কিন্তু গিলিয়াত নির্বিকার, যেন এ জগতে নেই। পানির শব্দ ছাপিয়ে দূর থেকে কাঠ কাটার শব্দ আসছে। লেতিয়ারি বোধহয় ওর নৌকা থেকে এনজিনটা নামানোর জন্যে লোক লাগিয়েছে।
পশ্চিম দিকে তাকাল গিলিয়াত। এইমাত্র ঘোরা শেষ করেছে কাশমির, মহিষ পাহাড়ের কাছ ঘেঁষে মন্থর গতিতে গভীর সাগরের দিকে চলতে শুরু করে দিয়েছে।
ডেকে বসা দেরুশেত ও কড্রের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল গিলিয়াত। ওরা দুজনও তীরের দিকে তাকিয়ে আছে একভাবে। কথা নেই কারও মুখে।
হঠাৎ মহিষ পাহাড়ের ওপর চোখ পড়তে বিস্মিত হলো দেরুশেত। ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠল, দেখো, দেখো! ওই পাহাড়ের চুড়োয় কে যেন বসে আছে! সাগরে তো জোয়ার এসে গেছে, তারপরও বসে আছে লোকটা! হুঁশ নেই নাকি?
জবাবে কড়ে কি বলল জানা হলো না।
কয়েক মিনিটের মধ্যে গিলিয়াতের পা ছুঁয়ে ফেলল পানি। তারপর দেখতে দেখতে হাঁটু পর্যন্ত উঠে এল। ও শুধু একবার নিচের দিকে তাকাল, পানি কতখানি উঠেছে দেখে নিয়ে আগের মত অপলক, সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে দ্রুত বিলীয়মান জাহাজটার দিকে তাকিয়ে থাকল। অন্য কোনদিকে খেয়ালই নেই।
অনুকুল বাতাস পেয়ে ভালই গতি লাভ করেছে কাশমির, ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে। এরই মধ্যে প্রায় দিগন্তে পৌঁছে গেছে। তবু গিলিয়াতের সেদিক থেকে নজর ফেরানোর কোন লক্ষণ নেই, চেয়ে আছে তো আছেই।
এক ঘন্টা কেটে গেছে এর মধ্যে, পানি ওর কোমর পর্যন্ত উঠে এসেছে, তবু হুশ ফিরছে না। যেন দুচোখ মেলে পৃথিবীর শেষ সীমা অব্দি জাহাজটাকে অনুসরণ করতে না পারলে ফিরবেও না।
আরও এক ঘণ্টা কাটল। আবছা ধোয়াটে দূর দিগন্তে কাশমিরকে দেখতে লাগছে ছোট একটা ম্যাচবাক্সের মত। ক্রমে আরও ছোট হয়ে আসছে। সূর্যের শেষ বিকেলের নিস্তেজ রশি চ্যানেলের বুকে অদ্ভুত মায়াবি এক রঙের মেলা বসিয়েছে।
গিলিয়াতের চারদিকের লোনা পানি খল খল্ ছল্ ছল শব্দে প্রাণ খুলে হাসছে। জাহাজ ঘাটের কোলাহল জোয়ারের পানির ভয়াবহ শব্দের কাছে হার মেনে গেছে অনেক আগেই।
ও বসে আছে ধ্যানমপ্নের মত। গলা পর্যন্ত উঠে এসেছে পানি, কোনমতে মাথাটা জেগে আছে কেবল, তবু গিলিয়াত মহিষ পাহাড়ের মত অবিচল, অনড়।
মাথার ওপর গাঙচিল ও অন্যান্য সামুদ্রিক পাখি ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে, ডানা ঝাঁপটে আর অবিরাম চিৎকার করে বৃথাই বোকা লোকটাকে সতর্ক করার চেষ্টা করছে ওরা। কোন কাজ হচ্ছে না।
কাশমির ততক্ষণে অনেক অ-নে-ক দূরে চলে গেছে। অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে ওটাকে, একটা বিন্দুর মত। গিলিয়াতের দুচোখ এখনও একভাবে অনুসরণ করছে জাহাজটাকে। পৃথিবীর কোন কিছুর সাথেই তার সেই বিষাদ মাখা করুণ দৃষ্টির তুলনা চলে না।
সেখানে ফুটে আছে সব হারানোর কঠিন মর্মবেদনার ছাপ। দীর্ঘদিন ধরে মনের রাজ্যে একটু একটু করে গড়ে তোলা কল্পনার রঙিন বাসর আচমকা ঝড় এসে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলে এমনই হয় বোধহয়।
অপ্রত্যাশিত বেদনায় হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত গিলিয়াতের, অথচ কারও বিরুদ্ধে তিল পরিমাণ অভিযোগ নেই। এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেলেনি। মুখ বুজে জীবনের এতবড় ব্যর্থতাকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু অন্তর সে কষ্ট সয়ে নিতে পারলেও চোখ দুটো পারেনি বোধহয়। তাই এত বিষাদ, এত বেদনা আর ব্যাকুলতা ফুটে আছে সেখানে।
ধীরে ধীরে গোধুলির আবছা অন্ধকার নেমে আসছে স্যামসনে। গ্রামে থেকেও গ্রামছাড়া বাড়িটা খা খা করছে-মনে হচ্ছে মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলেছে ওটা, কাকে যেন খুঁজছে ব্যাকুল হয়ে। আরেকদিকে লেতিয়ারির বিশাল বাড়িতে কিসের যেন হই-চই চলছে।
বৃদ্ধ কি করছে এখন কে জানে! বোধহয় মেয়ে-জামাইয়ের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে অস্থির চিত্তে।
ধরনী থেকে গোধুলির সামান্য আলোটুকুও মিলিয়ে গেছে এখন। কুয়াশায় পুরোপুরি ঝাপসা হয়ে গেছে দিগন্ত, তাই কাশমিরকে আর দেখা যাচ্ছে না।
ওটার চিহ্ন মুছে গেছে ধরণীর বুক থেকে, একই সঙ্গে গিলিয়াতের মাথাটাও পানির নিচে তলিয়ে গেছে। আর উঠল না হতভাগ্য যুবক। মহিষ পাহাড়ের মাথায় বড় বড় ঢেউ হয়ে ভেঙে পড়তে লাগল ভরা জোয়ারের পানি, কিছুক্ষণের মধ্যে গোটা পাহাড় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
সদ্য সন্তানহারা, বেদনাকাতর মায়ের মত কি এক অব্যক্ত আকুতি নিয়ে গিলিয়াতের বাড়ির পায়ের কাছে বারে বারে মাথা খুঁড়তে লাগল ইংলিশ চ্যানেল। উন্মাতাল বাতাস আর পানির মিলিত বোবা কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে সাঁঝের পরিবেশ।
দিনের আলো মুছে গিয়ে আঁধারের রাজত্ব শুরু হয়েছে গেরানসি দ্বীপের স্যামসন গ্রামে। রাত নেমেছে। ব্যতিক্রমী এক রাত।
গ্রামবাসীরা কেউ জানে না, আর কোনদিন গভীর নিশীথে ঘুম ভাঙলে সেই খেয়ালী বাঁশিওয়ালার মনকাড়া সুরের জাদু শুনতে পাবে না তারা।
সারাদিন মাছ ধরে আর বাঁশি বাজিয়ে বেড়ানো সেই হতচ্ছাড়া, ভবঘুরে ছেলেটি চিরতরে হারিয়ে গেছে।