গভীর রাতে বহুদিন তোমার বাড়ির দিক থেকে বাঁশির করুণ সুর ভেসে আসতে শুনেছি আমি। কাকে শোনাবার জন্যে তুমি ওভাবে বাঁশি বাজাতে, আমি বুঝি না? কাকে আপন করে পেতে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তুমি ডোভারের মত– ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক জায়গায় গিয়েছিলে, পুরো একটা মাস ঝড়-তুফান আর খিদে-তেষ্টার অসহনীয় কষ্ট স্বীকার করে এনজিনটা নিয়ে এলে, আমি তা বুঝি না ভেবেছ? এত কষ্ট করেছ তুমি কেবল এই বুড়োকে খুশি করার জন্যে?
আর কারও জন্যে নয়? স্বর্গের দেবতারা সবাই নেমে এলেও যে কাজ করতে পারত না, সেই অসম্ভব কাজ তুমি একা সম্ভব করেছ শুধু আমার দিকে চেয়ে?
মাথা নাড়ল বৃদ্ধ। দেরুশেতকে ভালবাসো না, এমন ডাহা মিথ্যে কথাটা কি করে বললে তুমি? আমাকে এ কথাও বিশ্বাস করতে বলো? বুড়ো হয়েছি বলে কি আমি কিছুই বুঝি না?
ওর জবাবের জন্যে একটু অপেক্ষা করল বৃদ্ধ, কিন্তু এত কথার পরও ছেলেটা নীরব, একটা কথাও বলছে না দেখে মন দমে গেল তার। সন্দেহ দেখা দিল।
তাছাড়া, বাবা! এবার অনুনয়ের সুরে বলল লেতিয়ারি, দেরুশেত যে তোমাকে বিয়ে করবে বলে প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে! এখন যদি তুমি বিয়ে না করো, তাহলে যে ওকে সারাজীবন কুমারী থেকে যেতে হবে! না, না, গিলিয়াত। তা হয় না, বাবা। এ কিছুতেই হতে পারে না।
তুমি দেরুশেতকে অবশ্যই বিয়ে করবে, তুমি আমার নতুন দুরান্দের ক্যাপ্টেন হবে, আমরা তিনজন মিলে আবার নতুন করে আমাদের সংসার গড়ে তুলব। তুমি এখন না বললে তো চলবে না, বাবা!
না, এ ব্যাপারে তোমার কোন আপত্তি শুনতে চাই না আমি। দাঁড়াও না, সকাল হলেই গির্জার ফাদারকে চিঠি দিচ্ছি আমি। যাতে সকালেই উনি তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। নাহ্, আর দেরি করা যায় না।
আপনমনে বক বক করে চলেছে লেতিয়ারি, টেরও পায়নি কখন চলে গেছে গিলিয়াত। বাইরে এসে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল ও, যেন ভেবে পাচ্ছে না কোনদিকে যাবে।
চাঁদ ডুবে যেতে বসেছে, হলদেটে হয়ে এসেছে আলো। একটু দূরে অশান্ত চ্যানেলের বড় বড় ঢেউ অবিশ্রান্তভাবে তীরে আছড়ে পড়ছে। এ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই কোথাও।
১৫. সাগরতীর থেকে
পনেরো
সাগরতীর থেকে খানিকটা ভেতরে, স্যামসনের এক প্রান্তে সেইন্ট পিটার গির্জা। নিয়মিত প্রার্থনাকারীদের কেউই আজ গির্জায় আসেনি গ্রাম ফাঁকা বলে।
গ্রাম ফাঁকা কারণ গিলিয়াত নামের সেই হতচ্ছাড়া, ভবঘুরে ছেলেটা ভয়ঙ্কর ডোভার থেকে শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যি দূরান্দের এনজিন উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে, এ খবর ছড়িয়ে পড়তে গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবাই জাহাজ ঘাটে ছুটে গেছে।
সকাল দশটায় গির্জায় এসে ঢুকল রেভারেন্ড কড্রে, দেরুশেত ও গিলিয়াত। ক্লান্ত দেহে রাত জাগার ফলে শুকনো মুখটা আরও শুকিয়ে এতটুকুন গেছে গিলিয়াতের! ভীষণ ক্লান্ত আর অন্যমনস্ক লাগছে ওকে। ওদিকে বর-কনের মুখে কথা নেই। জড়পিণ্ডের মত হাঁটছে ওরা।
ভেতরে একটা টেবিল ঘিরে বসে আছে তিনজন লোক। সৌম্য চেহারার ফাদার, গির্জার সচিব ও বিয়ে রেজিস্ট্রি করানোর দায়িত্বে নিয়োজিত এক কর্মচারী। তাদেরই গির্জার এক রেভারেন্ডের সাথে মাদামোয়াজেল দেরুশেতের বিয়ে রেজিস্ট্রি করাতে হবে, তাই পাত্র-পাত্রী ও পাত্রীর অভিভাবকের অপেক্ষায় আছে লোকগুলো।
বিয়ে সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্র তৈরি করাই আছে, এখন শুধু বর-কনে কিছু ফাঁকা ঘর পূরণ করে স্বাক্ষর করে দিলেই হয়। কনেসহ বর রেভারেন্ড কড্রে ও গিলিয়াতকে ভেতরে ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন ফাদার ও অন্য তিনজন। ফাদারের সৌমা মুখে হাসি ফুটল।
আসুন, আসুন! আমরা আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছি। সব কিছু ঠিক করা আছে, অনুষ্ঠান শুরু করতে বিশেষ কোন বাধা নেই।
একটু থামলেন তিনি। একে একে তাদের তিনজনকে দেখে নিয়ে বললেন, আপনাদের বিয়ে রেজিস্ট্রি করানোর আবেদন আরও আগে পেলে ভাল হতো, এত আড়াহুড়ো করতে হতো না। যাই হোক, সমস্ত আয়োজন সারা হয়ে গেছে।
বরের পক্ষে বিয়ের সাক্ষী হবেন আমাদের গির্জার সচিব, কি কনের পক্ষে কথা শেষ না করে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে গিলিয়াতের দিকে তাকালেন ফাদার। তার অনুচ্চারিত প্রশ্নের জবাবে মাথা নাড়ল যুবক-কনের পক্ষে ও নিজে সাক্ষী হবে।
তাহলে আর কি! ফাদার মাথা নাড়লেন। ঠিকই আছে, আর বিশেষ কোন সমস্যা নেই।
আড়চোখে এক পলক গিলিয়াতকে দেখল বর রেভারেন্ড কড়ে! লোকটার ডোভর অভিযানে যাওয়ার মূল প্রেরণার উৎস কি ছিল, সে কথা এখন আর অজানা নেই তার। কাজেই সঙ্কোচ বোধ করছে সে। ওদিকে দেশতও আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের বিয়ে দিতে গিলিয়াত এত ব্যগ্র কেন, তাই ভাবছে সকাল থেকে!
না, একটু ভুল হলো, ক্ষমা প্রার্থনার দৃষ্টিতে কড্রের দিকে তাকালেন ফাদার। সমস্যা একটা এখনও আছে, গিলিয়াতকে নির্দেশ করলেন। আজ খুব ভোরে এই ভদ্রলোক এসে মাদামোয়াজেল দেরুশেতের বাবার হয়ে আপনাদের বিয়ের অনুমতির জন্যে লিখিত আবেদন করেছেন।
এঁর মুখে শুনেছি, মঁশিয়ে লেতিয়ারি খুব জরুরি এক কাজে ব্যস্ত বলে বিয়েতে থাকতে পারবেন না। কিন্তু তিনি চান, বিয়েটা যেন আজ সকালের মধ্যেই হয়ে যায়। তার ইচ্ছের ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ করার কিছু নেই।