আরও জানাল, তার নিজের জাহাজ এটা। এক নামকরা ফরাসী এনজিনিয়ারকে দিয়ে তৈরি করিয়ে এনেছে। খরচ পড়েছে চল্লিশ হাজার ফ্লা। গোটা বন্দরে রীতিমত হুড়োহুড়ি পড়ে গেল এই খবরে। অদ্ভুত এনজিনটা দেখার জন্যে রীতিমত প্রতিযোগিতায় লেগে পড়ল আশপাশের প্রতিটা গ্রামের মানুষ।
একমাত্র আদরের ধন দেরুশেতের নামের সাথে মিল রেখে লেতিয়ারি ওটার নাম রাখল দুরা। আবার নতুন করে পুরোদমে ব্যবসায়ে লেগে পড়ল।
সাধারণ পালের জাহাজের তুলনায় দুরান্দের বহন ক্ষমতা এবং গতি, দুটোই ছিল অনেক বেশি। অল্প সময়ে বেশি বেশি পণ্য আনা-নেয়া করতে পারে দুরান্দ। তাছাড়া ওটাতে করে সমুদ্রযাত্রা ছিল যেমন নিরাপদ, তেমনি আরামের। কাজেই দিনে দিনে ওটার চাহিদা বাড়তে থাকল। ফলে লেতিয়ারির তখন একেবারে পোয়াবারো।
তার শূন্য সিন্দুক ক্রমে আবার ভরে উঠতে শুরু করল। দেখতে দেখতে সে গেরানসির অন্যতম শীর্ষ ধনীদের একজনে পরিণত হলো।
কিন্তু হঠাৎ করে বাতরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ায় কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল লেতিয়ারি। তবে ভাগ্য ভাল, তার আগেই আরেক যুবককে শিখিয়ে-পড়িয়ে ওস্তাদ নাবিক বানিয়ে নিতে পেরেছিল সে।
এখন বাতে প্রায় পঙ্গু লেতিয়ারি। সাগর পাড়ি দেয়ার মত কঠিন দায়িত্ব তার পক্ষে আর চালিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না, তাই দুরান্দের পুরো দায়িত্ব সেই যুবকের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। বাড়িতে বসে এখন কেবল হিসেব-পত্র দেখাশোনার কাজ করে সে সারাদিন।
বন্দরের প্রবেশপথের কাছে মস্তবড় একটা বাড়ি কিনে নিয়েছে লেতিয়ারি। বাড়িটার পশ্চিম আঙিনায় সুন্দর একটা ফুলের বাগান আছে। নানা জাতের, নানা বর্ণের বাহারী ফুলে ভরা সে বাগান দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
বাড়ির দক্ষিণদিকে, সামান্য দূরে স্যামসনের জাহাজঘাট। সেদিকটাতেই বৃদ্ধ তার শোয়ার ঘর বানিয়ে নিয়েছে। খাট পেতেছে জানালার কাছে, যাতে ইচ্ছেমত সাগর-জাহাজঘাট সব দেখতে পায়।
শুয়ে-বসে বন্দরের দিকে তাকিয়ে থেকেই দিন কাটে বৃদ্ধের, জাহাজের আসা-যাওয়া দেখে চুপচাপ। দেশ-বিদেশ ঘুরে যেদিন তার দুরান্দ বন্দরে ফিরে আসে, সেদিন বৃদ্ধের আনন্দের সীমা থাকে না।
আবেগে উত্তেজনায় অস্থির হয়ে পড়ে সে, বাতের ব্যাথার কথা ভুলে দেরুশেতকে সাথে নিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে পায়ে পায়ে একেবারে জেটির কাছে এসে দাঁড়ায়।
দেরুশেতের শোয়ার ঘর বাড়ির পশ্চিমদিকে। বাগানটাও সেদিকেই। লেতিয়ারির সেবা-যত্নসহ সংসারের যাবতীয় কাজ একাই করে সে, অবসর সময়ে বাগান থেকে ফুল তুলে এনে ঘর সাজায়। নিজেও সাজে।
বাগানের নিচু পাঁচিলের ওপাশে একটা রাস্তা আছে, পাচিল ঘেঁষে সাগরের দিকে চলে গেছে। সেই রাস্তার শেষ মাথায় বড় এক পাথরের টিলা। গিলিয়াতের দৈত্যপুরী ওটার ওপরেই। লেতিয়ারি দুরান্দের দায়িত্ব যার হাতে ছেড়ে দিয়েছে, তার নাম ক্লুবিন। যুবক কথা বলে খুব কম, কাজ করে বেশি। সৎ বলে যথেষ্ট সুনাম আছে তার এ অঞ্চলে। চেহারা-সুরতে হিসেবী কেরাণী গোছের কিছু মনে হলেও যুবক আসলে একজন পাক্কা নাবিক। জলচর প্রাণীর মতই সুদক্ষ সাঁতাঙরু সে। উত্তাল সমুদ্রে নির্ভয়ে সাঁতার কাটতে পারত ক্লুবিন। তার অন্তদৃষ্টিও ছিল ভীষণ তীক্ষ্ণ। বিশেষ করে এই গুনটির জন্যে লেতিয়ারি যুবককে বেশ পছন্দ করে।
একদিন এই যুবকই তাকে রাতাগের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল, রাতাগ লোকটাকে ভুলেও কখনও বিশ্বাস করবেন না দেখবেন, সুযোগ পেলে লোকটা একদিন চরম সর্বনাশ ঘটিয়ে ছাড়বে আপনার।
অবশ্য এই জন্যেই যে লেতিয়ারি ক্লুবিনকে দুরান্দের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব দিয়েছে, ব্যাপারটা সেরকম নয়। কথায় বলে, গরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ডরায়। বিশ্বাসঘাতক রাতাগ পালিয়ে যাওয়ার পর কিছুদিন লেতিয়ারিরও সেই অবস্থা গেছে।
তাই ছেলেটাকে নিয়োগ দেয়ার আগে তার ব্যাপারে খুব ভাল করে খোঁজ-খবর নিয়ে তবেই দিয়েছে। বেশ কিছু ছোটখাট পরীক্ষাও করিয়ে নিয়েছিল সে তাকে দিয়ে। তার সবগুলোয় বেশ ভালভাবেই উৎরে গেছে ক্লুবিন।
০৫. বড়দিনের দিন
পাঁচ
পথে-ঘাটে দেরুশেতের সঙ্গে অনেকবার চোখাচোখি হয়েছে গিলিয়াতের, কিন্তু কথা হয়নি কখনও। বড়দিনের দিন নির্জন পথে আবারও দুজনের দেখা হয়ে যাওয়া এবং বরফের ওপর দেরুশেতের তার নাম লিখে রাখার ব্যাপারটা একেবারে হতচকিত করে তুলল গিলিয়াতকে।
এমন কিছু ঘটতে পারে, স্যামসনের কেউ ওকে নিয়ে মাথা ঘামায়, তা কখনও স্বপ্নেও কল্পনা করেনি সে। এটা যখনকার ঘটনা, দেরুশেতের বয়স তখন মোল পুরো হয়েছে।
খুব চিন্তিত মনে সেদিন বাড়ি ফিরল গিলিয়াত। ভেবে পেল না, এই কনকনে শীতের মধ্যে কি এমন জরুরি কাজে বাড়ির বাইরে গিয়েছিল সে। বড়দিন বলে অন্যদের মত প্রার্থনা করতে গির্জায় যাবে বলে বেরিয়েছিল, ব্যাপারটা যদি সেরকম হত, কোন কথা ছিল না।
কিন্তু সে জন্যে তো বেরোয়নি সে, তাহলে কেন বেবিয়েছিল? কি কাজে? দিনটা আকাশ-পাতাল ভেবে পার করল গিলিয়াত। রাতে ঘুমাতে গিয়ে আবিষ্কার করল, ঘুম তার চোখের ত্রিসীমানার ধারও ঘেঁষছে না। রাজ্যের যত আবোল তাবোল চিন্তা জুড়ে বসে আছে মাথার মধ্যে। মায়ের কথা মনে পড়ল ওর, ঘরের কোণে রাখা সেই বাক্সটার কথা মনে পড়ল। আরও কত-শত ভাবনা আলোড়িত করল রাতভর, তার ইয়ত্তা নেই। পরদিন যখন ওর ঘুম ভাঙল, তখন কড়া রোদে ঘর ভরে গেছে।