বিশপের পদে তিনি অধিষ্ঠিত হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যে সম্রাট তাঁকে আরও কয়েকজন বিশপের সঙ্গে ব্যারন পদে ভূষিত করেন। আমরা যতদূর জানি, ১৮৩৯ সালেই ৫, ৬ জুলাই পোপকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ফরাসি ও ইতালীয় বিশপদের এক ধর্মীয় সভায় যোগদানের জন্য নেপোলিয়ঁন তাঁকে ডাকেন। এই সভা প্যারিসের নোতার দ্যাম গির্জায় কার্ডিনাল ফ্রেস্কের সভাপতিত্বে ১৮১১ (রাজা, দুটি সালে মিলছে না) সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় মোট পঁচানব্বই জন বিশপের মধ্যে মঁসিয়ে মিরিয়েলও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তিনি মূল সভা ছাড়া আরও তিন-চারটি ছোটখাটো সভায় যোগদান করেন। মনে হয় যে পার্বত্য অঞ্চলে তিনি থাকতেন সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়া সকল গ্রাম্য জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত থাকার জন্য তাঁর কৃষকসুলভ বেশভূষা ও জীবনযাত্রা প্রণালী সভায় বিশেষ কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তিনি সভার জাঁকজমকপূর্ণ আদবকায়দায় অস্বস্তিবোধ করায় তাড়াতাড়ি দিগনেতে ফিরে আসেন। এ বিষয়ে তখন তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমার উপস্থিতিতে ওরা অস্বস্তিবোধ করছিল। যে বাইরের জগৎ সম্বন্ধে তারা একেবারে অনবহিত, আমি যেন সেই জগতের এক ঝলক অপ্রত্যাশিত হাওয়া আমার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম তাদের কাছে। বাইরের জগতের রুদ্ধ দরজাটা সহসা আমি যেন খুলে দিয়েছিলাম তাদের সামনে।
তিনি আরও বলেছিলেন, তোমরা কী আশা করতে পার? অন্যান্য বিশপরা যেন এক একজন রাজপুত্র। আমি সামান্য একজন চাষিদের যাজক ছাড়া আর কিছুই নই।
মোট কথা, তিনি সেই সভায় যোগদান করতে গিয়ে অসন্তুষ্ট হন। একদিন তার এক নামকরা সহকর্মীর বাড়িতে গিয়ে বলেন, কত সব বড় বড় দামি ঘড়ি, কত সুন্দর সুন্দর কার্পেট, কত সব জমকালো সাজ-পোশাক পরা চাকর-বাকর–আমার পক্ষে এসব সত্যিই অস্বস্তিকর। এইসব বিলাসব্যসনের মধ্যে আমি থাকতে পারব না। এসবের মধ্যে থাকলে আমার প্রায়ই মনে পড়ত কত লোক ক্ষুধায় ও শীতে কষ্ট পাচ্ছে। কত গরিব আছে। কত সব গরিব।
বিলাসব্যসনের প্রতি বিশপের ঘৃণা খুব একটা যুক্তিসংগত নয়। কারণ বিলাসিতাকে ঘৃণা করলে বিলাসের উপকরণের সঙ্গে জড়িত অনেক শিল্পকর্মকেই ঘৃণা করতে হয়। কিন্তু একজন যাজকের পক্ষে তার আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মের বাইরে যেকোনও বিলাসের উপকরণই ঘৃণ্য ও বর্জনীয়। সেক্ষেত্রে বিলাসিতা এমনই একটি মনোভাব যার সঙ্গে বদান্যতা বা দানশীলতার কোনও সম্পর্ক নেই। ধনী যাজক এক বৈপরীত্যের প্রতিমূর্তি। যাজকদের অবশ্যই গরিবদের আপনজন হিসেবে তাদের কাছাকাছি থাকা উচিত। কিন্তু একজন কিভাবে গরিবদের দুঃখকষ্টের সংস্পর্শে দিনরাত আসতে বা থাকতে পারে যদি না তার বেশভূষা বা চালচলনের মধ্যে দারিদ্রের ছাপ না থাকে? আমরা কি এমন কোনও লোকের কল্পনা করতে পারি যে সারাদিন কোনও জ্বলন্ত লোহার হাপরে বা ফার্নেসের সামনে কাজ করবে, অথচ তার গায়ে তাপ লাগবে না, অথবা সে তার মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাটবে না অথবা তার হাতের নখে কালো দাগ ধরবে না বা তার মাথা বা গাঁ থেকে এক ফোঁটা ঘাম ঝরবে না অথবা তার মুখে একটুকরো ছাই থাকবে না। এক যাজকের দানশীলতার প্রথম প্রমাণ হল দরিদ্রসুলভ জীবনযাত্রা।
এটাই ছিল দিগনের বিশপের ব্যক্তিগত মত এবং যাজকবৃত্তি সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি। তবে তার মানে এই নয় যে সে যুগের ভাবধারার কোনও অংশই তিনি কোনও ব্যাপারে গ্রহণ করতেন না। বরং কতকগুলি সমস্যামূলক ব্যাপারে সে যুগের প্রচলিত ভাবধারারই অনুবর্তন করে চলতেন। তিনি তখন যেসব ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে আলোচনা সভা হত তাতে খুব একটা বেশি যোগদান করতেন না। রাষ্ট্র ও চার্চসংক্রান্ত কোনও বিরোধমূলক সমস্যা সম্পর্কে তিনি কোনও মন্তব্য করতেন না। কিন্তু যদি কোনও সময় এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতেন তা হলে দেখা যেত তার মনের মধ্যে রক্ষণশীলতার থেকে অতি আধুনিকতার উপাদানই বেশি থাকত। আমরা যেহেতু তার একটি পূর্ণ জীবনচিত্র আঁকছি এবং কোনও কিছুই গোপন রাখতে চাই না সেইহেতু আমরা অবশ্যই একথা স্বীকার করব যে নেপোলিয়ঁনের পতন শুরু হওয়ার সময় তিনি তাঁর ঘোর বিরোধী ছিলেন। ১৮১৩ সাল থেকে তিনি সম্রাটবিরোধীদের বিক্ষোভ মিছিলকে সমর্থন করতেন এবং অভিনন্দন জানাতেন। এলবা থেকে ফেরার সময় ম্রাট নেপোলিয়ঁন যখন বিশপের অঞ্চল দিয়ে যান তখন তিনি দেখা করতে চাননি সম্রাটের সঙ্গে। সম্রাটের সংকটের সময় তিনি কোনও সমবেত প্রার্থনাসভার অনুষ্ঠান করার অনুমতি দেননি।
এক বোন ছাড়া বিশপের দুই ভাই ছিল। দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন ছিল সামরিক বিভাগের বড় অফিসার আর একজন পুলিশের বড় কর্তা। বিশপ তাঁর ভাইদের সঙ্গে চিঠিপত্রে যোগাযোগ রাখতেন। কিছুদিন ধরে তাঁর যে ভাই সৈন্যবিভাগে সেনাপতিত্বের কাজ করত তার সঙ্গে মনকষাকষি চলছিল বিশপের। কারণ তাঁর সেনাপতি ভাই একবার বারোশো সৈনিকের একটি দলের সেনাপতি হিসেবে নেপোলিয়ঁনকে ধরার জন্য তাঁর পিছু ধাওয়া করে, কিন্তু আসলে তার ধরার ইচ্ছা ছিল না অর্থাৎ এমনভাবে যায় যাতে হাতের নাগালের বাইরে চলে যেতে প্রচুর সুযোগ পান নেপোলিয়ঁন। তার অন্য ভাই পুলিশের কাজ থেকে অবসর গ্রহণের পর প্যারিসে বাস করছিল। সে মানুষ হিসেবে খুবই ভালো ছিল বলে বিশপ তাকে মেহের চোখে দেখতেন।