তাই তার খুব ইচ্ছে ছিল সময় হলে মৃত্যুও যেন সাগরেই হয়, পানিতে ভাসতে ভাসতেই যেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারে সে। কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছেই কি পূরণ হয়? এখন বাতে প্রায় অচল হয়ে বাড়িতে পড়ে আছে বুড়ো লেতিয়ারি।
যে সাগরের আচরণ, মতিগতি পর্যবেক্ষণ করে জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে, সেই সাগরের সাথে আজ তার সম্পর্ক চিরতরে ঘুচে গেছে। তারপরও স্যামসনে লেতিয়ারির সাথে কারও তুলনাই হয় না।
সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের মানুষ। পরাজয় কাকে বলে জানে না। কাজ যত কঠিনই হোক না কেন, একবার হাতে নিলে সেটা শেষ না করে ছাড়েনি সে কখনও।
প্রায় ষাট বছর ধরে সাগর বহু কঠোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে তার ওপর দিয়ে, কিন্তু কোনদিন কাবু করতে পারেনি। মহিষ পাহাড়ের মত অটল থেকে সমস্ত ঝড় ঝাঁপটার মোকাবেলা করে গেছে লেতিয়ারি।
বিশালদেহী মানুষ সে। প্রশস্ত, ঢালু কাধ। বুকের পাটাও তেমনি। গলার স্বর ভরাট, গম্ভীর। হাত দুটো দেহের তুলনায় বেশ দীর্ঘ। ও দুটোর মত তার অন্তরটাও বড়, উদার। বিপত্নীক সে, এবং নিঃসন্তান।
সংসারে দুটি স্নেহের পাত্র-পাত্রী আছে লেতিয়ারির। একটি দেরুশেত, অন্যটি দুরান্দ। দেরুশেত তার ভাইঝি। বাপ-মা মরা এই মেয়েটিই বৃদ্ধের জীবনের প্রধান অবলম্বন। খুব ছোট থাকতে মেয়েটিকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে সে, সন্তানের মত স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে বড় করেছে। মোলয় পা দিয়েছে এখন দেরুশেত।
চমৎকার ছিপছিপে গড়ন। চোখ দুটো হরিণের মত টানা টানা, মায়াবী। অতুলনীয় সুন্দর মুখখানায় মিটিমিটি হাসি সবসময় লেগেই থাকে। গেরানসিতে দেরুশেতের মত সুন্দরী মেয়ে দ্বিতীয়টি নাকি নেই।
লেতিয়ারিকে বাবা ডাকে মেয়েটা। গ্রামের সবাই জানে দেরুশেত তারই মেয়ে। আর দুরান্দ? দুরান্দ হচ্ছে তার প্রিয় জাহাজের নাম-গেরানসির প্রথম স্টীম এজিন চালিত জাহাজ। সেই পালতোলা নৌকা-জাহাজের যুগে ওরকম বাষ্প চালিত অত্যাধুনিক জাহাজ সাগরে নামানোর মত যুগান্তকারী পদক্ষেপ কেবল লেতিয়ারির মত দৃঢ়চেতা, কঠিন সংগ্রামী এবং দূরদর্শী নাবিকের পক্ষেই নেয়া সম্ভব।
একসময় লেতিয়ারির পণ্য পরিবহণের খুব রমরমা ব্যবসা ছিল। নিজের পুরানো স্কুনারে নানান মালপত্র বোঝাই দিয়ে মাসের পর মাস এ-বন্দর সে-বন্দর করে বেড়াত সে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতেই একদিন এক বন্দরে নিজের মত আরেক দুঃসাহসী নাবিকের সাথে পরিচয় হয় তার।
লোকটির নাম রাতাগ। তার নিজেরই মত দীর্ঘ, বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী ছিল মানুষটা। একই রকম কর্মঠ, নিউঁকি। তাকে এক বিশেষ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করেছিল সে, তাই তার প্রতি রাগের কৃতজ্ঞতার অন্ত ছিল না। লেতিয়ারিরও ভাল লেগেছিল রাতাগকে।
তাই তাকে গেরানসিতে নিয়ে এল সে। এবং তাল্পদিনের মধ্যে বুঝে ফেলল লোকটা যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং বিশ্বস্ত। এরকম একজন সাহায্যকারী থাকলে খুবই উপকার হয় তার। নিজের খাটুনি অনেক কমে যাবে, আবার সেই সাথে ব্যবসাও আগের মত সমান তালেই চলতে থাকবে।
কাজেই লোকটাকে নিজের জাহাজ ব্যবসার একেবারে অধের্ক অংশীদার করে নিয়ে ওটার সম্পূর্ণ ভার তার হাতেই তুলে দিল সে।
রাতাগ ছিল খুব চাপা স্বভাবের মানুষ, সারাক্ষণ মুখ বুজে থাকত। নিজের সম্পর্কে কখনও কারও সামনে মুখ খুলত না। এই কারণে গেরানসিতে দীর্ঘদিন থাকার পরও তার ব্যাপারে বলতে গেলে প্রায় কিছুই জানত না মানুষ।
লোকটার চাল-চলন, কথাবার্তা, গতিবিধি, সবই কেমন যেন রহস্যময় ছিল। লোকে বলাবলি করত, রাতাগ করতে পারে না এমন কাজ নাকি পৃথিবীতে নেই। বেশ কয়েক বছর সাফল্যের সাথে লেতিয়ারির জাহাজের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালন করল লোকটা। পরিবহণ ব্যবসা আবার ফুলে-ফেঁপে উঠল।
তার ব্যাপারে সে যখন পুরোপুরি নিশ্চিত, তখনই হঠাৎ একদিন রাতের আঁধারে উধাও হয়ে গেল রাতাগ। জানা গেল খালি হাতে যায়নি সে, লেতিয়ারির অফিসের সিন্দুকে নগদ টাকাকড়ি যা ছিল, সব ঝেটিয়ে নিয়ে গেছে।
ওটায় তার নিজেরও অল্প কিছু সঞ্চয় ছিল ঠিকই, কিন্তু লেতিয়ারির ছিল পুরো পঞ্চাশ হাজার ফ্রা-বলতে গেলে তার সুদীর্ঘ চল্লিশ বছরের অমানুষিক পরিশ্রমের অর্ধেক ফসল।
মাল কেনার জন্যে মাত্র কদিন আগে টাকাটা সে ব্যাংক থেকে তুলে এনে সিন্দুকে রেখেছিল। রাতাগকে খুঁজে বের করার অনেক চেষ্টা করল লেভিয়ারি, কিন্তু কাজ হলো না। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে সে একেবাবে।
কিন্তু তাই বলে ভেঙে পড়েনি লেতিয়ারি, শেষ সম্বল আয়ও পঞ্চাশ হাজার ফ্রা ছিল তার, ঠিক করল তাই দিয়ে একটা বাস্পীয় এনজিন চালিত জাহাজ কিনবে এবাব, আরেকবার চেষ্টা করে দেখবে ভাগ্য ফেরানোর।
আধুনিক বাষ্পীয় জাহাজের চল সবেমাত্র শুরু হয়েছে সে আমলে। যে কথা সেই কাজ, একদিন ফ্রান্সের পথে পাড়ি জমাল লেতিয়ারি, এবং ছয় মাস পর আজবদর্শন এ জাহাজ নিয়ে দেরুশেত ফিরে ফিরে এল।
ভীষণ গর্জনের সাথে কুচকুচে কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ওটা যখন জেটিতে এসে ভিড়ল, গোটা দ্বীপের মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। প্রথমে সবাই ভাল জাহাজটায় আগুন ধরে গেছে বুঝি, নইলে ওরকম ধোঁয়া উঠবে কেন?
অবশ্য কিছুক্ষণ পর বুড়ো লেতিয়ারিকে উদ্ভাসিত চেহারায় ওটা থেকে নেমে আসতে দেখে ভুল ভাঙল তাদের। লেতিয়ারি সবাইকে আশ্বস্ত করল, আগুন-টাগুন কিছু নয়, জাহাজটা বাপীয় এনজিন চালিত বলে ওভাবে ধোয়া ছাড়ে।