***
কয়েকদিন পরের কথা। দেরুশেত ওর রুমে বসে পিয়ানোয় কি এক মিষ্টি সুর বাজাচ্ছে, এই সময় বাগানের দেয়ালের ওপাশের রাস্তা ধরে কোথাও যাচ্ছিল গিলিয়াত।
সুরটা কানে যেতেই সচেতন হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগল। বাগানের নিচু দেয়ালের ওপর দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে চোরা চোখে দেরুশেতকে খুঁজল সে, কিন্তু মেয়েটির দেখা পেল না।
ওইদিন থেকে কেমন এক নেশায় পেয়ে বসল যেন যুবককে। যখন,তখন ওদের বাড়ির পশ্চিম দেয়াল ঘেঁষে অযত্নে বেড়ে ওঠা বড় এক ঝোঁপের আড়ালে এসে দাঁড়াত। দেরুশেতের দেখা পাওয়ার আশায় অপেক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
একটুও ক্লান্তি অনুভব হত না গিলিয়াতের। ভাগ্য ভাল থাকলে মেয়েটিকে কোনদিন বাগানে ফুল তুলতে দেখতে পেত, অথবা আড়াল থেকে ভেসে আসা ওর মিষ্টি গলার গান শুনতে পেত। কোনও কোনও দিন আবার কিছুই ঘটত না, হতাশ মনে বাড়ি ফিরে যেত সে। ও বাড়ির বাগানে বড় একটা বেঞ্চ পাতা আছে, রোজ সন্ধের পর দেরুশেতকে নিয়ে সেটায় বসত বৃদ্ধ।
বিশ্রাম নিত, শরীর-মন ভাল থাকলে আদরের ভাইঝিকে নিজের জীবনের সগ্রাম আর সুখ-দুঃখের কাহিনী শোনাত সে লম্বা সময় ধরে। গল্পে গল্পে রাত কখন গম্ভীর হয়ে এসেছে, হুঁশ থাকত না তাদের কারও।
কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারত না যে আরও একজন শ্রোতা আশেপাশেই আছে। লেতিয়ারির জীবন যুদ্ধের গল্প সে-ও শুনছে মুগ্ধ হয়ে।
এক রাতে শুতে যাচ্ছে দেরুশেত, এমন সময় দূর থেকে বাঁশির মন পাগল করা মিষ্টি সুর ভেসে আসতে শুনে কান খাড়া হয়ে উঠল ওর। আওয়াজটা গিলিয়াতের বাড়ির দিক থেকে আসছে না?
অবাক হলো দেরুশেত। কে এই জাদুকর যে বাঁশিতে এমন হৃদয় নিংড়ানো সুর তুলতে পারে?
আশ্চর্য! পিয়ানোয় ও নিজে সাধারণত যে সুর তুলে থাকে, সেই সুরই তো! ভাবতে ভাবতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে কিছুই দেখার উপায় নেই। তন্ময় হয়ে বাঁশির সুর শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল ও।
সেদিনের পর থেকে প্রায় রাতেই নিয়মিত শোনা যেতে লাগল সেই বাঁশি, বিশেষ করে অন্ধকার রাতে। কে বাজাত, জানে না দেরুশেত।
অচেনা, খেয়ালী বাদকের সেই মায়াবী, মিষ্টি সুর অন্ধকার রাতের বুকে কাঁপন ধরিয়ে একসময় ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে যেত। আর কারও প্রাণে তা কোনরকম দোলা জাগাতে পারত কি না কে জানে! এভাবেই দেখতে দেখতে চার বছর পার হয়ে গেল। চার বছর একেবারে কম সময় নয়! দেরুশেত কুড়িতে পা দিয়েছে, অথচ এতদিনেও ওর সাথে গিলিয়াতের একটা বাক্য বিনিময় পর্যন্ত হয়নি। ওকে নিয়ে দিনরাত কেবল কনার জাল বুনে চলেছে যুবক।
এই সময় একটা ঘটনা ঘটল। গ্রামের সেইন্ট পিটার গির্জায় এক নতুন রেভারেন্ড এসেছে। বয়স অল্প, প্রায় গিলিয়াতের বয়সী। নাম কড্রে। আর্থিক অবস্থা তেমন সচ্ছল নয় তার, তবে শিক্ষা-দীক্ষা ভালই আছে।
গেরানসির সবাই জানল, লন্ডনে তার এক মামা আছে। ভদ্রলোক খুব ধনী। ছেলে-মেয়ে বা আর কোন ওয়ারিশ নেই সে মামার, ভাগ্নে কড্রেই তার সমস্ত সহায়-সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। কাজেই মামার মৃত্যুর পর সে যে ধনী হয়ে যাবে, সে ব্যাপারে প্রত্যেকে নিশ্চিত। যে ঘটনার কথা বলতে যাচ্ছিলাম, তা এই রেভারেন্ডকে নিয়েই।
তার সেইন্ট পিটার গির্জার কাজে যোগ দেয়ার একদিন কি দুদিন পর গিলিয়াত ওর খুদে নৌকাটা নিয়ে সাগরে বেরিয়েছিল মাছ ধরতে। সারাদিন মাছ ধরে সন্ধের আগে আগে দ্বীপে ফিরে যাচ্ছে ও।
মহিষ পাহাড়ের ধার দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ মনে হলো ওটার সিংহাসনের ওপর আবছামত একটা ছায়া যেন দেখা যাচ্ছে! এখন জোয়ারের সময়। গিলিয়াত ভাল করেই জানে এ সময় ওখানে থাকার মত দুঃসাহস এ তল্লাটের কারও থাকতেই পারে না। ওদিকে পানি বেড়ে ওঠায় মহিষ পাহাড়ে যাওয়ার সরু পথটাও ততক্ষণে তলিয়ে গেছে।
কাজেই কোন জীব-জন্ত্ররও ওখানে থাকার সম্ভাবনা নেই এখন। এরকম বিপজ্জনক মুহূর্তের সময় তারাও ওই টিলার ধারেকাছে ঘেঁষে না। কিন্তু কেউ যে মহিষ পাহাড়ে আছে, তাতেও বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না গিলিয়াতের।
দেরি না করে নৌকার গলুই সেদিকে ঘুরিয়ে দিল ও। কাছে গিয়ে দেখল সন্দেহ মিথ্যে নয়, সত্যিই কেউ একজন আছে। সিংহাসনে শুয়ে আছে। নড়াচড়া নেই, একদম নিথর।
এদিকে জোয়ারের পানি ততক্ষণে আরও ফুলে-ফেঁপে উঠে মহিষ পাহাড়কে উপকূল থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে গোটা টিলাটাই সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবে সাগরে।
মানুষটা যে-ই হোক, ওরকম অনড় শুয়ে আছে কেন ভেবে পেল না গিলিয়াত। মরে যায়নি তো? কিন্তু দেখে সেরকম মনে হলো না ওর! বরং মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছে।
নিশ্চিত হওয়া দরকার, কাজেই সময় নষ্ট না করে গায়ের জোরে নৌকা বেয়ে টিলার যতটা সম্ভব কাছে চলে এল সে, চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল লোকটাকে। কিন্তু অনেক ডাকাডাকি করেও সাড়া পাওয়া গেল না তার।
আগের মতই অসাড় পড়ে আছে। ওদিকে উন্মত্ত চ্যানেলের ভরা জোয়ারের পানি তাণ্ডব নৃত্য শুরু করে দিয়েছে মহিষ পাহাড়ের চূড়াটাকে ঘিরে। লোকটার নিরাপত্তার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল গিলিয়াত। এরকম সময় নৌকা নিয়ে টিলার বেশি কাছে যাওয়াও বিপদ, ঢেউয়ের আঘাতে ওটার ওপর আছড়ে পড়ে চোখের পলকে চুরমার হয়ে যেতে পারে।