সেইন্ট ম্যালো জাহাজ ঘাটের কাছেই একটা হোটেল আছে। সেটার একটা রুম লেতিয়ারির জাহাজ কোম্পানির অফিস হিসেবে ব্যবহার হয়। দুরান্দের শাখা অফিস। ক্লুবিন এলে সেই রুমেই থাকে।
হোটেলটার ডাইনিং রুমে দুটো বড় টেবিল আছে, একটা জাহাজের ক্যাপ্টেনদের খাওয়া-দাওয়ার জন্যে নির্দিষ্ট, অন্যটা শুল্ক বিভাগের অফিসার ও সাধারণ নাবিকদের জন্যে। সেদিন দুই টেবিলেরই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কয়েক ঘন্টা আগে বন্দরে নোঙর করা তামোলিপা নামের এক আমেরিকান জাহাজ এবং সেটার ক্যাপ্টেন জুয়েলা।
কিছুদিন পর পর দেখা মেলে লোকটার। ব্যবসার কাজে তার জাহাজ ফ্রান্সের বিভিন্ন উপকূলীয় বন্দরে নিয়মিত আসা যাওয়া করে। সেইন্ট ম্যালো বন্দরে সম্ভবত এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে ক্যাপ্টেন জুয়েলাকে চেনে না।
কারও অজানা নেই অল্পদিনেই প্রচুর কাঁচা টাকা-পয়সার মালিক বনে গেছে সে ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে দুনম্বরী কারবার করে। মানুষ পাচারের ধান্ধা করে থাকে ক্যাপ্টেন জুয়েলা। ক্লুবিনও চিনত জুয়েলাকে, কিন্তু কখনও আলাপ হয়নি তাদের দুজনের।
পুলিসের ভয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকা চরমপন্থী রাজনীতিক অথবা পাওনাদারদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানো দেউলিয়া বা পুলিসের তাড়া খাওয়া খুনী-ডাকাত, অথবা অন্য যে কোন অপরাধেই অপরাধী হোক না কেন, দেশ ছেড়ে কারও পালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে তাকে সাহায্য করতে জুয়েলা সব সময় এক পায়ে খাড়া।
তামোলিপার খোলের মধ্যে পুরে তাকে সবার চোখে ধুলো দিয়ে নিরাপদে পাচার করে দেবে সে, বিনিময়ে দিতে হবে মোটা অঙ্কের টাকা। কথাবার্তা পাকা হয়ে গেলে উপকূলের নির্দিষ্ট কোন এক নির্জন, গোপন জায়গায় গিয়ে অপেক্ষা করতে হয় তাদেরকে। পরে সময়মত বন্দর ছেড়ে দূরে কোথাও গিয়ে জাহাজের লাইফবোট পাঠিয়ে তাদেরকে তুলে নেয় জুয়েলা। কুকমটা বন্দর থেকে নিরাপদ দূরতে গিয়ে সারা হয় বলে ফরাসী কাস্টমস, উপকূল রক্ষী পুলিস বা গোয়েন্দারা হাতেনাতে ধরতে পারে না লোকটাকে।
অনেকের মতে গত সফরের সময়ও নাকি এরকম দুজনকে নিয়ে গেছে জুয়েলা। এবারও তার একই প্ল্যান আছে। বিরাট দাও মারতে যাচ্ছে এবার সে।
তবে পুলিস কি ভাবে যেন আগেভাগেই টের পেয়ে গেছে ব্যাপারটা। কড়া নজর রেখেছে তারা ক্যাপ্টেন জুয়েলার ওপর। গোয়েন্দারাও সদাসতর্ক-এবার পাকড়াও করবেই তাকে।
ওদিকে এবারের মত তামোলিপায় মালপত্র বোঝাই দেয়ার কাজ পুরোদমে চলছে, আর কদিনের মধ্যেই সেইন্ট ম্যালো ছেড়ে যাবে ওটা।
মঙ্গলবার শেষ বিকেল। আঁধার ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। সূর্য ডুবতে আর বেশি দেরি নেই। এই সময় দুরান্দ এসে নাক ঢোকাল সেইন্ট ম্যালো হারবারে। ওটার ফোর ডেকে দাঁড়িয়ে আছে তখন ক্যাপ্টেন ক্লুবিন, নাবিকদেরকে এটা-সেটা নির্দেশ দিচ্ছে।
ওরই মাঝে তীরের দিকে চোখ গেল তার। দেখতে পেল বন্দর থেকে বেশ খানিকটা দূরে, নির্জন সাগরতটে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দুজন লোক-কথা বলছে। যথেষ্ট দূরে রয়েছে বলে তাদের ঠিকমত দেখা যায় না ঠিকই, কিন্তু ভাবভঙ্গী দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় জরুরি কোন বিষয় নিয়েই আলোচনা চলছে লোক দুটোর মধ্যে।
সন্দেহ হলো ক্লুবিনের। এরকম অসময়ে বন্দর থেকে এত দূরে, নির্জন জায়গায় কারা ওরা? এমন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে? দূরবীন তুলে চোখে লাগাল সে, অমনি একলাফে অনেক কাছে চলে এল দৃশ্যটা।
আঁধার হয়ে এলেও প্রথম দর্শনেই দুজনের একজনকে চিনে ফেলল সে। লোকটা ক্যাপ্টেন জুয়েলা। দ্বিতীয়জনের দিকে নজর দিল কুবন, একভাবে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মনে হল কেও যেন চেনা চেনা লাগছে।
বেশ বয়স্ক মানুষ সে, তবে যথেষ্ট শক্তপোক্ত দেহের অধিকারী। দেখলেই বোঝা যায় এই বয়সেও দেহে প্রচুর শক্তি ধরে মানুষটা।
বন্দরে নেমে প্রথমেই তামোলিপা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিল ক্লুবিন। জানা গেল আরও দশদিন থাকবে ওটা সেইন্ট ম্যালোয়, তারপর ছেড়ে যাবে।
নিয়মমাফিক পরের শুক্রবার মালপত্র নিয়ে স্যামসনে ফিরে এল দুরান্দ। মাল খালাসের কাজ শুরু হলো। একসময় রাত নামল দ্বীপে। রাত একটু গম্ভীর হতে ক্যাপ্টেন ক্লুবিন তৎপর হলো। একটা কম্পাস, একটা দূরবীন এবং সাথে কিছু বিস্কিট ইত্যাদি একটা ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে সবার অলক্ষে জাহাজ থেকে নেমে এল সে। বন্দর এলাকা ছাড়িয়ে এসে উপকূল রেখা ধরে জোর পায়ে হেঁটে চলল অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে। ঘন্টাখানেক একনাগাড়ে চলার পর উপকূলের কাছাকাছি হোট, নির্জন এক গ্রাম, প্লইমোয় এসে পৌঁছল যুবক।
খুব ছোট আর জনবিরল গ্রাম প্লইমো, স্যামসনের কয়েক মাইল দূরে। হাতে গোনা কয়েক ঘর জেলে ছাড়া আর কেউ থাকে না সেখানে। রাত নামতে না নামতেই চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে গ্রাম।
এই গ্রামের এক মাথায়, সাগরের তীরে পুরানো আমলের একটা পোড়োবাড়ি আছে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারের মধ্যে নির্ভয়ে সেই বাড়িটায় ঢুকে পড়ল ক্লুবিন, ব্যাগটা ভেতরে কোথাও রেখে একটু পরই আবার বেরিয়ে এসে ধীর গায়ে স্যামসনে ফিরে চলল। সে সময় অন্যমনস্ক লাগছিল তাকে। কোন গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল হয়তো।
যে পোড়োবাড়িতে গিয়েছিল ক্লুবিন, সেটা আসলে স্থানীয় চোরাচালানীদের প্রধান আল্লখানা! এখান থেকেই পরিচালিত হয় এ অঞ্চলের যত নিষিদ্ধ ও চোরাই মালামালের আমদানী রফতানীর ব্যবসা।