- বইয়ের নামঃ টয়লার্স অভ দ্য সী
- লেখকের নামঃ ভিক্টর হুগো
- প্রকাশনাঃ হাসি প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রহস্য, গল্পের বই, রোমাঞ্চকর, গোয়েন্দা কাহিনী
টয়লার্স অভ দ্য সী
০১. ইংলিশ চ্যানেল
টয়লার্স অভ দ্য সী – ভিক্টর হুগো / রূপান্তর : সমীর দাস / সম্পাদনা : ইফতেখার আমিন
[স্যামসনের এক দুঃসাহসী, ভবঘুরে যুবক, গিলিয়াত। বাঁশি বাজিয়ে আর দুরন্ত সাগরে মাছ ধরে ওর দিন কাটে। এরই মাঝে অপূর্ব সুন্দরী দেরুশেতের প্রেমে পড়ল সে। কিন্তু বেচারা মুখ ফুটে কথাটা বলতে পারেনি কোনদিন।
প্রেয়সীর চোখের পানি মোছাতে মহাবিপজ্জনক ডোভার আইল্যান্ডে গেল গিলিয়াত, সফল হয়ে ফিরেও এল।
কিন্তু একদিন যে রেভারেন্ড কড্রের প্রাণ বাঁচিয়েছিল গিলিয়াত, সে-ই কিনা…
তারপর কি হলো? দুরন্ত ইংলিশ চ্যানেল গ্রামে থেকেও গ্রামছাড়া বাড়িটার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে কি আকুতি জানাচ্ছে বারবার?]
.
এক
ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে ইংলিশ চ্যানেল নামে দিগন্ত বিস্তৃত এক সাগর।
তার ঢেউ খেলানো নীল পানির বুক ফুড়ে এখানে-সেখানে জেগে আছে অসংখ্য ছোট-বড় দ্বীপ। সেগুলোর মধ্যে একটার নাম গেরানসি। এই দ্বীপের ছোট্ট এক গ্রাম স্যামসন। আজ এখানকার মানুষের আনন্দের দিন। কারণ আজ বড়দিন, পঁচিশে ডিসেম্বর।
একে বড়দিন, তারওপর এবার শীতের শুরু থেকেই দ্বীপে বেশ তুষারও পড়ছে। এমনিতে নিয়মিত তুষারপাত হয় না গেরানসিতে, তাই ব্যাপারটা শুরু হলে রীতিমত সাড়া পড়ে যায়। কিন্তু আজ নটা বেজে যাওয়ার পরও কোথাও সেরকম কিছু চোখে পড়ছে না।
চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ। রাস্তায় মানুষজন নেই। বিশেষ উৎসবের দিনের আনন্দ-উল্লাসের কোন লক্ষণ তো নেই-ই, তুষার নিয়েও কারও যেন কোন মাথাব্যথা নেই। চ্যানেলের তীর ঘেঁষে একটা রাস্তা গ্রামের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত চলে গেছে, ওটাই প্রধান রাস্তা এখানকার। গোটা গ্রামের সাধে সেটাও আজ তুষারের পুরু চাদরের তলায় চাপা পড়ে আছে।
কুয়াশার আবছা পর্দা ভেদ করে সূর্যের নিস্তেজ আলো সবেমাত্র স্যামসনের বুক ছুঁয়েছে। কনকনে শীত। এত শীতও সাধারণত পড়ে না গেরানসিতে, হয়তো সেজন্যেই বিশেষ দিন হওয়া সত্ত্বেও মানুষজন ঘর ছেড়ে পথে বেরোতে তেমন উৎসাহ বোধ করছে না।
তবু, এর মধ্যেও তিনজনকে দেখা যাচ্ছে রাস্তায়। যেন গ্রামবাসীর মন রাখতেই বেরিয়েছে তারা-একটি ছোট ছেলে, এক সুন্দৰী তরুণী এবং এক যুবক। তুষারমোড়া রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে।
ছেলেটি রয়েছে সবার আগে, মাঝখানে তরুণী এবং যুবক পিছনে। ছাড়াছাড়া হয়ে যে যার মত পথ চলেছে ওরা তিনজন। দেখলেই বোঝা যায় কারও সাথে কারও সম্পর্ক নেই। ছেলেটির বয়স বছর আটেক হবে। চলতে চলতে প্রায়ই থমকে দাঁড়াচ্ছে সে, শিশুসুলভ বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চারদিকের বরফের বিন্তার দেখছে। চেহারায় প্রচণ্ড কৌতূহল ওর।
সম্ভবত গ্রামের সেইন্ট পিটার গির্জা থেকে আসছে ওরা, বড়দিনের বিশেষ প্রার্থনায় যোগ দিতে গিয়েছিল। যুবককে দেখলে শ্রমিক বা নাবিকগোছের কিছু মনে হয়। পরনে ক্যাম্বিসের ডিলেটালা পাজামা গায়ে বাদামী রঙের মোটা গেঞ্জি। খুব সাধারণ বেশভুষা যুবকের। বিশেষ উৎসবের দিনের কোন আমেজ নেই তাতে। আমনা, উদাসীন প্রকৃতির মানুষ সে। কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই! এমনভাবে হাঁটছে যেন এ জগতেই নেই। সামনের জলজ্যান্ত সুন্দরীটির দিকে পর্যন্ত তাকাচ্ছে না।
তরুণীর সাজ-সজ্জা সম্পূর্ণ উল্টো। আজকের উপযুক্ত সাজেই সেজেছে সে। চলার মধ্যে রয়েছে সাবলীল একটা ভাব। ওকে দেখলে যে কেউ সহজেই বুঝবে জগৎ-সংসারের কঠিন কোন দায়িত্ব এখনও ছুঁতে পারেনি মেয়েটিকে। দিব্যি সুখে আছে।
কিছুদূর যেতে পথের পাশে বেশ কয়েকটা বড় বড় ওক গাছ পড়ে। সেগুলোর তলায় পৌঁছতে অনেকটা যেন বেখেয়ালেই হাঁটার গতি কমে গেল তরুণীর, ঘুরে তাকাল। চোখ পড়ল যুবকের ওপর। সে তখন ওর শখানেক হাত পিছনে, ধীর পায়ে হেঁটে আসছে।
দাঁড়িয়ে পড়ল তরুণী। কিছু ভাবল খানিক, তারপর একটুখানি হেসে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে পথের ওপর কি যেন করল। কাজ সেরে সোজা হয়ে আবার পিছনে তাকাল ও, চোখাচোখি হয়ে গেল যুবকের সাথে।
এবার টনক নড়ল তার, সামনের তরুণীটিকে এতক্ষণে যেন চিনতে পেরেছে। ও আর কেউ নয়, তারই প্রতিবেশী-অপরপা দেরুশেত। যুবকের সাথে চোখাচোখি হতেই মেয়েটি বাতাসে মন পাগল করা এক টুকরো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বাঁ-দিকের এক গলিতে ঢুকে পড়ল। উধাও হয়ে গেল মুহূর্তে
যুবকের মধ্যে বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া হয়েছে বলে মনে হলো না। যেমন চলছিল, তেমনি চলতে থাকল। আনমন, উদাসীন। দেরুশেত যে গাছগুলোর নিচে থেমেছিল, কয়েক মিনিট পর সেখানটায় এসে পৌঁছল যুবক।
নরম তুষারের বুকে একজোড়া ছোট, মেয়েলি পায়ের ছাপ ফুটে আছে দেখতে পেয়ে ক্ষণিকের জন্যে হাঁটার গতি পড়ে গেল তার। শুধু পায়ের ছাপই নয়, সাথে আরও কিছু আছে ওখানটায়। অতি পরিচিত একটা নাম-গিলিয়াত।
আঙুলে তুষার কেটে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা রয়েছে যুবকেরই নাম। দেরুশেত লিখেছে।
বুকের রক্ত মুহূর্তের তরে চঞ্চল হয়ে উঠল তার। চার অক্ষরের নামটার দিকে কিছুক্ষণ বোকার মত তাকিয়ে থাকল সে, ছোট ছোট পায়ের ছাপগুলোও কিছুসময় দেখল। খানিক পর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল সে, মাথা নিচু করে ধীর পায়ে এগিয়ে চলল গন্তব্যের দিকে।
দুই
স্যামসন গেরানসি দ্বীপের কয়েকটা নৌ-বন্দরের অন্যতম, ছোটখাট এক বন্দর। এখানকার বাসিন্দাদের বেশিরভাগই সাগরের ওপর নির্ভরশীল পেশাজীবী। কেউ জাহাজের নাবিক, কেউ বা জেলে। অনেকে নিজ নিজ নৌকায় করে আশপাশের দ্বীপগুলোয় নানান পণ্য পরিবহণের কাজও করে।