মুক্তির আনন্দে পাখিরা যখন আকাশে ডানা মেলে দিত, আনন্দে চিৎকার করতে করতে উড়ে যেত, গিলিয়াত মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকত। কি এক অনাবিল আনন্দে ওর চোখমুখ ঝলমল করত সে সময়ে।
এই পাখিকে কেন্দ্র করে একবার একটা ঘটনা ঘটল। গ্রামের এক কিশোের একদিন গাছে উঠে পাখির বাসা থেকে কয়েকটা পাখির ছানা নিয়ে নেমে আসছিল, এমন সময় গিলিয়াত এসে হাজির সেখানে।
ছেলেটার হাত থেকে ওগুলো কেড়ে নিয়ে তখুনি গাছে উঠে পড়ল গিলিয়াত, পরম যত্নের সাথে জায়গামত রেখে এল। গ্রামের মুরুব্বি গোছের কয়েকজন সেখান দিয়ে যাচিছল ওই সময়। এই ঘটনা দেখে তার লেটির পক্ষ হয়ে গিলিয়াতকে বেশ কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিল।
প্রতিবাদ দূরে থাকুক, গিলিয়াত একটা কথাও বলল না। শুধু হাত তুলে তাদেরকে দেখাল শাবকহারা মা পাখিগুলো কিভাবে অত চিৎকার করছে আর গাছের ওপর অনবরত চক্কর দিচ্ছে। ওর চোখ ছল-ছল করছিল তখন ওর মনের অবস্থা অনুমান করতে পেরে আর কথা বাড়ায়নি লোকগুলো, বিস্ময় চেপে রেখে চলে গেল।
গ্রামের একজন সৈনিকের কাছ থেকে একটা ব্যাগপাইপ বাঁশি কিনেছিল গিলিয়াত। প্রায়ই সন্ধের পর সাগরের তীরে বসে করুণ সুরে বাজাত সেটা।
বাজাতে বাজাতে উদাস হয়ে পড়ত-কখন আঁধার নেমেছে, রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়ে চলেছে, হুঁশ থাকত না তার। গভীর নিশীথে হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা গায়ের লোকে কতদিন যে তন্ময় হয়ে গেছে তার সেই বাঁশির করুণ সুরের বিস্ময়কর ঐন্দ্রজালে, তার হিসেব নেই।
নিজের খেয়াল খুশিমত দিন কাটাত গিলিয়াত। গ্রামের মানুষ মনে করত ছেলেটা ছন্নছাড়া, ভবঘুরে। একটা অপদার্থ ছাড়া কিছু নয়।
অথচ অন্যের উপকার করার ক্ষেত্রে স্যামসনে গিলিয়াতের কোন জুড়ি ছিল না। কেউ কোন সমস্যায় পড়লে সবার আগে ওকেই স্মরণ করত, আর ও-ও সানন্দে ছুটে যেত। সে যত কঠিন সমস্যাই হোক না কেন, পরোয়া করত না গিলিয়াত।
ওর বাড়িটা যে টিলায়, তার কিছুটা দূরে, সাগরের মধ্যে গ্যানিট পাথরের আরেকটা উঁচু টিলা আছে। ওটার আকৃতি দেখলে মনে হয় পানিতে ডুব দিয়ে থাকা মোষের খাড়া শিং, পানির ওপর জেগে আছে বুঝি। এই জন্যে স্থানীয়রা ওটার নাম রেখেছে মহিষ পাহাড়।
তীর থেকে একটা সঙ্কীর্ণ পাথুরে রাস্তা আছে ওটায় যাওয়ার। জোয়ারের সময় পানি বাড়লে ডুবু ডুবু হয়ে যায় রাস্তাটা, নইলে এমনিতে সব সময় পানি থেকে অনেকখানি জেগে থাকে। ঢেউয়ের ক্রমাগত ঝাঁপটায় পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে এক প্রস্থ সিঁড়ির মত বেশ কিছু ধাপের সৃষ্টি হয়েছে টিলাটার গায়ে, সেই ধাপ বেয়ে ওটার চূড়ায় ওঠা যায়।
স্রোতের কারণে মহিষ পাহাড়ের চূড়ার কাছের খানিকটা জায়গা সমতল হয়ে চমৎকার একটা সিংহাসনের আকার পেয়েছে। প্রকৃতি তার অদ্ভুত খেয়ালবশে সিংহাসনটায় ঠেস দিয়ে বসার জন্যে একটা ব্যাকরেস্ট, এমনকি হাত রাখার জন্যে দুপাশে দুই হাতলও তৈরি করে দিয়েছে। পানির ওপরে যখন জেগে থাকে, মহিষ পাহাড়ে গিয়ে ওঠার লোভ সামলানো তখন সত্যিই খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
আবার গেলে সমস্যাও আছে। চলমান জাহাজ, পাল তোলা নৌকার বহর আর চারদিকের অপূর্ব নৈসর্গিক শোভা, এইসব দেখতে গিয়ে মানুষ অনেক সময় দুনিয়াদারি ভুলে যায়।
দুর্ভাগ্যবশত কারও বেলায় যদি তেমনটা ঘটে, টেরও পায় না সে কখন জোয়ার এসেছে চ্যানেলে-তার দ্বীপে ফিরে যাওয়ার পথ তলিয়ে গেছে সাগরে, মহিষপাহাড় ডুবিয়ে দিতে খুব দ্রুত উঠে আসছে। অসহায়ের মত মৃত্যুকে মেনে নেয়া ছাড়া তখন আর কোন পথ খোলা নেই তার।
শোনা যায়, ওই টিলায় গিয়ে অতীতে স্যামসনের দুএকজন বেখেয়াল বাসিন্দা এভাবেই প্রাণ হারিয়েছে। তাই স্থানীয় কেউ জোয়ারের সময় ওখানে যাওয়ার দুঃসাহস ভুলেও করে না। অবশ্য গিলিয়াতের কথা আলাদা।
একেবারেই আলাদা ধাচের মানুষ ও, তাই বিশে তাই মহিষ পাহাড়ের সাথে বিশেষ সখ্যতা গড়ে নিয়েছে। ওর বাড়ি থেকে মহিষ পাহাড়ের দূরত্ব তেমন বেশি নয়, ইচ্ছেমত যখন-তখন সেখানে চলে যায় গিলিয়াত। সিংহাসনে বসে প্রায়ই কি যেন গভীর ভাবনায় তলিয়ে যায়। জোয়ারের পানিকে ও ঘোড়াই কেয়ার করে।
কতদিন গভীর রাতে জোয়ারের পানির ভয়াবহ গুরু গর্জনের শব্দ ছাপিয়ে মহিষ পাহাড় থেকে বাঁশির সুর ভেসে আসতে শুনেছে স্যামসনের মানুষ। সেখানকার ছেলে-বুড়ো সবার খুব ভালই পরিচিত ওই বাঁশি।
ওরকম অপূর্ব সুরের মায়াজাল সৃষ্টি করার মত খেয়ালী বাদকটি যে কে, তাও তারা ভালই জানে।
চার
জাহাজ ব্যবসায়ী বৃদ্ধ লেতিয়ারি স্যামসনের নাম করা ধনীদের একজন। পেশাদারী জীবনের শুরুতে জাহাজের সাধারণ নাবিক ছিল লোকটা, আর আজ নিজেই একটা জাহাজের মালিক। তাও যেমন-তেমন কোন জাহাজের নয়, একেবারে স্টীম এজিন চালিত আধুনিক বাণিজ্য জাহাজের।
প্রায় সত্তর বছরের জীবনে অনেক ঝড়-ঝাঁপটা গেছে লেতিয়ালির ওপর দিয়ে, কিন্তু কোনদিন কোনকিছুর কাছেই নতি স্বীকার করেনি সে। অথচ দুর্ভাগ্য, শেষ পর্যন্ত অভিশপ্ত ব্যাধি বাতের কাছে তাকে হার মানতেই হলো।
বাত প্রায় অচল, পঙ্গু করে ফেলেছে তাকে। এখন তাই ঘরের মধ্যে একরকম বন্দী জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে সে। যে জীবন কিছুকাল আগে পর্যন্ত বলতে গেলে জাহাজে করে সাগর পাড়ি দিয়েই কেটেছে, আজকাল সেই জীবনকে সুদূর অতীতের কোন মিষ্টি মধুর স্বপ্নের মত মনে হয় তার। লেতিয়ারিদের কয়েক পুরুষের আদি পেশা ছিল মূলত জাহাজের নাবিকের চাকরি। পৃথিবীর সাথে লেতিয়ারির প্রথম পরিচয়টা বলতে গেলে সাগরের বুকেই হয়েছিল।