভাবগ্রস্ত তাদের তিনি তাদের বাসায় গিয়ে দেখতেন। তিনি সকলকে আশীর্বাদ করে তাদের ধন্য করতেন এবং নিজেও ধন্য হতেন। পথে যেতে যেতে মাঝে মাঝে থেমে অনেক শিশু আর তাদের মায়েদের সঙ্গে হেসে কথা বলতেন। যখন তার হাতে টাকা থাকত তখন তিনি গরিবদের বাড়ি যেতেন আর যখন টাকা থাকত না তখন তিনি ধনীদের বাড়ি যেতেন।

বাইরে কোথাও যাওয়ার সময় বিশপের আলখাল্লাটি তিনি পরে যেতেন। সেটি একেবারে অচল না হওয়া পর্যন্ত পরতেন। সেটা দু-এক জায়গায় ছিঁড়ে গেলেও তা গ্রাহ্য করতেন না। তবে গরমকালে সেটা পরে বাইরে বেরোতে কষ্ট হত।

সন্ধে সাড়ে আটটার সময় তিনি বাড়িতে তার বোনের সঙ্গে রাতের খাওয়া খেতেন। ম্যাগলোরি পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। তাঁর নৈশভোজনের মধ্যে থাকত শাকসবজির ঝোল আর শুকনো রুটি। এর থেকে কম খরচের খাওয়া আর হতে পারে না। যদি কোনও যাজক নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে থাকত তা হলে ম্যাগলোরি সেই সুযোগে কিছু মাছ বা। মাংসের ব্যবস্থা করত। যাজকরা তাঁর বাড়িতে খেতে ভালোবাসত আর বিশপও তা সমর্থন করতেন।

নৈশভোজনের পর আধ ঘণ্টা তার বোন আর ম্যাগলোলারির সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন মিরিয়েল। তার পর নিজের শোবার ঘরে চলে যেতেন। তাঁর শোবার ঘরটা ছিল নিচের তলায়। বাপতিস্তিনে আর ম্যাগলোরি উপরতলায় তাদের শোবার ঘরে চলে যেত। শোবার ঘরে গিয়ে পড়ালেখার কাজ করতেন মিরিয়েল অনেক রাত পর্যন্ত। তিনি উচ্চশিক্ষিত ছিলেন এবং ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনশাস্ত্রে তাঁর প্রচুর পড়াশোনা এবং পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি বাইবেলের ‘জেনেসিস’ বা সৃষ্টিতত্ত্বের একটি পঙক্তির ওপর একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। সেই পঙক্তিটাতে ছিল ‘জেনেসিস’ সৃষ্টির আগে শুধু ছিল জল এবং ঈশ্বরের আত্মা জলের উপর ঘুরে বেড়াত। তিনি এই পঙক্তিটির সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্বের উল্লিখিত অনুরূপ পঙক্তিগুলো মিলিয়ে দেখেন। আরবি শাস্ত্রে লিখিত একটি পঙক্তিতে আছে, ‘ঈশ্বরের বাতাস বইতে লাগল।’ ফ্লোবিয়াস জোসেফ লিখেছেন, স্বর্গ থেকে বাতাস নেমে এল মর্তে। চ্যালভিনয় অনূদিত রব্বি অঙ্কেলোতে আছে, ঈশ্বরপ্রেরিত বাতাসের রাশি জলের উপর দিয়ে বয়ে যেতে লাগল।

আর একটি প্রবন্ধে তিনি টলেমার ভূতপূর্ব বিশপ শার্লস লুই হুগোর ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কিত লেখাগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। এই রচনাগুলো আগের শতাব্দীতে কয়েকটি পুস্তিকা ও প্রচারপত্রে প্রকাশিত হয়।

কখনও কখনও কোনও গভীর বিষয় পড়তে পড়তে দিবাস্বপ্নের মধ্যে মগ্ন হয়ে পড়তেন। তার মাঝে মাঝে সেই দিবাস্বপ্নের গম্ভীর হতে উঠে এসে দু একটা পঙুক্তি লিখতেন। যে বই তাঁর হাতে থাকত, সেই বই-এর কোনও না কোনও পাতার উপর পর্ভূক্তিগুলো লিখতেন। এই লেখাগুলোর সঙ্গে তাঁর হাতের বই-এর কোনও সম্পর্ক ছিল না। আমরা একটি বইয়ের উপর তাঁর লেখা কয়েকটি ছত্র পাই। তাতে এক জায়গায় লেখা ছিল, তুমি হচ্ছ এই :

যাজক সম্প্রদায় তোমাকে বলে ‘সর্বশক্তিমান’, ম্যাকারিরা তোমাকে বলে ‘স্রষ্টা’, একেসীয়দের কাছে লিখিত পত্রাবলিতে তোমাকে ‘স্বাধীনতা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে, বারুক তোমাকে বলেছেন ‘অনন্ত’, বাইবেলের প্রার্থনাস্তোত্রে তোমাকে বলা হয়েছে ‘প্রজ্ঞা আর সত্য’, দ্য বুক অব কিংস, তোমাকে বলেছেন “লর্ড’ বা প্রভু, ওল্ড টেস্টামেন্টের কাজোড়াসে বলা হয়েছে তুমিই ‘ঐশ্বরিক বিধান’, লেভিটিকাস বলেছেন, তুমিই ‘পবিত্রতা’, এসড্রাস তোমাকে বলেছেন, ন্যায়পরায়ণতা, সৃষ্টিতত্ত্বে তোমাকে বলা হয়েছে ‘ঈশ্বর’, মানুষ তোমাকে বলে ‘পরম পিতা’; কিন্তু সলোমন বলেছেন তুমি ‘পরম করুণা’ এবং এইটিই তোমার সবচেয়ে সুন্দর এবং শ্রেষ্ঠ নাম।

রাত্রি নটা বাজতেই বাড়ির মহিলা দু জন উপরতলায় তাদের শোবার ঘরে চলে যেত। এবার দিগনের বিশপ যে বাড়িতে বাস করতেন সে বাড়ির একটি বিবরণ দান করা উচিত।

.

যে বাড়িতে বিশপ বাস করতেন তার দুটি তলা ছিল। প্রত্যেক তলাতে ছিল তিনটি করে ঘর। এছাড়া ছাদের উপর একটি ঘর ছিল। বাড়িটির পেছন দিকে এক একর সমান একটি বাগান ছিল। বাড়ির মেয়েরা উপরতলায় আর বিশপ নিচের তলায় থাকতেন। বিশপের যে তিনটি ঘর ছিল তার মধ্যে রাস্তার দিকের ঘরটি খাবার ঘররূপে ব্যবহৃত হত। দ্বিতীয় ঘরটি শোবার ঘর ও পড়ার ঘররূপে ব্যবহার করতেন। তৃতীয় ঘরটি তাঁর বক্তৃতার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত। বক্তৃতার ঘরের এক প্রান্তে একটি বিছানা পাতা থাকত অতিথিদের জন্য। বিছানাটির পাশে পর্দা ফেলা থাকত। গির্জা-সংক্রান্ত ব্যাপারে গ্রাম্য যাজকদের প্রায়ই বিশপের কাছে আসতে হত। পর্দা দিয়ে আড়াল করে রাখা হত বিছানাটা; যেন মনে হত একটা শোবার ঘর।

বিশপের এই বাড়িটি আগে ছিল হাসপাতাল। হাসপাতালের যে ঘরটিতে ওষুধ দেওয়া হত রোগীদের সেই ঘরটিকে দু’ভাগ করে ভাঁড়ার ঘর ও রান্নাঘরে পরিণত করা হয়। বাগানের একটি অংশে একটি গোয়ালঘর তৈরি করে সেখানে দুটি গরু রাখা হত। গরুতে যা দুধ দিত তার অর্ধেক বিশপ বাড়িতে রেখে অর্ধেক হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতেন।

বিশপের শোবার ঘরটি ছিল বড়। শীতকালে ঘরটাকে উত্তপ্ত করার জন্য অনেক কাঠের দরকার। দিগনেতে কাঠের দাম খুব বেশি হওয়ার জন্য শীতকালে প্রয়োজনমতো জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে পারতেন না। শীতকালে রাত্রির দিকে শীতে খুব কষ্ট হওয়ায় বিশপ গোয়ালঘরের একটি দিক ঘিরে সন্ধ্যার সময় সেইখানে বসে পড়াশোনা করতেন। তিনি বলতেন, ‘এটি আমার শীতের বিশ্রামাগার।’ কিন্তু তার সেই শীতের বিশ্রামাগারে একটি কাঠের টেবিল আর চারটি চেয়ার ছাড়া আর কোনও আসবাব ছিল না। একটি কাঠের বোর্ডকে বক্তৃতার ঘরে বেদি হিসেবে সাজিয়ে রাখা হত।

দিগনের ধনী ধার্মিক ও ভক্ত মহিলারা বক্তৃতাকক্ষে একটি ভালো বেদি তৈরির জন্য কয়েকবার চাঁদা তুলে টাকা দিয়েছিল বিশপের হাতে। কিন্তু সে টাকা গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেন বিশপ। তিনি বলেন, যে সব হতভাগ্য নিরুপায় হয়ে ঈশ্বরের কাছে অন্তরের সঙ্গে সান্ত্বনা চায় তাদের আত্মাই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বেদি।

বসার ঘরে বেশি চেয়ার ছিল না। দুটি মাত্র বসার টুল ছিল। তাঁর শোবার ঘরে মাত্র একটি আমচেয়ার ছিল। যখন বিশপের বসার ঘরে ছ সাতজন অথবা দশ-এগারো জন্য অতিথি আসত, বিভিন্ন ঘর থেকে চেয়ার আনতে হত। এগারো জনের বেশি অতিথি এলে বিশপকে আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হত। আর গ্রীষ্মকাল হলে চেয়ারের অভাবে তিনি অতিথিদের বাগানে নিয়ে গিয়ে বেড়াতে বেড়াতে কথা বলতেন।

অতিথিদের বিছানার পাশে যে একটা চেয়ার ছিল তার একটা পা ভাঙা থাকায় সেটা দেয়ালের গাঁ ঘেঁষে সেঁটে রাখা হয়েছিল। সুতরাং সেটা বার করে ব্যবহার করা চলত না। বাপতিস্তিনের ঘরে ইজি চেয়ার ছিল, কিন্তু সিঁড়িগুলো সরু থাকায় জানালা দিয়ে ঘরে ঢোকানোর সময় ভেঙে যায়। তার ফলে সেটাও ব্যবহার করা চলত না। বাপতিস্তিনের অনেক দিনের ইচ্ছা মেহগনি কাঠের আর হলুদ ভেলভেটের গদিওয়ালা একটা আর্মচেয়ার কিনবে। কিন্তু তার দাম পাঁচশো ফ্রাঁ। অথচ গত পাঁচ বছরের মধ্যে সে মাত্র বিয়াল্লিশ ফ্রাঁ দশ সু জমাতে পেরেছে। ফলে সেই দামি আর্মচেয়ার কেনার আশাটা ত্যাগ করতে হয় বাপতিস্তিনকে। এমনি করে অনেক স্বপ্নই সফল হয় না আমাদের।

বিশপের শোবার ঘরের মতো এমন সাদাসিধে ঘর দেখাই যায় না। এ ঘরে ছিল বাগানের দিকে একটি জানালা আর দুটি দরজা –একটি দরজা খাবার ঘরে যাওয়ার জন্য আর একটি বক্তৃতার ঘরে যাবার জন্য। একটি লোহার খাটে বিছানা পাতা থাকত, তার উপরে ছিল সবুজ সার্জের এক চাঁদোয়া। খাবার ঘরে যাওয়ার দরজাটার পাশে ছিল বইয়ের তাক। তাকগুলো বইয়ে ভর্তি ছিল। আগুন রাখার জায়গাটার ছিল কাঠের, কিন্তু দেখে মনে হত মার্বেল পাথরের। তার সামনের দুটো ফুলদানিতে দুটো কুকুরের মূর্তি ছিল। দেয়ালের গাঁয়ে যেখানে আগুন জ্বালানো হয় তার উপর যে তাক ছিল তার মাথায় আয়নার পরিবর্তে চারকোনা একখণ্ড ভেলভেটের উপর একটা তামার ক্রস ঝোলানো ছিল। জানালার পাশে একটা বড় টেবিলে অনেক কাগজপত্র ছড়ানো ছিল আর তাতে একটা দোয়াত ছিল। টেবিলের পাশে ছিল একটা কমদামি আর্মচেয়ার আর বিছানায় খাটের পাশে প্রার্থনা করার জন্য একটা টুল ছিল। এই টুলটা আসলে বক্তৃতার ঘরে থাকত এবং দরকারের সময় আনা হত।

বিছানার দু’পাশে দুটি ফ্রেম আঁটা ছবি ছিল। ছবি দুটি ভূতপূর্ব এক বিশপ ও কয়েকজন যাজকের। ছবি দুটি ছিল আগেকার হাসপাতালে। হাসপাতালের এই বাড়িটাতে আসার পর থেকে বিশপ এগুলো উত্তরাধিকারসূত্র পেয়ে যান যেন। ছবিগুলো

এ বাড়িতে আসার পর ম্যাগলোরি যখন ঝাড়ামোছা করছিল তখন তা দেখতে পেয়ে যান বিশপ। দেখেন ছবিতে আঁকা বিশপ ও যাজকরা সবাই ১৭৮৫ সালের এপ্রিল মাসে কাজে নিযুক্ত হন। জানালায় যে পর্দাটা ছিল তার অনেকটা ছিঁড়ে যায় এবং ম্যাগলোরি বাধ্য হয়ে সেই ছেঁড়াটা ঢাকার জন্য তালি দিয়ে দেয়। তালিটা দেওয়া হয় ক্রসের আকারে। তা দেখে খুশি হন বিশপ। গোটা বাড়িটাকে ব্যারাক বাড়ি বা হাসপাতালের মতই রঙ করা হয়েছিল।

খাবার ঘরের টেবিলে ছয়টা রুপোর কাঁটা-চামচ চকচক করত আর দুটো রুপোর ভারী বাতিদান ছিল। বিশপের নিজস্ব ধনসম্পদ বলতে এছাড়া আর কিছু ছিল না। এই রুপোর জন্য গর্ব অনুভব করত ম্যাগলোরি। কোনও সম্মানিত অতিথি খেতে এলে সেই বাতিদানে মোমবাতি রেখে তা জ্বালত। বিশপ একদিন রুপোর কাঁটা-চামচগুলো সম্বন্ধে মন্তব্য করেন, এই রুপোর জিনিসগুলোর সাহায্য ছাড়া খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে পারছি না আমি।

বাগানটা চারদিকে একটা সাদা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল। বাগানের মধ্যে ফাঁকা জায়গাটায় বর্গক্ষেত্রাকার চার টুকরো জমি ছিল। তার তিনটেতে ম্যাগলোরি শাকসবজি লাগাত আর একটাতে ফুলগাছ বসিয়েছিলেন বিশপ। বাগানে কিছু ফলের গাছও ছিল। একদিন ম্যাগলোরি রাগের সঙ্গে বিশপকে বলেছিল, মঁসিয়ে, আপনি আমাদের সবকিছুর সদ্ব্যবহার করার জন্য উপদেশ দেন। কিন্তু আপনি ফুলগাছ বসিয়ে জমিটা নষ্ট করছেন। ফুলের থেকে চাটনির দরকার বেশি। তাই ওখানে ফুলের বদলে চাটনির জন্য কিছু সবজি লাগালে ভালো হত।

বিশপ তার উত্তরে বলেন, ভুল করছ তুমি। সংসারের প্রয়োজনীয় বস্তুর মতো সুন্দরেরও প্রয়োজন আছে। বোধ হয় সুন্দর যে কোনও বস্তুর থেকে বেশি প্রয়োজনীয়।

প্রতিদিন বাগানে দু-এক ঘণ্টা করে কাটাতেন বিশপ। ফুলগাছগুলোর যত্ন করতেন। কখনও তিনি গাছের গোড়া থেকে আগাছা উপড়ে ফেলতেন, কখনও মাটি খোঁচাতেন, কখনও বা নতুন গাছ বসাতেন। কিন্তু মালীর দক্ষতা তাঁর ছিল না। গাছগুলোর কিভাবে ক্ষতি বা বৃদ্ধি হয় সে জ্ঞানও তাঁর ছিল না। উদ্ভিদধিদ্যায় কোনও আগ্রহ ছিল না তার। যেসব পোকামাকড় গাছের চারাগুলোর ক্ষতি করে সেগুলোকে ওষুধ দিয়ে মারার কোনও ব্যবস্থা করতেন না তিনি। তার একমাত্র আগ্রহ ছিল ফুলের প্রতি। তিনি ফুল ভালোবাসতেন। পণ্ডিত লোকদের শ্রদ্ধা করতেন তিনি। গ্রীষ্মকালে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি নিজের হাতে জলপাত্র হাতে বাগানের গাছগুলোতে জল দিতেন।

বাড়ির কোনও দরজায় তালাচাবি দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা করেননি বিশপ। বাপতিস্তিনে ও ম্যাগলোরি বিশপকে অনেক করে তার শোবার ঘরের দরজায় খিল দিতে বলেন রাত্রিতে। কিন্তু বিশপ তা শোনেননি। তার দেখাদেখি তারাও আর খিল দিত না। ম্যাগলোরি অবশ্য মাঝে মাঝে ক্ষোভ প্রকাশ করত এ ব্যাপারে।

মিরিয়েল এ ব্যাপারে তাঁর নীতির কথাটি একদিন বাইবেলের একটি পাতার উপর লিখে রাখেন, ‘ডাক্তারের সঙ্গে যাজকের এখানেই তফাৎ। ডাক্তারের বাড়ির দরজা কখনও বন্ধ করা চলবে না। যাজকের বাড়িও সব সময় খোলা রাখতে হবে।’ ‘অ্যা ফিলজফি অব মেডিক্যাল সায়েন্স’ নামে একখানি বইয়ের উপর একদিন তার একটা লেখা পাওয়া যায়। তাতে লেখা ছিল, আমিও কি একজন ডাক্তার নই? আমারও রোগী। আছে। রোগগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা হতভাগ্য, যারা দীন-দুঃখী তারাও তো মনের দিক থেকে রুগুণ এবং সেই রোগ প্রতিকারের জন্যই তারা আসে আমার কাছে।

আর একটি বইয়ে তিনি একবার লেখেন, রাত্রিকালে যদিও কোনও লোক বাড়িতে আশ্রয় চাইতে আসে তা হলে তার নাম-ধাম জিজ্ঞাসা করো না। যে ব্যক্তি দেখবে তার নাম-ধাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক তারই আশ্রয়ের বেশি দরকার।

একদিন এক যাজক বিশপের সঙ্গে দেখা করতে এসে ম্যাগলোরির অনুরোধে বিশপকে প্রশ্ন করেন, কেন আপনি সব সময় সব ঘরের দরজা খুলে রাখেন? তালা বা খিল কিছুই দেন না। এতে বিপদ ঘটতে পারে একসময়।

বিশপ মিরিয়েল তখন যাজকের কাঁধের উপর একটি হাত রেখে একটি প্রার্থনাস্তোত্র থেকে একটি ছত্র উদ্ধৃত করে বলেন, ঈশ্বর যদি কোনও নগর রক্ষা করতে না চান তা হলে প্রহরীর দৃষ্টি যতই সজাগ থোক তা ব্যর্থ হতে বাধ্য।

এই থেকে তিনি বলেন, কোনও সেনাদলের কর্নেলের মতো একজন যাজকেরও সমান পরিমাণ সাহস আছে। তবে সে সাহস বড় শান্ত এবং নিরুচ্চার।

.

এই সময় একদিন আর একটি ঘটনা ঘটে, যা বিশপের চরিত্রের ওপর বেশ কিছুটা আলোকসম্পাত করে। সুতরাং ঘটনাটির উল্লেখ না করে পারা যাবে না।

একসময় গাসপার্দ বে’র মতো ভয়ঙ্কর দস্যুদল অলিউনের পার্বত্য অঞ্চলের আশপাশের গাগুলো লুটপাট করে তাণ্ডব চালাতে থাকে। ক্রাভাত্তে নামে এই দস্যুদলের এক নেতা পুলিশের ভয়ে পাহাড়ে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। যেসব দস্যু বেঁচে ছিল এবং যারা ধরা পড়েনি তাদের নিয়ে প্রথমে সে বিলেতে ও পরে পিদমতে কিছুদিন লুকিয়ে থাকার পরে প্যারিসের বার্মিলোনেত্তে অঞ্চলে এসে ওঠে।

ক্রাভাত্তের সাঙ্গপাঙ্গদের প্রথমে জঞ্জিয়ারে ও পরে তুলেতে দেখা যায়। পরে তারা জুং দেল এগলে পাহাড়ের গুহায় পালিয়ে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। রাত্রিকালে গুহার আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এসে তারা পার্শ্ববর্তী গাঁগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, যা পারত লুটপাট করে পালাত।

কোনও এক রাতে ক্রাভাত্তে তার দলবল নিয়ে এমব্রাসের একটি বড় গির্জায় ঢুকে ধর্মীয় জিনিসপত্র সব চুরি করে নিয়ে যায়। তার অত্যাচারে গ্রামবাসীরা সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। পুলিশ তাদের অনুসরণ করে ধরার অনেক চেষ্টা করে। কিন্তু সব বারেই তারা পাহাড়ে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। কখনও কখনও আবার পুলিশের সঙ্গে লড়াই করে পালিয়ে যায়। সত্যিই ক্রাভাত্তে ছিল এক দুর্ধর্ষ দুর্বৃত্ত।

এইভাবে যখন এই অঞ্চলে এক সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছিল তখন সেখানে একদিন পরিদর্শনের কাজে এসে পড়েনে বিশপ মিরিয়েল। আসার পথে চাস্তেলার নামে এক জায়গায় সেখানকার মেয়রের সঙ্গে তার দেখা হয়। মেয়র ফিরে যেতে বলেন বিশপকে। লার্কে পর্যন্ত সমস্ত পার্বত্য এলাকাটা তখন একরকম ক্রাভাত্তের দখলে। তার ওপারেও তার আধিপত্য বিস্তৃত। সঙ্গে রক্ষী নিয়েও ওদিকে যাওয়া যাবে না। ওদিকে যাওয়া খুবই বিপজ্জনক, শুধু শুধু তিন-চারজন রক্ষীর প্রাণ যাবে।

তা শুনে বিশপ বললেন, সত্যিই তাই? আমি রক্ষী সঙ্গে না নিয়েই যাব।

মেয়র আবার বললেন, মঁসিয়ে, ওখানে যাওয়ার কথা মনেও ভাববেন না।

বিশপ মিরিয়েল বললেন, আমি এই কথাই ভাবছি যে ওখানে আমি কোনও রক্ষী ছাড়াই যাব এবং ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমি রওনা হব।

একা যাবেন?

হ্যাঁ একা।

না মঁসিয়ে, যাবেন না।

বিশপ তখন বললেন, ওই পাহাড় অঞ্চলে আদিবাসীদের একটি গাঁ আছে। আমি সেখানে তিন বছর যাইনি। ওইসব আদিবাসী বন্ধু। তারা বড় শান্তিপ্রিয়। উপত্যকায় ছাগল চরায় আর বাঁশি বাজায়। মাঝে মাঝে ঈশ্বর সম্বন্ধে তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য একজন লোকের দরকার। একজন বিশপ যদি দস্যুর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাদের কাছে না যায়, তা হলে কী ভাববে তারা? আমি যদি না যাই হলে আমার সম্বন্ধেই-বা কী ভাববে?

মেয়র বললেন, কিন্তু মঁসিয়ে, আপনি যদি দস্যুদের কবলে পড়েন?

বিশপ বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই পড়তে পারি। আপনি যখন বললেন তখন আমি অবশ্যই দেখা করব তাদের সঙ্গে। ঈশ্বরের কথা তাদের বলার জন্য তাদেরও নিশ্চয় একজন লোকের দরকার।

কিন্তু তারা তো একদল নেকড়ের মতো।

আর সেইজন্যই হয়তো যিশু আমাকে তাদের রাখাল হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। ঈশ্বরের বিধানের কথা কে বুঝতে পারে?

তারা আপনার সব কিছু অপহরণ করবে।

আমার কিছুই নেই।

ওরা আপনাকে হত্যা করতে পারে।

মন্ত্র উচ্চারণরত একজন বৃদ্ধ যাজককে কেন তারা মারবে?

আপনি যদি তাদের সঙ্গে দেখা করেন ঈশ্বর যেন আপনার মঙ্গল করেন।

আমি আমার গরিবদের জন্য তাদের কাছে ভিক্ষা চাইব।

মঁসিয়ে, আমার অনুরোধ, যাবেন না। শুধু শুধু আপনার জীবন বিপন্ন করবেন না।

বিশপ তার উত্তরে বললেন, আপনার সব কিছু বলা শেষ হয়েছে মঁসিয়ে মেয়র? আমার জীবন রক্ষার জন্য আমাকে কিন্তু এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়নি। আমাকে পাঠানো হয়েছে মানুষের আত্মাকে রক্ষা করার জন্য।

সুতরাং কারও কোনও নিষেধ বা অনুরোধ বাধা দিতে পারল না বিশপকে। তিনি চলে গেলেন। বিশপের এই অনমনীয় জেদের কথাটা ক্রমে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। সকলে তার কথা ভেবে ভয় পেয়ে গেল।

তার বোন ও ম্যাগলোরিকে সঙ্গে নিলেন না বিশপ। শুধু পথ দেখাবার জন্য এক স্থানীয় ছেলেকে সঙ্গে নিলেন। তারা টাটু ঘোড়ায় চেপে গেলেন। পথে কারও সঙ্গে দেখা হল না। নিরাপদেই তারা সে পার্বত্য আদিবাসীদের গাঁয়ে পৌঁছলেন। সেখানে পুরো একপক্ষকাল রয়ে গেলেন বিশপ। তাদের মধ্যে ধর্মপ্রচার করলেন, ধর্মে দীক্ষা দিলেন, অনেক নীতি শিক্ষা দিলেন।

অবশেষে গাঁ ছেড়ে আসার আগে একদিন প্রার্থনাসভার শেষে ‘তে দিউম’ বা ‘হে ঈশ্বর, তোমার প্রতি’ নামে এক স্তোত্রগানের অনুষ্ঠান করতে বললেন স্থানীয় যাজককে। কিন্তু এই অনুষ্ঠান করতে গিয়ে একটা সমস্যা দেখা গেল। সেই গ্রাম্য গির্জায়

এই অনুষ্ঠানের উপযুক্ত ধর্মীয় পোশাক পাওয়া গেল না।

বিশপ তবু বললেন, যাই হোক, তোমরা ঘোষণা করে দাও নীতি উপদেশ দানের পরই ‘তে দিউম’ অনুষ্ঠিত হবে। কিছু না কিছু একটা উপায় হবেই।

আশপাশের গির্জাগুলোতে পোশাকের জন্য লোক পাঠানো হল। বিভিন্ন গির্জা ঘুরে যা কিছু পাওয়া গেল তাতে দেখা গেল অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে না।

এমন সময় কোথা থেকে হঠাৎ দু জন অশ্বারোহী এসে একটা বড় সিন্দুক বিশপের কাছে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। সিন্দুকটা নামিয়ে দিয়েই অশ্বারোহী দু জন চলে গেল। সেটা খুলে দেখা গেল কিছুদিন আগে এমব্রাসের গির্জা থেকে যেসব মূল্যবান সোনা ও হীরের জরি বসানো ধর্মীয় পোশাক চুরি গিয়েছিল সেইসব পোশাক সিন্দুকটাতে গুছিয়ে রাখা আছে। তার সঙ্গে একটা কাগজে লেখা ছিল, ক্রাভেত্তে এগুলো মঁসিয়ে বিয়েনভেনু’র হাতে তুলে দিল।

বিশপ বললেন, দেখলে তো? আমি আগেই বলেছিলাম কিছু একটা উপায় হবে। যে সামান্য ফুলে বা গ্রাম্য যাজকের পোশাকে সন্তুষ্ট থাকে ঈশ্বর তাকে একদিন আর্কবিশপের পোশাক দান করেন।

গ্রাম্য যাজক বলল, কিন্তু যে লোকটি এ পোশাক দিয়ে গেল সে ঈশ্বর না শয়তান?

বিশপ তার পানে কড়াভাবে তাকিয়ে বললেন, ঈশ্বর।

বিশপ চাস্তেলারে ফিরে দেখলেন তাঁকে দেখার জন্য পথের দু পাশে শহরের সব লোক সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শহরের গির্জায় তার জন্য বাপতিস্তিনে আর ম্যাগলোরি অপেক্ষা করছিল। বিশপ তাদের বললেন, আমি ঠিক বলিনি? একজন গরিব যাজক গরিব পার্বত্য উপজাতিদের কাছে গিয়েছিল শূন্য হাতে, ফিরে এল হাত ভর্তি করে। আমি গিয়েছিলাম একমাত্র ঈশ্বরবিশ্বাসকে সম্বল করে। কিন্তু ফিরে এসেছি একটি গির্জার হারানো ধনসম্পদ নিয়ে।

সে রাতে বিছানায় শুতে যাওয়ার আগে বিশপ বললেন, দস্যু ও নরঘাতকদের কখনই আমাদের ভয় করা উচিত নয়। এরা যেসব বিপদের সৃষ্টি করে তা বাইরের ব্যাপার, সে বিপদ তুচ্ছ। আমরা নিজেরাই হচ্ছি নিজেদের ভয়ের বস্তু। কুসংস্কার হচ্ছে প্রকৃত দস্যু আর হিংসা হচ্ছে প্রকৃত খুনি। আমাদের দেহের উপর আঘাত হানার বা অর্থহানি ঘটাবার কেউ যদি ভয় দেখায় তা হলে কেন আমরা ভয় পাব বা বিব্রত বোধ করব? আসলে আমাদের আত্মার নিরাপত্তা সম্পর্কে, দেখতে হবে আমাদের আত্মাকে কেউ যেন ভয় না দেখায় বা তার কোনও বিঘ্ন না ঘটে।

এবার বিশপ তার বোনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, একজন যাজক কখনও আর পাঁচজনের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার কথা ভাববে না। ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া কোনও কাজ হতে পারে না। ঈশ্বর মানুষকে যে কাজ করার অনুমতি দেন মানুষ সেই কাজই করতে পারে। আমরা শুধু বিপদে পড়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে পারি। কিন্তু আমাদের নিজেদের জন্য কোনও কিছু প্রার্থনা করা উচিত নয়, আমরা প্রার্থনা করব যাতে আমাদের জন্য আমাদের ভাইরা যেন কোনও পাপকর্মে জড়িয়ে না পড়ে।

এই ধরনের ঘটনা অবশ্য খুব একটা বেশি ঘটত না। আমরা শুধু যেসব ঘটনার কথা জানি সেইসব ঘটনার কথা বলতাম। তবে এই ধরনের কাজ জীবনে অনেক করে যেতেন মিরিয়েল।

এমব্রাস গির্জার হারানো ধনগুলো নিয়ে বিশপ কী করেছিলেন সে কথা আমরা ঠিক জানি না। সেগুলো সত্যিই বড় মূল্যবান বস্তু, বড় লোভনীয়। গরিবদের মঙ্গলের জন্য সেগুলো সত্যিই খুব উপযুক্ত, সেগুলো আগেই অপহৃত হয়েছিল। এবার সেই অপহৃত দ্রব্যগুলো অন্য পথে পরিচালিত করে সেগুলোর একটা সদ্ব্যবহার করা যেতে পারে! তবে আমরা কোনও মন্তব্য করতে চাই না এ বিষয়ে। এ বিষয়ে আমরা বিশপের একচ্ছত্র লেখা পেয়েছিলাম এক জায়গায়। তিনি লিখেছিলেন, এবার আমাকে স্থির করতে হবে এগুলো আমি গির্জাকে ফেরত দেব, না হাসপাতালে নিয়ে যাব।

.

যে সিনেটর ভদ্রলোকের নাম আমরা আগেই উল্লেখ করেছি সে সিনেটর ছিল এমনই একজন লোক যে এক দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ পূরণ করে যেত, যে তার স্বার্থপূরণের পথে বিবেক, ঈশ্বরবিশ্বাস, ন্যায়পরায়ণতা, কর্তব্যপরায়ণতা প্রভৃতি কোনও কিছুর দ্বিধা বা বাধা মানত না বা তার আপন লক্ষ্য হতে বিচ্যুত হত না। এই সিনেটর আগে ছিল এক দক্ষ সরকারি অ্যাটর্নি যে তার ছেলে, জামাই ও আত্মীয়-বন্ধুদের স্বার্থটা সব সময় বেশি করে দেখত এবং তার লাভের পথে পাওয়া যে কোনও সুযোগ হাতছাড়া করত না। কারণ এ সুযোগ হাতছাড়া করাটাকে সে বোকামি এবং অবান্তর বলে ভাবত। সে ছিল বুদ্ধিমান এবং সুশিক্ষিত। সে নিজেকে দার্শনিক এপিকিউরাসের শিষ্য বলে ভাবত, যদিও পিগল্ট ব্রোনের মতো নিচু স্তরের লেখকদের নীতিই সে বেশি মেনে চলত। সে চিরপ্রতিষ্ঠিত চিরন্তর সত্যের কথাগুলো হেসে উড়িয়ে দিত এবং আমাদের মহান বিশপের কাজকর্মকে বাতুলতা বলে তার সাক্ষাতে-অসাক্ষাতে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত।

একবার আধা-সরকারি অনুষ্ঠানে এই সিনেটর মঁসিয়ে মিরিয়েল আর পুলিশের এক বড়কর্তার সঙ্গে এক ভোজসভায় মিলিত হয়। খাওয়ার পর সে মদের ঘোরে বলতে থাকে, আসুন মঁসিয়ে, এবার কিছু কথা বলা যাক। একজন সিনেটর আর বিশপের মধ্যে নীতির দিক থেকে খুব একটা মিল হতে পারে না। আমরা দু জনেই ঈশ্বরের অনুগৃহীত ব্যক্তি। তবে আমি স্বীকার করছি আমার এক নিজস্ব জীবনদর্শন আছে।

বিশপ বললেন, তা তো বটেই। কোনও মানুষের জীবনদর্শন হচ্ছে তার বিছানার মতো, যার উপর সে শোয় প্রতিদিন। আপনার সে জীবনদর্শনের শয্যা হচ্ছে কুসুমশয্যা।

সিনেটর বলল, এখন কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষের মতো কথা বলব।

সাধারণ শয়তান বলতে পারেন।

আমি একথাও স্বীকার করি যে মার্কুই দ্য আর্গেনস, পাইরো, হবস, মঁসিয়ে নাইজিওন প্রমুখ দার্শনিকদের ভণ্ড পাণ্ডিত্যাভিমানী বলে মনে করি না। তবে আমার বইয়ের তাকে আরও অনেক দার্শনিকের বই আছে।

যাদের দর্শন আপনার নিজস্ব দর্শনের মতো।

সিনেটর বলল, আমি দিদেরোকে মোটেই পছন্দ করি না। তিনি হচ্ছেন ভাববাদী, বাগাড়ম্বরসর্বস্ব বাগ্মী, এমন একজন বিপ্লবী যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। তিনি ভলতেয়ারের থেকে আরও গোড়া। ভলতেয়ার বলতেন, নিডহ্যাম স্রষ্টা হিসেবে ঈশ্বরের কল্পনা আর বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে স্বতঃস্ফূর্ততার নীতি এই দুটি পরস্পরবিরুদ্ধ বিষয়কে তলিয়ে ফেলেছেন। এই নিয়ে বিদ্রূপ করেছেন নিডহ্যামকে নিয়ে। কিন্তু ভলতেয়ারের এটা অন্যায়। কারণ নিডহ্যাম যে পাঁকাল মাছের কথা বলেছেন তাতে এই কথাই প্রমাণ হয় ঈশ্বরের কোনও প্রয়োজন নেই সৃষ্টির ব্যাপারে। পাকাল মাছের মতো জগৎ ও জীবনের সৃষ্টির ব্যাপারেও পরম পিতার কোনও প্রয়োজন থাকতে পারে না। হে আমার প্রিয় বিশপ, এ বিষয়ে জেহোভা তত্ত্বও আমি বুঝতে পারি না। এ তত্ত্ব থেকে শুধু শীর্ণ আর রিক্তমস্তিষ্ক মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। আমি মহান সর্বস্ব থেকে মহান শূন্যতা বেশি পছন্দ করি। স্বীকারোক্তি হিসেবে আমি আপনার কাছে সরলভাবে স্বীকার করছি, আমি একজন সরল সাদাসিধে মানুষ। আপনাদের যিশুর প্রতি আমার কোনও ভালোবাসা নেই। তিনি শুধু বৈরাগ্য আর আত্মত্যাগ প্রচার করে গেছেন, যা ভিক্ষুকদের প্রতি কৃপণের উপদেশ ছাড়া আর কিছুই নয়। এ বৈরাগ্য এ ত্যাগ কিসের জন্য? একটি নেকড়ে কখনও অন্য নেকড়ের মঙ্গলের জন্য কিছু ত্যাগ করেছে একথা আমি কখনও শুনিনি। প্রকৃতিকে অনুসরণ করা উচিত আমাদের। যেহেতু মানুষ হিসেবে আমরা সব জীবের ঊর্ধ্বে, আমাদের এক উন্নততর জীবনদর্শন থাকা উচিত। আপনি মানুষ হয়ে যদি অন্য কোনও মানুষের নাকের ডগা ছাড়া আর কিছু দেখতে না পান তা হলে সব কিছু বিষয়ে মাতব্বরি করে লাভ কী? যে জীবন আমরা পেয়েছি সে জীবন যতদূর পারি সুখে কাটানো উচিত! এ জীবনের পর স্বর্গ বা নরক বলে কিছু আছে, একথা আমি পরিষ্কার অবিশ্বাস করি। আপনি শুধু ত্যাগ করে বৈরাগ্যের প্রয়োজনীয়তার কথা আমাকে বলবেন। আমাকে প্রতিটি কাজ চিন্তা-ভাবনা করে করতে হবে, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ নিয়ে আমার মস্তিষ্ককে বিব্রত থাকতে হবে সব সময়। কিন্তু কেন? কারণ পরে তার বিচার হবে, সব কর্মাকর্মের জন্য আমাকে জবাব দিতে হবে। কখন? না, আমার মৃত্যুর পরে। আমার মৃত্যুর পর আমাকে ধরার জন্য নিশ্চয় এক চতুর বিচারকের প্রয়োজন হবে। কারণ তখন আমার প্রেতাত্মার হাতে একমুঠো ধুলো ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। কী উদ্ভট কল্পনা! আমরা বাস্তব সত্যকে স্বীকার না করে যারা আইসিসের আঁচলের তলায় উঁকিঝুঁকি মারে তাদের নিয়ে মাতামাতি করি। আসলে ভালো-মন্দ বলে কিছু নেই। চাই উন্নতি সব কিছু বাদ দিয়ে একমাত্র বাস্তব সত্যকে আমাদের খোঁজা উচিত। সব কিছু তলিয়ে দেখতে হবে, বস্তুর স্বরূপকে দেখতে হবে। তাই নয় কি? সত্যকে ধরার জন্য দরকার হলে পৃথিবীর তলদেশের শেষ প্রান্তে যেতে হবে। বলিষ্ঠ হয়ে গড়ে উঠে আনন্দ উপভোগ করাটাই গৌরবের। আমি যদি বলিষ্ঠতার সঙ্গে খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারি এটাই যথেষ্ট। মানুষের অমরত্ব একটা বিশ্বাস মাত্র, এক মধুর প্রতিশ্রুতির মিথ্যা সান্ত্বনা–আপনি ইচ্ছা করলে তা বিশ্বাস করতে পারেন। আদম হতে পারাটা কত আনন্দের কথা অথবা কোনও বিদেহী আত্মা অথবা পিঠে নীল ডানাওয়ালা কোনও দেবদূত হবে মানুষ? তার্তুলিয়া না কে যেন বলছিল না ঈশ্বরের অনুগৃহীত বা আশীর্বাদধন্য মানুষ একদিন গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে স্বচ্ছন্দে ভ্রমণ করে বেড়াবে। আমরা হব আকাশের ফড়িং। আমরা ঈশ্বরকে দেখব। যত সব বাজে কথা। ঈশ্বর হচ্ছে এক অদ্ভুত ধরনের ভণ্ড প্রতারক। একথা আমি অবশ্য লিখব না, একথা আমি শুধু মদ্যপানের সময় আমার বন্ধুদের কাছে চুপি চুপি বলব। স্বর্গের লোভে এ জগতের সব কিছু ত্যাগ করা হল বস্তুকে ফেলে ছায়াকে ধরতে যাওয়ার মতোই এক বাতুলতামাত্র। অনন্তের হাতের পুতুল হওয়া আমার ধাতে সইবে না, আমার দ্বারা তা হবে না। আমি কে? কিছুই না। আমি একজন সিনেটর। কিন্তু জন্মের আগে কি আমার কোনও অস্তিত্ব ছিল? না। মৃত্যুর পর কি আমার কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। আমি শুধু একমুঠো মাটির দ্বারা গঠিত এক বস্তু। আমি পৃথিবীতে কী করব? আমাকে সেটা ঠিক করে নিতে হবে।

আমি দুঃখ ভোগ করতে পারি অথবা আনন্দ উপভোগ করতে পারি। আমাকে সেটা বেছে নিতে হবে। এই দুঃখভোগের শেষ পরিণতি কী? এর পরিণতি হচ্ছে বিস্মৃতি। তবু আমাকে দুঃখভোগ করে যেতেই হবে। আনন্দ উপভোগেরই-বা পরিণতি কোথায়? বিস্মৃতিতে। তবু আমি আনন্দ উপভোগ করেই যাব। আমি এটা স্থির করে ফেলেছি, এটা আমি বেছে নিয়েছি। মানুষ হয় খাবে, অথবা কারও দ্বারা খাদিত হবে। আমি খেয়েই যাব। ঘাসের থেকে দাঁত থাকা ভালো। আপনি যা কিছুই করুন-না কেন, পরিণামে মৃত্যু আপনার জন্য প্রতীক্ষা করছে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মৃত্যুর পর তাদের উজ্জ্বল কীর্তির সমাধিস্তম্ভ লাভ করবে, কিন্তু সবাইকেই নরকে যেতে হবে। মৃত্যুতেই সবার সব কিছু শেষ হয়ে যাবে। এক সম্পূর্ণ সর্বভূতে বিলুপ্তি, সবাই অদৃশ্য হয়ে যাবে। আমার মৃত্যুর পর কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে এবং আমাকে কিছু বলবে এই কথা শুনলে আমার হাসি পায়। এটা বুড়িদের এক অবান্তর অর্থহীন রূপকথা। শিশুদের জন্য আছে শয়তান আর বয়স্ক লোকদের জন্য আছে জেহোভা। না, আমাদের মৃত্যুর পর সব কিছুই অন্ধকার। আপনি সাধু বা শয়তান। সার্দানাপেলাম বা ভিনসেন্ট পল যাই হোন না কেন, সমাধির ওপারে সকলের জন্যই বিরাজ করছে নরকের অন্ধকার। এইটাই হল সত্যি কথা। মানবজীবনের একমাত্র কাজ হল বাঁচার মতো বাঁচা। যতদূর সম্ভব জীবনের সদ্ব্যবহার করুন। আমার এক নিজস্ব জীবনদর্শন আছে, আমার বাছাই করা একজন দার্শনিকও আছে। তবে আমি যতসব আজগুবি কথা বিশ্বাস করে বোকা বানাতে চাই না নিজেকে। তবে আমি একথা বলতে চাই না যে এ বিশ্বাসের কারও কোনও প্রয়োজন নেই একেবারে। যারা নিঃস্ব, দরিদ্র, যারা পেট ভরে খেতে পায় না, যাদের কোনও ঘরবাড়ি নেই, যারা অধঃপতিত বা নিজে নেমে গেছে, তাদের বাঁচার জন্য একটা বিশ্বাস চাই। আমরা তাদের পুরাণ ও গল্পকথা শোনাই, আত্মা, অমরত্ব, স্বর্গ, ভাগ্য এইসব কিছুর কথা বলে সান্ত্বনা দিই এবং তারা এই কথাগুলো গোগ্রাসে গিলে খায়। তারা মাখনের পরিবর্তে এইসব কথার অমৃত তাদের শুকনো রুটিগুলোতে মাখিয়ে নেয়। যাদের কিছুই নেই, একেবারে নিঃস্ব, তাদের ঈশ্বর আছে। কিছু না থাকার থেকে এটা ভালো এবং আমার তাতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু আমার কথা স্বতন্ত্র। আমি চাই বস্তুবাদকে আঁকড়ে ধরে থাকতে। ঈশ্বর থাক সাধারণ মানুষদের জন্য।

বিশপ হাততালি দিয়ে উঠলেন।

তিনি আবেগের সঙ্গে বললেন, চমঙ্কার কথা। এ ধরনের বস্তুবাদ কী চমৎকার জিনিস! সকলেই এ বস্তুবাদ লাভ করতে পারে না। কিন্তু যে ব্যক্তি তা লাভ করে সে তো আর নিজেকে বোকা বানাতে পারে না। সে তো আর কেটোর মতো নির্বাসিত করতে পারে না নিজেকে। স্টিফেনের মতো পাথরের আঘাত খেয়ে মরতে পারে না অথবা জোয়ান অব আর্কের মতো জীবন্ত দগ্ধ হতে পারে না। একজন দায়িত্বহীন মানুষের সব আনন্দ সে লাভ করতে পারে, সে তার সহজ অতিসরল মন নিয়ে সারা পৃথিবীটাকে পরিক্রমা করতে পারে–এই ধরনের একটা আত্মপ্রসাদও সে অনুভব করতে পারে–অনেক সম্মান ও শক্তি সে লাভ করতে পারে, লাভজনক নাস্তিকতা, বিশ্বাসঘাতকতা, বিবেকের সঙ্গে সুবিধাজনক আপোস এইসব কিছুকেই সে প্রশ্রয় দিতে পারে। এইসব কিছুই উদরস্থ করে সে তার সমাধিতে যেতে পারে। কত আনন্দের কথা! আমি আপনাকে তিরস্কার করছি না মঁসিয়ে সিনেটর। আমি আপনাকে অভিনন্দন না জানিয়ে পারছি না। আপনি বলেছেন, আপনারা যারা সমাজের উপরতলার মানুষ তাদের এক নিজস্ব জীবনদর্শন আছে। যে দর্শন সূক্ষ্ম, মার্জিত, যে দর্শন শুধু ধনীদের ক্ষেত্রেই থাকে, সব অবস্থাতেই যা খাপ খায় সে দর্শন জীবনের যত কিছু আনন্দলাভের পক্ষে নিঃসন্দেহে এক চমৎকার হাতিয়ার। যারা এ বিষয়ে সিদ্ধ তাদের অন্তরের গম্ভীর হতে এ দর্শন উৎসারিত। কিন্তু আপনি সহৃদয় ব্যক্তি, যেসব সাধারণ মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে তাদের প্রতি আপনার কোনও ঈর্ষা বা ক্ষোভ নেই।

.

দিগনের বিশপ কিভাবে তাঁর পারিবারিক জীবনযাত্রা নির্বাহ করতেন এবং তাঁর বাড়ির দু জন মহিলা তাদের কর্ম, চিন্তা, প্রবৃত্তি ও জীবনের উদ্দেশ্যকে বিশপের কর্ম ও চিন্তার অনুগত করেছিল তা লিখে প্রকাশ না করে তার সারা জীবনের বান্ধবী ভিকেঁতেসি দ্য বয়শেনকে লেখা একখানি চিঠি উদ্ধৃত করব।

দিগনে, ১৬ ডিসেম্বর
প্রিয় মাদাম,

তোমার কথা না বলে আমাদের একটা দিনও কাটে না। এটা যেন আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। তবে তোমাকে চিঠি লেখার আর একটা কারণ আছে। এখানে আসার পর আমাদের ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে ম্যাদময়জেল ম্যাগলোরি দেয়ালে একটা জিনিস দেখতে পায়। কাগজের তলায় কিছু দেয়ালচিত্র দেখতে পাই আমরা। একটা চিত্রে দেখা যায় টলেমা মিনার্ভার কাছ থেকে নাইট উপাধি গ্রহণ করছেন। তাতে সন তারিখ সব লেখা আছে। আর একটি চিত্র উলেমার বাগানবাড়ির, যে বাগানে একটি রাত রোমের মহিলারা কাটান। ম্যাগলোরি ঘরটা ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলেছে এবং সেটা এখন জাদুঘরের মতো দেখাচ্ছে। ছবিগুলো রঙ করতে ছয় ফ্রাঁ খরচ হবে। কিন্তু টাকাটা গরিব-দুঃখীদের দান করাই ভালো। তার থেকে আমার ঘরের জন্য একটা গোল মেহগনি কাঠের টেবিল কিনব।

আমি সুখেই আছি। আমার দাদা খুব ভালো লোক। তিনি তার যথাসর্বস্ব আর্ত ও অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিদের দান করেন। আমাদের সংসারে কখনই সচ্ছলতা থাকে না। এ অঞ্চলে শীত খুব বেশি এবং এ অঞ্চলের অভাবগ্রস্ত শীতার্ত ব্যক্তিদের শীত নিবারণের জন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হয়। যাই হোক, কোনও রকমে আমরা নিজেদের গরম রাখার ব্যবস্থা করি এবং অন্ধকারে আলো জ্বালি না, এটাই আমাদের বড় যন্ত্রণার কথা।

আমার দাদার কিছু দোষও আছে। কিন্তু উনি বলেন এ দোষ বিশপের থাকা উচিত। তুমি হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবে না, আমাদের ঘরে কখনও তালাচাবি দেওয়া হয় না। যে কোনও লোক ইচ্ছা করলেই আমার দাদার ঘরে সোজা ঢুকে পড়তে পারে। তিনি কোনও কিছুই ভয় করেন না, রাত্রিতেও ভয় করেন না। তিনি বলেন, এটা তার এক ধরনের সাহস।

তিনি আমাকে বা ম্যাগলোরিকে তার সম্বন্ধে কোনও কথা ভাবতে দেন না। তিনি যত সব বিপদের ঝুঁকি নেবেন, অথচ আমাদের তা নির্বাক দর্শকের মতো দেখে যেতে হবে। তাকে বুঝতে, শিখতে হবে। তিনি বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে যান, কাদার উপর দিয়ে যাতায়াত করেন, দারুণ শীতকেও গ্রাহ্য করেন না। তিনি অন্ধকার, দুর্গম পথ বা পথের বিপদ-আপদ কোনও কিছুই ভয় করেন না।

গত বছর তিনি এমন এক অঞ্চলে একা যান যে অঞ্চলটা ভয়ঙ্কর দস্যুদের দ্বারা অধ্যুষিত। আমাদের কাউকে তিনি সঙ্গে নিয়ে গেলেন না। তিনি সেখানে একপক্ষকাল ছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম তিনি মারা গেছেন দস্যুদের হাতে। কিন্তু তিনি অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসে বললেন, ‘আমি তোমাদের দেখাব আমি কিভাবে অপহৃত হয়েছি।’ এই বলে তিনি একটি বাক্স খুলে সেইসব ধনরত্ন বার করলেন, যা কিছুদিন আগে এমব্রাস গির্জা থেকে চুরি যায় এবং সেগুলো ডাকাতরা তাকে ফিরিয়ে দেয়। তিনি যখন সেখান থেকে ফিরে আসেন আমি তখন অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলাম তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। তাকে কিছুটা তিরস্কারও করেছিলাম, কিন্তু এমনভাবে তিরস্কারের কথাগুলো বলেছিলাম যাতে কেউ তা শুনতে না পায়।

ক্রমে আমি ভাবতে থাকি, কোনও বিপদ তাঁকে কোনও কাজে বাধা দিতে পারবে না, তিনি নির্ভীক, দুর্জয়। এইভাবে তাঁর জীবনযাত্রা প্রণালীর সঙ্গে পরিচিত ও অভ্যস্ত হয়ে উঠি আমি। ম্যাগলোরি যাতে তাঁকে বিরক্ত না করে তার জন্য নিষেধ করি আমি। তিনি ইচ্ছামতো যত সব বিপদের ঝুঁকি নেন। আমি রোজ রাতে ম্যাগলোরিকে তার ঘরে শুতে পাঠিয়ে আমি আমার ঘরে তার জন্য প্রার্থনা করি, তার পর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি। ভাবি, তার যদি কোনও বিপদ ঘটে তা হলে আমাদেরও তাঁর সঙ্গে মরতে হবে। তা হলে আমার ভাই এবং বিশপের সঙ্গে আমাদেরও মৃত্যুপুরীতে যেতে হবে। তাঁর এই হঠকারিতা আমার যেতে ম্যাগলোরির পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু এখন সে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে এবং শোবার আগে সে-ও আমার সঙ্গে প্রার্থনা করে। শয়তান যদি তার ঘরে ঢোকে কেউ তাকে বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু আমাদের বাড়িতে কোনও কিছু হারাবারই-বা কি আছে? আমাদের সঙ্গে এমন একজন সব সময় আছেন যিনি সবার থেকে শক্তিমান। শয়তান আমাদের বাড়িতে আসতে পারে, কিন্তু সেই সর্বশক্তিমান আমাদের বাড়িতে বাস করেন।

এই হল তাঁর কথা। আমার দাদা আমাকে আর কোনও কথা বলেন না। তিনি কিছু বললেও তার সব কথা আমি বুঝি এবং ঈশ্বরের বিধানে আস্থা রাখি। এক মহান আত্মার সঙ্গে এইভাবে আমরা বাস করি।

ফক্স পরিবারের যেসব কথা তুমি জানতে চেয়েছ সেসব কথা তাঁকে জিগ্যেস করেছিলাম আমি। তুমি জান তিনি এই ব্যাপারে সব কিছুই জানেন এবং সব কিছুই তাঁর মনে আছে। তিনি এখনও মনে-প্রাণে রাজতন্ত্রবাদীই রয়ে গেছেন। ফক্স পরিবার কেন অঞ্চলের এক প্রাচীন নর্মান পরিবার। ওই পরিবারের রুল দ্য ফক্স, আঁ দ্য ফক্স, টমাস দ্য ফক্সের পাঁচশো বছরের পুরনো অনেক নথিপত্র আছে। এরা সবাই সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক। এই পরিবারের সেনার দ্য বশেফোর্ট নামে এক ভদ্রলোক বড়দরের একজন সামন্ত ছিলেন। এই পরিবারের শেষ বংশধর লি এতিয়েন আলেকজান্দার সামরিক বিভাগের একজন কর্নেল ছিলেন এবং তিনি তোর ছোটখাটো এক অশ্বারোহী দলের সেনাপতিত্ব। করেন। তাঁর কন্যা মেরি লুই ফরাসি বাহিনীর এক বড় সামরিক অফিসার, দাক লুই দ্য গ্রেদ্রতের পুত্র আমিয়েঁ শার্লসকে বিবাহ করেন। এই পরিবারের নাম ফক্স বা ফক।

আশা করি মাদাম, তুমি তোমার সাধুপ্রকৃতির আত্মীয় কার্ডিনালকে আমাদের কথা বলবে। তোমার প্রিয় সিলভানি তোমার কাছে সব সময় থাকে এবং তোমাকে চিঠি লিখতে দেয় না। কিন্তু সে ভালো আছে জেনে সুখী হলাম। সে আমাকে আজও ভালোবাসে জেনে খুশি হলাম। আমার শরীর ভালোই আছে, তবে দিন দিন চেহারাটা রোগা হয়ে যাচ্ছে। আমার কাগজ ফুরিয়ে আসছে। প্রীতি নিও। ইতি।

বাপতিস্তিনে।

তোমার বউদি এখন এখানেই আছে তাঁর ছোট সংসার নিয়ে। তোমার ভাইপোর ছেলেটি বেশ সুন্দর। সে পাঁচ বছরে পড়েছে। সে তার ছোট ভাইকে নিয়ে খেলা করে বেড়াচ্ছে।

এই চিঠিটি থেকে বোঝা যাবে এই দু জন মহিলা তাদের সহজাত নারীসুলভ বুদ্ধির দ্বারা একজন মানুষকে ভালোভাবেই চিনতে পেরেছিল এবং বিশপের জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। বিশপ ইচ্ছামতো তাঁর কাজ করে যাচ্ছিলেন। অনেক সময় তিনি অনেক দুঃসাহসিক কাজ বিপদের ঝুঁকি নিয়ে করতেন। তা দেখে তাঁর বোন শিউরে উঠত ভয়ে। ম্যাগলোরি প্রতিবাদ করতে যেত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেরে উঠত না। কোনও কিছুই তাঁকে তাঁর কর্তব্যপথ থেকে বিচ্যুত করতে পারত না। তারা বুঝতে পারত তারা বিশপের ছায়া মাত্র; বিশপের কোনও কাজের ব্যাপারে বাধা দেওয়ার মতো কোনও ক্ষমতাই তাদের নেই। তারা শুধু সময়মতো চেষ্টা করে যেত। ক্রমে বিশপের ব্যাপারটা ঈশ্বরের ওপর ছেড়ে দেয়।

বাপতিস্তিনে জানত এবং মুখে বলত তার দাদার মৃত্যু মানেই তাদের মৃত্যু। ম্যাগলোরি মুখে এ কথা না বললেও মনে মনে তা জানত।

.

১০

বাপতিস্তিনে তার বান্ধবীকে চিঠিটা লেখার পর অল্প দিনের মধ্যেই এমন একটি দুঃসাহসিক কাজ করেন বিশপ, যা দস্যু-অধ্যুষিত সেই পার্বত্য এলাকায় যাওয়ার থেকে অনেক বেশি বিপজ্জনক। দিগনের অনতিদূরে একজন লোক নিভৃতে আত্মগোপন করে ছিল। লোকটি বিপ্লবী কনভেনশনের একজন ভূতপূর্ব সদস্য ছিল।

দিগনের সমস্ত লোক লোকটার নাম শুনলেই ভয়ে শিউরে উঠত। লোকটা যেন এক রাক্ষস। কনভেনশনের সদস্য–যেন এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। যদিও সে রাজার মৃত্যুর সপক্ষে ভোট দান করেনি তথাপি নীতিগতভাবে সে তাই চেয়েছিল। তাই রাজহত্যায় তার হাত ছিল বলে একটা কুখ্যাতি ছিল তার। তা যদি হয় তা হলে বৈধ রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর তার বিচার হল না কেন? তারা তার মাথা কাটতে পারত, আবার সে জীবন ভিক্ষা চাইলে তাকে মার্জনা করা হত। আবার একটা দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য তাকে নির্বাসিত করাও হত। আর সব বিপ্লবীর মতো সে আবার নাস্তিক ছিল। তাই শকুনির চারদিকে ভিড় করা সন্ত্রস্ত রাজহাঁসের দলের মতো শহরের লোকটার ভীতিবিহ্বল দৃষ্টিতে দেখত তাকে।

কিন্তু লোকটা কি সত্যিই একটা ভয়ঙ্কর শকুনি ছিল? সে তো নির্জনে নিভৃতে এক জায়গায় বাস করত।

রাজার মৃত্যুর ব্যাপারে সে ভোট না দেওয়ায় নির্বাসনদণ্ডে দণ্ডিতদের তালিকায় তার নাম ছিল না। তাই সে ফ্রান্সে থাকতে পেরেছিল। শহর থেকে কিছু দূরে এমন একটা নির্জন উপত্যকায় বাস করত যেখানে যাওয়ার কোনও রাস্তাঘাট ছিল না। লোকে বলত সে নাকি একটুকরো জমি চাষ করত এবং নিজের থাকার জন্য আদিম কালের মতো একটা কুঁড়ে তৈরি করে ছিল, যেটাকে একটা পশুর গুহা বলা যেতে পারে। কেউ তার কাছে যেত না। লোকে বলত সেটা ঘাতকের ঘর। সেই উপত্যকায় যাওয়ার যে একটা পথ ছিল লোকটা সেখানে বাস করতে যাওয়ার পর থেকে কেউ সেখানে যাতায়াত না করায় পথটায় বন গজিয়ে ওঠে।

একমাত্র বিশপ সেই উপত্যকা দিয়ে যেতে যেতে তার শেষ প্রান্তে গাছপালাগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে ভাবতেন, ওখানে এক নিঃসঙ্গ ব্যক্তি বাস করে। তার পরই মনে ভাবতেন, তার কাছে একবার আমার যাওয়া উচিত।

তবে কথাটা প্রথমে স্বাভাবিক এবং সরল মনে হলেও কিছুটা ভাবনা-চিন্তা করার পর সেটা অদ্ভুত আর অসম্ভব মনে হল তার। কিছুটা বিতৃষ্ণা জাগল তাঁর মনে। কারণ সাধারণ লোকে যা ভাবত তা তিনিও ভাবতেন। একজন ভূতপূর্ব নাস্তিক বিপ্লবী তাঁর মনে স্বাভাবিকভাবেই যে বিতৃষ্ণা জাগায় তা ক্রমে ঘৃণায় পরিণত হয়। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি এটাও ভাবতেন যে রাখাল কি কখনও ভেড়াকে ভয় বা ঘৃণা করে সরে যায় তার থেকে কখনই না। কিন্তু এ ভেড়াটা তো শয়তান। বিশপ একটা অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েন। তিনি কয়েকবার লোকটার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে মাঝপথ থেকে ফিরে আসেন।

একদিন শহরে একটা কথা শোনা গেল। যে একটা গ্রাম্য ছেলে লোকটার কাছে কাজ করত, সে হঠাৎ শহরে ডাক্তারের খোঁজে আসে। লোকটার নাকি খুব অসুখ। জানা গেল তার শরীরের একটা অঙ্গ পক্ষাঘাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। শহরের লোকেরা। বলাবলি করতে লাগল, বুড়ো রাক্ষসটা মরতে বসেছে, কেউ কেউ আবার বলতে লাগল, ভালোই হয়েছে।

সেদিন বিকালের দিকে তার ছেঁড়া আলখাল্লাটা ঢাকার জন্য একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে ছড়ি হাতে বেরিয়ে পড়লেন বিশপ।

তিনি যখন পশুর গুহার মতো বুড়ো লোকটার কুঁড়েতে পৌঁছলেন তখন দিগন্তে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। একটা খাল পার হয়ে একটা ঝোঁপের পাশ দিয়ে একটা ছোটখাটো বাগানের বেড়া ঠেলে এগিয়ে গিয়ে কুঁড়েটা দেখতে পেলেন বিশপ। একটু দূর থেকে দেখতে পেলেন তিনি, বৃদ্ধ পাকা চুলওয়ালা লোকটি সেই কুঁড়ের দরজার কাছে একটা সাদাসিধে ইজি চেয়ারের উপর বসে সূর্যাস্ত দেখছে আর যে ছেলেটা তার ফাইফরমাশ খাটত সেই ছেলেটা তার হাতে একটা বাটি দুধ দিচ্ছে।

দুধটা খেয়ে লোকটা ছেলেটার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বলল, ধন্যবাদ! এখন এটাই আমি চাইছিলাম।

বিশপের পায়ের শব্দ পেয়ে সেদিকে তাকাল লোকটা। দীর্ঘকাল পর একজন মানুষকে তার কাছে আসতে দেখায় সীমাহীন বিস্ময়ের এক অনুভূতি তার চোখেমুখে ফুটে উঠল।

লোকটা বিশপকে বলল, আমি এখানে আসার পর থেকে একমাত্র আপনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি আমার কাছে এলেন। আপনি কে মঁসিয়ে?

বিশপ উত্তর করলেন, আমার নাম বিয়েনভেনু মিরিয়েল।

বিয়েনভেনু মিরিয়েল! এ নাম আমি তো কখনও শুনিনি। তবে লোকে যাকে মঁসিয়ে বিয়েনভেনু বলে আপনি কি সেই?

হ্যাঁ, তাই।

লোকটি হাসিমুখে বলল, তা হলে আপনি তো আমারও বিশপ।

অল্পবিস্তর তাই।

করমর্দনের জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিল লোকটি। কিন্তু বিশপ তা ধরলেন না। তিনি শুধু বললেন, তা হলে কি আমি ভুল খবর পেয়েছি? আপনাকে তো খুব একটা অসুস্থ দেখাচ্ছে না।

বৃদ্ধ লোকটি বলল, আমার সব কষ্টের অবসান হতে চলেছে।

একটু থেমে সে আবার বলল, তিন ঘণ্টার মধ্যেই আমি মারা যাব। আমি চিকিৎসাবিদ্যার কিছুটা জানি। আমি জানি আমার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। গতকাল শুধু আমার পা দুটো অসাড় হয়ে যায়। আজ সকালবেলায় সেই অসাড় ভাবটা হাঁটু পর্যন্ত উঠে আসে, এখন আবার দেখছি সেটা কোমর পর্যন্ত উঠে এসেছে। এই পক্ষাঘাত রোগটা আমার হৃৎপিণ্ডটাকে আক্রমণ করলেই আমি আর বাঁচব না। সূর্যাস্তটা সত্যিই খুব সুন্দর। তাই না কি? আমি ছেলেটাকে চেয়ারের চাকাটাকে ঘুরিয়ে এই দিকে আনতে বললাম যাতে আমি শেষবারের মতো পৃথিবীটা দেখতে পারি। আপনি ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারেন, আমি বিরক্তবোধ করব না। আপনি একজন মুমূর্ষ লোককে দেখতে এসে ভালোই করেছেন। এই সময় একজন সাক্ষী দরকার। সব লোকেরই এক একটা খেয়ালখুশি থাকে। আমি চেয়েছিলাম আগামীকাল সকাল পর্যন্ত বাঁচতে, কিন্তু আমি জানি আমার জীবন আর মাত্র তিন ঘণ্টা আছে। দিনের আলোর আর প্রয়োজন নেই, আমি নক্ষত্রের আলোয় মরব।

এরপর ছেলেটার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, যাও তুমি শোওগে। তুমি গতকাল সারারাত জেগেছ, এখন ক্লান্ত।

ছেলেটা ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। লোকটি তখন নিজের মনে বলতে লাগল, ও যখন ঘুমোবে তখনই আমার মৃত্যু হবে। দুটি ঘুম পাশাপাশি চলবে।

রুগণ মুমূর্ষ লোকটির অবস্থা দেখে বিশপ যতটা বিচলিত হবেন ভেবেছিলেন ততটা বিচলিত তিনি হলেন না। এই ধরনের লোকের মধ্যে ঈশ্বরের কোনও উপস্থিতি অনুভব করতে পারলেন না তিনি। তাঁর প্রতি লোকটার ভাবভঙ্গি ভালো লাগল না। সাধারণ মানুষের মতো মহান ব্যক্তিদের স্বভাবে কতকগুলি অসংগতি থাকে। সে বিশপ সাধারণত কারও কাছ থেকে কোনও সম্মান চান না, তাঁকে মহান বিশপ’ বলে সম্বোধন করলে তিনি তা হেসে উড়িয়ে দিতেন, বিরক্ত বোধ করতেন। আজ এই ভূতপূর্ব বিপ্লবী তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান না দেখানোয় এবং তাঁকে মঁসিয়ে হিসেবে সম্বোধন না করায় তিনি ক্ষুণ্ণ না হয়ে পারলেন না। সাধারণ যাজক আর ডাক্তাররা অবশ্য সর্বত্র যথাযোগ্য সম্মানের প্রত্যাশা করে এবং তা না পেলে ক্ষুণ্ণ হয়। কিন্তু বিশপ তো সে ধরনের লোক নন। কারও কাছ থেকে কোনও সম্মান প্রত্যাশা করা তাঁর স্বভাব নয়, এটা তাঁর অভ্যাসের বাইরে। বিপ্লবী কনভেনশনের ভূতপূর্ব সদস্য, জনগণের প্রতিনিধি এই বৃদ্ধ লোকটি একদিন সত্যিই খুব সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন।

লোকটা বিশপকে যথাযোগ্য সম্মান না দেখালেও তার কথাবার্তায় একটা অন্তরঙ্গতার ভাব আর একটা নম্রতা ছিল, যে নম্রতা সব মুমূর্ষ লোকের মধ্যে দেখা যায়।

বিশপ লোকটির প্রতি কোনও অযথা বা অসংযত কৌতূহল না দেখালেও সহানুভূতিমিশ্রিত এক মনোযাগে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন তাকে। সেই সহানুভূতির বশে অন্য কেউ হলে তিনি তাকে তিরস্কার করতেন। কিন্তু বিপ্লবীদের অন্য চোখে দেখতেন। তাঁর মতে বিপ্লবীরা হল পলাতক দস্যুদের থেকে একটু উপরে এবং দানশীলতার পরিসীমার বাইরে।

লোকটি অল্প সময়ের মধ্যে মরবে বললেও তখনও সে শান্তভাবে খাড়া হয়ে বসেছিল। তার স্পষ্ট পরিষ্কার কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হচ্ছিল চারদিকে। এই অশীতিপর মুমূর্ষ লোকটি যেকোনও মনোবিজ্ঞানীকে তাক লাগিয়ে দেবে। বিপ্লবের সময়ে এই ধরনের সহিষ্ণু ও শক্তিমান লোক অনেক দেখা গেছে। কিন্তু লোকটার সহ্য করার শক্তি সত্যিই অসাধারণ। ঠিক এই মুহূর্তে মৃত্যু তার এত কাছে ঘনিয়ে আসা সত্ত্বেও তাকে দেখে সুস্থ ও সবল বলে মনে হচ্ছে। তার দৃষ্টির স্বচ্ছতায়, তার কণ্ঠের দৃঢ়তায়, তার কাঁধ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বলিষ্ঠ সঞ্চালনে এমন একটা উদ্ধত অনমনীয় ভাব দেখা যায় যা মৃত্যুকে অস্বীকার করছে, যা। কখনই মাথা নত করতে চায় না মৃত্যুর কাছে। মুসলমানদের মৃত্যুদূত আজরাইল আজ তার আত্মাকে এই সময় নিতে এলে সে নিজে নিজেই ফিরে যাবে, ভাববে সে ভুল করে এ দরজায় ঢুকে পড়েছে। মনে হচ্ছে লোকটা যেন ইচ্ছামৃত্যু বরণ করে নিচ্ছে। সে মরতে চাইছে বলেই সে মরছে। মৃত্যু জোর করে ধরে নিয়ে যেতে পারছে না তাকে। রোগযন্ত্রণার মধ্যে একটা মুক্তির আনন্দ তাকে আচ্ছন্ন করে আছে যেন। তার একটা পা গতি হারিয়ে ফেলেছে আর তাই মৃত্যুর অন্ধকার একমাত্র সেই জায়গাটাতেই এসে চেপে ধরেছে। তার একটা পা শুধু মরে গেছে, কিন্তু তার মাথাটা পরিপূর্ণভাবে বেঁচে আছে। এখনও এবং মনে হচ্ছিল তার সমস্ত প্রাণশক্তি এখনও তার আয়ত্তেই আছে। এই বিরল মুহূর্তে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন প্রাচ্যের এক রূপকথার নায়ক রাজা, যার দেহের উপর দিকটায় মাংস আছে আর নিচের দিকটা মর্মর প্রস্তরে গাঁথা।

কুঁড়েটার সামনে যে একটা পাথর ছিল তার উপরে বসলেন বিশপ। বসেই কোনও ভূমিকা না করেই তার ধর্মীয় উপদেশ দানের কাজ শুরু করলেন। তিনি প্রথমে বললেন, একটা বিষয়ের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি আপনাকে। আপনি অন্তত রাজার মৃত্যুর জন্য ভোট দেননি।

‘অন্তত’ কথাটার যে একটা ঝাঁঝ ছিল তা লক্ষ করে কড়াভাবে লোকটি বলল, আমাকে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে কিন্তু খুব একটা বেশি দূর যাবেন না মঁসিয়ে। আমি এক অত্যাচারীর উচ্ছেদের জন্য ভোট দিয়েছিলাম।

তার মানে? বিশপ জিজ্ঞাসা করলেন।

তার মানে এই যে মানুষ আসলে শাসিত হয় এক অত্যাচারীর দ্বারা, যার নাম হল অজ্ঞতা। এই অত্যাচারীরই উচ্ছেদ আমি চেয়েছিলাম। এই অত্যাচারীই রাজতন্ত্রের জন্ম দেয়। রাজতন্ত্রের যা কিছু শক্তি ও প্রভুত্ব তা মিথ্যার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু জ্ঞানের যা কিছু শক্তি তা সত্যের ভিত্তিভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষ শাসিত হবে জ্ঞানের দ্বারা।

বিশপ বললেন, জ্ঞান আর বিবেক।

ও দুটো এক জিনিস। বিবেক হচ্ছে জ্ঞানেরই অন্তর্নিহিত এক শক্তি।

আশ্চর্য হয়ে এই কথাগুলো শুনতে লাগলেন বিশপ। তাঁর মনে হল এটা যেন। জীবনকে দেখার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। বিপ্লবী আবার বলতে লাগল, রাজা ষোড়শ লুইয়ের ক্ষেত্রে তাঁর মৃত্যুর বিরুদ্ধে আমি ভোট দিয়েছিলাম। আমি মনে করি না কোনও মানুষকে হত্যা করার অধিকার আমার আছে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, অন্যায়কে উচ্ছেদ করা আমার কর্তব্য। আমি নারীদের বেশ্যাগিরি, ক্রীতদাসপ্রথা, শিশুদের ওপর অবিচার প্রভৃতি অত্যাচারগুলোর উচ্ছেদের জন্য ভোট দিয়েছিলাম। প্রজাতন্ত্রের পক্ষে ভোট দিয়ে আমি আসলে এইসব অত্যাচারের অবসান ঘটাতে চেয়েছিলাম। আমি সৌভ্রাতৃত্ব, ঐক্য আর এক নতুন যুগের প্রভাতের জন্য ভোট দিয়েছিলাম। সমস্ত রকমের কুসংস্কার আর মিথ্যাচারের পতন ঘটাতে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম এগুলোর ধ্বংস। হলেই সব অন্ধকার কেটে গিয়ে আলোর যুগ আসবে। দুঃখের পৃথিবী অনাবিল আনন্দের আধারে পরিণত হবে।

বিশপ বললেন, কিন্তু সে আনন্দ অনাবিল আনন্দ নয় নিশ্চয়।

বিপ্লবী বলল, আপনি বলতে পারেন এটা অনিশ্চিত আনন্দ, কারণ রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে অতীত আবার ফিরে আসায় সে আনন্দ বিলীন হয়ে যায়। হায়, আমার কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেল। আমরা পুরনো রাষ্ট্র ও সমাজের কাঠামোটাকে ধ্বংস করেছিলাম, ভেঙে দিয়েছিলাম, তার ভাবধারাকে ধ্বংস করতে পারিনি। শুধু অত্যাচারের উচ্ছেদ ঘটালেই চলবে না, যুগ-যুগান্তব্যাপী প্রথাগুলোরও পরিবর্তন দরকার। আমরা কারখানাটাকে ভেঙে ফেলেছিলাম কিন্তু তার যন্ত্রটা আজও চলছে।

আপনারা ধ্বংস করেছিলেন; ধ্বংসেরও প্রয়োজন আছে ঠিক। কিন্তু আমার বিশ্বাস যে ধ্বংসকার্য ক্রোধের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয় সে ধ্বংসকার্য কোনও শুভ ফল দান করতে পারে না।

হে আমার লর্ড বিশপ, ন্যায়পরায়ণতার এক নিজস্ব ক্রোধ আছে। সেই ক্রোধই হল অগ্রগতির বা প্রগতির এক উপাদান। ফরাসি বিপ্লব সম্বন্ধে যা-ই বলা হোক না কেন, খ্রিস্টের আবির্ভাবের পর থেকে এ বিপ্লব মানবজাতির পক্ষে অগ্রগতির পথে এক বিরাট পদক্ষেপ। অসমাপ্ত রয়ে গেলেও এ বিপ্লব মহান। সমাজের অবরুদ্ধ আবেগকে এ বিপ্লব মুক্ত করে দেয়। অনেক বিক্ষুব্ধ অন্তরকে শান্ত করে, সারা বিশ্বে সভ্যতার এক নবজোয়ার এনে দেয়। অন্ধকারে আলো দেখায় অজস্র মানুষকে। ফরাসি বিপ্লব যেন মানবজাতির পবিত্র তৈলাভিষেক।

বিশপ গুঞ্জনধ্বনির মতো বলে উঠলেন, কিন্তু ১৭৯৩ সালের বিভীষিকা?

বিপ্লব কনভেনশনের সেই ভূতপূর্ব সদস্য চেয়ারে সোজা হয়ে বসে গম্ভীরভাবে গলার স্বর উঁচু করে বলল, হ্যাঁ, ১৭৯৩ সালের কথায় আসছি। পনেরশো বছর ধরে মেঘ ঘন হয়ে উঠছিল, অবশেষে ১৭৯৩ সালে ঝড় ওঠে। আপনারা এই ঝড়কেই বজ্র বলে ধিক্কার দিচ্ছেন।

বিশপ কথাটার মানে বুঝতে পারলেন। তবু প্রতিবাদের সুরে বললেন, বিচারক যা কিছু বলেন বা করেন তা সব ন্যায়বিচারের নামে চালিয়ে দেন। যাজক বলেন করুণার কথা যে করুণা ন্যায়বিচারের এক ঊর্ধ্বতন স্তর। বজ্র কখনও ভুল করে না। আর ষোড়শ লুই?

মুমূর্ষ বিপ্লবী হাত বাড়িয়ে বিশপের একটি হাত ধরে বলল, আপনি কি ষোড়শ লুই-এর জন্য শোকে বিলাপ করছেন? তিনি যদি এক নিষ্পাপ শিশু হতেন তা হলে আমিও আপনার সঙ্গে কাঁদব। আমার কাছে রাজপরিবারের দুটি শিশু হত্যা খুবই দুঃখজনক। শুধু কাশের ভাই হওয়ার জন্য একটি নির্দোষ শিশুকে প্লেস দ্য গ্রেভে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং পঞ্চদশ লুই-এর পৌত্রকে শুধু রাজার পৌত্র বলেই হত্যা করা হয়।

বিশপ বললেন, অতশত নাম আমার জানার দরকার নেই। কাত্রুশ না পঞ্চদশ লুই? কার নামে আপনার আপত্তি?

কিছুক্ষণ দু জনেই চুপ করে রইলেন। এখানে আসার জন্য অনুশোচনা বোধ করতে লাগলেন বিশপ। তবু তিনি বেশ কিছুটা বিচলিত হয়ে উঠলেন। কেন তা তিনি বুঝতে পারলেন না।

মুমূর্ষ বলল, শুনুন মঁসিয়ে, আপনি সত্যের স্থূল দিকটা গ্রাহ্য করেন না। কিন্তু খ্রিস্ট তা করেন, সুদখোর উত্তমবর্ণের মন্দির থেকে বিতাড়িত করেন। তীক্ষ্ণ বাক্যবাণের দ্বারা অনেক সত্যকে তুলে ধরতেন। তিনি বলতেন, যারাই আমার কাছে আসবে তাকেই কষ্টভোগ করতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি শিশু-বৃদ্ধের মধ্যে কোনও পার্থক্য মানতেন না। হেরদের পুত্রের সঙ্গে বারাব্বাসের পুত্রের মেলামেশাটাকে তিনি খারাপ ভাবতেন না। নির্দোষিতার একটি নিজস্ব মর্যাদা আছে; বাইরের কোনও পৃথক মান-মর্যাদার প্রয়োজন হয় না। ছেঁড়া কাপড়ে ও রাজপোশাকে নির্দোষিতা সমান মর্যাদাজনক, তার মহত্ত্ব সব ক্ষেত্রেই সমানভাবে থাকে অম্লান আর উজ্জ্বল।

বিশপ শান্ত নিচু গলায় বললেন, তা অবশ্য বটে।

বিপ্লবী বলল, আপনি সপ্তদশ লুই-এর নাম করেছেন। আমাদের পরস্পরের বক্তব্য ভালো করে বোঝা দরকার। আপনি কি অভিজাত, নীচজাত, ছোট-বড় নির্বিশেষে সব নির্দোষ, আর শহিদ, সব শিশুর জন্য চোখের জল ফেলতে বলছেন? তা হলে আমিও আপনার সঙ্গে কাঁদব তাদের জন্য। কিন্তু আমাদের ৯৩ সাল ও সপ্তদশ লুই-এর আগে চলে যেতে হবে। আপনি যদি শিশুদের জন্য অশ্রুপাত করেন তা হলে আমিও রাজপরিবারের শিশুদের জন্য অশ্রুপাত করব।

বিশপ বললেন, আমি সকলের জন্যই অশ্রুপাত করব।

কিন্তু সকলের জন্য সমানভাবে অশ্রুপাত করতে হবে। তবে তুলনামূলকভাবে সাধারণ জনগণের শিশুদের দাবিই বেশি কারণ তারাই দীর্ঘকাল দুঃখকষ্ট ভোগ করে এসেছে।

কিছুক্ষণ আবার দু জনেই চুপ করে রইল। বিপ্লবী এবার কনুই-এর উপর ভর দিয়ে তার এক দিকের গালে আঙুল দিয়ে একটা চিমটি কেটে কথা বলার জন্য প্রস্তুত হল। আর সঙ্গে সঙ্গে তার মুমূর্ষ জীবনের স্তিমিতপ্রায় প্রাণশক্তির একটা জ্বলন্ত আগুন জ্বলতে লাগল তার দুচোখে। তার কথাগুলো বিস্ফোরণের মতো জ্বালাময় শব্দ করে উঠল বিশপের কানে।

বিপ্লবী বলতে লাগল, জনগণ বহুদিন ধরে বহু দুঃখকষ্ট ভোগ করে এসেছে মঁসিয়ে। সেইটাই সব নয়। আমাকে প্রশ্ন করার এবং সপ্তদশ লুই সম্বন্ধে আমার সঙ্গে কথা বলার আপনি কে? আমি আপনাকে চিনি না। এখানে আসার পর থেকে আমি কাউকে দেখিনি, কেউ আমার কাছে আসেনি, আমি কোথাও যাইনি। শুধু এই ছেলেটা আমার কাছে কাজ করে এবং একেই আমি দেখি। অবশ্য আপনার নাম আমার কানে এসেছে এবং এটাও শুনেছি যে লোকে আপনাকে শ্রদ্ধা করে। কিন্তু তাতে কিছু বোঝা যায় না। চতুর লোকেরা নানা উপায়ে সাধারণ লোকের মন জয় করে, তাদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠে। আমি আপনার গাড়ির চাকার শব্দ কোনওদিন শুনিনি। আপনি নিশ্চয় গাড়িটা দূরে কোথাও রেখে এসেছেন। আমি আবার বলছি আমি আপনাকে চিনি না। আপনি বলছেন আপনি বিশপ। কিন্তু তাতে আপনার প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ পায় না। আমি আবার আপনাকে প্রশ্ন করছি, আপনি কে? আপনি বিশপ, চার্চের রাজা, প্রভূত ঐশ্বর্য ভোগের অধিকারী এক ব্যক্তি। দিগনের বিশপের মাইনে বছরে পনেরো হাজার ফ্রা, দশ হাজার ফ্রাঁ তার পেছনে খরচ। সব মিলিয়ে বছরে পঁচিশ হাজার ফ্রাঁ। আপনি এক বিরাট প্রাসাদে বাস করেন, অনেক চাকরবাকর আছে সে প্রাসাদে, আপনার রান্নাঘরে অনেক খাবারের প্রাচুর্য। প্রতি শুক্রবার মুরগির মাংস পরিবেশন করা হয় খাবার টেবিলে। খ্রিস্টের নামে আপনি গাড়ি চড়ে বেড়ান অথচ খ্রিস্ট নিজে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতেন, উচ্চপদস্থ যাজক হিসেবে প্রচুর ভোগ-সুখ ও আরাম-স্বাচ্ছন্দের উপকরণ আপনি ভোগ করেন। কিন্তু এতে আপনার আসল স্বরূপ বা সত্তার পরিচয় পাওয়া যায় না। আপনি তা হলে আমাকে জ্ঞানের কথা শোনাতে এসেছেন মনে হয়। কিন্তু কার সঙ্গে আমি কথা বলছি? কে আপনি?

বিশপ মাথা নত করে একটি প্রার্থনাস্তোত্রের একটি ছত্র উদ্ধৃত করে বললেন, আমি একটি কীটমাত্র, মানুষ নই।

মুমূর্ষ বিপ্লবী যত কঠোর ভাব ধারণ করল বিশপ ততই বিস্ত্র হয়ে উঠলেন। তিনি শান্তভাবে বললেন, মনে করুন আপনি যা বললেন তা সব সত্য। আমার আয়, আমার ঐশ্বর্য, আমার গাড়ি, আমার খাওয়া-দাওয়ার যেসব কথা বললেন তা সব সত্য হলেও একটা কথা আপনাকে ব্যাখ্যা করে বলতে হবে। আপনাকে প্রমাণ করতে হবে করুণা কেন মানবজীবনের একটা প্রধান গুণ নয়? মার্জনা কেন মানবজীবনের প্রধান কর্তব্য নয় এবং ১৭৯৩ সালটি কেন ক্ষমার অযোগ্য নয়?

বৃদ্ধ বিপ্লবী কপালে হাত দিয়ে কিছু মুছল। তার পর বলল, আপনার কথার উত্তর দেওয়ার আগে প্রথমে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি মঁসিয়ে। আপনি আমার অতিথি এবং যথাযোগ্য সৌজন্য দেখাতে পারিনি। আমরা আমাদের আপন আপন ভাবধারার কথা আলোচনা করছি এবং এক্ষেত্রে যুক্তি দিয়ে সব কথা বলতে হবে; আপনার সম্পদ আর সুযোগ-সুবিধাভোগ তর্কের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছি সুবিধার জন্য, কিন্তু এটা সুরুচির পরিচায়ক নয়। কিন্তু এগুলো আর আমি উল্লেখ করব না।

বিশপ বললেন, এজন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি আপনাকে।

আপনি আমাকে একটা জিনিস ব্যাখ্যা করতে বলেছেন। আপনি বললেন ১৭৯৩ সাল ক্ষমার অতীত।

বিশপ বললেন, হ্যাঁ। মারাও যে গিলোটিন নিয়ে এত উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে সে বিষয়ে কী বলতে চান আপনি?

সৈন্যরা যখন প্রোটেস্ট্যান্টদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছিল কানে বুসতে তখন ‘তে দিউম’ গানের অনুষ্ঠান করেছিল সে বিষয়েই বা আপনি কী বলতে চান?

উত্তরটা খুবই কড়া। তীক্ষ্ণ তরবারির মতো এ উত্তরটা বিদ্ধ করল বিশপকে। বিশপ কেঁপে উঠলেন। তিনি কোনও উত্তর খুঁজে পেলেন না। তবে বুসেতের উল্লেখ করায় তিনি রেগে গেলেন। যারা মহান ব্যক্তি তাদের কিছু না কিছু দুর্বলতা হয়তো থাকে, কিন্তু তর্কের খাতির তাঁদের অশ্রদ্ধা করাটা সত্যিই রাগের কথা।

বৃদ্ধ বিপ্লবী হাঁপাতে লাগল। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তবে তাতে একটুও ম্লান হয়নি তার দৃষ্টির স্বচ্ছতা। সে বলতে লাগল, আমরা আর একটু এগিয়ে গিয়ে ব্যাপারটা দেখতে পারি। সমগ্রভাবে বিচার করলে দেখা যাবে বিপ্লব মানবতার এক বিরাট স্বীকৃতি, শুধু ১৭৯৩ সালটাই তার ব্যতিক্রম। আপনি এ সালটাকে ক্ষমা করতে পারেন না। কিন্তু মঁসিয়ে, সমগ্রভাবে বিচার করলে রাজতন্ত্রই কি ক্ষমার যোগ্য? স্বীকার করি ফ্যারিয়ার অপরাধী, কিন্তু মন্ত্রী ভানকে কী বলবেন? ফুকিয়ের তিনভিল একজন শয়তান ছিল ঠিক, কিন্তু লাময়গনান বেতিলকে কী বলবেন? ম্যালিয়ার্দ ঘৃণ্য হতে পারেন, কিন্তু সয়তানে কী? জের্দে কুপ তেতির থেকে মার্কুই দ্য লুভয় কি বেশি ভয়ঙ্কর মঁসিয়ে, আমি রানি মেরি আঁতানোতের মৃত্যুর জন্য দুঃখ প্রকাশ করি ঠিক, কিন্তু হুগোমত নারীর জন্যও কম দুঃখ বোধ করি না। রাজা লুই-এর আমলে সেই নারীকে একটা খুঁটিতে কোমর পর্যন্ত অনাবৃত অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয় আর তার শিশুসন্তানকে তার সামনে ধরে রাখা হয়। শিশুটি তার স্তনদুধ খাবার জন্য জোরে কাঁদতে থাকে। তখন মেয়েটিকে বলা হয় তার শিশুসন্তানের জীবন আর তার শালীনতা–এই দুটির মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে তাকে। একটি মাতার ওপর এই অত্যাচারকে আপনি কী বলবেন মঁসিয়ে? আপনাকে একটা কথা মনে রাখতে হবে। বিপ্লবের অবশ্যই কতকগুলি কারণ আছে। এর যা কিছু ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের মানুষ তা ভুলে গিয়ে এর কারণগুলো বুঝতে পারবে। এর একমাত্র ফল এক নতুন জগতের উদ্ভব। এই বিপ্লবের মধ্যে অনেক ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত্মক কাজ অনুষ্ঠিত হলেও তার থেকে একটা ভালো জিনিস বেরিয়ে আসে–সেটা হল মানবতার প্রতি অকুণ্ঠ আলিঙ্গন। যাই হোক, এ বিষয়ে আর আমি কিছু বলব না। আমার বলার আরও কিছু আছে। তাছাড়া আমার মৃত্যু আসন্ন।

বিশপের দিকে না তাকিয়েই বৃদ্ধ বলতে লাগল, অগ্রগতির পথে যেসব নিষ্ঠুরতা দেখা দেয় তাকে আমরা বিপ্লব বলি। বিপ্লবের শেষে আমরা দেখি অনেক মারামারি কাটাকাটি ও অনেক কিছু ধ্বংস হয়েছে ঠিক, কিন্তু মানবজাতি তা সত্ত্বেও কিছুটা এগিয়ে গেছে।

কথাগুলো বলে বৃদ্ধ আত্মপ্রসাদ লাভ করলেও সে বুঝতে পারেনি, তুকের পথে সে বিশপের আত্মরক্ষার অনেকগুলো বেড়া একে একে ভেঙে ফেললেও একটা প্রধান বেড়া তার শক্তির এক দুর্ভেদ্য দুর্গ তখনও অজেয় রয়ে গেছে।

বিশপ এবার কিছুটা কড়াভাবেই বললেন, সব প্রগতিরই উচিত ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলা। অধর্মাচরণের দ্বারা কোনও মঙ্গলই সাধিত হতে পারে না। কোনও নাস্তিক কখনও মানবজাতির ভালো নেতা হতে পারে না।

বৃদ্ধ এ কথার উত্তর দিল না। তার দেহটা একবার কেঁপে উঠল। সে আকাশের পানে একবার তাকাল। তার চোখ থেকে একবিন্দু জল গালের উপর গড়িয়ে পড়ল। সে আকাশের দিকে মুখ করেই আমতা আমতা করে বলতে লাগল, তুমি হচ্ছ পূর্ণ! তুমিই একমাত্র সত্য।

একটু থেমে বৃদ্ধ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, অনন্তের একটা অস্তিত্ব আছে এবং সে অস্তিত্ব একমাত্র ওখানেই আছে! এই অনন্তের যদি আত্মা না থাকে তা হলে কোনও জিনিসই থাকবে না। কিন্তু আত্ম আছে। অনন্তের আত্মাই হল ঈশ্বর।

শেষের কথাগুলো সে বলল স্পষ্ট ভাষায়, আবেগকম্পিত সুরে। তার পর সে চোখ বন্ধ করল। কথাগুলো বলতে পরিশ্রম হয়েছে তার। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই যেন কয়েকটা বছর পার হয়ে গেছে। সে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে আগের থেকে আর এই ক্লান্তিই যেন মৃত্যুর আরও কাছে এনে দিয়েছে তাকে।

বিশপ দেখলেন নষ্ট করার মতো সময় নেই। তিনি যাজক হিসেবে এখানে এসেছিলেন। তাঁর সকল ঔদাসীন্য ক্রমে পরিণত হল এক গভীর আবেগে। বৃদ্ধের মুদিত চোখ দুটির পানে তাকিয়ে তার হিম হয়ে যাওয়া রুগ্‌ণ হাতটি ধরে তার উপর ঝুঁকে বললেন তিনি, এখন এই মুহূর্তটি ঈশ্বরের। এ মুহূর্তের যথাযথ সদ্ব্যবহার করতে না পারাটা সত্যিই কত দুঃখজনক, সেটা আপনি মনে করেন না?

বৃদ্ধ চোখ খুলে তাকাল। এক ছায়াচ্ছন্ন গাম্ভীর্য ফুটে উঠল তার চোখেমুখে। দুর্বলতার জন্য সে ধীরে ধীরে বলতে লাগল, হে আমার লর্ড বিশপ, পড়াশোনা, চিন্তা আর ধ্যানের মধ্য দিয়ে আমি জীবনযাপন করেছি। আমার বয়স যখন ষাট তখন দেশের কাজের জন্য আমাকে ডাকা হয়। আমি সে ডাকে সাড়া দিই। দেশের মধ্যে অনেক কুপ্রথা এবং কুসংস্কার ছিল, আমি তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলাম, অনেক অত্যাচার-অবিচার আমি ধ্বংস করেছিলাম, অনেক মানবিক অবিচার এবং নীতিকে আমি প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমার দেশ যখন আক্রান্ত হয় তখন আমি তাকে রক্ষা করেছিলাম। ফ্রান্সকে বিদেশিরা আক্রমণের ভয় দেখালে আমি দেশের জন্য প্রাণ-মন উৎসর্গ করি। আমি কখনই ধনী ছিলাম না, এখনও আমি গরিব। রাষ্ট্রের কর্তাদের মধ্যে আমি একজন ছিলাম। আমাদের রাজকোষ এত বেশি ধনরত্নে পূর্ণ ছিল যে সোনা-রুপোর চাপে দেয়ালগুলো ভেঙে যাওয়ার ভয়ে দেয়ালগুলোর বাইরে থাম গেঁথে সেগুলোকে ঠেকা দিয়ে জোরালো করতে হয়। তবু আমি পভার্টি স্ট্রিটের একটা হোটেলে বাইশ স্যুতে খেতাম। আমি উৎপীড়িতদের দুঃখমোচন করি এবং আর্তদের সান্ত্বনা দিই। আমি বেদির কাপড় ছিঁড়ে ফেলেছিলাম তা ঠিক, কিন্তু দেশের ক্ষতস্থান বেঁধে দেওয়ার জন্যই তা করেছিলাম। আলোকোজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের পানে মানবজাতির অগ্রগতির জন্যই আমি সংগ্রাম করেছিলাম। ক্ষমাহীন অত্যাচারের অগ্রগতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। বহুক্ষেত্রে আমি আপনাদের বিরুদ্ধবাদী হলেও অনেক যাজককে রক্ষা করেছিলাম। ফ্ল্যান্ডার্সের অন্তর্গত পিথেঘেমে যেখানে একদিন মেরো-ভিঙ্গিয়ান রাজাদের গ্রীষ্মকাল ছিল তার কাছাকাছি একটা চার্চ ছিল। ১৭৯৩ সালে ধ্বংসের কবল থেকে সে চার্চকে রক্ষা করেছিলাম। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি, আমার যথাশক্তি মানুষের মঙ্গল সাধন করেছি। এতে আমার যশের হানি হয়, আমাকে পীড়ন সহ্য করতে হয়, আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো হয়, আমাকে বিজ্ৰপ করা হয়। আমি জানি এখনও পর্যন্ত অনেক লোকে বিশ্বাস করে আমাকে ঘৃণ্য করার তাদের অধিকার আছে। বহুলোকের কাছে আমি ধিকৃত। আমি তাই ঘৃণার বস্তুরূপে নির্জনে বাস করে আসছি, অথচ আমি কাউকে ঘৃণা করি না; এখন আপনি আমার কাছে কী চান?

সঙ্গে সঙ্গে নতজানু হয়ে বিশপ বললেন, আপনার আশীর্বাদ।

বিশপ যখন মুখ তুলে তাকালেন তখন দেখলেন বৃদ্ধ লোকটির চোখেমুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। বিশপ দেখলেন তার মৃত্যু হয়েছে।

সেদিন রাতে চিন্তামগ্ন অবস্থায় বাড়ি ফিরলেন বিশপ। সারারাত তিনি প্রার্থনা করে কাটালেন। পরদিন কিছু কৌতূহলী লোক বিশপকে সেই জনপ্রতিনিধির কথা জিজ্ঞাসা করায় বিশপ শুধু নীরবে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে কী দেখালেন। তার পর থেকে দুস্থ ও আর্তদের প্রতি বিশপের মায়ামমতা আরও বেড়ে যায়।

এরপর কেউ যদি বুড়ো শয়তান বলে অভিহিত করত সেই বিপ্লবীকে তা হলে বিশপ চুপ করে কী ভাবতেন। তিনি ভাবতেন যে লোকটি তার সামনে মারা গেল, তার উন্নত বিবেক তাঁর নিজের পূর্ণতার প্রতি সংগ্রামকে অবশ্যই প্রভাবিত করবে।

তবে সেই বিপ্লবী বৃদ্ধটির মৃত্যুকালে তার কাছে যাওয়ার জন্য শহরের অনেকেই সমালোচনা করতে থাকে বিশপের। যখন সব বিপ্লবীই নাস্তিক, যেখানে তাদের কাউকেই ধর্মান্তরিতকরণের কোনও আশা নেই সেখানে কেন গিয়েছিলেন বিশপ? তার আত্মাটাকে শয়তানে কিভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেটা দেখার জন্যই কি গিয়েছিলেন তার শয্যাপাশে?

মৃত স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী এক বিধবা মহিলা ঔদ্ধত্যকে বুদ্ধি বলে ভাবত। সে একদিন বিশপকে বলল, আমরা আশ্চর্য হয়ে সবাই ভাবছি মঁসিয়ে, আপনি হয়তো একদিন বিপ্লবীদের মতো মাথায় লাল ফিতে ব্যবহার করবেন।

বিশপ বললেন, লাল রংটা এমনই যে তা সব ক্ষেত্রেই চলে। আশ্চর্য এই যে যারা বিপ্লবীদের লাল ফিতেকে ঘৃণার চোখে দেখে তারাই আবার লাল টুপি পরে।

.

১১

এর থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ভুল হবে যে মঁসিয়ে বিয়েনভেনু একজন দার্শনিক যাজক ছিলেন। সেই জনপ্রতিনিধির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারের পর থেকে তার মনে যে বিস্ময় জাগে সে বিস্ময় তাকে আরও শান্ত করে তোলে।

যদিও রাজনীতি নিয়ে তিনি কখনও মাথা ঘামাতেন না তথাপি সেকালে দেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলি সম্বন্ধে তাঁর মনোভাব কী ছিল সে বিষয়ে কিছু বিবরণ দান করা উচিত। আর তার জন্য কয়েক বছর পেছনে যেতে হবে আমাদের।

বিশপের পদে তিনি অধিষ্ঠিত হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যে সম্রাট তাঁকে আরও কয়েকজন বিশপের সঙ্গে ব্যারন পদে ভূষিত করেন। আমরা যতদূর জানি, ১৮৩৯ সালেই ৫, ৬ জুলাই পোপকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ফরাসি ও ইতালীয় বিশপদের এক ধর্মীয় সভায় যোগদানের জন্য নেপোলিয়ঁন তাঁকে ডাকেন। এই সভা প্যারিসের নোতার দ্যাম গির্জায় কার্ডিনাল ফ্রেস্কের সভাপতিত্বে ১৮১১ (রাজা, দুটি সালে মিলছে না) সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় মোট পঁচানব্বই জন বিশপের মধ্যে মঁসিয়ে মিরিয়েলও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তিনি মূল সভা ছাড়া আরও তিন-চারটি ছোটখাটো সভায় যোগদান করেন। মনে হয় যে পার্বত্য অঞ্চলে তিনি থাকতেন সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়া সকল গ্রাম্য জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত থাকার জন্য তাঁর কৃষকসুলভ বেশভূষা ও জীবনযাত্রা প্রণালী সভায় বিশেষ কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তিনি সভার জাঁকজমকপূর্ণ আদবকায়দায় অস্বস্তিবোধ করায় তাড়াতাড়ি দিগনেতে ফিরে আসেন। এ বিষয়ে তখন তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমার উপস্থিতিতে ওরা অস্বস্তিবোধ করছিল। যে বাইরের জগৎ সম্বন্ধে তারা একেবারে অনবহিত, আমি যেন সেই জগতের এক ঝলক অপ্রত্যাশিত হাওয়া আমার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম তাদের কাছে। বাইরের জগতের রুদ্ধ দরজাটা সহসা আমি যেন খুলে দিয়েছিলাম তাদের সামনে।

তিনি আরও বলেছিলেন, তোমরা কী আশা করতে পার? অন্যান্য বিশপরা যেন এক একজন রাজপুত্র। আমি সামান্য একজন চাষিদের যাজক ছাড়া আর কিছুই নই।

মোট কথা, তিনি সেই সভায় যোগদান করতে গিয়ে অসন্তুষ্ট হন। একদিন তার এক নামকরা সহকর্মীর বাড়িতে গিয়ে বলেন, কত সব বড় বড় দামি ঘড়ি, কত সুন্দর সুন্দর কার্পেট, কত সব জমকালো সাজ-পোশাক পরা চাকর-বাকর–আমার পক্ষে এসব সত্যিই অস্বস্তিকর। এইসব বিলাসব্যসনের মধ্যে আমি থাকতে পারব না। এসবের মধ্যে থাকলে আমার প্রায়ই মনে পড়ত কত লোক ক্ষুধায় ও শীতে কষ্ট পাচ্ছে। কত গরিব আছে। কত সব গরিব।

বিলাসব্যসনের প্রতি বিশপের ঘৃণা খুব একটা যুক্তিসংগত নয়। কারণ বিলাসিতাকে ঘৃণা করলে বিলাসের উপকরণের সঙ্গে জড়িত অনেক শিল্পকর্মকেই ঘৃণা করতে হয়। কিন্তু একজন যাজকের পক্ষে তার আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মের বাইরে যেকোনও বিলাসের উপকরণই ঘৃণ্য ও বর্জনীয়। সেক্ষেত্রে বিলাসিতা এমনই একটি মনোভাব যার সঙ্গে বদান্যতা বা দানশীলতার কোনও সম্পর্ক নেই। ধনী যাজক এক বৈপরীত্যের প্রতিমূর্তি। যাজকদের অবশ্যই গরিবদের আপনজন হিসেবে তাদের কাছাকাছি থাকা উচিত। কিন্তু একজন কিভাবে গরিবদের দুঃখকষ্টের সংস্পর্শে দিনরাত আসতে বা থাকতে পারে যদি না তার বেশভূষা বা চালচলনের মধ্যে দারিদ্রের ছাপ না থাকে? আমরা কি এমন কোনও লোকের কল্পনা করতে পারি যে সারাদিন কোনও জ্বলন্ত লোহার হাপরে বা ফার্নেসের সামনে কাজ করবে, অথচ তার গায়ে তাপ লাগবে না, অথবা সে তার মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাটবে না অথবা তার হাতের নখে কালো দাগ ধরবে না বা তার মাথা বা গাঁ থেকে এক ফোঁটা ঘাম ঝরবে না অথবা তার মুখে একটুকরো ছাই থাকবে না। এক যাজকের দানশীলতার প্রথম প্রমাণ হল দরিদ্রসুলভ জীবনযাত্রা।

এটাই ছিল দিগনের বিশপের ব্যক্তিগত মত এবং যাজকবৃত্তি সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি। তবে তার মানে এই নয় যে সে যুগের ভাবধারার কোনও অংশই তিনি কোনও ব্যাপারে গ্রহণ করতেন না। বরং কতকগুলি সমস্যামূলক ব্যাপারে সে যুগের প্রচলিত ভাবধারারই অনুবর্তন করে চলতেন। তিনি তখন যেসব ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে আলোচনা সভা হত তাতে খুব একটা বেশি যোগদান করতেন না। রাষ্ট্র ও চার্চসংক্রান্ত কোনও বিরোধমূলক সমস্যা সম্পর্কে তিনি কোনও মন্তব্য করতেন না। কিন্তু যদি কোনও সময় এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতেন তা হলে দেখা যেত তার মনের মধ্যে রক্ষণশীলতার থেকে অতি আধুনিকতার উপাদানই বেশি থাকত। আমরা যেহেতু তার একটি পূর্ণ জীবনচিত্র আঁকছি এবং কোনও কিছুই গোপন রাখতে চাই না সেইহেতু আমরা অবশ্যই একথা স্বীকার করব যে নেপোলিয়ঁনের পতন শুরু হওয়ার সময় তিনি তাঁর ঘোর বিরোধী ছিলেন। ১৮১৩ সাল থেকে তিনি সম্রাটবিরোধীদের বিক্ষোভ মিছিলকে সমর্থন করতেন এবং অভিনন্দন জানাতেন। এলবা থেকে ফেরার সময় ম্রাট নেপোলিয়ঁন যখন বিশপের অঞ্চল দিয়ে যান তখন তিনি দেখা করতে চাননি সম্রাটের সঙ্গে। সম্রাটের সংকটের সময় তিনি কোনও সমবেত প্রার্থনাসভার অনুষ্ঠান করার অনুমতি দেননি।

এক বোন ছাড়া বিশপের দুই ভাই ছিল। দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন ছিল সামরিক বিভাগের বড় অফিসার আর একজন পুলিশের বড় কর্তা। বিশপ তাঁর ভাইদের সঙ্গে চিঠিপত্রে যোগাযোগ রাখতেন। কিছুদিন ধরে তাঁর যে ভাই সৈন্যবিভাগে সেনাপতিত্বের কাজ করত তার সঙ্গে মনকষাকষি চলছিল বিশপের। কারণ তাঁর সেনাপতি ভাই একবার বারোশো সৈনিকের একটি দলের সেনাপতি হিসেবে নেপোলিয়ঁনকে ধরার জন্য তাঁর পিছু ধাওয়া করে, কিন্তু আসলে তার ধরার ইচ্ছা ছিল না অর্থাৎ এমনভাবে যায় যাতে হাতের নাগালের বাইরে চলে যেতে প্রচুর সুযোগ পান নেপোলিয়ঁন। তার অন্য ভাই পুলিশের কাজ থেকে অবসর গ্রহণের পর প্যারিসে বাস করছিল। সে মানুষ হিসেবে খুবই ভালো ছিল বলে বিশপ তাকে মেহের চোখে দেখতেন।

আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো মঁসিয়ে বিয়েনভেনুও কোনও এক রাজনৈতিক দলমতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তেন। মাঝে মাঝে অনেক তিক্ততা আর মোহমুক্তির বেদনা অনুভব করতেন। বিশপের মহান আত্মা সব সময় যতসব চিরন্তন ও শাশ্বত আধ্যাত্মিক বিষয়ে নিমগ্ন থাকলেও সমকালীন সমাজজীবনের বিক্ষুব্ধ ঢেউগুলোর আঘাতে একেবারে অবিচলিত থাকতে পারত না। অবশ্য তাঁর মতো লোকের রাজনৈতিক মতামতের সঙ্গে জড়িয়ে না-পড়াই উচিত ছিল। তবে এ বিষয়ে ভুল বুঝলে চলবে না আমাদের। আমরা যেন রাজনৈতিক মতামতের সঙ্গে প্রগতিবাদ, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, মানবতাবাদ প্রভৃতি যেসব প্রত্যয় বা বিশ্বাসগুলো সব মনীষী ও মহাপুরুষের সকল চিন্তাশীলতার মূল ভিত্তি সেগুলোকে গুলিয়ে না ফেলি বা এক করে না দেখি। যেসব বিষয়ের সঙ্গে আমাদের এই বইটি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয়, শুধু পরোক্ষ বা গৌণভাবে জড়িত সেইসব বিষয়ের গভীরে না গিয়ে আমরা শুধু এই কথাই বলতে পারি যে মঁসিয়ে বিয়েনভেনু রাজতন্ত্রবাদী না হলেই ভালো হত। ধ্যানস্নিগ্ধ প্রশান্ত চিন্তার যে উদার ক্ষেত্রটি জুড়ে সত্য, ন্যায় ও বদান্যতার শাশ্বত নীতিগুলো এক অম্লান অন্তহীন ভাস্বরতায় উজ্জ্বল হয়ে বিরাজ করে সেই মহান ধ্যানসমুন্নতির স্তর থেকে তাঁর দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্য বিক্ষুব্ধ মানবজীবনের সমস্যাবলির ওপর নেমে না এলেই আরও ভালো হত তার পক্ষে।

যদিও আমরা স্বীকার করি, ঈশ্বর মঁসিয়ে বিয়েনভেনুকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য পাঠাননি তবু সম্রাট নেপোলিয়ঁন ক্ষমতার উচ্চ শিখরে আরোহণ করেন তখন তিনি যদি বিপদের ঝুঁকি নিয়েও সম্রাটের বিরোধিতা করে উচ্চ মনের পরিচয় দিতেন তা হলে আমরা তাঁর গুণগান না করে পারতাম না। কিন্তু উদীয়মান কোনও নক্ষত্রের ক্ষেত্রে যা প্রশংসনীয় ও গৌরবময়, সে নক্ষত্র অস্তম্লান হয়ে পড়লে তা আর তেমন প্রশংসনীয় বা গৌরবময় মনে হয় না। যে যুদ্ধ বিপজ্জনক আমরা সেই যুদ্ধকেই শ্রদ্ধা করি এবং সে ক্ষেত্রে যারা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে যায় তারাই চূড়ান্ত জয়ের গৌরব লাভ করে। যে মানুষ কারও সুখসমৃদ্ধির সময়ে কোনও কথা বলে না তার বিরুদ্ধেই তার দুঃখ-বিপদের সময় কোনও কথা বলা উচিত নয়। সাফল্যের সময়ে যে কাউকে আক্রমণ করতে পারে একমাত্র সে-ই তার পতন ঘটাবার বৈধ অধিকারী। ঈশ্বরের বিধানের কাছে আমরা মাথা নত করে থাকি। ১৮১২ সাল থেকেই যে আইনসভা এতদিন সমর্থন করে আসছিল ১৮১৩ সালে সম্রাটের বিপর্যয়ে উৎসাহিত হয়ে সহসা নীরবতা ভঙ্গ করে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এটা খুবই পরিতাপ আর লজ্জার কথা। এ কাজ কোনওমতেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। ১৮১৪ সালে মার্শালরা বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং সিনেটের অধঃপতন ঘটে। এ যেন এতদিন কাউকে দেবতা বলে মেনে পরে তাকে অপমান করা; পৌত্তলিক হয়ে পুতুল বা প্রতিমার উপর থুতু ফেলার মতো এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। ১৮১৬ সালে যখন শেষ বিপর্যয়ের ধ্বনি শোনা যায় আকাশে-বাতাসে, যখন সমস্ত ফ্রান্স তা শুনে ভয়ে কেঁপে উঠতে থাকে, নেপোলিয়ঁনের ওপর ঘনিয়ে ওঠা ওয়াটারলু যুদ্ধের ছায়া দূর থেকে দেখতে পাওয়া যায়, যখন ভাগ্যাহত যে পুরুষের দিকে সেনাদল ও সাধারণ মানুষ বেদনার্ত হৃদয়ে শেষবারের মতো হাত বাড়িয়ে সম্ভাষণ জানায় তখন সে পুরুষ কখনই উপহাসের পাত্র নন। এক বিশাল শূন্যতার মাঝে পতনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এক মহান জাতির সঙ্গে এক মহান পুরুষের যে মিলন ঘটে সেই মিলনের নিবিড়তার মাঝে যে একটি মহৎ ও মর্মস্পর্শী দিক ছিল সে দিকটি না দেখা বা উপেক্ষা করা দিগনের বিশপের মতো একজন মহাত্মা ব্যক্তির পক্ষে ভুল হয়েছে।

এছাড়া বিশপের আর কোনও দোষ ছিল না। তিনি ছিলেন সত্যবাদী, সরলমনা, বুদ্ধিমান, বিনয়ী এবং যোগ্য। তিনি ছিলেন পরোপকারী, সত্যিকারের একজন যাজক, সাধুপ্রকৃতির লোক এবং মানুষের মতো মানুষ। এমনকি তার রাজনৈতিক মতামতের আমরা সমর্থন করতে পারি না, এবং যার জন্য আমরা তার নিন্দা করে থাকি, সেইসব রাজনৈতিক মতামতের ব্যাপারেও তিনি ছিলেন উদার।

সম্রাট সৈন্যবিভাগের এক ভূতপূর্ব সার্জেন্টকে টাউন হলের কর্মকর্তা নিযুক্ত করেন। লোকটি আগে অস্টারলিজের যুদ্ধে এক বিরাট বাহিনীতে যোগদান করে বীরত্ব দেখিয়ে সম্মানসূচক পদক পায়। কিন্তু সে যখন-তখন এমন সব মন্তব্য করত যেসব মন্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কথা বলে মনে করত লোকে। তার পদক থেকে সম্রাটের মুখটা মুছে গেলে সে আর পদক তিনটে পরত না। সে বলত, আমার বুকের উপর এই তিনটে বিষাক্ত ব্যাঙ চাপিয়ে রাখার থেকে মরা ভালো। নেপোলিয়ঁনের দেওয়া ক্রসটাও সে পরত না। আবার সপ্তদশ লুই সম্বন্ধে কোনও কথা উঠলেও সে বুদ্ধি করে কিছু বলতে পারত না। বরং সে বলত, উনি তো প্রুশিয়া চলে যেতে পারতেন। এর দ্বারা প্রুশিয়া আর ইংল্যান্ডের প্রতি তার ঘৃণার ভাবটাকে প্রকাশ করে। সে এসব কথা প্রায়ই বলত বলে তার চাকরি যায় এবং তার ফলে স্ত্রী-পুত্রদের নিয়ে সে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। বিশপ তখন তাকে ডেকে গির্জার দেখাশোনার ভার দেন।

মঁসিয়ে বিয়েনভেনু ছিলেন একজন সার্থক যাজক, সকল মানুষেরই বন্ধু। দিগনেতে তিনি নয় বছরের যে যাজকজীবন যাপন করেন তাতে তাঁর সরলতা আর শান্ত স্বভাব দেখে সেখানকার জনগণের মনে ভক্তি জাগে তার প্রতি। এমনকি নেপোলিয়ঁনের প্রতি তাঁর বিরূপ মনোভাবটাকে লোকে ক্ষমার চোখে দেখতে থাকে। সাধারণ সরলমনা জনগণ তার কাছে ভিড় করত। তারা যেমন তাদের সম্রাটকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করত দেবতার মতো, তেমনি বিশপকেও ভালোবাসত।

.

১২

কোনও সেনাপতির অধীনে যেমন অনেক ছোটখাটো অফিসার থাকে তেমনি একজন বিশপের অধীনেও অনেক ছোট ছোট যাজক থাকে। প্রত্যেক বিশপের অধীনে চার্চে একজন করে লোক থাকে যারা তাঁর ফাইফরমাশ খাটে। এইভাবে তারা বিশপের কাজকর্ম করে তাঁর মন জয় করতে পারলে তাদের পদোন্নতি ঘটে।

সেকালে প্রতিটি চার্চ এক একটি রাষ্ট্রের মতো ছিল। চার্চের বিশপরা যেমন ধর্মীয় কাজকর্ম করে যেতেন তেমনি শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বিশপের চারদিকে ভিড় করে রাজনীতির কথাবার্তা বলত, তারা দেশের ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে যোগসূত্র বজায় রেখে চলত। ছোটখাটো যাজকরাও আপন আপন পদোন্নতির চেষ্টা করত। বিশপরাও প্রায় সকলেই উচ্চাভিলাষী ছিলেন এবং আপন আপন উচ্চাভিলাষ পূরণের চেষ্টা করে যেতেন। একজন বিশপ ভালো কাজ দেখিয়ে বিশপ থেকে আর্চবিশপ ও পরে কার্ডিনাল হতে পারতেন। এইভাবে সেকালে একজন যাজক ভবিষ্যতে রাজা পর্যন্ত হতে পারতেন। এইভাবে প্রতিটি বড় চার্চে ছোট-বড় যাজকদের মধ্যে উচ্চাভিলাষ আর দিবাস্বপ্নের স্রোত বয়ে যেত।

কিন্তু মঁসিয়ে বিয়েনভেনুর মনে উচ্চাভিলাষের কোনও আগুন জ্বলত না। তিনি ছিলেন শান্ত, বি মিতব্যয়ী। গরিবানার মধ্য দিয়ে তিনি তার জীবনযাত্রা নির্বাহ করতেন। তাঁর চার্চে রাজনীতি বা কূটনীতির কোনও আলোচনা বা জল্পনা-কল্পনা চলত না। তার ফাইফরমাশ খাটা বা হুকুম তামিল করার জন্য কোনও লোক ছিল না। বিশপের মনটি ছিল যেন এক শান্ত সাজানো সুন্দর বাগান। সে বাগান তার সারা জীবনব্যাপী যে এক স্নিগ্ধ ছায়া বিস্তার করেছিল সে ছায়ায় ভবিষ্যতের কোনও গোলাপি স্বপ্নের কোনও আলো দেখা যেত না। কোনও উচ্চাভিলাষের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে ওঠার কোনও সুযোগ পেত না সে বাগান। তাঁর অধীনে যেসব যাজক কাজ করত তারাও তাদের পদোন্নতি ঘটিয়ে কোনও উচ্চাশা পূরণের সুযোগ পেত না। আর তার জন্য কোনও যুবকবয়সী যাজক বেশিদিন থাকতে চাইত না তার কাছে। চার্চে কোনও বিশপের অত্যধিক আত্মনিগ্রহ এবং দারিদ্র্যসুলভ জীবনযাত্রা অন্য যাজকদের মধ্যে সংক্রামিত হয় সমাজে। তাদের ভোগবৃত্তিগুলো অবদমিত ও কঠিন হয়ে পড়ে ক্রমশ, এই ত্যাগ ও তিতিক্ষাকে যাজকরা তাদের উন্নতির পথে বাধা বলে মনে ভাবত। তাই তারা বিশপ বিয়েনভেনুকে ছেড়ে চলে যেত। আমরা এমন এক অদ্ভুত সমাজে বাস করি যেখানে সাফল্যলাভ না উচ্চাভিলাষ পূরণ মানেই দুর্নীতি। দুর্নীতির উচ্চভূমি থেকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যে রস পড়ে, তাই হল এখানে সাফল্য।

প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে সাফল্য মানেই এক কুৎসিত ব্যাপার। মানুষ ভুল করে এটাকে একটা বড় রকমের গুণ বা যোগ্যতা বলে ভাবে। সাধারণ মানুষের জীবনের সাফল্যের প্রভাব ও প্রভুত্ব অসাধারণ। সাফল্য অর্জনের যে ক্ষমতা এক ভণ্ড প্রতিভা ছাড়া আর কিছুই নয়, যে ক্ষমতা বা প্রতিভা আবহমান কাল হতে প্রভুত্ব করে আসছে। মানবসমাজের ওপর, ইতিহাস হল তারই সবচেয়ে বড় শিকার। সাফল্য মানেই রক্তপাতের পথে উচ্চাভিলাষ পূরণ আর এই রক্তপাতের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাকেই মানুষ যোগ্যতা ও প্রতিভা বলে এসেছে, বীরত্ব হিসেবে তা খ্যাত হয়ে এসেছে ইতিহাসে। একমাত্র জুভেনাল আর ট্যাসিটাস এই প্রতিভাতে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেন না। আজকাল আবার এই সাফল্যের ঘরে এসে এক দরকারি জীবনদর্শন বাসা বেঁধেছে। সাফল্যলাভই তার নীতি। সমৃদ্ধি লাভই হল যোগ্যতা। লটারিতে জিতে যাও, তা হলেই তোমাকে সবাই বলবে চতুর লোক। বলবে যোগ্য আর বুদ্ধিমান। ভাগ্যই হচ্ছে সব; কোনও রকমে একবার সৌভাগ্য লাভ করতে পারলেই তোমাকে বড় বলবে সবাই। এ শতাব্দীতে দেখা যায় সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধাভক্তির ব্যাপারটা বড় ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন। গিল্টি করা নকল সোনাকেই তারা আসল সোনা ভাবে। কোনও রকমে পেলেই হল। জনগণ হচ্ছে এক বৃদ্ধ নার্সিসাসের মতো যে শুধু নিজেকেই ভালোবাসে, নিজের আত্মার উপাসনা করে। মোজেস, এসকাইলাস, দান্তে, মিকালাঞ্জেলো অথবা নেপোলিয়ঁনের বিরাট গুণ ও প্রতিভাগুলোকে সাধারণ মানুষ ছোট করে দেখে এবং তারা মনে করে এ গুণ এ প্রতিভা যে কোনও মানুষ চেষ্টা করলেই অর্জন করতে পারে। সাধারণ মানুষ ভাবে, যে কর্মচারী কোনও রকমে ডেপুটির পদ পায়, যে বাজে ব্যর্থ নাট্যকার কোনওরকমে কর্নেলের মতো এক হাসির নাটক লিখে নাম পান, যে সেনাপতি কোনও মতে একটা যুদ্ধ জয় করে, অথবা যে যোদ্ধাপ্রহরী কোনওরকমে হারেম জয় করে বসে তারা সবাই প্রতিভাবান। যে ধুরন্ধর ব্যবসায়ী সৈন্যবিভাগে জুতো সরবরাহ করে বছরে চার হাজার পাউন্ড আয় করে, যে সুদখোর বছরে কোনওরকমে আট মিলিয়ন পাউন্ড আয় করে, যে যাজক জোর গলায় ধর্মপ্রচার করে বিশপ পদে উন্নীত হয়, কোনও এস্টেটের যে গোমস্তা টাকা রোজগার করতে করতে অবসর গ্রহণ করার পর অর্থমন্ত্রী হয় লোকে এদের সবাইকে প্রতিভাবান বলে। লোকে আজকাল কোনও মেয়ে মুখে রঙ মাখলেই তাকে সুন্দরী বলে, আর ভালো দামি পোশাক পরলেই তাকে রাজসম্মান দান করে। কাদার উপরে পাতিহাঁসের নক্ষত্রাকার ছাপ দেখলে লোকে তাকে আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র ভাবে।

.

১৩

দিগনের বিশপের ধর্মীয় গোঁড়ামির সমালোচনা করা আমাদের কাজ নয়। তার মতো এক মহান আত্মা শুধু শ্রদ্ধা জাগায় আমাদের মনে। একজন খাড়াখাড়ি লোকের জীবনসত্যকে তার নিজস্ব খাতিরেই মেনে নিতে হবে নির্বিবাদে। বিভিন্ন মানুষের স্বভাবের ভিন্নতা সত্ত্বেও মানবজীবনের মহত্ত্বের যে একটি নিজস্ব সৌন্দর্য আছে সে সৌন্দর্য সহজ বিশ্বাসের মধ্য দিয়েই উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে, বরণীয় হয়ে উঠতে পারে।

বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিশপের যে কতকগুলি গোপন রহস্যের দিক ছিল, তা একমাত্র মৃত্যুর পরেই প্রকটিত হয়ে উঠতে পারে। তবে আমরা শুধু এইটুকু জোর করে বলতে পারি যে তার ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে কোনও ভণ্ডামি ছিল না। হিরেতে যেমন কোনও খাদ থাকে না, তার ধর্মবিশ্বাসেও কোনও খাদ ছিল না। এই নিখাদ ধর্মবিশ্বাসের বশবর্তী হয়েই তিনি তাঁর দৈনন্দিন কাজকর্ম করে যেতেন। তাতে তাঁর বিবেক তৃপ্ত হত। তিনি যে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত সে বিষয়ে নিশ্চিত হতেন তিনি।

ধর্মবিশ্বাস ছাড়া বিশপের আর একটি গুণ ছিল। মানুষের প্রতি এক নির্বিশেষে নিখাদ ভালোবাসার অন্তহীন প্রবাহে তাঁর অন্তর প্লবিত হত সতত। এই ভালোবাসার জন্য শহরের আত্মম্ভরী, অহঙ্কারী ও তথাকথিত শিক্ষিত নাগরিকরা তাঁকে দুর্বলমনা ভাবত। বিশপের এই ভালোবাসার আতিশয্যটা আসলে কী, তা অনেকে বুঝে উঠত না। আসলে এটা ছিল এমনই পরোপকার প্রবৃত্তি যা সকল মানুষ ও এমনকি ইতর প্রাণীদের পর্যন্ত আলিঙ্গন করত এবং সর্বত্র প্রসারিত ছিল। কোনও কিছুকেই ঘৃণা করতেন না তিনি, ঈশ্বরের সৃষ্টি হিসেবে সব কিছুকেই তিনি ভালোবেসে যেতেন। এমনকি অনেক ভালো ভালো মানুষের প্রতি উদাসীন থেকে পশুদের ভালোবাসা দান করতেন। অন্য যাজকদের মধ্যে এ বিষয়ে যে অসহিষ্ণুতা দেখা যেত দিগনের বিশপের মধ্যে তা ছিল না। তিনি ব্রাহ্মণদের মতো অত সাত্ত্বিক পূজারি না হলেও তিনি প্রায়ই স্তোত্রগান করতেন আপন মনে। কে জানে মহান ব্যক্তিদের আত্মা কেন ঊর্ধ্বে গমন করে আর পশুদের আত্মা কেন নরকের দিকে গমন করে। কোনও কোনও কুৎসিত চেহারা বা বিকৃত কোনও প্রবৃত্তি তাঁকে ভীত করে তুলতে পারত না। তিনি অবশ্য তাতে বিচলিত হতেন, মাঝে মাঝে দুঃখবোধ করতেন এবং জীবনের এইসব অবাঞ্ছিত বহিরঙ্গের অন্তরালে কী কারণ থাকতে পারে, তা খোঁজার চেষ্টা করতেন। তিনি মাঝে মাঝে ঈশ্বরের কাছে জীবন ও জগতের সব কিছু পুনর্গঠিত করার জন্য প্রার্থনা করতেন। এক স্থিতধী প্রজ্ঞা আর প্রশান্তির সঙ্গে তিনি জীবনের যত সব অসংগতি, প্রকৃতি জগতের যত কিছু বিশৃঙ্খলার কথা চিন্তা করতেন এবং সেই চিন্তাভাবনার কথা মাঝে মাঝে তার মুখ থেকে স্বগতোক্তির মতো বেরিয়ে আসত। একদিন তিনি যখন বাগানে বেড়াচ্ছিলেন তখন এই ধরনের একটা কথা বেরিয়ে আসে তাঁর মুখ থেকে। তিনি ভাবছিলেন তিনি একা আছেন। কিন্তু তার থেকে কয়েক পা দূরে তাঁর বোন ছিল তিনি তা দেখতে পাননি। মাটির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন তিনি। একটা বড় কালো মাকড়সা দেখতে পেলেন।

বাপতিস্তিনে শুনতে পেলেন তার ভাই বলছেন, হায় হতভাগ্য প্রাণী, বেচারার কোনও দোষ নেই।

এইসব আপাত-অবান্তর মহত্ত্ব ও মহানুভবতার কথাগুলো নথিভুক্ত করে রাখা হয়নি কেন কে জানে। এইসব কথাগুলো যদি ছেলেমানুষির পরিচায়ক হয় তা হলে সেন্ট ফ্রান্সিস ও মার্কাস অরেলিয়াসের কথাগুলোকে ছেলেমানুষি হিসেবে ধরতে হবে। একবার একটি পিঁপড়েকে তাঁর পথে দেখতে পেয়ে তাকে পা দিয়ে না মাড়িয়ে কষ্ট করে সেটাকে পাশ কাটিয়ে যান। এক একসময় তিনি বাগানের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়তেন। কিন্তু তাঁকে সে অবস্থায় দেখে আরও শ্রদ্ধা জাগত মনে।

মঁসিয়ে বিয়েনভেনুর বাল্যজীবন ও যৌবনের যেসব কথা শোনা যায় তার থেকে জানা যায় তিনি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ছিলেন এবং তিনি হিংসার আশ্রয় নিতেন না। সকল মানুষ ও জীবের প্রতি তার যে করুণার স্রোত সতত প্রবাহিত হত, সে করুণার স্রোত তাঁর কোনও সহজাত প্রবৃত্তি হতে উৎসারিত হত না, উৎসারিত হত এমন এক গভীর প্রত্যয় থেকে যে প্রত্যয় তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মধ্যে বিভিন্ন চিন্তার ভেতর দিয়ে জলের ফোঁটার মতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়ত তার অন্তরে। পাহাড়ের উপর থেকে জল ঝরে পড়ার জন্য যেমন ঝরনা বা গিরিখাতের সৃষ্টি হয়, মানুষের স্বভাবের মধ্যেও তেমনি প্রত্যয়ের জল ঝরে পড়ে পড়ে একটি নদীখাতের সৃষ্টি হয়।

১৮১৫ সালে তার বয়স হয় পঁচাত্তর। কিন্তু তাকে দেখে ষাট বছরের বেশি বলে মনে হত না। তার চেহারাটা লম্বা ছিল না, তবে স্থূলতার দিকে একটা ঝোঁক ছিল এবং এই স্থূলতার ভাবটাকে কমাবার জন্য তিনি রোজ অনেকটা করে হাঁটতেন। তিনি যখন লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতেন তখন তাঁর পিঠটা একটু ধনুকের মতো বাঁকা দেখাত। এর থেকে অবশ্য কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। যোড়শ পোপ গ্রেগরি আশি বছর বয়সেও খাড়া হয়ে হাসিমুখে চলতেন। তবু পোপ হিসেবে খ্যাতিলাভ করতে পারেননি। বিশপ বিয়েনভেনুর চেহারাটা সুদর্শন ছিল, কিন্তু তাঁর ব্যবহারটা এমনই মধুর ছিল যে তার চেহারার কথাটা কেউ মনে রাখত না।

তার কথাবার্তায় যে শিশুসুলভ এক সরলতা আর সুষমা ছিল তাতে সকলেই স্বচ্ছন্দ অনুভব করত। তার সমস্ত দেহ হতে একটা জ্যোতি বিচ্ছুরিত হত। তিনি যখন হাসতেন, তখন তাঁর সাদা ঝকঝকে সুন্দর দাঁতগুলো বেরিয়ে আসত, তখন সবাই তার শিশুসুলভ সরলতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে তাদের আপনজন ভাবত। অনেকে বলত, “যেন এক সুন্দর ছেলে। আবার অনেক বলত, কী ভালো লোক! নেপোলিয়ঁন যখন তাঁকে প্রথম দেখেন তখন তার মনেও এই ভাব জাগে। যে কোনও লোক তাঁকে প্রথম দেখলেই এইরকম ভাব মনে জাগত তার। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা তার কাছে থাকলে দেখা যেত তাঁর চিন্তামগ্ন চেহারা ক্রমশ পাল্টে আরও মনোহারী হয়ে উঠছে। তার মাথায় পাকা চুল থাকায় তার প্রশস্ত উদার ললাট আরও গম্ভীর দেখাত। তিনি প্রায়ই ঈশ্বরচিন্তায় বিভোর ও ধ্যানমৌন থাকার জন্য সে ললাট আরও মহান ও উন্নত দেখাত। অন্তরের সততা থেকে এক স্তব্ধমহান গাম্ভীর্য উৎসারিত হয়ে ছড়িয়ে থাকত তার সারা দেহে। তাকে দেখলেই এক সদাহাস্যময় দেবদূতের কথা মনে পড়ত যে দেবদূত পক্ষবিস্তার করে হাসি ছড়াচ্ছে। তাকে দেখলেই এক অবর্ণনীয় শ্রদ্ধা জাগত সকলের মনে, মনে হত তারা যেন এসে পড়েছে পরম করুণাময় এক মহান ব্যক্তির কাছে যার সর্বাঙ্গ থেকে সতত এক সর্বব্যাপী করুণা ও মমতার মধু ঝরে পড়ছে।

আমরা আগেই দেখেছি দৈনন্দিন জীবনে সব সময় তিনি কোনও না কোনও কাজে ব্যস্ত থাকতেন। প্রার্থনা, অফিসের কাজ, ভিক্ষাদান, আর্তদের সান্ত্বনাদান, বাগানের কাজ, তার দেহটি যখন এইসব কাজে সর্বদা ব্যস্ত থাকত, মনটি তখন তাঁর সৌভ্রাতৃত্ব, মিতব্যয়িতা, আতিথেয়তা, ত্যাগ, বিশ্বাস আর পড়াশোনার কথায় ভরে থাকত। এইভাবে সৎ চিন্তা আর সৎ কর্মের মধ্য দিয়েই দিনগুলো কেটে যেত তার। কিন্তু সারাদিন সব কাজ করেও তার মনে হত কিছু করা হল না যদি না রাত্রিতে শোবার আগে আবহাওয়া ভালো থাকলে বাগানে দু’এক ঘণ্টা একা না কাটাতেন। ঘুমোবার আগে স্তব্ধগম্ভীর নৈশ আকাশের তলে কিছুক্ষণ ধ্যান ও ঈশ্বরচিন্তা করাটা এক অত্যাবশ্যক আনুষ্ঠানিক কর্ম বলে ধরে নিয়েছিলেন তিনি।

বাড়ির মহিলা দু জন তখন শুতে চলে যেত। তারা উপরতলায় গিয়ে যদি ঘুমিয়ে না। পড়ত তা হলে তারা শুনতে পেত বাগানের পথে একা একা পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন বিশপ। আপন নিঃসঙ্গতায় আপনি বিভোর হয়ে তিনি যেন আকাশে উদার প্রশান্তির সঙ্গে আপন অন্তরের প্রশান্তিকে মিলিয়ে নিয়ে দৃশ্য-অদৃশ্য সকল বস্তুর মাঝে ঈশ্বরের ঐশ্বর্যের সন্ধান করে চলতেন মনে মনে। অজ্ঞাতলোক হতে যেসব চিন্তা ঝরে পড়ত নিঃশব্দে তার সামনে তাঁর অন্তরকে প্রসারিত করে দিতেন তিনি। এইসব মুহূর্তে বিশ্বসৃষ্টির সর্বব্যাপী ঐশ্বর্যের দ্বারা পরিবৃত হয়ে নক্ষত্রালোকিত রাত্রির মাঝে ক্রমোন্মীলিত গন্ধবিহীন কুসুমরাজির মতো তিনি যখন ধীরে ধীরে আপন অন্তরকে উন্মীলিত করে দিতেন তখন তিনি বুঝতে পারতেন না, তিনি কী পেলেন বা কী দিলেন, বাইরে থেকে কী এসে প্রবেশ করল তার অন্তরে আর তাঁর অন্তর থেকেই-বা কী বেরিয়ে গেল, বুঝতে পারতেন না কী ঘটত তার অন্তর্জগতে। এইভাবে বিশ্বসৃষ্টির অনন্তত্বের সঙ্গে তার আপন অন্তরের অনন্তত্ত্বের এক রহস্যময় আদান-প্রদান চলত।

জাগতিক সব বস্তুর মধ্যে ঈশ্বরের মহত্ত্ব এবং জীবন্ত অস্তিত্ব উপলব্ধি করার চেষ্টা। করতেন বিশপ। অনন্ত অতীত ও অনন্ত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতেন। তাঁর বোনের সামনে পরিদৃশ্যমান শান্ত সসীম বস্তুর মাঝে অসীম অনন্তকে ধরার চেষ্টা করতেন। কিন্তু বোধাতীত এইসব বিষয়কে বুঝতে না পেরে তিনি শুধু চিন্তা করে যেতেন। তিনি ঈশ্বরকে নিয়ে বিচার-বিবেচনা করতেন না, তিনি শুধু মুগ্ধ বিস্ময়ে ঈশ্বরের মহিমা উপলব্ধি করে যেতেন। অণু-পরমাণুর যে সুষম সমন্বয় প্রতিটি বস্তুর অবয়বকে গড়ে তুলে তাকে সত্তা দান করে, তাকে শক্তি দেয়, একের মধ্যে অসংখ্য এবং সমগ্রের মধ্যে ভিন্নতার সৃষ্টি করে এবং এক আলোক বিকীরণ করে তার মাধ্যমে সৌন্দর্যের জন্ম দেয়, সেই আণবিক সমন্বয়ের কথা ভাবতেন তিনি। এই সময় এবং অন্তহীন যোগ-বিয়োগের লীলাই জীবন এবং মৃত্যু।

বাগানে একটি বেঞ্চের উপর বসে তার ভাঙা রডের গায়ে পিঠটা হেলান দিয়ে ফলের গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে আকাশের তারার পানে তাকিয়ে থাকতেন তিনি। সারা বাড়িটার মধ্যে এই জায়গাটা বড় প্রিয় ছিল তার কাছে।

সারা দিনরাতের মধ্যে এই অবসরটুকু ছাড়া আর কিছুই চান না বিশপ। রোজ দু বার করে বাগানে যেতেন তিনি–একেবার দিনের বেলায় বাগানের কাজ করতেন, গাছের যত্ন নিতেন আর রাত্রিবেলায় বাগানে বসে ঈশ্বরচিন্তা করতেন। তাঁর কর্মব্যস্ত দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে মুক্ত আকাশের চন্দ্রাতপতলে এই ছোট্ট জায়গাটুকু ঈশ্বরোপাসনার পক্ষে যথেষ্ট। পায়ের তলায় ছড়ানো অসংখ্য ফুল আর মাথার উপরে অসংখ্য তারা নিয়ে এই স্বল্পপরিসর জায়গাটুকুতে পায়চারি আর চিন্তা করা–আর কী চান তিনি।

.

১৪

আমরা বিশপের যে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বিবরণ দান করেছি তাতে মনে হবে তিনি ছিলেন সর্বেশ্বরবাদী। কিন্তু আসলে বিশপ এক নিজস্ব জীবনদর্শন গড়ে তুলেছিলেন। তার নিঃসঙ্গ নির্জন মনের উদার পটভূমিতে সঞ্জাত এই জীবনদর্শন অনেক সময় প্রথাগত প্রচলিত ধর্মমতের সঙ্গে খাপ খেত না। যারা মঁসিয়ে বিয়েনভেনুকে চিনত ও জানত তাদের এই ধারণাই হত তার সম্বন্ধে। তারা বুঝত তাঁর অন্তরই ছিল সব চিন্তার উৎস, অন্তরের আলো থেকেই তাঁর সব ভাব ও প্রজ্ঞার উদ্ভব হত।

কিন্তু কোনও এক বিশেষ দার্শনিক তত্ত্ব সৃষ্টি করেননি তিনি। অনেক দার্শনিক কথা চিন্তা করতেন তিনি শুধু নির্জনতার শান্ত আকাশে। এইসব নির্জন চিন্তার ফলে সহজ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যেসব তত্ত্বকথা তাঁর অন্তর থেকে বেরিয়ে আসত সেইসব কথাই বাইরে বলতেন তিনি। কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে তার যুক্তিকে বিব্রত করে তুলতেন না কখনও। একজন ঈশ্বরপ্রেরিত পুরুষ অনেক বেশি সাহসের পরিচয় দিতে পারেন। কিন্তু একজন বিশপকে সতর্কতার সঙ্গে চলতে হয়। যেসব সমস্যা দেশের বড় বড় চিন্তাশীল ও ধর্মগুরুদের ভাবনার বস্তু সেইসব সমস্যা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাতেন না তিনি। সেইসব জটিল সমস্যার দ্বারপ্রান্তে এসে এক ধর্মগত ভয়ে থমকে দাঁড়াতেন তিনি। যে দ্বারপ্রান্তের ওপারে অন্ধকার প্রশস্ত বারান্দা প্রসারিত হয়ে আছে, কিন্তু কোনও এক অদৃশ্য অশ্রুত কণ্ঠস্বর যেন যেখানে প্রবেশ করতে নিষেধ করতে তাকে। যে দুঃসাহসী ব্যক্তি সেখানে জোর করে প্রবেশ করে তাকে দুঃখ পেতে হয় পরিশেষে। কিছু কিছু প্রতিভাধর পুরুষ সীমাহীন নির্বিশেষ কল্পনা আর অন্তহীন ধ্যান-ধারণার গভীরে গিয়ে যেসব তত্ত্ব উপলব্ধি করেন সেগুলোকে তারা প্রথমে ঈশ্বরকেই সমর্পণ করেন। সেই তত্ত্বকথাগুলোই এক একটি ব্যক্তিগত ধর্মমতে পরিণত হয়। তবু তার মধ্যে অনেক প্রশ্নের অবকাশ আছে, অনেক দায়িত্ব জড়িয়ে আছে তার সঙ্গে।

মানুষের চিন্তার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। মানুষ কোনও কিছু বুঝতে না পারলেও সেই দুর্বোধ্য বিষয়কে সে তার উদ্ধত চিন্তা দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। প্রাকৃত বা বস্তুজগৎকে ফেলে সে এক তুরীয়লোকে উঠে যায়। সেখানে চিন্তার কর্তা এবং চিন্তার বস্তু মিলে মিশে এক হয়ে যায়। যাই হোক, কিছু লোক অবশ্য আছেন যারা তাদের চিন্তা দিগন্তের ওপারে পরম সত্যের চূড়াটি স্পষ্ট দেখতে পান। সে যেন এক ভয়ঙ্কর অন্তহীন সীমাহীন এক বিশাল পাহাড়। মঁসিয়ে বিয়েনভেনু এইসব নেতাদের একজন ছিলেন না; তাঁর সে প্রতিভা ছিল না। তিনি সেই বিশাল পাহাড়ের অভ্রভেদী চূড়াগুলোকে বিশ্বাস করতে পারতেন না, যার থেকে সুইডেনবার্গ ও পাস্কেলের মতো মহান পণ্ডিতরা পড়ে গিয়ে উন্মাদ হয়ে যান। অবশ্য এইসব শক্তিশালী চিন্তাশীলের চিন্তার একটা মূল্য আছে, কারণ এই চিন্তার থেকেই আমরা পূর্ণতার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারি। কিন্তু বিশপ বিয়েনভেনু সে পথে না গিয়ে এক সহজ পথ ধরেন। সে পথ হচ্ছে বাইবেলের হোলি গসপেলের পথ।

তিনি এলিজার পোশাক পরে বর্তমানের কুয়াশাচ্ছন্ন কঠিন ঘটনাজালের ওপর ভবিষ্যৎ দৃষ্টির কোনও আলোকসম্পাত করতে চাইতেন না। সেই দূরদৃষ্টির আলোকটিকে এক উজ্জ্বল জ্যোতিতে পরিণত করতে পারতেন না। তিনি ভবিষ্যদ্রষ্টা বা ঋষি ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক সাধারণ সরল প্রকৃতির মানুষ যিনি সকলকে নির্বিশেষে ভালোবেসে যেতেন।

তিনি ধর্মগত সীমাকে অতিক্রম করে তার প্রার্থনার বস্তুকে অতিমানবিক আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্য পর্যন্ত প্রসারিত করতেন ঠিক। কিন্তু আমাদের ভালোবাসার যেমন একটা সীমা আছে, তেমনি প্রার্থনারও একটা সীমা আছে। তবে ধর্মগত সীমার বাইরে ধর্মগ্রন্থনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু বাইরে প্রার্থনা করাটা যদি খ্রিস্টীয় ধর্মমতের বিরোধিতা হয় তা হলে সেন্ট টেরেস ও সেন্ট জেরোফ খ্রিস্টবিরোধী ছিলেন।

তাঁর অন্তর শুধু মানুষের দুঃখমোচনের চিন্তায় সব সময় বিব্রত থাকত। তাঁর মনে হত সারা জগৎ অন্তহীন দুঃখদুর্দশায় ভরা। তিনি সর্বত্রই দেখতেন শুধু দুঃখকষ্টের উত্তাপ এবং সে দুঃখকষ্টের কারণ জানতে না চেয়ে সেই দুঃখের ক্ষত নিরাময় করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যেতেন তিনি। বাস্তব দুঃখদুর্দশার ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মমতা ও সমবেদনা বেড়ে গেল। সেই দুঃখদুর্দশার হাত থেকে কিভাবে মুক্ত করা যায় মানুষকে তিনি তার উপায় খুঁজতেন এবং আর পাঁচজনকে সে উপায় বলে দিতেন। তাঁর কেবলি মনে হত পৃথিবীর সব মানুষ যেন এক অসহনীয় দুঃখের নিবিড়তায় সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।

অনেক মানুষ সোনার জন্য খনি খোঁড়ে। কিন্তু বিশপ বিয়েনভেনুর কাছে দুঃখ-দারিদ্রই ছিল সোনার খনি। সে খনি খুঁড়ে তার থেকে শুধু করুণা কুড়িয়ে আনতেন তিনি। বিশ্বব্যাপী দুঃখকষ্টের জন্য বিশ্বব্যাপী বদান্যতার এক প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন। ‘পরস্পরকে ভালোবাস’–এই ছিল তার নীতি এবং এই নীতিই ছিল তার জীবনের সব। এর বেশি আর কিছু চাইতেন না তিনি।

যে সিনেটরের কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, যিনি বিশপকে দার্শনিক বলতেন, তিনি একদিন তাকে বলেন, আপনি দেখুন, এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ একে অপরের সঙ্গে সংগ্রামে মত্ত এবং যে বলবান সে-ই জয়লাভ করে সে সংগ্রামে। পরস্পরকে ভালোবাস–এই নীতি এক নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই না।

বিশপ তখন তাঁর সঙ্গে কোনও বিতর্ক না করে বলেন, ঠিক আছে, এটা যদি নির্বুদ্ধিতা হয়, তা হলে সব মানুষের আত্মার উচিত ঝিনুকের মধ্যে মুক্তোর মতো সে নির্বুদ্ধিতাকে বুকের মধ্যে ধরে রেখে তা বহন করা। তিনি তাই করতেন। সেই নির্বুদ্ধিতাকে বুকের মধ্যে ঢেকে রেখে তিনি চলতেন, যেসব বড় বড় প্রশ্ন এক একটি অন্তহীন বিশাল শূন্যতা গভীরতা নিয়ে চিন্তাশীল মানুষদের মোহমুগ্ধ ও ভীত করে তোলে, তিনি সেগুলোকে এড়িয়ে যেতেন। আস্তিকরা এইসব প্রশ্নের বিশাল গভীরতার মধ্যে ঈশ্বরকে দেখতে পায়, আর নাস্তিকরা সেখানে ঈশ্বরকে না পেয়ে নরকে গমন করে। মানুষের ভাগ্য, ভালো-মন্দ, মানুষ মানুষে বিবাদ-বিসম্বাদ, মানুষের ও পশুর চেতনা, মৃত্যুতে মানুষের রূপান্তর, সমাধিতে মানুষের পুনর্জীবনের কল্পনা, গতিশীল আত্মার নতুন নতুন প্রেমের অভিজ্ঞতা, বস্তু ও তার সত্তা, মানুষের আত্মার স্বরূপ, স্বাধীনতা, প্রয়োজন, খাড়াই পাহাড়ের মতো এইসব সমস্যামূলক প্রশ্নগুলো বিরাট চিন্তাশীল ব্যক্তিদের অভিভূত করে। লুক্রেশিয়া, পল ও দান্তের মতো দার্শনিক ও চিন্তাশীল এইসব প্রশ্নের অন্তহীন অন্ধকার শূন্যতার মাঝে সন্ধানী দৃষ্টির আলো ফেলে তার সমাধান খুঁজতে গিয়ে সেই অনন্ত শক্তির সন্ধান পান, যা সমস্ত আলোর উৎস।

মঁসিয়ে বিয়েনভেনু ছিলেন এক সরল মানুষ, যিনি এইসব প্রশ্ন ও সমস্যাগুলোকে বাইরে থেকে দূর থেকে দেখতেন, তাদের খুব কাছে গিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতেন না। এইসব প্রশ্নের দ্বারা মনকে কখনও পীড়িত হতে দিতেন না। ইহলোক অতিক্রম করে পরলোকের চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকতেন।

১.২ দিগনে শহরের পথে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮১৫ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে সূর্যাস্তের এক ঘণ্টা আগে একজন পথিক পদব্রজে দিগনে শহরের পথে প্রবেশ করল। শহরের কিছুসংখ্যক লোক যারা খোলা জানালা বা দরজা দিয়ে তাকে দেখল, এক অস্পষ্ট সংশয়ে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল তাদের মন। এমন অবাঞ্ছিত অশোভন বেশভূষায় কোনও পথিককে সাধারণত দেখা যায় না। বয়সে লোকটি ছিল মধ্যবয়সী, প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি। চেহারাটা ছিল বলিষ্ঠ, কাঁধ দুটো চওড়া, দেহের উচ্চতা মাঝামাঝি। মাথায় ছিল একটা চামড়ার টুপি। তাতে তার মুখের আধখানা প্রায় ঢাকা ছিল। রোদে পোড়া মুখখানা থেকে ঘাম ঝরছিল। তার গায়ের চাদরটা দড়ির মতো পাকানো ছিল এবং তার পরনের জ্যাকেট পায়জামা সবই ছেঁড়া ছিল। তার পায়ে মোজা ছিল না, জুতোয় পেরেক আঁটা ছিল। তার মাথার চুলগুলো লম্বা করে ছাঁটা ছিল, কিন্তু মুখের দাড়িটা লম্বা হয়ে উঠেছিল। বেশ কিছুদিন কাটা হয়নি দাড়িটা। ঘাম আর পথের ধুলো আরও শোচনীয় করে তুলেছিল তার চেহারাটাকে।

এ শহরের কেউ চিনত না তাকে। হয়তো সে দক্ষিণ দিকের উপকূলভাগ থেকে এসে শহরে ঢুকছিল। ঠিক সেই পথ দিয়ে শহরে ঢুকছিল যে পথ দিয়ে সাত সাল আগে নেপোলিয়ঁন কেন থেকে প্যারিসে গিয়েছিলেন। সে নিশ্চয় সারাদিন পথ হাঁটছিল, তাই তাকে খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। বাজারের কাছে সাধারণের জল খাবার জন্য একটা ঝরনা ছিল, তাতে সে দু বার জল খায়।

র‍্যু পয়শেভার্তের কোণের কাছে সে বাদিকে ঘুরে টাউন হলে যাবার পথ ধরে। সে টাউন হলে ঢুকে আধ ঘণ্টা পরে বেরিয়ে আছে। টাউন হলের দরজার কাছে একটা পাথরের বেঞ্চের উপর একজন পুলিশ বসেছিল সেখানে থেকে ৪ মার্চ জেনারেল দ্রাউন্ড সমবেত জনতাকে নেপোলিয়ঁনের গলফ জুয়ানে অবতরণের ঘোষণাপত্রটি পড়ে শুনিয়ে চমকে দেন। পথিক পুলিশের কাছে এসে টুপি খুলে অভিবাদন জানাল তাকে। পুলিশ তাকে প্রতি-অভিবাদন না জানিয়ে তার চেহারাটাকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। পথিকটি সঙ্গে সঙ্গে চলে যেতেই সে তার নিজের কাজে অফিসের ভেতর ঢুকে গেল। সেকালে দিগনেতে একটি সুদৃশ্য পান্থশালা ছিল, তার নাম ছিল ক্ৰয় দ্য কোলবা আর তার মালিকের নাম ছিল জ্যাকিন লাবারে। গ্রেনোবেলের এয় ডফিন নামে পান্থশালার মালিক আর এক লাবারের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক ছিল। সম্রাটের গলফ জুয়ানে অবতরণকালে। ত্রয় ডফিন সম্পর্কে অনেক গুজব রটেছে। লোকে বলত গত বছর জানুয়ারিতে জেনারেল বার্ট্রান্ড গোপনে ত্রয় ডফিন গাড়িচালকের ছদ্মবেশে এসে সৈনিকদের পদক আর কিছু নাগরিককে মুদ্রা দান করে যায়। আসল কথা হল এই যে সম্রাট নেপোলিয়ঁন গ্রোনোবেলে এসে মেয়র যেখানে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করেছিল সেখানে না থেকে তিনি ক্রয় ডফিনে চলে যান। বলেন, সেখানে তার এক পরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। তাতে ক্রয় ডফিনের খ্যাতি চারদিকে পঁচিশ মাইল দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে দিগনের হয় দ্য কোলবার খ্যাতিও বেড়ে যায়। লোকে বলে ত্রয় কোলবার মালিক ত্রয় ডফিনের মালিকের জ্ঞাতি ভাই।

পথিক দিগনের ত্রয় কোলবার দিকে এগিয়ে যায়। হোটেলের রান্নাঘরটি রাস্তার দিকে ছিল। পথিক সেই ভোলা রান্নাঘর দিয়ে হোটেলে প্রবেশ করল। রান্নার উনোনগুলোতে তখন আগুন জ্বলছিল। হোটেলের মালিক তখন রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিল। সে তখন ওয়াগনে করে আসা একদল লোকের খাবার তৈরি করছিল। লোকগুলো পাশের ঘরে কথাবার্তা বলছিল আর হাসাহাসি করছিল। ওয়াগনে করে আসা লোকেরা হোটেলে বেশি খাতির পায় একথা সবাই জানে।

দরজা দিয়ে পথিক রান্নাঘরে প্রবেশ করতেই হোটেলমালিক বলল, আমি মঁসিয়ের জন্য কী করতে পারি?

পথিক বলল, খাবার আর একটা বিছানা চাই।

পথিককে খুঁটিয়ে দেখে হোটেলমালিক বলল, তা অবশ্যই পাওয়া যাবে, তবে তার জন্য আপনাকে টাকা দিতে হবে।

তার জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা চামড়ার থলে বার করে পথিক বলল, আমার কাছে টাকা আছে।

হোটেলের মালিক বলল, তা হলে আপনি থাকতে পারেন। আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

চামড়ার থলেটা আবার তার পকেটে রেখে তার পিঠে সৈনিকদের মতো যে একটা ব্যাগ ছিল সেটা মেঝের উপর নামিয়ে রাখল। তার পর হাতের লাঠিটা ধরেই আগুনের পাশে একটা টুলের উপর বসে পড়ল পথিকটি। দিগনে শহরটা পাহাড়ের উপর অবস্থিত বলে অক্টোবর মাসেই সেখানে দারুণ শীত পড়ে। হোটেলমালিক রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকলেও মাঝে মাঝে পথিকের পানে তাকিয়ে কী দেখছিল।

হোটেলমালিক একসময় বলল, আপনার খাবার কি তাড়াতাড়ি চাই?

পথিক উত্তর করল, হ্যাঁ, খুব তাড়াতাড়ি।

ঘরের দিকে পেছন ফিরে বসে আগুনে গা-টা গরম করছিল পথিক। হোটেলমালিক জ্যাকিন লাবারে একটা খবরের কাগজ থেকে একটুকরো ছিঁড়ে তার উপর পেন্সিল দিয়ে দুই-এক লাইন কী লিখল। তার পর তার একটা বালকভৃত্যকে ডেকে সেই কাগজটা তার হাতে দিয়ে কী বলতেই ছেলেটা টাউন হলের দিকে তখনি চলে গেল। পথিক এসব কিছুই দেখতে পেল না।

সে হোটেলমালিককে জিজ্ঞাসা করল, খাবার শিগগির পাওয়া যাবে?

হোটেলমালিক বলল, হ্যাঁ, শিগগির পাওয়া যাবে।

ছেলেটি ফিরে এসে একটুকরো কাগজ এনে হোটেলমালিকের হাতে দিতেই সে সেটা ব্যগ্রভাবে ধরে নিল। তার পর একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে কী ভাবতে লাগল। পরে সে পথিকের কাছে গিয়ে দেখল পথিক এক মনে কী সব ভাবছে।

হোটেলমালিক বলল, দুঃখিত মঁসিয়ে, আমি এখানে আপনাকে থাকতে দিতে পারব না।

পথিকটি মুখ ঘুরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কিন্তু কেন? আমি টাকা দিতে পারব না বলে আপনি কি ভয় করছেন? আপনি কি আগাম টাকা চান? আমি তো বলেছি আমার কাছে টাকা আছে।

কথাটা তা নয়।

তা হলে কী?

আপনার কাছে টাকা আছে। কিন্তু—

কিন্তু কী?

আমার হোটেলে ঘর খালি নেই।

পথিক তখন শান্ত কণ্ঠে বলল, তা হলে আমাকে আস্তাবলে একটা জায়গা করে দিন।

সেখানে আমি থাকতে দিতে পারি না।

কেন পারেন না?

সেখানে ঘোড়াগুলো গোটা ঘরটা জুড়ে থাকে।

তা হলে খড়ের গাদার কাছে। খাওয়ার পর সেটা দেখা যাবে।

আপনাকে আমি খাবার দিতে পারব না।

হোটেলমালিকের দৃঢ় ও স্পষ্ট কণ্ঠস্বরে পথিকের সর্বাঙ্গ যেন কেঁপে উঠল। সে বলল, কিন্তু আমি ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়েছি। সকাল থেকে পথ হাঁটছি আমি। প্রায় চব্বিশ মাইল পথ হেঁটেছি। কিছু না কিছু আমাকে খেতেই হবে।

হোটেলমালিক বলল, আপনাকে কিছুই দিতে পারব না আমি।

কিন্তু ব্যাপারটা কী?

সব খাবার ও ঘর সংরক্ষিত করে রেখেছে।

কাদের দ্বারা সংরক্ষিত হয়েছে।

ওয়াগনে করে আসা লোকেদের।

ওরা সংখ্যায় কত জন?

বারো জন।

কিন্তু কুড়ি জনের মতো খাবার ও ঘর আছে এখানে।

ওরা সব কিছুর জন্য আগেই অগ্রিম টাকা দিয়ে রেখেছে।

পথিক আবার বসে পড়ে আপন মনে বলতে লাগল, আমি একজন ক্ষুধার্ত পথিক। আমি এখানেই বসে থাকব।

হোটেলমালিক পথিকের ঘাড়ের উপর ঝুঁকে পড়ে বলে উঠল, চলে যাও এখান থেকে।

তা শুনে চমকে উঠল পথিক। সে কী বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সে মুখ খোলার আগেই হোটেলমালিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলতে লাগল, আর কথা বলে লাভ নেই। তুমি কে, কী কর তা কি আমার কাছ থেকে শুনতে চাও? তোমার নাম হচ্ছে জাঁ ভলজাঁ। আমি টাউন হলে লোক পাঠিয়েছিলাম এবং দেখ কী লিখে দিয়েছে।

একটা কাগজের টুকরো পথিকের সামনে হোটেলমালিক ধরতেই তার উপরকার লেখাটা পড়ে ফেলল সে। তাতে লেখা ছিল, আমি সকলের সঙ্গেই দ্র ব্যবহার করতে চাই। দয়া করে চলে যান।

আর কিছু না বলে পথিকটি টুল থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আর পেছন ফিরে না তাকিয়ে আনমনে বড় রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলতে লাগল সে। অপমানবোধের এক জ্বালাময় বিষাদ আচ্ছন্ন করে ছিল তার মনকে। কিন্তু যদি একবার সে মুখ ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকাত তা হলে সে দেখতে পেত হোটেলের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হোটেলমালিক তার দিকে আঙুল বাড়িয়ে কী সব বলছে আর তার চারদিকে একদল লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারল তার এই আকস্মিক আসার কথাটা অল্প সময়ের মধ্যেই প্রচারিত হয়ে পড়বে সারা শহরে।

এসব কিছুই দেখতে পায় না সে। দুর্ভাগ্যপীড়িত মানুষ পেছন ফিরে কখনও তাকায় না। কারণ সে জানে দুর্ভাগ্য পেছন থেকে তাড়া করে মানুষকে। নিঃসীম নিবিড় হতাশার চাপে ক্লান্তির কথা ভুলে গিয়ে অজানা শহরের পথ দিয়ে লক্ষ্যহীনভাবে এগিয়ে চলল সে। হঠাৎ ক্ষুধার জ্বালাটা আবার অনুভব করতে লাগল সে। সে দেখল সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। রাত্রির মতো একটা আশ্রয় দরকার।

সে জানত কোনও ভালো বাসস্থান আর সে পাবে না। তার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন সে চায় গরিব-দুঃখীরা যেখানে থাকে সেই ধরনের ছোটখাটো একটা পান্থশালা। যেতে যেতে হঠাৎ সে দেখল যে পথ দিয়ে সে হাঁটছিল তার শেষ প্রান্তে একটা ঘরে একটা টর্চের আলো ঝুলছে। সেই আলোটা লক্ষ্য করে এগিয়ে চলল সে।

র‍্যু দ্য সোফা অঞ্চলে ওটা হচ্ছে একটা ছোটখাটো হোটেল। হোটেলটার কাছে এসে পথিক জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ঘরের ভেতরটা দেখল। দেখল ঘরের ভেতরে টেবিলের উপর একটা আলো জ্বলছে। জনকতক লোক মদ পান করছে। হোটেল মালিক আগুনের পাশে বসেছিল আর উনোনে কী একটা রান্নার জিনিস সিদ্ধ হচ্ছিল। হোটেলে ঢোকার দুটো প্রবেশপথ ছিল –একটা সামনের দিকে আর একটা পেছন দিকে একটা উঠোনের উপর দিয়ে গোবরের স্কুপের পাশ দিয়ে। পথিক সামনের দিক দিয়ে যেতে সাহস পেল না। সে তাই পেছন দিকে উঠোন পার হয়ে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকল।

হোটেলমালিক বলল, কে আসে?

পথিক বলল, খাবার আর একটা বিছানা চাই শোবার জন্য।

তা হলে ভেতরে আসতে পার। দুটোই পাবে।

পথিক ঘরের ভেতর ঢুকে উনোনের জ্বলন্ত আগুনের আভা আর টেবিল ল্যাম্পের আলোর মাঝখানে দাঁড়াতেই উপস্থিত সকলেই তার পানে তাকাল। সে তার পিঠের ব্যাগটা যখন নামাল তখনও সকলে নীরবে তাকিয়ে ছিল তার পানে।

হোটেলমালিক বলল, উনোনে ঝোল সিদ্ধ হচ্ছে। এস বন্ধু, শরীরটা একটু গরম করে নাও।

পথিক আগুনের ধারে বসে তার ক্লান্ত পা দুটো ছড়িয়ে দিল। ঝোল সিদ্ধর একটা মিষ্টি গন্ধ আসছিল। মাথার টুপিটা মুখের উপর অনেকটা নামানো থাকায় তার মুখের যতটা দেখা যাচ্ছিল তাতে বোঝা যাচ্ছিল সে সচ্ছল সুখী পরিবারের লোক। কিন্তু দীর্ঘকাল দুঃখকষ্টে জর্জরিত হওয়ার ফলে তার অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখখানায় বিষাদ জমে থাকলেও সে মুখ দেখে বোঝা যায় তার চেহারা বেশ বলিষ্ঠ। বৈপরীত্যমূলক অদ্ভুত একটা ভাব ছিল সে মুখে। সে মুখে একদিকে ছিল আপাতোর একটা ছাপ আর অন্যদিকে ছিল আপাতপ্রভুত্বের এক ঔদ্ধত্য। তার ঘন ভ্রুযুগলের নিচে তার চোখ দুটো ঝোঁপের তলায় আগুনের মতো জ্বলছিল।

ঘরের মধ্যে যেসব লোক মদ পান করছিল তাদের মধ্যে একজন মৎস্য ব্যবসায়ী ছিল। আজ সকালে সে যখন ঘোড়ায় চেপে এক জায়গা দিয়ে আসছিল তখন এই পথিকের সঙ্গে দেখা হয়। পথিক নিদারুণ ক্লান্তির জন্য ওই মৎস্য ব্যবসায়ীকে তার ঘোড়ার উপর তাকে চাপিয়ে নেবার জন্য অনুরোধ করে কিন্তু মৎস্য ব্যবসায়ী তার উত্তরে জোরে চালিয়ে দেয় তার ঘোড়াটাকে। আবার কিছুক্ষণ আগে জ্যাকিন বারে যখন তার হোটেল থেকে এই পথিককে তাড়িয়ে দেয় তখনও ওই মৎস্য ব্যবসায়ী হোটেলের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে এখানে এসে সবাইকে সেকথা বলে দেয়। হোটেলমালিক সে কথা জানত না। পথিক এ হোটেলে এসে ঢুকে আগুনের ধারে বসতেই সে হোটেলমালিককে ডেকে তাকে জানিয়ে দিল কথাটা।

সে কথা শুনে হোটেলমালিক পথিকের কাছে এসে তার কাঁধে একটা হাত দিয়ে বলল, এখান থেকে তোমাকে চলে যেতে হবে।

পথিক মুখ তুলে শান্তভাবে বলল, তোমরাও তা হলে জেনে ফেলেছ?

হ্যাঁ।

ওরা আমাকে ওদের হোটেল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

এখান থেকেও তোমায় তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু কোথায় যাব আমি?

অন্য কোথাও।

পথিক তখন হাতে লাঠিটা আর পিঠে ব্যাগটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বড় রাস্তায় আসতেই একদল ছেলে কোথা থেকে এসে ঢিল ছুঁড়তে লাগল পথিকের উপর। সে তখন তার লাঠিটা ঘোরাতেই ছেলেগুলো পাখির ঝাঁকের মতো পালিয়ে গেল।

পথিক এবার একটা জেলখানার সামনে এসে দাঁড়াল। সে ফটকের সামনে একটা শিকলে ঝোলানো ঘন্টাটা বাজাতেই দরজা খুলে একজন প্রহরী বেরিয়ে এল।

পথিক তখন তার টুপিটা মাথা থেকে সরিয়ে বলল, মঁসিয়ে, আপনি দয়া করে রাতটার মতো এখানে আমাকে থাকতে দেবেন?

প্রহরী বলল, এটা কারাগার, পান্থশালা নয়। গ্রেপ্তার না হলে এখানে থাকতে পাওয়া যায় না।

এই বলে সে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

পথিক এবার বড় রাস্তা ছেড়ে একটা গলিপথে ঢুকে একটা বাগান দেখতে পেল। সেই বাগানের ভেতর একটা একতলা বাড়ি ছিল। সে বাড়ির একটা ঘরের খোলা জানালা দিয়ে আলোর ছটা আসছিল। পথিক জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতর দৃষ্টি ছড়িয়ে দেখল, প্রশস্ত ঘরখানার মাঝখানে খাটের উপর একটা বিছানা পাতা ছিল। বিছানার উপর ক্যালিকো কাপড়ের একটা চাদর পাতা ছিল। ঘরের এককোণে একটা দোলনা ছিল। টেবিলে একটা পাত্রে মদ ছিল। প্রায় চল্লিশ বছরের একটা লোক টেবিলের ধারে একটা চেয়ারে বসে একটি শিশুকে তার হাঁটুর উপর দাঁড় করিয়ে তাকে নাচাচ্ছিল। তার সামনে এক যুবতী নারী একটি শিশুকে স্তনদান করছিল। পিতা তার শিশুকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল আর মা হাসিমুখে তা দেখছিল। একটি পিতলের ল্যাম্পের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিল ঘরখানা।

পথিক জানালার ধারে দাঁড়িয়ে এই মধুর দৃশ্যটি দেখতে দেখতে ভাবতে লাগল। সে কী ভাবছিল সে-ই তা জানে। সে হয়তো ভাবছিল এই সুখী পরিবারে হয়তো আতিথেয়তার অভাব হবে না। যেখানে এত আনন্দ সেখানে একটুখানি বদান্যতা আশা করা হয়তো অন্যায় হবে না।

পথিক দরজার উপর মৃদু করাঘাত করল। কিন্তু ঘরের ভেতরে কেউ তা শুনতে পেল না। সে আবার দ্বিতীয়বার দরজায় করাঘাত করতে স্ত্রী তা শুনতে পেয়ে তার স্বামীকে বলল, কে হয়তো ডাকছে।

স্বামী বলল, ও কিছু না।

পথিক তৃতীয়বার দরজায় করাঘাত করতেই স্বামী এবার বাতিটা হাতে নিয়ে দরজা খুলল।

লোকটির চেহারাটা লম্বা। তাকে দেখে মনে হল সে একজন চাষি, কিন্তু কোনও কারখানায় মিস্ত্রির কাজ করে। সে চামড়ার একটা আলখাল্লা পরে ছিল। তার দ্রুযুগল ঘন।

পথিক বলল, মাপ করবেন মঁসিয়ে, আমি যদি আপনাকে টাকা দিই তা হলে আপনি কি আমাকে এক প্লেট ঝোল আর আপনার বাড়ির বাইরে বাগানের ধারে এই চাতালটায় রাতের মতো থাকতে দেবেন?

লোকটি বলল, টাকা দিলে কোনও ভদ্রলোককে অবশ্যই আমি আশ্রয় দেব। কিন্তু আপনি কেন কোনও হোটেলে গেলেন না?

হোটেলে কোন ঘর খালি নেই।

সে কি? আজ তো হাটবার নয়। আপনি লাবারতে গিয়ে একবার দেখেছিলেন?

হ্যাঁ গিয়েছিলাম।

তা হলে?

পথিক অস্বস্তিসহকারে বলল, কেন জানি না, ওরা আমাকে থাকতে দিল না।

অন্য হোটেলে দেখেছিলেন? যেমন র‍্যু দ্য শোফা?

পথিকের অস্বস্তি বেড়ে গেল। সে বিড়বিড় করে বলল, ওরাও আমাকে থাকতে দিল না।

লোকটির মুখের ওপর এবার এক অবিশ্বাসের ভাব ফুটে উঠল। লোকটি পথিকের আপাদমস্তক একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে বলল, তুমি কি তা হলে

এই কথা বলেই সে ঘরের ভেতর ঢুকে বাতিটা নামিয়ে রেখে দেয়াল থেকে তার দোনলা বন্দুকটা এনে পথিককে বলল, বেরিয়ে যাও। চলে যাও এখান থেকে।

স্বামীর কথায় তার স্ত্রী ছেলে দুটিকে ধরে বলে উঠল, তবে কি ডাকাত?

পথিক বলল, আমি অনুরোধ করছি মঁসিয়ে, আমাকে এক গ্লাস জল দিন।

লোকটি বলল, বন্দুকের গুলি ছাড়া আর কিছুই পাবে না তুমি।

এই কথা বলেই সে দরজাটা বন্ধ করে দরজায় খিল দিয়ে দিল।

রাত্রি ক্রমশই গম্ভীর হয়ে উঠছিল। আল্পস পর্বতের তুহিনশীতল কনকনে বাতাস বইছিল।

সেই বাগানটা থেকে বেরিয়ে এসে গলির ধারে আরও একটা বাগানের মধ্যে দেখল পাতায় ঢাকা একটা কুঁড়ে রয়েছে। রাস্তা মেরামতের যারা কাজ করে তারা পথের ধারে এই ধরনের কুঁড়ে তৈরি করে অস্থায়ীভাবে সেখানে থাকার জন্য। পথিক ভাবল এখন কুঁড়েটার মধ্যে কোনও লোক নেই। সে তাই কাঠের বেড়াটা ডিঙিয়ে পার হয়ে কুঁড়েটার মধ্যে গিয়ে ঢুকল। ভেতরটা বেশ গরম। তার মধ্যে খড়ের বিছানা পাতা ছিল। সে তার পিঠ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে সেটা মাথায় দিয়ে শুতে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ একটা কুকুরের গর্জন শুনে কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে এল সে। সে বুঝল এই কুঁড়েটা কুকুর থাকার ঘর।

কুকুরটা পথিককে আক্রমণ করে তার পোশাকগুলো আরও ছিঁড়ে দিল। পথিক তার লাঠি ঘুরিয়ে কোনওমতে বেরিয়ে গেল বাগান থেকে।

সে আবার গলিপথে এসে পড়ল। একটা পাথরের উপর বসে আপন মনে বলে উঠল, আমি কুকুরেরও অধম।

সেখান থেকে উঠে শহরটাকে পেছনে ফেলে ক্রমাগত হাঁটতে লাগল সে। শহর থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে তার সামনে একটা ফাঁকা মাঠ দেখতে পেল। সম্প্রতি ফসল উঠে যাওয়ায় মাঠটাকে ন্যাড়া মাথার মতো দেখাচ্ছিল। রাত্রির অন্ধকার আর আকাশটাকে মেঘে ছেয়ে থাকার জন্য দিগন্তটা কালো হয়ে ছিল। আকাশে চাঁদ না থাকায় অন্ধকারটাকে আরও ঘন দেখাচ্ছিল।

পথিক দেখল সারা মাঠটার মধ্যে একটা মাত্র গাছ ছাড়া আর কিছু নেই। নৈশ প্রকৃতির রহস্যময় আবেদনে সাড়া দেবার মতো কোনও সূক্ষ্ম সুকুমার অনুভূতি তার ছিল না। সমস্ত অন্ধকার আকাশ, নিঃসঙ্গ গাছ, শূন্য মাঠ, প্রান্তর সব কিছুকে এমন গভীরভাবে শূন্য মনে হচ্ছিল এবং সেই শূন্যতার কৃষ্ণকুটিল পটভূমিতে তার আপন অবস্থার নিঃসঙ্গতাটাকে এমন অসহনীয় মনে হচ্ছিল যে সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না সেখানে। তার মনে হল মাঝে মাঝে প্রকৃতি এমনি করে প্রতিকূল হয়ে ওঠে মানুষের।

নিরুপায় হয়ে সে আবার দিগনে শহরে ফিরে এল। কিন্তু তখন নগরদ্বার রুদ্ধ হয়ে গেছে। সেকালে আক্রমণের আশঙ্কায় উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল শহরটা। দুদিকে দুটো ফটক ছিল। কিন্তু ফটক বন্ধ হয়ে গেলেও ভাঙা প্রাচীরের এক জায়গায় একটা ফাঁক দিয়ে শহরে প্রবেশ করল সে।

রাত্রি তখন আটটা বাজে। অজানা পথের এদিক-ওদিক ঘুরে এগোতে লাগল সে। একসময় সে বড় গির্জাটার পাশ দিয়ে যাবার সময় গির্জার দিকে ঘুষি পাকিয়ে হাতটা নাড়ল। সেই পথটার এককোণে একটা ছাপাখানা ছিল। এই ছাপাখানাতেই একদিন সম্রাট নেপোলিয়ঁনের ঘোষণাপত্র ছাপা হয়। অতিশয় ক্লান্ত আর হতাশ হয়ে ছাপাখানার দরজার বাইরে একটা পাথরের বেলচার উপর পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল সে।

একজন বয়স্ক মহিলা বড় গির্জা থেকে বেরিয়ে এসে পথিককে সেখানে শুয়ে থাকতে দেখে তাকে বলল, এখানে কী করছ তুমি?

পথিক বলল, হে আমার সদাশয় মহিলা, তুমি দেখতে পাচ্ছ আমি কী করছি। আমি এখানে শুয়ে ঘুমোব।

এই সদাশয় মহিলা একজন মার্কুইপত্নী ছিলেন। তিনি বললেন, এই বেঞ্চিতে শোবে?

পথিক বলল, আমি উনিশ বছর কাঠের উপর শুয়েছি। এখন পাথরের উপর শুয়েছি।

তুমি কি সৈনিক ছিলে?

হ্যাঁ সৈনিক।

তুমি কেন কোনও হোটেলে গেলে না?

কারণ আমার টাকা নেই।

মার্কুই বললেন, হায়, আমার কাছে এখন মাত্র চার স্যু আছে।

কিছু না থাকার চেয়ে এটা ভালো।

পথিক মার্কুই-এর কাছ থেকে চার স্যু-ই নিল। মার্কুই তখন বললেন, এ পয়সাতে হোটেলখরচ হবে না। কিন্তু তুমি হোটেলে গিয়ে চেষ্টা করে দেখেছ? রাত্রিতে তুমি এখানে থাকতে পারবে না। তুমি নিশ্চয় শীতার্ত এবং ক্ষুধার্ত। নিশ্চয় কোনও দয়ালু ব্যক্তি তার ঘরে থাকতে দেবেন তোমাকে।

আমি প্রতিটি বাড়িতে খোঁজ করে দেখেছি।

তুমি কি বলছ কেউ তোমাকে—

প্রতিটি বাড়ি থেকে আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

মহিলাটি তখন পথিকের কাঁধে একটা হাত দিয়ে রাস্তাটার ওপারে বিশপের প্রাসাদের পাশে একটা ছোট বাড়ির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, তুমি প্রত্যেকটি বাড়িতে গিয়ে দেখেই বলছ?

হ্যাঁ।

ওই বাড়িটায় গিয়ে দেখেছ?

না।

তা হলে ওখানে যাও।

.

দিগনের বিশপ সারাদিনের কাজ সেরে শহর থেকে সন্ধ্যার সময় ঘুরে এসে তার ঘরে জেগে ছিলেন। তিনি তখন খ্রিস্টানদের কর্তব্য সম্বন্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে ব্যস্ত ছিলেন। এ সম্বন্ধে অভিজ্ঞ ও পণ্ডিতদের মতামতগুলো খুঁটিয়ে দেখছিলেন। সব ধর্মীয় কর্তব্যগুলোকে দুভাগে বিভক্ত করে দেখতে হবে তাকে। প্রথমে সামাজিক কর্তব্য, তার পর ব্যক্তিগত কর্তব্য। খ্রিস্টানদের সামাজিক বা সম্প্রদায়গত কর্তব্যগুলোকে চার ভাগে বিভক্ত করেন সেন্ট ম্যাথিউ। এই সামাজিক কর্তব্যগুলো হল ঈশ্বরের প্রতি কর্তব্য, নিজের প্রতি কর্তব্য, প্রতিবেশীর প্রতি কর্তব্য আর সমস্ত জীবের প্রতি কর্তব্য। ব্যক্তিগত কর্তব্যগুলো বিশপ অন্য এক জায়গায় প্রকাশিত দেখেছিলেন। সেন্ট পিটার রোমানদের কাছে লিখিত একটি চিঠিতে রাজা এবং প্রজাদের কর্তব্যগুলো লিপিবদ্ধ করেন। তার পর একেসীয়দের কাছে লিখিত একখানি চিঠিতে ম্যাজিস্ট্রেট স্ত্রী, মাতা ও যুবকদের কর্তব্যগুলো নির্ধারণ করেন। ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্তের কর্তব্যের কথাগুলো হিব্রুদের কাছে একটি চিঠিতে আর কুমারীদের কর্তব্যগুলো কোরিন্থীয়দের কাছে লিখিত একটি চিঠিতে লিপিবদ্ধ করেন। বিশপ বিয়েনভেনু বিভিন্ন জায়গায় লিখিত এইসব কর্তব্য বাছাই করে এক জায়গায় সেগুলো লিখে রেখেছিলেন যাতে সকল শ্রেণির লোকের মঙ্গল হয়।

সেদিন রাত্রি আটটার সময় বিশপ তাঁর হাঁটুর উপর একটা বড় বই খুলে রেখে সেটা পড়তে পড়তে কয়েকটা টুকরো কাগজে কী লিখছিলেন। এমন সময় ম্যাগলোরি একবার বিশপের ঘরে ঢুকে বিছানার পাশে আলমারি থেকে কী একটি জিনিস বার করে নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর বিশপ যখন বুঝলেন খাবার টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। এবং তার জন্য তার বোন অপেক্ষা করে বসে আছে তখন তিনি আর দেরি না করে বইটা নামিয়ে রেখে খাবার ঘরে চলে গেলেন। তাদের খাবার ঘরটা ছিল আয়তক্ষেত্রাকার এবং তার একটা দরজা রাস্তার দিকে আর একটা দরজা বাগানের দিকে ছিল। ঘরের মধ্যে আগুন জ্বলছিল।

ম্যাগলোরি তখন খাবার দেবার আগে টেবিলটা সাজাচ্ছিল আর বাপতিস্তিনের সঙ্গে কথা বলছিল। টেবিলের উপর একটা বাতি জ্বলছিল। দু জন মহিলারই বয়স ষাটের ওপর হয়েছিল। ম্যাগলোরর চেহারাটা ছিল মোটা আর বলিষ্ঠ। বাপতিস্তিনের চেহারাটা ছিল রোগা রোগা। ম্যাগলোরিকে দেখে চাষি ঘরের মেয়ে আর বাপতিস্তিনেকে সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলা বলে মনে হত। ম্যাগলোরির উপরকার ঠোঁটটা মোটা আর নিচের ঠোঁটটা সরু ছিল। তার চোখে-মুখে এক উজ্জ্বল বুদ্ধি আর অন্তরে উদারতার ছাপ ছিল। ম্যাগলোরির চেহারার মধ্যে এক রাজকীয় ঔদ্ধত্যের ভাব ছিল। বাপতিস্তিনের মধ্যে এক শান্ত ও সাধু প্রকৃতির ভাব ছিল। সে কথা কম বলত। তার ধর্মবিশ্বাস প্রগাঢ় ছিল। প্রকৃতি তাকে মেষশাবক করে পৃথিবীতে পাঠায়, ধর্মবিশ্বাস তাকে দেবদূতে পরিণত করে।

বিশপ যখন খাবার ঘরে ঢুকলেন তখন ম্যাগলোরি বাপতিস্তিনেকে জোর গলায়। একটা বিষয়ের কথা বলছিল যেটা সে এর আগেও বলেছে এবং সেটা বিশপ জানেন। বিষয়টা হল বাড়ি ও সামনের দিকে দরজাটা বন্ধ করে রাখার কথা। আজ সে সেই পুরনো বিষয়টার সঙ্গে একটা ঘটনার কথা যোগ করে দিল। সে বলল আজ সন্ধ্যায় বাজার করতে গিয়ে শহরে একটা গুঞ্জব শোনে। অদ্ভুত চেহারা আর বেশভূষাওয়ালা একটা ভবঘুরে শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাই বলছে আজ বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকা বা দরজা খুলে রাখা উচিত নয়। আজকাল শহরের মেয়র আর পুলিশের বড় কর্তার সঙ্গে মনকষাকষির জন্য পুলিশি ব্যবস্থা ভালো নয়। কাজেই নাগরিকদেরই নিজেদের নিরাপত্তা সম্বন্ধে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে। সদর দরজায় তালা দিতে হবে আর সব ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতে হবে।

বিশপ কথাগুলো শুনলেন। কিন্তু কোনও মন্তব্য না করে আগুনের ধারে গিয়ে বসলেন। ম্যাগলোরি দরজা বন্ধ করার কথাগুলো আবার বলতে লাগল।

বাপতিস্তিনে তার দাদাকে বিরক্ত না করে ম্যাগলোরিকে সমর্থন করার জন্য বিশপকে বলল, ম্যাগলোরি কী বলছে তা শুনেছ?

বিশপ বললেন, হ্যাঁ, কিছুটা শুনেছি।

তার পর তিনি হাসিমুখে ম্যাগলোরির দিকে তাকিয়ে বললেন, ব্যাপার কী? আমরা কি কোনও ঘোরতর বিপদে পড়েছি?

ম্যাগলোরি তখন ঘটনাটার পুনরাবৃত্তি করল। বলল, লোকটা এক ভবঘুরে, ভয়ঙ্কর ধরনের এক ভিখিরি। সে জ্যাকিন লাবারের হোটেলে গিয়েছিল। কিন্তু তারা তাড়িয়ে দিয়েছে। গাসেন্দি বাজারের পথে পথে তাকে অনেকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে। তার পিঠে সৈনিকদের মতো একটা ভারী ব্যাগ আছে আর তার মুখটা ভয়ঙ্কর রকমের দেখতে।

বিশপ বললেন, তাই নাকি?

বিশপের আগ্রহ দেখে ম্যাগলোরি ভাবল, বিশপ তার ভয়ের কথাটা সমর্থন করছেন। সে তখন উৎসাহিত হয়ে বলতে লাগল, হ্যাঁ মঁসিয়ে, আজ রাতে ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটবে। চারদিকে পাহাড়ঘেরা এই ছোট্ট শহরটার রাস্তাঘাটগুলো পিচের মতো অন্ধকার। পথে একটা আলো নেই। আমি যা বলছি ম্যাদময়জেলের তাতে সমর্থন আছে।

বাপতিস্তিনে বলল, আমি কিছু বলছি না, দাদা যা করবেন তাই হবে।

ম্যাগলোরি বলল, আমরা বলছি কি মঁসিয়ে অনুমতি দিলেই আমি এখনি একজন কামারের কাছে গিয়ে আমাদের দরজা কিছু তালাচাবি করাতে পারি এবং ভালো খিল লাগাবার ব্যবস্থা করতে পারি। আমাদের দরজায় যা খিল আছে তাতে কোনও লোককে আটকানো যাবে না। যে কোনও লোক রাত্রিবেলায় ঘরে ঢুকে পড়তে পারে। মঁসিয়ে আবার রাত দুপুরে বাইরে থেকে লোককে ডেকে আনেন।

এমন সময় দরজায় জোর করাঘাতের শব্দ হল।

বিশপ বললেন, ভেতরে এস।

.

ঘরের দরজা খুলে একজন লোক প্রবেশ করল। এই লোকটিই হল সেই পথিক যাকে আমরা আগেই দেখেছি। পথিক ঘরে ঢুকেই দরজার কাছে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জ্বলন্ত আগুনের আভায় তার মুখটাকে খুব ক্লান্ত ও অবসন্ন দেখাচ্ছিল। তার পিঠে সেই ব্যাগটা আর হাতে একটা লাঠি ছিল। ছেঁড়া ময়লা বেশভূষায় তার চেহারাটা কুৎসিত আর ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল।

ম্যাগলোরি তাকে দেখে মুখটা হাঁ করে ভয়ে কাঁপতে লাগল। কোনও কথা বার হল না তার মুখ থেকে। বাপতিস্তিনে উঠে দাঁড়িয়ে ভয়ে চিৎকার করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার দাদার দিকে তাকিয়ে শান্ত হয়ে রইল।

বিশপ শান্তভাবে আগন্তুককে দেখতে লাগলেন। কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই আগন্তুক ঘরের তিনজনকে দেখে নিয়ে কড়া গলায় বলতে লাগল, শুনুন, আমার নাম জাঁ ভলজাঁ। আমি একজন মুক্ত জেল-কয়েদি। আমি উনিশ বছর জেলে ছিলাম। চারদিন আগে ওরা আমায় জেল থেকে ছেড়ে দেয় এবং আমি পন্তালিয়ের যাচ্ছি। আমি ঠুলো থেকে চারদিন পথ হেঁটে এখানে আসি। আজ আমি সকাল থেকে তিরিশ মাইল পথ হেঁটেছি, এই শহরে এসে আমি একটি হোটেলে যাই, কিন্তু হোটেলমালিক আমাকে তাড়িয়ে দেয়। কারণ আমি প্রথমে আমার জেল-ফেরতের হলুদ টিকিটটি টাউন হলের কর্তৃপক্ষকে বিধিমতো দেখাই। আমি তখন আর একটি হোটেলে যাই, তারাও আমায় চলে যেতে বলে। কেউ আমায় স্থান দিতে চায়নি। আমি কারাগারে যাই, কিন্তু রক্ষীও দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি একটা কুকুরের আস্তানায় রাত্রিবাসের জন্য যাই, কিন্তু কুকুরগুলোও আমায় তাড়িয়ে দেয় মানুষদের মতো। তার পর আমি শহরের বাইরে মাঠে যাই শোবার জন্য, কিন্তু আকাশে মেঘ থাকায় বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে দেখে চলে আসি। আমি একটা পাথরের বেঞ্চের উপর শুয়ে পড়ি। তখন একজন মহিলা আমাকে এই বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। তাই আমি এখানে এসে দরজায় করাঘাত করি। এ বাড়িটা কি হোটেল? আমার কাছে টাকা আছে। উনিশ বছর জেলখানায় কাজ করে আমি একশো নয় ফ্রাঁ পনের স্যু পাই। আমি এখানে থাকা-খাওয়ার জন্য যা লাগবে, তা যাই হোক আমি দিতে রাজি আছি। আমি অতিশয় ক্লান্ত, বারো লিগ পথ আমি হেঁটেছি। আমি দারুণ ক্ষুধার্ত। আমাকে এখানে থাকতে দেবেন?

বিশপ বললেন, ম্যাদময়জেল ম্যাগলোরি, দয়া করে টেবিলে আর একটা খাবার জায়গা করবে?

ভলজাঁ কথাটা বুঝতে না পেরে জ্বলন্ত চুল্লিটার কাছে এল। বলল, আমার কথা আপনারা শোনেননি? আমি একজন জেলফেরত কয়েদি। আমি জেলে সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেছি।

সে তার পকেট থেকে একটা হলুদ কাগজ বার করে বলল, এই হল আমার হলুদ টিকিট। এই জন্যই সবাই আমাকে তাড়িয়ে দেয়। আপনারা এটা পড়তে চাইলে পড়ে দেখতে পারেন। আমিও পড়তে পারি। জেলখানায় শ্রেণিবিভাগ আছে। এতে লেখা আছে, জাঁ ভলজাঁ জেলের আসামি মুক্ত, তার জন্ম –সে উনিশ বছর কারাদণ্ড ভোগ করেছে, তার মধ্যে হিংসার আশ্রয় নিয়ে ডাকাতি করার জন্য পাঁচ বছর, জেল থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করার জন্য চৌদ্দ বছর অতিশয় বিপজ্জনক লোক। এই হচ্ছে আমার পরিচয়। সকলেই আমায় তাড়িয়ে দিয়েছে। আপনারা আমাকে থাকতে দেবেন? এটা কি একটা হোটেল? আমাকে কিছু খাবার আর রাত্রির মতো থাকতে দেবেন? আপনাদের কি আস্তাবল আছে?

বিশপ বললেন, ম্যাগলোরি, অতিথিদের বিছানাটায় একটা পরিষ্কার চাদর পেতে দাও।

বিশপের কথা বিনা প্রতিবাদে মহিলা দু জন মেনে চলত, একথা আগেই আমরা বলেছি। ম্যাগলোরি বিশপের আদেশ পালন করতে চলে গেল।

বিশপ এবার লোকটির দিকে ঘুরে বললেন, আপনি বসুন মঁসিয়ে, শরীরটাকে একটু গরম করুন। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার দেওয়া হবে এবং আপনি খেতে খেতেই বিছানা প্রস্তুত হয়ে যাবে।

লোকটি এবার বিশপের কথাটা বুঝল। তার চোখ-মুখের কঠোর ভাবটা সহসা কেটে গিয়ে তার জায়গায় বিস্ময়, অবিশ্বাস এবং আনন্দের ভাব ফুটে উঠল। সে শিশুসুলভ উচ্ছৃঙ্খলতার সঙ্গে কথা বলতে লাগল। সে বলল, আপনারা সত্যিই আমাকে খাবার আর থাকার জায়গা দেবেন? আমি একজন জেল-কয়েদি হওয়া সত্ত্বেও আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না? আপনি আমাকে মঁসিয়ে বলে সম্বোধন করলেন। কিন্তু অন্য সবাই আমাকে বলেছে, বেরিয়ে যাও, কুকুর কোথাকার! আমি ভেবেছিলাম আপনারাও তাড়িয়ে দেবেন, তাই আমি আগেই সব কথা বললাম। আমার আসল পরিচয় দান করলাম। যে মহিলা আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন তাঁর কাছে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। রাতের খাওয়া আর বিছানা।

তোশক, চাদর, বালিশ–উনিশ বছর আমি কোনও বিছানায় শুইনি। ঠিক আছে, আমার টাকা আছে, আমি দাম দিতে পারব। আপনার নামটা জানতে পারি স্যার? আপনি খুব ভালো লোক। টাকা আমি দেব। আপনি নিশ্চয় একজন হোটেলমালিক। তাই নয় কি?

বিশপ বললেন, আমি একজন যাজক এবং এখানেই থাকি।

যাজক! কিন্তু সত্যিই খুব ভালো যাজক। তা হলে আমাকে টাকা দিতে হবে না! আপনিই এই বড় গির্জার ভারপ্রাপ্ত যাজক? আমিই বোকা, আপনার মাথায় যাজকের টুপিটা আমি এতক্ষণ দেখিনি।

কথা বলতে বলতে পথিক তার পিঠের ব্যাগটা আর হাতের লাঠিটা ঘরের এক কোণে রাখল। তার পর হলুদ টিকিটটা পকেটের মধ্যে ভরে রেখে বসল। বাপতিস্তিনে তার দিকে তাকিয়ে তাকে দেখছিল। সে বলল, আপনি একজন মানুষের মতো মানুষ মঁসিয়ে। আপনি কোনও মানুষকে ঘৃণা করেন না। যাজক যদি মানুষ হিসেবে ভালো হয় তা হলে সত্যিই মানুষের উপকার হয়। তা হলে আমাকে কোনও টাকা-পয়সা দিতে হবে না?

বিশপ বললেন, না। কত পেয়েছেন আপনি? একশো নয় ফ্রাঁ?

আর পনেরো স্যু।

এ টাকা কতদিনে রোজগার করেছেন?

উনিশ বছরে।

পথিক বলল, টাকাটা আমার কাছে এখনও প্রায় সবটাই আছে। এই ক’দিনে আমি এর থেকে শুধু পঁচিশ স্যু খরচ করেছি। এ পয়সাটা আমি গ্রেসি নামে এক জায়গাতে গাড়ি থেকে মাল নামিয়ে দিয়ে রোজগার করেছিলাম। আমাদের জেলখানায় মার্শেল থেকে একজন বিশপ আসতেন। জেলখানার ভেতরে যে বেদি ছিল তার সামনে তিনি সমবেত প্রার্থনার অনুষ্ঠান করতেন। তাঁর মাথার টুপিটাতে সোনার জরির কাজ করা ছিল। দুপুরের রোদে তাই চকচক করত টুপিটা। তাকে আমরা ভালো করে দেখতেই পেতাম না। তিনি আমাদের কাছ থেকে অনেকটা দূরে থাকায় কী বলতেন, তা শুনতেও পেতাম না।

ঘরের দরজাটা খোলা ছিল। বিশপ উঠে গিয়ে সেটা বন্ধ করে দিলেন। ম্যাগলোরি বাড়তি এক প্লেট খাবার নিয়ে এলে বিশপ বললেন, ওটা যথাসম্ভব আগুনের কাছে রাখ।

বিশপ এবার অতিথিকে বললেন, আল্পস পর্বত থেকে ঠাণ্ডা কনকনে বাতাস বইছে। আপনার নিশ্চয় খুব শীত লাগছে মঁসিয়ে?

বিশপ যতবার পথিককে ‘মঁসিয়ে’ বলে সম্বোধন করেন পরম বন্ধুর মতো ততবারই তার মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এক ভূতপূর্ব জেলের কয়েদিকে এই ধরনের সৌজন্য দান করাটা লবণসমুদ্রে ভাসমান কোনও জাহাজডুবি মানুষকে সুপেয় জলদানের মতো বাঞ্ছিত অথচ অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। অপমানিত মানুষই সম্মানের পিপাসায় আর্ত হয়ে ওঠে।

বিশপ বললেন, এই বাতিটার আলো তেমন জোর নয়।

তার মনের কথা বুঝতে পেরে ম্যাগলোরি বিশপের শোবার ঘর থেকেই দুটো রুপোর বাতিদান নিয়ে এসে তাতে দুটো বাতি জ্বালিয়ে খাবার টেবিলের উপর রাখল।

পথিক আবার বলল, মঁসিয়ে, আপনি বড় ভালো লোক। আপনি আমাকে ঘরে জায়গা দিয়ে আমার জন্য বাতি জ্বেলেছেন, আমাকে খাবার দিয়েছেন, অথচ আমি আমার কথা সব বলেছি।

বিশপ তাঁর একটি হাত পথিকের একটি বাহুর উপর রেখে বললেন, আপনার কিছুই বলার দরকার ছিল না। এ বাড়ি আমার নয়, খ্রিস্টের, তাঁর নামেই আমি ভোগ করি। এখানে। এলে কোনও মানুষকে তার নাম-ধাম বলতে হয় না, বলতে হয় শুধু কী বিপদে সে পড়েছে। আপনি বিপদে পড়েছেন, আপনি ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, নিরাশ্রয়; সুতরাং আপনি এখানে স্বাগত। আপনাকে এ বাড়িতে স্থান দেওয়ার জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানাবার কিছু নেই। যে কোনও নিরাশ্রয় ব্যক্তিই এখানে আশ্রয় চাইলে পাবে। এ বাড়িতে আমার থেকে আপনাদের অধিকারই বেশি। এখানকার সব কিছুই আপনাদের। কেন আমি আপনার নাম জিজ্ঞাসা করব? তাছাড়া আপনার নাম তো আমার আগেই জানা ছিল।

পথিক বিস্ময়ে চমকে উঠে বলল, আমার নাম আপনি জানেন?

বিশপ বললেন, অবশ্যই জানি। আপনার নাম হল ভাই।

পথিক বলল, মঁসিয়ে যাজক, আমি এখানে বড় ক্ষুধার্ত অবস্থায় আসি। কিন্তু এখন সে ক্ষুধা আমি অনুভব করতেই পারছি না। সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেছে।

বিশপ অন্তরঙ্গভাবে বললেন, আপনি অনেক কষ্ট ভোগ করেছেন।

হ্যাঁ, অনেক কষ্ট–কৃষিশ্রমিকদের মতো লম্বা আলখাল্লার মতো নোংরা পোশাক, হাতে শিকল, কাঠের তক্তার উপর শোয়া, তীব্র শীত-গ্রীষ্ম সহ্য করা, কঠোর পরিশ্রম, তার উপর মাঝে মাঝে চাবুকের আঘাত–এইসব কিছু সহ্য করতে হয়েছে আমাকে। এমনকি যখন আমি শুয়ে থাকতাম তখনও শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হত আমায়। কুকুরেরাও আমার থেকে ভালো থাকত। এইভাবে উনিশ বছর কাটাতে হয়েছে আমাকে। এখন আমার বয়স ছেচল্লিশ। আবার তার ওপর এক হলুদ টিকিট সঙ্গে আছে আমার। এই হল আমার কাহিনী।

বিশপ বললেন, তা থাক। শুনুন, একশো ধার্মিক যাজকের সাদা পোশাকের থেকে একজন পাপীর চোখে এক বিন্দু অনুতাপের অশ্রু ঈশ্বরের কাছে অনেক আনন্দদায়ক। আপনি যেখানে দুঃখভোগ করতেন সে জায়গাটি যদি আপনি সেখানকার মানুষদের প্রতি অন্তরে ঘৃণা আর ক্রোধ নিয়ে ত্যাগ করেন তা হলে আপনি আমাদের করুণার পাত্র হবেন, কিন্তু যদি আপনি কারও প্রতি কোনও অভিযোগ না রেখে শান্ত মনে সকলের প্রতি শুভেচ্ছা পোষণ করে সে জায়গা ত্যাগ করেন তা হলে আপনি মহত্ত্বে আমাদের সবাইকে ছাড়িয়ে যাবেন।

ম্যাগলোরি ততক্ষণে খাবারের সব ডিশ টেবিলের উপর সাজিয়ে দিয়ে গেছে। এক একটি ডিশে ছিল একটা করে বড় পাউরুটি, কিছু মাখন, কিছুটা তেল, নুন, কিছু শুয়োর ও ভেড়ার মাংস, আর ডুমুরের ঝোল। তার ওপর ছিল জল আর মদ। বিশপ দৈনন্দিন যে মদ ব্যবহার করতেন তার সঙ্গে অতিথিদের জন্য সংরক্ষিত মদ থেকে আনা কিছু পুরনো ভালো মদ এনে পরিবেশন করল ম্যাগলোরি।

বিশপ তার নিজস্ব প্রথা অনুসারে অতিথিকে তার ডান দিকে বসালেন। তাঁর বোন বসল তার বাঁ দিকে। বিশপের মুখের প্রসন্ন ভাব দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল তিনি অতিথিবৎসল।

বিশপ খেতে খেতে একসময় বললেন, টেবিলে একটা জিনিসের অভাব দেখা যাচ্ছে।

ব্যাপারটা বুঝতে পারল ম্যাগলোরি। এই বাড়িতে মোট ছয় জনের খাবার মতো রুপোর কাঁটাচামচ আছে। এই বাড়ির প্রথা হল এই যে কোনও অতিথি এলে খাবার টেবিলে ছয় জনের কাঁটাচামচ সব বার করে সাজিয়ে রাখতে হবে টেবিলে। এ যেন সামান্য কিছু একমাত্র ঐশ্বর্যের শিশুসুলভ ও নির্দোষ প্রকাশ। এই ঐশ্বর্যের এক আবরণ দিয়ে বিশপ যেন তার সংসারের দীনতা ও দারিদ্রকে ঢাকার প্রয়াস পেতেন।

ম্যাগলোরি রুপোর সব কাঁটাচামচ এনে খাবার টেবিলে পাতা সাদা ধবধবে কাপড়ের উপর সাজিয়ে দিল সেগুলো।

.

খাবার টেবিলে সেদিন কী কী কথা হয়েছিল তার বিবরণ মাদাম দ্য বয়শেনকে লেখা বাপতিস্তিনের একটি চিঠির অংশ থেকে বোঝা যাবে। বাপতিস্তিনে তাদের সেই অতিথি আর দাদার মধ্যে সে রাতে খাবার সময় যেসব কথাবার্তা হয়েছিল তার একটি পূর্ণ বিবরণ দান করে। সে লেখে,… লোকটা প্রথমে কোনও দিকে নজর না দিয়ে বুভুক্ষুর মতো খেয়ে চলেছিল একমনে। অবশেষে মদ পান করার পর সে বিশপকে বলল, মঁসিয়ে যাজক, ওয়াগনের লোকগুলো কিন্তু আপনাদের থেকে ভালো খায়।

সত্যি বলতে কি কথাটা শুনে আমি আঘাত পাই মনে। কিন্তু আমার দাদা সহজভাবে বললেন, তার কারণ আমার থেকে তারা বেশি পরিশ্রমের কাজ করে।

লোকটা বলল, না। কারণ তাদের বেশি টাকা আছে। আমি দেখছি আপনারা গরিব। হয়তো আপনি খুবই একটা ছোট গ্রাম্য যাজক। ঈশ্বর করেন যেন তাই হয়।

বিশপ বললেন, ঈশ্বর ন্যায়পরায়ণ, তিনি ঠিকই করেছেন।

একটু থেমে বিশপ আবার বললেন, মঁসিয়ে জাঁ ভলর্জ, আপনি কি পালিয়ে যাচ্ছেন?

ওই পথেই আমাকে যাবার আদেশ দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল সকাল হলেই আমাকে রওনা হতে হবে। এ পথে যাওয়া খুবই কঠিন। দিনে গরম, রাত্রিতে দারুণ ঠাণ্ডা।

আমার দাদা বললেন, আপনি এক ভালো অঞ্চলেই যাচ্ছেন। বিপ্লবে আমার পরিবার ধ্বংস হয়ে যায় একেবারে। আমি তখন ফ্রোশেকোঁতে চলে যাই এবং সেখানে দৈহিক শ্রমের দ্বারা জীবিকা অর্জন করি। ওখানে কাজের কোনও অভাব নেই। কাজ খুঁজতে আমার কষ্ট হয়নি, কারণ ওদিকে গোটা অঞ্চলটা কাগজের কল, তৈলশোধক কারখানা, লোহা আর তামার কারখানা, ঢালাই কারখানা প্রভৃতি কল-কারখানায় ভর্তি। ওই অঞ্চলের নাম লডস, শাতিলিয়ন, অজিনকোর্ট আর বোরে।

এইসব জায়গার নাম করার পর আমার দাদা আমার দিকে ফিরে বললেন, আচ্ছা ওই অঞ্চলে আমাদের কোনও আত্মীয় নেই?

আমি বললাম, আগে ছিল। অন্যদের মধ্যে মঁসিয়ে দ্য লুসেনেত আমাদের এক আত্মীয় ছিলেন। তিনি নগরদ্বারের এক ক্যাপ্টেন।

আমার দাদা বললেন, ১৭৯৩ সালের পর আমাদের আর কোনও আত্মীয় সেখানে ছিল না। আমাদের মধ্যে শুধু আমরাই অবশিষ্ট ছিলাম। ওখানে অনেক মাখনের কারখানা আছে। কারখানার মালিকরা হচ্ছে দুই শ্রেণির। একদল মালিক হল ধনী আর একদল মালিক হল গরিব চাষির দল। তারা কয়েকজন করে মিলে একটি করে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। মাখন তৈরির কাজ শুরু হয় এপ্রিলের শেষের দিকে। তার পর জুনের মাঝামাঝি চাষিরা তাদের গরুগুলো পাহাড়ের উপত্যকায় চরাতে নিয়ে যায়।

আরও বেশি খাবার জন্য আমার দাদা অনুরোধ এবং উৎসাহিত করছিলেন তাকে। তিনি নিজে যে মদ কোনওদিন বেশি দাম বলে খান না, মভ থেকে আনা ভালো মদ তিনি তাকে খেতে বললেন, তার পর আমার দাদা মাখন তৈরির কথা বলছিলেন এবং মাঝে মাঝে থামছিলেন যাতে আমি এই আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারি। একটা জিনিস দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। লোকটি কী ধরনের ছিল তা আমি আগেই তোমায় বলেছি। আমার দাদা কিন্তু সন্ধে থেকে কখনও বা খাবার সময়েও লোকটার কোনও পরিচয় জানতে চাননি এবং তিনিও নিজের সম্বন্ধে কিছু বলেননি। সাধারণত একজন বিশপের পক্ষে একজন দুষ্কৃতকারীকে হাতের কাছে পেয়ে কিছু উপদেশ দানের এটাই ছিল সুবর্ণ সুযোগ। একইভাবে তিনি তার মনে রেখাপাত করতে পারতেন। অন্য কেউ হলে মৃদু ভর্ৎসনা আর নীতি-উপদেশের বাক্যদ্বারা তার দেহ ও আত্মাকে পাপের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে পারতেন। সহানুভূতির সঙ্গে এই আশা করতেন যে ভবিষ্যতে সে তার পথ পরিবর্তন করে ভালোভাবে বাঁচবে।

কিন্তু আমার দাদা লোকটা কোথায় জন্মেছে, সে কথাও তাকে একবার জিজ্ঞাসা করলেন না। তার জীবনকাহিনীর কথা জানতে চাইলেন না। তার জীবনকাহিনীর মধ্যে নিশ্চয় কিছু অপরাধের কথা ছিল। আমার দাদা সেইসব অপরাধের কথাগুলোকে পরিষ্কার এড়িয়ে গেলেন। আমার দাদা একবার পন্তালিয়েরের নির্দোষ, নিরীহ পার্বত্য অধিবাসীরা কিভাবে মুক্ত আকাশের তলে সন্তুষ্ট চিত্তে আনন্দের সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করে চলে তার কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন পাছে তাতে লোকটা রুষ্ট হয়। আমার দাদার মনে তখন কী ছিল আমি পরে সেখানে জানতে পেরেছিলাম। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন জাঁ ভলজাঁ নামে সেই লোকটা আগে থেকেই হয়তো তার পাপচেতনায় জর্জরিত ছিল। তাই হয়তো তিনি তাকে তখনকার মতো সেই পাপচেতনার বোঝা থেকে তার মনটাকে মুক্ত করে তাকে অনুভব করাতে চাইছিলেন সে-ও আর পাঁচজনের মতো মানুষ। এটাও কি এক ধরনের বদান্যতা নয়? এক সূক্ষ্ম মানবতাবোধের বশবর্তী হয়ে এইভাবে ধর্মপ্রচার ও নীতি-উপদেশ দানের কাজ থেকে বিরত থাকা কি প্রকৃত যাজকের কাজ নয়? তার মনের ক্ষতটা নিয়ে ঘাটাঘাটি না করাটাও কি প্রকৃত সহানুভূতির ধর্ম নয়? আমার মনে হয় এটাই ছিল তার মনের আসল ভাব। তবে এটাও ঠিক যে তিনি তার এই ভাবের কোনও লক্ষণ আমার কাছেও কিছুমাত্র প্রকাশ করেননি। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি জাঁ ভলজাঁর সঙ্গে একজন সাধারণ লোকের মতো খেয়ে গেলেন যেমন তিনি কোনও যাজক বা পদস্থ সরকারি অফিসারের মতো কোনও সম্মানিত অতিথির সঙ্গে খেতেন।

আমাদের খাওয়া যখন শেষ হয়ে আসছিল তখন দরজায় আবার করাঘাত হল। দরজা খুলতে দেখা গেল মাদাম গার্লদ ছেলে কোলে করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার দাদা ছেলেটার কপালে চুম্বন করে আমার কাছ থেকে পনেরো সু ধার করে মাদাম গার্লদকে দিলেন। জাঁ ভলজাঁ এদিকে কোনও নজর দিল না। তাকে তখন খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। মাদাম গার্লদ চলে গেলে আমার দাদা ভলজাঁর দিকে ঘুরে বললেন, আপনি তো এবার শুতে যাচ্ছেন। ম্যাগলোরি তাড়াতাড়ি খাবার টেবিলটা পরিষ্কার করে ফেলল। আমি বুঝলাম এবার আমাদের চলে যেতে হবে। লোকটাকে ঘুমোতে দিতে হবে। এই ভেবে আমরা উপরতলায় চলে গেলাম। কিন্তু কিছু পরেই আমি আমার ছাগলের চামড়ার কম্বলটা লোকটার কাছে পাঠিয়ে দিলাম, কারণ সেদিন খুব শীত ছিল এবং তাতে তার শরীরটা বেশ গরম হবে। আমার দাদা সেই জার্মানি থেকে কিনে এনেছিলেন। সেই সঙ্গে খাবার টেবিলে ব্যবহার করার জন্য হাতির দাঁতের বাটওয়ালা একটা ছুরিও কিনে এনেছিলেন। ম্যাগলোরি ফিরে এলে আমরা প্রার্থনার কাজ সেরে চলে গেলাম আর কোনও কথা না বলে।

.

তার বোনকে রাত্রির মতো বিদায় দিয়ে মঁসিয়ে বিয়েনভেনু দুটি রুপোর বাতিদানের মধ্যে একটি তুলে নিয়ে তাঁর অতিথিকে তার শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন। অতিথিদের শোবার ঘরে যেতে হলে বিশপের শোবার ঘরের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। ম্যাগলোরি তখন রুপোর কাঁটাচামচগুলো আলমারিতে গুছিয়ে রাখছিল।

অতিথির জন্য বিছানাটা পাতা হয়ে গিয়েছিল। লোকটা বিশপের সঙ্গে সেই শোবার ঘরটায় গিয়ে বাতিটা টেবিলের উপর রাখল।

বিশপ বললেন, ভালো করে শান্তিতে ঘুমোন। কাল সকালে এখান থেকে যাবার আগে আমাদের গরুর দেওয়া একপাত্র গরম দুধ পান করে যাবেন।

লোকটি বলল, ধন্যবাদ হে যাজক।

এই কথাটা বলার পরই হঠাৎ সে এক ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে দাঁড়াল, যা মেয়েরা দেখলে সত্যিই দারুণ ভয় পেয়ে যেত। কী আবেগের বশবর্তী হয়ে সে সেই মুহূর্তে এক ভয়ঙ্কর ভাব ধারণ করলে তা জানা যায় না, সে নিজেও হয়তো তা জানতো না। সে কি এর দ্বারা সতর্ক করে দিচ্ছিল বিশপকে অথবা ভয় দেখাচ্ছিল? অথবা এটা একটা তার সহজাত দুর্বার প্রবৃত্তির অদম্য আত্মপ্রকাশ? যা হোক, লোকটা সহসা ঘুরে দাঁড়িয়ে বিশপের দিকে ভয়ঙ্করভাবে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল, চমৎকার! কী আশ্চর্যের ব্যাপার।

আপনি আমায় আপনার শোবার ঘরের পাশেই শুতে দিচ্ছেন!

হঠাৎ সে এক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। সে হাসিতে এক দানবিক উচ্ছ্বাস ছিল। সে আবার বলল, আপনি কী করছেন তা একবার ভেবে দেখেছেন? আপনি কী করে। জানলেন যে আমি কখনও কাউকে হত্যা করিনি।

বিশপ শান্তভাবে বললেন, এটা ঈশ্বরের কাজ।

বিশপের ঠোঁট দুটি একবার প্রার্থনার স্বগত উচ্চারণে নড়ে উঠল, তিনি নিজেকে নিজে কী বলছিলেন। তার পর তিনি তাঁর ডান হাতটি তুলে দুটি আঙুল প্রসারিত করে লোকটিকে আশীর্বাদ করলেন। লোকটি তার মাথাটা একবারও নত করল না। বিশপ সেদিকে আর না তাকিয়ে নীরবে তাঁর শোবার ঘরে চলে গেলেন।

অতিথির বিছানার পাশে একটা পর্দা ফেলে দিয়ে বেদি থেকে বিছানাটাকে পৃথক করে রাখা হত। বিশপ একবার সেই পর্দার পাশে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করলেন। তার পর তিনি অন্যদিনকার মতো বাগানে চলে গেলেন। সেখানে পায়চারি করতে করতে সেইসব রহস্যের কথা ভাবতে লাগলেন যেসব রহস্য ঈশ্বর রাত্রির নীরব শান্ত অবকাশে সজাগ ব্যক্তির সামনে উদ্ঘাটিত করেন।

লোকটি এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে সে পরিষ্কার চাদরপাতা ভালো নরম বিছানাটার আরাম তার সজাগ সচেতন অনুভূতি দিয়ে উপভোগ করতে পারল না। সে বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।

বিশপ যখন বাগান থেকে তাঁর শোবার ঘরে চলে এলেন তখন রাত্রি প্রায় দুপুর। কিছুক্ষণের মধ্যে গোটা বাড়িটাই এক গভীর ঘুমের মধ্যে ঢলে পড়ল।

শেষরাতের দিকে জাঁ ভলজাঁ জেগে উঠল।

.

ব্রাই নামে একটি গাঁয়ের এক গরিব কৃষক পরিবারে জাঁ ভলজাঁর জন্ম হয়। শৈশবে সে লেখাপড়া শিখতে পারেনি। একটু বড় হলে সে ফেবারোলে গাছ কাটার কাজ করতে যায়। তার মার নাম ছিল ম্যাথিউ এবং তার বাবার নাম ছিল জাঁ ভলজাঁ। ডাক নাম ছিল ভাজা।

বাল্যকালে ভাবুক প্রকৃতির ছিল জাঁ ভলজাঁ। মনের মধ্যে কোনও বিষাদ না থাকলেও সে প্রায়ই কী সব ভাবত, তবে তার অন্তরটা ছিল সরল। তার চেহারার মধ্যে আকর্ষণ করার মতো কিছু ছিল না। কিশোর বয়সেই সে বাবা-মা দু জনকেই হারায়। তার মা প্রথমে রোগভোগে মারা যায়। তার বাবাও গাছ কাটার কাজ করত এবং একদিন গাছ কাটতে গিয়ে একটা গাছ তার উপর পড়ে যাওয়ায় সে মারা যায়। জাঁ ভলজাঁর আত্মীয় বলতে ছিল তার এক দিদি। তার দিদির স্বামী তখন বেঁচে থাকলেও দিদির সংসারে অভাব ছিল। তার সাতটা ছেলেমেয়ে ছিল। দিদির স্বামীও হঠাৎ মারা যায়। তখন তাদের বড় ছেলের বয়স আট। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর তার দিদিই জাঁ ভলজাঁকে তাদের বাড়িতে আশ্রয় দেন। তখন তার বয়স চব্বিশ। দিদির সংসারেই থাকত-খেত সে। দিদির স্বামীর মৃত্যুর পর জাঁ ভলজাঁ খেটে দিদির সংসার চালাতে লাগল। বেশি খেটে কম মাইনে পেত সে। তার সারা যৌবন এই কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে কেটে যায়। যৌবনে কারও ভালোবাসা সে পায়নি। কোনও মেয়ের প্রেমের পড়ার কোনও সুযোগ পায়নি।

সারা দিনের কাজ শেষ করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে নীরবে রাতের খাওয়া সেরে ফেলত জাঁ ভলজাঁ। তার সামনে তার খাবারের পাত্র থেকে দু-এক টুকরো ভালো মাংস তুলে নিয়ে তার কোনও না কোনও ছেলেমেয়েকে দিত তার দিদি। জাঁ ভলজাঁ সেদিকে ইচ্ছা করেই কোনও নজর দিত না। তার দিদির বাড়ির কাছে একটা খামারে এক চাষি পরিবার বাস করত। দিদির ছেলে-মেয়েরা সেই চাষি পরিবার থেকে প্রায় দিনই তাদের মার নাম করে এক জগ করে দুধ এনে নিজেরা কাড়াকাড়ি করে খেত। তাদের মা জানতে পারলে তাদের মারত। কিন্তু জাঁ ভলজাঁ তা জানত এবং তার দিদিকে লুকিয়ে সেই দুধের দাম দিয়ে দিত।

গাছকাটার মরশুমে গাছকাটার কাজ করে রোজ চব্বিশ স্যু করে পেত। কিন্তু মরশুম শেষ হয়ে গেলে সে ফসল তোলা বা পশুচারণের কাজ করত। বছরের সব সময়েই সে কিছু না কিছু একটা করত এবং তার দিদিও কাজ করত। কিন্তু সাতটা ছেলেমেয়ের ভরণপোষণ চালাতে বড় কষ্ট হত তাদের। দারিদ্রগ্রস্ত এইসব ছেলেমেয়ে সব সময় অনাথ শিশুদের মতো ঘুরে বেড়াত। একবার শীতকালে জাঁ ভলজাঁদের সংসারে বড় দুঃসময় দেখা দিল। জাঁ ভলজাঁর তখন কোনও কাজ ছিল না। সে বেকার বসে ছিল। কোনও রোজগার ছিল না। সংসারে খাবার কিছু নেই, অথচ সাতটি ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়ের মুখে কিছু না কিছু দিতে হবে।

কোনও এক রবিবার রাত্রিতে মবেয়ার ইসাবো নামে ফেবারোলের এক রুটির কারখানার মালিক যখন শুতে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ রুটি রাখার ভাড়ারঘরের জানালার কাঁচের সার্সি ভাঙার শব্দ শুনতে পায়। ইসাবো দেখে একটা লোক জানালার কাঁচ ভাঙার সেই ফাঁকটা দিয়ে একটা হাত ঢুকিয়ে একটা রুটি তুলে নিল। রুটি নিয়ে হাতটা বেরিয়ে গেল জানালা থেকে। ইসাবো তখন চোরটাকে তাড়া করল। লোকটা রুটি চুরি করে পালাচ্ছিল। কিন্তু ইসাবো তাকে ধরে ফেলল। চোরটার হাত থেকে তখনও রক্ত বার হচ্ছিল।

তখন চলছিল ১৭৯৫ সাল। বাড়ির দরজা ভেঙে বে-আইনি প্রবেশ ও চুরির অপরাধে অভিযুক্ত ভলজাঁর বিচার হয় স্থানীয় আদালতে। তার একটা ছোট বন্দুক ছিল। সেটা নাকি সে বৈধ ব্যাপারে ব্যবহার করত না। প্রমাণ পাওয়া গেল সে মাছ চুরি করত। মাছ চুরির কাজটা চোরাই মাল চালান করার মতোই অপরাধজনক। তবে একটা কথা বলা যেতে পারে, যারা পরের বাগানে গিয়ে পশুপাখি মেরে আনে বা মাছ চুরি করে তারা শহরের চোরাই মাল চালানকারী খুনি অপরাধীদের মতো কখনই ভয়ঙ্কর নয়। শহর মানুষকে হিংস্র এবং দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে। বন, পাহাড়, নদী, সমুদ্র মানুষকে হঠকারী করে তোলে। প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রূপ মানুষের মধ্যে বন্য দুর্বার ভাবটাকে জাগিয়ে তোলে বটে, কিন্তু তার মানবিক গুণ বা অনুভূতিগুলোকে ধ্বংস করে না।

বিচারে দোষী সাব্যস্ত হল জাঁ ভলজাঁ। সভ্য জগতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, এমন অনেক আইনের বিধান আছে, যা এক একটি মানুষের জীবনকে ভেঙে দেয়। এমন এক একটি মুহূর্ত আসে মানুষের জীবনে যখন সমাজ এক একটি মানুষকে ত্যাগ করে দূরে ঠেলে দেয়। তাকে নিঃস্ব ও সর্বহারা করে তোলে। জাঁ ভলজাঁ পাঁচ বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়।

১৭৯৬ সালের ২২ এপ্রিল যেদিন প্যারিসে মোতেনেত্তের বিজয়বার্তা ঘোষিত হয় সেদিন বিকেত্রের জেলখানায় জাঁ ভলজাঁ একজন শৃঙ্খলিত কয়েদি হিসেবে অবস্থান করছিল। যার বয়স এখন নব্বই এমন এক প্রাচীন কয়েদি তখন একই জেলখানায় ছিল। সেদিন জেলখানার উঠোনে কয়েদিদের চতুর্থ সারিতে শৃঙ্খলিত অবস্থায় জাঁ ভলজাঁ বসে ছিল। সে তার অজ্ঞ অশিক্ষিত সরল চাষি-মনে এই কথাই শুধু বুঝতে পেরেছিল যে তার অবস্থা সত্যিই ভয়ঙ্কর এবং তার অপরাধের অনুপাতে তার শাস্তিটা খুবই বেশি। যখন হাতুড়ির ঘা দিয়ে তার গলায় লোহার বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হত তখন সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত। সে তার হাত তুলে বোঝাতে চাইত সে যা কিছু করেছে তার বোনের সাতটি ছেলেমেয়ের জন্যই করেছে।

এরপর তাকে একটি মালবাহী গাড়িতে করে সাতাশ দিনের পথ অতিক্রম করে গলায় শিকল বাধা অবস্থায় তুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে তখন এক লাল আলখাল্লা পরিয়ে দেওয়া হয়। তার পূর্বজীবনের যা কিছু মুছে দেওয়া হয়। তার নামটাও যেন মুছে গিয়েছিল। সে যেন আর জাঁ ভলজাঁ নামে কোনও লোক ছিল না। সে শুধু একজন কয়েদি যার নম্বর ছিল ২৪৬০১। তার বোন ও বোনের ছেলেমেয়েদের ভাগ্যে কী ঘটল তার। কিছুই জানতে পারল না। কোনও গাছকে যখন করাত দিয়ে কাটা হয় তখন তার পাতাগুলোর অবস্থা কী হয়, তা সবাই জানে।

এ সেই একই পুরনো কাহিনী। এইসব দুঃখী মানুষ ঈশ্বরের সৃষ্ট জীব হলেও সহায়সম্বলহীন ও নিরাশ্রয় অবস্থায় যেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে কেন্দ্রচ্যুত হয়। নিষ্ঠুর ভাগ্যের বিধানে এইসব হতভাগ্যের দল আপন আপন জীবনের পথে চলে যায়। মানবজাতির অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে সে পথ থেকে দূরে সরে পিছু কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায় তারা তা কে জানে! তাদের আপন আপন জেলা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তাদের গাঁয়ের গির্জার গম্বুজ, গাঁয়ের পাশের ঝোঁপঝাড়ের কথা সব যেন ভুলে গিয়েছিল ভুলজা। মাত্র কয়েক বছরের কারাবাস অতীত জীবনের সব কিছু ভুলিয়ে দিয়েছিল যেন। তার মনের মধ্যে যে ক্ষত ছিল এতদিন একেবারে উন্মুক্ত, ক্রমে সেখানে যেন একটা ঢাকনা পড়ে গেল। তুলোতে থাকাকালে সে মাত্র একবার তার বোনের খবর পেয়েছিল। তুলোতে চার বছর থাকাকালে চতুর্থ বছরের শেষের দিকে সে খবর পায়। কার কাছ থেকে কিভাবে খবরটা পেল সে কেউ বলতে পারে না। তবে সে জেনেছিল তার বোনকে প্যারিসের পথে দেখতে পাওয়া গেছে। তার বোনের কাছে তখন শুধু তার কনিষ্ঠ সন্তান সাত বছরের একটি ছেলে ছিল। বাকি ছয়টি ছেলেমেয়ে কোথায় গেল, তা কেউ জানে না। তাদের মা-ও হয়তো জানে না। তার বোন একটি ছাপাখানায় কাজ করে কোনও এক জায়গায় থাকে। তার বাচ্চা ছেলেটাকে একটি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। সকালে উঠেই তাকে দু’টার সময় দোকানে হাজির হতে হয়। ছেলেটির স্কুল খোলে সাতটায়। তাই ছেলেটিকে সঙ্গে করে তার দোকানের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখতে হয় এক ঘণ্টা, কারণ দোকানের ভেতর তাকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। শীতের সময় ছেলেটির বড় কষ্ট হয়। সে শীতে কুঁকড়ে কাঁপতে থাকে। বৃষ্টি এলে এক বৃদ্ধা দয়ার বশে ছেলেটিকে তার আস্তানায় আশ্রয় দেয়।

ছেলেটি সাতটা বাজলেই স্কুলে চলে যেত। ভলজাঁ শুধু তার বোনের এইটুকু খবরই পেয়েছিল। তার দিদির এই কাহিনী তার মনের মধ্যে অতীতের একটা রুদ্ধ জানালা খুলে হঠাৎ এক ঝলক আলো এনে তার প্রিয়জনদের কথা মনে পড়িয়ে দেয় এবং পরক্ষণেই সে জানালাটা রুদ্ধ হয়ে যায় চিরদিনের জন্য। তার পর থেকে সে তার দিদির আর কোনও খবর পায়নি, সে-ও তাদের দেখতে পায়নি।

তুলোঁর জেলখানায় থাকাকালে চতুর্থ বছরেই জেল থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে জাঁ ভলজাঁ। এ ব্যাপারে জেলখানার অন্যান্য কয়েদি তাদের প্রথা অনুসারে সাহায্য করে তাকে। জেল থেকে পালিয়ে গিয়ে দু’দিন গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়ায় সে। প্রতিমুহূর্তে ধরা পড়ার ভয়ে সচকিত হয়ে আহার-নিদ্রাহীন অবস্থায় ঘুরে বেড়ানোটা যদি মুক্তি হয় তা হলে মাত্র দুদিনের জন্য সে-মুক্তি পেয়েছিল সে। প্রতিটি পথিক দেখলেই আঁতকে উঠত সে। কোনও কুকুর ডাকলে বা কোনও ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ পেলে চমকে উঠত। এইভাবে দু’দিন কাটাবার পর আবার সে ধরা পড়ে। ট্রাইব্যুনালের বিচারে আগেকার কারাদণ্ডের সঙ্গে নতুন করে তিন বছরের কারাদণ্ড যুক্ত হয়। এরপর ষষ্ঠ বছরে আবার একবার পালায় জেল থেকে। কিন্তু বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে পায়নি। জেলখানায় নাম ডাকার সময় তাকে না দেখে প্রহরীরা তার খোঁজ করে। রাত্রিবেলায় ডকের কাছে এক জায়গায় তাকে দেখতে পেয়ে তাকে ধরে আনে। এবার সে প্রহরীদের সঙ্গে লড়াই করে এবং তাদের বাধা দেয় বলে এবার তার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়। তাকে দুটো শিকল দিয়ে বাঁধা হয়। দশম বছরে সে আবার পালায় এবং আবার ব্যর্থ হয়ে ধরা পড়ে। আবার তিন বছরে কারাদণ্ড বেড়ে গিয়ে সবসুদ্ধ মোলো বছরের কারাদণ্ড হয়। চতুর্থবার পালাবার অপরাধে আবার তিন বছর বেড়ে গিয়ে তার মোট কারাদণ্ড উনিশ বছরে গিয়ে দাঁড়ায়। ফলে ১৭৯৬ সালে কারাগারে প্রবেশ করে উনিশ বছর পর ১৮১৫ সালের অক্টোবর মাসে সে মুক্ত হয়। তার অপরাধ ছিল মাত্র একটা, একটি জানালার কাঁচের সার্সি ভেঙে একটা পাউরুটি চুরি করা।

এইভাবে একটি পাঁউরুটি চুরির ঘটনা একটি জীবনকে নষ্ট করে দেয়। জাঁ ভলজাঁর মতো ক্লদ গুয়েকও একটি পাউরুটি চুরি করে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে। ইংল্যান্ডের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় প্রতি পাঁচটি ডাকাতির মধ্যে চারটির প্রত্যক্ষ কারণ হল ক্ষুধা।

জাঁ ভলজাঁ যখন প্রথম জেলখানায় যায় তখন সে কাঁদতে থাকে, ভয়ে কাঁপতে থাকে। কিন্তু যখন মুক্ত হয় তখন সে কিছুই করেনি, পাথরের মতো শক্ত হয়ে ছিল। নিবিড় হতাশা নিয়ে সে জেলে গিয়েছিল, কিন্তু যখন সে ফিরে আসে তখন আশা বা নিরাশা কিছুই ছিল না তার মনে। তার অন্তর্লোকে কী আলোড়ন বা পরিবর্তনের খেলা চলেছিল, তা কে জানে?

.

এ প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করা উচিত আমাদের। আমাদের মনে হয় এ সব দিকে সমাজের নজর দেওয়া উচিত। এটা সমাজেরই কাজ।

আমরা আগেই বলেছি জাঁ লেখাপড়া শিখতে পারেনি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে সে নির্বোধ ছিল। সহজাত বুদ্ধির একটা স্ফুলিঙ্গ তার মধ্যে ছিল। যে দুঃখ আগুনের দেহ এনেছিল তার জীবনে, সেই দুঃখই আলোর এক অপূর্ব জ্যোতি নিয়ে আসে। প্রথম প্রত্যূষের আলোর মতো সে জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার মনের প্রতিটি দিক-দিগন্ত। যতই সে বেত্রাঘাতে জর্জরিত হয়েছে, শৃঙ্খলের বন্ধনে আপীড়িত হয়েছে, কঠোর পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, নির্জন কারাকক্ষের নিঃসঙ্গতায় অশান্ত হয়ে উঠেছে, ভূমধ্যসাগরীয় সূর্যের জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ হয়েছে এবং কাঠের তক্তার কাঠিন্যে নিদ্রা তার বিঘ্নিত হয়েছে প্রতি রাত্রে, ততই সে নিজের বিবেকের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে শুধু ভেবেছে।

সে একাধারে নিজেই নিজের বিচারক ও জুরি হয়ে নিজের মামলার নিজেই বিচার করেছে।

সে যে অন্যায়ভাবে দণ্ডিত এক নির্দোষ নিরপরাধ লোক নয়, একথা সে স্বীকার করেছে। আবেগের আতিশয্যবশত যে কাজ সে করে ফেলেছে তা অবশ্যই নিন্দার্য।

যে পাঁউরুটি সে চুরি করেছিল তা চাইলে হয়তো সে পেত আর যদি চাইলে তাকে না দিত সে দান অথবা কর্মপ্রাপ্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারত। কিন্তু কোনও অর্ধভুক্ত মানুষ কি অপেক্ষা করতে পারে, এ প্রশ্ন কেউ করলে তার উত্তরে বলা যায় ক্ষুধার জ্বালায় খুব কম লোকই মরে। মানুষের দেহমন এমনভাবে গঠিত যে দীর্ঘকাল দুঃখকষ্ট ও নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করেও সে কখনও মৃত্যুমুখে পতিত হয় না। তাকে আরও কিছুদিন ধৈর্য ধরতে হত এবং তা হলে তার দিদির ছেলেমেয়েদের সুবিধা হত। সমাজকে গলা টিপে ধরে মারতে যাওয়ার আগে তার সীমিত ক্ষমতার কথাটা ভাবা উচিত ছিল। চুরির রাস্তা ধরে সে দারিদ্রের কবল থেকে মুক্ত হবে, তার এই ধারণাটাকে প্রশ্রয় দিয়ে নির্বোধের মতো কাজ করেছে সে। যে মানুষকে অখ্যাতির পথে নিয়ে যায় সে পথ কখনও মুক্তির পথ হতে পারে না। মোট কথা, সে যে অন্যায় করেছে একথা অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করেছে সে।

কিন্তু এরপর নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে কতকগুলি। সে কি শুধু একাই এ কাজ করে বসেছে? কাজ করতে ইচ্ছুক কোনও লোক যদি কাজ বা খাদ্য না পায় তা হলে সেটা কি একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়? তাছাড়া দোষ স্বীকার করাটাই কি একটা ভয়ঙ্কর শাস্তি নয়? সে অপরাধ করে যত না অন্যায় করেছে, আইন তাকে লঘু পাপে গুরু শাস্তি দিয়ে কি তার থেকে অনেক বেশি অপরাধ করেনি? ন্যায়বিচারের দাঁড়িপাল্লায় শাস্তির দিকটা কি ঝুঁকে পড়েনি? এইভাবে একদিকের পাল্লা ভারী হয়ে ঝুঁকে পড়ায় তার ফল কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে যায়। সে অপরাধী তার দিকে পাল্লাটা না ঝুঁকে ঝুঁকল সেই দিকে যেদিকে চাপানো ছিল শাস্তির বোঝা। পালাবার চেষ্টার জন্য কারাদণ্ডের দেয়ালটা বারবার বাড়িয়ে দেওয়া কি দুর্বলের ওপর সবলের এক ধরনের আক্রমণাত্মক অত্যাচার নয়? এটা কি ব্যক্তির ওপর সমাজের অবিচার নয় এবং উনিশ বছর ধরে এই অত্যাচার-অবিচার অনুষ্ঠিত হয়ে আসেনি?

সে নিজেকে প্রশ্ন করল, কারও ওপর অর্থহীন প্রাচুর্য আর কারও ওপর নিষ্ঠুর অভাব আর নিঃস্বতা চাপিয়ে দেবার অধিকার সমাজের আছে কি না, একজন নিঃস্ব গরিবকে প্রয়োজন আর আতিশয্যের জাঁতাকলে পিষ্ট করার অধিকার আছে কি না–কাজের প্রয়োজন আর শাস্তির আতিশয্য। যেসব লোক সম্পদের সমবণ্টন চায় তাদের সঙ্গে এইরকম নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহার করাটা কোনও সমাজের পক্ষে এক দানবিক নির্মমতার কাজ নয়?

সে এইসব প্রশ্ন করল এবং সমাজকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দান করল।

সে ঘৃণার সঙ্গে সমাজকে ধিক্কার দিল। সে যেসব দুঃখকষ্ট ভোগ করেছে তার জন্য সমাজকেই দায়ী করল এবং সংকল্প করল যদি কোনওদিন সুযোগ পায় তা হলে সে সমাজের কাছে কৈফিয়ত চাইবে। পরিশেষে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, যে অপরাধ সে করেছে তার ওপর যে শাস্তি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে কোনও প্রকৃত সামঞ্জস্য নেই। আইনের দিক থেকে যদিও এই শাস্তিটা কোনও অন্যায় নয় তথাপি নীতির দিক থেকে অসংগতিপূর্ণ এবং অন্যায়।

জাঁ ভলজাঁ’র ক্রোধটা হয়তো অবান্তর এবং অবিবেচনাপ্রসূত মনে হতে পারে। কিন্তু তার ক্রোধের মধ্যে গভীর একটা জোরালো যুক্তি ছিল। তাই সে সংগত কারণেই ক্ষুব্ধ হয়েছিল সমাজের ওপর।

তাছাড়া সমগ্রভাবে সমাজ তার ক্ষতি ছাড়া কিছুই করেনি। যে সমাজে প্রতিটি লোকই ন্যায়বিচারের নামে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছে তার প্রতি। যারাই তার দেহ স্পর্শ করেছে তারাই তাকে আঘাত করেছে। শৈশব থেকে একমাত্র তার মা আর দিদি ছাড়া কারও কাছ থেকে শুনতে পায়নি সে একটু ভালোবাসার কথা বা কারও চোখে একটু সদয় দৃষ্টি দেখতে পায়নি। চরম দুঃখভোগের সময় তার শুধু বারবার মনে হয়েছে। গোটা জীবনটাই একটা সংগ্রাম এবং সে সংগ্রামে সে হেরে গেছে। এই সংগ্রামে ঘৃণাই ছিল তার একমাত্র হাতিয়ার এবং জেলখানায় যতদিন সে ছিল সে হাতিয়ারটাকে শান দিয়ে তীক্ষ্ণ করেছে এবং সেখান থেকে আসার সময়েও সেই তীক্ষ্ণ হাতিয়ারটাকে সঙ্গে করে এনেছে।

তুলোতে যাজকদের দ্বারা পরিচালিত একটা স্কুল আছে। যে হতভাগ্য শিক্ষাদীক্ষাহীন লোক পড়াশুনো করতে চায় তাদের সেখানে লেখাপড়া শেখানো হয়। সেই স্কুলে জাঁ ভলজাঁ কিছুদিন গিয়েছিল। তখন তার বয়স ছিল চল্লিশ। সেখানে সে লিখতে, পড়তে ও কিছু অঙ্ক কষতে শেখে। কিন্তু তখন তার মনে শুধু এই চিন্তাই ছিল যে তার মনের উন্নতিসাধন করা মানে যুক্তি দিয়ে তার ঘৃণার ভাবটাকে সুরক্ষিত করা। অনেক অবস্থায় দেখা যায় মানুষের শিক্ষা আর জ্ঞান তার কুভাব ও কুমতিকে বাড়িয়ে দেয়।

সমাজকে তার দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী করে ধিক্কার দিতে গিয়ে ঈশ্বরের যে বিধান সমাজকে সৃষ্টি করেছে সেই বিধানের ওপরেই সে বিরূপ রায় দান করে বসে এবং সে বুঝতে পারে এটা তার অন্যায়। ফলে নিজেকেও সে ধিক্কার দেয়। সুতরাং তার উনিশ বছরের এই পীড়ন ও দাসত্বের কালে তার আত্মা একই সঙ্গে প্রসারিত ও সঙ্কুচিত হয়। একদিকে তার মধ্যে আলো প্রবেশ করে আর সঙ্গে সঙ্গে আর এক দিকে অন্ধকার প্রবেশ করে।

আমরা দেখেছি ভলজাঁ আসলে খারাপ প্রকৃতির লোক ছিল না। যখন সে কারাগারে যায় তখনও তার মধ্যে সদ্‌গুণ ছিল। কারাগারে থাকাকালে সমাজকে ধিক্কার দিতে গিয়ে পাপবোধ জাগে তার মধ্যে। ঈশ্বরকে ধিক্কার দিয়ে সে অধর্মাচরণ করছে একথা সে জানত।

এখানে একটা কথা ভাববার আছে।

কোনও মানুষের স্বরূপ বা স্বভাবটাকে কি সমগ্র ও মূলগতভাবে পাল্টানো যায়? যে মানুষ ঈশ্বরের বিধানে সৎ প্রকৃতির হয়ে জন্মেছে তাকে কি অন্য মানুষ অসৎ ও দুষ্ট প্রকৃতির করে তুলতে পারে? ভাগ্য কি মানুষের আত্মাকে নতুন করে অন্য রূপে গড়ে তুলতে পারে এবং কারও ভাগ্য খারাপ বলে সে-ও কি খারাপ হয়ে উঠতে পারে? প্রতিকূল অবস্থা বা দুর্ভাগ্যের চাপে কারও অন্তর কি একেবারে বিকৃত ও কুৎসিত রূপ ধারণ করতে পারে? কোনও উঁচু স্তম্ভকে কি নিচু ছাদ দিয়ে ঢাকা যায়? প্রতিটি মানবাত্মার মধ্যে কি দেবভাবের এমন এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নেই যা ইহলোকে ও পরলোকে অমর ও অবিনশ্বর, যা সহজাত সততার দ্বারা পুষ্ট ও সংরক্ষিত হয়ে গৌরবময় ও অনির্বাণ এক আলোকশিখায় পরিণত হয়, যাকে কোনও পাপ সম্পূর্ণরূপে নির্বাপিত করতে পারে না।

এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল প্রশ্ন। কোনও মনোবিজ্ঞানী যদি আইনের দ্বারা দণ্ডিত, সমাজ ও সভ্যতার দ্বারা ধিকৃত জাঁ ভলজাঁকে শ্রমহীন কোনও শান্ত অবকাশে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ বুকে নিয়ে চিন্তান্বিতভাবে বসে থাকতে দেখতেন তা হলে তিনি ওইসব জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতেন না।

এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে তিনি তা পারতেন না। সেই মনোবিজ্ঞানী পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারতেন জাঁ ভলজাঁর মনের মধ্যে যে দুরারোগ্য ব্যাধি ঢুকেছে তার জন্য তিনি দয়া বোধ করতেন কিন্তু তার কোনও প্রতিকার করতে পারতেন না। দান্তে যেমন নরকের দ্বারে গিয়ে এক বিশাল অন্ধকার খাদ দেখে চমকে উঠেছিলেন। তেমনি তিনি জাঁ ভলজাঁর আত্মার মধ্যে এক বিশাল শূন্যতা দেখে ভয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতেন। তার কপালে ঈশ্বর যে আশার কথা তার আঙুল দিয়ে লিখেছেন সে কথা তিনি মুছে দিতেন।

কিন্তু ভলজাঁর ব্যাপারটা কী? তার যে আত্মিক সরল অবস্থার কথা আমরা পাঠকদের কাছে চিত্রিত করেছি, সে অবস্থাটা কি তার কাছেও তেমনি সরল ছিল? তার নৈতিক অধঃপতনের মধ্যে মূলে যেসব উপাদান কাজ করেছিল তা কি সে স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিল? তার মতো অশিক্ষিত স্থল প্রকৃতির এক মানুষ কি কখন কিভাবে ক্রমান্বয়ে তার আত্মা ওঠানামা করতে করতে তার নীতিচেতনার শূন্য গভীরে তলিয়ে যায় তার গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে পারে? আমরা তা পারব না এবং আমরা সেটা বিশ্বাস করতে পারব না। এত দুঃখকষ্টের পরেও তার অজ্ঞতার জন্য সে সরলভাবে চিন্তাগুলোকে সাজিয়ে কোনও কিছু বিশ্লেষণ করতে পারল না। অনেক সময় সে তার আপন অনুভূতিরই তল খুঁজে পেত না। সে যে ছায়ার মধ্যে বাস করত, ছায়ার মধ্যেই কষ্ট ভোগ করত, সে ছায়াকে ঘৃণা করত, সে যেন নিজেকে নিজে ঘৃণা করত। সে একজন অন্ধ লোকের মতো মনের অন্ধকারে কী যেন হাতড়ে বেড়াত, স্বপ্নবিষ্টের মতো সেখানে থাকত সব সময়। মাঝে মাঝে অতিরিক্ত দুঃখভোগের জন্য এক প্রচণ্ড ক্রোধের আবেগে ফেটে পড়ত সে। সে ক্রোধের একটি অগ্নিশিখা তার সমস্ত আত্মাকে আলোকিত করে তার জীবনপথের সামনে-পেছনে যেসব নিয়তিসৃষ্ট ফাঁক ছিল তার উপর এক জ্যোতি বিকীরণ করত।

কিন্তু এইসব আলোর ছটা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই অপসৃত হয়ে পড়ত। ফলে আবার অন্ধকার ঘন হয়ে উঠত তার চারদিকে। সে কোথায় তা নিজেই বুঝতে পারত না।

এই ধরনের শাস্তির মধ্যে এমন এক নির্মম পাশবিকতা আছে, যা ধীরে ধীরে মানুষের মনটাকে ক্ষয় করে ফেলে তাকে পশুতে পরিণত করে তোলে। এক একসময় হিংস্র হয়ে ওঠে সে পশু। জাঁ ভলোর বারবার পালিয়ে যাবার চেষ্টা মানবাত্মার ওপর আইনের কঠোরতার এক অভ্রান্ত প্রমাণ ছাড়া আর কিছুই নয়। সে কখনও কোনও সুযোগ পেলেই পরিণাম বা অতীত অভিজ্ঞতার কথা কিছু না ভেবেই বারবার পালাবার চেষ্টা করত। রুদ্ধদ্বার নেকড়ে বাঘের মতো দরজা খোলা পেলেই সে পাগলের মতো ছুটে যেত সেই দিকে। তার সহজাত প্রবৃত্তি তাকে সে দরজা দিয়ে পালাতে বলত, আর যুক্তিবোধ তাকে সেখানেই থাকতে বলত। এই ধরনের এক প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্বে অদৃশ্য হয়ে যেত তার যুক্তিবোধ। ফলে তার মধ্যে পশুটাই রয়ে যেত এবং সে ধরা পড়লে তাকে যে বাড়তি শাস্তি দেওয়া হত তা সেই পশুর হিংস্রতাকে বাড়িয়ে দিত।

একটা কথা অবশ্যই বলা উচিত যে জেলখানার অন্য কয়েদিদের থেকে জাঁ ভলজাঁর দৈহিক শক্তি অনেক বেশি ছিল। যে কোনও শক্ত কাজে সে ছিল চারটে লোকের সমান। সে অনেক ভারী ভারী বোঝা তুলতে পারত। একবার তুলোর টাউন হল মেরামতের একটা কাঠের ভারী বাড়ি পড়ে যাবার উপক্রম হলে সাহায্য না আসা পর্যন্ত ভলজাঁ কাঁধে করে বেশ কিছুক্ষণ সেটাকে ধরে রাখে।

তার দৈহিক শক্তির থেকে বুদ্ধি ও কৌশল আরও বেশি ছিল। যেসব দেয়াল বা কোনও খাড়া পাহাড়ে কোনও হাত-পা রাখার জায়গা নেই, সেসব দেয়াল বা পাহাড়ের উপর সে অবলীলাক্রমে উঠে যেত এক সুদক্ষ জাদুকরের মতো। এইভাবে যেকোনও তিনতলা বাড়ির ছাদের উপর উঠে যেতে পারত সে।

সে খুব কম কথা বলত এবং হাসত না কখনও। তার মুখ থেকে কোনও জোর হাসি বা অট্টহাসি বার করা খুবই কঠিন ছিল। কখনও সে মনে কোনও প্রবল আবেগ না জাগলে সে কখনও হো হো শব্দে হাসত না। তাকে দেখলেই মনে হত সে যেন সব সময় ভয়ঙ্কর এক চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে।

এইভাবে দিন কাটাত সে। এক অসংগঠিত অসংহত চরিত্রের অলস উপলব্ধি আর অসংগত বুদ্ধিবৃত্তির ভারী বোঝাভার নিয়ে এক অন্তহীন বিহ্বলতার সঙ্গে সে শুধু এই কথা অনুভব করে যেত যে এক বিরাট দানবিক শক্তি সব সময় পীড়ন করে চলেছে তাকে। অস্বচ্ছ অপ্রচুর আলোর যে বৃত্তসীমা তার জীবনকে ঘিরে রেখেছিল সে বৃত্তের বাইরে উধ্বালোকে তাকিয়ে সে কি কিছু দেখার চেষ্টা করত? যদি তা করত তা হলে সে ভয় আর ক্রোধের এক মিশ্র অনুভূতির সঙ্গে দেখতে পেত আইন, কুসংস্কার, মানুষের সমাজজীবন ও ব্যক্তিজীবনের অসংখ্য তথ্যপুঞ্জ সমন্বিত পিরামিডের মতো এক অদ্ভুত আকারের সুবিশাল সৌধ দাঁড়িয়ে আছে তার মাথার উপরে যে সৌধকে আমরা সভ্যতা বলে অভিহিত করে থাকি। সেই অদ্ভুত সৌধের পুঞ্জীভূত রূপটাই অভিভূত করত তাকে। তার মধ্যস্থিত উপাদানগুলো পৃথকভাবে স্পষ্ট করে বুঝতে পারত না সে। তবে মাঝে মাঝে সেই তথ্যপুঞ্জের ফাঁকে ফাঁকে কতকগুলি জিনিসকে স্পষ্ট করে দেখতে পেত সে যেমন জেলখানার প্রহরী, পুলিশ, বিশপ আর সবার উপর মুকুটমণ্ডিত সম্রাট। এইসব দূরস্থিত ঐশ্বর্যের বস্তুগুলো কমানোর পরিবর্তে বাড়িয়ে দিত তার মনের অন্ধকারটাকে। সে দেখত কত মানুষ আসা-যাওয়া করছে তার মাথার উপর দিয়ে। কত আইন, প্রথা, কুসংস্কার, গোঁড়ামি, মানবজীবনের কত ঘটনা প্রভৃতির অজস্র উপাদানে ঈশ্বর যে সভ্যতাকে জটিল করে তুলেছেন সে সভ্যতা শান্ত নিষ্ঠুর এক ঔদাসীন্যের চাপে তার আত্মাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। যারা দুঃখ-বিপর্যয়ের অতল গহ্বরে পতিত, যারা নরকের অন্ধকারে দিশাহারা, যারা সমাজ ও আইনের দ্বারা অবজ্ঞাত ও ধিকৃত সেইসব হতভাগ্য মানুষ তাদের ঘাড়ের উপর এক নিষ্করুণ সমাজের দুর্বিষহ বোঝাভার অনুভব করে চলে। সে বোঝাভার দেখে বাইরের লোকেরা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। এই অবস্থার মধ্যে জাঁ ভলজাঁ কী সব ভাবত। কিন্তু কী ভাবত সে?

জাঁতাকলের মাঝখানে সামান্য এক শস্যদানার চিন্তা ছাড়া আর কোন চিন্তা বিষয়বস্তু হতে পারে তার কল্পনার সঙ্গে বাস্তব এবং বাস্তবের সঙ্গে কল্পনা মিশে তার মনের কাঠামোটাকে এমন করে তুলেছিল যে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। জেলখানায় কঠোর শ্রমের কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে কী ভাবত সে। তার সে যুক্তিবোধ আগের থেকে আরও পরিণত ও আরও বিচলিত হয়ে উঠেছিল তা এক সহজ অবিশ্বাসের মধ্যে ঢলে পড়ত। যেসব ঘটনা তার সামনে ঘটত সেসব ঘটনার মানে বুঝতে না পেরে তাদের অকল্পনীয় ও অচিন্ত্যনীয় মনে হত। বড় অদ্ভুত মনে হত তার চারপাশের জগৎকে। নিজের মনে মনে বলত, এইসব কিছুই স্বপ্ন। যে প্রহরী তার কাছে দাঁড়িয়ে থাকত তাকে ভূত বলে মনে হত তাকে কোনও আঘাত না করা পর্যন্ত।

প্রকৃতিজগৎ সম্বন্ধে তার কোনও চেতনাই ছিল না। জাঁ ভলজাঁ সম্বন্ধে একথা বলা প্রায় ঠিক হবে সে সূর্যের কোনও অস্তিত্ব ছিল না তার কাছে। একমাত্র ঈশ্বরই জানেন কোন সত্যের আলোয় প্রতিভাত হয়ে থাকত তার আত্মা।

জাঁ ভলজাঁর উনিশ বছরের সশ্রম কারাজীবন তার জীবন ও আত্মাকে যেন ভেঙেচুরে নতুন রূপে গড়ে তুলেছিল। ফলে সমাজের কাছ থেকে যে অন্যায় অত্যাচার ও উৎপীড়ন তাকে সহ্য করতে হয়েছে, তার বিরুদ্ধে মন তার বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সমাজের প্রতি প্রতিশোধবাসনা জাগে তার অন্তরে। এই প্রতিশোধবাসনার বশবর্তী হয়ে সে দুই ধরনের কুকর্ম করে বসত। এক একসময় সে কোনও ভাবনা-চিন্তা না করে অন্ধ ক্রোধের আবেগে অনেক কুকর্ম করে বসত। আবার অনেক সময় ঠাণ্ডা মাথায় যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করে অনেক অন্যায় করে বসত। তবে তার সকল অন্যায়, কুকর্ম বা অপকর্মের পেছনে সমাজের বিরুদ্ধে এক দুর্মর দুর্জয় প্রতিশোধবাসনা কাজ করে যেত। তার এই শেষোক্ত যুক্তিভিত্তিক কুকর্ম করার আগে তার মনের সব ভাবনা-চিন্তা পরপর তিনটি স্তর অতিক্রম করে এক সিদ্ধান্তে উপনীত হত। এই তিনটি স্তর ছিল–যুক্তি, সংকল্প আর গোঁড়ামি। তার সমস্ত আবেগ ও প্রবৃত্তি ক্রোধ, তিক্ততা আর পীড়নজনিত এক চেতনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও অনুশাসিত হত। তার এই ক্রোধাবেগ অনেক সময় কোনও নিরীহ নির্দোষ লোক তার সামনে পড়ে গেলে তার ওপরেও বর্ষিত হত। তার সমস্ত চিন্তার শুরু এবং শেষে ছিল মানব সমাজে প্রচলিত আইন-কানুনের প্রতি এক তীব্র ঘৃণা। সাধারণত এই ভয়ঙ্কর ঘৃণা কোনও ঐশ্বরিক বিধানের দ্বারা প্রতিহত না হলে তা বাড়তে বাড়তে সমস্ত সমাজ, মানবজাতি ও ঈশ্বরের সৃষ্টি সকল বস্তুকে গ্রাস করে ধীরে ধীরে। তখন সে সমগ্রভাবে মনুষ্যবিদ্বেষী হয়ে ওঠে। যে কোনও লোকের ক্ষতি করার এক দুর্বার বাসনায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে। জেল থেকে বেরিয়ে যে হলুদ টিকিট তার কাছে সব সময় থাকত সে টিকিটের উপর লেখা ছিল, অতিশয় বিপজ্জনক ও ভয়ঙ্কর লোক। দিনে দিনে তার অন্তরাত্মাটা একেবারে শুকিয়ে যায়। জগৎ ও জীবনকে দেখার সহজ, স্বাভাবিক ও স্বচ্ছ দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে সে। তার উনিশ বছরের কারাজীবনের মধ্যে কোনওদিন একফোঁটা চোখের জল ফেলেনি সে।

.

জাহাজের যাত্রীটি লাফিয়ে পড়ল জলে।

কিন্তু জাহাজ থামল না। অনুকূল বাতাসের সহায়তায় ধ্বংসোনুখ জাহাজটা এগিয়ে চলেছে চরম পরিণতির দিকে। আত্মহননের লক্ষ্য থেকে কোনওমতেই বিচ্যুত হবে না যেন সে। সেই পথে অনিবারণীয় অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলতে লাগল সে।

লোকটা জলে ডুব দিয়ে আবার উঠে এল। সে দু হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু কেউ তার কথা শুনতে পেল না। বাতাসের আনুকূল্যে জাহাজ তার কাজ করে যেতে লাগল। কিন্তু যে যাত্রীটি জাহাজ থেকে জলে ঝাঁপ দিল তার কী হল, তা জাহাজের নাবিক বা কোনও যাত্রীর সেদিকে কোনও নজর ছিল না। অন্তহীন বিশাল সমুদ্রে যেন সূচ্যগ্রপ্ৰমাণ এক চিহ্ন।

লোকটা হতাশ হয়ে অপস্রিয়মাণ জাহাজটার পানে তাকিয়ে ডাকতে লাগল। কিন্তু ভূতের মতো দেখতে জাহাজটা দ্রুত আড়াল হয়ে গেল তার দৃষ্টিপথ থেকে। কিছুক্ষণ আগেও সে ওই জাহাজেই ছিল। নাবিকরা অন্য সব যাত্রীর সঙ্গে ডেকের উপর ছিল। সে-ও তাদের সকলের সঙ্গে সমান ভাবে আলো-বাতাস ভোগ করেছে। কিন্তু তার একটু পরেই সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দেয়।

চারদিক থেকে দানবিক ঢেউগুলোর আঘাতের সঙ্গে লড়াই করতে লাগল, সে চঞ্চল বাতাসের আঘাতে ঢেউগুলো সব উত্তাল হয়ে উঠল। তার মুখে সমুদ্রের নোনা জল এসে লাগতে লাগল। যে ভয়ঙ্কর সমুদ্রটা তাকে গ্রাস করতে চাইছে সেই অন্ধকার সমুদ্রটাই তার কাছে ঘৃণার এক মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠল।

তবু সে মরিয়া হয়ে সাঁতার কেটে যেতে লাগল। ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করতে করতে তার শক্তি ক্ষয় হতে লাগল। সে মাথার উপর দেখল ঘন মেঘমালা আকাশটাকে আচ্ছন্ন। করে আছে। সারা সমুদ্রের অনন্ত পটভূমিজুড়ে মূর্তিমান মৃত্যুকে যেন হেঁটে বেড়াতে দেখল সে। পৃথিবীর দূর প্রান্ত থেকে অজানা কতসব দূরাগত শব্দের ধ্বনি শুনতে পেল সে। আকাশে মেঘমালার কোলে কোলে পাখি উড়ে বেড়াচ্ছিল। মানুষের দুঃখ-দুর্দশার মাঝে দেবদূতেরা পাখা মেলে উড়ে আসে। কিন্তু সে দেবদূতেরা কী করতে পারে তার জন্য? তারা শুধু গান করতে করতে পাখা মেলে উড়ে যায় আর সে শুধু বাঁচার জন্য। সংগ্রাম করে যায়।

অনন্ত আকাশ আর অনন্ত সমুদ্রের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলল সে। সমুদ্র হচ্ছে এক বিশাল সমাধিগহ্বর আর আকাশ হচ্ছে শবাচ্ছাদন। তখন অন্ধকার ঘন হয়ে আসছিল। যতক্ষণ তার শক্তি ছিল দেহে ততক্ষণ সে সমানে সাঁতার কেটে এসেছে। এদিকে জাহাজটা তার যাত্রীদের নিয়ে অনেকক্ষণ আগেই কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। গোধূলির বিশাল ছায়ান্ধকারে এক অসহায় নিঃসঙ্গতার মাঝে সে শুধু অনুভব করল চারদিক থেকে অসংখ্য তরঙ্গমালা তার কাছে ছুটে আসছে। শেষবারের মতো একবার ভয়ে চিৎকার করে উঠল সে। কোনও মানুষকে ডাকল না। কিন্তু ঈশ্বর কোথায়?

যে কোনও বস্তু বা ব্যক্তি যার নাম ধরেই ডাকুক না কেন, কেউ কোনও সাড়া দিল না সে ডাকে। না সমুদ্রের জলরাশি, না অনন্ত প্রসারিত আকাশ কেউ সাড়া দিল না তার ডাকে। সে সমুদ্র ও বাতাসকে ডাকল। কিন্তু তারা যেন একেবারে বধির। তার চারদিকে গোধূলির ধূসর অন্ধকার, অন্তহীন নিঃসঙ্গতা আর উদ্দাম অবিরাম জলকল্লোল। তার অন্তরে তখন শুধু শঙ্কা আর অবসাদ, তার তলদেশে তখন অতলান্তিক শূন্যতা। পায়ের তলায় দাঁড়াবার কোনও জায়গা নেই। সে শুধু বুঝতে পারল তার দেহটা অন্ধকারে ভেসে চলেছে। ঠাণ্ডায় অসাড় হয়ে আসছে তার সর্বাঙ্গ। তার হাত দুটো মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আছে, কিন্তু সে হাতে কিছুই ধরা নেই। শুধু বাতাস, সমুদ্রের কল্লোল আর আকাশের তারাদের অর্থহীন চাউনি। করবে সে? হতাশা চায় আত্মসমর্পণ, ক্লান্তি বা অবসন্নতা চায় মৃত্যু। সে-ও অবশেষে সব সগ্রাম ত্যাগ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। সে ডুবে গেল।

এই হল মানবসমাজের এক অপরিণামদর্শী অগ্রগতি। তার চলার পথে কত জীবন, কত আত্মা নিষ্পেষিত হয়ে যাচ্ছে তার দর্পিত পদভরে। এ যেন এক আশ্চর্য মহাসমুদ্র যার মধ্যে নিষ্ঠুর আইনের দ্বারা নির্বাসিত কত মানুষ কোনও সাহায্য না পেয়ে নৈতিক মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হয়েছে। এই সমুদ্র হচ্ছে নির্মম নিষ্করণ এক সামাজিক অন্ধকার, দুঃখের অতলগর্ভ খাদ যার মধ্যে আইনে দণ্ডিত হতভাগ্য মানুষদের সমাজ ফেলে দেয়। যেসব মানুষের আত্মা এই সমুদ্রগর্ভে সমাধি লাভ করে তাদের কেউ উদ্ধার করতে পারে না।

.

জেলখানা থেকে বার হবার সময় জাঁ ভলজাঁ যখন তুমি মুক্ত’ এই কথা দুটো শুনল তখন সে যেন তা বিশ্বাস করতে পারছিল না, অবিশ্বাসের অন্ধকারে মনটা যেন ধাঁধিয়ে গেল তার। সহসা যেন আলোর একটা তীর এসে চোখ দুটোকে বিদ্ধ করল তার। সে আলো হল জীবনের আলো, জীবন্ত মানুষের আলো। কিন্তু ফুটে উঠতে না উঠতে সে আলো ম্লান হয়ে গেল মুহূর্তে। স্বাধীনতার কল্পনায় সে যেন অভিভূত হয়ে পড়ল। সেই মুহূর্তে এক নতুন জীবনের আশ্বাসে সঞ্জীবিত হয়ে উঠল সে। কিন্তু হাতে একটা হলুদ টিকিট পাবার সঙ্গে সঙ্গেই তার স্বাধীনতার অর্থটা বুঝতে পারল।

এর পরেও ছিল আরও মোহমুক্তি। সে আগে ভেবেছিল এতদিন কারাগারে কাজ করে যে টাকা উপার্জন করেছে তা সব মিলিয়ে হবে একশো সত্তর ফ্রাঁ কিন্তু রবিবারগুলোর খাটুনি সে ভুল করে ধরেছিল। সেসব বাদ দিয়ে সে মোট পেল একশো উনিশ ফ্রাঁ পনেরো স্যু।

এর মানে সে বুঝতে পারল না। সে ভাবল তাকে ঠকিয়েছে তারা। জেলকর্তৃপক্ষ তার খাটুনির টাকা চুরি করে নিয়েছে।

জেল থেকে যেদিন সে ছাড়া পায় সেদিন সেখান থেকে বেরিয়ে পথ হাঁটতে হাঁটতে গ্রেসি নাম একটা জায়গাতে সে দেখল একটা কারখানার সামনে মাল নামানো হচ্ছিল। ওয়াগন থেকে। তখন সে সেখানে কুলির কাজ করতে চায়। সেখানে লোকের দরকার ছিল বলে মাল খালাস করার কাজে তাকে নিল তারা। সে যখন কাজ করছিল তখন একজন পুলিশ এসে তার পরিচয় জানতে চাইলে সে তার হলুদ টিকিটটা দেখায় তাকে। তার পর আবার কাজ করতে থাকে। দিনের শেষে একজন কুলিকে সে তাদের পারিশ্রমিক কত করে, তা জানতে চায়। তাকে বলা হয় এ কাজের রোজ হচ্ছে তিরিশ স্যু। কিন্তু ফোরম্যান লোকটা তার হলুদ টিকিট দেখতে পাওয়ায় সে তার কাছে থেকে মজুরি চাইতে গেলে সে তাকে মাত্র পঁচিশ স্যু দেয়। সে বার বার তিরিশ স্যু দাবি করলে ফোরম্যান তাকে বলে, নেবে নাও, না হলে আবার তোমাকে জেলে ঢুকতে হবে।

আবার সে বুঝতে পারল সে প্রতারিত হল। এর আগে সমাজ তাকে প্রতারিত করেছে। এবার সে পেল ব্যক্তিবিশেষের প্রতারণা। সে বুঝল জেল থেকে খালাস মানেই মুক্তি নয়। একটা লোক জেলখানা ত্যাগ করলেই সে মুক্ত হয় না, তার দণ্ড ঘোচে না। সমাজের কাছে সে চিরদণ্ডিতই রয়ে যায়।

গ্লেসিতে যে ঘটনা ঘটেছিল এই হল তার বিবরণ। দিগনেতে সে কী রকম অভ্যর্থনা লাভ করে, তা আমরা আগেই জেনেছি।

.

গির্জার ঘড়িতে দুটো বাজতেই ঘুম থেকে জেগে উঠল জাঁ ভলজাঁ।

বিছানার অতিরিক্ত আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যের অনুভূতিই ঘুমটা দীর্ঘ হতে দেয়নি তার। সে উনিশ বছর কোনও বিছানায় শোয়নি, তবু তক্তার কাঠই ছিল তার একমাত্র শয্যা। সে তার পোশাক না খুলেই শুয়ে পড়েছিল বিছানায়। ঘুমটা তার খুব একটা দীর্ঘায়িত না হলেও সে চার ঘণ্টা ঘুমিয়েছিল আর তাতে তার দেহের ক্লান্তিটা দূর হয়ে যায় একেবারে। কখনই খুব বেশি বেলা পর্যন্ত ঘুমোয় না ভলজাঁ।

চোখ মেলে অন্ধকারেই একবার তাকাল সে। তার পর আবার ঘুমিয়ে পড়ার জন্য বন্ধ করল চোখ দুটো। কিন্তু গতকাল সারাদিন বিভিন্ন রকমের আবেগানুভূতি আর চিন্তার পীড়নে মস্তিষ্কটা গরম থাকায় ঘুমটা ভাঙার পর আর নতুন করে ঘুম এল না তার। সে আর ঘুমোতে পারল না; শুয়ে শুয়েই ভাবতে লাগল।

তার মনের মধ্যে জোর আলোড়ন চলছিল তখন। নতুন-পুরনো অনেক চিন্তা আসা-যাওয়া করতে লাগল তার মনে। অনেক চিন্তা এল আর চলে গেল। কিন্তু একটা চিন্তা বারবার ফিরে আসতে লাগল। সে চিন্তা অন্য সব চিন্তাকেই মুছে দিতে লাগল জোর করে। সে চিন্তা হল বিশপের টেবিলের উপর নামিয়ে রাখা রুপোর কাঁটাচামচগুলো।

খাবার সময় টেবিলের উপর সেগুলো দেখেছিল সে। তার পর দেখেছিল শোবার সময় ম্যাগলোরি সেগুলো বিশপের ঘরের ভেতর আলমারিতে রাখে। সে দেখে নিয়েছে খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে বিশপের ঘরে ঢুকলেই ডান দিকের আলমারিতে আছে সেগুলো। সেই খাঁটি রুপোর জিনিসগুলো বিক্রি করলে তার থেকে অন্তত দুশো ট্র্য পাওয়া যাবে। সে উনিশ বছরের মধ্যে যা রোজগার করছে তার দ্বিগুণ, যদিও জেলকর্তৃপক্ষ তাকে না ঠকালে সে আরও কিছু বেশি পেত।

পুরো এক ঘণ্টা সে দারুণ অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে ভুগতে লাগল; কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারল না। গির্জার ঘড়িতে তিনটে বাজল। সে চোখ খুলে বিছানায় বসল। বিছানার পাশে পড়ে যাওয়া পিঠের ব্যাগটা কুড়িয়ে নিল। পা দুটো ঝুলিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় বসে রইল সে। সারা বাড়িটার মধ্যে একমাত্র সে-ই জেগে ছিল। হঠাৎ পা থেকে জুতো দুটো খুলে পাপোশের কাছে রেখে দিয়ে আবার ভাবতে লাগল।

সেই কুৎসিত চিন্তাটা ভারী বোঝার মতো আবার আসা-যাওয়া করতে লাগল মনের মধ্যে। তার মাঝে মাঝে অন্য অপ্রাসঙ্গিক চিন্তাও আসতে লাগল। ব্রিভেত নামে জেলখানার এক কয়েদি তার পায়জামাটা পা থেকে গুটিয়ে বেঁধে রাখল সুতোর একটা দড়ি দিয়ে।

সকাল পর্যন্ত হয়তো এইভাবে বসে বসেই ভাবত ভলজাঁ। কিন্তু ঘড়িতে সাড়ে তিনটে বাজার একটা ঘন্টা পড়তেই সচকিত হয়ে ওঠে আবার।

এবার সে উঠে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনতে লাগল বাড়ির কোথাও কোনও শব্দ শুনতে পাওয়া যায় কি না। দেখল গোটা বাড়িটা তখনও নীরব। সে জানালাটা কোথায় তা বুঝতে পেরে সেদিকে এগিয়ে গেল। রাত্রির অন্ধকার ছিল তখনও। আকাশে সেদিন পূর্ণ চাঁদ থাকার কথা হলেও ভাসমান মেঘমালায় চাঁদটা মাঝে মাঝে চাপা পড়ে যাওয়ায় আলো-ছায়ার খেলা চলছিল আকাশে। মেঘে চাঁদটা ঢাকা পড়ে যেতেই অন্ধকারটা গাঢ় দেখাচ্ছিল।

ঘরের ভেতরটা গোধূলির ধূসর অস্পষ্ট আলোয় কিছুটা আলোকিত ছিল। তাতে ঘরের মধ্যে যাতায়াত করা যায়। জানালার কাছে ভলজাঁ দেখল জানালাটা শুধু একটা ছিটকিনি দিয়ে আঁটা আছে। কপাটটা খুললেই আর কোনও বাধা নেই। জানালাটা দিয়ে সহজেই বাগানে যাওয়া যায়। জানালাটা খুলতেই এক ঝলক ঠাণ্ডা কনকনে হাওয়া এসে ঘরে ঢুকতেই জানালাটা বন্ধ করে দিল সে। এবার বাগানটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। দেখল বাগানটা চারদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আছে। পাঁচিলটাতে অবশ্য ওঠা সহজ। বাগানের ওপারে গাছে ঘেরা একটা বড় অথবা ছোট রাস্তা আছে।

বাগানটা খুঁটিয়ে দেখার পর সে আবার তার ঘরের মধ্যে ফিরে এল। মনে হল এবার একটা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছে। তার পিঠের ব্যাগটা খুলে সে তার মধ্যে তার জুতোজোড়াটা ভরে নিল। তার পর পিঠের উপর ঝুলিয়ে নিয়ে টুপিটা মাথায় পরল। ব্যাগের ভেতর থেকে একটা ছোট লোহার রড বর করে সে বিছানার উপর রেখেছিল। রডটার একদিকে সূচালো। সে এটা নিয়ে কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে, তা বোঝা গেল না। তুলোঁর জেলখানায় সে যখন কাজ করত পাহাড়ে তখন এই ধরনের যন্ত্র পাথর কাটার কাজে ব্যবহার করত তারা।

সেই লোহার যন্ত্রটা এক হাতে নিয়ে ঘরের কোণ থেকে তার লাঠিটা তুলে আর এক হাতে নিল। তার পর সে পা টিপে নিঃশব্দে বিশপের শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। দেখল দরজটা খোলা রয়েছে। বিশপ সেটা বন্ধ করেননি।

.

১০

ভলজাঁ কান পেতে কী শোনার চেষ্টা করল। কিন্তু কোনও শব্দ ছিল না সে ঘরে।

ভলজাঁ প্রথমে তার আঙুলের ডগা দিয়ে দরজাটায় একটু ঠেলা দিল। দরজাটা একটু ফাঁক হল, অথচ কোনও শব্দ হল না। কিন্তু দরজার সামনেই একটা টেবিল ছিল পথরোধ করে। সে দেখল দরজাটায় আরও জোরে একটু ঠেলা দিলে টেবিলটা সরে যাবে। সে তাই এবার জোরে ঠেলে দিল দরজাটা এবং তাতে জোর একটা ক্যাচ করে শব্দ হল।

ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠল ভলজাঁর। ভয়ের আবেগে সেই মুহূর্তে তার মনে হল দরজাটার যেন এক অতিপ্রাকৃত শক্তি আছে এবং তাই সেটা বাড়ির সবাইকে জাগিয়ে দেবার জন্য কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করছে। কাঁপতে কাঁপতে ভয়ে পিছিয়ে এল সে। তার মনে হল তার নাকের প্রতিটি নিশাসের শব্দ যেন ঝড়ের গর্জন। তবে তার মনে হল এ শব্দ ঠিক ভূমিকম্পের শব্দ নয় এবং তাতে নিশ্চয় বাড়িটা জেগে উঠবে না। তবু সে ভাবল দরজার শব্দটায় জেগে উঠবে বৃদ্ধ বিশপ। তার বোন চিৎকার করে উঠবে। চারদিক থেকে সাহায্য করার জন্য লোক ছুটে আসবে। তার কেবলি মনে হতে লাগল আবার তার সর্বনাশ হয়ে গেল।

যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেইখানেই দাঁড়িয়ে রইল সে। নড়াচড়া করতে সাহস পেল না। এইভাবে কয়েক মুহূর্ত পার হয়ে গেল। দরজাটা তার সামনে তেমনি ভোলা রয়ে গেছে। সে সাহস করে একবার ভেতরে দেখল। দেখল কেউ জেগে ওঠেনি বা কেউ নড়াচড়া করছে না। ঘরের মধ্যে কোনও শব্দ শুনতে পেল না সে। বুঝল শব্দটা তা হলে কাউকে জাগাতে পারেনি।

বিপদটা কেটে গেল। যদিও তার বুকের মধ্যে একটা আলোড়ন চলছিল তবু সে পেছন ফিরে চলে গেল না। তার একমাত্র চিন্তা শুধু কাজটা সেরে ফেলা। এবার সে বিশপের শোবার ঘরে ঢুকে পড়ল।

ঘরের ভেতরটা দারুণ শান্ত ছিল। তবে তখনও কিছুটা অন্ধকার থাকায় ঘরের ভেতরে চেয়ার-টেবিল, কাগজপত্র, বই, টুল, পোশাক-আশাক প্রভৃতি যেসব জিনিসপত্র ছিল তা সে বুঝতে পারল না। আধো-আলো আধো-অন্ধকারে সেগুলোকে এক একটা বস্তুপুঞ্জ বলে মনে হল। সাবধানে পা টিপে এগিয়ে যেতে লাগল ভলজাঁ। ঘরের অপর প্রান্ত হতে ঘুমন্ত বিশপের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ কানে আসছিল তার। হঠাৎ যেটা সে চাইছিল সেটা বিছানার পাশে পেয়ে যাওয়ায় চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে।

প্রকৃতি যেন অনেক সময় আমাদের কর্মাকর্মের ওপর গুরুগম্ভীরভাবে মন্তব্য করে আমাদের ভাবিয়ে তোলে সে বিষয়ে। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে আকাশে মেঘ জমে ছিল। ভলজাঁ যখন বিশপের বিছানার পাশে থমকে দাঁড়িয়েছিল তখন হঠাৎ মেঘটা সরে যেতেই এক ঝলক চাঁদের আলো জানালা দিয়ে এসে বিশপের মুখের উপর পড়ল। বিশপ শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন। রাত্রিতে খুব শীত থাকার জন্য বিশপ সে রাতে হাত পর্যন্ত বাদামি। রঙের একটা পশমি জ্যাকেট পরেছিলেন। তাঁর মাথাটা বালিশের উপর ঢলে পড়েছিল। তার হাতের আঙুলে একটা যাজকের আংটি ছিল। তাঁর যে হাত দুটি কত মানুষের কত মঙ্গল করেছে, কত উপকার করেছে, সে হাত দুটি চাদরের বাইরে ছড়ানো পড়ে আছে। তাঁর মুখের উপর ফুটে আছে অদ্ভুত এক প্রশান্তি, এক পরম তৃপ্তি আর পরম সুখের স্নিগ্ধ আলো, যে আলোর প্রতিফলন আর কোথাও দেখা যায় না। ধার্মিক লোকের আত্মা যে রহস্যময় স্বর্গীয় সুষমার অমৃতে মিলে মিশে এক হয়ে যায়।

মোট কথা, বিশপের মুখে তখন ছিল এক স্বর্গীয় জ্যোতি। এ জ্যোতি তার আপন অন্তরাত্মা থেকে বিচ্ছুরিত এক জ্যোতি, এ জ্যোতি তার আপন বিবেকের জ্যোতি। যে মূহূর্তে চাঁদের আলো জানালা দিয়ে এসে তাঁর অন্তরের জ্যোতির সঙ্গে মিলিত হয়ে এক হয়ে গিয়েছিল তখন সেই ঘরখানার নরম অন্ধকারে তাঁর মুখের উপর একটা স্বর্গীয় জ্যোতি ফুটে উঠেছিল। চাঁদের উজ্জ্বলতা, বাড়ি আর বাগানের নিস্তব্ধতা, নৈশ পরিবেশের অটল প্রশান্তি–এইসব কিছু শিশুসুলভ এক অনাবিল ঘুমের মধ্যে ডুবে যাওয়া বিশপের শ্রদ্ধাজনক মুখখানার উপর এনে দিয়েছিল এমন এক প্রশান্ত গাম্ভীর্য আর মহত্ত্ব, যা ক্রমশই অচেতনভাবে ঈশ্বরানুভূতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।

সেই লোহার যন্ত্রটা হাতে নিয়ে নৈশ ছায়ার মধ্যে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল জাঁ ভলজাঁ। বৃদ্ধ বিশপের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন ভয় হচ্ছিল তার। এমন দৃশ্য এর আগে কখনও দেখেনি সে। তার নীতি-চেতনার স্তরে দুই বিপরীত ভাবের এক তুমুল দ্বন্দ্ব চলছিল তখন। একদিকে এক পাপকর্মের অনুষ্ঠানে উন্মুখ প্রবৃত্তির পটভূমিকায় তার বিপন্ন বিবেকের অক্ষম উপস্থিতি আর একদিকে এক অসতর্ক ও নির্দোষ নিরীহ মানুষের সুগভীর নিদ্রা। এই নিঃসঙ্গ নীরব দ্বন্দ্বের মধ্যে দাঁড়িয়ে জাঁ ভলজাঁ এক মহান ব্যক্তিত্বের অস্তিত্ব সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন হয়ে উঠল ধীরে ধীরে।

জাঁ ভলজাঁ’র মনের সেই অনুভূতিটা অন্য কেউ তো দূরের কথা, সে নিজেই তা প্রকাশ করতে পারবে না। এক পরম প্রশান্তির সামনে অগ্রসরমান এক চরম হিংসার রূপকে কল্পনা করে নিতে হবে আমাদের। তার যে মুখে শুধু এক বিহ্বল বিব্রত বিস্ময় ছাড়া আর কিছুই ছিল না, সে মুখ দেখে তার মনের ভাব বোঝা সম্ভব ছিল না। সে নিচের দিকে মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মনের কথা ধরতে পারাটা সম্ভব ছিল না কারও পক্ষে। তবে সে যে বিশেষ বিচলিত হয়ে পড়েছিল তা তার তখনকার চেহারা বা মুখচোখের ভাব দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু কী ধরনের আবেগ ছিল তার মনের মধ্যে, তা বোঝা যাচ্ছিল না।

বিছানা থেকে তার দৃষ্টিটা সরিয়ে নিল ভলজাঁ। তখন তার মুখচোখের ভাব থেকে। একটা জিনিস স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। তার মন তখন পরস্পরবিরুদ্ধ দুটি স্রোতের টানে ভেসে চলেছিল–একদিকে মৃত্যু আর একদিকে মুক্তি। হয় তাকে ঘুমন্ত বিশপের মাথাটাকে ভেঙে গুঁড়ো করে দিতে হবে অথবা তার হাতটাকে চুম্বন করতে হবে।

কিছুক্ষণ এইভাবে কেটে যাবার পর ভলজাঁ তার বাঁ হাত দিয়ে মাথা থেকে টুপিটা তুলে আর ডান হাতে সেই লোহার যন্ত্রটা ধরে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে লাগল। বিশপ তখনও শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন। তার ভয়ঙ্কর দৃষ্টি যেন ভেদ করতে পারছে না বিশপের শান্ত নিদ্রার আবরণটাকে। বিছানার পাশে আলনার উপরে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর একটা ছোট মূর্তি ছিল। যিশু যেন দু হাত বাড়িয়ে ঘরের মধ্যে দু জন লোকের একজনকে আশীর্বাদ আর একজনকে ক্ষমা দান করছেন।

ভলজাঁ হঠাৎ টুপিটা আবার মাথায় পরে ঘুমন্ত বিশপের দিকে না তাকিয়ে আলমারিটার কাছে চলে গেল। চাবিটা কাছে পেয়ে গেল বলে আর তালা ভাঙতে হল না। চাবি খুলে আলমারি থেকে রুপোর কাঁটাচামচের ঝুড়িটা নিয়ে আবার তার ঘরে চলে গেল। তার পর তার পিঠের ব্যাগটা খুলে তার মধ্যে রুপোর কাঁটাচামচগুলো ভরে নিয়ে বুড়িটা ফেলে দিল। ব্যাগটা পিঠে নিয়ে ছড়িটা হাতে ধরে খোলা জানালা দিয়ে বাগানে লাফ দিয়ে পড়ে পাঁচিলে উঠে বিড়ালের মতো একমুহূর্তে ওদিকের রাস্তাটায় পড়ল।

.

১১

পরদিন সকালে সূর্যোদয়ের সময় তার বাগানের কাজ করছিলেন মঁসিয়ে বিয়েনভেনু। এমন সময় ম্যাগলোরি ছুটতে ছুটতে উত্তেজিতভাবে তাঁর কাছে এল।

ম্যাগলোরি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, বঁসিয়ে মঁসিয়ে, আপনি জানেন রুপোর জিনিসপত্র রাখা ঝুড়িটা কোথায়?

বিশপ বললেন, হ্যাঁ জানি।

ম্যাগলোরি বলল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। জিনিসটা গেল কোথায় তা আমি বুঝতেই পারছিলাম না।

কিছুক্ষণ আগে খালি ঝুড়িটা বাগানের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখতে পান বিশপ। তিনি ঝুড়িটা তুলে ম্যাগলোরির হাতে দিয়ে বলেন, এই নাও।

ম্যাগলোরি বলল, কিন্তু এটা তো খালি। রুপোর জিনিসগুলো গেল কোথায়?

বিশপ বললেন, তা হলে তুমি রুপোর জিনিসগুলো চাইছ? সেগুলো কোথায় তা তো আমি জানি না।

ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন। সেগুলো চুরি গেছে। গতকাল রাতে যে লোকটা এসেছিল সেই সেগুলো চুরি করে নিয়ে গেছে।

এই বলে লোকটা অতিথিদের জন্য নির্দিষ্ট যে জায়গায় শুয়েছিল সেখানে ছুটে চলে গেল। সেখানে কাউকে দেখতে না পেয়ে আবার ছুটতে ছুটতে ফিরে এল। বিশপ তখন ঝুড়ির চাপে পিষ্ট একটা ফুলগাছের উপর ঝুঁকে পড়ে কী দেখছিলেন।

ম্যাগলোরি বলল, মঁসিয়ে মঁসিয়ে, লোকটা চলে গেছে। রুপোর জিনিসগুলো সব চুরি করে নিয়ে গেছে।

কথা বলতে বলতে বাগানের চারদিকে তাকিয়ে দেখছিল ম্যাগলোরি। দেখল রাস্তার দিকের বাগানের পাঁচিলের এক জায়গায় একটা-দুটো ইট খসে পড়েছে। ওই ভাঙা জায়গাটা যেন চোর পালানোর সাক্ষী হয়ে আছে।

ম্যাগলোরি বলল, ওই যে ওই পথে পালিয়েছে রাক্ষসটা। সে পাঁচিল পার হয়ে রাস্তায় চলে গেছে। আমাদের সব রুপোগুলো চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে।

কিছুক্ষণ ভাববার পর বিশপ গম্ভীরভাবে ম্যাগলোরির দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বললেন, প্রথম কথা ওগুলো কি সত্যি সত্যিই আমাদের ছিল?

হতবাক ও হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে ম্যাগলোরি। কোনও কথা খুঁজে পেল না। কথাটার মানে কিছু বুঝতে পারল না।

বিশপ আবার বলতে লাগলেন, আমি দেখছি এতদিন ধরে জিনিসগুলো রাখা আমারই ভুল হয়ে গেছে। আসলে ওগুলো গরিব-দুঃখীদের জিনিস। যে লোকটা সেগুলো নিয়ে গেছে সে-ও গরিব নয় তো কি?

ম্যাগলোরি বলল, আমার বা আপনার বোনের জন্য বলছি না, মঁসিয়ে এবার থেকে কী করে খাবেন?

আপাত বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে বিশপ বললেন, টিন বা সিসের কাঁটাচামচ কিনে আনবে।

তার থেকে গন্ধ বার হবে।

তা হলে লোহার কাঁটাচামচ আনবে।

তার একরকম বাজে স্বাদ আছে।

তা হলে কাঠের কাঁটাচামচের ব্যবস্থা করবে।

কিছুক্ষণ পর খাবার ঘরের যে টেবিলে গতরাতে জাঁ ভলজাঁ বসে খেয়েছিল সেখানে বসে বিশপ তার বোনের পাশে বসে প্রাতরাশ খাচ্ছিলেন। একসময় খেতে খেতে তিনি খুশিমনে তার বোনকে বললেন, দেখ, আসলে কাঠের হোক বা যারই হোক, কোনও কাঁটাচামচের দরকাই নেই। একপাত্র দুধে একটা রুটি ডোবাতে কোনও কাঁটাচামচের দরকার হয় না।

ম্যাগলোরি নিজের মনে মনে স্বগতোক্তি করল, আর কীই-বা আশা করতে পার তুমি। একটা বাজে লোককে ঘরে থাকতে দিয়ে খাইয়ে ভালো বিছানায় শুইয়ে তার ফল পেলে কি না সেসব চুরি করে নিয়ে গেল। ঘৃণায় ও রাগে সর্বাঙ্গ আমার কাঁপছে।

বিশপ আর তাঁর বোন যখন প্রাতরাশ খাওয়ার পর টেবিল থেকে উঠে যাচ্ছিলেন তখন দরজায় কে করাঘাত করল বাইরে থেকে। বিশপ বললেন, ভেতরে এস।

সঙ্গে সঙ্গে দরজা ঠেলে তিনজন পুলিশ একটা লোকের ঘাড় ধরে ঘরের মধ্যে ঢুকল। লোকটা হল জাঁ ভলজাঁ।

তিনজন পুলিশ ছাড়া একজন সার্জেন্ট দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে এগিয়ে এসে বিশপকে ডাকল, মঁসিয়ে–

এ কথায় ভলজাঁ আশ্চর্য ও হতবুদ্ধি হয়ে বোকার মতো বলে উঠল, মঁসিয়ে! উনি তা হলে কুরে বা ছোট যাজক নন।

সার্জেন্ট তাকে ধমক দিয়ে বলল, চুপ কর। উনি হচ্ছে মহামান্য বিশপ।

মঁসিয়ে বিয়েনভেনু তখন তাদের কাছে ছুটে এলেন। তিনি ভলজাঁকে দেখেই বললেন, তুমি তা হলে আবার এসেছ? তোমাকে দেখে আনন্দিত হলাম। তুমি কি রুপোর বাতিদান দুটো নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিল? ওগুলোও খাঁটি রুপোর এবং দু’শো টাকা দাম হবে। আমি তো ও দুটোও দিয়েছিলাম। তুমি হয়তো ভুলে গেছ।

জাঁ ভলজাঁর চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠল। সে সেই বিস্ফারিত চোখের অপরিসীম বিস্ময় আর বিহ্বলতা নিয়ে তাকিয়ে রইল বিশপের পানে। তার সেই চোখমুখের অদ্ভুত ভাব থেকে তার মনের অনুভূতি অনুমান করা সম্ভব ছিল না।

সার্জেন্ট বিশপকে বলল, মঁসিয়ে, তা হলে কি ধরে নেব এই লোকটা যা বলেছে তা সত্যি? তাকে ছুটতে দেখে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করি। তার পিঠের ব্যাগের মধ্যে এই রুপোর জিনিসগুলো পাই তাই–

বিশপ হাসিমুখে বললেন, আর ও বলেছে একজন বৃদ্ধ যাজক যার ঘরে রাত কাটিয়েছে সে তাকে ওগুলো দিয়েছে। এবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি। আপনারা অবশ্য ওকে এখানে ধরে আনতে বাধ্য। কিন্তু আপনারা ভুল করেছেন।

সার্জেন্ট বলল, তা হলে বলতে চান ওকে আমরা ছেড়ে দেব?

পুলিশরা ভলজাঁকে ছেড়ে দিতে সে আমতা আমতা করে বলল, আমি তা হলে এবার সত্যিই কি যেতে পারি?

ভলজাঁ যেন ঘুমের ঘোরে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল কথাগুলো।

একজন পুলিশ বলল, তুমি কি শুনতে পাওনি?

বিশপ বললেন, এবার কিন্তু রুপোর বাতিদান দুটো নিয়ে যেতে ভুলবে না।

আলনার উপর থেকে বাতিদান দুটো এনে ভলজাঁর হাতে তুলে দিলেন বিশপ। তাঁর বোন ও ম্যাগলোরি কোনও কথা বলে অথবা কোনও প্রতিবাদসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হস্তক্ষেপ করল না বিশপের কাজে। ভলজাঁর হাত দুটো কাঁপতে লাগল। সে অন্যমনে যন্ত্রচালিতের মতো বাতিদান দুটো নিল।

বিশপ ভলজাঁকে বললেন, এবার তুমি শান্তিতে যেতে পার। এবার যদি কোনওদিন ঘটনাক্রমে এ বাড়িতে আস তা হলে আর বাগানের মধ্য দিয়ে যেতে হবে না। এ দরজায় কোনওদিন তালা দেওয়া হয় না।

এবার পুলিশদের দিকে ঘুরে বিশপ বললেন, ধন্যবাদ ভদ্রমহোদয়গণ!

পুলিশরা চলে গেল। ভলজাঁ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, যেন মনে হল সে পড়ে যাবে। বিশপ তার কাছে গিয়ে বললেন, তুমি ভুলে যেও না তুমি কথা দিয়েছ তুমি তোমার সব টাকা দিয়ে এমন একটা কিছু কাজ করবে যাতে তুমি একজন সৎ লোক হয়ে উঠতে পার।

ভলজাঁর মনে পড়ল না কী প্রতিশ্রুতি সে দিয়েছে। সে তাই চুপ করে রইল। এর আগের কথাগুলোই বিশপ ধীরে ধীরে নিচু গলায় বললেন, জাঁ ভলজাঁ, হে আমার ভাই, এখন আর কোনও পাপ নেই তোমার মধ্যে। এবার থেকে তুমি শুধু ভালো কাজ করে। যাবে। তোমার আত্মাকে যত সব কুটিল চিন্তা আর অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য তোমার আত্মাকে কিনে নিয়েছি আমি এবং তার পর ঈশ্বরকে তা ফিরিয়ে দিয়েছি।

.

১২

শহর ছেড়ে একরকম ছুটতে ছুটতে ভলজাঁ গ্রামাঞ্চলে গিয়ে পড়ল। কোথায় কোন দিকে যাচ্ছে তার কিছু খেয়াল ছিল না তার। এইভাবে পথে পথেই সারা সকালটা কেটে গেল তার। এর মধ্যে কিছু সে খায়নি, কোনও ক্ষুধাও বোধ করেনি। যে অদ্ভুত চেতনা বা অনুভূতি তার মনটাকে তখন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, তার মধ্যে ছিল এক ধরনের রাগ। কিন্তু এ রাগ কার ওপর তা সে জানে না। এই ঘটনায় সে সম্মান বা আঘাত কী পেয়েছে, তা সে বুঝতে পারছে না। গত কুড়ি বছরের মধ্যে কোনও কোনও অসতর্ক মুহূর্তে তার। মনে কোনও মমতামেদুর ভাব জাগলে সে কঠোরভাবে তা অবদমিত করেছে। তার মনের অবস্থা তখন সত্যিই বড় ক্লান্ত ছিল। সে ভয়ে ভয়ে বুঝল এতদিনের অন্যায় অবিচার আর দুর্ভাগ্যের চাপে তার মনের মধ্যে যে একটা ভয়ঙ্কর শান্ত নিষ্ক্রিয় ভাব গড়ে উঠেছিল, এখন সেটা ধসে পড়ছে। কিন্তু তার পরিবর্তে আবার কোন ভাব গড়ে উঠবে? এক একসময় আবার জেলখানায় ফিরে যেতে ইচ্ছা হয় তার, যা আগে কখনও হয়নি। জেলখানায় গেলে আর কিছু না হোক অন্তত কোনও দুশ্চিন্তা থাকবে না তার মনে। তখন বছরটা প্রায় শেষ হয়ে এলেও কিছু ফুল তখনও ছিল পথের ধারের বনে-ঝোপে। সেইসব বুনো ফুলের গন্ধে ছেলেবেলাকার কথা মনে পড়ল তার। বিস্মৃতির অতল গর্ভে সমাহিত সেইসব স্মৃতি সত্যিই দুঃসহ তার পক্ষে।

এইসব মানসিক অশান্তি আর গোলমালের মধ্য দিয়ে সারাটা দিন কেটে গেল তার। বিকালে সূর্য অস্ত যাবার সময় যখন সব বস্তুর ছায়াগুলো বড় বড় হয়ে উঠল তখন এক প্রান্তরের ধারে একটা ঝোঁপের পাশে সে বসল। প্রান্তরটা একেবারে ফাঁকা আর জনশূন্য। দূর দিগন্তের একদিকে আল্পস পর্বতের চূড়া অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল। দিগনে শহর থেকে সে প্রায় সাত মাইল দূরে চলে এসেছে। একটা পায়ে চলা পথ তার পাশ দিয়ে প্রান্তরটা ভেদ করে দূরে চলে গেছে।

নিবিড় পথক্লান্তির সঙ্গে নিদারুণ মানসিক দুশ্চিন্তা আরও ভয়াবহ করে তুলেছিল তার চেহারাটা। এমন সময় এক জীবন্ত মানুষের শব্দ কানে এল তার। মুখ ফিরিয়ে দেখল একটা বছর দশেকের ছেলে গান গাইতে গাইতে সেই হাঁটা পথটা দিয়ে আসছে। তার পিঠের উপর বাঁধা একটা বাক্সের মধ্যে তার জিনিসপত্র সব ছিল। মনে হল সে একজন ভবঘুরে জাতীয় ছেলে যে গাঁয়ে গায়ে চিমনি পরিষ্কারের কাজ করে বেড়ায় ছেঁড়া পায়জামা পরে। পথ চলতে চলতে মাঝে মাঝে থেমে খেলা করছিল সে। তার হাতে চল্লিশটা স্যু ছিল, তা নিয়ে লোফালুফি করছিল সে। সেটা উপরে ছুঁড়ে দিয়ে উল্টো দিক। দিয়ে লুফে নিচ্ছিল। এই পয়সাই তার জীবনের একমাত্র সম্বল।

জাঁ ভলজাঁকে দেখতে না পেয়ে সে ঝোঁপটার ধারে দাঁড়িয়ে পয়সাটা নিয়ে আবার খেলা করতে শুরু করে দিল। এবার সে পয়সাটা গড়িয়ে দিতে লাগল। গড়াতে গড়াতে পয়সাটা ভলজাঁর পায়ের কাছে এসে পড়ল। পায়ের কাছে আসতেই পা দিয়ে পয়সাটা চেপে দিল ভলজাঁ।

ছেলেটা দেখেছিল তার পয়সাটা কোথা গেছে। সে সোজাঁ ভলজাঁর কাছে চলে এল। জায়গাটা একেবারে নির্জন। পথে বা প্রান্তরের কোথাও একজন মানুষ নেই। মাথার অনেক উপরে এক ঝাঁক উড়ন্ত পাখির কলবর ছাড়া আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। অস্তম্লান সূর্যের কিছু আলো এসে ছেলেটার মাথার সোনালি চুল আর ভলজাঁর মুখের উপর পড়েছিল।

ছেলেটি বলল, মঁসিয়ে, আমার পয়সাটা দেবেন?

তার কণ্ঠে শিশুসুলভ এক সরল বিশ্বাসের সঙ্গে নির্দোষিতা আর অজ্ঞতার একটা ভাব ছিল।

ভলজাঁ বলল, তোমার নাম কী?

পেতিত গার্ভে মঁসিয়ে।

চলে যাও।

দয়া করে আমার পয়সাটা ফিরিয়ে দিন মঁসিয়ে।

জাঁ ভলজাঁ মাথা নিচু করে বসে রইল। কথাটার কোনও উত্তর দিল না।

ছেলেটি আবার বলল, দয়া করুন মঁসিয়ে।

ভলজাঁ মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।

ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার পয়সা। একটা রুপোর মুদ্রা।

ভলজাঁ যেন কথাটা শুনতে পেল না। ছেলেটা তখন তার ভারী জুতোপরা পা-টা সরিয়ে পয়সাটা বার করার চেষ্টা করতে লাগল। সে বারবার বলতে লাগল, আমার পয়সাটা দিয়ে দিন। আমার চল্লিশটা স্যু। এবার কাঁদতে লাগল জোরে। ভলজাঁ এবার মাথাটা তুলল। সে আশ্চর্য হয়ে ছেলেটার পানে তাকাল। তার পর তার ছড়িটা খুঁজতে খুঁজতে ভয়ঙ্কর গলায় বলে উঠল, কে এখানে?

ছেলেটা বলল, আমি পেতিত গার্ভে মঁসিয়ে। আপনি দয়া করে পা-টা সরিয়ে আমার চল্লিশ স্যু মুদ্রাটা দিয়ে দিন।

ছেলেটা রেগে গিয়ে কড়া গলায় বলল, আপনি পা-টা সরাবেন?

ভলজাঁ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলে যাও বলছি। এখনও আছে?

সে তার একটা পা দিয়ে তখনও ছেলেটার মুদ্রাটাকে চেপে রইল। পা-টা সরাল না।

ছেলেটা ভলজাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেল। কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর সে আর পেছন ফিরে না তাকিয়ে বা কোনও কথা না বলে ছুটে পালাল। ছেলেটা ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে পড়েছিল। এক একবার পথের উপর দাঁড়াচ্ছিল। সে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। তার চাপা কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল ভলজাঁ। কিন্তু একটু পরেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দেখতে দেখতে সূর্য অস্ত গেল। গোধূলির ছায়া ঘন হয়ে উঠল জাঁ ভলজাঁর চারদিকে। সারা দিন তার কিছুই খাওয়া হয়নি। গাঁয়ে জ্বর বোধ করছিল। যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল স্থির হয়ে। ছেলেটার চলে যাওয়ার পর এক পা-ও নড়েনি কোথাও। সহসা সে তার সামনে দেখল ঘাসের উপর নীল রঙের একটা ভাঙা পাত্রের একটা টুকরো পড়ে রয়েছে। গাঁয়ে জোর ঠাণ্ডা লাগতে বুকের উপর শার্টটা বেঁধে নিল। তার পর মাটির উপরে থাকা ছড়িটা কুড়িয়ে নিতে গিয়ে তার পায়ের তলায়। এতক্ষণ ধরে পড়ে থাকা চল্লিশ ব্যু’র মুদ্রাটা দেখতে পেল। ঠাণ্ডায় কাঁপতে লাগল সে।

তা দেখে এক বৈদ্যুতিক আঘাত পেয়ে যেন চমকে উঠল সে। আপন মনে বলে উঠল, এটা কী? মনে হল চকচকে রুপোর মুদ্রাটা তার উজ্জ্বল চোখ মেলে তাকিয়ে তাকে দেখছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সে সরে গিয়ে মুদ্রাটা হাতে তুলে নিয়ে তার চারপাশে নিরাপদ আত্মগোপনের এক আশ্রয় খুঁজতে থাকা ভীতসন্ত্রস্ত এক জন্তুর মতো দৃষ্টি ছড়িয়ে তাকাতে লাগল।

কোনও দিকে কিছুই দেখতে পেল না সে। রাত্রির অন্ধকার নেমে আসছিল। গোটা প্রান্তরটা ঠাণ্ডা হিম হয়ে উঠেছে। তার উপর নীলচে এক কুয়াশা নেমে এসে গোধূলির শেষ আলোটুকু অকালে মুছে দিয়েছে। ছেলেটা যেদিকে পালায় সেই পথেই জোর পায়ে হাঁটতে লাগল ভলজাঁ। কিছুদূর যাওয়ার পর একবার থেমে আবার তাকাল চারদিকে। এবারও কিছুই দেখতে পেল না সে। তখন জোর চিৎকার করে ডাকতে লাগল, পেতিত গার্ভে! পেতিত গার্ভে!

সে একবার থামল। কিন্তু কারও কোনও সাড়া পেল না। এক কুয়াশাঘন অন্ধকার প্রান্তরের বিশাল শূন্যতা আর অখণ্ড স্তব্ধতার মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল সে। সে স্তব্ধতার মাঝে তার সব কণ্ঠস্বর নিঃশেষে তলিয়ে গিয়েছিল কোথায়। তীক্ষ্ণ কনকনে বাতাস বইতে লাগল। ঝোঁপঝাড়ের গাছগুলো প্রচণ্ড রাগে ডালপালা নেড়ে ভয় দেখাতে লাগল যেন তাকে।

আবার পথ হাঁটতে লাগল সে। সহসা ছুটতে শুরু করে দিল। ছুটতে ছুটতে মাঝে মাঝে পেতিত গার্ভের নাম ধরে হতাশ কণ্ঠে ভয়ঙ্করভাবে ডাকতে লাগল। পেতিত গার্ভে সে ডাক শুনতে পেলে কোথাও হয়তো লুকিয়ে পড়ত।

ভলজাঁ দেখল ঘোড়ায় চেপে একজন যাজক আসছে। সে তার কাছে গিয়ে বলল, মঁসিয়ে লে কুরে। একটা ছেলেকে এই পথে যেতে দেখেছেন? পেতিত গার্ভে নামে একটা ছেলে?

না, আমি কোনও ছেলেকে দেখিনি।

ভলজাঁ পাঁচ ফ্রাঁ’র দুটো মুদ্রা বার করে যাজকের হাতে দিয়ে বলল, দরিদ্রদের সেবার জন্য এটা নিন মঁসিয়ে লে কুরে… ছেলেটার বয়স বছর দশেক হবে। তার পিঠে একটা বাক্স ছিল। হয়তো সে চিমনির ঝাড়ুদার অথবা ওই ধরনের কিছু কাজ করে।

আমি তাকে দেখিনি।

পেতিত গার্ভে তার নাম। এখানকার পাশাপাশি কোন গাঁয়ে থাকে কি?

যাজক বলল, আমি তা জানি না। মনে হয় সে এখানকার ছেলে নয়। বিদেশি কোনও ভবঘুরে। ওরা মাঝে মাঝে আসে।

আরও দুটো পাঁচ ফ্রাঁ’র মুদ্রা বার করে যাজকের হাতে দিয়ে ভাজা বলল, দরিদ্রদের সেবার জন্য এটাও রেখে দিন।

যাজক ঘোড়াটা চালিয়ে দিলে ভলজাঁ চিৎকার করে বলে উঠল, মঁসিয়ে লাব্বে, আমাকে গ্রেপ্তার করুন, আমি চোর।

যাজক ভয়ে ঘোড়াটাকে জোরে ছুটিয়ে চলে গেল।

যেদিকে যাচ্ছিল সেইদিকেই যেতে লাগল ভলজাঁ। অনেকক্ষণ ধরে ছুটল। পেতিত গার্ভের নাম ধরে অনেক ডাকল। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না বা কোনও সাড়াও পেল না। মাঝে মাঝে পথের ধারে এক একটা ঝোঁপ বা বড় পাথরের ছায়া দেখে মনে হতে লাগল কোনও মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু পরে দেখল সেটা দেখার ভুল। এক জায়গায় এসে ভলক্স দেখল তিন দিকে তিনটে পথ চলে গেছে। সেইখানে তিনটে পথের মুখের কাছে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার পর শেষবারের মতো একবার চিৎকার করে ডাকল, ‘পেতিত গার্ভে।’ এরপর আর একবার ডাকল। কিন্তু গলা দিয়ে কোনও শব্দ বার হচ্ছিল না। নিজের কথা নিজেই শুনতে পাচ্ছিল না। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না সে। এক অপরাধ-চেতনার গুরুভারের চাপে পা দুটো তার বসিয়ে দিচ্ছিল যেন কোনও অদৃশ্য শক্তি। একটা পাথরের উপর হাঁটু দুটোর মাঝে মাথাটা খুঁজে বসে রইল সে। আপন মনে বলে উঠল, আমি হচ্ছি হতভাগ্য এক শয়তান। মহাপাপী। অনুতাপের অপ্রতিরোধ্য বেদনার আবেগে পরিপ্লাবিত হয়ে উঠল তার সমস্ত অন্তর। সে কাঁদতে লাগল। গত উনিশ বছরের মধ্যে এই প্রথম কাঁদল সে।

আমরা জানি জাঁ ভলজাঁ যখন বিশপের বাড়ি থেকে চলে আসে তখন তার মনের অবস্থা এমন একটা আকার ধারণ করে, যা আগে কখনও করেনি। তার মনের মধ্যে তখন কী ধরনের আলোড়ন চলছিল, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না সে। বৃদ্ধ দয়ালু বিশপের সব কথা ও কাজের বিরুদ্ধে সে অকারণে শুধু তার অন্তরটাকে কঠোর করে তুলেছে। বিশপ তাকে একসময় বলেছিল, ‘তুমি আমাকে কথা দিয়েছ এবার থেকে তুমি সৎ হবে। আমি তোমার আত্মাকে কিনে নিচ্ছি। সে আত্মাকে আমি বিকৃত যত সব কামনা আর কুচিন্তার হাত থেকে মুক্ত করে ঈশ্বরকে দান করছি।’ কথাগুলো বারবার তার মনে আনাগোনা করেছিল। কিন্তু আত্মাভিমানের যে দুর্ভেদ্য দুর্গ আমাদের সব পাপপ্রবৃত্তিকে এক নিরাপদ আশ্রয় দান করে সেই আত্মাভিমানের বশবর্তী হয়েই মনের তলায় চেপে রেখে দিয়েছিল বিশপের সেই কথাগুলোকে। অস্পষ্টভাবে হলেও একটা কথা বুঝতে পেরেছিল সে, বিশপের ক্ষমাই তার নিষ্ঠুর প্রকৃতির ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত হানে। সেই আক্রমণ ও আঘাতকে যদি সে সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত করতে পারে তা হলে অক্ষুণ্ণ থেকে যাবে তার মানসপ্রকৃতির অবিমিশ্র নিষ্ঠুরতা, তা হলে চিরকালের জন্য পাথরের মতো কঠিন থেকে যাবে তার অন্তরটা; আর যদি সে আঘাত ও আক্রমণের কাছে আত্মসমর্পণ করে তা হলে এতদিন ধরে অসংখ্য মানুষের দুর্ব্যবহারে সে প্রবল ঘৃণা সঞ্জাত হয়েছিল তার মনে, যে ঘৃণা এখন তার অবিরাম সহচর হিসেবে বিরাজ করে তার অন্তরে সে ঘৃণাকে ত্যাগ করতে হবে তাকে চিরকালের জন্য। অস্পষ্টভাবে সে আরও বুঝতে পারল এখন শেষ লড়াইয়ের ক্ষণ এসে গেছে। এখন হয় তাকে জয়লাভ করতে হবে অথবা পরাভব স্বীকার করতে হবে সে যুদ্ধে। একদিকে তার অন্তর্নিহিত পাপ আর একদিকে সেই ধর্মাত্মা বিশপের পুণ্য–এই দুইয়ের সংগ্রামে একজনকে জিততেই হবে।

এইসব কথা ভাবতে ভাবতে নানা জটিল চিন্তার দ্বারা বিব্রত হয়ে মাতালের মতো টলতে লাগল। এইভাবেই সে আবার পথ হাঁটতে লাগল। দিগনেতে বিশপের বাড়িতে যেসব ঘটনা ঘটে গেছে তার ফল কী হবে, সে বিষয়ে কি তার কোনও ধারণা আছে? এইসব ঘটনার সঙ্গে যেসব ব্যাপার জড়িয়ে আছে তা কি সে বোঝে? কেউ কি তার কানে কানে একটা কথা ফিস ফিস করে বলেনি যে সে আজ জীবনের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে যেখানে মধ্যপথ বলে কিছু নেই। এখন থেকে হয় তাকে মানুষ হিসেবে খুব ভালো হতে হবে অথবা খুব খারাপ হয়ে উঠতে হবে, হয় তাকে বিশপের থেকে আরও অনেক বড় হতে হবে অথবা শয়তানের থেকে নীচ হতে হবে, হয় তাকে মানবতা ও মহত্ত্বের সর্বোচ্চ স্তরে উঠে যেতে হবে অথবা নীচতা ও হীনতার সর্বনিম্ন স্তরে নেমে যেতে হবে।

আমরা আবার এ প্রশ্ন করতে পারি, জাঁ ভলজাঁ কি তার মনের মধ্যে এসব কথা বুঝতে পেরেছিল? দুঃখ-বিপর্যয় অবশ্য মানুষের বুদ্ধিকে তীক্ষ্ণ করে তোলে। তবু ভলজাঁ এইসব জটিল ব্যাপারগুলো ঠিকমতো বুঝতে পেরেছিল কি না, তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এ সব চিন্তা তার মনের মধ্যে ঢুকেছিল তার স্পষ্ট কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না, শুধু অস্পষ্টভাবে তার একটা ধারণা করে নিতে হয়। তাছাড়া এসব চিন্তা তার মনের মধ্যে ঢুকে তার মনটাকে এক বেদনার্ত ও দুর্বিষহ আলোড়নের মধ্যে ফেলে দেওয়া ছাড়া তার কোনও ভালো করতে পারেনি। নারকীয় এক কুটিল অন্ধকারে ভরা কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেই বিশপের সঙ্গে তার সাক্ষাৎকার তার মনশ্চক্ষুকে একেবারে বিহ্বল করে দিয়েছিল, দীর্ঘক্ষণ অন্ধকারে থাকার পর কোনও লোক হঠাৎ উজ্জ্বল দিবালোক দেখতে পেলে তার চোখ দুটো যেমন ধাঁধিয়ে যায়। বিশপের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, সততা ও শুচিতায় যে উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি এনে দিয়েছিল তার জীবনে, সে প্রতিশ্রুতি সঙ্গে সঙ্গে অভিশাপ হয়ে প্রবল ভয়ে কাঁপিয়ে তুলেছিল তাকে। সত্যি সত্যিই হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল সে। অন্ধকার কোটর হতে অকস্মাৎ নির্গত কোনও পেঁচা যেমন সূর্যোদয়ের আলোকবন্যায় বিহ্বল ও বিব্রত হয়ে পড়ে, তেমনি সহসা পুণ্যের উজ্জ্বলতায় চোখে অন্ধকার দেখছিল সে।

সে বুঝতে না পারলেও একটা জিনিস নিশ্চিত যে সে আর আগেকার সেই মানুষ নেই। তার অন্তরের মধ্যে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে, তার মনের কাঠামোটাই বদলে গেছে একেবারে। বিশপ তাকে এ কথা বলেনি বা তার অন্তরকে স্পর্শ করেনি একথা জোর গলায় বলে বেড়াবার মতো শক্তি তার আর নেই।

এই ধরনের মানসিক গোলমাল ও গোলযোগের মধ্যে পেতিত গার্ভের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। সে তার চল্লিশ ব্যু ছরি করে। কেন সে এ কাজ করেছে? সে নিশ্চয়। এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে না। সুদীর্ঘ কারাবাস তার মনের মধ্যে যে অশুভ শক্তি জাগিয়ে তোলে সেই শক্তিই কি তার অন্তর্নিহিত কুপ্রবৃত্তিকে উত্তেজিত করে তোলে? হয়তো তাই, অথবা যতটা ভাবছি ততটা নয়। তবে মোট কথা, যে পেতিত গার্ভে নামে ছেলেটার পয়সা চুরি করেছিল সে মানুষ নয়, জাঁ ভলজাঁর মধ্যে যে একটা পশু ছিল সেই পশুটাই তার অভ্যাসগত ও প্রকৃতিগত পাশবিকতার বশে পয়সাটার উপর পা-টা চেপেছিল। আর তখন ভলজাঁর ভেতরকার মানুষটা নতুন চিন্তাগুলোর সঙ্গে বুদ্ধি দিয়ে লড়াই করে চলেছিল। সে যখন বুঝতে পারল তার ভেতরকার পশুটা এ কাজ করেছে। তখন সে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে।

আশ্চর্যের কথা এই যে, নতুন অবস্থার মধ্যে যে মানসিকতা তার গড়ে উঠেছিল তাতে সে বেশ বুঝতে পারল, যে কাজ সে করে ফেলেছে সে কাজের মানসিক প্রতিক্রিয়া সে সহ্য করতে পারবে না।

যাই হোক, তার এই শেষের কুকর্মটা তার মনের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করল। তার মনের সব বিশৃঙ্খলা ভেদ করে এ ঘটনা এমন এক আলোকসম্পাত করল তার মনের ওপর যার ফলে তার মন ও বুদ্ধি অন্ধকার থেকে আলোটাকে পৃথক করতে পারল এবং রাসায়নিক বিশ্লেষণের মতো তার কাজের ন্যায়-অন্যায়ের উপাদানগুলো বিচার করে দেখতে পারল।

প্রথমেই সে কোনও নিমজ্জমান ব্যক্তির তৃণখণ্ড আঁকড়ে ধরার মতো কোনও কিছু নতুন করে চিন্তা করার আগে ছেলেটাকে খুঁজে তার পয়সাটা ফেরত দিতে চাইল। যখন সে তা পারল না তখন সে সত্যিই হতাশ হয়ে বসে পড়ল। যে মুহূর্তে সে ‘পাপী শয়তান এই কথা দুটো উচ্চারণ করল তখন সে ভেতরকার যে মানুষটা হতে এতদিন বিচ্ছিন্ন ছিল সে তাকে দেখতে পেয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। অথচ বাইরে সে দেখল সে একটা রক্তমাংসের মানুষ, অপরাধী পাপী জাঁ ভলজাঁ যার হাতে ছড়ি, পিঠে চুরি করা জিনিসপত্রে ভরা একটা ব্যাগ, মুখখানা কালো এবং মনে কালো মুখখানার থেকে কালো কুটিল যত চিন্তা।

অতিরিক্ত দুঃখভোলা মানুষকে করুণাপ্রবণ করে তোলে। জাঁ ভলজাঁও কেমন যেন কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠেছিল। জাঁ ভলজাঁ নামে মানুষটার মুখোমুখি হয়ে সে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল কে ওই মানুষটা? নিজেকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল সে।

এইসব মুহূর্তে যখন মনের সমুদ্রটা ভয়ঙ্করভাবে শান্ত হয়ে ওঠে এবং অন্তদৃষ্টিটা স্বচ্ছ হয়ে ওঠে তখন আমাদের চিন্তাগুলো বাস্তব জগৎটাকে পরিহার করে গভীরে চলে যায়। তখন এই পরিদৃশ্যমান বাস্তব জগৎটাকে আর আমরা দেখতে পাই না, তখন শুধু আমরা আমাদের অন্তরের জগৎ, তার অন্তর প্রকৃতিটাকেই দেখতে পাই।

এইভাবে সে যখন নিজের মুখোমুখি হয়ে আপন অন্তরের রহস্যময় গভীরে তলিয়ে গিয়ে ভাবছিল তখন হঠাৎ বাইরে থেকে একটা টর্চের আলো এসে লাগল তার চোখে। প্রথমে সে ভাবল এটা তারই চেতনার আলো। কিন্তু ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে সে বুঝল একটা মানুষ এ আলো ফেলেছে আর সে মানুষ হল দিগনের সেই বিশপ।

তখন তার মনশ্চক্ষুর সামনে দুটো মানুষের মূর্তি ফুটে উঠল –একজন বিশপ আর একজন জাঁ ভলজাঁ। প্রথমে মনে হল জাঁ ভলজাঁর দানবিক চেহারাটার বিশাল ছায়ায় বিশপের মূর্তিটা ঢাকা পড়ে গেছে। কিন্তু ক্রমে ভাবতে ভাবতে সে দেখল বিশপের উজ্জ্বল জ্যোতির তীব্রতায় জাঁ ভলজাঁ মুখ লুকিয়ে পালিয়ে গেছে কোথায়। জাঁ ভলজাঁ একেবারে অদৃশ্য হয়ে যেতে বিশপ একাই দাঁড়িয়ে আছেন তার সামনে। তার দেহ থেকে বিচ্ছুরিত জ্যোতির প্লাবনে তার ছায়াচ্ছন্ন বিষাদগ্রস্ত আত্মাটা আলোকিত হয়ে উঠেছে যেন।

অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল জাঁ ভলজাঁ। কোনও বেদনার্ত বা শোকার্ত একজন নারী বা শিশুর থেকে আরও আকুলভাবে কাঁদল সে। কাঁদতে কাঁদতে সে দেখল এক নতুন দিনের প্রভাত-সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে তার আত্মাটা। সে এক আশ্চর্য দিন–একই সঙ্গে বিস্ময়কর এবং ভয়ঙ্কর। সে আলোর স্বচ্ছতায় সেসব জিনিস, তার বর্তমান ও অতীত জীবনের অনেক ঘটনা স্পষ্টভাবে দেখতে পেল যা সে এর আগে কখনও দেখতে পায়নি। তার অপরাধ, তার সুদীর্ঘকালীন অভিশাপ, তার কারামুক্তি ও প্রতিশোধবাসনা, তার অন্তরের ও বাইরের কঠোরতা, বিশপের বাড়ির ঘটনা, সবশেষে ছেলেটার পয়সা চুরির ঘটনা–সব কিছু খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সে। বিশপ তাকে মার্জনা করার পরেও এই শেষ চুরির ঘটনাটায় সে বড় লজ্জা পেল। সেসব কিছু দেখে সে নিজের জীবনের ও আত্মার একটা ছবি এঁকে ফেলল। সে ছবি যেমন কুৎসিত তেমনি ভয়ঙ্কর। তবু সে দেখল জীবন ও আত্মার জগতে এক নতুন দিনের প্রভাত-সূর্যের আবির্ভাব হয়েছে। আর সে দেখল এক স্বর্গীয় আলোর জ্যোতিতে এক শয়তান উদ্ভাসিত ও অভিন্নত হয়ে উঠেছে।

কতক্ষণ সে সেইখানে বসে বসে কেঁদেছিল? তার পর সে কী করেছিল এবং কোথায় গিয়েছিল? তা আমরা জানি না। তবে সেই রাত্রিতে গ্রেনোবল থেকে আসা এক ঘোড়ার গাড়ির ড্রাইভার দিগনের বড় গির্জাটার পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখে মঁসিয়ে বিয়েনভেনুর বাড়ির সামনে একজন মানুষ নতজানু হয়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে আছে।

 ১.৩ অষ্টাদশ লুই-এর রাজত্বকাল

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তখন অষ্টাদশ লুই-এর রাজত্বকাল। ১৮১৭ সাল। নেপোলিয়ঁন তখন সেন্ট হেলেনা দ্বীপে ইংরেজদের হাতে বন্দি অবস্থায় দিন যাপন করছিলেন। প্রুশীয় সৈন্যরা ফান্সের উপর বুক চেপে বসেছিল তখনও। এই বছর রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও তুলিয়ের শহর ধ্বংস করার অভিযোগে অভিযুক্ত প্লেগনিয়ের, ক্যাবেয়ো আর তলেরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে তাদের প্রথমে হাত ও পরে মাথা কেটে বিপ্লব দমন করে অবস্থা আয়ত্তে আনা হয়। এ বছর দুটো ঘটনা লোকের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। একটি ঘটনা হল ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের নির্বাচিত রচনাসগ্রহের প্রকাশ এবং দ্বিতীয় ঘটনা হল দতানের ভ্রাতৃহত্যা। দতান নাকি তার ভাইয়ের মাথা কেটে মাথাটা একটা জলাশয়ে ফেলে দেয়। মেদুসে নামে একটি যুদ্ধজাহাজ হারিয়ে যায় এবং সেটি খুঁজে বার করার এক সরকারি তদন্ত শুরু হয়। এ বছর কর্নেল মেলভেস মিশরে পালিয়ে গিয়ে মুসলমান হয়ে সুলেমান পাশা উপাধি ধারণ করে। এ বছর মঁসিয়ে কেঁতে লিঞ্চ একটা বড় কাজ করেন। ১৮১৪ সালের ১২ মার্চ তারিখে তিনি বোর্দো শহরের মেয়র হওয়ার পর শহরটাকে ডিউক দ্য অ্যাঙ্গুলিমের হাতে তুলে দেন। এই বছর অ্যাকাডেমি ফ্রাঁসোয়া এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। তার বিষয়বস্তু ছিল পাণ্ডিত্য থেকে প্রাপ্ত সুখ। ক্লেয়ার দ্য আলবে আর মালেক আদেল এই দুটি বিখ্যাত গ্রন্থের জন্য মাদাম কত্তিনকে সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখিকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইনস্টিটিউট দ্য ফ্রান্স থেকে নেপোলিয়ঁন বোনাপার্টের নামটি বাদ দেওয়া হয়। অ্যাঙ্গুলিমেতে এক নৌবাহিনীর কলেজ স্থাপিত হয়। অ্যালিমের ডিউক নৌবাহিনীর প্রধান হিসেবে শহরটিকে এক প্রসিদ্ধ সমুদ্রবন্দরে পরিণত করা চেষ্টা করেন, কারণ তার ধারণা ছিল তা না হলে রাজতন্ত্রের মর্যাদা অপমানিত হবে। নেতা ও জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদ তখনও ছিল। রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন কাফে লেমক্লিনের লোকেরা রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিল এবং কাফে ভেলয়ের লোকেরা বুর্বনদের সমর্থক ছিল। তবে সব বুদ্ধিজীবী ও বিচক্ষণ ব্যক্তিরা এ বিষয়ে একমত ছিলেন যে রাজা অষ্টাদশ লুই এক সনদের মাধমে চিরতরে বিপ্লবের অবসান ঘটিয়েছেন। রাজতন্ত্রকে সুদৃঢ় করার জন্য দক্ষিণপন্থীরা নানারকম পরিকল্পনা রচনা করার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। দক্ষিণপন্থীরা প্রায়ই বলতেন উগ্র রাজতন্ত্রী মতবাদের জন্য আমাদের বেকলের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। তবে আবার সেন নদীর ধারে তুলিয়েরের প্রাসাদশীর্ষে মিলিত হয়ে কাউন্ট দার্নয়ের একদল সার্থক ষড়যন্ত্রের জল্পনা-কল্পনা করতেন। বিবাহবিচ্ছেদ প্রথার উচ্ছেদ করা হয়। সমস্ত উচ্চ বিদ্যালয়গুলোকে কলেজের মর্যাদা দেওয়া হয়। অভিনেতা পিকার্দ একাডেমির সদস্য নির্বাচিত হয়, নাট্যকার মলিয়ের যা কোনওদিন পারেননি। থিয়েটার দ্য লোসেওনে কিদার্দ লে দিউ ফিলবার্ত নাটকে নিয়মিত অভিনয় করতেন। এ বছর সবাই একবাক্যে বলতে থাকে মঁসিয়ে শার্লক লয়জেঁ এ শতাব্দীর সবচেয়ে সেরা প্রতিভাধর ব্যক্তি হয়ে উঠবেন। তবে ঈর্ষাকাতর ব্যক্তিরা প্রায় বলতেন, লয়জে যখন আকাশে উড়ছেন, তাঁর পা দুখানি মাটিতেই আছে। যে দার্শনিক সেন্ট সাইমনের কথা লোকে জানতই না, তিনি হঠাৎ বিখ্যাত হয়ে ওঠেন, তিনি বিজ্ঞান একাডেমির সদস্য হন। ইংরেজ কবি লর্ড বায়রন ফ্রান্সে পরিচিত উঠে খ্যাতি লাভ করতে থাকেন। মঁসিয়ে জেনাভে পুলিশের বড়কর্তার পদ লাভ করলে ফবুর্গের অভিজাত সমাজ তাঁর ধর্মাচরণের জন্য তাঁকে সমর্থন করে। দু জন নামকরা সার্জেন এ কোন দ্য মেডিসিনের সভাকক্ষে খ্রিস্টের ঐশ্বরিকত্ব নিয়ে বিতর্কে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বিতর্ককালে আবেগের উত্তাপে তারা পরস্পরের প্রতি ঘুষি পাকাতে থাকেন। তাঁদের একজন কুভিয়ের একই সঙ্গে প্রকৃতি জগৎ ও বাইবেলের জেনেসিসের প্রতি তার আনুগত্য ও শ্রদ্ধা দেখান। একই সঙ্গে তিনি ধর্মশাস্ত্র আর ফসিল বা জীবাশ্মের গুরুত্ব স্বীকার করেন এবং সেই সঙ্গে যে কোনও লুপ্ত বৃহদাকার প্রাণীর থেকে মোজেসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করেন। কাউন্ট সার্তয়কে নোতার দ্যমে প্রবেশ করতে দেখে একজন লোক বলে ওঠে, যেদিন আমি বোনাপার্ট আর তালমাকে হাত ধরাধরি করে বল সভেজে ঢুকতে দেখি সেদিনটা কী অভিশপ্ত!’ এই কথা বলার জন্য লোকটার দুমাস কারাদণ্ড হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে। নেপোলিয়ঁনের সামনে যারা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গা-ঢাকা দেয় তারা আবার প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসতে থাকে। যারা একদিন যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষে যোগদান করে, তারা সম্মান ও পুরস্কার লাভ করতে থাকে। যারা একদিন ছিল রাজতন্ত্রের বিরোধী তারা আবার দৃঢ়ভাবে প্রকাশ্যে রাজতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য দেখাতে থাকে।

এই হল ১৮১৭ সালের মোটামুটি এক চিত্র। লোকে এখন এসব কথা প্রায় সব ভুলে গেছে। এইসব ছোটখাটো ঘটনা বাতিল করে দিয়ে ইতিহাস বড় বড় ঘটনা নিয়ে মত্ত হয়ে থাকে। কিন্তু মানুষের জীবনকাহিনীতে এই আপাততুচ্ছ ছোটখাটো ঘটনারও মূল্য আছে। ইতিহাসস্বরূপ বিশাল বনস্পতির শাখা-প্রশাখায় যেসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা পাতার মতো বিরাজ করতে থাকে তারা কেউ মৃত্যুহীন নয় একেবারে। এক একটি বছরের উপাদানেই শতাব্দীর বিশাল মুখমণ্ডলটি রচিত হয়।

১৮১৭ সালে প্যারিসের চারজন যুবক হাস্যকৌতুকে বিশেষ নাম করে।

.

তুলুজ, লিমোজে, ক্যাহর আর মঁতাবাঁ থেকে চারজন ছাত্র প্যারিসে পড়তে আসে। তারা ছিল বছর কুড়ি বয়সের সাধারণ যুবক। মোটামুটি ধরনের দেখতে। তাদের সম্বন্ধে ভালো বা মন্দ, পণ্ডিত বা মূর্খ, বুদ্ধিমান বা বোকা কোনওটাই ঠিকমতো বলা যায় না। তাদের স্বভাবের সঙ্গে স্ক্যান্ডিনেভিয়া আর ক্যালিডোনিয়া অঞ্চলের অধিবাসীদের স্বভাবের একটা মিল ছিল। তাদের চালচলন ছিল অস্কারসুলভ, ইংরেজ ভাবাপন্ন তখনও হয়ে ওঠেনি।

তুলুজ থেকে আসা যুবকের নাম ছিল ফেলিক্স থোলোমায়েস, ক্যাহরের যুবকের নাম ছিল লিস্তোলিয়ের, লিমোজে থেকে যে যুবক এসেছিল তার নাম ছিল ফেমিউল আর মঁতাবাঁর যুবকের নাম ছিল ব্ল্যাকিভেল। যুবকদের প্রত্যেকেরই একজন করে প্রেমিকা ছিল। ব্ল্যাকিভেল ভালোবাসত ফেবারিতেকে। ফেবারিতে আগে ইংল্যান্ডে বাস করত। লিস্তোলিয়ের ভালোবাসত ডালিয়াকে। তার প্রিয় ফুলের এই নামটা সে নিজে পছন্দ করে ধারণ করে। ফেমিউল ভালোবাসত জেফিনেকে। অনেকে আবার তাকে জোশেফাইন বলে ডাকত। থোলোমায়েস ভালোবাসত ফাঁতিনেকে। তার সোনালি চুলের জন্য লোকে তাকে লা ব্লক বা সুন্দরী বসে ডাকত।

ফেবারিতে, ডালিয়া, জেফিনে আর ফাঁতিনে–এই চারজন মেয়েরই মোহিনী শক্তি ছিল। তারা সব সময় চকচকে পোশাক পরত, গাঁয়ে গন্ধদ্রব্য ব্যবহার করত। তাদের। মুখগুলো হাসিখুশিতে ভরা থাকত। তবে তাদের দেখলেই বোঝা যেত তারা আগে দর্জির কাজ করত এবং সূচিশিল্পের কাজ তখনও ছাড়েনি তারা। তারা এখন প্রেমে পড়লেও তাদের আগেকার কর্মজীবনের শান্ত স্র একটা ভাব তাদের চোখে-মুখে ফুটে ছিল তখনও। নারীদের অধঃপতন শুরু হলেও তাদের চরিত্রের ধাতুর মধ্যে একটা পবিত্রতার বীজ রয়ে যায় এবং এই মেয়েগুলোরও তাই ছিল। এই মেয়েগুলোর মধ্যে যে সবচেয়ে ছোট ছিল তাদের সবাই ‘বেরি’ বলে ডাকত। আর যে সবচেয়ে বড় ছিল বয়সে তাকে সবাই ‘বিগ সিস্টার বা বড় বোন’ বলত। বড় বোনের বয়স ছিল তেইশ। এদের মধ্যে যে তিনজন বড় ছিল তারা ছিল অনেক অভিজ্ঞ, বেপরোয়া এবং প্রেমের ব্যাপারে অভ্যস্ত আর সুন্দরী ফাঁতিনে প্রথম প্রেমের অভিজ্ঞতা জীবনে প্রথম অর্জন করছিল এবং তার আস্বাদ অনুভব করছিল।

ডালিয়া, জেফিনে আর ফেবারিতের জীবনে একাধিক প্রেমের অভিজ্ঞতা ছিল। আগে তাদের জীবনে তাদের প্রেমকাহিনীর নায়ক হিসেবে যে তিন জন যুবক আসে তারা হল অ্যাডলেফ, আলফোনসে আর গুস্তভ। দারিদ্র্য আর চটুল প্রেমাভিনয় সুন্দরী খেটে খাওয়া শ্রমিক মেয়েদের এক অপ্রতিরোধ্য প্রলোভন হিসেবে এসে তাদের জীবনটাকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। দারিদ্র্য তাদের খোঁচা দেয়, আর তার পীড়ন তাদের কুপথে ঠেলে দেয়। প্রেম তাদের তোষামোদের পথে নিয়ে যায়। এই দুই-এর আবেদনের কাছে তারা অসহায় এবং তাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারে না তারা। যে প্রেমের ফুল তাদের উপর ছুঁড়ে দেওয়া হয় তা পরে পাথর হয়ে তাদের আঘাত করে। এইভাবে তারা নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনে। যে আশা আপাতগৌরবময় অথচ এক দুর্বোধ্য ছলনায় জটিল, সে আশার মোহ তাদের জীবনের পথ থেকে সরিয়ে দূরে নিয়ে যায়।

এদের মধ্যে ফেবারিতে কিছুকাল ইংল্যান্ডে থাকায় জেফিনে আর ডালিয়া তাকে খাতির করত। ছোটবেলা থেকেই তার একটা বাড়ি ছিল। তার বাবা ছিলেন গণিতের শিক্ষক। অহঙ্কারী আত্মম্ভরী এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। যৌবনে একটি মেয়ের প্রেমে পড়েন। কিন্তু বিয়ে করেননি তাকে। ফেবারিতের জন্ম হয় তারই গর্ভে। ফেবারিতের বাবার বয়স বাড়লেও নারীলোলুপতা কমেনি। তার বাবার কাছে থাকত না ফেবারিতে। মাঝে মাঝে দেখা করতে যেত। ফেবারিতে একবার তার বাড়িতে থাকাকালে কোনও এক সকালে রক্তচক্ষু এক বয়স্ক মহিলা তার ঘরে ঢুকে তাকে বলে, তুমি জান আমি কে? আমি তোমার মা। মহিলাটি ঘরে ঢুকে নিজের হাতে খাবার বার করে খেয়ে একটা তোক নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মহিলাটি খুব বদমেজাজি ছিল এবং ফেবারিতের সঙ্গে একটা কথাও বলত না কখনও। সে তার বাবার কাছে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনত।

ডালিয়া ভালোবাসত লিস্তোলিয়েরকে। এই ভালোবাসা কিভাবে গড়ে ওঠে তা কেউ জানে না। তবে ডালিয়ার গোলাপি আঙুলের নখগুলো খুব সুন্দর ছিল। এই সুন্দর নখ নিয়ে কোনও মেয়ে কঠোর শ্রমের কাজ করতে পারে না। কাউকে ধার্মিক হতে হলে আগে তাকে হাত দুটিকে উৎসর্গ করতে হবে। সে হাতে কঠোর শ্রম করতে হবে। জেফিনে ফেমিউলকে প্রেমিক হিসেবে লাভ করে তার গায়ে পড়া ঢলে পড়া ভাব আর তোষামোদসূচক আদরের কথাবার্তার দ্বারা।

যুবকরা ছিল পরস্পরের কমরেড’ আর মেয়েরা ছিল পরস্পরের বান্ধবী। এইসব ক্ষেত্রে সাধারণ প্রেম আর বন্ধুত্ব পাশাপাশি সমান্তরালভাবে চলতে থাকে।

সদ্‌গুণ আর দর্শন দুটি ভিন্ন বস্তু। তার প্রমাণস্বরূপ বলা যেতে পারে ফেবারিতে, জেফিনে আর ডালিয়া ছিল দার্শনিক মনোভাবাপন্ন আর ফাঁতিনে ধর্মভাবাপন্ন আর গুণশীলসম্পন্না।

কিন্তু এই তো গেল ফাঁতিনের কথা, কিন্তু থোলোমায়েস? সলোমন হয়তো বলতেন প্রেম ধর্মেরই এক অঙ্গ। ফাঁতিনের কাছে সেটা তাই ছিল। তার জীবনে এটাই হল প্রথম প্রেম এবং একমাত্র প্রেম। সে ছিল প্রেমের দিক থেকে সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত। সব মেয়েদের মধ্যে একমাত্র তাকেই তার প্রেমিক আপনজন মনে করত এবং তাকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করত।

ফাঁতিনে ছিল সমাজের নিচুতলার মানুষদের একজন। অবজ্ঞা আর অপরিচয়ের অপরিসীম কলঙ্ক সারা গাঁয়ে মেখে সে উঠে আসে এক নারকীয় সমাজের গভীরতম প্রদেশ থেকে। তার জন্মপরিচয়, বাবা-মা কিছুই জানত না সে। মন্ত্রিউল সুর-মের নামক এক জায়গায় তার জন্ম হয়, কিন্তু কে তার বাবা-মা তা সে জানত না। তার কোনও ঘরবাড়ি ছিল না বলে বাড়ির দেওয়া কোনও নাম ছিল না। সে যুগে চার্চ ছিল না বলে জন্মের পর চার্চে তার কোনও ধর্মীয় নামকরণ হয়নি। সুদূর শৈশবে একদিন সে যখন রাস্তা দিয়ে খালি পায়ে ছুটতে ছুটতে কোথায় যাচ্ছিল তখন এক পথচারী তাকে দেখে তার নাম দেয় লা পেতিত ফাঁতিনে। সেই নামটাকেই সে মেনে নেয়, মাথার উপর ঝরে পড়া বৃষ্টিকে যেমন মেনে নেয় মানুষ। তার নাম লা পেতিত ফাঁতিনে নিজের সম্বন্ধে সে শুধু এইটুকুই জানে। এর বেশি কিছু না। তার বয়স যখন দশ তখন সে শহর ছেড়ে কাছাকাছি এক গাঁয়ের খামারে কাজ করতে যায়। পনেরো বছর বয়সে সে ভাগ্যান্বেষণে যায় প্যারিসে। সে ছিল দেখতে সুন্দরী। যতদিন পেরেছিল সে তার কুমারী জীবনের শুচিতাকে রক্ষা করে এসেছিল। তার মাথার চুলগুলো ছিল সোনালি আর দাঁতগুলো ছিল মুক্তোর মতো সাদা ঝকঝকে। সোনা আর মুক্তো দিয়ে ভূষিত ছিল সে। কিন্তু সোনা ছিল তার মাথায় আর মুক্তো ছিল তার দাতে।

বাঁচার জন্য কাজ করত সে এবং বাঁচার জন্যই সে যেন প্রেমে পড়ে। কারণ পেটের মতো অন্তরেরও একটা ক্ষিদে আছে। সে ক্ষিদে মেটাবার জন্যই সে যেন থোলোমায়েসের প্রেমে পড়ে।

থোলোমায়েসের কাছে ভালোবাসার ব্যাপারটা ছিল জীবনের এক চলমান ঘটনা। কিন্তু ফাঁতিনের কাছে ভালোবাসাই ছিল জীবন।

লাতিন কোয়ার্টারে যেখানে ছাত্রাবাস ছিল সেখানেই ফাঁতিনের প্রথম প্রেমের জন্ম হয়। তার স্বপ্নের ফুল সেখানেই প্রথম ফোটে। প্যানথিয়নের যে পাহাড়ে অনেক ছেলেমেয়ে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ ও মুক্ত হয় সে পাহাড়ে কিছুদিনের জন্য থোলোমায়েসের কাছ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল ফাঁতিনে। কিন্তু তবু সে পাহাড় থেকে থেলোমায়েসকে দেখার চেষ্টা করত। অনেক সময় মানুষ ছুটে পালিয়ে যায় কাউকে অনুসরণ করার জন্য। ফাঁতিনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।

চারজন যুবকের মধ্যে থোলোমায়েস ছিল সবচেয়ে প্রাণবন্ত আর হাসিখুশিতে ভরা।

ছাত্র হিসেবে থোলোমায়েসের চালনচলন ছিল পুরনো ধাঁচের। সে ছিল ধনী পরিবারের ছেলে। তার বার্ষিক আয় চার হাজার ফ্রাঁ। তার বয়স ছিল তেইশ। কিন্তু এই বয়সেই তার গায়ের চামড়ায় কোঁচকানো দাগ পড়েছিল। মাথার একটা জায়গায় টাক পড়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে কিছুই মনে করত না সে। সে বলত, তিরিশ বছরে টাক পড়েছে, চল্লিশ বছরে হাঁটু গেড়ে গেড়ে চলতে হবে। তার হজমশক্তি ভালো ছিল না। একটা চোখে কম দেখত। কিন্তু তার এই বিগতপ্রায় যৌবনের জন্য কোনও দুঃখ না করে বরং তা নিয়ে আনন্দোচ্ছল হয়ে উঠত। তার ভাঙা দাঁত, পড়া চুল আর ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে সে নিজেই হাসি-তামাশা করত। মোট কথা, তার যৌবনহানির ব্যাপারটাকে হাসিমুখে সানন্দে মেনে নিয়েছিল সে। সে একটা নাটক লিখেছিল। কিন্তু বদেভিলের থিয়েটার সে নাটক মঞ্চস্থ করতে চায়নি। মাঝে মাঝে কবিতা লিখত সে। তাছাড়া তার চারপাশের সবাইকে ছোট ভাবত। কারও কোনও গুণকে স্বীকার করত না। তার মাথায় টাক ছিল আর সবার সব কিছু সমালোচনা করত বলে সে সহজেই নেতা হয়ে গিয়েছিল যুবকদলের। সবার ওপর প্রভুত্ব করত।

একদিন থোলোমায়েস তার বন্ধুদের আড়ালে এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে তাদের বলল, প্রায় এক বছর ধরে তিনে, জেফিনে আর ফেবারিতে তাদের একবার চমক লাগিয়ে দেবার জন্য বলছে আমাদের। আমরাও তাদের তা দেব বলে কথা দিয়েছি। তারা কথাটা আমাদের বরাবর বলে আসছে। বিশেষ করে আমাকে। নেপলস-এর মেয়েরা সেন্ট জেভিয়েরকে একবার বলেছিল, কই হলুদমুখো, তোমার মাছ দেখাও। তেমনি ওরাও আমাকে বলে, কই খোলোমায়েস, তোমার চমক কোথাও। তা দেখাও। এখন আমরা বাড়ি থেকে বাবা-মা’র চিঠি পেয়েছি। দু’দিক থেকেই আমরা বিব্রত। আমার মনে হয় এবার আমাদের সময় এসেছে। এখন ব্যাপারটা আমাদের ভেবে দেখতে হবে।

থোলোমায়েস এবার তার গলার স্বরটা নিচু করে তাদের কী বলতেই তারা সবাই জোর হাসিতে ফেটে পড়ল। ব্ল্যাকিভেল চিৎকার করে বলে উঠল, চমৎকার পরিকল্পনা!

পরদিন ছিল রবিবার। চারজন যুবক আর চারজন যুবতী এক প্রমোদভ্রমণে বেরিয়ে গেল।

.

আজ হতে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে কয়েকজন ছেলেমেয়ে মিলে কোনও গ্রামাঞ্চল দিয়ে বেড়াতে গেলে কী ধরনের ব্যাপার হত তা আজকের দিনে কল্পনা করা কঠিন। আজকাল প্যারিস শহরের প্রান্তে বেড়াতে যাবার মতো কোনও গ্রামাঞ্চল নেই। আজকাল ঘোড়ার সেই ডাকগাড়ির পরিবর্তে লোকে রেলগাড়িতে চড়ে অথবা জলপথে স্টিমবোটে করে বাইরে যায়। ১৮৬২ সালে সারা ফ্রান্সের মধ্যে প্যারিসই ছিল একমাত্র শহর, আর সব শহরতলি।

আটজন ছেলেমেয়ে শহর থেকে দূর গ্রামাঞ্চলে গিয়ে তখনকার দিনে যত রকমের গ্রাম্য আমোদ-প্রমোদ প্রচলিত ছিল তাতে স্বেচ্ছায় গা ঢেলে দিয়ে মত্ত হয়ে উঠল। আর গ্রীষ্মের ছুটি সবে মাত্র শুরু। উষ্ণ উচ্ছৃঙ্খল গ্রীষ্মের দিন। আগের দিন চারজন মেয়ের পক্ষ থেকে থোলোমায়েসকে একখানি চিঠি লিখে পাঠায় ফাঁতিনে। কারণ সে-ই একমাত্র লিখতে পারত। তাতে লেখে ‘সেই বড় চমকের জন্য খুব সকালে উঠতে হবে।’

সেদিন তারা সকাল পাঁচটায় উঠেছিল। তারা ঘোড়ার গাড়িতে করে প্রথমে সেন্ট ক্লাউতে গিয়ে পৌঁছয়। সেখানে জল দেখে তারা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। তেতিনয়েরে তারা প্রাতরাশ খেয়ে ইচ্ছামতো দৌড়ঝাঁপ করে বেড়াতে থাকে। তারা পুকুরে সাঁতার কাটে, গাছে চড়ে, জুয়ো খেলে, ফুল তোলে, ক্রিমপাফ কেনে এবং গাছ থেকে আপেল পেড়ে খায়।

পিঞ্জরমুক্ত পাখির মতো মেয়েরা হাসিখুশিতে উজ্জ্বল হয়ে বেড়াতে থাকে। তারা পুরুষদের টীকা-টিপ্পনী কেটে ঠাট্টা-তামাশা করতে থাকে। এ হল প্রথম যৌবন-জীবনের উন্মত্ততা, কতকগুলি অবিস্মরণীয় মুহূর্তের সমষ্টি, এ যেন কতকগুলি বড় বড় মাছির রঙিন ডানার উচ্ছ্বসিত কম্পন। প্রথম যৌবনের এইসব কথা কি তোমাদের কারও মনে নেই? তোমরা কি কেউ কখনও কোনও সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে হাত ধরাধরি করে ঝোপে-ঝাড়ের বা কোনও জলাশয়ের ধারে বেড়াওনি? পথের ছোটখাটো বাধা-বিপত্তি কখনও এইসব প্রমোদাভিলাষী দলের কারও মনে কোনও বিরক্তি উৎপাদন করতে পারেনি। ফেবারিতে একবার অবশ্য তাদের সাবধান করে দিয়েছিল, পথে ওই যে খোলাহীন শামুক দেখা যাচ্ছে, এটা হচ্ছে বৃষ্টি আসার লক্ষণ।

মেয়ে চারজনের দেহসৌন্দর্য আর বেশভূষা ছিল সত্যিই মনোমুগ্ধকর। তারা সেন্ট ক্লাউডে বাদামগাছের তলায় সকাল ছ’টার সময় যখন বেড়াচ্ছিল তখন একজন বয়স্ক কবি তাদের দেখে অবাক হয়ে যান। মেয়েদের মধ্যে সবার বড় এবং ব্ল্যাকিভেলের বান্ধবী তেইশ বছরের ফেবারিতে সাবার আগে আগে গাছগুলোর তলা দিয়ে যাচ্ছিল। যত সব খাল-নালা ডিঙিয়ে ঝোঁপঝাড়ের পাশ কাটিয়ে একরকম নাচতে নাচতে পথ হাঁটছিল আর সবাইকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। জেফিনে আর ডালিয়া দু জনে ঘন হয়ে পাশাপাশি পথ হাঁটছিল। একে অন্যের সম্পূরক হিসেবে ইংরেজি আদব-কায়দা দেখাচ্ছিল। তখন মেয়েদের মাথার চুল কুঞ্চিত করার রীতি প্রথম প্রচলিত হয়। বায়রন। সুলভ এক ভাবময় বিষাদে স্বেচ্ছায় গা ঢেলে দেওয়ার এক রীতিও শিক্ষিত মেয়েদের সমাজে প্রচলিত ছিল। পরে এ বিষাদ ইউরোপের শিক্ষিত পুরুষদের পেয়ে বসে। জেফিনে আর ডালিয়া তাদের পোশাক আঁট করে পরেছিল। লিস্তোলিয়ের আর ফেমিউল তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সম্বন্ধে কী সব আলোচনা করছিল। তারা ফাঁতিনেকে আইনের অধ্যাপক মঁসিয়ে ডেলভিনকোট ও মঁসিয়ে ব্লোদের মধ্যে কী নিয়ে ঝগড়া হয় তা বোঝাচ্ছিল। ব্ল্যাকিভেল সমানে ফেবারিতের গায়ের শালটা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। যেন এই কাজের জ্যই তার জন্ম হয়েছে পৃথিবীতে।

দলের নেতা হিসেবে তখনও সবার পেছনে ছিল থেলোমায়েস। সে রসিক ছিল, কিন্তু তার রসিকতার মাঝে নেতৃত্বসুলভ এক গাম্ভীর্য ছিল। তার কথা সবাই মানতে বাধ্য হত। তার পোশাক বলতে ছিল একটা ঢিলা পায়জামা, আর একটা শার্ট। হাতে ছিল একটা ছড়ি আর মুখে একটা চুরুট। তার সঙ্গীরা বলাবলি করত, ওই পায়জামা পরলে থোলোমোয়েসকে সত্যিই অসাধারণ দেখায়।

ফাঁতিনে ছিল আনন্দের প্রতিমূর্তি। তার সাদা সুন্দর দাঁতগুলো যেন হাসির জন্য সৃষ্টি হয়েছিল। তার হাতে সব সময় থাকত সাদা ফিতেওয়ালা একটা খড়ের তৈরি বনেট। তার মাথায় সোনালি চুলের রাশগুলো প্রায়ই ছড়িয়ে পড়ত মাথার চারদিকে। তার ঠোঁট দুটো সব সময় ভোলা থাকত আনন্দের আবেগে। তার মুখের কোণ দুটো যেমন একদিকে কোনও উদ্ধত যুবকের অগ্রপ্রসারী প্রেমোচ্ছ্বাসকে আহ্বান করছিল অন্যদিকে তেমনি তার চোখের বড় বড় অবনত পাতাগুলো এক অব্যক্ত বিষাদ ছড়িয়ে সেই ঔদ্ধত্যকে খর্ব করার প্রয়াস পাচ্ছিল। তার পোশাক ও বেশভূষার মধ্যে একই সঙ্গে এক মিষ্টি গানের ছন্দ আর শীতল আগুনের শিখা অদৃশ্য অবস্থায় বিরাজ করছিল অপর তিনজনের পোশাক মাঝামাঝি ধরনের ছিল। তাতে কোনও পারিপাট্যের আতিশয্য ছিল না। সব মিলিয়ে ফাঁতিনের চেহারাটার মধ্যে একই সঙ্গে এক সংযমের শাসন আর উদ্ধত প্রেমের ছলনা লুকিয়ে ছিল। অনেক সময় মানুষের নির্দোষিতার মূলে থাকে কৃত্রিমতার একটা প্রয়াস, জোর করে ভালো হবার একটা সচেতন চেষ্টা।

হাসিখুশিতে উজ্জ্বল মুখ, সুন্দর চেহারা, ভারী ভারী পাতাওয়ালা নীল চোখের গভীর চাউনি, ঈষৎ ধনুকের মতো বাঁকা পা, সুঠাম গঠন, সাদা ধবধবে গায়ের মাঝে দু’একটা নীল শিরার উঁকিঝুঁকি, যৌবনলাবণ্যপুষ্ট গাল, ঈজিয়ার জুনোর মতো ঋজু ঘাড়, জামার ফাঁকে ফাঁকে দেখতে পাওয়া কোনও এক নামকরা ভাস্করদের গঠিত মূর্তির মতো সুন্দর দুটো কাঁধ–এই হল ফাঁতিনের দেহের মোটামুটি বিবরণ। আত্মসচেতনতার দ্বারা সংযত, আনন্দোশ্রুল্লতায় সঞ্জীবিত এক সুন্দর প্রতিমা।

আত্মসচেতন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হলেও নিজের সৌন্দর্য সম্বন্ধে কোনও অহঙ্কার ছিল না ফাঁতিনের। কোনও সৌন্দর্যের উপাসক যিনি সকল দেহসৌন্দর্যের মধ্যে এক নিখুঁত পরিপূর্ণতার সন্ধান করেন তিনি হয়তো ফাঁতিনেকে দেখে তার চেহারার মধ্যে কোনও কোনও খুঁত ধরার চেষ্টা করবেন। আবার তিনি হয়তো তার মধ্যে এক প্রাচীন সৌন্দর্যরীতি ও সামঞ্জস্যের সুষমা খুঁজে পাবেন। সৌন্দর্যের দুটি দিক আছে–রূপাবয়ব আর ছন্দ। রূপাবয়ব হচ্ছে আদর্শ আঙ্গিক বা আধার, আর ছন্দ হচ্ছে গতি।

আমরা আগেই বলেছি ফাঁতিনে ছিল আনন্দের প্রতিমূর্তি। কিন্তু সেই সঙ্গে শালীনতাবোধ, নারীসুলভ গুণশীলতারও কোনও অভাব ছিল না তার মধ্যে। কেউ যদি খুঁটিয়ে তাকে দেখত তা হলে বুঝতে পারত তার যৌবনের উন্মাদনার অন্তরালে নববসন্ত আর ফুল্লকুসুমিত এক প্রেমের ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আত্মস্বাতন্ত্রের এক অজেয় দুর্গও ছিল। জীবনে প্রথম প্রেমের ঘটনায় সে ক্ষণে ক্ষণে অনুভব করত এক অপার বিস্ময়ের চমক আর নির্দোষিতাজনিত এক অবুঝ আশঙ্কা, যে আশঙ্কার দ্বারা সাইককে ভেনাস থেকে সহজে পৃথক করা যায়। তার সরু সরু লম্বা আঙুলগুলো যেন কোনও কুমারী সন্ন্যাসিনীর মালার জপ করার ভঙ্গিতে মৃদু সঞ্চালিত হত, মনে হত সেগুলো যেন এক পবিত্র অগ্নিশিখার অন্তরালে ভস্মাচ্ছাদিত এক একটি স্বর্ণদণ্ড। যদিও থোলোমায়েসকে তার অদেয় কিছুই ছিল না, তবু সে মাঝে মাঝে যখন গম্ভীর হয়ে উঠত, যখন সংযমশাসিত কুমারীত্বের কঠোর একটা ভাব ফুটে উঠত তার চোখে-মুখে, গভীর অনমনীয় এক আত্মমর্যাদাবোধ আচ্ছন্ন করে ফেলত তাকে, যখন তার যৌবনজীবনের সকল আনন্দোচ্ছলতা ত্যাগ আর আত্মনিগ্রহের অগ্রপ্রসারী আক্রমণে অভিগ্রস্ত হয়ে পড়ত সহসা তখন দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে উঠত যে কেউ। সেই মুহূর্তে তাকে দেখে মনে হত সে যেন রোষকষায়িতলোচনা নিষ্করুণ কোনও দেবী। তখন তার কপাল, নাক ও চিবুকে এমন সব রেখা ফুটে উঠত যাতে তার সমগ্র মুখমণ্ডলের ভারসাম্য নষ্ট হত, আর সঙ্গে সঙ্গে তার নাক আর উপরকার ঠোঁটের মাঝখানে অপরিদৃশ্যপ্ৰায় এমন এক সুন্দর কুঞ্চন দেখা দিত যা সতীত্বের এক দুর্বোধ্য নিদর্শন, যা দেখে একদিন, আইকোনিয়ামের ধ্বংসাবশেষের মাঝে বার্বাডোসা ডায়েনার প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়েছিল।

অনেক সময় ভালোবাসা ভুল হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু ফাঁতিনের নিষ্পাপ মনের সততা সে ভুলকে অতিক্রম করে চলছিল স্বচ্ছন্দে।

.

সেদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উজ্জ্বল সূর্যালোকের প্লাবন বয়ে যেতে লগাল। মনে হচ্ছিল সমস্ত প্রকৃতি যেমন ছুটির আনন্দে ঢলে পড়েছে। সেন্ট ক্লাউডের প্রান্তর থেকে ফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল। নদীতীরের বাতাসে গাছপালার শাখাগুলো দুলছিল। মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে বেড়াচ্ছিল ফুলে ফুলে। যুঁই, ওট, মিলকয়েল প্রভৃতি ফুলের উপর প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছিল দল বেঁধে। এদিকে ফ্রান্সের রাজার পার্কটাকে কোথা থেকে একদল যাযাবার পাখি এসে দখল করে বসেছিল।

প্রকৃতির এই সুন্দর পরিবেশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল যেন আটজন যুবক-যুবতী। তারা নাচছিল, গান করছিল, প্রজাপতিদের পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছিল, বনফুল তুলে আনছিল, যখন-তখন এ ওকে চুম্বন করছিল। একমাত্র ফাঁতিনে ছিল এর ব্যতিক্রম। এক সলজ্জ স্বপ্নবরণের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে সে হয়তো তার প্রেমের কথা ভাবছিল। ফেবারিতে তাকে একবার বলল, তুমি কারও পানে না তাকালেও তোমাকে সবাই সব সময় দেখে।

এই হল জীবনের আনন্দ। ক্ষণপ্রণয়িত এক আনন্দের তাৎক্ষণিক আবেশে মত্তবিভোর চারজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা পর্যাপ্ত আলো আর উষ্ণতায় মণ্ডিত এক উদার প্রকৃতির প্রাণবন্ত আহ্বানে সাড়া দিতে ছুটে এসেছে এখানে। হয়তো কোনও বিস্মৃত অতীতে কোনও এক পরী এইসব মাঠ-বনকে শুধু যুবক-যুবতীর অন্তরের সামনে নিজেদের উন্মুক্ত করে দেবার জন্য আদেশ দিয়ে গেছে। সেই পরীকে অশেষ ধন্যবাদ, তার জন্যই আজও মুক্ত আকাশের তলে বৃক্ষছায়া দ্বারা আলিঙ্গিত প্রান্তরে প্রেমিক-প্রেমিকারা দল বেঁধে ছুটে আসে। যতদিন আকাশ, প্রান্তর আর গাছ থাকবে, যতদিন নীল আকাশ থেকে অবারিত আলোর চুম্বন ঝরে পড়বে এই প্রান্তরে, যতদিন এইসব বৃক্ষরাজি তাদের স্পর্শশীতল ছায়ার দ্বারা আলিঙ্গন করবে এইসব প্রান্তরকে ততদিন এখানে ছুটে আসবে এই ধরনের প্রেমিক-প্রেমিকার অসংখ্য দল।

এইজন্যই হয়তো বসন্তকালের এত জনপ্রিয়তা। সামন্ত থেকে বালকভৃত্য, জমিদার থেকে চাষি-ক্ষেতমজুর, সভাসদ থেকে সাধারণ শহরবাসী সকলেই এই বসন্তরূপ মায়াবিনী পরীর দ্বারা বিছিয়ে দেওয়া মোহের আবেশে আচ্ছন্ন হয়। কোর্টের সামান্য মুহুরিও যেন স্বর্গের দেবতা হয়ে ওঠে। তারা হাসির স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়, বাতাসের মধ্যে কিসের যেন খোঁজ করে বেড়ায় পাগলের মতো, যেন এক রহস্যময় রূপান্তর ঘটে তাদের প্রেমবিগলিত অন্তরে। ঘাসের উপর হৈ-হুল্লোড় করতে করতে ছুটে বেড়ানো, পরস্পরের কোমর ধরাধরি করা, গানের ছন্দভরা অর্ধস্ফুট কথার গুঞ্জন, পরস্পরের মুখে মুখে চেরি ফলের আনাগোনা আরও কত কী যে সব করে তারা, তার ইয়ত্তা নেই। এই সময় মেয়েরা হাসিমুখে বিলিয়ে দেয় নিজেদের এবং ভাবে এই সুখ চিরস্থায়ী হবে। দার্শনিক, কবি ও শিল্পীরা প্রেমিক-প্রেমিকাদের এই উন্মাদসুলভ আবেগ আর আচরণের একটা মানে খোঁজার চেষ্টা করেন, কিন্তু বুঝতে না পেরে হতবুদ্ধি হয়ে যান। লানস্ৰেত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষদেরও আকাশে উড়তে দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। দিদেররা সব হালকা প্রেমকেই দু হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানান।

আটজন যুবক-যুবতী প্রাতরাশের পর রাজার বাগান দেখতে গেল। সে বাগানে ভারত থেকে একটি বিরল গাছের চারা এসেছে। তার নামটা ভুলে গিয়েছি। তা দেখার জন্য সমস্ত প্যারিসের লোক ভিড় করেছে সেন্ট ক্লাউডে। গাছটা লম্বা একটা সুন্দর ঝোঁপের মতো দেখতে যার কোনও ডালপালা বা পাতা নেই, যার সুতোর মতো শাখাগুলোতে ছোট ছোট সাদা ফুল ফোটে। মনে হয় সাদা ফুলে ভরা একমাথা চুল। একরাশ মুগ্ধ জনতার ভিড় গাছটাকে ঘিরে ছিল সব সময়।

থোলোমায়েস প্রস্তাব করল, গাধার পিঠে চড়ে খানিকটা বেড়াব আমরা।

তখন কয়েকটা গাধা জোগাড় করে বানব্রে থেকে আইসি গেল ওরা।

আইসিতে একটা ঘটনা ঘটল। পার্কের মতো যে ঘেরা বাগানটা ওরা দেখতে গেল সেটা তখন সৈন্যবিভাগের খাবার পরিবেশনকারী কুঁগুই-এর অধীনে ছিল। বাগানের লোহার গেটটা তখন ভোলা ছিল। ওরা গেট দিয়ে পার্কের মধ্যে প্রথমে অ্যাঙ্কোরিতের প্রতিমূর্তিটা দেখল। তার পর সেই বিখ্যাত আয়নার ঘরটা দেখল যে ঘরে ঢুকলে সবারই মুখগুলো বিকৃত দেখায়। এরপর ওরা বাদামগাছে ঘেরা বড় দোলনাটায় পালাক্রমে দুলল। দোলনায় দুলবার সময় হাসিতে ফেটে পড়ছিল ওরা। তুলু থেকে আসা থোলোমায়েসের স্বভাবটায় স্প্যানিশ ভাবটা তখনও পুরোমাত্রায় ছিল। সে মনের সুখে একটা গান ধরল। গানটার অর্থ হল, আমি বাজাজ থেকে এসেছি। প্রেমই আমায় ডেকে এনেছে এখানে। আমার আত্মা এখন আমার চোখের তারায় এসে ফুটে উঠেছে, কারণ তুমি তোমার পা দেখাচ্ছ আমায়।

একমাত্র ফাঁতিনেই দোলনায় দুলল না।

ফেবারিতে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, আমি কোনও লোকের অহঙ্কার দেখতে পারি না।

গাধায় চড়ার শখ মিটলে ওরা একটা নৌকো ভাড়া করে পাসি থেকে ব্যারিয়ের দ্য লেতয়েনে গেল। ওরা সকাল পাঁচটায় বেরিয়ে সারাদিন এখানে-ওখানে ছোটাছুটি করছে। তবু ওরা ক্লান্ত হয়ে ওঠেনি। ফেবারিতে বলল, রবিবারে ক্লান্তি বলে কোনও কথা নেই। রবিবারে কেউ ক্লান্ত হয় না কখনও। ওরা রু বুর্জোর উঁচু জায়গাটায় দাঁড়িয়ে দূরে গাছপালার মাথায় শ্যাম্প এলিনার চূড়াটা দেখতে পেল।

ফেবারিতে মাঝে মাঝে বলছিল, কিন্তু সেই বিস্ময়ের চমকটা কোথায়?

থোলোমায়েস বলল, তোমাদের ধৈর্য ধরতে হবে।

.

পাহাড়ের চূড়োয় উঠতে গিয়ে এবার ওরা কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তখনও ওদের দুপুরের খাওয়া হয়নি। এবার ওরা সবাই খাবার কথা বলতে লাগল। তখন ওরা শ্যাম্প এলিসি’র বিখ্যাত রেস্তোরাঁ বম্বার্দার একটি শাখা হোটেল ক্যাবারে বম্বার্দায় খেতে গেল। হোটেলটা ছিল র‍্যু দ্য রিভেলিতে।

সেদিন রবিবার বলে হোটেলটায় ছিল দারুণ ভিড়। সব ঘর লোকে ভর্তি। ওরা একটা বড় অপরিচ্ছন্ন ঘর পেল। ঘরটার একপ্রান্তে পার্টিশান করা একটা ছোট ঘর ছিল। তার মধ্যে একটা বিছানা ছিল। ঘরের মধ্যে দুটো টেবিলের ধারে কয়েকটা চেয়ার ছিল। ওরা চারজন সেই চেয়ারগুলোতে বসল। দুটো ভোলা জানালা দিয়ে এলম গাছের ফাঁক দিয়ে নদী দেখতে পেল ওরা। তখন আগস্ট মাস। বিকাল সাড়ে চারটে বাজে। সূর্য সবেমাত্র অস্ত যেতে শুরু করেছে। টেবিলের উপর খাবার ও মদ দেওয়া হল। প্রচুর হৈ-হুল্লোড় করতে লাগল ওরা।

শ্যাম্প এলিসিতে তখনও সূর্যের আলো ছিল। জনাকীর্ণ পথে ধুলোর ঝড় উঠছিল। পথে অনেক ঘোড়ার গাড়ি যাওয়া-আসা করছিল। অ্যাভেনিউ দ্য নিউলি দিয়ে একদল সৈন্য চলে গেল। তাদের সামনে একদল বাদক জয়ঢাক বাজিয়ে যাচ্ছিল। তুলিয়েরের প্রাসাদের চূড়ার উপর উড়তে থাকা সাদা পতাকাটা অস্তম্লান সূর্যের ছটায় গোলাপি দেখাচ্ছিল। প্লেস দে লা কঙ্কর্দে তখন লোকের দারুণ ভিড়। সেই ভিড়ের মধ্যে অনেকে কোটের বোতামে সাদা ফিতেয় জড়ানো রুপোর ফুল খুঁজে বেড়াচ্ছিল। এখানে-সেখানে একদল করে ছোট ছোট মেয়ে দর্শকদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে বুর্বন গাইছিল।

রবিবারের পোশাক পরা অনেক শ্রমিক বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে ভিড় করেছে শহরের পথে। তাদের অনেকে মদ পান করছিল, কেউ কেউ ঘোড়ায় চেপে বেড়াচ্ছিল। সকলেই হাসিখুশিতে মেতে উঠেছিল। তখন দেশে শান্তি বিরাজ করছিল। রাজতন্ত্রীদের পক্ষে সময়টা ছিল বেশ নিরাপদ। পুলিশের বড়কর্তা কাউন্ট অ্যাঙ্গলে রাজার কাছে প্যারিসের শ্রমিক ও সাধারণ জনগণ সম্বন্ধে এক গোপন রিপোর্ট পেশ করেন। সে রিপোর্টে বলা হয়, মহাশয় সব দিক বিবেচনা করে দেখলে বোঝা যায়, এইসব জনগণ থেকে ভয়ের কিছু নেই। তারা যেমন উদাসীন তেমনি বিড়ালের মতো অলস। গ্রামাঞ্চলের নিচের তলায় মানুষরা কিছুটা বিক্ষুব্ধ আছে, কিন্ত প্যারিসের জনগণের মধ্যে কোনও বিক্ষোভ নেই। তাদের চেহারাগুলোও বেঁটেখাটো এবং তারা দু জনে একজন পুলিশের সমকক্ষ হতে পারে। রাজধানী প্যারিসের শ্রমিকশ্রেণির কাছ থেকে আমাদের ভয়ের কিছু নেই। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এই যে, গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে প্যারিস ও শহরতলির জনগণের চেহারা বিপ্লবের আগে যা ছিল তার থেকে অনেক খারাপ হয়ে গেছে। তারা মোটেই বিপজ্জনক নয়। এক কথায় তারা বড় উদাসীন, কোনও কিছুরই খেয়াল রাখে না।

কিন্তু কোনও পুলিশের বড়কর্তাই বিশ্বাস করে না যে বিড়ালও সিংহ হতে পারে। পুলিশের বড় কর্তারা যাই বলুক প্যারিসে অনেক কিছুই ঘটে। এটাই হচ্ছে প্যারিসের জনমতের রহস্য। তাছাড়া কিছুকাল আগে প্রজাতন্ত্রীরা এই বিড়ালদেরই স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে শ্রদ্ধার চোখে দেখত। এই ধরনের এক বিড়ালেরই এক বিরাট ব্রোঞ্জমূর্তি কোরিনথের মেন স্কোয়ারে পিরেউসের মিনার্ভার মূর্তির অনুকরণে দাঁড়িয়ে আছে। রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর পুলিশ প্যারিসের জনগণ সম্বন্ধে অতিমাত্রায় আশাবাদী হয়ে ওঠে। কিন্তু প্যারিসের সাধারণ জনগণ মোটেই ঢিলেঢালা বা উদাসীন প্রকৃতির নয়। ফরাসিদের কাছে প্যারিসের অধিবাসীরা গ্রিকদের কাছে এথেন্সের জনগণের মতো। উপর থেকে তাদের দেখে মনে হবে তাদের মতো এত ঘুমোতে কেউ পারে না, কেউ এত তাদের মতো উচ্ছৃঙ্খল এবং অলস প্রকৃতির নয়। কিন্তু এ ধারণা স্পষ্ট ভ্রান্ত। তারা উদাসীনও উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারে। কিন্তু যখন কোনও বৃহত্তর গৌরব অর্জনের জন্য তাদের ডাক পড়বে তখন এক প্রচণ্ড সংগ্রামশীলতায় আশ্চর্য ও অভাবনীয়ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠবে তারা। প্যারিসের কোনও একটা লোক হাতে একটা বর্শা পেলে সে ১০ আগস্টের যুদ্ধের অবতারণা করতে পারে আর যদি সে একটা বন্দুক পায় তা হলে অস্টারলিৎসের যুদ্ধ বাধিয়ে তুলতে পারে। এই প্যারিসের লোকই ছিল নেপোলিয়ঁনের সাম্রাজ্য বিস্তারের মূল শক্তি, তারাই ছিল বিপ্লবী দাঁতনের মূল ভিত্তি। লা পার্টির ডাকে তারা সেনাবিভাগে যোগ দেয় দলে দলে। স্বাধীনতার ডাকে তারা পদভরে রাজপথ ও ফুটপাতগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। সুতরাং সাবধান। রাগে তাদের মাথার চুল একবার খাড়া হয়ে উঠলে তারা এক মহাকাব্যসুলভ বীরত্ব লাভ করে, তাদের সামান্য জামাগুলো গ্রিক বীরের সামরিক পোশাক বা বর্মে পরিণত হয়। তাদের গণ-অভ্যুত্থান গদিন কোর্কের যুদ্ধের রূপ নেয়। যুদ্ধজয়ের ঢাকের শব্দে শহরের অলি-গলিতে বাস করা অধিবাসীরা এক মহাশক্তিতে সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে। বেঁটেখাটো লোকগুলোর চোখের দৃষ্টি ভয়ঙ্কর ভাব ধারণ করে। তাদের সংকীর্ণ বুকগুলো থেকে বেরিয়ে আসা নিঃশব্দ নিশ্বাসগুলো এক মত্ত প্রভঞ্জনের রূপ পরিগ্রহ করে দিগন্তপ্রসারী আল্পস পর্বতের চূড়াটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চায়। প্যারিসের এইসব ছোটখাটো লোকগুলোকে ধন্যবাদ, এদের দ্বারা সংঘটিত বিপ্লবই সেনাবাহিনীকে অনুপ্রাণিত করে সারা ইউরোপ জয় করে একদিন। তারা যুদ্ধের গানে আনন্দ পায়। সে গানের সুর আর ছন্দ তাদের প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খায়। কারমাগনোল’ গান গেয়ে তারা যোড়শ লুই-এর সিংহাসন উল্টে দেয় আর মার্সেলাই’ গান গেয়ে সারা পৃথিবীকে মুক্ত করতে পারে।

কোঁতে অ্যাঙ্গলের এই রিপোর্টের কথা বলে আমরা সেই আটজন যুবক-যুবতীর কাছে ফিরে যাব, যাদের আহারপর্ব বম্বার্দা হোটেলে সমাপ্তির পথে এগিয়ে চলেছিল।

.

টেবিলের কোনও আলোচনা আর প্রেমিকদের আলোচনা হাওয়ার মতোই অলীক আর বিলীয়মান। প্রেমিকদের আলোচনা বা কথাবার্তা হল কুয়াশা, টেবিলের আলোচনা ক্ষণবিলীন এক সুবাস।

ফেমিউল আর ডালিয়া গুনগুন করে গান গাইছিল। থোলোমায়েস মদ খাচ্ছিল। জেফিনে হো হো করে হাসছিল, আর ফাঁতিনের মুখে ছিল মৃদু হাসি। লিস্তোলিয়েরের হাতে সেন্ট ক্লাউডে কেনা কাঠের যে জয়ঢ়াকটা ছিল সেটা সে বাজাচ্ছিল।

ফেবারিতে তার প্রেমিকের দিকে তাকিয়ে বলল, ব্ল্যাকিভেল, আমি তোমাকে দারুণ ভালোবাসি।

এ কথায় ব্ল্যাকিভেল এক প্রশ্ন করে বসল, আমি যদি তোমাকে আর ভালো না বাসি তা হলে তুমি কী করবে ফেবারিতে?

ফেবারিতে বলল, আমি? ঠাট্টা করেও এসব কথা বলবে না তুমি। যদি তুমি আমাকে ভালো না বাস তা হলে আমি তোমাকে ছাড়ব না, তোমার পিছু পিছু ঘুরব, আমি তোমাকে মারব। তোমার চোখ দুটো উপড়ে ফেলব; তোমাকে গ্রেপ্তার করাব।

ব্ল্যাকিভেল যখন কথাটা শুনে পুরুষোচিত অহঙ্কার আর আত্মতৃপ্তির হাসি হাসছিল, ফেবারিতে তখন আবার বলল, তুমি কী ভেবেছ, অসভ্য কোথাকার! আমি চেঁচামিচি করব, পাড়ার সব লোককে জাগাব।

ব্ল্যাকিভেল এবার চেয়ারে হেলান দিয়ে আনন্দে চোখে দুটো বন্ধ করে কী ভাবছিল। ডালিয়া তখন খেতে খেতে ফেবারিতেকে চুপি চুপি কী একটা কথা জিজ্ঞাসা করল।

ডালিয়া বলল, সত্যি সত্যিই কি তুমি ওকে ভালোবাস?

ফেবারিতে হাতে কাঁটাটা তুলে নিয়ে তেমনি চাপা গলায় বলল, আমি ওকে মোটেই সহ্য করতে পারি না। ও বড় নীচ। আমি রাস্তার ওপারের একটা ছেলেকে ভালোবাসি। আমি কার কথা বলছি তুমি জান?

তাকে দেখলেই তুমি বুঝতে পারবে অভিনেতা হওয়ার জন্যই যেন জন্ম হয়েছে। তার। আমি অভিনেতাদের পছন্দ করি। রোজ রাত্রিতে সে বাড়ি ফিরে বাড়ির ছাদে গিয়ে এত জোরে গান গায় আর আবৃত্তি করে যে নিচের তলার সব লোক তা শুনতে পায়। সে একটা উকিলের কেরানি হিসেবে এখনই রোজ কুড়ি করে রোজগার করে। তার বাসা সেন্ট জ্যাকে একটা দলে সমবেত গান গাইত। ছেলেটা সত্যিই সুন্দর। সে আমাকে এত ভালোবাসে যে একদিন আমি যখন কেক তৈরি করার জন্য ময়দা মাখছিলাম তখন সে আমাকে বলল, তুমি যদি তোমার হাতের দস্তানা ছিঁড়ে দাও তা হলেও আমি তা খাব। একজন শিল্পীই এ কথা বলতে পারে। তার ব্যবহারটা সত্যিই বড় মিষ্টি। আমি তার জন্য পাগল। কিন্তু আমি ব্ল্যাকিভেলকে বলি আমি তাকে ভালোবাসি। আমি ভয়ঙ্কর মিথ্যাবাদী, তাই নয় কি?

ফেবারিতে কিছুক্ষণের জন্য থেমে আবার বলতে লাগল, আমার মনমেজাজ খুব খারাপ ডালিয়া। আমার জীবনে কোনও বসন্ত নেই, আছে শুধু বর্ষার অবিরল ধারা। যেন তার শেষ নেই। ব্ল্যাকিভেলের মনটা বড় ছোট, এদিকে বাজারে সব জিনিসেরই প্রচুর দাম। যেমন ধর মটরদানা, মাখন সব কিছু। যাই হোক, আমরা এখানে এসেছি, খাচ্ছি একটা ঘরে। ঘরের মধ্যে একটা বিছানা আছে। কিন্তু জীবনটা আমার কাছে বিতৃষ্ণ হয়ে গেছে।

.

দলের কেউ কেউ গান গাইছিল, কেউ কেউ আবার জোরে কথা বলছিল। ঘরের ভেতর চলছিল তুমুল হট্টগোল। থোলোমায়েস এবার সকলকে শান্ত করার চেষ্টা করল।

খোলোমায়েস বলল, এখন শান্ত হয়ে যুক্তির সঙ্গে কথা বল। এখন ভেবে দেখতে হবে জীবনে আমরা বড় হতে চাই কি না। হঠকারীর মতো যা-তা বলাতে আত্মশক্তিরই ক্ষয় হয়। ঘন ঘন মদ খেলে চিন্তাশক্তি বাড়ে না। তাড়াহুড়ো করে কোনও লাভ নেই দ্রমহোদয়গণ, এখন আমাদের এই আমোদ-প্রমোদের সঙ্গে মর্যাদাবোধের সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে, ক্ষুধার সঙ্গে সুবিবেচনার। বসন্তকাল থেকে আমরা একটা শিক্ষা পেতে পারি। বসন্ত যদি খুব তাড়াতাড়ি আসে এবং তাড়াতাড়ি খুব জোর গরম পড়ে যায় তা হলে অনেক ফলের ক্ষতি হয়। নিজের গরমে নিজেই পুড়ে ছারখানা হয়ে যায় বসন্ত। উদ্যমের আতিশয্য সুরুচিকে নষ্ট করে। অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো করে খাওয়াও ভালো হয় না। এ বিষয়ে রেনিয়ের আর তালিবাদ একমত।

বাকি সবাই একযোগে প্রতিবাদ করে উঠল।

ব্ল্যাকিভেল বলল, আমাদের বিরক্ত কর না থোলোমায়েস।

ফেমিউল বলে উঠল, অত্যাচারীরা নিপাত যাক, আজ রবিবার।

লিস্তোলিয়ের বলল, আমাদের সকলেরই জ্ঞানবুদ্ধি আছে।

ব্ল্যাকিভেল বলল, হে আমার প্রিয় খোলোমায়েস, আমার শান্ত ভাবটা একবার দেখ।

থোলোমায়েস বলল, তুমি স্বয়ং মার্কুই দ্য মঁতকাম হয়ে উঠেছ।

মঁতকামের মার্কুই ছিলেন সে যুগের এক প্রখ্যাত রাজতন্ত্রবাদী। কথাটা ঠাট্টার ছলে বললেও তাতে কাজ হল। ব্যাঙডাকা কোনও জলাশয়ে ঢিল ছুঁড়লে যেমন ব্যাঙগুলো একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়, তেমনি সবাই চুপ করে গেল।

থোলোমায়েস শান্ত কণ্ঠে নেতা হিসেবে তার প্রভুত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য বলতে লাগল, শান্ত হয়ে আরাম করে বস বন্ধুগণ। ঠাট্টার ছলে যে কথাটা মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে গেছে সেটাকে আর ধরো না। আকাশ থেকে ঝরে পড়া এইসব তুচ্ছ কথাগুলোকে কোনও গুরুত্ব দিতে নেই। ঠাট্টা-তামাশা হচ্ছে পলায়মান আত্মা থেকে ঝরে পড়া এক বস্তু। সেটা যে কোনও জায়গায় পড়তে পারে। তা যেখানেই পড়ুক এইসব চটুল রসিকতার বোঝা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মা তখন আকাশে উঠতে থাকে। পাহাড়ের মাথার উপর একটা সাদা দাগ দেখলে ঈগল কখনও তার উড়ে চলার কাজ। বন্ধ করে না। আমি যে ঠাট্টা বা রসিকতা ঘৃণা করি তা নয়। তাদের যেটুকু মূল্য আছে। আমি শুধু সেইটুকুই তাকে দিতে চাই; তার বেশি নয়। মানবজাতির মধ্যে অনেক মহাপুরুষ ও মহাজ্ঞানী ব্যক্তিরাও রসিকতা করতেন মাঝে মাঝে। যিশু একবার পিটারকে নিয়ে তামাশা করেছিলেন। মোজেস একবার আইজাককে নিয়ে ঠাট্টা করেছিলেন। এসকাইলাস পলিনিয়েস আর ক্লিওপেট্রা অক্টেভিয়াসকে নিয়েও তামাশা করেছিলেন। তবে আমরা দেখতে পাই অ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধের আগে ক্লিওপেট্রা এই ঠাট্টার কথাটা না বললে আমরা তোরিনা নগরের কথাটা কেউ মনে রাখতাম না। তোরিনা শব্দটা এসেছে একটা গ্রিক শব্দ থেকে যার অর্থ হল কাঠের চামচ। যাই হোক, আমরা আবার আমাদের মূল কথায় ফিরে যাই। হে আমার প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমি আবার বলছি, কোনও হৈ-হুল্লোড় বা হট্টগোল নয়, কোনও আতিশয্য বা উচ্ছৃঙ্খলতা, চপলতা নয়। আনন্দোৎসবের মত্ততায় আমাদের জ্ঞানবুদ্ধিকে বিসর্জন দিলে চলবে না। আমার কথা শোন, আমার কাছে অ্যাফিয়ারাসের বিজ্ঞতা আর বুদ্ধি আর সিজারের টাক। ঠাট্টা-তামাশা আর খাওয়া-দাওয়ারও একটা সীমা থাকা উচিত। মেয়েরা, তোমরা। আপেল ভালোবাস, কিন্তু এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। এখানেও সুমতি আর কলাকৌশলের ভূমিকা আছে। গোগ্রাসে সব কিছু গিলে অতি ভোজন করলে শাস্তি পেতে হয়। পাকস্থলীর ওপর নীতিবোধ চাপিয়ে দেবার জন্যই ঈশ্বর অজীর্ণ রোগের সৃষ্টি করেছিলেন। সুতরাং মনে রেখো, আমাদের সব আবেগানুভূতির, এমনকি প্রেমাবেগেরও একটা পাকস্থলী বলে জিনিস আছে যার গ্রহণক্ষমতার একটা সীমা আছে। যথাসময়ে সবকিছুর শেষে আমাদের ইতি’ লিখে দেওয়া উচিত। সংযমের রশ্মি দিয়ে কামনার বেগ। প্রবল হয়ে উঠলে তাকে টেনে ধরা উচিত। ক্ষুধার দরজা সময়ে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। অবস্থাবিশেষে আমরা অসংযত হয়ে উঠলে আমাদের নিজেদেরই বন্দি বা গ্রেপ্তার করা উচিত। যিনি কোন সময়ে কী করা উচিত সেটা জানতে পারেন তিনিই যথার্থ জ্ঞানী। আমার ওপর আস্থা স্থাপন করতে পার, কারণ আমি কিছুটা আইন পড়েছি, অন্তত পরীক্ষার ফল তাই বলে। কখন কী করতে হবে বা বলতে হবে তা আমি জানি। প্রাচীন রোমে পীড়নের পদ্ধতি সম্পর্কে আমি লাতিন ভাষায় এক গবেষণামূলক তত্ত্ব রচনা করেছি। আমি অল্পদিনের মধ্যে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করব। সুতরাং এর থেকে বোঝা যাবে আমি একেবারে অপদার্থ নই। আমি চাই তোমরা কামনা-বাসনার দিক থেকে নরমপন্থী হও এবং আমার মতে এটাই বিজ্ঞজনোচিত পরামর্শ। সেই মানুষই সুখী যে যথাসময়ে বীরের মতো কোনও জায়গায় প্রবেশ করে, আবার সময় হলে চলে যায়।

গভীর মনোযোগের সঙ্গে কথাগুলো শুনছিল ফেবারিতে।

ফেবারিতে বলল, ফেলিক্স নামটা কী সুন্দর! ফেলিক্স শব্দটা লাতিন। এর মানে হচ্ছে সুখী।

থোলোমায়েস আবার বলতে লাগল, বন্ধুগণ, তোমরা কি কামনার দংশন থেকে মুক্তি পেতে চাও? তোমরা বাসরশয্যা বাতিল করতে চাও অথবা কুটিল প্রেমের ছলনাকে পরিহার করতে চাও? তা হলে তা সহজেই করতে পারবে। এটাই হল ব্যবস্থাপত্র। বিরামহীন বিদ্রি শ্রমের মধ্য দিয়ে তোমাদের নিজেদের ক্ষয় হয়ে যেতে হবে, আহার। নিয়ন্ত্রণ করে প্রায় উপবাসে জীবন কাটাতে হবে, সামান্যতম পোশাক পরতে হবে আর ঠাণ্ডা জলে স্নান করতে হবে।

লিস্তোলিয়ের বলল, আমি কিছুদিনের মধ্যেই এক নারীকে লাভ করব।

থোলোমায়েস আবেগে চিৎকার করে উঠল, নারী! নারী থেকে সাবধান! নারীদের চটুল চঞ্চল অন্তরকে যারা বিশ্বাস করে তারা জাহান্নামে যাক। নারীরা হচ্ছে অবিশ্বস্ত এবং চঞ্চল প্রকৃতির। সে সাপকে তার প্রতিদ্বন্দিনী ভেবে ঘৃণা করে, অথচ সেই সাপ তার সামনের বাড়িতেই থাকে।

ব্ল্যাকিভেল বলল, থোলোমায়েস, তুমি মাতাল হয়ে পড়েছ।

হয়তো তাই।

তা হলে অন্তত আনন্দ কর।

গ্লাসে মদ ঢেলে উঠে দাঁড়িয়ে থোলোমায়েস বলল, ঠিক আছে। মদের জয় হোক। মেয়েরা, আমাকে ক্ষমা করবে। স্পেনদেশীয় রীতি। মদই মানুষকে নাচায়। শোন। ভদ্রমহিলারা, বন্ধুর একটা উপদেশ শোন। ইচ্ছে হলেই তোমার প্রেমের অংশীদার পরিবর্তন করতে পার। ইংরেজ নারীদের মতো কোনও নারীর অন্তরে আবব্ধ হয়ে থাকার জন্য প্রেমের জন্ম হয়নি, এক বাধাহীন গণ্ডিহীন আনন্দ চঞ্চলতায় অন্তর থেকে অন্তরে ঘুরে বেড়াবার জন্যই প্রেমের সৃষ্টি হয়েছে। ভুল করাই মানুষের কাজ, এটা প্রবাদের কথা। আমি বলি ভালোবাসা মানেই ভুল করা। ভদ্রমহিলাগণ, আমি তোমাদের প্রত্যেককেই শ্রদ্ধা করি। জেফিনে, জোশেফাইন, তোমরা একটু কম কটুভাষিনী হলে এবং ক্রোধের অভিব্যক্তিটা একটু কম হলে তোমরা আরও বেশি মনোহারিণী হয়ে উঠতে পারতে। আর ফেবারিতে, একদিন ব্ল্যাকিভেল যখন রু্য গেরিন বয়সের একটা রাস্তা পার হচ্ছিল তখন সাদা মোজাপরা একটি মেয়ে তাকে পা দেখাল এবং তাতে এত আনন্দ পায় যে মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলে সে। ফেবারিতে, তোমার ঠোঁট দুটো গ্রিক ভাস্কর্যের মতো। একমাত্র ইউফোরিয়ন যে চিত্রকর শুধু ঠোঁটের ছবি আঁকায় নাম করে সে-ই তোমার মুখের ছবি ঠিকমতো আঁকতে পারত। তোমার আগে আর কোনও মেয়ে ওই নামের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। ভেনাসের মতো তোমাদের আপেল দাবি করা উচিত আর ইভের মতো তোমাদের সে আপেল খেয়ে ফেলা উচিত। এইমাত্র তুমি আমার নামের কথা বলেছিলে এবং আমি তাতে কিছুটা অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু নামের শব্দার্থগুলো বড় ছলনাময়। আমার নাম ফেলিক্স, কিন্তু আমি সুখী নই। শব্দগুলো মিথ্যাবাদী, তাদের কথা বিশ্বাস করা উচিত নয়। মিস ডালিয়া, আমি যদি তুমি হতাম তা হলে আমি নিজেকে গোলাপ বলে চালাতাম। ফুলের যেমন গন্ধ থাকা উচিত, মেয়েদের তেমনি গুণ থাকা উচিত। ফাঁতিনে সম্বন্ধে আমি কিছু বলতে চাই না। সে বড় স্বপ্নালু আর সূক্ষ্ম চেতনাসম্পন্ন। তার চেহারাটা পরীর মতো হলেও তার অবনত বিষাদগ্রস্ত চোখ দুটো সন্ন্যাসিনীর মতো। শ্রমজীবিনী হলেও স্বপ্নের আয়নার মধ্যে ডুবে থাকে মনে মনে। সে স্বর্গের দিকে তাকিয়ে গান করে, প্রার্থনা করে, কিন্তু কী দেখে কী করে তা সে নিজেই জানে না। সে এমন এক বাগানে প্রায়ই চলে যায় যেখানে এত পাখি আছে যে বাস্তব কোনও জীবন বা জগতে তা নেই। আমি কী বলছি শোন ফাঁতিনে, আমি থেলোমায়েস, একটা মায়া মাত্র… কিন্তু সে শুনছে না, তার সোনালি স্বপ্নের মধ্যে ডুবে আছে। তার মধ্যে সব কিছুই সবুজ, সজীব, মেদুর, যৌবন আর প্রভাতী আলো। ফাঁতিনে, তোমার নাম রাখা উচিত ছিল মার্গারেট অথবা পার্ল। তুমি যেমন দূরপ্রাচ্যের ঐশ্বর্যশালিনী কোনও দেশের মেয়ে। আর একটা উপদেশের কথা শোন মেয়েরা, বিয়ে করো না তোমরা। কিন্তু একথা আমি কেন বলছি? কেন আমি আমার নিশ্বাস ক্ষয় করছি? বিয়ে ব্যাপারটাকে মেয়েরা কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারে না। জ্ঞানী ব্যক্তিরা যতই উপদেশ দিন না কেন, মেয়েরা যে কাজই করুক, বা যত গরিবই হোক, তারা শুধু এমন স্বামীর স্বপ্ন দেখে যে হীরে বোঝাই করে এনে তাদের কাছে ঢেলে দেবে। সে যাই হোক, তোমরা বড় বেশি চিনি খাও। তোমাদের যদি কোনও দোষ থাকে তো সে দোষ একটাই। তোমরা শুধু চঞ্চল মিষ্টি বস্তুমাত্র। তোমাদের ঝকঝকে দাঁতগুলো শুধু চিনি খেতে চায়। কিন্তু মনে রেখ, চিনি নুনের মতোই। নুন-চিনি দুটোই বেশি খেলে শরীরটাকে শুকিয়ে দেয়। শিরায় রক্তের চাপ বাড়িয়ে দেয়, রক্তের গতিবেগ বাড়িয়ে দেয়, রক্তকে জমাট বাঁধিয়ে দেয়। ফুসফুসেতে ঘায়ের সৃষ্টি করে। এইভাবে তা মানুষকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়। বহুমূত্র থেকে যক্ষ্মরোগের সৃষ্টি হয়। সুতরাং হে ভদ্রমহিলারা, তোমরা চিনি খেয়ো না, দীর্ঘদিন জীবিত থাক।… এবার আমি পুরুষদের কথা বলব। হে ভদ্রমহোদয়গণ, তোমরা বিজয় অভিযান শুরু কর। তোমরা তোমাদের বন্ধুদের প্রেমিকাকে নির্মমভাবে ছিনিয়ে নাও। ঘুষি বা তরবারি চালিয়ে এগিয়ে যাও–প্রেমের ব্যাপারে বন্ধুত্ব বলে কিছু নেই। যেখানেই সুন্দরী নারী সেখানেই প্রকাশ্য যুদ্ধ, কোনও ক্ষমা নেই। সুন্দরী নারীরাই যত অনর্থের মূল, তারা কীটদষ্ট কুসুমের মতো। নারীর সৌন্দর্যই অনেক ঐতিহাসিক যুদ্ধের কারণ। নারীরা পুরুষদের বৈধ শিকার। যুদ্ধজয়ের পর রোমুলাস মেথাইন নারীদের বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিলেন। ন্যান্ডির উইলিয়ম বহু স্যাক্সন নারীকে এবং সিজার রোমের বহু নারীকে ধর্ষণ করেন। যারা নিজেরা ভালোবাসা পায় না তারা শকুনির মতো অপরের প্রেমাস্পদের ওপর ভাগ বসাতে চায়। যেসব হতভাগ্য পুরুষের কোনও প্রেমিকা নেই, ইতালির সেনাদলের কাছে বলা বোনাপার্টের একটি কথার পুনরাবৃত্তি করে তাদের বলতে চাই আমি, সৈনিকগণ, তোমাদের কিছুই নেই, অথচ সৈনিকদের সব আছে।

হাঁফ ছাড়ার জন্য থোলোমায়েস একবার থামল। ব্ল্যাকিভেল, লিস্তোলিয়ের আর ফেমিউল একটা বাজে গান ধরল। যে গানের কোনও যুক্তি বা মাথামুণ্ডু নেই, যা মনের মধ্যে কোনও রেখাপাত করতে পারে না, শুধু তামাকের ধোয়ার মতো উড়ে যায়, উবে যায় মুহূর্তে। এ গানের উদ্দেশ্য হল থোলোমায়েসের আবেগটাকে আরও বাড়িয়ে দেওয়া। গ্লাসের মদটা এক চুমুকে শেষ করে আবার তাতে মদ ঢেলে তার কথাটা শেষ করার জন্য আবার বলতে লাগল, জাহান্নামে যাক যত সব জ্ঞান! আমি যা কিছু বলেছি সব ভুলে যাও। আমরা সতী নারী বা পরিণামদর্শী পুরুষ কোনওটাই হব না। আমি চাই শুধু আনন্দের মত্ততা। খাওয়া-দাওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের আলোচনায় জলাঞ্জলি দিয়ে আনন্দ করো। হজম, বদহজম সব চুলোয় যাক। পুরুষরা বিচার চায় আর মেয়েরা ফুর্তি আর আমোদ উৎসব চায়। এই বিশ্বসৃষ্টি কত সুন্দর, কত ঐশ্বর্যমণ্ডিত! কত আনন্দে ভরা এই পৃথিবী। বসন্তের পৃথিবী উজ্জ্বল সূর্যালোকে মুক্তোর মতো চকচক করছে। পথে-ঘাটে পাখির গান ঝরে পড়ছে অবিরল ধারায়। অ্যাভেনিউ দ্য অবজারভেরিতে কত সুন্দরী ধাত্রীরা শিশুদের দিকে অজানা দৃষ্টি রেখে স্বপ্নবিষ্ট হয়ে বসে আছে। আমার অন্তরাত্মা পাখির মতো

অনাবিষ্কৃত কোনও অরণ্যে অথবা নির্জন সাভানা অঞ্চলে উড়ে যেতে চায় যেখানে সব। কিছুই সুন্দর, সব কিছুই মনোরম। মাছিরা ঝাঁক বেঁধে সেখানে সূর্যের আলোয় উড়ে বেড়ায়, যে সূর্যের আলো থেকে অনেক সঙ্গীতমুখর পাখির জন্ম হয়। আমাকে চুম্বন করো ফাঁতিনে।

কিন্তু অন্যমনস্কভাবে সে ফেবারিতেকে চুম্বন করল।

.

জেফিনে বলল, এ হোটেলে থেকে ইডনের খাবার ভালো।

ব্ল্যাকিভেল বলল, আমি বম্বার্দাকে বেশি পছন্দ করি। পরিবেশটা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। নিচের তলায় দেয়ালগুলোতে আয়না আছে।

ফেবারিতে বলল, আমি শুধু দেখতে চাই আমার প্লেটে কী খাবার দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু এখানকার কাঁটাচামচগুলো দেখ। হাতলগুলো সব রুপোর। ইডনে এগুলো হাড়ের।

থোলোমায়েস জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কী দেখছিল।

ফেমিউল তাকে বলল, থোলোমায়েস, লিস্তোলিয়েরের সঙ্গে আবার ঝগড়া হচ্ছে।

থোলোমায়েস বলল, বিবাদ ভালো, তবে ঝগড়া আরও ভালো।

ফেমিউল বলল, আমরা দর্শনের একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সেকার্তে ও স্পিনোতার মধ্যে তুমি কাকে পছন্দ করো?

থোলোমায়েস বলল, আমি পছন্দ করি বিখ্যাত ক্যাবারে গায়ক দেসজিয়েতকে।

এরপর বিচারের পর রায়দানের ভঙ্গিতে সে বলতে লাগল, আমি বাঁচতে চাই। এখনও পৃথিবীর পরমায়ু শেষ হয়নি, সুতরাং এখনও আমরা বাজে কথা বলে ফুর্তি করতে পারি। আর এই ফুর্তির জন্য অমর দেবতাদের ধন্যবাদ দিই আমি। আমরা মিথ্যা কথা বলি, তবু হাসি। আমরা কোনও কিছু মেনে নিয়েও তাতে সংশয় পোষণ করি। চমৎকার। ন্যায়মূর্তির আশ্রয়বাক্য থেকে অপ্রত্যাশিত অনেক কিছু অনেক সময় বেরিয়ে আসে। পৃথিবীতে এখনও এমন অনেক লোক আছে যারা বিস্ময়ের চমকে ভরা বৈপরীত্যের বাক্স খুলে বা বন্ধ করে অনেকখানি আনন্দ পায়। হে মহিলাগণ, তোমরা এখন যে মদ পান করছ শান্তিতে তা এখানকার সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিনশো সত্তর মাইল দূরে কোরাল দ্য ফ্রেইরার আঙুরক্ষেতে তৈরি হয় এবং সেখান থেকে চালান আসে। একবার ভেবে দেখ, তিনশো সত্তর মাইল দূর থেকে এই বম্বার্দা হোটেলে যে মদ আসে তা লিটারপ্রতি সাড়ে চার ফ্রাঁতে এখানে বিক্রি হয়।

ফেমিউল প্রতিবাদ করে কী বলতে গেল। সে বলল, থোলোমায়েস, তুমি নেতা, তোমার মতই আইন। কিন্তু তুমি কি ভেবে দেখেছ–

ঘোলোমায়েস সে কথা গ্রাহ্য না করে বলতে লাগল, বম্বার্দা হোটেলের জয় হোক। বম্বার্দা এলিফ্যান্টার মিউনোফিসের সমান মর্যাদা পাবে যদি সে আমাকে একটা নাচের মেয়ে জোগাড় করে দেয়। আবার সে যদি আমাকে সঙ্গদানের জন্য একটা মেয়ে এনে দিতে পারে তা হলে সে শেরোনেউসের থাইজেলিয়নের মর্যাদা পাবে। বিশ্বাস করো মহিলাগণ, আপুলিউসের কথা থেকে জানতে পারা যায় গ্রিস ও মিশরেও বম্বার্দা নামে হোটল ছিল। সলোমন তাই হয়তো বলতেন, জগতে নতুন কোনও কিছুই নেই। আবার ভার্জিল বলেছিলেন, আসলে এই প্রেম যুগে যুগে বিভিন্ন নরনারীর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ লাভ করে। আজ যেমন কয়েকটি যুবতী তাদের যুবক প্রেমিক এক একজন লুইকে নিয়ে সেন্ট ক্লাউডে নৌকোবিহার করে বেড়াচ্ছে তেমনি অতীতে একদিন অ্যাসপেপসিয়াও পেরিক্লিসের সঙ্গে জাহাজে করে সামস দ্বীপে বেড়াতে যায়। অ্যাসপেসিয়া কে ছিল, তোমরা তা জান কি? সে এমন একটা যুগের মেয়ে ছিল যখন মেয়েদের আত্মা বলে কোনও জিনিস ছিল না। তথাপি তার মধ্যে এমন একটা আত্মা ছিল যা একই সঙ্গে গোলাপি এবং লাল, যে আত্মা একই সঙ্গে ছিল অগ্নিশিখার থেকে তপ্ত আর স্নিগ্ধ, সকলের থেকে শীতল। নারীচরিত্রের দুটি প্রান্তসীমাকে সে অতিক্রম করেছিল। সে ছিল বারবণিতা দেবী, সে ছিল অংশত সক্রেটিস আর অংশত মেলন লেসকৎ। আসলে সে যেন প্রমিথিউসের সেবার জন্য সৃষ্টি হয়েছিল। অবশ্য প্রমিথিউস যদি তা চাইত।

কথা বলার আবেগ তখন পেয়ে বসেছিল থোলোমায়েসকে এবং তাকে তখন থামানো কঠিন হত যদি-না তখন তাদের ঘরের বাইরে জানালাটার তলায় গাড়ি টানতে টানতে একটা ঘোড়া হঠাৎ পড়ে না যেত। ঘোড়াটা ছিল মাদী এবং বয়সে বুড়ি। গাড়ি টানার সামর্থ্য তার ছিল না। গাড়িটা টানতে টানতে ঘোড়াটা তাই ক্লান্তির নিবিড়তায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল। আর যেতে পারছিল না। গাড়ির চালক গালাগালি করছিল। নির্মমভাবে চাবুক মারতে লাগল। কিন্তু ঘোড়াটা আর চলল না, পড়ে গেল। তখন গাড়িটার চারদিকে ভিড় জমে গেল। গোলমাল শুনে থোলোমায়েস ও তার দলের সবাই জানালা দিয়ে উঁকি মারতে লাগল।

সবাই অন্যমনা হয়ে ঘটনাটা দেখতে ব্যস্ত থাকায় থোলোমায়েস ফেবারিতেকে কাছে পেয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল। ফেবারিতে বলল, কিন্তু চমক কোথায়? তোমরা যে বলছিলে আমাদের চমকে দেবে?

খোলোমায়েস বলল, ঠিক বলেছ। এখন তার সময় হয়েছে। ভদ্রমহোদয়গণ, এবার মেয়েদের চমক দেখাতে হবে। মহিলাগণ, কয়েক মিনিট ধৈর্য ধরে একটু অপেক্ষা করতে হবে।

ব্ল্যাকিভেল বলল, তা হলে প্রথমে চুম্বন দিয়ে শুরু করা যাক।

থোলোমায়েস বলল, আর সে চুম্বন হবে কপালে।

এরপর প্রত্যেকটি প্রেমিক তার প্রেমিকাকে চুম্বন করল। তার পর পুরুষরা একযোগে সারবন্দিভাবে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে হাততালি দিয়ে উঠল ফেবারিতে। বলল, কী মজার ব্যাপার!

ফাঁতিনে বলল, বেশি দেরি করো না কিন্তু, আমরা অপেক্ষা করে থাকব।

.

মেয়েরা সবাই জানালার ধারে বসে রইল রাস্তার দিকে তাকিয়ে। তারা দেখল পুরুষরা হাতধরাধরি করে যেতে যেতে একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। তার পর শ্যাম্প এলিসির পথে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ফাঁতিনে চিৎকার করে একবার বলল, বেশি দেরি করো না।

জেফিনে বলল, ওরা কী আনবে বলে মনে হয়?

ডালিয়া বলল, আমার মনে হয় নিশ্চয় সুন্দর কিছু আনবে।

ফেবারিতে বলল, আমার তো মনে হয় সোনার একটা কিছু আনবে।

অদূরে জলের ধারে আবার কী একটা গোলমাল শুনে সেদিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হল ওদের। গাছের ফাঁক দিয়ে ওরা দেখতে পেল জলের ধারে কিসের একটা গোলমাল হচ্ছে। তখন ডাকগাড়ি যাবার সময়। শ্যাম্প এলিসি শহরটার পাশ দিয়ে নদীর বাঁধটার ধার ঘেঁষে ডাক নিয়ে অনেক ঘোড়ার গাড়ি দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে জোর গতিতে এগিয়ে চলেছিল। গাড়িগুলোর উপর যাত্রী মানুষগুলো ত্রিপল দিয়ে ঢাকা ছিল। পথের উপর পড়ে থাকা পাথরখণ্ডগুলোকে চাকার আঘাতে গুঁড়ো করে দিয়ে দুপাশের জনতাকে পাশ কাটিয়ে গাড়িগুলো এমন জোরে যাচ্ছিল যাতে মনে হচ্ছিল এক প্রচণ্ড ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে যেন গাড়িগুলো। গাড়িগুলোর গতিবেগের এই উন্মত্ততা দেখে মেয়েরা বেশ মজা পাচ্ছিল।

ফেবারিতে বলল, হা ভগবান! কী গোলমাল! মনে হচ্ছে কতকগুলি পুরনো লোহার তাল আকাশে উড়তে চাইছে।

ওরা এক ঝাঁক এলম গাছের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল অনেকগুলো গাড়ির মধ্যে একটা ঘোড়ার গাড়ি ছুটে যেতে যেতে হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। তার পর আবার ছুটতে ছুটতে চলে গেল। তা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল ফাঁতিনে।

ফাঁতিনে বলল, ডাকগাড়ি কিন্তু থামে না কোথাও। এটা অস্বাভাবিক।

ফেবারিতে বলল, ফাঁতিনের ব্যাপারটাই আলাদা। যে কোনও সাধারণ ঘটনা দেখেও ও আশ্চর্য হয়ে যায়, শোন, মনে করো আমি একজন যাত্রী, আমি ড্রাইভারকে একসময় বললাম, আমি এখন সামনের দিকে বেড়াতে যাচ্ছি। তুমি ফেরার সময় আমাকে তুলে নিয়ে যাবে। আমি ওই বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে থাকব। সুতরাং ড্রাইভার আমাকে ফেরার পথে তুলে নিয়ে যাবেই। এটা প্রতিদিনই হয়। জীবন সম্বন্ধে তোমার কোনও অভিজ্ঞতাই নেই।

কিছুক্ষণ এই ধরনের কথাবার্তা বলতে লাগল। তার পর ফাঁতিনের মনে সেই কথাটা ঘুরে এল। সে বলল, কই, সেই বিস্ময়ের চমক কোথায়?

ডালিয়া বলল, হ্যাঁ, সেই বিরাট বিস্ময়ের চমক কোথায় গেল?

ফাঁতিনের একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ওরা বড় দেরি করছে।

ফাঁতিনের কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হোটেলে যে তাদের খাবার পরিবেশন করছিল সে একটা খামের চিঠি নিয়ে এসে তাদের দিল।

ফেবারিতে বলল, এ কিসের চিঠি?

হোটেল-চাকরটি বলল, আপনাদের লোকেরা যাবার সময় এই চিঠি আপনাদের হাতে দেবার জন্য দিয়ে গেছেন।

ফেবারিতে চিঠিটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল, আরও আগে দাওনি কেন?

ফেবারিতে বলল, কোনও ঠিকানা নেই চিঠিখানার উপর। তবে ভেতরে কী লেখা আছে দেখি। এই হচ্ছে বিস্ময়ের চমক। এই কথাগুলো খামটার উপরেই লেখা আছে।

তাড়াতাড়ি চিঠিটা খাম থেকে বার করে ভাঁজ খুলে জোর গলায় পড়তে লাগল ফেবারিতে, হে প্রিয়তমাবৃন্দ! তোমরা প্রথমেই জেনে রাখ, আমাদের পিতামাতা আছে। তোমাদের কাছে হয়তো বাবা-মা’র বিশেষ কোনও দাম নেই। কিন্তু আইনের দিক থেকে আমরা বাবা-মার কথা শুনতে বাধ্য। তাঁদের এখন বয়স হয়েছে। তাঁরা স্বভাতই উদ্বিগ্ন আমাদের জন্য। তারা চান আমরা এখন তাদের কাছে ফিরে যাই। আমরা তাঁদের বাইবেলবর্ণিত অমিতব্যয়ী পুত্রের মতো যারা ঘরে ফিরে গেলেই তারা মোটা বাছুর কেটে ভোজ দেবার কথা বলেছেন। যেহেতু আমরা কর্তব্যপরায়ণ সন্তান, তাঁদের কথা আমাদের শুনতেই হবে। তোমরা যখন আমাদের এই চিঠিটা পড়বে তখন পাঁচটা দ্রুতগতিসম্পন্ন ঘোড়া আমাদের বাড়ির পথে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা যেন দূরে, বহু দূরে পালিয়ে যাচ্ছি। তুলোর পথে ধাবমান গাড়িগুলো যেন তোমাদের প্রেম আর যৌবনের ফুলে ভরা পথ থেকে আমাদের উদ্ধার করে সমাজজীবনের নানারকম কর্তব্যের পথে নিয়ে চলেছে আমাদের। আমরা এখন আমাদের সেই সামাজিক কর্তব্যের পথে ঘন্টায় প্রায় ছয় মাইল বেগে এগিয়ে চলেছি। আপন পরিবার ও সমাজের প্রতি কর্তব্য আছে আমাদের। আমরা সদাচরণের মাধ্যমে যথাযথভাবে সে কর্তব্য পালন করি, দেশ এটাই আশা করে আমাদের কাছ থেকে। আমরা হব পুলিশের বড় কর্তা, সন্তানের পিতা, স্থানীয় রক্ষীবাহিনী ও আইনসভার সদস্য। আমাদের এই আত্মত্যাগের জন্য তোমরা। আমাদের সম্মান করো, শ্রদ্ধা করো, আমাদের জন্য কিছুটা চোখের জল ফেলো, তার পর আমাদের জায়গায় একে একে বিকল্প প্রেমিক গ্রহণ করে। এ চিঠি পড়ে তোমাদের অন্তর যদি দুঃখে বিদীর্ণ হয় তা হলেও আমাদের করার কিছুই থাকবে না। তোমরা যা খুশি করতে পার। বিদায়।

প্রায় দুই বছর ধরে আমরা তোমাদের যথাসম্ভব সুখ দিয়েছি। আমাদের প্রতি কোনও বিদ্বেষভাব পোষণ করো না।

স্বাক্ষর : ব্ল্যাকিভেল
ফেমিউল
লিস্তোলিয়ের
ফিলিক্স থোলোমায়েস

পুনঃ–ডিনারের টাকা আমরা দিয়ে দিয়েছি।

মেয়েরা পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল।

ফেবারিতেই প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করে কথা বলল, যাই হোক, এটা কিন্তু বেশ মজার ঠাট্টা।

জেফিনে বলল, সত্যিই ব্যাপারটা বড় মজার।

ফেবারিতে বলল, আমি বেশ বলতে পারি এটা ব্ল্যাকিভেলের পরিকল্পনা। এজন্য তাকে আরও ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। ভালোবাসতে না বাসতেই ওরা হারিয়ে যায়। এটাই হল জগতের রীতি।

ডালিয়া বলল, না, এটা থোলোমায়েসের পরিকল্পনা। এটা কখনও তার মাথা ছাড়া আর কারও মাথা থেকে বার হতে পারে না।

ফেবারিতে বলল, তা যদি হয় তা হলে ব্ল্যাকিভেল নিপাত যাক, আর থোলোমায়েস দীর্ঘজীবী হোক।

ডালিয়া-জেফিনে একসঙ্গে বলে উঠল, থোলোমায়েস দীর্ঘজীবী হোক।

কথাটা বলেই হাসতে লাগল ওরা।

প্রথমটায় ফাঁতিনেও হাসতে লাগল ওদের সঙ্গে। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরে সে তার ঘরে গিয়ে একা একা কাঁদতে লাগল। এটা তার জীবনে প্রথম প্রেম। থোলোমায়েসের কাছে সে অনুগত স্ত্রীর মতো বিলিয়ে দিয়েছিল নিজেকে। তার একটি সন্তান গর্ভে ধারণ করেছে সে।

১.৪ প্যারিসের অনতিদূরে

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

এই শতাব্দীর প্রথম ভাগে প্যারিসের অনতিদূরে মঁতফারমেল গাঁয়ে একটা ছোট হোটেল ছিল। হোটেলটা এখন আর নেই। হোটেলটা রুয়েন দু বুলেঙ্গার অঞ্চলে অবস্থিত ছিল আর সেটা ব্রেনাদিয়ের দম্পতি চালাত। হোটেলটার সামনে দরজার উপর একটা কাঠের বোর্ডের উপর ছবি আঁকা ছিল। তাতে একটা সৈনিক তার পিঠের উপর তারকাচিহ্নিত সেনাপতির পোশাক পরা অবস্থায় আর একজনকে বয়ে নিয়ে চলেছে। ছবিটিতে রঙের সাহায্যে চাপ চাপ রক্ত আর ধোঁয়ার রাশি দেখানো হয়েছে। ছবিটার মাথার উপর লেখা আছে, দি সার্জেন্ট অব ওয়াটারলু।

কোনও হোটেলের সামনে কোনও যাত্রীবাহী গাড়ি বা মালবাহী ওয়াগন বা বড় ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকাটা এমন কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। কিন্তু ১৮১৮ সালের বসন্তের এক সন্ধ্যায় হোটেলের সামনে এক বিরাট মালবাহী ওয়াগন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন চিত্রকর রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আশ্চর্য হয়ে যায়। ওয়াগনটার শেষের দিকে লোহার পাটাতনওয়ালা একটা অংশ বড় বড় দুটো চাকার উপর দাঁড়িয়েছিল। তার থেকে একটা লোহার শিকল ঝুলছিল। সে শিকল দিয়ে গোলিয়াথ, হোমারের পলিফেমাস বা শেকসপিয়ারের ক্যালিবনের মতো দৈত্যদের বাধা যেত।

ওয়াগনটা তখন রাস্তাটা জুড়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন তার অন্য কোনও কাজ ছিল না। তার থেকে ঝুলতে থাকা শিকলটার একটা অংশ মাটির উপর পড়েছিল আর দুটো বাচ্চা মেয়ে সেটা ধরে দোলনার মতো দুলছিল। বাচ্চা দুটির মা কাছেই বসেছিল। একটি মেয়ের বয়স আড়াই বছর আর একটি মেয়ের বয়স মাত্র দেড় বছর। একটা শাল দিয়ে তাদের মা বাচ্চা দুটিকে শিকলটার সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছিল যাতে মেয়ে দুটি খেলা করতে করতে পড়ে না যায়। মা ভাবছিল শিকলটা বাচ্চাদের খেলার পক্ষে সত্যিই একটা মজার বস্তু। মেয়ে দুটিও তাতে খুবই আনন্দ পাচ্ছিল। তাদের তখন দেখে লোহার স্তূপের উপর দুটো ফুটন্ত গোলাপের মতো মনে হচ্ছিল। তাদের চোখগুলো বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল আর তাদের গোলাপি গানগুলো হাসিতে ফুলে উঠেছিল। তাদের মধ্যে একজনের মাথার চুল বাদামি আর একজনের চুল কালো। তাদের নির্দোষ নিষ্পাপ মুখগুলো আনন্দের উত্তেজনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। ছোট মেয়েটির অনাবৃত পেটটা দেখা যাচ্ছিল। ক্রীড়ারত আত্মভোলা এই শিশুদের সরল সুন্দর এক দৃশ্যের পটভূমিকায় ওয়াগনের উপর দিকটা একটা বিরাটকায় দানবের বিকৃত মুখের মতো দেখাচ্ছিল। শিশুকন্যাদের মার চেহারাটা তেমন সুন্দর না হলেও এই দৃশ্যের সঙ্গে তাকে বেশ মানিয়ে গিয়েছিল। সে তখন হোটেলটার সামনে বসে তার মেয়েদের দোলাচ্ছিল তন্ময় হয়ে। সূর্যাস্তের এক রঙিন আভা তাদের মুখের উপর তখন ছড়িয়ে পড়েছিল। শিশুরা যখন শিকলটা ধরে ঝুলছিল পালাক্রমে তখন শিকলটা থেকে একটা কাঁচক্যাচ শব্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল নিষ্প্রাণ লোহার শিকলটা যেন এক অস্পষ্ট অস্ফুট প্রতিবাদে ফেটে পড়ছিল। মা যখন তার শিশুসন্তানদের নিরাপত্তার দিকে সতত সজাগ দৃষ্টি ছড়িয়ে তাদের দেখাশোনা করছিল তখন তার মুখের উপর একই সঙ্গে পশু ও দেবদূতের মিশ্রিত ভাব ফুটে উঠছিল।

শিশুদের দোলাবার সময় মা অনুক্ত সুরে একটা গান গাইছিল। সে তখন এমন তন্ময় হয়ে আত্মভোলো এক ভাবের আবেশে বিভোর হয়ে ছিল যে হোটেলের সামনের রাস্তায় কী হচ্ছিল না-হচ্ছিল সে বিষয়ে তার কোনও খেয়াল ছিল না।

হঠাৎ কার কণ্ঠস্বরে তার চমক ভাঙল। কে তাকে বলল, আপনার মেয়ে দুটি খুবই সুন্দর মাদাম।

শিশুকন্যাদের মা তাকিয়ে দেখল তার সামনে এক যুবতী মেয়ে কোলে একটি সুন্দর মেয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার সঙ্গে আছে ভ্রমণকারী একটা ভারী বড় ব্যাগ।

আগন্তুক যুবতী মহিলার কোলে যে শিশুটি ছিল তার বয়স দুই থেকে তিনের মধ্যে। সে তখন নিশ্চিন্তভাবে তার মা’র কোলে ঘুমোচ্ছিল। সে একটা লিনেনের সুন্দর ফ্রক পরে ছিল। তার আপেলের মতো গোলাপি গাল দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল তার স্বাস্থ্য ভালো। চোখ দুটো বেশ বড় বড়।

আগন্তুক যুবতী মাতাটিকে দেখে গরিব মনে হচ্ছিল। সে হয়তো কোনও শহরে শ্রমিকের কাজ অথবা কোনও গাঁয়ে চাষির কাজ করে। বয়সে সে যুবতী এবং সুন্দর ছিল, কিন্তু তার পোশাক-আশাক দেহগত লাবণ্য প্রকাশের উপযুক্ত ছিল না। তার মাথায় চুল ছিল প্রচুর এবং সে চুলের একটি গোছা মাথায় শক্ত করে পরা টুপির পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসে তার চিবুকের উপর ছড়িয়ে পড়েছিল। সে যদি একবার হাসত তা হলে হয়তো তার সুন্দর ঝকঝকে দাঁতগুলো দেখা যেত। কিন্তু সে হাসেনি। জমাটবাঁধা এক অব্যক্ত বিষাদের জন্য তার মুখটা ম্লান আর চোখদুটো শুকনো দেখাচ্ছিল। সে তখন খুব ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। তার কোলের ঘুমন্ত শিশুটার পানে সে সকরুণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। তার গায়ে ছিল ক্যালিকো কাপড়ের জামা আর মোটা পশমের একটা কোট। গলায় জড়ানো ছিল একটা বড় নীল রুমাল। তার হাত দুটো ছিল খসখসে এবং ডান হাতের তর্জনীটাতে ছিল সূচ ফোঁটার দাগ। এই যুবতী মেয়েটিই হল ফাঁতিনে।

আসলে সে ফাঁতিনে হলেও তাকে তখন চেনা যাচ্ছিল না। তবে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলে বেশ বোঝা যাচ্ছিল তার দেহসৌন্দর্য তখনও অটুট ছিল। কিন্তু বিষাদের কতকগুলি কুটিল রেখা, এক অব্যক্ত দুঃখবাদের এক নীরব নিরুচ্চার সূচনা নেমে এসেছে তার অত্যুজ্জ্বল গাল দুটিতে। তার মসলিন পোশাক-আশাকের সেই পারিপাট্য, আনন্দের উজ্জ্বলতা, গানের অবিচ্ছিন্ন সুরধারা সব চলে গেছে তার জীবন থেকে। গাছের উপর শুভ্রোজ্জ্বল তুষারকণাগুলো নিঃশেষে ঝরে গেলে যেমন গাছের শূন্য শাখাগুলোকে কালো কালো দেখায় তেমনি ফাঁতিনের জীবনে থেকে সব আনন্দের উজ্জ্বলতা আর সুরের ধারা নিঃশেষে চলে গিয়ে কেমন যেন বিবর্ণ ও ম্লান হয়ে উঠেছিল তার সমগ্র মুখমণ্ডল।

ফাঁতিনেদের সেই প্রমোদভ্রমণের পর দশটি মাস কেটে গেছে। তার মধ্যে কী ঘটে গেছে তার জীবনে তা অনুমান করা খুব একটা কঠিন হবে না।

তার যে জীবন একদিন এক নিবিড় নিচ্ছিদ্র ঔদাসীন্যে ভরে ছিল, সে জীবনে নেমে এল এক কঠোর বাস্তব সচেতনতা, এল লাভ-ক্ষতি আর দেনাপাওনার এক অবাঞ্ছিত হিসাবপ্রবণতা। তাদের প্রেমিকরা চলে যেতেই ফাঁতিনে ফেবারিতে, ডালিয়া আর জেফিনের সঙ্গে সব যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তাদের থেকে। সে শুধু একা নয়, যে বন্ধন ছিঁড়ে নির্মমভাবে সকলে চলে যায় সে বাঁধন মেয়েরাও সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে ফেলে মুক্ত করে ফেলে নিজেদের। সকলেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পরস্পর থেকে। এই বিচ্ছেদের ঘটনার এক পক্ষকাল পরে কেউ যদি তাদের পারস্পরিক বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিত তা হলে তারা নিজেরাই হয়তো আশ্চর্য হয়ে যেত। ফাঁতিনে একেবারে নিঃসঙ্গ ও অসহায় হয়ে পড়ে। এইসব প্রেমের ক্ষেত্রে বিচ্ছেদটাই স্বাভাবিক এবং এক অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার। সন্তানের পিতা সন্তানকে ছেড়ে চলে গেলে তার সব ভার স্বাভাবিকভাবেই মার ওপরে এসে পড়ে। এবার নিজের রুজি-রোজগারের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে হয় ফাঁতিনেকে। থোলোমায়েসের সংস্পর্শ এবং সাহচর্যে আসার পর থেকে তার আগেকার চাকরিটাকে ঘৃণার চোখে দেখতে থাকে সে। কাজ বা রুজি-রোজগারের ওপর সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, সঙ্গে সঙ্গে আমোদ-উৎসবের প্রতি দেখা দেয় এক অত্যধিক প্রবণতা। যেসব কাজ বা চাকরি আগে সে সহজেই পেত, সেসব কাজকে সে অবহেলা করতে থাকায় সব যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে সে। সব চাকরির পথ একে একে বন্ধ হয়ে যায় তার সামনে। ফলে যখন তার সত্যি সত্যিই চাকরির দরকার দেখা দিল তখন চেষ্টা করেও চাকরি পেল না কোনও। সে লিখতে-পড়তে জানত না, ছোটবেলায় সে শুধু কোনওরকমে নাম-সই করতে শেখে। সে একজনকে টাকা দিয়ে থোলোমায়েসকে পাঠাবার জন্য তিনখানা চিঠি লেখায়, কিন্তু থোলোমায়েস একটা চিঠির উত্তর দেয়নি। আজ সে যখন মেয়ে কোলে করে রাস্তায় বার হয় তখন রাস্তার লোকেরা তাকে বিদ্রূপ করে। উপহাসের সুরে কী সব বলাবলি করতে থাকে। ফলে থোলোমায়েসের ওপর কঠোর হয়ে ওঠে তার মনটা। এখন সে কী করবে এবং কোথায় যাবে? সে অন্যায় করেছে ঠিক, কিন্তু আসলে সে সৎ এবং গুণবতী। সে যখন দেখল অধঃপতনের এক অতলান্তিক খাদ তার সামনে পথরোধ করে। দাঁড়িয়ে আছে তখন সে ভয়ে পিছিয়ে না গিয়ে সাহস ও ধৈর্যসহকারে তার সম্মুখীন হল। সে তার জন্মস্থান তার দেশের শহর মন্ত্রিউল-সুর-মেরে ফিরে যেতে চাইল। সেখানে তাকে অনেকে চেনে এবং তাদের মধ্যে কেউ না কেউ আশ্রয় বা কাজ দিতে পারে তাকে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তার এই অবৈধ সন্তানের জননী হিসেবে কুমারী মাতার অনপনেয় কলঙ্কের কথাটাকে সম্পূর্ণ গোপন রাখতে হবে। কলঙ্কের বোঝাটাকে কোথাও নামিয়ে যেতে হবে। আবার কেউ সেকথা না জেনে তাকে গ্রহণ করে তাকে আশ্রয় দিলেও পরে যদি সব কথা জেনে ফেলে তা হলে আবার বিচ্ছেদ অনিবার্য এবং সেটা হবে প্রথম বিচ্ছেদের থেকে আরও বেদনাদায়ক, আরও মর্মবিদারক। কিন্তু ফাঁতিনে মনে মনে সংকল্প করে ফেলেছিল। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য উপযুক্ত সাহসের অভাব ছিল না ফাঁতিনের। সেই সাহসের সঙ্গে সৈনিকসুলভ ভঙ্গিতে সংকল্পসাধনে এগিয়ে চলল সে।

ভালো পোশাক পরা ছেড়ে দিয়েছিল ফাঁতিনে। সিল্কের যা কিছু পোশাক ছিল তা সে তার মেয়ের জন্য রেখে দিয়েছিল। তার ঘরে দামি জিনিসপত্র যা কিছু ছিল তা সব বিক্রি করে দিয়ে দুশো ফ্রাঁ পায়। কিন্তু তার থেকে সব দেনা শোধ করে মাত্র আশি ঐ অবশিষ্ট থাকে। তার পর বসন্তের কোনও এক সকালে বাইশ বছরের এক যুবতী ফাঁতিনে কোলে এক বাচ্চা নিয়ে প্যারিস শহর ত্যাগ করল। যারা তাকে তখন শহর ছেড়ে চলে যেতে দেখে তারা সত্যিই দুঃখ প্রকাশ না করে পারেনি তার জন্য। একমাত্র তার এই শিশুসন্তান ছাড়া জগতে আর কেউ নেই তিনের। সন্তানটিরও তার মা ছাড়া আর কেউ ছিল না। ফাঁতিনেকে তার মেয়েকে প্রায়ই স্তনদুধ খাওয়াতে হত। তার ফলে তার শরীর ক্ষয় হয়। তার বুকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। সে প্রায়ই কাশতে থাকে।

মঁসিয়ে ফেলিক্স থোলোমায়েসের কথা বলে আর লাভ নেই। তার সম্বন্ধে শুধু এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে বাইশ বছর পরে রাজা লুই ফিলিপের অধীনে একজন ধনী প্রভাবশালী অ্যাটর্নি হিসেবে সে নাম করে। কড়া ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও কাজ করে সে। কিন্তু যে কোনও অবস্থাতেই হাসিখুশিতে মেতে থাকত।

কয়েক স্যু খরচ করে ফাঁতিনে একটা গাড়িতে করে প্যারিস থেকে মঁতফারমেলে এসে হাজির হয়। তার পর হাঁটতে হাঁটতে রুয়েন দু বুলেঙ্গারে এই হোটেলটায় চলে আসে। হোটেলটার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল সে। হঠাৎ দুটি শিশুকন্যাকে তাদের মা’র কাছে খেলা করতে দেখার সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যটা ভালো লেগে যায় তার। একটি সুখী পরিবারের পুরো ছবিটা ভেসে উঠল তার সামনে। সেই ছবি আর এই সুন্দর দৃশ্য থেকে উদ্ভূত একটি অনির্বচনীয় সুখের আবেশ আচ্ছন্ন করে ফেলল ফাঁতিনের মনটাকে। তাই শিশু দুটির মা যখন গান গাইতে গাইতে একবার থামল তখনি সে এগিয়ে এসে মাকে বলল, আপনার শিশু দুটি খুবই সুন্দরী মাদাম!

কোনও হিংস্র জন্তুও কেউ তার বাচ্চাকে ভালো বললে তার প্রতি অনেকখানি নমনীয় ও সহনীয় হয়ে ওঠে।

কথাটা শুনে শিশু দুটির মা ফাঁতিনেকে ধন্যবাদ দিয়ে তাকে পাশের একটা বেঞ্চিতে বসতে বলল। সে নিজেও তার সামনে এক জায়গায় বসে বলল, আমার নাম থেনার্দিয়ের। আমি আর আমার স্বামী এই হোটেলটা চালাই।

মাদাম থেনার্দিয়েরের চেহারা বেশ বলিষ্ঠ, হাড়গুলো দারুণ শক্ত আর মোটা। মাথার চুলগুলো লালচে। যেন কোনও সৈনিকের স্ত্রী; মোটাসোটা এবড়ো-খেবড়ো চেহারা। অঙ্গসৌষ্ঠবের মধ্যে কোনও সূক্ষ্মতা নেই। তবু দেহটা তার যতই রুক্ষ হোক, যত সব জনপ্রিয় গল্প-উপন্যাস পড়ে তার মনটা বেশ কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। তার বয়স তিরিশের বেশি হবে না। দেহে তখনও তার ছিল পূর্ণ যৌবন। দরজার সামনে না বসে থেকে সে যদি খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত তা হলে তার বলিষ্ঠ পুরুষালি চেহারা দেখে ভয় পেয়ে যেত ফাঁতিনে। ফলে কোনও কথাই সে তাকে বলতে পারত না।

থেনার্দিয়েরের সামনে বসে ফাঁতিনে তার জীবনকাহিনী সব বলল। তবে কিছুটা পরিবর্তিত আকারে বলল। সে বলল, সে ছিল প্যারিসের এক শ্রমিকের স্ত্রী। তার স্বামী সম্প্রতি প্যারিসে মারা গেছে। সে সেখানে কোনও চাকরি না পেয়ে গ্রামাঞ্চলে যাচ্ছে কাজ খুঁজতে। সে আজ সকালেই প্যারিস থেকে রওনা হয়। কিছুটা পথ গাড়িতে আর কিছুটা পথ হেঁটে সে মঁতফারমেলে এসে পৌঁছেছে। তার কোলের শিশু মেয়েটিও কিছুটা হেঁটেছে। তার পর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তার কোলে।

কথা বলতে বলতে ফাঁতিনে একবার তার কোলের ঘুমন্ত শিশুটাকে আদর করে চুম্বন করতেই সে জেগে উঠল। তার মা’র মতো নীল বড় বড় চোখ দুটো খুলে চারদিকে তাকাতে লাগল। ছোট ছোট শিশুরা এইভাবে অনেক সময় পরিবেশকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আর হয়তো ভাবে সারা পৃথিবীতে একমাত্র তারাই দেবদূত আর সবাই মানুষ। এরপর ফাঁতিনের শিশু মেয়েটি চারদিকে তাকিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ জোর হাসতে লাগল। তার মা তাকে থামাবার চেষ্টা করলেও থামাতে পারল না, আরও জোরে খিল খিল করে হাসতে লাগল এবং তার মার কোল থেকে নেমে যেতে চাইল। মা’র কোল থেকে নেমে শিশুরা যে শিকলটাতে দোলনার মতো করে দুলছিল সেটা দেখে আনন্দে কী বলল। মাদাম থেনার্দিয়ের তার মেয়েদের দোলনা থেকে নামিয়ে বলল, এবার তোমরা সকলে মিলে খেল।

শিশুদের এই বয়সে তাদের বন্ধুত্ব খুব তাড়াতাড়ি গড়ে ওঠে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনটি শিশু একযোগে খেলা করতে লাগল। তারা পরম আনন্দে মাটিতে গর্ত খুঁড়তে লাগল। ফাঁতিনের বাচ্চা মেয়েটি একটা কাঠের টুকরো পেয়ে তাই দিয়ে গর্ত খুঁড়তে লাগল। গর্ত নয় যেন ইঁদুরের কবর।

এদিকে তাদের মায়েরা কথা বলতে লাগল। থোর্দিয়ের ফাঁতিনেকে বলল, তোমার মেয়ের নাম কী?

ফাঁতিনে বলল, কসেত্তে।

আসলে তার মেয়ের নাম ছিল ইউফ্রেজি। ইউফ্রেজি নামটাই চলতি কথায় বলতে বলতে সেটাকে কসেত্তে করে তুলেছে তিনে। যেমন করে অনেক সময় জোসেফ থেকে সাধারণের মুখে মুখে চলতি কথায় বোপিতা আর ফ্রঁসোয়া সিলেক্তে হয়ে দাঁড়ায়। ভাষাগত এই রূপান্তর ভাষাবিজ্ঞানীদের বিস্ময়ে অভিভূত করে তোলে।

থেনার্দিয়ের আবার প্রশ্ন করল, ওর বয়স কত?

ফাঁতিনে বলল, তিন বছরের কাছাকাছি।

বাচ্চারা তখন একই সঙ্গে এক প্রবল আশঙ্কা আর আনন্দের উত্তেজনায় দল বেঁধে দাঁড়িয়ে কী দেখছিল। কিছু একটা ঘটেছে। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে একটা পোকা বেরিয়ে পড়ায় তারা সকলেই একই সঙ্গে ভয় পেয়ে যায় আর আনন্দের আবেগে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তারা তিনজনে তখন ঘন হয়ে দাঁড়ায়।

মাদাম থেনার্দিয়ের তাদের পানে তাকিয়ে বলল, শিশু কত তাড়াতাড়ি পরস্পরকে চিনে ফেলে। যেন মনে হচ্ছে ওরা তিন বোন।

কথাটা শুনে উৎসাহিত হয়ে উঠল ফঁতিনে। এই কথাটাই সে শুনতে চাইছিল। সহসা সে মাদাম থেনার্দিয়ের একটা হাত তুলে নিয়ে বলল, তুমি আমার মেয়েকে তোমার কাছে রেখে দেবে ভাই?

মাদাম থেনার্দিয়ের চমকে উঠল। হ্যাঁ বা না কোনও কিছুই বলল না। ফাঁতিনে আবার বলতে লাগল, আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে ওকে নিয়ে যেতে পারি। আমাকে এখন কাজ খুঁজতে হবে এবং সঙ্গে বাচ্চা থাকলে কাজ পাওয়া যায় না। ও অঞ্চলের লোকরাই বড় একগুয়ে এবং যুক্তিহীন। ঈশ্বর যেন এখানে আমাকে পথ দেখিয়ে এনেছেন। আমি তোমার মেয়েদের দেখে ভাবলাম যার বাচ্চারা এমন সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন তার মা না জানি কত ভালো! ও যদি তোমাদের এখানে থাকে তা হলে ওরা ঠিক তিন বোনের মতো খেলা করবে। বল, তুমি ওর দেখাশোনা করবে এখানে রেখে?

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, কথাটা ভেবে দেখতে হবে আমাদের।

ফাঁতিনে বলল, আমি ওর জন্য মাসে ছয় ফ্রাঁ করে দিতে পারি।

এমন সময় বাড়ির ভেতর থেকে এক পুরুষকণ্ঠ শোনা গেল, মাসিক সাত ফ্রাঁ’র কম হবে না, আর দু মাসের অগ্রিম দিতে হবে।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, সাত ফ্ৰাঁ করে হলে ছয় মাসে বিয়াল্লিশ ঐ লাগবে।

ফাঁতিনে বলল, ঠিক আছে।

সেই পুরুষকণ্ঠ আবার বলল, আরও পনের ফ্রাঁ বাড়তি লাগবে।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, তা হলে সবসুদ্ধ সাতান্ন ফ্রাঁ লাগছে।

কসেত্তের মা ফাঁতিনের বলল, ঠিক আছে তাই পাবে। আমার কাছে মোট আশি ফ্রাঁ আছে। তোমাদের সাতান্ন ফ্রাঁ দিয়ে দিলে যা থাকবে তাতে আমি পায়ে হেঁটে গাঁয়ে পৌঁছতে পারব। আমি চাকরি পেলে কিছু জমিয়েই ওকে দেখতে আসব।

পুরুষের সেই কণ্ঠস্বর ভেতর থেকে আবার বলল, ওরা পোশাক-আশাক আছে তো?

মাদাম থেনার্দিয়ের ফাঁতিনেকে বলল, ও হল আমার স্বামী।

ফাঁতিনে বলল, আমি তাই অনুমান করেছিলাম। ওর পোশাক যথেষ্ট আছে। এক সম্ভ্রান্ত মহিলার মতো ওর সিল্কের পোশাকও আছে।

পুরুষ কণ্ঠস্বর বলল, ওগুলো আমাদের দিয়ে যাবে।

ফাঁতিনে বলল, অবশ্যই দিয়ে যাব। আমি কি আমার মেয়েকে নগ্ন অবস্থায় রেখে যাব ভাবছ?

যে পুরুষ এতক্ষণ ঘরের ভেতর থেকে কথা বলছিল সে এবার দরজার কাছে এসে দেখা দিয়ে বলল, ঠিক আছে।

এইভাবে সব বোঝাপড়া বা দরাদরি শেষ হয়ে গেল। ফাঁতিনে রাতটা হোটেলেই কাটাল। তার পর সকাল হতেই সব টাকা মিটিয়ে দিয়ে হোটেল থেকে চলে গেল। তার মেয়ের পোশাকগুলো বার করে দিতে ব্যাগটা হালকা হয়ে গেল। ফাঁতিনে বলল, সে তাড়াতাড়ি চলে আসবে তার মেয়েকে দেখতে। তবু যাবার সময় ফাঁতিনের বুকে ছিল এক হতাশার বোঝ। ফাঁতিনে যখন সকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন হোটেলের পাশের বাড়ির একজন লোক তাকে দেখে মাদাম থেনার্দিয়েরকে বলে, আমি এই মাত্র দেখলাম একটি মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল তার অন্তরটা ফেটে যাচ্ছে।

থেনার্দিয়ের এরপর তার স্ত্রীকে বলল, তুমি মেয়েগুলোকে নিয়ে বেশ ফাঁদ পেতেছিলে। তবে আরও পঞ্চাশ ফ্রাঁ হলে ভালো হত।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, কিন্তু তার মানেটা কী হল।

.

ব্যাগ যত ভালোই হোক, একটা ছোট্ট ইঁদুর সেটাকে কেটে ফেলতে পারে ধীরে ধীরে।

এই থেনার্দিয়েররা কে ছিল?

এখন আমরা তাদের কথা বলব সংক্ষেপে। ফলে তাদের চরিত্রের পুরো চিত্রটা পাওয়া যাবে।

থেনার্দিয়েররা সমাজের এমন একটা স্তরের মানুষ যে স্তরটি উচ্চ আর নীচ এই দুই পরস্পরবিরুদ্ধ শ্রেণির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে। সমাজের উঁচুতলার যেসব লোক কোনও কারণে যারা নিচে নেমে গেছে অথবা যেসব নিচু তলার লোকেরা কোনওক্রমে কিছুটা উপরে উঠে এসেছে ওরা তাদের মাঝামাঝি এবং তাদের থেকে কিছু কিছু উপাদান নিয়ে গড়ে উঠেছিল ওদের শ্রেণিগত স্তরটা। ফলে তাদের ভালো গুণগুলো কিছুই পায়নি, পেয়েছিল শুধু তাদের দোষগুলো। ওরা যেমন শ্রমিক শ্রেণির উদারতা পায়নি, তেমনি বুর্জোয়া শ্রেণির সম্মানজনক সততারও কিছু পায়নি।

আসলে তারা অবস্থার দিক থেকে আপাতদৃষ্টিতে বামনের মতো মনে হলেও ঘটনার আনুকূল্য পেলে সহসা দৈত্যাকার হয়ে উঠতে পারে। মেয়েটার অন্তরে সুপ্ত ছিল নিষ্ঠুরতার এক বীজ আর লোকটার অন্তর ছিল শয়তানিতে ভরা। দু জনেই ছিল যত রকমের অন্যায় ও পাপকর্মে বিশেষভাবে পারদর্শী। সংসারে এক ধরনের মানুষ আছে যারা ক্রে মাছের মতো, যাদের গতি শুধু ছায়া আর অন্ধকারের দিকে, যারা কখনও সামনের দিকে এগিয়ে যায় না, যারা শুধু পেছনের দিকে যায়। তাদের জীবনের সব অভিজ্ঞতাই বিকৃত হয়ে ওঠে এবং তারা ক্রমশই গভীরতর অন্ধকারের দিকে চলে যায়। থেনার্দিয়েরদের জীবনেও তাই ঘটেছিল।

যারা মুখ দেখে মানুষের মনের কথা বুঝতে চায় তাদের কাছে থেনার্দিয়ের ছিল একটা সমস্যা। এমন কতকগুলি লোক আছে যাদের চারদিকে এমন একটা শূন্যতা ঘিরে থাকে যার জন্য তাদের ওপর আমরা নির্ভর করতে পারি না, আমরা তাদের বিশ্বাস করতে পারি না। এই ধরনের লোকেরা আমাদের সামনে বা পেছনে যেখানেই থাক না কেন, আমাদের পক্ষে তারা হয়ে ওঠে ক্ষতিকর আর ভয়াবহ। তাদের স্বরূপ কিছুতেই জানা যায় না, তাদের মধ্যে সব সময় অজ্ঞেয়তার একটা রহস্যময় উপাদান রয়ে যায়। তাই তারা কখন কী করে বসতে তা কেউ ঠিকমতো বলতে পারে না। অনেক সময় তাদের চোখের চাউনি দেখে তাদের মনে কুমতলবের কথা জানা যায় কিছুটা। তারা যদি কোনও কথা বলে অথবা কিছু করে তা হলে আমরা সে কথা বা কাজের মধ্যে তাদের অতীত কিংম্বা ভবিষ্যতের কোনও রহস্য খুঁজে পাবার চেষ্টা করে থাকি।

থেনার্দিয়ের আগে সৈনিকের কাজ করত। সে সার্জেন্ট ছিল। সে নিজে বলত ১৮১৫ সালের সামরিক অভিযানে যোগদান করে। এর ফলে কী ঘটেছিল আমরা পরে তা জানতে পারব। সে যে যুদ্ধ করতে জানে এবং সে যে একদিন সৈনিকের কাজ করত তা তার হোটেলটা দেখলেই বোঝা যায়। নিজের হাতে আঁকা কতকগুলি যুদ্ধের ছবি সে হোটেলটার এখানে-সেখানে টাঙিয়ে রেখে দিয়েছে। সে ছবি আঁকতে ভালো না জানলেও সব বিষয়ে মাতব্বরি করতে চায় এবং সব কিছুই খারাপ করে বসে।

সে যুগে কিছু ঐতিহাসিক উপন্যাস জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ম্যাদময়জেল দ্য স্কুদেরি থেকে শুরু করে মাদাম বাৰ্থেলেমি হেদত এই ধরনের উপন্যাস লিখে বেশ নাম করেন। এইসব উপন্যাসের বিষয়বস্তুর মধ্যে অনেক অশ্লীলতার উপকরণ ছিল এবং প্যারিসের পাঠকদের মনে রোমান্টিক ভাবধারা সঞ্চার করত। মাদাম থেনার্দিয়ের বেশি লেখাপড়া না জানলেও এই ধরনের উপন্যাস পড়ার মতো ক্ষমতা ছিল তার। মাদাম থেনার্দিয়ের ওইসব উপন্যাস গোগ্রাসে গিলত যেন এবং তার থেকে খারাপ জিনিসগুলো গ্রহণ করত। যেমন এইসব উপন্যাস পাঠের ফলেই তার স্বামীর প্রতি এক রোমান্টিক আনুগত্য সব সময় প্রদর্শন করত মাদাম থেনার্দিয়ের। কিন্তু তার স্বামী লেখাপড়া জানলেও আসলে এক দুর্বৃত্ত ছিল। তার বুদ্ধি এবং রুচি খুবই স্থল প্রকৃতির ছিল। তবে সে পিগল ব্রোনের ভাবপ্রবণতার সমর্থক ছিল। মেয়েদের আচার-আচরণ ও চালচলন সম্বন্ধে সে প্রথাগত রক্ষণশীলতায় বিশ্বাসী ছিল। একথা সে মুখে বলত। মাদাম ছিল তার স্বামীর থেকে পনেরো বছরের ছোট। যখন বিয়োগান্তক উপন্যাসের পরিবর্তে আনন্দোচ্ছল হালকা ধরনের উপন্যাসের প্রচলন দেখা গেল দেশে তখন মাদাম থেনার্দিয়েরও সেই সব বাজে বইয়ের ভক্ত হয়ে উঠল। এইসব কিছু পাঠের অবশ্যই একটা অশুভ প্রভাব আছে এবং এই প্রভাবের ফলেই মাদাস থেনার্দিয়ের তার বড় মেয়ের নাম রাখে এপোনিনে। আর তার ছোট মেয়ের নামটা গুলনেয়ারের পরিবর্তে আজেলমা রাখা হয়।

আসলে ওই যুগটায় নামকরণের এক অরাজকতা চলছিল। এটাকে এক সামাজিক ব্যাধির উপসর্গ বলা যেতে পারে, আবার আবার তা রোমান্টিক উপন্যাস পাঠেরও ফল হতে পারে। যার ফলে গ্রামের চাষিদের ছেলেদের নাম রাখা হত আর্থার, আলফ্রেড, আলফনসে। অন্যদিকে কাউন্ট পরিবারের ছেলেদের নাম রাখা হত টমাস, পিয়ের অথবা জ্যাক। দুটি সামাজিক শ্রেণির মধ্যে নামকরণের এই বিপরীতমুখী ভাব দেশে সাম্যের বৈপ্লবিক ভাবধারা প্রসারের প্রত্যক্ষ ফল ছাড়া আর কিছুই নয়। এক নতুন যুগের হাওয়া বইছিল যেন সর্বত্র। জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রে যে কোনও বৈপরীত্যের পেছনে খোঁজ করলেই ফরাসি বিপ্লবের এক গভীরতর তাৎপর্য অবশ্যই খুঁজে পাব আমরা।

.

শুধু অকুণ্ঠ দুর্নীতিপরায়ণতা সমৃদ্ধি আনতে পারে না কখনও। থেনার্দিয়েরদের হোটেলের অবস্থা দিনে দিনে খারাপের দিকে যাচ্ছিল।

ফাঁতিনে তার মেয়ের জন্য যে সাতান্ন ফ্রী দিয়ে গিয়েছিল তাতে তাদের অনেকটা উপকার হয়। তাতে এক ঋণের মামলা থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু এক মাস পর আবার অভাব দেখা দিল তাদের। সংসারে একবারে টাকা নেই, কোনও আয় নেই। মাদাম থেনার্দিয়ের কসেত্তের দামি পোশাকগুলো সব প্যারিসে নিয়ে গিয়ে বন্ধক দিয়ে ষাট ফ্রাঁ নিয়ে এল। ওই টাকাটাও ফুরিয়ে গেল থেনার্দিয়ের দম্পতি কসেত্তেকে অনাথ শিশু হিসেবে দেখতে লাগল। তাকে তাদের মেয়েদের ছেঁড়া ফেলে দেওয়া জামাগুলো পরতে দিত। তাকে কুকুর-বিড়ালের সঙ্গে টেবিলের তলায় খেতে দেওয়া হত একটা কাঠের পাত্রে।

ইতোমধ্যে মন্ত্রিউলে ফাঁতিনে একটা চাকরি পায়। সেখান থেকে প্রতি মাসেই সে তার মেয়ের খবর পাবার জন্য থেনার্দিয়েরদের চিঠি লিখত। প্রতিবারই তার চিঠির উত্তরে থেনার্দিয়েররা ফাঁতিনেকে জানাত তার মেয়ের স্বাস্থ্য খুব ভালো আছে।

ছয় মাস কেটে যাবার পর আগের প্রতিশ্রুতি অনুসারে ফাঁতিনে আর মেয়ের মাসিক খরচ হিসেবে ছয় ফ্রাঁ’র পরিবর্তে সাত ফ্ৰাঁ করে পাঠাতে থাকে। এইভাবে এক বছর কেটে গেলে থেনার্দিয়ের ফাঁতিনের কাছ থেকে মাসিক বারো ফ্রাঁ করে দাবি করে। ফাঁতিনেকে যখন জানানো হল তার মেয়ে বেশ সুখেই আছে তখন সে নির্বিবাদে তা দিয়ে যেতে লাগল।

এমন অনেক মানুষ আছে সংসারে যারা ভালোবাসার অভাব ঘৃণা দিয়ে পূরণ করে। মাদাম থেনার্দিয়ের যখন দেখল কসেত্তে তার মেয়েদের সব অধিকারে ভাগ বসাতে এসেছে তখন সে তাকে ঘৃণা করতে থাকে। মাতৃস্নেহের এটাই কুৎসিত স্বার্থপরতার দিক। কসেক্তের দাবি খুবই কম হলেও মাদাম থেনার্দিয়ের ভাবল সে দাবি পূরণ করা মানে তার মেয়েদের একটা প্রাপ্য অংশ থেকে বঞ্চিত করা। তার মনে হল কসেত্তে যেন তার মেয়েদের প্রয়োজনীয় প্রাণবায়ুর একটা অংশ কেড়ে নিতে এসেছে। সাধারণ নারীদের মতো বাদাম থেনার্দিয়েরের অন্তরটাও ছোট ছিল। সে অন্তরে বেশি দয়া বা স্নেহমমতার স্থান ছিল না।

মাদাম থেনার্দিয়ের কসেত্তেকে প্রায়ই তিরস্কার এবং মারধর করত। কসেত্তে তার প্রতিটি পদক্ষেপে শুধু ভৎর্সনা পেত আর তারই সামনে তার মেয়েদের আদর করত মাদাম থেনার্দিয়ের।

মা’র দেখাদেখি এপপানিনে আর আজেলমা নামে মেয়ে দুটিও দুর্ব্যবহার করত কসেত্তের সঙ্গে।

এইভাবে দুটি বছর কেটে গেল।

গায়ের সবাই বলাবলি করতে লাগল, থেনার্দিয়েররা খুব ভালো লোক। তারা ধনী নয়, তাদের অবস্থা ভালো নয়, কিন্তু তারা একটা অনাথা মেয়েকে মানুষ করছে। মেয়েটাকে বোঝা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয় তাদের ওপর।

গাঁয়ের লোকরা ভাবত কসেত্তের মা তাকে ত্যাগ করে চলে গেছে।

এদিকে থেনার্দিয়েররা কোনওক্রমে জানতে পারে কসেত্তে তার কুমারী মাতার এক অবৈধ সন্তান। এরপর কসেত্তে’র মাসিক খরচ বারো থেকে পনেরো ফ্রতে বাড়িয়ে দেয়।

থেনার্দিয়ের একদিন তার স্ত্রীকে বলে, মেয়েটি বড় হচ্ছে এবং তার খাওয়াও বেড়েছে। আমার আরও টাকা চাই তার জন্য। তা না হলে মেয়েটাকে তার মা’র কাছে দিয়ে আসব।

এইভাবে বছরের পর বছর কেটে যেতে লাগল। কসেত্তে’র বয়স যেমন বাড়তে লাগল তেমনি তার দুরবস্থাও বেড়ে যেতে লাগল। তার বয়স পাঁচ হতেই বাড়িতে তাকে। দিয়ে ঝি-এর কাজ করানো হতে লাগল। পাঁচ বছরের শিশু কাজ করতে না পারলেও তখনকার কালে অনাথা মেয়েদের এইভাবে খাটানো হত এবং এইভাবে তাদের জীবিকার্জন করতে হত। আমরা সম্প্রতি দামোনার্দ নামে এক যুবককের বিচারকাহিনী থেকে জানতে পারি সে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে নিরাশ্রয় ও অনাথ হয়ে খেটে জীবিকার্জন করত এবং মাঝে মাঝে চুরি করত।

কসেত্তেকে অনেক ফাইফরমাশ খাটতে হত। ঘরের মেঝে মুছতে হত, উঠোন ঝট দিতে হত। থালা-ডিশ ধুতে হত। বোঝা বইতে হত। থেনার্দিয়ের দম্পতি তাকে দিয়ে বেশি করে এই কাজ করাত কারণ সম্প্রতি তার মা নিয়মিত প্রতি মাসে টাকা পাঠাত না। খরচের টাকা দু-এক মাসে বাকি পড়ে যায়।

ফাঁতিনের যদি তিন বছর পর মঁতফারমলে আসত তা হলে সে তার মেয়েকে দেখে চিনতেই পারত না। সুন্দর ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল অবস্থায় যে মেয়েকে সে হোটেলে রেখে যায় সে মেয়ে এখন রোগা আর ম্লানমুখ হয়ে গেছে। থেনার্দিয়েররা বলত, মেয়েটা বড় চতুর আর চঞ্চল।

ক্রমাগত দুর্ব্যবহার তাকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে এবং ক্রমাগত দুঃখভোগ তাকে কুৎসিত করে তোলে। শুধু চোখ দুটোর সৌন্দর্য রয়ে গিয়েছিল। তাতে তার দুরবস্থাটা আরও বেশি করে প্রকটিত হয়ে উঠত। কারণ চোখ দুটো বড় বড় হওয়ার জন্য তাতে তার অন্তরে বেদনাটা বেশি পরিমাণে প্রকাশ পেত। প্রতিদিন শীতের সকালে সূর্য ওঠার আগেই যখন ছয় বছরের একটা মেয়ে ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক পরে শীতে কাঁপতে কাঁপতে হোটেলের বাইরের দিকের বারান্দাটা একটা বড় ঝাঁটা দিয়ে ঝাঁট দিত তখন তাকে দেখে যে কোনও লোকের অন্তরটা বিদীর্ণ হয়ে যেত দুঃখে। আঁটাটা এত বড় ছিল যে সে তার। ছোট হাতে ভালো করে ধরতেই পারত না।

পাড়ার লোকেরা তাকে বলত লা লুয়েত্তে অর্থাৎ লার্ক পাখি। গাঁয়ের লোকেরা এই প্রতীক নামটাই তার পক্ষে প্রযোজ্য ভেবেছিল, কারণ সে ছিল লার্ক পাখির মতোই সশঙ্কচিত্ত, কম্পমান এবং ক্ষীণকায় এবং লার্ক পাখির মতো প্রতিদিন সকাল হওয়ার আগেই উঠত। কিন্তু সে ছিল এমনই পাখি যে কখনও কোনও গান গাইত না।

১.৫ মঁতফারমেলের হোটেলে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

যে মা একদিন মঁতফারমেলের হোটেলে তার শিশুকন্যাকে নিশ্চিন্তে রেখে চলে গিয়েছিল সে মায়ের কী হল এখন আমরা তা দেখব।

পথনার্দিয়েরের কাছে তার মেয়েকে যেদিন রেখে ফাঁতিনে চলে যায় মন্ত্রিউল-সুর-মেরে সেটা হল ১৮১৮ সাল।

তখন থেকে দশ বছর আগে মন্ত্রিউল ছেড়ে চলে আসে ফাঁতিনে। এদিকে সে যখন ধীরে ধীরে দারিদ্রের গভীর থেকে গভীরতর প্রদেশে ডুবে যেতে থাকে তখন তাদের এই জেলা শহরটা সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে। গত দুবছরের মধ্যে ওই অঞ্চল শিল্পের দিক থেকে এমনই উন্নত হয়ে ওঠে যে ওই অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে।

মন্ত্রিউল শহরের পুরনো আঞ্চলিক শিল্প হল জার্মানির কালো কাঁচ আর ইংল্যান্ডের কালো পালিশ করা এক ধরনের ছোট ছোট বল, যা দিয়ে জপের মালা তৈরি হয়। কিন্তু কাঁচামালের দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় এ শিল্পের কোনও উন্নতি হচ্ছিল না এবং শ্রমিকদের ঠিকমতো বেতন দেওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ১৮১৫ সালের শেষের দিকে শহরে কোথা থেকে একজন নবাগত আসে যে এই শিল্পের। ক্ষেত্রে কাঁচামালের রদবদল করে। সে আগে ব্যবহৃত গাছের রস থেকে তৈরি এক ধরনের আঠার পরিবর্তে গালা ব্যবহার করতে থাকে। তাতে উৎপাদন ব্যয় অনেক কমে যাওয়ায় শ্রমিকদের বেশি করে বেতন দিতে পারা যায়। ফলে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা উপকৃত হয়। উৎপন্ন শিল্পদ্রব্যের দাম কমিয়ে দেওয়ায় বেশি পরিমাণে মাল বিক্রি হতে থাকায় লাভ বেশি হতে থাকে। ফলে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই নবাগত এ অঞ্চলে এক বিরাট শিল্পবিপ্লব নিয়ে আসে। সে কম টাকায় উৎপাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে প্রচুর লাভ করে ধনী হয়ে ওঠে এবং সেই সঙ্গে তার চারপাশের গোটা অঞ্চলটাই সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠতে থাকে তার পথ অনুসরণ করে।

এ জেলার কোনও লোক তাকে চেনে না। তার জন্মপরিচয়ের কিছুই জানা যায়নি। সে কিভাবে কোথায় জীবন শুরু করে তা-ও কেউ জানতে পারেনি। লোকে শুধু বলত মাত্র কয়েকশ ফ্র্য নিয়ে এ শহরে সে প্রথম আসে। এই অল্প টাকা মূলধন হিসেবে খাঁটিয়ে কৌশলে এবং বুদ্ধি খাঁটিয়ে শিল্পে উন্নতি করে ধনসম্পদের অধিকারী হয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে এ অঞ্চলের লোকদেরও উন্নতি হয়।

সে যখন প্রথম এখানে আসে তখন তার চেহারা ও বেশভূষা একজন শ্রমিকের মতো। ছিল। তখন ছিল ডিসেম্বর মাস। সেই ডিসেম্বরের কোনও এক সন্ধ্যায় সে যখন সকলের একরকম অলক্ষ্যে শহরে এসে ঢোকে, সেই সময় শহরে ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ড ঘটে। তখন এই নবাগত ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে দুটি বিপন্ন শিশুকে উদ্ধার করে আনে। তার অবশ্য বিশেষ কোনও ক্ষতি হয়নি। সেই শিশু দুটি ছিল পুলিশ বিভাগের এক ক্যাপ্টেনের। তাই কেউ তার পরিচয়পত্র দেখতে চায়নি এবং পুলিশের কর্তারা সন্তুষ্ট ছিল তার প্রতি। সবাই তাকে পিয়ের ম্যাদলেন বলে। ডাকত। প্রথম আসার দিনে তার পিঠে একটা ব্যাগ আর হাতে একটা ছড়ি ছিল।

.

তার বয়স হবে প্রায় পঞ্চাশ এবং আচরণ ও কথাবার্তা থেকে তাকে সৎ প্রকৃতির বলে মনে হত।

শিল্পের দ্রুত উন্নতি হওয়ায় মন্ত্রিউল শহর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এক বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে উঠল। স্পেন থেকে অনেক অর্ডার আসতে লাগল। সেখানে উৎপন্ন শিল্পদ্রব্যের চাহিদা বেড়ে যেতে লাগল দিনে দিনে। বিক্রির পরিমাণ এত বেড়ে গেল যে পিয়ের ম্যাদলেন আরও দুটো নতুন কারখানা তৈরি করল–একটা পুরুষদের আর একটা শুধু নারীদের জন্য। বেকার লোকরা দলে দলে কাজের জন্য আবেদন করতেই তারা কাজ পেয়ে গেল এবং জীবন ধারণের উপযোগী ভালো বেতন পেতে লাগল। ম্যাদলেন চাইল পুরুষ-নারী সব কর্মীরা সৎ হবে, তাদের নীতিবোধ উন্নত হবে। পুরুষ ও নারী কর্মীদের পৃথকভাবে কাজ করার ব্যবস্থা করায় নারীদের শালীনতা হানির কোনও অবকাশ রইল না। এ ব্যাপারে ম্যাদলেন ছিল অনমনীয় ও আপোসহীন। কারও কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতি সহ্য করত না সে। মন্ত্রিউল শহরে এক সৈন্যনিবাস থাকায় নারীদের চরিত্রহানির অনেক সুযোগ ছিল বলে ম্যাদলেন বিশেষভাবে কড়াকড়ি করত। যে শহর একদিন কাজকর্মের সুযোগ হারিয়ে স্থিতিশীল এক আবর্তে পরিণত হয়ে উঠেছিল আজ তা এক উন্নত শিল্পের ছত্রছায়ায় কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে। ক্রমে সমস্ত অঞ্চল থেকে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর হয়ে যায়। প্রত্যেকের হাতেই কিছু না কিছু পয়সা এল। প্রতিটি ঘরে কিছু সুখশান্তি এল।

কর্মব্যস্ততার মাঝে অর্থসঞ্চয়ের দিকেও মন দিল ম্যাদলেন। ব্যবসা ছাড়া নিজে আলাদা করে একটা মোটা অঙ্কের টাকা ব্যাংকে রেখে দিল। ১৮২০ সালে লোকে জানত লাফিত্তের ব্যাংকে তার নামে মোট ৬ লক্ষ ৩৫ হাজার ফ্ৰাঁ জমা ছিল। তবে টাকাটাই তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। ব্যবসার উন্নতিই ছিল তার সবচেয়ে বড় লক্ষ্য। ব্যাংকে ওই জমা টাকা ছাড়াও সে শহরের গরিবদের অবস্থার উন্নতি সাধনের জন্য এক লক্ষ টাকা খরচ করে।

আগে শহরের হাসপাতালটা অর্থাভাবে ভুগছিল। ম্যাদলেন টাকা দিয়ে দশটা বেড় বাড়িয়ে দিল। মন্ত্রিউলের যে অঞ্চলে ম্যাদলেন থাকত সেখানে মাত্র একটা স্কুল ছিল। ম্যাদলেন সেখানে আরও দুটো স্কুল গড়ে তুলল–একটা ছেলেদের আর একটা মেয়েদের জন্য। সে তার টাকা থেকে স্কুলমাস্টারদের বেতন বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে দিল। তাছাড়া অকর্মণ্য, অনাথ ও নিরাশ্রয় বৃদ্ধদের জন্য এক আবাস স্থাপন করল যেখানে তারা বিনা পয়সায় থাকা-খাওয়ার সুযোগ পেত। নতুন কারখানা স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকদের থাকার জন্য কোয়ার্টার করে দিল। তখনকার দিনে ফ্রান্সে অসহায় দুস্থ বৃদ্ধদের এ ধরনের কোনও আবাস ছিল না।

ম্যাদলেন যখন প্রথম কাজ শুরু করে তখন শহরের সবাই বলত, লোকটা টাকা উপায় করতে এসেছে। সে ধনী হতে চায়। কিন্তু যখন তারা দেখল যে নিজে সব টাকা সঞ্চয় না করে এখানকার জনসাধারণের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধন করতে চায় তখন তারা বলাবলি করতে লাগল ও কোনও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূরণ করতে চায়। অনেকে ভাবল এ কথার কিছুটা যুক্তি আছে, কারণ ম্যাদলেনের ধর্মের দিকে মতিগতি ছিল। সে প্রতি রবিবার সকালে চার্চে গিয়ে সমবেত প্রার্থনাসভায় যোগদান করত। স্থানীয় ডেপুটি সব বিষয়ে ম্যালেনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করত। ম্যাদলেন হাসপাতালে দশটা বেড রোগীদের জন্য দান করায় সে-ও দুটো বেড দান করে। ম্যাদলেন নিয়মিত চার্চে যাওয়ায় সে-ও সকাল-সন্ধে প্রার্থনায় যোগ দিত। অথচ আগে সে ঈশ্বরে বিশ্বাসই করত না।

১৮১৯ সালে গুজব শোনা গেল পুলিশের বড় কর্তাদের পরামর্শে এবং জনসেবার কাজ দেখে রাজা মঁসিয়ে ম্যাদলেনকে মন্ত্রিউলের মেয়র মনোনীত করেছেন। যারা আগে বলত ম্যাদলেনের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ আছে তাদের ধারণা সত্যি হয়েছে জেনে তারা খুশি হল। সমস্ত শহর উত্তেজনায় ফেটে পড়ল। গুজবটা ক্রমে সত্যে পরিণত হল। কয়েকদিন পরে লে মন্ত্রিউল পত্রিকায় রাজার মনোনয়নের খবরটা প্রকাশিত হল। কিন্তু পরের দিন মঁসিয়ে ম্যাদলেন এই মেয়রের পদ প্রত্যাখ্যান করল।

১৮১৯ সালে ম্যালেনের সব শিল্পকর্ম এক শিল্প প্রদর্শনীতে দেখানো হল। যেসব নতুন পদ্ধতি সে উদ্ভাবন করে সেইসব পদ্ধতি বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। জুরিদের পরামর্শক্রমে রাজা আবার ম্যাদলেনকে লিজিয়ন দ্য অনার বা গ্র্যান্ড ক্রস উপাধি দান করার কথা ঘোষণা করেন। অনেকে তখন বলতে থাকে ম্যাদলেন মেয়রের পদ প্রত্যাখ্যান করলেও এই সম্মান ঠিক গ্রহণ করবে। ও হয়তো এই ধরনের সম্মানই চাইছিল। কিন্তু ম্যাদলেন গ্র্যান্ড ক্রসও প্রত্যাখ্যান করে।

আসলে ম্যাদলেন সকলের কাছে একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। যারা তার আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বরাবর জল্পনা কল্পনা করত এবং নানারকম ভবিষ্যদ্বাণী করত, তাদের সব ধারণা একে একে ব্যর্থ প্রতিপন্ন হওয়ায় তারা এই বলে কোনওরকমে মুখরক্ষা করে বলত, যাই হোক, ও যা হোক কিছু একটা চায়, মতলব কিছু একটা আছে।

সারা জেলা ম্যালেনের কাছে ঋণী এবং সারা জেলার গরিবরাও তার কাছে ঋণী। ম্যালেনের অবদান অমূল্য এবং তার জন্য তাকে সম্মান দেওয়া উচিত। তার কারখানার কর্মীরা তাকে শ্রদ্ধা করত। ম্যাদলেন যখন ব্যবসায়ে লাভ করতে করতে প্রচুর ধনী হয়ে ওঠে তখন শহরের লোকেরা তাকে সম্মান করে ‘সিয়ে ম্যাদলেন’ বলত। কিন্তু ম্যালেনের কারখানার সব কর্মী ও তাদের ছেলেমেয়েরা আগের মতোই তাকে পিয়ের ম্যাদলেন বলত। এই নাম শুনেই সবচেয়ে খুশি হত সে। তার মুখে হাসি ফুটে উঠত। সে ক্রমে বড় হয়ে উঠতেই বিভিন্ন জায়গায় যাবার জন্য তার কাছে নিমন্ত্রণ আসতে লাগল। সমাজের উঁচু তলার লোকরা তার খোঁজ করতে লাগল। মন্ত্রিউলের কিছু অভিজাত বাড়ির বৈঠকখানার যে দরজা সাধারণ ব্যবসায়ীদের সামনে উন্মুক্ত হত না কখনও সে দরজা লক্ষপতি মঁসিয়ে ম্যালেনের জন্য উন্মুক্ত ছিল সব সময়। অনেকে অনেক জায়গায় তাকে নিয়ে যাবার জন্য তার কাছে আসত। কিন্তু সবার সব নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করত সে।

এ নিয়ে তখন আবার এক লোকনিন্দার সৃষ্টি হয়। নিন্দুকরা বলতে থাকে, লোকটা আসলে অজ্ঞ আর অশিক্ষিত। কেউ জানে না সে কোথা থেকে এসেছে। উচ্চ ভদ্র সমাজে গিয়ে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, তা জানে না। সে লিখতে-পড়তে পারে কি না, তাতেও সন্দেহ আছে।

নিন্দুকরা সব সময়ই তাদের নিন্দার ভিত্তি হিসেবে একটা করে যুক্তি খুঁজে বার করত। প্রথমে যখন সে ব্যবসা করে টাকা করতে থাকে তখন তারা বলত, লোকটা পাকা ব্যবসাদার। যখন সে জনকল্যাণকর কাজে অনেক টাকা দান করতে থাকে তখন তারা বলত, লোকটা রাজনীতিতে নেমে নেতা হতে চায়। যখন সম্মান প্রত্যাখ্যান করে তখন তারা বলত লোকটা আরও বেশি সম্মান চায়। আবার সে যখন দ্র সমাজের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে তখন তারা বলত লোকটা নিরক্ষর চাষি।

১৮২০ সালে অর্থাৎ মন্ত্রিউলে তার আসার পাঁচ বছর পর সে অঞ্চলের শিল্পোন্নয়নে তার অবদান এমনই আশ্চর্যজনক হয়ে ওঠে এবং তার জনহিতকর কাজের জন্য জনগণ তার এমনই প্রশংসা করতে থাকে যে রাজা তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাকে আবার মন্ত্রিউলের মেয়র মনোনীত করেন। কিন্তু এবারও সে মেয়রের পদ প্রত্যাখ্যান করে। তবে এবার তার প্রত্যাখ্যান পুলিশের বড় কর্তারা স্বীকার করল না। তাছাড়া শহরের বিশিষ্ট লোকেরা এবং সাধারণ জনগণ তার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকায় শেষ পর্যন্ত সে মেয়রের পদ গ্রহণে রাজি না হয়ে পারল না। একদিন রাস্তার ধারের একটি বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে এক বুড়ি ম্যাদলেনকে বলতে থাকে, মেয়রের কাজ হল জনগণের উপকার করা। সুতরাং জনগণের উপকার করার এই সুযোগ ছেড়ে দিতে চাইছ কেন তুমি?

এইভাবে ম্যালেনের জীবনে উন্নতির তৃতীয় স্তর শুরু হল। এ অঞ্চলে প্রথম এসে যে যখন ব্যবসা শুরু করে তখন সে ছিল পিয়ের ম্যাদলেন। তার পর তার ধনসম্পদ যখন বাড়তে থাকে, ব্যবসায় উন্নতি হতে থাকে তখন সে হয়ে ওঠে মঁসিয়ে ম্যাদলেন অর্থাৎ শহরের এক গণ্যমান্য ব্যক্তি। পরে সে হয়ে উঠল শহরের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি মঁসিয়ে লে মেয়র।

.

কিন্তু মেয়র হলেও বিশেষ কোনও পরিবর্তন দেখা দিল না ম্যাদলেনের জীবনযাত্রায়। এখানে প্রথম আসার দিন যেমন ছিল তেমনি সাদাসিধে রয়ে গেল সে। তার গায়ের রংটা ছিল শ্রমিকদের গায়ের রঙের মতো তামাটে। কিন্তু মুখের ওপর ছিল চিন্তাশীল দার্শনিকের ছাপ। সে সবসময় একটা চওড়া টুপি আর গলা পর্যন্ত বোম লাগানো লম্বা ঝুলওয়ালা কোট পরত। সে মেয়রের কাজ করে যেত, কিন্তু কথা কম বলত। সে যতদূর সম্ভব অপরের অভিবাদন বা সৌজন্যমূলক কথাবার্তা এড়িয়ে চলত। যথাসম্ভব নীরবে সে ভিক্ষা বা দানের জিনিস অভাবগ্রস্ত লোকদের বিতরণ করত। মেয়েরা তার সম্বন্ধে বলাবলি করত, লোকটা যেন এক দয়ালু ভাবুক। অবসর সময়ে গ্রামাঞ্চলে গিয়ে একা একা বেড়িয়ে সে সবচেয়ে আনন্দ পেত।

সে সবসময় একা খেত। তার পাশে একটা বই থাকত খাবার সময়। তার একটা বাছাই করা বইয়ের ছোটখাটো লাইব্রেরি ছিল। সে বই ভালোবাসত। বই-ই ছিল আর একমাত্র বন্ধু যারা তার কাছ থেকে কিছু চাইত না। হাতে টাকা আসার সঙ্গে সঙ্গে তার অবসর সময় বেড়ে যায় এবং সেই সময়টা সে বই পড়ে সময়ের সদ্ব্যবহার করে আত্মোন্নতির চেষ্টা করত। তার ভাষা আগের থেকে আরও মার্জিত, ভদ্র, স্পষ্ট এবং ন্যায়সংগত হয়ে উঠল।

সে যখন একা একা বেড়াতে বার হত তখন তার হাতে একটা ছোেট শিকারি বন্দুক থাকত। কিন্তু সেটা কদাচিৎ ব্যবহার করত। তবে কখনও দরকার হলে সেটা ব্যবহার করলে তা নির্ভুল লক্ষ্যের পরিচয় দিত। সে কখনও কোনও নিরীহ নির্দোষ প্রাণী বধ করত না অথবা ছোট ছোট পাখি মারত না।

তার বয়স যৌবন পার হয়ে গেলেও তার গায়ে শক্তি ছিল প্রচুর। কোনও লোক বিপদে পড়লে সে তার দু হাত বাড়িয়ে তাকে সাহায্য করত। কোনও ঘোড়া পড়ে গেলে সে ঘোড়াটাকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিত। কোনও গাড়ির চাকা মাটিতে বসে গেলে সে কাঁধ না দিয়ে হাত দিয়ে ধরে সেটাকে টেনে তুলে দিত। কোনও বলদ পালিয়ে গেলে সে তার শিং ধরে আটকে দিত তাকে। কোনও গাঁয়ের ভেতর গেলে সে গায়ের ছেলেমেয়েরা তাকে দেখে খুশি হত, তার চারদিকে মাছির ঝাঁকের মতো ভিড় করত।

সে নিশ্চয় আগে গাঁয়ে বাস করত। কারণ সে চাষিদের চাষের কাজ সম্বন্ধে প্রায়ই যেসব উপদেশ দিত তাতে তার চাষ সম্বন্ধে যে জ্ঞান আছে তা বোঝা যেত। ফসলের উপর কিভাবে ওষুধ ছড়িয়ে পোকা নষ্ট করতে হয় তা সে চাষিদের বলে দিত। কিভাবে জমিতে নুন দিতে হয় তা-ও সে বলে দিত। ফসলভরা জমিতে যেসব আগাছা গজিয়ে উঠে ফসল নষ্ট করে তার উপায় বলে দিত ম্যাদলেন। ইঁদুরের উৎপাত বন্ধ করারও ব্যবস্থা বলে দিত।

একদিন মাঠের ধার থেকে ম্যাদলেন দেখল একদল চাষি মাঠে পাটশাকের মতো এক ধরনের শুকনো আগাছা তুলে ফেলে দিচ্ছে। তা দেখে ম্যাদলেন তাদের বলল, এই চারাগাছগুলো এখন শুকিয়ে গেছে। কিন্তু কাঁচা অবস্থায় এর শাকগুলো রান্না করে খাওয়া যায়। এর গাছগুলো থেকে শনের মতো একরকমের সুতো বার হয়। সেই সুতো থেকে কাপড় পর্যন্ত বোনা যায়। শাকগুলো গবাদিপশুরা কাঁচা খেতে পারে। এর বীজগুলো ভূমির ধারে ধারে বা ফাঁকা জায়গায় ছড়িয়ে দিলেই প্রচুর পরিমাণে এই গাছ জন্মায়। এর জন্য আলাদা করে চাষ করতে বা যত্ন করতে হয় না।

ছেলেমেয়েরা ম্যাদলেনকে বেশি ভালোবাসত। কারণ সে খড় আর নারকেলের ভোলা থেকে খেলনা তৈরি করতে পারত।

যে কোনও মৃত্যুই দুঃখ জাগাত তার মনে। যে কোনও সময়ে চার্চের দরজায় শোকসূচক কালো রঙ দেখলেই ভেতরে ঢুকে পড়ত সে। কোনও লোক মারা গেলে মৃতের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে মিশে গিয়ে সে-ও শোক প্রকাশ করত। কারও শোক-দুঃখ দেখলেই তার অন্তর কাঁদত। তার সহজাত বিষাদ আর শোকের সঙ্গীত যেন এক সুরে বাঁধা ছিল। মৃত্যুর অন্তহীন শূন্য গহ্বরের এপারে দাঁড়িয়ে কয়েকজন জীবিত মানুষ যে অন্ত্যেষ্টিকালীন গান গাইত সে গানের সকরুণ সুরধারা ম্যাদলেনের মনটাকে যেন মৃত্যুর ওপারে অনন্ত অজানিত এক পরলোকের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত।

অনেক সময় অনেক দয়ার কাজ খুব সতর্কভাবে গোপন করত ম্যাদলেন, যেন সে কাজ এক ঘৃণ্য কুকর্ম। অনেক সময় সে কোনও গরিব লোকের বাড়িতে দরজা ঠেলে চুপি চুপি ঢুকে সকলের অলক্ষ্যে অগোচরে টেবিলের উপর একটা স্বর্ণমুদ্রা রেখে আসত। বাড়ির মালিক বাইরে থেকে এসেই ঘরের দরজা খোলা দেখে ভাবত বাড়িতে চোর ঢুকেছিল। কিন্তু পরে সে আশ্চর্য হয়ে দেখত টেবিলের উপর স্বর্ণমুদ্রা পড়ে রয়েছে। কোনও চোর যদি ঢুকে থাকে তো সে চোর বাড়ির কোনও জিনিসপত্র বা টাকাকড়িতে হাত দেয়নি, বরং তাকে এক স্বর্ণখণ্ড দান করে গেছে। বুঝত সে চোর হল পিয়ের ম্যাদলেন।

সকলের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হলেও ম্যাদলেন ছিল বড় বিষণ্ণ। লোকে বলত, লোকটা ধনী হলেও অহঙ্কারী নয়। সৌভাগ্যবান হলেও সে সুখী নয়

ম্যাদলেন মানুষ হিসেবে ছিল সত্যিই বড় রহস্যময়। লোকে বলত, সে নাকি তার শোবার ঘরে কাউকে ঢুকতে দেয় না। সে ঘরটা নাকি সন্ন্যাসীদের গুহার মতো করে মড়ার মাথার খুলি আর হাড়-কঙ্কালে ভর্তি। এইসব কথা শুনে অনেক সাহসী যুবতী মেয়ে সোজা ম্যাদলেনের কাছে গিয়ে বলত, মঁসিয়ে, আপনার শোবার ঘরটা একবার দেখতে পারি? লোকে বলে, ওটা নাকি একটা গুহা।

ম্যাদলেন মৃদু হেসে তাকে সঙ্গে করে তার শোবার ঘরে নিয়ে যেত। কিন্তু সে ঘরে ঢুকে কেউ আশ্চর্যজনক কোনও বস্তু দেখতে না পেয়ে হতাশ হত। তারা দেখত ঘরটা মেহগনি কাঠের সাধারণ সাদাসিধে ধরনের আসবাবে ভর্তি। সে ঘরের মধ্যে দুটো রুপোর বাতিদান ছিল।

তবু সবাই বলত, পিয়ের ম্যালেনের নির্জন শোবার ঘরটায় ঢুকলেই সন্ন্যাসীর গুহা অথবা সমাধিগহ্বর বলে মনে হয়।

লোকে এই বলে গুজব রটাত যে লাফিত্তে ব্যাংকে ম্যাদলেনের লাখ লাখ ফ্রাঁ জমা আছে এবং ব্যাংকের সঙ্গে তার ব্যবস্থা আছে সে যে কোনও সময়ে ব্যাংকে সোজা চলে গিয়ে লাখ লাখ ফ্রাঁ তুলে নিয়ে আসতে পারে। মাঝে মাঝে ব্যাংকে গিয়ে ম্যাদলেনকে অবশ্য কিছু করে টাকা তুলে আনতে হত। কিন্তু লোকে যেখানে লাখ লাখের কথা বলত সেখানে লাখটা ছিল আসলে হাজার।

.

১৮২২ সালে খবরের কাগজে দিগনের বিশপ মঁসিয়ে মিরিয়েলের মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হল। তিনি বিরাশি বছর বয়সে পবিত্র ধর্মস্থানে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। সংবাদে আরও জানা যায়, মৃত্যুর কয়েক বছর আগে অন্ধ হয়ে যান বিশপ মিরিয়েল। তবে তাঁর বোন সব সময় তাঁর পাশে থেকে তাঁর সেবা করে যেত।

এখানে প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলা যেতে পারে। এ জগতে কোনও জীবনই সম্পূর্ণরূপে সুখী নয়, কোনও মানুষই জীবনে পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। তবু অন্ধ হয়েও অনেকে সুখী হতে পারে।

কোনও অন্ধ লোকের পাশে যদি তার স্ত্রী, কন্যা অথবা বোন সব সময় থেকে দরকারমতো সেবা করে যায়, যদি তার নিরন্তর উপস্থিতি থেকে তার অন্তরের মমতার একটা পরিমাণ বোঝা যায়, যদি তার পোশাকের খসখস শব্দ অথবা গানের গুনগুন শব্দ থেকে তার বাঞ্ছিত মধুর উপস্থিতির কথা জানা যায়, নক্ষত্রকেন্দ্রিক এক দেবদূতের মতো সেই মমতাময়ী সেবাকারিণী সেই অন্ধ লোকের সঙ্গ কখনও ত্যাগ না করে তা হলে সেই অন্ধ লোকের মতো সুখী আর কেউ হতে পারে না। জগতের সবচেয়ে বড় সুখ হল ভালোবাসার এক নিবিড় আশ্বাসে অভিষিক্ত হওয়া। সব দিক দিয়ে নিঃস্ব এবং ভালোবাসার অযোগ্য হয়েও শুধু ভালোবাসার খাতিরে ভালোবাসা পাওয়া সত্যিই কত সুখের! অন্ধ লোক এই ধরনের ভালোবাসা এবং সেবা পায়। এ ভালোবাসা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হয় কিছু না পেয়েও সব কিছু পেয়ে গেছে সে। ভালোবাসার আলোয় নিষিক্ত হয়ে তার মনে হয় সে আর আলো থেকে বঞ্চিত নয়। সে ভালোবাসা একেবারে বিশুদ্ধ এবং নিঃস্বার্থতায় পবিত্র, যে ভালোবাসা নিশ্চয়তার দৃঢ় ভিত্তিভূমির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত সে ভালোবাসা লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে আর কোনও অন্ধত্ব থাকে না। যে মানুষ কোনও ভালোবাসা পায়নি সে অন্তত আলোর মাঝেও অন্ধকার দেখে আর এই অন্ধকারে তার প্রেমহীন আত্মা এক প্রেমময় আত্মাকে হাতড়ে বেড়ায় যখন দেখে এক জীবন্ত নারীমূর্তি তার প্রেমময় আত্মাকে তার দিকে প্রসারিত করে দিয়ে তার সেবার জন্য সতত প্রস্তুত হয়ে আছে, যে নারীর ওষ্ঠাধর তার ললাটকে স্পর্শ করছে, তার হাত তার সেবায় সতত নিয়ত হয়ে আছে, তার মেদুর নিশ্বাস তার দেহগাত্রের উপর নিঃশব্দে ঝরে পড়ছে, যখন দেখে তা মমতা আর শ্রদ্ধার এক নিবিড়তম অনুভূতি তার নিঃসঙ্গতার অসহায়তাকে নিঃশেষে দ্রবীভূত করে দিয়ে তাকে ঘিরে আছে সব সময়ের জন্য, তখন তার মনে হয় ঈশ্বরের অনন্ত করুণা নেমে এসেছে সেই নারীর হাতের মধ্যে। স্বয়ং ঈশ্বরই মূর্ত হয়ে উঠেছেন সে নারীর মধ্যে। এ সুখের থেকে বড় সুখ আর কী হতে পারে? তখন তার সমগ্র অন্তরাত্মা স্বর্গীয় সুষমাসিক্ত এক অদৃশ্য ফুলের মতো ফুটে ওঠে, যার রহস্যময় আলোর উজ্জ্বলতা তার দুচোখের সব অন্ধত্বকে দূর করে দেয়। সে তখন আর কোনও আলো চায় না। যে অন্ধকার ভালোবাসার ছোঁয়ায় আলোর ফুল ফুটে ওঠে জীবনে সে অন্ধকারের বিনিময়ে কোনও আলোই চায় না মানুষ। এক জ্যোতিষ্মন দেবদূতের মতো সে নারী অন্ধকে ঘিরে থাকে সব সময়, তাকে ফেলে কোথাও যায় না। মাঝে মাঝে মুহূর্তের জন্য স্বপ্নের মতো অদৃশ্য হয়ে গেলেও পরমুহূর্তেই সে আবার ফিরে আসে বাস্তবতার মাঝে। সে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহমন হতে বিচ্ছুরিত জ্যোতির উষ্ণতার এক পরম আস্বাদ পাই আমরা, তার প্রশান্ত ব্যক্তিত্বের প্রেমময় উপস্থিতি আনন্দের উচ্ছ্বসিত প্লাবন নিয়ে আসে আমাদের নীরস প্রাণে। অন্ধকারের মাঝেও তার জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় হয়ে উঠি আমরা। আমাদের সেবা, আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সে নারীর মমতামধুর ভালোবাসা বারবার ধ্বনিত হয়, তার সেবায়, বারবার সিক্ত ও অভিস্নাত হয়ে নবজীবন লাভ করি আমরা। ছায়াচ্ছন্ন এক ব্যাপ্ত বিষাদের মাঝে এক স্বর্গসুখের সন্ধান পাই আমরা।

এই স্বর্গসুখের জগৎ থেকেই পরলোকে চলে যান মঁসিয়ে বিয়েনভেনু।

মন্ত্রিউলের এক পত্রিকায় বিশপ বিয়েনভেনুর মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হয়। আর তার পরদিনই মঁসিয়ে ম্যাদলেন কালো পোশাক পরে শোক পালন করতে থাকে। এ নিয়ে শহরের লোকের মুখে আলোচনা চলতে থাকে। এই ঘটনার মাঝে কেউ কেউ ম্যালেনের অতীত জীবনের রহস্যের সন্ধান করতে থাকে। শহরে অভিজাত লোকেরা তাদের বৈঠকখানায় বসে বলাবলি করতে থাকে, ম্যাদলেন দিগনের বিশপের জন্য শোক পালন করছে। বিশপ হয়তো ওর কোনও আত্মীয় ছিলেন। এতে অভিজাত সমাজে তার খাতির বেড়ে যায়। শহরের বয়স্ক মহিলারা ঘন ঘন দেখা করতে আসে ম্যালেনের সঙ্গে। যুবতী মেয়েরা তাকে হেসে অভিবাদন জানাতে থাকেন।

একদিন সন্ধ্যার সময় এক বিধবা মহিলা এসে তাকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা মঁসিয়ে মেয়র, দিগনের বিশপ কি আপনার জ্ঞাতিভাই ছিলেন?

ম্যাদলেন বলল, না মাদাম।

বিধবা বললেন, কিন্তু আপনি তো শোক পালন করছেন।

ম্যাদলেন বলল, কারণ যৌবনে আমি তাদের বাড়িতে ভৃত্য ছিলাম।

শহরে যখন কোনও ভবঘুরে ছেলে চিমনি পরিষ্কার বা ঝট দেওয়ার কাজ করতে আসত তখন ম্যাদলেন তাকে ডেকে পাঠাত। তার নাম জিজ্ঞাসা করত, তাকে টাকা দিত। কথাটা প্রচারিত হতে অনেক ভবঘুরে ছেলে প্রায়ই এ শহরে আসত।

.

ক্রমে মঁসিয়ে ম্যালেনের বিরুদ্ধে সব প্রতিকূলতা, যত নিন্দাবাদ স্তব্ধ হয়ে গেল। মানুষ বড় হলেই তাকে অনেক নিন্দা সহ্য করতে হয়। ম্যাদলেনকেও তাই করতে হয়েছিল। কিন্তু ক্রমে তা অতীতের ঈর্ষাত্মক ঘটনার কাহিনী হিসেবে চাপা পড়ে গেল লোকের মনের মধ্যে। ১৮২১ সাল পর্যন্ত ম্যালেনের প্রতি স্থানীয় জনগণের শ্রদ্ধাভক্তি বেড়ে যেতে থাকে ক্রমশ। তার খ্যাতি দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ায় প্রায় কুড়ি মাইল দূর থেকে বহু লোক মেয়র মঁসিয়ে ম্যালেনের নানা বিষয়ে আলোচনা করতে লাগল। ম্যাদলেন অনেক ঝগড়া-বিবাদ ও মামলা-মোকদ্দমা মিটিয়ে দিত। অনেকের অনেক শক্রতার অবসান ঘটিয়ে তাদের মধ্যে মিল করিয়ে দিত। সকলেরই তার বিচার-বিবেচনায় আস্থা ছিল। তার কথাই ছিল যেন আইন। এইভাবে মাত্র ছয়-সাত বছরে মধ্যে সারা দেশে তার যশ মহামারি রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ল।

একটা মাত্র লোক এই ছোঁয়াচে রোগের সংক্রমণ থেকে মুক্ত ছিল। মাদলেন যত ভালো কাজই করুক না কেন, লোকটা তা কখনও স্বীকার করত না ভালো বলে। তার প্রতি সব সময় একটা সংশয় আর অবিশ্বাসকে পোষণ করে চলত। কতকগুলি লোকের মধ্যে পাপপ্রবৃত্তি খুব প্রবল থাকে যে প্রবৃত্তি নিখাদ ধাতুর মতো খাঁটি এবং যে প্রবৃত্তির দ্বারা মানুষের প্রতি অনুরাগ-বিরাগ নিয়ন্ত্রিত হয়। এই পাপপ্রবৃত্তির জন্য সেইসব মানুষ আত্মম্ভরিতার বশবর্তী হয়ে কোনও বুদ্ধি বা যুক্তির পরামর্শ মানতে চায় না। তারা সককেই শুধু ঘৃণা করে যায়। তাদের মনের সংশয় আর অবিশ্বাস কোনও অপরিচিত লোক দেখলেই বিড়ালের পেছনে কুকুর আর খেকশিয়ালের পেছনে সিংহের মতো ছুটে যায় তার পেছনে।

ম্যাদলেন যখন রাস্তা দিয়ে দু ধারের নাগরিকদের অভ্যর্থনা পেতে পেতে হাসিমুখে কোথাও যেত, লম্বা চেহারার ঝুল কোটপরা একটা লোক ছড়িহাতে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ করত। ম্যাদলেন যতক্ষণ পর্যন্ত তার চোখের আড়াল হয় ততক্ষণ তাকে লক্ষ করতে যেত লোকটা। লক্ষ করত সে তার নিচের ঠোঁটটা উপরের ঠোঁটের উপর চাপিয়ে মাথাটা আপন মনে নাড়ত। যেন আপন মনে বলত, লোকটা কে? আমি আগে নিশ্চয় কোথাও দেখেছি, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

লোকটা দেখতে এমনই যে তাকে একবার দেখলেই মনে রেখাপাত করে। মনের মধ্যে কেমন এক অজানা ভয় জাগে। লোকটার নাম হল জেতার্ত এবং সে পুলিশের লোক।

মন্ত্রিউল-সুর-মের-এর পুলিশ ইন্সপেক্টর সে তার যথাকর্তব্য পালন করে গেলেও মাঝে মাঝে তার কাছের লোক তাকে ঘৃণা করত। ম্যাদলেন যখন প্রথম মন্ত্রিউলে আসে জেভার্ত তখনও আসেনি। ম্যাদলেন কিভাবে তার কাজ-কারবার শুরু করে তা সে দেখেনি। সে যখন মন্ত্রিউলের পুলিশ ইনস্পেক্টর হিসেবে তার কার্যভার গ্রহণ করে তখন ম্যাদলেন নাম আর টাকা দুটোই করেছে। সে তখন পিয়ের ম্যাদলেন থেকে মঁসিয়ে ম্যাদলেন হয়ে উঠেছে।

সাধারণত পুলিশ অফিসারদের মধ্যে কিছু ভালো প্রবৃত্তির সঙ্গে একটা প্রভুত্বের ভাব থাকে। কিন্তু জেভার্তের মধ্যে ছিল শুধু অবিমিশ্র প্রভুত্বের ভাব, তার মধ্যে ভালো কোনও প্রবৃত্তি ছিল না।

মানুষের আত্মা যদি মানুষে দেখতে পেত তা হলে সে বুঝতে পারত প্রাণিজগতের বিভিন্ন পশু-পাখিগুলো মানুষের আত্মারই এক একটা প্রতিরূপ। সামান্য ঝিনুক থেকে ঈগলপাখি, শুয়োর থেকে বাঘ–সব আছে মানুষের মধ্যে। কোনও কোনও মানুষের মধ্যে আছে আবার দু’ তিন রকমের জন্তুর স্বভাব।

আসলে প্রাণিজগতের সব জন্তুই মানুষের ভালো-মন্দ স্বভাবের এক একটা বস্তুর প্রতিরূপ। তাদের আত্মারই এক একটা বাস্তব প্রতিফলন। ঈশ্বর আমাদের চোখের সামনে পশুদের হাজির করিয়ে আমাদের শিক্ষা দিতে চান। তবে মানুষের আত্মার মধ্যে বুদ্ধি বলে একটা জিনিস আছে এবং শিক্ষালাভের একটা শক্তি আছে। সুপরিচালিত সামাজিক শিক্ষার দ্বারা মানুষ তার আত্মার অন্তর্নিহিত শক্তিকে বার করে এনে কাজে লাগাতে পারে। আমরা এই সামাজিক শিক্ষার দ্বারা কোনও মানুষকে বা পশুকে দেখে তাদের ভেতরকার স্বভাবের কথা জানতেও পারি। কোনও মানুষের চেহারা বা দেহাবয়ব দেখে তার অন্তরের স্বরূপটা বুঝতে না পারার কোনও কারণ থাকতে পারে না।

জেভার্তের জন্ম হয় কারাগারে। তার মা জ্যোতিষের কাজ করত। তার বাবা কাজ করত নৌবহরে। বড় হয়ে জেভার্ত বুঝতে পারল সমাজে প্রবেশ করার কোনও অধিকার নেই তার। সমাজের কাছে সে এক ঘৃণ্য জীব। কিন্তু সে সমাজের দুটো শ্রেণির লোককে ভয় করে এবং তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চায়। এই দুটো শ্রেণির একটা সমাজের ক্ষতিসাধন করতে চায়, সমাজের মধ্যে বিশৃঙ্খলা আনতে চায় অর্থাৎ তারা সমাজবিরোধী, আর এক শ্রেণি হল সমাজের রক্ষাকর্তা। জেতার্ত দেখল এই দুটো শ্রেণির একটাকে তার বেছে নিতেই হবে।

ভবঘুরে ধরনের সমাজবিরোধীদের সে ঘৃণা করত, কারণ সে নিজে একদিন তাদের শ্রেণীভুক্ত ছিল। সে তাই পুলিশেই যোগদান করে।

এদিক দিয়ে সে বেশই উন্নতি করে। চল্লিশ বছর বয়সেই সে পুলিশ ইনস্পেক্টর হয়। অথচ যৌবনে সে মিদিতে ছিল এক জেলপ্রহরী। যাই হোক, এবার আমরা জেভার্তের মুখটা খুঁটিয়ে দেখব।

তার নাকটা ছিল থ্যাবড়া; নাসারন্ধ্র দুটো ছিল বেশ বড় বড়। নাকের দু দিকে ছিল দুটো লম্বা-চওড়া গালপাট্টা। একনজরে দেখলেই তার গালপাট্টা দুটো কালো ঝোঁপের মতো দেখায়। জেভার্ত খুব হাসত। কিন্তু যখন সে হাসত তার সব দাঁত আর দাঁতের মাড়ি দেখা যেত। তার নাকের দু ধারে দুটো বড় বড় টোল খেত। জেভার্ত যখন হাসত না তখন তাকে বুলডগের মতো দেখাত আর যখন সে হাসত তখন তাকে বাঘের মতো দেখাত। তার ভ্র দুটো সংকীর্ণ ছিল, কিন্তু চোয়াল দুটো বড় ছিল। তার লম্বা চুলগুলো কপালটাকে ঢেকে থাকত। তার ভ্রু দুটো প্রায় সব সময় কুঞ্চিত থাকত বলে তার ক্রোধটা প্রকটিত হয়ে উঠত। তার চোখ আর মুখ দুটোই ভয়ঙ্কর দেখাত।

তার মনের ভাবধারার দুটো প্রধান উপাদান ছিল। সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রতি তার একটা কুটিল শ্রদ্ধা ছিল এবং সেই কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করে তাদের প্রতি তার একটা ভয়ঙ্কর ঘৃণা ছিল। চৌর্য, নরহত্যা প্রভৃতি যে কোনও অপরাধকে সরকারি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলে ধরে নিত সে।

সামান্য পিয়ন থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত যেসব লোক প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত থাকত, জেভার্ত তাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখত এবং যে কোনও প্রশাসনিক কাজকে সে পবিত্র মনে করত। যারা আইন ভঙ্গ করত তাদের প্রতি এক প্রবল ঘৃণা, বিরক্তি আর বিতৃষ্ণা অনুভব করত। কোনও বিষয়ে তার কোনও বিচারকে সে অভ্রান্ত বলে মনে করত। তার কেবলই মনে হত তার সে বিচারের মধ্যে কোনও ত্রুটি বা ফাঁক নেই। সে একদিকে বলত, সরকারি কর্মচারীরা কোনও অন্যায় করতে পারে না। ম্যাজিস্ট্রেটরা সব সময় ঠিক বিচার করে থাকে। আবার অন্যদিকে অপরাধীদের সম্বন্ধে বলত, ওরা একেবারে অধঃপতিত, ওদের দ্বারা আর কিছু হবে না, ওরা জীবনে আর কোনও ভালো কাজ করতে পারবে না। যেসব উগ্র মনোভাবাপন্ন লোক আইনের শক্তিকে সর্বোচ্চ, সার্বভৌম আর অবিসংবাদিত বলে মনে করে জেতার্ত তাদের সঙ্গে একমত। সে ছিল স্টইক সন্ন্যাসীদের মতো আত্মনিগ্রহে কঠোর, আবার ভোগে আগ্রহী। কল্পনাপ্রবণ ভাববাদী লোকদের মতো সে ছিল একই সঙ্গে বিনম্র এবং অহঙ্কারী। তার চোখের দৃষ্টি ছিল একই সঙ্গে হিমশীতল আর মর্মভেদী। প্রহরীর মতো সব সময় সজাগ থাকাই তার জীবনের মূলমন্ত্র ছিল। তার বিবেকটাকে সে তার নীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। যেটাকে সে কর্তব্য বলে মনে করত সেই কর্তব্যকর্মই ছিল তার ধর্ম। গুপ্তচরের মতো সে সবার কাজকর্ম অলক্ষ্যে লক্ষ করে যেত। একমাত্র অভিশপ্ত এবং হতভাগ্য ব্যক্তিরাই তার। কু-নজরে পড়ত বা তার হাতে ধরা পড়ত। জেল থেকে পালানোর জন্য সে হয়তো তার বাবাকেও গ্রেপ্তার করতে পারত এবং আইন ভঙ্গ করার জন্য সে হয়তো তার মাকেও দণ্ডদান করতে পারত এবং এ কাজকে সে পবিত্র ধর্মীয় কাজ বলে মনে করত। সে যে কঠোর কর্তব্যপরায়ণতায় অবিচল, আত্মনিগ্রহ আর নিষ্ঠুর সততার জীবন যাপন করত, তার মধ্যে কোনও ফাঁক বা বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ছিল না। সে ছিল মনে-প্রাণে নিঃসঙ্গ। পুলিশের কাজে তার এক অদ্ভুত সততা আর নিষ্ঠা ছিল। ব্রুটাস আর দাগি অপরাধী থেকে পুলিশের বড়কর্তা হওয়া ডিদোকের সংমিশ্রণে গড়া সে যেন ছিল মর্মর প্রস্তরনির্মিত এক নির্মম গুপ্তচরের প্রতিমূর্তি।

জেভার্তের স্বভাব ছিল সব কিছু গোপনে লক্ষ করা। যারা ছিল জোশেফ দ্য মেস্তারের দলের লোক এবং রাজতন্ত্রের উপাসক, যারা সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যার মাধ্যমে রাজতন্ত্রের সমর্থনে পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লিখত তারা জেভার্তকে এক আদর্শ রাজকর্মচারীর প্রতীক। হিসেবে ভাবতে পারত।

সাধারণত জেভার্তের কপালটা দেখা যেত না। টুপিটা কপালের উপর নামানো থাকত। চোখ দুটো দ্রুযুগলের নিচে কেমন যেন চাপা পড়ে থাকত, তার হাত দুটো জামার আস্তিনের নিচে ছড়িটাকে ধরে থাকত বলে সাধারণত তা দেখা যেত না। কিন্তু দরকার হলে তার কপাল, চোখ, মুখ, হাত, হাতের ছড়ি এই সবকিছু ঝোঁপের আড়ালে লুকোনো শত্রুর মতো অকস্মাৎ বেরিয়ে এসে এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করত।

অবসর সময়ে বই পড়ত জেভাৰ্ত, যদিও বই পড়া কাজটাকে অলসদের কাজ হিসেবে ঘৃণা করত সে। যাই হোক, সে পড়তে পারত এবং একেবারে অশিক্ষিত ছিল না। তার কথাবার্তা থেকেও এটা প্রায়ই বোঝা যেত। তার কোনও নেশা ছিল না, বা সে কোনও কুকর্ম করত না। তবে তার মন ভালো থাকলে সে একটু করে নস্যি নিত। এটাই ছিল তার একমাত্র নেশা।

বিচার বিভাগীয় মন্ত্রীর বাৎসরিক পরিসংখ্যান তালিকায় পদমর্যাদাহীন নিচের তলার যেসব মানুষের নাম ছিল তাদের কাছে জেভার্ত ছিল এক ত্রাসের বস্তু। তার নাম শুনলে তারা ছিটকে পালাবার চেষ্টা করত, দেখা হয়ে গেলে তারা ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে যেত। জেভার্ত তাদের কাছে ছিল এমনই ভয়ঙ্কর।

মঁসিয়ে ম্যালেনের ওপর কড়া নজর রেখে এক অপার সংশয় আর বিস্ময়ের সঙ্গে তাকে লক্ষ করে যেত জেভার্ত। ম্যাদলেনও ক্রমে এটা জানতে পারে। কিন্তু সে এটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। এ নিয়ে সে কোনওদিন প্রশ্ন করেনি জেভার্তকে, তাকে ডেকে পাঠায়নি অথবা তাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। সে জেভার্তের এই গুপ্তচরগিরি সহ্য করে যায়। আর পাঁচজন লোকের সঙ্গে যেমন ব্যবহার করত তেমনি জেভার্তের সঙ্গেও ভালো ব্যবহার করে যেত।

এ বিষয়ে জেভার্ত যা দু-চারটে কথা বলেছিল তার থেকে বোঝা যায় সে মঁসিয়ে ম্যালেনের পূর্বজীবনের অনেক খোঁজ-খবর পেয়েছে, সে কোথায় কী কী করেছে, তা সে জানতে পেরেছে। এক দূর গ্রামাঞ্চলের যে একটি পরিবার অন্যত্র চলে যায় সেই পরিবার সম্বন্ধে অন্য একজন খোঁজ-খবর নিচ্ছে। জেভার্ত একদিন নিজের মনেই বলে ওঠে, এইবার বলছি তাকে।

কিন্তু এরপরই সে নীরব হয়ে যায় একেবারে। তার থেকে মনে হয় সন্ধানের যে সুতোটা সে খুঁজে পেয়েছিল সে সুতোটা হঠাৎ ছিঁড়ে গেছে।

কোনও মানুষের স্বভাব বা প্রবৃত্তি কখনও অভ্রান্ত হতে পারে না একেবারে। সে যত সতর্কভাবেই চলুক না কেন, কখনও কখনও সে অসতর্ক হয়ে পড়বেই। মঁসিয়ে ম্যালেনের মধ্যে শান্ত ভাব দেখে জেভার্ত হতবুদ্ধি হয়ে যেত। ম্যালেনের ব্যাপারে সে যে এত খোঁজ-খবর নিচ্ছে তা সে তাকে ঘুণাক্ষরেও জানতে বা বুঝতে দিত না। কিন্তু কোনও একদিনের ঘটনায় সে এমন একটা আচরণ করে ফেলল যাতে সে নিজেই মঁসিয়ে ম্যালেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলল।

.

একদিন শহরের একদিকে একটা কাঁচা পথ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ একটা গোলমাল শুনতে পেল ম্যাদলেন। দেখল এক জায়গায় একদল লোক জড়ো হয়েছে। এগিয়ে গিয়ে ম্যাদলেন দেখল পিয়ের ফকেলেভেন্ত নামে একজন লোকের গাড়ির ঘোড়াটা পড়ে যাওয়ায় সে নিজে গাড়ির তলায় চাপা পড়ে গেছে।

পিয়ের ফকেলেভেন্ত ছিল সেইসব লোকের একজন যারা তখনও পর্যন্ত ম্যাদলেনকে বন্ধুভাবে গ্রহণ করতে পারেনি বা তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেনি। সে অল্প লেখাপড়া শিখে দলিল নকলের কাজ করত। কিন্তু ম্যাদলেন যখন এ অঞ্চলে আসে তখন ফকেলেভেন্তের কারবার খারাপের দিকে যেতে থাকে। ফকেলেভেন্তু যখন দেখল তার চোখের সামনে কারবার করতে করতে ম্যাদলেন ফুলে উঠল, তার কারখানায় কত লোক কাজ করে ভালো বেতন পেতে লাগল তখন অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় মাদলেনের ওপর দারুণ ঈর্ষা অনুভব করতে লাগল সে। অথচ সে শ্রমিকের কাজও করতে পারত না, কারণ তখন তার বয়স হয়েছিল এবং সে শক্তি তার ছিল না। বাড়িতে অবশ্য তার ছেলে-পরিবার কেউ ছিল না। তার একটা ঘোড়া আর একটা গাড়ি ছিল। অন্য কোনও উপায় না দেখে ফকেলেভেন্ত ঘোড়ার গাড়িটা বার করে ভাড়া খাটাতে লাগল। এর পর মাল বয়ে বেড়াত।

ঘোড়াটার পেছনে পা দুটো ভেঙে যায়। সে আর উঠতে পারবে না। ফকেলেভেন্ত গাড়ির তলায় এমনভাবে চাপা পড়ে যায় যে গাড়ির সমস্ত ভারটা তার বুকের উপর পড়ল। কারণ গাড়ির চাকাগুলো কাদার মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল ক্রমশ। গাড়ির তলা থেকে ফকেলেভেন্তকে টেনে বার করার অনেক চেষ্টা করা হয়। কিন্তু করা যায়নি। জেভার্তও ঘটনাস্থলে গিয়ে পড়ে। সে গাড়িটা কেটে ফকেলেভেন্তকে বার করার জন্য একটা কর্মকারকে ডেকে পাঠায়।

এমন সময় ম্যাদলেন সেখানে যেতে সকলে সম্ভ্রমভরে সরে গিয়ে তার জন্য পথ করে দিতে লাগল। ম্যাদলেন জানত, কর্মকারকে ডাকতে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু তার আসতে পনেরো মিনিট সময় লাগবে।

আগের দিন জোর বৃষ্টি হওয়ায় মাটি ভিজে ছিল। তাই গাড়ির চাকাগুলো ক্রমশই বসে যাচ্ছিল। ফলে ফকেলেভেন্তের বুকের উপর বেশি করে চাপ পড়ছিল। আরও কিছুক্ষণ দেরি হলে তার বুকের পাঁজরগুলো ভেঙে যাবে।

ম্যাদলেন বলল, পনেরো মিনিট, অনেক সময়।

একজন বলল, কিন্তু কোনও উপায় নেই।

ম্যাদলেন ভিড় করা জনতার দিকে তাকিয়ে বলল, এমন কেউ নেই যে গাড়ির তলায় ঢুকে পিঠ দিয়ে গাড়িটা তুলে ধরবে? তা হলে সহজেই ফকেলেভেন্ত বেরিয়ে আসতে পারবে। আমি তা হলে তাকে পাঁচ লুই দেব।

কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না ভিড়ের মধ্য থেকে।

ম্যাদলেন বলল, দশ লুই দেব। ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলল, এর তলায় যে ঢুকবে তাকে শয়তানের মতো শক্তিমান হতে হবে।

তা না হলে সে নিজেই চাপা পড়ে মরবে।

ম্যাদলেন বলল, কুড়ি লুই দেব।

তবু কেউ এগিয়ে এল না।

ম্যাদলেন এবার জেভার্তকে দেখতে পেল। এতক্ষণ তার নজর যায়নি সেদিকে।

জেভার্ত বলল, প্রচুর শক্তির দরকার। একটা বোঝাই করা গাড়ি পিঠ দিয়ে তোলা সহজ ব্যাপার নয়।

ম্যাদলেনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে জেতার্ত কুটিলভাবে বলল, আমি মাত্র একজনকে জানি মঁসিয়ে ম্যাদলেন, যে এটা করতে পারে। সে ছিল একদিন কয়েদি।

ম্যাদলেন আশ্চর্য হয়ে বলল, তাই নাকি?

জেভার্ত বলল, হ্যাঁ, সে ছিল তুলোঁর জেলখানায়।

ম্যালেনের মুখখানা ম্লান হয়ে গেল।

এদিকে গাড়ির চাকাগুলো আরও বসে যাচ্ছিল। ফকেলেভেন্তু যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে বলছিল, আমাকে বাঁচাও, আমার বুকের পাঁজরগুলো ভেঙে যাচ্ছে। আমার শাসরোধ হয়ে আসছে।

ম্যাদলেন আবার একবার ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলল, কুড়ি লুই-এর বিনিময়েও কেউ এই লোকটিকে বাঁচাবার জন্য একবার চেষ্টা করবে না?

জেভার্ত বলল, আমি যার কথা বললাম একমাত্র সে-ই পারে।

ম্যাদলেন ইতস্তত করতে লাগল। সে একবার জেভার্তের শকুনিসুলভ চোখের দিকে আর একবার স্তব্ধ জনতার দিকে তাকাল। তার পর নিজেই গাড়ির তলায় ঢুকে পড়ল।

ম্যাদলেন প্রথমে কনুই-এর ভর দিয়ে উপুড় হয়ে দুবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। বাইরে থেকে একদল লোক বলল, পিয়ের ম্যাদলেন, চলে এস ওখান থেকে।

ভেতর থেকে ফকেলেভেন্তও বলল, চলে যান মঁসিয়ে ম্যাদলেন, আমি আর বাঁচব না, আপনি চলে যান। আপনিও মারা যাবেন।

ম্যাদলেন কোনও কথা বলল না।

জনতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সহসা বসে যাওয়া চাকাগুলো ধীরে ধীরে উঠতে লাগল। ম্যাদলেন চাপা গলায় বলতে লাগল, আমাকে একটু সাহায্য কর।

হঠাৎ সবই ছুটে এসে গাড়িটা তোলার চেষ্টা করতে লাগল। একটা লোকের শক্তি আর সাহস দেখে অবাক হয়ে গেল সবাই। ফকেলেভেন্ত বেঁচে গেল।

গাড়িটা উঠে যেতেই ম্যাদলেন উঠে দাঁড়াল। তার মুখটা ঘামে ভিজে গিয়েছিল। তবু একটা তৃপ্তির অনুভূতি ছড়িয়ে ছিল তার মুখে। তার পোশাকটা ছিঁড়ে গিয়েছিল এবং তাতে কাদা লেগে গিয়েছিল। ফকেলেভেন্ত ম্যালেনের সামনে নতজানু হয়ে বসে তাকে জড়িয়ে ধরল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে লাগল। ম্যালেনের চোখে-মুখে এক তৃপ্তি ও বিজয়গর্বের সঙ্গে এক কাতর ভাব ছিল। সে ভাবের সঙ্গে জেভার্তের ভয়টা তখনও ছিল। সে শান্তভাবে জেভার্তের মুখপানে তাকাল। দেখল জেভাৰ্ত তখনও তার মুখপানে তাকিয়ে তাকে লক্ষ করছে।

.

সেদিনকার দুর্ঘটনায় গাড়িচাপা পড়ে ফকেলেভেন্তের হাঁটুর একটা চাকতি ভেঙে যায়। ম্যাদলেন তাকে সঙ্গে করে একটা হাসপাতালে ভর্তি করে তার দেখাশোনা করার জন্য দু জন নার্স নিযুক্ত করল। এ হাসপাতালটা তার শ্রমিকদের সুবিধার জন্য তার একটা কারখানার মধ্যেই করেছিল। পরের দিন সকালে ফকেলেভেন্তু তার ঘরে বিছানার পাশে একটা টেবিলের উপর এক হাজার ফ্রাঁ’র নোট পেল। তার সঙ্গে একটি কাগজে ম্যালেনের হাতে লেখা ছিল, আমি আপনার গাড়ি ও ঘোড়ার ব্যবস্থা করছি।

ফকেলেভেন্তের গাড়িটা ভেঙে যায় এবং ঘোড়াটা মারা যায়। ফকেলেভেন্ত সেরে উঠল কিছুদিনের মধ্যে। কিন্তু তার হাঁটুটা শক্ত আর খাড়া হয়ে রইল। হাঁটুটা আগের মতো মুড়তে পারল না। কয়েকজনের পরামর্শে মাদলেন প্যারিসের সেন্ট আঁতোনের অন্তর্গত এক কনভেন্টে এক মালীর কাজ জোগাড় করে দিল ফকেলেভেন্তকে।

এই ঘটনার কিছু পরেই মঁসিয়ে ম্যাদলেন দ্বিতীয়বারের জন্য মেয়র নির্বাচিত হল। শহরের সর্বময় কর্তা হয়ে উঠল সে। সে যখন মেয়রের পোশাক পরে বার হত তখন তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ঈর্ষার এক কাঁপন জাগত জেভার্তের বুকের মধ্যে, ভেড়ার চামড়া ঢাকা এক নেকড়ে দেখে এক শিকারি কুকুরের মধ্যে যেমন কাঁপন জাগে। তবে যতদূর সম্ভব মেয়রকে এড়িয়ে চলত জেভার্ত। সরকারি কোনও কর্তব্যের খাতিরে মেয়রের কাছে জেতার্তকে যেতে হলে সে প্রথম তো তাকে সম্মান জানাতে বাধ্য হত।

ম্যাদলেনের জন্য শহরের বহিরঙ্গটারই শুধু উন্নতি হয়নি, অদৃশ্য কয়েকটি দিকেও তার উন্নতি হয়। শহরের অধিবাসীদের অবস্থা আগে যখন খুব খারাপ ছিল তখন কর ঠিকমতো আদায় হত না। আবার সেই বাকি কর আদায় করার জন্য বেশি লোক লাগত এবং তার জন্য খরচ বেশি হত। কিন্তু বর্তমানে শহরবাসীদের আয়ের উন্নতি হওয়ায় কর সবাই সহজে দিয়ে দেয় এবং কর আদায়ের জন্য খরচও অনেক কম হয়। অর্থমন্ত্রী মন্ত্রিউল-সুর-মেরের কথা উল্লেখ করে অন্য শহরের মেয়রদের শিক্ষা দেন।

মন্ত্রিউল শহরের যখন এই রকম অবস্থা চলছিল তখন একদিন ফাঁতিনে ফিরে আসে সেখানে। কেউ তার কথা মনে রাখেনি। তবে তাকে কষ্ট পেতে হয়নি তার জন্য। কারণ ম্যালেনের কারখানার দরজা তখন খোলা ছিল। সে মেয়েদের কারখানায় একটা চাকরি পেয়ে যায়। কাজটা তার কাছে নতুন এবং সে কাজ সে ভালো জানতও না। বেতনও খুব একটা বেশি ছিল না। তবু এই চাকরিটা পাওয়াতে ফাঁতিনের খুবই উপকার হল। সে অন্তত তার জীবিকাটা অর্জন করতে পারল।

.

ফাঁতিনে যখন দেখল সে দু বেলা পেট ভরে খেতে পাচ্ছে তখন তার খুশির অন্ত রইল না। সদ্ভাবে পরিশ্রম করে জীবিকার্জন করতে পারাটা ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। এর ফলে কাজের প্রতি তার আগ্রহ আর নিষ্ঠা বেড়ে গেল। সে তার থাকার জন্য ছোটখাটো একটা ঘর ভাড়া করল। সে একটা আয়না কিনল। সেই আয়না দিয়ে সে তার মুখ-চোখ, যৌবন, দেহসৌন্দর্য, সাদা দাঁত, সুন্দর চুল–সব কিছু দেখত এবং দেখে আনন্দ পেত। অতীতের অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনার কথা ভুলে গেল সে। সে শুধু তার মেয়ে কসেত্তের কথা ভাবত। তার ভবিষ্যৎ কিভাবে গড়ে তুলবে সে তার জন্য অনেক পরিকল্পনা করত মনে মনে।

তার বিয়ে হয়েছে এ কথা কারও কাছে বলেনি ফাঁতিনে। সুতরাং তার যে মেয়ে আছে এ কথাও বলতে পারেনি কাউকে। প্রথম প্রথম সরকারি চিঠি লেখানোর লোকের কাছে গিয়ে তাকে দিয়ে থেনার্দিয়েরদের কাছে চিঠি ও টাকা পাঠাত। কিন্তু পরে কথাটা জানাজানি হয়ে যায়। অনেকে মন্তব্য করতে থাকে, মেয়েটা মিথ্যা কথা বলে।

যাদের সঙ্গে আমাদের কোনও স্বার্থের ব্যাপার নেই, যাদের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই, আমাদের চালচলন ও কাজকর্মের দিকে তাদের নজরই বেশি। তা না হলে সন্ধের দিকে একটা লোককে ফাঁতিনের বাসার কাছে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাবে কেন? আবার পেছনের দিকে রাস্তাটাতেই বা দু-একজনকে দেখা যাবে কেন?

কতকগুলি লোক আছে যারা অবসর সময়ে ভালো কাজ না করে শুধু এক তরল কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে পরের খোঁজখবর নিয়ে বেড়াবে। তারা অপরের জীবনের কোনও অজানা রহস্যের সন্ধান করার জন্য দিনের পর দিন কষ্ট করবে, খরচ করবে আর সেই রহস্য অবশেষে উদ্ঘাটন করতে পারলে কৌতূহল নিবৃত্ত করতে পারার জন্য এক অকারণ আত্মতৃপ্তি লাভ করবে।

অনেকে আবার শুধু পরচর্চা করতে ভালোবাসে আর সেই পরচর্চা করতে গিয়ে অকারণে ঈর্ষায় ফেটে পড়ে। প্রতিবেশীদের প্রতি অনুভূত ঈর্ষার আগুনে পরচর্চা ইন্ধন জোগায়।

ফাঁতিনের জীবনযাত্রার ওপর অনেকেই লক্ষ রাখত। কয়েকজন মেয়েশ্রমিক তার দেহসৌন্দর্যের জন্য, বিশেষ করে তার চুল আর দাঁতের জন্য ঈর্ষাবোধ করত। তার সঙ্গে কারখানায় যেসব মেয়ে কাজ করত তারা মাঝে মাঝে দেখত ফাঁতিনে মুখটা ঘুরিয়ে চোখের জল মোছে। তার মেয়ের কথা বা তার পুরনো প্রেম আর প্রেমিকের কথা মনে পড়ে গেলে বেদনায় বিহ্বল হয়ে ওঠে তার অন্তরটা।

পরে একটা কথা জানাজানি হয়ে গেল। অনেকে জানতে পারল, প্রতি মাসে দু বার বিশেষ এক জায়গায় চিঠি পাঠায় ফাঁতিনে আর যার কাছে চিঠি পাঠায় তার নাম থেনার্দিয়ের এবং জায়গাটার নাম মঁতফারমেল।

যে লোকটা চিঠি লিখে দিত ফাঁতিনের সে কোনও কথা গোপন রাখতে পারল না শেষ পর্যন্ত। তাকে একদিন কয়েকজন লোক একটা মদের দোকানে নিয়ে এক পেট মদ খাইয়ে দিতেই সে আসল কথাটা বলে ফেলল। বলল, ফাঁতিনের একটি সন্তান আছে। তখন অনেকে বলতে লাগল, ও বাবা, মেয়েটা তা হলে এই ধরনের নোংরা প্রকৃতির! শহরের এক কৌতূহলী মহিলা সোজা মঁতফারমেলে গিয়ে থেনার্দিয়েরদের সঙ্গে কথা। বলল। সে ফিরে এসে বলল, যাওয়া-আসায় আমার তিরিশ ফ্রাঁ খরচ হয়েছে, তবে এখন আমি সব জানতে পেরেছি। আমি তার মেয়েকে দেখেছি।

এই মহিলা হল মাদাম ভিকতারনিয়েন। সমাজের সাধারণ মানুষের নীতির অভিভাবিকা। তার বয়স ছাপ্পান্ন। বয়স হওয়ার জন্য তার মুখটা কুৎসিত দেখাত। তার গলার স্বরটা ছিল কাঁপা কাঁপা, তবে মনটা ছিল তেজি। ১৭৯১ সালে তার যখন যৌবন ছিল, সে এক যাজককে বিয়ে করে। এখন তার বয়স হলেও এবং চেহারাটা শুকিয়ে গেলেও সে তার স্বামীর স্মৃতিটা বুকে ধরে বেঁচে আছে। সে ঈর্ষাকাতর এবং মনটা তার হিংসায় ভরা। তার স্বামী যতদিন বেঁচে ছিল, তাকে কড়া শাসনের মধ্যে রেখেছিল। তার অল্প যা কিছু সম্পত্তি ছিল সে ধর্মের কাজে দান করে। তার পর সে আরাসের বিশপের দয়ার ওপর নির্ভর করে জীবন ধারণ করত। এই মাদাম ভিকতারনিয়েন মিতফারমেল গিয়ে ফিরে এসে বলে, আমি তার সন্তানকে দেখেছি।

মাদাম ভিকতারনিয়েন যে মাসে থেনার্দিয়েরদের সঙ্গে দেখা করতে যায় সেই মাসে তারা কসেক্তের খরচ বাবদ সাত থেকে বারো ফ্ৰাঁ দাবি করে এবং পরে পনেরো ফ্ৰাঁ চায়।

এদিকে ফাঁতিনের অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে। সে মন্ত্রিউল জেলা ছেড়ে কোথাও যেতে পারছিল না, কারণ বাড়িভাড়া আর আসবাবপত্র বাবদ দেড়শো ফ্ৰাঁ ধার ছিল। সে কারখানার সুপারভাইজারকে এই টাকার কথা বলে। সুপারভাইজার তাকে টাকা দিয়ে বরখাস্ত করে। তার চাকরির স্থায়িত্ব ছিল না, অস্থায়ী কর্মী হিসেবেই সে ঢুকেছিল। লজ্জা আর হতাশার চাপে অভিভূত হয়ে সে বাসার ভেতরেই থাকত সব সময়। কারখানার কাজ ছেড়ে সে বাসাতেই আশ্রয় নিয়েছিল। তার দোষের কথাটা জানাজানি হয়ে যায়। মেয়রের কাছে গিয়ে সব কথা বুঝিয়ে বলার মতো সাহস ছিল না। মেয়রের কাছে যাওয়ার জন্য অনেকেই তাকে পরামর্শ দিয়েছিল, কিন্তু সে লজ্জার ও ভয়ে যেতে পারেনি। সুপারভাইজারের মাধ্যমে দয়াবশত মেয়র ম্যাদলেন পঞ্চাশ ঐ ফাঁতিনেকে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু কাজ থেকে তাকে ছাড়িয়ে দেয়, কারণ সে ছিল ন্যায়পরায়ণতার দিক থেকে ভীষণ কড়া। ফাঁতিনে তার মালিকের রায় মেনে নেয়।

.

এইভাবে মাদাম ভিকতারনিয়েনের কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়।

এদিকে মঁসিয়ে ম্যাদলেন ফাঁতিনেকে কোনওদিন দেখেনি এবং তার সম্বন্ধে কিছুই জানত না। সুপারভাইজার মালিকের নামে যা কিছু করার নিজেই করেছে। মেয়েদের কারখানায় মোটেই যেত না ম্যাদলেন, তার কাজ দেখাশোনাও করত না। এর জন্য যে একজন অবিবাহিতা মেয়েকে সে কারখানা দেখাশোনা করার জন্য সুপারভাইজার নিযুক্ত করে তার ওপর সব ভার দেয়। সুপারভাইজার মেয়েটি ছিল সৎ এবং সরলমনা। তার অন্তরে দয়ামায়া ছিল। তবে যে পরিমাণ কঠোর নীতিজ্ঞান ছিল তার, সে পরিমাণ ক্ষমাগুণ ছিল না। তার কাজের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা ছিল ম্যাদলেনের। সুপারভাইজারই ফাঁতিনের ব্যাপারটার সব কিছু বিচার করে। সে নিজেই রায় দেয়। ম্যাদলেনকে কিছুই জানায়নি এবং ফাঁতিনেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার পর সে তাকে মেয়রের নাম করে যে পঞ্চাশ ফ্রাঁ দেয় তা গরিব-দুঃখীদের দান-খয়রাতের জন্য তার হাতে যে একটা ফান্ড ছিল তার থেকে দেয়। এই ফান্ডটা মেয়র তার কাছেই রেখেছিল।

ফাঁতিনে কারও ঘরে কাজ করার জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু কেউ তাকে কাজ দিতে চায়নি। বাড়িভাড়া আর আসবাবের টাকা বাকি থাকায় সে শহর ছেড়ে কোথাও যেতে পারছিল না। শেষে যে পঞ্চাশ ফ্রাঁ সে পায় তা সে দু জন পাওনাদারকে ভাগ করে দেয়। সে মাত্র বিছানা ছাড়া আর সব আসবাব ছেড়ে দেয়। সব দেনা দেওয়ার পর তার কাছে মোট একশো ফ্রাঁ থাকে।

সে তখন সেনানিবাসের সৈন্যদের জামা সেলাই করে দিয়ে বারো স্যু করে পেত। তার থেকে তার মেয়ের খরচের জন্য দশ সু করে চলে যেত। এই সময় অভাবের জন্য প্রতি মাসে ঠিকমতো তার মেয়ের জন্য টাকা পাঠাতে পারত না।

দারিদ্র্য আর অভাবের মধ্য দিয়ে কিভাবে দিন কাটাতে হয়, তা ফাঁতিনে এক বৃদ্ধার কাছে আগেই শিখেছিল। শীতকালে কিভাবে আগুন ছাড়াই থাকতে হয়, কিভাবে পেটিকোট দিয়ে কম্বলের অভাব পূরণ করতে হয়, জানালা দিয়ে আসা রাস্তার আলোয় রাতের খাওয়া সেরে বাতির খরচ বাঁচাতে হয়–এ সব জানা ছিল তার।

ফাঁতিনে একদিন তার এক প্রতিবেশিনীকে বলল, আমি যদি রাতে মাত্র পাঁচ ঘণ্টা করে ঘুমোই এবং বাকি সময়টা কাজ করি তা হলে তাতে আমার চলে যাবে। মনে খাওয়ার চিন্তা না থাকলে কম খেয়েও বেঁচে থাকা যাবে।

মেয়েটা এই সময় কাছে থাকলে দুঃখের মাঝেও মনে কিছুটা শান্তি পেত ফাঁতিনে। কিন্তু কতকগুলি অসুবিধা ছিল এ বিষয়ে। প্রথম কথা, সে তার এই ভয়ঙ্কর দারিদ্র্যের কথা তার মেয়েকে জানতে দিতে চাইছিল না। দ্বিতীয় কথা, থেনার্দিয়েরদের কাছে তার যে ঋণ ছিল তা শোধ করে না দিলে মেয়েকে তারা ছাড়বে না। তার ওপর যাওয়া-আসার পথখরচ আছে।

যে অবিবাহিতা বৃদ্ধা মহিলা ফাঁতিনেকে দারিদ্র্যের মধ্যে কিভাবে জীবনযাপন করতে হয় তা শেখায়, তার নাম হল মার্গারিতে। সে লেখাপড়া বেশি জানত না, কোনওরকমে নাম সই করতে পারত। তবে সে খুব ধার্মিক ছিল এবং তার দয়া-দাক্ষিণ্যও ছিল।

ঘটনাটা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর প্রথম প্রথম লজ্জায় অভিভূত হয়ে পড়ে ফাঁতিনে। সে ঘর হতে বার হতে পারত না। তার মনে হত সে রাস্তায় একবার বার হলেই সকলেই তার পানে তাকাবে। ছোট শহরে অধঃপতিত নারী সকলের ঘৃণা আর অবজ্ঞার বস্তু হয়। প্যারিসের মতো বড় কোনও শহরে কেউ কারও খবর রাখে না। কেউ কারও বিচার করে না। প্যারিসে যেতে পারলে তার ভালো হত। কিন্তু এখন তা আর সম্ভব নয়। তাছাড়া দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সে। দু তিন মাসের মধ্যেই একে একে সব লজ্জা কেটে গেল তার। সে এবার রাস্তায় বার হল, মাথা উঁচু করে হাঁটল, যেন কিছুই হয়নি। একদিন মাদাম ভিকতারনিয়েন ফাঁতিনেকে পথে দেখে খুশি হল। বেশি খেটে এবং ভালো করে খেতে না পেয়ে শরীরটা রোগা হয়ে গিয়েছিল ফাঁতিনের। তার দেহসৌন্দর্যের অনেকখানি শুকিয়ে গিয়েছিল। তার শুকনো কাশিটা আবার বেড়ে উঠেছিল। তার এই শোচনীয় অবস্থা দেখে মাদাম ভিকতারনিয়েনের শয়তান আত্মাটা এক কৃষ্ণকুটিল সুখের আস্বাদ, এক বিষাক্ত তৃপ্তি অনুভব করল।

তবুও এত দুঃখের মাঝে সকালের দিকে ফাঁতিনে যখন তার মাথার রেশমের মতো চুলের লম্বা গোছাটা হাতে ধরে চুল আঁচড়াত তখন একটা গর্ব অনুভব না করে পারত না সে।

.

১০

ফাঁতিনের যখন কারখানার কাজটা চলে যায় তখন শীতের শেষ। সে গ্রীষ্মকালটা কোনওরকমে কাটাল। তার পর আবার শীত এল। ভয়ঙ্কর শীত, উষ্ণতা বলতে নেই, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুধু ধূসর কুয়াশা। বন্ধ জানালা দিয়ে বাইরের কোনও কিছু দেখা যায় না। সমস্ত আকাশ মেঘ আর কুয়াশায় ঢাকা থাকে। কখনও কখনও দরজায় একটুখানি ক্ষীণ সূর্যের আলো এসে দাঁড়ায়। ভয়ঙ্কর শীত শুধু আকাশ থেকে বৃষ্টি আনে আর হিমে মানুষের বুকগুলোর রক্ত জমিয়ে দেয়। ফাঁতিনের পাওনাদারেরা টাকার জন্য চাপ দিতে লাগল।

ফাঁতিনের রোজগার একেবারে কমে গেল আর ঋণের বোঝা বেড়ে যেতে লাগল। থেনার্দিয়েররা কড়া ভাষায় চিঠির পর চিঠি দিতে লাগল। সে চিঠি পড়লে ফঁতিনের বুক ফেটে যায়। একবার তারা লিখল কসেত্তে রাতে নগ্ন হয়ে থাকবে। তার পশমের পোশাকের জন্য দশ ফ্রাঁ লাগবে। চিঠিটা পড়ে সারাদিন ভাবতে লাগল ফাঁতিনে। সন্ধের সময় একটা নাপিতের দোকানে গেল সে। তার কোমর পর্যন্ত লম্বা চুলের গোছাটা দেখাল।

নাপিত বলল, কী সুন্দর চুল!

ফাঁতিনে বলল, এই চুলের জন্য তুমি কত দেবে?

নাপিত বলল, দশ ফ্রাঁ।

ফাঁতিনে বলল, ঠিক আছে, কেটে নাও।

তাই দিয়ে সে একটা পোশাক কিনে এনে থেনার্দিয়েরদের কাছে পাঠিয়ে দিল। তারা সেটা পেয়ে রেগে আগুন হয়ে গেল। কারণ তারা টাকা চেয়েছিল। তারা পোশাকটা তাদের মেয়ে এগোনিনেকে দিয়ে দিল। কসেতে শীতে কাঁপতে লাগল।

এদিকে চুলটা হারিয়ে ফাঁতিনের মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। সে আর চুল আঁচড়াতে বা বাঁধতে পারত না। সমস্ত মানুষের ওপর মনটা বিষিয়ে গেল তার। সকলের মতো আগে সে ম্যাদলেনকে শ্রদ্ধা করত। কিন্তু যখন দেখল ম্যাদলেন তাকে কারখানা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে এবং তার জন্যই এত দুঃখ-কষ্ট তখন সে তাকে ঘৃণার চোখে দেখতে লাগল। একদিন কারখানার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় যখন দেখল কারখানায় ঢোকার জন্য মেয়েরা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তখন সে পাগলের মতো হাসতে আর গান করতে লাগল। একজন বুড়ি তা দেখে বুঝতে পারল, মেয়েটা অকালে মারা যাবে।

অন্তরে ক্ষোভ আর প্রচণ্ড রাগ নিয়ে সে একটা লোককে প্রেমিক হিসেবে ধরল। লোকটা কুঁড়ে এবং পথে পথে গান গেয়ে বেড়াত। ফাঁতিনেকে মারধর করত, অবশেষে তাকে ছেড়ে একদিন চলে গেল।

এত কিছু সত্ত্বেও তার মেয়েকে ভালোবাসত ফাঁতিনে। যতই সে দুঃখ-কষ্টের গভীরে নেমে যেতে লাগল, ততই সে একটা আশাকে আঁকড়ে ধরল। সে আপন মনে বলত, একদিন আমি ধনী হব আর কসেত্তেকে তখন আমি আমার কাছে রাখব। এই ভেবে নিজের মনে হাসল। তার কাশিটা তাকে কায়দা করতে পারত না। রাত্রিতে মাঝে মাঝে ঘাম দিত।

থেনার্দিয়েররা আবার একটা চিঠি দিল। তাতে লেখা ছিল, কসেত্তের অসুখ করেছে। এই রোগটা এ অঞ্চলে খুব হচ্ছে। রোগটার নাম মিলিটারি ফিভার। এক ধরনের দূষিত জ্বর সৈনিকদের থেকে ছড়িয়ে পড়ে। তার জন্য তাদের ওষুধ কেনার পয়সা নেই। ফাঁতিনে যদি চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চল্লিশ ফ্রাঁ না পাঠায়, এক সপ্তার মধ্যে তা হলে তার মেয়ে মারা যাবে।

চিঠিটা পড়ে পাগলের মতো হাসতে লাগল ফাঁতিনে। সে মার্গারিতেকে বলল, চমৎকার! চল্লিশ ফ্রাঁ কোথা থেকে পাব? ওরা কি পাগল?

জানালার ধারে দাঁড়িয়ে চিঠিটা আবার পড়ল ফাঁতিনে। তাদের সে ঘর থেকে রাস্তায় চলে গেল হাসতে হাসতে। একজন জিজ্ঞাসা করল, এত হাসির কারণ কী? ফাঁতিনে বলল, চল্লিশ ফ্র। এক গ্রামের এক গরিব চাষি চল্লিশ ফ্রাঁ চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে।

ফাঁতিনে দেখল রাস্তার উপর এক জায়গায় অনেক লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে তখন এগিয়ে গিয়ে দেখল একটা লোক দাঁত বিক্রি করার জন্য বক্তৃতা দিচ্ছে আর তাকে ঘিরে একদল ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। যাদের দাঁত নেই তাদের কাছে এক একটা দাঁতের সেট বিক্রি করার চেষ্টা করছে সে। তার মজার মজার কথা শুনে অনেকে হাসছিল। ফাঁতিনেও ভিড়ের মধ্যে ঢুকে হাসতে লাগল। এমন সময় সেই দাঁত বিক্রেতা

ফাঁতিনেকে বলল, তোমার দাঁতগুলো তো বেশ সুন্দর। তোমার উপরকার পাটির দুটো দাঁতের জন্য দুটো স্বর্ণমুদ্রা দেব।

ফাঁতিনে বলল, উপরকার পাটির দুটো দাঁত?

লোকটা বলল, হ্যাঁ, দুটো সোনার মুদ্রা অর্থাৎ দুটো নেপোলিয়ঁ যা ভাঙালে চল্লিশ ফ্রাঁ পাবে।

ফাঁতিনে বলল, কী ভয়ঙ্কর কথা!

একজন বুড়ি কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, দুটো নেপোলিয়ঁ। তোমার ভাগ্য ভালো।

ফাঁতিনে কানে আঙুল দিয়ে পালিয়ে গেল। চিৎকার করে বলতে লাগল, ভালো করে ভেবে দেখ মেয়ে। চল্লিশ ফ্রাঁ। যদি তোমার মনের পরিবর্তন হয় তা হলে আজ সন্ধ্যায় তিলাক দার্জেন্তে আমাকে পাবে।

ফাঁতিনে রাগে আগুন হয়ে একরকম ছুটতে ছুটতে তার বাসায় গিয়ে মার্গারিতেকে সব কথা বলল। সে বলল, এই ঘৃণ্য লোকটাকে কেন ঘুরে বেড়াতে দেয়? ও বলল, আমার উপরকার পাটির দুটো দাঁত তুলে নেবে। আমাকে তা হলে ভয়ঙ্করভাবে বিশ্রী দেখাবে। চুল আবার গজাবে, কিন্তু দাঁত আর বেরোবে না। মানুষ নয়, লোকটা একটা রাক্ষস। তার থেকে জানালা থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরা ভালো। ও আবার বলল, তিলাক দার্জেন্তে ওর সঙ্গে সন্ধেবেলায় দেখা হবে।

মার্গারিতে বলল, দাম কত দেবে বলল?

ফাঁতিনে বলল, দুটো নেপোলিয়ঁ বা স্বর্ণমুদ্রা।

মার্গারিতে বলল, তার মানে, চল্লিশ ফ্রাঁ।

ফাঁতিনে বলল, হ্যাঁ, চল্লিশ।

চিন্তান্বিত অবস্থায় ফাঁতিনে সেলাইয়ের কাজ করতে লাগল। মিনিট পনেরো কাজ করার পর সে একবার উঠে গিয়ে থেনার্দিয়েরদের চিঠিটা পড়ল। তার পর আবার তার জায়গায় গিয়ে মার্গারিতেকে বলল, আচ্ছা মিলিটারি ফিভারটা কী? তুমি এ রোগের নাম শুনেছ?

মার্গারিতে বলল, হ্যাঁ, একটা রোগ।

এ রোগের জন্য কি অনেক ওষুধ লাগে?

হ্যাঁ, খুব জোরালো ওষুধ দরকার।

কিভাবে রোগটা হয়?

যেমন করে সব রোগ হয়।

মেয়েদের এ রোগ হয়?

এ রোগ ছেলেদেরই বেশি হয়।

এ রোগে মৃত্যু হয়?

প্রায়ই মৃত্যু হয়।

ফাঁতিনে ঘর থেকে বেরিয়ে আবার চিঠিটা পড়তে গেল। সেদিন সন্ধ্যায় সে বাসা থেকে বেরিয়ে র‍্যু দ্য প্যারিসের দিকে চলে গেল দ্রুত পায়ে।

পরদিন সকালে মার্গারিতে যখন ফাঁতিনের ঘরে ঢুকল তখন দেখল সে বিছানায় শুয়ে নেই। সে মেঝের উপর বসে রয়েছে এক জায়গায় হাঁটু দুটো জড়ো করে এবং বাতিটা জ্বলতে জ্বলতে একেবারে পুড়ে গেছে। মার্গারিতে ফাঁতিনের সঙ্গে সেলাইয়ের কাজ করত বলে রোজ সকালে এসে ফাঁতিনেকে ওঠাত। একই বাতিতে তারা কাজ করত। মার্গারিতে বুঝল, সারারাত ঘুমোয়নি ফাঁতিনে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে বলে উঠল, হা ভগবান! কী হল তোমার?

ফাঁতিনে বলল, আমার কিছুই হয়নি। আমি এখন সুখী, আমার মেয়ে আর ওষুধ অভাবে মরছে না।

এরপর টেবিলের উপর নামানো দুটো স্বর্ণমুদ্রার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখাল ফাঁতিনে।

মার্গারিতে বলল, এ তো অনেক টাকা! কোথায় পেলে এত টাকা?

ফাঁতিনে বলল, আমি রোজগার করেছি।

বলতে বলতে হাসল ফাঁতিনে। মার্গারিতে দেখল তার হাসিটা রক্তমাখা। মুখে তখনো রক্ত লেগে ছিল ফাঁতিনের। তার উপরকার পাটিতে দুটো দাঁত ছিল না বলে ফাঁকা ফাঁকা দেখাচ্ছিল।

টাকাটা তফারমেলে পাঠিয়ে দিল ফাঁতিনে।

একথা বলা নিষ্প্রয়োজন যে থেনার্দিয়েররা মিথ্যা কথা বলেছিল। কসেত্তের কোনও অসুখ করেনি।

এদিকে চুল আর দাঁত হারিয়ে ফাঁতিনে রেগে আয়নাটা ফেলে দিয়েছিল। তিনতলার একটা ঘরে তাকে থাকতে হত। সেখানে শীত আরও বেশি। ফাঁতিনের কোনও খাট ছিল না। বিছানা বলতে মেঝের উপর একটা তোষক পাতা থাকত। আর একটা ছেঁড়া কম্বল। একটা আধভাঙা চেয়ার ছিল ঘরের এক কোণে। আর একটা জলের বালতি ছিল। তাতে জলটা জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল শীতে। যারা ফাঁতিনের কাছে টাকা পেত সেইসব পাওনাদার রাস্তায় তাকে দেখতে পেলেই শান্তিতে পথ চলতে দিত না। অনেক সময় অনেক পাওনাদার বাসায় এসে তাগাদা করত। গোলমাল ও হৈ-চৈ করত টাকার জন্য। তার জামা ময়লা হয়ে গিয়েছিল। মোজা দুটো ছিঁড়ে গিয়েছিল। ছেঁড়া জামায় তালি বসিয়েছিল। সে প্রায় সারারাত চিন্তা করে আর চোখের জল ফেলে কাটাত। ঘুম হত না। পিঠে আর কাঁধের কাছে একটা ব্যথা অনুভব করত। খুব কাশি হত। সে পিয়ের ম্যাদলেনকে গভীরভাবে ঘৃণা করত বলে তার বিরুদ্ধে কিছুই বলত না কারও কাছে। সে প্রতিদিন সতেরো ঘণ্টা করে সেলাই করত, কিন্তু তাতে মাত্র নয় স্যু করে পেত। জেলখানার এক কন্ট্রাক্টার তাদের বেতন কমিয়ে দেয়। সতেরো ঘণ্টা কাজ করে মাত্র নয় স্যু পাওয়ায় তাতে কোনওরকমে খাওয়া ছাড়া আর কিছুই হত না। তার পাওনাদারেরা ক্রমশই অশান্ত হয়ে উঠতে লাগল। তারা আর কোনও কথা শুনতে চায় না। আর সে কী করবে? পাওনাদারদের অবিরাম তাগাদার জ্বালায় সে পশুর মতো হয়ে উঠল। এমন সময় একদিন থেনার্দিয়ের এক চিঠিতে জানাল, সে যদি একশো ফ্ৰাঁ না পাঠায় তা হলে তারা কসেত্তেকে তাদের বাড়ি থেকে বার করে দেবে। সম্প্রতি রোগ থেকে উঠে দুর্বল অবস্থায় পথে পথে ঘুরে বেড়াবে সে। তাতে সে অবশ্যই মরবে।

একশো ফ্ৰাঁ কী করে জোগাড় করবে সে? দিনে নয় স্যু’র জায়গায় একশো স্যু করে রোজগার করতে হবে তাকে। তবে একটামাত্র পথ আছে। সে ভাবল, ঠিক আছে, আমি তাই করব, আমি একবার আমার দেহ বিক্রি করব।

ফাঁতিনে বারবণিতা হয়ে গেল।

.

১১

ফাঁতিনের কাহিনী হল সমাজ একটি মানুষকে কিভাবে চিনে নেয় তার কাহিনী। দারিদ্র্য, ক্ষুধা, নিঃসঙ্গতা, শীতার্ত অসহায়তা, নিরাপত্তার অভাব, নিরাশ্রয়তা প্রভৃতির হাত থেকে বাঁচার জন্য মানুষ কিভাবে নিজেকে বিলিয়ে দেয়, আত্মবিক্রীত হয় তার এক সকরুণ কাহিনী। দারিদ্র্য তাদের বিলিয়ে দেয় আর সমাজ তাদের হাত বাড়িয়ে নিয়ে নেয়।

আমাদের সমাজ যিশু খ্রিস্টের উপদেশাবলির দ্বারা অনুশাসিত হয়। কিন্তু সেটা নামে মাত্র। সে উপদেশ তারা আসলে মেনে চলে না। আমরা বলি ক্রীতদাসপ্রথা ইউরোপীয় সভ্যতা থেকে চলে গেছে, কিন্তু ক্রীতদাসপ্রথা এখনও আছে এবং সেটা শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রেই চলে এবং তার নাম হল বেশ্যাগিরি।

এ প্রথা নারীদের ওপর পীড়ন চালায়। তাদের যৌবন, সৌন্দর্য, মাতৃত্ব সব কেড়ে নেয়। অথচ তাতে পুরুষরা কোনও লজ্জা পায় না।

যে অবস্থার মধ্যে ফাঁতিনে এখন পড়েছে তাতে আগেকার সেই ফাঁতিনে নামে সুন্দরী মেয়েটির কিছুই অবশিষ্ট নেই। তার বাইরের সৌন্দর্য আর অন্তরের সত্তা সব অদৃশ্য হয়ে গেছে। এখন সে একেবারে যেন পাথর হয়ে গেছে ভেতরে-বাইরে। এখন তাকে স্পর্শ করা মানে হিমশীতল এক পাথরের মূর্তিকে স্পর্শ করা। কোনও লোক এলে তাকে গ্রহণ করে, নিজেকে বিলিয়ে দেয় তার কাছে, কিন্তু মনে মনে তাকে উপেক্ষা করে, ঘৃণার চোখে দেখে। তার ব্যক্তিজীবন এবং সমাজজীবন শেষ কথা বলে দিয়েছে তাকে। খারাপ যা কিছু ঘটার সব ঘটে গেছে। সে সব দুঃখ জেনে গেছে, সব দুঃখ সহ্য করে সে দেখেছে, শেষ অশ্রুবিন্দুটুকু সে পাত করেছে। নিদ্রা যেমন প্রসারিত হয়ে চিরনিদ্রা বা মৃত্যুতে পরিণত হয়, তেমনি ভাগ্যের কাছে তার নীরব আত্মসমর্পণ ধীরে ধীরে এক হিমশীতল ঔদাসীন্যে পরিণত হয়। আর সে কোনও দুঃখকষ্টকে ভয় করে না, আর সে কোনও দুঃখকষ্ট থেকে পরিত্রাণ বা মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছা বা চেষ্টা করে না। এখন যদি সমস্ত আকাশটা তার মাথায় ভেঙে পড়ে, সমুদ্রতরঙ্গ যদি ছুটে এসে তাকে গ্রাস করে তা হলেও তাতে তার কিছু যায়-আসে না।

এখন ফাঁতিনের মনে হয় ভাগ্যের বিধানে পাওয়া দুঃখ আমরা ভোগ করি, কখনও করতে পারি না একথা মনে করা ভুল। ভাগ্য যত দুঃখই দিক না কেন, আমরা তা ভোগ করতে পারি, অপরিসীম আমাদের সহনশক্তি। ভাগ্যের নিষ্ঠুরতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সহনশক্তিও অবশ্যই বেড়ে যায়।

কিন্তু এই ভাগ্য কী? কোথায় আমাদের নিয়ে যায় সে ভাগ্য? এই ভাগ্য কারও ওপর সুপ্রসন্ন আর কারও ওপর অপ্রসন্ন হয় কেন? এ প্রশ্নের উত্তর একমাত্র ঈশ্বরই দিতে পারেন।

.

১২

মন্ত্রিউল-সুর-মেরের মতো ছোট শহরে একশ্রেণির যুবক আছে যারা তাদের বছরে পনেরো হাজার ফ্ৰাঁ বাজে খরচ করে উড়িয়ে দেয়। প্যারিসে পিয়ার বা জমিদাররা বছরে আড়াই হাজার ফ্ৰাঁ বাজে খরচ করে। এই ধরনের লোকরা সাধারণত বড় অপদার্থ এবং অলস প্রকৃতির হয়। তারা কোনওরকমে একবার কিছু টাকা রোজগার করলেই হোটেলে ঘুরে বেড়ায় আর বড় বড় কথা বলে। তারা কখনও শিকার করে, কখনও বিলিয়ার্ড খেলে আর যখন-তখন মদ খায়। আসলে সারা জীবনের মধ্যে ভালো-মন্দ কাজই করে না, শুধু বাজে কাজে ঘুরে বেড়িয়ে জীবনটাকে নষ্ট করে।

মঁসিয়ে ফেলিক্স থোলোমায়েস যদি প্যারিসে না এসে গাঁয়েই থাকত তা হলে ওই ধরনের এক অলস ভবঘুরে হয়ে উঠত। তবে এই ধরনের লোক গরিব হলে তাকে ভবঘুরে বলত আর ধনী হলে বলত অমিতব্যয়ী ভদ্রলোক। এই ধরনের লোকরা মোচ রাখত। গাঁয়ের ভবঘুরেরা বেশি বড় বড় মোচ রাখত। তারা হাতে একটা করে ছড়ি রাখত এবং নাটকীয় ঢঙে কথা বলত।

সে যুগে স্পেনের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আমেরিকায় প্রজাতন্ত্রের যুদ্ধ চলছিল। মোরিলোর সঙ্গে লড়াই চলছিল বলিভার। যারা ছোট কানাওয়ালা টুপি পরত আর রাজতন্ত্রের সমর্থনে কথা বলত তাদের বলা হত মোরিলো। আর যারা উদারনীতিভাবাপন্ন ছিল আর চওড়া কানাওয়ালা টুপি পরত তাদের বলা হত বলিভার।

যে ঘটনার কথা বলা হয়েছে তার আট-দশ মাস পরে ১৮২৪ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথমে কোনও এক তুষারাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় এক অলস ভবঘুরে ধনী অফিসারদের এক কাফেতে ভালো পোশাক আর মমারিলোদের মতো টুপি পরে একটি মেয়ের সঙ্গে বসে কথা বলছিল। মেয়েটি একটি লো-কাট গাউন পরেছিল আর তার মাথায় ফুল গোঁজা ছিল।

ভদ্রলোক ধূমপান করছিল। তখনকার দিনে ধূমপান খুব শৌখিনতার পরিচায়ক ছিল। লোকটি মেয়েটার মুখে বারবার ধোয়া ছাড়ছিল আর ঠাট্টা করে কী সব বলছিল। মেয়েটির মুখখানা বিষণ্ণ ছিল। সে তখন ক্লান্ত ও অবসন্ন থাকায় সে গ্রাহ্য করছিল না লোকটাকে।

ওরা কাফের বাইরে তুষারপাতের মধ্যেই বেড়াচ্ছিল। লোকটি যখন দেখল মেয়েটি তাকে তেমন গ্রাহ্য করছে না তখন পথ থেকে একমুঠো বরফ কুড়িয়ে মেয়েটির অনাবৃত ঘাড়ের উপর দিয়ে দিল। লোকটির নাম ছিল মঁসিয়ে বামাতাবয়। মেয়েটি একবার জোরে চিৎকার করে উঠে তার হাতের নখ দিয়ে লোকটার মুখটা ছিঁড়ে-খুঁড়ে দিতে লাগল। সে বাঘিনীর মতো উগ্র রূপ ধারণ করল। তার ফোকলা মুখ থেকে যত সব নোংরা গালাগালি বার হতে লাগল। মেয়েটি হল ফাঁতিনে।

গোলমাল শুনে কাফের ভেতর থেকে অফিসাররা ছুটে এল। ধস্তাধস্তি করতে থাকা একজন নারী আর একজন পুরুষকে ঘিরে একদল জড়ো হয়ে হাসাহাসি করতে লাগল। লোকটা আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিল আর ফাঁতিনে তাকে চড়-লাথি মারছিল আর চিৎকার করছিল উন্মাদের মতো।

সহসা ভিড়ের মধ্য থেকে একজন লম্বা লোক এগিয়ে এসে ফাঁতিনের একটা হাত ধরে ফেলল। ফাঁতিনের পোশাকের উপর কাদা লেগে ছিল। যে লোকটি ফাঁতিনের হাত ধরেছিল সে তাকে বলল, তুমি আমার সঙ্গে এস। লোকটিকে দেখে চুপ করে গেল ফাঁতিনে। প্রচণ্ড রাগে আগুন হয়ে থাকা মুখখানা সহসা ম্লান হয়ে গেল আর ভয়ে কাঁপতে লাগল। সে চিনতে পেরেছিল লোকটি জেভাৰ্ত, পুলিশের লোক।

সুযোগ বুঝে মঁসিয়ে বামাতাবয় এক ফাঁকে তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেল।

.

১৩

কৌতূহলী দর্শকদের ভিড় সরিয়ে জেতার্ত ফাঁতিনেকে টানতে টানতে কাছাকাছি একটা পুলিশ ফাঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। ফাঁতিনে কোনও বাধা দিল না। কেউ কোনও বাধা দিল না। দর্শকরা আনন্দে চিৎকার করতে করতে তাদের অনুসরণ করতে লাগল। দর্শকদের কুৎসিত আনন্দ দেখে চরম অপমান আর লজ্জাবোধ করতে লাগল ফাঁতিনে।

পুলিশ ফাঁড়ি রাস্তার ধারে একটা ঘর। ঘরের দরজাটা ছিল রাস্তার দিকে। ঘরের ভেতর একটা স্টোভ জ্বলছিল। ঘরের ভেতর তিনেকে নিয়ে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিল জেভার্ত। এতে দর্শকরা হতাশ হল। দর্শকরা ঘাড় উঁচু করেও কিছু দেখতে পেল না।

ঘরের এক কোণে ফাঁতিনে গিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত এক জন্তুর মতো বসে রইল। অফিসে যে সার্জেন্ট কর্তব্যরত ছিল সে একটা বাতি জ্বালিয়ে টেবিলের উপর রাখল। জেভার্ত পকেট থেকে একটা সাদা কাগজ বার করে কী লিখতে লাগল।

দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে এই ধরনের মেয়েরা সম্পূর্ণ পুলিশের দয়ার ওপর নির্ভর করে। পুলিশ তাদের যে কোনও শাস্তি দিতে পারে, তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা একেবারে কেড়ে নিতে পারে। জেভার্তের মনে চিন্তার আলোড়ন চলতে থাকলেও তার মুখে কোনও আবেগের চিহ্নমাত্র ছিল না। এসব ক্ষেত্রে সে পুরোপুরি তার বিবেকের নির্দেশে চলতে পারে, কোনও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কোনও নির্দেশ চাইতে হবে না। এই অফিসের চেয়ারটাই হল বিচারপতির আসন। এই চেয়ারে বসেই সে আসামির বিচার করে রায় দেবে। সে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দেখল এটা একটা অপরাধ। মঁসিয়ে বামাতাবয় তার চোখে সমাজের এমনই এক গণ্যমান্য লোক যিনি এক তিনতলা বাড়ির মালিক এবং যার ভোটাধিকার আছে। এই ধরনের এক বিশিষ্ট নাগরিককে সমাজবহির্ভূতা এক বারবণিতা মারধর করেছে। জেভার্ত নিজে তা দেখেছে। সে আপন মনে লিখে যেতে লাগল।

তার লেখা শেষ হলে তাতে সই করে কাগজটা ভাজ করে সার্জেন্টের হাতে দিয়ে বলল, রক্ষীকে দিয়ে এই মেয়েটাকে জেলে পাঠিয়ে দাও।

এরপর সে ফাঁতিনের দিকে ঘুরে বলল, তোমাকে ছয় মাসের জন্য জেলে যেতে হবে। নিবিড় হতাশার সঙ্গে চিৎকার করে উঠল, ছয় মাস! ছয় মাস জেল! সারাদিনের। খাটুনির বিনিময়ে মাত্র সাত সু? কসেত্তের কী হবে? আমার মেয়ের কী হবে? মঁসিয়ে ইন্সপেক্টর, আপনি কি জানেন থেনার্দিয়েরের কাছে আমার একশো ফ্রাঁ ঋণ আছে?

জোড়হাত করে মেঝের উপর নতজানু হয়ে বসল ফাঁতিনে। তার পর বলতে লাগল, মঁসিয়ে জেভাৰ্ত, আমাকে দয়া করুন। এটা আমার দোষ নয়। আপনি যদি জানতেন ব্যাপারটার মূল কারণটা কী। আমি ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি আমার কোনও দোষ নেই। একজন ভদ্রলোক যাকে আমি চিনি না, আমার ঘাড়ের উপর বরফ দেয়। আপনি দেখছেন আমার শরীর ভালো নেই। তার পর সে যত সব অবাঞ্ছিত অন্যায় কথা বলতে থাকে। সে বলে আমি দেখতে কুৎসিত এবং আমার দাঁত নেই, যেন আমি এসব জানি না। কিন্তু আমি কিছু বলিনি। আমি ভাবছিলাম ও আমাকে ঠাট্টা করছে। আমি নীরবে হাঁটছিলাম এমন সময় আমার ঘাড়ের উপর বরফ চাপিয়ে দেয়। মঁসিয়ে জেভাৰ্ত, যা ঘটেছিল তা বলার মতো কি কেউ নেই? আমার অবশ্য রেগে যাওয়াটা অন্যায় হয়েছিল, কিন্তু এই ধরনের ঘটনা যদি ঘটে, যদি কেউ অপ্রত্যাশিতভাবে আপনার ঘাড়ের উপর বরফ চাপিয়ে দেয় তা হলে আপনি নিশ্চয় আত্মবিস্মৃত হয়ে সব সংযম হারিয়ে ফেলতেন। ভদ্রলোকের টুপিটা নষ্ট করে দেওয়া আমার উচিত হয়নি। কিন্তু উনি কেন পালিয়ে গেলেন? উনি থাকলে আমি ক্ষমা চাইতাম, যদিও ক্ষমা চাওয়ার মন আমার নেই। মঁসিয়ে জেভাৰ্ত, এবারকার মতো আমাকে ছেড়ে দিন। আমার মনে হয় আপনি জানেন না জেলখানার খাটুনির জন্য প্রতিদিন মাত্র সাত স্যু করে দেওয়া হয়। আমার একশো ফ্ৰাঁ ধার আছে এবং তা না দিতে পারার জন্য আমার বাচ্চা মেয়েকে পথে বার করে দেওয়া হবে। অবশ্য সাত স করে দেওয়াটা সরকারের দোষ, তা বলছি না। তবে আমার এই অবস্থা। ঈশ্বর আমায় দয়া করুন। আমার মেয়েকে আমি এখন কাছে রাখতে পারি না। আমি যে ধরনের জীবনযাপন করি তাতে তাকে কাছে রাখা যায় না। আমার সন্তানের কী হবে? হোটেলমালিক থেনার্দিয়েররা ভালো লোক নয়, ওদের দয়ামায়া বা কোনও যুক্তিবোধ নেই, ওরা শুধু টাকা চায়। আমাকে জেলখানায় পাঠাবেন না। এই শীতে ওরা আমার সন্তানকে তাড়িয়ে দেবে। একটু ভেবে দেখবেন মঁসিয়ে জেতার্ত। ও যদি বড় হত তা হলে নিজের জীবিকা নিজেই অর্জন করতে পারত। কিন্তু ওর বয়স এত কম যে তা পারবে না। আমি সত্যি সত্যিই খারাপ নই। অবশ্য লোভ-লালসার জন্য আমার এ অবস্থা হয়নি। আমি অবশ্য মাদক বা নেশার পিল খাই, কিন্তু দুঃখের চাপে পড়েই তা খাই, কারণ তা আমার মনের দুশ্চিন্তাটা কাটিয়ে দেয়। আমি যেসব পোশাক পরতাম তা দেখলে আপনি বুঝতে পারতেন আমি হালকা প্রকৃতির মেয়ে ছিলাম না বা উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতাম না। আমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন লিনেনের তৈরি ভদ্র পোশাক পরতাম। আমাকে দয়া করুন মঁসিয়ে জেভার্ত।

আধখোলা বুকের উপর হাত দুটো জড়ো করে নতজানু হয়ে কথা বলছিল ফাঁতিনে আর মাঝে মাঝে কাশছিল। তার চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। চরম দুঃখ থেকে এমন এক জ্যোতি নির্গত হয়, যা যে কোনও মানুষের অসহায় ও শোচনীয় অবস্থাকেও কিছুটা রূপান্তরিত করে তোলে। ফাঁতিনে যখন সামনের দিকে ঝুঁকে জেভার্তের কোটের প্রান্তভাগটাকে তার ঠোঁটের উপর ঠেকিয়ে কথা বলছিল তখন তাকে সত্যিই সুন্দর দেখাচ্ছিল। তার মর্মবিদারক কথা শুনে যে কোনও পাথরের অন্তর গলে যেত, কিন্তু কাঠের অন্তর কখনও গলে না।

জেতার্ত বলল, আমি তোমার সব কথা শুনেছি। আর কিছু তোমার বলা আছে? এবার তুমি যেতে পার। তোমাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতেই হবে। স্বয়ং পরম পিতা ঈশ্বরও এ দণ্ড মকুব করতে পারবেন না।

পরম পিতার নাম শুনে ফাঁতিনে বুঝল জেভার্তের দেওয়া দণ্ড চূড়ান্ত। সে মেঝের উপর পড়ে গেল। তার মুখ থেকে শুধু একটা কথা বেরিয়ে এল, দয়া, দয়া কর।

জেভার্ত তার দিকে পেছন ফিরল এবং দু জন পুলিশ ফাঁতিনেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ধরল।

কয়েক মিনিট আগে একজন লোক সকলের অলক্ষে ঘরে ঢুকে নীরবে দাঁড়িয়ে তিনের দুঃখের কথা শুনছিল। ফাঁতিনের কাতর আবেদনের সব কথা শুনেছিল সে। পুলিশরা যখন ফাঁতিনেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল তখন সে এগিয়ে এল। সে জেভার্তকে লক্ষ করে বলল, একমুহূর্ত একটু অপেক্ষা করবেন?

জেতার্ত মুখ ফিরিয়ে দেখল, মঁসিয়ে ম্যাদলেন কথা বলছে। সে টুপিটা খুলে একটু নত হয়ে বলল, মাপ করবেন মঁসিয়ে মেয়র।

ম্যাদলেনের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ল ফাঁতিনে। সে উঠে দাঁড়িয়ে ম্যালেনের সামনে এসে বলল, তুমিই মেয়র?

পাগলের মতো হাসতে হাসতে ম্যালেনের মুখের উপর থুতু ফেলল।

ম্যাদলেন তার মুখ থেকে থুতুটা মুছে বলল, ইন্সপেক্টর জেভাৰ্ত, এই মেয়েটিকে ছেড়ে দিতে হবে। কথাটা শুনে জেভার্তের মনে হল সে পাগল হয়ে যাবে। এমন সব ভয়ঙ্কর আবেগের আঘাতে তার অন্তর আন্দোলিত হতে লাগল, যা এর আগে কখনও সে অনুভব করেনি। শহরের একটা সামান্য মেয়ে মুখের উপর থুতু ফেলবে, এটা তার কল্পনাতীত। এটা সে ভাবতেই পারে না। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে একটা অস্পষ্ট ধারণা হল হয়তো এই মেয়েটির সঙ্গে মেয়রের একটা অবৈধ সম্পর্ক ছিল এবং মেয়র নিজেই প্রকটিত করে তুললেন সেই গোপন সম্পর্কটা। কিন্তু যখন সে দেখল মেয়র শান্তভাবে মুখ থেকে থুতু মুছে মেয়েটাকে ছেড়ে দিতে বলল তখন বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল সে।

ফাঁতিনেও কম আশ্চর্য হয়নি। সে গলার স্বরটাকে নিচু করে বলতে লাগল, আমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে? ছয় মান জেলভোগ করতে হবে না? কিন্তু কথাটা কে বলল? একথা কেউ বলতে পারে না। আমি নিশ্চয় ভুল শুনেছি। এ কথা নিশ্চয় ওই দানব মেয়র বলেনি। হে সদাশয় মঁসিয়ে জেভাৰ্ত, আপনিই কি বললেন আমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে? আমি সব কথা বলব, তা হলে আপনি আমাকে ছেড়ে দেবেন। এই সবকিছু ওই শয়তান মেয়রটার জন্যই হয়েছে। কয়েকজন মেয়ের কথা শুনে ও আমায় চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেয়। এক সৎ মেয়ে-শ্রমিককে অকারণে বরখাস্ত করাটা কি এক ঘৃণ্য কাজ নয়? চাকরি না থাকার জন্য আমি কিছু রোজগার করতে পারতাম না এবং তার থেকেই যত বিপত্তির উৎপত্তি হয়। তবে পুলিশেরও কিছু করার আছে। জেলখানার কন্ট্রাক্টাররা কম টাকায় বাইরের গরিব মেয়েদের বেশি খাঁটিয়ে অবিচার করে তাদের প্রতি। এটা পুলিশ বন্ধ করতে পারে। আগে আমরা জামা সেলাই করে দিনে বারো স্যু করে পেতাম। পরে ওরা তা কমিয়ে নয় স্যু করে। আমার মেয়ে কসেত্তের কথা আমায় ভাবতে হত, তাই আমাকে কুপথে নামতে হয়। তা হলে এবার দেখতে পাচ্ছেন মেয়রই এই সবকিছুর মূলে? ঘটনাক্রমে আমি ওই কাফের বাইরে ভদ্রলোকের টুপিটা ঘুষি মেরে খারাপ করে দিই, কারণ আমার ঘাড়ে বরফ চাপিয়ে দিয়েছিল। আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই কারও ক্ষতি করতে চাইনি। আমার থেকে কত খারাপ মেয়ে ভালো অবস্থার মধ্যে আছে। আপনি সবাইকে আমার কথা জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আমার বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন আমি নিয়মিত ভাড়া দিয়ে যাই। আমি সৎ।

মঁসিয়ে ম্যাদলেন এতক্ষণ ফাঁতিনের সব কথা মন দিয়ে শুনছিল। ফাঁতিনে যখন কথা বলছিল তখন সে তার পকেট থেকে টাকার ব্যাগটা বার করে। কিন্তু দেখে ব্যাগটা খালি। পকেটের মধ্যে ব্যাগটা রেখে সে ফাঁতিনেকে বলল, কত টাকা তোমার দেনা আছে বললে?

ফাঁতিনে এতক্ষণ জেভার্তকে লক্ষ করে কথা বলছিল। সে এবার মুখ ফিরিয়ে ম্যাদলেনকে বলল, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি।

ফাঁতিনে এবার জেভাৰ্তকে বলল, আপনি দেখলেন আমি ওর মুখের উপর থুতু ফেলেছি।

এবার ম্যালেনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি অসভ্য, তুমি আমাকে ভয় দেখাতে চেয়েছ। কিন্তু তোমার ভয়ে আমি ভীত নই। আমি শুধু মঁসিয়ে জেতার্তকে ভয় করি।

ফাঁতিনে এবার জেভার্তকে লক্ষ্য করে বলতে লাগল, মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করাই উচিত। আমি জানি, আপনি ভালো লোক। আসলে ব্যাপারটা এমন কিছু নয়। একটা লোক একটি মেয়ের ঘাড়ে বরফ দেয় আর তা নিয়ে অফিসাররা হাসাহাসি করে। মেয়েদের এসব সহ্য করতে হয়। তার পর আপনি এলেন, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখাই আপনাদের কর্তব্য। আমি গোলমাল করায় আপনি আমাকে ধরে নিয়ে এলেন। তার পর আমার কাতর আবেদন শুনে আমার মেয়ের কথা ভেবে আমার ওপর দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিলেন। আপনি আমাকে বলতে পারেন, এ কাজ আর কখনও করো না। আমি বলছি, এ কাজ আর কখনও আমি করব না। শুধু এবারকার মতো আমাকে ক্ষমা করুন। আচমকা বরফটা দেওয়ায় আমার মেজাজটা গরম হয়ে ওঠে। আমার শরীরটা ভালো নেই। আমার কাশি হচ্ছে। ভেতরটা যেন জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। আমার গাঁয়ে হাত দিয়ে দেখতে পারেন।

আর কাঁদছিল না ফাঁতিনে। তার চোখে জল ছিল না। তার কণ্ঠটা শান্ত ও নরম ছিল। সে জেভার্তের রুক্ষ হাতটা টেনে নিয়ে তার গলার উপর রাখল। তার পর আলুথালু পোশাকটা ঠিক করে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। পুলিশদের বলল, ইন্সপেক্টার আমাকে যেতে বলেছেন।

দরজার খিলটা খুলতেই একটা শব্দ হল।

জেভার্ত এতক্ষণ পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে মেঝের উপর দৃষ্টি রেখে দাঁড়িয়েছিল অন্য মনে। তার কোনও বিছু খেয়াল ছিল না। খিল খোলার শব্দে তার চমক ভাঙল। হিংস্র জন্তুর মতো সে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে চোখ তুলে তাকাল ফাঁতিনের দিকে।

জেভার্ত পুলিশদের বাল, সার্জেন্ট, দেখছ না মেয়েটা পালাচ্ছে? কে তাকে যেতে বলেছে?

ম্যাদলেন বলল, আমি বলেছি।

জেভার্তের কথা শুনে ফাঁতিনে দরজার খিল ছেড়ে পেছন ফিরে দাঁড়াল। যেন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে।

ম্যাদলেনের কথা শুনে সে এবার তার পানে তাকাল। তার বিস্মিত ব্যথাহত চোখের দৃষ্টি পালাক্রমে জেভার্ত আর মাদলেনের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে লাগল।

জেভার্ত যখন সার্জেন্টকে কড়া গলায় হুকুম দিয়েছিল তখন সে কি মেয়রের উপস্থিতির কথা জানত না? অথবা সে কি মনে ভেবেছিল এ ধরনের কথা মেয়রের মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলতে পারেন না এবং যেন ভুল করে এ কথা বলে ফেলেছেন? সে কি ভেবেছিল এই মুহূর্তে সমস্ত নীতি, ন্যায়বিচার, সরকার, আইন, সমাজ সব মূর্ত হয়ে উঠেছে শুধু তারই মধে?

সে যাই হোক, মঁসিয়ে ম্যালেনের কথা শুনে জেভার্ত এবার তার দিকে ধীরে পায়ে এগিয়ে গেল। তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। ঠোঁটটা নীল হয়ে উঠেছিল। এক মৃদু কম্পনে শরীরটা কাঁপছিল তার। চোখ দুটো নামিয়ে অথচ দৃঢ় কণ্ঠে সে বলল, মঁসিয়ে মেয়র, তা তো হতে পারে না।

মঁসিয়ে ম্যাদলেন বলল, কেন হতে পারে না?

জেভার্ত বলল, কারণ এ নারী একজন বিশিষ্ট নাগরিককে অপমান করেছে।

ম্যাদলেন শান্ত কণ্ঠে বলল, শুনুন ইন্সপেক্টার জেতার্ত, আমি জানি আপনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি, ব্যাপারটা আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলছি। আসল ঘটনাটা হল এই। আপনি যখন একে ধরে আনছিলেন আমি তখন রাস্তা পার হচ্ছিলাম। তখন সেখানে কিছু লোক দাঁড়িয়েছিল। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করি, কী হয়েছে। আমি সব কথা শুনেছি। যে নাগরিককে এ অপমান করেছে, দোষটা তার। আইন অনুসারে তাকেই গ্রেপ্তার করা উচিত।

জেভার্ত জোর দিয়ে বলল, কিন্তু এই শহরের মেয়র আপনাকেও অপমান করেছে।

মাদলেন বলল, সেটা আমার অপমান, আমার এক ধরনের সম্পত্তি। আমি তা নিয়ে যা খুশি করতে পারি।

জেভার্ত বলল, মাপ করবেন মঁসিয়ে মেয়র। অপমান শুধু আপনাকে নয়, ন্যায়বিচারকেই ও অপমানিত করেছে।

বিবেকই সবচেয়ে বড় বিচারক মঁসিয়ে জেভার্ত। আমি মেয়েটির সব কথা শুনেছি এবং আমি কী করেছি আমি তা জানি।

আমি নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছি না মঁসিয়ে মেয়র।

তা হলে আমার কথামতো কাজ করুন।

আমাকে আমার কর্তব্য করতে হবে। আমার কর্তব্য হল ওকে ছয় মাসের জন্য জেলে পাঠানো।

ম্যাদলেন তবু শান্ত কণ্ঠে বলল, আপনাকে এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। ও একদিনের জন্যও জেলে যাবে না।

ম্যালেনের কথাগুলোতে জেভার্ত আরও সাহস পেয়ে গেল। সে শ্রদ্ধার সঙ্গে ম্যালেনের পানে তাকিয়ে বলতে লাগল, মেয়রের সঙ্গে এ ব্যাপারে তর্ক করতে আমার বড় খারাপ লাগছে। এ ধরনের ঘটনা এর আগে কখনও ঘটেনি। কিন্তু আমি মঁসিয়ে মেয়রকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আমি আমার ক্ষমতা অনুসারেই কাজ করছি। নাগরিকদের স্বার্থ দেখাই আমাদের কাজ। আমি সেখানে ছিলাম। মেয়েটি মঁসিয়ে বামাতাবয়কে মারধর করেছে। মঁসিয়ে বামাতাবয় একজন নাগরিক, নির্বাচকমণ্ডলীর তালিকায় তাঁর নাম আছে, এক তিনতলা বাড়ির মালিক। এ ব্যাপারটা পুলিশ আইনের আওতায় পড়ে। আমি তাই ফাঁতিনেকে ধরেছি।

এ কথায় মঁসিয়ে ম্যাদলেন হাত দুটো জড়ো করে এমন গলায় কথা বলতে লাগল, যা এর আগে কেউ কখনও শোনেনি। সে বলল, আপনি যে আইনের কথা বললেন সেটা মিউনিসিপ্যাল পুলিশের আইন এবং সেটা হল অপরাধবিধির নয়, এগারো, পনেরো আর ছেষট্টি ধারা এবং তার ওপর আমার পূর্ণ কর্তৃত্ব আছে। আমি সেই ধারা বলে মেয়েটিকে ছেড়ে দিতে বলছি।

জেভার্ত একবার শেষ চেষ্টা করে দেখল। বলল, কিন্তু মঁসিয়ে মেয়র

ম্যাদলেন বলল, আমি আপনাকে ১৭৯৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর পাস করা আইনের একাশি ধারার কথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যাতে কাউকে আটক রাখা যায়।

আমার কথা শুনুন মঁসিয়ে মেয়র।

খুব হয়েছে। এটাই যথেষ্ট বলে মনে করি।

কিন্তু–

আপনি দয়া করে এখান থেকে চলে যান।

জেতার্ত একজন কর্তব্যরত রুশ সৈনিকের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার পর মাথাটা একবার নুইয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ফাঁতিনে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল আর শুনছিল। সে আশ্চর্য হয়ে জেভার্তের যাওয়ার পথ করে দিল।

তার অন্তরেও তখন জোর আলোড়ন চলছিল। সে দেখেছে তাকে নিয়ে দু জন পদস্থ লোকের কত তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। এই দু জন লোকের ওপর তার স্বাধীনতা, তার মেয়ের জীবন নির্ভর করছিল। একজন তাকে গভীরতর অন্ধকারে টেনে নিয়ে যেতে চাইছিল আর একজন তাকে আলোর দিকে নিয়ে যেতে চাইছিল। সে ভয়ে ভয়ে লক্ষ করছিল এই দু জন শক্তিশালী পুরুষ দৈত্যের মতো বাকযুদ্ধ করছিল–একজন দৈত্যের মতো কথা বলছিল আর একজন দেবদূতের মতো কথা বলছিল। অবশেষে দেবদূতই জয়লাভ করে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা এই যে, যে দেবদূত তাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করে সে হল তার চোখে সেই ঘৃণ্য মেয়র যাকে সে তার সকল দুঃখকষ্টের মূল কারণ হিসাবে ভেবে এসেছে। সে অপমান করা সত্ত্বেও সেই মেয়রই তাকে উদ্ধার করল। তবে সে কি অন্যায় করেছে? তবে কি তার অন্তরের পরিবর্তন করতে হবে? সে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল আর ম্যাদলেনের পানে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। ক্ৰমে ম্যালেনের প্রতি তার ঘৃণার পাথরটা গলে যেতে লাগল। তার পরিবর্তে এক শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসের অনুভূতি জাগতে লাগল।

জেতার্ত চলে গেলে ম্যালেন এবার ফাঁতিনের কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে বলতে লাগল, তুমি যা বলেছ আমি সব শুনেছি। আমাকে এ সব কথা জানানো হয়নি। তবু আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি। আমি জানতামই না তুমি কাজ ছেড়ে দিয়েছ। তুমি আমার কাছে গিয়ে আবেদন করনি কেন? যাই হোক, আমি তোমার ঋণ শোধ করে দেব এবং তোমার মেয়েকে আনার অথবা তার কাছে তোমার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব। তুমি এখানে থাকবে অথবা প্যারিসে ইচ্ছা করলে যেতে পারবে। তুমি না চাইলে তোমাকে কাজ করতে হবে না, তোমার যা টাকা লাগবে আমি দেব। তুমি আবার সত্তাবে জীবনযাপন করে সুখী হতে পারবে। তুমি যা বলেছ তা যদি সত্যি হয় এবং তাতে আমার কোনও সন্দেহ নেই, তা হলে তুমি ঈশ্বরের চোখে সৎ এবং খাঁটি।

ফাঁতিনে আর সহ্য করতে পারছিল না। সে কসেত্তেকে ফিরে পাবে। বর্তমানের এই ঘৃণ্য জীবন থেকে মুক্তি পাবে। সে স্বাধীনভাবে কসেত্তেকে নিয়ে সুখে জীবনযাপন করতে পারবে। তার দুঃখের অন্ধকারে এই স্বর্গসুখের সম্ভাবনা সহ্য করতে পারছিল না সে। সে শুধু অবাক হয়ে ম্যালেনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার পা দুটো কাঁপছিল। সে কোনওরকমে নতজানু হয়ে ম্যালেনের একটা হাত টেনে নিয়ে তার ঠোঁটের উপর চেপে ধরল।

তার পর মূৰ্ছিত হয়ে প্যল ফাঁতিনে।

১.৬ কারখানার হাসপাতালে

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

মঁসিয়ে ম্যাদলেন ফাঁতিনেকে কারখানার হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে নার্সদের দেখাশোনা করতে বলল। তার গায়ে তখন দারুণ জ্বর এবং রাত্রিতে প্রলাপ বকতে লাগল জ্বরের ঘোরে। পরে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন দুপুরে তার ঘুম ভাঙলে সে বুঝতে পারল তার বিছানার পাশে কার নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মশারিটা একটু তুলে দেখল মঁসিয়ে ম্যাদলেন তার মাথার দিকের দেয়ালের উপর একটি ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মূর্তির তলায় দাঁড়িয়ে বেদনার্ত দৃষ্টিতে সেই মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছে।

এখন ফাঁতিনের চোখে মঁসিয়ে ম্যাদলেন একেবারে বদলে গেছে। তার মনে হচ্ছিল ম্যালেনের গোটা চেহারাটা এক স্বর্গীয় জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় হয়ে উঠেছে। তার ঠোঁট দুটো কাঁপছিল। ফাঁতিনে কোনও বাধা সৃষ্টি না করে ম্যালেনের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইল। অবশেষে সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কী করছেন?

ম্যাদলেন সেইখানে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়েছিল। ফাঁতিনের ঘুম ভাঙার জন্য অপেক্ষা করছিল সে। ফাঁতিনের ঘুম ভেঙেছে দেখে তার হাতটা ধরে নাড়ি টিপে বলল, এখন কেমন আছ?

ফাঁতিনে বলল, এখন ভালো বোধ করছি। আমার ঘুম ভালো হয়েছে। আমার মনে হয় আমি ভালো হয়ে গেছি। মারাত্মক কিছু হয়নি।

ম্যাদলেন এবার ফাঁতিনের প্রশ্নটার জবাব দিয়ে বলল, আমি তোমার জন্য প্রার্থনা করছিলাম।

গতকাল রাত থেকে আজকের সারা সকাল ফাঁতিনে সম্বন্ধে সব খবরাখবর সগ্রহ করেছে। তার সকরুণ জীবনকাহিনীর সব জেনেছে। সে বলল, তুমি বড় কষ্ট ভোগ করেছ মেয়ে। তবে আর কোনও কষ্ট তোমার থাকবে না। সব ক্ষতি পূরণ হয়ে যাবে। এইভাবে যে দুঃখভোগের মধ্য দিয়ে মানুষ সেন্ট হয় তার জন্য অপরকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। যে নরকযন্ত্রণা তুমি ভোগ করেছ সে নরকই স্বর্গের দ্বারপথ। সেই নরকের মধ্য দিয়ে তোমাকে স্বর্গে যেতে হবে।

ম্যাদলেন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ফাঁতিনে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল।

গতরাত্রিতেই জেতার্ত একটা চিঠি নিয়ে সকাল হতেই ডাকঘরে যায় চিঠিটা ফেলতে। চিঠিটা প্যারিসের পুলিশ বিভাগের সচিবের কাছে লেখা। পুলিশ ফাঁড়িতে গতকাল যে ঘটনা ঘটেছে তা শহরে জানাজানি হয়ে যায়। তাই সে ডাকঘরে চিঠি ফেলতে গেলে ডাকঘরের লোকরা ভাবল সে পদত্যাগপত্র পাঠাচ্ছে।

মঁসিয়ে ম্যাদলেন থেনার্দিয়েরকে একখানি চিঠি দিল। সে তিনশো ফ্ৰাঁ পাঠিয়েছে। চিঠিতে লিখে দিল একশো ফ্রাঁ ঋণের টাকা কেটে নিয়ে বাকি টাকায় সে ফাঁতিনের মেয়েকে দিয়ে যাবে মন্ত্রিউলে।

সে চিঠি পেয়ে থেনার্দিয়ের আশ্চর্য হয়ে গেল। সে বলল, হা ভগবান! মেয়েটাকে এখন পাঠানো চলবে না। এ যে দেখছি সোনার খনি। বুঝতে পেরেছি কী হয়েছে। মনে হয় কোনও ধনী লোক ওর মার প্রেমে পড়েছে।

থেনার্দিয়ের চিঠির জবাবে মোট পাঁচশো ফ্রাঁ দাবি জানাল। লিখল, ডাক্তার দেখাতে ও তার রোগ সারাতে অনেক খরচ হয়েছে। আসলে ওর মেয়েদের ডাক্তারখরচের সব বিলগুলোর কথা উল্লেখ করল। শেষে তিনশো ফ্রাঁ পেয়েছে সেটাও জানাল।

ম্যাদলেন আরও তিনশো ফ্ৰাঁ পাঠিয়ে কসেত্তেকে তাড়াতাড়ি পাঠাতে লিখে দিল।

থেনার্দিয়ের তা পেয়ে বলল, বয়ে গেছে আমাদের পাঠাতে।

এদিকে ফাঁতিনে তখনও হাসপাতালেই ছিল। তার রোগ সারেনি। হাসপাতালের নার্সরা প্রথমে ঘৃণার চোখে দেখত তিনেকে। এইসব অধঃপতিত মেয়েকে তারা ভালো চোখে দেখে না। কিন্তু ফাঁতিনের স্র স্বভাব এবং ভদ্র আচরণ দেখে নার্সরা সন্তুষ্ট হল। তাছাড়া তারা যখন দেখল ফাঁতিনে এক সন্তানের জননী তখন তাদের মমতা হল তার ওপর। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকার সময় ফাঁতিনে একবার বলে, আমি পাপ করেছি ঠিক, কিন্তু আমার সন্তান আমার কাছে এলে বুঝব ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করেছে। আমি নোংরা

জীবনযাপন করার জন্যই তাকে কাছে রাখতে পারিনি। আমি তার জন্যই, তার ব্যয়ভার। বহনের জন্যই কুপথে নেমেছি। সে এখানে এলে বুঝব ঈশ্বরের আশীর্বাদ আমি পেয়েছি। তার নিষ্পাপ মুখ দেখে আমি জোর পাব মনে। আমার জীবনে কী ঘটেছে না ঘটেছে তার কিছুই জানে না সে। দেবদূতের মতো সরল নিষ্পাপ সে। তার বয়সে আমাদেরও দেবদূতের মতো পাখা ছিল।

দিনে দুবার করে ম্যাদলেন হাসপাতালে এসে দেখা করত ফাঁতিনের সঙ্গে। সে দেখতে এলেই ফাঁতিনে জিজ্ঞাসা করত, কসেত্তে কখন আসবে?

ম্যাদলেন বলত, সম্ভবত কাল। যে কোনও সময়েই সে এসে পড়তে পারে।

এ কথা শুনে ফাঁতিনের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠত।

কিন্তু ফাঁতিনের অবস্থা মোটেই ভালোর দিকে যাচ্ছিল না। বরং দু এক সপ্তা যেতেই তার অবস্থা খারপের দিকে যেতে লাগল। তার ঘাড়ের উপর লাগানো একমুঠো বরফের হিম তার অস্থিমজ্জার ভেতরে ঢুকে দীর্ঘদিনের সঞ্চিত পুরনো সব রোগ ঠেলে এনেছে। অধ্যাপক লেনেক অনেক করে রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করতে লাগলেন।

রোগ পরীক্ষা হলে ম্যালেন ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করল, কেমন দেখলেন?

ডাক্তার বলল, তার কি কোনও সন্তান আছে?

ম্যাদলেন বলল, তার একটি কন্যাসন্তান আছে।

তা হলে যত তাড়াতাড়ি পারেন তাকে এখানে আনার ব্যবস্থা করুন।

ম্যাদলেন ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু ফাঁতিনে তাকে ডাক্তার কী বলল তা জিজ্ঞাসা করায় সে বলল, ডাক্তার জোর করে হেসে বলল, তোমার মেয়ে তোমার কাছে এলেই রোগ সেরে যাবে।

ফাঁতিনে বলল, ডাক্তার ঠিকই বলেছেন। থেনার্দিয়েররা কেন এখনও কসেত্তেকে রেখে দিয়েছ? কবে সে ঠিক এসে যাবে? তা হলে আমি খুব সুখী হব।

কিন্তু থেনার্দিয়েররা যত সব আজেবাজে কারণ দেখিয়ে আটকে রেখে দিয়েছিল কসেত্তেকে। তারা লিখল, এখনও ছোটখাটো অনেক দেনা আছে, তার হিসাব তারা তৈরি করছে। তাছাড়া অসুখের পর সে এখন পথ হাঁটতে পারবে না এই শীতকালে।

ম্যাদলেন আবার একটা চিঠি লিখল ফাঁতিনের কথামতো। তার পর চিঠিটার শেষে ফাঁতিনের সইটা করিয়ে নিল।

কিন্তু ইতোমধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল। আমরা আমাদের জীবনের রহস্যময় উপাদানগুলোকে নাড়াচাড়া করে জীবনকে যেভাবেই গড়ে তুলতে চাই না। কেন, ভাগ্যের কুটিল বিধান সব ওলটপালট করে দেয়।

.

সেদিন সকালে তার অফিসে বসে কতকগুলি জরুরি কাজ সেরে নিচ্ছিল ম্যাদলেন। যদি তাকে মঁতফারমেলে যেতে হয় তার জন্য কাজগুলো সেরে রাখছিল। এমন সময় তাকে জানানো হল ইন্সপেক্টর জেতার্ত তার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। জেভার্তের নামটা তার ভালো লাগল না। সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে জেভার্তের সঙ্গে দেখা হয়নি তার। জেভাৰ্তও তাকে এড়িয়ে চলে।

ম্যাদলেন বলল, তাকে নিয়ে এস এখানে।

বলার সঙ্গে সঙ্গে জেতার্ত ঢুকে পড়ল ঘরে।

ম্যাদলেন তার টেবিলে বসে রইল হাতে কলম নিয়ে। কতকগুলি আইনভঙ্গের রিপোর্ট পড়ছিল সে। সে নীরসভাবে বসতে বলল জেতার্তকে।

জেভাৰ্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে ম্যাদলেনকে নমস্কার জানিয়ে ম্যালেনের সামনে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল।

জেভাৰ্তকে আগে যারা দেখেছে, যারা তার চরিত্রের কথা জানে তারা এখন তাকে দেখলে অবাক হয়ে যাবে অপার বিস্ময়ে। ম্যালেনের প্রতি তার সেই দীর্ঘসঞ্চিত গোপন বিতৃষ্ণা আর নেই। জেভার্তের কঠোর, নিষ্ঠুর, অনমনীয় স্বরূপের সঙ্গে পরিচিত যে কোনও লোক তাকে এখন দেখলে বুঝতে পারবে সে একটা বড় রকমের আত্মিক সংকটে ভুগছে। এখন যেন তার গোটা আত্মাটাই ফুটে উঠেছে তার চোখে-মুখে। সব আবেগপ্রবণ লোকের মতো জেভার্তেরও খুব তাড়াতাড়ি মনের ভাবের পরিবর্তন হয়। তখন তার আচরণটা সত্যিই রহস্যময় মনে হচ্ছিল। সে এমনভাবে ম্যাদলেনকে অভিবাদন জানাল যে ভাবের মধ্যে বিন্দুমাত্র ক্রোধ বা বিতৃষ্ণা ছিল না। সে ম্যালেনের সামনে থেকে কয়েক পা দূরে সামরিক কায়দায় ধৈর্য ধরে সমভরে দাঁড়িয়ে রইল। টুপিটা হাতে নিয়ে নম্র নীরব আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে সে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন একজন সৈনিক তার ঊর্ধ্বতন অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আবার একই সঙ্গে মনে হচ্ছিল কোনও অপরাধী আসামি যেন দাঁড়িয়ে আছে তার বিচারকের সামনে। কখন দয়া করে মেয়র তার দিকে তাকাবে তার জন্য নীরবে অপেক্ষা করছে সে। তার পাথরের মতো কঠিন মুখখানায় একমাত্র এক ব্যাপ্ত বিষাদ ছাড়া অতীতের আর কোনও আবেগানুভূতির চিহ্নমাত্র নেই। তার সমস্ত চেহারাটার মধ্যে তখন ফুটে উঠেছিল এক উদ্ধত আনুগত্য আর পরাভূত বীরত্বের এক মিশ্রিত ভাব।

অবশেষে হাত থেকে কলমটা নামিয়ে ম্যাদলেন প্রশ্ন করল, কী বলবে জেভার্ত? জেভাৰ্ত একমুহূর্ত কী ভেবে নিয়ে বিষাদগম্ভীর কণ্ঠে বলল, এক দারুণ শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনা ঘটে গেছে মঁসিয়ে।

কী ধরনের শৃঙখলভঙ্গ?

নিম্নপদস্থ এক সরকারি কর্মচারী একজ