উপায় নেই, যেতেই হবে। নইলে মামার শেষকৃত্যে যোগ দিতে পারবে না সে।
চলুন, চলুন! ওদের দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠল গিলিয়াত। জাহাজ ছাড়ার সময় হয়ে গেছে দেখছেন না!
ওর দিকে চকিতে একপলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল দেরুশেত। আজ ভোরবেলা থেকে তাদের দুজনের বিয়ে নিয়ে মানুষটা যে তৎপরতা দেখাল, ব্যাপারটা রীতিমত রহস্যময় লাগছে ওর। কিন্তু সে ভাবনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না মনে, ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ল দেরুশেত।
জাহাজ ছাড়তে সত্যি আর দেরি নেই, এখন লেতিয়ারির সাথে দেখা করে তার আশীর্বাদ নিতে গেলে সমস্যা হয়ে যাবে। তাই ঠিক হলো, আজ আর তার সাথে দেখা করতে যাবে না বর-কনে। বরং লন্ডন থেকে একটা চিঠিতে বৃদ্ধকে এর কারণ পুলে জানাবে তারা। লেতিয়ারি যে এ বিয়েতে মত দিয়েছে, তাতে দেরুশেত বা কড্রের মনে কোন সন্দেহ নেই। কারণ অনুমতি দিয়ে লেখা তার চিঠি তো তারা দেখেছে। কাজেই বিশেষ কারণে দেখা করতে না পারার ক্রটি নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দেবে সে।
জোর পা চালিয়ে আগে আগে জাহাজ ঘাটের দিকে চলল দেরুশেত ও কড্রে, গিলিয়াত রয়েছে ওদের একটু পিছনে। উপযুক্ত জেটির অভাবে এখানে তীর থেকে সরাসরি জাহাজে চড়ার উপায় নেই, নৌকায় করে উঠতে হয়। তাই নৌকার দিকে এগোল ওরা।
কড্রে আগে উঠল নৌকায়। দেরুশেত তাকে অনুসরণ করতে যাচ্ছিল, এই সময় পিছন থেকে গাউনে টান পড়তে ঘুরে তাকাল। দেখল গিলিয়াত ওর গাউনের প্রান্ত ধরে আছে।
কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়াই হঠাৎ করে বিদেশে চলে যেতে হচ্ছে, চোখাচোখি হতে অপ্রস্তুতের মত হাসল যুবক, জামা কাপড় কিছুই তো নিয়ে যেতে পরলে না। কিন্তু ওসব ছাড়া চলবে কি করে? তাই জাহাজে তোমাদের কেবিনে একটা বড় বাক্স রেখে এসেছি আমি, ওর মধ্যে মেয়েদের কয়েক সেট পোশাক আছে। সব নতুন।
একটু দ্বিধাগ্রস্থ দেখাল গিলিয়াতকে। ওগুলো আমার মা জমিয়ে রেখেছিলেন নিজের ছেলের বউ এলে তাকে দেবেন বলে। তুমি ওগুলো গ্রহন করলে আমি খুশি হবো!
বলার মত কিছু খুঁজে পেল না দেরুশেত, কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।
গিলিয়াত নিচু স্বরে বলে চলল, তোমাকে কোনদিন নিজের মনের কথা বলা হয়নি আমার। জীবনে আর কখনও হবেও না, তাই এই ফাঁকে কয়েকটা কথা বলে নিই।
যেদিন দুরান্দের ডুবে যাওয়ার খবর আসে, সেদিন আরও অনেকের সাথে তুমিও ছিলে তোমাদের বৈঠকখানায়। তখন সাময়িক উত্তেজনাবশেই বোধহয় সেখানে একটা প্রতিজ্ঞা করে বসেছিলে তুমি।
এখন বুঝতে পারছি একটা কথার কথা ছিল সেটা। মঁশিয়ে লেতিয়ারিও ঈশ্বরের নামে শপথ করে একই ধরনের কথা বলেছিল সে সময়ে। কথাটা তোমার মনে নেই, বুঝতে পারছি। তা ভুলে যাওয়ারই কথা।
এরকম প্রতিজ্ঞা তো আমরা কতই করে থাকি, সব কি আর মনে রাখা যায়? না রাখলেই তা পালন করা সম্ভব হয়? আর মঁশিয়ে লেতিয়ারির তো তখন দুরান্দ হারিয়ে পথে বসার দশা, মাথার ঠিক ছিল না। কি বলতে কি বলেছিল! সে কবেকার কথা, কে অতসব মনে করে বসে থাকে!
একটু থামল যুবক। মুখে বিষণ্ণ হাসি। হাত তুলে দূরের বড়সড় একটা জটলা দেখাল দেরুশেতকে।
ওই যে ওখানে ভিড় করে আছে মানুষ, কেন বলতে পারো? স্যামসনের সবাই দুরান্দের এনজিন দেখতে এসেছে। অনেক বলে-কয়েও যখন ওটাকে উদ্ধার করে আনতে কাউকে ডোভারে পাঠানো যাচ্ছিল না, নগদ টাকার কথা বলেও না, তখন আমি এক কথায় যেতে রাজি হয়েছিলাম। কোন কথার ওপর, আজ আর তার কোন মূল্য নেই। আর সে অনেক বছর আগের এক বড়দিনের কথা, স্যামসনের রাস্তা বরফের তলায় চাপা পড়ে ছিল সেদিন। তুমি গির্জা থেকে ফেরার সময় পথের ওপর কি যেন লিখেছিলে। কাছে গিয়ে দেখি সেটা আমারই নাম।
শ্রাগ করল গিলিয়াত। কি জানি! সেদিন তো বেশ কুয়াশা ছিল, হয়তো ওর মধ্যে ভুলই দেখেছি! যাকগে, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। জাহাজ ছাড়ার সময় হয়ে গেছে।
তোমাদের যাত্রা আজ ভালই হবে মনে হচ্ছে। কেমন পুবাল বাতাস বইছে দেখেছ? যাও তাহলে! বিদায়!
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে একটু পিছিয়ে এসে দাঁড়ল গিলিয়াত। পনেরো মিনিটের মধ্যে জাহাজে উঠে পড়ল দেরুশেত ও কড্রে। একটু পর ঘণ্টী বাজাল কাশমির, ঘড়ঘড় শব্দে নোঙর তোলা হলো। ঘাট ছেড়ে পিছিয়ে গিয়ে অনেকখানি জায়গা নিয়ে ঘুরতে শুরু করল ওটা। ঘাড় কাত করে সেদিকে একভাবে তাকিয়ে থাকল যুবক।
বুকের ভেতরে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ওর। জীবনে এই প্রথমবার মনে হলো, ঈশ্বর সৃষ্ট এতবড় পৃথিবীতে সে সত্যিই বড় একা। ভীষণ একা। জীবনটা যেন কেমন তার, আদি-অন্ত হীন নিরস, ধূ ধূ মরুভূমির মত। বসন্তের বাতাস বইল না সেখানে, ফুল ফুটি ফুটি করেও ফুটল না, পাখি ডাকল না।
বেখেয়ালে এক চিলতে রাস্তাটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে মহিষ পাহাড়ে এসে উঠল গিলিয়াত। পুবাল বাতাস পেয়ে সাগরের পানি যে হু হু করে বাড়ছে, সেদিকে মনে হলো খেয়ালই নেই।
অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে বেশ কিছু সময় ধরে কি যেন ভাবল ও। মনে হলো গুরুত্বপূর্ণ কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কিসের, তা সে-ই জানে। নিজের বাড়িটা এক পলক দেখে নিল ও, তারপর লেতিয়ারির বাড়ির দিকে তাকাল।
গোটা স্যামসনের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে আনল বিষাদ মাখা অলস দৃষ্টি। তারপর আরেকবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে সিংহাসনের ওপর বসে পড়ল পা ঝুলিয়ে। জোয়ার শুরু হয়ে গেছে আরও আগেই-পুবাল বাতাসের তাড়নায় ওর চারদিকের এ্যানিটের দেয়ালে ছলাৎ ছল শব্দে আছড়ে পড়ছে ইংলিশ চ্যানেল।