কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে মঁশিয়ে লেতিয়ারি স্বয়ং কনের বাবা ও অভিভাবক। এরকম ক্ষেত্রে আমাদের গির্জার আইনমতে কিছুটা সমস্যা আছে। তা হচ্ছে, কনের অভিভাবকের মৌখিক ইচ্ছেকেই যথেষ্ট বলে মনে করে না আমাদের আইন।
এ জন্যে লিখিত প্রয়োজন। মঁশিয়ে লেতিয়ারির নিজ হাতে লেখা একটা চিঠি বা ওরকম কিছু একটা হলে ভাল হয়, আবার ক্ষমা প্রার্থনার হাসি হাসলেন ফাদার। আপনারা নিশ্চই বুঝতে পারছেন …।
নড়ে উঠল গিলিয়াত! পকেট থেকে এক টুকরো ভাজ করা কাগজ বের করে ফাদারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এই নিন ফাদার, এ ব্যাপারে সঁশিয়ে লেতিয়ারির নিজ হাতে লেখা চিঠি। পড়ে দেখুন। আর তাড়াতাড়ি করুন দয়া করে। এ জন্যে দেরি করার প্রয়োজন দেখি না আমি।
ভাঁজ খুলে কাগজটা দেখলেন ফাদার। ছোট্ট একটা চিঠি, ওই দিনের তারিখে লেখা।
সেটা এরকম : ফাদারের কাছ থেকে বিয়ের অনুমতিপত্র চেয়ে নিয়ে এসো। আমি চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের বিয়েটা হয়ে যাক। আর একটুও দেরি করতে রাজি নই আমি।
-লেতিয়ারি।
চিরকুটটা ভাঁজ করে টেবিলে রেখে দিলেন ফাদার। মুখ তুলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে গিলিয়াতের দিকে তাকালেন।
এতে কিন্তু কিছুই প্রমাণ হয় না, সঁশিয়ে। শিয়ে লেতিয়ারির সই থাকলেও এটা কাকে লেখা, বোঝা গেল না। কোন সমোধন বা সেরকম কিছুই নেই।
চিঠিতে বিয়ের কথা আছে বটে, কিন্তু কার সঙ্গে কার বিয়ে, সে ব্যাপারেও কিছু লেখেননি মঁশিয়ে লেতিয়ারি। পড়ে তো আমার মনে হয়, পত্রবাহক যে-ই হোন, তার নিজের বিয়ের ব্যাপারে বলা হয়েছে এটায়।
একটু থামলেন ফাদার। তবে ভদ্রলোক নিজেই যখন এ বিয়ের সাক্ষী হতে এসেছেন, নিজেই বলছেন এটা এই দুজনের বিয়ের ব্যাপারেই লিখেছেন মঁশিয়ে লেতিয়ারি, তখন চিঠিটাকে বিয়ের প্রধান দলিল হিসেবে গ্রহন করতে আমাদের আপত্তির কিছু থাকতে পারে না।
আমাদের একজন সহকর্মীর বিয়ের ক্ষেত্রে এরচেয়ে বড় প্রমাণ আর দরকার নেই। এবার তাহলে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করে দেয়া যেতে পারে।
ধীরে ধীরে বসলেন বৃদ্ধ ফাদার। কলমদানী থেকে কলম তুলে নিয়ে বিয়ের দলিলের শূন্য ঘরগুলো নিজেই একে একে পূরণ করতে লাগলেন।
কাজটা শেষ হতে বর ও কনেকে কাছে ডাকলেন। হাত ধরাধরি করে ধীর পায়ে টেবিলটার দিকে এগোল কড্রে ও দেরুশেত। ওদের জীবনের এক পরম লগ্ন এটা, তাই দুজনেই মনে মনে উত্তেজিত। গিলিয়াত একটু দূরের এক পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে, দেরুশেতকে দেখছে একদৃষ্টে।
চোখের সামনে বাইবেল মেলে ধরে বিয়ের গৎ বাঁধা শ্লোক আওড়ালেন ফাদার, তারপর মুখ তুলে অমুকের সঙ্গে তমুকের বিয়ে ঘোষণা করে জিজ্ঞেস করলেন, এই দুজনের বিয়েতে কারও কোনরকম আপত্তি বা বাধা আছে বলে জানা আছে। আপনাদের কারও?
কেউ জবাব দিল না দেখে সন্তুষ্ট হলেন ফাদার। কনে সম্প্ৰদান কে করবেন?
গিলিয়াত আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। আমি, ফাদার।
অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে এল গির্জার হলরুমে, আপনজনকে একান্ত করে পাওয়ার আনন্দের মাঝেও একটা অস্বস্তিকর অনুভুতি অনবরত খুঁচিয়ে চলেছে কড্রে ও দেরুশেতকে। কেউই গিলিয়াতের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।
বিয়ের আংটি কোথায়? ফাদারের প্রশ্নে নীরবতা ভঙ্গ হলো। লজ্জায় পড়ে গেল কড্রে। অসহায়ের মত এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। হুড়োহুড়িতে কনের জন্যে আংটির ব্যবস্থা করা হয়ে ওঠেনি। কথাটা মনেই ছিল না। গিলিয়াত উদ্ধার করল তাকে। ওর নিজের হাতের একমাত্র আংটিটা খুলে নীরবে তার হাতে তুলে দিল।
চরম বিব্রত চেহারায় ওটা নিল কড্রে, কোনমতে দেরুশেতের কম্পিত বাঁ হাতের অনামিকায় পরিয়ে দিয়ে ফাদারের সাথে গলা মিলিয়ে ওকে আমৃত্যু সহধর্মিনী হিসেবে গ্রহন করার ঘোষণা উচ্চারণ করল।
***
জাহাজঘাটে বেজায় ভিড়। গোটা স্যামসন ভেঙে পড়েছে যেন দুরান্দের এনজিন দেখতে। ওদিকে লেতিয়ারি নিজের বিছানায় শুয়ে রয়েছে। ভীষণ আনমনা সে, গম্ভীর।
কিছু ভাবছে। হয়তো গিলিয়াত আর দেরুশেতের কথাই ভাবছে। বেলা তো কম হলো না, এতক্ষণে ওদের বিয়ে হয়ে গেছে নিশ্চয়ই!
সেই সকাল থেকে এ পর্যন্ত মেয়েকে দেখেনি লেতিয়ারি। কখন গিলিয়াতের সাথে গির্জায় চলে গেছে কে জানে! বিয়ের জন্যে এতই ব্যস্ত যে বুড়ো বাপের কথা একবারও মনেই পড়েনি হয়তো, ভাবছে সে।
তা ব্যস্ত হওয়ারই কথা। যে নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে লেতিয়ারিকে তার মেয়েসহ পথে বসার হাত থেকে উদ্ধার করেছে, জন্ম-জন্মান্তরের জন্যে ঋণী করে ফেলেছে তাদেরকে, তার মত একজন বীরকে স্বামীত্বে বরণ করার মত সৌভাগ্য কজন মেয়ের হয়? হোক না সে হতচ্ছাড়া ভবঘুরে।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বিয়ে হয়ে গেছে ওদের, ভাবল বৃদ্ধ। বলা যায় না, যে কোন মুহূর্তে তার আর্শীবাদ নিতে ফিরে আসবে ওরা! কথাটা মনে হতেই ধড়মড় করে উঠে বসল লেতিয়ারি।
হায়! যদি জানত কি অকল্পনীয় নাটক চলছে তখন সেইন্ট পিটার গির্জায়। যদি জানত তার সমস্ত স্বপ্নসাধ ভেঙে খানখান হয়ে গেছে ততক্ষণে! কিছুই জানতে পারল না বৃদ্ধ। জান। কেবল নিষ্ঠুর বিধাতা।
অন্তরীক্ষে বসে নির্বিকার চিত্তে সেই বিয়োগান্তক নাটক উপভোগ করছে সে প্রাণ ভরে।
***
বিয়ে সেরে ওরা যখন গির্জা থেকে বের হলো, ঘাটে তখন কাশমিরের ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া প্রায় শেষ। ওটায় করে আজ, এখনই সস্ত্রীক লন্ডনে চলে যাচ্ছে কড়ে।