কিন্তু না গেলেও নয়, কিছুক্ষণের মধ্যে নির্ঘাত মরবে তাহলে লোকটা। কাজেই খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ও, বিপদের ভয় একপাশে সরিয়ে রেখে টিলার দিকে এগোল।
ততক্ষণে ও নিশ্চিত বুঝে ফেলেছে মানুষটা যে-ই হোক, ঘুমিয়ে আছে। তাই সাড়া দিচ্ছে না। দ্রুত আঁধার ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে দেখে মহাব্যস্ত হয়ে উঠল গিলিয়াত। টিলার আরও কাছে এগিয়ে গেল। অন্ধকারে লোকটাকে চিনতে না পারলেও সে যে স্থানীয়, তেমনও মনে হলো না ওর। তার পরনে পাদ্রিদের মত পোশাক। এর মধ্যে পানি মহিষ পাহাড়ের চূড়ার এতই কাছে পৌঁছে গেছে যে নৌকার ওপর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলেই ও লোকটাকে ছুঁতে পারে।
জোয়ারের পূর্ণতা পেতে আর বেশি দেরি নেই, তাই পানির লাফ-ঝাঁপ সামান্য কমেছে বলে মনে হলেও খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারল না গিলিয়াত।
কারণ পানি বাড়লেও স্রোতের তেজ এখনও বলতে গেলে আগের মতই আছে, এই পরিস্থিতিতে সতর্ক না থাকলে বিপদ। যে কোন মুহূর্তে ওর সাধের ছোট্ট নৌকাটাকে টিলার ওপর আছড়ে ফেলে চুরমার করে দেয়ার মত যথেষ্ট ক্ষমতা এখনও রয়েছে চ্যানেলের।
তাই আরও সাবধানে এগোল গিলিয়াত, নৌকাটাকে বহুকষ্টে কোনমতে টিলার কয়েক হাতের মধ্যে নিয়ে এল। তারপর ওটাকে আড়াআড়িভাবে রেখে এক পা নৌকায়, আরেক পা টিলার সাথে ঠেকিয়ে দাঁড়াল সে। নৌকা যাতে এ্যানিটের দেয়ালে বাড়ি না খায়, সেদিকে কড়া নজর।
সামলে নিয়ে ঘুমন্ত লোকটার পা ধরে টান দিল গিলিয়াত। সঙ্গে সঙ্গে ধড়মড় করে উঠে বসল সে, পরমুহূর্তে নিজের চারদিকে পানির অস্বাভাবিক বিস্তার দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল একেবারে।
এই যে, মঁশিয়ে! গলা চড়িয়ে ডাকল ও। কে আপনি? এই অসময়ে এখানে কি করছেন?
ভয়ে বিস্ফারিত চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল লোকটা, ওর প্রশ্ন শুনে হড়বড় করে বলতে লাগল, দেখুন, মঁশিয়ে! আমি এই দ্বীপে নতুন। সব জায়গা ঠিকমত চিনি না। আজ দ্বীপটা ঘুরে দেখতে এসে এই জায়গাটা ভাল লেগে গেল বলে একটু বিশ্রাম নিতে বসেছিলাম। সমুদ্রযাত্রায় খুব ক্লান্ত ছিলাম কি না, তাই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, টেরই পাইনি।
তা তো বুঝলাম, বলল গিলিয়াত। কিন্তু এটা কোন ঘুমানোর জায়গা হলো? আর কয়েক মিনিট এভাবে থাকলে যে ঘুমটা চিরস্থায়ী হয়ে যেত আপনার! জোয়ারের পানি টিলা ডুবিয়ে দিতে বসেছে দেখছেন না?
গিলিয়াতের নৌকার পাটাতনে কিছু মাছ দেখতে পেয়ে লোকটা ওকে জেলে ভেবে নিল। কিন্তু এই ভরা জোয়ারের সময় এতটুকুন এক নৌকা নিয়ে মানুষ কিভাবে বিক্ষুব্ধ সাগরে যেতে সাহস করে, ভেবে ভারী অবাক হলো সে। অথচ মাঝি লোকটা কি নির্বিকার, আমলই দিচ্ছে না ব্যাপারটাকে।
হ্যাঁ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি, বলল লোকটা। কিন্তু আপনিই বা এই অসময়ে কোত্থেকে এলেন?
সে সব পরে শুনলেও চলবে, লোকটার দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল গিলিয়াত। আমার হাত ধরুন। তাড়াতাড়ি উঠে আসুন নৌকায়।
তাকে কোনমতে তুলে নিল ও, তারপর এ্যানিটের দেয়ালে বৈঠা দিয়ে জোর এক পুঁতো মেরে ওটার কাছ থেকে সরে এল, গলুই ঘুরিয়ে নীরবে উপকূলের দিকে চলতে শুরু করল। অল্প সময়ের মধ্যে লোকটাকে নিয়ে তীরে পৌঁছে একটা খুঁটির সাথে নৌকা বাঁধার জন্য উঠল গিলিয়াত।
এমন সময় চোখের কোনে একটা নড়াচড়া ধরা পড়তে ঘুরে তাকিয়ে দেখল, লোকটা তার পরনের যাজকদের মত ঢোলা, কালো পোশাকের পকেট থেকে একটা গিনি বের করে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে আছে। হাতটা সরিয়ে দিয়ে নীরবে নৌকা বাঁধতে লাগল গিলিয়াত।
ওর কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল আগম্ভক, তারপর মৃদু প্রতিবাদের সুরে বলল, দেখুন, মঁশিয়ে, আজ আপনি আমাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। আপনি না থাকলে …
হতে পারে, নির্বিকার চেহারায় জবাব দিল ও।
সে জন্যে আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ, মঁশিয়ে। এতবড় একটা ঋণ শোধ করার
ঋন? সে তো কখন শোধ হয়ে গেছে, বাধা দিয়ে বলে উঠল গিলিয়াত। অন্যমনস্ক।
কিন্তু আপনার তো অনেক কষ্ট হয়েছে! তা হয়েছে। কিন্তু নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে হলে ওটুকু যে আমাকে করতেই হতো! পাশাপাশি হেঁটে চলল গিলিয়াত ও রেভারেন্ড কড্রে, কথা নেই কারও মুখে। আগন্তকই মুখ খুলল একটু পর।
আপনি এই গ্রামের লোক? সঙ্গীকে ভাল করে দেখে নিয়ে প্রশ্ন করল সে।
না।
তাহলে?
হাত তুলে আকাশ নির্দেশ করল গিলিয়াত। ওই যে, ওখানকার।
আর কোন প্রশ্ন করল না লোকটা, অবাক চোখে যুবকের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের পথে চলে গেল। কিন্তু কয়েক পা গিয়ে কি খেয়াল হতে ফিরে এল সে। পকেট থেকে চামড়ায় বাঁধানো একটা ছোট, সুদৃশ্য বই বের করে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরল।
এই বইটা আপনাকে উপহার দিতে চাই আমি। নিতেই হবে আপনাকে।
আপত্তি না করে হাত বাড়াল গিলিয়াত। বুঝল ওটা একটা বাইবেল। জীবন রক্ষাকারীর হাতে বইটা তুলে দিয়ে নিজের পথে চলে গেল রেভারেন্ড। আনমনে তার গমণপথের দিকে তাকিয়ে থাকল ও।
ছয়
সেইন্ট ম্যালো ফ্রান্সের এক উপকূলীয় বন্দর। স্যামসন থেকে প্রতি মঙ্গলবার দুরান্দ বোঝাই করে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে এখানে আসে ক্লুবিন। দুদিন থেকে বয়ে আনা মালপত্র খালাস করে, তারপর নতুন পণ্য নিয়ে শুক্রবার স্যামসনে ফিরে যায়।